ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল দ্বাপর যুগে ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১৮ জুলাই ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বুধবার রাত্রির তৃতীয় প্রহরে অর্থাৎঃ আজ থেকে ৫২৪৫ বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল। । সেই মান্যতা অনুসারে প্রতি বছর এই তিথিতে অর্থাৎঃ সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন (জন্মাষ্টমী) পালন করা হয়। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ জন্ম তিথিকে জন্মাষ্টমী বলা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতার নাম বসুদেব ও মাতার নাম দেবকী। তিনি পিতামাতার অষ্টম পুত্র। রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসের কারাগারে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। জন্মাষ্টমীকে কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্টার অনুযায়ী, ফি বছর অগাস্টের মাঝখান থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে কোনও এক সময়ে পড়ে।
হরিবংশেই আছে যে, মহাভারত কথিত হইলে পর উগ্রশ্রবাঃ সৌতি শৌনকাদি ঋষির প্রার্থনানুসারে হরিবংশ কীর্তন করিতেছেন। অতএব উহা মহাভারতের পরবর্তী গ্রন্থ। কিন্তু মহাভারতের কত পরে এই গ্রন্থ প্রণীত হইয়াছিল, ইহা নিরূপণ আবশ্যক। মহাভারতের পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে হরিবংশের প্রসঙ্গ কেবল শেষ শ্লোকে আছে, তাহা ২৯।৩০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করিয়াছি। কিন্তু মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের অন্তর্গত বিষয় সকল ঐ পর্বসংগ্রহাধ্যয়ে সংক্ষেপে যেরূপ কথিত হইয়াছে, হরিবংশের অন্তর্গত বিষয় সম্বন্ধে সেখানে সেরূপ কিছু কথিত হয় নাই। ঐ শ্লোক পাঠ করিয়া এমনই বোধ হয় যে, যখন প্রথম ঐ পর্বসংগ্রহাধ্যায় সঙ্কলিত হইয়াছিল, তখন হরিবংশের কোন প্রসঙ্গই ছিল না। পরিশেষে লক্ষ শ্লোক মিলাইবার জন্য কেহ ঐ শ্লোকটি যোজনা করিয়া দিয়াছেন। হরিবংশে এক্ষণে তিন পর্ব পাওয়া যায়;—হরিবংশপর্ব, বিষ্ণুপর্ব ও ভবিষ্যর্ব। কিন্তু পূর্বোদ্ধৃত মহাভারতের শ্লোকে কেবল হরিবংশপর্ব ও ভবিষ্যপর্বের নাম আছে, বিষ্ণুপর্বের নাম মাত্র নাই, হরিবংশপর্বে ও ভবিষ্যপর্বে ১২,০০০ শ্লোক ইহাই লিখিত আছে। এক্ষণে তিন পর্বে ১৬,০০০ শ্লোকের উপর পাওয়া যায়। অতএব নিশ্চিতই মহাভারতে ঐ শ্লোক প্রবিষ্ট হইবার পরে বিষ্ণুপর্ব হরিবংশে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে।
৩য় খণ্ড (মথুরা-দ্বারকা)
৪র্থ খণ্ড (ইন্দ্রপ্রস্থ)
৫ম খণ্ড (উপপ্নব্য)
৭ম খণ্ড (প্রভাস)
“অষ্টাদশপর্ব মহাভারতের অতিরিক্ত হরিবংশ নামক গ্রন্থকে অনেকে ভারতের অন্তর্ভূত একটী পর্ব বলিয়া গণনা করিয়া থাকেন এবং উহাকে আশ্চর্য পর্ব বা ঊনবিংশ পর্ব বলিয়া উল্লেখ করেন, কিন্তু বস্তুতঃ হরিবংশ ভারতান্তর্গত একটী পর্ব নহে। উহা মূল মহাভারত রচনার বহুকাল পরে পরিশিষ্টরূপে উহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। হরিবংশের রচনাপ্রণালী ও তাৎপর্য পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে বিচক্ষণ ব্যক্তি অনায়াসেই উহার আধুনিকত্ব অনুভব করিতে সমর্থ হয়েন। যদিও মূল মহাভারতের স্বর্গারোহণপর্বে হরিবংশশ্রবণের ফলশ্রুতি বর্ণিত আছে, কিন্তু তাহাতে হরিবংশের প্রাচীনত্ব প্রমাণ না হইয়া বরং ঐ ফলশ্রুতিবর্ণনেরই আধুনিকত্ব প্রতিপন্ন হয়। মূল মহাভারত গ্রন্থের সহিত হরিবংশ অনুবাদিত করিলে লোকের মনে পূর্বোক্ত ভ্রম দৃঢ়ীভূত হইবে। আশঙ্কা করিয়া উহা এক্ষণে অনুবাদ করিতে ক্ষান্ত রহিলাম।”
হরেস্ হেমন্ উইলসন্ সাহেবও হরিবংশের সম্বন্ধে ঐ কথা বলেন। তিনি বলেন;— “The internal evidence is strongly indicative of a date considerably subesquent to that of the major portion of the Mahabharata.”*
আমারও সেইরূপ বিবেচনা হয়। আর হরিবংশ মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের অল্পকাল-পরবর্তী হইলেও এমন সন্দেহ করিবার কারণও আছে যে, বিষ্ণুপর্ব তাহাতে অনেক পরে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এ সকল কথার নিশ্চয়তা সম্পাদন অতি দুঃসাধ্য।
সুবন্ধুকৃত বাসবদত্তায় হরিবংশের পুষ্করপ্রাদুর্ভাব নামক বৃত্তান্তের উল্লেখ আছে। ইউরোপীয় বিচারে স্থির হইয়াছে, সুবন্ধু খ্রীঃ সপ্তম শতাব্দীর লোক। অতএব তখনও হরিবংশ প্রচলিত গ্রন্থ। কিন্তু কবে ইহা প্রণীত হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না। তবে ইহা বলা যাইতে পারে যে, মহাভারত ও বিষ্ণুপুরাণের পরবর্তী, এবং ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্তের পূর্ববর্তী।
কোন্ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া এ কথা বলিতে সাহসী হই, সেটি অতি গুরুতর কথা, এবং এই কৃষ্ণচরিত্রবিচারের মূলসূত্র বলিলেও হয়। আমরা পরিপরিচ্ছেদে তাহা বুঝাইতে চেষ্টা করিব।
ধর্ম সম্বন্ধে আমার যাহা বলিবার আছে, তাহার সমস্ত আনুপূর্বিক সাধারণকে বুঝাইতে পারি, এমন সম্ভাবনা অল্পই। কেন না, কথা অনেক, সময় অল্প। সেই সকল কথার মধ্যে তিনটি কথা, আমি তিনটি প্রবন্ধে বুঝাইতে প্রবৃত্ত আছি। ঐ প্রবন্ধ তিনটি দুইখানি সাময়িক পত্রে ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হইতেছে।
উক্ত তিনটি প্রবন্ধের একটি অনুশীলন ধর্মবিষয়ক; দ্বিতীয়টি দেবতত্ত্ব বিষয়ক; তৃতীয়টি কৃষ্ণচরিত্র। প্রথম প্রবন্ধ “নবজীবনে” প্রকাশিত হইতেছে; দ্বিতীয় ও তৃতীয় “প্রচার” নামক পত্রে প্রকাশিত হইতেছে। প্রায় দুই বৎসরহইলএইপ্রবন্ধগুলিপ্রকাশআরম্ভহইয়াছে; কিন্তু ইহার মধ্যে একটিও আজি পর্যন্ত সমাপ্ত করিতে পারি নাই। সমাপ্তি দূরে থাকুক, কোনটিও অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। তাহার অনেকগুলি কারণ আছে। একে বিষয়গুলি অতি মহৎ, অতি বিস্তারিত সমালোচনা ভিন্ন তন্মধ্যে কোন বিষয়েরই মীমাংসা হইতে পারে না; তাহাতে আবার দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ লেখকের সময়ও অতি অল্প; এবং পরিশ্রম করিবার শক্তিও মনুষ্যের চিরকাল সমান থাকে না।
এই সকল কারণের প্রতি মনোযোগ করিয়া, এবং মনুষ্যের পরমায়ুর সাধারণ পরিমাণ ও আপনার বয়স বিবেচনা করিয়া, আমি আমার বক্তব্য কথা সকলগুলি বলিবার সময় পাইব, এমন আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। যে দেবমন্দির গঠন করিবার উচ্চাভিলাষকে মনে স্থান দিয়া, দুই একখানি করিয়া ইষ্টক সংগ্রহ করিতেছি, তাহা সমাপ্ত করিতে পারিব, এমন আশা আর রাখি না। যে তিনটি প্রবন্ধ আরম্ভ করিয়াছি, তাহাও সমাপ্ত করিতে পারিব কি না, জগদীশ্বর জানেন। সকলগুলি সম্পূর্ণ হইলে তাহা পুনর্মুদ্রিত করিব, এ আশায় বসিয়া থাকিতে গেলে, হয়ত সময়ে কোন প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হইবে না। কেন না, সকল কাজেরই সময় অসময় আছে। এই জন্য কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম খণ্ড এক্ষণে পুনর্মুদ্রিত করা গেল। বোধ করি এইরূপ পাঁচ ছয় খণ্ডে গ্রন্থ সমাপ্ত হইতে পারে। কিন্তু সকলই সময় ও শক্তি এবং ঈশ্বরানুগ্রহের উপর নির্ভর করে।
আগে অনুশীলন ধর্ম পুনর্মুদ্রিত হইয়া তৎপরেকৃষ্ণচরিত্রপুনর্মুদ্রিতহইলেইভালহইত। কেন না, “অনুশীলন ধর্মে” যাহা তত্ত্ব মাত্র, কৃষ্ণচরিত্রে তাহা দেহবিশিষ্ট। অনুশীলনে যে আদর্শে উপস্থিত হইতে হয়, কৃষ্ণচরিত্র কর্মক্ষেত্রস্থ সেই আদর্শ। আগে তত্ত্ব বুঝাইয়া, তার পর উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্টীকৃত করিতে হয়। কৃষ্ণচরিত্র সেই উদাহরণ; কিন্তু অনুশীলন ধর্ম সম্পূর্ণ না করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না। সম্পূর্ণ হইবারও বিলম্ব আছে।
যাঁহারা দৃঢ় বিশ্বাস করেন যে, কৃষ্ণ ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তাঁহাদের কথা এখন ছাড়িয়া দিই। আমার সকল পাঠক সেরূপ বিশ্বাসযুক্ত নহেন। যাঁহারা সেরূপ বিশ্বাসযুক্ত নহেন, তাহারা বলিবেন, কৃষ্ণচরিত্রের মৌলিকতা কি? কৃষ্ণ নামে কোন ব্যক্তি পৃথিবীতে কখনও বিদ্যমান ছিলেন, তাহার প্রমাণ কি? যদি ছিলেন, তবে তাঁহার চরিত্র যথার্থ কি প্রকার ছিল, তাহা জানিবার কোন উপায় আছে কি?
আমরা প্রথমে এই দুই সন্দেহের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইব।
আমরা প্রথমে এই দুই সন্দেহের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইব।
কৃষ্ণের বৃত্তান্ত নিম্নলিখিত প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়ঃ—
(১) মহাভারত।
(২) হরিবংশ।
(৩) পুরাণ।
ইহার মধ্যে পুরাণ আঠারখানি। সকলগুলিতে কৃষ্ণবৃত্তান্ত নাই। নিম্নলিখিতগুলিতে আছেঃ—
(১) ব্রহ্মপুরাণ।
(২) পদ্মপুরাণ।
(৩) বিষ্ণুপুরাণ।
(৪) বায়ুপুরাণ।
(৫) শ্রীমদ্ভাগবত।
(১০) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
(১৩) স্কন্দপুরাণ।
(১৪) বামনপুরাণ।
(১৫) কূর্মপুরাণ।
(২) হরিবংশ।
(৩) পুরাণ।
ইহার মধ্যে পুরাণ আঠারখানি। সকলগুলিতে কৃষ্ণবৃত্তান্ত নাই। নিম্নলিখিতগুলিতে আছেঃ—
(১) ব্রহ্মপুরাণ।
(২) পদ্মপুরাণ।
(৩) বিষ্ণুপুরাণ।
(৪) বায়ুপুরাণ।
(৫) শ্রীমদ্ভাগবত।
(১০) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
(১৩) স্কন্দপুরাণ।
(১৪) বামনপুরাণ।
(১৫) কূর্মপুরাণ।
মহাভারত, আর উপরিলিখিত অন্য গ্রন্থগুলির মধ্যে কৃষ্ণজীবনী সম্বন্ধে একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। যাহা মহাভারতে আছে, তাহা হরিবংশে ও পুরাণগুলিতে নাই। যাহা হরিবংশ ও পুরাণে আছে, তাহা মহাভারতে নাই। ইহার একটি কারণ এই যে, মহাভারত পাণ্ডবদিগের ইতিহাস; কৃষ্ণ পাণ্ডবদিগের সখা ও সহায়; তিনি পাণ্ডবদিগের সহায় হইয়া বা তাঁহাদের সঙ্গে থাকিয়া যে সকল কার্য করিয়াছেন, তাহাই মহাভারতে আছে, ও থাকিবার কথা। প্রসঙ্গক্রমে অন্য দুই একটা কথা আছে মাত্র। তাঁহার জীবনের অবশিষ্টাংশ মহাভারতে নাই বলিয়াই হরিবংশ রচিত হইয়াছিল, ইহা হরিবংশে আছে। ভাগবতেও ঐরূপ কথা আছে। ব্যাস নারদকে মহাভারতের অসম্পূর্ণতা জানাইলেন। নারদ ব্যাসকে কৃষ্ণচরিত্র রচনার উপদেশ দিলেন। অতএব মহাভারতে যাহা আছে, এই ভাগবতে বা হরিবংশে বা অন্য পুরাণে তাহা নাই; মহাভারতে, যাহা নাই—পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহাই আছে।
অতএব মহাভারত সর্বপূর্ববর্তী। হরিবংশাদি ইহার অভাব পূরণার্থ মাত্র। যাহা সর্বাগ্রে রচিত হইয়াছিল, তাহাই সর্বাপেক্ষা মৌলিক, ইহাই সম্ভব। কথিত আছে যে, মহাভারত, হরিবংশ, এবং অষ্টাদশ পুরাণ একই ব্যক্তি রচিত। সকলই মহর্ষি বেদব্যাসপ্রণীত। এ কথা সত্য কি না, তাহার বিচারে এক্ষণে প্রয়োজন নাই। আগে দেখা যাউক, মহাভারতের কোন ঐতিহাসিকতা আছে কি না। যদি তাহা না থাকে, তবে হরিবংশে ও পুরাণে কোন ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধান বৃথা।
এক্ষণে যে বিচারে প্রবৃত্ত হইব, তাহাতে দুই দিকে দুই ঘোর বিপদ্। এক দিকে, এ দেশীয় প্রাচীন সংস্কার যে, সংস্কৃতভাষায় যে কিছু রচনা আছে, যে কিছুতে অনুস্বার আছে, সকলই অভ্রান্ত ঋষি প্রণীত; সকলই প্রতিবাদ বা সন্দেহের অতীত যে সত্য, তাহাই আমাদিগের কাছে আনিয়া উপস্থিত করে। বেদবিভাগ, লক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত, হরিবংশ, এবং অষ্টাদশ পুরাণ সকল একজনে করিয়াছেন; সকলই কলিযুগের আরম্ভে হইয়াছে; সেও পাঁচহাজার বৎসর হইল; আর এই সকল বেদব্যাস যেমন করিয়াছিলেন, ঠিক তেমনই আছে। অনেক লোকে, এ সংস্কারের প্রতিবাদ শুনা দূরে যাউক, যে প্রতিবাদ করিবে, তাহাকে মহাপাতকী, নারকী এবং দেশের সর্বনাশে প্রস্তুত মনে করেন। এই এক দিকের বিপদ্। আর দিকে গুরুতর বিপদ্, বিলাতী পাণ্ডিত্য। ইউরোপ ও আমেরিকার কতকগুলি পণ্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহারা প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে ঐতিহাসিক তত্ত্ব উদ্ভূত করিতে নিযুক্ত, কিন্তু তাহাদের এ কথা অসহ্য যে, পরাধীন দুর্বল হিন্দুজাতি, কোন কালে সভ্য ছিল, এবং সেই সভ্যতা অতি প্রাচীন। অতএব দুই চারি জন ভিন্ন তাহারা সচরাচর প্রাচীন ভারতবর্ষের গৌরব খর্ব করিতে নিযুক্ত। তাঁহারা যত্নপূর্বক ইহাই প্রমাণ করিতে চাহেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয় গ্রন্থ সকলে যাহা কিছু আছে—হিন্দুধর্মবিরোধী বৌদ্ধগ্রন্থ ছাড়া—সকলই আধুনিক, আর হিন্দুগ্রন্থে যাহাই আছে, তাহা হয় সম্পূর্ণ মিথ্যা, নয় অন্য দেশ হইতে চুরি করা। কোন মহাত্মা বলেন, রামায়ণ হোমরের কাব্যের অনুকরণ; কেহ বা বলেন, ভগবদ্গীতা বাইবেলের ছায়ামাত্র। হিন্দুর জ্যোতিষ চীন, যবন বা কাল্ডিয় হইতে প্রাপ্ত; হিন্দুর গণিতও পরের কাছে পাওয়া; লিখিত অক্ষরও কোন সীমীয় জাতীয় হইতে প্রাপ্ত। এ সকল কথা প্রতিপন্ন করিবার জন্য তাঁহাদের বিচারপ্রণালীর মূল সূত্র এই যে, ভারতবর্ষীয় গ্রন্থে ভারতপক্ষে যাহা পাওয়া যায়, তাহা মিথ্যা বা প্রক্ষিপ্ত, যাহা ভারতবর্ষের বিপক্ষে পাওয়া যায়, তাহাই সত্য। পাণ্ডবদিগের ন্যায় বীরচরিত্র ভারতবর্ষীয় পুরুষের কথা মিথ্যা, পাণ্ডব কবিকল্পনা মাত্র, কিন্তু পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর পঞ্চ পতি সত্য, কেন না, তদ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, প্রাচীন ভারতবাসীয়েরা চূয়াড় জাতি ছিল, তাহাদিগের মধ্যে স্ত্রীলোকদিগের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। ফর্গুসন্ সাহেব অট্টালিকার ভগ্নাবশেষে কতকগুলা বিবস্ত্রা স্ত্রীমূর্তি দেখিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে স্ত্রীলোকেরা কাপড় পরিত না; এদিকে মথুরা প্রভৃতি স্থানের অপূর্ব ভাস্কর্য দেখিয়া বিলাতী পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, এ শিল্প গ্রীক্ মিস্ত্রীর। বেবর (Weber) সাহেব, কোন মতে হিন্দুদিগের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাচীনতা উড়াইয়া দিতে না পারিয়া স্থির করিলেন, হিন্দুরা চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল বাবিলনীয়দিগের নিকট হইতে পাইয়াছে। বাবিলনীয়দিগের যে চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল আদৌ কখনও ছিল না, তাহা চাপিয়া গেলেন। প্রমাণের অভাবেও Whitney সাহেব বলিলেন, তাহা হইতে পারে, কেন না, হিন্দুদের মানসিক স্বভাব তেমন তেজস্বী নয় যে, তাহার নিজবুদ্ধিতে এত করে।
এক্ষণে যে বিচারে প্রবৃত্ত হইব, তাহাতে দুই দিকে দুই ঘোর বিপদ্। এক দিকে, এ দেশীয় প্রাচীন সংস্কার যে, সংস্কৃতভাষায় যে কিছু রচনা আছে, যে কিছুতে অনুস্বার আছে, সকলই অভ্রান্ত ঋষি প্রণীত; সকলই প্রতিবাদ বা সন্দেহের অতীত যে সত্য, তাহাই আমাদিগের কাছে আনিয়া উপস্থিত করে। বেদবিভাগ, লক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত, হরিবংশ, এবং অষ্টাদশ পুরাণ সকল একজনে করিয়াছেন; সকলই কলিযুগের আরম্ভে হইয়াছে; সেও পাঁচহাজার বৎসর হইল; আর এই সকল বেদব্যাস যেমন করিয়াছিলেন, ঠিক তেমনই আছে। অনেক লোকে, এ সংস্কারের প্রতিবাদ শুনা দূরে যাউক, যে প্রতিবাদ করিবে, তাহাকে মহাপাতকী, নারকী এবং দেশের সর্বনাশে প্রস্তুত মনে করেন। এই এক দিকের বিপদ্। আর দিকে গুরুতর বিপদ্, বিলাতী পাণ্ডিত্য। ইউরোপ ও আমেরিকার কতকগুলি পণ্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহারা প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে ঐতিহাসিক তত্ত্ব উদ্ভূত করিতে নিযুক্ত, কিন্তু তাহাদের এ কথা অসহ্য যে, পরাধীন দুর্বল হিন্দুজাতি, কোন কালে সভ্য ছিল, এবং সেই সভ্যতা অতি প্রাচীন। অতএব দুই চারি জন ভিন্ন তাহারা সচরাচর প্রাচীন ভারতবর্ষের গৌরব খর্ব করিতে নিযুক্ত। তাঁহারা যত্নপূর্বক ইহাই প্রমাণ করিতে চাহেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয় গ্রন্থ সকলে যাহা কিছু আছে—হিন্দুধর্মবিরোধী বৌদ্ধগ্রন্থ ছাড়া—সকলই আধুনিক, আর হিন্দুগ্রন্থে যাহাই আছে, তাহা হয় সম্পূর্ণ মিথ্যা, নয় অন্য দেশ হইতে চুরি করা। কোন মহাত্মা বলেন, রামায়ণ হোমরের কাব্যের অনুকরণ; কেহ বা বলেন, ভগবদ্গীতা বাইবেলের ছায়ামাত্র। হিন্দুর জ্যোতিষ চীন, যবন বা কাল্ডিয় হইতে প্রাপ্ত; হিন্দুর গণিতও পরের কাছে পাওয়া; লিখিত অক্ষরও কোন সীমীয় জাতীয় হইতে প্রাপ্ত। এ সকল কথা প্রতিপন্ন করিবার জন্য তাঁহাদের বিচারপ্রণালীর মূল সূত্র এই যে, ভারতবর্ষীয় গ্রন্থে ভারতপক্ষে যাহা পাওয়া যায়, তাহা মিথ্যা বা প্রক্ষিপ্ত, যাহা ভারতবর্ষের বিপক্ষে পাওয়া যায়, তাহাই সত্য। পাণ্ডবদিগের ন্যায় বীরচরিত্র ভারতবর্ষীয় পুরুষের কথা মিথ্যা, পাণ্ডব কবিকল্পনা মাত্র, কিন্তু পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর পঞ্চ পতি সত্য, কেন না, তদ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, প্রাচীন ভারতবাসীয়েরা চূয়াড় জাতি ছিল, তাহাদিগের মধ্যে স্ত্রীলোকদিগের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। ফর্গুসন্ সাহেব অট্টালিকার ভগ্নাবশেষে কতকগুলা বিবস্ত্রা স্ত্রীমূর্তি দেখিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে স্ত্রীলোকেরা কাপড় পরিত না; এদিকে মথুরা প্রভৃতি স্থানের অপূর্ব ভাস্কর্য দেখিয়া বিলাতী পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, এ শিল্প গ্রীক্ মিস্ত্রীর। বেবর (Weber) সাহেব, কোন মতে হিন্দুদিগের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাচীনতা উড়াইয়া দিতে না পারিয়া স্থির করিলেন, হিন্দুরা চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল বাবিলনীয়দিগের নিকট হইতে পাইয়াছে। বাবিলনীয়দিগের যে চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল আদৌ কখনও ছিল না, তাহা চাপিয়া গেলেন। প্রমাণের অভাবেও Whitney সাহেব বলিলেন, তাহা হইতে পারে, কেন না, হিন্দুদের মানসিক স্বভাব তেমন তেজস্বী নয় যে, তাহার নিজবুদ্ধিতে এত করে।
এই সকল মহাপুরুষগণের মতের সমালোচনায় আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। কেন না, আমি স্বদেশীয় পাঠকের জন্য লিখি, হিন্দুদ্বেষীদিগের জন্য লিখি না। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, আমার স্বদেশীয় শিক্ষিতসম্প্রদায়মধ্যে অনেকে তাঁহাদের মতের অনুবর্তী। অনেকেই নিজে কিছু বিচার আচার না করিয়াই, কেবল ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের মত বলিয়াই, সেই সকল মতের অনুবর্তী। আমার দুরাকাঙ্ক্ষা যে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও কেহ কেহ এই গ্রন্থ পাঠ করেন। তাই, আমি ইউরোপীয় মতেরও প্রতিবাদে প্রবৃত্ত। যাঁহাদের কাছে বিলাতী সবাই ভাল, যাঁহারা ইস্তক বিলাতী পণ্ডিত, লাগায়েৎ বিলাতী কুকুর, সকলেরই সেবা করেন, দেশী গ্রন্থ পড়া দূরে থাক, দেশী ভিখারীকেও ভিক্ষা দেন না, তাঁহাদের আমি কিছু করিতে পারিব না। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই সত্যপ্রিয় এবং দেশবৎসল। তাঁহাদের জন্য লিখিব।
কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম সংস্করণে কেবল মহাভারতীয় কেবল মহাভারতীয় কৃষ্ণকথা সমালোচিত হইয়াছিল। তাহাও অল্পাংশ মাত্র। এবার মহাভারতে কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রয়োজনীয় কথা যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহা সমস্তই সমালোচিত হইয়াছে। তা ছাড়া হরিবংশে ও পুরাণে যাহা সমালোচনার যোগ্য পাওয়া যায়, তাহাও বিচারিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া উপক্রমণিকাভাগ পুনর্লিখিত এবং বিশেষরূপে পরিবর্ধিত হইয়াছে। ইহা আমার অভিপ্রেত সম্পূর্ণ গ্রন্থ। প্রথম সংস্করণে যাহা ছিল, তাহা এই দ্বিতীয় সংস্করণের অল্পাংশ মাত্র। অধিকাংশই নূতন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম ইংরাজি শিক্ষা পাইয়া আমরা যখন রাজনীতির সমালোচনা আরম্ভ করিয়া দিলাম, সমাজনীতি এবং ধর্মনীতিও সেই নিষ্ঠুর পরীক্ষার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি প্রাপ্ত হয় নাই। তখন ছাত্রমাত্রেরই মনে আমাদের সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে একটা অসন্তোষ ও সংশয়ের উদ্রেক হইয়াছিল।
বিচারের পর কাজের পালা। মতের দ্বারা ভালোমন্দ স্থির করা কঠিন নহে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তদনুসারে আপন কর্তব্য নিয়মিত করা অত্যন্ত দুরূহ। রাজ্যতন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের নিজের কর্তব্য অতি যৎসামান্য; কারণ, রাজত্বের অধিকার আমাদের হস্তে কিছুই নাই। এইজন্য পোলিটিকাল সমালোচনা এখনো অত্যন্ত তীব্র ও প্রবলভাবেই চলিতেছে, তৎসম্বন্ধেকোনোপ্রকারদ্বিধাঅথবাবাধাঅনুভবকরিবারকোনোকারণঘটেনাই।কিন্তুসমাজওধর্ম-সম্বন্ধীয়কর্তব্যআমাদেরনিজেরহাতে; অতএব ধর্ম ও সমাজনীতি সম্বন্ধে বিচারে যাহা স্থির হয় কাজে তাহার প্রয়োগ না হইলে সেজন্য আপনাকে ছাড়া আর কাহাকেও দোষী করা যায় না। মানুষ বেশিক্ষণ আপনাকে দোষী করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে না; এবং নিজের প্রতি দোষারোপ করিয়া অম্লানবদনে বসিয়া থাকাও তাহার পক্ষে মঙ্গলজনক নহে। এইজন্য সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে এক-একটি কৈফিয়ত বাহির করিয়া আমরা মনকে সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করিলাম; অবশেষে এমন হইল যে, আমাদের যাহা-কিছু আছে তাহাই সর্বোৎকৃষ্টওসর্বাঙ্গসম্পূর্ণইহাআমরাকিছুঅধিকউচ্চস্বরেএবংপ্রাণপণবল-সহকারেঘোষণাকরিতেপ্রবৃত্তহইলাম।
এরূপ ব্যবহার যে কপট ও কৃত্রিম আমি তাহা বলি না। বস্তুত, সমাজ ও ধর্মের মূল জাতীয় প্রকৃতির এমন গভীরতম দেশে অনুপ্রবিষ্ট যে, তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে গেলে নানা দিক হইতে নানা গুরুতর বাধা আসিয়া পড়ে এবং পুরাতন অমঙ্গলের স্থলে নূতন অমঙ্গল মাথা তুলিয়া দাঁড়ায়। এমন স্থলে শঙ্কিতচিত্তে পুনরায় নিশ্চেষ্টতা অবলম্বন করিতে প্রবৃত্তি হয় এবং সেই নিশ্চেষ্টতার পথে প্রত্যাবর্তন করিবার সময় কিঞ্চিৎঅতিরিক্তস্পর্ধারসহিতআস্ফালনকরাওঅস্বাভাবিকনহে–বুকফুলাইয়াসর্বসাধারণকেবলিতেইচ্ছাকরে, ইহা আমাদের হার নহে, জিত।
আমাদের বঙ্গসমাজের এইরূপ উল্টারথের দিনে বঙ্কিমচন্দ্রের “কৃষ্ণচরিত্র’ রচিত হয়। যখন বড়ো-ছোটো অনেক মিলিয়া জনতার স্বরে স্বর মিলাইয়া গোলে হরিবোল দিতেছিলেন তখন প্রতিভার কণ্ঠে একটা নূতন সুর বাজিয়া উঠিল– বঙ্কিমচন্দ্রের”কৃষ্ণচরিত্র’ গোলে হরিবোল নহে। ইহাতে সর্বসাধারণের সমর্থন নাই, সর্বসাধারণের প্রতি অনুশাসন আছে।
যে সময়ে “কৃষ্ণচরিত্র’ রচিত হইয়াছে সেই সময়ের গতি এবং বঙ্কিমের চতুর্দিকবর্তী অনুবর্তিগণের ভাবভঙ্গি বিচার করিয়া দেখিলে এই “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে প্রতিভার একটি প্রবল স্বাধীন বল অনুভব করা যায়।
সেই বলটি আমাদের একটি স্থায়ী লাভ। সেই বলটি বাঙালির পরম আবশ্যক। সেই বল স্থানে স্থানে ন্যায় এবং শিস্টতার সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে তথাপি তাহা আমাদের ন্যায় হীনবীর্য ভীরুদের পক্ষে একটি অভয় আশ্রয়দণ্ড।
যখন আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও আত্মবিস্মৃত হইয়া অন্ধভাবে শাস্ত্রের জয়ঘোষণা করিতেছিলেন তখন বঙ্কিমচন্দ্র বীরদর্পসহকারে “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে স্বাধীন মনুষ্যবুদ্ধির জয়পতাকা উড্ডীন করিয়াছেন। তিনি শাস্ত্রকে ঐতিহাসিক যুক্তিদ্বারা তন্নতন্নরূপে পরীক্ষা করিয়াছেন এবং চিরপ্রচলিত বিশ্বাসগুলিকেও বিচারের অধীনে আনয়নপূর্বক অপমানিক বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনশ্চ তাহার গৌরবের সিংহাসনে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়া দিয়াছেন।
আমাদের মতে “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের নায়ক কৃষ্ণ নহেন, তাহার প্রধান অধিনায়ক, স্বাধীন বুদ্ধি, সচেষ্ট চিত্তবৃত্তি। প্রথমত বঙ্কিম বুঝাইয়াছেন, জড়ভাবে শাস্ত্রের অথবা লোকাচারের অনুবর্তী হইয়া আমরা পূজা করিব না, সতর্কতার সহিত আমাদের মনের উচ্চতম আদর্শের অনুবর্তী হইয়া পূজা করিব। তাহার পরে দেখাইয়াছেন, যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে, যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র। এই মূল ভাবটিই “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের ভিতরকার অধ্যাত্মশক্তি, ইহাই সমস্ত গ্রন্থটিকে মহিমান্তিত করিয়া রাখিয়াছে।
বর্তমান গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের শ্রেষ্ঠতা এবং ঐতিহাসিকতা প্রমাণের বিষয়। গ্রন্থের প্রথমাংশে লেখক ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন।
কৃষ্ণচরিত্রে রীতিমত ইতিহাস-সমালোচনা এই প্রথম। ইতিপূর্বে কেহ ইহার সূত্রপাত করিয়া যায় নাই, এইজন্য ভাঙিবার এবং গড়িবার ভার উভয়ই বঙ্কিমকে লইতে হইয়াছে। কোন্টা ইতিহাস তাহা স্থির করিবার পূর্বে কোন্টা ইতিহাস নহে তাহা নির্ণয় করা বিপুল পরিশ্রমের ও বিচক্ষণতার কাজ। আমাদের বিবেচনায় বর্তমান গ্রন্থে বঙ্কিম সেই ভাঙিবার কাজ অনেকটা পরিমাণে শেষ করিয়াছেন– গড়িবার কাজে ভালো করিয়া হস্তক্ষেপ করিবার অবসর পান নাই।
মহাভারতকেই বঙ্কিম প্রধানত আশ্রয় করিয়াছেন। কিন্তু তিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহাভারতের মধ্যে বিস্তর প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। অথচ ঠিক কোন্টুকুযে মূল মহাভারত তাহা তিনি স্থাপনা করিয়া যান নাই। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন–
বঙ্কিম মহাভারতের তিনটি স্তর আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রথম স্তরের রচনা উদার ও উচ্চকবিত্বপূর্ণ; দ্বিতীয় স্তরের রচনা অনুদার এবং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্রাপ্ত এবং তৃতীয় স্তর বহুকালের বহুবিধ লোকের যদৃচ্ছামৃত রচনা।
এ কথা পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য যে, কাব্যাংশের উৎকর্ষওঅপকর্ষবিচারকরিয়াস্তরনির্ণয়করানিতান্তইআনুমানিক।রুচিভেদেকবিত্বভিন্নলোকেরনিকটভিন্নরূপেপ্রতীয়মানহয়।আবার, একই কবির রচনার ভিন্ন ভিন্ন অংশের কবিত্ব হিসাবে আকাশ-পাতাল তফাত হয় এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নহে। অতএব ভাষার প্রভেদ ঐতিহাসিকের প্রধান সমালোচ্য বিষয়, কবিত্বের প্রভেদ নহে। মহাভারতের মধ্যে এই ভাষার অনুসরণ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন কবির রচনা নির্ণয় করা এবং মূল মহাভারত নির্বাচন করা প্রভূত শ্রমসাধ্য।
দ্বিতীয় কথা এই যে, ভালো কবির রচনায় ভালো কাব্য থাকিতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকতা কবিত্বের উপর নির্ভর করে না। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবিবরণ সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতে নানা স্থানের নানা লোকের মুখে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। কোনো উৎকৃষ্টকবিসেই-সকলগল্পেরমধ্যহইতেতাঁহারকবিত্বেরউপযোগীউপকরণসংগ্রহওসংগঠনকরিয়ালইয়াএকটিসুসংগতসুন্দরকাব্যরচনাকরিয়াথাকিতেপারেন এবং অনেক অকবি ও কুকবিবর্গ তাঁহার সেই কাব্যের মধ্যে তাঁহাদের নিজের জানা ইতিহাস জুড়িয়া দিতে পারেন। সে স্থলে সুকাব্যের অপেক্ষা অকাব্য ঐতিহাসিক হিসাবে অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইতে পারে। এ কথা কাহারো অবিদিত নাই যে, কাব্যহিসাবে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিতে হইলে সমগ্র ইতিহাসকে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা যায় না। শেক্স্পীয়ারের কোনো ঐতিহাসিক নাটকে যদি পরবর্তী সত্যপ্রিয় ব্যক্তিগণ ঐতিহাসিক অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া দিবার জন্য নিজ নিজ রচনা নির্বিচারে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিতে থাকেন তবে তাহাতে কাব্যের কত ত্রুটি, মূলের সহিত কত অসামঞ্জস্য এবং শেক্স্পীয়ার-বর্ণিত চরিত্রের সহিত কত বিরোধ ঘটিতে থাকে তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে; সে স্থলে কাব্যসমালোচক কবিত্ব বিচার করিয়া শেক্স্পীয়ারের মূলনাটক উদ্ধার করিতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস-সমালোচক ইতিহাস-উদ্ধারের জন্য একমাত্র শেক্স্পীয়ারের মূল গ্রন্থের উপরেই নির্ভর করিবেন এমন কথা বলিতে পারি না।
যাহা হউক, মহাভারতে যে নানা লোকের রচনা আছে তাহা স্বীকার্য; কিন্তু তাহাদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের রচনাকাল ও তাহাদের আপেক্ষিক সত্যাসত্য নির্ণয় যে কেমন করিয়া সাধিত হইতে পারে তাহা এখনো আবিষ্কৃত হয় নাই।
কেবল, বঙ্কিমবাবু অনৈতিহাসিকতার একটি-যে লক্ষণ নির্ণয় করিয়াছেন সে সম্বন্ধে কাহারো মতভেদ থাকিতে পারে না; তাহা অনৈসর্গিকতা। প্রথমত, যাহা অনৈসর্গিক তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের যে অংশে অনৈসর্গিকতা দেখা যায়, সে অংশ যে ঘটনাকালের বহু পরে রচিত তাহা মোটামুটি বলা যাইতে পারে।
বঙ্কিমবাবু অনৈতিহাসিকতার আর-একটি যে লক্ষণ স্থির করিয়াছেন তাহাও প্রণিধানযোগ্য। যে অংশে কোনো ঐতিহাসিক মহৎব্যক্তিদেবতাবলিয়াপূজিতহইয়াছেনসেঅংশওযেপরবর্তীকালেরযোজনাতাহাসুনিশ্চিত।
অতএব বঙ্কিম যে-সকল স্থলে কৃষ্ণচরিত্র হইতে অতিপ্রাকৃত অমানুষিক অংশ বর্জন করিয়াছেন সে স্থলে কোনো ঐতিহাসিকের মনে বিরুদ্ধ তর্ক উদয় হইতে পারে না। কিন্তু যেখানে তিনি মহাভারতের একাংশের সহিত অসংগত বলিয়া কিছু পরিত্যাগ করিয়াছেন সেখানে পাঠকের মন নিঃসংশয় হইতে পারে না। কারণ একটা বড়ো লোক এবং বড়ো ঘটনা সম্বন্ধে দেশে বিচিত্র জনশ্রুতি প্রচলিত থাকে। সেই-সকল জনশ্রুতি বর্জন এবং মার্জন-পূর্বক ভিন্ন কবি আপন আদর্শ অনুযায়ী ভিন্নরূপ কাব্য রচনা করিতে পারেন। কেহ-বা শ্রীকৃষ্ণকে পরম ধর্মশীল দেবপ্রকৃতির মানুষ বলিয়া গড়িতে পারেন, কেহ-বা তাঁহাকে কূটবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞ চক্রীরূপে চিত্রিত করিতে পারেন। সম্ভবত উভয়েরই চিত্র অসম্পূর্ণ। এবং পরস্পরবিরোধী হইলেও সম্ভবত উভয়ের রচনাতেই আংশিক সত্য আছে। বস্তুত নির্ণয় করিয়া বলা কঠিন, ইতিহাস হিসাবে কে বেশি নির্ভরযোগ্য।
এই হেতু বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণের প্রত্যেক উক্তি এবং মত যতটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার সহিত আলোচনা করিয়াছেন এবং তাহা হইতে যে ঐতিহাসিক চরিত্র গঠন করিয়াছেন তাহা আমাদের মতে যথেষ্ট তথ্যমূলক নহে। বঙ্কিমবাবুও মধ্যে মধ্যে বলিয়াছেন যে, মহাভারতে কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে সবই যে কৃষ্ণ বাস্তবিক বলিয়াছিলেন তাহা নহে, তদ্দ্বারা কৃষ্ণসম্বন্ধে কবির কিরূপ ধারণা ছিল তাহাই প্রমাণিত হইতেছে। কিন্তু কবির আদর্শকে সর্বতোভাবে ঐতিহাসিক আদর্শের অনুরূপ বলিয়া স্বীকার করিতে হইলে কবির কাব্য ব্যতীত অন্যান্য অনুকূল প্রমাণের আবশ্যক। আমরা একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করি। বঙ্কিমবাবু বলিতেছেন–
“কুন্তী পুত্রগণ ও পুত্রবধুর দুঃখের বিবরণ স্মরণ করিয়া কৃষ্ণের নিকট অনেক কাঁদাকাটা করিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ যাহা তাঁহাকে বলিলেন তাহা অমূল্য। যে-ব্যক্তি মনুষ্যচরিত্রের সর্বপ্রদেশ সম্পূর্ণরূপে অবগত হইয়াছে সে ভিন্ন আর কেহই সে কথার অমূল্যত্ব বুঝিবে না। মূর্খের তো কথাই নাই। শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, “পাণ্ডবগণ নিদ্রা তন্দ্রা ক্রোধ হর্ষ ক্ষুধা পিপাসা হিম রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখে সন্তুষ্ট আছেন; সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্নবীরগণকদাচঅল্পেসন্তুষ্টহয়েননা।বীরব্যক্তিরাহয়অতিশয়ক্লেশ, না-হয় অত্যুৎকৃষ্টসুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন; আর ইন্দ্রিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।”
বঙ্কিমবাবু মহাভারত হইতে কৃষ্ণের যে উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহা সুগভীর ভাবগর্ভ উপদেশে পূর্ণ। কিন্তু ইহা হইতে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের চরিত্রনির্ণয়ের বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় এমন আমরা বিশ্বাস করি না। ইহাতে মহাভারতকার কবির মানবচরিত্রজ্ঞতা এবং হৃদয়ের উচ্চতা প্রকাশ করে। উদ্যোগপর্বের নবতিতম অধ্যায়ে কৃষ্ণের এই উক্তি বর্ণিত আছে; ইহার প্রায় চল্লিশ অধ্যায় পরেই কুন্তীর মুখে বিদুলা-সঞ্জয়সংবাদ-নামক একটি পুরাতন কাহিনী সন্নিবেশিত হইয়াছে; তাহাতে তেজস্বিনী বিদুলা তাঁহার যুদ্ধচেষ্টাবিমুখ পুত্র সঞ্জয়কে ক্ষত্রধর্মে উৎসাহিতকরিবারজন্যযেকথাগুলিবলিয়াছেনকৃষ্ণেরপূর্বোদ্ধৃতউক্তিরসহিততাহারকিছুমাত্রপ্রভেদনা।
বিদুলাবলিতেছেন–
বিদুলাবলিতেছেন–
“এখনো পুরুষোচিত চিন্তাভার বহন করো। অল্পদ্বারা পরিতৃপ্ত রাখিয়া অপরিমেয় আত্মাকে অনর্থক অবমানিত করিয়ো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিম্নগাসকল যেমন অল্প জলেই পরিপূর্ণা হয় এবং মূষিকের অঞ্জলি যেমন অল্প দ্রব্যেই পূর্ণ হইয়া উঠে সেইরূপ কাপুরুষেরাও অত্যল্পমাত্রে পরিতৃপ্ত হওয়ায় সহজেই সন্তুষ্ট হইতে থাকে। চিরকাল ধূমিত হওয়া অপেক্ষা মুহূর্তকাল জ্বলিত হওয়াও শতগুণে শ্রেষ্ঠ। … ইহসংসারে প্রজ্ঞাবান্ পুরুষ অত্যল্প বস্তুকে অপ্রিয় বোধ করেন; অত্যল্প বস্তু যাহার প্রিয় হয়, তাহার সেই অল্প বস্তুই নিশ্চয় অনিষ্টকর হইয়া থাকে। ||| যাহারা ফলের অনিত্যত্ব স্থির করিয়াও কর্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ না হয় তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইতেও পারে, না হইতেও পারে; কিন্তু অনিশ্চিত বোধে যাহারা একেবারেই অনুষ্ঠানে বিরত হয় তাহারা আর কস্মিন্কালেও কৃতকার্য হইতে পারে না।’
ইহা হইতে এই দেখা যাইতেছে যে, কর্তব্যপরায়ণতা সম্বন্ধে মহাভারতের কবিত্ব আদর্শ অত্যন্ত উচ্চ ছিল, এবং সেই আদর্শ তিনি নানা উদাহরণের দ্বারা নানা স্থানে প্রচার করিয়াছেন। মহাভারত ভালো করিয়া পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে এমন কল্পনা করাও অসংগত হয় না যে, এক সময়ে ভারতে কর্মধর্মের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণার উদ্দেশে কবি লোকবিখ্যাত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবৃত্তান্ত মহাকাব্যে গ্রথিত করিয়াছেন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতি মহাভারতের প্রধান নায়কগুলিমাত্রেই কর্মবীরের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তস্থল; এমন-কী, গান্ধারী এবং দ্রৌপদীও কর্তব্যনিষ্ঠার মহিমায় দীপ্তিমতী। সেইজন্য গান্ধারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন এবং দ্রৌপদী বলিয়াছিলেন, “অবধ্য ব্যক্তিকে বধ করিলে যে পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও সেই পাপ হইয়া থাকে।’
অতএব বঙ্কিম যাহা বলিতেছেন তাহাতে যদি প্রমাণের কোনো ত্রুটি না থাকে তবে তদ্দ্বারা ইহাই স্থির হইয়াছে যে, কোনো-একটি অজ্ঞাতনামা কবির মনে মহত্ত্বের আদর্শ অতি উচ্চ ছিল; এবং তাঁহার সেই উচ্চতম আদর্শ-সৃষ্টিই মহাভারতের কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক হইতে পারেন কিন্তু মহাভারতের কৃষ্ণ যে সর্বাংশে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের প্রতিরূপ তাহার কোনো প্রমাণ নাই। ইহাও দেখা যাইতেছে যে, এই মহাভারতেই ভিন্ন লোক ভিন্ন আদর্শের কৃষ্ণ সংগঠন করিয়াছেন।
যেখানে এক সাক্ষী বিরোধী কথা কহিতেছে সেখানে অন্যান্য সাক্ষী ডাকিয়া সত্য সংগ্রহ করিতে হয়। কিন্তু বঙ্কিমবাবু দেখাইয়াছেন, মহাভারতে কৃষ্ণের জীবনের যে অংশ বর্ণিত হইয়াছে অন্য কোনো পুরাণেই তাহা হয় নাই; সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য তুলনা করিয়া সত্য উদ্ধারের যে উপায় আছে, এ স্থলে তাহাও নাই।
অতএব বঙ্কিমবাবুর প্রমাণমতে দেখিতে পাইতেছি, ব্যাসরচিত মূল মহাভারত বর্তমান নাই। এখন যে মহাভারত পাওয়া যায় তাহা ব্যাসের মুখ হইতে বৈশম্পায়ন, বৈশম্পায়নের মুখ হইতে উগ্রশ্রবার পিতা, পিতার মুখ হইতে উগ্রশ্রবা, এবং উগ্রশ্রবার মুখ হইতে অন্য কোনো-একজন কবি সংগ্রহ করিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, এ মহাভারতের মধ্যেও কালক্রমে নানা লোকের রচনা মিশ্রিত হইয়াছে; তাহা নিঃসংশয়ে বিশ্লিষ্ট করিবার কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় আপাতত স্থির হয় নাই। তৃতীয়ত, অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ হইতে তুলনা-দ্বারা মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করিবারও পথ নাই।
বঙ্কিম প্রধানত কৃষ্ণচরিত্রকেই উপলক্ষ করিয়া কেবল প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বিচার করিয়াছেন; কিন্তু প্রথমে প্রমাণ ও বিচার প্রয়োগপূর্বক প্রধানত সমস্ত মহাভারতের ইতিহাস-অংশ বাহির করিলে পর, তবে কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা সন্তোষজনকরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।
