ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

17 September, 2025

মুহাম্মদের স্ত্রী ও সন্তান

17 September 0

📊 নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিবাহ, স্ত্রীরা ও সন্তান (সহজ চার্ট আকারে)

ক্র. স্ত্রীর নাম (রা.) বিবাহের সময় নবীজি (সা.)-এর বয়স স্ত্রীর বয়স বিবাহের পূর্বে সম্পর্ক/অবস্থা সন্তান
1 খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.) 25 40 মক্কার ধনী ব্যবসায়ী নারী, বিধবা, নবীজি (সা.) ছিলেন তাঁর বাণিজ্য প্রতিনিধি ২ ছেলে: কাসেম, আবদুল্লাহ ৪ মেয়ে: যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা
2 সাওদা বিনতে জামআ (রা.) 50 প্রায় 55 বিধবা নারী, স্বামীর মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ সন্তান হয়নি
3 আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.) 53 প্রায় 9 আবু বকর (রা.)-এর কন্যা, পূর্বে সম্পর্ক: সাহাবীর কন্যা সন্তান হয়নি
4 হাফসা বিনতে উমর (রা.) 56 প্রায় 18 উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর কন্যা, পূর্বে বিধবা সন্তান হয়নি
5 যায়নাব বিনতে খুজাইমা (রা.) 56 প্রায় 30 পূর্বে বিধবা, দরিদ্রদের সাহায্য করতেন “উম্মুল মাসাকিন” সন্তান হয়নি
6 উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া (রা.) 57 প্রায় 29 পূর্বে বিধবা, চার সন্তানের জননী ছিলেন নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে নতুন সন্তান হয়নি
7 যায়নাব বিনতে জাহশ (রা.) 58 প্রায় 38 নবীজি (সা.)-এর চাচাতো বোন, পূর্বে ছিলেন দত্তকপুত্র যায়েদ বিন হারিসার স্ত্রী সন্তান হয়নি
8 জুয়ারিয়া বিনতে হারিস (রা.) 58 প্রায় 20 বন্দি অবস্থায় মুসলিম হলেন, মুক্তি পান ও বিবাহ হল সন্তান হয়নি
9 উম্মে হাবিবা রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা.) 59 প্রায় 35 মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা, পূর্বে স্বামী খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল সন্তান হয়নি
10 সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রা.) 59 প্রায় 17 ইহুদি নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা, বন্দি অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন সন্তান হয়নি
11 মাইমুনা বিনতে হারিস (রা.) 60 প্রায় 26 পূর্বে বিধবা, নবীজি (সা.)-এর খালা উম্মুল ফাদলের বোন সন্তান হয়নি
12 মারিয়া ক্বিবতিয়া (দাসী, স্ত্রী মর্যাদায়) 61 অজ্ঞাত (যুবতী) মিসরের শাসকের উপহার হিসেবে আসেন ১ ছেলে: ইব্রাহিম

📝 সারসংক্ষেপ

  • মোট স্ত্রী: ১১ জন (আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহিত) + মারিয়া ক্বিবতিয়া (দাসী, স্ত্রী মর্যাদায়)

  • সন্তান:

    • খাদিজা (রা.) থেকে: ৬ জন (২ ছেলে, ৪ মেয়ে)

    • মারিয়া (রা.) থেকে: ১ জন (ইব্রাহিম)

    • অন্য স্ত্রীদের থেকে সন্তান হয়নি।


Read More

16 September, 2025

আর্য সমাজ এবং ডঃ আম্বেদকর

16 September 0

 

আর্য সমাজ এবং ডঃ আম্বেদকর

আর্য সমাজ এবং ডঃ আম্বেদকর

লেখক : প্রা. ডঃ কুশলদেব শাস্ত্রী

প্রকাশক : শ্রী ঘূডমল প্রহ্লাদকুমার আর্য ধর্মার্থ ট্রাস্ট, হিণ্ডৌন সিটি (রাজস্থান) পিন-৩২২২৩০

আমার উৎকট ইচ্ছা ছিল যে ‘‘আর্য সমাজ এবং ডঃ আম্বেদকর’’ বিষয়ে কিছু লেখা হোক। আমি নিজেও এই বিষয়ে কিছু লিখবই, কিন্তু আমি চাইছিলাম যে প্রিয় ভাই কুশলদেবজি এই বিষয়ে অবশ্যই একটি স্বরোজপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করুন। আনন্দের বিষয় এই যে তিনি তাঁর ব্যস্ত জীবনের কিছু মুহূর্ত বের করে এই পাঠযোগ্য এবং সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থটি লিখে ফেলেছেন।

আর্য সমাজের এক কর্মঠ ও প্রাজ্ঞ বিদ্বান ডঃ রামকৃষ্ণ আর্য এটি আর্য পরিবার প্রকাশন समिति, কোটার মাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার করার গৌরব অর্জন করেছেন এবং বর্তমানে শ্রদ্ধেয় প্রভাকরদেবজি আর্য এই কৃতিত্ব উপভোগ করছেন। জাতীয় ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য এই কৃতির প্রকাশ সত্যিই প্রশংসনীয়। এর ফলে ঘৃণা-দ্বেষের দেওয়াল ভেঙে যাবে এবং ভ্রান্ত ধারণাও দূর হবে। এর প্রতিটি পঙ্‌ক্তি দেশজাতির সেবকদের পড়া উচিত। ডঃ কুশলদেবজি যা কিছুই লিখেছেন, দেশ ও সমাজের হিতার্থেই লিখেছেন—একটি বেদনা নিয়ে লিখেছেন।

আর্য সমাজ গুণ–কর্ম–স্বভাব অনুসারে সমাজ গঠনে এবং জন্মজাত জাতি-পাঁতির দুর্গ ধ্বংস করার কাজে ৭৫ শতাংশ ব্যর্থ হয়েছে—এটি ডঃ কুশলদেবজির অন্তর্জ্বালা প্রকাশ করে। আমি এই বেদনায় তাঁর সহভাগী। আমি-ও জীবনের মূল্যবান ৫০ বছর এই জাতিগত মহারোগের নিবারণে ব্যয় করেছি। আমি ডঃ কুশলদেবজির প্রতিটি পঙ্‌ক্তি পড়েছি। ‘জাতপাঁত তোড়ক মণ্ডল’-এর প্রতিষ্ঠাতা জীবনের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত আর্য সমাজী ছিলেন। শ্রদ্ধেয় সন্তরামজি আর্য সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক ‘আর্য মুসাফির’-এর সফল সম্পাদক ছিলেন।

ডঃ আম্বেদকরকে জাতপাঁত তোড়ক সম্মেলনের সভাপতি করতে অক্ষমতার কারণ ছিল “বেদ নিন্দা” প্রচারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা। নচেৎ বিরোধিতা করা তিনজনই জাতি-পাঁতির বিরোধী ছিলেন। দেবতাস্বরূপ ভাই পরমানন্দজি তো তাঁর সন্তানদের বিবাহ জাতিপাঁত ভেঙেই করেছিলেন।

এটিও নিবেদন করি যে ডঃ গোকুলচন্দ নারাং ছিলেন ভাইজির ভক্ত, শিষ্য, বন্ধু ও সহযোগী।

পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদজি উপাধ্যায় কোলহাপুরের রাজারাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তখনই স্বল্পকালে তিনি নিকট থেকে ডঃ আম্বেদকর ও তাঁর কার্যকলাপ দেখেছিলেন।

মহারাষ্ট্রে জন-জাগরণ, শিক্ষা-প্রসার এবং অস্পৃশ্যতা নিবারণের আন্দোলনে প্রিয় ডঃ বালকৃষ্ণজিরও অসাধারণ অবদান ছিল। সেই আর্য মণীষীকে কোলহাপুরে ডেকে এনেছিলেন শ্রী শাহু মহারাজ। ডঃ বালকৃষ্ণজির ব্যক্তিত্ব ও সেবার প্রভাব ডঃ আম্বেদকরের উপরও পড়েছিল, সেটিও মনে রাখা দরকার।

পাঞ্জাবে তো বিংশ শতাব্দীর আরম্ভেই দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু সংস্কার বেদিক রীতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে এই যুগ পরে এসেছিল।

দেশপ্রেমীদের কর্তব্য এই গ্রন্থের অধিকতর প্রচার করা। শেষমেশ একটি কথা বলতে চাই যে ডঃ আম্বেদকর বেদ ও বৈদিক মতবাদের বিরুদ্ধে যা কিছুই বলেছেন বা লিখেছেন, তা কেবল রূঢ়িবাদীদের ঘোষিত আচরণেরই প্রতিক্রিয়া ছিল; অন্যথায় তাঁর বেদের প্রতি কোনো বিরোধিতা ছিল না। ‘ধম্মপদ’-এ তো একটি শব্দও বেদের নিন্দায় পাওয়া যায় না।


আষাঢ় পূর্ণিমা, ২০৫৭ বিক্রমাব্দ
(গুরু পূর্ণিমা), রবিবার

রাজেন্দ্র ‘জিজ্ঞাসু’
১৬ জুলাই ২০০০
বেদ সদন, আবোহর (পাঞ্জাব)

পিন – ১৫২১১৬

ট্ট্বে-বচ্চসি

আমার শিক্ষা-দীক্ষা আর্যসমাজী শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গুরুকুল ঝজ্জর (হরিয়াণা) এবং গুরুকুল জ্বালাপুর (হরিদ্বার) এ হয়েছে। গুরুকুলীয় ছাত্রজীবনে এক-দু’টি জাতির নাম যদিও কানে এসেছিল, তবে জাতিগত ভেদাভেদ বা উঁচু-নীচু হওয়ার কোনো সামান্যতম অনুভূতিও হয়নি। নিজের কিংবা অন্যান্য ছাত্রদের জাতি সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না, ফলে অস্পৃশ্যতার প্রশ্নই ওঠেনি। আমরা সকলে ছাত্ররা এক পরিবারের স্নেহশীল সদস্যের মতোই জীবনযাপন করতাম।

পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন—
“গুরুকুলের ভর্তিপত্রে জাতি-বিরাদরির খোঁজাখুঁজি থাকত না।”
( ভারতীয় উন্নতি এবং পতনের কাহিনী, পৃ. ১৫১৯ )

গুরুকুলের চারদেয়ালের বাইরে আসার পর প্রথম জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে অবগতি হলাম, তারপর ধীরে ধীরে জাতিভিত্তিক ভেদাভেদের তিক্ততার সঙ্গে পরিচয় হতে লাগল। আমাদের বাড়ি ছিল আর্যসমাজী, এবং তা-ও আবার কার্যত আন্তর্জাতীয় বিবাহের সমর্থক। তাই সামাজিক সৌহার্দ্যের এক দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক ছিল। গ্রামে আমার পিতাজি “এক গ্রাম-এক পনঘাট” এবং “মন্দির প্রবেশ”-এর মতো উদ্যোগের মাধ্যমে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ তৈরি করতে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। ফলে গুরুকুল এবং গৃহ—উভয় দিক থেকেই মানবতাবাদী সংস্কার আমি অর্জন করেছি।

গুরুকুল সম্পর্কে নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত উদয়বীরজি ‘বিরাজ’ (জ. ১৯২১) লিখেছেন—
“আমার মতে গুরুকুল শিক্ষাপদ্ধতি আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি। যখন কোথাও দলিতোদ্ধার ছিল না, তখন গুরুকুলে দলিতোদ্ধার ছিল। যখন কোথাও সমাজতন্ত্র ছিল না, তখন গুরুকুলে সমাজতন্ত্র ছিল। যখন কোথাও হিন্দিতে পাঠদান হতো না, তখন গুরুকুলে সব বিষয় হিন্দিতেই শেখানো হতো। মহাত্মা মুন্সীরাম (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ) যুবকদের ব্রহ্মচর্য-দীক্ষা দিয়ে তাঁদের আদর্শ নাগরিক, আদর্শ মানুষ করে তুলতে চেয়েছিলেন।”
(নিজামশাহীর প্রথম আঘাত, পৃ. ৪১)

ডঃ আম্বেদকরজি স্বামী শ্রদ্ধানন্দজিকে তো “দলিতোদ্ধারের ক্ষেত্রের চ্যাম্পিয়ন” বলেছেন।

উপন্যাস সম্রাট প্রেমচন্দ (১৮৮০–১৯৩৬) মাননীয় ডঃ আম্বেদকরজির সমাজ-সংস্কারমূলক সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। তাই তিনি সম্পাদিত হংস মাসিকের আগস্ট ১৯৩৩ সংখ্যার মুখপৃষ্ঠে ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের ছবি প্রকাশ করেছিলেন। এপ্রিল ১৯৩৬-এ লাহোর আর্যসমাজের জয়ন্তী উপলক্ষে “আর্য ভাষা সম্মেলন”-এর সভাপতি হিসেবে প্রসঙ্গক্রমে প্রেমচন্দজি আর্যসমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন—

“আমি তো আর্যসমাজকে যতটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মনে করি, ততটাই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও মনে করি। তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তার ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের তুলনায় বেশি প্রসিদ্ধ এবং উজ্জ্বল। দলিতদের উদ্ধারে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিল আর্যসমাজই। কন্যাদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম সে-ই বুঝেছিল। বর্ণব্যবস্থাকে জন্মগত নয়, কর্মগত বলে প্রমাণ করার কৃতিত্বও তার। জাতিভিত্তিক ভেদাভেদ এবং খাওয়া-দাওয়ায় ছুঁত-ছাত ও রান্নাঘরের বাধা দূর করার গৌরবও তার। তার উপদেশকরা বেদ ও বেদাঙ্গের গূঢ় বিষয়কে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বানিয়েছিলেন, যেগুলো বিদ্বান ও আচার্যদের অনেকগুলো তালা-চাবির আড়ালে লুকোনো ছিল।”

নিশ্চয়ই আর্যসমাজ ও ডঃ আম্বেদকর প্রমুখের অনুপ্রেরণায় চলমান আন্দোলন মূলত সমাজ-সংস্কারকে গতিশীল করার আন্দোলন হয়েছে। আজও সমাজে যেখানে-সেখানে জাতিভিত্তিক ভেদাভেদের কারণে ঘৃণার কালো মেঘ জমে, সেগুলোকে বিদীর্ণ করার জন্য ডঃ আম্বেদকর ও ঋষি দয়ানন্দের অনুগামীদের অগ্রসারিতে দেখা উচিত, এবং তারা সেই পথে এগিয়েও চলেছেন। তবে এখানে কাজ করতে গিয়ে আমাদের ভাষা ও কার্যকলাপ এমন সংযমিত হওয়া প্রয়োজন যাতে সেখানে অনুদারতা বা উগ্রতার প্রকাশ না ঘটে।

আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি এজন্যও যে কোথাও যেন বিহার প্রদেশের মতো অন্যত্রও বর্ণ-দ্বেষ শ্রেণি-দ্বেষে রূপান্তরিত না হয়। পরিপূর্ণ সাবধানতার সঙ্গে আমাদের এই চেষ্টা হওয়া উচিত যে সামাজিক বৈষম্য যেন সামাজিক ঘৃণায় পরিণত না হয়ে সমতা ও ভ্রাতৃত্বে রূপান্তরিত হয়। মানুষ ও মানুষের মধ্যে জাতিভিত্তিক ভেদাভেদের কারণে যে খাত প্রতিদিন বাড়ছে, সেটিকে পূরণ করাই আমাদের সকলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এই লেখারও মূল উদ্দেশ্য তাই।

এই বিষয়ের উপর প্রাথমিক প্রবন্ধটি আর্য লেখক পরিষদ-এর উদয়পুর (রাজস্থান) অধিবেশনে পাঠ করা হয়েছিল। এ লেখাটি তারই সম্প্রসারিত রূপ, যা শ্রী ঘূডমল প্রহ্লাদকুমার আর্য ধর্মার্থ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা, যশস্বী প্রকাশক শ্রী প্রভাকরদেবজি আর্যের পবিত্র প্রচেষ্টায় হিণ্ডৌন সিটি (রাজস্থান) থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

আর্যসমাজের খ্যাতনামা গবেষক ও ইতিহাসজ্ঞ প্রা. রাজেন্দ্রজি ‘জিজ্ঞাসু’ গ্রন্থটির ভূমিকালেখন করে বইটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন, এজন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

কুশলদেব শাস্ত্রী
রামানন্দ নগর, পাওডে ওয়াড়ি নাকের কাছে, নানদেড় (মহারাষ্ট্র) – ৪৩১৬০২
দূরভাষ : ০৭২৪৬-২-২৫০৯২৩


আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর জন্ম সন ১৮২৪ সালে এবং বালিদান ১৮৮৩ সালে হয়।

আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পরে এবং স্বামী দয়ানন্দের দেহাবসানের প্রায় ৮ বছর পরে, ১৪ এপ্রিল ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতরত্ন ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর মধ্যপ্রদেশের মহূ-তে জন্মগ্রহণ করেন। এটি সুস্পষ্ট যে মাননীয় ডঃ আম্বেদকরের যুগে স্বামী দয়ানন্দ শরীররূপে বিদ্যমান ছিলেন না, তবে আর্যসমাজ-আন্দোলনের রূপে তাঁর যশঃশরীর অবশ্যই বিদ্যমান ছিল। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের গ্রন্থসম্ভারই এর সাক্ষ্য বহন করে যে, তিনি স্বামী দয়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ এবং তার অনুসারীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। ঐ সময়ে আর্যসমাজ আন্দোলন ছিল তার পূর্ণ যৌবনে, যার প্রভাব ডঃ আম্বেদকর এবং তাঁর যুগে নিশ্চিতভাবেই পড়েছিল। এই লেখকের উদ্দেশ্য ডঃ আম্বেদকর ও আর্যসমাজের পারস্পরিক সম্পর্ককে উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা।

যেমন স্বামী দয়ানন্দ গুজরাটি হয়েও মূলতঃ ঔদিচ্য তিওয়ারি ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হতেন, তেমনি ডঃ আম্বেদকরও মধ্যপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেও তথাকথিত শূদ্র (মহার) কুলে জন্মগ্রহণকারী মহারাষ্ট্রীয় হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কালের প্রবাহে উভয়েই শুধু জাতীয় নন, আন্তর্জাতিক মহাপুরুষ হিসেবেও প্রসিদ্ধ হলেন। যখন মহারাষ্ট্রে (তৎকালীন বোম্বে রাজ্যে) “রানাডে-ফুলে যুগ” অবসান হচ্ছিল, সেই সময়েই শ্রী সায়াজিরাও গায়কোয়াড়, রাজর্ষি শাহু মহারাজ এবং ডঃ আম্বেদকরের যুগের সূচনা হচ্ছিল। এই দ্বিতীয় প্রজন্মও তাঁদের পূর্ববর্তী দয়ানন্দ-রানাডে-ফুলে প্রমুখ মহাপুরুষদের কর্মপদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত ছিল।

শ্রী সায়াজিরাও গায়কোয়াড় ও রাজর্ষি শাহু মহারাজ স্বামী দয়ানন্দ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন, আর ডঃ আম্বেদকর মহাত্মা ফুলে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত সত্যশোধক সমাজ দ্বারা। তবে গায়কোয়াড় ও শাহু মহারাজ আর্যসমাজী হয়েও সত্যশোধক সমাজের সহযোগী ও প্রশংসক ছিলেন। অপরদিকে ডঃ আম্বেদকর ফুলের শিষ্য হয়েও স্বামী দয়ানন্দ ও তাঁর আর্যসমাজ আন্দোলনের প্রশংসক এবং সমালোচক দুটোই ছিলেন, কিন্তু তাঁকে গায়কোয়াড় ও শাহুর মতো আর্যসমাজ আন্দোলনের সহযোগী বলা যায় না। হ্যাঁ, আর্যসমাজ আন্দোলনের প্রতি ডঃ আম্বেদকর সর্বদাই সদ্ভাবাপন্ন ছিলেন। তবে তাঁর কাছে দয়ানন্দের তুলনায় মহাত্মা ফুলে অধিক গ্রহণযোগ্য ছিলেন। ডঃ আম্বেদকর গৌতম বুদ্ধ, সন্ত কবীর এবং মহাত্মা ফুলে এই মহাপুরুষত্রয়কে তাঁর গুরু বলে মেনেছিলেন।

সংস্কৃত ও রাষ্ট্রভাষা হিন্দির মতো প্রাদেশিক স্তরে মারাঠি ভাষায় কাজকর্ম করতে না পারার কারণে মহারাষ্ট্রে আর্যসমাজ আন্দোলন উত্তর ভারতের মতো ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রাজর্ষি শাহু মহারাজের মতে, “ব্রাহ্মণ-নৌকরশাহির” জন্যই মহারাষ্ট্রে আর্যসমাজ আন্দোলন সফল হতে পারেনি।


বড়োদা নৃপতির ভূমিকা

বড়োদার মহারাজ সায়াজিরাও গায়কোয়াড় মেধাবী ডঃ আম্বেদকরের ইন্টার পাশ করার পর তাঁকে বি.এ., এম.এ., পি.এইচ.ডি., ডি.এস.সি. (লন্ডন), এল.এল.ডি., বার-অ্যাট-ল’ প্রভৃতি উপাধি অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে এক বিশিষ্ট পণ্ডিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে আর্যসমাজ আন্দোলনের, সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে, এক অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। এটি আর কেউ জানুক বা না জানুক, ডঃ আম্বেদকর নিজে অবশ্যই জানতেন। তাই তাঁর গ্রন্থাবলীতে আর্যসমাজ আন্দোলনের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রতিফলিত হয়েছে।

যেখানে গায়কোয়াড় মহারাজ ১৯১২ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত ডঃ আম্বেদকরকে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান করে আমেরিকা পাঠান, সেখানে আন্তরিক আর্যসমাজী রাজর্ষি শাহু মহারাজও ১৯১৯ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত বিদেশে পড়াশোনার জন্য আম্বেদকরজিকে পূর্ণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। আর্যনৃপ শাহু মহারাজ ডঃ আম্বেদকরের প্রথম পত্রিকা ‘মূকনায়ক’-এর প্রকাশনার ক্ষেত্রেও অর্থসাহায্য প্রদান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯২০ সালে মানগাঁও-এ অনুষ্ঠিত প্রথম অস্পৃশ্যতা সম্মেলনে শাহু মহারাজ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—
“ডঃ আম্বেদকর একদিন সমগ্র ভারতের সর্বভারতীয় নেতা হবেন।”

তৎকালীন বোম্বে রাজ্যের এই দুই রাজপুরুষের যে উদার হৃদয় ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তার পেছনে আমি স্বামী দয়ানন্দেরই প্রভাব দেখতে পাই। নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্তরে আর্যসমাজ আন্দোলনের বিশেষ ছাপ ছিল।


ডঃ আম্বেদকরের ঐতিহাসিক পত্র (মারাঠি থেকে হিন্দি অনুবাদ)

মূকনায়ক, মুম্বই ১৩.৬.২০

শ্রীমান মহারাজ শাহু ছত্রপতি, করভীর মহাশয়-এর সেবায়

মানগাঁও ও নাগপুরের সভায় গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে ২৬শে জুন তারিখে সর্বত্র আপনার জন্মদিবস অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। একই দিনে আপনার আশ্রয়ে প্রকাশিত ‘মূকনায়ক’-এর বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে শ্রিমন্ত মহারাজের সচিত্র কর্মময় জীবনের উজ্জ্বল সামগ্রিক রূপরেখা দেওয়া হবে। এজন্য আপনার শাসনকাল পর্যন্ত বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য আমি পূর্বে একবার অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ অবধি সেই তথ্য পাইনি। দিন খুবই অল্প বাকি আছে, তাই আমি নিজেই এসে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই উদ্দেশ্যে আজ সান্ধ্যবেলায় আমি উপস্থিত হব। আশা নয়, পূর্ণ বিশ্বাস যে শ্রিমন্ত মহাশয়ের দর্শনলাভ অবশ্যই হবে।

আপনার কৃপাভিলাষী,
ভীমরাও আম্বেদকর


সন্দर्भ: ‘पत्रांच्या अंतरंगातुन डॉ. बाबासाहेब आंबेडकर’ নামক মারাঠি গ্রন্থের মুখপৃষ্ঠ থেকে এই হস্তলিখিত পত্র উদ্ধৃত।
লেখিকা: সৌ. চন্দ্রকলা রঘুনাথ উকরণ্ডে
প্রকাশক: শ্রী সমর্থ প্রকাশন, ৪৭৩ দত্তওয়াড়ি, পুলিশ চৌকির পেছনে, পুনে–৪১১০৩০
মূল্য: ₹১৫০০.০০, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৪৪

আর্যসমাজের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি

বড়োদার নৃপতি সায়াজীরাও গায়কোয়াড় (১৮৬৩–১৯৩৯) এবং কোলহাপুর নৃপতি রাজর্ষি শাহু (১৮৭৪–১৯২২)-এর স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল— আর্যসমাজের বেদবিষয়ক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এই ক্ষত্রিয় রাজাদের তৎকালীন রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা “শূদ্র” বলে মনে করতেন এবং এই কারণে তাঁদের বেদোক্ত সংস্কার করার অধিকার দিতে রাজি ছিলেন না। অথচ স্বামী দয়ানন্দের দৃষ্টিতে বেদ পড়ার অধিকার সকল মানবজাতিরই ছিল। মহারাষ্ট্রকেশরী ছত্রপতি শিবাজীর উপনয়ন সংস্কার করতেও যে রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা দ্বিধা করেছিলেন, তাঁদের সেই প্রথাগত সংকীর্ণতা বিশ শতকেও একইভাবে বজায় ছিল। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ বেদের ভিত্তিতেই প্রমাণ করেছিলেন যে, সমগ্র মানবসমাজের সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শূদ্রদেরও বেদ অধ্যয়নের অধিকার আছে। এই রক্ষণশীল পণ্ডিতদের সংকীর্ণতায় বিরক্ত হয়ে শ্রী সায়াজীরাও গায়কোয়াড় ও শাহু মহারাজ আর্যসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এঁরা শুধু ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরকেই নন, অন্যান্য মেধাবী দলিতদেরও বৃত্তি প্রদান করেছিলেন।


আম্বেদকরজীর দ্বারা “নমস্তে” অভিবাদনের ব্যবহার

মহর্ষি দয়ানন্দ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ প্রারম্ভ থেকেই অভিবাদনের রূপে প্রাচীন, শাস্ত্রীয় ও সার্বজনীন “নমস্তে”-র পুনরুজ্জীবন ও প্রচার করেছিলেন। শহীদ পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিস্মিলের মতে, “যখন আর্যসমাজের এই প্রচেষ্টা কিছু লোকের কাছে উঁচু–নিচু ভেদভাভ ভাঙার প্রচেষ্টা বলে মনে হল, তখন তারা সহ্য করতে পারল না যে নিম্নবর্ণীয়রা উচ্চবর্ণীদের মতো ‘নমস্তে’ করবে। তাই তারা ‘গরীব নিবাজ’, ‘পালাগন’, ‘জোহার’ ইত্যাদিকে জোর করে চালু রাখতে চাইল।”

ডঃ আম্বেদকরও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ে মহারাষ্ট্রের নিম্নজাতিরা যখন উচ্চজাতির সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখন সেই প্রচেষ্টা উচ্চজাতিরা ধ্বংস করে দেয়। এমনকি যখন সোনাররা উচ্চকুলীয়দের মতো প্রণাম করতে চাইল, তখন কোম্পানির কাছে তাদের প্রণামে নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করানো হয়েছিল।

আর্যনৃপতি ও আত্মারাম অমৃতসরি প্রমুখ আর্যসমাজীদের সংস্পর্শে এসে শ্রী ভীমরাও আম্বেদকর “জোহার”-এর পরিবর্তে “নমস্তে” অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা অজানা, যার ফলে তিনি আবার “নমস্তে”-র পরিবর্তে “জোহার” ব্যবহার শুরু করেন। ডঃ আম্বেদকরের জীবন ও কর্মের বিদগ্ধ বিশ্লেষক ডঃ গঙ্গাধর পান্তাওনে বলেছেন যে জীবনের শেষ দিকে তিনি আধুনিক বৌদ্ধদের প্রচলিত “জয় ভীম” অভিবাদনও গ্রহণ করেছিলেন। এখানে “ভীম” শব্দটি তাঁর নিজের নামের অংশ। প্রতিটি বৌদ্ধ “জয় ভীম” বলার সময় একভাবে ডঃ আম্বেদকরের চিন্তাধারার বিজয়কেই প্রকাশ করে।

ডঃ আম্বেদকরজী “নমস্তে” অভিবাদন ব্যবহার করেছেন— এ তথ্য প্রমাণিত হয় তাঁর লন্ডন থেকে পাঠানো তিনটি চিঠি দ্বারা। প্রথম দুটি তিনি তাঁর সহযোগী ও সচিব শ্রী সীতারাম নামদেব শিবতারকরকে পাঠিয়েছিলেন এবং তৃতীয়টি তাঁর সহধর্মিণী রমাবাইকে। যেমন—

  • ৬ অক্টোবর ১৯২০: “প্রিয় শিবতারকর, নমস্তে।”

  • ১০ জুন ১৯২১: “রাজমান্য রাষ্ট্রশ্রী শিবতারকর ইয়াঁস নমস্তে।”

  • ২৫ নভেম্বর ১৯২৯: “প্রিয় রামু (শ্রীমতী রমাবাই ভীমরাও আম্বেদকর), নমস্তে।”

  • ১২ জুন ১৯২৭: “রা. রা. সুকুন্দরাবাও পাটিল ইয়াঁস অनेক জোহার।”

শ্রী সীতারাম নামদেব শিবতারকর ১৯৩৩–৩৬ অবধি মুম্বইয়ের লোয়ার পরেল আর্যসমাজের সভাপতি ছিলেন এবং সেই সময় ডঃ আম্বেদকরও এই আর্যসমাজে উপস্থিত থাকতেন। (তথ্যসূত্র: আর্যসমাজ লোয়ার পরেল সুবর্ণ মহোৎসব স্মরণিকা, ১৯৭৭, মারাঠি)।


ডঃ আম্বেদকরের বৈদিক সংস্কারের প্রতি আকর্ষণ

স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের বৈদিক নিষ্ঠা সুস্পষ্ট। আর্যসমাজের তৃতীয় নিয়মই হলো— “বেদ পড়া–পড়ানো এবং শোনা–শোনানো সকল আর্যের পরমধর্ম।” আর্যসমাজে সকল সংস্কার বৈদিক পদ্ধতিতেই সম্পন্ন হয়।

ডঃ আম্বেদকরের “বহিষ্কৃত ভারত” নামক সাপ্তাহিক মারাঠি পত্রিকার ১২ এপ্রিল ১৯২৯ সংখ্যায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে “সমাজ সমতা সংঘ”-এর নতুন উদ্যোগ: মহার সমাজে বৈদিক বিবাহপদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে।”

একই সংখ্যার অন্য একটি সংবাদে উল্লেখ ছিল— বৈদিক পদ্ধতিতে একটি বিবাহ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি গजानন ভাস্কর চৈত্য (১৮৬৬–১৯২১) কর্তৃক সংকলিত বৈদিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। সংবাদটির শেষে আশা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, বৈদিক পদ্ধতির প্রচলনের মাধ্যমে অস্পৃশ্য সমাজ তাদের উপর চাপানো কলঙ্ক মুছে ফেলতে সক্ষম হবে।

