ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Hindusim

Post Top Ad

স্বাগতম

03 November, 2025

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩

03 November 0

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩
ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩-এর সঠিক অর্থ ও গোমাংস ব্যাখ্যার খণ্ডন


🌼 ভুল ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ

কিছু আধুনিক লেখক, বিশেষত পশ্চিমা দার্শনিক ও কিছু “বেদবিরোধী” অনুবাদক, ঋগ্বেদের ১০.২৮.৩ মন্ত্রে “বৃষভা পচন্তি” অংশটি দেখে দাবি করেছেন— “তাহারা ষাঁড় রান্না করে এবং ইন্দ্রকে তা ভক্ষণ করতে বলা হয়েছে।” এই ব্যাখ্যা ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ও বেদীয় ব্যাকরণ অনুসারে সম্পূর্ণ ভুল।


🕉️ অপ্রামাণিক সংস্কৃত পাঠ

পচস্তি তে বৃষভা অৎসি তেষাম

এটি আসলে ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রেরই একটি মাত্র অংশ মূল মন্ত্রটি নীম্নে দেওয়া হলঃ

প্রামাণিক পাঠ (ঋগ্বেদ ১০।২৮।৩)

অদৃণা তে মন্দিন ইন্দ্র তূযান্ত্‌সুন্বন্তি সোমান্‌ পিবসি ত্বমেষাম্‌।
পচন্তি তে বৃষভাঁ অত্সি তেষাং পৃক্ষেণ যন্মঘবন্ন্‌ হূযমানঃ॥

“বৃষভ” শব্দের ভাবার্থ পরিপক্বতা বা সম্পূর্ণ বিকাশ বোঝায়।

 বৈদিক সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে একটি বিশ্লেষণ

পদার্থঃ (ইন্দ্র) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! (তে) তোমার জন্যে, (অদৃণা) প্রশংসাকারী বৈদ্য বা পুরোহিত দ্বারা প্রেরিত, (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিত করা পারিবারিক জন বা রাজকর্মচারী, (তূয়াৎ সোমান্ সুন্বন্তি) রসময় সোমপদার্থ (অর্থাৎ শক্তিদায়ক রস) প্রস্তুত করে,(তেষাম্ ত্বং পিবসি)  তুমি তা পান করো, এবং (তে) তোমার জন্যে, (বৃষভান্ পচন্তি) সুখবর্ষণকারী ভোগ্য বস্তুকে প্রস্তুত করে, (মঘবন্ পৃক্ষেণ হূয়মানঃ) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক দ্বারা আহ্বানিত হয়ে, (তেষাম্ অত্সি)  তুমি তাদের ভোগ করো। ॥৩॥

ভাবার্থঃ যখন আত্মা শরীরে অবতীর্ণ হয়, তখন তাকে অনুমোদনকারী বৈদ্য এবং আনন্দদানকারী পারিবারিক জনেরা নানা রকমের রস ও ভোগ্যবস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে, এবং স্নেহসহকারে তাকে খাওয়ায়–পান করায়, যাতে দেহ ক্রমে পুষ্ট হতে থাকে। একইভাবে, যখন রাজা রাজপদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার প্রশংসাকারী পুরোহিত ও সন্তুষ্টিদায়ক রাজকর্মচারীরা সোমাদির মতো ঔষধি রস এবং নানান ভোগ্য বস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে। রাজা, স্নেহভরে ও সম্মানসহ যাদের দ্বারা আহ্বানিত হন, তিনি সেই সকল প্রস্তুত ভোগ্যবস্তুর আস্বাদ গ্রহণ করেন। ॥৩॥

(ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কর্তৃক হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

अद्रि॑णा ते म॒न्दिन॑ इन्द्र॒ तूया॑न्त्सु॒न्वन्ति॒ सोमा॒न्पिब॑सि॒ त्वमे॑षाम् । 

पच॑न्ति ते वृष॒भाँ अत्सि॒ तेषां॑ पृ॒क्षेण॒ यन्म॑घवन्हू॒यमा॑नः ॥

পদার্থঃ [১] পূর্ববর্তী মন্ত্রে প্রভু জীবকে "সুত সোম" (অর্থাৎ পরিশুদ্ধ শক্তিময়) হতে বলেছিলেন। তার উত্তর দিতে গিয়ে সে বলে—হে (ইন্দ্র) = সোমপানকারী প্রভু! (তে মন্দিনঃ) = তোমার স্তোতা ভক্তগণ, (অদৃণা) = [অদ্রিঃ = বজ্রঃ] ক্রিয়াশীলতার দ্বারা, অথবা [না দীর্যতে] ধর্মমার্গ থেকে বিচ্যুত না হয়ে, (তূয়ান্) = বিলম্ব না করে, অর্থাৎ দ্রুত কর্মসম্পাদনের শক্তি প্রদানকারী, (সোমান্) = সোমরূপ শক্তিকণসমূহকে (সুন্বন্তি) = উৎপন্ন করে। (ঐষাম্) = এই সোমকণগুলির (ত্বম্) = আপনিই (পিবসি) = পান করেন অর্থাৎ এই সোমকণসমূহ আমার শরীরে আপনার কৃপায় সংরক্ষিত থাকে। আপনার স্মরণ আমাকে কামনা বাসনা থেকে উপরে তুলে আনে, এবং কামনা থেকে উর্ধ্বে উঠার ফলে আমি সোমকে (অর্থাৎ আত্মশক্তিকে) রক্ষা করতে সক্ষম হই।

[২] এইভাবে, (তে) = তোমার এই ভক্তগণ (বৃষভান্ পচন্তি) = অর্থাৎ পরিপক্ব ও শক্তিশালী পুরুষে রূপান্তরিত হয়, শক্তিশালী হয়ে তারা অপরের উপর সুখের বর্ষণ ঘটায়।

[৩] হে প্রভু! আপনি (তেষাম্) = তাদের পথের অন্তরায়রূপ বাধাসমূহের (অত্সি) = বিনাশ করেন [‘অদ্’ = ধ্বংস করা]। কিন্তু এই বাধা-বিঘ্নের বিনাশ আপনি কখন করেন? (যৎ) = যখন (পৃক্ষেণ) = [পৃচি = সংস্পর্শ] আপনার সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে, হে (মঘবন্) = ঐশ্বর্যশালী প্রভু! আপনি (হূয়মানঃ) = আহ্বান করা হন। এই ভক্তগণ প্রাতে ও সায়ং আপনার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং শক্তিশালী হয়ে, সমস্ত বাধা দূর করে, অগ্রসর হয়।

ভাবার্থঃ ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে আমরা কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে রক্ষা করব। সোম (অর্থাৎ আত্মশক্তি ও সত্ত্বগুণ) সংরক্ষণের দ্বারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলব। প্রভুর সংস্পর্শে এসে, শক্তিসঞ্চয় করে, বাধা-বিঘ্ন দূর করে আমরা দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হব।

(হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কারজীর হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

📘 পদার্থ বিশ্লেষণ

শব্দ ধাতু / উৎস নিরুক্ত / সূত্র প্রামাণিক অর্থ রূপক ভাব
পচন্তি (pachanti) √पच্ (ধাতু) নিরুক্ত ১.১.১.১২  “সিদ্ধ করা”, “পরিপক্ব করা” সিদ্ধ করে / পরিপক্ব করে আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধন
বৃষভাঃ (vṛṣabhāḥ) √वृष্ ধাতু নিরুক্ত ৯.২৩.১  “বলবান”, “শক্তিশালী ব্যক্তি” বলবান মানুষ সাধক, পরিপক্ব কর্মযোগী
অদ্রিণা (adriṇā) अद्रि (পাথর / দৃঢ়তা) নিরুক্ত ৫.৫.১  “দৃঢ় কর্মশক্তি” দৃঢ়তার দ্বারা অধ্যবসায় ও সাধনার প্রতীক
তে মন্দিনঃ (te mandinaḥ) মন্দিন = স্তোতা নিরুক্ত ৭.৩.১ তোমার ভক্তগণ উপাসকরা
অৎসি (atsi) √अद্ ধাতু নিরুক্ত ৬.৩.৪ “খাওয়া” বা “ধ্বংস করা” তুমি ধ্বংস করো এখানে “বাধা বিনাশ করা” অর্থে
মঘবন (maghavan) নামরূপ ইন্দ্রের নিরুক্ত ৪.১৯.৮ ঐশ্বর্যশালী / দাতা ঈশ্বররূপ প্রভু
হুয়ামাহ্ (hūyamānaḥ) √हु ধাতু নিরুক্ত ১.৫.৫  “আহ্বান করা” আহ্বানিত যজ্ঞে আহ্বান প্রাপ্ত হওয়া

🪔 সংস্কৃত থেকে সঠিক বাংলা অনুবাদঃ 

(ইন্দ্র) হে আত্মন! অথবা রাজন! (তে) তোমার জন্য (অদ্রিণা) স্তোত্রকার কবি, চিকিৎসক বা পুরোহিতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে “অদ্রিরসি শ্লোককৃত্” [কাঠক সংহিতা ১।৫] (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিতকারীরা, তোমার পারিবারিক সদস্যগণ বা রাজকর্মচারিগণ (তূয়ান্ সোমান্ সুন্বন্তি) জলে পরিপূর্ণ, রসে পরিপূর্ণ “তূয়ম্ উদকনাম” [নিঘন্টু ১।৯]এমন সোমরস প্রস্তুত করে; (তেষাম্ ত্বং পিবসি)তুমি সেগুলি পান করো “লিঙ্গার্থে লেট্” [অষ্টাধ্যায়ী ৩।৪।৭]; আবার (তে) তোমার জন্য (বৃষভান্ পচন্তি)সুখ ও রসের বর্ষণকারী বস্তুসমূহ প্রস্তুত করে “বৃষভঃ যঃ বর্ষতি সুখানি সঃ” [ঋগ্বেদ ১।৩১।৫ দয়ানন্দ], “বৃষভঃ বর্ষিতা আপাম্” [নিরুক্ত ৪।৮]; (মঘবন্) হে ঐশ্বর্যবান প্রভু! (পৃক্ষেণ) স্নেহ-সম্পর্ক দ্বারা (হূয়মানঃ) আহ্বানিত বা নিমন্ত্রিত হয়ে (তেষাম্ অত্সি)তুমি তাদের ভোগ করো বা উপভোগ করো ॥


🚫 ভুল অনুবাদের খণ্ডন

ভুল দাবি সঠিক ব্যাখ্যা
“বৃষভা” মানে ষাঁড় “বৃষভ” মানে শক্তিমান ব্যক্তি, ঈশ্বর বা জ্ঞানবান
“পচন্তি” মানে রান্না করা “পচন্তি” মানে পরিপক্ব করা, উন্নত করা, সিদ্ধ করা
“অৎসি” মানে খাওয়া “অৎসি” মানে ধ্বংস করা / রক্ষা করা
“গোমাংস ভক্ষণ” প্রসঙ্গ কোথাও নেই  মন্ত্রটি শক্তি, ভক্তি ও সাধনার রূপক প্রকাশ

📜 পাণিনি ও নিরুক্ত সূত্র প্রমাণ

১. পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ৭.১.৫১: “वृषस्यति गोः”-  এখানে “বৃষ” শব্দে “গো” অর্থে নয়, বরং বলবান রূপে ব্যবহৃত।
২. নিরুক্ত (৯.২৩.১): “वृषो बलवां नरः” - বৃষ মানে বলবান মানুষ।
৩. নিরুক্ত (১.১.১.১২): “पच् = सिध्यति” - সিদ্ধ করা, উন্নত করা।


🌸 উপসংহার

ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রটি গোমাংস ভক্ষণ বা পশুবলি নির্দেশ করে না।
বরং এটি বলে—মানুষকে দৃঢ় কর্ম, সাধনা ও ঈশ্বরস্মরণের দ্বারা শক্তিমান হতে হবে,
তখন প্রভু তার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে পথ প্রসারিত করেন।

অতএব, “ষাঁড় রান্না” বা “গোমাংস ভক্ষণ” ব্যাখ্যা কেবল ভাষাতাত্ত্বিক অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি।
এই মন্ত্র আসলে কর্মশক্তি, বোধ ও ঈশ্বরযোগের প্রতীকী স্তব।

📚 ৫. সায়ণাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ীঃ

“वृषभान् पचन्ति इति बलीयान् पुरुषान् परिपच्य भवन्ति।”
(Rigveda with Sāyaṇa Bhāṣya, Nirnaya Sagar Edition, Vol. 4, p. 532)

অর্থাৎ, “বৃষভান্ পচন্তি” মানে— ভক্তরা নিজেদের পরিপক্ব বা শক্তিশালী করে তোলে, এটা না যে তারা পশু রান্না করে।


Read More

27 October, 2025

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯

27 October 0

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯

অথর্ববেদ ১৪/১/১৯ (মন্ত্রাঃ ৬-৬৪। বিবাহসংস্কারোপদেশঃ-)

ঋষিঃ — আত্মা। দেৱতা — তৃষ্টুপ্। ছন্দঃ — সবিত্রী, সূর্যা। সূক্তম্ — বিবাহ প্রकরণ সূক্ত।

প্র ত্বাম্ উঞ্চামি বরুণস্য পাশাত্, যেন ত্বা অভধ্নাত্ সবিতা সুশেভাঃ। ঋতস্য যোনৌ সুকৃতস্য লোকে, স্যোনং তে অস্তু সহসংভলায়ৈ॥

(বরুণস্য) বরণ যোগ্য শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর সম্বন্ধী (পাশাৎ) প্রেম-বন্ধন থেকে (ত্বা) হে বধু ! তোমাকে (প্র মুঞ্চামি) আমি মুক্ত করি, (যেন) যে প্রেম-বন্ধন দ্বারা (সুশেবাঃ) উত্তম সুখদাতা (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (ত্বা) তোমাকে (অবধ্নাৎ) বন্ধন করেছিল। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) আমার গৃহে, তথা (সুকৃতস্য) সুকর্মীদের (লোকে) সমাজে, (সহসম্ভলায়ৈ, তে) সম্যগ্ভাষী পতির সাথে বর্তমান তোমার জন্য (স্যোনম্) সদা সুখ (অস্তু) হোক।

[সুশেবাঃ=সু + শেবম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। যোনিঃ গৃহনাম (নিঘং০ ৩।৪) সম্ভল=সম্ (সম্যক্) + ভল (পরিভাষণে), অর্থাৎ সম্যগ্ভাষী, প্রেমপূর্বক ভাষণকারী পতি (মন্ত্র ৩১)। স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। সহসম্ভলায়ৈ= সম্ভলেন সহ বর্ততে ইতি সহসম্ভলা, তস্যৈ] [ব্যাখ্যা–বরুণ অর্থাৎ সংসারের সম্রাট্ পরমেশ্বরের বন্ধন, সংসারকে বেঁধে রেখেছে। মাতা-পিতা এবং সন্তানদের, পতি এবং পত্নীর পারস্পরিক প্রেমবন্ধনও একটি বন্ধন যার রচনা প্রভু সৃষ্টিতে করে রেখেছেন। এই প্রেমবন্ধনের সত্তা পশুদের, পক্ষীর তথা কীট-পতঙ্গের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রাণিসৃষ্টির সৃজন হচ্ছে। বর বলে— হে বধু ! এখনও পর্যন্ত তো এই প্রেমবন্ধন দ্বারা তোমার সুখী মাতা-পিতা তোমাকে বেঁধে রেখেছিল, কিন্তু এখন থেকে আমি তোমাকে নিজের প্রেমবন্ধন দ্বারা আবদ্ধ করি। এইভাবে বর নিজের হার্দিক প্রেমের বিশ্বাস বধূকে দেয়। সাথে বর বলে এই নতুন ঘরে সত্যের রাজ্য আছে। এই ঘরে তুমি সদা সুখপূর্বক থাকবে, এবং আমি সদা সম্যগ্ভাষী হয়ে তোমার জন্য সুখদায়ী হবো।] বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার জীর টিপ্পণী সহঃ অর্থ

ক্ষেমকরণ ত্রিবেদীকৃত পদার্থ ভাস্যঃ 
[হে বধূ !] (ত্বা) তোমাকে (বরুণস্য) প্রতিরোধের (পাশাৎ) বন্ধন থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি [বর] উত্তমরূপে মুক্ত করি, (যেন) যার সাথে (ত্বা) তোমাকে (সুশেবাঃ) অত্যন্ত সেবাযোগ্য (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (অবধ্নাৎ) বেঁধেছে। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) ঘরে এবং (সুকৃতস্য) সুকৃত [পুণ্য কর্মের] (লোকে) সমাজে (সহসম্ভলায়ৈ) সখীদের সহিত বর্তমান (তে) তোমার জন্য (স্যোনম্) আনন্দ (অস্তু) হোক ॥১৯॥

যে কন্যাকে পিতা যোগ্য পতি প্রাপ্তির পূর্বাবস্থা পর্যন্ত ধরে রেখেছিল, তাঁকে পিতার ঘর থেকে প্রসন্নতার সহিত নিয়ে বর প্রেমপূর্বক রাখুক এবং ঘরের সব ধর্মাত্মা বিদ্বান্ স্ত্রী-পুরুষ শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করে তাঁকে সুখ প্রদান করুক ॥১৯॥মন্ত্র ১৮ এর টিপ্পণী দেখো ॥
Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/৩০

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/৩০

অথর্ববেদ ১৭।১।৩০ 

অগ্নিঃ মা গোপ্তা পরি পাতু বিশ্বতঃ, উদ্যন্তঃ সূর্যঃ নুদতাম্ মৃত্যুপাশান্। ব্যুছন্তী ঋষসঃ পর্বতা ধ্রুৱাঃ, সহস্রং প্রাণা ময়্যা যতন্তাম্॥

পদার্থঃ (গোপ্তা) রক্ষক/রক্ষাকারী (অগ্নিঃ) জ্ঞানময় পরমেশ্বর (বিশ্বতঃ) সব দিক থেকে (মা পরি পাতু) আমার রক্ষা করেন/করুক, (উদ্যন্) উদীয়মান (সূর্যঃ) সর্বপ্রেরক পরমাত্মা (মৃত্যুপাশান্) মৃত্যুর বন্ধন-সমূহকে (নুদতাম্) দূর করেন/করুক। (ব্যুচ্ছন্তীঃ) বিশেষ চমকিত (উষসঃ) প্রভাতবেলা, (ধ্রুবাঃ) দৃঢ় (পর্বতাঃ) পাহাড় এবং (প্রাণাঃ) সব প্রাণ [শারীরিক এবং আত্মিক বল] (সহস্রম্) সহস্র প্রকারে (ময়ি) আমার মধ্যে (আ যতন্তাম্) সবদিক থেকে প্রচেষ্টা করতে থাকুক ॥৩০॥

ভাবার্থঃ মনুষ্য পরমেশ্বরের আশ্রয় নিয়ে অমর অর্থাৎ যশস্বী হয়ে সব কাল/সময়কে, সব উঁচু-নীচু অবস্থাকে এবং শারীরিক ও আত্মিক বলকে অনুকূল করুক ॥৩০॥