উদাহরণস্বরূপে বলিতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ প্রামাণিক সত্য কি না, সে বিষয়ে বঙ্কিম সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন; অতএব দেখা আবশ্যক, বঙ্কিম যাহাকে মূল মহাভারত বলিতেছেন তাহার সর্বত্র হইতেই দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ বর্জন করা যায় কি না, এবং বঙ্কিম মহাভারতের যে যে অংশ হইতে কৃষ্ণচরিত্রের ইতিহাস সংকলন করিয়াছেন, সেই সেই অংশে দ্রৌপদীর পঞ্চপতিচর্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নাই কি না। বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত যে-সকল ঘটনাকে অনৈতিহাসিক মনে করেন সে-সমস্ত যদি তিনি তাঁহার কল্পিত মূল মহাভারত হইতে প্রমাণসহকারে দূর করিয়া দিতে পারেন তবে আমরা তাঁহার নির্বাচিত অংশকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসরূপে গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারি। কিন্তু মহাভারতের ঠিক কতটুকু মূল ঐতিহাসিক অংশ তাহা বঙ্কিম সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্টত করেন নাই, তিনি কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের ধারাটি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। তিনি এক স্থানে বলিয়াছেন–
“আমিও বিশ্বাস করি না যে, যজ্ঞের অগ্নি হইতে দ্রুপদ কন্য পাইয়াছিলেন, অথবা সেই কন্যার পাঁচটি স্বামী ছিল। তবে দ্রুপদের ঔরসকন্যা থাকা অসম্ভব নহে, এবং তাঁহার স্বয়ংবর বিবাহ হইয়াছিল, এবং সেই স্বয়ংবরে অর্জুন লক্ষ্যবেধ করিয়াছিলেন, ইহা অবিশ্বাস করিবারও কারণ নাই। তার পর, তাঁহার পাঁচ স্বামী হইয়াছিল, কি এক স্বামী হইয়াছিল, সে কথার মীমাংসায় আমাদের কোনো প্রয়োজন নাই।’
প্রয়োজন যথেষ্ট আছে। কারণ, বঙ্কিম মহাভারতকে ইতিহাস বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সেইজন্যেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীবিবাহ ব্যাপারটি তুচ্ছ নহে; কিন্তু এতবড়ো ঘটনাটি যদি মিথ্যা হয়, এবং সেই মিথ্যা যদি বঙ্কিমের নির্বাচিত মহাভারতেও স্থান পাইয়া থাকে তবে তদ্দ্বারা সেই মহাভারতে প্রামাণিকতা হ্রাস ও সেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা খর্ব হইয়া আসে। সাক্ষী যখন একমাত্র, তখন তাহার সাক্ষ্যের কোনো-এক বিশেষ অংশ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে গেলে সাক্ষ্যের অপরাংশে মিথ্যাসংস্রব না থাকা আবশ্যক।
কিন্তু এত আয়োজন করিয়া অগ্রসর হইতে গেলে সম্ভবত “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থখানি বাঙালি পাঠকের অদৃষ্টে জুটিত না। সমুচিত পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া সমস্ত মহাভারতের সমূলক অংশ উদ্ধার করা একজন লোকের জীবিতকালে সম্ভব কি না সন্দেহ। অতএব মহাভারতের বিস্তীর্ণ গহন অরণ্যের মধ্যে বঙ্কিম যে এক সংকীর্ণ পথের সূচনা করিয়া দিয়াছেন তাহা আমাদের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের কথা, এবং অল্প বিস্ময়ের বিষয় নহে। আমাদের কেবল বক্তব্য এই যে, তাঁহার কার্য পরিসমাপ্ত হয় নাই। বঙ্কিমের প্রতিভা আমাদিগকে যেখানে উপনীত করিয়াছেন সেইখানেই যে আমাদিগকে সন্তুষ্ট চিত্তে বসিয়া থাকিতে হইবে, তাহা নহে। তিনি আমাদিগকে অসন্তোষের উদাহরণ দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহাই আমাদিগকে অনুসরণ করিতে হইবে; সচেষ্টভাবে সত্যের রাজ্য বিস্তার করিতে হইবে। তিনি আমাদের হাতে মুক্তাটি দিয়া যান নাই, দৃষ্টান্তসহকারে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, যদি মুক্তা চাও তো সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হইবে। খুব সম্ভবত আমরা নমস্কার করিয়া বলিব, আমাদের মুক্তায় কাজ নাই, আমরা সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিব না।
বঙ্কিম, মেকলে কার্লাইল লামার্টিন খুকিদিদীস প্রভৃতি উদাহরণ দেখাইয়া মহাভারতকে কবিত্বময় ইতিহাস বলিতে চাহেন; আমরা মহাভারতকে ঐতিহাসিক কাব্য বলিয়া গণ্য করি। কিন্তু কৃষ্ণচরিত্রের আদর্শ আমরা ইতিহাস হইতে পাই, অথবা কাব্য হইতে পাই, অথবা কাব্য-ইতিহাসের মিশ্রণ হইতে পাই তাহা লইয়া অধিক তর্ক করিতে চাহি না। ফলত ইতিহাস যে বেদবাক্য তাহা নহে; সকলেই জানেন একটা উপস্থিত ঘটনাস্থলেও প্রকৃত বৃত্তান্ত প্রকৃতরূপে গ্রহণ করিতে এবং প্রকৃতরূপে বর্ণনা করিতে অতি অল্প লোকই পারে। খণ্ড খণ্ড বৃত্তান্ত হইতে একটি সমগ্র মানবচরিত্র ও ইতিহাস রচনা করা আরো অল্প লোকের সাধ্যায়ত্ত। সকলেই জানেন আত্মীয় সম্বন্ধেও আত্মীয়ের ভ্রম হয় এবং বন্ধুকেও বন্ধু অনেক বিষয়ে বিপরীতভাবে বুঝিয়া থাকেন। অসাধারণ লোককে প্রকৃতভাবে জানা আরো কঠিন; দূর হইতে এবং অতীত বৃত্তান্ত হইতে তাহার যথার্থ প্রতিকৃতি-নির্মাণ বহুলপরিমাণে কাল্পনিক, তাহার আর সন্দেহ নাই। প্রমাণে এবং অনুমানে মিশ্রিত করিয়া একই লোকের এত বিভিন্নপ্রকার মূর্তি গড়িয়া তোলা যায় যে তাহার মধ্যে কোন্টা মূলের অনুরূপ তাহা প্রকৃতিভেদে ভিন্ন লোকে ভিন্ন ভাবে বিশ্বাস করেন। ইতিহাসমাত্রই যে বহুল পরিমাণে লেখকের অনুমান ও পাঠকের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তাহাতে সন্দেহ নাই। এরূপ স্থলে কবির অনুমান ঐতিহাসিকের অনুমানের অপেক্ষা প্রকৃত ইতিহাসের অনেক কাছাকাছি যাওয়া কিছুই অসম্ভব নহে। ফস্টার সাহেব স্ট্র৻াফোর্ডেরযেজীবনীপ্রকাশকরিয়াছেন, জনশ্রুতি এই যে, তাহা কবি ব্রাউনিঙের স্বরচিত বলিলেই হয়, কিন্তু উক্ত কবি অনতিকাল পরে স্ট্র৻াফোর্ড নামক যে নাটক লিখিয়াছেন, তাহা তাঁহার ইতিহাসের অপেক্ষা অধিকতর সত্য বলিয়া পরে প্রমাণিত হইয়াছে। সেইরূপ, পুরাকালে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধবৃত্তান্তসম্বন্ধে যে-সকল কিম্বদন্তী বিক্ষিপ্তভাবে প্রচলিত ছিল, মহাভারতের কবি কল্পনাবলে তাহাদের অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া তাহাদিগকে যে-একটি সমগ্র চিত্তে প্রতিফলিত করিয়া তুলিয়াছেন তাহা যে ঐতিহাসিকের ইতিহাস অপেক্ষা অল্প সত্য হইবেই এমন কোনো কথা নাই।
তথ্য, যাহাকে ইংরাজিতে ফ্যাক্ট কহে, সত্য তদপেক্ষা অনেক ব্যাপক। এই তথ্যস্তূপ হইতে যুক্তি এবং কল্পনাবলে সত্যকে উদ্ধার করিয়া লইতে হয়। অনেক সময় ইতিহাসে শুষ্ক ইন্ধনের ন্যায় রাশীকৃত তথ্য পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সত্য কবির প্রতিভাবলে কাব্যেই উদ্ভাসিত হইয়া উঠে। অতএব এত দীর্ঘকাল পরে মহাভারতের কবিবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণ লইতে বসা আমরা দুঃসাধ্য এবং উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে বাহুল্য বোধ করি। সুবিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিৎফ্রডসাহেববলিয়াছেন“যথার্থমহৎব্যক্তিরঅকৃত্রিমএবংস্বাভাবিকমহত্ত্বগদ্যেরআয়ত্তেরবাহিরে; তাহা কেবলমাত্র কবির লেখনী দ্বারাই বর্ণনসাধ্য। ইহার কারণ যাহাই হউক, ফলত ইহা সত্য। কবিতার এই সঞ্জীবনীশীক্তি আছে এবং গদ্যের তাহা নাই; এবং সেই কারণেই কবিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক।’
আমরা ফ্রডের উপরি-উক্ত কথার এই অর্থ বুঝি যে, মহৎব্যক্তিরকার্যবিবরণকেবলতথ্যমাত্র, তাঁহার মহত্ত্বটাই সত্য; সেই সত্যটি পাঠকের মনে উদিত করিয়া দিতে ঐতিহাসিকের গবেষণা অপেক্ষা কবিপ্রতিভার আবশ্যকতা অধিক।
সে হিসাবে দেখিতে গেলে মহাভারতের কবিবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের প্রত্যেক তথ্যটি প্রকৃত না হইতে পারে; কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে এবং তাঁহার প্রতি যত কার্যকলাপের আরোপ হইয়াছে তাহার প্রত্যেক ক্ষুদ্র বৃত্তান্তটি প্রামাণিক না হইতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য তিনি পাঠকদের মনে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন তাহাই সর্বাপেক্ষা মহামূল্য সত্য। কৃষ্ণের যদি ইতিহাস থাকিত তবে সম্ভবত তাহাতে এমন সহস্র ঘটনার উল্লেখ থাকিত যাহা কৃষ্ণ-কর্তৃক অনুষ্ঠিত হইলেও তাহার কোনো স্থায়ী মূল্য নাই অর্থাৎযে-সকলকাজকৃষ্ণেরকৃষ্ণত্বপ্রকাশকরেনা–এমনকি, শেষ পর্যন্ত সকল কথা জানা সম্ভব নহে বলিয়া তাহার অনেকগুলি কৃষ্ণের যথার্থ স্বভাবের বিরোধী বলিয়াও মনে হইতে পারিত। প্রত্যেক মানুষে অনেক কাজে নিজের যথার্থ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করিয়াও থাকে। মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্রে নিশ্চয়ই সেই-সকল অনাবশ্যক এবং আকস্মিক তথ্যগুলি বর্জিত হইয়া কেবল প্রকৃত স্বরূপগত সত্যগুলি নির্বাচিত হইয়াছে– এমন-কি, কৃষ্ণ যে কথা বলেন নাই কিন্তু যে কথা কেবল কৃষ্ণই বলিতে পারিতেন, সেই কথা কৃষ্ণকে বলাইয়া, কৃষ্ণ যে কাজ করেন নাই কিন্তু যে কাজ কেবল কৃষ্ণই করিতে পারিতেন সেই কাজ কৃষ্ণকে করাইয়া কবি বাস্তবিক-কৃষ্ণ অপেক্ষা তাঁহার কৃষ্ণকে অধিকতর সত্য করিয়া তুলিয়াছেন।
অর্থাৎ, বাস্তব-পক্ষে স্বভাবতই অকৃষ্ণ যাহা ছিল তাহা দূরে রাখিয়া এবং বাস্তব-কৃষ্ণ নিজের চরিত্রগুণে কবির মনে যে আদর্শের উদয় করিয়া দিয়াছেন পরন্তু নানা বাহ্য কারণে যাহা কার্যে সর্বত্র ধারাবাহিক পরিস্ফুটভাবে ও নির্বিরোধে প্রকাশ হইতে পারে নাই, সেই আদর্শকে সর্বত্র পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুট করিয়া কবি বাস্তবিক ইতিহাস হইতে সত্যতম নিত্যতম কৃষ্ণকে উদ্ধার করিয়া লইয়াছেন।
অতএব, বঙ্কিম যখন কৃষ্ণচরিত্রের মাহাত্ম্য বাঙালি পাঠকদিগের মনে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন তখন কবির কাব্য হইতে তাহা উদ্ধৃত করিয়া লওয়াই তাঁহার উপযুক্ত কার্য হইয়াছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মহাভারত নানা কালের নানা লোকের রচনার মধ্যে চাপা পড়িয়াছে; কবির মূল আদর্শটি বাহির করা সহজ ব্যাপার নহে। সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পারিলে, কেবল কৃষ্ণ নহে, ভীষ্ম কর্ণ অর্জুন দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলেই উজ্জ্বলতর সম্পূর্ণতর আকারে আমাদের নিকট প্রকাশিত হইবেন। মহাভারতের আদিকবির মূল রচনাটি উদ্ধার করা হইলে মানবজাতির একটি পরমতম লাভ হইবে।
কিন্তু, মহাভারতের আদিকবির আদর্শ কৃষ্ণচরিত্র কিরূপ ছিল বঙ্কিম নিজের আদর্শ অনুসারে তাহা আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; তাহাতে কৃতকার্য হইয়াছেন কি না তাহা নিঃসংশয়ে বলিবার পূর্বে অষ্টাদশপর্ব পারাবার হইতে মূল মহাভারতটিকে মন্থন করিয়া লওয়া আবশ্যক। আপাতত কেবল একটি বিষয়ে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি।
কিন্তু..বঙ্কিম কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করিতেন [ঈশ্বেরে অবতার যা বেদ বিরূদ্ধ মত]। এই মহৎ প্রভেদবশতমহাভারতগতপ্রথমস্তরেরকবিরআদর্শকৃষ্ণচরিত্রতাঁহারপক্ষেনির্বাচনকরিয়ালওয়াসহজছিলনা। তিনি যে-কৃষ্ণের অন্বেষণে নিযুক্ত ছিলেন সে-কৃষ্ণ তাঁহার নিজের মনের আকাঙক্ষাজাত। সমস্ত চিত্তবৃত্তির সম্যক্ অনুশীলনে সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি আদর্শ তিনি ব্যাকুলচিত্তে সন্ধান করিতেছিলেন, তাঁহার ধর্মতত্ত্বে যাহাকে তত্ত্বভাবে পাইয়াছিলেন ইতিহাসে তাহাকেই সজীব সশরীর -ভাবে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য নিঃসন্দেহ তাঁহার নিরতিশয় আগ্রহ ছিল। মনের সে অবস্থায় অন্য কোনো কবির আদর্শকে অবিকলভাবে উদ্ধার করা মনুষ্যের পক্ষে সহজ নহে।
উত্তরে কেহ বলিতে পারেন যে, বঙ্কিম যদিও কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করিতেন তথাপি তিনি বারম্বার বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর যখন অবতাররূপে নরলোকে অবতীর্ণ হন তখন তিনি সম্পূর্ণ মানুষ-ভাবেই প্রকাশ পাইতে থাকেন, কোনোপ্রকার অলৌকিক কাণ্ডদ্বারা আপনাকে দেবতা বলিয়া প্রচার করেন না। অতএব বঙ্কিম দেবতা-কৃষ্ণকে নহে, মানুষ-কৃষ্ণকেই মহাভারত হইতে আবিষ্কার করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন।
কিন্তু যে-মানুষকে বঙ্কিম খুঁজিতেছিলেন তাহার কোথাও কোনো অসম্পূর্ণতা নাই, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপ্রাপ্ত। অর্থাৎসেএকটিমূর্তিমানথিয়োরি।কিন্তুসম্ভবতমহাভারতকারেরকৃষ্ণদেবতানহেন, অনুশীলনপ্রাপ্ত চিত্তবৃত্তি নহেন, তিনি কৃষ্ণ।
মহাভারতকার এমন-একটি মানুষের সৃষ্টি করেন নাই, যিনি মনুষ্য-আকারধারী তত্ত্বকথা বা নীতিসূত্র মাত্র। সেই তাঁহার অত্যুচ্চ কবিপ্রতিভার পরিচায়ক। তিনি তাঁহার বড়ো বড়ো বীরদিগকেও অনেক সময় এমন সকল অযোগ্য কাজে প্রবৃত্ত করাইয়াছেন যাহা ছোটো কবিদের সাহসে কুলাইত না। ছোটো কবিদের সৃজনশক্তি নাই, নির্মাণশক্তি আছে; তাহারা যাহা গড়ে তাহার আদ্যোপান্ত নিয়ম অনুসারে গড়ে– কোথাও তাহার মধ্যে ব্যতিক্রম বা আত্মবিরোধ রাখিতে পারে না। প্রকৃত বড়ো জিনিসের অসম্পূর্ণতাও তাহার বড়োত্ব সূচনা করে; প্রকৃতি একটা পর্বতকে নিখুঁত মণ্ডলাকার করিবার আবশ্যক বোধ করে না– তাহার সমস্ত ভাঙাচোরা– তাহার সমস্ত অযত্ন-অবহেলা লইয়াও সে অভ্রভেদী রাজগৌরবগর্বিত। সে আপন অপূর্ণতাগুলি এমন অনায়াসে বহন করিতে পারে যে, তাহার অপূর্ণতার দ্বারা তাহার প্রকাণ্ড সম্পূর্ণতার পরিমাপ হইয়া থাকে। ক্ষুদ্র বস্তুতে সামান্য অপূর্ণতা মারাত্মক– তাহার প্রতি দৃষ্টি এবং শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে হইলে তাহাকে নিখুঁত করাই আবশ্যক হইয়া পড়ে।
মহাভারতকার কবি যে-একটি বীরসমাজ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে একটি সুমহৎসামঞ্জস্যআছেকিন্তুক্ষুদ্রসুসংগতিনাই।খুবসম্ভব, আধুনিক খ্যাত-অখ্যাত অনেক আর্য বাঙালি লেখকই সরলা বিমলা দামিনী যামিনী -নামধেয়া এমন-সকল সতীচরিত্রের সৃষ্টি করিতে পারেন যাঁহারা আদ্যোপান্তসুসংগত অপূর্ব নৈতিকগুণে দ্রৌপদীকে পদে পদে পরাভূত করিতে পারেন, কিন্তু তথাপি, মহাভারতের দ্রৌপদী তাঁহার সমস্ত অপূর্ণতা অসংকোচে বক্ষে বহন করিয়া এই-সমস্ত নব্য বল্মীকরচিত ক্ষুদ্র নীতিস্তূপগুলির বহু উর্ধ্বে উদার আদিম অপর্যাপ্ত প্রবল মাহাত্ম্যে নিত্যকাল বিরাজ করিতে থাকিবেন। মহাভারতের কর্ণ সভাপর্বে পাণ্ডবদের প্রতি যে-সকল হীনতাচরণ করিয়াছেন আমাদের নাটক-নভেলের দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বর্গকখনোই তাহা করেন না, তাঁহারা সময়ে-অসময়ে স্থানে-অস্থানে অনায়াসেই আত্ম-বিসর্জন করিয়া থাকেন, তথাপি মহাভারতের কবি বিনা চেষ্টায় কর্ণকে যে অমরলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন এই দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বর্গ সমালোচক-প্রদত্ত সমস্ত ফার্স্ট ক্লাস টিকিট এবং নৈতিক পাথেয় লইয়াও তাহার নিম্নতম সোপান পর্যন্ত পৌঁছিতে পারে কি না সন্দেহ।
সেই কারণেই বলিতেছিলাম, প্রথম স্তরের মহাভারতকার কবি যদি কৃষ্ণকে দেবতা বলিয়া মানিতেন না ইহা সত্য হয়, তবে তিনি যে তাঁহাকে নীতিশিক্ষার অখণ্ড উদাহরণ-স্বরূপ গড়িয়াছিলেন ইহা আমাদের নিকট সম্ভবপর বোধ হয় না। বঙ্কিম মহাভারতের প্রথমস্তর-রচয়িতাকে শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া স্থির করিয়াছেন, অনেক স্থলে সেই শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়া তিনি কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত অসংগতি-অসম্পূর্ণতা বাদ দিয়াছেন। কিন্তু আমরা বলিতেছি, সেই শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ যে সংগতি তাহা নহে। এ পর্যন্ত হ্যাম্লেট চরিত্রের সংগতি কেহ সন্তোষজনকরূপে আবিষ্কার করিতে পারে নাই, কিন্তু কাব্যজগতের মধ্যে হ্যাম্লেট যে একটি পরম স্বাভাবিক সৃষ্টি সে বিষয়ে কেহ সন্দেহ প্রকাশ করে নাই।
অতএব, বঙ্কিম মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত মন্দ অংশ বাদ দিয়া যে আদিম মহাভারতকারের আদর্শ কৃষ্ণকেই আবিষ্কার করিয়াছেন, সে বিষয়ে আমাদের সম্পূর্ণ সন্দেহ আছে।
এক্ষণে কথা এই যে, মহাভারতকারের আদর্শ না-হইল, বঙ্কিমের আদর্শ যদি যথার্থ মহৎহয়তবেসেওবঙ্গীয়পাঠকদেরপক্ষেপরমলাভবলিতেহইবে।
বঙ্কিমের আদর্শ যে মহৎএবং“কৃষ্ণচরিত্র’যেবঙ্গসাহিত্যেরপরমলাভসেবিষয়েআমাদেরকোনোসন্দেহনাই।
কিন্তু সেইজন্যই “কৃষ্ণচরিত্র’ পাঠ করিতে সর্বদাই মনে এই খেদ উপস্থিত হয় যে, সাহিত্যে যে প্রণালীতে আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিতে হয় বঙ্কিম সে প্রণালী অবলম্বন করেন নাই।
ফ্রড যে বলিয়াছেন, মহং লোকের মাহাত্ম্য ইতিহাস যথার্থরূপে প্রকাশ করিতে পারে না, কাব্য পারে, সে কথা সত্য। কারণ, মাহাত্ম্য পদার্থটি পাঠকের মনে অখণ্ডভাবে সজীবভাবে সঞ্চার করিয়া দিবার জিনিস। তাহা তর্কদ্বারা যুক্তিদ্বারা ক্রমশ খণ্ড খণ্ড আকারে মনের মধ্যে কিয়দংশে প্রমাণিত হইতে পারে, কিন্তু তর্কযুক্তি তাহাকে হৃদয়ের মধ্যে সর্বাংশে সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারে না।
বঙ্কিম গ্রন্থের প্রারম্ভ হইতেই তরবারি হস্তে সংগ্রাম করিতে করিতে অগ্রসর হইয়াছেন; কোথাও শান্তভাবে তাঁহার কৃষ্ণের সমগ্র মূর্তি আমাদের সম্মুখে একত্র ধরিবার অবসর পান নাই।
সেজন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়াও যায় না। কারণ, ভক্তসম্প্রদায়ের বাহিরে এমন-কি, ভিতরেও কৃষ্ণচরিত্র যেরূপ কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত ছিল তাহাতে প্রথমত সেই পূর্বসংস্কার ঘুচাইবার জন্য তাঁহাকে বিপুল প্রয়াস পাইতে হইয়াছে। যেখানে তাঁহার দেবপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে সেখানকার জঙ্গল সাফ করিবার জন্য তাঁহাকে কুঠার ধারণ করিতে হইয়াছিল। কৃষ্ণ সম্বন্ধে আমাদের সংস্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রকৃত কৃষ্ণ যে অনেক বিভিন্ন, বঙ্কিমের “কৃষ্ণচরিত্র’ হইতে তাহা আমরা শিক্ষা করিয়াছি।
কিন্তু বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্রন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য তাঁহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য।
“পাশ্চাত্য মুর্খ’ অর্থাৎয়ুরোপীয়পণ্ডিতগণেরপ্রতিলেখকঅজস্রঅবজ্ঞাবর্ষণকরিয়াছেন।প্রথমতসে-কাজটাইগর্হিত; দ্বিতীয়ত এমন গ্রন্থে সেটা অত্যন্ত অশোভন হইয়াছে। মান্যজনের সমক্ষে অন্য কাহারো প্রতি অযথা দুর্ব্যবহার কেবল দুর্ব্যবহার মাত্র নহে, তাহা মান্য ব্যক্তির প্রতিও অশিষ্টতা। বঙ্কিম যাঁহাকে মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, যিনি একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সক্ষম হইয়াও অকারণে, এমন-কি, সকারণে অস্ত্র ধারণ করিতে অনেক সময়েই বিরত হইয়াছেন, তাঁহারই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে তাঁহারই আদর্শের সম্মুখে উপবিষ্ট হইয়া মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা আদর্শের অবমাননা। কেবল য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণের প্রতি নহে, সাধারণত য়ুরোপীয় জাতির প্রতিই লেখক স্থানে অস্থানে তীব্র বৈরিতা প্রকাশ করিয়াছেন। দুই-একটা দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করি।
শিশুপালের গালি “শুনিয়া ক্ষমাগুণের পরমাধার পরমযোগী আদর্শপুরুষ কোনো উত্তর করিলেন না। কৃষ্ণের এমন শক্তি ছিল যে তদ্দণ্ডেই তিনি শিশুপালকে বিনষ্ট করিতে সক্ষম– পরবর্তী ঘটনায় পাঠক তাহা জানিবেন। কৃষ্ণও কখনো যে এরূপ পরুষবচনে তিরষ্কৃত হইয়াছিলেন এমন দেখা যায় না। তথাপি তিনি এ তিরস্কারে ভ্রুক্ষেপও করিলেন না। য়ুরোপীয়দের মতো ডাকিয়া বলিলেন না, “শিশুপাল, ক্ষমা বড়ো ধর্ম, আমি তোমায় ক্ষমা করিলাম।” নীরবে শত্রুকে ক্ষমা করিলেন।’
শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনাস্থলে অকারণে য়ুরোপীদের প্রতি একটা অন্যায় খোঁচা দেওয়া যে কেবল অনাবশ্যক হইয়াছে তাহা নহে; ইহাতে মূল উদ্দেশ্যটি পর্যন্ত নষ্ট হইয়াছে। পাঠকদের চিত্তকে যেরূপভাবে প্রস্তুত করিয়া তুলিলে তাহারা কৃষ্ণের ক্ষমাশক্তির মাহাত্ম্য হৃদয়ে গ্রহণ করিতে পারিত তাহা ভাঙিয়া দেওয়া হইয়াছে। “কৃষ্ণচরিত্রে’র ন্যায় গ্রন্থ কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য লিখিত হওয়া উচিত নহে, তাহা সর্বকালের সর্বজাতির জন্যই রচিত হওয়া কর্তব্য। পাঠকেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন এই অংশ পাঠকালে একজন য়ুরোপীয় পাঠকের মনে কিরূপ বিদ্রোহী ভাবের উদয় হওয়া সম্ভব। বিশেষত, ক্ষমা করিবার সময় ক্ষমাধর্মের মহিমাকীর্তন যে য়ুরোপীয়দের জাতীয় প্রকৃতি এরূপ সাধারণ কথা লেখক কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন বলা কঠিন। আমাদের শাস্ত্রে এরূপ উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে– যখন বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের গাভী বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছিলেন এবং নন্দিনী অতিশয় তাড়িত হইয়া আর্তরবে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন তখন বশিষ্ঠ কহিলেন, “হে ভদ্রে নন্দিনী, তুমি পুনঃপুনঃ রব করিতেছ, তাহা আমি শুনিতেছি; কিন্তু হে ভদ্রে, যখন রাজা বিশ্বামিত্র তোমাকে বলপূর্বক হরণ করিতেছেন তখন আমি কী করিব! যেহেতু আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ।’ পুনশ্চ নন্দিনী তাঁহার নিকট কাতরতা প্রকাশ করিলে তিনি কহিলেন, “ক্ষত্রিয়ের বল তেজ এবং ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা; অতএব আমি ক্ষমাগুণে আকৃষ্ট হইতেছি।’
শ্রীকৃষ্ণের এই মহদুক্তি উদ্ধৃত করিয়া বঙ্কিম বলিতেছেন–
“হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কিনা, মেমসাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না-হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মতো কিচিরমিচির করি।’
ক্ষণে ক্ষণে লেখকের এরূপ ধৈর্যচ্যুতি “কৃষ্ণচরিত্রে’র ন্যায় গ্রন্থে অতিশয় অযোগ্য হইয়াছে। গ্রন্থের ভাষায় ভাবে ও ভঙ্গিতে সর্বত্রই একটি গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য ও ঔদার্য রক্ষা না করাতে বর্ণনীয় আদর্শচরিত্রের উজ্জ্বলতা নষ্ট হইয়াছে।
বঙ্কিম সামান্য উপলক্ষমাত্রেই য়ুরোপীয়দের সহিত, পাঠকদের সহিত এবং ভাগ্যহীন ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিত কলহ করিয়াছেন। সেই কলহের ভাবটাই এ গ্রন্থে অসংগত হইয়াছে; তাহা ছাড়া প্রসঙ্গক্রমে তিনি বিস্তর অবান্তর তর্কের উত্থাপন করিয়া পাঠকের মনকে অনর্থক বিক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন। প্রথমত, যখন তিনি কৃষ্ণকে মনুষ্যশ্রেষ্ঠ বলিয়া দাঁড় করাইয়াছেন, তখন ঈশ্বরের অবতারত্ব সম্ভব কি না এ প্রশ্নের উত্থাপন করিয়া কেবল পাঠকের মনে একটা তর্ক উঠাইয়াছেন, অথচ তাহার ভালোরূপ মীমাংসা করেন নাই। নিরাকার ঈশ্বর আকার ধারণ করিবেন কী করিয়া, এরূপ আপত্তি যাঁহারা করেন বঙ্কিম তাঁহাদিগকে এই উত্তর দিয়াছেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান তিনি আকার গ্রহণ করিতে পারেন না ইহা অসম্ভব। যাঁহারা আপত্তি করেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান তাঁহার দেহ ধারণ করিবার প্রয়োজন কী, তিনি তো ইচ্ছামাত্রেই রাবণ কুম্ভকর্ণ অথবা কংস শিশুপাল বধ করিতে পারেন, তাঁহাদের কথার উত্তরে বঙ্কিম বলেন যে, রাবণ অথবা শিশুপাল -বধ করিবার জন্যই যে ঈশ্বর দেহ ধারণ করেন তাহা নহে, মনুষ্যের আদর্শ স্থাপন করাই তাঁহার অবতার হইবার উদ্দেশ্য। তিনি দেবতার ভাবে যদি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করেন তবে তাহাতে মানুষের কোনো শিক্ষা হয় না; পরন্তু তিনি যদি মনুষ্য হইয়া দেখাইয়া দেন মনুষ্যের দ্বারা কতদূর সম্ভব তবেই তাহা আমাদের স্থায়ী কল্যাণের কারণ হয়। এক্ষণে তৃতীয় আপত্তি এই উঠিতে পারে যে, ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন এবং মনুষ্যের নিকট মনুষ্যত্বের আদর্শ স্থাপন করাই যদি তাঁহার অভিপ্রায় হয়, তবে তিনি কি আদর্শরূপী মনুষ্যকে অভিব্যক্ত করিয়া তুলিতে পারেন না– তাঁহার কি নিজেই মনুষ্য হইয়া আসা ছাড়া গত্যন্তর নাই? এইখানেই কি তাঁহার শক্তির সীমা? বঙ্কিম এই আপত্তি উত্থাপনও করেন নাই, এই আপত্তির উত্তরও দেন নাই।
পরন্তু, সমস্ত গ্রন্থের উদ্দেশ্যের সহিত এই তর্কের কিঞ্চিৎযোগআছে।বঙ্কিম নানা স্থলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের আদর্শ যেমন কার্যকারী এমন দেবতার আদর্শ নহে। কারণ, সর্বশক্তিমানের অনুকরণে আমাদের সহজেই উৎসাহনাহইতেপারে।যারামানুষেসাধনকরিয়াছেতাহাআমরাওসাধনকরিতেপারিএইবিশ্বাসএবংআশাঅপেক্ষাকৃতসুলভএবংস্বাভাবিক।অতএবকৃষ্ণকে দেবতা প্রমাণ করিতে গিয়া বঙ্কিম তাঁহার মানব-আদর্শের মূল্য হ্রাস করিয়া দিতেছেন। কারণ, ঈশ্বরের পক্ষে সকলই যখন অনায়াসে সম্ভব তখন কৃষ্ণচরিত্রে বিশেষরূপে বিস্ময় অনুভব করিবার কোনো কারণ দেখা যায় না।
বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই।
“কৃষ্ণের বহুবিবাহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে রুক্ষ্ণিণী ব্যতীত কৃষ্ণের অন্য স্ত্রী ছিল না ইহাই প্রমাণ করিয়া লেখক সর্বশেষে তর্ক তুলিয়াছেন যে, পুরুষের বহুবিবাহ সকল অবস্থাতেই অধর্ম এ কথা ঠিক নহে। তিনি বলিয়াছেন–
“সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ণ যে সে কোনোমতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তর পরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তাহা বুঝিতে পারি না। যদি য়ুরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেনরিকে কথায় কথায় পত্মীহত্যা করিতে হইত না। য়ুরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যাহাই বিলাতি তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধ্বাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।’
কৃষ্ণ যখন একাধিক বিবাহ করেন নাই তখন বিবাহসম্বন্ধীয় এই তর্ক নিতান্তই অনাবশ্যক; তাহা ছাড়া তর্কটারই বা কী মীমাংসা হইল। প্রথম স্থির হইল, যাহার স্ত্রী রুগণ অথবা ভ্রষ্টা অথবা বন্ধ্যা সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু য়ুরোপে রুগণা, ভ্রষ্টা এবং বন্ধ্যার স্বামী সহজে দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে না বলিয়াই যে, সেখানকার সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এত পত্নীহত্যা হইতেছে তাহা নহে; অনেক সময় পত্নীর প্রতি বিরাগ ও অন্যের প্রতি অনুরাগ বশত হত্যা ঘটনা অধিকতর সম্ভবপর। যদি সে হত্যা নিবারণ করিতে হয় তবে অন্য স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ সঞ্চারকেও দ্বিতীয় স্ত্রী-গ্রহণের ধর্মসংগত বিধান বলিয়া স্থির করিতে হয়। তাহা হইলে “সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম এ কথাটার এই তাৎপর্যদাঁড়ায়যে, যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে যাইবে তখন যেন একটা কোনো কারণ থাকে, কাজটা যেন অকারণে না হয়। অর্থাৎযদিতোমারস্ত্রীরুগ্ণঅক্ষমহয়তবেতুমিবিবাহকরিতেপার, অথবা যদি অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে তোমার ইচ্ছা বোধ হয় তাহা হইলেও তুমি বিবাহ করিতে পার; কারণ, সেইরূপ ইচ্ছার বাধা পাইয়া ইংলণ্ডের অষ্টম হেনরি পত্নীহত্যা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনো কারণ না থাকিলে বিবাহ করিয়ো না। জিজ্ঞাস্য এই যে, স্বামীকে যে যুক্তি অনুসাযে যে-সকল স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী করা হইল, ঠিক সেই যুক্তি অনুসারে অনুরূপ স্থলে স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ ক্ষমতা অর্পণ করা যায় কি না, এবং আমাদের সমাজে স্ত্রীর সেই-সকল স্বাধীন ক্ষমতা না থাকাতে স্ত্রী “অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত’ হয় কি না।
ইহার অনতিপরেই সুভদ্রাহরণ কার্যটা যে বিশেষ দোষের হয় নাই ইহাই প্রতিপন্ন করিতে গিয়া লেখক, “মালাবারী’ নামক এক পারসি– সম্ভবত যাঁহার খ্যাতিপুষ্প বর্তমান কালের গুটিকয়েক সংবাদপত্রপুটের মধ্যেই কীটের দ্বারা জীর্ণ হইতে থাকিবে– তাঁহার প্রতি একটা খোঁচা দিয়া আর-একটা সামাজিক তর্ক তুলিয়াছেন। সে তর্কটারও মীমাংসা কিছুমাত্র সন্তোষজনক হয় নাই, অথচ লেখক অধীরভাবে অসহিষ্ণু ভাষায় অনেকের সঙ্গে অনর্থক একটা কলহ করিয়যাছেন।
বঙ্কিম যদি কৃষ্ণকে দেবতা না মনে করিতেন এবং কৃষ্ণের সমস্ত চিত্তবৃত্তির সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষসম্বন্ধেতাঁহারকোনোরূপথিয়োরিনাথাকিততাহাহইলেএ-সমস্ততর্ক-বিতর্কের কোনো প্রয়োজন থাকিত না, এবং তিনি সর্বত্র সংযম রক্ষা করিয়া চলিতে পারিতেন। তাহা হইলে তিনি নিরপেক্ষ নির্বিকারচিত্তে মহাভারতকার কবির আদর্শ কৃষ্ণকে অবিকলভাবে উদ্ধার করিয়া পাঠকদের সম্মুখে উপনীত করিতেন– এবং পাছে কোনো অবিশ্বাসী সংশয়ী পাঠক তাঁহার কৃষ্ণচরিত্রের কোনো অংশে তিলমাত্র অসম্পূর্ণতা দেখিতে পায় এজন্য আগেভাগে তাহাদের প্রতি রোষ প্রকাশ করিয়া তাঁহার গ্রন্থ হইতে উচ্চসাহিত্যের লক্ষ্যগত অচঞ্চল শান্তি দূর করিয়া দিতেন না।
যেমন প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চের উপরে নেপথ্যবিধান করিতে আরম্ভ করিলে অভিনয়ের রসভঙ্গ হয়, কাব্যসৌন্দর্য সমগ্রভাবে শ্রোতৃবর্গের মনের মধ্যে মুদ্রিত হয় না, সেইরূপ বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রে পদে পদে তর্কযুক্তি বিচার উপস্থিত হইয়া আসল কৃষ্ণচরিত্রটিকে পাঠকের হৃদয়ে অখণ্ডভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে বাধা দিয়াছে। কিন্তু বঙ্কিম বলিতে পারেন, “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থটি স্টেজ নহে; উহা নেপথ্য; স্টেজ-ম্যানেজার আমি নানা বাধাবিঘ্নের সহিত সংগ্রাম করিয়া, নানা স্থান হইতে নানা সাজসজ্জা আনয়নপূর্বক কৃষ্ণকে নরোত্তমবেশে সাজাইয়া দিলাম– এখন কোনো কবি আসিয়া যবনিকা উত্তোলন করিয়া দিন, অভিনয় আরম্ভ করুন, সর্বসাধারণের মনোহরণ করিতে থাকুন। তাঁহাকে শ্রমসাধ্য চিন্তাসাধ্য বিচারসাধ্য কাজ কিছুই করিতে হইবে না।
কৃষ্ণচরিত্র – প্রথম খণ্ড
উপক্রমণিকা
মহতস্তমসঃ পারে পুরুষং হ্যতিতেজসম্।
যং জ্ঞাত্বা মৃত্যুমত্যেতি তস্মৈ জ্ঞেয়াত্মনে নমঃ||
মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৪৭ অধ্যায়।
প্রথম পরিচ্ছেদ—গ্রন্থের উদ্দেশ্য
ভারতবর্ষের অধিকাংশ হিন্দুর, বাঙ্গালা দেশের সকল হিন্দুর বিশ্বাস যে, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার। কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং—ইহা তাঁহাদের দৃঢ় বিশ্বাস। বাঙ্গালা প্রদেশে, কৃষ্ণের উপাসনা প্রায় সর্বব্যাপক। গ্রামে গ্রামে কৃষ্ণের মন্দির, গৃহে গৃহে কৃষ্ণের পূজা, প্রায় মাসে মাসে কৃষ্ণোৎসব, উৎসবেউৎসবেকৃষ্ণযাত্রা, কণ্ঠে কণ্ঠে কৃষ্ণগীতি, সকল মুখে কৃষ্ণনাম। কাহারও গায়ে দিবার বস্ত্রে কৃষ্ণনামাবলি, কাহারও গায়ে কৃষ্ণনামের ছাপ। কেহ কৃষ্ণনাম না করিয়া কোথাও যাত্রা করেন না; কেহ কৃষ্ণনাম না লিখিয়া কোন পত্র বা কোন লেখাপড়া করেন না; ভিখারী “জয় রাধে কৃষ্ণ” না বলিয়া ভিক্ষা চায় না। কোন ঘৃণার কথা শুনিলে “রাধে কৃষ্ণ!” বলিয়া আমরা ঘৃণা প্রকাশ করি; বনের পাখী পুষিলে তাহাকে “রাধে কৃষ্ণ” নাম শিখাই। কৃষ্ণ এদেশে সর্বব্যাপক।
কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং। যদি তাহাই বাঙ্গালীর বিশ্বাস, তবে সর্বসময়ে কৃষ্ণরাধনা, কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণকথা ধর্মেরই উন্নতিসাধক। সকল সময়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করার অপেক্ষা মনুষ্যের মঙ্গল আর কি আছে? কিন্তু ইঁহারা ভগবান্কে কি রকম ভাবেন? ভাবেন, ইনি বাল্যে চোর—ননী মাখন চুরি করিয়া খাইতেন; কৈশোরে পারদারিক—অসংখ্য গোপনারীকে পাতিব্রত্যধর্ম হইতে ভ্রষ্ট করিয়াছিলেন; পরিণত বয়সে বঞ্চক ও শঠ-বঞ্চনার দ্বারা দ্রোণাদির প্রাণহরণ করিয়াছিলেন। ভগবচ্চরিত্র কি এইরূপ? যিনি কেবল শুদ্ধসত্ত্ব, যাঁহা হইতে সর্বপ্রকার শুদ্ধি, যাঁহার নামে অশুদ্ধি, অপুণ্য দূর হয়, মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া সমস্ত পাপাচরণ কি সেই ভগবচ্চরিত্রসঙ্গত?
ভগবচ্চরিত্রের এইরূপ কল্পনায় ভারতবর্ষের পাপস্রোত বৃদ্ধি পাইয়াছে, সনাতনধর্মদ্বেষিগণ বলিয়া থাকেন। এবং সে কথার প্রতিবাদ করিয়া জয়শ্রী লাভ করিতেও কখনও কাহাকে দেখি নাই। আমি নিজেও কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান্ বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করি; পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিণাম আমার এই হইয়াছে যে, আমার সে বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হইয়াছে। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের যথার্থ কিরূপ চরিত্র পুরাণেতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা জানিবার জন্য, আমার যতদূর সাধ্য, আমি পুরাণ ইতিহাসের আলোচনা করিয়াছি। তাহার ফল এই পাইয়াছি যে, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় যে সকল পাপোপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত আছে, তাহা সকলই অমূলক বলিয়া জানিতে পারিয়াছি, এবং উপন্যাসকারকৃত কৃষ্ণসম্বন্ধীয় উপন্যাস সকল বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা অতি বিশুদ্ধ, পরমপবিত্র, অতিশয় মহৎ, ইহাও জানিতে পারিয়াছি। জানিয়াছি—ঈদৃশ সর্বগুণান্বিত, সর্বপাপসংস্পর্শশূন্য, আদর্শ চরিত্র আর কোথাও নাই। কোন দেশীয় ইতিহাসেও না, কোন দেশীয় কাব্যেও না।
কি প্রকার বিচারে আমি এরূপ সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছি, তাহা বুঝান এই গ্রন্থের একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু সে কথা ছাড়িয়া দিলেও এই গ্রন্থের বিশেষ প্রয়োজন আছে। আমার নিজের যাহা বিশ্বাস, পাঠককে তাহা গ্রহণ করিতে বলি না, এবং কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব সংস্থাপন করাও আমার উদ্দেশ্য নহে। এ গ্রন্থে আমি তাঁহার কেবল মানবচরিত্রেরই সমালোচনা করিব। তবে এখন হিন্দুধর্মের আলোচনা কিছু প্রবলতা লাভ করিয়াছে। ধর্মান্দোলনের প্রবলতার এই সময়ে কৃষ্ণচরিত্রের সবিস্তারে সমালোচনা প্রয়োজনীয়। যদি পুরাতন বজায় রাখিতে হয়, তবে এখানে বজায় রাখিবার কি আছে না আছে, তাহা দেখিয়া লইতে হয়। আর যদি পুরাতন উঠাইতে হয়, তাহা হইলেও কৃষ্ণচরিত্রের সমালোচনা চাই; কেন না, কৃষ্ণকে না উঠাইয়া দিলে পুরাতন উঠান যাইবে না।
ইহা ভিন্ন আমার এক গুরুতর উদ্দেশ্য আছে। ইতিপূর্বে* “ধর্মতত্ত্ব” নামে গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছি। তাহাতে যে কয়টি কথা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি, সংক্ষেপে তাহা এইঃ—
“১। মনুষ্যের কতকগুলি শক্তি আছে। আমি তাহার বৃত্তি নাম দিয়াছি।
সেইগুলির অনুশীলন, প্রস্ফুরণ ও চরিতার্থতায় মনুষ্যত্ব।
২। তাহাই মনুষ্যের ধর্ম।
৩। সেই অনুশীলনের সীমা, পরস্পরের সহিত বৃত্তিগুলির সামঞ্জস্য।
৪। তাহাই সুখ।”
এক্ষণে আমি স্বীকার করি যে, সমস্ত বৃত্তিগুলির সম্পূর্ণ অনুশীলন, প্রস্ফুরণ, চরিতার্থতা ও সামঞ্জস্য একাধারে দুর্লভ। এ সম্বন্ধে ঐ গ্রন্থেই যাহা বলিয়াছি, তাহাও উদ্ধৃত করিতেছিঃ—
“শিষ্য।…জ্ঞানে পাণ্ডিত্য, বিচারে দক্ষতা, কার্যে তৎপরতা, চিত্তে ধর্মাত্মতা এবং সুরসে রসিকতা, এই সকল হইলে, তবে মানসিক সর্বাঙ্গীণ পরিণতি হইবে। আবার তাহার উপর শারীরিক ক্রিয়ায় সুদক্ষ হওয়া চাই।
* * *
এরূপ আদর্শ কোথায় পাইব? এরূপ মনুষ্য ত দেখি না।
গুরু। মনুষ্য না দেখ, ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বরই সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তির ও চরম পরিণতির একমাত্র উদাহরণ।”
পুনশ্চঃ—
“অনন্তপ্রকৃতি ঈশ্বর উপাসকের প্রথমাবস্থায় তাহার আদর্শ হইতে পারেন না, ইহা সত্য, কিন্তু ঈশ্বরের অনুকারী মনুষ্যেরা, অর্থাৎযাঁহাদিগকেগুণাধিক্যদেখিয়াঈশ্বরাংশবিবেচনাকরাযায়, অথবা যাঁহাদিগের মানবদেহধারী ঈশ্বর মনে করা যায়, তাঁহারাই সেখানে বাঞ্ছনীয় আদর্শ হইতে পারেন। এই জন্য যীশুখৃষ্ট খ্রীষ্টীয়ানের আদর্শ, শাক্যসিংহ বৌদ্ধের আদর্শ। কিন্তু এরূপ ধর্মপরিবর্ধক আদর্শ যেরূপ হিন্দুশাস্ত্রে আছে, এমন আর পৃথিবীর কোন ধর্মপুস্তকে নাই—কোন জাতির মধ্যে প্রসিদ্ধ নাই। জনকাদি রাজর্ষি, নারদাদি দেবর্ষি, বশিষ্ঠাদি ব্রহ্মর্ষি, সকলেই অনুশীলনের চরমাদর্শ। তাহার উপর শ্রীরামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, “অর্জুন, লক্ষ্মণ, দেবব্রত, ভীষ্ম প্রভৃতি ক্ষত্রিয়গণ আরও সম্পূর্ণতা” প্রাপ্ত আদর্শ। খ্রীষ্ট ও শাক্যসিংহ কেবল উদাসীন, কৌপীনধারী নির্মল ধর্মবেত্তা। কিন্তু ইঁহারা তা নয়। ইঁহারা সর্বগুণবিশিষ্ট – ইঁহাদিগেতেই সর্ববৃত্তি, সর্বাঙ্গসম্পন্ন স্ফূর্তি পাইয়াছে। ইঁহারা সিংহাসনে বসিয়াও উদাসীন; কার্মুকহস্তেও ধর্মবেত্তা; রাজা হইয়াও পণ্ডিত; শক্তিমান্ হইয়াও সর্বজনে প্রেমময়। কিন্তু এই সকল আদর্শের উপর হিন্দুর আর এক আদর্শ আছে, যাঁহার কাছে আর সকল আদর্শ খাটো হইয়া যায়— যুধিষ্ঠির যাঁহার কাছে ধর্ম শিক্ষা করেন, স্বয়ং অর্জুন যাঁহার শিষ্য, রাম ও লক্ষ্মণ যাঁহার অংশমাত্র, যাঁহার তুল্য মহামহিমাময় চরিত্র কখন মনুষ্যভাষায় কীর্তিত হয় নাই।”
এই তত্ত্বটা প্রমাণের দ্বারা প্রতিপন্ন করিবার জন্যেও শ্রীকৃষ্ণচরিত্রের ব্যাখ্যানে প্রবৃত্ত হইয়াছি।
—————————
* ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম সংস্করণের পরে এবং এই দ্বিতীয় সংস্করণের পূর্বে প্রচারিত হইয়াছিল।
কৃষ্ণের চরিত্র কিরূপ ছিল, তাহা জানিবার উপায় কি?
আদৌ এখানে দুইটি গুরুতর আপত্তি উপস্থিত হইতে পারে। যাঁহারা দৃঢ় বিশ্বাস করেন যে, কৃষ্ণ ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তাঁহাদের কথা এখন ছাড়িয়া দিই। আমার সকল পাঠক সেরূপ বিশ্বাসযুক্ত নহেন। যাঁহারা সেরূপ বিশ্বাসযুক্ত নহেন, তাহারা বলিবেন, কৃষ্ণচরিত্রের মৌলিকতা কি? কৃষ্ণ নামে কোন ব্যক্তি পৃথিবীতে কখনও বিদ্যমান ছিলেন, তাহার প্রমাণ কি? যদি ছিলেন, তবে তাঁহার চরিত্র যথার্থ কি প্রকার ছিল, তাহা জানিবার কোন উপায় আছে কি?
