ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

18 December, 2025

অথর্ববেদ ১৯/৫৩/৭

18 December 0

অথর্ববেদ ১৯/৫৩/৭


কালমহিমোপদেশঃ

কালে মনঃ কালে প্রাণঃ কালে নাম সমাহিতম্।

কালেন সর্বানন্দন্ত্যাগতেন প্রজা ইমাঃ।। (অথর্ববেদ ১৯।৫৩।৭)

পদার্থঃ (কালে) কালের মধ্যে (মনঃ) মননশক্তি, (কালে) কালের মধ্যে (প্রাণঃ) প্রাণশক্তি, এবং (কালে) কালের মধ্যে (নাম) নাম (সমাহিতম্) সমাহিত। (আগতেন কালেন) আগত কাল দ্বারা   (ইমাঃ)  এই (সর্বাঃ)  সকল (প্রজাঃ) প্রজা (নন্দন্তি) প্রসন্ন তথা সমৃদ্ধ হয়। (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

টিপ্পণীঃ [মনঃ= সৃষ্টিরচনার জন্য পরমেশ্বরনিষ্ঠ মনন। প্রাণঃ=প্রাণবায়ুর উৎপত্তি। নাম=বৈদিক শব্দাবলি, অর্থাৎ বেদের১ আবির্ভাব। অথবা—শিশুর উৎপত্তির নিশ্চিত কালেই তাঁর মধ্যে মননশক্তি, গর্ভাবস্থায় প্রাণশক্তি, তথা নিশ্চিত কালেই তাঁর নামকরণ হয়। নন্দন্তি=আগত শুভ অবসরে প্রজা প্রসন্ন তথা সমৃদ্ধ হয়।] [১. ঋগ্বেদে বেদকে "নামধেয়ম" বলা হয়েছে। নামদেয় এবং নাম— একার্থক। যথা— বৃহস্পতে প্রথমং অগ্রং যৎপ্রৈরত নামধেয়ং দধানাঃ" (১০.৭১.১)]

১. কাল নামক সেই প্রভুর মধ্যেই (মনঃ) = সমস্ত প্রাণীর মন (সমাহিতম্) = আশ্রিত ও প্রতিষ্ঠিত। সেই কাল-প্রভুর মধ্যেই (প্রাণঃ) = পঞ্চবৃত্তিক প্রাণসমূহ সমাহিত রয়েছে। আবার (কালে) = সেই কাল-প্রভুর মধ্যেই (নাম) = সমস্ত সংজ্ঞা ও নাম (সমাহিতম্) = নিহিত। সমস্ত বস্তুর রূপ নির্মাণ করে তাদের নামের ব্যবহারও সেই প্রভুই নির্ধারণ করেন। (হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার)

২. (আগতেন) = আগত, অর্থাৎ বসন্ত প্রভৃতি রূপে উপস্থিত হওয়া কাল থেকেই (ইমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ) = এই সমস্ত প্রজাগণ (নন্দন্তি) = নিজ নিজ কর্মের সিদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয় এবং আনন্দ অনুভব করে।

ভবার্থঃ কালের উত্তম প্রয়োগ দ্বারা মন এবং প্রাণ অর্থাৎ সব ইন্দ্রিয়-সমূহের স্বাস্থ্য এবং যশ বৃদ্ধি পায়/হয়, তবেই সব প্রাণী সুখ প্রাপ্ত হয় ॥ (ক্ষেমকরণ ত্রিবেদী)

এখন "ওম্" -এর বিষয়ে উপনিষদে দেখুন -

বাগেবর্ক প্রাণঃ সামোমিত্যেতদক্ষর মুদ্গীথঃ।
তদ্বা এতন্মিথুনম্ য়দ্ বাক্ চ প্রাণশ্চর্ক চ সাম চ।।৫।।

তদেতন্মিথুনমোমিত্যেতস্মিন্নক্ষরে সꣳসৃজ্যতে য়দা বৈ মিথুনৌ সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্।।৬।। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ১।১।৫-৬)

এই দুটো প্রমাণ থেকে "কাল" ও "ওম্" -এর সম্বন্ধ প্রকট হয়। বেদে লেখা আছে কালের মধ্যে মন, প্রাণ ও নাম অর্থাৎ ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে কিংবা কাল তত্ত্বের মধ্যেই সেগুলো আশ্রিত আর এইসব থেকে নানা প্রজা অর্থাৎ পদার্থের প্রসন্ন, তৃপ্ত বা উৎপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে উপনিষদও ছন্দ আর প্রাণ রশ্মির মিথুনকে উদ্গীথ=ওম্ এরমধ্যেই আশ্রিত এবং সেখান থেকেই নানা মিথুন বানিয়ে পরস্পর তৃপ্ত হতে কিংবা নানা পদার্থকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হওয়ার কথা লেখা আছে।

দুটো প্রমাণ থেকেই কাল তত্ত্ব এবং "ওম্" তত্ত্বের সম্বন্ধ প্রকট হয়ে আমার কাল সম্বন্ধীয় ধারণাকে পুষ্ট করছে। এইভাবে কাল তত্ত্ব হল সেই পদার্থ, যার মধ্যে মহত্, অহংকার থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত, আশ্রিত এবং তার দ্বারাই সঞ্চালিত হয়। এরই সংকেত বেদ করেছে -

का॒लो भू॒तिम॑सृजत का॒ले तप॑ति॒ सूर्यः॑। का॒ले ह॒ विश्वा॑ भू॒तानि॑ का॒ले चक्षु॒र्वि प॑श्यति ॥

কালো ভূতিমসৃজত কালে তপতি সূর্য়ঃ।
কালে হ বিশ্বা ভূতানি কালে চক্ষুর্বি পশ্যতি।। অথর্ব০ ১৯।৫৩।৬।।

পদার্থভাষ্যঃ (কালঃ) কাল (ভূতিম্) জগতের সত্তা, সমৃদ্ধি, ধন, এবং যোগজন্য বিভূতি-সমূহ   (অসৃজত)  সৃষ্টি করেছে। (কালে) গ্রীষ্মকালে (সূর্যঃ তপতি) সূর্য তপ্ত হয়। (কালে হ) কালের মধ্যেই (বিশ্বা ভূতানি) সব ভূতভৌতিক জগৎ স্থিত। (কালে) কালের মধ্যেই (চক্ষুঃ) চক্ষু (বি পশ্যতি)  বিবিধ জগত দেখে। [স্বপ্নকালে দেখে না, জাগরিত কালে দেখে।] (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

ভাবার্থঃ কাল প্রাপ্ত করে সব ঐশ্বর্য, প্রকাশ এবং পদার্থ উৎপন্ন হয় ॥ (ক্ষেমকরণ ত্রিবেদী)


তেনেষিতং তেন জাতম্ তদু তস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতম্।
কালো হ ব্রহ্ম ভূত্বা বিভর্তি পরমেষ্ঠিনম্।। (অথর্ববেদ ১৯।৫৩।৯)

