"বেদোহখিলো ধর্মমূলম্।"
(মনুস্মৃতি, ২/৬)
(মনুস্মৃতি, ২/৬)
অর্থাৎ— বেদ এই একমাত্র ধর্মের মূল। বেদ শব্দটি বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান। এ জ্ঞান কোন সাধারণ জ্ঞান নয়; এক অতীন্দ্রিয় অপৌরুষের জ্ঞান। ঝর্ণা ধারার মত স্নিগ্ধ এ জ্ঞান জীব কল্যাণে নেমে এসেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।পৃথিবী কীভাবে চলবে তার একটি নির্দেশিকাই বেদ। বেদ নৈমিত্তিক (প্রয়োজনার্থক) জ্ঞান।
সমগ্র আকাশে পশ্যন্তি মধ্যমা বেদ বানী ভরা আছে। মনস্তাত্ত্বিক এই ফ্লাকচুয়েশন বানী কম্পন্নরত অবস্থায় আকাশে নৃত্যের ন্যায় ছন্দায়িত হচ্ছে। আমাদের ঋতম্বরা প্রজ্ঞা লাভকারী সমাধিস্থ ঋষি তা শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় সহজে গ্রহন করে নিয়েছিলেন।
আজ আমাদের নিকট তাহা চারবেদ হিসাবে খ্যাত।
তাইতো ঋষি মনু বলেছেন, ‘বেদঃ অখিলধর্মমূলম্।বেদ অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্মের মূল। প্রায় একই কথা ধর্ম সূত্রকার ঋষি গৌতমও বলেছেন- ‘বেদঃ ধর্মমূলম্।’ বেদের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপে অবিহিত করা হয়েছে।
বেদের শব্দগুলির প্রকৃতি যৌগিক হবার কারণ~ শব্দকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়- যৌগিক,যোগরূঢ়ি,রূঢ়ি।যৌগিক শব্দ, প্রকৃতি প্রত্যয় থেকে তৈরি হয় যেমন পঠ্ ধাতু থেকে পাঠক বা লিখ্ ধাতু থেকে লেখক।যোগরূঢ়ি হলো সেইসব শব্দ, যেটা মূলতঃ যৌগিক কিন্তু কোন বিশেষ অর্থে রূঢ় হয়ে যায়। যেমন,জলজ শব্দের যৌগিক অর্থ হলো,"জলে যে জন্ম নেয়"। যেমন,পদ্ম, শ্যাওলা, অনেক প্রকারের পোকামাকড়,গাছ ইত্যাদি সবাই জলে জন্ম নেয়। কিন্তু,জলজ শব্দের যোগরূঢ় অর্থ হলো পদ্ম। কোন শব্দকে যোগরূঢ় হওয়ার জন্য কিছু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়।পরম্পরা যে কোন অর্থে শব্দকে কিছু সময়ে যোগরূঢ় করে দেয়।বেদে, যৌগিক শব্দ অনেক বেশি। যোগরূঢ় কম। শুদ্ধ রূঢ়,যেমন, মালা,সুতা,খড়ম ইত্যাদি প্রয়োগ কিছু সময় পরেই সম্ভব।সুতরাং, বেদে রূঢ়ি শব্দ নেই।
আদি ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ (VEDA) । এই বেদ (পুস্তক) কিন্তু কোনো একক ধর্মগ্রন্থ নয়। অনেকগুলো ধর্মগ্রন্থের সমষ্ঠি ।এর মধ্যে আছে চারটি সংহিতা ( ঋকঃ, যজুঃ, সামঃ ও অথর্ববেদ ), ব্রাহ্মণ, আরন্যক (অরণ্য ব্রহ্ম অর্থে ব্যবহৃত হয়,অরণ্য অর্থাৎ যা নিবিড়,গভীর,ব্রহ্মতত্ত্বও নিবিড় এবং দূরহগাহ্য। সেই অরণ্য অর্থাৎ ব্রহ্ম সম্বব্ধীয় জ্ঞান যে শাস্ত্রে আছে তাই আরণ্যক।)এবং উপনিষদ ।রচনাকালের দিক থেকে সংহিতা চারটিই সবার আগে রচিত।তারপর ব্রাহ্মণ এবং আরন্যক,আর তারপরে উপনিষদ।
“অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ”।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.১০)
সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ং প্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নি:শ্বাসস্বরূপ। যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহহীন আমরা চলতে পারবো না, আমাদের মানবসভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান।
“যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।”
------------------------ (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)
যুগান্তে প্রলয়কালে বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞান পুনরায় লাভ করেন।
অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় ‘সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ। যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি।
যুগান্তে প্রলয়কালে বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞান পুনরায় লাভ করেন।
অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় ‘সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ। যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি।
নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- স্বয়ম্ভূ অভ্যানর্ষত্তদূষীর্ণামৃষিত্মম্। (নিরুক্ত : ২.১)
তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যই তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মত ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়।
পরাশর সংহিতায় (১/২০) বলা হয়েছে-‘ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি’।
অর্থাৎঃ কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা।
দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি।
শতপথ ব্রাহ্মণ শ্লোক অনুসারে অগ্নি, বায়ু ও সূর্য (আদিত্য) তপস্যা করে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্বেদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রথম তিন বেদ অর্থাৎ ঋগ্বেদকে অগ্নি, যজুর্বেদকে বায়ু ও সামবেদকে সূর্য (আদিত্য) প্রকাশ করেন। শেষে ঝষি অঙ্গিরা অথর্ববেদ প্রকাশ করেন।
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর অগ্নি ঋষি, বায়ু ঋষি, আদিত্য ঋষি ও অঙ্গিরা ঋষির আত্মায় যথাক্রমে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ প্রকাশ করিয়েছেন।
ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদে সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’।
যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকিক ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’।
যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থ সচল এবং অথর্ব অর্থ অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
মহামতী বেদব্যাস বেদকে সংহত ও বিভক্ত করেন। সম্পূর্ন বেদকে একত্রিত করে সংহত করে প্রকাশ করা হয়েছে বলে বেদ কে সংহিতা বলা হয়। এই সংহিতা হল চার বেদ।চারি বেদের সংহিতা অংশ প্রধানত মন্ত্রাত্মক।("তেষামৃগ্ যত্রার্থবশেন পাদব্যবস্থা"মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৫) বেদের মন্ত্র ভাগ ঋক,সাম,যজুঃ ভেদে ত্রিবিধ। ঋক্ বেদ কাব্যময়,ছন্দো বা ছন্দোবদ্ধ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশিত। সামবেদ প্রধানতঃ ঋক বেদের মন্ত্র এবং অন্যকিছু মন্ত্র নিয়ে সঙ্গীতময়। আর ঋক ও সাম ভিন্ন বেদ হল যজুর্বেদ যা গদ্যাত্বক। মন্ত্রাত্মক এই দেদেরই যজ্ঞে প্রয়োগ ব্যবস্থিত। ই ত্রিবিধ বেদকে অবলম্বন করেই যজ্ঞ প্রতিষ্ঠত।এই জন্য বেদের আর এক নাম ত্রয়ী। অনেকের মত, অথর্ববেদের যজ্ঞে বব্যহারনা থাকায়তা বেদ পদবাচ্য নয়- এরূপমত প্রচলিত থাকলেও তা গ্রহনযোগ্য নয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে লেখা আছে "অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিমেতৎ ঋক্-বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্বাঙ্গিরসঃ"(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০)- অর্থাৎ এই সাকল বেদ সেই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। মীমাংসা সূত্র বলা হয়েছে "শেষে ব্রাহ্মণ শব্দঃ"(মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৩)- তাৎপর্য এই য, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ যে গুলিকে মন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন সেঘুলিই মন্ত্র। আর যার সাহায্যে মন্ত্রের বিনিয়োগ ইত্যাদি জানা যায়,সেই অংশই ব্রহ্মণ।
ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদে সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’।
যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকিক ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’।
যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থ সচল এবং অথর্ব অর্থ অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
মহামতী বেদব্যাস বেদকে সংহত ও বিভক্ত করেন। সম্পূর্ন বেদকে একত্রিত করে সংহত করে প্রকাশ করা হয়েছে বলে বেদ কে সংহিতা বলা হয়। এই সংহিতা হল চার বেদ।চারি বেদের সংহিতা অংশ প্রধানত মন্ত্রাত্মক।("তেষামৃগ্ যত্রার্থবশেন পাদব্যবস্থা"মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৫) বেদের মন্ত্র ভাগ ঋক,সাম,যজুঃ ভেদে ত্রিবিধ। ঋক্ বেদ কাব্যময়,ছন্দো বা ছন্দোবদ্ধ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশিত। সামবেদ প্রধানতঃ ঋক বেদের মন্ত্র এবং অন্যকিছু মন্ত্র নিয়ে সঙ্গীতময়। আর ঋক ও সাম ভিন্ন বেদ হল যজুর্বেদ যা গদ্যাত্বক। মন্ত্রাত্মক এই দেদেরই যজ্ঞে প্রয়োগ ব্যবস্থিত। ই ত্রিবিধ বেদকে অবলম্বন করেই যজ্ঞ প্রতিষ্ঠত।এই জন্য বেদের আর এক নাম ত্রয়ী। অনেকের মত, অথর্ববেদের যজ্ঞে বব্যহারনা থাকায়তা বেদ পদবাচ্য নয়- এরূপমত প্রচলিত থাকলেও তা গ্রহনযোগ্য নয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে লেখা আছে "অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিমেতৎ ঋক্-বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্বাঙ্গিরসঃ"(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০)- অর্থাৎ এই সাকল বেদ সেই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। মীমাংসা সূত্র বলা হয়েছে "শেষে ব্রাহ্মণ শব্দঃ"(মীমাংসাসূত্র ২/১/৩৩)- তাৎপর্য এই য, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ যে গুলিকে মন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন সেঘুলিই মন্ত্র। আর যার সাহায্যে মন্ত্রের বিনিয়োগ ইত্যাদি জানা যায়,সেই অংশই ব্রহ্মণ।
শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস।
বেদে 28000 পাণ্ডুলিপি রয়েছে আর এই পাণ্ডুলিপি মহারাষ্ট্রের পোনের অরিয়েন্টে রিচার্চ ইন্সটিটিউটে নিরাপদ কেন্দ্রের ভাণ্ডারে রাখা হয়েছে।ঋগ্বেবেদের 30 পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই ইউনেস্কো 1500 থেকে 1800 খৃষ্ঠাব্দের মধ্যে ঝগবেদের এই 30 পাণ্ডুলিপির তথ্য সংগ্রহ করে সাংস্কৃতিক তথ্য কেন্দ্রে রাখে।
পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী👇
বেদ আর্য্য জাতির ধর্ম্মগ্রন্থ এবং সমগ্র মানবের আদি জ্ঞান ভাণ্ডার। জগতের যাবতীয় ধর্ম বেদ হইতেই জন্মলাভ করিয়াছে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষা বৈদিক ভাষা হইতেই নিঃসৃত। পৃথিবীর যে কোনও মানব তাহার শিক্ষা সভ্যতা ও ভাষার ইতিহাস পাঠ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে বেদের শরণাপন্ন হইতে হয়।
বেদের মধ্যে যে অক্ষর জ্ঞান সম্পদ স্তূপীকৃত রহিয়াছে তাহা আহরণের জন্য যুগে যুগে সব দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা আমরণ পরিশ্রম করিয়াছেন। সে পরিশ্রম এখনও শেষ হয় নাই। পৃথিবীর নানা জাতি নানা ভাষায় ও নানা ভাবে আজও বেদের গবেষণা করিতেছে। বেদের উপর পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধা থাকিলেও সকলে বেদকে একভাবে দেখেন না। যাঁহারা বেদ-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিতে পারি। একদল বেদকে “পৌরুষেয়”, দ্বিতীয় দল “আর্ষ”, তৃতীয় দল “ঈশ্বরীয়” এবং চতুর্থ দল “অপৌরুষেয়” বলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বেদকে পৌরুষেয়’ বলেন। তাঁহাদের মতে বেদ মানবের রচনা মনে করিয়াই তাঁহারা বেদকে পুরুষ বিশেষের রচিত বা “পৌরুষেয়” বলেন। বেদ তাঁহাদের মতে মানব মস্তিষ্কের চরম উৎকর্ষ। ঋষিদিগকেই তাঁহারা বেদ মন্ত্রের রচয়িতা ও উপদেষ্টা মনে করেন। বেদ মানব জাতির গ্রন্থ ভাণ্ডারে প্রাচীনতম গ্রন্থ ইহা তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। বেদকে কেন্দ্র করিয়াই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাঁহারা এই সব সাহিত্য রাজির মধ্য হইতে প্রাচীন আর্য জাতির ইতিহাস উদ্ধার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছেন। প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক বৃত্তান্তও তাঁহারা বেদ হইতেই উদ্ধার করিতে প্রায়াস পাইয়াছে। পৌরুষেয়বাদী এই সব দেশী ও বিদেশী পণ্ডিত বেদকে উপাদেয় গ্রন্থ ও গবেষণার ক্ষেত্র মনে করয়িা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেছেন।
দ্বিতীয় পক্ষ বেদকে “আর্ষ” বলেন। প্রাচীনকাল হইতেই ইহারা ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন যে, বেদ ঋষি প্রণীত। স্বচ্ছ-হৃদয়, সত্যাচারী শুদ্ধাত্মা ঋষিরা পুণ্যবলে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ের যে সাক্ষাৎ জ্ঞান দর্শন করিয়াছিলেন, ইহাই বেদ মন্ত্রের সমষ্টি। ইঁহাদের মতে বেদের বিষয়ীভূত জ্ঞান সর্বদাই একরস থাকে। কল্প কল্পান্তরেও এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয় না। এই জ্ঞান মানব জাতির উন্নতির চির সহায়। এক কথায় আর্ষবাদীরা বেদ মন্ত্রের ভাষাকে ঋষিদের নিজস্ব মনে করেন, কিন্তু বেদমন্ত্রের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নিজস্ব মনে করেন। তাঁহাদের মতে বেদান্তর্গত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তির নিয়ম অপৌরুষেয় বা ঈশ্বরীয়। পরমেশ্বর বেদকে উৎপন্ন করিয়াছেন এবং ইহা ঋষিদের ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। পৌরুষেয় ও আর্ষ পক্ষ উভয়েরই মতেই বেদমন্ত্র একসঙ্গে রচিত হয় নাই। বেদ মন্ত্র রচনা করিতে ঋষিদের কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হইয়াছে। আর্ষবাদী মতে উপনিষদ রচিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিদের যুগ শেষ হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদের মধ্যে কল্পিত উপাখ্যানও আছে। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজের বলিয়াই তাঁহারা ইহাকে ‘আর্ষ’ বলিয়া থাকেন।
