ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

05 November, 2025

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

05 November 0

 

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম।

ন শেষো অগ্নে অন‍্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥

ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ সরস্বতীর সংস্কৃত ভাষ্যের ভিত্তিতে)

বিষয়: আপন ধন কোনটি এবং পরধন কোনটি—এই বিষয়টিকে পরের মন্ত্রে বলা হয়েছে॥

পদার্থ

হে (অগ্নে) বিদ্বান্‌! আপনি (অচেতনস্য) চেতনাহীন মূর্খের (পথঃ) পথগুলোকে (মা) যেন না (বিদুক্ষঃ) কলুষিত করেন। (পরিষদ্যম্) সভায় যে (অন্যজাতম্) অন্য থেকে উৎপন্ন, সেই (হি) সেই (রেক্ণঃ) ধনকে এইরূপ জানুন যে এর (শেষঃ) বিশেষতা বা নিজের আত্মার দৃষ্টিতে শুদ্ধ বিবেচনার কিছুই (ন, অস্তি) নেই এমনি জানুন। আপনার সঙ্গ বা সাহায্যে আমরা (অরণস্য) সংঘর্ষহীন, (নিত্যস্য) স্থির, (রায়ঃ) ধনের (পতয়ঃ) স্বামী (স্যাম) হই॥৭॥

ভাবার্থ

হে মানুষ! ধর্মসঙ্গত পুরুষার্থে যে ধন লাভ হয়, তাকেই নিজের ধন বলে মানো; কিন্তু অন্যায়ে উপার্জিত ধনকে নিজের বলে গণ্য করো না। জ্ঞানীদের পথকে পাখণ্ডের উপদেশে কলুষিত কোরো না। যেমন ধর্মযুক্ত পুরুষার্থে ধন অর্জিত হয়, তেমনি চেষ্টা করো॥৭॥

ঋগ্বেদ ভাষ্য (হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার)

বিষয়: ঋণগ্রস্ত হওয়ার দোষ

পদার্থ: [১] (অরণস্য) [অপার্ণস্য নি°] = ঋণমুক্ত ব্যক্তির (রেক্ণঃ) = ধন (হি) = নিশ্চয়ই (পরিষদ্যম্) = যথেষ্ট হয়। [‘পরিষদ্যং–পর্যাপ্তং’ সা°] অর্থাৎ সংসারী ধন এতটাই হওয়া উচিত যাতে আমরা ঋণগ্রস্ত না হই। প্রয়োজনগুলো পূর্ণ হতে থাকে এইরূপ ধনই আমাদের প্রাপ্ত হওয়া উচিত। আমরা সেই (রায়ঃ) = ধনের (পতয়ঃ স্যাম) = অধিপতি হই, যা (নিত্যস্য) নিত্য, অর্থাৎ ঋণ নিয়ে প্রাপ্ত নয়। ঋণ নিয়ে অর্জিত ধন তো আবার ফিরিয়ে দিতেই হবে।

[২] হে (অগ্নে) = প্রভু! আমরা যেন এইভাবে বুঝে চলি যে (অন্যজাতং শেষঃ ন অস্তি) = অন্যের থেকে জন্মানো অর্থাৎ নেওয়া ঋণে মৃত্যু থেকে মুক্তি নেই; অর্থাৎ মানুষ ঋণ নিয়ে নিজ জীবনকে অকালেই ঋণের ভারে মৃত্যুগ্রস্ত করে ফেলে। হে মানুষ! তুমি (অচেতনস্য) = তোমার পরবর্তী অজ্ঞ সন্তানদের (পথঃ) = পথগুলোকে (মা বিদুঃক্ষঃ) = কলুষিত কোরো না। তারা যেন জন্মাবস্থাতেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জীবন শুরু না করে। পিতার ঋণ সন্তানদের দুর্দশার কারণ হয়ে না ওঠে।

ভাবার্থ

ধনাভাব সংসারযাত্রার সবচেয়ে বড় বাধা, আর অতিরিক্ত ধন ভোগ-বিলাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রভু এমন ধন দিন যাতে আমরা ঋণগ্রস্ত না হই। ঋণকে মৃত্যুসম বিপদ জ্ঞান করো। তোমার সন্তানদের জন্য ঋণের ভার রেখে যেও না॥

এই মন্ত্রের ঋষি হলেন বসিষ্ঠ। এর অর্থ— “বশিষ্ঠঃ– প্রাণো বৈ বশিষ্ঠঃ” অর্থাৎ এই ছন্দরশ্মির উদ্ভব প্রাণ নামক মৌলিক জীবনীশক্তি থেকে ঘটে। এর দেবতা অগ্নি এবং ছন্দ ভুরিক্‌ পঙ্‌ক্তি হওয়ায় এর দৈবিক ও ছান্দসিক প্রভাবে অগ্নিতত্ত্বের বিস্তার ঘটে এবং আকর্ষণ-অনাকর্ষণ শক্তির বৃদ্ধি হয়।

আধিদেবিক ভাষ্য—
(পরিষদ্যম্‌ হি) “পরিহর্তব্যং হি নোপসর্তব্যম্‌” অর্থাৎ যে বস্তু ত্যাজ্য বা দূরে রাখার যোগ্য।
(অরণস্য, রেক্ণঃ) — [রণঃ = সংগ্রামের নাম; রেক্ণঃ = যে ব্যয় সৃষ্টি করে]
কোন বস্তু ত্যাজ্য ও দূরে রাখার যোগ্য এর উত্তর হিসেবে বলা হয়েছে
“অরণস্য রেক্ণঃ অরণোঅপার্ণো ভবতি রেক্ণ ইতি ধননাম রিচ্যতে প্রযতঃ”
অর্থাৎ যেসব পদার্থে সংঘাত বা সংযোগের প্রক্রিয়া আর ঘটে না, যাদের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত এমন নিকটবর্তী বা দূরবর্তী পদার্থ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় ত্যাজ্য। সংযোগ-বিচ্ছেদে অংশ নিতে গিয়ে এদের শক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, কিছু শক্তি নিঃসৃত হয়, এবং এরা সূক্ষ্ম কণারূপে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকে।

এবার বলা হচ্ছে.. কোন পদার্থ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় কার্যকর?

(নিত্যস্য, রায়ঃ, পতয়ঃ, স্যম্‌) “নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যম্‌ পিত্র্যস্যেব ধনস্য” 
[রায়ঃ = পশু বা শক্তিসমূহ; নিত্যঃ = নিয়মিত বা নিয়ন্ত্রিত]
সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে কেবল সেই কণা বা পদার্থ, যা নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত মরুৎ বা ছন্দ-রশ্মি দ্বারা পালন ও রক্ষিত। যখন এই রশ্মিগুলো অনিয়ন্ত্রিত বা ক্ষণস্থায়ী হয়, তখন তারা সংযোগের যোগ্য থাকে না। 

[পিতরঃ = যাঁদের মধ্যে উষ্ণতার অংশ আছে] গ্রন্থকার বলেন:- যেসব পদার্থ উষ্ণতায় পরিপূর্ণ, তারাই সংযোগ-যোগ্য; উষ্ণতাহীন কণা কখনোই সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না।

(ন, শেষঃ, অগ্নে, অন্যান্যতম্‌, অস্তি) “ন শেষো অগ্নে অন্যান্যতম্‌ অস্তি শেষ ইত্যপত্যনাম শিষ্যতে प्रयतः (প্রযতঃ)” [অন্য = ভিন্ন; সপত্ন = পাপ বা প্রতিকূল শক্তি] অর্থাৎ দূরবর্তী, অনিয়ন্ত্রিত বা অসুর-প্রভাবিত পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত অগ্নিতত্ত্ব শেষ অর্থাৎ কার্যরূপে নতুন অণু গঠনে অসমর্থ হয়। অর্থ এই যে অত্যধিক উত্তপ্ত পদার্থ যদি চরমভাবে অস্থির, অনিয়ন্ত্রিত, অতিদূরস্থিত কিংবা অসুর-তরঙ্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়, তবে তা পরবর্তী ধাপের পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। এখানে কার্যরূপ পদার্থকে “অপত্য” ও “শেষ” উভয়ই বলা হয়েছে।

অর্থাৎ অগ্নি যখন সুপরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখনই সে কার্যরূপ পদার্থ উৎপাদনে সক্ষম হয়; তখন অগ্নি নিজেই কার্যরূপ পদার্থে রূপান্তরিত হয় অথবা সেই পদার্থের রূপে অবশিষ্ট থাকে। উদাহরণ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় বায়ু বা অগ্নিতত্ত্ব পরবর্তী ধাপ সম্পন্ন করে যথাক্রমে অগ্নি ও জলতত্ত্বে অবস্থান করে; তাই এরা পূর্ববর্তী তত্ত্বের শেষ

(অচেতনস্য, মা, পথঃ, বিদুক্ষঃ)
“অচেতযমানস্য তত্প্ৰমত্তস্য ভবতি মা নঃ পথম্‌ বিদৃদুষ ইতি”
অর্থাৎ যেসব পদার্থ দীপ্তিহীন বা জাগ্রত নয়, তারা বিভিন্ন ক্রিয়ায় বিচ্যুত হয় সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। অগ্নিতত্ত্ব এসব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদার্থের পথকে বিকৃত হতে দেয় না; অর্থাৎ উপযুক্ত উষ্ণতা ও শক্তির মাধ্যমেই সূক্ষ্ম কণা ও পদার্থ নিজেদের নির্দিষ্ট পথে সক্রিয়ভাবে গমন করতে পারে এবং বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়।

ভাবার্থঃ ক্ষীণ শক্তিযুক্ত কণারা সৃষ্টির যজন-প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা মহাবিশ্বে ইদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। যে কণারা নিয়ন্ত্রিত মরুদ্‌ বা ছন্দাদি রশ্মি দ্বারা যুক্ত থাকে, তারা যজন-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকে। যখন মরুদাদি রশ্মি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তারা সংযোজনে সক্ষম থাকে না। উষ্ণতাযুক্ত কণা সংযোজ্য, উষ্ণতাহীন কণা নয়। দূরবর্তী অনিয়ন্ত্রিত বা অসুর-পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত কণাও কোনো নতুন পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। দীপ্তিযুক্ত পদার্থই পরবর্তী ধাপের পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হয়, দীপ্তিহীন নয়। আরও স্পষ্টতার জন্য পরবর্তী ঋচাটি পরবর্তী খণ্ডে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

“নহি গ্রভায়া অরণঃ সুশেভো’ন্যো দর্যো মনসা মন্তভা উ।
অধা চিদ্‌ অকঃ পুনরিত্স এত্যা নো বাজিক্‌ অভীষাল এ‌তু নব্যঃ ॥ ঋগ্বেদ ৭।৪।৮॥

এই মন্ত্রের ঋষি ও দেবতা পূর্বোক্ত মন্ত্রের মতোই, এবং এর ছন্দ পঙ্‌ক্তি। তাই দেবতা ও ছান্দসিক প্রভাবও মোটামুটি একই। কেবল একটি পার্থক্য এ মন্ত্রের প্রভাবে পূর্বোক্ত আকর্ষণ-প্রতিকর্ষণ শক্তির বৃদ্ধি ঘটে না, কিন্তু অগ্নিতত্ত্বের বিস্তার পূর্বের মতোই বজায় থাকে।

“ন হি গ্রহীতব্যোऽরণঃ” অর্থাৎ ক্ষণিক বলযুক্ত কণা পরস্পরের সংযোগ-বিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ যদি তাদের সংযোগ ঘটে যায়, তা অস্থির হয়, যার ফলে পরবর্তী উৎপাদের সৃষ্টি সম্ভব হয় না।

“সুশুখতমোऽপ্যন্যোদরর্যো” দূরবর্তী উখা অর্থাৎ সুদূর আকাশে অবস্থিত সপ্তদশ স্তোম নামে পরিচিত সতেরোটি গায়ত্রী রশ্মিতে যাদের সম্বন্ধে বেদবিজ্ঞান-আলোক ৩.৪২.২-এ পাঠযোগ্য বর্তমান কোনো সূক্ষ্ম পদার্থ যদিও নিজের স্থানে সৃজন-প্রক্রিয়ার জন্য সুখকর অর্থাৎ অনুকূল হয়;
“মনসাপি ন মন্তব্যঃ ময়ং পুত্র ইতি” তবুও মনত্ব দ্বারা তা অপ্রকাশিতই থাকে, অর্থাৎ সৃজন-প্রক্রিয়ার উপযোগী হয় না। কারণ এই যে, দূরস্থিত বা অসুর-পদার্থে আবৃত সেই সংযোজ্য পদার্থ নিজের স্থানে সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করতে পারে, কিন্তু দূরে অবস্থিত কোনো পদার্থের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।

