দশম অধ্যায়-বিভূতি-যোগ
ত্রয়োদশ-অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
নবম অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।
গীতা = ৭/৩
★অনুবাদঃ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোনো একজন আমাকে লাভ করবার জন্য যত্ন করেন, এবং সেই যত্নকারীদের মধ্যে হয়তো কেউ আমাকে তত্ত্বতঃ জানতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, সেই আমি টা কে? আমি টা কি শ্রীকৃষ্ণ নাকি অন্যকেউ? অন্যকেউ বলতে সেই পরমসত্ত্বা পরব্রহ্ম... আর এই আমাকে জেনে লোকের কি অবস্থা হয়?
একটু পিছনে ফিরে আমরা উপনিষদে যাই,
★★যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে অস্তম্ গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়। তথা বিদ্বান্ নামরূপাদ্ বিমুক্তঃ পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্।। মুণ্ডক উপনিষদ, ৩/২/৮।।
★অনুবাদঃ যেরূপ প্রবহমান নদীগুলো নামরূপ ত্যাগ করে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, সেইরূপ জ্ঞানী মহাত্মাও নাম রূপ থেকে মুক্ত হয়ে উত্তম থেকে উত্তম দিব্য পরমপুরুষ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন।
আর এই পরমাত্মাকে লাভ করার পর কি অবস্থা হয়, এর পরের মন্ত্রে আমরা দেখে নেই...
★★ স যো হ বৈ তৎপরমং ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।।মুণ্ডকোপনিষদ, ৩/২/৯।।
★অনুবাদঃ নিশ্চয়ই যে কেহ ঐ পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে জানেন সে ব্রহ্মই হয় অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপতা লাভ করে ব্রহ্মের মতই আচরণ করেন।
ঠিক যেভাবে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আচরণ করেছিলেন, তেমনি কিছু আচরণ আমরা দেখে নেই...
প্রথমেই
প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ থেকেই দেখে নেই বেদ কি বলে,
★★প্র তদ্ বোচেদ্ অমৃতস্য বিদ্বান্ গন্ধর্বো ধাম পরমং গুহ্য যৎ। ব্রীণি পদানি নিহিতা গুহাস্য যস্তানি বেদ স পিত্বষ্পিতাসৎ।। অথর্ববেদ = ২/১/১/২।।
★অনুবাদঃ অমৃত(অবিনাশী) ব্রহ্মের স্বরূপ জেনে, আদিত্য উপাসকদের কাছে সে ব্রহ্মতত্ত্ব বলুক। সে ব্রহ্মের আবৃত্তি রহিত পরমস্থান, হৃদয়রূপ গুহায় স্থিত। এই পরমাত্মার তিনটি পদ গুহায় নিহিত আছে। গুহানিহিত পদার্থের মত অজ্ঞাত অপরিচ্ছন্ন ব্রহ্ম কেবল উপদেশের দ্বারা জ্ঞাত হয়। এ পরব্রহ্মের তিন পদ (অংশস্বরূপ) বিরাট, হিরন্যগর্ভ ও ঈশ্বর মুমুক্ষগন লাভ করেন। শম-দমাদি সম্পন্ন অধিকারী গুরুর উপদেশ দ্বারা জীব ও ঈশ্বরের উপাধি ত্যাগ করে সে নিষ্কল ব্রহ্মের সাক্ষাৎ লাভ করে থাকে। যে তাকে জানে, সে নিজ জনকেরও কারণভূত (পিতা) হয় অর্থাৎ সর্ব্বজগতের অধিষ্ঠানরূপ ব্রহ্মের সাথে নিজেরও সর্বজগৎ-কারণত্ব উপলব্ধি করে।
এখন বেদের আলোকেই তার প্রমাণ দেখে নেই, অথর্ববেদে_অম্ভৃণ মহর্ষির দুহিতা বাক্ নাম্নী ব্রহ্মবাদিনী বলছেন...