টিপ্পণীঃ [মন্ত্রে অগ্নি এবং সূর্য পরমেশ্বর বাচক [মন্ত্র ৬ এর ব্যাখ্যা], কেননা অগ্নি অর্থাৎ সর্বাগ্রণী পরমেশ্বরই সবদিক থেকে পূর্ণরক্ষা করার ক্ষেত্রে সমর্থ। তথা পরমেশ্বরই হৃদয়াকাশে উদিত হয়ে, নিজ জ্যোতি দ্বারা অবিদ্যান্ধকার দূর করে মৃত্যু অর্থাৎ জন্ম-মরণের ফাঁদ থেকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন। যথা "তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি" (যজু০ ৩১।১৮)। উষসঃ= ঊষা কালের সাত্ত্বিক সময়, তথা পর্বতীয় শুদ্ধ বায়ুর সেবন, এবং এগুলোর দ্বারা প্রাণ-সমূহের শুদ্ধ হওয়া,–এই উপায়গুলোর দ্বারা জীবনে শক্তি সঞ্চার হলে ব্যক্তি প্রচেষ্টাশীল হয়/হয়ে যায়। সহস্র প্রাণাঃ শরীরের প্রত্যেক অবয়ব এবং অঙ্গে, তথা অঙ্গের প্রকোষ্ঠে (cells) নিজ নিজ শক্তি নিহিত রয়েছে যাকে প্রাণ বলা হয়। এই দৃষ্টিতে প্রাণ-সমূহকে সহস্রম্ বলা হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসও প্রাণ। জীবনে এগুলোর সংখ্যা অসংখ্য। এইভাবে প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান এগুলোও প্রাণ। এই দৃষ্টিতে প্রাণ-সমূহের জন্য সহস্ত্রম্ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। পর্বতাঃ ধ্রুবাঃ= পর্বত-এর দুটি অর্থ, (১) মেঘ (নিঘং০ ১।১০) তথা পার্থিব পর্বত। পার্থিব পর্বত ধ্রুব/স্থির, মেঘ অধ্রুব। মন্ত্রে অগ্নি দ্বারা অগ্নিহোত্রের অগ্নি তথা সূর্য দ্বারা দ্যুলোকস্থ সূর্যেরও গ্রহণ অভিপ্রেত হয়েছে। অগ্নিহোত্রের অগ্নি স্বাস্থ্যকারী তথা রোগ বিনাশক সামগ্রীর আহুতির দ্বারা, তথা সূর্য নিজ জ্যোতি তথা তেজ দ্বারা জীবনের রক্ষা করে, আয়ু বৃদ্ধি করে, শীঘ্র মৃত্যু থেকে রক্ষা করে। এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর সাথে-সাথে ঊষাকালের সেবন তথা পর্বতবাস আদি দ্বারা প্রাণশুদ্ধি আদিও আয়ুবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়] টীকাঃ বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার


Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/২১

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/২১

রুচিরসি রোচোऽসি। স যথা ত্বং রুচ্যা রোচোऽস্যেবাহং পশুভিশ্চ ব্রাহ্মণবৰ্চসেন চ রুচিষীয়॥

পদার্থঃ [হে পরমেশ্বর !] তুমি (রুচিঃ) প্রীতিরূপ (অসি) হও, তুমি (রোচঃ) প্রীতিকর (অসি) হও। (সঃ ত্বম্) সেই তুমি (যথা) যেমন (রুচ্যা) প্রীতি সহিত (রোচঃ) প্রীতিকর (অসি) হও, (এব) তেমনই (অহম্) আমি (পশুভিঃ) প্রাণীদের সহিত (চ চ) এবং (ব্রাহ্মণবর্চসেন) ব্রাহ্মণদের [ব্রহ্মজ্ঞানীদের] সমান তেজ সহিত (রুচিষীয়) রুচি করি ॥২১॥

ভবার্থঃ যেমন পরমাত্মা আমাদের সাথে প্রীতি করে অনেক উপকার করেন, তেমনই আমরা মহাত্মাদের সমান সব প্রাণীদের এবং বেদজ্ঞান দ্বারা প্রীতি করে সদা উপকার করি ॥২১॥

টিপ্পণীঃ [রুচিঃ, রোচঃ=রুচ্ দীপ্তৌ, অভিপ্রীতৌ চ। সংসারের উৎপত্তি, স্থিতি, প্রলয়ে পরমেশ্বরের কোনো স্বার্থ নেই, জীবাত্মার ভোগ এবং অন্ত/শেষে অপবর্গ অর্থাৎ মোক্ষের নিমিত্ত/জন্য, প্রেমবশ হয়ে, সে উৎপত্তি আদি কার্য করে। "তত্ত্বসমাস" সাংখ্য সূত্রে সূত্র রয়েছে "অনুগ্রহ সর্গঃ"। (তত্ত্ব সমাস, সূত্র ১৭) অর্থাৎ সৃষ্টি পরমেশ্বরের কেবল অনুগ্রহ, দয়া এবং প্রেমের প্রদর্শন। উপাসকও সকলের প্রেমপাত্র হতে চায়। এরজন্য সে পরমেশ্বরের কাছে পশুদের এবং ব্রাহ্মণবর্চসের যাচনা করে যাতে সে পশুদের দ্বারা সর্বোপকার করতে পারে, তথা ব্রহ্মবেত্তাদের তেজ সমান তেজ প্রাপ্ত করে সকলের আধ্যাত্মিক উন্নতি করে তাঁদের প্রেমের পাত্র হতে পারে। রুচিঃ- Liking, love (আপ্টে)]

Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/২০

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/২০

শুক্রোऽসি ভ্রাজোऽসি। স যথা ত্বং ভ্রাজতা ভ্রাজোऽস্যেবাহং ভ্রাজতা ভ্রাজ্যাসম্॥

আয়ুর্বৃদ্ধ্যর্থমুপদেশঃ
পদার্থঃ [হে পরমেশ্বর !] তুমি (শুক্রঃ) শুদ্ধ [স্বচ্ছ নির্মল] (অসি) হও, তুমি (ভ্রাজঃ) প্রকাশমান (অসি) হও। (সঃত্বম্) সেই তুমি (যথা) যেমন (ভ্রাজতা) প্রকাশমান স্বরূপের সাথে (ভ্রাজঃ) প্রকাশমান (অসি) হও, (এব) তেমনই (অহম্) আমি (ভ্রাজতা) প্রকাশমান স্বরূপের সাথে (ভ্রাজ্যাসম্) প্রকাশমান থাকি ॥২০॥

ভাবার্থঃ জগদীশ্বরের প্রকাশস্বরূপের ধ্যান করে মনুষ্য বিদ্যা আদি উত্তম গুণ দ্বারা সংসারে তেজস্বী হোক॥২০॥

টিপ্পণীঃ 
[সূর্য পবিত্র তথা ভূমণ্ডলকে পবিত্র করছে। সূর্য, পরমেশ্বরের প্রকাশ দ্বারা, প্রকাশিত হচ্ছে, "তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি" (মুণ্ডক ২।১০)। উপাসক ইচ্ছা প্রকট করে, আমিও পরমেশ্বরের প্রকাশ প্রাপ্ত করে প্রকাশিত হবো। এইভাবে মন্ত্রে মুখ্য রূপে সূর্যের বর্ণনা হয়েছে, এবং সাথে, সূর্যকে প্রদীপ্তকারী পরমেশ্বরেরও বর্ণনা হয়েছে। ভ্রাজতা=ভাজৃ দীপ্তৌ+শতৃ (কর্তরি)। "যোঽসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোঽসাবহম্। ওঽম্ খং ব্রহ্ম" (যজু০ ৪০।১৭)]
Read More

অথর্ববেদ ১৭/১/১৯

27 October 0

অথর্ববেদ ১৭/১/১৯

অসতিসত্প্রতিষ্ঠিতং সতি ভূতং প্ৰতিষ্ঠিতম্। 
ভূতং হ ভব্য আহিতং ভব্যং ভূতে প্ৰতিষ্ঠিতং তবেদ্বিষ্ণো বহুধা বির্যাণি। 

ত্বং নঃ পৃণীহিপশুভির্বিশ্বরূপৈঃ সুধায়াং মা ধেহি পরমে ব্যোমন্॥

আয়ুর্বৃদ্ধ্যর্থমুপদেশঃ--

পদার্থঃ (অসতি) অনিত্য [কার্যে] (সৎ) নিত্য বর্ত্তমান [আদিকারণ ব্রহ্ম] (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত, এবং (সতি) নিত্য [ব্রহ্মের] মধ্যে (ভূতম্) সত্তাবান জগৎ [অথবা পৃথিবী আদি ভূতপঞ্চক] (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত। (ভূতম্) ভূত/অতীত (ভব্যে) ভবিতব্যের মধ্যে (হ) নিশ্চিতরূপে (আহিতম্) স্থাপিত, এবং (ভব্যম্) ভবিতব্য (ভূতে) অতীতের মধ্যে (প্রতিষ্ঠিতম্) প্রতিষ্ঠিত/স্থিত, (বিষ্ণো) হে বিষ্ণু ! [সর্বব্যাপক পরমেশ্বর] (তবইৎ) তোমারই (বীর্যাণি) বীরকর্ম [পরাক্রম] (বহুধা) অনেক প্রকার। (ত্বম্) তুমি (নঃ) আমাদের (বিশ্বরূপৈঃ) সব রূপবিশিষ্ট (পশুভিঃ) প্রাণীদের দ্বারা (পৃণীহি) ভরপূর করো, (মা) আমাকে (পরমে) সর্বোচ্চ/পরম (ব্যোমন্) বিশেষ রক্ষাপদে (সুধায়াম্) পূর্ণ পোষণশক্তির মাঝে (ধেহি) রাখো/ধারণ করো ॥১৯॥

ভবার্থঃ যে ওম্ তৎসৎ পরমাত্মা নিজের মহিমা দ্বারা সকলের আদি কারণ হয়ে সকলের ভেতরে/অভ্যন্তরে এবং বাহিরে এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানে একরস/সমানভাবে ব্যাপক হয়ে সব ব্রহ্মাণ্ডকে ধরে রেখেছেন, আমরা সবাই উনার উপাসনা করে সুখী হই ॥১৯॥

টিপ্পণীঃ
[অসতি সৎপ্রতিষ্ঠিতম্ =অসৎ অর্থাৎ সদ্রূপে অপ্রতীত প্রকৃতি হল কারণ, উপাদান-কারণ, এবং সৎ অর্থাৎ বিদ্যমান জগৎ হল কার্য। কার্যের স্থিতি উপাদান-কারণের মধ্যে দর্শানো হয়েছে। ইহার দ্বারা সৎকার্যবাদের সিদ্ধান্তের পরিপুষ্টি হয়। সৎকার্য নিজ উপাদান-কারণের মধ্যে শক্তি রূপে থাকে; উপাদান-কারণ থেকে-উৎপন্ন হওয়ার-যোগ্যতা রূপে থাকে, যেমন অঙ্কুর, নিজের কারণ বীজের মধ্যে উৎপন্ন হওয়ার যোগ্যতা-রূপে থাকে। "সতি ভূতম্” “ভব্যে ভূতম্” “ভূতে ভব্যম্" = এগুলোর অভিপ্রায় এটাও হয়, "সত অর্থাৎ বিদ্যমান পদার্থে উহার ভূতরূপ অর্থাৎ অতীতরূপও থাকে," এবং "ভব্য অর্থাৎ যে পদার্থ উৎপন্ন হবে উহার মধ্যেও উহার ভূতরূপ অর্থাৎ অতীত-রূপ নিহিত থাকে, “তথা ভূত পদার্থের মধ্যে উহার ভব্য/ভবিষ্যত/ভবিতব্যরূপও স্থিত থাকে"। তবেই মহাযোগী ত্রিকাল-দর্শী হতে পারে। এইজন্য যোগ-এ বলা হয়েছে “পরিণামত্রয়সংয়মাদতীতানাগতজ্ঞানম্" (যোগ০ ৩।১৬) অর্থাৎ তিনটি পরিণামে সংযম করলে ভূত এবং ভবিষ্যতের জ্ঞান হয়, ইহার কারণ যোগ-এ ইহা দর্শানো হয়েছে “ক্রমান্যত্বং পরিণামান্যত্বে হেতুঃ" (যোগ০ ৩।১৫), অর্থাৎ যে যে পদার্থের মধ্যে উহার যে যে রূপ প্রথম উৎপন্ন হয়ে যায়/হয়, এবং যা যা ভবিষ্যতে হবে, এই সবকিছুর মধ্যে ক্রম নিয়ত রয়েছে। ক্রম-এর ভেদ/পার্থক্যই পরিণামের ভেদ/পার্থক্যের কারণ, নিয়ামক, অতঃ যে যোগী বস্তুর উৎপত্তির এই নিয়ত ক্রমকে জেনে নেয় সে সেই বস্তুর ভূতরূপ এবং ভাবী/ভবিতব্য রূপেরও দ্রষ্টা হয়ে যায়। যোগ-এ অন্য সূত্রগুলোতে ত্রিকাল দ্রষ্টৃত্ব-এর পর্যাপ্ত বর্ণনা হয়েছে২] [১. মন্ত্রোক্ত সিদ্ধান্তকে নিম্নলিখিত দৃষ্টান্ত দ্বারা সুগমতাপূর্বক বোঝা যেতে পারে। যথাঃ - মাটি থেকে/দ্বারা ঘড়া/কলস তৈরি হয়েছে। সৎ-ঘড়া মাটি রূপ কারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, নিজের স্থিতি রাখে। ইহাই । "অসতি সৎ প্রতিষ্ঠিতম্" অর্থাৎ প্রকৃতিতে সৎ জগতের স্থিতি। যেমন মাটি থেকে/দ্বারা নির্মিত ঘড়া-এর মধ্যে, ঘড়া/কলসের পূর্বরূপ যে মাটি তা স্থিত থাকে, এইভাবে "সতি ভূতং প্রতিষ্ঠিতম্” অর্থাৎ সৎ-জগতে, জগতের ভূতরূপ অর্থাৎ পূর্বরূপ প্রকৃতিও স্থিত থাকে। যেমন কলসের ভবিতব্যরূপ ঠিকরা-এর মধ্যে ঘড়ার ভূতপূর্ব মাটি স্থিত থাকে, এইভাবে "ভব্যে ভূতম্ আহিতম্" অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কালে সম্ভাব্য জগতের স্বরূপের মধ্যেও প্রকৃতি স্থিত থাকে। তথা যেভাবে ঘড়ার ভব্য অর্থাৎ ভবিষ্যৎ-কালে সম্ভাব্য ঠিকরা-এর--স্বরূপ ভূতস্বরূপ মাটি তথা ঘটে স্থিত হয়/থাকে, এইভাবে "ভব্যং ভূতে প্রতিষ্ঠিতম্" অর্থাৎ জগতের ভব্য অর্থাৎ ভবিষ্যৎ-কালে পরিবর্তিত স্বরূপও, ভূতরূপ প্রকৃতির মধ্যে তথা উহার পূর্ব পরিণামেও স্থিত থাকে। এইভাবে এক উপাদান-প্রকৃতিকে বিবিধ নামরূপে পরিণত করা, -সর্বব্যাপক পরমেশ্বরের নানাবিধ বীর্য অর্থাৎ সামর্থ্যের কাজ, "তবেদ্ বহুধা বীর্যাণি। মন্ত্রে এই নানাবিধ নামরূপকে পরমেশ্বরের সামর্থ্যরূপ বলা হয়েছে। এই ভাবনাকে "নামরূপে ব্যাকরবাণি" (ছান্দো০ উপ০ অধ্যায় ৬, খং০ ৩) এ বলা হয়েছে। মন্ত্রে ইহা দর্শানো হয়েছে, বস্তুর বর্তমান স্বরূপে উহার পূর্ববর্তী পরিণাম-সমূহ তথা ভবিষ্যম্ভাবী পরিণাম-সমূহের স্থিতিও অনভিব্যক্তাবস্থায় থাকে, যার জ্ঞান যোগীর সূক্ষ্মপ্রবেশী চিত্ত দ্বারা যোগীর হয়ে যায়। বাচ্চা যখন জন্ম হয় তখন তাঁর বর্তমান চিত্তেও পূর্বজন্মের ভূতকালের পরিণাম সংস্কার রূপে থাকে, তথা ভবিষ্যৎ কালে উদ্ভূত পরিণাম-সমূহের অর্থাৎ ভাবীপরিণামের সংস্কারও অনুদ্ভূতাবস্থায় থাকে। এইভাবে অন্য বস্তুরও স্থিতি। এই সিদ্ধান্তকে "সনং সর্বরূপ"---এই মহাব্যাপী নিয়ম দ্বারাও প্রকট করা হয় ॥ ২. মন্ত্রোক্ত ভাবনার পরিপুষ্টিতে নিম্নলিখিত, যোগদর্শনের সূত্রগুলো দেখা উচিৎ। যথাং "অতীতানাগতং স্বরূপতোঽস্ত্যধ্বভেদাদ্ধর্মাণাম্ ॥ তে ব্যক্তসূক্ষ্মাঃ গুণাত্মানঃ ॥ পরিণামৈকত্বাদ্বস্তুতত্ত্বম্ ॥ তদা সর্বাবরণমলাপেতস্য জ্ঞানস্যানন্ত্যাজ্জ্ঞেয়মল্পম্" ॥ (যোগ ৪।১২, ১৩, ১৪, ৩১)। তথা “সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিমাত্রস্য সর্বভাবাধিষ্ঠাতৃত্বং সর্বজ্ঞাতৃত্বং চ ॥ তারকং সর্ববিষয়ং সর্বথাবিষয়ম্ অক্রমং চেতি বিবেকজং জ্ঞানম্" (যোগ ৩।৪৬, ৫৪) ॥]
Read More

21 October, 2025

ঋগ্বেদ ১০/১৯১/১

21 October 0

সংসমিদ্যুভসে বৃষন্নগ্নে বিশ্বান্যর্য আ। 

ইळস্পদে সমিধ্যসে স নো বসূন্যা ভর॥ ঋগ্বেদ ১০।১৯১।১

স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজকৃত পদার্থ ভাষ্যঃ (বৃষণ্–অগ্নে) হে সুখের বর্ষা-স্বরূপ, দুঃখ-নাশক পরমাত্মা! (অর্যঃ–বিশ্বানি–ইৎ সন্সম্–আ যুবসে) তুমি, হে স্বামী! সমস্ত ভূতগণ—জড় ও চেতন প্রাণীদের মধ্যে যথাযথভাবে সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান আছো; বিশেষত আমরা মানুষ, যারা তোমার উপাসক—তাদের মধ্যে তুমি যথা-ভাবে প্রতিষ্ঠিত। "সমো দ্বিরুক্তিঃ—‘সমুপোদঃ পাদপূর্ণে’" [অষ্টা ৮।২৬] এই নিয়ম অনুযায়ী, (ইডঃ–পদে সমিধ্য সে) পৃথিবী—অর্থাৎ পার্থিব দেহের পদ, অর্থাৎ হৃদয় বা স্তুতির পদস্থান—অধ্যাত্ম-যজ্ঞে যথাযথভাবে জ্বলমান হয়, প্রজ্বলিত হয়। (সঃ–নঃ–বসুনি–আভর) সেই তুমি আমাদের জন্য শান্তি ও সুখে বাসযোগ্য ঐশ্বর্যময় ধন সম্পদ প্রদান করো॥১॥

