তৃতীয় অধ্যায়- কর্মযোগ-(Bangla Gita)
অর্জুন উবাচ
জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন।
তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব।।১।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে জনার্দন! হে কেশব! যদি তোমার মতো কর্ম অপেক্ষা ভক্তি-বিষয়িনী বুদ্ধি শ্রেয়তর হয়, তাহলে এই ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কেন আমাকে প্ররোচিত করছ?
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহমাপ্নুয়াম্।।২।।
অনুবাদঃ তুমি যেন দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত করছ। তাই, দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে সবচেয়ে শ্রেয়স্কর।
শ্রীভগবানুবাচ
লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম্।।৩।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে নিষ্পাপ অর্জুন! আমি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে, দুই প্রকার মানুষ আত্ম-উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। কিছু লোক অভিজ্ঞতালব্ধ আবার তা ভক্তির মাধ্যমে জানতে চান।
ন কর্মণামনারম্ভান্ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্লুতে।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধং সমাধিগচ্ছতি।।৪।।
অনুবাদঃ কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ।।৫।।
অনুবাদঃ সকলেই মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে।।৬।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ,রস আদি ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি স্মরণ করে, সেই মূঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী ভন্ড বলা হয়ে থাকে।
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশষ্যতে।।৭।।
অনুবাদঃ কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।
নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণ।।৮।।
অনুবাদঃ তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান কর, কেন না কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।৯।।
অনুবাদঃ বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্।।১০।।
অনুবাদঃ সৃষ্টির প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা যজ্ঞাদি সহ প্রজাসকল সৃষ্টি করে বলেছিলেন-“এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও। এই যজ্ঞ তোমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূর্ণ করবে।”
দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়স্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমাবাস্প্যথ।।১১।।
অনুবাদঃ তোমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রীত হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন। এভাবেই পরস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে।
ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ।।১২।।
অনুবাদঃ যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্ছিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। কিন্তু দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাঁদের নিবেদন না করে যে ভোগ করে, সে নিশ্চয়ই চোর।
অর্থ- যজ্ঞ দ্বারা সংবর্দ্ধিত দেবতাগণ তােমাদের অভীষ্ট ভােগ্যবস্তু প্রদান করবেন। তাঁদের প্রদত্ত ভােগ্যবস্তু তাঁদের উৎসর্গ না করেই যে ভােগ করে সেই ব্যক্তি নিশ্চই চোর।
শব্দার্থ: সংবর্ধনা = সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে এমন।
টীকাঃ এই পরমাত্মাই সমস্তকিছু। তাই দেবতাদের প্রদত্ত ভােগ্যবস্তু পরমাত্মাই দান করেন। সেজন্য দেবতাদের উৎসর্গ করেই সবকিছু ভাগ করা উচিৎ। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩/১০/৬) বলছে- "আমি অন্ন, আমি অন্নভােক্তা; যিনি অন্নরূপী আমাকে দান না করে স্বয়ং ভােজন করে, আমি তাঁকে ভক্ষণ (বিনাশ) করি।
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ।।১৩।।
অনুবাদঃ ভগবদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।
অর্থ:- যজ্ঞে অবশিষ্ট অন্নের ভােগকারী শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সকল পাপ থেকে মুক্ত হন। আর যে পাপী (শুধুমাত্র) নিজের শরীর পালনের জন্য পাক করে তারা তাে পাপকেই ভােজন করে।
শব্দার্থ: পাক = রান্না।
টীকা: এখানে যজ্ঞ শব্দে পঞ্চমহাযজ্ঞ বুঝানাে হয়েছে। ২)ব্ৰহ্মযজ্ঞ (শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সন্ধ্যোপাসনা) ২)দেবযজ্ঞ (হবন অর্থাৎ, অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে যে যজ্ঞ করা হয়) ৩) পিতৃযজ্ঞ (পিতা-মাতা সহ গুরুজনদের শ্রদ্ধার সাথে সেবা করা) ৪)অতিথিযজ্ঞ (ধর্মাত্মা অতিথিদের সেবা করা) ৫)ভূতযজ্ঞ (প্রাণীদের সেবা করা) -এই পাঁচ প্রকার যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর অবশিষ্ট অন্ন ভােগকারী পাপমুক্ত হয় ।
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ।।১৪।।
অনুবাদঃ অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।
অর্থ :- সকল প্রাণী অন্ন থেকে উৎপন্ন হয়, অন্নের উৎপত্তি হয় বৃষ্টি থেকে, বৃষ্টি হয় যজ্ঞ দ্বারা এবং যজ্ঞ কর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে।