পদার্থঃ (তেন) সেই কাল দ্বারা (ইষিতম্) প্রেরিত, (তেন) সেই কাল দ্বারা (জাতম্) উৎপন্ন (তৎ) সেই জগৎ (তস্মিন্) সেই কালের মধ্যে (উ) নিশ্চিতরূপে (প্রতিষ্ঠিতম্) স্থিত। (কালঃ হ) কালই মানো (ব্রহ্ম ভূত্বা) ব্রহ্মরূপ হয়ে (পরমেষ্ঠিনম্) পরম স্থান অর্থাৎ দ্যুলোকে স্থিত নক্ষত্রাদিরও (বিভর্তি) ধারণ পোষণ করে। (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

১. (তেন) = সেই কাল থেকেই (ইষিতম্) = সমগ্র সৃষ্টিযোগ্য জগৎ ইচ্ছিত হয় [ইষ্ট–কামিত], যেমন— “সো অকাময়ত্”। (তেন জাতম্) = সেই কাল নামক প্রভু থেকেই এই জগতের উৎপত্তি হয়েছে, (উ) = এবং (তৎ) = সেই উৎপন্ন জগৎ (তস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতম্) = সেই কালেই প্রতিষ্ঠিত ও অধিষ্ঠিত রয়েছে।

২. (কালঃ) = কালই (ব্রহ্ম ভূত্বা) = সঞ্চিত সুখরূপ, অবাধ ও পরমার্থ তত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে (পরমেষ্ঠিনম্) = সর্বোচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ব্রহ্মাকে (বিভর্তি) = ধারণ করেন। কর্মানুসারে যিনি সর্বোচ্চ, উত্তম সাত্ত্বিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত জীব, তিনিই ব্রহ্মা—এবং সেই ব্রহ্মাও এই কাল নামক প্রভুর দ্বারাই ধারণপ্রাপ্ত। (হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার)

কালেন বাতঃ পবতে কালেন পৃথিবী মহী।
দ্যৌর্মহী কাল আহিতা।। অথর্ব০ ১৯।৫৪।২।।

পদার্থঃ (কালেন) সময়ে (বাতঃ) বায়ুঃ (পবতে) প্রবাহিত হয়।(কালেন)  সময়ে (পৃথিবী) পৃথিবী (মহী)  মহাপরিমাণযুক্ত হয়েছে। (মহী) মহাপরিমাণযুক্ত (দ্যৌঃ) দ্যুলোক (কালে) সময়ে (আহিতা) স্থাপিত হয়েছে। [আকাশে]। (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

ভাবার্থ (ক্ষেমকরণ ত্রিবেদী) সময়ের কারণে বায়ু, পৃথিবী, আকাশাদির পরমাণু সংযোগ প্রাপ্ত করে সাকার হয়ে সংসারের উপকার করে ॥

টিপ্পণীঃ [বাতঃ পবতে=কখনও পূর্বী বায়ু প্রবাহিত হয়, কখনও মৌসুমী বায়ু, কখনও গ্রীষ্ম ঋতুর ঝঞ্ঝাবাত ইত্যাদি। মহী=পৃথিবী একসময় আগ্নেয়রূপ ছিল, পরে দ্রবরূপ/তরল হয়েছে, এখন “দৃঢা” হয়ে মহাপরিমাণযুক্ত দর্শিত হয়। “যেন দ্যৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢা” (যজুঃ০ ৩২.৬)। দ্যুলোক এখনও পর্যন্ত উগ্র অর্থাৎ আগ্নেয়রূপ।]

का॒लो ह॑ भू॒तं भव्यं॑ च पु॒त्रो अ॑जनयत्पु॒रा। का॒लादृचः॒ सम॑भव॒न्यजुः॑ का॒लाद॑जायत ॥

কালো হ ভূতম্ ভব্যম্ চ পুত্রো অজনয়ত্ পুরা।
কালাদৃচঃ সমভবন্ য়জুঃ কালাদ জায়ত।। (অথর্ববেদ ১৯।৫৪।৩)

পদার্থভাষ্যঃ (পুত্রঃ) পুত্ররূপ (কালঃ হ) কাল নিশ্চিতরূপে (ভূতম্ ভব্যম্ চ) ভূত এবং ভবিষ্যৎ (পুরা)  পূর্বেও (অজনয়ৎ) উৎপন্ন করেছে। (কালাৎ) কাল দ্বারা (ঋচঃ) বেদের ছন্দোময়ী রচনা (সমভবৎ) প্রকট হয়েছে। (যজুঃ) এবং বেদের গদ্যময়ী রচনা (কালাৎ) কাল দ্বারা (অজায়ত) উৎপন্ন হয়েছে।

টিপ্পণীঃ [পুত্রঃ= ইহার দ্বারা প্রতীত হয়, কালেরও কোনো পিতা আছে, যার পুত্র হল কাল। সেই পিতা পরমেশ্বরই। অথবা— দেখো মন্ত্র (১৯.৫৩.৪)। পরমেশ্বর দ্বারা কাল উৎপন্ন হয়েছে, এবং অন্য সৃষ্টি কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে। ভূতং ভব্য পুরা=সৃষ্টির আরম্ভ থেকেই “ভূত এবং ভব্য” এর স্থিতি চলমান, যা ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে। অথর্ব০ ১৯.৫৩.৪ এ কালের পিতৃত্ব এবং পুত্রত্ব দার্শনিক দৃষ্টিতে হয়েছে, এবং ১৯.৫৪.৩ এ কালের পুত্রত্ব বাস্তবিক।] (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

ক্ষেমকরণ ত্রিবেদীকৃত পদার্থভাষ্যঃ (কালঃ)  কালরূপী (পুত্রঃ)  পুত্র (হ) ই (ভূতম্) ভূত (চ) এবং  (ভব্যম্) ভবিষ্যত/ভবিতব্য (পুরা) পূর্বে/সৃষ্টির প্রারম্ভে (অজনয়ৎ) উৎপন্ন করেছে। (কালাৎ) কাল থেকে/দ্বারা (ঋচঃ) ঋচা-সমূহ [গুণপ্রকাশক বিদ্যা] (সম্ অভবন্) উৎপন্ন হয়েছে, (কালাৎ) কাল থেকে (যজুঃ)  যজুর্বেদ [সৎকর্মের জ্ঞান] (অজায়ত) উৎপন্ন হয়েছে ॥

ভাবার্থঃ নিত্য বর্তমান কাল পিতার সমান পূর্বে এবং পুত্রের সমান আগামীতেও বিদ্যমান থাকে-[দেখো গত সূক্ত মন্ত্র ৪]। কালের প্রভাবে সব আগে-পরের সৃষ্টি এবং বেদের প্রাদুর্ভাব হয় ॥

