ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

29 December, 2025

ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী

29 December 0

ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী
বৈদিক বাঙ্গময়ের ইতিহাস – প্রথম অধ্যায়: 

১. গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ ও এর অর্থ

বৈদিক এবং সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থকার, ভাষ্যকার, বাতিককার ও টীকাকাররা সাধারণত ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ স্পষ্টভাবে লিখেননি। সায়ণ প্রভৃতি ভাষ্যকার কেবল লক্ষণই উল্লেখ করে সন্তুষ্ট হয়েছেন। নিজের ঋগ্বেদ-ভাষ্যের ভূমিকাে সায়ণ বলেন “যা পরম্পরা থেকে মন্ত্র নয়, তা ব্রাহ্মণ, এবং যা ব্রাহ্মণ নয়, তা মন্ত্র।”

ব্যাকরণ অনুসারে ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ হলো ব্রহ্ম বা মন্ত্র, অর্থাৎ ব্রহ্মই মন্ত্র এবং বেদও ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পর্কিত।

দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামী পরিশোধিত অনুভ্রমোচ্ছেদন এ লিখেছেন “যার মাধ্যমে এই ঐতরেয় ইত্যাদি গ্রন্থ ব্রহ্ম অর্থাৎ বেদের ব্যাখ্যা, সেই ব্যাখ্যাগুলি ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত।”
সত্যার্থপ্রকাশেও একই মত প্রকাশ করা হয়েছে “তাঁদের নাম ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ব্রহ্ম, যা বেদ, তার ব্যাখ্যা গ্রন্থ হওয়ায় ব্রাহ্মণ নামকরণ হয়েছে।”

আপস্তম্ভ-পরিভাষা-সুত্রে টীকাকার লিখেছেন “মন্ত্র নাম মনন থেকে এসেছে; ব্রহ্মের বক্তৃতা থেকে ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ হয়েছে।”

স্কন্দ স্বামীও বলেন “তথা অমীমদন্ত পিতার যেমন ভাগমা আভৃষায়িভত্… ইত্যসের মতো ভাগমা-শিষুর প্রতি শতপথব্রাহ্মণে বিবরণ আছে।”

অতএব, ব্রাহ্মণ শব্দ মূলত বেদ এবং তার ব্যাখ্যা গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

সূত্রসমূহ:

  1. পৃঃ ১৭, ঋগ্বেদ ভাষ্য, উপোদ্ঘাত ভাগ ১, বৈদিক সংস্করণ, পুনা, ১৯৩৩

  2. কাণ্ড ৭, অধ্যায় ১, ব্রাহ্মণ ১।৫।।, শ্রীগ্রন্থ, ভাগ ৩, ভেঙ্কটেশ্বর প্রেস, মুম্বাই, ১৬৪০

  3. ৪।১১।৪।৩।।; ৪।২৫।৩।।, জয়পুর উঃ ব্রাহ্মণ, রামদেব, লাহোর, ১৬২১

  4. পৃঃ ৬, বনাস, সম্বৎ ১১৩৭

  5. পৃঃ ২৬৬, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, রামলাল কাপুর ট্রাস্ট, বহালগড়, হরিয়ানা, संवत্ ২০২৬

  6. সূত্র ৩২, পৃঃ ৭৪, দর্শপূর্ণমাসপ্রকাশ, আনন্দাথম, পুনা, ১৬২৪

  7. ১।৩২।৩।।, ঋগ্বেদ, বিশ্ববন্ধু, বি. ৩০ গবেষণা সংখ্যা, হোশিয়ারপুর, সম্বৎ ২০২১

তিনি পুনরায় লিখেছেন “শতপথে যে শ্রেষ্ঠ, সেই বাসিষ্ঠঃ, অর্থাৎ ‘বাসিষ্ঠ’ শব্দের শ্রেষ্ঠ শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা ও দৃষ্টান্ত।”

২. গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ

গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ সাধারণত নপুংসক লিঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। বেদ বা মন্ত্রসংহতিতে এই শব্দের সরাসরি উপস্থিতি নেই। ব্রাহ্মণদের বক্তৃতা মূলত মন্ত্রের ব্যাখ্যা ও প্রকাশের উদ্দেশ্যে হওয়ায় মন্ত্রের মধ্যে এই শব্দের থাকা প্রয়োজন ছিল না। তবে, তৈত্তিরীয় সংহিতা, ব্রাহ্মণ, সূত্র এবং নৃুক্ত প্রভৃতি গ্রন্থে এই শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে সবসময়ই এটি নপুংসক লিঙ্গে এসেছে।

অমরকোষ ইত্যাদিতে এই শব্দের উল্লেখ নেই। তবে মেদিনীকোষের ণান্ত বিভাগে নিম্নলিখিত শ্লোক উল্লেখ আছে—

“ब्राह्मणं ब्रह्मसंघाते वेदभागे नपुंसकम् ॥ ৬৭৭”

অর্থাৎ, ব্রহ্মসংঘাত ও বেদভাগে ব্রাহ্মণ শব্দ নপুংসক লিঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে।

বায়ু পুরাণেও ব্রাহ্মণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন—

“मन्त्रो मन्त्रयतेर्धातोर्वाह्मणे ब्रह्मणोऽरणनात्”

এখানে ‘অরণনাত’ থেকে অর্থ, পাণিনির পূর্ববর্তী ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ‘কথন’ বোঝায়।

‘বাঙ্ময’ শব্দ সংস্কৃত সাহিত্যে সাধারণত শাস্ত্রসমূহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

বৌধায়ন ধর্মসূত্রে ‘বাগ্’ থেকে ব্রাহ্মণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিষ্ণুধর্মোত্তরে আরেকটি ব্যবহার দেখা যায়—

“मन्त्राः सब्राह्मणाः प्रोक्तास्तदर्थ ब्राह्मणं स्मृतम् । कल्पना च तथा कल्पाः कल्पश्च ब्राह्मणस्तथा ॥ ১১”

সূত্রসমূহ:

  1. ১।৩০।১০।।, ঋগ্বেদ

  2. (ক) “সুবর্গ লোকṁ ন প্রজানন্তি তেভ্য ইদṁ ব্রাহ্মণṁ ব্রুহি।” কাণ্ড ৩, প্রপাঠক ১, অনুবাক ১, তৈত্তিরীয় সংহিতা, সাতভলেকর, সং. ২০১৩
    (খ) “সো’ব্রবীদ্ ব্রাহ্মণং,” ২।৫।২।।, একই

  3. (ক) “যদ্ বাকো বাক্যং ব্রাহ্মণং, তদেৱৈতেনাপ্নুবন্তি তদ্বরুন্ধতে,” ৪।৬।৬।২০।।, শ্রী ব্রা., ভাগ ১, পৃঃ ৫৫৬, কাশী, সং. ১৬৬৪
    (খ) ১।১১৬।।, জে গ্রা., রঘুবীর ও লোকেশচন্দ্র, নাগপুর, ১৬২৪

  4. ছন্দব্রাহ্মণানি চ তদ্বিষয়াণি, ৪।২।৬৫।।, পাণিনীয়ষ্টক, পূর্বার্ধ, গঙ্গাদত্ত, হরিদ্বার, ১৯৬১

  5. ৪।২৭।।, নৃুক্ত শাস্ত্র, ভাগবদ্দত্ত, রামলাল কাপুর ট্রাস্ট, আমৃতসর, সং. ২০২১

  6. মেদিনীকোষ, সম্পাদক সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৮৬৬

  7. মধ্যকালীন গ্রন্থকাররা ব্রাহ্মণ গ্রন্থকে বেদাংশই মনে করতেন

  8. (ক) ৫৬।১৪১।।, আনন্দাশ্রম, পুনা
    (খ) ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, অধ্যায় ৩৪

  9. জগগু হেম্যস্ত সমস্ত বাঙ্ময, শ্লোক ১২, কাদম্বরী ভূমিকা, উপেন্দ্রনাৰায়ণ মিশ্র, इलाहাবাদ, ১৬৬৪

  10. “বাগিতি ব্রাহ্মণমুচ্যতে,” ১।৭।১০।।, উমেশচন্দ্র পাণ্ডে, চৌ। সং. সি।, বারাণসী

  11. ৩।১৭।১।।, প্রিয়বালা শাহ, বড়োদা, ১৯৫৮

অর্থাৎ মন্ত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বক্তৃতা করা হয়েছে, যা জানা উচিত। ‘কল্পনা’ এবং ‘কল্প’ এবং ‘কল্য’ এবং ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দগুলি সেই মন্ত্রগুলির (ব্যাখ্যা ইত্যাদির) জন্য ব্রাহ্মণ (মন্ত্রের ব্যবহার দেখানো হয়েছে) বোঝায়।

এখানে শ্লোকের শেষে আসা ব্রাহ্মণ পদ সন্দেহজনক। যদি এটি জাতি-সূচক ধরা হয়, তাহলে অর্থ সঙ্গত হয় না। সুতরাং প্রশ্ন থেকে যায়—পুল্লিঙ্গে কি ব্রাহ্মণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, নাকি এখানে পাঠ নষ্ট হয়েছে, অথবা অর্থ কিছু ভিন্ন।

মহাভারতের উদ্যোগ-পর্বের একটি শ্লোক এই বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে। সেখানে ব্রাহ্মণ শব্দ পুল্লিঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে—

“য ইমে ব্রাহ্মরণাঃ প্রোক্তা মন্ত্ৰা ও প্রোক্ষণে গবাম্। এতে প্রমারণং ভবত উতাহো নেতি বাসব ॥১৭৭৬”

অর্থাৎ, এই ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্র গোমেধে পড়া হয়েছে, হে বাসব! এরা আপনার কাছে প্রমাণ কি না।

দক্ষিণ ভারতীয় শান্তি-পর্বের একটি শ্লোকে ‘ব্রহ্মরণা’ ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন—

“বৃহস্পতি সবেনেষ্ত্বা সূরাপো ব্রাহ্মণঃ পুনঃ। সমিতি ব্রাহ্মণো গচ্ছেদিতি বৈ ব্রহ্মরণঃ শ্রুতিঃ ॥২”

এখানে এটি মন্ত্রের বিশেষণ হবে। সম্ভবত কেউ এই ব্যবহারকে আর্ষ বলে এড়াতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়ের যথাযথ অনুসন্ধান প্রয়োজন।

৩. ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ—যজ্ঞ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা

ব্রাহ্মণ গ্রন্থে যজ্ঞ সম্পর্কিত ক্রিয়ার ব্যাখ্যায়ও ব্রাহ্মণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে—

“দূরোহণং রোহতি তস্যোক্তং ব্রাহ্মণম্”

এর পূর্বে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দূরোহণ ব্রাহ্মণের ব্যাখ্যা এইভাবে করা হয়েছে—

“দূরোহণং রোহতি। স্বর্গং ও লোকো দূরোহণং। স্বর্গমেভ তং লোকং রোহতি। য এভা দূরোহণং ৩ অসৌ সে দূরোহো য’সৌ তপ্তি। কশ্চিদ্বা অত্রে গচ্ছতি। স যদ্বরোহণং রোহতি এভাবে রোহতি। হংসবত্যা রোহতি। হংসঃ শুচিভবিত্যেভ সে হংসঃ শুচিষৎ।”

এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘দূরোহণ ব্রাহ্মণ’-এ ‘দূরোহণ’ শব্দের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

তদ্রূপ, লেখা আছে—

“যদ্গৌরিভীতং তস্যোক্তং ব্রাহ্মরণম্”

এর পূর্বে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এর ব্রাহ্মণ ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে—

“গৌরিভীতং ষোডশি সাম কুর্বীত। তেজস্কামো ব্রহ্মবর্চস্কামস্তেজো যং ব্রহ্মবর্চসং গৌরিভীতং। তেজস্বী ব্রহ্মবর্চসী ভবতি। য এভা বিদ্বান গৌরিবোতং ষোডশি সাম কুরুতে। নানং ষোডশি সাম কর্তব্যমিত্যাহুঃ।”

সূত্রসমূহ:

  1. ভান্ডারকর, পুনা সংস্করণ

  2. ৩৪।১৮

  3. পঞ্চিকা ৬। অধ্যায় ২৬। লণ্ড ৬। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ভাগ ২, পৃঃ ৭৫৭, আনন্দাশ্রম, সন ১৯৩১

  4. ৪।১৮।৬, ভাগ ১

  5. ৮।৩৬।২।।, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ

  6. ৪।১৬।২।।

এই ‘গৌরিভীত ব্রাহ্মণ’-এ গৌরিভীত শব্দের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

একই পরম্পরায়, অথাস্মা ঔদুম্বরীমাসন্দী সংবরণ্তি। তস্যা উক্তং ব্রাহ্মণম্ লেখা হয়েছে। এর পূর্বে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ইতিমধ্যে এর ব্রাহ্মণ বলা হয়েছে। যেমন—

“ঔদুম্বরি সমন্বারভন্ত ইষমূর্জমন্বারম্ভ ইত্যূর্জ্যা অন্নাদ্যামুটুম্বরো পই তদদেবা ইমূর্জ্য ব্যভজন্ত। তৎ উদুম্বরঃ সমভবত্তসমাত্রা ত্রিঃ সংস্কৎসরস্য পচ্যতে।”

উভট-যজুর্বেদের ভাষ্যে শ্রুতি শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণ করা হয়েছে। যেমন— “শ্রুতির্বাহ্মণম্”

এ থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণদের বক্তা-ঋষিরা এই শব্দের অর্থ ব্রহ্মের ব্যাখ্যা বোঝতেন।

ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বহু স্থানে এভাবেই লেখা আছে— “ইত্যেক ব্যাখ্যানাঃ”, অর্থাৎ এই ঋচাগুলো সমান ব্যাখ্যাযুক্ত। এতটুকু লিখে এই মন্ত্রগুলিকে বাহ্মণ বলা হয় না। এ থেকেও বোঝা যায় যে, ‘ব্যাখ্যান’ শব্দই ব্রাহ্মণের সমার্থক।

৪. ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী?

যতগুলো শাখা প্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ, প্রায় সবগুলির ব্রাহ্মণ গ্রন্থও বিদ্যমান ছিল। এই ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বক্তৃতাও সেই ঋষিরা করেছেন, যারা তাদের সংহতির মন্ত্র রচনা করেছিলেন। শাখা-গ্রন্থের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ গ্রন্থেরও নির্দেশ ছিল।

পাণিনীয় সূত্রে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের দুটি ভাগ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। একটি সূত্রে পাণিনি সাধারণ নির্দেশ দিয়েছেন— “ছন্দোব্রাহ্মণানি চ তদ্বিষয়াণি”। অন্য সূত্রে প্রাচীন ও অর্বাচীন দুটি বিভাগে ইঙ্গিত— “পুরাণপ্রোক্তেষু ব্রাহ্মরণকল্পেষু”

পুরাণে উল্লেখিত এবং অর্বাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সীমা কী ছিল? তা কি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের শাখা-প্রবচন ছিল? অর্থাৎ, কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের শাখা-প্রবচনের আগে প্রোক্ত ব্রাহ্মণ প্রাচীন এবং তার শিষ্যদের দ্বারা প্রোক্ত ব্রাহ্মণ অর্বাচীন।

কাশিকার জ্যাদিত্য প্রমাণ করেন— পুরাণ-প্রোক্ত ব্রাহ্মণগুলিতে ভল্লব, শাট্যায়ন, ঐতরেয় এবং অর্বাচীন ব্রাহ্মণগুলিতে যাজ্ঞবল্ক্য বা শতপথ ব্রাহ্মণ উল্লেখিত। তিনি শতপথ ব্রাহ্মণকে অর্বাচীন মনে করেন।

সূত্রসমূহ:

  1. ৮/৩৬।৩।। ঐতরেয় গ্রন্থ

  2. ৫১২৪।৫।।

  3. ১৮১১।।, যজুর্বেদ, উভট-ভাষ্যসহ, সিদ্ধান্ত সাগর প্রেস, ১৬২৬

  4. অর্থাৎ— বাক্, মন্ত্র, সত্য, বেদ, যজ্ঞ

    • (ক) ১০ ৪২২, বৈদিক কোষ, হংসরাজ, প্রথম সংস্করণ, লাহোর, ১৬২৬

    • (খ) ১০ ৭৬৩, ব্রাহ্মণোদ্দারকোষ, বিশ্ববন্ধু, হোশিয়ারপুর, संवत ২০২৩

    • (গ) ১০ ৬২৭, বাহী

    • (ঘ) ১০ ৩৭১, বাহী

    • (ঙ) পৃঃ ৬৬১, একই

  5. ৬।৭।৪।৬।। শ্রী গ্রন্থ, ভাগ ৩

  6. ৪।২।৬৬।।, অষ্টাধ্যায়ী, শ্রীশচন্দ্র বসু, প্রথম ভাগ, পৃঃ ৭২০, মোতিলাল বানারসীদাস, ১৬৬২

  7. ৪।৩।১০৫।। অষ্টাধ্যায়ী

  8. ৪।৩।১০৫।। কাশিকা, সম্পাদক—শর্মা প্রমুখ, সংস্কৃত পর্ষদ, উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দ্রাবাদ, ১৯৬৬

ব্রাহ্মণ-এর আরেকটি নাম ওজসনেয় বাহ্রাণ। জ্যাদিত্য প্রাচীন ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাণ্ড এবং অর্বাচীন ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সৌলভ ব্রাহ্মণ নামেরও উল্লেখ করেন।

৫. ব্রাহ্মণের অন্তর্গত বিদ্যার সম্পর্ক একটি আথর্বণ মন্ত্র

ব্রাহ্মণদের মধ্যে যেসব বিষয় সংরক্ষিত আছে, সেগুলির উল্লেখ আথর্ববেদের একটি মন্ত্রে পাওয়া যায়—

“তামিতিহাসশ্চ পুরাণং ব গাথাশ্চ নারাশংসীশ্চানুভ্যচলন্ ॥৩”

এই মন্ত্রে কোনো বিশেষ গ্রন্থের ইঙ্গিত নেই। সাধারণভাবে বিদ্যার বিশেষ বিষয়গুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই ইতিহাস, পুরাণ, গাথা, নারাশংসী ইত্যাদির সংগ্রহ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পাওয়া যায়।

৬. ব্রাহ্মণ-পর্যায়ের প্রচারণা

গ্রন্থভাষায় ব্রাহ্মণ শব্দের অন্য একটি সমার্থক “প্রবচন”। লেখা হয়েছে— “প্রবচন শব্দেন ব্রাহ্মণমুচ্যতে”। প্রাবচন-চরণকেও উল্লেখ করা হয়েছে।

গঙ্গারাজ শ্রীপুরুষের শক ৬৬৩ তম তাম্রশাসনে লেখা আছে—

“হারিত গোত্রস্য নীলকণ্ঠনামধেয়स्य প্রাবচনচরণস্য”

ভারমিত্রোদয়ের আহ্নিক প্রকাশে একই অর্থ প্রকাশ পেয়েছে—

“বসিষ্ঠঃ শ্রপি চ কাঠকে প্রবচনে বিজ্ঞায়তে শ্রদ্য শ্বো বা বিজ্ঞনিষ্যমানঃ”

অনুশাসন পার্ব অনুযায়ী, শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ-প্রবচন পংক্তি-পবিত্র বলে গণ্য। যেমন—

“অগ্রয়া সর্বেষু বেদেষু সর্বপ্রবচনেষু চ”

একই অর্থ অন্য স্থানে গোভিল-গৃহ্যকর্মপ্রকাশিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। এখানে দশ প্রবচনকারীর তर्पণ বলা হয়েছে—

“শটিঃ, ভল্লবিঃ, কাল্ববিঃ, তাণ্ড্যঃ, বৃষারণঃ, শমবাহুঃ, রুরুকিঃ, অগস্ত্যঃ, বষ্কশিরাঃ, দূহঃ”

৭. ব্রাহ্মণের সম্পর্ক বিজ্ঞায়তে শব্দ

বিজ্ঞায়তে শব্দের প্রথম ব্যবহার গোপথ ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। যেমন—

“আত্মা বং স যজ্ঞস্যেতি বিজ্ঞায়তে”, অর্থাৎ এটি যজ্ঞের আত্মা, এটি ব্রাহ্মণ থেকে জানা যায়। বিজ্ঞায়তে শব্দের অর্থ হলো— “শ্রুত্যন্তরে এই বিশেষতা আছে, নিজের শাখায় নেই।” এই ভাব প্রকাশ পায় পুরুষোত্তমের প্রবরমঞ্জরী থেকে।

সূত্রসমূহ:

  1. ৪।৩।১০৬।। গণপাঠ, কপিলদেব শাস্ত্রী, কুরুক্ষেত্র

  2. ৪।২।৬৬।। কাশিকা

  3. ১৫।৬।১১।। সাতবালেকর, স্বাধ্যায়মন্ডল, ১৬৫৮

  4. ৮।৮।।, পুষ্পসূত্র, পৃঃ ১০৬, লক্ষ্মণ শাস্ত্রী, চৌঃ সংঃ সিঃ, ১৬২৩

  5. পৃঃ ৩৪১, সংখ্যা ২০, প্রথম ভাগ, ভাগবদ্দত্ত, দ্বিতীয় সংস্করণ, অমৃতসর, संवত ২০১৩

  6. Epigraphia Indica, Vol. XXVII, p. 151

  7. পৃঃ ৫৬৪, নিত্যনন্দ শর্মা, চীঃ সংঃ সিঃ, ১৬১০

  8. ৬০/২৮।।, ভাণ্ডারকর, পুনে সংস্করণ

  9. পৃঃ ৩০০, শুকদেব বর্মা, ১৯৩২

  10. ২।২।৬।। ১০ ১০৬, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কলকাতা, ১৮৭২

  11. পৃ০ ১৪, ১৫

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বিজ্ঞায়তে শব্দটিও পাওয়া যায়। তবে এখানে এর অর্থ কিছু ভিন্ন। বিজ্ঞায়তে শব্দের ব্যাখ্যা নিম্নলিখিত স্থানে খুঁজে দেখা উচিত—

(ক) গৌতম ধর্ম সূত্র ১১।১১।। এবং ১১।১৬।।, মস্করি ভাষ্যসহ।
(খ) ঋক্সর্বানুক্রমণী ১।১।।, ষড়গুরু-শিষ্য প্রথা অনুযায়ী।
(গ) বোধায়ন ধর্ম সূত্রে গোবিন্দ স্বামীয়ের বর্ণনা একই অর্থ প্রকাশ করে।
(ঘ) সায়ণও নিজের ঋগ্বেদ ভাষ্যে একই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন।

শ্রোত্র, গৃহ্য, শুল্ব, ধর্ম সূত্র, নিরুক্ত ও নিদান ইত্যাদি গ্রন্থে, যেমন তৈত্তিরীয়াদি সংহিতায় ব্রাহ্মণ প্রবচন এবং ব্রাহ্মণান্তর্গত বচনকে প্রায়শই “বিজ্ঞায়তে” বলে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

কিন্তু এখনো জানা যায়নি কেন এই শব্দটি ব্রাহ্মণ বচনের দ্যোতক হিসেবে ধরা হয়েছে। ধূর্ত স্বামী ঘাপস্তম্ব সূত্রের টীকা এবং যাজ্ঞবাল্ক্য স্মৃতি-র বালক্রীড়া টীকা-তেও একইরকম উল্লেখ রয়েছে।

সূত্রসমূহ:

  1. ৪।১৮।৮।।

  2. (ক) ধর্মস্য হ্যশংভাগ্ভবতীতি বিজ্ঞায়তে ১১।১১।।
    (খ) ব্রহ্মপ্রসুতং হি ক্ষত্রমৃদ্যতে নি ব্যথতে ইতি চ বিজ্ঞায়তে ১১।১৬।। গৌতম ধর্ম সূত্র, মস্করি ভাষ্যসহ, ১৬৬৬

  3. পৃঃ ১, কাত্যায়ন কৃত ঋক্সর্বানুক্রমণী, ম্যাকডানেল, অক্সফোর্ড, ১৮৮৬

  4. অধ্যায় ৪, খণ্ড ৬, ১৫।।, চিন্ন স্বামী শাস্ত্রী, চৌঃ সংঃ সিঃ, ১৬৯১

  5. পৃঃ ৫, পংক্তি ৬, ভাগ প্রথম, ঋগ্বেদ, সায়ণ ভাষ্যসহ, ম্যাক্সমুলার, চৌঃ সংঃ সিঃ, ১৬৬৬

  6. ২।৫।২।।; ২।১১।৬।।, আপনি:আপস্তম্ব শ্রৌত সূত্র, ধূর্ত স্বামী টীকা সহ, মাইসুর, ১৬৪৫