২৯ জুন ১৯২৯–এ বৈদিক পদ্ধতিতে কেশব গোবিন্দরাও আদ্রেকরের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ডঃ আম্বেদকর স্বয়ং তাঁর সহধর্মিণীকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। এটি পরেল (মুম্বই)-এর দামোদর মূলজি ঠাকরসি হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বলা হয়, দলিত সমাজে বৈদিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন এটাই ছিল প্রথম বিবাহ।

এছাড়া ৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৯–এর “বহিষ্কৃত ভারত”-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল— “মনমাড়ের মহাররা শ্রাবণী পালন করল; ২৬ ব্যক্তি উপনয়ন গ্রহণ করল।”

এসব সংবাদ থেকে স্পষ্ট যে জীবনের প্রথম ভাগে ডঃ আম্বেদকরের বৈদিক সংস্কারগুলির প্রতি কিছুটা আকর্ষণ ছিল এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় বৈদিক আচার–অনুষ্ঠান সম্পর্কিত খবরও স্থান দিতেন।


জাতিগত বৈষম্যের কারণে ভাড়া–বাড়ির সমস্যাও

ভারতের রক্ত–মজ্জায় জাতিভেদ এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে তথাকথিত নিম্নজাতিকে বাড়িওয়ালা ভাড়াতেও ঘর দিত না। বড়োদার প্রগতিশীল মহারাজ সায়াজীরাও গায়কোয়াড়ের চাকরিতে থেকেও ডঃ আম্বেদকরকে এই সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। তবে যা বড়োদায় ঘটেছিল, মুম্বইয়ে তা ঘটেনি। কারণ মুম্বইয়ের ভাটিয়া সম্প্রদায় আর্যসমাজ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল, ফলে মুম্বইয়ে ডঃ আম্বেদকরকে বাসস্থানের সংকটে পড়তে হয়নি।

৮ ডিসেম্বর ১৯২৩ থেকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ পর্যন্ত লেখা বহু চিঠিতে দেখা যায়, প্রায় সাত বছর ধরে তাঁর চিঠিপত্রের ঠিকানা ছিল পরেল, মুম্বইয়ের দামোদর ঠাকরসি হল। এই ঠাকরসি পরিবার ছিল প্রগতিশীল আর্যসমাজী। দামোদর ঠাকরসির পিতা মূলজি ঠাকরসি ছিলেন বিশ্বের প্রথম আর্যসমাজ— “আর্যসমাজ বোম্বে”—এর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং স্বামী দয়ানন্দের ঘনিষ্ঠ।


জাতি–উচ্ছেদ ও বর্ণব্যবস্থা প্রসঙ্গে

ডঃ আম্বেদকরের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো “জাতি নির্মূলন”। গ্রন্থটির ভূমিকায় বলা হয়েছে— “ডঃ আম্বেদকর কর্তৃক লাহোরের ‘জাতি–পান্তি তাড়ক মণ্ডল’-এর ১৯৩৬ সালের বার্ষিক অধিবেশনের জন্য প্রস্তুত করা অভিভাষণ, কিন্তু যা দেওয়া যায়নি, কারণ স্বাগত কমিটি মনে করেছিল যে এতে প্রকাশিত মতামত গৃহীত হবে না।”

এই অভিভাষণে ডঃ আম্বেদকর জন্মনির্ভর নয়, কর্মনির্ভর বর্ণব্যবস্থার সমর্থনকারী আর্যসমাজীদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এটিকে অবাস্তব, কাল্পনিক ও পরিত্যাজ্য বলেছেন। তাঁর মতে, মানুষকে “ব্রাহ্মণ–ক্ষত্রিয়–বৈশ্য–শূদ্র” ইত্যাদি লেবেল দেওয়া অর্থহীন, কারণ ব্যক্তির যোগ্যতা লেবেল ছাড়াই বোঝা যায়।

তবে গ্রন্থের সংযোজিত পরিশিষ্টে তিনি মহাত্মা গান্ধীর বর্ণব্যবস্থার তুলনায় স্বামী দয়ানন্দ প্রতিপাদিত বর্ণব্যবস্থাকে “বুদ্ধিগ্রাহ্য ও নিরুপদ্রবী” বলেছেন। তাঁর ভাষায়—

“মহাত্মা গান্ধী যে বর্ণব্যবস্থার সমর্থন করেন, তা কি বৈদিক বর্ণব্যবস্থা, নাকি স্বামী দয়ানন্দ অনুমোদিত বর্ণব্যবস্থা? দয়ানন্দ ও তাঁর অনুসারী আর্যসমাজীদের মতে বর্ণব্যবস্থা হলো স্বাভাবিক যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করা। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর মতে বর্ণের সার হলো পূর্বপুরুষদের পেশা গ্রহণ করা, স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক। সুতরাং গান্ধীর বর্ণব্যবস্থা ও জাতিব্যবস্থা আলাদা কিছু নয়।…”

অতএব বোঝা যায়— মহাত্মা গান্ধীর তুলনায় স্বামী দয়ানন্দ প্রতিপাদিত বর্ণব্যবস্থার প্রতি ডঃ আম্বেদকর সহমত ছিলেন। তবে নিজের মূল ভাষণে তিনি এটিকে অগ্রহণযোগ্য ও অব্যবহারিক বলেছেন।

আর্যসমাজের ১৩৩ বছরের ইতিহাস

আমরা যখন আর্যসমাজের ১৩৩ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে গুণ–কর্ম–স্বভাব অনুযায়ী বর্ণব্যবস্থাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সে ৭৫ শতাংশ ব্যর্থ হয়েছে এবং যতদিন না একে সম্পূর্ণভাবে কার্যকর রূপ দিতে সক্ষম হয়, ততদিন যুগ ডঃ আম্বেদকরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবে যে বর্ণব্যবস্থা অব্যবহারযোগ্য, কাল্পনিক এবং বর্জনীয়। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে জাতিনির্মূলনের প্রসঙ্গে ডঃ আম্বেদকর ও তাঁর অনুগামীদের কাছে যুগেরও একটি প্রশ্ন থাকবে, আর সেটি হলো—কোনো এক ধর্ম ত্যাগ করে অপর ধর্ম গ্রহণ করলে কি জাতিগত ভেদাভেদ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়? কারণ ডঃ আম্বেদকরজি তাঁর আলোচিত সভাপতিত্বমূলক ভাষণে বলেছেন যে—“ধর্মীয় আবেগের উচ্ছেদ না করলে জাতিব্যবস্থা ভাঙা সম্ভব নয়।”

নিঃসন্দেহে জাতিগত ভেদাভেদ নষ্ট করার জন্য ডঃ আম্বেদকর যথাসাধ্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন এবং সম্ভবত এই উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায় গ্রহণ করেছিলেন, দীক্ষা নিয়েছিলেন, তাঁর বহু অনুগামীও বৌদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, না আর্যসমাজের কর্মণা-ভিত্তিক বর্ণব্যবস্থার কারণে জাতিগত ভেদাভেদ সম্পূর্ণ দূর হলো, না ডঃ আম্বেদকরের ধর্মান্তরণের মাধ্যমে জাতি-পাঁতির বিষ বিলীন হলো।

(যে দলিত সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে মনুস্মৃতির বিরোধিতা করা হয়েছে ও হচ্ছে, তাদের মধ্যে কি জাতি-পাঁতি ভেঙেছে? তাদের মধ্যে পারস্পরিক ছুঁতাছুঁতি কি পুরোপুরি বিলীন হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তবে পারস্পরিক বিবাহ তো বহুদূরের কথা। —সম্পাদক)

বুদ্ধ মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। আজ বৌদ্ধরাই মহাত্মা বুদ্ধ ও ডঃ আম্বেদকরের মূর্তিপূজা করছে। হিন্দুদের মতো বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকেও মূর্তি সরানো যায়নি। পার্থক্য শুধু এই যে, হিন্দুরা বহু দেবমূর্তির পূজা করে, আর বৌদ্ধরা এক-দুটি প্রতিমার। হিন্দুরা প্রদীপ জ্বালায়, আর বৌদ্ধরা মোমবাতি। হিন্দুরা কেশরী রংকে প্রিয় মনে করে, আর বৌদ্ধরা নীলকে। একজন কেশরী টুপি পরে, আরেকজন নীল।

এখানে বাহ্যিক আচার-আচরণে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু অন্তরের প্রবণতা এখনো সেই একই রয়ে গেছে। রং বদলেছে, কিন্তু অন্তঃকরণ বদলায়নি। আত্মার রূপান্তর হয়নি। দয়ানন্দ ও আম্বেদকরের নিজ নিজ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জাতিগত ভেদাভেদ আজও যথাস্থানে বিদ্যমান। তবে কি সত্যিই জাতি সেই যা যেতে যেতে যায় না? কে জানে, সমূলে জাতি-পাঁতির উচ্ছেদ কবে হবে? হয়তো জ্ঞান ও কর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে সমাজ এই বৈপরীত্যময় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। জাতি ভাঙা তো দূরের কথা, সমাজ এখনো তার উপজাতিগুলো ভাঙার সাহসও সঞ্চয় করতে পারেনি।

জাতিনির্মূলনের একমাত্র অচুক উপায় হলো আন্তঃজাতীয় বিবাহ, যার সমর্থন ডঃ আম্বেদকরও করেছেন। এ ধরনের বিবাহ এক প্রজন্ম নয়, বরং সাত প্রজন্ম ধরে চলতে হবে, তাহলেই জাতিগত ভেদাভেদের সমূলে বিনাশ ঘটবে। এর বাইরে অন্য কোনো উপায় কার্যকর মনে হয় না।

ডঃ আম্বেদকর জাতি-পাঁতি-তোড়ক মণ্ডলের (১৯৩৬) বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতিত্বের প্রসঙ্গে লিখেছেন যে—
“এটি আমার জীবনের নিশ্চিতভাবেই প্রথম সুযোগ, যখন আমাকে সवर्ण হিন্দুদের অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল (এবং আমার লিখিত সভাপতিত্বমূলক ভাষণের ভাবগত মতভেদের কারণে অধিবেশনই বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল)। দুঃখজনক যে এর সমাপ্তি এক বেদনাময় পরিণতিতে হলো।”


জাতি-পাঁতি-তোড়ক মণ্ডল ও আর্যসমাজের আত্মীয় সম্পর্ক

সম্ভবত খুব কম মানুষই জানেন যে, আর্যসমাজের যে প্রধান কর্মীরা ছিলেন, তাঁরাই জাতি-পাঁতি-তোড়ক মণ্ডলেরও কর্মী ছিলেন। আইনগত দৃষ্টিতে আমাদের কয়েকজন বন্ধুর এ মন্তব্য ঠিক যে জাতি-পাঁতি-তোড়ক মণ্ডল একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান এবং এর সঙ্গে আর্যসমাজের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু গভীরভাবে দেখা হলে বোঝা যায়, জাতি-পাঁতি-তোড়ক মণ্ডল ও আর্যসমাজের এক অবিচ্ছেদ্য আত্মীয় সম্পর্ক ছিল। এই মণ্ডলের অধিকাংশ সদস্যই বৈদিক মতাবলম্বী ছিলেন।

মণ্ডলের প্রতিষ্ঠাতা সনতরাম বি.এ. (১৮৮৭–১৯৮৮) স্বামী দয়ানন্দকে অন্ধ অনুসারী বা সম্পূর্ণ দয়ানন্দভক্ত না হলেও, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বের প্রতি নতমস্তক ছিলেন। ১৯৭১–৭২ সালে মরাঠওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সনতরাম বি.এ.-এর লেখা স্বামী দয়ানন্দ নামক একটি বিশদ জীবনী পড়ানো হতো। সনতরাম বি.এ.-এর জন্য তাঁর মণ্ডলের পরে সবচেয়ে নিকটতম ও আত্মীয় প্রতিষ্ঠান যদি কোনোটি ছিল, তবে তা ছিল আর্যসমাজ।

শ্রী সনতরাম বি.এ.-এর পক্ষ থেকে ডঃ আম্বেদকরের সঙ্গে যে ২৭.৩.১৯৩৭ তারিখে পত্রব্যবহার হয়েছিল, তাতে ডঃ আম্বেদকরের সভাপতিত্বমূলক ভাষণ নিয়ে যাঁরা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের চার বা পাঁচজনের নাম দেওয়া আছে। এর মধ্যে প্রথম তিনজনই আমার জানা মতে সুপরিচিত সর্বভারতীয় আর্যসমাজী নেতা ছিলেন। তাঁদের নাম—

  • ভাই পরমানন্দ (১৮৭৬–১৯৪৭)

  • মহাত্মা হংসরাজ (১৮৬৪–১৯৩৮)

  • ডঃ গোকুলচন্দ নারঙ্গ এম.এ., পিএইচ.ডি., ডি.লিট. (১৮৭৮–১৯৬৯)

ভাই পরমানন্দ ছোটবেলায়ই আর্যসমাজী হয়ে যান। লাহোরের দয়ানন্দ হাইস্কুল ও কলেজের স্নাতক ছিলেন। দয়ানন্দ কলেজ, লাহোরে তিনি অধ্যাপকও ছিলেন এবং দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক (ডি.এ.ভি.) শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে তিনি বিদেশে গিয়ে আর্যসমাজের প্রচার করেছিলেন। এঁরাই সেই ভাই পরমানন্দ, যিনি আজীবন কালাপানির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সরদার ভগতসিংহের দাদা–পিতার অন্তরঙ্গ সখা–স্নেহভাজন এবং লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে সুখদেব–ভগতসিংহ প্রমুখ বিপ্লবীদের শিক্ষক।

দ্বিতীয় নাম মহাত্মা হংসরাজের

যিনি ছিলেন দয়ানন্দ কলেজ (ডি.এ.ভি.) লাহোরের অধ্যক্ষ এবং যিনি কোনো প্রকার পারিশ্রমিক না নিয়ে ২৬ বছর (১৮৮৬–১৯১২) পর্যন্ত ঐ শিক্ষণ-সংস্থাকে সেবা করেছিলেন এবং জীবনের ২৬ বছর আর্যসমাজ আন্দোলনের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।

তৃতীয় মহাপুরুষ ডঃ গোকুলচন্দ নারঙ্গও ভাই পরমানন্দের শিষ্য এবং ডি.এ.ভি. শিক্ষণ-সংস্থার ছাত্র ছিলেন। তিনি স্বামী শ্রদ্ধানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় শুদ্ধি সভা (১৯২৩)-এর কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন। পণ্ডিত ইন্দ্র বিদ্যাবাচস্পতি রচিত আর্যসমাজ কা ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকাও তিনি লিখেছিলেন। ইন্দ্রজি তাঁকে আর্যজাতির জ্ঞানবৃদ্ধ–জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন। তিনি ডি.এ.ভি. কলেজ, লাহোর এবং কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকও ছিলেন।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ সালে বোম্বাইয়ে ডঃ কল্যাণদাস দেশাইয়ের সভাপতিত্বে জাতি–পাঁতি–তোড়ক মণ্ডলের যে বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই অধিবেশনে বক্তৃতাকারী অধিকাংশই আর্যসমাজী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, পণ্ডিত ঘাসীরাম (১৮৫৭–১৯৩৪), স্বামী মুনীশ্বরানন্দ, স্বামী সত্যদেব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ অধিবেশনে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, সেখান থেকেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে মণ্ডলের ওপর আর্যসমাজের প্রভাব কতটা প্রবল ছিল। প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ—

“এই মণ্ডলের মতে বর্তমান যে বর্ণব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তা অন্যায়। তাই প্রয়োজনীয় হলো খাওয়া–দাওয়া ও বিবাহ–সম্পর্কিত সমস্ত বাধাবন্ধন উঠিয়ে দেওয়া। এজন্য এই মণ্ডল প্রত্যেক আর্য যুবক–যুবতীকে প্রেরণা দেয় যে, বিবাহাদি অনুষ্ঠানে বর্তমান যেসব বাঁধন আছে, সেগুলো জেনেশুনে ভেঙে ফেলতে হবে এবং জাতি–পাঁতির বাইরে বিবাহ করতে হবে।”

আর্যসমাজ ও জাতি–পাঁতি–তোড়ক মণ্ডলের সম্পর্ক স্পষ্ট করতে গিয়ে ডঃ সত্যকেতু বিদ্যালঙ্কার লিখেছেন—
“বিশ শতকের প্রথম পর্যায়ে (সন ১৯২১) লাহোরে জাতি–পাঁতি–তোড়ক মণ্ডলের প্রতিষ্ঠা হয়, যার প্রধান নেতা ছিলেন সনতরাম বি.এ.। যদিও এই মণ্ডল আর্যসমাজ সংগঠনের অন্তর্গত ছিল না, কিন্তু এর পরিচালনা আর্যসমাজীরাই করতেন। এই মণ্ডল জাতি–পাঁতি ভেঙে বিবাহসম্পর্ক স্থাপনের জন্য আন্দোলন করত।”

এ থেকে স্পষ্ট হয় যে আইনগত দিক দিয়ে আর্যসমাজ ও জাতি–পাঁতি–তোড়ক মণ্ডল দুটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও, ভাবাদর্শগত দিক দিয়ে মণ্ডল আসলে আর্যসমাজেরই প্রতিরূপ বা পোষক অংশ ছিল। আর্যসমাজ তার প্রারম্ভিক কাল থেকেই জাতিনির্মূলন ও দলিতোদ্ধারে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিল। ডঃ আম্বেদকরও নিজের বিশেষ ভঙ্গিতে এই আন্দোলনগুলিতে প্রবল আগ্রহী ছিলেন।

এই কর্মসূচির ভাব–সাম্য থাকার কারণেই জাতি–পাঁতি–তোড়ক মণ্ডলের মাধ্যমে শ্রী সনতরাম বি.এ. ডঃ আম্বেদকরকে ১৯৩৬ সালের মণ্ডলের বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতিত্বের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু কোনো অজানা কারণে তৎকালীন কয়েকজন আর্যসমাজী ডঃ আম্বেদকরের চিন্তাধারা যথাযথ শোনার ধৈর্যও প্রদর্শন করতে পারলেন না। হায়, যদি তাঁরা ধৈর্য ধরে আম্বেদকরের বক্তব্য শুনতেন! মতপার্থক্য সত্ত্বেও নিজেদের জেদ একপাশে সরিয়ে রেখে উদার মানসিকতায় খোলামেলা আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তখনকার আর্যসমাজীরা সেই পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হন। যদি তাঁরা তা পারতেন, তবে অন্তত এই কৃতিত্ব তাঁদের থাকত যে, ডঃ আম্বেদকরকে প্রথমবার কোনো অধিবেশনের সভাপতিত্বের সুযোগ তাঁরাই দিয়েছিলেন।

কিন্তু ইতিহাসে আজ আর্যসমাজ কেবল এক অসফল আমন্ত্রক বা সংযোজক হিসেবেই থেকে গেছে। ইতিহাসবিদ এতটুকুই বলতে পারবেন যে, ডঃ আম্বেদকরকে তাঁর বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতিত্বের একমাত্র আমন্ত্রণ যদি কেউ দিয়েছিল, তবে তা আর্যসমাজীরাই, কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হলো না, ব্যর্থ হলো। ডঃ আম্বেদকরের নিজের ভাষায়—
“আমার বিশ্বাস, এটাই প্রথমবার হলো যখন স্বাগত সমিতি সভাপতির নিয়োগ বাতিল করে দিল, কারণ তারা সভাপতির মতামত মেনে নিতে পারল না।”


সভাপতিত্বমূলক ভাষণ ও প্রতিক্রিয়া

চর্চিত সভাপতিত্বমূলক ভাষণে ডঃ আম্বেদকর শাস্ত্রের পাশাপাশি বেদকেও সমালোচনা করেছিলেন, যা তৎকালীন চিরপ্রামাণ্যবাদী আর্যসমাজীরা সহ্য করতে পারেননি। সম্ভবত এই কারণেই আর্যসমাজ বচ্চোয়ালি লাহোর–এর প্রাক্তন প্রধান শ্রী হরভগবান তাঁর ১৪ এপ্রিল ১৯৩৭–এর চিঠিতে ডঃ আম্বেদকরকে লিখেছিলেন—
“আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চান যে অধিবেশন কোনো অপ্রিয় ঘটনার মধ্যে শেষ না হোক, তাই তাঁরা চান অন্তত ‘বেদ’ শব্দটি আপাতত বাদ দেওয়া হোক।”

স্মরণীয় যে, এই সভাপতিত্বমূলক ভাষণেই ডঃ আম্বেদকর তাঁর আসন্ন ধর্মান্তরের ইঙ্গিত দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন—
“হিন্দু হিসেবে এটাই আমার শেষ ভাষণ।”

বেদের তথাকথিত সমালোচনা এবং ভবিষ্যৎ ধর্মান্তরের সংকেত—এই দুটি বিষয়ই এমন ছিল, যা আর্যসমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অটল রইল। ডঃ আম্বেদকর নিজের মতাদর্শে দৃঢ় ছিলেন এবং কোনো প্রকার সমঝোতায় যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন—
“আমি একটি কমা পর্যন্ত পরিবর্তন করতে রাজি নই, আমার ভাষণে কোনো প্রকার সেন্সরের অনুমতি দেব না।”

এছাড়াও তিনি মণ্ডলের প্রতিনিধিকে লিখেছিলেন—
“যদি আপনাদের মধ্যে কেউ সামান্য ইঙ্গিত দিতেন যে, আমাকে সভাপতি বানিয়ে যে সম্মান দিচ্ছেন, তার বিনিময়ে আমাকে ধর্মান্তর (হিন্দু থেকে বৌদ্ধ)–সংক্রান্ত আমার বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে, তবে আমি সোজাসুজি বলে দিতাম যে, আপনাদের দেওয়া সম্মানের চেয়ে আমি আমার বিশ্বাসকে বেশি মূল্য দিই।”


স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ও ডঃ আম্বেদকর

জাতিনির্মূলন ও দলিতোদ্ধারের প্রসঙ্গে আর্যসমাজের প্রকৃত কর্মযজ্ঞ থেকে ডঃ আম্বেদকর অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্বামী দয়ানন্দের শিষ্য এবং গুরুকুল কাংড়ির প্রতিষ্ঠাতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (১৮৫৬–১৯২৬)-এর প্রসঙ্গে তিনি তাঁর What Congress and Gandhi Have Done to the Untouchables গ্রন্থে লিখেছেন—
“স্বামী শ্রদ্ধানন্দ দলিতদের সর্বশ্রেষ্ঠ সহায়ক ও সমর্থক ছিলেন। অস্পৃশ্যতা–নিবারণ সম্পর্কিত (কংগ্রেসের) কমিটিতে থেকে যদি তাঁকে স্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হতো, তবে নিঃসন্দেহে আজ আমাদের সামনে এক বিশাল পরিকল্পনা উপস্থিত থাকত।”

স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মৃত্যুসংবাদ শুনে ডঃ আম্বেদকরের উপস্থিতিতে যে শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল (অর্থাৎ বহিষ্কৃত লিগ, কুলাবা জেলা পরিষদের প্রথম অধিবেশন, ১৯–২০ মার্চ ১৯২৭), তার ভাষা ছিল এইরূপ—
“স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির অমানবিক হত্যার সংবাদ পেয়ে এই সভা (অর্থাৎ বহিষ্কৃত লিগ) গভীর শোক প্রকাশ করছে। আমাদের অনুরোধ যে, তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে হিন্দুসমাজ অস্পৃশ্যতার নির্মূলন করবে।”


লালা লাজপত রায় ও ডঃ আম্বেদকর

ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের বিস্তৃত জীবনী যিনি মারাঠি ভাষায় লিখেছেন, সেই ডঃ চাংদেব ভবানরাও খৈরমোড়ের মতে জাতীয় নেতাদের মধ্যে লালা লাজপত রায় ডঃ আম্বেদকরের কাছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মনে হতো। তাঁর দৃষ্টিতে তিলক, গোখলে এবং গান্ধী নিজ নিজ স্থানে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, কিন্তু লাজপত রায়ের মতো কাছের মনে হতো না। এর একটি কারণ ছিল—১৯১৩ থেকে ১৯১৬ আমেরিকায় অবস্থানকালে লাজপত রায় ও আম্বেদকরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

১৯১৪ সালে লাজপত রায় তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে। তখন তিনি দেখতে পান, তাঁর আগে এসে বসা এবং তাঁর পরে গ্রন্থাগার থেকে বের হওয়া এক ভারতীয় ছাত্র। কৌতূহলবশত পরিচয় করলে জানতে পারেন, সেই ছাত্র আর কেউ নন, স্বয়ং ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর পরিচয় ও গভীর জ্ঞান দেখে লাজপত রায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।

স্ত্রৈরমোতে তাঁর জীবনীতে আম্বেদকর রচিত স্বর্গীয় লালা লাজপত রায় প্রবন্ধ উদ্ধৃত করার আগে লেখেন যে, এই শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখার পূর্বে ডঃ আম্বেদকরের মানসিক অবস্থা ছিল—

লালা লাজপত রায় (১৮৬৫–১৯২৮)-এর মৃত্যুসংবাদ শুনে ডঃ আম্বেদকর গভীরভাবে ব্যথিত হন। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের আত্মবলিদান ছাড়া অন্য কোনো জাতীয় নেতার মৃত্যুতে তিনি এর আগে বা পরে এতটা ব্যথিত হননি। সেই রাতেই তিনি বহিষ্কৃত ভারত সভা–র পক্ষ থেকে এক শোকসভা আয়োজন করেছিলেন। সেখানে লালাজিকে নিয়ে ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। তাঁর সমগ্র জনজীবনে কোনো জাতীয় নেতার মৃত্যুর পর শোকসভা আয়োজন বা শ্রদ্ধাঞ্জলি–ভাষণ তিনি কখনো দেননি।

এমনকি নাথুরাম গডসের তিনটি গুলিতে ৩০–১–১৯৪৮ মহাত্মা গান্ধিজির মৃত্যু হলে সেদিনও ডঃ আম্বেদকর গান্ধিজি সম্পর্কে বা তাঁর মৃত্যুর প্রসঙ্গে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

লালাজির আত্মবলিদান উপলক্ষে ডঃ আম্বেদকর যে শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখিতভাবে ব্যক্ত করেছিলেন, সেটি এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট চার-এ যথাযথভাবে সংযোজিত হয়েছে।

মাস্টার আত্মারাম অমৃতসরি এবং ডঃ আম্বেদকর

এ ঘটনাগুলো ইংরেজ শাসনামলের। ডঃ আম্বেদকর (১৮৯১–১৯৫৬) ইতিমধ্যেই দলিতদের নেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ক্ষেত্রের দাবিও তুলেছিলেন। এই দাবির বিরোধিতায় মহাত্মা গান্ধীজি ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালে অনশন শুরু করেছিলেন। এই অনশন-সংক্রান্ত ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় লিখেছিলেন— “শ্রী আম্বেদকরজি প্রথম আশ্রয় আর্য সমাজেই পেয়েছিলেন।” (গ্রন্থ: জীবনচক্র, প্রকাশক: কলা প্রেস, এলাহাবাদ, সংস্করণ–১৯৫৪)। কিন্তু উপাধ্যায়জি সেখানে ঘটনাবলী বা সময়কাল উল্লেখ করেননি, যার ফলে এই কৌতূহল রয়ে যায় যে— “বাবাসাহেব আম্বেদকর জীবনে প্রথম কবে এবং কীভাবে আর্য সমাজের সংস্পর্শে এলেন?”

