ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

20 December, 2024

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

20 December 0

 


নবম ভাগ



ভোজন


ভূমিকা -

"ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্"

.
ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উদ্দেশ্য। এই পুরুষার্থচতুষ্টয় সিদ্ধির মূলকারণ হল আরোগ্য। শরীর যদি সুস্থ না থাকে, রোগী হয় তাহলে পুরুষার্থচতুষ্টয় কেন, শৌচ স্নানাদি নিত্য কর্মের অনুষ্ঠানও সঠিকভাবে হবে না। রোগী স্বয়ং অন্যের উপর বোঝা হয়ে যাবে, সে কিভাবে অন্যের সেবা বা উপকার করবে তথা কিভাবে ধর্মানুসারে চলবে? এইজন্য শরীরের সুস্থতাকে পুরুষার্থচতুষ্টয়ের সিদ্ধির জন্য আমাদের শাস্ত্রকারগণ সর্বপ্রথম আর মুখ্য স্থান দিয়েছেন।
.
জীবনের চরম লক্ষ্য, অন্তিম ধ্যেয় হল মোক্ষপ্রাপ্তি আর তার প্রাপ্তি আত্মা এই শরীররূপী রথের সহায়তায় করে। যদি শরীররূপী রথ সুস্থ আর দৃঢ় না হয় তাহলে মাঝ পথেই জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাবে তথা আত্মা তার লক্ষ্যের প্রাপ্তি করতে পারবে না। আবাগমনের চক্র থেকে না বেরিয়ে বরং দুঃখসাগরেই পাক খেতে থাকবে। সুতরাং আমাদের শরীররূপী রথ, জীবন যাত্রার সাধন, সুস্থ দৃঢ় আর সুগঠিত হোক সেটা অবশ্যক।

আহারবৈষম্যাদস্বাস্হ্যম্" (সুশ্রুত অধ্যায় ৪৬)

.
ভোজন বিষমতার কারণে স্বাস্থ্য খারাপ হয়। শরীরকে সুস্থ আর নীরোগ রাখার জন্য ভোজনের স্থান হল সর্বপ্রথম, কারণ এই পঞ্চভৌতিক শরীর ভোজনের মাধ্যমেই হৃষ্ট-পুষ্ট আর দৃঢ়াঙ্গ হয়। শরীরের উপচয়-অপচয় বা বৃদ্ধি আর হ্রাস ভোজনের উপর নির্ভর করে। যদি শরীরকে যথা সময়ে উচিত ভোজন দেওয়া হয় তাহলে শরীরও হৃষ্ট-পুষ্ট আর সুডৌল হয় অন্যথা স্বাস্থ্য খারাপ হয়।
.
ভোজনের মতো আবশ্যক আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপেক্ষা করা মানে নিজের জীবনের উপেক্ষা করা, ভোজনের বিষয়ে অজ্ঞানী থাকা মানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে রাখা। আমাদের পূর্বজ ঋষি-মহর্ষিগণ এই বিষয়ে অনেক গম্ভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেছেন। কোন পদার্থের কি গুণ আছে আর সেটা কি অবস্থায় লাভদায়ক তথা হানিপ্রদ, দেশ-কাল আর প্রকৃতি ভেদে আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভক্ষ্যাভক্ষ্য পদার্থের পূর্ণ মীমাংসা করে দিয়েছেন, এইজন্য আমাদের দেশ যখন শাস্ত্রবিহিত ভোজন করতো তখন সংসারের মধ্যে আমাদের দেশে সবাই বীর শক্তিশালীর শিরোমণি ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজ আমরা শাস্ত্রকে ভুলে গেছি, তাই ভোজনের নামে অনেক কুপ্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে। মদ্য, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ আদি অভক্ষ্য পদার্থও নিঃসঙ্কোচ হয়ে লোকে সেবন করছে।
.
এর মুখ্য কারণ হল আমরা ভোজনের মুখ্য উদ্দেশ্যটাই ভুলে গেছি, আমাদের ভোজন জীবনের জন্য নয় বরং জীবনটাই ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। ভোজন পরীক্ষার সাধন কেবল জিহ্বাই রয়ে গেছে আর এই পিশাচিনী এত লোলুপ হয়ে গেছে যে সব সর্বনাশ করে দিয়েছে।
.
ভোজন বিগড়ে যাওয়াতে আর অসংযত হওয়াতে ব্রহ্মচর্য পালন আর সংযত জীবনের অভাব হয়ে গেছে। বিষয়বাসনা, শৃঙ্গার আর ব্যভিচারের আগুন এত প্রচণ্ড ভাবে জ্বলছে যে ঋষিদের এই পবিত্র ভূমি শুধু ভারতই নয় বরং সমস্ত বিশ্বকেই ভস্মসাৎ করে দিচ্ছে।
.
এমন বিকট সময়ে এই ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায় "ভোজন" যদি কারও কোনো পথ প্রদর্শন করতে পারে তাহলে আমার পরিশ্রম সফল তথা দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করবো।
.
এরমধ্যে ভোজন সম্বন্ধীয় অনেক ভ্রান্তধারণা আর কুপ্রথার খণ্ডন করা হয়েছে। এমন অনেক বিষয় পাঠক মহানুভবগণ দেখবেন যা সর্বথা নবীন বলে মনে হবে, সেগুলোর উপর গম্ভীর ভাবে বিচার করলে তত্ত্বজ্ঞান হবে। আমি সেটা যথাশক্তি উপযোগী আর সহজভাবে করার চেষ্টা করেছি, আমি আমার কাজে কতটা সফল হয়েছি তা পাঠক মহানুভবই বলতে পারবেন।
✍️ ওমানন্দ সরস্বতী
গুরুকুল ঝজ্জর
বৈশাখ ২০৩৪ (বিক্রম)
মে ১৯৭৭ ইংরাজি
____________________________________________
.
🍁 আমাদের ভোজন 🍁
.
প্রত্যেক মানুষ সুস্থ থাকতে চায়, কেউই রোগী হয়ে থাকতে চায় না। স্বাস্থ্য আর ভোজনের মধ্যে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। বিচারশীল পুরুষ তথা সমাজ এর গুরুত্বকে সঠিক ভাবে জানে। আমাদের প্রাচীন পুরুষ ভোজনের গুরুত্বকে ঠিকভাবে জানতেন তাই তাঁরা এই বিষয়ে খুব সাবধান ছিলেন। আজ আমরা তাঁদের সন্তান ভোজনের বিষয়ে কিঞ্চিৎমাত্র ধ্যান রাখি না।
.
দৈনিক আহার আমাদের স্বাস্থ্য, ব্রহ্মচর্য, মন, বুদ্ধি আর আত্মার উপর কি প্রভাব ফেলে সেটা নিয়েও আমরা কখনও ভাবার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। শুদ্ধাহার দ্বারাই মানুষের সবকিছু শুদ্ধ হয় আর মিথ্যাহার দ্বারা হয় সর্বনাশ। এর উপর আমাদের প্রাচীন ঋষি-মহর্ষিগণ গম্ভীর ভাবে কেবল বিচারই করেছেন তা নয় বরং পূর্ণ রূপে অনুভব করেছেন। এইজন্য তাঁরা নিজের অনুসন্ধানের আধারে শুদ্ধাহারের অনেক প্রশংসা করেছেন। ছান্দোগ্যোপনিষদের মধ্যে লেখা আছে -
.
আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাম্ বিপ্রমোক্ষঃ।।
.
আহার শুদ্ধ হওয়াতে অন্তঃকরণ অর্থাৎ বুদ্ধি আদির শুদ্ধি হয়, বুদ্ধি শুদ্ধি হওয়াতে স্মৃতি দৃঢ় বা স্থির হয়, স্মৃতি দৃঢ় হওয়াতে হৃদয়ের আবরণ অর্থাৎ জন্ম-মরণের বন্ধন ঢিলে হয়, অবিদ্যা-অন্ধকার মুছে গিয়ে মানুষ সকল প্রকার দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয় আর পরম পদ মোক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। সুতরাং শুদ্ধাহারের ফলে মানুষের এই লোক তথা পরলোক দুটোতেই মঙ্গল হয়। য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার মধ্যে একে এইভাবে লিখেছেন -
.
য়ুক্তাহারবিহারস্য য়ুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
য়ুক্তস্বপ্নাববোধস্য য়োগো ভবতি দুঃখহা।। (৬/১৭)
.
যথাযত আহার-বিহার, যথাযত কর্মকারী, উচিত মাত্রায় নিদ্রা আর জাগরণকারীর এই য়োগ দুঃখনাশক হয় অর্থাৎ সঠিকভাবে আহার-বিহার আদির সেবন করলে মানুষের সব দুঃখ দূর হয়।
.
ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণীর আছে, কীট পতঙ্গ থেকে শুরু করে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ পর্যন্ত এই ভোজনের জন্য ব্যাকুল হতে দেখা যায়। এই যুগের মানুষের সম্পূর্ণ শক্তি এই ভোজনের জোগাড় করতেই চলে যায়। প্রাতঃকাল থেকে শুরু করে সায়ংকাল পর্যন্ত "হায় ভোজন হায় ভোজন" করে দৌড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, আজ মানুষের জীবন-মরণও ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ভোজন কেন করি, এর উচিত উত্তর সহস্র ব্যক্তির মধ্যে কোনো বিচারশীল ব্যক্তিই দিতে পারবে। আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে এর উত্তর এই ভাবে দেওয়া আছে -
.
আহারঃ প্রীণনঃ সদ্যোবলকৃদ্দেহধারণঃ।
স্মৃত্যায়ুঃ শক্তিবর্ণোজঃ মত্ত্বশোভাবিবর্ধনঃ।। (ভাব০ ৪/১)
.
ভোজন দ্বারা তৎকাল শরীরের পোষণ আর ধারণ হয়, বলের বৃদ্ধি হয় তথা স্মরণ শক্তি, আয়ু, সামর্থ্য, শরীরের বর্ণ, কান্তি, উৎসাহ, ধৈর্য্য আর শোভা বৃদ্ধি পায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হল যে - আহার হচ্ছে আমাদের জীবন। কারণ ভোজন দ্বারা শুধু মানুষ কেন সকল প্রাণীর জীবন রক্ষা হয়, সুতরাং ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণধারীদের আছে অথবা বলা উচিত প্রাণীমাত্রের জীবনের আধার হল ভোজন। যদি আমরা ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে আমাদের জীবিত থাকা অসম্ভব। সুতরাং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাণী জীবনধারণার্থ ভোজন গ্রহণ করতে থাকে আর তার দ্বারাই জীবিত থাকে। সুতরাং সর্বপ্রথম তথা সর্বোত্তম ভোজনের গুরুত্ব আমাদের জীবনে এটাই, যাকে ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে আমরা যদি অন্ধকারে থাকি তাহলে সেটা বড়ই আশ্চর্য তথা মুর্খতা হবে। অপঠিত বা অশিক্ষিত জীবনের বিষয়ে যাদের কোনো জ্ঞান নেই, এমন ব্যক্তি যদি এই বিষয়ে কিছু না জানে তাহলে কোনো বড় বিষয় হবে না, কিন্তু আজকের শিক্ষিত সমুদায় এই বিষয়ে একদম পঙ্গু যা বড়ই দুঃখের বিষয়। অশিক্ষিত ভাই তো কিছু প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে এই বিষয়ে একটু হলেও কম-বেশি কিছু জ্ঞান রাখে কিন্তু বড়-বড় বি.এ., এম.এ., প্রভাকর আর শাস্ত্রী আদি ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদের মধ্যে জীবনের আধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জ্ঞানের অভাব থাকলে, তাহলে তো এইরকম দুঃখজনক অবস্থাকে দেখে অত্যন্ত দুঃখই হবে আর দেশের নিকট ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল প্রতীত হয় না।
.
তাছাড়া এটুকু জ্ঞান তো প্রত্যেক প্রাণীর আছে যে ভোজনের পশ্চাৎ বল উৎসাহ প্রতীত হয়, ক্ষুধার্ত প্রাণীর মধ্যে এর অভাব দেখা যায়। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে মৃত্যু নিশ্চিৎ রূপে দর্শন দিবে, এটা শরীরের রচয়িতা বা প্রকৃতির অটল নিয়ম। উচিত এবং আবশ্যক ভোজন প্রাপ্তি বিনা স্বাস্থ্যরক্ষা অথবা জীবনরক্ষা হবে না। এইজন্য স্বাস্থ্য প্রাপ্তি তথা জীবন রক্ষার জন্য ভোজনেরও একটা বিশেষ স্থান আছে। এই বিষয়ে চরকসংহিতার মধ্যে বলা হয়েছে -
.
বলমারোগ্যমায়ুশ্চ প্রাণাশ্চাগ্নৌ প্রতিষ্ঠিতাঃ।
অন্নপানেন্ধনৈশ্চাগ্নির্দীপ্যতে শাম্যতেऽন্যথা।।
.
শরীরের ভিতরে যে অগ্নি আছে তারই আশ্রয়ে শরীরে প্রাণ স্থির থাকে। এই অগ্নি বল, আরোগ্য আর আয়ুর প্রতিষ্ঠাকারী হয় অথবা বলা উচিত অন্তরগ্নিতে শরীর স্থিত আছে। অন্ন-পান রূপী জ্বালানি দ্বারাই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, এই অগ্নির দীপন আর শমন ভোজনের দ্বারাই হয়। এটা আমরা প্রত্যক্ষ দেখি যে অন্ন-পানের সেবন দ্বারা আয়ুপর্যন্ত প্রাণ থাকে। এই বিষয়ে চরক সংহিতাতে লেখা আছে -
.
ইষ্টবর্ণগন্ধরসস্পর্শবিধিবিহিতমন্নপানম্ প্রাণিনাম্ প্রাণি সঞ্জ্ঞকানাম্ প্রাণমাচক্ষতে কুশলাঃ, প্রত্যক্ষফলদর্শনাৎ, তদিন্ধনা হ্যন্তরাগ্নেঃ স্থিতিঃ, তৎসত্ত্বমূর্জয়তি, তচ্ছরীরধাতুব্যূহবলবর্ণেন্দ্রিয়প্রসাদকরম্ য়থোক্তমুপসেব্যমানম্ বিপরীতমহিতায় সম্পদ্যতে।
.
কুশল বিচারশীল পুরুষ যে অন্ন-পান (ভোজন) বিধিপূর্বক বানানো হয়েছে, যা সুন্দর বর্ণ (রঙ) গন্ধ রস তথা স্পর্শসংযুক্ত তাকে মনুষ্য আদি দেহধারীদের জন্য প্রাণতুল্য মানেন। কারণ এটা প্রত্যক্ষ অনুভবের বিষয় যে অন্ন-পান দ্বারা প্রাণীদের প্রাণ কাজ করে। ভোজন না করলে আয়ু ক্ষীণ হয়ে মৃত্যু হয়। অন্ন-পানের কারণেই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, অন্নের কারণে মনের মধ্যেও বল আসে। যখন ভোজন যথাযত ভাবে করা হয় তখন এটা শরীরের বাতাদি দোষের রস রক্ত বীর্যাদি ধাতুর সংঘাতকে তৈরী করে। যেখানে যে ধাতুর ন্যূনতা থাকে সেখানে তার ভোজন পূর্তি করে দেয়। বিধিপূর্বক ভোজন শরীরকে বল দেয়, বর্ণকে উজ্জ্বল করে, কান্তি দায়ক আর ইন্দ্রিয়কে প্রসন্ন তথা তৃপ্ত করে। বিধির বিপরীত সেবন করলে হানিকারক সিদ্ধ হয়।
.
🍁 আহার দ্বারা শরীরের বিকাশ আর বৃদ্ধি 🍁
.
সব প্রাণী যখনই জন্ম নেয় ততকাল খিদে তাদের যন্ত্রণা দেয়। মাতার গর্ভ থেকে বাইরে আসা মাত্র মানব-শিশু সঙ্গে-সঙ্গে কান্না আর ঝটপট করতে থাকে আর যখন মাতার স্তন যেখানে, সেখানে তার মুখ আসে তথা সে দুগ্ধামৃতের পান করে, সে ততকাল শান্তচিত্ত হয়ে খেলা শুরু করে বা ঘুমিয়ে পড়ে। খিদের নিবৃত্তির সঙ্গে-সঙ্গে তার ব্যাকুলতাও পালিয়ে যায়। সব প্রাণীর অবস্থাই এইরূপ সমান হয়।
.
এই দুগ্ধপান তথা ভোজনের সেবন দ্বারা সব প্রাণী খিদে শান্ত হতেই যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনি এদের শরীরের মধ্যে কিছু দিনের মধ্যেই বৃদ্ধি-বিকাশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হয় যে জন্মের সময় থেকে যুবকাবস্থা পর্যন্ত শুধু মানুষই নয় বরং প্রত্যেক প্রাণীর শরীরের বৃদ্ধি তথা বিকাশ প্রতিদিনের করা ভোজনের মাধ্যমে হয়।
.
সুতরাং আমাদের শরীরের সম্যক্তয়া বৃদ্ধি বা সম্পূর্ণ বিকাশ আমাদের ভোজনের উপর নির্ভর করে, যদি আমরা যথাযত ভাবে ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে শরীরের বিকাশও থেমে যাবে। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে বিকাশের স্থানে হ্রাস তথা শেষে শরীরের নাশ হবে। তাই আহার যেমন জীবনের আধার তেমনই বিকাশ বা বৃদ্ধিরও মুখ্য কারণ কিন্তু সেই ভোজন হিতকর হওয়া উচিত। হিতকর ভোজন বিনা বৃদ্ধি অসম্ভব। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে -
.
"হিতাহারোপয়োগ এব পুরুষস্যাভিবৃদ্ধিকরো ভবতি"
.
অর্থাৎ একমাত্র হিতকর আহারের ব্যবহারই পুরুষের শরীরের বৃদ্ধি করে। তাছাড়া যেটাই খাওয়া হয় তাকেই আহার (ভোজন) বলে। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে "আহারত্বমাহারস্যৈকবিধমর্থাভেদাৎ" নিগরণ অর্থাৎ গ্রাসের ক্রিয়া সব আহারের মধ্যে এক সমান হয়। ভিন্ন-ভিন্ন ভোজনের বস্তুতে নিগরণ সমান হওয়ার কারণে সবগুলোকে আহার বলে। "আহার্য়তে গলাদধো নীয়তে ইত্যাহারঃ" গলা থেকে নীচে যা নিয়ে যাওয়া হয় তাকে আহার বলে। সব আহারের দ্রব্যতে আহারতা থাকে, কিন্তু আমাদের জন্য হিতকর আহার কোনটা সেটা জেনে রাখা উচিত। যে আহার শরীরের বৃদ্ধি করে আর হিতকর হয়, এই একটা লক্ষণ তো করে দেওয়া হয়েছে। এরপর এই বিষয়ে লেখা আছে -
.
সমাঁশ্চৈব শরীরধাতূন্ প্রকৃতৌ স্থাপয়তি বিষমাঁশ্চ সমীকরোতীত্যেতদ্ধিতম্ বিদ্ধি, বিপরীতমহিতমিতি, এতদ্ হিতাহিতলক্ষণমনপবাদম্ ভবতি। (চরক সূত্র০ অ০ ২৫)
.
অগ্নিবেশ জিগ্যেস করাতে ভগবান্ আত্রেয় উত্তর দেন - যে আহার অসমাবস্থায় স্থিত শরীরের বাত, পিত্ত, কফ, রক্ত, মাংস, বীর্যাদি ধাতুকে প্রকৃতি অর্থাৎ সাম্যাবস্থাতে রাখে, দূষিত হতে দেয় না আর সুরক্ষিত রাখে। বিষম (খারাপ হওয়া) ধাতুকে সমাবস্থায় নিয়ে আসে অর্থাৎ সুধরে দেয়, সেই ভোজনকে হিতকর বলে। এর বিপরীত যেটা সম ধাতুকে বিষম (নষ্ট) করে দেয় আর বিষম অবস্থায় রাখে অর্থাৎ খারাপকে খারাপই করে রাখে তাকে অহিতকর বলে। এই বিষয়ে বিস্তার ভাবে পরে লেখা হবে। বিষম আর অহিতকর ভোজন করলে অরুচি, শারীরিক দুর্বলতা, কণ্ডু, পামা, কুষ্ঠ আদি রোগের উৎপত্তি হয়। অঙ্গাবসাদ তথা দোষ প্রকুপির হওয়াতে সেই-সেই স্থানের অনুসারে গ্রহণী অর্শ আদি রোগ উৎপন্ন করে।

🍁 অধিক ভোজন 🍁 এটা প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনের অনুভব তথা অধিকাংশ ডাক্তারের মত হল এটাই যে ৯৯ শতাংশ মানুষ আবশ্যকতার অধিক আহার গ্রহণ করে। আর এর মুখ্য কারণ হল আমরা সবাই জিহ্বার দাস হয়ে গেছি। আমাদের রসনা (জিহ্বা) সর্বদা সুস্বাদু ভোজনের জন্য ছটপট করে, তাই আমরা স্বাদের চক্করে পড়ে অধিক আহার করে ফেলি। কিন্তু স্বভাবে স্বাদপ্রিয় মানুষ সুস্বাদু ভোজনের মধ্যে যে ক্ষণিক সুখ অনুভব করে এই সুখকেই নিজের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় আর নিজের সব বহুমূল্য জীবন এই সুখের ইচ্ছাপূর্তিতেই হারিয়ে দেয় আর ভুলে যায় যে আমাদের হিত ও কল্যাণ এই সুস্বাদু ভোজন দিয়ে সম্ভব নয়। এর ফলে মানুষ পেটুক হয়ে যায়। স্বাস্থ্য, বল, বীর্য, শক্তি, ব্রহ্মচর্য চুলোয় যাক কিন্তু এই পেটুক মানুষকে চটপটা আর মিষ্টি সুস্বাদু ভোজনই চাই। জিহ্বার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে এমন ব্যক্তি খুব কম দেখা যায়। সুস্বাদু ভোজন করা কোনো পাপ নয় তবে স্বাদের কারণে অধিক আহার তথা ভোজনকে সুস্বাদু বানানোর জন্য লবণ, লংকা, মসলা, টক আদি হানিকারক পদার্থ দিয়ে ভোজনকে খারাপ করে খাওয়া তো মহামুর্খতাই হবে। কবিরাজ হরনামদাস জী এই বিষয়ে লিখেছেন "চূর্ণ আর চটপটে বস্তুর চল বেড়ে গেছে। বাবুরা ফুচকা, ইমলীর চাট, ভল্লে পকড়িয়া এক স্থানে বসে খেয়ে নেয়। হে মানব! জাগো, কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারছো, এইসব বস্তু পরিপাকতন্ত্রকে খারাপ করে আর জীবনের সার (বীর্য) -কে দুর্বল করে আর সন্তান উৎপন্ন করার যোগ্যতা রাখে না। ছোটো বাচ্চারা যারা টক খায় তাদের মধ্যে যুবকাবস্থার পূর্বেই কামবাসনার প্রতি টান আসতে থাকে, যাদের চোখ খোলা আছে তারা এইসব বিষয় স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে, অধিক কি লিখবো! এইরূপ দৃশ্যকে দেখে আমি এই পরিণামে এসেছি যে আমাদের দুর্বলতা, আমাদের রোগ, আমাদের বৃদ্ধাবস্থা, একটা সীমা পর্যন্ত অন্ন-পানের কারণেই হয়। সুতরাং ভোজনে অনেক সাবধান আর সংযত থাকা আবশ্যক। . 🍁 ভোজনে নিয়ন্ত্রণ 🍁 স্বাস্থ্যপ্রিয় ব্যক্তি বা ব্রহ্মচারী না অধিক আহার করে আর না ন্যুন; কিন্তু শরীরের জন্য যতটা আবশ্যক ঠিক ততটুকুই আহার করে। অধিক আহার করাটা সহজ আর সর্বথা উপবাস করাও সহজ কিন্তু যথাযথ (না ন্যুন না অধিক) ভোজন করা অধিক কঠিন ব্যাপার। ভোজনে সমতা বজায় রাখাই তো ব্রহ্মচারীর আসল তপস্যা আর ভোজনের নিয়ন্ত্রণ বলতে এটাই, "মিতভোজন স্বাস্থ্যম্" একটা সূত্র আছে যার অর্থ হল মিতভোজন অর্থাৎ অল্পাহার স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর। অতিভোজন তো সবাই নিষেধ করেছেন তবে মিতাহারের প্রশংসা প্রায় সব লেখক আর প্রভাষক করেছেন। কিন্তু মানুষের জন্য বিশেষ তো তখন হবে যখন শরীরের জন্য যতটা ভোজনের আবশ্যকতা ঠিক ততটাই সে গ্রহণ করবে, না অধিক না ন্যুন। যথাযথ ভোজন করা অনেক বড় সংযম আর ভোজনের এই সংযম হল ব্রহ্মচর্য, স্বাস্থ্য আদি সব শুভ কর্মের আধারশিলা। ভোজনে সংযম করে এমন মানুষ কয়েক হাজারের মধ্যে এক-দুই জন হয় আর এমন সংযমী পুরুষই স্বাস্থ্যের আসল স্বাদ ভোগ করে তথা এইরূপ সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিই ব্রহ্মচর্য পালনে সফলতা প্রাপ্ত করে। ৭৫ শতাংশ স্বপ্নদোষের রোগী ভোজনে সংযম না হওয়ার কারণেই হয়। যেখানে ভোজন একটু অধিক সুস্বাদু লাগে, সংযম না হওয়ার কারণে মানুষ পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভরে দেয়, রাতে পেট ভারী থাকার কারণে স্বপ্নদোষ হয়। যার ফলে স্বাদ বেরিয়ে যায়, কান্না আর আফসোস করে। অনেকেই নিজের এই ভুলকে জানতে পারে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এইভাবে হানি বহন করে বেড়ায়। কিছু রোগী অজ্ঞানবশতঃ ভোজনে অধিক আহার করার ভুল করে, যখন তারা জানতে পারে তখন অধিক আহার করা ছেড়ে দেয় আর আহার-ব্যবহারের সংযমকে ধারণ করে নেয়। নিত্য উচিত আহার-বিহার ছাড়া কল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যার্থী তথা সবার জন্য উচিত আহার-বিহারের আদেশ বা উপদেশ ঋষিরা করেছেন - "নিত্যম্ য়ুক্তাহারবিহারবান্ বিদ্যোপার্জনে চ য়ত্নবান্ ভব" বিদ্যার্থী অর্থাৎ ব্রহ্মচারীকে নিত্য উচিত পরিমাণ আহার-বিহার করার পাশাপাশি বিদ্যা গ্রহণে যত্নশীল হওয়া উচিত। কিন্তু অধিক অল্প মাত্রায় আহার করলে বল, বর্ণ, কান্তি, শক্তি, পুষ্টির নাশ বা ক্ষীণতা হয়, উদাবর্ত (যৌনরোগ) আদি রোগ উৎপন্ন হয়; মানুষ অতৃপ্ত আর অশান্ত থাকে, বীর্য আদি ধাতুর বৃদ্ধি হয় না, আয়ু কমে যায়। শরীরের আবশ্যকতানুসারে ভোজন না করলে শরীরের সারভাগ বীর্য, বল, ওজ নষ্ট হয়ে যায়। মন-বুদ্ধি আর ইন্দ্রিয়ের শক্তির হ্রাস আর নাশ হয় আর ৮০ প্রকারের বাত রোগের উৎপত্তি হয়। সুতরাং অল্পাহার, সুস্থশরীরে উপবাস করা আদি স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক কিন্তু এটা স্মরণে রাখা উচিত যে আবশ্যকতার তুলনায় অল্প আহার যেমন শরীরকে রোগী তথা ক্ষীণ করে, তেমনই আবশ্যকতার অধিক আহার বল, বীর্য, ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যের জন্য আরও অধিক ঘাতক হয়। অল্পাহার করা যতটা অপরাধ নয়, তারথেকেও বড় আর প্রচণ্ড অপরাধ হল অধিক আহার করা। অল্প আহার করার ফলে শরীরের ক্ষতি কিছু অধিক দিনে হয় কিন্তু অধিক আহার করা ব্যক্তি নিজের অপরাধের দণ্ড শীঘ্রই প্রাপ্ত করে। সুতরাং এখানে সংক্ষেপে অধিক আহার করার হানিগুলো দর্শানো হল। . 🍁 অধিক আহারের ফলে হানি 🍁 মাত্রাতিরিক্ত খাবার খেলে আলস্য, প্রমাদ, পেট ফোলা, পেটের মধ্যে গুড়গুড় আদি উপদ্রপ উৎপন্ন হয়। বায়ুবিকার উৎপন্ন হয়, তেঁতো ঢেক আসে, এটা ভোজন না হজম হওয়ার পরিচয়। ডাক্তার আর বৈদ্য সবার মত হল, পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভর্তি করলে বিশূচিকা (হৈজা) রোগ খুব শীঘ্র হয় আর ইনফ্লুএঞ্জা হওয়ারও আশঙ্কা থাকে; বদহজম, অজীর্ণ, মলবন্ধ, আনাহ (Anaphylaxis), সংগ্রহণী (IBS), অর্শ তথা স্বপ্নদোষ, প্রমেহাদি ধাতু সম্বন্ধীয় রোগ অধিক আহারকারী পেটুক ব্যক্তিদেরই হয়। মানুষ প্রায়শঃ যতটা খাবার খায় তার তিন ভাগও হজম করতে পারে না, যেসব খাবার হজম হয় না সেটা পেটের মধ্যে পড়ে থেকে রক্তকে বিষাক্ত আর দূষিত করে আর স্বপ্নদোষ তথা অর্শাদি অসংখ্য বিকারের জন্ম দেয়। প্রাণশক্তিকে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়, একটা তো অধিক ভোজনকে হজম করতে আর আরেকটা মলকে বাইরে বের করতে। অধিক আহারের ফলে রাষ্ট্রের অন্ন আর ধন, উভয়ের অপব্যয় হয় তথা প্রকৃতি দেবীও দণ্ডরূপ রোগ প্রদান করেন। ধনী ব্যক্তিরা এই দোষের অধিক দোষী, অনেক নির্ধন মানুষের পালন যার দ্বারা হওয়া সম্ভব এমন অধিক অন্ন তারা প্রতিদিন নষ্ট করে। খুবই গুরুতর অপরাধ এটা, সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত অধিক ভোজন করা উচিত নয়। এই বিষয়ে ভগবান্ মনু বলেছেন - . অনারোগ্যমনায়ুষ্যমস্বর্গ্যম্ চাতিভোজনম্ । অপুণ্যম্ লোকবিদ্বিষ্ট তস্মাত্তৎপরিবর্জয়েৎ ।। (মনু.২.৫৭) . অতি আহার করলে স্বাস্থ্য হানি তথা রোগের বৃদ্ধি হয়, আয়ু হ্রাস পায়, ব্যাধি আদির কারণে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়, পুণ্যের নাশ আর পাপের বৃদ্ধি হয় আর সমাজে অধিক আহার কারী ব্যক্তির নিন্দা হয়। ব্রহ্মচারীকে তো ভুলেও অধিক ভোজন করা উচিত নয়। পেট ঠুসে-ঠুসে অধিক আহারকারী ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী থাকতে পারবে না। ব্রহ্মচারীদের সায়ংকালের ভোজন মধ্যাহ্নের থেকে অর্ধেক হওয়া উচিত তথা শুতে যাওয়ার ২ থেকে ৩ ঘন্টা পূর্বেই ভোজন করা উচিত। দুগ্ধ তথা জলপানও শুতে যাওয়ার দুই বা তিন ঘন্টা পূর্বেই করা উচিত। সুতরাং ভোজন অধিক করা উচিত নয়। . এই বিষয়ে "ব্রহ্মচর্যই হল জীবন" পুস্তকের প্রসিদ্ধ লেখক স্বামী শিবানন্দ জী লিখেছেন - " অধিক ভোজন করা ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী হবে না, কারণ ঝড়ের দমকা হওয়া যেমন গাছকে উপড়ে ফেলে দেয় ঠিক তেমনই কামদেব পেটুক মানুষকে আছড়ে-আছড়ে মেরে ফেলে। অধিক আহার কারী ব্যক্তি কোনোভাবেই বীর্যকে থামিয়ে রাখতে পারবে না, তার চিত্ত সর্বদা বিষয়ের উপর লেগে থাকবে। মন আর শরীর দুটোই রোগী হয়ে যাবে, আয়ু কমে যাবে আর স্বার্থ ও পরমার্থ দুটোই বর্বাদ হবে। যদি আপনি বীর্যবান বা আরোগ্যবান হতে চান, স্বপ্নদোষ তথা অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই সাদা মিতাহারী হতে হবে।" . 🍁 উত্তম ভোজন থেকে উত্তম সন্তান 🍁 মহর্ষি দয়ানন্দ জী তাঁর গ্রন্থ সংস্কারবিধিতে গর্ভাধান সংস্কার বিষয়ে লিখেছেন - "উত্তম সন্তান মুখ্যতঃ বধূ আর বরের যথাশাস্ত্রোক্ত আহারের উপর নির্ভর করে। অতএব পতি ও পত্নী স্ব-স্ব শরীর ও আত্মার পুষ্টির জন্য বল আর বুদ্ধি আদির বর্দ্ধক সর্বোষধি সেবন করবে। . সেই সর্বোষধি এইরূপ, যথা - দুই খণ্ড আম-আদা, হরিদ্রা, চন্দন, একাঙ্গী, কুড়, জটামাসী, মূর্বা, শিলাজীত, কর্পূর, মুথা আর নাগরমুথা। . এইসব ঔষধি চূর্ণ করে প্রত্যেকটা সমভাগে (পরিমাণে) নিয়ে যজ্ঞডুমুরের কাষ্ঠপাত্রে গোদুগ্ধ সহিত মিশ্রিত করে তার দই প্রস্তুত করবে আর সেই ডুমুরের কাষ্ঠেরই মন্থনদণ্ড দিয়ে মন্থন করে সেখান থেকে মাখন বের করে তার ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতে সুগন্ধি দ্রব্য যথা - কেশর, কস্তুরী, জায়ফল, এলাইচ, জয়ত্রী মিশ্রণ করবে। . অর্থাৎ একসের পরিমাণ দুধে এক ছটাক পরিমাণে সর্বোষধি মিশ্রিত করে জ্বাল দিয়ে উক্ত বিধিতে ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতের প্রত্যেক সেরে কস্তুরী এক রতি, কেশর এক মাসা, জায়ফল এক মাসা, জয়ত্রী এক মাসা আর এলাচ এক মাসা মিশ্রিত করে প্রতিদিন প্রাতঃকালে সেই সুগন্ধি দ্রব্য মিশ্রিত সর্বোষধি ঘৃত দ্বারা ২৪ থেকে ২৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখিত বিধিতে আঘারাবাজ্যভাগাহুতি ৪ আর ৪০ পৃষ্ঠায় লিখিত "বিষ্ণুর্য়োনিম্.." ইত্যাদি ৭ টা মন্ত্রের শেষে "স্বাহা" শব্দ উচ্চারণ করে যে রাতে গর্ভস্থাপন ক্রিয়া করতে হবে এক প্রহর রাত্রির পরে সেইদিন দিবাভাগে হোম করে হুতশেষ ঘৃত, ক্ষীর বা অন্নের সঙ্গে মিশ্রিত করে উভয়ে যথারীতি ভোজন করবে। এইভাবে গর্ভস্থাপন করলে সুশীল, বিদ্বান, দীর্ঘায়ু, তেজস্বী, সুদৃঢ় ও নীরোগ পুত্র উৎপন্ন হবে। যদি কন্যা লাভের ইচ্ছা হয়, তাহলে অন্নের সহিত পূর্বোক্ত প্রকারে প্রস্তুত ঘৃত মিশ্রিত করে ডুমুরকাষ্ঠের পাত্রে জমানো দধির সহিত সেই অন্ন সেবন করবে। এতে উত্তম গুণযুক্ত কন্যা জন্মাবে। কারণ "আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধি সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।।" এটা ছান্দোগ্যের বচন অর্থাৎ মদ্যমাংসাদিরহিত ঘৃত, দুগ্ধাদি আর তণ্ডুল, গোধূম ইত্যাদি শুদ্ধাহার করলে অন্তঃকরণের শুদ্ধি বুদ্ধি, বল, পুরুষকার আর আরোগ্য লাভ হয়। যেমন সব পদার্থকে উৎকৃষ্ট করার বিদ্যা আছে, তেমনই সন্তানকেও উৎকৃষ্ট করার এইরূপ বিদ্যা আছে। এই বিষয়ে মানুষকে বিশেষরূপে মনোযোগী হওয়া উচিত, কারণ এতে মনোযোগী না হলে বংশের হানি আর অধঃপতন হয় তথা মনোযোগী হলে বংশের বৃদ্ধি আর উন্নতি অবশ্যই হতে থাকে।" . গর্ভাধানের সময় স্ত্রীকে সাবধান থাকার জন্য লিখেছেন - "তৎপশ্চাত স্ত্রীর গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সুনিয়ম করে দিবে। স্ত্রীরা কখনও মদ্যাদি মাদক দ্রব্য, হরিত্যকাদি রেচক দ্রব্য, অতি লবণাদি ক্ষার দ্রব্য, অত্যম্ল, চণকাদি রুক্ষ পদার্থ এবং লঙ্কাদি তীক্ষ্ণ দ্রব্য ভক্ষণ করবে না। তবে ঘৃত, গোদুগ্ধ, মিষ্টি, সোমলতা অর্থাৎ গুড়ুচ্যাদি ঔষধি, অন্ন, মিষ্ঠ, দধি, গোধূম, মুগ, মাষকলাই, অড়হরাদি খাদ্য এবং পুষ্টিকর তরকারী ভোজন করবে। তাতে ঋতুভেদে ভিন্ন-ভিন্ন মশলা যেমন গ্রীষ্মকালে স্নিগ্ধ শ্বেত এলাইচ প্রভৃতি এবং শীতকালে কস্তুরী ও কেশরাদি মিশ্রিত করে সেবন করবে। সর্বদা উচিত আহার-বিহার করবে। এতে সন্তান অতি বুদ্ধিমান, নিরোগ আর শুভ গুণ-কর্ম-স্বভাবযুক্ত হবে।" . উত্তম সন্তান নির্মাণার্থ পুংসবন সংস্কারের মধ্যে মহর্ষি লিখেছেন - "স্ত্রী সুনিয়ম ও উচিত আহার-বিহারের পাশাপাশি বিশেষভাবে গুলঞ্চ, ব্রাহ্মী ঔষধি ও শুন্ডী দুধের সহিত মিশ্রিত করে অল্প-অল্প সেবন করবে। অধিক নিদ্রা, অধিক বাক্যালাপ পরিত্যাগ করবে, অধিক ক্ষার, অম্ল, তীক্ষ্ণ, কটু আর হরিতকী আদি রেচক বস্তু খাবে না। লঘুপাক দ্রব্য আহার করবে। ক্রোধ, দ্বেষ ও লোভাদি দোষে আবদ্ধ থাকবে না। চিত্তকে সদা প্রসন্ন রাখবে - ইত্যাদি শুভ আচরণ করবে।" . 🍁 ভোজনের স্থান 🍁 ভোজনালয় - যে স্থানে বসে মানুষ ভোজন করবে সেটা শুদ্ধ, ধোয়া-মোছা-পরিষ্কার, ধুলোবালি রহিত, বায়বীয়, খোলামেলা হওয়া উচিত, যাতে আহার গ্রহণ করার সময় মনের মধ্যে কোনোরূপ বিকার না আসে। সেই সময় ভোজন কারী ব্যক্তির চিত্ত ভোজনালয়ের স্বচ্ছতা আদি হতে প্রভাবিত হয়ে সর্বথা শান্ত আর প্রসন্ন হওয়া উচিত। আহার গ্রহণ করার সময় যদি চিত্তের মধ্যে কোনো ধরণের গণ্ডগোল বা অশান্তি থাকে তাহলে ভোজনের পাচন কর্ম সঠিকভাবে হবে না। ভোজন করার সময় মানসিক বিচারের অত্যধিক প্রভাব শরীরযন্ত্রের উপর পড়ে। . যারা শুদ্ধি করে না তাদের ভোজনালয়ে কোথাও কয়লা, কোথাও ছাই, কোথাও খড়ি, কোথাও ভগ্ন ফুটো হাঁড়ি, কোথাও এঁটো বাসন তথা মাংসাহারীদের স্থানে হাড়-হাড্ডি আদি অন্যান্য পদার্থ পড়ে থাকে আর মাছির কথা তো কি বলবো! স্থানটা এমন জঘন্য মনে হয় যে, যদি কোনো ভদ্রলোক গিয়ে সেখানে বসে তাহলে তার বমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন দুর্গন্ধযুক্ত স্থানে ভোজন করলে শরীর আর মনের উপর ভালো প্রভাব কিভাবে পড়বে? পূর্বোক্ত দোষের নিবৃত্তির জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "যদি পাকা ঘর হয় তাহলে জল দিয়ে ধুয়ে শুদ্ধ করা উচিত।" . আর কাঁচা ঘরে গরুর গোবর দিয়ে চৌকো লাগানোর গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন - "গোময় (গরুর গোবর) মসৃণ হওয়াতে শীঘ্র উঠে যায় না। তাতে বস্ত্র বিকৃত বা মলিন হয় না। মাটি দ্বারা যেরূপ ময়লা জন্মে, শুষ্ক গোময় থেকে সেইরূপ হয় না। তাছাড়া মাটি আর গোময় দিয়ে যে স্থান লেপন করা হয়, সেটা দেখতে অতি সুন্দর হয়। রন্ধনশালায় ভোজন করলে ঘৃত, মিষ্ট আর উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে, তাতে মাছি, কীট এবং অন্যান্য জীব অপরিষ্কৃত স্থান থেকে সেখানে এসে বসে। তাই প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে সেইস্থান পরিষ্কার করে লেপন করা না হলে সেটা পায়খানার ন্যায় হয়ে উঠবে। অতএব প্রত্যহ গোময়, মৃত্তিকা এবং সম্মার্জনী দ্বারা উক্তস্থান পরিষ্কার রাখবে।" এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় - "রান্নাঘরে বসে ভোজন করা উচিত নাকি রান্নাঘরের বাইরে ভোজন করা উচিত?" উত্তর দিয়েছেন - "উত্তম ও রমণীয় স্থানে ভোজন করা উচিত।" এই বিষয়ে মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন - . ভোক্তারম্ বিজনে রম্যে নিঃসম্য়াতে শুভে শুচৌ । সুগন্ধপুষ্পরচিতে সমে দেশে চ ভোজয়েৎ ।।৪৫৮।। (সূত্র স্থান অধ্যায় ৪৬) . একান্ত স্থানে, যেখানে মানুষের যাতায়াত = আসা-যাওয়া হয় না, রময়ীয়, শুদ্ধ পবিত্র তথা পুষ্পাদি দ্বারা সুগন্ধিত, সম (সেটা উঁচু নীচু হবে না), এইরূপ স্থানে ভোজন করা উচিত। আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভোজন, ভোজনের স্থান আর ভোজ্য পদার্থের শুদ্ধতা তথা পবিত্রতার উপর অধিক বল দিয়েছেন, সুতরাং ভোজনের স্থানাদিকে ধুয়ে-মুছে-লেপে সদা শুদ্ধ রাখা উচিত। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যের রহস্য নিহিত আছে। . 🍁 ভোজনের পূর্বে তথা পশ্চাৎ আবশ্যক ক্রিয়া 🍁 ভোজনের পূর্বে স্নান করার গুরুত্বকে আমাদের প্রাচীন পুরুষগণ বিশেষভাবে মানতেন। গ্রামীণ ব্যক্তিদের মধ্যে এর ছাপ এখনও দেখা যায়। এমন অনেক অশিক্ষিত ভারতীয় মানুষ আছে যারা বিনা স্নান করে ভোজন করাকে পাপ মনে করে। সুতরাং মকরসংক্রান্তি আদি পর্বে তো স্নান করে না এমন ব্যক্তিও ভোজনের পূর্বে স্নান করে নেয়। এই প্রসিদ্ধ প্রবাদ "শত কাজ ছেড়ে স্নান করো" মানুষের মধ্যে একটু ব্যবহারিক রূপে প্রচলিত আছে। সংস্কৃত শ্লোকের এই ভাগ - "শতম্ বিহায় ভোক্তব্যম্ সহস্রম্ স্নানমাচরেৎ" এটাই সিদ্ধ করে যে ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত। . মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে লিখেছেন - "প্রথমে স্নান এইজন্য যে এতে শরীরের বাহ্য অবয়বের শুদ্ধি আর আরোগ্য আদি হয়, এইজন্য ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত।" এখনকার শিক্ষিত ব্যক্তি ভোজন তো চার-পাঁচ বার করে কিন্তু স্নানের মতো আবশ্যক কৃত্যকে দিনে একটাবারও করতে চায় না। এমন অনেক বাবু ব্যক্তি এই ভারতের মধ্যে পাওয়া যাবে যারা সারা শীতকাল ধরে একটাবারও স্নান করেনি আর বিস্কুট আদি তো বিনা শৌচ হতে নিবৃত্তি হয়ে বিছানাতে ঘুম থেকে জেগেই চেয়ে বসে। কিন্তু ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যপ্রেমী ব্যক্তিকে প্রতিদিন সব ঋতুতে বিনা স্নান করে ভোজন করা মোটেও উচিত নয়। যদি স্নান প্রাতঃ সায়ং দুই সময় করা হয় তাহলে তো আরও ভালো। . আসলে ভোজনের অধিকারী তো তারাই যারা প্রাতঃ কাল ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে শৌচ, স্নান, প্রাণায়াম, ঈশ্বরোপাসনা, যজ্ঞ, ব্যায়াম আদি নিত্যপ্রতি প্রাতঃকালেই করে নেয় আর এইভাবে সায়ংকালেও সব নিত্যকর্ম করে। ভোজনের সময় হাত, পা আর মুখকে ভালোভাবে শুদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে স্বচ্ছ করে নেওয়া উচিত। তারপর শুদ্ধ বস্ত্র ধারণ করে ভোজনশালাতে গিয়ে কুশ আসনে বসবেন, যদি গৃহস্থ হন তাহলে বলিবৈশ্বদেবযজ্ঞ করে নিবেন তথা নিজের আশ্রিত গরু, কুকুর আদি প্রাণীদেরও ভোজন দিবেন। . আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে অতিথি সৎকারের গুরুত্ব অত্যধিক পাওয়া যায়। অথর্ববেদের মধ্যে লেখা আছে - "শ্রেয়াম্সমেনমাত্মনো মানয়েৎ" (১৫/১০/২) যদি কোনো অতিথি আপনার গৃহে আসে তাহলে নিজের সৌভাগ্য ভেবে তার সৎকার করা উচিত আর "অশিতবত্যতিথো অশ্নীয়াৎ" (৯/৮/৮) এই বেদাজ্ঞার অনুসারে গৃহস্থকে অতিথির পূর্বে কখনও ভোজন করা উচিত নয়। সুতরাং নিজের পূজ্যজন সাধু মহাত্মা অতিথিদের শ্রেষ্ঠ ভোজন দিয়ে তৃপ্ত করার উপরান্তই স্বয়ং প্রসন্নচিত্ত হয়ে ভোজন গ্রহণ করা উচিত। . ভোজন করার সময় কথা বলা বা কোলাহল করা, আমাদের সভ্যতার বিরুদ্ধ। "বাগ্যতস্তু ভুঞ্জীত" অনুসারে মৌন হয়ে শান্তিপূর্বক ভোজন করা উচিত। নিজের ভাগ্য আর পরিশ্রম করার পশ্চাৎ যা প্রাপ্ত হয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত আর অন্নের নিন্দা কখনও করা উচিত নয়। . ভোজনোপরান্ত তৎকালই কঠিন শারীরিক বা মানসিক কোনো কাজ করা বা দৌড়ানো আদি হানিকারক। শান্তিপূর্বক শারীরিক বা মানসিক সাধারণ কোনো কাজ করা যেতে পারে। ভোজনের পূর্বে বা পশ্চাৎ ক্রোধাদি করলে ভোজন বিষ হয়ে যায়। অনেক দেরিতে হজম হয়, সুতরাং সাবধান তথা শান্ত থাকা উচিত। . ভোজন করার সময় সব ধরণের চিন্তা শোক ঈর্ষাদি পরিত্যাগ করে সর্বথা প্রসন্নচিত্ত থাকলে ভোজন ভালোভাবে হজম তথা শুদ্ধ রক্তাদি ধাতুর নির্মাণ করে আর বলিষ্ঠ করে তোলে। এর পাশাপাশি ভক্ষ্যাভক্ষ্যের আলোচনা অবশ্যই করা উচিত।

(ক্রমশঃ)
Read More

13 December, 2024

शिव कौन हें ?

13 December 0

 हिरण्यबाहु, गणपति, पशुपति, शितिकण्ठ, करपर्दिन, व्युप्तकेश, शतधन्व, हस्व, वामन, शम्भु, मयोभव, शंकर, मयस्कर, शिवतर, भूतानाम्‌ अधिपति । वेद में हम स्पष्ट रूप से देखते हैं कि ये सभी नाम वह अर्थ नहीं देते जो आज लोक में प्रचलित हैं ।

शिव कौन हें ?


कुछ विद्वान ऐसा मानते हैं कि वेद में उसी शिव का वर्णन है जिसके नाम पर अनेक पौराणिक कथाओं का सृजन हुआ है और उसी की पूजाउपासना वैदिक काल से आज तक चली आती है । यहाँ तक कि शिव के अनेक नामों की व्याख्या करने के लिए ही तरह-तरह को कहानियों की रचना की गई है । ये कहानियाँ सृष्टि क्रम के विरुद्ध होने के साथ-साथ युक्ति संगत भी नहीं हे । इन कहानियों से शिव का उज्जवल स्वरूप तो नष्ट होता ही है साथ ही अनेक अनर्गल क्रिया कलाप भी इससे जुड़ जाते हैं । इन कहानियों के रचयिता शिव को अजर-अमर मानते हुए भी उनका ऐतिहासिक रूप इस वीभत्सता से प्रस्तुत करते हें ह- स्पष्ट नहीं हो पाता कि हम कौन से शिव का अवलोकन कर रहे हें ।


रामायण में शिव का वर्णन


रामायण के नाम से हम दो ग्रन्थों से विशेषतः परिचित हें । प्रथम वाल्मीकि द्वारा रचित रामायण और द्वितीय तुलसीदास द्वारा रचित रामचरितमानस । आमतौर पर तुलसीदास की रामचरितमानस को भी रामायण कह दिया जाता है जोकि गलत है । इन दोनों ग्रन्थों में महान अन्तर है । भाषा का अन्तर तो हे ही, कथा का भी अन्तर है । वाल्मीकि का वृत्तान्त सत्यता के निकट है, उस पर हम पूरा भरोसा कर सकते हैं जबकि तुलसी का वृतान्त भक्ति भावना से लिखा गया मानवीय और अमानवीय कथ्यों का अजीब मिश्रण है । यह निरिचित ही नहीं हो पाता कि तुलसी दशरथ के पुत्र राम का वर्णम कर रहे हैं या संसार की नियामक शक्ति का । शिव के सम्बन्ध में भी तुलसी का वर्णन विउ्वसनीय नहीं माना जा सकता । अतः हम वाल्मीकि कृत रामायण में ही देखना चाहेंगे कि उसमें कौन से शिव का वर्णन है । क्योंकि वाल्मीकि रामायण ही प्राचीनतम राम-काव्य हे।


वाल्मीकि रामायण के बालकाण्ड में जिव का वर्णन सर्वप्रथम तेईसवें सर्ग में मिलता है । विह्वामित्र के साथ भ्रमण करते हुए राम-लक्ष्मण जब सरयू तट पर बने एक आश्रम के विषय में उनसे पूछते हैं तो विशवामित्र का उत्तर इस प्रकार मिलता है- “बुद्धिमानों से ज़ो 'काम' कहा जाता हे वह कन्दर्प (पहले) शरीर धारी था। यहाँ नियम पूर्वक एकाग्र हुए तपस्या करते हुए विवाह करके मरुतों के साथ जाते हुए देवेश महादेव को टुष्ट बुद्धि वाले काम ने पीड़ित किया । महात्मा शिव ने हुंकार किया । हे रघुनन्दन रुद्र की आँख से जले हुए दुर्मत (काम) के शरीर से सब अंग गिर गये । महात्मा (शिव) से जलाये हुए अंग नष्ट हुए । देवेइवर शिव ने क्रोध से काम को शरीर-रहित किया । हे राधव उस काल से वह अनंग नाम से विख्यात हुआ । उसी (शिव) का यह पहले पुण्य आश्रम था ।


इस वर्णन से इतना ज्ञात होता है कि पहले इस आश्रम में शिव नाम के कोई महात्मा तपस्या करते थे । और उन्होंने 'काम' को अपने शरीर पर किसी भी प्रकार से हावी नहीं होने दिया था । उक्त कथन के बाद यह भी कहा गया है कि वे विवाह करके जा रहे थे । यह कथन हमें असंगत लगता है । जब बे विवाह करने को प्रस्तुत ही हो गये तो निडिचित्‌ है कि “काम” का सेवन उन्हें करना ही होगा । जब 'काम' को शरीर रहित हो करना था तो विवाह की क्‍या आवश्यकता था । स्पष्ट रूप से वे शिव बेद में कहे गये डिव नहीं हो सकते । ये पूर्णतः मानवीय गुणों से युक्त हैं ।


धन्‌ष भंग के प्रसंग में जिस धनुष का नाम आता है वह जनक के किसी पूर्वज का दिया हुआ था । यह भ्रमपूर्ण कथन है कि इसका सम्बन्ध शिव से था । एक अन्य धारणा यह भी हे कि रावण शिव भक्त था। जहाँ तक हमारा अभिमत है शंकर का अस्तित्व राम के समय नहीं था । अतः रावण के शिव भक्त होने का प्रइन ही नहीं उठता । शंकर वस्तुतः महाभारत काल में ही थे इनका वर्णन वेदों से भी निकालना उचित नहीं है । क्योंकि वेदों में इतिहास नहीं है ।


राम के विषय में भी यही धारणा लोक में प्रचलित है कि राम शिव के उपासक थे । यदि यह कहा जाय कि राम इस संसार के रचयिता शिव के उपासक थे तब तो ठीक है किन्तु यदि उस शिव का आरोपण यहाँ किया जाये, जिसका वर्णन महाभारत ओर पुराणों में हे तो यह गलत होगा । वस्तुतः यह घपला तुलसीदास का किया हुआ है । उन्होंने हो शिव और राम को एक दूसरे का उपास्य बताकर इतिहास क्रम को दूषित किया है । अक्सर राम के द्वारा सेतु-बन्धन का उदाहरण दिया जाता है और कहा जाता है कि इस अवसर पर राम द्वारा शिवलिंग को स्थापना की गई और आज उसी स्थान पर रामेइवरम का मन्दिर विद्यमान है । वाल्मीकि रामायण से यह प्रमाणित नहीं होता । वस्तुतः यह मन्दिर ११वीं शती का निर्माण हे और एक दक्षिण भारतीय राजा रामचन्द्र ने इसका निर्माण कराया था इसीलिये इसका नाम रामेइवरम पड़ा है । यह राजा शिव का उपासक था ।


रावण किसका उपासक था इसकी विवेचना हम किसी अन्य लेख में करना चाहेंगे । महाभारत के शिव


महाभारत में हम जिस शिव का वर्णन पाते हैं वे ऐतिहासिक पुरुष हैं और काफी हद तक मानवीय भावनाओं से ओतप्रोत है । वस्तुतः ये भूटान के राजा थे जो उस समय भूतस्थान के नाम से प्रसिद्ध रहा होगा जो बाद में भूतान अथवा भूटान हो गया । इस प्रदेश के रहने वालों को आज भी भोट या भोटिया कहते हैं जो भूत और - भूतिया के अपभ्रंश हैं । पूर्वकाल में इस प्रदेश पर देवों का आधिपत्य हो चुका था | इस प्रदेश के मूल निवासियों और देवों के मिश्रण से ही इस जाति का उद्भव हुआ था । भूतों के राजा होने के कारण ही शिव के नाम भूतपति, भूतेश, भूतनाथ आदि कहे गये हैं । इन्हें महादेव भी कहा गया है ।


यद्यपि आज का भूटान एक छोटा सा प्रदेश है तथापि प्राचीन काल में यह प्रदेश काफी बड़ा था | यही कारण है कि महादेव की गद्दी कैलाश पर्वत पर थी और वहीं से वे भूत तथा पिज्ञाच जाति पर शासन करते थे । पहाड़ों के राजा होने से ह. गिरीश भी कहा है । इनकी


पत्नी पार्वती है अर्थात्‌ पहाड़ी स्त्री । पहाडी राजा सत्रो से होना स्वाभाविक ही है । # राजा का विवाह पहाड़ी


महाभारत के कुछ प्रसंग ऐसे हैं जो इन्हें स्पष्टतः: ऐतिहासिक सिद्ध करते हें । अजु न पाशुपत अस्त्र को प्राप्ति लक औ-.+


्ी प्ति के लिए हिमालय पर जाते हैं । यह अस्त्र शिव से ही प्राप्त होना था । शिव 'नके प लेकर ही अस्त्र उन्हें प्रदान करते हैं । एक और प्रसंग में शंकर का युद्ध कृष्ण से होता है । बाणासुर की पुत्री उषा का विवाह कृष्ण के पौत्र अनिरुद्ध से हुआ था इसी संदर्भ में बाणासुर का युद्ध कृष्ण से हुआ और शंकर बाणासुर के सहायक हुए इस युद्ध में शंकर की हार हो गई ।


शंकर को क्रतु-ध्वंसी भी कहा गया है । यज्ञ का विनाश करने वाले । यह कार्य कोई स्वधर्मी नहीं कर सकता । हम देखते हैं कि महादेव सदेव असुरों और राक्षसों की सहायता करते हैं । बाणासुर जेसे अनेक राक्षसों को महादेव से सहायता मिलती थी और प्रबल होकर वे भारतवासियों को सताते थे । प्रारम्भ में ये न तो देवों के पक्षपातो थे और न आर्यो के सहायक अपितु स्वतन्त्र रूप से अपना राज्य चलाते थे । किन्तु विष्णु के प्रयत्न से इन्हें अनेक बार असफलता प्राप्त हुई और अपने अन्तिम दिनों में ये देवों के सहायक बन गये ।


सांस्कृतिक टृष्टि से हम देखें तो पता लगेगा कि इनको सभ्यता काफी पिछड़ी हुई थी । जिस समय विष्णु रेशमी पीताम्बर धारण करते थे, साधारण भारतीय सूती वस्त्र का प्रयोग करते थे वहां भूतों के राजा शंकर कच्चे चमड़े के वस्त्र ही पहनते थे । जब राजा ही कच्चा चमड़ा पहनता हो तो उसकी प्रजा का क्‍या हाल होगा । पुराणों के शिव


पुराणों के शिव का रूप बहुत ही विकृत है । स्वयं शिवजी की उत्पत्ति । उनके पुत्रों की उत्पत्ति आदि भी अत्यन्त काल्पनिक है । हम यहाँ गणेश की उत्पत्ति पर भी थोड़ा सा विचार करें तो स्थिति स्पष्ट हो सकती हे । शिवजी जब घर से बाहर गये थे तो पार्वती ने स्नान करने का विचार किया । उन्हें द्वार पर रक्षक की आवश्यकता हुई तो हथेली रगड़ कर एक बालक को उत्पन्न किया और द्वार पर बठा दिया । जब शंकर आये तो इस बालक ने उन्हें रोकना चाहा । शंकर को यह बददत नहीं हुआ कि कोई उन्हें उनके ही घर में न घुसने दे । फलतः शंकर के त्रिशूल से इस बालक का मस्तक कट गया । पार्वती को जब ज्ञात हुआ तो उन्होंने विलाप करना प्रारम्भ कर दिया । यह समाचार जब विष्णु को मिला तो उन्होंने अपने चक्र से एक नवजात गज-शिज्गु का मस्तक काटकर उस बालक की गर्दन पर लगा दिया । यही बालक गणेश हुआ । क


इस कथा में ऐतिहासिकता इतनी भर है कि शिव के / पुत्र गणेज्ञ थे । शोष भाग तर्क रहित और असम्भव है । हम जानते हैँ कि हथेली की रगड़ से कोई सन्तान उत्पन्न नहीं होती । पार्वती यदि ऐसा कर सकती थी तो उसे ज्िव से विवाह करने की आवश्यकता ही नहीं थी । इधर शिव को पता नहीं चल सका कि यह मेरा ही पुत्र है । कैसे अन्तरयामी थे वे ? उनका क्रोध तो हद को भी पार कर गया । किसी बालक का पस्तक काट देना क्या विवेकहीनता नहीं है ? उसे तो बॉधा भो जा सकता था । ज्ञिव से अधिक बलवान भी उसे नहीं कहा जा सकता। पार्व॑ती भी टुबारा हथेली रगड़ कर बालक बना सकती थी ।


बालक धड़ पर हाथी के बच्चे का सिर जोड़ना किसी भो प्रकार युक्ति संगत नहीं है । प्रथम तो इसमें भूल यहो है कि उसी बालक का सिर क्‍यों नहीं जोड़ा गया, वह तो वहीं पड़ा रह गया । उसे ढूँढने की आवश्यकता नहीं होती । वह नहीं तो किसी अन्य बच्चे का सिर लगाया जाता किन्तु उन्हें तो हाथी के बच्चे का सिर लगाना था । हमारी इस बात से कोई इन्कार नहीं कर सकता कि हाथी का बच्चा कितना ही छोटा हो उसका सिर किसी मानव-शिशु की गर्दन पर सही नहीं बैठ सकता ।


पौराणिक कथाओं में इसी प्रकार की अनेकों विसंगतियाँ भरी पडी हैं जिनका कोई युक्तिपूर्ण समाधान नहीं है । ढ


इसके अतिरिक्त पुराणों में शिव पार्वती के काम-सम्बन्ध की चर्चा इतनी खुलकर को गई है कि वह अइलीलता की हद को भी पार कर गई है । उसे हम यहाँ लिखना भी नहीं चाहते । पराणों के अध्ययन कर्ता स्वयं ही यह सब जानते हैं और इन प्रसंगों की अहलीलता पर लीपापोती करने के कं इनको आध्यात्मिक व्याख्या प्रस्तुत करने का भरसक प्रयास करते रहते है । चुकी | सत्य छिपता नहीं । आज शंकर-पूजा लिंग-पूजा म॑ परिवर्तित हो चुकी है। यह असभ्यता का प्रतीक है । भारतीय इतिहास के मध्यकाल में जब बाम मार्ग का आविर्भाव हुआ तो लिंग- पूजा का अत्यधिक प्रचार और प्रसार हुआ । फलतः भारतीय आध्यात्मिकता अपने अधःपतन को प्राप्त हो गई । दूसरी ओर भारत पर अनेकों विदेशी आक्रमणों ने भी इस कार्य में सहयोग दिया । विदेशियों के मिथ्या विश्वास भी भारतीय जन जीवन में घुसपैंठ कर गये और इस पतन में सहायक हुए। साकार शिव - हिमालय


हमारी सम्मति में आज हम जिस शिव की पूजा अर्चना करते हैं वह वस्तुतः हिमालय पर्वत और हिमालय निवासी शिव, दोनों का मिला जुला वर्णन है । मध्य-कालीन कवियों और लेखकों ने अपने साहित्य पें चमत्कार प्रदर्शित करने के लिए ही इन दोनों का मिश्रण किया होगा । हम समझते हैं मिश्रण कोई अच्छी बात नहीं है जबकि इसके परिणाम दूरगामी हों । एक बात यह भी है कि कविता की समझ सभो को नहीं होती । मूढ़ मन तो लिखी हुई हर बात को पत्थर की लकोर समझता है । फिर यदि संस्कृत में लिखा हो तो वह उसे ब्रह्म वाक्य ही लगता है । वह उसे अक्षरशः सत्य मानता है । आज भोली भाली जनता इसी मिश्रित साहित्य के कारण दिग्भ्रमित होती है और शित्र को समझने में असमर्थ रहती है ।


आइये कुछ ठोस आधारों पर इसकी विवेचना करें। किसी भो मानव आकृति को हम शिव का रूप देना चाहें तो कुछ बातों पर विशेष ध्यान टेना होगा । उस आकृति में जटा जूट में ऊपर अर्धचन्द्र रखा होना चाहिए । जटा जूट से गंगा निकलनी चाहिए, माथे पर त्रिपुण्ड, तोसरा नेत्र, गले में सर्पमाल, हाथ में त्रिशूल, वस्त्र के नाम पर बाघम्बर । इतना काफी है किसी मानव आकृति को शिव बनाने के लिए हम आजकल भी इन्ही विशेषताओं से युक्त शिव का चित्र देखते हैं । चित्र में कुछ बातें तो साधारण ही होती हैं जेसे माथे पर चन्दन लगाना । सिर पर जटा-जूट होना, हाथ में त्रिशूल, गले में सर्प माला और वस्त्र के नाम पर बाघम्बर पहनना कोई विशेष बातें नहीं हैं, इन्हें कोई भी कर सकता है । किन्तु तीन बातें-अवशय ही विचारणीय हैं | सिर पर चन्द्रमा धारण करना, जटाजूट से गंगा का निकलना और त्रिनेत्र होना । ये तीन विशेषताएँ इन्हें अन्य मानवों से अलग करती हैं ।


उक्त तीनों विशेषतायें हिमालय से सम्बन्ध रखने वाली हैं अतः स्पष्टतः शिव का वास्तविक रूप हिमालय ही है । देखें यह किस प्रकार है। जिन लोगों ने हिमालय पर्वत श्रेणियों को प्रत्यक्ष देखा है वे इसे आसानी से समझ सकते हैं । कल्पना कीजिए कि अर्धचन्द्र जिस समय ऐसी स्थिति में हो कि वह हिमालय पर्वत के पृष्ठ भाग में इतनी उंचाई पर हो कि वह पर्वत को छूता हुआ सा लगे तो ऐसा ही लगेगा पानो यह पर्वत पर रखा हुआ है । यही दृश्य जटाजट पर चन्द्रमा के रखे होने का आधार है ।


दूसरा प्रबल प्रतीक हे गंगा का सिर से निकलना । सभी जानते हैं कि गंगा हिमालय पर्वत से ही निकलती है और फिर वहाँ से निकलकर विचरण करती हुई बंगाल की खाड़ी में गिरती है । जटाजूट की कल्पना हिमालय की पर्वत श्रृंखलाओं में की गई है । यही शिव के मस्तक से गंगा का निकलना है । यद्यपि इस प्रसंग में अनेकों कथायें गढ़ो गई हैं । अनेकों व्याख्याएँ प्रस्तुत की गई हैं किन्तु वे तर्क संगत नहीं


तीसरी विशेषता हे शिव का त्िनेत्र होना । यह नेत्र वेसे तो बन्द रहता है किन्तु शिव जब नृत्य करते हैं तभी यह सुलवा है । शिव के ताण्डव से थ्वी कम्पायमान हो जाती है और विनाश लीला प्रारम्भ हो जाती है । ताण्डव नृत्य विनाश का सूचक है । कल्पना कीजिए कि हिमालय का समूचा प्रदेश कम्पन करने लगे और ज्वालामुखी के रूप में अग्ति वर्षा आरम्भ कर दे तो प्रलय काल ही उपस्थित हो जाएगा । कितना विनाश होगा यह कल्पनानीत हे ।


शंकर के गले में सर्प माला भी रहती है । यह दृश्य भी हिमालय पर देखने को मिल सकता है | जिस समय हिम श्रृंगों को बादल वलय के आकार में घेर ले तो यही प्रतोत होगा कि यह शिव रूपी हिमालय की गर्दन की माला हें । वेद में बादल के लिए अहि राब्द भी प्रयोग हुआ है और लोकिक संस्कृत में इसे सर्प का पर्याय देखते हैं । अतः इसपें सर्प को कल्पना की गई । क्षण-क्षण आकार बदलने के कारण गतिशील भी रहता है | यही इसकी सर्पशीलता है ।


शंकर को पत्नी का नाम पार्वती प्रसिद्ध हे | पार्वती का अर्थ पर्वत पर उत्पन्न होने वाली वनस्पति से भी हे । हिमालय के सन्दर्भ में हम उसके स्पप्टोकरण के लिए कुछ मध्यकालीन चित्रों का अवलोकन करें तो पायेंगे कि पार्वती को शंकर की गोद में बैठा हुआ चित्रित किया गया हे । इसे हम केवल मानवीय चित्रण की दृष्टि से देखें तो कुछ अच्छा नहीं लगेगा कि पति पत्नी को इस प्रकार चित्रित किया जाय । किन्तु इसकी संगति हम हिमालय के साथ उस पर फैली हुई वनस्पति से लगायें तो बात स्पष्ट हो जाती है । इस सन्दर्भ में हमें “वैदिक सम्पत्ति के पृष्ठ १९५ पर लिखित एक पंक्ति का स्मरण हो आता है । लिखा हे “हम देखते हें कि हिमालय रूपी शंकर को गोद में वनस्पति रूपी पार्वती अधिकता से विद्यमान है ।”


शिव को अजर-अपमर कहा गया है । कम से कम मानव जाति के लिए तो हिमालय भी इसी कोटि में आता है । अपनी ऊंचाई और विशालता के आधार पर इसका सर्वप्रथम उदभूत होना अवश्यम्भावी है । इसके विषय में 'वैटिक सम्पत्ति' के पृष्ठ १९३ पर हम पढ़ते हैं“जो पहाड़ जितना ही ऊंचा होता है, उसके फेंकने वाली अग्नि, प्रपात की गञक्ति भी उतना ही अधिक बलवान होती है । हिमालय सबसे विशाल और उच्च है, इसलिए उसको बनाने वाली शक्ति भी समस्त अपात शक्तियों से प्रबल, थी । इतनी बड़ी महान शक्ति संचित रूप से तभी मिल सकती है । जब वह बिल्कुल ही अक्षुण्ण रही हो । और यह तो निर्विवाद है कि ऐसी शक्ति सृष्टि के आदि में ही मिल सकती है । इससे अनुमान करना सरल हो जाता हे कि पृथ्वी का सर्वोच्च हिमालय पहाड़ ही सर्वप्रथम उत्पन्न हुआ ।”


हिमालय ही कल्याणकारी होने से शंकर भी है । अनेकों नदियाँ हूं से निकलकर हमें जीवन प्रदान करती हैं अतः वह प्रजापति भी है ।


संसार की समस्त प्राचीन सभ्यतायें भी हिमालय को किसी न किसी नाम से जानती हैं । हिमालय का एक नाम मेरु भी हे इसे ही ईरान में 'मौरु,' यूनान में 'मेरोस' दक्षिणी तुर्किस्तान में 'मेरुव', मिश्र में 'पेरई' और असीरिया पें 'मोरुख' कहा गया है । अतः निश्चित ही हिमालय हमारा आदिदेव महादेव है ।


समय-समय पर अनेक व्यक्ति शिव, शंकर, हे महादेव आदि नाम के होते रहे हैं । अतः आवश्यकता इस बात की है कि हम उन्हें एक साथ मिलाकर न देखें । वेदों के शिव या शंकर निराकार प्रभु हैं जो अजन्मा और अनादि हैं । वाल्मीकि रामायण में शिव नामधारी किसी महापुरुष का नाम अवञझ्य आता है किन्तु यह महापुरुष महाभारत कालीन शिव से भिन्न हैं । महाभारत कालीन शिव के नाम पर ही अनेकों कथायें पुराणों में संकलित की गई हैं जिसके कारण भ्रम उत्पत्र होता है ओर साधारण जन उन सभी को एक ही समझकर भ्रमित 'हो जाते हैं । महाभारत के शिव मानवीय गुणों से सम्पन्न हैं । लिंग पूजा का सम्बन्ध भी इन्हीं शिव के साथ जोड़ दिया जाता है । हिमालय पर्वत का मानवीकरण करके भी इन्हीं शिव से पिला दिया गया और भक्ति भावना के अतिरेक में इन्हें ही देवाधिदिव परम पुरुष मान लिया गया है । इस सारे मिश्रण के कारण ही अनेक विसंगतियों का जन्म हुआ है । आवश्यकता इस बात की है कि हम उन्हें अलग-अलग करके ही देखें । स्पष्टीकरण के लिए हमने मुख पृष्ठ पर हिमालय का मानवोौकरण प्रस्तुत करने का उपक्रम किया है ।


हम देखते हैं कि मानव मन सरलता की ओर दौड़ने में सदेव तत्पर रहा है अतः हम परम पिता शिव के वास्तविक रूप को जानने का कष्ट नहीं करना चाहते और अनेक निरर्थक कार्यक्रमों में लिप्त रहते हें । केवल जड़ वस्तुओं की पूजा-अर्चना करके ही हम अपने को परम धार्मिक व्यक्ति मान लेते हैं । ईश्वर की सच्ची पूजा तो उसके वास्तविक स्वरूप को जानने में हे मानने में नहीं । हम रोज ही देखते हें कि अनेक मठ-मन्दिर हर समय भीड से भरे रहते हैं । प्रत्येक व्यक्ति अपने को धार्मिक समझता है फिर तो संसार की समस्त बुराइयों का नाश हो जाना चाहिए। किन्तु बुराइयाँ कम होने का नाम नहीं लेतीं। कारण यही हे कि गलत दिशा की ओर जा रहे हैं। हम परम पिता से भी यह गलत आज्ञा करते हैं कि हम गलतियाँ करते जायें और वह हमें क्षमा करता जाय । इसी अज्ञानवश हम एक पर एक भूल करते जाते हैं ।


इस विचार सरणि को प्रस्तुत करके हम आज्ञा करते हैं कि सच्चे शिव को जानने में हमें अवश्य ही यह सहायक होगी । यदि ऐसा हो सका तो हम अपना परिश्रम सार्थक समझेंगे । परिशिष्ट


लघु पुस्तिका 'शिव कौन हैं ?' की प्रतिक्रिया हुई |जहाँ इस पुस्तिका का स्वागत हुआ वहाँ प्रतिक्रिया स्वरूप एक आलोचनात्मक पत्र भी हमें प्राप्त हुआ|पत्र पाठकों के समक्ष रखने का आशय इतना ही है कि पाठक स्वयं पु निर्णय करें कि यह प्रतिक्रिया किस प्रकार की है । पत्र इस प्रकार है-


।। श्री राम ।। २१-०३-९२ आदरणीय प्रकाशक एवं लेखक, कल पालीवाल पार्क में भेंट हुई थी । 'भारतीय इतिहास की भयंकर भूलें' पुस्तक खरीदने पर आपने जो पुस्तक 'शिव कौन हैं भेंट दी थी, पूरी पढ़ीऔर गम्भीरता से पढ़ी निष्कर्ष यही निकला कि आप लोग अव्वल दर्जे के सिरफिरे हैं; दरअसल आपके पास बुद्धि का पैमाना कम क्षमता है और आप अधिक नाप करते हैं । ठीक वैसा ही काम जेसे मसाला तौलने वाले तराजू से हिमालय तौलने का बहा दा प्रयास |आपने शिव के सन्दर्भ में जो असंभवताऐ व्यक्त की हें वे ठीक ऐसी हैं, जेसी लोग मारकोनी को दिया करते थे कि बेतार के उपकरण से वार्तालाप केसे सम्भव है, किन्तु आज सब कुछ प्रत्यक्ष हे तो वे मूर्ख खामोश हैं | दरअसल शिव को या किसी अन्य परमेश्वर के अवतार को समझने की बुद्धि दुर्भाग्य से परमात्मा ने आपको नहीं दी लेकिन इतना तय है कि आपके इस अनर्गल प्रलाप का असर बुद्धिमान और चिन्तवान्‌ लोगों पर कदापि पड़ने वाला नहीं है| आप कबसे चीखते चले आ रहे हैं, किन्तु कहीं कुछ नहीं बदला । दरअसल यह हिन्दुस्तान का परम दुर्भाग्य ही रहा कि यहाँ दयानन्द जैसा आदमी जन्मा] खेर,फिर भी कुछ नहीं बिगड़ा और न बिगडेगा। आर्य समाज अब मरणासत्न है, और ऐसा ही रहेगा, यह भी निश्चित है । संकीर्णता की हद होती है, जिसे मीरा के पद से चिढ़ हो, वह उदार क्या होगा)उदार होना मनुष्य की पहली पहचान हे, अन्यथा वह पशु और दानव की श्रेणी में ही खड़ा है। होली की शुभकामनाएं, पत्र दीजिए। भवदीय सुनीत गोस्वामी, पत्रकार ओ३म्‌ ७/४/९२


श्रीयुत सुनीत गोस्वामी, स्वस्ति ।


पत्र आपका यथा समय मिल गया था|कुछ पारिवारिक और कुछ सामाजिक कार्यो में उलझा रहा इसीलिए आपके पत्र का उत्तर तत्काल नहीं दे सका । आपने हमारी लघु पुस्तक 'शिव कौन हैं ?' के सन्दर्भ में लिखा है कि वह आपने गम्भीरता से पढ़ी।ऐसा लिखने के लिए धन्यवाद । किन्तु इससे आगे जो उपाधि हमें भेजने का कष्ट किया है उससे तो यही लगता है कि आपने उसे पूर्वाग्रह से ग्रसित होकर ही पढ़ा है, उस पर विचार नहीं किया। उसको सत्यता का आकलन नहीं किया। आपकी भेजी उपाधियों के लिए हमारे पास स्थान का भी अभाव हे और उतनी पात्रता भी हमारी नहीं है अतः हम उन्हें आपको ही समर्पित करते हें ।


पुराण वर्णित शिव के सम्बन्ध में हमने जो कुछ लिखा है उसे आप किस आधार पर काट सकते हैं । वह कहानी बनाई ही गई हे बुद्धिरहित होकर । शरीर के मैल से पुत्र बनाना । विश्व का नियन्ता होने पर शिव का अज्ञानता वश उस बालक को न पहचानना, फिर सिर काट देना । शिव पुराण में स्पष्ट लिखा है-'अंत में शिवजी को बहुत क्रोध आया और उन्होंने अपने त्रिशल से उसका सिर काट डाला । उस बालक का सिर कटा हुआ देखकर देवता और गण शान्‍्त हो गए ।“इसकां सीधा अर्थ यही है कि वह सिर बहीं कटा हुआ पड़ा था।अगर उन लोगों में यही शक्ति थी कि वे सिर जोड़ कर उसे जीवित कर सकें तो वही सिर क्‍यों नहीं लगाया गया? बेचारे हाथी के बच्चे ने क्‍या अपराध किया था ( हाथी के बच्चे का सिर उसके धड़ पर फिट केसे हो गया 0 और पार्वती जी ने इतना तूफान क्‍यों खड़ा किया, दुबारा शरीर का मैल उतार कर एक बच्चा और बना लेती ।


मूल बात यह है कि इस प्रकार की निराधार कहानियों पर आधारित मत टिक नहीं सकता, उस पर कोई भी उंगली उठा सकता है ।


आपने इसी सन्दर्भ में लिखा हे कि'मारकोनी के बेतार के उपकरण का उपहास करने वाले कहते थे कि बेतार के उपकरण से वार्तालाप कैसे संभव है, किन्तु आज न सब कुछ प्रत्यक्ष हे तो वे मूर्ख खामोश हैं ।”


आपने यह नहीं लिखा कि वे मूर्ख कौन हैं । यदि आपको यह भ्रम हो कि वे आर्यसमाज के लोग होंगे तो इस विषय में हमारा वक्तव्य यह हे कि

ऋग्वेदादि भाष्य भूमिका में पूरा एक अध्याय ही महर्षि दयानन्द ने तार विद्या पर लिखा है ।


यह पुस्तक महर्षि दयानन्द ने बि० स० १९३३ में लिखी थी । अर्थात्‌ ११६ वर्ष पूर्व। इसका १७ बां अध्याय तारबिद्या को ही समर्पित है जिसमें उन्होंने ऋवेद १/८/२१/५ की साक्षी से इसे प्रमाणित किया है । इसी सन्दर्भ में टृष्टव्य है कि शुक्रनीति में अतिप्राचीन काल में दूरसंवाद संचार प्रणाली का उल्लेख होने से इस विषय को स्पष्ट समझ सकते हैं।जो लोग इन ग्रन्थों का अध्ययन करते हैं वे आपकी उस सीमा रेखा में नहीं आते हैं जिसका आपने उल्लेख किया है ।


परमेश्वर के अवतार लेने की बात हर प्रकार से अप्रामाणिक है । अवतार की बात पुराणों में ही आती है । कहा जाता है कि समस्त पुराणों के रचयिता बेद व्यास हैं । किन्तु इनके अध्ययन से पता चलता है कि यह बात असिद्ध है । एक ही अवतार को लेकर प्रत्येक पुराण में अलग-अलग कहानी गढ़ी गई है । अब किस पुराण की बात सच मानी जाये । इन अवतारों के विषय में जो घोषणा की गई है वह क्‍या पूरी हो चुकी हे7 न तो पापी कम हुए और न ही धर्म का साम्राज्य स्थापित हुआ । जब सत्ययुग में जेसा कि कहा जाता है कि धर्म अधिक था ४ अवतार माने जाते हैं, त्रेता में तीन वह भी एक ही समय, द्वापर में दो, और कलयुग में जब धर्म के नाम पर अधर्म ही पनप रहा है केवल १ अवतार' ऐसा क्‍यों ?