  7. (ক) ১।১০।১৫।।; ৩।৫।৭।। আশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্র, ভবানি শঙ্কর শর্মা, মুম্বাই, ১৬০৬
    (খ) ১।৩।১৪।।; ২।৫।৭২।। বোধায়ন গৃহ্য সূত্র, শাম শাস্ত্রী, মাইসুর, ১৬২০
    (গ) ২৪।২০।। কাঠক গৃহ্য সূত্র, পৃঃ ৮৭, ক্যালেন্ড, লাহোর, ১৬২৫

  8. ৩০০৮।।, ১০ ৪০৬, ভাগ ৩, বোধায়ন শুল্ব সূত্র, ক্যালেন্ড, কলকাতা, ১৯১৩

  9. ১১৩৬।।; ১১৪৬শা; ৪১৩॥; ৫।৮।।; ১১১৪।; ২।৩১॥; ২৩।৩৩॥, বাসিষ্ঠ ধর্ম শাস্ত্র, ফিউহেরার, পুনে, ১৯৩০

  10. ২০১১০; ২০১৮

  11. ৩।৫।।, পৃঃ ৪৬, নিদান সূত্র, ভাটনাগর, দিল্লি, ১৯৭১

  12. বিস্ময়করভাবে, নীরুক্ত ৪।৪।।-এ ঋগ্বেদীয় মন্ত্রস্থ পদগুলোকে “ইতি বিজ্ঞায়তে” বলে উদ্ধৃত করা হয়েছে। একইভাবে বোধায়ন পিতৃ সূত্র ১।১৩।৬।।-এও বলা হয়েছে “দাশতয়ে বিজ্ঞায়তে”

  13. পৃঃ ৩১, নরসিংহাচার, মাইসুর, ১৬৪৫

  14. এখানে বিজ্ঞায়ত ইতি শ্রুত্যুপন্যাস অনুযায়ী, পৃঃ ১২০, ভাগ ২, গণপতি শাস্ত্রী, ত্রিবেন্দ্রম, ১৬২৪

দুর্গাচার্য নীরুক্ত টীকা ২।১২।। এবং ২।১৭।।-এ ইতি বিজ্ঞায়তে শব্দের অর্থ এবং ब्राह्मणेऽपि विज्ञायते-কে বিবেচনা করলে তা প্রকাশ পায়।

৮. ব্রাহ্মণের দুটি প্রকার

ভট্ট ভাস্কর, তৈত্তিরীয় সংহিতার ভাষ্য ভূমিকায় লিখেছেন—
“দ্বিভিদং ব্রাহ্মণং। কর্ম-ব্রাহ্মরণং, कल्प-ব্রাহ্মণং চেতি।।”
অর্থাৎ তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থে দুই প্রকার ব্রাহ্মণ রয়েছে। একটি হলো কর্ম ব্রাহ্মণ, অন্যটি হলো कल्प ব্রাহ্মণ
কর্ম ব্রাহ্মণ কেবল কর্মের বিধান এবং মন্ত্রের ব্যবহার বলে, প্রশংসা বা নিন্দা নয়।
कल्प ব্রাহ্মণ শুধুমাত্র মন্ত্রের পাঠ, ব্যবহার নেই।
ভট্ট ভাস্কর প্রদর্শিত এই সংজ্ঞাগুলি কতটা প্রাচীন তা চিন্তা করার বিষয়। তিনি ব্রহ্ম শব্দের অর্থও ব্রাহ্মণ ধরেন, যেমন— ব্রহ্মণামন্ত্রৈর্঵াহ্মণৈর্঵া।

৬. আট প্রকারের ব্রাহ্মণ

সায়ণ, তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ব্যাখ্যায়, বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রমাণ অনুযায়ী ব্রাহ্মণের আট প্রকার দেখান—
“ব্রাহ্মণং চাষ্ঠধাভিন্নম্। তদ্ভবাস্তু, ওয়াজসনেয়ীভিরাম্নায়তে ইতিহাস, পুরাণং, বিদ্যা, উপনিষৎঃ, শ্লোকা, সূত্রাপ্যঅনুভ্যাখ্যানি, ব্যাখ্যানানি ইতি।”
আচার্য শঙ্করও বৃহদারণ্যক উপনিষদের একই স্থানে ব্রাহ্মণের এই আট বিভাগ লিখেছেন।

১০. অনুব্রাহ্মণ

অষ্টাধ্যায়ী-এ একটি সূত্র আছে— “অনুব্রাহ্মরণাবিনিঃ”
কাশিকাকার জয়াদিত্য লিখেছেন—
“ব্রাহ্মণসদৃশোয়ং গ্রন্থো অনুব্রাহ্মণম্।”
প্রায় সকল টীকারকারই লিখেছেন, এটি ব্রাহ্মণ নয়, তবে ব্রাহ্মণের সমান গ্রন্থকে অনুব্রাহ্মণ বলা হয়।
কিছু লোক সামবেদের ছোট ছোট ব্রাহ্মণ থেকেও যেকোনো একটি অনুব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করেন।
সত্যব্রত সামশ্রমী আর্ষেয় ব্রাহ্মণকে মুখপৃষ্ঠে অনুব্রাহ্মণ লিখেছেন।
নীরুক্তালোচনে বলা হয়েছে—
“তাণ্ড্যাংশভূতানি, তাণ্ড্যপরিশিষ্টভূতানি, বা অনুব্রাহ্মণানি বা অপরাণ্যাপি সপ্তাধীয়ন্তে চ।”

অর্থাৎ—অগ্নিই হলো যজ্ঞ এবং বনস্পতিই যজ্ঞের যোগ্য। মানুষ যজ্ঞ করতে পারে না যদি বনস্পতি না থাকে। তাই বলা হয়েছে, বনস্পতিই যজ্ঞের যোগ্য।

এ থেকে প্রকাশ পায় যে যজ্ঞের জন্য বনস্পতি হলো উপযুক্ত উপাদান। পশু ইত্যাদির বলি কেন এবং কবে থেকে শুরু হলো, ব্রাহ্মণদের মধ্যে বলির প্রক্রিয়া সর্বত্র পাওয়া যায় কি না—এগুলি সব আলাদাভাবে বিবেচনার বিষয়।

(ত) দেবতা

ব্রাহ্মণ গ্রন্থে সমস্ত যজ্ঞের হাভি গ্রহণকারী দেবতাদের উল্লেখ আছে। এই দেবতা দুই প্রকারের—একটি হলো মানুষদেব এবং অন্যটি ভৌতিক দেব

মানুষদেবদের সম্পর্কে ব্রাহ্মণ লিখেছে—

  1. ২।১।৩।। ষড়্বিংশ ব্রাহ্মণ

  2. ৩।৪।৫।। একই

  3. ৩।২।২।৬।। শতপথ

সূত্রসমূহ:

  1. নীরুক্ত, ভদকমকর, মুম্বাই, ১৯১৮

  2. ১।৮।১।।, ভাগ ৩, পৃঃ ১০৫, মাইসুর, ১৮৬৫

  3. একই

  4. ৭৭৪।১২।।, তৈঃ সংঃ, পৃঃ ৭৪, ভাগ ১২, মাইসুর, ১৮৬৮

  5. ৮।২।।, দ্বিতীয় ভাগ, পৃঃ ৫৬৩, আনন্দাশ্রম, পুনে, ১৬২৭

  6. ২।৪।১০।।, বৃহদারণ্যক উপঃ, শঙ্কর ভাষ্যসহ, আনন্দাশ্রম, পুনে, ১৬২৭

  7. ৪।২।৬২।।, পূর্বে দেখানো হয়েছে

  8. পৃঃ ১৬৭, কলকাতা, ১৬০৭

এই লেখার অর্থ হলো সত্যব্রত বলছেন, সামবেদের তাণ্ড্য বাদে বাকী সাতটি ব্রাহ্মণকে অনুব্রাহ্মণ ধরা যেতে পারে। নিধান সূত্রেও প্রায়শই অনুব্রাহ্মণ বলে বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখিত হয়েছে।

ভট্ট ভাস্কর, তৈত্তিরীয় সংহিতা ১১৮।১।।-এর ভূমিকায় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণান্তর্গত ১১৬।১১।১।। উদ্ধৃত করে লিখেছেন—
“অনুব্রাহ্মণং চ ভবতি—অষ্টাভেতানি হवींষি ভবন্তি। ইতি।”

মাধব, তার তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ভাষ্যে ১।৬।১।।-এ ব্যবহৃত এই অনুবাকের সব ব্রাহ্মণের নাম উল্লেখ করেছেন। শাঙ্কহায়ন শ্রৌত ভাষ্যকার আনর্তীয় বরদত্ত লিখেছেন—
“অথ রাজসূয়স্য অনুব্রাহ্মণং” এবং “এত্থ অনুব্রাহ্মণমেতত্ মহাকৌষীতকোদাহৃতং, कल्पকারেণাধ্যায়ত্রয়ং।”

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, कल्प সূত্রকাররা ব্রাহ্মণ গ্রন্থের যে অংশটি कल्प সূত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তা হলো অনুব্রাহ্মণ, যা ব্রাহ্মণদের অন্তর্বিভাগের সমান।

অনুপ্রবচন শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। অষ্টাধ্যায়ী-এ দেখা যায় যে, ব্রাহ্মণের সমার্থক শব্দ হলো প্রবচন, অনুপ্রবচন কি অনুব্রাহ্মণের সমার্থক।

১১. ব্রাহ্মণাচ্ছন্সি

মন্ত্রে বহু স্থানে এই শব্দ পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতার কিছু স্থানে ভট্ট ভাস্কর লিখেছেন—
“ব্রাহ্মণা-দাহৃত্য শংসতি ব্রাহ্মণানি শংসতি বা।”

এটি নির্দেশ করে, ব্রাহ্মণ গ্রন্থের ওচন থেকে যে প্রশংসা করা হয়েছে। মহাভাষ্যকারও লিখেছেন—
“ব্রাহ্মণানি শংসতীতি ব্রাহ্মণাচ্ছন্সি। ব্রাহ্মণে ভ্যোহ গ্রহীৎ করা… শংসতীতি ব্রাহ্মণাচ্ছন্সি।”

অর্থাৎ, যা ব্রাহ্মণদের থেকে নেওয়া হয়েছে, তা অনুব্রাহ্মণ হতে পারে। তবে, ইতিহাস অনুযায়ী মন্ত্রের আগে অন্য কোনো ব্রাহ্মণ ছিল না।

সূত্রসমূহ:

  1. কুমারিল—সবকেই ব্রাহ্মণ মনে করেন। তন্ত্রবাতিক ১১৩।১২।।, মীমাংশা দর্শন, শাওয়ার ভাষ্যসহ, আনন্দাশ্রম, পুনে, ১৬২৬

  2. ভট্টনাগর, দিল্লি, ১৬৭১

  3. ১।৬।১।।, তৈঃ সংঃ, মাইসুর, ১৮৬৫

  4. ৪।১০।১।।, ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইতিহাস, প্রথম ভাগ, ইউ. মি., পৃঃ ২৪৩, দ্বিতীয় সংস্করণ

  5. ৫০১।১১

  6. ১।৮।১৮।। ভাগ ৩, পৃঃ ২০৩

  7. ৬।৩।২।।, পৃঃ ১৪২, ভাগ ৩, কিলাহানং, মুম্বাই, ১৬০৬

Read More

বেদের ঋষি

29 December 0

বেদের ঋষি
বৈদিক শাখাগুলির বিবরণ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। শাখা-প্রবচন কালের বিষয়টিও নির্ণীত হয়েছে। এখন প্রশ্ন ওঠে— বেদের কাল কীভাবে নির্ধারণ করা যায়। বেদের কাল জানার জন্য পাশ্চাত্য লেখকেরা নানা ধরনের কল্পনা করেছেন। সেগুলি সবই ভিত্তিহীন কল্পনা। সেগুলির দ্বারা কোনো বাস্তব তথ্য জানা যায় না; তবে সাধারণ মানুষ সেগুলি পড়ে বিভ্রান্ত হতে পারে।

ঋষি-ইতিহাসের প্রয়োজন
বেদের কাল নির্ণয়ের জন্য বেদের ঋষিদের ইতিহাস জানা অত্যন্ত সহায়ক। আমরা জানি যে বেদমন্ত্রগুলির সঙ্গে যেসব ঋষির নাম লিখিত আছে, অথবা মন্ত্রসম্বন্ধে অনুক্রমণীতে যেসব ঋষির নাম দেওয়া হয়েছে, তারা সকলেই সেই মন্ত্রগুলির আদিদ্রষ্টা নন। বহু মন্ত্র তাদের অনেক আগেই বিদ্যমান ছিল। তথাপি সেই ঋষিদের ইতিবৃত্ত জানলে অন্তত এতটুকু বলা যায় যে অমুক অমুক মন্ত্র শাখা-প্রবচন কালের এতটা আগে অবশ্যই বিদ্যমান ছিল। সেই মন্ত্রগুলি ওই কালের পরবর্তী হতে পারে না।

পুরাণসমূহে ঐসব ঋষিদের বিষয়ে ভালো তথ্য সংরক্ষিত আছে। বায়ুপুরাণ ৫৬.৫৬, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ ২.৩২.৬২ এবং মৎস্যপুরাণ ১৪৫.৫৮— এই তিনটি পুরাণে এই বিবরণ আরম্ভ হয়েছে। এই তিন পুরাণের পাঠ বর্তমানে অত্যন্ত অশুদ্ধ হয়ে গেছে; তথাপি নীচে দেওয়া শ্লোকগুলি কিছুটা সংশোধন করে লেখা হচ্ছে। এগুলির সংশোধনে আমরা সম্পূর্ণ সফল না হলেও আংশিক সাফল্য অবশ্যই পেয়েছি। শ্লোকগুলির সংখ্যা ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুসারে দেওয়া হয়েছে—

ঋষীণাং তপ্যতামুদ্র
তপঃ পরমবুষ্করम् ॥৬৭॥

মন্ত্রাঃ প্রাদুর্বভূবুর্বাহ পূর্বমন্বন্তরেষ্বিহ ।

অসন্তোষাদ্ ময়াদ্ দুঃখাত্
সুলাত্ শোকাচ্চ পঞ্চধা ॥৬৮॥

ঋষীণাং তপঃ কাত্স্যেন
দর্শনেন যদৃচ্ছয়া ।

এই শ্লোকগুলির যথার্থ অভিপ্রায় এই যে— তপস্যা প্রভৃতি আটটি প্রভাবের দ্বারা ঋষিদের নিকট মন্ত্রগুলির সাক্ষাৎকার হয়েছিল। সেই তপ নানা কারণবশত করা হয়েছিল। এই ভাবই নিরুক্ত এবং তৈত্তিরীয় আরণ্যক (?) গ্রন্থেও পাওয়া যায়।

পাঁচ প্রকারের ঋষি
যেসব ঋষিদের নিকট মন্ত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছিল, তারা পাঁচ প্রকারের। তাদের বলা হয়— মহর্ষি, ঋষি, ঋষীক, ঋষিপুত্রক এবং শ্রুষি। চরকতন্ত্র সূত্রস্থান ১.৭-এর ভাষ্যে ভট্টার হরিচন্দ্র চার প্রকার মুনির কথা বলেছেন—
মুনিনাং চতুর্বিধো ভেদঃ— ঋষয়ঃ, ঋষিকাঃ, ঋষিপুত্রাঃ, মহর্ষয়শ্চ।

১. মৎস্য-মোহাচ্

হরিচন্দ্র শ্রুতঋষিদের গণনা করেন না। এই পাঁচ প্রকার ঋষির মধ্যে বর্তমানে পুরাণসমূহে কেবল তিন প্রকার ঋষিরই বিবরণ অবশিষ্ট আছে। বাকি দুই প্রকার ঋষি-সম্পর্কিত পাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঋষিদের বিষয়ে পুরাণস্থিত পাঠ নিচে দেওয়া হল—

অতীতানাগতানাং চ পঞ্চধা হ্যার্ষকং স্মৃতম্ ।
অতস্ত্বৃষীণাং বক্ষ্যামি তত্র হ্যার্ষসমুদ্ভবম্ ॥৭০॥

ইত্যেতা ঋষিজাতীস্তা নামভিঃ পঞ্চ বৈ শৃণু ॥১৫॥

অর্থাৎ— এখন পাঁচ প্রকার ঋষির বিবরণ করা হচ্ছে।

১. মহর্ষি ঈশ্বর
ভৃগুর্মরীচিরত্রিশ্চ হ্যঙ্গিরাঃ পুলহঃ ক্রতুঃ ।
মনুর্বক্ষো বসিষ্ঠশ্চ পুলস্ত্যশ্চৈতি তে দশ ॥৬৬॥

ব্রহ্মণো মানসা হ্যেতে উদ্ভূতাঃ স্বয়মীশ্বরাঃ ।
পরত্বেনর্ষয়ো যস্মাত্ স্মৃতাস্তস্মান্মহর্ষয়ঃ ॥৬৭॥

ঋষিকোটিতে প্রথম এই দশজন মহর্ষি। তুলনা করুন— শান্তিপর্ব ২০৭.৩–৫ এবং ৩৪৬.৬৭–৬৮। তাঁরা স্বয়ং ঈশ্বর এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র।

২. ঋষি
এই দশ ভৃগু প্রভৃতি মহর্ষিদের পুত্রদের বিবরণ পরবর্তীতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ঋষি বলা হয়—

ঈশ্বরাণাং সুতা হ্যেতে ঋষয়স্তান্নিবোধত ।
কাব্যো বৃহস্পতিশ্চৈব কশ্যপশ্চ্যবনস্তথা ॥৬৮॥

উতথ্যো বামদেবশ্চ অগস্ত্যশ্চৌশিজস্তথা ।
কর্দমো বিশ্রবাঃ শক্তির্বালখিল্যাস্তথার্বতঃ ॥৬৯॥

ইত্যেতে ঋষয়ঃ প্রোক্তাস্তপসা চষিতাং গতাঃ ।

অর্থাৎ— উশনা কাব্য, বৃহস্পতি, কশ্যপ, চ্যবন, উতথ্য, বামদেব, অগস্ত্য, উশিক্, কর্দম, বিশ্রবা, শক্তি, বালখিল্য ও অর্বত— এঁরা ব্রহ্মর্ষিদের পুত্র ঋষি, যাঁরা তপস্যার দ্বারা এই পদ লাভ করেছেন।

৩. ঋষিপুত্র (ঋষীক)
ঋষিপুত্রানৃষীকাংস্তু গর্ভোত্পন্নান্নিবোধত ॥১০০॥

বৎসরো নগ্নহূশ্চৈব ভরদ্বাজস্তথৈব চ ।
ঋষিদীর্ঘতমাশ্চৈব বৃহদ্যুক্তঃ শরদ্বতঃ ॥১০১॥

বাজশ্রবাঃ সুবিত্তশ্চ বশ্যাশ্বশ্চ পরাশরঃ ।
দধীচঃ শংশপাশ্চৈব রাজা বৈশ্রবণস্তথা ॥১০২॥

ইত্যেতে ঋষিকাঃ প্রোক্তাস্তে সত্যাবৃষিতাং গতাঃ ।

ঋষিপুত্র ও ঋষীক সমার্থক। (তুলনা করুন— শান্তিপর্ব ১২.৪৮)। ‘শরদ্বত’ পাঠটি বিচার্য। শংশপের পুত্র শাংশপায়ন পুরাণপ্রবক্তা ছিলেন।

উনিশটি ভৃগুপুরাণে ভৃগুকুলের উনিশজন মন্ত্রকর্তা ঋষির উল্লেখ আছে। তাঁদের নাম নিম্নলিখিত শ্লোকগুলিতে দেওয়া হয়েছে—

এতে মন্ত্রকৃতঃ সর্বে কৃত্স্নশস্তান্নিবোধত ।
ভৃগুঃ কাব্যঃ প্রচেতাশ্চ দধীচো হ্যাপন্বানপি ॥১০৪॥

ঔর্বোऽথ জমদগ্নিশ্চ বিদঃ সারস্বতস্তথা ।
আষ্টিষেণশ্চ্যবনশ্চ বীতহব্যঃ সুমেধসঃ ॥১০৫॥

বৈন্যঃ পৃথুদিবোদাসো বাঘ্রঘশ্বো গৃত্সশৌণকঃ ।
একোনবিংশতিহ্যতে ভৃগবো মন্ত্রবাদিনঃ ॥১০৬॥

১. বায়ু— অয়োজ্যশ্চৌশি। ব্রহ্মাণ্ড— অপাস্যশ্চোশি। মৎস্য— অগস্ত্যঃ কৌশিকস্তথা।
২. বায়ু— প্রোক্তা জ্ঞানয়ো ঋষিতাম্।
৩. শ্যা বা শ্বশ্চ ?

১. ভৃগু ২. কাব্য (উশনা–শুক্র) ৩. প্রচেতা ৪. দধ্যঙ্‌ (আথর্বণ) ৫. আপন্বান্ ৬. ঔর্ব (ঋচীক) ৭. জমদগ্নি ৮. বিদ ৯. সারস্বত ১০. আষ্টিষেণ ১১. চ্যবন ১২. বীতহব্য ১৩. সুমেধাঃ ১৪. বৈন্য পৃথু ১৫. দিবোদাস ১৬. বাঘ্রযশ্ব ১৭. গৃত্স (মদ) ১৮. শৌণক।

এগুলি আঠারোজন ঋষির নাম। পুরাণসমূহে মোট সংখ্যা উনিশ বলা হয়েছে এবং সেখানে বৈন্য ও পৃথুকে দুই ব্যক্তি হিসেবে গণনা করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে বৈন্য পৃথু একই ব্যক্তি, অতএব আমরা এটিকে একটিমাত্র নাম হিসেবে গ্রহণ করেছি। এইভাবে উনিশতম নামটি অন্য কোথাও অনুসন্ধান করতে হবে। এদের মধ্যে বহু ঋষিকেই ভৃগু বলা হয়েছে। তাঁদের মূল ভৃগু থেকে সর্বদা পৃথক্‌ করে জানা উচিত। এই কুলের শ্রেষ্ঠ বৃত্তান্ত মহাভারতের আদিপর্ব ৬০.৪০ থেকে আরম্ভ হয়েছে। সেই অনুসারে ভৃগুর পুত্র ছিলেন কবি। কবির পুত্র ছিলেন শুক্র, যিনি যোগাচার্য ও দৈত্যদের গুরু ছিলেন। ভৃগুর আর এক পুত্র ছিলেন চ্যবন। এই চ্যবনের পুত্র ছিলেন ঔর্ব। ঔর্বের পুত্র ছিলেন ঋচীক এবং ঋচীকের পুত্র ছিলেন জমদগ্নি। মহাভারতে এরপর অন্যান্য বংশের বিবরণ চলতে থাকে। পুরাণ অনুযায়ী চ্যবন ও সুকন্যার দুই পুত্র ছিলেন— একজন আপন্বান্ এবং অপরজন দধীচ বা দধ্যঙ্। আপন্বানের পুত্র ছিলেন ঔর্ব। ঔর্বদের অবস্থান ছিল মধ্যদেশে। এখানেই এই ভৃগুবংশীয়দের কার্তবীর্য অর্জুনের সঙ্গে বিরোধের সূচনা হয়। এখানেই অর্জুনের পুত্রেরা জমদগ্নিকে বধ করেছিল। বীতহব্য প্রথমে ক্ষত্রিয় ছিলেন। এক ভৃগু ঋষির বচনে তিনি ব্রাহ্মণ হন। তাঁরই কুলে গৃত্সমদ ও শৌণকের জন্ম হয়েছিল। গৃত্সমদ দাশরথি রামের সমসাময়িক ছিলেন।

ভৃগুকুল এবং অথর্ববেদ— পৃষ্ঠা ২৫৬-এ আমরা পূর্বে লিখেছি যে, অথর্ববেদের একটি নাম ছিল ‘ভৃগ্বঙ্গিরোবেদ’। এর অর্থ এই যে, ভৃগু ও অঙ্গিরা— এই দুই কুলের সঙ্গে এই বেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ভৃগুকুলের ঋষিদের নাম উপরে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভৃগু, দধ্যঙ্ এবং শৌণক স্পষ্টতই আথর্বণ। সম্ভবত এই শৌণকই আথর্বণ শৌণক শাখার প্রবর্তক। ভৃগু, গৃত্সমদ ও শুক্র বহু আথর্বণ সূক্তের দ্রষ্টা। এদের মধ্যে শুক্রের সূক্ত সংখ্যা সর্বাধিক। ভৃগ্বঙ্গিরাদেরও বহু সূক্ত আছে। অতএব অথর্ববেদের ‘ভৃগ্বঙ্গিরোবেদ’ নামটি সম্পূর্ণ সঙ্গত।