আমরা প্রথমে এই দুই সন্দেহের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইব।
কৃষ্ণের বৃত্তান্ত নিম্নলিখিত প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়ঃ—
(১) মহাভারত।
(২) হরিবংশ।
(৩) পুরাণ।
ইহার মধ্যে পুরাণ আঠারখানি। সকলগুলিতে কৃষ্ণবৃত্তান্ত নাই। নিম্নলিখিতগুলিতে আছেঃ—
(১) ব্রহ্মপুরাণ।
(২) পদ্মপুরাণ।
(৩) বিষ্ণুপুরাণ।
(৪) বায়ুপুরাণ।
(৫) শ্রীমদ্ভাগবত।
(১০) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
(১৩) স্কন্দপুরাণ।
(১৪) বামনপুরাণ।
(১৫) কূর্মপুরাণ।
মহাভারত, আর উপরিলিখিত অন্য গ্রন্থগুলির মধ্যে কৃষ্ণজীবনী সম্বন্ধে একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। যাহা মহাভারতে আছে, তাহা হরিবংশে ও পুরাণগুলিতে নাই। যাহা হরিবংশ ও পুরাণে আছে, তাহা মহাভারতে নাই। ইহার একটি কারণ এই যে, মহাভারত পাণ্ডবদিগের ইতিহাস; কৃষ্ণ পাণ্ডবদিগের সখা ও সহায়; তিনি পাণ্ডবদিগের সহায় হইয়া বা তাঁহাদের সঙ্গে থাকিয়া যে সকল কার্য করিয়াছেন, তাহাই মহাভারতে আছে, ও থাকিবার কথা। প্রসঙ্গক্রমে অন্য দুই একটা কথা আছে মাত্র। তাঁহার জীবনের অবশিষ্টাংশ মহাভারতে নাই বলিয়াই হরিবংশ রচিত হইয়াছিল, ইহা হরিবংশে আছে। ভাগবতেও ঐরূপ কথা আছে। ব্যাস নারদকে মহাভারতের অসম্পূর্ণতা জানাইলেন। নারদ ব্যাসকে কৃষ্ণচরিত্র রচনার উপদেশ দিলেন। অতএব মহাভারতে যাহা আছে, এই ভাগবতে বা হরিবংশে বা অন্য পুরাণে তাহা নাই; মহাভারতে, যাহা নাই—পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহাই আছে।
অতএব মহাভারত সর্বপূর্ববর্তী। হরিবংশাদি ইহার অভাব পূরণার্থ মাত্র। যাহা সর্বাগ্রে রচিত হইয়াছিল, তাহাই সর্বাপেক্ষা মৌলিক, ইহাই সম্ভব। কথিত আছে যে, মহাভারত, হরিবংশ, এবং অষ্টাদশ পুরাণ একই ব্যক্তি রচিত। সকলই মহর্ষি বেদব্যাসপ্রণীত। এ কথা সত্য কি না, তাহার বিচারে এক্ষণে প্রয়োজন নাই। আগে দেখা যাউক, মহাভারতের কোন ঐতিহাসিকতা আছে কি না। যদি তাহা না থাকে, তবে হরিবংশে ও পুরাণে কোন ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধান বৃথা।
এক্ষণে যে বিচারে প্রবৃত্ত হইব, তাহাতে দুই দিকে দুই ঘোর বিপদ্। এক দিকে, এ দেশীয় প্রাচীন সংস্কার যে, সংস্কৃতভাষায় যে কিছু রচনা আছে, যে কিছুতে অনুস্বার আছে, সকলই অভ্রান্ত ঋষি প্রণীত; সকলই প্রতিবাদ বা সন্দেহের অতীত যে সত্য, তাহাই আমাদিগের কাছে আনিয়া উপস্থিত করে। বেদবিভাগ, লক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত, হরিবংশ, এবং অষ্টাদশ পুরাণ সকল একজনে করিয়াছেন; সকলই কলিযুগের আরম্ভে হইয়াছে; সেও পাঁচহাজার বৎসরহইল; আর এই সকল বেদব্যাস যেমন করিয়াছিলেন, ঠিক তেমনই আছে। অনেক লোকে, এ সংস্কারের প্রতিবাদ শুনা দূরে যাউক, যে প্রতিবাদ করিবে, তাহাকে মহাপাতকী, নারকী এবং দেশের সর্বনাশে প্রস্তুত মনে করেন। এই এক দিকের বিপদ্। আর দিকে গুরুতর বিপদ্, বিলাতী পাণ্ডিত্য। ইউরোপ ও আমেরিকার কতকগুলি পণ্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহারা প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে ঐতিহাসিক তত্ত্ব উদ্ভূত করিতে নিযুক্ত, কিন্তু তাহাদের এ কথা অসহ্য যে, পরাধীন দুর্বল হিন্দুজাতি, কোন কালে সভ্য ছিল, এবং সেই সভ্যতা অতি প্রাচীন। অতএব দুই চারি জন ভিন্ন তাহারা সচরাচর প্রাচীন ভারতবর্ষের গৌরব খর্ব করিতে নিযুক্ত। তাঁহারা যত্নপূর্বক ইহাই প্রমাণ করিতে চাহেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয় গ্রন্থ সকলে যাহা কিছু আছে—হিন্দুধর্মবিরোধী বৌদ্ধগ্রন্থ ছাড়া—সকলই আধুনিক, আর হিন্দুগ্রন্থে যাহাই আছে, তাহা হয় সম্পূর্ণ মিথ্যা, নয় অন্য দেশ হইতে চুরি করা। কোন মহাত্মা বলেন, রামায়ণ হোমরের কাব্যের অনুকরণ; কেহ বা বলেন, ভগবদ্গীতা বাইবেলের ছায়ামাত্র। হিন্দুর জ্যোতিষ চীন, যবন বা কাল্ডিয় হইতে প্রাপ্ত; হিন্দুর গণিতও পরের কাছে পাওয়া; লিখিত অক্ষরও কোন সীমীয় জাতীয় হইতে প্রাপ্ত। এ সকল কথা প্রতিপন্ন করিবার জন্য তাঁহাদের বিচারপ্রণালীর মূল সূত্র এই যে, ভারতবর্ষীয় গ্রন্থে ভারতপক্ষে যাহা পাওয়া যায়, তাহা মিথ্যা বা প্রক্ষিপ্ত, যাহা ভারতবর্ষের বিপক্ষে পাওয়া যায়, তাহাই সত্য। পাণ্ডবদিগের ন্যায় বীরচরিত্র ভারতবর্ষীয় পুরুষের কথা মিথ্যা, পাণ্ডব কবিকল্পনা মাত্র, কিন্তু পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর পঞ্চ পতি সত্য, কেন না, তদ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, প্রাচীন ভারতবাসীয়েরা চূয়াড় জাতি ছিল, তাহাদিগের মধ্যে স্ত্রীলোকদিগের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। ফর্গুসন্ সাহেব অট্টালিকার ভগ্নাবশেষে কতকগুলা বিবস্ত্রা স্ত্রীমূর্তি দেখিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে স্ত্রীলোকেরা কাপড় পরিত না; এদিকে মথুরা প্রভৃতি স্থানের অপূর্ব ভাস্কর্য দেখিয়া বিলাতী পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, এ শিল্প গ্রীক্ মিস্ত্রীর। বেবর (Weber) সাহেব, কোন মতে হিন্দুদিগের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাচীনতা উড়াইয়া দিতে না পারিয়া স্থির করিলেন, হিন্দুরা চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল বাবিলনীয়দিগের নিকট হইতে পাইয়াছে। বাবিলনীয়দিগের যে চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল আদৌ কখনও ছিল না, তাহা চাপিয়া গেলেন। প্রমাণের অভাবেও Whitney সাহেব বলিলেন, তাহা হইতে পারে, কেন না, হিন্দুদের মানসিক স্বভাব তেমন তেজস্বী নয় যে, তাহার নিজবুদ্ধিতে এত করে।
এই সকল মহাপুরুষগণের মতের সমালোচনায় আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। কেন না, আমি স্বদেশীয় পাঠকের জন্য লিখি, হিন্দুদ্বেষীদিগের জন্য লিখি না। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, আমার স্বদেশীয় শিক্ষিতসম্প্রদায়মধ্যে অনেকে তাঁহাদের মতের অনুবর্তী। অনেকেই নিজে কিছু বিচার আচার না করিয়াই, কেবল ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের মত বলিয়াই, সেই সকল মতের অনুবর্তী। আমার দুরাকাঙ্ক্ষা যে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও কেহ কেহ এই গ্রন্থ পাঠ করেন। তাই, আমি ইউরোপীয় মতেরও প্রতিবাদে প্রবৃত্ত। যাঁহাদের কাছে বিলাতী সবাই ভাল, যাঁহারা ইস্তক বিলাতী পণ্ডিত, লাগায়েৎবিলাতীকুকুর, সকলেরই সেবা করেন, দেশী গ্রন্থ পড়া দূরে থাক, দেশী ভিখারীকেও ভিক্ষা দেন না, তাঁহাদের আমি কিছু করিতে পারিব না। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই সত্যপ্রিয় এবং দেশবৎসল।তাঁহাদেরজন্যলিখিব।
মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি;—
১ম,—এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনাই করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তাহা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করিয়া বলিবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,—এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করিবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই ইহার উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,—আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ—বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করিয়াছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁহাকে পুরাণসংহিতা দান করিলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তাহার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হইতে তিনখানি সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই।
এক্ষণে ইউরোপীয়দিগের যে সাধারণ ভ্রম, তাহার বিষয়ে কিছু বলা যাউক। ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
* ভাগবতের বক্তা ব্যাসপুত্র শুকদেব। “বৈশম্পায়নহারীতৌ” ইতি পাঠান্তরও আছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
“রথন্তরস্য কল্পস্য বৃত্তান্তমধিকৃত্য যৎ।
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
অর্থাৎ যে পুরাণে রথন্তর কল্পবৃত্তান্তাধিকৃত কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুক্ত কথা নারদকে সাবর্ণি বলিতেছেন এবং যাহাতে পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মবরাহচরিত কথিত হইয়াছে, সেই অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকসংযুক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
এক্ষণে যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ প্রচলিত আছে, তাহা সাবর্ণি নারদকে বলিতেছেন না। নারায়ণ নামে অন্য ঋষি নারদকে বলিতেছেন। তাহাতে রথন্তরকল্পের প্রসঙ্গমাত্র নাই, এবং ব্রাহ্মবরাহচরিতের প্রসঙ্গমাত্র নাই। এখনকার প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তে প্রকৃতিখণ্ড ও গণেশখণ্ড আছে। যাহার কোন প্রসঙ্গ দুই শ্লোকে নাই। অতএব প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এক্ষণে আর বিদ্যমান নাই। যাহা ব্রহ্মবৈবর্ত নামে চলিত আছে, তাহা নূতন গ্রন্থ। তাহা দেখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-সঙ্কলন-সময় নিরূপণ করা অপূর্ব রহস্য বলিয়াই বোধ হয়।
উইল্সন সাহেব পুরাণ সকলের এইরূপ প্রণয়নকাল নিরূপিত করিয়াছেন:—
ব্রহ্মপুরাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দী।
পদ্মপুরাণ ,, ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।*
বিষ্ণুপুরাণ ,, দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ ,, ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ ,, নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ ,, অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ ,, দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
* তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
পাঠক দেখিবেন, ইঁহার মতে (এই মতই প্রচলিত) কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, বোধ হয়, ইংরাজি পড়িয়া যাঁহার নিতান্ত বুদ্ধিবিপর্যয় না ঘটিয়াছে, তিনি ভিন্ন এমন কোন হিন্দুই নাই, যিনি এই সময়নির্ধারণ উপযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। দুই একটা কথার দ্বারাই ইহার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাইতে পারে।
এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক লোক এবং বিক্রমাদিত্য খ্রীঃ পূঃ ৫৬ বৎসরে জীবিত ছিলেন। কিন্তু সে সকল কথা এখন উড়িয়া গিয়াছে। ডাক্তার ভাও দাজি স্থির করিয়াছেন যে, কালিদাস খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এখন ইউরোপ শুদ্ধ এবং ইউরোপীয়দিগের দেশী শিষ্যগণ সকলে উচ্চৈঃস্বরে সেই ডাক ডাকিতেছেন। আমরাও এ মত অগ্রাহ্য করি না। অতএব কালিদাস ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক হউন। সকল পুরাণই তাঁহার অনেক পরে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাই উইল্সন্ সাহেবের উপরিলিখিত বিচারে স্থির হইয়াছে। কিন্তু কালিদাস মেঘদূতে লিখিয়াছেন—
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ nbsp; শ্লোক।
যে পাঠক সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাকে শেষ ছত্রের অর্থ বুঝাইলেই হইবে। ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা উজ্জ্বল বিষ্ণুর গোপবেশের সহিত ইন্দ্রধনুশোভিত মেঘের উপমা হইতেছে। এখন, বিষ্ণুর গোপবেশ নাই, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের গোপবেশ ছিল। ইন্দ্রধনুর সঙ্গে উপমেয় কৃষ্ণচূড়াস্থিত ময়ূরপুচ্ছ। আমি বিনীতভাবে ইউরোপীয় মহামহোপাধ্যায়দিগের নিকট নিবেদন করিতেছি, যদি ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে কোন পুরাণই ছিল না, তবে কৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছচূড়ার কথা আসিল কোথা হইতে? এ কথা কি বেদে আছে, না মহাভারতে আছে, না রামায়ণে আছে?—কোথাও না। পুরাণ বা তদনুবর্তী গীতগোবিন্দাদি কাব্য ভিন্ন আর কোথাও নাই। আছে, হরিবংশে বটে; কিন্তু হরিবংশও ত উইল্সন্ সাহেবের মতে বিষ্ণুপুরাণেরও পরবর্তী। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, কালিদাসের পূর্বে অর্থাৎ অন্ততঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে হরিবংশ অথবা কোন বৈষ্ণব পুরাণ প্রচলিত ছিল।
আর একটা কথা বলিয়াই এ বিষয়ের উপসংহার করিব। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রচলিত, তাহা প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত না হইলেও, অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর অপেক্ষাও প্রাচীন গ্রন্থ। কেন না, গীতগোবিন্দকার জয়দেব-গোস্বামী গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেনের সভাপণ্ডিত। লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমাংশের লোক। ইহা বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রমাণীকৃত, এবং ইংরেজদিগের দ্বারাও স্বীকৃত। আমরা পরে দেখাইব যে, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তখন চলিত ও অতিশয় সম্মানিত না থাকিলে, গীতগোবিন্দ লিখিত হইত না, এবং বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায় তখন প্রচলিত না থাকিলে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক “মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্” ইত্যাদি কখনও রচিত হইত না। অতএব এই ভ্রষ্ট ব্রহ্মবৈবর্তও একাদশ শতাব্দীর পূর্বগামী। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত না জানি আরও কত কালের। অথচ উইল্সন্ সাহেবের বিবেচনায় ইহা দুই শত মাত্র বৎসরের গ্রন্থ হইতে পারে।
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি;—
১ম,—এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনাই করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তাহা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করিয়া বলিবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,—এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করিবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই ইহার উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,—আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ—বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করিয়াছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁহাকে পুরাণসংহিতা দান করিলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তাহার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হইতে তিনখানি সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই।
এক্ষণে ইউরোপীয়দিগের যে সাধারণ ভ্রম, তাহার বিষয়ে কিছু বলা যাউক। ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
* ভাগবতের বক্তা ব্যাসপুত্র শুকদেব। “বৈশম্পায়নহারীতৌ” ইতি পাঠান্তরও আছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
“রথন্তরস্য কল্পস্য বৃত্তান্তমধিকৃত্য যৎ।
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
অর্থাৎ যে পুরাণে রথন্তর কল্পবৃত্তান্তাধিকৃত কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুক্ত কথা নারদকে সাবর্ণি বলিতেছেন এবং যাহাতে পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মবরাহচরিত কথিত হইয়াছে, সেই অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকসংযুক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
এক্ষণে যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ প্রচলিত আছে, তাহা সাবর্ণি নারদকে বলিতেছেন না। নারায়ণ নামে অন্য ঋষি নারদকে বলিতেছেন। তাহাতে রথন্তরকল্পের প্রসঙ্গমাত্র নাই, এবং ব্রাহ্মবরাহচরিতের প্রসঙ্গমাত্র নাই। এখনকার প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তে প্রকৃতিখণ্ড ও গণেশখণ্ড আছে। যাহার কোন প্রসঙ্গ দুই শ্লোকে নাই। অতএব প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এক্ষণে আর বিদ্যমান নাই। যাহা ব্রহ্মবৈবর্ত নামে চলিত আছে, তাহা নূতন গ্রন্থ। তাহা দেখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-সঙ্কলন-সময় নিরূপণ করা অপূর্ব রহস্য বলিয়াই বোধ হয়।
উইল্সন সাহেব পুরাণ সকলের এইরূপ প্রণয়নকাল নিরূপিত করিয়াছেন:—
ব্রহ্মপুরাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দী।
পদ্মপুরাণ ,, ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।*
বিষ্ণুপুরাণ ,, দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ ,, ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ ,, নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ ,, অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ ,, দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
* তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
পাঠক দেখিবেন, ইঁহার মতে (এই মতই প্রচলিত) কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, বোধ হয়, ইংরাজি পড়িয়া যাঁহার নিতান্ত বুদ্ধিবিপর্যয় না ঘটিয়াছে, তিনি ভিন্ন এমন কোন হিন্দুই নাই, যিনি এই সময়নির্ধারণ উপযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। দুই একটা কথার দ্বারাই ইহার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাইতে পারে।
এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক লোক এবং বিক্রমাদিত্য খ্রীঃ পূঃ ৫৬ বৎসরে জীবিত ছিলেন। কিন্তু সে সকল কথা এখন উড়িয়া গিয়াছে। ডাক্তার ভাও দাজি স্থির করিয়াছেন যে, কালিদাস খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এখন ইউরোপ শুদ্ধ এবং ইউরোপীয়দিগের দেশী শিষ্যগণ সকলে উচ্চৈঃস্বরে সেই ডাক ডাকিতেছেন। আমরাও এ মত অগ্রাহ্য করি না। অতএব কালিদাস ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক হউন। সকল পুরাণই তাঁহার অনেক পরে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাই উইল্সন্ সাহেবের উপরিলিখিত বিচারে স্থির হইয়াছে। কিন্তু কালিদাস মেঘদূতে লিখিয়াছেন—
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ nbsp; শ্লোক।
যে পাঠক সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাকে শেষ ছত্রের অর্থ বুঝাইলেই হইবে। ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা উজ্জ্বল বিষ্ণুর গোপবেশের সহিত ইন্দ্রধনুশোভিত মেঘের উপমা হইতেছে। এখন, বিষ্ণুর গোপবেশ নাই, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের গোপবেশ ছিল। ইন্দ্রধনুর সঙ্গে উপমেয় কৃষ্ণচূড়াস্থিত ময়ূরপুচ্ছ। আমি বিনীতভাবে ইউরোপীয় মহামহোপাধ্যায়দিগের নিকট নিবেদন করিতেছি, যদি ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে কোন পুরাণই ছিল না, তবে কৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছচূড়ার কথা আসিল কোথা হইতে? এ কথা কি বেদে আছে, না মহাভারতে আছে, না রামায়ণে আছে?—কোথাও না। পুরাণ বা তদনুবর্তী গীতগোবিন্দাদি কাব্য ভিন্ন আর কোথাও নাই। আছে, হরিবংশে বটে; কিন্তু হরিবংশও ত উইল্সন্ সাহেবের মতে বিষ্ণুপুরাণেরও পরবর্তী। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, কালিদাসের পূর্বে অর্থাৎ অন্ততঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে হরিবংশ অথবা কোন বৈষ্ণব পুরাণ প্রচলিত ছিল।
আর একটা কথা বলিয়াই এ বিষয়ের উপসংহার করিব। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রচলিত, তাহা প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত না হইলেও, অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর অপেক্ষাও প্রাচীন গ্রন্থ। কেন না, গীতগোবিন্দকার জয়দেব-গোস্বামী গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেনের সভাপণ্ডিত। লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমাংশের লোক। ইহা বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রমাণীকৃত, এবং ইংরেজদিগের দ্বারাও স্বীকৃত। আমরা পরে দেখাইব যে, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তখন চলিত ও অতিশয় সম্মানিত না থাকিলে, গীতগোবিন্দ লিখিত হইত না, এবং বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায় তখন প্রচলিত না থাকিলে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক “মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্” ইত্যাদি কখনও রচিত হইত না। অতএব এই ভ্রষ্ট ব্রহ্মবৈবর্তও একাদশ শতাব্দীর পূর্বগামী। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত না জানি আরও কত কালের। অথচ উইল্সন্ সাহেবের বিবেচনায় ইহা দুই শত মাত্র বৎসরের গ্রন্থ হইতে পারে।
১ম খণ্ড (উপক্রমণিকা) |
তৃতীয় পরিচ্ছেদ—মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
বলিয়াছি যে, কৃষ্ণচরিত্র যে সকল গ্রন্থে পাওয়া যায়, মহাভারত তাহার মধ্যে সর্বপূর্ববর্তী। কিন্তু মহাভারতের উপর কি নির্ভর করা যায়? মহাভারতের ঐতিহাসিকতা কিছু আছে কি? মহাভারতকে ইতিহাস বলে, কিন্তু ইতিহাস বলিলে কি History ই বুঝাইল? ইতিহাস কাহাকে বলে? এখনকার দিনে শৃগাল কুক্কুরের গল্প লিখিয়াও লোকে তাহাকে “ইতিহাস” নাম দিয়া থাকে। কিন্তু বস্তুতঃ যাহাতে পুরাবৃত্ত, অর্থাৎপূর্বেযাহাঘটিয়াছে, তাহার আবৃত্তি আছে, তাহা ভিন্ন আর কিছুকেই ইতিহাস বলা যাইতে পারে না—
“ধর্মার্থকামমোক্ষাণামুপদেশসমন্বিতম্।
পূর্ববৃত্তকথাযুক্তমিতিহাসং প্রচক্ষতে ||”
এখন, ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থ সকলের মধ্যে কেবল মহাভারতই অথবা কেবল মহাভারত ও রামায়ণ ইতিহাস নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। যেখানে মহাভারত ইতিহাস পদে বাচ্য, যখন অন্ততঃ রামায়ণ ভিন্ন আর কোন গ্রন্থই এই নাম প্রাপ্ত হয় নাই, তখন বিবেচনা করিতে হইবে যে, ইহার বিশেষ ঐতিহাসিকতা আছে বলিয়াই এরূপ হইয়াছে।
সত্য বটে যে, মহাভারতে এমন বিস্তর কথা আছে যে, তাহা স্পষ্টতঃ অলীক, অসম্ভব, অনৈতিহাসিক। সেই সকল কথাগুলি অলীক অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু যে অংশে এমন কিছুই নাই যে, তাহা হইতে ঐ অংশ অলীক বা অনৈতিহাসিক বিবেচনা করা যায়, সে অংশগুলি অনৈতিহাসিক বলিয়া কেন পরিত্যাগ করিব? সকল জাতির মধ্যে, প্রাচীন ইতিহাসে এইরূপ ঐতিহাসিকে ও অনৈতিহাসিকে, সত্যে ও মিথ্যায়, মিশিয়া গিয়াছে। রোমক ইতিহাসবেত্তা লিবি প্রভৃতি, যবন ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটস্ প্রভৃতি, মুসলমান ইতিহাসবেত্তা ফেরেশ্তা প্রভৃতি এইরূপ ঐতিহাসিক বৃত্তান্তের সঙ্গে অনৈসর্গিক এবং অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত মিশাইয়াছেন। তাঁহাদিগের গ্রন্থ সকল ইতিহাস বলিয়া গৃহীত হইয়া থাকে—মহাভারতই অনৈতিহাসিক বলিয়া একেবারে পরিত্যক্ত হইবে কেন?
আমি জানি যে, আধুনিক ইউরোপীয়েরা এই সকল ইতিহাসবেত্তাদিগকে (Livy, Herodotus প্রভৃতিকে) আদর করেন না। কিন্তু তাঁহারা এমন বলেন না যে, ইঁহাদের গ্রন্থ অনৈসর্গিক ব্যাপারে পরিপূর্ণ, এই জন্যই ইঁহারা পরিত্যাজ্য। তাঁহারা বলেন যে, ইঁহারা যে সকল সময়ের ইতিহাস লিখিয়াছেন, সে সকল সময়ে ইঁহারা নিজেও বর্তমান ছিলেন না, কোন সমসাময়িক লেখকেরও সাহায্য পান নাই; অতএব তাঁহাদের গ্রন্থের উপর, প্রকৃত ইতিহাস বলিয়া নির্ভর করা যায় না। এ কথা যথার্থ, কিন্তু লিবি বা হেরোডোটাস অপেক্ষা মহাভারতের সমসাময়িকতা সম্বন্ধে দাবি দাওয়া কিছু বেশী, তাহা এই গ্রন্থে সময়ান্তরে প্রমাণীকৃত হইবে। এই পর্যন্ত এখন বলিতে ইচ্ছা করি যে, আধুনিক ইউরোপীয় সমালোচকেরা যাহাই বলুন, প্রাচীন রোমক বা গ্রীক্ লিপি বা হেরোডোটসের গ্রন্থকে কখন অনৈতিহাসিক বলিতেন না। পক্ষান্তরে এমন দিনও উপস্থিত হইতে পারে যে Giffon বা Froude অসমসাময়িক বলিয়া পরিত্যক্ত হইবেন। আর আধুনিক সমালোচকের দল যাই বলুন, লিবি বা হেরোডোটস্কে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া রোম বা গ্রীসের কোন ইতিহাস আজিও লিখিত হয় না।
পাঠক মনে রাখিবেন যে, অনৈসর্গিকতার বাহুল্যঘটিত যে দোষ, তাহারই বিচার হইতেছে। এ বিষয়ে ইউরোপীয়দিগের পদচিহ্নানুসরণই যদি বিদ্যাবুদ্ধির পরাকাষ্ঠার পরিচয় হয়, তবে আমরা এখানে সে গৌরবে বঞ্চিত নহি। তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, ভারতবর্ষের পূর্বতন অবস্থা জানিবার জন্য দেশীয় গ্রন্থ সকল হইতে কোন সাহায্য পাওয়া যায় না, কেন না, সে সকল অতিশয় অবিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু গ্রীক্ লেখক Megasthenes এবং Ktesias এ বিষয়ে অতিশয় বিশ্বাসযোগ্য,—সে জন্য ইঁহারাই সে বিষয় ইউরোপীয় লেখকদিগের অবলম্বন। কিন্তু এই লেখকদিগের ক্ষুদ্র গ্রন্থগুলিতে যে রাশি রাশি অদ্ভুত, অলীক, অনৈসর্গিক উপন্যাস পাওয়া যায়, তাহা মহাভারতের লক্ষ শ্লোকের ভিতরও পাওয়া যায় না। এ গ্রন্থগুলি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস, আর মহাভারত অবিশ্বাসযোগ্য কাব্য!! কি অপরাধে?
এখন ইহাও স্বীকার করা যাউক যে, ঐ সকল ভিন্নদেশীয় ইতিহাসগ্রন্থের অপেক্ষা মহাভারতে অনৈসর্গিক ঘটনার বাহুল্য অধিক। তাহাতেও, যেটুকু নৈসর্গিক ও সম্ভব ব্যাপারের ইতিবৃত্ত সেটুকু গ্রহণ করিবার কোন আপত্তি দেখা যায় না। মহাভারতে যে অন্য দেশের প্রাচীন ইতিহাসের অপেক্ষা কিছু বেশী কাল্পনিক ব্যাপারের বাহুল্য আছে, তাহার বিশেষ কারণও আছে। ইতিহাসগ্রন্থে দুই কারণে অনৈসর্গিক বা মিথ্যা ঘটনা সকল স্থান পায়। প্রথম, লেখক জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া, সেই সকলকে সত্য বিবেচনা করিয়া তাহা গ্রন্থভুক্ত করেন। দ্বিতীয়, তাঁহার গ্রন্থ প্রচারের পর, পরবর্তী লেখকেরা আপনাদিগের রচনা পূর্ববর্তী লেখকের রচনামধ্যে প্রক্ষিপ্ত করে। প্রথম কারণে সকল দেশের প্রাচীন ইতিহাস কাল্পনিক ব্যাপারের সংস্পর্শে দূষিত হইয়াছে—মহাভারতেও সেইরূপ ঘটিয়া থাকিবে।
কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি অন্য দেশের ইতিহাসগ্রন্থে সেরূপ প্রবলতা প্রাপ্ত হয় নাই—মহাভারতকেই বিশেষ প্রকারে অধিকার করিয়াছে। তাহার তিনটি কারণ আছে।
প্রথম কারণ এই যে, অন্যান্য দেশে যখন ঐ সকল প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণীত হয়, তখন প্রায়ই সে সকল দেশে গ্রন্থ সকল লিখিত করিবার প্রথা চলিয়াছে। গ্রন্থ লিখিতে হইলে, তাহাতে পরবর্তী লেখকেরা স্বীয় রচনা প্রক্ষিপ্ত করিবার বড় সুবিধা পান না—লিখিত গ্রন্থে প্রক্ষিপ্ত রচনা শীঘ্র ধরা পড়ে। কেন না, প্রাচীন একখানা কাপির দ্বারা অন্য কাপির শুদ্ধাশুদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষে গ্রন্থ সকল প্রণীত হইয়া মুখে মুখে প্রচারিত হইত, লিপিবিদ্যা প্রচলিত হইলে পরেও গ্রন্থ সকল পূর্বপ্রথানুসারে গুরু-শিষ্য-পরম্পরা মুখে মুখেই প্রচারিত হইত। তাহাতে প্রক্ষিপ্ত রচনা প্রবেশ করিবার বিশেষ সুবিধা ঘটিয়াছিল।
দ্বিতীয় কারণ এই যে, রোম, গ্রীস বা অন্য কোন দেশে কোন ইতিহাসগ্রন্থ, মহাভারতের ন্যায় জনসমাজে আদর বা গৌরব প্রাপ্ত হয় নাই। সুতরাং ভারতবর্ষীয় লেখকদিগের পক্ষে মহাভারতে স্বীয় রচনা প্রক্ষিপ্ত করিবার যে লোভ ছিল, অন্য কোন দেশীয় লেখকদিগের সেরূপ ঘটে নাই।
তৃতীয় কারণ এই যে, অন্য দেশের লেখকেরা আপনার যশ বা তাদৃশ অন্য কোন কামনার বশীভূত হইয়া গ্রন্থ প্রণয়ন করিতেন। কাজেই আপনার নামে আপনার রচনা প্রচার করাই তাঁহাদিগের উদ্দেশ্য ছিল, পরের রচনার মধ্যে আপনার রচনা ডুবাইয়া দিয়া আপনার নাম লোপ করিবার অভিপ্রায় তাঁহাদিগের কখনও ঘটিত না। কিন্তু ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণেরা নিঃস্বার্থ ও নিষ্কাম হইয়া রচনা করিতেন। লোকহিত ভিন্ন আপনাদিগের যশ তাঁহাদিগের অভিপ্রেত ছিল না। অনেক গ্রন্থে তৎপ্রণেতারনামমাত্রনাই।অনেকশ্রেষ্ঠগ্রন্থএমনআছেযে, কে তাহার প্রণেতা, তাহা আজি পর্যন্ত কেহ জানে না। ঈদৃশ নিষ্কাম লেখক, যাহাতে মহাভারতের ন্যায় লোকায়ত গ্রন্থের সাহায্যে তাঁহার রচনা লোকমধ্যে বিশেষ প্রকারে প্রচারিত হইয়া লোকহিত সাধন করে, সেই চেষ্টায় আপনার রচনা সকল তাদৃশ গ্রন্থে প্রক্ষিপ্ত করিতেন।
এই সকল কারণে মহাভারতে কাল্পনিক বৃত্তান্তের বিশেষ বাহুল্য ঘটিয়াছে। কিন্তু কাল্পনিক বৃত্তান্তের বাহুল্য আছে বলিয়া এই প্রসিদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থে যে কিছুই ঐতিহাসিক কথা নাই, ইহা বলা নিতান্ত অসঙ্গত।
মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
চতুর্থ পরিচ্ছেদ—মহাভারতের ঐতিহাসিকতা
ইউরোপীয়দিগের মত
অসঙ্গতই হউক আর সঙ্গতই হউক, মহাভারতের ঐতিহাসিকতা অস্বীকার করেন, এমন অনেক আছেন। বলা বাহুল্য যে, ইঁহারা ইউরোপীয় পণ্ডিত, অথবা তাঁহাদিগের শিষ্য। তাঁহাদিগের মতের সংক্ষেপতঃ উল্লেখ করিব।
বিলাতী বিদ্যার একটা লক্ষণ এই যে, তাঁহারা স্বদেশে যাহা দেখেন, মনে করেন বিদেশে ঠিক তাই আছে। তাঁহারা Moor ভিন্ন অগৌরবর্ণ কোন জাতি জানিতেন না, এজন্য এদেশে আসিয়া হিন্দুদিগকে “Moor” বলিতে লাগিলেন। সেইরূপ স্বদেশে Epic কাব্য ভিন্ন পদ্যে রচিত আখ্যানগ্রন্থ দেখেন নাই, সুতরাং ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা মহাভারত ও রামায়ণের সন্ধান পাইয়াই ঐ দুই গ্রন্থ Epic কাব্য বলিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন। যদি কাব্য, তবে আর উহার ঐতিহাসিকতা কিছু রহিল না, সব এক কথায় ভাসিয়া গেল।
ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা এ বোল কিয়ৎপরিমাণেছাড়িয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদের দেশী শিষ্যেরা ছাড়েন নাই।
কেন, মহাভারতকে সাহেবরা কাব্যগ্রন্থ বলেন, তাহা তাঁহারা ঠিক বুঝান নাই। উহা পদ্যে রচিত বলিয়া এরূপ বলা হয়, এমত হইতে পারে না, কেন না, সর্বপ্রকার সংস্কৃত গ্রন্থই পদ্যে রচিত;—বিজ্ঞান, দর্শন, অভিধান, জ্যোতিষ, চিকিৎসাশাস্ত্র, সকলই পদ্যে প্রণীত হইয়াছে। তবে এমন হইতে পারে, মহাভারতে কাব্যাংশ বড় সুন্দর;—ইউরোপীয়েরা যে প্রকার সৌন্দর্য Epic কাব্যের লক্ষণ বলিয়া নির্দেশ করেন, সেই জাতীয় সৌন্দর্য উহাতে বহুল পরিমাণে আছে বলিয়া, উহাকে Epic বলেন। কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে ঐ জাতীয় সৌন্দর্য অনেক ইউরোপীয় মৌলিক ইতিহাসেও আছে। ইংরেজের মধ্যে মেকলে, কার্লাইল্ ও ফ্রুদের গ্রন্থে, ফরাসীদিগের মধ্যে লামার্তীন্ ও মিশালার গ্রন্থে, গ্রীকদিগের মধ্যে থুকিদিদিসের গ্রন্থে, এবং অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থে আছে। মানব-চরিত্রই কাব্যের শ্রেষ্ঠ উপাদান; ইতিহাসবেত্তাও মনুষ্যচরিত্রের বর্ণন করেন; ভাল করিয়া তিনি যদি আপনার কার্য সাধন করিতে পারেন, তবে কাজেই তাঁহার ইতিহাসে কাব্যের সৌন্দর্য আসিয়া উপস্থিত হইবে। সৌন্দর্যহেতু ঐ সকল গ্রন্থ অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যক্ত হয় নাই—মহাভারতও হইতে পারে না। মহাভারতে যে সে সৌন্দর্য অধিক পরিমাণে ঘটিয়াছে, তাহার বিশেষ কারণও আছে।
মূর্খের মতের বিশেষ আন্দোলনের প্রয়োজন নাই। কিন্তু পণ্ডিতে যদি মূর্খের মত কথা কয়, তাহা হইলে কি কর্তব্য? বিখ্যাত Weber সাহেব পণ্ডিত বটে, কিন্তু আমার বিবেচনায় তিনি যে ক্ষণে সংস্কৃত শিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, ভারতবর্ষের পক্ষে সে অতি অশুভক্ষণ। ভারতবর্ষের প্রাচীন গৌরব সেদিনকার জর্মনির অরণ্যনিবাসী বর্বরদিগের বংশধরের পক্ষে অসহ্য। অতএব প্রাচীন ভারতবর্ষের সভ্যতা অতি আধুনিক, ইহা প্রমাণ করিতে তিনি সর্বদা যত্নশীল। তাঁহার বিবেচনায় যিশুখ্রীষ্টের জন্মের পূর্বে যে মহাভারত ছিল, এমন বিবেচনা করিবার মুখ্য প্রমাণ কিছু নাই। এতটুকু প্রাচীনতার কথা স্বীকার করিবারও একমাত্র কারণ এই যে, Chrysostom নামা একজন ইউরোপীয় ভারতবর্ষে আসিয়া দাঁড়ী-মাঝির মুখে মহাভারতের কথা শুনিয়া গিয়াছিলেন। পাণিনির সূত্রে মহাভারত শব্দও আছে, যুধিষ্ঠিরাদিরও নাম আছে। কিন্তু তাহাতে তাঁহার বিশ্বাস হয় না, কেন না, পাণিনিও তাঁহার মতে “কালকের ছেলে”। তবে একজন ইউরোপীয়ের পবিত্র কর্ণরন্ধ্রে প্রবিষ্ট নাবিকবাক্যের কোন প্রকার অবহেলা করিতে তিনি সক্ষম নহেন। অতএব মহাভারত যে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ছিল ইহা তিনি কায়ক্লেশে স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু আর একজন ইউরোপীয় লেখক (Megasthenes) যিনি খ্রীষ্ট-পূর্ব তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দীর লোক, এবং ভারতবর্ষে আসিয়া চন্দ্রগুপ্তের রাজধানীতে বাস করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার গ্রন্থে মহাভারতের কথা লেখেন নাই। কাজেই বেবর সাহেবের বিবেচনায় তাঁহার সময় মহাভারত ছিল না।* এখানে জর্মান পণ্ডিতটি জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছাপূর্বক জুয়াচুরি করিয়াছেন। কেন না, তিনি বেশ জানেন যে, মিগাস্থেনিসের ভারতসম্বন্ধীয় গ্রন্থ বিদ্যমান নাই, কেবল গ্রন্থকার তাহা হইতে যে সকল অংশ তাঁহাদিগের নিজ নিজ পুস্তকে উদ্ধৃত করিয়াছিলেন, তাহাই সঙ্কলনপূর্বক ডাক্তার শ্বান্বেক (Dr. Schwanbeck) নামক একজন আধুনিক পণ্ডিত একখানি গ্রন্থ প্রস্তুত করিয়াছেন; তাহাই এখন মেগাস্থেনিসকৃত ভারতবৃত্তান্ত বলিয়া প্রচলিত। তাঁহার গ্রন্থের অধিকাংশ বিলুপ্ত; সুতরাং তিনি মহাভারতের কথা বলিয়াছিলেন কি না বলা যায় না। ইহা জানিয়া শুনিয়াও কেবল ভারতবর্ষের প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধিবশতঃ বেবর সাহেব এরূপ কথা লিখিয়াছেন। তাঁহার প্রণীত ভারত-সাহিত্যের ইতিবৃত্ত-বিষয়ক গ্রন্থে আদ্যোপান্ত ভারতবর্ষের গৌরব লাঘবের চেষ্টা ভিন্ন, অন্য কোন উদ্দেশ্য দেখা যায় না। ইহার পর বলা বাহুল্য যে, মিগাস্থেনিস্ মহাভারতের নাম করেন নাই, ইহা হইতেই এমন বুঝায় না যে, তাঁহার সময়ে মহাভারত ছিল না। অনেক হিন্দু জর্মানি বেড়াইয়া আসিয়াছেন, গ্রন্থও লিখিয়াছেন, তাঁহাদের কাহারও গ্রন্থে ত বেবর সাহেবের নাম দেখিলাম না। সিদ্ধান্ত করিতে হইবে কি যে, বেবর সাহেব কখনও ছিলেন না?
অন্যান্য পণ্ডিতেরা, বেবরসাহেবের মত, সব উঠাইয়া দিতে চাহেন না। তাঁহারা যে আপত্তি করেন, তাহা দুই প্রকারঃ—
(১) মহাভারত প্রাচীন গ্রন্থ বটে, কিন্তু খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ কি পঞ্চম শতাব্দীতে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার পূর্বে এরূপ গ্রন্থ ছিল না।
(২) আদিম মহাভারতে পাণ্ডবদিগের কোন কথা ছিল না। পাণ্ডব ও কৃষ্ণ প্রভৃতি কবিকল্পনা মাত্র।
দেশী মত আবার বিপরীত সীমান্তে গিয়াছে। দেশীয়েরা বলেন, কলির আরম্ভের ঠিক পূর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হইয়াছিল। সে সময় বেদব্যাস বর্তমান ছিলেন। কলির প্রবৃত্তিমাত্রে পাণ্ডবেরা স্বর্গারোহণ করেন। অতএব কলির আরম্ভেই অর্থাৎঅদ্যহইতে৪,৯৯২ বৎসরপূর্বে, মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল।
দুটি মতই ঘোরতর ভ্রমপরিপূর্ণ। দুই দলের মতেরই খণ্ডন আবশ্যক। তজ্জন্য প্রথম প্রয়োজনীয় তত্ত্ব এই যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কবে হইয়াছিল, ইহার নির্ণয়। তাহা নির্ণীত হইলেই কতক বুঝিতে পারিব, মহাভারত কবে প্রণীত হইয়াছিল, এবং পাণ্ডবাদি কবিকল্পনা মাত্র কি না? তাহা হইলেই জানিতে পারিব, মহাভারতের উপর নির্ভর করা যায় কি না?
————————
* Since Megasthenes says nothing of this epic, it is not an improbable hypothesis that its origin is to be placed in the interval between his times and that of Chrysostom; for what ignorant sailors took note of would hardly have escaped his observation.
History of Sanskrit Literature, English Translation, p. 186. Trubner & Co., 1882.
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কবে হইয়াছিল
প্রথমে দেশী মতেরই সমালোচনা আবশ্যক। ৪,৯৯২ বৎসরপূর্বেযেকুরুক্ষেত্রেরযুদ্ধহইয়াছিল, এ কথাটা সত্য নহে, ইহা আমি দেশী গ্রন্থ অবলম্বন করিয়াই প্রমাণ করিব। রাজত রঙ্গিণীকার বলেন, কলির ৬৫৩ বৎসর গতে গোর্নদ্দ কাশ্মীরে রাজা হইয়াছিলেন।আরওবলেন, গোর্নদ্দ যুধিষ্ঠিরের সমকালবর্তী রাজা। তিনি ৩৫ বৎসররাজত্বকরেন।অতএব প্রায় সাতশত বৎসর আরও বাদ দিতে হয়। তাহা হইলে ২৪০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ পাওয়া যায়।
কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে আছে—
সপ্তর্ষীণাঞ্চ যৌ পূর্বৌ দৃশ্যেতে উদিতৌ দিবি।
তয়োস্তু মধ্যনক্ষত্রং দৃশ্যতে যৎসমৎনিশি||
তেন সপ্তর্ষয়ো যুক্তাস্তিষ্ঠন্ত্যব্দশতং নৃণাম।
তে তু পারিক্ষিত কালে মঘাস্বাসন্ দ্বিজোত্তম ||
তদা প্রবৃত্তশ্চ কলির্দ্বাদশাব্দশতাত্মকঃ।
—৪ অংশঃ, ২৪ অ, ৩৩-৩৪
অর্থ। সপ্তর্ষিমণ্ডলের মধ্যে যে দুইটি তারা আকাশে পূর্বদিকে উদিত দেখা যায়, ইঁহাদের সমসূত্রে যে মঘা নক্ষত্র দেখা যায়, সেই নক্ষত্রে সপ্তর্ষি শত বৎসরঅবস্থানকরেন।[1] সপ্তর্ষি পরীক্ষিতের সময়ে মঘা নক্ষত্রে ছিলেন, তখন কলির দ্বাদশ শত বৎসরপ্রবৃত্তহইয়াছিল।
অতএব এই কথা মতে কলির দ্বাদশ শত বর্ষের পর পরীক্ষিতের সময়; তাহা হইলে উপরি উদ্ধৃত ৩৪ শ্লোক অনুসারে ১৯০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হইয়াছিল।
কিন্তু ৩৩ শ্লোকে যাহা পাওয়া যায়, তাহার সঙ্গে এ গণনা মিলে না। ঐ ৩৩ শ্লোকের তাৎপর্যঅতিদুর্গম—সবিস্তারেবুঝাইতেহইল।সপ্তর্ষিমণ্ডলকতকগুলিস্থিরনক্ষত্র, উহার বিলাতী নাম Great Bear বা Ursa Major. মঘা নক্ষত্রও কতকগুলি স্থিরতারা। সকলেই জানেন, স্থিরতারার গতি নাই। তবে বিষুবের একটু সামান্য গতি আছে—ইংরেজ জ্যোতির্বিদেরা তাহাকে বলেন “Precession of the Equinoxes.” এই গতি হিন্দুমতে প্রতি বৎসর৫৪বিকলা।একএকনক্ষত্রে১৩১/৩অংশ।এহিসাবেকোনস্থিরতারারএকনক্ষত্র—পরিভ্রমণকরিতেসহস্রবৎসরলাগে—শত বৎসরনয়।তাহাছাড়া, সপ্তর্ষিমণ্ডল কখনও মঘা নক্ষত্রে থাকিতে পারে না। কারণ মঘা নক্ষত্র সিংহরাশিতে। দ্বাদশ রাশি রাশিচক্রের ভিতর। সপ্তর্ষিমণ্ডল রাশিচক্রের বাহিরে। যেমন ইংলণ্ড ভারতবর্ষে কখনও থাকিতে পারে না, তেমনি সপ্তর্ষিমণ্ডল মঘা নক্ষত্রে থাকিতে পারে না।
পাঠক জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, তবে পুরাণকার ঋষি কি গাঁজা খাইয়া এই সকল কথা লিখিয়াছিলেন? এমন কথা আমরা বলিতেছি না, আমরা কেবল ইহাই বলিতেছি যে, এই প্রাচীন উক্তির তাৎপর্যআমাদেরবোধগম্যনহে।কিভাবিয়াপুরাণকারলিখিয়াছিলেনতাহাআমরাবুঝিতেপারিনা।পাশ্চাত্যপণ্ডিতবেণ্ট্লি সাহেব তাহা এইরূপ বুঝিয়াছেনঃ—
“The notion originated in a contrivance of the astronomers to show the quantity of the precession of the equinoxes: This was by assuming an imaginary line, or great circle, passing through the poles of the ecliptic and the beginning of the fixed Magha, which circle was supposed to cut some of the stars in Great Bear.*** The seven stars in the Great Bear being called the Rishis, the circle so assumed was called the line of the Rishis; and being invariably fixed to the beginning of lunar asterism Magha, the precession would be noted by stating the degree &c. of any moveable lunar mansion cut by that fixed line or circle as an index.”
Historical View of the Hindu Astronomy, p. 65.
এইরূপ গণনা করিয়া বেণ্ট্লি যুধিষ্ঠিরকে ৫৭৫ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে আনিয়া ফেলিয়াছেন। অর্থাৎতাঁহারমতেযুধিষ্ঠিরশাক্যসিংহেরঅল্পপূর্ববর্তী।আমেরিকারপণ্ডিতWhitney সাহেব বলেন, হিন্দুদিগের জ্যোতিষিক গণনা এত অশুদ্ধ যে, তাহা হইতে কোন কালাবধারণ-চেষ্টা বৃথা। কিন্তু যে কোন প্রকারে হউক, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কালাবধারণ হইতে পারে, দেখাইতেছি।
প্রথমতঃ পুরাণকার ঋষির অভিপ্রায় অনুসারেই গণনা করা যাউক। তিনি বলেন যে, যুধিষ্ঠিরের সময়ে সপ্তর্ষি মঘায় ছিলেন, নন্দ মহাপদ্মের সময় পূর্বাষাঢ়ায়।
প্রযাস্যন্তি যদা চৈতে পূর্বাষাঢ়াং মহর্ষয়ঃ।
তদা নন্দাৎপ্রভৃত্যেষকলির্বৃদ্ধিংগমিষ্যতি|| ৪।২৪। ৩৯
তার পরে, শ্রীমদ্ভাগবতেও ঐ কথা আছে—
যদা মঘাভ্যো যাস্যন্তি পূর্বাষাঢ়াং মহর্ষয়ঃ।
তদা নন্দাৎপ্রভৃত্যেষকলির্বৃদ্ধিংগমিষ্যতি|| ১২।২। ৩২
মঘা হইতে পূর্বাষাঢ়া দশম নক্ষত্র; যথা—মঘা, পূর্বফল্গুনী, উত্তরফল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া। অতএব যুধিষ্ঠির হইতে নন্দ ১০ x ১০০ = সহস্র বৎসরঅন্তর।
এখন, আর এক প্রকার গণনা যাহা সকলেই বুঝিতে পারে, তাহা দেখা যাউক। বিষ্ণু পুরাণের যে শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহার পূর্বশ্লোক এইঃ—
যাবৎপরিক্ষিতোজন্মযাবন্নন্দাভিষেচনম্।
এতদ্বর্ষসহস্রন্তু জ্ঞেয়ং পঞ্চদশোত্তরম্ || ৪।২৪। ৩২
নন্দের পুরা নাম নন্দ মহাপদ্ম। বিষ্ণুপুরাণে ঐ ৪ অংশের ২৪ অধ্যায়েই আছে—
“মহাপদ্মঃ তৎপুত্রাশ্চএকবর্ষশতমবনীপতয়োভবিষ্যন্তি।নবৈবতান্নন্দান্কোটিল্যোব্রাহ্মণঃসমুদ্ধরিষ্যতি।তেষামভাবেমৌর্যাশ্চপৃথিবীংভোক্ষ্যন্তি।কৌটিল্য এব চন্দ্রগুপ্তং রাজ্যেহভিষেক্ষ্যতি।”
ইহার অর্থ—মহাপদ্ম এবং তাঁহার পুত্রগণ একশতবর্ষ পৃথিবীপতি হইবেন। কৌটিল্য[2] নামে ব্রাহ্মণ নন্দবংশীয়গণকে উন্মূলিত করিবেন। তাঁহাদের অভাবে মৌর্যগণ পৃথিবী ভোগ করিবেন। কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্যাভিষিক্ত করিবেন।
তবেই যুধিষ্ঠির হইতে চন্দ্রগুপ্ত ১১১৫ বৎসর।চন্দ্রগুপ্তঅতিবিখ্যাতসম্রাট্—ইনিইমাকিদনীয়যবনআলেক্জন্দরওসিলিউকস্নৈকটরেরসমসাময়িক।ইনিবাহুবলেমাকিদনীয়যবনদিগকেভারতবর্ষহইতেদূরীকৃতকরিয়াছিলেন, এবং প্রবলপ্রতাপ সিলিউকস্কে পরাভূত করিয়া তাঁহার কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। তাঁহার মত দোর্দণ্ডপ্রতাপ তখন কেহই পৃথিবীতে ছিলেন না। কথিত আছে তিনি অকুতোভয়ে আলেক্জন্দরের শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। আলেক্জন্দর ৩২৫ খ্রীঃ পূর্বাব্দে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন।
চন্দ্রগুপ্ত ৩১৫ খ্রীঃ পূর্বাব্দে রাজ্যপ্রাপ্ত হয়েন। অতএব ঐ ৩১৫ অঙ্কের সহিত উপরিলিখিত ১১১৫ যোগ করিলেই যুধিষ্ঠিরের সময় পাওয়া যাইবে। ৩১৫ + ১১১৫ = ১৪৩০ খ্রীঃ পূঃ তবে মহাভারতের যুদ্ধের সময়।
অন্যান্য পুরাণেও ঐরূপ কথা আছে। তবে মৎস্যওবায়ুপুরাণে১১১৫স্থানে১১৫০লিখিতআছে।তাহাহইলে১৪৬৫পাওয়াযায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে ইহার বড় বেশি পূর্বে হয় নাই, বরং কিছু পরেই হইয়াছিল, তাহার এক অখণ্ডনীয় প্রমাণ পাওয়া যায়। সকল প্রমাণ খণ্ডন করা যায়—গণিত জ্যোতিষের প্রমাণ খণ্ডন করা যায় না— “চন্দার্কৌ যত্র সাক্ষিণৌ।”
সকলেই জানে যে, বৎসরেরদুইটিদিনেদিবারাত্রসমানহয়।সেইদুইটিদিনএকেরছয়মাসপরেআরএকটি উপস্থিত হয়। উহাকে বিষুব বলে। আকাশের যে যে স্থানে ঐ দুই দিনে সূর্য থাকেন, সেইস্থান দুইটিকে ক্রান্তিপাতবিন্দু (Equinoctial point) বলে। উহার প্রত্যেকটির ঠিক ৯০ অংশ (90 degrees) পরে অয়ন পরিবর্তন হয় (Solstice) । ঐ ৯০ অংশে উপস্থিত হইলে সূর্য দক্ষিণায়ন হইতে উত্তরায়ণে বা উত্তরায়ণ হইতে দক্ষিণায়নে যান।
মহাভারতে আছে, ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু। তিনি শরশয্যাশায়ী হইলে বলিয়াছিলেন যে, আমি দক্ষিণায়নে মরিব না, (তাহা হইলে সদ্গতির হানি হয়); অতএব শরশয্যায় শুইয়া উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মাঘ মাসে উত্তরায়ণ হইলে তিনি প্রাণত্যাগ করিলেন। প্রাণত্যাগের পূর্বে ভীষ্ম বলিতেছেন,—
“মাঘোহয়ং সমনুপ্রাপ্তো মাসঃ সৌম্যো যুধিষ্ঠির।”
তবে, তখন মাঘ মাসেই উত্তরায়ণ হইয়াছিল। অনেকে মনে করেন, এখনও মাঘ মাসেই উত্তরায়ণ হয়, কেন না, ১লা মাঘকে উত্তরায়ণ দিন এবং তৎপূর্বদিনকেমকর-সংক্রান্তিবলে।কিন্তুতাহা আর হয় না। যখন অশ্বিনী নক্ষত্রের প্রথম অংশে ক্রান্তিপাত হইয়াছিল, তখন অশ্বিনী প্রথম নক্ষত্র বলিয়া গণিত হইয়াছিল; তখন আশ্বিন মাসে বৎসরআরম্ভকরাহইত, এবং তখনই ১লা মাঘে উত্তরায়ণ হইত। এখনও গণনা সেইরূপ চলিয়া আসিতেছে, এখন ফসলী সন ১লা আশ্বিনে আরম্ভ হয়, কিন্তু এখন আর অশ্বিনী নক্ষত্রে ক্রান্তিপাত হয় না; এবং ১লা মাঘে পূর্বের মত উত্তরায়ণ হয় না। এখন ৭ই পৌষ বা ৮ই পৌষ (২১শে ডিসেম্বর) উত্তরায়ণ হয়। এখনও গণনা সেইরূপ চলিয়া আসিতেছে, এখন ফসলী সন ১লা মাঘে পূর্বের মত উত্তরায়ণ হয় না। এখন ৭ই পৌষ বা ৮ই পৌষ (২১শে ডিসেম্বর) উত্তরায়ণ হয়। ইহার কারণ এই যে, ক্রান্তিপাত—বিন্দুর একটা গতি আছে, ঐ গতিতে ক্রান্তিপাত, সুতরাং আয়নপরিবর্তনস্থানও, বৎসরবৎসরপিছাইয়াযায়।ইহাইপূর্বকথিতPrecession of the Equinoxes—হিন্দুনাম “অয়নচলন”। কত পিছাইয়া যায়, তাহারও পরিমাণ স্থির আছে। হিন্দুরা বলেন, বৎসরে৫৪বিকলা, ইহাও পূর্বে কথিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে সামান্য ভুল আছে। ১৭২ খ্রীঃ-পূর্বাব্দে হিপার্কস্নামা গ্রীক জ্যোতির্বিদ্ ক্রান্তিপাত হইতে ১৭৪ অংশে চিত্রা নক্ষত্রকে দেখিয়াছিলেন। মাক্সেলাইন্ ১৮০২ খ্রীঃ অব্দে চিত্রাকে ২০১ অংশে ৪ কলা ৪ বিকলায় দেখিয়াছিলেন। ইহা হইতে হিসাব করিয়া পাওয়া যায়, ক্রান্তিপাতের বার্ষিক গতি সাড়ে পঞ্চাশ বিকলা। বিখ্যাত ফরাশী জ্যোতির্বিদ্ Leverrier ঐ গতি অন্য কারণ হইতে ৫০.২৪ বিকলা স্থির করিয়াছেন, এবং সর্বশেষে Stockwell গণিয়া ৫০.৪৩৮ বিকলা পাইয়াছেন। এই গণনা প্রথম গণনার সঙ্গে মিলে। অতএব ইহাই গ্রহণ করা যাউক।
ভীষ্মের মৃত্যুকালেও মাঘ মাসে উত্তরায়ণ হইয়াছিল, কিন্তু সৌর মাঘের কোন্ দিনে, তাহা লিখিত নাই। পৌষ মাঘে সচরাচর ২৮ কি ২৯ দিন দেখা যায়। এই দুই মাসে ৫৭ দিনের বেশী প্রায় দেখা যায় না। কিন্তু এমন হইতে পারে না যে, তখন মাঘ মাসের শেষ দিনেই উত্তরায়ণ হইয়াছিল। কেন না, তাহা হইলে “মাঘেহয়ং সমনুপ্রাপ্তঃ” কথাটি বলা হইত না। ২৮শে মাঘে উত্তরায়ণ ধরিলেও এখন হইতে ৪৮ দিন তফাৎ।৪৮দিনেরবিরগতিমোটামুটি৪৮অংশধরাযাইতেপারে; কিন্তু ইহা ঠিক বলা যায় না, কেন না, রবির শীঘ্রগতি ও মন্দগতি আছে। ৭ই পৌষ হইতে ২৯শে মাঘ পর্যন্ত রবিস্ফুট বাঙ্গালা পঞ্জিকা ধরিয়া গণিলে ৪৪ অংশ ৪ কলা মাত্র গতি পাওয়া যায়। ঐ ৪৪ অংশ ৪ কলা হইলে খ্রীঃ পূঃ ১২৬৩ বৎসরপাওয়াযায়।৪৮অংশপূরালইলেখ্রীঃপূঃ১৫৩০বৎসরপাওয়াযায়।ইহাকোনমতেইহইতেপারেনাযে, ইহার পূর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হইয়াছিল। বিষ্ণুপুরাণ হইতে যে খ্রীঃ পূঃ ১৪৩০ পাওয়া গিয়াছে, তাহাই ঠিক বোধ হয়। ভরসা করি, এই সকল প্রমাণের পর আর কেহই বলিবেন না যে, মহাভারতের যুদ্ধ দ্বাপরের শেষে, পাঁচ হাজার বৎসরপূর্বেহইয়াছিল।তাহাযদিহইত, তবে সৌর চৈত্রে উত্তরায়ণ হইত। চান্দ্র মাঘও কখনও সৌর চৈত্রে হইতে পারে না।
————————
1 নক্ষত্র এখানে অশ্বিন্যাদি।
2 বিখ্যাত চাণক্য।
3 সে কালেও সৌর মাসের নামই প্রচলিত ছিল, ইহা আমি প্রমাণ করিতে পারি। ছয় ঋতুর কথা মহাভারতেই আছে। বার মাস নহিলে ছয় ঋতু হয় না।
পাণ্ডবদিগের ঐতিহাসিকতা
ইউরোপীয় মত
মহাভারতের যুদ্ধকাল সম্বন্ধে ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে আমাদিগের কোন মারাত্মক মতভেদ হইতেছে না। কোলব্রুক্ সাহেব গণনা করিয়াছেন, খ্রীঃ পূঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে এই যুদ্ধ হইয়াছিল। উইলস্ন সাহেবও সেই মতাবলম্বী। এলফিন্ষ্টোন্ তাহা গ্রহণ করিয়াছেন। উইলফোর্ড সাহেব বলেন, খ্রীঃ পূঃ ১৩৭০ বৎসরেঐযুদ্ধহয়।বুকাননেরমতত্রয়োদশশতাব্দীতে।প্রাটসাহেবগণনাকরিয়াছেন, খ্রীঃ পূঃ দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। প্রতিবাদের কোন প্রয়োজন দেখা যায় না। কিন্তু পূর্বে বলিয়াছি যে, ইউরোপীয়দিগের মত এই যে, মহাভারত খ্রীষ্ট-পূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল। এবং আদিম মহাভারতে পাণ্ডবদিগের কোন কথা ছিল না—ও সব পশ্চাদ্বর্তী কবিদিগের কল্পনা, এবং মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত।
যদি এই দ্বিতীয় কথাটা সত্য হয়, তবে মহাভারত কবে প্রণীত হইয়াছিল, সে কথা মীমাংসার কিছু প্রয়োজন থাকে না। তাহা হইলে, যবেই মহাভারত প্রণীত হউক না কেন—কৃষ্ণঘটিত কথা যাহা কিছু এখন মহাভারতে পাওয়া যায়, সবই মিথ্যা। কেন না, কৃষ্ণঘটিত মহাভাতীয় সমস্ত কথাই প্রায় পাণ্ডবদিগের সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট। অতএব আগে দেখা উচিত যে, এই শেষোক্ত আপত্তির কোন প্রকার ন্যায্যতা আছে কি না।
প্রথমতঃই লাসেন্ সাহেবকে ধরিতে হয়—কেন না, তিনি বড় লব্ধপ্রতিষ্ঠ জর্মাণ পণ্ডিত। মহাভারত যবেই প্রণীত হউক, তিনি স্বীকার করেন যে, ইহার কিছু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু তিনি যেটুকু স্বীকার করেন সেটুকু এই মাত্র যে, মহাভারতে যে যুদ্ধ বর্ণিত আছে, তাহা কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ—পাণ্ডবগণকে অনৈতিহাসিক কবিকল্পনাপ্রসূত বলিয়া উড়াইয়া দেন। বেবর সাহেবও সে মত গ্রহণ করেন। সর মনিয়র ইউলিয়ম্স্ বাবু রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি অনেকেই সেই মতের অবলম্বী। মতটা কি তাহা সংক্ষেপে বুঝাইতেছি।
কুরু নামে একজন রাজা ছিলেন। আমরা পুরাণেতিহাসে শুনি, তদ্বংশীয় রাজগণকে কুরু বা কৌরব বলা যায়। তাঁহাদিগের অধিকৃত দেশবাসিগণকেও ঐ নামে অভিহিত করা যাইতে পারে। তাহা হইলে কুরু শব্দে কৌরবাধিকৃত জনপদবাসীদিগকে বুঝাইল। পাঞ্চালেরা দ্বিতীয় জনপদবাসী। এই অর্থেই পাঞ্চাল শব্দ মহাভারতে ব্যবহৃত হইয়াছে। এই দুই জনপদ পরস্পর সন্নিহিত। উত্তর পশ্চিমে যে সকল জনপদ ছিল, মহাভারতীয় যুদ্ধের পূর্বে এই দুই জনপদ তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। বোধ হয়, এককালে এই দুই জনপদবাসিগণ মিলিতই ছিল। কেন না, কুরু-পাঞ্চাল পদ বৈদিক গ্রন্থে পাওয়া যায়। পরে তাহাদিগের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। বিরোধের পরিণাম মহাভারতের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কুরুগণ পাঞ্চালগণ কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিল।
এতদূর পর্যন্ত আমরা কোন আপত্তি করি না, এবং এ কথায় আমাদের সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। বস্তুতঃ কুরুগণের প্রকৃত বিপক্ষগণ পাঞ্চালগণই বটে। মহাভারতে কৌরবদিগের প্রতিযুদ্ধকারী সেনা পাঞ্চাল সেনা, অথবা পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ[1] বলিয়া বর্ণিত হইয়াছিল। পাঞ্চালরাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নই সেই সেনার সেনাপতি। পাঞ্চালরাজপুত্র শিখণ্ডীই কৌরবপ্রধান ভীষ্মকে নিপাতিত করেন। পাঞ্চালরাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরবাচার্য দ্রোণকে নিপাতিত করেন। যদি এ যুদ্ধ প্রধানতঃ ধৃতরাষ্ট্রপুত্র ও পাণ্ডুপুত্রদিগের যুদ্ধ হইত, তাহা হইলে ইহাকে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ কখনই বলিত না, কেন না, পাণ্ডবেরাও কুরু; তাহা হইলে ইহাকে ধার্তরাষ্ট্রপাণ্ডবদিগের যুদ্ধ বলিত। ভীষ্ম, এবং কৌরবাচার্য দ্রোণ ও কৃপের সঙ্গে ধার্তরাষ্ট্রদিগের যে সম্বন্ধ, পাণ্ডবদিগের সঙ্গেও সেই সম্বন্ধ, স্নেহও তুল্য। যদি এ যুদ্ধ ধার্তরাষ্ট্র-পাণ্ডবের যুদ্ধ হইত, তবে তাঁহারা কখনই দুর্যোধনপক্ষ অবলম্বন করিয়া পাণ্ডবদিগের অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইতেন না—কেন না, তাঁহারা ধর্মাত্মা ও ন্যায়পর। কুরুপাঞ্চালের বিরোধ পাণ্ডবগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইবার পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল, ইহা মহাভারতেই আছে। মহাভারতেই আছে যে, পাণ্ডব ও ধার্তরাষ্ট্রগণ প্রভৃতি সকল কৌরব মিলিত এবং দ্রোণাচার্য কর্তৃক অভিরক্ষিত হইয়া পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করেন। এবং পাঞ্চালরাজাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার অতিশয় লাঞ্ছনা করেন।
অতএব এই যুদ্ধ যে প্রধানতঃ কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ, স্বীকার করি। স্বীকার করিয়া, ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ, যে সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছেন, আমি তাহা গ্রহণ করিতে পারি না। তাঁহারা বলেন যে, যুদ্ধটা কুরুপাঞ্চালের, পাণ্ডবেরা কেহ নহেন, পাণ্ডু বা পাণ্ডব কেহ ছিলেন না। এ সিদ্ধান্তের অন্য হেতুও তাঁহারা নির্দেশ করেন। সে সকল হেতুর সমালোচনা আমি পশ্চাৎকরিব।এখনইহাবুঝাইতেচাইযে, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ বলিয়া যে, পাণ্ডবদিগের অস্তিত্ব অস্বীকার করিতে হইবে, ইহা সঙ্গত নহে। পাণ্ডবের শ্বশুর পাঞ্চালাধিপতি ধার্তরাষ্ট্রদিগের উপর আক্রমণ করিলে, পাণ্ডবেরা তাঁহার সহায় হইয়া, তাঁহার পক্ষে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, ইহাই সম্ভব। পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্তান্ত এই;—কৌরবাধিপতি বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। [2]ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ, কিন্তু অন্ধ। অন্ধ বলিয়া রাজ্যশাসনে অনধিকারী বা অক্ষম। রাজ্য পাণ্ডুর হস্তগত হইল। পরিশেষে পাণ্ডুকেও রাজ্যচ্যুত ও অরণ্যচারী দেখি—ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য আবার ধৃতরাষ্ট্রের হাতে গেল। তাহার পর পাণ্ডুপুত্রেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হইল, রাজ্য পাইবার আকাঙ্ক্ষা করিল, কাজেই ধৃতরাষ্ট্র ও ধার্তরাষ্ট্রগণ তাঁহাদিগকে নির্বাসিত করিলেন। তাঁহারা বনে বনে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে পাঞ্চালরাজের কন্যা বিবাহ করিয়া পাঞ্চালদিগের সহিত আত্মীয়তা সংস্থাপন করিলেন। পাঞ্চালরাজের সাহায্যে এবং তাঁহাদিগের মাতুলপুত্র ও প্রবলপ্রতাপ যাদবদিগের নেতা কৃষ্ণের সাহায্যে তাঁহারা ইন্দ্রপ্রস্থে নূতন রাজ্য সংস্থাপিত করিলেন। পরিশেষে সে রাজ্যও ধার্তরাষ্ট্রদিগের করকবলিত হইল।
পাণ্ডবেরা পুনর্বার বনচারী হইলেন। এই অবস্থায় বিরাটের সঙ্গে সখ্য ও সম্বন্ধ স্থাপন করিলেন। পরে পাঞ্চালেরা কৌরবদিগকে আক্রমণ করিল। পূর্ববৈর প্রতিশোধজন্য এ আক্রমণ, এবং পাণ্ডবদিগের রাজ্যাধিকার উপলক্ষ মাত্র কি না, স্থির করিয়া বলা যায় না। যাই হৌক, পাঞ্চালেরা যুদ্ধে বদ্ধপরিকর হইলে পাণ্ডবেরা তাঁহাদের পক্ষ থাকিয়া ধার্তরাষ্ট্রগণের সহিত যুদ্ধ করাই সম্ভব।
বলিয়াছি যে, পাণ্ডব ছিল না, এ সব কথা বলিবার উপরিলিখিত পণ্ডিতেরা অন্য কারণ নির্দেশ করেন। একটি কারণ এই যে, সমসাময়িক কোন গ্রন্থে পাণ্ডব নাম পাওয়া যায় না। উত্তরে হিন্দু বলিতে পারেন, এই মহাভারতই ত সমসাময়িক গ্রন্থ—আবার চাই কি? সে কালে ইতিহাস লেখার প্রথা ছিল না যে, কতকগুলা গ্রন্থে তাঁহাদের নাম পাওয়া যাইবে। তবে ইউরোপীয়েরা বলিতে পারেন যে, শতপথব্রাহ্মণ একখানি অনল্পপরবর্তী গ্রন্থ। তাহাতে ধৃতরাষ্ট্র, পরিক্ষিৎএবংজনমেজয়েরনামআছে, কিন্তু পাণ্ডবদিগের নামগন্ধ নাই—কাজেই পাণ্ডবেরাও ছিল না।
এরূপ সিদ্ধান্ত ভারতবর্ষীয় প্রাচীন রাজগণ সম্বন্ধে হইতে পারে না। কোন ভারতবর্ষীয় গ্রন্থে মাকিদনের আলেক্জন্দরের নামগন্ধ নাই—অথচ তিনি ভারতবর্ষে আসিয়া যে কাণ্ডটা উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহা কুরুক্ষেত্রের ন্যায় গুরুতর ব্যাপার। সিদ্ধান্ত করিতে হইবে কি, আলেক্জন্দর নামে কোন ব্যক্তি ছিলেন না, এবং গ্রীক ইতিহাসবেত্তা তদ্বৃত্তান্ত যাহা লিখিয়াছেন, তাহা কবিকল্পনামাত্র? কোন ভারতবর্ষীয় গ্রন্থে গজনবী মহম্মদের নামগন্ধ নাই—সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, ইনি মুসলমান লেখকদিগের কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি মাত্র? বাঙ্গালার সাহিত্যে বখ্তিয়ার খিলিজির নামমাত্র নাই—সিদ্ধান্ত করিতে হইবে কি যে, ইনি মিন্হাজদ্দিনের কল্পনাপ্রসূত মাত্র? যদি তাহা না হয়, তবে একা মিন্হাজদ্দিনের বাক্য বিশ্বাসযোগ্য হইল কিসে, আর মহাভারতের কথা অবিশ্বাসযোগ্য কিসে?
