শ্রী কৃষ্ণ ঈশ্বর নাকি যোগেশ্বর - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

21 June, 2017

শ্রী কৃষ্ণ ঈশ্বর নাকি যোগেশ্বর

ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অণুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র তারই উপসনা করা উচিত।গীতায় অনেক জায়গায় যোগ শব্দ কর্ম যোগ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন গীতার ২ অধ্যায়ের ৫০ শ্লোকে বলা হয়েছে "যোগঃ কর্মসু কৌশলম" অর্থাৎ কর্মে কৌশলই যোগ" আর কৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলার কারণ হল শ্রীকৃষ্ণ কর্ম , কৌশল , যুক্তি , সাধনা ইত্যাদিতে অন্যান্য যোগীদের থেকে উত্তম বা সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন , তাই শ্রীকৃষ্ণ জীকে যোগেশ্বর কথন করা হয়েছে , এটা একটা উপাধিও বলা যায় । যোগেশ্বর অর্থাৎ যোগ কা ঈশ্বর (স্বামী) ।
শ্রী কৃষ্ণ যে যোগেশ্বর সেটা আমরা গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৭৫ ও ৭৮ শ্লোকে পাই।
ব্যাসপ্রসাদাচ্ছ্রুতবানেতদ্গুহ্যমহং পরম্৷
যোগং যোগেশ্বরাত্কৃষ্ণাত্সাক্ষাত্কথয়তঃ স্বয়ম্৷৷-গীতা ১৮/৭৫ শ্লোক

অর্থ : ব্যাসদেবের কৃপায় এই পরম গোপনীয় যোগের উপদেশ আমি স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছিলাম।
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ৷
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম৷৷-গীতা ১৮/৭৮ শ্লোক

অর্থ: যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানে শ্রী, বিজয়, ভূতি ও ন্যায় বর্তমান এই আমার অভিমত।
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে৷
তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্৷৷- গীতা ২/৫০ শ্লোক

অর্থ : যিনি ভগবত্ ভক্তির অনুশীলন করেন তিনি এই জীবনেই পাপ-পুণ্য উভয় থেকে মুক্ত হন । সুতরাং হে অর্জুন, তুমি নিস্কাম কর্মযোগের অনুশীলন কর সেটাই হল সর্বাঙ্গীণ কর্মকৌশল ।

দশম অধ্যায়-বিভূতি-যোগ

কথং বিদ্যামহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়ন্।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোহসি ভগবন্ময়া।।১৭।।(অর্জুন উবাচ)
অনুবাদঃ হে যোগেশ্বর! কিভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করলে আমি তোমাকে জানতে পারব? হে ভগবন্! কোন্ কোন্ বিবিধ আকৃতির মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব?
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগঃ
ব্যাসপ্রসাদাচ্ছ্রুতবানেতদ্ গুহ্যমহং পরম্।
যোগং যোগেশ্বরাৎ কৃষ্ণাৎসাক্ষাৎকথয়তঃ স্বয়ম্।।৭৫।।(সঞ্জয় উবাচ)
অনুবাদঃ ব্যাসদেবের কৃপায়, আমি এই পরম গোপনীয় যোগ সাক্ষাৎ বর্ণনাকারী স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছি।

যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।৭৮।।(সঞ্জয় উবাচ)
অনুবাদঃ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।


'যোগ' শব্দের নানা অর্থ আছে, যথা-'যোগঃ সংহনন-উপায়-ধ্যান-সঙ্গতি-যুক্তিষু।' এর একটিঅর্থ হল উপায়, কৌশল,সাধনা, যুক্তি।সঞ্জয় কৃষ্ণ কে 'যোগেশ্বর' বলে সম্বোধন করেছেন,আর যোগেশ্বর এর অর্থ,মহাযোগী,শ্রেষ্ঠযোগী বা যোগদ্বারা যিনি ঈশ্বর কে জেনেছেন



মহাভারতের নানা জায়গায় এই অর্থে

যোগ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যথা- দ্রোণাচার্য
বধের উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে- "একোহি
যোগোহস্য ভবেদ্ বধায়" অর্থাৎ উহাকে বধের
একটি মাত্র উপায় বা কৌশল আছে। ঠিক তদরূপ ঈশ্বর
প্রাপ্তিরও অনেক রকম যোগ বা কৌশল বা উপায়
আছে যথা- কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ,
ভক্তিযোগ ইত্যাদি।

গীতায় অনেক স্থানেই যোগ শব্দ কর্ম যোগ
অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যথা গীতার ২।৫০এ বলা
হয়েছে
"যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ অর্থাৎ কর্মে কৌশলই
যোগ"। আর শ্রী কৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলার
কারণ হল শ্রীকৃষ্ণ কর্ম কৌশল, যুক্তি, সাধনা
ইত্যাদিতে অন্যান্ন যোগীদের চেয়ে
সর্বোত্তম ছিলেন। তাই অর্জুন কৃষ্ণকে
যোগেশ্বর বলেছেন। বলা চলে এটা একটা


উপাদি।সুতরাং, তিনি ইশ্বর নন! মানুষ!
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।৭।।
অনুবাদঃ হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।

এখানে বলা হয়নি যে ঈশ্বর নিজে সৃষ্টি হন বা অবতরণ করেন, কারণ এমন কোন স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে ঈশ্বর থাকে না। এখানে মূলত বলা হয়েছে ঈশ্বর জীবাআত্মাকে  প্রকাশ করেন। ধর্মের যখন গ্লানি হয় তখন সময়ে সময়ে আমরা এই ধরণে ধর্মাত্মাদের দেখেছি। এখন যারা অযথা কুতর্ক করে বলবেন যে ঐ শ্লোকে "আত্মানং " বলতে মূলত নিজেকে তথা কৃষ্ণজীকে বুঝিয়েছেন। তাদের এটাই বলতে চাই যে এই ক্ষেত্রেও ঈশ্বরের অবতরণ তত্ব টিকে না। কারণ আপনাদের কথা মত এটা শ্রীকৃষ্ণেজীর কথা। তাহলে আপনাদের কথা মতে তিনি নিজেই বলছে যে যখন যখন ধর্মের গ্লানি হয় ও অধর্ম বেড়ে যায় তখন কৃষ্ণজী অবতরণ করে। আর মুক্তি প্রাপ্ত জী (শ্রীকৃষ্ণজী ও মুক্ত আত্মা) যে নিজের ইচ্ছা মত অবতরণ করতে পারেন তা নিচের কিছু উদাহরণ থেকে প্রমাণ হয়।