পদার্থ (হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কার)

[১] হে (বৃষণ্) = আমাদের সকলের উপর সুখের বর্ষণকারী, (অগ্নে) = হে অগ্রগণ্য প্রভু! আপনি (ইৎ) = নিশ্চয়ই (বিশ্বানি সংস্কং যুবসে) = সমস্ত প্রাণীদের সাথে সম্যকভাবে মিলিত হন। আপনি সকলেরই পিতা। এই পিতৃত্বই সকলকে পরস্পরের নিকটে আনয়ন করে। আপনাকে পিতার রূপে স্মরণ করলে সকলে পরস্পর ভ্রাতৃত্বের স্মরণ করে।

[২] (অর্যঃ) = আপনিই সকলের স্বামী। (ইডঃ পদে) = [ইডা = বাণী, বেদবাণী] বেদবাণীর শব্দসমূহে আপনি (আ সমিধ্যসে) = সর্বতোভাবে দীপ্ত হন — “সর্বে বেদাঃ যৎ পদমামনন্তি”, “ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্” ইত্যাদি এরই প্রমাণ।

[৩] (সঃ) = সেই আপনি (নঃ) = আমাদের জন্যে (বসুনি) = বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদার্থ (আ ভর) = প্রাপ্ত করান। আপনিই সকলের প্রভু, আপনিই সকলকে ঐশ্বর্য ও সম্পদ প্রাপ্ত করান। ॥

ভাবার্থ — পরমাত্মা সুখের বর্ষা ঘটান এমন স্বামী; তিনি সমস্ত জড় ও সচেতন সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। তিনি দেহের বিশেষ স্থান অর্থাৎ হৃদয়ে, অথবা স্তুতির স্থান — আধ্যাত্মিক যজ্ঞে — প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হন। তখন তিনি মানুষকে শান্তি ও সুখে স্থিত রাখার জন্য সকল ঐশ্বর্য ও ধন প্রদান করেন ॥১॥ ব্রহ্মমুনি

Read More

10 October, 2025

শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম

10 October 0

 

শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম

🍁 সম্পাদকীয় 🍁
আজ ভারতে যে মহাপুরুষের সর্বাধিক পূজা করা হয়, তিনি হলেন - ভগবান্ মহাদেব শিব। একদিকে যেমন পৌরাণিক বিদ্বানরা মহাদেব শিবের চরিত্রকে অত্যন্ত অশ্লীল, চমৎকারী আর কাল্পনিক রূপে প্রস্তুত করেছে, তেমনই অন্যদিকে আর্যসমাজিরা তাঁর চরিত্রকে নিকৃষ্ট বলে মনে করে অবহেলা করে দিয়েছে। বস্তুতঃ দুটোই তাঁর যথার্থ স্বরূপকে সমাজের সম্মুখে প্রস্তুত করতে পারেনি। সম্ভবতঃ তারা তাঁকে, তাঁর চরিত্রকে, তাঁর আদর্শ এবং সিদ্ধান্তকে জানেই না। এমন পরিস্থিতিতে পূজ্য আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক ভগবান্ মহাদেবের বাস্তবিক স্বরূপের বোধ করার জন্য মহাভারত গ্রন্থের আধারে তাঁর ধর্মবিষয়ক উপদেশকে সংসারের সামনে প্রস্তুত করেছেন। এই বিষয়ে আচার্যশ্রীর প্রবচনের প্রসারণ আমাদের "বৈদিক ফিনিক্স" ইউটিউব চ্যানেলের মধ্যে ষোলোটা ভিডিওর মাধ্যমে করা হয়েছে। এই প্রবচন মহাভারতের অনুশাসন পর্বের অন্তর্গত দানধর্ম পর্বের একটা শ্লোকের উপর আধারিত। এরমধ্যে অহিংসা, সত্য, দয়া, শম আর দানের প্রমাণপূর্বক ও দৃষ্টান্তসহিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
.
প্রবচন প্রত্যেক মানুষকে শোনা ও গ্রহণ করা উচিত আর শুনে নিজ ব্যবহারে সেটা ধারণ করা উচিত, বিশেষ করে গৃহস্থিদের। মহাভারতে লেখা আছে -
.
"শ্রূয়তাম্ ধর্মসর্বস্বম্ শ্রুত্বা চৈবাবধার্য়তাম্।"
.
অর্থাৎ ধর্মের স্বরূপ কি? শুনুন আর শুনে তদনুসারে চলুন।
.
ধর্মের অনিবার্যতা নিয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে বলেছেন -
ঊর্ধ্ববাহুর্বিরৌম্যেষ ন চ কশ্চিচ্ছৃণোতি মে।
ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ সঃ কিমর্থম্ ন সেব্যতে।।
.
অর্থাৎ আমি আমার দুই বাহু উপর তুলে, চিৎকার করে বলছি, কিন্তু আমার কথা কেউই শুনছে না। ধর্মের দ্বারা মোক্ষ তো প্রাপ্ত হয়, অর্থ আর কামও ধর্মের দ্বারাই সিদ্ধ হয়, তা সত্ত্বেও মানুষ তার সেবন কেন করে না? আচার্য চাণক্য ধর্মকে সুখের মূল বলেছেন - "সুখস্য মূলম্ ধর্মঃ"। এইজন্য প্রত্যেক সুখাভিলাষী ব্যক্তিকে ধর্মের আচরণ অবশ্যই করা উচিত।
.
এই পুস্তকের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মের প্রথম লক্ষণ "অহিংসা"র উপর বিচার করে হয়েছে। হিংসা, কাম, ক্রোধ, লোভ আদির তরঙ্গগুলো সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে কিভাবে প্রভাবিত করে? এই বিজ্ঞান পাঠকদের জন্য নবীন হবে। এর পশ্চাৎ "সত্য" নিয়ে চর্চা করা হয়েছে, যার উপর সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড টিকে আছে। দয়ার দ্বারা কিভাবে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে? পরে এই বিষয়ে সবিস্তারে বলা হয়েছে। পরবর্তী কিছু অধ্যায়ের মধ্যে মানুষের মন ও ইন্দ্রিয় কিভাবে প্রদূষিত হচ্ছে আর এগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে কিভাবে ব্রহ্মচর্যের পালন করা সম্ভব, তা নিয়ে বলা হয়েছে। অন্তিমে দুটো অধ্যায়ের মধ্যে দান কেন করবেন? আর সর্বশ্রেষ্ঠ দান কি? এইরূপ প্রশ্নের উত্তর পাঠকগণ পড়তে পারবেন। পুস্তকের অন্তিমে পরিশিষ্টের রূপে ভগবান্ শিবের অনুসারে চার বর্ণের ধর্ম, বর্ণ পরিবর্তন আর স্বর্গের অধিকারী কে? এইসব বিষয় বর্ণিত আছে।
.
পাঠকদের সুবিধা আর কিছু সজ্জনদের আগ্রহে আমি এই প্রবচনকে লিপিবদ্ধ করার নির্ণয় লিয়েছি। আচার্যশ্রীর উপদেশকে লিখিত রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব প্রিয় য়শপাল আর্যের। মৌখিক আর লিখিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য হওয়ার কারণে ভাষাকে পরিষ্কৃত করা অত্যাবশ্যক ছিল। এই কাজ আমার সহধর্মিণী শ্রীমতি মধুলিকা আর্যা, যিনি শ্রীমদ্ দয়ানন্দ কন্যা গুরুকুল, চোটিপুরার সুযোগ্যা স্নাতিকা হন তথা সম্প্রতি পি.এইচ.ডি. পূর্ণ করতে চলেছেন, তিনি দক্ষতার সাথে সম্পাদিত করেছেন, এরজন্য তাকে সহৃদয়ে ধন্যবাদ জানাই।
.
পাঠকদের কাছে বিনম্র নিবেদন যে তারা পুস্তকটা আদ্যোপান্ত পড়বেন, তার পাশাপাশি তারা এই বিষয়গুলোর উপর গম্ভীরতাপূর্বক চিন্তন করবেন আর এই উপদেশগুলোকে নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করবেন, যাতে তাদের জীবন সুখময় আর আদর্শ হয়ে ওঠে।
- বিশাল আর্য
🍁 ভূমিকা 🍁
ভগবান্ মহাদেব শিব একজন ঐতিহাসিক মহাপুরুষ ছিলেন, যিনি দেব বর্গে উৎপন্ন হয়েছিলেন। কৈলাশ ক্ষেত্র তাঁর রাজধানী ছিল। আজ শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই দেশ ও বিদেশের শিবালয়গুলোতে পূজা, কীর্তন, কথাবাচন, শিবলিঙ্গের অশ্লীল পূজা, যেটা শিবপুরাণের মধ্যে বর্ণিত দারুবন কথার উপর আধারিত তথা এই কথাকে কোনো সভ্য ও সুসংস্কৃত মহিলা বা পুরুষ শুনতেই পাবে না, শুরু হয়ে যায়। শিবলিঙ্গের উপর দুধ চড়ানো, যেটা বয়ে নর্দমায় গিয়ে পরিবেশকে দূষিত করে, পূজা করার স্বরূপ কি সত্যিই এমন? আশ্চর্যের বিষয় যে ভগবান্ শিবের এই অভাগা রাষ্ট্রের মধ্যে যেখানে কোটি-কোটি বাচ্চা বা বৃদ্ধ পেট ভরে খাওয়ার জন্য ভুগছে, সেই দেশের মধ্যে এইভাবে দুধ ছড়ানো, এটা সেই ক্ষুধার্ত নর-নারীর সাথে-সাথে স্বয়ং ভগবান্ শিবেরও অপমান নয় কি? কত জন শিবভক্ত আছে যারা ভগবান্ শিবের বিমল ও দিব্য চরিত্র, শৌর্য, ঈশ্বরভক্তি, য়োগসাধনা এবং অদ্ভুত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত? এটা আপনারা স্বয়ং আত্মনিরীক্ষণ করুন। ভগবান্ শিব কেমন ছিলেন, তাঁর কি প্রতিভা ছিল, তাঁর কি উপদেশ ছিল, এইসব জানা বা বোঝার না তো কারও কাছে সময় আছে আর না বোধ আছে। এই কারণে আমি একটা শৃঙ্খলা রূপে তাঁর গম্ভীর উপদেশ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মহাভারত গ্রন্থের আধারে প্রস্তুত করা প্রারম্ভ করবো। এই বর্ণনা ভীষ্ম পিতামহের সেই উপদেশগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়, যা তিনি শরশয্যাতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন। আজ এটা ভারী সমস্যা যে পৌরাণিক (তথাকথিত সনাতনী) ভাইরা ভগবত্পাদ মহাদেব শিবকে অত্যন্ত অশ্লীল, চমৎকারী ও কাল্পনিক রূপে চিত্রিত করেছে, অপরদিকে আর্যসামাজী বন্ধুরা যেন তাঁকে জঞ্জালের পাত্রে ফেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁর যথার্থ চিত্রন এই সংসারের সম্মুখে নিতান্ত লুপ্ত হয়েগেছে।
পৌরাণিক বন্ধু ধর্মের নামে প্রচলিত বিভিন্ন মান্যতা ও কথনকে বুদ্ধির চক্ষু বন্ধ করে অক্ষরশঃ সত্য বলে মেনে নেয় আর যদি বা কেউ মিথ্যা কথনের খণ্ডন করে, তাহলে তাকে হিন্দু বিরোধী বলে ঝগড়া করতে উদ্যত হয়। তারা এটাও কিভাবে না যে মিথ্যা কথন আর অন্ধবিশ্বাসের কারণেই এই ভারত আর হিন্দু জাতির এই দুর্গতি হয়েছে, ভারতের ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নষ্ট হয়েছে, ভারত কয়েকশ বছর ধরে বিদেশীদের দাস ছিল। অন্যদিকে আর্যসামাজী বন্ধু বিনা গম্ভীর চিন্তন ও স্বাধ্যায় করে পুরাণের সাথে-সাথে মহাভারত, বাল্মিকী রামায়ণের সব অথবা অধিকাংশ কথাকে কাল্পনিক মনে করে খণ্ডন করার জন্য তৎপর থাকে; মহাদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রের মতো ভগবানদের ভুলে যাওয়ার পাপ করতে হলেও, তারা খণ্ডন করাকেই আর্যবর্ত বলে মনে করে। তারা এটা ভাবে না যে যদি মিথ্যা কথন আর অন্ধবিশ্বাসের খণ্ডন করতে হয়, তাহলে এই দেবতাদের সত্য ইতিহাসও তো জানা ও জানিয়ে দেওয়া অনিবার্য হবে। আপনাদের কাছে আগ্রহ করবো যে আপনারা এই উপদেশগুলোকে গম্ভীর্তাপূর্বক শুনবেন, বিচার করবেন তথা আচরণে নিয়ে এসে আসল শিবভক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন। ঈশ্বর আমাদের সবাইকে এমন সত্য শিবভক্ত হওয়ার বুদ্ধি ও শক্তি প্রদান করুক, এটাই কামনা করি।
.
ভগবান্ শিবের বিষয়ে প্রায়শই শিবপুরাণের কথার বাচন হয়, অথচ মহর্ষি বেদব্যাস কৃত মহাভারতকে পড়ার পাঠক এখন আর নেই বললেই চলে। উল্লেখনীয় হল যে মহর্ষি বেদব্যাস দ্বারা রচিত আঠারো পুরাণের মান্যতা আসলে তাঁর দ্বারা নয় বরং অন্য আচার্যদের দ্বারা রচিত ছিল আর এই গ্রন্থগুলো কোনো প্রামাণিক গ্রন্থের ধাঁচে আসে না। যদিও মহাভারতেও প্রায় ৯৫ শতাংশ এমন আছে, যা মহর্ষি বেদব্যাসের পশ্চাৎ তাঁর শিষ্য এবং কালান্তরে অনেক অপ্রামাণিক বিদ্বানরা লিখে জুড়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও বলবো যে মহাভারত হল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা গ্রন্থ। মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত "সত্যার্থপ্রকাশ" আর "ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা"র গম্ভীর অধ্যায়ণ থেকে প্রাপ্ত ও নীর-ক্ষীর বিবেকী প্রজ্ঞার দ্বারা আমি যেকোনো আর্ষ গ্রন্থকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি। আমার "বেদবিজ্ঞান-আলোক" গ্রন্থও এই ধরণের তদন্তে পরোক্ষ সহযোগিতা করতে পারে।
এখন আমি মহাদেব শিবের চর্চা করবো -
মহর্ষি দয়ানন্দ তাঁর পুনা প্রবচনে মহাদেব শিবকে অগ্নিষ্বাতের পুত্র বলেছেন। অগ্নিষ্বাত কার পুত্র ছিলেন, এটা খুব স্পষ্ট নয় তবে তিনি মহর্ষি ব্রহ্মার বংশজ অবশ্যই ছিলেন। মহাভারতে মহর্ষি বৈশম্পায়ন বলেছেন -
.
উমাপতির্ভূতপতিঃ শ্রীকণ্ঠো ব্রহ্মণঃ সুতঃ।
উক্তবানিদমব্যগ্রো জ্ঞানম্ পাশুপতম্ শিবঃ।।
শান্তিপর্ব । মোক্ষধর্মপর্ব । অধ্যায় ৩৪৯ । শ্লোক ৬৭ (গীতাপ্রেস)
.
এখানে ভগবতী উমার পতি ভূতপতি, যেটা ভগবান্ শিবেরই নাম, তাঁকে মহর্ষি ব্রহ্মার পুত্র বলেছেন। তাঁর পাশুপত অস্ত্র বিশ্বপ্রসিদ্ধ ছিল। এই অস্ত্রকে নষ্ট করতে পারে এমন কোনো অস্ত্র ভূমণ্ডলে ছিল না।
.
মহাভারতের অনুশীলন করে জানা যায় যে, ভগবান্ শিব অত্যন্ত বিরক্ত পুরুষ, সর্বদা য়োগ-সাধনায় লীন, বিবাহিত হয়েও পূর্ণ জিতেন্দ্রিয়, আকাশগমন আদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধি সম্পন্ন, বেদ-বেদাঙ্গের মহান বৈজ্ঞানিক, সুগঠিত, তেজস্বী ও অত্যন্ত বলিষ্ঠ শরীর ও বীরতার অপ্রতিম ধনী দিব্য পুরুষ ছিলেন। তিনি জীবনমুক্ত অবস্থা প্রাপ্ত মহাবিভূতি ছিলেন। তাঁর ইতিহাসের বর্ণনা তো অধিক পাওয়া যায় না কিন্তু তাঁর উপদেশগুলোকে আমরা মহাভারতের মধ্যে পড়তে পারি। এই কারণে আমি এই গ্রন্থের উপরই ধ্যান কেন্দ্রিত করবো।
🌿 ২. ভগবান্ শিবের অনুসারে ধর্মের প্রথম লক্ষণ
ও৩ম্ য়ো ভূতম্ চ ভব্যম্ চ সর্বম্ য়শ্চাধিতিষ্ঠতি।
স্বর্য়স্য চ কেবলম্ তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ ১০.৮.১)
.
এখন আমি মহাভারতের আধারে ভগবান্ শিবের উপদেশের বর্ণনা প্রারম্ভ করবো। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে দানধর্ম পর্বের অন্তর্গত ভগবতী উমা মহাদেব শিবের নিকট প্রশ্ন করেছেন যে -
ধর্মঃ কিম্লক্ষণঃ প্রোক্তঃ কথম্ বা চরিতুম্ নরৈঃ।
শক্যো ধর্মমবিন্দদ্ভির্ধর্মজ্ঞ বদ মে প্রভো।।২৩।।
অর্থাৎ হে প্রভো ধর্মজ্ঞ! ধর্মের লক্ষণ কি? তথা যারা ধর্মকে জানে না, তারা কিভাবে ধর্মের আচরণ করবে?
.
আজ ধর্মের পরিভাষা বাইরের লক্ষণকে দেখে করা হয়। কেউ দাড়ি দেখে, তো কেউ শিখা দেখে, কেউ যজ্ঞোপবীত দেখে, তো কেউ সন্ধ্যা করতে দেখে, কেউ যজ্ঞ করতে, তো কেউ নামাজ পড়তে আর কেউ প্রার্থনা করতে দেখে। এগুলোর মধ্যে একটাও ধর্মের লক্ষণ নয়। সন্ধ্যা করাও ধর্মের লক্ষণ নয়। সন্ধ্যা করলে আমাদের ভিতরে যে গুণগুলো তৈরি হবে, সেগুলো ধর্মের লক্ষণ হবে। সন্ধ্যা করেছি আর আমাদের ভিতরে ধর্মের লক্ষণ আসেনি, তো সন্ধ্যা ধর্ম নয়। সন্ধ্যা হল ধর্ম পথে চলার জন্য একটা সাধন।
এখন মহাদেব শিব ধর্মের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন -
অহিম্সা সত্যবচনম্ সর্বভূতানুকম্পনম্।
শমো দানম্ য়থাশক্তি গার্হস্থ্য়ো ধর্ম উত্তমঃ ।। ২৫।।
(মহাভারত অনুশাসন পর্ব, দানধর্ম পর্ব, অধ্যায় ১৪১)
শ্রীমহেশ্বর বললেন - দেবী ! কোনো জীবের উপর হিংসা না করা, সত্য বলা, সব প্রাণীর উপর দয়া করা, মন আর ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ করা তথা নিজের সামর্থ্যানুসারে দান দেওয়া হল গৃহস্থ আশ্রমের উত্তম ধর্ম ।।২৫।।
.
এখানে অহিংসাকে প্রথম ধর্ম বলা হয়েছে আর যদি পাতঞ্জল য়োগদর্শনকে দেখি, তাহলে অষ্টাঙ্গ য়োগের মধ্যে প্রথম ধর্ম য়ম আছে - অহিংসা। ভগবান্ পতঞ্জলি এটাও লিখেছেন যে অহিংসা হল মূল, অহিংসা হল মহাব্রত, অহিংসার থেকে বড় কোনো ব্রত নেই।
.
এখন অহিংসা কি, এর উপর বিচার করবো -
প্রায়শঃ মানুষ এমন মনে করে যে অহিংসার অর্থ হল কারও সাথে শত্রুতা না করা। আমরা গান্ধীর তিন বাঁদরের কথা শুনেছি - কারও মন্দ দেখো না, কারও মন্দ শোনো না আর কাউকে মন্দ বলো না। মন্দটা কি, সেটাও তো জেনে রাখা দরজার। যদি রাজা কারও মন্দ না শোনে, তাহলে অপরাধীকে কিভাবে দণ্ড দিবে? কোনো ব্যক্তি যদি আবেদনকারী হয়ে ন্যায়ের জন্য আবেদন নিয়ে আসে, আর সেখানে রাজা চোখ, মুখ আর কান বন্ধ করে বসে পড়ে, তাহলে কি হবে? অর্থাৎ অহিংসার অর্থ বোঝাই হয়নি। অহিংসার অর্থ প্রাচীন ঋষিদের কালের পশ্চাৎ যদি সবথেকে বেশি কেউ জেনেছেন তো তিনি হলেন ঋষি দয়ানন্দ। তিনি সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে অহিংসার অর্থ সম্বন্ধে লিখেছেন -
"প্রাণীমাত্রের প্রতি দ্রোহ ত্যাগ অর্থাৎ সবার সঙ্গে প্রীতি করা।"
.
এখানে "অর্থাৎ সবার সঙ্গে প্রীতি করা" যদি না লিখতেন, তাহলে অহিংসা বোঝাই যেতো না। পরমাণু বোম কারও হিংসা করে না, কেউ তাকে চালাবে, তখন সেটা হিংসা করবে। বন্দুকের গুলিও স্বয়ং কারও হিংসা করে না, তাহলে কি এটা অহিংসা হবে? কবুতর কারও হিংসা করে না, কেউ মারতে এলে, তাহলে চোখ বন্ধ করে নেয়, এটা কি অহিংসা হবে? পাথরও হিংসা করে না, যদি কেউ সেটা মাথায় মারে, তাহলে সেটা আঘাতকারীর হিংসা হবে। এর ফলে পাথর কি অহিংসক হবে? এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ জুড়ে দিয়েছেন - "সবার সঙ্গে প্রীতি করা"। অন্যদিকে মহর্ষি ব্যাস য়োগদর্শনের ভাষ্যতে অহিংসার পরিভাষা করে লিখেছেন -
"সর্বথা সর্বদা সর্বভূতানাম্ অনভিদ্রোহঃ সা অহিংসা"
- য়োগদর্শন
.
(সর্বথা) সব রকম ভাবে (সর্বদা) সব কালে (সর্বভূতানাম্) সব জীবের প্রতি (অনভিদ্রোহঃ) দ্রোহ করা উচিত নয়, (সা অহিংসা) সেটা হল অহিংসা।
.
যখন বিচারক কাউকে দণ্ড দেয়, তো তার মনে কোনো দ্রোহের ভাবনা থাকে না, বরং ন্যায়ের ভাবনা থাকে। বিচারকের মনে এই ভাবনা থাকে যে পীড়িত ব্যক্তি ন্যায় পাবে তথা অপরাধীরও উন্নতি হবে। যদি বিচারক অহিংসার অর্থ এটাই গ্রহণ করে যে কারও সাথে দ্রোহ না করা অর্থাৎ অপরাধীকে দণ্ড না দেওয়া, তাহলে অপরাধ বাড়বে। আর এর জন্য উত্তরদায়ী বিচারকই হবে। এইজন্য অহিংসার অর্থ হবে - কারও সাথে দ্রোহ না করা। ন্যায়ার্থ কাউকে মারা হিংসা নয়, বরং অহিংসা হয়। এর দ্বারা অনেকের প্রাণ বাঁচবে, এইজন্য ডাকাতকে দণ্ড দেওয়া অহিংসার অন্তর্গত আসে, হিংসার অন্তর্গত নয়।
.
এখন দ্বিতীয় কথা হল - সবার সাথে প্রীতি করা। দুষ্টকে দণ্ড দেওয়া কঠিন কাজ বটে। দুষ্ট যদি দুর্বল হয় তাহলে যে কেউ তাকে দণ্ড দিয়ে দিবে, কিন্তু যদি বলবান হয় তাহলে দণ্ড দেওয়ার সাহস কে করবে? ঋষি দয়ানন্দ মানুষের পরিভাষা নিয়ে বলেছেন - "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না।" মানুষের লক্ষণ প্রথমে বলে দিয়েছেন - মানুষ অহিংসা থেকে তৈরি হয় আর যে ব্যক্তি মানুষ হয়, সেই ব্যক্তিই য়োগী হয়। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী য়োগী হতে পারে না। এইজন্য মানবতার প্রথম পরিভাষাও অহিংসাই হয়। ধর্মের পরিভাষা হল অহিংসা আর যে ব্যক্তি ধর্মকে ধারণ করে, সেই ব্যক্তিই মানুষ হয়। "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না" এটা কোনো সহজ কাজ নয়। যদি রাজা অন্যায়কারী হয়, তাহলে তাকেও ভয় না পাওয়া। এর বিপরীত ন্যায়কারী, ধর্মাচরণকারী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তি, খুব দুর্বল, যার কাছে কিছুই নেই, তবুও তাকে ভয় করে চলবে। কিন্তু ব্যবহারে এমন হয় না। আজ সত্য কথা বলা ও সত্যের উপর চলা ব্যক্তিদের কেউ কিছু মনেই করে না, যারা ক্ষমতা এবং বলসম্পন্ন আছে, সবাই তাদের তোষামোদ করে, এমন করা হিংসা হয়। যদি দুষ্ট ব্যক্তির তোষামোদ করা হয়, তাহলে সেই দুষ্ট আরও অধিক দুষ্ট কর্ম করবে। এইভাবে তার দোষও আমাদের উপরই আসবে। এইজন্য ঋষি লিখেছেন যে "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না, সর্বদা তার নাশের চেষ্টা করতে থাকবে", তার নাশ করাও অহিংসার কোটিতে আসবে। একজন রাজা যদি দুষ্ট হয়, তাহলে তাকে দণ্ড দিলে সম্পূর্ণ রাজ্য সুখী হয়ে উঠবে, এইজন্য তাকে দণ্ড দেওয়া অহিংসার কোটিতে আসবে। ভগবান্ কৃষ্ণ, ভগবান্ রাম, ভগবান্ মহাদেব আদি এমনই তো করেছেন, সবার হাতে অস্ত্র আছে, এটা হিংসার জন্য নয়, বরং অহিংসার রক্ষার জন্য। তাঁদের অস্ত্রের ব্যবহারও অহিংসার কোটিতে আসে। যেমন - বিচারকের ন্যায়পূর্বক ফাঁসির শাস্তি দেওয়াও অহিংসার কোটিতে আসে। যদি অন্যায়পূর্বক দণ্ড দেয়, তাহলে সেটা হিংসার কোটিতে আসবে।
.
এরপরের কথায় আসবো, "ধর্মাত্মা নির্বল হলেও সর্বদা তাকে ভয় করে চলবে, তার সর্বদা প্রিয়াচরণ করবে" অর্থাৎ তার সঙ্গে প্রীতি রাখবে। মহর্ষি দয়ানন্দ এটাও বলে দিয়েছেন যে কার সাথে প্রীতি আর কার সাথে শত্রুতা করবেন - "অন্যায়কারীর সাথে শত্রুতা আর সজ্জনদের সাথে প্রীতি করবে।" সবার সাথে প্রীতি করে, এটা মুখে বলা অনেক সহজ, কিন্তু এক নিজের ভাই আছে আর এক শত্রুর ভাই আছে। শত্রু যতই দুষ্ট হোক না কেন, কিন্তু তার ভাই যদি সজ্জন হয়, তাহলে কতজন মানুষ আছে যে তার সাথে প্রীতি করবে? নিজের আর অপরের ভেদ মুছে ফেলে ব্যবহার করা, এটাই হল বাস্তবে প্রীতি করা আর এটাই হল অহিংসা। সবার সাথে প্রীতি করা অর্থাৎ সবার সুখ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। মন্দিরে স্লোগান দেওয়া হয় - ধর্মের জয় হোক, অধর্মের নাশ হোক, সবাই সুখী হোক, সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা হোক, সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। এইসব এমন ভাবে বলা হয়, যেভাবে টেপ রেকর্ডার বলে। টেপ রেকর্ডের মধ্যে কোনো ভাবনা থাকে না, কেবল শব্দ থাকে আর যখন আমরা কথাবলি, তখন ভাবও থাকে। এইভাবে যেসব স্লোগান দেওয়া হয়, সেগুলোতেও কোনো ভাব থাকে না। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় যে সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা এবং তাদের কল্যাণের জন্য আপনি কি করছেন? যেমন কোনো ডাক্তার স্লোগান দেয় যে সব রোগী ঠিক হোক, সব রোগী নিরোগ হোক, সব রোগী সুস্থ্য হোক আর ওষুধ কাউকে না দেয়, তাহলে কি তার স্লোগানে সব রোগী ঠিক হয়ে যাবে? কখনও না। ঠিক সেইরকম ভাবে আমরা স্লোগান দিচ্ছি - ধর্মের জয় হোক, অধর্মের নাশ হোক, সবাই সুখী হোক, সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অহিংসক হয়ে উঠবো না আর আমাদের মনের মধ্যে সবার প্রতি প্রীতির ভাবনা উৎপন্ন হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এইসব স্লোগান দিয়েও কোনো লাভ হবে না।
.
দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে এমন কি কোনো সময় আছে যখন আমরা সবার ভালোর জন্য চিন্তা ভাবনা করি? সব সময় আমার দোকান, আমার বাড়ি, আমার ব্যবসা, আমার চাকরি, আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, আমার মা-বাবা, এমন বলতে থাকি। কেবল মাত্র নিজের বিষয়েই ভাবি, নিজের বিষয়ে ভাবা মোটেও মন্দ নয়, অবশ্যই ভাবা উচিৎ, এটা ভালো কথা। নিজের সম্বন্ধে যদি না ভাবেন তাহলে অন্যের ভালো কিভাবে করবেন? কিন্তু এইসব করার পরেও কি এমন কোনো সময় আসে যে আমরা দেশের সম্বন্ধে ভাবি, মানবতার সম্বন্ধে ভাবি, ধর্মের সম্বন্ধে ভাবি? মন্দিরে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দিবো আর তিন-চারটা স্লোগান দিয়ে ফিরে চলে আসবো। যখন আমার স্লোগান দিবো আর সেই সময় কোনো দুঃখী ব্যক্তি এসে পরে, তাহলে কি আমরা তার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হবো? আমরা তাকে বলবো যে আমাদের পূজা করতে দাও। যদি আমরা ধ্যানে বসি আর কোনো দুঃখীর আওয়াজ আসে, তাহলে আমাদের কি কর্তব্য করা উচিত? আমরা কি ধ্যানে বসে থাকবো নাকি সেখানে গিয়ে তার সহায়তা করবো? উত্তর হল সেখানে গিয়ে তার সহায়তা করা। পরমাত্মাকে ধ্যানের কোনো আবশ্যকতা নেই। আমি চার ঘন্টা ধ্যান করি, তো এর থেকে সে কি পাবে? আমরা ধ্যান নিজের স্বার্থের জন্য করি, যাতে আমাদের আত্মা এবং বুদ্ধি পবিত্র হয়, যার দ্বারা আমরা ভালো কাজ করবো আর ভালো ফল পাবো। এইজন্য অবশ্যই ধ্যান করা উচিত, কারণ যদি এগুলো পবিত্র না হয় তাহলে সারা জীবন অব্যবস্থিত হয়ে যাবে। এইভাবে অহিংসা অর্থ হল - কারও সাথে দ্রোহ না করা, কাউকে অন্যায় ও দ্বেষ দৃষ্টিতে না দেখা, বরং প্রেম আর স্নেহের দৃষ্টিতে দেখা। এইজন্য য়জুর্বেদের মধ্যে বলা হয়েছে -
"মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।" (য়জুর্বেদ ৩৬.১৮)
অর্থাৎ আমরা সব প্রাণীকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখবো।
.
এই সংসারের মধ্যে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি প্রকারের প্রাণ আছে। সেগুলোর মধ্যে আমরাও হলাম একটা প্রজাতি। অহিংসা বলে - সব প্রাণীর প্রতি প্রীতিভাব। আমরা তো মানবের সাথেও প্রীতি করতে পারিনি, তো অন্য প্রাণীদের সাথে কিবা করতে পারি। স্বয়ংকে ছেড়ে দিয়ে বাকি সবাইকে তো আমরা নিজের ভোজন বানিয়ে ফেলেছি। যাকেই খাওয়া যেতে পারে, মানুষ তাকেই খাওয়ার চেষ্টা করছে। যেখানে অহিংসা বলছে যে সবার সাথে প্রীতি করো, সেখানে আমরা সব প্রাণীকে খাওয়াই নিজের ধর্ম বানিয়েছি। আমরা এমন বলি যে - আমরা কি খাবো কি খাবো না এটা আমরা নির্ণয় করবো, অন্যরা কেন তার নির্ণয় নিবে? এটাই তো আমাদের স্বতন্ত্রতা। এর জন্য অধিকারের আওয়াজ ওঠে যে আমাদের খাওয়ার অধিকার আছে। আমি গরু খাবো নাকি কি খাবো, এটা আমার অধিকার, গোহত্যা বন্ধ করলে কি হবে? এই কারণেই গোহত্যা আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। এখন বাকি রইলো মানুষ, তাদের মধ্যেও একে-অপরকে খাওয়ার কথা করছে। সারা বিশ্বের মধ্যে ৭-৮ আরব মানুষ আছে, সেগুলোর মধ্যে আমরা কতজনের ভালো চাই? মহাদেব শিবের পরিভাষা তো এটাও ছিল যে কেউই আমাদের কারণে যেন দুঃখী না হয়, কিন্তু দুষ্টকে দণ্ড দেওয়ার ও আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। হিংসা জেআরএম অনেক প্রকারের হয়, তেমনই অহিংসাও অনেক প্রকারের হয়। এরপর আমরা এই বিষয়ে চর্চা করবো।