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।।
অথর্ববেদ, ৪র্থ কাণ্ড/৬ষ্ট অনুবাক/৫ম সূক্ত/১নং মন্ত্র।
অনুবাদঃ আমি একাদশ রুদ্র ও অষ্ট বসুগণের সাথে অভিন্নরূপে বিচরণ করি। সেরূপ আদিত্যগণ ও বিশ্বদেবগণের সাথে অভিন্নরূপে আমি বর্তমান। আমিই পরব্রহ্মাত্মিকা মিত্র ও বরুণদেবকে ধারণ করি, ইন্দ্র ও অগ্নিকে আমিই ধারণ করি এবং উভয় অশ্বিনীকুমারদ্বয়কেও আমিই ধারণ করি।
এখানে "আমি" শব্দ দ্বারা মন্ত্রের বক্তাকে ঈশ্বর মানলে ঋষিকন্যা বাক্ কেও তো ঈশ্বর হিসেবে মানতে হয়। ব্যাপারটা কি তাই নয়?
আবার ঋগ্বেদে ৪র্থ মণ্ডলে ২৬ নং সূক্তের ১ম পংক্তিতে ঋষি বামদেব বলছেন,
★অহং মনুরভবং, সূর্যশ্চাহং কক্ষীবী ঋষিরস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ং ন্যৃংজে অহং কবিরুশনা পশ্যতা মা।।
অর্থাৎ আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস ঋষিকে অলংকৃত করেছি। আমি কবি উশন। আমাকে দর্শন কর।
তাহলে এখানে কি ঋষি বামদেব কেও ঈশ্বর মানা উচিত নয়?
"★স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিতাথাতঃ
অহঙ্কারাদেশ ___
এব অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং
দক্ষিণতঃ অহমুত্তরতঃ অহমেবেদং সর্বমিতি।।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.
★অনুবাদঃ তিনিই নিম্নে, তিনিই উর্ধ্বে, তিনি পশ্চাতে, তিনি সম্মুখে, তিনি দক্ষিণে, তিনি উত্তরে,--তিনিই এই সমস্ত।
আমিই অধো ভাগে, আমিই উর্ধ্বে, আমিই পশ্চাতে, আমিই সম্মূখে, আমিই দক্ষিণে, আমিই উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ– শীক্ষাবল্লী ১০ম অনুবাক।
★অনুবাদঃ আমি সংসাররূপ বৃক্ষের উচ্ছেদক, আমার কীর্তি পর্বতের শিখরের মতো উন্নত। অন্নোৎপাদক শক্তিযুক্ত সূর্য উত্তম অমৃতের মতো, সেইরূপ আমিও অতিশয় পবিত্র অমৃত স্বরূপ তথা আমি প্রকাশযুক্ত ধনের ভাণ্ডার, পরমানন্দময় অমৃত দ্বারা অভিসিঞ্চিত তথা শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন– এরূপ এই ত্রিশঙ্কুর ঋষির অনুভূত বৈদিক প্রবচন।
অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩হহমন্নাদো৩হহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোহমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩বাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্।। সুবর্ণ জ্যোতীঃ য এবং বেদ। ইত্যুপনিষৎ।।
তৈত্তিরীয়_উপনিষদ–ভৃগুবল্লী ১০ম অনুবাক।
নিরুক্ত ১।১৯
অনুবাদঃ তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি) এবং তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেন নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বের ১৬-তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণর নিজেই বলেছেন,
মহাত্ম্যং দেব দেবকীমাতস্তশ্চতে রূপমৈশ্বরম্।। ১৬/৫।।
ধর্মৈ স্বরূপিণে পার্থ সর্বলোকাংশ্চ শাশ্বতান্।।১৬/৯।।
অবুদ্ধয়া নাগ্রহীর্যস্ত্বং তন্মে সুমহদপ্রিয়ম্।
ন চ সাদ্য পুনর্ভূয়ঃ স্মৃতির্মে সম্ভবিষ্যতি।।১৬/১০।।
নয়।
★★নূনমশ্রধানোহসি দুর্সেধা হ্যসি পান্ডব।
ন চ শক্য পূনর্বক্তুমশেষেণ ধনন্জয়।।১১।।