বেবর সাহেব বলেন, শতপথব্রাহ্মণে অর্জুন শব্দ আছে, কিন্তু ইহা ইন্দ্রার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে–কোন পাণ্ডবকে বুঝায়, এমন অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই। এজন্য তিনি বুঝিয়াছেন যে, পাণ্ডব অর্জুন মিথ্যাকল্পনা, ইন্দ্রস্থানে ইনি আদিষ্ট হইয়াছেন মাত্র। এ বুদ্ধির ভিতর প্রবেশ করিতে আমরা অক্ষম। ইন্দ্রার্থে অর্জুন শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, এজন্য অর্জুন নামে কোন মনুষ্য ছিল না, এ সিদ্ধান্ত বুঝিতে আমরা অক্ষম।
কথাটা হাসিয়া উড়িয়া দিলে চলিত, কিন্তু বেবর সাহেব মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত, বেদ ছাপাইয়াছেন; আর আমরা একে বাঙ্গালী, তাতে গণ্ডমূর্খ, তাঁহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া বড় ধৃষ্টতার কাজ হয়। তবে, কথাটা একটু বুঝাই। শতপথব্রাহ্মণে, অর্জুন নাম আছে, ফাল্গুন নামও আছে। যেমন অর্জুন ইন্দ্র ও মধ্যম পাণ্ডব উভয়ের নাম, ফাল্গুনও তেমনই ইন্দ্র ও মধ্যম পাণ্ডব উভয়ের নাম। ইন্দ্রের নাম ফাল্গুন, কেন না, ইন্দ্র ফাল্গুনী নক্ষত্রের অধিষ্ঠাতৃদেবতা;[3] অর্জুনের নাম ফাল্গুন, কেন না, তিনি ফল্গুনী নক্ষত্রে জন্মিয়াছিলেন। হয়ত ইন্দ্রাধিষ্ঠিত নক্ষত্রে জন্ম বলিয়াই তিনি ইন্দ্রপুত্র বলিয়া খ্যাত; ইন্দ্রের ঔরসে তাঁহার জন্ম, এ কথা কোন শিক্ষিত পাঠক বিশ্বাস করিবেন না। আবার অর্জুন শব্দে শুক্ল। মেঘদেবতা ইন্দ্রও শুক্ল নহে, মেঘবর্ণ অর্জুনও শুক্লবর্ণ নহে। উভয়ে নির্মলকর্মকারী শুদ্ধ, পবিত্র; এজন্য উভয়েই অর্জুন। ইন্দ্রের নাম যে অর্জুন, শতপথব্রাহ্মণে সে কথাটা এইরূপে আছে—“অর্জুনো বৈ ইন্দ্রো যদস্য গুহ্যনাম”; অর্জুন ইন্দ্র; সেটি ইঁহার গুহ্য নাম। ইহাতে কি বুঝায় না যে, অর্জুন নামে অন্য ব্যক্তি ছিল, তাঁহার মহিমাবৃদ্ধির অভিপ্রায়ে ইন্দ্রের সঙ্গে তাঁহার ঐক্যস্থাপনজন্য, অর্জুনের নাম, ইন্দ্রের একটা লুকানো নাম বলিয়া প্রচারিত করিতেছেন? বেবর সাহেব “গুহ্য” অর্থে “mystic” বুঝিয়া, লোককে বোকা বুঝাইয়াছেন।
আর একটি রহস্যের কথা বলি। কুরচি গাছের নামও অর্জুন। আবার কুরচি গাছের নামও ফাল্গুন। এ গাছের নাম অর্জুন, কেন না, ফুল শাদা; ইহার নাম ফাল্গুন, কেন না, ইহা ফাল্গুন মাসে ফুটে। এখন আমার বিনীত নিবেদন যে, ইন্দ্রের নামও অর্জুন ও ফাল্গুন বলিয়া আমাদিগকে বলিতে হইবে যে, কুরচি গাছ নাই, ও কখনও ছিল না? পাঠকেরা সেইরূপ অনুমতি করুন, আমি মহামহোপাধ্যায় Weber সাহেবের জয় গাই।
এই সকল পণ্ডিতেরা বলেন যে, কেবল ললিতবিস্তরে, পাণ্ডবদিগের নাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সে পাণ্ডবেরা পার্বত্য দস্যু মাত্র। আমাদের বিবেচনা, তাহা হইতে এমন বুঝা যায় না যে, পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব পাঁচজন কখন জগতে বর্তমান ছিলেন না। বাঙ্গালা সাহিত্যে, “ফিরিঙ্গী” শব্দ যে দুই একখানা গ্রন্থে পাওয়া যায়, যে সকল গ্রন্থে ইহার অর্থ হয় “Eurasian”, নয় “European”—“Frank” শব্দ কোথাও পাওয়া যায় না, বা এ অর্থে “ফিরিঙ্গী” শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয় নাই। ইহা হইতে যদি আমরা সিদ্ধ করি যে, “Frank” জাতি কখন ছিল না, তাহা হইলে ইউরোপীয় পণ্ডিত ও তাঁহাদের শিষ্যগণ যে ভ্রমে পতিত হইয়াছেন, আমরাও সেই ভ্রমে পতিত হইব।[4]
এখনও লাসেন সাহেবের মতের সমালোচনা বাকি আছে। তিনি বলেন, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যাপার; মহাভারতের ততটুকু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু তিনি পাণ্ডব প্রভৃতি নায়কনায়িকাদিগের প্রতি অবিশ্বাসযুক্ত। তিনি বলেন, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যাপার; মহাভারতের ততটুকু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু তিনি পাণ্ডব প্রভৃতি নায়কনায়িকাদিগের প্রতি অবিশ্বাসযুক্ত। তিনি বলেন, অর্জুনাদি সব রূপকমাত্র। যথা—অর্জুন শব্দের অর্থ শ্বেতবর্ণ, এজন্য যাহা আলোকময়, তাহাই অর্জুন। যিনি অন্ধকার, তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণাও তদ্রূপ। পাণ্ডবদিগের অবস্থানকালে যিনি রাজ্যধারণ করিয়াছিলেন, তিনি ধৃতরাষ্ট্র। পঞ্চ পাণ্ডব পাঞ্চালের পাঁচটি জাতি, এবং পাঞ্চালীর সহিত তাঁহাদিগের বিবাহ ঐ পঞ্চ জাতির একীকরণ—সূচক মাত্র। যিনি ভদ্র অর্থাৎমঙ্গলআনয়নকরেন, তিনি সুভদ্রা। অর্জুনের সঙ্গে যাদবদিগের সৌহার্দ্যই এই সুভদ্রা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি স্বীকার করি, হিন্দুদিগের শাস্ত্রগ্রন্থ সকলে—বেদে, ইতিহাসে, পুরাণে, কাব্যেও রূপকের অতিশয় প্রাবল্য। অনেক রূপক আছে। এই গ্রন্থে আমাদিগকেও অনেকগুলি রূপকের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করিতে হইবে। কিন্তু তাই বলিয়া এমন স্বীকার করিতে পারি না যে, হিন্দুশাস্ত্রে যাহা কিছু আছে, সবই রূপক—যে রূপক ছাড়া শাস্ত্রগ্রন্থে আর কিছুই নাই।
আমরা ইহাও জানি যে, সংস্কৃত সাহিত্যে বা শাস্ত্রে যাহা কিছু আছে, তাহা রূপক হউক বা না হউক, রূপক বলিয়া উড়াইয়া দিতে অনেকেই ভালবাসেন। রামের নামের ভিতর ‘রম্’ ধাতু পাওয়া, এবং সীতার নামের ভিতর ‘সি’ ধাতু পাওয়া যায়, এই জন্য রামায়ণ কৃষিকার্যের রূপকে পরিণত হইয়াছে। জর্মন্ পণ্ডিতেরা এমনই দুই চারিটা ধাতু আশ্রয় করিয়া ঋগ্বেদের সকল সূক্তগুলিকে সূর্য ও মেঘের রূপক করিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। চেষ্টা করিলে, বোধ করি, পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে, তাহা এইরূপে উড়াইয়া দেওয়া যায়। আমাদিগের মনে পড়ে, এক সময় রহস্যচ্ছলে আমরা বিখ্যাত নবদ্বীপাধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রকে এইরূপ রূপক করিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলাম। তোমরা বলিবে, তিনি সে দিনের মানুষ—তাঁহার রাজধানী, রাজপুরী, রাজবংশ, সকলই আজিও বিদ্যমান আছে, তিনিও ইতিহাসে কীর্তিত হইয়াছেন। তাহার উত্তরে বলা যায় যে, কৃষ্ণ অর্থে অন্ধকার, তমোরূপী। কৃষ্ণনগরে অর্থাৎঅন্ধকারপূর্ণস্থানেতাঁহাররাজধানী।তাঁহারছয়পুত্র, অর্থাৎতমোগুণহইতেছয়রিপুরউৎপত্তি।একজনবালকপলাসিরযুদ্ধসম্বন্ধেএইরূপরূপককরিয়াছিলযে, পলমাত্র উদ্ভাসিত যে অসি তাহা ক্লীবগুণযুক্ত ক্লৈব (Clive) কর্তৃক প্রযুক্ত হওয়ায় সুরাজা অর্থাৎযিনিউত্তমরাজাছিলেন, তিনি পরাভূত হইয়াছিলেন। অতএব রূপকের অভাব নাই। আর এই বালকরচিত রূপকের সঙ্গে লাসেন্রচিত রূপকের বিশেষ প্রভেদ দেখা যায় না। আমরা ইচ্ছা করিলে ‘লস্’ ধাতু খোদ লাসেন্ সাহেবের নামের ব্যুৎপত্তি সিদ্ধ করিয়া, তাঁহার ঐতিহাসিক গবেষণা ক্রীড়াকৌতুক বলিয়া উড়াইয়া দিতে পারি।
ভারতবর্ষের ইতিহাসলেখক (Talboys Wheeler), সাহেবেরও একটা মত আছে। যখন হস্তী অশ্ব তলগামী, তখন মেষের জলপরিমাপেচ্ছার প্রতি বেশী শ্রদ্ধা করা যায় না। তিনি বলেন,—হাঁ ইহার কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বটে, কিন্তু তাহা সামান্য মাত্র—
“The adventures of the Pandavas in the jungle, and their encounters with Asuras and Rakshasas are all palpable fictions, still they are valuable as traces which have been left in the minds of the people of the primitive wars of the Aryans against the Aborigines.”
টল্বয়স্ হুইলর সাহেব সংস্কৃত জানেন না, মহাভারত কখনও পড়েন নাই। তাঁহার অবলম্বন বাবু অবিনাশচন্দ্র ঘোষ নামে কোন ব্যক্তি। তিনি অবিনাশ বাবুকে অনুরোধ করিয়াছিলেন যে, মূল মহাভারত অনুবাদ করিয়া তাঁহাকে দেন। অবিনাশ বাবু রহস্যপ্রিয় লোক সন্দেহ নাই, কাশীদাসের মহাভারত হইতে কত দূর অনুবাদ করিয়াছিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু হুইলর সাহেব চন্দ্রহাস ও বিষয়ার উপাখ্যান প্রভৃতি সামগ্রী মূল মহাভারতের অংশ বলিয়া পাচার করিয়াছেন। যে বর্ষীয়সী মাণিকপীরের গান শুনিয়া রামায়ণভ্রমে অশ্রুমোচন করিতেছিল, বোধ হয়, সেও এই পণ্ডিতবরের অপেক্ষা উপহাসাস্পদ নহে। ঈদৃশ লেখকের মতের প্রতিবাদ করা পাঠকের সময় বৃথা নষ্ট করা বিবেচনা করি। ফলে মহাভারতের যে অংশ মৌলিক, তাহার লিখিত বৃত্তান্ত ও পাণ্ডবাদি নায়ক সকল কল্পনাপ্রসূত, এরূপ বিবেচনা করিবার কোন উপযুক্ত কারণ এ পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয় নাই। যাহা নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহার সকলই এইরূপ অকিঞ্চিৎকর।সকলগুলিরপ্রতিবাদকরিবারএগ্রন্থেস্থানহয়না।মহাভারতেরঅনেকভাগপ্রক্ষিপ্ত, ইহা আমি স্বীকার করিয়াছি। কিন্তু পাণ্ডবাদির সকল কথা প্রক্ষিপ্ত নহে। ইহা প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কোন কারণ নাই। তাঁহারা ঐতিহাসিক, ইহা বিবেচনা করিবার কারণ যাহা বলিয়াছি, তাহা যদি যথেষ্ট না হয়, তবে পরপরিচ্ছেদে আরও কিছু বলিতেছি।
———————–
1 সৃঞ্জয়েরা পাঞ্চালভুক্ত—তাহাদিগের জ্ঞাতি।
2 বিদুর বৈশ্যাজাত।
3 এখনকার দৈবজ্ঞেরা এ কথা বলেন না, কিন্তু শতপথব্রাহ্মণেই এ কথা আছে। ২ কাণ্ড, ১ অধ্যায়, ২ ব্রাহ্মণ, ১১, দেখ।
4 “বৌদ্ধ-গ্রন্থকারেরা পাণ্ডব নামে পর্বতবাসী একটি জাতির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন; তাহারা উজ্জয়িনী ও কোশলবাসীদের শত্রু ছিল। (Weber’s H. I. Literature, 1878, p. 185.) মহাভারতে পাণ্ডবদিগকে হস্তিনাপুরবাসী বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে বটে, কিন্তু ঐ গ্রন্থেরও স্থলবিশেষে লিখিত আছে, প্রথমে তাঁহারা হিমালয় পর্বতে থাকিয়া পরিবর্ধিত হন।
এবং পাণ্ডোঃ সুতাঃ পঞ্চ দেবদত্তা মহাবলাঃ।* *
* * বিবর্ধমানাস্তে তত্র পুণ্যে হৈমবতে গিরৌ ||
আদিপর্ব। ১২৪। ২৭-২৯।
এইরূপে পাণ্ডুর দেব-দত্ত পাঁচটি মহাবল পুত্র * * * সেই পবিত্র হিমালয় পর্বতে পরিবর্ধিত হইতে থাকেন।
প্লিনি ও সলিনস্ নামে গ্রীক গ্রন্থকারেরা ভারতবর্ষের পশ্চিমোত্তর দিকে বাহ্ণীক দেশে উত্তরাংশে সোগ্ডিয়েনা দেশের একটি নগরের নাম পাণ্ড্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন এবং সিন্ধু নদীর মুখ সমীপস্থ জাতিবিশেষকেও পাণ্ড্য বলিয়া লিখিয়া গিয়াছেন। ভূগোলবিৎটলেমিপাণ্ড্য-নামলোকবিশেষকেবিতস্তানদীরসমীপস্থবলিয়াকীর্তনকরিয়াছেন।কাত্যায়নএকটিপাণিনিসূত্রেরবার্তিকেপাণ্ডুহইতেপাণ্ড্যশব্দনিষ্পন্নকরিয়াছেন।[5] লক্ষ্মীধর স্বকৃত ষড়্ভাষাচন্দ্রিকার মধ্যে কেকয় বাহ্ণীকাদি উত্তরদিক্স্থ কতকগুলি জনপদের সহিত পাণ্ড্য দেশের নাম উল্লেখ করিয়াছেন এবং সে সমুদয়কে পিশাচ অর্থাৎঅসভ্যদেশবিশেষবলিয়াকীর্তনকরিয়াগিয়াছেন।
“পাণ্ড্যকেকয়বাহ্ণীক * * * এতে পৈশাচদেশাঃ স্যু।”
হরিবংশে দক্ষিণদিক্স্থ চোল কেরলাদির সহিত পাণ্ড্য দেশের নাম উল্লিখিত আছে। (হরিবংশ, ৩২ অ, ১২৪ শ্লো) অতএব উহা দক্ষিণাপথের অন্তর্গত পাণ্ড্য দেশ। শ্রীমান্ উইলসন্ বিবেচনা করেন; ঐ জাতীয় লোক প্রথমে সোগ্ডিয়েনা দেশের অধিবাসী ছিল; তথা হইতে ক্রমশঃ ভারতবর্ষে আসিয়া বাস করে এবং উত্তরোত্তর ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অধিবাস করিয়া পশ্চাৎহস্তিনাপুর-বাসীহয়, ও অবশেষে দক্ষিণাপথে গিয়া পাণ্ড্যরাজ্য সংস্থাপন করে। Asiatic Researches, Vol. XV., pp. 95 and 96.
রাজতরঙ্গিণীর মতে, কাশ্মীর রাজ্যের প্রথম রাজারা কুরুবংশীয়। অতএব তৎপ্রদেশহইতেপাণ্ডবদেরহস্তিনায়আসিয়াউপনিবেশকরাসম্ভব।তাঁহারামধ্যদেশবাসীঅথচকিরূপেপাণ্ডব বলিয়া পরিচিত হইলেন, এই সমস্যা পূরাণার্থেই কি পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব বলিয়া ক্রমশঃ একটি জনপ্রবাদ প্রচারিত হইল? তাঁহাদের জন্মবৃত্তান্তঘটিত গোলযোগ প্রসিদ্ধই আছে। লোকেও তাহাতে সংশয় প্রকাশ করিয়াছিল, তাহারও নিদর্শন পাওয়া যায়।
যদা চিরমৃতঃ পাণ্ডু কথং তস্যেতি চাপরে।
আদিপর্ব। ১। ১১৭।
অন্য অন্য লোকে বলিল, “বহুকাল অতীত হইল, পাণ্ডু প্রাণত্যাগ করিয়াছেন; অতএব ইঁহারা কিরূপে তদীয় পুত্র হইতে পারেন?”
ভারতবর্ষীয় উপাসকসম্প্রদায়, অক্ষয়কুমার দত্ত-প্রণীত, দ্বিতীয় ভাগ, উপক্রমণিকা, ১০৫ পৃঃ। অক্ষয় বাবু সচরাচর ইউরোপীয়-দিগের মতের অবলম্বী।
——————–
5 পাণ্ডোর্ড্যণ্ বক্তব্যঃ—বার্তিক।
পাণ্ডবদিগের ঐতিহাসিকতা
পাণিনি সূত্র করিয়াছেন,—
মহান্ ব্রীহ্যপরাহ্নগৃষ্টীষ্বাসজাবালভারভারতহৈলিহিলরৌররবপ্রবৃদ্বেষু। ৬। ২। ৩৮
অর্থাৎব্রীহিইত্যাদিশব্দেরপূর্বেমহৎশব্দপ্রযুক্তহয়।তাহারমধ্যেএকটিশব্দ‘ভারত’।অতএবপাণিনিতেমহাভারতশব্দপাওয়াগেল। প্রসিদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থ ভিন্ন আর কোন বস্তু “মহাভারত” নামে কখনও অভিহিত হইয়াছিল, এমন প্রমাণ নাই। Weber সাহেব বলেন, এখানে মহাভারত অর্থে ভরতবংশ। এটি কেবল তাঁহার গায়ের জোর। এমন প্রয়োগ কোথাও নাই।
পুনশ্চ, পাণিনিসূত্র—
“গবিযুধিভ্যাং স্থির।”“গবিযুধিভ্যাং স্থির।” ৮। ৩। ৯৫
গবি ও যুধি শব্দের পর স্থির শব্দের স স্থানে ষ হয়। যথা—গবিষ্ঠিরঃ, যুধিষ্ঠিরঃ।
পুনশ্চ,—
“বহ্বচ ইজঃ প্রাচ্যভরতেষু।” ২। ৪। ৬৬
ভরতগোত্রের উদাহরণ “যুধিষ্ঠিরাঃ।”[1]
পুনশ্চ,—
“স্ত্রিয়ামবন্তিকুন্তিকুরুভ্যশ্চ।” ৪। ১। ১৭৬
পাওয়া গেল “কুন্তি”।
পুনশ্চ,—
পুনশ্চ,— “বাসুদেবার্জুনাভ্যাং বুন্।” ৪। ৩। ৯৮
অর্থাৎবাসুদেবওঅর্জুনশব্দেরপরষষ্ঠ্যর্থেবুন্হয়।
পুনশ্চ,—
“নভ্রাণ্নপান্নবেদানাসত্যানমুচিনকুলনখনপুংসকনক্ষত্রনক্রনাকেষু।” ৬। ৩। ৭৫
ইহাতে “নকুল” পাওয়া গেল।
দ্রোণপর্বতজীবন্তাদন্যতরতরস্যাম্। ৪। ১। ১০৩
“দ্রোণায়ন” শব্দ পাওয়া গেল। ইহাতে অশ্বত্থামা ভিন্ন আর কিছুই বুঝায় না। এইরূপ পাঁচটি পাণ্ডবের নামেই এবং কুন্তী, দ্রোণ, অশ্বত্থামা প্রভৃতির নাম পাণিনিসূত্রে পাওয়া যায়।
যদি মহাভারত গ্রন্থের নাম এবং সেই গ্রন্থের নায়কদিগের নাম পাওয়া গেল, তবে পাণিনির সময়েও মহাভারত পাণ্ডবদিগের ইতিহাস। এখন দেখিতে হইবে, পাণিনি কবেকার লোক।
ভারতদ্বেষী Weber সাহেব তাঁহাকেও আধুনিক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু এখানে তাঁহার মত চলে নাই,—স্বয়ং গোল্ড্ষ্টুকর পাণিনির অভ্যুদয়কাল নির্ণীত করিয়াছেন। তিনি যাহা বলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ এ স্থান নহে; কিন্তু বাবু রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁহার গ্রন্থের সারাংশ বাঙ্গালায় সঙ্কলন করিয়াছেন, অতএব না বলিলেও চলিবে। যাঁহারা বাঙ্গালা গ্রন্থ পড়িতে ঘৃণা করেন, তাঁহারা গোল্ড্ষ্টুকরের গ্রন্থই ইংরাজিতে পড়িতে পারেন। তাঁহার বিচারে পাণিনি অতি প্রাচীন বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছেন, এজন্য Weber সাহেব অতিশয় দুঃখিত। তিনি গোল্ড্ষ্টুকরের প্রতিবাদও করিয়াছেন, এবং লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া বলিয়াছেন, জয়পতাকা আমিই উড়াইয়াছি। কিন্তু আর কেহ তাহা বলে না।
গোল্ড্ষ্টুকর প্রমাণ করিয়াছেন যে, পাণিনির সূত্র যখন প্রণীত হয়, তখন বুদ্ধদেবের[2] আবির্ভাব হয় নাই। তবেই পাণিনি অন্ততঃ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক। কিন্তু কেবল তাহাই নহে, তখন ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ্ প্রভৃতি বেদাংশ সকলও প্রণীত হয় নাই। ঋক্, যজুঃ, সামসংহিতা ভিন্ন আর কিছুই হয় নাই। আশ্বলায়ন, সাংখ্যায়ন প্রভৃতি অভ্যুদিত হন নাই। মক্ষমূলর বলেন, ব্রাহ্মণ-প্রণয়ন-কাল খ্রীঃ পূঃ সহস্র বৎসরহইতেআরম্ভ।ডাক্তারমার্টিনহৌগবলেন, ঐ শেষ; খ্রীঃ পূঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে আরম্ভ। অতএব পাণিনির সময় খ্রীঃ পূঃ দশম বা একাদশ শতাব্দী বলিলে বেশী বলা হয় না।
Max, Muller, Weber, প্রভৃতি অনেকেই এ বিচারে প্রবৃত্ত, কিন্তু কাহারও কথায় গোল্ড্ষ্টুকরের মত খণ্ডিত হইতেছে না। অতএব আচার্যের এ মত গ্রহণ করা যাইতে পারে। তবে ইহা স্থির যে, খ্রীষ্টের সহস্রাধিক বৎসরপূর্বেযুধিষ্ঠিরাদিরবৃত্তান্তসংযুক্তমহাভারতগ্রন্থপ্রচলিতছিল।এমনপ্রচলিতযে, পাণিনিকে মহাভারত ও যুধিষ্ঠিরাদির ব্যুৎপত্তিলিখিতেহইয়াছে।আরইহাও সম্ভব যে, তাঁহার অনেক পূর্বেই মহাভারত প্রচলিত হইয়াছিল। কেন না, “বাসুদেবার্জুনাভ্যাং বুন্” এই সূত্রে ‘বাসুদেবক’ ও ‘অর্জুনক’ শব্দ এই অর্থে পাওয়া যায়, বাসুদেবের উপাসক, অর্জুনের উপাসক। অতএব পাণিনিসূত্রপ্রণয়নের পূর্বেই কৃষ্ণার্জুন দেবতা বলিয়া স্বীকৃত হইতেন। অতএব মহাভারতের যুদ্ধের অনল্প পরেই আদিম মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া যে প্রসিদ্ধি আছে, তাহার উচ্ছেদ করিবার কোন কারণ দেখা যায় না।
এক্ষণে ইহাও বক্তব্য যে, কেবল পাণিনির নয়, আশ্বলায়ন ও সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রেও মহাভারতের প্রসঙ্গ আছে। অতএব মহাভারতের প্রাচীনতা সম্বন্ধে বড় গোলযোগ করার কাহারও অধিকার নাই।
———————-
1 উদাহরণটি সিদ্ধান্তকৌমুদীর, ইহা বলা কর্তব্য।
2 মহাভারতে ‘বৌদ্ধ’ শব্দ পাওয়া যায়, কিন্তু ঐ অংশ যে প্রক্ষিপ্ত, তাহাও অনায়াসে প্রমাণ করা যাইতে পারে।
কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা
অষ্টম পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা
কৃষ্ণের নাম পাণিনির কোন সূত্রে থাক না থাক, তাহাতে আসিয়া যায় না। কেন না, ঋগ্বেদসংহিতায় কৃষ্ণ[1] শব্দ অনেকবার পাওয়া যায়। প্রথম মণ্ডলের ১১৬ সূক্তের ২৩ ঋকে এবং ১১৭ সূক্তের ৭ ঋকে এক কৃষ্ণের নাম আছে। সে কৃষ্ণ কে, তাহা জানিবার উপায় নাই। সম্ভবতঃ তিনি বাসুদেবনন্দন নহেন। তাহার পর দেখিতে পাই ঋগ্বেদসংহিতার অনেকগুলি সূক্তের ঋষি একজন কৃষ্ণ। তাঁহার কথা পরে বলিতেছি। অথর্বসংহিতায় অসুর কৃষ্ণকেশীর নিধনকারী কৃষ্ণের কথা আছে। তিনি বাসুদেবনন্দন সন্দেহ নাই। কেশিনিধনের কথা আমি পশ্চাৎবলিব।
পাণিনির সূত্রে ‘বাসুদেব’ নাম আছে–সে সূত্র উদ্ধৃত করিয়াছি। কৃষ্ণ মহাভারতে বাসুদেব নামে সচরাচর অভিহিত হইয়াছেন। বসুদেবের পুত্র বলিয়াই বাসুদেব নাম নহে, সে কথা স্থানান্তরে বলিব। বসুদেবের পুত্র না হইলেও বাসুদেব নাম হয়। এই মহাভারতেই পাওয়া যায়–পুণ্ড্রাধিপতিরও নাম ছিল বাসুদেব। বসুদেবকে কবিকল্পনা বলিতে হয়, বল–কিন্তু বাসুদেব কবিকল্পনা নহেন।
ইউরোপীয়দিগের মত এই যে, কৃষ্ণ আদৌ মহাভারতে ছিলেন না, পরে মহাভারতে তাঁহাকে বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এরূপ বিবেচনা করিবার যে সকল কারণ তাঁহারা নির্দেশ করেন, তাহা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।কেহবলেন, কৃষ্ণকে মহাভারত হইতে উঠাইয়া দিলে মহাভারতের কোন ক্ষতি হয় না। এক হিসাবে নয় বটে। গত ফরাসীপ্রুসের যুদ্ধ হইতে মোল্টকেকে উঠাইয়া দিলে কোন ক্ষতি হয় না। Gravelotte, Woerth, Metz, Sedan, Paris প্রভৃতি রণজয় সবই বজায় থাকে; কেন না, Moltke হাতে হাতিয়ারে এ সকলের কিছুই করেন নাই। তাঁহার সেনাপতিত্ব তারে তারে বা পত্রে পত্রে নির্বাহিত হইয়াছিল। মহাভারত হইতে কৃষ্ণকে উঠাইয়া দিলে সেরূপ ক্ষতি হয় না। তাহার বেশী ক্ষতি হয় কি না, এ গ্রন্থ পাঠ করিলেই পাঠক জানিতে পারিবেন।
হুইলর সাহেবেরও এ বিষয়ে একটা মত আছে। তাঁহার যেরূপ পরিচয় দিয়াছি, তাহাতে বোধ হয়, তাঁহার মতে প্রতিবাদের বিশেষ প্রয়োজন নাই। তথাপি মতটা কিয়ৎপরিমাণেচলিয়াছেবলিয়া, তাঁহার প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিলাম। তিনি বলেন, দ্বারকা হস্তিনাপুর হইতে সাত শত ক্রোশ ব্যবধান। কাজেই কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদিগের যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ মহাভারতে কথিত হইয়াছে, তাহা অসম্ভব। কেন অসম্ভব, আমরা তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, কাজেই উত্তর করিতে পারিলাম না। বাঙ্গালার মুসলমান রাজপুরুষদিগের সঙ্গে দিল্লীর পাঠান মোগল রাজপুরুষদিগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যিনিই স্মরণ করিবেন, তিনিই বোধ হয়, হুইলর সাহেবের এই অশ্রাব্য কথায় কর্ণপাত করিবেন না।
বিখ্যাত ফরাসী পণ্ডিত Bournouf বলেন যে, বৌদ্ধশাস্ত্রে কৃষ্ণ নাম না পাইলে, ঐ শাস্ত্র প্রচারের উত্তরকালে কৃষ্ণোপাসনা প্রবর্তিত হয়, বিবেচনা করিতে হইবে। কিন্তু বৌদ্ধশাস্ত্রের মধ্যে ললিতবিস্তরে কৃষ্ণের নাম আছে। বৌদ্ধশাস্ত্র মধ্যে সূত্রপিটক সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ। তাহাতেও কৃষ্ণের নাম আছে। ঐ গ্রন্থে কৃষ্ণকে অসূর বলা হইয়াছে। কিন্তু নাস্তিক ও হিন্দুধর্মবিরোধী বৌদ্ধেরা কৃষ্ণকে যে অসূর বিবেচনা করিবে, ইহা বিচিত্র নয়। আর ইহাও বক্তব্য, বেদাদিতে ইন্দ্রাদি দেবগণকে মধ্যে মধ্যে অসূর বলা হইয়াছে। বৌদ্ধেরা ধর্মের প্রধান শত্রু যে প্রবৃত্তি, তাহার নাম দিয়াছেন “মার”। কৃষ্ণপ্রচারিত অপূর্ব নিষ্কামধর্ম, তৎকৃতসনাতনধর্মেরঅপূর্বসংস্কার, স্বয়ং কৃষ্ণের উপাসনা বৌদ্ধধর্মপ্রচারের প্রধান বিঘ্ন ছিল সন্দেহ নাই। অতএব তাঁহারা কৃষ্ণকেই অনেক সময় মার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।
এ সকল কথা থাক। ছান্দোগ্যোপনিষদে একটি কথা আছে; সেইটি উদ্ধৃত করিতেছি। কথাটি এই–
“তদ্ধৈতদ্ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায় উক্ত্বা, উবাচ। অপিপাস এব স বভূব। সোহন্তবেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেত অক্ষিতমসি, অচ্যুতমসি, প্রাণসংশিতমসীতি।”
ইহার অর্থ। আঙ্গিরসবংশীয় ঘোর (নামে ঋষি) দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে এই কথা বলিয়া বলিলেন, (শুনিয়া তিনিও পিপাসাশূন্য হইলেন) যে অন্তকালে এই তিনটি কথা অবলম্বন করিবে, “তুমি অক্ষিত, তুমি অচ্যুত, তুমি প্রাণসংশিত।”
এই ঘোর ঋষির পুত্র কণ্ব[2]। ঘোরপুত্র কণ্ব ঋগ্বেদের কতকগুলি সূক্তের ঋষি। যথা, প্রথম মণ্ডলে ৩৬ সূক্ত হইতে ৪৩ সূক্ত পর্যন্ত; এবং কণ্বের পুত্র মেধাতিথি ঐ মণ্ডলের ১২শ হইতে ২৩শ পর্যন্ত সূক্তের ঋষি। এবং কণ্বের অন্য পুত্র প্রষ্কণ্ব ঐ মণ্ডলের ৪৪ হইতে ৫০ পর্যন্ত সূক্তের ঋষি। এখন নিরুক্তকার যাস্ক বলেন, “যস্য বাক্যংস ঋষিঃ।” অতএব ঋষিগণ সূক্তের প্রণেতা হউন বা না হউন, বক্তা বটে। অতএব ঘোরের পুত্র এবং পৌত্রগণ ঋগ্বেদের কতকগুলি সূক্তের বক্তা। তাহা যদি হয়, তবে ঘোরশিষ্য কৃষ্ণ তাঁহাদিগের সমসাময়িক, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। এখন আগে বেদের সূক্তগুলি উক্ত হইয়াছিল, তাহার পর বেদবিভাগ হইয়াছিল, এ সিদ্ধান্তের কোনও মতেই প্রতিবাদ করা যায় না। অতএব কৃষ্ণ বেদবিভাগকর্তা বেদব্যাসের সমসাময়িক লোক, উপন্যাসের বিষয়মাত্র নহেন, তদ্বিষয়ে কোনও সংশয় করা যায় না।
ঋগ্বেদসংহিতায় অষ্টম মণ্ডলে ৮৫। ৮৬। ৮৭ সূক্ত এবং দশম মণ্ডলের ৪২।৪৩।৪৪ সূক্তের ঋষি কৃষ্ণ। এই কৃষ্ণ দেবকীনন্দন কৃষ্ণ কি না, তাহার নির্ণয় করা দুরূহ। কিন্তু কৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বলিয়াই বলা যাইতে পারে না যে, তিনি এই সকল সূক্তের ঋষি নহেন; কেন না, ত্রসদস্যু, ত্র্যরুণ, পুরুমীঢ়, অজমীঢ়, সিন্ধুদ্বীপ, সুদাস, মান্ধাতা, সিবি, প্রতর্দন, কক্ষীবান্ প্রভৃতি রাজর্ষি যাঁহারা ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচিত, তাঁহারাও ঋগ্বেদ-সূক্তের ঋষি, ইহা দেখা যায়। দুই এক স্থানে শূদ্র ঋষির উল্লেখও পাওয়া যায়। কবষ নামে দশম মণ্ডলে একজন শূদ্র ঋষি আছেন; অতএব ক্ষত্রিয় বলিয়া কৃষ্ণের ঋষিত্বে আপত্তি হইতে পারে না। তবে ঋগ্বেদসংহিতার অনুক্রমণিকায় শৌনক কৃষ্ণ আঙ্গিরস ঋষি বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন।
উপনিষদ্ সকল বেদের শেষভাগ, এই জন্য উপনিষদ্কে বেদান্তও বলে। বেদের যে সকল অংশকে ব্রাহ্মণ বলে, তাহা উপনিষদ্ হইতে প্রাচীনতর বলিয়া বোধ হয়। অতএব ছান্দোগ্যোপণিষদ্ হইতে কৌষীতকিব্রাহ্মণ আরও প্রাচীন বলিয়া বোধ হয়। তাহাতেও এই আঙ্গিরস ঘোরের নাম আছে, এবং কৃষ্ণেরও নাম আছে। কৃষ্ণ তথায় দেবকীপুত্র বলিয়া বর্ণিত হয়েন নাই; আঙ্গিরস বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। কিন্তু কতকগুলি ক্ষত্রিয়ও আঙ্গিরস বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। তদ্বিষয়ে বিষ্ণুপুরাণে একটি প্রাচীন শ্লোক ধৃত হইয়াছে।
এতে ক্ষত্রপ্রসূতা বৈ পুনশ্চাঙ্গিরসঃ স্মৃতাঃ।
রথীতরাণাং প্রবরাঃ ক্ষাত্রোপেতো দ্বিজাতয়ঃ|| —৪ অংশ, ২।২
কিন্তু এই রথীতর রাজা সূর্যবংশীয়। কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ যদু, যযাতির পুত্র, কাজেই চন্দ্রবংশীয়। এই কথাই সকল পুরাণেতিহাসে লেখে, কিন্তু হরিবংশে বিষ্ণুপর্বে পাওয়া যায় যে, মথুরার যাদবেরা ইক্ষ্বাকুবংশীয়।
এবং ইক্ষ্বাকুবংশাদ্ধি যদুবংশো বিনিঃসৃতঃ।—৯৫ অধ্যায়ে, ৫২৯ শ্লোকঃ।
কথাটা খুব সম্ভব, কেন না, রামায়ণে পাওয়া যায় যে, ইক্ষ্বাকুবংশীয় রামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রঘ্ন মথুরাজয় করিয়াছিলেন।
সে যাহাই হউক, “বাসুদেবর্জুনাভ্যাং বুন্” এই সূত্র আমরা পাণিনি হইতে উদ্ধৃত করিয়াছি। কৃষ্ণ এত প্রাচীন কালের লোক যে, পাণিনির সময়ে উপাস্য বলিয়া আর্যসমাজে গৃহীত হইয়াছিলেন। ইহাই যথেষ্ট।
————————–
1 কৃষ্ণ শব্দ আমি পাণিনির অষ্টাধ্যায় খুঁজিয়া পাই নাই।—আছে কি না, বলিতে পারি না। কিন্তু কৃষ্ণ শব্দ যে পাণিনির পূর্বে প্রচলিত ছিল, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কেন না, ঋগ্বেদসংহিতায় কৃষ্ণ শব্দ পুনঃ পুনঃ পাওয়া যায়। কৃষ্ণনামা বৈদিক ঋষির কথা পশ্চাৎবলিতেছি।তদ্ভিন্নঅষ্টমমণ্ডলে৯৬সূক্তেকৃষ্ণনামাএকজনঅনার্যরাজারকথাপাওয়াযায়। এই অনার্য কৃষ্ণ অংশুমতী নদীতীরবাসী; সুতরাং ইনি যে বাসুদেব কৃষ্ণ নহেন, তাহা নিশ্চিত। পাঠক ইহাতে বুঝিতে পারিবেন যে, পাণিনির কোন সূত্রে “কৃষ্ণ” শব্দ থাকিলে তাহা বাসুদেব কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতার প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয় না। কিন্তু পাণিনিসূত্রে “বাসুদেব” নাম যদি পাওয়া যায়, তবে তাহা প্রমাণ বলিয়া গণ্য ঠিক। তাহাই আছে।
2 এই কণ্ব শকুন্তলার পালকপিতা কণ্ব নহেন। সে কণ্ব কাশ্যপ; ঘোরপুত্র কণ্ব আঙ্গিরস।
মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত
আমরা এতক্ষণ যা বলিলাম, তাহার স্থূলমর্ম এই যে, মহাভারতের ঐতিহাসিকতা আছে, এবং মহাভারতে কৃষ্ণপাণ্ডব সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন জিজ্ঞাসা হইতে পারে যে, মহাভারতের কৃষ্ণপাণ্ডব সম্বন্ধে যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহাই কি ঐতিহাসিক তত্ত্ব?
মহাভারতের ঐতিহাসিকতা, বা মহাভারত কথিত কৃষ্ণপাণ্ডবসম্বন্ধীয় বৃত্তান্তের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে ইউরোপীয়গণের যে প্রতিকূল ভাব, তাহার মূলে এই কথা আছে যে, প্রাচীন কালে মহাভারত ছিল বটে, কিন্তু সে এ মহাভারত নহে। ইহার অর্থ যদি এমন বুঝিতে হয় যে, প্রচলিত মহাভারতে সেই প্রাচীন মহাভারতের কিছুই নাই, তাহা হইলে আমরা তাঁহাদের কথা যথার্থ বলিয়া স্বীকার করি না; এবং এরূপ স্বীকার করি না বলিয়াই, তাঁহাদের কথার এত প্রতিবাদ করিয়াছি। আর তাঁহাদের কথার মর্মার্থ যদি এই হয় যে, সে প্রাচীন মহাভারতের উপর অনেক প্রক্ষিপ্ত উপন্যাসাদি চাপান হইয়াছে, প্রাচীন মহাভারত তাহার ভিতর ডুবিয়া আছে, তবে তাঁহাদের সঙ্গে আমার কোন মতভেদ নাই।
আমরা পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি যে, পরবর্তী প্রক্ষিপ্তকারদিগের রচনাবাহুল্যে আদিম মহাভারত প্রোথিত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ঐতিহাসিকতা যদি কিছু থাকে, তবে সে আদিম মহাভারতের। অতএব বর্তমান মহাভারতের কোন্ অংশ আদিমমহাভারতভুক্ত, তাহাই প্রথমে আমাদের বিচার্য বিষয়। তাহাতে কৃষ্ণকথা যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহারই কিছু ঐতিহাসিক মূল্য থাকিলে থাকিতে পারে। তাহাতে যাহা নাই, অন্য গ্রন্থে থাকিলেও, তাহার ঐতিহাসিক মূল্য অপেক্ষাকৃত অল্প। কেন না, মহাভারতই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ।
প্রাচীন সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই বলিবেন, মহাভারতের কোন অংশই যে প্রক্ষিপ্ত, তাহারই বা প্রমাণ কি? এই পরিচ্ছেদে তাহার কিছু প্রমাণ দিব।
আদিপর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম পর্বসংগ্রহাধ্যায়। মহাভারতে যে যে বিষয় বর্ণিত বা বিবৃত আছে, ঐ পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে তাহার গণনা করা হইয়াছে। উহা এখনকার গ্রন্থের সূচিপত্র বা Table of Contents সদৃশ। অতি ক্ষুদ্র বিষয়ও ঐ পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের গণনাভুক্ত হইয়াছে। এখন যদি দেখা যায় যে, কোন একটা গুরুতর বিষয় ঐ পর্বসংগ্রহাধ্যায়ভুক্ত নহে, তবে অবশ্য বিবেচনা করিতে হইবে যে, উহা প্রক্ষিপ্ত। একটা উদাহরণ দিতেছি। আশ্বমেধিক পর্বে অনুগীতা ও ব্রাহ্মণগীতা পর্বাধ্যায় পাওয়া যায়। এই দুইটি ক্ষুদ্র বিষয় নয়, ইহাতে ছত্রিশ অধ্যায় গিয়াছে। কিন্তু পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে উহার কিছু উল্লেখ নাই, সুতরাং বিবেচনা করিতে হইবে যে, অনুগীতা ও ব্রাহ্মণগীতা সমস্তই প্রক্ষিপ্ত।
২য়-অনুক্রমণিকাধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, মহাভারতের লক্ষ শ্লোক, এবং পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে কোন্ পর্বে কত শ্লোক, তাহা লিখিত হইয়াছে। যথা—
আদি … … … ৮৮৮৪
সভা … … … ২৫১১
বন … … … ১১৬৬৪
বিরাট … … … ২০৫০
উদ্যোগ … … … ৬৬৯৮
ভীষ্ম … … … ৫৮৮৪
দ্রোণ … … … ৮৯০৯
কর্ণ … … … ৪৯৬৪
শল্য … … … ৩২২০
সৌপ্তিক … … … ৮৭০
স্ত্রী … … … ৭৭৫
শান্তি … … … ১৪৭৩২
অনুশাসন … … … ৮০০০
আশ্বমেধিক … … … ৩৩২০
আশ্রমবাসিক … … … ১৫০৬
মৌসল … … … ৩২০
মহাপ্রস্থানিক … … … ৩২০
স্বর্গারোহণ … … … ২০৯
ইহাতে কিন্তু লক্ষ শ্লোক হয় না; মোট ৮৪,৮৩৬ হয়। অতএব লক্ষ শ্লোক পূরাইবার জন্য পর্বাধ্যায়সংগ্রকার লিখিলেনঃ—
“অষ্টাদশৈবমুক্তানি পর্বাণ্যেতান্যশেষতঃ।
খিলেষু হরিবংশঞ্চ ভবিষ্যঞ্চ প্রকীর্তিতম্ ||
দশশ্লোকসহস্রাণি বিংশশ্লোকশতানি চ।
খিলেষু হরিবংশে চ সংখ্যাতানি মহর্ষিণা ||”
অর্থাৎ“এইরূপেঅষ্টাদশপর্বসবিস্তারেউক্তহইয়াছে।ইহারপরহরিবংশভবিষ্যপর্ব কথিত হইয়াছে। মহর্ষি হরিবংশে দ্বাদশ সহস্র শ্লোকসংখ্যা করিয়াছেন।” পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে এইটুকু ভিন্ন হরিবংশের আর কোন প্রসঙ্গ নাই। ইহাতে ৯৬,৯৩৬ শ্লোক হইল। এক্ষণে প্রচলিত মহাভারতের শ্লোক গণনা করিয়া নিম্নলিখিত সংখ্যা সকল পাওয়া যায়ঃ—
আদি … … … ৮৪৭৯
সভা … … … ২৭০৯
বন … … … ১৭,৪৭৮
বিরাট … … … ২৩৭৬
উদ্যোগ … … … ৭৬৫৬
||
ভীষ্ম … … … ৫৮৫৬
দ্রোণ … … … ৯৬৪৯
কর্ণ … … … ৫০৪৬
শল্য … … … ৩৬৭১
সৌপ্তিক … … … ৮১১
স্ত্রী … … … ৮২৭
||
শান্তি … … … ১৩,৯৪৩
অনুশাসন … … … ৭৭৯৬
আশ্বমেধিক … … … ২৯০০
আশ্রমবাসিক … … … ১১০৫
মৌসল … … … ২৯২
মহাপ্রস্থানিক … … … ১০৯
স্বর্গারোহণ … … … ৩১২
খিল হরিবংশ … … … ১৬,৩৪৭
মোট ১০৭৩৯০। ইহাতে দেখা যায় যে, প্রথমতঃ মহাভারতে লক্ষ শ্লোক কখনই ছিল না। পর্বসংগ্রহের পর হরিবংশ লইয়া মোটের উপর প্রায় এগার হাজার শ্লোক বাড়িয়াছে, অর্থাৎপ্রক্ষিপ্তহইয়াছে।
তয়—এইরূপ হ্রাসবৃদ্ধির উদাহরণস্বরূপ অনুক্রমণিকাধ্যায়কে গ্রহণ করা যাইতে পারে। অনুক্রমণিকাধ্যায়ে ১০২ শ্লোকে লিখিত আছে যে, ব্যাসদেব সার্ধশত শ্লোকময়ী অনুক্রমণিকা লিখিয়াছিলেন।
“ততোহধ্যর্ধশতং ভূয়ঃ সংক্ষেপং কৃতবানৃষিঃ।
অনুক্রমণিকাধ্যায়ং বৃত্তান্তানাং সপর্বণাম্ ||”
এক্ষণে বর্তমান মহাভারতের অনুক্রমণিকাধ্যায়ে ২৭২ শ্লোক পাওয়া যায়। অতএব পর্বসংগ্রহাধ্যায় লিখিত হওয়ার পরে এই অনুক্রমণিকাতেই ১২২ শ্লোক বেশী পাওয়া যায়।
৪র্থ—পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ৮৪, ৮৩৬ শ্লোকে পাওয়া যায়। কিন্তু সহজেই বুঝা যাইতে পারে যে, পর্বসংগ্রহাধ্যায় আদিম মহাভারতকার কর্তৃক সঙ্কলিত নয় এবং আদিম মহাভারত রচিত হইবার সময়েও সঙ্কলিত হয় নাই। মহাভারতেই আছে যে, মহাভারত বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের নিকট কহিয়াছিলেন। তাহাই উগ্রশ্রবাঃ নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষিগণের নিকট কহিতেছেন। পর্বাধ্যায়সংগ্রহকার এই সংগ্রহ উগ্রশ্রবার উক্তি বলিয়া বর্ণিত করিয়াছেন। বৈশম্পায়নের উক্তি নহে, কাজেই ইহা আদিম বা বৈশম্পায়নের মহাভারতের অংশ নহে। অনুক্রমণিকাধ্যায়েই আছে যে, কেহ কেহ প্রথমাবধি, কেহ বা আস্তীকপর্বাবধি, কেহ বা উপরিচর রাজার উপাখ্যানাবধি মহাভারতের আরম্ভ বিবেচনা করেন। সুতরাং যখন এই মহাভারত উগ্রশ্রবাঃ ঋষিদিগকে শুনাইতেছিলেন, তখনই পর্বসংগ্রহাধ্যায় দূরে থাক, প্রথম ৬২ অধ্যায়, সমস্ত প্রক্ষিপ্ত বলিয়া প্রবাদ ছিল। এই পর্বসংগ্রহাধ্যায় পাঠ করিলেই বিবেচনা করা যায় যে, প্রক্ষিপ্তাংশ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়াতে ভবিষ্যতে তাহার নিবারণের জন্য এই পর্বসংগ্রহাধ্যায় সঙ্কলনপূর্বক অনুক্রমণিকাধ্যায়ের পর কেহ সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। অতএব এই পর্বসংগ্রহাধ্যায় সঙ্কলিত হইবার পূর্বেও যে অনেক অংশ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহাই অনুমেয়।
৫ম,—ঐ অনুক্রমণিকাধ্যায়ে আছে যে, মহাভারত প্রথমতঃ উপাখ্যান ত্যাগ করিয়া চতুর্বিংশতি সহস্র শ্লোকে বিরচিত হয় এবং বেদব্যাস তাহাই প্রথমে স্বীয় পুত্র শুকদেবকে অধ্যয়ন করান।
চতুর্বিংশতিসাহস্রীং চক্রে ভারতসংহিতাম্।
উপাখ্যানৈর্বিনা তাবদ্ভারতং প্রোচ্যতে বুধৈঃ ||
ততোহধ্যর্ধশতং ভূয়্ সংক্ষেপং কৃতবানৃষি।
অনুক্রমণিকাধ্যায়ং বৃত্তান্তানাং সপর্বণাম্ ||
ইদং দ্বৈপায়নঃ পূর্বং পুত্রমধ্যাপয়ৎশুকম্।
ততোহন্যেভ্যোহনুরূপেভ্যঃ শিষ্যেভ্যঃ প্রদদৌ বিভুঃ || —আদিপর্ব, ১০১-১০৩।
শুকদেবের নিকট বৈশম্পায়ন মহাভারতশিক্ষা করিয়াছিলেন। অতএব এই চতুর্বিংশতি-সহস্রশ্লোকাত্মক মহাভারতই জনমেজয়ের নিকট পঠিত হইয়াছিল। এবং আদিম মহাভারতে চতুর্বিংশতি সহস্র মাত্র শ্লোক ছিল। পরে ক্রমে নানা ব্যক্তির রচনা উহাতে প্রক্ষিপ্ত হইয়া মহাভারতের আকার চারিগুণ বাড়িয়াছে। সত্য বটে, ঐ অনুক্রমণিকাতেই লিখিত আছে যে, তাহার পর বেদব্যাস ষষ্টিলক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন, এবং তাহার কিয়দংশ দেবলোকে, কিয়দংশ পিতৃলোকে, কিয়দংশ গন্ধগর্বলোকে ও এক লক্ষ মাত্র মনুষ্যলোকে পঠিত হইয়া থাকে। এই অনৈসর্গিক ব্যাপারঘটিত কথাটা যে আদিম অনুক্রমণিকাধ্যায়ের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে কোনও সংশয় থাকিতে পারে না। দেবলোকে বা পিতৃলোকে বা গন্ধর্বলোকে মহাভারতপাঠ, অথবা বেদব্যাসই হউন বা যেই হউন, ব্যক্তিবিশেষের ষষ্টি লক্ষ শ্লোক রচনা করা আমরা সহজেই অবিশ্বাস করিতে পারি। আমি পূর্বেই দেখাইয়াছি যে, ২৭২ শ্লোকাত্মক উপক্রমণিকার মধ্যে ১২২ শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। এই ষষ্টি লক্ষ শ্লোক এবং লক্ষ শ্লোকের কথা প্রক্ষিপ্তের অন্তর্গত, তাহাতে কোন সংশয় নাই।
প্রক্ষিপ্তনির্বাচনপ্রণালী
আমাদিগের বিচার্য বিষয় যে, মহাভারতের কোন কোন অংশ প্রক্ষিপ্ত। ইহা পূর্বপরিচ্ছেদে স্থির হইয়াছে। এক্ষণে দেখিতে হইবে যে, এই বিচার সম্পন্ন করিবার কোন উপায় আছে কি না। অর্থাৎ কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত এবং কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত নহে, তাহা স্থির করিবার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় কি না?