৩. মহাদেব শিবের উপদেশের জন্য আপনি কি করছেন? পূর্বে আমরা ভগবান্ শিব দ্বারা উপদিষ্ট ধর্মের প্রথম লক্ষণ অহিংসার উপর বিচার করছিলাম। দ্বিতীয় হল - সত্য বচন, তৃতীয় হল - সব প্রাণীর উপর দয়া, চতুর্থ হল - মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা আর পঞ্চম হল - দান। . এখন আমরা অহিংসার চর্চাকে আগে বাড়িয়ে হিংসাকেও জানার চেষ্টা করবো। ভগবান্ পতঞ্জলি য়োগদর্শনে আর মহর্ষি ব্যাসকৃত ভাষ্যে তিন প্রকারের হিংসার কথা বলা হয়েছে - কৃতা, কারিতা আর অনুমোদিতা। . কৃতা অর্থাৎ যেটা নিজের দ্বারা করা হয়। যেমন - মাংসাহারী ব্যক্তি, যারা স্বয়ং মেরে খায়। কারিতা অর্থাৎ যেটা অন্য কাউকে দিয়ে করানো হয়। অনুমোদিতা অর্থাৎ না নিজে করেছে আর না কাউকে দিয়ে করিয়েছে, কিন্তু অনুমোদন করেছে অর্থাৎ কারও দ্বারা হিংসা করা হলে এমন কথা বলা যে ঠিক করেছে, ভালো করেছে, এমনই হওয়া উচিত। এই তিনজনই পাপী হয় - যে করে, যে করায় আর যে হিংসার অনুমোদন করে। . এইভাবে অহিংসাও তিন প্রকারের হয়ে যাবে - একটা হল যেটা আমরা স্বয়ং আচরণে নিয়ে আসছি, দ্বিতীয় হল কাউকে শেখাচ্ছি আর তৃতীয় হল যদি কোনো ধার্মিক ব্যক্তি বা মহাত্মা আছে, তাহলে তার অনুমোদন করছি। . অন্য তিন প্রকারের হিংসা হল - মনসা, বাচা আর কর্মণা। . মনসা হিংসা - অনেক ভুল বিষয় আমাদের মনের মধ্যে থাকে, কিন্তু সমাজ ও শাসনের ভয়ের কারণে করতে পারি না। যেমন - একে মেরে ফেলবো, তাকে মেরে ফেলবো, ওর ধন সম্পদ নিয়ে নিবো, তবে করতে পারি না। কিন্তু মন দিয়ে করা হিংসাও পাপ হয়। বাচা হিংসা - বাণী দ্বারা কাউকে দুঃখ দেওয়া। অনেক ব্যক্তি আছে যারা কিছু করতে পারে না কিন্তু কঠোরভাবে কথা বলে। এই রকম হিংসাকে বাণী দ্বারা করা হিংসা বলে। কর্মণা হিংসা - নিজের কর্মের দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া। এইভাবে কৃতা, কারিতা এবং অনুমোদিতা হিংসার পরে আরও তিন-তিনটা ভেদ হওয়াতে সর্বমোট নয় প্রকারের হিংসা আছে। . মহর্ষি ব্যাস এরমধ্যেও হিংসার আরও তিনটা ভেদ বলেছেন - মৃদু, মধ্যম আর তীব্র। . যেমন কাউকে গালি দেওয়া হিংসা হবে, তাকে আঘাত করলে, তার থেকেও বড় হিংসা হবে, কিন্তু তাকে হত্যা করা, তার থেকেও বড় হিংসা হবে। আজ আমাদের দেশে সবথেকে বেশি মন্দির মহাদেব শিবের পাওয়া যায় আর শ্রাবণমাসকে মহাদেব শিবের মাস বলে ধরা হয়। অনেক মাংসাহারী শ্রাবণমাসে মাংস খাবে না, চুল কাটবে না, প্রতিদিন মন্দিরে গিয়ে দুধ ও জল চরাবে। কিন্তু মহর্ষি ব্যাস বলেছেন যে অহিংসা কোনো দেশ বা কালের অনুসারে হয় না যে মন্দিরে হিংসা করবো না, ঘরে গিয়ে করবো। ধর্ম সব স্থানে হবে আর অধর্ম সব স্থানে মানা হবে। এইরকমই শ্রাবণমাসে হিংসা করবো না, পরে অন্য কোনো মাসে করবো। যখনই হোক আর যেখানেই হোক, এটা অপরাধই হবে। কোনো একাদশী, পূর্ণিমা বা অমাবশ্যাতে পাপ করবো না, এটাও হল ভারী অজ্ঞান। ধর্ম সার্বভৌম হয়, অহিংসাও সার্বভৌম হয়। সব প্রাণীর প্রতি প্রীতি সদা করা উচিত আর সর্বদা দ্রোহ ত্যাগ করা উচিত। কেউ সোমবারে হিংসা করে না, কারণ মহাদেবের দিন মানে, তো কেউ মঙ্গলবারে করে না কারণ হনুমানের দিন মানে। মহাদেবের তো প্রতিদিন হবে কারণ মহাদেব নামটা হল পরমাত্মার। যদি মহাপুরুষ ওয়ালা মহাদেবকে মানা হয় তাহলে তিনি আজ নেই আর থাকলে মোক্ষের মধ্যে আছেন। যদি তাঁকেও স্মরণ করতে হয় তো প্রতিদিন করুন, কখনও-সখনও কেন? সোমবারেই কেন? যে দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি শিব মন্দির আছে, সেই দেশের মধ্যে ৭০ শতাংশের অধিক মাংসাহারী হয়ে গেছে। এই বিষয়ে সব অহিংসক, ধর্মাচার্য ও শিবভক্ত মৌন আছে। নন্দীর পূজা করবে, কারণ তারা মনে করে যে ভগবান্ শিব নন্দী¹ বৃষের উপর গমন করতেন। নন্দীর মূর্তি প্রত্যেকটা মহাদেব মন্দিরে পাওয়া যায়, মানুষ তার পূজা করে। কিন্তু নিজের আবশ্যকতার পূর্তির জন্য নন্দীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কারও চিন্তা নেই। হিন্দু মাছকেও অবতার মানে, তো অন্যদিকে সরকার মাছ রপ্তানি করে কয়েক আরব টাকা কামাই করছে। মাছ মেরে বিক্রি করাকে যদি নীলী অর্থব্যবস্থা বলা হয়, তাহলে মাংস বিক্রিকে গুলাপী। আজ অর্থব্যবস্থাও রঙ হয়ে গেছে। মাছ মরে যাওয়ার কারণে যে ঘূর্ণিঝড় আসবে, তারমধ্যে একটা ঘূর্ণিঝড়ও যদি ভয়ংকর হয়, তাহলে কয়েক আরব টাকাও সেই ক্ষতির পূর্তি করতে পারবে না। যতটা বিনাশ হয়, সরকার ততটা দেয়ও না আর দিতেও পারবে না। আজকের সেই অর্থশাস্ত্রী, সমাজশাস্ত্রী, বৈজ্ঞানিক সবগুলো মূর্খ আছে, তারা ভাবে যে মানুষকে মদ্যপান করিয়ে ধন কামাবে , তারা এটা ভাবে না যে মদ্যপান করালে যেসব রোগ হবে, অপরাধ হবে আর এক্সিডেন্ট হবে, তাতে কত বিনাশ হবে, তার কোনো গণনা নেই। যেকোনো ভাবে যারা হিংসা করছে, তারা সবাই হল ভগবান্ শিবের দ্রোহী, তা সে তিলক আদি লাগিয়ে বর্ফানী বাবার দর্শনও করুক না কেন, এখন তো দর্শনও অনলাইন হয়ে গেছে। মহাদেব শিব যেটা লিখে গেছেন, তাকে মানে এমন কেউকে আজ দেখা যায় না। এটা ঠিক যে কোনো মহাদেবের মন্দিরে হিংসা হয় না, কিন্তু দেবীর কিছু মন্দিরে তো হয়। . এখন ভোজন ও অর্থব্যবস্থার নামে যে হিংসা হচ্ছে, কেউ এর প্রতিকার করছে না, সবাই ধন চায়। বৈজ্ঞানিক রিসার্চ করেছে যে মাছের বিস্কুট খেলে প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু যজ্ঞ, ব্যায়াম, প্রাণায়ামাদি করলে প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়বে, এটা কেউ বলে না। ফল-শাক, দুধ আদির সেবন করলে প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়বে, এটা কেউ বলে না। এলোপ্যাথির মধ্যে এমন কোনো ওষুধ নেই, যেটা প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, আয়ুর্বেদের মধ্যে অবশ্য আছে। সর্বত্র হিংসার সাম্রাজ্য চলছে। যদি আজ মহাদেব শিব হতেন, তাহলে একটা পাশুপত অস্ত্র চালাতেন আর সবাইকে নষ্ট করে ফেলতেন। কিন্তু আজ না মহাদেব আছেন আর না তাঁর কোনো ভক্ত, যে এই অহিংসার বিরুদ্ধে বলতে পারবে। নেতাদের হাতে ক্ষমতা থাকে আর একটাও নেতা মহাদেব শিবের ভক্ত নয়। সবাই হিংসক হয়ে গেছে, সবার উপর রাক্ষসী প্রবৃত্তি আধিপত্য করছে। রাক্ষসী প্রবৃত্তির কেন আধিপত্য আছে, এর তিনটাই কারণ হতে পারে - সবাই হয় আতঙ্কিত হয়ে আছে নয়তো ভ্রমিত অথবা লোভে পড়ে আছে। যে ভয় দেখাচ্ছে, প্রলোভন দিচ্ছে আর লোভ দিচ্ছে সে দেশের বাইরে বসে আছে। কে কতটা লাভ প্রাপ্ত করলো, এটা তো সে স্বয়ং জানে তথা ঈশ্বর জানে। যাকে আজ আমরা বিজ্ঞান বলি, সেটা সারা বিশ্বের অনেক প্রজাতিকে নষ্ট করে দিয়েছে আর আমাদের এখানে স্লোগান হয় "অহিম্সা পরমো ধর্মঃ"। . অহিংসা অর্থাৎ প্রাণীমাত্রের দ্রোহ ত্যাগ তখনই মানা হবে, যখন এই দেশ থেকে মাংসাহার সমাপ্ত হয়ে যাবে আর তখনই এই দেশ মহাদেব শিবের দেশ মানা হবে। যখন ওষুধের নামে হিংসা সমাপ্ত হয়ে যাবে আর যেসব টেকনিকের কারণে প্রজাতিগুলো মারা যাচ্ছে, সেইসব টেকনিক যখন সমাপ্ত হয়ে যাবে, তখন এই দেশ হবে - ঋষিদের দেশ, দেবতাদের দেশ, বুদ্ধ-মহাবীরের দেশ, মহর্ষি দয়ানন্দের দেশ। অহিংসা ছাড়া ধর্ম, ধর্ম থাকে না, সম্প্রদায় বা মত-পন্থ হতে পারে, তবে ধর্ম নয়। যেসব ব্যক্তি অহিংসক নয়, যাদের মধ্যে প্রাণীমাত্রের প্রতি সমবেদনা নেই, তারা হল অধর্মী ও পাপী। . কিছু ব্যক্তি বলে যে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে ধর্মের কি যায়-আসে? তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিত যে মানুষের মাংস খাবেন,আর খেলে কিছু যায়-আসবে নাকি যায়-আসবে না? ধর্ম কি কেবল মানুষের জন্যই হয়? ধর্ম সারা ভূমণ্ডলের জন্য হয়, সারা ব্রহ্মাণ্ডের জন্য হয়। ধর্মের অর্থ হল "ধিয়তে লোকোऽনেন" অর্থাৎ যার দ্বারা সৃষ্টিকে ধারণ করা হয়, সেটাই হল ধর্ম। আমরা হিংসা করে ভাবছি যে আমরা সুস্থ্য হবো, ধন আসবে, কিন্তু আমরা এটা ভাবছি না যে এতে সুস্থ্য হবো না, বরং রোগ আরও অধিক বেড়ে যাবে। কাল যদি কোনো ডাক্তার এমন অনুসন্ধান করে যে মানুষের রক্তপান করলে যৌবন ফিরে আসবে, তাহলে কি মানুষের রক্তও পান করবেন? শুনেছি কিছু ক্রূর ব্যক্তি এমনও করছে। গরীবের বাচ্চাকে অপহরণ করে, তাদের যন্ত্রণা দিয়ে, সেই দিশাতে তাদের রক্ত বের করে পান করে এমন ব্যক্তিও এই ভূমিতে আছে। একথা কতটা প্রমাণিত আমি তা জানি না, কিন্তু যদি এমন নরভক্ষী মানুষও এই ভূমিতে থাকে তাহলে এ হল সেই রাক্ষস, যাদের বধ করার জন্য ভগবান্ শ্রীরাম বনে গিয়েছিলেন। আমরা রাম মন্দিরের জন্য গ্রাম-গ্রাম থেকে ধন একত্রিত করছি, কিন্তু এই নরভক্ষীদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে প্রস্তুত নয়। . মহর্ষি দয়ানন্দ গো-করুণানিধির মধ্যে লিখেছেন - হে মাংসাহারীগণ! যখন এই ভূমিতে প্রাণী সমাপ্ত হয়ে যাবে, তখন কি মানুষকেও ছেড়ে দিবে নাকি তাদেরও খেয়ে ফেলবে? যারা ধনবান আছে, সত্তাবান আছে, ঐশ্বর্য-সম্পন্ন আছে, তারা গরীবদের খেয়ে ফেলবে, তাদের বাধা দেওয়ার কেউ থাকবে না আর আমাদের সবাইকে মনোরঞ্জনের নামে মোবাইলের মধ্যে, ইন্টারনেটের মধ্যে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে, যাতে আমরা সেগুলোতে ব্যস্ত থাকি আর সেই হিংসকরা সারা বিশ্বের মধ্যে রাজত্ব করতে থাকে। এটা হল মহাদেব শিবের দেশ। যে সকল মহাদেব ভক্ত আমার আওয়াজ শুনছেন্, তারা ভেবে দেখুন যে মহাদেব শিবের এই উপদেশগুলোকে আত্মসাৎ করার জন্য আপনি কি করছেন? অন্যদের আপনি কি প্রেরণা দিচ্ছেন? এইসব বিষয়ের উপর ধর্মগুরু মৌন আছে। আসলে ধর্মগুরুরা সমাজকে মূর্খ করে রেখেছে। আমি কেবল মহাদেব শিবের কথা করবো, তাঁর অনুসারে ধর্মের প্রথম লক্ষণ হল - অহিংসা। . আসুন, আমরা আত্মনিরীক্ষণ করি যে আমরা মহাদেব শিবের কত ভক্তি করি, আমরা তাঁর কত অনুগামী? মহাদেব হলেন আমাদের পূর্বজ, আমাদের মহাপুরুষ। পরমেশ্বরেরও আরেকটা মহাদেব, যিনি সৃষ্টির রচনা করেন, সেই মহাদেবের চর্চা এখানে হচ্ছে না, কারণ তিনি তো উপদেশ বেদের মধ্যে আমাদের দিয়েছেন, যাকে আমরা ভুলে গেছি। যে বেদভক্ত মহাদেব শিব মহাপুরুষ ছিলেন, তাঁর বিষয়ে এমন মানা হয় যে তিনি মান কৈলাশে থাকতেন। মানসরোবরও এখন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে, সেখানে অসুরের শাসন হচ্ছে। এইজন্য বিচার করুন যে আমাদের কি করা উচিত? এখন আপনাকে আপনার আত্মার আওয়াজ শুনতে হবে তথা এটা জানতে হবে যে আমাদের কি কি করতে হবে? মহর্ষি দয়ানন্দ লিখেছেন যে "মানুষের আত্মা সত্যাসত্যের জ্ঞানী হয়, তবুও নিজের প্রয়োজনের সিদ্ধি, হঠ, দুরাগ্রহ আর অবিদ্যাদি দোষের কারণে সত্যকে ছেড়ে দিয়ে অসত্য অর্থাৎ অধর্মের দিকে ঝুঁকে যায়। _______________ ¹ সম্ভবতঃ নন্দী নামক কোনো বাহন ছিল।