ন শক্যং তন্ময়া ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।।১২।।
★★ উপরোক্ত শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বললেন যে, সেই জ্ঞানের উপদেশ পূনরায় তিনি করতে পারবেন না। কেননা সেই জ্ঞানের উপদেশ করার মতো অবস্থা এখন তাহার বশে নেই। শ্রীকৃষ্ণ কেন সেই উপদেশ পূনরায় দিতে পারেননি সেই কথা স্পষ্ট করে, তিনি বলেছেন -
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মবন্নথৈ পুরাতনম্।। ১৬/১৩।।
★★ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥১৮/৬১॥
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥১৮/৬২॥
সর্ব ইন্দ্রিয় গুন আভাসম সর্ব ইন্দ্রিয় বিবর্জিতম্ ।
অসক্তম সর্বভুত চ এব নির্গুনম গুনভোক্তৃ চ ।।১৫
অর্থ-সেই পরমআত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের জ্ঞাতা হয়েও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয় রহিত । যদিও তিনি সকলের পালক তথাপি তিনি সম্পুর্ন অনাসক্ত নির্গুণ হয়েও সমস্ত গুনের ভোক্তা ।
এখানে কৃষ্ণ নিজেই বলেছে পরমাত্মা কোনো ইন্দ্রিয় নেই, সে ইন্দ্রিয় রহিত। এই শ্লোকে তো স্পষ্ট ভাবে ঈশ্বর কে নিরাকার বলেছে, এইটা চোখে পড়েনি ? এইবার কৃষ্ণ ভক্তদের প্রশ্ন করছি যে কৃষ্ণের কি ইন্দ্রিয় ছিলোনা ? এখানে স্পষ্ট ভাবে বলেছে ঈশ্বর এর ইন্দ্রিয় নেই । এই শ্লোকেও পরমাত্মা কে কৃষ্ণ নিজেই 'তিনি' বলে কথন করেছে। এই ১৩ নং অধ্যায় এর প্রায় সমস্ত জায়গায় কৃষ্ণ জী নিজে পরমাত্মা কে 'তিনি ,তার, যিনি' বলে কথন করেছে।
গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, কৃষ্ণ যেসব বিভিন্ন গুণাবলীর বর্ণনা দেন, সে সকলই প্রকৃত গুণের পরিচায়ক (ভ. গী. ১৩.৭-১১)।
অমানিত্বমদম্ভিত্বং অহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্ |
আচার্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ |৭|
ইন্দ্রিযার্থেষু বৈরাগ্যং অনহঙ্কার এব চ |
জন্মমৃত্যুজরাব্যাধি দুঃখদোষানুদর্শনম্ |৮|
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু |
নিত্যং চ সমচিত্তত্বং ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু |৯|
মযি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী |
বিবিক্তদেশসেবিত্বং অরতির্জনসংসদি |১০|
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্ |
এতজ্জ্ঞানম্ ইতি প্রোক্তং অজ্ঞানং যদতোঽন্যথা |১১|
তিনি স্বয়ং সেই সমস্ত গুণাবলীর সাক্ষ্য -
‘অমানিত্বম ' – অর্থাৎ, নিরহংকার ও নম্র থাকা - বলশালী জরাসন্ধকে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে পরাজিত করার পর কৃষ্ণ যুদ্ধক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যদি প্রতিনিয়ত এভাবেই আক্রমণ চলতে থাকে, জনগণের উন্নতি ও বিকাশের সম্ভাবনা কি আদৌ আছে ? সুতরাং তিনি স্থানত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদি প্রজাদের প্রাণ বাঁচে, তবে তাঁকে কেউ কাপুরুষ বলল কিনা, তাতে তাঁর কিছু এসে যায়না। কোনোরকম অহংকার বা ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। একইভাবে, নিজের মর্যাদার কথা চিন্তা না করে নরকাসুরের স্ত্রীদের তিনি নতুন জীবনদান করেছিলেন (ভ. পু. ১০.৫৯)।