অথর্ববেদ ও দৈত্যদেশ— উশনা শুক্র যে দৈত্যদের গুরু ছিলেন, তা সুপ্রসিদ্ধ। পারস্য, কালদিয়া, ব্যাবিলোনিয়া প্রভৃতি দেশই ছিল দৈত্যদেশ। শুক্র নিশ্চয়ই এই সব দেশে তাঁর পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত আথর্বণ শ্রুতির প্রচার করেছিলেন। এই কারণেই এই দেশগুলির ভাষায় বহু আথর্বণ শব্দ প্রচলিত হয়ে যায়। উপরে উল্লিখিত ‘আলিঙ্গী’ প্রভৃতি শব্দ সেইগুলির অন্তর্গত। অতএব বাল গঙ্গাধর তিলকের এই মত যে, এই শব্দগুলি কালদিয়ার ভাষা থেকে অথর্ববেদে প্রবেশ করেছে— তা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই শব্দগুলি বরং শুক্রের মাধ্যমে অথর্ববেদ থেকে কালদিয়ার ভাষায় গিয়েছে।

ইউরোপ দৈত্যদের বংশধরদের দ্বারা বসতিস্থাপিত হয়েছিল— এর বিশদ আলোচনা এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা ৫১–৬১ এবং ভাষার ইতিহাস পৃষ্ঠা ১০৮–১০৬-এ দ্রষ্টব্য।

১. দেখুন পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা ৫১–৬৩

অঙ্গিরা কুলের তেত্রিশ ঋষি— অঙ্গিরা কুলের নিম্নলিখিত তেত্রিশ ঋষির নাম পুরাণে লিখিত আছে—

১. অঙ্গিরা ২. ত্রিত ৩. ভারদ্বাজ বাস্কল ৪. ঋতবাক ৫. গর্গ ৬. শিনি ৭. সংকৃতি ৮. গুরুবীত ৯. মান্ধাতা ১০. অম্বরীষ ১১. যুবনাশ্ব ১২. পুরুকুৎস ১৩. ত্রসদস্যু ১৪. সদস্যুমান ১৫. আহার্য ১৬. অজমীঢ় ১৭. ঋষভ ১৮. কপি ১৯. পৃষদশ্ব ২০. বিরূপ ২১. কণ্ব ২২. মুদ্গল ২৩. উতথ্য ২৪. শরদ্বান্ ২৫. বাজশ্রবা ২৬. অয়াস্য ২৭. সুবিত্তি ২৮. বামদেব ২৯. অসিজ ৩০. বৃহদুক্ত ৩১. দীর্ঘতমা ৩২. কক্ষীবান্।

এই কুলে আরও ছয়জন ব্রহ্মবাদী কাশ্যপ রয়েছেন। তেত্রিশতম নামটি অশুদ্ধ পাঠের কারণে লুপ্ত হয়ে গেছে। এই বত্রিশটি নামের মধ্যেও অনেকগুলির শুদ্ধ রূপ আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই অঙ্গিরা গোত্রে পরে বহু শাখা গড়ে ওঠে, যেমন— কণ্ব, মুদ্গল, কপি ইত্যাদি। এই কুলের মূল পুরুষ অঙ্গিরা ছিলেন অত্যন্ত প্রাচীন ব্যক্তি। অঙ্গিরা কুলের এই মন্ত্রদ্রষ্টাদের মধ্যে মান্ধাতা, অম্বরীষ ও যুবনাশ্ব প্রভৃতি ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজা অম্বরীষও এক অতি প্রাচীন ব্যক্তি ছিলেন। মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে নাভাগ অম্বরীষ নামে তাঁর উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। অঙ্গিরারও অথর্ববেদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্বতন্ত্রভাবে এবং ভৃগুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর বহু সূক্ত অথর্ববেদে রয়েছে।

কাশ্যপ কুলের ছয় ঋষি

১. কাশ্যপ
২. বৎসার
৩. নৈধ্রুব
৪. রেভ্য
৫. অসিত
৬. দেবল

কাশ্যপ কুলে এই ছয়জন ঋষি হয়েছেন। এদের মধ্যে অসিত ও দেবলের সঙ্গে মহাভারতকালের একই নামধারী ব্যক্তিদের সম্পর্ক আছে বলে জানা উচিত। সম্ভবত উভয়েই পিতা-পুত্র ছিলেন এবং অত্যন্ত দীর্ঘজীবী ছিলেন।

ছয় আত্রেয় ঋষি

১. অত্রি
২. অর্চনানা
৩. শ্যাবাশ্ব
৪. গবিষ্ঠির
৫. আবিহোত্র
৬. পূর্বাতিথি

পঞ্চম নামটির বহু পাঠান্তর রয়েছে। সম্ভবত এই নামটি ‘অন্ধিগু’। অন্ধিগু গবিষ্ঠিরের পুত্র এবং ঋগ্বেদ ৬.১০১-এর ঋষি।

সাত বাসিষ্ঠ ঋষি

১. বসিষ্ঠ
২. প্রাক্তি
৩. পরাশর
৪. ইন্দ্রপ্রমতি
৫. ভরদ্বসু
৬. মৈত্রাবারুণি
৭. কুণ্ডিন

বসিষ্ঠ কুলে এই সাতজন ব্রহ্মবাদী ছিলেন। এদের মধ্যেই একজন পরাশর, যিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পিতা। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মহাভারত ও বেদান্তসূত্রে মন্ত্রকে নিত্য বলেছেন। কৃষ্ণের মতো সত্যবক্তা ঋষি যখন তাঁর পিতার দৃষ্ট মন্ত্রগুলিকে নিত্য বলেন, তখন এই নিত্য-সিদ্ধান্তের গভীর বিচার করা উচিত। বহু আধুনিক ব্যক্তি এখনও বেদের নিত্য-সিদ্ধান্ত সম্যকভাবে বুঝতে অক্ষম।

তেরো ব্রহ্মিষ্ঠ কৌশিক ঋষি

১. বিশ্বামিত্র
২. দেবরাত
৩. উদ্দাল (বল)
৪. মধুচ্ছন্দা
৫. অঘমর্ষণ
৬. কীল
৭. লোহিত
৮. কত
৯. অষ্টক
১০. দেবশ্রবা
১১. রেণু
১২. পূরণ
১৩. ধনঞ্জয়

মৎস্য পুরাণে আরও দুইটি নাম যোগ করা হয়েছে। সেগুলি হল— শিশির এবং শালঙ্কায়ন। বসিষ্ঠদের বর্ণনার পর বায়ু পুরাণের পাঠ ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে। বায়ু পুরাণ ৬১।৬৩ অনুসারে দেবরাতের কৃত্রিম পিতা বিশ্বামিত্রের প্রকৃত নাম ছিল বিশ্বরথ। বিশ্বরথের পিতার নাম ছিল গাধি। গাধির পর বিশ্বরথ রাজ্য শাসন করেন। কিছুদিন রাজ্য শাসনের পর বিশ্বরথ রাজ্য ত্যাগ করে বারো বছর কঠোর তপস্যা করেন। এই বিশ্বরথের সঙ্গে বসিষ্ঠের বৈরিতা সৃষ্টি হয়। সত্যব্রত ত্রিশঙ্কু নামে অযোধ্যার এক রাজকুমার ছিল। বিশ্বরথ তাকে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন। তারই পুত্র ছিলেন হরিশ্চন্দ্র এবং পৌত্র ছিলেন রোহিত। তপস্যার ফলে এই বিশ্বরথ ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হননি, বরং ঋষি হয়েছিলেন। ঋষি হওয়ার পর তাঁর নাম হয় বিশ্বামিত্র। যজ্ঞে তিনি শুনঃশেপ দেবরাতকে নিজের কৃত্রিম পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এই কাহিনি প্রসিদ্ধ। মধুচ্ছন্দা ও অঘমর্ষণ ধর্মের সুবিদ্বান ছিলেন।

তিন আগস্ত্য ঋষি

১. অগস্ত্য
২. দৃঢ়দ্যম্ন (দৃঢ়ায়ু)
৩. ইন্দ্রবাহু (বিধ্মবাহ)

এই তিনজন অগস্ত্য কুলের ঋষি ছিলেন।

দুই ক্ষত্রিয় মন্ত্রবাদী

বৈবস্বত মনু এবং ঐল রাজা পুরুরবা— এই দুইজন ক্ষত্রিয় ঋষি ছিলেন।

তিন বৈশ্য ঋষি

১. ভলন্দন
২. বৎস
৩. সংকীল

এই তিনজন বৈশ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। বৈবস্বত মনু মূলত ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে তিনি ক্ষত্রিয় হন। তাঁর পুত্র ছিলেন নাভানেদিষ্ঠ। নাভানেদিষ্ঠ ক্ষত্রিয় হননি, তিনি বৈশ্য হয়েছিলেন এবং সেই কুলেই এই তিন ঋষির জন্ম হয়।

এইভাবে মোট ঋষির সংখ্যা ছিল ৬২। তাদের বিবরণ নিম্নরূপ—

ভৃগু — ১৬
আঙ্গিরস — ৩৩
কাশ্যপ — ৬
আত্রেয় — ৬
বাসিষ্ঠ — ৭
কৌশিক — ১৩
আগস্ত্য — ৩
ক্ষত্রিয় — ২
বৈশ্য — ৩

মোট — ৬২

ব্রহ্মাণ্ডে মোট সংখ্যা ১০ লিলী, কিন্তু মালয় অনুযায়ী সংখ্যা ৬২ মাত্র। ব্রহ্মাণ্ডের পাঠ অসম্পূর্ণ মনে হয়। এর পরেও ব্রহ্মাণ্ডে এই বিষয়ের কিছু পাঠ আরও পাওয়া যায়। বায়ুর পাঠ ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে এবং মত্যের পাঠ এই সংখ্যাকে গণনা করে ভেঙে যায়। ব্রহ্মাণ্ডে ঋষিপুত্রক এবং অতষীদের বৃত্তান্তও লেখা আছে। ব্রাহ্মণদের প্রবচনকারীরা শেষ প্রকারের ঋষিরাই। তাদের নাম ব্রাহ্মণ অংশে লেখা হবে।

বদ মন্ত্র, মন্ত্র-দ্রষ্টা ঋষিদের থেকে প্রাপ্ত মন্ত্র বিদ্যমান

আমরা পৃঃ ২৬৫-এ লিখেছি যে, যে ঋষিদের নাম এখন মন্ত্রগুলির সাথে অনুক্রমণিতে স্মরণ করা হয়; তারা প্রায়শই মন্ত্রগুলির শেষ ঋষি। মন্ত্রগুলি তাদের পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। এই বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য আমরা আমাদের ঋগ্বেদে বক্তৃতায় দুটি প্রমাণ দিয়েছি। সেই দুটি প্রমাণ এবং কিছু নতুন প্রমাণ নিচে দেওয়া হলো—

১. তাইত্তিরীয় সংহিতা ৩.১, ৬.৩০, মৈত্রায়ণী সংহিতা ১.৫৮ এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.১৪-এ একটি কাহিনী পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে যে মনুর অনেক পুত্র পিতার আজ্ঞা অনুযায়ী পিতার সম্পত্তি ভাগ করেছেন। তাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাভানেদিষ্ঠ তখনও ব্রহ্মচর্য বাস করছে। গুরুকুল থেকে ফিরে নাভানেদিষ্ঠ পিতার কাছে নিজের অংশ চায়। অন্যান্য দ্রব্য না থাকায় পিতা তাকে দুইটি সূক্ত এবং একটি ব্রাহ্মণ দিয়ে বলেন যে আঙ্গিরস ঋষি স্বর্গের কামনা নিয়ে যজ্ঞ করছেন। যজ্ঞের মধ্যে তারা ভুল করে বসেন। তুমি এই সূক্তগুলি দিয়ে সেই ভুল দূর করো। যারা দক্ষিণা দেব, সেটি তুমি নিজের অংশ মনে করো। এই সূক্তগুলি ঋগ্বেদ দশম মণ্ডলের সুপরিচিত ৬১, ৬২ সূক্ত। ব্রাহ্মণের একটি পাঠ তাইত্তিরীয় সংহিতার ভাষ্যে ভট্ট ভাস্কর মিশ্র দিয়েছেন। অনুক্রমণী অনুযায়ী এই সূক্তগুলির ঋষি নাভানেদিষ্ঠ। নাভানেদিষ্ঠের নামও ৬১.১৮-এ পাওয়া যায়। এই কাহিনীর অর্থ হলো যে এই সূক্তগুলি নাভানেদিষ্ঠের যুগের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তবে এই সূক্তগুলির ঋষি সেই নাভানেদিষ্ঠই।

২. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬.১৬ এবং গোপথ ব্রাহ্মণ ৬.১-এ লেখা আছে যে ঋগ্বেদ ৪.১৬ ইত্যাদি সমপাৎ ঋচাগুলি বিশ্বামিত্র প্রথম (প্রথমং) দেখেছিলেন। এর পর বিশ্বামিত্র থেকে দেখা সেই সমপাৎ ঋচাগুলি বামদেব সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কাত্যায়ন সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী এই ঋচাগুলির ঋষি বামদেব, বিশ্বামিত্র নয়। এই ঋচাগুলি বামদেব ঋষির আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল।

৩. কাউষীতকি ব্রাহ্মণ ১২.২ থেকে কভস ঋষির উল্লেখ শুরু হয়। সেখানে লেখা আছে যে কভস ১৫ ঋচা বিশিষ্ট ঋগ্বেদ ১০.৩০ সূক্ত দেখেছেন। এর পর তিনি এটি যজ্ঞে ব্যবহার করেছিলেন। কাউষীতকি ব্রাহ্মণ ১২.৩-এ পুনরায় লেখা হয়েছে— কভসवंষ মহিমা সূক্তस्य চানুভেদিতা

অর্থাৎ, কভসের এই মহিমা হলো, তিনি ১০.৩০ সূক্তের উত্তরবর্তী জানার ব্যক্তি।

এর থেকে জানা যায় যে কভসের আগে এই সূক্ত জানেন এমন ঋষিরা ইতিমধ্যেই ছিলেন। অনেক স্থানে বিদ্ ইত্যাদি ধাতুর সঙ্গে অনু অর্থক্রমক্রমে বা অনুক্রম অনুযায়ী হয়। তবে একই স্থানে অনু অর্থ পরেও হতে পারে। অতএব কাউষীতকি বচনের যে অর্থ আমরা নিয়েছি, তা এই বচনের সরাসরি অর্থ।

১. উপরে পৃঃ ১৩০-১৫৫ দেখুন (পুস্তকে)। 

মিত্রবর শ্রী পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জীর শিষ্য ব্রহ্মচারী পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংশক-এর একটি প্রবন্ধ আর্য-সিদ্ধান্ত বিতর্কে প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম—ঋষি কী বৈদিক মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন? সেখানে তিনি চারটি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যা আমাদের পূর্বোক্ত পক্ষকেই শক্তিশালী করে। সেই প্রবন্ধ থেকে দুটি প্রমাণ সংক্ষিপ্তভাবে এখানে দেওয়া হলো। বাকি দুই প্রমাণের বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি—

১. সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী কস্য নুনং… ঋগ্বেদ ১.২৪-এর ঋষি আজীরগাত, অজীগর্ত-এর পুত্র দেবরাত। এই দেবরাতই বিশ্বামিত্রের কৃত্রিম পুত্র হয়ে শুনঃশেপ নামে পরিচিত হন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩৩.৩,৪-এও বলা হয়েছে যে শুনঃশেপ কস্য নুনং ঋক্ দ্বারা প্রজাপতির স্তুতি করেছেন। বররুচি-কৃত নৃপুক্ত সমুচ্ছয়-এও এই সূক্তের বিষয়ে একটি আখ্যান রয়েছে। তার অনুযায়ী এই সূক্তের দর্শক অজীগর্ত নিজেই। যদি নৃপুক্ত সমুচ্ছয়-এর পাঠ ভ্রান্ত না হয়ে যেত, তবে শুনঃশেপের আগে ফস্য নুনং ইত্যাদি মন্ত্র বিদ্যমান ছিল।

২. তাইত্তিরীয় সংহিতা ৫.২.৩ এবং কাঠক সংহিতা ২০.১০-এ ঋগ্বেদ ৩.২২ সূক্ত বিশ্বামিত্র দ্বারা দর্শিত হয়েছে। সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী এই সূক্ত গাথী-গাধী-এর। এটি নির্দেশ করে যে বিশ্বামিত্রের আগে এই সূক্ত গাধীর কাছে ছিল।

অনেক প্রমাণ থেকে আমরা দেখিয়েছি যে মন্ত্রদর্শক ঋষি মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন না। তারা ছিলেন মন্ত্রার্থ-প্রকাশক বা মন্ত্র বিনিয়োজক। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদি ঋষি মন্ত্রদর্শক ছিলেন। এই ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির যুগ মহাভারত যুগের বহু আগে। মহাভারত যুদ্ধের সময় বিক্রম থেকে প্রায় ৩০৪০ বছর পূর্বে। তাই চিন্তা করা উচিত, যখন বৈদিক মন্ত্র ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির যুগের বহু আগে, অর্থাৎ বিক্রম থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে বিদ্যমান ছিল, তখন বলা যে ঋগ্বেদের কাল খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০–২০০০ বছর আগে, এটি কেবল বিভ্রান্তি।

যে আধুনিক গবেষকরা ভাষাতত্ত্ব (Philology)-এ অধিক গুরুত্ব দিয়ে বৈদিক মন্ত্রের কাল খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০–১৫০০ বছর নির্ধারণ করেন, তাদের উচিত ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির মন্ত্রের ভাষা পরাশরের মন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা। পরাশর ভারতযুদ্ধ যুগের, কিন্তু ভৃগু, অঙ্গিরা বহু আগে। তখন তারা বুঝতে পারবে যে তাদের ভাষাগত কৌশল বৈদিক মন্ত্রের কাল নির্ধারণে সহায়ক নয়। বৈদিক মন্ত্রের কাল কেবল ঐতিহাসিক ক্রম অনুসারে নির্ধারণযোগ্য, এবং সেই অনুযায়ী বৈদিক মন্ত্র যুগ-কাল থেকে চলে আসছে। ঋষিদের ইতিহাসই আমাদের এই ফলাফলে পৌঁছে দিয়েছে।

মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি প্রাদুর্ভাব

উপরোক্ত প্রমাণ থেকে এটি নিশ্চিত হয় যে মন্ত্রের প্রাদুর্ভাব বারবার হয়েছে। এজন্য একাধিকবার একই সূক্তের অনেক ঋষি হয়েছে। গণনা প্রায় শত পর্যন্ত পৌঁছায়। এটি প্রমাণ করে যে ঋষি মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন না, বরং তারা মন্ত্রদর্শক। এই বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে দেখানো হয়েছে।

১. এর দুটি সংস্করণ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
২. পৃঃ ১৩০ থেকে আগের অংশ।

মন্ত্রার্থ দর্শক ঋষি

মন্ত্রের বারবার প্রাদুর্ভাবের একটি আরও গভীর অর্থ রয়েছে। আমরা জানি, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে একই মন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একই মন্ত্রের ব্যবহারও বিভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। মন্ত্রার্থের এই ভিন্নতা থেকেই এক মন্ত্র বিভিন্ন সময়ে অনেক ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ কারণে প্রাচীন আচার্যরা লিখেছেন যে ঋষি মন্ত্রার্থ দর্শকও ছিলেন। এর জন্য নিম্নলিখিত প্রমাণ বিবেচনীয়—

১. নিরুক্ত ২.৮-এ লেখা আছে যে শাকপূণি সিদ্ধান্ত নিল যে আমি সব দেবতাকে জানব। তার জন্য দুটি লিঙ্গযুক্ত দেবতা প্রাদুর্ভূত হলো। তিনি তাকে জানতে পারলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। সেই দেবতা ঋ০ ১.১৬৪.২৬ সূক্তের নির্দেশ দিল। এটাই “মুজ দেবতা বালা মন্ত্র”। এই প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে দেবতা শাকপূণিকে সূক্তও জানাল এবং ঋগ্বেদসংক্রান্ত অর্থও দেখাল। তখনই শাকপূণি মন্ত্রার্থ জ্ঞান লাভ করলেন এবং দেবতাকে চিনলেন। এই মন্ত্র শাকপূণির আগে থেকেই পরিচিত ছিল। মন্ত্রটি বৈদিকের অংশ ছিল এবং ব্যাস প্রমুখরা আগে থেকেই এটি পাঠ করেছেন। শাকপূণি নিজেও এই মন্ত্রটি পড়েছিলেন। তবুও তার জন্য এই মন্ত্রের নির্দেশ হলো এবং তিনি মন্ত্রে উদ্ভূত লিঙ্গ দেবতা দেখলেন।

২. নিরুক্ত ১৩.১২-এ লেখা আছে—“না হ্যেষু প্রতক্ষমস্ত্যনৃষের তপসো বা”। অর্থাৎ এই মন্ত্রগুলিতে অনুষি এবং তপশূন্যতার সরাসরি প্রকাশ নেই। যারা সংস্কৃত ভাষার মর্ম বোঝেন, তারা এই বাক্য পড়ে বুঝবেন যে এই বাক্যর অর্থ হলো মন্ত্র বহুধা বিদ্যমান থাকে এবং সেই মন্ত্রগুলিতেই ঋষিদের দর্শন ঘটে। যেমন পৃথিবীতে গোলাপের ফুল বহুদিন ধরে আছে, তবুও তার বৈশিষ্ট্যে বৈদ্যের দৃষ্টি মাঝে মাঝে যায়। যখনই দৃষ্টি খোলে, তখনই সেই ফুলের একটি নতুন ব্যবহার উদ্ভাবিত হয়।

এরপর নিরুক্তকার লিখেছেন—

“মনুষ্য বা ঋষিষূত্রক্রমত্সু দেবানন্ বন্ত। কে ন ঋষিঃ ভবিধ্যতি। তেবা এতং তর্কমুধি প্রায়চ্ছন। মন্ত্রার্থচিন্তামিউহমভ্যূলহম। তসমাদ্যদেব কিচানূচানোভ্যূহত্যার্থং তদ্ভবতি।”

এই পুরো বাক্যের অর্থ হলো ঋষিরা প্রায়ই মন্ত্রার্থই বুঝতেন। বেণ্কটমাধব তার ঋগ্ভধ্যের অষ্টম অষ্টকে সপ্তম অধ্যায়ের অনুক্রমণীতে লিখেছেন যে নিরুক্তের এই পাঠ কোনো প্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থের পাঠ। তিনি প্রকৃতপক্ষে এটি ব্রাহ্মণের নামে উদ্ধৃত করেছেন। এটি নির্দেশ করে যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও ঋষিকে প্রায়ই মন্ত্রার্থ দর্শক হিসেবে ধরা হয়েছে। যাস্কের এষু প্রতক্ষম্ পদ থেকে নিরুক্ত ৭.৩-এ এসেছে যে ঋষীণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ঃ-এর সপ্তমি পার্ক অর্থও একই নির্দেশ দেয়। এতে বোঝা যায় যে বিদ্যমান মন্ত্রেও ঋষিদের দর্শন ছিল।

৩. নিরুক্ত ১০.১০-এ লেখা আছে—“না ঋষৃ বর্ষার্থস্য প্রীতি ভবতি আখ্যান সংযুক্তা।” এখানে ‘দৃষ্টার্থ’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ হতে পারে মন্ত্র বা মন্ত্রার্থ। মন্ত্রার্থের অর্থ থেকেই এখানে আমাদের প্রাপ্ত অভিপ্রায় নিশ্চিত হয়।

৪. ন্যায়সূত্র ৪.৬.৬২-এ ভাষ্য করতে গিয়ে কোনো ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রমাণ দিয়ে वात্স্যায়ন মুনি লিখেছেন—

“য় এং মন্ত্রব্রাহ্মণের দর্শক এবং প্রবর্তক, তারা ইতিহাস, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্রেরই।”

পুনঃ সূত্র ২.২.৬২-এর ভাষ্যে বাৎস্যায়ন লিখেছেন—

“য এৱাপ্তা বেদার্থানাং দর্শ্তারঃ প্রবর্তারশ্চ ত এবাযুর্বেদপ্রণৃতীনামিতি।”