তৃতীয় পক্ষ বেদকে “ঈশ্বরীয়” বলেন। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রথমে স্বচ্ছ হৃদয় মানবের হৃদয়ে ঈশ্বর বেদবাণীর প্রেরণা দান করেন। যে সব মানবের আত্মা পূর্ব সৃষ্টিতে শুভকর্ম দ্বারা শুদ্ধ থাকে তাঁহাদের হৃদয়ই বেদবাণীর প্রেরণা লাভ করে। ঈশ্বরীয় পক্ষ বলেন –চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গলোকাদি যেমন পূর্ব কল্পের অনুযায়ী, যেমন এ কল্পে রচিত হইয়াছে তেমন পূর্ব পূর্ব কল্পে বেদ যেভাবে প্রকট হইয়াছিল এ কল্পেও সেই ভাবেই প্রকট হইয়াছে। ইহাদের মতে বেদের মন্ত্র, ভাষ্য ও অর্থ প্রত্যেক কল্পে একরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। আর্ষপক্ষ জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন আর ঈশ্বরীয় পক্ষ ভাষা, শব্দ, মন্ত্র ও জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, - কল্পের প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদ অর্পিত হইয়াছিল এবং ব্রহ্মার নিকট হইতে শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। কাহারও মতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এই চারিজন ঋষির হৃদয়ে চারি বেদ অর্পিত হইয়াছিল। এই চারিজন ঋষি হইতেই শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবজাতির মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদ ‘ঈশ্বরীয়’ ও নিত্য। কল্পের প্রারম্ভে ঋষিরা ইহার প্রকাশ করিয়াছিলেন। বেদ ঋষিদের নিজস্ব বস্তু নয়, তাঁহারা বেদের রচয়িতা নহেন তাঁহারা বেদের দ্রষ্টা। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন এই ঈশ্বরীয় পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। উত্তর মীমাংসার মতে বেদ দিব্যবাক্।
চতুর্থ পক্ষ বেদকে “অপৌরুষেয়” বলেন। ইঁহারা বেদের উৎপত্তি স্বীকার করেন না; অভিব্যাক্তি স্বীকার করেন। মীমাংসা দর্শনকার জৈমিনীর মতে শব্দ নিত্য। নিত্য পদার্থ অপরিণামী ও প্রবাহ ভেদে দ্বিবিধ। যাহার স্বরূপ বা গুণের কোনই পরিবর্তন হয় না তাহা ‘অপরিণামী-নিত্য’ এবং যাহা নানা রূপান্তরের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে তাহা ‘প্রবাহ-নিত্য’। পরমাত্মা অপরিণামী-নিত্য। তিনি সর্বদাই এক রস থাকেন কিন্তু প্রকৃতি প্রবাহ-নিত্য। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের চক্র প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয় কিন্তু কারণ রূপে ইহা নিত্য। বেদ শব্দময়। মহর্ষি জৈমিনি শব্দকে নিত্য বলিয়াছেন। অ-আ-ক-খ প্রভৃতি বর্ণের উৎপত্তি হয় না। ইহার অভিব্যক্তি হয়। স্বর্ণ হইতে অলঙ্কারের উৎপত্তি হয় কারণ অলংকার পূর্বে ছিল না। অন্ধকার গৃহে প্রদীপের সাহায্যে অলঙ্কার দৃষ্ট হয় এখানে অলঙ্কারের অস্তিত্ব পূর্বেই ছিল, তবে তাহার মাত্র অভিব্যক্তি হইল। কোনও বস্তুর অভিব্যক্তির পূর্বে তাহার উৎপত্তি হয়, উৎপত্তির পূর্বে অভিব্যক্তি হয় না। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতিকে অক্ষর বলে, কেননা ইহাদের ক্ষরণ বা ধংস হয় না। অক্ষর জগতের প্রত্যেক স্থানেই বর্ত্তমান রহিয়াছে। কন্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থান অক্ষরকে উৎপাদন করে না, ব্যক্ত করে মাত্র। অক্ষর সমস্টি মিলিত হইয়া পদ ও শব্দসমষ্টি। ইহারা কোন অর্থ প্রকাশ করিতে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে অক্ষর বা বর্ণ কোন পুরুষ বিশেষের রচিত নয় বলিয়া অপৌরুষেয়। বর্ণ অপৌরুষেয় হইলেও বিভিন্ন অর্থের সংকেত অনুসারে ইহার মিলিত হইয়া পদ গঠন করে এবং বিভিন্ন পদও অর্থের সংকেতানুসারে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে। মনুষ্যকৃত গ্রন্থে এই সব বর্ণ ও বাক্যের সাহায্যে অর্থের সংকেত প্রকাশ করা হইয়াছে। বেদ ও মনুষ্যকত গ্রন্থে পার্থক্য এই স্থানে যে মনুষ্যকৃত গ্রন্থের বর্ণ বা অক্ষর অপৌরুষেয় হইলেও পদ বা বাক্য সমষ্টি পৌরুষেয়। কিন্তু বেদের পদ, শব্দার্থ, বাক্য বাক্যার্থ সবই অপৌরুষেয়। বেদমন্ত্রকে কোন পুরুষ বিশেষ রচনা করে নাই। ইহা নির্দিষ্ট আকারে অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ঋষিরা নিজের তপোবলে এই নিত্য বেদকে দর্শন করেন ও তাহাকে অভিব্যক্ত করেন। বেদমন্ত্রের অর্থকেও তাঁহারা দর্শন করেন। বেদ শব্দার্থ সন্বন্ধযুক্ত হইয়াই অনাদিরূপে অবস্থান করে। ঋষিরা যুগে যুগে ইহা প্রকাশ করেন। জৈমিনি শব্দের নিত্যতা প্রমাণ করিয়াই বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন এবং শব্দের অনিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।
পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী👇
বেদ আর্য্য জাতির ধর্ম্মগ্রন্থ এবং সমগ্র মানবের আদি জ্ঞান ভাণ্ডার। জগতের যাবতীয় ধর্ম বেদ হইতেই জন্মলাভ করিয়াছে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষা বৈদিক ভাষা হইতেই নিঃসৃত। পৃথিবীর যে কোনও মানব তাহার শিক্ষা সভ্যতা ও ভাষার ইতিহাস পাঠ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে বেদের শরণাপন্ন হইতে হয়।
বেদের মধ্যে যে অক্ষর জ্ঞান সম্পদ স্তূপীকৃত রহিয়াছে তাহা আহরণের জন্য যুগে যুগে সব দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা আমরণ পরিশ্রম করিয়াছেন। সে পরিশ্রম এখনও শেষ হয় নাই। পৃথিবীর নানা জাতি নানা ভাষায় ও নানা ভাবে আজও বেদের গবেষণা করিতেছে। বেদের উপর পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধা থাকিলেও সকলে বেদকে একভাবে দেখেন না। যাঁহারা বেদ-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিতে পারি। একদল বেদকে “পৌরুষেয়”, দ্বিতীয় দল “আর্ষ”, তৃতীয় দল “ঈশ্বরীয়” এবং চতুর্থ দল “অপৌরুষেয়” বলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বেদকে পৌরুষেয়’ বলেন। তাঁহাদের মতে বেদ মানবের রচনা মনে করিয়াই তাঁহারা বেদকে পুরুষ বিশেষের রচিত বা “পৌরুষেয়” বলেন। বেদ তাঁহাদের মতে মানব মস্তিষ্কের চরম উৎকর্ষ। ঋষিদিগকেই তাঁহারা বেদ মন্ত্রের রচয়িতা ও উপদেষ্টা মনে করেন। বেদ মানব জাতির গ্রন্থ ভাণ্ডারে প্রাচীনতম গ্রন্থ ইহা তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। বেদকে কেন্দ্র করিয়াই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাঁহারা এই সব সাহিত্য রাজির মধ্য হইতে প্রাচীন আর্য জাতির ইতিহাস উদ্ধার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছেন। প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক বৃত্তান্তও তাঁহারা বেদ হইতেই উদ্ধার করিতে প্রায়াস পাইয়াছে। পৌরুষেয়বাদী এই সব দেশী ও বিদেশী পণ্ডিত বেদকে উপাদেয় গ্রন্থ ও গবেষণার ক্ষেত্র মনে করয়িা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেছেন।
দ্বিতীয় পক্ষ বেদকে “আর্ষ” বলেন। প্রাচীনকাল হইতেই ইহারা ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন যে, বেদ ঋষি প্রণীত। স্বচ্ছ-হৃদয়, সত্যাচারী শুদ্ধাত্মা ঋষিরা পুণ্যবলে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ের যে সাক্ষাৎ জ্ঞান দর্শন করিয়াছিলেন, ইহাই বেদ মন্ত্রের সমষ্টি। ইঁহাদের মতে বেদের বিষয়ীভূত জ্ঞান সর্বদাই একরস থাকে। কল্প কল্পান্তরেও এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয় না। এই জ্ঞান মানব জাতির উন্নতির চির সহায়। এক কথায় আর্ষবাদীরা বেদ মন্ত্রের ভাষাকে ঋষিদের নিজস্ব মনে করেন, কিন্তু বেদমন্ত্রের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নিজস্ব মনে করেন। তাঁহাদের মতে বেদান্তর্গত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তির নিয়ম অপৌরুষেয় বা ঈশ্বরীয়। পরমেশ্বর বেদকে উৎপন্ন করিয়াছেন এবং ইহা ঋষিদের ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। পৌরুষেয় ও আর্ষ পক্ষ উভয়েরই মতেই বেদমন্ত্র একসঙ্গে রচিত হয় নাই। বেদ মন্ত্র রচনা করিতে ঋষিদের কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হইয়াছে। আর্ষবাদী মতে উপনিষদ রচিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিদের যুগ শেষ হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদের মধ্যে কল্পিত উপাখ্যানও আছে। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজের বলিয়াই তাঁহারা ইহাকে ‘আর্ষ’ বলিয়া থাকেন।
তৃতীয় পক্ষ বেদকে “ঈশ্বরীয়” বলেন। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রথমে স্বচ্ছ হৃদয় মানবের হৃদয়ে ঈশ্বর বেদবাণীর প্রেরণা দান করেন। যে সব মানবের আত্মা পূর্ব সৃষ্টিতে শুভকর্ম দ্বারা শুদ্ধ থাকে তাঁহাদের হৃদয়ই বেদবাণীর প্রেরণা লাভ করে। ঈশ্বরীয় পক্ষ বলেন –চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গলোকাদি যেমন পূর্ব কল্পের অনুযায়ী, যেমন এ কল্পে রচিত হইয়াছে তেমন পূর্ব পূর্ব কল্পে বেদ যেভাবে প্রকট হইয়াছিল এ কল্পেও সেই ভাবেই প্রকট হইয়াছে। ইহাদের মতে বেদের মন্ত্র, ভাষ্য ও অর্থ প্রত্যেক কল্পে একরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। আর্ষপক্ষ জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন আর ঈশ্বরীয় পক্ষ ভাষা, শব্দ, মন্ত্র ও জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, - কল্পের প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদ অর্পিত হইয়াছিল এবং ব্রহ্মার নিকট হইতে শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। কাহারও মতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এই চারিজন ঋষির হৃদয়ে চারি বেদ অর্পিত হইয়াছিল। এই চারিজন ঋষি হইতেই শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবজাতির মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদ ‘ঈশ্বরীয়’ ও নিত্য। কল্পের প্রারম্ভে ঋষিরা ইহার প্রকাশ করিয়াছিলেন। বেদ ঋষিদের নিজস্ব বস্তু নয়, তাঁহারা বেদের রচয়িতা নহেন তাঁহারা বেদের দ্রষ্টা। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন এই ঈশ্বরীয় পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। উত্তর মীমাংসার মতে বেদ দিব্যবাক্।
চতুর্থ পক্ষ বেদকে “অপৌরুষেয়” বলেন। ইঁহারা বেদের উৎপত্তি স্বীকার করেন না; অভিব্যাক্তি স্বীকার করেন। মীমাংসা দর্শনকার জৈমিনীর মতে শব্দ নিত্য। নিত্য পদার্থ অপরিণামী ও প্রবাহ ভেদে দ্বিবিধ। যাহার স্বরূপ বা গুণের কোনই পরিবর্তন হয় না তাহা ‘অপরিণামী-নিত্য’ এবং যাহা নানা রূপান্তরের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে তাহা ‘প্রবাহ-নিত্য’। পরমাত্মা অপরিণামী-নিত্য। তিনি সর্বদাই এক রস থাকেন কিন্তু প্রকৃতি প্রবাহ-নিত্য। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের চক্র প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয় কিন্তু কারণ রূপে ইহা নিত্য। বেদ শব্দময়। মহর্ষি জৈমিনি শব্দকে নিত্য বলিয়াছেন। অ-আ-ক-খ প্রভৃতি বর্ণের উৎপত্তি হয় না। ইহার অভিব্যক্তি হয়। স্বর্ণ হইতে অলঙ্কারের উৎপত্তি হয় কারণ অলংকার পূর্বে ছিল না। অন্ধকার গৃহে প্রদীপের সাহায্যে অলঙ্কার দৃষ্ট হয় এখানে অলঙ্কারের অস্তিত্ব পূর্বেই ছিল, তবে তাহার মাত্র অভিব্যক্তি হইল। কোনও বস্তুর অভিব্যক্তির পূর্বে তাহার উৎপত্তি হয়, উৎপত্তির পূর্বে অভিব্যক্তি হয় না। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতিকে অক্ষর বলে, কেননা ইহাদের ক্ষরণ বা ধংস হয় না। অক্ষর জগতের প্রত্যেক স্থানেই বর্ত্তমান রহিয়াছে। কন্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থান অক্ষরকে উৎপাদন করে না, ব্যক্ত করে মাত্র। অক্ষর সমস্টি মিলিত হইয়া পদ ও শব্দসমষ্টি। ইহারা কোন অর্থ প্রকাশ করিতে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে অক্ষর বা বর্ণ কোন পুরুষ বিশেষের রচিত নয় বলিয়া অপৌরুষেয়। বর্ণ অপৌরুষেয় হইলেও বিভিন্ন অর্থের সংকেত অনুসারে ইহার মিলিত হইয়া পদ গঠন করে এবং বিভিন্ন পদও অর্থের সংকেতানুসারে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে। মনুষ্যকৃত গ্রন্থে এই সব বর্ণ ও বাক্যের সাহায্যে অর্থের সংকেত প্রকাশ করা হইয়াছে। বেদ ও মনুষ্যকত গ্রন্থে পার্থক্য এই স্থানে যে মনুষ্যকৃত গ্রন্থের বর্ণ বা অক্ষর অপৌরুষেয় হইলেও পদ বা বাক্য সমষ্টি পৌরুষেয়। কিন্তু বেদের পদ, শব্দার্থ, বাক্য বাক্যার্থ সবই অপৌরুষেয়। বেদমন্ত্রকে কোন পুরুষ বিশেষ রচনা করে নাই। ইহা নির্দিষ্ট আকারে অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ঋষিরা নিজের তপোবলে এই নিত্য বেদকে দর্শন করেন ও তাহাকে অভিব্যক্ত করেন। বেদমন্ত্রের অর্থকেও তাঁহারা দর্শন করেন। বেদ শব্দার্থ সন্বন্ধযুক্ত হইয়াই অনাদিরূপে অবস্থান করে। ঋষিরা যুগে যুগে ইহা প্রকাশ করেন। জৈমিনি শব্দের নিত্যতা প্রমাণ করিয়াই বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন এবং শব্দের অনিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।
ঋগ্বেদে এক একটি মন্ত্রের নাম 'ঋক'। কয়েকটি ঋক্ দ্বারা কোন দেবতার যে একটি স্তুতি রচিত হয়, তার নাম 'সূক্ত'। অনেক গুলি সূক্ত দ্বারা একটি 'মন্ডল' গঠিত হয়। এইরূপ ১০মন্ডলে ৮৫ অনুবাক ও ১০১৮ সূক্তে সম্পূর্ণ হইয়াছে।