টীকাঃ এই শ্লোকে ভগবান সমগ্র জগৎ চক্রের ধারণা দিয়েছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি ক্রমবিবর্তনবাদ। শ্লোকে অন্ন' শব্দটি শুধু শস্য নয়, সকল খাদ্যকে বুঝানাে হয়েছে। ১৫তম অধ্যায়ের ১৪তম শ্লোকেও ভগবান চার প্রকার অন্নের উল্লেখ করেছেন। প্রাণীর অন্যতম খাদ্য উদ্ভিদ। জড় উপাদান থেকে জৈব (Organic) পদার্থ প্রস্তুত করতে পারে কেবল উদ্ভিদ, এবং সকল প্রাণী জীবন ধারণ করে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদভোজী অন্য প্রাণীকে ভক্ষণ করে। পৃথিবীতে উদ্ভিদই প্রাণী জীবনের আদিস্বরূপ। বিজ্ঞানও এই মত স্বীকার করে। ক্রমবিবর্তনের ফলে উদ্ভিদ থেকেই প্রাণীর এবং পর্যায়ক্রমিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে। (বৃষ্টি থেকে অন্ন উৎপত্তি) বলতে বুঝানাে হয়েছে - যত প্রকার খাদ্য আছে, সকল খাদ্যের উৎপত্তির প্রধান কারণ বৃষ্টি অথাৎ জল। জল ছাড়া উদ্ভিদ উৎপত্তি সম্ভব নয়।(বৃষ্টি হয় যজ্ঞ দ্বারা) স্বাভাবিক ভাবে এই কথা বিজ্ঞান সমর্থন করবে না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এখানে যজ্ঞ শব্দটি রূপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক গীতাভাষ্যকার বলেছেন, মানুষ যজ্ঞ করলে মেঘ জমে বৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই যজ্ঞ প্রসঙ্গ এসেছে, কর্ম ⇒ যজ্ঞ > বৃষ্টি > অন্ন > প্রাণী। তাই এই প্রসঙ্গ মান্য করা যায় না। সূর্যের তাপে জল বাষ্প হয়ে মেঘ উৎপন্ন হয়ে বৃষ্টি হয়। মূলত এই চক্রকেই যজ্ঞ বুঝানাে হয়েছে। কেবল অগ্নিতে আহুতি দেওয়াই যজ্ঞ নয়। (যজ্ঞ কর্ম দ্বারা উৎপন্ন) এখানে কর্ম শব্দটি ভগবান নিজেই ৮ম অধ্যায়ের ৩য় শ্লোকে বলেছেন- বিশ্বব্যাপী প্রাণীসমূহের উৎপত্তির যে সৃষ্টিক্রিয়া, তাকে বলা হয় কর্ম। প্রকৃতির এই কর্ম ভগবানের ইচ্ছা পূরণ করছে। ভগবানে অর্পিত কর্মকেই যজ্ঞ বলা হয়। সেই কর্মযজ্ঞ দিয়ে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে অন্ন (উদ্ভিদ) অন্ন থেকে প্রাণী সমূহ সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত গীতা শ্লোকটি অনুরূপ ভাবে তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩/২/১) এবং বৃহদারণাক উপনিষদে (৩/৯/৬) রয়েছে ।
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্।।১৫।।
অনুবাদঃ যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
অর্থ-(১৫) কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন বলে জানবে। বেদ অবিনাশী অক্ষর থেকে উৎপন্ন। সেজন্য সর্বব্যাপী ব্রহ্ম নিত্য (সবসময়) যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।
টীকাঃ অক্ষর শব্দে ক্ষয় রহিত পরমাত্মাকে বুঝানাে হয়েছে (মুণ্ডক উপনিষদ: ১/১/৭)। প্রাচীন টীকাকারেরা বলেছেন- ব্রহ্ম শব্দে এখানে বেদ বুঝতে হবে এবং অক্ষর শব্দে পরমাত্মা। তবে কেউ কেউ প্রথম চরণে ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন, দ্বিতীয় চরণে ব্রহ্ম শব্দে পরমব্রহ্ম বুঝেছেন। তা না হলে অর্থের অসঙ্গতি হয়। কিন্তু শঙ্করাচার্য দ্বিতীয় চরণেও ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন। অর্থাৎ "বেদ সর্বার্থ প্রকাশক হেতু নিত্য যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। তবে এজন্য মূল তাৎপর্যের কোনাে সমস্যা হয় না। পাঠক যে-কোনাে একটি অনুবাদ গ্রহণ করতে পারে। আমরা এই স্থানে শ্রীধর স্বামী, কেদারনাথদত্ত, বিশ্বনাথ ইত্যাদি বহু প্রচলিত টাকাকারের অর্থ গ্রহণ করেছি।
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি।।১৬।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।
অর্থ- হে পার্থ (অর্জুন)! যে এই পৃথিবীতে এই প্রকার প্রবর্তিত চক্র অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ ভােগী পাপময় ব্যর্থ জীবন ধারণ করে।
টীকা: প্রবর্তিত’ শব্দে উপরে উল্লেখিত কর্মকে বুঝানাে হয়েছে।
যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যনং ন বিদ্যতে।।১৭।।
অনুবাদঃ কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত এবং আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁরা কোন কর্তব্যকর্ম নেই।
অর্থ-কিন্তু যে মানুষ আত্মাতেই প্রীতিযুক্ত, এবং যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত আর আত্মাতেই সন্তুষ্ট হয়, তাঁর কোনাে প্রকার কর্তব্য কর্ম নেই ।
নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন।
ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ।।১৮।।
অনুবাদঃ আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।
অর্থ-এই সংসারে তাঁর কর্ম করাতেও প্রয়ােজন থাকে না, কর্ম না করাতেও (কোনাে প্রয়ােজন) থাকে না এবং তাঁর সকল প্রাণীর সাথে বিন্দুমাত্র স্বার্থের সম্বন্ধ থাকে না।
টীকা: তাঁর' শব্দে সেই আত্মনিষ্ঠ মানুষের কথা বুঝানাে হয়েছে।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।।১৯।।
অনুবাদঃ অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে।
অর্থ: অতএব তুমি অনাসক্ত হয়ে কর্তব্য কর্ম উত্তম ভাবে পালন কর। কেননা অনাসক্ত হয়ে কর্ম পালনকারী পুরুষ পরমাত্মাকে লাভ করেন।
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি।।২০।।
অনুবাদঃ জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।
অর্থ:- জনকাদি মহাত্মারা কর্ম দ্বারাই পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন। এজন্য লােকসংগ্রহ লক্ষ্য রেখে তােমার কর্ম করাই কর্তব্য।
