ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

23 December, 2025

গায়ত্রী মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য

23 December 0
গায়ত্রী মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য

ভূর্ভুবঃ স্বরিত্যস্য বিশ্বামিত্র ঋষিঃ । সবিতা দেবতা । পূর্বস্য দৈবী বৃহতী ছন্দঃ, তৎসবিতুরিত্যুত্তরস্য নিচৃদ্গায়ত্রী ছন্দঃ । মধ্যমষড্জৌ স্বরৌ ॥ 

ও৩ম্  ভূর্ভুবঃ॒ স্বঃ᳖ । তৎস॑বি॒তুর্বরে॑ণ্যং॒ ভর্গো॑ দে॒বস্য॑ ধীমহি ।

ধিয়ো॒ য়ো নঃ॑ প্রচো॒দয়া॑ৎ ॥ যজু ৩৬।৩ ॥

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! যেমন আমরা (ভূঃ) কর্মকান্ডের বিদ্যা (ভুবঃ) উপাসনা কান্ডের বিদ্যা এবং  (স্বঃ) জ্ঞানকান্ডের বিদ্যাকে সংগ্রহপূর্বক পড়িয়া (য়ঃ) যাহা (নঃ) আমাদের (ধিয়ঃ) ধারণাবতী বুদ্ধিদিগকে  (প্রচোদয়াৎ) প্রেরণা করিবে সেই (দেবস্য) কামনার যোগ্য (সবিতুঃ) সমস্ত ঐশ্বর্য্যপ্রদাতা পরমেশ্বরের  (তৎ) সেই ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ না করার যোগ্য পরোক্ষ (বরেণ্যম্) স্বীকার করিবার যোগ্য (ভর্গঃ) সর্ব দুঃখের নাশক তেজঃস্বরূপের (ধীমহি) ধ্যান করি, সেইরূপ তুমিও ইহার ধ্যান কর ॥

ভাবার্থঃ- এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালঙ্কার আছে । যে মনুষ্য কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান সম্পর্কীয় বিদ্যাগুলির সম্যক গ্রহণ করিয়া সম্পূর্ণ ঐশ্বর্য্যযুক্ত পরমাত্মা সহ নিজের আত্মাকে যুক্ত করে তথা অধর্ম, অনৈশ্বর্য্য এবং দুঃখরূপ মল হইতে মুক্ত হইয়া ধর্ম, ঐশ্বর্য্য এবং সুখ প্রাপ্ত হয় তাহাদেরকে অন্তর্যামী জগদীশ্বর স্বয়ংই ধর্মের অনুষ্ঠান ও অধর্মের ত্যাগ করাইতে সর্বদা কামনা করে ॥ মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ভাষ্যের বাংলা অনুবাদ

তাৎপর্যঃ— এই মন্ত্রে বাচকলুপ্ত উপমালঙ্কার আছে। যে মানুষ কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান-সম্পর্কিত বিদ্যাগুলির যথাযথ গ্রহণ করে, সর্বসম্পূর্ণ ঐশ্বর্যে যুক্ত পরমাত্মার সঙ্গে নিজের আত্মাকে যুক্ত করে এবং অধর্ম, অনৈশ্বর্য ও দুঃখরূপ মল ত্যাগ করে ধর্ম, ঐশ্বর্য ও সুখ লাভ করে তাদেরকে অন্তর্যামী জগদীশ্বর স্বয়ং ধর্মের অনুশীলন ও অধর্মের ত্যাগ করাতে সর্বদা ইচ্ছুক থাকেন।

এর তর্জমা Ralph T. H. Griffith এইভাবে করেছেন— “May we attain that excellent glory of Savitar the God. So may he stimulate our prayers.”

এই তর্জমা আধ্যাত্মিক, কিন্তু বিদ্বান পাঠক নিজে এটি মহর্ষি দয়ানন্দের তর্জমার সঙ্গে তুলনা করে গ্রিফিথের বৈদিকতার স্তর জানতে পারেন।

এই মন্ত্রটি (ব্যাহৃতি-রহিত রূপে) যজুর্বেদ ৩।৩৫; ২২।৯; ৩০।২; ঋগ্বেদ ৩।৬২।১০; সামবেদ ১৪।৬২-এও বিদ্যমান। এটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও বহুস্থানে এসেছে। এদের মধ্যে যজুর্বেদ ৩০.২-এ এই মন্ত্রের ঋষি নারায়ণ এবং অন্যত্র বিশ্বামিত্র। দেবতা সবিতা, ছন্দ নিছৃদ্ বৃহতী এবং স্বর ষড়জ। ব্যাহৃতিগুলির ছন্দ দৈবী বৃহতী এবং স্বর ব্যাহৃতিসহ সম্পূর্ণ মন্ত্রের স্বর মধ্যম ষড়জ। মহর্ষি দয়ানন্দ সর্বত্রই এর ভাষ্য আধ্যাত্মিক করেছেন। কেবল যজুর্বেদ ৩০।২-এর ভাবার্থে আধিভৌতিকের সামান্য ইঙ্গিত আছে, অবশিষ্ট ভাষ্য আধ্যাত্মিকই।

একজন বিদ্বান একবার আমাদের বলেছিলেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো কিছু মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য কোনো প্রকারে ভাষ্য হতেই পারে না। আমরা বিশ্বের সকল বেদজ্ঞকে ঘোষণাপূর্বক বলতে চাই যে বেদের প্রত্যেক মন্ত্র এই সমগ্র সৃষ্টিতে বহু কল্পনার (ভাইব্রেশনস) রূপে বিদ্যমান। এই মন্ত্রগুলির এই রূপে উৎপত্তি পৃথিব্যাদি লোকসমূহের উৎপত্তিরও পূর্বে হয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই প্রত্যেক মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য অবশ্যই হয়ে থাকে। ত্রিবিধ অর্থপ্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বাধিক ও সর্বপ্রথম সম্ভাবনা এই প্রকার অর্থেরই হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের আধিদৈবিক অর্থ হতে পারে না এমন ধারণা করা বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞতার পরিচায়ক।

এই ঋচাটির দেবতা সবিতা। সবিতার বিষয় সম্পর্কে ঋষিদের বক্তব্য হলো—

  1. সবিতা সর্বস্য প্রস্বিতা (নিরুক্ত ১০।৩১)

  2. সবিতা বৈ দেবানাং প্রস্বিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।২।১৭)

  3. সবিতা বৈ প্রসবানামীশঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।৩০)

  4. প্রজাপতিবৈ সবিতা (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ১৬।৫।১৭)

  5. মনো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬।৩।১।১৩)

  6. পশবো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৩।২।৩।১১)

  7. বিশ্বদেব সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)

  8. প্রাণো বৈ সবিতা (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।১৯)

  9. বেদা এভ সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)

  10. সবিতা রাষ্ট্রং রাষ্ট্রপতিঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২।৫।৭।৪)

এথেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হয়—

  1. ‘সবিতা’ নামক পদার্থ সকলের উৎপত্তি ও প্রেরণার উৎস বা সাধন।

  2. এটি সকল প্রকাশিত ও কামনা অর্থাৎ আকর্ষণাদি বল দ্বারা যুক্ত কণাগুলির উৎপাদক ও প্রেরক।

  3. এটি সকল উৎপন্ন পদার্থের নিয়ন্ত্রক।

  4. ‘ওম্’ রশ্মিরূপ ছন্দ, রশ্মি এবং মনস্তত্ত্বই সবিতা।

  5. বিভিন্ন মরুদ্‌ রশ্মি এবং দৃশ্য কণা ‘সবিতা’ নামে অভিহিত।

  6. বিদ্যুৎকেও ‘সবিতা’ বলা হয়।

  7. বিভিন্ন প্রাণরশ্মিও ‘সবিতা’ নামে পরিচিত।

  8. সকল ছন্দ-রশ্মিও ‘সবিতা’।

  9. তারাগুলির কেন্দ্রীয় অংশরূপ রাষ্ট্রকে প্রকাশিত ও তাদের পালনকারী সম্পূর্ণ তারা-সমষ্টিকেও ‘সবিতা’ বলা হয়। 

এটি আমরা পূর্বে লিখে এসেছি যে দেবতা কোনো মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি, মনস্তত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব এবং সকল ছন্দরশ্মি। এই ঋচার উৎপত্তি বিশ্বামিত্র ঋষি [বাগ্ বৈ বিশ্বামিত্রঃ (কৌ. ব্রা. ১০।৫), বিশ্বামিত্রঃ সর্বমিত্রঃ (নিরুক্ত ২।২৪)] অর্থাৎ সকলকে আকর্ষণ করতে সক্ষম ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি থেকে হয়েছে।

আধিদৈবিক ভাষ্য— (ভূঃ) ‘ভূঃ’ নামক ছন্দরশ্মি কিংবা অপ্রকাশিত কণ বা লোক, (ভুবঃ) ‘ভুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা আকাশতত্ত্ব, (স্বঃ) ‘সুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা প্রকাশিত কণ, ফোটন বা সূর্যাদি তারার মধ্যে ব্যাপ্ত, (তৎ, সবিতুঃ) সেই অগোচর বা দূরস্থিত সবিতা অর্থাৎ মন, ‘ওম্’ রশ্মি, সকল ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ ও সূর্যাদি পদার্থকে (বরেণ্যম্, ভর্গঃ, দেবস্য) সর্বত্র আচ্ছাদনকারী ব্যাপক [ভর্গঃ=অগ্নির্বৈ ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৮), আদিত্ত্যো বৈ ভর্গঃ (জৈ. উ. ৪।১২।২।২), বীর্যং বৈ ভর্গোऽস্য বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ (শত. ব্রা. ৫।৪।৫।১), অয়ং বৈ (পৃথিবী) লোকো ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৭)] আগ্নেয় তেজ, যা সমগ্র পদার্থকে ব্যাপ্ত করে বহু সংযোজক ও সংবেদক বল দ্বারা যুক্ত হয়ে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লোকসমূহের নির্মাণে প্রেরণা দিতে সক্ষম হয়, (ধীমহি) প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ সে সমগ্র পদার্থে সেই আগ্নেয় তেজ, বল ইত্যাদিকে ব্যাপকভাবে ধারণ করে। (ধিয়ঃ, যঃ, নঃ, প্রচোদয়াত্) যখন সেই উপযুক্ত আগ্নেয় তেজ ঐ পদার্থকে ব্যাপ্ত করে নেয়, তখন বিশ্বামিত্র ঋষি-সংজ্ঞক মন ও ‘ওম্’ রশ্মিরূপ পদার্থ [ধীঃ = কর্মনাম (নিঘ. ২।১), প্রজ্ঞানাম (নিঘ. ৩।৯), বাগ্ বৈ ধীঃ (ঐ. আ. ১।১।৪)] বিভিন্ন প্রকারের বাক্‌রশ্মিকে নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে উত্তমভাবে প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করে।

ভাবার্থ— মন এবং ‘ওম্’ রশ্মিগুলি ব্যাহৃতি রশ্মির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে সকল মরুদ্‌, ছন্দাদি রশ্মিকে অনুকূলভাবে সক্রিয় করতে করতে সকল কণ, কোয়ান্টা এবং আকাশতত্ত্বকে উপযুক্ত বল ও নিয়ন্ত্রণে যুক্ত করে। এর ফলে সকল লোক তথা অন্তরিক্ষে বিদ্যমান পদার্থ নিয়ন্ত্রিত শক্তিতে যুক্ত হয়ে নিজেদের নিজ নিজ ক্রিয়াগুলি যথাযথভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। এর দ্বারা বিদ্যুৎবলও যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকে।

সৃষ্টিতে এই ঋচার প্রভাব— এই ঋচার উৎপত্তির পূর্বে বিশ্বামিত্র ঋষি অর্থাৎ ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিগুলি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। এর ছন্দ দৈবী বৃহতী + নিছৃদ্ গায়ত্রী হওয়ার কারণে এর ছান্দস প্রভাব থেকে বিভিন্ন প্রকাশিত কণ বা রশ্মি ইত্যাদি পদার্থ তীক্ষ্ণ তেজ ও বল লাভ করে সংবেদিত হতে থাকে। এর দৈবত প্রভাব থেকে মনস্তত্ত্ব এবং ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিরূপ সূক্ষ্মতম পদার্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণ, মরুদ্‌, ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ-এর সঙ্গে সঙ্গে সকল দৃশ্য কণ বা কোয়ান্টাও প্রভাবিত অর্থাৎ সক্রিয় হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ‘ভূঃ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘সুবঃ’ নামক সূক্ষ্ম ছন্দরশ্মিগুলি ‘ওম্’ ছন্দরশ্মির দ্বারা বিশেষভাবে সংগঠিত ও প্রেরিত হয়ে কণ, কোয়ান্টা, আকাশতত্ত্ব পর্যন্ত প্রভাবিত করে। এর ফলে এ সকলের মধ্যে বল ও শক্তির বৃদ্ধি হয়ে সকল পদার্থ বিশেষ সক্রিয়তা লাভ করে।

এই সময় সংঘটিত সকল ক্রিয়ায় যে যে ছন্দরশ্মিগুলি নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে, সেগুলি সকলই বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে নানাবিধ কর্মকে সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন লোক হোক তারা সূর্যাদি প্রকাশিত লোক অথবা পৃথিব্যাদি গ্রহ বা উপগ্রহাদি অপ্রকাশিত লোক সকলেরই রচনার সময় এই ছন্দরশ্মি নিজ ভূমিকা পালন করে। এর প্রভাবে সমগ্র পদার্থে বিদ্যুৎ ও উষ্মার বৃদ্ধি ঘটে, কিন্তু এই অবস্থাতেও এই ছন্দরশ্মি বিভিন্ন কণ বা কোয়ান্টাকে সক্রিয়তা প্রদান করলেও অনুকূলভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখতে সহায়ক হয়। হ্যাঁ, সেখানে ব্যাহৃতিগুলির অবিদ্যমানতা অবশ্যই রয়েছে। এর ষড়জ স্বরের প্রভাবে এই রশ্মিগুলি অন্যান্য রশ্মিকে আশ্রয় দেওয়া, নিয়ন্ত্রণ করা, দমন করা এবং বহন করতে সহায়ক হয়। ব্যাহৃতিগুলির মধ্যম স্বর এগুলিকে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে নিজ ভূমিকা পালন করার ইঙ্গিত দেয়।