মনুষ্যজীবনে যে সকল কার্য সম্পন্ন হয়, সকলই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া নির্বাহ করা যায়। তবে বিষয়ভেদে প্রমাণের অল্প বা অধিক বলবত্তা প্রয়োজনীয় হয়। যে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমরা সচরাচর জীবনযাত্রার কার্য নির্বাহ করি, তাহার অপেক্ষা গুরুতর প্রমাণ ব্যতীত আদালতে একটা মোকদ্দমা নিষ্পন্ন হয় না, এবং আদালতে যেরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া বিচারক একটা নিষ্পত্তিতে উপস্থিত হইতে পারেন, তাহার অপেক্ষা বলবান্ প্রমাণ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞানসম্বন্ধীয় কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন না। এই জন্য বিষয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণশাস্ত্র সৃষ্ট হইয়াছে। যথা—আদালতের জন্য প্রমাণসম্বন্ধীয় আইন (Law of Evidence), বিজ্ঞানের জন্য অনুমানতত্ত্ব (Logic বা Inductive Philosophy) এবং ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিরূপণ জন্য এইরূপ একটি প্রমাণশাস্ত্রও আছে। উপস্থিত তত্ত্ব নিরূপণ জন্য সেইরূপ কতকগুলি প্রমাণের নিয়ম সংস্থাপন করা যাইতে পারে; যথা—
১ম,—আমরা পূর্বে পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের কথা বলিয়াছি। যাহার প্রসঙ্গ সেই পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে নাই, তাহা যে নিশ্চিত প্রক্ষিপ্ত, ইহাও বুঝাইয়াছি। এইটিই আমাদিগের প্রথম সূত্র।
২য়,—অনুক্রমণিকাধ্যায়ে লিখিত আছে যে, মহাভারতকার ব্যাসদেবই হউন, আর যিনিই হউন, তিনি মহাভারত রচনা করিয়া সার্ধশত শ্লোকময়ী অনুক্রমণিকায় ভারতীয় নিখিল বৃত্তান্তের সার সঙ্কলন করিলেন। ঐ অনুক্রমণিকাধ্যায়ের ৯৩ শ্লোক হইতে ২৫১ শ্লোক পর্যন্ত এইরূপ একটি সারসঙ্কলন আছে। যদিও ইহাতে সার্ধশতের অপেক্ষা ৯টি শ্লোক বেশী হইল, তাহা না ধরিলেও চলে। এমনও হইতে পারে যে, ৯টি শ্লোক ইহারই মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এখন এই ১৫৯ শ্লোকের মধ্যে যাহার প্রসঙ্গ না পাইব, তাহা আমরা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিতে বাধ্য।
৩য়,—যাহা পরস্পর বিরোধী, তাহার মধ্যে একটি অবশ্য প্রক্ষিপ্ত। যদি দেখি যে, কোন ঘটনা দুই বার বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ দুটি বিবরণ ভিন্নপ্রকার বা পরস্পর বিরোধী, তবে তাহার মধ্যে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করা উচিত। কোন লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি, এবং অনর্থক পুনরুক্তি দ্বারা আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনবধানতা বা অক্ষমতাবশতঃ যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। তাহাও অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।
৪র্থ,—সুকবিদিগের রচনাপ্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। মহাভারতের কতকগুলি এমন অংশ আছে যে, তাহার মৌলিকতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ হইতে পারে না—কেন না, তাহার অভাবে মহাভারতে মহাভারতত্ব থাকে না, দেখা যায় যে, সেগুলির রচনাপ্রণালী সর্বত্র এক প্রকার লক্ষণবিশিষ্ট। যদি আর কোন অংশের রচনা এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই, এবং এমন সকল লক্ষণ আছে যে, তাহা পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে অসঙ্গত, তবে সেই অসঙ্গতলক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়।
৫ম,—মহাভারতের কবি একজন শ্রেষ্ঠ কবি, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসঙ্গত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, তবে সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। মনে কর, যদি কোন হস্তলিখিত মহাভারতের কাপিতে দেখি যে, স্থানবিশেষে ভীষ্মের পরদারপরায়ণতা বা ভীমের ভীরুতা বর্ণিত হইতেছে, তবে জানিব যে, ঐ অংশ প্রক্ষিপ্ত।
৬ষ্ঠ,—যাহা অপ্রাসঙ্গিক, তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, না হইলেও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত পাঁচটি লক্ষণের মধ্যে কোন লক্ষণ দেখিতে পাই, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ আছে।
৭ম,—যদি দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বিবরণের মধ্যে একটিকে তৃতীয় লক্ষণের দ্বারা প্রক্ষিপ্ত বোধ হয়, যেটি অন্য কোন লক্ষণের অন্তর্গত হইবে, সেইটিকেই প্রক্ষিপ্ত বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে।
এখন এই পর্যন্ত বুঝান গেল। নির্বাচনপ্রণালী ক্রমশঃ স্পষ্টতর করা যাইবে।
এই সময়ে জরাসন্ধের উত্তেজনায় আর এক প্রবল শত্রু কৃষ্ণকে আক্রমণ করিবার জন্য উপস্থিত হইল। অনেক গ্রন্থেই দেখা যায় যে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে স্থানে স্থানে যবনদিগের রাজত্ব ছিল। এক্ষণকার পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে প্রাচীন গ্রীকদিগকেই ভারতবর্ষীয়েরা যবন বলিতেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বিশুদ্ধ কি না, তদ্বিষয়ে অনেক সন্দেহ আছে। বোধ হয়, শক, হূণ, গ্রীক প্রভৃতি অহিন্দু সভ্য জাতিমাত্রকেই যবন বলিতেন। যাহাই হউক, ঐ সময়ে, কালযবন নামে একজন নামে একজন যবন রাজা ভারতবর্ষে অতি প্রবলপ্রতাপ হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি আসিয়া সসৈন্যে মথুরা অবরোধ করিলেন। কিন্তু পরমসমররহস্যবিৎ কৃষ্ণ তাঁহার সহিত সসৈন্যে যুদ্ধ করিতে ইচ্ছা করিলেন না। কেন না, ক্ষুদ্র যাদবসেনা তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে বিমুখ করিলেও, সংখ্যায় বড় অল্প হইয়া যাইবে। হতাবশিষ্ট যাহা থাকিবে, তাহারা জরাসন্ধকে বিমুখ করিতে সক্ষম হইতে না পারে। আর ইহাও পশ্চাৎ দেখিব যে, সর্বভূতে দয়াময় কৃষ্ণ প্রাণিহত্যা পক্ষে ধর্ম প্রয়োজন ব্যতীত অনুরাগ প্রকাশ করেন না। যুদ্ধ অনেক সময়েই ধর্মানুমোদিত, সে সময়ে যুদ্ধে অপ্রবৃত্ত হইলে, ধর্মের হানি হয়, গীতায় কৃষ্ণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। এবং এখানেও কালযবন এবং জরাসন্ধের সহিত যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ। আত্মরক্ষার্থে এবং স্বজনরক্ষার্থে, প্রজাগণের রক্ষার্থে যুদ্ধ না করা ঘোরতর অধর্ম। কিন্তু যদি যুদ্ধ করিতেই হইল, তবে যত অল্প মনুষ্যের প্রাণহানি করিয়া কার্য সম্পন্ন করা যায়, ধার্মিকের তাহাই কর্তব্য। আমরা মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায়ে দেখিব যে, যাহাতে অন্য কোন মনুষ্যের জীবন হানি না হইয়া জরাসন্ধবধ সম্পন্ন হয়, কৃষ্ণ তাহার সদুপায় উদ্ভূত করিয়াছিলেন। কালযবনের যুদ্ধেও তাহাই করিলেন। তিনি সসৈন্যে কালযবনের সম্মুখীন না হইয়া কালযবনের বধার্থ কৌশল অবলম্বন করিলেন। একাকী কালযবনের শিবিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কালযবন তাঁহাকে চিনিতে পারিল। কৃষ্ণকে ধরিবার জন্য হাত বাড়াইলে, কৃষ্ণ ধরা না দিয়া পলায়ন করিলেন। কালযবন তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইল। কৃষ্ণ যেমন বেদে বা যুদ্ধবিদ্যায় সুপণ্ডিত, শারীরিক ব্যায়ামেও তদ্রূপ সুপারগ। আদর্শ মনুষ্যের এইরূপ হওয়া উচিত, আমি “ধর্মতত্ত্বে” দেখাইয়াছি। অতএব কালযবন কৃষ্ণকে ধরিতে পারিলেন না। কৃষ্ণ কালযবন কর্তৃক অনুসৃত হইয়া এক গিরিগুহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কথিত আছে, সেখানে মুচুকুন্দ নামে এক ঋষি নিদ্রিত ছিলেন। কালযবন গুহান্ধকারমধ্যে কৃষ্ণকে দেখিতে না পাইয়া, সেই ঋষিকেই কৃষ্ণভ্রমে পদাঘাত করিল। পদাঘাতে উন্নিদ্র হইয়া ঋষি কালযবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র কালযবন ভস্মীভূত হইয়া গেল।
এই অতিপ্রকৃত ব্যাপারটাকে আমরা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। স্থূল কথা এই বুঝি যে, কৃষ্ণ কৌশলাবলম্বনপূর্বক কালযবনকে তাহার সৈন্য হইতে দূরে লইয়া গিয়া, গোপন স্থানে তাহার সঙ্গে দ্বৈরথ্য যুদ্ধ করিয়া তাহাকে নিহত করিয়াছিলেন। কালযবন নিহত হইলে, তাহার সৈন্য সকল ভঙ্গ দিয়া মথুরা পরিত্যাগ করিয়া গেল। তাহার পর জরাসন্ধের অষ্টাদশ আক্রমণ,—সে বারও জরাসন্ধ বিমুখ হইল।
উপরে যেরূপ বিবরণ লিখিত হইল, তাহা হরিবংশে ও বিষ্ণুদিপুরাণে আছে। মহাভারতে জরাসন্ধের যেরূপ পরিচয় কৃষ্ণ স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের কাছে দিয়াছেন, তাহাতে এই অষ্টাদশ বার যুদ্ধের কোন কথাই নাই। জরাসন্ধের সঙ্গে যে যাদবদিগের যুদ্ধ হইয়াছিল, এমন কথাও স্পষ্টতঃ নাই। যাহা আছে, তাহাতে কেবল এইটুকু বুঝা যায় যে, জরাসন্ধ মথুরা একবার আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু হংস নামক তাঁহার অনুগত কোন বীর বলদেব কর্তৃক নিহত হওয়ায় জরাসন্ধ দুঃখিত মনে স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছিলেন। সেই স্থান আমরা উদ্ধৃত করিতেছি:—
“কিয়ৎকাল অতীত হইল, কংস যাদবগণকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ঐ দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবর্গকে পরাজয় করতঃ সর্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠিল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রূরকে আহুককন্যা প্রদান করিয়া জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধানার্থ বলভদ্র সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম। তাহাতে কংসভয় নিবারিত হইল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরেই জরাসন্ধ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিল। তখন আমরা জ্ঞাতি বন্ধুগণের সহিত একত্র হইয়া পরামর্শ করিলাম যে, যদি আমরা শত্রুনাশক মহাস্ত্র দ্বারা তিন শত বৎসর অবিশ্রাম জরাসন্ধের সৈন্য বধ করি, তথাপি নিঃশেষিত করিতে পারিব না। দেবতুল্য তেজস্বী মহাবলপরাক্রান্ত হংস ও ডিম্বক নামক দুই বীর তাহার অনুগত আছে; উহারা অস্ত্রাঘাতে কদাচ নিহত হইবে না। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, এই দুই বীর এবং জরাসন্ধ এই তিন জন একত্র হইলে ত্রিভুবন বিজয় করিতে পারে। হে ধর্মরাজ! এই পরামর্শ কেবল আমাদিগের অভিমত হইল এমত নহে, অন্যান্য ভূপতিগণও উহাতে অনুমোদন করিবেন।
হংস নামে সুবিখ্যাত এক নরপতি ছিলেন। বলদেব তাঁহাকে সংগ্রামে সংহার করেন। ডিম্বক লোকমুখে হংস মরিয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিয়া নামসাদৃশ্যপ্রযুক্ত তাহার সহচর হংস নিধন প্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া স্থির করিল। পরে হংস বিনা আমার জীবন ধারণে প্রয়োজন নাই, এই বিবেচনা করতঃ যমুনায় নিমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিল। এ দিকে তৎ-সহচর হংসও পরম প্রণয়াস্পদ ডিম্বকে আপন মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে প্রাণত্যাগ করিতে শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া যমুনাজলে আত্মসমর্পণ করিল। জরাসন্ধ এই দুই বীর পুরুষের নিধনবার্তা শ্রবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও শূন্যমনা হইয়া স্বনগরে প্রস্থান করিলেন। জরাসন্ধ বিমনা হইয়া স্বপুরে গমন করিলে পর আমরা পরমাহ্লাদে মথুরায় বাস করিতে লাগিলাম।
কিয়দ্দিনান্তর পতিবিয়োগ-দুঃখিনী জরাসন্ধনন্দিনী স্বীয় পিতার সমীপে আগমন পূর্বক আমার পতিহন্তাকে সংহার কর’ বলিয়া বারংবার তাঁহাকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমরা পূর্বেই জরাসন্ধের বলবিক্রমের বিষয় স্থির করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহা স্মরণ করতঃ সাতিশয় উৎকণ্ঠিত হইলাম। তখন আমরা আমাদের বিপুল ধনসম্পত্তি বিভাগ করতঃ সকলে কিছু কিছু লইয়া প্রস্থান করিব, এই স্থির করিয়া স্বস্থান পরিত্যাগ পূর্বক পশ্চিমদিকে পলায়ন করিলাম। ঐ পশ্চিম দেশে রৈবতোপশোভিত পরম রমণীয় কুশস্থলীনাম্নী পুরীতে বাস করিতেছি—তথায় এরূপ দুর্গসংস্কার করিয়াছি যে, সেখানে থাকিয়া বৃষ্ণিবংশীয় মহারথিদিগের কথা দূরে থাকুক, স্ত্রীলোকেরাও অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। হে রাজন্! এক্ষণে আমরা অকুতোভয়ে ঐ নগরীমধ্যে বাস করিতেছি। মাধবগণ সমস্ত মগধদেশব্যাপী সেই সর্বশ্রেষ্ঠ রৈবতক পর্বত দেখিয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। হে কুরুকুলপ্রদীপ! আমরা সামর্থ্যযুক্ত হইয়াও জরাসন্ধের উপদ্রবভয়ে পর্বত আশ্রয় করিয়াছি। ঐ পর্বত দৈর্ঘ্যে তিন যোজন, প্রস্থে এক যোজনের অধিক এবং একবিংশতি শৃঙ্গযুক্ত। উহাতে এক এক যোজনের পর শত শত দ্বার এবং অত্যুৎকৃষ্ট উন্নত তোরণ সকল আছে। যুদ্ধদুর্মদ মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণ উহাতে সর্বদা বাস করিতেছেন। হে রাজন্! আমাদের কুলে অষ্টাদশ সহস্র ভ্রাতা আছে। আহুকের একশত পুত্র, তাহারা সকলেই অমরতুল্য। চারুদেষ্ণ ও তাঁহার ভ্রাতা, চক্রদেব, সাত্যকি, আমি, বলভদ্র, যুদ্ধবিশারদ শাম্ব—আমরা এই সাত জন রথী; কৃতকর্মা, অনাবৃষ্টি, সমীক, সমিতিঞ্জয়, কক্ষ, শঙ্কু ও কুন্তি, এই সাত জন মহারথ, এবং অন্ধকভোজের দুই বৃদ্ধ পুত্র ও রাজা এই মহাবলপরাক্রান্ত দৃঢ়কলেবর দশ জন মহাবীর,—ইঁহারা সকলেই জরাসন্ধাধিকৃত মধ্যম দেশ স্মরণ করিয়া যদুবংশীয়দিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন।”
এই জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায় প্রধানতঃ মৌলিক মহাভারতের অংশ বলিয়া আমার বিশ্বাস। দুএকটা কথা প্রক্ষিপ্ত থাকিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশই মৌলিক। যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে, কৃষ্ণের সহিত জরাসন্ধের বিরোধ-বিষয়ে উপরি উক্ত বৃত্তান্তই প্রামাণিক বলিয়া আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। কেন না, পূর্বে বুঝাইয়াছি যে, হরিবংশ এবং পুরাণ সকলের অপেক্ষা মহাভারতের মৌলিকাংশ অনেক প্রাচীন। যদি এ কথা যথার্থ হয়, তবে জরাসন্ধকৃত অষ্টাদশ বার মথুরা আক্রমণ এবং অষ্টাদশ বার তাহার পরাভব, এ সমস্তই মিথ্যা গল্প। প্রকৃত বৃত্তান্ত এই হইতে পারে যে, একবারমাত্র সে মথুরা আক্রমণে আসিয়াছিল এবং নিষ্ফল হইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়াছিল। দ্বিতীয়বার আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু কৃষ্ণ দেখিলেন যে, চতুর্দিকে সমতল ভূমির মধ্যবর্তী মথুরা নগরীতে বাস করিয়া জরাসন্ধের অসংখ্যসৈন্যকৃত পুনঃপুনঃ অবরোধ নিষ্ফল করা অসম্ভব। অতএব যেখানে দুর্গনির্মাণপূর্বক দুর্গাশ্রয়ে ক্ষুদ্র সেনা রক্ষা করিয়া জরাসন্ধকে বিমুখ করিতে পারিবেন, সেইখানে রাজধানী তুলিয়া লইয়া গেলেন। দেখিয়া জরাসন্ধ আর সে দিকে ঘেঁষিলেন না। জয়-পরাজয়ের কথা ইহাতে কিছুই নাই। ইহাতে কেবল ইহাই বুঝা যায় যে, যুদ্ধকৌশলে কৃষ্ণ পারদর্শী, তিনি পরম রাজনীতিজ্ঞ এবং অনর্থক মনুষ্যহত্যার নিতান্ত বিরোধী। আদর্শ মনুষ্যের সমস্ত গুণ তাঁহাতে ক্রমশঃ পরিস্ফুট হইতেছে।
ইহাকে ‘হরণ’ বলে। হরণ অর্থে কন্যার প্রতি কোনরূপ অত্যাচার বুঝায় না। কন্যার যদি পাত্র অভিমত হয়, এবং সে বিবাহে সে সম্মত থাকে, তবে তাহার প্রতি কি অত্যাচার? রুক্সিণী-হরণেও সে দোষ ঘটে নাই, কেন না, রুক্মিণী কৃষ্ণে অনুরক্তা, এবং পরে দেখাইব যে, কৃষ্ণানুমোদিত অর্জুনকৃত সুভদ্রাহরণেও সে দোষ ঘটে নাই। তবে এরূপ কন্যাহরণে কোন প্রকার দোষ আছে কি না, তাহার বিশেষ বিচার আবশ্যক, এ কথা আমরা স্বীকার করি। আমরা সে বিচার সুভদ্রাহরণের সময় করিব। কে না, কৃষ্ণ নিজেই সে বিচার সেই সময় করিয়াছেন। অতএব এক্ষণে সে বিষয়ে কোন কথা বলিব না।
তবে ইহার ভিতর আর একটা কথা আছে। সে কালে ক্ষত্রিয়রাজগণের বিবাহের দুইটি পদ্ধতি প্রশস্ত ছিল;—এক স্বয়ংবর বিবাহ, আর এক হরণ। কখনও কখনও এক বিবাহে দুই রকম ঘটিয়া যাইত, যথা—কাশিরাজকন্যা অম্বিকাদির বিবাহে। ঐ বিবাহে স্বয়ংবর হয়। কিন্তু আদর্শ ক্ষত্রিয় দেবব্রত ভীষ্ম, স্বয়ংবর না মানিয়া, তিনটি কন্যাই কাড়িয়া লইয়া গেলেন। আর কন্যার স্বয়ংবরই হউক, আর হরণই হউক, কন্যা একজন লাভ করিলে, উদ্ধতস্বভাব রণপ্রিয় ক্ষত্রিয়গণ একটা যুদ্ধবিগ্রহ উপস্থিত করিতেন। ইতিহাসে দ্রৌপদীস্বয়ংবরে এবং কাব্যে ইন্দুমতীস্বয়ংবরে দেখিতে পাই যে, কন্যা হৃতা হয় নাই, তথাপি যুদ্ধ উপস্থিত। মহাভারতের মৌলিক অংশে রুক্মিণী যে হৃতা হইয়াছিলেন, এমন কথাটা পাওয়া যায় না।
শিশুপালবধ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ বলিতেছেন:—
রুক্মিণ্যামস্য মূঢ়স্য প্রার্থনাসীন্মুমূর্ষতঃ।
ন চ তাং প্রাপ্তবান্ মূঢ়ঃশূদ্রো বেদশ্রুতীমিব||
শিশুপালবধপর্বাধ্যায়ে, ৪৫ অঃ, ১৫ শ্লোকঃ।
শিশুপাল উত্তর করিলেন:—
মৎপূর্বাং রুক্মিণীং কৃষ্ণ সংসৎসু পরিকীর্তয়ন্।
বিশেষতঃ পার্থিবেষু ব্রীড়াং ন কুরুষে কথম্ ||
মন্যমানো হি কঃ সৎসু পুরুষঃ পরিকীর্তয়েৎ।
অন্যপূর্বাং স্ত্রিয়ং জাতু ত্বদন্যো মধুসূদন ||
শিশুপালবধপর্বাধ্যায়ে, ৪৫ অঃ, ১৮-১৯ শ্লোকঃ।
ইহাতে এমন কিছুই নাই যে, তাহা হইতে বুঝিতে পারিব যে, রুক্সিণী হৃতা হইয়াছিলেন, বা তজ্জন্য কোন যুদ্ধ হইয়াছিল। তার পর উদ্যোগপর্বে আর এক স্থানে আছে,—
যো রুক্মিণীমেকরথেণ ভোজান্ উৎসাদ্য রাজ্ঞঃ সমরে প্রসহ্য।
উবাহ ভার্যাং যশসা জ্বলন্তীং যস্যাং জজ্ঞে রৌক্মিণেয়ো মহাত্মা||
ইহাতে যুদ্ধের কথা আছে, কিন্তু হরণের কথা নাই।
আর এক স্থানে রুক্মিণীহরণবৃত্তান্ত আছে। উদ্যোগপর্বে সৈন্যনির্যাণ সময়ে রুক্মিণীর ভ্রাতা রুক্মী পাণ্ডবদিগের শিবিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তদুপলক্ষে কথিত হইতেছে:—
“বাহুবলগর্বিত রুক্মী পূর্বে ধীমান্ বাসুদেবের রুক্মিণীহরণ সহ্য করিতে না পারিয়া, ‘আমি কৃষ্ণকে বিনষ্ট না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না’, এইরূপ প্রতিজ্ঞাপূর্বক প্রবৃদ্ধ ভাগীরথীর ন্যায় বেগবতী বিচিত্র আয়ুধধারিণী চতুরঙ্গিণী সেনা সমভিব্যাহারে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন। পরে তাঁহার সন্নিহিত হইবামাত্র পরাজিত ও লজ্জিত হইয়া প্রতিগমন করিলেন। কিন্তু যে স্থানে বাসুদেবকর্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন, তথায় ভোজকট নামক প্রভূত সৈন্য ও গজবাজিসম্পন্ন সুবিখ্যাত এক নগর সংস্থাপন করিয়াছিলেন। এক্ষণে সেই নগর হইতে ভোজরাজ রুক্মী এক অক্ষৌহিণী সেনা সমভিব্যাহারে সত্বরে পাণ্ডবগণের নিকট আগমন করিলেন এবং পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতসারে কৃষ্ণের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত কবচ, ধনু, তলবার, খড়্গ ও শরাসন ধারণ করিয়া আদিত্যসঙ্কাশ ধ্বজের সহিত পাণ্ডবসৈন্যমণ্ডলী মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।”
এই কথা উদ্যোগপর্বে ১৫৭শ অধ্যায়ে আছে। ঐ অধ্যায়ের নাম রুক্মিপ্রত্যাখ্যান। মহাভারতের যে পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের কথা পূর্বে বলিয়াছি, তাহাতে লিখিত আছে যে, উদ্যোগপর্বে ১৮৬ অধ্যায়, এবং ৬৬৯৮ শ্লোক আছে।
“উদ্যোগপর্বনির্দিষ্টং সন্ধিবিগ্রহমিশ্রিতম্।
অধ্যায়ানাং শতং প্রোক্তং ষড়শীতির্মর্ষিণা ||
শ্লোকানাং ষট্সহস্রাণি তাবন্ত্যেব শতানি চ।
শ্লোকাশ্চ নবতিঃ প্রোক্তাস্তথৈবাষ্টৌ মহাত্মনা ||”
মহাভারতম্, আদিপর্ব।
এক্ষণে মহাভারতে ১৯৭ অধ্যায় পাওয়া যায়। অতএব ১১ অধ্যায় পর্বসংগ্রহাধ্যায় সঙ্কলিত হওয়ার পরে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এক্ষণে উদ্যোগপর্বে ৭৬৫৭ শ্লোক পাওয়া যায়। অতএব প্রায় এক হাজার শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। প্রক্ষিপ্ত এই একাদশ অধ্যায় ও সহস্র শ্লোক কোন্গুলি? প্রথমেই দেখিতে হয় যে, উগ্যোগপর্বান্তর্গত কোন্ বৃত্তান্তগুলি পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ধৃত হয় নাই। এই রুক্মিসমাগম বা রুক্মিপ্রত্যাখ্যান পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ধৃত হয় নাই। অতএব ঐ ১৫৭ অধ্যায় প্রক্ষিপ্ত একাদশ অধ্যায়ের মধ্যে একটি, ইহা বিচারসঙ্গত। এই রুক্মিপ্রত্যাখ্যান পর্বাধ্যায়ের সঙ্গে মহাভারতের কোন সম্বন্ধ নাই। রুক্মী সসৈন্যে আসিলেন এবং অর্জুন কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলেন, পশ্চাৎ দুর্যোধন কর্তৃকও পরিত্যক্ত হইলেন, পশ্চাৎ স্বস্থানে চলিয়া গেলেন, ইহা ভিন্ন মহাভারতের সঙ্গে তাঁহার আর কোন সম্বন্ধ নাই। এই দুইটি লক্ষণ একত্রিত করিয়া বিচার করিয়া দেখিলে, অবশ্য বুঝিতে হইবে যে, ১৫৭ অধ্যায় প্রক্ষিপ্ত, কাজেই রুক্মিণীহরণ বৃত্তান্ত মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত। ইহার অন্যতর প্রমাণ এই যে, বিষ্ণুপুরাণে আছে যে, মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বেই রুক্মী বলরাম কর্তৃক অক্ষক্রীড়াজনিত বিবাদে নিহত হইয়াছিলেন। রুক্মিণীকে শিশুপাল কামনা করিয়াছিলেন, ইহা সত্য এবং তিনি রুক্মিণীকে বিবাহ করিতে পান নাই—কৃষ্ণ তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহাও সত্য। বিবাহের পর একটা যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু ‘হরণ’ কথাটা মৌলিক মহাভারতে কোথাও নাই। হরিবংশে ও পুরাণে আছে।
শিশুপাল ভীষ্মকে তিরস্কারের সময় কাশিরাজের কন্যাহরণ জন্য তাঁহাকে গালি দিয়াছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকে তিরস্কারের সময় রুক্মিণীহরণের কোন কথাও তুলেন নাই। অতএব বোধ হয় না যে, রুক্মিণী হৃতা হইয়াছিলেন। পূর্বোদ্ধৃত কথোপকথনে ইহাই সত্য বোধ হয় যে, শিশুপাল রুক্মিণীকে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু ভীষ্মক রুক্মিণীকে কৃষ্ণকেই সম্প্রদান করিয়াছিলেন। তার পর তাঁহার পুত্র রুক্মী শিশুপালের পক্ষ হইয়া বিবাদ উপস্থিত করিয়াছিলেন। রুক্মী অতিশয় কলহপ্রিয় ছিলেন। অনিরুদ্ধের বিবাহকালে দ্যূতোপলক্ষে বলরামের সঙ্গে কলহ উপস্থিত করিয়া নিজেই নিহত হইয়াছিলেন।
এই নরকাসুরবধ হইতে বিষ্ণুপুরাণের মতে পারিজাত হরণের সূত্রপাত। কৃষ্ণ দিতির কুণ্ডল লইয়া অদিতিকে দিবার জন্য সত্যভামা সমভিব্যাহারে ইন্দ্রালয়ে গমন করিলেন। সেখানে সত্যভামা পারিজাত কামনা করায় পারিজাত বৃক্ষ লইয়া ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ বাধিল। ইন্দ্র পরাস্ত হইলেন। হরিবংশে ইহা ভিন্নপ্রকারে লিখিত আছে। কিন্তু যখন আমরা বিষ্ণুপুরাণকে হরিবংশের পূর্বগামী গ্রন্থ বিবেচনা করি, তখন এখানে বিষ্ণুপুরাণেরই অনুবর্তী হইলাম। উভয় গ্রন্থকথিত বৃত্তান্তই অত্যদ্ভুত ও অতিপ্রকৃত। যখন আমরা ইন্দ্র, ইন্দ্রালয় এবং পারিজাতের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অবিশ্বাসী, তখন এই সমস্ত পারিজাতহরণবৃত্তান্তই আমাদের পরিহার্য।
ইহার পর বাণাসুরবধবৃত্তান্ত। তাহাও ঐরূপ অতিপ্রকৃত অদ্ভুতব্যাপার—পরিপূর্ণ, এজন্য তাহাও আমরা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য। তাহার পর পৌণ্ড্র বাসুদেববধ এবং বারাণসীদাহ। ইহার কতকটা ঐতিহাসিকতা আছে বোধ হয়। পৌণ্ড্রদিগের রাজা ঐতিহাসিক, এবং পৌণ্ড্র জাতির কথা ঐতিহাসিক এবং অনৈতিহাসিক সময়েও বিবিধ দেশী বিদেশী গ্রন্থে পাওয়া যায়। রামায়ণে তাহাদিগকে দাক্ষিণাত্যে দেখা যায়, কিন্তু মহাভারতের সময়ে তাহারা আধুনিক বাঙ্গালার পশ্চিমভাগবাসী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পৌণ্ড্রেরা উপস্থিত ছিল। মহাভারতে তাহারা অনার্য জাতির মধ্যে গণিত হইয়াছে। দশকুমারচরিতেও তাহাদিগের কথা আছে এবং একজন চৈনিক পরিব্রাজক তাহাদিগকে বাঙ্গালা দেশে স্থাপিত দেখিয়া গিয়াছেন। তিনি তাহাদিগের রাজধানী পৌণ্ড্রবর্ধনেও গিয়াছিলেন, কৃষ্ণের সময়ে যিনি পৌণ্ড্রদিগের রাজা ছিলেন, তাঁহারও নাম বাসুদেব। বাসুদেব শব্দের অনেক অর্থ হয়। যিনি বসুদেবের পুত্র, তিনি বাসুদেব। এবং যিনি সর্বনিবাস অর্থাৎ সর্বভূতের বাসস্থান, তিনিও বাসুদেব। অতএব যিনি ঈশ্বরের অবতার, তিনিই প্রকৃত বাসুদেব নামের অধিকারী। এই পৌণ্ড্রক বাসুদেব প্রচার করিলেন যে, দ্বারকানিবাসী বাসুদেব, জাল বাসুদেব; তিনি নিজেই প্রকৃত বাসুদেব—ঈশ্বরাবতার। তিনি কৃষ্ণকে বলিয়া পাঠাইলেন যে, তুমি আমার নিকটে আসিয়া, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাদি যে সকল চিহ্নে আমারই প্রকৃত অধিকার, তাহা আমাকেই দিবে। কৃষ্ণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া পৌণ্ড্ররাজ্যে গমন করিলেন এবং চক্রাদি অস্ত্র পৌণ্ড্রকের প্রতি ক্ষিপ্ত করিয়া তাহাকে নিহত করিলেন। বারাণসীর অধিপতিগণ পৌণ্ড্রেকের পক্ষ হইয়াছিল, এবং পৌণ্ড্রকের মৃত্যুর পরেও কৃষ্ণের সঙ্গে শত্রুতা করিয়া, যুদ্ধ করিতেছিল। এজন্য তিনি বারাণসী আক্রমণ করিয়া শত্রুগণকে নিহত করিলেন এবং বারাণসী দগ্ধ করিলেন।
এ স্থলে শত্রুকে নিহত করা অধর্ম নহে, কিন্তু নগরদাহ ধর্মানুমোদিত নহে। পরম ধর্মাত্মা কৃষ্ণের দ্বারা এরূপ কার্য কেন হইয়াছিল, তাহার বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ কিছু পাওয়া যায় না। বিষ্ণুপুরাণে লেখা আছে যে, কাশিরাজ কৃষ্ণহস্তে নিহত হইলে, তাঁহার পুত্র মহাদেবের তপস্যা করিয়া কৃষ্ণের বধের নিমিত্ত “কৃত্যা উৎপন্ন হউক,” এই বর প্রার্থনা করিলেন। কৃত্যা অভিচারকে বলে। অর্থাৎ যজ্ঞ হইতে শরীরবিশিষ্টা অমোঘ কোন শক্তি উৎপন্ন হইয়া শত্রুর বধসাধন করে। মহাদেব প্রার্থিত বর দিলেন। কৃত্যা উৎপন্ন হইয়া ভীষণ মূর্তিধারণপূর্বক কৃষ্ণের বধার্থ ধাবমান হইল। কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রকে আজ্ঞা করিলেন যে, তুমি এই কৃত্যাকে সংহার কর। বৈষ্ণবচক্রের প্রভাবে মাহেশ্বরী কৃত্যা বিধ্বস্তপ্রভাবা হইয়া পলায়ন করিল। চক্রও পশ্চাদ্ধাবিত হইল। কৃত্যা বারাণসী নগর মধ্যে প্রবেশ করিল। চক্রানলে সমস্ত পুরী দগ্ধ হইয়া গেল। ইহা অতিশয় অনৈসর্গিক ও অবিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। হরিবংশে পৌণ্ড্রকবধের কথা আছে, কিন্তু বারাণসীদাহের কথা নাই। কিন্তু ইহার কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ মহাভারতে আছে। অতএব বারাণসীদাহ অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। তবে কি জন্য বারাণসীদাহ করিতে কৃষ্ণ বাধ্য হইয়াছিলেন, তাহার বিশ্বাসযোগ্য কারণ কিছু জানা যায় না।
যে সকল যুদ্ধের কথা কথা বলা গেল, তদ্ভিন্ন উদ্যোগপর্বে ৪৭ অধ্যায়ে অর্জুনবাক্যে কৃষ্ণকৃত গান্ধারজয়, পাণ্ড্যজয়, কলিঙ্গজয়, শাল্বজয় এবং একলব্যের সংহারের প্রসঙ্গ আছে। ইহার মধ্যে শাল্বজয়বৃত্তান্ত মহাভারতের বনপর্বে আছে। ইহা ভিন্ন আর কয়টির কোন বিস্তারিত বিবরণ আমি কোন গ্রন্থে পাইলাম না। বোধ হয়, হরিবংশ ও পুরাণ সকল সংগ্রহের পূর্বে এই সকল যুদ্ধ-বিষয়ক কিম্বদন্তী বিলুপ্ত হইয়াছিল। হরিবংশে ও ভাগবতে অনেক নূতন কথা আছে, কিন্তু মহাভারতে বা বিষ্ণুপুরাণে তাহার কোন প্রসঙ্গ নাই বলিয়া আমি সে সকল পরিত্যাগ করিলাম।
এই কথার উদাহরণস্বরূপ স্যমন্তক মণির বৃত্তান্ত পাঠককে উপহার দিতে ইচ্ছা করি। সামন্তক মণির বৃত্তান্ত অতিপ্রকৃত পরিপূর্ণ। অতিপ্রকৃত অংশ বাদ দিলে যেটুকু থাকিবে, তাহাও কত দূর সত্য, বলা যায় না। যাহা হউক, স্থূল বৃত্তান্ত পাঠককে শুনাইতেছি।
সত্রাজিত নামে এক জন যাদব দ্বারকায় বাস করিতেন। তিনি একটি অতি উজ্জ্বল সর্বজনলোভনীয় মণি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন! মণির নাম স্যমন্তক। কৃষ্ণ সেই মণি দেখিয়া বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, ইহা যাদবাধিপতি উগ্রসেনেরই যোগ্য। কিন্তু জ্ঞাতিবিরোধ-ভয়ে সত্রাজিতের নিকট মণি প্রার্থনা করেন নাই। কিন্তু সত্রাজিত মনে ভয় করিলেন যে, কৃষ্ণ এই মণি চাহিবেন। চাহিলে তিনি রাখিতে পারিবেন না, এই ভয়ে মণি তিনি নিজে ধারণ না করিয়া আপনার ভ্রাতা প্রসেনকে দিয়াছিলেন। প্রসেন সেই মণি ধারণ করিয়া এক দিন মৃগয়ায় গিয়াছিলেন। বনমধ্যে একটা সিংহ তাঁহাকে হত করিয়া সেই মণি মুখে করিয়া লইয়া চলিয়া যায়। জাম্ববান্ সিংহকে হত করিয়া সেই মণি গ্রহণ করে। জাম্ববান্ একটা ভল্লুক। কথিত আছে যে, সে ত্রেতাযুগে রামের বানরসেনার মধ্যে থাকিয়া রামের পক্ষে যুদ্ধ করিয়াছিল।
এ দিকে প্রসেন নিহত এবং মণি অন্তর্হিত জানিতে পারিয়া দ্বারকাবাসী লোকে এইরূপ সন্দেহ করিল যে, কৃষ্ণের যখন এই মণি লইবার ইচ্ছা ছিল, তখন তিনিই প্রসেনকে মারিয়া মণি গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। এইরূপ লোকাপবাদ কৃষ্ণের অসহ্য হওয়ায় তিনি মণির সন্ধানে বহির্গত হইলেন। যেখানে প্রসেনের মৃতদেহ দেখিলেন, সেইখানে সিংহের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন। তাহা সকলকে দেখাইয়া আপনার কলঙ্ক অপনীত করিলেন। পরে সিংহের পদচিহ্নানুসরণ করিয়া ভল্লুকের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন। সেই পদচিহ্ন ধরিয়া গর্তের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তথায় জাম্ববানের পুত্রপালিকা ধাত্রীর হস্তে সেই স্যমন্তক মণি দেখিতে পাইলেন। পরে জাম্ববানের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাভব করিলেন। তখন জাম্ববান্ তাঁহাকে স্যমন্তক মণি দিল, এবং আপনার কন্যা জাম্ববতীকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিল। কৃষ্ণ মণি লইয়া দ্বারকায় আসিয়া মণি সত্রাজিতকেই প্রত্যর্পণ করিলেন। তিনি পরস্ব কামনা করিতেন না। কিন্তু সত্রাজিত, কৃষ্ণের উপর অভূতপূর্ব কলঙ্ক আরোপিত করিয়াছিলেন, এই ভয়ে ভীত হইয়া কৃষ্ণের তুষ্টিসাধনার্থ আপনার কন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন। সত্যভামা সর্বজনপ্রার্থনীয় রূপবতী কন্যা ছিলেন। এজন্য তিন জন প্রধান যাদব, অর্থাৎ শতধন্বা, মহাবীর কৃতবর্মা এবং কৃষ্ণের পরম ভক্ত ও সুহৃৎ অক্রূর ঐ কন্যাকে কামনা করিয়াছিলেন। এক্ষণে সত্যভামা কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা হওয়ায় তাঁহারা আপনাদিগেক অত্যন্ত অপমানিত বিবেচনা করিলেন এবং সত্রাজিতের বধের জন্য ষড়যন্ত্র করিলেন। অক্রূর ও কৃতবর্মা শতধন্বাকে পরামর্শ দিলেন যে, তুমি সত্রাজিতকে বধ করিয়া তাহার মণি চুরি কর। কৃষ্ণ তোমাদের যদি বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাহা হইলে, আমরা তোমার সাহায্য করিব। শতধন্বা সম্মত হইয়া কদাচিৎ কৃষ্ণ বারণাবতে গমন করিলে, সত্রাজিতকে নিদ্রিত অবস্থায় বিনাশ করিয়া মণি চুরি করিলেন।
সত্যভামা পিতৃবধে শোকাতুরা হইয়া কৃষ্ণের নিকট নালিশ করিলেন। কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় প্রত্যাগমন করিয়া, বলরামকে সঙ্গে লইয়া, শতধন্বার বধে উদ্যোগী হইলেন। শুনিয়া শতধন্বা কৃতবর্মা অক্রূরের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। তাঁহারা কৃষ্ণ বলরামের সহিত শত্রুতা করিতে অস্বীকৃত হইলেন। তখন শতধন্বা অগত্যা অক্রূরকে মণি দিয়া দ্রুতগামী ঘোটকে আরোহণ পূর্বক পলায়ন করিলেন। কৃষ্ণ বলরাম রথে যাইতেছিলেন, রথ ঘোটককে ধরিতে পারিল না। শতধন্বার অশ্বিনীও পথক্লান্তা হইয়া প্রাণত্যাগ করিল। শতধন্বা তখন পাদচারে পলায়ন করিতে লাগিল। ন্যায়যুদ্ধপরায়ণ কৃষ্ণ তখন রথে বলরামকে রাখিয়া স্বয়ং পাদচারে শতধন্বার পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন। কৃষ্ণ দুই ক্রোশ গিয়া শতধন্বার মস্তকচ্ছেদন করিলেন। কিন্তু মণি তাঁহার নিকট পাইলেন না। ফিরিয়া আসিয়া বলরামকে এই কথা বলিলে বলরাম তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন না। ভাবিলেন, মণির ভাগে বলরামকে বঞ্চিত করিবার জন্য কৃষ্ণ মিথ্যা কথা বলিতেছেন। বলরাম বলিলেন, “ধিক্ তোমায়! তুমি এমন অর্থলোভী! এই পথ আছে, তুমি দ্বারকায় চলিয়া যাও; আমি আর দ্বারকায় যাইব না।” এই বলিয়া তিনি কৃষ্ণকে ত্যাগ করিয়া বিদেহ নগরে গিয়া তিন বৎসর বাস করিলেন। এদিকে অক্রূরও দ্বারকা ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন। পরে যাদবগণ তাঁহাকে অভয় দিয়া পুনর্বার দ্বারকায় আনাইলেন। কৃষ্ণ তখন এক দিন সমস্ত যাদবগণকে সমবেত করিয়া অক্রূরকে বলিলেন যে, স্যমন্তক মণি তোমার নিকট আছে, আমরা তাহা জানি। সে মণি তোমারই থাক্, কিন্তু সকলকে একবার দেখাও। অক্রূর ভাবিলেন, আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে সন্ধান করিলে, আমার নিকট মণি বাহির হইবে। অতএব তিনি অস্বীকার না করিয়া মণি বাহির করিলেন। তাহা দেখিয়া বলরাম এবং সত্যভামা সেই মণি লইবার জন্য অতিশয় ব্যস্ত হইলেন। কিন্তু সত্যপ্রতিজ্ঞ কৃষ্ণ সেই মণি বলরাম বা সত্যভামা কাহাকেও দিলেন না, আপনিও লইলেন না, অক্রূরকেই প্রত্যর্পণ করিলেন।*
এই স্যমন্তকমণিবৃত্তান্তেও কৃষ্ণের ন্যায়পরতা, স্বার্থশূন্যতা, সত্যপ্রতিজ্ঞতা এবং কার্যদক্ষতা অতি পরিস্ফুট। কিন্তু উপন্যাসটা সত্যমূলক বলিয়া বোধ হয় না।
এই নরকাসুরের ষোল হাজার কন্যার আষাঢ়ে গল্প ছাড়িয়া দিই। কিন্তু তদ্ভিন্ন আট জন “প্রধানা” মহিষীর কথা পাওয়া যাইতেছে। এক জন রুক্মিণী। বিষ্ণুপুরাণকার বলিয়াছেন, আর সাত জন। কিন্তু ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে নাম দিতেছেন আট জনের, যথা—
“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||”
১। কালিন্দী
২। মিত্রবিন্দা
৩। নগ্নজিৎকন্যা সত্যা
৪। জাম্ববতী
৫। রোহিণী (ইনি কামরূপিণী)
৬। মদ্ররাজসুতা সুশীলা
৭। সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৮। লক্ষ্মণা
অবাপ লক্ষ্মণা পুত্রাঃ কালিন্দ্যাঞ্চ শ্রুতাদয়ঃ || ৪||
এই তালিকায় পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
১। সত্যভামা (৭)
৩। জাম্ববতী (৪)
৪। নাগ্নজিতী (৩)
২। রোহিণী (৫)
৫। শৈব্যা (২)
৬। মাদ্রী (৬)
৭। লক্ষ্মণা (৮)
৮। কালিন্দী (১)
কিন্তু ৪র্থ অংশের ১৫ অধ্যায়ে আছে, “তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী-জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।” এখানে আবার সব নাম পাওয়া গেল না, নূতন নাম “জালহাসিনী” একটা পাওয়া গেল। এই গেল বিষ্ণুপুরাণে। হরিবংশে আরও গোলযোগ।
হরিবংশে আছে;—
মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ ||
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||
১১৮ অধ্যায়ে, ৪০-৪৩ শ্লোকঃ।
এখানে পাওয়া যাইতেছে যে, লক্ষ্মণাই জালহাসিনী। তাহা ধরিয়াও পাই,—
১। কালিন্দী
২। মিত্রবিন্দী
৩। সত্যা
৪। জাম্ববৎ-সুতা
৫। রোহিণী
৬। মাদ্রী সুশীলা
৭। সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৮। জালহাসিনী লক্ষ্মণা
৯) শৈব্যা
“সত্যে! যথা ত্বমিত্যুক্তং ত্বয়া কৃষ্ণাসকৃৎপ্রিয়ম্।”
আবশ্যক হইলে, আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা যথেষ্ট।
অতএব এই দশ জনের মধ্যে, সত্যা সত্যভামারই নাম বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন আট জন পাই। যথা—
১। রুক্মিণী ৫। কালিন্দী
২। সত্যভামা ৬। মিত্রবিন্দা
৩। জাম্ববতী ৭। মাদ্রী
৪। শৈব্যা ৮। জালহাসিনী লক্ষ্মণা
ইহার মধ্যে পাঁচ জন—শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, লক্ষ্মণা ও মাদ্রী সুশীলা—ইঁহারা তালিকার মধ্যে আছেন মাত্র। ইঁহাদের কখনও কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই না। ইঁহাদের কবে বিবাহ হইল, কেন বিবাহ হইল, কেহ কিছু বলে না। কৃষ্ণজীবনে ইঁহাদের কোন সংস্পর্শ নাই। ইঁহাদের পুত্রের তালিকা কৃষ্ণপুত্রের তালিকার মধ্যে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে তখনও কর্মক্ষেত্রে দেখি না। ইঁহারা কাহার কন্যা, কোন্ দেশসম্ভূতা, তাহার কোন কথা কোথাও নাই। কেবল, সুশীলা মদ্ররাজকন্যা, ইহাই আছে। কৃষ্ণের সমসাময়িক মদ্ররাজ, নকুল সহদেবের মাতুল, কুরুক্ষেত্রের বিখ্যাত রথী শল্য। তিনি ও কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ দিন, পরস্পরের শত্রুসেনা মধ্যে অবস্থিত। অনেক বার তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে বলিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকে বলিতে হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে শুনিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকেও শুনিতে হইয়াছে। এক পলক জন্য কিছুতেই প্রকাশ নাই যে, কৃষ্ণ শল্যের জামাতা বা ভগিনীপতি, বা তাদৃশ কোন সম্বন্ধবিশিষ্ট। সম্বন্ধের মধ্যে এইটুকু পাই যে, শল্য কর্ণকে বলিয়াছেন, ‘অর্জুন ও বাসুদেবকে এখনই বিনাশ কর’। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে শল্যবধে নিযুক্ত করিয়া তাহার যমস্বরূপ হইলেন। কৃষ্ণ যে মাদ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বোধ হয়। শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা এবং লক্ষ্মণার কুলশীল, দেশ এবং বিবাহবৃত্তান্ত কিছুই কেহ জানে না। তাঁহারাও কাব্যের অলঙ্কার, সে বিষয়ে আমার সংশয় হয় না।
কেন না, কেবল মাদ্রী নয়, জাম্ববতী, রোহিণী ও সত্যভামাকেও ঐরূপ দেখি। জাম্ববতীর সঙ্গে কালিন্দী প্রভৃতির প্রভেদ এই যে, তাঁহার পুত্র শাম্বের নাম, আর পাঁচ জন যাদবের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাম্ব কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ, কেবল এক লক্ষ্মণাহরণে। লক্ষ্মণা দুর্যোধনের কন্যা। মহাভারত যেমন পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত, তেমনি কৌরবদিগেরও জীবনবৃত্ত। লক্ষ্মণাহরণে যদি কিছু সত্য থাকিত, তবে মহাভারতে লক্ষ্মণাহরণ থাকিত। তাহা নাই। লক্ষ্মণাহরণ ভিন্ন যদুবংশধ্বংসেও শাম্বের নায়কতা দেখা যায়। তিনিই পেটে মুসল জড়াইয়া মেয়ে সাজিয়াছিলেন। আমি এই গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বলিয়াছি যে, এই মৌসলপর্ব প্রক্ষিপ্ত। মুসল-ঘটিত বৃত্তান্তটা অতিপ্রকৃত, এজন্য পরিত্যাজ্য। জাম্ববতীর বিবাহের পরে সুভদ্রার বিবাহ—অনেক পরে। সুভদ্রার পৌত্র পরিক্ষিৎ তখন ৩৬ বৎসরের, তখন যদুবংশধ্বংস। সুতরাং যদুবংশধ্বংসের সময় শাম্ব প্রাচীন। প্রাচীন ব্যক্তির গর্ভিণী সাজিয়া ঋষিদের ঠকাইতে যাওয়া অসম্ভব। জাম্ববতী নিজে ভল্লুককন্যা, ভল্লুকী। ভল্লুকী কৃষ্ণভার্যা বা কোন মানুষের ভার্যা হইতে পারে না। এই জন্য রোহিণীকে কামরূপিণী বলা হইয়াছে। কামরূপিণী কেন না, ভল্লুকী হইয়াও মানবরূপিণী হইতে পারিতেন। কামরূপিণী ভল্লুকীতে আমি বিশ্বাসবান্ নহি, এবং কৃষ্ণ ভল্লুককন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি না।
সত্যভামার পুত্র ছিল শুনি, কিন্তু তাঁহারা কোন কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন। তাঁহার প্রতি সন্দেহের এই প্রথম কারণ। যবে সত্যভামা নিজে রুক্মিণীর ন্যায় মধ্যে মধ্যে কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত বটে। তাঁহার বিবাহবৃত্তান্তও সবিস্তারে আলোচনা করা গিয়াছে।
মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে সত্যভামাকে পাওয়া যায়। ঐ পর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত; মহাভারতের বনপর্বের সমালোচনাকালে পাঠক তাহা দেখিতে পাইবেন। ঐখানে দ্রৌপদীসত্যভামা সংবাদ বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পর্বাধ্যায় আছে, তাহাও প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতীয় কথার সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। উহা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিরূপ আচরণ কর্তব্য, তৎসম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধমাত্র। প্রবন্ধটার লক্ষণ আধুনিক।
তার পর উদ্যোগপর্বেও সত্যভামাকে দেখিতে পাই—যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ে। সে স্থানও প্রক্ষিপ্ত, যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ের সমালোচনা কালে দেখাইব। কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বরণ হইয়া উপপ্লব্য নগরে আসিয়াছিলেন—যুদ্ধযাত্রায় সত্যভামাকে সঙ্গে আনিবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সত্যভামা সঙ্গে ছিলেন না, তাহা মহাভারত পড়িলেই জানা যায়। যুদ্ধপর্ব সকলে এবং তৎপরবর্তী পর্ব সকলে কোথাও আর সত্যভামার কথা নাই।
কেবল কৃষ্ণের মানবলীলাসম্বরণের পর, মৌসলপর্বে সত্যভামার নাম আছে। কিন্তু মৌসলপর্বও প্রক্ষিপ্ত, তাহাও পরে দেখাইব।
ফলতঃ মহাভারতের যে সকল অংশ নিঃসন্দেহে মৌলিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, তাহার কোথাও সত্যভামার নাম নাই। প্রক্ষিপ্ত অংশ সকলেই আছে। সত্যভামা সম্বন্ধীয় সন্দেহের এই দ্বিতীয় কারণ।
তার পর বিষ্ণুপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণে ইঁহার বিবাহবৃত্তান্ত স্যমন্তক মণির উপাখ্যানমধ্যে আছে। যে আষাঢ়ে গল্পে কৃষ্ণের সঙ্গে ভল্লুকসুতার পরিণয়, ইঁহার সঙ্গে পরিণয় সেই আষাঢ়ে গল্পে। তার পর কথিত হইয়াছে যে, এই বিবাহের জন্য দ্বেষবিশিষ্ট হইয়া শতধন্বা সত্যভামার পিতা সত্রাজিতকে মারিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে, জতুগৃহদাহপ্রবাদ জন্য পাণ্ডবদিগের অন্বেষণে গিয়াছিলেন। সেইখানে সত্যভামা তাঁহার নিকট নালিশ করিয়া পাঠাইলেন। কথাটা মিথ্যা। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে যান নাই—গেলে মহাভারতে থাকিত। তাহা নাই। এই সকল কথা সন্দেহের তৃতীয় কারণ।
তার পর, বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামাকে কেবল পারিজাতহরণবৃত্তান্তে পাই। সেটা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপার; প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় তাঁহাকে বিষ্ণুপুরাণে কোথাও পাই না। সন্দেহের এই চতুর্থ কারণ।
মহাভারতে আদিপর্বে সম্ভব-পর্বাধ্যায়ে সপ্তষট্টি অধ্যায়ের নাম ‘অংশাবতরণ’। মহাভারতের নায়কনায়িকাগণ কে কোন্ দেব দেবী অসুর রাক্ষসের অংশে জন্মিয়াছিল, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে। শেষ ভাগে লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের অংশ, বলরাম শেষ নাগের অংশ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ, দ্রৌপদী শচীর অংশ, কুন্তী ও মাদ্রী সিদ্ধি ও ধৃতির অংশ। কৃষ্ণমহিষীগণ সম্বন্ধে লেখা আছে যে, কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী অপ্সরাগণের অংশ এবং রুক্মিণী লক্ষ্মী দেবীর অংশ। আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর নাম নাই। সন্দেহের এই পঞ্চম কারণ। সন্দেহের এ কারণ কেবল সত্যভামা সম্বন্ধে নহে। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের সকল প্রধানা মহিষীদিগের প্রতি বর্তে। নরকের ষোড়শ সহস্র কন্যার অনৈসর্গিক কথাটা ছাড়িয়া দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোনও মহিষী ছিল না, ইহাই মহাভারতের এই অংশের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
ভল্লুকদৌহিত্র শাম্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা বাদ দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণীবংশেই রাজা হইল—আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না। এমন হইতেও পারে, ছিল। তখনকার এই রীতিই ছিল। পঞ্চ পাণ্ডবের সকলেরই একাধিক মহিষী ছিল। আদর্শ ধার্মিক ভীষ্ম, কনিষ্ঠ ভ্রাতার জন্য কাশিরাজার তিনটি কন্যা হরণ করিয়া আনিয়াছিলেন। একাধিক বিবাহ যে কৃষ্ণের অনভিমত, এ কথাটাও কোথাও নাই; আমিও বিচারে কোথাও পাই নাই যে, পুরুষের একাধিক বিবাহ সকল অবস্থাতে অধর্ম। ইহা নিশ্চিত বটে যে, সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ন যে, সে কোন মতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তপরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না, তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। আদালতে যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তাহার উদাহরণ আমরা সভ্যতর সমাজে দেখিতে পাইতেছি। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তা বুঝিতে পারি না। ইউরোপ যিহুদার নিকট শিখিয়াছিল যে, কোন অবস্থাতেই দারান্তর গ্রহণ করিতে নাই। যদি ইউরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেন্রীকে কথায় কথায় পত্নীহত্যা করিতে হইত না। ইউরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যাহাই বিলাতী, তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।
কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোন গণনীয় প্রমাণ নাই, ইহা দেখিয়াছি। যদি করিয়া থাকেন, তবে কেন করিয়াছিলেন, তাহারও কোন বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত নাই। যে যে তাঁহাকে স্যমন্তক মণি উপহার দিল, সে সঙ্গে সঙ্গে অমনি একটি কন্যা উপহার দিল, ইহা পিতামহীর উপকথা। আর নরকরাজার ষোল হাজার মেয়ে, ইহা প্রপিতামহীর উপকথা। আমরা শুনিয়া খুসী—বিশ্বাস করিতে পারি না।
দেখিয়াছি, বাল্যে কৃষ্ণ শারীরিক বলে আদর্শ বলবান্। তাঁহার অশিক্ষিত বলপ্রভাবে বৃন্দাবন হিংস্রজন্তু প্রভৃতি হইতে সুরক্ষিত হইত। তাঁহার অশিক্ষিত বলেও কংসের মল্ল প্রভৃতি নিহত হইয়াছিল। গোচারণকালে গোপালগণের সঙ্গে সর্বদা ক্রীড়া ও ব্যায়ামাদিতে তিনি শারীরিক বলের স্ফূর্তি জন্মাইয়াছিলেন। দেখিয়াছি, দ্রুতগমনে কালযবনও তাঁহাকে পারেন নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁহার রথসঞ্চালনবিদ্যার বিশেষ প্রশংসা দেখা যায়।
এই বল শিক্ষিত হইলে, তিনি সে সময়ের ক্ষত্রিয়সমাজে সর্বপ্রধান অস্ত্রবিৎ বলিয়া গণ্য হইয়াছিলেন। কেহ কখন তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারেন নাই। তিনি কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি সে সময়ের সর্বপ্রধান যোদ্ধৃগণের সঙ্গে, এবং অন্যান্য বহুতর রাজগণের সঙ্গে,—কাশী, কলিঙ্গ, পৌণ্ড্রক, গান্ধার প্রভৃতি রাজাদিগের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সকলকেই পরাভূত করিয়াছিলেন, কেহ কখন তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারেন নাই। তাঁহার যুদ্ধশিষ্যেরা, যথা—সাত্যকি ও অভিমন্যু যুদ্ধে প্রায় অপরাজেয় হইয়াছিলেন। স্বয়ং অর্জুনও তাঁহার নিকট কোন কোন বিষয়ে যুদ্ধ সম্বন্ধে শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন।
কেবল শারীরিক বলের ও শিক্ষার উপর যে রণপটুতা নির্ভর করে, পুরাণেতিহাসে তাহারই প্রশংসা দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেরূপ রণপটুতা একজন সামান্য সৈনিকেরও থাকিতে পারে। সৈনাপত্যই যোদ্ধার প্রকৃত গুণ। সৈনাপত্যে সে সময়ের যোদ্ধৃগণ পটু ছিলেন না। মহাভারতে বা পুরাণে কাহারও সে গুণের বড় পরিচয় পাই না, ভীষ্মের বা অর্জুনেরও নহে। কৃষ্ণের সৈনাপত্যের বিশেষ কিছু পরিচয় পাওয়া যায়, জরাসন্ধযুদ্ধে। তাঁহার সৈনাপত্য গুণে ক্ষুদ্রা যাদবসেনা জরাসন্ধের সংখ্যাতীত সেনা মথুরা হইতে বিমুখ করিয়াছিল। সেই অগণনীয়া সেনার ক্ষয়, যাদবসেনার দ্বারা অসাধ্য জানিয়া মথুরা পরিত্যাগ, নূতন নগরীর নির্মাণার্থ সাগরদ্বীপ দ্বারকার নির্বাচন, এবং তাহার সম্মুখস্থ রৈবতক পর্বতমালায় দুর্ভেদ্য দুর্গশ্রেণীনির্মাণ যে রণনীতিজ্ঞতার পরিচয়, সেরূপ পরিচয় পুরাণেতিহাসে কোন ক্ষত্রিয়েরই পাওয়া যায় না। পুরাণকার ঋষিদিগের ইহা অবোধগম্য—অতএব ইহাও এক অন্যতর প্রমাণ যে, কৃষ্ণেতিহাস তাঁহাদের কল্পনামাত্রপ্রসূত নহে।
শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকলও চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত, তাহারও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। তিনি অদ্বিতীয় বেদজ্ঞ, ইহাই ভীষ্ম তাঁহার অর্ঘপ্রাপ্তির অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। শিশুপাল সে কথার অন্য উত্তর দেন নাই, কেবল ইহাই বলিয়াছিলেন যে, তবে বেদব্যাস থাকিতে কৃষ্ণের পূজা কেন?
কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকল যে চরমোৎকর্ষ প্রাপ্ত হইয়াছিল, কৃষ্ণপ্রচারিত ধর্মই ইহার তীব্রোজ্জ্বল প্রমাণ। এই ধর্ম যে কেবল গীতাতেই পাওয়া যায়, এমত নহে, মহাভারতের অন্য স্থানেও পাওয়া যায়, ইহা দেখিয়াছি। কৃষ্ণকথিত ধর্মের অপেক্ষা উন্নত, সর্বলোকহিতকর, সর্বজনের আচরণীয় ধর্ম আর কখন পৃথিবীতে প্রচারিত হয় নাই, ইহা গ্রন্থান্তরে বলিয়াছি। এই ধর্মে যে জ্ঞানের পরিচয় দেয়, তাহা প্রায় মনুষ্যাতীত। কৃষ্ণ মানুষী শক্তির দ্বারা সকল কার্য সিদ্ধ করেন, ইহা আমি পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি ও প্রমাণীকৃত করিতেছি। কেবল এই গীতায়, শ্রীকৃষ্ণ প্রায় অনন্ত জ্ঞানের আশ্রয় লইয়াছেন।
সর্বজনীন ধর্ম হইতে অবতরণ করিয়া রাজধর্মে বা রাজনীতি সম্বন্ধেও দেখিতে পাই যে, কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকল চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্ভ্রান্ত রাজনীতিজ্ঞ বলিয়াই যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের পরামর্শ পাইয়াও কৃষ্ণের পরামর্শ ব্যতীত রাজসূয় যজ্ঞে হস্তার্পণ করিলেন না। অবাধ্য যাদবেরা এবং বাধ্য পাণ্ডবেরা তাঁহাকে না জিজ্ঞাসা করিয়া কিছু করিতেন না। জরাসন্ধকে নিহত করিয়া, কারারুদ্ধ রাজগণকে মুক্ত করা, উন্নত রাজনীতির অতি উৎকৃষ্ট উদাহরণ— সাম্রাজ্য স্থাপনের অল্পায়াসসাধ্য অথচ পরম ধর্ম্য উপায়। ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের পর, ধর্মরাজ্য শাসনের জন্য রাজধর্মনিয়োগ ভীষ্মের দ্বারা রাজব্যবস্থা সংস্থাপন করান, রাজনীতিজ্ঞতার দ্বিতীয় অতিপ্রশংসীয় উদাহরণ। আরও অনেক উদাহরণ পাঠক পাইয়াছেন।
কৃষ্ণের বুদ্ধি, চরম স্ফূর্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া, তাহা সর্বব্যাপিনী, সর্বদর্শিনী, সকল প্রকার উপায়ের উদ্ভাবিনী, ইহা আমরা পুনঃ পুনঃ দেখিয়াছি। মনুষ্যশরীর ধারণ করিয়া যত দূর সর্বজ্ঞ হওয়া যায়, কৃষ্ণ তত দূর সর্বজ্ঞ। অপূর্ব অধ্যাত্মতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব, যাহার উপরে আজিও মনুষ্যবুদ্ধি আর যায় নাই, তাহা হইতে চিকিৎসাবিদ্যা ও সঙ্গীতবিদ্যা এমন কি, অশ্বপরিচর্যা পর্যন্ত তাঁহার আয়ত্ত ছিল। উত্তরার মৃত পুত্রের পুনর্জীবন একের উদাহরণ; বিখ্যাত বংশীবিদ্যা দ্বিতীয়ের, এবং জয়দ্রথবধের দিবসে অশ্বের শল্যোদ্ধার তৃতীয়ের উদাহরণ।
কৃষ্ণের কার্যকারিণী বৃত্তি সকলও চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত। তাঁহার সাহস, ক্ষিপ্রকারিতা, এবং সর্বকর্মে তৎপরতার অনেক পরিচয় দিয়াছি। তাঁহার ধর্ম এবং সত্য যে অবিচলিত, এই গ্রন্থে তাহার প্রমাণ পরিপূর্ণ। সর্বজনে দয়া ও প্রীতিই এই ইতিহাসে পরিস্ফুট হইয়াছে। বলদৃপ্তগণের অপেক্ষা বলবান্ হইয়াও লেকাহিতার্থ তিনি শান্তির জন্য দৃঢ়যত্ন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সর্বলোকহিতৈষী, কেবল মনুষ্যের নহে—গোবৎসাদি তির্যক্ যোনির প্রতিও তাঁহার দয়া। গিরিযজ্ঞে তাহা পরিস্ফুট। ভাগবতকারকথিত বাল্যকালে বানরদিগের জন্য নবনীত চুরির এবং ফলবিক্রেত্রীর কথা কতদূর কিম্বদন্তীমূলক, বলা যায় না। কিন্তু যিনি গোবৎসের উত্তম ভোজন জন্য ইন্দ্রযজ্ঞ বন্ধ করাইলেন, ইহাও তাঁহার চরিত্রানুমোদিত। তিনি আত্মীয় স্বজন জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কিরূপ হিতৈষী, তাহা দেখিয়াছি, কিন্তু ইহাও দেখিয়াছি, আত্মীয় পাপাচারী হইলে তিনি তাহার শত্রু। তাঁহার অপরিসীম ক্ষমাগুণ দেখিয়াছি, আবার ইহাও দেখিয়াছি যে, সময় উপস্থিত দেখিলে তিনি অযোনির্মিত হৃদয়ে অকুণ্ঠিতভাবে দণ্ডবিধান করেন। তিনি স্বজনপ্রিয়, কিন্তু লেকাহিতার্থে স্বজনের বিনাশেও তিনি কুণ্ঠিত হইতেন না। কংস মাতুল; পাণ্ডবেরা যাহা, শিশুপালও তাহা;—পিতৃষ্বসার পুত্র; উভয়কেই দণ্ডিত করিলেন; তারপর, পরিশেষে স্বয়ং যাদবেরা সুরাপায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণ হইলেও, তাহাদিগকেও রক্ষা করিলেন না।
এই সকল শ্রেষ্ঠ বৃত্তি কৃষ্ণে চরম স্ফূর্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলনে তিনি অপরাঙ্মুখ ছিলেন না, কেন না, তিনি আদর্শ মনুষ্য। যে জন্য বৃন্দাবন ব্রজলীলা, পরিণত বয়সে সেই উদ্দেশ্যে সমুদ্রবিহার, যমুনাবিহার, রৈবতক-বিহার। তাহার বিস্তারিত বর্ণনা আবশ্যক বিবেচনা করি নাই।
কেবল একটা কথা এখন বাকি আছে। ধর্মতত্ত্বে বলিয়াছি, ভক্তিই মনুষ্যের প্রধানা বৃত্তি। কৃষ্ণ আদর্শ মনুষ্য, মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচারের জন্য অবতীর্ণ—তাঁহার ভক্তির স্ফূর্তি দেখিলাম কই। কিন্তু যদি তিনি ঈশ্বরাবতার হয়েন, তবে তাঁহার এই ভক্তির পাত্র কে? তিনি নিজে।* নিজের প্রতি যে ভক্তি, সে কেবল আপনাকে পরমাত্মা হইতে অভিন্ন হইলেই উপস্থিত হয়। ইহা জ্ঞানমার্গের চরম। ইহাকে আত্মরতি বলে। ছান্দোগ্য উপনিষদে উহা এইরূপ কথিত হইয়াছে—“য এবং পশ্যন্বেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড় ভবতীতি।”
“যে ইহা দেখিয়া, ইহা ভাবিয়া, ইহা জানিয়া, আত্মায় রত হয়, আত্মাতেই ক্রীড়াশীল হয়, আত্মাই যাহার মিথুন (সহচর), আত্মাই যাহার আনন্দ, সে স্বরাট্।”
ইহাই গীতায় ব্যাখ্যাত হইয়াছে, কৃষ্ণ আত্মারাম; আত্মা জগন্ময়; তিনি সেই জগতে প্রীতি-বিশিষ্ট। পরমাত্মার আত্মরতি আর কোন প্রকার বুঝিতে পারি না। অন্ততঃ আমি বুঝাইতে পারি না।
উপসংহারের বক্তব্য, কৃষ্ণ সর্বত্র সর্বসময়ে সর্বগুণের অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, পুণ্যময়, প্রীতিময়, দয়াময়, অনুষ্ঠেয় কর্মে অপরাঙ্মুখ-ধর্মাত্মা, বেদজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, শাস্তা, নির্মম, নিরহঙ্কার, যোগযুক্ত, তপস্বী। তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা কর্ম নির্বাহ করেন, কিন্তু তাঁহার চরিত্র অমানুষ। এই প্রকার মানুষী শক্তির দ্বারা অতিমানুষ চরিত্রের বিকাশ হইতে তাঁহার মনুষ্যত্ব বা ঈশ্বরত্ব অনুমিত করা বিধেয় কি না, তাহা পাঠক আপন বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে স্থির করিবেন। যিনি মীমাংসা করিবেন যে, কৃষ্ণ মনুষ্যমাত্র ছিলেন, তিনি অন্ততঃ Rhys Davids শাক্যসিংহ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, কৃষ্ণকে তাহাই বলিবেন; “The Wisest and Greatest of the Hindus.” আর যিনি বুঝিবেন যে, এই কৃষ্ণচরিত্রে ঈশ্বরের প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়, তিনি যুক্তকরে, বিনীতভাবে এই গ্রন্থ সমাপনকালে আমার সঙ্গে বলুন—
নাকারণাৎ কারণাদ্বা কারণাকারণান্ন চ।
শরীরগ্রহণং বাপি ধর্মত্রাণায় তে পরম্ ||
আমাদিগের বিচার্য বিষয় যে, মহাভারতের কোন কোন অংশ প্রক্ষিপ্ত। ইহা পূর্বপরিচ্ছেদে স্থির হইয়াছে। এক্ষণে দেখিতে হইবে যে, এই বিচার সম্পন্ন করিবার কোন উপায় আছে কি না। অর্থাৎ কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত এবং কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত নহে, তাহা স্থির করিবার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় কি না?
মনুষ্যজীবনে যে সকল কার্য সম্পন্ন হয়, সকলই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া নির্বাহ করা যায়। তবে বিষয়ভেদে প্রমাণের অল্প বা অধিক বলবত্তা প্রয়োজনীয় হয়। যে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমরা সচরাচর জীবনযাত্রার কার্য নির্বাহ করি, তাহার অপেক্ষা গুরুতর প্রমাণ ব্যতীত আদালতে একটা মোকদ্দমা নিষ্পন্ন হয় না, এবং আদালতে যেরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া বিচারক একটা নিষ্পত্তিতে উপস্থিত হইতে পারেন, তাহার অপেক্ষা বলবান্ প্রমাণ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞানসম্বন্ধীয় কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন না। এই জন্য বিষয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণশাস্ত্র সৃষ্ট হইয়াছে। যথা—আদালতের জন্য প্রমাণসম্বন্ধীয় আইন (Law of Evidence), বিজ্ঞানের জন্য অনুমানতত্ত্ব (Logic বা Inductive Philosophy) এবং ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিরূপণ জন্য এইরূপ একটি প্রমাণশাস্ত্রও আছে। উপস্থিত তত্ত্ব নিরূপণ জন্য সেইরূপ কতকগুলি প্রমাণের নিয়ম সংস্থাপন করা যাইতে পারে; যথা—
১ম,—আমরা পূর্বে পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের কথা বলিয়াছি। যাহার প্রসঙ্গ সেই পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে নাই, তাহা যে নিশ্চিত প্রক্ষিপ্ত, ইহাও বুঝাইয়াছি। এইটিই আমাদিগের প্রথম সূত্র।
২য়,—অনুক্রমণিকাধ্যায়ে লিখিত আছে যে, মহাভারতকার ব্যাসদেবই হউন, আর যিনিই হউন, তিনি মহাভারত রচনা করিয়া সার্ধশত শ্লোকময়ী অনুক্রমণিকায় ভারতীয় নিখিল বৃত্তান্তের সার সঙ্কলন করিলেন। ঐ অনুক্রমণিকাধ্যায়ের ৯৩ শ্লোক হইতে ২৫১ শ্লোক পর্যন্ত এইরূপ একটি সারসঙ্কলন আছে। যদিও ইহাতে সার্ধশতের অপেক্ষা ৯টি শ্লোক বেশী হইল, তাহা না ধরিলেও চলে। এমনও হইতে পারে যে, ৯টি শ্লোক ইহারই মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এখন এই ১৫৯ শ্লোকের মধ্যে যাহার প্রসঙ্গ না পাইব, তাহা আমরা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিতে বাধ্য।
৩য়,—যাহা পরস্পর বিরোধী, তাহার মধ্যে একটি অবশ্য প্রক্ষিপ্ত। যদি দেখি যে, কোন ঘটনা দুই বার বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ দুটি বিবরণ ভিন্নপ্রকার বা পরস্পর বিরোধী, তবে তাহার মধ্যে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করা উচিত। কোন লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি, এবং অনর্থক পুনরুক্তি দ্বারা আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনবধানতা বা অক্ষমতাবশতঃ যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। তাহাও অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।
৪র্থ,—সুকবিদিগের রচনাপ্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। মহাভারতের কতকগুলি এমন অংশ আছে যে, তাহার মৌলিকতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ হইতে পারে না—কেন না, তাহার অভাবে মহাভারতে মহাভারতত্ব থাকে না, দেখা যায় যে, সেগুলির রচনাপ্রণালী সর্বত্র এক প্রকার লক্ষণবিশিষ্ট। যদি আর কোন অংশের রচনা এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই, এবং এমন সকল লক্ষণ আছে যে, তাহা পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে অসঙ্গত, তবে সেই অসঙ্গতলক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়।
৫ম,—মহাভারতের কবি একজন শ্রেষ্ঠ কবি, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসঙ্গত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, তবে সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। মনে কর, যদি কোন হস্তলিখিত মহাভারতের কাপিতে দেখি যে, স্থানবিশেষে ভীষ্মের পরদারপরায়ণতা বা ভীমের ভীরুতা বর্ণিত হইতেছে, তবে জানিব যে, ঐ অংশ প্রক্ষিপ্ত।
৬ষ্ঠ,—যাহা অপ্রাসঙ্গিক, তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, না হইলেও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত পাঁচটি লক্ষণের মধ্যে কোন লক্ষণ দেখিতে পাই, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ আছে।
৭ম,—যদি দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বিবরণের মধ্যে একটিকে তৃতীয় লক্ষণের দ্বারা প্রক্ষিপ্ত বোধ হয়, যেটি অন্য কোন লক্ষণের অন্তর্গত হইবে, সেইটিকেই প্রক্ষিপ্ত বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে।
এখন এই পর্যন্ত বুঝান গেল। নির্বাচনপ্রণালী ক্রমশঃ স্পষ্টতর করা যাইবে।
নির্বাচনের ফল
মহাভারত পুনঃ পুনঃ পড়িয়া এবং উপরিলিখিত প্রণালীর অনুবর্তী হইয়া বিচারপূর্বক আমি এইটুকু বুঝিয়াছি যে, এই গ্রন্থের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। প্রথম, একটি আদিম কঙ্কাল; তাহাতে পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত এবং আনুষঙ্গিক কৃষ্ণকথা ভিন্ন আর কিছুই নাই। ইহা বড় সংক্ষিপ্ত। বোধ হয়, ইহাই সেই চতুর্বিংশতিসহস্রশ্লোকাত্মিকা ভারতসংহিতা। তাহার পর আর এক স্তর আছে, তাহা প্রথম স্তর হইতে ভিন্নলক্ষণাক্রান্ত; অথচ তাহার অংশ সমুদায় এক লক্ষণাক্রান্ত। আমরা দেখিব যে, মহাভারতের কোন কোন অংশের রচনা অতি উদার, বিকৃতিশূন্য, অতি উচ্চ কবিত্বপূর্ণ। অন্য অংশ অনুদার, কিন্তু পরমার্থিক দার্শনিকতত্ত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, সুতরাং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্রাপ্ত; কবিত্বশূন্য নহে, কিন্তু যে কবিত্ব আছে, সে কবিত্বের প্রধান অংশ অঘটনঘটনকৌশল, তদ্বিষয়ে সৃষ্টিচাতুর্য। প্রথম শ্রেণীর লক্ষণাক্রান্ত যে সকল অংশ, সেগুলি এক জনের রচনা; দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট যে সকল রচনা, তাহাই তাহাই দ্বিতীয় ব্যক্তির রচনা বলিয়া বোধ হয়। প্রথম শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট অংশই প্রাথমিক, বা আদিম; এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণযুক্ত অংশগুলি পরে রচিত হইয়া, তাহার উপর প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, এরূপ বিবেচনা করা যাইতে পারে। কেন না, প্রথম কথিত অংশ উঠাইয়া লইলে, মহাভারত থাকে না; যাহা থাকে, তাহা কঙ্কালবিচ্যুতমাংসপিণ্ডের ন্যায় বন্ধনশূন্য এবং প্রয়োজনশূন্য নিরর্থক বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট যাহা, তাহা উঠাইয়া লইলে, মহাভারতের কিছু ক্ষতি হয় না, কেবল কতকগুলি নিষ্প্রয়োজনীয় অলঙ্কার বাদ যায়; পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত অখণ্ড থাকে। অতএব প্রথম শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট অংশগুলিকে আমি প্রথম স্তর, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণবিশিষ্ট রচনাগুলিকে দ্বিতীয় স্তর বিবেচনা করি। প্রথম স্তরে ও দ্বিতীয় স্তরে, আর একটা গুরুতর প্রভেদ এই দেখিব যে, প্রথমস্তরে কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার বা বিষ্ণুর অবতার বলিয়া সচরাচর পরিচিত নহেন; নিজে তিনি আপনার দেবত্ব স্বীকার করেন না; এবং মানুষী ভিন্ন দৈবী শক্তি দ্বারা কোন কর্ম সম্পন্ন করেন না। কিন্তু দ্বিতীয় স্তরে, তিনি স্পষ্টত্ বিষ্ণুর অবতার বা নারায়ণ বলিয়া পরিচিত এবং অর্চিত; নিজেও নিজের ঈশ্বরত্ব ঘোষিত করেন; কবিও তাঁহার ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করিবার জন্য বিশেষ প্রকারে যত্নশীল।
ইহা ভিন্ন মহাভারতে আরও এক স্তর আছে। তাহাকে তৃতীয় স্তর বলিতেছি। তৃতীয় স্তর অনেক শতাব্দী ধরিয়া গঠিত হইয়াছে। যে যাহা যখন রচিয়া “বেশ রচিয়াছি” মনে করিয়াছে, সে তাহাই মহাভারতে পূরিয়া দিয়াছে। মহাভারত পঞ্চম বেদ। এ কথার একটি গূঢ় তাৎপর্য আছে। চারি বেদে শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের অধিকার নাই কিন্তু Mass Education লইয়া তর্কবিতর্ক আজ নূতন ইংরেজের আমলে হইতেছে না। অসাধারণ প্রতিভাশালী ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন যে, বিদ্যা ও জ্ঞানে স্ত্রীলোকের ও ইতর লোকের, উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গে সমান অধিকার। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, আপামর সাধারণ সকলেরই শিক্ষা ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই। কিন্তু তাঁহারা আধুনিক হিন্দুদিগের মত প্রতিভাশালী পূর্বপুরুষদিগকে অবজ্ঞা করিতেন না। তাঁহারা “অতীতের সহিত বর্তমানের বিচ্ছেদকে” বড় ভয় করিতেন। পূর্বপুরুষেরা বলিয়া গিয়াছেন যে, বেদে শূদ্র ও স্ত্রীলোকের অধিকার নাই।—ভাল, সে কথা বজায় রাখা যাউক। তাঁহারা ভাবিলেন, যদি এমন কিছু উপায় করা যায় যে, যাহা শিখিবার, তাহা স্ত্রীলোকে ও শূদ্রে বেদ অধ্যয়ন না করিয়াও এক স্থানে পাইবে, তবে সে কথা বজায় রাখিয়া চলা যায়। বরং যাহা সর্বজনমনোহর, এমন সামগ্রীর সঙ্গে যুক্ত হইয়া সর্বলোকের নিকট সে শিক্ষা বড় আদরণীয় হইবে। তিন স্তরে সম্পূর্ণ যে মহাভারত এখন আমরা পড়ি, তাহা ব্রাহ্মণদিগের লোক-শিক্ষার উদ্দেশে অক্ষয় কীর্তি;* কিন্তু এই কারণে ভালমন্দ অনেক কথাই ইহার ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে। শান্তিপর্ব ও অনুশাসনিক পর্বের অধিকাংশ, ভীষ্মপর্বের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায়, বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা পর্বাধ্যায়, উদ্যোগপর্বের প্রজাগর পর্বাধ্যায়, এই তৃতীয় স্তর-সঞ্চয় কালে রচিত বলিয়া বোধ হয়। পক্ষান্তরে আদিপর্বের শকুন্তলোপাখ্যানের পূর্বের যে অংশ এবং বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায় প্রভৃতি অপকৃষ্ট অংশও এই স্তর-গত।
এই তিন স্তরের, নিম্ন অর্থাৎ প্রথম স্তরই প্রাচীন, এই জন্যই তাহাই মৌলিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। যাহা সেখানে নাই, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরে দেখিলে, তাহা কবিকল্পিত অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত বলিয়া আমাদিগের পরিত্যাগ করা উচিত।
ইহা ভিন্ন মহাভারতে আরও এক স্তর আছে। তাহাকে তৃতীয় স্তর বলিতেছি। তৃতীয় স্তর অনেক শতাব্দী ধরিয়া গঠিত হইয়াছে। যে যাহা যখন রচিয়া “বেশ রচিয়াছি” মনে করিয়াছে, সে তাহাই মহাভারতে পূরিয়া দিয়াছে। মহাভারত পঞ্চম বেদ। এ কথার একটি গূঢ় তাৎপর্য আছে। চারি বেদে শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের অধিকার নাই কিন্তু Mass Education লইয়া তর্কবিতর্ক আজ নূতন ইংরেজের আমলে হইতেছে না। অসাধারণ প্রতিভাশালী ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন যে, বিদ্যা ও জ্ঞানে স্ত্রীলোকের ও ইতর লোকের, উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গে সমান অধিকার। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, আপামর সাধারণ সকলেরই শিক্ষা ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই। কিন্তু তাঁহারা আধুনিক হিন্দুদিগের মত প্রতিভাশালী পূর্বপুরুষদিগকে অবজ্ঞা করিতেন না। তাঁহারা “অতীতের সহিত বর্তমানের বিচ্ছেদকে” বড় ভয় করিতেন। পূর্বপুরুষেরা বলিয়া গিয়াছেন যে, বেদে শূদ্র ও স্ত্রীলোকের অধিকার নাই।—ভাল, সে কথা বজায় রাখা যাউক। তাঁহারা ভাবিলেন, যদি এমন কিছু উপায় করা যায় যে, যাহা শিখিবার, তাহা স্ত্রীলোকে ও শূদ্রে বেদ অধ্যয়ন না করিয়াও এক স্থানে পাইবে, তবে সে কথা বজায় রাখিয়া চলা যায়। বরং যাহা সর্বজনমনোহর, এমন সামগ্রীর সঙ্গে যুক্ত হইয়া সর্বলোকের নিকট সে শিক্ষা বড় আদরণীয় হইবে। তিন স্তরে সম্পূর্ণ যে মহাভারত এখন আমরা পড়ি, তাহা ব্রাহ্মণদিগের লোক-শিক্ষার উদ্দেশে অক্ষয় কীর্তি;* কিন্তু এই কারণে ভালমন্দ অনেক কথাই ইহার ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে। শান্তিপর্ব ও অনুশাসনিক পর্বের অধিকাংশ, ভীষ্মপর্বের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায়, বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা পর্বাধ্যায়, উদ্যোগপর্বের প্রজাগর পর্বাধ্যায়, এই তৃতীয় স্তর-সঞ্চয় কালে রচিত বলিয়া বোধ হয়। পক্ষান্তরে আদিপর্বের শকুন্তলোপাখ্যানের পূর্বের যে অংশ এবং বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায় প্রভৃতি অপকৃষ্ট অংশও এই স্তর-গত।
এই তিন স্তরের, নিম্ন অর্থাৎ প্রথম স্তরই প্রাচীন, এই জন্যই তাহাই মৌলিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। যাহা সেখানে নাই, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরে দেখিলে, তাহা কবিকল্পিত অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত বলিয়া আমাদিগের পরিত্যাগ করা উচিত।
* স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতং—শ্রীমদ্ভাগবত। ১ স্ক। ৪অ। ২৫।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতং—শ্রীমদ্ভাগবত। ১ স্ক। ৪অ। ২৫।
অনৈসর্গিক বা অতিপ্রকৃত
এতদূরে আমরা যে কথা পাইলাম, তাহা স্থূলতঃ এইঃ— যে সকল গ্রন্থে কৃষ্ণকথা আছে, তাহার মধ্যে মহাভারত সর্বপূর্ববর্তী। তবে, আমাদিগের মধ্যে যে মহাভারত প্রচলিত, তাহার তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত; এক ভাগ মাত্র মৌলিক। সেই এক ভাগের কিছু ঐতিহাসিকতা আছে। কিন্তু, সেই ঐতিহাসিকতা কতটুকু?
এই প্রশ্নের উত্তরে কেহ কেহ বলিবেন যে, সে বিচারে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কেন না মহাভারত ব্যাসদেবপ্রণীত; ব্যাসদেব মহাভারতের যুদ্ধের সমকালিক ব্যক্তি; মহাভারত সমসাময়িক আখ্যান,—Contemporary History, ইহার মৌলিক অংশ অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য।
এখন যে মহাভারত প্রচলিত, তাহাকে ঠিক সমসাময়িক গ্রন্থ বলিতে পারি না। আদিম মহাভারত ব্যাসদেবের প্রণীত হইতে পারে, কিন্তু আমরা কি তাহা পাইয়াছি? প্রক্ষিপ্ত বাদ দিলে যাহা থাকে, তাহা কি ব্যাসদেবের রচনা? যে মহাভারত এখন প্রচলিত, তাহা উগ্রশ্রবাঃ সৌতি নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষিদিগের নিকট বলিতেছেন। তিনি বলেন যে, জনমেজয়ের সর্পসত্রে বৈশম্পায়নের নিকট যে মহাভারত শুনিয়াছিলেন, তাহাই তিনি ঋষিদিগের শুনাইবেন। স্থানান্তরে কথিত হইয়াছে যে, উগ্রশ্রবাঃ সৌতি তাঁহার পিতার কাছেই বৈশম্পায়ন-সংহিতা অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। এক্ষণে মহাভারতে ব্যাসের জন্মবৃত্তান্তের পর, ৬৩ অধ্যায়ে, বৈশম্পায়ন কর্তৃকই কথিত হইয়াছে যে—
বেদানধ্যাপয়ামাস মহাভারতপঞ্চমান্। সুমন্তুং জৈমিনিং পৈলং শুকঞ্চৈব স্বমাত্মজম্ || প্রভুর্বরিষ্ঠো বরদো বৈশম্পায়নমেব চ। সংহিতাস্তৈঃ পৃথক্ত্বেন ভারতস্য প্রকাশিতাঃ || —আদিপর্ব। ৬৩অ। / ৯৫-৯৬
অর্থাৎ ব্যাসদেব, বেদ এবং পঞ্চম বেদ মহাভারত সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, স্বীয় পুত্র শুক, এবং বৈশম্পায়নকে শিখাইলেন। তাঁহারা পৃথক্ পৃথক্ ভারতসংহিতা প্রকাশিতা করিলেন।*
তাহা হইলে, প্রচলিত মহাভারত বৈশম্পায়ন প্রণীত ভারতসংহিতা। ইহা জনমেজয়ের সভায় প্রথম প্রচারিত হয়। জনমেজয়, পাণ্ডবদিগের প্রপৌত্র।
সে যাহা হউক, উপস্থিত মহাভারত আমরা বৈশম্পায়নের নিকটও পাইতেছি না। উগ্রশ্রবাঃ বলিতেছেন যে, আমি ইহা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছি। অথবা তাঁহার পিতা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছিলেন, তিনি তাঁহার পিতার নিকট পাইয়াছিলেন। উগ্রশ্রবাঃ যাহা বলিতেছেন, তাহা আমরা আর এক ব্যক্তির নিকট পাইতেছি। সেই ব্যক্তিই বর্তমান মহাভারতের প্রথম অধ্যায়ের প্রণেতা, এবং মহাভারতের অনেক স্থানে তিনিই বক্তা।
তিনি বলিতেছেন, নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষি উপস্থিত; সেখানে উগ্রশ্রবাঃ আসিলেন, এবং ঋষিগণের সঙ্গে উগ্রশ্রবাঃর এই ভারত সম্বন্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে যে কথোপকথন হইল, তাহাও তিনি বলিতেছেন।
তবে ইহা স্থির যে, (১) প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়সিকী সংহিতা নহে। (২) ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না, তাহা সন্দেহ। তার পর প্রমাণ করিয়াছি যে, (৩) ইহার প্রায় তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত। অতএব আমাদের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক যে, মহাভারতকে কৃষ্ণচরিত্রের ভিত্তি করিতে গেলে অতি সাবধান হইয়া এই গ্রন্থের ব্যবহার করিতে হইবে।
সেই সাবধানতার জন্য আবশ্যক যে, যাহা অতিপ্রকৃত বা অনৈসর্গিক, তাহাতে আমরা বিশ্বাস করিব না।
আমি এমন বলি না যে, আমরা যাহাকে অনৈসর্গিক বলি, তাহা কাজে কাজেই মিথ্যা। আমি জানি যে, এমন অনেক নৈসর্গিক নিয়ম আছে, যাহা আমরা অবগত নহি। যেমন একজন বন্যজাতীয় মনুষ্য, একটা ঘড়ি, কি বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রীকে অনৈসর্গিক ব্যাপার মনে করিতে পারে, আমরাও অনেক ঘটনাকে সেইরূপ ভাবি। আপনাদিগের এরূপ অজ্ঞতা স্বীকার করিয়াও বিশেষ প্রমাণ ব্যতীত, কোন অনৈসর্গিক ঘটনায় বিশ্বাস করিতে পারি না। কেন না, আপনার জ্ঞানের অতিরিক্ত কোন ঐশিক নিয়ম প্রমাণ ব্যতীত কাহারও স্বীকার করা কর্তব্য নহে। যদি তোমাকে কেহ বলে, আমগাছে তাল ফলিতেছে দেখিয়াছি, তোমার তাহা বিশ্বাস করা কর্তব্য নহে। তোমাকে বলিতে হইবে, হয় আমগাছে তাল দেখাও, নয় বুঝাইয়া দাও কি প্রকারে ইহা হইতে পারে। আর যে ব্যক্তি বলিতেছে যে, আমগাছে তাল ফলিয়াছে, সে ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি দেখি নাই—শুনিয়াছি,’ তবে অবিশ্বাসের কারণ আরও গুরুতর হয়। কেন না, এখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাওয়া গেল না। মহাভারতও তাই। অতিপ্রকৃতের প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাইতেছি না।
বলিয়াছি যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইলেও অতিপ্রকৃত হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। নিজে চক্ষে দেখিলে হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, বরং আমাদিগের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি সম্ভব, তথাপি প্রাকৃতিক নিয়মলঙ্ঘন সম্ভব নহে। বুঝাইয়া দাও যে, যাহাকে অতিপ্রকৃত বলিতেছি, তাহা প্রাকৃতিক নিয়মসঙ্গত, তবে বুঝিব। বন্যজাতীয়কে ঘড়ি বা বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রী বুঝাইয়া দিলে, সে ইহা অনৈসর্গিক ব্যাপার বলিয়া বিশ্বাস করিবে না।
আর ইহাও বক্তব্য যে, যদি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করা যায় (আমি তাহা করিয়া থাকি), তাহা হইলে, তাঁহার ইচ্ছায় যে কোন অনৈসর্গিক ব্যাপার সম্পাদিত হইতে পারে না ইহা বলা যাইতে পারে না। তবে যতক্ষণ না শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারা যায়, এবং যতক্ষণ না এমন বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি মনুষ্য-দেহ ধারণ করিয়া ঐশী শক্তি দ্বারা তাঁহার অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতেন, ততক্ষণ আমি অনৈসর্গিক ঘটনা তাঁহার ইচ্ছা দ্বারা সিদ্ধ বলিয়া পরিচিত করিতে পারি না বা বিশ্বাস করিতে পারি না।
কেবল তাহাই নহে। যদি স্বীকার করা যায় যে, কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার, তিনি স্বেচ্ছাক্রমে অতিপ্রকৃত ঘটনাও ঘটাইতে পারেন, তাহা হইলেও গোল মিটে না। যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ, তাহাতে যেন বিশ্বাস করিলাম, কিন্তু যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ নহে, এমন সকল অনৈসর্গিক ব্যাপারে বিশ্বাস করিব কেন? সাল্ব অসুর অন্তরীক্ষে সৌভনগর স্থাপিত করিয়া যুদ্ধ করিল; বাণের সহস্র বাহু; অশ্বত্থামা ব্রহ্মশিরা অস্ত্র ত্যাগ করিলে তাহাতে ব্রহ্মাণ্ড দগ্ধ হইতে লাগিল; এবং পরিশেষে অশ্বত্থামার আদেশানুসারে, উত্তরার গর্ভস্থ বালককে গর্ভমধ্যে নিহত করিল, ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বাস করিব কেন?
তার পর কৃষ্ণের নিজ-কৃত অনৈসর্গিক কর্মেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করিলেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তিনি মানবশরীর ধারণ করিয়া যদি কোন অনৈসর্গিক কর্ম করেন, তবে তাহা তাঁহার দৈবী বা ঐশী শক্তির দ্বারা! কিন্তু দৈবী বা ঐশী শক্তি দ্বারা যদি কর্ম সম্পাদন করিবেন, তবে তাঁহার মানব-শরীরধারণের প্রয়োজন কি? যিনি সর্বকর্তা সর্বশক্তিমান্, ইচ্ছাময়—যাঁহার ইচ্ছায় এই সমস্ত জীবের সৃষ্টি ও ধ্বংস হইয়া থাকে, তিনি মনুষ্যশরীর ধারণ না করিয়াও কেবল তাঁহার ঐশী শক্তির প্রয়োগের দ্বারা, যে কোন অসুরের বা মানুষের সংহার বা অন্য যে কোন অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতে পারেন। যদি দৈবী শক্তি বা ঐশী শক্তি দ্বারা কার্য নির্বাহ করিবেন, তবে তাঁহার মনুষ্যশরীরধারণের প্রয়োজন নাই। যদি ইচ্ছাময় ইচ্ছাপূর্বক মনুষ্যের শরীর ধারণ করেন, তবে দৈবী বা ঐশী শক্তির প্রয়োগ তাঁহার উদ্দেশ্য বা অভিপ্রেত হইতে পারে না।
তবে শরীরধারণের প্রয়োজন কি? এমন কোন কর্ম আছে কি যে, জগদীশ্বর শরীরধারণ না করিলে সিদ্ধ হয় না?
ইহার উত্তরের প্রথমে এই আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে যে, জগদীশ্বরের মানবশরীরধারণ কি সম্ভব?
প্রথমে ইহার মীমাংসা করা যাইতেছে।
এই প্রশ্নের উত্তরে কেহ কেহ বলিবেন যে, সে বিচারে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কেন না মহাভারত ব্যাসদেবপ্রণীত; ব্যাসদেব মহাভারতের যুদ্ধের সমকালিক ব্যক্তি; মহাভারত সমসাময়িক আখ্যান,—Contemporary History, ইহার মৌলিক অংশ অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য।
এখন যে মহাভারত প্রচলিত, তাহাকে ঠিক সমসাময়িক গ্রন্থ বলিতে পারি না। আদিম মহাভারত ব্যাসদেবের প্রণীত হইতে পারে, কিন্তু আমরা কি তাহা পাইয়াছি? প্রক্ষিপ্ত বাদ দিলে যাহা থাকে, তাহা কি ব্যাসদেবের রচনা? যে মহাভারত এখন প্রচলিত, তাহা উগ্রশ্রবাঃ সৌতি নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষিদিগের নিকট বলিতেছেন। তিনি বলেন যে, জনমেজয়ের সর্পসত্রে বৈশম্পায়নের নিকট যে মহাভারত শুনিয়াছিলেন, তাহাই তিনি ঋষিদিগের শুনাইবেন। স্থানান্তরে কথিত হইয়াছে যে, উগ্রশ্রবাঃ সৌতি তাঁহার পিতার কাছেই বৈশম্পায়ন-সংহিতা অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। এক্ষণে মহাভারতে ব্যাসের জন্মবৃত্তান্তের পর, ৬৩ অধ্যায়ে, বৈশম্পায়ন কর্তৃকই কথিত হইয়াছে যে—
বেদানধ্যাপয়ামাস মহাভারতপঞ্চমান্। সুমন্তুং জৈমিনিং পৈলং শুকঞ্চৈব স্বমাত্মজম্ || প্রভুর্বরিষ্ঠো বরদো বৈশম্পায়নমেব চ। সংহিতাস্তৈঃ পৃথক্ত্বেন ভারতস্য প্রকাশিতাঃ || —আদিপর্ব। ৬৩অ। / ৯৫-৯৬
অর্থাৎ ব্যাসদেব, বেদ এবং পঞ্চম বেদ মহাভারত সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, স্বীয় পুত্র শুক, এবং বৈশম্পায়নকে শিখাইলেন। তাঁহারা পৃথক্ পৃথক্ ভারতসংহিতা প্রকাশিতা করিলেন।*
তাহা হইলে, প্রচলিত মহাভারত বৈশম্পায়ন প্রণীত ভারতসংহিতা। ইহা জনমেজয়ের সভায় প্রথম প্রচারিত হয়। জনমেজয়, পাণ্ডবদিগের প্রপৌত্র।
সে যাহা হউক, উপস্থিত মহাভারত আমরা বৈশম্পায়নের নিকটও পাইতেছি না। উগ্রশ্রবাঃ বলিতেছেন যে, আমি ইহা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছি। অথবা তাঁহার পিতা বৈশম্পায়নের নিকট পাইয়াছিলেন, তিনি তাঁহার পিতার নিকট পাইয়াছিলেন। উগ্রশ্রবাঃ যাহা বলিতেছেন, তাহা আমরা আর এক ব্যক্তির নিকট পাইতেছি। সেই ব্যক্তিই বর্তমান মহাভারতের প্রথম অধ্যায়ের প্রণেতা, এবং মহাভারতের অনেক স্থানে তিনিই বক্তা।
তিনি বলিতেছেন, নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষি উপস্থিত; সেখানে উগ্রশ্রবাঃ আসিলেন, এবং ঋষিগণের সঙ্গে উগ্রশ্রবাঃর এই ভারত সম্বন্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে যে কথোপকথন হইল, তাহাও তিনি বলিতেছেন।
তবে ইহা স্থির যে, (১) প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়সিকী সংহিতা নহে। (২) ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না, তাহা সন্দেহ। তার পর প্রমাণ করিয়াছি যে, (৩) ইহার প্রায় তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত। অতএব আমাদের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক যে, মহাভারতকে কৃষ্ণচরিত্রের ভিত্তি করিতে গেলে অতি সাবধান হইয়া এই গ্রন্থের ব্যবহার করিতে হইবে।
সেই সাবধানতার জন্য আবশ্যক যে, যাহা অতিপ্রকৃত বা অনৈসর্গিক, তাহাতে আমরা বিশ্বাস করিব না।
আমি এমন বলি না যে, আমরা যাহাকে অনৈসর্গিক বলি, তাহা কাজে কাজেই মিথ্যা। আমি জানি যে, এমন অনেক নৈসর্গিক নিয়ম আছে, যাহা আমরা অবগত নহি। যেমন একজন বন্যজাতীয় মনুষ্য, একটা ঘড়ি, কি বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রীকে অনৈসর্গিক ব্যাপার মনে করিতে পারে, আমরাও অনেক ঘটনাকে সেইরূপ ভাবি। আপনাদিগের এরূপ অজ্ঞতা স্বীকার করিয়াও বিশেষ প্রমাণ ব্যতীত, কোন অনৈসর্গিক ঘটনায় বিশ্বাস করিতে পারি না। কেন না, আপনার জ্ঞানের অতিরিক্ত কোন ঐশিক নিয়ম প্রমাণ ব্যতীত কাহারও স্বীকার করা কর্তব্য নহে। যদি তোমাকে কেহ বলে, আমগাছে তাল ফলিতেছে দেখিয়াছি, তোমার তাহা বিশ্বাস করা কর্তব্য নহে। তোমাকে বলিতে হইবে, হয় আমগাছে তাল দেখাও, নয় বুঝাইয়া দাও কি প্রকারে ইহা হইতে পারে। আর যে ব্যক্তি বলিতেছে যে, আমগাছে তাল ফলিয়াছে, সে ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি দেখি নাই—শুনিয়াছি,’ তবে অবিশ্বাসের কারণ আরও গুরুতর হয়। কেন না, এখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাওয়া গেল না। মহাভারতও তাই। অতিপ্রকৃতের প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাইতেছি না।
বলিয়াছি যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইলেও অতিপ্রকৃত হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। নিজে চক্ষে দেখিলে হঠাৎ বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, বরং আমাদিগের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি সম্ভব, তথাপি প্রাকৃতিক নিয়মলঙ্ঘন সম্ভব নহে। বুঝাইয়া দাও যে, যাহাকে অতিপ্রকৃত বলিতেছি, তাহা প্রাকৃতিক নিয়মসঙ্গত, তবে বুঝিব। বন্যজাতীয়কে ঘড়ি বা বৈদ্যুতিক সংবাদতন্ত্রী বুঝাইয়া দিলে, সে ইহা অনৈসর্গিক ব্যাপার বলিয়া বিশ্বাস করিবে না।
আর ইহাও বক্তব্য যে, যদি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করা যায় (আমি তাহা করিয়া থাকি), তাহা হইলে, তাঁহার ইচ্ছায় যে কোন অনৈসর্গিক ব্যাপার সম্পাদিত হইতে পারে না ইহা বলা যাইতে পারে না। তবে যতক্ষণ না শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারা যায়, এবং যতক্ষণ না এমন বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি মনুষ্য-দেহ ধারণ করিয়া ঐশী শক্তি দ্বারা তাঁহার অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতেন, ততক্ষণ আমি অনৈসর্গিক ঘটনা তাঁহার ইচ্ছা দ্বারা সিদ্ধ বলিয়া পরিচিত করিতে পারি না বা বিশ্বাস করিতে পারি না।
কেবল তাহাই নহে। যদি স্বীকার করা যায় যে, কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার, তিনি স্বেচ্ছাক্রমে অতিপ্রকৃত ঘটনাও ঘটাইতে পারেন, তাহা হইলেও গোল মিটে না। যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ, তাহাতে যেন বিশ্বাস করিলাম, কিন্তু যাহা তাঁহার দ্বারা সিদ্ধ নহে, এমন সকল অনৈসর্গিক ব্যাপারে বিশ্বাস করিব কেন? সাল্ব অসুর অন্তরীক্ষে সৌভনগর স্থাপিত করিয়া যুদ্ধ করিল; বাণের সহস্র বাহু; অশ্বত্থামা ব্রহ্মশিরা অস্ত্র ত্যাগ করিলে তাহাতে ব্রহ্মাণ্ড দগ্ধ হইতে লাগিল; এবং পরিশেষে অশ্বত্থামার আদেশানুসারে, উত্তরার গর্ভস্থ বালককে গর্ভমধ্যে নিহত করিল, ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বাস করিব কেন?
