শ্রীমদ্ভগবতগীতা দ্বিতীয় অধ্যায় -
সঞ্জয় উবাচ
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ।।১।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-অর্জুনকে এভাবে অনুতপ্ত, ব্যাকুল ও অশ্রুসিক্ত দেখে, কৃপায় আবিষ্ট হয়ে মধুসূদন বা শ্রীকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন।
সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় বলিলেন) তথা (তথাবিধ) কৃপয়া আবিষ্টম্ (কৃপাপরবশ) অশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্ (অশ্রুপূর্ণাকুলনয়ন) বিষীদন্তং তং (বিষণ্ণ বদন অর্জ্জুনকে) মধুসূদনঃ (শ্রীকৃষ্ণ) ইদং বাক্যম্ (এই বাক্য) উবাচ (বলিলেন) ॥১॥
সঞ্জয় কহিলেন—মধুসূদন তখন সেই অশ্রুপূ্র্ণ আকুল নয়ন কৃপাবিষ্ট বিষণ্ণানন অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন ॥১॥
শ্রীভগবানুবাচ
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন।।২।।
অনুবাদঃ পুরুষোত্তম শ্রীভগবান বললেন-প্রিয় অর্জুন, এই ঘোর সঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকুত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে।
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন ! ) কুতঃ (কি হেতু) বিষমে (এই সংগ্রাম-সংকটে) অনার্য্যজুষ্টম্ (আর্য্যগণের অযোগ্য) অস্বর্গ্যম্ (স্বর্গ-প্রতিবন্ধক) অকীর্ত্তিকরম্ (এবং অযশস্কর) ইদং কশ্মলম্ (এই মোহ) ত্বা (তোমার) সমুপস্থিতম্ (উপস্থিত হইল) ॥২॥
শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে অর্জ্জুন ! এই বিষম যুদ্ধ সময়ে কি জন্য তোমার অনার্য্যোচিত, অস্বর্গকর ও কীর্ত্তি নাশক এই মোহ উপস্থিত হইল ? ॥২॥
ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।৩।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই সম্মান হানিকর। ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না। এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত। হে পরন্তপ!হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও।
[হে] পার্থ ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ (কাতরতাপ্রাপ্ত হইও না) এতৎ (এই কাতরতা) ত্বয়ি (তোমাতে) ন উপপদ্যতে (শোভা পায় না) । [হে] পরন্তপ ! (হে শত্রু তাপন !) ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্ব্বল্যম্ (ক্ষুদ্র মানসিক দুর্ব্বলতা) ত্যক্ত্বা (পরিত্যাগ করিয়া) উত্তিষ্ঠ (উঠ, যুদ্ধার্থ উত্থিত হও) ॥৩॥
হে পার্থ ! কাতরতা ত্যাগ কর, কাতরতা তোমার উপযুক্ত নহে । হে পরন্তপ ! ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্ব্বল্য পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধার্থ উত্থিত হও ॥৩॥
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন।।৪।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে অরিসূদন! হে মধুসূদন! এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো পরম পূজনীয় ব্যক্তিদের কেমন করে আমি বাণের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব?
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] অরিসূদন ! মধুসূদন ! (হে শত্রু নাশক মধুসূদন !) অহং (আমি) পূজার্হৌ (পূজনীয়) ভীষ্মং দ্রোণঞ্চ (ভীষ্ম ও দ্রোণকে) [লক্ষীকৃত্য] (লক্ষ্য করিয়া) কথং (কি প্রকারে) সংখ্যে (যুদ্ধে) ইষুভিঃ (বাণ দ্বারা) প্রতিযোৎস্যামি (প্রতি যুদ্ধ করিব) ॥৪॥
অর্জ্জুন কহিলেন—হে অরিনিসূদন মধুসূদন ! যুদ্ধে আমি কি প্রকারে পূজনীয় পিতামহ ভীষ্ম ও আচার্য্য দ্রোণের সহিত বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব ॥৪॥
গুরুনহত্বা হি মহানুভাবান্
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরুনিহৈব
ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্।।৫।।
অনুবাদঃ আমার মহানুভক শিক্ষাগুরুদের জীবন হানি করে এই জগৎ ভোগ করার থেকে বরং ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ভাল। তাঁরা পার্থিব বস্তুর অভিলাষী হলেও আমার গুরুজন। তাঁদের হত্যা করা হলে, যুদ্ধলব্ধ সমস্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের রক্তমাখা হবে।
মহানুভাবান্ গুরূন্ (মহানুভাব গুরুদিগকে) অহত্বা হি (বধ না করিয়া) ইহ লোকে (এই জগতে) ভৈক্ষ্যম্ অপি ভোক্তুং (ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভোজন করাও) শ্রেয়ঃ (ভাল) । তু (কিন্তু) গুরূন্ হত্বা (গুরুবর্গকে বধ করিয়া) ইহ এব (ইহলোকেই) রুধিরপ্রদিগ্ধান্ (শোণিত লিপ্ত) অর্থ কামান্ ভোগান্ (অর্থ ও কামাদি ভোগ্য বস্তুসকল) ভুঞ্জীয় (আমাকে ভোগ করিতে হইবে) ॥৫॥
মহানুভাব গুরুজনদিগকে হত্যা না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভক্ষণ করাও মঙ্গলজনক, কিন্তু গুরুজনদিগকে হত্যা করিলে এই জগতেই তাহাদের রুধিরাক্ত অর্থ ও কামাদি ভোগ্যসমূহ আমাকে ভোগ করিতে হইবে ॥৫॥
ন চৈতদ্ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ্ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্
তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ।।৬।।
অনুবাদঃ তাদের জয় করা শ্রেয়, না তাদের দ্বারা পরাজিত হওয়া শ্রেয়, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করি, তা হলে আমাদের আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। তবুও এই রণাঙ্গনে তারা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।