ডঃ আম্বেদকরের প্রায় পনেরো বছরের সহচর শ্রী চাংদেব ভাওনারাও খৈরমোডে ১৯০২ সালে ডঃ ভীমরাওজি আম্বেদকরের চরিত্রগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেই গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে গিয়ে জানা যায় যে প্রথমবার ১৯১৩ সালে বরোদা অবস্থানকালে শ্রী আম্বেদকর আর্য-বিদ্বান পণ্ডিত আত্মারাম অমৃতসরি এবং আর্য সমাজ বরোদার সংস্পর্শে এসেছিলেন।


পণ্ডিত আত্মারাম অমৃতসরি

পণ্ডিত আত্মারামজি (১৮৬৬–১৯৩৮) মূলত অমৃতসরের বাসিন্দা ছিলেন। আর্য বিদ্বান পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যালর্থীর প্রেরণায় তিনি ইংরেজ সরকারের চাকরি না করার সংকল্প করেছিলেন। ১৮৯১ সালে তিনি লাহোরের দয়ানন্দ হাই স্কুলে অধ্যাপনায় যুক্ত হন এবং ১৮৯৪ সালে আর্য প্রতিনিধি সভা, লাহোরের উপমন্ত্রী হন।

১৮৯৭ সালে পণ্ডিত লেখারামের বীরমৃত্যুর পর আত্মারামজি তাঁর সংগ্রহ করা স্বামী দয়ানন্দ সম্পর্কিত জীবন-উপকরণকে সুবিন্যস্ত করে এক বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তথাকথিত শূদ্রদের বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত করে প্রকাশ্যে তাঁদের হাত থেকে অন্ন-জল গ্রহণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে তিনি পৌরাণিক ও মৌলবীদের সঙ্গে শাস্ত্রার্থও করেছেন।

বরোদা রাজ্যের উদ্যোগে ন্যায়বিভাগের জন্য বহু ভাষায় অভিধান সংকলন করা হয়। তার হিন্দি বিভাগের দায়িত্ব আত্মারামজির উপর ন্যস্ত হয়েছিল। এই গ্রন্থ “শ্রী সায়াজী শাসন-कल्पतरু” নামে প্রকাশিত হয়। মৌলিক ও অনুবাদসহ প্রায় কুড়ি গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন।

যখন দলিতরা ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল, তখন বরোদা নরেশ সিদ্ধান্ত নেন যে রিয়াসতে দলিতোদ্ধার কার্যক্রম চালানো হবে। স্বামী নিত্যানন্দ আহ্যাচার্যের অনুরোধে আত্মারামজি ১৯০৮ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত বরোদা রিয়াসতে এবং পরে কোলহাপুর রিয়াসতে দলিতোদ্ধারের কাজ করেন। তাঁর এই কাজের প্রশংসা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, কর্মবীর বিধুল রামজি শিন্দে, জুগল কিশোর বিড়লা, ইন্দোর নরেশ তুকোজিরাও হোলকার প্রমুখ।

বরোদা নরেশ সায়াজীরাও গায়কোয়াড় আত্মারামজিকে ছাত্রাবাসের সভাপতি ও বিদ্যালয়-পরিদর্শক নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় শূদ্রাতিশূদ্রদের জন্য শত শত বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, যেখানে প্রায় বিশ হাজার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করত। তিনি বরোদায় আর্য কন্যা মহাবিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরবর্তীকালে কোলহাপুর নরেশ রাজর্ষি শাহু মহারাজ তাঁর কর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কোলহাপুরে আমন্ত্রণ জানান। ১৯১৮ সালে শাহু মহারাজ আত্মারামজিকে বন্ধু ও ধর্মগুরু রূপে গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাত দিয়েই কোলহাপুরে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে বরোদা (গুজরাট) ও কোলহাপুর (মহারাষ্ট্র)-এর মাধ্যমে আত্মারামজি সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে দলিতোদ্ধারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।


বরোদায় আম্বেদকর ও আর্য সমাজ (১৯১৩)

ভীমরাও আম্বেদকর ১৯০৭ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯১২ সালে পারস্য ও ইংরেজি নিয়ে বি.এ. উত্তীর্ণ হন। এসময় আত্মারামজি বরোদায় দলিতোদ্ধার কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯১৩ সালে বি.এ. পাশ করার পর আম্বেদকর বরোদায় আসেন এবং দলিত মহল্লায় বসবাস শুরু করেন।

চরিত্রলেখক খৈরমোডে লিখেছেন—

“ভীমরাও ২৩ জানুয়ারি ১৯১৩ নাগাদ বরোদায় আসেন। সরকারি ব্যবস্থায় থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা না হওয়ায় তিনি প্রথমে মহারবাড়িতে দুই-তিন দিন ছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে আত্মারামজির পরিচয় হয়। আত্মারামজি তাঁকে আর্য সমাজের কার্যালয়ে নিয়ে যান। অন্য ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ভীমরাও সেখানেই থাকেন। তিনি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আর্য সমাজ বরোদায় আত্মারাম অমৃতসরির সঙ্গে ছিলেন।”

তখন আম্বেদকর বরোদা নরেশের সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯১৩ সালের সফরে তিনি দু’সপ্তাহের বেশি থাকেননি। মুম্বাই থেকে টেলিগ্রামে খবর আসে তাঁর পিতা গুরুতর অসুস্থ। পৌঁছতেই তিনি পিতার শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হন। তাঁর মা বহু আগেই (যখন আম্বেদকরের বয়স মাত্র ছয়) মারা গিয়েছিলেন। ফলে ২১ বছর বয়সেই তিনি এতিম হলেন।


বরোদা নরেশের বৃত্তি (১৯১৩–১৯১৬)

পিতার মৃত্যু পরবর্তী শোকাবহ অবস্থায় আম্বেদকর মুম্বাইতে থাকাকালীন সায়াজীরাও গায়কোয়াড় উচ্চশিক্ষার জন্য চারজন ছাত্রকে আমেরিকা পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। মুম্বাইতে সাক্ষাৎ হলে আম্বেদকরও এই বৃত্তির চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে তাঁকে অন্তত দশ বছর বরোদা রিয়াসতে চাকরি করতে হতো।


দ্বিতীয় সাক্ষাৎ (১৯১৭)

১৯১৬ সালে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ১৯১৭ সালে যখন আম্বেদকর বরোদায় চাকরিতে ফিরলেন, তখন প্রথমেই আত্মারাম অমৃতসরির কাছে গেলেন। এবার তিনি এম.এ. ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন এবং লন্ডন ও আমেরিকার মুক্তচিন্তার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। আত্মারামজি তাঁকে এক পারসি ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।


তৃতীয় সংযোগ (১৯২৪)

তৃতীয় সংযোগ সরাসরি নয়, চিঠির মাধ্যমে হয়। আম্বেদকর বরোদা সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। চাকরি করা সম্ভব হচ্ছিল না—কারণ জাতিভেদে তাঁকে থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা দেওয়া হয়নি। অত্যাচার, অপমান, এমনকি পানীয় জল থেকেও বঞ্চিত হতে হয়েছিল তাঁকে। ফলে চাকরি ছেড়ে তিনি মুম্বাই ফিরে আসেন।

১৯২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি আত্মারাম অমৃতসরিকে চিঠি লিখে আর্থিক দুরবস্থার কথা জানান। আত্মারামজি এই বিষয়টি বরোদা প্রশাসনের কাছে উত্থাপন করেন। ফলস্বরূপ সায়াজীরাও গায়কোয়াড় সেই ঋণ পুরোপুরি মওকুফ করে দেন।


👉 এইভাবে দেখা যায়, পণ্ডিত আত্মারাম অমৃতসরি একাধিকবার আম্বেদকরের জীবনে সহায়ক ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন—প্রথম বরোদা অবস্থানে আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে, পরবর্তীকালে আর্থিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করা পর্যন্ত।

বাবাসাহেবের গঠনে আর্যসমাজের ত্রিমূর্তির অবিস্মরণীয় সহযোগ

বড়োদরা এবং কোলহাপুরের মহারাজারা বাবাসাহেব আম্বেদকরকে দেশে ও বিদেশে শিক্ষা অর্জনের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। আম্বেদকর যখন জে.ও.এ-তে পড়াশোনা করছিলেন, তখন থেকেই বড়োদরার মহারাজ তাঁকে মাসে পনেরো টাকা করে বৃত্তি দিতেন। এই দুই প্রগতিশীল আর্যশাসকের আমন্ত্রণেই আর্যপণ্ডিত আত্মারামজি অমৃতসরি প্রায় তিন দশক ধরে পদদলিত ও বঞ্চিত সমাজের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

শ্রী সয়াজীরাও গায়কওয়াড়, রাজর্ষি সাহু মহারাজ এবং পণ্ডিত আত্মারামজি অমৃতসরি—এই তিন মহাপুরুষের কাছ থেকে আম্বেদকর ক্রমান্বয়ে সহৃদয় আত্মীয়তা এবং অবিস্মরণীয় আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। তাঁরা সবাই অন্তরে অন্তরে আর্যসমাজী ছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ ও তাঁর রচিত সত্যার্থপ্রকাশ গ্রন্থের প্রতি এই ত্রিমূর্তির গভীর আস্থা ছিল। সত্যার্থপ্রকাশ-এর মরাঠি অনুবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও বড়োদরা ও কোলহাপুরের মহারাজারা সময়ে সময়ে বিশেষ আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। পণ্ডিত আত্মারামজি শুধু উর্দুই নয়, পাঞ্জাবিতেও সত্যার্থপ্রকাশ অনুবাদ করেছিলেন।

আম্বেদকরজি থেকে আত্মারামজি প্রায় ত্রিশ বছর বড় ছিলেন। তিনি বাবাসাহেবকে সেই সময় পিতৃতুল্য স্নেহ দিয়েছিলেন, যখন বড়োদরার রক্ষণশীল সমাজ তাঁদের বাসস্থান বা খাদ্যের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে রাজি ছিল না। উচ্চপদে চাকরি করার পরও অফিসে তাঁকে জল পর্যন্ত খেতে দেওয়া হতো না, এমনকি অধীনস্ত কর্মীরাও ফাইল ফেলে-ফেলে দিত।

পণ্ডিত নর্দেবরাজজি বেদতীর্থ তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন—

“অদ্ভুত বক্তৃতা, অসাধারণ কর্মদক্ষতা, অদম্য লেখনী, অনন্য প্রশাসনিক দক্ষতা—এই সব কারণে মাস্টার আত্মারামজি আর্যসমাজের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হতেন। তিনি মিশুক, রসিক ও অহংবর্জিত মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবনযাপন ছিল ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিত। সময় নষ্ট করতেন না। কঠোর কিন্তু চিন্তাশীল সমাজসেবক ছিলেন। তাঁর বিদ্যাপ্রীতি ও স্বাধ্যায় প্রবল ছিল। বড়োদরায় যে কোনও সামাজিক জাগরণ বা প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব মাস্টারজির। বড়োদরার মহারাজ তাঁর উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁকে রাষ্ট্ররত্ন, রাজ্যমিত্র, রাওবাহাদুর ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।”

আম্বেদকরও তাঁর এক সন্তানের নাম রাজরত্ন রেখেছিলেন। সম্ভবত আত্মারামজির মহান গুণাবলির স্মৃতিতেই তিনি এই নাম দিয়েছিলেন। বলা যায়, বড়োদরার মহারাজ সয়াজীরাও গায়কওয়াড়, কোলহাপুরের ছত্রপতি সাহুজি মহারাজ ও পণ্ডিত আত্মারামজি অমৃতসরির আর্যোচিত উদার আচরণকে মনে রেখে পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী জীবন-চক্র (১৯৫৪) বইয়ে লিখেছিলেন—

“আম্বেদকরজি প্রথম আশ্রয় আর্যসমাজেই পেয়েছিলেন।”


আর্য মহাপুরুষদের প্রতি ড. আম্বেদকরের কৃতজ্ঞতা

আম্বেদকর আর্য মহাপুরুষদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা পোষণ করতেন। তিনি তাঁর পিএইচডি গবেষণাপত্র বড়োদরার মহারাজ সয়াজীরাও গায়কওয়াড়কে উৎসর্গ করেছিলেন। আবার তাঁর গুরু জ্যোতিবা ফুলেকে “মহাত্মা” উপাধি ১৮৮৬ সালে এক অনুষ্ঠানে প্রদান করেছিলেন সয়াজীরাও গায়কওয়াড়ই।

১৯২২ সালের মে মাসে কোলহাপুরের সাহু মহারাজ মারা গেলে আম্বেদকর যুবরাজ রাজারাম মহারাজকে লিখেছিলেন—

“সাহু মহারাজের মৃত্যুসংবাদ পড়ে আমি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। এতে আমি একদিকে অসাধারণ এক বন্ধুকে হারালাম, অন্যদিকে দলিত সমাজ তাদের সবচেয়ে বড় হিতৈষীকে হারালো। আমি গভীর শোকে ডুবে আছি, এমন সময় আপনাদের ও মহারাণীর দুঃখে আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”

স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সম্পর্কে আম্বেদকর লিখেছিলেন—

“স্বামীজি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন, প্রজ্ঞাবান আর্যসমাজী, যিনি আন্তরিকভাবে অস্পৃশ্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন।”

জাতীয় নেতা লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে আম্বেদকরের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯১৫ সালে আমেরিকার একটি গ্রন্থাগারে। তখন লালাজি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কথা বলেছিলেন। অনেক পরে তিনি জানলেন যে এই ছাত্র দলিত সমাজভুক্ত। আম্বেদকর লিখেছেন—

“লালাজির পিতা আর্যসমাজী ছিলেন, তাই তিনি ছোট থেকেই উদারমনস্কতা শিখেছিলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে তিনি বিপ্লবী ছিলেন। দলিতোদ্ধার আন্দোলনে তিনি বিশ্বস্ত ও সহানুভূতিশীল সহযোগী ছিলেন।”

আম্বেদকর জাত-পাঁত তোড়ক মণ্ডল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ সমতা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি নিজেই এর সভাপতি ছিলেন। এই সংঘের মতো জনসেবী প্রতিষ্ঠান ভারতীয় সমাজকে দিয়েছে ভাই পরমানন্দ ও সন্তরাম বি.এ.-র মতো কর্মী, যারা আর্যসমাজেরই দান।

আম্বেদকরের জীবনের প্রথমদিকে তিনি বেদোক্ত বিবাহ, উপনয়ন ও শ্রাবণী অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশ নিতেন। তিনি চিঠিতে “জোহর”-এর বদলে “নমস্তে” লিখতেন। সহভোজ ও আন্তর্জাতীয় বিবাহের মতো সমাজ-সংস্কারমূলক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। নিঃসন্দেহে এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল মহর্ষি দয়ানন্দ ও আর্যসমাজ আন্দোলনের প্রেরণা। এর কৃতিত্ব বিশেষভাবে প্রাপ্য পণ্ডিত আত্মারামজির, যিনি বড়োদরার দরিদ্র বস্তি থেকে আম্বেদকরকে প্রথমবার আর্যসমাজের আলোর মুখ দেখিয়েছিলেন।

পরে তিনি মুম্বইয়ের লোয়ার পরল আর্যসমাজের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন। বলা যায়, বড়োদরার মহারাজ সয়াজীরাও, কোলহাপুরের রাজর্ষি সাহু মহারাজ ও আত্মারামজির যৌথ আর্যোচিত আচরণের মাধ্যমেই বাবাসাহেব প্রথম আর্যসমাজের স্নেহের আস্বাদ পান। মহর্ষি দয়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজের ছায়া তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে স্পষ্ট। যদিও পরে তিনি একেবারে নাস্তিক ও বেদবিদ্বেষী হয়ে পড়েছিলেন—সম্ভবত বৈদিক দর্শনে অজ্ঞতা ও পাশ্চাত্য দার্শনিক প্রভাবের কারণে।


মনুস্মৃতি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি

আম্বেদকর ও তাঁর অনুসারীরা প্রায়ই বলতেন যে মনুস্মৃতি বৈষম্যমূলক গ্রন্থ। অথচ আর্যসমাজ ও তাদের অনুগামীরা মনুস্মৃতি মেনে চললেও বাস্তব জীবনে সমতা ও মানবতাবাদের পক্ষে দাঁড়াতেন। এর কারণ—আর্যসমাজ শুধুমাত্র বেদসম্মত ও অপ্রক্ষিপ্ত মনুস্মৃতি গ্রহণ করে।

মহর্ষি দয়ানন্দ স্পষ্ট করেছিলেন—

“মনুস্মৃতি-কে আমি মনুর মত জানার জন্য দেখি, তাকে গ্রহণযোগ্য সত্য মনে করি না। যা কিছু বেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, আমি মানি; যা বিরোধী, তা মানি না। তাই আমার গ্রন্থে যেমন সত্যার্থপ্রকাশ বা সংস্কারবিধি-তে মনুস্মৃতির অনেক উদ্ধৃতি আছে, সেগুলো আমি মত জানার জন্য দিয়েছি; বেদসম্মত অংশকেই প্রমাণ হিসেবে মেনে নিই।”


বৈদিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা

আর্যসমাজের কয়েকজন বিদ্বান সময়ে সময়ে ড. আম্বেদকরকে বৌদ্ধধর্ম থেকে বৈদিক ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে সার্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভার সহকারী সেক্রেটারি পণ্ডিত ধর্মদেব সিদ্ধান্তালঙ্কার (স্বামী ধর্মানন্দ বিদ্যমার্তণ্ড, ১৯০১–১৯৭৮) ১৯৫২ সালে “বৌদ্ধমত ও বৈদিক ধর্ম : তুলনামূলক অনুসন্ধান” নামে ২৩০ পৃষ্ঠার এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বহুবার আম্বেদকরের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন।

১৯৫৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে “আস্তিকবাদ” বিষয়ে দিল্লির হার্ডিঞ্জ অ্যাভিনিউর তাঁর বাড়িতে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে তিনি তা সার্বদেশিক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এর আগেও, ১৯৫০ সালের ১২ মে, তাঁর সঙ্গে আম্বেদকরের আলোচনা হয়েছিল।

আম্বেদকর কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি-র ইংরেজি পত্রিকায় “Buddha and the Future of His Religion” নামে প্রবন্ধ লেখেন (এপ্রিল-মে ১৯৫০)। এটি পড়ে ধর্মদেবজি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন।

ড. ডি. আর. দাস (পণ্ডিত উত্তমমুনি বাণপ্রস্থী) জানিয়েছিলেন—

“আম্বেদকরজি ধর্মদেবজিকে বলেছিলেন—‘যেভাবে মা তার সন্তানকে বোঝায়, সেভাবেই আপনি আমাকে বৈদিক ধর্ম বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি কী করব, হিন্দুদের মানসিকতা আমাকে বদলাতে দেখাচ্ছে না। তাঁদের স্বভাব কঠোর ধর্মান্ধদের মতো প্রতিগামী হয়ে গেছে।’”

ড. বালকৃষ্ণ এবং ড. আম্বেদকর

বিশিষ্ট গবেষক, পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর রাজেন্দ্রজি জিজ্ঞাসু তাঁর গবেষণা-গ্রন্থ “आर्यसमाज और डॉ० भीमराव अम्बेडकर” (আর্যসমাজ ও ড. ভীমরাও আম্বেদকর) বইয়ের ভূমিকায় ১৬ জুলাই ২০০০ তারিখে লিখেছিলেন—

“সাতারায় শিক্ষার প্রসার, অস্পৃশ্যতার নিরসন এবং জনজাগরণের আন্দোলনে আর্যপণ্ডিত ড. বালকৃষ্ণজির অসাধারণ অবদান রয়েছে এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সেবার ছাপ ড. আম্বেদকরের উপরও পড়েছিল।”

তখন আমার ড. বালকৃষ্ণ ও ড. আম্বেদকরের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছুই জানা ছিল না। তবে প্রফেসর জিজ্ঞাসুজির সেই ভূমিকাই আমার মধ্যে এ বিষয়ে জানার আগ্রহ জাগিয়েছিল।

মহারাষ্ট্র আর্য লেখক সংঘের সভাপতি ও আর্যসমাজ রামনগর লাতুরের সম্পাদক জ্ঞানকুমারজি আর্যর কাছে আমি যখন ড. বালকৃষ্ণজির জীবন ও কর্ম নিয়ে তথ্য জানতে চাইলাম, তিনি ৭ জুন ২০০২ তারিখে তাঁদের গ্রন্থাগার থেকে “ড. বালকृष্ণ চরিত্র, কার্য ও आठवणी” (জীবনী, কর্ম ও স্মৃতিচারণ) নামক গ্রন্থের ফটোকপি আমাকে দিলেন। এই গ্রন্থ থেকেই প্রথমবার ড. বালকৃষ্ণ ও ড. আম্বেদকর সম্পর্কিত জিজ্ঞাসুজির বক্তব্যকে সমর্থনকারী নির্ভরযোগ্য তথ্য পেলাম।

ড. বালকৃষ্ণজির মৃত্যুর দুই বছর পর কোলহাপুর আর্যসমাজ ও ড. বালকৃষ্ণ স্মারক সমিতির তত্ত্বাবধানে সম্পাদক মো. রা. বাটঠম্বে এই ৩০৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে ২২টি প্রবন্ধ মারাঠিতে, ১৫টি ইংরেজিতে এবং ২টি হিন্দিতে আছে। শিরোনামের “आठवणी” শব্দটির অর্থ হলো “স্মৃতি” বা “স্মরণ।”


আমরা দলিতদের পক্ষের মানুষ

কোলহাপুরের বিষ্ণু বন্তবন্ত শেন্ডগে তাঁর প্রবন্ধ “আমরা দলিতদের পক্ষের মানুষ” (মারাঠি শিরোনাম: आम्हा हरिजनांचे कैबारी)-তে লিখেছেন—

ছত্রপতি সাহু মহারাজ ১৯১৮ সালে তাঁর রাজধানী কোলহাপুরে আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২২ সাল থেকে ড. বালকৃষ্ণ কোলহাপুর আর্যসমাজের সভাপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২২ থেকে প্রায় ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আর্যসমাজের মাধ্যমে তিনি যে দলিতোদ্ধারের উজ্জ্বল কাজ করেছিলেন, তা সত্যিই অবিস্মরণীয়।

ড. বালকৃষ্ণ সাহেবের অন্তরে দলিতদের প্রতি গভীর আত্মীয়তা ও সহানুভূতি ছিল। তাঁদের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য তিনি নিজে যেমন চেষ্টা করেছেন, তেমনি অন্যদের দ্বারাও অনেক কাজ করিয়েছেন। দলিত সমাজের মহান নেতা ড. আম্বেদকর ও ড. বালকৃষ্ণ সাহেবের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

ড. আম্বেদকর (১৮৯১–১৯৫৬) থেকে ড. বালকৃষ্ণ (১৮৮২–১৯৪০) প্রায় নয় বছর বয়সে বড় ছিলেন। দুজনেই অর্থনীতি ও ইতিহাসের পণ্ডিত, শ্রেষ্ঠ বক্তা ও লেখক ছিলেন।


ঐতিহাসিক প্রমাণ

ড. বালকৃষ্ণ ও ড. আম্বেদকরের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পরে চাঙ্গদেব ভবানরাও খৈরমোড়ে রচিত জীবনীগ্রন্থ “শ্রীরাও ভীমরাও আম্বেদকর”-এও পাওয়া যায়। লেখক প্রায় পনেরো বছর ড. আম্বেদকরের সান্নিধ্যে ছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশাতেই একাধিক খণ্ডে এই জীবনী রচনা করেছিলেন।

তিনি দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন—

১৯২৭ সালে মুম্বই অঞ্চলে তিনটি সরকারি পদ শূন্য ছিল। সেখানে প্রথম মহার দলিত স্নাতক (সংস্কৃত নিয়ে বি.এ অনার্স) শ্রী মান. কা. জাধবও আবেদন করেছিলেন। যখন তিনি বি.এ পাশ করেন, তখন ড. আম্বেদকর তাঁকে অভিনন্দন জানান এবং সমাবর্তনে পরার জন্য নিজের ব্যারিস্টারি গাউন তাঁকে উপহার দেন। শুধু তাই নয়, আম্বেদকর স্বয়ং কোলহাপুর রাজারাম কলেজের অধ্যক্ষ ড. বালকৃষ্ণকে বলে জাধবকে ফেলো হিসেবে নিয়োগ করিয়েছিলেন।

কিন্তু যখন সরকারি নিয়োগ হলো, তখন দুটি পদে মারাঠা সম্প্রদায়ের লোক এবং একটি পদে একজন মুসলমান প্রার্থী নিয়োগ পেলেন। মুসলিম প্রার্থীর কেবল সাধারণ বি.এ ডিগ্রি ছিল, অথচ অনার্সপ্রাপ্ত জাধবকে বঞ্চিত করা হয়। এতে ড. আম্বেদকর গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন—

“এটি স্পষ্টতই দলিত প্রার্থীর উপর চরম অন্যায়।”


ড. বালকৃষ্ণের ন্যায়নিষ্ঠতা

সেই সময়ে শুধু অশিক্ষিত দলিত নয়, শিক্ষিত দলিতরাও বৈষম্যের শিকার হতেন। এর মধ্যে ড. বালকৃষ্ণ একজন দলিত স্নাতককে আর্যসমাজ পরিচালিত কোলহাপুরের রাজারাম কলেজে সংস্কৃত ফেলো হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। এ ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

অধ্যক্ষ ড. বালকৃষ্ণের এই আর্যোচিত আচরণ আম্বেদকরের হৃদয় ছুঁয়েছিল। আর্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যে প্রশংসা তিনি শুনেছিলেন, বাস্তব জীবনেও সেটি তিনি সত্যি বলে পেয়েছিলেন।

১৯২৭ সালে এ ঘটনার সময় ড. বালকৃষ্ণের বয়স ছিল ৪৫ এবং ড. আম্বেদকরের বয়স ছিল ৩৬। পরবর্তীকালে সমসাময়িক সাহিত্য ও ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার থেকে আরও তথ্য জানা গেছে যে তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

শেন্ডগে তাঁর লেখায় বলেছেন—

“নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ড. বালকৃষ্ণ আর্যসমাজের পক্ষে দলিতোদ্ধারের জন্য নিরলস ও অক্লান্ত সংগ্রাম করে গেছেন।”


কোলহাপুরে আর্যসমাজের প্রয়োজনীয়তা

কোলহাপুরের ছত্রপতি সাহুজি মহারাজ আর্যসমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাজারাম কলেজকে যুক্ত প্রাদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভার হাতে তুলে দেন। সভা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে প্রেরণ করে বিশিষ্ট আর্যপণ্ডিত ড. বালকৃষ্ণকে।

তিনি কোলহাপুরেই থেকে যান এবং সেখানে বৈদিক ধর্মপ্রচারে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি করেন। হাজার হাজার মানুষ শুদ্ধ হয়ে আর্যধর্মে দীক্ষিত হন। ড. বালকৃষ্ণ, ড. অযিনাশচন্দ্র জোশি, পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় প্রমুখের প্রচেষ্টায় অস্পৃশ্যতা ও জন্মগত জাতিভেদের শিকড় উপড়ে যেতে শুরু করে।

দুঃখের বিষয়, যেখানে ড. বালকৃষ্ণের মতো খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক ও ইতিহাসবিদ আজীবন কাজ করেছিলেন, সেই কোলহাপুরেই আজ সক্রিয় কোনো আর্যসমাজ নেই। অথচ সেখানে আগে হিন্দি, মারাঠি ও ইংরেজি ভাষায় প্রচুর আর্যসমাজ-সম্পর্কিত সাহিত্য প্রকাশ হতো।

স্বামী বেদানন্দ তীর্থ এবং ডঃ আম্বেদকর

‘স্বাধ্যায়-সন্দোহ’ এর লেখক স্বামী বেদানন্দজি তীর্থ (১৮৯২–১৯৫৬) তিনিও তাঁর গ্রন্থ “রাষ্ট্ররক্ষা के वैদिक साधन” (১৯০০) এর প্রাককথন ডঃ জি. আর. আম্বেদকর দ্বারা এই উদ্দেশ্যে লিখিয়ে নিয়েছিলেন যে, এই গ্রন্থটি পড়ে ডঃ আম্বেদকরজি বৌদ্ধ ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে বৈদিক ধর্মের দিকে উন্মুখ হবেন। উক্ত গ্রন্থের ডঃ আম্বেদকরজি লিখিত প্রাককথন পড়ে মনে হয় যে তিনি ওই আলোচিত গ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত তো হয়েছিলেন, কিন্তু এতে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হননি। তাঁর দ্বারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লেখা সেই প্রাককথন এইরূপ—

“স্বামী বেদানন্দ তীর্থের এই গ্রন্থের প্রাককথন লিখবার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কর্মভারবশত আমি লেখকের প্রার্থনা মেনে নিতে বারবার অসমর্থতা প্রকাশ করছিলাম, কিন্তু আমার দ্বারা কিছু শব্দ লেখার জন্য লেখকের অনুরোধ ক্রমাগত ছিল, অতএব লেখকের অনুরোধ আমি শেষ পর্যন্ত মেনে নিলাম। লেখকের স্থাপনা এই যে— স্বাধীন ভারত বেদপ্রোক্ত শিক্ষা নিজের ধর্মরূপে গ্রহণ করুক। এই শিক্ষা সমগ্র বেদে বিভিন্ন স্থানে নিদিষ্ট আছে এবং লেখক এই গ্রন্থে তার সংকলন করেছেন। আমি এ কথা বলতে পারি না যে, এই গ্রন্থ ভারতবর্ষের ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠবে; কিন্তু এ কথা অবশ্যই বলি যে, এই গ্রন্থ প্রাচীন আর্যদের ধর্মগ্রন্থ থেকে সংকলিত উদ্ধৃতির এক বিস্ময়কর ভাণ্ডারই নয়, বরং এ বিস্ময়করভাবে সেই চিন্তাধারা ও আচরণের শক্তিকে প্রকাশ করেছে, যা প্রাচীন আর্যদের অনুপ্রাণিত করেছিল। গ্রন্থটি প্রধানত এই প্রতিপাদন করেছে যে, প্রাচীন আর্যদের মধ্যে সেই নৈরাশ্যবাদ (দুঃখবাদ) এর লেশমাত্রও ছিল না, যা বর্তমান হিন্দুদের মধ্যে প্রবলভাবে ছেয়ে আছে।”

প্রাককথনের শেষ অনুচ্ছেদে তিনি পুনরায় লিখেছেন—
“গ্রন্থের উপযোগিতা আরও বাড়ত যদি লেখক মহাশয় এ দেখাবার চেষ্টা করতেন যে, প্রাচীন ভারতের সত্ত্ববাদ ও আশাবাদকে উত্তরকালের নৈরাশ্যবাদ কিভাবে পরাভূত করল? আশা করি লেখক অন্য সময়ে এই সমস্যার বিশ্লেষণ করবেন। তথাপি এই মুহূর্তে আমাদের জ্ঞানে এটি কোনো সামান্য বৃদ্ধি নয় যে, মায়াবাদ (সंसারকে মায়া মানা) এক নবীন কল্পনা। এই দৃষ্টিতে আমি এই গ্রন্থের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।”


পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় এবং ডঃ আম্বেদকর

শ্রী পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদজি উপাধ্যায় (১৮৮১–১৯৬৮) ডঃ আম্বেদকরজিকে একজন বিদ্বান তর্কশীল, উত্তম লেখক এবং বক্তা স্বীকার করে লিখেছেন—
“শ্রী আম্বেদকরজিকে প্রথম আশ্রয় তো আর্যসমাজেই মিলেছিল।”

আর্যসমাজে দলিতদের প্রবেশ পঞ্চাশ বছর আগেই শুরু হয়েছিল। মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের সোশ্যাল কনফারেন্সে অধিকাংশ সময় আর্যসমাজীদের সহযোগিতা ছিল। আর্য নেতা ও সহস্র আর্যসমাজী দলিতোদ্ধারে নিয়োজিত ছিলেন। পার্থক্য কেবল উদ্যোগ ও সাফল্যের মাত্রার। শ্রী আম্বেদকরজি স্বভাবে এমন ব্যক্তি ছিলেন যারা হাতের তালুতে সরষে ফলাতে চান—তাঁর ইচ্ছেমত জিনিস যদি তৎক্ষণাৎ না মেলে তবে তিনি দল পরিবর্তন করে নিতেন।

এই ধারণার পরও আর্য বিদ্বান পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদজি মাননীয় ডঃ আম্বেদকরজি কর্তৃক প্রস্তাবিত হিন্দু কোড বিল এর পক্ষপাতী ছিলেন।

ঘটনাটি তখনকার, যখন গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় আর্য প্রতিনিধি সভা, উত্তর প্রদেশের সভাপতি (১৯৪৫–১৯৪৭) ছিলেন। তখন কাশীর কিছু পণ্ডিত আর্যসমাজ এলাহাবাদ চৌক হয়ে তাঁর কাছে এসে বলেছিলেন—
“বিদেশি সরকার হিন্দুদের ধর্মকে কলুষিত করার জন্য হিন্দু কোড বিল পাশ করতে চাইছে। আর্যসমাজ সর্বদা হিন্দু সংস্কৃতির রক্ষক। আমরা চাই এর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্দোলন চালানো হোক এবং আর্যসমাজ এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা দিক।”

কাশীর পণ্ডিতদের এই অনুরোধ শুনে উপাধ্যায়জি বলেছিলেন—
“যতক্ষণ না আমি বিলটির সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করি এবং আমার বন্ধুদের সাথে এর গুণ–দোষ নিয়ে আলোচনা করি, আমার পক্ষে বলা কঠিন হবে যে আর্যসমাজ আপনাদের কতটা সহযোগিতা করতে পারবে।—সম্ভবত আর্যসমাজ এই দৃষ্টিকোণ থেকে আপনাদের সাথে একমত হবে না, কারণ আর্যসমাজ একটি সংস্কারক সংস্থা এবং হিন্দু পণ্ডিতদের চিরকালীন মানসিকতা হল সংস্কারের কাজে বাধা সৃষ্টি করা। হিন্দু সমাজ মৃত্যুপথযাত্রী হচ্ছে। আপনারা নিজেরা চিকিৎসার উপায় ভাবেন না, আবার অন্যদের রোগীর কাছে ফটকাতে দেন না। আর্যসমাজ জন্মলগ্ন থেকে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা পাচ্ছে। বাল্যবিবাহ-নিষেধ (১৯২০) আইনে আপনারা বিরোধ করেছেন। অনুমতি আইন (অ্যান্টারেজ?) মতো অত্যাবশ্যক আইনের সময়েও একই সুর উঠেছে যে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। আর্যসমাজ নিজের সংস্কারে প্রতিটি উপযুক্ত উপায় ব্যবহার করেছে এবং একাংশে আপনারাও বিদেশি সরকারের থেকে মুক্ত হতে পারেননি; নিজের আত্মরক্ষার জন্য বিদেশি সরকারের আদালত, পুলিশ, সেনা ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন।”