টীকা: জনকাদি শব্দদ্বারা সীতা মাতার পিতা জনক এবং অন্যান্য মহাপুরুষদের বুঝানাে হয়েছে। লােকসংগ্রহ" শব্দদ্বারা মহাপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে বুঝানাে হয়েছে।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।২১।।
অনুবাদঃ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারেই অনুসরণ করে।
অর্থ: শ্রেষ্ঠ মানুষেরা যা যা আচরণ করেন, সাধারণ ব্যক্তিরা সেই সেই কর্মই করেন। তিনি যা প্রামাণ বলে গ্রহণ করেন, সাধারণ লােকে তারই অনুসরণ করে।
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।।২২।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
অর্থ:- হে পার্থ (অর্জুন)! ত্রিলােক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নেই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নেই, তবুও আমি কর্মের অনুষ্ঠানে নিযুক্ত আছি।
শব্দার্থ: ত্রিলােক = স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, অর্থাৎ সম্পূর্ণ জগত। অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য না পাওয়া বা পাওয়া।
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।২৩।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্।
সঙ্করস্য চ কর্ত স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।।২৪।।
অনুবাদঃ আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।
সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।
কুর্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।।২৫।।
অনুবাদঃ হে ভারত! অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমনই জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্ ।
জোষয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্।।২৬।।
অনুবাদঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।
প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণনি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ।
অহঙ্কারবিমুঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।২৭।।
অনুবাদঃ অহঙ্কারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে ‘আমি কর্তা’-এই রকম অভিমান করে।
তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ।
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে।।২৮।।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো! তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্ত হন না।
প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়াঃ সজ্জন্তে গুণকর্মসু।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ।।২৯।।
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।
ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।।৩০।।
অনুবাদঃ অতএব, হে অর্জুন! অধ্যাত্মচেতনা-সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশূন্য, নিষ্কাম ও শোকশূন্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।
যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তেহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্মভিঃ।।৩১।।
অনুবাদঃ আমার নির্দেশ অনুসারে যে- সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।
যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্।
সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ।।৩২।।
অনুবাদঃ কিন্তু যারা অসূয়াপূূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।
সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।।৩৩।।
অনুবাদঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যেকেই ত্রিগুণজাত তাঁর স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে?
ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ।।৩৪।।
অনুবাদঃ সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।৩৫।।
অনুবাদঃ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।
অর্জুন উবাচ
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।।৩৬।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে বার্ষ্ণেয়! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?
শ্রীভগবানুবাচ
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্।।৩৭।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।
ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ।
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্।।৩৮।।
অনুবাদঃ অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত্ত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত্ত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।
আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ।।৩৯।।
অনুবাদঃ কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।
ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্।।৪০।।
অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।
তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ।
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্।৪১।।
অনুবাদঃ অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসসন্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।।৪২।।
অনুবাদঃ স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিন (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্।।৪৩।।
অনুবাদঃ হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