যদ্ধা (যদিই) [বয়ং] (আমরা) জয়েম (জয় করি) যদি বা (কিংবা) [এতে] (ইহারা) নঃ জয়েয়ুঃ (আমাদিগকে জয় করুক) নঃ (আমাদের সম্বন্ধে) এতৎ কতরৎ (ইহার মধ্যে কোন্টি) গরীয়ঃ (অধিক শ্রেয়স্কর) ন চ বিদ্মঃ (তাহা বুঝিতেছি না) যান্ হত্বা (যাহাদিগকে বধ করিয়া) ন জিজীবিষামঃ এব (বাঁচিতেই ইচ্ছা করি না) তে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ (সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্ত্রগণ) প্রমুখে (যুদ্ধার্থ সম্মুখে) অবস্থিতাঃ (উপস্থিত রহিয়াছে) ॥৬॥
কোন্টি কোনটি আমাদের অধিক শ্রেয় তাহা বুঝিতেছি না । কেন না, জয় পরাজয় যাহাই হউক, যাহাদিগকে বধ করিয়া আমরা বাঁচিতেও ইচ্ছা করি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্ত্রগণ যুদ্ধার্থ পুরোভাগে অবস্থিত রহিয়াছে ॥৬॥
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মুঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।।৭।।
অনুবাদঃ কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল।এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও।
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ (চিত্তের দীনতা ও কুলক্ষয়জনিত দোষদ্বারা অভিভূত স্বভাব) [তথা] (এবং) ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ (ধর্ম্মাধর্ম্মনিশ্চয়বিষয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত) [অহং] (আমি) ত্বাং (আপনাকে) পৃচ্ছামি (জিজ্ঞাসা করিতেছি) মে (আমার পক্ষে) যৎ (যাহা) নিশ্চিতং শ্রেয়ঃ (যথার্থ মঙ্গলজনক) তৎ (তাহা) [ত্বম্] ব্রূহি (আপনি বলুন) । অহং (আমি) তে (আপনার) শিষ্যঃ (শাসনার্হ) [অতঃ] (অতএব) ত্বাং প্রপন্নম্ (আপনার শরণাগত) মাং (আমাকে) শাধি (শিক্ষা দান করুন) ॥৭॥
এক্ষণে কার্পণ্যদোষে আমার স্বভাব অভিভূত হওয়ায় ধর্ম্মবিষয়ে বিমূঢ়চিত্ত আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, আমার পক্ষে যাহা শ্রেয়স্কর তাহা আপনি নিশ্চয় করিয়া বলুন । আমি আপনার শিষ্য, অতএব আপনার শরণাপন্ন আমাকে শিক্ষা প্রদান করুন ॥৭॥
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভুমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্।।৮।।
অনুবাদঃ আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে যে শোক, তা দূর করবার কোন উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এমন কি স্বর্গের দেবতাদের মতো আধিপত্য নিয়ে সমৃদ্ধশালী, প্রতিদ্ধন্দ্বিতাবিহীন রাজ্য এই পৃথিবীতে লাভ করলেও আমার এই শোকের বিনাশ হবে না।
ভূমৌ (পৃথিবীতে) অসপত্নম্ (নিষ্কণ্টক) ঋদ্ধং (সমৃদ্ধ) রাজ্যং (রাজ্য) সুরাণামপি (এবং দেবতাগণেরও) আধিপত্যং চ অবাপ্য (আধিপত্য প্রাপ্ত হইয়া) যৎ (যে কর্ম্ম) ইন্দ্রিয়াণাম্ (ইন্দ্রিয়গণের) উচ্ছোষণম্ অতি শোষণ কর) মম (আমার) শোকম্ (শোক) অপনুদ্যাৎ (দূর করিবে) তৎ (তাহা) [অহং] (আমি) ন হি প্রপশ্যামি (দেখিতে পাইতেছি না) ॥৮॥
পৃথিবীর কণ্টকশূন্য সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ও স্বর্গের আধিপত্য, আমি এমন কোন উপায় দেখিতেছি না যাহা আমার ইন্দ্রিয়শোষণকারী এই শোক অপনোদন করিতে পারে ॥৮॥
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তুষ্ণীং বভূব হ।।৯।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-এভাবে মনোভাব ব্যক্ত করে গুড়াকেশ অর্জুন তখন হৃষীকেশকে বললেন, “হে গোবিন্দ! আমি যুদ্ধ করব না”, এই বলে তিনি মৌন হলেন।
সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় বলিলেন) পরন্তপঃ (শক্র মর্দ্দনকারী) গুড়াকেশঃ (জিতনিদ্র অর্জ্জুন) হৃষীকেশম্ (শ্রীকৃষ্ণকে) এবম্ উক্ত্বা (এরূপ বলিবার পর) [অহং] (আমি) ন যোৎস্যে (যুদ্ধ করিব না) ইতি (ইহা) গোবিন্দম্ (গোবিন্দকে) উক্ত্বা (বলিয়া) তূষ্ণীং (মৌনী) বভূব হ (হইয়া রহিলেন) ॥৯॥
সঞ্জয় কহিলেন—ইন্দ্রিয়াধিপতি শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিবার পর, জিতনিদ্র শত্রুতাপন অর্জ্জুন গোবিন্দকে ‘আমি যুদ্ধ করিব না’ এই বলিয়া মৌনী হইয়া রহিলেন ॥৯॥
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ।।১০।।
অনুবাদঃ হে ভরতবংশীয় ধৃতরাষ্ট্র! সেই সময় স্মিত হেসে, শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে বিষাদগ্রস্থ অর্জুনকে এই কথা বললেন।
[হে] ভারত ! (হে ধৃতরাষ্ট্র!) হৃষীকেশঃ (হৃষীকেশ) প্রহসন্ ইব (প্রসন্ন বদন হইয়া) উভয়োঃ সেনয়োঃ মধ্যে (দুই পক্ষের সৈন্যমধ্যে ) বিষীদন্তম্ (বিষাদগ্রস্ত) তম্ (অর্জ্জুনকে) ইদং বচঃ (এই কথা) উবাচ (বলিলেন) ॥১০॥
হে ভারত ! অনন্তর ভগবান্ হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যস্থলে বিষাদগ্রস্ত পার্থকে হাস্যযুক্ত প্রসন্ন বদনে এইকথা বলিলেন ॥১০॥
শ্রীভগবানুবাচ
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পন্ডিতাঃ।।১১।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-তুমি প্রাজ্ঞের মতো কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয়, সেই বিষয়ে শোক করছ। যাঁরা যথার্থই পন্ডিত তাঁরা কখনও জীবিত অথবা মৃত কারও জন্যই শোক করেন না।
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) ত্বম্ (তুমি) অশোচ্যান্ (যাহাদের জন্য শোক করা অনুচিত তাহাদের জন্য) অন্বশোচঃ (শোক করিতেছ) প্রজ্ঞাবাদান্ চ ভাষসে (পণ্ডিতের ন্যায় কথাও বলিতেছ) [কিন্তু] পণ্ডিতাঃ (পণ্ডিতগণ) গতাসূন্ (মৃত) অগতাসূন্ চ (ও জীবিত বন্ধুদিগের জন্য) ন অনুশোচন্তি (অনুশোচনা করেন না) ॥১১॥
শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে অর্জ্জুন ! তুমি যে বিষয়ে শোক করা অনুচিত সেই বিষয়ে শোক করিতেছ আর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাক্য বলিতেছ । কিন্তু পণ্ডিতগণ কি জীবিত, কি মৃত কাহারও নিমিত্ত শোক করেন না ॥১১॥