হিন্দু কোড বিল অধ্যয়নের পর পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদজি উপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে—
“হিন্দু কোড বিলের বিরোধ, না ভেবে–সমঝে, সনাতনী ধর্মের তথাকথিত রক্ষকদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে।”

সার্বদেশিক সভা তার সভাপতি পণ্ডিত ইন্দ্র বিদ্যাবাচস্পতি (১৮৮৯–১৯৬০) এবং মন্ত্রী পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় হিন্দু কোড বিলের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দলগতভাবে এর বিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সার্বদেশিক সভার এই সিদ্ধান্তে নিজের তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেও উপাধ্যায়জি লিখেছিলেন—
“আর্যসমাজ এই বিরোধ করে নিজের নাম কলঙ্কিত করেছে। এখন—(এই প্রসঙ্গে)—আর্যসমাজের নাম সংস্কারক সংস্থার তালিকা থেকে কেটে ফেলা হবে। অধিকাংশ আর্যসমাজীও সনাতনিদের সাথে যোগ দিয়ে তাদেরই সুরে সুর মিলিয়েছে, যা আমার মতে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অর্থহীন ও আর্যসমাজের উন্নতির জন্য ঘাতক।”

শ্রী উপাধ্যায়জির মতে হিন্দু কোড বিল ছিল “পুরাণিক এবং বৈদিক ধর্মের মাঝের এক সেতু, যা আর্যসমাজের অধিক নিকট এবং পুরাণিকতার থেকে অধিক দূরে।” সুতরাং আর্যসমাজকে এর সমর্থন করা উচিত ছিল। কিন্তু সে এর বিরোধ করে পুরাণিক কুপথের জীবনদানে সাহায্য করল।

উপাধ্যায়জির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে—
“ফল যাই হোক, আর্যসমাজকে কোনো অবস্থাতেই সংস্কার-বিরোধীদের সাথে গিয়ে সংস্কার-বিরোধী মানসিকতাকে উৎসাহিত করা উচিত নয়। আমি হাসি বা মরি, আমার তো সেটাই বলা উচিত যা সত্য।”

পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় সার্বদেশিক সভার মন্ত্রী (১৯৪৬–১৯৫১) হয়েও আর্যসমাজীদের হিন্দু কোড বিলের প্রসঙ্গে নিজের পক্ষে আনতে ব্যর্থ হন। তবুও তিনি আর্যসমাজের এই সনাতনী প্রবণতার পরোয়া না করে, মাননীয় ডঃ আম্বেদকরজির হিন্দু কোড বিল এর অনুকূলে বহু স্থানে বক্তৃতা দিয়েছেন।

শ্রী উপাধ্যায়জির মতে এ ছিল ভ্রান্ত ও রাজনীতি-প্রণোদিত প্রচার যে হিন্দু কোড বিল—
১. ভাই–বোনের বিবাহ (সমগোত্র বিবাহ) অনুমোদন করে,
২. তালাক চালু করতে চায়, এবং
৩. কন্যাদের সম্পত্তিতে অধিকার দিয়ে হিন্দুদের পারিবারিক জীবন ধ্বংস করতে চায়।

আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত নই যে, মাননীয় ডঃ আম্বেদকর এবং পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় কখনও সরাসরি সাক্ষাৎ করেছিলেন কিনা। কিন্তু শ্রী উপাধ্যায়জির রচিত—
১. অছুতদের প্রশ্ন,
২. হিন্দু জাতির ভয়ঙ্কর ভ্রম,
৩. দলিত জাতি ও নতুন প্রশ্ন,
৪. হিন্দুদের হিন্দুদের সাথে অন্যায়,
৫. ডঃ আম্বেদকরের হুমকি
ইত্যাদি সমসাময়িক প্রচারার্থে লিখিত লঘু পুস্তিকাগুলো থেকে সম্ভবত এইসব বিষয়ে আরও আলোকপাত হতে পারে।

হিন্দু কোড বিলের প্রসঙ্গে শ্রী উপাধ্যায়জি তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন যে—
“সনাতনী মানসিকতা আর্যসমাজে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে।”

এই মানসিকতাকেই ১৯২৮ সালে ডঃ আম্বেদকরজি টের পেয়েছিলেন এবং নিজের এক লেখায় লিখেছিলেন— “আজ আর্যসমাজকে সনাতন ধর্ম গিলে নিয়েছে।” 

পণ্ডিত লক্ষ্মীদত্ত দীক্ষিত এবং ড. আম্বেদকর

হিন্দু কোড বিল প্রসঙ্গে আর্যসমাজ জগতের এক শিরোমণি পণ্ডিত, বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজসংস্কারক পণ্ডিত লক্ষ্মীদত্ত দীক্ষিত (স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী, ১৯১৫–২০০৩) ড. আম্বেদকরের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর মাননীয় ড. আম্বেদকরের সঙ্গে চারবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সময়ে লক্ষ্মীদত্তজি দিল্লির টুরিয়াগঞ্জ অঞ্চলে বাস করতেন আর ড. আম্বেদকরের কোঠি ছিল তিলক মার্গে।

প্রথম সাক্ষাতে মাননীয় ড. আম্বেদকর স্পষ্ট বলেছিলেন—
“আমার এই বিষয়ে কোনো জোর নেই যে হিন্দু সমাজের একটি আচরণবিধি হতেই হবে।”

দ্বিতীয় সাক্ষাতে তিনি লক্ষ্মীদত্তজিকে বলেন—
“সনাতনধর্মীদের বিরোধ আমার কাছে কোনো সমস্যা নয়, কারণ তারা তো চিরকাল থেকে ভালো বিষয়ের বিরোধ করে এসেছে এবং ছয় মাসের বেশি তাদের বিরোধ টিকে না। আর্যসমাজের সঙ্গে আলোচনায় আমি সর্বদা প্রস্তুত, কারণ সব বিষয়ে সহমত না হলেও আমি এটুকু মানি যে তাদের বক্তব্য সবসময় যুক্তিসঙ্গত।”

তৃতীয়বার লক্ষ্মীদত্তজি যখন ড. আম্বেদকরের কাছে গেলেন, তিনি তাঁকে একটি বিশাল কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেখানে দূরদূরান্ত পর্যন্ত টেবিলে স্তূপ করে রাখা বই, এবং বহু ছাত্র-ছাত্রী ও সন্ন্যাসী অধ্যয়নে মগ্ন। ড. আম্বেদকর বললেন—
“যারা হিন্দু কোড বিলকে হিন্দুধর্ম-বিরোধী বলে, তাদের সামনে আমি প্রতিটি ধারার জন্য হিন্দুশাস্ত্র থেকে দশটি করে প্রমাণ হাজির করতে পারি।”
লক্ষ্মীদত্তজির মতে, ড. আম্বেদকরের পক্ষে এমন কাজ একেবারেই কঠিন ছিল না।

তিনি হিন্দু কোড বিল নিয়ে দেশের প্রায় ৫০০ জন উচ্চমানের পণ্ডিত, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি পরিপত্র পাঠান। সেটি ছিল একপ্রকার উত্তরদানি পোস্টকার্ড, যেখানে তিনি লিখেছিলেন—
হিন্দু কোড বিল নিয়ে তিন প্রকার মত থাকতে পারে—
১. এর প্রতিটি অক্ষরের বিরোধ করা।
২. এর প্রতিটি অক্ষরের সমর্থন করা।
৩. চিন্তাভাবনা করে যা যুক্তিসঙ্গত তাকে সমর্থন, আর যা অযৌক্তিক তাকে বিরোধ।

তিনি অনুরোধ করেছিলেন, সংলগ্ন কার্ডে নিজের সমর্থনযোগ্য মত টিক দিয়ে অন্য দু’টি কেটে দিয়ে স্বাক্ষর করে ফেরত পাঠাতে। প্রায় তিনশো ব্যক্তি উত্তর পাঠান। তাঁদের মধ্যে কেবল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী নরহর বিষ্ণু গাডগিল বিলের প্রতিটি অক্ষরের সমর্থনে মত দেন, আর হিন্দু মহাসভার নেতা শ্রী নারায়ণ ভাস্কর খারে প্রতিটি অক্ষরের বিরোধিতা করেন। বাকিরা যুক্তিসঙ্গত বিষয়ে সমর্থন এবং অযৌক্তিক বিষয়ে বিরোধ জানান। লক্ষ্মীদত্তজি এই সমস্ত মতামত ড. আম্বেদকরের কাছে পাঠিয়ে দেন।

সম্ভবত ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে হিন্দু কোড বিল লোকসভায় উপস্থাপিত হয়। সেদিন দর্শক-আসন ছিল উপচে ভরা। লক্ষ্মীদত্তজিকে লোকসভার উপাধ্যক্ষ অনন্ত শায়নম আয়ঙ্গারের পরিবারবর্গের কক্ষে বসার সুযোগ মেলে। ড. আম্বেদকর লক্ষ্মীদত্তজি সংগ্রহ করা বিবরণ হিন্দুস্থান টাইমস-এ প্রকাশের জন্য দেন। ঠিক যেদিন লোকসভায় বিল পেশ হয়, সেদিনই ওই বিবরণ হিন্দুস্থান টাইমসে বের হয়। সমগ্র তৃতীয় পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল লক্ষ্মীদত্তজির বক্তব্য। এভাবেই পণ্ডিতজির চতুর্থ সাক্ষাৎ হয় ড. আম্বেদকরের সঙ্গে।


পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞানসু ও হিন্দু কোড বিল

সার্বদেশিক আর্য মহাসম্মেলনের সপ্তম অধিবেশন (২৭ অক্টোবর–১০ নভেম্বর ১৯৫১, মীরাট) উপলক্ষে পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞানসু (১৮৯২–১৯৬৪) তাঁর “দেদবাণী” মাসিক পত্রিকায় বিস্তারিত লিখেছিলেন। তিনি আর্যসমাজকে অনুরোধ করেন—
“হিন্দু কোড বিল নিয়ে আর্যসমাজের কোনো স্পষ্ট ঘোষণা হয়নি। এখন বিল আলোচনায় আসছে, তাই একে একে প্রতিটি ধারার ওপর নিজেদের মত ঘোষণা করা উচিত। যতটুকু গ্রহণযোগ্য, তাতে সীলমোহর দিন। যা পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজন, সেগুলির ওপরও অবস্থান স্পষ্ট করুন। দ্বিধা করার কিছু নেই।”

তবে হিন্দু কোড বিল মূল আকারে পাস হয়নি। পরে ১৯৫৬ সালে সংশোধিত রূপে এটি হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট এবং হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট নামে দুটি আইনে বিভক্ত হয়ে পাস হয়।


পণ্ডিত শিবপূজন সিংহ এবং ড. আম্বেদকর

২০০১ সালের ১০ জুন মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের বাশিম জেলায় অবস্থিত কারাঞ্জা (লাড়)-এর আর্যসমাজ গ্রন্থাগার দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে বহু দুর্লভ পাণ্ডুলিপির মধ্যে ১৯৫১ সালের “সার্বদেশিক মাসিক”-এর একটি সংখ্যাও ছিল। তাতে কানপুরের গবেষক শিবপূজন সিংহের লেখা “ভ্রান্তি নিবারণ” প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি ড. আম্বেদকরের বেদ-সম্পর্কিত মতের বিশ্লেষণ করেছিলেন।

এই প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। লেখক জানান, ড. আম্বেদকর “শূদ্রদের অনুসন্ধান” গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণ থেকে একটি বিতর্কিত অংশ সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। একই নির্দেশ তিনি হিন্দি অনুবাদক পণ্ডিত সোहनলাল শাস্ত্রীকেও দেন। কিন্তু প্রকাশকরা সে নির্দেশ মানেননি, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

উল্লেখিত অংশে বলা হয়েছিল—
১. আর্যসমাজ বিশ্বাস করে যে আর্যদের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে চারটি বর্ণ বিদ্যমান। কিন্তু প্রাচীন গ্রন্থে দেখা যায়, প্রথমে কেবল তিনটি বর্ণ ছিল।
২. আর্যসমাজ মনে করে, বেদ অনাদি ও ঈশ্বরকৃত। কিন্তু এই গ্রন্থে প্রমাণ করা হয়েছে যে, পুরুষসূক্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরবর্তীকালে সংযোজিত।

ড. আম্বেদকরের মতে, এই ধারণাগুলি আর্যসমাজের নীতির পরিপন্থী। তাঁর যুক্তি—
“যখন পর্যন্ত এই বিশ্বাস থাকবে যে বেদ অনাদি, অনন্ত ও অপ্রমাদযোগ্য, তখন পর্যন্ত হিন্দু সমাজে সংস্কার সম্ভব নয়।”

👉 এভাবেই পণ্ডিত লক্ষ্মীদত্ত দীক্ষিত, ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞানসু ও শিবপূজন সিংহের সঙ্গে মতবিনিময়ের সূত্রে ড. আম্বেদকরের চিন্তাভাবনা ও আর্যসমাজের সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, যে নিজের কথায় টস-সেঁস না হওয়া, নিজের লেখায় অল্প বিরামও কম না করা ডঃ অম্বেডকর মতো সুহৃদ ব্যক্তি কি কখনও নিজের কথা পিছনে নিতেন? আমরা ঠিক यही বলতে চাই যে—ডঃ অম্বেডকর প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন এবং নিজের থেকে বিরোধী নীতি হলে তা স্বীকার করতেন। জেনে-জেনে খারাপ জল খেতে তাদের ভালো লাগত না। স্বামী বিবেকানন্দ তীর্থ লিখিত 'রাষ্ট্র-রক্ষা کے বৈদিক সাধন' এর প্রস্তাবনায় ডঃ অম্বেডকর স্বীকার করেছেন যে—“এটি আমি বলতে পারি না যে এই গ্রন্থ ভারতের ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠবে, তবে আমি অবশ্যই বলি যে এই গ্রন্থ প্রাচীন আর্যদের ধর্মগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত উদ্ধৃতিগুলোর কেবল অদ্ভুত সংগ্রহ নয়, বরং এটি আশ্চর্যজনকভাবে সেই চিন্তাধারা এবং আচরণশক্তিকে প্রকাশ করে, যা প্রাচীন আর্যদের প্রেরণা জুগিয়েছিল।" এই গ্রন্থ মূলত প্রমাণ করে যে প্রাচীন আর্যদের মধ্যে সেই নিরাশাবাদ (দুঃখবাদ) ছিল না, যা বর্তমান হিন্দুদের মধ্যে প্রবলভাবে বিরাজমান। এই সময় আমাদের জ্ঞানে কোন অল্প বৃদ্ধি নয় যে মায়াবাদ (সৃষ্টি বা সংসারকে মায়া মনে করা) নতুন কোনো কল্পনা নয়। এই দৃষ্টিতে আমি এই গ্রন্থের হৃদয়ঙ্গমভাবে অভিনন্দন জানাই।

ডঃ অম্বেডকর এবং পণ্ডিত ধর্মদেবজীর মধ্যে সাইদ্ধান্তিক আলোচনা পাঠক “বৌদ্ধমত এবং বৈদিক ধর্মের তুলনামূলক অনুশীলন” গ্রন্থে বিস্তারিত পড়তে পারবেন। এখানে আমি শুধুমাত্র সেই কথাটি উপস্থাপন করছি, যা মহারাষ্ট্রের বৌদ্ধ উপদেশক পণ্ডিত উত্তমমুনিজী বনপ্রস্থী বলেছেন। তিনি বলেছিলেন—“একবার পণ্ডিত ধর্মদেবজী আমাদেরকে বলেছেন, 'সম্মানীয় ডঃ অম্বেডকরজী আমাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বলেছেন—'এক মা যেমন তার সন্তানকে বোঝায়, সেই মাতৃত্ববোধের সঙ্গে আপনি আমাকে বৈদিক ধর্ম বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমি কি করি, এই হিন্দুদের মানসিকতা আমার পরিবর্তিত মনে হয় না। তাদের স্বভাব কঠোরপন্থী হয়ে গেছে।'"

প্রফেসর ডঃ মহেন্দ্রদাস ঠাকুর অনুসারে, ডঃ অম্বেডকর নিজে আর্যসমাজে দলিতদের সঙ্গে প্রবেশ করার মনোভাব পোষণ করেছিলেন, কিন্তু হিন্দু মহাসভার এবং আর্যসমাজের ঘনিষ্ঠতা দেখে বুদ্ধ দীক্ষা গ্রহণের দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন। (লেখা--‘ববহ তুফান সাথে নিয়ে চলেটা’ ‘জৈদিক গর্জনা’ --পণ্ডিত নরেন্দ্র স্মৃতি, বিশেষ সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল ২০০৮, পৃষ্ঠা ৫৩)

স্মরণীয় যে, সাইদ্ধান্তিক স্তরে ডঃ অম্বেডকর বর্ণব্যবস্থাকে মানতেন না, তবু তিনি স্বীকার করেছিলেন—“মহাত্মা গান্ধীর জন্মন বর্ণব্যবস্থার তুলনায় স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কর্মণা বর্ণব্যবস্থা বুদ্ধিগম্য এবং নিরুপদ্রবী।"

মাননীয় ডঃ অম্বেডকরজী পণ্ডিত ধর্মদেবজী সাইদ্ধান্তালাড্ডুগরকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। এটি এ কথাই প্রমাণ করে যে, তিনি নিজের বিধি মন্ত্রীকালীন সময়ে ভারত সরকারের বিধি মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে “হিন্দু কোড বিল এবং তার উদ্দেশ্য” নামক ২০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে পণ্ডিত ধর্মদেবজী দ্বারা লিখিত দশটি প্রবন্ধ ৫৬ থেকে ১৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করে লিখেছেন—“বেদের সুপরিচিত বিদ্বান পণ্ডিত ধর্মদেব বিদ্যাচস্পতি তাদের মধ্যে একজন, যাদের জীবনের অধিকাংশ সময় বেদ এবং প্রাচীন আর্য ধর্মগ্রন্থের অধ্যয়ন ও গবেষণায় কেটেছে। সম্প্রতি তাদের একটি প্রবন্ধ দিল্লির সুপরিচিত হিন্দি দৈনিক ‘বীর অর্জুন’-এ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে প্রাচীন স্মৃতি, বেদ ও শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দু বিলের বিভিন্ন বিধান আলোচনা করা হয়েছে। অধ্যয়নশীল পাঠকদের জন্য ‘বীর অর্জুন’-এর অনুমোদন নিয়ে এই প্রবন্ধ এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।” (পৃষ্ঠা ৫৬)

এই দীর্ঘ প্রস্তাবনার সঙ্গে উপস্থাপিত হলো, শ্রী শিবপুজনসিং লিরখিবত “ভ্রান্তি নিবারণ!” প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ, যেখানে ডঃ অম্বেডকরজীর বেদাদি-বিষয়ক চিন্তার সমালোচনা করা হয়েছে। পূর্বপক্ষ হিসেবে ডঃ অম্বেডকরজীর বেদাদি-বিষয়ক আক্ষেপ এবং বৈদিক বিদ্বানদের চিন্তাধারার ভিত্তিতে শ্রী শিবপুজনসিং-এর সমাধানপক্ষ পরবর্তীতে সারসংক্ষেপ আকারে পাঠকদের জন্য উপস্থাপিত হয়েছে।

পণ্ডিত শিবপুজনসিং কুস্বাহা গবেষণামূলক এবং উদ্ধৃতি-প্রধান শৈলীর সুপরিচিত লেখক। তিনি ‘অচ্ছুত কে এবং কেসে’ এবং ‘শূদ্রদের অনুসন্ধান’ গ্রন্থে ডঃ মহোদয়ের বৈদিক চিন্তাধারার আক্ষেপগুলো “ভ্রান্তি নিবারণ” শিরোনামে সার্বজনীন মাসিক (জুলাই-আগস্ট ১৯০৭১) এ পর্যালোচনা করেছেন। ‘অচ্ছুত কে এবং কেসে’ গ্রন্থের আটটি বিষয় এবং ‘শূদ্রদের অনুসন্ধান’ গ্রন্থের তিনটি বিষয় তিনি সমালোচনার বিষয় করেছেন। স্বাধ্যায়ী শ্রী শিবপুজনসিং একটি গ্রন্থও লিখেছেন, ‘অথর্ববেদ-এর প্রাচীনতা’, যা পণ্ডিত ধর্মদেবজী দ্বারা ডঃ অম্বেডকরজীর কাছে পাঠানো হয়। প্রবন্ধের শেষে লেখক লিখেছেন—“আশা করি আপনি আমার প্রমাণসমূহের ভিত্তিতে যথাযথ বিবেচনা করে আপনার গ্রন্থে সংশোধন করবেন।” এই আবেদনসহ প্রবন্ধ শেষ হয়েছে।

‘অচ্ছুত কে এবং কেসে’ গ্রন্থে ডঃ অম্বেডকর প্রদত্ত পূর্বপক্ষ বা আক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় শ্রী শিবপুজনসিং “ভ্রান্তি নিবারণ” প্রবন্ধে উত্তরপক্ষ বা সমাধানপক্ষ হিসেবে যে নিরাকরণ করেছেন, তা বিবেকশীল পাঠকদের জন্য সংলাপরূপে উপস্থাপিত হলো—

ডঃ অম্বেডকর: আর্যরা নিঃসন্দেহে দুটি ভাগ এবং দুটি সংস্কৃতিতে বিভক্ত ছিলেন—একটি ঋগ্বেদীয় আর্য এবং অন্যটি যজুর্বেদীয় আর্য, যার মধ্যে সাংস্কৃতিক তফাৎ প্রচুর। ঋগ্বেদীয় আর্য যজ্ঞে বিশ্বাস করতেন, অথর্ববেদীয় জাদু-টোনে।

পণ্ডিত শিবপুজনসিং: আর্যদের দুটি প্রকারের ধারণা কেবল আপনার এবং আপনার মতো কিছু মস্তিষ্কের উদ্ভাবন। এটি কল্পনাচক্র বা কল্পনার বিলাস। এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কোনো ঐতিহাসিক বিদ্বানও এটি সমর্থন করে না। অথর্ববেদে কোনো প্রকার জাদু-টোনা নেই।

ডঃ অম্বেডকর: ঋগ্বেদে আর্যদেবতা ইন্দ্র তার শত্রু অহি-বনচ্ন (সাপ-দেবতা) এর সঙ্গে লড়াই করেন, যিনি পরবর্তীতে নাগদেবতার নামে পরিচিত হন।

পণ্ডিত শিবপুজনসিং: বৈদিক ও লৌকিক সংস্কৃতিতে আকাশ-পাতালের পার্থক্য রয়েছে। এখানে ইন্দ্র অর্থ সূর্য এবং বনচন অর্থ মেঘ। এই সংগ্রাম আর্যদেবতা ও নাগদেবতার নয়, সূর্য ও মেঘের মধ্যে সংঘর্ষ। বৈদিক শব্দের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র নৈরুক্তির মতই গ্রহণযোগ্য। যেহেতু আপনি নৈরুক্ত প্রক্রিয়ার অজ্ঞ, তাই বিভ্রান্ত হয়েছেন।

ডঃ অম্বেডকর: মহামহোপাধ্যায় ডঃ কাণে-এর মত অনুযায়ী, গরুর পবিত্রতার কারণে ওজসনেয়ী সংহিতায় গরুর মাংস ভক্ষণে বিধান দেওয়া হয়েছে।

পণ্ডিত শিবপুজনসিং: শ্রী কাণে সংহিতার কোনো প্রমাণ বা রেফারেন্স দেননি, এবং আপনি নিজে যজুর্বেদ অধ্যয়ন করেননি। আপনি নিজে যজুর্বেদ অধ্যয়ন রলে তাতে গোমাংস নিষেধের প্রমাণ পাবেন।

ডঃ অম্বেডকর: ঋগ্বেদ স্পষ্টভাবে জানায় যে সেই সময় আর্যরা গরু হত্যা করত এবং গোমাংস খেত।

পণ্ডিত শিবপুজনসিং: কিছু প্রাচ্য ও পশ্চিমা বিদ্বান আর্যদের গোমাংস ভক্ষণের জন্য দোষারোপ করেন, কিন্তু অনেক প্রাচ্য বিদ্বান এই মত খণ্ডন করেছেন। ঋগ্বেদ থেকে গরু হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ আপনার যে বিধান, তা বলা হয়েছে, সেটি বৈদিক এবং লৌকিক সংস্কৃতির পার্থক্য অজ্ঞ হওয়ায় বলা হয়েছে। যেমন, বেদে ‘উক্ষ’ একটি শক্তিবর্ধক ঔষধ, যদিও লৌকিক সংস্কৃতিতে এর অর্থ হয় ‘বাঁশ’।

ডঃ অম্বেডকর— মাংস ছাড়া মধুপর্ক হতে পারে না। মধুপর্কে মাংস এবং বিশেষতঃ গোমাংস একটি অপরিহার্য অঙ্গ।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— আপনার এই বিধান বেদ নয়, বরং গৃহ্যসূত্রের উপর নির্ভরশীল। গৃহ্যসূত্রের বাক্য বেদবিরুদ্ধ হওয়ায় মান্য নয়। বেদকে স্বয়ংপ্রমাণ মান্য করা মহর্ষি দयानন্দ সরস্বতীর মতে—‘দইয়ে তিলভী বা মধু মেশানো মধুপক্ক নামে পরিচিত। এর পরিমাণ ১২ তোলা দইয়ে ৪ তোলা মধু বা ৪ তোলা ঘি মেশানো।’

ডঃ অম্বেডকর— অতিথির জন্য গোহত্যা এতটাই সাধারণ হয়ে গিয়েছিল যে অতিথিরই নাম হলো ‘গোঘ্ন’, অর্থাৎ গোরু হত্যা-কারী।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— ‘গোঘ্ন’ এর অর্থ গোহন্তা নয়। এই শব্দ ‘গৌ’ এবং ‘হন্‌’-এর যোগে গঠিত। ‘গৌ’-এর বহু অর্থ আছে—যেমন: বাক্য, জল, বিশেষ সুখ, চোখ ইত্যাদি। ধাতুপাঠে মহর্ষি পাণিনি ‘হন্‌’-এর অর্থ ‘গতি’ ও ‘হিংসা’ বলেছেন। গতির অর্থ—জ্ঞান, গমন ও প্রাপ্তি। প্রায় সব সভ্য দেশে যখনই কারও বাড়ি অতিথি আসে তখন গৃহস্বামী স্বাগত জানাতে বাইরে আসেন, কিছু গতি করেন, চলেন, মধুর ভাষায় কথা বলেন, পরে জল দিয়ে আপ্যায়ন করেন এবং সম্ভব হলে অতিথির সুখের জন্য অন্য জিনিস উপস্থাপন করেন। এবং অতিথি খুশি হলেন কিনা তা জানার জন্য গৃহস্বামীর চোখও সেদিকে স্থির থাকে। তাই ‘গোঘ্ন’ এর অর্থ—‘যার জন্য গৌদান করা হয়, সেই অতিথি গোঘ্ন নামে পরিচিত।’

ডঃ অম্বেডকর— হিন্দু, ব্রাহ্মণ হোক বা অব্রাহ্মণ, কেবল মাংসাশীই ছিলেন না, বরং গোমাংসাশী ছিলেন।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— আপনার উক্তি ভ্রান্তিপূর্ণ। বেদে গোমাংস ভক্ষণের কথা তো দূরের কথা, মাংস ভক্ষণেরও কোনো বিধান নেই।

ডঃ অম্বেডকর— মনুও গোহত্যার বিরুদ্ধে কোনো আইন করেননি, বরং বিশেষ উপলক্ষে গোমাংসাহারকে বাধ্যতামূলক করেছেন।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— মনুস্মৃতিতে কোথাও মাংস-ভক্ষণের বিধান নেই, যা আছে তা প্রতিপত্তি। আপনিও কোনো প্রমাণ দেননি যে মনু কোথায় গোমাংস বাধ্যতামূলক করেছেন। বরং মনু (৫।০১৫) অনুসারে, হত্যার অনুমতি দেওয়া, পশু কাটা, হত্যা করা, ক্রয়-বিক্রয় করা, রান্না করা, পরিবেশন করা এবং খাওয়া—এসবকেই ঘাতক বলা হয়েছে।


‘অচ্ছুত কে এবং কেসে’-এর অতিরিক্ত মাননীয় ডঃ অম্বেডকরের আরেকটি গ্রন্থ হলো—‘শূদ্রদের অনুসন্ধান’। এখানেও তিনি বৈদিক চিন্তাধারার উপর কিছু আক্ষেপ করেছেন। এখানে পূর্বের মতোই সংলাপ-শৈলীতে ডঃ অম্বেডকরজীর আক্ষেপপক্ষ এবং শিবপূজনসিংহের সমাধানপক্ষ উপস্থাপিত হলো—

ডঃ অম্বেডকর— পুরুষ সূক্ত ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রতিপাদিত করেছে। কোলবুক বলেছেন যে পুরুষ সূক্ত ছন্দ ও শৈলীতে বাকি ঋগ্বেদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরও অনেক বিদ্বানের মত, পুরুষ সূক্ত পরে সংযোজিত।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— আপনি যে পুরুষ সূক্ত নিয়ে আক্ষেপ করেছেন, তা আপনার বেদ-অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করে। আধিভৌতিক দৃষ্টিতে চার বর্ণের মানুষের সমষ্টি হলো ‘সহস্থিত সমাজ’—‘এক পুরুষ’। এই সমাজপুরুষ বা জাতি-পুরুষের সঠিক পরিচয়ের জন্য পুরুষ সূক্তের মূল মন্ত্র ‘ব্রাহ্মণোস্য মুখমাসীত্‌…’ (যজুর্বেদ ৩১।১১৫) চিন্তা করতে হবে।

উক্ত মন্ত্রে বলা হয়েছে—ব্রাহ্মণ হলো মুখ, ক্ষত্রিয় বাহু, বৈশ্য উরু এবং শূদ্র পা। কেবল মুখ, কেবল বাহু, কেবল উরু বা কেবল পা পুরুষ নয়। বরং এগুলির সমষ্টিই পুরুষ। কিন্তু যদি সমষ্টি অসংগঠিত হয়, তবে তা পুরুষ নয়। সংগঠিত ও ক্রমযুক্ত সমষ্টিই পুরুষ।

রাষ্ট্রে মুখের প্রতিরূপ ব্রাহ্মণ, বাহুর প্রতিরূপ ক্ষত্রিয়, উরুর প্রতিরূপ বৈশ্য ও পায়ের প্রতিরূপ শূদ্র। রাষ্ট্রে এই চার বর্ণ যখন শরীরের অঙ্গের মতো সুবিন্যস্ত হয়, তখনই পুরুষ বলা হয়। ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় এরা পুরুষ নয়। তাই বৈদিক পরিভাষায় পুরুষ অর্থ সুবিন্যস্ত ও ঐক্যে বাঁধা জনসমষ্টি।