आपके अनुसार परमेश्वर के अवतार के समझने की बुद्धि दुर्भाग्य से परमात्मा ने हमें नहीं दी।यह वाक्य आपने विचार कर नहीं लिखा क्योंकि इसमें हमारा कोई दुर्भाग्य नहीं है।यह गलती तो आपने परमात्मा पर आरोपित की है अतः इसका भागी तो वही हे । हम परमात्मा से कुछ छीन कर तो ले नहीं सकते । जब आपने ही निर्णय ले लिया कि बुद्धि परमात्मा ने ही हमें नहीं दी तो इसमें हमारा क्या दोष हे ?


अब हमारा प्रलाप अनर्गल है और आप जेसे बुद्धिमान और चिन्तावान लोगों पर इसका असर पड़ने वाला नहीं तो यह आपके पत्र से ही जाहिर हे हमारी पुस्तक की कोई न कोई प्रतिक्रिया आप पर अवश्य हो हुई है जिस कारण से आपने हमें पत्र लिखने का कष्ट उठाया ।


लगता है आप ने इस बात पर कभी भी विचार नहीं किया कि भारत में ही आपकी विचारधारा वाले लोग हैं जो अवतार बाद के समर्थक हैं । समूचे विश्व का कितना बड़ा भाग आपकी विचारधारा से सहमत नहीं है तो क्‍या आप उनके लिए भी परमात्मा को दोषी नहीं ठहरायेंगे। हम तो अवतार की कथाओं से भली भाँति परिचित हैं किन्तु उनके लिए आप क्‍या कहेंगे जिन्हें परमात्मा ने आपके तथाकथित धर्म का बिरोधी बनाया हुआ है । उन्हें किसने उत्पन्न किया । अगर आप कहें कि उनका परमात्मा और है तो आपका कल्पित परमात्मा उनसे छोटा बैठता है क्योंकि उनकी संख्या बहुत _त अधिक बैठती है । आपने आगे लिखा है “आप कबसे चीखते चले आ रहे ! , कहीं कुछ नहीं बदला | यदि आपका आशय आर्य समाज के चीखने से है तो आप अपने चारों ओर निगाह उठाकर देखें कि आर्य समाज के द्वारा आरम्भ किये गये सभी कार्यक्रम या तो सरकारों द्वारा अपना लिए गये हैं या अन्य संगठन इन कार्यो को अपनाये हुए हैं यथा अछूतोद्धार, जाति पाँति का उन्मूलन, नारी शिक्षा, वर्णाश्रम व्यवस्था, बेद का प्रचार, शुद्धि आन्दोलन, विधवाओं का पुनर्विवाह, गोरक्षा आन्दोलन, गुरुकुल प्रणाली का पुनर्चलन, अनाथालयों की स्थापना, हिन्दी प्रचार ।


स्वराज शब्द का सर्वप्रथम प्रयोग महर्षि ने अपने अमर ग्रन्थ सत्यार्थ प्रकाश में किया था। और 'आर्याभिविनय' में प्रभु से प्रार्था कौ- हे महाराजाधिराज पार ब्रह्म परमेश्वर हम लोगों को यथावत्‌ पुष्ट कर, अन्य देशीय राजे हमारे देश में कभी न हों तथा हम लोग कभी पराधीन न हों ।


आगे आपने लिखा है- “अरअसल यह हिन्दुस्तान का परम दुर्भाग्य ही रहा कि यहाँ दयानन्द जेसा आदमी जन्मा । खेर-फिर भी कुछ नहीं बिगड़ा और न बिगडेगा ।”


आपने यह भी बिना विचारे ही लिख दिया । क्‍योंकि भारत में जन्म लेना न तो दयानन्द के हाथ में था और न ही इसमें भारत कुछ दखल रखता है । हम तो यह कार्य परमात्मा का ही मानते हैं | आप पता नहीं कया समझते हैं । आपने परमात्मा को सलाह देने का नेक काम नहीं किया कि टयानन्द को भारत में न आने दो । आपके न चाहते हुए भी दयानन्द ने भारत में जन्म ले ही लिया और अपना कार्य करके वे चले गये । लगता है आपको उनके आने से काफी क्षति हुई है । सम्भवतः आर्थिक क्षति अधिक हुई है । हाँ, यदि आप चाहते हें कि हिन्दुस्तान का सौभाग्य लौट आये तो आप दयानन्द के किये कार्यों को मिटाना शुरू कर दीजिये ।


१. वेदों का प्रचार बन्द करवा दीजिए । २. नारी शिक्षा के सभी संस्थान बन्द करा दीजिए । ३. अछूतों के साथ वही व्यवहार चालू करा दीजिए जो दयानन्द से पूर्व होता है । ४. दयानन्द ने समस्त पाखण्डों का उन्मूलन करने हा लिए पाखण्ड खण्डनी पताका फहरायी थी । आप पाखण्डमण्डनी पताका लगाय । ५. अनाथालय समाप्त करा दीजिए । ६. शुद्धि आन्दोलन को समाप्त करा दीजिए; जो लोग ईसाई, मुसलमान मत छोड़कर वैदिक थर्मी हो गये हैं उन्हें फिर ईसाई और मुसलमान बना दीजिए | विधवाओं का विवाह न होने दें और बाल-विवाह का फिर से प्रचलन करादें | ६. दयानन्द ने अनेक प्राचीन ग्रन्थों में मिलावट होने के कारण उन्हें त्याज्य बताया था,आप फिर से उन ग्रन्थों में मिलावट कराकर प्रचार आरम्भ कर दें । दयानन्द ने आर्य समाज का गठंन किया,आप अनार्य समाज की रचना करें । ऐसे ही कितने कार्य दयानन्द ने किये उन्हें उलटे बिना आपके सपनों का हिन्दुस्तान नहीं बन सकता ।


आगे आपने आर्य समाज को मरणासन्न लिखा है और उसके वैसा ही रहने की निश्चितता बताई हे । इसमें हम आपकी कोई सहायता नहीं कर सकते।जिसको जितना देखने की सीमा होती है वह उतना ही देख सकता है । आर्य समाज मरणासन्न है या नहीं यह तो आर्य समाज स्वयं ही अच्छी तरह जानता है ।


अब बात मीरा के पद की आती है जो आपको किसी आर्य समाज मन्दिर में नहीं गाने दिया गणा जिसके कारण आप समस्त आर्य समाज से कुपित हैं । यह घटना परोक्ष की होने के कारण हम कुछ भी टीका टिप्पणी नहीं करना चाहते । पता नहीं कया परिस्थिति रही होगी । एक ही पक्ष को सुनकर कोई राय कायम नहीं को जा सकती ।


उदारता को आपने मनुष्य होने की पहली पहचान बताया है तभी तो आपने बड़ी उदारता ? से हमसे परिचित न होते हुए भी उपाधियाँ प्रदान करने का स्तुत्य कार्य किया । होली की शुभ कामनाओं के लिए धन्यवाद, आप के लिखे अनुसार हमने पत्र का उत्तर दे दिया है । अब आपका दायित्व है कि आप पत्रकार होते हुए हमारे इस पत्र को अपने उत्तर सहित अपने पत्र में स्थान दें जिसे आप अपनी सेवा से सुशोभित कर रहे हें ।


भवदीय


स. कुमार

उपसहार


पाठक वृन्द ! “शिव कौन हें ?” उसकी प्रतिक्रिया और उसका उत्तर आपके समक्ष प्रस्तुत हैं। निर्णय आपको ही करना है कि आप कौन से शिव को चाहते हैं। हमारा आशय तो यही है कि यथार्थ की पृष्ठभूमि पर उतर कर सत्य का स्वीकार करना ही अधिक समीचीन है। हमने इस निबन्ध में शिव का मूल बेदों में पाया और ज्ञात हुआ कि वेद का शिव परमात्मा का एक नाम है जो कल्याणकारी है। आदि सृष्टि में वेद के अन्तर्गत अनेक नामों से परमात्मा का स्मरण किया गया है। मानव सृष्टि के विस्तार के साथ-साथ मानवों के नाम भी वेद में आये नामों के आधार पर रखे गये और यह परम्परा आज तक चली आ रही है। स्पष्ट है कि आज कोई व्यक्ति शिव नामधारी हो तो उसका वर्णन वेदों में मानना उचित नहीं है। ऐसा ही महाभारत कालीन पर्वतीय राजा शिव के साथ समझना चाहिए।


कालान्तर में हिमालय पर्वत की कल्पना मुनष्यवत्‌ करने पर जो चित्र बनता है उसे भी इस पर्वतीय शासक के जीवन चरित्र के साथ जोड़ा गया और वाम मार्ग ने इसमें लिंग पूजा का समावेश कराकर इसे वर्तमान स्थिति में पहुंचा दिया।


साधारण जन तो गतानुगतिक रीति का ना सरण करते हें उन्हें जो धर्म के नाम पर बताया जाता है, स्वीकार कर लेते हैं। जब यह परम्परा रूढ़ हो जाती है तो इससे विमुख होना कठिन हो जाता है। आवश्यकता इसी बात की है कि यथार्थ को स्वीकार कर ऐसी गलत परम्परा को यथाशीघ्र बहिष्कृत कर देना चाहिए।


उपासना करने योग्य तो वही परमात्मा है जो इस संसार का रचयिता, पालन कर्ता और संहर्ता है। उसके गुणों का पार नहीं है। बेद में उसी परमात्मा को शिव नाम से भी उल्लिखित किया गया हे।


सांसारिक अवगुणों से युक्त व्यक्ति परमात्मा हो ही नहीं सकता। लोक कथाओं और पुराणों का शिव संसार के सभी दुर्गुणों से युक्त है अतः वह हमारा आदर्श होने योग्य नहीं है। उसकी लोकप्रियता का कारण भी यही है कि उसके चरित्र के साथ जिसने जैसा चाहा अपना सम्बन्ध जोड़ लिया। यहाँ तक कि भाँग, गाँजा, अफोम, चरस आदि मादक पदार्थों का सेवन करने वाले व्यक्ति भी अपने को शिव भक्त बताकर उसे अपने जैसा ही वर्णित करते हैं। वाममार्ग का समर्थन भी शिव कथाओं से होता है। ऐसे चर्ित्रों की कथाएं हमारा मनोरंजन भले ही करती हों, हमें परमात्मा की ओर नहीं ले जा सकती।


परमात्मा कौ प्राप्ति के लिए तो बेद वर्णित शिव का ही आश्रय लेता उचित है।

Read More

12 December, 2024

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড

12 December 0

 ভারতে বিবেকানন্দ


০১. কলম্বো স্বামীজীর বক্তৃতা


স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড

[আমেরিকা ও ইওরোপে সাড়ে তিন বৎসর কাল বেদান্ত প্রচার করিয়া ১৮৯৭ খ্রীঃ ১৫ জানুআরী স্বামীজী সিংহলের রাজধানী কলম্বো বন্দরে অবতরণ করেন। ঐ দিনই এক অভিনন্দনের উত্তরে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। পরদিন অপরাহ্নে ‌‍‍‍‌‍‍‘ফ্লোরাল হল’-এ স্বামীজী যে বক্তৃতা দেন, তাহাই ‘কলম্বো হইতে আলমোড়া বক্তৃতাবলী’র প্রথম বক্তৃতা।]

যেটুকু সামান্য কার্য আমাদ্বারা কৃত হইয়াছে, তাহা আমার নিজের কোন শক্তিবলে হয় নাই; পাশ্চাত্যদেশে পর্যটনকালে আমার এই পরম-পবিত্র প্রিয় মাতৃভূমি হইতে যে উৎসাহবাক্য, যে শুভেচ্ছা, যে আশীর্বাণী লাভ করিয়াছি, উহা সেই শক্তিতেই হইয়াছে। অবশ্য কিছু কাজ হইয়াছে বটে, কিন্তু এই পাশ্চাত্যদেশ-ভ্রমণে বিশেষ উপকার হইয়াছে আমার; কারণ পূর্বে যাহা হয়তো হৃদয়ের আবেগে বিশ্বাস করিতাম, এখন তাহা আমার পক্ষে প্রমাণসিদ্ধ সত্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পূর্বে সকল হিন্দুর মত আমিও বিশ্বাস করিতাম—ভারত পুণ্যভূমি— কর্মভূমি। মাননীয় সভাপতি মহাশয়ও তাহা বলিয়াছেন; আজ আমি এই সভায় দাঁড়াইয়া দৃঢ়তার সহিত বলিতেছি—ইহা সত্য, সত্য, অতি সত্য। যদি এই পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন দেশ থাকে, যাহাকে ‘পুণ্যভূমি’ নামে বিশেষিত করা যাইতে পারে—যদি এমন কোন স্থান থাকে, যেখানে পৃথিবীর সকল জীবকেই তাহার কর্মফল ভোগ করিবার জন্য আসিতে হইবে—যেখানে মনুষ্যজাতির ভিতর সর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমা, দয়া, পবিত্রতা, শান্তভাব প্রভৃতি সদ্গুণের বিকাশ হইয়াছে—যদি এমন কোন দেশ থাকে, যেখানে সর্বাপেক্ষা আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ হইয়াছে, তবে নিশ্চয়ই বলিতে পারি, তাহা আমাদের মাতৃভূমি—ভারতবর্ষ।


অতি প্রাচীনকাল হইতেই এখানে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপয়িতাগণ আবির্ভূত হইয়া সমগ্র পৃথিবীকে বারংবার সনাতন ধর্মের পবিত্র আধ্যাত্মিক বন্যায় ভাসাইয়া দিয়াছেন। এখান হইতে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম—সর্বত্র দার্শনিক জ্ঞানের প্রবল তরঙ্গ বিস্তৃত হইয়াছে। আবার এখান হইতেই তরঙ্গ উত্থিত হইয়া সমগ্র পৃথিবীর জড়বাদী সভ্যতাকে আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ করিবে। অন্যান্য দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীর হৃদয়দগ্ধকারী জড়বাদরূপ অনল নির্বাণ করিতে যে জীবনপ্রদ বারির প্রয়োজন, তাহা এখানেই সঞ্চিত রহিয়াছে। বন্ধুগণ, বিশ্বাস করুন—ভারতই আবার পৃথিবীকে আধ্যাত্মিক তরঙ্গে প্লাবিত করিবে।


সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করিয়া, অনেক দেখিয়া শুনিয়া আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি; আপনাদের মধ্যেও যাঁহারা বিভিন্ন জাতির ইতিহাস মনোযোগ সহকারে পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা এই তথ্য অবগত আছেন। যদি বিভিন্ন দেশের ইতিহাস তুলনা করা যায়, তবে দেখা যাইবে, এই সহিষ্ণু নিরীহ হিন্দুজাতির নিকট পৃথিবী যতটা ঋণী, ততটা আর কোন জাতিরই নিকট নহে। ‘নিরীহ হিন্দু’ কথাটি সময়ে সময়ে তীব্র নিন্দারূপেই প্রযুক্ত হইয়া থাকে; কিন্তু যদি কোন তিরস্কারবাক্যের মধ্যে গভীর সত্য লুক্কায়িত থাকে; তবে ইহাতেও আছে। হিন্দুগণ চিরকালই ঈশ্বরের মহিমান্বিত সন্তান। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও সভ্যতার বিকাশ হইয়াছে সত্য, প্রাচীন ও বর্তমানকালে অনেক শক্তিশালী বড় বড় জাতি হইতে উচ্চ উচ্চ ভাব প্রসূত হইয়াছে সত্য, অদ্ভুত অদ্ভুত তত্ত্ব এক জাতি হইতে অপর জাতিতে প্রচারিত হইয়াছে সত্য, কোন কোন জাতির জীবন-তরঙ্গ প্রসারিত হইয়া চতুর্দিকে মহাশক্তিশালী ভাবের বীজসমূহ ছড়াইয়াছে সত্য,—কিন্তু বন্ধুগণ, ইহাও দেখিবেন—ঐ-সকল ভাব রণভেরীর নির্ঘোষে ও রণসাজে সজ্জিত গর্বিত সেনাকুলের পদবিক্ষেপের সহিত প্রচারিত হইয়াছিল, রক্তবন্যায় সিক্ত করিয়া লক্ষ লক্ষ নরনারীর রুধির-কর্দমের মধ্য দিয়াই ঐ-সকল ভাবকে অগ্রসর হইতে হইয়াছে। প্রত্যেক শক্তিপূর্ণ ভাব-প্রচারের পশ্চাতেই অগণিত মানুষের হাহাকার, অনাথের ক্রন্দন ও বিধবার অশ্রুপাত লক্ষিত হইয়াছে।



প্রধানতঃ এই উপায়েই অপর জাতিসকল পৃথিবীকে শিক্ষা দিয়াছে, ভারত কিন্তু শান্তভাবে সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া জীবিত রহিয়াছে। যখন গ্রীসের অস্তিত্বই ছিল না, রোম যখন ভবিষ্যতের অন্ধকারে লুক্কায়িত ছিল, যখন আধুনিক ইওরোপীয়দের পূর্বপুরুষেরা জার্মানির গভীর অরণ্যে অসভ্য অবস্থায় নীলবর্ণে নিজেদের রঞ্জিত করিত, তখনও ভারতের কর্মশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। আরও প্রাচীনকালে—ইতিহাস যাহার কোন সংবাদ রাখে না, কিংবদন্তীও যে সুদূর অতীতের ঘনান্ধকারে দৃষ্টিপাত করিতে সাহস করে না—সেই অতি প্রাচীনকাল হইতে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভাবের পর ভাবের তরঙ্গ ভারত হইতে প্রসারিত হইয়াছে, কিন্তু উহার প্রত্যেকটি তরঙ্গই সম্মুখে শান্তি ও পশ্চাতে আশীর্বাণী লইয়া অগ্রসর হইয়াছে। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে কেবল আমরাই কখনও অপর জাতিকে যুদ্ধবিগ্রহ দ্বারা জয় করি নাই, সেই শুভ কর্মের ফলেই আমরা এখনও জীবিত। এমন সময় ছিল, যখন প্রবল গ্রীকবাহিনীর বীরদর্পে বসুন্ধরা কম্পিত হইত। তাহারা এখন কোথায়? তাহাদের চিহ্নমাত্র নাই। গ্রীসের গৌরব-রবি আজ অস্তমিত! এমন একদিন ছিল, যখন রোমের শ্যেনাঙ্কিত বিজয়পতাকা জগতের বাঞ্ছিত সমস্ত ভোগ্য পদার্থের উপরেই উড্ডীয়মান ছিল।রোম সর্বত্র যাইত এবং মানবজাতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিত। রোমের নামে পৃথিবী কাঁপিত। আজ ক্যাপিটোলাইন গিরি১ ভগ্নস্তূপমাত্রে পর্যবসিত! যেখানে সীজারগণ দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করিতেন, সেখানে আজ ঊর্ণনাভ তন্তু রচনা করিতেছে। অন্যান্য অনেক জাতি এইরূপ উঠিয়াছে, আবার পড়িয়াছে, মদগর্বে স্ফীত হইয়া প্রভুত্ব বিস্তার করিয়া স্বল্পকালমাত্র অত্যাচার-কলঙ্কিত জাতীয় জীবন যাপন করিয়া তাহারা জলবুদ‍্‍বুদের ন্যায় বিলীন হইয়া গিয়াছে।



এইরূপেই এই-সকল জাতি মনুষ্যসমাজে নিজেদের চিহ্ন এককালে অঙ্কিত করিয়া এখন অন্তর্হিত হইয়াছে। আপনারা কিন্তু এখনও জীবিত, আর আজ যদি মনু এই ভারতভূমিতে পুনরাগমন করেন, তিনি এখানে আসিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্য হইবেন না; কোন এক অপরিচিত স্থানে আসিয়া পড়িয়াছি—এ-কথা মনে করিবেন না! সহস্র সহস্র বর্ষব্যাপী চিন্তা ও পরীক্ষার ফলস্বরূপ সেই প্রাচীন বিধানসকল এখানে এখনও বর্তমান; শত শত শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ সেই-সকল সনাতন আচার এখানে এখনও বর্তমান। যতই দিন যাইতেছে, ততই দুঃখ-দুর্বিপাক তাহাদের উপর আঘাতের পর আঘাত করিতেছে, তাহাতে শুধু এই ফল হইয়াছে যে, সেইগুলি আরও দৃঢ়—আরও স্থায়ী আকার ধারণ করিতেছে। ঐ-সকল আচার ও বিধানের কেন্দ্র কোথায়, কোন্‌ হৃদয় হইতে শোণিত সঞ্চালিত হইয়া উহাদিগকে পুষ্ট রাখিতেছে, আমাদের জাতীয় জীবনের মূল উৎসই বা কোথায়—ইহা যদি জানিতে চান, তবে বিশ্বাস করুন তাহা এই ধর্মভাবেই বিদ্যমান। সমস্ত পৃথিবী ঘুরিয়া আমি যে সামান্য অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমি এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইয়াছি।


অন্যান্য জাতির পক্ষে ধর্ম—সংসারের অন্যান্য কাজের মত একটা কাজ মাত্র। রাজনীতি-চর্চা আছে, সামাজিকতা আছে, ধন ও প্রভুত্বের দ্বারা যাহা পাওয়া যায় তাহা আছে, ইন্দ্রিয়নিচয় যাহাতে আনন্দ অনুভব করে, তাহার চেষ্টা আছে। এই-সব নানা কার্যের ভিতর এবং ভোগে নিস্তেজ ইন্দ্রিয়গ্রাম কিসে একটু উত্তেজিত হইবে—সেই চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে একটু-আধটু ধর্মকর্মও অনুষ্ঠিত হয়। এখানে—এই ভারতের কিন্তু মানুষের সমগ্র চেষ্টা ধর্মের জন্য; ধর্মলাভই তাহার জীবনের একমাত্র কার্য।



চীন-জাপানে যুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, আপনাদের মধ্যে কয়জন তাহা জানেন? পাশ্চাত্য সমাজে যে-সকল গুরুতর রাজনীতিক ও সামাজিক আন্দোলন সংঘটিত হইয়া উহাকে সম্পূর্ণ নূতন আকার দিবার চেষ্টা করিতেছে, আপনাদের মধ্যে কয়জন সেই সংবাদ রাখেন? যদি রাখেন, দুই চারিজন মাত্র। কিন্তু আমেরিকায় এক বিরাট ধর্মসভা বসিয়াছিল এবং সেখানে এক হিন্দু সন্ন্যাসী প্রেরিত হইয়াছিলেন, কি আশ্চর্য! দেখিতেছি—এখানকার সামান্য মুটে-মজুরও তাহা জানে! ইহাতে বুঝা যাইতেছে—হাওয়া কোন্ দিকে বহিতেছে, জাতীয় জীবনের মূল কোথায়। পূর্বে দেশীয়, বিশেষতঃ বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিগণকে প্রাচ্য জনসাধারণের অজ্ঞতার গভীরতায় শোক প্রকাশ করিতে শুনিতাম, আর নিমেষে ভূপ্রদক্ষিণ- কারী পর্যটকগণের পুস্তকে ঐ বিষয় পড়িতাম! এখন বুঝিতেছি, তাঁহাদের কথা আংশিক সত্য, আবার আংশিকভাবে অসত্যও বটে। ইংলণ্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি বা যে-কোন দেশের একজন কৃষককে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করুন—‘তুমি কোন্‌ রাজনীতিক দল-ভুক্ত?’ সে বলিয়া দিবে—সে উদারনৈতিক বা রক্ষণশীল-দলভুক্ত,২ এবং কাহাকেই বা ভোট দিবে। আমেরিকার কৃষক জানে, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্রাট। এমন কি রৌপ্য-সমস্যা (Silver question) সম্বন্ধেও তাহার কিছু জ্ঞান আছে। কিন্তু তাহার ধর্ম সম্বন্ধে তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন, সে বলিবে, ‘বিশেষ কিছু জানি না, গির্জায় গিয়া থাকি মাত্র!’ বড়জোর সে বলিবে— তাহার পিতা খ্রীষ্টধর্মের অমুক শাখাভুক্ত ছিলেন। সে জানে, গির্জায় যাওয়াই ধর্মের চূড়ান্ত।



অপর দিকে আবার একজন ভারতীয় কৃষককে জিজ্ঞাসা করুন, ‘রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু জান কি? সে আপনার প্রশ্নে বিস্মিত হইয়া বলিবে, ‘এটা আবার কি? সোশ্যালিজম্ প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, পরিশ্রম ও মূলধনের সম্পর্ক এবং এইরূপ অন্যান্য কথা সে জীবনে কখনও শোনে নাই। সে কঠোর পরিশ্রম করিয়া জীবিকা অর্জন করে—রাজনীতি বা সমাজনীতির সে এইটুকুই বুঝে। কিন্তু তাহাকে যদি জিজ্ঞাসা কর, ‘তোমার ধর্ম কি?’ সে নিজের কপালের তিলক দেখাইয়া বলিবে, ‘আমি এই সম্প্রদায়ভুক্ত।’ ধর্মবিষয়ে প্রশ্ন করিলে তাহার মুখ হইতে এমন দুই-একটি কথা বাহির হইবে যাহাতে আমরাও উপকৃত হইতে পারি। নিজ অভিজ্ঞতা হইতেই আমি ইহা বলিতেছি; তাই ধর্মই আমাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তি।


প্রত্যেক ব্যক্তির একটা-না-একটা বিশেষত্ব আছে, প্রত্যেক ব্যক্তিই বিভিন্ন পথে উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। আমরা হিন্দু—আমরা বলি, অনন্ত পূর্বজন্মের কর্মফলে মানুষের জীবন একটি বিশেষ নির্দিষ্ট পথে চলিয়া থাকে; কারণ অনন্ত অতীতকালের কর্মসমষ্টিই বর্তমান আকারে প্রকাশ পায়; আর আমরা বর্তমানের যেরূপ ব্যবহার করি, তদনুসারেই আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন গঠিত হইয়া থাকে। এই কারণেই দেখা যায়, এই সংসারে জাত প্রত্যেক ব্যক্তিরই একদিকে না একদিকে বিশেষ ঝোঁক থাকে; সেই পথে তাহাকে যেন চলিতেই হইবে; সেই ভাব অবলম্বন না করিলে সে বাঁচিতে পারিবে না। ব্যক্তি সম্বন্ধে যেমন, ব্যক্তির সমষ্টি জাতি সম্বন্ধেও ঠিক তাই। প্রত্যেক জাতির যেন একটি বিশেষ ঝোঁক থাকে। প্রত্যেক জাতিরই জীবনের যেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। সমগ্র মানবজাতির জীবনকে সর্বাঙ্গ-সম্পূর্ণ করিবার জন্য প্রত্যেক জাতিকেই যেন একটি বিশেষ ব্রত পালন করিতে হয়। নিজ নিজ জীবনের উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত করিয়া প্রত্যেক জাতিকেই সেই সেই ব্রত উদ্‌যাপন করিতে হয়। রাজনীতিক বা সামরিক শ্রেষ্ঠতা কোন কালে আমাদের জাতীয় জীবনের উদ্দেশ্য নহে—কখনও ছিল না, আর জানিয়া রাখুন, কখনও হইবেও না। তবে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্য উদ্দেশ্য আছে, তাহা এইঃ সমগ্র জাতির আধ্যাত্মিক শক্তি সংহত করিয়া যেন এক বিদ্যুদাধারে রক্ষা করা এবং যখনই সুযোগ উপস্থিত হয়, তখনই এই সমষ্টিভূত শক্তির বন্যায় সমগ্র পৃথিবী প্লাবিত করা। যখনই পারসীক, গ্রীক, রোমক, আরব, বা ইংরেজরা তাহাদের অজেয় বাহিনীসহ দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়া বিভিন্ন জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়াছে, তখনই ভারতের দর্শন ও অধ্যাত্মবিদ্যা এই-সকল নূতন পথের মধ্য দিয়া জগতে বিভিন্ন জাতির শিরায় শিরায় প্রবাহিত হইয়াছে। সমগ্র মনুষ্যজাতির উন্নতিকল্পে শান্তিপ্রিয় হিন্দুরও কিছু দিবার আছে—আধ্যাত্মিক আলোকই পৃথিবীর কাছে ভারতের দান।



এইরূপে অতীতের ইতিহাস পাঠ করিয়া আমরা দেখিতে পাই, যখনই কোন প্রবল দিগ্বিজয়ী জাতি পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়াছে, ভারতের সহিত অন্যান্য দেশের, অন্যান্য জাতির মিলন ঘটাইয়াছে, নিঃসঙ্গতাপ্রিয় ভারতের একাকিত্ব তখনই ভাঙিয়াছে; যখনই এই ব্যাপার ঘটিয়াছে, তখনই তাহার ফলস্বরূপ সমগ্র পৃথিবীতে ভারতের আধ্যাত্মিক তরঙ্গের বন্যা ছুটিয়াছে। বর্তমান (ঊনবিংশ) শতাব্দীর প্রারম্ভে বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বেদের এক প্রাচীন অনুবাদ হইতে জনৈক ফরাসী যুবক-কৃত অস্পষ্ট ল্যাটিন অনুবাদ পাঠ করিয়া বলিয়াছেন, ‘উপনিষদ্ ব্যতীত সারা পৃথিবীতে হৃদয়ের উন্নতিবিধায়ক আর কোন গ্রন্থ নাই। জীবৎকালে উহা আমাকে সান্ত্বনা দিয়াছে, মৃত্যুকালেও উহাই আমাকে শান্তি দিবে।’ অতঃপর সেই বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছেন, ‘গ্রীক সাহিত্যের পুনরভ্যুদয়ে চিন্তাপ্রণালীতে যে পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, শীঘ্রই তাহা অপেক্ষা শক্তিশালী ও ব্যাপক পরিবর্তন জগৎ প্রত্যক্ষ করিবে।’ আজ তাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইতেছে।


যাঁহারা চক্ষু খুলিয়া আছেন, যাঁহারা পাশ্চাত্য জগতের বিভিন্ন জাতির মনের গতি বুঝেন, যাঁহারা চিন্তাশীল এবং বিভিন্ন জাতি সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা করেন, তাঁহারা দেখিবেন—ভারতীয় চিন্তার এই ধীর অবিরাম প্রবাহের দ্বারা জগতের ভাবগতি, চালচলন ও সাহিত্যের কি গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে। তবে ভারতীয় প্রচারের একটি বিশেষত্ব আছে। আমি সেই সম্বন্ধে আপনাদিগকে পূর্বেই কিঞ্চিৎ আভাস দিয়াছি। আমরা কখনও বন্দুক ও তরবারির সাহায্যে কোন ভাব প্রচার করি নাই। যদি ইংরেজী ভাষায় কোন শব্দ থাকে, যাহা-দ্বারা জগতের নিকট ভারতের দান প্রকাশ করা যাইতে পারে—যদি ইংরেজী ভাষায় এমন কোন শব্দ থাকে, যাহা-দ্বারা মানবজাতির উপর ভারতীয় সাহিত্যের প্রভাব প্রকাশ করা যাইতে পারে, তাহা হইতেছে—fascination (সম্মোহনী শক্তি)। হঠাৎ যাহা মানুষকে মুগ্ধ করে, ইহা সেরূপ কিছু নহে, বরং ঠিক তাহার বিপরীত; উহা ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে মানব-মনে তাহার প্রভাব বিস্তার করে। অনেকের পক্ষে ভারতীয় চিন্তা, ভারতীয় প্রথা, ভারতীয় আচার-ব্যবহার, ভারতীয় দর্শন, ভারতীয় সাহিত্য প্রথম দৃষ্টিতে বিসদৃশ বোধ হয়; কিন্তু যদি মানুষ অধ্যবসায়ের সহিত আলোচনা করে, মনোযোগের সহিত ভারতীয় আচার গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করে, ভারতীয় আচার-ব্যবহারের মূলীভূত মহান্ তত্ত্বসমূহের সহিত বিশেষভাবে পরিচিত হয়, তবে দেখা যাইবে—শতকরা নিরানব্বই জনই ভারতীয় চিন্তার সৌন্দর্যে, ভারতীয় ভাবে মুগ্ধ হইয়াছে। লোকলোচনের অন্তরালে অবস্থিত, অশ্রুত অথচ মহাফলপ্রসূ, ঊষাকালীন শান্ত শিশির-সম্পাতের মত এই ধীর সহিষ্ণু ‘সর্বংসহ’ ধর্মপ্রাণ জাতি চিন্তা-জগতে নিজ প্রভাব বিস্তার করিতেছে।



আবার প্রাচীন ইতিহাসের পুনরভিনয় আরম্ভ হইয়াছে। কারণ আজ যখন আধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্য-আবিষ্কার মুহুর্মুহুঃ প্রবল আঘাতে পুরাতন আপাতদৃঢ় ও অভেদ্য ধর্মবিশ্বাসগুলির ভিত্তি পর্যন্ত শিথিল হইয়া যাইতেছে, যখন বিভিন্ন সম্প্রদায় মানব-জাতিকে নিজ নিজ মতের অনুবর্তী করিবার যে বিশেষ বিশেষ দাবী করিয়া থাকে, তাহা শূন্যে বিলীন হইয়া যাইতেছে, যখন আধুনিক প্রত্নতত্ত্বানুসন্ধানের প্রবল মুষলাঘাত প্রাচীন বদ্ধমূল সংস্কারগুলিকে ভঙ্গুর কাচ-পাত্রের মত চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া ফেলিতেছে, যখন পাশ্চাত্য জগতে ধর্ম কেবল অজ্ঞদিগের হস্তে ন্যস্ত রহিয়াছে, আর জ্ঞানিগণ ধর্মসম্পর্কিত সমুদয় বিষয়কে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তখনই যে-ভারতের অধিবাসিগণের ধর্মজীবন সর্বোচ্চ দার্শনিক সত্য-দ্বারা নিয়মিত, সেই ভারতের দর্শন—ভারতীয় মনের ধর্মবিষয়ক সর্বোচ্চ ভাবসমূহ জগতের সমক্ষে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। তাই আজ এই-সকল মহান্ তত্ত্ব—অসীম জগতের একত্ব, নির্গুণ ব্রহ্মবাদ, জীবাত্মার অনন্তত্ব ও বিভিন্ন জীবশরীরে তাহার অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা-রূপ অপূর্ব তত্ত্ব, ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত তত্ত্ব—পাশ্চাত্য জগৎকে বৈজ্ঞানিক জড়বাদ হইতে রক্ষা করিতে স্বভাবতই অগ্রসর হইয়াছে। প্রাচীন সম্প্রদায়সমূহ এই পৃথিবীকে একটি ক্ষুদ্র কাদামাটির ডোবা মনে করিত, এবং ভাবিত—কাল অতি অল্পদিনমাত্র আরম্ভ হইয়াছে।দেশ, কাল ও নিমিত্তের অনন্তত্ব এবং সর্বোপরি মানবাত্মার অনন্ত মহিমার বিষয় কেবল আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহেই বিদ্যমান, এবং সর্বকালেই এই মহান্ তত্ত্ব সর্বপ্রকার ধর্মতত্ত্ব- অনুসন্ধানের ভিত্তি। যখন ক্রমোন্নতিবাদ, শক্তির নিত্যতা (Conservation of Energy) প্রভৃতি আধুনিক বিস্ময়কর মতগুলি সর্বপ্রকার অপরিণত ধর্মমতের মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে—তখন মানবাত্মার অপূর্বসৃষ্টি—ঈশ্বরের অদ্ভুত বাণীস্বরূপ এই বেদান্তের হৃদয়গ্রাহী, মনের উন্নতি-বিধায়ক ও চিত্তপ্রসারকারী তত্ত্বসমূহ ব্যতীত আর কিছু কি শিক্ষিত মানবজাতির শ্রদ্ধা-ভক্তি আকর্ষণ করিতে পারে?



কিন্তু ইহাও বলিতে চাই, ভারতের বাহিরে ভারতীয় ধর্মের প্রভাব বলিতে আমি ভারতীয় ধর্মের মূলতত্ত্বসমূহ—যেগুলির উপর ভারতীয় ধর্মরূপ সৌধ্য নির্মিত—সেইগুলি মাত্র লক্ষ্য করিতেছি। উহার বিস্তারিত শাখা-প্রশাখা—শত শত শতাব্দীর সামাজিক আবশ্যকতায় যে-সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৌণ বিষয় উহার সহিত জড়িত হইয়াছে, সেইগুলি বিভিন্ন প্রথা, দেশাচার ও সামাজিক কল্যাণবিষয়ক খুঁটিনাটি বিচার; এইগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘ধর্ম’-সংজ্ঞার অন্তর্ভূত হইতে পারে না।


আমরা ইহাও জানি, আমাদের শাস্ত্রে দুই প্রকার সত্যের নির্দেশ রহিয়াছে এবং উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট প্রভেদ করা হইয়াছে। একটি সত্য সনাতন—উহা মানুষের স্বরূপ, আত্মার স্বরূপ, ঈশ্বরের সহিত মানবাত্মার সম্বন্ধ, ঈশ্বরের স্বরূপ, পূর্ণত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সৃষ্টির অনন্তত্ব, জগৎ যে শূন্য হইতে প্রসূত নহে—পূর্বে অবস্থিত কোন কিছুর বিকাশমাত্র— এতদ্বিষয়ক মতবাদ, যুগপ্রবাহ-সম্বন্ধীয় আশ্চর্য নিয়মাবলী ও এইরূপ অন্যান্য তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সর্বজনীন, সার্বকালিক ও সার্বদেশিক বিষয়সমূহ এই-সকল সনাতন তত্ত্বের ভিত্তি। এগুলি ছাড়া আবার অনেকগুলি গৌণ বিধিও আমাদের শাস্ত্রে দেখিতে পাওয়া যায়; সেইগুলির দ্বারা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কার্য নিয়মিত। সেইগুলিকে ‘শ্রুতি’র অন্তর্গত বলিতে পারা যায় না, ঐগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘স্মৃতি’র—পুরাণের অন্তর্গত। এইগুলির সহিত প্রথমোক্ত তত্ত্বসমূহের কোন স্থায়ী সম্পর্ক নাই। আমাদের আর্যজাতির ভিতরও এইগুলি ক্রমাগত পরিবর্তিত হইয়া বিভিন্ন আকারে পরিণত হইতেছে দেখা যায়। এক যুগের যে বিধান, অন্য যুগে তাহা নহে। যখন এই যুগের পর অন্য যুগ আসিবে, তখন ঐগুলি আবার অন্য আকার ধারণ করিবে। মহামনা ঋষিগণ আবির্ভূত হইয়া নূতন দেশকালের উপযোগী নূতন নূতন আচার প্রবর্তন করিবেন।



জীবাত্মা, পরমাত্মা এবং ব্রহ্মাণ্ডের এই-সকল অপূর্ব অনন্ত চিত্তোন্নতিবিধায়ক ক্রমবিকাশশীল ধারণার ভিত্তিস্বরূপ মহৎ তত্ত্বসমূহ ভারতেই প্রসূত হইয়াছে। ভারতেই কেবল মানুষ—ক্ষুদ্র জাতীয় দেবতার (Tribal Gods) জন্য ‘আমার ঈশ্বর সত্য, তোমার ঈশ্বর মিথ্যা; এস, যুদ্ধের দ্বারা ইহার মীমাংসা করি’ বলিয়া প্রতিবেশীর সহিত বিরোধে প্রবৃত্ত হয় নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবতার জন্য যুদ্ধরূপ সঙ্কীর্ণ ভাব কেবল এই ভারতেই কখনও দেখা যায় নাই। মানুষের অনন্ত স্বরূপের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া এই মহান্ মূলতত্ত্বগুলি সহস্র বৎসর পূর্বের মত আজও মানবজাতির কল্যাণসাধনে সমর্থ। যতদিন এই পৃথিবী থাকিবে, যতদিন কর্মফল থাকিবে, যতদিন আমরা ব্যষ্টি জীবরূপে জন্মগ্রহণ করিব এবং যতদিন স্বীয় শক্তি দ্বারা আমাদিগকে নিজেদের অদৃষ্ট গঠন করিতে হইবে, ততদিন উহাদের ঐরূপ শক্তি বিদ্যমান থাকিবে।


সর্বোপরি, ভারত জগৎকে কোন্‌ তত্ত্ব শিখাইবে, তাহা বলিতেছি। যদি আমরা বিভিন্ন জাতির মধ্যে ধর্মের উৎপত্তি ও পরিণতির প্রণালী লক্ষ্য করি, তবে আমরা সর্বত্র দেখিব যে, প্রথমে প্রত্যেক জাতিরই পৃথক্‌ পৃথক্‌ দেবতা ছিল। এই-সকল জাতির মধ্যে যদি পরস্পর বিশেষ সম্বন্ধ থাকিত, তবে সেই-সকল দেবতার আবার একটি সাধারণ নাম হইত—যেমন বেবিলনীয় দেবতাগণ। যখন বেবিলনবাসিগণ বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হইয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের দেবতাগণের নাম ছিল ‘বল’ (Baal)। এইরূপ য়াহুদী জাতিরও বিভিন্ন দেবগণের সাধারণ নাম ছিল ‘মোলক’ (Moloch)। আরও দেখিতে পাইবেন, এই-সকল বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতিবিশেষ যখন অপরগুলি হইতে বড় হইয়া উঠিত, তখন তাহারা আপন রাজাকে সকলের রাজা বলিয়া দাবী করিত। এই ভাব হইতে আবার স্বভাবতই এইরূপ ঘটিত যে, সেই জাতি নিজের দেবতাকেও অপর সকলের দেবতা করিয়া তুলিতে চাহিত। বেবিলন- বাসিগণ বলিত, ‘বল মেরোডক’ দেবতা সর্বশ্রেষ্ঠ—অন্যান্য দেবগণ তদপেক্ষা নিকৃষ্ট। ‘মোলক য়াভে’ অন্যান্য মোলক হইতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আর দেবগণের এই শ্রেষ্ঠতা বা নিকৃষ্টতা যুদ্ধের দ্বারা মীমাংসিত হইত। ভারতেও দেবগণের মধ্যে এই সংঘর্ষ—এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী দেবগণ শ্রেষ্ঠত্বলাভের জন্য পরস্পরের প্রতিযোগিতা করিতেন। কিন্তু ভারতের ও সমগ্র জগতের সৌভাগ্যক্রমে এই অশান্তি-কোলাহলের মধ্য হইতে ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’৪ একমাত্র সৎস্বরূপই আছেন, জ্ঞানী ঋষিগণ তাঁহাকে নানাপ্রকারে বর্ণনা করিয়া থাকেন—এই মহাবাণী উত্থিত হইয়াছিল। শিব বিষ্ণু অপেক্ষা বড় নহেন, অথবা বিষ্ণুই সব, শিব কিছু নহেন—তাহাও নহে। এক ভগবানকেই কেহ শিব, কেহ বিষ্ণু, আবার অপরে অন্যান্য নানা নামে ডাকিয়া থাকে। নাম বিভিন্ন, কিন্তু বস্তু এক। পূর্বোক্ত কয়েকটি কথার মধ্যেই ভারতের সমগ্র ইতিহাস পাঠ করিতে পারা যায়। সমগ্র ভারতের বিস্তারিত ইতিহাস ওজস্বী ভাষায় সেই এক মূল তত্ত্বের পুনরুক্তিমাত্র। এই দেশে এই তত্ত্ব বার বার উচ্চারিত হইয়াছে; পরিশেষে উহা এই জাতির রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়াছে, এই জাতির ধমনীতে প্রবাহিত প্রতিটি শোণিতবিন্দুতে উহা মিশ্রিত হইয়া শিরায় শিরায় প্রবাহিত হইয়াছে—জাতীয় জীবনের উপাদানস্বরূপ হইয়া গিয়াছে, যে-উপাদানে এই বিরাট জাতীয় শরীর নির্মিত, তাহার অংশস্বরূপ হইয়া গিয়াছে। এইরূপে এই ভারতভূমি পরধর্ম-সহিষ্ণুতার এক অপূর্ব লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। এই শক্তিবলেই আমরা আমাদের এই প্রাচীন মাতৃভূমিতে সকল ধর্মকে—সকল সম্প্রদায়কে সাদরে ক্রোড়ে স্থান দিবার অধিকার লাভ করিয়াছি।



এই ভারতে আপাতবিরোধী বহু সম্প্রদায় বর্তমান, অথচ সকলেই নির্বিরোধে বাস করিতেছে। এই অপূর্ব ব্যাপারের একমাত্র ব্যাখ্যা—পরধর্ম-সহিষ্ণুতা। তুমি হয়তো দ্বৈতবাদী, আমি হয়তো অদ্বৈতবাদী। তোমার হয়তো বিশ্বাস—তুমি ভগবানের নিত্য দাস, আবার আর একজন হয়তো বলিতে পারে, সে ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন; কিন্তু উভয়েই খাঁটি হিন্দু। ইহা কিরূপে সম্ভব হয়? সেই মহাবাক্য পাঠ কর, তাহা হইলেই বুঝিবে ইহা কিরূপে সম্ভবঃ ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—সৎস্বরূপ এক, ঋষিগণ তাঁহাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন।


হে আমার স্বদেশীয় ভ্রাতৃবৃন্দ! সর্বোপরি পৃথিবীকে এই মহান্ সত্য আমাদের শিখাইতে হইবে। অন্যান্য দেশের বড় বড় শিক্ষিত ব্যক্তিগণও নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া আমাদের ধর্মকে পৌত্তলিকতা বলেন। আমি তাঁহাদিগকে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি, কিন্তু তাঁহারা স্থির হইয়া কখনও ভাবেন না যে, তাঁহাদের মস্তিষ্কে কি ঘোর কুসংস্কার রাশি বর্তমান! এখনও সর্বত্র এই ভাব—এই ঘোর সাম্প্রদায়িকতা, মনের এই নীচ সঙ্কীর্ণতা! তাঁহারা মনে করেন, তাঁহাদের নিজেদের যাহা আছে, তাহাই অতি মূল্যবান্; অর্থোপার্জনই তাঁহাদের মতে জীবনের একমাত্র সদ্ব্যবহার। তাঁহাদের যাহা আছে তাহাই একমাত্র কাম্য বস্তু, আর বাকী সব কিছুই নহে। যদি তিনি মৃত্তিকা-দ্বারা কোন অসার বস্তু নির্মাণ করিতে পারেন, অথবা কোন যন্ত্র আবিষ্কার করিতে সমর্থ হন, তবে সব-কিছু ফেলিয়া দিয়া ঐগুলিকেই ভাল বলিতে হইবে। শিক্ষা ও বিদ্যার বহুল প্রচার সত্ত্বেও সমগ্র পৃথিবীর এই অবস্থা! কিন্তু বাস্তবিক পৃথিবীতে এখনও শিক্ষার প্রয়োজন—এখনও সভ্যতার প্রয়োজন। বলিতে কি, এখনও কোথাও সভ্যতার আরম্ভমাত্র হয় নাই, এখনও মনুষ্যজাতির শতকরা নিরানব্বই জন অল্প-বিস্তর অসভ্য অবস্থায় রহিয়াছে। বিভিন্ন পুস্তকে এই-সব কথা পড়িতে পার, পরধর্ম-সহিষ্ণুতা ও এরূপ তত্ত্ব সম্বন্ধে আমরা গ্রন্থ পাঠ করিয়া থাকি বটে, কিন্তু নিজ অভিজ্ঞতা হইতে আমি বলিতেছি, এখনও পৃথিবীতে এই ভাবগুলি নাই বলিলেই হয়; শতকরা নিরানব্বই জন এই-সকল বিষয় চিন্তাও করে না। পৃথিবীর যে-কোন দেশে আমি গিয়াছি, সেখানেই দেখিয়াছি—এখনও অন্যধর্মাবলম্বীর উপর দারুণ নির্যাতন চলিতেছে; নূতন বিষয় শিক্ষা করা সম্বন্ধে পূর্বেও যে- সকল আপত্তি উঠিত, এখনও সেই পুরানো আপত্তিগুলিই উত্থাপিত হইয়া থাকে। জগতে যতটুকু পরধর্ম-সহিষ্ণুতা ও ধর্মভাবের প্রতি সহানুভূতি আছে, কার্যতঃ তাহা এইখানেই—এই আর্যভূমিতেই বিদ্যমান, অপর কোথাও নাই। কেবল এখানেই হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও খ্রীষ্টানদের জন্য র্গিজা নির্মাণ করিয়া দেয়, আর কোথাও নহে। যদি তুমি অন্য কোন দেশে গিয়া মুসলমানদিগকে বা অন্যধর্মাবলম্বিগণকে তোমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতে বল, দেখিবে তাহারা কিরূপ সাহায্য করে! তৎপরিবর্তে তোমার মন্দির এবং পারে তো সেই সঙ্গে তোমার দেহমন্দিরটিও তাহারা ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। এই কারণেই পৃথিবীর পক্ষে এই শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন—ভারতের নিকট পৃথিবীকে এখনও এই পরধর্ম-সহিষ্ণুতা—শুধু তাহাই নহে, পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি শিক্ষা করিতে হইবে। শিবমহিম্নঃস্তোত্রে কথিত হইয়াছেঃ



‘ত্রয়ী সাংখ্যং যোগঃ পশুপতিমতং বৈষ্ণবমিতি

প্রভিন্নে প্রস্থানে পরমিদমদঃ পথ্যমিতি চ।

রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং

নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব ||’


বেদ, সাংখ্য, যোগ, পাশুপত ও বৈষ্ণব মত—এই সকল ভিন্ন ভিন্ন মতের মধ্যে কেহ একটিকে শ্রেষ্ঠ, অপরটিকে হিতকর বলেন। সমুদ্র যেমন নদীসকলের একমাত্র গম্যস্থান, রুচিভেদে সরল-কুটিল নানাপথগামী জনগণের তুমিই একমাত্র গম্য।


ভিন্ন ভিন্ন পথে যাইলেও সকলেই কিন্তু একই লক্ষ্যে চলিতেছে। কেহ একটু বক্রপথে ঘুরিয়া, কেহ বা সরল পথে যাইতে পারে; কিন্তু অবশেষে সকলেই সেই এক প্রভুর নিকট পৌঁছিবে। যখন তোমরা শুধু তাঁহাকে শিবলিঙ্গ নয়—সর্বত্র দেখিবে, তখনই তোমাদের শিব- ভক্তি এবং তোমাদের শিবদর্শন সম্পূর্ণ হইবে। তিনিই যথার্থ সাধু, তিনিই যথার্থ হরিভক্ত, যিনি সেই হরিকে সর্বজীবে ও সর্বভূতে দেখিয়া থাকেন। যদি তুমি শিবের যথার্থ ভক্ত হও, তবে তুমি তাঁহাকে সর্বজীবে ও সর্বভূতে দেখিবে। যে নামে, যে রূপে তাঁহাকে উপাসনা করা হউক না কেন, তোমাকে বুঝিতে হইবে যে, সব তাঁহারই উপাসনা। কাবা-র৪ দিকে মুখ করিয়াই কেহ জানু অবনত করুক অথবা খ্রীষ্ট্রীয় গির্জায় বা বৌদ্ধ চৈত্যেই উপাসনা করুক, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সে তাঁহারই উপাসনা করিতেছে। যে-কোন নামে যে-কোন মূর্তির উদ্দেশে যে-ভাবেই পুষ্পাঞ্জলি প্রদত্ত হউক না কেন, তাহা ভগবানের পাদপদ্মে পৌঁছায়, কারণ তিনি সকলের একমাত্র প্রভু, সকল আত্মার অন্তরাত্মা। পৃথিবীতে কি-অভাব, তাহা তিনি আমাদের অপেক্ষা অনেক ভালভাবেই জানেন। সর্ববিধ ভেদ দূরীভূত হইবে, ইহা অসম্ভব। ভেদ থাকিবেই। বৈচিত্র্য ব্যতীত জীবন অসম্ভব। চিন্তারাশির এই সংঘর্ষ ও বৈচিত্র্যই জ্ঞান উন্নতি প্রভৃতি সকলের মূলে। পৃথিবীতে অসংখ্য পরস্পরবিরোধী ভাবসমূহ থাকিবেই। কিন্তু তাই বলিয়া যে পরস্পরকে ঘৃণা করিতে হইবে, পরস্পর বিরোধ করিতে হইবে, তাহার কোন প্রয়োজন নাই।



অতএব সেই মূল সত্য আমাদিগকে পুনরায় শিক্ষা করিতে হইবে, যাহা কেবলমাত্র এখান হইতে—আমাদের মাতৃভূমি হইতেই প্রচারিত হইয়াছিল। আর একবার ভারতকে জগতের সমক্ষে এই সত্য প্রচার করিতে হইবে। কেন আমি এ-কথা বলিতেছি? কারণ এই সত্য শুধু যে আমাদের শাস্ত্র-গ্রন্থেই নিবদ্ধ, তাহা নহে; আমাদের জাতীয় সাহিত্যের প্রত্যেক বিভাগে, আমাদের জাতীয় জীবনে সর্বত্র ইহা প্রবাহিত রহিয়াছে। এইখানে—কেবল এইখানেই ইহা প্রাত্যহিক জীবনে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, আর চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করিবেন যে, এইখানে ছাড়া আর কোথাও ইহা কার্যে পরিণত করা হয় নাই। এইভাবে আমাদের জগৎকে ধর্মশিক্ষা দিতে হইবে। ভারত ইহা অপেক্ষাও অন্যান্য উচ্চতর শিক্ষা দিতে সমর্থ বটে, কিন্তু সেইগুলি কেবল পণ্ডিতদের জন্য। এই নম্রতা, শান্তভাব, তিতিক্ষা, পরধর্ম-সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি ও ভ্রাতৃভাবের মহতী শিক্ষা আবালবৃদ্ধবনিতা—শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সর্বজাতি, সর্ববর্ণ শিক্ষা করিতে পারে। ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।’

০২. জাফনায় বক্তৃতা—বেদান্ত

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০২. জাফনায় বক্তৃতা—বেদান্ত

[কলম্বো হইতে কাণ্ডি, অনুরাধাপুর ও ভাভোনিয়া হইয়া স্বামীজী জাফনা শহরে পদার্পণ করেন। সর্বত্র তিনি বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন। জাফনায় অভিনন্দনের উত্তরে ২৩ জানুআরী ‘হিন্দু কলেজ’ প্রাঙ্গণে তিনি ‘বেদান্ত’ সম্বন্ধে এই সুদীর্ঘ বক্তৃতাটি দেন।]


বিষয় অতি বৃহৎ, কিন্তু সময় খুবই কম; একটি বক্তৃতায় হিন্দুদিগের ধর্মের সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ অসম্ভব। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট আমাদের ধর্মের মূল তত্ত্বগুলি যত সহজ ভাষায় পারি, বর্ণনা করিব। যে ‘হিন্দু’ নামে পরিচয় দেওয়া এখন আমাদের প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার কিন্তু আর কোন সার্থকতা নাই; কারণ ঐ শব্দের অর্থ—‘যাহারা সিন্ধুনদের পারে বাস করিত।’ প্রাচীন পারসীকদের বিকৃত উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ শব্দই ‘হিন্দু’রূপে পরিণত হয়; তাঁহারা সিন্ধুনদের অপরতীর-বাসী সকলকেই ‘হিন্দু’ বলিতেন। এইরূপেই ‘হিন্দু’শব্দ আমাদের নিকট আসিয়াছে; মুসলমান-শাসনকাল হইতে আমরা ঐ শব্দ নিজেদের উপর প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিয়াছি। অবশ্য এই শব্দ-ব্যবহারে কোন ক্ষতি নাই, কিন্তু আমি পূর্বেই বলিয়াছি, এখন ইহার সার্থকতা নাই; কারণ তোমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, বর্তমানকালে সিন্ধুনদের এই দিকে সকলে আর প্রাচীনকালের মত এক ধর্ম মানেন না। সুতরাং ঐ শব্দে শুধু খাঁটি হিন্দু বুঝায় না; উহাতে মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন এবং ভারতের অন্যান্য অধিবাসিগণকেও বুঝাইয়া থাকে। অতএব আমি ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহার করিব না। তবে কোন্‌ শব্দ ব্যবহার করিব? আমরা ‘বৈদিক’ শব্দটি ব্যবহার করিতে পারি, অথবা ‘বৈদান্তিক’ শব্দ ব্যবহার করিলে আরও ভাল হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ প্রধান প্রধান ধর্মই বিশেষ বিশেষ কতকগুলি গ্রন্থকে প্রামাণ্য বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকে। লোকের বিশ্বাস—এই গ্রন্থগুলি ঈশ্বর অথবা কোন অতিপ্রাকৃত পুরুষবিশেষের বাক্য; সুতরাং ঐ গ্রন্থগুলিই তাহাদের ধর্মের ভিত্তি। আধুনিক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে ঐ-সকল গ্রন্থের মধ্যে হিন্দুদের বেদই প্রাচীনতম। অতএব বেদ সম্বন্ধে কিছু জানা আবশ্যক।


বেদ-নামক শব্দরাশি কোন পুরুষের উক্তি নহে। উহার সন-তারিখ এখনও নির্ণীত হয় নাই, কখনও হইতে পারে না। আর আমাদের (হিন্দুদের) মতে বেদ অনাদি অনন্ত। একটি বিশেষ কথা তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম—ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর অথবা ভগবানের দূত বা প্রেরিত পুরুষের বাণী বলিয়া তাহাদের শাস্ত্রের প্রামাণ্য দেখায়। হিন্দুরা কিন্তু বলেন, বেদের অন্য কোন প্রমাণ নাই, বেদ স্বতঃপ্রমাণ; কারণ বেদ অনাদি অনন্ত, উহা ঈশ্বরের জ্ঞানরাশি। বেদ কখনও লিখিত হয় নাই, উহা কখনও সৃষ্ট হয় নাই, অনন্তকাল ধরিয়া উহা রহিয়াছে। যেমন সৃষ্টি অনাদি অনন্ত, তেমনি ঈশ্বরের জ্ঞানও অনাদি অনন্ত। ‘বেদ’ অর্থে এই ঐশ্বরিক জ্ঞানরাশি; বিদ্ ধাতুর অর্থ—জানা। বেদান্ত নামক জ্ঞানরাশি ঋষিগণ কর্তৃক আবিষ্কৃত। ঋষি শব্দের অর্থ মন্ত্রদ্রষ্টা; পূর্ব হইতেই বিদ্যমান সত্যকে তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন মাত্র, ঐ জ্ঞান ও ভাবরাশি তাঁহার নিজের চিন্তাপ্রসূত নহে। যখনই তোমরা শুনিবে, বেদের অমুক অংশের ঋষি অমুক, তখন ভাবিও না যে, তিনি উহা লিখিয়াছেন বা নিজের মন হইতে উহা সৃষ্টি করিয়াছেন; তিনি পূর্ব হইতে বিদ্যমান ভাবরাশির দ্রষ্টামাত্র। ঐ ভাবরাশি অনন্ত কাল হইতেই এই জগতে বিদ্যমান ছিল—ঋষি উহা আবিষ্কার করিলেন মাত্র। ঋষিগণ আধ্যাত্মিক আবিষ্কর্তা।



বেদ-নামক গ্রন্থরাশি প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভক্ত—কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডের মধ্যে নানাবিধ যাগযজ্ঞের কথা আছে; উহাদের মধ্যে অধিকাংশই বর্তমান যুগের অনুপযোগী বলিয়া পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং কতকগুলি এখনও কোন-না-কোন আকারে বর্তমান। কর্মকাণ্ডের প্রধান প্রধান বিষয়গুলি, যথা সাধারণ মানবের কর্তব্য—ব্রহ্মচারী, গৃহী, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসী এই-সকল বিভিন্ন আশ্রমীর বিভিন্ন কর্তব্য এখনও পর্যন্ত অল্প-বিস্তর অনুসৃত হইতেছে। দ্বিতীয় ভাগ জ্ঞানকাণ্ড—আমাদের ধর্মের আধ্যাত্মিক অংশ। ইহার নাম ‘বেদান্ত’ অর্থাৎ বেদের শেষ ভাগ—বেদের চরম লক্ষ্য। বেদজ্ঞানের এই সারভাগের নাম বেদান্ত বা উপনিষদ্। আর ভারতের সকল সম্প্রদায়—দ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, অদ্বৈতবাদী অথবা সৌর, শাক্ত, গাণপত্য, শৈব ও বৈষ্ণব—যে-কেহ হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত থাকিতে চাহে, তাহাকেই বেদের এই উপনিষদ্‌ভাগ মানিয়া চলিতে হইবে। তাহারা নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী উপনিষদ্ ব্যাখ্যা করিতে পারে; কিন্তু তাহাদিগকে উহার প্রামাণ্য স্বীকার করিতেই হইবে। এই কারণেই আমরা ‘হিন্দু’ শব্দের পরিবর্তে ‘বৈদান্তিক’ শব্দ ব্যবহার করিতে চাই। ভারতে সকল প্রাচীনপন্থী দার্শনিককেই বেদান্তের প্রামাণ্য স্বীকার করিতে হইয়াছে—আর আজকাল ভারতে হিন্দুধর্মের যত শাখাপ্রশাখা আছে, তাহাদের মধ্যে কতকগুলিকে যতই বিসদৃশ বোধ হউক না কেন, উহাদের উদ্দেশ্য যতই জটিল বোধ হউক না কেন, যিনি বেশ ভাল করিয়া উহাদের আলোচনা করিবেন, তিনিই বুঝিতে পারিবেন—উপনিষদ্‌ হইতেই উহাদের ভাবরাশি গৃহীত হইয়াছে। এই-সকল উপনিষদের ভাব আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় এতদূর প্রবিষ্ট হইয়াছে যে, যাঁহারা হিন্দুধর্মের খুব অমার্জিত শাখা-বিশেষেরও রূপকতত্ত্ব আলোচনা করিবেন, তাঁহারা সময়ে সময়ে দেখিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, উপনিষদে রূপকভাবে বর্ণিত তত্ত্ব দৃষ্টান্তরূপে পরিণত হইয়া ঐ-সকল ধর্মে স্থান লাভ করিয়াছে। উপনিষদেরই সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক রূপকগুলি আজকাল স্থূলভাবে পরিণত হইয়া আমাদের গৃহে পূজার বস্তু হইয়া রহিয়াছে। অতএব আমাদের ব্যবহৃত ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকগুলি সবই বেদান্ত হইতে আসিয়াছে, কারণ বেদান্তে ঐগুলি রূপকভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। ক্রমশঃ ঐ ভাবগুলি জাতির মর্মস্থলে প্রবেশ করিয়া পরিশেষে প্রতীকরূপে প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছে।



বেদান্তের পরই স্মৃতির প্রামাণ্য। এইগুলি মুনিদের লেখা গ্রন্থ, কিন্তু ইহাদের প্রামাণ্য বেদান্তের অধীন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বিগণের পক্ষে তাহাদের ধর্মগ্রন্থ যেরূপ, আমাদের পক্ষে স্মৃতিও তদ্রূপ। আমরা স্বীকার করিয়া থাকি যে, বিশেষ বিশেষ মুনি এই-সকল স্মৃতি প্রণয়ন করিয়াছেন; এই অর্থে অন্যান্য ধর্মের শাস্ত্রসমূহের প্রামাণ্য যেরূপ, স্মৃতির প্রামাণ্যও সেইরূপ; তবে স্মৃতিই আমাদের চরম প্রমাণ নহে। স্মৃতির কোন অংশ যদি বেদান্তের বিরোধী হয়, তবে উহা পরিত্যাগ করিতে হইবে, উহার কোন প্রামাণ্য থাকিবে না। আবার এই-সকল স্মৃতি যুগে যুগে ভিন্ন। আমরা শাস্ত্রে পাঠ করি—সত্যযুগে এই এই স্মৃতির প্রামাণ্য; ক্রেতা, দ্বাপর ও কলি—এই-সকল যুগের প্রত্যেক যুগে আবার অন্যান্য স্মৃতির প্রামাণ্য। দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্তন অনুসারে আচার প্রভৃতির পরিবর্তন হইয়াছে; আর স্মৃতি প্রধানতঃ এই আচারের নিয়ামক বলিয়া সময়ে সময়ে উহাদেরও পরিবর্তন করিতে হইয়াছে। আমি এই বিষয়টি তোমাদিগকে বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে বলি।


বেদান্তে ধর্মের যে মূল তত্ত্বগুলি ব্যাখ্যাত হইয়াছে, তাহা অপরিবর্তনীয়। কেন?— কারণ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে অপরিবর্তনীয় তত্ত্বসমূহ রহিয়াছে, সেইগুলি ঐ মূল- তত্ত্বগুলির উপর প্রতিষ্ঠিত। ঐগুলির কখনও পরিবর্তন হইতে পারে না। আত্মা, স্বর্গগমন প্রভৃতির ভাব কখনও পরিবর্তিত হইতে পারে না। সহস্র বৎসর পূর্বে ঐ-সকল তত্ত্ব সম্বন্ধে যে ভাব ছিল, এখনও তাহাই আছে, লক্ষ লক্ষ বৎসর পরেও তাহাই থাকিবে।



কিন্তু যে-সকল ধর্মকার্য আমাদের সামাজিক অবস্থা ও সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে, সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সেইগুলিও পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। সুতরাং সময়-বিশেষে কোন বিশেষ বিধিই সত্য ও ফলপ্রদ হইবে, অপর সময়ে নহে। তাই আমরা দেখিতে পাই, কোন সময়ে কোন খাদ্য-বিশেষের বিধান রহিয়াছে, অন্য সময়ে তাহা আবার নিষিদ্ধ। সেই খাদ্য সেই সময়-বিশেষের উপযোগী ছিল, কিন্তু ঋতু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে উহা তৎকালের অনুপযোগী হওয়ায় স্মৃতি তখন ঐ খাদ্য-ব্যবহার নিষেধ করিয়াছেন। এই কারণে স্বভাবতই প্রতীত হইতেছে যে, যদি বর্তমানকালে আমাদের সমাজের কোন পরিবর্তন আবশ্যক হয়, তবে ঐ পরিবর্তন করিতেই হইবে; কিভাবে ঐ-সকল পরিবর্তন করিতে হইবে—ঋষিরা আসিয়া তাহা দেখাইয়া দিবেন। আমাদের ধর্মের মূল সত্যগুলি বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হইবে না, ঐগুলি সমভাবে থাকিবে।


তারপর পুরাণ। পুরাণ পঞ্চলক্ষণান্বিত। উহাতে ইতিহাস, সৃষ্টিতত্ত্ব, নানাবিধ রূপকের দ্বারা দার্শনিক তত্ত্বসকলের বিবৃতি প্রভৃতি বহু বিষয় আছে। বৈদিক ধর্ম সর্বসাধারণে প্রচার করিবার জন্য পুরাণ লিখিত হয়। বেদ যে-ভাষায় লিখিত তাহা অতি প্রাচীন; অতি অল্পসংখ্যক পণ্ডিতই ঐ গ্রন্থের সময়-নিরূপণে সমর্থ। পুরাণ সমসাময়িক লোকের ভাষায় লিখিত—উহাকে আধুনিক সংস্কৃত বলা যায়। ঐগুলি পণ্ডিতদের জন্য নয়, সাধারণ লোকের জন্য; কারণ সাধারণ লোক দার্শনিক তত্ত্ব বুঝিতে অক্ষম। তাহাদিগকে ঐ-সকল তত্ত্ব বুঝাইবার জন্য স্থূলভাবে সাধু, রাজা ও মহাপুরুষগণের জীবনচরিত এবং ঐ জাতির মধ্যে যে-সকল ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল, সেইগুলির মধ্য দিয়া শিক্ষা দেওয়া হইত। মুনিরা যে কোন বিষয় পাইয়াছেন, তাহাই গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু প্রত্যেকটিই ধর্মের নিত্য সত্য বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে।



তারপর তন্ত্র। এইগুলি কতক কতক বিষয়ে প্রায় পুরাণের মত এবং তাহাদের মধ্যে কতকগুলিতে কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত প্রাচীন যাগযজ্ঞকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে।


এইগুলি সবই হিন্দুদের শাস্ত্র। যে জাতির মধ্যে এত অধিকসংখ্যক ধর্মশাস্ত্র বিদ্যমান এবং যে-জাতি অগণিত বর্ষ ধরিয়া দর্শন ও ধর্মের চিন্তায় তাহার শক্তি নিয়োজিত করিয়াছে, সে-জাতির মধ্যে এত অধিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব অতি স্বাভাবিক। আরও সহস্র সহস্র সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় কেন হইল না, ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। কোন কোন বিষয়ে এই-সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিশয় পার্থক্য বিদ্যমান। সম্প্রদায়গুলির এই-সকল খুঁটিনাটির বিভিন্নতা বুঝিবার সময় এখন আমাদের নাই। সুতরাং যে-সকল মতে—যে-সকল তত্ত্বে হিন্দুমাত্রেরই বিশ্বাস থাকা আবশ্যক, সম্প্রদায়সমূহের সেই সাধারণ তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করিব।


প্রথমতঃ সৃষ্টিতত্ত্ব। হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের মত—এই সৃষ্টি, এই প্রকৃতি, এই মায়া অনাদি অনন্ত। জগৎ কোন বিশেষ দিনে সৃষ্ট হয় নাই। একজন ঈশ্বর আসিয়া এই জগৎ সৃষ্টি করিলেন, তারপর তিনি ঘুমাইতেছেন—ইহা হইতে পারে না। সৃষ্টিকারিণী শক্তি এখনও বর্তমান। ঈশ্বর অনন্তকাল ধরিয়া সৃষ্টি করিতেছেন, তিনি কখনই বিশ্রাম করেন না। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেনঃ যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ। *** উপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ||—যদি আমি ক্ষণকাল কর্ম না করি, তবে জগৎ ধ্বংস হইয়া যাইবে।



জগতে এই যে সৃষ্টিশক্তি দিবারাত্র কার্য করিতেছে, ইহা যদি ক্ষণকালের জন্য বন্ধ থাকে, তবে এই জগৎ ধ্বংস হইয়া যায়। এমন সময় কখনই ছিল না, যখন সমগ্র জগতে এই শক্তি ক্রিয়াশীল ছিল না; তবে অবশ্য যুগশেষে প্রলয় হইয়া থাকে। আমাদের ‘সৃষ্টি’ ইংরেজী ‘Creation’ নহে। ‘Creation’ বলিতে ইংরেজীতে ‘কিছু-না হইতে কিছু হওয়া, অসৎ হইতে সতের উদ্ভব’—এই অপরিণত মতবাদ বুঝাইয়া থাকে। এইরূপ অসঙ্গত কথা বিশ্বাস করিতে বলিয়া আমি তোমাদের বুদ্ধি ও বিচার-শক্তির অবমাননা করিতে চাই না। সমগ্র প্রকৃতিই বিদ্যমান থাকে, কেবল প্রলয়ের সময় উহা ক্রমশঃ সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইতে যায়, শেষে একেবারে অব্যক্তভাব ধারণ করে। পরে কিছুকাল যেন বিশ্রামের পর আবার ব্যক্ত হইয়া উহা সম্মুখে নিক্ষিপ্ত হয়; তখন পূর্বের মতই সংযোগ, পূর্বের মতই প্রকাশ হইতে থাকে। কিছুকাল এইরূপ খেলা চলিয়া আবার ঐ খেলা ভাঙিয়া যায়—ক্রমশ সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইতে থাকে, শেষে সমুদয় আবার অব্যক্তে লীন হইয়া যায়। আবার বাহিরে আসে; অনন্তকাল এইরূপ তরঙ্গের মত একবার সম্মুখে আর-বার পশ্চাতে আন্দোলিত হইতেছে। দেশ, কাল এবং অন্যান্য সব-কিছুই এই প্রকৃতির অন্তর্গত। এই কারণেই ‘সৃষ্টির আরম্ভ আছে’ বলা সম্পূর্ণ বাতুলতা। সৃষ্টির আরম্ভ বা শেষ সম্বন্ধে কোন কথাই উঠিতে পারে না। এই জন্য যখনই আমাদের শাস্ত্রে সৃষ্টির আদি বা অন্তের উল্লেখ করা হইয়াছে, তখনই কোন যুগবিশেষের আদি-অন্ত বুঝিতে হইবে; উহার অন্য কোন অর্থ নাই।



কে এই সৃষ্টি করিতেছেন?—ঈশ্বর। ইংরেজীতে সাধারণতঃ God শব্দে যাহা বুঝায় আমার অভিপ্রায় তাহা নহে। সংস্কৃত ‘ব্রহ্ম’ শব্দ ব্যবহার করাই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত। তিনিই এই জগৎপ্রপঞ্চের সাধারণ কারণস্বরূপ। ব্রহ্মের স্বরূপ কি? ব্রহ্ম নিত্য—নিত্যশুদ্ধ নিত্যজাগ্রত সর্বশক্তিমান্ সর্বজ্ঞ দয়াময় সর্বব্যাপী নিরাকার অখণ্ড। তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন। এখন প্রশ্ন এই, যদি এই ব্রহ্ম জগতের নিত্য স্রষ্টা ও বিধাতা হন, তাহা হইলে দুইটি আপত্তি উপস্থিত হয়। জগতে তো যথেষ্ট বৈষম্য রহিয়াছে—এখানে কেহ সুখী, কেহ দুঃখী; কেহ ধনী, কেহ দরিদ্র; এইরূপ বৈষম্য কেন? আবার এখানে নিষ্ঠুরতাও বিদ্যমান। কারণ এখানে একের জীবন অন্যের মৃত্যুর উপর নির্ভর করিতেছে। এক প্রাণী আর এক প্রাণীকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেছে, প্রত্যেক মানবই নিজ ভ্রাতার গলা টিপিবার চেষ্টা করিতেছে। এই প্রতিযোগিতা, এই নিষ্ঠুরতা, এই উৎপাত, এই দিবা-রাত্রি গগনবিদারী দীর্ঘনিঃশ্বাস—ইহাই আমাদের এই জগতের অবস্থা! ইহাই যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়, তবে সেই ঈশ্বর ঘোরতর নিষ্ঠুর! মানুষের কল্পিত নিষ্ঠুরতম দানব অপেক্ষা এই ঈশ্বর আরও নিষ্ঠুর। বেদান্ত বলেন, ঈশ্বর এই বৈষম্য ও প্রতিযোগিতার কারণ নহেন। তবে কে ইহা করিল?—আমরা নিজেরাই করিয়াছি। মেঘ সকল ক্ষেত্রের উপর সমভাবেই বর্ষণ করে। কিন্তু যে-ক্ষেত্র উত্তমরূপে কর্ষিত, তাহাই শস্যশালী হয়; যে-ভূমি ভালভাবে কর্ষিত নয়, তাহা ঐ বৃষ্টির ফল লাভ করিতে পারে না। ইহা মেঘের অপরাধ নহে। তাঁহার দয়া অনন্ত অপরিবর্তনীয়—আমরাই কেবল এই বৈষম্য সৃষ্টি করিতেছি। কিরূপে আমরা এই বৈষম্য সৃষ্টি করিলাম? কেহ জগতে সুখী হইয়া জন্মাইল, কেহ বা অসুখী—তাহারা তো এই বৈষম্য সৃষ্টি করে নাই? করিয়াছে বৈ কি! পূর্বজন্মকৃত কর্মের দ্বারা এই ভেদ—এই বৈষম্য সৃষ্ট হইয়াছে।



এখন আমরা সেই দ্বিতীয় তত্ত্বের আলোচনায় আসিলাম—যাহাতে শুধু আমরা হিন্দুরা নই, বৌদ্ধ এবং জৈনগণও একমত। আমরা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকি, সৃষ্টির মত জীবনও অনন্ত। শূন্য হইতে যে জীবনের উৎপত্তি হইয়াছে, তাহা নহে—তাহা হইতেই পারে না; এইরূপ জীবনের কোন প্রয়োজন নাই। কালে যাহার আরম্ভ, কালেই তাহার অন্ত হইবে। গতকল্য যদি জীবনের আরম্ভ হইয়া থাকে, তবে আগামী কল্য উহার শেষ হইবে—পরে উহার সম্পূর্ণ ধ্বংস হইবে। জীবন অবশ্য পূর্বেও বর্তমান ছিল। আজকাল ইহা বেশী বুঝাই- বার আবশ্যক নাই; কারণ আধুনিক বিজ্ঞান এই বিষয়ে আমাদিগকে সাহায্য করিতেছে— জড়-জগতের আবিষ্কারগুলির সাহায্যে আমাদের শাস্ত্রনিহিত তত্ত্বগুলি বুঝাইয়া দিতেছে। তোমরা সকলে পূর্ব হইতেই অবগত আছ যে, আমাদের প্রত্যেকেই অনন্ত অতীতের কর্মসমষ্টির ফলস্বরূপ। কবিগণের বর্ণনানুযায়ী কোন শিশুকেই প্রকৃতি স্বহস্তে জগৎ-রঙ্গমঞ্চে লইয়া আসেন না, তাহার স্কন্ধে অনন্ত অতীতের কর্মসমষ্টি রহিয়াছে। ভালই হউক আর মন্দই হউক, সে নিজ অতীত কর্মের ফল ভোগ করিতে আসে। ইহা হইতেই বৈষম্যের উৎপত্তি। ইহাই কর্মবিধান; আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অদৃষ্টের নিয়ামক। এই মতবাদের দ্বারা অদৃষ্টবাদ খণ্ডিত হয় এবং ইহা-দ্বারাই ‘ঈশ্বরের বৈষম্য-নৈর্ঘৃণ্য-দোষ’ নিরাকৃত হয়। আমরা যাহা কিছু ভোগ করি, তাহার জন্য আমরাই দায়ী, অপর কেহ নহে। আমরাই কার্য, আমরাই কারণস্বরূপ; সুতরাং আমরা স্বাধীন। যদি আমরা অসুখী হই, তবে বুঝিতে হইবে—আমিই আমাকে অসুখী করিয়াছি। আর ইহাও প্রতীয়মান হইবে যে, আমি যদি ইচ্ছা করি, তবে সুখীও হইতে পারি। যদি আমি অপবিত্র হই, তবে তাহাও আমার নিজকৃত; আর বুঝিতে হইবে যে, আমি ইচ্ছা করিলে আবার পবিত্র হইতে পারি। সকল বিষয়ে এইরূপ বুঝিতে হইবে। মানুষের ইচ্ছা কোন ঘটনার অধীন নহে। মানুষের অনন্ত ইচ্ছাশক্তি ও মুক্ত স্বভাবের সম্মুখে সকল শক্তি, এমন কি, প্রাকৃতিক শক্তিগুলি পর্যন্ত মাথা নত করিবে—দাস হইয়া থাকিবে।