এই উক্তি এবং পূর্বের উক্তিগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, ঋষিরা, যাঁরা প্রাপ্তসাক্ষাৎধর্মের অধিকারী ছিলেন, তাঁরা বেদার্থের দর্শকও ছিলেন। এই বেদার্থ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বিদ্যমান, তাই বলা যায় ঋষিরা বেদার্থরূপী ব্রাহ্মণের দর্শক ছিলেন। এর অর্থ হলো, সময়ে সময়ে একই মন্ত্র বিভিন্ন ঋষির কাছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার প্রদর্শিত হয়েছে।

৫. যজুর্বেদ’এর সপ্তম অধ্যায়ে ৪৬তম মন্ত্র—

“ব্রাহ্মণমদ্য বিদেয়ং পিতুমন্তং পৈত্র্যমুষি- মার্ষেয়ম্।”

এখানে ঋষি পদ নিয়ে ব্যাখ্যায় উওট লিখেছেন— ঋষিঃ মন্ত্রাণাং ব্যাখ্যাতা। অর্থাৎ ঋষি মন্ত্রের ব্যাখ্যাতা।

৬. বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২.৬.৩৬-এ ঋষি পদ পাওয়া যায়। এর ব্যাখ্যায় গোবিন্দ স্বামী লিখেছেন— ঋষিঃ মন্ত্রার্থজ্ঞঃ। অর্থাৎ ঋষি মন্ত্রার্থের জ্ঞানী।

কাশিকার জ্ঞানের সমালোচনা—
সংস্কৃত ভাষা-জ্ঞান: আয়ুর্বেদ ইতিহাস’এর প্রথম ভাগের সমালোচনায় পূণায় কাশিকার জি লিখেছেন যে, वातস্যায়নের উক্তি এটি প্রকাশ করে না যে আয়ুর্বেদ, ইতিহাস, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্রের রচয়ীতারাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রবর্তক ছিলেন।

এই প্রবন্ধ থেকে বোঝা যায়, অসত্য ইউরোপীয় পক্ষের পক্ষপাত এবং হঠের কারণে কাশিকার জি এমন একটি ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েছেন, যা ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষিতরাও স্বপ্নেও জানতেন না। ন্যায়শাস্ত্রের এই উক্তির প্রাসঙ্গিক অর্থ কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি থেকে পড়ে বোঝা যায়। ইউরোপীয় কল্পিত-পক্ষের গবেষকরা এটি কেবল উপহাসের বিষয়।

৭. ভৃগু-প্রোক্ত মনুস্মৃতি’র প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকান্তর্গত ‘মহর্ষয়ঃ’ পদে মেধা-তিথি লিখেছেন—

“শ্রঋষিবন্দঃ। তদধ্যয়ন-বিজ্ঞান-তদর্থানুষ্ঠানাতিশয়যোগাত পুরুষে অপিউষিশব্দঃ।”

অর্থাৎ বেদের অধ্যয়ন, বিজ্ঞান, অর্থানুষ্ঠান ইত্যাদির কারণে ‘পুরুষ’ ও ক্ষেত্রে ঋষি শব্দ ব্যবহার হয়।

এভাবে অনেক প্রমাণ থেকে জানা যায়, মন্ত্রার্থদর্শক ঋষির জন্যও ‘ঋষি’ শব্দের ব্যবহার প্রাচীন সাহিত্যেই চলিত হয়েছে।

মন্ত্র থেকে নেওয়া বহু ঋষির নাম
আমরা পৃঃ ২৬৬-এ লিখেছি, বিশ্বরথ নামের রাজা তীব্র তপস্যা করেছিলেন। এই তপস্যার প্রভাবে তিনি ঋষি হন। ঋষি হওয়ার পর তার নাম হয়ে যায় বিশ্বামিত্র। এটি নির্দেশ করে যে ঋষি হওয়ার পর অনেকেই নিজেদের নাম পরিবর্তন করে বেদের কোনো শব্দ নিজের নামে ব্যবহার করেছেন। শিবসংকল্প ঋষিও যজুঃ ৩৪.১ থেকে শিবসংকল্প শব্দ নিয়ে নাম নিয়েছেন।

এই বিষয়ের সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন পরলোকগত মিত্রবর শ্রী শিবশঙ্কর জী কাব্যতীর্থ তাদের বৈদিক ইতিহাসে।

সূত্র: বুলেটিন অব দ্য ভাণ্ডারকর অরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৫৪।

সার্থ নির্নয় পৃঃ ২৪–২৯ পর্যন্ত এ বলা হয়েছে। ঐতরেয়ারণ্যক-এর প্রমাণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বামিত্র, গৃত্সমদ প্রভৃতি নাম প্রাণবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একইভাবে, ওমদেব, অত্রি এবং ভারত্বাজ নামও সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

শতপয় ব্রাহ্মণ-এর প্রমাণ অনুযায়ী, বাসিষ্ঠ প্রভৃতি নাম ইন্দ্রিয়দের নির্দেশ করে। ঋগ্বেদ ১০.১৫১-এর বালে শ্রদ্ধাসূক্ত-এর ঋষিকা হলো শ্রদ্ধা কামায়নী। এই কন্যা নিশ্চয়ই তার নাম পরিবর্তন করেছে। এই ধরনের বহু প্রমাণ সংক্ষেপে উক্ত গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। বিচক্ষণ পাঠক সেই সূত্র থেকে এগুলো অধ্যয়ন করবেন। ইতিহাসবিজ্ঞানের ভিত্তিতে, যারা বেদপাঠ করেন, তাদের হৃদয়ে স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রকাশ পাবে যে, বেদ মন্ত্রের আশ্রয়ে বহু ব্যক্তি বহু নাম নিয়েছেন বা পরিবর্তন করেছেন। এজন্যই ভগবান মনু ভৃগু-প্রোক্ত শাস্ত্রে ১.২১-এ বলেছেন—

“সর্বেষাং তু স নামানী কর্মাণী চ পৃথক্ পৃথক্। বেদশব্দেব্য এবাদৌ পৃথক্ সংস্হাশ্চ নির্মমে।”

অর্থাৎ বেদের শব্দ থেকেই আদিতে বহু পদার্থের নাম স্থাপন করা হয়েছে।

আর্য ধর্মের জীবনদাতা ঋষি

আর্য ধর্মের জীবনদাতা এই ঋষিরা ছিলেন। এদের উপদেশ থেকেই আর্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। এই ঋষিদের মান্যতা আর্য সম্রাটগণ তাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য মনে করতেন। বিশাল সাম্রাজ্যশালী সম্রাটগণও তাদের কন্যাদের এই ঋষিদের বিবাহে দিতেন এবং এটিকেই গৌরব মনে করতেন। উদাহরণস্বরূপ, জানশ্রুতি তার কন্যা রক্কাকে দিয়েছে, লোপামুদ্রা রাজকন্যা ছিলেন, এবং সুকন্যা সম্রাট শর্যতীর কন্যা ছিলেন।

এই ধরনের বহু উদাহরণ মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে বিদ্যমান। যখন ঋষিরা আর্য রাজাদের সভায় যেতেন, তখন রাজারা রত্ন, ধন, ধান্য দিয়ে তাদের মান্যতা দিতেন। ঋষিদের চেয়ে আর্য জনদের মধ্যে আর কারো স্থান ছিল না। তাদের কথা প্রমাণস্বরূপ ছিল। তারা সরাসরি ধর্মের ধারক ছিলেন, পরম সত্যবাদী এবং সত্যনিষ্ঠ। তাদের রচিত ধর্মসূত্রগুলোতে নানা প্রক্ষেপ থাকলেও প্রাচীন আর্য ধর্মের একটি উজ্জ্বল রূপ প্রতীয়মান।

বর্তমান দুঃখগ্রস্ত পৃথিবীর জন্য এটি শান্তির একটি মহান উৎস হতে পারে। ধর্ম ও অ-ধর্মের ন্যায্য সিদ্ধান্ত কেবল এই ঋষিদের বাক্য দ্বারা সম্ভব। যাদব কৃষ্ণ সদৃশ তেজস্বী যোগীরা এই ঋষিদের কতটা শ্রদ্ধা করতেন, তা মহাভারত-এ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন ভগবান মধুসূদন দূতকার্যের জন্য যুধিষ্ঠীরের সঙ্গে বিদায় নেন, পথে ঋষিদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা বলেন “হে কেশব, সভায় তোমার বক্তব্য শোনার জন্য আসব।”

এরপর শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুরে পৌঁছান। রাতে বিদুরের গৃহে অবস্থান করেন। প্রাতঃকালে সমস্ত কার্যক্রম থেকে অবকাশ নিয়ে রাজ-সভায় প্রবেশ করেন। সাত্যকী তাদের সঙ্গে ছিলেন। সেই সভায়, রাজাদের মধ্যে অবস্থানরত দাশার্হ আকাশস্থ ঋষিদের দেখেন। তখন, বাসুদেব শন্তনুর পুত্র ভীষ্মজীকে ধীরে ধীরে বললেন—

পাঠিভী সমিতি দর্শন করুক ঋষিসমূহ, রাজা।

নিমন্ত্রণ করা হোক, আসন ও সম্মানসহ শ্রদ্ধা প্রদর্শন কর।
যাদের কাছে বসা যায় না, তাদের উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বসানো সম্ভব নয়।

(উদ্যোগপর্ব, অধ্যায় ৬৪, শ্লোক ৫৪–৫৫)

১. ৪.১.১০৪ সূত্রে মহাভাষ্য অনুসারে বলা হয়েছে, বিশ্বামিত্র তপস্যা করলেন, “আমি অনুধি না হই।” তিনি ঋষি হলেন। পুনরায় তপস্যা করলেন, “আমি অষি-এর পুত্র না হই।” তখন গাধি ঋষি হলেন। তিনি পুনরায় তপস্যা করলেন, “আমি অনুষি-এর নাতি না হই।” তখন কুশিক ঋষি হলেন। পিতা এবং পিতামহের পরে ঋষি হলেন।

২. এই বচন সম্পর্কে প্রভাতচন্দ্রের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ পূর্ব পৃঃ ৫০, ২৬-এ দেখুন। অর্থাৎ—
“হে রাজা! পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত এই সভা দেখার জন্য ঋষিগণ পর্বত থেকে এখানে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের বহুবিধ সম্মান ও আসন দিয়ে আদর কর। যতক্ষণ তারা বসেনি, অন্য কেউ বসতে পারবে না। ঋষিদের পূজা সম্পন্ন হলে তারা বসলেন।”

তাদের উপবিষ্ট হলে ভারত গ্রহন করল।
নিষসাদাসনে কৃশ্ণও রাজাসহ যথাসম্মান নিজের আসনে বসলেন।

অর্থাৎ ঋষিদের বসার পর কৃশ্ণজী তাদের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন, এবং অন্যান্য রাজারা নিজেদের আসনে বসলেন।

নিজের জ্ঞানদাতাদের, ধর্মসংরক্ষকদের, ধর্মপ্রচারকদের এবং দ্যিভ জ্ঞানসঞ্চয়কারীদের প্রতি কত শ্রদ্ধা রয়েছে। এই ভূমিতে অন্য কোন জাতি কি এমন দৃশ্য স্থাপন করেছে? কোথায় বড় বড় সম্রাটগণ এমন ধনহীন ব্যক্তিদের সামনে নত হয়েছেন? সত্যিই আর্য সংস্কৃতি মহান এবং অনন্য। এই শ্রদ্ধাতেই এই সংস্কৃতির জীবন এবং প্রাণ নিহিত ছিল।

বেদের সমার্থক ঋষি শব্দ

অনেক প্রাচীন ভাষ্যকার বহু প্রসঙ্গে ঋষি শব্দকে বেদের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই প্রবণতা কখন থেকে শুরু হয়েছে, তা ইতিহাসগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেজন্য নিচে প্রদর্শন করা হলো—

১. ভোজরাজ কৃত উণাদিসূত্র ২.১.১৫৬-এর ব্যাখ্যায় দণ্ডনাথ নারায়ণ লিখেছেন—
“ঋষিঃ বেদঃ।” অর্থাৎ ঋষি বেদকে বোঝায়।

২. হদত্তমিশ্র পাণিনীয় সূত্র ১.১.১৮-এর পদমঞ্জরী ব্যাখ্যায় লিখেছেন—
“ঋষি-বন্দঃ। তদুক্তমৃষিণা ইত্যাদৌ দর্শন।”

অর্থাৎ— ব্রাহ্মণ গ্রন্থের তদুক্তমুষিণ পাঠের অনুরোধে ঋষি শব্দের অর্থ বেদ।

৩. বৈজয়ন্তিকোষে যাদবপ্রকাশ লিখেছেন— “ঋষি-ত্বেবে-বে।” অর্থাৎ ঋষি শব্দ বেদের অর্থে ব্যবহৃত হয়।

৪. মনু ভাধ্যকার মেধাতিথির “ঋষিঃ বেদঃ” প্রমাণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

৫. অষ্টম শতাব্দীর আগে শাশ্বত কোষ শ্লোক ৭১৬-এ লেখা— “বিবেণ দে।” এইসব প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত ঋষি শব্দের বেদ অর্থ সুপরিচিত ছিল। কতকাল আগে এই অর্থ প্রচলিত হয়েছে, তা বিবেচনা করার বিষয়।

বেদ এবং ঋষিদের বিষয়ে তৎগত বুদ্ধের সম্মতি

শান্তরক্ষিত তাঁর তত্ত্বসংগ্রহে লিখেছেন—
“যয়োক্তং ভগবতা ইত্যেতে আনন্দ পौरাণ মহর্ষয়ো বেদানং কর্তাগে মন্ত্রাণাং প্রবর্তয়িতারঃ।” (১০ ১৪)

অর্থাৎ— “ভগবান বুদ্ধ বলেছেন— হে আনন্দ! এরা প্রাচীন মহর্ষি ছিলেন, যারা বেদ রচনা করেছেন এবং মন্ত্র প্রচলন করেছেন।”

মন্ত্র প্রচলনের মাধ্যমে বুদ্ধের উদ্দেশ্য কী, তা বিবেচ্য। বুদ্ধের কৃতবেদদের দ্বারা বোধহয় সেই শাখার প্রবক্তাদের বোঝানো হয়েছে। বুদ্ধ যদি বেদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা দেখাতেন, তাও তাঁর অনুচরদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

মজ্জিমনিকায় ২.৫.৫-এ বুদ্ধ বলেছেন— ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ ঋষি: অট্টক, যামক…

পুনরায় মজ্জিমনিকায় ২.৫.৬-এ বুদ্ধ বিহারের ধাওস্তী উল্লেখ করেন। শ্রাবস্তীর জেত-বনে বুদ্ধ বলেন—
“মাণব, যে তারা বেদের রচয়িতা, মন্ত্রের প্রবক্তা এবং ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ ঋষি ছিলেন, যাদের গীতি, সঙ্গীত এবং প্রাচীন মন্ত্র আজও ব্রাহ্মণরা সেই অনুযায়ী পাঠ করে।”

(সেখানে পূর্বপুরুষ ঋষি যেমন— অট্টক-অষ্টক, বামক-বামদেব, বিশ্বামিত্র, জামদাগ্নি, অঙ্গিরা, ভারদ্বাজ, বাসিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু)।

এই বচনে “বামক” সম্ভবত বামদেবকে বোঝায় এবং বাকী আট ঋষি প্রযোজ্য। পালি ভাষায় তারা “অট্টক” নামে পরিচিত। মজ্জিমনিকায় এই বচন থেকে বোঝা যায় যে শান্তরক্ষিতের পাঠে “প্রবর্তয়িতারঃ” এর স্থলে “প্রবক্তারঃ” পাঠ থাকা উচিত।

তত্ত্বার্য শ্লোকবার্তিকের রচয়িতা বিদ্যানন্দ স্বামী সূত্র ১.২০-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন—

“তত্কারণং হি কাণাদাঃ স্মরন্তি চতুরাননম্। জৈনাঃ কালাসুরং বৌদ্ধাঃ স্বষ্টকাত্সকালাঃ সদা।” (৩৬)

অর্থাৎ— বৈশেষিক দর্শনের ব্রহ্মা থেকে বেদ উৎপত্তি মানা হয়, জৈনরা কালাসুর থেকে এবং সকল বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্বষ্টক থেকে বেদ উৎপত্তি মানে।

জৈনরা কিভাবে কালাসুর থেকে বেদ উৎপত্তি মানে, তা জৈন ইতিহাসেই লেখা আছে। বিদ্যানন্দ স্বামী এখানে বৌদ্ধদের যে মতটি উল্লেখ করেছেন, তার মূল পূর্বে প্রদর্শিত মজ্জিমনিকায় প্রমাণে পাওয়া যায়। “স্বষ্টক” পদটি সু-অট্টক থেকে উদ্ভূত।

বেদ অনাদি কাল থেকে প্রচলিত। যখনই বেদের ক্ষয় হয় বা প্রচার কম হয়, তখনই ঋষিরা সেই বেদ প্রচার করেন, অর্থ প্রকাশ করেন। প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঋষি কাল কতদূর পর্যন্ত চলল

সাধারণভাবে বলতে গেলে ঋষি কাল কখনো শেষ হয়নি। তপস্যা, যোগ, জ্ঞান বা বেদাভ্যাস দ্বারা যে কেউ ঋষি হতে পারে, তবে এটি অসাধারণ ঘটনা। বর্তমানে বেদমন্ত্র বা মন্ত্রার্থের দর্শন কেবল বিরল ব্যক্তির ভাগ্য হয়। অতীত যুগে যেমন শত শত ঋষির সংখ্যা দেখা গেছে, তা ভারত যুদ্ধের কিছু সময়ের আগ পর্যন্ত দেখা যায়। এটি বায়ু ইত্যাদি পুরাণে উল্লেখ আছে।

যুধিষ্ঠিরের পর, পরিবৃত্ত হস্তিনাপুরের রাজগদী গ্রহণ করেন। পরিবৃত্তের পুত্র জন্মেজয় এবং জন্মেজয়ের পুত্র শাতানীক। শাতানীকের পুত্র ছিলেন অশ্বমেধদত্ত।

বায়ুপুরাণ ৬৬ অধ্যায়ে অশ্বমেধদত্তের পুত্র সম্পর্কে লেখা আছে—

“পুত্রোঃ অশ্বমেধদলাইজাতঃ পরপুরঞ্জয়ঃ” (২৫৭)
“অধিসোমকৃষ্ণো ধর্মাত্মা সাংপ্রতোয়ঁ মহাযশাঃ। যস্মিন প্রচাসতি মহীং ইউষ্মাভিরিদমাহৃতম্। দুরাপং দীর্ঘসত্রং শ্রীণি বর্ষাণি বুশ্চরম্। বর্শদ্বয়ং কুরুক্ষেত্রে বৃষদ্বত্যা দ্বিজোত্তমাঃ।” (২৫৬–২৫৮)

অর্থাৎ— অশ্বমেধদত্তের পুত্র ছিল অধিসোমকৃষ্ণ। তার রাজ্যে ঋষিরা দীর্ঘ সত্র সম্পন্ন করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে বায়ুপুরাণের প্রারম্ভে লেখা আছে—

শাতানীক সম্ভবত কোনো অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এর পর এই পুত্রের জন্ম হয়, এ কারণেই তার এমন নামকরণ করা হয়েছে।

অসোমকৃষ্ণের রাজ্যে ঋষিরা কুরুক্ষেত্রে দৃষদ্বতীর তটে দীর্ঘ সত্র সম্পন্ন করেছিলেন—

“অসোমকৃষ্ণে বিক্রান্তে রাজন্যে অনুপমত্ভিষি। প্রশাসতীমাং ধর্মেণ ভূমি ভূমিসত্তমে।” (১২)
“ঋষযঃ সংশিতাত্মানঃ সত্যব্রতপরায়ণাঃ। ঋজবো নষ্টরজঃ শান্তা দান্তা জিতেন্দ্রিয়াঃ।” (১৩)
“ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে দীর্ঘসত্র তু ঈজিগরে। নদ্যাস্তীরে বৃষদ্বত্যাঃ পুণ্যায়াঃ শুচিরোধসঃ।” (১৪)

অর্থাৎ— অসোমকৃষ্ণের রাজ্যে ঋষিরা কুরুক্ষেত্রে দৃষদ্বতীর তটে একটি দীর্ঘসত্র সম্পন্ন করেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজত্যাগের সময় কালিয়ুগ শুরু হয়। এরপর বংশক্রম অনুযায়ী—

  • পরিবৃত্তের রাজ্যকাল: ৬০ বছর

  • জন্মেজয়: ৮৪ বছর

  • শাতানীক ও অশ্বমেধদত্ত: ৮২ বছর

মোট প্রায় ২২৬ বছর। অসোমকৃষ্ণ এদের পরবর্তী রাজা, যারও রাজ্যকাল দীর্ঘ ছিল। অনুমান অনুযায়ী, তার রাজ্যের ১৫তম বছরে হয়তো দীর্ঘসত্র শুরু হয়। অর্থাৎ কালি সংবত ২৪০-এ এই দীর্ঘযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, যেখানে ঋষিরা উপস্থিত ছিলেন। এই যজ্ঞের ২০০ বছর পরও কিছু ঋষি ছিলেন, কারণ এই যজ্ঞের পরে প্রাচীন গ্রন্থে তাদের উপস্থিতির আর কোনও উল্লেখ নেই। ফলে বলা যায়, কালি সংবত প্রায় ৪৪০–৪৫০ পর্যন্ত ঋষিরা সক্রিয় ছিলেন।

গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতভূমিতে কোনো ঋষি ছিল না। বৌদ্ধ সাহিত্যেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যা দেখায় যে বুদ্ধের সময় ঋষি উপস্থিত ছিলেন। বুদ্ধের সময়ের অনেক আগে থেকেই আধ্যাত্মিক ও আচার্য যুগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধ নিজে তার সময়ের ব্রাহ্মণদের বলেন, তাদের পূর্বপুরুষরা ঋষি ছিলেন—অর্থাৎ তার সময়ে নতুন ঋষি ছিলেন না।

আর্ষ সাহিত্যকাল

যখন ঋষিদের সময়সীমা প্রায় চিহ্নিত হয়ে গেছে, তখন বলা যায় যে সমস্ত আর্ষ সাহিত্য কালি সংবত ৪৫০-এর আগে রচিত। এতে অন্তর্ভুক্ত—

  • ধর্মশাস্ত্র: মনু, বৌধায়ন, আপস্তম্ভ

  • আয়ুর্বেদ: চরক, সুশ্রুত, হরিত, জাটুকণ

  • অর্থশাস্ত্র: ভ্রদ্বাজ, পিশুন, উশনা, বৃশপতি

  • নিরুক্ত: শাকপূণি, ঔর্ণব, ঔপমান্যব

  • দর্শন: বেদান্ত, মীমাংসা, কপিল

  • ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং অন্যান্য সহস্রাধিক আর্ষ শাস্ত্র

যে বিদেশী গ্রন্থকারেরা এই সাহিত্যকে খ্রিস্টপূর্বের মাত্র এক বা দেড় সহস্র বছর পূর্ববর্তী বা খ্রিস্টাব্দের করে দেখিয়েছেন, তারা পক্ষপাতিত্বের কারণে আর্ষ সাহিত্যকে গুরুতর অবমাননা করেছেন।

এই অন্যায় ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্যই এই ইতিহাস লিখার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। যত তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করাচ্ছে যে ভারত-যুদ্ধ যুগ এবং আর্ষ যুগের নির্ণয় প্রাচীন সাহিত্যকের সময়কাল নির্ধারণ করবে। গ্রন্থের অন্যান্য অংশ থেকে এই বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