৪. নাকারাত্মক তরঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডকে কিভাবে প্রভাবিত করে?
মহাভারতে চারটা স্থানে লেখা আছে - "অহিম্সা পরমো ধর্মঃ।"
.
মহর্ষি পতঞ্জলিও অহিংসাকে মূল বলেছেন, বাকি সব হল এর শাখা, এইজন্য এর উপর আরও একটু বিচার করবো। অহিংসার বিপরীত হল - হিংসা। হিংসা কেন ভয়ংকর হয়? কেন অহিংসারূপী ধর্মই সারা সংসারকে শরণ দিতে পারবে? এর উপর বিচার করবো -
.
যদি আমি বৈজ্ঞানিকদের জিজ্ঞেস করি যে এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, তাহলে তারা বলবে যে মোলিকিউলস দিয়ে, তারপর আমি জিজ্ঞেস করবো যে মোলিকিউলস কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, তো তারা বলবে যে এটম দিয়ে। তারপর আমি জিজ্ঞেস করবো যে এটম কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, তো তারা বলবে যে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন তথা অন্য কিছু কণা দিয়ে। তারপর আমি জিজ্ঞেস করবো যে এগুলো কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, তো তারা বলবে যে এগুলো কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি হয়েছে, কিন্তু ইলেকট্রন কি দিয়ে তৈরি? এর কোনো জ্ঞান কারও কাছে নেই। তারপর আমি জিজ্ঞেস করি যে কোয়ার্ক তথা ফোটন কি দিয়ে তৈরি, তো এরও কোনো জ্ঞান কারও কাছে নেই, কিন্তু কিছু স্ট্রিং থিয়োরি ওয়ালা ব্যক্তি বলে দিবে যে এগুলো স্ট্রিং দিয়ে তৈরি, কিন্তু স্ট্রিং কি দিয়ে তৈরি হয়েছে? এর কোনো জ্ঞান তাদের কাছে নেই। আমি বলছি যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড ধ্বনি তরঙ্গের কম্পন দিয়ে তৈরি হয়েছে আর সেই কম্পনই হল বৈদিক ছন্দ (মন্ত্র), সেই কম্পনই হল প্রাণ। এই কম্পন মনস্তত্ত্বের মধ্যে হচ্ছে। এখন তারা জিজ্ঞেস করবে যে মন কি দিয়ে তৈরি, তো এর উত্তর হল - প্রকৃতি দিয়ে।
.
এখন এখানে বিচার করবো যে যখন আমরা কোনো প্রাণীকে পীড়া দেই, তো সেই পীড়া কে অনুভব করে? সবার আগে মনই অনুভব করে কিন্তু এই পীড়া মন পর্যন্ত গিয়েই থেমে যায় না, বরং আত্মা পর্যন্ত যায়, এইজন্য উপনিষদের মধ্যে বলা হয়েছে -
"এষ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা রসয়িতা মন্তা বোদ্ধা কর্তা বিজ্ঞানাত্না পুরুষঃ।" (প্রশ্নোপনিষত্ ৪.৯)
.
এর তাৎপর্য হল এই যে জীবাত্মা আছে, এটাই দেখে, স্পর্শ করে, শোনে, শুঁকে, জানে আর কর্ম করে। আমাদের বাণী এবং মনের বিচারের প্রভাব, আত্মা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। এখন একটু ভাবুন যে আত্মা ধ্বনি তরঙ্গের কোন রূপকে অনুভব করে? উত্তর হল - আত্মা ধ্বনি তরঙ্গকে পরা রূপে গ্রহণ করে আর পরা ধ্বনি তরঙ্গ দিয়েই সব তৈরি হয়েছে, এমনকি মন পর্যন্ত। জীবের উপর হিংসা করার কারণে যে পেইন-ওয়েভ উৎপন্ন হবে, তাকে এক ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রফেসর মদন মোহন বাজাজ তার পুস্তকের মধ্যে "আইনস্টাইন পেইন ওয়েভ" নাম দিয়েছেন। যদি তিনি এই নাম দিয়ে থাকেন আর বাজাজ একজন ভালো বৈজ্ঞানিক হন, তাহলে এর অর্থ এই হল যে আইনস্টাইন মানতেন যে পেইন ওয়েভ হয়। আমি পড়িনি, প্রফেসর বাজাজ তার পুস্তকের মধ্যে দিয়েছেন আর সেই পুস্তক আমার কাছে আছে। যদি আইনস্টাইন, ফাইনম্যান আদি কোনো পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক বলে, আমরা কি তখনই মারবো? তাহলে এটা আমাদের বৌদ্ধিক দাসত্ব হবে। আমাদের ঋষি যা বলেছেন, আমাদের সেটাই মানা উচিত আর তাঁদের মার্গে যদি কোনো বৈজ্ঞানিক কিছু বলে, তাহলে তাকেও স্বাগত বা সমর্থন করা উচিত। অজ্ঞানী বালকও যদি তর্কসঙ্গত কথা বলে, তাহলে তাকে স্বীকার করা উচিত আর যদি তর্কবিহীন ও মিথ্যা কথা কোনো বড় বৈজ্ঞানিক বলে, তাকেও মানা উচিত নয়।
.
সম্পূর্ণ সৃষ্টি মনস্তত্ত্ব দিয়ে তৈরি হয়েছে। যখন কোনো প্রাণীকে মারা হবে, তো সেখান থেকে যে হিংসার তরঙ্গ বের হবে, তাতে সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্বের মধ্যে কম্পন হবে। যেমন একটা পুলের উপর ৫০ জন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে আর একজন ব্যক্তি কোনো ভাবে পুলটাকে হেলায়, তো তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা সব ৫০ জন ব্যক্তিও প্রভাবিত হবে, এমন হবে না যে কেবল পুলটাই প্রভাবিত হবে। যখন কোনো হিংসার চিৎকার হয়, তখন এক তো সেই ধ্বনি তরঙ্গ স্বয়ং হানিকারক হয়, দ্বিতীয়ত তার পীড়ার তরঙ্গ, যেটা মন থেকে বের হচ্ছে, এই দুটোই সংসারকে প্রভাবিত করে। প্রোফেসর বাজাজ এরপর বলেছেন যে অন্য গ্যালাক্সি পর্যন্ত এই পেইন ওয়েভ যাবে।
.
এখন এর উপর বিচার করবো যে মানুষ কেন হিংসা করে -
কেউ লোভে হিংসা করে, ভাবে যে পশুকে মারলে চামড়া পাওয়া যাবে, মাংস বিক্রি করলে ধন প্রাপ্ত হবে। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য অন্যকে মারা, এটা হল বর্তমান অসুরী স্বাস্থ্য নীতি। কেউ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্রোধে হিংসা করে। যুদ্ধ লোভ আর প্রতিশোধ উভয়ের জন্য হয়। তৃতীয় কারণ হল - কাম। বর্তমানে কামের কারণেও খুব হিংসা হচ্ছে। যে হিংসাই করবে, তো সেই হিংসার তরঙ্গের সঙ্গে-সঙ্গে কাম, ক্রোধ আর লোভের কোনো-না-কোনো তরঙ্গ অবশ্যই আসবে। ধরে নিন, আমি লোভ করছি, তাই ভাবছি যে তার ধন আমার কাছে আসুক, মাছ তথা পশুকে মেরে ধন সংগ্রহ করবো, তো যেমন পেইন-ওয়েভ ব্রহ্মাণ্ডকে প্রভাবিত করে, তেমনই লোভ ও ক্রোধাদির তরঙ্গও ব্রহ্মাণ্ডকে প্রভাবিত করবে। সারা ব্রহ্মাণ্ডের আধার হল এই মন, আজ সেটা সম্পূর্ণ ভাবে কম্পন করছে। যদি ঘরের ভিত্তিকে কম্পন করতে থাকা হয়, তাহলে ঘর কতক্ষণ স্থির থাকবে? নিরন্তর দুর্বল হয়ে পড়ে যাবে। মানুষ আজ রাক্ষস হয়ে গেছে, সেই রাক্ষস রাজনেতা, কর্মচারী, বৈজ্ঞানিক, অর্থশাস্ত্রী, শিক্ষাশাস্ত্রী, সমাজশাস্ত্রী, পুঁজিপতি যেকোনো রূপে হতে পারে। আজ মনে হচ্ছে যে সবথেকে বড় পুঁজিপতিরাই হচ্ছে আসল বৈজ্ঞানিক। কিন্তু সত্য বিজ্ঞানকে জানা বৈজ্ঞানিক কখনও হিংসার কথা বলতে পারে না।
.
হিংসার তরঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? যেমন কোনো ঘরে একটু কম্পন করা হয়, তাহলে তার প্রত্যেকটা অণু প্রভাবিত হবে। ঠিক সেইরকম হিংসার তরঙ্গের কারণে সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্ব প্রভাবিত হবে তথা সেই মনস্তত্ত্ব দিয়ে তৈরি হওয়া যত পার্টিকলস্ আছে, সেগুলোও প্রভাবিত/কম্পিত হবে। সেই কম্পিত হওয়া পার্টিকলও তরঙ্গ উৎপন্ন করবে আর সেই তরঙ্গ আমাদের মন, আমাদের স্বাস্থ্য, পৃথ্বী, সমুদ্র আদিকে প্রভাবিত করবে, যারফলে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও তুফান আসবে। সেই তরঙ্গগুলো মেঘকেও প্রভাবিত করবে, যারফলে কোথাও বন্যা আসবে তো কোথাও শুকিয়ে যাবে। সেই তরঙ্গই সূর্যকে প্রভাবিত করবে, তো তারফলে হিট-ওয়েভ আসবে।
.
হিংসার তরঙ্গ ক্রোধ, লোভ আর মোহ থেকে উৎপন্ন হয়, তো তাকে কিভাবে শান্ত করা যাবে? ক্রোধের বিপরীত প্রেম, লোভের বিপরীত ত্যাগ আর পীড়ার বিপরীত হল শান্তি। ক্রোধের তরঙ্গ নাকারাত্মক প্রভাব ফেলবে আর প্রেমের তরঙ্গ সাকারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কারণ প্রেমের তরঙ্গের মধ্যে সত্ত্বগুণ প্রধান হবে আর সত্ত্বগুণের পরিণাম হল - সুখ, শান্তি আর আনন্দ। ক্রোধের তরঙ্গের মধ্যে রজোগুণ ও তমোগুণ প্রধান হবে, যার পরিণাম হবে - অশান্তি, অজ্ঞানতা, মূঢ়তা আদি। এইভাবে ক্রোধ, লোভ, হিংসা, পীড়া আদির তরঙ্গকে দূর করার একমাত্র উপায় হল, প্রেমের তরঙ্গকে সংসারের মধ্যে উৎপন্ন করা। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ বলেছেন যে সবার সঙ্গে প্রীতি করা। আজ হিংসার তরঙ্গের সঙ্গে পীড়া, লোভ, ক্রোধ আর কামের তরঙ্গও যুক্ত হয়ে গেছে। এই পাঁচটা মিলিত হয়ে এই সংসারের নাশ করছে। সেটা ভূগর্ভীয় কম্পনের বৃদ্ধি হোক বা তুফান, সেটা বিশ্বের কোনো বন্যা হোক বা সাইবেরিয়ার মতো ঠাণ্ডা স্থানে উচ্চ তাপমান। এই সবগুলোর কারণ হল গত কয়েক বছর থেকে হিংসা অনেক অধিক বেড়ে গেছে। আজ হিংসার তরঙ্গের যে তাণ্ডব চলছে, তার পিছনে ক্রোধ নয়, বরং ধনের লোভ প্রমুখ কারণ আছে। রাক্ষস ব্যক্তিরা হিংসা ও পীড়ার তরঙ্গকে নিরন্তর বাড়িয়ে তোলার কাজ করছে আর মহাদেব ভক্ত মৌন আছে। তারা শুধু মৌনই নয়, বরং সমর্থনও করছে। অহিংসার প্রকরণ আমি এখানেই সমাপ্ত করছি। এরপর আমি সত্যের উপর চর্চা করবো।