তার পর কৃষ্ণের নিজ-কৃত অনৈসর্গিক কর্মেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করিলেও অবিশ্বাস করিবার কারণ আছে। তিনি মানবশরীর ধারণ করিয়া যদি কোন অনৈসর্গিক কর্ম করেন, তবে তাহা তাঁহার দৈবী বা ঐশী শক্তির দ্বারা! কিন্তু দৈবী বা ঐশী শক্তি দ্বারা যদি কর্ম সম্পাদন করিবেন, তবে তাঁহার মানব-শরীরধারণের প্রয়োজন কি? যিনি সর্বকর্তা সর্বশক্তিমান্, ইচ্ছাময়—যাঁহার ইচ্ছায় এই সমস্ত জীবের সৃষ্টি ও ধ্বংস হইয়া থাকে, তিনি মনুষ্যশরীর ধারণ না করিয়াও কেবল তাঁহার ঐশী শক্তির প্রয়োগের দ্বারা, যে কোন অসুরের বা মানুষের সংহার বা অন্য যে কোন অভিপ্রেত কার্য সম্পাদন করিতে পারেন। যদি দৈবী শক্তি বা ঐশী শক্তি দ্বারা কার্য নির্বাহ করিবেন, তবে তাঁহার মনুষ্যশরীরধারণের প্রয়োজন নাই। যদি ইচ্ছাময় ইচ্ছাপূর্বক মনুষ্যের শরীর ধারণ করেন, তবে দৈবী বা ঐশী শক্তির প্রয়োগ তাঁহার উদ্দেশ্য বা অভিপ্রেত হইতে পারে না।
তবে শরীরধারণের প্রয়োজন কি? এমন কোন কর্ম আছে কি যে, জগদীশ্বর শরীরধারণ না করিলে সিদ্ধ হয় না?
ইহার উত্তরের প্রথমে এই আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে যে, জগদীশ্বরের মানবশরীরধারণ কি সম্ভব?
প্রথমে ইহার মীমাংসা করা যাইতেছে।
* জৈমিনিভারতের নাম শুনিতে পাওয়া যায়। ইহার অশ্বমেধ-পর্ব বেবর সাহেব দেখিয়াছেন। আর সকল বিলুপ্ত হইয়াছে। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে আছে—“সুমন্তুজৈমিনিবৈশম্পায়নপৈল-সূত্র-ভারতমহাভারত-ধর্মচার্যাঃ। তাহা হইলে সুমন্তসূত্রকার, জৈমিনি ভারতকার, বৈশম্পায়ন মহাভারতকার, এবং পৈল ধর্মশাস্ত্রকার।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া কি সম্ভব?
বস্তুতঃ কৃষ্ণচরিত্রের আলোচনার প্রথমেই কাহারও কাহারও কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় যে, ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া কি সম্ভব? এ দেশের লোকের বিশ্বাস, কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার। শিক্ষিতের বিশ্বাস যে, কথাটা অতিশয় অবৈজ্ঞানিক, এবং আমাদিগের খ্রীষ্টান উপদেশকদিগের মতে অতিশয় উপহাসের যোগ্য বিষয়।
এখানে একটা নহে, দুইটি প্রশ্ন হইতে পারে—(১) ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব কি না, (২) তাহা হইলে কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার কি না। আমি এই দ্বিতীয় প্রশ্নের কোন উত্তর দিব না। প্রথম প্রশ্নের কিছু উত্তর দিতে ইচ্ছা করি।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদিগের খ্রীষ্টীয়ান গুরুদিগের সঙ্গে আমাদিগের এই স্থূল কথা লইয়া মতভেদ হইবার সম্ভাবনা নাই। তাঁহাদিগকে ঈশ্বরের অবতার সম্ভব বলিয়া মানিতে হয়, নহিলে যিশু টিকেন না। আমাদিগের প্রধান বিবাদ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে।
ইঁহাদিগের মধ্যে অনেকে এই আপত্তি করিবেন, যেখানে আদৌ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণাভাব, সেখানে আবার ঈশ্বরের অবতার কি? যাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, আমরা তাঁহাদিগের সঙ্গে কোন বিচার করি না। তাঁহাদের ঘৃণা করিয়া বিচার করি না, এমত নহে। তবে জানা আছে যে, এ বিচারে কোন পক্ষের উপকার হয় না। তাঁহারা আমাদের ঘৃণা করেন, তাহাতে আপত্তি নাই।
তাহার পর আর কতকগুলি লোক আছেন যে, তাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁহারা বলিবেন, ঈশ্বর নির্গুণ। সগুণেরই অবতার সম্ভব। ঈশ্বর নির্গুণ, সুতরাং তাঁহার অবতার অসম্ভব।
এ আপত্তিরও আমাকে বড় সোজা উত্তর দিতে হয়। নির্গুণ ঈশ্বর কি, তাহা আমি বুঝিতে পারি না, সুতরাং এ আপত্তির মীমাংসা করিতে সক্ষম নহি। আমি জানি যে, বিস্তর পণ্ডিত ও ভাবুক ঈশ্বরকে নির্গুণ বলিয়াই মানেন। আমি পণ্ডিতও নহি, ভাবুকও নহি, কিন্তু আমার মনে মনে বিশ্বাস যে, এই ভাবুক পণ্ডিতগণও আমার মত, নির্গুণ ঈশ্বর বুঝিতে পারেন না, কেন না, মনুষ্যের এমন কোন চিত্তবৃত্তি নাই, যদ্দ্বারা আমরা নির্গুণ ঈশ্বর বুঝিতে পারি। ঈশ্বর নির্গুণ হইলে হইতে পারেন, কিন্তু আমরা নির্গুণ বুঝিতে পারি না, কেন না, আমাদের সে শক্তি নাই।[1] মুখে বলিতে পারি বটে যে, ঈশ্বর নির্গুণ, এবং এই কথার উপর একটা দর্শনশাস্ত্র গড়িতে পারি, কিন্তু যাহা কথায় বলিতে পারি, তাহা যে মনে বুঝি, ইহা অনিশ্চিত। “চতুষ্কোণ গোলক” বলিলে আমাদের রসনা বিদীর্ণ হয় না বটে, কিন্তু “চতুষ্কোণ গোলক” মানে ত কিছুই বুঝিলাম না। তাই হর্বর্ট স্পেন্সর এত কাল পরে নির্গুণ ঈশ্বর ছাড়িয়া দিয়া সগুণেরও অপেক্ষা যে সগুণ ঈশ্বর (“Something higher than personality”) তাহাতে আসিয়া পড়িয়াছেন। অতএব আইস, আমরাও নির্গুণ ঈশ্বরের কথা ছাড়িয়া দিই। ঈশ্বরকে নির্গুণ বলিলে স্রষ্টা বিধাতা, পাতা, ত্রাণকর্তা কাহাকেও পাই না। এমন ঝক্মারিতে কাজ কি?
যাঁহারা সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করেন, তাঁহাদেরও ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা স্বীকার পক্ষে অনেকগুলি আপত্তি আছে। এক আপত্তি এই যে ঈশ্বর সগুণ হউন, কিন্তু নিরাকার। যিনি নিরাকার, তিনি আকার ধারণ করিবেন কি প্রকারে?
উত্তরে, জিজ্ঞাসা করি, যিনি ইচ্ছাময় এবং সর্বশক্তিমান্, তিনি ইচ্ছা করিলে নিরাকার হইলেও আকার ধারণ করিতে পারেন না কেন? তাঁহার সর্বশক্তিমত্তার এ সীমানির্দেশ কর কেন? তবে কি তাঁহাকে সর্বশক্তিমান্ বলিতে চাও না? যিনি এই জড় জগৎকে আকার প্রদান করিয়াছেন, তিনি ইচ্ছা করিলে নিজে আকার গ্রহণ করিতে পারেন না কেন?
যাঁহারা এ আপত্তি না করেন, তাঁহারা বলিতে পারেন ও বলেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান্, তাঁহার জগৎ-শাসনের জন্য, জগতের হিত জন্য, মনুষ্যকলেবর ধারণ করিবার প্রয়োজন কি? যিনি ইচ্ছাক্রমেই কোটি কোটি বিশ্ব সৃষ্ট ও বিধ্বস্ত করিতেছেন, রাবণ কুম্ভকর্ণ কি কংস শিশুপাল-বধের জন্য তাঁহাকে নিজে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, বালক হইয়া মাতৃস্তন্য পান করিতে হইবে, ক, খ, গ, ঘ শিখিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতে হইবে, তাহার পর দীর্ঘ মনুষ্য-জীবনের অপার দুঃখ ভোগ করিয়া শেষে স্বয়ং অস্ত্রধারণ করিয়া, আহত বা কখন পরাজিত হইয়া, বহ্বায়াসে দুরাত্মাদের বধসাধন করিতে হইবে, ইহা অতি অশ্রদ্ধেয় কথা।
যাঁহারা এইরূপ আপত্তি করেন, তাঁহাদের মনের ভিতর এমনি একটা কথা আছে যে, এই মনুষ্য-জন্মের যে সকল দুঃখ-গর্ভে অবস্থান, জন্ম, স্তন্যপান, শৈশব, শিক্ষা, জয়, পরাজয়, জরা, মরণ, এ সকলে আমরাও যেমন কষ্ট পাই, ঈশ্বরও বুঝি সেইরূপ। তাহাদিগের স্থূল বুদ্ধিতে এটুকু আসে না যে, তিনি সুখদুঃখের অতীত,—তাঁহার কিছুতেই দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। জগতের সৃজন, পালন, লয়, যেমন তাঁহার লীলা (Manifestation), এ সকল তেমনি তাঁহার লীলামাত্র হইতে পারে। তুমি বলিতেছ, তিনি মুহূর্তমধ্যে যাহাদিগকে ইচ্ছাক্রমে সংহার করিতে পারেন, তাহাদের ধ্বংসের জন্য তিনি মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কাল ব্যাপিয়া আয়াস পাইবেন কেন? তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, যাঁহার কাছে অনন্ত কালও পলক মাত্র, তাঁহার কাছে মুহূর্তে ও মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কালে প্রভেদ কি?
তবে এই যে অসুরবধ কথাটা আমরা বিষ্ণুর অবতার সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে পুরাণাদিতে শুনিয়া আসিতেছি, এ কথা শুনিয়া অনেকের অবতার সম্বন্ধে অনাস্থা হইতে পারে বটে। কেবল একটা কংস বা শিশুপাল মারিবার জন্য যে স্বয়ং ঈশ্বরকে ভূতলে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, ইহা অসম্ভব কথা বটে। যিনি অনন্তশক্তিমান্, তাঁহার কাছে কংস শিশুপালও যে, এক ক্ষুদ্র পতঙ্গও সে। বাস্তবিক যাহারা হিন্দুধর্মের প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিতে না পারে, তাহারাই মনে করে যে, অবতারের উদ্দেশ্য দৈত্য বা দুরাত্মাবিশেষের নিধন। আসল কথাটা, ভগবদ্গীতায় অতি সংক্ষেপে বলা হইতেছে :—
“পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংরক্ষণার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ||”
এ কথাটা অতি সংক্ষিপ্ত। “ধর্মসংরক্ষণ” কি কেবল দুই একটা দুরাত্মা বধ করিলেই হয়? ধর্ম কি? তাহার সংরক্ষণ কি কি প্রকারে হইতে পারে?
আমাদিগের শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি সকলের সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ধর্ম। এই ধর্ম অনুশীলনসাপেক্ষ, এবং অনুশীলন কর্মসাপেক্ষ।[2] অতএব কর্মই ধর্মের প্রধান উপায়। এই কর্মকে স্বধর্মপালন (Duty) বলা যায়।
মনুষ্য কতকটা নিজ রক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে, তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না—আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বর আমাদের আদর্শ হইতে পারেন না। কেন না, তিনি প্রথমতঃ অশরীরী, শারীরিকবৃত্তিশূন্য; আমরা শরীরী, শারীরিক বৃত্তি আমাদের ধর্মের প্রধান বিঘ্ন। দ্বিতীয়তঃ তিনি অনন্ত, আমরা সান্ত, অতি ক্ষুদ্র। অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবতারের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয়, তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশী সম্ভাবনা। এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?
এ কথা আমি গড়িয়া বলিতেছি না। ভগবদ্গীতায় ভগবদুক্তির তাৎপর্যও এই প্রকার।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতিপুরুষঃ || ১৯
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি || ২০।
যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে || ২১।
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানাবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি || ২২।
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশ্ || ২৩।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪। গীতা, ৩ অ।
“পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া, কর্মানুষ্ঠান করিলে মোক্ষলাভ করেন; অতএব তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান কর, জনক প্রভৃতি মহাত্মাগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহা করিয়া থাকে, এবং তিনি যাহা মান্য করেন, তাহারা তাহারই অনুষ্ঠান অনুবর্তী হয়। অতএব তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষার্থ কর্মানুষ্ঠান কর। দেখ, ত্রিভুবনে আমার কিছুই অপ্রাপ্য নাই, সুতরাং আমার কোন প্রকার কর্তব্যও নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠান করিতেছি।[3] যদি আমি আলস্যহীন হইয়া কখন কর্মানুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে, সমুদায় লোকে আমার অনুবর্তী হইবে, অতএব আমি কর্ম না করিলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হইয়া যাইবে, এবং আমি বর্ণসঙ্কর ও প্রজাগণের মলিনতার হেতু হইব।”
কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ।
এখানে একটা নহে, দুইটি প্রশ্ন হইতে পারে—(১) ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব কি না, (২) তাহা হইলে কৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার কি না। আমি এই দ্বিতীয় প্রশ্নের কোন উত্তর দিব না। প্রথম প্রশ্নের কিছু উত্তর দিতে ইচ্ছা করি।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদিগের খ্রীষ্টীয়ান গুরুদিগের সঙ্গে আমাদিগের এই স্থূল কথা লইয়া মতভেদ হইবার সম্ভাবনা নাই। তাঁহাদিগকে ঈশ্বরের অবতার সম্ভব বলিয়া মানিতে হয়, নহিলে যিশু টিকেন না। আমাদিগের প্রধান বিবাদ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে।
ইঁহাদিগের মধ্যে অনেকে এই আপত্তি করিবেন, যেখানে আদৌ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণাভাব, সেখানে আবার ঈশ্বরের অবতার কি? যাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, আমরা তাঁহাদিগের সঙ্গে কোন বিচার করি না। তাঁহাদের ঘৃণা করিয়া বিচার করি না, এমত নহে। তবে জানা আছে যে, এ বিচারে কোন পক্ষের উপকার হয় না। তাঁহারা আমাদের ঘৃণা করেন, তাহাতে আপত্তি নাই।
তাহার পর আর কতকগুলি লোক আছেন যে, তাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁহারা বলিবেন, ঈশ্বর নির্গুণ। সগুণেরই অবতার সম্ভব। ঈশ্বর নির্গুণ, সুতরাং তাঁহার অবতার অসম্ভব।
এ আপত্তিরও আমাকে বড় সোজা উত্তর দিতে হয়। নির্গুণ ঈশ্বর কি, তাহা আমি বুঝিতে পারি না, সুতরাং এ আপত্তির মীমাংসা করিতে সক্ষম নহি। আমি জানি যে, বিস্তর পণ্ডিত ও ভাবুক ঈশ্বরকে নির্গুণ বলিয়াই মানেন। আমি পণ্ডিতও নহি, ভাবুকও নহি, কিন্তু আমার মনে মনে বিশ্বাস যে, এই ভাবুক পণ্ডিতগণও আমার মত, নির্গুণ ঈশ্বর বুঝিতে পারেন না, কেন না, মনুষ্যের এমন কোন চিত্তবৃত্তি নাই, যদ্দ্বারা আমরা নির্গুণ ঈশ্বর বুঝিতে পারি। ঈশ্বর নির্গুণ হইলে হইতে পারেন, কিন্তু আমরা নির্গুণ বুঝিতে পারি না, কেন না, আমাদের সে শক্তি নাই।[1] মুখে বলিতে পারি বটে যে, ঈশ্বর নির্গুণ, এবং এই কথার উপর একটা দর্শনশাস্ত্র গড়িতে পারি, কিন্তু যাহা কথায় বলিতে পারি, তাহা যে মনে বুঝি, ইহা অনিশ্চিত। “চতুষ্কোণ গোলক” বলিলে আমাদের রসনা বিদীর্ণ হয় না বটে, কিন্তু “চতুষ্কোণ গোলক” মানে ত কিছুই বুঝিলাম না। তাই হর্বর্ট স্পেন্সর এত কাল পরে নির্গুণ ঈশ্বর ছাড়িয়া দিয়া সগুণেরও অপেক্ষা যে সগুণ ঈশ্বর (“Something higher than personality”) তাহাতে আসিয়া পড়িয়াছেন। অতএব আইস, আমরাও নির্গুণ ঈশ্বরের কথা ছাড়িয়া দিই। ঈশ্বরকে নির্গুণ বলিলে স্রষ্টা বিধাতা, পাতা, ত্রাণকর্তা কাহাকেও পাই না। এমন ঝক্মারিতে কাজ কি?
যাঁহারা সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করেন, তাঁহাদেরও ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা স্বীকার পক্ষে অনেকগুলি আপত্তি আছে। এক আপত্তি এই যে ঈশ্বর সগুণ হউন, কিন্তু নিরাকার। যিনি নিরাকার, তিনি আকার ধারণ করিবেন কি প্রকারে?
উত্তরে, জিজ্ঞাসা করি, যিনি ইচ্ছাময় এবং সর্বশক্তিমান্, তিনি ইচ্ছা করিলে নিরাকার হইলেও আকার ধারণ করিতে পারেন না কেন? তাঁহার সর্বশক্তিমত্তার এ সীমানির্দেশ কর কেন? তবে কি তাঁহাকে সর্বশক্তিমান্ বলিতে চাও না? যিনি এই জড় জগৎকে আকার প্রদান করিয়াছেন, তিনি ইচ্ছা করিলে নিজে আকার গ্রহণ করিতে পারেন না কেন?
যাঁহারা এ আপত্তি না করেন, তাঁহারা বলিতে পারেন ও বলেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান্, তাঁহার জগৎ-শাসনের জন্য, জগতের হিত জন্য, মনুষ্যকলেবর ধারণ করিবার প্রয়োজন কি? যিনি ইচ্ছাক্রমেই কোটি কোটি বিশ্ব সৃষ্ট ও বিধ্বস্ত করিতেছেন, রাবণ কুম্ভকর্ণ কি কংস শিশুপাল-বধের জন্য তাঁহাকে নিজে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, বালক হইয়া মাতৃস্তন্য পান করিতে হইবে, ক, খ, গ, ঘ শিখিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতে হইবে, তাহার পর দীর্ঘ মনুষ্য-জীবনের অপার দুঃখ ভোগ করিয়া শেষে স্বয়ং অস্ত্রধারণ করিয়া, আহত বা কখন পরাজিত হইয়া, বহ্বায়াসে দুরাত্মাদের বধসাধন করিতে হইবে, ইহা অতি অশ্রদ্ধেয় কথা।
যাঁহারা এইরূপ আপত্তি করেন, তাঁহাদের মনের ভিতর এমনি একটা কথা আছে যে, এই মনুষ্য-জন্মের যে সকল দুঃখ-গর্ভে অবস্থান, জন্ম, স্তন্যপান, শৈশব, শিক্ষা, জয়, পরাজয়, জরা, মরণ, এ সকলে আমরাও যেমন কষ্ট পাই, ঈশ্বরও বুঝি সেইরূপ। তাহাদিগের স্থূল বুদ্ধিতে এটুকু আসে না যে, তিনি সুখদুঃখের অতীত,—তাঁহার কিছুতেই দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। জগতের সৃজন, পালন, লয়, যেমন তাঁহার লীলা (Manifestation), এ সকল তেমনি তাঁহার লীলামাত্র হইতে পারে। তুমি বলিতেছ, তিনি মুহূর্তমধ্যে যাহাদিগকে ইচ্ছাক্রমে সংহার করিতে পারেন, তাহাদের ধ্বংসের জন্য তিনি মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কাল ব্যাপিয়া আয়াস পাইবেন কেন? তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, যাঁহার কাছে অনন্ত কালও পলক মাত্র, তাঁহার কাছে মুহূর্তে ও মনুষ্য-জীবন-পরিমিত কালে প্রভেদ কি?
তবে এই যে অসুরবধ কথাটা আমরা বিষ্ণুর অবতার সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে পুরাণাদিতে শুনিয়া আসিতেছি, এ কথা শুনিয়া অনেকের অবতার সম্বন্ধে অনাস্থা হইতে পারে বটে। কেবল একটা কংস বা শিশুপাল মারিবার জন্য যে স্বয়ং ঈশ্বরকে ভূতলে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, ইহা অসম্ভব কথা বটে। যিনি অনন্তশক্তিমান্, তাঁহার কাছে কংস শিশুপালও যে, এক ক্ষুদ্র পতঙ্গও সে। বাস্তবিক যাহারা হিন্দুধর্মের প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিতে না পারে, তাহারাই মনে করে যে, অবতারের উদ্দেশ্য দৈত্য বা দুরাত্মাবিশেষের নিধন। আসল কথাটা, ভগবদ্গীতায় অতি সংক্ষেপে বলা হইতেছে :—
“পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংরক্ষণার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ||”
এ কথাটা অতি সংক্ষিপ্ত। “ধর্মসংরক্ষণ” কি কেবল দুই একটা দুরাত্মা বধ করিলেই হয়? ধর্ম কি? তাহার সংরক্ষণ কি কি প্রকারে হইতে পারে?
আমাদিগের শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি সকলের সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ধর্ম। এই ধর্ম অনুশীলনসাপেক্ষ, এবং অনুশীলন কর্মসাপেক্ষ।[2] অতএব কর্মই ধর্মের প্রধান উপায়। এই কর্মকে স্বধর্মপালন (Duty) বলা যায়।
মনুষ্য কতকটা নিজ রক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে, তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না—আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বর আমাদের আদর্শ হইতে পারেন না। কেন না, তিনি প্রথমতঃ অশরীরী, শারীরিকবৃত্তিশূন্য; আমরা শরীরী, শারীরিক বৃত্তি আমাদের ধর্মের প্রধান বিঘ্ন। দ্বিতীয়তঃ তিনি অনন্ত, আমরা সান্ত, অতি ক্ষুদ্র। অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবতারের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয়, তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশী সম্ভাবনা। এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?
এ কথা আমি গড়িয়া বলিতেছি না। ভগবদ্গীতায় ভগবদুক্তির তাৎপর্যও এই প্রকার।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতিপুরুষঃ || ১৯
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি || ২০।
যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে || ২১।
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানাবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি || ২২।
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশ্ || ২৩।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪। গীতা, ৩ অ।
“পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া, কর্মানুষ্ঠান করিলে মোক্ষলাভ করেন; অতএব তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান কর, জনক প্রভৃতি মহাত্মাগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহা করিয়া থাকে, এবং তিনি যাহা মান্য করেন, তাহারা তাহারই অনুষ্ঠান অনুবর্তী হয়। অতএব তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষার্থ কর্মানুষ্ঠান কর। দেখ, ত্রিভুবনে আমার কিছুই অপ্রাপ্য নাই, সুতরাং আমার কোন প্রকার কর্তব্যও নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠান করিতেছি।[3] যদি আমি আলস্যহীন হইয়া কখন কর্মানুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে, সমুদায় লোকে আমার অনুবর্তী হইবে, অতএব আমি কর্ম না করিলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হইয়া যাইবে, এবং আমি বর্ণসঙ্কর ও প্রজাগণের মলিনতার হেতু হইব।”
কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ।
সেশ্বর বৈজ্ঞানিকদিগের শেষ ও প্রধান আপত্তির কথা এখনও বলি নাই। তাঁহারা বলেন যে, ঈশ্বর আছেন সত্য, এবং তিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা, ইহাও সত্য। কিন্তু তিনি গাড়ীর কোচমানের মত স্বহস্তে রাশ ধরিয়া বা নৌকার কর্ণধারের মত স্বহস্তে হাল ধরিয়া এই বিশ্বসংসার চালান না। তিনি কতকগুলি অচল নিয়ম সংস্থাপন করিয়া দিয়াছেন, জগৎ তাহারই বশবর্তী হইয়া চলিতেছে। এই নিয়মগুলি অচলও বটে, এবং জগতের স্থিতিপক্ষে যথেষ্টও বটে। অতএব ইহার মধ্যে ঈশ্বরের স্বয়ং হস্তক্ষেপণ করিবার স্থান নাই প্রয়োজনও নাই। সুতরাং ঈশ্বর মানব-দেহ ধারণ করিয়া যে ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইবেন ইহা অশ্রদ্ধেয় কথা।
ঈশ্বর যে কতকগুলি অচল নিয়ম সংস্থাপন করিয়া দিয়াছেন, জগৎ তাহারই বশবর্তী হইয়া চলে, এ কথা মানি। সেইগুলি জগতের রক্ষা ও পালন পক্ষে যথেষ্ট, এ কথাও মানি। কিন্তু সেগুলি আছে বলিয়া যে ঈশ্বরের নিজের কোন কাজের স্থান ও প্রয়োজন নাই, এ কথা কি প্রকারে সিদ্ধ হয়, বুঝিতে পারি না। জগতের কিছুই এমন উন্নত অবস্থায় নাই যে, যিনি সর্বশক্তিমান্, তিনি ইচ্ছা করিলেও তাহার আর উন্নতি হইতে পারে না। জাগতিক ব্যাপার আলোচনা করিয়া বিজ্ঞানশাস্ত্রের সাহায্যে ইহাই বুঝিতে পারি যে, জগৎ ক্রমে অসম্পূর্ণ ও অপরিণতাবস্থা হইতে সম্পূর্ণ ও পরিণতাবস্থায় আসিতেছে। ইহাই জগতের গতি এবং এই গতি জগৎকর্তার অভিপ্রেত বলিয়া বোধ হয়। তার পর, জগতের বর্তমান অবস্থাতে এমন কিছু দেখি না যে, তাহা হইতে বিবেচনা করিতে পারি যে, জগৎ চরম উন্নতিতে পৌঁছিয়াছে। এখনও জীবের সুখের অনেক বাকি আছে, উন্নতির বাকি আছে। যদি তাই বাকি আছে, তবে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপণের বা কার্যের স্থান বা প্রয়োজন নাই কেন? সৃজন, রক্ষা, পালন, ধ্বংস ভিন্ন জগতের আর একটা নৈসর্গিক কার্য আছে,—উন্নতি। মনুষ্যের উন্নতির মূল, ধর্মের উন্নতি। ধর্মের উন্নতিও ঐশিক নিয়মে সাধিত হইতে পারে, ইহাও স্বীকার করি। কিন্তু কেবল নিয়মফলে যত দূর তাহার উন্নতি হইতে পারে, ঈশ্বর কোন কালে স্বয়ং অবতীর্ণ হইলে তাহার অধিক উন্নতি সিদ্ধ হইতে পারে না, এমত বুঝিতে পারি না। এবং এরূপ অধিক উন্নতি যে তাঁহার অভিপ্রেত নহে, তাহাই বা কি প্রকারে বলিব?
আপত্তিকারকেরা বলেন যে, নৈসর্গিক যে সকল নিয়ম, তাহা ঈশ্বরকৃত হইলেও তাহা অতিক্রমপূর্বক জগতে কোন কাজ হইতে দেখা যায় নাই। এজন্য এ সকল অতিপ্রকৃত ক্রিয়া (Miracle) মানিতে পারি না। ইহার ন্যায্যতা স্বীকার করি; তাহার কারণও পূর্বপরিচ্ছেদে নির্দিষ্ট করিয়াছি। আমাকে ইহাও বলিতে হয় যে, এরূপ অনেক ঈশ্বরবতারের প্রবাদ আছে যে, তাহাতে অবতার অতিপ্রকৃতের সাহায্যেই স্বকার্য সম্পন্ন করিয়াছেন। খ্রীষ্ট অবতারের এরূপ অনেক কথা আছে। কিন্তু খ্রীষ্টের পক্ষসমর্থনের ভার খ্রীষ্টানদিগের উপরই থাকুক। আরও, বিষ্ণুর অবতারের মধ্যে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ প্রভৃতির এইরূপ কার্য ভিন্ন অবতারের উপাদান আর কিছুই নাই। এখন, বুদ্ধিমান্ পাঠককে ইহা বলা বাহুল্য যে, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ প্রভৃতি উপন্যাসের বিষয়ীভূত পশুগণের, ঈশ্বরাবতারত্বের যথার্থ দাবি দাওয়া কিছুই নাই। গ্রন্থান্তরে দেখাইব যে, বিষ্ণুর দশ অবতারের কথাটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক, এবং সম্পূর্ণরূপে উপন্যাস-মূলক। সেই উপান্যাসগুলিও কোথা হইতে আসিয়াছে, তাহাও দেখাইব। সত্য বটে, এই সকল অবতার পুরাণে কীর্তিত আছে, কিন্তু পুরাণে যে অনেক অলীক উপন্যাস স্থান পাইয়াছে, তাহা বলা বাহুল্য। প্রকৃত বিচারে শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন আর কাহাকেও ঈশ্বরের অবতার বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না।
কৃষ্ণের যে বৃত্তান্তটুকু-মৌলিক, তাহার ভিতর অতিপ্রকৃতের কোন সহায়তা নাই। মহাভারত ও পুরাণসকল, প্রক্ষিপ্ত ও আধুনিক নিষ্কর্মা ব্রাহ্মণদিগের নিরর্থক রচনায় পরিপূর্ণ, এজন্য অনেক স্থলে কৃষ্ণের অতিপ্রকৃতের সাহায্য গ্রহণ করা উক্ত হইয়াছে। কিন্তু বিচার করিয়া দেখিলে জানা যাইবে যে, সেগুলি মূল গ্রন্থের কোন অংশ নহে। আমি ক্রমে সে বিচারে প্রবৃত্ত হইব, এবং যাহা বলিতেছি, তাহা সপ্রমাণ করিব। দেখাইব যে, কৃষ্ণ অতিপ্রকৃত কার্যের দ্বারা, বা নৈসর্গিক নিয়মের বিলঙ্ঘন দ্বারা, কোন কার্য সম্পন্ন করেন নাই। অতএব সে আপত্তি কৃষ্ণ সম্বন্ধে খাটিবে না।
আমরা যাহা বলিলাম, কেবল তাহা আমাদের মত, এমন নহে। পুরাণকার ঋষিদিগেরও সেই মত, তবে লোকপরম্পরাগত কিম্বদন্তীর সত্যমিথ্যানির্বাচন-পদ্ধতি সে কালে ছিল না বলিয়া অনেক অনৈসর্গিক ঘটনা পুরাণেতিহাসভুক্ত হইয়াছে।
বিষ্ণুপুরাণে আছে,—
মনুষ্যধর্মশীলস্য লীলা সা জগতঃ পতেঃ।
অস্ত্রাণ্যনেকরূপাণি যদরাতিষু মুঞ্চতি ||
মনসৈব জগৎসৃষ্টিং সংহারঞ্চ করোতি যঃ।
তস্যারিপক্ষক্ষপণে কোহয়মুদ্যমবিস্তরঃ ||
তথাপি যো মনুষ্যাণাং ধর্মস্তমনুবর্ততে।
কুর্বন্ বলবতা সন্ধিং হীনৈর্যুদ্ধং করোত্যসৌ ||
সাম চোপপ্রদানঞ্চ তথা ভেদং প্রদর্শয়ন্।
করোতি দণ্ডপাতঞ্চ কচ্চিদেব পলায়নম্ ||
মনুষ্যদেহিনাং চেষ্টামিত্যেবমনুবর্ততঃ।
লীলা জগৎপতেস্তস্য ছন্দতঃ সৎপ্রবর্ততে|| —৫ অংশ, ২২ অধ্যায়, ১৪-১৮
“জগৎপতি হইয়াও যে তিনি শত্রুদিগের প্রতি অনেক অস্ত্রনিক্ষেপ করিলেন, ইহা তিনি মনুষ্যধর্মশীল বলিয়া তাঁহার লীলা। নহিলে যিনি মনের দ্বারাই জগতের সৃষ্টি ও সংহার করেন, অরিক্ষয় জন্য তাঁহার বিস্তর উদ্যম কেন? তিনি মনুষ্যদিগের ধর্মের অনুবর্তী, এজন্য তিনি বলবানের সঙ্গে সন্ধি এবং হীনবলের সঙ্গে যুদ্ধ করেন সাম, দান, ভেদ প্রদর্শনপূর্বক দণ্ডপাত করেন কখনও পলায়নও করেন। মনুষ্যদেহীদিগের ক্রিয়ার অনুবর্তী সেই জগৎপতির এইরূপ লীলা তাঁহার ইচ্ছানুসারে ঘটিয়াছিল।”
আমি ঠিক এই কথাই বলিতেছিলাম। ভরসা করি, ইহার পর কোন পাঠক বিশ্বাস করিবেন না যে, কৃষ্ণ মনুষ্যদেহে অতিমানুষশক্তির দ্বারা কোন কার্য সম্পাদন করিয়াছিলেন।[4] অতএব বিচারের তৃতীয় নিয়ম সংস্থাপিত হইল।
বিচারের নিয়ম তিনটি পুনর্বার স্মরণ করাই :—
১। যাহা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া প্রমাণ করিব, তাহা পরিত্যাগ করিব।
২। যাহা অতিপ্রাকৃত, তাহা পরিত্যাগ করিব।
৩। যাহা প্রক্ষিপ্ত নয়, বা অতিপ্রাকৃত নয়, তাহা যদি অন্য প্রকারে মিথ্যার
লক্ষণযুক্ত দেখি, তবে তাহাও পরিত্যাগ করিব।
ঈশ্বর যে কতকগুলি অচল নিয়ম সংস্থাপন করিয়া দিয়াছেন, জগৎ তাহারই বশবর্তী হইয়া চলে, এ কথা মানি। সেইগুলি জগতের রক্ষা ও পালন পক্ষে যথেষ্ট, এ কথাও মানি। কিন্তু সেগুলি আছে বলিয়া যে ঈশ্বরের নিজের কোন কাজের স্থান ও প্রয়োজন নাই, এ কথা কি প্রকারে সিদ্ধ হয়, বুঝিতে পারি না। জগতের কিছুই এমন উন্নত অবস্থায় নাই যে, যিনি সর্বশক্তিমান্, তিনি ইচ্ছা করিলেও তাহার আর উন্নতি হইতে পারে না। জাগতিক ব্যাপার আলোচনা করিয়া বিজ্ঞানশাস্ত্রের সাহায্যে ইহাই বুঝিতে পারি যে, জগৎ ক্রমে অসম্পূর্ণ ও অপরিণতাবস্থা হইতে সম্পূর্ণ ও পরিণতাবস্থায় আসিতেছে। ইহাই জগতের গতি এবং এই গতি জগৎকর্তার অভিপ্রেত বলিয়া বোধ হয়। তার পর, জগতের বর্তমান অবস্থাতে এমন কিছু দেখি না যে, তাহা হইতে বিবেচনা করিতে পারি যে, জগৎ চরম উন্নতিতে পৌঁছিয়াছে। এখনও জীবের সুখের অনেক বাকি আছে, উন্নতির বাকি আছে। যদি তাই বাকি আছে, তবে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপণের বা কার্যের স্থান বা প্রয়োজন নাই কেন? সৃজন, রক্ষা, পালন, ধ্বংস ভিন্ন জগতের আর একটা নৈসর্গিক কার্য আছে,—উন্নতি। মনুষ্যের উন্নতির মূল, ধর্মের উন্নতি। ধর্মের উন্নতিও ঐশিক নিয়মে সাধিত হইতে পারে, ইহাও স্বীকার করি। কিন্তু কেবল নিয়মফলে যত দূর তাহার উন্নতি হইতে পারে, ঈশ্বর কোন কালে স্বয়ং অবতীর্ণ হইলে তাহার অধিক উন্নতি সিদ্ধ হইতে পারে না, এমত বুঝিতে পারি না। এবং এরূপ অধিক উন্নতি যে তাঁহার অভিপ্রেত নহে, তাহাই বা কি প্রকারে বলিব?
আপত্তিকারকেরা বলেন যে, নৈসর্গিক যে সকল নিয়ম, তাহা ঈশ্বরকৃত হইলেও তাহা অতিক্রমপূর্বক জগতে কোন কাজ হইতে দেখা যায় নাই। এজন্য এ সকল অতিপ্রকৃত ক্রিয়া (Miracle) মানিতে পারি না। ইহার ন্যায্যতা স্বীকার করি; তাহার কারণও পূর্বপরিচ্ছেদে নির্দিষ্ট করিয়াছি। আমাকে ইহাও বলিতে হয় যে, এরূপ অনেক ঈশ্বরবতারের প্রবাদ আছে যে, তাহাতে অবতার অতিপ্রকৃতের সাহায্যেই স্বকার্য সম্পন্ন করিয়াছেন। খ্রীষ্ট অবতারের এরূপ অনেক কথা আছে। কিন্তু খ্রীষ্টের পক্ষসমর্থনের ভার খ্রীষ্টানদিগের উপরই থাকুক। আরও, বিষ্ণুর অবতারের মধ্যে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ প্রভৃতির এইরূপ কার্য ভিন্ন অবতারের উপাদান আর কিছুই নাই। এখন, বুদ্ধিমান্ পাঠককে ইহা বলা বাহুল্য যে, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ প্রভৃতি উপন্যাসের বিষয়ীভূত পশুগণের, ঈশ্বরাবতারত্বের যথার্থ দাবি দাওয়া কিছুই নাই। গ্রন্থান্তরে দেখাইব যে, বিষ্ণুর দশ অবতারের কথাটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক, এবং সম্পূর্ণরূপে উপন্যাস-মূলক। সেই উপান্যাসগুলিও কোথা হইতে আসিয়াছে, তাহাও দেখাইব। সত্য বটে, এই সকল অবতার পুরাণে কীর্তিত আছে, কিন্তু পুরাণে যে অনেক অলীক উপন্যাস স্থান পাইয়াছে, তাহা বলা বাহুল্য। প্রকৃত বিচারে শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন আর কাহাকেও ঈশ্বরের অবতার বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না।
কৃষ্ণের যে বৃত্তান্তটুকু-মৌলিক, তাহার ভিতর অতিপ্রকৃতের কোন সহায়তা নাই। মহাভারত ও পুরাণসকল, প্রক্ষিপ্ত ও আধুনিক নিষ্কর্মা ব্রাহ্মণদিগের নিরর্থক রচনায় পরিপূর্ণ, এজন্য অনেক স্থলে কৃষ্ণের অতিপ্রকৃতের সাহায্য গ্রহণ করা উক্ত হইয়াছে। কিন্তু বিচার করিয়া দেখিলে জানা যাইবে যে, সেগুলি মূল গ্রন্থের কোন অংশ নহে। আমি ক্রমে সে বিচারে প্রবৃত্ত হইব, এবং যাহা বলিতেছি, তাহা সপ্রমাণ করিব। দেখাইব যে, কৃষ্ণ অতিপ্রকৃত কার্যের দ্বারা, বা নৈসর্গিক নিয়মের বিলঙ্ঘন দ্বারা, কোন কার্য সম্পন্ন করেন নাই। অতএব সে আপত্তি কৃষ্ণ সম্বন্ধে খাটিবে না।
আমরা যাহা বলিলাম, কেবল তাহা আমাদের মত, এমন নহে। পুরাণকার ঋষিদিগেরও সেই মত, তবে লোকপরম্পরাগত কিম্বদন্তীর সত্যমিথ্যানির্বাচন-পদ্ধতি সে কালে ছিল না বলিয়া অনেক অনৈসর্গিক ঘটনা পুরাণেতিহাসভুক্ত হইয়াছে।
বিষ্ণুপুরাণে আছে,—
মনুষ্যধর্মশীলস্য লীলা সা জগতঃ পতেঃ।
অস্ত্রাণ্যনেকরূপাণি যদরাতিষু মুঞ্চতি ||
মনসৈব জগৎসৃষ্টিং সংহারঞ্চ করোতি যঃ।
তস্যারিপক্ষক্ষপণে কোহয়মুদ্যমবিস্তরঃ ||
তথাপি যো মনুষ্যাণাং ধর্মস্তমনুবর্ততে।
কুর্বন্ বলবতা সন্ধিং হীনৈর্যুদ্ধং করোত্যসৌ ||
সাম চোপপ্রদানঞ্চ তথা ভেদং প্রদর্শয়ন্।
করোতি দণ্ডপাতঞ্চ কচ্চিদেব পলায়নম্ ||
মনুষ্যদেহিনাং চেষ্টামিত্যেবমনুবর্ততঃ।
লীলা জগৎপতেস্তস্য ছন্দতঃ সৎপ্রবর্ততে|| —৫ অংশ, ২২ অধ্যায়, ১৪-১৮
“জগৎপতি হইয়াও যে তিনি শত্রুদিগের প্রতি অনেক অস্ত্রনিক্ষেপ করিলেন, ইহা তিনি মনুষ্যধর্মশীল বলিয়া তাঁহার লীলা। নহিলে যিনি মনের দ্বারাই জগতের সৃষ্টি ও সংহার করেন, অরিক্ষয় জন্য তাঁহার বিস্তর উদ্যম কেন? তিনি মনুষ্যদিগের ধর্মের অনুবর্তী, এজন্য তিনি বলবানের সঙ্গে সন্ধি এবং হীনবলের সঙ্গে যুদ্ধ করেন সাম, দান, ভেদ প্রদর্শনপূর্বক দণ্ডপাত করেন কখনও পলায়নও করেন। মনুষ্যদেহীদিগের ক্রিয়ার অনুবর্তী সেই জগৎপতির এইরূপ লীলা তাঁহার ইচ্ছানুসারে ঘটিয়াছিল।”
আমি ঠিক এই কথাই বলিতেছিলাম। ভরসা করি, ইহার পর কোন পাঠক বিশ্বাস করিবেন না যে, কৃষ্ণ মনুষ্যদেহে অতিমানুষশক্তির দ্বারা কোন কার্য সম্পাদন করিয়াছিলেন।[4] অতএব বিচারের তৃতীয় নিয়ম সংস্থাপিত হইল।
বিচারের নিয়ম তিনটি পুনর্বার স্মরণ করাই :—
১। যাহা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া প্রমাণ করিব, তাহা পরিত্যাগ করিব।
২। যাহা অতিপ্রাকৃত, তাহা পরিত্যাগ করিব।
৩। যাহা প্রক্ষিপ্ত নয়, বা অতিপ্রাকৃত নয়, তাহা যদি অন্য প্রকারে মিথ্যার
লক্ষণযুক্ত দেখি, তবে তাহাও পরিত্যাগ করিব।
1 “Our concption of the Deity is then bounded by the conditions which bound all human knowledge and therefore we cannot represent the Deity as he is, but as he appears to us.”-Mansel, Metaphysics, p. 384
2 “মৃৎকৃত এই ধর্মের ব্যাখ্যা ধর্মতত্ত্বে দেখ।
3 কৃষ্ণ অর্থাৎ যিনি শরীরধারী ঈশ্বর, তিনি এই কথা বলিতেছেন।
4 ‘It is true that in the Epic poems Rama and Krishna appear as incarnations of Vishnu, but they at the same time come before us as human heroes, and these two characters (the divine and the human) are so far from being inseparably blended together, that both of these heroes are for the most part exhibited in no other light than other highly gifted men-acting according to human motives and taking no advantage of their divine superiority. It is only in certain sections which have been added for the purpose of enforcing their divine character that they take the character of Vishnu. It is impossible to read either of these two poems with attention, without being reminded of the later interpolation of such sections as ascribe a divine character to the heroes, and of the unskillful manner in which these passages are often introduced and without observing how loosely they are connected with the rest of the narrative, and how unnecessary they are for its progress.” Lassen’s Indian Antiquities quoted by Muir.
“In other places (অর্থাৎ ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায় ভিন্ন) the divine nature of Krishna is less decidedly affirmed, in some it is disputed or denied; and in most of the situations he is exhibited in action, as a prince and warrior not as a divinity. He exercises no superhuman faculties in defence of himself, or his friends, or in the defeat and destruction of his foes. The Mahabharata, however, is the work of various periods, and requires to be read through carefully and critically, before its weight as an authority can be accurately appreciated.” Wilson, Preface to the Vishnu Purana.
2 “মৃৎকৃত এই ধর্মের ব্যাখ্যা ধর্মতত্ত্বে দেখ।
3 কৃষ্ণ অর্থাৎ যিনি শরীরধারী ঈশ্বর, তিনি এই কথা বলিতেছেন।
4 ‘It is true that in the Epic poems Rama and Krishna appear as incarnations of Vishnu, but they at the same time come before us as human heroes, and these two characters (the divine and the human) are so far from being inseparably blended together, that both of these heroes are for the most part exhibited in no other light than other highly gifted men-acting according to human motives and taking no advantage of their divine superiority. It is only in certain sections which have been added for the purpose of enforcing their divine character that they take the character of Vishnu. It is impossible to read either of these two poems with attention, without being reminded of the later interpolation of such sections as ascribe a divine character to the heroes, and of the unskillful manner in which these passages are often introduced and without observing how loosely they are connected with the rest of the narrative, and how unnecessary they are for its progress.” Lassen’s Indian Antiquities quoted by Muir.
“In other places (অর্থাৎ ভগবদ্গীতা পর্বাধ্যায় ভিন্ন) the divine nature of Krishna is less decidedly affirmed, in some it is disputed or denied; and in most of the situations he is exhibited in action, as a prince and warrior not as a divinity. He exercises no superhuman faculties in defence of himself, or his friends, or in the defeat and destruction of his foes. The Mahabharata, however, is the work of various periods, and requires to be read through carefully and critically, before its weight as an authority can be accurately appreciated.” Wilson, Preface to the Vishnu Purana.
পুরাণ
মহাভারতের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তার পর পুরাণ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে।
পুরাণ সম্বন্ধেও দুই রকম ভ্রম আছে,—দেশী ও বিলাতী। দেশী ভ্রম এই যে, সমস্ত পুরাণগুলিই এক ব্যক্তির রচনা। বিলাতী ভ্রম এই যে, এক একখানি পুরাণ এক ব্যক্তির রচনা। আগে দেশী কথাটার সমালোচনা করা যাউক।
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি;—
১ম,—এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনাই করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তাহা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করিয়া বলিবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,—এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করিবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই ইহার উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,—আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি;—
১ম,—এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনাই করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তাহা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করিয়া বলিবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,—এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করিবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই ইহার উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,—আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ—বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করিয়াছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁহাকে পুরাণসংহিতা দান করিলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তাহার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হইতে তিনখানি সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।[1]
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই।
এক্ষণে ইউরোপীয়দিগের যে সাধারণ ভ্রম, তাহার বিষয়ে কিছু বলা যাউক। ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।[1]
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই।
এক্ষণে ইউরোপীয়দিগের যে সাধারণ ভ্রম, তাহার বিষয়ে কিছু বলা যাউক। ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
“রথন্তরস্য কল্পস্য বৃত্তান্তমধিকৃত্য যৎ।
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
অর্থাৎ যে পুরাণে রথন্তর কল্পবৃত্তান্তাধিকৃত কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুক্ত কথা নারদকে সাবর্ণি বলিতেছেন এবং যাহাতে পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মবরাহচরিত কথিত হইয়াছে, সেই অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকসংযুক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
এক্ষণে যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ প্রচলিত আছে, তাহা সাবর্ণি নারদকে বলিতেছেন না। নারায়ণ নামে অন্য ঋষি নারদকে বলিতেছেন। তাহাতে রথন্তরকল্পের প্রসঙ্গমাত্র নাই, এবং ব্রাহ্মবরাহচরিতের প্রসঙ্গমাত্র নাই। এখনকার প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তে প্রকৃতিখণ্ড ও গণেশখণ্ড আছে। যাহার কোন প্রসঙ্গ দুই শ্লোকে নাই। অতএব প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এক্ষণে আর বিদ্যমান নাই। যাহা ব্রহ্মবৈবর্ত নামে চলিত আছে, তাহা নূতন গ্রন্থ। তাহা দেখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-সঙ্কলন-সময় নিরূপণ করা অপূর্ব রহস্য বলিয়াই বোধ হয়।
উইল্সন সাহেব পুরাণ সকলের এইরূপ প্রণয়নকাল নিরূপিত করিয়াছেন:—
ব্রহ্মপুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দী।
পদ্মপুরাণ – ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।[2]
বিষ্ণুপুরাণ-দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ -সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ- ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ- অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ -ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ- খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ -দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ- ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ- ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
পদ্মপুরাণ – ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।[2]
বিষ্ণুপুরাণ-দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ -সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ- ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ- অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ -ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ- খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ -দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ- ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ- ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
পাঠক দেখিবেন, ইঁহার মতে (এই মতই প্রচলিত) কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, বোধ হয়, ইংরাজি পড়িয়া যাঁহার নিতান্ত বুদ্ধিবিপর্যয় না ঘটিয়াছে, তিনি ভিন্ন এমন কোন হিন্দুই নাই, যিনি এই সময়নির্ধারণ উপযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। দুই একটা কথার দ্বারাই ইহার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাইতে পারে।
এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক লোক এবং বিক্রমাদিত্য খ্রীঃ পূঃ ৫৬ বৎসরে জীবিত ছিলেন। কিন্তু সে সকল কথা এখন উড়িয়া গিয়াছে। ডাক্তার ভাও দাজি স্থির করিয়াছেন যে, কালিদাস খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এখন ইউরোপ শুদ্ধ এবং ইউরোপীয়দিগের দেশী শিষ্যগণ সকলে উচ্চৈঃস্বরে সেই ডাক ডাকিতেছেন। আমরাও এ মত অগ্রাহ্য করি না। অতএব কালিদাস ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক হউন। সকল পুরাণই তাঁহার অনেক পরে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাই উইল্সন্ সাহেবের উপরিলিখিত বিচারে স্থির হইয়াছে। কিন্তু কালিদাস মেঘদূতে লিখিয়াছেন—
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ শ্লোক।
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ শ্লোক।
যে পাঠক সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাকে শেষ ছত্রের অর্থ বুঝাইলেই হইবে। ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা উজ্জ্বল বিষ্ণুর গোপবেশের সহিত ইন্দ্রধনুশোভিত মেঘের উপমা হইতেছে। এখন, বিষ্ণুর গোপবেশ নাই, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের গোপবেশ ছিল। ইন্দ্রধনুর সঙ্গে উপমেয় কৃষ্ণচূড়াস্থিত ময়ূরপুচ্ছ। আমি বিনীতভাবে ইউরোপীয় মহামহোপাধ্যায়দিগের নিকট নিবেদন করিতেছি, যদি ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে কোন পুরাণই ছিল না, তবে কৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছচূড়ার কথা আসিল কোথা হইতে? এ কথা কি বেদে আছে, না মহাভারতে আছে, না রামায়ণে আছে?—কোথাও না। পুরাণ বা তদনুবর্তী গীতগোবিন্দাদি কাব্য ভিন্ন আর কোথাও নাই। আছে, হরিবংশে বটে; কিন্তু হরিবংশও ত উইল্সন্ সাহেবের মতে বিষ্ণুপুরাণেরও পরবর্তী। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, কালিদাসের পূর্বে অর্থাৎ অন্ততঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে হরিবংশ অথবা কোন বৈষ্ণব পুরাণ প্রচলিত ছিল।
আর একটা কথা বলিয়াই এ বিষয়ের উপসংহার করিব। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রচলিত, তাহা প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত না হইলেও, অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর অপেক্ষাও প্রাচীন গ্রন্থ। কেন না, গীতগোবিন্দকার জয়দেব-গোস্বামী গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেনের সভাপণ্ডিত। লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমাংশের লোক। ইহা বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রমাণীকৃত, এবং ইংরেজদিগের দ্বারাও স্বীকৃত। আমরা পরে দেখাইব যে, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তখন চলিত ও অতিশয় সম্মানিত না থাকিলে, গীতগোবিন্দ লিখিত হইত না, এবং বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায় তখন প্রচলিত না থাকিলে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক “মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্” ইত্যাদি কখনও রচিত হইত না। অতএব এই ভ্রষ্ট ব্রহ্মবৈবর্তও একাদশ শতাব্দীর পূর্বগামী। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত না জানি আরও কত কালের। অথচ উইল্সন্ সাহেবের বিবেচনায় ইহা দুই শত মাত্র বৎসরের গ্রন্থ হইতে পারে।
1 ভাগবতের বক্তা ব্যাসপুত্র শুকদেব। “বৈশম্পায়নহারীতৌ” ইতি পাঠান্তরও আছে।
2 তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
2 তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পুরাণ
আঠারখানি পুরাণ মিলাইলে অনেক সময়ই ইহা দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনেকগুলি শ্লোক কতকগুলি পুরাণে একই আছে। কোনখানে কিঞ্চিৎ পাঠান্তর আছে। কোনখানে তাহাও নাই। এই গ্রন্থে এইরূপ কতকগুলি শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে বা হইবে। নন্দ মহাপদ্মের সময়-নিরূপণ জন্য যে কয়টি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা এ কথার উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার অপেক্ষা আর একটা গুরুতর উদাহরণ দিতেছি। ব্রহ্মপুরাণের উত্তরভাগে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইয়াছে, ও বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। উভয়ে কোন প্রভেদ নাই; অক্ষরে অক্ষরে এক। এই পঞ্চম অংশে আটাশটি অধ্যায়। বিষ্ণুপুরাণের এই আটাশ অধ্যায়ে যতগুলি শ্লোক আছে, ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে, এবং ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে যে শ্লোকগুলি আছে, বিষ্ণুপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে। এই দুই পুরাণে এই সম্বন্ধে কোন প্রকার প্রভেদ বা তারতম্য নাই। নিম্নলিখিত তিনটি কারণের মধ্যে কোন একটি কারণে এরূপ ঘটা সম্ভব।
১ম,—ব্রহ্মপুরাণ হইতে বিষ্ণুপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
২য়,—বিষ্ণুপুরাণ হইতে ব্রহ্মপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
৩য়,—কেহ কাহারও নিকট চুরি করেন নাই; এই কৃষ্ণচরিতবর্ণনা সেই আদিম বৈয়াসিকী পুরাণসংহিতার অংশ। ব্রহ্ম ও বিষ্ণু উভয় পুরাণেই এই অংশ রক্ষিত হইয়াছে।
প্রথম দুইটি কারণ যথার্থ কারণ বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, এরূপ প্রচলিত গ্রন্থ হইতে আটাশ অধ্যায় স্পষ্ট চুরি অসম্ভব, এবং অন্য কোনও স্থলেও এরূপ দেখাও যায় না। যে এরূপ চুরি করিবে, সে অন্ততঃ কিছু পরিবর্তন করিয়া লইতে পারে এবং রচনাও এমন কিছু নয় যে, তাহার কিছু পরিবর্তন হয় না। আর কেবল এই আটাশ অধ্যায় দুইখানি পুরাণে একরূপ দেখিলেও, না হয়, চুরির কথা মনে করা যাইত, কিন্তু বলিয়াছি যে, অনেক ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের অনেক শ্লোক পরস্পরের সহিত ঐক্যবিশিষ্ট। এবং অনেক ঘটনা সম্বন্ধে পুরাণে পুরাণে বিরোধ থাকিলেও অনেক ঘটনা সম্বন্ধে আবার পুরাণে পুরাণে বিশেষ ঐক্য আছে। এ স্থলে, পূর্বকথিত একখানি আদিম পুরাণসংহিতার অস্তিত্বই প্রমাণীকৃত হইয়াছে। সেই আদিম সংহিতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাসরচিত না হইলেও হইতে পারে। তবে সে সংহিতা যে অতি প্রাচীন কালে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। কেন না, আমরা পরে দেখিব যে, পুরাণকথিত অনেক ঘটনার অখণ্ডনীয় প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায়, অথচ সে সকল ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয় নাই। সুতরাং এমন কথা বলা যাইতে পারে না যে, পুরাণকার তাহা মহাভারত হইতে লইয়াছেন।
যদি আমরা বিলাতী ধরনে পুরাণ সকলের সংগ্রহসময় নিরূপণ করিতে বসি, তাহ হইলে কিরূপ ফল পাই দেখা যাউক। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্থাংশে চতুর্বিংশাধ্যায়ে মগধ রাজাদিগের বংশাবলী কীর্তিত আছে। বিষ্ণুপুরাণে যে সকল বংশাবলী কীর্তিত হইয়াছে, তাহা ভবিষ্যদ্বাণীর আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। অর্থাৎ বিষ্ণুপুরাণ বেদব্যাসের পিতা পরাশরের দ্বারা কলিকালের আরম্ভসময়ে কথিত হইয়াছিল বলিয়া পুরাণকার ভূমিকা করিতেছেন। সে সময়ে নন্দবংশীয়াদি আধুনিক রাজগণ জন্মগ্রহণ করেন নাই। কিন্তু উক্ত রাজগণের সমকাল বা পরকালবর্তী প্রক্ষেপকারকের ইচ্ছা যে, উক্ত রাজগণের নাম ইহাতে থাকে। কিন্তু তাঁহাদিগের নামের উল্লেখ করিতে গেলে, ভবিষ্যদ্বাণীর আবরণ রচনার উপর প্রক্ষিপ্ত না করিলে, পরাশরকথিত বলিয়া পাচার করা যায় না। অতএব সংগ্রহকার বা প্রক্ষেপকারক এই সকল রাজার কথা লিখিবার সময় বলিয়াছেন, অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তিনি যে সকল রাজদিগের নাম করিয়াছেন, তাহার মধ্যে অনেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং তাঁহাদিগের রাজত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধগ্রন্থ, যবনগ্রন্থ, সংস্কৃতগ্রন্থ, প্রস্তরলিপি ইত্যাদি বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
যথা;— নন্দ, মহাপদ্ম, মৌর্য, চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, পুষ্পমিত্র, পুলিমান্, শকরাজগণ, অন্ধ্ররাজগণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে লেখা আছে,—“নব নাগাঃ পদ্মাবত্যাং কান্তিপুর্যাং মথুরায়ামনুগঙ্গাপ্রয়াগং মাগধা গুপ্তাশ্চ ভোক্ষ্যন্তি।”* এই গুপ্তবংশীয়দিগের সময় Fleet সাহেবের কল্যাণে নিরূপিত হইয়াছে। এই বংশের প্রথম রাজাকে মহারাজগুপ্ত বলে। তার পর ঘটোৎকচ ও চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার পর সমুদ্রগুপ্ত। ইঁহারা খ্রীঃ চতুর্থ শতাব্দীর লোক। তার পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, বুদ্ধগুপ্ত—ইঁহারা খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর লোক। এই সকল গুপ্তগণ রাজা হইয়াছিলেন বা রাজত্ব করিতেছেন, ইহা না জানিলে, পুরাণসংগ্রহকার কখনই এরূপ লিখিতে পারিতেন না। অতএব ইনি গুপ্তদিগের সমকাল বা পরকালবর্তী। তাহা হইলে, এই পুরাণ খ্রীষ্টীয় চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বা প্রণীত হইয়াছিল। কিন্তু এমন হইতে পারে যে, এই গুপ্তরাজাদিগের নাম বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থাংশে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। অথবা এমনও হইতে পারে যে, এই চতুর্থাংশ এক সময়ের রচনা, এবং অন্যান্য অংশ অন্যান্য সময়ে রচনা; সকলগুলিই কোনও অনির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হইয়া বিষ্ণুপুরাণ নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। আজিকার দিনেও কি ইউরোপে, কি এদেশে, সচরাচর ঘটিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা একত্রিত হইয়া একখানি সংগ্রহগ্রন্থে নিবদ্ধ হয়, এবং ঐ সংগ্রহের একটি বিশেষ নাম দেওয়া হয়। যথা, “Percy Reliques,” অথবা রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায় সঙ্কলিত ফলিত জ্যোতিষ।” আমার বিবেচনায় সকল পুরাণই এইরূপ সংগ্রহ। উপরি-উক্ত দুইখানি পুস্তকই আধুনিক সংগ্রহ; কিন্তু যে সকল বিষয় ইহাতে সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা প্রাচীন। সংগ্রহ আধুনিক বলিয়া সেগুলি আধুনিক হইল না।
তবে এমন অনেক সময়েই ঘটিয়া থাকিতে পারে যে সংগ্রহকার নিজে অনেক নূতন রচনা করিয়া সংগ্রহের মধ্যে প্রবেশিত করিয়াছেন অথবা প্রাচীন বৃত্তান্ত নূতন কল্পনাসংযুক্ত এবং অত্যুক্তি অলঙ্কারে রঞ্জিত করিয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণ সম্বন্ধে একথা বলা যায় না, কিন্তু ভাগবত সম্বন্ধে ইহা বিশেষ প্রকারে বক্তব্য।
প্রবাদ আছে যে, ভাগবত পুরাণ বোপদেবপ্রণীত। বোপদেব দেবগিরির রাজা হেমাদ্রির সভাসদ্। বোপদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু অনেক হিন্দুই উহা বোপদেবের রচনা বলিয়া স্বীকার করেন না। বৈষ্ণবেরা বলেন, ভাগবতদ্বেষী শাক্তেরা এইরূপ প্রবাদ রটাইয়াছে।
বাস্তবিক ভাগবতের পুরাণত্ব লইয়া অনেক বাদবিতণ্ডা ঘটিয়াছে। শাক্তেরা বলেন, ইহা পুরাণই নহে,—বলেন, দেবীভাগবতই ভাগবত পুরাণ। তাঁহারা বলেন, “ভগবত ইদং ভাগবতং” এইরূপ অর্থ না করিয়া “ভাগবত্যা ইদং ভাগবতং” এই অর্থ করিবে।
কেহ কেহ এইরূপ শঙ্কা করে বলিয়া শ্রীধর স্বামী ইহার প্রথম শ্লোকের টীকাতে লিখিয়াছেন—“ভাগবতং নামান্যদিত্যপি নাশঙ্কনীয়ম্”। ইহাতে বুঝিতে হইবে যে, ইহা পুরাণ নহে—দেবীভাগবতই প্রকৃত পুরাণ, এরূপ আশঙ্কা শ্রীধর স্বামীর পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল; এবং তাহা লইয়া বিবাদও হইত। বিবাদকালে উভয় পক্ষে যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নামগুলি বড় মার্জিত রুচির পরিচায়ক। একখানির নাম “দুর্জনমুখচপেটিকা,” তাহার উত্তরের নাম “দুর্জনমুখমহাচপেটিকা” এবং অন্য উত্তরের নাম “দুর্জনমুখপদ্মপাদুকা”। তার পর “ভাগবত-স্বরূপ-বিষয়শঙ্কানিরাসত্রয়োদশঃ” ইত্যাদি অন্যান্য পুস্তকও এ বিষয়ে প্রণীত হইয়াছিল। আমি এই সকল পুস্তক দেখি নাই, কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন এবং Bournouf সাহেব “চপেটিকা,” “মহাচপেটিকা” এবং “পাদুকা”—র অনুবাদও করিয়াছেন। Wilson সাহেব তাঁহার বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদে ভূমিকায় এই বিবাদের সারসংগ্রহ লিখিয়াছেন। আমাদের সে সকল কথায় কোন প্রয়োজন নাই। যাঁহার কৌতূহল থাকে, তিনি Wilson সাহেবের গ্রন্থ দেখিবেন। আমার মতের স্থূল মর্ম এই যে, ভাগবত পুরাণেও অনেক প্রাচীন কথা আছে। কিন্তু অনেক নূতন উপন্যাসও তাহাতে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এবং প্রাচীন কথা যাহা আছে, তাহাও নানাপ্রকার অলঙ্কারবিশিষ্ট এবং অত্যুক্তি দ্বারা অতিরঞ্জিত হইয়াছে। এই পুরাণখানি অন্য অনেক পুরাণ হইতে আধুনিক বোধ হয়, তা না হইলে ইহার পুরাণত্ব লইয়া এত বিবাদ উপস্থিত হইবে কেন?