‘অদম্ভিত্বম’ – অর্থাৎ, ভণ্ডামি ও দম্ভ থেকে মুক্ত হয়ে থাকা - কৃষ্ণ তাঁর অতীত নিয়ে কখনও লজ্জিত ছিলেননা, কখনও তাঁকে এ নিয়ে অভিযোগ করতেও দেখা যায়নি। তিনি কখনও তাঁর অতীত কে গোপন করার চেষ্টা করেননি এবং দম্ভ থেকে মুক্ত হয়েই বেঁচেছেন। গোকুলে গোপালকদের সঙ্গে বড় হওয়ার কারণে তাঁকে গোবিন্দ বলেও ডাকা হত। তিনি তাতে কখনও অপমানিত বোধ করেননি। তাঁর জীবন ছিল অকৃত্রিম। তিনি কখনও নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও করেননি বা কখনও নিজেকে তাচ্ছিল্যও করেননি।
‘অহিংসা' – কৃষ্ণ তাঁর জীবনকালে কখনও কাউকে খেয়াল বশে আঘাত করেননি, এবং হয়ত সেই কারণেই তিনি নিঃসংশয়ে অর্জুনকে বলতে পেরেছিলেন - “শুভকর্মের জন্য যে সংগ্রাম করে তাকে কখনও দুর্দশার মুখ দেখতে হয়না” (ভ. গী. ৬.৪০)। কৃষ্ণ কখনও কারোর অমঙ্গল কামনা করেননি। শুধু ধর্মের বিরূদ্ধাচরণকারীদের শাস্তি দিয়েছেন মাত্র। মহাভারতের বিখ্যাত একটি বাণী - (এই শ্লোকটি জটিল সংস্করণে না থাকলেও অন্যান্য পুঁথি থেকে উদ্ধৃতি নেবার সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে) - “অহিংসা পরমো ধর্মহ, ধর্মহিংসা তথৈব চ” - অহিংসাই হল পরম ধর্ম, ধর্মরক্ষার্থে হিংসাও সেই ধর্মেরই অন্তর্গত। অর্জুনকে তিনি এও বলেছিলেন ( ভ. গী. ২.৩৩)। কংসবধের পর (ভা. পু. ১০.৪৪) কৃষ্ণ কংসের পত্নীদের বাপের বাড়ি অর্থাৎ জরাসন্ধের কাছে পাঠিয়ে দেন। ভীমের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যুর পর, কৃষ্ণ জরাসন্ধের পরিবার ও প্রজাদের নিরাপত্তা ও অভয় দান করেন এবং জরাসন্ধের পুত্র সহদেবকে সিংহাসনে বসান। এক সহস্র রাজাকে হত্যা করবার উদ্দেশে জরাসন্ধ বন্দী করে রেখেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁদের সকলকে মুক্ত করেন। তাঁরা যখন জিজ্ঞাসা করেন যে এর পরিবর্তে তাঁরা কিছু সাহায্য করতে পারেন কিনা, কৃষ্ণ বলেন, “আমি কিছু চাইনা, কিন্তু বড় ভাল হয় যদি আপনারা যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে কোনও প্রকার সাহায্য করতে পারেন” (ম. ভা. ২.১৮-২২, ভা.পু. ১০.৭৩)। তিনি হিংসার বিপক্ষে ছিলেন বলেই অত্যন্ত সততার সঙ্গে পাণ্ডব ও কৌরবদের ভিতর শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
‘ক্ষান্তি’ – ক্ষমাশীলতা - কালিয়া নাগ বা শিশুপাল, গান্ধারী বা তাঁর প্রাণঘাতী ব্যাধ, সকলকেই তিনি ক্ষমা করেছিলেন।
‘আর্জবম' – ন্যায়পরায়ণতা, অকপটতা, সারল্য – কৃষ্ণ সর্বদা সোজাসাপটা কথা বলেন। কোনও বন্ধু অথবা অধিক শক্তিশালী ব্যক্তির ভুল ধরিয়ে দেবার সময়ও কৃষ্ণ কখনও তাঁর কথার ধরণ অযথা তির্যক করে তোলেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শল্য পর্বে যখন দুর্যোধন সরোবরের গভীরে আত্মগোপন করে আছেন, তখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে উদ্দেশ্য করে একটা নির্বোধের মত প্রস্তাব করে বসলেন যে দুর্যোধন যদি পাণ্ডবদের মধ্যে যেকোনো একজনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেন, তাহলেই তিনি সমস্ত রাজ্যলাভ করবেন। কৃষ্ণ এবার যুধিষ্ঠিরকে তীব্রভাবে তিরস্কার করলেন- “আপনি যথার্থই নির্বোধের ন্যায় কথা বলেছেন। একমাত্র ভীম ব্যতীত দ্বন্দ্বযুদ্ধে দুর্যোধনের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা আর কারোর নেই। আপনি পুনরায় দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ করেছেন বলে মনে হচ্ছে (ম. ভা. ৯.৩২)।”