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্।।১২।।
অনুুবাদঃ এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না।
অহং (আমি) জাতু (কদাচিৎ অর্থাৎ ইতঃপূর্ব্বে) ন আসম্ (ছিলাম না) ইতি তু ন এব (ইহা কিন্তু নহে) ত্বং ন (তুমি যে ছিলে না) [ইতি] (ইহাও) ন (নহে), ইমে জনাধিপাঃ (এই সকল নৃপতিগণ) ন (ছিলেন না) [ইতি] (ইহাও) ন (নহে) অতঃপরম্ চ (এবং অতঃপর) সর্ব্বে বয়ং (আমরা সকলে) ন ভবিষ্যামঃ (থাকিব না) [ইতি] (ইহাও) ন এব (নহে) ॥১২॥
পূর্ব্বে যে আমি কখনও ছিলাম না তাহা নহে । তুমিও যে ছিলে না এমনও নয় । এই রাজন্যবর্গও যে ছিল না তাহাও নহে । অর্থাৎ আমরা যেমন এখন আছি সেইরূপ পূর্ব্বেও ছিলাম এবং পরেও থাকিব ॥১২॥
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩।।
অনুবাদঃ দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পন্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।
যথা (যেমন) দেহিনঃ (দেহাভিমানী জীবের) অস্মিন্ দেহে (এই স্থূলদেহে) কৌমারং (কৌমার) যৌবনং (যৌবন) জরা (ও জরা) [ভবতি] (ঘটে) তথা (তেমন) দেহান্তর-প্রাপ্তিঃ (অন্য দেহ লাভও) [ভবতি] (ঘটে) ধীরঃ (ধীর ব্যাক্তি) তত্র (তাহাতে) ন মুহ্যতি (মোহপ্রাপ্ত হন না) ॥১৩॥
যেমন দেহধারী জীবের বর্ত্তমান দেহে ক্রমান্বয়ে কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্তি ঘটে সেইরূপ অপর দেহ প্রাপ্তিও ঘটিয়া থাকে । কিন্তু তাহাতে পণ্ডিতগণ কখনও মোহ প্রাপ্ত হন না ॥১৩॥
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।১৪।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেনশীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ!সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভুতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র অর্জ্জুন !) মাত্রাস্পর্শাঃ তু (বিষয়ের সহিত মিলিত ইন্দ্রিয়বৃত্তি সকল ) শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ (শীত, উষ্ণ, সুখ ও দুঃখাদি প্রদানকারী) [তে] (তাহারা) আগমাপায়িনঃ (উৎপত্তি-বিনাশ-শীল) অনিত্যাঃ (ও অনিত্য) [অতএব] [হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তান্ (তাহাদিগকে ) তিতিক্ষস্ব (সহ্য কর) ॥১৪॥
হে কৌন্তেয় ! ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়ের সংযোগই শীতগ্রীষ্ম, সুখদুঃখ, দান করিয়া থাকে । কিন্তু উহারা গমনাগমনশীল, অনিত্য । অতএব হে ভারত ! তাহা সহ্য কর ॥১৪॥
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।।১৫।।
অনুবাদঃ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন)! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী।
[হে] পুরুষর্ষভ ! (হে পুরুষশ্রেষ্ঠ !) এতে (এই সকল) [মাত্রাস্পর্শাঃ] (বিষয়ের সহিত মিলিত ইন্দ্রিয় বৃত্তি) সমদুঃখসুখং (দুঃখ-সুখে সমভাবাপন্ন) যং ধীরং পুরুষং (যে বিবেকী ব্যক্তিকে) ন ব্যথয়ন্তি (বিচলিত করিতে পারে না) সঃ হি (তিনিই) অমৃতত্বায় (মোক্ষলাভে) কল্পতে (যোগ্য হন) ॥১৫॥
হে পুরুষশ্রেষ্ঠ ! সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন যে ধীর ব্যক্তিকে এই সকল মাত্রাস্পর্শ (অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বৃত্তির দ্বারা বিষয়ানুভব) ব্যথিত করিতে পারে না ; তিনি মোক্ষ লাভের যোগ্য হন ॥১৫॥
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিত্যতে সতঃ
উভয়োরপি দৃষ্টোহস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।১৬।।
অনুবাদঃ যাঁরা তত্ত্বদ্রষ্ট্রা তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে অনিত্য জড় বস্তুর স্থায়িত্ব নেই এবং নিত্য বস্তু আত্মার কখনও বিনাশ হয় না। তাঁরা উভয় প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
অসতঃ (অনিত্য বস্তুর) ভাবঃ (বিদ্যমানতা) ন বিদ্যতে (নাই) সতঃ (নিত্য বস্তুর) অভাবঃ (নাশ) ন বিদ্যতে (নাই) । তত্ত্বদর্শিভিঃ (তত্ত্বদর্শিগণ কর্ত্তৃক) অনয়োঃ উভয়োঃ অপি (এই দুইয়েরই) তু (কিন্তু) অন্তঃ (শেষ) দৃষ্টঃ (পর্য্যালোচিত হইয়াছে) ॥১৬॥
অসৎ অর্থাৎ পরিণামশীল দেহাদি নশ্বর বস্তুর নিত্য স্থায়িত্ব নাই ; এবং সৎ অর্থাৎ নিত্যবস্তু আত্মার কখনও পরিণতি বা বিনাশ নাই । অত্ত্বদর্শীগণের দ্বারা এইরূপে (পৃথক্ করিয়া) সৎ ও অসতের তত্ত্ব বিচারিত হইয়াছে ॥১৬॥
অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্।
বিনাশশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি।।১৭।।
অনুবাদঃ যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে। সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত।।১৮।।
অনুবাদঃ অবিনাশী, অপরিমেয় ও শাশ্বত আত্মার জড় দেহ নিঃসন্দেহে বিনাশশীল। অতএব হে ভারত! তুমি শাস্ত্রবিহিত স্বধর্ম পরিত্যাগ না করে যুদ্ধ কর।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।১৯।।
অনুবাদঃ যিনি জীবাত্মাকে হন্তা বলে মনে করেন কিংবা যিনি একে নিহত বলে ভাবেন, তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না। কারণ আত্মা কাউকে হত্যা করেন না এবং কারও দ্বারা নিহতও হন না।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।২০।।
অনুবাদঃ আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিতশাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হস্তি কম্।।২১।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, শাশ্বত, জন্মরহিত ও অক্ষয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাউকে হত্যা করতে বা হত্যা করাতে পারেন?