আধ্যাত্মিক ভাষ্য— (ভূঃ) প্রাণসমূহের থেকেও প্রিয় এবং সকলের প্রাণের আধার, ভূলোকে অর্থাৎ সকল অপ্রকাশিত লোকের স্বামী এবং সৎ স্বরূপ পরমাত্মন্! (ভুবঃ) অপানস্বরূপ অর্থাৎ সকল দুর্গুণ ও দুঃখ দূরকারী চেতনাস্বরূপ পরমেশ্বর! (স্বঃ) ব্যানস্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতকে বিভিন্ন প্রকারে ক্রিয়াশীল করানো সকল প্রকাশিত লোকের স্বামী, আনন্দস্বরূপ এবং সকলকে আনন্দ প্রদানকারী জগদীশ্বর! (সবিতুঃ) সমগ্র জগতের উৎপত্তিকারী, সকলকে শুভ কর্মের প্রেরণা দানকারী, সকল লোকের ধারক পরমাত্মার (দেবস্য) সকল দিব্য গুণে যুক্ত, সকল প্রকাশিত লোককেও প্রকাশিতকারী, সকল মানুষকে বেদজ্ঞান প্রদানকারী, সমগ্র সৃষ্টির নিয়ন্তা, সকলের কামনা পূরণে যোগ্য, প্রলয়কালে সকলকে সুপ্ত করানো দেবস্বরূপ পরমাত্মার (তৎ, বরেণ্যম্) সেই বরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ (ভর্গঃ) পাপনাশক তেজকে (ধীমহি) আমরা আমাদের অন্তঃকরণ বা আত্মায় ধারণ করি। (যঃ, নঃ, ধিয়ঃ) যে অর্থাৎ সেই তেজ [ধীঃ=প্রজ্ঞানাম (নিঘ০ ৩।৯), কর্মনাম (নিঘ০ ২।১)] আমাদের বুদ্ধি ও কর্মকে (প্রচোদয়াত্) উত্তমভাবে প্রেরিত করে, অর্থাৎ সেই ঈশ্বর আমাদের সন্মার্গে চলার জন্য প্রেরণা দেন এবং আমরা সেই প্রেরণার অনুসরণ করতে করতে সন্মার্গে চলার সামর্থ্যও লাভ করি এবং সেই মার্গে সদা চলতে থাকি।

এই মন্ত্রটিকে উপাসনার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে, কারণ এতে পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা—এই তিনটিরই সমন্বয় রয়েছে। ‘ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, সবিতুঃ, দেবস্য, বরেণ্যম্, ভর্গঃ’ এই পদগুলি পরমেশ্বরের গুণাবলির প্রতিপাদন করে; এই কারণেই এগুলি স্তুতিপরক। এই গুণসমূহের কীর্তনের ফলে সাধকের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাবের উদ্ভব হয়। সকল ব্যাহৃতির চিন্তনের মাধ্যমে সে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বরকেই অনুভব করতে শুরু করে। তিনি তাঁকে দুঃখনাশক ও সুখপ্রদাতা বলে জেনে সংসারিক দুঃখ ভুলে আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন।

তিনি ঈশ্বরকে সমগ্র সৃষ্টির উৎপাদক ও নিয়ন্তা বলে মান্য করে স্বত্ববোধজনিত অহংকার থেকে মুক্ত হতে শুরু করেন। সেই ঈশ্বরকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জেনে তাঁরই সাক্ষাৎকারের কামনা করেন। তাঁর পাপনাশক স্বরূপ স্মরণ করে নিজের অন্তঃকরণের মলিনতা দূর হচ্ছে এমন অনুভব লাভ করেন। এখানে ‘ধীমহি’ পদটি তাঁর উপাসনার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই পদের উপর চিন্তনকালে সাধক সেই পরমাত্মার তেজকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করেন এবং ‘ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্’ এই প্রার্থনামূলক পদের জপের মাধ্যমে তিনি শুদ্ধ বুদ্ধি দান ও তদনুযায়ী কর্ম করার সামর্থ্য প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনার ফলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে সর্বতোভাবে অহংকারশূন্য হওয়ার প্রয়াসে প্রবৃত্ত হন।

আধিভৌতিক ভাষ্য—
এখন আমরা এই মন্ত্রের আধিভৌতিক অর্থের উপর চিন্তা করি—

ভাবার্থ— এখানে ‘ভূঃ’ দ্বারা কর্মবিদ্যা, ‘ভুবঃ’ দ্বারা উপাসনাবিদ্যা এবং ‘স্বঃ’ দ্বারা জ্ঞানবিদ্যা বোঝানো হয়েছে। এই তিন প্রকার বিদ্যার দ্বারা যিনি সম্পূর্ণ, সেই ‘সবিতা’ অর্থাৎ যোগপদার্থের জ্ঞানকে প্রসবিত ও বিকশিতকারী। তিনি দেবগুণে বিভূষিত রাজা, অথবা মাতা–পিতা, উপদেশক, আচার্য কিংবা যোগীপুরুষ যাঁরা গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ, এবং যাঁদের তেজ পাপাদি দোষকে নাশ করে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে যজ্ঞ অর্থাৎ সংগঠন, ত্যাগ ও বলিদানের ভাব সমৃদ্ধ করে এমন যে উপদেশ বা বিধান, তাকেই আমরা সকল মানুষ হৃদয়ে ধারণ করি। এইরূপ রাজা, যোগী, আচার্য বা মাতা–পিতা এবং তাঁদের বিধান ও উপদেশ আমাদের কর্ম ও বুদ্ধিকে ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক উন্নতির পথে সঠিকভাবে প্রেরণা দেয়।

সারকথা এই যে, উত্তম যোগী ও জ্ঞানী মাতা–পিতা, আচার্য এবং রাজা তাঁদের সন্তান, শিষ্য বা প্রজাকে শ্রেষ্ঠ উপদেশ ও সর্বহিতকারী বিধানের মাধ্যমে সকল প্রকার দুঃখ ও পাপ থেকে মুক্ত করে উত্তম পথে পরিচালিত করেন। এইরূপ মাতা–পিতা, আচার্য ও রাজাদের প্রতি সন্তান, শিষ্য ও প্রজারা গভীর শ্রদ্ধাভাব পোষণ করে; যার ফলে সমগ্র পরিবার, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সর্বতোভাবে সুখী হতে পারে।

ধ্যাতব্য— গায়ত্রী-মন্ত্রের সাধনা করেন এবং সন্ধ্যা করেন এমন সাধকের জন্য যোগ্যতা এই যে, তিনি যেন কেবল নিজের বুদ্ধি ও কর্মকে পবিত্র করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকেন; বরং এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তামসিক প্রবৃত্তিগুলিকে দূর করার জন্যও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর সর্বদা বুদ্ধিবর্ধক ও সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা উচিত।

এই গ্রন্থে কেবল মন্ত্রের দেবতার ব্যাখ্যার প্রসঙ্গেই আমরা নয়টি প্রমাণ প্রদান করেছি এবং প্রতিটি প্রমাণের পৃথক-পৃথক অর্থও বাংলায় স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। ঋষি-তত্ত্বকে বোঝানোর জন্যও দুটি প্রমাণ দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলির অর্থও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রেও বহু প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেসবের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে; অথচ মহর্ষি দয়ানন্দ জি এই মন্ত্রের ভাষ্যে কোনো প্রমাণই দেননি।

তবুও কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এত প্রমাণ দেওয়ার পরও কি অর্থ স্পষ্ট হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়, শুরুতে প্রমাণগুলিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই প্রক্রিয়াকে ন্যূনতম করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, গ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই ধীরে ধীরে বিষয় বোঝার যোগ্য হয়ে ওঠেন এবং তখন আর নতুন পাঠকের মতো করে সব কিছু আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। উপরন্তু, সময়সীমার বিষয়টিও সামনে ছিল।

এখন আমি আপনাদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই যদি আপনারা আমার স্থানে থাকতেন, তাহলে কী করতেন? আশা করি, আপনারা নিজেদের প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই পেয়ে গেছেন।

প্রশ্ন— আপনার এই নিরুক্ত-ভাষ্যের ফলে কি বর্তমানে প্রচলিত গুরুুকুল-পরম্পরা ধ্বংস হয়ে যাবে না? যদি এমন হয়, তবে তার সম্পূর্ণ দায়ভার কি আপনারই হবে?

উত্তর— আপনার এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। গুরুুকুলগুলিকে বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহের রক্ষার জন্যই সর্বদা সচেষ্ট থাকা উচিত। আমার এই নিরুক্ত অথবা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ভাষ্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ব্যাকরণবেদ, ছন্দশাস্ত্রের পাদ এবং নিরুক্ত শাস্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হবে। যখন গুরুুকুলের আচার্যরা এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তখন এই গ্রন্থগুলির প্রতি তাঁদের বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি শ্রদ্ধা জন্মাবে। তাঁদের আত্মবল বৃদ্ধি পাবে।

ভেবে দেখুন, আমি নিরুক্ত-ভাষ্যে কী করেছি। আমি বেদমন্ত্র এবং মহর্ষি যাস্কের বচনগুলির সঙ্গে কোনো রকম ছেঁড়াছেঁড়া করিনি। একটি শব্দেরও কোথাও কোনো ভেদ করিনি। আমি কেবল সেই শব্দগুলিরই আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছি। আমি অন্যান্য সব ভাষ্যকারদের ভাষ্যও দেখেছি, তাতে নানা প্রকার পাপের বিদ্যমানতাও অনুভব করেছি। এই কারণেই শাস্ত্রগুলির প্রতি সর্বদিক থেকে যে নিন্দা হয়ে আসছে, তার অভিজ্ঞতাও আমি পেয়েছি।

এই কারণেই আমি মধ্যযুগীয় ও বর্তমান ভাষ্যকারদের অনার্ষ পরম্পরাকেই দোষী জেনে তাকে ধ্বংস করার দায়িত্ব অবশ্যই গ্রহণ করেছি। শাস্ত্রের অপমান দেখে আপনার মতো নীরব থাকতে আমি পারি না, কারণ তা করা অপরাধ হবে। তখন আমার সামনে কেবল দুটি পথই ছিল... প্রথমত, আমি আপনার মতোই মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ভাষ্যকারদের পাণ্ডিত্যের সামনে নতমস্তক হয়ে সমস্ত পাপের দায় ঋষিদের গ্রন্থ ও বেদসমূহের ওপর চাপিয়ে দিই। এরপর হয় আপনার মতো নীরব থাকি, অথবা এমন করার পর নিজেও তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিশি, যারা দিনরাত বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর এ রকম ঘৃণিত অভিযোগ আরোপ করে চলেছে এবং যারা দেশ ও ধর্মের জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

শৈশবকাল থেকেই কেবল সত্যের ওপর দৃঢ় থাকার স্বভাবের কারণে আমি যদি এই শাস্ত্রগুলিকে বহু পাপের পোষক মনে করে তাদের সর্ববৃহৎ বিরোধী হয়ে যেতাম, তবে আপনাদের সবার জন্যই আমি সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠতাম। যখন আপনারা খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ এবং বামপন্থীদের অভিযোগেরই উত্তর দিতে পারছেন না, তখন আমার সঙ্গে আপনারা মোকাবিলা করতেন কীভাবে?