‘আচার্যোপাসনম' – গুরুর সেবা করা - পাণ্ডব এবং কৌরবরা যখন দ্রোণের কাছ থেকে একান্তে শিক্ষাগ্রহণ করার সুবিধা ভোগ করছেন, কৃষ্ণকে তখন সান্দীপনীর কাছে শিক্ষালাভ করার জন্য মথুরা থেকে সুদূর উজ্জয়িনী যেতে হয়েছে। তাঁকে গুরুর জন্য গভীর বনে গিয়ে জ্বালানির কাঠ পর্যন্ত সংগ্রহ করে আনতে হত। পাণ্ডব এবং কৌরবদের এসব কিছুই করতে হয়নি।
‘শৌচম' – শুচিতা, শুধু শরীরের নয়, সেই সঙ্গে বাক্ ও মনেরও। কৃষ্ণ এই তিনদিক দিয়েই শুদ্ধ ছিলেন। তিনি ‘মানস বাচ কর্মন’ (চিন্তা, শব্দ ও কর্ম) – এর বিশুদ্ধতার প্রতীক।
‘স্থৈর্যম' – স্থৈর্য, স্থিরতা - কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে তুষ্ট করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছেন, তিনি নিজে কিন্তু তার আগে এর চেয়েও বড় যুদ্ধে লড়েছেন। তিনি চরম স্থৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন যখন তিনি জরাসন্ধের ২৮ অক্ষৌহিণী সৈন্যের সম্মুখীন হয়েছেন (যা মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মিলিত সৈন্য সংখ্যার চেয়েও বেশী)। তারপর তিনি শুধু ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে সিংহের গুহা, গিরিব্রজে (জরাসন্ধের রাজধানী) প্রবেশ করেন। তিনি সর্বদা সরাসরি ভাবে শত্রুর সম্মুখীন হয়েছেন।
‘আত্মবিনিগ্রহঃ' – আত্মসংযম – কৃষ্ণের জীবনে আমরা কোনও হঠকারিতার উদাহরণ পাইনা বললেই চলে। তাঁকে হয়ত অনেক সময় তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু করতে হয়েছে কিন্তু তাকে তাড়াহুড়ো করা বা আবেগপ্রবণতা বলা চলেনা। নিজের ইন্দ্রিয় ও সত্ত্বার উপর তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। শান্তি দৌত্যের সময় দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দী করার চেষ্টা করেন। অতি সহজেই কৌরবদের কবল মুক্ত হয়ে কৃষ্ণ বলেন, “ আত্মরক্ষা কীভাবে করতে হয় আমি জানি। হে রাজন, ওরা যদি হিংসা চায়, করতে দিন। কিন্তু, মর্যাদাহানি হয় এমন কোনও কর্ম আমি করবনা।”
‘ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যম ' – ইন্দ্রিয়ের প্রতি কারণগত বৈরাগ্য – কৃষ্ণ কখনও নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করেননি। তিনি সর্বদা সাধারণ বস্ত্র পরিধান করেছেন এবং সাধারণভাবেই জীবনধারণ করেছেন, কখনও নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে আশকারা দেননি। কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল বা কৌরবদের মত ভুল উপায়ে ক্ষমতালাভকারীদের সঙ্গে কৃষ্ণ কখনও সখ্যতা গড়ে তোলেননি, বরং সর্বহারা পাণ্ডবদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যাঁদের সদ্গুণ ছিল তাঁদের প্রতি যত্নবান হয়েছেন এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেছেন।