[“পুত্রঃ”তস্মাদাহুঃ কর্তুরিব পুত্র ইতি (কাঠ.সং. ১৩.৩), বরো হি পুত্রঃ (কাঠ.সং. ৯.১৪)]

এই কারণে সেই দূরবর্তী পদার্থকে এখানে অবস্থিত পদার্থ নিজের উৎপাদ বা উৎপাদক বলে মানতে পারে না। এখানে ‘পুত্র’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ নির্মাতা এবং নিজের কর্মরূপ পদার্থ (উৎপাদ) উভয়ই গ্রহণ করতে হবে।

“অথ স অকঃ পুনরেব তদেতি যৎ আগতো ভবতি অক ইতি নিবাসনামোচ্যতে” অর্থাৎ এরপরও সে চলে যায় সেই স্থানে, যেখান থেকে এসেছে। এর তাৎপর্য এই যে, দূরবর্তী পদার্থ যদি কোনো আকর্ষণবলে আকৃষ্ট হয়ও, তা কিছুদূর এসে আবার পূর্ববর্তী স্থানে ফিরে যায়। অনুরূপভাবে কোনো অণু যদি দৃঢ় বলযুক্ত হয় এবং কোনোভাবে ভাঙে এবং তার কিছু আয়ন অন্য কোনো আয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যবর্তী বন্ধনবল দুর্বল হয়, তবে সেই আয়ন ভেঙে পূর্ব-অণুর রূপ গ্রহণ করে। এখানে উদ্দেশ্য এই যে, আয়নদের মিলন দ্বারা অণু-গঠনের একটি নিয়মযুক্ত প্রক্রিয়া আছে।

“এতু নো বাজী বেজনবান্‌ অভিঋষমানঃ সপত্নান্‌ নবজাতঃ স এব পুত্র ইতি” এখানে ‘নঃ’ সর্বনামটি সেই কণাদের জন্য ব্যবহৃত, যারা সংযোগের ইচ্ছুক। ফলে এই পাদের অর্থ এই কণারা এমন নূতন উৎপন্ন কণার কামনা করে, যাদের উপযুক্ত বেগ ও শক্তি আছে এবং যারা বাধক অসুর-প্রভৃতি পদার্থকে কম্পিত ও দমনে সক্ষম। এখানে ইঙ্গিত এই যে, কোনো ক্ষেত্রে যেসব কণা সংযোজনে উপযুক্ত, সেই ধরনের কণাই ঐ ক্ষেত্রে উৎপন্ন হতে থাকে। তারা পূর্ব-উৎপন্ন কণাদের অপত্য অর্থাৎ কর্মরূপ। পাশাপাশি তারা সংযোগাদি ক্রিয়ায়ও শ্রেষ্ঠ, তাই তাদের ‘পুত্র’ বলা হয়েছে।

Read More

03 November, 2025

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩

03 November 0

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩
ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩-এর সঠিক অর্থ ও গোমাংস ব্যাখ্যার খণ্ডন


🌼 ভুল ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ

কিছু আধুনিক লেখক, বিশেষত পশ্চিমা দার্শনিক ও কিছু “বেদবিরোধী” অনুবাদক, ঋগ্বেদের ১০.২৮.৩ মন্ত্রে “বৃষভা পচন্তি” অংশটি দেখে দাবি করেছেন— “তাহারা ষাঁড় রান্না করে এবং ইন্দ্রকে তা ভক্ষণ করতে বলা হয়েছে।” এই ব্যাখ্যা ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ও বেদীয় ব্যাকরণ অনুসারে সম্পূর্ণ ভুল।


🕉️ অপ্রামাণিক সংস্কৃত পাঠ

পচস্তি তে বৃষভা অৎসি তেষাম

এটি আসলে ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রেরই একটি মাত্র অংশ মূল মন্ত্রটি নীম্নে দেওয়া হলঃ

প্রামাণিক পাঠ (ঋগ্বেদ ১০।২৮।৩)

অদৃণা তে মন্দিন ইন্দ্র তূযান্ত্‌সুন্বন্তি সোমান্‌ পিবসি ত্বমেষাম্‌।
পচন্তি তে বৃষভাঁ অত্সি তেষাং পৃক্ষেণ যন্মঘবন্ন্‌ হূযমানঃ॥

“বৃষভ” শব্দের ভাবার্থ পরিপক্বতা বা সম্পূর্ণ বিকাশ বোঝায়।

 বৈদিক সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে একটি বিশ্লেষণ

পদার্থঃ (ইন্দ্র) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! (তে) তোমার জন্যে, (অদৃণা) প্রশংসাকারী বৈদ্য বা পুরোহিত দ্বারা প্রেরিত, (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিত করা পারিবারিক জন বা রাজকর্মচারী, (তূয়াৎ সোমান্ সুন্বন্তি) রসময় সোমপদার্থ (অর্থাৎ শক্তিদায়ক রস) প্রস্তুত করে,(তেষাম্ ত্বং পিবসি)  তুমি তা পান করো, এবং (তে) তোমার জন্যে, (বৃষভান্ পচন্তি) সুখবর্ষণকারী ভোগ্য বস্তুকে প্রস্তুত করে, (মঘবন্ পৃক্ষেণ হূয়মানঃ) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক দ্বারা আহ্বানিত হয়ে, (তেষাম্ অত্সি)  তুমি তাদের ভোগ করো। ॥৩॥

ভাবার্থঃ যখন আত্মা শরীরে অবতীর্ণ হয়, তখন তাকে অনুমোদনকারী বৈদ্য এবং আনন্দদানকারী পারিবারিক জনেরা নানা রকমের রস ও ভোগ্যবস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে, এবং স্নেহসহকারে তাকে খাওয়ায়–পান করায়, যাতে দেহ ক্রমে পুষ্ট হতে থাকে। একইভাবে, যখন রাজা রাজপদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার প্রশংসাকারী পুরোহিত ও সন্তুষ্টিদায়ক রাজকর্মচারীরা সোমাদির মতো ঔষধি রস এবং নানান ভোগ্য বস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে। রাজা, স্নেহভরে ও সম্মানসহ যাদের দ্বারা আহ্বানিত হন, তিনি সেই সকল প্রস্তুত ভোগ্যবস্তুর আস্বাদ গ্রহণ করেন। ॥৩॥

(ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কর্তৃক হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

अद्रि॑णा ते म॒न्दिन॑ इन्द्र॒ तूया॑न्त्सु॒न्वन्ति॒ सोमा॒न्पिब॑सि॒ त्वमे॑षाम् । 

पच॑न्ति ते वृष॒भाँ अत्सि॒ तेषां॑ पृ॒क्षेण॒ यन्म॑घवन्हू॒यमा॑नः ॥

পদার্থঃ [১] পূর্ববর্তী মন্ত্রে প্রভু জীবকে "সুত সোম" (অর্থাৎ পরিশুদ্ধ শক্তিময়) হতে বলেছিলেন। তার উত্তর দিতে গিয়ে সে বলে—হে (ইন্দ্র) = সোমপানকারী প্রভু! (তে মন্দিনঃ) = তোমার স্তোতা ভক্তগণ, (অদৃণা) = [অদ্রিঃ = বজ্রঃ] ক্রিয়াশীলতার দ্বারা, অথবা [না দীর্যতে] ধর্মমার্গ থেকে বিচ্যুত না হয়ে, (তূয়ান্) = বিলম্ব না করে, অর্থাৎ দ্রুত কর্মসম্পাদনের শক্তি প্রদানকারী, (সোমান্) = সোমরূপ শক্তিকণসমূহকে (সুন্বন্তি) = উৎপন্ন করে। (ঐষাম্) = এই সোমকণগুলির (ত্বম্) = আপনিই (পিবসি) = পান করেন অর্থাৎ এই সোমকণসমূহ আমার শরীরে আপনার কৃপায় সংরক্ষিত থাকে। আপনার স্মরণ আমাকে কামনা বাসনা থেকে উপরে তুলে আনে, এবং কামনা থেকে উর্ধ্বে উঠার ফলে আমি সোমকে (অর্থাৎ আত্মশক্তিকে) রক্ষা করতে সক্ষম হই।

[২] এইভাবে, (তে) = তোমার এই ভক্তগণ (বৃষভান্ পচন্তি) = অর্থাৎ পরিপক্ব ও শক্তিশালী পুরুষে রূপান্তরিত হয়, শক্তিশালী হয়ে তারা অপরের উপর সুখের বর্ষণ ঘটায়।

[৩] হে প্রভু! আপনি (তেষাম্) = তাদের পথের অন্তরায়রূপ বাধাসমূহের (অত্সি) = বিনাশ করেন [‘অদ্’ = ধ্বংস করা]। কিন্তু এই বাধা-বিঘ্নের বিনাশ আপনি কখন করেন? (যৎ) = যখন (পৃক্ষেণ) = [পৃচি = সংস্পর্শ] আপনার সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে, হে (মঘবন্) = ঐশ্বর্যশালী প্রভু! আপনি (হূয়মানঃ) = আহ্বান করা হন। এই ভক্তগণ প্রাতে ও সায়ং আপনার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং শক্তিশালী হয়ে, সমস্ত বাধা দূর করে, অগ্রসর হয়।

ভাবার্থঃ ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে আমরা কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে রক্ষা করব। সোম (অর্থাৎ আত্মশক্তি ও সত্ত্বগুণ) সংরক্ষণের দ্বারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলব। প্রভুর সংস্পর্শে এসে, শক্তিসঞ্চয় করে, বাধা-বিঘ্ন দূর করে আমরা দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হব।

(হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কারজীর হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

📘 পদার্থ বিশ্লেষণ

শব্দ ধাতু / উৎস নিরুক্ত / সূত্র প্রামাণিক অর্থ রূপক ভাব
পচন্তি (pachanti) √पच্ (ধাতু) নিরুক্ত ১.১.১.১২  “সিদ্ধ করা”, “পরিপক্ব করা” সিদ্ধ করে / পরিপক্ব করে আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধন
বৃষভাঃ (vṛṣabhāḥ) √वृष্ ধাতু নিরুক্ত ৯.২৩.১  “বলবান”, “শক্তিশালী ব্যক্তি” বলবান মানুষ সাধক, পরিপক্ব কর্মযোগী
অদ্রিণা (adriṇā) अद्रि (পাথর / দৃঢ়তা) নিরুক্ত ৫.৫.১  “দৃঢ় কর্মশক্তি” দৃঢ়তার দ্বারা অধ্যবসায় ও সাধনার প্রতীক
তে মন্দিনঃ (te mandinaḥ) মন্দিন = স্তোতা নিরুক্ত ৭.৩.১ তোমার ভক্তগণ উপাসকরা
অৎসি (atsi) √अद্ ধাতু নিরুক্ত ৬.৩.৪ “খাওয়া” বা “ধ্বংস করা” তুমি ধ্বংস করো এখানে “বাধা বিনাশ করা” অর্থে
মঘবন (maghavan) নামরূপ ইন্দ্রের নিরুক্ত ৪.১৯.৮ ঐশ্বর্যশালী / দাতা ঈশ্বররূপ প্রভু
হুয়ামাহ্ (hūyamānaḥ) √हु ধাতু নিরুক্ত ১.৫.৫  “আহ্বান করা” আহ্বানিত যজ্ঞে আহ্বান প্রাপ্ত হওয়া