ঋগ্বেদের বেদের দেবতা ও ঋষিশব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘শব্দ স্বয়ং উৎপন্ন হয় না, কণ্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতির প্রযত্ন দ্বারা ইহা উৎপন্ন হয়; শব্দ এক প্রকারের উচ্চারণ ক্রিয়া। উচ্চারণের সহিত স্বল্প সময়ের জন্য শব্দ প্রত্যক্ষ হয়। ইহা প্রথমে অনুৎপন্ন ছিল, উচ্চারণের সময় স্বল্প সময়ের জন্য ইহার স্থিতি হয় এবং উচ্চারণের পরেই ইহার ধ্বংস হয়। অতএব যাহা উৎপন্ন তাহা নিত্য নহে। শব্দের নিত্যতাবাদীরা ইহার উত্তরে বলেন, উচ্চারণের পূর্বে শব্দের অস্তিত্ব আছে; ইহা নিরাকার, নিত্য ও অব্যক্তরূপে আছে। উচ্চারণ করিলে ইহা উৎপন্ন হয় না, শুধু ব্যক্ত হয় মাত্র। উচ্চারণের পর ইহার ধ্বংস হয় না শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়র অগোচর হয় মাত্র। উচ্চারিত হইলে ইহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় এবং শব্দকারীর সহিত ইহার কোন সন্বন্ধ থাকে না। আজ একটা শব্দ শ্রুতি গোচর হইয়া জ্ঞান প্রকাশ করিল, বহুদিন পরও শব্দটী জ্ঞান প্রকাশ করিবে। ইহাতেই শব্দের নিত্যতা সিদ্ধ হয়।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন-‘রাম শব্দ করিল, যদু শব্দ করিবে’ ইত্যাদি বাক্যে শব্দের কর্তা রাম ও যদুকেই বুঝায়। যখন শব্দ কোন ব্যক্তি কর্তৃক উৎপন্ন কার্য, তখন তাহার নিত্যতা হইতে পারে না’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘রাম ও যদু শব্দের নির্মাতা নহে, শব্দের উচ্চারণ কর্তা মাত্র। কেহই শব্দকে উৎপন্ন করিতে বলে না, উচ্চারণ করিতেই বলে। উৎপন্ন পদার্থের উপাদান কারণের প্রয়োজন হয় কিন্তু শব্দ উৎপাদনের জন্য উপাদান কারণ পাওয়া দুষ্কর। বায়ু শব্দের উপাদান কারণ নয়। বায়ু সাহায্য করে মাত্র। বায়ু শব্দকে বহন করে। ধ্বনি ও শব্দের পার্থক্য সকলেই মানিয়া থাকেন।
শব্দের অনিত্যবাদীরা বলেন –‘এক সঙ্গে বহু লোকে মিলিয়া শব্দ করিলে তাহার বৃদ্ধি হয় এবং অল্প লোক, বালক বা রোগী উচ্চারণ করিলে তাহা হ্রাস হয়, শব্দ নিত্য হইলে তাহাতে হ্রাস বৃদ্ধি হইতে পারে না’। নিত্যতাবাদীরা বলেন- ‘বহুজনে মিলিয়া শব্দ করিলে শুধু ধ্বনি বৃদ্ধি পায়, শব্দ বৃদ্ধি পায় না। ধ্বনির হ্রাস বৃদ্ধিতে শব্দের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে না’।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর হ্রাস বৃদ্ধি হয় না কিন্তু ব্যাকরণ গ্রন্থে দেখি শব্দের বিকৃতি, রূপান্তর ও হ্রাস বৃদ্ধি হয়।’ শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন-‘ব্যাকরণ গ্রন্থে যে, ‘ই’ স্থানে ‘য’ হয় বা ‘উ’ স্থানে ‘ব’ হয় ইহা আকৃতির বিকৃতি ভাব নহে এখানে দুটী বর্ণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক।’
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘বহু সময় বহু স্থানে বহু লোক একই শব্দের উচ্চারণ করে। শব্দ নিত্য হইলে এইরূপ ঘটিত না।’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর ইহাও একটি লক্ষণ। একই পরমাত্মাকে বহু স্থানে বহু ব্যক্তি অনুভব করিতে পারে। ইহাতে নিত্যত্ব খণ্ডিত হয় না, সিদ্ধ হয়।’
চারিবেদ
পরমাত্মা যেমন নিত্য তাঁহার জ্ঞান এই বেদও নিত্য। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যা জানিবার জন্য একই বেদ চারিভাগে বিভক্ত হইয়াছে-ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি, বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদের সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’। যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকি ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’। যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থে সচল এবং অথর্ব অর্থে অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
বেদের আয়তন ও মন্ত্রসংখ্যা
ঋগ্বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ১০৫৮৯। সমস্ত ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডলে, ৮৫ অনুবাকে ও ১০১৮ সূক্তে বিভক্ত। ঋগ্বেদকে অন্য ভাবেও বিভাগ করা হইয়াছে। যেমন-অষ্টক ৮, অধ্যায় ৬৪ ও বর্গ ১০২৪। যজুর্বেদের মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৯৭৫ এবং সাম বেদের মন্ত্রসংখ্যা ১৮৯৩। সামবেদ ৩ ভাগে বিভক্ত, যথা পূর্বার্চিক, মহানাম্নীআর্চিক ও উত্তরার্চিক। মহানাম্নী আর্চিককে পূর্বার্চিকের মধ্যেই ধরা হয়। পূর্বার্চিক ৪ কাণ্ডে বিভক্ত, ৪ কাণ্ড ৬ প্রপাঠক বা ৫ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রপাঠক অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চিক ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক। এই প্রপাঠকগুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে, দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে। অথর্ব্ব বেদের মন্ত্রসংখ্যা ৫৯৭৭। অথর্ববেদে ২০ কাণ্ড। এই কাণ্ডগুলি ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত। ইহাতে ১১১ অনুবাক্, ৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত। সমগ্র বেদে মোট মন্ত্রসংখ্যা ২০৪৩৪।
-পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী
ভিন্ন মত *বেদ মন্ত্র সংখ্যা ২০৩৭৯*
ঋগ্বেদের মন্ত্র সংখ্যা- ১০,৫৫২ জ্ঞান কান্ড (১০ মন্ডল ৮৫ অনুবাক ও ১০২৮ সূক্তে বিভক্ত)
যজুর্বেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৯৭৫ কর্ম্মকান্ড (৪০ অধ্যায় ৩০৩ অনুবাকে বিভক্ত)
সামবেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৮৭৫ উপাসনা কান্ড (৩ ভাগে বিভক্ত-পূর্বাচ্চিক,মহানাম্নী আর্চ্চিক ও উত্তরার্চ্চিক *মহানাম্নীকে পূর্বাচ্চিকের মধ্যেও ধরা হয়। পূর্বাচ্চিক ৪ কান্ডে বিভক্ত,৪ কান্ড ৬ প্রপাঠকে বিভক্ত,প্রপাঠক গুলি অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চ্চিকে ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক, এই প্রপাঠক গুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে,দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে)
অথর্ববেদের মন্ত্র সংখ্যা-৫,৯৭৭ বিজ্ঞান (২০কান্ড ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত, ১১১ অনুবাক,৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত)
মন্ত্রের ঋষি, দেবতা, ছন্দ
বেদের মন্ত্রগুলি গদ্য, পদ্য ও গানে প্রকাশিত। যজুঃ গদ্যে, ঋক্ পদ্যে, এবং সাম গানে প্রকাশিত – এজন্য বেদের আর এক নাম ‘ত্রয়ী’। প্রত্যেকটি মন্ত্রের সহিত ঋষি, দেবতা, ছন্দ এবং স্বর উল্লেখিত হয়। যে যে ঋষি যে যে মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করিয়া মানব জাতির মহা উপকার সাধন করিয়াছেন, সেই সেই ঋষির নাম, সেই সেই মন্ত্রের সহিত স্মরণ করা হয়। ঋষিগণ মন্ত্রের রচয়িতা ছিলেন না, তাঁহারা ছিলেন মন্ত্রের দ্রষ্টা। মন্ত্রগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, বর্ণিত হইয়াছে। যে মন্ত্রের যেটি মুখ্য বিষয় সে মন্ত্রের সেইটিই দেবতা। মন্ত্রের বর্ণিত বিষয়কে দেবতা বলে। মন্ত্রের সহিত দেবতার উল্লেখ থাকায় দৃষ্টি মাত্রেই মন্ত্রের মূখ্য বিষয়টি উপলদ্ধি হয়।
আমরা সবাই জানি যে, বেদ চারটি যথাঃ ঋগবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ। কিন্তু অনেক স্থলে দেখা যায় যে, বেদকে ত্রয়ী বলা হয়েছে।
যেমনঃ মনুস্মৃতি -ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীংবিদ্যাৎ"-(মনুস্মৃতি:৭/৪৩), "ত্রৈবিদ্যা মাংসোমপাঃ পূতপাপা"(গীতা:৯/২০), "ত্রয়ী বৈ বিদ্যা"-(শতপথব্রাহ্মণ : ৪/৬/৭/১) ইত্যাদি ।
অনেক পন্ডিতের ধারণা এরূপ যে, পূর্বে বেদ তিনটিই ছিলো এজন্য বেদকে ত্রয়ী বলা হতো। এবং পরবর্তীতে অথর্ববেদ সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু তাদের এই ধারণা বৈদিক পরম্পরা বিরুদ্ধ। বেদ যে চারটিই ছিলো তার বহু প্রমাণ সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় -
তত্রাপরা ঋগ্বেদোযজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং।
নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।।
(মুন্ডকোপনিষদ ১।১।৫)
অপরা বিদ্যা - ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যকরন, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। পরা বিদ্যা - যা দ্বারা অক্ষর ব্রহ্মকে জানা যায়।
"ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্বাঙ্গিরসঃ"- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ: ২/৪/১০)
শুধুমাত্র উপনিষদ নয়। এমনকি বেদেও চতুর্বেদের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে -
তস্মাৎ যজ্ঞাত্ সর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাৎ যজুস্তস্মাদজায়ত।।
(ঋঃ ১০।৯০।৯, যজুঃ ৩১।৭, অথর্বঃ ১৯।৬।১৩)
=>>সেই পূজনীয় এবং সবার গ্রহনযোগ্য পরমেশ্বর হতে ঋগ্বেদ (পদার্থের গুণ প্রকাশক বিদ্যা) সামবেদ (মোক্ষ বিদ্যা) উৎপন্ন হয়েছে। তাহা থেকেই অথর্ববেদ (আনন্দদায়ক বিদ্যা) উৎপন্ন হয়েছে এবং তাহা থেকেই যজুর্বেদ (সৎকর্মের জ্ঞান) উৎপন্ন হয়েছে।
বেদের অন্যান্য মন্ত্রেও ঋক, সাম, যজুর সাথে অথর্ববেদের নাম এসেছে -
যস্মাদৃচো অপাতক্ষ্যন্যজুর্যস্মাদপাকষন্।
সামানি যস্য লোমান্যথর্বাঙ্গিরসো মুখং স্কম্ভং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
(অথর্ববেদ ১০।৭।২০)
=>>সরলার্থঃ যাহা থেকে ঋকমন্ত্র তৈরী হয়েছে যাহা থেকে যজুমন্ত্র নির্মিত হয়েছে। সামমন্ত্র যাহার লোমতূল্য অথর্বমন্ত্র যাহার মুখ, তিনি কে নিশ্চরূপে? তাহাকে সর্বাধার পরমেশ্বর বলো।। ২০।।
উপরে স্পষ্ট হয়েছে যে, ঈশ্বরকৃত চার বেদের মধ্যে অথর্ব এক বেদ। তাহার নাম ছন্দ (ছন্দাংসি), অথর্বাঙ্গিরা (অথর্বাঙ্গিরসঃ)। এই শব্দগুলোর অর্থ এই প্রকার যে,
(i) অথর্ববেদ - ইহা অথর্ব [অথর্বন্] এবং বেদ এই দুই শব্দের সমুদায়ে গঠিত। থর্ব ধাতুর অর্থ চলা এবং অথর্বের অর্থ নিশ্চল, এবং বেদের অর্থ জ্ঞান, অর্থাৎ অথর্ব, নিশ্চল, যিনি একরস সর্বব্যাপক পরমব্রহ্ম, তাহার জ্ঞান অথর্ববেদ। (অথর্বাণোথনবন্তস্থর্বনিশ্চরতিকর্মা তৎপ্রতিষেধঃ, নিরুক্ত ১১।১৮)
(ii) ছন্দ - ইহার অর্থ আনন্দদায়ক, অর্থাৎ তাহার মধ্যে আনন্দদায়ক পদার্থের বর্ণনা রয়েছে। (চান্দেরাদেশ্চ ছঃ। উঃ৪।২১৯। ইতি চদু আহ্লাদে- অসুন, চস্য ছঃ। চন্দয়তি আহ্লাদয়তীতি ছন্দঃ।।
(iii) অথর্বাঙ্গিরা - এই পদের অর্থ এই যে, তাহার মধ্যে অথর্ব, নিশ্চল পরমব্রহ্ম বোধক অঙ্গিরা অর্থাৎ জ্ঞানের মন্ত্র রয়েছে। (অঙ্গঃতেরসিরিরুঙাগমশ্চ। উঃ ৪।২২৬। ইতি অহি গতৌ- অসি, ইরুট আগম্। অঙ্গতি গচ্ছতি প্রাপ্নোতি জাতগ্নি বা পরব্রহ্ম যেনেতি অঙ্গিরা, বেদঃ। অথর্বণোহঙ্গিরসোহথর্বাঙ্গিরসঃ।।)
এখন তবে প্রশ্ন এই যে, বেদ যখন চারটিই তবে তাকে ত্রয়ী কেন বলা হয়? মূলত ত্রয়ী শব্দ বেদ চারটি বা তিনটির কারণে হয় নি। মূলত চার বেদের মধ্যে তিন প্রকার মন্ত্রের কারণেই বেদকে ত্রয়ী বলা হয়েছে।
পূর্ব মিমাংসায় স্পষ্ট হয়েছে যে,
তেষাং ঋগ যত্রার্থবশেন পাদ ব্যবস্থা।
গীতিষু সামাখ্যা শেষে যজুঃ শব্দ।
(পূর্বমীমাংসা ২।১।৩৫-৩৭)
=>>যাহার মধ্যে অর্থবশ পাদ ব্যবস্থা তাকে ঋক বলা হয়। যে মন্ত্র গায়ন করা হয় তাকে সাম এবং বাকী মন্ত্র যজুর্বেদের অন্তর্গত। এই তিন প্রকারের মন্ত্র চার বেদের মধ্যে রয়েছে।
এই কথা সর্বানুক্রমনীবৃত্তির ভূমিকায় "পঙ্গুরুশিষ্য" বলেছেন -
"বিনিয়োক্তঞ্চরূপশ্চ ত্রিবিধঃ সম্প্রদর্শ্যতে।
ঋগ যজুঃ সামরূপেন মন্ত্রোবেদচুতষ্টয়ে।।"
অর্থাৎ যজ্ঞে তিন প্রকারের মন্ত্র বিনির্যুক্ত হয়ে করতে হয়। চার বেদে তাহা ঋগ যজু সাম রূপে রয়েছে।
তিন প্রকারের মন্ত্র, অথবা বেদে জ্ঞান, কর্ম এবং উপাসনা তিন প্রকারের কর্তব্যের বর্ণনা করার কারনেও বেদত্রয়ী বলা হয়। এই বেদত্রয়ী শব্দে চার বেদের সমাবেশ রয়েছে। কেউ যদি এ কুতর্ক করে যে, অথর্ববেদ অত্যন্ত নবীন তবে সে বেদকেই উলঙ্ঘন করার দুঃসাহস করলো। কারণ অথর্বেদের বেদত্ব স্বয়ং বেদ এবং উপনিষদ্ স্বীকার করেছে।
পাঠের সুবিধার জন্য মন্ত্রের সহিত ছন্দেরও উল্লেখ করা হয়। বেদের যে যে মন্ত্র, যে যে ছন্দে প্রকাশিত, সেই সেই মন্ত্রে সেই সেই ছন্দ। ছন্দ তিন প্রকারের – ছন্দ, অতিছন্দ ও বিছন্দ [স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত]। এই তিনের প্রত্যেকটিতে ৭টি করিয়া ভেদ আছে। ছন্দ সাতটি, যথা- গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী। অতিছন্দও সাতটি। যথা – অতিজগতী, শক্করী, অতিশক্করী, অষ্টি, অত্যষ্টি, ধৃতি ও অতিধৃতি। বিছন্দও সাতটি, যথা- কৃতি, প্রকৃতি, আকৃতি, বিকৃতি, সংকৃতি, অতিকৃতি ও উৎকৃতি। এই ২১টি ছন্দের প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন সংখ্যক অক্ষরযুক্ত থাকে। গায়ত্রীতে ২৪ অক্ষর, উষ্ণিকে ২৭টি, অনুষ্টুপে ৩২টি, বহতীতে ৩৬টি, পংক্তিতে ৪০টি, ত্রিষ্টুপে ৪৪ টি, জগতীতে ৬০টি, অত্যষ্টিতে ৬৮টি, ধৃতিতে ৭২টি, অতিধৃতিতে ৭৬টি, কৃতিতে ৮০টি, প্রকৃতিতে ৮৪টি, আকৃতিতে ৮৮টি, বিকৃতিতে ৯২টি, সংকৃতিতে ৯৬টি, অতিকৃতিতে ১০০টি এবং উৎকৃতিতে ১০৪টি অক্ষর থাকে। এই ২১ ছন্দের মধ্যে কোনটিতে এক অক্ষর কম হইলে তাহাতে নিচৃৎ এবং এক অক্ষর বেশী হইলে ভুরিজ বিশেষণ যুক্ত হয়। এই ২১ ছন্দের আর্ষী, দৈবী, আসুরী, প্রজাপত্যা, যাজুষী সাম্লী, আর্চী ও ব্রাহ্মী ভেদে ৮ ভেদ এবং বিরাট, নিচৃৎ, শুদ্ধা, ভূরিজ্ ও স্বরাট্ ভেদে ৪ ভেদ হয়। অতিছন্দ ও বিছন্দেরও ভেদ হয়। এইভাবে নানা পদ যোজনা ও অক্ষর যোজনা দ্বারা এই সব ছন্দের না না বিভেদ করা হইয়াছে।
বেদাঙ্গ ও স্বর
বেদাঙ্গের অভ্যাস বেদার্থ বোধের সহায়তা করে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ছয়টিকে বেদের ‘ষড়ঙ্গ’ বলে। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সম – ‘শিক্ষা’ এই পাঁচটি বিষয়ের শিক্ষা দান করে। স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দুই প্রকার। অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বর্ণগুলির জ্ঞান অত্যাবশ্যক। প্রধানত: স্বর ত্রিবিধ-উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিৎ। উদাত্ত বিধানে উ্চ্চৈঃস্বরে, অনুদাত্ত বিধানে কোমল স্বরে, এবং স্বরিৎ বিধানে উদাত্ত ও অনুদাত্ত মধ্যবর্তী স্বরে উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরিৎ উদাত্ত ও অনুদাত্তের মিলন স্বর ১৪ প্রকার। উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎস, স্বরিদুদাত্ত ও একশ্রুতি এই সতটি স্বর উদাত্ত ভেদে এবং ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই সাতটি স্বর যড়ঙ্গ ভেদে বিধান করা হইয়াছে। ষড়ঙ্গ বিহিত সাতটি স্বরকে সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। উদাত্ত হইতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হইতে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিৎ হইতে ষডজ, মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পনা করা হইয়াছে।