মহর্ষি দयानন্দ এই মন্ত্রের অর্থ করেছেন এভাবে—‘এই পুরুষের আদেশ অনুসারে বিদ্যা প্রভৃতি উত্তম গুণ এবং সত্যভাষণ ও সত্যোপদেশ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ কর্ম থেকে ব্রাহ্মণ বর্ণ উৎপন্ন হয়। তার প্রধান গুণ ও কর্মের কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ হন। ঈশ্বর শক্তি ও পরাক্রম প্রভৃতি গুণ থেকে ক্ষত্রিয় বর্ণ উৎপন্ন করেন। পুরুষের আদেশ থেকে কৃষি, বাণিজ্য, ভাষা-জ্ঞান ও পশুপালন প্রভৃতি মধ্যম গুণ থেকে বৈশ্য বর্ণ হয়। আর পায়ের নীচের অংশের মতো অজ্ঞানতা প্রভৃতি নিম্নগুণ থেকে শূদ্র বর্ণ হয়।’

আপনার লেখা যে পুরুষ সূক্ত পরে ঋগ্বেদে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। চার বেদই ঈশ্বরীয় জ্ঞান, পুরুষ সূক্ত পরে সংযোজিত নয়। আমি আমার গ্রন্থ ‘ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পাশ্চাত্য বিদ্বানদের কুঠারাঘাত’-এ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব বিদ্বানের এই মত খণ্ডন করেছি যে দশম মণ্ডল পরে সংযোজিত।

ডঃ অম্বেডকর— শূদ্ররা ক্ষত্রিয়ের বংশধর, তাই ক্ষত্রিয়। ঋগ্বেদে সুধাস, শিনিউ, তুরবাশা, তৃত্সু, ভারত ইত্যাদি শূদ্রদের নাম এসেছে।

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— বেদের সব শব্দ যোগিক, রূঢ় নয়। আপনি যে নামগুলি উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলি ঐতিহাসিক নয়। বেদে ইতিহাস নেই, কারণ বেদ সৃষ্টি-কালের আদিতে প্রদত্ত জ্ঞান।

ডঃ অম্বেডকর— ছত্রপতি শিবাজি শূদ্র ছিলেন এবং রাজপুতরা হুণদের সন্তান। (‘শূদ্রদের অনুসন্ধান’, দশম অধ্যায়, পৃঃ ৭৭-৯৬)

পণ্ডিত শিবপূজনসিংহ— শিবাজি শূদ্র নন, বরং ক্ষত্রিয় ছিলেন। এর অসংখ্য প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। রাজস্থানের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ মহামহোপাধ্যায় ডঃ গৌরিশঙ্কর হীরাচন্দ্র ওঝা ডি.লিট লিখেছেন—‘মারাঠা জাতি দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। তাদের বিখ্যাত রাজা ছত্রপতি শিবাজির বংশের মূলপুরুষ মেওয়াড়ের সিসোদিয়া রাজবংশ থেকে।’ কবিরাজ শ্যামলদাস লিখেছেন—‘শিবাজি মহারাণা অজয়সিংহের বংশে ছিলেন।’ একই মত ডঃ বালকৃষ্ণ এম.এ., ডি.লিট, এফ.আর.এস.এস.এস.-এরও।

ঠিক তেমনি রাজপুতরা হুণদের সন্তান নয়, বরং বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়। শ্রী চিন্তামণি বিনায়ক চৈত্য এম.এ., শ্রী ই.বি. কাওয়েল, শ্রী শেরিং, শ্রী হুইলার, শ্রী হান্টার, শ্রী কার্ক, পণ্ডিত নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এম.এম.ডি.এল প্রমুখ বিদ্বানও রাজপুতদের ক্ষত্রিয় মানতেন। প্রিভি কাউন্সিলও রায় দিয়েছে—ভারতে বসবাসকারী ক্ষত্রিয় ও রাজপুত একই শ্রেণির।

৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬-এ মাননীয় ডঃ অম্বেডকরজীর দেহাবসান ঘটে। শিবপূজনসিংহের এই আলোচিত ‘ভ্রান্তি নিবারণ’ প্রবন্ধ ‘সার্বদেশিক’ মাসিকে তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর তিন মাস পূর্বে প্রকাশিত হয়। ‘সার্বদেশিক’-এর সঙ্গে ডঃ অম্বেডকর পরিচিত ছিলেন এবং আলোচিত সংখ্যা যথাসময়ে তাঁর নিকট প্রেরণও করা হয়।

ভারতরত্ন ডঃ অম্বেডকরজীর ‘অচ্ছুত কে এবং কেসে’‘শূদ্রদের অনুসন্ধান’ গ্রন্থ এবং মহর্ষি দयानন্দ সরস্বতীর ‘ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা’ ও গবেষক শিবপূজনসিংহ কুশ্বাহার ‘ভ্রান্তি নিবারণ’ নামক ১৬ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ পাঠ করে আশা করি বিবেকবান পাঠক সত্য-মিথ্যার বিচার করবেন। মূলতঃ ‘ভ্রান্তি নিবারণ’ প্রবন্ধ সংলাপ শৈলীতে নয়, বরং প্রশ্নোত্তর বা শঙ্কা-সমাধান শৈলীতে। পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা একে সংলাপ শৈলীতে রূপান্তর করেছি।

পণ্ডিত রঘুনাথপ্রসাদ পাঠক এবং ডঃ অম্বেডকর

আর্যসমাজের আন্তর্জাতিক সংস্থা সার্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভা-র মুখপত্র সার্বদেশিক তার জন্মকাল (১৯২৭) থেকে সম্পাদনা করছিলেন পণ্ডিত রঘুনাথপ্রসাদ পাঠক (১৮৯১–১৯৮৫)। তিনি ডঃ অম্বেডকরের ধর্মান্তরের উপর তাঁর সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখে তাঁকে নিজের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাঠকজীর মন্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ এইরূপ

“গত অক্টোবর মাস (১৯৫৬)-এ শ্রীযুক্ত ডঃ অম্বেডকর প্রায় দুই লক্ষ দলিতের সাথে নাগপুরে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এই সংবাদে হিন্দু সমাজে আলোড়ন ওঠা স্বাভাবিক ছিল। তিনি দেশের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি। যদি তিনি একাই বৌদ্ধ মত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাতে দীক্ষিত হতেন তবে সমাজে বিশেষ চিন্তার কারণ হতো না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যারা দীক্ষিত হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বৌদ্ধ মত সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও রাখেন না। তাই এই ধর্মান্তরে হৃদয়ের কোনো প্রেরণা না থাকায় একে স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন বলা যায় না।

আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে এই ধর্মান্তর রাজনীতিক স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যদি তা হয় তবে এই বৌদ্ধধর্মে প্রবেশকারীরা বৌদ্ধ মতেরই কলঙ্কের কারণ হবেন। আরেকটি ভয়ও আছে, তা হলো, এরা সংখ্যায় যতই হোন না কেন, গ্রামে তাঁদের সঙ্গে আগের মতোই অস্পৃশ্য আচরণ হতে পারে। তাঁদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, বরং বৌদ্ধধর্মের মধ্যে নতুনভাবে জাতপাতের ব্যাধি প্রবেশ করতে পারে।

অস্পৃশ্যতার নিবারণের উপায় হলো সবার আগে সवর্ণদের হৃদয় থেকে প্রশিক্ষণ ও সময়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতার বোধ মুছে ফেলা এবং অস্পৃশ্যদের মন থেকেও আত্ম-হীনতার মনোভাব দূর করা। এজন্য ধৈর্য ও বিবেক দিয়ে কাজ করতে হবে। এই কাজ ধীরে ধীরে চলছে এবং উভয়পক্ষের মনোভাবেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। আর্যসমাজ এই কাজে দিশা দেখাচ্ছে। কংগ্রেসও অস্পৃশ্যতাকে আইনত অপরাধ ঘোষণা করেছে।

এই ধরণের গণ-ধর্মান্তরের মাধ্যমে না হিন্দুদের মানসিকতা পাল্টানো সম্ভব, না অস্পৃশ্যদের অবস্থা উন্নত করা সম্ভব। বরং এর দ্বারা উপকারের চাইতে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। অস্পৃশ্য বলে পরিচিত ভাইদের নিজের কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং নিজেদের ভেড়া-বকরি বানাতে দেওয়া উচিত নয়। ইতিমধ্যেই তাঁরা রাজনীতিক চালে অনেকক্ষেত্রে সামষ্টিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে সতর্ক না হলে আরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে।

শেষে আমরা এই প্রার্থনা ও আশা করছি যে ডঃ অম্বেডকর নিজের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করবেন। যদি তিনি হিন্দুদের হৃদয় পরিবর্তনের কাজ হাতে নেন তবে তিনি বিরাট সাফল্য অর্জন করতে পারবেন, কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার প্রতি সवর্ণ হিন্দুদের মধ্যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।”
(সার্বদেশিক : মাসিক, ডিসেম্বর ১৯৫৬ : পৃঃ ৫১১–৫১২)


ডঃ ভবানীলাল ভারতী এবং ডঃ অম্বেডকর

আর্যসমাজের ভূমিকা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন যেসব লেখক, তাঁদের মধ্যে ডঃ ভবানীলাল ভারতীর (জন্ম ১ মে ১৯২৮) স্থান উল্লেখযোগ্য। ডঃ অম্বেডকরের ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর দ্বারা আর্য সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে করা সমালোচনার উপর তিনি একটি সমালোচনামূলক মন্তব্য লিখেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় সেই সারাংশ এখানে দেওয়া হলো

“ডঃ ভীমরাও অম্বেডকর ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তি। হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদপ্রথার পরিণতি, দলিত ও অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত জাতিগুলির দুঃসহ অবস্থা এবং তাঁদের প্রতি চালানো অমানবিক ও নৃশংস আচরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা তিনি ছাত্রাবস্থায়ই পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দলিত জাতিগুলির নেতা এবং তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থের অবিসংবাদিত প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে তাঁর আক্রোশ সवর্ণ হিন্দু, তথাকথিত উচ্চবর্ণ ও আর্যদের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্রতর হয়। তিনি বর্ণব্যবস্থাকে সমাজে বৈষম্য, বিভেদ ও শোষণের মূল কারণ বলে মনে করতেন এবং এর জন্য ব্রাহ্মণদের দায়ী করতেন। এই তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমর্থন তিনি মনুস্মৃতিতে খুঁজে পান। তাই তিনি মনুস্মৃতির বিরোধে আন্দোলন চালান এবং ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৭ তারিখে মনুস্মৃতির পৃষ্ঠাসমূহ দাহ করা হয়। তাঁর কিছু উগ্র অনুগামী ৪ মার্চ ১৯৬০ সালে ভারতের সংসদ ভবনে মনুস্মৃতির পাতা ছিঁড়েও ফেলেন।”

ডঃ অম্বেডকর ছিলেন গম্ভীর ও অধ্যয়নপ্রবণ প্রকৃতির মানুষ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় তাঁর উপর অন্য কিছু গুরুদায়িত্বও ন্যস্ত হয়। আইনশাস্ত্রে উচ্চতর বিদ্বান এবং বহু দেশের সংবিধানের অধ্যয়নকারী হওয়ায় তাঁকে স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি সেই দায়িত্ব নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে পালন করেন। বৌদ্ধ ধর্মের অধ্যয়ন করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মহাত্মা বুদ্ধই সামাজিক সমতার শ্রেষ্ঠ উপদেশক। বুদ্ধের সমতাবাদ তাঁকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সহস্রাধিক অনুগামীর সঙ্গে ত্রিরত্ন (বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ)-এর শরণ গ্রহণ করেন।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে ডঃ অম্বেডকর বৌদ্ধ ধর্মকেই কেন গ্রহণ করলেন। তিনি খ্রিস্টান বা মুসলমান কেন হলেন না, যদিও ভারতে তখনকার প্রথা ছিল যে যে-কোনো ব্যক্তি হিন্দুধর্ম থেকে বিমুখ হলে খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম গ্রহণ করত। আসলে ডঃ অম্বেডকর ছিলেন সুপণ্ডিত ও চিন্তাশীল। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের কঠোর রক্ষণশীলতা, তাদের জটিল আচার অনুষ্ঠান এবং প্রায়শই দর্শনশূন্য ধর্মচর্চা তাঁর কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়নি। তিনি এই ধর্মগুলির অসহিষ্ণুতা ও কট্টরপন্থা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তাই তিনি খ্রিস্টান বা মুসলমান না হয়ে তথাগত বৌদ্ধ ধর্মকেই গ্রহণ করেন।

তথাপি ডঃ অম্বেডকর তাঁর রচনাসমূহে বৈদিক ধর্ম, আর্যদের ধর্মীয় বিশ্বাস, তাঁদের সমাজ সংগঠন ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে বহু কঠোর ও নির্মম, যদিও অনেকাংশে ভিত্তিহীন, আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। তাঁর শেষ অথচ অসম্পূর্ণ রচনা ১৯৫৮ সালের এপ্রিল ও মে মাসে ন্যায়চক্র নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এতে আর্য সভ্যতা এবং আর্য সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতি সম্পর্কে বহু অসত্য আক্ষেপ করা হয়েছে। যদিও তাঁর বহু মত ইতিহাসের দৃঢ় তথ্যের উপর ভিত্তি করে ছিল, তবে তাঁর লেখার উদ্দেশ্য আর্য বৈদিক সভ্যতাকে অসভ্য, অনৈতিক, ব্যভিচারের উত্স এবং সদাচারের বিনাশক হিসেবে প্রতিপন্ন করা।

এটি সত্য যে বুদ্ধের কালের আগেই আর্য সমাজের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা বহু দিক দিয়ে অধোগত হয়েছিল, কিন্তু এর জন্য আর্যদের মূল গ্রন্থ ও তাতে বর্ণিত আদর্শ বিধানকে দোষী করা যায় না। পাশা খেলা, মদ্যপান, ব্যভিচার ইত্যাদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দোষ, যা কিছু কমবেশি সব সমাজেই পাওয়া যায়। তাই এর মানে এই নয় যে সংশ্লিষ্ট ধর্মশাস্ত্র বা মহাপুরুষরা এসব দোষকেই অনুমোদন করেছেন।

ডঃ অম্বেডকরের মতে জুয়ার নেশা কেবল আর্যদের মধ্যেই ছিল, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল। কৌটিল্যের যুগে যদি জুয়ার আড্ডা লাইসেন্সপ্রাপ্ত থাকত তবে তা বোঝায় রাজা ওইসব নেশাগ্রস্তদের থেকেও রাজস্ব আদায়ের উপায় করতেন। আজও কি সরকার মদের উপর কর বসিয়ে রাজস্ব অর্জন করছে না? কৌটিল্য কেবল জুয়া নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন, প্রশংসা করেননি। সোম ও সুরা নামে মদের দ্বৈত শ্রেণিবিভাগ লেখকের কল্পনামাত্র। বেদে যে সোমের উল্লেখ আছে তা কোনো বস্তুগত নেশা নয়, তা এক আধ্যাত্মিক নেশা। এ সম্পর্কে গুরু নানকও বলেছেন…

মাডা নশা শরাব দা, উত্তর যায় প্রভাত। নাম সর্বুমারি নানকা, চড়়়ী রহে দিন রাত॥

আর্যদের যৌন আচরণ বিষয়ক নিরঙ্কুশতা অথবা আচরণশৈথিল্যের উদাহরণ দেবার জন্য ডাঃ আম্বেদকর বেদ এবং তৎসদৃশ অন্যান্য সাহিত্যে উল্লিখিত কিছু সन्दर्भ তো দিয়েছিলেন, কিন্তু এই প্রসঙ্গগুলির ব্যাখ্যার সময় ব্যবহৃত অলঙ্কারিক শৈলীর সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন। তাই তো তিনি ভ্রাতৃবধূগমন, যম-যমী সূক্ত, সূর্য ও উষা প্রভৃতির এমন সব উদাহরণ দিয়েছিলেন, যা প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা ঘটনা ছিলই না। উল্লিখিত প্রসঙ্গগুলির ব্যাখ্যার জন্য বেদার্থের নিরুক্ত লণিত পদ্ধতির জ্ঞান অপরিহার্য। কোনো যুগে যদি যৌন স্বেচ্ছাচারিতার উদাহরণ পাওয়া যায়ও, তাহলেও সেটি কোনো সর্বজনীন বা শাশ্বত বিধান নয় এবং আচারনীয়ও নয়। তাই পরাশর-সত্যবতী, কুন্তীর কৌমার্য অবস্থায় গর্ভধারণ প্রভৃতি প্রসঙ্গকে আদর্শ বা অনুসরণীয় কেউ মনে করে না। লাজাহোম ও সপ্তপদী সম্পর্কে ডাঃ আম্বেদকরের মন্তব্যও নিছক কল্পনা মাত্র। নিয়োগ প্রথা কোনো এক সময়ে গ্রহণযোগ্য মনে করা হত, কিন্তু কালের পরিক্রমায় তাকে পশুধর্ম বলে নিন্দিত ও পরিত্যাজ্য বলে মনে করা হয়েছে। সুতরাং কোনো সময় বা দেশ-বিদেশে প্রচলিত কোনো সামাজিক বা নৈতিক নিয়মের ভিত্তিতে কোনো জাতি বা ধর্মকে কলঙ্কিত করা যায় না।

মনুস্মৃতিতে বর্ণিত ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য আসলে ব্রাহ্মণ্যত্বের প্রশংসা। তেমনি শূদ্রও কোনো বিশেষ শ্রেণির প্রতিশব্দ নয়, বরং গুণকর্মহীন ব্যক্তির সূচক। এমন ব্যক্তি তো সমাজের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সেবা ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য রাখে না। আর যদি তার ভেতর উন্নতি করার শক্তি ও সামর্থ্য থাকে, তবে তাকে আটকে দেওয়া বা তার পথ রুদ্ধ করার বিধান কোনো শাস্ত্রে নেই। বরং আর্যগ্রন্থে বহু উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে ব্রাহ্মণরা নিজেদের কর্মহীনতার কারণে নিম্নবর্ণে নেমে গেছে এবং হীনবর্ণের মানুষ উচ্চস্থানে উন্নীত হয়েছে।

তথাপি, এটিও মানতে দ্বিধা নেই যে মধ্যযুগীয় স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্রের নানা নিবন্ধগ্রন্থ ও অন্যান্য বিধিগ্রন্থে সামাজিক বৈষম্য বাড়ানো, বর্ণগুলির মধ্যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী কথাবার্তা বিপুল পরিমাণে রয়েছে। কিন্তু আর্যসমাজের মতো সামাজিক সৌহার্দ্য প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান এবং তার প্রতিষ্ঠাতা ঋষি দয়ানন্দ কখনোই এসব ধর্মগ্রন্থকে প্রামাণ্য মনে করেননি, কিংবা তাদের কোনো গুরুত্বও দেননি।

ডাঃ আম্বেদকরের আজকের অনুগামীদের মধ্যে তাঁদের নেতা যেমন উদার, গম্ভীর এবং অধ্যয়নশীল ছিলেন, তেমন গুণ নেই। তাই তাঁরা সামাজিক বৈষম্যের বিরোধিতা ও তফসিলভুক্ত ও পিছিয়ে পড়া জাতির অধিকার দাবি করতে করতে এতটাই অনুদার ও উগ্র হয়ে ওঠেন যে মনে হয় যদি এই আম্বেদকরবাদ চলতে থাকে তবে অচিরেই সवর্ণ এবং তফসিলভুক্ত জাতির মধ্যে যে সৌহার্দ্য রয়েছে, তা সম্পূর্ণ লোপ পাবে এবং বর্ণবিদ্বেষ শ্রেণীবিদ্বেষে পরিণত হবে। ঈশ্বর করুন সেই দুর্দিন না আসে। সামাজিক বৈষম্যকে সামাজিক ঘৃণায় রূপান্তরিত করার ফল বর্ণযুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। আমাদের বিনম্র মত হলো, ব্রাহ্মণ্যশাহীর ভুত দাঁড় করিয়ে সামাজিক বৈষম্য, শোষণ এবং অত্যাচারে পীড়িত বর্তমান সমাজে আরও অরাজকতার আমন্ত্রণ দেওয়া হচ্ছে। (সন্দर्भ: আর্যদের সমাজ-ব্যবস্থার ডাঃ আম্বেদকৃত সমালোচনার পর্যালোচনা, সমালোচক: ডাঃ ভবানীলাল ভারতীয়, সর্বদেশিক সাপ্তাহিক, ৩০ আগস্ট ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৭ ও ৮৬ এবং সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৬ ও ৮)

উপসংহার

কেউ কার ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন, কে কার থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন, এই বিষয়গুলো গৌণ। পৃথিবীতে ভালো কিছুর বীজ কখনোই পুরোপুরি নষ্ট হয় না। বিষ্ণু বুয়া ব্রহ্মচারী (১৮২০-১৮৭১), বালশাস্ত্রী জান্ভেকর (১৮১২-১৮৪৬), দাদোবা পাণ্ডুরঙ্গ তর্খড়কর (১৮১৪-১৮৮২), সেবকলাল কুরসনদাস, নানা শঙ্করশেল (১৮০৩-১৮৬৫), ন্যায়মূর্তি রানাড়ে (১৮৪২-১৯০১) এবং মহাত্মা ফुले (১৮২৭-১৮৯০) মহারাষ্ট্রের সামাজিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনার জন্য নিরলস চেষ্টা করেছিলেন। তাই মুম্বাইয়ে বিশ্বের প্রথম আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয়নি। স্বামী দয়ানন্দের কার্যকলাপ অল্প বা বেশি যাই হোক না কেন, মহারাষ্ট্রে দৃঢ়মূল হয়েছিল। শুধু মহারাষ্ট্রেই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের ভূমিকা এমন ছিল যে, তার ফলে সচেতন বা অসচেতনভাবে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে ডাঃ আম্বেদকর সমতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ তুলনামূলকভাবে সহজে করতে পেরেছিলেন।

যুগনায়ক, মূকনায়ক ডাঃ আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬)-এর জন্য যদি স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের সময়কাল না থাকত, তবে নিশ্চিতভাবেই তাঁকে অবহেলিত মানবতার পথ সুগম করার জন্য আরও অনেক বেশি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হত। ভারতীয় সংবিধানের নির্মাতা ডাঃ আম্বেদকর এবং আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দের মহৎ স্বপ্ন পূরণের জন্য আজ সব প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি, যাতে আগামী প্রজন্মের পথ বাধাহীন হয় এবং সন্ত জ্ঞানেশ্বরের বিশ্বচি মাজে ঘর (বসুধৈব কুটুম্বকম) ধারণা সহজেই বাস্তবায়িত হয়। তখনই মহাত্মা ফुले, স্বামী দয়ানন্দ এবং ভারতরত্ন ডাঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো সত্যিই অর্থবহ ও সফল হবে।

ডাঃ আম্বেদকর জি-এর লালা লাজপত রায় জিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

এই তথ্য লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের অত্যন্ত দুঃখ হচ্ছে যে দেশভক্ত লালা লাজপত রায়ের গত মাসের ১৭ তারিখে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। সাইমন কমিশনের লাহোরে আগমনের সময় তাকে ফিরে যেতে বলার জন্য এক মিছিল স্টেশনে গিয়েছিল, তার অগ্রভাগে লালা জি উপস্থিত ছিলেন। ভিড়কে পেছনে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার সময় এক পুলিশ অফিসার লালা জির বুকে লাঠির আঘাত করেছিল। ডাক্তারদের মতে ওই লাঠির আঘাতই লালা জির হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কারণ প্রমাণিত হয়েছে। যদি এটি সঠিক হয় তবে এমন উন্মত্ত ও রাক্ষসী প্রবৃত্তির পুলিশ অফিসারের যত নিন্দা করা যায় তা কমই হবে।

যাই হোক, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে লালা জির মৃত্যুর ফলে দেশ একটি কর্মঠ ও দক্ষ নেতাকে হারাল। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক নেতার কখনো অভাব হয়নি, কিন্তু লালা জির মতো সত্যনিষ্ঠ, স্বার্থত্যাগী এবং কৃতসংকল্প হয়ে কর্মের জন্য তন-মন-ধন নিবেদনকারী নেতা অত্যন্ত বিরল ছিলেন। নেতাগিরির জন্য লালায়িত এবং তার জন্য নিজেদের সদাসদ্‌বিবেক, বুদ্ধি, শয়তানি বা অসুরী প্রবৃত্তির কাছে বিক্রি করে দেওয়া লোকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এদের কথার সঙ্গে কাজের যে অমিল দেখা যেত, তা যখন মানুষের চোখে পড়ত তখন তারা সেটিকে “মেন্টাল রিজারভেশন” বলে এড়িয়ে যেত। কিন্তু লালা জির জীবনযাত্রায় এ ধরনের কোনো অবস্থা চোখে পড়ে না। শ্রী নরসিংহ চিন্তামণি কেলকারের মতো দ্বৈত চরিত্রসম্পন্ন অথবা শ্রী আয়ঙ্গার ধাঁচের নেতাদের অশোভনতা থেকে লালা জি বহু দূরে ছিলেন। তার কর্মদক্ষতা ছিল অতুলনীয় ও মহান।

লালা জির চরিত্রের বিশেষত্ব এই যে তিনি অতিরিক্ত বকবক বা গোলযোগ না করে অত্যন্ত চিন্তাভাবনা করে ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করা কর্মকে সম্পন্ন করতেন। লালা জির জন্ম ১৮৬৫ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের এক দরিদ্র বৈশ্য পরিবারে হয়। তার পিতা ছিলেন আর্যসমাজী, তাই শৈশব থেকেই তিনি উদার মতবাদের শিক্ষা পেয়েছিলেন। আজ আর্যসমাজকে সনাতন ধর্ম গিলে নিয়েছে, কিন্তু তখন আর্যসমাজ ও সনাতন ধর্ম ছিল চিরশত্রু, কারণ সে যুগে আর্যসমাজ মুসলমানদের আক্রমণের চেয়ে হিন্দু সমাজের ভেতরের জাতিভেদ প্রভৃতি দোষের দিকেই বেশি মনোযোগ দিত। ফলে তারা রূঢ়িবদ্ধ পৌরাণিক লোকদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই অপ্রিয় ছিল।

পৌরাণিক মতবাদ ও আর্যসমাজের এই সংগ্রামে লালা জি আর্যসমাজের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং সেই সমাজের নীতিকে দৃঢ় ও কার্যকর রূপ দিতে কিছু বন্ধুদের সহযোগে ১৮৮৬ সালে দयानন্দ অ্যাংলো বৈদিক কলেজ (ডি এ ভি কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জনজীবনের সূচনা এই ঘটনাতেই হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন এবং প্রচুর স্বার্থত্যাগও করেছিলেন। আজ পাঞ্জাবে এই প্রতিষ্ঠানকে একটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গণনা করা হয়।

এরপর তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন, তবে তিনি অন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতাদের মতো রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজের পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙে নিজের অপারগতার প্রমাণ কখনো দেননি। দুই ক্ষেত্রেই তিনি বিপ্লবী ছিলেন। এ কথা মনে রাখার মতো যে রাজনৈতিক আন্দোলনে পদার্পণ করার কারণে সরকার যখন তাকে আন্দামানের জেলে পাঠায়, তখন অনেক পৌরাণিক মানুষ আনন্দ প্রকাশ করেছিল। এইভাবে ব্রিটিশ সরকার ও পৌরাণিক উভয়ের বিরোধ সয়ে লালা জি তার জনসম্মুখ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।

পাঞ্জাবের কিছু স্পৃশ্যবর্গীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত অস্পৃশ্যদের স্পৃশ্যীকরণ (দলিতোদ্ধার) আন্দোলনে তিনি আন্তরিকভাবে অংশ নিয়েছিলেন। স্পৃশ্যবর্গীয় মানুষদের পরিচালিত “অস্পৃশ্যোদ্ধার” আন্দোলন থেকে আমাদের যদি সম্পূর্ণ তৃপ্তি না-ও হয়ে থাকে, তবুও এ নিয়ে আমাদের সন্দেহ নেই যে লালা জির সহানুভূতি ছিল সম্পূর্ণ আন্তরিক। আমাদের দৃষ্টিতে তা পূর্ণতা না পেলেও অবিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

লালা জি ছিলেন এক উৎকৃষ্ট লেখকও। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক বহু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। “দ্য পিপল” নামে ইংরেজি পত্রও তিনি প্রকাশ করতেন। দयानন্দ অ্যাংলো বৈদিক কলেজ ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম “সার্ভেন্টস অফ ইন্ডিয়া”। যদিও এই প্রতিষ্ঠানটি “সোসাইটি”-র মতো নিয়মাবলি তৈরি করেছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। মুম্বাইয়ের “সোসাইটি” যেহেতু “নরমপন্থী দলের” নিয়ন্ত্রণে ছিল, তাই তাদের সমস্ত কর্মসূচি শান্ত ও মন্থর গতিতে চলত। রাজনৈতিক বিষয়ে যেমন ধীরগতি, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও মন্থরগতি। এক পা সামনে বাড়ানোর আগে তার ওপর দশ ঘণ্টা ধরে আলোচনা চলত। এই প্রতিষ্ঠানের কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে “গরম”, “অগ্রগামী” এবং “প্রগতিশীল” হলেও সমষ্টিগতভাবে তারা নরমপন্থী দলের কাঠামোয় আটকে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে থাকত।

তার বিপরীতে লাহোরের সোসাইটিকে লালা জির মতো তেজস্বী নেতৃত্ব পাওয়ার কারণে সেটি সর্বাঙ্গীন প্রগতিশীল রূপ ধারণ করেছিল। এই সোসাইটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সমানভাবে প্রগতিশীল কর্মী তৈরি করার কাজ উৎসাহ ও সাহসের সঙ্গে করে আসছিল। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য তিনি প্রচুর কষ্ট সহ্য করেছিলেন।

এইভাবে লালা লাজপত রায় জির চরিত্র বহুমুখী। সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষামূলক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে তিনি তার অমূল্য অবদান রেখে গেছেন এবং তার মৃত্যু ঘটলেও তার বহুমুখী সৃজনশীল কর্ম তার সচেতন স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে চিরস্থায়ী ও অমর হয়ে থাকবে।

সন্দর্ভ
(১) ডাঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর চরিত্র, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৯৭, লেখক চাংদেব ভবানরাও স্বেরমোড়ে, দ্বিতীয় আজীবন সংস্করণ ১৪ অক্টোবর ১৯৯১, মূল্য ৯০.০০, প্রকাশক সুভাগা প্রকাশন, পুনে, মহারাষ্ট্র
(২) বহিষ্কৃত ভারত (মারাঠি সাপ্তাহিক), সম্পাদক ডাঃ ভীমরাও আম্বেদকর, তারিখ ৭ ডিসেম্বর ১৯২৮
(৩) অনুবাদ কুশলদেব শাস্ত্রী

ডাঃ আম্বেদকর জি কর্তৃক স্বামী শ্রদ্ধানন্দ জির অভিনন্দনঃ

যেসব হিন্দু সংস্কারক অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তাদের বিষয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকর (সন ১৯২০ থেকে ১৯২৭) গর্ববোধ প্রকাশ করতে দেখা যায় এবং তারা আরও বেশি কাজ করুন, এই দৃষ্টিকোণ থেকেও আহ্বান জানাতে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে আর্যসমাজ ও তাদের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন।