मूल लेखक द्वारा रचित तथा सम्पादित पुस्तकें

१. ऋग्वेद पर व्याख्यान

२. बार्हस्पत्य सूत्र की भूमिका

३. वैदिक कोष की भूमिका

४. वैदिक वाङ्मय का इतिहास

प्रथम भाग वेदों की शाखाएं

द्वितीय भाग- ब्राह्मण और आरण्यक

तृतीय भाग- वेदों के भाष्यकार

५. भारतवर्ष का बृहद् इतिहास - प्रथम भाग

६. भारतवर्ष का बृहद् इतिहास - द्वितीय भाग

७. भारतवर्ष का इतिहास- गुप्त साम्राज्य के अन्त तक

८. भाषा का इतिहास

e. Western Indologists

१०. वेद-विद्या-निदर्शन

११. Story of Creation as seen by Seers

सम्पादित

१. वाल्मीकीय रामायण (पश्चिमोत्तर पाठ) बाल काण्ड तथा अरण्य काण्ड का कुछ भाग

२. आथर्वण ज्योतिष

३. माण्डूकी शिक्षा

४. अथर्ववेद पञ्चपटलिका

५. उद्‌गीथाचार्य कृत ऋग्वेद भाष्य, दशम मण्डल का कुछ भाग

६. ऋषि दयानन्द सरस्वती का स्वरचित जन्म चरित

७. ऋग्-मन्त्र व्याख्या

८. ऋषि दयानन्द सरस्वती के पत्र और विज्ञापन

१. गुरुदत्त लेखावली- भाषा-अनुवाद


सम्पादक द्वारा लिखित तथा सम्पादित पुस्तकें

१. Sakas in India

२. Irrigation in India

३. प्राचीन भारत में सिचाई

४. वैदिक वाङ्मय का इतिहास - ब्राह्मण तथा आरण्यक ग्रन्थ

नोट: उपलब्ध पुस्तकें प्रणव प्रकाशन से प्राप्य हैं।

Read More

বেদ শব্দ এবং তার অর্থ

29 December 0

বেদ শব্দ এবং তার অর্থ
স্বর-ভেদে বেদ শব্দের দুই প্রকার—স্বর-ভেদের কারণে প্রাচীন গ্রন্থসমূহে বেদ শব্দের দুই প্রকার দেখা যায়। আদ্যোদাত্ত বেদ শব্দ প্রথমা একবচনে একবার পাওয়া যায়। আবার অন্তোদাত্ত বেদ শব্দও পাওয়া যায়। একটি আদ্যোদাত্ত এবং অন্যটি অন্তোদাত্ত। ঋগ্বেদে এটি পনেরোবার ব্যবহৃত হয়েছে, এবং তৃতীয়া একবচনে ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না। যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে অন্তোদাত্ত ‘বেদ’ শব্দ পাওয়া যায়।

বেদ শব্দের এই দুই প্রকারকে লক্ষ্য করেই পাণিনি উঞ্ছাদি ৬।১।১৬০।। এবং বুধাদি ৬।১।২০৩।।—এই দুই গণে বেদ শব্দ দু’বার পাঠ করেছেন। দयानন্দ সরস্বতী তাঁর সৌবর গ্রন্থে উঞ্ছাদি সূত্রের ব্যাখ্যায় লেখেন—করণ কারকে প্রত্যয় হলে ঘঞন্ত বেগ, বেদ, বেষ্ট, বন্ধ—এই চারটি শব্দ অন্তোদাত্ত। … ‘ভেত্তি যেন স বেদঃ’ … এবং ভাব বা অধিকরণে প্রত্যয় হলে আদ্যোদাত্তই বুঝতে হবে।

বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি

১. সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অনুসারে কাথক, মৈত্রায়ণী ও তৈত্তিরীয় সংহিতায় বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিম্নরূপে পাওয়া যায়—

“বেদেন বৈ দেবা অসুরাণাং বিত্তং বেদ্যমবিন্দন্ত তদ্বেবস্য বেদত্বম্।”
তৈ. সং. ১।১৪।২০॥

তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এইরূপ বাক্য পাওয়া যায়—

“বেদিদং দেবভ্যো নিলায়ত। তাং বেদেনান্ববিন্দন্।”

“বেদেন বেদি বিবিদুঃ পৃথিবীম্।”
তৈ. ব্রা. ৩।৩।৬।৬৬॥

উপরিউক্ত প্রমাণসমূহে—অন্ববিন্দন্, অবিন্দন্, অবিন্দন্ত এবং বিবিদুঃ—এই সমস্ত প্রয়োগ পাণিনীয় মতানুসারে ‘বিবিদ্’ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন।

ভট্ট ভাস্কর তৈত্তিরীয় সংহিতার উক্ত প্রমাণের অর্থে লেখেন—

“বিদ্যতে = লভ্যতেऽনেনে ইতি করণে ঘন্। উঞ্ছাদিত্বাদন্তোদাত্তম্।”

১. বেদঃ—ঋগ্বেদ ১।১৭।১৫।। ৩।৫৩।১৪।। প্রভৃতি।

২. বেদেন = স্বাধ্যায়েন—ইতি বেঙ্কটমাধবঃ। তদ্রূপ—বেদেন বেদাধ্যয়নেন ব্রহ্মযজ্ঞে ন—ইতি সায়ণঃ (৮।১৬।৫।)।

৩. বেদঃ—যজুর্বেদ ২।২১।। অথর্ববেদ ৭।২৬।১।।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের উক্ত প্রমাণের অর্থে তিনি লেখেন—বিবিদুঃ = লব্ধবন্তঃ

তৈত্তিরীয় সংহিতার ভাষ্যে ভট্ট ভাস্কর লেখেন—

পুরুষার্থানাং বেদয়িতা বেদ উচ্যতে। ৩।৩।৪।৭।।

২. আনন্দতীর্থ তাঁর বিষ্ণুতত্ত্বনির্ণয় গ্রন্থে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রদর্শনের জন্য পিপ্পলাদ শাখা-সম্পর্কিত কোনো নবীন উপনিষদ অথবা খিল থেকে এইরূপ প্রমাণ প্রদান করেছেন—

নেন্দ্রিয়াণি নানুমানং বেদা হো বেনং বেদয়ন্তি। তস্মাদাহুর্বেদা ইতি পিপ্পলাদশ্রুতিঃ।

৩. সুশ্রুত সংহিতা-তে লেখা আছে—

আয়ুরস্মিন্ বিদ্যতেऽনেনে বা আয়ুর্বিন্বতীতিযায়ুর্বেদঃ। সূত্রস্থান ১।১৪।।

এই বাক্যের ব্যাখ্যায় ডল্হণ লেখেন—

আয়ুঃ অস্মিন্নায়ুর্বেদে বিদ্যতে অস্তি… বিদ্যতে জ্ঞায়তেऽনেনে… বিদ্যতে বিচার্যতেऽনেনে বা…
আয়ুরনেনে বিন্দতি প্রাপ্নোতি ইতি বা আয়ুর্বেদঃ।

সুশ্রুতের উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুশ্রুতকার করণ ও অধিকরণ—উভয় অর্থেই প্রত্যয় মান্য করেছেন। তাঁর টীকাকার ডল্হণ মনে করেন—বিদ্ সত্তায়াম্, বিদ্ জ্ঞানে, বিদ্ বিচারণে এবং বিদ্ (লাভে)—এই সকল ধাতু থেকেই সুশ্রুতকার বেদ শব্দের সিদ্ধি অভিপ্রেত করেছেন।

৪. চরক সংহিতা-তে লেখা আছে—

তন্ত্রায় বেদ ব্যতীতায় বেদঃ। সূত্রস্থান ৩০।২০।।

চরকের টীকাকার চক্রপাণি এ বিষয়ে লেখেন—বেদয়তি বোধয়তি—অর্থাৎ বিদ্ জ্ঞানে ধাতু থেকে কর্তৃ অর্থে প্রত্যয় মেনে বেদ শব্দ গঠিত হয়েছে।

৫. নাট্যশাস্ত্র—নাট্যশাস্ত্র ১।১।। এর বিবৃতিতে অভিনবগুপ্ত লেখেন—

নাট্যস্য বেদনং সত্তা লাভো বিচারশ্চ যত্র তন্নাট্যার্থ দশত্বেন… উচ্যতে।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অভিনবগুপ্ত ভাবার্থেও প্রত্যয় মেনে সত্তা, লাভ ও বিচার অর্থবাহী বিদ্ ধাতু থেকে বেদ শব্দের সিদ্ধি করেছেন।

৬. শব্দকোষ ও তাদের টীকা
অমরকোষ ১।৫।৩।। এর টীকায় ক্ষীরস্বামী লেখেন—

বিবন্ত্যনেনে ধর্মবোধঃ।

সর্বানন্দ তাঁর টীকায় লেখেন—

বিবন্তি ধর্মাবিকমনেনে ইতি বেদঃ।

জৈনাচার্য হেমচন্দ্র তাঁর অভিধান চিন্তামণি (পৃ. ১০৬)-এ লেখেন—

বিন্দত্যনেনে ধর্মবোধঃ।

এই সকল লেখন থেকে জানা যায় যে, ক্ষীরস্বামী, সর্বানন্দ ও হেমচন্দ্র—তিনজনেই করণার্থে প্রত্যয় মেনেছেন; তবে প্রথম দুই পণ্ডিত জ্ঞানার্থক বিদ্ ধাতু থেকে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি মানেন, আর তৃতীয়জন বিদ্ (লাভার্থক) ধাতু থেকে মানেন।

৭. মানবধর্মশাস্ত্র-ভাষ্য—মানবধর্মশাস্ত্র ২।৬।। এর ভাষ্যে মেধাতিথি লেখেন—

ব্যুৎপাদ্যতে চ বেদশব্দঃ। বিদন্ত্যনন্যপ্রমাণবেদ্য ধর্মলক্ষণমচং তস্মাদিতি বেদঃ। তচ্চ
বেদনমেককস্মাদ্ বাক্যাদ্ ভবতি।

—প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভ।

৮. আপস্তম্ব-পরিভাষা-ভাষ্য—আপস্তম্ব সূত্র ১।৩৩।। এর ভাষ্যে কপর্দীস্বামী লেখেন—

নিঃশ্রেয়স্করাণি কর্মাণ্যাবেদয়ন্তি বেদাঃ।

সূত্র ১।৩।। এর বৃত্তিতে হরদত্ত লেখেন—

বেদয়তীতি বেদঃ।

এতে লেখা আছে—
১. ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা—দयानন্দ সরস্বতী স্বামী তাঁর ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা-গ্রন্থে লেখেন—

বিদন্তি জানন্তি, বিদ্যন্তে ভবন্তি, বিন্দন্তি অথবা বিন্বন্তে লভন্তে, বিন্বন্তি বিচারয়ন্তি—সর্বে মনুষ্যাঃ সর্বাঃ সত্যবিদ্যার্থেষু বা বিদ্বাংসশ্চ ভবন্তি তে বেদাঃ।

এইভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কাথকাদি সংহিতার কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত
১. বিদ্ জ্ঞানে,
২. বিদ্ সত্তায়াম্,
৩. বিদ্ (লাভে),
৪. বিদ্ বিচারণে
এই চার ধাতুর যে কোনো একটিতে বা চারটিতেই করণ অথবা অধিকরণে প্রত্যয় মেনে পণ্ডিতগণ বেদ শব্দের সিদ্ধি করে এসেছেন। এবং বহু গ্রন্থকার ভাবার্থে প্রত্যয় মেনেও বেদ শব্দের সিদ্ধি করেন।

বেদ ও ঋষি পরস্পর পর‍্যায়বাচী শব্দ।

স্বামী হরিপ্রসাদ তাঁর বেদ সর্বস্ব গ্রন্থের উপোদ্ঘাতে অধিকরণার্থে প্রত্যয় মানা এবং সত্তা, লাভ ও বিচারার্থক বিদ্ ধাতু থেকে ব্যুৎপত্তি মানাকে অসম্ভব বা নিরর্থক মনে করেন। উপরিউক্ত প্রমাণসমূহের আলোকে এই মত যুক্তিহীন বলেই প্রতীয়মান হয়।

যে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তির প্রকার পূর্বে বলা হয়েছে, সেই বেদ শব্দ বেদ-সংহিতার অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও কোথাও ভাষ্যকারগণ তা থেকে দরভমুষ্টি প্রভৃতি অর্থও গ্রহণ করেছেন, কিন্তু এই অর্থবাচক বেদ শব্দ আমাদের এখানে প্রয়োজনীয় নয়।

বেদ-সংহিতা অর্থবাচক বেদ শব্দকে ভাষ্যকারগণ অন্তোদাত্ত বলে গ্রহণ করেন। বেদ শব্দ দ্বারা এখানে আমাদের অভিপ্রায় মন্ত্র-সংহিতাসমূহ। বহু বিদ্বান মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ—উভয়কেই বেদ বলে মানেন। তাঁদের পরম্পরাও যথেষ্ট প্রাচীন। তাঁদের মতের বিস্তৃত সমালোচনা এই গ্রন্থের ব্রাহ্মণ অংশে রয়েছে।

হিরণ্যকেশীয় শ্রৌতসূত্র ২৭।৭।১৪৪।। এবং আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২।৪।৮।১২।।-এ লেখা আছে—

শব্দার্থ-মারম্ভণানাং তু কর্মখাণ্ডসমাম্নায়সমাপ্তৌ বেদশব্দঃ।

অর্থাৎ—যে কর্মসমূহ প্রত্যক্ষ প্রভৃতি দ্বারা সিদ্ধ নয়, কিন্তু শব্দপ্রমাণ দ্বারা বিধেয়, সেই কর্মগুলির উপদেশ যেখানে সমাপ্ত হয়, সেই সকল গ্রন্থের জন্য বেদ শব্দ ব্যবহৃত হয়।

এর অভিপ্রায় ব্যাজয়ন্তীকার মহাদেব এইরূপে ব্যাখ্যা করেন যে—মন্ত্র, ব্রাহ্মণ ও কল্প—এই তিনটিই বেদ শব্দ দ্বারা অভিপ্রেত। এই লক্ষণ অত্যন্ত ব্যাপক ও আনুষ্ঠানিক।

অতএব এখানে আমরা সাধারণভাবে বেদ শব্দের সিদ্ধির প্রকার প্রদর্শন করেছি। বেদ শব্দের যে সিদ্ধি ও যে অর্থ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নির্দেশ করেছেন, তাতেই সমগ্র অভিপ্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

১।১০।৭—বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ, বেদদের ভাষ্যকার, পৃ. ১৬৭৬।

আগে কী বেদ একটিই ছিল

আর্যাবর্তীয় মধ্যযুগীয় বহু পণ্ডিত এই মত পোষণ করতেন যে আদিতে বেদ একটিই ছিল। দ্বাপর পর্যন্ত তাই চলে এসেছে এবং দ্বাপরের শেষে ভগবান ব্যাস ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ—এই চার ভাগে তা বিভক্ত করেন।

পূর্বপক্ষ—দেখা যাক মধ্যযুগীয় গ্রন্থকারেরা কী লেখেন—

১. মহীধর তাঁর যজুর্বেদ-ভাষ্যের আরম্ভে লেখেন—

তত্রাবীব্রহ্মপরম্পরয়া প্রাপ্তং বেদং বেদব্যাসো মন্দমতীন্মনুষ্যান্ বিচিন্ত্য তৎকৃপয়া চতুর্ধা ব্যস্য ঋগ্যজুঃ সামাথর্বাল্যাংশ্চতুরো বেদান্ পৈলবৈশম্পায়নজৈমিনিসুমন্তুভ্যঃ ক্রমাদুপদিদেশ।

অর্থাৎ—ব্রহ্মার পরম্পরা থেকে প্রাপ্ত বেদ ভগবান বেদব্যাস মন্দবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কথা বিবেচনা করে কৃপাবশত চার ভাগে বিভক্ত করে ঋগ্‌, যজুঃ, সাম ও অথর্ব—এই চার বেদ পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও সুমন্তুকে ক্রমানুসারে উপদেশ দেন।

২. মহীধরের পূর্ববর্তী ভট্টভাস্কর তাঁর তৈত্তিরীয় সংহিতা-ভাষ্যের আরম্ভে লেখেন—

পূর্বং ভগবতা ব্যাসেন জগদুপকারার্থমেকীভূয়স্থিতা বেদা ব্যস্তাঃ শাখাশ্চ পরিছিন্নাঃ।

অর্থাৎ—পূর্বে ভগবান ব্যাস জগতের উপকারার্থে একত্র অবস্থানকারী বেদসমূহকে বিভক্ত করে শাখাগুলি নির্দিষ্ট করেন।

৩. ভট্টভাস্করেরও অনেক পূর্বে আচার্য দুর্গ নিরুক্তের বৃত্তিতে লেখেন—

বেদং তাবদেকং সন্তমতিমহত্ত্বাদ্ দুরধ্যেয়মনেকশাখাভেদেন সমাম্নাসিষুঃ। সুখগ্রহণায় ব্যাসেন সমাম্নাতবন্তঃ। ১।১।২০॥

অর্থাৎ—বেদ প্রথমে একটিই ছিল, অতিশয় বৃহৎ হওয়ায় অধ্যয়নে দুষ্কর ছিল; তাই পরে বহু শাখার ভেদে সমাম্নাত করা হয়। সহজ গ্রহণের জন্য ব্যাস কর্তৃক এর বিভাজন করা হয়।

এই মতের অল্প ভিত্তি পুরাণেও পাওয়া যায়। সেখানে লেখা আছে—

জাতুকর্ণোऽভবন্মত্তঃ কৃষ্ণ পায়নস্ততঃ।
অষ্টাবিংশতিরিত্যেতে বেদব্যাসাঃ পুরাতনাঃ।
একো বেদশ্চতুর্থা তু যৈঃ কৃতো দ্বাপরাবিষু।
৩।৩।১৬।২০॥ বিষ্ণু পুরাণ।

এবং—

বেদশ্চৈকশ্চতুর্ধা তু ব্যস্যতে দ্বাপরাবিষু॥ ১৪৪।১১॥ মৎস্য পুরাণ।

অর্থাৎ—প্রত্যেক দ্বাপরের শেষে একটিমাত্র চতুষ্পাদ বেদ চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই বিভাজন এখন পর্যন্ত আটাশ বার হয়েছে। যিনি এই বিভাজন করেন তাঁর নামই ব্যাস।

উত্তরপক্ষ—দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামী এই মতের খণ্ডন করেন। সত্যার্থপ্রকাশ একাদশ সমুল্লাসে লেখা আছে—

যাঁরা বলেন যে বেদসমূহ ব্যাসজি একত্র করেছিলেন, এই কথা মিথ্যা। কারণ ব্যাসের পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ—পরাশর, শক্তি, বশিষ্ঠ এবং ব্রহ্মা প্রভৃতিরাও চারটি বেদই অধ্যয়ন করেছিলেন।

এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনটি প্রাচীন ও সত্য—তা পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হবে।

(ক) মন্ত্র-প্রমাণ
১. সমস্ত বৈদিক এই বিষয়ে একমত যে মন্ত্র অনাদি। মন্ত্রগত শিক্ষা সর্বকালের জন্য। অতএব যদি মন্ত্রে বহুবচনান্ত বেদাঃ পদ পাওয়া যায়, তবে নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে যে আদিকাল থেকেই বেদ বহু ছিল। এখন দেখা যাক মন্ত্র কী বলে—

যস্মিন্ বেদা নিহিতা বিশ্বরূপাঃ।
৪।৩৫।৬।। অথর্ববেদ।

অর্থাৎ—যে পরব্রহ্মে সমগ্র বিদ্যার ভাণ্ডারস্বরূপ বেদসমূহ স্থিত আছে।

২. পুনরায়—

ব্রহ্ম প্রজাপতির্ধাতা লোকা বেদাঃ সপ্ত ঋষয়োऽগ্নয়ঃ।
তৈমে কৃতং স্বস্ত্যয়নমিন্দ্রো মে শর্ম যচ্ছতু॥

১৬।৬।১২।। অথর্ববেদ।

এখানেও বেদাঃ বহুবচনান্ত পদ এসেছে। এই মন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে আচার্য সায়ণ লেখেন—বেদাঃ সাঙ্গাশ্চত্বারঃ। অর্থাৎ এই মন্ত্রে বহুবচনান্ত ‘বেদ’ পদ দ্বারা চারটি বেদকেই বোঝানো হয়েছে।

৩. আবার তৈত্তিরীয় সংহিতায় একটি মন্ত্র আছে—

বেদেভ্যঃ স্বাহা। ৭।৭।৫।১১।২।।

৪. এই পূর্বোক্ত মন্ত্র কাথক সংহিতা ৫।২।।-এও পাওয়া যায়।

এই সকল প্রমাণ থেকে জানা যায় যে প্রাচীনতম কাল থেকেই বেদ বহু সংখ্যায় প্রচলিত ছিল।

(খ) ব্রাহ্মণ গ্রন্থ-প্রমাণ—এই বিষয়ে ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহের মতও একই। শুধু তাই নয়, সেখানে তো এটাও লেখা আছে যে চারটি বেদ আদিকাল থেকেই প্রচলিত। মাধ্যন্দিন শতপথ ব্রাহ্মণের একাদশ কাণ্ডের স্বাধ্যায়-প্রশংসা ব্রাহ্মণে আদিকাল থেকেই বহু বেদের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। ঐতরেয় প্রভৃতি অন্যান্য ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও একই কথা পাওয়া যায়।

১. কভঠ ব্রাহ্মণে লেখা আছে—

চত্বারি শৃঙ্গা ইতি বেদা বা এতদুক্তা।

অর্থাৎ—“চত্বারি শৃঙ্গাঃ” এই প্রসিদ্ধ মন্ত্রে চারটি বেদেরই উল্লেখ রয়েছে।

২. পুনরায় কাথক শতাধ্যায়ন ব্রাহ্মণের আরম্ভে ব্রহ্মৌদন প্রकरणে অথর্ববেদের প্রাধান্যের বর্ণনা করতে গিয়ে কেবল চারটি বেদেরই উল্লেখ করা হয়েছে—

আয়র্বণো বৈ ব্রহ্মণঃ সমানঃ... চত্বারো হোমে বেদাস্তানেব ভাগিনঃ করোতি, মূলং বৈ ব্রাহ্মণো বেদাঃ, বেদানামেতন্মূলং, যজ্বৃত্বিজঃ প্রাশ্নন্তি তদ্ ব্রহ্মৌদনস্য ব্রহ্মাদনত্যম্।

অর্থাৎ—চারটিই বেদ। তাদের মধ্যে অথর্ববেদ প্রধান—ইত্যাদি।

১। পৃ. ২৬৬, ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক, বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস, ১৬২৭।

৩. গোপথ ব্রাহ্মণ—পূর্ব ভাগে লেখা আছে—

ব্রহ্ম হ বৈ ব্রাহ্মণং পুষ্করে সসৃজে। স… সর্বাংশ্চ বেদান্ ……। ১।১৬।॥

অর্থাৎ—পরমাত্মা ব্রহ্মাকে পৃথিবী-কমলের উপর উৎপন্ন করেন। তাঁর মনে চিন্তা হয়—কোন এক অক্ষরের দ্বারা আমি সমস্ত বেদকে উপলব্ধি করব।

(গ) উপনিষদ্-প্রমাণ—উপনিষদের যেসব অংশে অলংকার, গাথা বা ঐতিহাসিক কাহিনি রয়েছে সেগুলি বাদ দিলে, অবশিষ্ট যে অংশ মন্ত্রময়, তা নিঃসন্দেহে প্রাচীনতম কালের। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে মন্ত্রোপনিষদ বলা হয়। তার একটি মন্ত্র বিদ্বৎসমাজে বহু কাল ধরে প্রসিদ্ধ। এই মন্ত্র থেকে কেবল ব্যাসের পূর্বেই বেদ একাধিক ছিল তাই নয়, সৃষ্টির আরম্ভেই বেদ একাধিক ছিল—এ কথাও সুস্পষ্টভাবে নির্ণীত হয়। সেই প্রসিদ্ধ মন্ত্রটি হল—

यो ब्रह्माणं विदधाति पूर्वं यो वै वेदान्श्च प्रहिणोति तस्मै। ৬।১৮।।

অর্থাৎ—যিনি আদিতে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁর জন্য বেদসমূহ প্রদান করেন।

আমাদের পক্ষের পক্ষে এই প্রমাণ এতই শক্তিশালী যে, এর অর্থ সর্বদিক থেকে বিচার করা আবশ্যক।

(ঘ) শঙ্করাচার্যের প্রমাণ—বেদান্তসূত্র ভাষ্য ১।৩।৩০।। এবং ১।৪।১।।-এ স্বামী শঙ্করাচার্য লেখেন—

ঈশ্বরাণাং হিরণ্যগর্ভাদীনাং বর্তমানকল্পাদৌ প্রাদুর্ভবতাং পরমেশ্বরানুগৃহীতানাং সুপ্তপ্রবুদ্ধবৎ কল্পান্তরব্যবহারানুসন্ধানোপপত্তিঃ। তথা চ শ্রুতিঃ—যো ব্রহ্মাণং… ইতি।

শঙ্করাচার্য এখানে ব্রহ্মা বলতে হিরণ্যগর্ভকেই বোঝান। এই হিরণ্যগর্ভই তাঁর মতে ঈশ্বর। তিনি মানবের ঊর্ধ্বতন। সেই দেব ব্রহ্মার বুদ্ধিতে কল্পের আরম্ভে পরমেশ্বরের কৃপায় বেদসমূহ প্রকাশিত হয়। বাচস্পতি মিশ্র ‘ঈশ্বর’ শব্দের অর্থ করেন—ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্যের অতিশয়সম্পন্ন ব্যক্তি।

বৈদিক দেবতাবাদে এইরূপ স্থানে ‘দেব’ শব্দের অর্থ বহু সময় বিদ্বান মানুষও হয়ে থাকে। অতএব সর্বত্র প্রথমে অধিষ্ঠাতৃ দেবতার কল্পনা করে পরে বৈদিক গ্রন্থসমূহের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য স্থাপন করা কেবল কষ্টসাধ্য কল্পনামাত্র। অতএব এই ক্লিষ্ট কল্পনার অবকাশ নেই।

প্রমাণ আছে যে ব্রহ্মা আদিসৃষ্টির এক বিদ্বান মানুষ—এই অর্থে মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মন্ত্র—

ব্রহ্মা দেবানাং প্রথমঃ সম্বভূব বিশ্বস্য কর্তা ভুবনস্য গোপ্তা।
স ব্রহ্মবিদ্যাং সর্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠামথর্বায় জ্যেষ্ঠপুত্রায় প্রাহ।

এখানেও শঙ্কর অথবা তাঁর পদাঙ্ক অনুসারীরা ‘বেদানাম্’ পদ উপস্থিত থাকায় ব্রহ্মাকে মানবাতীত মনে করেন। কিন্তু পরবর্তী ‘জ্যেষ্ঠপুত্রায়’ পদটি তাঁদের জন্য আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মের তো পুত্রই নেই, সেখানে জ্যেষ্ঠ পুত্র কেমন করে হবে?