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-
ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।২২।।
অনুবাদঃ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন।
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।২৩।।
অনুবাদঃ আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানো যায় না।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোয্য এব চ।
নিত্যঃ সর্কগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।।২৪।।
অনুবাদঃ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোয্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি।।২৫।।
অনুবাদঃ এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।
অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি।।২৬।।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো! আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মার বারবার জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়, তা হলেও তোমার শোক করার কোন কারণ নেই।
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।২৭।।
অনুবাদঃ যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। অতেএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।
অব্যক্তাদীনি ভুতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।২৮।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সমস্ত সৃষ্ট জীব উৎপন্ন হওয়ার আগে অপ্রকাশিত ছিল, তাদের স্থিতিকালে প্রকাশিত থাকে এবং বিনাশের পর আবার অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং, সেই জন্য শোক করার কি কারণ?
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম্
আশ্চর্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চার্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।।২৯।।
অনুবাদঃ কেউ এই আত্মাকে আশ্চর্যবৎ দর্শন করেন, কেউ আশ্চর্যভাবে বর্ণনা করেন এবং কেউ আশ্চর্য জ্ঞানে শ্রবণ করেন, আর কেউ শুনেও তাকে বুঝতে পারেন না।
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।৩০।।
অনুবাদঃ হে ভারত! প্রাণীদের দেহে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। অতএব কোন জীবের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।
স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।৩১।।
অনুবাদঃ ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়।
অপি (এমন কি ) স্বধর্ম্মং (ক্ষাত্ত্রিধর্ম্ম) অবেক্ষ্য চ (পর্য্যালোচনা করিয়াও) বিকম্পিতুম্ (ভয় করিতে) ন অর্হসি (পার না) । হি (যেহেতু) ক্ষত্ত্রিয়স্য (ক্ষত্ত্রিয়ের পক্ষে) ধর্ম্ম্যাৎ যুদ্ধাৎ (ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ অপেক্ষা) অন্যৎ শ্রেয়ঃ (অপর শ্রেয়স্কর কর্ম্ম) ন বিদ্যতে (নাই) ॥৩১॥
আর স্বধর্ম্মের* প্রতি লক্ষ্য করিলেও তোমার বিকম্পিত হইবার কিছুই নাই । কেননা ক্ষত্ত্রিয়ের ধর্ম্মযুদ্ধাপেক্ষা শ্রেয়স্কর ধর্ম্ম আর নাই ॥৩১॥
*মন্তব্য— স্বধর্ম্ম জীবের মুক্ত ও বদ্ধ দশা ভেদে দ্বিবিধ । মুক্তাবস্থায়, স্বধর্ম্ম-উপাধি রহিত ; বদ্ধাবস্থায়, স্বধর্ম্ম উপাধিযুক্ত । মুক্ত জীব সর্ব্বোতোভাবে ভগবৎ-সেবন-চেষ্টারূপ ধর্ম্মনিরত এবং তাহাই শুদ্ধ-স্বধর্ম্ম । আর বদ্ধজীব যখন কর্ম্মফলে চুরাশী লক্ষ যোনি ভ্রমণ করিতে করিতে পুণ্যবলে মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়, তখন মুক্তাবস্থার শুদ্ধ স্বধর্ম্ম সাধনানুকূলে দৈব বর্ণাশ্রম ধর্ম্মে থাকিয়া যে নিজ নিজ স্বভাব ও চেষ্টা প্রকাশ করে ; তাহাকে স্থূলভাবে স্বধর্ম্ম বলা হইয়া থাকে । অর্থাৎ ধূম্রাবৃত বহ্নিকে যে প্রকার বহ্নি বলা হয়, তদ্রূপ নিরুপাধিক আত্মার স্বধর্ম্ম—যে স্বল্প উপাধিযুক্ত অবস্থায় অনুভূত হইতে পারে তাহাকেই বর্ণাশ্রম বিচারে স্বধর্ম্ম সংজ্ঞায় সংজ্ঞিত করা হয় ॥৩১॥
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্।।৩২।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! স্বর্গদ্বার উন্মোচনকারী এই প্রকার ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না চাইতেই যে সব ক্ষত্রিয়ের কাছে আসে, তাঁরা সুখী হন।
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) সুখীনঃ (সৌভাগ্যবান্) ক্ষত্ত্রিয়াঃ (ক্ষত্ত্রিয়গণ) যদৃচ্ছয়া (অপ্রার্থিতভাবে) উপপন্নম্ (উপস্থিত) অপাবৃতম্ স্বর্গদ্বারম্ চ (এবং উদ্ ঘাটিত স্বর্গদ্বাররূপ) ঈদৃশম্ (এরূপ) যুদ্ধম্ (যুদ্ধ) লভন্তে (লাভ করে) ॥৩২॥
হে পার্থ ! যদৃচ্ছাক্রমে উপস্থিত উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ এইরূপ যুদ্ধ, সৌভাগ্যবান্ ক্ষত্ত্রিয়গণেরই লভ্য হইয়া থাকে ॥৩২॥
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যাং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাস্প্যসি।।৩৩।।
অনুবাদঃ কিন্তু, তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে।
অথ (পক্ষান্তরে) চেৎ (যদি) ত্বম্ (তুমি) ইমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং (এই ধর্ম্ম সঙ্গত যুদ্ধ) ন করিষ্যসি (না কর) ততঃ (তাহা হইলে) স্বধর্ম্মং কীর্ত্তিং চ (ক্ষত্ত্রিয় ধর্ম্ম ও কীর্ত্তি) হিত্বা (ত্যাগ করিয়া) পাপম্ (পাপ) অবাপ্স্যসি (লাভ করিবে) ॥৩৩॥
প্রকৃত পক্ষে তুমি যদি এই ধর্ম্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম্ম ও কীর্ত্তি ভ্রষ্ট হইয়া পাপগ্রস্ত হইবে ॥৩৩॥
অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্তিমরণাদতিরিচ্যতে।।৩৪।।
অনুবাদঃ সমস্ত লোক তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে এবং যে-কোন মর্যাদাবান লোকের পক্ষেই এই অসম্মান মৃত্যু অপেক্ষাও অধিকতর মন্দ।