“স্বামীজি ছিলেন দলিতদের সর্বোত্তম হিতকর্তা ও হিতচিন্তক” এই উক্তি ডাঃ আম্বেদকর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত কংগ্রেস ও গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের জন্য কী করেছিলেন গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন (পৃষ্ঠা ২৯-৩০)। কংগ্রেসে থাকাকালীন স্বামীজি যে কাজ করেছিলেন তার তিনি কৃতজ্ঞতাসহকারে প্রশংসা করেছেন। কংগ্রেস অস্পৃশ্যোদ্ধারের জন্য ১৯২২ সালে একটি কমিটি স্থাপন করেছিল। সেই কমিটিতে স্বামীজি ছিলেন। অস্পৃশ্যোদ্ধারের জন্য তিনি কংগ্রেসের সামনে এক বৃহৎ পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন এবং তার জন্য একটি বড় তহবিলও চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আবেদন নাকচ করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন (পৃষ্ঠা ২৯)। উক্ত গ্রন্থে স্বামীজির বিষয়ে আরেক স্থানে তিনি বলেন, “স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি অস্পৃশ্যতা নিবারণ ও দলিতোদ্ধারের কর্মসূচিতে আগ্রহী ছিলেন, তাদের জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাকে পদত্যাগে বাধ্য হতে হয়েছিল” (পৃষ্ঠা ২২৩)।

তারিখ ১.১.১৯২৮-এর বহিষ্কৃত ভারত পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বাবাসাহেব লিখেছেন “আর্যসমাজ অর্থাৎ এই সমাজ (ব্রাহ্মণ নয়, বরং) ব্রাহ্মণ্যতামুক্ত হিন্দুধর্মের একটি সংস্কারিত-সংশোধিত সংস্করণ। আর্যসমাজ হিন্দুসমাজের জন্মনির্ভর চাতুর্বর্ণ্য ভেঙে তাকে একবর্ণী করার জন্য জন্ম নেওয়া আন্দোলন, তার সাহস অনন্য” (পৃষ্ঠা ১৫১৫২)। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যা হয়েছিল ২৩.১২.১৯২৬ তারিখে এবং তার পরে আর্যসমাজের চরিত্র পরিবর্তনের সমালোচনা বাবাসাহেব করেছেন। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন “আর্যসমাজ হিন্দুসমাজকে একবর্ণী করার মূলকাজ ভুলে গিয়ে হিন্দু মহাসভার মতো শুদ্ধি আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে, এখন এই দুইয়ের এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে হিন্দু মহাসভার লক্ষ্যই আর্যসমাজের লক্ষ্য হয়ে গেছে” (পৃষ্ঠা ১১৫২)।

তারিখ ৭.১০.১৯২৭-এ অমরাবতীতে অনুষ্ঠিত আর্য ধর্ম পরিষদে চাতুর্বর্ণ্যের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল বলে বাবাসাহেব উল্লেখ করেছেন। তবু আর্যসমাজের প্রতি আশাবাদী থেকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন যে “আর্যসমাজ হিন্দু মহাসভার কথায় প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে হিন্দু মহাসভাকে নিজেদের চিন্তার অনুরূপ করে তুলবে, এই কাজেই আর্যসমাজের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে” (পৃষ্ঠা ১১২)।

তারিখ ২২.৪.১৯২৭-এর বহিষ্কৃত ভারত-এ আর্যসমাজের শুদ্ধি কার্যকলাপের সমালোচনা করে বাবাসাহেব বলেছেন “শুদ্ধি করে যে মানুষরা বিদর্মে গিয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার একদিকে চেষ্টা করা আর অন্যদিকে যারা স্বধর্মে রয়ে গেছে তাদের সঙ্গে বিদ্বেষ দেখানো সচেতন মানুষের লক্ষণ নয়। স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির সফল কর্মের এ কোনো স্মারক নয়, বরং সেই মহাপুরুষ যে কাজ শুরু করেছিলেন তার বিকৃত রূপ” (পৃষ্ঠা ১০)। তারিখ ১৮ মার্চ ১৯২৯-এর বহিষ্কৃত ভারত সম্পাদকীয়তেও তিনি স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির প্রশংসা ও আর্যসমাজের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন “স্বর্গীয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির পবিত্র আন্দোলনকে এই ভণ্ডেরা একেবারে গুলিয়ে দিয়েছে” (পৃষ্ঠা ২৪৪)।

তারিখ ২৯.১২.১৯২৮-এর বহিষ্কৃত ভারত সংখ্যায় স্বামীজির গৌরব নিয়ে শ্রী পি আর লেলে জির একটি বিশাল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তার শেষে বলা হয়েছিল “তাকে (স্বামীজিকে) শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার অধিকার প্রধানত বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের (দলিতদের)ই। যদি তাদের উন্নতি না ঘটে তবে স্বামীজি, তাদের সত্যিকার হিতৈষীর আত্মা শান্তি পাবে না” (পৃষ্ঠা ২০৫)। “মহাত্মা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হিন্দুদের উদ্ধারের জন্য, আর অন্যেরা ব্রাহ্মণদের উদ্ধারের জন্য, দিনরাত চিন্তিত থাকতেন” প্রায়ই এই কথা বাবাসাহেব বলে থাকতেন (পৃষ্ঠা ৩১)। একই কৃতজ্ঞতার ভাব থেকে মহাড়ে মার্চ ১৯২৭-এ অনুষ্ঠিত কুলাবা জেলা বহিষ্কৃত পরিষদে স্বামীজিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল “শ্রদ্ধানন্দজির অমানবিক হত্যায় এই সভা গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং তার নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী হিন্দু জাতিকে অস্পৃশ্যতা নির্মূলের কাজ সম্পন্ন করতে হবে” (পৃষ্ঠা ৯)। (ডাঃ আंबেডকরের সামাজিক নীতি : এক অধ্যয়ন, লেখক শেশরাও মোরে, পৃষ্ঠা ৭৫-৭৬, প্রথম সংস্করণ, জুন ১৯৯৮)।

কংগ্রেস অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কাজ না করায় কংগ্রেস কমিটি থেকে পদত্যাগকারী স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির যে গৌরব তিনি করেছিলেন, তা আপনি দেখেছেনই। কিন্তু ১৯৪৫ সালের কংগ্রেস ও গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের জন্য কী করেছিলেন গ্রন্থে বাবাসাহেব গান্ধীজির সমালোচনা করে লিখেছিলেন “স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির পক্ষে থাকার পরিবর্তে গান্ধীজি শ্রদ্ধানন্দজির বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন” (পৃষ্ঠা ২২৬)। শুধু তাই নয়, ১৯১৭ সালের কংগ্রেসের অস্পৃশ্যতা নিবারণ প্রস্তাব অর্থাৎ অস্পৃশ্যদের সম্পর্কিত পুরো বিষয়টি ছিল ছলনা নাটক (পৃষ্ঠা ২২)। তা ছিল নিছক রাজনীতি (পৃষ্ঠা ২৬)। এমনই ডাঃ আম্বেদকর উক্ত গ্রন্থে বলেছেন (তত্রৈব, পৃষ্ঠা ৮৫)।

তারিখ ৩ জুন ১৯২৭-এর বহিষ্কৃত ভারত সম্পাদকীয়তে বাবাসাহেব লিখেছিলেন হিন্দু মহাসভা কবে এবং কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই তথ্য। “কংগ্রেসের পুরনো সদস্যদের মতো সামাজিক পরিষদ, তেমনই নতুন সদস্যদের হিন্দু মহাসভা” এভাবেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন (পৃষ্ঠা ৪৩)। প্রথমে মনে হয়েছিল হিন্দু সমাজের পুনর্গঠন সফলভাবে সম্পন্ন হবে। কিন্তু সমাজ সংস্কারের কোনো উদ্যোগই এই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, তার কার্যক্ষমতা কেবল শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই অভিযোগ আমাদের নয়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দজিই করেছিলেন। বাবাসাহেবের মতে, এই কারণেই শ্রদ্ধানন্দজি মহাসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন (পৃষ্ঠা ৪৩, তত্রৈব, ১৫৮০)।

দেশ বিভাজন ও হায়দরাবাদ মুক্তি সংগ্রামের কঠিন কালে ডাঃ আম্বেদকরজি উৎসুকতার সঙ্গে আর্যসমাজি নেতাদের প্রতীক্ষায় ছিলেন

শুদ্ধির যোগ্য সময় : কোনো আর্যসমাজি নেতাকে আমার সঙ্গে মিলিয়ে দিন

জাতিভেদ ও বৈষম্য উপেক্ষা করে শুদ্ধি আন্দোলনের ভণ্ডামিপূর্ণ দিকের প্রতি আপত্তি জানালেও অন্যান্য পরিস্থিতিতে ইচ্ছানুযায়ী শুদ্ধি অথবা ধর্মান্তর বিষয়ে বাবাসাহেবের আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন কালে হিন্দুধর্ম একটি মিশনারি ধর্ম ছিল। এই কথায় তিনি তার প্রশংসাই করেছিলেন (পৃষ্ঠা ৫৪২৩)। স্বয়ং তিনি ধর্মান্তরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। তাই শুদ্ধি অথবা ধর্মান্তরের প্রতি তিনি উপেক্ষা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেননি, বরং তার গুণমানের ভিত্তিতে বিবেচনা করেছিলেন। যখন শুদ্ধির অর্থাৎ ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের তাদের মূল ধর্মে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন প্রতীয়মান হয়েছিল, তখন তিনি তার সমর্থনই করেছিলেন।

দেশ বিভাজনের পর পাকিস্তানে অস্পৃশ্যদের জোর করে মুসলমান বানানো হচ্ছিল। একই রকম দুর্দশা শুরু হয়েছিল নিজামের হায়দরাবাদ রাজ্যে। তারিখ ১৮ নভেম্বর ১৯৪৭-এ একটি পরিপত্র জারি করে বাবাসাহেব তাদের সবাইকে ভারতে বা হিন্দু প্রদেশে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এইসবের শুদ্ধি করে পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার এবং তাদের প্রতি পূর্বজাত আচরণ করার আশ্বাসও তিনি দিয়েছিলেন (পৃষ্ঠা ৩৪৯)।

সন ১৯৪৭-এ যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়, হিন্দুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মুসলমানেরা চুটি রাখতে শুরু করে, কপালে তিলক দিতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় শ্রী সোহনলাল শাস্ত্রীর কাছে বাবাসাহেব বলেছিলেন “কোনো এক আর্যসমাজি নেতাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন, আমি তাকে বুঝিয়ে বলব যে এখন এমন সময় এসেছে যে তাদের (মুসলমানদের) হিন্দুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। তারা বেচারা বাঁচবে আর হিন্দুদের সংখ্যাও বাড়বে” (পৃষ্ঠা ৫৭২)।

জাতি বিনাশক হিন্দু সংগঠনকে গুরুত্ব না দিয়ে শুদ্ধি কার্যকারীদের উপর ডাঃ বাবাসাহেব ভীষণ আক্রমণ করেছিলেন। তারিখ ১৫ মার্চ ১৯২৯-এর বহিষ্কৃত ভারত সংখ্যায় তিনি এমন লোকদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন “সংগঠন ও শুদ্ধি অর্থাৎ সম্ভাব্য লফঙ্গাগিরি” (পৃষ্ঠা ২৪৪)। “স্পষ্ট বিরোধী পুরাণমতাবলম্বীরা সহৃদয়, কিন্তু শুদ্ধি সংগঠনের ভণ্ডেরা তাদের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর” এইরূপ অভিযোগ তিনি করেছিলেন। এই ভণ্ডেরাই বর্তমানে সংগঠনে ঢুকে পড়েছে। স্বর্গীয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির পবিত্র আন্দোলনকে এই ভণ্ডেরা বিকৃত করে ফেলেছে। তাদের লাথি মেরে বাইরে না করা পর্যন্ত শুদ্ধি আন্দোলনে আসল জোর আসবে না (পৃষ্ঠা ২৪৪)।

তারিখ ৪ নভেম্বর ১৯২৭-এর বহিষ্কৃত ভারত সংখ্যায় আর্যসমাজ ও হিন্দু মহাসভার গাট্টি (মৈত্রী) শিরোনামে বাবাসাহেবের মন্তব্য এই প্রসঙ্গে পাঠযোগ্য। তিনি লিখেছেন “আর্যসমাজ হিন্দুসমাজকে একবর্ণী করার মূলকাজ ভুলে গিয়ে হিন্দু মহাসভার মতো শুদ্ধি আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে।” এভাবে তিনি যে সমালোচনা করেছেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রবল (পৃষ্ঠা ১১৫২)। একবর্ণী হিন্দুসমাজ বলতে তিনি হিন্দু সংগঠনকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন। তার এই সমীকরণ ও সামঞ্জস্য প্রতিটি পাঠক সর্বত্র দেখতে পাবেন।

সন্দর্ভ : লেখক শ্রী শেশরাও মোরে, ডাঃ আম্বেদকরांचे সামাজিক धोरण – एक अभ्यास, প্রকাশক রাজহংস প্রকাশন, ১৫০২৫, সদাশিব পেঠ, পুণে ৪১১০৩০, মারাঠি গ্রন্থ, প্রথম সংস্করণ, জুন ১৯৯৮, মূল্য ৩০০।

সমতা-র সেনানি :
ছত্রপতি শাহু, ড. আম্বেদকর এবং যশবন্তরাও চৌহান

মহারাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ ইতিহাস সংশোধক ও ইতিহাসকার ড. জয়সিংরাও পাওয়ারের মতে, রাজর্ষি শাহু মহারাজ সামাজিক বিপ্লবের মশাল ড. আম্বেদকরজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মহার সমাজের এক যুবক আমেরিকা থেকে এম এ ও পিএইচডি শিক্ষা সম্পন্ন করে ফিরেছেন—এই সংবাদ পেয়ে শাহু মহারাজ অতিশয় আনন্দে অভিভূত হয়ে মুম্বাই শহরের বস্তিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি ড. আম্বেদকরের প্রতি তাঁর হর্ষ ও স্নেহ উজাড় করে দিয়ে বলেন, “এখন আমার চিন্তা দূর হলো। দলিতরা তাঁদের নেতা পেয়ে গেছে।”

পরবর্তীতে, কিছুদিনের মধ্যেই ড. আম্বেদকরজীকে কোলহাপুর আসার আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাঁর আগমনে শাহু মহারাজ তাঁকে নিজ রথে বসিয়ে সোনভলি ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে রাজপরিবারের সঙ্গে আসন দিয়ে সহভোজন করান। এরপর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে রেশমি পাগড়ি পরিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন। এই সুযোগে ড. আম্বেদকর বলেছিলেন, “ছত্রপতি শাহুজী আমার মাথায় যে রেশমি পাগড়ি বেঁধে দিয়েছেন, তার মর্যাদা আমি রাখব।” প্রকৃতপক্ষে, ড. আম্বেদকরজী শুধু মহারাষ্ট্রেই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে দলিত-পতিতদের মুক্তি আন্দোলন চালিয়ে শাহু মহারাজের দেওয়া সেই রেশমি পাগড়ির মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। (রাজর্ষি শাহু ছত্রপতি: এক সিংহावलোকন, পৃঃ ২–৩)

স্থূলভাবে দেখা যায়, ‘মহার শ্রেণি’ গ্রামে ‘বতনদার’ ছিল, কিন্তু এই মর্যাদার আড়ালে তাদের সারা গ্রামের দাসত্ব, চাকরি ও বদ্ধ শ্রম দিতে হতো। মহার সমাজকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা ‘মহার বতন’ প্রথা বিলোপের দৃঢ় সংকল্প নেন শাহু মহারাজ। ১৯১৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি এক বিশেষ রাজাজ্ঞা জারি করেন, যার ফলে ওই সমাজ অন্যদের মতো “স্বাধীন প্রজাজন” হয়ে যায় এবং দাসত্বের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়। মহার বতন বিলোপের সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাভ করেছিলেন ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর। তিনি বহু আগেই দাবি তুলেছিলেন যে মহারদের নিজেদের উচিত এই দাসত্ব ত্যাগ করা, অথবা সরকার আইন করে এই প্রথাকে ধ্বংস করুক। ১৯০২ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত মুম্বাইয়ের বহু সরকার এই দাবিতে সাড়া দিতে পারেনি। অবশেষে ১৯১৮ সালে রাজর্ষি শাহু মহারাজই নিজের উদ্যোগে এই ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেন। পরে, মুম্বাই রাজ্যে ১৯৫৮ সালে কোলহাপুরের রাজারাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং শাহু মহারাজ ও আর্য সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আত্মপরিচয়ে বড় হওয়া যশবন্তরাও বালওন্তরাও চৌহানের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে মহারদের এই দাসত্ব সম্পূর্ণভাবে বিলোপ পায় (তত্রেবঃ, পৃঃ ২২–২৩)।

দলিতোদ্ধারে দয়ানন্দের দেবদূত ও আর্য সমাজের ভূমিকা

শ্রী নন্দকিশোর তিওয়ারীর সম্পাদনায় ‘চাঁদ’ নামে হিন্দি মাসিক পত্রিকার একটি ‘অচ্ছুত বিশেষাঙ্ক’ মে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি আজ থেকে প্রায় ৯৮ বছর পূর্বে, অর্থাৎ ৮১ বছরের উল্লেখটি মূল লেখার প্রকাশ-কাল অনুযায়ী। ‘চাঁদ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন নন্দকিশোর তিওয়ারী এবং কম্পোজিটার ছিলেন বংশীলাল কোরি। এই বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদে একটি সাদা-কালো ছবি ছাপা হয়েছিল, যেখানে সরযূ পারিণ ব্রাহ্মণ তিওয়ারী এবং কোরি চামারকে একই থালা ও টেবিলে সহভোজ করতে দেখা যায়। পুরো সংখ্যার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৯২। এটি মূলত দলিতোদ্ধার ও সামাজিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। সম্পাদক ভূমিকায় স্পষ্ট করেছিলেন যে পত্রিকার লক্ষ্য হলো সামাজিক অত্যাচার তুলে ধরা এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা।

এই বিশেষ সংখ্যায় পণ্ডিত কিশোরীদাস বাজপেয়ীর মতো শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্বান ভল্মীকী, রবিদাস, নামদেব, কবীর-কুবীর প্রমুখ দলিত সন্ত ও ভক্তদের গুরুত্ব আলোচনা করেন। ধর্মান্তরের প্রসঙ্গে আলোকপাত করে হিন্দি গবেষক জহুরশরুশ ‘অচ্ছুত কি আত্মকথা’ রচনা করেন। মুনশি প্রেমচন্দের কালজয়ী গল্প ‘মন্দির’ও এই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। দলিতদের বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজ এবং সত্যিকারের দলিতোদ্ধারক শহীদ স্বামী শ্রদ্ধানন্দের পূর্ণাঙ্গ ছবি এক একটি পূর্ণ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। রेखাচিত্রের মাধ্যমে সে সময়ের দলিত সমাজকে জীবন্ত করে তোলার প্রয়াসও নেওয়া হয়েছিল।

‘সম্পাদকীয় ভাবনা’-য় উল্লেখ আছে যে মহাস প্রদেশের এক জেলায় পাঁচ বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দলিত খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন। বহু রेखাচিত্রের মধ্যে একটি বিশেষ চিত্রে খাজা হাসান নিজামীকে স্বপ্নে দেখা গেছে যে দলিতরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, দলিতদের মধ্যে জাগরণের স্রোত উঠছে, সংগঠিত হওয়ার বোধ ও আত্মসম্মানের জাগরণে তারা সংস্কারবাদের দিকে ঝুঁকছে। মহাড়ে ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরের আন্দোলন তথাকথিত দ্বিজ শ্রেণির কঠোরতা ও সংকীর্ণতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছিল।

বিখ্যাত ‘চাঁদ’ বিশেষ সংখ্যার শেষ ভাগে দলিতদের ব্যথা-বেদনা ফুটিয়ে তোলা বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিছু প্রতিবেদনে আর্য সমাজকে এই বার্তা দিতে দেখা গেছে, “দলিতদের আপন বুকে টেনে নিন ভাইয়ের মতো, নয়তো তারা অন্যের ঘরে চলে যাবে।” শূদ্রদের যজ্ঞোপবীত প্রদান, তাঁদের সঙ্গে সহভোজ, বিভক্ত গ্রামকে ‘এক গ্রাম এক পনঘাট’-এ পরিণত করা, ‘সার্ভেন্টস অফ পুলিশ সোসাইটি’র উদ্যোগ, দলিতোদ্ধার সম্মেলনে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্ব, আর্য প্রচারক লক্ষ্মণরাও ওঘলের ভাষণ, বডোদরার রাজা সায়াজীরাও গায়কোয়াড়ের দলিতোদ্ধার সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন, দলিতদের আর্য সমাজে প্রবেশাধিকার, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ পরিচালিত দলিতোদ্ধার পাঠশালার শিক্ষক সম্মেলন—এসব কর্মকাণ্ডে আর্য সমাজের স্বেচ্ছাসেবক এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ‘দেবদূতদের’ সক্রিয় দেখা যায়।

মাননীয় ড. আম্বেদকর দলিতদের ব্যথা-বেদনা ব্যক্ত করতে গিয়ে যেসব ঘটনার আশ্রয় নিয়েছেন, তার নব্বই থেকে পঁচানব্বই শতাংশ ঘটনাই তিনি ‘তেজ’, ‘অর্জুন’, ‘মিলাপ’, ‘প্রতাপ’ প্রভৃতি আর্য সমাজপন্থী পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন। (তথ্যসূত্র: তৎকালীন ইতিহাস ও পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি অধ্যয়নের জন্য ‘চাঁদ’ (অচ্ছুত-সংখ্যা) অমূল্য দলিল। ১৯২৭ সালের পর ১৯৯৭ সালে রাধাকৃষ্ণ প্রকাশন, ২/৩৭ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মার্গ, দরিয়াগঞ্জ, নয়া দিল্লি, পিন ১১০০০২ থেকে এই বিরল উপাদান পুনর্মুদ্রিত হয়। সাংবাদিকতা সাহিত্য সর্বদাই সমাজের সর্বোৎকৃষ্ট আয়না। এই বিশেষ সংখ্যার প্রতিটি পদ, প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি রচনা ও প্রতিটি রূপচিত্র তাঁর সময়ের নথি ও দলিল।)

অস্পৃশ্যতা-নিবারণ

ভোলা (বড়াল) অঞ্চলে দাস জাতির কিছু হিন্দু বসবাস করতেন, যাদের স্থানীয়রা দলিত ও অস্পৃশ্য মনে করত। আনন্দের বিষয়, এখন সেখানে হিন্দুরা তাঁদের পুরনো মানসিকতা বদলেছেন। সম্প্রতি এলাকার ‘বার লাইব্রেরি’-তে এক সহভোজন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দাস জাতির পুরুষদের সঙ্গে স্থানীয় বিখ্যাত ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও কায়স্থরা মিলিত হয়ে ভোজন করেন।

অনুদারতার সীমা

বম্বে প্রদেশের মহাড় নামক গ্রামে দ্বিজদের দ্বারা দলিতদের ওপর নৃশংস অত্যাচারের সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। বলা হয়, পৌরসভা সেখানকার সর্বজনীন পুকুরগুলোকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তখন কিছু দলিত ভাই স্নানের উদ্দেশ্যে পুকুরে গেলে পিছন থেকে কিছু দ্বিজ আক্রমণ চালায়। এতে প্রায় বিশ জন গুরুতর আহত হয়েছিলেন।

অস্পৃশ্যতা-নিবারণ
ভোলা (বড়াল) অঞ্চলে দাস জাতির কিছু হিন্দু বাস করতেন, যাদের স্থানীয়রা দলিত ও অস্পৃশ্য মনে করত। আনন্দের বিষয় হলো, এখন সেখানে হিন্দুরা তাঁদের পুরনো মানসিকতা বদলে দিয়েছেন। সম্প্রতি এলাকার ‘বার লাইব্রেরি’-তে এক সহভোজন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে দাস জাতির পুরুষদের সঙ্গে বিখ্যাত ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও কায়স্থদেরও ভোজন করতে দেখা যায়।

অনুদারতার সীমা
বোম্বে প্রদেশের মহাড় নামক গ্রামে দ্বিজদের দ্বারা দলিতদের উপর নির্যাতনের সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। বলা হয়, পৌরসভা সেখানকার সর্বজনীন পুকুরগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তখন কিছু দলিত ভাই সেখানে স্নান করতে গেলে পিছন থেকে কিছু দ্বিজ আক্রমণ চালায়। এতে কুড়িজন আহত হয়।

অস্পৃশ্যদের সঙ্গে সহভোজন
জবলপুরের কালীমাই মন্দিরে সম্প্রতি অস্পৃশ্যদের সঙ্গে একটি সহভোজন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণের অনেক ভদ্রলোক যোগ দিয়েছিলেন।

মেহতারদের মধ্যে জাগরণ
দিল্লির মেহতারদের মধ্যে ক্রমশ জাগরণ ঘটছে। তাঁরা নিজেদের মহল্লায় ‘ভাল্মীকি সেবা-সদ্ভাব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার মাধ্যমে তারা সমাজে নবজীবন আনার চেষ্টা করছেন এবং নিজেদের দেব-দেবীর রক্ষার জন্য সংগঠন তৈরি করেছেন। আশা করা যায়, অন্য অঞ্চলের মেহতাররাও দিল্লির অনুকরণ করবেন।

সর্বজনীন শোভাযাত্রায় অচ্ছুত
আলিগড়, বারাণসী প্রভৃতি বহু জায়গা থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে যে হোলির সময় সর্বজনীন শোভাযাত্রায় অচ্ছুতরা অংশ নিয়েছেন। এ সময় হিন্দু ভাইয়েরা তাঁদের বুকে টেনে নিয়েছেন এবং মিষ্টান্ন খাওয়ানো হয়েছে।

মুসলমানদের আক্রমণ
সম্প্রতি বারাণসীতে রবিদাস ভাইদের এক বিশাল সভা হচ্ছিল, যেখানে জাতি-সংস্কার ও অধিকারের বিষয়ে বক্তব্য হচ্ছিল। হঠাৎ প্রায় চল্লিশজন লাঠিধারী মুসলমান তাঁদের উপর আক্রমণ চালায়। পুলিশ দ্রুত পৌঁছে যাওয়ায় বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়নি, দুষ্কৃতিরা পালিয়ে যায়।

চামারদের অধিকার
ভিওয়ানির হিন্দুরা চামারদের সর্বজনীন কূপ থেকে জল তোলার অনুমতি দিয়েছেন। অনেক জায়গায় তাঁরা যখন কূপে জল তুলতে গিয়েছেন, তখন তাঁদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে।

মন্দিরে অচ্ছুত প্রবেশ
ঢান্ডা (রাঁচি)-র মহন্ত শ্রী রামশরণদাসজি গত শিবরাত্রিতে তাঁর শিবমন্দিরে অচ্ছুতদের প্রবেশাধিকার দেন। ফলে ভোর থেকেই বহু মেহতার ও চামার ভাই পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং শিবরাত্রির উৎসব পালন করেন।

কানপুরে অচ্ছূতোদ্ধার
কানপুরে হিন্দু-বাল-সভা অচ্ছূতোদ্ধারের কাজ দ্রুত গতিতে চালাচ্ছে। তারা অনেক মহল্লায় অচ্ছুতদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে অচ্ছুত-সভা স্থাপন করেছে। অচ্ছুত পাঠশালাও অনেক স্থানে গড়ে উঠেছে এবং ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চামার সম্মেলন
গাড়িওয়ালা (পাঞ্জাব)-এ সম্প্রতি এক বিশাল চামার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে অচ্ছুত জাতির প্রায় দশ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনের প্রভাবে ধীরে ধীরে হিন্দুদের কঠোরতা কমতে শুরু করে এবং সেখানে এগারোটি সর্বজনীন কূপ দলিতদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

অন্ত্যজোদ্ধার-সংক্রান্ত আইন
বড়োদা রাজ্যের বিধানসভায় অন্ত্যজ প্রতিনিধি শ্রী মূলদাস ভূधरদাসজি একটি বিল উপস্থাপন করেন। এর বিধান অনুযায়ী, অন্ত্যজদের সরকারি স্কুল, বসতি, পাঠাগার, কোর্ট-কাচারি, পুকুর, কূপ, মন্দির, ধর্মশালা প্রভৃতির সমান অধিকার থাকবে। বেগার প্রথা সম্পূর্ণ বিলোপ হবে। অন্ত্যজ রোগীদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্যদের মতোই চিকিৎসা দেওয়া হবে। এই আইন ভঙ্গ করলে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি হারাতে হবে এবং অ-সরকারি ব্যক্তিকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে।

বিশাল সভা
সম্প্রতি কলকাতায় সর্বভারতীয় রবিদাস (চামার) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় পাঁচ হাজার রবিদাস ভাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকেরাও যোগ দিয়েছিলেন। সভায় মদ ও গোমাংস বর্জনের বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

রোহতকে জাগরণ
সম্প্রতি রোহতকের দানক সমাজের এক বিশাল সভা স্বামী রামানন্দজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। রাজপুতানা, জিন্দ, হিসার, করনাল, গুরগাঁও, দিল্লি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সভায় বিদ্বানদের বক্তৃতা ও বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

বারাসত সম্মেলন
সম্প্রতি বারাসত (বড়াল)-এ অচ্ছুত সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক শ্রী পীয়ূষকান্তি ঘোষ। এই সম্মেলনে কলকাতা সহ বহু খ্যাতিমান ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। প্রস্তাবগুলির মধ্যে অস্পৃশ্যতা-নিবারণ, শিক্ষা-প্রচার এবং দলিতোদ্ধার সম্পর্কিত বহু প্রস্তাব গৃহীত হয়। উচ্চবর্ণের নেতারাও এগুলির সমর্থন করেন।

অচ্ছুতদের মন্দিরে প্রবেশ
ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের বিখ্যাত বজ্রযোগিনী গ্রামে অচ্ছুতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তাঁরা মন্দিরে গিয়ে পূজা করেছেন এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাঁদের সঙ্গে বসে জল ও মিষ্টান্ন গ্রহণ করেছেন। সন্ধ্যায় এক বিশাল সভা হয়, যেখানে অস্পৃশ্যতা-নিবারণ ও দলিতদের সমঅধিকার নিয়ে জোরালো বক্তৃতা হয়।

গুরগাঁও দলিতোদ্ধার সম্মেলন
সম্প্রতি গুরগাঁও জেলার বল্লভগড়ে এক দলিতোদ্ধার সম্মেলন উৎসাহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ড. মুছ্জেজী। সেখানে শাহপুরাধীশ শ্রী সরনাহারসিংহ, কুঁয়ার রণঝয়সিংহ, ড. কেশবদত্ত শাস্ত্রী, স্বামী রামানন্দজি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অস্পৃশ্যতা-নিবারণ ও বেগার বন্ধ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

অচ্ছুতদের অধিকার
সম্প্রতি বোম্বে প্রাদেশিক বিধানসভায় প্রশ্ন তোলা হলে স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের মন্ত্রী জানান যে সরকার কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছে অচ্ছুতদের সর্বজনীন কূপ, পুকুর ও প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের অধিকার কার্যকর করার জন্য।