সৌভাগ্যবশত আমি ঋষি দয়ানন্দকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। বেদ ও ঋষিদের বিষয় সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধিও আমি স্পষ্টভাবে বুঝেছিলাম। এই কারণেই এই শাস্ত্রগুলির ওপর কোনো প্রকার দোষারোপ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই এই শাস্ত্রগুলির ভাষ্যকাররা—তাঁরা আমার কাছে যতই পূজনীয় হোন না কেন—তাঁদের উপেক্ষা করে, প্রভুপ্রদত্ত জন্মজাত বুদ্ধি ও সত্যপালনের শক্তির ওপর ভরসা করে নিজস্ব পথ নিজেই নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারই ফল এই যে, আমি এই দুই গ্রন্থ মানবকল্যাণের জন্য উপস্থাপন করতে পেরেছি। এটিই আমার দ্বিতীয় বিকল্প।

এই বিকল্প গ্রহণ করার জন্য আপনার তো আনন্দিত হওয়াই উচিত ছিল যে আমি আপনাকে বিরোধীদের মতো চ্যালেঞ্জ জানানো ব্যক্তি হয়ে উঠিনি। যদি বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহকে নিষ্কলুষ ও মহান বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও আপনার আপত্তি থাকে, তবে তা আপনারই সমস্যা।

কোনো বেদবিরোধী যদি এই কাজের বিরোধিতা করে, তবে তা বোঝা যায়। কিন্তু যে নিজেকে বেদভক্ত ও ঋষিভক্ত বলে পরিচয় দেয়, সে যদি এমন করে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার।

দুর্ভাগ্যবশত আজ আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে নিজ নিজ গোষ্ঠীর বিদ্বানদের মান-সম্মান নিয়েই কেবল চিন্তিত। নিজের পদ, প্রতিষ্ঠা ও ধনের চিন্তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। যদি ঋষি বা বেদের মান-সম্মান আপনার দৃষ্টিতে সামান্যও গুরুত্ব পেত, তবে বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর আরোপিত ঘৃণিত অভিযোগ দেখে আপনি গান্ধীর তিন বানরের মতো নীরব থাকতেন না।

আমি আপনাদের সকলকে বলতে চাই আমার গ্রন্থগুলিতে যদি এই ধরনের কোনো অভিযোগের সত্যতা প্রতীয়মান হয়, তবে শুধু তার সমাধানই নয়, আমার খণ্ডনও করুন এর জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদই জানাব। কিন্তু ভিত্তিহীন নিন্দার প্রতি আমি উদাসীনই থাকব।

সবশেষে আপনাদের সকলের কাছে এই করজোড় নিবেদন করছি নিজ নিজ সাথী বা গুরুর মান-প্রতিষ্ঠার চিন্তা পরিত্যাগ করে কেবল ঋষি ও বেদের সম্মান ও প্রতিষ্ঠার কথাই ভাবুন। কারণ তাঁদের প্রতিষ্ঠাই সত্যের প্রতিষ্ঠা, মানবতার প্রতিষ্ঠা; আর সত্য ছাড়া ধর্ম নেই।

এবার আমরা গুরুকুলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছি। যখন গুরুকুলে এই ধরনের ভাষ্য পাঠ করানো হবে এবং সেখানে প্রতিভাবান ছাত্ররা আসবে, তখন আমাদের গুরুকুলগুলো এক–দু’জন বেদবিরোধী ব্যক্তির আপত্তির জবাব দেওয়াতেই শুধু সক্ষম হবে না, বরং তাদের কাছে বেদ ও ঋষিদের গৌরবও স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারবে। সেই সময় গুরুকুলগুলো বিজ্ঞানীদের কাছেও তীর্থস্থান হয়ে উঠবে, যেমন প্রাচীন কালে হয়ে থাকত।

গুরুকুলের ব্রহ্মচারীরা তারা কেবল বেদপাঠী হোক বা শাস্ত্রসমূহের নিয়মিত অধ্যয়নকারীই হোক সবার মধ্যেই এক ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার জাগরণ ঘটবে এবং তাদের মধ্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জন্ম হবে। তারা বড় বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাপনা সংস্থার মতোই সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠবে। এই কারণে আমার কাজের ফলে গুরুকুলের পরম্পরা ধ্বংস হবে না; বরং সেই পরম্পরা বিশ্বজুড়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে।

-আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক জীর লেখা হতে বঙ্গানুবাদ (বেদার্থ বিজ্ঞানম্)

Read More

20 December, 2025

বেদের প্রাদুর্ভাব

20 December 0

বেদের প্রাদুর্ভাব
বৈদিক ঋচাগুলো অন্তরীক্ষে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ঋষিরশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে সেই রশ্মি অনুয়ায়ী নাম হয়, অগ্নি আদি ঋষি

ঋষি— ভৃগ্বঙ্গিরাঃ, দেবতা— ইন্দ্রঃ, অনড্বান্, ছন্দ— জগতী, সূক্তম্— অনড্বান্ সূক্ত

অনড্বান্ দুহে সুকৃতস্য লোক এনং প্যায়য়তি পবমানঃ পুরস্তাত্।
পর্‌জন্যো ধারা মরুত ঊধো অস্‌য যজ্ঞঃ পয়ো দক্ষিণা দোহো অস্‌য॥ অথর্ববেদ ৪।১১।৪


পদার্থঃ (সুকৃতস্য লোকে) সুকর্মের লোকে (অনড্বান্) সংসার-শকটের বহনকারী পরমেশ্বর (দুহে) ভোগ্যসমূহ দোহন করেন, প্রদান করেন (পবমানঃ) পবিত্রকারী সূর্য (পুরস্তাৎ) পূর্বে বিদ্যমান হয়ে (এনম্) এই অনড্বান্-কে (আপ্যায়য়তি) বর্ধিত করে, গুণ-কর্মের প্রকাশ করে। (পর্জন্যঃ) মেঘ, (ধারাঃ) মেঘোৎপন্ন বর্ষাধারা, (মরুতঃ) মৌসুমী বায়ু (অস্য) এই অনড্বানের (ঊধঃ) দুগ্ধাশয়, (যজ্ঞঃ) অনড্বানের প্রসাদের জন্য কৃত যজ্ঞকর্ম (পয়ঃ) তৎফলরূপ দুগ্ধ, দুগ্ধ-সদৃশ পুষ্টিকারক, (দক্ষিণা) যজ্ঞকর্মে প্রাপ্ত দক্ষিণাও (অস্য) এই অনড্বানের (দোহঃ) দোহরূপ১।

ভাবার্থঃ সেই জগদীশ্বর পুণ্যাত্মাদের ইচ্ছা পূর্ণ করেন, ও সৃষ্টির আদিতে বেদ প্রদান করে সকলের বৃদ্ধি করেন এবং যেভাবে মেঘ, বায়ু আদি পদার্থ উপকারী, এইভাবে সেই পরমাত্মা মেঘ, পবন আদি ধারণকারী আদিমূল ॥

টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার) ১. মন্ত্রে ৭ দোহের কথন হয়েছে। (১) সুকর্মের লোকে অনড্বান্ দ্বারা প্রদত্ত ভোগ। (২) পর্জন্য অর্থাৎ মেঘরূপী দোহ। (৩) মেঘীয় বর্ষা-ধারা-রূপী দোহ। (৪) মরুতঃ অর্থাৎ মৌসুমী বায়ু-রূপী দোহ। (৫) পরমেশ্বরের প্রসন্নতার জন্য কৃত অকাম্য যজ্ঞকর্ম, যার প্রবৃত্তি অনড্বানের প্রেরণা দ্বারা হয়, এটাও দোহরূপ। (৬) পয়ঃ অর্থাৎ দুগ্ধরূপে প্রাপ্ত আত্মশুদ্ধি-রূপ দোহ। (৭) দক্ষিণারূপী দোহ, অর্থাৎ পরমেশ্বরীয় যজ্ঞকর্মকে ঋত্বিক রূপে করার ফলে পরমেশ্বর রূপী যজমান দ্বারা প্রাপ্ত দক্ষিণা, অর্থাৎ বৃদ্ধি; দক্ষিণা = দক্ষ বৃদ্ধৌ (ভ্বাদিঃ)। [ বিশেষ—অনড্বান্ হলেন সংসার-শকটের বহনকারী পরমেশ্বর, প্রজাপতি, যিনি প্রজাদের মধ্যে বিদ্যমান। এই দোহ হলো চতুষ্পাদ-ব্রহ্মের। চতুষ্পাদ্-ব্রহ্মই কর্ম-ভেদে অনড্বান্-পরমেশ্বর কথিত হন। পর্জন্য আদি দোহ অনড্বান্ পরমেশ্বরকৃত।]

বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা কথিত সব মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন থেকে হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে। যদি কখনও এরকম কোনো টেকনিক বিকশিত হয়, যা দিয়ে পশ্যন্তী ধ্বনিকে শোনা যেতে পারে, তাহলে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেক স্থানে বেদের সস্বর মন্ত্র শুনতে পারবো। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি একাকী না থেকে সমূহতে থাকে। যখন সেই রশ্মির সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়। যখন সেই রশ্মির সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মূলকণার রূপ ধারণ করে নেয়। যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টার) নির্মাণ করে। এই অধ্যায়ে আমরা এই রশ্মির বর্গীকরণ আর তাদের গুণকে বোঝার চেষ্টা করবো। পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে বোঝার জন্য আমাদের এই রশ্মির গুণগুলোকে বুঝে নেওয়া অতি আবশ্যক।

অক্ষর রশ্মি:
সব ধরনের রশ্মি সূক্ষ্ম অক্ষর রূপ অবয়ব দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে আমরা সর্বপ্রথম অক্ষর রূপ পদার্থের উপর বিচার করবো।

মহত্ তত্ত্ব এই অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়। কালের উৎপত্তির সময়েই সাম্যাবস্থার মধ্যে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়। এই রশ্মি পূর্ণতভাবে কখনও অবিদ্যামান হয় না, সেটা মহাপ্রলয়াবস্থাই হোক না কেন। এই রশ্মিগুলো ছন্দ রূপ ধারণ তখনই করে, যখন সেগুলো শব্দের রূপ ধারণ করে নেয়। একে এইভাবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, যেরকম কম্পিউটারের স্ক্রিনে অক্ষর অব্যক্ত হয় আর যখন আমরা কিবোর্ডে বটন চাপ দেই, সেটা আমাদের সমক্ষ ব্যক্ত হয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে মহাপ্রলয় অবস্থাতে অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" রশ্মির সঞ্চরণ দ্বারা ব্যক্ত হয়ে যায়। অক্ষর রশ্মি দুই প্রকারের হয় -
1. স্বর = মনস্তত্ত্বের ভিতরে এটা অত্যন্ত লঘু কম্পনের রূপে (যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম হয়) বিদ্যমান থাকে। এই লঘু রশ্মি স্বয়ং প্রকাশিত হয় অর্থাৎ এদের ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য ব্যঞ্জনের আবশ্যকতা হয় না, কিন্তু এটা নিরন্তর লম্বা দূরত্ব পর্যন্ত গতিমান থাকতে পারে না।

2. ব্যঞ্জন = এই অব্যক্ত সূক্ষ্মতম অবয়বও মহত্তত্ত্বেরই রূপ হয়, যা সর্বদা স্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গতিশীল হতে পারে। মহত্ বা অহংকারের মধ্যে অকস্মাৎ সূক্ষ্মতম স্ফোট রূপে উৎপন্ন ব্যঞ্জন, যা এক স্থানে উৎপন্ন হয়ে রয়ে যায়। সেটা কোনো স্বর রূপী সূক্ষ্ম কম্পনের সঙ্গে মিলিত হলে পরে গতি, বল ও প্রকাশের অব্যক্ত রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটা স্বরের সঙ্গে মিলে সূক্ষ্ম ছন্দের রূপ ধারণ করে নেয়। "ওম্", "ভূঃ" আদি ছন্দ রশ্মি হল এর উদাহরণ ।

[যেরকম মোতি দিয়ে মালা তৈরি হয়, ঠিক সেইভাবে অক্ষর ও ব্যঞ্জন রশ্মির সঙ্গে মিলে বড়ো ছন্দ রশ্মি (ঋচা/মন্ত্র) তৈরি হয়।]

ওম্ (অ+উ+ম্)
এরমধ্যে "অ", "উ" দুটি স্বর তথা "ম্" ব্যঞ্জনের যোগ হয়। যদিও "ম্" ব্যঞ্জন "অ" এবং "উ" এই দুটি স্বরের সঙ্গে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে "ম" তথা "অম্" এবং "মু" তথা "উম্" ছন্দের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু "অ+উ"= "ও"-এর সঙ্গে "ম্" সংগত হয়ে যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেটা সর্বাধিক ব্যাপক বল ও গতির দ্বারা সম্পন্ন হয়। "ওম্" ছন্দের মধ্যে মনস্ তত্ত্ব বা মহত্ তত্ত্বের মাত্রা অন্য যেকোনো দৈবী গায়ত্রী ছন্দের তুলনায় অধিক হওয়ায় এর ব্যাপকতা সর্বাধিক হয়।

🔷 এটা হল অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সব প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মি এর দ্বারাই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
🔷 এই রশ্মি মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করে।
🔷 এই রশ্মিই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করে, আবার বেঁধেও রাখে। মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটা পশ্যন্তী অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, অথচ মহত্ বা কালের মধ্যে পরা অবস্থায়।

মহত্ বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন এটা এক এরকম স্পন্দন, যা এতই সূক্ষ্ম হয়, যেন সেটা স্পন্দনই হয় না অথবা একে এরকম তরঙ্গ বলা যেতে পারে, যার তরঙ্গদৈর্ধ্য প্রায় অনন্ত হবে, তখন আবৃত্তি প্রায় শূন্য হবে। বাস্তবিকতা এই হচ্ছে যে একে অভিব্যক্ত করাই অসম্ভব। এইভাবে বিজ্ঞানের ভাষায় একে অত্যন্ত ক্ষীণ শক্তিসম্পন্ন অব্যক্ত সূক্ষ্মতম এবং সর্বপ্রথম উৎপন্ন ঊর্জার রূপ বলা যেতে পারে।

ধ্যাতব্য হল, সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। উদাহরণ, যেভাবে মস্তিষ্ক বল দ্বারা শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তার থেকে স্থূল বল উৎপন্ন করে দেয়।

প্রাণ ও ছন্দ তত্ত্ব
যখন "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা অর্থাৎ ঊর্জা বেড়ে যায়, সেই সময় চেতন তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যা সর্বত্র একরসবত্ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মির দ্বারা এরকম স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরের মধ্যে এক সঙ্গে তীব্রতে অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ঢেউ উৎপন্ন করছে, সেইভাবে চেতন তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী ঢেউ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে©। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই ঢেউ (রশ্মি) মুখ্যতঃ চার প্রকারের হয় -
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
(স) মাস ও ঋতু রশ্মি
(দ) অন্য ছন্দ ও মরুত্ রশ্মি।

(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
অক্ষর রশ্মির উৎপত্তির পরে নিম্নলিখিত প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -
ব্যাহৃতি রশ্মি
যে রশ্মি বিশেষ রূপে নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে।