এইবার স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে—আত্মা কি? আত্মাকে না জানিলে আমাদের শাস্ত্রোক্ত ঈশ্বরকেও জানিতে পারি না। ভারতে ও অন্যান্য দেশে বহিঃপ্রকৃতির আলোচনা-দ্বারা সেই সর্বাতীত সত্তার আভাস পাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমরা জানি, ইহার ফলও অতি শোচনীয় হইয়াছে। সেই সত্তার আভাস পাওয়া দূরে থাক্, আমরা যতই জড়-জগতের আলোচনা করি, ততই অধিকতর জড়বাদী হইতে থাকি। যদি বা একটু-অধটু ধর্মভাব পূর্বে থাকে, জড়-জগতের আলোচনা করিতে করিতে তাহাও দূর হইয়া যায়। অতএব আধ্যাত্মিকতা ও সেই পরমপুরুষের জ্ঞান বাহ্যজগৎ হইতে পাওয়া যায় না। অন্তরমধ্যে—আত্মার মধ্যে ঐ তত্ত্ব অন্বেষণ করিতে হইবে। বাহ্যজগৎ আমাদিগকে সেই অনন্তের কোন সংবাদ দিতে পারে না, অন্তর্জগতে অন্বেষণ করিলেই উহার সংবাদ পাওয়া যায়। অতএব কেবল আত্মতত্ত্বের অন্বেষণেই, আত্মতত্ত্বের বিশ্লেষণেই ঈশ্বরকে জানিতে পারি। জীবাত্মার স্বরূপ-সম্বন্ধে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মতভেদ আছে বটে, কিন্তু কোন কোন বিষয়ে সকলে একমত। যথা—সকল জীবাত্মা অনাদি অনন্ত, স্বরূপতঃ অবিনাশী। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক আত্মায় সর্ববিধ শক্তি আনন্দ পবিত্রতা সর্বব্যাপিতা ও সর্বজ্ঞত্ব অন্তর্নিহিত রহিয়াছে। এই গুরুতর তত্ত্বটি সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে। প্রত্যেক মানবে, প্রত্যেক প্রাণীতে—সে যতই দুর্বল বা মন্দ হউক, সে বড় বা ছোট হউক—সেই সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ আত্মা রহিয়াছেন। আত্মা হিসাবে কোন প্রভেদ নাই—প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে। ঐ ক্ষুদ্রতম প্রাণী ও আমার মধ্যে প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে—স্বরূপতঃ তাহার সহিত আমার কোন ভেদ নাই; সে আমার ভ্রাতা; তাহারও যে আত্মা, আমারও সেই আত্মা। ভারত এই মহত্তম তত্ত্ব জগতে প্রচার করিয়াছে। অন্যত্র ‘সমগ্র মানবজাতির ভ্রাতৃভাব’ প্রচারিত হইয়া থাকে, ভারতে উহা ‘সর্বপ্রাণীর ভ্রাতৃভাব’—এই আকার ধারণ করিয়াছে। অতি ক্ষুদ্রতম প্রাণী, এমন কি ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত আমার ভাই—তাহারাও আমার দেহস্বরূপ। ‘এবং তু পণ্ডিতৈর্জ্ঞাত্বা সর্বভূতময়ং হরিম্’ ইত্যাদি—এইরূপে পণ্ডিতগণ সেই প্রভুকে সর্বভূতময় জানিয়া সকল প্রাণীকে ঈশ্বরজ্ঞানে উপাসনা করিবেন। সেই কারণেই ভারতে ইতরপ্রাণী ও দরিদ্রগণের প্রতি এত দয়ার ভাব বর্তমান; সকল বস্তু সম্বন্ধেই—সকল বিষয়েই ঐ দয়ার ভাব। আত্মাতে সমুদয় শক্তি বর্তমান—এই মত ভারতের সকল সম্প্রদায়ের মিলনভূমি।



স্বভাবতই এইবার আমাদের ঈশ্বরতত্ত্ব-আলোচনার সময় আসিয়াছে। কিন্তু তৎপূর্বেই ‘আত্মা’ সম্বন্ধে একটি কথা বলিতে চাই। যাঁহারা ইংরেজী ভাষা চর্চা করেন, তাঁহারা অনেক সময় Soul ও Mind—এই দুইটি শব্দে বড় গোলযোগে পড়িয়া যান। সংস্কৃত ‘আত্মা’ ও ইংরেজী’ ‘Soul’ শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্নার্থবাচক। আমরা যাহাকে ‘মন’ বলি, পাশ্চাত্যেরা তাহাকে ‘Soul’ বলেন। পাশ্চাত্য দেশে আত্মা সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান কোন দিন ছিল না। প্রায় বিশ বৎসর হইল সংস্কৃত দর্শনশাস্ত্রের সাহায্যে ঐ জ্ঞান পাশ্চাত্য দেশে আসিয়াছে। আমাদের এই স্থূল শরীরের পশ্চাতে মন; মন কিন্তু আত্মা নহে; উহা সূক্ষ্ম শরীর—সূক্ষ্ম তন্মাত্রয় নির্মিত। উহাই জন্মজন্মান্তরে বিভিন্ন শরীর আশ্রয় করে, উহার পশ্চাতে মানুষের আত্মা রহিয়াছে। এই ‘আত্মা’ শব্দ Soul বা Mind শব্দের দ্বারা অনূদিত হইতে পারে না—সুতরাং আমাদিগকে সংস্কৃত ‘আত্মা’ অথবা আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকগণের মতানুযায়ী ‘Self’ শব্দ ব্যবহার করিতে হইবে। যে শব্দই আমরা ব্যবহার করি না কেন, আত্মা যে মন ও স্থূল-শরীর—উভয় হইতেই পৃথক্‌, এই ধারণাটি মনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে রাখিতে হইবে। আর এই আত্মাই মন বা সূক্ষ্ম-শরীরকে সঙ্গে লইয়া এক দেহ হইতে দেহান্তরে গমন করে; কালে যখন সর্বজ্ঞত্ব ও পূর্ণত্ব লাভ করে, তখন উহার আর জন্মমৃত্যু হয় না—তখন উহা মুক্ত হইয়া যায়; ইচ্ছা করিলে জীবাত্মা এই মন বা সূক্ষ্ম-শরীরকে রাখিতেও পারে, অথবা উহাকে পরিত্যাগ করিয়া অনন্তকালের জন্য স্বাধীন ও মুক্ত হইয়া যাইতে পারে। মুক্তিই আত্মার লক্ষ্য। ইহাই আমাদের ধর্মের বিশেষত্ব।


আমাদের ধর্মেও স্বর্গ-নরক আছে, কিন্তু উহারা চিরস্থায়ী নহে। স্বর্গ-নরকের স্বরূপ বিচার করিলে সহজেই প্রতীত হয় যে, উহারা চিরস্থায়ী হইতে পারে না। যদি স্বর্গ বলিয়া কিছু থাকে, তবে তাহা এই মর্ত্যলোকেরই পুনরাবৃত্তিমাত্র হইবে—না হয় একটু বেশী সুখ, একটু না হয় বেশী ভোগ। তাহাতে বরং আরও মন্দই হইবে। এইপ্রকার স্বর্গ অনেক। যাহারা ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ইহলোকে কোন সৎকর্ম করে, তাহারা মৃত্যুর পর এইরূপ কোন স্বর্গে ইন্দ্রাদি দেবতা হইয়া জন্মগ্রহণ করে। এই দেবত্ব বিশেষ বিশেষ পদমাত্র। এই দেবতারাও এক সময়ে মানুষ ছিলেন; সৎকর্মবশে ইহাদের দেবত্বপ্রাপ্তি হইয়াছে। ইন্দ্র-বরুণাদি কোন দেব-বিশেষের নাম নহে। সহস্র সহস্র ইন্দ্র হইবেন। রাজা নহুষ মৃত্যুর পর ইন্দ্রত্ব লাভ করিয়াছিলেন। ইন্দ্রত্ব পদমাত্র। কোন ব্যক্তি সৎকর্মের ফলে উন্নত হইয়া ইন্দ্রত্ব লাভ করিলেন, কিছুদিন সেই পদে প্রতিষ্ঠিত রহিলেন, আবার সেই দেবদেহ ত্যাগ করিয়া পুনরায় মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করিলেন। মনুষ্যজন্মই শ্রেষ্ঠ জন্ম। কোন কোন দেবতা স্বর্গসুখের বাসনা ত্যাগ করিয়া মুক্তিলাভের চেষ্টা করিতে পারেন; কিন্তু যেমন এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ধন মান ঐশ্বর্য লাভ করিলে উচ্চতত্ত্ব ভুলিয়া যায়, সেইরূপ অধিকাংশ দেবতাই ঐশ্বর্যমদে মত্ত হইয়া মুক্তির চেষ্টা করেন না; তাঁহাদের শুভ কর্মের ফলভোগ শেষ হইয়া গেলে তাঁহারা পুনরায় এই পৃথিবীতে আসিয়া মনুষ্যদেহ ধারণ করেন। অতএব এই পৃথিবীই কর্মভূমি; এই পৃথিবী হইতেই আমরা মুক্তি লাভ করিতে পারি। সুতরাং এই-সকল স্বর্গেও আমাদের বিশেষ প্রয়োজন নাই। তবে কোন্ বস্তু লাভ করিবার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত?—মুক্তি। আমাদের শাস্ত্র বলেনঃ ‘শ্রেষ্ঠ স্বর্গেও তুমি প্রকৃতির দাসমাত্র। বিশ হাজার বৎসর তুমি রাজত্ব ভোগ করিলে—তাহাতে কি হইল? যতদিন তোমার শরীর থাকে, ততদিন তুমি সুখের দাসমাত্র। যতদিন দেশ-কাল তোমার উপর কার্য করিতেছে, ততদিন তুমি ক্রীতদাসমাত্র।’ এই কারণেই আমাদিগকে বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতি—উভয়কে জয় করিতে হইবে। প্রকৃতি যেন তোমার পদতলে থাকে—প্রকৃতিকে পদদলিত করিয়া, তাহাকে অতিক্রম করিয়া স্বাধীন মুক্তভাবে তোমাকে নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে। তখন তুমি জন্মের অতীত হইলে, সুতরাং মৃত্যুরও পারে উপনীত হইলে। তখন তোমার সুখ চলিয়া গেল, সুতরাং তুমি দুঃখেরও অতীত হইলে। তখনই তুমি সর্বাতীত অব্যক্ত অবিনাশী আনন্দের অধিকারী হইলে। আমরা যাহাকে এখানে সুখ ও কল্যাণ বলি, তাহা সেই অনন্ত আনন্দের এক কণামাত্র। ঐ অনন্ত আনন্দই আমাদের লক্ষ্য।



আত্মা অনন্ত আনন্দস্বরূপ, উহা লিঙ্গবর্জিত। আত্মাতে নরনারী ভেদ নাই। দেহ সম্বন্ধেই নরনারী ভেদ। অতএব আত্মাতে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আরোপ করা ভ্রমমাত্র—শরীর সম্বন্ধেই উহা সত্য। আত্মার সম্বন্ধে কোনরূপ বয়সও নির্দিষ্ট হইতে পারে না, সেই প্রাচীন পুরুষ সর্বদাই একরূপ।


এই আত্মা কিরূপে সংসারে বদ্ধ হইলেন? একমাত্র আমাদের শাস্ত্রই ঐ প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন। অজ্ঞানই বন্ধনের কারণ। আমরা অজ্ঞানেই বদ্ধ হইয়াছি—জ্ঞানোদয়েই অজ্ঞানের নাশ হইবে, জ্ঞানই আমাদিগকে এই অজ্ঞানের পারে লইয়া যাইবে। এই জ্ঞানলাভের উপায় কি? ভক্তিপূর্বক ঈশ্বরের উপাসনা এবং ভগবানের মন্দিরজ্ঞানে সর্বভূতে প্রেম দ্বারা সেই জ্ঞানলাভ হয়। ঈশ্বরে পরানুরক্তিবলে জ্ঞানের উদয় হইবে, অজ্ঞান দূরীভূত হইবে, সকল বন্ধন টুটিয়া যাইবে এবং আত্মা মুক্তিলাভ করিবেন।


আমাদের শাস্ত্রে ঈশ্বরের দ্বিবিধ স্বরূপের বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে—সগুণ ও নির্গুণ। সগুণ ঈশ্বর অর্থে সর্বব্যাপী, জগতের সৃষ্টি-স্থিতি ও প্রলয়-কর্তা—জগতের শাশ্বত জনক- জননী। তাঁহার সহিত আমাদের ভেদ নিত্য। মুক্তির অর্থ তাঁহার সামীপ্য ও সালোক্য-প্রাপ্তি। নির্গুণ ব্রহ্মের বর্ণনায় সগুণ ঈশ্বরের প্রতি সচরাচর প্রযুক্ত সর্বপ্রকার বিশেষণ অনাবশ্যক ও অযৌক্তিক বলিয়া পরিত্যক্ত হইয়াছে। সেই নির্গুণ সর্বব্যাপী পুরুষকে জ্ঞানবান্ বলা যাইতে পারে না; কারণ জ্ঞান মনের ধর্ম। তাঁহাকে চিন্তাশীল বলা যইতে পারে না; কারণ চিন্তা সসীম জীবের জ্ঞানলাভের উপায়মাত্র। তাঁহাকে বিচারপরায়ণ বলা যাইতে পারে না; কারণ বিচারও সসীমতা—দুর্বলতার চিহ্নস্বরূপ। তাঁহাকে সৃষ্টিকর্তা বলা যাইতে পারে না; কারণ বদ্ধ ভিন্ন মুক্ত পুরুষের সৃষ্টিতে প্রবৃত্তি হয় না। তাঁহার আবার বন্ধন কি? প্রয়োজন ভিন্ন কেহই কোন কার্য করে না। তাঁহার আবার প্রয়োজন কি? অভাব না থাকিলে কেহ কোন কার্য করে না।—তাঁহার আবার অভাব কি? বেদে তাঁহার প্রতি ‘সঃ’ শব্দ প্রযুক্ত হয় নাই। ‘সঃ’ শব্দের দ্বারা নয়, নির্গুণ ভাব বুঝাইবার জন্য ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা তাঁহার নির্দেশ করা হইয়াছে। ‘সঃ’ শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট হইলে ব্যক্তিবিশেষ বুঝাইত, তাহাতে জীব-জগতের সহিত তাঁহার সম্পূর্ণ পার্থক্য সূচিত হইত। তাই নির্গুণবাচক ‘তৎ’ শব্দের প্রয়োগ করা হইয়াছে, ‘তৎ’ শব্দবাচ্য নির্গুণ ব্রহ্ম প্রচারিত হইয়াছে। ইহাকেই অদ্বৈতবাদ বলে।


এই নৈর্ব্যক্তিক সত্তার সহিত আমাদের সম্বন্ধ কি?—তাঁহার সহিত আমরা অভিন্ন। আমরা প্রত্যেকেই সকল জীবের মূল ভিত্তিস্বরূপ সেই সত্তার বিভিন্ন বিকাশমাত্র। যখনই আমরা এই অনন্ত নির্গুণ সত্তা হইতে আমাদিগকে পৃথক্ ভাবি, তখনই আমাদের দুঃখের উৎপত্তি; আর এই অনির্বচনীয় নির্গুণ সত্তার সহিত আমাদের অভেদ-জ্ঞানেই মুক্তি। সংক্ষেপতঃ আমাদের শাস্ত্রে আমরা ঈশ্বরের এই দ্বিবিধ ভাবের উল্লেখ দেখিতে পাই। এখানে বলা আবশ্যক যে, নির্গুণ ব্রহ্মবাদই সর্বপ্রকার নীতিবিজ্ঞানের ভিত্তি। অতি প্রাচীনকাল হইতেই প্রত্যেক জাতির ভিতর এই সত্য প্রচারিত হইয়াছে—সকলকে নিজের মত ভালবাসিবে। ভারতবর্ষে আবার মনুষ্য ও ইতরপ্রাণীতে কোন প্রভেদ করা হয় নাই, প্রাণি-নির্বিশেষে সকলকেই নিজের মত প্রীতি করিতে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু অপর প্রাণিগণকে নিজের মত ভালবাসিলে কেন কল্যাণ হইবে, কেহই তাহার কারণ নির্দেশ করেন নাই। একমাত্র নির্গুণ ব্রহ্মবাদই ইহার কারণ নির্দেশ করিতে সমর্থ। যখন সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডকে এক ও অখণ্ড বলিয়া বোধ করিবে, যখন জানিবে অপরকে ভালবাসিলে নিজেকেই ভালবাসা হইল, তখনই বুঝিবে—অপরের ক্ষতি করিলে নিজের ক্ষতি করা হইল; তখনই আমরা বুঝিব, কেন অপরের অনিষ্ট করা উচিত নয়। সুতরাং এই নির্গুণ ব্রহ্মবাদেই নীতিবিজ্ঞানের মূলতত্ত্বের যুক্তি পাওয়া যায়।


অদ্বৈতবাদের কথা বলিতে গিয়া আরও অনেক কথা আসিয়া পড়ে। সগুণ ঈশ্বরে বিশ্বাসবান্ হইলে হৃদয়ে কি অপূর্ব প্রেমের উচ্ছ্বাস হয়, তাহা আমি জানি। বিভিন্ন কালের প্রয়োজন অনুসারে লোকের উপর ভক্তির প্রভাব ও কার্যকারিতার বিষয় আমি বিশেষভাবে অবগত আছি। কিন্তু আমাদের দেশে এখন আর কাঁদিবার সময় নাই—এখন কিছু বীর্যের প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। এই নির্গুণ ব্রহ্মে বিশ্বাস হইলে—সর্বপ্রকার কুসংস্কার-বর্জিত হইয়া ‘আমিই সেই নির্গুণ ব্রহ্ম’ এই জ্ঞানসহায়ে নিজের পায়ের উপর নিজে দাঁড়াইলে হৃদয়ে কি অপূর্ব শক্তির বিকাশ হয় তাহা বলা যায় না! ভয়?—কাহাকে ভয়? আমি প্রকৃতির নিয়ম পর্যন্ত গ্রাহ্য করি না। মৃত্য আমার নিকট উপহাসের বস্তু। মানুষ নিজ আত্মার মহিমায় অবস্থিত—সেই আত্মা অনাদি অনন্ত ও অবিনাশী, তাঁহাকে কোন অস্ত্র ভেদ করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল গলাইতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না, তিনি অনন্ত জন্মরহিত মৃত্যুহীন, তাঁহার মহিমার সম্মুখে সূর্য-চন্দ্রসমূহ—এমন কি, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সিন্ধুতে বিন্দুতুল্য প্রতীয়মান হয়, তাঁহার মহিমার সম্মুখে দেশকালের অস্তিত্ব বিলীন হইয়া যায়। আমাদিগকে এই মহিমময় আত্মার বিশ্বাসবান্ হইতে হইবে—তবেই বীর্য আসিবে। তুমি যাহা চিন্তা করিবে, তাহাই হইয়া যাইবে। যদি তুমি আপনাকে দুর্বল ভাব, তবে দুর্বল হইবে; তেজস্বী ভাবিলে তেজস্বী হইবে। যদি তুমি নিজেকে অপবিত্র ভাব, তবে তুমি অপবিত্র; নিজেকে বিশুদ্ধ ভাবিলে বিশুদ্ধই হইবে। অদ্বৈতবাদ আমাদের নিজেকে দুর্বল ভাবিতে শিক্ষা দেয় না, পরন্তু নিজেদের তেজস্বী সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ ভাবিতে উপদেশ দেয়। আমার ভিতরে ঐ ভাব এখনও প্রকাশিত নাও হইতে পারে, কিন্তু উহা তো আমার ভিতরে রহিয়াছে। আমার মধ্যে সকল জ্ঞান, সকল শক্তি, পূর্ণ পবিত্রতা ও স্বাধীনতার ভাব রহিয়াছে। তবে আমি ঐ ভাবগুলি জীবনে রূপায়িত করিতে পারি না কেন? কারণ, ঐ কথা আমি বিশ্বাস করি না। যদি উহাতে আমি বিশ্বাসী হই, তবে ইহা এখনই প্রকাশিত হইবে—নিশ্চয়ই হইবে। অদ্বৈতবাদ ইহাই শিক্ষা দেয়।


অতি শৈশবাবস্থা হইতেই তোমাদের সন্তানগণ তেজস্বী হউক, তাহাদিগকে কোনরূপ দুর্বলতা, কোনরূপ বাহ্য অনুষ্ঠান শিক্ষা দিবার প্রয়োজন নাই। তাহারা তেজস্বী হউক, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াক,—সাহসী সর্বজয়ী সর্বংসহ হউক। সর্বপ্রথমে তাহারা আত্মার মহিমা সম্বন্ধে জানুক। এই শিক্ষা বেদান্তে—কেবল বেদান্তেই পাইবে; অন্যান্য ধর্মের মত ভক্তি উপাসনা প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক উপদেশ বেদান্তে আছে—যথেষ্ট পরিমাণেই আছে; কিন্তু আমি যে আত্মতত্ত্বের কথা বলিতেছি, তাহাই জীবনপ্রদ এবং অতি অপূর্ব। কেবল বেদান্তেই সেই মহান্ তত্ত্ব নিহিত, যাহা সমগ্র জগতের ভাবরাশিকে আমূল পরিবর্তিত করিয়া ফেলিবে এবং বিজ্ঞানের সহিত ধর্মের সামঞ্জস্য বিধান করিবে।


আমি তোমাদের নিকট আমাদের ধর্মের প্রধান তত্ত্বগুলি বলিলাম। ঐগুলি কিভাবে কার্যে পরিণত করিতে হইবে, এখন সে-সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিব। পূর্বেই বলিয়াছি, ভারতে যে-সকল কারণ বর্তমান, তাহাতে এখানে অনেক সম্প্রদায় থাকিবারই কথা। কার্যতও দেখিতেছি—এখানে অনেক সম্প্রদায়। আরও একটি আশ্চর্য ব্যাপার এখানে দেখা যাইতেছে যে, এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের সহিত বিরোধ করে না। শৈব এ-কথা বলে না যে, বৈষ্ণবমাত্রেই অধঃপাতে যাইবে, অথবা বৈষ্ণবও শৈবকে ঐ-কথা বলে না। শৈব বলে, ‘আমি আমার পথে চলিতেছি, তুমি তোমার পথা চল; পরিণামে আমরা একই স্থানে পৌঁছিব।’ ভারতের সকল সম্প্রদায়ই এই কথা স্বীকার করিয়া থাকে। ইহাকেই ‘ইষ্টতত্ত্ব’ বলে। অতি প্রাচীন কাল হইতেই এ-কথা স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে যে, ঈশ্বরোপাসনার বিভিন্ন প্রণালী আছে। ইহাও স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে যে, বিভিন্ন প্রকৃতির পক্ষে বিভিন্ন সাধনপ্রণালীর প্রয়োজন। তুমি যে-প্রণালীতে ঈশ্বর লাভ করিবে, সে-প্রণালী আমার পথ নাও হইতে পারে, হয়তো তাহাতে আমার ক্ষতি হইতে পারে। সকলকেই এক পথে যাইতে হইবে—এ-কথার কোন অর্থ নাই, ইহাতে বরং ক্ষতিই হইয়া থাকে; সুতরাং সকলকে এক পথ দিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা একেবারে পরিত্যাজ্য। যদি কখনও পৃথিবীর সব লোক একধর্মমতাবলম্বী হইয়া এক পথে চলে, তবে বড়ই দুঃখের বিষয় বলিতে হইবে। তাহা হইলে লোকের স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও প্রকৃত ধর্মভাব একেবারে বিলুপ্ত হইবে। বৈচিত্র্যই আমাদের জীবনযাত্রার মূলমন্ত্র। বৈচিত্র্য সম্পূর্ণরূপে চলিয়া গেলে সৃষ্টিও লোপ পাইবে। যতদিন চিন্তাপ্রণালীর এই বিভিন্নতা থাকিবে, ততদিন আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব থাকিবে। বৈচিত্র্য আছে বলিয়া বিরোধের প্রয়োজন নাই। তোমার পথ তোমার পক্ষে ভাল বটে, কিন্তু আমার পক্ষে নহে। আমার পথ আমার পক্ষে ঠিক, কিন্তু তোমার পক্ষে নহে। প্রত্যেকেরই ইষ্ট ভিন্ন—এ-কথায় এই বুঝায় যে, প্রত্যেকের পথ ভিন্ন।


এটি মনে রাখিও, কোন ধর্মের সহিত আমাদের বিবাদ নাই। আমাদের প্রত্যেকেরই ইষ্ট ভিন্ন। কিন্তু যখন দেখি—কেহ আসিয়া বলিতেছে, ‘ইহাই একমাত্র পথ’ এবং ভারতের ন্যায় অসাম্প্রদায়িক দেশে জোর করিয়া আমাদিগকে ঐ মতাবলম্বী করিতে চায়, তখন আমরা তাহাদের কথা শুনিয়া হাসিয়া থাকি। যাহারা ঈশ্বরলাভের উদ্দেশ্যে ভিন্নপথাবলম্বী ভ্রাতাদের বিনাশ-সাধন করিতে ইচ্ছুক, তাহাদের মুখে প্রেমের কথা বড়ই অসঙ্গত ও অশোভন। তাহাদের প্রেমের বিশেষ কিছু মূল্য নাই। অপরে অন্য পথের অনুসরণ করিতেছে, ইহা যে সহ্য করিতে পারে না, সে আবার প্রেমের কথা বলে! ইহাই যদি প্রেম হয়, তবে দ্বেষ বলিব কাহাকে? খ্রীষ্ট বুদ্ধ বা মহম্মদ—জগতের যে-কোন অবতারেরই উপাসনা করুক না, কোন ধর্মাবলম্বীর সহিত আমাদের বিবাদ নাই। হিন্দু বলেন, ‘এস ভাই, তোমার যে-সাহায্য আবশ্যক, তাহা আমি করিতেছি; কিন্তু আমি আমার পথে চলিব, তাহাতে কিছু বাধা দিও না।’ আমি আমার ইষ্টের উপাসনা করিব। তোমার পথ খুব ভাল তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আমার পক্ষে হয়তো উহাতে ঘোরতর অনিষ্ট ঘটিতে পারে। কোন্ খাদ্য আমার শরীরের উপযোগী, তাহা আমার নিজ অভিজ্ঞতা হইতে আমিই বুঝিতে পারি, কোটি কোটি ডাক্তার সে-সম্বন্ধে আমাকে কিছু শিক্ষা দিতে পারে না। এইরূপ কোন্ পথ আমার উপযোগী হইবে, তাহা আমার অভিজ্ঞতা হইতে আমিই ঠিক বুঝিতে পারি—ইহাই ইষ্টনিষ্ঠা। এই কারণেই আমরা বলিয়া থাকি যে, যদি কোন মন্দিরে গিয়া অথবা কোন প্রতীক বা প্রতিমার সাহায্যে তুমি তোমার অন্তরে অবস্থিত ভগবানকে উপলব্ধি করিতে পার, তবে তাহাই কর; প্রয়োজন হয় দুই শত প্রতিমা গড় না কেন? যদি কোন বিশেষ অনুষ্ঠানের দ্বারা তোমার ঈশ্বর-উপলব্ধির সাহায্য হয়, তবে শীঘ্র ঐ সকল অনুষ্ঠান অবলম্বন কর। যে-কোন ক্রিয়া বা অনুষ্ঠান তোমাকে ভগবানের নিকট লইয়া যায়, তাহাই অবলম্বন কর; যদি কোন মন্দিরে যাইলে তোমার ঈশ্বরলাভের সহায়তা হয়, সেখানে গিয়াই উপাসনা কর। কিন্তু বিভিন্ন পথ লইয়া বিবাদ করিও না। যে-মুহূর্তে তুমি বিবাদ কর, সেই মুহূর্তে তুমি ধর্মপথ হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছ—তুমি সম্মুখে অগ্রসর না হইয়া পিছু হটিতেছ, ক্রমশ পশুস্তরে উপনীত হইতেছ।


আমাদের ধর্ম কাহাকেও বাদ দিতে চায় না, উহা সকলকেই নিজের কাছে টানিয়া লইতে চায়। আমাদের জাতিভেদ ও অন্যান্য নিয়মাবলী আপাততঃ ধর্মের সহিত সংসৃষ্ট বলিয়া বোধ হইলেও বাস্তবিক তাহা নহে। সমগ্র হিন্দুজাতিকে রক্ষা করিবার জন্য এই-সকল নিয়ম আবশ্যক ছিল। যখন আর আত্মরক্ষার প্রয়োজন থাকিবে না, তখন ঐগুলি আপনা হইতেই উঠিয়া যাইবে।


যতই বয়োবৃদ্ধি হইতেছে, ততই এই প্রাচীন প্রথাগুলি আমার ভাল বলিয়া বোধ হইতেছে। একসময় আমি ঐগুলির অধিকাংশই অনাবশ্যক ও বৃথা মনে করিতাম। কিন্তু যতই আমার বয়স হইতেছে, ততই আমি ঐগুলির একটিরও বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সঙ্কোচ বোধ করিতেছি। কারণ শত শত শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলে ঐগুলি গঠিত হইয়াছে। গতকালের শিশু—যে আগামীকালই হয়তো মৃত্যুমুখে পতিত হইবে—সে যদি আসিয়া আমাকে আমার অনেক দিনের সংকল্পিত বিষয়গুলি পরিত্যাগ করিতে বলে এবং আমিও যদি সেই শিশুর কথা শুনিয়া তাহার মতানুসারে আমার কার্যপ্রণালীর পরিবর্তন করি, তবে আমিই আহাম্মক হইলাম, অপর কেহ নহে। ভারতের বাহিরে নানাদেশে হইতে আমরা সমাজ-সংস্কার সম্বন্ধে যে-সকল উপদেশ পাইতেছি, তাহারও অধিকাংশ ঐ ধরনের। তাহাদিগকে বল—তোমরা যখন একটি স্থায়ী সমাজ গঠন করিতে পারিবে, তখন তোমাদের কথা শুনিব। তোমরা দুদিন একটা ভাব ধরিয়া রাখিতে পার না, বিবাদ করিয়া উহা ছাড়িয়া দাও; ক্ষুদ্র পতঙ্গের ন্যায় তোমাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী! বুদ্বুদের ন্যায় তোমাদের উৎপত্তি, বুদ্বুদের ন্যায় বিলয়! আগে আমাদের মত স্থায়ী সমাজ গঠন কর; প্রথমে এমন কতকগুলি সামাজিক নিয়ম ও প্রথার প্রবর্তন কর, যেগুলির শক্তি শত শত শতাব্দী ধরিয়া অব্যাহত থাকিবে পারে—তখন তোমাদের সহিত এই বিষয়ে আলোচনা করিবার সময হইবে। কিন্তু যতদিন না তাহা হইতেছে, ততদিন তোমরা চঞ্চল বালকমাত্র।


আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে আমার যাহা বলিবার ছিল, তাহা বলা শেষ হইয়াছে। এখন আমি বর্তমান যুগের যাহা বিশেষ প্রয়োজন, এমন একটি বিষয় তোমাদিগকে বলিব। মহাভারত-কার বেদব্যাসের জয় হউক! তিনি বলিয়া গিয়াছেন, ‘কলিযুগে দানই একমাত্র ধর্ম।’ অন্যান্য যুগে যে-সকল কঠোর তপস্যা ও যোগাদি প্রচলিত ছিল, তাহা আর এখন চলিবে না। এই যুগে বিশেষ প্রয়োজন দান—অপরকে সাহায্য করা। ‘দান’ শব্দে কি বুঝায়? ধর্মদানই শ্রেষ্ঠ দান, তারপর বিদ্যাদান, তারপর প্রাণদান; অন্নবস্ত্রদান সর্বনিম্নে। যিনি ধর্মজ্ঞান প্রদান করেন, তিনি আত্মাকে অনন্ত জন্ম-মৃত্যু-প্রবাহ হইতে রক্ষা করিয়া থাকেন। যিনি বিদ্যা দান করেন, তিনিও আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের সহায়তা করেন। অন্যান্য দান, এমন কি প্রাণদান পর্যন্ত তাহার তুলনায় অতি তুচ্ছ। অতএব তোমাদের এইটুকু জানা উচিত যে, এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান অপেক্ষা অন্যান্য সব কাজ নিম্নস্তরের। আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিস্তার করিলেই মনুষ্যজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য করা হয়। আমাদের শাস্ত্র আধ্যাত্মিক ভাবের অনন্ত উৎস।


এই ত্যাগের দেশ—ভারত ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোথায় ধর্মের অপরোক্ষানুভূতির এরূপ দৃষ্টান্ত পাইবে? পৃথিবী সম্বন্ধে আমার একটু অভিজ্ঞতা আছে। আমায় বিশ্বাস কর— অন্যান্য দেশে অনেক বড় বড় কথা শুনিতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু এখানে—কেবল এখানেই এমন মানুষ পাওয়া যায়, যিনি ধর্মকে জীবনে পরিণত করিয়াছেন। বড় বড় কথা বলাই ধর্ম নয়; তোতাপাখিও কথা কয়, আজকাল কলেও কথা বলে; কিন্তু এমন জীবন দেখাও দেখি, যাহার মধ্যে ত্যাগ আধ্যাত্মিকতা তিতিক্ষা ও অনন্ত প্রেম বিদ্যমান। এই-সকল গুণ থাকিলে তবে তুমি ধার্মিক পুরুষ। যখন আমাদের শাস্ত্রে এই-সকল সুন্দর সুন্দর ভাব রহিয়াছে এবং আমাদের দেশে এমন মহৎ জীবনসমূহ উদাহরণস্বরূপ রহিয়াছে, তখন যদি আমাদের যোগিশ্রেষ্ঠগণের হৃদয় ও মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা-রত্নগুলি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হইয়া ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকলের সম্পত্তি না হয়, তবে বড়ই দুঃখের বিষয়। ঐ-সকল তত্ত্ব শুধু ভারতেই প্রচার করিতে হইবে তাহা নহে, সমগ্র জগতে ছড়াইতে হইবে। ইহাই আমাদের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। আর যতই তুমি অপরকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবে, ততই দেখিবে—তুমি নিজেরই কল্যাণ করিতেছ। যদি তোমরা যথার্থই তোমাদের ধর্মকে ভালবাস, যদি তোমরা যথার্থই তোমাদের দেশকে ভালবাস, তবে তোমাদিগকে সাধারণের নিকট দুর্বোধ্য শাস্ত্রাদি হইতে এই রত্নরাজি উদ্ধার করিয়া প্রকৃত উত্তরাধিকারগণকে দিতে হইবে—এই মহাব্রত-সাধনে প্রাণ পণ করিতে হইবে।


সর্বোপরি আমাদিগকে একটি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। হায়! শত শত শতাব্দী ধরিয়া আমরা ঘোরতর ঈর্ষাবিষে জর্জরিত হইতেছি—আমরা সর্বদাই পরস্পরকে হিংসা করিতেছি। অমুক কেন আমা অপেক্ষা বড় হইল, আমি কেন তাহা অপেক্ষা বড় হইলাম না—অহরহঃ আমাদের এই চিন্তা! এমন কি ধর্মকর্মেও আমরা এই শ্রেষ্ঠত্বের অভিলাষী—আমরা এমন ঈর্ষার দাস হইয়াছি! ইহা ত্যাগ করিতে হইবে। যদি ভারতে ভয়ানক কোন পাপ রাজত্ব করিতে থাকে, তবে তাহা এই ঈর্ষাপরতা। সকলেই আদেশ করিতে চায়, আদেশ পালন করিতে কেহই প্রস্তুত নহে! প্রথমে আজ্ঞাপালন করিতে শিক্ষা কর, আজ্ঞা দিবার শক্তি আপনা হইতেই আসিবে। সর্বদাই দাস হইতে শিক্ষা কর, তবেই প্রভু হইতে পারিবে। প্রাচীনকালের সেই অদ্ভুত ব্রহ্মচর্য-আশ্রমের অভাবেই এরূপ ঘটিয়াছে। ঈর্ষাদ্বেষ পরিত্যাগ কর, তবেই তুমি এখনও যে-সব বড় বড় কাজ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা করিতে পারিবে। আমাদের পূর্বপূরুষগণ অতি বিস্ময়কর কাজ করিয়াছিলেন—আমরা ভক্তি ও স্পর্ধার সহিত তাঁহাদের কার্যকলাপের আলোচনা করিয়া থাকি। কিন্তু এখন আমাদের কাজ করিবার সময়—আমাদের ভবিষ্যদ্বংশধরগণ যেন গৌরবের সহিত আমাদের এই কার্যকলাপের আলোচনা করে। আমাদের পূর্বপূরুষগণ যতই শ্রেষ্ঠ ও মহিমান্বিত হউন না কেন, প্রভুর আশীর্বাদে আমরা প্রত্যেকেই এমন সব কাজ করিব, যাহা দ্বারা তাঁহাদেরও গৌরব-রবি ম্লান হইয়া যাইবে।

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড

০৩. পাম্বান-অভিনন্দনের উত্তর


[জাফনা হইতে জলপথে যাত্রা করিয়া স্বামীজী ২৬ জানুআরী ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে পান্বান দ্বীপে পৌঁছিলেন। জেটির নিম্নে এক চন্দ্রাতপতলে তাঁহাকে অভিনন্দিত করা হয়। রামনাদের রাজাও হৃদয়ের আবেগে স্বামীজীকে এক স্বতন্ত্র অভিনন্দন প্রদান করিলেন। পাশ্চাত্যদেশে ধর্মপ্রচারের পর স্বামীজী ভারতবর্ষে আসিয়া প্রথম পান্বানে পদার্পণ করেন। এই ঘটনা স্মরণার্থ রামনাদের রাজা সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়া দেন। স্বামীজী এখানে নিম্নোক্তভাবে উত্তর প্রদান করিলেনঃ]


আমাদের পুণ্য মাতৃভূমিতেই ধর্ম ও দর্শনের উৎপত্তি ও পরিপুষ্টি। এখানেই বড় বড় ধর্মবীর জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। এখানে—কেবল এখানেই ত্যাগ-ধর্ম প্রচারিত হইয়াছে; এখানে—কেবল এখানেই অতিপ্রাচীন কাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের সম্মুখে উচ্চতম আদর্শসমূহ স্থাপিত হইয়াছে।


আমি পাশ্চাত্যদেশের অনেক স্থানে ঘুরিয়াছি—অনেক দেশ পর্যটন করিয়াছি, অনেক জাতি দেখিয়াছি। আমার বোধ হয়—প্রত্যেক জাতিরই এক-একটি মুখ্য আদর্শ আছে। সেই আদর্শই যেন তাহার জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ডস্বরূপ। রাজনীতি, যুদ্ধ, বাণিজ্য বা যন্ত্রবিজ্ঞান ভারতের মেরূদণ্ড নহে; ধর্ম—কেবল ধর্মই ভারতের মেরুদণ্ড। ধর্মের প্রাধান্য ভারতে চিরকাল।


শারীরিক শক্তিবলে অনেক অদ্ভুত কার্য সম্পন্ন হইতে পারে সত্য; বুদ্ধিবলে বিজ্ঞানসাহায্যে যন্ত্রাদি নির্মাণ করিয়া তাহা দ্বারা অনেক অদ্ভুত কার্য দেখান যায়, ইহাও সত্য; কিন্তু আধ্যাত্মিক শক্তির যেরূপ প্রভাব, এগুলির প্রভাব তাহার তুলনায় কিছুই নহে। ভারতের ইতিহাস পাঠ করিলে জানা যায়, ভারত বরাবরই কর্মকুশল। আজকাল আমাদের শেখানো হয়—হিন্দুরা হীনবীর্য ও নিষ্কর্মা; যে সকল ব্যক্তির নিকট এই শিক্ষা পাই, তাঁহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞানের প্রত্যাশা করি। তাঁহাদের শিক্ষায় এই ফল হইয়াছে যে, অন্যান্য দেশের লোকের নিকট ইহা একটি কিংবদন্তী হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, হিন্দুরা হীনবীর্য ও নিষ্কর্মা। ভারত যে কোন কালে নিষ্ক্রিয় ছিল, এ-কথা আমি কোনমতেই স্বীকার করি না। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি যেরূপ কর্মপরায়ণ, অন্য কোন দেশেই সেরূপ নহে। তাহার প্রমাণ—এই অতি প্রাচীন মহান্ জাতি এখনও জীবিত রহিয়াছে। আর তাহার মহামহিমময় জীবনের প্রতি সন্ধিক্ষণেএই জাতি যেন অবিনাশী অক্ষয় নবযৌবন লাভ করিতেছে। ভারতে কর্মপরায়ণতা যথেষ্ট আছে বটে, কিন্তু উহা অপরের দৃষ্টিপথে না পড়িবার কারণ—যে যে- কাজটি করে বা ভাল বোঝে, সে সেটিকেই মাপকাঠি করিয়া অপরের বিচার করে; ইহাই মনুষ্য-প্রকৃতি! মুচি জুতাসেলাই বোঝে, মিস্ত্রী গাঁথনিই বোঝে—পৃথিবীতে যে আর কিছু করিবার বা জানিবার আছে, ইহা তাহাদের বুঝিবার অবসর হয় না। যখন আলোকের স্পন্দন অতি তীব্র হয়, তখন আমরা আলোক দেখিতে পাই না; কারণ আমাদের দর্শনশক্তির একটা সীমা আছে—সেই সীমার বাহিরে আর আমরা দেখিতে পাই না। যোগী কিন্তু তাঁহার আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টিবলে সাধারণ অজ্ঞলোকের জড়দৃষ্টি ভেদ করিয়া ভিতরের বস্তু দেখিতে সমর্থ হন।



এক্ষণে সমগ্র পৃথিবী আধ্যাত্মিকতার জন্য ভারতভূমির দিকে তাকাইয়া আছে। ভারতকে পৃথিবীর সকল জাতির জন্য এই আধ্যাত্মিক খাদ্য যোগাইতে হইবে। এখানেই মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলি বিদ্যমান। পাশ্চাত্য বুধমণ্ডলী এখন আমাদের সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শন নিবন্ধ ভারতবাসীর সনাতন বিশেষত্বের পরিচায়ক এই আদর্শটি বুঝিবার চেষ্টা করিতেছেন।


ইতিহাসের প্রারম্ভ হইতে কোন প্রচারক হিন্দু আদর্শ প্রচারের জন্য ভারতের বাহিরে যান বা না যান, এখন কিন্তু যাইতেই হইবে; পৃথিবীতে অদ্ভুত পরিবর্তন আসিতেছে। শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, ‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি জগতের কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হইয়া থাকি।’ ধর্মের ইতিহাস গবেষণা করিয়া আবিষ্কৃত হইয়াছে, যে-কোন জাতির ভিতর উত্তম নীতিশাস্ত্র প্রচলিত, সেই-জাতিই উহার কতক অংশ আমাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছে, আর যে-সকল ধর্মে আত্মার অমরত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান পরিস্ফুট, সেগুলিও মুখ্য বা গৌণভাবে আমাদের নিকট হইতেই ঐ ভাব গ্রহণ করিয়াছে।


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দুর্বলের উপর প্রবলের যেরূপ অত্যাচার-দস্যুতা-জুলুম প্রভৃতি হইয়াছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও এরূপ হয় নাই। সকলেই জানেন, বাসনা জয় না করিলে মুক্তি নাই। যে প্রকৃতির দাস, সে কখনও মুক্ত হইতে পারে না। পৃথিবীর সব জাতিই এখন এই মহাসত্য বুঝিয়া উহার আদর করিতে শিখিতেছে। শিষ্য যখন এই সত্য ধারণা করিবার উপযুক্ত হয়, তখনই তাহার উপর গুরুর কৃপা হয়। ভগবান্‌ অনন্ত কাল সকল ধর্মের মানুষের প্রতি প্রভূত দয়া প্রকাশ করিয়া তাহাদের জন্য সাহায্য প্রেরণ করিতেছেন। আমাদের প্রভু সকল ধর্মেরই ঈশ্বর—এই উদার ভাব কেবল ভারতেই বর্তমান। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে এরূপ উদার ভাব দেখাও তো!



বিধির বিধানে আমরা হিন্দুগণ বড় সঙ্কটময় ও দায়িত্বপূর্ণ অবস্থায় পড়িয়াছি। পাশ্চাত্য জাতিগুলি আমাদের নিকট আধ্যাত্মিক সহায়তার জন্য আসিতেছে। ভারতসন্তানগণের এখন কর্তব্য—সমগ্র পৃথিবীকে মানব-জীবনের সমস্যাগুলির প্রকৃষ্ট সমাধান শিক্ষা দিবার জন্য নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়িয়া তোলা। ভারতবাসীরা সমগ্র পৃথিবীকে ধর্ম শিখাইতে ন্যায়তঃ বাধ্য। এক একটি বিষয় আমরা গৌরবের সহিত স্মরণ করিতে পারি। অন্যান্য দেশের শ্রেষ্ঠ ও বড় লোকেরা পার্বত্যদুর্গনিবাসী, পথিকের সর্বলুণ্ঠনকারী দস্যু ব্যারনগণ হইতে তাঁহাদের বংশাবলীর উৎপত্তি হইয়াছে—এইরূপ দেখাইতে পারিলে বড় আনন্দ ও গৌরব অনুভব করেন; আমরা হিন্দুগণ কিন্তু পর্বতগুহানিবাসী ফলমূলাহারী ব্রহ্মধ্যানপরায়ণ মুনিঋষির বংশধর বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিতে গৌরব অনুভব করি। আমরা এখন অবনত ও হীন হইয়া পড়িতে পারি, কিন্তু যদি আমাদের ধর্মের জন্য আমরা প্রাণ পণ করি, তবে আবার আমরা মহৎ পদবীতে উন্নীত হইতে পারিব।


আপনারা আমাকে যে আন্তরিকতার সহিত অভ্যর্থনা করিয়াছেন, সেজন্য আমার হৃদয়ের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। রামনাদের রাজা আমার প্রতি যে-ভালবাসা দেখাইয়াছেন, সেজন্য তাঁহার নিকট আমি যে কত কৃতজ্ঞ, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে অক্ষম। যদি আমাদ্বারা কিছু সৎকার্য হইয়া থাকে, তবে তাহার প্রত্যেকটির জন্য ভারত এই মহানুভব রাজার নিকট ঋণী; কারণ আমাকে চিকাগোয় পাঠাইবার কল্পনা তাঁহার মনেই প্রথম উদিত হয়, তিনিই আমার মাথায় ঐ ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং উহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য আমাকে বার বার উৎসাহিত করেন। তিনি এখন আমার পাশে দাঁড়াইয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ উৎসাহে আরও অধিক কাজের আশা করিতেছেন। যদি তাঁহার মত আরও কয়েকজন রাজা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণে আগ্রহান্বিত হইয়া ইহার আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করেন, তবে বড়ই ভাল হয়।


০৪. রামেশ্বর-মন্দিরে বক্তৃতা

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৪. রামেশ্বর-মন্দিরে বক্তৃতা

[মহাসমারোহে পাম্বান হইতে স্বামীজীকে রামাশ্বরে লইয়া যাওয়া হয়; সেখানে তিনি একদিন রামেশ্বর-মন্দির দর্শন করিলেন। অবশেষে তাঁহাকে সমবেত জনগণের সমক্ষে বক্তৃতা দিতে বলা হইল। স্বামীজী ইংরেজীতে বক্তৃতা দিলেন, নাগলিঙ্গম্ মহাশয় তামিল ভাষায় অনুবাদ করিয়া শ্রোতৃবর্গকে বুঝাইতে লাগিলেন।]


ধর্ম অনুরাগে,—বাহ্য অনুষ্ঠানে নহে। হৃদয়ের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম। যদি দেহ-মন শুদ্ধ না হয়, তবে মন্দিরে গিয়া শিবপূজা করা বৃথা। যাহাদের দেহ-মন পবিত্র, শিব তাহাদেরই প্রার্থনা শুনেন। আর যাহারা অশুদ্ধচিত্ত হইয়াও অপরকে ধর্মশিক্ষা দিতে যায়, তাহারা অসদ্গতি প্রাপ্ত হয়। বাহ্য পূজা মানস পূজার বহিরঙ্গমাত্র—মানস পূজা ও চিত্তশুদ্ধিই আসল জিনিষ। এইগুলি না থাকিলে বাহ্য পূজায় কোন ফললাভ হয় না। এই কলিযুগে লোকে এত হীনস্বভাব হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহারা মনে করে—তাহারা যাহা খুশি করুক না কেন, তীর্থস্থানে গমন করিবামাত্র তাহাদের পাপ ক্ষয় হইয়া যাইবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যদি কেহ অপবিত্রভাবে কোন তীর্থে গমন করে, তবে সেখানে অপরাপর ব্যক্তির যত পাপ, সব তাহার ঘাড়ে আসিয়া পড়ে—তখন তাহাকে আরও গুরুতর পাপের বোঝা লইয়া গৃহে ফিরিতে হয়। তীর্থে সাধুগণ বাস করেন, সেখানে পবিত্রভাবোদ্দীপক অন্যান্য বস্তুও থাকে। কিন্তু যদি কোন স্থানে কেবল কতকগুলি সাধু ব্যক্তি বাস করেন, অথচ সেখানে একটিও মন্দির না থাকে, তবে সেই স্থানকেই তীর্থ বলিতে হইবে। যদি কোন স্থানে শত শত মন্দির থাকে, অথচ যদি সেখানে অনেক অসাধু লোক বাস করে, তবে সেই স্থানের আর তীর্থত্ব থাকে না। আবার তীর্থে বাস করাও বড় কঠিন ব্যাপার; কারণ অন্য স্থানের পাপ তীর্থে খণ্ডিত হয়, কিন্তু তীর্থে কৃত পাপ কিছুতেই দূরীভূত হয় না। সকল উপাসনার সার—শুদ্ধচিত্ত হওয়া ও অপরের কল্যাণ সাধন করা। দরিদ্র, দুর্বল, রোগী—সকলেরই মধ্যে যিনি শিব দর্শন করেন, তিনিই যথার্থ শিবের উপাসনা করেন। আর যে-ব্যক্তি কেবল প্রতিমার মধ্যে শিবের উপাসনা করে, সে প্রবর্তক মাত্র। যে-ব্যক্তি কেবল মন্দিরেই শিব দর্শন করে, সে ব্যক্তি অপেক্ষা যে জাতি- ধর্মনির্বিশেষে একটি মাত্র দরিদ্রকেও শিববোধে সেবা করে, তাহার প্রতি শিব অধিকতর প্রসন্ন হন।


কোন ধনী ব্যক্তির একটি বাগান ছিল এবং দুইটি মালী ছিল। তাহাদের মধ্যে একজন খুব অলস, সে কোন কাজ করিত না; কিন্তু প্রভু আসিবামাত্র করজোড়ে ‘প্রভুর কিবা রূপ, কিবা গুণ!’ বলিয়া তাঁহার সম্মুখে নৃত্য করিত। অপর মালীটি বেশী কথা জানিত না—সে খুব পরিশ্রম করিয়া প্রভুর বাগানে সকল প্রকার ফল ও শাক-সবজি উৎপন্ন করিত ও সেইগুলি মাথায় করিয়া অনেক দূরে প্রভুর বাটীতে লইয়া যাইত। বল দেখি, এই দুই জন মালীর মধ্যে প্রভু কাহাকে অধিকতর ভালবাসিবেন? এইরূপে শিব আমাদের সকলের প্রভু, জগৎ তাঁহার উদ্যানস্বরূপ, আর এখানে দুই প্রকার মালী আছে। এক প্রকার মালী অলস কপট, কিছুই করিবে না, কেবল শিবের রূপের—তাঁহার চোখ নাক ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা করিবে; আর এক প্রকার মালী আছেন, যাঁহারা শিবের দরিদ্র দুর্বল সন্তানগণের জন্য, তাঁহার সৃষ্ট সকল প্রাণীর কল্যাণের জন্য চেষ্টা করেন। এই দ্বিবিধ প্রকৃতি-বিশিষ্ট ভক্তের মধ্যে কে শিবের প্রিয়তর হইবে? নিশ্চয়ই যিনি শিবের সন্তানগণের সেবা করেন। যিনি পিতার সেবা করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাকে আগে তাঁহার সন্তানগণের সেবা করিতে হইবে। যিনি শিবের সেবা করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাকে শিবের সন্তানগণের সেবা সর্বাগ্রে করিতে হইবে—জগতের জীবগণের সেবা আগে করিতে হইবে। শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে, যাঁহারা ভগবানের দাসগণের সেবা করেন, তাঁহারাই ভগবানের শ্রেষ্ঠ দাস। অতএব এইটি সর্বদা স্মরণ রাখিবে।



পুনরায় বলিতেছি, তোমাদিগকে শুদ্ধচিত্ত হইতে হইবে, এবং যে-কেহ তোমাদের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হয়, যথাসাধ্য তাহার সেবা করিতে হইবে। এইভাবে পরের সেবা করা শুভ কর্ম। এই সৎকর্মবলে চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং সকলের ভিতরে যে শিব রহিয়াছেন, তিনি প্রকাশিত হন। তিনি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করিতেছেন। যদি দর্পণের উপর ধূলি ও ময়লা থাকে, তবে তাহাতে আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই না। আমাদের হৃদয়- দর্পণেও এইরূপ অজ্ঞান ও অসৎ-ভাবের মলিনতা রহিয়াছে। সবচেয়ে বড় পাপ স্বার্থপরতা—আগে নিজের ভাবনা ভাবা। যে মনে করে—আমি আগে খাইব, আমি অপরের চেয়ে অধিক ঐশ্বর্যশালী হইব, আমি সর্বসম্পদের অধিকারী হইব; যে মনে করে—আমি অপরের আগে স্বর্গে যাইব, আমি অপরের আগে মুক্তিলাভ করিব, সেই ব্যক্তিই স্বার্থপর। স্বার্থশূন্য ব্যক্তি বলেন, আমার পালা সকলের শেষে; আমি স্বর্গে যাইতে চাই না—যদি আমার ভাতৃবর্গকে সাহায্য করিবার জন্য নরকে যাইতে হয়, তাহাতেও প্রস্তুত আছি। কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক—পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে-ই অধিক ধার্মিক, সে-ই শিবের সামীপ্য লাভ করে; সে পণ্ডিতই হউক, মূর্খই হউক, শিবের বিষয় কিছু জানুক বা না জানুক, সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থাকে, সে যদি চিতাবাঘের মত সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত।


০৫. রামনাদ অভিনন্দনের উত্তর

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৫. রামনাদ অভিনন্দনের উত্তর

সুদীর্ঘ রজনী প্রভাতপ্রায়া বোধ হইতেছে। মহাদুঃখ অবসানপ্রায় প্রতীত হইতেছে। মহানিদ্রায় নিদ্রিত শব যেন জাগ্রত হইতেছে। ইতিহাসের কথা দূরে থাকুক, কিংবদন্তী পর্যন্ত সে সুদূর অতীতের ঘনান্ধকার ভেদ করিতে অসমর্থ, সেখান হইতে এক অপূর্ব বাণী যেন শ্রুতিগোচর হইতেছে। জ্ঞান-ভক্তি-কর্মের অনন্ত হিমালয়স্বরূপ আমাদের মাতৃভূমি ভারতের প্রতিশৃঙ্গে প্রতিধ্বনিত হইয়া যেন ঐ বাণী মৃদু অথচ দৃঢ় অভ্রান্ত ভাষায় কোন্‌ অপূর্ব রাজ্যের সংবাদ বহন করিয়া আনিতেছে। যতই দিন যাইতেছে, ততই যেন উহা স্পষ্টতর, গভীরতর হইতেছে। যেন হিমালয়ের প্রাণপ্রদ বায়ুস্পর্শে মৃতদেহের শিথিলপ্রায় অস্থিমাংসে পর্যন্ত প্রাণসঞ্চার হইতেছে—নিদ্রিত শব জাগিয়া উঠিতেছে, তাহার জড়তা ক্রমশঃ দূর হইতেছে। অন্ধ যে, সে দেখিতেছে না; বিকৃতমস্তিষ্ক যে, সে বুঝিতেছে না—আমাদের এই মাতৃভূমি গভীর নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া জাগ্রত হইতেছেন। আর কেহই এখন ইঁহার গতিরোধে সমর্থ নহে, ইনি আর নিদ্রিত হইবেন না—কোন বহিঃশক্তিই এখন আর ইঁহাকে দমন করিয়া রাখিতে পারিবে না, যেন কুম্ভকর্ণের দীর্ঘনিদ্রা ভাঙিতেছে।


হে রাজন, হে রামনাদবাসী ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা যে দয়া প্রকাশ করিয়া হৃদয়ের সহিত আমাকে অভিনন্দন প্রদান করিয়াছেন, সেজন্য আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনারা আমার প্রতি যে আন্তরিক ভালবাসা প্রকাশ করিতেছেন, তাহা আমি প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছি। কারণ মুখের ভাষা অপেক্ষা হৃদয়ে হৃদয়ে ভাববিনিময় অতি অপূর্ব—আত্মা নীরবে অথচ অভ্রান্ত ভাষায় অপর আত্মার সহিত আলাপ করেন, তাই আমি আপনাদের ভাব প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছি। হে রামনাদাধিপ, আমাদের ধর্ম ও মাতৃভূমির জন্য যদি এই দীন ব্যক্তি-দ্বারা পাশ্চাত্যদেশে যদি কোন কার্য নিষ্পন্ন হইয়া থাকে, যদি নিজ গৃহেই অজ্ঞাত ও গুপ্তভাবে রক্ষিত অমূল্য রত্নরাজির প্রতি আমাদের স্বদেশবাসীর চিত্ত আকৃষ্ট করিবার জন্য কোন কার্য কৃত হইয়া থাকে, যদি তাহারা অজ্ঞতাবশে তৃষ্ণার তাড়নায় প্রাণত্যাগ না করিয়া বা অপর স্থানের মলিন পয়ঃপ্রণালীর জলপান না করিয়া তাহাদের গৃহের নিকটবর্তী অফুরন্ত নির্ঝরের নির্মল জল পান করিতে আহূত হইয়া থাকে, যদি আমাদের স্বদেশবাসীকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে কর্মপরায়ণ করিবার জন্য—রাজনীতিক উন্নতি, সমাজসংস্কার বা কুবেরের ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও ধর্মই যে ভারতের প্রাণ, ধর্ম লুপ্ত হইলে যে ভারতও মরিয়া যাইবে, ইহা বুঝাইবার জন্য যদি কিছু করা হইয়া থাকে, হে রামনাদাধিপ, ভারত অথবা ভারতেতর দেশে আমাদ্বারা কৃত কার্যের জন্য প্রশংসার ভাগী আপনি। কারণ, আপনিই আমার মাথায় প্রথম এই ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং আপনিই পুনঃপুনঃ আমাকে কার্যে উত্তেজিত করেন। আপনি যেন অন্তর্দৃষ্টিবলে ভবিষ্যৎ জানিতে পারিয়া আমাকে বরাবর সাহায্য করিয়া আসিয়াছেন, কখনই উৎসাহদানে বিরত হন নাই। অতএব আপনি যে আমার সফলতায় প্রথম আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন এবং আমি যে দেশে ফিরিয়া আপনার রাজ্যেই ভারতের মৃত্তিকা প্রথম স্পর্শ করিলাম, ইহা ঠিকই হইয়াছে।



হে ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের রাজা পূর্বেই বলিয়াছেন—আমাদিগকে বড় বড় কাজ করিতে হইবে, অদ্ভুত শক্তির বিকাশ দেখাইতে হইবে, অপর জাতিকে অনেক বিষয় শিখাইতে হইবে। দর্শন ধর্ম বা নীতিবিজ্ঞানই বলুন, অথবা মধুরতা কোমলতা বা মানবজাতির প্রতি অকপট প্রীতিরূপ স‍‍‍‍‍‍‍‍‍দ‍্গুণরাজিই বলুন, আমাদের মাতৃভূমি এই সব- কিছুরই প্রসূতি। এখনও ভারতে এইগুলি বিদ্যমান, আর পৃথিবী সম্বন্ধে যতটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমি এখন দৃঢ়ভাবে সাহসের সহিত বলিতে পারি, এখনও ভারত এই-সব বিষয়ে পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।


এই আশ্চর্য ব্যাপারটি লক্ষ্য করিয়া দেখুন। গত চার-পাঁচ বৎসর ধরিয়া পৃথিবীতে অনেক গুরুতর রাজনীতিক পরিবর্তন ঘটিতেছে। পাশ্চাত্যদেশের সর্বত্রই বড় বড় সম্প্রদায় উঠিয়া বিভিন্ন দেশের প্রচলিত নিয়মপদ্ধতিগুলি একেবারে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিবার চেষ্টায় কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইতেছে; আমাদের দেশের লোককে জিজ্ঞাসা করুন, তাহারা এই- সকল কথা কিছু শুনিয়াছে কিনা। কিছুই শুনে নাই। কিন্তু চিকাগোয় ধর্মমহাসভা বসিয়াছিল, ভারত হইতে একজন সন্ন্যাসী প্রেরিত হইয়া সেখানে সাদরে গৃহীত হন এবং সেই অবধি পাশ্চাত্যদেশে কার্য করিতেছিলেন—এখানকার অতি দরিদ্র ভিক্ষুকও তাহা জানে। লোকে বলিয়া থাকে, আমাদের দেশের সাধারণ লোক বড় স্থূলবুদ্ধি, তাহারা দুনিয়ার কোন প্রকার সংবাদ রাখে না, রাখিতে চাহেও না। পূর্বে আমারও ঐ-প্রকার মতের দিকে একটা ঝোঁক ছিল; কিন্তু এখন বুঝিতেছি, কাল্পনিক গবেষণা অথবা ক্ষিপ্রগতিতে দেশ-দর্শক ও ভূ-পর্যটকগণের লিখিত পুস্তক-পাঠ অপেক্ষা অভিজ্ঞতা অনেক বেশী শিক্ষাপ্রদ।



আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে আমি এই জ্ঞানলাভ করিয়াছি যে, আমাদের দেশের সাধারণ লোক নির্বোধও নহে বা তাহারা যে জগতের সংবাদ জানিতে কম ব্যাকুল, তাহাও নহে; পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোক যেমন সংবাদ-সংগ্রহে আগ্রহশীল, ইহারাও সেইরূপ। তবে প্রত্যেক জাতিরই জীবনের এক-একটি উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেক জাতিই প্রাকৃতিক নিয়মে কতকগুলি বিশেষত্ব লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সকল জাতি মিলিয়া যেন এক মহা ঐকতান বাদ্যের সৃষ্টি করিয়াছে—প্রত্যেক জাতিই যেন উহাতে এক-একটি পৃথক্‌ পৃথক্‌ সুর সংযোজন করিতেছে। উহাই তাহার জীবনীশক্তি। উহাই তাহার জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড, মূলভিত্তি। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমির মূলভিত্তি, মেরুদণ্ড বা জীবনকেন্দ্র—একমাত্র ধর্ম। অপরে রাজনীতির কথা বলুক, বাণিজ্য-বলে অগাধ ধনরাশি উপার্জনের গৌরব, বাণিজ্যনীতির শক্তি ও উহার প্রচার, বাহ্য স্বাধীনতালাভের অপূর্ব সুখের কথা বলুক। হিন্দু এই-সকল বুঝে না, বুঝিতে চাহেও না। তাহার সহিত ধর্ম, ঈশ্বর, আত্মা, মুক্তি-সম্বন্ধে কথা বলুন। আমি আপনাদিগকে নিশ্চয়ই বলিতেছি, অন্যান্য দেশের অনেক তথাকথিত দার্শনিক অপেক্ষা আমাদের দেশের সামান্য কৃষকের পর্যন্ত এই-সকল তত্ত্বসম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞান আছে। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদিগকে বলিয়াছি, এখনও আমাদের জগৎকে শিখাইবার কিছু আছে। এই জন্যই শত শত বর্ষের অত্যাচার এবং প্রায় সহস্র বর্ষের বৈদেশিক শাসনের পীড়নেও এই জাতি এখনও জীবিত রহিয়াছে। এই জাতি এখনও জীবিত, কারণ এখনও এই জাতি ঈশ্বর ও ধর্মরূপ মহারত্নকে পরিত্যাগ করে নাই।



আমাদের এই মাতৃভূমিতে এখনও ধর্ম ও অধ্যাত্মবিদ্যা-রূপ যে নির্ঝরিণী বহিতেছে, এখনও তাহা হইতে মহাবন্যা প্রবাহিত হইয়া সমগ্র পৃথিবীকে ভাসাইবে এবং রাজনীতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রতিদিন নূতন ভাবে সমাজগঠনের চেষ্টায় প্রায় অর্ধমৃত হীনদশাগ্রস্ত পাশ্চাত্য ও অন্যান্য জাতিকে নূতন জীবন প্রদান করিবে। নানাবিধ মত-মতান্তরের বিভিন্ন সুরে ভারত-গগন প্রতিধ্বনিত হইতেছে সত্য, কোন সুর ঠিক তালে-মানে বাজিতেছে, কোনটি বা বেতালা; কিন্তু বেশ বুঝা যাইতেছে, উহাদের মধ্যে একটি প্রধান সুর যেন ভৈরবরাগে সপ্তমে উঠিয়া অপরগুলিকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে। ত্যাগের ভৈরবরাগের নিকট অন্যান্য রাগরাগিণী যেন লজ্জায় মুখ লুকাইয়াছে। ‘বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ’—ভারতীয় সকল শাস্ত্রেরই এই কথা, ইহাই সকল শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব। দুনিয়া দুদিনের একটা মায়ামাত্র। জীবন তো ক্ষণিক। ইহার পশ্চাতে, দূরে—অতি দূরে সেই অনন্ত অপার রাজ্য; যাও, সেখানে চলিয়া যাও। এ রাজ্য মহাবীর মনীষিগণের হৃদয়জ্যোতিতে উদ্ভাসিত; তাঁহারা এই তথাকথিত অনন্ত জগৎকেও একটি ক্ষুদ্র মৃত্তিকাস্তূপ-মাত্র জ্ঞান করেন; তাঁহারা ক্রমশঃ সে রাজ্য ছাড়াইয়া আরও দূরে—দূরতম রাজ্যে চলিয়া যান। কালের—অনন্ত কালেরও অস্তিত্ব সেখানে নাই; তাঁহারা কালের সীমা ছাড়াইয়া দূরে—অতি দূরে চলিয়া যান। তাঁহাদের পক্ষে দেশেরও অস্তিত্ব নাই—তাঁহারা তাহারও পারে যাইতে চান। ইহাই ধর্মের গূঢ়তম রহস্য। প্রকৃতিকে এইরূপে অতিক্রম করিবার চেষ্টা, যেরূপেই হউক—যতই ক্ষতিস্বীকার করিয়া হউক—সাহস করিয়া প্রকৃতির অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করিয়া অন্ততঃ একবারও চকিতের মত সেই দেশ-কালাতীত সত্তার দর্শনচেষ্টাই আমাদের জাতির বৈশিষ্ট্য। তোমরা যদি আমাদের জাতিকে উৎসাহ-উদ্দীপনায় মাতাইতে চাও—তাহাদিগকে এই রাজ্যের কোন সংবাদ দাও, তাহারা মাতিয়া উঠিবে। তোমরা তাহাদের নিকট রাজনীতি, সমাজসংস্কার, ধনসঞ্চয়ের উপায়, বাণিজ্যনীতি প্রভৃতি যাহাই বল না, তাহারা এক কান দিয়া শুনিবে, অপর কান দিয়া সে-সব বাহির হইয়া যাইবে। অতএব পৃথিবীকে তোমাদের ধর্মের শিক্ষাই দিতে হইবে।



এখন প্রশ্ন এই—পৃথিবীর নিকট আমাদের কিছু শিখিবার আছে কি? সম্ববতঃ অপর জাতির নিকট হইতে আমাদিগকে কিছু বহির্বিজ্ঞান শিক্ষা করিতে হইবে; কি-রূপে সঙ্ঘ গঠন করিয়া পরিচালন করিতে হয়, বিভিন্ন শক্তিকে প্রণালীবদ্ধভাবে কাজে লাগাইয়া কিরূপে অল্প চেষ্টায় অধিক ফললাভ করিতে হয়, তাহাও শিখিতে হইবে। ত্যাগ আমাদের সকলের লক্ষ্য হইলেও দেশের সকল লোক যতদিন না সম্পূর্ণ ত্যাগ-স্বীকারে সমর্থ হইতেছে, ততদিন সম্ভবতঃ পাশ্চাত্যের নিকট পূর্বোক্ত বিষয়গুলি কিছু কিছু শিখিতে হইবে। কিন্তু মনে রাখা উচিত—ত্যাগই আমাদের সকলের আদর্শ। যদি কেহ ভারতে ভোগসুখকেই পরম-পুরুষার্থ বলিয়া প্রচার করে, যদি কেহ জড়-জগৎকেই ঈশ্বর বলিয়া প্রচার করে, তবে সে মিথ্যাবাদী। এই পবিত্র ভারতভূমিতে তাহার স্থান নাই—ভারতের লোক তাহার কথা শুনিতে চায় না। পাশ্চাত্য সভ্যতার যতই চাকচিক্য ও ঔজ্জ্বল্য থাকুক না কেন, উহা যতই অদ্ভুত ব্যাপার- সমূহ প্রদর্শন করুক না কেন, এই সভায় দাঁড়াইয়া আমি তাহাদিগকে মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, ও-সব মিথ্যা, ভ্রান্তি—ভ্রান্তিমাত্র। ঈশ্বরই একমাত্র সত্য, আত্মাই একমাত্র সত্য, ধর্মই একমাত্র সত্য। ঐ সত্য ধরিয়া থাক।


তথাপি আমাদের যে-সব ভ্রাতারা এখনও উচ্চতম সত্যের অধিকারী হয় নাই, তাহাদের পক্ষে হয়তো এক প্রকার জড়বাদ কল্যাণের কারণ হইতে পারে—অবশ্য উহাকে আমাদের প্রয়োজনের উপযোগী করিয়া লইতে হইবে। সকল দেশেই, সকল সমাজেই একটি বিষম ভ্রম চলিয়া আসিতেছে। আর বিশেষ দুঃখের বিষয় এই—যে-ভারতে পূর্বে এই ভ্রম কখনও হয় নাই, কিছুদিন যাবৎ সেখানেও এই ভ্রান্তি প্রবেশ করিয়াছে। সেই ভ্রম এইঃ অধিকারী বিচার না করিয়া সকলের জন্য একই ধরনের ব্যবস্থা-দান। প্রকৃতপক্ষে সকলের পথ এক নহে। তুমি যে সাধন-প্রণালী অবলম্বন করিয়াছ, আমার সেই একই প্রণালী নাও হইতে পারে। তোমরা সকলে জান, সন্ন্যাস-আশ্রমই হিন্দুজীবনের চরম লক্ষ্য। আমাদের শাস্ত্র সকলকেই সন্ন্যাসী হইতে আদেশ করিতেছেন। সংসারের সুখসমুদয় ভোগ করিয়া প্রত্যেক হিন্দুকেই জীবনের শেষভাগে সংসার ত্যাগ করিতে হইবে। যে তাহা না করে, সে হিন্দু নহে; তাহার নিজেকে হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিবার অধিকার নাই, সে শাস্ত্র অমান্য করে। যখন ভোগের দ্বারা প্রাণে প্রাণে বুঝিবে যে, সংসার অসার—তখন তোমাকে সংসার ত্যাগ করিতে হইবে। আমরা জানি—ইহাই হিন্দুর আদর্শ। যখন পরীক্ষা করিয়া বুঝিবে, সংসার-রূপ ফলের ভিতরটা ভুয়া—আমড়ার মত উহার ‘আঁটি ও চামড়া’ই সার, তখন সংসার ত্যাগ করিয়া যেখান হইতে আসিয়াছ, সেখানে ফিরিবার চেষ্টা কর। মন যেন চক্রগতিতে সম্মুখে ইন্দ্রিয়ের দিকে ধাবমান হইতেছে—উহাকে আবার ফিরিয়া পশ্চাতে আসিতে হইবে। প্রবৃত্তিমার্গ ত্যাগ করিয়া নিবৃত্তিমার্গের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে—ইহাই আদর্শ। কিন্তু কিছু পরিমাণ অভিজ্ঞতা হইলে তবে এই আদর্শ ধরিতে পারা যায়। শিশুকে ত্যাগের তত্ত্ব শেখানো যায় না। সে জন্মাবধি আশার স্বপ্ন দেখিতেছে। ইন্দ্রিয়েই তাহার জীবনের অনুভূতি, তাহার জীবন কতকগুলি ইন্দ্রিয়সুখের সমষ্টিমাত্র। প্রত্যেক সমাজে শিশুর মত অবোধ মানুষ আছে। সংসারের অসারতা বুঝিতে হইলে প্রথমে তাহাদিগকে কিছু সুখভোগের অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে হইবে—তবেই তাহারা বৈরাগ্যলাভে সমর্থ হইবে। আমাদের শাস্ত্রে ইহার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রহিয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরবর্তী কালে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে সন্ন্যাসীদের নিয়মে বাঁধিবার একটা বিশেষ ঝোঁক দেখা গিয়াছে। ইহা মহা ভুল। ভারতে যে দুঃখদারিদ্র্য দেখা যাইতেছে, তাহা অনেকটা এই কারণেই হইয়াছে। দরিদ্র ব্যক্তিকে নানাবিধ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নিয়মে বাঁধা হইয়াছে; তাহার পক্ষে এইগুলির কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। তাহার কাজের উপর হস্তক্ষেপ না করিয়া হাত গুটাইয়া লও দেখি। বেচারা একটু সুখভোগ করিয়া লউক। দেখিবে—সে ক্রমশঃ উন্নত হইবে, ক্রমশঃ তাহার মধ্যে ত্যাগের ভাব আপনা-আপনি আসিবে।



হে ভদ্রমহোদয়গণ, ভোগের ব্যাপারে কিরূপে সফলতা লাভ করা যায়, আমরা পাশ্চাত্য জাতির নিকট সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ শিখিতে পারি। কিন্তু অতি সাবধানে এই শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। অত্যন্ত দুঃখের সহিত আমাকে বলিতে হইতেছে, আজকাল আমরা পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত যে-সকল ব্যক্তি দেখিতে পাই, তাহাদের প্রায় কাহারও জীবন বড় আশাপ্রদ নহে। এখন আমাদের একদিকে প্রাচীন হিন্দু-সমাজ, অপর দিকে আধুনিক ইওরোপীয় সভ্যতা। এই দুইটির মধ্যে আমি প্রাচীন হিন্দু-সমাজকেই বাছিয়া লইব। কারণ সেকেলে হিন্দু অজ্ঞ হইলেও, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হইলেও তাহার একটা বিশ্বাস আছে—সেই জোরে সে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারে; কিন্তু পাশ্চাত্যভাবাপন্ন ব্যক্তি একেবারে মেরুদণ্ডহীন, সে চারিদিক হইতে কতকগুলি এলোমেলো ভাব পাইয়াছে—সেগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য নাই, শৃঙ্খলা নাই; সেগুলিকে সে আপনার করিয়া লইতে পারে নাই, কতকগুলি ভাবের বদহজম হওয়ায় সে সামঞ্জস্যহীন হইয়া পড়িয়াছে। সে নিজের পায়ের উপর দণ্ডায়মান নয়—তাহার মাথা বোঁ বোঁ করিয়া এদিক ওদিক ঘুরিতেছে। সে যাহা কিছু করে, তাহার প্রেরণা-শক্তি কোথায়? ইংরেজ কিসে তাহার পিঠ চাপড়াইয়া দুটা ‘বাহবা’ দিবে, ইহাই তাহার সকল কাজের অভিসন্ধির মূলে! সে যে সমাজসংস্কারে অগ্রসর হয়, সে যে আমাদের কতকগুলি সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করে, তাহার কারণ—ঐ-সকল আচার সাহেবদের মতবিরুদ্ধ! আমাদের কতকগুলি প্রথা দোষাবহ কেন?—কারণ সাহেবরা এইরূপ বলিয়া থাকে! এইরূপ ভাব আমি চাহি না। বরং নিজের যাহা আছে, তাহা লইয়া নিজের শক্তির উপর নির্ভর করিয়া মরিয়া যাও। জগতে যদি কিছু পাপ থাকে, তবে দুর্বলতাই সেই পাপ। সর্বপ্রকার দুর্বলতা ত্যাগ কর— দুর্বলতাই মৃত্যু, দুর্বলতাই পাপ। এই প্রাচীন পন্থাবলম্বী ব্যক্তিগণ ‘মানুষ’ ছিলেন—তাঁহাদের একটা দৃঢ়তা ছিল; কিন্তু এই সামঞ্জস্যহীন ভারসাম্যহীন জীবগণ এখনও কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব লাভ করিতে পারে নাই। তাহাদিগকে কি বলিব—পুরুষ, না স্ত্রী, না পশু? তবে তাহাদের মধ্যেও কয়েকজন আদর্শ-স্থানীয় ব্যক্তি আছেন। তোমাদের রাজা তাহার একটি দৃষ্টান্ত। সমগ্র ভারতে ইঁহার ন্যায় নিষ্ঠাবান্‌ হিন্দু দেখিতে পাইবে না; প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল বিষয়েই বিশেষ সংবাদ রাখেন, এমন রাজা ভারতে আর একটি বাহির করিতে পারিবে না। ইনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় ভাবেরই সামঞ্জস্য বিধান করিয়াছেন—উভয় জাতির যাহা ভাল, তাহাই ইনি গ্রহণ করিয়াছেন। মনু মহারাজ তৎকৃত সংহিতায় বলিয়াছেনঃ



শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি। অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি ||৫


শ্রদ্ধাপূর্বক নীচ ব্যক্তির নিকট হইতেও উত্তম বিদ্যা গ্রহণ করিবে। অতি নীচ জাতির নিকট হইতেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম অর্থাৎ মুক্তিমার্গের উপদেশ লইবে। নীচকূল হইতেও বিবাহের জন্য উত্তমা স্ত্রী গ্রহণ করিবে।