‘অনহংকার' – ঔদ্ধত্য থেকে মুক্ত – কৃষ্ণের দাদা বলরাম ছিলেন এক নিষ্প্রভ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মদ্যপ, জুয়াড়ি এবং দুর্যোধনের বন্ধু ( এবং গুরু)। কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ এবং রুক্মির পৌত্রীর বিবাহকালে, বলরাম রুক্মির সঙ্গে পাশা খেলছিলেন। অসাধু উপায়ে জিতেও রুক্মি পরাজিত বলরামকে উত্যক্ত করছিলেন। বলরাম মেজাজ হারিয়ে সেখানেই রুক্মিকে হত্যা করেন। বিবাহবাসর শ্মশানে পরিণত হয়। রুক্মিণী কৃষ্ণের কাছে নালিশ করেন যে তাঁর দাদাকে কৃষ্ণের দাদা হত্যা করেছেন (যদিও বহু বছর ধরে রুক্মিণী ও রুক্মি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেননি)। বলরাম কৃষ্ণের কাছে নালিশ করেন যে, কৃষ্ণের শ্যালক অসাধু উপায় অবলম্বন করায় এই শাস্তি তাঁর প্রাপ্য ছিল। কৃষ্ণ শান্তই থাকেন। তিনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান না। (ভা. পু. ১০.৬১)
‘জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম ' – জন্ম, মৃত্যু, বার্ধক্য, ব্যাধি এবং যন্ত্রণা সংক্রান্ত দুর্দশা ও ক্লেশের প্রতি যে অন্তর্দৃষ্টি - কৃষ্ণ কে কখনও জন্ম, মৃত্যু, বার্ধক্য, ব্যাধি বা যন্ত্রণা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। তিনি শুধুই নিজের কর্ম করে গেছেন।
‘অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু' – নিষ্কাম, স্ত্রী, পুত্র, গৃহের প্রতি অনাসক্ত। পরিবার-পরিজনদের থেকে কৃষ্ণ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। যখন তাঁর স্ত্রীরা তাঁকে প্রায় নিলামে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন, তিনি তুলাভারে বসে নারদকে তাঁর সবকিছু দিয়ে দেন। (এই উপাখ্যানটি হরিবংশের ক্রিটিকাল টেক্স্ট/জটিল সংস্করণে পাওয়া না গেলেও গোরখপুর সংস্করণে পাওয়া যায়)। তিনি কখনও এবিষয়ে একটি কথাও বলেননি। যখন তাঁর সন্তানেরা একে অন্যের বিরূদ্ধে লড়াই শুরু করেছে, কৃষ্ণ সেই অনাসৃষ্টি নিয়ে এতটুকুও বিচলিত ছিলেননা। সত্যি বলতে কি, তাঁকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন পিতাও বলা যায়! তাঁর পুত্র শাম্ব দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বরে গিয়েছিলেন। লক্ষণা তাঁকে পছন্দ না করায় শাম্ব হট্টগোল আরম্ভ করেন এবং দুর্যোধন তাঁকে আটক করেন। যখন কৃষ্ণ এই সম্বন্ধে জানতে পারেন, তিনি কোনওরকম কলহের পথে যাননা। তিনি শুধু বলেন, “ওকে কিছুদিন আটক থাকতে দাও, তাহলেই ওর শিক্ষা হবে।” বলরাম পরে গিয়ে শাম্বকে মুক্ত করে আনেন (ভা. পু. ১০.৬৮)। একইভাবে যখন কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করে বিবাহ করার পরামর্শ দেন, তখনও তিনি তাঁর পরিবারের মর্যাদার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হননি। সুভদ্রার জন্য যা ঠিক তিনি তাই করেছেন (তাঁর পিতা-মাতা সুভদ্রার জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না)।
