মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কি সত্যার্থ প্রকাশে শূদ্রদের বেদ অধিকার প্রসঙ্গে স্ববিরোধী কথা বলেছেন ?
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী নাকি ওনার রচিত সত্যার্থ প্রকাশে শুদ্রদের বেদ অধিকার প্রসঙ্গে স্ববিরোধী কথা বলেছেন! এইরূপ কোন এক অতিমূর্খর পোষ্টের খন্ডনের নিমিত্তে আমার নিম্নোক্ত সরল কথন!
মূর্খ কাকে বলে ও কত প্রকার তা তোমার কথাতেই ফুটে উঠল যে কিনা সত্যার্থ প্রকাশের বাংলা লেখাই বুঝে পড়তে পারে না!!! কারণ, তুমি এখানে (সত্যার্থ প্রকাশের ৩য় সমুল্লাসে অগ্নিহোত্র ও আহুতি প্রসঙ্গের আলোচনায়) সুশ্রুত সূত্রস্থানের ২য় অধ্যায়ের বাণীকে মহর্ষি দয়ানন্দজীর (বেদ পাঠে শুদ্রদের অধিকার নেই) সিদ্ধান্ত বলে ভুল করেছ। তুমি সত্যার্থ প্রকাশের লেখাটিকে হলুদ কালি দিয়ে মার্কিং করে দেখানোর চেষ্টা করেছ যে- "শূদ্র কুলীন ও শুভ লক্ষনযুক্ত হইলে তাহাকে মন্ত্রসংহিতা ব্যাতীত সকল শাস্ত্র পড়াইবে৷"
এইটা আসলে মহর্ষির কোন মত বা সিদ্ধান্তই নয় বরং তিনি সুশ্রুত সূত্রের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন (তাও তিনি বেদ পাঠের অধিকার প্রসঙ্গে এই শ্লোকটিকে উল্লেখ করেনি)। এছাড়া মহর্ষি অন্যান্য আচার্যদের প্রসঙ্গ এনে এটাও বলেছেন যে
"অনেক আচার্যের মত এই যে, শূদ্র বিদ্যা শিক্ষা করিবে কিন্তু তাহার উপনয়ন হইবে না।"
এই উক্তিটিও দয়ানন্দজীর মত বা সিদ্ধান্ত নয়, কারণ তিনি এখানে নিজের কোন সিদ্ধান্তই উপস্থাপন করেনি।বরংচ বলেছেন অনেক আচার্য এমন বলে থাকেন।
প্রশ্ন হল তাহলে বেদ পাঠ সম্মন্ধে দয়ানন্দজীর নিজের সিদ্ধান্ত কি?
সত্যার্থ প্রকাশের ৩য় সমুল্লাসে যর্জুবেদ ২৬/২ অনুসরন করেই দয়ানন্দ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন শূদ্রসহ সকলেইবেদপাঠ করতে পারবে৷ আমি মহর্ষিরর পুরো লেখাটাই কপি করে দিলাম, অবশ্যই তুমি কুলীন ও শুভ লক্ষণ যুক্ত শুদ্র কিনা তাতেই আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। তাই এই লেখাটিও বুঝতে পারবে কিনা সন্ধেহ হচ্ছে! তারপরও পড়ে দেখ-
(প্রশ্ন)–স্ত্রী শূদ্রও কি বেদ পাঠ করিবে? ইহারা যদি বেদপাঠ করে তবে আমরা কি করিব? আর ইহাদের বেদপাঠ বিষয়ে কোন প্রমাণও নাই, বরং নিষেধ আছে, যথা–
স্ত্রীশূদ্রৌ নাধিয়াতামিতি শ্রুতেঃ।।
এই শ্রুতি আছে যে স্ত্রী এবং শূদ্র বেদপাঠ করিবেনা।
(উত্তর)–স্ত্রী পুরুষ সকলের অর্থাৎ মনুষ্যমাত্রেরই বেদপাঠ করিবার অধিকার আছে। তুমি অধঃপাতে যাও! এই শ্রুতি তোমার কপোল কল্পিত। ইহা কোন প্রামাণিক গ্রন্থের উদ্ধরণ নহে। সকলের যে বেদাদি শাস্ত্র পড়িবার ও শুনিবার অধিকার আছে, সে বিষয়ে যজুর্ব্বেদের ষড়্বিংশতি অধ্যায়ে দ্বিতীয় মন্ত্র প্রমাণ; যথাঃ–
পরমেশ্বর বলিতেছেন (যথা) যেমন আমি (জনেভ্যঃ) সকল মনুষ্যের জন্য (ইমাম্) এই (কল্যাণীম্) কল্যাণ অর্থাৎ সাংসারিক সুখ এবং মুক্তি, সুখ প্রদায়িণী (বাচম্) ঋগ্বেদের চারি বেদের বাণী (আবদানি) উপদেশ করতেছি সেইতূপ তোমরাও উপদেশ করিতে থাক।
