ভূর্ভুবঃ স্বরিত্যস্য বিশ্বামিত্র ঋষিঃ । সবিতা দেবতা । পূর্বস্য দৈবী বৃহতী ছন্দঃ, তৎসবিতুরিত্যুত্তরস্য নিচৃদ্গায়ত্রী ছন্দঃ । মধ্যমষড্জৌ স্বরৌ ॥
ও৩ম্ ভূর্ভুবঃ॒ স্বঃ᳖ । তৎস॑বি॒তুর্বরে॑ণ্যং॒ ভর্গো॑ দে॒বস্য॑ ধীমহি ।
তাৎপর্যঃ— এই মন্ত্রে বাচকলুপ্ত উপমালঙ্কার আছে। যে মানুষ কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান-সম্পর্কিত বিদ্যাগুলির যথাযথ গ্রহণ করে, সর্বসম্পূর্ণ ঐশ্বর্যে যুক্ত পরমাত্মার সঙ্গে নিজের আত্মাকে যুক্ত করে এবং অধর্ম, অনৈশ্বর্য ও দুঃখরূপ মল ত্যাগ করে ধর্ম, ঐশ্বর্য ও সুখ লাভ করে তাদেরকে অন্তর্যামী জগদীশ্বর স্বয়ং ধর্মের অনুশীলন ও অধর্মের ত্যাগ করাতে সর্বদা ইচ্ছুক থাকেন।
এর তর্জমা Ralph T. H. Griffith এইভাবে করেছেন— “May we attain that excellent glory of Savitar the God. So may he stimulate our prayers.”
এই তর্জমা আধ্যাত্মিক, কিন্তু বিদ্বান পাঠক নিজে এটি মহর্ষি দয়ানন্দের তর্জমার সঙ্গে তুলনা করে গ্রিফিথের বৈদিকতার স্তর জানতে পারেন।
এই মন্ত্রটি (ব্যাহৃতি-রহিত রূপে) যজুর্বেদ ৩।৩৫; ২২।৯; ৩০।২; ঋগ্বেদ ৩।৬২।১০; সামবেদ ১৪।৬২-এও বিদ্যমান। এটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও বহুস্থানে এসেছে। এদের মধ্যে যজুর্বেদ ৩০.২-এ এই মন্ত্রের ঋষি নারায়ণ এবং অন্যত্র বিশ্বামিত্র। দেবতা সবিতা, ছন্দ নিছৃদ্ বৃহতী এবং স্বর ষড়জ। ব্যাহৃতিগুলির ছন্দ দৈবী বৃহতী এবং স্বর ব্যাহৃতিসহ সম্পূর্ণ মন্ত্রের স্বর মধ্যম ষড়জ। মহর্ষি দয়ানন্দ সর্বত্রই এর ভাষ্য আধ্যাত্মিক করেছেন। কেবল যজুর্বেদ ৩০।২-এর ভাবার্থে আধিভৌতিকের সামান্য ইঙ্গিত আছে, অবশিষ্ট ভাষ্য আধ্যাত্মিকই।
একজন বিদ্বান একবার আমাদের বলেছিলেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো কিছু মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য কোনো প্রকারে ভাষ্য হতেই পারে না। আমরা বিশ্বের সকল বেদজ্ঞকে ঘোষণাপূর্বক বলতে চাই যে বেদের প্রত্যেক মন্ত্র এই সমগ্র সৃষ্টিতে বহু কল্পনার (ভাইব্রেশনস) রূপে বিদ্যমান। এই মন্ত্রগুলির এই রূপে উৎপত্তি পৃথিব্যাদি লোকসমূহের উৎপত্তিরও পূর্বে হয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই প্রত্যেক মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য অবশ্যই হয়ে থাকে। ত্রিবিধ অর্থপ্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বাধিক ও সর্বপ্রথম সম্ভাবনা এই প্রকার অর্থেরই হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের আধিদৈবিক অর্থ হতে পারে না এমন ধারণা করা বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞতার পরিচায়ক।
এই ঋচাটির দেবতা সবিতা। সবিতার বিষয় সম্পর্কে ঋষিদের বক্তব্য হলো—
সবিতা সর্বস্য প্রস্বিতা (নিরুক্ত ১০।৩১)
সবিতা বৈ দেবানাং প্রস্বিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।২।১৭)
সবিতা বৈ প্রসবানামীশঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।৩০)
প্রজাপতিবৈ সবিতা (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ১৬।৫।১৭)
মনো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬।৩।১।১৩)
পশবো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৩।২।৩।১১)
বিশ্বদেব সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)
প্রাণো বৈ সবিতা (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।১৯)
বেদা এভ সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)
সবিতা রাষ্ট্রং রাষ্ট্রপতিঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২।৫।৭।৪)
এথেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হয়—
‘সবিতা’ নামক পদার্থ সকলের উৎপত্তি ও প্রেরণার উৎস বা সাধন।
এটি সকল প্রকাশিত ও কামনা অর্থাৎ আকর্ষণাদি বল দ্বারা যুক্ত কণাগুলির উৎপাদক ও প্রেরক।
এটি সকল উৎপন্ন পদার্থের নিয়ন্ত্রক।
‘ওম্’ রশ্মিরূপ ছন্দ, রশ্মি এবং মনস্তত্ত্বই সবিতা।
বিভিন্ন মরুদ্ রশ্মি এবং দৃশ্য কণা ‘সবিতা’ নামে অভিহিত।
বিদ্যুৎকেও ‘সবিতা’ বলা হয়।
বিভিন্ন প্রাণরশ্মিও ‘সবিতা’ নামে পরিচিত।
সকল ছন্দ-রশ্মিও ‘সবিতা’।
তারাগুলির কেন্দ্রীয় অংশরূপ রাষ্ট্রকে প্রকাশিত ও তাদের পালনকারী সম্পূর্ণ তারা-সমষ্টিকেও ‘সবিতা’ বলা হয়।