আমরা সকলেই যাহা কিছু উচ্চারণ করি উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিৎ বিধানে উচ্চারণ করি। আয়াম অর্থাৎ অঙ্গ সকলকে রুদ্ধ করিয়া, দারুণ অর্থাৎ বাণীকে রুক্ষ করিয়া বা উচ্চেঃস্বরে এবং অণুতা অর্থাৎ কণ্ঠকে কিছু রুদ্ধ করিয়া উদাত্ত স্বরের উচ্চারণ করা হয়। ‘অন্বয়’ অর্থাৎ গাত্রকে দোলায়মান করিয়া ‘মার্দব’ অথ্যাৎ স্বরের কোমলতা করিয়া এবং উরুতা অথ্যাৎ কণ্ঠকে বিস্তৃত করিয়া অনুদাত্তের মিলনে উৎপত্তি হয়। উচ্চ, নীচ, হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদেও স্বর উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎ, স্বরিতোদাত্ত ও একশ্রুতি, এই সাত প্রকারের হইয়া থোকে। স্বরিতেরও তিন ভেদ আছে –হ্রস্ব, স্বরিৎ, দীর্ঘ স্বরিৎ ও প্লুত স্বরিৎ! ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ – এই সপ্ত স্বরকেই সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। সঙ্গীতে ও গান্ধার উদাত্তের লক্ষণে, ঋষভ ও ধৈবত অনুদাত্তের লক্ষণে ষড়জ্ মাধ্ম ও পঞ্চম স্বরিতের লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়।
স্বরের চিহ্ন
বেদ মন্ত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিৎ ভেদ বুঝাইবার জন্য বৈদিক গ্রন্থ সমূহে কতগুলি চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়। উদাত্ত স্বরের সহিত কোনও চিহ্ন প্রযুক্ত হয় না। অনুদাত্ত বর্ণের নীচে শায়িত একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। স্বরিতের উপরে লম্বমান একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। মাত্রা তিন প্রকারের হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত। প্লুত স্বর বুঝাইতে ৩ সংখ্যা ব্যবহৃত হয়।
ক, খ, গ ঘ ৩ –এখানে ক উদাত্ত, খ অনুদাত্ত গ স্বরিৎ এবং ঘ প্লুত স্বরিৎ। ‘নি’ হ্রস্ব, ‘নী’ দীর্ঘ এবং নি ই ই’ প্লুত। ক্রন্দনে ও গানে প্লুত স্বর ব্যবহৃত হয়। ইহাকে দীর্ঘ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরের চিহ্ন সন্বন্ধে মতদ্বৈত ও দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ উদাত্ত বুঝাইতে বণেৃর উপরে লম্বমান রেখার, অনুদাত্ত বুঝাইতে বর্ণের নীচে শায়িত রেখার প্রয়োগ করেন এবং স্বরিতের কোনও রেখারই প্রয়োগ করেন না। কেহ কেহ স্বরিত বুঝাইতে বর্ণের নীচে একটি বক্র রেখার ও প্রয়োগ করেন। কণ্ঠ দ্বারাই স্বরের উচ্চারণ করিতে হয় কিন্তু বৈদিক পণ্ডিতেরা কেহ কেহ স্বর পাঠের সংস্কারকে দৃঢ় করিবার জন্য অঙ্গ বিশেষের পরিচালনা করেন। ঋগ্বেদ, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ পাঠ করিতে মস্তককে নীচু করিয়া অনুদাত্ত, উচু করিয়া স্বরিৎ, এবং মস্তককে ঠিক রাখিয়া উদাত্ত। শুক্ল যজুর্বেদ পাঠ করিতে হস্তের অগ্রভাগ সঞ্চালন করা হয়। হস্তের অগ্রভাগ নামাইয়া অনুদাত্ত, উঠাইয়া উদাত্ত এবং দক্ষিণে বামে তির্যক সঞ্চালন করিয়া স্বরিৎ প্রকাশ করা হয়। ঋক, যজু ও অথর্ববেদ সন্বন্ধেও এই ব্যবস্থা। সামবেদ ১, ২ ও ৩ সংখ্যা বর্ণের উপর প্রয়োগ করা হয়। বর্ণের উপরে ১ উদাত্ত, ২ দ্বারা অনুদাত্ত এবং ৩ দ্বারা স্বরিৎ। কেহ, ২ দ্বারা স্বরিৎ এবং ৩ দ্বারা অনুদাত্ত প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে অন্যরূপ ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের মধ্যেই স্বর উচ্চারিত হয়, চিহ্নাদিরও প্রয়োগ করা হয়। ঋক্, সাম ও অথর্ব বেদের ব্রাহ্মণের স্বর উচ্চারিত হয় না, চিহ্নাদিরও পয়োগ করা হয় না। কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্রাহ্মণে সংহিতার ন্যায়ই স্বরের উচ্চারণ হয় এবং চিহ্নাদির প্রয়োগ করা হয়। শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণের নীচে অনুদাত্তবৎ শায়িত রেখা প্রয়োগ করিয়া উদাত্ত প্রকাশ করা হয়।
বর্ণের উচ্চারণেরে মধ্যেও নানা পার্থক্য দৃষ্ট হয়। স্বর বর্ণের মধ্যস্থিত ‘ড’ কে ‘ড়’ এবং ‘ঢ’ কে ‘ঢ়’ উচ্চারণ করা হয়। অনুদাত্তের(ং) উচ্চারণ নানাবিধ। ং স্বরকে কেহ কেহ অনুস্বারের পরে ‘ব’(উয়) সংযোগ করিয়া উচ্চারণ করেন, কেহ কেহ দীর্ঘ অনুস্বারকে ‘’ এইরূপ, হ্রস্ব অনুস্বারকে ং এইরূপ লিখিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা বর্ণের উপর ঁ চন্দ্রবিন্দু দিয়া অনুস্বারের কার্য চালাইয়া থাকেন। দীর্ঘ অনুস্বারের উচ্চারণ গ্বু ‘’ এইভাবেই করিয়া থাকেন। ‘য’ এর উচ্চারণ কেহ কেহ ‘ইঅ’ না করিয়া ‘জ’ বৎ এবং ‘ষ’ এর উচ্চারণ ‘খ’ বৎ করিয়া থাকেন। সামবেদের উদাত্ত উচ্চারণের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে পৃথক্ রাখিয়া অন্য চারি আঙ্গুলিকে মিলিতভাবে খুলিয়া রাখা হয়। অনুদাত্ত উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগ তর্জনীর মধ্যপর্বে সংলগ্ন করা হয়। এবং স্বরিৎ উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে পর্বসংলগ্ন করা হয়। সামবেদে স্বরের সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝাইতে আরও নানারূপ চিহ্ন প্রদত্ত হয়। অক্ষরের উপরে ‘র’ থাকিলে বাম হস্তের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী, অঙ্গুষ্ঠ এক এক করিয়া তালু দেশে মুড়িয়া আনিতে হয়। ‘উ’ অনুদাত্তের সঙ্গেই থাকে। তাহা প্রদর্শনের জন্য মধ্যম অঙ্গুলি মুড়িয়া অঙ্গুষ্ঠের মূলে আনা হয়। ‘ক’ স্বরিতেরই সঙ্গে থাকে, ইহা প্রদর্শনের জন্য অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা মধ্যমার মূল ভাগ হইতে অগ্রভাগ পর্যন্ত স্পর্শ করিয়া লইতে হয়।
উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিতের ভেদ প্রদর্শন না করিয়া একটানা পড়িয়া যাওয়ার নামই ‘একশ্রুতি’। যজ্ঞ কর্মে একশ্রুতি স্বরে বেদ মন্ত্রের উচ্চারণ করিতে হয়। বেদ মন্ত্রের জপ করিতে ‘নূঙ্খ’ নামক বৈদিক স্তুতিতে এবং সামবেদে একশ্রুতি স্বরের ব্যবহার না করিয়া উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিতের ভেদ অনুসারে উচ্চারণ করিতে হয়।
সামগান
সামগানে স্বর সন্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। উর, কণ্ঠ ও শির –এই তিন স্থান হইতে শব্দ উত্থিত হয়। উর স্থানকে প্রাতঃ সবন, কণ্ঠ স্থানকে মাধ্যন্দিন সবন এবং শিরস্থানকে তৃতীয় সবন মনে করিতে হইবে। এই তিন স্থানে সাত সাতটি স্বর বিচরণ করে। আমরা কর্ণ দ্বারা উহা শ্রবণ করিতে পারিনা। ৭ স্বর, ৩ গ্রাম, ২১ মূর্চ্ছনা ও ৪৯ প্রকার স্বর; ইহাকে স্বর মণ্ডল বলে। ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই ৭টি স্বর। ষডজ, মধ্যম ও গান্ধার এই তিনটি গ্রাম। ষডজ গ্রামে তান ১৪টি, মধ্যম গ্রামে ২০টি এবং গান্ধার গ্রামে তান ১৫টি। মুর্চ্চনা তিন প্রকারের – ঋষি, পিতৃ ও দেব। নন্দী, বিশালা, সুমুখী, চিত্রা, চিত্রবতী, সুখা ও বলা- এই সাতটি দেবমূর্চ্ছনা। আপ্যায়নী, বিশ্বভৃতা, চন্দা, হেমা, কপাদিনী, মৈত্রী ও বার্হতী এই সাতটি পিতৃ মূর্চ্ছনা। উত্তর মন্দ্রা, উদ্গাতা, অশ্বক্রান্তা, সৌবীরা হৃষ্যকা, উত্তরায়তা ও রজনী এই ৭টি ঋষি মূর্চ্ছনা। গানের গুণ ১০টি – রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিস্ক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সম, সুকুমার ও মধুর। সঙ্গীত শাস্ত্রানুসারে সামবেদের মন্ত্রকে গানের আকারে রাখিয়া একই মন্ত্রের বিভিন্ন শব্দকে একাধিকবার প্রয়োগ করিয়া বহুদীর্ঘ করা হয়। ইহাকে গান সংহিতা বলে। সামগানে গান সংহিতারই প্রয়োগ হয়। গান সংহিতা মন্ত্র সংহিতা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।
বেদপাঠ প্রণালী
বেদমন্ত্র কোনও রূপেই বিস্মৃত না হয় এবং ইহার মধ্যে কিছুই প্রক্ষিপ্ত না হইতে পারে এ জন্য বেদ পাঠের দুই প্রণালী আছে – ‘নির্ভূজ’ সংহিতা ও ‘প্রতৃণ’ সংহিতা। মন্ত্রটি যেরূপ আছে ঠিক সেইরূপ পাঠ করিলে তাহা ‘নির্ভূজ’ সংহিতা। “অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম” এই মন্ত্রটিকে ‘অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্’ ঠিক এইরূপ অবিকৃতভাবে পাঠ করিলেই তাহাকে ‘নির্ভুজ’ সংহিতা বলে। ‘প্রতৃণ’ সংহিতার বহু ভেদ আছে। যেমন পদপাঠ, ক্রমপাঠ, জটাপাঠ, ধনপাঠ ইত্যাদি। সন্ধি ও বিরাম আদি বিচার করিয়া পাঠ করিলে তাহার নাম ‘পদপাঠ’, যেমন- ‘অগ্নিম, ঈডে, পুরোহিতম, যজ্ঞস্য, দেবম্, ঋত্বিজম্’। ‘ক্রমপাঠ’ এইরূপ, যেমন –‘অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্। ‘জটাপাঠ’ এইরূপ যেমন –অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম্। অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস দেবম্, দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবম্, দেবং ঋত্ত্বিজম্। ‘ধনপাঠ’ এইরূপ যেমন – অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম, অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; পুরোহিতং ঈডে অগ্নিম্; অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পূরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য দেবম্। দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্ ইত্যাদি।
বেদাঙ্গের অভ্যাস বেদার্থ বোধের সহায়তা করে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ছয়টিকে বেদের ‘ষড়ঙ্গ’ বলে। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সম – ‘শিক্ষা’ এই পাঁচটি বিষয়ের শিক্ষা দান করে। স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দুই প্রকার। অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বর্ণগুলির জ্ঞান অত্যাবশ্যক। প্রধানত: স্বর ত্রিবিধ-উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিৎ। উদাত্ত বিধানে উ্চ্চৈঃস্বরে, অনুদাত্ত বিধানে কোমল স্বরে, এবং স্বরিৎ বিধানে উদাত্ত ও অনুদাত্ত মধ্যবর্তী স্বরে উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরিৎ উদাত্ত ও অনুদাত্তের মিলন স্বর ১৪ প্রকার। উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎস, স্বরিদুদাত্ত ও একশ্রুতি এই সতটি স্বর উদাত্ত ভেদে এবং ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই সাতটি স্বর যড়ঙ্গ ভেদে বিধান করা হইয়াছে। ষড়ঙ্গ বিহিত সাতটি স্বরকে সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। উদাত্ত হইতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হইতে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিৎ হইতে ষডজ, মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পনা করা হইয়াছে।
আমরা সকলেই যাহা কিছু উচ্চারণ করি উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিৎ বিধানে উচ্চারণ করি। আয়াম অর্থাৎ অঙ্গ সকলকে রুদ্ধ করিয়া, দারুণ অর্থাৎ বাণীকে রুক্ষ করিয়া বা উচ্চেঃস্বরে এবং অণুতা অর্থাৎ কণ্ঠকে কিছু রুদ্ধ করিয়া উদাত্ত স্বরের উচ্চারণ করা হয়। ‘অন্বয়’ অর্থাৎ গাত্রকে দোলায়মান করিয়া ‘মার্দব’ অথ্যাৎ স্বরের কোমলতা করিয়া এবং উরুতা অথ্যাৎ কণ্ঠকে বিস্তৃত করিয়া অনুদাত্তের মিলনে উৎপত্তি হয়। উচ্চ, নীচ, হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদেও স্বর উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎ, স্বরিতোদাত্ত ও একশ্রুতি, এই সাত প্রকারের হইয়া থোকে। স্বরিতেরও তিন ভেদ আছে –হ্রস্ব, স্বরিৎ, দীর্ঘ স্বরিৎ ও প্লুত স্বরিৎ! ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ – এই সপ্ত স্বরকেই সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। সঙ্গীতে ও গান্ধার উদাত্তের লক্ষণে, ঋষভ ও ধৈবত অনুদাত্তের লক্ষণে ষড়জ্ মাধ্ম ও পঞ্চম স্বরিতের লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়।
স্বরের চিহ্ন
বেদ মন্ত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিৎ ভেদ বুঝাইবার জন্য বৈদিক গ্রন্থ সমূহে কতগুলি চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়। উদাত্ত স্বরের সহিত কোনও চিহ্ন প্রযুক্ত হয় না। অনুদাত্ত বর্ণের নীচে শায়িত একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। স্বরিতের উপরে লম্বমান একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। মাত্রা তিন প্রকারের হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত। প্লুত স্বর বুঝাইতে ৩ সংখ্যা ব্যবহৃত হয়।