প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির মধ্যে সর্বপ্রথম সাত ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি মনস্তত্ত্ব থেকে নিম্নলিখিত ক্রমে হয় -
1. ভূঃ = "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের উৎপত্তির পশ্চাৎ অতি শীঘ্রই এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মিরই উৎপত্তি হয়। যখন কখনও ঋক্® সঞ্জক রশ্মি, পৃথিবী তত্ত্ব বা অপ্রকাশিত কণার উৎপত্তি হয়, তারমধ্যে এই রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মি নানা রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে সক্ষম হয় তথা বাধক সূক্ষ্ম রশ্মিদের নিষিদ্ধ করে ক্রিয়াগুলোকে নির্বাধ বানায়।
2. ভুবঃ = মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভূঃ" রূপ স্পন্দনগুলোকে "ওম্" রশ্মি বিকৃত করে "ভুবঃ" রশ্মিদের উৎপন্ন করে। কালান্তরে এই রশ্মি আকাশ তথা "য়জুঃ" নামক সঞ্জক রশ্মিদের উৎপন্ন করতে সর্বোপরি ভুমিকা পালন করা।
3. স্বঃ = "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বের মধ্যে "স্বঃ" রশ্মি রূপ স্পন্দন উৎপন্ন হয়। কালান্তরে সাম রশ্মি এবং প্রকাশাণুর (ফোটন) নির্মাণের মধ্যে এই রশ্মির ভারী ভূমিকা থাকে।
4. মহঃ= এই সূক্ষ্ম রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পরস্পর সংযুক্ত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
5. জনঃ= এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের মধ্যে সর্বতঃ উৎপন্ন হয়ে তাদের সঙ্গত করে অন্য ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এই রশ্মি বাধক রশ্মিকে প্রতিবন্ধিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
6. তপঃ= এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পৃষ্ঠ ভাগ অথবা কিনারায় অবস্থিত হয়ে তাদের বহির্ভাগে ব্যাপ্ত বা সঙ্গত হয়ে তাদের রক্ষা করে।
7. সত্যম্ = এই রশ্মি সব রশ্মির সঙ্গে সঙ্গত ও পূর্ণ ব্যাপ্ত হয়ে তাদের আধার প্রদান করে তাদের বহির্ভাগে অবস্থিত থাকে।

মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল ব্যাহৃতি রশ্মি বিভিন্ন বেদ-ঋচা রূপী ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দিতে ও সুরক্ষিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই রশ্মির অবিদ্যমানতায় বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি আর তারথেকে নির্মিত বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা আকাশ আদি সবই নির্বল বা নষ্ট হয়ে যাবে।

(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
উপরিউক্ত সূক্ষ্ম রশ্মির পশ্চাৎ প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এর বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সব প্রাণ রশ্মি অক্ষরের সমুদায় হয়। প্রাণ তত্ত্ব দড়ির সমান নিয়ন্ত্রণকারী হয়, এটা মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির মিলন দ্বারাই উৎপন্ন হয়। প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে একটাই, কিন্তু তার নানা প্রকারের গতির কারণে নানা ভেদ হয়ে যায়। মহর্ষি ব্যাস বলেছেন সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়। এটা হল মুখ্য প্রাণ। বস্তুতঃ এই রশ্মি এগারো প্রকারের হয়। মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন স্পন্দনের তীব্রতা, গতি এবং স্বভাব আদির ভেদ হতে একটা প্রাণ তত্ত্বেরই এগারোটা রূপ হয়। চলুন, এই রশ্মিগুলোর গুণ সংক্ষেপে জেনে নিই -
1. সূত্রাত্মা বায়ু = সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিকে পরস্পর সঙ্গত করার বিশেষ গুণ যুক্ত হয়। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলোই। মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এটা এরকম অব্যক্ত স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়, যা পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জালের সমান বোনা থাকে। এই রশ্মিগুলো এই রকম উৎপন্ন হয় যে প্রত্যেক রশ্মির মধ্যে থেকে আরও সূক্ষ্ম রশ্মি উৎসর্জিত হয়ে একটা জাল বানায়, এই কারণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি নিজের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রূপ সূক্ষ্ম রশ্মির (স্পন্দনের) দ্বারাই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের সঙ্গে তথা পরস্পর বেঁধে রাখে।

সূত্রাত্মা বায়ুকে একটা সুতোর সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে, যা সব কণা বা রশ্মিকে একে-অন্যের সঙ্গে বোনা থাকে। যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির ধনঞ্জয় রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির মধ্যে প্রতিকর্ষণ একদম হয় না।

2. ধনঞ্জয় = এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক তীব্র গতির স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মির গতি প্রকাশের গতির অপেক্ষায় চার গুণ অধিক হয়। যদি প্রকাশের গতি তিন লক্ষ গুণ কিমি প্রতি সেকেণ্ড ধরা হয়, তাহলে ধনঞ্জয় রশ্মির গতি প্রায় বারো লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড হবে। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এরথেকে অধিক গতি কোনো পদার্থের মধ্যে হয় না। এখানে আপনার মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুসারে তো প্রকাশের থেকে বেশি গতি অন্য কারও হতে পারে না, তাহলে ধনঞ্জয় প্রাণের এত গতি কিভাবে হতে পারে? এটা কি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হচ্ছে না? এর উত্তরটা হল এই রকম যে, সেখানে প্রকাশের গতি আকাশের মধ্যে করা হয়েছে অর্থাৎ আকাশের মধ্যে যেকোনো বস্তুর গতি প্রকাশের থেকে অধিক হবে না। অন্যদিকে ধনঞ্জয় রশ্মি হচ্ছে আকাশের থেকে সূক্ষ্ম, এইজন্য তাকে গতি করার জন্য আকাশের আবশ্যকতা হয় না, সেটা তো মনস্তত্ত্বের মধ্যে গতি করে। এইভাবে এই রশ্মি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরোধ করে না।

এই রশ্মির সংযোগ বা আচ্ছাদন দ্বারা যেকোনো রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের গতি তীব্র হয়ে যায়। প্রকাশ বা যেকোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এই ধনঞ্জয় রশ্মির দ্বারাই টেনে নিয়ে আসা হয়, এই কারণে তার গতি ও শক্তি তীব্র হয়। এই রশ্মি যেরকম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং তীব্রগামী সূক্ষ্ম কণার গতির কারণ হয়, সেইরকম সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে মিলে কণার অক্ষের উপর ঘূর্ণনেরও কারণ হয়।

3. প্রাণ = সব প্রাথমিক প্রাণের মধ্যে এই প্রাণ রশ্মির স্থান সর্বোচ্চ মানা হয়, এর নাম দিয়েই সব প্রকারের প্রাণ রশ্মিদের গ্রহণ করা হয়। যখন মনস্ তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো তীব্র বেগ ও বলের সঙ্গে গমন করে, তখন এরথেকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন রূপে উৎপন্ন রশ্মিদের "প্রাণ" বলা হয়। এরমধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য থাকে। এটা সবার আকর্ষক হয়ে সবাইকে আকর্ষণ বলের সঙ্গে যুক্ত করে সেই কণা বা তরঙ্গের মধ্যে ভিতর থেকে বাইরে নিরন্তর সঞ্চারিত হতে থাকে। এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানেই আকর্ষণ বলের শক্তি আছে, সেখানে এই বলের মূল কারণ রূপ এই তত্ত্বের শক্তি অবশ্যই বিদ্যমান আছে। মহর্ষি ব্যাস -এর প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে কথন হল -
"প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্র০ সূ০ 1.3.39)
এর দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রাণ সূক্ষ্ম স্পন্দনের হয়। ধ্যান রাখবেন যে, এই পরিভাষা কেবল এই প্রাণ রশ্মির জন্য নয় বরং সব প্রাণ রশ্মিগুলো জন্য।

4. অপান= এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতর "ওম্" রশ্মির দ্বারা এইরকম স্পন্দন, যার গতি প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণের অপেক্ষায় ঠিক বিপরীত তথা যা বিভিন্ন স্পন্দনকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রাণ ও অপান উভয় রশ্মি যৌথভাবে থাকার পরেও পরস্পর বিপরীত দিশাতে স্পন্দিত হতে থাকে, এই কারণে অপান রশ্মি প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করার মূল কারণ হয়। প্রাণ রশ্মির প্রতি এই রশ্মির আকর্ষণ ভাব থাকে।

প্রাণ রশ্মি সত্বপ্রধান এবং অপান রশ্মি রজস্ প্রধান হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান রশ্মি ক্রমশঃ বল ও ক্রিয়া প্রধান হয়। বস্তুতঃ এই উভয় প্রকারের রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত থাকে। কোথাও এর পৃথক্পন দেখা যায় না। এর সংযুক্ত স্বভাবের দ্বারা প্রত্যেক পদার্থের বল এবং ক্রিয়া দুটোই সম্পন্ন হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে প্রাণের প্রাধান্য তথা অপান গৌণ রূপে বিদ্যমান হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য কিন্তু ক্রিয়াশীলতা গৌণ হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে অপানের প্রাধান্য এবং প্রাণ গৌণ হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে ক্রিয়াশীলতা প্রধান তথা বলের ন্যূনতা হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত বল আকর্ষণ এবং প্রতিকর্ষণ দুই রূপেই বিদ্যমান হয়, কিন্তু গুরুত্বাকর্ষণ বল প্রায়শঃ আকর্ষণেরই প্রভাব রাখে। এর কারণ হল এই বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মির প্রাধান্য তথা অপানের অপ্রাধান্য হওয়া। এইদিকে ক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিতে বিচার করলে পরে, তাহলে যে পদার্থের মধ্যে যত অধিক গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা দ্রব্যমান হবে,সেটা ততই কম সক্রিয় হবে। এই দৃষ্টিতে এখানে অপান প্রাণের ন্যূনতা বা অবিদ্যমানতা সিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে গুরুত্ব বল রশ্মির মধ্যে কেবল আকর্ষণ বলই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সেই রশ্মির ক্রিয়াশীলতা খুবই কম হয়, এই কারণে এটা অত্যন্ত কম আবৃত্তির হয় অর্থাৎ নির্বল হয়।

প্রশ্ন - যখন প্রাণ এবং অপান উভয় যুগ্মেরই রূপে থাকে তখন এরমধ্যে কারও প্রাধান্য ও কারও অপ্রাধান্যতা কিভাবে বলা যেতে পারে?

উত্তর - যুগ্মের মধ্যেও একটা অধিক বলবান্ হতে পারে আর যেটা বলবান্ হয়, তারই প্রাধান্য মানা হয়। যেরকম কিছু প্রাণীর মধ্যে নর প্রধান হয়, আবার কিছুর মধ্যে মাদা।

5. ব্যান = এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এই ভাবে উৎপন্ন হয় যে প্রাণ ও অপানের মাঝে সন্ধির কার্য করতে পারে। ব্যান রশ্মি ছাড়া প্রাণ ও অপান সঙ্গে-সঙ্গে সঙ্গত থাকতে পারবে না। ব্যান রশ্মি না কেবল প্রাণ ও অপানকে বেঁধে রাখে, অপিতু অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে বাঁধতে প্রাণ ও অপান রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে প্রকাশিত কণাকে অপ্রকাশিত কণার অপেক্ষায় অতি ন্যূন সঘনতা প্রদান করে। যখন "ওম্" রূপী অক্ষর রশ্মি দুই বার আবৃত্ত হয়ে পুনঃ পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন ব্যান নামক প্রাথমিক প্রাণকে উৎপন্ন করে।

6. সমান = যখন "ওম্" রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে সম গতি ও বলের সঙ্গে স্পন্দন উৎপন্ন করে, তখন সেই সময় সমান নামক প্রাণ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির বল ও গতিকে সুষম বানিয়ে রাখে, বিশেষ করে প্রাণ ও অপান নামক প্রাণ রশ্মিদের সুষম বানিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই রশ্মি সমান লয়ের সঙ্গে নিরন্তর গমন করতে থাকে।

7. উদান = যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির স্পন্দন এই ধরনের হয় যে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণের প্রাদূর্ভাব হতে থাকে, সেই সময় উৎপন্ন স্পন্দন ঊর্ধ্ব গমনকারী হয়। এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণ উৎপন্ন করার সঙ্গে গতি করে, এরদ্বারা উৎপন্ন উদান নামক স্পন্দন ঊর্ধ্বগমন যুক্ত হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মির মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণ ( অর্থাৎ কোনো বলের বিরুদ্ধে বল লাগানো। যেমন, ঘর্ষণ বল লাগানো বলের বিরূদ্ধে কার্য করে) উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়। উদান রশ্মি নিয়মিত, নিয়ন্ত্রিত লয়ের সঙ্গে গতি করে আর ব্যাপক স্তরে এক প্রকারের দীপ্তিকে উৎপন্ন করে।

8. নাগ = এটা হচ্ছে প্রাণ নামক প্রাণ তত্ত্বের উপপ্রাণ, যা প্রাণ নামক রশ্মির ক্ষুব্ধ ও অব্যবস্থিত হলে পরে তাদের নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। নাগ প্রাণ রশ্মির প্রাধান্যের মধ্যেই ঊষ্মার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয়। এর স্পন্দন অতি সূক্ষ্ম ও ক্ষীণ হয়, যা অন্য প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্থিরের মতো মানা যেতে পারে।

9. কূর্ম = এই রশ্মি হল অপান প্রাণের উপপ্রাণ, যা অপান রশ্মিদের বল ও প্রেরণ প্রদান করে। আমরা জানি যে, অপান প্রাণ রশ্মিগুলোর প্রতিকর্ষণ বল প্রধান হয়, তবুও ব্যান রশ্মির মাধ্যম দ্বারা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই কূর্ম উপপ্রাণ সংযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে কচ্ছপের মতো অপান রশ্মিদের কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হয়। যেভাবে মস্তক সম্পূর্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেইভাবে কূর্ম রশ্মি প্রাণ ও অপানের মাঝে নিয়ন্ত্রণ বানিয়ে রাখতে নিজের ভূমিকা পালন করে।