যদিও জড় পদার্থের ক্ষেত্রেও কারণ-কার্য সম্পর্কের ভিত্তিতে পুত্র প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এখানে অথর্বা কোনো জড় পদার্থ নয়।

অতএব পূর্বোক্ত প্রমাণে ব্রহ্মাকে মনুষ্যেতর মানা যুক্তিযুক্ত নয়। এই ব্রহ্মাই আদিসৃষ্টিতে অগ্নি প্রভৃতির মাধ্যমে চারটি বেদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

(২) শ্রী গোবিন্দের ব্যাখ্যা—বেদান্তসূত্র ১।৩।৩০।।-এর শাঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রী গোবিন্দ লেখেন—

পূর্বকল্পাদৌ সৃজতি তস্মৈ ব্রহ্মণে প্রহিণোতি গময়তি তস্য বুদ্ধৌ বেদানাবির্ভাবয়তি।

এখানেও যদিও তাঁর অভিপ্রায় অধিষ্ঠাতৃ দেবতাকেই বোঝানো হতে পারে, তথাপি তিনি বেদসমূহের আদিকাল থেকেই বহুবিধ অস্তিত্ব স্বীকার করেন।

(৩) আনন্দগিরীয় ব্যাখ্যা—এই সূত্রের ভাষ্যের উপর লিখতে গিয়ে আনন্দগিরিও ব্রহ্মাকেই বেদসমূহ প্রাপ্ত হওয়ার কথা মানেন—

বিপূর্বী দধাতি করোত্যর্থঃ। পূর্বকল্পাদৌ প্রহিণোতি দদাতি।

অন্য স্থানে শঙ্কর প্রভৃতিরা যে প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন, সেখানেও আমাদের প্রদর্শিত অভিপ্রায়ের সঙ্গে কোনো বিরোধ পড়ে না। এই ব্রহ্মাই আদিব্রহ্মা, যাকে মহাভারতে ধর্ম, অর্থ ও কামশাস্ত্র—এই বৃহৎ ত্রিবর্গশাস্ত্রের উপদেষ্টা বলা হয়েছে।

চার বেদ জানলেই ব্রহ্মা হওয়া যায়। এমন ব্রহ্মা আদিসৃষ্টি থেকে বহুবার হয়ে আসছেন। ব্যাসের প্রপিতামহের পিতাও ব্রহ্মাই ছিলেন। এদের সকলের মধ্যে প্রথম বা আদিসৃষ্টির ব্রহ্মার উল্লেখ মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মন্ত্রে আছে। সেই উপনিষদেই তাঁর বংশপরম্পরা এইভাবে বলা হয়েছে—ব্রহ্মা, অথর্বা, অঙ্গিরঃ, ভারদ্বাজ সত্যবাহ, অঙ্গিরস্‌, শৌনক।

এই শৌনক, বৃহদ্দেবতা প্রভৃতি গ্রন্থের কর্তা, আশ্বলায়নের গুরু শৌনকের থেকেও অনেক পূর্ববর্তী হবেন। অতএব তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসেরও বহু পূর্ববর্তী। এই শৌনককে উপদেশ দিতে গিয়ে ভগবান অঙ্গিরস্‌ বলেন—ঋগ্বেদঃ, যজুর্বেদঃ, সামবেদঃ, অথর্ববেদঃ।

যখন এত প্রাচীন কালে চারটি বেদ বিদ্যমান ছিল, তখন এই কথা বলা যে প্রত্যেক দ্বাপরের শেষে কোনো ব্যাস এক বেদকে চার বেদে ভাগ করেন, অথবা মন্ত্রসমূহ একত্র করে চার বেদ রচনা করেন—এটি যুক্তিসঙ্গত নয়।

(ঙ) প্রাচীন ইতিহাস—পূর্বে প্রদত্ত প্রমাণগুলি ইতিহাসবহির্ভূত গ্রন্থসমূহ থেকে নেওয়া। এখন ইতিহাস এ বিষয়ে কী বলে তা দেখা প্রয়োজন। আমাদের ইতিহাস রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়। এদের মধ্যেই আরও প্রাচীন কালের বহু উপাখ্যান সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের এই ইতিহাসগ্রন্থগুলিকে প্রমাণের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করার জন্য বহু পক্ষপাতদুষ্ট বিদেশি পণ্ডিত চেষ্টা করেছেন। কিছু ভারতীয় পণ্ডিতকেও তাঁদের অনুকরণ করতে দেখা যায়। স্বীকার করা যায় যে এই গ্রন্থগুলিতে কিছু প্রক্ষেপ হয়েছে, কিছু অংশ নষ্ট হয়েছে, কিছু অসংগতিও আছে, এবং কিছু আধুনিক সভ্যতার অনুকূল বলে মনে হয় না; কিন্তু এই সব কারণ দেখিয়ে সমগ্র ইতিহাসের উপর অবিশ্বাস করা কেবল একরকম জেদ মাত্র।

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছিলেন। তিনিই মহাভারত রচনা করেন। তাঁরই পিতা, তাঁরই শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে ব্রাহ্মণাদি, পিতামহ পরাশর, শক্তি প্রভৃতি ছিলেন।

১। পৃ. ১৬, বার্হস্পত্য সূত্র, ভগবদ্দত্তকৃত।

তিনি আর্যজ্ঞানের এক অতুলনীয় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁকে কল্পিত বলা বিদেশি পণ্ডিতদেরই দুঃসাহস। এইরূপ দুরাগ্রহ জগতের ক্ষতি করে এবং সাধারণ মানুষকে ভ্রান্তিতে ফেলে।

আমরা পরবর্তী প্রমাণ মহাভারত থেকেই প্রদান করব। আমাদের দৃষ্টিতে এই গ্রন্থ বিশ্বের অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থের মতোই প্রামাণিক। এই ইতিহাস ঋষিপ্রণীত। হ্যাঁ, এর কিছু সাম্প্রদায়িক অংশ নবীন।

(১) মহাভারতের শল্যপর্ব, অধ্যায় ৪১-এ কৃতযুগের একটি কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে মুনি বৈশম্পায়ন মহারাজ জনমেজয়কে বলেন—

পুরা কৃতযুগে রাজন্নাষ্টিষেণো দ্বিজোত্তমঃ।
বসন্ গুরুকুলে নিত্যং নিত্যমধ্যয়নে রতঃ।।৩।।
তস্য রাজন্ গুরুকুলে বসতো নিত্যমেব চ।
সমাপ্তিং নাগমদ্ বিদ্যা নাপি বেদা বিশাম্পতে।।৪।।

অর্থাৎ—প্রাচীন কালে কৃতযুগে আষ্টিষেণ নামক এক শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ গুরুকুলে বাস করে সর্বদা অধ্যয়নে রত থাকতেন। কিন্তু হে রাজন্, তিনি বিদ্যারও সমাপ্তি করতে পারেননি, বেদগুলিরও নয়।

(২) দশরথনন্দন রামের রাজ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে মহাভারতের দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ৫১-এ লেখা হয়েছে—

চতুর্ভির্বেদৈঃ সুপ্রীতাঃ প্রাপ্নুবন্তি বিবৌকসঃ।
হব্যং কব্যং চ বিবিধং নিষ্পূর্তং হুতমেব চ।।২২।।

অর্থাৎ—রামের রাজ্যে চারটি বেদ অধ্যয়নকারী বিদ্বানরা তৃপ্ত ছিলেন।

(৩) আদিপর্ব ৭৬।১৩।।-এ যযাতি দেবযানীকে বলেন যে তিনি সম্পূর্ণ বেদ অধ্যয়ন করেছেন—

ব্রহ্মচর্যেণ কৃত্স্নো মে বেদঃ শ্রুতিপথং গতঃ।।

(৪) শান্তিপর্ব ৭৩।৫।। থেকে ভীষ্মজি উশনার প্রাচীন শ্লোক উদ্ধৃত করে শোনাচ্ছেন। উশনা বলেন—

রাজ্ঞশ্চাচর্যং বেদেন সর্বকর্মাণি কারয়েত্।।৭।।

অর্থাৎ—অথর্ববেদের দ্বারা রাজাকে পুরোহিত সমস্ত কর্ম সম্পাদন করাবে।

(৫) মহাভারতের বনপর্ব, অধ্যায় ২১-এ দ্রৌপদীকে উপদেশ দিতে গিয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির কাশ্যপ-গীত নামে একটি প্রাচীন গাথা শোনান—

অত্রাপ্যুদাহরন্তীমা গাথা নিত্যং ক্ষমাবতাম্।
গীতাঃ ক্ষমাবর্তা কৃষ্ণে কাশ্যপেন মহাত্মনা।।৩৮।।
ক্ষমা শ্রুতম্। ক্ষমন্তুমर्हতি।।৩৬।।
ক্ষমা ধর্মঃ ক্ষমা যজ্ঞঃ ক্ষমা বেদাঃ যস্তামেব বিজানাতি স সর্ব…

অর্থাৎ—এটি মহাত্মা কাশ্যপের গীত গাথা, যেখানে বলা হয়েছে—ক্ষমাই বেদ।

মহাভারতের আদিপর্বে শকুন্তল উপাখ্যান প্রসিদ্ধ। সেখানে সুরম্য আশ্রমে প্রবেশের সময়কার দৃশ্য ভগবান বর্ণনা করেছেন। রাজর্ষি দুষ্যন্তের সেই দৃশ্য কাশ্যপ কণ্বের আশ্রমে দ্বৈপায়ন অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। অধ্যায় ৬৪-এ বলা হয়েছে—

ঋচো যজুঃ চ মুখ্যৈশ্চ প্রর্যমাণাঃ পদক্রমৈঃ।
শুশ্রাব মনুজব্যাঘ্রো বিততেষ্বিহ কর্মসু।।৩১।।
অথর্বাণং চ প্রবরাḥ পূয়যাজ্ঞিকসংমতাঃ।
সংহিতামীরয়ন্তি স্ম পদক্রমযুতাং তু তে।।৩৩।।

অর্থাৎ—সেখানে প্রধান ঋক্‌ ও যজুঃ মন্ত্র পদক্রমে পাঠ করা হচ্ছিল, যা মনুষ্যব্যাঘ্র দুষ্যন্ত শুনলেন। তদ্রূপ অথর্ববেদের শ্রেষ্ঠ ঋত্বিজগণ যজ্ঞোপযোগী বলে সম্মত সংহিতা পদক্রমসহ উচ্চারণ করছিলেন।ঋগ্বেদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা পদ ও ক্রমপাঠ অনুসারে ঋচা পাঠ করছিলেন, এবং অথর্ববেদে পারদর্শী বিদ্বানগণ পদ ও ক্রমযুক্ত সংহিতা পাঠ করছিলেন।

এটি কী স্পষ্ট প্রমাণ! এতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে ব্যাসজীর সহস্র সহস্র বছর পূর্বে মহারাজ দুষ্যন্তের কালে পর্যন্তও অথর্ববেদের সংহিতা পদ ও ক্রমসহ পাঠ করা হতো। এটি সেই সময়ের বর্ণনা, যখন বেদের স্বতন্ত্র শাখাসমূহ এখনো গঠিত হয়নি, কিন্তু মন্ত্রের ব্যাখ্যারূপ পাঠান্তর আর্যাবর্তের বহু গুরুগৃহে প্রসিদ্ধ ছিল, এবং ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের বিষয়বস্তুও বহু আচার্য-পরম্পরায় একত্রিত হয়ে গিয়েছিল।

এই বেদগুলিরই পাঠান্তর ও ব্যাখ্যার ফলে পরে বহু শাখার সৃষ্টি হয়। তখন এই বেদগুলি কোনো নির্দিষ্ট প্রবক্তা ঋষির নামে প্রসিদ্ধ ছিল না। এই বেদই সনাতন কাল থেকে চলে এসেছে। ব্যাসজী বহু ঋষি-মুনির সহায়তায় সেই পাঠান্তরগুলিকে একত্র করে বেদশাখা নির্মাণ করেন, এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তুকেও ক্রমানুসারে সংশ্লিষ্ট শাখার উপযোগী করে সংকলন করেন। কিছু আচার্য ব্রাহ্মণাদিকেও বেদ বলতেন, তাই তারা বলতে শুরু করেন যে ব্যাসজীই বেদের বিভাগ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বেদব্যাসজী ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থেরই বিভাগ করেছিলেন। বেদ তো চিরকাল থেকেই চলে এসেছে। বাস্তবে পুরাণসমূহেও এর বিপরীত কিছু বলা হয়নি। সেখানেও এটিই লেখা আছে যে বেদ আদিকাল থেকেই চতুষ্পাদ ছিল, অর্থাৎ এক বেদের চারটি সংহিতাই ছিল।

*

১. পূনা সংস্করণ, আরণ্যকপর্ব, ৩০।৩৫-৩৬।

২. পুণে সংস্করণে এই পাঠটি নেই।

তথ্যঃ

1 (a) In other words, there was no one author of the great Epic, though with a not uncommon confusion of editor with author, an author was recognized, called Vyāsa. Modern scholarship calls him, The Unknown Vyāsa, for convenience. p. 58, The Great Epic of India, W. Hopkins.

(b) But this Vyāsa is a very shadowy person. In fact his name probably covers a guild of rivisors and retellers of the tale. W. Hopkins, p. 69, India Old and New.

(c) Badarāyaņa is very loosely identified with the legendry person named Vyāsa. Monier Williams, p. 111, footnote 2.

(d) Tradition invented as the name of its author the designation Vyāsa, (arranger). A. A. Macdonell, p. 88, India's Past.

(e) To Ramanuja the legendry Vyasa was the seer. India's Past, A. A. Macdonell, p. 149.

(f) Vyāsa Pārāśarya is the name of a mythical sage. p. 339, Vedic India, A. A.

Macdonell and A. B. Keith, এই বিষয় নিয়ে ইউরোপীয় লেখকদের অতিরিক্ত প্রলাপ আমাদের ‘ভারতবর্ষের বৃহৎ ইতিহাস’ প্রথম ভাগ, পৃষ্ঠা ২৮৪-এ দেখা যেতে পারে।

প্রাচীন বৈদিক আচার্য

প্রজাপতি ব্রহ্মা – সর্বদিকমুখী প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রাচীন বৈদিক আচার্য ছিলেন। সমগ্র বৈদিক সাহিত্য এবং সংস্কৃত গ্রন্থসমূহে সমস্ত বিদ্যার প্রবর্তক—ব্রহ্মাই ছিলেন। ব্রহ্মা আগ্নি, বায়ু এবং অন্যান্য প্রাচীন ঋষিদের থেকে চারটি বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত হন। সেই ভিত্তিতেই তিনি লোককল্যাণমুখী সমস্ত বিদ্যার প্রবর্তন করেন। এ কারণে ভারতীয় সাহিত্যসভায় তিনি আদি বৈদিক আচার্য হিসেবে পরিচিত। বেদের অর্থ ও শাস্ত্রের ধারাবাহিকতা ক্রমবর্ধমানভাবে বিকাশিত হয়েছে।

আপান্তরতমা = প্রাচীনগর্ভ

(ক) আচার্য শঙ্কর তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে লিখেছেন—
তথা হি-আপান্তরতমা নাম বেদাচার্যঃ পুরারণাশঃ বিষ্ণুনিয়োগাত্ কলিদ্বাপরযোঃ সংঘৌ কৃষ্ণ-দ্বৈপায়নঃ संबভূভুতি স্মরন্তি।

অর্থাৎ, আপান্তরতমা নামে বেদাচার্য এবং প্রাচীন ঋষি ছিলেন, যিনি কলি-দ্বাপর যুগের সংধিতে বিষ্ণুর আদেশে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

(খ) এই প্রসঙ্গে অহির্বুধন্যসংহিতা উল্লেখ করে—
অথ কালবিপর্যায়সাদ যুগমেদসমুদ্র্ভবে ॥৫০॥
ত্রেতাদাউ সত্ত্বসংকোচাব্রজসি প্রবিজুম্ভতে।
আপান্তরতমা নাম মুনির্বাক সম্ভব হরেঃ ॥৫৩॥
কপিলশ্চ পুরাবিরাদিবেভসমুদ্র্ভবঃ।
হিরণ্যগর্ভো লোকাদিরহং পশুপতিঃ শিবঃ ॥৫৪॥
উদভূত্তত্র ধীরূপমৃগ্যজুঃ সামসংকুলम् ॥৫৮॥
বিষ্ণুসংকল্পসংভূতমেতদ্ বাচ্যায়নেরিতম্।

অর্থাৎ, বাচের পুত্র বাচ্যায়ন, যার অপর নাম আপান্তরতমা। (কালক্রমের বিপর্যয়ের কারণে) ত্রেতা যুগের প্রারম্ভে বিষ্ণুর আদেশে আপান্তরতমা, কপিল ও হিরণ্যগর্ভ প্রাচীন আচার্যরা যথাক্রমে ঋগ্বেদ, সামবেদ, সাংখ্য শাস্ত্র ও যোগ ইত্যাদির বিভাগ করেন। অহির্বুধন্যসংহিতা শঙ্করের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

(গ) আরও অনেক আগেই মহাভারতে বৈশাম্পায়ন রাজা জনমেজয়কে বলা হয়েছে—
আপান্তরতমা নাম সুতো বক্সম্ভবো বিভোহঃ।
ভূতভব্যভবিষ্যশঃ সত্যবাদি বৃদ্ধব্রতঃ ॥৩৮॥

উল্লেখিত সূত্রসমূহ:
১. ৩।৩।৩২।। পৃঃ ৩৩৫, ব্রহ্মসূত্র শঙ্করভাষ্য, মতি লাল বনারসি দাস, ১৬৬৪
২. অধ্যায় ১১, পৃঃ ১০০, ১০১, সম্পাদক রামানুজাচার্য, অদধার ১৬৬৬
৩. অধ্যায় ৩৩৭, মহাভারত, ভঃ ওঃ রিঃ ঈঃ, পুনে

তমুভাচ নতং মূর্জা দেবানামাদিরঅব্যয়ঃ। 

বেদাণ্যানে শ্রুতিঃ কার্যাঃ ত্বয়ঃ মতিমতাং বরঃ॥৪০॥ 

তস্মাত্ করু যথাজ্ঞপ্তং মর্যতদ্বচনং মুনে। 

তেন বিভ্নাস্তদা বেদা মনঃ স্বায়ম্ভুভে'ন্তরে॥৪১॥ 

শ্রপান্তরতমাশ্চৈব বেদাচার্যঃ স উচ্যতে। 

প্রাচীনগর্ভ তমৃষি প্রবদন্তীহ কেচন॥৬১॥

এই শ্লোকগুলি এবং মহাভারতের এই অধ্যায়ের অন্যান্য শ্লোকগুলির অর্থ একই— আপান্তরতামা ঋষি বেদাচার্য অথবা প্রাচীনগর্ভ নামে পরিচিত। তিনি একবার প্রাচীনকালে বেদগুলির শাখা-বিভাগ করেছেন।

আপান্তরতামার একটি নিজস্ব সিধান্তগ্রন্থও ছিল। যোগিয়াজ্ঞল্ক্য গ্রন্থে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়।

মহাভারতে বর্ণিত বেদাচার্য:
শান্তি পর্বে সাতটি প্রধান বেদাচার্যের নাম স্মরণ করা হয়েছে—
মরিচি, অঙ্গিরি, রাশ্চাত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ঋতু, বশিষ্ঠ।
এরা সাতজন প্রধান বেদবিদ্যাজ্ঞানী বেদাচার্য হিসেবে বিবেচিত। এদের কার্যকলাপ ও ধর্মকর্ম প্রজাপতি দ্বারা নির্ধারিত হয়।

অনুশাসন পর্বেও এ বেদাচার্যদের স্মরণ করা হয়েছে—
পিতামহঃ পুলস্ত্যশ্চ বশিষ্ঠঃ পুলহস্তথা। অঙ্গিরাশ্চ ক্রতুঃচৈব কশ্যপশ্চ মহান্বিঃ।
এরা কুরু কুলের শ্রেষ্ঠ মহাযোগেশ্বর হিসেবে স্মৃত। এবং পিতৃদের মতই এদেরও শ্রাদ্ধবিধি পালন করা হয়।

সূত্রসমূহ:
১. যাজ্ঞবাল্ক্য স্মৃতি, অপরার্ক টীকা; ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, পদ ২, অধ্যায় ৩৫, শ্লোক ১২৪–১২৬, ভেঙ্কটেশ্বর প্রেস, ১৬৬২, বম্বে। এখানে ৩২ জন ব্যাসের নাম উল্লেখ রয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে, এরা ৩৮ জন ব্যাস হয়ে গেছেন।
২. মহাভারত, অধ্যায় ৩২৭, ভা. ও. ২ি. ৩০, পুনা।
৩. মহাভারত, অধ্যায় ৬২, শ্লোক ২০–২১।

পুনরায় একই পর্বে লেখা হয়েছে—

অথ সপ্তমহাভাগা ঋষয় লোকবিশ্রুতাঃ।
বশিষ্ঠপ্রमुखাঃ সর্বে ব্রমাণং পদ্মসম্ভবম্। প্রদক্ষিণমভিক্রম্য সর্বে প্রাঞ্জলয়ঃ স্থিতা। উবাচ বচনং তেষাং বশিষ্ঠো ব্রমভিত্তমঃ॥

এখানে বর্ণিত হয়েছে— মহাভারতের শান্তি পর্বে আরেক স্থানে দশজন প্রধান বেদাচার্যের নাম উল্লেখ আছে—

ভূগুমরিচিরাত্রিশ্চ হ্যঙ্গিরাঃ পুলহঃ ক্রতুঃ। মনুর্বক্ষো বশিষ্ঠশ্চ পুলস্ত্যশ্চেতি তে দশঃ॥৬৬॥
ব্রাহ্মণো মানসা হা তে উদ্ভূতাঃ স্বয়মীশ্বরাঃ। পরত্বেনষংয়ো যসমাত্-স্মৃতাস্তস্মান্ মহর্ষয়ঃ॥১৭॥

অর্থাৎ— ভুগু, মরিচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহঃ, ঋতু, মনু, দক্ষ, বশিষ্ঠ, পুলস্ত্য এই দশজন প্রধান ঋষি। এরা নিজেই ঈশ্বর এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র।

বেদব্যাস-সাহিত্য অনুযায়ী— ব্যাসের চিহ্ন হলো “বেদান্ বিন্যাস যসমাত্স বেদব্যাস ইতি স্মৃতঃ।” এই অনুযায়ী, ২৮ ঋষি বিভিন্ন সময়ে শাখা ও বেদপ্রবচনের কাজ করেছেন। এদের মধ্যে বাল্মীকি প্রভৃতি কয়েকজন ব্যাস দ্বারা শাখা-নিয়ম বিশেষ শাখায় সংরক্ষিত।

মহাভারত শান্তি পর্বে লেখা আছে—
বেদার্থবেত্তুভ্র্যাসস্য। অর্থাৎ বেদার্থবেত্তা ব্যাস।

মহাভারত এবং বেদপ্রবচনের মধ্যে— শান্তি পর্বে ভীষ্ম, ব্যাস এবং শুক্রের সংলাপ উল্লেখ আছে। সেখানে শ্লোকটি হলো—

ত্রেতায় সংহতা বেদা যজ্ঞা বর্ণাস্তথৈব চ।
সংরোধাদায়ুষস্ত্বেতে ব্যস্যন্তে দ্বাপরে যুগে॥৬৫॥

অর্থাৎ— ত্রেতায় বেদসমূহ সংহত বা পৃথকভাবে একত্রিত হয়েছিল; যজ্ঞ ও বর্ণও তেমনই। দ্বাপরে আয়ু সংরোধের হ্রাসের কারণে শাখা আকারে প্রচারিত হয়েছে।

পুরাণে উল্লেখিত ২৮ বেদাচার্য—
অট্ঠাইস ব্যাস পুরাণে ভৈবস্বত মনু থেকে শুরু করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পর্যন্ত প্রতি দ্বাপরের জন্য ২৮ ব্যাসকে গণনা করা হয়েছে। ভৈবস্বত মনু ত্রেতা যুগের শুরুতে ছিলেন এবং বেদ-প্রবচন দ্বাপরে সম্পন্ন হয়েছে। ধরা হয়েছে...