ক, খ, গ ঘ ৩ –এখানে ক উদাত্ত, খ অনুদাত্ত গ স্বরিৎ এবং ঘ প্লুত স্বরিৎ। ‘নি’ হ্রস্ব, ‘নী’ দীর্ঘ এবং নি ই ই’ প্লুত। ক্রন্দনে ও গানে প্লুত স্বর ব্যবহৃত হয়। ইহাকে দীর্ঘ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরের চিহ্ন সন্বন্ধে মতদ্বৈত ও দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ উদাত্ত বুঝাইতে বণেৃর উপরে লম্বমান রেখার, অনুদাত্ত বুঝাইতে বর্ণের নীচে শায়িত রেখার প্রয়োগ করেন এবং স্বরিতের কোনও রেখারই প্রয়োগ করেন না। কেহ কেহ স্বরিত বুঝাইতে বর্ণের নীচে একটি বক্র রেখার ও প্রয়োগ করেন। কণ্ঠ দ্বারাই স্বরের উচ্চারণ করিতে হয় কিন্তু বৈদিক পণ্ডিতেরা কেহ কেহ স্বর পাঠের সংস্কারকে দৃঢ় করিবার জন্য অঙ্গ বিশেষের পরিচালনা করেন। ঋগ্বেদ, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ পাঠ করিতে মস্তককে নীচু করিয়া অনুদাত্ত, উচু করিয়া স্বরিৎ, এবং মস্তককে ঠিক রাখিয়া উদাত্ত। শুক্ল যজুর্বেদ পাঠ করিতে হস্তের অগ্রভাগ সঞ্চালন করা হয়। হস্তের অগ্রভাগ নামাইয়া অনুদাত্ত, উঠাইয়া উদাত্ত এবং দক্ষিণে বামে তির্যক সঞ্চালন করিয়া স্বরিৎ প্রকাশ করা হয়। ঋক, যজু ও অথর্ববেদ সন্বন্ধেও এই ব্যবস্থা। সামবেদ ১, ২ ও ৩ সংখ্যা বর্ণের উপর প্রয়োগ করা হয়। বর্ণের উপরে ১ উদাত্ত, ২ দ্বারা অনুদাত্ত এবং ৩ দ্বারা স্বরিৎ। কেহ, ২ দ্বারা স্বরিৎ এবং ৩ দ্বারা অনুদাত্ত প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে অন্যরূপ ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের মধ্যেই স্বর উচ্চারিত হয়, চিহ্নাদিরও প্রয়োগ করা হয়। ঋক্, সাম ও অথর্ব বেদের ব্রাহ্মণের স্বর উচ্চারিত হয় না, চিহ্নাদিরও পয়োগ করা হয় না। কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্রাহ্মণে সংহিতার ন্যায়ই স্বরের উচ্চারণ হয় এবং চিহ্নাদির প্রয়োগ করা হয়। শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণের নীচে অনুদাত্তবৎ শায়িত রেখা প্রয়োগ করিয়া উদাত্ত প্রকাশ করা হয়।
বর্ণের উচ্চারণেরে মধ্যেও নানা পার্থক্য দৃষ্ট হয়। স্বর বর্ণের মধ্যস্থিত ‘ড’ কে ‘ড়’ এবং ‘ঢ’ কে ‘ঢ়’ উচ্চারণ করা হয়। অনুদাত্তের(ং) উচ্চারণ নানাবিধ। ং স্বরকে কেহ কেহ অনুস্বারের পরে ‘ব’(উয়) সংযোগ করিয়া উচ্চারণ করেন, কেহ কেহ দীর্ঘ অনুস্বারকে ‘’ এইরূপ, হ্রস্ব অনুস্বারকে ং এইরূপ লিখিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা বর্ণের উপর ঁ চন্দ্রবিন্দু দিয়া অনুস্বারের কার্য চালাইয়া থাকেন। দীর্ঘ অনুস্বারের উচ্চারণ গ্বু ‘’ এইভাবেই করিয়া থাকেন। ‘য’ এর উচ্চারণ কেহ কেহ ‘ইঅ’ না করিয়া ‘জ’ বৎ এবং ‘ষ’ এর উচ্চারণ ‘খ’ বৎ করিয়া থাকেন। সামবেদের উদাত্ত উচ্চারণের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে পৃথক্ রাখিয়া অন্য চারি আঙ্গুলিকে মিলিতভাবে খুলিয়া রাখা হয়। অনুদাত্ত উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগ তর্জনীর মধ্যপর্বে সংলগ্ন করা হয়। এবং স্বরিৎ উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে পর্বসংলগ্ন করা হয়। সামবেদে স্বরের সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝাইতে আরও নানারূপ চিহ্ন প্রদত্ত হয়। অক্ষরের উপরে ‘র’ থাকিলে বাম হস্তের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী, অঙ্গুষ্ঠ এক এক করিয়া তালু দেশে মুড়িয়া আনিতে হয়। ‘উ’ অনুদাত্তের সঙ্গেই থাকে। তাহা প্রদর্শনের জন্য মধ্যম অঙ্গুলি মুড়িয়া অঙ্গুষ্ঠের মূলে আনা হয়। ‘ক’ স্বরিতেরই সঙ্গে থাকে, ইহা প্রদর্শনের জন্য অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা মধ্যমার মূল ভাগ হইতে অগ্রভাগ পর্যন্ত স্পর্শ করিয়া লইতে হয়।
উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিতের ভেদ প্রদর্শন না করিয়া একটানা পড়িয়া যাওয়ার নামই ‘একশ্রুতি’। যজ্ঞ কর্মে একশ্রুতি স্বরে বেদ মন্ত্রের উচ্চারণ করিতে হয়। বেদ মন্ত্রের জপ করিতে ‘নূঙ্খ’ নামক বৈদিক স্তুতিতে এবং সামবেদে একশ্রুতি স্বরের ব্যবহার না করিয়া উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিতের ভেদ অনুসারে উচ্চারণ করিতে হয়।
সামগান
সামগানে স্বর সন্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। উর, কণ্ঠ ও শির –এই তিন স্থান হইতে শব্দ উত্থিত হয়। উর স্থানকে প্রাতঃ সবন, কণ্ঠ স্থানকে মাধ্যন্দিন সবন এবং শিরস্থানকে তৃতীয় সবন মনে করিতে হইবে। এই তিন স্থানে সাত সাতটি স্বর বিচরণ করে। আমরা কর্ণ দ্বারা উহা শ্রবণ করিতে পারিনা। ৭ স্বর, ৩ গ্রাম, ২১ মূর্চ্ছনা ও ৪৯ প্রকার স্বর; ইহাকে স্বর মণ্ডল বলে। ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই ৭টি স্বর। ষডজ, মধ্যম ও গান্ধার এই তিনটি গ্রাম। ষডজ গ্রামে তান ১৪টি, মধ্যম গ্রামে ২০টি এবং গান্ধার গ্রামে তান ১৫টি। মুর্চ্চনা তিন প্রকারের – ঋষি, পিতৃ ও দেব। নন্দী, বিশালা, সুমুখী, চিত্রা, চিত্রবতী, সুখা ও বলা- এই সাতটি দেবমূর্চ্ছনা। আপ্যায়নী, বিশ্বভৃতা, চন্দা, হেমা, কপাদিনী, মৈত্রী ও বার্হতী এই সাতটি পিতৃ মূর্চ্ছনা। উত্তর মন্দ্রা, উদ্গাতা, অশ্বক্রান্তা, সৌবীরা হৃষ্যকা, উত্তরায়তা ও রজনী এই ৭টি ঋষি মূর্চ্ছনা। গানের গুণ ১০টি – রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিস্ক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সম, সুকুমার ও মধুর। সঙ্গীত শাস্ত্রানুসারে সামবেদের মন্ত্রকে গানের আকারে রাখিয়া একই মন্ত্রের বিভিন্ন শব্দকে একাধিকবার প্রয়োগ করিয়া বহুদীর্ঘ করা হয়। ইহাকে গান সংহিতা বলে। সামগানে গান সংহিতারই প্রয়োগ হয়। গান সংহিতা মন্ত্র সংহিতা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।
বেদপাঠ প্রণালী
বেদমন্ত্র কোনও রূপেই বিস্মৃত না হয় এবং ইহার মধ্যে কিছুই প্রক্ষিপ্ত না হইতে পারে এ জন্য বেদ পাঠের দুই প্রণালী আছে – ‘নির্ভূজ’ সংহিতা ও ‘প্রতৃণ’ সংহিতা। মন্ত্রটি যেরূপ আছে ঠিক সেইরূপ পাঠ করিলে তাহা ‘নির্ভূজ’ সংহিতা। “অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম” এই মন্ত্রটিকে ‘অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্’ ঠিক এইরূপ অবিকৃতভাবে পাঠ করিলেই তাহাকে ‘নির্ভুজ’ সংহিতা বলে। ‘প্রতৃণ’ সংহিতার বহু ভেদ আছে। যেমন পদপাঠ, ক্রমপাঠ, জটাপাঠ, ধনপাঠ ইত্যাদি। সন্ধি ও বিরাম আদি বিচার করিয়া পাঠ করিলে তাহার নাম ‘পদপাঠ’, যেমন- ‘অগ্নিম, ঈডে, পুরোহিতম, যজ্ঞস্য, দেবম্, ঋত্বিজম্’। ‘ক্রমপাঠ’ এইরূপ, যেমন –‘অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্। ‘জটাপাঠ’ এইরূপ যেমন –অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম্। অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস দেবম্, দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবম্, দেবং ঋত্ত্বিজম্। ‘ধনপাঠ’ এইরূপ যেমন – অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম, অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; পুরোহিতং ঈডে অগ্নিম্; অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পূরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য দেবম্। দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্ ইত্যাদি।
অতি প্রাচীনকালে কোন কোন মন্ত্র কেবল উচ্চারিত না হইয়া গীত হইত। এই গীত ঋক্গুলির সমষ্টির নাম সামবেদ। বেদ সঙ্কলন সময়ে এই গীতগুলি পৃথক করিয়া সংহিতা বন্ধ করা হইয়াছে। বেদে তিনটি স্বরের প্রয়োগ দৃষ্ট হয়, উদাত্ত,অনুদাত্ত ও স্বরিত। পাণিনি এই তিনটি স্বরের লক্ষণ দিয়াছেন,- উদ্দত্ত (উচ্চৈরুদাত্ত, acute or raised accent), অনুদাত্ত-"নীচৈরুনুদাত্ত"(grave accent),স্বরিত-"সমাহারঃ স্বরিতঃ(circumflex accent)
বেদ মন্ত্রের যথার্থ জ্ঞানের জন্য স্বর,বর্ণ,অক্ষর,মাত্রা বিনিয়োগ এবং অর্থের জ্ঞান পদে পদে আবশ্য়ক। যদি ,মন্ত্র ব্যবহরনে স্বরের ভ্রান্তি ঘটে, অর্থ অন্যরূপ হইয়া যাইবে, এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে একই পদে স্বরভেদে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরূদ্ধ অর্থ প্রকাশ করে। বেদ মন্ত্রে কোন শব্দ পরে যোগ করতে বা বিয়োগ করলে
সেই মন্ত্র বেদ পাঠ করলে ভুল ধরা পড়বে, তাই কোন ভাবে তা বিকৃত করা সম্ভব নয়। একটা মন্ত্র একাদশ প্রকার পাঠভেদ আছে। ১) সংহিতাপাঠ,২)পদপাঠ,৩)ক্রম পাঠ, ৪)জটা পাঠ, ৫)মালাপাঠ, ৬)লেখাপাঠ, ৭)শিখাপাঠ, ৮)ধ্বজপাঠ, ৯)দন্ডপাঠ, ১০)রথপাঠ ১১)ঘনপাঠ। আনুমানিক চার হাজার বর্ষ পূর্বে এতগুলি বেদ মন্ত্রে এত প্রকার বিভিন্ন পাঠ ও জটিল পাঠ কেবল মুখে মুখে বলে শ্রবন করিয়া আর্যগন শ্রুতিতে যথাযথ ধারণ করিতেন এবং এইভাবে সাধকগন সমুদ্রতুল্য বিশাল বৈদিক জ্ঞান অবিকৃত রূপে ধারণ ও বহন করিয়া ছিলেন। বৈদিক আচার্যগন এই বিশাল বেদ শাস্ত্র বিভিন্ণ পাঠসহ কন্ঠস্থ করিয়া অবিকৃত ভাবে রক্ষা করিয়া গিয়াছেন।
উদঃ-যেমন ঋগ্বেদের ১।১।১ মন্ত্র "अ॒ग्निमी॑ळे पु॒रोहि॑तं य॒ज्ञस्य॑ दे॒वमृ॒त्विज॑म्। होता॑रं रत्न॒धात॑मम्॥" সংহিতা পাঠ অর্থাৎ বেদের সংহিতাভাগে মন্ত্রটি যেমন লিপিবদ্ধ আছে অবিকল সেইভাবে পাঠ করাকে বোঝায়, "অগ্নিমীড়ে পুরোহিতং, হোতারং রত্নধাতমম্"। এই মন্ত্রটির পদপাঠ হবে 'অগ্নিম। ঈড়ে। পুরঃsহিতম্। যজ্ঞস্য।দেবম্।ঋত্বিজম্। হোতারম্।রত্নsধাতমম্।।
এখাতে "s" চিহ্নটি অবগ্রহ চিহ্ন। ঋষি শাকল্য এই পদপাঠের রচনা করিয়াছেন। আবার ক্রমপাঠঃ একটি ঋকের দুইটি করিয়া পদ(word) একবারে গৃহীত হয় এবং প্রথম পদ ও অন্তিম পদ ব্যাতিত মধ্যবর্ত্তি সকল পদই দুইবার করিয়া পঠ করা হয়, উদাঃ " অগ্নিম ঈড়ে। ঈড়ে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য। যজ্ঞস্য দেবম্। দেবম্ ঋত্বিজম্। ঋত্বিজং হোতারম্। হোতারং রত্নধাতমম্"।।
এই ক্রমপাঠে প্রথম পদ "অগ্নিম" এবং অন্তিম পদ "রত্নধতমম্" ব্যতীত প্রতিপদ দুইবার করে পাঠ হয়। আক্ষরিক প্রতীকের মাধ্যমে ক্রমপাঠকে এই ভাবে বোঝানো যায়- একদুই,দুইতিন,তিনচার,চারপাঁচ,পাঁচছয়,ছয়সাত,সাত আট ইত্যাদি। ক্রমপাঠ প্রক্ষিপ্ত নিবারণের একটি উপায় সন্দেহ নাই, কিন্তু প্রথম ও অন্তিম পদ দুটির দ্বিত্ব না হওয়ায় এই দুটি পদের প্রক্ষিপ্ত হবার সম্ভবনা থাকে তা নিবারনের জন্য
সূক্মদর্শী ও তীক্ষধীসম্পন্ন ঋষিগণ জটা পাঠ মালাপাঠ ইত্যাদি রীতি সৃষ্টি করেছিলেন।
বেদভাষ্য ও ভাষ্যকার
বেদভাষ্য ও ভাষ্যকার
আধিদৈবিক (বৈজ্ঞানিক),আধিভৌতিক (লৌকিক ব্যবহারিক),আধ্যাত্মিক
বেদের তত্ব ও রহস্যকে সুস্পষ্ট করিতেই বিভিন্ন ভাষ্যের সৃষ্টি হইয়াছে। স্মরণাতীত কাল হইতে কত জনে, কতভাবে বেদভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রাচীন কালের সায়ণাচার্য এবং বর্তমান যুগের দয়ানন্দ সরস্বতীই উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদ ভাষ্য পড়িলে জানা যায়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধুরন্ধর পণ্ডিত ছিলেন। সায়ণাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয় নগরের মহারাজার মন্ত্রীপদে অসীন ছিলেন। তাঁহার ভাষ্য পড়িলে মনে হয়, তিনি একাকী সমগ্র ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। তাঁহার নেতৃত্বে অন্যান্য পণ্ডিতেরা ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী(১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ) বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। পণ্ডিত রোম্যাঁরলার মতে –“আচার্য শঙ্করের পর বেদের এতবড় পণ্ডিত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন নাই”।
ঋগ্বের ভাষ্যকার
১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।
যজুর্বেদ ভাষ্যকার
১। শৌনক। ২। হরিস্বামী (৫৮১খৃঃ)। ৩। উবট (১১শ শতাব্দী)। ৪। গৌরধর (১২৯৩ খৃঃ)। ৫। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৬। মহীধর (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১১৮৩ খৃষ্টাব্দ)
সামবেদ ভাষ্যকার
১। গুণ বিষ্ণু (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ২। মাধব। ৩। ভরত স্বামী (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৪। সায়ণাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৫। শোভাকর ভট্ট (খৃঃ ১৫শ শতাব্দী)। ৬। মহাস্বামী। ৭। সূর্যদৈবজ্ঞ(খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)।
অথর্বদেব ভাষ্যকার
১। সায়নাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। দয়ানন্দের পরে পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালংকার আজমীড় হইতে চতুর্বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনি এবং পণ্ডিত শিবশংকর কাব্যতীর্থের বেদভাষ্য উচ্চ সম্মান লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর যজুর্বেদ ভাষ্য, তুলসীরাম স্বামীর সামবেদ ভাষ্য এবং পণ্ডিত ক্ষেমকরণের অথর্ববেদ ভাষ্য বর্তমানে আদৃত হইয়াছে।
বেদের অঙ্গ, উপাঙ্গ, উপবেদ
বেদার্থ জানিবার জন্য শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ‘ষড়ঙ্গ’ প্রবর্তিত হইয়াছে। ‘শিক্ষা’ ছয় প্রকারের –শব্দ, শব্দাঘাত, শব্দাবয়ব, শব্দাবয়বাঘাত, স্বর মাধুর্য ও শব্দ সন্ধি। শিক্ষা গ্রন্থে এই সকল শিক্ষা দেওয়া হয়। শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শল্ব এই চারি সূত্রের নাম ‘কল্প’। ইহাতে যজ্ঞ প্রয়োগ বিধি কল্পিত হইয়াছে বলিয়া ইহার নাম কল্প। আপস্তন্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, প্রভৃতি ঋষিরা সূত্রাকারে কল্প গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। শ্রোত সূত্রে ধর্মানুষ্ঠান ও যজ্ঞ সন্বন্ধের বিধান; গৃহ্য সূত্রে গার্হস্থ্য বিধি, গর্ভাধান হইতে অন্ত্যেষ্টি এই ষোড়শ সংস্কার ও পঞ্চ মহাযজ্ঞের বিধান, ধর্মসূত্রে দায়ভাগ, শাসন বিধি কর্মবিধি ও চারিবর্ণের আচার বিচার এবং শূল্ব সূত্রে বেদীরচনা, অগ্নি কুণ্ড রচনাদি বর্ণিত আছে। শূল্ব সূত্রের সন্বন্ধ শ্রৌত্র সূত্রেরই সঙ্গে।
কর্ম কাণ্ডের জন্য সূত্র গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন ও সাংখ্যায়ন শ্রৌত সূত্র এবং ইহাদের উভয়ের গৃহ্য সূত্রও পাওয়া যায়। শৌনকের এক প্রতিশাখ্য সূত্র আছে। যজুর্বেদের কঠ, মানব, লৌগাক্ষি, কাত্যায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশী বাধুল, বৈখানস, মৈত্রা বরুণী ও ছাগল শ্রৌতসূত্র পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্র ও এতগলিই আছে। শুক্ল যজুর্বেদের কাত্যায়ন ও বৈজপায় শ্রোতসূত্র, পারস্কর ও কাতীয় গৃহ্যসূত্র। কাত্যায়নের এক প্রতি শাখায় আছে। সামবেদের পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের এক শ্রৌতসূত্র ও এক গৃহ্যসূত্র আছে। দ্বিতীয় –লাট্যায়ন শ্রোতসূত্র বা মশকসূত্র, তৃতীয় –দ্রাক্ষায়ণ শ্রৌত্রসূত্র, চতুর্থ – অনুপদ সূত্র, পঞ্চম-গোভিল কৃত পুষ্প সূত্র এবং তাণ্ডা, লক্ষণ, উপগ্রন্থ, কল্পানুপদ, অনুস্তোত্র ও ক্ষুদ্র সূত্র আছে। ইহার গৃহ্য সূত্রের মধ্যে গোভিল গৃহ্যসূত্র; কাত্যায়ন কর্মদীপ, খদির গৃহ্যসূত্র ও পিতৃমেধসূত্র আছে। অর্থববেদের কৌশিক, বৈতান, নক্ষত্র কল্প, অঙ্গিরস ও শান্তিকল্প সূত্র আছে।