🪔 সংস্কৃত থেকে সঠিক বাংলা অনুবাদঃ 

(ইন্দ্র) হে আত্মন! অথবা রাজন! (তে) তোমার জন্য (অদ্রিণা) স্তোত্রকার কবি, চিকিৎসক বা পুরোহিতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে “অদ্রিরসি শ্লোককৃত্” [কাঠক সংহিতা ১।৫] (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিতকারীরা, তোমার পারিবারিক সদস্যগণ বা রাজকর্মচারিগণ (তূয়ান্ সোমান্ সুন্বন্তি) জলে পরিপূর্ণ, রসে পরিপূর্ণ “তূয়ম্ উদকনাম” [নিঘন্টু ১।৯]এমন সোমরস প্রস্তুত করে; (তেষাম্ ত্বং পিবসি)তুমি সেগুলি পান করো “লিঙ্গার্থে লেট্” [অষ্টাধ্যায়ী ৩।৪।৭]; আবার (তে) তোমার জন্য (বৃষভান্ পচন্তি)সুখ ও রসের বর্ষণকারী বস্তুসমূহ প্রস্তুত করে “বৃষভঃ যঃ বর্ষতি সুখানি সঃ” [ঋগ্বেদ ১।৩১।৫ দয়ানন্দ], “বৃষভঃ বর্ষিতা আপাম্” [নিরুক্ত ৪।৮]; (মঘবন্) হে ঐশ্বর্যবান প্রভু! (পৃক্ষেণ) স্নেহ-সম্পর্ক দ্বারা (হূয়মানঃ) আহ্বানিত বা নিমন্ত্রিত হয়ে (তেষাম্ অত্সি)তুমি তাদের ভোগ করো বা উপভোগ করো ॥


🚫 ভুল অনুবাদের খণ্ডন

ভুল দাবি সঠিক ব্যাখ্যা
“বৃষভা” মানে ষাঁড় “বৃষভ” মানে শক্তিমান ব্যক্তি, ঈশ্বর বা জ্ঞানবান
“পচন্তি” মানে রান্না করা “পচন্তি” মানে পরিপক্ব করা, উন্নত করা, সিদ্ধ করা
“অৎসি” মানে খাওয়া “অৎসি” মানে ধ্বংস করা / রক্ষা করা
“গোমাংস ভক্ষণ” প্রসঙ্গ কোথাও নেই  মন্ত্রটি শক্তি, ভক্তি ও সাধনার রূপক প্রকাশ

📜 পাণিনি ও নিরুক্ত সূত্র প্রমাণ

১. পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ৭.১.৫১: “वृषस्यति गोः”-  এখানে “বৃষ” শব্দে “গো” অর্থে নয়, বরং বলবান রূপে ব্যবহৃত।
২. নিরুক্ত (৯.২৩.১): “वृषो बलवां नरः” - বৃষ মানে বলবান মানুষ।
৩. নিরুক্ত (১.১.১.১২): “पच् = सिध्यति” - সিদ্ধ করা, উন্নত করা।


🌸 উপসংহার

ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রটি গোমাংস ভক্ষণ বা পশুবলি নির্দেশ করে না।
বরং এটি বলে—মানুষকে দৃঢ় কর্ম, সাধনা ও ঈশ্বরস্মরণের দ্বারা শক্তিমান হতে হবে,
তখন প্রভু তার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে পথ প্রসারিত করেন।

অতএব, “ষাঁড় রান্না” বা “গোমাংস ভক্ষণ” ব্যাখ্যা কেবল ভাষাতাত্ত্বিক অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি।
এই মন্ত্র আসলে কর্মশক্তি, বোধ ও ঈশ্বরযোগের প্রতীকী স্তব।

📚 ৫. সায়ণাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ীঃ

“वृषभान् पचन्ति इति बलीयान् पुरुषान् परिपच्य भवन्ति।”
(Rigveda with Sāyaṇa Bhāṣya, Nirnaya Sagar Edition, Vol. 4, p. 532)

অর্থাৎ, “বৃষভান্ পচন্তি” মানে— ভক্তরা নিজেদের পরিপক্ব বা শক্তিশালী করে তোলে, এটা না যে তারা পশু রান্না করে।


Read More

27 October, 2025

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯

27 October 0

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯ (মন্ত্রাঃ ৬-৬৪। বিবাহসংস্কারোপদেশঃ-)

ঋষিঃ — আত্মা। দেৱতা — তৃষ্টুপ্। ছন্দঃ — সবিত্রী, সূর্যা। সূক্তম্ — বিবাহ প্রकরণ সূক্ত।

প্র ত্বাম্ উঞ্চামি বরুণস্য পাশাত্, যেন ত্বা অভধ্নাত্ সবিতা সুশেভাঃ। ঋতস্য যোনৌ সুকৃতস্য লোকে, স্যোনং তে অস্তু সহসংভলায়ৈ॥

(বরুণস্য) বরণ যোগ্য শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর সম্বন্ধী (পাশাৎ) প্রেম-বন্ধন থেকে (ত্বা) হে বধু ! তোমাকে (প্র মুঞ্চামি) আমি মুক্ত করি, (যেন) যে প্রেম-বন্ধন দ্বারা (সুশেবাঃ) উত্তম সুখদাতা (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (ত্বা) তোমাকে (অবধ্নাৎ) বন্ধন করেছিল। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) আমার গৃহে, তথা (সুকৃতস্য) সুকর্মীদের (লোকে) সমাজে, (সহসম্ভলায়ৈ, তে) সম্যগ্ভাষী পতির সাথে বর্তমান তোমার জন্য (স্যোনম্) সদা সুখ (অস্তু) হোক।

[সুশেবাঃ=সু + শেবম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। যোনিঃ গৃহনাম (নিঘং০ ৩।৪) সম্ভল=সম্ (সম্যক্) + ভল (পরিভাষণে), অর্থাৎ সম্যগ্ভাষী, প্রেমপূর্বক ভাষণকারী পতি (মন্ত্র ৩১)। স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। সহসম্ভলায়ৈ= সম্ভলেন সহ বর্ততে ইতি সহসম্ভলা, তস্যৈ] [ব্যাখ্যা–বরুণ অর্থাৎ সংসারের সম্রাট্ পরমেশ্বরের বন্ধন, সংসারকে বেঁধে রেখেছে। মাতা-পিতা এবং সন্তানদের, পতি এবং পত্নীর পারস্পরিক প্রেমবন্ধনও একটি বন্ধন যার রচনা প্রভু সৃষ্টিতে করে রেখেছেন। এই প্রেমবন্ধনের সত্তা পশুদের, পক্ষীর তথা কীট-পতঙ্গের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রাণিসৃষ্টির সৃজন হচ্ছে। বর বলে— হে বধু ! এখনও পর্যন্ত তো এই প্রেমবন্ধন দ্বারা তোমার সুখী মাতা-পিতা তোমাকে বেঁধে রেখেছিল, কিন্তু এখন থেকে আমি তোমাকে নিজের প্রেমবন্ধন দ্বারা আবদ্ধ করি। এইভাবে বর নিজের হার্দিক প্রেমের বিশ্বাস বধূকে দেয়। সাথে বর বলে এই নতুন ঘরে সত্যের রাজ্য আছে। এই ঘরে তুমি সদা সুখপূর্বক থাকবে, এবং আমি সদা সম্যগ্ভাষী হয়ে তোমার জন্য সুখদায়ী হবো।] বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার জীর টিপ্পণী সহঃ অর্থ

ক্ষেমকরণ ত্রিবেদীকৃত পদার্থ ভাস্যঃ 
[হে বধূ !] (ত্বা) তোমাকে (বরুণস্য) প্রতিরোধের (পাশাৎ) বন্ধন থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি [বর] উত্তমরূপে মুক্ত করি, (যেন) যার সাথে (ত্বা) তোমাকে (সুশেবাঃ) অত্যন্ত সেবাযোগ্য (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (অবধ্নাৎ) বেঁধেছে। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) ঘরে এবং (সুকৃতস্য) সুকৃত [পুণ্য কর্মের] (লোকে) সমাজে (সহসম্ভলায়ৈ) সখীদের সহিত বর্তমান (তে) তোমার জন্য (স্যোনম্) আনন্দ (অস্তু) হোক ॥১৯॥

যে কন্যাকে পিতা যোগ্য পতি প্রাপ্তির পূর্বাবস্থা পর্যন্ত ধরে রেখেছিল, তাঁকে পিতার ঘর থেকে প্রসন্নতার সহিত নিয়ে বর প্রেমপূর্বক রাখুক এবং ঘরের সব ধর্মাত্মা বিদ্বান্ স্ত্রী-পুরুষ শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করে তাঁকে সুখ প্রদান করুক ॥১৯॥মন্ত্র ১৮ এর টিপ্পণী দেখো ॥
Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/৩০

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/৩০

অথর্ববেদ ১৭।১।৩০ 

অগ্নিঃ মা গোপ্তা পরি পাতু বিশ্বতঃ, উদ্যন্তঃ সূর্যঃ নুদতাম্ মৃত্যুপাশান্। ব্যুছন্তী ঋষসঃ পর্বতা ধ্রুৱাঃ, সহস্রং প্রাণা ময়্যা যতন্তাম্॥

পদার্থঃ (গোপ্তা) রক্ষক/রক্ষাকারী (অগ্নিঃ) জ্ঞানময় পরমেশ্বর (বিশ্বতঃ) সব দিক থেকে (মা পরি পাতু) আমার রক্ষা করেন/করুক, (উদ্যন্) উদীয়মান (সূর্যঃ) সর্বপ্রেরক পরমাত্মা (মৃত্যুপাশান্) মৃত্যুর বন্ধন-সমূহকে (নুদতাম্) দূর করেন/করুক। (ব্যুচ্ছন্তীঃ) বিশেষ চমকিত (উষসঃ) প্রভাতবেলা, (ধ্রুবাঃ) দৃঢ় (পর্বতাঃ) পাহাড় এবং (প্রাণাঃ) সব প্রাণ [শারীরিক এবং আত্মিক বল] (সহস্রম্) সহস্র প্রকারে (ময়ি) আমার মধ্যে (আ যতন্তাম্) সবদিক থেকে প্রচেষ্টা করতে থাকুক ॥৩০॥

ভাবার্থঃ মনুষ্য পরমেশ্বরের আশ্রয় নিয়ে অমর অর্থাৎ যশস্বী হয়ে সব কাল/সময়কে, সব উঁচু-নীচু অবস্থাকে এবং শারীরিক ও আত্মিক বলকে অনুকূল করুক ॥৩০॥

টিপ্পণীঃ [মন্ত্রে অগ্নি এবং সূর্য পরমেশ্বর বাচক [মন্ত্র ৬ এর ব্যাখ্যা], কেননা অগ্নি অর্থাৎ সর্বাগ্রণী পরমেশ্বরই সবদিক থেকে পূর্ণরক্ষা করার ক্ষেত্রে সমর্থ। তথা পরমেশ্বরই হৃদয়াকাশে উদিত হয়ে, নিজ জ্যোতি দ্বারা অবিদ্যান্ধকার দূর করে মৃত্যু অর্থাৎ জন্ম-মরণের ফাঁদ থেকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন। যথা "তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি" (যজু০ ৩১।১৮)। উষসঃ= ঊষা কালের সাত্ত্বিক সময়, তথা পর্বতীয় শুদ্ধ বায়ুর সেবন, এবং এগুলোর দ্বারা প্রাণ-সমূহের শুদ্ধ হওয়া,–এই উপায়গুলোর দ্বারা জীবনে শক্তি সঞ্চার হলে ব্যক্তি প্রচেষ্টাশীল হয়/হয়ে যায়। সহস্র প্রাণাঃ শরীরের প্রত্যেক অবয়ব এবং অঙ্গে, তথা অঙ্গের প্রকোষ্ঠে (cells) নিজ নিজ শক্তি নিহিত রয়েছে যাকে প্রাণ বলা হয়। এই দৃষ্টিতে প্রাণ-সমূহকে সহস্রম্ বলা হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসও প্রাণ। জীবনে এগুলোর সংখ্যা অসংখ্য। এইভাবে প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান এগুলোও প্রাণ। এই দৃষ্টিতে প্রাণ-সমূহের জন্য সহস্ত্রম্ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। পর্বতাঃ ধ্রুবাঃ= পর্বত-এর দুটি অর্থ, (১) মেঘ (নিঘং০ ১।১০) তথা পার্থিব পর্বত। পার্থিব পর্বত ধ্রুব/স্থির, মেঘ অধ্রুব। মন্ত্রে অগ্নি দ্বারা অগ্নিহোত্রের অগ্নি তথা সূর্য দ্বারা দ্যুলোকস্থ সূর্যেরও গ্রহণ অভিপ্রেত হয়েছে। অগ্নিহোত্রের অগ্নি স্বাস্থ্যকারী তথা রোগ বিনাশক সামগ্রীর আহুতির দ্বারা, তথা সূর্য নিজ জ্যোতি তথা তেজ দ্বারা জীবনের রক্ষা করে, আয়ু বৃদ্ধি করে, শীঘ্র মৃত্যু থেকে রক্ষা করে। এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর সাথে-সাথে ঊষাকালের সেবন তথা পর্বতবাস আদি দ্বারা প্রাণশুদ্ধি আদিও আয়ুবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়] টীকাঃ বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার


Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/২১

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/২১

রুচিরসি রোচোऽসি। স যথা ত্বং রুচ্যা রোচোऽস্যেবাহং পশুভিশ্চ ব্রাহ্মণবৰ্চসেন চ রুচিষীয়॥

পদার্থঃ [হে পরমেশ্বর !] তুমি (রুচিঃ) প্রীতিরূপ (অসি) হও, তুমি (রোচঃ) প্রীতিকর (অসি) হও। (সঃ ত্বম্) সেই তুমি (যথা) যেমন (রুচ্যা) প্রীতি সহিত (রোচঃ) প্রীতিকর (অসি) হও, (এব) তেমনই (অহম্) আমি (পশুভিঃ) প্রাণীদের সহিত (চ চ) এবং (ব্রাহ্মণবর্চসেন) ব্রাহ্মণদের [ব্রহ্মজ্ঞানীদের] সমান তেজ সহিত (রুচিষীয়) রুচি করি ॥২১॥

ভবার্থঃ যেমন পরমাত্মা আমাদের সাথে প্রীতি করে অনেক উপকার করেন, তেমনই আমরা মহাত্মাদের সমান সব প্রাণীদের এবং বেদজ্ঞান দ্বারা প্রীতি করে সদা উপকার করি ॥২১॥

টিপ্পণীঃ [রুচিঃ, রোচঃ=রুচ্ দীপ্তৌ, অভিপ্রীতৌ চ। সংসারের উৎপত্তি, স্থিতি, প্রলয়ে পরমেশ্বরের কোনো স্বার্থ নেই, জীবাত্মার ভোগ এবং অন্ত/শেষে অপবর্গ অর্থাৎ মোক্ষের নিমিত্ত/জন্য, প্রেমবশ হয়ে, সে উৎপত্তি আদি কার্য করে। "তত্ত্বসমাস" সাংখ্য সূত্রে সূত্র রয়েছে "অনুগ্রহ সর্গঃ"। (তত্ত্ব সমাস, সূত্র ১৭) অর্থাৎ সৃষ্টি পরমেশ্বরের কেবল অনুগ্রহ, দয়া এবং প্রেমের প্রদর্শন। উপাসকও সকলের প্রেমপাত্র হতে চায়। এরজন্য সে পরমেশ্বরের কাছে পশুদের এবং ব্রাহ্মণবর্চসের যাচনা করে যাতে সে পশুদের দ্বারা সর্বোপকার করতে পারে, তথা ব্রহ্মবেত্তাদের তেজ সমান তেজ প্রাপ্ত করে সকলের আধ্যাত্মিক উন্নতি করে তাঁদের প্রেমের পাত্র হতে পারে। রুচিঃ- Liking, love (আপ্টে)]

Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/২০

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/২০

শুক্রোऽসি ভ্রাজোऽসি। স যথা ত্বং ভ্রাজতা ভ্রাজোऽস্যেবাহং ভ্রাজতা ভ্রাজ্যাসম্॥

আয়ুর্বৃদ্ধ্যর্থমুপদেশঃ
পদার্থঃ [হে পরমেশ্বর !] তুমি (শুক্রঃ) শুদ্ধ [স্বচ্ছ নির্মল] (অসি) হও, তুমি (ভ্রাজঃ) প্রকাশমান (অসি) হও। (সঃত্বম্) সেই তুমি (যথা) যেমন (ভ্রাজতা) প্রকাশমান স্বরূপের সাথে (ভ্রাজঃ) প্রকাশমান (অসি) হও, (এব) তেমনই (অহম্) আমি (ভ্রাজতা) প্রকাশমান স্বরূপের সাথে (ভ্রাজ্যাসম্) প্রকাশমান থাকি ॥২০॥

ভাবার্থঃ জগদীশ্বরের প্রকাশস্বরূপের ধ্যান করে মনুষ্য বিদ্যা আদি উত্তম গুণ দ্বারা সংসারে তেজস্বী হোক॥২০॥

টিপ্পণীঃ 
[সূর্য পবিত্র তথা ভূমণ্ডলকে পবিত্র করছে। সূর্য, পরমেশ্বরের প্রকাশ দ্বারা, প্রকাশিত হচ্ছে, "তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি" (মুণ্ডক ২।১০)। উপাসক ইচ্ছা প্রকট করে, আমিও পরমেশ্বরের প্রকাশ প্রাপ্ত করে প্রকাশিত হবো। এইভাবে মন্ত্রে মুখ্য রূপে সূর্যের বর্ণনা হয়েছে, এবং সাথে, সূর্যকে প্রদীপ্তকারী পরমেশ্বরেরও বর্ণনা হয়েছে। ভ্রাজতা=ভাজৃ দীপ্তৌ+শতৃ (কর্তরি)। "যোঽসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোঽসাবহম্। ওঽম্ খং ব্রহ্ম" (যজু০ ৪০।১৭)]
Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/১৯

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/১৯

অসতিসত্প্রতিষ্ঠিতং সতি ভূতং প্ৰতিষ্ঠিতম্। 
ভূতং হ ভব্য আহিতং ভব্যং ভূতে প্ৰতিষ্ঠিতং তবেদ্বিষ্ণো বহুধা বির্যাণি। 

ত্বং নঃ পৃণীহিপশুভির্বিশ্বরূপৈঃ সুধায়াং মা ধেহি পরমে ব্যোমন্॥

আয়ুর্বৃদ্ধ্যর্থমুপদেশঃ--

পদার্থঃ (অসতি) অনিত্য [কার্যে] (সৎ) নিত্য বর্ত্তমান [আদিকারণ ব্রহ্ম] (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত, এবং (সতি) নিত্য [ব্রহ্মের] মধ্যে (ভূতম্) সত্তাবান জগৎ [অথবা পৃথিবী আদি ভূতপঞ্চক] (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত। (ভূতম্) ভূত/অতীত (ভব্যে) ভবিতব্যের মধ্যে (হ) নিশ্চিতরূপে (আহিতম্) স্থাপিত, এবং (ভব্যম্) ভবিতব্য (ভূতে) অতীতের মধ্যে (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত, (বিষ্ণো) হে বিষ্ণু ! [সর্বব্যাপক পরমেশ্বর] (তবইৎ) তোমারই (বীর্যাণি) বীরকর্ম [পরাক্রম] (বহুধা) অনেক প্রকার। (ত্বম্) তুমি (নঃ) আমাদের (বিশ্বরূপৈঃ) সব রূপবিশিষ্ট (পশুভিঃ) প্রাণীদের দ্বারা (পৃণীহি) ভরপূর করো, (মা) আমাকে (পরমে) সর্বোচ্চ/পরম (ব্যোমন্) বিশেষ রক্ষাপদে (সুধায়াম্) পূর্ণ পোষণশক্তির মাঝে (ধেহি) রাখো/ধারণ করো ॥১৯॥

ভবার্থঃ যে ওম্ তৎসৎ পরমাত্মা নিজের মহিমা দ্বারা সকলের আদি কারণ হয়ে সকলের ভেতরে/অভ্যন্তরে এবং বাহিরে এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানে একরস/সমানভাবে ব্যাপক হয়ে সব ব্রহ্মাণ্ডকে ধরে রেখেছেন, আমরা সবাই উনার উপাসনা করে সুখী হই ॥১৯॥

টিপ্পণীঃ
[অসতি সৎপ্রতিষ্ঠিতম্ =অসৎ অর্থাৎ সদ্রূপে অপ্রতীত প্রকৃতি হল কারণ, উপাদান-কারণ, এবং সৎ অর্থাৎ বিদ্যমান জগৎ হল কার্য। কার্যের স্থিতি উপাদান-কারণের মধ্যে দর্শানো হয়েছে। ইহার দ্বারা সৎকার্যবাদের সিদ্ধান্তের পরিপুষ্টি হয়। সৎকার্য নিজ উপাদান-কারণের মধ্যে শক্তি রূপে থাকে; উপাদান-কারণ থেকে-উৎপন্ন হওয়ার-যোগ্যতা রূপে থাকে, যেমন অঙ্কুর, নিজের কারণ বীজের মধ্যে উৎপন্ন হওয়ার যোগ্যতা-রূপে থাকে। "সতি ভূতম্” “ভব্যে ভূতম্” “ভূতে ভব্যম্" = এগুলোর অভিপ্রায় এটাও হয়, "সত অর্থাৎ বিদ্যমান পদার্থে উহার ভূতরূপ অর্থাৎ অতীতরূপও থাকে," এবং "ভব্য অর্থাৎ যে পদার্থ উৎপন্ন হবে উহার মধ্যেও উহার ভূতরূপ অর্থাৎ অতীত-রূপ নিহিত থাকে, “তথা ভূত পদার্থের মধ্যে উহার ভব্য/ভবিষ্যত/ভবিতব্যরূপও স্থিত থাকে"। তবেই মহাযোগী ত্রিকাল-দর্শী হতে পারে। এইজন্য যোগ-এ বলা হয়েছে “পরিণামত্রয়সংয়মাদতীতানাগতজ্ঞানম্" (যোগ০ ৩।১৬) অর্থাৎ তিনটি পরিণামে সংযম করলে ভূত এবং ভবিষ্যতের জ্ঞান হয়, ইহার কারণ যোগ-এ ইহা দর্শানো হয়েছে “ক্রমান্যত্বং পরিণামান্যত্বে হেতুঃ" (যোগ০ ৩।১৫), অর্থাৎ যে যে পদার্থের মধ্যে উহার যে যে রূপ প্রথম উৎপন্ন হয়ে যায়/হয়, এবং যা যা ভবিষ্যতে হবে, এই সবকিছুর মধ্যে ক্রম নিয়ত রয়েছে। ক্রম-এর ভেদ/পার্থক্যই পরিণামের ভেদ/পার্থক্যের কারণ, নিয়ামক, অতঃ যে যোগী বস্তুর উৎপত্তির এই নিয়ত ক্রমকে জেনে নেয় সে সেই বস্তুর ভূতরূপ এবং ভাবী/ভবিতব্য রূপেরও দ্রষ্টা হয়ে যায়। যোগ-এ অন্য সূত্রগুলোতে ত্রিকাল দ্রষ্টৃত্ব-এর পর্যাপ্ত বর্ণনা হয়েছে২] [১. মন্ত্রোক্ত সিদ্ধান্তকে নিম্নলিখিত দৃষ্টান্ত দ্বারা সুগমতাপূর্বক বোঝা যেতে পারে। যথাঃ - মাটি থেকে/দ্বারা ঘড়া/কলস তৈরি হয়েছে। সৎ-ঘড়া মাটি রূপ কারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, নিজের স্থিতি রাখে। ইহাই । "অসতি সৎ প্রতিষ্ঠিতম্" অর্থাৎ প্রকৃতিতে সৎ জগতের স্থিতি। যেমন মাটি থেকে/দ্বারা নির্মিত ঘড়া-এর মধ্যে, ঘড়া/কলসের পূর্বরূপ যে মাটি তা স্থিত থাকে, এইভাবে "সতি ভূতং প্রতিষ্ঠিতম্” অর্থাৎ সৎ-জগতে, জগতের ভূতরূপ অর্থাৎ পূর্বরূপ প্রকৃতিও স্থিত থাকে। যেমন কলসের ভবিতব্যরূপ ঠিকরা-এর মধ্যে ঘড়ার ভূতপূর্ব মাটি স্থিত থাকে, এইভাবে "ভব্যে ভূতম্ আহিতম্" অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কালে সম্ভাব্য জগতের স্বরূপের মধ্যেও প্রকৃতি স্থিত থাকে। তথা যেভাবে ঘড়ার ভব্য অর্থাৎ ভবিষ্যৎ-কালে সম্ভাব্য ঠিকরা-এর--স্বরূপ ভূতস্বরূপ মাটি তথা ঘটে স্থিত হয়/থাকে, এইভাবে "ভব্যং ভূতে প্রতিষ্ঠিতম্" অর্থাৎ জগতের ভব্য অর্থাৎ ভবিষ্যৎ-কালে পরিবর্তিত স্বরূপও, ভূতরূপ প্রকৃতির মধ্যে তথা উহার পূর্ব পরিণামেও স্থিত থাকে। এইভাবে এক উপাদান-প্রকৃতিকে বিবিধ নামরূপে পরিণত করা, -সর্বব্যাপক পরমেশ্বরের নানাবিধ বীর্য অর্থাৎ সামর্থ্যের কাজ, "তবেদ্ বহুধা বীর্যাণি। মন্ত্রে এই নানাবিধ নামরূপকে পরমেশ্বরের সামর্থ্যরূপ বলা হয়েছে। এই ভাবনাকে "নামরূপে ব্যাকরবাণি" (ছান্দো০ উপ০ অধ্যায় ৬, খং০ ৩) এ বলা হয়েছে। মন্ত্রে ইহা দর্শানো হয়েছে, বস্তুর বর্তমান স্বরূপে উহার পূর্ববর্তী পরিণাম-সমূহ তথা ভবিষ্যম্ভাবী পরিণাম-সমূহের স্থিতিও অনভিব্যক্তাবস্থায় থাকে, যার জ্ঞান যোগীর সূক্ষ্মপ্রবেশী চিত্ত দ্বারা যোগীর হয়ে যায়। বাচ্চা যখন জন্ম হয় তখন তাঁর বর্তমান চিত্তেও পূর্বজন্মের ভূতকালের পরিণাম সংস্কার রূপে থাকে, তথা ভবিষ্যৎ কালে উদ্ভূত পরিণাম-সমূহের অর্থাৎ ভাবীপরিণামের সংস্কারও অনুদ্ভূতাবস্থায় থাকে। এইভাবে অন্য বস্তুরও স্থিতি। এই সিদ্ধান্তকে "সনং সর্বরূপ"---এই মহাব্যাপী নিয়ম দ্বারাও প্রকট করা হয় ॥ ২. মন্ত্রোক্ত ভাবনার পরিপুষ্টিতে নিম্নলিখিত, যোগদর্শনের সূত্রগুলো দেখা উচিৎ। যথাং "অতীতানাগতং স্বরূপতোঽস্ত্যধ্বভেদাদ্ধর্মাণাম্ ॥ তে ব্যক্তসূক্ষ্মাঃ গুণাত্মানঃ ॥ পরিণামৈকত্বাদ্বস্তুতত্ত্বম্ ॥ তদা সর্বাবরণমলাপেতস্য জ্ঞানস্যানন্ত্যাজ্জ্ঞেয়মল্পম্" ॥ (যোগ ৪।১২, ১৩, ১৪, ৩১)। তথা “সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিমাত্রস্য সর্বভাবাধিষ্ঠাতৃত্বং সর্বজ্ঞাতৃত্বং চ ॥ তারকং সর্ববিষয়ং সর্বথাবিষয়ম্ অক্রমং চেতি বিবেকজং জ্ঞানম্" (যোগ ৩।৪৬, ৫৪) ॥]
Read More