সূত্রসমূহ—
১. অনুশাসন পর্ব পরিশিষ্ট ১, সংখ্যা ১৪, শ্লোক ২৫৬–২৬০, মহাভারত।
২. ১২২।৪৪।। তুলনা করুন শান্তি পর্ব ২০৭।৩–৫০ এবং ৩৪৬। ৬৭–৬৮।
৩. ৩৩৭।৬।। মহাভারত।
৪. অধ্যায় ২২৪, মহাভারত, ভা. ও. রি. ই., পুনা।
৫. বায়ুপুরাণ অংক ২৩, শ্লোক ১১৪-এর পর।

অতএব, ত্রেতা যুগীয় বৈবস্বত মনু থেকে বেদ-প্রবচন কিভাবে আরম্ভ হয়েছিল, তা পরস্পর বিরোধী মনে হয়। পুরাণের এই প্রসঙ্গে “দ্বিতীয়েদ্বাপরে, তৃতীয়দ্বাপরে” ইত্যাদি বলে “পরিবতেঃ পুনঃ ষষ্ঠ” এবং “পর্যায়শ্চ চতুর্বশ” ইত্যাদির মাধ্যমে গণনা করা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, বেদ-প্রবচন বিষয়ক গণনার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সুতরাং, ত্রেতার শুরু থেকে দ্বাপরের শেষ পর্যন্ত ২৮ বার বেদ-প্রবচন ধরা হয়েছে।

যদি ধরা হয় যে এখানে প্রতিটি চতুর্যুগের দ্বাপর গোনা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

কারণ—
১. বৈবস্বত মনু প্রথম চতুর্যুগের দ্বাপরে ছিলেন না, তিনি ত্রেতার শুরুতে ছিলেন।
২. ঋক্ষ অর্থাৎ ভাল্মীকি ২৪তম পরিবতের ব্যাস ধরা হয়েছে। তিনি দাশরথী রামের সমকালিক। রাম থেকে ভারতযুদ্ধ পর্যন্ত কেবল ৩৫ প্রজন্ম গণ্য করা যায়, অধিক নয়। এগুলো প্রধান প্রজন্ম নয়, সম্পূর্ণ প্রজন্ম। অতএব ঋক্ষকে ২৪তম চতুর্যুগ ধরা ইতিহাসের বিপরীতে।
৩. ২৬তম পরিবতের ব্যাস পারাশর এবং ২৭তম পরিবতের ধ্যস জাতুকর্ণ্য যথাক্রমে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পিতা ও চাচা ছিলেন। এরা পূর্ব চতুর্যুগের নয়।

এই ২৮ বেদ-প্রবচনে আপান্তরতামার নাম কোথাও দেখা যায় না। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তিনি বৈবস্বত মনুর পূর্বে স্বয়ম্ভুব-অন্তরে বেদ-প্রবচন করেছেন।

বিশিষ্ট ব্যাস

বেদ-প্রবচনকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যাসদের বিশেষ উল্লেখ আছে। তাদের দ্বারা প্রচারিত অনেক শাখা ক্রমানুসারে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের বেদ-প্রবচনের গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

১. ভার্গব উষ্ণ কাব্য— তৃতীয় দ্বাপরের বেদ-প্রবচক উষ্ণ কাব্য ছিলেন। অসুরাচার্য উষ্ণ কবি ভূগুর সন্তান হওয়ায় তিনি ভার্গব ছিলেন। আথর্ববেদকে ভূগু-অঙ্গিরোবেদও বলা হয়। অনেক আথর্বণ সুক্ত উষ্ণ দ্বারা প্রদর্শিত। উষ্ণ মহান ভিষক ছিলেন। আথর্বসংহিতায় এক মন্ত্রে “ভিষক্” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মন্ত্রায়ণী সংহিতায় একই স্থানে “কবি” শব্দ পাঠিত হয়েছে। এই অনুযায়ী উষ্ণও কবি ছিলেন। প্রাচীন প্রয়োগ অনুযায়ী আজও বৈদ্য বা ভিষক কবিরাজ বলা হয়।

২. সারস্বত— নবম পরিবতের ব্যাস। তাঁর চার শিষ্য: পারাশর, গার্গ্য, ভার্গব এবং অঙ্গিরা। অন্যান্য ব্যাসদেরও চারজন শিষ্য বা সন্তান গোনা হয়েছে। শিষ্যকে সন্তান বলা হয়েছে। যেমন শীশু সারস্বত অঙ্গিরা বৃদ্ধ ঋষিদের সন্তান বলেছেন।

সারস্বতের বেদ-প্রবচন নিম্নলিখিতভাবে প্রমাণিত—
(ক) সংস্কাররত্নমালাতে কৃষ্ণ যজুর সম্পর্কিত সারস্বত পাঠের বর্ণনা।
(খ) অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরনন্দ কাব্যে বেদ-প্রবচনের উল্লেখ।
(গ) তাণ্ডধ ব্রাহ্মণে নিম্নলিখিত পাঠ—
শিশুর্বা শ্রাঙ্গিরসো মন্ত্রকৃতাং মন্ত্রকৃতাসীত্। ১৩।৩।২৪।।
অর্থাৎ অঙ্গিরা গোত্রোৎপন্ন শীশু সারস্বত কবি চরণ-প্রবচনকারীদের মধ্যে অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। এখানে “মন্ত্রকৃত্” অর্থ মন্ত্র রচয়িতা নয়, বরং মন্ত্রপ্রবচনকারী। বিশেষ আলোচনা ‘ঋগ্বেদে ব্যাখ্যান’ অংশে পাওয়া যাবে।

সারস্বত পাঠ— সারস্বত দ্বারা প্রবর্তিত বেদপাঠ তৈত্তিরীয় সংহিতা ইত্যাদিতে যথেষ্টভাবে সংরক্ষিত।

শৈশব সাম— শীশু সারস্বত দ্বারা প্রদর্শিত শৈশব সাম প্রসিদ্ধ। উপরোক্ত তাণ্ড্য বচনও শৈশব সামের প্রশংসায় লেখা।

৩. ভারদ্বাজ – ভারদ্বাজ ছিলেন ষোড়শ পরিবতের ব্যাস। তাঁর সন্তান ছিলেন হিরণ্যনাভ, কৌশল্য, কুচুমি ইত্যাদি। এই বারহস্পত্য ভারদ্বাজই আয়ুর্বেদ ও বহু শাস্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। এজন্য ঐতরেয় আরণ্যকে মাহীদাস লিখেছেন, তিনি ঋষীদের মধ্যে অত্যন্ত নত এবং দীর্ঘজীবী ছিলেন। যেমন—

भरद्वाजो ह वा ऋवीरणामनूचानतमो दीर्घजीवितमस्तपस्वितम आस। ১।२।२॥

“অনূচান” হওয়ার লক্ষণ ছিল—

वेदवेदाङ्गतत्त्वज्ञः शुद्धात्मा पापजितः। दशेषं श्रोत्रियवत् प्राप्तः सोऽनूचान इति स्मृतः॥२

ভারদ্বাজ শিক্ষা ভারদ্বাজ শ্রোত্রিয় ও গৃহ্য সংক্রান্ত সম্ভবত তাঁরই প্রবর্তিত চরণ।

৪. ঋক্ষ অর্থাৎ ভাল্মীকি – তিনি চব্বিশতম পরিবতের ব্যাস ছিলেন। তাঁর সন্তান ছিলেন শালিহোত্র, অগ্নিবেশ্য, যুবনাশ্ব এবং শরদ্বসু। এই দীর্ঘজীবী অগ্নিবেশ্য দ্রোণের গুরু ছিলেন এবং পূর্বে পুনর্বসু আত্রেয়ের আয়ুর্বেদোপদেশকে তন্ত্রবদ্ধ করেছিলেন। ভাল্মীকি-এর বেদ-প্রবচন, তাঁর চরণের সংধি এবং উচ্চারণ সংক্রান্ত তিনটি নিয়ম তৈত্তিরী প্রাতিশাখ্য-তে বর্ণিত আছে। বেদ-প্রবচনের কারণে ভাল্মীকি ঋষি হিসেবে স্বীকৃত হন। তাই তাঁর কাব্যময় ইতিহাস রামায়ণ-এ বহু স্থানে আর্ষ কাব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রমাণসমূহ—
(ক) সারস্বতশ্চাপি জগাদ নষ্টং ওয়েভং পুনয়ং … (বুদ্ধচরিত, লাহোর, ১৬৩৬)
(খ) সারস্বতো যত্র সুতোऽস্য জজ্ঞে নষ্টস্য বেদস্য পুনঃ প্রবক্তা … (সৌন্দরনন্দ, লাহোর, ১৬২৮)

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সূত্র—

  • পৃষ্ঠা ২৮৪ ও ৪৪২, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, অপরার্ক টীকা, আনন্দাশ্রম, পুনা, ১৬০৩।

  • ৫।৩৬।০; ১১৪; ১৮/৬॥, মাদ্রাস, ১৬৩০।

  • ৪।৪০।।; ৫।৪।।, বালকাণ্ড, পশ্চিমোত্তর শাখা, লাহোর, ১৬৩১।

Read More

27 December, 2025

ঋগ্বেদ ১/২৯/২

27 December 0

ঋগ্বেদ ১/২৯/২

ঋষি- শুনঃশেপ আজীগর্তিঃ। দেবতা- ইন্দ্রঃ।  ছন্দ- বিরাট্পঙ্ক্তি। স্বর- পঞ্চমঃ।।

শিপ্রিন্বাজানাং পতে শচীবস্তব দংসনা। 

আ তূ ন ইন্দ্র শংসয় গোষ্বশ্বেষু শুভ্রিষু সহস্রেষু তুবীমঘ॥ ঋগ্বেদ ১/২৯/২

স্বর সহিত পদ পাঠ শিপ্রিন্ । বাজানাম্ । পতে । শচীঽবঃ । তব । দংসনা । আ । তু । নঃ । ইন্দ্র । শংসয় । গোষু । অশ্বেষু । শুভ্রিষু । সহস্রেষু । তুবিঽমঘ ॥

বিষয়ঃ পুনঃ স ঐশ্বর্যযুক্তঃ কীদৃশ ইত্যুপদিশ্যতে॥

অন্বয়ঃ-হে শিপ্রিন্ শচীবো বাজানাং পতে তুবীমঘেন্দ্র ন্যায়াধীশ ! যা তব দংসনাস্তি তয়া সহস্রেষু শুভ্রিষু গোষ্বশ্বেষু নোঽস্মানাশংসয় প্রকৃষ্টগুণবতঃ সম্পাদয়॥২॥

পদার্থঃ-(শিপ্রিন্) শিপ্রে প্রাপ্তুমর্হে প্রশস্তে ব্যবহারিকপারমার্থিকে সুখে বিদ্যেতে যস্য সভাপতেস্তৎসম্বুদ্ধৌ। অত্র প্রশংসার্থ ইনিঃ। শিপ্রে ইতি পদনামসু পঠিতম্॥ (নিঘং৪.১) (বাজানাম্) সংগ্ৰামাণাং মধ্যে (পতে) পালক (শচীবঃ) শচী বহুবিধং কর্ম বহ্বী প্রজা বা বিদ্যতে যস্য তৎসম্বুদ্ধৌ। শচীতি প্রজানামসু পঠিতম্। (নিঘং৩.৯) কর্মনামসু চ (নিঘং২.১) অত্র ছন্দসীরঃ। (অষ্টা০৮.২.১৫) ইতি মতুপো মস্য বঃ। মতুবসো রু০ (অষ্টা০৮.৩.১) ইতি রুত্বং চ। (তব) ন্যায়াধীশস্য (দংসনা) দংসয়তি ভাষয়ত্যনয়া ক্রিয়য়া সা। ণ্যাসশ্রন্থো যচর্। (অষ্টা০৩.৩.১০) অনেন দংসিভাষার্থ ইত্যস্মাদ্যুচ্ প্রত্যয়ঃ। (আ) অভ্যর্থে ক্রিয়োগে (তু) পুনরর্থে। পূর্ববদ্দীর্ঘঃ (নঃ) অস্মাঁস্ত্বদাজ্ঞায়াং বর্তমানান্ বিদুষঃ (ইন্দ্র) সর্বরাজ্যৈশ্বর্যধারক (শংসয়) প্রকৃষ্টগুণবতঃ কুরু (গোষু) সত্যভাষণশাস্ত্রশিক্ষাসহিতেষু বাগাদিন্দ্রিয়েষু। গৌরিতি বাঙ্নামসু পঠিতম্। (নিঘং১.১১) (অশ্বেষু) বেগাদিগুণবৎসু অগ্ন্যাদিষু (শুভ্রিষু) শোভনেষু বিমানাদিয়ানেষু তৎ সাধকতমেষু বা (সহস্রেষু) বহুষু (তুবিমঘ) বহুবিধং মঘং পূজ্যং বিদ্যাধনং যস্য তৎসম্বুদ্ধৌ। মঘমিতি ধননামসু পঠিতম্। (নিঘং২.১০) মঘমিতি ধননামধেয়ম্। মংহতের্দানকর্মণঃ। (নিরু০১.৭) অন্যেষামপি দৃশ্যত ইতি দীর্ঘঃ॥২॥

ভাবার্থঃ-মনুষ্যৈরিত্থং জগদীশ্বরং প্রার্থনীয়ঃ। হে ভগবন্ ! ত্বয়া কৃপয়া যথা ন্যায়াধীশত্বমুত্তমং রাজ্যাদিকং চ সম্পাদ্যতে তথাস্মান্ পৃথিবীরাজ্যবতঃ সত্যভাষণযুক্তান্ ব্রহ্মশিল্পবিদ্যাদিসিদ্ধিকারকান্ বুদ্ধিমতো নিত্যং সম্পাদয়েতি॥২॥

বিষয়- এরপর সেই বিভূতিযুক্ত (ঐশ্বর্যশালী) সভাধ্যক্ষ কেমন, এই  বিষয়ের উপদেশ পরবর্তী মন্ত্রে করা হয়েছে।

পদার্থ-হে (শিপ্রিন্) প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য প্রশংসনীয় ঐহিক ও পারমার্থিক সুখ প্রদানকারী, (শচীবঃ) বহুবিধ প্রজা বা কর্মযুক্ত, (বাজানাম্) বড় বড় যুদ্ধের (পতে) পালনকারী এবং (তুবীমঘ) অনেক প্রকার প্রশংসনীয় বিদ্যাধনযুক্ত (ইন্দ্র) পরম ঐশ্বর্যশালী সভাধ্যক্ষ! যা (তব) আপনার (দংসনা) বেদবিদ্যাযুক্ত বাণীর সহিত ক্রিয়া, তার দ্বারা আপনি (সহস্রেষু) হাজার হাজার (শুভ্রিষু) শোভন বিমান আদি রথ বা তাদের উত্তম সাধনসমূহে, (গোষু) সত্যভাষণ এবং শাস্ত্রের শিক্ষা সহিত বাক্ আদি ইন্দ্রিয়সমূহে এবং (অশ্বেষু) বেগ আদি গুণবিশিষ্ট অগ্নি আদি পদার্থযুক্ত অশ্ব আদি ব্যবহারে (নঃ) আমাদের (আশংসয়) উত্তম গুণযুক্ত করুন॥ ২॥

ভাবার্থ-মানুষের উচিত এইভাবে জগদীশ্বরের প্রার্থনা করা যে—হে ভগবন্! কৃপা করে যেমন ন্যায়াধীশ অত্যুত্তম রাজ্য আদি প্রাপ্ত করান, তেমনই আমাদের পৃথিবীর রাজ্য [ভোগে], সত্য কথা বলা এবং শিল্পবিদ্যা আদি ব্যবহারের সিদ্ধি লাভে নিত্য বুদ্ধিমান করুন॥ ২॥

ভাষ্য-মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী

পদার্থঃ (কৃষ্ণকান্ত বৈদিক শাস্ত্রী) হে (শিপ্রিন্) যাঁর কাছে প্রাপ্তিযোগ্য, প্রশংসনীয় ব্যবহারিক ও পারমার্থিক সুখ বিদ্যমান, সেই সুখদানকারী সভাপতি! (শচীবঃ) যাঁর নিকট বহুবিধ কর্ম অথবা বহুবিধ প্রজা বিদ্যমান, এমন কর্মসমৃদ্ধ! (বাজানাম্) বৃহৎ বৃহৎ সংগ্রামের মধ্যে, (পতে) পালনকারী, রক্ষক! (তুভীমঘ) যাঁর নিকট নানাবিধ পূজনীয়, প্রশংসনীয় বিদ্যাধন বিদ্যমান, (ইন্দ্র) সর্ব রাজ্য ও ঐশ্বর্য ধারণকারী, (ন্যায়াধীশ) হে ন্যায়াধীশ! (যা) যে, (তব) ন্যায়াধীশের, (দংসনা) যে ক্রিয়ার দ্বারা প্রকাশ ও ভাষণ করা হয়, অর্থাৎ বেদবিদ্যাযুক্ত বাক্যসহ কার্য, (অস্তি) বিদ্যমান, (তয়া) তার দ্বারা, (সহস্রেষু) বহু ক্ষেত্রে, (শুভ্রিষু) শোভন বিমান, রথ অথবা তাদের উৎকৃষ্ট সাধনসমূহে, (গোষু) সত্যভাষণ ও শাস্ত্রশিক্ষাসহ বাক্‌শক্তি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়সমূহে, (অশ্বেষু) তদ্রূপ বেগ ও অন্যান্য গুণসম্পন্ন অগ্নি প্রভৃতি উপাদানে যুক্ত অশ্বাদি ব্যবহারসমূহে, (নঃ) আমরা, তোমার আজ্ঞায় বর্তমান বিদ্বানগণকে, (আ) উত্তমভাবে, সম্পূর্ণরূপে,(শংসয়) উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন করে তুলুন। ॥২॥

Read More

23 December, 2025

গায়ত্রী মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য

23 December 0
গায়ত্রী মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য

ভূর্ভুবঃ স্বরিত্যস্য বিশ্বামিত্র ঋষিঃ । সবিতা দেবতা । পূর্বস্য দৈবী বৃহতী ছন্দঃ, তৎসবিতুরিত্যুত্তরস্য নিচৃদ্গায়ত্রী ছন্দঃ । মধ্যমষড্জৌ স্বরৌ ॥ 

ও৩ম্  ভূর্ভুবঃ॒ স্বঃ᳖ । তৎস॑বি॒তুর্বরে॑ণ্যং॒ ভর্গো॑ দে॒বস্য॑ ধীমহি ।

ধিয়ো॒ য়ো নঃ॑ প্রচো॒দয়া॑ৎ ॥ যজু ৩৬।৩ ॥

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! যেমন আমরা (ভূঃ) কর্মকান্ডের বিদ্যা (ভুবঃ) উপাসনা কান্ডের বিদ্যা এবং  (স্বঃ) জ্ঞানকান্ডের বিদ্যাকে সংগ্রহপূর্বক পড়িয়া (য়ঃ) যাহা (নঃ) আমাদের (ধিয়ঃ) ধারণাবতী বুদ্ধিদিগকে  (প্রচোদয়াৎ) প্রেরণা করিবে সেই (দেবস্য) কামনার যোগ্য (সবিতুঃ) সমস্ত ঐশ্বর্য্যপ্রদাতা পরমেশ্বরের  (তৎ) সেই ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ না করার যোগ্য পরোক্ষ (বরেণ্যম্) স্বীকার করিবার যোগ্য (ভর্গঃ) সর্ব দুঃখের নাশক তেজঃস্বরূপের (ধীমহি) ধ্যান করি, সেইরূপ তুমিও ইহার ধ্যান কর ॥

ভাবার্থঃ- এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালঙ্কার আছে । যে মনুষ্য কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান সম্পর্কীয় বিদ্যাগুলির সম্যক গ্রহণ করিয়া সম্পূর্ণ ঐশ্বর্য্যযুক্ত পরমাত্মা সহ নিজের আত্মাকে যুক্ত করে তথা অধর্ম, অনৈশ্বর্য্য এবং দুঃখরূপ মল হইতে মুক্ত হইয়া ধর্ম, ঐশ্বর্য্য এবং সুখ প্রাপ্ত হয় তাহাদেরকে অন্তর্যামী জগদীশ্বর স্বয়ংই ধর্মের অনুষ্ঠান ও অধর্মের ত্যাগ করাইতে সর্বদা কামনা করে ॥ মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ভাষ্যের বাংলা অনুবাদ

তাৎপর্যঃ— এই মন্ত্রে বাচকলুপ্ত উপমালঙ্কার আছে। যে মানুষ কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান-সম্পর্কিত বিদ্যাগুলির যথাযথ গ্রহণ করে, সর্বসম্পূর্ণ ঐশ্বর্যে যুক্ত পরমাত্মার সঙ্গে নিজের আত্মাকে যুক্ত করে এবং অধর্ম, অনৈশ্বর্য ও দুঃখরূপ মল ত্যাগ করে ধর্ম, ঐশ্বর্য ও সুখ লাভ করে তাদেরকে অন্তর্যামী জগদীশ্বর স্বয়ং ধর্মের অনুশীলন ও অধর্মের ত্যাগ করাতে সর্বদা ইচ্ছুক থাকেন।

এর তর্জমা Ralph T. H. Griffith এইভাবে করেছেন— “May we attain that excellent glory of Savitar the God. So may he stimulate our prayers.”