যাহা দ্বারা ভাষায় সম্যক জ্ঞান লাভ হয় তাহার নাম ‘ব্যাকরণ’। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণই বর্তমানে একমাত্র বৈদিক ব্যাকরণ। মহর্ষি পতঞ্জলি ইহার উপর মাহভাষ্য নামে এক ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন। পাণিনির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন, তন্মধ্যে সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্মন্, ভারদ্বাজ, অপিশালী ও কাশ্যপের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহাদের ব্যাকরণ হইতেই পাণিনি সুত্রাকারে অষ্টাধ্যায়ী প্রণয়ন করিয়াছিলেন।
নিরক্ত গ্রন্থে বৈদিক শব্দ ও বাক্য সমূহের অর্থ সুস্পষ্ট করা হইয়াছে। যাস্কমুনি কৃত অতি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ নিরুক্ত গ্রন্থই বর্তমানে আদৃত হইতেছে। যাস্কের পূর্বেও কৌৎস, শাকপুণি ঔর্ণনাভ ও স্থোলাষ্টীরী প্রভৃতি নিরুক্তকার বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর লোক। নিঘন্টু নিরুক্তের অঙ্গীভূত। নিঘন্টু বেদের অর্থ প্রকাশক শব্দকোষ বা অভিধান মাত্র। দেবরাজ যজ্বা নিঘন্টুর টীকা লিখিয়াছেন এবং দুর্গাচার্য নিরুক্তের বৃত্তি প্রণয়ন করিয়াছেন। ছন্দ সন্বন্ধে পূর্বেই বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘জ্যোতিষ’ গ্রন্থে আকাশস্থ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর গতি বিধি সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। ‘উপাঙ্গ’ ছয়টি। গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, কপিলের সাংখ্য, পতজ্ঞলির যোগ, জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা এবং ব্যাসদেবের ব্রহ্মসূত্র বা উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত)। উপাঙ্গের তীক্ষ্ ন বিচার দ্বারা বেদের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। ‘উপবেদ’ চারি প্রকারের। ধনুর্বেদ বা যুদ্ধবিদ্যা, গন্ধর্ববেদ বা সঙ্গীত বিদ্যা, অর্থবেদ বা শিল্প বিদ্যা, আর্য়ুবেদ বা চিকিৎসা বিদ্যা।
বেদের ছয় উপাঙ্গের নাম ষড়দর্শন ব্ ষট্ শাস্ত্র। জৈমিনি কৃত পূর্ব মীমাংসা সূত্রে কর্মকাণ্ডের বিধান ধর্ম ও ধর্মী সন্বন্ধে বর্ণনা রহিয়াছে। ব্যাসদেব পূর্ব মীমাংসার ভাষ্য রচনা করিয়াছেন। গৌতমমুনি কণাদ কৃত বৈশেষিক সূত্রের প্রশস্ত পাদ ভাষ্য, বাৎসায়ন মুনি গৌতম কৃত ন্যায় সূত্রের ভাষ্য, ব্যাসদেব পতঞ্জলি কৃত।
বেদের তত্ব ও রহস্যকে সুস্পষ্ট করিতেই বিভিন্ন ভাষ্যের সৃষ্টি হইয়াছে। স্মরণাতীত কাল হইতে কত জনে, কতভাবে বেদভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রাচীন কালের সায়ণাচার্য এবং বর্তমান যুগের দয়ানন্দ সরস্বতীই উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদ ভাষ্য পড়িলে জানা যায়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধুরন্ধর পণ্ডিত ছিলেন। সায়ণাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয় নগরের মহারাজার মন্ত্রীপদে অসীন ছিলেন। তাঁহার ভাষ্য পড়িলে মনে হয়, তিনি একাকী সমগ্র ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। তাঁহার নেতৃত্বে অন্যান্য পণ্ডিতেরা ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী(১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ) বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। পণ্ডিত রোম্যাঁরলার মতে –“আচার্য শঙ্করের পর বেদের এতবড় পণ্ডিত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন নাই”।
ঋগ্বের ভাষ্যকার
১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।
যজুর্বেদ ভাষ্যকার
১। শৌনক। ২। হরিস্বামী (৫৮১খৃঃ)। ৩। উবট (১১শ শতাব্দী)। ৪। গৌরধর (১২৯৩ খৃঃ)। ৫। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৬। মহীধর (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১১৮৩ খৃষ্টাব্দ)
সামবেদ ভাষ্যকার
১। গুণ বিষ্ণু (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ২। মাধব। ৩। ভরত স্বামী (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৪। সায়ণাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৫। শোভাকর ভট্ট (খৃঃ ১৫শ শতাব্দী)। ৬। মহাস্বামী। ৭। সূর্যদৈবজ্ঞ(খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)।
অথর্বদেব ভাষ্যকার
১। সায়নাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। দয়ানন্দের পরে পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালংকার আজমীড় হইতে চতুর্বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনি এবং পণ্ডিত শিবশংকর কাব্যতীর্থের বেদভাষ্য উচ্চ সম্মান লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর যজুর্বেদ ভাষ্য, তুলসীরাম স্বামীর সামবেদ ভাষ্য এবং পণ্ডিত ক্ষেমকরণের অথর্ববেদ ভাষ্য বর্তমানে আদৃত হইয়াছে।
বেদের অঙ্গ, উপাঙ্গ, উপবেদ
বেদার্থ জানিবার জন্য শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ‘ষড়ঙ্গ’ প্রবর্তিত হইয়াছে। ‘শিক্ষা’ ছয় প্রকারের –শব্দ, শব্দাঘাত, শব্দাবয়ব, শব্দাবয়বাঘাত, স্বর মাধুর্য ও শব্দ সন্ধি। শিক্ষা গ্রন্থে এই সকল শিক্ষা দেওয়া হয়। শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শল্ব এই চারি সূত্রের নাম ‘কল্প’। ইহাতে যজ্ঞ প্রয়োগ বিধি কল্পিত হইয়াছে বলিয়া ইহার নাম কল্প। আপস্তন্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, প্রভৃতি ঋষিরা সূত্রাকারে কল্প গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। শ্রোত সূত্রে ধর্মানুষ্ঠান ও যজ্ঞ সন্বন্ধের বিধান; গৃহ্য সূত্রে গার্হস্থ্য বিধি, গর্ভাধান হইতে অন্ত্যেষ্টি এই ষোড়শ সংস্কার ও পঞ্চ মহাযজ্ঞের বিধান, ধর্মসূত্রে দায়ভাগ, শাসন বিধি কর্মবিধি ও চারিবর্ণের আচার বিচার এবং শূল্ব সূত্রে বেদীরচনা, অগ্নি কুণ্ড রচনাদি বর্ণিত আছে। শূল্ব সূত্রের সন্বন্ধ শ্রৌত্র সূত্রেরই সঙ্গে।
কর্ম কাণ্ডের জন্য সূত্র গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন ও সাংখ্যায়ন শ্রৌত সূত্র এবং ইহাদের উভয়ের গৃহ্য সূত্রও পাওয়া যায়। শৌনকের এক প্রতিশাখ্য সূত্র আছে। যজুর্বেদের কঠ, মানব, লৌগাক্ষি, কাত্যায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশী বাধুল, বৈখানস, মৈত্রা বরুণী ও ছাগল শ্রৌতসূত্র পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্র ও এতগলিই আছে। শুক্ল যজুর্বেদের কাত্যায়ন ও বৈজপায় শ্রোতসূত্র, পারস্কর ও কাতীয় গৃহ্যসূত্র। কাত্যায়নের এক প্রতি শাখায় আছে। সামবেদের পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের এক শ্রৌতসূত্র ও এক গৃহ্যসূত্র আছে। দ্বিতীয় –লাট্যায়ন শ্রোতসূত্র বা মশকসূত্র, তৃতীয় –দ্রাক্ষায়ণ শ্রৌত্রসূত্র, চতুর্থ – অনুপদ সূত্র, পঞ্চম-গোভিল কৃত পুষ্প সূত্র এবং তাণ্ডা, লক্ষণ, উপগ্রন্থ, কল্পানুপদ, অনুস্তোত্র ও ক্ষুদ্র সূত্র আছে। ইহার গৃহ্য সূত্রের মধ্যে গোভিল গৃহ্যসূত্র; কাত্যায়ন কর্মদীপ, খদির গৃহ্যসূত্র ও পিতৃমেধসূত্র আছে। অর্থববেদের কৌশিক, বৈতান, নক্ষত্র কল্প, অঙ্গিরস ও শান্তিকল্প সূত্র আছে।
যাহা দ্বারা ভাষায় সম্যক জ্ঞান লাভ হয় তাহার নাম ‘ব্যাকরণ’। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণই বর্তমানে একমাত্র বৈদিক ব্যাকরণ। মহর্ষি পতঞ্জলি ইহার উপর মাহভাষ্য নামে এক ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন। পাণিনির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন, তন্মধ্যে সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্মন্, ভারদ্বাজ, অপিশালী ও কাশ্যপের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহাদের ব্যাকরণ হইতেই পাণিনি সুত্রাকারে অষ্টাধ্যায়ী প্রণয়ন করিয়াছিলেন।
নিরক্ত গ্রন্থে বৈদিক শব্দ ও বাক্য সমূহের অর্থ সুস্পষ্ট করা হইয়াছে। যাস্কমুনি কৃত অতি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ নিরুক্ত গ্রন্থই বর্তমানে আদৃত হইতেছে। যাস্কের পূর্বেও কৌৎস, শাকপুণি ঔর্ণনাভ ও স্থোলাষ্টীরী প্রভৃতি নিরুক্তকার বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর লোক। নিঘন্টু নিরুক্তের অঙ্গীভূত। নিঘন্টু বেদের অর্থ প্রকাশক শব্দকোষ বা অভিধান মাত্র। দেবরাজ যজ্বা নিঘন্টুর টীকা লিখিয়াছেন এবং দুর্গাচার্য নিরুক্তের বৃত্তি প্রণয়ন করিয়াছেন। ছন্দ সন্বন্ধে পূর্বেই বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘জ্যোতিষ’ গ্রন্থে আকাশস্থ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর গতি বিধি সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। ‘উপাঙ্গ’ ছয়টি। গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, কপিলের সাংখ্য, পতজ্ঞলির যোগ, জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা এবং ব্যাসদেবের ব্রহ্মসূত্র বা উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত)। উপাঙ্গের তীক্ষ্ ন বিচার দ্বারা বেদের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। ‘উপবেদ’ চারি প্রকারের। ধনুর্বেদ বা যুদ্ধবিদ্যা, গন্ধর্ববেদ বা সঙ্গীত বিদ্যা, অর্থবেদ বা শিল্প বিদ্যা, আর্য়ুবেদ বা চিকিৎসা বিদ্যা।
বেদের ছয় উপাঙ্গের নাম ষড়দর্শন ব্ ষট্ শাস্ত্র। জৈমিনি কৃত পূর্ব মীমাংসা সূত্রে কর্মকাণ্ডের বিধান ধর্ম ও ধর্মী সন্বন্ধে বর্ণনা রহিয়াছে। ব্যাসদেব পূর্ব মীমাংসার ভাষ্য রচনা করিয়াছেন। গৌতমমুনি কণাদ কৃত বৈশেষিক সূত্রের প্রশস্ত পাদ ভাষ্য, বাৎসায়ন মুনি গৌতম কৃত ন্যায় সূত্রের ভাষ্য, ব্যাসদেব পতঞ্জলি কৃত।
বেদ কোন একটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। এ গ্রন্থের সমষ্টি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। বেদের প্রাচীন কল্পসূত্রকার আপস্তম্ব তাঁর যজ্ঞপরিভাষাসূত্রে (১/৩৪) বলেছেন-‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্’ অর্থাৎ মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণকে একত্রে বেদ বলে। এ মতকেই সমর্থন করে চতুর্দশ শতাব্দীর বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন- ‘মন্ত্রব্রাহ্মণাত্মকঃ শব্দরাশির্বেদঃ।’ মন্ত্র অংশকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। ব্রাহ্মণ অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত- আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদ বলতে আমরা বুঝি চার প্রকার শাস্ত্রগ্রন্থকে যথা (১) সংহিতা (২) ব্রাহ্মণ (৩) আরণ্যক ও (৪) উপনিষদ। এদের মধ্যে সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় ক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড। যেখানে যাগযজ্ঞ বিভিন্ন প্রকার বিধি ব্যবস্থার কথাই প্রধানত আছে। অবশিষ্ট আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড; যেখানে বিভিন্ন প্রকার উপাসনা বিধি এবং অধ্যাত্মবিদ্যাই মূখ্য আলোচনার বস্তু। যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বেদান্তদর্শন।
আরণ্যক বেদ-এর একটি অংশ। এগুলি বৈদিক সংস্কৃতে লেখা। আরণ্যক-এর কোনো কোনো অংশ ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্-এর অংশ।উপবেদ চারটি। সেগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধবর্বেদ এবং অর্থবেদ। আয়ুর্বেদ হলো ঋকবেদের উপবেদ, ইহাতে শরীরের রক্ষা, আরোগ্য এবং সুস্থ থাকার উপায় আছে, ঔষধিগুণ এবং রোগ নিবারণের উপায় বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে আয়ুর্বেদ এর গ্ৰন্থে চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতা প্রসিদ্ধ। ধনুর্বেদ হলো যজুর্বেদ এর উপবেদ, ইহাতে তির ধনুক চালোনোর বিষয় রয়েছে। গান্ধবর্বেদ হলো সামবেদের উপবেদ, ইহাতে সঙ্গীতের বিষয় রয়েছে। অথর্ববেদের উপবেদ হলো অর্থবেদ, ইহাতে শিল্প শাস্ত্রের বিষয় রয়েছে। অনেকের মতে, আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের উপবেদ কেননা ঋকবেদের মতো অথর্ববেদেও ঔষধি বিষয়ক অনেক সুক্ত পাওয়া যায়।
আরণ্যক বেদ-এর একটি অংশ। এগুলি বৈদিক সংস্কৃতে লেখা। আরণ্যক-এর কোনো কোনো অংশ ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্-এর অংশ।উপবেদ চারটি। সেগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধবর্বেদ এবং অর্থবেদ। আয়ুর্বেদ হলো ঋকবেদের উপবেদ, ইহাতে শরীরের রক্ষা, আরোগ্য এবং সুস্থ থাকার উপায় আছে, ঔষধিগুণ এবং রোগ নিবারণের উপায় বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে আয়ুর্বেদ এর গ্ৰন্থে চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতা প্রসিদ্ধ। ধনুর্বেদ হলো যজুর্বেদ এর উপবেদ, ইহাতে তির ধনুক চালোনোর বিষয় রয়েছে। গান্ধবর্বেদ হলো সামবেদের উপবেদ, ইহাতে সঙ্গীতের বিষয় রয়েছে। অথর্ববেদের উপবেদ হলো অর্থবেদ, ইহাতে শিল্প শাস্ত্রের বিষয় রয়েছে। অনেকের মতে, আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের উপবেদ কেননা ঋকবেদের মতো অথর্ববেদেও ঔষধি বিষয়ক অনেক সুক্ত পাওয়া যায়।
বেদাঙ্গ
সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ ছাড়াও প্রত্যেক বেদের সাথে যুক্ত আরও চার প্রকারের সূত্র আছে তাদের বলা হয় কল্পসূত্র। সায়নাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ – ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন- ‘কল্প্যতে সমর্থ্যতে যাগ প্রয়োগোহত্রইতি’। অর্থাৎ যার দ্বারা যাগযজ্ঞাদি কল্পিত বা সমর্থিত হয় তাকে কল্প বলে। বৃত্তিকার বিষ্ণুমিত্রের মতে ‘কল্পো বেদ বিহিতানাং কর্মনামানুপূর্ব্যণে কল্পনা শাস্ত্রম্।’ অর্থাৎ কল্প হলো বেদবিহিত কর্মের নিয়মানুসারী ব্যবস্থা বিধায়ক শাস্ত্র। এ কল্পসূত্র প্রধানত দুই প্রকার- শ্রৌতসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র। এ দুটি ভাগের মধ্যে আবার দুটি করে ভাগ নিহিত আছে। শ্রৌতসূত্রের সাথে আছে যজ্ঞের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শুল্বসূত্র এবং গৃহ্যসূত্রের সাথে যুক্ত আছে ধর্মসূত্র। এভাবে আমরা চার প্রকার কল্পসূত্র পাই- (১) গৃহ্যসূত্র, (২) ধর্মসূত্র, (৩) শ্রৌতসূত্র এবং (৪) শুল্বসূত্র।
প্রত্যেক বেদেরও পৃথক পৃথক কল্পসূত্র আছে। প্রাচীনকালে বেদের যতগুলো শাখা ছিল, ঠিক ততগুলিই কল্পসূত্র ছিল বলে বিশ্বাস। প্রাচীন উৎস থেকে জানা যায়, পূর্বে কল্পসূত্র ছিল ১১৩০টি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে এতগুলো কল্পসূত্র পাওয়া যায় না। বর্তমানে পাওয়া যায় প্রায় ৫০টি কল্পসূত্র। নিচে এর তালিকা দেয়া হলো।
ঋগ্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন (৩) পরশুরাম।
গৃহ্যসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন।
ধর্মসূত্র : (১) বশিষ্ঠ
সামবেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) লাট্যায়ন বা আর্ষেয়কল্প (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয়।
গৃহ্যসূত্র : (১) গোভিল (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয় (৪) খাদির।
ধর্মসূত্র : (১) গৌতম।
কৃষ্ণযজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) সত্যাষাঢ় বা হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
গৃহ্যসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) ভারদ্বাজ (৬) বারাহ (৭) কাঠক (৮) লৌগাক্ষি (৯) বৈখানস (১০) বাধুল।
ধর্মসূত্র : (১) মানব (২) বৌধায়ন (৩) আপস্তম্ব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
শুল্বসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) হিরণ্যকেশী (৪) কাঠক (৫) মানব (৬) বারাহ।
সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ ছাড়াও প্রত্যেক বেদের সাথে যুক্ত আরও চার প্রকারের সূত্র আছে তাদের বলা হয় কল্পসূত্র। সায়নাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ – ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন- ‘কল্প্যতে সমর্থ্যতে যাগ প্রয়োগোহত্রইতি’। অর্থাৎ যার দ্বারা যাগযজ্ঞাদি কল্পিত বা সমর্থিত হয় তাকে কল্প বলে। বৃত্তিকার বিষ্ণুমিত্রের মতে ‘কল্পো বেদ বিহিতানাং কর্মনামানুপূর্ব্যণে কল্পনা শাস্ত্রম্।’ অর্থাৎ কল্প হলো বেদবিহিত কর্মের নিয়মানুসারী ব্যবস্থা বিধায়ক শাস্ত্র। এ কল্পসূত্র প্রধানত দুই প্রকার- শ্রৌতসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র। এ দুটি ভাগের মধ্যে আবার দুটি করে ভাগ নিহিত আছে। শ্রৌতসূত্রের সাথে আছে যজ্ঞের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শুল্বসূত্র এবং গৃহ্যসূত্রের সাথে যুক্ত আছে ধর্মসূত্র। এভাবে আমরা চার প্রকার কল্পসূত্র পাই- (১) গৃহ্যসূত্র, (২) ধর্মসূত্র, (৩) শ্রৌতসূত্র এবং (৪) শুল্বসূত্র।
প্রত্যেক বেদেরও পৃথক পৃথক কল্পসূত্র আছে। প্রাচীনকালে বেদের যতগুলো শাখা ছিল, ঠিক ততগুলিই কল্পসূত্র ছিল বলে বিশ্বাস। প্রাচীন উৎস থেকে জানা যায়, পূর্বে কল্পসূত্র ছিল ১১৩০টি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে এতগুলো কল্পসূত্র পাওয়া যায় না। বর্তমানে পাওয়া যায় প্রায় ৫০টি কল্পসূত্র। নিচে এর তালিকা দেয়া হলো।
ঋগ্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন (৩) পরশুরাম।
গৃহ্যসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন।
ধর্মসূত্র : (১) বশিষ্ঠ
সামবেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) লাট্যায়ন বা আর্ষেয়কল্প (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয়।
গৃহ্যসূত্র : (১) গোভিল (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয় (৪) খাদির।
ধর্মসূত্র : (১) গৌতম।
কৃষ্ণযজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) সত্যাষাঢ় বা হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
গৃহ্যসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) ভারদ্বাজ (৬) বারাহ (৭) কাঠক (৮) লৌগাক্ষি (৯) বৈখানস (১০) বাধুল।
ধর্মসূত্র : (১) মানব (২) বৌধায়ন (৩) আপস্তম্ব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
শুল্বসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) হিরণ্যকেশী (৪) কাঠক (৫) মানব (৬) বারাহ।
শুক্লযজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
গৃহ্যসূত্র : (১) পারস্কর বা বাজসনেয়।
ধর্মসূত্র : (১) শঙ্খ (২) লিখিত।
শুল্বসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
অথর্ববেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৈতান।
গৃহ্যসূত্র : (১) কৌশিক।
ধর্মসূত্র : (১) পঠিনসী।
শ্রৌতসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
গৃহ্যসূত্র : (১) পারস্কর বা বাজসনেয়।
ধর্মসূত্র : (১) শঙ্খ (২) লিখিত।
শুল্বসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
অথর্ববেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৈতান।
গৃহ্যসূত্র : (১) কৌশিক।
ধর্মসূত্র : (১) পঠিনসী।
ঋগ্বেদ, সামবেদ, শুক্লযজুর্বেদ, কৃষ্ণযজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ এ পাঁচপ্রকারের প্রত্যেকের অন্তর্ভুক্ত সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ নিয়ে সমগ্র বেদবিদ্যা। এর মধ্যে শুধু অথর্ববেদের কোন আরণ্যক নেই।
ষড়বেদাঙ্গ। শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতিষ। অথর্ববেদীয় মুণ্ডক উপনিষদে আমরা বেদাঙ্গ সহ বেদবিদ্যার তালিকা পাই- “তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।” (মুণ্ডক উপনিষদ: প্রথম মুণ্ডক, প্রথম অধ্যায়, মন্ত্র-৫)
–অপরা বিদ্যা ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ এ দশটি।
1Vedaবেদে ধ্বনিতত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেবার কারণে ধ্বনিতত্ত্বকে আলোচনার মাধ্যমেই প্রথম বেদাঙ্গ শিক্ষা শুরু হয়। যে শাস্ত্রে বর্ণ, স্বর, মাত্রা ইত্যাদির যথাযথ উচ্চারণ ও প্রয়োজনবিধি লিপিবদ্ধ আছে তাকে শিক্ষা বলে। প্রত্যেক বেদের সাথে শিক্ষা যুক্ত আছে। যথা- ঋগ্বেদ : পাণিনীয় শিক্ষা সামবেদ : নারদীয় শিক্ষা যজুর্বেদ : যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা অথর্ববেদ : মাণ্ডূকী শিক্ষা ।
1Vedaবেদে ধ্বনিতত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেবার কারণে ধ্বনিতত্ত্বকে আলোচনার মাধ্যমেই প্রথম বেদাঙ্গ শিক্ষা শুরু হয়। যে শাস্ত্রে বর্ণ, স্বর, মাত্রা ইত্যাদির যথাযথ উচ্চারণ ও প্রয়োজনবিধি লিপিবদ্ধ আছে তাকে শিক্ষা বলে। প্রত্যেক বেদের সাথে শিক্ষা যুক্ত আছে। যথা- ঋগ্বেদ : পাণিনীয় শিক্ষা সামবেদ : নারদীয় শিক্ষা যজুর্বেদ : যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা অথর্ববেদ : মাণ্ডূকী শিক্ষা ।
২. কল্প : বেদাঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হলেও কল্পসূত্র গুলি মূল বেদের সাথে এমনভাবে যুক্ত যে চার প্রকার (ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ) বেদের সাথে সে অচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। তাই পূর্বে চার প্রকার বেদের সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের তালিকার সাথে সাথে চার প্রকার কল্পসূত্রেরও তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং কল্প সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা সেখানেই করা হয়েছে। তবুও আমরা চার প্রকার সূত্রের নাম দিয়ে দিচ্ছি।
শ্রৌতসূত্র : যাগযজ্ঞ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থা সংক্রান্ত সূত্র।
গূহ্যসূত্র : এ সূত্রগুলোকে আমরা এক কথায় বলতে পারি পারিবারিক আইন। অর্থাৎ একজন মানুষের পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করণীয় কর্তব্য।
ধর্মসূত্র : ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজনিষ্ঠ নাগরিক জীবনের কর্তব্য। এতে ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার বিধিনিষেধাদি লিপিবদ্ধ আছে।
শুল্বসূত্র : শুধুমাত্র যজুর্বেদেরই শুল্বসূত্র পাওয়া যায়। যজুর্বেদ যেহেতু যজ্ঞসম্বন্ধীয়, তাই যজ্ঞবেদির নির্মাণে শূল্বসূত্রের একান্ত প্রয়োজন। শুল্ব অর্থ পরিমাপ। বিধি প্রকার যজ্ঞবেদি নির্মাণে এ পরিমাপ একান্ত প্রয়োজনীয়। শুল্বসূত্রকে পৃথিবীর প্রাচীনতম জ্যামিতির নিদর্শন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে ইউক্লিড, থ্যালিস, পিথাগোরাসের বহু পূর্বে আমাদের দেশের ঋষিরা কত অসাধারণভাবে জ্যামিতি বিজ্ঞানের চর্চা করেছেন।
গূহ্যসূত্র : এ সূত্রগুলোকে আমরা এক কথায় বলতে পারি পারিবারিক আইন। অর্থাৎ একজন মানুষের পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করণীয় কর্তব্য।
ধর্মসূত্র : ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজনিষ্ঠ নাগরিক জীবনের কর্তব্য। এতে ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার বিধিনিষেধাদি লিপিবদ্ধ আছে।
শুল্বসূত্র : শুধুমাত্র যজুর্বেদেরই শুল্বসূত্র পাওয়া যায়। যজুর্বেদ যেহেতু যজ্ঞসম্বন্ধীয়, তাই যজ্ঞবেদির নির্মাণে শূল্বসূত্রের একান্ত প্রয়োজন। শুল্ব অর্থ পরিমাপ। বিধি প্রকার যজ্ঞবেদি নির্মাণে এ পরিমাপ একান্ত প্রয়োজনীয়। শুল্বসূত্রকে পৃথিবীর প্রাচীনতম জ্যামিতির নিদর্শন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে ইউক্লিড, থ্যালিস, পিথাগোরাসের বহু পূর্বে আমাদের দেশের ঋষিরা কত অসাধারণভাবে জ্যামিতি বিজ্ঞানের চর্চা করেছেন।
৩. নিরুক্ত: ‘নির্ঘণ্টু’ নামক পঞ্চ অধ্যায়ে বিভক্ত কোষ গ্রন্থই নিরুক্তের প্রাচীনতম উৎস। এ কোষ গ্রন্থটি অজানা কোন এক ঋষি প্রণীত। এ নির্ঘণ্টু নামক ১৭৭১টি শব্দতালিকার উপরই যাস্ক মুনি ব্যাখ্যামূলক একটি কোষগ্রন্থ রচনা করেন; তাই নিরুক্ত। নিঃশেষরূপে পদসমূহ এতে উক্ত হয়েছে বলে একে নিরুক্ত বলে। ‘নির্ঘণ্টু’ এবং যাস্কমুনি রচিত এর ব্যাখ্যা নিরুক্তই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন অভিধান কোষ।
নিরুক্ত তিনটি ভাগে বিভক্ত- (১) নৈর্ঘণ্টুকাণ্ড (২) নৈগম কাণ্ড ও (৩) দৈবত কাণ্ড।
৪. ব্যাকরণ: কোন একটি ভাষার ভিত্তিসৌধ রচিত হয় সেইভাষার ব্যাকরণের উপর। বেদের ন্যায় প্রাচীনতম ভাষার ক্ষেত্রে এ কথাটি সর্বাংশে সত্য। একারণে পাণিনীয় শিক্ষায় ব্যাকরণকে বেদের মুখ বলা হয়েছে। বি-আ-কৃ+অনট্= ব্যাকরণ। তাই ব্যাকরণ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ- ব্যাকৃত করা, প্রকাশিত করা, ছড়িয়ে দেয়া। বেদবিদ্যাকে প্রকাশিত করার জন্য ব্যাকরণবিহীন অসম্ভব। এ কারণে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে ব্যাকরণের প্রয়োজন বোঝানোর জন্য কাত্যায়ণ বররুচির একটি বার্ত্তিক উল্লেখ করা হয়েছে-‘রক্ষোহাগমলঘ¡সন্দেহাঃ প্রয়োজনম্।’ অর্থাৎ রক্ষা, ঊহ, আগম, লঘু এবং অসন্দেহ- এ পাঁচটি বিষয়ের জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন।
রক্ষা : বেদের রক্ষার জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন। প্রকৃতি, প্রত্যয়, সন্ধি, সমাস, বর্ণের লোপ, বর্ণের আগম, বর্ণবিকার সম্বন্ধে যিনি সঠিকভাবে জানেন তিনিই বিশুদ্ধভাবে বেদের জ্ঞান লাভ করতে পারবেন এবং বিশুদ্ধ বেদবিদ্যার ধারাকে রক্ষা করতে পারবেন।
ঊহ: সঠিক বিচার করে পরিবর্তন। কারণ বেদে সমস্ত লিঙ্গ এবং সমস্ত বিভক্তিতে মন্ত্রগুলি পঠিত হয়নি। যিনি যজ্ঞ করবেন তাঁর প্রধান কর্তব্য সঠিক ব্যাকরণ জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি যজ্ঞের প্রয়োজন অনুযায়ী মন্ত্রগুলির যথাযথ পরিবর্তন সাধন করে যজ্ঞকর্ম সমাধা করবেন।
আগম : কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয়ে ষড়বেদাঙ্গসহ বেদ অধ্যয়ন করা এবং অবগত হওয়া জ্ঞানী ব্যক্তির কর্তব্য। অর্থাৎ নিষ্কামভাবে বেদবিদ্যাকে ভালবেসে সঠিক বেদবিদ্যার চর্চার জন্যও ব্যাকরণের প্রয়োজন।
লঘু: লঘু অর্থ সংক্ষেপ। অর্থাৎ ভাষাকে সহজ এবং সংক্ষিপ করার জন্যও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করা উচিত। বেদজ্ঞকে সঠিক বেদজ্ঞানের জন্য অসংখ্য শব্দ জানতে হবে। কারণ শব্দজ্ঞানবিহীন ব্যক্তি বেদরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাই ব্যাকরণই একমাত্র সহজতর এবং সংক্ষেপতম উপায় যথার্থ শব্দ জ্ঞান লাভের।
অসন্দেহ: বেদমন্ত্রের সন্দেহ নিবারণের জন্যও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করা উচিত।
এ পাঁচটি প্রধান প্রয়োজনের অতিরিক্ত মহর্ষি পতঞ্জলি (খ্রি. পূ. দ্বিতীয় শতক) শব্দানুশাসনের অর্থাৎ ব্যাকরণের আরও ১৩টি প্রয়োজনের কথা বলেছেন-
(১) তেহসুরাঃ (২) দুষ্টঃ শব্দঃ (৩) যদধীতম্ (৪) যন্তু প্রযুঙ্ক্তে (৫) অবিদ্বাংসঃ (৬) বিভক্তিং কুর্বন্তি, (৭) যো বা ইমাম্ (৮) চত্বারি (৯) উত ত্বঃ (১০) সক্তুমিব (১১) সারস্বতীম্ (১২) দশম্যাং পুত্রস্য (১৩) সুদেবো অসি বরুণ