আমরাবতীতে বিশাল সভা
আমরাবতীর গণেশ থিয়েটারে হিন্দু সভার পক্ষ থেকে এক সর্বজনীন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কয়েক হাজার মহার উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন এম বি জোশী, মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার প্রাক্তন উপ-প্রধান। শ্রী পণ্ডিত লক্ষ্মণরাও ওঘলে শাস্ত্রী ও শ্রী বি জি সাপার প্রমুখ অস্পৃশ্যতা-নিবারণ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। সভায় তিল ও গুড় বিতরণ করা হয়, যা সকলে গ্রহণ করেন।

সার্ভেন্ট অফ পিউপিল সোসাইটি
সার্ভেন্ট অফ পিউপিল সোসাইটি সম্প্রতি সাত বছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে তারা অচ্ছূতোদ্ধারে বহু কাজ করেছে। যেখানে একসময় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ভাল্মীকি (ভাড়ুয়া)-দের ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে চলত, সেখানে আজ লাহোরে তাদের বিশাল শোভাযাত্রা হয় এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাঁদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। বহু স্থানে এই সোসাইটির প্রচারের ফলে হিন্দুদের মধ্যে জাগরণ হচ্ছে। সম্প্রতি তাদের বার্ষিক অধিবেশন উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়, যার সঙ্গে একটি ভাল্মীকি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন দানবীর সেঠ জামনালাল বাজাজ।

দলিতোদ্ধার শিক্ষক সম্মেলন
গত ১৫ই এপ্রিল শ্রদ্ধানন্দ দলিতোদ্ধার সভার পাঠশালাগুলির শিক্ষক সম্মেলন বুলন্দশহরে অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক পরমাত্মাশরণ এম এ। সেখানে দলিত শিক্ষার প্রসারে বহু প্রস্তাব গৃহীত হয়।

অচ্ছুতদের অধিকার
কুম্ভমেলায় মহামনা পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় সনাতন ধর্মসভা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অচ্ছুতদের দেবস্থান প্রবেশ ও সর্বজনীন কূপ থেকে জল তোলায় বাধা না দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

দলিতদের আর্য সমাজে প্রবেশ
সম্প্রতি বিজনৌর জেলার গোবিন্দপুর ও সদাফল গ্রামে প্রায় আশি-নব্বই জন চর্মকার আর্য সমাজে দীক্ষা নিয়েছেন। বিজনৌর জেলার আর্য সমাজ তাঁদের দীক্ষা অনুষ্ঠান আয়োজন করে, যেখানে নারী-পুরুষেরা হোমযজ্ঞে অংশ নেন। এরপর সহভোজন হয়।

অখিল ভারতীয় অচ্ছূতোদ্ধার সম্মেলন
গত ১৭ই এপ্রিল হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে ‘পাঞ্জাব কেশরী’ লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে অখিল ভারতীয় অচ্ছূতোদ্ধার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগতসভায় বলা হয় যে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অস্পৃশ্যতা-নিবারণ আন্দোলন চালু করা হোক। লালা লাজপত রায় তাঁর ভাষণে অস্পৃশ্যতার অভিশাপের নিন্দা করে তা মুছে ফেলার আহ্বান জানান। পরে অস্পৃশ্যতা-নিবারণ সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর মধ্যে দলিত শ্রেণিকে শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে সমঅধিকার প্রদান এবং সর্বজনীন কূপ তাঁদের জন্য উন্মুক্ত করার দাবি ছিল।

বারাণসী অচ্ছুত সম্মেলন
গত ২৪শে এপ্রিল চৌবেপুরে বারাণসী জেলা অচ্ছুত সম্মেলন শ্রী নরেন্দ্র দেবজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শ্রী গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থী, শ্রী বিহারীলাল চর্মকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির ভাষণে বলা হয়, যদি আমরা অচ্ছুতদের আপন না করি, তবে হিন্দু ধর্ম, জাতি ও সভ্যতা দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে। সম্মেলনে অচ্ছূতোদ্ধার সংক্রান্ত বহু প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার মধ্যে অচ্ছুতদের সর্বজনীন অধিকার দেওয়া ও তাঁদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের ওপর জোর দেওয়া হয়।

অস্পৃশ্যতা-নিবারণের সমর্থন
সম্প্রতি কলকাতায় সর্বভারতীয় অগ্রওয়াল মহাসভার বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন শ্রী নেবাটিয়াজী। তিনি বক্তৃতায় অগ্রওয়াল সমাজকে অস্পৃশ্য জাতিকে উন্নত করার এবং অস্পৃশ্যতা দূর করার আহ্বান জানান।

হিন্দু মহাসভা ও অচ্ছুত
সম্প্রতি ইস্টারের ছুটিতে ড. মুছ্লের সভাপতিত্বে হিন্দু মহাসভার দশম অধিবেশন পাটনায় অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে অস্পৃশ্যতাকে অসার বলে ঘোষণা করেন। সভায় অচ্ছুতদের বিষয়ে বহু প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তাঁদের সর্বজনীন অধিকার প্রদানের ওপর জোর দেওয়া হয়।

মনুস্মৃতি প্রসঙ্গে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর এবং আর্যসমাজ

মাননীয় ডঃ আম্বেদকরজী কেন মনুস্মৃতি’র তীব্র বিরোধ করলেন? এ প্রশ্নটি গভীরভাবে বোঝার জন্য যে অপমানজনক ঘটনাগুলো অপ্রশিক্ষিত অস্পৃশ্য সমাজকে সময়-সময়ে স্পৃশ্য সমাজের থেকে ভোগ করতে হয়েছে, সেগুলোর উপরও নজর দেওয়া প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৭ সালের শেষে মনুস্মৃতি দাহ করা হয়েছিল; ঠিক একই বছরের মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের মহাড় (জেলা — রায়গড়) নামক স্থানে ডঃ আম্বেদকরজীর নেতৃত্বে জনগণের সামনে এক হোহকারের সত্যাগ্রহে—এক পুকুরে সম্মিলিতভাবে পান করার সাহসী অভিযান করা হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণসমাজ ক্ষুব্ধ হয়। 'জ্ঞানপ্রকাশ' সংবাদপত্রের ২৭/৩/১৯২৭ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২১ মার্চ ১৯২৭-এ ওই পুকুরটিকে আর্য ঐতিহ্য অনুযায়ী 'শুদ্ধ' করার রীতিও পালিত হয়। একই সময়ে সশ্বর্ণ সমাজের পক্ষ থেকে অস্পৃশ্য সমাজের প্রতি প্রতিশোধাত্মক আঘাত-প্রহারও করা হয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরকে অত্যন্ত দুঃখিত করেছিল। তাদের ব্যথা ছিল যে, অস্পৃশ্য সমাজকে যে মৌলিক মানবিক অধিকার—একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করার অধিকার—তা ওদের দেওয়া হয়নি।

ডঃ আম্বেদকরজীর ধারণা গড়ে ওঠে যে সমাজে প্রচলিত বৈষম্যমূলক বিশ্বাসগুলোর পেছনে মূলত মনুস্মৃতি দায়ী। তাই তিনি ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৭-এ মহাড় সত্যাগ্রহ পরিষদের সময় রাত্রি ৯টা নাগাদ প্রতীকী রীতিতে মনুস্মৃতি দাহ করেছিলেন। মনুস্মৃতি চাতুর্বর্ণ্য তত্ত্বকে সমর্থন করে এবং ডঃ আম্বেদকরের মতে জন্মসূত্রে চাতুর্বর্ণ্য যে ধারণা আছে, তা বৈষম্যের ভিত্তিতেই দাঁড়ানো—তাই তিনি সমতার বিপক্ষে দাঁড়ানো সেই কিতাবকে জ্বলাতে বাধ্যবোধ করলেন। এরপর আট বছরের মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটল যে, ডঃ আম্বেদকরজী বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরের ঘোষণা প্রদান করেন। নাসিকের (মহারাষ্ট্র) সেই কালারাম মন্দিরে, যেখানে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ১৮৭৪ সালের বক্তৃতাগুলো হয়েছিল, সেখানে দেবস্থানপ্রবেশের অধিকার আদায়ে ডঃ আম্বেদকর পরিচালনায় ৩ মার্চ ১৯৩০ থেকে অক্টোবর ১৯৪৫ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ধরে সত্যাগ্রহ চলে; তবু অস্পৃশ্য সমাজকে মন্দির প্রবেশের অধিকার মেলেনি। ডঃ আম্বেদকরজী যে ধর্মান্তরের ঘোষণা দেন, তার পটভূমিতেও ওই ছয় বছরের কালারাম মন্দির সত্যাগ্রহের ঘটনা অবস্থান করে। ১৩ অক্টোবর ১৯৩৫ (১৯৩৫ই?)-এ ইয়েভলা নগরে এক ভাষণে ডঃ আম্বেদকর ঘোষণা করেন যে, 'আমি হিন্দু হিসেবে জন্মেছি ঠিকই, কিন্তু হিন্দু হিসেবে মরব না।'

সাধারণ এবং ভক্তশ্রেণীর অনুগামীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে ডঃ আম্বেদকর মনুস্মৃতির বিপক্ষে ছিলেন এবং আজ তার অনুগামীরাও মনুস্মৃতি’র বিরোধী। ঠিক একইভাবে স্বামী দয়ানন্দ যদি বেদানুকূল মনুস্মৃতি’কে সমর্থন করেছেন, তবে তাঁর আর্যসমাজী অনুচররাও প্রায়শই বিশুদ্ধ, শুদ্ধ ও বেদানুকূল মনুস্মৃতি’র পক্ষে দাঁড়ান—অনুয়ায়ীতার ন্যায়। অনুগামীদের মত অধিকার তাদের অনুপ্রেরণায় দাঁড়ায়। জ্ঞানের গভীরে পৌঁছে নিজের মতকে নেতা-স্তরের বৌদ্ধিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত বা তারও অতিক্রমে নিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য সহজ নয়; তাই অনেকেই একাধিক প্রমাণের মধ্যে একপর্যায়ের 'আপাতপ্রমাণ' বা 'আপ্তপ্রমাণ'কেই গ্রহণ করেন। উভয় সমাজেই তাত্ত্বিকভাবে জন্মনাভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা, জাতিভেদ-বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা আছে — তবে দুই পক্ষেই নিজেদের নিজস্ব পন্থায় কাজ করে লাভ-হানি কী কী হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা মাত্রা স্বতন্ত্র এক বইয়ের বিষয়। আর্যসমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাধারণ হিন্দু আজও পুরাণমনা রক্ষণশীল প্রবণতাকে সহজে মেনে নিতে চায় না।

সমাজসुधারে পটচারণ করা প্রকৃতপক্ষে কঠোর তপস্যা। আমরা আমাদের নেতাদের গৌরব করতেই রাজি, কিন্তু তাঁদের তপস্যাসম্পন্ন সংগ্রামী পথ অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক, কারণ আমরা স্বচ্ছন্দতার অভ্যাসে অভ্যস্ত। জয় ধ্বনি ওঠানো সহজ, কিন্তু নীতিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অনুবর্তী করা কঠিন। সাধারণ সমাজ একেবারেই হঠাৎ পরিবর্তিত হয় না; ধীরে ধীরে বদলায়। যে দ্বিজ ব্যক্তি বেদ অধ্যয়নে কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক নয়, সে শূদ্রত্বের বিধি-ফল পাবে—মনু-উক্তি (২.১.৪৩) স্বামী দয়ানন্দও উদ্ধৃত করেছেন। স্বামীজি 'সংস্কার-বিধি'র সাধারণ প্রकरणে লিখেছেন—

সব সংস্কারে মধুর স্বরেই যে যজমানকেই জৈবিক মন্ত্রোচ্চারণ করা উচিত; দ্রুত নয়, বিলম্বও নয়—মধ্যভাবেই, যেমন যেদিন কোন বেদের উচ্চারণ করা হয়। যদি যজমান নিজে না পড়তে পারে, তবে আশাকৃত (প্রার্থনা, উপাসনা, স্বস্তিবাচন, হস্তকর্ম ইত্যাদি) মন্ত্রগুলো অন্তত তিনি পড়েন। যদি কোন কর্মকার্তা জড়, ধীর, অক্ষর-জ্ঞানে নাপ্রাঙ হয়, সে শূদ্র—অর্থাৎ, যদি শূদ্র মন্ত্রউচ্চারণে অক্ষম হয়, তবে পুরোহিত বা ঋত্বিক মন্ত্রপাঠ করবেন এবং কর্মটি সেই অজ্ঞ যজমানের হাতে সম্পন্ন করানো হবে।

স্বামীজির কথার সার হল—সংস্কারবিধির নির্ধারিত ও সংগ্রহিত চার্বেদী মন্ত্রগুলো সাধারণ পাঠে করা না জানলে সে ব্যক্তি শূদ্ররূপী বিবেচিত হবে। এই মাপকাঠিতে আর্যসমাজের অনেক সদস্যকে তুলনা করলে অনেকে শূদ্রশ্রেণিতে পড়বেন। আর্যসমাজে সঠিকভাবে চারবেদের সস্বর মন্ত্রপাঠ জানে এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুবই অল্প—হাতের আঙুলে গোনা যেত এমন কয়েকজন বেদপাঠী ছাড়া।

আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতার মহৎ স্বপ্নগুলি বাস্তবায়নে আর্যসমাজের সদস্যদের উচ্চতা অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হচ্ছে। ব্যক্তিত্ব যদি নিতান্তই ক্ষুদ্র হয়, তবুও প্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব প্রয়োজন; ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র করে ফেলার প্রয়োজন নেই। যখন আর্যসমাজ নিজেই বৈদিক সিধান্তগুলো কার্যকরী রূপে প্রয়োগে অক্ষম প্রমাণিত হচ্ছে, তখন সাধারণ হিন্দু বা সাধারণ মানুষ কীভাবে আর্যসমাজের সমস্ত বিশ্বাস গ্রহণ করবে—এটি অনেক দূরের কথা। তবে সীমিতভাবে আর্যসমাজের কিছু মতামত হিন্দুদের নয়, সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়েরও গ্রহণ যোগ্য হয়েছে।

গত দশক ধরে রাজনীতিতে 'মনুবাদ' শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে। যারা এটি প্রচার করছেন, তারা মনুবাদকে প্রগতিশীলতা হিসেবে প্রচার করছেন না, বরং প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে প্রচার করছেন। যারা মনুস্মৃতি থেকে নির্বাচিত অংশকে ছাড়া বাকি অবিকৃত অংশকে গ্রহণযোগ্য ধরে, তারা মনুবাদকে প্রগতিশীলতার নিরপেক্ষ অর্থে গ্রহণ করছেন। তাদের মতে মনুর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বর্ণবিন্যাস জন্ম সূত্রে নয়, বরং গুণ-কর্ম ও স্বভাবের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। নারী ও শূদ্রদের শিক্ষাগ্রহণ ও সম্মান বিষয়ে মনুর বিধানও কিছুটা পাশ্চাত্যমানানুকূল বিভাজন রাখে—আর্যসমাজের ক্ষেত্রে মনুবাদকে প্রগতিশীলতার আশ্রয় বলে ধরা হয়।

মনুস্মৃতিপন্থীদের পক্ষে যুক্তি

২৪ জুলাই ১৮৭৫-এ মাহারাষ্ট্রের বিদ্যাবহুল নগরী পুনেতে ইতিহাস বিষয়ক বক্তৃতায় স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন—এখন মনু-জির ধর্মশাস্ত্র কোথায় দাঁড়িয়েছে, তা বিবেচনা করা উচিত। যেমন—গোয়ালারা দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করে ক্রেতাকে ঠকায়; তেমনি মানবধর্মশাস্ত্রেরও অবস্থা এমন হয়েছে। এতে বহু ক্ষেপকপ্রবৃত্ত শ্লোক (প্রবেশিত) আছে, যা সত্যিকারের মহর্ষি মনুর নয়। মনুপদৃশ শ্রেষ্ঠ পুরুষের গ্রন্থে নিজের স্বার্থসাধনের জন্য এমন শ্লোক ঢোকানো মানে সত্যিই নিন্মচেতনতা। (উপদেশমঞ্জরি—সম্পাদক রাজবীর শাস্ত্রী)।

স্বামীজির এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় লিখেছেন—যদি পানি ময়লা হয় তবে তাকে ছাঁকানো উচিত; ময়লা দেখে পানি থেকে বিরত থাকা বোকার কাজ হবে। বিদ্বানদের উচিত তাদের গ্রন্থসমূহ পুনরায় অনুসন্ধান করে দুর্নীতিপূর্ণ অংশগুলো উচ্ছিন্ন করা এবং মানুষের জন্য মনুর রূপকে চিকিৎসাসদৃশ করে তোলা। (সার্বদেশিক: আগস্ট ১৯৪৮, পৃ.২০৯২–৬০)।

ডঃ সোমদেব শাস্ত্রীর মতে—মেধাতিথি (৯ম শতাব্দী)র টীকা থেকে কুল্লুক ভট্ট (১২শ শতাব্দী)র টীকায় প্রায় ১৭০ শ্লোকের যোগ देखा যায়। তিন শতাব্দীর সময়ে এই শ্লোকগুলোর মিশ্রণ ঘটেছে। মেধাতিথির যুগে প্রায় ৫০০ পাঠ-ভেদ ছিল এবং কুল্লুক ভট্টের যুগে ৬০০ পাঠভেদ—এগুলি দেখিয়ে দেয় মনুস্মৃতিতে সময়ের সাথে বিভিন্ন প্রক্ষেপ হয়েছে। (স্মৃতি সংবাদ: পৃ.৭) পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় অনুযায়ী কিছু শ্লোক মেধাতিথি ও কুল্লুক ভট্টের ভাষ্যবলে নেই, অথচ বর্তমান মনুস্মৃতিতে রয়েছে। (মনুস্মৃতি: ভূমিকা ও অনুবাদ, পৃ.২৪)।

মনুস্মৃতি ইত্যাদি গ্রন্থের তুলনায় বেদগুলোর প্রামাণিকতা স্বামী দয়ানন্দের কাছে সর্বোচ্চ ছিল। মনুস্মৃতি থেকে প্রক্ষেপিত অংশগুলো বাদ দিলে যে বিশুদ্ধ ও বেদানুকূল অংশ থাকে, সেটাই তিনি প্রমাণনীয় বলে মেনেছিলেন। নিজলিখিত গ্রন্থগুলিতে তিনি মনুস্মৃতি’র ৫১৫৪ শ্লোককে প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করেছেন। মহর্ষি দয়ানন্দের অনুসরণে আর্য-বিদ্বানরাও তাদের সমালোচনাসহ বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন—পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা, পণ্ডিত আর্যমুনি, স্বামী দর্শানন্দ, পণ্ডিত হরিচন্দ্র বিদ্যালংকার প্রভৃতি 'মানব-ধর্ম-শাস্ত্র', 'মান্বর্য্য ভাষ্য' ইত্যাদি নাম নিয়ে মনুস্মৃতি সংশোধিত সংস্করণ ও ভাষ্য রচনা করেছেন। শ্রী জগন্নাথদাস, মহাত্মা হংসরাজ, মহাত্মা মুনশিরাম (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ), ডঃ সোমদেব শাস্ত্রী প্রমুখরা ছাত্র ও সাধারণ জনগণের জন্য 'মানব-ধর্ম-চিন্তা' (১৮৮৩), 'মানব-ধর্ম-সার' (১৮৯০), 'বেদানুকূল সংক্ষিপ্ত মনুস্মৃতি' (১৯১১), 'স্মৃতি সংবাদ' (১৯৯৬) প্রভৃতি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন।

পণ্ডিত তুলসীরাম (তুলসীরাম স্বামী), পণ্ডিত চন্দ্রমাণি বিদ্যালংকার, পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায়, পণ্ডিত সতীকাম সিদ্ধান্ত শাস্ত্রী ও ডঃ সুরেন্দ্র কুমার প্রভৃতি মনুস্মৃতি থেকে প্রক্ষেপিত শ্লোকগুলো পার্থক্য করে আলাদা করার উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন—তাঁরা 'মনুস্মৃতি ভাষ্য' (১৯০৮–৫১৫৯২২), 'আর্ষ সানুস্মৃতি' (১৯১৭), 'মনুস্মৃতি: ভূমিকা ও ভাষ্য' (১৯৩৮), 'বৈদিক মনুস্মৃতি' (১৯৪৮) ও 'সম্পূর্ণ মনুস্মৃতি' (১৯৫৮১) ইত্যাদি মাধ্যমে এ কাজটি করেছেন। ডঃ সুরেন্দ্রকুমার 'সমগ্র মনুস্মৃতি'তে সন্দেহভাজন শ্লোকগুলোকে বিশেষ চিহ্নসহ প্রকাশ করেছেন এবং 'বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি' (১৯৮১) সংস্করণে সন্দেহনীয় শ্লোকগুলো প্রকাশ না করাই অনুচিত মনে করেছেন। তাঁর সম্পাদিত 'মনুস্মৃতি' (সংস্করণ ৫৯৯৫) অনুযায়ী মোট শ্লোক সংখ্যা ২৬৮৫, যার মধ্যে মৌলিক শ্লোক ১৫২১৪ (?) এবং প্রক্ষেপিত শ্লোক ১৪৭৯ বলা হয়েছে। তিনি বিষয়বস্তুর বিরোধ, প্রসঙ্গবিরোধ, পারস্পরিক বিরোধ, পুনরুক্তি, শৈলীবিরোধ, অন্তর্বিরোধ, লেডবিরোধ—এছাড়া সাত ধরনের ভিত্তিতে ১৪৭৫ শ্লোককে প্রমাণভিত্তিক ভাবে প্রক্ষেপিত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

ডঃ ভবনীলাল ভারতীয়ের মতে সুরেন্দ্রকুমার জির মনুস্মৃতি-ভাষ্যে প্রক্ষেপিত শ্লোক পৃথকীকরণের জন্য বিশেষ যৌক্তিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। ডঃ সোমদেব শাস্ত্রীর ব্যাখ্যায় যে ব্যক্তি মনুস্মৃতির তলস্পর্শী অধ্যয়ন করেছেন, ডঃ সুরেন্দ্র কুমার তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ব্যয় করে প্রক্ষেপিত শ্লোকগুলো আলাদা করে মনুস্মৃতির প্রকৃত রূপ পাঠকের সামনে এনেছেন এটি প্রশংসনীয়। পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রীর দৃষ্টিতে, যদি মনুস্মৃতি থেকে প্রক্ষেপিত অংশগুলি আগেই আলাদা করে সরিয়ে ফেলা হত, তবে স্বাধীনতার পরদেশের সংবিধান রচনাকারীরূপে ডঃ আম্বেদকররাও এই গ্রন্থ সম্পর্কে তাঁদের ভুল ধ্যান-ধারণা বদলাতে বাধ্য হতেন। এই অবহেলার জন্য আমরাও আর্যবন্ধুরাও কম দোষী নই। (অতএব 'বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি' : আর্ষ সাহিত্য প্রচার— দিল্লি : ২৬ ডিসেম্বর ১৮৭১ : পৃ.৩–৭)।

মনু বিরোধী পক্ষ

মাননীয় ড. আম্বেদকর গৌতম বুদ্ধ, সান্ত কবীর ও মহাত্মা ফুলের ত্রিমূর্তিকে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁদেরই গুরু হিসেবে স্বীকার করেছিলেন। ফुलेজি তাঁর রচনাবলীতে সর্বত্রই মনুস্মৃতির বিরোধিতা করেছেন। তিনি তাঁর “তৃতীয় রত্ন” (রচনাকাল ১৮৫৮ এবং প্রকাশকাল ১৮৭৯) নাটকে রुढ়িবাদী ব্রাহ্মণদের উপর ব্যঙ্গ করে লিখেছেন — “আপনাদেরই পূর্বপুরুষ মনুর আইন দেখিয়ে আমাদের বারবার এই কথাই বলে এসেছেন যে, তোমাদের পড়াশোনার অধিকার নেই। তবে কি তাঁরা মনুর আইন ভেঙে নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেন? যখন তোমরা তাঁদের পড়তে দিলে না, এখন সেই বংশধরদের মধ্যেই এমন লোক জন্ম নিচ্ছে যারা মনুর আইনকে অমান্য করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” (মহাত্মা ফुले সমগ্র বাণ্ডসয় – পৃ. ২৮)

মহাত্মা ফুলের দ্বিতীয় গ্রন্থ “গুলামগিরি” (১৮৭৩)। এতে “ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীত্‌” মন্ত্রের উপর ফुलेজি তাঁর গ্রাম্য ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ব্রাহ্মণকে জন্মদানকারী মুখ ঋতুকালে চার দিন আলাদা বসত বা ভস্ম মেখে ঘরের কাজ করত, এই প্রসঙ্গে মনু কিছু লিখেছেন কি না? (তত্রৈব – পৃ. ১৪২)

“শেতকার্যাচ্যা আসুড” (অর্থাৎ কৃষকের চাবুক) (১৮৮৩) নামক গ্রন্থে মহাত্মা ফুলে লিখেছেন যে, ব্রাহ্মণেরা মনুস্মৃতির মতো স্বার্থপর গ্রন্থ রচনা করে শূদ্র কৃষকদের বিদ্যাধ্যয়ন নিষিদ্ধ করে তাঁদের লুটে নিয়েছে। (তত্রৈব – পৃ. ২৬৫)

এমনকি তাঁর “সৎসার” (১৮৮৫) নামক গ্রন্থে তিনি প্রতিপাদন করেছেন, মনুস্মৃতি কীভাবে শূদ্র-অতিশূদ্রদের সর্বনাশ করেছে। (তত্রৈব – পৃ. ৩৫৪)

তাঁর শেষ গ্রন্থ “সার্বজনিক সত্যধর্ম” (১৮৯১)-এ তিনি লিখেছেন — “যদি শূদ্র-অতিশূদ্ররা ভট্ট ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মনুস্মৃতির মতোই নীচতাপূর্ণ ব্যবহার শুরু করে, যেমন ব্রাহ্মণরা এতদিন ধরে তাঁদের সঙ্গে করে এসেছে, তবে তাঁদের কেমন লাগবে?” (তত্রৈব – পৃ. ৪৫১)

মহাত্মা ফুলের এই ভঙ্গিতেই ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর তাঁর “মনু অ্যান্ড দ্য শূদ্রস” প্রবন্ধের শেষে লিখেছিলেন যে, “ব্রাহ্মণকে শূদ্রের স্থানে বসানো হলে তবেই মনু প্রণীত নির্লজ্জ ও বিকৃত মানবধর্মের নিবারণ হতে পারে।” (রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস অফ ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর – পৃ. ৭১৫৯)

“রিডলস ইন হিন্দুইজম”-এর তৃতীয় খণ্ডে “মডেল অফ দ্য হাউস” নামক অধ্যায় মনুস্মৃতির উপর ভিত্তি করে। তাতে ড. আম্বেদকর লিখেছেন — মনু প্রণীত বর্ণব্যবস্থায় বিদ্রোহ করার অধিকার কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের আছে, শূদ্রের নেই। কিন্তু যদি ক্ষত্রিয়রা অস্ত্রশক্তির মাধ্যমে এই ব্যবস্থা ভাঙতে বিদ্রোহ করে, তবে তাঁদের দণ্ডিত করার জন্য মনু ব্রাহ্মণকে অস্ত্র ধারণ করার অনুমতি দিয়েছেন। বর্ণব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মনু তাঁর মৌলিক নীতিতেও পরিবর্তন করেছেন, অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে অস্ত্র হাতে নেওয়ার অনুমতিতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। মনু প্রণীত বর্ণব্যবস্থা থেকে ত্রিবর্ণই লাভবান, শূদ্র একেবারেই নয়। ত্রিবর্ণের মধ্যেও ব্রাহ্মণ সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। ড. আম্বেদকরের দৃষ্টিতে মনু পক্ষপাতদুষ্ট, তাই বৈষম্য সৃষ্টিকারী মনুস্মৃতির বিরোধিতা তিনি কেবল জরুরি নয়, বরং অনিবার্য মনে করতেন।

জয়পুরে স্থাপিত মনু মূর্তি বিষয়ক বিতর্ক

মনুস্মৃতি বিষয়ে আর্য সমাজ ও ড. আম্বেদকরের ভূমিকার এই সারসংক্ষেপের পর এবার এক নজর দেখা যাক জয়পুর উচ্চ আদালতে স্থাপিত সেই মনু মূর্তির দিকে, যার কারণে মনু, মনুস্মৃতি বা মনুবাদ প্রসঙ্গে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আরও প্রবল আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনার প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ —

২ মে ১৯৮৭-তে জয়পুর উচ্চ আদালতের নিকটবর্তী চত্বরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আর. ভেঙ্কটরমণ ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরের একটি মূর্তির উন্মোচন করেছিলেন। বলা হয়, যানবাহনের অসুবিধার অজুহাতে অনেকদিন এই মূর্তিকে যথাযথ স্থান দেওয়া হয়নি। এরপর প্রায় দুই বছর পরে জয়পুরের প্রথম শ্রেণির বিচারপতি পদ্মকুমার জৈন উচ্চ আদালতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মনুর একটি মূর্তি স্থাপনের লিখিত প্রস্তাব দেন প্রধান বিচারপতি নরেন্দ্র কাসলিওয়ালকে, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯-এ। তাঁর অনুমোদনসহ কংগ্রেসের মহাসচিব রাজকুমার কালা ও স্থানীয় লায়ন্স ক্লাবের সহযোগিতায় চার ফুট উচ্চ মূর্তি নির্মিত হয় এবং ২৮ জুন ১৯৮৯-এ আদালতের সামনে চত্বরে স্থাপন করা হয়।

সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তেই দলিত সমাজে প্রতিক্রিয়া হয়। তাঁরা বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তায় “মনু মূর্তি অপসারণ সংগ্রাম কমিটি” গঠন করেন, যা রামনাথ আর্যের নেতৃত্বে সক্রিয় হয়েছিল। ১০ জুলাই থেকে মূর্তি অপসারণ আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় নরেন্দ্র মোহন কাসলিওয়াল অবসর নেন এবং তাঁর স্থলে মিলাপচন্দ জৈন প্রধান বিচারপতি হন। ২৮ জুলাই যোধপুরে উচ্চ আদালতের ১৮ বিচারপতির এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, মনুকে কেন্দ্র করে কোনো বিতর্ক তৈরি হওয়া উচিত নয়, তাই মূর্তি সরিয়ে ফেলা হোক। তবে সরকার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগেই বজরং দলের ধর্মেন্দ্র মহারাজ ও সোমেন্দ্র শর্মা আদালতে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেন, যা বিচারপতি সরেশচন্দ্র আগরওয়াল মঞ্জুর করেন এবং পরে রায় দিতে গিয়ে বলেন — এই সমস্যার সমাধান প্রশাসনিকভাবে হওয়া উচিত। মনুর পেছনে ব্যাপক জনমানস ও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। এই মামলায় মনু মূর্তি রক্ষার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন অ্যাডভোকেট সি. কে. গর্গ এবং “মনু মূর্তি অপসারণ সংগ্রাম কমিটি”-র পক্ষে ছিলেন ভঁবর বাগড়ি। এই সময় প্রায় একশ’ আইনজীবী যৌথভাবে আবেদন করেন — “মনু মূর্তি অপসারণ মানবতার অপমান।”