শতপথ ব্রহ্মণ গ্রন্থ থেকে দেখুন-
"শৃণ্বন্ শ্রোত্রং ভবতি, স্পর্শয়ন্ ত্বগ্ভবতি, পশ্যন চক্ষুর্ভবতি,রসয়ন্ রসনা ভবতি, জিঘ্রন্ ঘ্রাণং ভবতি, মন্বানো মনো ভবতি, বোধয়ন্ বুদ্ধির্ভবতি, চেতয়ঁশ্চিত্তম্ভবত্যহঙকুর্বাণো হঙ্কারো ভবতি।।" 
(শতপথ ব্রাহ্মণ কাং ১৪) 
অর্থাৎ মুক্তি অবস্থায় জীবাত্মা শুনিতে ইচ্ছা করিলে স্বশক্তি দ্বারাই শ্রোত্র, স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করিলে ত্বক, দেখিবার সংকল্প হইলে চক্ষু, স্বাদ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণ, সংকল্প বিকল্প করিবার জন্য মন, নিশ্চয় করিবার জন্য বুদ্ধি, স্মরণ করিবার জন্য চিত্ত, অহংবুদ্ধির জন্য যেমন ইন্দ্রিয়গোলকের দ্বারা স্বকার্য সিদ্ধ করে সেইরূপ মুক্তি অবস্থায় স্বশক্তি দ্বারা সমস্ত আনন্দ ভোগ করে।"এর থেকে একেবারে নিশ্চত ভাবে যানা যায় যে মুক্ত আত্মারা চাইলে অবতরণ করতে পারেন। কৃষ্ণজীও মুক্ত আত্মা ছিলেন, যার ফলে তিনি ইচ্ছা করেছিলেন যে যখনই ধর্মের গ্লাণি হয় অধর্ম বেড়ে যায় তখন সাধুদের রক্ষার জন্য তিনি অবতরণ করে। এই অবতরণ মুক্ত বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবাত্মার হয়,ঈশ্বর বা পরমাত্মার বা পরমেশ্বরের বা পরমব্রহ্মের নয়।
মুক্ত আত্মারা যে দেহধারণ করে তার আরো কিছু প্রমাণ দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্ত সূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন।
প্রমাণ দেখুন-
"ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্পামননাৎ" (বেদান্তসূত্র ৪।৪।১১)
অর্থাৎ মুক্ত আত্মার দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি থাকে, ইহা  জৈমিনি মুনির মত। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে যে, তারা নানা রূপ দেহধারণ করার ক্ষমতা আছে। তিনি(মুক্ত জীবাত্মা) এক প্রকার থাকেন, তিন প্রকার হন, পঞ্চ প্রকার, সপ্ত প্রকার এবং নব প্রকার হন...।"
.
দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্ত সূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন প্রমাণ দেখুন
(ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৬।২)
এছাড়াও তিনি যে যা ইচ্ছা তাই পেয়ে থাকেন তথা করতে পারেন তার প্রমাণ আরো দেখুন-
"তিনি যদি পিতৃলোক কামনা করেন, তবে তাহার
সঙ্কল্পমাত্রই পিতৃগণ তাঁহা সহিত মিলিত হন...।
মাতৃলোক কামনা করলে মাতৃগনের সহিত মিলিত হন... ভাতৃলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হতে
পারেন... । ভগিনীলোক কামনা করলে, বন্ধুলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হন। এক কথায় যাহা চান
তাহাই প্রাপ্ত হন।"
(ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৮।২।১-১০)
বোধ করি কৃষ্ণজীও মুক্ত আত্মা বা মোক্ষলাভ করা আত্মাই ছিলেন।
গীতা ভাষ্য মতে এই
সিদ্ধান্তেই উপনিত হওয়া যায় যে তিনি মুক্ত আত্মা। আর পরমাত্মা বা ঈশ্বর যে অবতরণ করে না তা যজুর্বেদের ৪০।৮ নং মন্ত্রে স্পষ্ট করেই বলা আছে।
গীতা ৪।৫ ও ৬নং শ্লোকের ব্যাখ্যা দেখুন। এই শ্লোকদ্বয় কৃষ্ণের, পরমেশ্বর বা ঈশ্বরের নয়। দেখুন-
“আমি জম্মরহিত, অক্ষয় আত্মা, জীবসমূহের ঈশ্বর হয়েও নিজের অন্তরঙ্গ শক্তিকে বা স্বভাবকে আশ্রয় করে মায়ার দ্বারা দেহ ধারণ করি।”(গীত ৪।৬)
ব্যাখ্যা- পূর্বের শ্লোকে মানে গীতা ৪।৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে-আমার ও তোমার বহু জম্ম অতীত হয়েছে।
অথচ গীতার ৪।৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে তিনি জম্মরহিত। তাহলে কি এই দুই শ্লোকের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান? প্রকৃত পক্ষে তা নয়, কারণ ৫নং শ্লোকে মোক্ষ বা মুক্তি প্রাপ্ত জীবাত্মা শ্রীকৃষ্ণ যে পূর্বে পাপ পূর্ণ রূপ কর্মফলে আবদ্ধ হয়ে দেহধারণ হয়েছিল অর্থাৎ জম্মগ্রহণ করেছিলেন তা স্বীকার করেছেন। আর ৬নং শ্লোকে তিনি নিজের ইচ্ছায় অবতরণের কথা বলেছেন। কেননা সকল মুক্ত আত্মারা নিজের ইচ্ছা শক্তি দ্বারা দেহ ধারণ করতে পারেন। আর এই ভাবে দেহধারণকেই অবতরণ বলে (কিন্তু জম্ম নয়) ও জ্ঞানীরা ঐ মুক্ত জীবাত্মাকে বলে অবতার। আর তিনি এটাও বলেছেন যে তিনি অক্ষয় আত্মা(জীবাত্মা), আমরা সকলেই জানি কোন জীবাত্মারই ক্ষয় নেই।
গীতার ৪।৬নং শ্লোকে তিনি বলেছেন আত্মমায়ায় দেহধারণ করেন, আর মোক্ষ প্রাপ্ত আত্মারা তা পারেন। তার প্রমাণ বেদান্ত সূত্র থেকে দেখুন-
.
“সংকল্পাদেব তু তচ্ছ্রুতেঃ
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।৮.)
অর্থাৎ ইচ্ছামাত্র মুক্ত আত্মারা তাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারেন।”
গীতা ৪।৬নং শ্লোকে তিনি নিজেকে  জীবসমূহের ঈশ্বর বলেছেন। ইহারও একটা কারণ আছে, বেদান্ত সূত্র থেকে দেখুন-
.
“অত এব চানন্যাধিপতিঃ
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।৯.)
অর্থাৎ সেই স্থানে মুক্ত আত্মার কোন অধিপতি নাই। কারণ তখন তিনি স্বাধীন ও সতন্ত্র থাকেন।”
সংসার জগতে যেমন প্রধান অপ্রধান থাকে, মুক্তিতে সেইরূপ থাকে না বলেই তিনি নিজেকে সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের ঈশ্বর বলেছেন। কারণ ঐ সময় তিনি সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের চেয়ে উন্নত ছিলেন, কারণ তিনি মুক্ত ছিলেন। তবে এটাও জেনে রাখা উচিত মুক্ত জীবাত্মা সর্বশক্তির অধীশ্বর নয়, বেদান্ত সূত্রে ইহা স্পষ্ট বলা আছে। প্রমাণ দেখুন-
.
“ভোগমাত্রসাম্যলিঙ্গাচ্চ।।
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।২১.)
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভোগ্য ব্যাপারে পরমেশ্বর ও মুক্ত জীবাত্মার মধ্য সাম্যভাব আছে। সর্বশক্তিমত্তা বিষয়ে নয়।”
আরো জেনে রাখা উচিত যে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদি ব্যাপার ব্যতীত অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। প্রমাণ দেখুন-
.
“জগদ্ব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ অসন্নিহিতত্বাচ্চ।।
বেদান্ত সূত্র ৪।৪।১৭
অর্থাৎ মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদি শক্তি ব্যাপার ব্যতীত অন্য ক্ষমতার অধিকারী হন।”

শ্রীভগবানুবাচ
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।৫।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।
অজেহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানীমীম্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।৬।।
অনুবাদঃ যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
গীতা ৪ অধ্যায়, ৫-৬ শ্লোক স্ববিরোধী 

গীতা-নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্যঃ
সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহস্তি ন প্রিয়ঃ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।২৯।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউই আমার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নয় এবং প্রিয়ও নয়। কিন্তু যাঁরা ভক্তি- পূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তাঁরা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও তাঁদের মধ্যে বাস করি।
াআবার
ন চ তস্মাম্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মে প্রিয়কৃত্তমঃ। 
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভুুবি।।৬৯।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অধিক পিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর হবে না।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু। 
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমর ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
শ্রদ্ধাবাননসূয়শ্চ শৃণুয়াদপি যো নরঃ। 
সোহপি মুক্তঃ শুভাঁল্লোকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পুণ্যকর্মণাম্।।৭১।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ শ্রদ্ধাবান ও অসূয়া-রহিত যে মানুষ গীতা শ্রবণ করেন, তিনিও পাপমুক্ত হয়ে পুণ্য কর্মকারীদের শুভ লোকসমূহ লাভ করেন।

কচ্চিদেতৎ শ্রতং পার্থ ত্বয়ৈকাগ্রেণ চেতসা। 
কচ্চিদজ্ঞানসম্মোহঃ প্রণষ্টস্তে ধনঞ্জয়।।৭২।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ হে পার্থ! হে ধনঞ্জয়! তুমি একাগ্রচিত্তে এই গীতা শ্রবণ করেছ কি? তোমার অজ্ঞান-জনিত মোহ বিদুরিত হয়েছে কি?

ত্রয়োদশ-অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ


জ্ঞেয়ং যত্তৎপ্রবক্ষ্যামি যজজ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে। 
অনাদি মৎপরং ব্রহ্ম ন সত্তন্নাসদুচ্যতে।।১৩।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ আমি এখন জ্ঞাতব্য বিষয় সম্বন্ধে বলব, যা জেনে অমৃতত্ব লাভ হয়। সেই জ্ঞেয় বস্তু অনাদি এবং আমার আশ্রিত। তাকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তা কার্য ও কারণের অতীত।

সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।১৪।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ তাঁর হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান।

সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্। 
আসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৫।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।

 বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ। 
সূক্ষ্মাত্বত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।।১৬।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ সেই পরমতত্ত্ব সমস্ত ভূতের অন্তরে ও বাইরে বর্তমান। তাঁর থেকেই সমস্ত চরাচর; অত্যন্ত সূক্ষ্মতা হেতু তিনি অবিজ্ঞেয়। যুদিও তিনি বহু দূরে অবস্থিত, কিন্তু তবুও তিনি সকলের অত্যন্ত নিকটে।
অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্। 
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং প্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।১৭।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ পরমাত্মাকে যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবুও তাঁকে সংহার-কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্।।১৮।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ তিনি সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তাঁকে সমস্ত অন্ধকারের অতীত অব্যক্ত স্বরূপ বলা হয়। তিনিই জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় এবং তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।

কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরচ্যতে। 
পুরুষঃ সুখদুঃখনাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে।।২১।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ সমস্ত জড়ীয় কার্য ও কারণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিকে হেতু বলা হয়, তেমনিই জড়ীয় সুখ ও দুঃখের ভোগ বিষয়ে জীবকে হেতু বলা হয়।
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙক্তে প্রকৃতিজান্ হুণান্। 
কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদযোনিজন্মসু।।২২।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে জীব প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির গুণের সঙ্গবশতই তার সৎ ও অসৎ যোনিসমূহে জন্ম হয়।

উপদ্রষ্টানুমস্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।।২৩।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ এই শরীরে আর একজন পরম পুরষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।

য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিং চ গুণৈঃ সহ। 
সর্বথা বর্তমানোহপি ন স ভূয়োহভিজায়তে।।২৪।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ যিনি এভাবেই পুরুষকে এবং গুণাদি সহ জড় প্রকৃতিকে অবগত হন, তিনি জড় জগতে বর্তমান হয়েও পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন না।

ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা। 
অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে।।২৫।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ কেউ কেউ পরমাত্মাকে অন্তরে ধ্যানের দ্বারা দর্শন করেন, কেউ সাংখ্য-যোগের দ্বারা দর্শন করেন এবং অন্যেরা কর্মযোগের দ্বারা দর্শন করেন।

নবম অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ


ন চ মাং তানি কর্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়। 
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্মসু।।৯।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়! সেই সমস্ত কর্ম আমাকে আবদ্ধ করতে পারে না। আমি সেই সমস্ত কর্মে অনাসক্ত ও উদাসীনের  ন্যায় অবস্থিত থাকি। 



অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানষীং তনুমাশ্রিতম্।

পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।।১১।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মুর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না। 
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্। 
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ।।৫।। (শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ যদিও সব কিছুই আমারই সৃষ্ট, তবুও তারা আমাতে অবস্থিত নয়। আমার যোগৈশ্বর্য দর্শন কর! যদিও তারা আমাতে অবস্থিত নয়। আমার যোগৈশ্বর্য দর্শন কর! যদিও আমি সমস্ত জীবের ধারক এবং যদিও আমি সর্বব্যাপ্ত,তবুও আমি এই জড় সৃষ্টির অন্তর্গত নই, কেন না আমি নিজেই সমস্ত সৃষ্টির উৎস। 

ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা। 

মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ।।৪।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ অব্যক্তরূপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত আছি। সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই।

মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।৩২।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী, বৈশ্য, শুদ্র আদি নীচকুলে জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে।
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।১৩।।
অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।
গীতা-দশম-অধ্যায়-বিভূতি-যোগঃ
আদত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী।।২১।।(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।
বেদানাং সামবেতোহস্মি দেবনামস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা।।২২।।
অনুবাদঃ সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মম্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা।
রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্।।২৩।।
অনুবাদঃ রুদ্রদের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু।
াআবার     গীতা-একাদশ-অধ্যায়-বিশ্বরূপ-দর্শন(শ্রীভগবানুবাচ)
পশ্যাদিত্যান্ বসূন্ রুদ্রানশ্বিনৌ মরুতস্তথা। 
বহূন্যদৃষ্টপূর্বাণি পশ্যাশ্চর্যাণি ভারত।।৬।।
অনুবাদঃ হে ভারত! দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ঊনপঞ্চাশ মরুত এবং অনেক অদৃষ্টপূর্ব আশ্চর্য রূপ দেখ।
ভবাপ্যয়ৌ হি ভুতানাং শ্রুতৌ বিস্তরশো ময়া।
ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মহাত্ম্যমপি চাব্যয়ম্।।২।।-গীতা-একাদশ-অধ্যায়-বিশ্বরূপ-দর্শন(শ্রীভগবানুবাচ)
অনুবাদঃ হে পদ্ধপলাশলোশন! সর্বভূতের উৎপত্তি ও প্রলয় তোমার থেকেই হয় এবং তোমার কাছ থেকেই আমি তোমার অব্যয় মাহাত্ম্য অবগত হলাম।
গীতা-দশম-অধ্যায়-বিভূতি-যোগঃ

পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্।
সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ।।২৪।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।
আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্।
প্রজন্শ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকিঃ।।২৮।।
অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্।
পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্।।২৯।।
 অনুবাদঃ সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। সন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি। সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ। পিতৃদের মধ্যে আমি অর্যমা এবং দন্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।
পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্।
ঋষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী।।৩১।।
অনুবাদঃ পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা।

অক্ষরাণামকারেহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ। 
অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ।।৩৩।।
অনুবাদঃ সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব-সমাস, সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা।
নাস্তোহস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ। 
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভুতের্বিস্তরো ময়া ।।৪০।।
অনুবাদঃ হে পরন্তপ! আমার দিব্য বিভুতি-সমূহের অন্ত নেই। আমি এই সমস্ত বিভুতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম।