(১) তেহসুরাঃ (২) দুষ্টঃ শব্দঃ (৩) যদধীতম্ (৪) যন্তু প্রযুঙ্ক্তে (৫) অবিদ্বাংসঃ (৬) বিভক্তিং কুর্বন্তি, (৭) যো বা ইমাম্ (৮) চত্বারি (৯) উত ত্বঃ (১০) সক্তুমিব (১১) সারস্বতীম্ (১২) দশম্যাং পুত্রস্য (১৩) সুদেবো অসি বরুণ
৫. ছন্দ: বেদ মন্ত্রের জন্য ছন্দের জ্ঞান অপরিহার্য। কারণ চারবেদের অধিকাংশ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। বৈদিক ছন্দ সাতটি। গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী। বৈদিক ছন্দকে অক্ষরছন্দ বলা হয়। কারণ মন্ত্রের অক্ষরের সংখ্যা গুণে গুণে নির্ণয় করতে হয়। অক্ষর বলতে কোনবর্ণ নয়, শব্দ উচ্চারণের স্বল্পতম প্রয়াসকে বোঝায়। যাকে আমরা ইংরেজিতে Syllable বলি। গায়ত্রী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ২৪টি, উষ্ণিক ছন্দে ২৮টি, অনুষ্টুপ ছন্দে ৩২টি, বৃহতী ছন্দে ৩৬টি, পঙ্ক্তি ছন্দে ৪০টি, ত্রিষ্টুপ ছন্দে ৪৪টি এবং সর্বশেষে জগতী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ৪৮টি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় অসাধারণ গাণিতিক বিন্যাসে বৈদিক ছন্দের উদ্ভব। অর্থাৎ গায়ত্রী থেকে জগতী পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছন্দে পর্যায়ক্রমে চারটি করে অক্ষরের বৃদ্ধি ঘটেছে। এ কারণেই ঋষি কাত্যায়ন বলেছেন (কাত্যায়ন ১/১), “যিনি ঋষি ছন্দ দেবতা ও মন্ত্রের বিনিয়োগ না জেনে মন্ত্রের দ্বারা যাগ করেন বা অধ্যয়ন-অধ্যাপন করেন, তিনি কাঠের গুঁড়ির মত কেবল ভারবাহী হন অথবা গর্তে পতিত হয়ে পাপে আচ্ছন্ন হন।” একারণেই ছন্দ জানার জন্য ছন্দগ্রন্থের প্রয়োজন। ছন্দ সম্পর্কে যাস্কের নিরুক্তে বলা হয়েছে, ‘ছন্দাংসি ছাদনাৎ’ (৭/১২) অর্থাৎ আচ্ছাদন করে বলে তাকে ছন্দ বলে। কি থেকে আচ্ছাদন? পাপ থেকে আচ্ছাদন। অর্থাৎ যা মৃত্যু থেকে রক্ষা করে অমৃতে নিয়ে যায় তাই ছন্দ। পূর্বে হয়ত একাধিক ছন্দোগ্রন্থ ছিল কিন্তু বর্তমানে একমাত্র ঋষি পিঙ্গল রচিত ‘পিঙ্গলছন্দসূত্র’ই একমাত্র বিদ্যমান। পিঙ্গলছন্দসূত্রের উপর হলায়ুধ ভট্টের বৃত্তি অনন্য।
৬. জ্যোতিষ: ষড়বেদাঙ্গের সর্বশেষ জ্যোতিষ। এ জ্যোতিষ বর্তমানে প্রচলিত হস্তরেখা বিদ্যা নয়। এ হলো নক্ষত্রবিদ্যা। যাকে আমরা ইংরেজিতে বলতে পারি ‘ঠবফরপ অংঃৎড়হড়সু’। সে যুগে বর্তমান কালের মত ঘরে ঘরে ক্যালেন্ডার ছিল না, কিন্তু সে সময়েও তিথি-নক্ষত্রের হিসাব রাখতে হতো। শ্রৌতশাস্ত্রগুলোর মধ্যে দেখা যায় অধিকাংশ যজ্ঞেরই তিথি নক্ষত্র এবং ঋতু উল্লেখ করে দেয়া আছে। অর্থাৎ কখন এ যজ্ঞকর্মটি করতে হবে। যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে যে ‘দশপূর্ণমাস’ নামক যজ্ঞের কথা বলা আছে তা অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত করতে হয়। অর্থাৎ কেউ যদি কখন অমাবস্যা এবং কখন পূর্ণিমা তা না জানেন তাহলে সে যজ্ঞ কর্ম সমাধা করতে পারবেন না। এ কারণেই তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে, ‘যজ্ঞকাল সিদ্ধির জন্য জ্যোতিষের প্রয়োজন’। বৈদিক জ্যোতিষের বিভিন্ন তত্ত্বের উল্লেখ পাই আমরা ঋগ্বেদের কিছু মন্ত্রে এবং শতপথব্রাহ্মণে। বৈদিক জ্যোতিষের দুটি গ্রন্থ পাওয়া যায়-একটি ঋগে¦দীয়, এতে আছে ৩৬টি শ্লোক এবং অন্যটি যজুর্বেদীয়, এতে আছে ৪৩টি শ্লোক। এ গ্রন্থ দুটিতে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নে চন্দ্রসূর্যের অবস্থান অমাবস্যা, পূর্ণিমা তিথি এবং নক্ষত্রম-ল ইত্যাদি বিবিধ বৈজ্ঞানিক বিষয়ের আলোচনা আছে।
বেদান্ত
ভারতীয় পরম্পরার বৈশিষ্ট্যই হলো কোন বিষয় যেমন খুব বড় কাঠামোতে থাকে ঠিক তেমনিভাবে অতি ক্ষুদ্র কাঠামোতে সূত্রাকারেও থাকে। যজ্ঞ কর্মের বিধানগুলো শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতো বৃহৎ বৃহৎ ব্রাহ্মণগুলোতে যেমন বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। ঠিক তেমনি এ বিধানগুলোই আছে বিভিন্ন শ্রৌতসূত্রগুলোতে সূত্রাকারে সংক্ষিপ্তভাবে। বেদান্তে যে জ্ঞানের কথা আছে তাই আছে বেদান্তসূত্রে। যা আমাদের কাছে ব্রহ্মসূত্র নামে প্রচলিত। এর অন্য নাম ব্যাসসূত্র, ভিক্ষুসূত্র, শারীরিকসূত্র, বাদরায়ণসূত্র ইত্যাদি। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বেদ দুটি কাণ্ডে বিভক্ত- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা জ্ঞানকাণ্ড। কিন্তু প্রচলিত এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বেদ অর্থই জ্ঞান। সর্বপ্রকার জ্ঞান যা জীবকে নিঃশ্রেয়স এবং অভ্যুদয় দুই দান করে। অভ্যুদয়ের মাধ্যমে আমরা জাগতিক সমৃদ্ধি লাভ করি এবং নিশ্রেয়সের মাধ্যমে আমরা মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ ও কৈবল্য লাভ করি। যদিও বেদ মানে জ্ঞান এবং বেদবিদ্যার সর্বস্থানেই জ্ঞানতত্ত্ব আছে। এরপরও আমরা বেদের জ্ঞানকাণ্ডের শেষ অংশকে অর্থাৎ উপনিষদকে সাধারণত বেদান্ত বলে থাকি। উপনিষদগুলো বেদের কোন না কোন অংশের সাথে যুক্ত। কোনটি সংহিতার সাথে, কোনটি ব্রাহ্মণের সাথে, কোনটি আরণ্যকের অথবা কোনটি পরম্পরাগতভাবে যুক্ত।
ভারতীয় পরম্পরার বৈশিষ্ট্যই হলো কোন বিষয় যেমন খুব বড় কাঠামোতে থাকে ঠিক তেমনিভাবে অতি ক্ষুদ্র কাঠামোতে সূত্রাকারেও থাকে। যজ্ঞ কর্মের বিধানগুলো শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতো বৃহৎ বৃহৎ ব্রাহ্মণগুলোতে যেমন বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। ঠিক তেমনি এ বিধানগুলোই আছে বিভিন্ন শ্রৌতসূত্রগুলোতে সূত্রাকারে সংক্ষিপ্তভাবে। বেদান্তে যে জ্ঞানের কথা আছে তাই আছে বেদান্তসূত্রে। যা আমাদের কাছে ব্রহ্মসূত্র নামে প্রচলিত। এর অন্য নাম ব্যাসসূত্র, ভিক্ষুসূত্র, শারীরিকসূত্র, বাদরায়ণসূত্র ইত্যাদি। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বেদ দুটি কাণ্ডে বিভক্ত- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা জ্ঞানকাণ্ড। কিন্তু প্রচলিত এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বেদ অর্থই জ্ঞান। সর্বপ্রকার জ্ঞান যা জীবকে নিঃশ্রেয়স এবং অভ্যুদয় দুই দান করে। অভ্যুদয়ের মাধ্যমে আমরা জাগতিক সমৃদ্ধি লাভ করি এবং নিশ্রেয়সের মাধ্যমে আমরা মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ ও কৈবল্য লাভ করি। যদিও বেদ মানে জ্ঞান এবং বেদবিদ্যার সর্বস্থানেই জ্ঞানতত্ত্ব আছে। এরপরও আমরা বেদের জ্ঞানকাণ্ডের শেষ অংশকে অর্থাৎ উপনিষদকে সাধারণত বেদান্ত বলে থাকি। উপনিষদগুলো বেদের কোন না কোন অংশের সাথে যুক্ত। কোনটি সংহিতার সাথে, কোনটি ব্রাহ্মণের সাথে, কোনটি আরণ্যকের অথবা কোনটি পরম্পরাগতভাবে যুক্ত।
আরণ্যকে যে অধ্যাত্মবিদ্যার সূচনা উপনিষদে তা চরম শিখরে পৌঁছে জ্ঞানরাজ্যের মুকুটমণিতে পরিণত হয়েছে। উপনিষদ শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো উপ-নি+সদ্+ক্বিপ্=উপনিষধদ। ‘উপ’ অর্থ নিকটে। ‘নি’ অর্থ নিশ্চিতভাবে। ‘সদ্’ অর্থ বিনাশ করা। অর্থাৎ ব্যুৎপত্তিগতভাবে উপনিষদ শব্দের অর্থ হল আচার্যের নিকট উপস্থিত হয়ে নিশ্চয়ের সাথে বেদবিদ্যা অনুশীলনের মাধ্যমে অজ্ঞান-অবিদ্যার যা বিনাশ করে তাই উপনিষদ। উপনিষদ ১৪টি।
ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদ এবং কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন উপনিষদ।
সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং কেন ‘উপনিষদ।
কৃষ্ণযজুর্বেদের-কঠ উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, মৈত্রায়নী উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং মহানারায়ণ উপনিষদ।
শুক্লযজুর্বেদের- ঈশ উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ।
পরিশেষে অথর্ববেদের প্রশ্ন উপনিষদ, মণ্ডুক উপনিষদ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদ।
এ উপনিষদগুলো ব্যতীত অন্য যেসব উপনিষদ আছে তা শুধু নামেই উপনিষদ। এর সাথে বেদের কোন রূপ সম্পর্ক নেই।
‘বেদান্ত’ বললে যেমন শুধু উপনিষদকে বোঝায়, তেমনিভাবে ‘বেদান্তদর্শন’ বললে বোঝায় প্রস্থানত্রয়ীকে। ‘প্রস্থান’ বলতে চলে যাওয়া বোঝায়। কোথায় চলে যাওয়া? তত্ত্বেও চলে যাওয়া, ব্রহ্মের কাছে চলে যাওয়া। এ প্রস্থান অর্থাৎ ব্রহ্মের কাছে চলে যাবার পথ তিন প্রকার।
সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং কেন ‘উপনিষদ।
কৃষ্ণযজুর্বেদের-কঠ উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, মৈত্রায়নী উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং মহানারায়ণ উপনিষদ।
শুক্লযজুর্বেদের- ঈশ উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ।
পরিশেষে অথর্ববেদের প্রশ্ন উপনিষদ, মণ্ডুক উপনিষদ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদ।
এ উপনিষদগুলো ব্যতীত অন্য যেসব উপনিষদ আছে তা শুধু নামেই উপনিষদ। এর সাথে বেদের কোন রূপ সম্পর্ক নেই।
‘বেদান্ত’ বললে যেমন শুধু উপনিষদকে বোঝায়, তেমনিভাবে ‘বেদান্তদর্শন’ বললে বোঝায় প্রস্থানত্রয়ীকে। ‘প্রস্থান’ বলতে চলে যাওয়া বোঝায়। কোথায় চলে যাওয়া? তত্ত্বেও চলে যাওয়া, ব্রহ্মের কাছে চলে যাওয়া। এ প্রস্থান অর্থাৎ ব্রহ্মের কাছে চলে যাবার পথ তিন প্রকার।
এ কারণে তাকে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয়। এ প্রস্থানত্রয়ী হলো-
(১) শ্রুতি প্রস্থান : বেদ শ্রুতি পরম্পরায় রক্ষিত ছিল বহুদিন। তাই তাঁর এক নাম শ্রুতি। শ্রুতি প্রস্থান বলতে উপনিষদকে বোঝায় অর্থাৎ উপনিষদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মাধ্যমে অমৃতময় ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থান করা।
(২) স্মৃতি প্রস্থান : বেদের জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদের সারাংশ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে বলা হয় স্মৃতিপ্রস্থান।
(৩) ন্যায় প্রস্থান : ঋষি বাদরায়ণ রচিত ব্রহ্মসূত্র। যা চারটি অধ্যায়ে এবং ৫৫৫টি সূত্রে অখিল বেদবিদ্যাকে প্রকাশ করেছে। প্রথম অধ্যায়ে বেদবাক্যসমূহের সমন্বয়, দ্বিতীয় অধ্যায়ে অবিরোধ, তৃতীয় অধ্যায়ে সাধন এবং চতুর্থ অধ্যায়ে সিদ্ধি বা ফল বর্ণনা করে অনন্ত অধ্যাত্ম শাস্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ সংক্ষিপ্ত সূত্রশাস্ত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থিত হবার অনন্য পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। বেদান্তদর্শন বা প্রস্থানত্রয়ীর দিকে তাকালে আমরা দেখি বেদের লক্ষ লক্ষ মন্ত্রকে সারাংশ করে নিয়ে আসা হয়েছে বেদের জ্ঞানকা- উপনিষদে।
(১) শ্রুতি প্রস্থান : বেদ শ্রুতি পরম্পরায় রক্ষিত ছিল বহুদিন। তাই তাঁর এক নাম শ্রুতি। শ্রুতি প্রস্থান বলতে উপনিষদকে বোঝায় অর্থাৎ উপনিষদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মাধ্যমে অমৃতময় ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থান করা।
(২) স্মৃতি প্রস্থান : বেদের জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদের সারাংশ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে বলা হয় স্মৃতিপ্রস্থান।
(৩) ন্যায় প্রস্থান : ঋষি বাদরায়ণ রচিত ব্রহ্মসূত্র। যা চারটি অধ্যায়ে এবং ৫৫৫টি সূত্রে অখিল বেদবিদ্যাকে প্রকাশ করেছে। প্রথম অধ্যায়ে বেদবাক্যসমূহের সমন্বয়, দ্বিতীয় অধ্যায়ে অবিরোধ, তৃতীয় অধ্যায়ে সাধন এবং চতুর্থ অধ্যায়ে সিদ্ধি বা ফল বর্ণনা করে অনন্ত অধ্যাত্ম শাস্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ সংক্ষিপ্ত সূত্রশাস্ত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থিত হবার অনন্য পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। বেদান্তদর্শন বা প্রস্থানত্রয়ীর দিকে তাকালে আমরা দেখি বেদের লক্ষ লক্ষ মন্ত্রকে সারাংশ করে নিয়ে আসা হয়েছে বেদের জ্ঞানকা- উপনিষদে।
বেদ পরা বিদ্যা বা অথর্ববেদের ভাষায় বেদ হল পরাবতি সমুদ্র।
বেদ অপরা বিদ্যাও বটে। মুন্ডক ১/১/৫ এর ভাষ্য মতে বেদ অপরা বিদ্যা।
পরা অপরা শব্দের সমাধান।
বেদ বানী রূপে বিস্তৃত। বানীর ভেদ চার প্রকার। ১) পরা ২) পশ্যন্তি ৩) মধ্যমা ৪) বৈখরী।।
বেদের এই চার অবস্থা।
পরাবানী হল শাশ্বত অনাদি অবস্থা সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তিন কালে যে বানী একই অবস্থায় বিদ্যমান থাকেন তাকে পরাবানী বলে। পরাবানীকে পরমাত্মা ওম্ সদা নিয়ন্ত্রন করেন। তাই বাকি তিন বানী হতে পরা বানী জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ। পরা বানী ভিন্ন বাকি তিন বানী অপরা অক্ষর বা বিদ্যা। পশ্যন্তি,মধ্যমা, বৈখরী। এই তিন বানী পরা বানীর প্রভাবেই উৎপন্ন হয় তা এই তিন বানীকে ঋষি অপরা বলিলেন। বস্তুত বেদ বানী রূপে বিস্তৃত বলেই বেদ পরাঅপরা উভয় বিদ্যা বা অক্ষর রশ্মি।
মুন্ডক উপনিষদঃ।
তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহ্থর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।। ৫।।
পদার্থঃ (তত্র) তাহাতে (ঋগ্বেদঃ) ঋচাসমুহ (যজুর্বেদঃ) যজুর্বেদ (সামবেদঃ) সামবেদ (অথর্ববেদঃ) অথর্ব বেদ (শিক্ষা) স্বর বর্ণ এবং উচ্চরণ বিধি ( কল্পঃ) সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় বিষয়ক ঋচা সমুহ (ব্যাকারণ) শব্দ শাস্ত্র (নিরুক্তম্) বেদ শব্দার্থ (ছন্দঃ) ছন্দশাস্ত্র ( জ্যোতিষম্) জ্যোতির বিদ্যা ইতি ইহা সব ( অপরা) অপরা বানী (যথা) যাহা হতে ( তদক্ষরম্) এই অবিনাশী অক্ষর রশ্মি সকল ( অধিগম্যতে) জানা যায়।।
ভাবার্থঃ সৃষ্টির প্রথম পরা বানীই মুক্ত থাকে যদ্বারা অন্যান্য অক্ষর রশ্মির সৃষ্টি হয়। অক্ষর রশ্মি তথা পরা ওম্ রশ্মির প্রভাবে ঋক,সাম,যজু অথর্ব বেদ অাদি রশ্মির সৃষ্টি হয়ে থাকে। বেদ বানীরূপেই বিস্তৃত। পরা বানী হতে সৃষ্ট অন্য তিন বানী অপরা বানীর অন্তর্গত। অতএব বেদ পরা এবং অপরা উভয় বানীর রূপ হয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