10. কৃকল = এই প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে উদান প্রাণের উপপ্রাণ। ভেদন ক্ষমতা বা তীব্রতাকে প্রদান বা প্রাপ্তকারী প্রাণ তত্ত্বকেই কৃকল বলা হয়। যখন উদান রশ্মির উৎক্ষেপণ বলের মধ্যে কোনো বাঁধা আসে, তখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা কৃকল প্রাণ রশ্মি রূপ স্পন্দন অকস্মাৎ উৎপন্ন হয়ে উদান রশ্মিদের ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে বল প্রদান করে তার উৎক্ষেপণ বলকে সক্রিয় বা নির্বাধ করে দেয়।

11. দেবদত্ত = এটা হচ্ছে সমান প্রাণের উপপ্রাণ। এটা বিদিতই যে, সমান প্রাণ রশ্মিগুলো, প্রাণ তথা অপান রশ্মিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। এই রশ্মি সমান প্রাণের সঙ্গে সমলয় দ্বারা স্পন্দিত হয়ে প্রাণ ও অপানের লয় বানিয়ে রাখে।

জ্ঞাতব্য = বিভিন্ন উপপ্রাণ রশ্মির (স্পন্দনের) গতির দিশা নিজের-নিজের প্রাণ রশ্মির গতির দিশা থেকে বিপরীত হয়, আবার এটার স্পন্দন সম্বন্ধিত প্রাণ রশ্মির স্পন্দনের থেকে সূক্ষ্ম হয়, যা এর নিকট নিরন্তর উৎপন্ন হতে থাকে।
____________________________________________
© "ওম্" ছন্দ রশ্মির সঙ্গত না হলে সমস্ত প্রাণ রশ্মি ডার্ক এনার্জির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
® এই রশ্মির সম্বন্ধে পরে বলা হবে।

রশ্মি কাকে বলে?
মহর্ষি য়াস্কের অনুসারে, সেই সূক্ষ্ম কম্পন, যে নিজের তুলনায় স্থূল কম্পনকে উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত করে, তাকে রশ্মি বলে। রশ্মির মধ্যে সবথেকে সূক্ষ্ম পরা "ওম্" রশ্মি প্রকৃতির সাম্যাবস্থাকে, যারমধ্যে প্রকৃতির তিন গুণ (সত্, রজ আর তম) এর পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা থাকে, তাকে ভঙ্গ করে।

সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড (সমস্ত কণা, তরঙ্গ, আকাশ আদি) এই রশ্মির দ্বারাই নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত। যেকোনো রশ্মি বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা জানা গেছে এমন যেকোনো তরঙ্গের তুলনায় সূক্ষ্ম।

বাক্ রশ্মির (বাণী) চারটি রূপ
1. পরা - পরা বাণী হল সব বাণীর মধ্যে সবথেকে সূক্ষ্ম আর মূল। এটা হল এক এরকম সূক্ষ্ম বাণী, যে সর্বাধিক সূক্ষ্ম, সর্বত্র ব্যাপ্ত, অত্যধিক মাত্রা তথা সর্বদা অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান, সকলকে নিজের সঙ্গে বন্ধনকারী, কিন্তু স্বয়ং সবার থেকে মুক্ত এবং সবথেকে উচ্চতম অবস্থার। এই সূক্ষ্ম বাণীকে কান দিয়ে কখনও শোনা সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সূক্ষ্মতম রূপে ব্যাপ্ত থেকে প্রত্যেক কণাকে নিজের থেকে সমন্বিত রাখে। একে অত্যুত্কৃষ্ট য়োগী পুরুষই অনুভব করতে পারে। একে বর্তমানের যেকোনো বৈজ্ঞানিক টেকনিক দিয়ে জানা সম্ভব নয়। মানুষ যেই বৈখরী বাণীকে শোনে বা শোনায়, সেই বাণী আত্ম তত্ব দ্বারা পরা অবস্থাতেই গ্রহণ বা উৎপন্ন করা হয়। এই বাণীর মাধ্যম হল প্রকৃতি (সৃষ্টির সবথেকে মূল উপাদান পদার্থ)।

2. পশ্যন্তী - এই বাণী পরা বাণীর অপেক্ষায় স্থূল তথা এটা বিভিন্ন বর্ণকে তার স্বরূপ প্রদান করে বীজের সমান হয়। এটা পরা বাণীর থেকে স্থূল এবং মধ্যমার থেকে সূক্ষ্ম হয়। পশ্যন্তী বাক্ মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হয় আর এটাই হচ্ছে এর আধার এবং মাধ্যম। সমস্ত প্রাণ ও ছন্দ রশ্মিগুলো এই বাক্ তত্ত্ব দ্বারাই এবং এই মনস্তত্ত্বের মধ্যেই উৎপন্ন হয়। সম্ভবতঃ এই বাণীকে ভবিষ্যতে কোনদিন কোনো সূক্ষ্ম টেকনিক দিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি কান দিয়ে কোনো কথা শোনে, তখন কানের তন্ত্রিকার দ্বারা সংবেদনা মস্তিষ্ক পর্যন্ত পুনঃ মনস্তত্ত্বে পৌঁছায়। সেই সংবেদনার মধ্যে বর্ণ বিদ্যমান থাকে। মনের সহযোগ দ্বারা মস্তিষ্ক বর্ণের শনাক্তকরণ করে। সেই বাণীই হল পশ্যন্তী, যা কান দিয়ে তো শোনা যায় না, কিন্তু মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনস্তত্ত্ব যাকে অনুভব করে।

3. মধ্যমা - এই বাক্ -কে পশ্যন্তীর থেকে স্থূল ও বৈখরীর থেকে সূক্ষ্ম মানা হয়। এরমধ্যে বর্ণের রূপ পশ্যন্তীর অপেক্ষায় স্থূল এবং বৈখরীর অপেক্ষায় সূক্ষ্ম হয়। কর্ণপটহে যে ধ্বনি শোনা যায়, সেটা যে স্বরূপকে প্রাপ্ত করে, তাকে মধ্যমা বলে। মস্তিষ্ক ও কানের মাঝে যেই বাণীর সঞ্চরণ হয়, এটা হচ্ছে সেটাই। এই বাণীর মাধ্যম হল আকাশ তত্ত্ব (space)।

4. বৈখরী - এটা হল সেই স্থূল বাণী, যাকে আমরা বলি ও শুনি। এই বাণীটাই বক্তা ও শ্রোতার মাঝে গমন করে, যা শেষে শ্রোতার মস্তিষ্কে গিয়ে পশ্যন্তীর রূপ নেয়। অর্থাৎ যখন কোনো মানুষ বাণীর উচ্চারণ করে, তখন সামনের বক্তার মুখ থেকে আমাদের কান পর্যন্ত আসা বাণীটা হল বৈখরী, কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেটা যায় সেটা হল মধ্যমা, মস্তিষ্ক থেকে মন যেই রূপে গ্রহণ করে, সেটা হল পশ্যন্তী আর মন থেকে চেতন স্বরূপ আত্মা এটাকে পরা রূপে গ্রহণ করে।

উচ্চারণ করার সময় সর্বপ্রথম বাক্ (বাণী) আত্মার ভিতর উৎপন্ন হয়ে মন পর্যন্ত যেই রূপে যায়, সেটা পরা বাণী বলে। মন বা বুদ্ধি সেই পরা বাণীকে পশ্যন্তীতে পরিবর্তন করে দেয়। মস্তিষ্ক পর্যন্ত এটা পশ্যন্তী রূপে প্রেরিত হয়। এর পশ্চাৎ মস্তিষ্ক সেই বাণীকে মধ্যমা স্বরূপে পরিবর্তন করে আর তন্ত্রিকায়ের মাধ্যমে সেই বাণী আমাদের স্বরযন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছায়। শেষে স্বরযন্ত্র সেই মধ্যমা বাণীকে বৈখরীতে পরিবর্তন করে দেয়। এর মাধ্যম হল স্থূল পদার্থ (শক্ত, দ্রব্য, গ্যাস আদি)। এই বাণী চাপের মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে প্রেরিত হয়।

এখানে বাণীর এই পরিবর্তন সেই ভাবে হয়, যেভাবে ধ্বনি ধ্বনিগ্রাহী (মাইক্রোফোন) দিয়ে বিদ্যুৎ সংকেত (ইলেকট্রিক সিগনাল) আর তারপর বিদ্যুৎ সংকেত ধ্বনি-বিস্তারক (লাউস্পিকার) দিয়ে পুনঃ ধ্বনির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

বাক্
সামান্য ভাষায় একে ধ্বনি বলা হয়। এটা হল সেই প্রথম কম্পন, যা সৃষ্টির মূল উপাদান পদার্থের মধ্যে চেতন তত্ত্ব দ্বারা উৎপন্ন হয়। একে আমরা পরা বাণী রূপে পরিভাষিত করে এসেছি। এই কম্পন অর্থাৎ রশ্মি হল এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ ও সঞ্চালনের মধ্যে নিয়ন্ত্রক। এই কম্পনের পূর্বে কোনো ধরনের কোনো স্পন্দনের কল্পনা সম্ভব না। অন্য সব রশ্মি হল এরই বিভিন্ন রূপ।

ছন্দ
আচ্ছাদন আর বল দেয় এরকম রশ্মিগুলোকে ছন্দ রশ্মি বলে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সমস্ত রশ্মি কাউকে-না-কাউকে আচ্ছাদিত করে আছে আর বল প্রদান করে, তাই সব রশ্মিকে ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মিগুলো হচ্ছে বাক্-এরই রূপ। সৃষ্টির মধ্যে এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্ত্রী রূপ ব্যবহার করে।

প্রাণ রশ্মি
যে রশ্মি বল, গতি আর প্রকাশ দেয়, তাদের প্রাণ রশ্মি বলে। সমস্ত ছন্দ রশ্মির গুণ প্রাণ রশ্মির মধ্যে আর সমস্ত প্রাণ রশ্মির গুণ ছন্দ রশ্মির মধ্যে থাকে, এই কারণে মূলতঃ এটাও হচ্ছে বাক্ রশ্মিরই বিশেষ রূপ। ছন্দ রশ্মির প্রতি এর বিশেষ আকর্ষণ ভাব থাকে আর এটা তাদের সাপেক্ষে পুরুষ রূপ ব্যবহার করে।

মরুত্
ছোটো ছন্দ রশ্মিকে মরুত্ বলে। প্রাণ রশ্মির প্রতি এরও আকর্ষণ ভাব থাকে আর এটা তাদের সাপেক্ষে স্ত্রী রূপ ব্যবহার করে। এই রশ্মি সমূহতে গমন করে।

সোম
সোম রশ্মি মরুত্ রূপই হয়। এটা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অপ্রকাশিত অবস্থার মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং বিদ্যুৎ আবেশিত তরঙ্গ আকাশে গমন করার সাথে সোম রশ্মিগুলোকে অবশোষিত করে থাকে। এর তাপমাত্রা অনেক কম হয়।

ছন্দকে রশ্মি বলা হয় ও ছন্দ মন্ত্রকে বলা হয়। তাই বস্তুত বেদ মন্ত্রকে রশ্মি বলা হয়। এ রশ্মি প্রাণ স্বরূপ হয় তাই একে প্রাণ রশ্মিও বলা হয়। অতএব মন্ত্রকেই পদার্থ বলা হয় , ছন্দকেই পদার্থ বলা হয় , ছন্দই মন্ত্র ও মন্ত্রই ছন্দ ।

*ছন্দের প্রাণ রশ্মি হওয়ার প্রমাণ:-*
১|প্রাণ বৈ ছন্দাংসি ( কৌশিক ব্রাহ্মণে ১৭|২)
অর্থাৎ ছন্দ প্রাণ রূপে হয় ।
এবার , প্রাণ নিয়ে মহর্ষি বেদ ব্যাস বলেছেন:-
২|প্রাণা কম্পনাত্ ( ব্রহ্ম সূত্র ১|৩|৩৯)
অর্থাৎ কম্পন করবার জন্য প্রাণ বলা হয়।
৩|প্রাণা রশ্ম্যঃ ( তৈতরীয় ব্রাহ্মণ ৩|২|৫|২)
অর্থাৎ রশ্মিকে প্রাণ বলা হয়।
তাই ইহার দ্বারা সিদ্ধ হচ্ছে যে ছন্দ হচ্ছে কম্পন স্বরূপ প্রাণ যা রশ্মি (অর্থাৎ প্রাণ রশ্মি)।
৪|প্রাণ এবঃ রজ্জু ( কাণবীয় শতপথ ব্রাহ্মণ 3/¼/2)
অর্থাৎ প্রাণ হচ্ছে রজ্জু (দড়ি) । রজ্জু কোনো অন্য পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই প্রাণ রশ্মি বলা হয়। অর্থাৎ বেদ মন্ত্র কোনো দ্বিতীয় পদার্থ, রশ্মি , কণ আদিকে নিয়ন্ত্রণ করে এ জন্য বেদ মন্ত্র রজ্জু , রশ্মি বলা হয় অর্থাৎ বেদ মন্ত্রকেই প্রাণ রশ্মি বলা হয়।

এ সকল প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হচ্ছে যে:-
১| বেদ মন্ত্র কম্পন স্বরূপ।
২| বেদ মন্ত্র ছন্দ স্বরূপ।
৩| ছন্দ হচ্ছে পদার্থ ।
৪| ছন্দ প্রাণ রশ্মি ।
৫| ছন্দকেই বেদ বলা হয়।
৬| বেদ রশ্মি স্বরূপ।
৭| বেদ প্রাণ রশ্মি স্বরূপ ।
৮| বেদ মন্ত্র হচ্ছে পদার্থ ।