এই স্থলে যদি কেহ প্রশ্ন করেন যে, “জন” শব্দ দ্বিজ অর্থে গ্রহণ করা উচিত, কারণ স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিত আছে যে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যেরই বেদপাঠে অধিকার আছে, স্ত্রী ও শূদ্রাদি বর্ণের নাই।
(উত্তর)–(ব্রহ্মরাজন্যাব্যাম্) ইত্যাদি দেখ।
পরমেশ্বর স্বয়ং বলিতেছেন, “আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, (অর্য্যায়) বৈশ্য, (শূদ্রায়) শূদ্র এবং (স্বায়) নিজের ভৃত্য বা স্ত্রী আদি এবং (অরণায়) অতি শূদ্রাদির জন্যও বেদ প্রকাশ করিয়াছি” অর্থাৎ সকল মনুষ্য বেদের অধ্যয়ণ, অধ্যাপনা, শ্রবণ ও শ্রাবণ দ্বারা বিজ্ঞান বৃদ্ধি করিয়া সদ্বিষয়ের গ্রহণ এবং অসদ্বিষয়ের বর্জ্জন পূর্ব্বক দুঃখবিমুক্ত হইয়া আনন্দ প্রাপ্ত হউক
এছাড়াও ঋগবেদাদি ভাষ্যভূমিকা এর ২৬ নং অংশ (অধিকারানধিকারবিষয়ঃ) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে- "সকলেরই বেদ পাঠের অধিকার আছে।"
তুমি এতই মূর্খ যে, বেদ পাঠের অধিকার এর সাথে যজ্ঞোপবীত ধারণের প্রসঙ্গকে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছ! কারণ, সুশ্রুতের সূত্রস্থানের ঐ প্রসঙ্গটা মহর্ষি এনেছিলেন যজ্ঞে আহুতি দেওয়া প্রসঙ্গে। বেদ পাঠের অধিকার প্রসঙ্গে নয়। আর বেদ পাঠের অধিকারের প্রসঙ্গে মহর্ষি সরাসরি যজুর্বেদ ২৬/২ থেকেই প্রমাণ দিয়েছেন এবং নিজের মতও উপস্থাপন করেছেন।
বর্তমানে অনলাইনে বেদ এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা ব্যক্তিদের অধিকাংশই যজ্ঞোপবীত ধারণ না করে বেদ অধ্যায়ন করে লেখালেখি করছে। কিন্তু এই সকল লোকের বৈদিক যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার অধিকার নেই। আমরা সকলেই জানি অধিকাংশ আচার্যের এই মত যে-যজ্ঞোপবীত ধারণ না করলে তথা উপনয়ন সংস্কার না হলে মনুষ্য বৈদিক কর্মের অধিকারী হয় না।
যজ্ঞোপবীত বিহীন ব্যক্তির বৈদিক ক্রিয়ার কোন অধিকার নেই (যেমন কিনা স্কুলে ভর্তি না হলে সেই স্কুলে পড়ার অধিকার থাকে না)। আর এই অধিকার প্রাপ্ত করার জন্যই যজ্ঞোপবীত ধারণ করানো হয়। তাছাড়া-
তদেতৎ সর্বমাপ্নোতি যজ্ঞে শ্রোত্রামণি সুতে
আর এই কারণেই মূলত মহর্ষি দয়ানন্দ যজ্ঞে আহুতি দেওয়া প্রসঙ্গে অন্যান্য আচার্যদের মতকে শুধু উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোন মত উপস্থাপন করেনি। ওখানে তিনি বেদপাঠ বিষয়ে শুদ্রদের অধিকার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তই দেননি। আর তোমার মত অতিশুদ্র যারা আছ-যারা কিনা কুকুরের লেজের মতই সারাদিন নড়া চড়া কর। কিন্তু তা প্রকৃতপক্ষে অন্তত গরুর ছাগলের মত মশা মাছি তাড়ানোর মত কোন কাজেই আসে না! তুমি কি করে বেদ বুঝিবে সেই সংশ্চয়েই আমি ভুগছি! যে কিনা সত্যার্থ প্রকাশের সহজ সরল বাংলা লেখাই বুঝতে পারলে না!