ভূতানি চ (সকল লোকও) তে (তোমার) অব্যয়াম্ (চিরস্থায়িনী) অকীর্ত্তিম্ অপি (অকীর্ত্তিও) কথয়িষ্যন্তি (বলিবে) । সম্ভাবিতস্য চ (সম্মানিত ব্যক্তির কিন্তু ) অকীর্ত্তিঃ (অখ্যাতি) মরণাৎ (মৃত্যু অপেক্ষা) অতিরিচ্যতে (অধিক হয়) ॥৩৪॥
আর লোকে চিরদিন তোমার অকীর্ত্তি ঘোষণা করিবে । সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির অপযশ মৃত্যু অপেক্ষাও অধিক ॥৩৪॥
ভয়াদ্ রণাদুপরতং মংস্যস্তে ত্বাং মহারথাঃ।
যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভুত্বা যাস্যসি লাঘবম্।।৩৫।।
অনুবাদঃ সমস্ত মহারথীরা মনে করবেন যে, তুমি ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ এবং তুমি যাদের কাছে সম্মানিত ছিলে, তারাই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করবে।
মহারথাঃ (দুর্য্যোধনাদি মহারথগণ) ত্বাং (তোমাকে) ভয়াৎ (ভয়হেতু) রণাৎ (যুদ্ধ হইতে) উপরতং (বিরত) মংস্যন্তে (মনে করিবে) । চ (এবং) ত্বং (তুমি) যেষাং (যাহাদিগের) বহুমতঃ ভূত্বা (বহু সম্মানের পাত্র হইয়াছ) [তেষাং] (তাহাদিগের নিকট) লাঘবম্ যাস্যসি (অশ্রদ্ধার পাত্র হইবে) ॥৩৫॥
যাহারা তোমাকে বহুমানন করিয়া থাকেন সেই মহারথগণ ‘তুমি ভয়ে যুদ্ধ করিতেছ না’ এই মনে করিয়া তোমাকে অত্যন্ত লঘু জ্ঞান করিবেন ॥৩৫॥
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহুন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ।
নিন্দস্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম।।৩৬।।
অনুবাদঃ তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে। তার চেয়ে অধিকতর দুঃখদায়ক তোমার পক্ষে আর কি হতে পারে?
তব অহিতাঃ (তোমার শত্রুগণ) তব সামর্থ্যং (তোমার সামর্থ্যের) নিন্দন্তঃ (নিন্দা করতঃ) বহূন্ অবাচ্য বাদান্ চ (বহুবিধ অকথ্য বাক্য সমূহও) বদিষ্যন্তি (কহিবে) । নু (ওহে অর্জ্জুন !) ততঃ (তাহা অপেক্ষা) দুঃখতরং (অধিক দুঃখকর) কিম্ (কি হইতে পারে ?) ॥৩৬॥
তোমার শত্রুপক্ষ তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া বহুপ্রকার কটূক্তি করিবে, তাহা হইতে অধিক দুঃখতর আর কি আছে ? ॥৩৬॥
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কুতনিশ্চয়ঃ।।৩৭।।
অনুবাদঃ হে কুন্তীপুত্র! এই যদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব যদ্ধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উত্থিদ হও।
হতঃ বা (যদি যুদ্ধে হত হও) স্বর্গং প্রাপ্স্যসি (স্বর্গ লাভ করিবে) জিত্বা বা (কিম্বা জয়লাভ করিয়া) মহীং (পৃথিবী) ভোক্ষ্যসে (ভোগ করিবে) । [হে] কৌন্তেয় ! (হে অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (অতএব) যুদ্ধায় (যুদ্ধার্থে) কৃতনিশ্চয়ঃ [সন্] (কৃতনিশ্চয় হইয়া) উত্তিষ্ঠ (উত্থিত হও) ॥৩৭॥
হে কৌন্তেয় ! যদি তুমি হত হও, স্বর্গ লাভ করিবে, আর বিজয়ী হও, পৃথিবী ভোগ করিবে । অতএব কৃতনিশ্চয় হইয়া যুদ্ধার্থে উত্থিত হও ॥৩৭॥
সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভ্যে জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।৩৮।।
অনুবাদঃ সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি ও জয়-পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে তুমি যুদ্ধের নিমিত্ত যুদ্ধ কর, তা হলে তোমাকে পাপভাগী হতে হবে না।
সুখদুঃখে (সুখ ও দুঃখ) লাভালাভৌ (লাভ ও অলাভ) জয়াজয়ৌ [চ] (এবং জয় ও পরাজয়) সমে (সমান) কৃত্বা (করিয়া অর্থাৎ তুল্য দৃষ্টিতে দেখিয়া) ততঃ (তৎপরে) যুদ্ধায় (যুদ্ধার্থ) যুজ্যস্ব (প্রবৃত্ত হও) এবং (এই প্রকারে) পাপং (পাপ) ন অবাপ্স্যসি (প্রাপ্ত হইবে না) ॥৩৮॥
সুখ ও দুঃখ, লাভ ও অলাভ, জয় ও পরাজয়কে সমান জ্ঞান করিয়া যুদ্ধ কর, তাহা হইলে পাপভাগী হইবে না ॥৩৮॥
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি।।৩৯।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! আমি তোমাকে সাংখ্য -যোগের কথা বললাম। এখন ভক্তিযোগ সম্বন্ধিনী বুদ্ধির কথা শ্রবণ কর, যার দ্বারা তুমি কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে।
হে পার্থ (অর্জুন)! তােমাকে এতক্ষণ সাংখ্য নিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান অভিহিত করলাম। এখন যােগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ করাে। যে জ্ঞানে যুক্ত হয়ে কর্মবন্ধনকে ত্যাগ করতে পারবে।
টীকা; সাংখ্য" অর্থ সম্যক জ্ঞান, তাতে প্রকাশমান আত্মতত্ত্বই সাংখ্য। আর গীতায় যোগ বলতে নিষ্কাম কর্মযােগই বুঝায়। জ্ঞানমার্গ বুঝাতে "সাংখ্য' শব্দ ও নিষ্কাম কর্মযােগ বুঝাতে 'যােগ’ শব্দ গীতায় পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে (৩/৩, ৫/৩, ৫/৪, ৫/৫ ইত্যাদি)। জ্ঞানমার্গেরই একটি বিশিষ্ট প্রাচীন স্বরূপ মহর্ষি কপিলদেব-প্রণীত পুরুষপ্রকৃতিবিবেক বা সাংখ্যদর্শনে বিবৃত হয়েছে। কিন্তু এস্থলে সাংখ্য শব্দে সাংখ্যদর্শন বুঝায় না। যােগ বললে সাধারণত বাসন-প্রাণায়ামাদি পাতঞ্জল যােগ দর্শনােক্ত অষ্টাঙ্গযােগ বা সমাধিযােগ বুঝায়। কিন্তু এস্থলে যােগ শব্দ এ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। গীতায় সমাধিযােগ ও সাংখ্য দর্শনেরও অনেক তত্ত্বই সন্নিবিষ্ট আছে (৭/৪, ৬ষ্ঠ অধ্যায় ও ১৪তম অধ্যায়)। সুতরাং 'যােগ ও সাংখ্য শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা স্মরণ রাখা আবশ্যক।
নেহাভিত্রুমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।৪০।।
অনুবাদঃ ভক্তিযোগের অনুশীলন কখনও ব্যর্থ হয় না এবং তার কোনও ক্ষয় নেই। তার স্বল্প অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠাতাকে সংসাররূপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে।