৫. মিথ্যার ব্যাপার এবং সত্যের হ্রাস
এখন আমি মহাদেব দ্বারা নির্ধারিত ধর্মের দ্বিতীয় কথন "সত্য" -এর উপর চর্চা করবো -
.
কোনো ব্যক্তি সত্য তখনই বলবে, যখন সে সত্যকে জানবে। বেদের মধ্যে লেখা আছে - "স্বেন ক্রতুনা সম্বদেত" অর্থাৎ নিজের কর্মের দ্বারা বলো। এর অর্থ হল সত্য জানো, সত্য বলো আর সত্যই করো। সত্যের জন্য ঋগ্বেদের মধ্যে বলা হয়েছে -
.
সত্যেনোত্তভিতা ভূমিঃ সূর্য়েণোত্তেভিতা দ্যৌঃ। ঋতেনাদিত্যাস্তিষ্ঠন্তি দিবি সোমো অধি শ্রিতঃ।।
(ঋগ্বেদ ১০.৮৫.১)
.
এই ভূমি সত্যের উপর টিকে আছে, সূর্য সত্যের উপর টিকে আছে। সত্যের বিষয়ে মহর্ষি ব্যাস য়োগদর্শন ভাষ্যের মধ্যে লিখেছেন - "যেমন আত্মার মধ্যে আছে, তেমনই মনের মধ্যে, যেমন মনের মধ্যে আছে, তেমনই বাণীর মধ্যে আর তেমনই কর্মের মধ্যেও হোক, কিন্তু সেটা সবার হিতের জন্য হোক" আর ভগবান্ শিব মহাভারতের মধ্যে সত্যের লক্ষণ সম্বন্ধে লিখেছেন - "যেমন শুনেছেন, তাতে কোনো কিছু না মিশিয়ে, তাকে কোনো রূপ বিকৃত না করে প্রস্তুত করা হল সত্য।" এটা সবাই জানে যে সত্য কথা বলা সবথেকে সহজ কাজ, কিন্তু কেউ বলে না। অসত্য কথা বলতে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয় যে কি বলবো। কোনো অপরাধ বা একটু ত্রুটি হলে দেখবেন মনের মধ্যে কত তরঙ্গ ওঠে। এর সামনে এমন বলবে, অন্য কারও সামনে এমন বলবে, অর্থাৎ সবার সামনে আলাদা-আলাদা ভাবতে হবে, কিন্তু সত্য কথা বলতে কিছুই ভাবতে হয় না, যেমন জানা আছে, তেমনই বলে দিবে। খুব ছোট বাচ্চারা সত্য কথা বলে। তাদের মনের মধ্যে যেমন আছে, তারা তেমনই মুখ দিয়ে বলে দেয়। একজন পাগল ব্যক্তিও সত্য কথা বলে। তার মনে যা আসবে, সেটাই সে বলে দিবে আর করবেও ঠিক তেমনি। যদি তার মনে আসে যে কারও মাথায় পাথর মারতে হবে, তো সে মেরে দিবে, চিন্তা-ভাবনাও করবে না। এটা কি সত্য?
.
মহর্ষি ব্যাস সত্যের পরিভাষা করেছেন - "যেমন আত্মার মধ্যে আছে, তেমনই মনের মধ্যে, যেমন মনের মধ্যে আছে, তেমনই বাণীর মধ্যে আর যেমন বাণীর মধ্যে আছে, তেমনই কর্মের মধ্যে," কিন্তু তিনি এই শর্ত রেখে দিয়েছেন যে - যেটা সব প্রাণীর হিতের জন্য হবে সেটাই সত্য হবে আর যেটা প্রাণীর বিনাশের জন্য হবে, সেটাই অসত্য হবে। যেমন যদি কারও মনের মধ্যে আসে যে আমি কারও ধন চুরি করবো, কারও মাথা ফাটিয়ে দিবো, কাউকে গালি দিবো, কারও হানি করবো, তেমনই তার বাণীতেও হয় আর যদি সে তেমনই করে, তাহলে কি এটা সত্য হয়ে যাবে? যদি এইভাবে দেখা হয় তাহলে তো ডাকাতও সত্য কথা বলে, কারণ এমন অনেক ডাকাত আছে, যারা আগে থেকে পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দেয় যে অমুক দিনে ডাকাতি করতে আসবো, তোমার কাছে সাহস থাকলে থামিয়ে দেখাবে। এইজন্য মহর্ষি ব্যাস অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লিখেছেন যে যার দ্বারা সব প্রাণীর হিত হবে, সেটাই সত্য হবে। সব প্রাণীর ভালো হতে হবে, এমন নয় যে কেবল নিজের ভালো হবে।
.
কোনো দোকানদারকে জিজ্ঞেস করুন যে আপনি দিনে কতবার মিথ্যা কথা বলেন, তো তিনি বলবেন এটা জিজ্ঞেস করার এমন কি আছে, অসত্য তো বলতেই হয়, অসত্য না বললে ব্যবসা চলবে কিভাবে? রাজনেতাদের ভাষণ রাজনৈতিক সভাতে গিয়ে শুনুন আর তাদের জিজ্ঞেস করুন যে আপনি যে ভাষণ দিলেন, তারমধ্যে কত শতাংশ অসত্য ছিল? তো তারাও এটাই বলবেন যে এটা জিজ্ঞেস করার এমন কি আছে, অসত্য তো বলতেই হবে, তা নাহলে রাজনীতি চলবে কিভাবে? কিছু ব্যক্তি বলে যে আজ তো অসত্য ছাড়া ব্যবহারই চলবে না। কিন্তু আজও এমন কিছু দোকানদার আছে, যারা সবাইকে এক মূল্যে জিনিস দিবে, তা সে বালক হোক বা বৃদ্ধ আর তাদের ব্যবসাও খুব ভালো চলছে।
.
এমন নয় যে লোকব্যবহারে সত্যের পরিণাম ভালো হয় না। আমি তো স্বয়ং সত্যের ব্যবহার করেছি আর সত্যকে খুব পরীক্ষা করে দেখেছি। যখন আমি যুবকাবস্থায় ছিলাম, তো অপরাধীও আমার সামনে আসতো না আর বড়-বড় নেতা, অধিকারীর সঙ্গে আমার বিবাদ প্রায়শই হতো, কিন্তু কেউ আমার খারাপ করতে পারেনি। যারা অসত্য কথা বলে তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদি সত্য বললে হানি হয়, তাহলে সহ্য করা উচিত, কারণ অন্ততঃ সত্য বলাও লাভদায়ক হয়। যদি সবাই সত্য একদম না বলে আর কেবল অসত্য বলে, তাহলে ব্যবহারই চলবে না। যেমন কাউকে খিদে পেয়েছে, তার মা জিজ্ঞেস করছে যে খিদে পেয়েছে কিনা, তো সে যদি বলে যে খিদে পায়নি, তাহলে তো খাবারই পাবে না। আর যদি খিদে না পায় অথচ বলে যে হ্যাঁ খিদে পেয়েছে, তাহলে খাবার নিয়ে আসলেও সে খেতে পারবে না। সংসারের যত অসত্যের ব্যাপার চলছে, সেটা এই কারণে চলছে যে তার মধ্যে সত্যও মিলিত আছে। বিশ্বের মধ্যে যত সুখ দেখা যায়, সেগুলো সত্যের কারণে টিকে আছে আর যত দুঃখ দেখা যাচ্ছে, সেগুলো অসত্যের কারণে আছে।
.
অসত্য বলে আমরা ধন অর্জন করেছি, তাহলে কি আমরা সুখী হয়ে গেছি? আশ্চর্যের বিষয় যে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় চিহ্নে "সত্যমেব জয়তে" লেখা আছে, কিন্তু যতটা আমাদের ভারতে অসত্য বলা হয়, সম্ভবতঃ ততটা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বলা হয় না। ভারত ধর্মপ্রধান দেশ কোথায় আছে? মাত্র বাহ্য আডম্বর প্রধান দেশ হয়ে রয়ে গেছে। তিলক, জনেউ, শিখা, যজ্ঞ, তপ, ব্রত, উপবাস, মন্দিরে যাওয়া, শুয়ে-শুয়ে যাওয়া, পায়ে হেঁটে যাওয়া এইসব হল বাহ্য আডম্বর। যজ্ঞ, জনেউ, শিখা আদির নিজস্ব গুরুত্ব আছে, কিন্তু এগুলো হল প্রতীকমাত্র। আমরা প্রতীকগুলোকেই ধর্ম ভেবে নিয়েছি। আমরা ভারতের মানচিত্রকেই ভারত ভেবে নিয়েছি। মানচিত্র হল মার্গদর্শক, কিন্তু ভারত নয়। কোথাও "গৌ" শব্দ লেখা আছে, তো সেটা দুধ দিবে না, সেটা তো তার প্রতীকমাত্র।
.
সত্য হল সুপার এক্সপ্রেসওয়ের মত পথ, যেটা সোজা আর খালি পড়ে আছে, যার উপর দিয়ে আরামে দৌড়ে চলে যাবেন, কোথাও ধাক্কা লাগবে না আর অসত্য হল ভিড়-ভার যুক্ত পথের সমান, তার উপর কোথাও এদিক তো কোথাও সেদিক মুড়ে যেতে হয়। গাড়ি যদি সোজা যায় তাহলে সঠিক ভাবে যাবে আর যদি এদিক-সেদিক হয়ে চলে, তাহলে গাড়ির ক্ষতি হবে। ঠিক এমনই অসত্য কথা বললে আমাদের শরীরেরও হানি হবে। এটা সবাই জানে যে অসত্য কথা বলা ব্যক্তির মন কত কম্পন করে, বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়, দম ফুরিয়ে আসে, কারণ অসত্য শরীরের মধ্যে বিকার উৎপন্ন করে। যে অসত্য শরীরের মধ্যে বিকার উৎপন্ন করতে পারে, সেটা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কেন করবে না? একটা মনস্তত্ত্ব আমাদের ভিতরে আছে, যা দিয়ে সমষ্টি মন প্রভাবিত হয়, সেটা সারা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত আছে, যার দ্বারা সারা সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে। যেমন হিংসার তরঙ্গ, পার্টিকলস আর ওয়েভস সবাইকে প্রভাবিত করে, সেই রকম মুখে বলা অসত্যও এইসবকে প্রভাবিত করে, কারণ সেটাও এর আধারকে (মনস্তত্ত্ব) ঝাঁকাচ্ছে।
.
আজ বিশ্বের মধ্যে আট আরব মানুষ বসবাস করে। যদি একজন ব্যক্তি একদিনে প্রায় দশবার অসত্য কথা বলে, তাহলে আশি আরব বার অসত্য কথা বলা হবে। যদি অসত্যের দ্বারা কাউকে আতঙ্কিত করা হয়, তাহলে ভয়ের তরঙ্গ, যদি অসত্য ভাষণ করে কাউকে প্রলোভন দেওয়া হয় তাহলে লোভের তরঙ্গ আর যদি কেউ অহংকার বা অহেতুক নিজের প্রশংসায় অসত্য কথা বলে, তাহলে তাতে অহংকারের তরঙ্গ জুড়ে যাবে। কিছু মানুষ কোনো কথাকে ভালো করার জন্য অসত্য কথা বলে, যেমন বেশিরভাগ উপদেশক অসত্য মিলিয়ে উপদেশ করে। শুনেছি, একবার ডাক্তার সম্পূর্ণানন্দের কাছে একজন জিজ্ঞেস করে যে ভারত তো সত্যবাদী মহারাজ হরিশচন্দ্রের দেশ, তা সত্ত্বেও দেশের মধ্যে এত অসত্য বলা হয়, আমরা কেন সত্যবাদী হইনি? তো তিনি উত্তর দেন যে দেশ এইজন্য সত্যবাদী হতে পারেনি, কারণ সত্যবাদী হরিশচন্দ্রের কাহিনীতে অনেকগুলো অসত্য মিশ্রিত করে প্রচার করা হয়েছে, সত্যের মধ্যে অসত্য মিশ্রিত করা হয়েছে। সত্যকে মনোরঞ্জন ও অতিশয়োক্তিপূর্ণ বানানোর জন্য বা অন্য কোনো কারণে অসত্য বলা হয়। সব স্থানে অসত্যের ব্যাপার চলছে, তাহলে ভূমি টিকবে কিভাবে? কারণ ভূমি তো সত্যের উপর টিকে আছে।
.
যার উপর ভূতাদি প্রাণী বাস করে, তাকে ভূমি বলে। সেটা পৃথিবী হোক বা অন্য কোনো লোক, প্রাণী সর্বত্র বাস করে, সূর্যের মধ্যেও আগ্নেয় শরীর যুক্ত প্রাণী বাস করে। এর অর্থ হল সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড সত্যের উপর টিকে আছে। আচার্য চাণক্য বলেছেন -
সত্যেন ধার্য়তে পৃথ্বী সত্যেন তপতে রবিঃ।
সত্যেন বাতি বায়ুশ্চ সর্বম্ সত্যে প্রতিষ্ঠিতম্।।
(চাণক্যনীতিদর্পণম্ ৫.১৯)
.
এটাও আশ্চর্যের বিষয় যে মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণীই অসত্য বলে না। গরু, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল, সাপ আদি কেউই অসত্য বলে না, তারা কোনো অজুহাত করে না আর কাউকে বিভ্রান্তও করে না। বাঘ মারবে তো মারবেই, সে বিভ্রান্ত করবে না যে লেজ নাড়াবে আর তারপর মেরে ফেলবে। কিছু কুকুর চুপচাপ কামড়ে দেয় আর কিছু কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে কামড়ে দেয়, কুকুর যদি লেজ নাড়ায় তাহলে কামড়াবে না, কিন্তু এই মানুষ লেজ নাড়াবে, তবুও কামড়াবে অর্থাৎ সামনে-সামনে চাটুকারিতা করবে আর ভিতরে-ভিতরে আঘাত করবে। বিশ্বের মধ্যে যে নিজেকে সবথেকে বুদ্ধিমান মনে করে, সেই মানুষ সবথেকে বেশি অসত্য বলে। অসত্য তার জীবনের মধ্যে ভরে পড়ে আছে। আমাদের নেতা, যাদের আমরা প্রমাণ মানি যে এরা তো অন্ততঃ সত্যিই বলবে, বৈজ্ঞানিক সত্যিই বলবে, কিন্তু বর্তমানে এরা এমন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে যে সবাই অসত্য বলছে আর অসত্যের কারণে সম্পূর্ণ পরিবেশ তন্ত্র নষ্ট হচ্ছে। আজকের পরিবেশ বৈজ্ঞানিক কেবল এটাই ভাবে যে সূর্য থেকে উষ্ণতা আসে আর তাতে কোনো পরিবর্তন হলে, তো সেটাই পরিবেশ প্রদূষণের কারণ হয়। সব দোষকে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের নামে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেয়। তাদের জিজ্ঞেস করুন যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কেন হয়েছে? এর উত্তর তাদের কাছে নেই। কখনও আবহাওয়া খারাপ হবে, তো আবহাওয়া দপ্তর বলবে যে পশ্চিমী বিক্ষোভের কারণে এমন হচ্ছে, পূর্ব বিক্ষোভ, পশ্চিমী বিক্ষোভ পরস্পর সংঘর্ষ হয়েছে, তাই এমন হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলকে বিক্ষুব্ধ কে করেছে? আমরা বিক্ষুব্ধ করেছি, অসত্য বলে, লোভ, হিংসা, অহংকার, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষার তরঙ্গ দিয়ে। তারা এইসব বিষয়ে জানেই না, কারণ তাদের ক্ষেত্র পার্টিকল পর্যন্তই আছে। বৈজ্ঞানিক আজ পর্যন্ত জানতে পারেনি যে সেইসব পার্টিকলস্ কেমন, কি দিয়ে তৈরি, সেগুলোর ঘটক কি? যখন সত্য জানা নেই আর কেউ যদি সেটা বলে, তাহলে সেটা বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
.
সত্য বলার মধ্যে হৃদয় সামান্য থাকে, সরল থাকে, নিষ্কপট থাকে আর অসত্য বললে হৃদয়ের ধুকপুক বেড়ে যায়, এইজন্য মেশিন ধরে ফেলে। অসত্য আমাদের শরীরকে ভিতর পর্যন্ত ঝাঁকা দিয়েছে, কিন্তু এই বিষয়ে ভাবার জন্য কেউই প্রস্তুত নয়। অসত্যও এত দৃঢ় আর নির্লজ্জভাবে ভাবে বলে যাতে সবাই সত্য মনে করে। তাদের নির্লজ্জতা দেখে আমাদের মনে হয় যে তারা হয়তো সত্যিই বলছে। অভিনেতা যেভাবে কথা বলে, ঠিক সেইভাবে আজকের মানুষ কথা বলে। যেমন কোনো রাঁধুনি যদি নাটকে হনুমান সাজে আর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তুমি কে? তো সে বলবে যে হনুমান, যদি রাঁধুনি বলে তাহলে নাটক কিভাবে চলবে, এইজন্য অসত্য বলে। সর্বহিতের জন্য যদি কেউ এমন ধারাবাহিক করে, তাহলে ভালো কথা। কিন্তু যদি লোভের কারণে করে, তাহলে সেই অসত্য মানবতার জন্য ঘাতক হবে।