মনু মহারাজ যাহা বলিয়াছেন, তাহা ঠিক কথা। আগে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াও, তারপর সকল জাতির নিকট হইতেই শিক্ষা গ্রহণ কর, যাহা কিছু পার আপনার করিয়া লও; যাহা কিছু তোমার কাজে লাগিবে, তাহা গ্রহণ কর। তবে একটি কথা মনে রাখিও—তোমরা যখন হিন্দু, তখন তোমরা যাহা কিছু শিক্ষা কর না কেন, তাহাই যেন তোমাদের জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্রস্বরূপ ধর্মের নিম্নে স্থান গ্রহণ করে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই জীবনে এক বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। অতীত জন্মের কর্মফলে তাহার জীবনের এই নির্দিষ্ট গতি নিয়মিত হইয়া থাকে। তোমরাও প্রত্যেকে এক বিশেষ ব্রতসাধনের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছ। মহামহিমময় হিন্দুজাতির অনন্ত অতীত জীবনের সমুদয় কর্মসমষ্টি তোমাদের এই জীবনব্রতের নির্দেশক। সাবধান, তোমাদের লক্ষ লক্ষ পিতৃপুরুষ তোমাদের প্রত্যেক কার্য লক্ষ্য করিতেছেন! কি সেই ব্রত, যাহা সাধন করিবার জন্য প্রত্যেক হিন্দুসন্তানের জন্ম? মনু মহারাজ অতি স্পর্ধার সহিত ব্রাহ্মণের জন্মের যে কারণ নির্দেশ করিয়াছেন, তাহা কি তোমরা পড় নাই?—



ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে। ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে ||৬


‘ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে’—ধর্মরূপ ধনভাণ্ডারের রক্ষার জন্য ব্রাহ্মণের জন্ম। আমি বলি, এই পবিত্র ভারতভূমিতে যে-কোন নরনারী জন্মগ্রহণ করে, তাহারই জন্মগ্রহণের কারণ—‘ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে’। অন্যান্য সকল বিষয়কেই আমাদের জীবনের সেই মূল উদ্দেশ্যের অধীন করিতে হইবে। সঙ্গীতে যেমন একটি প্রধান সুর থাকে—অন্যান্য সুরগুলি তাহার অধীন, তাহারই অনুগত হইলে তবে সঙ্গীতে ‘লয়’ ঠিক হইয়া থাকে, এখানেও সেইরূপ করিতে হইবে। এমন জাতি থাকিতে পারে, যাহাদের মূলমন্ত্র রাজনীতিক প্রাধান্য; ধর্ম ও অন্যান্য সমুদয় বিষয় অবশ্যই তাহাদের এই মূল উদ্দেশ্যের নিম্নস্থান অধিকার করিবে। কিন্তু এই আর এক জাতি রহিয়াছে, যাহাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্ম ও বৈরাগ্য; যাহাদের একমাত্র মূলমন্ত্র—এই জগৎ অসার, দুদিনের ভ্রমমাত্র; ধর্ম ব্যতীত আর যাহা কিছু—জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভোগ-ঐশ্বর্য নাম-যশ ধন-দৌলত—সব-কিছুরই স্থান উহার নিম্নে।


তোমাদের রাজার চরিত্রের ইহাই বিশেষত্ব, তিনি তাঁহার পাশ্চাত্য বিদ্যা ধনমান পদমর্যাদা সবই ধর্মের অধীন—ধর্মের সহায়ক করিয়াছেন; এই ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতা হিন্দুজাতির—প্রত্যেক হিন্দুর জন্মগত সংস্কার। সুতরাং পূর্বোক্ত দুই প্রকার লোকের মধ্যে একজন পাশ্চাত্য শিক্ষায় অশিক্ষিত প্রাচীন সম্প্রদায়ভুক্ত, যাহার মধ্যে হিন্দুজাতির জীবনের মূলশক্তিস্বরূপ আধ্যাত্মিকতা বিদ্যমান, যাহার মধ্যে আর কিছু নাই— আর একজন, যে পাশ্চাত্য সভ্যতার কতকগুলি নকল হীরা-জহরত লইয়া বসিয়া আছে, অথচ যাহার ভিতর সেই জীবনপ্রদ শক্তিসঞ্চারী আধ্যাত্মিকতা নাই—এই উভয় সম্প্রদায়ের যদি তুলনা করা যায়, তবে আমার বিশ্বাস—সমবেত শ্রোতৃবর্গ সকলে একমত হইয়া প্রথমোক্ত সম্প্রদায়েরই পক্ষপাতী হইবেন। কারণ এই প্রাচীন সম্প্রদায়ের উন্নতির কতকটা আশা করিতে পারা যায়—তাহার একটা অবলম্বন আছে, জাতীয় মূলমন্ত্র তাহার প্রাণে জাগিতেছে, সুতরাং তাহার বাঁচিবার আশা আছে; শেষোক্ত সম্প্রদায়ের কিন্তু মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী; যেমন ব্যক্তিগত ভাবে বলা চলে—যদি মর্মস্থানে কোন আঘাত না লাগিয়া থাকে, জীবনের গতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে অন্য কোন অঙ্গে যতই আঘাত লাগুক না কেন, তাহাকে সাংঘাতিক বলা হয় না, কারণ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা তাহাদের ক্রিয়া জীবন- ধারণের পক্ষে অত্যাবশ্যক নহে; সেইরূপ মর্মস্থানে আঘাত না লাগিলে আমাদের জাতির বিনাশের কোন আশঙ্কা নাই। সুতরাং এইটি বেশ স্মরণ রাখিবে, তোমরা যদি ধর্ম ছাড়িয়া দিয়া পাশ্চাত্যজাতির জড়বাদ-সর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হও, তোমরা তিন পুরুষ যাইতে না যাইতেই বিনষ্ট হইবে। ধর্ম ছাড়িয়া দিলে হিন্দুর জাতীয় মেরুদণ্ডই ভাঙিয়া যাইবে—যে ভিত্তির উপর সুবিশাল জাতীয় সৌধ নির্মিত হইয়াছিল, তাহাই ভাঙিয়া যাইবে; সুতরাং ফল দাঁড়াইবে—সম্পূর্ণ ধ্বংস।



অতএব হে বন্ধুগণ, ইহাই আমাদের জাতীয় উন্নতির পথ—আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণের নিকট হইতে আমরা যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছি, প্রাণপণে তাহা ধরিয়া থাকাই আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। তোমরা কি এমন দেশের কথা শুনিয়াছ, যে দেশের বড় বড় রাজারা নিজদিগকে প্রাচীন রাজগণের অথবা পুরাতন-দুর্গনিবাসী, পথিকদের সর্বস্বলুণ্ঠনকারী দস্যুব্যারনগণের বংশধর বলিয়া পরিচয় দিবার পরিবর্তে অরণ্যবাসী অর্ধনগ্ন মুনিঋষির বংশধর বলিয়া পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করেন?তোমরা কি এমন দেশের কথা শুনিয়াছ? যদি না শুনিয়া থাক, শোন—আমাদের মাতৃভূমিই সেই দেশ। অন্যান্য দেশে বড় বড় ধর্মাচার্যগণও নিজেদের কোন প্রাচীন রাজার বংশধর বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন, আর এখানে বড় বড় রাজারা নিজেদের কোন প্রাচীন ঋষির বংশধর বলিয়া প্রমাণ করিতে সচেষ্ট। এই কারণেই আমি বলিতেছি, তোমরা ধর্মে বিশ্বাস কর বা নাই কর, যদি জাতীয় জীবনকে অব্যাহত রাখিতে চাও, তবে তোমাদিগকে এই ধর্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হইবে। এক হস্তে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে ধরিয়া অপর হস্ত প্রসারিত করিয়া অন্যান্য জাতির নিকট যাহা শিখিবার, তাহা শিখিয়া লও; কিন্তু মনে রাখিও যে, সেইগুলিকে হিন্দুজীবনের সেই মূল আদর্শের অনুগত রাখিতে হইবে, তবেই ভবিষ্যৎ ভারত অপূর্বমহিমামণ্ডিত হইয়া আবির্ভূত হইবে। আমার দৃঢ় ধারণা—শীঘ্রই সে শুভদিন আসিতেছে; আমার বিশ্বাস—ভারত শীঘ্রই অভূতপূর্ব শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হইবে। প্রাচীন ঋষিগণ অপেক্ষা মহত্তর ঋষিগণের অভ্যুদয় হইবে, আর তোমাদের পূর্বপুরুষগণ তাঁহাদের বংশধরদের এই অপূর্ব অভ্যুদয়ে শুধু যে সন্তুষ্ট হইবেন তাহা নহে, আমি বলিতেছি—নিশ্চয় তাঁহারা পরলোকে নিজ নিজ স্থান হইতে তাঁহাদের বংশধরগণের এরূপ মহিমা, এরূপ মহত্ত্ব দেখিয়া নিজদিগকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করিবেন।



হে ভ্রাতৃবৃন্দ, আমাদের সকলকেই এখন কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে, এখন ঘুমাইবার সময় নয়। আমাদের কার্যকলাপের উপরই ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। ঐ দেখ, ভারতমাতা ধীরে ধীরে নয়ন উন্মীলন করিতেছেন। তিনি কিছুকাল নিদ্রিত ছিলেন মাত্র। উঠ, তাঁহাকে জাগাও—আর নূতন জাগরণে নূতন প্রাণে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গৌরবমণ্ডিতা করিয়া ভক্তিভাবে তাঁহাকে তাঁহার শাশ্বত সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কর।


যিনি শৈবদের শিব, বৈষ্ণবদের বিষ্ণু, কর্মীদের কর্ম, বৌদ্ধদের বুদ্ধ, জৈনদের জিন, ঈশাহী ও য়াহুদীদের য়াভে, মুসলমানদের আল্লা, বৈদান্তিকদের ব্রহ্ম—যিনি সকল ধর্মের সকল সম্প্রদায়ের প্রভু, সেই সর্বব্যাপী পুরুষের সম্পূর্ণ মহিমা কেবল ভারতই জানিয়াছিল, প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব কেবল ভারতই লাভ করিয়াছিল, আর কোন জাতিই প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব লাভ করিতে পারে নাই। তোমরা হয়তো আমার এই কথায় আশ্চর্য হইতেছ, কিন্তু অন্য কোন ধর্মের শাস্ত্র হইতে প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব বাহির কর দেখি। অন্যান্য জাতির এক-একজন জাতীয় ঈশ্বর বা জাতীয় দেবতা—য়াহুদীর ঈশ্বর, আরবের ঈশ্বর ইত্যাদি; আর সেই ঈশ্বর আবার অন্যান্য জাতির ঈশ্বরের সহিত যুদ্ধবিগ্রহে নিযুক্ত। কিন্তু ঈশ্বরের করুণা, তিনি যে পরম দয়াময়, তিনি যে আমাদের পিতা মাতা সখা, প্রাণের প্রাণ, আত্মার অন্তরাত্মা—এই তত্ত্ব কেবল ভারতই জানিত। সেই দয়াময় প্রভু আমাদিগকে আশীর্বাদ করুন, আমাদিগকে সাহায্য করুন, আমাদিগকে শক্তি দিন, যাহাতে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত করিতে পারি।



ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ ||

তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ || ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ|| হরি ওঁ||


আমরা যাহা শ্রবণ করিলাম, তাহা যেন অন্নের মত আমাদের পুষ্টিবিধান করে, উহা আমাদের বলস্বরূপ হউক, উহা দ্বারা আমাদের এমন শক্তি উৎপন্ন হউক যে, আমরা যেন পরস্পরকে সাহায্য করিতে পারি। আমরা—আচার্য ও শিষ্য যেন কখনও পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁ॥


০৬. পরমকুডি অভিনন্দনের উত্তর

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৬. পরমকুডি অভিনন্দনের উত্তর

আপনারা আমাকে যেরূপ যত্নসহকারে আন্তরিক অভ্যর্থনা করিয়াছেন, সেজন্য আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিবার ভাষা আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না। তবে যদি আমাকে অনুমতি করেন তো বলিতে চাই—লোকে আমাকে পরম যত্নের সহিত অভ্যর্থনাই করুক বা অবজ্ঞা করিয়া এখান হইতে তাড়াইয়া দিক, তাহাতে স্বদেশের প্রতি, বিশেষতঃ আমার স্বদেশবাসীর প্রতি ভালবাসার কিছু তারতম্য হইবে না; কারণ আমরা গীতায় পাঠ করিয়াছি যে, কর্ম নিষ্কাম- ভাবে করা উচিত; আমাদের ভালবাসাও নিষ্কাম হওয়া উচিত। পাশ্চাত্যদেশে যে কাজ করিয়াছি, তাহা অতি সামান্যই; এখানে এমন কোন ব্যক্তিই উপস্থিত নাই, যিনি আমা অপেক্ষা শতগুণ অধিক কাজ করিতে না পারিতেন। আমি আগ্রহের সহিত সেই দিনের প্রতীক্ষা করিতেছি, যে-দিন মহামনীষী ধর্মবীরগণ আবির্ভূত হইয়া ভারতের অরণ্যরাজি হইতে সমুত্থিত ও ভারত-ভূমির নিজস্ব সেই আধ্যাত্মিকতা ও ত্যাগের বাণী ভারতের বাহিরে জগতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত প্রচার করিবেন।


মানবজাতির ইতিহাস অধ্যয়ন করিলে দেখা যায়, সময়ে সময়ে সব জাতির মধ্যেই যেন একটা সংসার-বিরক্তির ভাব আসিয়া থাকে। তাহারা দেখে, তাহারা যে-কোন পরিকল্পনা করিতেছে, তাহাই যেন হাত ফসকাইয়া যাইতেছে—প্রাচীন আচার-প্রথাগুলি সব যেন ধূলিসাৎ হইয়া যাইতেছে, সব আশা-ভরসা নষ্ট হইয়া যাইতেছে, সবই যেন শিথিল হইয়া যাইতেছে!


পৃথিবীতে দুই প্রকার বিভিন্ন ভিত্তির উপর সামাজিক জীবন প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা হইয়াছেঃ এক—ধর্মভিত্তির উপর; আর এক—সামাজিক প্রয়োজনের উপর। একটির ভিত্তি— আধ্যাত্মিকতা, অপরটির—জড়বাদ; একটির ভিত্তি—অতীন্দ্রিয়বাদ, অপরটির—প্রত্যক্ষবাদ। একটি এই ক্ষুদ্র জড়জগতের সীমার বাহিরে দৃষ্টিপাত করে এবং এমন কি, অপরটির সহিত কোন সংস্রব না রাখিয়া কেবল আধ্যাত্মিক ভাব লইয়াই জীবন যাপন করিতে সাহসী হয়; অপরটি নিজের চতুষ্পার্শ্বে যাহা দেখিতে পায়, তাহার উপর জীবনের ভিত্তি স্থাপন করিয়াই তৃপ্ত; সে আশা করে, ইহারই উপর সারা জীবন দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করিতে পারিবে।


আশ্চর্যের বিষয়, কখনও কখনও অধ্যাত্মবাদ প্রবল হয়, তারপরই আবার জড়বাদ প্রাধান্য লাভ করে, যেন তরঙ্গের গতিতে একটির পর আর একটি আসিয়া থাকে! এক দেশেই আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায়। এক সময়ে জড়বাদ পূর্ণপ্রতাপে রাজত্ব করিতে থাকে—দেশ ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ হয়; যে-শিক্ষায় অধিক অন্নাগমের উপায় হয়, যাহাতে অধিক সুখলাভের উপায় হয়, তাহারই আদর হইতে থাকে। ক্রমে এই অবস্থা হইতে আবার অবনতি আরম্ভ হয়। সৈভাগ্যসম্পদ হইলেই মানবজাতির অন্তর্নিহিত ঈর্ষাদ্বেষও প্রবল আকার ধারণ করে—পরস্পর প্রতিযোগিতা ও ঘোর নিষ্ঠুরতাই যেন তখন যুগধর্ম হইয়া পড়ে। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’—এই প্রকার স্বার্থপরতাই তখন মূলমন্ত্র হইয়া পড়ে। এই অবস্থা কিছুদিন চলিবার পর মানুষ চিন্তা করিতে থাকে—জীবনের সমগ্র পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত। ধর্ম সহায় না হইলে, জড়বাদের গভীর আবর্তে ক্রমশঃ মজ্জমান পৃথিবীর সাহায্যে ধর্ম অগ্রসর না হইলে, জড়বাদের গভীর আর্বতে ক্রমশঃ মজ্জমান পৃথিবীর সাহায্যে ধর্ম অগ্রসর না হইলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তখন মানুষ নূতন আশায় সঞ্জীবিত হইয়া নব অনুরাগে নূতনভাবে নূতন গৃহ প্রস্তুত করিবার জন্য নূতন ভিত্তির পত্তন করে। তখন ধর্মের আর এক বন্যা আসে। কালে আবার উহারও অবনতি হয়।



প্রকৃতির অব্যর্থ নিয়মে ধর্মের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এমন একদল লোকের অভ্যুদয় হয়, যাহার পার্থিব ব্যাপারে বিশেষ ক্ষমতার একচেটিয়া দাবী করে। ইহার অব্যবহিত ফল—পুনরায় জড়বাদের দিকে প্রতিক্রিয়া। জড়বাদের দিকে গতি একবার আরম্ভ হইলে শত শত বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার একচেটিয়া দাবী আরম্ভ হয়। ক্রমশঃ এমন সময় আসে, যখন সমগ্র জাতির শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষমতাগুলি নয়, সর্বপ্রকার লৌকিক ক্ষমতা ও অধিকারগুলি অল্পসংখ্যক কয়েকটি ব্যক্তির করায়ত্ত হয়। এই অল্পসংখ্যক লোক সর্বসাধারণের ঘাড়ে চড়িয়া তাহাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। তখন সমাজকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হয়। এই সময় জড়বাদ দ্বারাও বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে।


যদি আপনারা আমাদের মাতৃভূমি ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, দেখিবেন—এখানে এখন সেইরূপ ঘটিতেছে। ইওরোপে আপনাদের জাতীয় উত্তরাধিকার ধর্ম প্রচার করিতে একজন গিয়াছিলেন; সেইজন্যই আজ আপনারা এখানে সমবেত হইয়াছেন। ইহা অসম্ভব হইত, যদি না ইওরোপীয় জড়বাদ ইহার পথ করিয়া দিত। সুতরাং এক হিসাবে জড়বাদ যথার্থই ভারতের কিছু কল্যাণ সাধন করিয়াছে, উহা সকলেরই উন্নতির দ্বার খুলিয়া দিয়াছে, উচ্চ বর্ণের একচেটিয়া অধিকার দূর করিয়া দিয়াছে; অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তির নিকট যে- অমূল্য রত্ন গুপ্তভাবে ছিল এবং যাহার ব্যবহার তাহারা নিজেরাও ভুলিয়া গিয়াছিল, জড়বাদ তাহা সর্বসাধারণের নিকট উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে। ঐ অমূল্য রত্নের অর্ধভাগ নষ্ট হইয়া গিয়াছে, অপরার্ধ এমন সব লোকের হাতে আছে, যাহারা গরুর জাবের পাত্রে শয়ান সেই কুকুরের মত—নিজেরাও খাইবে না, অপরকেও খাইতে দিবে না!



অপর দিকে আবার আমরা ভারতে যে-সকল রাজনীতিক অধিকার লাভের চেষ্টা করিতেছি, সেগুলি ইওরোপে যুগ যুগ ধরিয়া রহিয়াছে, শত শতাব্দী ধরিয়া ঐগুলি পরীক্ষিত হইয়াছে; আর সেগুলি যে সামাজিক প্রয়োজন-সাধনে অসমর্থ, তাহাও প্রতিপন্ন হইয়াছে। ইওরোপের রাজনীতিক প্রশাসনিক পদ্ধতিগুলি এক এক করিয়া অনুপযোগী বলিয়া নিন্দিত হইয়াছে, আর এখন ইওরোপ অশান্তি-সাগরে ভাসিতেছে—কি করিবে, কোথায় যাইবে, বুঝিতে পারিতেছে না। ঐহিক ব্যাপারে অত্যাচার প্রচণ্ড হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দেশের সব ধন, সব ক্ষমতা অল্পসংখ্যক কয়েকটি লোকের হাতে; তাহারা নিজেরা কোন কাজ করে না, কিন্তু লক্ষ লক্ষ নরনারী দ্বারা কাজ করাইয়া লইবার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতাবলে তাহারা সমগ্র পৃথিবী রক্তস্রোতে প্লাবিত করিতে পারে। ধর্ম ও অন্যান্য যাহা কিছু, সবই তাহাদের পদতলে। তাহারাই সর্বেসর্বা শাসনকর্তা। পাশ্চাত্য জগৎ মুষ্টিমেয় ‘শাইলক’-এর শাসনে পরিচালিত হইতেছে। আপনারা যে প্রণালীবদ্ধ শাসন, স্বাধীনতা, পার্লামেণ্ট-মহাসভা প্রভৃতির কথা শোনেন—সেগুলি বাজে কথামাত্র। পাশ্চাত্য দেশ শাইলকগণের অত্যাচারে আর্তনাদ করিতেছে; প্রাচ্যদেশ আবার পুরোহিতদের অত্যাচারে কাতরভাবে ক্রন্দন করিতেছে। ধনী ও পুরোহিত পরস্পরকে শাসনে রাখিবে।


মনে করিবেন না, ইহাদের মধ্যে মাত্র একটি দ্বারা জগতের কল্যাণ হইবে। নিরপেক্ষ ঈশ্বর তাঁহার সৃষ্টিতে সকলকেই সমান করিয়াছেন। অতি অধম অসুরপ্রকৃতি মানুষেরও এমন কিছু গুণ আছে, যাহা একজন বড় সাধুর নাই। নগণ্য কীটেরও এমন কিছু গুণ থাকিতে পারে, যাহা হয়তো মহাপুরুষের নাই।



অতি দরিদ্র শ্রমজীবী, যাহার জীবনে ভোগ করিবার কিছু নাই, যাহার তোমার মত বুদ্ধি নাই, যে বেদান্তদর্শনাদি বুঝিতে পারে না—মনে করিতেছ, তাহার শরীর কিন্তু তোমার মত কষ্টে অত কাতর হয় না। দারুণভাবে ক্ষতবিক্ষত হইলে সে তোমা অপেক্ষা শীঘ্র সুস্থ হইয়া উঠিবে। তাহার প্রাণশক্তি ইন্দ্রিয়গত; সেখানেই তাহার সুখভোগ। সুতরাং তাহার জীবনে যেমন একপ্রকার সুখের অভাব, অপর দিকে তেমনি অন্যপ্রকার সুখের আধিক্য। সুতরাং দেখা যাইতেছে—তাহার জীবনেও সামঞ্জস্য রহিয়াছে। সুতরাং ভগবান্ সকলকেই নিরপেক্ষভাবে ইন্দ্রিয়জ, মানসিক বা আধ্যাত্মিক সুখ দিয়াছেন। অতএব মনে করিও না, আমরাই পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা।


আমরা—ভারতবাসীরা অপরকে অনেক বিষয় শিক্ষা দিতে পারি বটে, অপরের নিকট আমরা অনেক বিষয় শিক্ষাও করিতে পারি। আমরা পৃথিবীকে যে-বিষয়ে শিক্ষা দিতে সমর্থ, পৃথিবী তাহার জন্য এখন অপেক্ষা করিতেছে। যদি পাশ্চাত্য সভ্যতা আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর স্থাপিত না হয়, তবে উহা আগামী পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে সমূলে বিনষ্ট হইবে। মানবজাতিকে তরবারি-বলে শাসন করিবার চেষ্টা বৃথা ও অনাবশ্যক। আপনারা দেখিবেন, যে-সকল দেশ হইতে পশুবলে জগৎশাসন করিবার নীতির উদ্ভব, সেই-সকল স্থানেই প্রথমে অবনতি আরম্ভ হয়, সেই-সকল সমাজ শীঘ্রই ধ্বংস হইয়া যায়। জড়শক্তির লীলাভূমি ইওরোপ যদি নিজ সমাজের ভিত্তি পরিবর্তন করিয়া আধ্যাত্মিকতার উপর স্থাপিত না করে, তবে পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যেই ইহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। উপনিষদের ধর্মই ইওরোপকে রক্ষা করিবে।



আমাদের দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন শাস্ত্র ও বিভিন্ন দর্শনের মধ্যে যতই মতভেদ থাকুক—এই-সকল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এমন একটি সাধারণ ভিত্তি আছে, যাহা দ্বারা সমগ্র জগতের ভাবস্রোত পরিবর্তিত হইতে পারে। সেই সাধারণ ভিত্তি—জীবাত্মার সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস। ভারতের সর্বত্র হিন্দু জৈন বৌদ্ধ—সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন, আত্মা সর্বশক্তির আধার। আর তোমরা বেশ জান, ভারতে এমন কোন সম্প্রদায় নাই, যাহারা বিশ্বাস করে যে, শক্তি পবিত্রতা বা পূর্ণতা বাহির হইতে লাভ করিতে হয়। এগুলি আমাদের জন্মগত অধিকার—আমাদের স্বভাবসিদ্ধ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ অপবিত্রতার আবরণে আবৃত রহিয়াছে। প্রকৃত ‘তুমি’ কিন্তু অনাদিকাল হইতেই পূর্ণ অচল অটল সুমেরুবৎ। আত্মসংযমের জন্য বাহিরের সাহায্য কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। পূর্ব হইতেই তুমি আত্মসংযত, শুধু জানা এবং না-জানাতেই অবস্থার তারতম্য, এইজন্য শাস্ত্রে অবিদ্যাকেই সর্বপ্রকার অনিষ্টের মূল বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। ভগবান্‌ ও মানুষে, সাধু ও পাপীতে প্রভেদ কিসে?—কেবল অজ্ঞানে। অজ্ঞানেই প্রভেদ হয়। সর্বোচ্চ মানুষ এবং তোমার পদতলে অতি কষ্টে বিচরণকারী ঐ ক্ষুদ্র কীটের মধ্যে প্রভেদ কিসে?—অজ্ঞানই এই প্রভেদ করিয়াছে। কারণ অতি কষ্টে বিচরণশীল ঐ ক্ষুদ্র কীটের মধ্যে অনন্ত শক্তি, জ্ঞান ও পবিত্রতা—এমন কি সাক্ষাৎ অনন্ত ব্রহ্ম রহিয়াছেন। এখন উহা অব্যক্তভাবে রহিয়াছে—উহাকে ব্যক্ত করিতে হইবে। ভারত জগৎকে এই এক মহাসত্য শিখাইবে, কারণ ইহা আর কোথাও নাই। ইহা আধ্যাত্মিকতা—ইহাই আত্মবিজ্ঞান।



কিসের জোরে মানুষ উঠিয়া দাঁড়ায় ও কাজ করে?—শক্তির জোরে। এই বলবীর্যই ধার্মিকতা, দুর্বলতাই পাপ। যদি উপনিষদে এমন কোন শব্দ থাকে, যাহা বজ্রবেগে অজ্ঞান- রাশির উপর পতিত হইয়া উহাকে একেবারে ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া ফেলিতে পারে, তবে তাহা—‘অভীঃ’। যদি জগৎকে কোন ধর্ম শিখাইতে হয়, তবে তাহা এই ‘অভীঃ’। কি ঐহিক, কি আধ্যাত্মিক সকল বিষয়েই ‘অভীঃ’—এই মূলমন্ত্র অবলম্বন করিতে হইবে। কারণ ভয়ই পাপ ও অধঃপতনের নিশ্চিত কারণ। ভয় হইতেই মৃত্যু, ভয় হইতেই সর্বপ্রকার অবনতি আসে। এখন প্রশ্ন—এই ভয়ের উদ্ভব কোথা হইতে? আত্মার স্বরূপজ্ঞানের অভাব হইতেই ভয়ের উদ্ভব। যিনি রাজাধিরাজ, তাঁহার তুমি উত্তরাধিকারী—তুমি সেই ঈশ্বরের অংশ। শুধু তহাই নহে, অদ্বৈত- মতে তুমিই স্বয়ং ব্রহ্ম—তুমি স্বরূপ ভুলিয়া গিয়া নিজেকে ক্ষুদ্র মানুষ ভাবিতেছ। আমরা স্বরূপ হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছি—আমরা ভেদজ্ঞানে অভিনিবিষ্ট হইয়াছি; আমি তোমা অপেক্ষা বড়, তুমি আমা অপেক্ষা বড়—আমরা কেবল এই দ্বন্দ্ব করিতেছি।


‘আত্মায় সকল শক্তি নিহিত’—ভারত জগৎকে এই মহাশিক্ষা দিবে। এই তত্ত্ব হৃদয়ে ধারণ করিলে তোমার নিকট জগৎ আর একভাবে প্রতিভাত হইবে এবং পূর্বে তুমি নরনারী ও প্রাণীকে যে দৃষ্টিতে দেখিতে, তখন তাহাদিগকে অন্য দৃষ্টিতে দেখিবে। তখন এই পৃথিবী আর দ্বন্দ্বক্ষেত্ররূপে প্রতীয়মান হইবে না; তখন আর মনে হইবে না, পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেই এই পৃথিবীতে নরনারীর জন্ম—এখানে বলবান্‌ জয়লাভ করিবে ও দুর্বল মরিবে।তখন বোধ হইবে, এই পৃথিবী আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্র; স্বয়ং ভগবান্‌ শিশুর মত এখানে খেলিতেছেন, আর আমরা তাঁহার খেলার সঙ্গী, তাঁহার কাজের সহায়ক। যতই ভয়ানক, যতই বীভৎস মনে হউক —ইহা খেলামাত্র! আমরা ভ্রান্তিবশতঃ এই ক্রীড়াকে একটা ভয়ানক ব্যাপার মনে করিতেছি। আত্মার স্বরূপ জানিতে পারিলে অতি দুর্বল অধঃপতিত হতভাগ্য পাপীর হৃদয়েও আশার সঞ্চার হয়। শাস্ত্র কেবল বলিতেছেন—নিরাশ হইও না; তুমি যাহাই কর না কেন, তোমার স্বরূপের কখনও পরিবর্তন হয় না; তুমি কখনও তোমার প্রকৃতির পরিবর্তন করিতে পার না, প্রকৃতি কখনও প্রকৃতির বিনাশসাধন করিতে পারে না। তোমার প্রকৃতি শুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া তোমার এই স্বরূপ অব্যক্তভাবে থাকিতে পারে, কিন্তু পরিণামে উহা আপন তেজে ফুটিয়া বাহির হইবে। এই কারণেই অদ্বৈতবাদ সকলের নিকট আশার বাণীই বহন করিয়া আনে, নৈরাশ্যের নয়। বেদান্ত কখনও ভয়ে ধর্ম আচরণ করিতে বলে না। বেদান্ত বলে না যে, শয়তান সর্বদা তোমার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিতেছে; যদি তোমার একবার পদস্খলন হয়, অমনি তোমার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িবে!



বেদান্তে শয়তানের প্রসঙ্গই নাই; বেদান্ত বলেন, তোমার অদৃষ্ট তোমার নিজের হাতে—তোমার কর্মই তোমার এই শরীর গঠন করিয়াছে, অপর কেহ তোমার হইয়া এই শরীর গঠন করে নাই। সেই সর্বব্যাপী ভগবান্‌ তোমার অজ্ঞানবশতঃ অব্যক্ত রহিয়াছেন; আর তুমি যে-সব সুখ-দুঃখ ভোগ করিতেছ, এগুলির জন্য তুমিই দায়ী। ভাবিও না, তোমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তুমি এই ভয়াবহ জগতে আনীত হইয়াছ। তোমাকে জানিতে হইবে—তুমিই ধীরে ধীরে তোমার জগৎ রচনা করিয়াছ এবং এখনও করিতেছ। তুমি নিজেই আহার করিয়া থাক, অপর কেহ তোমার হইয়া আহার করে না। তুমি যাহা খাও, তাহার সারভাগ তুমিই শরীরে শোষণ করিয়া লও—অপর কেহই তোমার হইয়া উহা করে না; তুমিই ঐ খাদ্য হইতে রক্ত-মাংসের দেহ প্রস্তুত করিয়া থাক, অপর কেহ তোমার হইয়া উহা করে না। তুমি বরাবরই ইহা করিতেছ। একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলের এক অংশের গঠনপ্রণালী জানিতে পারিলে সমুদয় শৃঙ্খলটিকেই জানিতে পারা যায়। যদি ইহা সত্য হয় যে, বর্তমানে তুমি নিজ শরীর গঠন করিতেছ, তবে ইহাও সত্য যে, অতীতেও তুমি নিজ শরীর গঠন করিয়াছ, ভবিষ্যতেও করিবে। আর ভাল-মন্দ সব-কিছুরই দায়িত্ব তোমার। ইহা বড়ই আশার কথা যে, আমি যাহা করিয়াছি, আমিই তাহা নষ্ট করিতে পারি।


যদিও আমাদের শাস্ত্রে এই কঠোর কর্মবাদ রহিয়াছে, তথাপি আমাদের ধর্ম ভগবৎকৃপা অস্বীকার করেন না। আমাদের শাস্ত্র বলেন, শুভাশুভরূপ এই ঘোর সংসার- প্রবাহের পরপারে ভগবান্‌ রহিয়াছেন। তিনি বন্ধনশূন্য নিত্যকৃপাময়, সর্বদাই জগতের ত্রিতাপে অভিভূত নরনারীকে সংসার-সাগরের পারে লইয়া যাইবার জন্য বাহু প্রসারিত করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার কৃপার সীমা নাই; আর রামানুজ বলেন, বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তির নিকটেই এই কৃপা আবির্ভূত হয়।



আত্মবিজ্ঞান-প্রদত্ত সমাজ-জীবনের আধ্যাত্মিক ভিত্তিই ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে নূতন সমাজের ভিত্তিস্বরূপ হইবে। যদি আমার সময় থাকিত, তবে আমি দেখাইতে পারিতাম— অদ্বৈতবাদের কতকগুলি সিদ্ধান্ত হইতে পাশ্চাত্যদেশ এখনও কিরূপ শিক্ষা পাইতে পারে। কারণ এই জড়বিজ্ঞানের দিনে সগুণ ঈশ্বর, দ্বৈতবাদ—এই-সকলের বড় একটা মূল্য নাই। তবে যদি কেহ খুব অমার্জিত অনুন্নত ধর্মপ্রণালীতেও বিশ্বাস করে, আমাদের ধর্মে তাহাদেরও স্থান আছে। যদি কেহ এত মন্দির ও প্রতিমাদি চায়, যাহাতে পৃথিবীর সকল লোকেরই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হইতে পারে, যদি কেহ সগুণ ঈশ্বরকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতে চায়, তবে আমাদের শাস্ত্র তাহাদিগকে বিশেষ সাহায্যই করিবে। বলিতে কি, সগুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রে যে-সকল উচ্চ উচ্চ ভাব ও তত্ত্ব উপদিষ্ট হইয়াছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও সেরূপ দেখিতে পাইবে না। আবার যদি কেহ খুব যুক্তিবাদী হইতে চায়, নিজের তর্কবুদ্ধিকে পরিতৃপ্ত করিতে চায়, তবে আমরা তাহাকেও নির্গুণ ব্রহ্মবাদ-রূপ প্রবল যুক্তিসহ মতবাদ শিক্ষা দিতে পারি।


০৭. মনমাদুরা অভিনন্দনের উত্তর

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৭. মনমাদুরা অভিনন্দনের উত্তর

আপনারা আমাকে যে—আন্তরিকতা অভিনন্দন জানাইয়াছেন, সে জন্য আপনাদের নিকট যে কি গভীর কৃতজ্ঞতা-পাশে বদ্ধ হইয়াছি, তাহা ভষায় প্রকাশ করিতে আমি অক্ষম। দুঃখের বিষয়, প্রবল ইচ্ছাসত্ত্বেও আমার শরীরের অবস্থা এখন এমন নয় যে, আমি দীর্ঘ বক্তৃতা করি। আমাদের সংস্কৃতজ্ঞ বন্ধুটি আমার প্রতি অনুগ্রহপূর্বক সুন্দর সুন্দর বিশেষণ প্রয়োগ করিয়াছে বটে, তথাপি আমার একটা স্থূল-শরীর আছে—হইতে পারে শরীরধারণ বিড়ম্বনা, কিন্তু উপায় নাই। আর স্থূল-শরীর জড়ের নিয়মানুসারেই চালিত হইয়া থাকে, তাহার ক্লান্তি অবসাদ প্রভৃতি সবই হইয়া থাকে।


পাশ্চাত্যদেশে আমার দ্বারা যে সামান্য কাজ হইয়াছে, সেজন্য ভারতের প্রায় সর্বত্র লোকে যেরূপ অপূর্ব আনন্দ ও সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছেন, তাহা দেখিবার জিনিষ মত। তবে আমি ঐ আনন্দ ও সহানুভুতি কেবল এইভাবে গ্রহণ করিতেছিঃ ভবিষ্যতে যে-সব মহাপুরুষ আসিতেছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে ঐগুলি প্রয়োগ করিতে চাই। আমার মনে হয়, আমার দ্বারা যে সামান্য কার্য হইয়াছে, যদি তাহার জন্য সমগ্র জাতি এত অধিক প্রশংসা করে, তবে আমাদের পরে যে-সব বড় বড় দিগ্বিজয়ী ধর্মবীর মহাত্মা আবির্ভূত হইয়া জগতের কল্যাণ সাধন করিবেন, তাঁহারা এই জাতির নিকট হইতে না জানি আরও কত অধিক প্রশংসা ও সম্মান লাভ করিবেন।


ভারত ধর্মভূমি। হিন্দু ধর্ম বুঝে—কেবল ধর্মই বুঝে। শত শত শতাব্দী ধরিয়া হিন্দু কেবল এই শিক্ষাই পাইয়াছে। সেই শিক্ষার ফলও এই হইয়াছে যে, ধর্মই তাহাদের জীবনের একমাত্র ব্রত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আপনারা অনায়াসেই বুঝিতে পারেন যে, ইহা সত্য। সকলেরই দোকানদার বা স্কুলমাস্টার বা যোদ্ধা হইবার কোন প্রয়োজন নাই; এই সামঞ্জস্যপূর্ণ জগতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাব লইয়া এক মহাসামঞ্জস্যের সৃষ্টি করিবে।


সম্ভবতঃ আমরা বিভিন্ন জাতির এই ঐক্যতানে আধ্যাত্মিক সুর বাজাইবার জন্য বিধাতা কর্তৃক নিযুক্ত। আমাদের মহামহিমান্বিত পূর্বপুরুষদের যাঁহাদের বংশধর বলিয়া যে- কোন জাতি গৌরব অনুভব করিতে পারে—তাঁহাদের নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যে মহান্‌ তত্ত্বরাশি পাইয়াছি, সেগুলি যে আমরা এখনও হারাই নাই, ইহা দেখিয়াই আমার আনন্দ হইতেছে। ইহাতে আমাদের জাতির ভাবী উন্নতি সম্বন্ধে আমার আশা—শুধু আশা নয়, দৃঢ় বিশ্বাস হইতেছে। আমার প্রতি কৃত যত্নের জন্যই আমার আনন্দ হয় নাই, আমাদের জাতির হৃদয় যে এখনও অটুট রহিয়াছে, ইহাতেই আমার পরমানন্দ। এখনও এই জাতির হৃদয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নাই। ভারত এখনও বাঁচিয়া আছে; কে বলে সে মরিয়াছে? পাশ্চাত্যেরা আমাদিগকে কর্মকুশল দেখিতে চায়, কিন্তু ধর্ম ব্যতীত অন্য বিষয়ে আমাদের জাতীয় প্রচেষ্টা নাই বলিয়া আমরা তাহাদিগকে তাহাদের মনের মত কর্মকুশলতা দেখাইতে পারি না। যদি কেহ আমাদিগকে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ দেখিতে চায়, সে নিরাশ হইবে; আমরাও যদি আবার কোন যুদ্ধপ্রিয় জাতিকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে সক্রিয় দেখিতে চাই, আমরাও সেইরূপ নিরাশ হইব। পাশ্চাত্যেরা আসিয়া দেখুক, আমরা তাহাদেরই মত কর্মশীল; দেখিয়া যাক, জাতি কিভাবে বাঁচিয়া রহিয়াছে, পূর্বের মতই প্রাণবন্ত রহিয়াছে। আমরা যে অধঃপতিত হইয়াছি—এই ধারণাই দূর করিয়া দাও।



আমাদের জাতীয় জীবনের মূল ভিত্তি যে অক্ষুণ্ণ, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। তথাপি আমাকে এখন গোটাকতক রূঢ় কথা বলিতে হইবে। আশা করি, আপনারা সেগুলি ভালভাবেই গ্রহণ করিবেন। এইমাত্র আপনারা অভিযোগ করিলেন যে, ইওরোপীয় জড়বাদ আমাদিগকে একেবারে মাটি করিয়া ফেলিয়াছে। আমি বলি, দোষ শুধু ইওরোপীয়দের নয়, দোষ প্রধানতঃ আমাদের। আমরা যখন বৈদান্তিক, তখন আমাদিগকে সর্বদাই সকল বিষয় ভিতরের দিক হইতে—আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা যখন বৈদান্তিক, তখন নিশ্চয়ই জানি, যদি আমরা নিজের অনিষ্ট নিজেরা না করি, তবে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই, যাহা আমাদের কোন অনিষ্ট করিতে পারে। ভারতের এক-পঞ্চমাংশ অধিবাসী মুসলমান হইয়াছে। যেমন সুদূর অতীতের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী প্রাচীনকালে বৌদ্ধ হইয়াছিল, সেইরূপ ভারতের এক-পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হইয়াছে। এখনই প্রায় দশ লক্ষের অধিক খ্রীষ্টান হইয়া গিয়াছে।


ইহা কাহার দোষ? আমাদের একজন ঐতিহাসিক চিরস্মরণীয় ভাষায় বলিয়া গিয়াছেন, ‘যখন অফুরন্ত নির্ঝর নিকটেই বহিয়া যাইতেছে, তখন এই দরিদ্র হতভাগ্যগণই বা তৃষ্ণায় মরিবে কেন?’ প্রশ্ন এইঃ ইহাদের জন্য আমরা কি করিয়াছি? কেন তাহারা মুসলমান হইবে না? আমি ইংলণ্ডেও এক সরলা বালিকার সম্বন্ধে শুনিয়াছিলাম, সে অসৎ পথে পদার্পণ করিবার—বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিবার পূর্বে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা তাহাকে উক্ত পথে যাইতে নিষেধ করেন। তাহাতে সেই বালিকা উত্তর দেয়, ‘কেবল এই উপায়েই আমি লোকের সহানুভূতি পাইতে পারি। এখন আমায় কেহই সাহায্য করিবে না; কিন্তু আমি যদি পতিতা হই, তবে সেই দয়াবতী মহিলারা আসিয়া আমাকে তাঁহাদের গৃহে লইয়া যাইবেন, আমার জন্য সব করিবেন, কিন্তু এখন তাঁহারা কিছুই করিবেন না।’ আমরা এখন তাহাদের জন্য কাঁদিতেছি, কিন্তু ইহার পূর্বে আমরা তাহাদের জন্য কি করিয়াছি? আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই নিজ নিজ বুকে হাত রাখিয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করুক দেখি—আমরা কি করিয়াছি; আর নিজেদের হাতে জ্ঞানের মশাল লইয়া উহার আলোকবিস্তারে কতটা সহায়তা করিযাছি? আমরা যে উহা করি নাই, তাহা আমাদেরই দোষ—আমাদেরই কর্ম। এজন্য অপর কাহাকেও দোষ দিও না, দোষ দাও নিজেদের কর্মকে। যদি তোমরা আসিতে না দিতে, তবে কি জড়বাদ, মুসলমান ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম, পৃথিবীর অন্য কোন মতবাদ—কিছুই কি স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতে সমর্থ হইত? পাপ, দূষিত খাদ্য ও নানাবিধ অনিয়মের দ্বারা দেহ পূর্ব হইতেই যদি দুর্বল না হইয়া থাকে, তবে কোন প্রকার জীবাণু মনুষ্যদেহ আক্রমণ করিতে পারে না। সুস্থ ব্যক্তি সর্বপ্রকার বিষাক্ত জীবাণুর মধ্যে বাস করিয়াও নিরাপদ থাকিবে। আমরা তো তাহাদিগকে পূর্বে সাহায্য করি নাই, সুতরাং অপর জাতির উপর সমুদয় দোষ নিক্ষেপ করিবার পূর্বে প্রথমে নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত; এখনও প্রতিকারের সময় আছে।



প্রথমেই—ঐ যে অর্থহীন বিষয়গুলি লইয়া প্রাচীনকাল হইতেই বাদানুবাদ চলিতেছে, তাহা পরিত্যাগ কর। গত ছয়-সাত শত বৎসর ধরিয়া কি ঘোর অবনতি হইয়াছে দেখ! বড় বড় কর্তা-ব্যক্তিরা শত শত বৎসর ধরিয়া এই মহাবিচারে ব্যস্ত যে—এক ঘটি জল ডান-হাতে কি বাঁ-হাতে খাইব, হাত তিনবার ধুইব না চারবার; কুলকুচা করিব পাঁচবার কি ছয়বার! যাহারা সারা জীবন এইরূপ দুরূহ প্রশ্নসমূহের মীমাংসায় ও এই-সকল তত্ত্ব সম্বন্ধে মহাপাণ্ডিত্যপূর্ণ বড় বড় দর্শন লিখিতে ব্যস্ত, তাহাদিগের নিকট আর কি আশা করা যায়? আমাদের ধর্মটা যে রান্নাঘরে ঢুকিয়া সেইখানেই আবদ্ধ থাকিবে—এইরূপ এক আশঙ্কা রহিয়াছে। আমরা এখন বৈদান্তিকও নই, পৌরাণিকও নই, তান্ত্রিকও নই, আমরা এখন কেবল ‘ছুঁৎমার্গী’, আমাদের ধর্ম এখন রান্নাঘরে। ভাতের হাঁড়ি আমাদের ঈশ্বর, আর ধর্মমত—‘আমায় ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, আমি মহাপবিত্র!’ যদি আমাদের দেশে আর এক শতাব্দী ধরিয়া এই ভাব চলে, তবে আমাদের প্রত্যেককেই পাগলা-গারদে যাইতে হইবে!


মন যখন জীবনের উচ্চতম তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে চিন্তা করিতে অসমর্থ হয়, তখন ইহা মস্তিস্কের দুর্বলতার নিশ্চিত লক্ষণ বলিয়া জানিতে হইবে। এই অবস্থায় মৌলিক তত্ত্বের গবেষণা করিতে মানুষ একেবারে অসমর্থ হয়; নিজের সমুদয় তেজ, কার্যকরী শক্তি ও চিন্তাশক্তি হারাইয়া ফেলে; আর যতদূর সম্ভব ক্ষুদ্রতম গণ্ডির মধ্যেই তাহার কার্যক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়, তাহার বাহিরে সে আর যাইতে পারে না। প্রথমে এইগুলি একেবারে ছাড়িয়া দিতে হইবে। মহাবীর্যের সহিত কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে। ঐগুলি বাদ দিলেও যে- ধনভাণ্ডার আমরা পূর্বপুরুষদিগের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছি, তাহা অফুরন্ত থাকিবে। সমগ্র পৃথিবী যেন এই ধনভাণ্ডার হইতে সাহায্য পাইবার জন্য উৎসুক হইয়া আছে। উহা হইতে ধনরাশি বিতরণ না করিলে সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হইবে। অতএব বিতরণে আর বিলম্ব করিও না। ব্যাস বলিয়াছেন, কলিযুগে দানই একমাত্র ধর্ম—তাহার মধ্যে আবার ধর্মদান শ্রেষ্ঠ; বিদ্যাদান তাহার নিম্নে; তারপর প্রাণদান; সর্বনিম্নে অন্নদান। অন্নদান আমরা যথেষ্ট করিয়াছি; আমাদের ন্যায় দানশীল জাতি আর নাই। এখানে ভিক্ষুকের নিকটও যতক্ষণ পর্যন্ত একখানা রুটি থাকিবে, সে তাহার অর্ধেক দান করিবে। এইরূপ ব্যাপার কেবল ভারতেই দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা যথেষ্ট অন্নদান করিয়াছি, এক্ষণে আমাদিগকে অপর দুইপ্রকার দানে অগ্রসর হইতে হইবে—ধর্ম ও বিদ্যা-দান। যদি আমরা সকলেই অকুতোভয় হইয়া, হৃদয়কে দৃঢ় করিয়া, ভাবের ঘরে এক বিন্দু চুরি না করিয়া কাজে লাগিয়া যাই, তবে আগামী পঁচিশ বৎসরের মধ্যে আমাদের সকল সমস্যার মীমাংসা হইয়া যাইবে—বিরুদ্ধমতাবলম্বী আর কেহ থাকিবে না এবং সমগ্র ভারতবাসী আবার প্রাচীন আর্যগণের ন্যায় উন্নত হইবে।



এখন আমার যেটুকু বলিবার ছিল, বলিলাম। আমার সঙ্কল্পিত কার্যপ্রণালী বলিয়া বেড়াইতে আমি ভালবাসি না। কি করিতে ইচ্ছা করি বা না করি, মুখে না বলিয়া কাজে দেখানই পছন্দ করি। অবশ্য আমি একটা নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী স্থির করিয়াছি; যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, যদি আমার শরীর থাকে, তবে সঙ্কল্পিত বিষয়গুলি কার্যে পরিণত করিবার ইচ্ছা আছে। জানি না, আমি কৃতকার্য হইব কিনা; তবে একটা মহান্‌ আদর্শ লইয়া তাহাতেই মনপ্রাণ নিয়োগ করা—ইহাই জীবনের এক মহান্ আদর্শ। তাহা না হইলে হীন পশুজীবন যাপন করিয়া লাভ কি? এক মহান্ আদর্শের অনুগামী হওয়াই জীবনের একমাত্র সার্থকতা। ভারতে এই মহৎকার্য সাধন করিতে হইবে। এই কারণে ভারতের বর্তমান পুনরুজ্জীবনে অতিশয় আনন্দিত হইয়াছি। যদি বর্তমান শুভমুহূর্তের সুযোগ গ্রহণ না করি, তবে মহামূর্খের মত কাজ করিব।


০৮. মাদুরা অভিনন্দনের উত্তর

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৮. মাদুরা অভিনন্দনের উত্তর

[মনমাদুরা হইতে মাদুরায় আসিয়া স্বামীজী রামনাদের রাজার সুন্দর বাঙ্গলায় অবস্থান করেন। অপরাহ্নে, মখমলের খাপে পুরিয়া স্বামীজীকে একটি অভিনন্দন-পত্র প্রদত্ত হয়—উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ]


আমার খুব ইচ্ছা যে, কয়েকদিন তোমাদের নিকট থাকিয়া সুযোগ্য সভাপতি মহাশয়ের আদেশমত আমার পাশ্চাত্যদেশের সমুদয় অভিজ্ঞতা ও বিগত চারবৎসরব্যাপী প্রচারকার্যের বিবরণ দিই। দুঃখের বিষয়, সন্ন্যাসিগণকেও দেহভার বহন করিতে হয়। গত তিন সপ্তাহ যাবৎ ক্রমাগত নানাস্থানে ভ্রমণ ও বক্তৃতা করিয়া এত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, আর সন্ধ্যাকালে দীর্ঘ বক্তৃতা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। তোমরা আমার প্রতি যে অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছ, সেজন্য তোমাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়াই আমাকে সন্তুষ্ট থাকিতে হাইবে; আর অন্যান্য বিষয় ভবিষ্যতের জন্য রাখিয়া দিতে হইবে। স্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত ভাল হইলে এবং আর একটু অবকাশ পাইলে আমাদের অন্যান্য বিষয় আলোচনা করিবার সুবিধা হইবে। আজ এই অল্প সময়ের মধ্যে সব কথা বলিবার সুযোগ হইবে না। একটি কথা বিশেষভাবে আমার মনে উদিত হইতেছে। আমি এখন মাদুরায় তোমাদের স্বদেশবাসী স্বনামখ্যাত উদারচেতা রামনাদরাজের অতিথি। তোমরা বোধ হয় অনেকেই জান না, উক্ত রাজাই আমার মাথায় চিকাগো-সভায় যাইবার ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং বরাবরই সর্বান্তঃকরণে ও সর্বশক্তি-দ্বারা আমার কার্য সমর্থন করিয়াছেন। সুতরাং অভিনন্দন-পত্রে আমাকে যে-সকল প্রশংসা করা হইয়াছে, তাহার অধিকাংশই দাক্ষিণাত্যবাসী এই মহাপুরুষের প্রাপ্য। কেবল আমার মনে হয়, তিনি রাজা না হইয়া সন্ন্যাসী হইলে আরও ভাল হইত; কারণ তিনি সন্ন্যাসেরই উপযুক্ত।


যখনই পৃথিবীর অংশবিশেষে কোন কিছুর আবশ্যক হয়, তখনই তাহা এক অংশ হইতে অপরাংশে গিয়া সেখানে নূতন জীবন প্রদান করে। কি প্রাকৃতিক, কি আধ্যাত্মিক—উভয় ক্ষেত্রেই ইহা সত্য। যদি জগতের কোন অংশে ধর্মের অভাব হয় এবং অপর কোথাও সেই ধর্ম থাকে, তবে আমরা জ্ঞাতসারে চেষ্টা করি বা না করি, যেখানে সেই ধর্মের অভাব সেখানে ধর্মস্রোত আপনা-আপনি প্রবাহিত হইয়া উভয় স্থানের সামঞ্জস্য বিধান করিবে। মানবজাতির ইতিহাসে দেখিতে পাই—একবার নয়, দুইবার নয়, বার বার এই প্রাচীন ভারতকে যেন বিধাতার নিয়মে পৃথিবীকে ধর্মশিক্ষা দিতে হইয়াছে। দেখিতে পাই—যখনই কোন জাতির দিগ্বিজয় বা বাণিজ্যে প্রাধান্য উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ একসূত্রে গ্রথিত হইয়াছে এবং যখনই এক জাতির অপর জাতিকে কিছু দিবার সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে, তখনই প্রত্যেক জাতি অপর জাতিকে রাজনীতিক, সামাজিক বা আধ্যাত্মিক যাহার যাহা আছে, তাহাই দিয়াছে। ভারত সমগ্র পৃথিবীকে ধর্ম ও দর্শন শিখাইয়াছে। পারস্য-সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের অনেক পূর্বেই ভারত পৃথিবীকে আপন আধ্যাত্মিক সম্পদ দান করিয়াছে। পারস্য-সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়কালে আর একবার এই ঘটনা ঘটে। গ্রীকদিগের অভ্যুদয়কালে তৃতীয়বার। আবার ইংরেজের প্রাধান্যকালে এই চতুর্থবার সে বিধাতৃ-নির্দিষ্ট ব্রতপালনে নিযুক্ত হইতেছে। যেমন আমরা ইচ্ছা করি বা না-করি, পাশ্চাত্যদিগের সংঘবদ্ধ কার্যপ্রণালী ও বাহ্যসভ্যতার ভাব আমাদের দেশে প্রবেশ করিয়া সমগ্র দেশকে ছাইয়া ফেলিবার উপক্রম করিতেছে, সেইরূপ ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন পাশ্চাত্যদেশকে প্লাবিত করিবার উপক্রম করিতেছে। কেহই ইহার গতিরোধে সমর্থ নহে। আমরাও পাশ্চাত্য জড়বাদপ্রধান সভ্যতার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করিতে অসমর্থ। সম্ভবতঃ কিছু কিছু বাহ্যসভ্যতা আমাদের পক্ষে কল্যাণকর, পাশ্চাত্যদেশের পক্ষে আবার সম্ভবতঃ একটু আধ্যাত্মিকতা আবশ্যক। তাহা হইলে উভয়ের সামঞ্জস্য রক্ষিত হইবে; আমাদিগকে যে পাশ্চাত্যদেশ হইতে সব-কিছু শিখিতে হইবে বা পাশ্চাত্যকে আমাদের নিকট সব-কিছু শিখিতে হইবে, তাহা নহে। সমগ্র পৃথিবী যুগযুগান্তর ধরিয়া যে আদর্শ-অবস্থা কল্পনা করিয়া আসিতেছে, যাহাতে শীঘ্র তাহা রূপায়িত হয়, যাহাতে সকল জাতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়, তদুদ্দেশ্যে প্রত্যেকেরই যতটুকু সাধ্য ততটুকু ভবিষ্যৎ বংশধরদিগকে দেওয়া উচিত। এই আদর্শ-জগতের আবির্ভাব কখনও হইবে কিনা, তাহা জানি না; এই সামাজিক সম্পূর্ণতা কখনও আসিবে কিনা, এই সম্বন্ধে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে; কিন্তু জগতের এই আদর্শ অবস্থা কখনও আসুক বা না আসুক, এই অবস্থা আনিবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে চেষ্টা করিতে হইবে। মনে করিতে হইবে, কালই জগতের এই অবস্থা আসিবে, আর কেবল আমার কাজের উপরই ইহা নির্ভর করিতেছে। আমাদের প্রত্যেককেই বিশ্বাস করিতে হইবে যে, অপর সকলে নিজ নিজ কাজ শেষ করিয়া বসিয়া আছে—কেবল একমাত্র আমারই কাজ করার বাকী আছে; আমি যদি নিজের কাজ সম্পন্ন করি; তবেই সমাজ ও সংসারের সম্পূর্ণতা সাধিত হইবে। আমাদের নিজেদের এই দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হইবে।



যাহা হউক দেখা যাইতেছে—ভারতে ধর্মের এক প্রবল পুনরুত্থান হইয়াছে। ইহাতে খুব আনন্দের কারণ আছে বটে, আবার বিপদেরও আশঙ্কা আছে। কারণ ধর্মের পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক গোঁড়ামিও আসিয়া থাকে। কখনও কখনও লোকে এত বাড়াবাড়ি করিয়া থাকে যে, অনেক সময় যাঁহাদের চেষ্টায় এই পুনরভ্যুত্থান সাধিত হয়, কিছুদূর অগ্রসর হইলে তাঁহারাও উহা নিয়ন্ত্রিত করিতে পারেন না। অতএব পূর্ব হইতেই সাবধান হওয়া ভাল। আমাদের মধ্যপথ অবলম্বন করিতে হইবে। এক দিকে কুসংস্কারপূর্ণ প্রাচীন সমাজ, অপর দিকে জড়বাদ—ইওরোপীয় ভাব, নাস্তিকতা, তথাকথিত সংস্কার, যাহা পাশ্চাত্য জগতের উন্নতির মূল ভিত্তিতে পর্যন্ত প্রবিষ্ট। এই দুই-ভাব হইতেই সাবধান থাকিতে হইবে প্রথমতঃ আমরা কখনও পাশ্চাত্য জাতি হইতে পারিব না, সুতরাং উহাদের অনুকরণ বৃথা। মনে কর তোমরা পাশ্চাত্য জাতির হুবহু অনুকরণ করিতে সমর্থ হইলে, কিন্তু যে মুহূর্তে সমর্থ হইবে, সেই মুহূর্তেই তোমাদের মৃত্যু ঘটিবে—তোমাদের জাতীয় জীবনের অস্তিত্ব আর থাকিবে না; ইহা অসম্ভব। কালের প্রারম্ভ হইতে মানবজাতির ইতিহাসের লক্ষ লক্ষ বর্ষ ধরিয়া একটি নদী হিমালয় হইতে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে; তুমি কি উহাকে উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চাও? তাহাও যদি সম্ভব হয়, তথাপি তোমাদের পক্ষে ইওরোপীয়-ভাবাপন্ন হইয়া যাওয়া অসম্ভব। ইওরোপীয়গণের পক্ষে যদি কয়েক শতাব্দীর শিক্ষাসংস্কার পরিত্যাগ করা অসম্ভব বোধ হয়, তবে তোমাদের পক্ষে শত শত শতাব্দীর সংস্কার পরিত্যাগ করা কিরূপে সম্ভব হইবে? তাহা কখনই হইতে পারে না।



দ্বিতীয়তঃ আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে, আমরা সচরাচর যেগুলিকে আমাদের ধর্মবিশ্বাস বলি, সেগুলি আমাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র গ্রাম্যদেবতা-সম্বন্ধীয় এবং কতকগুলি ক্ষুদ্র কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচারমাত্র। এইরূপ দেশাচার অসংখ্য এবং পরস্পরবিরোধী। ইহাদের মধ্যে কোন্‌টি মানিব, আর কোন‌্‌টি মানিব না? উদাহরণস্বরূপ দেখ, দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ অপর ব্রাহ্মণকে এক টুকরা মাংস খাইতে দেখিলে ভয়ে দুই শত হাত পিছাইয়া যাইবে; আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ কিন্তু মহাপ্রসাদের অতিশয় ভক্ত, পূজার জন্য তিনি শত শত ছাগবলি দিতেছেন। তুমি তোমার দেশাচারের দোহাই দিবে, তিনি তাঁহার দেশাচারের দোহাই দিবেন। ভারতের বিভিন্ন দেশে নানাবিধ দেশাচার আছে, কিন্তু প্রত্যেক দেশাচারই স্থানবিশেষে আবদ্ধ; কেবল অজ্ঞ ব্যক্তিরাই তাহাদের নিজ নিজ পল্লীতে প্রচলিত আচারকে ধর্মের সার বলিয়া মনে করে, ইহাই তাহাদের মহাভুল।


ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি মুশকিল আছে। আমাদের শাস্ত্রে দুই প্রকার সত্য উপদিষ্ট হইয়াছে। এক প্রকার সত্য মানুষের নিত্যস্বরূপ-বিষয়ক—ঈশ্বর, জীবাত্মা ও প্রকৃতির পরস্পর সম্বন্ধ-বিষয়ক; আর একপ্রকার সত্য কোন বিশেষ দেশ-কাল-অবস্থার উপর নির্ভর করে। প্রথম প্রকার সত্য প্রধানতঃ আমাদের শাস্ত্র বেদে রহিয়াছে; দ্বিতীয় প্রকার সত্য স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতিতে রহিয়াছে। আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে, চিরকালের জন্য বেদই আমাদের চরম লক্ষ্য ও চরম প্রমাণ! আর যদি কোন পুরাণ বেদের বিরোধী হয়, তবে পুরাণের সেই অংশ নির্মমভাবে ত্যাগ করিতে হইবে। আমরা স্মৃতিতে কি দেখিতে পাই? দেখিতে পাই, বিভিন্ন স্মৃতির উপদেশ বিভিন্ন প্রকার। এক স্মৃতি বলিতেছেন—ইহাই দেশাচার, এই যুগে ইহারই অনুসরণ করিতে হইবে। অপর স্মৃতি আবার ঐ যুগের জন্যই অন্যপ্রকার আচার সমর্থন করিতেছেন। কোন স্মৃতি আবার সত্য-ত্রেতা প্রভৃতি যুগভেদে বিভিন্ন আচার সমর্থন করিয়াছেন। এখন দেখ, তোমাদের শাস্ত্রের এই মতটি কি উদার ও মহান্‌। সনাতন সত্যসমূহ মানবপ্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া যতদিন মানুষ আছে, ততদিন ঐগুলির পরিবর্তন হইবে না—অনন্তকাল ধরিয়া সর্বদেশে সর্ব অবস্থায় ঐগুলি ধর্ম। স্মৃতি অপর দিকে বিশেষ বিশেষ স্থানে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় অনুষ্ঠেয় কর্তব্যসমূহের কথাই অধিক বলিয়া থাকেন, সুতরাং কালে সেগুলির পরিবর্তন হয়। এইটি সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে—কোন সামান্য সামাজিক প্রথা বদলাইতেছে বলিয়া তোমাদের ধর্ম গেল, মনে করিও না। মনে রাখিও, চিরকালই এই-সকল প্রথা ও আচারের পরিবর্তন হইতেছে। এই ভারতেই এমন সময় ছিল, যখন গোমাংস ভোজন না করিলে কোন ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব থাকিত না। বেদপাঠ করিলে দেখিতে পাইবে, কোন বড় সন্ন্যাসী বা রাজা বা অন্য কোন বড়লোক আসিলে ছাগ ও গোহত্যা করিয়া তাঁহাদিগকে ভোজন করানোর প্রথা ছিল। ক্রমশঃ সকলে বুঝিল—আমাদের জাতি প্রধানতঃ কৃষিজীবী, সুতরাং ভাল ভাল ষাঁড়গুলি হত্যা করিলে সমগ্র জাতি বিনষ্ট হইবে। এই কারণেই গোহত্যা-প্রথা রহিত করা হইল—গোহত্যা মহাপাতক বলিয়া পরিগণিত হইল। প্রাচীনশাস্ত্র-পাঠে আমরা দেখিতে পাই, তখন হয়তো এমন সব আচার প্রচলিত ছিল, যেগুলিকে এখন আমরা বীভৎস বলিয়া মনে করি। ক্রমশঃ সেগুলির পরিবর্তে অন্য সব বিধি প্রবর্তন করিতে হইয়াছে। ঐগুলি আবার পরিবর্তিত হইবে, তখন নূতন নূতন স্মৃতির অভ্যুদয় হইবে। এইটিই বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বেদ চিরকাল একরূপ থাকিবে, কিন্তু কোন স্মৃতির প্রাধান্য যুগ-পরিবর্তনেই শেষ হইয়া যাইবে। সময়স্রোত যতই চলিবে, ততই পূর্ব পূর্ব স্মৃতির প্রামাণ্য লোপ পাইবে, আর মহাপুরুষগণ আবির্ভূত হইয়া সমাজকে পূর্বাপেক্ষা ভাল পথে পরিচালিত করিবেন; সেই যুগের পক্ষে যাহা অত্যাবশ্যক, যাহা ব্যতীত সমাজ বাঁচিতেই পারে না—তাঁহারা আসিয়া সেই সকল কর্তব্য ও পথ সমাজকে দেখাইয়া দিবেন।



এইরূপে আমাদিগকে এই উভয় বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করিতে হইবে; আমি আশা করি, আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেরই একদিকে যেমন উদার ভাব—হৃদয়ের প্রসারতা আসিবে, অপর দিকে তেমন দৃঢ় নিষ্ঠা ও বিশ্বাস থাকিবে; তাহা হইলে তোমরা আমার কথার মর্ম বুঝিবে—বুঝিবে আমার উদ্দেশ্য সকলকেই আপনার করিয়া লওয়া, কাহাকেও বর্জন করা নয়। আমি চাই গোঁড়ার নিষ্ঠাটুকু ও তাহার সহিত জড়বাদীর উদার ভাব। হৃদয় সমুদ্রবৎ গভীর অথচ আকাশবৎ প্রশস্ত হওয়া চাই। আমাদিগকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নতিশীল জাতির মত উন্নত হইতে হইবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবহমান কালের সঞ্চিত সংস্কারসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবান্ হইতে হইবে; আর হিন্দুই কেবল প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন প্রথাগুলিকে সম্মান করিতে জানে। সহজ কথা বলি—সর্ব ব্যাপারই আমাদিগকে মুখ্য ও গৌণ বিষয়ের বিভিন্নতা কোথায়, তাহা শিখিতে হইবে। মুখ্য তত্ত্বগুলি সর্বকালের জন্য, আর গৌণ বিষয়গুলি কোন বিশেষ সময়ের উপযোগী মাত্র। যদি যথাসময়ে সেইগুলির পরিবর্তে অন্য প্রথা প্রবর্তিত না হয়, তবে সেগুলির দ্বারা নিশ্চয় অনিষ্ট ঘটিয়া থাকে। আমার এ কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, তোমাদিগকে প্রাচীন আচারপদ্ধতিসমূহের নিন্দা করিতে হইবে। কখনই নহে, অতিশয় কুৎসিত আচারগুলিরও নিন্দা করিও না। নিন্দা কিছুরই করিও না; এখন যে প্রথাগুলিকে সাক্ষাৎসম্বন্ধে অনিষ্টকর বলিয়া বোধ হইতেছে, সেইগুলিই অতীত কালে প্রত্যক্ষভাবে জীবনপ্রদ ছিল। এখন যদি সেইগুলি উঠাইয়া দিতে হয়, তবে উঠাইয়া দিবার সময়ও সেইগুলির নিন্দা করিও না; বরং ঐগুলির দ্বারা আমাদের জাতীয় জীবনরক্ষারূপ যে মহৎ কার্য সাধিত হইয়াছে, সেজন্য ঐগুলির প্রশংসা কর—ঐগুলির প্রতি কৃতজ্ঞ হও।



আর আমাদিগকে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে, কোন সেনাপতি বা রাজা কোনকালে আমাদের সমাজের নেতা ছিলেন না, ঋষিগণই চিরকাল আমাদের সমাজের নেতা। ঋষি কাহারা? তিনিই ঋষি, যিনি ধর্মকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, যাঁহার নিকট ধর্ম কেবল পুঁথিগত বিদ্যা, বাগবিতণ্ডা বা তর্কযুক্তি নহে—সাক্ষাৎ উপলব্ধি অতীন্দ্রিয় সত্যের সাক্ষাৎকার। উপনিষদ্ বলিয়াছেন, এরূপ ব্যক্তি সাধারণ মানবতুল্য নহেন, তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা। তিনি ঋষিত্ব। আর এই ঋষিত্বলাভ কোন দেশ কাল জাতি বা সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে না। বাৎস্যায়ন ঋষি বলিয়াছেন—‘সত্যের সাক্ষাৎকার করিতে হইবে’; আর আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, তোমাকে আমাকে—আমাদের সকলকেই ঋষি হইতে হইবে, অগাধ আত্মবিশ্বাস-সম্পন্ন হইতে হইবে; আমরাই সমগ্র জগতে শক্তিসঞ্চার করিব। কারণ সব শক্তি আমাদের ভিতরে রহিয়াছে। আমাদিগকে ধর্ম প্রত্যক্ষ করিতে হইবে—উপলব্ধি করিতে হইবে; তবেই ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের সকল সন্দেহ দূরীভূত হইবে; তখনই ঋষিত্বের উজ্জ্বল জ্যোতিতে পূর্ণ হইয়া আমরা প্রত্যেকেই মহাপুরুষত্ব লাভ করিব। তখনই আমাদের মুখ হইতে যে বাণী নির্গত হইবে, তাহা অব্যর্থ অমোঘ ও শক্তিসম্পন্ন হইবে; তখনই আমাদের সম্মুখ হইতে যাহা কিছু মন্দ, তাহা আপনিই পলায়ন করিবে, আর কাহাকেও নিন্দা বা অভিসম্পাত করিতে হইবে না, অথবা কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে না। এখানে আজ যাঁহারা উপস্থিত আছেন, তাঁহাদের প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের মুক্তির জন্য ঋষিত্ব লাভ করিতে শ্রীভগবান্‌ সাহায্য করুন।

০৯. কুম্ভকোণম্ বক্তৃতা

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ০৯. কুম্ভকোণম্ বক্তৃতা

[মাদুরা হইতে ত্রিচিনপল্লী ও তাঞ্জোর হইয়া স্বামীজী কুম্ভকোণম্ আসেন। সেখানে অভিনন্দনের উত্তরে বেদান্ত সম্বন্ধে তিনি এক সুদীর্ঘ হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করেন। নিম্নে তাহার বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হইল।]


গীতাকার বলিয়াছেনঃ ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’—অল্পমাত্রও এই ধর্ম পালন করিলে অতি মহৎ ফল লাভ হয়। যদি এই বাক্য সমর্থনের জন্য কোন উদাহরণের আবশ্যক হয়, তবে আমি বলিতে পারি, আমার ক্ষুদ্র জীবনে প্রতিপদে এই মহাবাক্যের সত্যতা উপলব্ধি করিতেছি।


হে কুম্ভকোণম্ নিবাসী ভদ্রমহোদয়গণ, আমি অতি সামান্য কাজ করিয়াছি; কিন্তু কলম্বোয় নামিয়া অবধি এ পর্যন্ত যেখানেই গিয়াছি, সেখানেই যেরূপ আন্তরিক অভ্যর্থনা লাভ করিয়াছি, তাহা আমার স্বপ্নের অতীত। সেই সঙ্গে এ কথাও বলি যে, ইহা হিন্দুজাতির পূর্বাপর সংস্কার ও ভাবের উপযুক্তই হইয়াছে। কারণ ধর্মই হিন্দুজাতির প্রকৃত জীবনীশক্তি, ধর্মই তাহার মূলমন্ত্র।


আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যদেশে অনেক ঘুরিয়াছি, জগতের সম্বন্ধে আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। দেখিলাম—সকল জাতিরই এক-একটি প্রধান আদর্শ আছে, তাহাই সেই জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ। রাজনীতিই কোন কোন জাতির জীবনের মূলভিত্তি; কাহারও-বা সামাজিক উন্নতি, কাহারও-বা মানসিক উন্নতিবিধান, কাহারও-বা অন্য কিছু। কিন্তু আমাদের মাতৃভূমির জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি ধর্ম—শুধু ধর্মই। উহাই আমাদের জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড, উহারই উপর আমাদের জীবনরূপ প্রাসাদের মূলভিত্তি স্থাপিত।


তোমাদের মধ্যে অনেকের স্মরণ থাকিতে পারে, মান্দ্রাজবাসীরা অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আমেরিকায় যে অভিনন্দন পাঠাইয়াছিলেন, তাহার উত্তরে আমি একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পাশ্চাত্যদেশের অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি অপেক্ষা ভারতের কৃষকগণ ধর্মবিষয়ে বেশী শিক্ষিত। আজ আমি সেই বিষয়ের বিশেষ প্রমাণ পাইতেছি, ঐ বিষয়ে এখন আমার আর কোন সন্দেহ নাই। এমন সময় ছিল, যখন ভারতের সাধারণ লোকের মধ্যে পৃথিবীর সংবাদ জানিবার এবং ঐ সংবাদ সংগ্রহ করিবার আগ্রহের অভাব দেখিয়া আমার দুঃখ হইত। এখন আমি উহার রহস্য বুঝিয়াছি। আমাদের দেশের লোকও সংবাদ- সংগ্রহে খুব উৎসুক, তবে অবশ্য যে-বিষয়ে তাহার বিশেষ অনুরাগ, সেই বিষয়ের সংবাদেই তাহার আগ্রহ; এ বিষয়ে বরং অন্যান্য যে-সকল দেশ আমি দেখিয়াছি বা পর্যটন করিয়াছি, সেখানকার সাধারণ লোক অপেক্ষা তাহাদের আগ্রহ আরও বেশী। আমাদের কৃষকগণকে ইওরোপের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক পরিবর্তনগুলির সংবাদ জিজ্ঞাসা কর, ইওরোপীয় সমাজে যে-সব গুরুতর পরিবর্তন হইতেছে, সেগুলির বিষয় জিজ্ঞাসা কর—তাহারা সে-সব কিছুই জানে না, জানিতেও চাহেও না। কিন্তু সিংহলেও—যে সিংহল ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন, ভারতের স্বার্থের সহিত যাহার বিশেষ সংস্রব নাই—দেখিলাম—সেখানকার কৃষকেরাও জানিয়াছে, আমেরিকায় ধর্মমহাসভা বসিয়াছিল, আর তাহাদেরই একজন সেখানে গিয়াছিল, এবং কিছুটা পরিমাণে কৃতকার্যও হইয়াছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে—যে-বিষয়ে তাহাদের মনের আগ্রহ, সেই বিষয়ে তাহারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগুলির মতই সংবাদ-সংগ্রহে উৎসুক। আর ধর্মই ভারতবাসীর একমাত্র প্রাণের বস্তু—আগ্রহের বস্তু।



জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি ধর্ম হওয়া উচিত, না রাজনীতি—এ বিষয়ে এখন আমি বিচার করিতে চাই না; তবে ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, ভালই হউক, আর মন্দই হউক, ধর্মেই আমাদের জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি স্থাপিত। তুমি কখনও ইহা পরিবর্তন করিতে পার না, একটা জিনিষ নষ্ট করিয়া তাহার বদলে অপর জিনিষ বসাইতে পার না। একটি বৃহৎ বৃক্ষকে এক স্থান হইতে উপড়াইয়া অন্য স্থানে পুঁতিয়া দিলে উহা যে সেখানে জীবিত থাকিবে, তাহা কখনই আশা করিতে পার না। ভালই হউক আর মন্দই হউক—সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ ভারতে ধর্মই জীবনের চরম আদর্শরূপে পরিগণিত হইতেছে; ভালই হউক আর মন্দই হউক—শত শত শতাব্দী ধরিয়া ভারতের পরিবেশ ধর্মের মহান্‌ আদর্শে পূর্ণ রহিয়াছে; ভালই হউক আর মন্দই হউক—ধর্মের এই-সকল আদর্শের মধ্যেই আমরা পরিবর্ধিত হইয়াছি; এখন ঐ ধর্মভাব আমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়াছে—আমাদের শিরায় শিরায় প্রতি রক্তবিন্দুর সহিত প্রবাহিত হইতেছে, আমাদের প্রকৃতিগত হইয়া গিয়াছে, আমাদের জীবনীশক্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সহস্র বৎসর যাবৎ যে-মহানদী নিজের খাত রচনা করিয়াছে, তাহাকে না বুজাইয়া, মহাশক্তি প্রয়োগ না করিয়া তোমরা কি সেই ধর্ম পরিত্যাগ করিতে পার? তোমরা কি গঙ্গাকে তাহার উৎপত্তিস্থান হিমালয়ে ঠেলিয়া লইয়া গিয়া আবার নূতন খাতে প্রবাহিত করিতে ইচ্ছা কর? ইহাও যদি সম্ভব হয়, তথাপি এই দেশের পক্ষে তাহার জাতিগত বৈশিষ্ট্য—ধর্মজীবন পরিত্যাগ করিয়া রাজনীতি বা অপর কিছুকে জাতীয় জীবনের মূলভিত্তিরূপে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। স্বল্পতম বাধার পথেই তোমরা কাজ করিতে পার; ধর্মই ভারতের পক্ষে সেই স্বল্পতম বাধার পথ। এই ধর্মপথ অনুসরণ করাই ভারতীয় জীবনধারা, ভারতের উন্নতি ও কল্যাণের একমাত্র উপায়।