শ্রীমদ্ভগবত গীতার "আমি" রহস্য উন্মোচন
★★শ্রীমদ্ভগবদ গীতার এই শ্লোকটি খেয়াল করুন,
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।
গীতা = ৭/৩
অনুবাদঃ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোনো একজন আমাকে লাভ করবার জন্য যত্ন করেন, এবং সেই যত্নকারীদের মধ্যে হয়তো কেউ আমাকে তত্ত্বতঃ জানতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, সেই আমি টা কে? আমি টা কি শ্রীকৃষ্ণ নাকি অন্যকেউ? অন্যকেউ বলতে সেই পরমসত্ত্বা পরব্রহ্ম... আর এই আমাকে জেনে লোকের কি অবস্থা হয়?
একটু পিছনে ফিরে আমরা উপনিষদে যাই,
★★যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে অস্তম্ গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়। তথা বিদ্বান্ নামরূপাদ্ বিমুক্তঃ পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্।। মুণ্ডক উপনিষদ, ৩/২/৮।।
★অনুবাদঃ যেরূপ প্রবহমান নদীগুলো নামরূপ ত্যাগ করে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, সেইরূপ জ্ঞানী মহাত্মাও নাম রূপ থেকে মুক্ত হয়ে উত্তম থেকে উত্তম দিব্য পরমপুরুষ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন।
আর এই পরমাত্মাকে লাভ করার পর কি অবস্থা হয়, এর পরের মন্ত্রে আমরা দেখে নেই...
★★ স যো হ বৈ তৎপরমং ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।।মুণ্ডকোপনিষদ, ৩/২/৯।।
★অনুবাদঃ নিশ্চয়ই যে কেহ ঐ পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে জানেন সে ব্রহ্মই হয় অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপতা লাভ করে ব্রহ্মের মতই আচরণ করেন।
ঠিক যেভাবে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আচরণ করেছিলেন, তেমনি কিছু আচরণ আমরা দেখে নেই...
প্রথমেই
প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ থেকেই দেখে নেই বেদ কি বলে,
★★প্র তদ্ বোচেদ্ অমৃতস্য বিদ্বান্ গন্ধর্বো ধাম পরমং গুহ্য যৎ। ব্রীণি পদানি নিহিতা গুহাস্য যস্তানি বেদ স পিত্বষ্পিতাসৎ।। অথর্ববেদ = ২/১/১/২।।
★অনুবাদঃ অমৃত(অবিনাশী) ব্রহ্মের স্বরূপ জেনে, আদিত্য উপাসকদের কাছে সে ব্রহ্মতত্ত্ব বলুক। সে ব্রহ্মের আবৃত্তি রহিত পরমস্থান, হৃদয়রূপ গুহায় স্থিত। এই পরমাত্মার তিনটি পদ গুহায় নিহিত আছে। গুহানিহিত পদার্থের মত অজ্ঞাত অপরিচ্ছন্ন ব্রহ্ম কেবল উপদেশের দ্বারা জ্ঞাত হয়। এ পরব্রহ্মের তিন পদ (অংশস্বরূপ) বিরাট, হিরন্যগর্ভ ও ঈশ্বর মুমুক্ষগন লাভ করেন। শম-দমাদি সম্পন্ন অধিকারী গুরুর উপদেশ দ্বারা জীব ও ঈশ্বরের উপাধি ত্যাগ করে সে নিষ্কল ব্রহ্মের সাক্ষাৎ লাভ করে থাকে। যে তাকে জানে, সে নিজ জনকেরও কারণভূত (পিতা) হয় অর্থাৎ সর্ব্বজগতের অধিষ্ঠানরূপ ব্রহ্মের সাথে নিজেরও সর্বজগৎ-কারণত্ব উপলব্ধি করে।
এখন বেদের আলোকেই তার প্রমাণ দেখে নেই, অথর্ববেদে_অম্ভৃণ মহর্ষির দুহিতা বাক্ নাম্নী ব্রহ্মবাদিনী বলছেন...
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।।
অথর্ববেদ, ৪র্থ কাণ্ড/৬ষ্ট অনুবাক/৫ম সূক্ত/১নং মন্ত্র।
অনুবাদঃ আমি একাদশ রুদ্র ও অষ্ট বসুগণের সাথে অভিন্নরূপে বিচরণ করি। সেরূপ আদিত্যগণ ও বিশ্বদেবগণের সাথে অভিন্নরূপে আমি বর্তমান। আমিই পরব্রহ্মাত্মিকা মিত্র ও বরুণদেবকে ধারণ করি, ইন্দ্র ও অগ্নিকে আমিই ধারণ করি এবং উভয় অশ্বিনীকুমারদ্বয়কেও আমিই ধারণ করি।
এখানে "আমি" শব্দ দ্বারা মন্ত্রের বক্তাকে ঈশ্বর মানলে ঋষিকন্যা বাক্ কেও তো ঈশ্বর হিসেবে মানতে হয়। ব্যাপারটা কি তাই নয়?
আবার ঋগ্বেদে ৪র্থ মণ্ডলে ২৬ নং সূক্তের ১ম পংক্তিতে ঋষি বামদেব বলছেন,
★অহং মনুরভবং, সূর্যশ্চাহং কক্ষীবী ঋষিরস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ং ন্যৃংজে অহং কবিরুশনা পশ্যতা মা।।
অর্থাৎ আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস ঋষিকে অলংকৃত করেছি। আমি কবি উশন। আমাকে দর্শন কর।
তাহলে এখানে কি ঋষি বামদেব কেও ঈশ্বর মানা উচিত নয়?
★★ছান্দোগ্য উপনিষদেও সনৎকুমার তাঁর শিষ্য নারদকে বলেছেন-
"★স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিতাথাতঃ
অহঙ্কারাদেশ ___
এব অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং
দক্ষিণতঃ অহমুত্তরতঃ অহমেবেদং সর্বমিতি।।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.
★অনুবাদঃ তিনিই নিম্নে, তিনিই উর্ধ্বে, তিনি পশ্চাতে, তিনি সম্মুখে, তিনি দক্ষিণে, তিনি উত্তরে,--তিনিই এই সমস্ত।
আমিই অধো ভাগে, আমিই উর্ধ্বে, আমিই পশ্চাতে, আমিই সম্মূখে, আমিই দক্ষিণে, আমিই উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।
এখানে সনৎকুমার, গীতার শ্রীকৃষ্ণের মতন দু'রকম কথা বলেছে, তাহলে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানলে, সনৎকুমারকেও ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে। তাই নয় কি? বিচার করুন...
আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে –
★★অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। উর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ– শীক্ষাবল্লী ১০ম অনুবাক।
★অনুবাদঃ আমি সংসাররূপ বৃক্ষের উচ্ছেদক, আমার কীর্তি পর্বতের শিখরের মতো উন্নত। অন্নোৎপাদক শক্তিযুক্ত সূর্য উত্তম অমৃতের মতো, সেইরূপ আমিও অতিশয় পবিত্র অমৃত স্বরূপ তথা আমি প্রকাশযুক্ত ধনের ভাণ্ডার, পরমানন্দময় অমৃত দ্বারা অভিসিঞ্চিত তথা শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন– এরূপ এই ত্রিশঙ্কুর ঋষির অনুভূত বৈদিক প্রবচন।
তাহলে এখানে ত্রিশঙ্কুর ঋষিকেও ঈশ্বর বলে মান্য করতে হয়, তাই ত? ।
★★তৈত্তিরীয় উপনিষদে আরও বলা হয়েছে...
★★হা৩বু হা৩বু হা৩বু।
অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩হহমন্নাদো৩হহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোহমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩বাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্।। সুবর্ণ জ্যোতীঃ য এবং বেদ। ইত্যুপনিষৎ।।
তৈত্তিরীয়_উপনিষদ–ভৃগুবল্লী ১০ম অনুবাক।
অনুবাদঃ আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন। আমিই অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা, আমিই অন্ন ভোক্তা। আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী। আমি সত্যের অর্থাৎ প্রতক্ষ্য জগত অপেক্ষা সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রথম উৎপন্ন এবং দেবতাগণ হতেও পূর্বে বিদ্যমান অমৃতের কেন্দ্র হচ্ছি আমি। যে কেউ আমাকে অন্ন দেয় সে কার্য দ্বারা আমার রক্ষা করে। আমিই অন্নস্বরূপ হয়ে অন্ন ভক্ষণকর্তাকে ভক্ষণ করি। আমি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে অভিভূত করি। আমার প্রকাশের এক ঝলক সূর্যের ন্যায়। যে এরূপ জানে সেও স্থিতি লাভ করে। এরূপ এই উপনিষদ সমাপ্ত।
তাহলে এই আমি বলতে কি বুঝায় তার সমাধান কি?
বেদাঙ্গের অন্যতম "নিরুক্ত" তে ঋষি যাস্ক বলেছেন,
★★সাক্ষাত্কৃতধর্মোণ ঋষয়ো বভূবুস্তেহবরেভ্যোহসাক্ষাত্ কৃতধর্মস্য উপদেশেন মন্ত্রানসম্প্রাদু।
নিরুক্ত ১।১৯
অনুবাদঃ তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি) এবং তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেন নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
★ শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী ছিলেন তার প্রমাণ স্বয়ং গীতাতেই দেওয়া হয়েছে। গীতার ১৮/৭৮ এ শ্রীকৃষ্ণকে যোগী এবং ১৮/৭৫ এ তাঁকে যোগেশ্বর অর্থাৎ যোগে সিদ্ধ পুরুষ বলা হয়েছে।
মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বের ১৬-তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণর নিজেই বলেছেন,
★যুদ্ধের পরে অর্জুন যখন সেই গীতার উপদেশ পুনরায় শুনতে চেয়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
★বিদিতং মে মহাবাহো সংগ্রামে সমুপস্থিতে।
মহাত্ম্যং দেব দেবকীমাতস্তশ্চতে রূপমৈশ্বরম্।। ১৬/৫।।
অনুবাদঃ মহাবাহো! দেবকীনন্দন! যখন সংগ্রামের সময় উপস্থিত ছিলো, সেই সময় আমার মহাত্মার জ্ঞান এবং ঈশ্বরীয় স্বরূপের দর্শন হয়েছিলো।
★★যত্ তত্ ভগবতা প্রোক্তং পুরা কেশব সৌহৃদাত্। তত্ সর্বৈ পুরুষব্যাগ্র নষ্টং মে ভ্রষ্টচেতসঃ।।১৬/৬।।
অনুবাদঃ কিন্তু কেশব! নিজ সৌহার্দ্যবশতঃ প্রথমে আমাকে যে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছিলেন, আমার সেসব জ্ঞান ওই সময় বিচলিতচিত্ত হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
★★মম কৌতুহলং ত্বস্তি তেষ্বর্থেষু পুনঃ পুনঃ। ভবাংস্তু দ্বারকাং গন্তা নচরাদিব মাধব।।১৬/৭।।
অনুবাদঃ মাধব! সেই বিষয় শোনার জন্য আমার মন বারংবার উৎকন্ঠিত হচ্ছে। আপনি শীঘ্রই দ্বারকা গমন করবেন, অতঃ সেই বিষয় আমাকে শুনিয়ে দিন।
এ কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে অর্জুনকে বললেন -
★★শ্রাবিতস্ত্বং ময়া গুহ্যংজ্ঞাপিতশ্চ সনাতনম্।
ধর্মৈ স্বরূপিণে পার্থ সর্বলোকাংশ্চ শাশ্বতান্।।১৬/৯।।
অবুদ্ধয়া নাগ্রহীর্যস্ত্বং তন্মে সুমহদপ্রিয়ম্।
ন চ সাদ্য পুনর্ভূয়ঃ স্মৃতির্মে সম্ভবিষ্যতি।।১৬/১০।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! সেই সময় তোমাকে অত্যন্ত গোপনীয় জ্ঞানের শ্রবন করিয়েছিলাম। নিজ স্বরুপভূত ধর্ম সনাতন পুরুষোত্তমত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম এবং (শুক্ল কৃষ্ণ গতির নিরুপন করে) সম্পূর্ণ নিত্য লোকেরও বর্ণনা করেছিলাম। কিন্তু তুমি যে নিজে না বোঝার কারণে সেই উপদেশের স্মরণ করতে পারছো না, ইহা আমার অত্যন্ত অপ্রিত। সেই কথার এখন পুরোপুরি স্মরণ সম্ভব
নয়।
★★নূনমশ্রধানোহসি দুর্সেধা হ্যসি পান্ডব।
ন চ শক্য পূনর্বক্তুমশেষেণ ধনন্জয়।।১১।।
অনুবাদঃ পান্ডুনন্দন! নিশ্চয়ই তুমি বড় শ্রদ্ধাহীন, তোমার বুদ্ধি অত্যন্ত মন্দ। ধনন্জয়! এখন আমি সেই উপদেশের বর্ণনা করতে পারবো না।
★★ স হি ধর্মঃ সুপর্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্ময়া ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।।১২।।
অনুবাদঃসেই ধর্ম ব্রহ্ম পদের প্রাপ্তি করানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিলো। তাহার সারের ধর্ম সেই রূপে পূনরায় প্রদান করা এখন আমার বশের কথাও নয়।
★★ উপরোক্ত শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বললেন যে, সেই জ্ঞানের উপদেশ পূনরায় তিনি করতে পারবেন না। কেননা সেই জ্ঞানের উপদেশ করার মতো অবস্থা এখন তাহার বশে নেই। শ্রীকৃষ্ণ কেন সেই উপদেশ পূনরায় দিতে পারেননি সেই কথা স্পষ্ট করে, তিনি বলেছেন -
★★পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মবন্নথৈ পুরাতনম্।। ১৬/১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণ বললেন! সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে পরমাত্মতত্ত্বের বর্ণনা করেছিলাম। এখন সেই বিষয় এর জ্ঞান করানোর জন্য আমি এক প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনা করছি।
★★পরিশেষে, অর্থাৎ গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টাদশ অধ্যায়ে কি বলেছেন, আসুন দেখে নেই..
★★ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥১৮/৬১॥
অনুবাদঃ- হে অর্জুন ! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা পরিভ্রমণ করান।
★★তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥১৮/৬২॥
অনুবাদঃ হে ভারত ! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হন, তবে আবার কোন ঈশ্বরের স্মরণ নিতে বললেন? বলবেন কি? তাহলে বোঝা যায়, এই গীতার বাণীগুলো অচিন্ত্যস্বরূপ পরমাত্মার বাণী। আর এখানে "আমি" তাই সেই চিন্তার অতীত ইন্দ্রিয়াতীত পরমাত্মাই।

                   গীতা স্ববিরোধী
গীতা অধ্যায় ৪ জ্ঞান যোগ এর ৫ এবং ৬ শ্লোক

গীতা নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ- শ্লোক সংখ্যা ২৯
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ শ্লোক সংখ্যা ৬৫ ,৬৯

গীতা সপ্তম-অধ্যায়-বিজ্ঞান-যোগ শ্লোক সংখ্যা  ৬
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ শ্লোক সংখ্যা ৪৬

গীতা নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ- শ্লোক সংখ্যা ২৮
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ শ্লোক সংখ্যা ৬২

গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ-শ্লোক সংখ্যা ১৪
(কৃষ্ণ ঈশ্বর তাহলে এই শ্লোক গুলো কৃষ্ণ কোন ঈশ্বর এর উদ্দেশ্যে বলেছে ?)
গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ-শ্লোক সংখ্যা ১৫
(কৃষ্ণ ঈশ্বর তাহলে এই শ্লোক গুলো কৃষ্ণ কোন ঈশ্বর এর উদ্দেশ্যে বলেছে ?)
গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ-শ্লোক সংখ্যা ১৬
(কৃষ্ণ ঈশ্বর তাহলে এই শ্লোক গুলো কৃষ্ণ কোন ঈশ্বর এর উদ্দেশ্যে বলেছে ?)