🌿 ৬. সত্যই হল জীবনের সুন্দর সঙ্গীত 🌿
এখন আমি ভগবান্ শিবের দ্বারা নির্দেশিত ধর্মের দ্বিতীয় লক্ষণের উপর চর্চাকে আগে নিয়ে যাবো। আমি যেমন পূর্বে বলেছি যে মহর্ষি ব্যাসের অনুসারে "যেমন আত্মার মধ্যে আছে, তেমনই মনের মধ্যে হোক, যেমন মনের মধ্যে আছে, তেমনই বাণীর মধ্যে হোক আর তেমন কর্মের মধ্যেও হোক, কিন্তু সেটা সবার হিতের জন্য হোক।"
.
যদি আত্মা, মন আর বাণীর মধ্যে সমতা থাকে, তাহলে আমাদের জীবনের সঙ্গীত ভালো হবে। যেমন হারমোনিয়ামের যদি একটা স্বর এদিকে বাজে তো আরেকটা ওদিকে অথবা হারমোনিয়াম গাইছে একটা আর গায়ক গাইছে আরেকটা। ঢোল এক রকম বাজাচ্ছে আর করতাল আরেকরকম, তাহলে সঙ্গীত খারাপ হয়ে যাবে। ঠিক সেইরকম আমাদের জীবনরূপী সঙ্গীতের জন্য আমাদের সব ইন্দ্রিয়রূপী যন্ত্রের মধ্যে সমতা ও অভিন্নতা হওয়া উচিত। কঠোপনিষদের মধ্যে বলা হয়েছে -
.
আত্মানম্ রথিনম্ বিদ্ধি শরীরম্ রথমেব তু।
বুদ্ধিম্ তু সারথিম্ বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।
ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াম্স্তেষু গোচরান্।
আত্মেন্দ্রিয়মনোয়ুক্তম্ ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ।।
(কঠোপনিষদ্ ১.৩.৩-৪)
.
অর্থাৎ আত্মাকে রথী, শরীরকে রথ, বুদ্ধিকে সারথী, মনকে লাগাম, ইন্দ্রিয়কে ঘোড়া আর বিষয়কে মার্গ বলা হয়েছে। যদি রথী অর্থাৎ রথের মালিকের আজ্ঞানুসারে সারথী রথকে চালাচ্ছে, লাগামকে শক্ত করে ধরে আছে আর লাগাম ঘোড়ার সাথে নিয়ন্ত্রিত আছে, তাহলে সেটা সঠিক মার্গে যাবে। তা নাহলে মালিক বলবে একটা, সারথী করবে আরেকটা আর সারথীর হাতে লাগামও যদি দূর্বল হয়, তাহলে ঘোড়া কোথায় যাবে, সেটা কেউ জানে না। এইজন্য জীবনের সঙ্গীতে এর অভিন্নতা হওয়া উচিত আর সেই অভিন্নতার নামই হল সত্য, যারমধ্যে কোনো জটিলতা, বাধা, বিকৃত হবে না। যেমন এক ব্যক্তি অন্ধকে অন্ধ বলেছে, কথাটা তো সত্যি, একদম অভিন্ন। আত্মাও জানে যে এই ব্যক্তিটা অন্ধ, মনও জানে আর তারপর যদি বাণীও অন্ধকে অন্ধ বলে, তাহলে কি এটা সত্য হয়ে যাবে? এইজন্য মহর্ষি ব্যাস বলেছেন - না, এটা সত্য নয়। সত্য এমন হয় যেটা সবার হিতের জন্য হবে। অন্ধকে অন্ধ বলে বিরক্ত করলে কারও হিত নেই, কারণ এতে তার কোনো হিত হবে না আর আমাদেরও কোনো হিত হবে না তথা অন্য কোনো ব্যক্তিরও হিত হবে না, এইজন্য এটা সত্য নয়। ভগবান্ ব্রহ্মা মহাভারতে বলেছেন -
"সত্যস্য বচনম্ শ্রেয়ঃ সত্যজ্ঞানম্ তু দুষ্করম্।"
অর্থাৎ সত্য কথা বলা শ্রেষ্ঠ, তবে সত্যের জ্ঞান খুব কঠিন। তারপর লিখেছেন যেটা প্রাণীদের অত্যন্ত হিতকারী হবে সেটাই হল সত্য, ধর্মের মুখ্য লক্ষণ হল এটাই। যেমন একটা চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে আর তাকে বাঁচানোর জন্য আমরা যদি অসত্য বলি, তারপর আমরা ভাবি যে তার হিত হয়েছে। বস্তুতঃ এটা হবে না, বরং অনেকের অহিত হবে। কারণ সে যতদিন জীবিত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত চুরি করবে, এরফলে কত জনের অহিত হবে? এইজন্য সেই চোরকে রক্ষা করার জন্য অসত্য কথা তো অসত্যই হবে। কিন্তু যদি ধর্মের রক্ষার জন্য অসত্য বলা হয়, যেমন মহাভারতে বলা হয়েছে - "অশ্বত্থামা মারা গেছে"। ধর্মরাজকে এটা বলার প্রেরণা সাক্ষাৎ ধর্মের রূপ শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছিলেন। তাঁর শত্রুও বলেছিল যে -
"য়তঃ কৃষ্ণস্ততো ধর্মো য়তো ধর্মস্ততো জয়ঃ।"
.
অর্থাৎ যেখানে কৃষ্ণ আছে, সেখানে ধর্ম আছে আর যেখানে ধর্ম আছে সেখানে জয় আছে। শ্রীকৃষ্ণ অধর্ম করেছেন কোথায়? মহর্ষি ব্রহ্মা ও মহর্ষি ব্যাসের পরিভাষায় তো এটাই ছিল যে যারদ্বারা প্রাণীদের অত্যন্ত হিত হবে, সেটাই হল ধর্ম। দ্রোণাচার্য চলে গেলেন, অথচ ধর্মের বিজয় হয়ে গেল, কারণ দ্রোণাচার্য অধর্মের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি অসত্যের সাক্ষাৎ মূর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। এইজন্য সেটা মিথ্যাভাষণ নয়, বরং সত্যই ছিল।
.
এখন ভগবান্ শ্রীরামের জীবনে চলুন। শ্রীরাম যখন বনে যাচ্ছিলেন, সুমন্ত্র তাঁকে ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল। তখন মহারাজ দশরথ পিছনে-পিছনে দৌড়াচ্ছিলেন আর বলছিলেন "সুমন্ত্র রথ থামাও" তথা শ্রীরাম বলেন যে "সুমন্ত্র রথকে এগিয়ে নিয়ে যাও"। সুমন্ত্র জিজ্ঞেস করে যে মহারাজ বলছেন যে "রথ থামাও" আর আপনি বলছেন যে "রথকে এগিয়ে নিয়ে যাও", আমি কার আদেশ মানবো? তখন শ্রীরাম বলেন যে "তুমি সামনে চলো আর যদি মহারাজ জিজ্ঞেস করে যে রথ কেন থামাও নি, তাহলে বলে দিবে যে আমি শুনতে পাইনি"। ভগবান্ শ্রীরাম এমন এইজন্য বলেছেন, কারণ এরমধ্যেই সবার হিত ছিল। তিনি বলেন যে আমরা যতক্ষণ এখানে থাকবো, পিতার মোহ বাড়তে থাকবে আর নাগরিক আমাদের পিছনে আসতে থাকবে, এতে সবার কষ্ট হবে। এইজন্য এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা বেরিয়ে যাবো, ততই সবার হিত হবে। এখানে এটা মিথ্যাভাষণ নয়, বরং এটা সত্যভাষণ, কারণ এতে সবার হিত আছে। এরমধ্যে ভগবান্ শ্রীরামের কোনো স্বার্থ ছিল না। যদি তিনি স্বার্থী হতেন, তাহলে রাজা হয়ে যেতেন। কারণ মহারাজ দশরথ তো স্বয়ং বলেছেন যে আমাকে বন্দী বানিয়ে রাজা হয়ে যাও। তাঁর আগে ভাই লক্ষণও এমনই বলেছিলেন।
.
এখন ঋষি দয়ানন্দের জীবনে আসুন। তাঁর যখন বৈরাগ্য হয়, তখন তিনি শুদ্ধ চৈতন্য হয়ে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্যের দীক্ষা নেন। তখন একবার তিনি সিদ্ধপুর মেলাতে যান। সেখানে তাঁকে এক বৈরাগী চিনে ফেলেন যে এটা তো মূলশঙ্কর, কারণ তিনি প্রসিদ্ধ ব্যক্তির প্রসিদ্ধ পুত্র ছিলেন। সেই ব্যক্তি তাঁর পিতাকে জানিয়ে দেন যে আপনার পুত্র তো সাধু হয়ে, সিদ্ধপুর মেলাতে যাচ্ছে। তখন তাঁর পিতা সিপাহী নিয়ে সেখানে যান আর তাঁকে ধরে ফেলেন। শুদ্ধ চৈতন্য বলেন - পিতাজী! ভালো হয়েছে, আপনি এসেছেন। আমি তো আপনার কাছেই আসছিলাম। প্রতারণার প্রভাবে সাধু হয়ে গেছি। তবুও তাঁর পিতা পাহারা লাগিয়ে দেয় যে এর উপর করা নজর রাখবে। তাঁর গেরুয়া বস্ত্র ছিড়ে ফেলে দেন তথা অন্য বস্ত্র পরিয়ে দেন। রাতে যখন সব সিপাহী ঘুমাচ্ছিল, তখন শুদ্ধচৈতন্য ওঠেন তথা ঘটিতে জল নিয়ে রওনা হন আর মনে-মনে ভেবে নেন যে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যাচ্ছেন, তাহলে বলে দিবেন যে শৌচের জন্য যাচ্ছেন আর গিয়ে একটা বটগাছের মাথায় উঠে বসেন। পিতাজী সিপাহীদের দিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু অনেক খোঁজার পরও তাঁকে পেলেন না। এটা পিতা-পুত্রের অন্তিম মিলন ছিল। এখানেও অসত্য বলা হয়েছে, কিন্তু এটা সর্বহিতে হওয়ার কারণে সত্য ছিল। যদি সত্য বলে দিতেন তাহলে মারও খেতেন আর ঘরেও ফিরে যেতে হতো। এইজন্য মহর্ষি ব্যাস লিখেছেন যে যার দ্বারা সব প্রাণীর হিত হবে, সেটাই হল সত্য। এখন দোকানদার ব্যবসার জন্য যদি অসত্য বলে আর এমন বলে যে এতে আমার ভালো হবে, তো এমন উচিত নয়, কারণ সবার হিত হওয়া উচিত। তার ভাবা উচিত যে লোক ঠকিয়ে ধন কামানো এতে তারও হিত হবে না, কারণ আজ তো সে কামিয়ে নিবে, কিন্তু পরবর্তীতে তার ফল অবশ্যই তাকে ভুগতে হবে।
.
☘️ এখন হিত তথা রুচির মধ্যে একটু পার্থক্য জেনে নিবো -
অসত্য সর্বহিতের জন্য বলা যেতে পারে, রুচির জন্য নয়। সবার রুচি ভিন্ন-ভিন্ন হয়, কখনও এক হবেই না, কিন্তু হিত সবার জন্য সমান হয়। হিতের অর্থ হল - "যার দ্বারা নিজের ধারণ-পোষণ হবে" তথা রুচির অর্থ হল - "যেটা ইন্দ্রিয় ও মনকে ভালো লাগে"। যেমন - কারও মধুমেহ রোগ আছে, মিষ্টি খেতে তার খুব ভালো লাগে। এরমধ্যে তার রুচি তো আছে কিন্তু হিত নেই। চোরকে চুরি করতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু তাতে তার হিত নেই, সে লোক তথা পরলোক দুটোকেই নষ্ট করছে। রুচির পূর্তির জন্য অসত্য বলা যায় না। কোনো দোষীকে বাঁচানোর জন্য অসত্য বলা যায় না, কিন্তু ধর্ম, দেশ, নির্দোষ আদির রক্ষার জন্য বলা অসত্য কথাও সত্য হয়ে যায়।
.
একদা একস্থানে প্রবচননে আমি একবার এমন বলেছিলাম, তো সেখানে এক বিদ্বান ব্যক্তি বলেন যে আপনি তো অসত্য বলার লাইসেন্স দিচ্ছেন। অসত্য কেবল রাজা বা ক্ষত্রিয় বলতে পারে, কিন্তু ব্রাহ্মণ বা য়োগী কখনও অসত্য বলতে পারে না। তখন আমি বলি - এর মানে হল, আপনি কিছুই পড়েন নি। মহাভারতে ভীষ্ম পিতামহ খুব প্রসিদ্ধ ক্ষত্রিয় ছিলেন। তিনি রাজার লক্ষণ বলেছেন, তারমধ্যে দুটো লক্ষণ হল - জিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী হওয়া উচিত আর সত্যবাদী হওয়া উচিত। সুতরাং রাজাকে অসত্য বলার কোনো অধিকার নেই। তাছাড়া অসত্য বলার অধিকার তো কারও নেই, কিন্তু তিনি এমন বলেন নি যে ক্ষত্রিয় অসত্য বলতে পারবে। ধরে নিন কোথাও মেল হচ্ছে, সেখানে কোনো আতংবাদীর সঙ্গে দেখা হল আর সে জিজ্ঞেস করলো যে কোনদিকে লোকজন একত্রিত হবে? তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে সে ওখানে বোমা ফেলবে। যদি তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয় যে ঐদিকে আছে, একথা মুখে বলা তো সত্য হবে, কিন্তু বাস্তবে অসত্যই হবে। কারণ এতে অনেক প্রাণীর অহিত হবে।
.
আচার্য চাণক্য পদে-পদে যা করেছেন, তাতে সেই মহাপুরুষের কোনো স্বার্থ ছিল না, তিনি যা করেছেন রাষ্ট্র এবং সর্বহিতের জন্য করেছেন। যদি রাজা ধনানন্দ ভালো হতেন, তাহলে তিনি কোনো ধনানন্দকে সরানোর প্রতিজ্ঞা নিতেন না। সম্ভবতঃ তিনি খুব দুষ্ট রাজা ছিলেন।™ এমন দুষ্টকে মারার জন্য, যেকোনো প্রকারে মারাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, কারণ সেটাই হল সত্য।
.
সত্য হল ধর্মের জয় হওয়া উচিত আর অসত্য হল অসত্যের জয় হওয়া উচিত। কারণ অহিংসা হল ধর্মের মূল, যে সত্য আমাদের অহিংসা অর্থাৎ সবার ভালো করার দিকে নিয়ে যাবে, সেটাই হল সত্য আর যে সত্য অহিংসার বিরুদ্ধে হবে, সেটা সত্য নয়, বরং সেটা হবে সত্যের আভাসমাত্র। আমাদের এখানেও এমন কিছু জন আছে যারা একথার উপর শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণকে য়োগী মানে না, তারা বলেন যে, তাঁরা যুদ্ধও করেছেন, হিংসাও করেছেন, অসত্যও বলেছেন। তাঁদের সংখ্যার পরিমাণও দেয় যে শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ ৭০-৮০ শতাংশ য়োগী ছিলেন। পরীক্ষক, পরীক্ষার্থীর থেকেও অধিক যোগ্য হয়ে থাকে। তার মানে তাঁদের সংখ্যা-পরিমাণ দেওয়া ব্যক্তি স্বয়ংকে শ্রীরাম আর শ্রীকৃষ্ণের থেকে বড় য়োগী মনে করছে। এটা আমাদের এবং সম্পূর্ণ মানব সমাজের জন্য লজ্জার বিষয় যে এমন ব্যক্তি আমাদের সমাজের মধ্যে আছে। যার মধ্যে সবার হিত হবে এবং অহিংসার পূর্তি হবে, সেটাই হল সত্য। এর বিপরীত হল অসত্য।
.
একটা মামলাতে দুটো পক্ষ থাকে, একটা পক্ষ জানে যে সে অসত্য বলছে। সে জানে যে সে কারও হত্যা করেছে, তবুও সে বলে যে আমি করিনি আর তার উকিলও কেবল লাভের জন্যই তার সমর্থন করে। অসত্য কেবল লোভবশ, ক্রোধবশ, প্রশংসাবশ অথবা নিন্দাবশ বলা হয়। এইভাবে একটা অসত্য অনেকগুলো নাকারাত্মক তরঙ্গের জন্ম দেয়। এইজন্য সারা ব্রহ্মাণ্ড সেই অসত্যের কারণে প্রভাবিত হয়। না জেনে বলা অসত্য, ততটা বড় অপরাধ হয় না। এইজন্য ভগবান্ শিব বলেছেন যে যেসব অধর্ম বা অপরাধ অজান্তে হয়েছে, সেটা ক্ষম্য হবে। সেটা প্রায়শ্চিত্ত, তপ, দানাদির দ্বারা ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু যেসব অপরাধ জেনেশুনে করা হয়েছে, সেগুলো কখনও ক্ষম্য হবে না।
_____________________
™ ধারাবাহিক সিরিয়ালে আমরা যেমন দেখেছি।