অর্থাৎ কালই সব প্রকার পদার্থের সত্তা, সেগুলোর সমৃদ্ধি আর ঐশ্বর্যের কারণ হয়। যেকোনো পদার্থের উৎপত্তি "ওম্" রশ্মি ছাড়া সম্ভব নয়। উৎপত্তি হয়ে যাওয়ার পশ্চাৎ সেগুলোর স্থিতিও "ওম্" রশ্মিকে ছাড়া সম্ভব নয়। এইসব বস্তুর নানা প্রকারের ক্রিয়া ও বলে বৃদ্ধি আর পরস্পর একে-অপরের প্রতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাতে বৃদ্ধিও এই কাল রশ্মি ছাড়া সম্ভব নয়। কালের কারণেই সূর্য তপ্ত হচ্ছে আর কালের কারণেই তার উৎপত্তি হয়েছে। সব প্রকারের উৎপন্ন পদার্থ, সেটা প্রাণী হোক, বনস্পতি হোক অথবা জড় পদার্থ হোক, সর্বদা "ওম্" রশ্মির মধ্যেই নিবাস করে। যতদূর এই ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব আছে, সেখানে সর্বত্র কালেরও অস্তিত্ব আছে আর যেখানে ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব নেই, সেখানেও কালের অস্তিত্ব আছে। কালের মধ্যেই আমাদের নেত্র দেখে অর্থাৎ নেত্রের দ্বারা হওয়া দর্শন ক্রিয়াও কালের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রকাশের গমন এবং প্রতিফলন আদি ক্রিয়ার মধ্যে "ওম্" রশ্মির অন্তিম এবং অনিবার্য ভূমিকা আছে।

সমস্ত উৎপন্ন পদার্থ, সেটা যেমনই গতি করুক না কেন, তার পিছনে কালতত্ত্বেরই প্রেরণা আছে। এমনকি যখন সেগুলো গতি করে, তখনও সেগুলো কালের সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই কাল অর্থাৎ "ওম্" রশ্মিই পরমেষ্টী অর্থাৎ দ্যুলোকের ধারণ আর পোষণ করে। এইভাবে এই কাল পরব্রহ্ম পরমাত্মার সমান মহান্ আর ব্যাপক হয়। কালের দ্বারাই বায়ু নিরন্তর গতি করে আর এই "ওম্" রশ্মির দ্বারাই বায়ুর শোধন হয়। কালের দ্বারাই পৃথিবীর উৎপত্তি আর বিস্তার হয়। কালই বিশাল দ্যুলোককে সবদিক থেকে ধারণ করে রেখেছে। ঈশ্বরের পুত্র কাল অর্থাৎ ঈশ্বর থেকে উৎপন্ন "ওম্" রশ্মিই ভূত, ভবিষ্যত আর বর্তমানকে উৎপন্ন করে। কালতত্ত্ব থেকেই ঋক্ এবং য়জুঃ রশ্মি উৎপন্ন হয় অর্থাৎ সমস্ত বেদমন্ত্র কালের দ্বারাই উৎপন্ন হয়।

সারসংক্ষেপ হল, এই সৃষ্টির মধ্যে সূক্ষ্মতম থেকে শুরু করে স্থূলতম পদার্থ পর্যন্ত সব পদার্থ কাল দ্বারাই উৎপন্ন এবং কাল দ্বারাই প্রেরিত হয়। এই কাল হল পরমেশ্বরের পুত্র রূপ। এরদ্বারা "ওম্" রশ্মির সঙ্গে কালের সম্বন্ধও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহর্ষি কণাদ "কারণেন কালঃ" (বৈশেষিক দর্শন ৫।২।২৬) এবং "কারণে কালঃ (বৈশেষিক দর্শন ৭।১।২৫) দ্বারা সংকেত করেছেন যে কারণ রূপ প্রকৃতি ও "ওম্" রশ্মির দ্বারাই কাল প্রকট হয় তথা এই কারণ রূপ প্রকৃতি ও ঈশ্বরের মধ্যেই উপস্থিত থাকে। আচার্য প্রশস্তপাদ লিখেছেন -
"কারণে কাল ইতি বচনাৎ পরম মহত্পরিমাণম্" অর্থাৎ সেই কাল ঈশ্বর ও প্রকৃতির সমান পরম মহত্ পরিমাণ যুক্ত হয়। (অগ্নিব্রতজীর ব্যাখ্যা হতে উদ্ধৃত)

কালের স্বরূপের বিষয়ে অথর্ববেদের পূর্বোক্ত মন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান নিম্নলিখিত পদের উপর বিচার করবো -

১. সহস্রাক্ষ - অনেক অক্ষর রূপ অবয়ব যার আধার হয়, কিংবা এগুলোর উপর "ওম্" রশ্মির পরারূপ গমন করে। মূল প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে সব অক্ষর রশ্মিরূপে প্রকট হতে পারে না কিংবা অব্যক্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। পরারূপ "ওম্" রশ্মি এই সব অক্ষরের উপর ব্যাপ্ত হয়ে গমন করতে-করতে সেগুলোকে নানা পদরূপ রশ্মির রূপে প্রকট করে। এই "ওম্" রশ্মিই হল কালরূপ, যেটা মূল প্রকৃতির সাথে মিশ্রিত থাকে।

২. সপ্তরশ্মি - "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ", "মহঃ", "জনঃ", "তপঃ", "সত্যম্", এই সাত প্রকারের সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মি সর্বপ্রথম এই কালরূপ "ওম্" রশ্মি থেকেই উৎপন্ন বা প্রকট হয়। এই পরারূপ "ওম্" রশ্মি কোনো ছন্দ রশ্মির উপাদান কারণ হয় না, বরং নিমিত্ত কারণ হয়, সেটা ত্রিগুণা প্রকৃতি তথা মনস্ তত্ত্বাদিকে প্রেরিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। আমার মতে পরারূপ "ওম্" রশ্মি কালরূপ হয়ে সত্ত্ব রজস্ এই দুই গুণের মধ্যে রমণ করে প্রকৃতির তিন গুণকে প্রকট করে মহত্ এবং মনস্ তত্ত্বাদিকে উৎপন্ন করে। এর অর্থ হল কাল তত্ত্বই মহত্ আদিকে উৎপন্ন করে। এর পশ্চাৎ কাল তত্ত্ব মনস্তত্ত্ব আদিকে প্রেরিত করে ভূরাদি সাত ব্যাহৃতি রূপ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। এই সাত রশ্মির দ্বারাই কাল তত্ত্ব অগ্রিম রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে। এই কারণে কালকে "সপ্তরশ্মি" বলা হয়েছে অর্থাৎ যারদ্বারা ভূরাদি সাত রশ্মি উৎপন্ন হয় কিংবা যেটা ভূরাদি সাত রশ্মিকে সাধন রূপে ব্যবহার করে, সেই কাল তত্ত্বকে সপ্তরশ্মি বলে। এই পদের মধ্যে "সপ্ত" সংখ্যাবাচী পদের একটা বিশিষ্ট গুরুত্ব আছে। মহর্ষি য়াস্কের কথন হল - "সপ্ত সৃপ্তা সংখ্যা" (নিরুক্ত ৪.২৬)। এর দ্বারা সংকেত পাওয়া যায় যে কাল থেকে উৎপন্ন সাত রশ্মি কিংবা কালের সাধন রূপ ভূরাদি রশ্মি পরাবস্থা রূপ হয়ে ছড়িয়ে থাকার মতো হয়। এখানে এমন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে যে এই রশ্মিগুলো অগ্রিম উৎপন্ন পশ্যন্তী রূপ ভূরাদি অন্য রশ্মির তুলনায় অধিক ছড়িয়ে একরসবৎ থাকে। এমন সেই রশ্মির সঙ্গে কাল রশ্মির সাক্ষাৎ সম্বন্ধ আছে।