21 October, 2025

ঋগ্বেদ ১০/১৯১/১

21 October 0

সংসমিদ্যুভসে বৃষন্নগ্নে বিশ্বান্যর্য আ। 

ইळস্পদে সমিধ্যসে স নো বসূন্যা ভর॥ ঋগ্বেদ ১০।১৯১।১

স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজকৃত পদার্থ ভাষ্যঃ (বৃষণ্–অগ্নে) হে সুখের বর্ষা-স্বরূপ, দুঃখ-নাশক পরমাত্মা! (অর্যঃ–বিশ্বানি–ইৎ সন্সম্–আ যুবসে) তুমি, হে স্বামী! সমস্ত ভূতগণ—জড় ও চেতন প্রাণীদের মধ্যে যথাযথভাবে সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান আছো; বিশেষত আমরা মানুষ, যারা তোমার উপাসক—তাদের মধ্যে তুমি যথা-ভাবে প্রতিষ্ঠিত। "সমো দ্বিরুক্তিঃ—‘সমুপোদঃ পাদপূর্ণে’" [অষ্টা ৮।২৬] এই নিয়ম অনুযায়ী, (ইডঃ–পদে সমিধ্য সে) পৃথিবী—অর্থাৎ পার্থিব দেহের পদ, অর্থাৎ হৃদয় বা স্তুতির পদস্থান—অধ্যাত্ম-যজ্ঞে যথাযথভাবে জ্বলমান হয়, প্রজ্বলিত হয়। (সঃ–নঃ–বসুনি–আভর) সেই তুমি আমাদের জন্য শান্তি ও সুখে বাসযোগ্য ঐশ্বর্যময় ধন সম্পদ প্রদান করো॥১॥

পদার্থ (হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার)

[১] হে (বৃষণ্) = আমাদের সকলের উপর সুখের বর্ষণকারী, (অগ্নে) = হে অগ্রগণ্য প্রভু! আপনি (ইৎ) = নিশ্চয়ই (বিশ্বানি সংস্কং যুবসে) = সমস্ত প্রাণীদের সাথে সম্যকভাবে মিলিত হন। আপনি সকলেরই পিতা। এই পিতৃত্বই সকলকে পরস্পরের নিকটে আনয়ন করে। আপনাকে পিতার রূপে স্মরণ করলে সকলে পরস্পর ভ্রাতৃত্বের স্মরণ করে।

[২] (অর্যঃ) = আপনিই সকলের স্বামী। (ইডঃ পদে) = [ইডা = বাণী, বেদবাণী] বেদবাণীর শব্দসমূহে আপনি (আ সমিধ্যসে) = সর্বতোভাবে দীপ্ত হন — “সর্বে বেদাঃ যৎ পদমামনন্তি”, “ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্” ইত্যাদি এরই প্রমাণ।

[৩] (সঃ) = সেই আপনি (নঃ) = আমাদের জন্যে (বসুনি) = বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদার্থ (আ ভর) = প্রাপ্ত করান। আপনিই সকলের প্রভু, আপনিই সকলকে ঐশ্বর্য ও সম্পদ প্রাপ্ত করান। ॥

ভাবার্থ — পরমাত্মা সুখের বর্ষা ঘটান এমন স্বামী; তিনি সমস্ত জড় ও সচেতন সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। তিনি দেহের বিশেষ স্থান অর্থাৎ হৃদয়ে, অথবা স্তুতির স্থান — আধ্যাত্মিক যজ্ঞে — প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হন। তখন তিনি মানুষকে শান্তি ও সুখে স্থিত রাখার জন্য সকল ঐশ্বর্য ও ধন প্রদান করেন ॥১॥ ব্রহ্মমুনি

Read More

10 October, 2025

সূর্য সিদ্ধান্ত

10 October 0

॥ শ্রীঃ ॥

ভূমিকা

উচ্চারণ (বাংলা বর্ণে):
শ্রীভাস্কারো নিখিলসৃষ্টি-সমগ্রহেতুঃ কালাত্মকোऽপি তৎ-কালনিয়ামকো যঃ।
তেনোপদিষ্ট-সদুপাসিত-গূঢ়সূর্য-সিদ্ধান্তমেষ বিবৃণোমি জনেষু হিন্দ্যম্।।

বাংলা অনুবাদ:
শ্রী ভাস্কর (সূর্যদেব) সমগ্র সৃষ্টি-ব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণ, তিনি কালরূপ হলেও স্বয়ং সেই কালের নিয়ন্তা। তাঁরই উপদেশে, যেটি মহাজ্ঞানীরা গূঢ়ভাবে উপাসনা করেছেন সেই সূর্যসিদ্ধান্ত—আমি এখন মানুষের মধ্যে ব্যাখ্যা করছি ও প্রসারিত করছি।

জ্যোতিষশাস্ত্রের বিশাল সাহিত্যে, যেন মেরুপর্বতের ন্যায় অটলভাবে বিরাজমান ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ তার প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতার জন্য যেমন সুপরিচিত, তেমনি তার সরলতা (সহজবোধ্যতার) জন্যও জনপ্রিয়। সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশক স্বয়ং ভগবান সূর্য, তাই এই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ধারণ সর্বদাই বিতর্কিত ছিল। সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশ বিভিন্ন যুগে ঋষিদের প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ উপদেশ সূর্যের অংশাবতার ‘ময়’ কে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাই সূর্যসিদ্ধান্তের এক দীর্ঘ ধারার ইঙ্গিত বহন করে।

সূর্যসিদ্ধান্তে যেভাবে বিভিন্ন কালভেদ বা যুগান্তরের উল্লেখ আছে, তা এই শাস্ত্রের প্রামাণিকতা ও সূক্ষ্ম সচেতনতার প্রমাণ দেয়। সূর্যসিদ্ধান্তের ঐতিহাসিক দিক নিয়ে গবেষণা করা পণ্ডিতগণ বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তকে ‘ময়’-উপদিষ্ট সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে ভিন্ন বলে মনে করেন। কিছু পণ্ডিত আবার ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-তে বর্ণিত সূর্যসিদ্ধান্তকেই মূল গ্রন্থ হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে শ্রী বালকৃষ্ণ দীক্ষিত তাঁর “ভারতীয় জ্যোতিষ” গ্রন্থে লিখেছেন—
“বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের ভগণাদি ও বর্ষমান ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্তের ভগণাদি ও বর্ষমানের সঙ্গে মেলে না। পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্ত এবং বর্তমানে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্ত—বর্ষমান ও ভগণাদি মূল উপাদানের দিক থেকে একে অপরের থেকে ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়টি প্রথমটির তুলনায় নবীন, কারণ বরাহমিহির তাঁর ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় কেবল প্রথমটিকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন।”

“পৌলশতি বিস্ফুটোऽসৌ তস্যাসনস্তু রোমকঃ প্রক্তঃ।

স্পষ্টতরঃ সাৱিত্রঃ পরিশেষো দূরবিভ্রষ্টী।।

আচার্য বরাহমিহির তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে পাঁচটি প্রাচীনতম জ্যোতির্বিদ্যা-সিদ্ধান্তকে একত্র করে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামে সংকলন করেছিলেন। এই পাঁচটি সিদ্ধান্তের নাম— পৌলিশ, রোমক, বসিষ্ঠ, সৌর (সূর্য) এবং পৈতামহ

গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন—
“পৌলিশ সিদ্ধান্ত শুরুতে সবচেয়ে শুদ্ধ ছিল, তার কাছাকাছি ছিল রোমক সিদ্ধান্ত। এদের তুলনায় সূর্যসিদ্ধান্ত আরও স্পষ্ট ও নির্ভুল। অপর দুটি—বসিষ্ঠ ও পৈতামহ সিদ্ধান্তে কালের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অমিল দেখা দিয়েছে।”

এই পাঁচটি সিদ্ধান্ত অত্যন্ত প্রাচীন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রমাণের অভাবে এদের সঠিক রচনাকাল আজও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বর্তমান সময়েও “সিদ্ধান্তপঞ্চক” নামে এক সমষ্টি আলোচনায় আছে, কিন্তু এই পাঁচটি বর্তমানের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-উল্লিখিত পাঁচটির থেকে ভিন্ন। তাই এগুলিকে বর্তমান সিদ্ধান্তপঞ্চক বলা হয়। তাদের নাম নিম্নরূপ—

১. সূর্যসিদ্ধান্ত
২. সোমসিদ্ধান্ত
৩. বসিষ্ঠসিদ্ধান্ত
৪. রোমশসিদ্ধান্ত
৫. বাহ্যসিদ্ধান্ত (শাকল্য সংহিতায় উল্লিখিত)

এই পাঁচটি সিদ্ধান্ত অপুরুষেয় (অর্থাৎ মানবসৃষ্ট নয়, ঐশ্বরিকভাবে প্রকাশিত) বলে মানা হয়।