অন্যান্য দেশে পাঁচ রকম প্রয়োজনীয় জিনিষের মধ্যে ধর্ম একটি। একটি উদাহরণ দিই। আমি সচরাচর এই দৃষ্টান্তটি দিয়া থাকি—অমুক সম্ভ্রান্ত মহিলার ঘরে নানা জিনিষ আছে; এখানকার ফ্যাশন—একটি জাপানী পাত্র (Vase) ঘরে রাখা, না রাখিলে ভাল দেখায় না, সুতরাং তাঁহাকে একটা জাপানী পাত্র রাখিতেই হইবে। এইরূপ আমাদের কর্তার বা গিন্নীর অনেক কাজ, তার মধ্যে একটু ধর্মও চাই—তবেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হইল। এই কারণেই তাঁহাদের একটু-আধটু ‘ধর্ম’ করা চাই। জগতের অধিকাংশ লোকের জীবনের উদ্দেশ্য—রাজনীতিক বা সামাজিক উন্নতির চেষ্টা, এক কথায় সংসার। তাহাদের নিকট ঈশ্বর ও ধর্মের প্রয়োজন সংসারেরই একটু সুখবিধানের জন্য—তাহাদের নিকট ঈশ্বরের প্রয়োজন শুধু এইটুকু। তোমরা কি শোন নাই, গত দুই শত বৎসর যাবৎ কতকগুলি অজ্ঞ অথচ পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তির মুখে ভারতীয় ধর্মের বিরুদ্ধে একমাত্র এই অভিযোগ শোনা যাইতেছে যে, এই ধর্ম দ্বারা সাংসারিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য-লাভের সুবিধা হয় না, ‘কাঞ্চন’ লাভ হয় না, উহা সমগ্র জাতিকে দস্যুতে পরিণত করে না, বলবান্‌কে গরীবের ঘাড়ে পড়িয়া তাহার রক্তপান করিতে সাহায্য করে না! সত্যই, আমাদের ধর্ম এরূপ করে না। ইহাতে অন্যান্য জাতির সর্বস্ব লুণ্ঠন ও সর্বনাশ করিবার জন্য পদভরে ভূকম্পকারী সৈন্যপ্রেরণের ব্যবস্থা নাই। অতএব তাঁহারা বলেন—এ ধর্মে আছে কি? উহা চলতি কলে শস্য যোগাইয়া কাজ আদায় করিতে জানে না, অথবা উহা দ্বারা পেশীর শক্তি বর্ধিত হয় না। তবে এ ধর্মে আছে কি? তাহারা স্বপ্নেও ভাবে না যে, ঐ যুক্তির দ্বারাই আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আমাদের ধর্মে সাংসারিক সুখ হয় না, সুতরাং আমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, কারণ আমাদের ধর্ম এই দু-তিন দিনের ক্ষুদ্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে না। এই স্বল্প- বিস্তৃত ক্ষুদ্র পৃথিবীতেই আমাদের ধর্মের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নহে। আমাদের ধর্ম এই জগতের সীমার বাহিরে—দূরে, অতি দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে; সেই রাজ্য অতীন্দ্রিয়—সেখানে দেশ নাই, কাল নাই, সংসারের কোলাহল হইতে দূরে, অতি দূরে—সেখানে আর সংসারের সুখ-দুঃখ স্পর্শ করিতে পারে না, সমগ্র জগৎই সেই মহিমময় ভূমা আত্মা-রূপ মহাসমুদ্রে বিন্দুতুল্য হইয়া যায়। আমাদের ধর্মই সত্য ধর্ম, কারণ ইহা ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’—এই উপদেশ দিয়া থাকে; আমাদের ধর্ম বলে—‘কাঞ্চন লোষ্ট্র বা ধূলির তুল্য’; তোমরা যতই ক্ষমতা লাভ কর না কেন, সবই ক্ষণিক, এমন কি, জীবনধারণই অনেক সময় বিড়ম্বনামাত্র; এই জন্যই আমাদের ধর্ম সত্য। আমাদের ধর্মই সত্য ধর্ম—কারণ সর্বোপরি ইহা ত্যাগ শিক্ষা দেয়। শত শত যুগের সঞ্চিত জ্ঞানবলে দণ্ডায়মান হইয়া এই সত্যধর্ম আমাদের মহাজ্ঞানী প্রাচীন পূর্বপুরুষগণের তুলনায় যাহারা সেদিনের শিশুমাত্র, সেই-সকল জাতির নিকট সুদৃঢ় অথচ ষ্পষ্ট ভাষায় বলিতে থাকেঃ বালক! তুমি ইন্দ্রিয়ের দাস; কিন্তু ইন্দ্রিয়ের ভোগ অস্থায়ী—বিনাশই উহার পরিণাম। এই তিনদিনের ক্ষণস্থায়ী বিলাসের ফল—সর্বনাশ। অতএব ইন্দ্রিয়সুখের বাসনা ত্যাগ কর—ইহাই ধর্মলাভের উপায়। ত্যাগই আমাদের চরম লক্ষ্য, মুক্তির সোপান—ভোগ আমাদের লক্ষ্য নহে। এই জন্য আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম। বিস্ময়ের বিষয়, এক জাতির পর আর এক জাতি সংসার-রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইয়া কয়েক মুহূর্ত পরাক্রমের সহিত নিজ নিজ অংশ অভিনয় করিয়াছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই তাহাদের মৃত্যু ঘটিয়াছে! কালসমুদ্রে তাহারা একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গও সৃষ্টি করিতে পারে নাই—নিজেদের কিছু চিহ্ন পর্যন্ত রাখিয়া যাইতে পারে নাই। আমরা কিন্তু অনন্তকাল কাক-ভূশণ্ডীর মত বাঁচিয়া আছি—আমাদের যে কখন মৃত্যু হইবে, তাহার লক্ষণও দেখা যাইতেছে না।



আজকাল লোকে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ (Survival of the fittest)-রূপ নূতন মতবাদ লইয়া অনেক কথা বলিয়া থাকে। তাহারা মনে করে—যাহার গায়ের জোর যত বেশী, সেই তত অধিক দিন জীবিত থাকিবে। যদি তাহাই সত্য হইত, তবে প্রাচীনকালের যে-সকল জাতি কেবল অন্যান্য জাতির সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহে কাটাইয়াছে, তাহারাই মহাগৌরবের সহিত আজও জীবিত থাকিত এবং এই দুর্বল হিন্দুজাতি, যাহারা কখনও অপর একটি জাতিকে জয় করে নাই, তাহারা এতদিনে বিনষ্ট হইয়া যাইত। জনৈকা ইংরেজ মহিলা আমাকে এক সময় বলেন, হিন্দুরা কি করিয়াছে? তাহারা কোন একটা জাতিকেও জয় করিতে পারে নাই! পরন্তু এই জাতি এখনও ত্রিশকোটি প্রাণী লইয়া সদর্পে জীবিত রহিয়াছে! আর ইহা সত্য নহে যে, উহার সমুদয় শক্তি নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে; ইহাও সত্য নহে যে, এই জাতির শরীর পুষ্টির অভাবে ক্ষয় পাইতেছে। এই জাতির এখনও যথেষ্ট জীবনীশক্তি রহিয়াছে। যখনই উপযুক্ত সময় আসে, যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই এই জীবনীশক্তি মহাবন্যার মত পৃথিবীকে প্লাবিত করে।


আমরা যেন অতি প্রাচীনকাল হইতে সমগ্র পৃথিবীকে এক মহাসমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান করিয়াছি। পাশ্চাত্যদেশে সকলে চেষ্টা করিতেছে—কিরূপে তাহারা জগতের সর্বাপেক্ষা অধিক দ্রব্যসামগ্রীর অধিকারী হইবে; আমরা কিন্তু এখানে আর এক সমস্যার মীমাংসায় নিযুক্ত—কত অল্প জিনিষ লইয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায়। উভয় জাতির মধ্যে এই সংঘর্ষ ও প্রভেদ এখনও কয়েক শতাব্দী ধরিয়া চলিবে। কিন্তু ইতিহাসে যদি কিছুমাত্র সত্য থাকে, যদি বর্তমান লক্ষণসমূহ দেখিয়া ভবিষ্যৎ অনুমান করা বিন্দুমাত্র সম্ভব হয়, তবে বলা যায়, যাহারা স্বল্পের মধ্যে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে ও কঠোর আত্মসংযম অভ্যাস করিতে চেষ্টা করে, তাহারাই পরিণামে জয়ী হইবে; আর যাহারা ভোগসুখ ও বিলাসের দিকেই ধাবমান, তাহারা আপাততঃ যতই তেজস্বী ও বীর্যবান বলিয়া প্রতীয়মান হউক না কেন, পরিণামে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইবে।



মনুষ্যজীবনে, এমন কি জাতীয় জীবনেও সময়ে সময়ে সংসারের উপর বিতৃষ্ণা অত্যন্ত প্রবল হয়। বোধ হয় সমগ্র পাশ্চাত্যদেশে এইরূপ একটা সংসার-বিরক্তির ভাব আসিয়াছে। পাশ্চাত্যদেশের বড় বড় মনীষিগণ ইতোমধ্যেই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ঐশ্বর্য-সম্পদের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা—সবই বৃথা। সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষিত নরনারীই তাঁহাদের বাণিজ্য-প্রধান সভ্যতার এই প্রতিযোগিতায়, এই সংঘর্ষে, এই পাশব ভাবে অতিশয় বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছেন; তাঁহারা আশা করিতেছেন—এই অবস্থা পরিবর্তিত হইবে এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা আসিতেছে। এক শ্রেণীর লোক আছেন, যাঁহাদের এখনও দৃঢ় ধারণা—রাজনীতিক ও সামাজিক পরিবর্তনই ইওরোপের সমুদয় অশুভ-প্রতিকারের একমাত্র উপায়। কিন্তু ঐ দেশে বড় বড় মনীষীদের মধ্যে অন্য এক আদর্শ বিকাশ লাভ করিতেছে; তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন, রাজনীতিক বা সামাজিক পরিবর্তন যতই হউক না কেন, মনুষ্যজীবনের দুঃখ-কষ্ট কিছুতেই দূর হইবে না। কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতিবিধান করিতে পারিলেই সর্বপ্রকার দুঃখকষ্ট ঘুচিবে। যতই শক্তিপ্রয়োগ শাসনপ্রণালীর পরিবর্তন ও আইনের কড়াকড়ি কর না কেন, তাহাতে কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তিত হয় না। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাই অসৎ প্রবৃত্তি পরিবর্তিত করিয়া জাতিকে সৎপথে চালিত করিতে পারে। এই কারণেই পাশ্চাত্য জাতিগুলি কিছু নূতন ভাব—কোন নূতন দর্শনের জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িয়াছে। তাঁহারা যে-ধর্ম মানেন, সেই খ্রীষ্টধর্ম অনেক বিষয়ে মহৎ ও সুন্দর হইলেও উহার মর্ম তাঁহারা ভাল করিয়া বোঝেন নাই। আর এতদিন তাঁহারা খ্রীষ্টধর্মকে যেভাবে বুঝিয়া আসিতেছিলেন, তাহা আর তাঁহাদের নিকট পর্যাপ্ত বোধ হইতেছে না। পাশ্চাত্যদেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আমাদের প্রাচীন দর্শনসমূহে, বিশেষতঃ বেদান্তেই—এতদিন তাঁহারা যাহা খুঁজিতেছেন—সেই চিন্তাপ্রবাহ, সেই আধ্যাত্মিক খাদ্যপানীয়ের সন্ধান পাইতেছেন। আর ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই।



জগতের যতপ্রকার ধর্ম আছে, সেগুলির প্রত্যেকটির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য সেই সেই ধর্মাবলম্বিগণ নানাবিধ অপূর্ব যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া থাকেন। সে-সব শুনিয়া শুনিয়া অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। অতি অল্প দিনের কথা, আমার বিশেস বন্ধু ব্যারোজ সাহেব—‘খ্রীষ্টধর্মই যে একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম’ ইহা প্রমাণ করিতে বিশেষ চেষ্টা করেন, আপনারা তাহা নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন। এখন বাস্তবিক সার্বভৌম ধর্ম কোন্‌টি হইতে পারে, তাহা বিচার করিয়া দেখা যাক।


আমার ধারণা, বেদান্ত—কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হইতে পারে, আর কোন ধর্মই নয়। আমি আপনাদের নিকট আমার এই বিশ্বাসের যুক্তিপরম্পরা উপস্থাপিত করিব। আমাদের ধর্ম ব্যতীত পৃথিবীর প্রধান প্রধান প্রায় সকল ধর্মই তাহাদের নিজ নিজ প্রবর্তক মহাপুরুষের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেই-সকল ধর্মের মত, শিক্ষা, নীতিতত্ত্ব প্রভৃতি সেই সেই মহাপুরুষের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই সেই মতাদির প্রামাণ্য, তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই সেইগুলি সত্য, তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই ঐ উপদেশগুলি লোকের মনে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। আর আশ্চর্যের বিষয়, ধর্মপ্রবর্তকদের ঐতিহাসিকতার উপরই যেন সেই-সকল ধর্মের সব-কিছুর ভিত্তি স্থাপিত। যদি তাঁহাদের জীবনের ঐতিহাসিকতায় কিছুমাত্র আঘাত করা যায়, যদি তাঁহাদের তথাকথিত ঐতিহাসিকতার ভিত্তি একবার ভাঙিয়া দেওয়া যায়, তবে সমুদয় ধর্ম-প্রাসাদটিই একেবারে বিধ্বস্ত হইয়া পড়িবে—পুনরুদ্ধারের আর কোন সম্ভাবনা থাকিবে না। বাস্তবিক বর্তমানকালে তথাকথিত প্রায় সকল ধর্মপ্রবর্তকের জীবন সম্বন্ধে তাহাই ঘটিতেছে। আমরা জানি, তাঁহাদের জীবনের অর্ধেক ঘটনা লোকে ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে না, আর বাকী অর্ধেকও সন্দেহ করে। আমাদের ধর্ম ব্যতীত জগতের অন্যান্য সকল বড় বড় ধর্মই এইরূপ ঐতিহাসিক জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত; আমাদের ধর্ম কিন্তু কতকগুলি তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন পুরুষ বা নারী নিজেকে বেদের প্রণেতা বলিয়া দাবী করিতে পারেন না। বেদে সনাতন তত্ত্বসমূহ লিপিবদ্ধ হইয়াছে—ঋষিগণ উহার আবিষ্কর্তা মাত্র। স্থানে স্থানে এই ঋষিগণের নামের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু সেগুলি নামমাত্র। তাঁহারা কে ছিলেন, কি করিতেন, তাহাও আমরা জানি না। অনেক স্থলে তাঁহাদের পিতা কে ছিলেন, তাহাও জানা যায় না; আর প্রায় সকলেরই জন্মস্থান ও জন্মকাল আমাদের অজ্ঞাত। বাস্তবিক এই ঋষিগণ নামের আকাঙ্ক্ষা করিতেন না; তাঁহারা সনাতন তত্ত্বসমূহের প্রচারক ছিলেন এবং নিজেরা জীবনে সেই-সকল তত্ত্ব উপলব্ধি করিয়া আদর্শ জীবন যাপন করিবার চেষ্টা করিতেন।



আবার যেমন আমাদের ঈশ্বর নির্গুণ অথচ সগুণ, সেইরূপ আমাদের ধর্মও কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে না, অথচ ইহাতে অনন্ত অবতার ও অসংখ্য মহাপুরুষের স্থান হইতে পারে। আমাদের ধর্মে যত অবতার, মহাপুরুষ, ঋষি আছেন, আর কোন্ ধর্মে এত আছেন? শুধু তাহাই নহে, আমাদের ধর্ম বলে—বর্তমানে ও ভবিষ্যতে আরও অনেক অবতার-মহাপুরুষের অভ্যুদয় হইবে। ভাগবতে আছে—‘অবতারা হ্যসংখ্যেয়াঃ’। সুতরাং এই ধর্মে নূতন নূতন ধর্মপ্রবর্তক, অবতার ইত্যাদিকে গ্রহণ করিতে কোন বাধা নাই। এই হেতু ভারতের ধর্মেতিহাসে যে-সকল অবতার ও মহাপুরুষের বিষয় বর্ণিত আছে, যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁহারা ঐতিহাসিক নন, তাহা হইলেও আমাদের ধর্ম বিন্দুমাত্র আঘাত পাইবে না; উহা পূর্বের মতই দৃঢ় থাকিবে; কারণ কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত নয়—সনাতন সত্যসমূহের উপরই ইহা স্থাপিত। পৃথিবীর সকল লোককে জোর করিয়া কোন ব্যক্তিবিশেষকে মানাইবার চেষ্টা করা বৃথা; এমন কি সনাতন ও সার্বভৌম তত্ত্বসমূহ দ্বারাও অনেককে একমতাবলম্বী করা কঠিন। তবে যদি কখনও পৃথিবীর অধিকাংশ লোককে ধর্মসম্বন্ধে একমতাবলম্বী করা সম্ভব হয়, তবে কোন ব্যক্তিবিশেষকে সকলে মানুক—এরূপ চেষ্টা করিলে তাহা হইবে না, বরং সনাতন তত্ত্বসমূহে বিশ্বাসী হইয়া অনেকের একমতাবলম্বী হওয়া সম্ভব। অথচ আমাদের ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের কথার প্রামাণ্য ও প্রভাব সম্পূর্ণরূপেই স্বীকার করিয়া থাকে—এ বিষয়ে আমি পূর্বেই বলিয়াছি।



‘ইষ্টনিষ্ঠা’রূপ যে অপূর্ব মত আমাদের দেশে প্রচলিত, তাহাতে এই অসংখ্য অবতারের মধ্যে যাঁহাকে ইচ্ছা আদর্শ করিতে সকলকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। যে- কোন অবতারকে তোমার জীবনের আদর্শরূপে ও বিশেষ উপাস্যরূপে গ্রহণ করিতে পার; এমন কি তাঁহাকে সকল অবতারের মধ্যে শ্রেষ্ঠও মনে করিতে পার, তাহাতে কোন ক্ষতি নাই; কিন্তু সনাতন তত্ত্বসমূহই যেন তোমার ধর্মসাধনের মূলভিত্তি হয়। এই বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলে আশ্চর্য হইবে—যে-কোন অবতারই হউন না কেন, বৈদিক সনাতন তত্ত্বসমূহের জীবন্ত উদাহরণস্বরূপ বলিয়াই তিনি আমাদের মান্য। শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য এই যে, তিনি সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক এবং বেদান্তের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যাতা।


পৃথিবীর সকলেরই বেদান্তের চর্চা করা কেন উচিত, তাহার প্রথম কারণ এই যে, বেদান্তই একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম। দ্বিতীয় কারণ, জগতে যত শাস্ত্র আছে, তন্মধ্যে কেবল বেদান্তের উপদেশের সহিত বহিঃপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে লব্ধ জ্ঞানের পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে। অতি প্রাচীনকালে আকৃতি, বংশ ও ভাবের দিক হইতে সমতুল্য দুইটি বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন পথে জগতের তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। আমি প্রচীন হিন্দু ও প্রাচীন গ্রীকজাতির কথা বলিতেছি। শেষোক্ত জাতি বাহ্য জগতের বিশ্লেষণ করিয়া সেই চরম লক্ষ্যের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিল এবং প্রথমোক্ত জাতি অগ্রসর হইয়াছিল অন্তর্জগৎ বিশ্লেষণ করিয়া। ইতিহাসে তাহাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ উত্থান-পতনের অবস্থা আলোচনা করিলে দেখা যায়, এই দুই ভিন্ন প্রকার চিন্তাপ্রণালী সেই সুদূর চরমলক্ষ্যের একই প্রকার প্রতিধ্বনি তুলিয়াছে। ইহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, কেবল বেদান্তীই—যাহারা নিজেদের ‘হিন্দু’ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে—তাহাদের ধর্মের সহিত সামঞ্জস্য করিয়া আধুনিক জড়বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করিতে পারে; ইহাতে বেশ স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান জড়বাদ নিজের সিদ্ধান্তগুলি পরিত্যাগ না করিয়া বেদান্তের সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করিলেই আধ্যাত্মিকতার দিকে অগ্রসর হইতে পারে। আমাদের নিকট এবং যাঁহারা এই বিষয়ের বিশেষ আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহাদেরও নিকট ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আধুনিক বিজ্ঞান যে-সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইতেছে, বেদান্ত অনেক শতাব্দী পূর্বেই সেই-সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিল; কেবল আধুনিক বিজ্ঞানে সেগুলি জড়ের ভাষায় জড় বলিয়া উল্লিখিত হইতেছে মাত্র।



আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিগণের পক্ষে বেদান্ত-আলোচনার দ্বিতীয় হেতু—ইহার অদ্ভুত যুক্তিসিদ্ধতা। আমাকে পাশ্চাত্যদেশের অনেক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বলিয়াছেন, বেদান্তের সিদ্ধান্তগুলি অপূর্ব যুক্তিপূর্ণ। আমার সহিত ইঁহাদের একজনের বিশেষ পরিচয় আছে। এদিকে তাঁহার খাইবার বা গবেষণাগার হইতে বাহিরে যাইবার অবকাশ নাই, অথচ তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার বেদান্তবিষয়ক বক্তৃতা শুনিতেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন—বেদান্তের সিদ্ধান্তগুলি এতদূর বিজ্ঞানসম্মত, বর্তমান যুগের অভাব ও আকাঙ্ক্ষাগুলি বেদান্ত এত সুন্দরভাবে পূরণ করিয়া থাকে, আর আধুনিক বিজ্ঞান ক্রমশঃ যে-সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইতেছে, সেগুলির সহিত বেদান্তের এত সামঞ্জস্য যে, আমি ইহার প্রতি আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারি না।


ধর্মগুলির তুলনামূলক সমালোচনা করিয়া দুইটি বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়; সেই দুটির প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। প্রথম তত্ত্বটি এইঃ সকল ধর্মই সত্য। আর দ্বিতীয়টিঃ জগতের সকল বস্তু আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন বলিয়া মনে হইলেও সবই এক বস্তুর বিকাশমাত্র। বেবিলনীয় ও য়াহুদীদের ধর্মেতিহাস আলোচনা করিলে আমরা একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া থাকি। আমরা দেখিতে পাই—বেবিলনীয় ও য়াহুদী জাতির মধ্যে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা ও প্রত্যেকের পৃথক্‌ পৃথক্‌ দেবতা ছিল। এই সমুদয় পৃথক্ পৃথক্ দেবতার আবার একটি সাধারণ নাম ছিল। বেবিলনীয় দেবতাদের সাধারণ নাম ছিল ‘বল’। তাহাদের মধ্যে ‘বল মেরোদক’ প্রধান। কালে এই একটি শাখা সেই জাতির অন্তর্গত অন্যান্য শাখাগুলিকে জয় করিয়া নিজের সহিত মিশাইয়া লয়। ইহার স্বাভাবিক ফল এই হয় যে, বিজেতা জাতির দেবতা অন্যান্য শাখাজাতির দেবতাগুলির উপরে শীর্ষস্থান অধিকার করে। সেমাইট জাতি যে তথাকথিত ‘একেশ্বরবাদ’ লইয়া গৌরব করিয়া থাকে, তাহা এইরূপেই সৃষ্ট হইয়াছে। য়াহুদী জাতির দেবতাদের সাধারণ নাম ছিল ‘মোলক’। ইঁহাদের মধ্যে ইস্রায়েল জাতির দেবতার নাম ছিল ‘মোলক-য়াভা’। এই ইস্রায়েল জাতি ক্রমশঃ উহার সমশ্রেণীস্থ অন্যান্য কতকগুলি জাতিকে জয় করিয়া নিজেদের মোলককে অন্যান্য মোলকগণের অপেক্ষা বড় ও প্রধান বলিয়া ঘোষণা করিল। এইরূপ ধর্মযুদ্ধে যে-পরিণাম রক্তপাত ও পাশবিক অত্যাচার হইয়াছিল, তাহা আপনারা অনেকেই জানেন। পরবর্তী কালে বেবিলনীয়েরা মোলক-য়াভার এই প্রাধান্য লোপ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কৃতকার্য হয় নাই।



আমার বোধ হয়, ধর্মবিষয়ে পৃথক্‌ পৃথক্‌ জাতির প্রাধান্যলাভের চেষ্টা ভারতের সীমান্ত-প্রদেশেও ঘটিয়াছিল। এখানেও সম্ভবতঃ আর্যজাতির বিভিন্ন শাখা পরস্পরের পৃথক্‌ পৃথক্‌ দেবতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু বিধির বিধানে ভারতীয় ইতিহাস য়াহুদীদের ইতিহাসের মত হইল না। বিধাতা যেন অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ভারতকে পরধর্মে বিদ্বেষশূন্য ও ধর্মসাধনায় গরিষ্ঠ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। সেই কারণেই এখানে ঐ-সকল বিভিন্ন জাতি ও তাহাদের বিভিন্ন দেবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল স্থায়ী হইল না। সেই প্রাগৈতিহাসিক সুদূর অতীত যুগে—কিংবদন্তীও যে-যুগের ঘনান্ধকার ভেদ করিতে অসমর্থ, সেই অতি প্রাচীনকালে ভারতে একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষের অভ্যুদয় হয়; জগতে এইরূপ মহাপুরুষের সংখ্যা অতি অল্প। এই মহাপুরুষ সেই প্রাচীনকালেই এই সত্য উপলব্ধি করিয়া প্রচার করেন, ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—পরম সত্যবস্তু এক, ঋষিগণ তাঁহাকে নানাভাবে বর্ণনা করেন। এইরূপ চিরস্মরণীয় বাণী আর কখনও উচ্চারিত হয় নাই, এইরূপ মহান্ সত্য আর কখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। আর এই সত্যই আমাদের হিন্দুর জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ডস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। শত শত শতাব্দী ধরিয়া এই তত্ত্ব—‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ ক্রমশঃ পরিস্ফুট হইয়া আমাদের সমগ্র জাতীয় জীবনকে ওতপ্রোতভাবে পরিব্যাপ্ত ও প্রভাবিত করিয়াছে, আমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়াছে, আমাদের জীবনের সহিত যেন সর্বাংশে একীভূত হইয়া গিয়াছে। আমরা ঐ মহত্তম সত্যটিকে সর্বতোভাবে ভালবাসি, তাই আমাদের দেশ—পরধর্মে দ্বেষরাহিত্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ মহিমময় ভূমি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইখানে—কেবল এইখানেই লোকে তাহাদের ধর্মে ঘোরতর বিদ্বেষসম্পন্ন অপর ধর্মাবলম্বীর জন্যও মন্দির-গির্জাদি নির্মাণ করিয়া দেয়। পৃথিবীর লোককে আমাদের নিকট এই পরধর্মে সহিষ্ণুতা-রূপ মহতী শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে।



আমাদের দেশের বাহিরে এখনও কি ভয়ানক পরধর্ম-বিদ্বেষ রহিয়াছে, তাহা আপনারা কিছুই জানেন না। পরধর্ম-বিদ্বেষ অনেক স্থানে এরূপ প্রবল যে, অনেক সময় মনে হইয়াছে, আমাকে হয়তো বিদেশে হাড়-কখানা রাখিয়া যাইতে হইবে। ধর্মের জন্য একজনকে মারিয়া ফেলা এত তুচ্ছ কথা যে, আজ না হউক, কালই এই মহাদৃপ্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে এরূপ ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইতে পারে। পাশ্চাত্যদেশে কেহ প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহস করিলে তাহাকে সমাজচ্যুতি ও তাহার আনুষঙ্গিক যত প্রকার গুরুতর নির্যাতন সবই সহ্য করিতে হয়। আপনারাও যদি আমার মত পাশ্চাত্যদেশে গিয়া কিছুদিন বাস করেন, তবে জানিতে পারিবেন যে, এখানে পাশ্চাত্যের লোকেরা খুব সহজে স্বচ্ছন্দে আমাদের জাতিভেদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলিয়া থাকে, কিন্তু সেখানকার বড় বড় অধ্যাপকেরা পর্যন্ত—যাঁহাদের কথা আপনারা এখানে খুব শুনিতে পান, তাঁহারাও অত্যন্ত ভীরু; এবং ধর্মসম্বন্ধে তাঁহারা যাহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করেন, সাধারণের সমালোচনার ভয়ে তাহার শতাংশের একাংশও মুখ ফুটিয়া বলিতে সাহস করেন না।


এই কারণেই পৃথিবীকে এই পরধর্মসহিষ্ণুতারূপ মহান্ সত্য শিক্ষা করিতে হইবে। আধুনিক সভ্যতার ভিতরে এই ভাব প্রবেশ করিলে বিশেষ কল্যাণ হইবে। বাস্তবিকই এই ভাবে ভাবিত না হইলে কোন সভ্যতাই অধিক দিন স্থায়ী হইতে পারে না। গোঁড়ামি, রক্তপাত, পাশব অত্যাচার—যতদিন না এগুলি বন্ধ হয়, ততদিন সভ্যতার বিকাশই হইতে পারে না; যতদিন না আমরা পরস্পরের প্রতি মৈত্রীসম্পন্ন হই, ততদিন কোনরূপ সভ্যতাই মাথা তুলিতে পারে না; আর এই মৈত্রীভাব-বিকাশের প্রথম সোপান—পরস্পরের ধর্মবিশ্বাসের উপর সহানুভূতি প্রকাশ করা। শুধু তাহাই নহে, প্রকৃতপক্ষে এই ভাব হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে মুদ্রিত করিতে হইলে পরস্পরের প্রতি শুধু মৈত্রীভাবাপন্ন হইলেই চলিবে না—পরস্পরের ধর্মমত ও বিশ্বাস যতই পৃথক্‌ হউক না কেন, পরস্পরকে সকল বিষয়ে বিশেষভাবে সাহায্য করিতে হইবে। আমরা ভারতে ঠিক তাহাই করিয়া থাকি, এইমাত্র আপনাদিগকে আমি সে-কথা বলিয়াছি। এই ভারতেই কেবল হিন্দুরা খ্রীষ্টানদের জন্য চার্চ ও মুসলমানদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে। এইরূপই করিতে হইবে। তাহারা আমাদিগকে যতই ঘৃণা করুক, তাহারা যতই পাশব ভাব প্রকাশ করুক, তাহারা যতই নিষ্ঠুর হউক ও অত্যাচার করুক—তাহারা সচরাচর যেমন করিয়া থাকে, সেইরূপ আমাদের প্রতি যতই কুৎসিত ভাষার প্রয়োগ করুক, আমরা ঐ খ্রীষ্টানদের জন্য গির্জা ও মুসলমানদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করিতে বিরত হইব না, যতদিন পর্যন্ত না প্রেমবলে উহাদিগকে জয় করিতে পারি; যতদিন পর্যন্ত না আমরা জগতের সমক্ষে প্রমাণ করিতে পারি যে, ঘৃণা ও বিদ্বেষপরায়ণ জাতি কখনও দীর্ঘ জীবন লাভ করিতে পারে না—ভালবাসার বলেই জাতীয় জীবন স্থায়ী হইতে পারে, কেবল পশুত্ব ও শারীরিক শক্তি কখনও জয়লাভ করিতে পারে না, শান্ত স্বভাবই জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়, সফল হয়।


পৃথিবীকে, ইওরোপ ও সমগ্র জগতের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে আমাদের আর একটি মহৎ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে হইবে। সমগ্র জগতের আধ্যাত্মিক একত্বরূপ এই সনাতন মহৎ তত্ত্ব— সম্ভবতঃ উচ্চজাতি অপেক্ষা নিম্নজাতির, শিক্ষিত ব্যক্তিগণ অপেক্ষা অজ্ঞ জনসাধারণের, বলবান্‌ অপেক্ষা দুর্বলের পক্ষেই বেশী প্রয়োজনীয়।


হে মান্দ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ, আপনাদিগের নিকট আর বিস্তারিতভাবে বুঝাইবার প্রয়োজন নাই যে, ইওরোপের আধুনিক গবেষণা জড়বিজ্ঞানের প্রণালীতে কিরূপে সমগ্র জগতের একত্ব প্রমাণ করিয়াছে—পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তুমি আমি সূর্য চন্দ্র তারা প্রভৃতি সবই অনন্ত জড়সমুদ্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গস্বরূপ। আবার শত শত শতাব্দী পূর্বে ভারতীয় মনোবিজ্ঞানও জড়বিজ্ঞানের ন্যায় প্রমাণ করিয়াছে যে, শরীর ও মন উভয়ই জড়সমুদ্রে বা সমষ্টির মধ্যে কতকগুলি পৃথক্‌ পৃথক‌্ সংজ্ঞা অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গমাত্র। আবার আর এক পদ অগ্রসর হইয়া বেদান্তে দেখানো হইয়াছে—এই আপাত-প্রতীয়মান জগৎপ্রপঞ্চের একত্বভাবেরও পশ্চাতে যে যথার্থ আত্মা রহিয়াছেন, তিনিও ‘এক’। জগদ-ব্রহ্মাণ্ড জুড়িয়া একমাত্র আত্মাই রহিয়াছেন—সবই সেই এক সত্তামাত্র। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মূলে বাস্তবিক যে এই একত্ব রহিয়াছে—এই মহান্‌ তত্ত্ব শ্রবণ করিয়া অনেকে ভয় পাইয়া থাকেন! অন্যান্য দেশের কথা দূরে থাকুক, এদেশেও অনেকে এই অদ্বৈতবাদকে ভয় করিয়া থাকেন!এখনও এই মতের অনুগামী অপেক্ষা বিরোধীর সংখ্যাই অধিক! তথাপি আমি বলিতেছি, যদি জগৎকে আমাদের জীবনপ্রদ একটি মহৎ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে হয়, তবে তাহা এই অদ্বৈতবাদ। ভারতের মূক জনসাধারণের উন্নতিবিধানের জন্য এই অদ্বৈতবাদের প্রচার আবশ্যক। এই অদ্বৈতবাদ কার্যে পরিণত না হইলে আমাদের এই মাতৃভূমির পুনরুজ্জীবনের আর উপায় নাই।


যুক্তিবাদী পাশ্চাত্যজাতি নিজেদের সমুদয় দর্শন ও নীতিবিজ্ঞানের মূলভিত্তি অনুসন্ধান করিতেছে। কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষ, তিনিই যতই বড় বা ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তি হউন না কেন, যখন কাল জন্মগ্রহণ করিয়া আজই মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছেন, তখন তাঁহার অনুমোদিত বলিয়াই কোন দর্শন বা নীতিবিজ্ঞান প্রামাণিক হইতে পারে না। দর্শন বা নীতির প্রমাণের শুধু এই কারণ নির্দেশ করিলে তাহা কখনও উচ্চশ্রেণীর চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না; কোন মানুষের অনুমোদিত বলিয়া উহার প্রামাণ্য না মানিয়া তাঁহারা দেখিতে চাহেন, চিরন্তন তত্ত্বসমূহের উপরই উহার ভিত্তি স্থাপিত রহিয়াছে। একমাত্র অনন্ত সত্য তোমাতে, আমাতে—আমাদের সকলের আত্মায় বর্তমান রহিয়াছেন; অনাদী অনন্ত আত্মতত্ত্ব ব্যতীত নীতিবিজ্ঞানের সনাতন ভিত্তি আর কি হইতে পারে? আত্মার অনন্ত একত্বই সর্বপ্রকার নীতির মূলভিত্তি; তোমাতে আমাতে শুধু ‘ভাই ভাই’ সম্বন্ধ নহে,—মানবের দাসত্বশৃঙ্খল মোচন-চেষ্টার বর্ণনাপূর্ণ সকল গ্রন্থেই এই ‘ভাই ভাই’ ভাবের কথা আছে এবং শিশুতুল্য ব্যক্তিরাই তোমাদের নিকট উহার প্রচার করিয়াছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তুমি আমি এক—ভারতীয় দর্শনের ইহাই সিদ্ধান্ত। সর্বপ্রকার নীতি ও ধর্মবিজ্ঞানের মূলভিত্তি এই একত্ব।


আমাদের দেশের সামাজিক অত্যাচারে পদদলিত সাধারণ লোকেরা যেমন এই মতের দ্বারা উপকৃত হইতে পারে, ইওরোপের পক্ষেও তেমনি ইহার প্রয়োজন। বাস্তবিকপক্ষে ইংলণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকায় আজকাল যেভাবে রাজনীতিক ও সামাজিক উন্নতিবিধানের চেষ্টা হইতেছে, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হয়, অজ্ঞাতসারে এখনই তাহারা এই মহান্‌ তত্ত্বকে সকল উন্নতির মূলভিত্তিরূপে গ্রহণ করিতেছে। আর হে বন্ধুগণ, আপনারা ইহাও লক্ষ্য করিবেন যে, সাহিত্যের মধ্যে যেখানে মানুষের স্বাধীনতা—অনন্ত স্বাধীনতার চেষ্টা অভিব্যক্ত, সেইখানেই ভারতীয় বৈদান্তিক আদর্শসমূহ পরিস্ফুট। কোন কোন ক্ষেত্রে লেখকগণ তাঁহাদের প্রচারিত ভাবসমূহের মূল উৎস সম্বন্ধে অজ্ঞ, কোন কোন স্থলে তাঁহারা নিজদিগকে মৌলিক গবেষণাশীল বলিয়া প্রমাণ করিতে সচেষ্ট। কিন্তু কেহ কেহ আবার নির্ভয়ে কৃতজ্ঞহৃদয়ে কোথা হইতে তাঁহারা ঐ-সকল তত্ত্ব পাইয়াছেন, তাহা উল্লেখ করিয়া বেদান্তের নিকট ঋণ স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।


বন্ধুগণ, আমেরিকায় আমি অদ্বৈতবাদই অধিক প্রচার করিতেছি, দ্বৈতবাদ প্রচার করিতেছি না—একবার এইরূপ অভিযোগ শুনিয়াছিলাম। দ্বৈতবাদের প্রেম ভক্তি ও উপাসনায় যে কি অসীম আনন্দ লাভ হয়, তাহা আমি জানি; উহার অপূর্ব মহিমা আমি সম্পূর্ণ অবগত। কিন্তু বন্ধুগণ, এখন আমাদের আনন্দে ক্রন্দন করিবারও সময় নাই। আমরা যথেষ্ট কাঁদিয়াছি। এখন আর আমাদের কোমলভাব অবলম্বন করিবার সময় নাই। এইরূপে কোমলতার সাধন করিতে করিতে আমরা এখন জীবন্মৃত হইয়া পড়িয়াছি—আমরা রাশীকৃত তুলার মত কোমল হইয়া পড়িয়াছি। আমাদের দেশের পক্ষে এখন প্রয়োজন—লৌহবৎ দৃঢ় মাংসপেশী ও ইস্পাতের মত স্নায়ু; এমন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি চাই, কেহই যেন উহাকে প্রতিরোধ করিতে সমর্থ না হয়, উহা যেন ব্রহ্মাণ্ডের সমুদয় রহস্যভেদে সমর্থ হয়—যদি-বা এই কার্যসাধনে সমুদ্রের অতল তলে যাইতে হয়, যদি-বা সর্বদা সর্বপ্রকার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হয়! ইহাই এখন আমাদের আবশ্যক; আর অদ্বৈতবাদের মহান্ আদর্শ ধারণা করিয়া উপলব্ধি করিতে পারিলেই ঐ ভাবের আবির্ভাব, প্রতিষ্ঠা ও দৃঢ়তাসাধন হইতে পারে।


বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস—নিজের উপর বিশ্বাস—ঈশ্বরে বিশ্বাস—ইহাই উন্নতিলাভের একমাত্র উপায়। তোমার যদি এদেশীয় পুরাণের তেত্রিশ কোটি দেবতার উপর এবং বৈদেশিকেরা মধ্যে মধ্যে যে-সকল দেবতার আমদানি করিয়াছে, তাহাদের সবগুলির উপরই বিশ্বাস থাকে, অথচ যদি তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে তোমার কখনই মুক্তি হইবে না। নিজের উপর বিশ্বাসসম্পন্ন হও—সেই বিশ্বাস-বলে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও এবং বীর্যবান্ হও। ইহাই এখন আমাদের আবশ্যক। আমরা এই ত্রিশ কোটি লোক সহস্র বৎসর যাবৎ যে-কোন মুষ্টিমেয় বিদেশী আমাদের ভূলুণ্ঠিত দেহকে পদদলিত করিবার ইচ্ছা করিয়াছে, তাহাদেরই পদানত হইয়াছি, কেন? কারণ উহাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস ছিল—আমাদের ছিল না।


আমি পাশ্চাত্যদেশে গিয়া কি শিখিলাম? খ্রীষ্টীয় ধর্মসম্প্রদায়গুলি যে মানুষকে পতিত ও নিরুপায় পাপী বলিয়া নির্দেশ করে, এই-সকল বাজে কথার অন্তরালে উহাদের জাতীয় উন্নতির কি কারণ দেখিলাম?—দেখিলাম ইওরোপ ও আমেরিকা উভয়ত্র জাতীয় হৃদয়ের অভ্যন্তরে মহান্ আত্মবিশ্বাস নিহিত রহিয়াছে। একজন ইংরেজ বালক তোমাকে বলিবে, ‘আমি একজন ইংরেজ—আমি সব করিতে পারি।’ আমেরিকান বালকও এই কথা বলিবে— প্রত্যেক ইওরোপীয় বালকই এই কথা বলিবে। আমাদের বালকগণ এই কথা বলিতে পারে কি? না, পারে না; বালকগণ কেন, তাহাদের পিতারা পর্যন্ত পারে না। আমরা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারাইয়াছি। এই জন্যই বেদান্তের অদ্বৈত-ভাব প্রচার করা আবশ্যক, যাহাতে লোকের হৃদয় জাগ্রত হয়, যাহাতে তাহারা নিজ আত্মার মহিমা জানিতে পারে। এই জন্যই আমি অদ্বৈতবাদ প্রচার করিয়া থাকি; আর আমি সাম্প্রদায়িকভাবে উহা প্রচার করি না—সার্বভৌম ও সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি প্রদর্শন করিয়া আমি উহা প্রচার করিয়া থাকি।


এই অদ্বৈতবাদ এমনভাবে প্রচার করা যাইতে পারে—যাহাতে দ্বৈতবাদী বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরও কোন আপত্তির কারণ থাকিবে না; আর এই-সকল মতের সামঞ্জস্যসাধনও বড় কঠিন নহে। ভারতে এমন কোন ধর্ম নাই যাহাতে বলা হয় নাই যে, ভগবান্‌ সকলের ভিতরে রহিয়াছেন। বিভিন্ন মতের বৈদান্তিকগণ সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন যে, জীবাত্মার মধ্যে পূর্ব হইতেই পবিত্রতা, বীর্য ও পূর্ণত্ব অন্তর্নিহিত রহিয়াছে! তবে কাহারও কাহারও মতে এই পূর্ণত্ব যেন কখনও কখনও সঙ্কুচিত হইয়া যায়, আবার অন্য সময়ে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। তাহা হইলেও সেই পূর্ণত্ব যে আমাদের মধ্যেই রহিয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। অদ্বৈতবাদ-মতে উহা সঙ্কুচিতও হয় না, বিকাশপ্রাপ্তও হয় না, তবে সময়ে সময়ে অপ্রকাশিত ও প্রকাশিত হইয়া থাকে মাত্র। কার্যতঃ দ্বৈতবাদের সহিত ইহা অনেকটা একরূপই হইল। একটি মত অপরটি অপেক্ষা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হইতে পারে, কিন্তু উভয় মতই কার্যতঃ প্রায় একই প্রকার। এই মূল তত্ত্বটি প্রচার করা জগতের পক্ষে অতি আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে; আর আমাদের এই মাতৃভূমিতে ইহার যত অভাব, আর কোথাও তত নহে।


বন্ধুগণ, আমি তোমাদিগকে গোটাকতক রূঢ় অপ্রিয় সত্য শুনাইতে চাই। সংবাদপত্রে পড়া যায়, আমাদের একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে কোন ইংরেজ খুন করিয়াছে, অথবা কাহারও প্রতি অত্যন্ত অসদ্ব্যবহার করিয়াছে। অমনি সমগ্র দেশে হইচই পড়িয়া গেল; সংবাদপত্রে এই সংবাদ পড়িয়া অশ্রু বিসর্জন করিলাম, কিন্তু পর মুহূর্তেই আমার মনে প্রশ্ন উদিত হইল—এ-সকলের জন্য দায়ী কে? যখন আমি একজন বেদান্তবাদী, তখন আমি নিজেকে এ প্রশ্ন না করিয়া থাকিতে পারি না। হিন্দু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন; সে নিজের মধ্যেই সকল বিষয়ের কারণ অনুসন্ধান করে। আমি যখনই আমার মনকে এ বিষয় জিজ্ঞাসা করি—কে ইহার জন্য দায়ী? তখন প্রত্যেকবারই আমি এই উত্তর পাইয়া থাকি যে, ইহার জন্য ইংরেজ দায়ী নয়; আমরাই আমাদের দুর্দশা, অবনতি ও দুঃখকষ্টের জন্য দায়ী—একমাত্র আমরাই দায়ী।


আমাদের অভিজাত পুরুষগণ দেশের সাধারণ লোককে পদদলিত করিতে লাগিলেন—ক্রমশঃ তাহারা একেবারে অসহায় হইয়া পড়িল; অত্যাচারে এই দরিদ্র ব্যক্তিগণ ক্রমশঃ ভুলিয়া গেল যে তাহারা মানুষ। শত শত শতাব্দী যাবৎ তাহারা বাধ্য হইয়া কেবল কাঠ কাটিয়াছে, আর জল তুলিয়াছে। ক্রমশঃ তাহাদের মনে এই বিশ্বাস দাঁড়াইয়াছে যে, তাহারা ক্রীতদাস হইয়া জন্মিয়াছে—কাঠ কাটিবার ও জল তুলিবার জন্যই তাহাদের জন্ম। আর যদি কেহ তাহাদের প্রতি দয়া প্রকাশ করিয়া দু-একটি কথা বলিতে বলে, তবে প্রায়ই দেখিতে পাই—আধুনিক কালের শিক্ষাভিমানী আমাদের স্বজাতীয়গণ এই পদদলিত জনগণের উন্নতি-সাধনরূপ কর্তব্য কর্ম হইতে সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে।


শুধু তাই নয়, আরও দেখিতে পাই—উহারা পাশ্চাত্যদেশের বংশানুক্রমিক সংক্রমণ (hereditary transmission) ও সেই ধরনের অন্যান্য কতকগুলি অকিঞ্চিৎকর মতসহায়ে এমন সব পাশব ও আসুরিক যুক্তি প্রদর্শন করিয়া থাকে, যাহাতে দরিদ্রগণের উপর অত্যাচার করিবার ও উহাদিগকে আরও পশুপ্রকৃতি করিয়া ফেলিবার অধিকতর সুবিধা হয়। আমেরিকার ধর্মমহাসম্মেলনে অন্যান্য ব্যক্তিদের সহিত একজন নিগ্রো যুবকও আসিয়াছিল, সে খাঁটি আফ্রিকার নিগ্রো। একটি সুন্দর বক্তৃতাও সে দিয়াছিল। ঐ যুবকটি সম্বন্ধে আমার কৌতূহল হইল, আমি তাহার সহিত মধ্যে মধ্যে কথাবার্তা বলিতে লাগিলাম, কিন্তু তাহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিতে পারিলাম না। কিছুদিন পরে ইংলণ্ডে কয়েকটি আমেরিকানের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়; তাহারা আমাকে ঐ যুবকটি সম্বন্ধে এইরএপ বলিলঃ এই যুবক মধ্য-আফ্রিকার জনৈক নিগ্রো দলপতির পুত্র; কোন কারণে অপর একজন দলপতি ইহার পিতার প্রতি অতিশয় ক্রুদ্ধ হয় এবং তাহাকে ও তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া তাহাদের মাংস রাঁধিয়া খাইয়া ফেলে। সে এই বালকটিকেও হত্যা করিয়া খাইয়া ফেলিবার আদেশ দিয়াছিল। বালকটি কোনক্রমে পলায়ন করিয়া অনেক কষ্ট সহ্য করিয়া শত শত ক্রোশ ভ্রমণের পর সমুদ্রতীরে উপস্থিত হয়, সেখান হইতে একটি আমেরিকান জাহাজে করিয়া আমেরিকায় আসিয়াছে। সেই বালকটি এমন সুন্দর বক্তৃতা করিল! এইরূপ ঘটনা দেখিবার পর ‘বংশানুক্রমিক সংক্রমণ’ মতবাদে আর কিরূপে আস্থা থাকিতে পারে?


হে ব্রাহ্মণগণ! বংশানুক্রমিক ভাবসংক্রমণের নিয়ম অনুসারে বিদ্যাশিক্ষায় যদি ব্রাহ্মণের অধিকতর যোগ্যতা থাকে, তবে তাহার শিক্ষায় অর্থব্যয় না করিয়া চণ্ডালজাতির শিক্ষায় সমুদয় অর্থ ব্যয় কর। দুর্বলকে আগে সাহায্য কর; কারণ তাহারই তো সবটুকু সাহায্য প্রয়োজন। যদি ব্রাহ্মণ বুদ্ধিমান্ হইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে, তবে সে কোনরূপ সাহায্য ছাড়াই শিক্ষালাভ করিতে পারিবে। যদি অপর জাতি সেইরূপ বুদ্ধিমান না হয়, তবে কেবল তাহাদিগকেই শিক্ষা দিতে থাক—তাহাদিগের জন্যই শিক্ষক নিযুক্ত কর। আমার তো মনে হয়, ইহাই ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত।


এই দরিদ্রগণকে—ভারতের এই পদদলিত জনসাধারণকে তাহাদের স্বরূপ বুঝাইয়া দেওয়া আবশ্যক। জাতিবর্ণনির্বিশেষে সবলতা-দুর্বলতার বিচার না করিয়া প্রত্যেক নরনারীকে, প্রত্যেক বালকবালিকাকে শুনাও শিখাও—সবল-দুর্বল, উচ্চ-নীচনির্বিশেষে সকলেরই ভিতর সেই অনন্ত আত্মা রহিয়াছেন; সুতরাং সকলেই মহৎ হইতে পারে, সকলেই সাধু হইতে পারে। সকলেরই সমক্ষে উচ্চৈঃস্বরে বল—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’। উঠ, জাগ—যতদিন না চরম লক্ষ্যে পৌঁছিতেছ, ততদিন নিশ্চিন্ত থাকিও না। উঠ জাগ—নিজদিগকে দুর্বল ভাবিয়া তোমরা যে মোহে আচ্ছন্ন হইয়া আছ, তাহা দূর করিয়া দাও। কেহই প্রকৃতপক্ষে দুর্বল নহে—আত্মা অনন্ত, সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ। উঠ, নিজের স্বরূপ প্রকাশিত কর—তোমার ভিতর যে ভগবান্‌ রহিয়াছেন, তাঁহাকে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা কর, তাঁহাকে অস্বীকার করিও না। আমাদের জাতির ভিতর ঘোর আলস্য, দুর্বলতা ও মোহ আসিয়া পড়িয়াছে। হে আধুনিক হিন্দুগণ, এই মোহজাল ছিন্ন কর। ইহার উপায় তোমাদের শাস্ত্রেই রহিয়াছে। তোমরা নিজ নিজ স্বরূপের চিন্তা কর এবং সর্বসাধারণকে ঐ শিক্ষা দাও। ঘোর মোহনিদ্রায় অভিভূত জীবাত্মার নিদ্রাভঙ্গ কর। আত্মা প্রবুদ্ধ হইলে শক্তি আসিবে, মহিমা আসিবে, সাধুত্ব আসিবে, পবিত্রতা আসিবে—যাহা কিছু ভাল সকলই আসিবে। যদি গীতার মধ্যে কিছু আমার ভাল লাগে, তবে তাহা এই দুইটি মহাবলপ্রদ শ্লোক—শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের সারস্বরূপঃ


সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্।

বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি||

সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।

ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্||৭


বিনাশশীল সর্বভূতের মধ্যে অবিনাশী পরমেশ্বরকে যিনি সমভাবে অবস্থিত দেখেন, তিনিই যথার্থ দর্শন করেন; কারণ, ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি নিজেকে হিংসা করেন না, সুতরাং পরমগতি প্রাপ্ত হন।


সুতরাং দেখা যাইতেছে, বেদান্ত-প্রচারের দ্বারা এদেশে ও অন্যান্য দেশে যথেষ্ট লোকহিতকর কার্যের প্রবর্তন করা যাইতে পারে। এদেশে এবং অন্যত্র সমগ্র মনুষ্যজাতির দুঃখমোচন ও উন্নতিবিধানের জন্য পরমাত্মার সর্বব্যাপিত্ব ও সর্বত্র সমভাবে অবস্থিতিরূপ অপূর্ব তত্ত্বদ্বয় প্রচার করিতে হইবে। যেখানেই অশুভ—যেখানেই অজ্ঞান দেখা যায়, আমি আমার অভিজ্ঞতা হইতে বুঝিয়াছি এবং আমাদের শাস্ত্রও বলিয়া থাকেন, যা কিছু অশুভ, ভেদবুদ্ধি হইতেই উৎপন্ন এবং অভেদবুদ্ধি হইতে, অর্থাৎ সকল বিভিন্নতার মধ্যে এক সত্তা রহিয়াছে, এইরূপ বিশ্বাস করিলে সর্ববিধ কল্যাণ হইয়া থাকে। ইহাই বেদান্তের মহান্‌ আদর্শ।


তবে সকল বিষয়েই শুধু আদর্শে বিশ্বাস করা এক কথা, আর দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক খুঁটিনাটি বিষয়ে সেই আদর্শ অনুযায়ী চলা আর এক কথা। একটি উচ্চ আদর্শ দেখাইয়া দেওয়া অতি উত্তম, কিন্তু ঐ আদর্শে পৌঁছিবার কার্যকর উপায় কই? এখানে স্বভাবতঃ সেই কঠিন প্রশ্নটি আসিয়া উপস্থিত হয়, যাহা আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া সর্বসাধারণের মনে বিশেষভাবে জাগিতেছে; সেই প্রশ্ন আর কিছুই নহে—জাতিভেদ ও সমাজসংস্কার-বিষয়ক সেই পুরাতন সমস্যা। আমি সমাগত শ্রোতৃবৃন্দের নিকট খোলাখুলি বলিতে চাই যে, আমি একজন জাতিভেদলোপকারী বা সমাজসংস্কারক মাত্র নহি। জাতিভেদ বা সমাজসংস্কার-বিষয়ে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে আমার কিছু করিবার নাই। তুমি যে-কোন জাতির লোক হও, তাহাতে কোন ক্ষতি নাই, তবে সেজন্য অপর জাতির কাহাকেও ঘৃণা করিতে পার না। প্রেম—একমাত্র প্রেমই আমি প্রচার করিয়া থাকি; আর আমার এই উপদেশ বিশ্বাত্মার সর্বব্যাপিত্ব ও সমত্বরূপ বেদান্তের সেই মহান্ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।


বিগত প্রায় একশত বৎসর যাবৎ আমাদের দেশ সমাজসংস্কারকে ও তাঁহাদের নানাবিধ সমাজসংস্কার-বিষয়ক প্রস্তাবে প্লাবিত হইয়াছে। এই সংস্কারকগণের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে কিছুই বলিবার নাই। ইঁহাদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য খুব ভাল এবং কোন কোন বিষয়ে তাঁহাদের উদ্দেশ্য অতি প্রশংসনীয়। কিন্তু ইহাও স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, এই শতবর্ষব্যাপী সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে সমগ্র দেশে স্থায়ী শুভফল কিছু হয় নাই। বক্তৃতামঞ্চ হইতে সহস্র সহস্র বক্তৃতা হইয়া গিয়াছে—হিন্দুজাতি ও হিন্দুসভ্যতার মস্তকে অজস্র নিন্দাবাদ ও অভিশাপ বর্ষিত হইয়াছে, কিন্তু তথাপি সমাজের বাস্তবিক কোন উপকার হয় নাই। ইহার কারণ কি? কারণ বাহির করা শক্ত নহে। নিন্দাবাদ ও গালিবর্ষণই ইহার কারণ। প্রথমতঃ তোমাদিগকে পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদিগকে আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিতে হইবে। আমি স্বীকার করি, অন্যান্য জাতির নিকট হইতে আমাদিগকে অনেক বিষয় শিক্ষা করিতে হইবে; কিন্তু দুঃখের সহিত আমাকে বলিতে হইতেছে যে, আমাদের অধিকাংশ আধুনিক সংস্কারই পাশ্চাত্য কার্যপ্রণালীর বিবেচনাহীন অনুকরণ-মাত্র। ভারতে ইহা দ্বারা কাজ হইবে না। এই কারণেই আমাদের বর্তমান সংস্কার-আন্দোলনগুলি দ্বারা কোন ফল হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ কাহারও কল্যাণ সাধন করিতে হইলে নিন্দা বা গালিবর্ষণের দ্বারা কোন কাজ হয় না। আমাদের সমাজে যে অনেক দোষ আছে, সামান্য বালকেও তাহা দেখিতে পায়; আর কোন্ সমাজেই বা দোষ নাই?


হে আমার স্বদেশবাসিগণ, এই অবসরে তোমাদিগকে বলিয়া রাখি যে, আমি পৃথিবীর যে-সকল জাতি দেখিয়াছি, সেই বিভিন্ন জাতির সহিত তুলনা করিয়া আমি এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইয়াছি যে, আমাদের জাতিই মোটের উপর অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিকতর নীতিপরায়ণ ও ধার্মিক, এবং আমাদের সামাজিক বিধানগুলির উদ্দেশ্য ও কার্য-প্রণালী বিচার করিলে দেখা যায় যে, সেগুলিই মানবজাতিকে সুখী করিবার সর্বাপেক্ষা উপযোগী। এই জন্যই আমি কোন সংস্কার চাই না; আমার আদর্শ—জাতীয় আদর্শে সমাজের উন্নতি, বিস্তৃতি ও পরিণতি। যখন আমি আমার দেশের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তখন সমগ্র পৃথিবীতে এমন আর একটি দেশ দেখিতে পাই না, যাহা মানব-মনের উন্নতির জন্য এত অধিক কাজ করিয়াছে। এই কারণেই আমি আমার জাতিকে কোনরূপ নিন্দা করি না বা গালি দিই না। আমি বলি—‘যাহা করিয়াছ, বেশ হইয়াছে; আরও ভাল করিবার চেষ্টা কর।’ এদেশে প্রাচীন কালে অনেক বড় বড় কাজ করা হইয়াছে, কিন্তু আরও বড় বড় কাজ করিবার এখনও যথেষ্ট সময় ও অবকাশ রহিয়াছে। তোমরা নিশ্চয়ই জান, আমরা নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিতে পারি না। যদি একস্থানে বসিয়া থকি, তবে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। আমাদিগকে হয় সম্মুখে, নয় পশ্চাতে যাইতে হইবে; হয় আমাদিগকে উন্নতি সাধন করিতে হইবে, নতুবা আমাদের অবনতি হইবে। আমাদের পূর্বপূরুষগণ প্রাচীনকালে বড় বড় কাজ করিয়াছিলেন, কিন্তু আমাদিগকে তাঁহাদের অপেক্ষা উচ্চতর জীবনের বিকাশ করিতে হইবে এবং তাঁহাদের অপেক্ষা মহত্তর কর্মের দিকে অগ্রসর হইতে হইবে। এখন পশ্চাতে হটিয়া গিয়া অবনত হওয়া কিরূপে সম্ভব? তাহা হইতেই পারে না, তাহা কখনই হইতে দেওয়া হইবে না। পশ্চাতে হটিলে জাতির অধঃপতন ও মৃত্যু হইবে; অতএব ‘অগ্রসর হও এবং মহত্তর কর্মসমূহের অনুষ্ঠান কর’—ইহাই তোমাদের নিকট আমার বক্তব্য।


আমি কোনরূপ সাময়িক সমাজসংস্কারের প্রচারক নহি। আমি সমাজের বিশেষ কোন অমঙ্গলের প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিতেছি না; আমি বলিতেছি—তোমরা অগ্রসর হও এবং আমাদের পূর্বপুরষগণ সমগ্র মানবজাতির উন্নতির জন্য যে সর্বাঙ্গসুন্দর প্রণালীর উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন, সেই প্রণালী অবলম্বন করিয়া তাঁহাদের উদ্দেশ্য নিখুঁতভাবে কার্যে পরিণত কর। তোমাদের নিকট আমার কেবল ইহাই বক্তব্য যে, তোমরা সমগ্র মনুষ্যজাতির একত্ব ও মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব—এই বৈদান্তিক আদর্শ উত্তরোত্তর অধিকতর উপলব্ধি করিতে থাক। যদি আমার সময় থাকিত, তবে আমি তোমাদিগকে আনন্দের সহিত দেখাইয়া দিতাম যে, এখন আমাদিগকে যাহা করিতে ইহবে, তাহার প্রত্যেকটি আমাদের প্রাচীন স্মৃতিকারগণ সহস্র সহস্র বৎসর পূর্বেই বলিয়া গিয়াছেন, এবং এখন আমাদের জাতীয় আচার-ব্যবহারে যে-সকল পরিবর্তন ঘটিতেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটিবে, সেগুলিও তাঁহারা যথার্থই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহারাও জাতিভেদলোপকারী ছিলেন, তবে আধুনিকদিগের মত নহে। তাঁহারা জাতিভেদরাহিত্য অর্থে বুঝিতেন না যে, শহরের সব লোক মিলিয়া একত্র মদ্যমাংস আহার করুক, অথবা যত আহাম্মক ও পাগল মিলিয়া যখন যেখানে যাহাকে ইচ্ছা বিবাহ করুক, আর দেশটাকে একটা পাগলা-গারদে পরিণত করুক; অথবা তাঁহারা ইহাও বিশ্বাস করিতেন না যে, বিধবাগণের পতির সংখ্যা দ্বারা কোন জাতির উন্নতির পরিমাণ নির্ণয় করিতে হইবে। এরূপ করিয়া উন্নত হইয়াছে—এমন জাতি তো আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই।


ব্রাহ্মণই আমাদের পূর্বপুরুষগণের আদর্শ ছিলেন। আমাদের সকল শাস্ত্রেই এই ব্রাহ্মণের আদর্শ চরিত্র উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। ইওরোপের শ্রেষ্ঠ ধর্মাচার্যগণও—নিজেদের পূর্বপুরুষগণ যে সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন, তাহা প্রমাণ করিতে সহস্রমুদ্রা ব্যয় করিতেছেন, এবং যতক্ষণ না তাঁহারা প্রমাণ করিতে পারেন যে, পথিকের সর্বস্ব-লুণ্ঠনকারী পর্বতনিবাসী কোন ভয়ঙ্কর অত্যাচারী ব্যক্তি তাঁহাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন, ততক্ষণ তাঁহারা কিছুতেই শান্তি পান না। অপর দিকে আবার ভারতের বড় বড় রাজবংশধরগণ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করেন—কৌপীনধারী অরণ্যবাসী ফলমূলাহারী বেদাধ্যায়ী কোন প্রাচীন ঋষি হইতে তাঁহাদের বংশের উৎপত্তি। এখানে যদি তুমি কোন প্রাচীন ঋষিকে তোমার পূর্বপুরুষরূপে প্রতিপন্ন করিতে পার, তবে তুমি উচ্চজাতীয় হইলে, নতুবা নহে। সুতরাং আমাদের আভিজাত্যের আদর্শ অন্যান্য জাতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। আধ্যাত্মিক-সাধনসম্পন্ন ও মহাত্যাগী ব্রাহ্মণই আমাদের আদর্শ। ‘ব্রাহ্মণ আদর্শ’ বলিতে আমি কি বুঝিতেছি?—যাহাতে সাংসারিকতা একেবারে নাই এবং প্রকৃত জ্ঞান প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান, তাহাই আদর্শ ব্রাহ্মণত্ব। ইহাই হিন্দুজাতির আদর্শ। তোমরা কি শোন নাই যে, শাস্ত্রে লিখিত আছে—ব্রাহ্মণের পক্ষে কোন বিধিনিষেধ নাই, তিনি রাজার শাসনাধীন নহেন, তাঁহার মৃত্যুদণ্ড নাই? এ-কথা সম্পূর্ণ সত্য। স্বার্থপর অজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে-ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছে, অবশ্য সে-ভাবে বুঝিও না; প্রকৃত মৌলিক বৈদান্তিকভাবে ইহা বুঝিবার চেষ্টা কর। যদি ব্রাহ্মণ বলিতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি স্বার্থপরতা একেবারে বিসর্জন দিয়াছেন, যাঁহার জীবন জ্ঞান ও প্রেম লাভ করিতে এবং উহা বিস্তার করিতেই নিযুক্ত—কেবল এইরূপ ব্রাহ্মণ ও সৎস্বভাব ধর্মপরায়ণ নরনারী দ্বারা যে-দেশ অধ্যুষিত, সে-জাতি ও সে-দেশ যে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধের অতীত হইবে, ইহাতে আর আশ্চর্য কি! তাঁহাদের শাসনের জন্য আর সৈন্য- সামন্ত পুলিস প্রভৃতির কি প্রয়োজন? তাঁহাদিগকে শাসন করিবার কি প্রয়োজন? তাঁহাদের কোন প্রকার শাসনতন্ত্রের অধীনে বাস করিবারই বা কি প্রয়োজন?


তাঁহারা সাধুপ্রকৃতি মহাত্মা—তাঁহারা ঈশ্বরের অন্তরঙ্গস্বরূপ। আর আমরা শাস্ত্রে দেখিতে পাই—সত্যযুগে একমাত্র এই ব্রাহ্মণ-জাতিই ছিলেন। আমরা মহাভারতে পাঠ করিঃ প্রথমে পৃথিবীর সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন; ক্রমে যতই তাঁহাদের অবনতি হইতে লাগিল, ততই তাঁহারা বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হইলেন; আবার যখন যুগচক্র ঘুরিয়া সেই সত্যযুগের অভ্যুদয় হইবে, তখন আবার সকলেই ব্রাহ্মণ হইবেন। সম্প্রতি যুগচক্র ঘুরিয়া সত্যযুগের অভ্যুদয় সূচিত হইতেছে—আমি তোমাদের দৃষ্টি এ বিষয়ে আকর্ষণ করিতেছি। সুতরাং উচ্চবর্ণকে নিম্ন করিয়া, আহার-বিহারে যথেচ্ছাচার অবলম্বন করিয়া, কিঞ্চিৎ ভোগ-সুখের জন্য স্ব স্ব বর্ণাশ্রমের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া জাতিভেদ-সমস্যার মীমাংসা হইবে না; পরন্তু আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই যদি বৈদান্তিক ধর্মের নির্দেশ পালন করে, প্রত্যেকেই যদি ধার্মিক হইবার চেষ্টা করে, প্রত্যেকেই যদি আদর্শ ব্রাহ্মণ হয়, তবেই এই জাতিভেদ-সমস্যার সমাধান হইবে। তোমরা আর্য, অনার্য, ঋষি, ব্রাহ্মণ অথবা অতি নীচ অন্ত্যজ জাতি—যাহাই হও, ভারতবাসী সকলেরই প্রতি তোমাদের পূর্বপুরুষগণের এক মহান্ আদেশ রহিয়াছে। তোমাদের সকলের প্রতিই এই এক আদেশ, সে আদেশ এইঃ ‘চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না, ক্রমাগত উন্নতির চেষ্টা করিতে হইবে। উচ্চতম জাতি হইতে নিম্নতম পারিয়া (চণ্ডাল) পর্যন্ত সকলকেই আদর্শ ব্রাহ্মণ হইবার চেষ্টা করিতে হইবে।’ বেদান্তের এই আদর্শ শুধু যে ভারতেই খাটিবে, তাহা নহে—সমগ্র পৃথিবীকে এই আদর্শ অনুযায়ী গঠন করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমাদের জাতিভেদের ইহাই লক্ষ্য। ইহার উদ্দেশ্য—ধীরে ধীরে সমগ্র মানবজাতি যাহাতে আদর্শ ধার্মিক হয়—অর্থাৎ ক্ষমা ধৃতি শৌচ শান্তিতে পূর্ণ হয়, উপাসনা ও ধ্যান-পরায়ণ হয়। এই আদর্শ অবলম্বন করিলেই মানবজাতি ক্রমশঃ ঈশ্বর লাভ করিতে পারে।


এই উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত করিবার উপায় কি? তোমাদিগকে আবার স্মরণ করাইয়া দিতেছি যে, অভিশাপ নিন্দা ও গালিবর্ষণের দ্বারা কোন সৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। অনেক বর্ষ ধরিয়া তো ঐরূপ চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কোন সুফল হয় নাই। কেবল ভালবাসা ও সহানুভূতি দ্বারাই সুফল-প্রাপ্তির আশা করা যাইতে পারে। কি উপায়ে এই মহান্ উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত করা যায়, ইহা একটি গুরুতর সমস্যা। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য আমি যাহা করিতে চাই এবং ঐ-বিষয়ে দিন দিন আমার মনে যে-সকল নূতন নূতন ভাব উদিত হইতেছে, সেগুলি বিস্তারিতভাবে বলিতে গেলে আমাকে একাধিক বক্তৃতা দিতে হইবে। অতএব আজ এখানেই বক্তৃতার উপসংহার করিব।


হিন্দুগণ! তোমাদিগকে কেবল ইহাই স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, আমাদের এই মহান্ জাতীয় অর্ণবপোত শত শত শতাব্দী যাবৎ হিন্দুজাতিকে পারাপার করিতেছে। সম্ভবতঃ আজকাল উহাতে কয়েকটি ছিদ্র হইয়াছে—হয়তো উহা কিঞ্চিৎ জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। যদি তাহাই হইয়া থাকে, তবে আমাদের ভারতমাতার সকল সন্তানেরই উচিত— এই ছিদ্রগুলি বন্ধ করিয়া ঐ পোতের জীর্ণসংস্কার করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। আমাদের স্বদেশবাসী সকলকে এই বিপদের কথা জানাইতে হইবে—তাহারা জাগ্রত হউক, তাহারা এদিকে মনঃসংযোগ করুক। আমি ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে দেশবাসীকে ডাকিয়া জাগ্রত করিব, নিজেদের অবস্থা বুঝিয়া কর্তব্য সাধন করিতে তাহাদিগকে আহ্বান করিব। মনে কর, লোকে আমার কথা অগ্রাহ্য করিল, তথাপি আমি তাহাদিগকে গালি বা অভিশাপ দিব না। আমাদের জাতি অতীতকালে মহৎ কর্মসমূহ সম্পাদন করিয়াছে। যদি ভবিষ্যতে আমরা মহত্তর কার্য করিতে নাও পারি, তথাপি এই সান্ত্বনা লাভ করিব যে, আমরা যেন একসঙ্গে শান্তিতে ডুবিয়া মরিতে পারি।


স্বদেশহিতৈষী হও—যে-জাতি অতীতকালে আমাদের জন্য এত বড় বড় কাজ করিয়াছে, সেই জাতিকে প্রাণের সহিত ভালবাসো। আমার স্বদেশবাসিগণ! যতই আমাদের জাতির সহিত অপর জাতির তুলনা করি, ততই তোমাদের প্রতি আমার অধিকতর ভালবাসার সঞ্চার হয়। তোমরা শুদ্ধ, শান্ত, সৎস্বভাব। আর তোমরাই চিরকাল অত্যাচারে প্রপীড়িত হইয়াছ—এই মায়ার জগতে ইহা এক মর্মান্তিক পরিহাস। তাহা হউক, তোমরা উহা গ্রাহ্য করিও না—পরিণামে আধ্যাত্মিকতার জয় হইবেই হইবে। ইত্যবসরে আমাদিগকে কার্য করিতে হইবে, কেবল দেশবাসীর নিন্দা করিলে চলিবে না। আমাদের এই পরম পবিত্র মাতৃভূমির কালজীর্ণ আচার ও প্রথাসকলের নিন্দা করিও না; অতি কুসংস্কারপূর্ণ ও অযৌক্তিক প্রথাগুলির বিরুদ্ধেও একটি নিন্দাসূচক কথা বলিও না, কারণ সেগুলি দ্বারাও অতীতে আমাদের কিছু না কিছু কল্যাণ সাধিত হইয়াছে। সর্বদা মনে রাখিও, আমাদের সামাজিক প্রথাগুলির উদ্দেশ্য যেরূপ মহৎ, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই সেরূপ নহে। আমি পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জাতিভেদ দেখিয়াছি, কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য যেরূপ মহৎ, অন্য কোথাও সেরূপ নহে। অতএব যখন জাতিভেদ অনিবার্য, তখন অর্থগত জাতিভেদ অপেক্ষা পবিত্রতা কৃষ্টি ও আত্মত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ বরং ভাল।


অতএব নিন্দাবাদ একেবারে পরিত্যাগ কর। তোমাদের মুখ বন্ধ হউক, হৃদয় খুলিয়া যাক। এই দেশের এবং সমগ্র জগতের উদ্ধার সাধন কর। তোমাদের প্রত্যেককেই ভাবিতে হইবে, সমুদয় ভার তোমারই উপর। বেদান্তের আলোক প্রতি গৃহে লইয়া যাও, প্রতি গৃহে বেদান্তের আদর্শ অনুযায়ী জীবন গঠিত হউক—প্রত্যেক জীবাত্মায় যে ব্রহ্মত্ব অন্তর্নিহিত রহিয়াছে, তাহা জাগ্রত কর। তাহা হইলেই—তোমার সফলতার পরিমাণ যতটুকুই হউক না কেন—তুমি এই সন্তোষ লাভ করিবে যে, তুমি মহৎকার্যের জন্য জীবনযাপন করিয়াছ এবং মহৎকার্যে প্রাণ দিয়াছ। যেরূপেই হউক, এই মহৎকার্য সাধিত হইলেই মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হইবে।

১০. মান্দ্রাজ অভিনন্দনের উত্তর

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ১০. মান্দ্রাজ অভিনন্দনের উত্তর

[মান্দ্রাজের জনসাধারণ—বিশেষভাবে যুবকগণ, স্বামীজীকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করেন। গাড়ির ঘোড়া খুলিয়া দিয়া যুবকগণ নিজেরাই গাড়ি টানিয়া লইয়া যায়। ‘কার্নান ক্যাসল’-এ স্বামীজী কয়েকদিন অবস্থান করেন। মান্দ্রাজ অভ্যর্থনা-সমিতির এবং খেতড়ি-মহারাজার পক্ষ হইতে দুইটি অভিনন্দন-পত্র প্রদত্ত হয়। এইগুলির উত্তরে স্বামীজী বিভিন্ন দিবসে ছয়টি বক্তৃতা দেন।]


ভদ্রমহোদয়গণ,


একটা কথা আছে—মানুষ নানাবিধ সঙ্কল্প করে, কিন্তু ঈশ্বরের বিধানে যাহা ঘটিবার, তাহাই ঘটিয়া থাকে। ব্যবস্থা হইয়াছিল, অভ্যর্থনা ইংরেজী ধরনে হইবে; কিন্তু এখানে ঈশ্বরের বিধানে কার্য হইতেছে—গীতার ধরনে আমি রথ হইতে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর সমক্ষে বক্তৃতা করিতেছি। এরূপ ঘটনার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেছি। ইহাতে বক্তৃতার জোর বাড়িবে, তোমাদিগকে যাহা বলিতে যাইতেছি, সেই কথাগুলির ভিতর একটা শক্তি আসিবে। জানি না, আমার কণ্ঠস্বর তোমাদের সকলের নিকট পৌঁছিবে কিনা, তবে আমি যতদূর সম্ভব চেষ্টা করিব। ইহার পূর্বে আর কখনও আমার খোলা ময়দানে এত বড় সভায় বক্তৃতা করিবার সুযোগ হয় নাই।


কলম্বো হইতে মান্দ্রাজ পর্যন্ত লোকে আমার প্রতি যেরূপ অপূর্ব সহৃদয়তা দেখাইয়াছে, যেরূপ পরম আনন্দ ও উৎসাহ সহকারে আমার অভ্যর্থনা করিয়াছে এবং সমগ্র ভারতবাসীই যেরূপ অভ্যর্থনা করিবে বলিয়া বোধ হইতেছে, তাহা আমি কল্পনায়ও আশা করি নাই। কিন্তু ইহাতে আমার আনন্দই হইতেছে; কারণ ইহা দ্বারা পূর্বে বার বার আমি যাহা বলিয়াছি, সেই কথারই সত্যতা প্রমাণিত হইতেছে—প্রত্যেক জাতিরই জীবনীশক্তি এক-একটি বিশেষ আদর্শে প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক জাতিই একটি বিশেষ নির্দিষ্ট পথে চলিয়া থাকে, আর ধর্মই ভারতবাসীর সেই বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে বহু কার্যের মধ্যে ধর্ম একটি; প্রকৃতপক্ষে উহা জীবনের অতি ক্ষুদ্র অংশ অধিকার করিয়া থাকে। যথা ইংলণ্ডে, ধর্ম—জাতীয় জীবন-নীতির একটি অংশ মাত্র। ইংলিশ চার্চ ইংলণ্ডের রাজবংশের অধিকারভুক্ত, সুতরাং ইংরেজরা উহাতে বিশ্বাস করুক বা নাই করুক, নিজেদের চার্চ মনে করিয়া তাহারা উহার পোষকতা ও ব্যয়নির্বাহ করিয়া থাকে। প্রত্যেক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারই ঐ চার্চের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক, কারণ উহা ভদ্রতার পরিচায়ক। অন্যান্য দেশ সম্বন্ধেও একই কথা। যেখানেই কোন প্রবল জাতীয় শক্তি দেখা যায়, উহা—হয় রাজনীতি বা বিদ্যাচর্চার উপর, না হয় সমরনীতি বা বাণিজ্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর যে ভাবের উপর সেই শক্তি প্রতিষ্ঠিত, তাহাতেই সেই জাতির প্রাণস্পন্দন অনুভূত হইয়া থাকে। সেইটিই তাহার মুখ্য ভাব; ইহা ছাড়া তাহার অনেক গৌণ পোশাকী ভাব আছে—ধর্ম ঐগুলির অন্যতম।



এখানে—এই ভারতে ধর্ম জাতীয় হৃদয়ের মর্মস্থল। এই ভিত্তির উপরই জাতীয় সৌধ প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি, ক্ষমতা, এমন কি বিদ্যাবুদ্ধির চর্চাও এখানে গৌণমাত্র; সুতরাং ধর্মই এখানকার একমাত্র কার্য, একমাত্র চিন্তা। ভারতীয় জনসাধারণ জগতের কোন সংবাদ রাখে না, শত শতবার আমি এ কথা শুনিয়াছি—কথাটি সত্য। কলম্বোয় যখন নামিলাম, তখন দেখিলাম—ইওরোপে যে-সকল গুরুতর রাজনীতিক পরিবর্তন ঘটিতেছে, যথা মন্ত্রিসভার পতন প্রভৃতি সম্বন্ধে সাধারণ লোক কোন সংবাদ রাখে না; তাহাদের মধ্যে একজনও সোশ্যালিজম্ (Socialism), এনার্কিজম্ (Anarchism) প্রভৃতি শব্দের অর্থ এবং ইওরোপে রাজনীতিক ক্ষেত্রে যে-সব পরিবর্তন ঘটিতেছে, সেগুলির কথা কিছুই শোনে নাই; কিন্তু ভারতবর্ষ হইতে চিকাগোর ধর্ম-মহাসভায় একজন সন্ন্যাসী প্রেরিত হইয়াছিলেন এবং তিনি কতকটা কৃতকার্যও হইয়াছেন, এ-কথা সিংহলের আবালবৃদ্ধবনিতা শুনিয়াছে। ইহাতে প্রমাণিত হইতেছে যে, তাহাদের সংবাদ সংগ্রহ করিবার আগ্রহের অভাব নাই, তবে সেই সংবাদ তাহাদের উপযোগী হওয়া চাই, তাহাদের জীবনযাত্রায় যে-সকল বিষয় অত্যাবশ্যক, তদনুযায়ী কিছু হওয়া চাই। রাজনীতি প্রভৃতি বিষয় কখনও ভারতীয় জীবনের অত্যাবশ্যক বিষয় বলিয়া পরিগণিত হয় নাই, কেবল ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বলেই ভারত চিরকাল বাঁচিয়া আছে ও উন্নতি করিয়াছে এবং উহারই সাহায্যে ভবিষ্যতে বাঁচিয়া থাকিবে।



পৃথিবীর সকল জাতি দুইটি বড় সমস্যার সমাধানে নিযুক্ত। ভারত উহার মধ্যে একটির এবং অন্যান্য জাতি অপরটির মীমাংসায় নিযুক্ত। এখন প্রশ্ন—এই দুইটির মধ্যে কোন্‌টি জয়ী হইবে? কিসে জাতিবিশেষ দীর্ঘ জীবন লাভ করে, কিসেই বা কোন জাতি অতি শীঘ্র বিনাশপ্রাপ্ত হয়? প্রেমের জয় হইবে, না ঘৃণার?—ভোগের জয় হইবে না ত্যাগের?—জড় জয়ী হইবে না চৈতন্য? এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক যুগের অনেক পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যেরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন, আমাদের বিশ্বাসও সেইরূপ। ঐতিহ্যও যে অতীতের ঘনান্ধকার ভেদ করিতে অসমর্থ, সেই অতি প্রাচীনকাল হইতেই আমাদের মহিমময় পূর্বপুরুষগণ এই সমস্যাপূরণে অগ্রসর হইয়াছেন এবং পৃথিবীর নিকট তাঁহাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করিয়া উহার সত্যতা খণ্ডন করিতে আহ্বান করিয়াছেন। আমাদের সিদ্ধান্ত—ত্যাগ, প্রেম ও অপ্রতিকারই জগতে জয়ী হইবার পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত। ইন্দ্রিয়-সুখের বাসনা যে-জাতি ত্যাগ করিয়াছে, সেই জাতিই দীর্ঘজীবী হইতে পারে। প্রমাণস্বরূপ দেখ—ইতিহাস প্রতি শতাব্দীতেই অসংখ্য নূতন নূতন জাতির উৎপত্তি ও বিনাশের কথা আমাদিগকে জানাইতেছে,—শূন্য হইতে উহাদের উদ্ভব, কিছুদিনের জন্য পাপের খেলা খেলিয়া আবার তাহারা শূন্যে বিলীন হইতেছে। কিন্তু এই মহান্ জাতিকে অনেক দুঃখ ও বিপদের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে, অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান করিতে হইয়াছে, যাহা পৃথিবীর অপর কোন জাতিকে করিতে হয় নাই, তাহা সত্ত্বেও এই জাতি জীবিত রহিয়াছে; কারণ এ জাতি ত্যাগের পথ অবলম্বন করিয়াছে; আর ত্যাগ ব্যতীত ধর্ম কি করিয়া থাকিতে পারে?