‘নিত্যম চ সমচিত্তত্বম ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু' – কাম্য ও অকাম্য ঘটনাবলীর প্রতি নিত্য মানসিক ধীরতা বজায় রাখা - এই একটি বিষয় যা কৃষ্ণের জীবনের সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁকে অপ্রীতিকর মুহূর্তে বিচলিত হতেও দেখা যায়না, সুখকর মুহূর্তে আবেগে ভেসে যেতেও দেখা যায়না। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে ও নির্দ্বিধায়। বহুবার নানা অভিযোগের বাণ তাঁর দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং প্রতিবারই তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সেসবের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি, গান্ধারী যখন কৃষ্ণকে অভিশাপ দিলেন যে তাঁর গোষ্ঠীর সকলে পরস্পরের সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নাশ হবে, তিনি স্মিতহাস্য করে বলেছিলেন, “সেতো আমার বাকি রয়ে যাওয়া কাজ গুলির একটি” (ম. ভা. ১১.২৫-২৬)।
‘ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী' – আমার প্রতি (অর্থাৎ, ঈশ্বর) অটল ও অনন্যচিত্ত ভক্তি - কৃষ্ণ জানতেন তিনি স্বয়ং এক ‘অবতার’ এবং তাঁর অন্তঃস্থিত ঈশ্বরকে যথাযোগ্য শ্রদ্ধাও প্রকাশ করেছেন এবং একইসাথে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা করতে কখনও পিছপা হননি।
‘বিবিক্তদেশসেবিত্বম্ অরতির্জনসংসদি' – একাকীত্বের সন্ধান করা এবং ইতরজনের থেকে ব্যবধান রাখা - বিশ্বের সঙ্গে কৃষ্ণের নিত্য সংযোগ আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হলেও, তিনি একাকীত্ব-ই পছন্দ করতেন বেশী। ভিড় থেকে তিনি দূরেই থাকতেন। সকলের সঙ্গে থেকেও মানসিকভাবে তিনি বিচ্ছিন্নই থাকতেন।
‘অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং' – প্রকৃত সত্ত্বাকে জানার জন্য একনিষ্ঠ অধ্যবসায় – কৃষ্ণ সর্বদা তাঁর প্রকৃত সত্ত্বার অন্বেষণ করেছেন এবং সর্বদা তাঁর অন্তরাত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন।
‘তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম' – সত্যের জন্য নিত্য অন্বেষণ – কৃষ্ণ সর্বদা সত্যের পিছে ধাবমান। তিনি এক প্রকৃত যোগী, প্রকৃত জ্ঞানী, প্রকৃত ভক্ত। আশ্বমেধিক পর্বে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি যে বাণী আমায় শুনিয়েছিলেন তা আমার আর মনে নেই। সে আজ অনেকদিন হয়েও গেল, আপনি যদি পুনরায় একবার বলেন। আমার বড় জানতে ইচ্ছা করছে।” কৃষ্ণ বলেন, “হে নির্বোধ! প্রথমবারে তুমি কি বুঝতে পারনি? মহৎ বাণীর পুনরাবৃত্তি হয়না। সে ছিল এক মহান, শাশ্বত রহস্য। আমি বলেছিলাম যে, যে আগ্রহী নয় বা যার মনে শ্রদ্ধা বা তপসের কমতি আছে তার সামনে এই বাণী উচ্চারণ করোনা। আমি বলেছিলাম ! এখন দেখছি তুমি প্রমাণ করলে যে, তোমার মনে শ্রদ্ধা বা তপস কোনটাই নেই! তুমি এক নির্বোধে পরিণত হয়েছ। আমি তোমায় ওই বাণীগুলি যখন শুনিয়েছিলাম, তখন আমি মানসিকভাবে গভীর যোগসাধনায় নিমগ্ন ছিলাম। এখন আমার পক্ষে সেই একই বাণী উচ্চারণ করা সম্ভব নয়” (ম. ভা. ১৪.১৬-৫০)। সম্ভবত এই কারণেই সঞ্জয় কৃষ্ণকে ‘যোগেশ্বর’ নামে অভিহিত করেছেন, অর্থাৎ যোগের উপর যার পরম দক্ষতা (ভ. গী. ১৮.৭৫)।
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