৩. অশ্ব - এই পদ স্পষ্ট করে যে কালরূপ পরা "ওম্" রশ্মি তীব্রগামিনী তথা একরসবৎ সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। এখানে এই প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে যে যখন কাল রশ্মি অর্থাৎ পরারূপ "ওম্" রশ্মি একরসবৎ ব্যাপ্ত থাকে, তাহলে সেগুলো কিভাবে গতিশীল হতে পারে? গতি তো একদেশী পদার্থের মধ্যেই হতে পারে, ব্যাপক পদার্থের মধ্যে হতে পারে না, তাহলে কালকে আশুগামী কেন বলা হয়েছে? এই বিষয়ে আমার মত হল - ঈশ্বর তত্ত্ব থেকে প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে পরারূপ "ওম্" রশ্মি, যেটা কালরূপ হয়, সেটা অতিতীব্র বেগে ক্রমাগত সর্বত্র প্রকট হতে থাকে, এই কারণেই কালকে অশ্ব বলা হয়েছে। এই পদার্থও মূল প্রকৃতিবৎ প্রায় অব্যক্তই থাকে।

৪. অজর - পরারূপ "ওম্" রশ্মি সহিত প্রকৃতি পদার্থ, যাকে কাল তত্ত্ব বলে, সেটা কখনও জীর্ণ হয় না। প্রলয়াবস্থাতেও প্রকৃতিকে প্রেরিত না করে অব্যক্ত রূপে এই তত্ত্ব যথাযথ ভাবে বিদ্যমান থাকে।

৫. ভূরিরেতা - এই কাল তত্ত্বই অনেক প্রকারের পদার্থ ও কর্মের বীজরূপ হয়। সৃষ্টির সব দ্রব্য, বল, কর্ম, গুণ আদির বীজ এই তত্ত্বই হয়, যেটা সবার মূল ঈশ্বর তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

৬. সপ্তচক্র ও সপ্তনাভি - প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান, ধনঞ্জয় ও সূত্রাত্মা বায়ুর সপ্তক কিংবা সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মির চক্রকে এই কাল তত্ত্বই উৎপন্ন এবং বহন করে। এই সাত চক্রকে চালানোর জন্য ঈশ্বর তত্ত্ব ভূরাদি সাত ছন্দ রশ্মিকে নাভি অর্থাৎ কেন্দ্ররূপে প্রযুক্ত করেন। এই কারণে কালের সাতটা নাভি বলা হয়েছে। এই নাভিরূপ রশ্মিই সেই প্রাণাদি সাত রশ্মিকে এক রশ্মি রূপে বেঁধে রেখে গতি প্রদান করে কিংবা সেগুলোকে পরমাত্ম তত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে রাখে।

"কাল" পদের ব্যুৎপত্তি করে আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোষের মধ্যে বলেছেন - "কু ঈষত্ কৃষ্ণত্বম্ লাতি লা+ক, কোঃ কাদেশঃ"। যদিও আপ্টে এখানে "কালঃ" শব্দের অর্থ "কালা" গ্রহণ করেছেন তথা এতদর্থ কৃষ্ণের অর্থ কালাই মেনেছেন, কিন্তু আমরা এখানে "কৃষ্ণত্বম্" থেকে আকর্ষণ বলশীততা গ্রহণ করে অতি সূক্ষ্ম আকর্ষণ বল কিংবা বল ও গতির প্রারম্ভ যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের পূর্বোক্ত অবস্থার নামই কাল গ্রহণ করবো। এই কাল তত্ত্বই সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তার দ্বারা উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে প্রারম্ভিক বল সর্বদা উৎপন্ন করতে থাকে। বাকি মাস বা প্রাণাপানাদি রশ্মি কালের মাপক হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ত্রিগুণা প্রকৃতির বিকার মহত্ বা মনস্তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়। এই পদার্থই এই রশ্মিগুলোর উপাদান কারণ তথা কাল ও ঈশ্বর তত্ত্ব নিমিত্ত কারণ হয়। এই রশ্মিগুলোর মধ্যে তমোগুণের মাত্রা অন্য রশ্মির তুলনায় নিম্ন হয়। এই বিষয়ে পরে বিস্তার ভাবে লেখা হবে। এখন আমি প্রাণতত্ত্বের সম্বন্ধে প্রাণ সূক্তের কিছু মন্ত্রকে উদ্ধৃত করবো -

প্রাণায় নমো য়স্য সর্বমিদম্ বশে।
য়ো ভূতঃ সর্বস্যেশ্বরো য়স্মিন্ত্সর্বম্ প্রতিষ্ঠিতম্।।১।।

প্রাণঃ প্রজা অনু বস্তে পিতা পুত্রমিব প্রিয়ম্।
প্রাণো হ সর্বস্যেশ্বরো য়চ্চ প্রাণতি য়চ্চ ন।।১০।।

প্রাণো বিরাট্ প্রাণো দেষ্ট্রী প্রাণম্ সর্ব উপাসতে।
প্রাণো হ সূর্যশ্চন্দ্রমাঃ প্রাণমাহুঃ প্রজাপতিম্।।১২।।

প্রাণমাহুর্মাতরিশ্বানম্ বাতো হ প্রাণ উচ্যতে।
প্রাণে হ ভূতম্ ভব্যম্ চ প্রাণে সর্বম্ প্রতিষ্ঠিতম্।।১৫।। (অথর্ববেদ ১১.৪)

এখানে প্রাণ তত্ত্বকে সব উৎপন্ন পদার্থকে নিয়ন্ত্রিত ও ধারণকারী, সেগুলোকে ক্রমাগত আচ্ছাদনকারী, সূর্য, চন্দ্র আদি লোক এবং প্রজাপতি অর্থাৎ বাক্ এবং মনস্তত্ত্ব কিংবা নানা সংযোগাদি ক্রিয়ার, অন্তরীক্ষে শয়নকারী বায়ু তত্ত্ব এবং ভূত, ভবিষ্যৎ আদি কালে উৎপন্ন বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে।
এখানে প্রাণতত্ত্বের স্বরূপ পূর্বোক্ত কালতত্ত্বের স্বরূপের সঙ্গে প্রায় সাধারণত মিলে যায়। এই কারণে অহোরাত্র রূপ প্রাণাপানোদান রশ্মিও কাল তত্ত্বেরই রূপ হয় কিংবা তার একটা মাপক পরিমাণ বিশেষ হয়। একইভাবে মাস, ঋতু আদিকেও জানা যেতে পারে, কারণ এইসব প্রাণ রশ্মিরই রূপ হয়। 

Read More

ঋগ্বেদ ১০/৭১/৩

18 December 0

ঋগ্বেদ ১০/৭১/৩
আধিভৌতিক ভাষ্য- 

য়জ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্।

তামাভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাম্ সপ্তরেভা অভি সম্ নবন্তে।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.৩)