এই প্রসঙ্গে আর্য সমাজ নয়া বাস, দিল্লির ধর্মপাল আর্য, ঝাঁঝর-হরিয়ানার অধ্যাপক ড. সুরেন্দ্রকুমার এবং অজমেরের পরোপকারিণী সভার যুগ্মমন্ত্রী অধ্যাপক ড. ধর্মবীর প্রমুখ মনু সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে রক্ষামূলক ভূমিকা নেন। মনু প্রতিষ্টা সংগ্রাম কমিটি দিল্লির আর্য সাহিত্য প্রচার ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত ও ড. সুরেন্দ্রকুমার রচিত গবেষণামূলক মনুস্মৃতি আদালতে পেশ করে মূর্তিকে অক্ষত রাখার স্থগিতাদেশ আদায় করে।

উক্ত ঘটনার ১৫ বছর পরে মনে হয়েছিল এই বিতর্ক স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ড. ভাবা আঢাভ মহাড় থেকে জয়পুর পর্যন্ত “মনু মূর্তি অপসারণ যাত্রা” শুরু করেন, যা ৯ জানুয়ারি ২০০০-এ মহাড় থেকে শুরু হয়ে ২৫ মার্চ জয়পুরে পৌঁছায়। জয়পুরের ড. আম্বেদকর চত্বরে অবস্থান ধর্মঘট করে তাঁরা স্লোগান দেন — “মনুবাদ মুছাও, মনু মূর্তি সরাও, আম্বেদকর মূর্তি বসাও।”

এদিকে শরদ পওয়ারের সহযোগিতায় মহারাষ্ট্র থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান পার্টির সাংসদ রামদাস আঠাওয়ালের নেতৃত্বে ৮ মার্চ ২০০০-এ একই দাবিতে আরেকটি যাত্রা শুরু হয়, যা রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীকে মনু মূর্তি অপসারণের দাবিতে স্মারকলিপি দেয়।

কোনো মূর্তি সরানো বা বসানোর পক্ষে নেতৃত্ব যত সহজে ও উৎসাহে ভিড় জড়ো করতে পারে, তত সহজে ও উৎসাহে সেই ভিড়কে শাস্ত্র অধ্যয়নের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। নিরপেক্ষ, দলনিরপেক্ষ, স্বার্থহীন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে জনগণকে সমস্যার অন্তর্নিহিত দিক বোঝানো হয় না। স্বার্থান্বেষী রাজনীতি প্রতিটি মূল প্রশ্নকে গৌণ আর প্রতিটি গৌণ সমস্যাকে মূল করে তুলেছে। হিন্দি সাহিত্যিক অজ্ঞেয়র ভাষায় — “আত্মার তেজ আমরা সহ্য করতে পারি না, অস্থির জন্য আমরা শুধু মঞ্জুষা বানাই।” (গদ্যের বিবিধ রঙ – পৃ. ১১৫৭, সম্পাদক দুধনাথ সিং)

ডঃ মদনমোহন জাভলিয়ার মতে- ‘ধর্মশাস্ত্রকার, বিধি প্রণেতা এবং বেদানুমোদিত স্মৃতি প্রদানকারী মহর্ষি মনুর ওপর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করা লোকেরা রাজনীতি, আম্বেদকরবাদী বৌদ্ধ মতবাদ এবং না-ই বা দলিতদের কোনো মঙ্গল করছে। মনুর মূর্তি সরানো এবং তার স্থানে আম্বেদকরের মূর্তি বসানোর দাবি একরোখা মনোভাব এবং অলোকতান্ত্রিকতার পরিচায়ক। ন্যায়ালয়ে মনুই বা কি রাম- কৃষ্ণ, শঙ্করাচার্য- বুদ্ধ, মহাবীর, আম্বেদকরেরও মূর্তি বসুক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দলিতদের নামে গঠিত দলসমূহ এবং রাজনৈতিক দলগুলো “দলিত ভোটব্যাঙ্ক” দখল করার লোভে সवর্ণ-হিন্দুদের অপমান করার এক কুচক্রী চক্রান্ত রচনা করেছে, যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্যবাদী এবং মুসলিম সংগঠনগুলোও যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক কৌশল রচনা করে সরল-দরিদ্র হিন্দু এবং তথাকথিত দলিতদের বিভ্রান্ত করার পথ ত্যাগ করে এই তথাকথিত দলিত নেতাদের উচিত হবে শুদ্ধ হৃদয় থেকে বিশুদ্ধ মনুস্মৃতির অধ্যয়ন করা। স্থান-স্থান মূর্তির স্তুপ রচনা করার চেয়ে সেই শক্তিকে শাস্ত্র অধ্যয়নের ধারায় প্রবাহিত করা অধিক জরুরি। রাজনীতির নামে অরাজকতা পূর্ণ নীতি থেকে পৃথক হওয়া অত্যাবশ্যক।’ (লেখা- রাজর্ষি মনু, মনুস্মৃতি এবং মনুর প্রতিমা: আর্যজগত- সাপ্তাহিক: ২১ মে ২০০০, পৃষ্ঠা-৫)।

মহারাষ্ট্রের মহাড় থেকে রাজস্থানের জয়পুর পর্যন্ত ১৬০০ কিলোমিটার দূরত্বের “মনু প্রতিমা সরাও যাত্রা” পরিচালনাকারী ডঃ বাবা আঢাও তাঁর ক্ষোভভরা সুরে এই প্রতিপ্রশ্ন উপস্থিত করেছেন যে- “নারী এবং শূদ্রাতিশূদ্রদের কাছে মনুস্মৃতি পাঠ করা সম্পর্কিত দুঃসাহসী প্রশ্ন আসলেই কিভাবে করা যায়?” (পুরোগামী সত্যশোধক: ত্রৈমাসিক- অক্টোবর থেকে মার্চ ২০০০ পর্যন্ত যৌথ সংখ্যা- পৃষ্ঠা ৪৫)। ডঃ আঢাওয়ের উক্ত মন্তব্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঠিক মনে হয় না। যখন মহাত্মা ফুলে এবং স্বামী দয়ানন্দের প্রচেষ্টায় অধ্যয়ন-অধ্যাপনের দরজা নারী এবং শূদ্রদের জন্যও খুলে গেছে, তখন পাঠন-পাঠনের ঐতিহ্যকে বর্তমানে কেনই বা উৎসাহিত করা হবে না? ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের অনুসারী হোন, কিংবা আর্যসমাজের অথবা অন্য কোনো সংগঠনের, সবারই উচিত হবে শাস্ত্র অধ্যয়নের ঐতিহ্যকে উৎসাহিত করা। তাহলেই মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিতর্কের স্থানে বিতর্ক-সংলাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। অন্তত যেসব বিষয়ে আমরা একমত, সেসব বিষয়ে তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রগতির পথে একসঙ্গে এগোনো যেতে পারে। এক আর এক দুই নয়, বরং এগারো হয়ে সমাজ সংস্কারের রথ এবং দলিতোদ্ধারের চক্রকে আরও গতিশীল করা সম্ভব হবে।

মতভেদ থাকা সত্ত্বেও যখন আমাদের প্রেরণাস্ত্র মহাত্মা ফুলে এবং স্বামী দয়ানন্দ পুনেতে একে অপরকে সহযোগিতা করতে দেখা যায়, যখন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ছিল, একে অপরকে বোঝার প্রস্তুতি ছিল, তখন আমাদের অনুসারীদের মধ্যেও সেই সহযোগিতার মনোভাব কেনই বা থাকবে না? স্বামী দয়ানন্দ ১৬ জুলাই ১৮৭৫ সালে মহাত্মা ফুলেজির জুনাংগ পেঠস্থিত শূদ্রাতিশূদ্রদের স্কুলে বেদোপদেশ দিচ্ছেন, আর মহাত্মা ফুলে বুধবার পেঠ এবং ছাওনিতে গিয়ে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতির প্রবন্ধ শুনছেন। ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫ সালে পুনেতে যখন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতির বিদায় উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছিল, তখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো কোনো বাধা না ঘটায়, সেইজন্য মহাত্মা ফুলে তাঁর আখড়ার তরুণ অনুসারীদের নিয়ে প্রাণ হাতে করে সেই শোভাযাত্রায় চলেছেন। এমনকি ডঃ আম্বেদকরও আর্যসমাজকে উদারপন্থার সুধা পান করানো প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানতেন। পুনেতে ডঃ আম্বেদকরের প্রেরণায় পরিচালিত “পার্বতী মন্দির প্রবেশ সত্যাগ্রহ”-এ আর্যসমাজের স্বামী যোগানন্দজি ১৩ অক্টোবর ১৯২৯ সালে রক্ষণশীলদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু আন্দোলন থেকে বিমুখ হননি (বহিষ্কৃত ভারত- সাপ্তাহিক, ১৯৫ নভেম্বর ১৯২৯, পৃষ্ঠা ১০)।

সুপ্রসিদ্ধ হিন্দি সাহিত্যিক আচার্য চতুরসেন শাস্ত্রী আর্যসমাজী সংস্কারে পালিত-পুষ্ট ছিলেন। তাঁর পিতাজি তাঁর সময়ে “নমস্তেজি” নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। চতুরসেন শাস্ত্রী ‘অম্বপালিকা’, ‘প্রবুদ্ধ’, ‘ভিক্ষুরাজ’ প্রভৃতি বৌদ্ধ গল্প রচনা করেছেন এবং গুপ্তযুগীয় ইতিহাস-রসে ভরা ‘বৈশালীর নাগরবধূ’র মতো বৌদ্ধ উপন্যাস লিখেছেন। কাশীর সুপরিচিত লেখক শ্রী শিবপ্রসাদ গুপ্ত ভগবান বুদ্ধের জীবনী ও উপদেশে সেই সময়ের বর্ণনা করেছেন, যখন এক পরিবারের মধ্যেই ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ একসাথে বাস করত (পৃষ্ঠা-৮)। মহাত্মা ফুলেজিও তাঁর ‘সার্বজনিক সত্যধর্ম’ গ্রন্থে এমন পরিবারের কল্পনা করেছেন, যেখানে এক পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের হলেও সৌহার্দ্য, সমন্বয় এবং ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে বসবাস করছে। ভদন্ত আনন্দ কৌশল্যায়ন একবার ভেবেছিলেন- ‘আর্যসমাজের নিরাকার ঈশ্বর এবং বুদ্ধকে পাশাপাশি রাখব’ (যার কাছে আমি কৃতজ্ঞ: রাহুল সঙ্কৃত্যায়ন- পৃষ্ঠা ১৬৪)। প্রফেসর রাজেন্দ্রজি জিজ্ঞানসু সমাজে ভ্রাতৃত্বের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে একবার লিখেছিলেন, ‘জটিল দার্শনিক বিষয়গুলিকে সমাধান করার কাজ আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রের বিদ্বান বাবাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। মূল উদ্দেশ্য তো যেকোনো পরিস্থিতিতে পারস্পরিক স্নেহ, শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা।’

আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতিও লিখেছিলেন- “যখন পর্যন্ত বাদী-প্রতিবাদী হয়ে প্রীতি সহকারে বিতর্ক বা রচনা না করা হয়, তখন পর্যন্ত সত্য-মিথ্যার সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যখন বিদ্বান লোকদের মধ্যেই সত্য-মিথ্যার সিদ্ধান্ত হয় না, তখন অজ্ঞ লোকদের মহা অন্ধকারে পড়ে প্রচুর দুঃখ ভোগ করতে হয়। তাই সত্যের জয় এবং অসত্যের ক্ষয়ের জন্য, বন্ধুত্ব সহকারে বিতর্ক বা রচনা করা আমাদের মানবজাতির মূল কাজ। যদি এমন না হয়, তাহলে মানুষের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়।” (সত্যার্থপ্রকাশ: সম্পাদক-যুধিষ্ঠির মীমাংসক: দ্বাদশ সমুল্লাস: পৃষ্ঠা ৬০৭-৮)।

এ ধরনের সংলাপ সৃষ্টির জন্য সামাজিক সৌহার্দ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তাই এই আশাই করা যায় যে সামাজিক সৌহার্দ্যকে আরও ব্যাপক করে তোলার জন্য সমাজ সংস্কার এবং প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী স্বামী দয়ানন্দ এবং ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের অনুসারীরা মিলেমিশে নিজেদের অবদান রাখবেন। তখনই শব্দ, বেদপ্রমাণ্যবাদ, বৈষম্যের বিবিধ রূপ, মনুস্মৃতি, পুনর্জন্ম, সংরক্ষণ, আস্থিকতা প্রভৃতি গভীর বিষয়ে সুশীল সংলাপ এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সম্ভব হবে।

“ক্ষেপকের দোষ মনুর মাথায় নয়”
পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায়

“আমরা আর্যসমাজের বাইরে দেখি যে মনুস্মৃতির প্রকাশ্যে অপমান করা হয়। মনুকে ঔষধি ভাবার পরিবর্তে মানুষ বিষ মনে করে। সমগ্র হিন্দু সমাজের দোষত্রুটির কারণ হিসেবে মনুকে গণ্য করা হয়। অনেক স্থানে মনুস্মৃতির কপিগুলো প্রকাশ্যে দাহ করা হয়েছে, যাতে মনুর প্রতি মানুষের মনে যে শ্রদ্ধাবোধ বিদ্যমান, তার সম্পূর্ণ নাশ হয়ে যায়। অনেকেই এই বিষয়েই নিজেদের গৌরব মনে করে যে মনুর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা যায়।

এর প্রধান কারণ হলো সেই বিষ, যা সময়ে সময়ে মনুস্মৃতিতে ক্ষেপক (অর্থাৎ পরবর্তীতে সংযোজিত অংশ) আকারে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যা মনুর উপদেশগুলোকে বিষাক্ত অন্নের ন্যায় বানিয়ে দিয়েছে। নারী ও শূদ্রদের পদদলিত হওয়ার কারণ মনুকেই মনে করা হয়েছে। জাতপাতের কু-প্রথার ভিত্তি মনুকেই ধরা হয়েছে। এভাবে মনুকে তুচ্ছজ্ঞান করার নানা কারণ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

যদিও প্রকৃত কথা হলো, যে অবিদ্যা ইত্যাদি ভ্রান্তিমূলক দোষত্রুটিগুলো হিন্দু জাতির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, সেগুলো হিন্দু সাহিত্য এবং মনুর ওপরও আক্রমণ করেছে। মনুস্মৃতির ক্ষেপকদের দোষ মনুর মাথায় নয়, বরং এগুলোর কারণ ছিল সেই অবৈদিক প্রবণতাগুলো, যাদের ছায়া মনুতেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।”

(সার্বদেশিক মাসিক : আগস্ট ১৯৪৭, পৃ. ২০৫৯–৬০)

মনু এবং মনুস্মৃতির উপর আক্ষেপ : এক চিন্তাভাবনা

ড. রামকৃষ্ণ আর্য (বরুণমুনি বানপ্রস্থী)

রাজর্ষি মনু বেদের পর সর্বপ্রথম ধর্মপ্রবক্তা, সমগ্র মানবজাতির পূর্বপুরুষ, রাজধর্ম ও বিধি (আইন)-এর প্রথম প্রণেতা ছিলেন। তাঁর রচিত ধর্মশাস্ত্রই বিশ্বের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্মশাস্ত্র, যা মনুস্মৃতি নামে পরিচিত। এই মনুস্মৃতিতে কোনো পক্ষপাত না রেখে মানবজাতিকে উন্নতির সমান সুযোগ প্রদানকারী এক উৎকৃষ্ট, বৈজ্ঞানিক ও অনন্য সামাজিক ব্যবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে বর্ণব্যবস্থা বলা হয়। এটি মানুষের গুণ, কর্ম ও স্বভাবের উপর ভিত্তি করে।

মনুর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি জন্মের ভিত্তিতে কাউকে উচ্চ বা নীচ মনে করেননি।


মনুস্মৃতির বর্তমান রূপ

স্বয়ম্ভূ মনুই মনুস্মৃতির প্রবক্তা। তাঁকে প্রবক্তা বলা হয়, কারণ মনুস্মৃতি মূলতঃ তাঁর প্রবচন, যা মনুর প্রাথমিক শিষ্যরা সংকলন করে এক সুসংহত শাস্ত্র বা গ্রন্থের রূপ দেন।

মনুস্মৃতিতে মোট ১২টি অধ্যায় ও ২৬৮৫টি শ্লোক আছে। প্রাচীন গ্রন্থসমূহসহ মনুস্মৃতির আজ যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে, তার অনুযায়ী মনুস্মৃতিতে ১২,১৫৪টি শ্লোক মৌলিক এবং ১৫,৪৭১টি শ্লোক প্রক্ষিপ্ত (অন্তর্ভুক্ত/অতিরিক্ত সংযোজিত) বলে প্রমাণিত হয়েছে।


ভারত ও বিদেশে মনুস্মৃতির মর্যাদা

বেদের পর যদি কোনো গ্রন্থ ভারত ও ভারতের বাইরে বিদেশেও সর্বত্র বিশেষ মর্যাদা লাভ করে থাকে, তবে সেটি মনুস্মৃতি। বিস্তারের ভয়ে আমরা তার বর্ণনা এখানে করতে পারছি না।

তবুও এমন এক বিশ্বখ্যাত আইনপ্রণেতা ও সমাজব্যবস্থার নির্মাতার উপর আজকাল, জানি না কোন স্বার্থবশত, নানাবিধ আক্ষেপ ও অভিযোগ আনা হচ্ছে—যা সত্যিই চিন্তার বিষয়।


মনু ও মনুস্মৃতির উপর আক্ষেপ

মনু ও মনুস্মৃতির বিরুদ্ধে প্রধানত তিন রকমের অভিযোগ আনা হয়েছে—

১. মনু জন্মভিত্তিক জাত-পাত ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন।
২. সেই ব্যবস্থায় মনু শূদ্র তথা দলিতদের জন্য অমানবিক ও পক্ষপাতপূর্ণ বিধান করেছিলেন, অথচ সাভর্ণদের, বিশেষত ব্রাহ্মণদের বিশেষাধিকার দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মনু ছিলেন শূদ্রবিরোধী।
৩. মনু নারীবিরোধী ছিলেন। তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেননি, বরং নারীজাতির ঘোর নিন্দা করেছেন।


আক্ষেপগুলির উপর বিশ্লেষণ

(ক) মনু কি জন্মভিত্তিক জাত-পাত ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন?

না। মনু জন্মভিত্তিক জাত-পাত ব্যবস্থা নয়, বরং গুণ-কর্ম-স্বভাব নির্ভর বর্ণব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন। এর মূল ভিত্তি Ṛgveda (১০/৯০/১২), Yajurveda (৩১/১১) ও Atharvaveda (১৯/৬/৫-৬)-এ পাওয়া যায়।

মনু বেদকে সর্বোচ্চ প্রমাণ মানতেন। এই বর্ণব্যবস্থা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র—এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত।

  • ব্রাহ্মণ : জ্ঞান দান ও গ্রহণে নিয়োজিত প্রধান ব্যক্তি ও তার সম্প্রদায়।

  • ক্ষত্রিয় : সমাজরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণকারী, বীরত্বগুণসম্পন্ন প্রধান ব্যক্তি ও তার সম্প্রদায়।

  • বৈশ্য : কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় ও বিতরণে নিয়োজিত প্রধান ব্যক্তি ও তার সম্প্রদায়।

  • শূদ্র : যিনি পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও শিক্ষাগ্রহণে অক্ষম থেকে কেবল শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে সমাজসেবা করেন, সেই প্রধান ব্যক্তি ও তার সম্প্রদায়।

(মনুস্মৃতি ১/৩১, ৮৭-৯১, ১০/৪৭)

মনু তাঁর গ্রন্থে জন্মভিত্তিক জাতি বা গোত্রের কোথাও উল্লেখ করেননি। বরং তিনি বলেছেন—যে ব্যক্তি ভোজনকালে বংশ বা গোত্র জিজ্ঞাসা করে বা জানায়, সে নিন্দনীয়। (মনুস্মৃতি ৩/১০৫)।


জাতি ব্যবস্থা বনাম বর্ণব্যবস্থা

জাতি-ব্যবস্থা জন্মভিত্তিক, যেখানে গুণ, কর্ম বা যোগ্যতার মূল্য নেই। উদাহরণস্বরূপ—

  • ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিলেই সে ব্রাহ্মণ, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ্যগুণ থাকুক বা না থাকুক।

  • শূদ্র পরিবারে জন্ম নিলেই সে শূদ্র, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ্যগুণ থাকলেও।

অতএব, মনু জন্মভিত্তিক জাতি-পাতের প্রচারক ছিলেন না।


(খ) মনু কি শূদ্রবিরোধী ছিলেন?

না। মনুস্মৃতিতে শূদ্রের যে অবস্থান বর্ণিত হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় মনু শূদ্রবিরোধী ছিলেন না।

  • মনু প্রতিটি মানুষকে সমান শিক্ষালাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি শিক্ষা গ্রহণ করে, সে দ্বিজ (বিদ্যার মাধ্যমে দ্বিতীয় জন্ম) হয়। কিন্তু সুযোগ পেয়েও শিক্ষা না নিলে সে শূদ্র থেকে যায়।

  • জন্ম থেকে সবাই শূদ্র। কিন্তু সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিজ হতে হয়। (স্কন্দপুরাণ)।

  • মনুর শূদ্র সংজ্ঞা আজকের সমাজে প্রচলিত শূদ্র বা দলিতদের সাথে মেলে না। (মনুস্মৃতি ১/৯০, ১০/৪, ৬০ ইত্যাদি)।

শূদ্র সম্পর্কে মনুর কিছু বিধান:
১. শূদ্র অস্পৃশ্য নয়—মনু শূদ্রকে “উত্তম”, “শুচি” ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন (মনুস্মৃতি ৯/৩৩০)।
২. শূদ্রকে সবার আগে ভোজন করানোর বিধান রয়েছে (মনুস্মৃতি ৩/১১৬, ৩/১৫২, ৯/৩৩৪-৩৩৫)।
৩. বয়োজ্যেষ্ঠ শূদ্রকে বিশেষ সম্মান দিতে বলা হয়েছে (২/১৩৭, ২/১৫২)।
৪. শূদ্রকে ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে (১০/১২৬)। এমনকি বলা হয়েছে, শূদ্র থেকে উত্তম ধর্মও গ্রহণ করা উচিত।
৫. শূদ্রকে ন্যূনতম দণ্ডের বিধান, আর রাজাকে সর্বাধিক দণ্ড—এমন ন্যায়সংগত ব্যবস্থা করা হয়েছে (৮/৩৩৫-৩৩৮, ৩৪৭)।
৬. শূদ্র দাস নয়—সেবকদের ন্যায্য মজুরি দেওয়ার নির্দেশ আছে (৭/১৫২, ১৫২৬, ২১৬)।
৭. চার বর্ণই সাভর্ণ। শূদ্রও সাভর্ণ (১০/৪, ৪৫)।
৮. কুশল কারিগরদের বৈশ্য ধরা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে সমাজ তাদের শূদ্র বলেছে (৩/৬৪, ৯/৩২০, ১০/৯৯, ১০/২০)।

অতএব, মনু শূদ্র বা দলিতের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বা বৈষম্যমূলক ছিলেন না।


মনু ও ড. বি. আর. আম্বেদকর

ড. আম্বেদকর মনুস্মৃতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং মনে করেছিলেন এটি জাতিভেদ ও শোষণের মূল। কারণ তিনি নিজ জীবনে জন্মভিত্তিক বৈষম্য, অপমান ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন।

তবে সত্য এই যে, তাঁর সময়ে মনুস্মৃতির বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা প্রক্ষিপ্ত-শ্লোক আলাদা করার কাজ হয়নি। তাই তিনি মৌলিক ও প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের মধ্যে ভেদ করতে পারেননি। তবুও তিনি গুণ-কর্ম-স্বভাব নির্ভর বর্ণব্যবস্থাকে স্বীকার করেছিলেন এবং মহর্ষি দয়ানন্দের ব্যাখ্যার প্রশংসা করেছিলেন।


(গ) মনু কি নারীবিরোধী ছিলেন?

না। মনুস্মৃতির স্বয়ং প্রমাণগুলো দেখায় যে মনু নারীবিরোধী ছিলেন না।

নারী সম্পর্কিত মনুর কিছু বিধান:

  • যে পরিবারে নারীর সম্মান হয়, সেখানে দেবগুণ ও সৌভাগ্য আসে। যেখানে হয় না, সেখানে সবই নিষ্ফল হয় (৩/৫৬)।

  • নারীকে গৃহের সৌভাগ্য, সম্মান, আলোক, লক্ষ্মী ও গৃহস্বামিনী বলা হয়েছে (৯/২৬, ৫/১০০)।

  • স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সন্তুষ্ট হলে তবেই কল্যাণ সম্ভব (৯/১০১-১০২)।

  • মনু কন্যা ও পুত্রের সমানাধিকার ঘোষণা করেছেন (৯/১৩০-১৩১, ৯/১৫)।

  • নারীর সম্পত্তি দখল করলে তাকে চোরের মতো দণ্ড দেওয়া হবে (৯/২১২, ৮/২৯)।

  • নারীর প্রতি অপরাধের কঠোর শাস্তির বিধান করেছেন (৮/৩২৩, ৯/২, ৮/২৭৫, ৯/৪)।

  • কন্যাদের উপযুক্ত স্বামী বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, বিধবার পুনর্বিবাহের অধিকার এবং পণনিষেধ (৯/৯০-৯১, ৩/৪, ৯/৮৯)।

  • নারীদের সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতীয় কাজে সমান অংশীদার করেছেন (৯/২৮, ৯/৯৬, ৩/২৮)।

  • বধূ, কুমারী, অসুস্থ, গর্ভবতী, বৃদ্ধা—এমন নারীদের আগে ভোজন করাতে বলেছেন (২/১৩৮, ৩/১১৪)।

মনু নারীকে অযাচিত স্বাধীনতা দেননি, তবে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুরুষের বলে উল্লেখ করেছেন (৫/১৪৯, ৯/৩)।


উপসংহার

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে মনু না শূদ্রবিরোধী, না নারীবিরোধী। বরং তিনি ন্যায়পরায়ণ ও পক্ষপাতহীন আইনপ্রণেতা ছিলেন।

মনুস্মৃতি সংক্রান্ত সংক্ষেপ

মনুর বৈদিক বর্ণ-ব্যবস্থার মূলনীতি হলো গুণ, কর্ম এবং যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে সমাজবিন্যাস। মনুর মৌলিক শ্লোকে এই প্রথার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু জন্মভিত্তিক জাতি-বিভাজন বা পক্ষপাতমূলক বিধানও কিছু শ্লোকে প্রক্ষিপ্ত। মনুর সময়ে জাতিগুলো তৈরি হয়নি, তাই তিনি জাতির সংখ্যা উল্লেখ করেননি। এজন্যই বর্ণ সংকর বা বর্ণসংক্রান্ত সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত শ্লোকগুলো প্রক্ষিপ্ত।

মনুর দণ্ড-ব্যবস্থা একটি সাধারণ আইন, যা মৌলিক এবং ন্যায়সংগত। তবে, কিছু শ্লোকে পক্ষপাতমূলক ও কঠোর দণ্ডের বিধানও প্রক্ষিপ্ত রয়েছে। বর্ণ-ব্যবস্থার অধীনে শূদ্র সম্পর্কিত কিছু শ্লোক এমনভাবে রয়েছে, যা জন্মভিত্তিক শূদ্র নির্ধারণ, স্পর্শব্যবধান, উচ্চ-নিম্ন অধিকার হরণ এবং শোষণকে অনুমোদন করে। নারীর সম্মান, সমতা, স্বাধীনতা ও শিক্ষার বিষয়ক শ্লোকগুলি মৌলিক, এবং পক্ষপাতমূলক শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।


উপসংহার

এটি সত্য যে সাধারণ মানুষ এবং অনেক পরম্পরাবাদী বিদ্বান, সন্ন্যাসী ও মহাত্মারা এখনও প্রক্ষিপ্ত শ্লোকসহ মনুস্মৃতিকে প্রামাণিক মনে করে জন্মভিত্তিক জাতিব্যবস্থাকে ঈশ্বর প্রদত্ত বলে গ্রহণ করেন। আজও তারা নারী ও শূদ্রকে সমঅধিকার দিতে রাজি নন।

কিন্তু আর্যসমাজ জন্মভিত্তিক জাতিপ্রথায় বিশ্বাস করে না এবং শুরু থেকেই দলিতদের প্রকৃত হিতৈষী। তারা প্রক্ষিপ্ত শ্লোকবিহীন মনুস্মৃতিকেই প্রামাণিক মনে করে এবং গুণ, কর্ম, যোগ্যতা ভিত্তিক বর্ণ-ব্যবস্থার সমর্থক। যদিও আজ বর্ণ-ব্যবস্থার পুনঃস্থাপনা অসম্ভব মনে হয়, কারণ জাতি-পাঁত থাকলে বর্ণ-ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে না, তবুও জাতি-পাঁত ভেঙে জাতিহীন সমাজ হওয়া উচিত। এতে আর কেউ অসমতা বা স্পর্শব্যবধানের যন্ত্রণা ভোগ করবে না, যা আমাদের দেশের আধুনিক সংবিধানপ্রণেতা, ডঃ অম্বেডকর এবং তথাকথিত শূদ্র ও দলিতরা ভোগ করেছিলেন।

শেষে আমাদের আবেদন হলো, প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের ভিত্তিতে মনু ও মনুস্মৃতিকে ভুলভাবে অভিযুক্ত করা অনুচিত। প্রাচীন এবং বিশুদ্ধ মনুস্মৃতির অধ্যয়ন করলে বোঝা যাবে যে মনু জন্মভিত্তিক জাতি-প্রথার জন্য নয়, বরং মানবতাবাদী ছিলেন। মনু ও মনুস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ হওয়া উচিত, কারণ আমরা সকলেই মানবতাবাদী।


ভ্যাটিক সমাজবাদ

  • মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী

“পাঠশালায় সবাইকে সমান বস্ত্র, খাদ্য, আসন দেওয়া উচিত।
হোক সে রাজকুমার বা রাজকুমারী, দরিদ্রের সন্তান হোক, সবাইকে সমানভাবে শিক্ষা ও সুবিধা দেওয়া উচিত।”
— সত্যার্পপ্রকাশ প্রকাশক, শ্রী ঘুডমল প্রহলাদকুমার আর্য ধর্মার্থ ন্যাস, হিণ্ডাউন সিটি (রাজ.), পিন-৩২১২৩০, সংস্করণ ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮

“মাতা, পিতা, আচার্য, অতিথি, পুত্র, ভৃত্য প্রভৃতি সবাইকে খাবার খাওয়ানোর পর গৃহস্থকেও খাওয়ানো উচিত।”
— পঞ্চমহাযজ্ঞবিধি প্রকাশক, রামলাল কাপুর ট্রাস্ট, আনারকালী, লাহোর, সংস্করণ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৫৪

Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

মুহাম্মদের স্ত্রী ও সন্তান

📊 নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিবাহ, স্ত্রীরা ও সন্তান (সহজ চার্ট আকারে) ক্র. স্ত্রীর নাম (রা.) বিবাহের সময় নবীজি (সা.)-এর বয়স স্ত্রীর বয়স ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