ইওরোপ এই সমস্যার অপর দিকটি মীমাংসা করিবার চেষ্টা করিতেছে—মানুষ কতদূর ভোগ করিতে পারে, ভালমন্দ যে-কোন উপায়ে মানুষ কত অধিক ক্ষমতা লাভ করিতে পারে। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, সহানুভূতিশূন্য প্রতিযোগিতাই ইওরোপের মূলমন্ত্র। আমরা কিন্তু বর্ণাশ্রমধর্ম দ্বারা এই সমস্যা মীমাংসা করিবার চেষ্টা করিতেছি—এই বর্ণাশ্রমধর্ম প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, তাহার শক্তিকে খর্ব করে, উহার নিষ্ঠুরতা হ্রাস করে; বর্ণাশ্রম দ্বারাই এই রহস্যময় জীবনের মধ্য দিয়া মানবাত্মার গমনপথ সরল ও মসৃণ হইয়া থাকে।


এই সময় (প্রায় ১০,০০০ লোকের) জনতা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হইয়া উঠে। সকলে স্বামীজীর কথা শুনিতে না পাওয়ায় তিনি এই বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেনঃ


বন্ধুগণ, আমি তোমাদের অদ্ভুত উৎসাহ দেখিয়া বড়ই সুখী হইলাম। মনে করিও না, আমি তোমাদের প্রতি কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট হইতেছি; বরং তোমাদের উৎসাহ-প্রকাশে আমি বড়ই আনন্দিত হইয়াছি; ইহাই চাই—প্রবল উৎসাহ। তবে ইহাকে স্থায়ী করিতে হইবে—সযত্নে ইহা রক্ষা করিতে হইবে; এই উৎসাহাগ্নি যেন কখনও নিবিয়া না যায়। আমাদিগকে ভারতে বড় বড় কাজ করিতে হইবে। সেজন্য আমি তোমাদের সাহায্য চাই। এইরূপ উৎসাহ আবশ্যক। আর সভার কার্য চলা অসম্ভব। তোমাদর সদয় ব্যবহার ও সাগ্রহ অভ্যর্থনার জন্য আমি তোমাদিগকে অশেষ ধন্যবাদ দিতেছি। আমরা অন্যসময় ধীর-স্থিরভাবে পরস্পর চিন্তা- বিনিময় করিব। বন্ধুগণ, এখন বিদায়।



তোমরা সকলে শুনিতে পাও, এইভাবে বক্তৃতা করা আর অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং আজ অপরাহ্নে আমাকে দেখিয়াই তোমাদের সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। বক্তৃতা সুবিধামত অন্য সময়ে—ভবিষ্যতে হইবে। তোমাদের উৎসাহ ও অভ্যর্থনার জন্য তোমাদিগকে আবার ধন্যবাদ দিতেছি।


১১. আমার সমরনীতি

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ১১. আমার সমরনীতি

[মান্দ্রাজের ভিক্টোরিয়া হলে প্রদত্ত]


সেদিন অত্যধিক লোকসমাগমের দরুন বক্তৃতায় বেশী অগ্রসর হইতে পারি নাই, সুতরাং আজ এই অবসরে আমি মান্দ্রাজবাসিগণের নিকট বরাবর যে সদয় ব্যবহার পাইয়াছি, সেজন্য তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি। অভিনন্দনপত্রগুলিতে আমার প্রতি যে-সকল সুন্দর সুন্দর বিশেষণ প্রযুক্ত হইয়াছে, তাহার জন্য আমি কিভাবে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব জানি না, তবে প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাকে ঐ বিশেষণগুলির যোগ্য করেন, আর আমি যেন সারা জীবন আমাদের ধর্ম ও মাতৃভূমির সেবা করিতে পারি। প্রভু যেন আমাকে এই কার্যের যোগ্য করেন।


ভদ্রমহোদয়গণ, আমার মনে হয়, অনেক দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও আমার কিছুটা সাহস আছে। ভারত হইতে পাশ্চাত্যদেশে বহন করিবার জন্য আমার একটি বার্তা ছিল—আমি নির্ভীকচিত্তে মার্কিন ও ইংরেজ জাতিকে সেই বার্তা, সেই বাণী শ্রবণ করাইয়াছি। অদ্যকার বিষয় আরম্ভ করিবার পূর্বে আমি তোমাদের সকলের নিকট সাহসপূর্বক কয়েকটি কথা বলিতে চাই। কিছুদিন যাবৎ কতকগুলি ব্যাপার এমন দাঁড়াইতেছে যে, ঐগুলির জন্য আমার কাজে বিশেষ বিঘ্ন ঘটিতেছে। এমনকি সম্ভব হইলে আমাকে একেবারে পিষিয়া ফেলিয়া আমার অস্তিত্ব উড়াইয়া দিবার চেষ্টাও চলিয়াছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এই-সব চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে—আর এইরূপ চেষ্টা চিরদিনই বিফল হইয়া থাকে। গত তিন বৎসর যাবৎ দেখিতেছি, জনকয়েক ব্যক্তির আমার ও আমার কার্য সম্বন্ধে কিছুটা ভ্রান্ত ধারণা হইয়াছে। যতদিন বিদেশে ছিলাম, ততদিন চুপ করিয়াছিলাম, এমন কি একটি কথাও বলি নাই। কিন্তু এখন মাতৃভূমিতে দাঁড়াইয়া এ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বুঝাইয়া বলা আবশ্যক বোধ হইতেছে। এ কথাগুলির কি ফল হইবে, তাহা আমি গ্রাহ্য করি না; এ কথাগুলি বলার দরুন তোমাদের হৃদয়ে কি ভাবের উদ্রেক হইবে, তাহাও গ্রাহ্য করি না। লোকের মতামত আমি কমই গ্রাহ্য করিয়া থাকি। চার বৎসর পূর্বে দণ্ড-কমণ্ডলু-হস্তে সন্ন্যাসিবেশে তোমাদের শহরে প্রবেশ করিয়াছিলাম—আমি সেই সন্ন্যাসীই আছি। সারা দুনিয়া আমার সামনে এখনও পড়িয়া আছে। আর অধিক ভূমিকার প্রয়োজন নাই—এখন আমার বক্তব্য বিষয় বলিতে আরম্ভ করি।


প্রথমতঃ থিওজফিক্যাল সোসাইটি (Theosophical Society) সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার আছে। বলাই বাহুল্য যে, উক্ত সোসাইটির দ্বারা ভারতে কিছু কাজ হইয়াছে। এ কারণে প্রত্যেক হিন্দুই ইহার নিকট, বিশেষতঃ মিসেস বেস্যাণ্টের নিকট কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। মিসেস বেস্যাণ্ট সম্বন্ধে যদিও আমার অল্পই জানা আছে, তথাপি আমি যতটুকু জানি, তাহাতেই নিশ্চয় বুঝিয়াছি যে, তিনি আমাদের মাতৃভূমির একজন অকপট শুভাকাঙ্ক্ষিণী, আর সাধ্যানুসারে তিনি প্রাণপণ আমাদের দেশের উন্নতির জন্য চেষ্টা করিতেছেন। ইহার জন্য প্রত্যেক যথার্থ ভারতসন্তান তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবেন; তাঁহার ও তৎসম্পর্কীয় সকলের উপরেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ চিরকাল বর্ষিত হউক। কিন্তু এ এক কথা, আর থিওজফিস্টদের সোসাইটিতে যোগ দেওয়া আর এক কথা। ভক্তি-শ্রদ্ধা- ভালবাসা এক কথা, আর কোন ব্যক্তি যাহা কিছু বলিবে তর্কযুক্তি না করিয়া, বিচার না করিয়া বিনা বিশ্লেষণে সবই গিলিয়া ফেলা আর এক কথা।



একটা কথা চারিদিকে প্রচারিত হইতেছে যে, আমি আমেরিকা ও ইংলণ্ডে যে সামান্য কাজ করিয়াছি, থিওজফিস্টগণ তাহাতে আমার সহায়তা করিয়াছিলেন। আমি তোমাদিগকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি, এ-কথা সর্বৈব মিথ্যা। এই জগতে উদার ভাব এবং ‘মতভেদ সত্ত্বেও সহানুভূতি’ সম্বন্ধে আমরা অনেক লম্বা লম্বা কথা শুনিতে পাই। বেশ কথা, কিন্তু আমরা কার্যতঃ দেখিতে পাই, যতক্ষণ একজন অপর ব্যক্তির সব কথায় বিশ্বাস করে, ততক্ষণই ঐ ব্যক্তি তাহার প্রতি সহানুভূতি করিয়া থাকে। যখনই কেহ কোন বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করিতে সাহস করে, তখনই সেই সহানুভূতি চলিয়া যায়, ভালবাসা উড়িয়া যায়।


আরও অনেক আছে, তাহাদের নিজেদের এক-একটা স্বার্থ আছে। যদি কোন দেশে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে যাহাতে তাহাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তবে তাহাদের ভিতর প্রভূত ঈর্ষা ও ঘৃণার আবির্ভাব হয়; তাহারা তখন কি করিবে, কিছুই ভাবিয়া পায় না। হিন্দুরা নিজেদের ঘর নিজেরা পরিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে খ্রীষ্টান মিশনারীদের ক্ষতি কি? হিন্দুরা প্রাণপণে নিজেদের সংস্কার-সাধনের চেষ্টা করিতেছে—তাহাতে ব্রাহ্মসমাজ ও অন্যান্য সংস্কার-সভাগুলির কি অনিষ্ট হইবে? ইঁহারা কেন হিন্দুদের সংস্কার-চেষ্টায় বিরোধী হইবেন?ইঁহারা কেন এই-সব আন্দোলনের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়াইবেন? ‘কেন?’—আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি। আমার বোধ হয়, তাঁহাদের ঘৃণা ও ঈর্ষার পরিমাণ এত অধিক যে, এ-বিষয়ে তাঁহাদের নিকট কোনরূপ প্রশ্ন করা সম্পূর্ণ নিরর্থক।



প্রথমে থিওজফিস্টদের কথা বলি। চার বৎসর পূর্বে যখন থিওজফিক্যাল সোসাইটির নেতার নিকট গমন করি—তখন আমি একজন দরিদ্র অপরিচিত সন্ন্যাসী মাত্র, একজনও বন্ধু-বান্ধব নাই, সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া আমাকে আমেরিকায় যাইতে হইবে, কিন্তু কাহারও নামে লিখিত কোনপ্রকার পরিচয়পত্র নাই। আমি স্বভাবতই ভাবিয়াছিলাম, ঐ নেতা যখন একজন মার্কিন এবং ভারতপ্রেমিক, তখন সম্ভবতঃ তিনি আমাকে আমেরিকায় কাহারও নিকট পরিচয়পত্র দিতে পারেন। কিন্তু তাঁহার নিকট গিয়া ঐরূপ পরিচয়পত্র প্রার্থনা করায় তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি আমাদের সোসাইটিতে যোগ দিবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না, আমি কিরূপে আপনাদের সোসাইটিতে যোগ দিতে পারি? আমি আপনাদের অনেক মতই যে বিশ্বাস করি না।’ তিনি বলিলেন, ‘তবে যাও, তোমার জন্য আমি কিছু করিতে পারিব না।’ ‘ইহাই কি আমার পথ করিয়া দেওয়া? আমার থিওজফিষ্ট বন্ধুগণের কেহ যদি এখানে থাকেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, ইহাই কি আমার পথ করিয়া দেওয়া?


যাহা হউক, আমি মান্দ্রাজের কয়েকটি বন্ধুর সাহায্যে আমেরিকায় পৌঁছিলাম। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এখানে উপস্থিত আছেন, কেবল একজন অনুপস্থিত দেখিতেছি—বিচারপতি সুব্রহ্মণ্য আয়ার। আর আমি এই সভায় উক্ত ভদ্রমহোদয়ের উদ্দেশে আমার গভীরতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি, তাঁহার মধ্যে প্রতিভাশালী পুরুষের অন্তর্দৃষ্টি বিদ্যমান, আর এ জীবনে তাঁহার ন্যায় বিশ্বাসী বন্ধু আমি পাই নাই—তিনি ভারতমাতার একজন যথার্থ সুসন্তান। যাহা হউক, আমি আমেরিকায় পৌঁছিলাম। টাকা আমার নিকট অতি অল্পই ছিল—আর ধর্মমহাসভা বসিবার পূর্বেই সব খরচ হইয়া গেল। এদিকে শীত আসিতেছে। আমার শুধু গ্রীষ্মোপযোগী একখানি পাতলা পরিধেয় ছিল। একদিন আমার হাত হিমে আড়ষ্ট হইয়া গেল। এই ঘোরতর শীতপ্রধান দেশে আমি যে কি করিব, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। কারণ যদি রাস্তায় ভিক্ষায় বাহির হই, তবে আমাকে জেলে পাঠাইয়া দিবে। তখন আমার নিকট শেষ সম্বল কয়েকটি ডলার মাত্র ছিল। আমি মান্দ্রাজে কয়েকজন বন্ধুর নিকট তার করিলাম। থিওজফিস্টরা এই ব্যপারটি জানিতে পারিলেন; তাঁহাদের মধ্যে একজন লিখিয়াছিলেন, ‘শয়তানটা শীঘ্রই মরিবে—ঈশ্বরেচ্ছায় বাঁচা গেল।’ ইহাই কি আমার জন্য পথ করিয়া দেওয়া?



আমি এখন এ-সব কথা বলিতাম না, কিন্তু হে আমার স্বদেশবাসিগণ, আপনারা জোর করিয়া ইহা বাহির করিলেন। আমি তিন বৎসর এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করি নাই। নীরবতাই ছিল আমার মূলমন্ত্র, কিন্তু আজ ইহা বাহির হইয়া পড়িল। শুধু তাহাই নহে, আমি ধর্মমহাসভায় কয়েকজন থিওজফিস্টকে দেখিলাম। আমি তাঁহাদের সহিত কথা কহিতে— তাঁহাদের সহিত মিশিতে চেষ্টা করিলাম। তাঁহারা প্রত্যেকেই যে-অবজ্ঞাদৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিলেন, তাহা এখনও আমার স্মরণ আছে। তাঁহাদের সেই অবজ্ঞাদৃষ্টিতে যেন প্রকাশ পাইতেছিল—‘এ একটা ক্ষুদ্র কীট; এ আবার দেবতার মধ্যে কিরূপে আসিল?’ ইহাতে কি আমার পথ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল—বলুন, হইয়াছিল কি?


অতঃপর ধর্মমহাসভায় আমার নামযশ হইল। তখন হইতে প্রচণ্ড কার্যের সূত্রপাত হইল। যে-শহরেই আমি যাই, সেখানেই এই থিওজফিস্টরা আমাকে দাবাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহাদের সদস্যগণকে আমার বক্তৃতা শুনিতে নিষেধ করা হইত, আমার বক্তৃতা শুনিতে আসিলেই তাহারা সোসাইটির সহানুভূতি হারাইবে। কারণ ঐ সোসাইটির এসোটেরিক (গুপ্তসাধনা) বিভাগের মত এইঃ যে-কেহ উহাতে যোগ দিবে, তাহাকে কেবলমাত্র ‘কুথুমি ও মোরিয়ার’—তাঁহারা যাহাই হউন, তাঁহাদের নিকট হইতেই শিক্ষা লইতে হইবে। অবশ্য ইঁহারা অপ্রত্যক্ষ, আর ইঁহাদের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি—মিঃ জজ্ ও মিসেস বেস্যাণ্ট। সুতরাং এসোটেরিক বিভাগে যোগ দেওয়ার অর্থ এই যে, নিজের স্বাধীন চিন্তা একেবারে বিসর্জন দিয়া সম্পূর্ণভাবে ইঁহাদের নিকট আত্মসমর্পণ করা। অবশ্য আমি কখনই এরূপ করিতে পারিতাম না, আর যে-ব্যক্তি এরূপ করে, তাহাকে হিন্দু বলিতেও পারি না।



তারপর থিওজফিস্টদের নিজেদের ভিতরই গণ্ডগোল আরম্ভ হইল। পরলোকগত মিঃ জজের উপর আমার খুব শ্রদ্ধা আছে। তিনি একজন গুণবান, সরল, অকপট প্রতিপক্ষ ছিলেন; আর তিনি থিওজফিস্টদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তাঁহার সহিত মিসেস বেস্যাণ্টের যে বিরোধ হইয়াছিল, তাহাতে আমার কোনরূপ রায় দিবার অধিকার নাই, কারণ উভয়েই নিজ নিজ ‘মহাত্মা’র বাক্যকে সত্য বলিয়া দাবী করিতেছেন। সমগ্র ব্যাপারের মধ্যে আশ্চর্য এই যে, উভয়ে একই মহাত্মাকে দাবী করিতেছেন। ঈশ্বর জানেন সত্য কী; তিনিই একমাত্র বিচারক, আর যেখানে উভয়ের পক্ষেই যুক্তিপ্রমাণ সমতুল্য, সেখানে একদিকে বা অন্যদিকে ঝুঁকিয়া রায় দিবার অধিকার কাহারও নাই। এইরূপে তাঁহারা দুই বৎসর ধরিয়া সমগ্র আমেরিকায় আমার জন্য পথ প্রস্তুত করিয়াছিলেন! তারপর তাঁহারা—অপর বিরুদ্ধপক্ষ খ্রীষ্টান মিশনারিদের সহিত যোগ দিলেন। এই শেষোক্তেরা আমার বিরুদ্ধে এরূপ ভয়ানক মিথ্যা সংবাদ রটাইয়াছিল, যাহা কল্পনাতেও আনিতে পারা যায় না। তাহারা আমাকে প্রত্যেক বাড়ি হইতে তাড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং যে-কেহ আমার বন্ধু হইল, তাহাকেই আমার শত্রু করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আমাকে তাড়াইয়া দিতে এবং অনশনে মারিয়া ফেলিতে তাহারা আমেরিকাবাসী সকলকে বলিতে লাগিল।


আর আমার বলিতে লজ্জা হইতেছে যে, আমার একজন স্বদেশবাসী ইহাতে যোগ দিয়াছিলেন—তিনি ভারতের সংস্কারকদলের একজন নেতা। ইনি প্রতিদিনই প্রচার করিতেছেন, খ্রীষ্ট ভারতে আসিয়াছেন। খ্রীষ্ট কি এইরূপেই ভারতে আসিবেন? ইহাই কি ভারত সংস্কারের উপায়? আমি ইঁহাকে অতি বাল্যকাল হইতেই জানিতাম, তিনি আমার একজন পরম বন্ধু ছিলেন। অনেক বৎসর যাবৎ আমার সহিত এই স্বদেশবাসীর সাক্ষাৎ হয় নাই, সুতরাং তাঁহাকে দেখিয়া আমার বড়ই আনন্দ হইল, আমি যেন হাতে স্বর্গ পাইলাম। কিন্তু তাঁহারই নিকট আমি এই ব্যবহার পাইলাম! যেদিন ধর্ম-মহাসভায় আমি প্রশংসা পাই, যেদিন চিকাগোয় আমি সকলের প্রিয় হই, সেই দিন হইতে তাঁর সুর বদলাইয়া গেল; তিনি প্রচ্ছন্নভাবে আমার অনিষ্ট করিতে, আমাকে অনশনে মারিয়া ফেলিতে, আমেরিকা হইতে তাড়াইয়া দিতে সাধ্যমত চেষ্টা করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসা করি, খ্রীষ্ট কি এইরূপেই ভারতে আসিবেন? জিজ্ঞাসা করি, বিশ বৎসর খ্রীষ্টের পদতলে বসিয়া তিনি কি এই শিক্ষাই পাইয়াছেন? আমাদের বড় বড় সংস্কারকগণ যে বলিয়া থাকেন, খ্রীষ্টধর্ম এবং খ্রীষ্টশক্তি ভারতবাসিগণের উন্নতিবিধান করিবে, তাহা কি এইরূপে হইবে? অবশ্য যদি ঐ ভদ্রলোককে উহার দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যায়, তবে বড় আশা আছে বলিয়া বোধ হয় না।



আর এক কথা। আমি সমাজ-সংস্কারকগণের মুখপত্রে পড়িলাম যে, তাঁহারা বলিতেছেন, আমি শূদ্র, আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেনঃ শূদ্রের সন্ন্যাসী হইবার কি অধিকার আছে? ইহাতে আমার উত্তর এইঃ যদি তোমরা তোমাদের পুরাণ বিশ্বাস কর, তবে জানিও—আমি সেই মহাপুরুষের বংশধর, যাঁহার পদে প্রত্যেক ব্রাহ্মণ ‘যমায় ধর্মরাজায় চিত্রগুপ্তায় বৈ নমঃ’ মন্ত্র উচ্চারণসহকারে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন, আর যাঁহার বংশধরগণ বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়। এই বাঙালী সংস্কারকগণ জানিয়া রাখুন, আমার জাতি অন্যান্য নানা উপায়ে ভারতের সেবা ব্যতীত শত শত শতাব্দী ধরিয়া ভারতের অর্ধাংশ শাসন করিয়াছিল। যদি আমার জাতিকে বাদ দেওয়া যায়, তবে ভারতের আধুনিক সভ্যতার কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? কেবল বাঙলা দেশেই আমার জাতি হইতে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারকগণের অভ্যুদয় হইয়াছে। আমার জাতি হইতেই আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের অভ্যুদয় হইয়াছে। উক্ত সম্পাদকের আমাদের দেশের ইতিহাস কতকটা জানা উচিত ছিল। আমাদের তিন বর্ণ সম্বন্ধে তাঁহার কিছু জ্ঞান থাকা উচিত ছিল; তাঁহার জানা উচিৎ ছিল যে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—তিন বর্ণেরই সন্ন্যাসী হইবার সমান অধিকার, ত্রৈবর্ণিকেরই বেদে সমান অধিকার। এ-সব কথা প্রসঙ্গক্রমে উপস্থিত হইল বলিয়াই বলিলাম। আমি পূর্বোক্ত শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছি মাত্র, কিন্তু আমাকে শূদ্র বলিলে আমার বাস্তবিক কোন দুঃখ নাই। আমার পূর্বপুরুষগণ দরিদ্রগণের উপর যে অত্যাচার করিয়াছেন, ইহা তাহারই কিঞ্চিৎ প্রতিশোধস্বরূপ হইবে।



যদি আমি অতি নীচ চণ্ডাল হইতাম, তাহা হইলে আমার আরও অধিক আনন্দ হইত; কারণ আমি যাঁহার শিষ্য, তিনি একজন অতি শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হইলেও এক অস্পৃশ্য মেথরের গৃহ পরিষ্কার করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ঐ ব্যক্তি অবশ্য ইহাতে সম্মত হয় নাই—কি করিয়াই বা হইবে? এই ব্রাহ্মণ আবার সন্ন্যাসী, তিনি আসিয়া তাহার ঘর পরিষ্কার করিবেন—ইহাতে কি সে কখনও সম্মত হইতে পারে? সুতরাং গভীর রাত্রে অজ্ঞাতভাবে তাহার গৃহে প্রবেশ করিয়া তিনি পায়খানা পরিষ্কার করিতেন এবং তাঁহার বড় বড় চুল দিয়া সেই স্থান মুছিতেন। দিনের পর দিন এইরূপ করিতেন, যাহাতে তিনি নিজেকে সকলের দাস—সকলের সেবক করিয়া তুলিতে পারেন। সেই ব্যক্তির শ্রীচরণ আমি মস্তকে ধারণ করিয়া আছি। তিনিই আমার আদর্শ—আমি সেই আদর্শ পুরুষের জীবন অনুকরণ করিতে চেষ্টা করি।


হিন্দুরা এইরূপেই তোমাদিগকে ও সর্বসাধারণকে উন্নত করিবার চেষ্টা করেন এবং তাঁহারা ইহাতে বৈদেশিক ভাবের কিছুমাত্র সহায়তা গ্রহণ করেন না। বিশ বৎসর পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়া এমন চরিত্র গঠিত হইয়াছে যে, কেবল বন্ধুর কিছু মানযশ হইয়াছে বলিয়া, সে তাহার অর্থোপার্জনের বিঘ্নস্বরূপ দাঁড়াইয়াছে মনে করিয়া বিদেশে তাহাকে অনাহারে মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করে! আর খাঁটি পুরাতন হিন্দুধর্ম কিরূপে কাজ করে, অপরটি তাহার উদাহরণ। আমাদের সংস্কারকগণের মধ্যে কেহ সেই জীবন দেখান, নীচজাতির পায়খানা সাফ ও চুল দিয়া উহা মুছিয়া ফেলিতে প্রস্তুত হউন, তবেই আমি তাঁহার পদতলে বসিয়া উপদেশ গ্রহণ করিব, তাহার পূর্বে নহে। সামান্য এতটুকু কাজ হাজার হাজার লম্বা কথার সমতুল।



এখন আমি মান্দ্রাজের সংস্কার-সভাগুলির কথা বলিব। তাঁহারা আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহারা আমার প্রতি অনেক সহৃদয় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন এবং বাঙলা ও মান্দ্রাজের সংস্কারকগণের মধ্যে যে একটা প্রভেদ আছে, সেই বিষয়ে তাঁহারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন, আর আমি এ বিষয়ে তাঁহাদের সহিত একমত। তোমাদের মধ্যে অনেকের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে, তোমাদিগকে আমি অনেকবার বলিয়াছি—মান্দ্রাজের এখন বড়ই সুন্দর অবস্থা। বাঙলায় যেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলিয়াছে, এখানে সেরূপ হয় নাই। এখানে বরাবর ধীর অথচ নিশ্চিতভাবে সর্ববিষয়ে উন্নতি হইয়াছে, এখানে সমাজের ক্রমশঃ বিকাশ হইয়াছে, কোনরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নাই। অনেক স্থলে এবং কতক পরিমাণে বাঙলা দেশে পুরাতনের পুনরুত্থান হইয়াছে বলা যাইতে পারে, কিন্তু মান্দ্রাজের উন্নতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে হইতেছে। সুতরাং এখানকার সংস্কারকগণ দুই প্রদেশের সমাজ-সংস্কার ব্যাপারে যে প্রভেদ দেখান, সে-বিষয়ে আমি তাঁহাদের সহিত সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু আমার সহিত তাঁহাদের এক বিষয়ে মতভেদ আছে—সেটি তাঁহারা বুঝেন না।


আমার আশঙ্কা হয়, কতকগুলি সংস্কার-সমিতি আমাকে ভয় দেখাইয়া তাঁহাদের সহিত যোগ দিতে বাধ্য করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহাদের পক্ষে এরূপ চেষ্টা বড় আশ্চর্যের বিষয় বলিতে হইবে। যে-ব্যক্তি চতুর্দশ বৎসর ধরিয়া অনাহারে মৃত্যুর সহিত যুদ্ধ করিয়াছে, যে-ব্যক্তি এতদিন ধরিয়া কাল কি খাইবে, কোথায় শুইবে—তাহার কিছু ঠিক ছিল না, তাহাকে এত সহজে ভয় দেখানো যাইতে পারে না। যে ব্যক্তি [বিদেশে] একরূপ বিনা পরিচ্ছদে হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রী নীচে বাস করিতে সাহসী হইয়াছিল, যাহার সেখানেও কাল কি খাইবে—কিছুই ঠিক ছিল না, তাহাকে ভারতে এত সহজে ভয় দেখানো যাইতে পারে না। আমি তাঁহাদিগকে প্রথমেই বলিতে চাই যে, তাঁহারা জানিয়া রাখুন—আমার নিজের একটু দৃঢ়তা আছে, আমার নিজের একটু অভিজ্ঞতাও আছে, আর জগতের নিকট আমার কিছু বার্তা বহন করিবার আছে; আমি নির্ভয়ে ও ভবিষ্যতের কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া সেই মঙ্গলবার্তা মানুষকে দিয়া যাইব।



সংস্কারকগণকে আমি বলিতে চাই, আমি তাঁহাদের অপেক্ষা একজন বড় সংস্কারক। তাঁহারা একটু-আধটু সংস্কার করিতে চান—আমি চাই আমূল সংস্কার। আমাদের পার্থক্য কেবল সংস্কারের প্রণালীতে। তাঁহাদের প্রণালী—ভাঙিয়া-চুরিয়া ফেলা, আমার পদ্ধতি—সংগঠন। আমি সাময়িক সংস্কারে বিশ্বাসী নই, আমি স্বাভাবিক উন্নতিতে বিশ্বাসী। আমি নিজেকে ঈশ্বরের স্থানে বসাইয়া সমাজকে এই বলিয়া আদেশ করিতে সাহস করি না যে, ‘তোমায় এদিকে চলিতে হইবে, ওদিকে নয়।’ আমি কেবল সেই কাঠবিড়ালের মত হইতে চাই, যে রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনের সময় যথাসাধ্য এক অঞ্জলি বালুকা বহন করিয়াই নিজেকে কৃতার্থ মনে করিয়াছিল—ইহাই আমার ভাব।


এই অদ্ভুত জাতীয় যন্ত্র শত শতাব্দী যাবৎ কাজ করিয়া আসিতেছে, এই অদ্ভুত জাতীয় জীবন-নদী আমাদের সম্মুখে প্রবাহিত হইতেছে—কে জানে, কে সাহস করিয়া বলিতে পারে, উহা ভাল কি মন্দ বা কিরূপে উহার গতি নিয়মিত হওয়া উচিত? সহস্র ঘটনাচক্র উহাকে বিশেষরূপে বেগবিশিষ্ট করিয়াছে, তাই কখনও উহা মৃদু—কখনও-বা দ্রুত গতি-বিশিষ্ট হইতেছে। কে উহার গতি নিয়মিত করিতে সাহস করে? গীতার উপদেশ অনুসারে আমাদিগকে কেবল কর্ম করিয়া যাইতে হইবে, ফলাফলের চিন্তা একেবারে পরিত্যাগ করিয়া শান্তচিত্তে অবস্থান করিতে হইবে। জাতীয় জীবনের পুষ্টির জন্য যাহা আবশ্যক তাহা করিয়া যাও, কিন্তু জাতীয় জীবন স্বীয় প্রকৃতি অনুযায়ী বিকশিত হইবে, কাহারও সাধ্য নাই—‘এইরূপে বিকশিত হও’ বলিয়া উপদেশ দিতে পারে।



আমাদের সমাজে যথেষ্ট দোষ আছে; অন্যান্য সমাজেও আছে। এখানে বিধবার অশ্রুপাতে সময় সময় ধরিত্রী সিক্ত হয়, সেখানে—পাশ্চাত্যদেশে অনূঢ়া কুমারীগণের দীর্ঘনিঃশ্বাসে বায়ু বিষাক্ত। এখানে জীবন দারিদ্র্যবিষে জর্জরিত, সেখানে বিলাসিতার অবসাদে সমগ্র জাতি জীবন্মৃত; এখানে লোক না খাইতে পাইয়া আত্মহত্যা করিতে যায়, সেখানে খাদ্যদ্রব্যের প্রাচুর্যে লোক আত্মহত্যা করিয়া থাকে। দোষ সর্বত্র বিদ্যমান। ইহা পুরাতন বাতরোগের মত, পা হইতে দূর করিলে মাথায় ধরে; মাথা হইতে তাড়াইলে উহা আবার অন্যত্র আশ্রয় লয়। কেবল এখান হইতে ওখানে তাড়াইয়া বেড়ানো মাত্র—এইটুকুই করা যায়।


হে বালকগণ, অনিষ্টের মূলোচ্ছেদই প্রকৃত উপায়। আমাদের দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা দেয়—ভাল ও মন্দ নিত্যসংযুক্ত, এক জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ। একটি লইলে অন্যটিকে লইতেই হইবে। সমুদ্রে একটা ঢেউ উঠিল—বুঝিতে হইবে কোথাও-না-কোথাও জল খানিকটা নামিয়াছে। শুধু তাই নয়, সমুদয় জীবনই দুঃখময়। কাহারও প্রাণনাশ না করিয়া নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস গ্রহণ পর্যন্ত অসম্ভব; কাহাকেও বঞ্চিত না করিয়া এক টুকরা খাদ্যও গ্রহণ করা যায় না। ইহাই প্রকৃতির বিধান, ইহাই জীবন-দর্শন।



এই কারণে আমাদিগকে এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার বাহিরের চেষ্টা দ্বারা হইবে না, মনের উপর কার্য করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা যতই লম্বা লম্বা কথা বলি না কেন, বুঝিতে হইবে সমাজের দোষ সংশোধন করিতে হইলে প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা না করিয়া শিক্ষাদানের দ্বারা পরোক্ষভাবে উহার চেষ্টা করিতে হইবে। সমাজের দোষ সংশোধন সম্বন্ধে প্রথমে এই তত্ত্বটি বুঝিতে হইবে; এই তত্ত্ব বুঝিয়া আমাদের মনকে শান্ত করিতে হইবে, ইহা বুঝিয়া আমাদের রক্ত হইতে ধর্মান্ধতা একেবারে দূর করিয়া আমাদিগকে শান্ত—উত্তেজনাশূন্য হইতে হইবে। পৃথিবীর ইতিহাসও আমাদিগকে শিক্ষা দিতেছে যে, যেখানেই এইরূপ উত্তেজনার সহায়তায় কোন সংস্কার করিবার চেষ্টা হইয়াছে, সেইখানেই এই মাত্র ফল দাঁড়াইয়াছে যে, যে-উদ্দেশ্যে সংস্কার-চেষ্টা, সেই উদ্দেশ্যেই বিফল হইয়াছে। আমেরিকায় দাস-ব্যবসায় রহিত করিবার জন্য যে যুদ্ধ হইয়াছিল, মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইহা অপেক্ষা বৃহত্তর আন্দোলন কল্পনা করা যাইতে পারে না; তোমাদের সকলেরই উহা জানা আছে। কিন্তু ইহার ফল কি হইয়াছে। দাস-ব্যবসায় রহিত হইবার পূর্বে দাসদের যে অবস্থা ছিল, পরে তাহাদের অবস্থা পূর্বাপেক্ষা শতগুণ মন্দ হইয়াছে। দাস-ব্যবসায় রহিত হইবার পূর্বে এই হতভাগ্য নিগ্রোগণ ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হইত—নিজ সম্পত্তিরনাশের আশঙ্কায় অধিকারিগণকে দেখিতে হইত, যাহাতে তাহারা দুর্বল ও অকর্মণ্য হইয়া না পড়ে। কিন্তু এখন তাহারা কাহারও সম্পত্তি নয়, তাহাদের জীবনের এখন কিছুমাত্র মূল্য নাই; এখন সামান্য ছুতা করিয়া তাহাদিগকে জীবন্ত পুড়াইয়া ফেলা হয়, গুলি করিয়া মারিয়া ফেলা হয়; কিন্তু হত্যাকারীর শাস্তির জন্য কোন আইন নাই, কারণ নিহত ব্যক্তি যে ‘নিগার’—ইহারা মানুষ নহে, এমন কি পশু-নামেরও যোগ্য নহে। আইনের দ্বারা অথবা প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলনের দ্বারা কোন সামাজিক দোষ প্রতিকার করিবার চেষ্টার ফল এইরূপই হইয়া থাকে।



কোন কল্যাণসাধনের জন্য এইরূপ উত্তেজনাপ্রসূত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইতিহাসের এই সাক্ষ্য বিদ্যমান। আমি ইহা দেখিয়াছি, নিজ অভিজ্ঞতা হইতে আমি ইহা শিখিয়াছি। এই কারণেই আমি এইরূপ দোষারোপকারী কোন সমিতির সহিত যোগ দিতে পারি না। দোষারোপ বা নিন্দাবাদের প্রয়োজন কি? সকল সমাজেই দোষ আছে; সকলেই তাহা জানে। আজকালকার ছোট ছেলে পর্যন্ত তাহা জানে। সেও মঞ্চে দাঁড়াইয়া হিন্দুসমাজের গুরুতর দোষগুলি সম্বন্ধে আমাদিগকে রীতিমত একটি বক্তৃতা শুনিয়া দিতে পারে। যে-কোন অশিক্ষিত বৈদেশিক এক নিঃশ্বাসে ভূপ্রদক্ষিণ করিবার পথে ভারতে আসিয়া থাকেন, তিনিই তাড়াতাড়ি রেলভ্রমণের পর ভারতবর্ষের মোটামুটি একটা ধারণা করিয়া লইয়া ভারতের ভয়াবহ অনিষ্টকর প্রথাসম্বন্ধে খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিয়া থাকেন। আমরা তাঁহাদের কথা স্বীকার করিয়া থাকি। সকলেই দোষ দেখাইয়া দিতে পারে; কিন্তু যিনি এই সমস্যা হইতে উত্তীর্ণ হইবার পথ দেখাইয়া দিতে পারেন, তিনিই মানবজাতির যথার্থ বন্ধু। সেই জলমগ্ন বালক ও দার্শনিকের গল্পে—দার্শনিক যখন বালককে গম্ভীরভাবে উপদেশ দিতেছিলেন, তখন সেই বালক যেমন বলিয়াছিল, ‘আগে আমাকে জল হইতে তুলুন, পরে আপনার উপদেশ শুনিব,’ সেইরূপ এখন আমাদের দেশের লোক চীৎকার করিয়া বলিতেছে, ‘আমরা যথেষ্ট বক্তৃতা শুনিয়াছি, অনেক সমিতি দেখিয়াছি, ঢের কাগজ পড়িয়াছি; এখন আমরা এমন লোক চাই, যিনি আমাদের হাত ধরিয়া এই মহাপঙ্ক হইতে টানিয়া তুলিতে পারেন। এমন লোক কোথায়? এমন লোক কোথায়, যিনি আমাদিগকে যথার্থ ভালবাসেন? এমন লোক কোথায়, যিনি আমাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন?’ এইরূপ লোক চাই। এইখানেই আমার এই-সকল সংস্কার-আন্দোলনের সহিত সম্পূর্ণ মতভেদ। প্রায় শত বর্ষ ধরিয়া এই সংস্কার-আন্দোলন চলিতেছে। কিন্তু উহা দ্বারা অতিশয় নিন্দা ও বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যবিশেষের সৃষ্টি ব্যতীত কী উপকার হইয়াছে? ঈশ্বরেচ্ছায় ইহা না হইলেই ভাল ছিল। তাঁহারা প্রাচীন সমাজের কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন, উহার উপর যথাসাধ্য দোষারোপ করিয়াছেন, উহার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন; শেষে প্রাচীন সমাজের লোকেরা তাঁহাদের সুর ধরিয়াছেন, ঢিলটি খাইয়া পাটকেলটি মারিয়াছেন; আর তাহার ফল হইয়াছে এই যে, প্রত্যেকটি দেশীয় ভাষায় এমন এক সাহিত্যের সৃষ্টি হইয়াছে, যাহাতে সমগ্র জাতির—সমগ্র দেশের লজ্জিত হওয়া উচিত! ইহাই কি সংস্কার? ইহাই কি সমগ্র জাতির গৌরবের পথ? ইহা কার দোষ?


অতঃপর আর একটি গুরুতর বিষয় বিবেচনা করিতে হইবে। এখানে—ভারতে আমরা বরাবর রাজশাসনাধীনে কাটাইয়াছি—রাজারাই আমাদের জন্য চিরদিন বিধান প্রস্তুত করিয়াছেন। এখন সেই রাজারা নাই, এখন আর এ বিষয়ে অগ্রসর হইয়া পথ দেখাইবার কেহ নাই। সরকার সাহস করেন না। সরকারকে সাধারণের মতামতের গতি দেখিয়া নিজ কার্যপ্রণালী স্থির করিতে হয়। কিন্তু নিজেদের সমস্যাপূরণে সমর্থ, সাধারণের কল্যাণকর, প্রবল জনমত গঠিত হইতে সময় লাগে—অনেক সময় লাগে। এই মত গঠিত হইবার পূর্ব পর্যন্ত আমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে। সুতরাং সমুদয় সমাজসংস্কার-সমস্যাটি এইরূপ দাঁড়ায়—সংস্কার যাহারা চায়, তাহারা কোথায়? আগে তাহাদিগকে প্রস্তুত কর। সংস্কারপ্রার্থী লোক কই? অল্পসংখ্যক কয়েকটি লোকের নিকটই কোন বিষয় দোষযুক্ত বলিয়া বোধ হইয়াছে, অধিকাংশ ব্যক্তি কিন্তু তাহা এখনও বুঝে নাই। এখন এই অল্পসংখ্যক ব্যক্তি যে জোর করিয়া অপর সকলের উপর নিজেদের মনোমত সংস্কার চালাইবার চেষ্টা করেন, তাহা তো অত্যাচার; ইহার মত প্রবল অত্যাচার পৃথিবীতে আর নাই। অল্প কয়েকজন লোকের নিকট কতকগুলি বিষয় দোষযুক্ত হইলেই সেগুলি সমগ্র জাতির হৃদয় স্পর্শ করে না। সমগ্র জাতি নড়ে-চড়ে না কেন? প্রথমে সমগ্র জাতিকে শিক্ষা দাও, ব্যবস্থা-প্রণয়নে সমর্থ একটি দল গঠন কর; বিধান আপনা-আপনি আসিবে। প্রথমে যে শক্তিবলে—যাহার অনুমোদনে বিধান গঠিত হইবে, তাহা সৃষ্টি কর। এখন রাজারা নাই; যে নূতন শক্তিতে—যে নূতন সম্প্রদায়ের সম্মতিতে নূতন ব্যবস্থা প্রণীত হইবে, সে লোকশক্তি কোথায়? প্রথমে সেই লোকশক্তি গঠন কর। সুতরাং সমাজসংস্কারের জন্য প্রথম কর্তব্য—লোকশিক্ষা। এই শিক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেই হইবে।


গত শতাব্দীতে যে-সকল সংস্কারের জন্য আন্দোলন হইয়াছে, সেগুলির অধিকাংশ পোশাকী ধরনের। এই সংস্কার-চেষ্টাগুলি কেবল প্রথম দুই বর্ণ (জাতি)-কে স্পর্শ করে, অন্য বর্ণকে নহে। বিধবাবিবাহ-আন্দোলনে শতকরা সত্তর জন ভারতীয় নারীর কোন স্বার্থই নাই। আর সর্বসাধারণকে বঞ্চিত করিয়া যে-সকল ভারতীয় উচ্চবর্ণ শিক্ষিত হইয়াছেন, তাঁহাদেরই জন্য এ ধরনের সকল আন্দোলন। নিজেদের ঘর পরিষ্কার করিতে এবং বিদেশীদের চোখে সুন্দর প্রতীয়মান হইবার জন্য তাঁহারা কিছুমাত্র চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। ইহাকে তো সংস্কার বলা যায় না। সংস্কার করিতে হইলে উপর উপর দেখিলে চলিবে না, ভিতরে প্রবেশ করিতে হইবে, মূলদেশ পর্যন্ত যাইতে হইবে। ইহাকেই আমি ‘আমূল সংস্কার’ বা প্রকৃত সংস্কার বলিয়া থাকি। মূলদেশে অগ্নিসংযোগ কর, অগ্নি ক্রমশঃ ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকুক, [আবর্জনা পুড়িয়া যাক] এবং একটি অখণ্ড ভারতীয় জাতি গঠিত হউক।


আর সমস্যা বড় সহজও নহে। ইহা অতি গুরুতর সমস্যা; সুতরাং ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই! এটিও জানিয়া রাখো যে, গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ এই সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের দেশের মহাপুরুষগণ অবহিত ছিলেন। আজকাল বিশেষতঃ দাক্ষিণাত্যে বৌদ্ধধর্ম ও উহার অজ্ঞেয়বাদ সম্বন্ধে আলোচনা করা একটা ঢঙ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আলোচনাকারীরা স্বপ্নেও কখনও ভাবে না যে, আমাদের সমাজে যে-সকল বিশেষ দোষ রহিয়াছে, সেগুলি বৌদ্ধধর্ম-জাত। বৌদ্ধধর্মই আমাদিগকে তাহার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতির ভাগী করিয়াছে। যাঁহারা বৌদ্ধধর্মের উন্নতি ও অবনতির ইতিহাস কখনও পাঠ করেন নাই, তাঁহাদের লিখিত পুস্তকে তোমরা পড়িয়া থাক যে, গৌতমবুদ্ধ-প্রচারিত অপূর্ব নীতি ও তাঁহার লোকোত্তর চরিত্র-গুণে বৌদ্ধধর্ম এরূপ বিস্তার লাভ করিয়াছিল। ভগবান্ বুদ্ধদেবের প্রতি আমার যথেষ্ট ভক্তি ও শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আমার বাক্য অবহিত হইয়া শ্রবণ করঃ বৌদ্ধধর্মের বিস্তার উহার মতবাদের জন্য বা উক্ত মহাপুরুষের চরিত্রগুণে ততটা হয় নাই—বৌদ্ধগণ যে-সকল মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন, যে-সকল প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সমগ্র জাতির সমক্ষে যে-সকল আড়ম্বরপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ ধরিয়াছিলেন, সেগুলির জন্য যতটা হইয়াছিল। এইরূপেই বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করে। এই-সকল বড় বড় মন্দির ও ক্রিয়াকলাপের সহিত সংগ্রামে গৃহে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র হোমকুণ্ডগুলি দাঁড়াইতে পারিল না। ঐ সকল ক্রিয়াকলাপ-অনুষ্ঠান ক্রমশঃ অধঃপতিত হইল; অনুষ্ঠানগুলি পরিশেষে এরূপ ঘৃণিত ভাব ধারণ করে যে, শ্রোতৃবর্গের নিকট আমি তাহা বলিতে অক্ষম। যাঁহারা এ সম্বন্ধে জানিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা নানাপ্রকার কারুকার্যপূর্ণ দক্ষিণ ভারতের বড় বড় মন্দিরগুলি দেখিয়া আসিবেন। বৌদ্ধগণের নিকট হইতে দায়স্বরূপ আমরা ইহাই মাত্র পাইয়াছি। অতঃপর সেই মহান্‌ সংস্কারক শঙ্করাচার্য ও তাঁহার অনুবর্তিগণের অভ্যুদয় হইল, আর তাঁহার অভ্যুদয় হইতে আজ পর্যন্ত কয়েক শত বর্ষ যাবৎ ভারতের সর্বসাধারণকে ধীরে ধীরে সেই মৌলিক বিশুদ্ধ বৈদান্তিক ধর্মে লইয়া আসিবার চেষ্টা চলিতেছে। এই সংস্কারকগণ সমাজের দোষগুলি বিলক্ষণ জানিতেন, তথাপি তাঁহারা সমাজকে নিন্দা করেন নাই। তাঁহারা এ কথা বলেন নাই—তোমাদের যাহা আছে সব ভুল, তোমাদিগকে সব ফেলিয়া দিতে হইবে। তাহা কখনই হইতে পারে না। আমি সম্প্রতি পড়িতেছিলাম—আমার বন্ধু ব্যারোজ সাহেব বলিতেছেন, ৩০০ বৎসরে খ্রীষ্টধর্ম গ্রীক ও রোমক প্রভাবকে একেবারে উল্টাইয়া দিয়াছিল। যিনি ইওরোপ—গ্রীস ও রোম দেখিয়াছেন, তিনি কখনও এ-কথা বলিতে পারেন না। রোমক ও গ্রীক ধর্মের প্রভাব—এমন কি প্রোটেস্টাণ্ট দেশসমূহে পর্যন্ত রহিয়াছে, নামটুকু বদলাইয়াছে মাত্র; প্রাচীন দেবগণই নূতন বেশে বিদ্যমান—কেবল নাম বদলানো। দেবীগণ হইয়াছেন মেরী, দেবগণ হইয়াছেন সাধুবৃন্দ (Saints) এবং নূতন নূতন অনুষ্ঠান-পদ্ধতি প্রবর্তিত হইয়াছে। এমন কি, প্রাচীন উপাধি ‘পণ্টিফেক্স্ ম্যাক্সিমাস’৮ পর্যন্ত রহিয়াছে। সুতরাং সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইতেই পারে না, ইহা বড় সহজ নহে—আর শঙ্করাচার্য এ তত্ত্ব জানিতেন, রামানুজও জানিতেন, এরূপ পরিবর্তন হইতে পারে না। সুতরাং তদানীন্তন প্রচলিত ধর্মকে ধীরে ধীরে উচ্চতম আদর্শের অভিমুখে গড়িয়া তোলা ব্যতীত তাঁহাদের আর কোন পথ ছিল না। যদি তাঁহারা অন্য প্রণালী অবলম্বন করিতে চেষ্টা করিতেন, অর্থাৎ যদি তাঁহারা একেবারে সব উল্টাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেন, তবে তাঁহাদিগকে কপট হইতে হইত; কারণ তাঁহাদের ধর্মের প্রধান মতই ক্রমোন্নতিবাদ—এই-সকল নানাবিধ সোপানের মধ্য দিয়া আত্মা তাঁহার উচ্চতম লক্ষ্যে পৌঁছিবে—ইহাই তাঁহাদের মূল মত। সুতরাং এই সোপানগুলি সবই আবশ্যক এবং আমাদের সহায়ক। কে এই সোপানগুলিকে নিন্দা করিতে সাহসী হইবে?


আজকাল একটি কথা চালু হইয়া গিয়াছে, এবং সকলেই বিনা আপত্তিতে এটি স্বীকার করিয়া থাকেন যে, পৌত্তলিকতা অন্যায়। আমিও এক সময়ে ঐরূপ ভাবিতাম, এবং ইহার শাস্তিস্বরূপ আমাকে এমন একজনের পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিতে হইয়াছিল, যিনি পুতুলপূজা হইতে সব পাইয়াছিলেন। আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা বলিতেছি। হিন্দুগণ, যদি পুতুলপূজা করিয়া এইরূপ রামকৃষ্ণ পরমহংসের আবির্ভাব হয়, তবে তোমরা কি চাও?—সংস্কারকগণের ধর্ম চাও, না পুতুলপূজা চাও? আমি ইহার একটা উত্তর চাই। যদি পুতুলপূজা দ্বারা এইরূপ রামকৃষ্ণ পরমহংস সৃষ্টি করিতে পার, তবে আরও হাজার পুতুলের পূজা কর। ঈশ্বরেচ্ছায় তোমরা সাফল্য লাভ কর। যে-কোন উপায়ে হউক, এইরূপ মহান্‌ চরিত্র সৃষ্টি কর। আর পুতুলপূজাকে লোকে গালি দেয়! কেন?—তাহা কেহই জানে না। কারণ কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে জনৈক য়াহুদী-বংশসম্ভূত ব্যক্তি পুতুলপূজাকে নিন্দা করিয়াছিলেন অর্থাৎ তিনি নিজের পুতুল ছাড়া আর সকলের পুতুলকে নিন্দা করিয়াছিলেন। সেই য়াহুদী বলিয়াছিলেন, যদি কোন বিশেষ ভাব-প্রকাশক বা পরমসুন্দর মূর্তি দ্বারা ঈশ্বরের ভাব প্রকাশ করা হয়, তবে তাহা ভয়ানক দোষ, মহা পাপ; কিন্তু যদি একটি সিন্দুকের দুইধারে দুইজন দেবদূত, তাহার উপরে মেঘ—এইরূপে ঈশ্বরের ভাব প্রকাশ করা হয়, তবে তাহা মহা পবিত্র। ঈশ্বর যদি ঘুঘুর রূপ ধারণ করিয়া আসেন, তবে তাহা মহা পবিত্র; কিন্তু যদি গভীর রূপ ধারণ করিয়া আসেন, তবে তাহা হিদেনদের কুসংস্কার! অতএব উহার নিন্দা কর।


দুনিয়া এইভাবেই চলিয়াছে। তাই কবি বলিয়াছেন, ‘আমরা মর্ত্যমানব কি নির্বোধ!’ পরের চক্ষে দেখা ও বিচার করা কি কঠিন ব্যাপার! আর ইহাই মনুষ্যসমাজের উন্নতির অন্তরায়স্বরূপ। ইহাই ঈর্ষা ঘৃণা বিবাদ ও দ্বন্দ্বের মূল। বালকগণ, অর্বাচীন শিশুগণ, তোমরা মান্দ্রাজের বাহিরে কখনও যাও নাই; তোমরা সহস্র সহস্র প্রাচীনসংস্কার-নিয়ন্ত্রিত ত্রিশকোটি লোকের উপর আইন চালাইতে চাও—তোমাদের লজ্জা করে না? এরূপ বিষম দোষ হইতে বিরত হও এবং আগে নিজেরা শিক্ষা লাভ কর। শ্রদ্ধাহীন বালকগণ, তোমরা কেবল কাগজে গোটাকতক লাইন আঁচড় কাটিতে পার, আর কোন আহাম্মককে ধরিয়া উহা ছাপাইয়া দিতে পার বলিয়া নিজদিগকে জগতের শিক্ষক—ভারতের মুখপাত্র বলিয়া মনে করিতেছ! তাই নয় কি?


এই কারণে আমি মান্দ্রাজের সংস্কারকগণকে এইটুকু বলিতে চাই যে, তাঁহাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে; তাঁহাদের বিশাল হৃদয়, তাঁহাদের স্বদেশপ্রীতি, দরিদ্র ও অত্যাচারিত জনগণের প্রতি তাঁহাদের ভালবাসার জন্য আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। কিন্তু ভাই যেমন ভাইকে ভালবাসে অথচ তাহার দোষ দেখাইয়া দেয়, সেইভাবে আমি তাঁহাদিগকে বলিতেছি—তাঁহাদের কার্যপ্রণালী ঠিক নহে। শত বৎসর যাবৎ এই প্রণালীতে কার্য করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হয় নাই। এখন আমাদিগকে অন্য কোন নূতন উপায়ে কাজ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। এইটুকুই আমার বক্তব্য। ভারতে কি কখনও সংস্কারকের অভাব হইয়াছিল? তোমরা তো ভারতের ইতিহাস পড়িয়াছ? রামানুজ কি ছিলেন? শঙ্কর ? নানক? চৈতন্য? কবীর ? দাদু? এই যে বড় বড় ধর্মাচার্যগণ ভারতগগনে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের মত একে একে উদিত হইয়া আবার অস্ত গিয়াছেন, ইঁহারা কি ছিলেন?রামানুজের হৃদয় কি নীচজাতির জন্য কাঁদে নাই? তিনি কি সারাজীবন পারিয়াদিগকে৯ পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান দিতে চেষ্টা করেন নাই? তিনি কি হিন্দু মুসলমানকে পর্যন্ত গ্রহণ করিতে চেষ্টা করেন নাই? নানক কি হিন্দু মুসলমান উভয়ের সহিত আলোচনা ও পরামর্শ করিয়া সমাজে নূতন অবস্থা আনয়ন করিবার চেষ্টা করেন নাই? তাঁহারা সকলেই চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের কাজ এখনও চলিতাছে। তবে প্রভেদ এই—তাঁহারা আধুনিক সংস্কারকগণের মত চীৎকার ও বাহ্যাড়ম্বর করিতেন না। আধুনিক সংস্কারকগণের মত তাঁহাদের মুখ হইতে কখনও অভিশাপ উচ্চারিত হইত না, তাঁহাদের মুখ হইতে কেবল আশীর্বাদ বর্ষিত হইত। তাঁহারা কখনও সমাজের উপর দোষারোপ করেন নাই। তাঁহারা বলিতেন, হিন্দুজাতিকে চিরকাল ধরিয়া ক্রমাগত উন্নতি করিতে হইবে। তাঁহারা অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতেন—হিন্দুগণ, তোমরা এতদিন যাহা করিয়াছ, তাহা ভালই হইয়াছে; কিন্তু হে ভ্রাতৃগণ, আমাদিগকে আরও ভাল কাজ করিতে হইবে। তাঁহারা এ-কথা বলেন নাই যে, তোমরা এতদিন মন্দ ছিলে, এখন তোমাদিগকে ভাল হইতে হইবে। তাঁহারা বলিতেন, তোমরা ভালই ছিলে, কিন্তু এখন তোমাদিগকে আরও ভাল হইতে হইবে। এই দুই প্রকার কথার ভিতর বিশেষ পার্থক্য আছে। আমাদিগকে আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী উন্নতির চেষ্টা করিতে হইবে। বৈদেশিক সংস্থাগুলি জোর করিয়া আমাদিগকে যে প্রণালীতে চালিত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তদনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা বৃথা; উহা অসম্ভব। আমাদিগকে যে ভাঙিয়া-চুরিয়া অপর জাতির মত গড়িতে পারা অসম্ভব, সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি অন্যান্য জাতির সামাজিক প্রথার নিন্দা করিতেছি না। তাহাদের পক্ষে উহা ভাল হইলেও আমাদের পক্ষে নহে। তাহাদের পক্ষে যাহা অমৃত, আমাদের পক্ষে তাহা বিষবৎ হইতে পারে। প্রথমে এইটিই শিক্ষা করিতে হইবে। এক ধরনের বিজ্ঞান, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি অনুযায়ী গঠিত হওয়ায় তাহাদের আধুনিক সমাজব্যবস্থা একরূপ দাঁড়াইয়াছে। আমাদের পশ্চাতে আবার একপ্রকার ঐতিহ্য এবং সহস্র সহস্র বৎসর কর্ম রহিয়াছে, সুতরাং আমরা স্বভাবতই আমাদের সংস্কার অনুযায়ী চলিতে পারি, এবং আমাদিগকে সেইরূপ করিতে হইবে।


তবে আমি কি প্রণালীতে কাজ করিব? আমি প্রাচীন মহান্ আচার্যগণের উপদেশ অনুসরণ করিতে চাই। আমি তাঁহাদের কাজ বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছি এবং তাঁহারা কি প্রণালীতে কাজ করিয়াছিলেন, ঈশ্বরেচ্ছায় তাহা আবিষ্কার করিয়াছি। সেই মহাপুরুষগণ সমাজদেহ সংগঠন করিয়াছিলেন, তাঁহারা উহাতে বিশেষভাবে বল, পবিত্রতা ও জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করিয়াছিলেন। তাঁহারা অতি বিস্ময়কর কাজ করিয়াছিলেন। আমাদিগকেও ঐরূপ কার্য করিতেই হইবে। এখন অবস্থাচক্রের কিছু পরিবর্তন হইয়াছে, সেজন্য কার্যপ্রণালীর সামান্য পরিবর্তন করিতে হইবে, আর কিছু নয়।


আমি দেখিতেছি—ব্যক্তির পক্ষে যেমন, প্রত্যেক জাতির পক্ষেও তেমনি জীবনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। উহাই তাহার জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ। উহাই যেন তাহার জীবনসঙ্গীতের প্রধান সুর, অন্যান্য সুর যেন সেই প্রধান সুরের সহিত সঙ্গত হইয়া ঐক্যতান সৃষ্টি করিতেছে। কোন দেশের—যথা ইংলণ্ডের জীবনীশক্তি রাজনীতিক ক্ষমতায়। কলাবিদ্যার উন্নতিই হয়তো অপর কোন জাতির জীবনের মূল লক্ষ্য। ভারতে কিন্তু ধর্মই জাতীয় জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ, উহাই যেন জাতীয় জীবন-সঙ্গীতের প্রধান সুর। আর যদি কোন জাতি তাহার এই স্বাভাবিক জীবনীশক্তি—শত শতাব্দী ধরিয়া যেদিকে উহার নিজস্ব গতিধারা চলিয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করিতে চেষ্টা করে এবং যদি সেই চেষ্টায় কৃতকার্য হয়, তবে তাহার মৃত্যু নিশ্চয়। সুতরাং যদি তোমরা ধর্মকে কেন্দ্র না করিয়া, ধর্মকেই জাতীয় জীবনের প্রাণশক্তি না করিয়া রাজনীতি, সমাজনীতি বা অন্য কিছুকে উহার স্থলে বসাও, তবে তাহার ফলে তোমরা একেবারে লুপ্ত হইয়া যাইবে। যাহাতে এরূপ না ঘটে, সেজন্য তোমাদিগকে তোমাদের প্রাণশক্তি—ধর্মের মধ্য দিয়া সব কাজ করিতে হইবে। তোমাদের স্নায়ুতন্ত্রীগুলি তোমাদের ধর্মরূপ মেরূদণ্ডে দৃঢ়সম্বন্ধ হইয়া নিজ নিজ সুরে বাজিতে থাকুক। আমি দেখিয়াছি, সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে ধর্ম কিভাবে কাজ করিবে—ইহা না দেখাইয়া আমি আমেরিকায় ধর্মপ্রচার করিতে পারিতাম না। বেদান্তের দ্বারা কিরূপ অদ্ভুত রাজনীতিক পরিবর্তন সাধিত হইবে, ইহা না দেখাইয়া আমি ইংলণ্ডে ধর্মপ্রচার করিতে পারিতাম না। এইভাবে ভারতে সমাজসংস্কার প্রচার করিতে হইলে দেখাইতে হইবে, সেই নূতন সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা জীবন কতটা আধ্যাত্মিকভাবে ভাবিত হইবে। রাজনীতি প্রচার করিতে হইলেও দেখাইতে হইবে, উহা দ্বারা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান আকাঙ্ক্ষা—আধ্যাত্মিক উন্নতি কত অধিক পরিমাণে সাধিত হইবে।


এই পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ পথ বাছিয়া লয়; প্রত্যেক জাতিও সেইরূপ। আমরা শত শত যুগ পূর্বে নিজেদের পথ বাছিয়া লইয়াছি, এখন আমাদিগকে তদনুসারে চলিতে হইবে। আর এই পন্থা-নির্বাচন এমন কিছু খারাপ হয় নাই। জড়ের পরিবর্তে চৈতন্য, মানুষের পরিবর্তে ঈশ্বরের চিন্তাকে কি বিশেষ মন্দ পথ বলিতে পার? তোমাদের মধ্যে পরলোকে দৃঢ়বিশ্বাস, ইহলোকের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রবল ত্যাগশক্তি এবং ঈশ্বরে ও অবিনাশী আত্মায় দৃঢ়বিশ্বাস বিদ্যমান। কই, এই ভাব ত্যাগ কর দেখি! তোমরা কখনই ইহা ত্যাগ করিতে পার না। তোমরা জড়বাদী হইয়া কিছুদিন জড়বাদের কথা বলিয়া আমাকে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা করিতে পার, কিন্তু আমি তোমাদের স্বভাব জানি। যখনই তোমাদিগকে ধর্ম সম্বন্ধে একটু ভুল করিয়া বুঝাইয়া দিব, অমনি তোমরা পরম আস্তিক হইবে। স্বভাব বদলাইবে কিরূপে? তোমরা যে ধর্মগতপ্রাণ।


এই জন্য ভারতে যে-কোন সংস্কার বা উন্নতির চেষ্টা করা হউক, প্রথমতঃ ধর্মের উন্নতি আবশ্যক। ভারতকে সামাজিক বা রাজনীতিকভাবে প্লাবিত করার আগে প্রথমে আধ্যাত্মিক ভাবে প্লাবিত কর। প্রথমেই এইটি করা আবশ্যক। প্রথমেই আমাদিগকে এই কাজে মন দিতে হইবে যেঃ আমাদের উপনিষদে—আমাদের পুরাণে, আমাদের অন্যান্য শাস্ত্রে যে-সকল অপূর্ব সত্য নিহিত আছে, সেগুলি ঐ-সকল গ্রন্থ হইতে, মঠ হইতে, অরণ্য হইতে, সম্প্রদায়বিশেষের অধিকার হইতে বাহির করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়াইয়া দিতে হইবে, যেন ঐ-সকল শাস্ত্রনিহিত সত্য আগুনের মত উত্তর হইতে দক্ষিণ, পূর্ব হইতে পশ্চিম—হিমালয় হইতে কুমারিকা, সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত সারা দেশে ছুটিতে থাকে। সকলকেই এই-সকল শাস্ত্রনিহিত উপদেশ শুনাইতে হইবে; কারণ শাস্ত্র বলেন—প্রথমে শ্রবণ, পরে মনন, তারপর নিদিধ্যাসন কর্তব্য। প্রথমে লোকে শাস্ত্রবাক্যগুলি শুনুক, আর যে ব্যক্তি জনসাধারণকে তাহাদের ধর্মগ্রন্থের ও শাস্ত্রের অন্তর্গত মহান্ সত্যগুলি শুনাইতে সাহায্য করে, সে আজ এমন এক কাজ করিতেছে, যাহার সঙ্গে অন্য কোন কাজের তুলনা হইতে পারে না। মনু বলিয়াছেন, ‘এই কলিযুগে মানুষের একটি কাজ করিবার আছে। আজকাল আর যজ্ঞ ও কঠোর তপস্যায় কোন ফল হয় না। এখন দানই একমাত্র কর্ম।১০ দানের মধ্যে ধর্মদান—আধ্যাত্মিক জ্ঞানদানই শ্রেষ্ঠ দান; দ্বিতীয় বিদ্যাদান, তৃতীয় প্রাণদান, চতুর্থ অন্নদান। এই অপূর্ব দানশীল হিন্দুজাতির দিকে দৃষ্টপাত কর। এই দরিদ্র—অতি দরিদ্র দেশে লোকে কি পরিমাণ দান করে, লক্ষ্য কর। এখানে লোকে এমন অতিথিপরায়ণ যে, যে-কোন ব্যক্তি বিনাসম্বলে ভারতের উত্তর হইতে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়া আসিতে পারেন। লোকে পরমাত্মীয়কে যেমন যত্নের সহিত নানা উপচারের দ্বারা সেবা করে, সেইরূপ তিনি যেখানেই যাইবেন, লোকে সেই স্থানের সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুসমূহের দ্বারা তাঁহার সেবা করিবে। এখানে কোথাও যতক্ষণ পর্যন্ত এক টুকরা রুটি থাকে, ততক্ষণ কোন ভিক্ষুককেই না খাইয়া মরিতে হয় না।


এই দানশীল দেশে আমাদিগকে প্রথম দুই প্রকার দানে সাহসপূর্বক অগ্রসর হইতে হইবে। প্রথমতঃ আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান। এই জ্ঞানদান আবার শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ রাখিলে চলিবে না—সমগ্র বিশ্বে ইহা প্রচার করিতে হইবে। ইহাই বরাবর হইয়া আসিয়াছে। যাঁহারা তোমাদিগকে বলেন ভারতীয় চিন্তারাশি কখনও ভারতের বাহিরে যায় নাই—যাঁহারা তোমাদিগকে বলেন, ভারতের বাহিরে ধর্মপ্রচারের জন্য আমিই প্রথম সন্ন্যাসী গিয়াছি, তাঁহারা নিজেদের জাতির ইতিহাস জানেন না। এই ধর্মপ্রচারের ব্যাপার অনেকবার ঘটিয়াছে। যখনই প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই এই আধ্যাত্মিকতার অফুরন্ত বন্যা সমগ্র জগৎ প্লাবিত করিয়াছে। অগণিত সৈন্যদল লইয়া উচ্চরবে ভেরী বাজাইতে বাজাইতে রাজনীতিক শিক্ষা বিস্তার করা যাইতে পারে; লৌকিক জ্ঞান বা সামাজিক জ্ঞান বিস্তার করিতে হইলেও তরবারি বা কামানের সাহায্যে উহা হইতে পারে; শিশিরবিন্দু যেমন অশ্রুত ও অদৃশ্যভাবে পতিত হইয়াও রাশি রাশি গোলাপ-কলিকে প্রস্ফুটিত করে, আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান তেমনি নীরবে—সকলের অজ্ঞাতসারেই হওয়া সম্ভব।


ভারত বার বার জগৎকে এই আধ্যাত্মিক জ্ঞান উপহার দিয়া আসিতেছে। যখনই কোন শক্তিশালী দিগ্বিজয়ী জাতি উঠিয়া জগতের বিভিন্ন জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়াছে, যখনই তাহারা পথঘাট নির্মাণ করিয়া বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত সুগম করিয়াছে, অমনি ভারত উঠিয়া সমগ্র জগতের উন্নতিকল্পে তাহার যাহা দিবার আছে—অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করিয়াছে। বুদ্ধদেব জন্মিবার বহুদিন পূর্ব হইতেই ইহা ঘটিয়াছে। চীন, এশিয়া-মাইনর ও মালয়-দ্বীপপুঞ্জের মধ্যভাগে এখনও তাহার চিহ্ন বর্তমান। যখন সেই প্রবল গ্রীক দিগ্বিজয়ী তদানীন্তন পরিচিত জগতের সমগ্র অংশ একত্র গ্রথিত করিলেন, তখনও এই ব্যাপার ঘটিয়াছিল—তখনও ভারতীয় ধর্মভাব সেই-সকল স্থানে ছুটিয়া গিয়াছিল। আর পাশ্চাত্য দেশ এখন যে-সভ্যতার গর্ব করিয়া থাকে, তাহা সেই মহাবন্যারই অবশিষ্ট চিহ্নমাত্র। এখন আবার সেই সুযোগ উপস্থিত। ইংলণ্ডের শক্তি পৃথিবীর জাতিগুলিকে সংযুক্ত করিয়াছে; এরূপ আর পূর্বে কখনও হয় নাই। ইংরেজদের রাস্তা ও যাতায়াতের অন্যান্য উপায়গুলি জগতের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে, ইংরেজ-প্রতিভায় জগৎ আজ অপূর্বভাবে একসূত্রে গ্রথিত। আজকাল যেরূপ নানাস্থানে বাণিজ্যকেন্দ্রসমূহ স্থাপিত হইয়াছে, মানবজাতির ইতিহাসে পূর্বে আর কখনও এরূপ হয় নাই। সুতরাং এই সুযোগে ভারত জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কালবিলম্ব না করিয়া জগৎকে আধ্যাত্মিকতা দান করিতেছে। এখন এই-সকল পথ অবলম্বন করিয়া ভারতীয় ভাবরাশি সমগ্র জগতে ছড়াইতে থাকিবে।


আমি যে আমেরিকায় গিয়াছিলাম, তাহা আমার ইচ্ছায় বা তোমাদের ইচ্ছায় হয় নাই। ভারতের ভগবান্‌, যিনি তাহার ভাগ্যবিধাতা, তিনিই আমায় পাঠাইয়াছেন এবং তিনিই এইরূপ শত শত ব্যক্তিকে জগতের সকল জাতির নিকট প্রেরণ করিবেন। পার্থিব কোন শক্তিই ইহাকে বাধা দিতে পারে না। সুতরাং তোমাদিগকে ভারতের বাহিরে অন্যান্য দেশেও ধর্মপ্রচারে যাইতে হইবে। এই ধর্মপ্রচারের জন্য তোমাদিগকে ভারতের বাহিরে যাইতেই হইবে; জগতের সকল জাতির নিকট, সকল ব্যক্তির নিকট প্রচার করিতে হইবে। প্রথমেই এই ধর্মপ্রচার আবশ্যক।


ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই লৌকিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিদ্যা যাহা কিছু আবশ্যক, তাহা আপনি আসিবে। কিন্তু যদি ধর্মকে বাদ দিয়া লৌকিক জ্ঞানবিস্তারের চেষ্টা কর, তবে তোমাদিগকে স্পষ্টই বলিতেছি, ভারতে তোমাদের এ চেষ্টা ব্যর্থ হইবে—লোকের হৃদয়ে উহা প্রভাব বিস্তার করিবে না। এমন কি, এত বড় যে বৌদ্ধধর্ম, তাহাও কতকটা এই কারণেই এখানে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই।


হে বন্ধুগণ, এই জন্য আমার সঙ্কল্প এই যে, ভারতে আমি কতকগুলি শিক্ষালয় স্থাপন করিব—তাহাতে আমাদের যুবকগণ ভারতে ও ভারত-বহির্ভূত দেশে আমাদের শাস্ত্র-নিহিত সত্যসমূহ প্রচার করিবার কাজে শিক্ষালাভ করিবে। মানুষ চাই, মানুষ চাই; আর সব হইয়া যাইবে। বীর্যবান্, সম্পূর্ণ অকপট, তেজস্বী, বিশ্বাসী যুবক আবশ্যক। এইরূপ একশত যুবক হইলে সমগ্র জগতের ভাবস্রোত ফিরাইয়া দেওয়া যায়। অন্য কিছু অপেক্ষা ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অধিক। ইচ্ছাশক্তির কাছে আর সবই শক্তিহীন হইয়া যাইবে, কারণ ঐ ইচ্ছাশক্তি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের নিকট হইতে আসিতেছে। বিশুদ্ধ ও দৃঢ় ইচ্ছার শক্তি অসীম। তোমরা কি বিশ্বাস কর না? সকলের নিকট তোমাদের ধর্মের মহান্ সত্যসমূহ প্রচার কর, প্রচার কর; জগৎ এই-সকল সত্যের জন্য অপেক্ষা করিতেছে।


শত শত শতাব্দী যাবৎ মানুষকে তাহার হীনত্বজ্ঞাপক মতবাদসমূহ শেখানো হইতেছে; তাহাদিগকে শেখানো হইয়াছে—তাহারা কিছুই নয়। সর্বত্র জনসাধারণকে চিরকাল বলা হইয়াছে—তোমরা মানুষ নও। শত শত শতাব্দী যাবৎ তাহাদিগকে এইরূপে ভয় দেখানো হইয়াছে—ক্রমশঃ তাহারা সত্যসত্যই পশুস্তরে নামিয়া গিয়াছে। তাহাদিগকে কখনও আত্মতত্ত্ব শুনিতে দেওয়া হয় নাই। তাহারা এখন আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করুক; তাহারা জানুক যে, তাহাদের মধ্যে—নিম্নতম ব্যক্তির হৃদয়েও আত্মা রহিয়াছেন; সেই আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; তরবারি তাঁহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না; তিনি অবিনাশী অনাদি অনন্ত শুদ্ধস্বরূপ সর্বশক্তিমান্ ও সর্বব্যাপী।


অতএব আত্মবিশ্বাসী হও। ইংরেজ জাতির সঙ্গে তোমাদের এত প্রভেদ কিসে?তাহারা তাহাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রবল কর্তব্যজ্ঞান ইত্যাদির কথা যাহাই বলুক না কেন, আমি জানিয়াছি, উভয় জাতির মধ্যে প্রভেদ কোথায়। প্রভেদ এই—ইংরেজ নিজের উপর বিশ্বাসী, তোমরা বিশ্বাসী নও। ইংরেজ বিশ্বাস করে—সে যখন ইংরেজ, তখন সে যাহা ইচ্ছা করে তাহাই করিতে পারে। এই বিশ্বাসবলে তাহার অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠেন, সে তখন যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে। তোমাদিগকে লোকে বলিয়া আসিতেছে ও শিক্ষা দিতেছে যে, তোমাদের কোন কিছু করিবার ক্ষমতা নাই—কাজেই তোমরা অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছ। অতএব আত্মবিশ্বাসী হও।


আমাদের এখন প্রয়োজন—শক্তিসঞ্চার। আমরা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। সেইজন্যই আমাদের মধ্যে এই-সকল গুপ্তবিদ্যা, রহস্যবিদ্যা, ভুতুড়েকাণ্ড—সব আসিয়াছে। ঐগুলির মধ্যে কিছু মহৎ তত্ত্ব থাকিতে পারে, কিন্তু ঐগুলি আমাদিগকে প্রায় নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। তোমাদের স্নায়ু সতেজ কর। আমাদের আবশ্যক—লৌহের মত পেশী ও বজ্রদৃঢ় স্নায়ু। আমরা অনেক দিন ধরিয়া কাঁদিয়াছি; এখন আর কাঁদিবার প্রয়োজন নাই, এখন নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া মানুষ হও। আমাদের এখন এমন ধর্ম চাই, যাহা আমাদিগকে মানুষ করিতে পারে। আমাদের এমন সব মতবাদ আবশ্যক, যেগুলি আমাদিগকে মানুষ করিয়া গড়িয়া তোলে। যাহাতে মানুষ গঠিত হয়, এমন সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ শিক্ষার প্রয়োজন। কোন বিষয় সত্য কি অসত্য—জানিতে হইলে তাহার অব্যর্থ পরীক্ষা এইঃ উহা তোমাকে শারীরিক মানসিক বা আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল করে কিনা; যদি করে তবে তাহা বিষবৎ পরিহার কর—উহাতে প্রাণ নাই, উহা কখনও সত্য হইতে পারে না। সত্য বলপ্রদ, সত্যই পবিত্রতা-বিধায়ক, সত্যই জ্ঞানস্বরূপ। সত্য নিশ্চয়ই বলপ্রদ, হৃদযের অন্ধকার দূর করিয়া দেয়, হৃদয়ে বল দেয়। এই-সকল রহস্যময় গুহ্য মতে কিছু সত্য থাকিলেও সাধারণতঃ উহা মানুষকে দুর্বল করিয়া দেয়। আমাকে বিশ্বাস কর, সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে আমি ইহা বুঝিয়াছি। আমি ভারতের প্রায় সর্বত্র ভ্রমণ করিয়াছি, এদেশের প্রায় সকল গুহা অন্বেষণ করিয়া দেখিয়াছি, হিমালয়েও বাস করিয়াছি। এমন অনেককে জানি, যাহারা সারা জীবন সেখানে বাস করিতেছে। আমি ঐ-সকল গুহ্য মত সম্বন্ধে এই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ঐগুলি মানুষকে কেবল দুর্বল করিয়া দেয়। আর আমি আমার স্বজাতিকে ভালবাসি; তোমরা তো এখনই যথেষ্ট দুর্বল হইয়া পড়িয়াছ, তোমাদিগকে আর দুর্বলতর—হীনতর হইতে দেখিতে পারি না। অতএব তোমাদের কল্যাণের জন্য এবং সত্যের জন্য, আমার স্বজাতির যাহাতে আর অবনতি না হয় সেজন্য উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া বলিতে বাধ্য হইতেছিঃ আর না, অবনতির পথে আর অগ্রসর হইও না—যতদূর গিয়াছ, যথেষ্ট হইয়াছে।


এখন বীর্যবান্ হইবার চেষ্টা কর। তোমাদের উপনিষদ্—সেই বলপ্রদ আলোকপ্রদ দিব্য দর্শনশাস্ত্র আবার অবলম্বন কর, আর এই-সকল রহস্যময় দুর্বলতাজনক বিষয় পরিত্যাগ কর। উপনিষদ্‌রূপ এই মহত্তম দর্শন অবলম্বন কর। জগতের মহত্তম সত্য অতি সহজ। যেমন তোমার অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না, ইহাও সেইরূপ সহজবোধ্য। তোমাদের সম্মুখে উপনিষদের এই সত্যসমূহ রহিয়াছে। ঐ সত্য-সমূহ অবলোকন কর, ঐগুলি উপলব্ধি করিয়া কার্যে পরিণত কর—তবে নিশ্চয় ভারতের উদ্ধার হইবে।


আর একটি কথা বলিলেই আমার বক্তব্য শেষ হইবে। লোকে স্বদেশহিতৈষিতার আদর্শের কথা বলিয়া থাকে। আমিও স্বদেশহিতৈষিতায় বিশ্বাস করি। স্বদেশহিতৈষিতায় বিশ্বাসী আমারও একটা আদর্শ আছে। মহৎ কার্য করিতে গেলে তিনটি জিনিষ প্রয়োজন প্রথমতঃ হৃদয়বত্তা—আন্তরিকতা আবশ্যক। বুদ্ধি, বিচারশক্তি আমাদিগকে কতটুকু সাহায্য করিতে পারে? উহারা আমাদিগকে কয়েক পদ অগ্রসর করাইয়া দেয় মাত্র, কিন্তু হৃদয়দ্বার দিয়াই মহাশক্তির প্রেরণা আসিয়া থাকে। প্রেম অসম্ভবকে সম্ভব করে—জগতের সকল রহস্যই প্রেমিকের নিকট উন্মুক্ত।


হে ভাবী সংস্কারকগণ, ভাবী স্বদেশহিতৈষিগণ! তোমরা হৃদয়বান্‌ হও, প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ যে, কোটি কোটি দেব ও ঋষির বংশধর পশুপ্রায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে? তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছ—কোটি কোটি লোক অনাহারে মরিতেছে, কোটি কোটি লোক শত শতাব্দী ধরিয়া অর্ধাশনে কাটাইতেছে? তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ—অজ্ঞানের কৃষ্ণমেঘ সমগ্র ভারতগগনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে? তোমরা কি এই-সকল ভাবিয়া অস্থির হইয়াছ? এই ভাবনায় নিদ্রা কি তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছে?এই ভাবনা কি তোমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া তোমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হইয়াছে—তোমাদের হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনের সহিত কি এই ভাবনা মিশিয়া গিয়াছে? এই ভাবনা কি তোমাদিগকে পাগল করিয়া তুলিয়াছে? দেশের দুর্দশার চিন্তা কি তোমাদের একমাত্র ধ্যানের বিষয় হইয়াছে এবং ঐ চিন্তায় বিভোর হইয়া তোমরা কি তোমাদের নামযশ, স্ত্রীপুত্র, বিষয়সম্পত্তি, এমন কি শরীর পর্যন্ত ভুলিয়াছ? তোমাদের এরূপ হইয়াছে কি? যদি হইয়া থাকে, তবে বুঝিও তোমরা প্রথম সোপানে—স্বদেশহিতৈষী হইবার প্রথম সোপানে মাত্র পদার্পণ করিয়াছ। তোমরা অনেকেই জান, আমেরিকায় ধর্মমহাসভা হইয়াছিল বলিয়া আমি সেখানে যাই নাই, দেশের জনসাধারণের দুর্দশা দূর করিবার জন্য আমার ঘাড়ে যেন একটা ভূত চাপিয়াছিল। আমি অনেক বৎসর যাবৎ সমগ্র ভারতবর্ষে ঘুরিয়াছি, কিন্তু আমার স্বদেশবাসীর জন্য কাজ করিবার কোন সুযোগ পাই নাই। সেই জন্যই আমি আমেরিকায় গিয়াছিলাম। তখন তোমাদের মধ্যে যাহারা আমাকে জানিতে, তাহারা অবশ্য এ-কথা জান। ধর্মমহাসভা লইয়া কে মাথা ঘামায়? এখানে আমার নিজের রক্তমাংস-স্বরূপ জনসাধারণ দিন দিন ডুবিতেছে, তাহাদের খবর কে লয়?