.
(য়জ্ঞেন) [য়জ্ঞঃ = ব্রহ্ম হি য়জ্ঞঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৫.৩.২.৪), য়জ্ঞঃ প্রজাপতিঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১১.৬.৩.৯)] সেই ধীর বিদ্বানজন, যাঁদের চর্চা পূর্ব মন্ত্রের মধ্যে করা হয়েছে, সবার পালক পরব্রহ্ম পরমাত্মার সাক্ষাৎকার দ্বারা অর্থাৎ তাঁর সহায়তায় (বাচঃ, পদবীয়ম্) সেই বেদবাণীর বিভিন্ন পদের মার্গ আর অনুক্রমকে (আয়ন্) জানেন বা প্রাপ্ত করেন ( ঋষিষু, প্রবিষ্টাম্) আকাশস্থ সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে প্রবেশ হওয়া (তাম্, অনু, অবিন্দন্) সেই বেদবাণীকে অনুক্রমপূর্বক প্রাপ্ত করেন। (তাম্, আভৃত্য) সেই প্রাপ্ত হওয়া বেদবাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করে (পুরুত্রা, ব্যদধুঃ) সর্বত্র প্রচারিত করেন। (তাম্, সপ্তরেভাঃ) [রেভঃ = স্তোতৃনাম (নিঘন্টু ৩.১৬)] সেই বেদবাণীর মধ্যে সাত প্রকারের ছন্দ (অভি, সম্নবন্তে) [সম্নবন্তে = নবতে, গতিকর্মা (নিঘন্টু ২.১৪)] সবদিক দিয়ে ব্যাপ্ত থাকে।
.
ভাবার্থ - পূর্বোক্ত চার আদি ঋষি যখন ধ্যানাবস্থিত হন আর পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার করেন, তখন তাঁরা অন্তরীক্ষ থেকে আসা ঋচা আর সেগুলোর পদকে ক্রমপূর্বক আসতে অনুভব করেন। তাঁরা ক্রমপূর্বক সেইসব ঋচা আর পদের বিজ্ঞানকেও পূর্ণরূপে জানতে থাকেন। সেই ঋচাগুলো অন্তরীক্ষে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ঋষিরশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে, সেখান থেকে সেই ঋষিগণ সেগুলোকে নিজের অন্তঃকরণে গ্রহণ করেন। এইভাবে নিজের সামর্থ্যের অনুসারে সমস্ত ঋচাকে মহর্ষি ব্রহ্মার মাধ্যমে সর্বত্র প্রচারিত করেন। সেই বেদবাণী প্রধানত সাত ছন্দ যুক্ত হয়। [ সপ্ত = সৃপ্তা সংখ্যা (নিরুক্ত ৪.২৬)] সেইসব ছন্দ সম্পূর্ন আন্তরীক্ষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে আর সর্বত্র এগুলো একে-অপরের দিকে গতিশীল হয়। চারজন ঋষি সেগুলোর মধ্যে বেদের এই ঋচাগুলোকে গ্রহণ করেন।
Read More

ঋগ্বেদ ১০/৭১/২

18 December 0

ঋগ্বেদ ১০/৭১/২ আধিভৌতিক ভাষ্য

সক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো য়ত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।

অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাম্ লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।। (ঋগ্বেদ ১০।৭১।২)

(সক্তুম্, এব) [সুক্তুঃ = সুক্তুঃ সচতের্দুধাবো ভবতি (নিরুক্ত ৪.১০)] অশুদ্ধ মিশ্রিত ছাতু যাকে হাত দিয়ে শুদ্ধ করা কষ্টসাধ্য হয়, তাকে যেভাবে সহজে শুদ্ধ করা হয় (তিতউনা) [তিতউ = তিতউ পরিপবনম্ ভবতি। ততবদ্বা তুন্নবদ্বা তিলমাত্রম্ তুন্নমিতি বা (নিরুক্ত ৮.৯)] সূক্ষ্ম ছিদ্র যুক্ত বিস্তৃত শোধন কর্মকারী ছাঁকনি দিয়ে, (য়ত্র, ধীরাঃ) সেইরূপ যখন অথবা যেখানে অত্যন্ত সত্ত্বগুণ ধারণকারী সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন ঋষি ধ্যানাবস্থিত অবস্থায় [ধীরাঃ = প্রজ্ঞানবন্তো ধ্যানবন্তঃ (নিরুক্ত ৪.১০)] (মনসা) সমাহিত অন্তঃকরণ দ্বারা (পুনন্তঃ) অন্তরীক্ষস্থ বেদ বাণীকে শুদ্ধ করে (বাচম্, অক্রত) সেই বেদ বাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করেন। (অত্র, সখায়ঃ) এই বেদবিদ্যার বিষয়ে সব প্রাণীদের সখারূপ হিতচিন্তক সেই ঋষিজন (সখ্যানি, জানতে) [সখা = সমানম্ খ্যাতীতি সখা (উ.কো.৪.১২৮)] যেখানে এমন মানুষ আছেন যারা সকল প্রাণীর প্রতি মিত্রধর্মকে জানেন, সেখানে ঈশ্বরের সহায়তায় বেদমন্ত্র, সেগুলোর পদের অর্থ অর্থাৎ শব্দ এবং অর্থের সম্বন্ধকে পূর্ণ রূপে জেনে যান। (এষাম্, বাচি, অধি) সেই বেদবাণীর মধ্যে (ভদ্রা, লক্ষ্মীঃ) [লক্ষ্মীঃ = লক্ষ্মীর্লাভাদ্বা লক্ষণাদ্বা লক্ষ্যতে চিন্ত্যতে সর্বেণ - স্কন্দস্বামী (নিরুক্ত ৪.১০), ভদ্রম্ = ভদ্রম্ ভগেন ব্যাখ্যাতম্ ভজনীয়ম্ ভূতানামভিদ্রবণীয়ম্ ভবদ্রময়তীতি বা (নিরুক্ত ৪.১০)] সকল প্রাণীর জন্য প্রাপ্ত করার যোগ্য পদার্থ আর চিন্তন অর্থাৎ সেই পদার্থের বিজ্ঞান (নিহিতা) নিহিত থাকে।
.
ভাবার্থ - মানব সৃষ্টি উৎপত্তির সময় এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে বেদমন্ত্র ব্যাপ্ত থাকে। সেগুলো সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন হওয়া চার সর্বশ্রেষ্ঠ ঋষি সমাধিস্থ মনের দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋচাগুলোকে সেইভাবে ছাঁনিয়ে গ্রহণ করে যেভাবে ছাতু বা আটা ছাঁকনি দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। যেরূপ ছাঁকনি ছাড়া হাত দিয়ে ছাতু বা আটাকে শুদ্ধ করা কঠিন হয়, সেইরূপ সমাধিস্থ মন ছাড়া অন্তরীক্ষস্থ ঋচাকে গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এখানে এই উপমা এটাও দর্শায় যে চারজন ঋষির দ্বারা বেদমন্ত্র গ্রহণ করার জন্য এটা সিদ্ধ হয়ে যায় না যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে এই সমস্ত মন্ত্রের অতিরিক্ত আর কোনো মন্ত্র ছিল না। যদি এমন হতো, তাহলে ছাঁকনি দিয়ে ছাতু ছাঁনিয়ে নেওয়ার সমান মন্ত্রকে গ্রহণ করার চর্চা হতো না। সেই চারজন ঋষি প্রাণীমাত্রের হিতচিন্তক আর মুক্তি থেকে পুনরাবৃত্ত হয়ে মানুষের মধ্যেও সর্বোচ্চ স্তরের ছিলেন। এইজন্য তাঁরাই মন্ত্রকে গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তাঁরা ঈশ্বরের কৃপায় সেই গৃহীত মন্ত্র, সেগুলোর পদ আর সেই পদের অর্থের নিত্য সম্বন্ধকে সম্পূর্ণ রূপে জেনে নেন। সেইসব মন্ত্রের মধ্যে সৃষ্টির সম্পূর্ণ পদার্থকে যথাযথ ভাবে জানার জন্য সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নিহিত আছে আর সেই বিজ্ঞান প্রত্যেক মানুষের জন্য সকল প্রকারের লাভ প্রাপ্তকারীও হয়।