.
চাণক্যের একটি শ্লোক মনে পড়ছে তোমার আর্টিকেল দেখে, তা হল-
"যে কোনও পুস্তক পাঠ উপযুক্ত গুরুর কাছেই অধ্যায়ন করা সমীচিন। যদি কেউ মনে করে শুধু পুস্তক পাঠ করেই বিদ্বান হয়ে যাবো। তবে তার মতো মূর্খ আর কেউ হতে পারে না। এ ধরণের জ্ঞান খারাপ ফলদান করে থাকে। এরূপ ব্যক্তি অবৈধ গর্ভবতী স্ত্রীলোকের ন্যায়, সামনে কোনও সম্মান লাভ করে না।"
.
তোমার আর্টিকেলটা পড়ে তোমাকেও ঐরূপ অবৈধ গর্ভবতী স্ত্রীলোকের মত মনে হচ্ছে। সম্ভবত লোকদের দেখেই পূর্বের বিভিন্ন আচার্যগণ ও সুশ্রুত সূত্রস্থানের রচয়িতা মন্ত্র সংহিতা বা বেদ ব্যতিত সকল শাস্ত্র পড়ানোর কথা বলেছিলেন। কারণ, তোমরা তো প্রসঙ্গ অনুসারে সত্যার্থ প্রকাশের বাংলা লিখাই বুঝে পড়তে পারছ না! তাহলে এখন আমি ঐ আচার্যগণের আর কি দোষ দিব।
যাই হোক বেদের আলোকে মহর্ষির মত এটাই যে- শুদ্রদেরও বেদ পাঠে অধিকার আছে। তারপরও যদি তোমার বেদের সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন আচার্যদের রচিত শাস্ত্র বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে মহর্ষি মনু রচিত মনুসংহিতার সেই শ্লোকগুলোকেই মনে করিয়ে দেই তোমাকে। যা কিনা দয়ানন্দজীও ওনার সত্যার্থ প্রকাশে বলেছেন, আর তা হল-
.
"ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।
মনুঃ ২/১৩.
অর্থাৎ ধর্ম জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের কাছে বেদই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। (আর বেদ ও আচার্যদের লিখিত স্মৃতিশাস্ত্র এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বেদই পরম প্রমাণ, অন্যগুলো নয়।
কারণ-
"য়া বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো য়াশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতাঃ।।"
মনুঃ ১২/৯৫.
অর্থাৎ বেদ বিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ তর্কযুক্ত মতবাদসমূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত সব নিষ্ফল বলে প্রতিভাত হয় এবং তমোনিষ্ঠ বা অন্ধকার যুক্ত বলে প্রমাণ হয়ে থাকে।
"সর্বং তু সমবেক্ষ্যেদং নিখিলং জ্ঞানচক্ষুষা।
শ্রুতি প্রামাণ্যতো বিদ্বান্ স্বধর্মে নিবিশেত বৈ।।"
মনুঃ ২/৮.
অর্থাৎ বিদ্বান ব্যক্তি সমস্ত বিষয়ে জ্ঞানরূপ চক্ষু দ্বারা ভালো ভাবে বিচার পূর্বক নিরূপন করে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে নিজ ধর্মে নিবিষ্ট হবেন।
কেননা- "বেদোহখিলো ধর্মমূলং "
মনু ২/৬
অর্থাৎ বেদই অক্ষিল ধর্মের মূল।
আশাকরি হিংসার বশবর্তী না হয়ে পরনিন্দা থেকে দূরে থাকবে। কারণ অথর্ববেদ ৩/২৭/১-৬ এই ছয়টি মন্ত্রে বলা আছে- "য়ো৩স্মান্দ্বেষ্টি য়ং বয়ং দ্বিষ্মস্তং বো জম্ভে দধমঃ।
. ওম্ শান্তি শান্তি শান্তি
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