ইহাই স্বদেশহিতৈষী হইবার প্রথম সোপান। মানিলাম, তোমরা দেশের দুর্দশার কথা প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এই দুর্দশা প্রতিকার করিবার কোন উপায় স্থির করিয়াছ কি? কেবল বৃথাবাক্যে শক্তিক্ষয় না করিয়া কোন কার্যকর পথ বাহির করিয়াছ কি? দেশবাসীকে গালি না দিয়া তাহাদের যথার্থ কোন সাহায্য করিতে পার কি? স্বদেশবাসীর এই জীবন্মৃত অবস্থা দূর করিবার জন্য তাহাদের এই ঘোর দুঃখে কিছু সান্ত্বনাবাক্য শুনাইতে পার কি?—কিন্তু ইহাতেও হইল না। তোমরা কি পর্বতপ্রায় বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ করিয়া কাজ করিতে প্রস্তুত আছ? যদি সমগ্র জগৎ তরবারি হস্তে তোমাদের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়, তথাপি তোমরা যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছ, তাহাই করিয়া যাইতে পার কি? যদি তোমাদের স্ত্রী-পুত্র তোমাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়, যদি তোমাদের ধন-মান সব যায়, তথাপি কি তোমরা উহা ধরিয়া থাকিতে পার? রাজা ভর্তৃহরি যেমন বলিয়াছেন, ‘নীতিনিপুণ ব্যক্তিগণ নিন্দাই করুন বা প্রশংসাই করুন, লক্ষ্মীদেবী গৃহে আসুন বা যথা ইচ্ছা চলিয়া যান, মৃত্যু—আজই হউক বা যুগান্তরেই হউক, তিনিই ধীর, যিনি সত্য হইতে একবিন্দু বিচলিত হন না।১১ সেইরূপ নিজ পথ হইতে বিচলিত না হইয়া তোমার কি তোমাদের লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হইতে পার?তোমাদের কি এইরূপ দৃঢ়তা আছে? যদি এই তিনটি জিনিষ তোমাদের থাকে, তবে তোমরা প্রত্যেকেই অলৌকিক কার্য সাধন করিতে পার। তোমাদের সংবাদপত্রে লিখিবার অথবা বক্তৃতা দিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন হইবে না। তোমাদের মুখ এক অপূর্ব স্বর্গীয় জ্যোতিঃ ধারণ করিবে। তোমরা যদি পর্বতের গুহায় গিয়া বাস কর, তথাপি তোমাদের চিন্তারাশি ঐ পর্বতপ্রাচীর ভেদ করিয়া বাহির হইবে। হয়তো শত শত বৎসর যাবৎ উহা কোন আশ্রয় না পাইয়া সূক্ষ্মাকারে সমগ্র জগতে ভ্রমণ করিবে। কিন্তু একদিন না একদিন উহা কোন না কোন মস্তিষ্ককে আশ্রয় করিবেই করিবে। তখন সেই চিন্তানুযায়ী কার্য হইতে থাকিবে। অকপটতা, সাধু উদ্দেশ্য ও চিন্তার এমনই শক্তি।


আর এক কথা—আমার আশঙ্কা হয়, তোমাদের বিলম্ব হইতেছে; হে আমার স্বদেশবাসিগণ, আমার বন্ধুগণ, আমার সন্তানগণ, এই জাতীয় অর্ণবপোত লক্ষ লক্ষ মানবাত্মাকে জীবন-সমুদ্রের পারে লইয়া যাইতেছে। ইহার সহায়তায় অনেক শতাব্দী যাবৎ লক্ষ লক্ষ মানব জীবন-সমুদ্রের অপর পারে অমৃতধামে নীত হইয়াছে। আজ হয়তো তোমাদের নিজ-দোষেই উহাতে দু-একটি ছিদ্র হইয়াছে, উহা একটু খারাপও হইয়া গিয়াছে। তোমরা কি এখন উহার নিন্দা করিবে? জগতের সকল জিনিষ অপেক্ষা যে-জিনিষ আমাদের অধিক কাজে আসিয়াছে, এখন কি তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করা উচিত? যদি এই জাতীয় অর্ণবপোতে—আমাদের এই সমাজে ছিদ্র হইয়া থাকে, তথাপি আমরা তো এই সমাজেরই সন্তান। আমাদিগকেই ঐ ছিদ্র বন্ধ করিতে হইবে। আনন্দের সহিত আমাদের হৃদয়ের শোণিত দিয়াও বন্ধ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে; যদি আমরা বন্ধ করিতে না পারি, তবে মরিতে হইবে। আমরা আমাদের বুদ্ধিসহায়ে ঐ অর্ণবপোতের ছিদ্রগুলি বন্ধ করিব, কিন্তু কখনই উহার নিন্দা করিব না। এই সমাজের বিরুদ্ধে একটা কর্কশ কথা বলিও না। আমি ইহার অতীত মহত্ত্বের জন্য ইহাকে ভালবাসি। আমি তোমাদের সকলকে ভালবাসি, কারণ তোমরা দেবতাদের বংশধর, তোমরা মহামহিমান্বিত পূর্বপুরূষগণের সন্তান। তোমাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ হউক। তোমাদিগকে কি নিন্দা করিব বা গালি দিব?—কখনই নয়। হে আমার সন্তানগণ, তোমাদের নিকট আমার সমুদয় পরিকল্পনা বলিতে আসিয়াছি। যদি তোমরা আমার কথা শোন, আমি তোমাদের সঙ্গে কাজ করিতে প্রস্তুত আছি। যদি না শোন, এমন কি আমাকে ভারতভূমি হইতে তাড়াইয়া দাও, তথাপি আমি তোমাদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিব—আমরা সকলে ডুবিতেছি। এই জন্যই আমি তোমাদের ভিতর তোমাদেরই একজন হইয়া তোমাদের সঙ্গে মিশিতে আসিয়াছি। আর যদি আমাদিগকে ডুবিতেই হয়, তবে আমরা যেন সকলে একসঙ্গে ডুবি, কিন্তু কাহারও প্রতি যেন কটূক্তি প্রয়োগ না করি।


১২. ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ১২. ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা

[মান্দ্রাজে প্রদত্ত তৃতীয় বক্তৃতা]


আমাদের জাতি ও ধর্মের অভিধা বা সংজ্ঞা-স্বরূপ একটি শব্দ খুব চলিত হইয়া পড়িয়াছে। আমি ‘হিন্দু’ শব্দটি লক্ষ্য করিয়া এই কথা বলিতেছি। ‘বেদান্তধর্ম’ বলিতে আমি কি লক্ষ্য করিয়া থাকি, তাহা বুঝাইবার জন্য এই শব্দটির অর্থ ভাল করিয়া বুঝা আবশ্যক। প্রাচীন পারসীকগণ সিন্ধু-নদকে ‘হিন্দু’ বলিতেন। সংস্কৃত ভাষায় যেখানে ‘স’ আছে, প্রাচীন পারসীক ভাষায় তাহাই ‘হ’-রূপে পরিণত হইয়াছে। এইরূপে সিন্ধু হইতে ‘হিন্দু’ হইল। আর তোমরা সকলেই জান, গ্রীকগণ ‘হ’ উচ্চারণ করিতে পারিত না; সুতরাং তাহারা একেবারে ‘হ’ টিকে উড়াইয়া দিল—এইরূপে আমরা ‘ইণ্ডিয়ান’ নামে পরিচিত হইলাম।


এখন কথা এই, প্রাচীনকালে এই শব্দের অর্থ যাহাই থাকুক, উহা সিন্ধুনদের অপরতীরের অধিবাসিগণকেই বুঝাক বা যাহাই বুঝাক, বর্তমানে এই শব্দের আর কোন সার্থকতা নাই; কারণ এখন আর সিন্ধুনদের অপরতীরের অধিবাসিগণ একধর্মাবলম্বী নহে। এখানে এখন আসল হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান, পারসীক, খ্রীষ্টান, কিছু বৌদ্ধ ও জৈন বাস করিতেছেন। ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ধরিলে ইঁহাদের সকলকেই হিন্দু বলিতে হয়, কিন্তু ধর্মহিসাবে ইঁহাদের সকলকে হিন্দু বলা চলে না। আর আমাদের ধর্ম যেন নানা মত, নানা ভাব এবং নানাবিধ অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপের সমষ্টি—এইসব একসঙ্গে রহিয়াছে, কিন্তু ইহাদের একটা সাধারণ নাম নাই, একটা মণ্ডলী নাই, একটা সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নাই। এই কারণে আমাদের ধর্মের একটি সাধারণ বা সর্ববাদিসম্মত নাম দেওয়া বড় কঠিন। বোধ হয়, একটিমাত্র বিষয়ে আমাদের সকল সম্প্রদায় একমত, আমরা সকলেই আমাদের শাস্ত্র—বেদে বিশ্বাসী। এটি বোধ হয় নিশ্চিত যে, যে-ব্যক্তি বেদের সর্বোচ্চ প্রামাণ্য অস্বীকার করে, তাহার নিজেকে ‘হিন্দু’ বলিবার অধিকার নাই।


তোমরা সকলেই জান, এই বেদসমূহ দুই ভাগে বিভক্ত—কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে নানাবিধ যাগযজ্ঞ ও অনুষ্ঠানপদ্ধতি আছে, উহাদের মধ্যে অধিকাংশই আজকাল প্রচলিত নাই। জ্ঞানকাণ্ডে বেদের আধ্যাত্মিক উপদেশসমূহ লিপিবদ্ধ—উহা ‘উপনিষদ্’ বা ‘বেদান্ত’ নামে পরিচিত। দ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বা অদ্বৈতবাদী আচার্য ও দার্শনিকগণ—সকলেই উহাকে উচ্চতম প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। ভারতীয় প্রত্যেক দর্শন ও প্রত্যেক সম্প্রদায়কেই দেখাইতে হয় যে, ঐ দর্শন বা সম্প্রদায় উপনিষদ্‌-রূপ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। যদি কেহ তাহা না দেখাইতে পারেন, তবে সেই দর্শন বা সম্প্রদায় প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী বলিয়া পরিগণিত হইবে। সুতরাং বর্তমানকালে সমগ্র ভারতের হিন্দুকে যদি কোন সাধারণ নামে পরিচিত করিতে হয়, তবে তাহাদিগকে সম্ভবতঃ ‘বৈদান্তিক’ বা ‘বৈদিক’—এই দুইটির মধ্যে যেটি তোমাদের ইচ্ছা বলিলেই ঠিক বলা হইবে। আর আমি ‘বৈদান্তিক ধর্ম’ ও ‘বেদান্ত’ শব্দ দুইটি ঐ অর্থেই ব্যবহার করিয়া থাকি।



আর একটু স্পষ্ট করিয়া এইটি বুঝাইতে চাই; কারণ ইদানীং বেদান্তদর্শনের ‘অদ্বৈত’ ব্যাখ্যাকেই ‘বেদান্ত’ শব্দের সমার্থক-রূপে প্রয়োগ করা অধিকাংশ লোকেরই একটা রীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমরা সকলেই জানি, উপনিষদ্‌কে ভিত্তি করিয়া যে-সকল বিভিন্ন দর্শনের সৃষ্টি হইয়াছে, অদ্বৈতবাদ তাহাদের অন্যতম মাত্র। উপনিষদের প্রতি অদ্বৈতবাদীর যতটা শ্রদ্ধা ভক্তি আছে, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরও ততটা আছে; এবং অদ্বৈতবাদীরা তাঁহাদের দর্শন বেদান্ত-প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া যতটা দাবী করেন, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরাও ততটাই করিয়া থাকেন। দ্বৈতবাদী ও ভারতীয় অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিও এইরূপ করিয়া থাকেন। ইহা সত্ত্বেও সাধারণ লোকের মনে ‘বৈদান্তিক’ ও ‘অদ্বৈতবাদী’ সমার্থক হইয়া দাঁড়াইয়াছে; সম্ভবতঃ ইহার কিছু কারণও আছে।


যদিও বেদই আমাদের প্রধান শাস্ত্র, তথাপি বেদের পরবর্তী স্মৃতি-পুরাণও আমাদের শাস্ত্র; কারণ সেগুলিতে বেদেরই মত বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত ও নানাবিধ দৃষ্টান্ত দ্বারা সমর্থিত হইয়াছে। এগুলি অবশ্য বেদের মত প্রামাণিক নহে। আর ইহাও শাস্ত্রবিধান যে, যেখানে শ্রুতি ও স্মৃতির মধ্যে কোন বিরোধ হইবে, সেখানে শ্রুতির মতই গ্রাহ্য হইবে এবং স্মৃতির মত পরিত্যাগ করিতে হইবে। এখন আমরা দেখিতে পাই—অদ্বৈতকেশরী শঙ্করাচার্য ও তাঁহার অনুগামী আচার্যগণের ব্যাখ্যায় প্রমাণরূপে উপনিষদ্‌ অধিক পরিমাণে উদ্বৃত হইয়াছে। কেবল যেখানে এমন বিষয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন হইয়াছে, যাহা শ্রুতিতে কোনরূপে পাওয়া যায় না, এমন অল্পস্থলেই কেবল স্মৃতিবাক্য উদ্ধৃত হইয়াছে। অন্যান্য মতবাদিগণ কিন্তু শ্রুতি অপেক্ষা স্মৃতির উপরেই অধিক পরিমাণে নির্ভর করিয়াছেন; যতই আমরা দ্বৈতবাদী সম্প্রদায়সমূহের পর্যালোচনা করি, ততই দেখিতে পাই, তাঁহাদের উদ্ধৃত স্মৃতিবাক্য শ্রুতির তুলনায় এত অধিক যে, বৈদান্তিকের নিকট তাহা আশা করা উচিত নয়। বোধ হয়, ইঁহারা স্মৃতি-পুরাণাদি প্রমাণের উপর এত অধিক নির্ভর করিয়াছিলেন যে, কালে অদ্বৈতবাদীই খাঁটি বৈদান্তিক বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন।



যাহা হউক, আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, ‘বেদান্ত’ শব্দ দ্বারা ভারতীয় ধর্মসমষ্টি বুঝিতে হইবে। আর বেদান্ত যখন বেদ, তখন ইহা সর্বসম্মতিক্রমে আমাদের প্রাচীনতম গ্রন্থ। অবশ্য আধুনিক পণ্ডিতগণের মত যাহাই হউক, হিন্দুরা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নন যে, বেদের কিছু অংশ এক সময়ে, আবার এবং কিছু অংশ অন্য সময়ে লিখিত হইয়াছে। হিন্দুরা অবশ্য এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিয়া থাকেন যে, সমগ্র বেদ এককালে উৎপন্ন হইয়াছিল, অথবা যদি আমার এরূপ ভাষা-প্রয়োগে কেহ আপত্তি না করেন—বেদ কখনই সৃষ্ট হয় নাই, চিরকালই সৃষ্টিকর্তার মনে উহা ছিল। ‘বেদান্ত’ শব্দে আমি উহাকেই—অনাদি অনন্ত জ্ঞানরাশিকেই লক্ষ্য করিতেছি; ভারতের দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ সকলই উহার অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবতঃ আমরা বৌদ্ধধর্ম, এমন কি জৈনধর্মের অংশবিশেষও গ্রহণ করিতে পারি—যদি উক্ত ধর্মাবলম্বিগণ অনুগ্রহপূর্বক আমাদের মধ্যে আসিতে সম্মত হন। আমাদের হৃদয় তো যথেষ্ট প্রশস্ত—আমরা তো তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত—তাঁহারাই আসিতে অসম্মত। আমরা তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিতে অনায়াসে প্রস্তুত; কারণ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করিলে দেখিবে, বৌদ্ধধর্মের সারভাগ ঐ-সব উপনিষ‍দ্ হইতেই গৃহীত; এমন কি বৌদ্ধধর্মের নীতি—তথাকথিত অদ্ভুত ও মহান্ নীতিতত্ত্ব—কোন না কোন উপনিষদে অবিকল বর্মমান। এইরূপ জৈনদেরও ভাল ভাল মতগুলি উপনিষদে রহিয়াছে, কেবল অযৌক্তিক সিদ্ধান্তগুলি নাই। পরবর্তী কালে ভারতীয় ধর্মচিন্তার যে-সকল পরিণতি হইয়াছে, সেগুলিরও বীজ আমরা উপনিষদে দেখিতে পাই। সময়ে সময়ে বিনা যুক্তিতে এরূপ অভিযোগ করা হইয়া থাকে যে, উপনিষদে ‘ভক্তি’র আদর্শ নাই। যাঁহারা উপনিষদ্ বিশেষভাবে অধ্যয়ন করিয়া থাকেন, তাঁহারা জানেন—এ অভিযোগ মোটেই সত্য নহে। অনুসন্ধান করিলে প্রত্যেক উপনিষদেই যথেষ্ট ভক্তির কথা পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য অনেক বিষয়, যাহা পরবর্তী কালে পুরাণ ও স্মৃতিসমূহে বিশেষরূপে পরিণত হইয়া ফলপুষ্পশোভিত মহীরূহের আকার ধারণ করিয়াছে, উপনিষদে সেগুলি মাত্র বীজভাবে বর্তমান। উপনিষদে যেন ঐগুলি চিত্রের প্রথম রেখাপাত অথবা কাঠামোরূপে বর্তমান। কোন না কোন পুরাণে ঐ চিত্রগুলি পরিস্ফুট করা হইয়াছে, কঙ্কালসমূহে মাংস-শোণিত সংযুক্ত হইয়াছে। কিন্তু এমন কোন সুপরিণত ভারতীয় আদর্শ নাই, যাহার বীজ সেই সর্বভাবের খনিস্বরূপ উপনিষদে না পাওয়া যায়। ভালভাবে উপনিষদের জ্ঞান অর্জন করেন নাই, এরূপ কয়েকজন ব্যক্তি প্রমাণ করিবার হাস্যাস্পদ চেষ্টা করিয়াছেন যে, ভক্তিবাদ বিদেশ হইতে আগত; কিন্তু তোমরা সকলেই জান, তাঁহাদের সমুদয় চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। তোমাদের যতটুকু ভক্তির প্রয়োজন, সেটুকু সবই উপনিষদের কথা কি, সংহিতাতেই রহিয়াছে—উপাসনা প্রেম ভক্তিতত্ত্ব—যাহা কিছু আবশ্যক, সবই রহিয়াছে; কেবল ভক্তির আদর্শ উচ্চ হইতে উচ্চতর হইতেছে। সংহিতা ভাগে স্থানে স্থানে ভীতি-প্রসূত ধর্মের চিহ্ন পাওয়া যায়। সংহিতাভাগে স্থানে স্থানে দেখা যায়, উপাসক—বরুণ বা অন্য কোন দেবতার সম্মুখে ভয়ে কাঁপিতেছে; স্থানে স্থানে দেখা যায়, তাহারা নিজদিগকে পাপী ভাবিয়া অতিশয় যন্ত্রণা পাইতেছে; কিন্তু উপনিষদে এ-সকল বর্ণনার স্থান নাই। উপনিষদে ভয়ের ধর্ম নাই; উপনিষদের ধর্ম—প্রেমের, উপনিষদের ধর্ম—জ্ঞানের।



এই উপনিষদ‍্সমূহই আমাদের শাস্ত্র। এইগুলি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। আর আমি তোমাদিগকে পূর্বেই বলিয়াছি, পরবর্তী পৌরাণিক শাস্ত্র ও বেদের মধ্যে যেখানেই প্রভেদ লক্ষিত হইবে, সেখানেই পুরাণের মত অগ্রাহ্য করিয়া বেদের মত গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু কার্যতঃ দেখিতে পাই, আমরা শতকরা নব্বই জন পৌরাণিক আর বাকী শতকরা দশজন বৈদিক—তাহাও হয় কিনা সন্দেহ। আরও দেখিতে পাই—আমাদের মধ্যে নানাবিধ অত্যন্ত-বিরোধী আচার বিদ্যমান; দেখিতে পাই—আমাদের সমাজে এমন সব ধর্মমত রহিয়াছে, যেগুলির কোন প্রমাণ হিন্দুদের শাস্ত্রে নাই। আর শাস্ত্রপাঠে আমরা দেখিতে পাই এবং দেখিয়া আশ্চর্য হই যে, আমাদের দেশে অনেক স্থলে এমন সব প্রথা প্রচলিত আছে, যেগুলির প্রমাণ বেদ স্মৃতি পুরাণ কোথাও নাই—সেগুলি কেবল বিশেষ বিশেষ দেশাচারমাত্র। তথাপি প্রত্যেক অজ্ঞ গ্রামবাসীই মনে করে, যদি তাহার গ্রাম্য আচারটি উঠিয়া যায়, তাহা হইলে সে আর হিন্দু থাকিবে না। তাহার মনে বৈদান্তিক ধর্ম ও এই-সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশাচার অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। শাস্ত্রপাঠ করিয়াও সে বুঝিতে পারে না—সে যাহা করিতেছে, তাহাতে শাস্ত্রের সম্মতি নাই! তাহার পক্ষে ইহা বুঝা বড় কঠিন হইয়া উঠে যে, ঐ-সকল আচার পরিত্যাগ করিলে তাহার কিছুই ক্ষতি হইবে না, বরং সে পূর্বাপেক্ষা উন্নততর হইবে, মানুষের মত মানুষ হইবে। দ্বিতীয়তঃ আর এক অসুবিধা—আমাদের শাস্ত্র অতি বৃহৎ ও অসংখ্য। পতঞ্জলি-প্রণীত ‘মহাভাষ্য’ নামক শব্দশাস্ত্রে পাঠ করা যায়, সামবেদের সহস্র শাখা ছিল। সেগুলি গেল কোথায়, কেহই জানে না। প্রত্যেক বেদ সম্বন্ধেই এইরূপ। এই-সকল গ্রন্থের অধিকাংশই লোপ পাইয়াছে, সামান্য অংশমাত্র আমাদের নিকট অবশিষ্ট আছে। এক এক ঋষি-পরিবার এক এক শাখার ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই-সকল পরিবারের মধ্যে অধিকাংশেরই হয় স্বাভাবিক নিয়মানুসারে বংশলোপ হইয়াছে, অথবা বৈদেশিক অত্যাচারে বা অন্য কারণে তাঁহাদের বিনাশ ঘটিয়াছে। আর তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা যে-বেদের শাখাবিশেষ রক্ষা করিবার ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাও লোপ পাইয়াছে। এই বিষয়টি আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ রাখা আবশ্যক; কারণ যাহারা কিছু নূতন কিছু প্রচার করিতে চায় বা বেদের বিরোধী কোন বিষয় সমর্থন করিতে চায়, তাহাদের পক্ষে এই যুক্তিটি চরম অবলম্বন হইয়া দাঁড়ায়। যখনই ভারতে শ্রুতি ও দেশাচার লইয়া তর্ক উপস্থিত হয় এবং যখনই দেখাইয়া দেওয়া হয় যে, এই দেশাচারটি শ্রুতি-বিরুদ্ধ, তখন অপর পক্ষ এই উত্তর দিয়া থাকে, ‘না, উহা শ্রুতিবিরুদ্ধ নহে, উহা শ্রুতির সেই-সকল শাখায় ছিল, যেগুলি এখন লোপ পাইয়াছে। ঐ প্রথাটিও বেদসম্মত।’ শাস্ত্রের এই-সকল নানাবিধ টীকা-টিপ্পনীর ভিতর কোন সাধারণ সূত্র বাহির করা অবশ্যই বিশেষ কঠিন। কিন্তু সহজেই বুঝিতে পারি যে, এই-সকল নানাবিধ বিভাগ ও উপবিভাগের একটি সাধারণ ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। অট্টালিকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলি নিশ্চয় একটি সাধারণ নকশা অনুযায়ী নির্মিত হইয়াছে। আমরা যাহাকে আমাদের ‘ধর্ম’ বলি, সেই আপাতবিশৃঙ্খল মতগুলির নিশ্চয় কোন সাধারণ ভিত্তি আছে; তাহা না হইলে উহা এতদিন টিকিয়া থাকিতে পারিত না।



আবার আমাদের ভাষ্যকারদিগের ভাষ্য আলোচনা করিতে গেলে আর এক বাধা উপস্থিত হয়ঃ অদ্বৈতবাদী ভাষ্যকার যখন অদ্বৈতপর শ্রুতির ব্যাখ্যা করেন, তখন তিনি উহার সোজাসুজি অর্থ করেন; কিন্তু তিনিই আবার যখন দ্বৈতপর শ্রুতির ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হন, তখন উহার শব্দার্থ বিকৃত করিয়া উহা হইতে অদ্ভুত অদ্ভুত অর্থ বাহির করেন। ভাষ্যকার নিজ মনোমত অর্থ বাহির করিবার জন্য সময়ে সময়ে ‘অজা’ (জন্মরহিত) শব্দের অর্থ ‘ছাগী’ করিয়াছেন—কি অদ্ভুত পরিবর্তন! দ্বৈতবাদী ভাষ্যকারেরাও এইরূপ, এমন কি আরও বিকৃতিভাবে শ্রুতির ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যেখানে যেখানে তাঁহারা দ্বৈতপর শ্রুতি পাইয়াছেন, সেগুলি যথাযথ রাখিয়া দিয়াছেন, কিন্তু যেখানেই অদ্বৈতবাদের কথা আসিয়াছে, সেইখানেই তাঁহারা সেই-সকল শ্রুতির যথেচ্ছ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এই ভাষা এত জটিল—বৈদিক সংস্কৃত এত প্রাচীন, সংস্কৃত শব্দশাস্ত্র এত সুপরিণত যে, একটি শব্দের অর্থ লইয়া যুগযুগান্তর ধরিয়া তর্ক চলিতে পারে। কোন পণ্ডিতের যদি খেয়াল হয়, তবে তিনি যে-কোন যে-কোন অর্থহীন উক্তিকেও যুক্তিবলে এবং শাস্ত্র ও ব্যাকরণের নিয়ম উদ্ধৃত করিয়া শুদ্ধ সংস্কৃত করিয়া তুলিতে পারেন। উপনিষদ্ বুঝিবার পক্ষে এই-সকল বাধাবিঘ্ন আছে। বিধাতার ইচ্ছায় আমি এমন এক ব্যক্তির সঙ্গলাভের সুযোগ পাইয়াছিলাম, যিনি একদিকে যেমন ঘোর দ্বৈতবাদী, অপরদিকে তেমনি একনিষ্ঠ অদ্বৈতবাদী ছিলেন; যিনি একদিকে যেমন পরম ভক্ত, অপরদিকে তেমনি পরম জ্ঞানী ছিলেন। এই ব্যক্তির শিক্ষাতেই আমি শুধু অন্ধভাবে ভাষ্যকারদিগের অনুসরণ না করিয়া স্বাধীনভাবে উৎকৃষ্টরূপে প্রথমে উপনিষদ্ ও অন্যান্য শাস্ত্র বুঝিতে শিখিয়াছি। আমি এ-বিষয়ে যৎসামান্য যাহা অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহাতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, এই-সকল শাস্ত্রবাক্য পরস্পরবিরোধী নহে। সুতরাং আমাদের শাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা করিবার কোন প্রয়োজন নাই। শ্রুতিবাক্যগুলি অতি মনোরম, অতি অদ্ভুত আর উহারা পরস্পরবিরোধী নহে, ঐগুলির মধ্যে অপূর্ব সামঞ্জস্য বিদ্যমান, একটি তত্ত্ব যেন অপরটির সোপানস্বরূপ। আমি এই-সকল উপনিষদেই একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়াছি যে, প্রথমে দ্বৈতভাবের কথা—উপাসনা প্রভৃতি আরম্ভ হইয়াছে, শেষে অদ্বৈতভাবের অপূর্ব উচ্ছ্বাসে সেগুলি সমাপ্ত হইয়াছে।



সুতরাং এখন এই মহাপুরুষের জীবনালোকে আমি দেখিতেছি যে, দ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদীর পরস্পর বিবাদ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। জাতীয় জীবনে উভয়েরই বিশেষ স্থান আছে। দ্বৈতবাদী থাকিবেই—অদ্বৈতবাদীর ন্যায় দ্বৈতবাদীরও জাতীয় ধর্মজীবনে বিশেষ স্থান আছে। একটি ব্যতীত অপরটি থাকিতে পারে না, একটি অপরটির পরিণতি; একটি যেন কাঠামো, অপরটি ছাদ; একটি যেন মূল, অপরটি ফল।


আর উপনিষদের শব্দার্থ বিকৃত করিবার চেষ্টা আমার নিকট অতিশয় হাস্যাস্পদ বলিয়া বোধ হয়; কারণ আমি দেখিতে পাই, উহার ভাষাই অপূর্ব। শ্রেষ্ঠ দর্শনরূপে উহার গৌরব ছাড়িয়া দিলেও, মানবজাতির মুক্তিপথ-প্রদর্শক ধর্মজ্ঞানরূপে উহার অদ্ভুত গৌরব ছাড়িয়া দিলেও ঔপনিষদিক সাহিত্যে মহান্ ভাবের যেমন অতি অপূর্ব চিত্র আছে, জগতে আর কোথাও তেমন নাই। এখানেই মানবমনের সেই ব্যক্তিভাবাপন্ন বৈশিষ্ট্য—সেই অন্তর্দৃষ্টিপরায়ণ হিন্দুমন পরিপূর্ণ শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করে।


অন্যান্য সকল জাতির ভিতরেই এই মহান্ ভাবের চিত্র অঙ্কন করিবার চেষ্টা দেখা যায়; কিন্তু প্রায় সর্বত্রই দেখিবে, তাহারা বাহ্য প্রকৃতির মহান্ ভাবকে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ মিল্টন, দান্তে, হোমর বা অন্য যে-কোন পাশ্চাত্য কবির কাব্য আলোচনা করা যাউক, তাঁহাদের কাব্যে স্থানে স্থানে মহত্ত্বব্যঞ্জক অপূর্ব শ্লোকাবলী দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে সর্বত্রই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বহিঃপ্রকৃতির বর্ণনার চেষ্টা—বহিঃপ্রকৃতির বিশাল ভাব, দেশকালের অনন্ত ভাবের বর্ণনা। আমরা বেদের সংহিতাভাগেও এই চেষ্টা দেখিতে পাই। সৃষ্টি প্রভৃতি বর্ণনাত্মক কতকগুলি অপূর্ব ঋঙ‍্মন্ত্রে বাহ্য প্রকৃতির মহান্‌ ভাব, দেশকালের অনন্তত্ব অতি গম্ভীরভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে; কিন্তু তাঁহারা যেন শীঘ্রই দেখিতে পাইলেন যে, এ উপায়ে অনন্তস্বরূপকে ধরিতে পারা যায় না; বুঝিলেন, তাঁহাদের মনের যে-সকল ভাব তাঁহারা ভাষায় প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিতেছেন, অনন্ত দেশ—অনন্ত বিস্তার—অনন্ত বাহ্যপ্রকৃতিও সেগুলি প্রকাশ করিতে অক্ষম। তখন তাঁহারা জগৎ-সমস্যা ব্যাখ্যা করিবার জন্য অন্য পথ ধরিলেন।



উপনিষদের ভাষা নূতন মূর্তি ধারণ করিল—উপনিষদের ভাষা একরূপ নাস্তিভাবদ্যোতক, স্থানে স্থানে অস্ফুট, উহা যেন তোমাকে অতীন্দ্রিয় রাজ্যে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে; কিন্তু অর্ধ পথে গিয়াই ক্ষান্ত হইয়া তোমাকে কেবল এক ধারণাতীত অতীন্দ্রিয় বস্তুর আভাস দেখাইয়া দেয়, তথাপি সেই বস্তুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে তোমার কোন সন্দেহ থাকে না। জগতে এমন কবিতা কোথায়, যাহার সহিত এই শ্লোকের তুলনা হইতে পারে?—


ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্

নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুহোঽয়মগ্নিঃ।১২ সেখানে সূর্য কিরণ দেয় না, চন্দ্র-তারাও নহে, এই বিদ্যুৎও সেই স্থানকে আলোকিত করিতে পারে না, এই সামান্য অগ্নির আর কথা কি?


পৃথিবীর সমগ্র দার্শনিক ভাবের পূর্ণতর চিত্র আর কোথায় পাইবে? হিন্দুজাতির সমগ্র চিন্তার, মানবজাতির মুক্তির সামগ্রিক কল্পনার সারাংশ যেমন অদ্ভুত ভাষায় চিত্রিত হইয়াছে, যেমন অপূর্ব রূপকে বর্ণিত হইয়াছে, তেমন আর কোথায় পাইবে?


‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।

তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যোঽভিচাকশীতি ||

সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোঽনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।

জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ ||

যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্।

তদা বিদ্বান্ পুণ্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি ||’১৩



একই বৃক্ষের উপর সুন্দরপক্ষযুক্ত দুইটি পক্ষী রহিয়াছে—উভয়েই পরস্পর সখ্যভাবাপন্ন; তন্মধ্যে একটি সেই বৃক্ষের ফল খাইতেছে, অপরটি না খাইয়া স্থিরভাবে নীরবে বসিয়া আছে। নিম্নশাখায় উপবিষ্ট পক্ষী কখনও মিষ্ট কখনও-বা কটু ফল ভক্ষণ করিতেছে এবং সেই কারণে কখনও সুখী, কখনও-বা দুঃখী হইতেছে; কিন্তু উপরের শাখার পক্ষীটি স্থির গম্ভীরভাবে উপবিষ্ট—সে ভালমন্দ কোন ফলই খাইতেছে না, সে সুখ-দুঃখ উভয়েই উদাসীন—নিজ মহিমায় মগ্ন হইয়া আছে। এই পক্ষিদ্বয়—জীবাত্মা ও পরমাত্মা। মানবাত্মার ইহাই যথার্থ চিত্র। মানুষ ইহজীবনের স্বাদু ও কটুফল ভোজন করিতেছে—সে কাঞ্চনের অন্বেষণে মত্ত—সে ইন্দ্রিয়ের পশ্চাতে ধাবমান, সংসারের ক্ষণিক বৃথা সুখের জন্য মরিয়া হইয়া পাগলের মত ছুটিতেছে।


অন্য আর এক স্থলে উপনিষদ্ সারথি ও তাহার অসংযত দুষ্ট অশ্বের সহিত মানবের এই ইন্দ্রিয়সুখান্বেষণের তুলনা করিয়াছেন।১৪ মানুষ এইরূপে জীবনের বৃথা সুখানুসন্ধান-চেষ্টায় ছুটিতেছে। জীবনের ঊষাকালে মানুষ কত সোনার স্বপ্ন দেখিয়া থাকে; কিন্তু শীঘ্রই বুঝিতে পারে, সেগুলি স্বপ্নমাত্র—বার্ধক্যে সে তাহার অতীত কর্মসমূহেরই রোমন্থন করিতে থাকে, পুনরাবৃত্তি করিতে থাকে, কিন্তু কিসে এই ঘোর সংসারজাল হইতে বাহির হইবে, তাহার কোন উপায় খুঁজিয়া পায় না। ইহাই মানুষের নিয়তি। কিন্তু সকল মানুষেরই জীবনে সময়ে সময়ে এমন শুভ মুহূর্ত আসিয়া থাকে—গভীরতম শোকে, এমন কি গভীরতম আনন্দের মধ্যেও মানুষের এমন শুভক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয়, যখন সেই সূর্যালোক-অবরোধকারী মেঘের খানিকটা যেন ক্ষণকালের জন্য সরিয়া যায়। তখন আমরা আমাদের এই সীমাবদ্ধ ভাব সত্ত্বেও ক্ষণকালের জন্য সেই সর্বাতীত সত্তার চকিত দর্শন লাভ করি; দূরে, দূরে—পঞ্চেন্দ্রিয়াবদ্ধ জীবনের বহু দূরে—এই সংসারের ব্যর্থ ভোগ ও সুখদুঃখ হইতে অনেক দূরে—দূরে, দূরে—প্রকৃতির পরপারে—ইহলোকে বা পরলোকে আমরা যে সুখভোগের কল্পনা করিয়া থাকি, তাহা হইতে বহু দূরে, বিত্তৈষণা লোকৈষণা প্রজৈষণা হইতে বহু দূরে—মানুষ ক্ষণিকের জন্য দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া স্থিরভাব অবলম্বন করে, সে তখন বৃক্ষের উপরিভাগে অবস্থিত অপর পক্ষীটির শান্ত ও মহিমময় রূপ অবলোকন করে; সে দেখে—ঐ পক্ষীটি স্বাদু কটু কোন ফল ভক্ষণ করিতেছে না—নিজ মহিমায় নিজে বিভোর, আত্মতৃপ্ত—যেমন গীতায় উক্ত হইয়াছেঃ



যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।

আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ||


যিনি আত্মরতি, আত্মতৃপ্ত ও আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁহার আর কোন কার্য অবশিষ্ট থাকে না। তিনি আর কেন বৃথা কার্য করিয়া সময় কাটাইবেন?


একবার চকিতভাবে দর্শন করিয়া মানুষ আবার ভুলিয়া যায়, আবার সংসারবৃক্ষে স্বাদু ও তিক্ত ফল ভোজন করিতে থাকে—তখন আর তাহার কিছুই স্মরণ থাকে না। আবার হয়তো কিছুদিন পরে সে আর একবার পূর্বের ন্যায় চকিত দর্শন লাভ করে এবং যতই আঘাত পায়, ততই সেই নিম্নশাখাস্থিত পক্ষী উপরের পক্ষীর নিকটবর্তী হইতে থাকে। যদি সৌভাগ্যক্রমে সে ক্রমাগত সংসারের তীব্র আঘাত পায়, তবে সে তাহার সঙ্গী—তাহার প্রাণ—তাহার সখা সেই অপর পক্ষীর ক্রমশঃ সমীপবর্তী হইতে থাকে। আর যতই সে অধিকতর নিকটবর্তী হয়, ততই দেখে উপরের সেই পক্ষীর দেহজ্যোতিঃ আসিয়া তাহার পক্ষের চতুর্দিকে খেলা করিতেছে; যতই সমীপবর্তী হয়, ততই তাহার রূপান্তর হইতে থাকে। ক্রমশঃ যতই সে নিকট হইতে নিকটতর হইতে থাকে, ততই দেখে—সে যেন মিলাইয়া যাইতেছে; অবশেষে সম্পূর্ণ বিলীন হইয়া যায়। তখন সে বুঝিতে পারে—তাহার পৃথক্ অস্তিত্ব কোনকালে ছিল না, পত্ররাশির ভিতর সঞ্চরণশীল পক্ষীটি শান্ত গম্ভীরভাবে উপবিষ্ট অপর পক্ষীর প্রতিবিম্বমাত্র। তখন সে জানিতে পারে—সে নিজেই ঐ উপরের পক্ষী, সে সর্বদাই শান্তভাবে অবস্থিত ছিল; ঐ মহিমা তাহারই। তখন আর কোন ভয় থাকে না, তখন সে সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইয়া ধীর শান্তভাবে অবস্থান করে। এই রূপকের মাধ্যমে উপনিষদ্ তোমাদিগকে দ্বৈতভাব হইতে আরম্ভ করিয়া চূড়ান্ত অদ্বৈতভাবে লইয়া যাইতেছেন।



উপনিষদের এই অপূর্ব কবিত্ব, মহত্ত্বের চিত্র, মহোচ্চ ভাবসমূহ দেখাইবার জন্য শত শত উদাহরণ উল্লেখ করা যাইতে পারে, কিন্তু এই বক্তৃতায় আমাদের আর সময় নাই। তবে আর একটি কথা বলিব, উপনিষদের ভাষা, ভাব—সব-কিছুরই ভিতর কোন জটিলতা নাই, উহার প্রত্যেকটি কথাই তরবারি-ফলকের মত, হাতুড়ির ঘায়ের মত সাক্ষাৎভাবে হৃদয়ে আঘাত করে। উহাদের অর্থ বুঝিতে কিছুমাত্র ভুল হইবার সম্ভাবনা নাই—সেই সঙ্গীতের প্রত্যেকটি সুরের একটা শক্তি আছে, প্রত্যেকটি তাহার সম্পূর্ণ ভাব হৃদয়ে মুদ্রিত করিয়া দেয়। কোন ঘোরফের নাই, একটিও অসম্বদ্ধ প্রলাপ নাই, একটিও জটিল বাক্য নাই যাহাতে মাথা গুলাইয়া যায়। উহাতে অবনতির চিহ্নমাত্র নাই, বেশী রূপক-বর্ণনার চেষ্টা নাই। বিশেষণের পর বিশেষণ দিয়া ভাবটিকে ক্রমাগত জটিলতর করা হইল, প্রকৃত বিষয়টি একেবারে চাপা পড়িল, মাথা গুলাইয়া গেল, তখন সেই শাস্ত্ররূপ গোলকধাঁধার বাহিরে যাইবার আর উপায় রহিল না—উপনিষদে এ-ধরনের চেষ্টার কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। যদি ইহা মানবপ্রণীত হয়, তবে ইহা এমন এক জাতির সাহিত্য, যে-জাতি তখনও তাহার জাতীয় তেজবীর্য একবিন্দুও হারায় নাই। প্রতি পৃষ্ঠা ইহা আমাদিগকে তেজবীর্জের কথা বলিয়া থাকে।


এই বিষযটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে, সমগ্র জীবনে আমি এই মহাশিক্ষা পাইয়াছি—উপনিষদ্‌ বলিতেছেন, হে মানব, তেজস্বী হও, দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। মানুষ কাতরভাবে জিজ্ঞাসা করে—আমার কি দুর্বলতা নাই? উপনিষদ্ বলেন, আছে বটে, কিন্তু অধিকতর দুর্বলতা দ্বারা কি এই দুর্বলতা দূর হইবে? ময়লা দিয়া কি ময়লা দূর হইবে? পাপের দ্বারা কি পাপ দূর করা যায়? উপনিষদ্ বলিতেছেন—হে মানব, তেজস্বী হও, তেজস্বী হও, উঠিয়া দাঁড়াও, বীর্য অবলম্বন কর। জগতের সাহিত্যের মধ্যে কেবল উপনিষদেই ‘অভীঃ’ এই শব্দ বার বার ব্যবহৃত হইয়াছে—আর কোন শাস্ত্রে ঈশ্বর বা মানবের প্রতি ‘অভীঃ’ বা ভয়শূন্য এই বিশেষণ প্রযুক্ত হয় নাই। ‘অভীঃ’—ভয়শূন্য হও।



আমার মনে সুদূর অতীতের সেই পাশ্চাত্যদেশীয় সম্রাট্‌ আলেকজাণ্ডারের চিত্র উদিত হইতেছে। আমি যেন দেখিতেছি—সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট্‌ সিন্ধুনদের তীরে দাঁড়াইয়া অরণ্যবাসী, শিলাখণ্ডে উপবিষ্ট, সম্পূর্ণ উলঙ্গ, স্থবির আমাদেরই জনৈক সন্ন্যাসীর সহিত আলাপ করিতেছেন; সম্রাট্‌ সন্ন্যাসীর অপূর্ব জ্ঞানে বিস্মিত হইয়া তাঁহাকে অর্থ-মানের প্রলোভন দেখাইয়া গ্রীসদেশে যাইবার জন্য আহ্বান করিতেছেন। সন্ন্যাসী অর্থ-মানাদি প্রলোভনের কথা শুনিয়া একটু হাসিয়া গ্রীসে যাইতে অস্বীকার করিলেন; তখন সম্রাট্‌ নিজ রাজপ্রতাপ প্রকাশ করিযা বলেন, ‘যদি আপনি না আসেন, আমি আপনাকে মারিয়া ফেলিব।’ তখন সন্ন্যাসী উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, ‘তুমি এখন যেরূপ কথা বলিলে, জীবনে এরূপ মিথ্যা কথা আর কখনও বল নাই। আমাকে কে বধ করিতে পারে? ঐহিকজগতের সম্রাট্‌, তুমি আমায় মারিবে? তাহা কখনই হইতে পারে না! আমি চৈতন্যস্বরূপ, অজ ও অব্যয়। আমি কখনও জন্মাই নাই, কখনও মরিবও না! আমি অনন্ত, সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ! তুমি শিশু, তুমি আমায় মারিবে?’ ইহাই প্রকৃত তেজ, ইহাই প্রকৃত বীর্য।


হে বন্ধুগণ, হে স্বদেশবাসিগণ, আমি যতই উপনিষদ্ পাঠ করি, ততই আমি তোমাদের জন্য অশ্রুবিসর্জন করিয়া থাকি; কারণ উপনিষদুক্ত এই তেজস্বিতাই আমাদের জীবনে বিশেষভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। শক্তি, শক্তি—ইহাই আমাদের চাই। শক্তি আমাদের বিশেষ আবশ্যক। কে আমাদিগকে শক্তি দিবে? আমাদিগকে দুর্বল করিবার সহস্র সহস্র বিষয় আছে, গল্পও যথেষ্ট আছে। আমাদের প্রত্যেক পুরাণে এত গল্প আছে, যেগুলি পৃথিবীর গ্রন্থাগারসমূহের তিন-চতুর্থাংশ পূর্ণ করিতে পারে—এ-সকলই আমাদের আছে। যাহা কিছু আমাদের জাতিকে দুর্বল করিতে পারে, তাহাও বিগত সহস্র বর্ষ ধরিয়া আমাদের মধ্যে রহিয়াছে। বোধ হয় যেন বিগত সহস্র বর্ষ ধরিয়া আমাদের জাতীয় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল—কিভাবে দুর্বল হইতে দুর্বলতর হওয়া যায়। অবশেষে আমরা কেঁচোর মত হইয়া পড়িয়াছি—এখন যাহার ইচ্ছা সেই আমাদিগকে পদদলিত করিতেছে। বন্ধুগণ, তোমাদের সহিত আমার শোণিতের সম্বন্ধ, তোমাদের জীবনে মরণে আমার জীবনমরণ। তাই আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, আমাদের প্রয়োজন—শক্তি, শক্তি, কেবল শক্তি। আর উপনিষদ‍্সমূহ শক্তির বৃহৎ আকর। উপনিষদ্ যে শক্তি সঞ্চার করিতে সমর্থ, সেই শক্তি সমগ্র জগৎকে তেজস্বী করিতে পারে। উহার দ্বারা সমগ্র জগৎকে পুনরুজ্জীবিত, শক্তিমান্ ও বীর্যশালী করিতে পারা যায়। উহা সকল জাতির, সকল মতের, সকল সম্প্রদায়ের দুর্বল দুঃখী পদদলিতকে উচ্চরবে আহ্বান করিয়া নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইয়া মুক্ত হইতে বলে। দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিকমুক্তি বা স্বাধীনতা—ইহাই উপনিষদের মূলমন্ত্র। জগতের মধ্যে ইহাই একমাত্র শাস্ত্র, যাহা পরিত্রাণের (salvation) কথা বলে না, মুক্তির কথা বলে। প্রকৃত বন্ধন হইতে মুক্ত হও, দুর্বলতা হইতে মুক্ত হও।



আর উপনিষদ্ দেখাইয়া দেন যে, ঐ মুক্তি তোমার মধ্যে পূর্ব হইতেই বিদ্যমান। এই মতটি উপনিষদের আর এক বিশেষত্ব। তুমি দ্বৈতবাদী, তা হউক; কিন্তু তোমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, আত্মা স্বভাবতই পূর্ণস্বরূপ। কেবল কতকগুলি কাজের দ্বারা উহা সঙ্কুচিত হইয়াছে মাত্র। আধুনিক পরিণামবাদীরা (Evolutionists) যাহাকে ক্রমবিকাশ (Evolution) ও পূর্বানুকৃতি (Atavism) বলিয়া থাকেন, রামানুজের সঙ্কোচ-বিকাশের মতও ঠিক সেইরূপ। আত্মা তাঁহার স্বাভাবিক পূর্ণতা হইতে ভ্রষ্ট হইয়া যেন সঙ্কোচপ্রাপ্ত হন, তাঁহার শক্তিসমূহ অব্যক্তভাব ধারণ করে; সৎকর্ম ও সৎচিন্তা দ্বারা উহা পুনরায় বিকাশপ্রাপ্ত হয় এবং তখনই উহার স্বাভাবিক পূর্ণতা প্রকটিত হইয়া পড়ে। অদ্বৈতবাদীর সহিত দ্বৈতবাদীর প্রভেদ এইটুকু যে, অদ্বৈতবাদী প্রকৃতির পরিণাম স্বীকার করেন, আত্মার নয়। মনে কর, একটি যবনিকা রহিয়াছে, আর ঐ যবনিকাটিতে একটি ছোট ছিদ্র আছে। আমি ঐ যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া এই মহতী জনতাকে দেখিতেছি। প্রথমে কেবল কয়েকটি মুখ দেখিতে পাইব। মনে কর, ছিদ্রটি বাড়িতে লাগিল; ছিদ্রটি যতই বাড়িতে থাকিবে, ততই আমি এই সমবেত জনতার অধিকতর অংশ দেখিতে পাইব। বড় হইতে হইতে শেষে ছিদ্রটি যবনিকার সমান হইয়া যাইবে। তখন তোমাদের ও আমার মধ্যে কোন ব্যবধান থাকিবে না। এস্থলে তোমাদের বা আমার কোন পরিবর্তন হয় নাই; যাহা কিছু পরিবর্তন কেবল যবনিকাতেই ঘটিয়াছে। তোমরা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একরূপই ছিলে, কেবল যবনিকাটির পরিবর্তন হইল। পরিণাম সম্বন্ধে অদ্বৈতবাদীর মতঃ প্রকৃতির পরিণাম ও অন্তরাত্মার প্রকাশ। আত্মা কোনরূপে সঙ্কুচিত হইতে পারে না, ইহা অপরিণামী ও অনন্ত। আত্মা যেন মায়ারূপ অবগুণ্ঠনে আবৃত হইয়াছিল—যতই এই মায়ার আবরণ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হয়, ততই আত্মা সহজাত স্বাভাবিক মহিমায় প্রকাশিত হয় এবং ক্রমশ অধিকতর অভিব্যক্ত হইয়া থাকে।


ভারতের নিকট এই মহান্‌ তত্ত্বটি শিখিবার জন্য পৃথিবীর লোক অপেক্ষা করিতেছে; তাহারা যাহাই বলুক, যতই নিজেদের গরিমা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করুক, ক্রমশঃ যতই দিন যাইবে তাহারা বুঝিবে, এই তত্ত্ব স্বীকার না করিয়া কোন সমাজই টিকিতে পারে না। তোমরা কি দেখিতেছ না, সকল বিষয়েই কিরূপ গুরুতর পরিবর্তন হইতেছে? তোমরা কি দেখিতেছ না পূর্বে সব-কিছুকে স্বভাবতঃ মন্দ বলিয়া মনে করিবার রীতি ছিল, কিন্তু এখন সব-কিছু ভাল বলিয়া প্রমাণিত হইতেছে? কি শিক্ষাপ্রণালীতে, কি অপরাধিগণের শাস্তিবিধানে, কি উন্মাদের চিকিৎসায়, এমন কি, সাধারণ ব্যাধির চিকিৎসায় পর্যন্ত প্রাচীন নিয়ম ছিল—সবই স্বভাবতঃ মন্দ বলিয়া ধরিয়া লওয়া। আধুনিক নিয়ম কি? আধুনিক বিধান বলে—শরীর স্বভাবতই সুস্থ, নিজ প্রকৃতিবশে উহা ব্যাধির উপশম করিযা থাকে। ঔষধ বড়জোর শরীরের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ পদার্থ আছে, তাহা সঞ্চয় করিতে সাহায্য করে। অপরাধী সম্বন্ধে এই নববিধান কি বলে? নূতন বিধান স্বীকার করিয়া থাকে—কোন অপরাধী ব্যক্তি যতই হীন হউক, তাহার মধ্যে যে-দেবত্ব আছে, তাহার কখনও পরিবর্তন হয় না; সুতরাং অপরাধিগণের প্রতি আমাদের তদনুরূপ ব্যবহার করা উচিত। এখন পূর্বের ভাব সব বদলাইয়া যাইতেছে। এখন কারাগারকে অনেক স্থলে ‘সংশোধনাগার’ বলা হয়। সব বিষয়েই এরূপ ঘটিয়াছে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রত্যেক ব্যক্তির ভিতরেই দেবত্ব আছে—এই ভারতীয় ভাবটি ভারতের বাহিরে অন্যান্য দেশেও নানাভাবে ব্যক্ত হইতেছে। আর কেবল তোমাদের শাস্ত্রেই ইহার ব্যাখ্যা রহিয়াছে; অন্যান্য জাতিকে ঐ ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতেই হইবে। মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহারে গুরুতর পরিবর্তন আসিবে, আর কেবল দোষ প্রদর্শনরূপ পুরাতন ভাবটি লোপ পাইবে। এই শতাব্দীর মধ্যেই ঐ ভাবগুলি চরম আঘাত পাইবে। এখন লোকে আমার সমালোচনা করিতে পারে। ‘জগতে পাপ নাই’—আমি নাকি এই ঘোর পৈশাচিক তত্ত্ব প্রচার করিয়া থাকি; জগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত লোকে আমাকে এজন্য গালি দিয়াছে। ভাল কথা, কিন্তু এখন যাহারা আমায় গালি দিতেছে, তাহাদেরই বংশধরগণ আমাকে এই বলিয়া আশীর্বাদ করিবে যে—আমি অধর্ম প্রচার করি নাই, ধর্মই প্রচার করিয়াছি। অজ্ঞানান্ধকার বিস্তার না করিয়া জ্ঞানালোকে বিস্তার করিবার চেষ্টা করিতেছি বলিয়া আমি গৌরব অনুভব করিয়া থাকি।


আমাদের উপনিষদ্ হইতে আর একটি মহান্ উপদেশ লাভ করিবার জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করিতেছে—সমগ্র জগতের অখণ্ডত্ব। অতি প্রাচীন কালে এক বস্তু ও আর এক বস্তুতে যে পার্থক্য করা হইত, এখন অতি দ্রুত তাহা চলিয়া যাইতেছে। তড়িৎ ও বাষ্প-শক্তি জগতের বিভিন্ন অংশকে পরস্পরের সহিত পরিচয় করাইয়া দিতেছে। তাহার ফলস্বরূপ আমরা হিন্দুগণ এখন আর আমাদের দেশ ছাড়া অন্য সব দেশকে কেবল ভূত-প্রেত ও রাক্ষস-পিশাচে পূর্ণ বলি না, এবং খ্রীষ্টান দেশের লোকেরাও বলেন না যে, ভারতে কেবল নরমাংসভোজী ও অসভ্য মানুষের বাস।


আমাদের উপনিষদ্ ঠিকই বলিয়াছেন—অজ্ঞানই সর্বপ্রকার দুঃখের কারণ। সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের যে-কোন অবস্থায় প্রয়োগ করি না কেন, দেখা যায়, ঐ তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। অজ্ঞতাবশতই আমরা পরস্পরকে ঘৃণা করি, পরস্পরকে জানি না বলিয়াই আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা নাই। যখনই আমরা পরস্পরকে ঠিকমত জানিতে পারি, তখনই আমাদের মধ্যে প্রেমের উদয় হয়, হইবেই তো—কারণ আমরা সকলেই কি এক নহি? সুতরাং দেখিতে পাইতেছি, চেষ্টা না করিলেও আমাদের সকলের একত্ব-ভাব স্বভাবতই আসিয়া থাকে।


রাজনীতি ও সমাজনীতির ক্ষেত্রেও যে-সকল সমস্যা বিশ বৎসর পূর্বে শুধু জাতীয় সমস্যা ছিল, এখন আর জাতীয় ভিত্তিতে সেগুলির সমাধান করা যায় না। উক্ত সমস্যাগুলি ক্রমশঃ বিপুলায়তন হইতেছে, বিরাট আকার ধারণ করিতেছে। আন্তর্জাতিক ভিত্তিরূপ প্রশস্ততর ভূমি হইতেই উহাদের মীমাংসা করা যাইতে পারে। আন্তর্জাতিক সংহতি, আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক বিধান—ইহাই এ যুগের মূলমন্ত্র। সকলের ভিতর একত্ব-ভাব বিস্তৃত হইতেছে, ইহাই তাহার প্রমাণ।


বিজ্ঞানেও জড়তত্ত্ব সম্বন্ধে এইরূপ উদার ভাব এখন আবিষ্কৃত হইতেছে। এখন তোমরা সমগ্র জড়বস্তুকে—সমগ্র জগৎকে এক অখণ্ড বস্তুরূপে, এক বৃহৎ জড় সমুদ্ররূপে বর্ণনা করিয়া থাক; তুমি আমি, চন্দ্র সূর্য, এমন কি আর যাহা কিছু—সবই এই মহান্ সমুদ্রের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবর্ত মাত্র, আর কিছু নহে। মানসিক দৃষ্টিতে দেখিলে উহা এক অনন্ত চিন্তাসমুদ্ররূপে প্রতীত হয়; তুমি আমি সেই চিন্তাসমুদ্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবর্ত আর চৈতন্যদৃষ্টিতে দেখিলে সমগ্র জগৎ এক অচল অপরিণামী অখণ্ড সত্তা—অর্থাৎ আত্মা বলিয়া প্রতীত হয়। নৈতিক আদর্শের জন্যও জগৎ আগ্রহ প্রকাশ করিতেছে—তাহাও আমাদের গ্রন্থে রহিয়াছে। নীতিতত্ত্বের ভিত্তি সম্বন্ধেও জগৎ জানিতে উৎসুক, তাহাও আমাদের শাস্ত্র হইতেই পাইবে।


ভারতে—আমাদের কি প্রয়োজন? বৈদেশিকগণের যদি এই-সকল বিষয়ের প্রয়োজন থাকে, তবে আমাদের বিশগুণ প্রয়োজন আছে। কারণ আমাদের উপনিষদ্ যতই বড় হউক, অন্যান্য জাতির সহিত তুলনায় আমাদের পূর্বপুরুষ ঋষিগণ যতই বড় হউন, আমি তোমাদিগকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি—আমরা দুর্বল, অতি দুর্বল। প্রথমতঃ আমাদের শারীরিক দৌর্বল্য—এই শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের অন্ততঃ এক-তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা অলস, আমরা কাজ করিতে পারি না; আমরা একসঙ্গে মিলিতে পারি না; আমরা পরস্পরকে ভালবাসি না; আমরা ঘোর স্বার্থপর; আমরা তিন জন একসঙ্গে মিলিলেই পরস্পরকে ঘৃণা করিয়া থাকি, ঈর্ষা করিয়া থাকি। আমাদের এখন এই অবস্থা—আমরা অতিশয় বিশৃঙ্খলভাবাপন্ন, ঘোর স্বার্থপর হইয়া পড়িয়াছি—শত শত শতাব্দী যাবৎ এই লইয়া বিবাদ করিতেছি—তিলক ধারণ এইভাবে করিতে হইবে কি ঐভাবে। কোন মানুষের দৃষ্টিতে আমার খাওয়া নষ্ট হইবে কিনা—এই ধরনের গুরুতর সমস্যার উপর বড় বড় বই লিখিতেছি। যে-জাতির মস্তিস্কের সমুদয় শক্তি এইরূপ অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সমস্যার গবেষণায় নিযুক্ত, সে-জাতির নিকট হইতে বড় রকমের একটা কিছু আশা করা যায় না, এরূপ আচরণে আমাদের লজ্জাও হয় না! হাঁ, কখনও কখনও লজ্জা হয় বটে, কিন্তু আমরা যাহা ভাবি তাহা করিতে পারি না। আমরা ভাবি অনেক কিছু, কিন্তু কাজে পরিণত করি না। এইরূপে তোতাপাখির মত কথা বলা আমাদের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে—আচরণে আমরা পশ্চাৎপদ। ইহার কারণ কি? শারীরিক দুর্বলতাই ইহার কারণ। দুর্বল মস্তিস্ক কিছু করিতে পারে না; আমাদিগকে সবলমস্তিষ্ক হইতে হইবে—আমাদের যুবকগণকে প্রথমতঃ সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও—তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে। আমাকে অতি সাহসপূর্বক এই কথাগুলি বলিতে হইতেছে; কিন্তু না বলিলেই নয়। আমি তোমাদিগকে ভালবাসি। আমি জানি, সমস্যা কি—কাঁটা কোথায় বিঁধিতেছে। আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে। তোমাদের রক্ত একটু তাজা হইলে তোমরা শ্রীকৃষ্ণের মহতী প্রতিভা ও মহান্ বীর্য ভাল করিয়া বুঝিতে পারিবে। যখন তোমাদের শরীর তোমাদের পায়ের উপর দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান হইবে, যখন তোমরা নিজেদের মানুষ বলিয়া অনুভব করিবে, তখনই তোমরা উপনিষদ্ ও আত্মার মহিমা ভাল করিয়া বুঝিবে। এইরূপে বেদান্ত আমাদের কাজে লাগাইতে হইবে। অনেক সময় লোকে আমার অদ্বৈতমত-প্রচারে বিরক্ত হইয়া থাকে। অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ বা অন্য কোন বাদ প্রচার করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমাদের এখন কেবল আবশ্যকঃ আত্মার এই অপূর্ব তত্ত্ব—অনন্ত শক্তি, অনন্ত বীর্য, অনন্ত শুদ্ধতা ও অনন্ত পূর্ণতার তত্ত্ব অবগত হওয়া।


যদি আমার একটি ছেলে থাকিত, তবে সে ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র আমি তাহাকে শুনাইতে আরম্ভ করিতাম, ‘ত্বমসি নিরঞ্জনঃ’। তোমরা অবশ্যই পুরাণে রানী মদালসার সেই সুন্দর উপাখ্যান পাঠ করিয়াছ। একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করিলে তিনি তাহাকে স্বহস্তে দোলায় স্থাপন করিয়া দোল দিতে দিতে গাহিতে আরম্ভ করিলেন, ‘ত্বমসি নিরঞ্জনঃ’। এই উপাখ্যানের মধ্যে মহা সত্য নিহিত রহিয়াছে। তুমি আপনাকে মহান্ বলিয়া উপলব্ধি কর, তুমি মহান্ হইবে।


সকলেই জিজ্ঞাসা করিতেছ, আমি সমস্ত জগৎ ঘুরিয়া কি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলাম। ইংরেজ ‘পাপ, পাপী’ ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়া থাকে; বাস্তবিক যদি সকল ইংরেজ নিজেদের পাপী বলিয়া বিশ্বাস করিত, তবে আফ্রিকার অভ্যন্তরে নিগ্রোদের অবস্থার সহিত তাহাদের কোন পার্থক্য থাকিত না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে এ-কথা বিশ্বাস করে না, বরং বিশ্বাস করে—সে জগতের অধীশ্বর হইয়া জন্মিয়াছে; সে নিজের মহত্ত্বে বিশ্বাসী; সে বিশ্বাস করে—সে সব করিতে পারে, ইচ্ছা হইলে সে সূর্যালোকে চন্দ্রলোকে যাইতে পারে; তাহাতেই সে বড় হইয়াছে। যদি সে ধর্মযাজকদের বাক্যে আস্থা স্থাপন করিয়া বিশ্বাস করিত—সে ক্ষুদ্র হতভাগ্য পাপী মাত্র, অনন্ত কাল ধরিয়া তাহাকে নরকাগ্নিতে দগ্ধ হইতে হইবে, তবে আজ তাহাকে যেরূপ দেখিতেছ, সে কখনও সেরূপ হইত না। এইরূপে আমি প্রত্যেক জাতির ভিতরই দেখিতে পাই, তাহাদের পুরোহিতেরা যাহাই বলুক এবং তাহারা যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হউক, তাহাদের অভ্যন্তরীণ ব্রহ্মভাব কখনও বিলুপ্ত হয় না, উহা ফুটিয়া উঠিবেই উঠিবে। আমরা বিশ্বাস হারাইয়াছি। তোমরা কি আমার কথায় বিশ্বাস করিবে?— আমরা ইংরেজ নরনারী অপেক্ষা কম বিশ্বাসী, হাজারগুণ কম বিশ্বাসী। আমাকে স্পষ্ট কথা বলিতে হইতেছে, কিন্তু না বলিয়া উপায় নাই। তোমরা কি দেখিতেছ না, ইংরেজ নরনারী যখন আমাদের ধর্মতত্ত্ব একটু-আধটু বুঝিতে পারে, তখন তাহারা যেন উহাতে মাতিয়া উঠে, আর যদিও তাহারা রাজার জাতি, তথাপি স্বদেশের লোকের উপহাস ও বিদ্রূপ উপেক্ষা করিয়া ভারতে আমাদের ধর্ম প্রচার করিতে আসিয়া থাকে? তোমাদের মধ্যে কয়জন এরূপ করিতে পার? কথাটি একবার ভাবিয়া দেখ। আর কেন তোমরা ইহা করিতে পার না কেন?তোমরা কি জান না বলিয়া যে করিতে পার না—তাহা নয়, তাহাদের অপেক্ষা তোমরা বেশী জান, সেইজন্যই তোমরা কাজ করিতে পার না। যতটা জানিলে তোমাদের পক্ষে কল্যাণ, তোমরা তাহা অপেক্ষা বেশী জান—ইহাই তোমাদের মুশকিল। তোমাদের রক্ত পাতলা, তোমাদের মস্তিষ্ক আবিলতাপূর্ণ ও অসাড়, তোমাদের শরীর দুর্বল। শরীরের এ অবস্থা পরিবর্তন করিতে হইবে। শারীরিক দৌর্বল্যই সকল অনিষ্টের মূল, আর কিছু নয়। গত কয়েক শত বৎসর যাবৎ তোমরা নানাবিধ সংস্কার, আদর্শ প্রভৃতির কথা কহিয়াছ, কিন্তু কাজের সময় আর তোমাদের সন্ধান পাওয়া যায় না। ক্রমশঃ তোমাদের আচরণে সকলে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে; আর ‘সংস্কার’ নামটা পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর উপহাসের বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহার কারণ কি? তোমাদের জ্ঞানের কি কিছু কমতি আছে? জ্ঞানের কমতি কোথায়? তোমরা যে অতিরিক্ত জ্ঞানী! সকল অনিষ্টের মূল কারণ এই যে, তোমরা দুর্বল, অতি দুর্বল—তোমাদের শরীর দুর্বল, মন দুর্বল, তোমাদের আত্মবিশ্বাস একেবারেই নাই। শত শতাব্দী যাবৎ অভিজাত সম্প্রদায়, রাজা ও বৈদেশিকরা অত্যাচার করিয়া তোমাদিগকে পিষিয়া ফেলিয়াছে; হে ভ্রাতৃগণ, তোমাদেরই স্বজনবর্গ তোমাদের সব শক্তি হরণ করিয়াছে। তোমরা এখন পদদলিত, ভগ্নদেহ, মেরুদণ্ডহীন কীটের মত হইয়াছ। কে আমাদিগকে এখন বল দিবে? আমি বলিতেছি, আমাদের এখন চাই বল, চাই বীর্য।


এই বীর্যলাভের প্রথম উপায়—উপনিষদে বিশ্বাসী হওয়া এবং বিশ্বাস করা যে, ‘আমি আত্মা, তরবারি আমাকে ছেদন করিতে পারে না, কোন যন্ত্র আমাকে ভেদ করিতে পারে না, অগ্নি আমাকে দগ্ধ করিতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না, আমি সর্বশক্তিমান্, আমি সর্বজ্ঞ।’ অতএব এই আশাপ্রদ মুক্তিপ্রদ বাক্যগুলি সর্বদা উচ্চারণ কর; বলিও না—আমরা দুর্বল। আমরা সব করিতে পারি। আমরা কি করিতে পারি? আমাদের দ্বারা সবই হইতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে সেই মহিমময় আত্মা রহিয়াছেন। আত্মায় বিশ্বাসী হইতে হইবে। নচিকেতার মত বিশ্বাসী হও। নচিকেতার পিতা যখন যজ্ঞ করিতেছিলেন, তখন নচিকেতার অন্তরে শ্রদ্ধা প্রবেশ করিল। আমার ইচ্ছা—তোমাদের প্রত্যেকের ভিতর সেই শ্রদ্ধা আবির্ভূত হউক, তোমাদের প্রত্যেকেই বীরদর্পে দণ্ডায়মান হইয়া ইঙ্গিতে জগৎ- আলোড়নকারী মহামনীষাসম্পন্ন মহাপুরুষ হও, সর্বপ্রকার অনন্ত ঈশ্বরতুল্য হও; আমি তোমাদের সকলকেই এইরূপ দেখিতে চাই। উপনিষদ্ হইতে তোমরা এইরূপ শক্তি লাভ করিবে, উহা হইতে তোমরা এই বিশ্বাস পাইবে। এ সবই উপনিষদে রহিয়াছে।


এ যে শুধু সন্ন্যাসীর জন্য ছিল, এ যে রহস্য-বিদ্যা! প্রাচীনকালে অরণ্যবাসী সন্ন্যাসীরাই কেবল উপনিষদের চর্চা করিতেন! শঙ্কর একটু সদয় হইয়া বলিলেন, গৃহস্থেরাও উপনিষদ্ অধ্যয়ন করিতে পারে; ইহাতে তাঁহাদের কল্যাণই হইবে, কোন অনিষ্ট হইবে না। তবু লোকের মন হইতে এ সংস্কার এখনও যায় নাই যে, উপনিষদে কেবল সন্ন্যাসীদের আরণ্যক জীবনের কথাই আছে। আমি তোমাদিগকে সেদিনই বলিয়াছি, যিনি স্বয়ং বেদের প্রকাশ, সেই ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের দ্বারাই বেদের একমাত্র টীকা—একমাত্র প্রামাণিক টীকা ‘গীতা’— চিরকালের মত রচিত হইয়াছে। ইহার উপর আর কোন টীকা-টিপ্পনী চলিতে পারে না। এই গীতায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বেদান্ত উপবিষ্ট হইয়াছে। তুমি যে-কাজই কর না কেন, তোমার পক্ষে বেদান্তের প্রয়োজন। বেদান্তের এই-সকল মহান্‌ তত্ত্ব কেবল অরণ্যে বা গিরিগুহায় আবদ্ধ থাকিবে না; বিচারালয়ে, ভজনালয়ে, দরিদ্রের কুটিরে, মৎসজীবীর গৃহে, ছাত্রের অধ্যায়নাগারে—সর্বত্র এই-সকল তত্ত্ব আলোচিত হইবে, কার্যে পরিণত হইবে। প্রত্যেক নরনারী, প্রত্যেক বালকবালিকা—সে যে-কাজই করুক না কেন, সে যে-অবস্থায় থাকুক না কেন—সর্বত্র বেদান্তের প্রভাব বিস্তৃত হওয়া আবশ্যক।


আর ভয়ের কোন কারণ নাই। উপনিষদ্-নিহিত তত্ত্বাবলী জেলে-মালা প্রভৃতি জনসাধারণ কিভাবে কার্যে পরিণত করিবে? ইহার উপায় শাস্ত্রে প্রদর্শিত হইয়াছে; অনন্ত পথ আছে—ধর্ম অনন্ত, ধর্মের গণ্ডি ছাড়াইয়া কেহই যাইতে পারে না। আর তুমি যাহা করিতেছ, তোমার পক্ষে তাহাই অতি ইত্তম। যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হইলে অতি সামান্য কর্মও অদ্ভুত ফল দিয়া থাকে; অতএব যে যতটুকু পারে করুক। জেলে যদি নিজেকে আত্মা বলিয়া চিন্তা করে, তবে সে একজন ভাল মৎস্যজীবী হইবে; ছাত্র যদি নিজেকে আত্মা বলিয়া চিন্তা করে, তবে সে একজন ভাল বিদ্যার্থী হইবে। উকিল যদি নিজেকে আত্মা বলিয়া চিন্তা করে, তবে সে একজন ভাল আইনজ্ঞ হইবে। এইভাবে অন্যান্য সর্বত্র।


আর ইহার ফল হইবে এই যে, জাতিবিভাগ অনন্তকালের জন্য থাকিয়া যাইবে। সমাজের প্রকৃতিই এই—বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়া। তবে চলিয়া যাইবে কি? বিশেষ বিশেষ অধিকারগুলি আর থাকিবে না। জাতিবিভাগ প্রাকৃতিক নিয়ম। সামাজিক জীবনে আমি কোন বিশেষ কর্তব্য সাধন করিতে পারি, তুমি অন্য কাজ করিতে পার। তুমি না হয় একটা দেশ শাসন করিতে পার, আমি একজোড়া জুতা সারিতে পারি। কিন্তু তা বলিয়া তুমি আমা অপেক্ষা বড় হইতে পার না। তুমি কি আমার জুতা সারিয়া দিতে পার? আমি কি দেশ শাসন করিতে পারি? এই কার্যবিভাগ স্বাভাবিক। আমি জুতা সেলাই করিতে পটু, তুমি বেদপাঠে পটু! তাই বলিয়া তুমি আমার মাথায় পা দিতে পার না। তুমি খুন করিলে প্রশংসা পাইবে, আর আমি একটা আম চুরি করিলে আমাকে ফাঁসি যাইতে হইবে—এরূপ হইতে পারে না। এই অধিকার-তারতম্য উঠিয়া যাইবে। জাতবিভাগ ভাল জিনিষ। জীবনসমস্যা-সমাধানের ইহাই একমাত্র স্বাভাবিক উপায়। লোকে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ করিবে; ইহা অতিক্রম করিবার উপায় নাই। যেখানেই যাও, জাতিবিভাগ থাকিবেই। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, অধিকার-তারতম্যগুলিও থাকিবে। এগুলিকে প্রচণ্ড আঘাত করিতে হইবে। যদি জেলেকে বেদান্ত শিখাও, সে বলিবে—তুমি যেমন আমিও তেমন, তুমি না হয় দার্শনিক, আমি না হয় মৎসজীবী; কিন্তু তোমার ভিতর যে-ঈশ্বর আছেন, আমার ভিতর সেই ঈশ্বর আছেন। আর ইহাই আমরা চাই—কাহারও কোন বিশেষ অধিকার নাই, অথচ প্রত্যেক ব্যক্তির উন্নতি করিবার সমান সুবিধা থাকিবে।


সকল ব্যক্তিকেই তাহার অন্তর্নিহিত দেবত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দাও। প্রত্যেকে নিজেই নিজের মুক্তিসাধন করিবে। উন্নতির জন্য প্রথম প্রয়োজন—স্বাধীনতা। যদি তোমাদের মধ্যে কেহ এ কথা বলিতে সাহসী হয় যে, আমি এই নারীর বা ঐ ছেলেটির মুক্তির জন্য সাধনা করিয়া দিব, তবে সেটি অতি অন্যায়, অত্যন্ত ভুল কথা। আমাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, ‘আপনি বিধবাদিগের ও নারীজাতির উন্নতির উপায় সম্বন্ধে কি চিন্তা করেন?’ এ প্রশ্নের আমি শেষ বারের মত উত্তর দিতেছি—আমি কি বিধবা যে, আমাকে এই অর্থহীন প্রশ্ন করিতেছে? আমি কি নারী যে, আমাকে বারংবার এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছ? তুমি কে যে, গায়ে পড়িয়া নারীজাতির সমস্যা সমাধান করিতে অগ্রসর হইতেছ? তুমি কি প্রত্যেক বিধবা ও প্রত্যেক নারীর ভাগ্যবিধাতা ঈশ্বর? তফাত হও! তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই পূরণ করিবে। কি আপদ! যথেচ্ছাচারী তোমরা ভাবিতেছ—সকলের জন্য সব করিতে পার! তফাত! ভগবান্‌ সকলকে দেখিবেন। তুমি কে যে, নিজেকে সর্বজ্ঞ মনে করিতেছ?