অর্থ- এই (নিষ্কাম কর্মযােগে) আরুব্ধ কর্মের নিষ্ফলতা নেই এবং প্রত্যবায়ও হয় না। এই ধর্মের অতি অল্পমাত্র অনুষ্ঠানও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে।
শব্দার্থ: নিষ্কাম কর্ম = যে কর্মে কামনা নেই। প্রত্যবায় = পাপ। ত্রাণ = রক্ষা।
টীকা: এই ধর্মের" শব্দে নিষ্কাম কর্মযােগ বুঝানাে হয়েছে।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্।।৪১।।
অনুবাদঃ যারা এই পথ অবলম্বন করেছে তাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ। হে কুরুনন্দন, অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট ও বহিুমুখী।
অর্থ- হে কুরুনন্দন (অর্জুন)! এই কর্মে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি একই হয়। কিন্তু অব্যবসায়ীদের বুদ্ধি বহু শাখা বিশিষ্ট ও অনন্ত।
টীকা; এই কর্মে শব্দে নিষ্কাম কর্মযােগ বুঝানাে হয়েছে। ব্যবসায়াত্মিকা' শব্দে কর্ম ফলের আশা বাদ দেওয়া বুঝানাে হয়েছে। অব্যবসায়ী শব্দে অস্থির মনে ফলের কামনাযুক্ত মানুষ বুঝানাে হয়েছে।
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ
বেদবাদরাতাঃ পার্থ নান্যদন্তীতি বাদিনঃ।।৪২।।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।৪৩।।
অনুবাদঃ বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ,উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদিসকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই।
অর্থ-হে পার্থ (অর্জুন)। সকাম মানুষেরা বেদের পুষ্পিত অর্থবাদে আসক্ত। সেই অবিবেকী মানুষেরা এইরূপ বলেন- স্বর্গপরায়ণ থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই।" আরাে বাড়িয়ে এইরূপ বলেন- অনেক প্রকার (যাগযজ্ঞাদি) কর্মের দ্বারাই জন্মরূপ ফল লাভ হয় এবং আড়ম্বরপূর্ণ বিবিধ ক্রিয়াকলাপ ও ভােগৈশ্বর্য গতি প্রাপ্তি হয়।
টীকা: বেদের পুষ্পিত অর্থবাদ’ অর্থাৎ বেদের মুখ্য তাৎপর্য যে “পরমার্থ" - এটি না বুঝে মুর্খরা। কেবল গৌণ অর্থবাদে রত থাকে। (প্রভুপাদ সরস্বতী গােস্বামীর ব্যাখ্যা অনুসাৱে)। বেদের অর্থাভাসে রত কোন মানুষের বিচার এই যে, বেদ মন্ত্রের অর্থ শুধু মনােরম যজ্ঞাদি কাম্যকৰ্ম দ্বারাই সিদ্ধ হয়। তারা মনে করে কোন যজ্ঞ করলেই ইষ্টলাভ হবে। এই প্রকার এরা বেদমন্ত্রকে পুষ্পিত বলে মনে করে, কিন্তু বাস্তবে এরকম কোনাে তত্ত্বই বেদে নেই। গীতার এই অংশেও এরকম কাম্যকর্মীদের ও গৌণ অর্থবাদীদের নিন্দা করা হয়েছে, বৈদিক কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয় নি, ৩/১৫ ও ১৮/৫ শ্লোকে নিত্যযজ্ঞকে অপরিহার্য ও আবশ্যক বলেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।-(৪২-৪৩)
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪।।
অর্থ- যারা ভােগের প্রতি খুব আসক্ত, সেই সকল বিবেকহীন মুর্খ মানুষদের ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি পরমেশ্বরে একনিষ্ঠতা লাভ করে না।
অনুবাদঃ যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মুঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না।
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন।
নির্দ্বনেন্দ্বা নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।।৪৫।।
অনুবাদঃ বেদে প্রধানত জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। হে অর্জুন! তুমি সেই গুণগুলিকে অতিক্রম করে নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হও। সমস্ত দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও এবং লাভ-ক্ষতি ও আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্ম চেতনায় অধিষ্ঠিত হও।
।।ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন। নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান।। ( গীতা ২/ ৪৫)
পদার্থঃ তিনগুনের যে ভাব তাকে ' ত্রৈগুণ্য ' বলা হয় অর্থাৎ তিনগুনযুক্ত যে পুরুষ তাহার বিষয় বেদ এ জন্য ' ত্রৈগুণ্যবিষয়াঃ বেদাঃ = বলা হয়েছে, হে অর্জুন! এই মনুষ্য তিন গুনের ভাব - তিনগুনধারী, এ জন্য বেদের অর্থভাসে ফেসে যায় এবং তুমি "" নিস্ত্রৈগুণ্যোঃ = তীন গুন থেকে রহিত ""নিত্যসত্বস্থো = সদা সত্যগুনে স্থির অর্থাৎ সত্ব প্রধান হয়ে যাও "" নির্যোগক্ষেম = অপ্রাপ্তের প্রাপ্তি " যোগ' অার প্রাপ্তের রক্ষাকে ক্ষেম বলা হয় অর্থাৎ এই প্রকার নিষ্কাম কর্ম কর যেভাবে অপ্রাপ্তের প্রাপ্তি এবং প্রাপ্তের রক্ষা চিন্তা যেন না হয় "" আত্মবান = তুমি অত্মিক বলবান হও।
ভাষ্য- প্রকৃতির সত্ব, রজ, তম এই তিন গুনে যে ফেসে গেছে সে অর্থভাস এবং অর্থবাদ থেকে কদাপি বাচতে পারে না। সত্বপ্রধান লোকই বেদার্থে বেদবাদ থেকে বাচিতে পারে, এই অভিপ্রায়ে " নিত্যসত্বস্থো " বলা হয়েছে।
অর্থ:-হে অর্জুন! বেদসমূহ ত্রিগুণাত্মক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও। তুমি নির্দন্দ্ব হও, নিত্যসত্ত্বস্থ হও, যােগ-ক্ষেম-রহিত হও এবং আত্মবান হও।
টীকা: ত্রিগুণাত্মক' শব্দে সত্ত্ব, রজঃ তমঃ এই তিনগুণ বুঝানাে হয়েছে। নিস্ত্রৈগুণ্য হও, কথায় ভগবান এই তিন গুণের উর্দ্ধে উঠতে বলেছেন। “নির্দন্দ্ব শব্দে সুখ-দুঃখ চিন্তা বাদ দিতে বলেছেন। নিত্যসত্ত্বস্থ শব্দে প্রতিদিন সত্ত্বগুণের কর্ম করতে বলেছেন। যােগ-ক্ষেম-রহিত হও কথায় ভগবান অপ্রাপ্তকে প্রাপ্ত হওয়া এবং প্রাপ্তির রক্ষা করতে বলেছেন।
যবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লতোদকে।
ভবান্ সর্বেষু বেদেষু ব্রাক্ষণস্য বিজানতঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি বৃহৎ জলাশয় থেকে আপনা হতেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনই, ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি পরব্রক্ষের জ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন, তাঁরা কাছে সমস্ত বেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