গীতা-৪র্থ অধ্যায়-জ্ঞান যোগ
শ্রীভগবানুবাচ
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।৫।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।

অজেহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানীমীম্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।৬।।
অনুবাদঃ যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
গীতা-নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ-
সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহস্তি ন প্রিয়ঃ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।২৯।।
অনুবাদঃ আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউই আমার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নয় এবং প্রিয়ও নয়। কিন্তু যাঁরা ভক্তি- পূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তাঁরা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও তাঁদের মধ্যে বাস করি।
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু। 
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫।।
অনুবাদঃ তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমর ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
ন চ তস্মাম্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মে প্রিয়কৃত্তমঃ। 
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভুুবি।।৬৯।।
অনুবাদঃ এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অধিক পিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর হবে না।
গীতা-সপ্তম-অধ্যায়-বিজ্ঞান-যোগ
এতদযোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয়। 
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা।।৬।।
অনুবাদঃ আমার এই উভয় প্রকৃতি থেকে জড় ও চেতন সব কিছু উৎপন্ন হয়েছে। অতএব নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো যে, আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারণ।
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম্।
স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ যাঁর থেকে সমস্ত জীবের পূর্ব বাসনারূপ প্রবৃত্তি হয়, যিনি এই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত আছেন, তাঁকে মানুষ তার নিজের কর্মের দ্বারা অর্চন করে সিদ্ধি লাভ করে।
গীতা-নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষ্যসে কর্মবন্ধনৈঃ।
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।২৮।।
অনুবাদঃ এভাবেই আমাতে সমস্ত কর্ম অর্পণ দ্বারা শুভ ও অশুভ ফলবিশিষ্ট কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। এভাবেই সন্যাস যোগে যুক্ত হয়ে তুমি মুক্ত হবে এবং আমাকেই প্রাপ্ত হবে।
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত। 
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।।৬২।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
সর্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ। 
ইষ্টোহসি মে দৃঢ়মিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্।।৬৪।।
অনুবাদঃ তুমি আমার কাছ থেকে সবচেয়ে গোপনীয় পরম উপদেশ শ্রবণ কর। যেহেতু তুমি আমার অতিশয় প্রিয়, সেই হেতু তোমার হিতের জন্যই আমি বলছি।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু। 
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫।।
অনুবাদঃ তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমর ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।১৪।।
অনুবাদঃ তাঁর হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান।

সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্। 
আসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৫।।
অনুবাদঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।

 বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ। 
সূক্ষ্মাত্বত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।।১৬।।
অনুবাদঃ সেই পরমতত্ত্ব সমস্ত ভূতের অন্তরে ও বাইরে বর্তমান। তাঁর থেকেই সমস্ত চরাচর; অত্যন্ত সূক্ষ্মতা হেতু তিনি অবিজ্ঞেয়। যুদিও তিনি বহু দূরে অবস্থিত, কিন্তু তবুও তিনি সকলের অত্যন্ত নিকটে।
অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্। 
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং প্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।১৭।।
অনুবাদঃ পরমাত্মাকে যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবুও তাঁকে সংহার-কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্।।১৮।।
অনুবাদঃ তিনি সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তাঁকে সমস্ত অন্ধকারের অতীত অব্যক্ত স্বরূপ বলা হয়। তিনিই জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় এবং তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।

গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।১৪।।
অনুবাদঃ তাঁর হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান।

সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্। 
আসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৫।।
অনুবাদঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।

 বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ। 
সূক্ষ্মাত্বত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।।১৬।।
অনুবাদঃ সেই পরমতত্ত্ব সমস্ত ভূতের অন্তরে ও বাইরে বর্তমান। তাঁর থেকেই সমস্ত চরাচর; অত্যন্ত সূক্ষ্মতা হেতু তিনি অবিজ্ঞেয়। যুদিও তিনি বহু দূরে অবস্থিত, কিন্তু তবুও তিনি সকলের অত্যন্ত নিকটে।

অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্। 
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং প্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।১৭।।
অনুবাদঃ পরমাত্মাকে যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবুও তাঁকে সংহার-কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্।।১৮।।
অনুবাদঃ তিনি সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তাঁকে সমস্ত অন্ধকারের অতীত অব্যক্ত স্বরূপ বলা হয়। তিনিই জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় এবং তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।

ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চোক্তং সমাসতঃ।
মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে।।১৯।।
অনুবাদঃ এভাবেই ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয়-এই তিনটি তত্ত্ব সংক্ষেপে বলা হল। আমার ভক্তই কেবল এই সমস্ত বিদিত হয়ে আমার ভাব লাভ করেন।

উপদ্রষ্টানুমস্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।।২৩।।
অনুবাদঃ এই শরীরে আর একজন পরম পুরষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।

য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিং চ গুণৈঃ সহ। 
সর্বথা বর্তমানোহপি ন স ভূয়োহভিজায়তে।।২৪।।
অনুবাদঃ যিনি এভাবেই পুরুষকে এবং গুণাদি সহ জড় প্রকৃতিকে অবগত হন, তিনি জড় জগতে বর্তমান হয়েও পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন না।
যথা সর্বগতং সৌক্ষ্ম্যাদাকাশং নোপলিপ্যতে। 
সর্বত্রাবস্থিতো দেহে তথাত্মা নোপলিপ্যতে।।৩৩।।
অনুবাদঃ আকাশ যেমন সর্বগত হয়েও সূক্ষ্মতা হেতু অন্য বস্তুতে লিপ্ত হয় না, তেমনই ব্রহ্ম দর্শন-সম্পন্ন জীবাত্মা দেহে অবস্থিত হয়েও দেহধর্মে লিপ্ত হন না।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োরেবমন্তরং জ্ঞানচক্ষুষা। 
ভূতপ্রকৃতিমোক্ষং চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্।।৩৫।।
অনুবাদঃ যাঁরা এভাবেই জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের পার্থক্য জানেন এবং জড়া প্রকৃতির বন্ধন থেকে জীবগণের মুক্ত হওয়ার পন্থা জানেন, তাঁরা পরম গতি লাভ করেন।

১৩ অধ্যায়, শ্লোক ১৫

সর্ব ইন্দ্রিয় গুন আভাসম সর্ব ইন্দ্রিয় বিবর্জিতম্‌ ।
অসক্তম সর্বভুত চ এব নির্গুনম গুনভোক্তৃ চ ।।১৫

অর্থ-সেই পরমআত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের জ্ঞাতা হয়েও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয় রহিত । যদিও তিনি সকলের পালক তথাপি তিনি সম্পুর্ন অনাসক্ত নির্গুণ হয়েও সমস্ত গুনের ভোক্তা ।

এখানে কৃষ্ণ নিজেই বলেছে পরমাত্মা কোনো ইন্দ্রিয় নেই, সে ইন্দ্রিয় রহিত। এই শ্লোকে তো স্পষ্ট ভাবে ঈশ্বর কে নিরাকার বলেছে, এইটা চোখে পড়েনি ? এইবার কৃষ্ণ ভক্তদের প্রশ্ন করছি যে কৃষ্ণের কি ইন্দ্রিয় ছিলোনা ? এখানে স্পষ্ট ভাবে বলেছে ঈশ্বর এর ইন্দ্রিয় নেই । এই শ্লোকেও পরমাত্মা কে কৃষ্ণ নিজেই 'তিনি' বলে কথন করেছে। এই ১৩ নং অধ্যায় এর প্রায় সমস্ত জায়গায় কৃষ্ণ জী নিজে পরমাত্মা কে 'তিনি ,তার, যিনি' বলে কথন করেছে।
গীতা-২য় অধ্যায়-সাংখ্য-যোগ
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ
বেদবাদরাতাঃ পার্থ নান্যদন্তীতি বাদিনঃ।।৪২।।
পদার্থঃ ( অবিপশ্চিতঃ) {বিপশ্চিত্ বলা হয় পন্ডিতদের আর যিনি বিপশ্চিত্ নয় তাকে বলা হয় 'অবিপশ্চিতঃ'} সেই অবিপশ্চিত ব্যক্তিগণ (বেদবাদরতাঃ) বেদ কে না বুঝে (যামিমাম্) এই বাণী কে (পুষ্পিতাম্‌) অর্থপাদরূপ কথন করে (ন,অন্যত্, অস্তি) বেদে অন্য কোনো পরমার্থের উপদেশ নেই (ইতি বাদিনঃ) এই প্রকার মানেন অর্থ্যাৎ বেদ কে না বুঝে অবিপশ্চিত পুরুষ রা অনেক প্রকারের অর্থাভাস করে ।।৪২।।(আর্যমুনি ভাষ্য)
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।৪৩।।
অনুবাদঃ বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ,উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদিসকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই। 

ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্। 
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪।।
অনুবাদঃ যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মুঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না। 
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম্।
স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ যাঁর থেকে সমস্ত জীবের পূর্ব বাসনারূপ প্রবৃত্তি হয়, যিনি এই সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত আছেন, তাঁকে মানুষ তার নিজের কর্মের দ্বারা অর্চন করে সিদ্ধি লাভ করে।
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত। 
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।।৬২।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
শ্লোক দুটিতে পরিষ্কার ভাবে কৃষ্ণ নিজেই বলেছে অন্য কেউ নয়, এখানে কৃষ্ণ বলছে - ' তার নিত্যধাম প্রাপ্ত হবে ' কার শরণাপন্ন হতে বলছে এখানে ? 

গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, কৃষ্ণ যেসব বিভিন্ন গুণাবলীর বর্ণনা দেন, সে সকলই প্রকৃত গুণের পরিচায়ক (ভ. গী. ১৩.৭-১১)।

অমানিত্বমদম্ভিত্বং অহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্ |
আচার্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ |৭|
ইন্দ্রিযার্থেষু বৈরাগ্যং অনহঙ্কার এব চ |
জন্মমৃত্যুজরাব্যাধি দুঃখদোষানুদর্শনম্ |৮|
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু |
নিত্যং চ সমচিত্তত্বং ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু |৯|
মযি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী |
বিবিক্তদেশসেবিত্বং অরতির্জনসংসদি |১০|
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্ |
এতজ্জ্ঞানম্ ইতি প্রোক্তং অজ্ঞানং যদতোঽন্যথা |১১|

তিনি স্বয়ং সেই সমস্ত গুণাবলীর সাক্ষ্য -

‘অমানিত্বম – অর্থাৎ, নিরহংকার ও নম্র থাকা - বলশালী জরাসন্ধকে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে পরাজিত করার পর কৃষ্ণ যুদ্ধক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যদি প্রতিনিয়ত এভাবেই আক্রমণ চলতে থাকে, জনগণের উন্নতি ও বিকাশের সম্ভাবনা কি আদৌ আছে ? সুতরাং তিনি স্থানত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদি প্রজাদের প্রাণ বাঁচে, তবে তাঁকে কেউ কাপুরুষ বলল কিনা, তাতে তাঁর কিছু এসে যায়না। কোনোরকম অহংকার বা ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। একইভাবে, নিজের মর্যাদার কথা চিন্তা না করে নরকাসুরের স্ত্রীদের তিনি নতুন জীবনদান করেছিলেন (ভ. পু. ১০.৫৯)।

‘অদম্ভিত্বম’ – অর্থাৎ, ভণ্ডামি ও দম্ভ থেকে মুক্ত হয়ে থাকা - কৃষ্ণ তাঁর অতীত নিয়ে কখনও লজ্জিত ছিলেননা, কখনও তাঁকে এ নিয়ে অভিযোগ করতেও দেখা যায়নি। তিনি কখনও তাঁর অতীত কে গোপন করার চেষ্টা করেননি এবং দম্ভ থেকে মুক্ত হয়েই বেঁচেছেন। গোকুলে গোপালকদের সঙ্গে বড় হওয়ার কারণে তাঁকে গোবিন্দ বলেও ডাকা হত। তিনি তাতে কখনও অপমানিত বোধ করেননি। তাঁর জীবন ছিল অকৃত্রিম। তিনি কখনও নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও করেননি বা কখনও নিজেকে তাচ্ছিল্যও করেননি।

‘অহিংসা' – কৃষ্ণ তাঁর জীবনকালে কখনও কাউকে খেয়াল বশে আঘাত করেননি, এবং হয়ত সেই কারণেই তিনি নিঃসংশয়ে অর্জুনকে বলতে পেরেছিলেন - “শুভকর্মের জন্য যে সংগ্রাম করে তাকে কখনও দুর্দশার মুখ দেখতে হয়না” (ভ. গী. ৬.৪০)। কৃষ্ণ কখনও কারোর অমঙ্গল কামনা করেননি। শুধু ধর্মের বিরূদ্ধাচরণকারীদের শাস্তি দিয়েছেন মাত্র। মহাভারতের বিখ্যাত একটি বাণী - (এই শ্লোকটি জটিল সংস্করণে না থাকলেও অন্যান্য পুঁথি থেকে উদ্ধৃতি নেবার সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে) - “অহিংসা পরমো ধর্মহ, ধর্মহিংসা তথৈব চ” - অহিংসাই হল পরম ধর্ম, ধর্মরক্ষার্থে হিংসাও সেই ধর্মেরই অন্তর্গত। অর্জুনকে তিনি এও বলেছিলেন ( ভ. গী. ২.৩৩)। কংসবধের পর (ভা. পু. ১০.৪৪) কৃষ্ণ কংসের পত্নীদের বাপের বাড়ি অর্থাৎ জরাসন্ধের কাছে পাঠিয়ে দেন। ভীমের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যুর পর, কৃষ্ণ জরাসন্ধের পরিবার ও প্রজাদের নিরাপত্তা ও অভয় দান করেন এবং জরাসন্ধের পুত্র সহদেবকে সিংহাসনে বসান। এক সহস্র রাজাকে হত্যা করবার উদ্দেশে জরাসন্ধ বন্দী করে রেখেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁদের সকলকে মুক্ত করেন। তাঁরা যখন জিজ্ঞাসা করেন যে এর পরিবর্তে তাঁরা কিছু সাহায্য করতে পারেন কিনা, কৃষ্ণ বলেন, “আমি কিছু চাইনা, কিন্তু বড় ভাল হয় যদি আপনারা যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে কোনও প্রকার সাহায্য করতে পারেন” (ম. ভা. ২.১৮-২২, ভা.পু. ১০.৭৩)। তিনি হিংসার বিপক্ষে ছিলেন বলেই অত্যন্ত সততার সঙ্গে পাণ্ডব ও কৌরবদের ভিতর শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন।

‘ক্ষান্তি – ক্ষমাশীলতা - কালিয়া নাগ বা শিশুপাল, গান্ধারী বা তাঁর প্রাণঘাতী ব্যাধ, সকলকেই তিনি ক্ষমা করেছিলেন।

‘আর্জবম' – ন্যায়পরায়ণতা, অকপটতা, সারল্য – কৃষ্ণ সর্বদা সোজাসাপটা কথা বলেন। কোনও বন্ধু অথবা অধিক শক্তিশালী ব্যক্তির ভুল ধরিয়ে দেবার সময়ও কৃষ্ণ কখনও তাঁর কথার ধরণ অযথা তির্যক করে তোলেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শল্য পর্বে যখন দুর্যোধন সরোবরের গভীরে আত্মগোপন করে আছেন, তখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে উদ্দেশ্য করে একটা নির্বোধের মত প্রস্তাব করে বসলেন যে দুর্যোধন যদি পাণ্ডবদের মধ্যে যেকোনো একজনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেন, তাহলেই তিনি সমস্ত রাজ্যলাভ করবেন। কৃষ্ণ এবার যুধিষ্ঠিরকে তীব্রভাবে তিরস্কার করলেন- “আপনি যথার্থই নির্বোধের ন্যায় কথা বলেছেন। একমাত্র ভীম ব্যতীত দ্বন্দ্বযুদ্ধে দুর্যোধনের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা আর কারোর নেই। আপনি পুনরায় দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ করেছেন বলে মনে হচ্ছে (ম. ভা. ৯.৩২)।”

‘আচার্যোপাসনম– গুরুর সেবা করা - পাণ্ডব এবং কৌরবরা যখন দ্রোণের কাছ থেকে একান্তে শিক্ষাগ্রহণ করার সুবিধা ভোগ করছেন, কৃষ্ণকে তখন সান্দীপনীর কাছে শিক্ষালাভ করার জন্য মথুরা থেকে সুদূর উজ্জয়িনী যেতে হয়েছে। তাঁকে গুরুর জন্য গভীর বনে গিয়ে জ্বালানির কাঠ পর্যন্ত সংগ্রহ করে আনতে হত। পাণ্ডব এবং কৌরবদের এসব কিছুই করতে হয়নি।

‘শৌচম' – শুচিতা, শুধু শরীরের নয়, সেই সঙ্গে বাক্ ও মনেরও। কৃষ্ণ এই তিনদিক দিয়েই শুদ্ধ ছিলেন। তিনি ‘মানস বাচ কর্মন’ (চিন্তা, শব্দ ও কর্ম) – এর বিশুদ্ধতার প্রতীক।

‘স্থৈর্যম– স্থৈর্য, স্থিরতা - কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে তুষ্ট করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছেন, তিনি নিজে কিন্তু তার আগে এর চেয়েও বড় যুদ্ধে লড়েছেন। তিনি চরম স্থৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন যখন তিনি জরাসন্ধের ২৮ অক্ষৌহিণী সৈন্যের সম্মুখীন হয়েছেন (যা মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মিলিত সৈন্য সংখ্যার চেয়েও বেশী)। তারপর তিনি শুধু ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে সিংহের গুহা, গিরিব্রজে (জরাসন্ধের রাজধানী) প্রবেশ করেন। তিনি সর্বদা সরাসরি ভাবে শত্রুর সম্মুখীন হয়েছেন।

‘আত্মবিনিগ্রহঃ' – আত্মসংযম – কৃষ্ণের জীবনে আমরা কোনও হঠকারিতার উদাহরণ পাইনা বললেই চলে। তাঁকে হয়ত অনেক সময় তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু করতে হয়েছে কিন্তু তাকে তাড়াহুড়ো করা বা আবেগপ্রবণতা বলা চলেনা। নিজের ইন্দ্রিয় ও সত্ত্বার উপর তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। শান্তি দৌত্যের সময় দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দী করার চেষ্টা করেন। অতি সহজেই কৌরবদের কবল মুক্ত হয়ে কৃষ্ণ বলেন, “ আত্মরক্ষা কীভাবে করতে হয় আমি জানি। হে রাজন, ওরা যদি হিংসা চায়, করতে দিন। কিন্তু, মর্যাদাহানি হয় এমন কোনও কর্ম আমি করবনা।”

‘ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যম ' – ইন্দ্রিয়ের প্রতি কারণগত বৈরাগ্য – কৃষ্ণ কখনও নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করেননি। তিনি সর্বদা সাধারণ বস্ত্র পরিধান করেছেন এবং সাধারণভাবেই জীবনধারণ করেছেন, কখনও নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে আশকারা দেননি। কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল বা কৌরবদের মত ভুল উপায়ে ক্ষমতালাভকারীদের সঙ্গে কৃষ্ণ কখনও সখ্যতা গড়ে তোলেননি, বরং সর্বহারা পাণ্ডবদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যাঁদের সদ্গুণ ছিল তাঁদের প্রতি যত্নবান হয়েছেন এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেছেন।