💫 ৭. মাংস ভক্ষণকারীদের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ 💫

এখন আমি ভগবান্ শিবের দ্বারা নির্দেশিত ধর্মের তৃতীয় লক্ষণের উপর চর্চা করবো -

ধর্মের তৃতীয় লক্ষণ হল - সব প্রাণীর প্রতি দয়া। সত্যার্থ প্রকাশের দৃষ্টিতে যদি দেখা হয়, তাহলে দয়া হিংসার বিপরীত হবে আর অহিংসারই রূপ হবে। কিন্তু ভগবান্ শিব দয়াকে আলাদা রেখেছেন। সব প্রাণীর প্রতি দয়া, এটা মুখে বলা যতটা সহজ, জীবনে পালন করা ততটাই খুব কঠিন। আজ সংসারে যত মাংসাহারী আছে, তারা পশুকে স্বয়ং নিজে হাতে মেরে মাংস খায় না, যদি তারা স্বয়ং হত্যা করে খাওয়া শুরু করে, তাহলে তাদের ভিতরেও দয়ার ভাব উঠবে আর তারা মাংস খাওয়া ছেড়ে দিবে। যেসব মাংসাহারী, বাজার বা হোটেলে গিয়ে মাংস খায়, তাদেরকে কসাইখানা (slaughterhouse) দেখানো উচিত। কসাইখানাতে যা দেখা যায় - ছটপট করতে থাকা পশু, নালা দিয়ে বয়ে চলা রক্ত, পশুদের চিৎকার আর করুণ-ক্রন্দন। অধিকাংশ মানুষ একে সহ্য করতে পারবে না। খাওয়া যেমন আলাদা বিষয়, কিন্তু এমনভাবে রক্তপাত করা একদম আলাদা বিষয়। যারা আমাদের দেশের যোজনা তৈরি করে যে গরু, মোষ, মাছ, ছাগল, মুরগি আদিকে মেরে আয় বৃদ্ধি করবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ পর্যন্ত, মুখ্যমন্ত্রী থেকে বিধায়ক পর্যন্ত, এদের সবাইকে একবার কসাইখানা দেখতে অবশ্যই যাওয়া উচিত। হতে পারে তাদের হৃদয় পরিবর্তন হবে আর তারা এমন যোজনা তৈরি করবে না।
.
পরমাত্মা মানুষকে স্বভাবে দয়ালুই বানিয়েছে, এইজন্য সে পশুকে স্বয়ং মেরে খেতে পারে না। যখন সর্বপ্রথম মানুষ কোনো পশুকে মেরেছিল, তখন নিশ্চয়ই তার ভিতরেও দয়াভাব এসেছিল, কিন্তু ধীরে-ধীরে সে ক্রূর হয়ে যায়। মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য এটাই যে পশুর মধ্যে দয়াভাব হয় না, তার ভিতরে বুদ্ধি হয় না যে সে কারও উপর দয়া করবে। বাঘ মাংস খায়, তো মেরে খাবেই, গরু যদি কাউকে মারে, তাহলে মারবেই, দয়া করবে না। গরু যদিও মারে না, আত্মরক্ষা করে আর আত্মরক্ষা করার অধিকার সবার আছে। যদি দশটা পশু কোথাও যায় আর একটা পশু কোথাও গর্তে পরে যায়, তাহলে কোনো পশু তাকে বাঁচাবে না, কারণ তাদের মধ্যে বাঁচানোর বুদ্ধি নেই। কিন্তু যদি সেই পশু তাদের পরিবারের হয়, তাহলে তাদেরও দয়া আসে আর তারাও শোক পালন করে। কিন্তু অন্য কেউ হলে, তাহলে দয়া আসে না। বাঁদর মারা গেলে অনেক বাঁদর একত্রিত হয়ে যায়, কিন্তু কোনো কুকুর আসবে না। একটা কাক মারা গেলে অনেক কাক এসে যাবে আর একত্রিত হয়ে শোক পালন করবে, কিন্তু কেবল কাকের জন্য, নিজের জাতির জন্য। পরিবারের সদস্যদের প্রতি দয়াভাব তো তাদের মধ্যেও আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে এই ধর্মটা নেই যে সব প্রাণীর প্রতি দয়াভাব হোক।
.
মানুষ হল এমন প্রাণী যারমধ্যে সবার প্রতি দয়াভাব স্বাভাবিক রূপে আছে, আর একেই ধর্ম বলা হয়েছে। যেমন হিংসার থেকে বড় কোনো অধর্ম নেই, তেমনই দয়ার থেকে বড় কোনো ধর্ম নেই। আজ সংসারের মধ্যে যে হিংসার তরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে, তাকে নিষ্প্রভাবী করার একমাত্র উপায় হল এটাই যে আমাদের ভিতরে দয়া, করুণা ও প্রেমের তরঙ্গ উৎপন্ন হোক আর এগুলো উৎপন্ন তখনই হবে, যখন আমরা একবার হিংসার ভয়ংকর রূপকে দেখে নিবো। যারা মাংস খায় তারা জানেই না যে মাংস কিভাবে পাওয়া যায়? হিংসা না করে কেউ মাংস প্রাপ্তই করতে পারবে না। প্রাণীমাত্রের প্রতি দয়ার অর্থই হল দয়ার মধ্যে ভেদভাব হওয়া উচিত নয়, যেমনটা পশু-পাখির মধ্যে ভেদভাব হয়, তাদের কেবল নিজের জাতির প্রতি দয়া হয়। কিন্তু মানুষের তো নিজের জাতির প্রতিও একদম দয়া নেই। যদি মানুষ মানুষজাতির প্রতিও দয়া করা শুরু করে, তাহলেও তার স্তর অনেক উঁচু হয়ে যাবে। আজ যে অহিংসার কথা বলা হয়, সেটা কেবল মানুষ পর্যন্তই সীমিত আছে।
.
পশুকে মেরে খাওয়া মাংসাহারী বৌদ্ধ দেশ, তারা ভগবান্ বুদ্ধের অনুগামী। যে ভগবান্ বুদ্ধ অহিংসাকে মূল মেনে চলে ছিলেন, আজ তার সব অনুগামী কিভাবে মাংসাহারী হয়ে গেছে? এর কারণ কি ছিল? হয়তো তারা ভেবেছিল যে অহিংসার ব্যবহার কেবল মানুষের জন্যই হয়, অন্য প্রাণীগুলো তো আমাদের ভোজন। এটা ভারী সুন্দর কথা যে জৈনরা আজ পর্যন্ত এমন হতে দেয়নি, তারা আজও অহিংসার প্রতি দৃঢ় হয়ে আছে, লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কেউ খায় তো সেটা আদালা বিষয় হবে। যখন প্রাণীমাত্রের প্রতি দয়া হয়, তখন আমাদের ভিতর থেকে দয়ার তরঙ্গ প্রবাহিত হয়, যা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান ঈর্ষা, ক্রোধ, হিংসার তরঙ্গকে শান্ত করতে সহায়ক হয়। যেমন - পজিটিভ চার্জকে নেগেটিভ চার্জ শান্ত করে দেয় আর দুটোই নিউট্রোল হয়ে যায়, ঠিক তেমনই হিংসা আর পীড়ার তরঙ্গকে প্রেম, করুণা ও দয়ার তরঙ্গ শান্ত করতে পারে, এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এইজন্য সন্ধ্যার মন্ত্রতে বলা হয়েছে -

য়োऽস্মান্দ্বেষ্টি য়ম্ বয়ম্ দ্বিষ্মস্তম্ বো জম্ভে দধ্মঃ।।
(অথর্ববেদ ৩.২৭.৩)
.
যারা আমার উপর ক্রোধ বা দ্বেষ করে কিংবা আমি যাদের উপর ক্রোধ বা দ্বেষ করি, সেগুলো শান্ত হোক। হে ঈশ্বর! সেগুলো আমি তোমার ন্যায়রূপী দণ্ডের জন্য সমর্পণ করছি। কসাইখানাকে দেখে মানুষের হৃদয় গলে যাবে, কিন্তু সম্ভবতঃ কিছু সময়ের জন্য, তবে বেশিরভাগ মানুষ বদলে যাবে। এমন কিছুজন আছে যারা মারতে আনন্দ অনুভব করে, তারা এতই ক্রূর হয় যে পশুকে হত্যা করবে আর সেটাও হালাল করে। পশুকে এমনভাবে হত্যা করবে যাতে অধিক থেকে অধিক কষ্ট সে পায়, একেই হালাল বলে। এমন ব্যক্তি অহিংসা ও দয়া শিখতেই পারবে না। তাদের শব্দকোষে দয়া নামক কোনো শব্দই নেই। যেমন ডাকাত কিছু অর্থের জন্য যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে।
.
কয়েক বছর আছে আমি দেখি যে জলপাইগুড়িতে রেল দুর্ঘটনা হয়েছিল, তাতে প্রায় ৪৭৫ জন ব্যক্তি মারা যায়। সেখানে কিছু ব্যক্তি, মরে যাওয়া মৃত দেহগুলোর পকেট হাতড়াচ্ছিল। তাদের উদ্দেশ্য এই ছিল না যে মৃত ব্যক্তিদের বের করবে, বরং তাদের উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে পকেট থেকে কিছু পাওয়া যাবে তো ঠিক আছে। কারও সোনার চেন নিয়েছে, কারও হাতের আংটি নিয়েছে, কারও মানিব্যাগ নিয়েছে। যারা এইসব কাজ করেছিল, তারা কি মানুষ ছিল? মানুষ সবথেকে ভয়ংকর হয়ে গেছে, অথচ পরমাত্মা মানুষকে সবথেকে ভালো বানিয়ে ছিল। কোনো প্রাণীই হিংসা করে না, বরং সে ভোজনের জন্য এমন করে। মাংসাহারী প্রাণীকে মাংস খাওয়ার জনই তৈরি করা হয়েছে, তাই তারা খিদে পেলে মেরে খাবেই। কিন্তু মানুষ অকারণে বা শত্রুতা করে মেরে ফেলে। আমরা এটা ভাবি যে সব প্রাণীর প্রতি দয়ার ভাবনা হোক অর্থাৎ সব প্রাণী সুখী হোক, প্রাণীদের মধ্যে সদ্ভাবনা হোক, কিন্তু সেই সদ্ভাবনার জন্য আমরা কি করি?
.
আজ ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দয়া নেই। এক ভাই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে আর আরেক ভাই ব্যবসার কোনো কাজে বাইরে যাচ্ছে, তো এমন অনেক হবে যে ব্যবসার কাজকে থামিয়ে রাখবে না, অসুস্থ ভাই মরে যায় তো যাক। মহানগরে যদি কোনো প্রতিবেশী মারা যায়, তাহলেও কারও কোনো দয়া বা সহানুভূতি হয় না। আজ সবথেকে বড় ধন (টাকা) হয়ে গেছে, সেই ধনের জন্য মানুষ তার সবকিছু সমর্পণ করে দিচ্ছে। ধনের কোনো ঠিক নেই কখন আর কোথায় চলে যাবে, কিন্তু যে ধনের পিছনে মানুষ ছুটছে, সেই ধনের দ্বারা তৃপ্তিও হয় না। নিরুক্তকারের অনুসারে যার দ্বারা তৃপ্ত হওয়া যায়, সেটা হল ধন। কেউ কি আজ পর্যন্ত এই ধন দ্বারা তৃপ্ত হয়েছে? কঠোপনিষদের কথন হল -

ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ অর্থাৎ বিত্ত দিয়ে কোনো তৃপ্ত হয় না।
.
যদি ভোজন করে তৃপ্তি না হয় অর্থাৎ খিদে না মিটে, তো ভোজন করে লাভ কি? কল্পনা করুন যে বারংবার খাচ্ছেন অথচ খিদেই মিটছে না, তাহলে সেটা কেমন ভোজন হবে? সেইরকম ধন এমন ভোজন হয়ে গেছে যার দ্বারা তৃপ্তিই হয় না, বস্তুতঃ সেটা ধন নয়, বরং নিধন। সেই ধনকে পাওয়ার জন্য দয়া, প্রেম, ভ্রাতৃত্ব, করুণা সবকিছু সমাপ্ত হয়ে গেছে।
.
আজ সম্পূর্ণ দেশ অর্থপ্রধান হয়েছে। এই শিক্ষা কোথাও দেওয়া হয় না যে দয়া করো, কারণ এটা পাঠ্যক্রমে নেই। এটা কারও বিষয় না, কারণ আমাদের দেশ হল ধর্মনিরপেক্ষ, যেখানে দয়া, করুণা, সত্য, প্রেম এসবের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই। যারা ধর্মনিরপেক্ষ বলছে, তারা জানেই না যে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিভাষা কি? ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ অধর্মের সাপেক্ষে বা ধর্মের প্রতি উদাসীন। তারা মজহব-গুলোকেই ধর্ম ভেবে নিয়েছে।
.
যদি আমরা সব প্রাণীর প্রতি দয়া করতে পারি, তাদের কিছু সহায়তা করতে পারি, তাহলে করার চেষ্টা করা উচিত আর যদি না করতে পারি, তাহলে মনের মধ্যে অবশ্যই করুণা জাগা উচিত যে আমি কারও দুঃখকে কিভাবে দূর করতে পারবো? কোনো দুঃখীকে দেখে যদি আমাদের হৃদয়ে কোনো দয়ার ভাবনা না আসে, কোনো রোগীকে দেখে সেবার ভাবনা না আসে, কোনো বস্ত্রহীনকে দেখে বস্ত্র দেওয়ার ভাবনা না আসে, কোনো ক্ষুধার্তকে দেখে ভোজন দেওয়ার ভাবনা না আসে, কাউকে মারা যেতে দেখে তার প্রাণ বাঁচানোর ভাবনা না আসে, তাহলে বুঝে নেওয়া উচিত যে আমরা মানুষ নই, বরং আমরা ভয়ংকর পশু হয়েগেছি। দেওয়ার জন্য ধন চাই, আমাদের কাছে ধন নেই, কিন্তু তাতে কি হয়েছে, হৃদয়ের মধ্যে তো অন্ততঃ এমন ভাবনা হওয়া উচিত যে যদি আমার কাছে ধন হতো তাহলে আমি সবার দুঃখ দূর করার চেষ্টা করতাম আর নির্ধনদের সহায়তা করতাম। সহায়তার মানে এই নয় যে এমনিভাবে সবাইকে বিতরণ করা, বরং তাদের পুরুষার্থের জন্য প্রেরিত করা উচিত। দয়া আমাদের ভিতরে শান্তি উৎপন্ন করে। পশু তার আত্মরক্ষার জন্য মারে আর নিজের আত্মরক্ষার জন্য মারার অধিকার সবার আছে।
.
🔴 প্রশ্ন - কোনো পশুর দ্বারা অন্য পশুকে মারা হলে তখন কি তরঙ্গ উঠবে না?
.
🔵 উত্তর - যে পশু মরবে, তার থেকে তরঙ্গ তো উঠবে, কারণ সেই পশুর পীড়া হবে। কিন্তু কোনো পশু এমনভাবে মারে যে সে দ্রুত মারা যায়। যেমন বাঘ সোজা গলায় কামড়ে ধরে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই পশুর পীড়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পীড়ার তরঙ্গ অবশ্যই উঠবে। কিন্তু বাঘের ভিতর থেকে ক্রোধের তরঙ্গ উঠবে না, কারণ সে ক্রোধ, অহংকার বা লোভবশতঃ মারছে না, বরং খিদে মেটানোর জন্য মারছে। তার পেট ভরে গেল সে কোনো পশুকে মারবে না। কিন্তু মানুষ ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা, অহংকার, শত্রুতাবশতঃ মারবে, তখন এদের তরঙ্গ সঙ্গে মিলে যাবে।
.
অহিংসার অর্থ হল - প্রাণীমাত্রের প্রতি দ্রোহ ত্যাগ অর্থাৎ সবার সঙ্গে প্রীতি করা। দয়া অহিংসার মধ্যে সমাহিত আছে এমন বলা যেতে পারে, কারণ সবার সঙ্গে প্রীতি হবে, তবেই দয়া হবে। কিন্তু আমাদের কারও সঙ্গে প্রীতি নেই, আমরা কারও সঙ্গে দেখাও করতে চাই না, কোনো সম্বন্ধও রাখি না, তবুও যদি কাউকে দুঃখী দেখি, তাহলে ভিতর থেকে করুণার ভাব এসে যাবে। যেমন আমরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর কোনো পশুকে দুঃখী দেখলাম, তো দয়া এসে গেল। সেইরকম প্রাণীমাত্রের প্রতি প্রীতির মধ্যেও এই ভাবনাই হবে। প্রীতি যদি না থাকে, তাহলে সত্য সত্য থাকবে না আর দয়া দয়া থাকবে না। প্রীতি অনিবার্য কারণ অহিংসা হল সবার মূল। "প্রীতি" শব্দটা খুব বিস্তৃত। কেউ দুঃখী নয় তবুও তার সঙ্গে প্রীতি করো, তবে দয়া দুঃখীর উপরই হয়।
.
য়োগদর্শনের মধ্যে লেখা আছে - "সুখীর সঙ্গে মিত্রতা করো, দুঃখীকে দেখে দয়ালু হও, সজ্জনদের দেখে প্রসন্ন হও আর দুষ্ট জনদের উপেক্ষা করো"। সংসারে ব্যবহার করার পদ্ধতি হল এটাই। দয়া দুঃখীর জন্য হয়, কিন্তু প্রীতি সবার জন্য হয়। ভগবান্ শিব ধর্মের যে তৃতীয় লক্ষণ বলেছেন, তার অনুসারে আমরা সব প্রাণীর প্রতি দয়ার ভাব জাগাবো আর সব মাংসাহারীদের বলবো যে তোমরা মাংস খেতে চাও, তাহলে স্বয়ং নিজে হাতে হত্যা করে মাংস খেয়ে দেখাও। চলুন, আমরাও এই তৃতীয় লক্ষণকে গ্রহণ করি আর দয়ালু হই। (ক্রমশঃ)
Read More

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩

ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩-এর সঠিক অর্থ ও গোমাংস ব্যাখ্যার খণ্ডন 🌼 ভুল ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ কিছু আধুনিক লেখক, বিশেষত পশ্চিমা দার্শনিক ও কিছু “বেদবির...

Post Top Ad

ধন্যবাদ