অর্থ:- মানুষ সর্বত্র পরিপূর্ণ জলাশয় প্রাপ্ত করলে ছােট জলাশয়ে যতটা প্রয়ােজন থাকে, উত্তমরূপে ব্রহ্মজ্ঞান বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের সকল বেদে ততটা প্রয়ােজন থাকে।
টীকা; সকল দিকে জলাশয় থাকলে মানুষের কাছে ছােটো জলাশয়ের কোনাে প্রয়ােজন থাকে না। তেমন ভাবে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে গেলে সেই ব্রাহ্মণের কাম্যকর্মরূপ-কর্মকাণ্ডের কোনাে প্রয়ােজন থাকে না।
কর্কণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বাকর্মণি।।৪৭।।
অনুবাদঃ স্বধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কোন কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কখনও নিজেকে কর্মফলের হেতু বলে মনে করো না, এবং কখনও স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না।
অর্থ- কর্মে তােমার অধিকার, কর্মের ফলে তােমার অধিকার নেই। কর্ম ফলের আশায় কর্ম কর না এবং স্বধর্ম বর্জন করার প্রতিও আসক্ত
হবে না।
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্তা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোং সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।৪৮।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! ফলভোগের কামনা পরিত্যাগ করে ভক্তিযোগস্থ হয়ে স্বধর্ম-বিহিত কর্ম আচরণ কর। কর্মের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সম্বন্ধে যে সমবুদ্ধি, তাকেই যোগ বলা হয়।
অর্থ-হে ধনঞ্জয় (অর্জুন)! যোগ্যস্থঃ হয়ে, কর্মফলের চিন্তা বাদ দিয়ে, সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সমান জ্ঞান করে কর্ম কর। এই রকম সমান বুদ্ধিকেই যােগ বলে।
টীকা: এখানে যােগস্থঃ শব্দে ভগবান, ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত হতে বলেছেন।
দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগান্ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ।।৪৯।।
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়! বুদ্ধিযোগ দ্বারা ভক্তির অনুশীলন করে সকাম কর্ম থেকে দূরে থাক এবং সেই চেতনায় অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের শরণাগত হও। যারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করতে চায়, তারা কৃপণ।
অর্থ :- হে ধনঞ্জয় (অর্জুন)। কাম্য কর্ম বুদ্ধিযােগ অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট, অতএব তুমি সমত্ববুদ্ধির আশ্রয় নেও। যারা ফলের আশায় কর্ম করে, তারা কৃপণ।
শব্দার্থঃ কাম্য কর্ম = কেবল কামনার যােগ্য কর্ম। বুদ্ধিযােগ = নিষ্কাম কর্ম।
সমত্ববুদ্ধির = নিষ্কাম কর্মের।
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তষ্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।।৫০।।
অনুবাদঃ যিনি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তিনি এই জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় থেকেই মুক্ত হন। অতএব, তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর। সেটিই হচ্ছে সর্বঙ্গীণ কর্মকৌশল।
অর্থ:- সমত্ববুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি সংসার অবস্থাতেই পাপ-পুণ্য উভয়ই ত্যাগ করেন। সুতরাং তুমি যােগের অনুষ্ঠান কর; এই কর্ম কৌশলই যোগ।
টীকাঃ সবকিছু সমান মনে করে, পাপ-পূণ্য ত্যাগ করে ঈশ্বরে সমর্পিত হওয়া কর্ম কৌশলকে যোগ বলা হয়েছে। যােগদর্শনে (সমাধিপাদ: ২) এই কর্ম কৌশলকে বলা হয়েছে "চিত্তবৃত্তির নিরােধ। চিত্তের নিরােধ হলে যােগে স্থিত হওয়া যায়।
কর্মজং বুদ্ধিযুক্তো হি ফলং ত্যক্ত্বা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্।।৫১।।
অনুবাদঃ মনীষিগণ ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এভাবে তাঁরা সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার অতীত অবস্থা লাভ করেন।
অর্থ- বুদ্ধিযুক্ত মনীষীগণ কর্মফলে আবদ্ধ হন না। সুতরাং তাঁরা জন্ম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সকল প্রকার উপদ্রব ছেড়ে পরমপদ প্রাপ্ত হন।
টীকা: এখানে জন্ম বন্ধন' শব্দে ভগবান সংসার বন্ধন বুঝিয়েছেন। পরমপদ' হচ্ছে মোক্ষ।
যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।৫২।।
অনুবাদঃ এভাবে পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে,তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরুপে নিরপেক্ষ হতে পারবে।
অর্থ:- যখন তােমার বুদ্ধি মােহকে ছেড়ে যাবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হবে।
টীকাঃ শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হবে, কথায় ভগবান বুজিয়েছেন মােহ ছেড়ে গেলে সংসারের ভােগ সম্পর্কে পূর্বে যা শুনেছ এবং ভবিষ্যতে যা শুনবে, এই সকল বিষয়ে অনাসক্তি আসবে।
শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাস্প্যসি।।৫৩।।
অনুবাদঃ তোমার বুদ্ধি যখন বেদের বিচিত্র ভাষার দ্বারা আর বিচলিত হবে না এবং আত্ম-উপলব্ধির সমাধিতে স্থির হবে, তখন তুমি দিব্যজ্ঞান লাভ করে ভক্তিযোগে অধিষ্ঠিত হবে।
অর্থ- নানা রকম ফলশ্রুতিতে বিক্ষিপ্ত তােমার বুদ্ধি, যখন সমাধিতে স্থির হবে, তখন তুমি যােগ প্রাপ্ত হবে।
শব্দার্থঃ বিক্ষিপ্ত = অস্থির। সমাধি = পরমাত্মাতে স্থিত হওয়া।
অর্জুন উবাচ
স্থিতিপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্।।৫৪।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- কেশব! স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কি? তিনি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন এবং কিভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন?