প্রত্যেক সৃষ্টির প্রারম্ভে যে চারজন ঋষির দ্বারা আকাশ থেকে বৈদিক ছন্দকে গ্রহণ করা হয়, তাঁদের এই নামই হয়। এই নামগুলো রূঢ় নয়, বরং য়োগরূঢ় হয়।

প্রশ্ন - পরমাত্মা সৃষ্টির আদিতে চারজন পুরুষকেই কেন বেদজ্ঞান দিয়েছেন, স্ত্রীদের কেন দেন নি? এটা কি বৈষম্যের কারণ নয়?
.
উত্তর - আপনি এটা কিভাবে জানলেন যে এই চারজন ঋষি পুরুষই ছিলেন, এরমধ্যে কোনো স্ত্রী ছিলেন না। আপনি কি পাণিনীয় ব্যাকরণের আধারে এদের নাম থেকে লিঙ্গের নির্ধারণ করছেন? তাই যদি হয়, তাহলে আপনার জেনে রাখা উচিত যে ব্যাকরণের নিয়ম আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে সর্বত্র সমান রূপে কাজ করে না। সর্বত্র সর্বদা বেদাদি শাস্ত্রের প্রতি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ভালো নয়।

Read More

ঋগ্বেদ ১০/৭১/১

18 December 0

ঋগ্বেদ ১০/৭১/১
বেদের প্রাদুর্ভাব

বৃহস্পতে প্রথমম্ বাচো অগ্রম্ য়ৎপ্রৈরত নামধেয়ম্ দধানাঃ। 

য়দেষাম্ শ্রেষ্ঠম্ য়দরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাম্ নিহিতম্ গুহাবিঃ।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১)


(বৃহস্পতে) [এখানে "বৃহস্পতেঃ" এই স্থানে সম্বোধনান্ত পদ ব্যবহৃত হয়েছে। তারসঙ্গে এই পদ সম্বোধনার্থও ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।] হে বেদবাণীর পালক বিদ্বন্! (নামধেয়ম্) সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ এবং তার নামকে (দধানাঃ) ধারণকারী অত্যন্ত পবিত্র অন্তঃকরণ যুক্ত সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন ঋষি (য়ৎ, প্র, ঐরৎ) যে প্রেরণা পরমাত্মার থেকে প্রাপ্ত করেন অর্থাৎ সেই আদি ঋষি যেসব ঋচাকে পরব্রহ্ম পরমাত্মার প্রেরণায় ব্রহ্মাণ্ড থেকে গ্রহণ করেন, (প্রথমম্, বাচঃ, অগ্রম্) সেই বাণী হল মানব ব্যবহারে ব্যবহৃত হওয়া বাণীর মধ্যে সবথেকে অগ্রিম বাণী। (য়দেষাম্, য়ৎ, শ্রেষ্ঠম্) সেই বেদবাণী হল সমস্ত মানবী ভাষার মধ্যে সবথেকে উত্তম বাণী, (য়ৎ, অরিপ্রম্, আসীৎ) [অরিপ্রম্ = রীঙ্ শ্রবণে দিবা. ধাতো "লীরীঙ্গোহ্রস্ব. উ.কো. ৫.৫৫ সূত্রেণ রঃ প্রত্যয়ঃ পুগাগমো হ্রস্বশ্চ। নঞ্ সমাসঃ (বৈদিক কোষঃ )] সেটা পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে থাকে। ঋষিদের দ্বারা আকাশ থেকে গ্রহণ করার সময় সেই বাণী কোনোরূপ ক্ষয় প্রাপ্ত হয় না আর না তাতে কোনোরূপ মিশ্রণ থাকে। (তৎ, এষাম্, প্রেণা) সেই বেদবাণী এই সকল বাণীর মধ্যে সর্বাধিক বেগপূর্বক গমন কারী হয় অথবা সেটা প্রকৃষ্টরূপেণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। (গুহা, নিহিতম্, আবিঃ) [আবিঃ = আবিষ্কুরুতে (নিরুক্ত ৫.৯)] সেই বাণী অন্তরীক্ষরূপী গুহার মধ্যে নিহিত থাকে, যা ঋষিদের অন্তঃকরণ রূপী গুহার মধ্যে প্রকট হয়।
.
এখানে এই ঋচার প্রথম পদ "বৃহস্পতে" কে "বৃহস্পতেঃ" মানলে এই সংকেতও পাওয়া যায় যে সেই অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত বেদবাণী হল সম্পূর্ণ বাণী এবং সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পালক ও স্বামী পরমাত্মারই বাণী অর্থাৎ তাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে।
.
ভাবার্থ - সৃষ্টি উৎপন্ন হলে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে বেদের ঋচা প্রাপ্ত হয়। এই ঋচা পরা ও পশ্যন্তী রূপে সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষে ভরে থাকে। প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন সর্বাধিক পবিত্রাত্মা চার ঋষি সমাধিস্থ হয়ে ঈশ্বরের প্রেরণায় এইসব ঋচাকে গ্রহণ করেন। এর পূর্বে মানুষের কোথাও কোনো ভাষাই ছিল না, বরং ভাষার উৎপত্তি এইসব ঋচা উৎপত্তির পশ্চাৎ এরই অপভ্রষ্ট হওয়াতে হয়েছে। এই বাণী থেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্য কোনো ভাষা হওয়া সম্ভব নয়। যখন সেই ঋষি জন বাণীকে সমাহিত চিত্ত দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে গ্রহণ করেন, সেই সময় সেই বাণী শুদ্ধ ও পূর্ণ রূপে তাঁদের অন্তঃকরণে প্রবিষ্ট হয়। কোনো ঋচা ও ঋচার অংশের একটা পদও এই প্রক্রিয়াতে স্রাবিত হয় না অর্থাৎ অন্তরীক্ষে সেই ঋচাগুলো যেরূপ ব্যাপ্ত থাকে, সেগুলোকে সেইরূপে গ্রহণ করা হয়। সেই বাণী অর্থাৎ বেদমন্ত্র সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে অত্যন্ত শীঘ্রতাপূর্বক সহজে প্রবিষ্ট হয়ে যায়, যেভাবে কেউ মন্ত্রকে কণ্ঠস্থ করে সেইরূপ নয়। সেই মন্ত্রগুলো অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে, এর অর্থ হল সেইসব মন্ত্র ঋষিদের স্মৃতিস্তরে সদ্যঃ অঙ্কিত হয়ে যায়।