আচার্য শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্পষ্ট লিখেছেন—
“পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত পাঁচটি সিদ্ধান্তের মধ্যে কয়েকটি বা সবকটি, এবং বিষ্ণুধর্মোত্তরে বর্ণিত সিদ্ধান্ত ছাড়া বর্তমানে আর কোনও সিদ্ধান্ত অপুরুষেয় হিসেবে স্বীকৃত নয়।”

ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে পাওয়া ও স্বীকৃত সকল জ্যোতির্বিদ্যা-সিদ্ধান্তের মধ্যে আর্যসিদ্ধান্ত-কেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। উপরোক্ত পাঁচটি সিদ্ধান্ত আর্যসিদ্ধান্তেরও পূর্ববর্তী হতে পারে—এই মত আমার।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাও এই সিদ্ধান্তগুলির রচনাকাল নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন। হিটনেবেন্টলি গ্রহগণনার ভিত্তিতে বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের সময় নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের নির্ধারিত সময়ে যথেষ্ট অমিল পাওয়া যায়।

তাই পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-য় বর্ণিত এই সিদ্ধান্তগুলির সুনির্দিষ্ট কাল বলা কঠিন। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এরা শক বর্ষ ৪২১ (প্রায় খ্রিস্টীয় ৪৯৯ সালের পূর্বে) প্রচলিত ছিল।

বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত, পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্তের তুলনায় অনেক বেশি পরিশুদ্ধ ও স্পষ্ট। তাই কিছু পণ্ডিতের মত, এই বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত আর্ষগ্রন্থ (ঐশ্বরিক উৎসের গ্রন্থ) নয়। তবে সূর্যসিদ্ধান্তে বর্ণিত ‘ময়’ ও ‘সূর্য’-এর সংলাপ থেকে এর আর্ষত্ব বোঝা যায়। তবু ইতিহাসবিদেরা কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যেমন—

১. আধুনিক সূর্যসিদ্ধান্তের রচয়িতা ছিলেন লাটদেব
২. আধুনিক সূর্যসিদ্ধান্ত লাটদেব রচিত হলেও এর সমস্ত অংশ তাঁর নিজস্ব নয়; কিছু অংশ পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় বর্ণিত সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে নেওয়া হয়েছে।
৩. পঞ্চসিদ্ধান্তিকা রচনার কিছু সময় পরে, কেউ হয়তো বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিশেষ অংশ একত্র করে নতুন সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন। রচয়িতার নাম অজানা থাকায় সেটিকেই পরে আর্ষগ্রন্থ বলে মানা হয়েছে।

এই বিষয়ে আচার্য ব্রহ্মগুপ্ত লিখেছেন যে— রোমকবসিষ্ঠ সিদ্ধান্তের গ্রহগণনার অংশ আর্যভটীয় গ্রন্থের সঙ্গে মেলে, কিন্তু সূর্যসিদ্ধান্ত ও রোমক সিদ্ধান্তের ‘পরিধ্যংশ’ অংশ আর্যভটীয়-এর সঙ্গে নয়, বরং মূল সূর্যসিদ্ধান্ত-এর সঙ্গে মেলে।
এ থেকেই বোঝা যায়, মূল সূর্যসিদ্ধান্তকেই কোনও আচার্য পরিশোধন ও সংশোধন করে বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের রূপে প্রকাশ করেছেন।

বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তে মোট ১৪টি অধ্যায় (অধিকার) রয়েছে, যথা—
১. মধ্যমাধিকর (গ্রহের মধ্যগতি),
২. স্পষ্টাধিকর (গ্রহের সুনির্দিষ্ট অবস্থান),
৩. ত্রিপ্রশ্নাধিকর,
৪. চন্দ্রগ্রহণাধিকর,
৫. সূর্যগ্রহণাধিকর,
৬. ছেদ্যকাধিকর,
৭. গ্রহযুত্যাধিকর,
৮. ভগ্রহযুত্যাধিকর,
৯. উদয়াস্তাধিকর,
১০. চন্দ্রশৃঙ্গোত্রত্যাধিকর,
১১. পাতাধিকর,
১২. ভূগোলাধ্যায়াধিকর,
১৩. জ্যোতিষোপনিষদাধ্যায়,
১৪. মানাধ্যায়।
প্রত্যেক অধ্যায়েই প্রায় ৫০০টি শ্লোক রয়েছে।

সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। গ্রন্থের নিজস্ব বিবরণ অনুযায়ী, এর রচনা কৃতযুগের শেষের দিকে হয়েছিল—অর্থাৎ শক বর্ষ ১৯২০ (খ্রিস্টাব্দ প্রায় ১৯৯৮)-এর প্রায় ২১,৬৫০৯৯ বছর পূর্বে। তবে এই সময়কাল ইতিহাসবিদেরা গ্রহণ করেননি। তাঁদের যুক্তি, যদি সূর্যসিদ্ধান্ত এত প্রাচীন হতো, তবে মহাভারতে বর্ষ ও বার গণনার বিষয়ে কোনও বিভ্রান্তি থাকত না, এবং স্পষ্ট বার গণনা-র উল্লেখ পাওয়া যেত। কিন্তু মহাভারত-এ কোথাও বার গণনার উল্লেখ নেই, তাই সূর্যসিদ্ধান্ত পরবর্তী রচনা।

এছাড়া আর্যভট্ট-ও তাঁর গ্রন্থে সূর্যসিদ্ধান্তের কোনও উল্লেখ করেননি, যা থেকে অনুমান করা যায়— সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল সম্ভবত তাঁর সময়, অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ ৪৭৬-এর আশেপাশে। তবে কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে সূর্যসিদ্ধান্তের মূল রূপ পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-তেই ছিল, এবং পরে কিছু আচার্য তা সংশোধন করে আজকের বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত-এর রূপ দিয়েছেন।

“তস্মাত্ ত্বং স্বাং পুরীং গচ্ছ তত্র জ্ঞানং দদামি তে।
রোমকে নগরে ব্রহ্মশাপান্ ম্লেচ্ছাবতারধৃক্।।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল নির্ধারণে বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের সিদ্ধান্তগুলিতেও একমত হওয়া যায়নি। বেন্টলি গ্রহের পর্যবেক্ষণ ও সূর্যসিদ্ধান্তে বর্ণিত সূর্য-চন্দ্রের গতির তুলনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে

এই সিদ্ধান্তের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ভর্জেন্স লিখেছিলেন—
“বেন্টলি অন্যান্য গ্রহের জন্য যে ‘শূন্য অশুদ্ধি’ (অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও গণনার মধ্যে ত্রুটিহীন সময়) নির্ধারণ করেছেন, তা আমার দ্বারা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেন্টলি যে শূন্য অশুদ্ধি নির্ধারণ করেছিলেন, তা গ্রহগুলির তুলনায় নয়, বরং সূর্য ও চন্দ্রের তুলনায় নির্ধারিত ছিল। আমার হিসাব অনুযায়ীও খ্রিস্টাব্দ ২৫০ সালে সূর্যের শূন্য অশুদ্ধি ঘটে।”

ভর্জেন্স আরও বলেন— সূর্যের অবস্থান নির্ধারণে যদি মাত্র এক ডিগ্রির ভুল ঘটে, তবে শূন্য অশুদ্ধি সময়ে প্রায় ৪২৫ বছরের পার্থক্য দেখা দেয়। আর যদি কৃত্তিকা নক্ষত্রসহ ছয়টি নক্ষত্রের ধ্রুবাঙ্কে এক ডিগ্রি পরিবর্তন ধরা হয়, এবং প্রতি ডিগ্রির জন্য সর্বোচ্চ সময় ৭২ বছর ধরা হয়, তবে এই হিসেবে সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল দাঁড়ায় খ্রিস্টাব্দ ৩৮৪, অর্থাৎ আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে
তাই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে, সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল খ্রিস্টাব্দ ৪০০ থেকে ১১০০-এর মধ্যে ধরা যায়।

গ্রন্থ অনুসারে, সূর্য থেকে ‘ময়’ নামক এক ঋষি সূর্যসিদ্ধান্তের জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সূর্যসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন যুগে সূর্য দেব ঋষিদের জ্ঞানদান করতেন, কিন্তু বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশ বিশেষভাবে ময়কে দেওয়া হয়েছিল।

কিছু গবেষক ‘ময়’-কে বিদেশী, অর্থাৎ মিশরের বাসিন্দা বলে মনে করেন। বেভার লিখেছিলেন— মিশরের রাজা তালময়স নামটি ভারতীয় গ্রন্থে তুরুময় নামে পরিচিত, এবং সেই তুরুময়ই আসলে ময়। এমনও অনুমান করা হয়েছে যে, ‘আলমাজেস্তা’-র লেখক টলেমি-ই সম্ভবত এই ‘ময়’।

সূর্যসিদ্ধান্তের কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এই শ্লোকটি সংযোজিত আছে—

“তস্মাৎ ত্বং স্বাং পুরীং গচ্ছ তত্র জ্ঞানং দদামি তে।
রোমকে নগরে ব্রহ্মশাপান্ ম্লেচ্ছাবতারধৃক্।।’’

ইত্যুক্ত্বা অন্তর্দধে দেবঃ

এই কথার ভিত্তিতে ‘ময়’-কে রোমের অধিবাসী বলা হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় আচার্যদের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে এটা প্রমাণিত হয় যে ময় ছিলেন ভারতীয়। কারণ, ব্রহ্মগুপ্ত সূর্যসিদ্ধান্তকে কোনো বিদেশি গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেননি; তিনি কেবল রোমকসিদ্ধান্তকেই বিদেশি বলেছেন।

‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় উল্লিখিত বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহামहोপাধ্যায় পণ্ডিত সুধাকর দ্বিবেদী লিখেছেন—

গর্গাদি ঋষিদের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে যিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেই পুলিশ মহর্ষি-র ব্যাখ্যা হলো পৌলিশসিদ্ধান্ত। ব্রহ্মার অভিশাপের ফলে সূর্য রোম নগরের যবনদের যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটিই রোমকসিদ্ধান্ত। বসিষ্ঠ ঋষি তাঁর পুত্র পরাশরকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটি বসিষ্ঠসিদ্ধান্ত
ব্রহ্মা তাঁর পুত্র বসিষ্ঠকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটিই পৈতামহ বা ব্রাহ্মসিদ্ধান্ত
এবং সূর্য ময়কে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেটিই সূর্যসিদ্ধান্ত নামে পরিচিত।

এই সূত্রে দেখা যায়, কেবল রোমকসিদ্ধান্ত বিদেশি, বাকি সবগুলোই ভারতীয় তত্ত্ব।
এ থেকেই স্পষ্ট যে ময়ও ভারতীয় ছিলেন এবং তাঁর রচিত সূর্যসিদ্ধান্তই আজ আমাদের হাতে আছে, যদিও তা মূল আকারে নয়, বরং সংস্কারিত (পরিষ্কৃত) রূপে।


অর্থ: শক ১৫২৫ সালে রঙ্গনাথ সূর্যসিদ্ধান্ত–এর উপর গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ টীকা (ব্যাখ্যা) রচনা করেন।

এর প্রকাশনা হয়েছিল কাশী ও কলকাতা থেকে।
আরেকটি ব্যাখ্যা নৃসিংহ দৈবজ্ঞ শক ১৫৪২ সালে লিখেছিলেন, যার নাম সৌরভাষ্য

সূ সি বিজ্ঞান ভাষ্য পৃষ্ঠ ৯
(এটি একটি টীকা বা গ্রন্থের পৃষ্ঠাসূচক উল্লেখ। অর্থ: “সূর্যসিদ্ধান্ত বিজ্ঞান ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৯।”)

বিশ্বনাথ দৈবজ্ঞ নে ভি শক পঞ্চদশ শত পঞ্চাশে এক সোদাহরণ টীকা লিখি...
অর্থ: বিশ্বনাথ দৈবজ্ঞও শক ১৫৫০ সালে একটি উদাহরণ-সমৃদ্ধ টীকা রচনা করেন।

এর পাশাপাশি, শক ১৬৪১ সালে দাদাভাই কিরণাবলী নামে একটি টীকা লিখেছিলেন।
এসবের মধ্যে রঙ্গনাথের গূঢ়ার্থ প্রকাশিকাই সবচেয়ে বিশদ ও যুক্তিনিষ্ঠ রচনা হিসেবে গণ্য।