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মেনোগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।৫৫।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে পার্থ! জীব যখন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভুত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়।
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।৫৬।।
অনুবাদঃ ত্রিতাপ দুঃখ উপস্থিত হলেও যাঁর মন উদ্ভিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যাঁর স্পৃহা হয় না এবং যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনিই স্থিতধী অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ।
য সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৭।।
অনুবাদঃ জড় জগতে যিনি সমস্ত জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, যিনি প্রিয় বস্তু লাভে আনন্দিত হন না এবং অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে দ্বেষ করেন না, তিনি পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্টিতা।।৫৮।।
অনুবাদঃ কুর্ম যেমন তার অঙ্গসমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।
বিষয়া বিনিবর্তস্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জং রসোহপস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে।।৫৯।।
অনুবাদঃ দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু উচ্চতর স্বাদ আস্বাদন করার ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন।
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।।৬০।।
অনুবাদঃ হে কোন্তেয়! ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান এবং ক্ষোভকারী যে, তারা অতি যত্মশীল বিবেকসম্পন্ন পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে।
তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬১।।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে সংযত করে আমার প্রতি উত্তমা ভক্তিপরায়ণ হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে বশীভুত করেছেন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।৬২।।
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩।।
অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃুতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।৬৪।।
অনুবাদঃ সংযতচিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি এবং অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে ভগবানের কৃপা লাভ করেন।
প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে।
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে।।৬৫।।
অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন আর জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখ থাকে না; এভাবে প্রসন্নতা লাভ করা ফলে বুদ্ধি শীঘ্রই স্থির হয়।
নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।৬৬।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার চিত্ত সংযত নয় এবং তার পারমার্থিক বুদ্ধি থাকতে পারে না। আর পরমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। এই রকম শান্তিহীন ব্যক্তির প্রকুত সুখ কোথায়? [পাদ ভাষ্য]
পদচ্ছেদঃ না।অন্তি।বুদ্ধিঃ।অযুক্তস্য।ন।চ।অযুক্তস্য।ভাবনা।ন।চ।অভাবয়তঃ।শান্তিঃ।অশান্তস্য।কৃতঃ।মুখম্।
পদার্থ- (অযুক্তস্য) আর যে বশীভূত মনের হয় না তাহার (বুদ্ধিঃ) বুদ্ধি (ন,অস্তি) হয় না (ন,চ,অযুক্তস্য)আর না অযুক্ত পুরুষকে (ভাবনা) নিদিধ্যাসনরূপ চিত্তবৃত্তি হয় (চ)আর (অভাবয়তঃ)বিনা ভাবনা ব্যক্তির (শান্তিঃ) শান্তি(ন) হয় না আর (অশান্তস্য) অশন্তর (সুখং, কৃতঃ)সুখ কোথায়।
ভাবার্থ - যাহার চিত্ত বিষয় হইতে রহিত নয় তার অনাসক্ত বুদ্ধি প্রাপ্ত হয় না আর না 'পদার্থের তথা পরিস্তিতি আমার ঠীক সংকল্পের অনুকূল হয়ে পড়ে' ঐরকম দৃঢ় ভাবনা-শক্তি যার মধ্যে থাকে আর যে পদার্থকে নিজের অনুকূলে হয়ে বাধিত করে না, কিন্তু যেরূপ পরিস্তিতি বলে ঐরূপ হয়ে যায়, বায়ুর ঝাপটার সাথে চালায় শান্তি লাভ হয় না। আর যেখানে শান্তি লাভ হয় না তার সুখ কোথায় ?__(আর্যমুনি ভাষ্য)
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি।।৬৭।।
অনুবাদঃ প্রতিকূল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনই সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে।
তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬৮।।
অনুবাদঃ সুতরাং, হে মহাবাহো! যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভুতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।৬৯।।
অনুবাদঃ সমস্ত জীবের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ, স্থিতপ্রজ্ঞ সেই রাত্রিতে জাগরিত থেকে আত্ম-বুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন। আর যখন সমস্ত জীবেরা জেগে থাকে, তখন তত্ত্বাদর্শী মুনির নিকট তা রাত্রিস্বরূপ।
আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং
সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্ধৎ।
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে
স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।৭০।।
অনুবাদঃ বিষয়কামী ব্যক্তি কখনও শান্তি লাভ করে না। জলরাশি যেমন সদা পুরপূর্ণ এবং স্থির সমু্দ্রে প্রবেশ করেও তাকে ক্ষোভিত করতে পারে না, কামসমূহও তেমন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিতে প্রবিষ্ট হয়েও তাঁকে বিক্ষুব্ধ করতে পারে না, অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন।
বিহায় কামান্ যঃ সর্বান পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ।
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।৭১।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিষ্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করেন।
এষা ব্রাক্ষী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রক্ষনির্বাণমৃচ্ছতি।।৭২।।
অনুবাদঃ এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাক্ষীস্থিতি বলে। হে পার্থ! যিনি এই স্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না। জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন।
সমাপ্ত
-------------
এখানে বলা হয়েছে যে, সে মৃত্যুর পরও মৃত্যু প্রাপ্ত হয় যে পরমাত্মাকে নানাত্ব দেখে অর্থাৎ পরমাত্মা নিরাকার ও আবার সাকারও, জন্মগ্রহণও করেন আবার মৃত্যবরণও করেন ইত্যাদি বিরুদ্ধ ধর্মের আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই প্রকার বৈদিক ও উপনিষদের বাক্যে পরমাত্মাকে প্রাপ্তির জন্য অনিশ্চয়াত্মিকা মতি কে নিষেধ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