 ‘অনহংকার' – ঔদ্ধত্য থেকে মুক্ত – কৃষ্ণের দাদা বলরাম ছিলেন এক নিষ্প্রভ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মদ্যপ, জুয়াড়ি এবং দুর্যোধনের বন্ধু ( এবং গুরু)। কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ এবং রুক্মির পৌত্রীর বিবাহকালে, বলরাম রুক্মির সঙ্গে পাশা খেলছিলেন। অসাধু উপায়ে জিতেও রুক্মি পরাজিত বলরামকে উত্যক্ত করছিলেন। বলরাম মেজাজ হারিয়ে সেখানেই রুক্মিকে হত্যা করেন। বিবাহবাসর শ্মশানে পরিণত হয়। রুক্মিণী কৃষ্ণের কাছে নালিশ করেন যে তাঁর দাদাকে কৃষ্ণের দাদা হত্যা করেছেন (যদিও বহু বছর ধরে রুক্মিণী ও রুক্মি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেননি)। বলরাম কৃষ্ণের কাছে নালিশ করেন যে, কৃষ্ণের শ্যালক অসাধু উপায় অবলম্বন করায় এই শাস্তি তাঁর প্রাপ্য ছিল। কৃষ্ণ শান্তই থাকেন। তিনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান না। (ভা. পু. ১০.৬১)

‘জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম ' – জন্ম, মৃত্যু, বার্ধক্য, ব্যাধি এবং যন্ত্রণা সংক্রান্ত দুর্দশা ও ক্লেশের প্রতি যে অন্তর্দৃষ্টি - কৃষ্ণ কে কখনও জন্ম, মৃত্যু, বার্ধক্য, ব্যাধি বা যন্ত্রণা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। তিনি শুধুই নিজের কর্ম করে গেছেন।

‘অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু' – নিষ্কাম, স্ত্রী, পুত্র, গৃহের প্রতি অনাসক্ত। পরিবার-পরিজনদের থেকে কৃষ্ণ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। যখন তাঁর স্ত্রীরা তাঁকে প্রায় নিলামে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন, তিনি তুলাভারে বসে নারদকে তাঁর সবকিছু দিয়ে দেন। (এই উপাখ্যানটি হরিবংশের ক্রিটিকাল টেক্স্ট/জটিল সংস্করণে পাওয়া না গেলেও গোরখপুর সংস্করণে পাওয়া যায়)। তিনি কখনও এবিষয়ে একটি কথাও বলেননি। যখন তাঁর সন্তানেরা একে অন্যের বিরূদ্ধে লড়াই শুরু করেছে, কৃষ্ণ সেই অনাসৃষ্টি নিয়ে এতটুকুও বিচলিত ছিলেননা। সত্যি বলতে কি, তাঁকে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন পিতাও বলা যায়! তাঁর পুত্র শাম্ব দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বরে গিয়েছিলেন। লক্ষণা তাঁকে পছন্দ না করায় শাম্ব হট্টগোল আরম্ভ করেন এবং দুর্যোধন তাঁকে আটক করেন। যখন কৃষ্ণ এই সম্বন্ধে জানতে পারেন, তিনি কোনওরকম কলহের পথে যাননা। তিনি শুধু বলেন, “ওকে কিছুদিন আটক থাকতে দাও, তাহলেই ওর শিক্ষা হবে।” বলরাম পরে গিয়ে শাম্বকে মুক্ত করে আনেন (ভা. পু. ১০.৬৮)। একইভাবে যখন কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করে বিবাহ করার পরামর্শ দেন, তখনও তিনি তাঁর পরিবারের মর্যাদার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হননি। সুভদ্রার জন্য যা ঠিক তিনি তাই করেছেন (তাঁর পিতা-মাতা সুভদ্রার জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না)।

‘নিত্যম চ সমচিত্তত্বম ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু– কাম্য ও অকাম্য ঘটনাবলীর প্রতি নিত্য মানসিক ধীরতা বজায় রাখা - এই একটি বিষয় যা কৃষ্ণের জীবনের সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁকে অপ্রীতিকর মুহূর্তে বিচলিত হতেও দেখা যায়না, সুখকর মুহূর্তে আবেগে ভেসে যেতেও দেখা যায়না। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে ও নির্দ্বিধায়। বহুবার নানা অভিযোগের বাণ তাঁর দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং প্রতিবারই তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সেসবের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি, গান্ধারী যখন কৃষ্ণকে অভিশাপ দিলেন যে তাঁর গোষ্ঠীর সকলে পরস্পরের সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নাশ হবে, তিনি স্মিতহাস্য করে বলেছিলেন, “সেতো আমার বাকি রয়ে যাওয়া কাজ গুলির একটি” (ম. ভা. ১১.২৫-২৬)।

‘ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী– আমার প্রতি (অর্থাৎ, ঈশ্বর) অটল ও অনন্যচিত্ত ভক্তি - কৃষ্ণ জানতেন তিনি স্বয়ং এক ‘অবতার’ এবং তাঁর অন্তঃস্থিত ঈশ্বরকে যথাযোগ্য শ্রদ্ধাও প্রকাশ করেছেন এবং একইসাথে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা করতে কখনও পিছপা হননি।

‘বিবিক্তদেশসেবিত্বম্‌ অরতির্জনসংসদি' – একাকীত্বের সন্ধান করা এবং ইতরজনের থেকে ব্যবধান রাখা - বিশ্বের সঙ্গে কৃষ্ণের নিত্য সংযোগ আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হলেও, তিনি একাকীত্ব-ই পছন্দ করতেন বেশী। ভিড় থেকে তিনি দূরেই থাকতেন। সকলের সঙ্গে থেকেও মানসিকভাবে তিনি বিচ্ছিন্নই থাকতেন।

‘অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং' – প্রকৃত সত্ত্বাকে জানার জন্য একনিষ্ঠ অধ্যবসায় – কৃষ্ণ সর্বদা তাঁর প্রকৃত সত্ত্বার অন্বেষণ করেছেন এবং সর্বদা তাঁর অন্তরাত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন।

‘তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম' – সত্যের জন্য নিত্য অন্বেষণ – কৃষ্ণ সর্বদা সত্যের পিছে ধাবমান। তিনি এক প্রকৃত যোগী, প্রকৃত জ্ঞানী, প্রকৃত ভক্ত। আশ্বমেধিক পর্বে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি যে বাণী আমায় শুনিয়েছিলেন তা আমার আর মনে নেই। সে আজ অনেকদিন হয়েও গেল, আপনি যদি পুনরায় একবার বলেন। আমার বড় জানতে ইচ্ছা করছে।” কৃষ্ণ বলেন, “হে নির্বোধ! প্রথমবারে তুমি কি বুঝতে পারনি? মহৎ বাণীর পুনরাবৃত্তি হয়না। সে ছিল এক মহান, শাশ্বত রহস্য। আমি বলেছিলাম যে, যে আগ্রহী নয় বা যার মনে শ্রদ্ধা বা তপসের কমতি আছে তার সামনে এই বাণী উচ্চারণ করোনা। আমি বলেছিলাম ! এখন দেখছি তুমি প্রমাণ করলে যে, তোমার মনে শ্রদ্ধা বা তপস কোনটাই নেই! তুমি এক নির্বোধে পরিণত হয়েছ। আমি তোমায় ওই বাণীগুলি যখন শুনিয়েছিলাম, তখন আমি মানসিকভাবে গভীর যোগসাধনায় নিমগ্ন ছিলাম। এখন আমার পক্ষে সেই একই বাণী উচ্চারণ করা সম্ভব নয়” (ম. ভা. ১৪.১৬-৫০)। সম্ভবত এই কারণেই সঞ্জয় কৃষ্ণকে ‘যোগেশ্বর’ নামে অভিহিত করেছেন, অর্থাৎ যোগের উপর যার পরম দক্ষতা (ভ. গী. ১৮.৭৫)।

মহাভারত- অশ্বমেধিক পর্ব-অধ্যায়-১৬, শ্লোক-১১,১২,১৩

ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনজ্ঞয়।
স হি ধর্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্মষা ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।
পরং হি ব্রহ্মা কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন)হে, ধনজ্ঞয়(অর্জুন),সেই সমস্ত কথা(গীতার বাণী) আমার পক্ষে বলা আর সম্ভব নয়।সেই ধর্মটি পরমাত্নার স্বরূপ জানবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।আমি এখন সেই সমস্ত কথা,পুনরায় বলতে পারব না।সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে,পরব্রহ্মের বিষয় বলেছিলাম।এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলছি।
এখানে, শ্রীকৃষ্ণ পরিস্কার ভাষায় বলছেন,তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বিষয়ে বলেছেন।শ্রীকৃষ্ণ একবারও বলেননি যে,ঈশ্বর তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) মাধ্যমে,বাণী দিয়েছেন।
সুতরাং,গীতা কোন ঈশ্বরীয় বাণী নয়।ইহা শ্রীকৃষ্ণ নামক মরণশীল মানুষের নিজস্ব বানী
মুক্তি বিষয়ে,গীতা ও বেদের বিরোধ বর্তমান।এই বিরোধ প্রমাণ করে যে,গীতা ঈশ্বরের বাণী নয়। যদি গীতা ঈশ্বরের বাণী হয় তাহলে ঈশ্বর মিথ্যাবাদীতে রূপান্তরিত হন!! ঈশ্বর কি মিথ্যাবাদী?!!! এবং এটাও প্রমাণ হয় যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন একজন মরণশীল সাধারণ মানুষ মাত্র। শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হতেন তাহলে গীতা ও বেদে পরস্পর বিরুদ্ধ কথা বলতেন না।
এইবার প্রমাণ দেখুন-
যদ্ গত্বা ন নির্বত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।-গীতা-15/6
এই শ্লোক থেকে জানা যায়,মানুষ বা জীব একবার মুক্তি পেলে পুনরায় কখনো সংসারে আগমন করে না বা চিরকালের মতো মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।
এইবার মুক্তি বিষয়ে বেদের প্রমাণ দেখুন।বেদ মন্ত্র অনুযায়ী গীতার বচন, কিভাবে,মিথ্যা প্রমাণিত হয়,প্রমাণ দেখুন-
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কোনো মহ্যা অদিতযে পুনর্দাৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।1।।
অগ্নের্বযং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স নো মহ্যা অদিতযে পুনর্দা্ৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।2।।
ঋগ্বেদ-1/24/1-2
অর্থ- আমরা কার নাম পবিত্র বলে জানব? অবিনাশী পদার্থ সমূহের মধ্যে বিদ্যমান, চির প্রকাশ রূপ কোন্ দেব আমাদের সকলকে মুক্তি সুখ ভোগ করিয়ে পুনরায় এই সংসারে জন্মদান করান এবং পিতা-মাতা'কে দর্শন করান?।।1।।
আমরা এই স্বপ্রকাশরূপ, অনাদি এবং সদামুক্ত পরমাত্মার নাম পবিত্র বলে জানব।পরমাত্না আমাদের মুক্তিতে আনন্দ ভোগ করিয়ে পুনরায় মাতা-পিতার সংযোগে জন্মদান করিয়ে তাঁহাদের দর্শন করান।। 2।।

পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের দৈনন্দিন নিত্যকর্ম

যোগীরাজ হওয়ার দরুন তিনি তাঁর দৈনিক নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করেছেন। মহাভারত থেকে আমরা এর সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাই। যথা -
ততঃ শয়নমাবিশ্য প্রসুপ্তো মধুসূদনঃ।
য়ামমাত্রার্ধশেষায়াং যামিন্যাং প্রত্যবুদ্ধ্যত।।
স ধ্যানপথমাবিশ্য সর্বজ্ঞানানি মাধবঃ।
অবলোক্য ততঃ পশ্চাদ্ দধ্যৌ ব্রহ্ম সনাতনম্।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৫৩।১,২)

- তদনন্তর মধুসূদন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক সুন্দর শয্যাতে নিদ্রিত হলেন। যখন অর্ধ প্রহর রাত্রি বাকী আছে তখন তিনি জেগে উঠলেন। তারপর ধ্যানমার্গে স্থিত হয়ে মাধব সম্পূর্ণ জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ করে সনাতন ব্রহ্মস্বরূপের চিন্তন করতে লাগলেন। 
ততঃ সহস্রং বিপ্রাণাং চতুর্বেদবিদাং তথা।
গবাং সহস্রেণৈকৈকং বাচয়ামাস মাধবঃ।।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৫৩।৮)

- তারপর কৃষ্ণ অগ্নিহোত্র করে চার বেদের বিদ্বান এক হাজার ব্রাহ্মণদের প্রত্যেককে একটি করে গাভী দান করলেন এবং তাদের দ্বারা বেদমন্ত্রের পাঠ এবং সস্তিবাচন করালেন।
=> যাত্রাকালীন সময়ও শ্রীকৃষ্ণ সন্ধ্যাদি দৈনিক কর্ম করতেন। যখন  শ্রীকৃষ্ণ সন্ধির সন্দেশ নিয়ে যখন হস্তিনাপুর যাচ্ছিলেন তখন পথমধ্যে ঋষির আশ্রমে বিশ্রাম করলেন -
কৃত্বা পৌর্বাহ্নিকং কৃত্যং স্নাতঃ শুচিরলংকৃতঃ।
উপতস্থে বিবসন্তং পাবকং চ জনার্দনঃ।।
(মহাঃ উদ্যোগ ৮৩।৯)

- অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ পবিত্র তথা বস্ত্র আভূষণ দ্বারা অলংকৃত হয়ে সন্ধ্যাবন্দনা, সূর্যোপস্থান এবং অগ্নিহোত্র আদি পূর্বাহ্নকৃত্য সমাপ্ত করলেন।
বৃকস্থলং সমাসাদ্য কেশবঃ পরবীরহা।
প্রকীর্ণরহশ্মাদিত্যে ব্যোম্নি বৈ লোহিতায়তি।।
অবতীর্য় রথাৎ তুর্ণ কৃত্বা শৌচং য়থাবিধি।
রথমোচনমাদিশ্য সন্ধ্যামুপবিবেশ হ।।
(মহাঃ উদ্যোগ ৮৫।২০-২১)

- শূরবীরদের সংহারকারী শ্রীকৃষ্ণ যখন বৃক্ষস্থলে পৌছলেন, সেই সময় নানা কিরণমণ্ডিত সূর্য অস্তমিত হলো  এবং পশ্চিমের আকাশ লোহিত হয়ে গেলো। তখন শ্রীকৃষ্ণ শীঘ্রই রথ থেতে নেমে বিধিপূর্বক শৌচ-স্নান করে সন্ধোপাসনা করতে বসলেন।
=> বিদুরের গৃহে শ্রীকৃষ্ণ অনেক রাত্রি পর্যন্ত বার্তালাপ করে বিশ্রাম করলেন এবং  প্রাতঃকাল হওয়ার পর  সন্ধ্যোপসনা করলেন -
তত উত্থায় দাশার্হ ঋষভঃ সর্বসাত্বতাম্।
সর্বমাবশ্যকং চক্রে প্রাকঃকার্যং জনার্দনঃ।।
কৃতোদকানুজপ্যঃ স হুতাগ্নি সমলংকৃতঃ।
ততশ্চাদিত্যমুদ্যন্তমুপাতিষ্ঠত মাধবঃ।।
(মহাঃ উদ্যোগ ৯৪।৫-৬)

-তখন সমস্ত যদুবংশীয় শিরোমণি মহাবাহু শ্রীকৃষ্ণ শয্যা থেকে উঠে প্রাতঃকালের সমস্ত আবশ্যক কর্ম ক্রমশঃ সম্পন্ন করলেন। সন্ধ্যা তর্পন এবং জপ করে অগ্নিহোত্র করার পর মাধব অলংকৃত হয়ে উদয়কালে সূর্যের উপস্থান করলেন।
=> শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধেও উপযুক্ত সময়ে উপাসনা করতেন -
ততঃ সন্ধ্যামুপাসৈব বীরো বীরবসাদনে।
কথয়ন্তৌ রণে বৃত্তং প্রয়াতৌ রথমাস্থিতৌ।।
(মহাঃ দ্রোণ ৭২।৮)

তখন শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন এই দুই বীর সেই বীরসংহারক রণভূমিতে সন্ধ্যা বন্দনা করে পুণরায় রথে বসে যুদ্ধসমন্ধিত বার্তালাপ করে সামনে চললেন।
এভাবে মহাভারত থেকে স্পষ্ট যে, শ্রীকৃষ্ণ তার জীবন সংঘর্ষের মধ্যেও নিত্যকর্ম কখনো ত্যাগ করেন নি। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,  কর্মে নিরলস আমি যদি কর্মে না প্রবৃত্ত হই তবে হে পার্থ! সকল মনুষ্য আমার মার্গের অনুকরণ করবে, এইজন্য আমার কর্মের অনুষ্ঠান অবশ্য কর্তব্য (গীতা০ ৩।২৮)। কিন্তু আমরা আলস্য তথা কর্মবিমুখতার কারণে ঈশ্বর উপাসনা করি না। হ্যাঁ আমাদের সবারই কর্মব্যস্ততা আছে, তবুও এর মাঝে ঈশ্বর উপাসনার সময় বের করা উচিৎ। এতেই মূলত মানব জীবনের কল্যাণ নিহিত আছে।

মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ বিষয়ে ঋষি ব্যাসের লেখা মহাভারতে বর্ণনা রয়েছে,
মহাভারত অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এক বনে সমাধিতে ছিলেন সেই সময় জরানামক এক ব্যাধ মৃগ হত্যা করার জন্য সেখানে আসেন এবং শ্রীকৃষ্ণ কে মৃগ মনে করে বাণ মেরে দেন, যার হেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয় [ সংক্ষিপ্ত রূপে তুলে ধরা হলো]।
.
[মহাভারত,মৌসলপর্ব, চতুর্থ অধ্যায় ১২, ২২,২৩,২৪ শ্লোক। গীতা প্রেস, অনুবাদক- রামনারায়ণদত্ত শাস্ত্রী পাণ্ডেয়, হিন্দি]

অর্জুন যদু বংশের অন্যান্য মৃত ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করেন__
ততঃ শরীরে রামস্য বাসুদেবস্য চোভয়োঃ।
অন্বিষ্য দাহয়ামাস পুরুষৈরাপ্তকারিভিঃ।।৩১।।
.
তারপর বিশ্বস্ত পুরুষদের দ্বারা বাসুদেবনন্দন বলরাম এবং শ্রীকৃষ্ণের দেহ খুঁজে পেয়ে অর্জুন তাদের দাহ সংস্কার করেন।
স তেষাং বিধিবত্ কৃত্বা প্রেতকার্য়াণি পাণ্ডবঃ।
সপ্তমে দিবসে প্রায়াদ্ রথমারুহ্য সত্বরঃ।।৩২।।
.
পাণ্ডুনন্দন অর্জুন ওই সকলের [বলরাম, শ্রীকৃষ্ণ আদি যদুবংশের মৃত ব্যক্তিদের] প্রেতকর্ম বিধি পূর্বক সম্পূর্ণ করে সাত দিন পর রথে করে দ্বারকা থেকে চলে যান।
.
[মহাভারত, মৌসলপর্ব, সপ্তম অধ্যায়, ৩১,৩২ শ্লোক। অনুবাদক-রামনারায়ণদত্ত শাস্ত্রী পাণ্ডেয়, হিন্দি]

যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী।
অতএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।
.জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।-গীতা: ২/২৭

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

अथर्ववेद 6/137/1

  एक वरिष्ठ वैदिक विद्वान् ने मुझे अथर्ववेद के निम्नलिखित मन्त्र का आधिदैविक और आध्यात्मिक भाष्य करने की चुनौती दी। इस चुनौती के उत्तर में म...

Post Top Ad

ধন্যবাদ