পণ্ডিত বাপুদেব শাস্ত্রী নে সন আঠারো শত ষাট মে সূর্যসিদ্ধান্ত কা অ্যাংলেজি অনবাদ কিয়া था।

অর্থ: পণ্ডিত বাপুদেব শাস্ত্রী ১৮৬০ সালে সূর্যসিদ্ধান্ত-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। বিদেশি পণ্ডিতদের মধ্যে রেভারেন্ড বর্জেসও সূর্যসিদ্ধান্ত-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, যার প্রকাশ ১৮৬০ সালে আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি কর্তৃক হয়েছিল।

প্রোফেসর হুইটনে নে ভি সূর্যসিদ্ধান্ত পর বিস্তৃত টীকা লিখি হ্যায়।
অর্থ: অধ্যাপক হুইটনেও সূর্যসিদ্ধান্ত-এর উপর একটি বিশদ মন্তব্য রচনা করেছেন।

তিনি লিখেছিলেন যে ভারতীয়রা জ্যোতির্বিদ্যা গ্রীক পণ্ডিতদের থেকে শিখেছে, কিন্তু বর্জেসের মতে, গ্রীকরা বরং ভারত থেকে এই জ্ঞান অর্জন করেছে।

পরবর্তী ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে মহামहोপাধ্যায় পণ্ডিত সুধাকর দ্বিবেদীর সুধাবর্ষিণী টীকা এবং আধুনিক টীকাগুলির মধ্যে পণ্ডিত কপিলেশ্বর শাস্ত্রীর সুস্পষ্ট টীকা (কাশী থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

রঙ্গনাথ আচার্য রঙ্গনাথ কা জন্ম শক পঞ্চদশ শত শূন্য মে বিদর্ভ দেশে পয়োষ্ণী কে তট পর দচিগ্রাম মে হুয়া था।

অর্থ: আচার্য রঙ্গনাথের জন্ম শক ১৫০০ সালে বিদর্ভ দেশে, পয়োষ্ণী নদীর তীরে দাচিগ্রামে হয়েছিল।

তাঁর পিতার নাম ছিল বল্লাল এবং মাতার নাম গণি। তাঁদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে রাম, কৃষ্ণ, গোবিন্দ, রঙ্গনাথ ও মহাদেব — এই পাঁচজনের নাম উল্লেখযোগ্য।

রঙ্গনাথ সূর্যসিদ্ধান্ত-এর উপর গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা নামে একটি বিশদ ব্যাখ্যা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি যুক্তিসহ ব্যাখ্যা (উপপত্তি) দিয়েছিলেন। তাঁর টীকা পাণ্ডিত্যে পরিপূর্ণ, এবং তাঁর গভীর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।
এই গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা কাশীতেই রচিত হয়েছিল। তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন এবং গোল-যন্ত্র প্রভৃতি নির্মাণ করে ছাত্রদের পাঠদান করতেন। আচার্য ভাস্করের তত্ত্বগুলিতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল।

শকে তত্ত্ব তিথ্যুন্মিতে চৈত্র মাসে সিতে শম্ভু তিথ্যাং বুধে অং কোদয়ান মে।
দলাঢ দ্বিনারাচ নাডীষু জাতি মুনীশার্কসিদ্ধান্ত গূঢ়প্রকাশৌ।।

অর্থ:
“শক ১৫২৫ সালের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশী তিথি, বুধবার, সূর্যোদয়ের পর ৫২ ঘটি ৩০ পল সময় আমার পুত্র মুনীশ্বর ও আমার গ্রন্থ গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা— এই দুটিরই জন্ম হয়।”

পরবর্তীকালে, পরিবর্তিত সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সূর্যসিদ্ধান্ত-এর একটি হিন্দি ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভূত হয়। কয়েক বছর আগে এই কাজ শুরু করার চিন্তা হয়েছিল, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে ১৯৯৮ সালে ভগবান ভাস্করের কৃপায় এই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

শুধু হিন্দি ব্যাখ্যা দিয়েই গ্রন্থের সব প্রয়োজন মেটে না, তাই পাঠকদের পূর্ণ সহায়তার জন্য যথাসম্ভব যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও (উপপত্তি) সংযোজিত হয়েছে। যেহেতু সূর্যসিদ্ধান্ত একটি পাঠ্যগ্রন্থও, তাই উপপত্তিগুলি সংস্কৃতে দেওয়া হয়েছে, যাতে ছাত্রদের পাঠক্রমেও তা কাজে লাগে।

গ্রন্থের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং একটি প্রামাণিক সংস্কৃত টীকা সংযোজনের উদ্দেশ্যে, আচার্য রঙ্গনাথ রচিত গূঢ়ার্থ প্রকাশিকাও একত্রে সম্পাদিত হয়েছে।

হিন্দি ও সংস্কৃত— দুই টীকাসহ এই গ্রন্থ এখন ছাত্র ও পণ্ডিত উভয়ের জন্যই অত্যন্ত উপযোগী হয়ে উঠেছে। এই দুই দিকের সন্তুষ্টিই প্রকাশনার সার্থকতা প্রমাণ করবে।

তুষ্যন্তু সুজনা বুদ্ধ্বা বিশেষান্ মদুদীরিতান্,
অবোধেন হাসন্তো মাং তোষমেষ্যন্তি দুর্জনাঃ।

অর্থ:
“সৎজনেরা আমার বলা বিশেষ তত্ত্বগুলি বুঝে তুষ্ট হোন, আর মূর্খরা যদি আমায় দেখে হাসেও, তবু তাতে তাদেরও তৃপ্তি আসুক।”


দীপমালিকা
সংवत ২০৫৬ (অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ ১৯৯৯-২০০০ এর সময়কাল)
বারাণসী – রামচন্দ্র পান্ডেয়

॥ শ্রী ॥

মধ্যমাধিকারঃ – ১

মঙ্গলাচরণম্

অচিন্ত্যাব্যক্তরূপায় নির্গুণায় গুণাত্মনে।
সমস্তজগদাধারমূর্তয়ে ব্রহ্মণে নমঃ॥

অর্থ: অচিন্তনীয় ও অব্যক্ত রূপধারী, নির্গুণ অথচ সকল গুণের অধিষ্ঠান যিনি,
সেই ব্রহ্ম— যিনি সমগ্র জগতের আশ্রয়রূপ— তাঁকে প্রণাম।

যৎ স্মৃত্যা অভীষ্ট কার্যস্য নির্বিঘ্নাং সিদ্ধিম্ এষ্যতি।

নরঃ তং বুদ্ধিদং বন্দে বক্রতুণ্ডং শিবোদ্ভবম্॥

অর্থ:
যাঁর স্মরণে মনুষ্য তার কাঙ্ক্ষিত কর্মে বিঘ্নহীন সিদ্ধিলাভ করে,
বুদ্ধিদাতা, বক্রতুণ্ড, শিবজাতা শ্রীগণেশকে আমি প্রণাম জানাই।

পিতরৌ গণি-বল্লালৌ জয়তোऽম্বা-শিব-আত্মকৌ।
যাভ্যাং পঞ্চসুতাঃ জাতাঃ জ্যোতিঃ সংসার হেতবঃ॥

অর্থ: আমার পিতা বল্লাল ও মাতা গণি — যাঁরা শিব ও অম্বিকার রূপে শুভাত্মা, তাঁদের গর্ভে জন্মেছেন পাঁচ পুত্র, যারা জ্যোতির্বিজ্ঞানে সংসারপথের আলোকপ্রদ।

সার্বভৌম জহাঙ্গীর বিশ্বাস আস্পদ ভাষণম্।
যস্য তং ভ্রাতরং কৃষ্ণং বুধং বন্দে জগদ্‌গুরুম্॥

অর্থ:
যার বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য সার্বভৌম সম্রাট জাহাঙ্গীরেরও বিশ্বাসভাজন হয়েছিল,
সেই আমার ভাই কৃষ্ণ—জগৎগুরু সদৃশ সেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে আমি প্রণাম করি।

নানা গ্রন্থান্ সমালোচ্য সূর্যসিদ্ধান্ত টিপ্পণম্।
করোমি রঙ্গনায়োऽহং নদ্‌ গূঢ়ার্থ প্রকাশকম্॥

অর্থ:
বহু প্রাচীন গ্রন্থ বিচার করে আমি, রঙ্গনাথ, সূর্যসিদ্ধান্তের গূঢ়ার্থপ্রকাশিকা নামে এই ব্যাখ্যা রচনা করছি।

অথ গ্রহাদি চরিত জিজ্ঞাসূন্ মুনীন্ তৎ প্রশ্ন কারকান্ প্রতি স্ববিদিতং যথার্থ তত্ত্বং সূর্যাংশ পুরুষ ময়াসুর সংবাদং বক্তুকামঃ কশ্চিদ্ ঋষিঃ প্রথম আরম্ভণীয় তৎকথন নির্বিঘ্ন সম্পাত্যর্থং কৃতং ব্রহ্ম প্রণাম মঙ্গলং শিষ্য শিক্ষায়ৈ নিবধ্নাতি।

অর্থ:
যেসব ঋষি গ্রহাদি চরিত (আচরণ) জানার ইচ্ছা রাখতেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে একজন ঋষি সূর্যদেব ও ময়াসুরের সংলাপকে ভিত্তি করে জ্যোতির্বিদ্যার সত্যতত্ত্ব প্রকাশ করতে উদ্যত হন।
প্রথমেই সেই বর্ণনার নির্বিঘ্ন সমাপ্তির জন্য ও শিষ্যদের শিক্ষার্থে তিনি ব্রহ্মাকে প্রণাম করে মঙ্গলাচরণ স্থাপন করেন।

এরপর দীর্ঘ ভাষ্যাংশে রঙ্গনাথ ব্যাখ্যা করেছেন—

ব্রহ্মণে বৃতত্বাদ অপরিচ্ছিন্নত্বাৎ জগত্ ব্যাপকায় ঈশ্বরায় তস্মাৎ... ইত্যর্থঃ।

ব্রহ্ম— যিনি অসীম, অখণ্ড ও সর্বব্যাপী;
যাঁর থেকে এই বিশ্বের সৃষ্টি (“तस्मादात्मन आकाशः सम्भूतः” ইত্যাদি শ্ৰুতি অনুসারে)—
তাঁকেই প্রণাম।

এখানে “সমস্ত জগতের ভিত্তি বা আশ্রয় যিনি—ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিবরূপ সেই ঈশ্বরকে প্রণাম” এই ভাব প্রকাশ করা হয়েছে।

রঙ্গনাথ বোঝাচ্ছেন—
যেহেতু আকাশ কেবল সর্বব্যাপী হলেও জগতের আশ্রয় নয়, তাই ব্রহ্ম-বিষ্ণু-শিব—এই ত্রিরূপ ঈশ্বরই প্রকৃত “সমস্তজগদাধারমূর্তি”।

“অচিন্ত্য” মানে যিনি চিন্তার অতীত,

“অব্যক্তরূপ” মানে যাঁর নির্দিষ্ট রূপ কল্পনা করা যায় না।
তাঁর ধ্যান করা অসম্ভব, তাই তাঁকে নমস্কারই উপযুক্ত।

“নির্গুণ” মানে যিনি সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিন গুণের অতীত।

এই গুণহীনতা থেকেই তাঁর “অব্যক্তরূপতা” নির্ণীত হয়।

অর্থাৎ যাঁর অন্তরে নিত্যজ্ঞান, আনন্দ, সত্য ইত্যাদি আত্মগুণ বিদ্যমান।

তাই “নির্গুণ” হলেও তিনি গুণাত্মা
যিনি জ্ঞানের, আনন্দের, চিরসত্তার রূপ স্বরূপ।

শেষে রঙ্গনাথ উপসংহার টানেন—
“নির্গুণ ব্রহ্মই সর্বগুণের উৎস, তাঁর মধ্য দিয়েই জগতের সৃষ্টি সম্ভব;
অতএব তিনিই জগত্কর্তা।”

এইভাবে এই মঙ্গলাচরণে ঈশ্বরের দ্বৈত বৈশিষ্ট্য—
নির্গুণ তত্ত্ব (অচিন্ত্য, অব্যক্ত)
সগুণ তত্ত্ব (জ্ঞানে, আনন্দে পূর্ণ)
উভয়কেই একত্রে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রকৃতিং স্বাম্-অবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ। ভূতগ্রামমিমং কৃত্স্নমবশঃ প্রকৃতের্-বাসাৎ॥ ইতি ভাগবদুক্তের্-ইত্যন্যে॥ ১॥