এই তর্জমা আধ্যাত্মিক, কিন্তু বিদ্বান পাঠক নিজে এটি মহর্ষি দয়ানন্দের তর্জমার সঙ্গে তুলনা করে গ্রিফিথের বৈদিকতার স্তর জানতে পারেন।

এই মন্ত্রটি (ব্যাহৃতি-রহিত রূপে) যজুর্বেদ ৩।৩৫; ২২।৯; ৩০।২; ঋগ্বেদ ৩।৬২।১০; সামবেদ ১৪।৬২-এও বিদ্যমান। এটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও বহুস্থানে এসেছে। এদের মধ্যে যজুর্বেদ ৩০.২-এ এই মন্ত্রের ঋষি নারায়ণ এবং অন্যত্র বিশ্বামিত্র। দেবতা সবিতা, ছন্দ নিছৃদ্ বৃহতী এবং স্বর ষড়জ। ব্যাহৃতিগুলির ছন্দ দৈবী বৃহতী এবং স্বর ব্যাহৃতিসহ সম্পূর্ণ মন্ত্রের স্বর মধ্যম ষড়জ। মহর্ষি দয়ানন্দ সর্বত্রই এর ভাষ্য আধ্যাত্মিক করেছেন। কেবল যজুর্বেদ ৩০।২-এর ভাবার্থে আধিভৌতিকের সামান্য ইঙ্গিত আছে, অবশিষ্ট ভাষ্য আধ্যাত্মিকই।

একজন বিদ্বান একবার আমাদের বলেছিলেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো কিছু মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য কোনো প্রকারে ভাষ্য হতেই পারে না। আমরা বিশ্বের সকল বেদজ্ঞকে ঘোষণাপূর্বক বলতে চাই যে বেদের প্রত্যেক মন্ত্র এই সমগ্র সৃষ্টিতে বহু কল্পনার (ভাইব্রেশনস) রূপে বিদ্যমান। এই মন্ত্রগুলির এই রূপে উৎপত্তি পৃথিব্যাদি লোকসমূহের উৎপত্তিরও পূর্বে হয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই প্রত্যেক মন্ত্রের আধিদৈবিক ভাষ্য অবশ্যই হয়ে থাকে। ত্রিবিধ অর্থপ্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বাধিক ও সর্বপ্রথম সম্ভাবনা এই প্রকার অর্থেরই হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের আধিদৈবিক অর্থ হতে পারে না এমন ধারণা করা বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞতার পরিচায়ক।

এই ঋচাটির দেবতা সবিতা। সবিতার বিষয় সম্পর্কে ঋষিদের বক্তব্য হলো—

  1. সবিতা সর্বস্য প্রস্বিতা (নিরুক্ত ১০।৩১)

  2. সবিতা বৈ দেবানাং প্রস্বিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।২।১৭)

  3. সবিতা বৈ প্রসবানামীশঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।৩০)

  4. প্রজাপতিবৈ সবিতা (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ১৬।৫।১৭)

  5. মনো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬।৩।১।১৩)

  6. পশবো বৈ সবিতা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৩।২।৩।১১)

  7. বিশ্বদেব সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)

  8. প্রাণো বৈ সবিতা (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।১৯)

  9. বেদা এভ সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ ১।৩৩)

  10. সবিতা রাষ্ট্রং রাষ্ট্রপতিঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২।৫।৭।৪)

এথেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হয়—

  1. ‘সবিতা’ নামক পদার্থ সকলের উৎপত্তি ও প্রেরণার উৎস বা সাধন।

  2. এটি সকল প্রকাশিত ও কামনা অর্থাৎ আকর্ষণাদি বল দ্বারা যুক্ত কণাগুলির উৎপাদক ও প্রেরক।

  3. এটি সকল উৎপন্ন পদার্থের নিয়ন্ত্রক।

  4. ‘ওম্’ রশ্মিরূপ ছন্দ, রশ্মি এবং মনস্তত্ত্বই সবিতা।

  5. বিভিন্ন মরুদ্‌ রশ্মি এবং দৃশ্য কণা ‘সবিতা’ নামে অভিহিত।

  6. বিদ্যুৎকেও ‘সবিতা’ বলা হয়।

  7. বিভিন্ন প্রাণরশ্মিও ‘সবিতা’ নামে পরিচিত।

  8. সকল ছন্দ-রশ্মিও ‘সবিতা’।

  9. তারাগুলির কেন্দ্রীয় অংশরূপ রাষ্ট্রকে প্রকাশিত ও তাদের পালনকারী সম্পূর্ণ তারা-সমষ্টিকেও ‘সবিতা’ বলা হয়। 

এটি আমরা পূর্বে লিখে এসেছি যে দেবতা কোনো মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি, মনস্তত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব এবং সকল ছন্দরশ্মি। এই ঋচার উৎপত্তি বিশ্বামিত্র ঋষি [বাগ্ বৈ বিশ্বামিত্রঃ (কৌ. ব্রা. ১০।৫), বিশ্বামিত্রঃ সর্বমিত্রঃ (নিরুক্ত ২।২৪)] অর্থাৎ সকলকে আকর্ষণ করতে সক্ষম ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি থেকে হয়েছে।

আধিদৈবিক ভাষ্য— (ভূঃ) ‘ভূঃ’ নামক ছন্দরশ্মি কিংবা অপ্রকাশিত কণ বা লোক, (ভুবঃ) ‘ভুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা আকাশতত্ত্ব, (স্বঃ) ‘সুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা প্রকাশিত কণ, ফোটন বা সূর্যাদি তারার মধ্যে ব্যাপ্ত, (তৎ, সবিতুঃ) সেই অগোচর বা দূরস্থিত সবিতা অর্থাৎ মন, ‘ওম্’ রশ্মি, সকল ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ ও সূর্যাদি পদার্থকে (বরেণ্যম্, ভর্গঃ, দেবস্য) সর্বত্র আচ্ছাদনকারী ব্যাপক [ভর্গঃ=অগ্নির্বৈ ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৮), আদিত্ত্যো বৈ ভর্গঃ (জৈ. উ. ৪।১২।২।২), বীর্যং বৈ ভর্গোऽস্য বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ (শত. ব্রা. ৫।৪।৫।১), অয়ং বৈ (পৃথিবী) লোকো ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৭)] আগ্নেয় তেজ, যা সমগ্র পদার্থকে ব্যাপ্ত করে বহু সংযোজক ও সংবেদক বল দ্বারা যুক্ত হয়ে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লোকসমূহের নির্মাণে প্রেরণা দিতে সক্ষম হয়, (ধীমহি) প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ সে সমগ্র পদার্থে সেই আগ্নেয় তেজ, বল ইত্যাদিকে ব্যাপকভাবে ধারণ করে। (ধিয়ঃ, যঃ, নঃ, প্রচোদয়াত্) যখন সেই উপযুক্ত আগ্নেয় তেজ ঐ পদার্থকে ব্যাপ্ত করে নেয়, তখন বিশ্বামিত্র ঋষি-সংজ্ঞক মন ও ‘ওম্’ রশ্মিরূপ পদার্থ [ধীঃ = কর্মনাম (নিঘ. ২।১), প্রজ্ঞানাম (নিঘ. ৩।৯), বাগ্ বৈ ধীঃ (ঐ. আ. ১।১।৪)] বিভিন্ন প্রকারের বাক্‌রশ্মিকে নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে উত্তমভাবে প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করে।

ভাবার্থ— মন এবং ‘ওম্’ রশ্মিগুলি ব্যাহৃতি রশ্মির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে সকল মরুদ্‌, ছন্দাদি রশ্মিকে অনুকূলভাবে সক্রিয় করতে করতে সকল কণ, কোয়ান্টা এবং আকাশতত্ত্বকে উপযুক্ত বল ও নিয়ন্ত্রণে যুক্ত করে। এর ফলে সকল লোক তথা অন্তরিক্ষে বিদ্যমান পদার্থ নিয়ন্ত্রিত শক্তিতে যুক্ত হয়ে নিজেদের নিজ নিজ ক্রিয়াগুলি যথাযথভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। এর দ্বারা বিদ্যুৎবলও যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকে।

সৃষ্টিতে এই ঋচার প্রভাব— এই ঋচার উৎপত্তির পূর্বে বিশ্বামিত্র ঋষি অর্থাৎ ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিগুলি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। এর ছন্দ দৈবী বৃহতী + নিছৃদ্ গায়ত্রী হওয়ার কারণে এর ছান্দস প্রভাব থেকে বিভিন্ন প্রকাশিত কণ বা রশ্মি ইত্যাদি পদার্থ তীক্ষ্ণ তেজ ও বল লাভ করে সংবেদিত হতে থাকে। এর দৈবত প্রভাব থেকে মনস্তত্ত্ব এবং ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিরূপ সূক্ষ্মতম পদার্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণ, মরুদ্‌, ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ-এর সঙ্গে সঙ্গে সকল দৃশ্য কণ বা কোয়ান্টাও প্রভাবিত অর্থাৎ সক্রিয় হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ‘ভূঃ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘সুবঃ’ নামক সূক্ষ্ম ছন্দরশ্মিগুলি ‘ওম্’ ছন্দরশ্মির দ্বারা বিশেষভাবে সংগঠিত ও প্রেরিত হয়ে কণ, কোয়ান্টা, আকাশতত্ত্ব পর্যন্ত প্রভাবিত করে। এর ফলে এ সকলের মধ্যে বল ও শক্তির বৃদ্ধি হয়ে সকল পদার্থ বিশেষ সক্রিয়তা লাভ করে।

এই সময় সংঘটিত সকল ক্রিয়ায় যে যে ছন্দরশ্মিগুলি নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে, সেগুলি সকলই বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে নানাবিধ কর্মকে সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন লোক হোক তারা সূর্যাদি প্রকাশিত লোক অথবা পৃথিব্যাদি গ্রহ বা উপগ্রহাদি অপ্রকাশিত লোক সকলেরই রচনার সময় এই ছন্দরশ্মি নিজ ভূমিকা পালন করে। এর প্রভাবে সমগ্র পদার্থে বিদ্যুৎ ও উষ্মার বৃদ্ধি ঘটে, কিন্তু এই অবস্থাতেও এই ছন্দরশ্মি বিভিন্ন কণ বা কোয়ান্টাকে সক্রিয়তা প্রদান করলেও অনুকূলভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখতে সহায়ক হয়। হ্যাঁ, সেখানে ব্যাহৃতিগুলির অবিদ্যমানতা অবশ্যই রয়েছে। এর ষড়জ স্বরের প্রভাবে এই রশ্মিগুলি অন্যান্য রশ্মিকে আশ্রয় দেওয়া, নিয়ন্ত্রণ করা, দমন করা এবং বহন করতে সহায়ক হয়। ব্যাহৃতিগুলির মধ্যম স্বর এগুলিকে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে নিজ ভূমিকা পালন করার ইঙ্গিত দেয়।

আধ্যাত্মিক ভাষ্য— (ভূঃ) প্রাণসমূহের থেকেও প্রিয় এবং সকলের প্রাণের আধার, ভূলোকে অর্থাৎ সকল অপ্রকাশিত লোকের স্বামী এবং সৎ স্বরূপ পরমাত্মন্! (ভুবঃ) অপানস্বরূপ অর্থাৎ সকল দুর্গুণ ও দুঃখ দূরকারী চেতনাস্বরূপ পরমেশ্বর! (স্বঃ) ব্যানস্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতকে বিভিন্ন প্রকারে ক্রিয়াশীল করানো সকল প্রকাশিত লোকের স্বামী, আনন্দস্বরূপ এবং সকলকে আনন্দ প্রদানকারী জগদীশ্বর! (সবিতুঃ) সমগ্র জগতের উৎপত্তিকারী, সকলকে শুভ কর্মের প্রেরণা দানকারী, সকল লোকের ধারক পরমাত্মার (দেবস্য) সকল দিব্য গুণে যুক্ত, সকল প্রকাশিত লোককেও প্রকাশিতকারী, সকল মানুষকে বেদজ্ঞান প্রদানকারী, সমগ্র সৃষ্টির নিয়ন্তা, সকলের কামনা পূরণে যোগ্য, প্রলয়কালে সকলকে সুপ্ত করানো দেবস্বরূপ পরমাত্মার (তৎ, বরেণ্যম্) সেই বরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ (ভর্গঃ) পাপনাশক তেজকে (ধীমহি) আমরা আমাদের অন্তঃকরণ বা আত্মায় ধারণ করি। (যঃ, নঃ, ধিয়ঃ) যে অর্থাৎ সেই তেজ [ধীঃ=প্রজ্ঞানাম (নিঘ০ ৩।৯), কর্মনাম (নিঘ০ ২।১)] আমাদের বুদ্ধি ও কর্মকে (প্রচোদয়াত্) উত্তমভাবে প্রেরিত করে, অর্থাৎ সেই ঈশ্বর আমাদের সন্মার্গে চলার জন্য প্রেরণা দেন এবং আমরা সেই প্রেরণার অনুসরণ করতে করতে সন্মার্গে চলার সামর্থ্যও লাভ করি এবং সেই মার্গে সদা চলতে থাকি।

এই মন্ত্রটিকে উপাসনার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে, কারণ এতে পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা—এই তিনটিরই সমন্বয় রয়েছে। ‘ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, সবিতুঃ, দেবস্য, বরেণ্যম্, ভর্গঃ’ এই পদগুলি পরমেশ্বরের গুণাবলির প্রতিপাদন করে; এই কারণেই এগুলি স্তুতিপরক। এই গুণসমূহের কীর্তনের ফলে সাধকের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাবের উদ্ভব হয়। সকল ব্যাহৃতির চিন্তনের মাধ্যমে সে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বরকেই অনুভব করতে শুরু করে। তিনি তাঁকে দুঃখনাশক ও সুখপ্রদাতা বলে জেনে সংসারিক দুঃখ ভুলে আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন।

তিনি ঈশ্বরকে সমগ্র সৃষ্টির উৎপাদক ও নিয়ন্তা বলে মান্য করে স্বত্ববোধজনিত অহংকার থেকে মুক্ত হতে শুরু করেন। সেই ঈশ্বরকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জেনে তাঁরই সাক্ষাৎকারের কামনা করেন। তাঁর পাপনাশক স্বরূপ স্মরণ করে নিজের অন্তঃকরণের মলিনতা দূর হচ্ছে এমন অনুভব লাভ করেন। এখানে ‘ধীমহি’ পদটি তাঁর উপাসনার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই পদের উপর চিন্তনকালে সাধক সেই পরমাত্মার তেজকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করেন এবং ‘ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্’ এই প্রার্থনামূলক পদের জপের মাধ্যমে তিনি শুদ্ধ বুদ্ধি দান ও তদনুযায়ী কর্ম করার সামর্থ্য প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনার ফলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে সর্বতোভাবে অহংকারশূন্য হওয়ার প্রয়াসে প্রবৃত্ত হন।

আধিভৌতিক ভাষ্য—
এখন আমরা এই মন্ত্রের আধিভৌতিক অর্থের উপর চিন্তা করি—

ভাবার্থ— এখানে ‘ভূঃ’ দ্বারা কর্মবিদ্যা, ‘ভুবঃ’ দ্বারা উপাসনাবিদ্যা এবং ‘স্বঃ’ দ্বারা জ্ঞানবিদ্যা বোঝানো হয়েছে। এই তিন প্রকার বিদ্যার দ্বারা যিনি সম্পূর্ণ, সেই ‘সবিতা’ অর্থাৎ যোগপদার্থের জ্ঞানকে প্রসবিত ও বিকশিতকারী। তিনি দেবগুণে বিভূষিত রাজা, অথবা মাতা–পিতা, উপদেশক, আচার্য কিংবা যোগীপুরুষ যাঁরা গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ, এবং যাঁদের তেজ পাপাদি দোষকে নাশ করে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে যজ্ঞ অর্থাৎ সংগঠন, ত্যাগ ও বলিদানের ভাব সমৃদ্ধ করে এমন যে উপদেশ বা বিধান, তাকেই আমরা সকল মানুষ হৃদয়ে ধারণ করি। এইরূপ রাজা, যোগী, আচার্য বা মাতা–পিতা এবং তাঁদের বিধান ও উপদেশ আমাদের কর্ম ও বুদ্ধিকে ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক উন্নতির পথে সঠিকভাবে প্রেরণা দেয়।

সারকথা এই যে, উত্তম যোগী ও জ্ঞানী মাতা–পিতা, আচার্য এবং রাজা তাঁদের সন্তান, শিষ্য বা প্রজাকে শ্রেষ্ঠ উপদেশ ও সর্বহিতকারী বিধানের মাধ্যমে সকল প্রকার দুঃখ ও পাপ থেকে মুক্ত করে উত্তম পথে পরিচালিত করেন। এইরূপ মাতা–পিতা, আচার্য ও রাজাদের প্রতি সন্তান, শিষ্য ও প্রজারা গভীর শ্রদ্ধাভাব পোষণ করে; যার ফলে সমগ্র পরিবার, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সর্বতোভাবে সুখী হতে পারে।

ধ্যাতব্য— গায়ত্রী-মন্ত্রের সাধনা করেন এবং সন্ধ্যা করেন এমন সাধকের জন্য যোগ্যতা এই যে, তিনি যেন কেবল নিজের বুদ্ধি ও কর্মকে পবিত্র করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকেন; বরং এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তামসিক প্রবৃত্তিগুলিকে দূর করার জন্যও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর সর্বদা বুদ্ধিবর্ধক ও সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা উচিত।

এই গ্রন্থে কেবল মন্ত্রের দেবতার ব্যাখ্যার প্রসঙ্গেই আমরা নয়টি প্রমাণ প্রদান করেছি এবং প্রতিটি প্রমাণের পৃথক-পৃথক অর্থও বাংলায় স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। ঋষি-তত্ত্বকে বোঝানোর জন্যও দুটি প্রমাণ দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলির অর্থও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রেও বহু প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেসবের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে; অথচ মহর্ষি দয়ানন্দ জি এই মন্ত্রের ভাষ্যে কোনো প্রমাণই দেননি।

তবুও কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এত প্রমাণ দেওয়ার পরও কি অর্থ স্পষ্ট হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়, শুরুতে প্রমাণগুলিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই প্রক্রিয়াকে ন্যূনতম করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, গ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই ধীরে ধীরে বিষয় বোঝার যোগ্য হয়ে ওঠেন এবং তখন আর নতুন পাঠকের মতো করে সব কিছু আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। উপরন্তু, সময়সীমার বিষয়টিও সামনে ছিল।

এখন আমি আপনাদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই যদি আপনারা আমার স্থানে থাকতেন, তাহলে কী করতেন? আশা করি, আপনারা নিজেদের প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই পেয়ে গেছেন।

প্রশ্ন— আপনার এই নিরুক্ত-ভাষ্যের ফলে কি বর্তমানে প্রচলিত গুরুুকুল-পরম্পরা ধ্বংস হয়ে যাবে না? যদি এমন হয়, তবে তার সম্পূর্ণ দায়ভার কি আপনারই হবে?

উত্তর— আপনার এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। গুরুুকুলগুলিকে বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহের রক্ষার জন্যই সর্বদা সচেষ্ট থাকা উচিত। আমার এই নিরুক্ত অথবা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ভাষ্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ব্যাকরণবেদ, ছন্দশাস্ত্রের পাদ এবং নিরুক্ত শাস্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হবে। যখন গুরুুকুলের আচার্যরা এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তখন এই গ্রন্থগুলির প্রতি তাঁদের বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি শ্রদ্ধা জন্মাবে। তাঁদের আত্মবল বৃদ্ধি পাবে।

ভেবে দেখুন, আমি নিরুক্ত-ভাষ্যে কী করেছি। আমি বেদমন্ত্র এবং মহর্ষি যাস্কের বচনগুলির সঙ্গে কোনো রকম ছেঁড়াছেঁড়া করিনি। একটি শব্দেরও কোথাও কোনো ভেদ করিনি। আমি কেবল সেই শব্দগুলিরই আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছি। আমি অন্যান্য সব ভাষ্যকারদের ভাষ্যও দেখেছি, তাতে নানা প্রকার পাপের বিদ্যমানতাও অনুভব করেছি। এই কারণেই শাস্ত্রগুলির প্রতি সর্বদিক থেকে যে নিন্দা হয়ে আসছে, তার অভিজ্ঞতাও আমি পেয়েছি।

এই কারণেই আমি মধ্যযুগীয় ও বর্তমান ভাষ্যকারদের অনার্ষ পরম্পরাকেই দোষী জেনে তাকে ধ্বংস করার দায়িত্ব অবশ্যই গ্রহণ করেছি। শাস্ত্রের অপমান দেখে আপনার মতো নীরব থাকতে আমি পারি না, কারণ তা করা অপরাধ হবে। তখন আমার সামনে কেবল দুটি পথই ছিল... প্রথমত, আমি আপনার মতোই মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ভাষ্যকারদের পাণ্ডিত্যের সামনে নতমস্তক হয়ে সমস্ত পাপের দায় ঋষিদের গ্রন্থ ও বেদসমূহের ওপর চাপিয়ে দিই। এরপর হয় আপনার মতো নীরব থাকি, অথবা এমন করার পর নিজেও তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিশি, যারা দিনরাত বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর এ রকম ঘৃণিত অভিযোগ আরোপ করে চলেছে এবং যারা দেশ ও ধর্মের জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

শৈশবকাল থেকেই কেবল সত্যের ওপর দৃঢ় থাকার স্বভাবের কারণে আমি যদি এই শাস্ত্রগুলিকে বহু পাপের পোষক মনে করে তাদের সর্ববৃহৎ বিরোধী হয়ে যেতাম, তবে আপনাদের সবার জন্যই আমি সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠতাম। যখন আপনারা খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ এবং বামপন্থীদের অভিযোগেরই উত্তর দিতে পারছেন না, তখন আমার সঙ্গে আপনারা মোকাবিলা করতেন কীভাবে?

সৌভাগ্যবশত আমি ঋষি দয়ানন্দকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। বেদ ও ঋষিদের বিষয় সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধিও আমি স্পষ্টভাবে বুঝেছিলাম। এই কারণেই এই শাস্ত্রগুলির ওপর কোনো প্রকার দোষারোপ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই এই শাস্ত্রগুলির ভাষ্যকাররা—তাঁরা আমার কাছে যতই পূজনীয় হোন না কেন—তাঁদের উপেক্ষা করে, প্রভুপ্রদত্ত জন্মজাত বুদ্ধি ও সত্যপালনের শক্তির ওপর ভরসা করে নিজস্ব পথ নিজেই নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারই ফল এই যে, আমি এই দুই গ্রন্থ মানবকল্যাণের জন্য উপস্থাপন করতে পেরেছি। এটিই আমার দ্বিতীয় বিকল্প।

এই বিকল্প গ্রহণ করার জন্য আপনার তো আনন্দিত হওয়াই উচিত ছিল যে আমি আপনাকে বিরোধীদের মতো চ্যালেঞ্জ জানানো ব্যক্তি হয়ে উঠিনি। যদি বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহকে নিষ্কলুষ ও মহান বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও আপনার আপত্তি থাকে, তবে তা আপনারই সমস্যা।

কোনো বেদবিরোধী যদি এই কাজের বিরোধিতা করে, তবে তা বোঝা যায়। কিন্তু যে নিজেকে বেদভক্ত ও ঋষিভক্ত বলে পরিচয় দেয়, সে যদি এমন করে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার।

দুর্ভাগ্যবশত আজ আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে নিজ নিজ গোষ্ঠীর বিদ্বানদের মান-সম্মান নিয়েই কেবল চিন্তিত। নিজের পদ, প্রতিষ্ঠা ও ধনের চিন্তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। যদি ঋষি বা বেদের মান-সম্মান আপনার দৃষ্টিতে সামান্যও গুরুত্ব পেত, তবে বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর আরোপিত ঘৃণিত অভিযোগ দেখে আপনি গান্ধীর তিন বানরের মতো নীরব থাকতেন না।

আমি আপনাদের সকলকে বলতে চাই আমার গ্রন্থগুলিতে যদি এই ধরনের কোনো অভিযোগের সত্যতা প্রতীয়মান হয়, তবে শুধু তার সমাধানই নয়, আমার খণ্ডনও করুন এর জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদই জানাব। কিন্তু ভিত্তিহীন নিন্দার প্রতি আমি উদাসীনই থাকব।

সবশেষে আপনাদের সকলের কাছে এই করজোড় নিবেদন করছি নিজ নিজ সাথী বা গুরুর মান-প্রতিষ্ঠার চিন্তা পরিত্যাগ করে কেবল ঋষি ও বেদের সম্মান ও প্রতিষ্ঠার কথাই ভাবুন। কারণ তাঁদের প্রতিষ্ঠাই সত্যের প্রতিষ্ঠা, মানবতার প্রতিষ্ঠা; আর সত্য ছাড়া ধর্ম নেই।

এবার আমরা গুরুকুলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছি। যখন গুরুকুলে এই ধরনের ভাষ্য পাঠ করানো হবে এবং সেখানে প্রতিভাবান ছাত্ররা আসবে, তখন আমাদের গুরুকুলগুলো এক–দু’জন বেদবিরোধী ব্যক্তির আপত্তির জবাব দেওয়াতেই শুধু সক্ষম হবে না, বরং তাদের কাছে বেদ ও ঋষিদের গৌরবও স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারবে। সেই সময় গুরুকুলগুলো বিজ্ঞানীদের কাছেও তীর্থস্থান হয়ে উঠবে, যেমন প্রাচীন কালে হয়ে থাকত।

গুরুকুলের ব্রহ্মচারীরা তারা কেবল বেদপাঠী হোক বা শাস্ত্রসমূহের নিয়মিত অধ্যয়নকারীই হোক সবার মধ্যেই এক ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার জাগরণ ঘটবে এবং তাদের মধ্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জন্ম হবে। তারা বড় বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাপনা সংস্থার মতোই সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠবে। এই কারণে আমার কাজের ফলে গুরুকুলের পরম্পরা ধ্বংস হবে না; বরং সেই পরম্পরা বিশ্বজুড়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে।

-আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক জীর লেখা হতে বঙ্গানুবাদ (বেদার্থ বিজ্ঞানম্)

Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী

বৈদিক বাঙ্গময়ের ইতিহাস – প্রথম অধ্যায়:  ১. গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ ও এর অর্থ বৈদিক এবং সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থকার, ভাষ্যকার, বাতিককার ও ট...

Post Top Ad

ধন্যবাদ