বিদ্বানরা বাণীর চারটা রূপ বলেছেন -

চত্বারি বাক্পরিমিতা পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মনীষিণঃ। গুহা ত্রীণি নিহিতা নেঙ্গয়ন্তি তুরীয়ম্ বাচো মনুষ্যা বদন্তি।। (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫)
.
উপরোক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে ঋষি দয়ানন্দ বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে চার প্রকারের বাণী যথা - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত রূপে বর্গীকৃত করেছেন। আচার্য সায়ণ এই ভাষ্যে বাণীর বর্গীকরণ বৈয়াকরণের দৃষ্টির অতিরিক্ত নৈরুক্ত আদির দৃষ্টিকে নিয়েও করেছেন। এরমধ্যে একটা বর্গীকরণ হল - পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এরমধ্যে কেবল বৈখরী বাণী মানুষের ব্যবহারে আসে, বাকি তিন প্রকারের বাণীকে কেবল য়োগী পুরুষই দেখতে বা জানতে পারেন।
.
মহর্ষি প্রবর য়াস্ক নিরুক্ত ১৩.৯ এরমধ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে বাণীর বর্গীকরণ নিম্ন প্রকারে করেছেন -

"চত্বারি বাচঃ পরিমিতানি পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মেধাবিনঃ গুহায়াম্ ত্রীণি নিহিতানি নার্থম্ বেদয়ন্তে গুহা গূহতেঃ তুরীয়ম্ ত্বরতেঃ কতমানি তানি চত্বারি পদানি ওঙ্কারো মহাব্যাহৃতয়শ্চেত্যার্ষম্ নামাখ্যাতে চোপসর্গনিপাতাশ্চেতি বৈয়াকরণাঃ মন্ত্রঃ কল্পো ব্রাহ্মণম্ চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি য়াজ্ঞিকাঃ ঋচো য়জূম্ষি সামানি চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি নৈরুক্তাঃ সর্পাণাম্ বাগ্বয়সাম্ ক্ষুদ্রস্য সরীসৃপস্য চতুর্থী ব্যাবহারিকীত্যেকে পশুষু তূণবেষু মৃগেষ্বাত্মনি চেত্যাত্মপ্রবাদাঃ অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি।"
.
এখানে বর্গীকরণ নিম্নানুসারে -

১. আর্ষমত - ওঙ্কার আর ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ মহাব্যাহৃতি।
ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন -

অকারম্ চাপ্যুকারম্ চ মকারম্ চ প্রজাপতিঃ।
বেদত্রয়ান্নিরদুহদ্ ভূর্ভুবঃ স্বরিতীতি চ।। (মনুস্মৃতি ২.৭৬)

অর্থাৎ বেদ থেকে এই চার পদকে প্রজাপতি দোহন করেন - ওম্, ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ। বেদের সার হল এটাই।

২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত।

৩. য়াজ্ঞিক মত - মন্ত্র, কল্প, ব্রাহ্মণ এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।

৪. নৈরুক্ত মত - ঋক্, য়জুঃ, সাম এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।

৫. অন্য মত - সর্পের বাক্, পক্ষীর বাক্, ক্ষুদ্র সরীসৃপের বাক্ তথা ব্যাবহারিকী (মানব - লোকভাষা)।

৬. আত্মবাদী মত - পশু, বাদ্যযন্ত্র, সিংহ আদির মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকী বাণী।
.
এর অতিরিক্ত নিরুক্তকার (১৩.৯) বাণীর অন্য শ্রেণী সম্বন্ধে মৈত্রায়াণী সংহিতাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন -

"অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি - সা বৈ বাক্ সৃষ্টা চতুর্থা ব্যভবৎ এষু লোকেষু ত্রীণি তুরীয়াণি পশুষু তুরীয়ম্য়া পৃথিব্যাম্ সাগ্নৌ সা রথন্তরে য়ান্তরিক্ষে সা বাতে সা বামদেব্যে য়া দিবি সা বৃহতী সা স্তনয়িত্নৌ অথ পশুষু ততো য়া বাগত্যরিচ্যত তাম্ ব্রাহ্মণে ন্বদধু, স্তস্মাদ্ ব্রাহ্মণ উভয়ীম্ বাচম্ বদতি য়শ্চ দেব য়শ্চ ন..."
.
অর্থাৎ সেই উৎপন্ন হওয়া বাণী চার প্রকারের হয়। ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোক বা সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মিরূপে তিন প্রকারে তথা পশু অর্থাৎ বিভিন্ন মরুত্ ও ছন্দ রশ্মি রূপে [পশবো বৈ মরুতঃ] চতুর্থ প্রকারে। যে বাণী পৃথিবীর মধ্যে আছে, সেটাই অগ্নি তথা রথন্তর সামের মধ্যে আছে। এর তাৎপর্য হল যে বাণী অপ্রকাশিত পরমাণুর মধ্যে আছে, সেটা ঊষ্মা ও বিদ্যুৎ যুক্ত কণার মধ্যেও আছে তথা সেই বাণী রথন্তর সাম অর্থাৎ এমন তীব্র বিকিরণ, যা রমণীয় হয়েও তীক্ষ্ণ ভেদক তথা বিভিন্ন কণাকে অতিক্রমকারী হয়, তাতেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী অন্তরীক্ষে আছে, সেই বাণী বায়ুর (সূক্ষ্ম ও স্থূল) মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এখানে সূক্ষ্ম বায়ুর তাৎপর্য বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে হবে। সেই বাণী বামদেব্য অর্থাৎ বিভিন্ন সৃজন-প্রজনন কর্মে অংশগ্রহণ কারী প্রশস্য ও প্রকাশমান প্রাণ তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী দ্যুলোক অর্থাৎ সূর্যাদি তারার মধ্যে আছে, সেটাই সেগুলোর কিরণের মধ্যে তথা সেইরূপ বাণী স্তনয়িন্তু অর্থাৎ শব্দ করতে থাকা বিদ্যুতের মধ্যেও আছে। এছাড়া অন্য বাণী পশু অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকীর (লোক ভাষা) হয়। এর অতিরিক্ত যেসব বাণী আছে, পরমাত্মা সেগুলো ব্রাহ্মণের মধ্যে ধারণ করেন। এখানে ব্রাহ্মণের অর্থ হল - অত্যুচ্চ স্তরের য়োগী পুরুষ, যিনি পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে সর্বদা রমণ করেন। এমন ব্রহ্মবেত্তা মহাপুরুষ দুই প্রকারের (মোট চার প্রকারের) বাণী, সেগুলো বিভিন্ন দেবের (লোক আদি) মধ্যে বিদ্যমান হলেও অথবা মানুষের কথা বলার বাণী হলেও, তাঁরা জানেন। এমন ব্রাহ্মণের অক্ষর স্তুতি হয়।
.
এখানে নিরুক্তকার স্বমত তথা মৈত্রায়ণী সংহিতার মত থেকে বাক্-তত্ত্বের গম্ভীর ও ব্যাপক স্বরূপের উপর প্রকাশ ফেলেছেন।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিকও অনেক প্রকারের ধ্বনিকে জানে। সুপারনোবার বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন অতি শক্তিশালী তরঙ্গকে বৈজ্ঞানিক শক-ওয়েবস বলে। ইউ.এস.এ. খগোল ভৌতিকশাস্ত্রী জন গ্রিবিন ডার্ক ম্যাটার তথা কোস্মিক কিরণের মধ্যেও সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের উপস্থিতি মানেন। একথা তিনি তাঁর পুস্তক "দ্য অরিজিন্স অফ দ্য ফিউচার - টেন কোশ্চেনস ফর দ্য নেক্সট টেন ইয়ার" পৃষ্ঠা ১৩০ ও ১৩৪ এরমধ্যে লিখেছেন। সৃষ্টি উৎপত্তির মহা বিস্ফোরণে (বিগ ব্যাং) যে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন মানা হয়, সেই অত্যন্ত শীতল রেডিয়েশনের মধ্যেও অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্পন্দন (ফ্লাকচুয়েশন) হওয়াকে বৈজ্ঞানিক মানে আর এই উত্থান-পতন ধ্বনি তরঙ্গের রূপে হয়। "দ্য ট্রবল উইথ ফিজিক্স" নামক পুস্তকের ২০৫ পৃষ্ঠাতে লি স্মোলিন লিখেছেন -