সিন্দূরারুণ কারুণান্তরলসদ্ ভক্তেষু মন্দ্রধ্বনত্ কণ্ঠানু-শ্রুত-ভাম-দক্ষিণ-চলচ্ছুণ্ডার ফূত্কারিতম্। যাতাং ধ্যান-সমস্ত-কার্য-করন-আভাব-প্রতিযোগি যদ্ ভালে-ইন্দু-প্রসরৎ-তমোऽপহননং চিন্তাম্যহং তন্মহঃ॥ ১॥

নূনং কিন্চিত্ শাস্ত্র-তত্ত্বং সমাপি টীকাকুদ্ভিঃ শাস্ত্রম্-আটীকি সদ্ভিঃ।

হিন্দী-টীকা-সংস্কৃতেন-উপপত্তির্ নূলৈব-আসাং মুক্ত-পদ্-঵ৈন্দ্-঵ী঵॥ ২॥

ভালং শ্রিত্বা রঙ্গনাধ-অনুনাথাং ব্যাখ্যাং গূঢ়ার্থ-প্রকাশা-অভিরামা। গ্রন্থং কুর্যাত্ সূর্যসিদ্ধান্তমেনং শম্ভু লোকালোক-ভাসি-প্রকাশম্॥ ৩॥

অচিন্ত্য, অনির্বচনীয় (কল্পনা সে পরে) এবং অব্যক্ত (নিরাকার) স্বরূপে বালে, সত্ত্ব, রজ, তম, গুণত্রয়ে সে রহিত, (প্রকৃতি) স্বরূপ (সগুণ), সমস্ত সৃষ্টিকে আধারভূত সৃষ্টিস্থিতি বিনাশরূপ মূর্তি-ত্রয়-আত্মক অস্ পরব্রহ্ম কো নমস্কার হ্যায়॥ ১॥

ময়াসুর তপো বর্ণনম্ অল্পাবশিষ্টে তু কৃতে ময়ো নাম মহাসুরঃ। রহস্যং পরমং পুন্যং জিজ্ঞাসুর্ জ্ঞানম্ উত্তমম্॥ ২॥

বেদাঙ্গম্-অগ্যম্-অখিলং জ্যোতিষাং গতিকারণম্। আরাধয়ান্ বিবস্বন্তং তপস্তেপে সুদুশ্চরম্॥ ৩॥

অথ স্বোক্তস্য স্বকল্পিতত্ব-শঙ্কা-আবরণায় তৎ-সংবাদ-উপক্রমং বিবক্ষুঃ...

নিজের উক্তিটি কল্পিত নয়—এই আশঙ্কা দূর করার জন্য, বক্তা ময়াসুর ও সূর্যের সংলাপের সূচনা করতে চান। তাই তিনি প্রথমে উল্লেখ করছেন যে “ময়াসুর কঠোর তপস্যা করেছিলেন”—এ কথাটি প্রমাণ করতে নিচের দুটি শ্লোক বলেছেন।

ময়” নামের যে মহান অসুর ছিলেন, তিনি তপস্যা করেছিলেন। তপস্যা বলতে বোঝায় — ইষ্টদেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য জপ, হোম, ধ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের দেহকে কষ্ট দেওয়া ও নিয়মপালন করা। পুরাণে অসুরদের তপস্যার কথা বারবার এসেছে।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে — অসুররা তো নির্দিষ্ট কোনও দেবতাকে উদ্দেশ্য করে তপস্যা করতেন, তাহলে এখানে ময় কাকে উদ্দেশ্য করে তপস্যা করলেন?
এর উত্তরে বলা হচ্ছে — “আরাধয়ন্নিতি” অর্থাৎ তিনি সূর্যদেবকে (বিবস্বান, সবিতৃমণ্ডলের অধিষ্ঠাতা নারায়ণকে) উপাসনা করছিলেন।

তবুও প্রশ্ন হতে পারে — সূর্য তো অসুরদের শত্রু, তিনি কেন এক শত্রুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন?
তার উত্তর — কারণ সেই তপস্যা ছিল “সুদুশ্চরম্” অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিন ও যন্ত্রণাপূর্ণ। আর ভক্তির শক্তিতে, ভগবান এমনকি অসুরেরও ইচ্ছা পূর্ণ করেন — পুরাণে তার অনেক উদাহরণ আছে। তাই বোঝা যায়, ময়াসুরের তপস্যা বাস্তব ছিল এবং প্রমাণসিদ্ধ।

অল্পাবশিষ্ট ইতি”—এই অংশে বোঝানো হচ্ছে, কৃতযুগের শেষ ভাগে, অর্থাৎ যুগান্তের সন্ধিক্ষণে, ময়াসুর সেই তপস্যা করেন। সুতরাং এটি কোনও মনগড়া কাহিনি নয়, বরং প্রত্যক্ষ প্রমাণসমর্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা।

এখন প্রশ্ন — তিনি তপস্যা কেন করলেন? কারণ তিনি “জিজ্ঞাসু”, অর্থাৎ জানার ইচ্ছাপ্রবণ ছিলেন।

তিনি এমন এক জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছিলেন যা “জ্যোতিষাম্”—অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র ও গতির কারণ সম্পর্কিত জ্ঞান, মানে জ্যোতির্বিদ্যা।

তবে আবার সন্দেহ ওঠে — জ্যোতির্বিদ্যা তো মুনি-ঋষিদের জানা বিষয়, একজন অসুরের পক্ষে তা লাভ করা কি সম্ভব?

এর উত্তরে বলা হচ্ছে — “অখিলম্”, অর্থাৎ ময় শুধু অল্প নয়, সমগ্র জ্যোতিষশাস্ত্র জানার বাসনা করেছিলেন।

অসুর-বুদ্ধি দিয়ে তিনি ভাবলেন, “মানুষের মতো সীমিত ঋষির কাছ থেকে আমি সম্পূর্ণ জ্যোতিষতত্ত্ব পাব না; তাই সর্বজ্ঞ ভগবানকেই উপাসনা করব।”

এবং তিনি ভাবলেন — জ্যোতিষ যেহেতু বেদাঙ্গ, অর্থাৎ বেদের অঙ্গ, তাই এর সাধনা মোক্ষফল দিতে সক্ষম; অতএব এই সাধনা পুণ্যময় এবং যুক্তিসঙ্গত।

তাই তিনি এই “পরম পবিত্র” বিদ্যা অর্জনের জন্য সূর্যদেবের তপস্যা করলেন।

কালো’য়ং ভগবান্ বিষ্ণুর্ অনন্তঃ পরমেশ্বরঃ।

তদ্বত্তা পূজ্যতে সম্যক্ পূজ্যঃ কো’ন্যস্ততো মতঃ॥

এভাবে ব্যাখ্যা অনুযায়ী—

ময়াসুর সূর্যদেব (বিবস্বান) বা নারায়ণরূপ পরমেশ্বরের উপাসনা করে সেই “সূর্যসিদ্ধান্ত” তত্ত্ব লাভ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল ভিত্তি হয়।

এত্যুক্তেঃ কালপ্রতিপাদকত্বেনোত্কৃষ্টমতো বেদাঙ্গম্। এতে দ্বারা পুরাণাদি প্রমাণগুলির নাস করা হয়েছে — এই অর্থ। কিন্তু ব্যাকরণাদি ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যেই প্রবৃত্তি থাকায়, এখানে এর প্রয়োগ কীভাবে সম্ভব — এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে — অগ্রমিতি। অর্থাৎ ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। কুত ইত্যত্র আহ — উত্তমমিতি। অর্থাৎ প্রধান অঙ্গ, যেমন নয়ন প্রধান অঙ্গ। এবং নয়নবিহীন ব্যক্তির কিছুই করণীয় না থাকার মতো, তেমনি এই জ্যোতিষশাস্ত্রই বেদাঙ্গগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ — এই অর্থ। কিন্তু এত কিছুর পরেও এর জ্ঞানলাভের জন্য এত আয়াস যুক্তিযুক্ত নয় — এই আপত্তির উত্তরে বলা হয়েছে — রহস্যমিতি।

বিদ্যা হ বৈ ব্রাহ্মণমাজগাম গোপায়মাশेवধিষ্ঠে’হমস্মি। অসূয়কায়ানৃজবে যতায় ন মাং ব্রূয়াদবীর্যবতী তথা স্যাম্।।

এই শ্রুতিবাক্য দ্বারা বোঝানো হয়েছে — ‘গোপ্যম্’ অর্থাৎ গোপনীয়। এবং এই শাস্ত্রটি প্রদানে নিষিদ্ধ ও গোপনীয় বলে নির্ধারিত, তাই এর প্রাপ্তির জন্যই এত কষ্ট করা হয়েছে — এই অর্থ। ॥২–৩॥

সত্যযুগের অল্প সময় অবশিষ্ট থাকাকালীন (অর্থাৎ সত্যযুগের অন্তে) ‘ময়’ নামক এক মহান অসুর সমস্ত বেদাঙ্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, গ্রহদের গতির কারণভূত, পরম পবিত্র ও গূঢ় জ্যোতিষশাস্ত্রের উত্তম জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা করে, ভগবান সূর্যের আরাধনা করতে করতে কঠোর তপস্যা করেছিল। ॥২–৩॥

তোষিতস্তপসা তেন প্রীতস্তস্মৈ বরার্থিন। গ্রহাণাং চরিতং প্রাদান্ মযায় সবিতা স্বয়ম্॥৪॥

এরপর তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞানরূপ বর কামনা করা ময় অসুরকে ভগবান সূর্য নিজে, অতি আনন্দ সহকারে গ্রহদের চরিত্র (জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞান) দান করলেন। ॥৪॥

ময়ং প্রতি সূর্যোপদেশঃ

শ্রীসূর্য উবাচ — বিদিতস্তে ময়া ভাবস্তোষিতস্তপসা হ্যহম্। দদ্যাং কালাশ্রয়ং জ্ঞানং গ্রহাণাং চরিতং মহৎ॥৫॥

এখন প্রশ্ন — সূর্যদেব কীভাবে নিজের শত্রু অসুরের প্রতি এইরূপ বাণী বললেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে, ময়কে উদ্দেশ্য করে সূর্যের বলা কথার ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

“শ্রীসূর্য উবাচ” — অর্থাৎ তেজের সমূহ দ্বারা দীপ্তিমান সূর্য, ময় অসুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন। অন্যথায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্লোকের সংগতিই স্থাপিত হতো না। কী বললেন — তা নিচে বলা হচ্ছে।

হে ময় অসুর! তোমার ভাব, অর্থাৎ তোমার মনোবাঞ্ছা—জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা—আমি সূর্য নিজে, তোমার মুখে না বললেও, নিজের দ্বারা জেনে নিয়েছি। তারপরও তুমি ভাবছ, হয়তো আমার থেকে সেই সিদ্ধি হবে না—তাই আমি বলছি—

“অহম্” অর্থাৎ আমি সূর্য, তোমাকে দিচ্ছি—“কালাশ্রয়ং জ্ঞানং”—যে জ্ঞান কালের আশ্রয়যুক্ত, অর্থাৎ কালপ্রধান। “গ্রহাণাং চরিতং মহৎ”—গ্রহদের, প্রবহবায়ুতে অবস্থিত নক্ষত্রাদি গ্রহসমূহের মহান ও অপরিমেয় চরিত্ররূপ জ্ঞান।

অর্থাৎ গ্রহদের স্থিতি, গতি ইত্যাদি যাকে বলা হয়—সেই জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রকৃত জ্ঞান আমি তোমাকে প্রদান করছি।

আমি সূর্যমণ্ডলে অবস্থিত হয়ে সেটি দিচ্ছি। কিন্তু তুমি তো অসুর; তাহলে আমার এই বাণী কি তোমাকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে নয়?—এই সন্দেহ দূর করার জন্য সূর্য নিজেকে বিশেষণসহ, প্রতারণাহীনভাবে এই কথা বললেন—

Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

  পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম। ন শেষো অগ্নে অন‍্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥ ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