বেদের সমস্ত ছন্দকে এক সাথে মিলিয়ে প্রাণ রশ্মি বলা হয় যেখানে আলাদা আলাদা ছন্দ (ছন্দ রশ্মি) আছে যেমন গায়ত্রী, অনুষ্টুপ ইত্যাদি যার থেকে আলাদা রঙ নির্গত হয় তাই তা পদার্থ স্বরূপে যা ওপরে পিঙ্গল ছন্দ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে । অর্থাৎ বেদ মন্ত্র = ছন্দ স্বরূপ= রশ্মি = ছন্দ রশ্মি = প্রাণ রশ্মি = পদার্থ ।

ছন্দ শব্দটিতে লোকে এটি বোঝে যে বেদে যে সব মন্ত্র আছে, উহার কোনো বাক্যকে ছন্দ বলা হয়। আর যেমন গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ আদি এসবই ছন্দ । এ কথা নিশ্চিত সত্য । কিন্তু বেশির ভাগ লোকেই জানেনা যে ছন্দকেই বেদ বলা হয়। বেদই ছন্দ রূপ। বেদে আসা শব্দের সমূহকেই ছন্দ বলা হয় অর্থাৎ বেদ হচ্ছে ছন্দ রূপ। বেদে অনেক ছন্দ আছে। সরল শব্দে যদি বলা হয় তো বেদের কোনো মন্ত্রে যতো শব্দ আছে, তার মধ্যে কিছু নির্ধারিত শব্দের সমূহকেই ছন্দ বলা হয় অর্থাৎ এক মন্ত্রে একের অধিক অথবা বহু ছন্দ হতে পারে।
(ক) ছন্দের বেদ হওয়ার প্রমাণ :-
বেদঃ বেদাংশ্ ছন্দাংসি ।।( গোপথ ব্রাহ্মণ ১|৩২)
অর্থাৎ ছন্দকেই বেদ বলা হয়।
ছন্দ কেবল মন্ত্র অথবা শব্দকেই নয়। ছন্দ একটি পদার্থ অর্থাৎ বেদ মন্ত্রে যতোগুলি ছন্দ আছে, উহা সকল ছন্দকে পদার্থ বলা হয়।

(খ) ছন্দের পদার্থ হওয়ার প্রমাণ :-
মহর্ষি পিঙ্গল রচিত ছন্দ শাস্ত্র যাকে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী আপ্ত পাঠ বিধির অন্তর্গত এটিকে সম্মিলিত করেছে ও ছন্দ শাস্ত্র , যাকে এক বেদাঙ্গ মানা হয় । মহর্ষি পিঙ্গল ছন্দ শাস্ত্রের তৃতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন ছন্দকে বিভিন্ন রঙ (Colour) বলেছেন ।
"সিতসারঙ্গপিশঙ্গকৃষ্ণনীললোহিতগৌরা বর্ণা:" ( পিঙ্গলছন্দ সূত্রম্ ৩|৬৫)
অর্থাৎ গায়ত্রী ছন্দের রঙ - শ্বেত ( সিত)
উষ্ণিক ছন্দের রঙ- রঙিন, রঙ- বিরঙ( সারঙ্গ )
অনুষ্টুপ ছন্দের রঙ- লাল মিশ্রিত বাদামি ( পিশাঙ্গ)
বৃহতী ছন্দের রঙ - কালো (কৃষ্ণ)
পংক্তি ছন্দের রঙ- নীল ( নীলা)
ত্রিষ্টুপ ছন্দের রঙ- লাল ( লোহিত)
জগতি ছন্দের রঙ- গৌর( গৌরা)

যদি ছন্দ কেবল শব্দ রূপ হয় তো উহায় প্রকাশ কোথা থেকে আসবে? এটি দ্বারা কি প্রমাণিত হয়? এটির দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে ছন্দকে "পদার্থ" বলে। যদি তা না হয় তবে সেখান থেকে আলাদা রঙ (প্রকাশ) আসতে পারে না।
এবার পদার্থ বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ লোক এটি কদাপি বুঝতে পারে না যে ছন্দে রঙ বা বিভিন্ন প্রকাশ হওয়ার জন্যই ছন্দ পদার্থ হওয়ার প্রমাণ যা মহর্ষি পিঙ্গল দ্বারা রচিত ছন্দ শাস্ত্রের দ্বারা সিদ্ধ হইল ।

ঋষি দয়ানন্দের যজুর্বেদ ভাষ্যে "ছন্দ " এর অর্থ করে লিখেছেন :-
(i) পরিগ্রহণম্ (যজুর্বেদ ভাষ্য 14/5)
(ii) বলম্ (যজুর্বেদ ভাষ্য 14/9)
(iii)বলকারী, প্রযত্নম্ (যজুর্বেদ ভাষ্য 14/18)
(iv)ঊর্জানম্ , প্রকাশনম্ (যজুর্বেদ ভাষ্য 15/4)
(v)প্রকাশনম্ , প্রকাশরূপ (যজুর্বেদ ভাষ্য 15/5)
(vi)স্বচ্ছন্দতা (যজুর্বেদ ভাষ্য 19/74)
এই প্রমানের দ্বারা সিদ্ধ হলো ছন্দ রশ্মি স্বচ্ছন্দ রূপে বিচরণ করতে করতে বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিকে সব দিক থেকে গ্রহণ করে নেয় ও বল, প্রকাশ ও ঊর্জা উত্পন্ন করতে করতে নানা পদার্থ কে ধারণ ও সক্রিয় করে । এই ছন্দের দ্বারাই ব্রহ্মাণ্ডে বিভিন্ন প্রকারের কণ উত্পত্তি হয়।

অতএব ঋষি দয়ানন্দের এ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে ছন্দ পদার্থকে বলা হয়। ছন্দ অর্থাৎ পদার্থ অর্থাৎ বেদ মন্ত্র ।
ছন্দ বিষয়ে অন্যান্য ঋষি গণের প্রমাণ:-
১| ছন্দাংসি অচ্ছাদনাত্ ( নিরুক্ত ৭|১২)
অর্থাৎ ছন্দ কোনো কণকে, কোনো পদার্থকে, কোনো কিরণকে লোক- লোকান্তরে আচ্ছাদিত করে , এজন্য ছন্দকে পদার্থ বলা হয়।
২| ছন্দ উহা যা সবাইকে আচ্ছদন করে । ( দৈবত ব্রাহ্মণ ৩|১৯)
অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডে উপস্থিত সমস্ত পদার্থ, কণ, ধাতু, দ্রব্য, গ্যাস, ইলেকট্রনস্, প্রোটোনস্, কোয়ারকস্, অগ্নি, বায়ু, জল, আকাশ, অন্তরিক্ষ, গ্রহ, উপগ্রহ, সৌরমন্ডল, সূর্য, চন্দ্র, তারা, উল্কা- পিন্ড , ধূমকেতু আদি সমস্ত পদার্থ ছন্দের দ্বারা আচ্ছাদিত । আমাদের শরীরের এক এক কোষ ছন্দের দ্বারা আচ্ছাদিত । ইহার সব নির্মাণ বেদ মন্ত্র অর্থাৎ ছন্দের দ্বারা হয়েছে । ও এ ছন্দ কী? ছন্দ হচ্ছে পদার্থ যা বেদ মন্ত্র ।

এই প্রকারেই ছন্দ বিষয়ে অন্য ঋষিদের প্রমাণ :-
১| ছন্দ স্তোতৃণাম ( নিঘন্টু 3/16)
২| ছন্দতি অর্চতিকর্মা ( নিঘন্টু 3/14)
৩| ছন্দাংসি ছন্দয়নতীতী বা ( দৈবত ব্রাহ্মণ 3/19)
৪| ছন্দাংসি বৈ বাজিন: ( গোপথ ব্রাহ্মণ 1/20)
৫| ছন্দাংসি বৈ ধুরঃ ( জৈমিনী ব্রাহ্মণ 3/210)
৬| ছন্দোবীর্যজ্ঞস্থয়তে ( জৈমিনী ব্রাহ্মণ 2/431)
৭| উপবরহণম্ দদাতি । এতদৈ ছন্দাংসি রূপম্( কপিষ্ঠল সংহিতা 44/4)
৮| ছন্দোভিহীদঃ সর্ব বয়ুনং নদ্ধম্ ( শতপথ ব্রাহ্মণ 4/2/2/4)

এই প্রমানের দ্বারা ছন্দ রশ্মির বহু গুণ স্পট হয় :-
(ক) ছন্দ রশ্মি প্রকাশ কে উত্পন্ন করে।
(খ) ছন্দ রশ্মি কোনো কণ, পরমাণু, আদিকে সমস্ত দিক থেকে আচ্ছাদন করে।
(গ) ছন্দ রশ্মি বলের সংযোজিকা ও উতপাদিকা
(ঘ) ছন্দ রশ্মি বিভিন্ন কণ, ও সমস্ত লোকের আধার রূপকে ধারণ করে।
(ঙ) ছন্দ রশ্মি সমগ্র সৃষ্টির সংযোগ- বিয়োগ আদি ক্রিয়াকে সম্পাদিত ও সমৃদ্ধ করে ছড়ায় ।
(চ) সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড ছন্দ রশ্মি দ্বারা বাধিত।

সৃষ্টি যখন থেকে তৈরী হওয়া শুরু হয়, সেই সময় প্রারম্ভিক বৈদিক দৈবী ছন্দ "ওম্" এর উৎপত্তি সর্বপ্রথম এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সর্বত্র হয়। এরপর অন্য গায়ত্র্যাদি ছন্দের বিভিন্ন রূপের উৎপত্তি এই ব্রহ্মাণ্ডে হতে থাকে। এইসব ছন্দ বিভিন্ন প্রকার প্রাণ রশ্মিরই রূপ ছিল। তার মানে হল বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম বায়ুরূপ এইসব ছন্দরশ্মি সারা ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে ভরে যায়, কিংবা এরই স্থূল রূপ দ্বারা স্থূল বায়ু, অগ্নি আদির উৎপত্তি হয়। তবে প্রতিটি পদার্থ এই পদার্থেরই ঘনীভূত রূপ হয়। যখন মানুষের উৎপত্তি এই পৃথিবীতে হয়েছিল, তখন মানব প্রজন্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কার যুক্ত চারজন ঋষি, যাঁদের নাম অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা ছিল, তাঁরা আকাশে বিদ্যমান সেইসব ছান্দস তরঙ্গকে সমাধি, বিশেষ করে সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে অনুভূত করেন। এই সময় যেমন বিভিন্ন রেডিও তরঙ্গ সম্পূর্ণ আকাশে বিদ্যমান আছে, কিন্তু সবাই তার অনুভব করতে পারেন না। যার কাছে মোবাইল আদি ইলেকট্রনিক উপকরণ আছে, দূরদর্শন, রেডিও, ইন্টারনেট আদি ব্যবস্থা আছে, তারাই এইসব রেডিও তরঙ্গ থেকে একটা ব্যবস্থানুসারে ইচ্ছিত তরঙ্গের গ্রহণ করতে পারেন।

আমি যে ছান্দস রশ্মির চর্চা করছি, সেগুলো হল রেডিও তরঙ্গের থেকেও অতি সূক্ষ্ম। সেগুলোকে এইসব যন্ত্রের দ্বারা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এই রশ্মির মাধ্যম (আধার) আকাশ না হয়ে মনস্তত্ত্ব হয়, এইজন্য এগুলোর গ্রহণ কেবল সমাধিস্থ মনের দ্বারাই হওয়া সম্ভব। এই কারণে কেবল সেই চারজন ঋষি যাঁরা প্রথম মানব প্রজন্মের মধ্যে কিছু বিশিষ্ট যোগ্যতাধারী ব্যক্তি ছিলেন, তাঁরাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে অন্তঃকরণের রশ্মির দ্বারা পরমাত্মার সানিধ্য ও সহায়তায় সেইসব সর্বতোব্যাপ্ত ছান্দস তরঙ্গের মধ্যে তরঙ্গকে আকর্ষিত বা গ্রহণ করা শুরু করেন। সেই সময়ে জন্মা অন্য মানুষের এমন সামর্থ্য ছিল না যে তাঁরা সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারবেন। আজও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে লক্ষ-লক্ষ বছর পূর্বের বিভিন্ন ধ্বনি তরঙ্গ অতি সূক্ষ্ম অবস্থায় বিদ্যমান আছে। যদি মানুষ এমন টেকনিক বিকশিত করতে পারে যা দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত আদি কালে বলা হয়েছে এমন বিভিন্ন ধ্বনির সূক্ষ্ম রূপকে শুনতে পারবে, তো সেই ধ্বনিকে শোনা হয়তো সম্ভব হবে। বৈদিক ছন্দ এইসব ধ্বনির থেকেও সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান থাকে। ঋগ্বেদে বৈদিকী বাক্ গ্রহণ করার সুন্দর বিজ্ঞানকে এইভাবে দেখানো হয়েছে -

আমি এখানে প্রসঙ্গানুসারে এই মন্ত্রগুলোর কেবল আধিভৌতিক ভাষ্য করবো, তারমধ্যে প্রথম মন্ত্রের ভাষ্য হল এইরূপ -