হে নাস্তিকগণ, তোমরা ঈশ্বরের উপর কর্তৃত্ব করিতে সাহস কর কিসে? কারণ তোমরা কি জান না, প্রত্যেকটি আত্মাই পরমাত্মস্বরূপ? নিজেদের চরকায় তেল দাও, তোমাদের ঘাড়ে এক বোঝা কর্ম রহিয়াছে। হে নাস্তিকগণ, সমগ্র জাতি তোমাদিগকে গাছে তুলিয়া দিতে পারে, সমাজ তোমাদের উচ্চ প্রশংসা করিয়া আকাশে তুলিয়া দিতে পারে, মূর্খেরা তোমাদের সুখ্যাতি করিতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর নিদ্রিত নন; ইহলোকে বা পরলোকে নিশ্চয়ই তোমাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হইবে।


প্রত্যেক নরনারীকে—সকলকেই ঈশ্বরদৃষ্টিতে দেখিতে থাক। তোমরা কাহাকেও সাহায্য করিতে পার না, কেবল সেবা করিতে পার। প্রভুর সন্তানদের, যদি সৌভাগ্য হয় তবে স্বয়ং প্রভুর সেবা কর। যদি প্রভুর অনুগ্রহে তাঁহার কোন সন্তানের সেবা করিতে পার, তবে ধন্য হইবে। নিজেদের খুব বড় কিছু ভাবিও না। তোমরা ধন্য যে, সেবা করিবার অধিকার পাইয়াছ, অপরে পায় নাই। উপাসনাবোধে ঐটুকু কর। দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে আমি যেন ঈশ্বরকে দেখি, নিজ মুক্তির জন্য তাহাদের নিকটে গিয়া তাহাদের পূজা করিব—ঈশ্বর তাহাদের মধ্যে রহিয়াছেন। কতকগুলি লোক যে দুঃখ পাইতেছে, তাহা তোমার আমার মুক্তির জন্য—যাহাতে আমরা রোগী, পাগল, কুষ্ঠী, পাপী প্রভৃতি রূপধারী প্রভুর পূজা করিতে পারি। আমার কথাগুলি বড় কঠিন হইতেছে, কিন্তু আমাকে ইহা বলিতেই হইবে, কারণ তোমার আমার জীবনের ইহাই শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য যে, আমরা প্রভুকে এই-সকল বিভিন্ন রূপে সেবা করিতে পারি। কাহারও কল্যাণ করিতে পার—এ ধারণা ছাড়িয়া দাও। তবে যেমন বীজকে জল মৃত্তিকা বায়ু প্রভৃতি তাহার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় জিনিষগুলি যোগাইয়া দিলে উহা নিজ প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী যাহা কিছু আবশ্যক গ্রহণ করে এবং নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী বাড়িতে থাকে, তোমরাও সেইভাবে অপরের কল্যাণ সাধন করিতে পার।


জগতে জ্ঞানালোক বিস্তার কর; আলোক—আলোক লইয়া আইস। প্রত্যেকে যেন জ্ঞানের আলো পায়; যতদিন না সকলেই ভগবান্‌ লিভ করে, ততদিন যেন তোমাদের কাজ শেষ না হয়। দরিদ্রের নিকট জ্ঞানালোক বিস্তার কর, ধনীদের নিকট আরও অধিক আলোক লইয়া যাও, কারণ দরিদ্র অপেক্ষা ধনীদের অধিক আলোক প্রয়োজন। অশিক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট আলোক লইয়া যাও, শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট আরও অধিক আলোক লইয়া যাও, কারণ আজকাল শিক্ষাভিমান বড়ই প্রবল। এইভাবে সকলের নিকট আলোক বিস্তার কর, অবশিষ্ট যাহা কিছু প্রভুই করিবেন, কারণ ভগবানই বলিয়াছেনঃ


কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি||


কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নহে; তুমি এমনভাবে কর্ম করিও না, যাহাতে তোমাকে তাহার ফলভোগ করিতে হয়; অথচ কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।


যিনি শত শত যুগ পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদিগকে এমন মহোচ্চ তত্ত্বসমূহ শিখাইয়াছেন, তিনি যেন আমাদিগকে তাঁহার আদেশ কার্যে পরিণত করিবার শক্তি দান করেন।

১৩. ভারতীয় মহাপুরুষগণ

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড  ভারতে বিবেকানন্দ  ১৩. ভারতীয় মহাপুরুষগণ

[মান্দ্রাজে প্রদত্ত বক্তৃতা]


ভারতীয় মহাপুরুষগণের কথা বলিতে গিয়া আমার মনে সেই প্রাচীনকালের কথা উদিত হইতেছে, ইতিহাস যে-কালের কোন ঘটনার উল্লেখ করে না এবং ঐতিহ্য যে সুদূর অতীতের ঘনান্ধকার হইতে রহস্য-উদ‍্ঘাটনের বৃথা চেষ্টা করিয়া থাকে। ভারতে অসংখ্য মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন—বাস্তবিক হিন্দুজাতি সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ অসংখ্য মহাপুরুষের জন্ম দেওয়া ব্যতীত আর কি করিয়াছে? সুতরাং তাঁহাদের মধ্যে কয়েকজন যুগপ্রবর্তক শ্রেষ্ঠ আচার্যের কথা অর্থাৎ তাঁহাদের চরিত্র আলোচনা করিয়া যতটুকু বুঝিয়াছি, তাহাই তোমাদের নিকট বলিব।


প্রথমতঃ আমাদের শাস্ত্র সম্বন্ধেই আমাদের কিছু বুঝা আবশ্যক। আমাদের শাস্ত্রে দ্বিবিদ সত্য উপদিষ্ট হইয়াছে। প্রথমটি সনাতন সত্য; দ্বিতীয়টি প্রথমোক্তের ন্যায় ততদূর প্রামাণিক না হইলেও বিশেষ দেশকালপাত্রে প্রযোজ্য। সনাতন সত্য —জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ এবং উহাদের পরস্পর সম্বন্ধের বিষয় শ্রুতি বা বেদে লিপিবদ্ধ আছে। দ্বিতীয় প্রকার সত্য—স্মৃতি, মনু যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি সংহিতায় এবং পুরাণে ও তন্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে। এগুলির প্রামাণ্য শ্রুতির অধীন, কারণ স্মৃতি যদি শ্রুতির বিরোধী হয়, তবে শ্রুতিকেই সে স্থলে মানিতে হইবে। ইহাই শাস্ত্র-বিধান। তাৎপর্য এই যে, শ্রুতিতে জীবাত্মার নিয়তি ও তাঁহার চরমলক্ষ্য-বিষয়ক মুখ্য তত্ত্বসমূহের বিশদ বর্ণনা আছে, কেবল গৌণ বিষয়গুলি—যেগুলি উহাদের বিস্তার, সেগুলিই বিশেষভাবে বর্ণনা করা স্মৃতি ও পুরাণের কার্য। সাধারণভাবে উপদেশ দিতে শ্রুতিই পর্যাপ্ত; ধর্মজীবন-যাপনের সারতত্ত্ব সম্বন্ধে শ্রুতিনির্দিষ্ট উপদেশের বেশী আর কিছু বলা যাইতে পারে না, আর কিছু জানিবারও নাই। এ-বিষয় যাহা কিছু প্রয়োজন, সবই শ্রুতিতে আছে; জীবাত্মার সিদ্ধিলাভের জন্য যে-সকল উপদেশের প্রয়োজন, শ্রুতিতে সেগুলি সবই কথিত হইয়াছে। কেবল বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিধান শ্রুতিতে নাই; স্মৃতি বিভিন্ন সময়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা দিয়া গিয়াছেন। শ্রুতির আর একটি বিশেষত্ব আছে। যে-সকল ঋষি শ্রুতিতে বিভিন্ন সত্য ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশী, তবে কয়েকজন নারীরও উল্লেখ পাওয়া যায়; তাঁহাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে, যথা তাঁহাদের জন্মের সন-তারিখ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমরা অতি সামান্যই জানিতে পারি; কিন্তু তাঁহাদের সর্বোৎকৃষ্ট চিন্তা—তাঁহাদের শ্রেষ্ঠ আবিষ্ক্রিয়া বলিলেই ভাল হয়—আমাদের দেশের ধর্মসাহিত্যরূপে বেদে লিপিবদ্ধ ও রক্ষিত আছে। স্মৃতিতে কিন্তু মহাপুরুষগণের জীবনী ও কার্যকলাপই বিশেষভাবে দেখিতে পাওয়া যায়। ইঙ্গিতমাত্রে সমগ্র জগতকে নাড়া দিতে পারেন, এমন অদ্ভুত মহাশক্তিশালী মনোহরচরিত্র মহাপুরুষগণের পরিচয় পুরাণ বা স্মৃতিতেই আমরা সর্বপ্রথম পাইয়া থাকি—তাঁহাদের চরিত্র এত উন্নত যে, তাঁহাদের উপদেশাবলীও যেন উহার নিকট সামান্য বলিয়া বোধ হয়।



আমাদের ধর্মের এই বিশেষত্ত্বটি আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, আমাদের ধর্মে যে-ঈশ্বরের উপদেশ আছে, তিনি নির্গুণ অথচ সগুণ। উহাতে ব্যক্তিভাবরহিত অনন্ত সনাতন তত্ত্বসমূহের সঙ্গে অসংখ্য ব্যক্তিভাবাপন্ন অবতারের কথা প্রচারিত হইয়াছে। কিন্তু শ্রুতি বা বেদই আমাদের ধর্মের মূল—উহাতে কেবল সনাতন তত্ত্বের উপদেশ; বড় বড় অবতার, আচার্য ও মহাপুরুষগণের বিষয় সবই স্মৃতি ও পুরাণে রহিয়াছে। ইহাও লক্ষ্য করিও যে, কেবল আমাদের ধর্ম ছাড়া জগতের অন্যান্য সকল ধর্মই কোন বিশেষ ধর্মপ্রবর্তক বা ধর্মপ্রবর্তকগণের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। খ্রীষ্টধর্ম খ্রীষ্টের, মুসলমানধর্ম মহম্মদের, বৌদ্ধধর্ম বুদ্ধের, জৈনধর্ম জিনগণের এবং অন্যান্য ধর্ম অন্যান্য ব্যক্তিগণের জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ঐ-সকল ধর্মে ঐ মহাপুরুষগণের জীবনের তথাকথিত ঐতিহাসিক প্রমাণ লইয়া যে যথেষ্ট বিবাদ হইয়া থাকে, তাহা স্বাভাবিক। যদি কখনও এই প্রাচীন মহাপুরুষগণের অস্তিত্ববিষয়ে ঐতিহাসিক প্রমাণ দুর্বল হয়, তবে তাঁহাদের ধর্মরূপ অট্টালিকা ধসিয়া পড়িয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাইবে।


আমাদের ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত না হইয়া সনাতন তত্ত্বসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া আমরা এই বিপদ এড়াইয়াছি। কোন মহাপুরুষ, এমন কি, কোন অবতার বলিয়া গিয়াছেন বলিয়াই যে তোমরা ধর্ম মানিয়া চল, তাহা নহে। কৃষ্ণের কথায় বেদের প্রামাণ্য সিদ্ধ হয় না, কিন্তু বেদানুগত বলিয়াই কৃষ্ণবাক্যের প্রামাণ্য। কৃষ্ণের মাহাত্ম্য এই যে, বেদের যত প্রচারক হইয়াছেন, তাঁহাদার মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য অবতার ও মহাপুরুষ সম্বন্ধেও সেইরূপ বুঝিতে হইবে। আমরা গোড়াতেই এ-কথা স্বীকার করিয়া লই যে, মানুষের পূর্ণতালাভের জন্য, তাহার মুক্তির জন্য যাহা কিছু আবশ্যক, সবই বেদে কথিত হইয়াছে; নূতন কিছু আবিষ্কৃত হইতে পারে না। তোমরা কখনই সকল জ্ঞানের চরম লক্ষ্য পূর্ণ একত্বের বেশী অগ্রসর হইতে পার না। বেদ অনেক দিন পূর্বেই এই পূর্ণ একত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, আর অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। যখনই ‘তত্ত্বমসি’ আবিষ্কৃত হইল, তখনই আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পূর্ণ হইল; এই ‘তত্ত্বমসি’ বেদে রহিয়াছে। বাকী রহিল কেবল বিভিন্ন দেশ-কাল-পাত্র-অনুসারে সময়ে সময়ে লোকশিক্ষা। এই প্রাচীন সনাতন পথে জনগণকে পরিচালনা করা—ইহাই বাকী রহিল; সেইজন্যই সময়ে সময়ে বিভিন্ন মহাপুরুষ ও আচার্যগণের অভ্যুদয় হইয়া থাকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণের সেই সর্বজনবিদিত বাণীতে এই তত্ত্বটি যেমন পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে কথিত হইয়াছে, আর কোথাও তেমন হয় নাইঃ



যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত |

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ||


যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই সাধুভাব রক্ষা করিবার জন্য আমি নিজেকে সৃষ্টি করিয়া থাকি; দুর্নীতি বিনষ্ট করিবার জন্য আমি সময়ে সময়ে আবির্ভূত হইয়া থাকি, ইত্যাদি।—ইহাই ভারতীয় ধারণা।


ইহা হইতে কি পাওয়া যায়? সিদ্ধান্ত এই যে, একদিকে সনাতন তত্ত্বসমূহ রহিয়াছে, ঐগুলি স্বতঃপ্রমাণ,—কোনরূপ যুক্তির উপর নির্ভর করে না, ঋষিগণ—যত বড়ই হউন বা অবতারগণ যত মহিমাসম্পন্নই হউন—তাঁহাদের বাক্যের উপরও ঐগুলি নির্ভর করে না। আমরা এখানে এ-কথা বলিতে পারি যে, ভারতীয় চিন্তার এই বিশেষত্ব আছে বলিয়া আমরা বেদান্তকেই একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম বলিয়া দাবী করিতে পারি, বেদান্তই জগতের একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম; কারণ উহা কোন ব্যক্তিবিশেষের মতকে প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করিতে উপদেশ দেয় না, উহা কেবল সনাতন তত্ত্বসমূহই শিক্ষা দিয়া থাকে; ব্যক্তিবিশেষের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত কোন ধর্ম সমগ্র মানবজাতি কখনও গ্রহণ করিতে পারে না। আমাদের দেশেই আমরা দেখিতে পাই, এখানে কত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন! একটা ক্ষুদ্র শহরেই দেখিতে পাই, বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মহাপুরুষকে নিজেদের আদর্শ করিয়া থাকে। সুতরাং মহম্মদ, বুদ্ধ বা খ্রীষ্ট—এরূপ কোন এক ব্যক্তি কিভাবে সমগ্র জগতের একমাত্র আদর্শস্বরূপ হইতে পারেন? অথবা সেই এক ব্যক্তির বাক্যপ্রমাণেই বা সমগ্র নীতিবিদ্যা, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও ধর্মকে সত্য বলিয়া কিরূপে স্বীকার করা যায়? বৈদান্তিক ধর্মে এরূপ কোন ব্যক্তিবিশেষের বাক্যকে প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিবার আবশ্যক হয় না। মানবের সনাতন প্রকৃতিই ইহার প্রমাণ; ইহার নীতিতত্ত্ব মানবজাতির সনাতন আধ্যাত্মিক একত্বরূপ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত; এই একত্ব চেষ্টা করিয়া লাভ করিবার নয়, উহা পূর্ব হইতেই লব্ধ।



অন্যদিকে আবার আমাদের ঋষিগণ অতি প্রাচীন কাল হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, জগতের অধিকাংশ লোকই কোন না কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর না করিয়া থাকিতে পারে না। লোকের কোন না কোন আকারে একটি ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর চাই। যে বুদ্ধদেব ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রচার করিয়া গেলেন, তাঁহার দেহত্যাগের পর পঞ্চাশ বৎসর যাইতে না যাইতে তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকেই ‘ঈশ্বর’ করিয়া তুলিল। ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে। আমরা জানি, ঈশ্বরের বৃথা কল্পনা অপেক্ষা—অধিকাংশ স্থলেই এইরূপ কাল্পনিক ঈশ্বর মানবের উপাসনার অযোগ্য—মহত্তর জীবন্ত ঈশ্বরসকল এই পৃথিবীতে সময়ে সময়ে আমাদের মধ্যেই আবির্ভূত হইয়া বাস করিয়া থাকেন। কোনরূপ কাল্পনিক ঈশ্বর অপেক্ষা—আমাদের কল্পনাসৃষ্ট কোন বস্তু অপেক্ষা অর্থাৎ আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে যতটা ধারণা করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা তাঁহারা অধিকতর পূজ্য। ঈশ্বর সম্বন্ধে তুমি আমি যতটা ধারণা করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণ অনেক বড়। আমরা আমাদের মনে যতদূর উচ্চ আদর্শের চিন্তা করিতে পারি, বুদ্ধ তদপেক্ষা উচ্চতর আদর্শ—জীবন্ত আদর্শ। সেই জন্যই সর্বপ্রকার কাল্পনিক দেবতাকেও অতিক্রম করিয়া তাঁহারা চিরকাল মানবের পূজা পাইয়া আসিতেছেন। আমাদের ঋষিগণ ইহা জানিতেন, সেইজন্য তাঁহারা সকল ভারতবাসীর জন্য এই মহাপুরুষ-উপাসনার—এই অবতার-পূজার পথ খুলিয়া দিয়া গিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, যিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ অবতার, তিনি আর একটু অগ্রসর হইয়া বলিয়া গিয়াছেনঃ



যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা |

তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্ ||১৫


মানুষের মধ্যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হয়, জানিও আমি সেখানে বর্তমান; আমা হইতেই এই আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হইয়া থাকে।


ইহা দ্বারা হিন্দুগণের পক্ষে সকল দেশের সকল অবতারকে উপাসনা করিবার দ্বার খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। হিন্দু যে-কোন দেশের যে-কোন সাধু-মহাত্মার পূজা করিতে পারে। কার্যতও দেখিতে পাই, আমরা অনেক সময় খ্রীষ্টানদের চার্চে ও মুসলমানদের মসজিদে গিয়া উপাসনা করিয়া থাকি। ইহা ভালই বলিতে হইবে। কেন আমরা এভাবে উপাসনা করিব না? আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের ধর্ম সার্বভৌম। উহা এত উদার, এত প্রশস্ত যে সর্বপ্রকার আদর্শকেই উহা সাদরে গ্রহণ করিতে পারে; জগতে যতপ্রকার ধর্মের আদর্শ আছে, সেগুলিকে এখনই গ্রহণ করা যাইতে পারে, আর ভবিষ্যতে যে-সকল বিভিন্ন আদর্শ আসিবে, সেগুলির জন্য আমরা ধৈর্যের সহিত অপেক্ষা করিতে পারি। ঐগুলিকে ঐভাবে গ্রহণ করিতে হইবে, বৈদান্তিক ধর্মই তাহার অনন্ত বাহু প্রসারিত করিয়া সবগুলিকে আলিঙ্গন করিয়া লইবে।



ঈশ্বরাবতার-সম্বন্ধে আমাদের মোটামুটি ধারণা এই। দ্বিতীয় শ্রেণীর আর এক প্রকার মহাপুরুষ আছেন; বেদে ‘ঋষি’ শব্দের পুনঃপুনঃ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, আর আজকাল ইহা একটি চলিত শব্দ হইয়া পড়িয়াছে,—ঋষিবাক্যের বিশেষ প্রামাণ্য। আমাদিগকে ইহার তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। ‘ঋষি’ শব্দের অর্থ মন্ত্রদ্রষ্টা অর্থাৎ যিনি কোন তত্ত্ব ‘দর্শন’ করিয়াছেন। অতি প্রাচীন কাল হইতেই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছিলঃ ধর্মের প্রমাণ কি? বহিরিন্দ্রিয় দ্বারা ধর্মের সত্যতা প্রমাণিত হয় না—ইহা অতি প্রাচীন কাল হইতেই ঋষিগণ বলিয়া গিয়াছেনঃ ‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’১৬—মনের সহিত বাক্যও যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে। ‘ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ‍্ গচ্ছতি নো মনঃ ||১৭—সেখানে চক্ষু যাইতে পারে না, বাক্যও যাইতে পারে না, মনও নহে।


শত শত যুগ ধরিয়া ইহাই ঋষিদের ঘোষণা। বাহ্য প্রকৃতি আত্মার অস্তিত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, অনন্ত জীবন, মানবের চরম লক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। এই মনের সর্বদা পরিণাম হইতেছে, সর্বদাই যেন উহার প্রবাহ চলিয়াছে, উহা সসীম, উহা যেন খণ্ড খণ্ড ভাবে ভাঙিয়া চুরিয়া যায়। উহা কিরূপে সেই অনন্ত অপরিবর্তনীয় অখণ্ড অবিভাজ্য সনাতন বস্তুর সংবাদ দিবে?—কখনই দিতে পারে না। আর যখনই মানবজাতি চৈতন্যহীন জড়বস্তু হইতে এই-সকল প্রশ্নের উত্তর পাইতে বৃথা চেষ্টা করিয়াছে, ইতিহাসই জানে—তাহার ফল কতখানি অশুভ হইয়াছে। তবে ঐ বেদোক্ত জ্ঞান কোথা হইতে আসিল? ঋষিত্ব প্রাপ্ত হইলে ঐ জ্ঞানলাভ হয়,—ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয় না। ইন্দ্রিয়জ্ঞানই কি মানুষের সর্বস্ব? কে ইহা বলিতে সাহস করে? আমাদের জীবনে—আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসে, হয়তো আমাদের সম্মুখেই আমাদের কোন প্রিয়জনের মৃত্যু হইল বা আমরা অন্য কোনরূপে আঘাত পাইলাম, অথবা অতিশয় আনন্দের কিছু ঘটিল; এই-সব অবস্থায় সময়ে সময়ে মন যেন একেবারে স্থির হইয়া যায়। অনেক সময়ে এমনও ঘটে যে, মনটা শান্ত হইয়া যায়, বহির্জগতে অনাসক্ত হইয়া ভিতরে প্রবেশ করে, ক্ষণকালের জন্য অনন্তের একটু আভাস তখন আমাদের চোখে প্রকাশিত হয়; মন বা বাক্য—কিছুই সেখানে যাইতে পারে না। সাধারণ লোকের জীবনেই এইরূপ ঘটিয়া থাকে; অভ্যাসের দ্বারা এই অবস্থাকে প্রগাঢ়, স্থায়ী, পরিপূর্ণ ও নিখুঁত করিতে হইবে। মানুষ শত শত যুগ পূর্বে আবিষ্কার করিয়াছে—আত্মা ইন্দ্রিয় দ্বারা বদ্ধ বা সীমিত নহে, এমন কি চেতনা দ্বারাও নহে। আমাদের বুঝিতে হইবে যে, চেতনা সেই অনন্ত শৃঙ্খলের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম মাত্র। চেতনা সত্তার সহিত অভিন্ন নহে, উহা সত্তার একটি অংশ মাত্র। ঋষিগণ ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের অতীত ভূমিতে নির্ভীকভাবে আত্মানুসন্ধান করিয়াছেন। চেতনা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ। আধ্যাত্মিক জগতের সত্য লাভ করিতে হইলে মানুষকে ইন্দ্রিয়ের বহিরে যাইতেই হইবে। আর এখনও এমন সব লোক আছেন, যাঁহারা পঞ্চেন্দ্রিয়ের বাহিরে যাইতে সমর্থ। ইঁহাদিগকেই ঋষি বলে, কারণ ইঁহারা আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ সাক্ষাৎ করিয়া থাকেন। সুতরাং আমার সম্মুখস্থ এই টেবিলটিকে আমি যেমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা জানিয়া থাকি, বেদনিহিত সত্যসমূহের প্রমাণও সেইরূপ প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত। টেবিলটিকে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করিয়া থাকি, আর আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ জীবাত্মার অতিচেতন অবস্থায় প্রত্যক্ষ অনুভূত হইয়া থাকে। এই ঋষিত্ব-লাভ দেশ-কাল-লিঙ্গ বা জাতিবিশেষের উপর নির্ভর করে না। বাৎস্যায়ন অকুতোভয়ে বলিয়াছেন যে, এই ঋষিত্ব বংশধরগণের, আর্য-অনার্য—এমন কি ম্লেচ্ছদেরও সাধারণ সম্পত্তি।



বেদের ঋষিত্ব বলিতে ইহাই বুঝায়; আমাদিগকে ভারতীয় ধর্মের এই আদর্শ সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, আর আমি ইচ্ছা করি যে, জগতের অন্যান্য জাতিও এই আদর্শটি স্মরণ রাখিবেন, তাহা হইলেই বিভিন্ন ধর্মে বিবাদ-বিসংবাদ কমিয়া যাইবে। শাস্ত্রপাঠ করিলেই ধর্ম লাভ হয় না; বা মতমতান্তর ও বচন দ্বারা, এমন কি যুক্তিতর্ক-বিচার দ্বারাও ধর্মলাভ হয় না। ধর্ম সাক্ষাৎ করিতে হইবে—ঋষি হইতে হইবে। বন্ধুগণ, যতদিন না তোমাদের প্রত্যেকেই ঋষি হইতেছ, যতদিন না আধ্যাত্মিক সত্য সাক্ষাৎ করিতেছ, ততদিন তোমাদের ধর্মজীবন আরম্ভ হয় নাই, জানিবে। যতদিন না অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বার খুলিয়া যায়, ততদিন তোমাদের পক্ষে ধর্ম কেবল কথার কথা মাত্র, ততদিন কেবল ধর্মলাভের জন্য প্রস্তুত হইতেছ মাত্র, ততদিন পরোক্ষ বিবরণ দিতেছ মাত্র।


এক সময়ে বুদ্ধদেবের সহিত কতকগুলি ব্রাহ্মণের তর্ক হইয়াছিল। সেই সময়ে তিনি একটি অতি সুন্দর কথা বলিয়াছিলেন, তাহা এখানে বেশ খাটে। ব্রাহ্মণেরা বুদ্ধদেবের নিকট ব্রহ্মের স্বরূপ আলোচনা করিতে আসেন। সেই মহাপুরুষ তাঁহাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন?’ ব্রাহ্মণ বলিলেন, ‘না, দেখি নাই।’ বুদ্ধদেব আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার পিতা?’ ‘না, তিনিও দেখেন নাই।’ ‘আপনার পিতামহ?’ ‘বোধ হয়, তিনিও দেখেন নাই।’ তখন বুদ্ধ বলিলেন, ‘বন্ধু, আপনার পিতৃ-পিতামহগণও যাঁহাকে দেখেন নাই, এমন পুরুষ সম্বন্ধে আপনি কিরূপে বিচার দ্বারা অন্যকে পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন?’ পৃথিবীর সকলে এইরূপই করিতেছে। বেদান্তের ভাষায় আমাদিগকেও বলিতে হইবেঃ ‘নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।’১৮ বাগাড়ম্বর দ্বারা সেই আত্মাকে লাভ করা যায় না, মেধা দ্বারাও তাঁহাকে লাভ করা যায় না, এমন কি, বেদপাঠের দ্বারাও নয়।



পৃথিবীর সকল জাতিকে লক্ষ্য করিয়া বেদের ভাষায় আমাদিগকে বলিতে হইবেঃ তোমাদের বাদ-বিসংবাদ বৃথা; তোমরা যে-ঈশ্বরকে প্রচার করিতে চাও, তাঁহাকে দেখিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক, তবে বৃথাই তোমার প্রচার; তুমি কি বলিতেছ, তাহাই তুমি জান না; আর যদি ঈশ্বরকে দেখিয়া থাক, তবে তুমি আর বিবাদ করিবে না, তোমার মুখই উজ্জ্বল রূপ ধারণ করিবে।


এক প্রাচীন ঋষি তাঁহার পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞানলাভের জন্য গুরুগৃহে প্রেরণ করেন। সে যখন ফিরিল, পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি শিখিয়াছ?’ পুত্র বলিল, সে নানা বিদ্যা শিখিয়াছে। পিতা বলিলেন, ‘কিছুই শেখ নাই; আবার গুরুগৃহে যাও।’ পুত্র আবার গুরুগৃহে গেল; ফিরিয়া আসিলে পিতা পূর্ববৎ প্রশ্ন করিলেন। পুত্রও পূর্ববৎ উত্তর দিল। তাহাকে আর একবার গুরুগৃহে যাইতে হইল। এবার যখন সে ফিরিল, তখন তাহার সমগ্র মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময় হইয়া গিয়াছে। তখন পিতা বলিলেন,১৯ ‘বৎস, আজ তোমার মুখমণ্ডল ব্রহ্মবিদের ন্যায় উদ্ভাসিত দেখিতেছি।’ যখন তুমি ঈশ্বরকে জানিবে, তখন তোমার মুখ, তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার সমগ্র আকৃতিই পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। তখন তুমি মানবজাতির নিকট মহাকল্যাণস্বরূপ হইবে, কেহই তোমাকে বাধা দিতে পারিবে না। ইহাই ঋষিত্ব এবং ইহাই আমাদের ধর্মের আদর্শ। অবশিষ্ট যাহা কিছু—পরস্পর কথাবার্তা, যুক্তি-বিচার, দর্শন, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, এমন কি বেদ পর্যন্ত—এই ঋষিত্বলাভের প্রস্তুতি মাত্র, ও-গুলি গৌণ। ঋষিত্বলাভই মুখ্য। বেদ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষাদি—সবই গৌণ। ‘তাহাই পরা বিদ্যা, যাহা দ্বারা আমরা সেই অক্ষর পুরুষকে জানিতে পারি।’ যাঁহারা এই তত্ত্ব সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন, তাঁহারাই বৈদিক ঋষি। ঋষি-অর্থে আমরা এক শ্রেণীর বিশেষ-অবস্থাপন্ন ব্যক্তিকে বুঝিয়া থাকি। যথার্থ হিন্দু হইতে গেলে আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের কোন এক অবস্থায় এই ঋষিত্বলাভ করিতে হইবে, আর ঋষিত্বলাভই হিন্দুর নিকট মুক্তি। কতকগুলি মতবাদে বিশ্বাস, সহস্র সহস্র মন্দির দর্শন বা পৃথিবীতে যত নদী আছে সবগুলিতে স্নান করিলে হিন্দুমতে মুক্তি হইবে না। ঋষি হইলে—মন্ত্রদ্রষ্টা হইলে তবেই মুক্তিলাভ হইবে।



পরবর্তী সময়ের কথা আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই, তখন সমগ্র জগৎ-আলোড়নকারী মহাপুরুষগণ—শ্রেষ্ঠ অবতারগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। অবতারের সংখ্যা অনেক। ভাগবতের মতে অবতার অসংখ্য; তন্মধ্যে রাম ও কৃষ্ণই ভারতে বিশেষভাবে পূজিত হইয়া থাকেন। এই প্রাচীন বীরযুগের আদর্শ—সত্যপরায়ণতা ও নীতির সাকার মূর্তি, আদর্শ তনয়, আদর্শ পতি, আদর্শ পিতা, সর্বোপরি আদর্শ রাজা রামচন্দ্রের চরিত্র অঙ্কন করিয়া মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের সম্মুখে স্থাপন করিয়াছেন। এই মহাকবি যে-ভাষায় রামচরিত্র বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা শুদ্ধ, মধুর, অথচ সহজ সরল ভাষা আর হইতে পারে না। আর সীতার কথা কি বলিব! তোমরা জগতের সমগ্র প্রাচীন সাহিত্য অধ্যয়ন করিয়া নিঃশেষ করিতে পার, জগতের ভাবী সাহিত্যসমূহও নিঃশেষ করিতে পার, কিন্তু তোমাদিগকে নিঃসংশয়ে বলিতে পারি যে, আর একটি সীতার চরিত্র বাহির করিতে পারিবে না। সীতাচরিত্র অসাধারণ; ঐ চরিত্র একবারই চিত্রিত হইয়াছে, আর কখনও হয় নাই, হইবেও না। রাম হয়তো কয়েকটি হইয়াছেন, কিন্তু সীতা আর হন নাই। ভারতীয় নারীগণের যেরূপ হওয়া উচিত, সীতা তাহার আদর্শ; নারীচরিত্রের যত প্রকার ভারতীয় আদর্শ আছে, সবই এক সীতাচরিত্র হইতেই উদ্ভূত; আর সমগ্র আর্যাবর্তে এই সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার পূজা পাইয়া আসিতেছেন। মহামহিমময়ী সীতা—সাক্ষাৎ পবিত্রতা অপেক্ষাও পবিত্রতরা, সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত আদর্শ সীতা চিরকালই এইরূপ পূজা পাইবেন। যিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রদর্শন না করিয়া সেই মহাদুঃখের জীবন যাপন করিয়াছিলেন, সেই নিত্যসাধ্বী নিত্যবিশুদ্ধস্বভাবা আদর্শ পত্নী সীতা, সেই নরলোকের—এমন কি দেবলোকের পর্যন্ত আদর্শস্বরূপা মহীয়সী সীতা চিরদিনই আমাদের জাতীয় দেবতারূপে বর্তমান থাকিবেন। আমরা সকলেই তাঁহার চরিত্র বিশেষরূপে জানি, সুতরাং উহার বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন নাই। আমাদের সব পুরাণ নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, এমন কি আমাদের বেদ পর্যন্ত লোপ পাইতে পারে, আমাদের সংস্কৃত ভাষা পর্যন্ত চিরদিনের জন্য কালস্রোতে বিলুপ্ত হইতে পারে, কিন্তু অবহিত হইয়া শ্রবণ কর, যতদিন ভারতে অতি অমার্জিত গ্রাম্যভাষাভাষী পাঁচজন হিন্দুও থাকিবে, ততদিন সীতার উপাখ্যান থাকিবে। সীতা আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় মিশিয়া গিয়াছেন, প্রত্যেক হিন্দু নরনারীর শোণিতে সীতা বিরাজমানা। আমরা সকলেই সীতার সন্তান। আমাদের নারীগণকে আধুনিকভাবে গড়িয়া তুলিবার যে-সকল চেষ্টা হইতেছে, সেগুলির মধ্যে যদি সীতা-চরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। আর প্রত্যহই আমরা ইহার দৃষ্টান্ত দেখিতেছি। ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই ভারতীয় নারীর উন্নতির একমাত্র পথ।



অতঃপর তাঁহার কথা আলোচনা করা যাউক, যিনি নানাভাবে পূজিত হইয়া থাকেন, যিনি আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতবাসী—সকলেরই পরমপ্রিয় ইষ্টদেবতা। আমি তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াই এ-কথা বলিতেছি, ভাগবতকার যাঁহাকে অবতার বলিয়াই তৃপ্ত হন নাই, বলিয়াছেন, ‘এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।’২০—অন্যান্য অবতার সেই পুরুষের অংশ ও কলামাত্র, কিন্তু কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্।


যখন আমরা তাঁহার বিবিধভাবসমন্বিত চরিত্রের বিষয় আলোচনা করি, তখন তাঁহার প্রতি এরূপ বিশেষণ প্রযুক্ত হইয়াছে বলিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্য বোধ করি না। তিনি একাধারে অপূর্ব সন্ন্যাসী ও অদ্ভুত গৃহী ছিলেন; তাঁহার মধ্যে বিস্ময়কর রজঃশক্তির বিকাশ দেখা গিয়াছিল, অথচ তাঁহার অদ্ভুত ত্যাগ ছিল। গীতা পাঠ না করিলে কৃষ্ণচরিত্র কখনই বুঝা যাইতে পারে না; কারণ তিনি তাঁহার নিজ উপদেশের মূর্তিমান্ বিগ্রহ ছিলেন। সকল অবতারই, তাঁহারা যাহা প্রচার করিতে আসিয়াছিলেন, তাহার জীবন্ত উদাহরণস্বরূপ ছিলেন। গীতার প্রচারক শ্রীকৃষ্ণ চিরজীবন সেই ভগবদ্‌গীতার সাকার বিগ্রহরূপে বর্তমান ছিলেন—তিনি অনাসক্তির মহৎ দৃষ্টান্ত। তিনি অনেককে রাজা করিলেন, কিন্তু স্বয়ং সিংহাসনে আরোহণ করিলেন না; যিনি সমগ্র ভারতের নেতা—যাঁহার বাক্যে রাজগণ নিজ নিজ সিংহাসন ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তিনি স্বয়ং রাজা হইতে ইচ্ছা করেন নাই। বাল্যকালে যিনি সরলভাবে গোপীদের সহিত ক্রীড়া করিতেন, জীবনের সকল অবস্থাতেই তিনি সেই সরল সুন্দর শ্রীকৃষ্ণ।



তাঁহার জীবনের সেই চিরস্মরণীয় অধ্যায়ের কথা মনে পড়িতেছে, যাহা অতি দুর্বোধ্য। যতক্ষণ না কেহ পূর্ণ ব্রহ্মচারী ও পবিত্রস্বভাব হইতেছে, ততক্ষণ তাহা বুঝিবার চেষ্টা করা উচিত নয়। সেই প্রেমের অপূর্ব বিকাশের কথা মনে পড়িতেছে, যাহা সেই বৃন্দাবনের মধুর লীলায় রূপকভাবে বর্ণিত হইয়াছে; প্রেমমদিরা-পানে যে একেবারে উন্মত্ত হইয়াছে, সে ব্যতীত আর কেহ তাহা বুঝিতে পারে না। কে গোপীদের প্রেম-জনিত বিরহযন্ত্রণার ভাব বুঝিতে সমর্থ যে-প্রেম প্রেমের চরম আদর্শ, যে-প্রেম আর কিছু চাহে না, যে-প্রেম স্বর্গ পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষা করে না, যে-প্রেম ইহলোক-পরলোকের কোন বস্তু কামনা করে না! হে বন্ধুগণ, এই গোপীপ্রেম দ্বারাই সগুণ ও নির্গুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে বিরোধের একমাত্র মীমাংসা হইয়াছে। আমরা জানি, মানুষ সগুণ ঈশ্বর হইতে উচ্চতর ধারণা করিতে পারে না। আমরা ইহাও জানি, দার্শনিক দৃষ্টিতে সমগ্র জগদ্ব্যাপী ঈশ্বরে—সমগ্র জগৎ যাঁহার বিকাশ, সেই নির্গুণ ঈশ্বরে বিশ্বাসই স্বাভাবিক। এদিকে আমাদের প্রাণ একটা সাকার বস্তু চায়—এমন বস্তু চায়, যাহা আমরা ধরিতে পারি, যাঁহার পাদপদ্মে প্রাণ ঢালিয়া দিতে পারি। সুতরাং সগুণ ঈশ্বরই মানব-মনের সর্ব্বোচ্চ ধারণা। কিন্তু যুক্তি এই ধারণায় সন্তুষ্ট হইতে পারে না। ইহাই সেই অতি প্রাচীন, প্রাচীনতম সমস্যা—যাহা ব্রহ্মসূত্রে বিচারিত হইয়াছে, যাহা লইয়া বনবাসকালে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সহিত বিচার করিয়াছিলেনঃ যদি একজন সগুণ, সম্পূর্ণ দয়াময়, সর্ব্বশক্তিমান্ ঈশ্বর থাকেন, তবে এই নরককুণ্ড—সংসারের অস্তিত্ব কেন? কেন তিনি ইহা সৃষ্টি করিলেন? তাঁহাকে একজন মহাপক্ষপাতী ঈশ্বর বলিতে হইবে। এই সমস্যার কোনরূপ মীমাংসাই হয় নাই; কেবল গোপীপ্রেম সম্বন্ধে শাস্ত্রে যাহা পড়িয়া থাক, তাহাতেই ইহার মীমাংসা হইয়াছে। গোপীরা কৃষ্ণের প্রতি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করিতে চাহিত না; তিনি যে সৃষ্টিকর্তা, তিনি যে সর্বশক্তিমান্—তাহাও তাহারা জানিতে চাহিত না। তাহারা কেবল বুঝিত—তিনি প্রেমময়; ইহাই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট। গোপীরা কৃষ্ণকে কেবল বৃন্দাবনের কৃষ্ণ বলিয়া বুঝিত। সেই বহু সেনাবাহিনীর নেতা রাজাধিরাজ কৃষ্ণ তাহাদের নিকট বরাবর সেই রাখালবালকই ছিলেন।


‘ন ধনং ন জনং ন কবিতাং সুন্দরীং বা জগদীশ কাময়ে।

মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ||’২১


হে জগদীশ, আমি ধন জন কবিতা বা সুন্দরী—কিছুই প্রার্থনা করি না; হে ঈশ্বর, জন্মে জন্মে যেন তোমার প্রতি আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে। ধর্মের ইতিহাসে ইহা এক নূতন অধ্যায়—এই অহৈতুকী ভক্তি, এই নিষ্কাম কর্ম; আর মানুষের ইতিহাসে ভারতক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ অবতার কৃষ্ণের মুখ হইতে সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব নির্গত হইয়াছে। ভয়ের ধর্ম, প্রলোভনের ধর্ম চিরদিনের জন্য চলিয়া গেল; নরকের ভীতি ও স্বর্গ-সুখের প্রলোভন সত্ত্বেও এই অহৈতুকী ভক্তি ও নিষ্কাম কর্ম-রূপ আদর্শের অভ্যুদয় হইল।


এ প্রেমের মহিমা কি আর বলিব! এইমাত্র তোমাদিগকে বলিয়াছি, গোপীপ্রেম উপলব্ধি করা বড়ই কঠিন। আমাদের মধ্যেও এমন নির্বোধের অভাব নাই, যাহারা শ্রীকৃষ্ণ-জীবনের এই অতি অপূর্ব অংশের অদ্ভুত তাৎপর্য বুঝিতে পারে না। আমি আবার বলিতেছি, আমাদেরই স্বজাতি এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নির্বোধ আছে, যাহারা গোপীপ্রেমের নাম শুনিলে উহা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভাবিয়া ভয়ে দশহাত পিছাইয়া যায়। তাহাদিগকে শুধু এইটুকু বলিতে চাই—নিজের মন আগে শুদ্ধ কর; আর তোমাদিগকে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যিনি এই অদ্ভুত গোপীপ্রেম বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি আর কেহই নহেন, তিনি সেই চিরপবিত্র ব্যাসতনয় শুক। যতদিন হৃদয়ে স্বার্থপরতা থাকে, ততদিন ভগবৎপ্রেম অসম্ভব; উহা কেবল দোকানদারি—আমি তোমাকে কিছু দিতেছি, প্রভু, তুমি আমাকে কিছু দাও। আর ভগবান্‌ও বলিতেছেন, যদি তুমি এরূপ না কর, তবে তুমি মরিলে পর তোমাকে দেখিয়া লইব, চিরকাল আমি তোমাকে দগ্ধ করিয়া মারিব। সকাম ব্যক্তির ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা এইরূপ। যতদিন মাথায় এই-সব ভাব থাকে, ততদিন গোপীদের প্রেমজনিত বিরহের উন্মত্ততা লোকে কি করিয়া বুঝিবে?


‘সুরতবর্ধনং শোকনাশনং স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠু চুম্বিতম্ | ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং বিতর বীর নস্তেঽধরামৃতম্ ||’২২


একবার, একবারমাত্র যদি সেই অধরের মধুর চুম্বন লাভ করা যায়! যাহাকে তুমি একবার চুম্বন করিয়াছ, চিরকাল ধরিয়া তোমার জন্য তাহার পিপাসা বাড়িতে থাকে, তাহার সকল দুঃখ চলিয়া যায়, তখন আমাদের অন্যান্য সকল বিষয়ে আসক্তি চলিয়া যায়, কেবল তুমিই তখন একমাত্র প্রীতির বস্তু হও।


প্রথমে এই কাঞ্চন, নাম-যশ, এই ক্ষুদ্র মিথ্যা সংসারের প্রতি আসক্তি ছাড় দেখি। তখনই—কেবল তখনই তোমরা গোপীপ্রেম কি তাহা বুঝিবে। উহা এত শুদ্ধ যে, সর্বত্যাগ না হইলে উহা বুঝিবার চেষ্টাই করা উচিত নয়। যতদিন পর্যন্ত না চিত্ত সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়, ততদিন উহা বুঝিবার চেষ্টা বৃথা। প্রতি মুহূর্তে যাহাদের হৃদয়ে কামকাঞ্চনযশোলিপ্সার বুদ্বুদ উঠিতেছে, তাহারাই আবার গোপীপ্রেম বুঝিতে চায় এবং উহার সমালোচনা করিতে যায়! কৃষ্ণ-অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেওয়া। এমন কি দর্শনশাস্ত্র-শিরোমণি গীতা পর্যন্ত সেই অপূর্ব প্রেমোন্মত্ততার সহিত তুলনায় দাঁড়াইতে পারে না। কারণ গীতায় সাধককে ধীরে ধীরে সেই চরম লক্ষ্য মুক্তিসাধনের উপদেশ দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু এই গোপীপ্রেমের মধ্যে ঈশ্বর-রসাস্বাদের উন্মত্ততা, ঘোর প্রেমোন্মত্ততাই বিদ্যমান; এখানে গুরু-শিষ্য, শাস্ত্র-উপদেশ, ঈশ্বর-স্বর্গ সব একাকার, ভয়ের ধর্মের চিহ্নমাত্র নাই, সব গিয়াছে— আছে কেবল প্রেমোন্মত্ততা। তখন সংসারের আর কিছু মনে থাকে না, ভক্ত তখন সংসারে কৃষ্ণ—একমাত্র সেই কৃষ্ণ ব্যতীত আর কিছুই দেখেন না, তখন তিনি সর্বপ্রাণীতে কৃষ্ণদর্শন করেন, তাঁহার নিজের মুখ পর্যন্ত তখন কৃষ্ণের মত দেখায়, তাঁহার আত্মা তখন কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত হইয়া যায়। মহানুভব কৃষ্ণের ঈদৃশ মহিমা!


কৃষ্ণজীবনের ছোটখাটো খুঁটিনাটি লইয়া সময় নষ্ট করিও না; তাঁহার জীবনের মুখ্য অংশ যাহা, তাহাই অবলম্বন কর। কৃষ্ণের জীবনচরিতে হয়তো অনেক ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্য আছে, অনেক বিষয় হয়তো প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে—এ সবই সত্য হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও ঐ সময়ে সমাজে যে-এক অপূর্ব নূতন ভাবের অভ্যুদয় হইয়াছিল, তাহার অবশ্যই ভিত্তি ছিল। অন্য যে-কোন মহাপুরুষের জীবন আলোচনা করিলেই দেখিতে পাই যে, তিনি তাঁহার পূর্ববর্তী কতকগুলি ভাবের প্রতিধ্বনিমাত্র; আমরা দেখিতে পাই, তিনি তাঁহার নিজ দেশে, এমন কি সেই সময়ে যে-সকল ভাব প্রচলিত ছিল, শুধু সেগুলিই প্রচার করিয়া গিয়াছেন। এমন কি, সেই মহাপুরুষ আদৌ ছিলেন কিনা, সে-সম্বন্ধেই গুরুতর সন্দেহ থাকিতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণের উপদেশ বলিয়া কথিত এই নিষ্কাম কর্ম ও নিষ্কাম প্রেমতত্ত্ব জগতে অভিনব মৌলিক ভাব নহে—ইহা প্রমাণ কর দেখি। যদি না পার, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, কোন এক ব্যক্তি নিশ্চয়ই এই তত্ত্বগুলি উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। ঐ তত্ত্বগুলি অপর কোন ব্যক্তির নিকট হইতে গৃহীত বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না। কারণ কৃষ্ণের আবির্ভাবকালে আকাশে বাতাসে ঐ তত্ত্ব ভাসিতেছিল বলিয়া জানা যায় না। ভগবান্‌ কৃষ্ণই ইহার প্রথম প্রচারক, তাঁহার শিষ্য বেদব্যাস ঐ তত্ত্ব জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিলেন। মানবভাষায় এরূপ শ্রেষ্ঠ আদর্শ আর কখনও চিত্রিত হয় নাই। আমরা তাঁহার গ্রন্থে গোপীজনবল্লভ সেই বৃন্দাবনের রাখালরাজ অপেক্ষা আর কোন উচ্চতর আদর্শ পাই না। যখন তোমাদের মস্তিষ্কে এই উন্মত্ততা প্রবেশ করিবে, যখন তোমরা মহাভাগা গোপীগণের ভাব বুঝিবে, তখনই তোমরা জানিতে পারিবে প্রেম কি বস্তু! যখন তোমাদের দৃষ্টিপথ হইতে সমগ্র জগৎ অন্তর্হিত হইবে, যখন তোমাদের অন্য সব চিন্তা লুপ্ত হইবে, যখন তোমরা শুদ্ধচিত্ত হইবে, যখন তোমাদের আর কোন লক্ষ্য থাকিবে না, এমন কি সত্যানুসন্ধানস্পৃহা পর্যন্ত থাকিবে না, তখনই তোমাদের হৃদয়ে সেই প্রেমোন্মত্ততার আবির্ভাব হইবে, তখনই তোমরা গোপীদের অহেতুক প্রেমের শক্তি বুঝিবে। ইহাই লক্ষ্য। যখন এই প্রেম লাভ করিলে, তখন সব পাইলে।


এইবার আমরা একটু নিম্নস্তরে নামিয়া গীতাপ্রচারক শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আলোচনা করিব। ভারতে এখন অনেকের মধ্যে একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়—সেটা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মত। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা—কৃষ্ণ গোপীদের সহিত প্রেমলীলা করিয়াছেন, এটা যেন কি এক রকম! সাহেবেরাও ইহা বড় পচ্ছন্দ করে না। অমুক পণ্ডিত এই গোপীপ্রেমটা বড় সুবিধা মনে করেন না। তবে আর কি? গোপীদের যমুনার জলে ভাসাইয়া দাও! সাহেবদের অনুমোদিত না হইলে কৃষ্ণ টেকেন কি করিয়া? টিকিতেই পারেন না! মহাভারতে দু-একটি গুরুত্বহীন স্থানে ছাড়া অন্য কোথাও গোপীদের কোন উল্লেখই নাই! যথা—দ্রৌপদীর স্তবের মধ্যে এবং শিশুপালের বক্তৃতায় বৃন্দাবন কথা আছে মাত্র!


এগুলি সব প্রক্ষিপ্ত! সাহেবেরা যাহা না চায়, সব উড়াইয়া দিতে হইবে! গোপীদের কথা, এমন কি কৃষ্ণের কথা পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত! যে-সকল ব্যক্তি এইরূপ ঘোরতর বণিক্‌মনোভাবাপন্ন, যাহাদের ধর্মের আদর্শ পর্যন্ত ব্যবসাদারি হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাদের সকলেরই মনোভাব এই যে, তাহারা ইহলোকে কিছু করিয়া স্বর্গে যাইবে। ব্যবসাদার চক্রবৃদ্ধি-হারে সুদ চাহিয়া থাকে, তাহারা এখানে এমন কিছু পুণ্য সঞ্চয় করিয়া যাইতে চায়, যাহার ফলে স্বর্গে গিয়া সুখভোগ করিবে! ইহাদের ধর্মপ্রণালীতে অবশ্য গোপীদের স্থান নাই।


আমরা এখন সেই আদর্শ প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণের কথা ছাড়িয়া আর একটু নামিয়া গীতাপ্রচারক শ্রীকৃষ্ণের কথা আলোচনা করিব। এখানেও আমরা দেখিতে পাই, গীতার মত বেদের ভাষ্য আর কখনও হয় নাই, হইবেও না। শ্রুতি বা উপনিষদের তাৎপর্য বুঝা বড় কঠিন; কারণ ভাষ্যকারেরা সকলেই নিজেদের মতানুযায়ী উহা ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। অবশেষে যিনি স্বয়ং শ্রুতির বক্তা, সেই ভগবান্ নিজে আসিয়া গীতার প্রচারকরূপে শ্রুতির অর্থ বুঝাইলেন, আর আজ ভারতে সেই ব্যাখ্যা-প্রণালীর যেমন প্রয়োজন—সমগ্র জগতে উহার যেমন প্রয়োজন, আর কিছুরই তেমন নহে। আশ্চর্যের বিষয় পরবর্তী শাস্ত্রব্যাখ্যাতাগণ—এমন কি গীতার ব্যাখ্যা করিতে গিয়াও অনেক সময়ে ভগবদুক্ত বাক্যের তাৎপর্য ধরিতে পারেন নাই। গীতাতে কি দেখিতে পাওয়া যায়? আধুনিক ভাষ্যকারগণের লেখাতেই বা কি দেখিতে পাওয়া যায়? একজন অদ্বৈতবাদী ভাষ্যকার কোন উপনিষদের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইলেন; শ্রুতিতে অনেক দ্বৈতভাবাত্মক বাক্য রহিয়াছে; তিনি কোনরূপে সেগুলিকে ভাঙিয়া চুরিয়া তাহা হইতে নিজের মনোমত অর্থ বাহির করিলেন। আবার দ্বৈতবাদী ভাষ্যকারও অদ্বৈতবাদাত্মক বাক্যগুলিকে ভাঙিয়া চুরিয়া দ্বৈত অর্থ করিলেন। কিন্তু গীতায় শ্রুতির তাৎপর্য এরূপ বিকৃত করিবার চেষ্টা নাই। ভগবান্ বলিতেছেন, এগুলি সব সত্য; জীবাত্মা ধীরে ধীরে স্থূল হইতে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর সোপানে আরোহণ করিতেছেন, এইরূপে ক্রমশঃ তিনি সেই চরম লক্ষ্য অনন্ত পূর্ণস্বরূপে উপনীত হন। গীতায় এইভাবে বেদের তাৎপর্য বিবৃত হইয়াছে, এমন কি কর্মকাণ্ড পর্যন্ত গীতায় স্বীকৃত হইয়াছে, আর ইহা দেখান হইয়াছে যে, কর্মকাণ্ড—সাক্ষাৎভাবে না হইলেও গৌণভাবে মুক্তির সহায়, অতএব উহাও সত্য; মূর্তিপূজাও সত্য, সর্বপ্রকার অনুষ্ঠান ক্রিয়াকলাপও সত্য, শুধু একটি বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে—চিত্তশুদ্ধি। যদি হৃদয় শুদ্ধ ও অকপট হয়, তবেই উপাসনা সত্য হয় এবং আমাদিগকে চরম লক্ষ্যে লইয়া যায়, আর এই-সব বিভিন্ন উপাসনাপ্রণালীই সত্য, কারণ সত্য না হইলে সেগুলির সৃষ্টি হইল কেন? আধুনিক অনেক ব্যক্তির মত—বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায় কতকগুলি কপট ও দুষ্ট লোকে চালু করিয়াছে; তাহারা কিছু অর্থ-লালসায় এই-সকল ধর্ম ও সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। এ কথা একেবারে ভুল। তাঁহাদের ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে যতই যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ হউক না কেন, উহা সত্য নহে; ঐগুলি ঐরূপে সৃষ্ট হয় নাই। জীবাত্মার স্বাভাবিক প্রয়োজনেই ঐগুলির অভ্যুদয় হইয়াছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানবের ধর্মপিপাসা চরিতার্থ করিবার জন্যই ঐগুলির অভ্যুদয় হইয়াছে, সুতরাং উহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া কোন ফল নাই। যে-দিন সেই প্রয়োজন আর থাকিবে না, সে-দিন সেই প্রয়োজনের অভাবের সঙ্গে সেগুলিও লোপ পাইবে, আর যতদিন প্রয়োজন থাকিবে, ততদিন তোমরা যতই তীব্র সমালোচনা কর না কেন, যতই ঐগুলির বিরুদ্ধে প্রচার কর না কেন, ঐগুলি অবশ্যই থাকিবে। তরবারি-বন্দুকের সাহায্যে পৃথিবী রক্তস্রোতে ভাসাইয়া দিতে পার, কিন্তু যতদিন প্রতিমার প্রয়োজন থাকিবে, ততদিন প্রতিমাপূজা থাকিবেই থাকিবে। এই বিভিন্ন অনুষ্ঠানপদ্ধতি ও ধর্মের বিভিন্ন সোপান অবশ্যই থাকিবে, আর আমরা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে বুঝিতে পারিতেছি, সেগুলির কি প্রয়োজন।


শ্রীকৃষ্ণের তিরোভাবের কিছুকাল পরেই ভারতের ইতিহাসে এক শোচনীয় অধ্যায় আরম্ভ হইল। গীতাতেই দূরাগত ধ্বনির মত সম্প্রদায়সমূহের বিরোধ-কোলাহল আমাদের কানে আসে, আর সেই সামঞ্জস্যের অদ্ভুত উপদেষ্টা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ মধ্যস্থ হইয়া বিরোধ মিটাইয়া দিতেন। তিনি বলিতেছেন, ‘ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।’—যেমন সূত্রে মণিগণ গ্রথিত থাকে, তেমনি আমাতেই সব ওতপ্রোত রহিয়াছে।


আমরা সাম্প্রদায়িক বিরোধের দূরশ্রুত অস্ফুটধ্বনি তখন হইতেই শুনিতে পাই। সম্ভবতঃ ভগবানের উপদেশে এই বিরোধ কিছুকাল মন্দীভূত হইয়া সমন্বয় ও শান্তি আসিয়াছিল; কিন্তু আবার বিরোধ বাধিল। শুধু ধর্মমত লইয়া নহে, সম্ভবতঃ জাতি লইয়া এ বিবাদ চলিয়াছিল; আমাদের সমাজের দুইটি প্রবল অঙ্গ—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হইয়াছিল; এবং সহস্র বৎসর ধরিয়া যে মহান্ তরঙ্গ সমগ্র ভারতকে প্লাবিত করিয়াছিল, তাহার সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় আমরা আর এক মহামহিমময় মূর্তি দেখিতে পাই। তিনি আর কেহ নহেন—আমাদেরই গৌতম শাক্যমুনি। আমরা তাঁহাকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া পূজা করিয়া থাকি, পৃথিবী এত বড় নির্ভীক নীতিতত্ত্বের প্রচারক আর দেখে নাই। তিনি কর্মযোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেই কৃষ্ণই যেন নিজের শিষ্যরূপে নিজ মতগুলি কার্যে পরিণত করিবার জন্য আবির্ভূত হইলেন। আবার সেই বাণী উচ্চারিত হইল, যাহা গীতায় শিক্ষা দিয়াছিলঃ স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ—এই ধর্মের অতি সামান্য অনুষ্ঠানও মহাভয় হইতে রক্ষা করে। স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেঽপি যান্তি পরাং গতিম্ —স্ত্রী, বৈশ্য, এমন কি শূদ্রগণ পর্যন্ত পরমগতি প্রাপ্ত হয়। গীতার বাক্যসমূহ—শ্রীকৃষ্ণের বজ্রগম্ভীর মহতী বাণী সকলের বন্ধন, সকলের শৃঙ্খল ভাঙিয়া ফেলিয়া দেয়, সকলেরই সেই পরমপদলাভের অধিকার ঘোষণা করে।


ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।

নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ||


যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা এখানেই সংসার জয় করিয়াছেন। ব্রহ্ম সমভাবাপন্ন ও নির্দোষ, সুতরাং তাঁহারা ব্রহ্মেই অবস্থিত।


সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ |

ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ||


পরমেশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি নিজে আর নিজেকে হিংসা করেন না, আত্মহিংসাশূন্য হইয়া পরমগতি লাভ করেন।


গীতার এই উপদেশের জীবন্ত উদাহরণরূপে—উহার এক বিন্দুও অন্ততঃ যাহাতে কার্যে পরিণত হয় এইজন্য—সেই গীতা-উপদেষ্টাই অন্যরূপে আবার মর্ত্যধামে আসিলেন। ইনিই শাক্যমুনি। ইনি দুঃখী দরিদ্রদের উপদেশ দিতে লাগিলেন, যাহাতে সর্বসাধারণের হৃদয় আকর্ষণ করিতে পারেন, সেজন্য ইনি দেবভাষা পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া সাধারণলোকের ভাষায় উপদেশ দিতে লাগিলেন, রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া ইনি দুঃখী দরিদ্র পতিত ভিক্ষুকদের সঙ্গে বাস করিতে লাগিলেন, দ্বিতীয় রামের মত ইনি চণ্ডালকে বক্ষে লইয়া আলিঙ্গন করিলেন।


তোমরা সকলেই তাঁহার মহান্ চরিত্র ও অদ্ভুত প্রচারকার্যের বিষয় অবগত আছ। কিন্তু এই প্রচারকার্যের মধ্যে একটা বিষম ত্রুটি ছিল, তাহার জন্য আজ পর্যন্ত আমরা ভুগিতেছি। ভগবান্ বুদ্ধের কোন দোষ নাই, তাঁহার চরিত্র পরম পবিত্র ও মহামহিমময়। দুঃখের বিষয়—বৌদ্ধধর্মপ্রচারের ফলে যে-সকল বিভিন্ন অসভ্য ও অশিক্ষিত জাতি আর্যসমাজে প্রবেশ করিতে লাগিল, তাহারা বুদ্ধদেব-প্রচারিত উচ্চ আদর্শগুলি ঠিক ঠিক গ্রহণ করিতে পারিল না। এই-সকল জাতি তাহাদের নানাবিধ কুসংস্কার এবং বীভৎস উপাসনা-পদ্ধতিগুলি সঙ্গে লইয়া দলে দলে আর্যসমাজে প্রবেশ করিতে লাগিল। কিছুদিনের জন্য বোধ হইল তাহারা যেন সভ্য হইয়াছে, কিন্তু এক শতাব্দী যাইতে না যাইতে তাহারা তাহাদের পূর্বপুরুষদের সর্প ভূত প্রভৃতির উপাসনা সমাজে চালাইতে লাগিল। এইরূপে সমগ্র ভারত কুসংস্কারের পূর্ণ লীলাক্ষেত্র হইয়া অত্যন্ত অবনত হইল। প্রথমে বৌদ্ধগণ প্রাণিহিংসা নিন্দা করিতে গিয়া বৈদিক যজ্ঞসমূহের ঘোর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিল। পূর্বে প্রত্যেক গৃহে এই-সকল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইত, গৃহকোণে যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি প্রজ্বালিত থাকিত, ইহাই ছিল উপাসনার যা-কিছু সাজসজ্জা। বৌদ্ধদের প্রচারে এই যজ্ঞগুলি লোপ পাইল, তৎপরিবর্তে বিরাট বিরাট মন্দির, জাঁকালো অনুষ্ঠানপদ্ধতি, আড়ম্বরপ্রিয় পুরোহিতদল এবং বর্তমানকালে ভারতে আর যাহা কিছু দেখিতেছ, সেইগুলির আবির্ভাব হইল। বুদ্ধ সম্বন্ধে যাঁহাদের আরও বেশী জ্ঞান থাকা উচিত ছিল, এমন কয়েকজন আধুনিক ব্যক্তির লিখিত গ্রন্থে পড়া যায়, বুদ্ধ ব্রাহ্মণদের পৌত্তলিকতা ধ্বংস করেন। উহা পড়িয়া আমি হাস্য সংবরণ করিতে পারি না। তাঁহারা জানেন না যে, বৌদ্ধধর্মই ভারতে পৌরোহিত্য ও প্রতিমাপূজার সৃষ্টি করিয়াছিল।


দু-এক বৎসর পূর্বে একজন রুশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি একখানি পুস্তক প্রকাশ করেন; তাহাতে তিনি যীশুখ্রীষ্টের একখানি অদ্ভুত জীবনচরিত পাইয়াছেন বলিয়া দাবী করিয়াছেন। তিনি সেই পুস্তকখানির একস্থলে বলিতেছেন, খ্রীষ্ট ব্রাহ্মণদের নিকট ধর্মশিক্ষার্থ জগন্নাথের মন্দিরে গমন করেন, কিন্তু তাঁহাদের সঙ্কীর্ণতা ও মূর্তিপূজায় বিরক্ত হইয়া তথা হইতে তিব্বতের লামাদের নিকট ধর্মশিক্ষার্থ গমন করেন এবং তাঁহাদের উপদেশে সিদ্ধ হইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। যাঁহারা ভারতের ইতিহাস কিছুমাত্র জানেন, তাঁহাদের নিকট পূর্বোক্ত বিবৃতি দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয় যে, পুস্তকখানি আগাগোড়া প্রতারণা। কারণ জগন্নাথ-মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধমন্দিরকে হিন্দুমন্দির করিয়া লইয়াছি। এইরূপ ব্যাপার আমাদিগকে এখনও অনেক করিতে হইবে। ইহাই জগন্নাথ- মন্দিরের ইতিহাস, আর সে-সময়ে সেখানে একজনও ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তথাপি বলা হইতেছে—যীশুখ্রীষ্ট সেখানে ব্রাহ্মণদের নিকট উপদেশ লইবার জন্য আসিয়াছিলেন! আমাদের রুশীয় দিগ‍্গজ প্রত্নতাত্ত্বিক এই কথা বলিতেছেন!


পূর্বোক্ত কারণে বৌদ্ধধর্মের সর্বপ্রাণীতে দয়া, উহার উচ্চ নীতিতত্ত্ব ও নিত্য আত্মা আছে কি নাই—এই লইয়া চুলচেরা বিচারসত্ত্বেও সমগ্র বৌদ্ধধর্মের প্রাসাদ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল, আর চূর্ণ হইবার পর যে ভগ্নাবশেষ রহিল, তাহা অতি বীভৎস। বৌদ্ধধর্মের অবনতির ফলে যে বীভৎতা দেখা দিল, তাহা বর্ণনা করিবার সময় আমার নাই, প্রবৃত্তিও নাই। অতি বীভৎস অনুষ্ঠান-পদ্ধতিসমূহ, অতি ভয়ানক ও অশ্লীল গ্রন্থরাজি—যাহা মানুষের হাত দিয়া আর কখনও বাহির হয় নাই বা মানবমস্তিষ্ক যাহা আর কখনও কল্পনা করে নাই; অতি ভীষণ পাশব অনুষ্ঠানপদ্ধতিসমূহ, যেগুলি আর কখনও ধর্মের নামে চলে নাই—এ-সবই অবনত বৌদ্ধধর্মের সৃষ্টি।


কিন্তু ভারতের জীবনীশক্তি তখনও নষ্ট হয় নাই, তাই আবার ভগবানের আবির্ভাব হইল। যিনি বলিয়াছিলেন, ‘যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই আমি আসিয়া থাকি’, তিনি আবার আবির্ভূত হইলেন। এবার তাঁহার আবির্ভাব হইল দাক্ষিণাত্যে। সেই ব্রাহ্মণযুবক, যাঁহার সম্বন্ধে কথিত আছে যে, ষোড়শ বর্ষে তিনি তাঁহার সকল গ্রন্থের রচনা শেষ করিয়াছিলেন, সেই অদ্ভুত প্রতিভাশালী শঙ্করাচার্যের অভ্যুদয় হইল। এই ষোড়শবর্ষীয় বালকের রচনা আধুনিক সভ্য জগতের এক বিস্ময়! আর তিনিও ছিলেন বিস্ময়জনক! তিনি চাহিয়াছিলেন সমগ্র ভারতকে তাহার প্রাচীন পবিত্রভাবে লইয়া যাইতে; কিন্তু ভাবিয়া দেখ—এই কার্য কত কঠিন ও কত বিরাট! সে-সময়ে ভারতের অবস্থা যাহা দাঁড়াইয়াছিল, সে সম্বন্ধে তোমাদিগকে কিছু আভাস দিয়াছি। তোমরা যে-সকল বীভৎস আচারের সংস্কার করিতে অগ্রসর হইতেছ, সেগুলি সেই অধঃপতনের যুগ হইতে আসিয়াছে। তাতার বেলুচি প্রভৃতি দুর্দান্ত জাতিসকল ভারতে আসিয়া বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়া আমাদের সহিত মিশিয়া গেল, এবং তাহাদের জাতীয় আচারগুলিও সঙ্গে লইয়া আসিল। এইরূপে আমাদের জাতীয় জীবন অতি ভয়ানক পাশবিক আচারসমূহ দ্বারা কলুষিত হইল। উক্ত ব্রাহ্মণযুবক বৌদ্ধদের নিকট হইতে দায়স্বরূপ ইহাই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, আর সেই সময় হইতে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতে এই অবনত বৌদ্ধধর্ম হইতে বেদান্তের পুনর্বিজয় চলিতেছে, এখনও এ-কার্য চলিতেছে, এখনও উহা শেষ হয় নাই। মহান্ দার্শনিক শঙ্কর আসিয়া দেখাইলেন, বৌদ্ধধর্ম ও বেদান্তের সারাংশে বিশেষ প্রভেদ নাই। তবে বুদ্ধদেবের শিষ্যপ্রশিষ্যগণ তাঁহার উপদেশের তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া নিজেরা পতিত হয় এবং আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া নাস্তিক হইয়া পড়ে—শঙ্কর ইহাই দেখাইলেন; তখন বৌদ্ধেরা সকলেই তাহাদের প্রাচীন ধর্মে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। কিন্তু তাহারা যে-সকল অনুষ্ঠানপদ্ধতিতে অভ্যস্ত হইয়াছিল; সেগুলির কি হইবে—ইহাই এক মহাসমস্যা হইল।


তখন মহানুভব রামানুজের অভ্যুদয় হইল। শঙ্কর মহামনীষী ছিলেন বটে, কিন্তু বোধ হয় তাঁহার হৃদয় মস্তিষ্কের অনুরূপ ছিল না। রামানুজের হৃদয় শঙ্করের হৃদয় অপেক্ষা উদার ছিল। পতিতের দুঃখে তাঁহার হৃদয় কাঁদিল, তিনি তাহাদের দুঃখ মর্মে মর্মে অনুভব করিতে লাগিলেন। কালে যে-সকল নূতন নূতন অনুষ্ঠানপদ্ধতি দাঁড়াইয়াছিল, তিনি সেগুলি গ্রহণ করিয়া যথাসাধ্য সংস্কার করিলেন এবং নূতন নূতন অনুষ্ঠানপদ্ধতি, নূতন নূতন উপাসনাপ্রণালী সৃষ্টি করিয়া ঐগুলি যাহাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক, তাহাদিগকে সেগুলি উপদেশ দিতে লাগিলেন। অথচ তিনি ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল পর্যন্ত সকলের নিকট উচ্চতম আধ্যাত্মিক উপাসনার পথ উন্মুক্ত রাখিলেন। এইরূপে রামানুজের প্রচারকার্য চলিল। তাঁহার প্রচারের প্রভাব চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল, আর্যাবর্তে ঐ তরঙ্গের আঘাত লাগিল। সেখানে কয়েকজন আচার্য ঐভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া কাজ করিতে লাগিলেন; কিন্তু ইহা বহুদিন পরে—মুসলমান-শাসনকালে ঘটিয়াছিল। অপেক্ষাকৃত আধুনিক আর্যাবর্তবাসী আচার্যগণের মধ্যে চৈতন্যই শ্রেষ্ঠ।


রামানুজের সময় হইতে ধর্মপ্রচারে একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিও; তখন হইতে সর্বসাধারণের জন্য ধর্মের দ্বার খুলিয়া দেওয়া হয়। শঙ্করের পূর্ববর্তী আচার্যগণের যেমন ইহাই ছিল মূলমন্ত্র, রামানুজের পরবর্তী আচার্যগণেরও তাহাই হইল। শঙ্করকে কতকটা বর্জনশীল বলিয়া বর্ণনা করা হয়। কিন্তু তাঁহার লিখিত গ্রন্থে এমন কিছু দেখিতে পাই না, যাহাতে তাঁহার সঙ্কীর্ণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ভগবান্ বুদ্ধদেবের উপদেশাবলী যেমন তাঁহার শিষ্যপ্রশিষ্যবর্গ দ্বারা বিকৃত হইয়াছে, তেমনি শঙ্করাচার্যের উপদেশাবলীর উপর যে সঙ্কীর্ণতার দোষ আরোপিত হয়, সম্ভবতঃ তাহাতে শঙ্করের কোন দোষ নাই, তাঁহার শিষ্যদের বুঝিবার অক্ষমতার দরুনই এই দোষ শঙ্করে আরোপিত হইয়া থাকে।


আমি এখন এই উত্তরভারতের মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের বিষয় কিছু উল্লেখ করিয়া এই বক্তৃতা শেষ করিব। তিনি গোপীদের প্রেমোন্মত্ত ভাবের আদর্শ ছিলেন। চৈতন্যদেব স্বয়ং একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, তখনকার এক অতি বিচারশীল পণ্ডিতবংশে তাঁহার জন্ম হয়, তিনিও ন্যায়ের অধ্যাপক হইয়া তর্কে পণ্ডিতদের পরাস্ত করিয়া দিগ্বিজয়ী হন। বাল্যকাল হইতে তিনি শিখিয়াছিলেন, ইহাই জীবনের সর্ব্বোচ্চ আদর্শ। কোন মহাপুরুষের কৃপায় তাঁহার সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইয়া গেল; তখন তিনি বাদানুবাদ, তর্ক-ন্যায়ের অধ্যাপনা পরিত্যাগ করিলেন। পৃথিবীতে ভক্তির শ্রেষ্ঠ আচার্যদের অন্যতম প্রেমোন্মত্ত শ্রীচৈতন্য। তাঁহার ভক্তির তরঙ্গ সমগ্র বঙ্গদেশে প্লাবিত হইল, সকলের প্রাণে শান্তিবারি সিঞ্চিত হইল। তাঁহার প্রেমের কোন সীমা ছিল না। পুণ্যবান্ পাপী, হিন্দু মুসলমান, পবিত্র অপবিত্র, বেশ্যা পতিত—সকলেই তাঁহার ভালবাসার ভাগ পাইত, সকলকেই তিনি কৃপা করিতেন; যদিও তৎপ্রবর্তিত সম্প্রদায়ের অত্যন্ত অবনতি হইয়াছে, যেমন কালপ্রভাবে সকলেরই অবনতি হইয়া থাকে, তথাপি তাঁহার সম্প্রদায় দরিদ্র দুর্বল জাতিচ্যুত পতিত—সমাজে পরিত্যক্ত সকল ব্যক্তিরই আশ্রয়স্থল। কিন্তু আমাকে সত্যের অনুরোধে স্বীকার করিতে হইবে যে, দার্শনিক সম্প্রদায়সমূহেই আমরা অদ্ভুত উদার ভাব দেখিতে পাই। শঙ্করমতাবলম্বী কেহই এ কথা স্বীকার করেন না যে, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বাস্তবিক কোন ভেদ আছে। এদিকে কিন্তু জাতি-ব্যাপারে শঙ্কর অত্যন্ত বর্জনের ভাব পোষণ করিতেন। জাতিভেদের প্রশ্নে আমরা প্রত্যেক বৈষ্ণবাচার্যের উপদেশে অপূর্ব উদারতা দেখিতে পাই, কিন্তু ধর্মসম্বন্ধে তাঁহাদের মত সঙ্কীর্ণ।


শঙ্করের ছিল বিরাট মস্তিষ্ক, রামানুজ ও চৈতন্যের ছিল বিশাল হৃদয়। এখন এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাবের সময় হইয়াছিল, যাঁহার মধ্যে একাধারে এইরূপ হৃদয় ও মস্তিষ্ক থাকিবে, যিনি একাধারে শঙ্করের মহতী মেধা ও চৈতন্যের বিশাল অনন্ত হৃদয়ের অধিকারী হইবেন, যিনি দেখিবেন সকল সম্প্রদায় এক মহৎ ভাবে—ঈশ্বরের শক্তিতে অনুপ্রাণিত দেখিবেন প্রত্যেক প্রাণীতে সেই ঈশ্বর বিদ্যমান, যাঁহার হৃদয় ভারতে বা ভারতের বাহিরে দরিদ্র দুর্বল পতিত—সকলের জন্য কাঁদিবে, অথচ যাঁহার বিশাল বুদ্ধি এমন মহৎ তত্ত্বসকল উদ্ভাবন করিবে, যেগুলি ভারতে বা ভারতের বাহিরে বিরোধী সম্প্রদায়সমূহের সমন্বয়সাধন করিবে এবং এইরূপ বিস্ময়কর সমন্বয়ের দ্বারা হৃদয় ও মস্তিষ্কের সামঞ্জস্যপূর্ণ এক সার্বভৌম ধর্ম প্রকাশ করিবে। এইরূপ ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং আমি কয়েক বৎসর তাঁহার চরণতলে বসিয়া শিক্ষা পাইবার সৌভাগ্যলাভ করিয়াছিলাম।

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী ৫ম খণ্ড

এইরূপ এক ব্যক্তির জন্মগ্রহণ করিবার সময় হইয়াছিল—প্রয়োজন হইয়াছিল; আর অদ্ভুত ব্যাপার এই, তাঁহার সমগ্র জীবনের কার্য এমন এক শহরের নিকট অনুষ্ঠিত হয়, যে-শহর পাশ্চাত্যভাবে উন্মত্ত হইয়াছিল—ভারতের অন্যান্য শহর অপেক্ষা বেশী পরিমাণেই পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হইয়াছিল। পুঁথিগত বিদ্যা তাঁহার কিছুই ছিল না; মহামনীষাসম্পন্ন হইয়াও তিনি নিজের নাম পর্যন্ত লিখিতে পারিতেন না, কিন্তু প্রত্যেকে—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় উপাধিধারী ব্যক্তিগণ পর্যন্ত তাঁহাকে দেখিয়া একজন মহামনীষী বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। তিনি এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। সে অনেক কথা, আজ রাত্রে তোমাদিগের নিকট তাঁহার বিষয়ে কিছু বলিবার সময় নাই। সুতরাং আমাকে ভারতীয় সকল মহাপুরুষের পূর্ণপ্রকাশস্বরূপ যুগাচার্য মহাত্মা শ্রীরামকৃষ্ণের নামটুকু উল্লেখ করিয়াই আজ ক্ষান্ত হইতে হইবে—এই মহাপুরুষের উপদেশ আধুনিক যুগে আমাদের নিকট বিশেষ কল্যাণপ্রদ। ঐ ব্যক্তির ভিতর যে ঐশ্বরিক শক্তি খেলা করিত, সেটি লক্ষ্য করিও। ইনি দরিদ্রব্রাহ্মণ-সন্তান, বঙ্গদেশের অজ্ঞাত অপরিচিত কোন সুদূর পল্লীতে ইঁহার জন্ম। আজ ইওরোপ-আমেরিকায় সহস্র সহস্র ব্যক্তি সত্য-সত্যই ফুলচন্দন দিয়া তাঁহার পূজা করিতেছে এবং পরে আরও সহস্র সহস্র লোক পূজা করিবে। ঈশ্বরের ইচ্ছা কে বুঝিতে পারে? হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা যদি ইহাতে বিধাতার হাত না দেখিতে পাও, তবে তোমরা অন্ধ, নিশ্চিত জন্মান্ধ; যদি সময় আসে, যদি আর কখনও তোমাদের সহিত আলোচনা করিবার সুযোগ হয়, তবে তোমাদিগকে ইঁহার বিষয় আরও বিস্তারিতভাবে বলিব; এখন কেবল এইটুকু মাত্র বলিতে চাই, যদি আমার জীবনে একটিও যথার্থ তত্ত্ব কথা বলিয়া থাকি, তবে তাহা তাঁহার—তাঁহারই বাক্য; আর যদি এমন অনেক কথা বলিয়া থাকি, যেগুলি অসত্য—ভ্রমাত্মক, যেগুলি মানবজাতির কল্যাণকর নহে, সেগুলি সবই আমার, সেগুলির জন্য আমি—আমিই সম্পূর্ণ দায়ী।...........Continue

Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