"Over the last decades, the temperature fluctuations of the microwave background have been mapped by satellites, balloon borne detectors, and ground based detectors, one way to understand what these experiments measure is to think of the fluctuations as if they were sound waves in the early universe."

এখানে স্পষ্টভাবে সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের চর্চা করা হয়েছে। সূর্যতে হওয়া বিস্ফোরণ তথা সামান্য অবস্থাতেও পৃথিবীর ভিতরে বিভিন্ন গতিবিধি এবং অন্তরীক্ষে কোস্মিক রেজের সংঘর্ষ থেকেও ধ্বনি তরঙ্গের উৎপত্তিকে বৈজ্ঞানিক মানে ও জানে। যে কথা বৈজ্ঞানিক আজ জানেছে, তার থেকেও সূক্ষ্ম বিজ্ঞানকে মহর্ষি য়াস্ক ও মৈত্রায়ণী সংহিতাকার সহস্র বছর পূর্বে জানতেন। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বাক্ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান হল খুবই বিস্তৃত ও গম্ভীর। এই ধ্বনি আসলে কি, একে বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ভাবে জানতে পারেনি।
.
ধ্বনির বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের কথন হল -

"Sound is an alteration in pressure, stress, particle displacement or particle velocity, which is propogated in an elastic material, or the superposition of such propogated vibrations." (Definition recommended by American Standard Association) - "Acoustics" By Joseph L. Hunter
.
এখানে নিশ্চিত ভাবে ধ্বনির স্পষ্ট ও উত্তম স্বরূপ বলা হয়নি, বরং কোনো পদার্থে উৎপন্ন চাপের রূপেই ধ্বনি তরঙ্গকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ কথা। সেই চাপ কেন ও কিভাবে উৎপন্ন হয়, একথা বর্তমান বিজ্ঞান কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশাদি বিকিরণের মতো ধ্বনির কণাকেও কল্পনা করে। "কিউ ইজ ফর কোয়ান্টাম পার্টিকল ফিজিক্স ফ্রম এ টু জেড" নামক পুস্তকের ২৮১ পৃষ্ঠাতে জোন গ্রীবিন ধ্বনি কণা ফোননের বিষয়ে লিখেছেন -

"Phonon - A particle of sound travelling through a crystal lattice. The idea of a sound wave can be replaced by the idea of phonons in an analogous way to the description of light in terms of photons."
.
এখানে ধ্বনির কণার ধারণা স্পষ্ট আছে। বৈদিক বিচার ধারার মধ্যেও শব্দ তন্মাত্রার মান্যতা সনাতন থেকে চলে আসছে।
.
এই পর্যন্ত বাণীর বিভিন্ন রূপের চর্চা করার পর এখন আমরা পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা তথা বৈখরী এই চার রূপের উপর বিশেষ চর্চা করবো। বাণীর এই বিভাগ যেটা আচার্য সায়ণ করেছেন, তার প্রামাণিকতার উপর কিছু আর্য বিদ্বান প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও বৈদিক গ্রন্থকে বুঝতে হলে আচার্য সায়ণের শৈলী খুবই দোষপূর্ণ কিংবা মূর্খতাপূর্ণ। যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের আমি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছি, তাতে সায়ণ ভাষ্যের প্রায় উপেক্ষাই করেছি, কারণ তাঁর ভাষ্য সর্বথা দোষপূর্ণ, কোথাও-কোথাও বীভৎস, অশ্লীল, মূর্খতাপূর্ণ তথা বৈদিক দৃষ্টির একদম বিপরীত আছে। এতকিছুর পরও সায়ণাচার্যের কোনো উচিত কথাকেও অস্বীকার করা হোক, সেটা আমি স্বীকার করি না। এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ আর্য বিদ্বান পণ্ডিত ভগবৎদত্ত রিসার্চ স্কলার তাঁর নিরুক্ত ১৩.৯ ভাষ্যের মধ্যে লিখেছেন -
.
"পরাবাক্ সিদ্ধান্ত নতুন নয়। দেবকী পুত্র ভগবান্ কৃষ্ণ এর বর্ণনা সাম্ব পঞ্চাশিকার তৃতীয় শ্লোকে করেছেন।"
.
এইভাবে মহৎ বেদবিজ্ঞানী য়োগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মত আমি সর্বথা স্বীকার করি। যে বিদ্বান এর উপরও শঙ্কা করেন, তাদের কোনো উপায় নেই।
.
পরা, পশ্যন্তী আদি বাণীর চার রূপের চর্চা ব্যাকরণ মহাভাষ্যের ভাষ্য প্রদীপে আচার্য কৈয়ট তথা নাগেশ ভোট্টও করেছেন। ইনি "বাক্যপদীয়মে"র অনেক শ্লোককেও উদ্ধৃত করেছেন। (achrya agnivrat)
Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ১৯/৫৩/৭

কালমহিমোপদেশঃ কালে মনঃ কালে প্রাণঃ কালে নাম সমাহিতম্। কালেন সর্বানন্দন্ত্যাগতেন প্রজা ইমাঃ।। (অথর্ববেদ ১৯।৫৩।৭) পদার্থঃ (কালে)  কালের মধ্যে ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