বৃহস্পতে প্রথমম্ বাচো অগ্রম্ য়ৎপ্রৈরত নামধেয়ম্ দধানাঃ। 

য়দেষাম্ শ্রেষ্ঠম্ য়দরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাম্ নিহিতম্ গুহাবিঃ।। (ঋগ্বেদ ১০।৭১।১)
.
(বৃহস্পতে) [এখানে "বৃহস্পতেঃ" এই স্থানে সম্বোধনান্ত পদ ব্যবহৃত হয়েছে। তারসঙ্গে এই পদ সম্বোধনার্থও ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।] হে বেদবাণীর পালক বিদ্বন্! (নামধেয়ম্) সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ এবং তার নামকে (দধানাঃ) ধারণকারী অত্যন্ত পবিত্র অন্তঃকরণ যুক্ত সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন ঋষি (য়ৎ, প্র, ঐরৎ) যে প্রেরণা পরমাত্মার থেকে প্রাপ্ত করেন অর্থাৎ সেই আদি ঋষি যেসব ঋচাকে পরব্রহ্ম পরমাত্মার প্রেরণায় ব্রহ্মাণ্ড থেকে গ্রহণ করেন, (প্রথমম্, বাচঃ, অগ্রম্) সেই বাণী হল মানব ব্যবহারে ব্যবহৃত হওয়া বাণীর মধ্যে সবথেকে অগ্রিম বাণী। (য়দেষাম্, য়ৎ, শ্রেষ্ঠম্) সেই বেদবাণী হল সমস্ত মানবী ভাষার মধ্যে সবথেকে উত্তম বাণী, (য়ৎ, অরিপ্রম্, আসীৎ) [অরিপ্রম্ = রীঙ্ শ্রবণে দিবা. ধাতো "লীরীঙ্গোহ্রস্ব. উ.কো. ৫.৫৫ সূত্রেণ রঃ প্রত্যয়ঃ পুগাগমো হ্রস্বশ্চ। নঞ্ সমাসঃ (বৈদিক কোষঃ )] সেটা পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে থাকে। ঋষিদের দ্বারা আকাশ থেকে গ্রহণ করার সময় সেই বাণী কোনোরূপ ক্ষয় প্রাপ্ত হয় না আর না তাতে কোনোরূপ মিশ্রণ থাকে। (তৎ, এষাম্, প্রেণা) সেই বেদবাণী এই সকল বাণীর মধ্যে সর্বাধিক বেগপূর্বক গমন কারী হয় অথবা সেটা প্রকৃষ্টরূপেণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। (গুহা, নিহিতম্, আবিঃ) [আবিঃ = আবিষ্কুরুতে (নিরুক্ত ৫.৯)] সেই বাণী অন্তরীক্ষরূপী গুহার মধ্যে নিহিত থাকে, যা ঋষিদের অন্তঃকরণ রূপী গুহার মধ্যে প্রকট হয়।

এখানে এই ঋচার প্রথম পদ "বৃহস্পতে" কে "বৃহস্পতেঃ" মানলে এই সংকেতও পাওয়া যায় যে সেই অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত বেদবাণী হল সম্পূর্ণ বাণী এবং সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পালক ও স্বামী পরমাত্মারই বাণী অর্থাৎ তাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে।

ভাবার্থ - সৃষ্টি উৎপন্ন হলে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে বেদের ঋচা প্রাপ্ত হয়। এই ঋচা পরা ও পশ্যন্তী রূপে সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষে ভরে থাকে। প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন সর্বাধিক পবিত্রাত্মা চার ঋষি সমাধিস্থ হয়ে ঈশ্বরের প্রেরণায় এইসব ঋচাকে গ্রহণ করেন। এর পূর্বে মানুষের কোথাও কোনো ভাষাই ছিল না, বরং ভাষার উৎপত্তি এইসব ঋচা উৎপত্তির পশ্চাৎ এরই অপভ্রষ্ট হওয়াতে হয়েছে। এই বাণী থেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্য কোনো ভাষা হওয়া সম্ভব নয়। যখন সেই ঋষি জন বাণীকে সমাহিত চিত্ত দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে গ্রহণ করেন, সেই সময় সেই বাণী শুদ্ধ ও পূর্ণ রূপে তাঁদের অন্তঃকরণে প্রবিষ্ট হয়। কোনো ঋচা ও ঋচার অংশের একটা পদও এই প্রক্রিয়াতে স্রাবিত হয় না অর্থাৎ অন্তরীক্ষে সেই ঋচাগুলো যেরূপ ব্যাপ্ত থাকে, সেগুলোকে সেইরূপে গ্রহণ করা হয়। সেই বাণী অর্থাৎ বেদমন্ত্র সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে অত্যন্ত শীঘ্রতাপূর্বক সহজে প্রবিষ্ট হয়ে যায়, যেভাবে কেউ মন্ত্রকে কণ্ঠস্থ করে সেইরূপ নয়। সেই মন্ত্রগুলো অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে, এর অর্থ হল সেইসব মন্ত্র ঋষিদের স্মৃতিস্তরে সদ্যঃ অঙ্কিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় মন্ত্রের আধিভৌতিক ভাষ্য হল এইরূপ -


সক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো য়ত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।
অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাম্ লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।। (ঋগ্বেদ ১০।৭১।২)


(সক্তুম্, এব) [সুক্তুঃ = সুক্তুঃ সচতের্দুধাবো ভবতি (নিরুক্ত ৪.১০)] অশুদ্ধ মিশ্রিত ছাতু যাকে হাত দিয়ে শুদ্ধ করা কষ্টসাধ্য হয়, তাকে যেভাবে সহজে শুদ্ধ করা হয় (তিতউনা) [তিতউ = তিতউ পরিপবনম্ ভবতি। ততবদ্বা তুন্নবদ্বা তিলমাত্রম্ তুন্নমিতি বা (নিরুক্ত ৮.৯)] সূক্ষ্ম ছিদ্র যুক্ত বিস্তৃত শোধন কর্মকারী ছাঁকনি দিয়ে, (য়ত্র, ধীরাঃ) সেইরূপ যখন অথবা যেখানে অত্যন্ত সত্ত্বগুণ ধারণকারী সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন ঋষি ধ্যানাবস্থিত অবস্থায় [ধীরাঃ = প্রজ্ঞানবন্তো ধ্যানবন্তঃ (নিরুক্ত ৪.১০)] (মনসা) সমাহিত অন্তঃকরণ দ্বারা (পুনন্তঃ) অন্তরীক্ষস্থ বেদ বাণীকে শুদ্ধ করে (বাচম্, অক্রত) সেই বেদ বাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করেন। (অত্র, সখায়ঃ) এই বেদবিদ্যার বিষয়ে সব প্রাণীদের সখারূপ হিতচিন্তক সেই ঋষিজন (সখ্যানি, জানতে) [সখা = সমানম্ খ্যাতীতি সখা (উ.কো.৪.১২৮)] যেখানে এমন মানুষ আছেন যারা সকল প্রাণীর প্রতি মিত্রধর্মকে জানেন, সেখানে ঈশ্বরের সহায়তায় বেদমন্ত্র, সেগুলোর পদের অর্থ অর্থাৎ শব্দ এবং অর্থের সম্বন্ধকে পূর্ণ রূপে জেনে যান। (এষাম্, বাচি, অধি) সেই বেদবাণীর মধ্যে (ভদ্রা, লক্ষ্মীঃ) [লক্ষ্মীঃ = লক্ষ্মীর্লাভাদ্বা লক্ষণাদ্বা লক্ষ্যতে চিন্ত্যতে সর্বেণ - স্কন্দস্বামী (নিরুক্ত ৪.১০), ভদ্রম্ = ভদ্রম্ ভগেন ব্যাখ্যাতম্ ভজনীয়ম্ ভূতানামভিদ্রবণীয়ম্ ভবদ্রময়তীতি বা (নিরুক্ত ৪.১০)] সকল প্রাণীর জন্য প্রাপ্ত করার যোগ্য পদার্থ আর চিন্তন অর্থাৎ সেই পদার্থের বিজ্ঞান (নিহিতা) নিহিত থাকে।
.
ভাবার্থ - মানব সৃষ্টি উৎপত্তির সময় এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে বেদমন্ত্র ব্যাপ্ত থাকে। সেগুলো সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন হওয়া চার সর্বশ্রেষ্ঠ ঋষি সমাধিস্থ মনের দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋচাগুলোকে সেইভাবে ছাঁনিয়ে গ্রহণ করে যেভাবে ছাতু বা আটা ছাঁকনি দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। যেরূপ ছাঁকনি ছাড়া হাত দিয়ে ছাতু বা আটাকে শুদ্ধ করা কঠিন হয়, সেইরূপ সমাধিস্থ মন ছাড়া অন্তরীক্ষস্থ ঋচাকে গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এখানে এই উপমা এটাও দর্শায় যে চারজন ঋষির দ্বারা বেদমন্ত্র গ্রহণ করার জন্য এটা সিদ্ধ হয়ে যায় না যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে এই সমস্ত মন্ত্রের অতিরিক্ত আর কোনো মন্ত্র ছিল না। যদি এমন হতো, তাহলে ছাঁকনি দিয়ে ছাতু ছাঁনিয়ে নেওয়ার সমান মন্ত্রকে গ্রহণ করার চর্চা হতো না। সেই চারজন ঋষি প্রাণীমাত্রের হিতচিন্তক আর মুক্তি থেকে পুনরাবৃত্ত হয়ে মানুষের মধ্যেও সর্বোচ্চ স্তরের ছিলেন। এইজন্য তাঁরাই মন্ত্রকে গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তাঁরা ঈশ্বরের কৃপায় সেই গৃহীত মন্ত্র, সেগুলোর পদ আর সেই পদের অর্থের নিত্য সম্বন্ধকে সম্পূর্ণ রূপে জেনে নেন। সেইসব মন্ত্রের মধ্যে সৃষ্টির সম্পূর্ণ পদার্থকে যথাযথ ভাবে জানার জন্য সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নিহিত আছে আর সেই বিজ্ঞান প্রত্যেক মানুষের জন্য সকল প্রকারের লাভ প্রাপ্তকারীও হয়। এখন আমি তৃতীয় মন্ত্রের আধিভৌতিক ভাষ্য করবো -


য়জ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্।
তামাভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাম্ সপ্তরেভা অভি সম্ নবন্তে।। (ঋগ্বেদ ১০।৭১।৩)

(য়জ্ঞেন) [য়জ্ঞঃ = ব্রহ্ম হি য়জ্ঞঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৫.৩.২.৪), য়জ্ঞঃ প্রজাপতিঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১১.৬.৩.৯)] সেই ধীর বিদ্বানজন, যাঁদের চর্চা পূর্ব মন্ত্রের মধ্যে করা হয়েছে, সবার পালক পরব্রহ্ম পরমাত্মার সাক্ষাৎকার দ্বারা অর্থাৎ তাঁর সহায়তায় (বাচঃ, পদবীয়ম্) সেই বেদবাণীর বিভিন্ন পদের মার্গ আর অনুক্রমকে (আয়ন্) জানেন বা প্রাপ্ত করেন ( ঋষিষু, প্রবিষ্টাম্) আকাশস্থ সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে প্রবেশ হওয়া (তাম্, অনু, অবিন্দন্) সেই বেদবাণীকে অনুক্রমপূর্বক প্রাপ্ত করেন। (তাম্, আভৃত্য) সেই প্রাপ্ত হওয়া বেদবাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করে (পুরুত্রা, ব্যদধুঃ) সর্বত্র প্রচারিত করেন। (তাম্, সপ্তরেভাঃ) [রেভঃ = স্তোতৃনাম (নিঘন্টু ৩.১৬)] সেই বেদবাণীর মধ্যে সাত প্রকারের ছন্দ (অভি, সম্নবন্তে) [সম্নবন্তে = নবতে, গতিকর্মা (নিঘন্টু ২.১৪)] সবদিক দিয়ে ব্যাপ্ত থাকে।

ভাবার্থ - পূর্বোক্ত চার আদি ঋষি যখন ধ্যানাবস্থিত হন আর পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার করেন, তখন তাঁরা অন্তরীক্ষ থেকে আসা ঋচা আর সেগুলোর পদকে ক্রমপূর্বক আসতে অনুভব করেন। তাঁরা ক্রমপূর্বক সেইসব ঋচা আর পদের বিজ্ঞানকেও পূর্ণরূপে জানতে থাকেন। সেই ঋচাগুলো অন্তরীক্ষে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ঋষিরশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে, সেখান থেকে সেই ঋষিগণ সেগুলোকে নিজের অন্তঃকরণে গ্রহণ করেন। এইভাবে নিজের সামর্থ্যের অনুসারে সমস্ত ঋচাকে মহর্ষি ব্রহ্মার মাধ্যমে সর্বত্র প্রচারিত করেন। সেই বেদবাণী প্রধানত সাত ছন্দ যুক্ত হয়। [ সপ্ত = সৃপ্তা সংখ্যা (নিরুক্ত ৪।২৬)] সেইসব ছন্দ সম্পূর্ন আন্তরীক্ষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে আর সর্বত্র এগুলো একে-অপরের দিকে গতিশীল হয়। চারজন ঋষি সেগুলোর মধ্যে বেদের এই ঋচাগুলোকে গ্রহণ করেন।

এই তিন মন্ত্রের দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে যখন আকাশে অনেক ঋচা ছন্দরূপী প্রাণরশ্মি রূপে উৎপন্ন হয়ে বিদ্যমান থাকে, তখন অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা ঋষি সমাধি অবস্থায় পরমাত্মার কৃপায় অন্তরীক্ষস্থ সেই ঋচাগুলো থেকে মানব জীবন হেতু আবশ্যক ঋচাকে সমাহিত চিত্ত দ্বারা ছেঁকে-ছেঁকে নিজের চিত্তের মধ্যে সংগৃহীত করেন। সেই ঋচাই হল ক্রমশঃ ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ আর অথর্ববেদের রূপ। এই চারজন ঋষি না কেবল সেইসব ঋচাকে সংগ্রহ করেন, অপিতু পরমাত্মার কৃপায় সেই ঋষিগণ সেইসব ঋচা অর্থাৎ বাণীর অর্থকেও জেনে যান। সেই চারজন ঋষি এই জ্ঞানকে মহর্ষি আদ্য ব্রহ্মাকে প্রদান করেন। এইভাবে সংসারের মধ্যে পরবর্তীতে জ্ঞানের প্রবাহ চলতে থাকে।

ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার "বেদোৎপত্তিবিষয়" নামক অধ্যায়ে ঋষি দয়ানন্দ উদ্ধৃত করে লিখেছেন -

তস্মাদ্ য়জ্ঞাৎ সর্বহুত ऽঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাম্সি জজ্ঞিরে তস্মাদ্ য়জুস্তস্মাদজায়ত।। (য়জুর্বেদ ৩১.৭)
এবম্ বা অরেऽস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্যদৃগ্বেদো
য়জুর্বেদঃ সামবেদোऽথর্বাঙ্গিরসঃ।। (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪।৫।৪।১০)

অর্থাৎ তস্মাদ্ য়জ্ঞাৎ সচ্চিদানন্দাদিলক্ষণাৎ পূর্ণাৎ পুরুষাৎ সর্বহুতাৎ সর্বপূজ্যাৎ সর্বোপাস্যাৎ সর্বশক্তিমতঃ পরব্রহ্মণঃ ঋগ্বেদঃ, য়জুর্বেদঃ, সামবেদঃ, অথর্ববেদশ্চ চত্বারো বেদাস্তেনৈব প্রকাশিতা ইতি বেদ্যম্। মহত আকাশাদপি বৃহতঃ পরমেশ্বরস্যৈব সকাশাদ্ ঋগ্বেদাদিবেদচতুষ্টয়ম্ নিঃশ্বাসবৎ সহজতয়া নিঃসৃতমস্তীতি বেদ্যম্। য়থা শরীরাচ্ছ্বাসো নিঃসৃত্য পুনঃ তদেব প্রবিশতি, তথৈবেশ্ব-রাদ্ বেদানাম্ প্রাদুর্ভাবতিরোভাবৌ ভবত ইতি নিশ্চয়ঃ।।

অর্থাৎ সেই সচ্চিদানন্দস্বরূপ পূর্ণ পুরুষ পরমাত্মার থেকেই ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ সেই চার ঋষির হৃদয়ে প্রকাশিত হয়। এখন সেটা কিভাবে প্রকাশিত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে বোঝানোর জন্য ঋষি দয়ানন্দ শতপথ ব্রাহ্মণে বলা মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের বচনকে উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে পরমেশ্বর যিনি আকাশাদির থেকেও অনেক বড়, তাঁর থেকে চার বেদ সেই চারজন ঋষির মধ্যে প্রকাশিত হয় কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এমন ভাবে উৎপন্ন হয় যেভাবে কোনো প্রাণী সহজ ভাবে শ্বাস নেয় ও ছাড়ে। যেভাবে প্রাণীকে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াতে কোনো বিশেষ প্রচেষ্টা করতে হয় না, সেইভাবে পরব্রহ্ম পরমাত্মা দ্বারা ছন্দ রূপ বেদ এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সর্গোৎপত্তির সময় প্রসারিত হয়।

প্রশ্ন - অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গিরা নামক ঋষি কি কেবল এই সৃষ্টিতে উৎপন্ন হয়েছেন নাকি প্রত্যেক সৃষ্টিতে এই নামের ঋষিই বেদকে গ্রহণ করেন?

উত্তর - আমার মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রারম্ভে যে চারজন ঋষির দ্বারা আকাশ থেকে বৈদিক ছন্দকে গ্রহণ করা হয়, তাঁদের এই নামই হয়। এই নামগুলো রূঢ় নয়, বরং য়োগরূঢ় হয়।

প্রশ্ন - পরমাত্মা সৃষ্টির আদিতে চারজন পুরুষকেই কেন বেদজ্ঞান দিয়েছেন, স্ত্রীদের কেন দেন নি? এটা কি বৈষম্যের কারণ নয়?

উত্তর - আপনি এটা কিভাবে জানলেন যে এই চারজন ঋষি পুরুষই ছিলেন, এরমধ্যে কোনো স্ত্রী ছিলেন না। আপনি কি পাণিনীয় ব্যাকরণের আধারে এদের নাম থেকে লিঙ্গের নির্ধারণ করছেন? তাই যদি হয়, তাহলে আপনার জেনে রাখা উচিত যে ব্যাকরণের নিয়ম আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে সর্বত্র সমান রূপে কাজ করে না। সর্বত্র সর্বদা বেদাদি শাস্ত্রের প্রতি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ভালো নয়।

বিদ্বানরা বাণীর চারটা রূপ বলেছেন -

চত্বারি বাক্পরিমিতা পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মনীষিণঃ। 

গুহা ত্রীণি নিহিতা নেঙ্গয়ন্তি তুরীয়ম্ বাচো মনুষ্যা বদন্তি।। (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫)

উপরোক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে ঋষি দয়ানন্দ বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে চার প্রকারের বাণী যথা - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত রূপে বর্গীকৃত করেছেন। আচার্য সায়ণ এই ভাষ্যে বাণীর বর্গীকরণ বৈয়াকরণের দৃষ্টির অতিরিক্ত নৈরুক্ত আদির দৃষ্টিকে নিয়েও করেছেন। এরমধ্যে একটা বর্গীকরণ হল - পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এরমধ্যে কেবল বৈখরী বাণী মানুষের ব্যবহারে আসে, বাকি তিন প্রকারের বাণীকে কেবল য়োগী পুরুষই দেখতে বা জানতে পারেন।

মহর্ষি প্রবর য়াস্ক নিরুক্ত ১৩.৯ এরমধ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে বাণীর বর্গীকরণ নিম্ন প্রকারে করেছেন -

"চত্বারি বাচঃ পরিমিতানি পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মেধাবিনঃ গুহায়াম্ ত্রীণি নিহিতানি নার্থম্ বেদয়ন্তে গুহা গূহতেঃ তুরীয়ম্ ত্বরতেঃ কতমানি তানি চত্বারি পদানি ওঙ্কারো মহাব্যাহৃতয়শ্চেত্যার্ষম্ নামাখ্যাতে চোপসর্গনিপাতাশ্চেতি বৈয়াকরণাঃ মন্ত্রঃ কল্পো ব্রাহ্মণম্ চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি য়াজ্ঞিকাঃ ঋচো য়জূম্ষি সামানি চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি নৈরুক্তাঃ সর্পাণাম্ বাগ্বয়সাম্ ক্ষুদ্রস্য সরীসৃপস্য চতুর্থী ব্যাবহারিকীত্যেকে পশুষু তূণবেষু মৃগেষ্বাত্মনি চেত্যাত্মপ্রবাদাঃ অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি।"

এখানে বর্গীকরণ নিম্নানুসারে -

১. আর্ষমত - ওঙ্কার আর ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ মহাব্যাহৃতি।
ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন -

অকারম্ চাপ্যুকারম্ চ মকারম্ চ প্রজাপতিঃ।
বেদত্রয়ান্নিরদুহদ্ ভূর্ভুবঃ স্বরিতীতি চ।। (মনুস্মৃতি ২.৭৬)

অর্থাৎ বেদ থেকে এই চার পদকে প্রজাপতি দোহন করেন - ওম্, ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ। বেদের সার হল এটাই।

২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত।

৩. য়াজ্ঞিক মত - মন্ত্র, কল্প, ব্রাহ্মণ এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।

৪. নৈরুক্ত মত - ঋক্, য়জুঃ, সাম এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।

৫. অন্য মত - সর্পের বাক্, পক্ষীর বাক্, ক্ষুদ্র সরীসৃপের বাক্ তথা ব্যাবহারিকী (মানব - লোকভাষা)।

৬. আত্মবাদী মত - পশু, বাদ্যযন্ত্র, সিংহ আদির মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকী বাণী।
.
এর অতিরিক্ত নিরুক্তকার (১৩.৯) বাণীর অন্য শ্রেণী সম্বন্ধে মৈত্রায়াণী সংহিতাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন -

"অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি - সা বৈ বাক্ সৃষ্টা চতুর্থা ব্যভবৎ এষু লোকেষু ত্রীণি তুরীয়াণি পশুষু তুরীয়ম্য়া পৃথিব্যাম্ সাগ্নৌ সা রথন্তরে য়ান্তরিক্ষে সা বাতে সা বামদেব্যে য়া দিবি সা বৃহতী সা স্তনয়িত্নৌ অথ পশুষু ততো য়া বাগত্যরিচ্যত তাম্ ব্রাহ্মণে ন্বদধু, স্তস্মাদ্ ব্রাহ্মণ উভয়ীম্ বাচম্ বদতি য়শ্চ দেব য়শ্চ ন..."

অর্থাৎ সেই উৎপন্ন হওয়া বাণী চার প্রকারের হয়। ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোক বা সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মিরূপে তিন প্রকারে তথা পশু অর্থাৎ বিভিন্ন মরুত্ ও ছন্দ রশ্মি রূপে [পশবো বৈ মরুতঃ] চতুর্থ প্রকারে। যে বাণী পৃথিবীর মধ্যে আছে, সেটাই অগ্নি তথা রথন্তর সামের মধ্যে আছে। এর তাৎপর্য হল যে বাণী অপ্রকাশিত পরমাণুর মধ্যে আছে, সেটা ঊষ্মা ও বিদ্যুৎ যুক্ত কণার মধ্যেও আছে তথা সেই বাণী রথন্তর সাম অর্থাৎ এমন তীব্র বিকিরণ, যা রমণীয় হয়েও তীক্ষ্ণ ভেদক তথা বিভিন্ন কণাকে অতিক্রমকারী হয়, তাতেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী অন্তরীক্ষে আছে, সেই বাণী বায়ুর (সূক্ষ্ম ও স্থূল) মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এখানে সূক্ষ্ম বায়ুর তাৎপর্য বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে হবে। সেই বাণী বামদেব্য অর্থাৎ বিভিন্ন সৃজন-প্রজনন কর্মে অংশগ্রহণ কারী প্রশস্য ও প্রকাশমান প্রাণ তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী দ্যুলোক অর্থাৎ সূর্যাদি তারার মধ্যে আছে, সেটাই সেগুলোর কিরণের মধ্যে তথা সেইরূপ বাণী স্তনয়িন্তু অর্থাৎ শব্দ করতে থাকা বিদ্যুতের মধ্যেও আছে। এছাড়া অন্য বাণী পশু অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকীর (লোক ভাষা) হয়। এর অতিরিক্ত যেসব বাণী আছে, পরমাত্মা সেগুলো ব্রাহ্মণের মধ্যে ধারণ করেন। এখানে ব্রাহ্মণের অর্থ হল - অত্যুচ্চ স্তরের য়োগী পুরুষ, যিনি পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে সর্বদা রমণ করেন। এমন ব্রহ্মবেত্তা মহাপুরুষ দুই প্রকারের (মোট চার প্রকারের) বাণী, সেগুলো বিভিন্ন দেবের (লোক আদি) মধ্যে বিদ্যমান হলেও অথবা মানুষের কথা বলার বাণী হলেও, তাঁরা জানেন। এমন ব্রাহ্মণের অক্ষর স্তুতি হয়।

বেদবিদ্যার বিষয়ে ভগবৎ ব্যাস মহাভারত শান্তিপর্ব ২৩২ অধ্যায়ে শুকদেবকে বলেছেন -
অনাদিনিধনা বিদ্যা বাগুৎসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা।।২৪।।
ঋষীণাম্ নামধেয়ানি য়াশ্চ বেদেষু সৃষ্টয়ঃ।
নানারূপম্ চ ভূতানাম্ কর্মণাম্ চ প্রবর্ত্তনম্।।২৫।।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ নির্মিমীতে স ঈশ্বরঃ।।২৬।।

অর্থাৎ পরমব্রহ্ম পরমাত্মা অনাদি বেদবাণীকে উৎপন্ন করেছেন। এখানে "উৎসৃষ্ট" শব্দ সেটাই সংকেত করছে, যাকে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য শতপথ ব্রাহ্মণে ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন শ্বাস-প্রশ্বাসবৎ বাণীকে বলেছেন। এখানে "বিদ্যা-বাক্" মানে হল সেই বাণী যেখানে যথাযথ জ্ঞান আছে অর্থাৎ বেদবাণী।।২৪।।

বিভিন্ন ঋষিদের নাম অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডস্থ ঋষি প্রাণের নাম, যেখান থেকে মানব ঋষিগণ নিজেদের নাম রেখেছেন। সৃষ্টির যে যে পদার্থ বৈদিক ছন্দরূপ প্রাণের মধ্যে রচিত হয়, বিভিন্ন পদার্থ ও প্রাণীদের নানা রূপ এবং তাদের কর্মকে আদি সৃষ্টিতে ঈশ্বর বৈদিক শব্দ বা ছন্দ দিয়েই রচনা করেন এবং সেগুলোর মাধ্যমেই সেগুলোর বর্ণনা করেন।।২৫-২৬।।
Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

গায়ত্রী মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য

ভূর্ভুবঃ স্বরিত্যস্য বিশ্বামিত্র ঋষিঃ । সবিতা দেবতা । পূর্বস্য দৈবী বৃহতী ছন্দঃ, তৎসবিতুরিত্যুত্তরস্য নিচৃদ্গায়ত্রী ছন্দঃ ।  মধ্যমষড্জৌ স্বর...

Post Top Ad

ধন্যবাদ