পুরাণের মধ্যে যে সকল পুরাণে কৃষ্ণচরিত্রের প্রসঙ্গ নাই, সে সকলের আলোচনায় আমাদিগের কোনও প্রয়োজন নাই। যে সকল গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের কোনও প্রসঙ্গ আছে, তাহার মধ্যে ব্রহ্ম, বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত, এই চারিখানিতেই বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে। তাহার মধ্যে আবার ব্রহ্মপুরাণ বিষ্ণুপুরাণে একই কথা আছে। অতএব এই গ্রন্থে বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত ভিন্ন অন্য কোন পুরাণের ব্যবহার প্রয়োজন হইবে না। এই তিন পুরাণ সম্বন্ধে যাহা আমাদিগের বক্তব্য, তাহা বলিয়াছি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে আরও কিছু সময়ান্তরে বলিব। এক্ষণে কেবল আমাদের হরিবংশ সম্বন্ধে কিছু বলিতে বাকি আছে।
১ম,—ব্রহ্মপুরাণ হইতে বিষ্ণুপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
২য়,—বিষ্ণুপুরাণ হইতে ব্রহ্মপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
৩য়,—কেহ কাহারও নিকট চুরি করেন নাই; এই কৃষ্ণচরিতবর্ণনা সেই আদিম বৈয়াসিকী পুরাণসংহিতার অংশ। ব্রহ্ম ও বিষ্ণু উভয় পুরাণেই এই অংশ রক্ষিত হইয়াছে।
প্রথম দুইটি কারণ যথার্থ কারণ বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, এরূপ প্রচলিত গ্রন্থ হইতে আটাশ অধ্যায় স্পষ্ট চুরি অসম্ভব, এবং অন্য কোনও স্থলেও এরূপ দেখাও যায় না। যে এরূপ চুরি করিবে, সে অন্ততঃ কিছু পরিবর্তন করিয়া লইতে পারে এবং রচনাও এমন কিছু নয় যে, তাহার কিছু পরিবর্তন হয় না। আর কেবল এই আটাশ অধ্যায় দুইখানি পুরাণে একরূপ দেখিলেও, না হয়, চুরির কথা মনে করা যাইত, কিন্তু বলিয়াছি যে, অনেক ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের অনেক শ্লোক পরস্পরের সহিত ঐক্যবিশিষ্ট। এবং অনেক ঘটনা সম্বন্ধে পুরাণে পুরাণে বিরোধ থাকিলেও অনেক ঘটনা সম্বন্ধে আবার পুরাণে পুরাণে বিশেষ ঐক্য আছে। এ স্থলে, পূর্বকথিত একখানি আদিম পুরাণসংহিতার অস্তিত্বই প্রমাণীকৃত হইয়াছে। সেই আদিম সংহিতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাসরচিত না হইলেও হইতে পারে। তবে সে সংহিতা যে অতি প্রাচীন কালে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। কেন না, আমরা পরে দেখিব যে, পুরাণকথিত অনেক ঘটনার অখণ্ডনীয় প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায়, অথচ সে সকল ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয় নাই। সুতরাং এমন কথা বলা যাইতে পারে না যে, পুরাণকার তাহা মহাভারত হইতে লইয়াছেন।
যদি আমরা বিলাতী ধরনে পুরাণ সকলের সংগ্রহসময় নিরূপণ করিতে বসি, তাহ হইলে কিরূপ ফল পাই দেখা যাউক। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্থাংশে চতুর্বিংশাধ্যায়ে মগধ রাজাদিগের বংশাবলী কীর্তিত আছে। বিষ্ণুপুরাণে যে সকল বংশাবলী কীর্তিত হইয়াছে, তাহা ভবিষ্যদ্বাণীর আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। অর্থাৎ বিষ্ণুপুরাণ বেদব্যাসের পিতা পরাশরের দ্বারা কলিকালের আরম্ভসময়ে কথিত হইয়াছিল বলিয়া পুরাণকার ভূমিকা করিতেছেন। সে সময়ে নন্দবংশীয়াদি আধুনিক রাজগণ জন্মগ্রহণ করেন নাই। কিন্তু উক্ত রাজগণের সমকাল বা পরকালবর্তী প্রক্ষেপকারকের ইচ্ছা যে, উক্ত রাজগণের নাম ইহাতে থাকে। কিন্তু তাঁহাদিগের নামের উল্লেখ করিতে গেলে, ভবিষ্যদ্বাণীর আবরণ রচনার উপর প্রক্ষিপ্ত না করিলে, পরাশরকথিত বলিয়া পাচার করা যায় না। অতএব সংগ্রহকার বা প্রক্ষেপকারক এই সকল রাজার কথা লিখিবার সময় বলিয়াছেন, অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তিনি যে সকল রাজদিগের নাম করিয়াছেন, তাহার মধ্যে অনেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং তাঁহাদিগের রাজত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধগ্রন্থ, যবনগ্রন্থ, সংস্কৃতগ্রন্থ, প্রস্তরলিপি ইত্যাদি বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
যথা;— নন্দ, মহাপদ্ম, মৌর্য, চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, পুষ্পমিত্র, পুলিমান্, শকরাজগণ, অন্ধ্ররাজগণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে লেখা আছে,—“নব নাগাঃ পদ্মাবত্যাং কান্তিপুর্যাং মথুরায়ামনুগঙ্গাপ্রয়াগং মাগধা গুপ্তাশ্চ ভোক্ষ্যন্তি।”* এই গুপ্তবংশীয়দিগের সময় Fleet সাহেবের কল্যাণে নিরূপিত হইয়াছে। এই বংশের প্রথম রাজাকে মহারাজগুপ্ত বলে। তার পর ঘটোৎকচ ও চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার পর সমুদ্রগুপ্ত। ইঁহারা খ্রীঃ চতুর্থ শতাব্দীর লোক। তার পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, বুদ্ধগুপ্ত—ইঁহারা খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর লোক। এই সকল গুপ্তগণ রাজা হইয়াছিলেন বা রাজত্ব করিতেছেন, ইহা না জানিলে, পুরাণসংগ্রহকার কখনই এরূপ লিখিতে পারিতেন না। অতএব ইনি গুপ্তদিগের সমকাল বা পরকালবর্তী। তাহা হইলে, এই পুরাণ খ্রীষ্টীয় চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বা প্রণীত হইয়াছিল। কিন্তু এমন হইতে পারে যে, এই গুপ্তরাজাদিগের নাম বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থাংশে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। অথবা এমনও হইতে পারে যে, এই চতুর্থাংশ এক সময়ের রচনা, এবং অন্যান্য অংশ অন্যান্য সময়ে রচনা; সকলগুলিই কোনও অনির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হইয়া বিষ্ণুপুরাণ নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। আজিকার দিনেও কি ইউরোপে, কি এদেশে, সচরাচর ঘটিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা একত্রিত হইয়া একখানি সংগ্রহগ্রন্থে নিবদ্ধ হয়, এবং ঐ সংগ্রহের একটি বিশেষ নাম দেওয়া হয়। যথা, “Percy Reliques,” অথবা রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায় সঙ্কলিত ফলিত জ্যোতিষ।” আমার বিবেচনায় সকল পুরাণই এইরূপ সংগ্রহ। উপরি-উক্ত দুইখানি পুস্তকই আধুনিক সংগ্রহ; কিন্তু যে সকল বিষয় ইহাতে সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা প্রাচীন। সংগ্রহ আধুনিক বলিয়া সেগুলি আধুনিক হইল না।
তবে এমন অনেক সময়েই ঘটিয়া থাকিতে পারে যে সংগ্রহকার নিজে অনেক নূতন রচনা করিয়া সংগ্রহের মধ্যে প্রবেশিত করিয়াছেন অথবা প্রাচীন বৃত্তান্ত নূতন কল্পনাসংযুক্ত এবং অত্যুক্তি অলঙ্কারে রঞ্জিত করিয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণ সম্বন্ধে একথা বলা যায় না, কিন্তু ভাগবত সম্বন্ধে ইহা বিশেষ প্রকারে বক্তব্য।
প্রবাদ আছে যে, ভাগবত পুরাণ বোপদেবপ্রণীত। বোপদেব দেবগিরির রাজা হেমাদ্রির সভাসদ্। বোপদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু অনেক হিন্দুই উহা বোপদেবের রচনা বলিয়া স্বীকার করেন না। বৈষ্ণবেরা বলেন, ভাগবতদ্বেষী শাক্তেরা এইরূপ প্রবাদ রটাইয়াছে।
বাস্তবিক ভাগবতের পুরাণত্ব লইয়া অনেক বাদবিতণ্ডা ঘটিয়াছে। শাক্তেরা বলেন, ইহা পুরাণই নহে,—বলেন, দেবীভাগবতই ভাগবত পুরাণ। তাঁহারা বলেন, “ভগবত ইদং ভাগবতং” এইরূপ অর্থ না করিয়া “ভাগবত্যা ইদং ভাগবতং” এই অর্থ করিবে।
কেহ কেহ এইরূপ শঙ্কা করে বলিয়া শ্রীধর স্বামী ইহার প্রথম শ্লোকের টীকাতে লিখিয়াছেন—“ভাগবতং নামান্যদিত্যপি নাশঙ্কনীয়ম্”। ইহাতে বুঝিতে হইবে যে, ইহা পুরাণ নহে—দেবীভাগবতই প্রকৃত পুরাণ, এরূপ আশঙ্কা শ্রীধর স্বামীর পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল; এবং তাহা লইয়া বিবাদও হইত। বিবাদকালে উভয় পক্ষে যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নামগুলি বড় মার্জিত রুচির পরিচায়ক। একখানির নাম “দুর্জনমুখচপেটিকা,” তাহার উত্তরের নাম “দুর্জনমুখমহাচপেটিকা” এবং অন্য উত্তরের নাম “দুর্জনমুখপদ্মপাদুকা”। তার পর “ভাগবত-স্বরূপ-বিষয়শঙ্কানিরাসত্রয়োদশঃ” ইত্যাদি অন্যান্য পুস্তকও এ বিষয়ে প্রণীত হইয়াছিল। আমি এই সকল পুস্তক দেখি নাই, কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন এবং Bournouf সাহেব “চপেটিকা,” “মহাচপেটিকা” এবং “পাদুকা”—র অনুবাদও করিয়াছেন। Wilson সাহেব তাঁহার বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদে ভূমিকায় এই বিবাদের সারসংগ্রহ লিখিয়াছেন। আমাদের সে সকল কথায় কোন প্রয়োজন নাই। যাঁহার কৌতূহল থাকে, তিনি Wilson সাহেবের গ্রন্থ দেখিবেন। আমার মতের স্থূল মর্ম এই যে, ভাগবত পুরাণেও অনেক প্রাচীন কথা আছে। কিন্তু অনেক নূতন উপন্যাসও তাহাতে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এবং প্রাচীন কথা যাহা আছে, তাহাও নানাপ্রকার অলঙ্কারবিশিষ্ট এবং অত্যুক্তি দ্বারা অতিরঞ্জিত হইয়াছে। এই পুরাণখানি অন্য অনেক পুরাণ হইতে আধুনিক বোধ হয়, তা না হইলে ইহার পুরাণত্ব লইয়া এত বিবাদ উপস্থিত হইবে কেন?
পুরাণের মধ্যে যে সকল পুরাণে কৃষ্ণচরিত্রের প্রসঙ্গ নাই, সে সকলের আলোচনায় আমাদিগের কোনও প্রয়োজন নাই। যে সকল গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের কোনও প্রসঙ্গ আছে, তাহার মধ্যে ব্রহ্ম, বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত, এই চারিখানিতেই বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে। তাহার মধ্যে আবার ব্রহ্মপুরাণ বিষ্ণুপুরাণে একই কথা আছে। অতএব এই গ্রন্থে বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত ভিন্ন অন্য কোন পুরাণের ব্যবহার প্রয়োজন হইবে না। এই তিন পুরাণ সম্বন্ধে যাহা আমাদিগের বক্তব্য, তাহা বলিয়াছি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে আরও কিছু সময়ান্তরে বলিব। এক্ষণে কেবল আমাদের হরিবংশ সম্বন্ধে কিছু বলিতে বাকি আছে।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
উপনিষদে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এইরূপ কথিত হইয়াছে যে, জগদীশ্বর এক ছিলেন, বহু
ইতিহাসাদির পৌর্বাপর্য
হইতে ইচ্ছা করিয়া এই জগৎ সৃষ্টি করিলেন।[1] ইহা প্রসিদ্ধ অদ্বৈতবাদের স্থূলকথা। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকেরা অনেক সন্ধানের পর, সেই অদ্বৈতবাদের নিকটে আসিতেছেন। তাঁহারা বলেন, জগতের সমস্তই আদৌ এক, ক্রমশঃ বহু হইয়াছে। ইহাই প্রসিদ্ধ Evolution বাদের স্থূলকথা। এক হইতে বহু বলিলে, কেবল সংখ্যায় বহু বুঝায় না—একাঙ্গিত্ব এবং বহ্বঙ্গিত্ব বুঝিতে হইবে। যাহা অভিন্ন ছিল, তাহা ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে পরিণত হয়। যাহা “Homogeneous” ছিল, তাহা পরিণতিতে “Heterogeneous” হয়। যাহা “Uniform” ছিল, তাহা “Multifarious” হয়। কেবল জড়জগৎ সম্বন্ধে এই নিয়ম সত্য, এমন নহে। জড়জগতে, জীবজগতে, মানসজগতে, সমাজজগতে সর্বত্র ইহা সত্য। সমাজজগতের অন্তর্গত যাহা, সে সকলেরই পক্ষে ইহা খাটে। সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমাজজগতের অন্তর্গত, তাহাতেও খাটে। উপন্যাস বা আখ্যান সাহিত্যের অন্তর্গত, তাহাতেও ইহা সত্য। এমন কি, বাজারের গল্প সম্বন্ধে ইহা সত্য। রাম যদি শ্যামকে বলে, “আমি কাল রাত্রে অন্ধকারে শুইয়াছিলাম, কি একটা শব্দ হইল, আমার বড় ভয় করিতে লাগিল,” তবে নিশ্চয়ই শ্যাম যদুর কাছে গিয়া গল্প করিবে, “রামের ঘরে কাল রাত্রে ভূতে কি রকম শব্দ করিয়াছিল।” তারপর ইহাই সম্ভব যে, যদু গিয়া মধুর কাছে গল্প করিবে যে, “কাল রাত্রে রাম ভূত দেখিয়াছিল,” এবং মধুও নিধুর কাছে বলিবে যে, “রামের বাড়ীতে বড় ভূতের দৌরাত্ম্য হইয়াছে।” এবং পরিশেষে বাজারে রাষ্ট্র হইবে যে, ভূতে দৌরাত্ম্যে রাম সপরিবারে বড় বিপন্ন হইয়া উঠিয়াছে।
এ গেল বাজারে গল্পের কথা। প্রাচীন উপাখ্যান সম্বন্ধে এরূপ পরিণতির একটা বিশেষ নিয়ম দেখিতে পাই। প্রথমাবস্থায় নামকরণ,—যেমন বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু। দ্বিতীয়াবস্থায়, রূপক—যেমন বিষ্ণুর তিন পাদ, কেহ বলেন, সূর্যের উদয়, মধ্যাহ্নস্থিতি, এবং অস্ত; কেহ বলেন, ঈশ্বরের ত্রিলোকব্যাপিতা, কেহ বলেন, ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তারপর তৃতীয়াবস্থায় ইতিহাস—যেমন বলিবামনবৃত্তান্ত। চতুর্থাবস্থায় ইতিহাসের অতিরঞ্জন। পুরাণাদিতে তাহা দেখা যায়।
এ কথার উদাহরণান্তর স্বরূপ, আমরা উর্বশী-পুরুরবার উপাখ্যান লইতে পারি। ইহার প্রথমাবস্থা, যজুর্বেদসংহিতায়। তথায় উর্বশী, পুরুরবা, দুইখানি অরণিকাষ্ঠমাত্র। বৈদিক কালে দিয়াশলাই ছিল না; চকমকি ছিল না; অন্ততঃ যজ্ঞাগ্নি জন্য এ সকল ব্যবহৃত হইত না। কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণ করিয়া যাজ্ঞিক অগ্নির উৎপাদন করিতে হইত। ইহাকে বলিত “অগ্নিচয়ন”। অগ্নিচয়নের মন্ত্র ছিল। যজুর্বেদসংহিতার (মাধ্যনন্দিনী শাখায়) পঞ্চম অধ্যায়ের ২ কণ্ডিকায় সেই মন্ত্র আছে। উহার তৃতীয় মন্ত্রে একখানি অরণিকে, পঞ্চমে অপরখানিকে পূজা করিতে হয়। সেই দুই মন্ত্রের বাঙ্গালা অনুবাদ এই:—
“হে অরণে! অগ্নির উৎপত্তির জন্য আমরা তোমাকে স্ত্রীরূপে কল্পনা করিলাম। অদ্য হইতে তোমার নাম উর্বশী”। ৩।
(উৎপত্তির জন্য, কেবল স্ত্রী নহে, পুরুষও চাই। এজন্য উক্ত স্ত্রীকল্পিত অরণির উপর দ্বিতীয় অরণি স্থাপিত করিয়া বলিতে হইবে)
“হে অরণে! অগ্নির উৎপত্তির জন্য আমরা তোমাকে পুরুষরূপে কল্পনা করিলাম। অদ্য হইতে তোমার নাম পুরুরবা।” ৫। [2]
চতুর্থ মন্ত্রে অরণিস্পৃষ্ট আজ্যের নাম দেওয়া হইয়াছে আয়ু।
এই গেল প্রথমাবস্থা। দ্বিতীয়াবস্থা ঋগ্বেদসংহিতার& ১০ মণ্ডলের ৯৫ সূক্তে। এখানে উর্বশী পুরুরবা আর অরণিকাষ্ঠ নহে; ইহারা নায়ক নাহিকা। পুরুরবা উর্বশীর বিরহশঙ্কিত। এই রূপকাবস্থা। রূপকে উর্বশী (৫ম ঋকে) বলিতেছেন, “হে পুরুরবা, তুমি প্রতিদিন আমাকে তিন বার রমণ করিতে।” যজ্ঞের তিনটি অগ্নি ইহার দ্বারা সূচিত হইতেছে।! পুরুরবাকে উর্বশী “ইলাপুত্র” বলিয়া সম্বোধন করিতেছে। ইলার শব্দের অর্থ পৃথিবী।[3] পৃথিবীরই পুত্র অরণিকাষ্ঠ।
মহাভারতের পুরুরবা ঐতিহাসিক চন্দ্রবংশীয় রাজা। চন্দ্রের পুত্র বুধ, বুধের পুত্র ইলা, ইলার পুত্র পুরুরবা। উর্বশীর গর্ভে ইহার পুত্র হয়; ইহার পুত্র হয়; তাহার নাম আয়ু।[4] যজুর্মন্ত্র যাহা উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা দেখিলে পাঠক দেখিতে পাইবেন, আয়ু সেই অরণিস্পৃষ্ট আজ্য। মহাভারতে এই আয়ুর পুত্র বিখ্যাত নহুষ। নুহুষের পুত্র বিখ্যাত যযাতি। যযাতির পুত্রের মধ্যে দুই জনের নাম যদু ও পুরু। যদু, যাদবদিগের আদিপুরুষ; পুরু, কুরুপাণ্ডবের আদিপুরুষ। এই তৃতীয়াবস্থা। তৃতীয়াবস্থায় অরণিকাষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্রাট্।
চতুর্থ অবস্থা, বিষ্ণু, পদ্ম প্রভৃতি পুরাণে। পুরাণ সকলে তৃতীয় অবস্থার ইতিহাস নূতন উপন্যাসে রঞ্জিত হইয়াছে, তাহার দুইটি নমুনা দিতেছি। একটি এই,—
উর্বশী ইন্দ্রসভায় নৃত্য করিতে করিতে মহারাজ পুরুরবাকে দেখিয়া মোহিত হওয়ায় নৃত্যের তালভঙ্গ হওয়াতে ইন্দ্রের অভিশাপের পঞ্চপঞ্চাশৎ বর্ষ স্বর্গভ্রষ্টা হইয়া পুরুরবার সহিত বাস করিয়াছিলেন।
আর একটি এইরূপ:—
পূর্বকালে কোন সময়ে ভগবান্ বিষ্ণু ধর্মপুত্র হইয়া গন্ধমাদন পর্বতে বিপুল তপস্যা করিয়াছিলেন। ইন্দ্র তাঁহার উগ্র তপস্যায় ভীত তাঁহার বিঘ্নার্থ কতিপয় অপ্সরার সহিত বসন্ত ও কামদেবকে প্রেরণ করেন। সেই সকল অপ্সরা যখন তাঁহার ধ্যানভঙ্গে অশক্তা হইল, তখন কামদেব অপ্সরাগণের উরু হইতে ইঁহাকে সৃজন করিলেন। ইনিই তাঁহার তপোভঙ্গে সমর্থা হন। ইহাতে ইন্দ্র অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং ইঁহার রূপে মোহিত হইয়া ইঁহাকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিলেন। ইনিও সম্মতা হইলেন। পরে মিত্র ও বরুণ তাঁহাদিগকে ঐরূপ মনোভাব জ্ঞাপন করিলে ইনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাহাতে তাঁহাদের শাপে ইনি মনুষ্যভোগ্যা (অর্থাৎ পুরুরবার পত্নী) হন।
এই সকল কথার আলোচনায় আমরা স্পষ্টই বুঝিতে পারি যে, যজুর্বেদসংহিতার ৫ অধ্যায়ের সেই মন্ত্রগুলি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। তাহার পর, ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত। তারপর মহাভারত। তারপর পদ্মাদি পুরাণ।
আমরা যে সকল গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণচরিত্র বুঝিতে চেষ্টা করিব তাহারও পৌর্বাপর্য এই নিয়মের অনুবর্তী হইয়া নির্ধারিত করা যাইতে পারে। দুই একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
& সাহেবেরা বলেন, ঋগ্বেদসংহিতা আর সকল সংহিতা হইতে প্রাচীন। ইহার অর্থ এমন নয় যে, ঋক্সংহিতার সকল সূক্তগুলি সাম ও যজুঃসংহিতার সকল মন্ত্র হইতে প্রাচীন। যদি এ অর্থে এ কথা কেহ বলিয়া থাকেন বা বুঝিয়া থাকেন, তবে তিনি অতিশয় ভ্রান্ত। এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ঋক্সংহিতায় এমন কতকগুলি সূক্ত আছে যে, সেগুলি সকল বেদমন্ত্র অপেক্ষা প্রাচীন। নচেৎ যে, ঋক্সংহিতায় এমন অনেক পাওয়া যায় যে, তাহা স্পষ্টতঃ আধুনিক বলিয়া সাহেবেরাই স্বীকার করেন। অনেকগুলি ঋক্ সামবেদসংহিতাতেও আছে ঋগ্বেদসংহিতাতেও আছে। সংহিতা কেহ কাহারও অপেক্ষা প্রাচীন নহে, তবে কোন মন্ত্র অন্য মন্ত্রের অপেক্ষা প্রাচীন। এরূপ প্রাচীন মন্ত্র ঋক্সংহিতায় বেশী আছে কিন্তু ঋক্ সংহিতায় এমন অনেক মন্ত্রও আছে যে, তাহা যজুঃ সামের অনেক মন্ত্রের অপেক্ষা আধুনিক। দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত ইহার একটি উদাহরণ।
! মক্ষমূলর প্রভৃতি এই রূপকের অর্থ করেন, উর্বশী ঊষা, পুরুরবা সূর্য। Solar myth এই পণ্ডিতেরা কোন মতেই ছাড়িতে পারেন না। যজুর্মন্ত্র যাহা উদ্ধৃত করিলাম, তাহাতে এবং তিন বার সংসর্গের কথায় পাঠক বুঝিবেন যে, এই রূপকের প্রকৃত অর্থ উপরে লিখিত হইল।
প্রথম উদাহরণ স্বরূপ পূতনাবধবৃত্তান্ত দেওয়া যাউক।
ইহার প্রথমাবস্থা কোন গ্রন্থে নাই, কেবল অভিধানেই আছে, যেমন বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু। পরে দেখি, পূতনা, যথার্থতঃ সূতিকাগারস্থ শিশুর রোগ। কিন্তু পূতনা শকুনিকেও বলে; অতএব মহাভারতে পূতনা শকুনি। বিষ্ণুপুরাণে আর এক সোপান উঠিল; রূপকে পরিণত হইল। পূতনা “বালঘাতিনী” অর্থাৎ বালহত্যা যাহার ব্যবসায়; “অতিভীষণা”; তাহার কলেবর “মহৎ”; নন্দ দেখিয়া ত্রাসযুক্ত ও বিস্মিত হইলেন। তথাপি এখনও সে মানবী।[5] হরিবংশে দুইটা কথাই মিলান হইল। পূতনা মানবী বটে, কংসের ধাত্রী। কিন্তু সে কামরূপিণী পক্ষিণী হইয়া ব্রজে আসিল। রূপকত্ব আর নাই; এখন আখ্যান বা ইতিহাস; তৃতীয়াবস্থা এইখানে প্রথম প্রবেশ করিল। পরিশেষে ভাগবতে ইহার চূড়ান্ত হইল। পূতনা রোগও নয়, পক্ষিণীও নয়, মানবীও নহে। যে ঘোররূপা রাক্ষসী। তাহার শরীর ছয় ক্রোশ বিস্তৃত হইয়া পতিত হইয়াছিল, দাঁতগুলা এক একটা লাঙ্গল দণ্ডের মত, নাকের গর্ত গিরিকন্দরের তুল্য, স্তন দুইটা গণ্ডশৈল অর্থাৎ ছোট রকমের পাহাড়, চক্ষু অন্ধকূপের তুল্য, পেটটা জলশূন্য হ্রদের সমান, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা পীড়া ক্রমশঃ এত বড় রাক্ষসীতে পরিণত হইল, দেখিয়া পাঠক আনন্দ লাভ করিবেন আমরা ভরসা করি, কিন্তু মনে রাখেন যে, ইহা চতুর্থ অবস্থা।
ইহাতে পাই, অগ্রে মহাভারত; তারপর বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ; তারপর হরিবংশ; তারপর ভাগবত।
আর একটা উদাহরণ লইয়া দেখা যাউক। কাল শব্দের পর ইয় প্রত্যয় করিলে কালিয় শব্দ পাওয়া যায়। কালিয়ের নাম মহাভারতে নাই। বিষ্ণুপুরাণে কালিয়বৃত্তান্ত পাই। পড়িয়া জানিতে পারা যায় যে, ইহার কাল এং কালভয়নিবারণ কৃষ্ণপাদপদ্ম সম্বন্ধীয় একটি রূপক। সাপের একটি মাত্র ফণা থাকে, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে “মধ্যম ফণার” কথা আছে। মধ্যম বলিলে তিনটি বুঝায়। বুঝিলাম যে, ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানাভিমুখী কালিয়ের তিনটি ফণা। কিন্তু হরিবংশকার রূপকের প্রকৃত তাৎপর্য নাই বুঝিতে পারুন, বা তাহাতে নূতন অর্থ দিবার অভিপ্রায় রাখুন, তিনি দুইটি ফণা বাড়াইয়া দিলেন। ভাগবতকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন—একেবারে সহস্র ফণা করিয়া দিলেন।
এখন বলিতে পারি কি না যে, আগে মহাভারত, পরে বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ, পরে হরিবংশ, পরে ভাগবত।
এখন আর উদাহরণ বাড়াইবার প্রয়োজন নাই, কৃষ্ণচরিত্র লিখিতে লিখিতে অনেক উদাহরণ আপনি আসিয়া পড়িবে। স্থূল কথা এই যে, যে গ্রন্থে অমৌলিক, অনৈসর্গিক, উপন্যাসভাগ যত বাড়িয়াছে, সেই গ্রন্থ তত আধুনিক। এই নিয়মানুসারে, আলোচ্য গ্রন্থ সকলের পৌর্বাপর্য এইরূপ অবধারিত হয়।
প্রথম। মহাভারতের প্রথম স্তর।
দ্বিতীয়। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ।
তৃতীয়। হরিবংশ।
চতুর্থ। শ্রীমদ্ভাগবত।
ইহা ভিন্ন আর কোন গ্রন্থের ব্যবহার বিধেয় নহে। মহাভারতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর অমৌলিক বলিয়া অব্যবহার্য, কিন্তু তাহার অমৌলিকতা প্রমাণ করিবার জন্য, ঐ সকল অংশের কোথাও কোথাও সমালোচনা করিব। ব্রহ্মপুরাণ ব্যবহারের প্রয়োজন নাই, কেন না, বিষ্ণুপুরাণে যাহা আছে, ব্রহ্মপুরাণেও তাহা আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ পরিত্যাজ্য, কেন না, মৌলিক ব্রহ্মবৈবর্ত লোপপ্রাপ্ত হইয়াছে। তথাপি শ্রীরাধার বৃত্তান্ত জন্য একবার ব্রহ্মবৈবর্ত ব্যবহার করিতে হইবে। অন্যান্য পুরাণে কৃষ্ণকথা অতি সংক্ষিপ্ত, এজন্য সে সকলের ব্যবহার নিষ্ফল। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশ ভিন্ন চতুর্থাংশও কদাচিৎ ব্যবহার করার প্রয়োজন হইবে—যথা স্যমন্তক মণি, সত্যভামা, ও জাম্ববতীবৃত্তান্ত।
পুরাণ সকলের প্রক্ষিপ্তবিচার দুর্ঘট। মহাভারতে যে সকল লক্ষণ পাইয়াছি, তাহা হরিবংশে ও পুরাণে লক্ষ্য করা ভার। কিন্তু মহাভারত সম্বন্ধে আর যে দুইটা নিয়ম করিয়াছি যে, যাহা অনৈসর্গিক, তাহা অনৈতিহাসিক ও অতিপ্রকৃত বলিয়া পরিত্যাগ করিব; আর যাহা নৈসর্গিক, তাহাও যদি মিথ্যার লক্ষণাক্রান্ত হয়, তবে তাহাও পরিত্যাগ করিব; এই দুইটি নিয়ম পুরাণ সম্বন্ধেও খাটিবে।
এ গেল বাজারে গল্পের কথা। প্রাচীন উপাখ্যান সম্বন্ধে এরূপ পরিণতির একটা বিশেষ নিয়ম দেখিতে পাই। প্রথমাবস্থায় নামকরণ,—যেমন বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু। দ্বিতীয়াবস্থায়, রূপক—যেমন বিষ্ণুর তিন পাদ, কেহ বলেন, সূর্যের উদয়, মধ্যাহ্নস্থিতি, এবং অস্ত; কেহ বলেন, ঈশ্বরের ত্রিলোকব্যাপিতা, কেহ বলেন, ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তারপর তৃতীয়াবস্থায় ইতিহাস—যেমন বলিবামনবৃত্তান্ত। চতুর্থাবস্থায় ইতিহাসের অতিরঞ্জন। পুরাণাদিতে তাহা দেখা যায়।
এ কথার উদাহরণান্তর স্বরূপ, আমরা উর্বশী-পুরুরবার উপাখ্যান লইতে পারি। ইহার প্রথমাবস্থা, যজুর্বেদসংহিতায়। তথায় উর্বশী, পুরুরবা, দুইখানি অরণিকাষ্ঠমাত্র। বৈদিক কালে দিয়াশলাই ছিল না; চকমকি ছিল না; অন্ততঃ যজ্ঞাগ্নি জন্য এ সকল ব্যবহৃত হইত না। কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণ করিয়া যাজ্ঞিক অগ্নির উৎপাদন করিতে হইত। ইহাকে বলিত “অগ্নিচয়ন”। অগ্নিচয়নের মন্ত্র ছিল। যজুর্বেদসংহিতার (মাধ্যনন্দিনী শাখায়) পঞ্চম অধ্যায়ের ২ কণ্ডিকায় সেই মন্ত্র আছে। উহার তৃতীয় মন্ত্রে একখানি অরণিকে, পঞ্চমে অপরখানিকে পূজা করিতে হয়। সেই দুই মন্ত্রের বাঙ্গালা অনুবাদ এই:—
“হে অরণে! অগ্নির উৎপত্তির জন্য আমরা তোমাকে স্ত্রীরূপে কল্পনা করিলাম। অদ্য হইতে তোমার নাম উর্বশী”। ৩।
(উৎপত্তির জন্য, কেবল স্ত্রী নহে, পুরুষও চাই। এজন্য উক্ত স্ত্রীকল্পিত অরণির উপর দ্বিতীয় অরণি স্থাপিত করিয়া বলিতে হইবে)
“হে অরণে! অগ্নির উৎপত্তির জন্য আমরা তোমাকে পুরুষরূপে কল্পনা করিলাম। অদ্য হইতে তোমার নাম পুরুরবা।” ৫। [2]
চতুর্থ মন্ত্রে অরণিস্পৃষ্ট আজ্যের নাম দেওয়া হইয়াছে আয়ু।
এই গেল প্রথমাবস্থা। দ্বিতীয়াবস্থা ঋগ্বেদসংহিতার& ১০ মণ্ডলের ৯৫ সূক্তে। এখানে উর্বশী পুরুরবা আর অরণিকাষ্ঠ নহে; ইহারা নায়ক নাহিকা। পুরুরবা উর্বশীর বিরহশঙ্কিত। এই রূপকাবস্থা। রূপকে উর্বশী (৫ম ঋকে) বলিতেছেন, “হে পুরুরবা, তুমি প্রতিদিন আমাকে তিন বার রমণ করিতে।” যজ্ঞের তিনটি অগ্নি ইহার দ্বারা সূচিত হইতেছে।! পুরুরবাকে উর্বশী “ইলাপুত্র” বলিয়া সম্বোধন করিতেছে। ইলার শব্দের অর্থ পৃথিবী।[3] পৃথিবীরই পুত্র অরণিকাষ্ঠ।
মহাভারতের পুরুরবা ঐতিহাসিক চন্দ্রবংশীয় রাজা। চন্দ্রের পুত্র বুধ, বুধের পুত্র ইলা, ইলার পুত্র পুরুরবা। উর্বশীর গর্ভে ইহার পুত্র হয়; ইহার পুত্র হয়; তাহার নাম আয়ু।[4] যজুর্মন্ত্র যাহা উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা দেখিলে পাঠক দেখিতে পাইবেন, আয়ু সেই অরণিস্পৃষ্ট আজ্য। মহাভারতে এই আয়ুর পুত্র বিখ্যাত নহুষ। নুহুষের পুত্র বিখ্যাত যযাতি। যযাতির পুত্রের মধ্যে দুই জনের নাম যদু ও পুরু। যদু, যাদবদিগের আদিপুরুষ; পুরু, কুরুপাণ্ডবের আদিপুরুষ। এই তৃতীয়াবস্থা। তৃতীয়াবস্থায় অরণিকাষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্রাট্।
চতুর্থ অবস্থা, বিষ্ণু, পদ্ম প্রভৃতি পুরাণে। পুরাণ সকলে তৃতীয় অবস্থার ইতিহাস নূতন উপন্যাসে রঞ্জিত হইয়াছে, তাহার দুইটি নমুনা দিতেছি। একটি এই,—
উর্বশী ইন্দ্রসভায় নৃত্য করিতে করিতে মহারাজ পুরুরবাকে দেখিয়া মোহিত হওয়ায় নৃত্যের তালভঙ্গ হওয়াতে ইন্দ্রের অভিশাপের পঞ্চপঞ্চাশৎ বর্ষ স্বর্গভ্রষ্টা হইয়া পুরুরবার সহিত বাস করিয়াছিলেন।
আর একটি এইরূপ:—
পূর্বকালে কোন সময়ে ভগবান্ বিষ্ণু ধর্মপুত্র হইয়া গন্ধমাদন পর্বতে বিপুল তপস্যা করিয়াছিলেন। ইন্দ্র তাঁহার উগ্র তপস্যায় ভীত তাঁহার বিঘ্নার্থ কতিপয় অপ্সরার সহিত বসন্ত ও কামদেবকে প্রেরণ করেন। সেই সকল অপ্সরা যখন তাঁহার ধ্যানভঙ্গে অশক্তা হইল, তখন কামদেব অপ্সরাগণের উরু হইতে ইঁহাকে সৃজন করিলেন। ইনিই তাঁহার তপোভঙ্গে সমর্থা হন। ইহাতে ইন্দ্র অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং ইঁহার রূপে মোহিত হইয়া ইঁহাকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিলেন। ইনিও সম্মতা হইলেন। পরে মিত্র ও বরুণ তাঁহাদিগকে ঐরূপ মনোভাব জ্ঞাপন করিলে ইনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাহাতে তাঁহাদের শাপে ইনি মনুষ্যভোগ্যা (অর্থাৎ পুরুরবার পত্নী) হন।
এই সকল কথার আলোচনায় আমরা স্পষ্টই বুঝিতে পারি যে, যজুর্বেদসংহিতার ৫ অধ্যায়ের সেই মন্ত্রগুলি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। তাহার পর, ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত। তারপর মহাভারত। তারপর পদ্মাদি পুরাণ।
আমরা যে সকল গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণচরিত্র বুঝিতে চেষ্টা করিব তাহারও পৌর্বাপর্য এই নিয়মের অনুবর্তী হইয়া নির্ধারিত করা যাইতে পারে। দুই একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
& সাহেবেরা বলেন, ঋগ্বেদসংহিতা আর সকল সংহিতা হইতে প্রাচীন। ইহার অর্থ এমন নয় যে, ঋক্সংহিতার সকল সূক্তগুলি সাম ও যজুঃসংহিতার সকল মন্ত্র হইতে প্রাচীন। যদি এ অর্থে এ কথা কেহ বলিয়া থাকেন বা বুঝিয়া থাকেন, তবে তিনি অতিশয় ভ্রান্ত। এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ঋক্সংহিতায় এমন কতকগুলি সূক্ত আছে যে, সেগুলি সকল বেদমন্ত্র অপেক্ষা প্রাচীন। নচেৎ যে, ঋক্সংহিতায় এমন অনেক পাওয়া যায় যে, তাহা স্পষ্টতঃ আধুনিক বলিয়া সাহেবেরাই স্বীকার করেন। অনেকগুলি ঋক্ সামবেদসংহিতাতেও আছে ঋগ্বেদসংহিতাতেও আছে। সংহিতা কেহ কাহারও অপেক্ষা প্রাচীন নহে, তবে কোন মন্ত্র অন্য মন্ত্রের অপেক্ষা প্রাচীন। এরূপ প্রাচীন মন্ত্র ঋক্সংহিতায় বেশী আছে কিন্তু ঋক্ সংহিতায় এমন অনেক মন্ত্রও আছে যে, তাহা যজুঃ সামের অনেক মন্ত্রের অপেক্ষা আধুনিক। দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত ইহার একটি উদাহরণ।
! মক্ষমূলর প্রভৃতি এই রূপকের অর্থ করেন, উর্বশী ঊষা, পুরুরবা সূর্য। Solar myth এই পণ্ডিতেরা কোন মতেই ছাড়িতে পারেন না। যজুর্মন্ত্র যাহা উদ্ধৃত করিলাম, তাহাতে এবং তিন বার সংসর্গের কথায় পাঠক বুঝিবেন যে, এই রূপকের প্রকৃত অর্থ উপরে লিখিত হইল।
প্রথম উদাহরণ স্বরূপ পূতনাবধবৃত্তান্ত দেওয়া যাউক।
ইহার প্রথমাবস্থা কোন গ্রন্থে নাই, কেবল অভিধানেই আছে, যেমন বিষ্ ধাতু হইতে বিষ্ণু। পরে দেখি, পূতনা, যথার্থতঃ সূতিকাগারস্থ শিশুর রোগ। কিন্তু পূতনা শকুনিকেও বলে; অতএব মহাভারতে পূতনা শকুনি। বিষ্ণুপুরাণে আর এক সোপান উঠিল; রূপকে পরিণত হইল। পূতনা “বালঘাতিনী” অর্থাৎ বালহত্যা যাহার ব্যবসায়; “অতিভীষণা”; তাহার কলেবর “মহৎ”; নন্দ দেখিয়া ত্রাসযুক্ত ও বিস্মিত হইলেন। তথাপি এখনও সে মানবী।[5] হরিবংশে দুইটা কথাই মিলান হইল। পূতনা মানবী বটে, কংসের ধাত্রী। কিন্তু সে কামরূপিণী পক্ষিণী হইয়া ব্রজে আসিল। রূপকত্ব আর নাই; এখন আখ্যান বা ইতিহাস; তৃতীয়াবস্থা এইখানে প্রথম প্রবেশ করিল। পরিশেষে ভাগবতে ইহার চূড়ান্ত হইল। পূতনা রোগও নয়, পক্ষিণীও নয়, মানবীও নহে। যে ঘোররূপা রাক্ষসী। তাহার শরীর ছয় ক্রোশ বিস্তৃত হইয়া পতিত হইয়াছিল, দাঁতগুলা এক একটা লাঙ্গল দণ্ডের মত, নাকের গর্ত গিরিকন্দরের তুল্য, স্তন দুইটা গণ্ডশৈল অর্থাৎ ছোট রকমের পাহাড়, চক্ষু অন্ধকূপের তুল্য, পেটটা জলশূন্য হ্রদের সমান, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা পীড়া ক্রমশঃ এত বড় রাক্ষসীতে পরিণত হইল, দেখিয়া পাঠক আনন্দ লাভ করিবেন আমরা ভরসা করি, কিন্তু মনে রাখেন যে, ইহা চতুর্থ অবস্থা।
ইহাতে পাই, অগ্রে মহাভারত; তারপর বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ; তারপর হরিবংশ; তারপর ভাগবত।
আর একটা উদাহরণ লইয়া দেখা যাউক। কাল শব্দের পর ইয় প্রত্যয় করিলে কালিয় শব্দ পাওয়া যায়। কালিয়ের নাম মহাভারতে নাই। বিষ্ণুপুরাণে কালিয়বৃত্তান্ত পাই। পড়িয়া জানিতে পারা যায় যে, ইহার কাল এং কালভয়নিবারণ কৃষ্ণপাদপদ্ম সম্বন্ধীয় একটি রূপক। সাপের একটি মাত্র ফণা থাকে, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে “মধ্যম ফণার” কথা আছে। মধ্যম বলিলে তিনটি বুঝায়। বুঝিলাম যে, ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানাভিমুখী কালিয়ের তিনটি ফণা। কিন্তু হরিবংশকার রূপকের প্রকৃত তাৎপর্য নাই বুঝিতে পারুন, বা তাহাতে নূতন অর্থ দিবার অভিপ্রায় রাখুন, তিনি দুইটি ফণা বাড়াইয়া দিলেন। ভাগবতকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন—একেবারে সহস্র ফণা করিয়া দিলেন।
এখন বলিতে পারি কি না যে, আগে মহাভারত, পরে বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ, পরে হরিবংশ, পরে ভাগবত।
এখন আর উদাহরণ বাড়াইবার প্রয়োজন নাই, কৃষ্ণচরিত্র লিখিতে লিখিতে অনেক উদাহরণ আপনি আসিয়া পড়িবে। স্থূল কথা এই যে, যে গ্রন্থে অমৌলিক, অনৈসর্গিক, উপন্যাসভাগ যত বাড়িয়াছে, সেই গ্রন্থ তত আধুনিক। এই নিয়মানুসারে, আলোচ্য গ্রন্থ সকলের পৌর্বাপর্য এইরূপ অবধারিত হয়।
প্রথম। মহাভারতের প্রথম স্তর।
দ্বিতীয়। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চম অংশ।
তৃতীয়। হরিবংশ।
চতুর্থ। শ্রীমদ্ভাগবত।
ইহা ভিন্ন আর কোন গ্রন্থের ব্যবহার বিধেয় নহে। মহাভারতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর অমৌলিক বলিয়া অব্যবহার্য, কিন্তু তাহার অমৌলিকতা প্রমাণ করিবার জন্য, ঐ সকল অংশের কোথাও কোথাও সমালোচনা করিব। ব্রহ্মপুরাণ ব্যবহারের প্রয়োজন নাই, কেন না, বিষ্ণুপুরাণে যাহা আছে, ব্রহ্মপুরাণেও তাহা আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ পরিত্যাজ্য, কেন না, মৌলিক ব্রহ্মবৈবর্ত লোপপ্রাপ্ত হইয়াছে। তথাপি শ্রীরাধার বৃত্তান্ত জন্য একবার ব্রহ্মবৈবর্ত ব্যবহার করিতে হইবে। অন্যান্য পুরাণে কৃষ্ণকথা অতি সংক্ষিপ্ত, এজন্য সে সকলের ব্যবহার নিষ্ফল। বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশ ভিন্ন চতুর্থাংশও কদাচিৎ ব্যবহার করার প্রয়োজন হইবে—যথা স্যমন্তক মণি, সত্যভামা, ও জাম্ববতীবৃত্তান্ত।
পুরাণ সকলের প্রক্ষিপ্তবিচার দুর্ঘট। মহাভারতে যে সকল লক্ষণ পাইয়াছি, তাহা হরিবংশে ও পুরাণে লক্ষ্য করা ভার। কিন্তু মহাভারত সম্বন্ধে আর যে দুইটা নিয়ম করিয়াছি যে, যাহা অনৈসর্গিক, তাহা অনৈতিহাসিক ও অতিপ্রকৃত বলিয়া পরিত্যাগ করিব; আর যাহা নৈসর্গিক, তাহাও যদি মিথ্যার লক্ষণাক্রান্ত হয়, তবে তাহাও পরিত্যাগ করিব; এই দুইটি নিয়ম পুরাণ সম্বন্ধেও খাটিবে।
ধর্ম সম্বন্ধে আমার যাহা বলিবার আছে, তাহার সমস্ত আনুপূর্বিক সাধারণকে বুঝাইতে পারি, এমন সম্ভাবনা অল্পই। কেন না, কথা অনেক, সময় অল্প। সেই সকল কথার মধ্যে তিনটি কথা, আমি তিনটি প্রবন্ধে বুঝাইতে প্রবৃত্ত আছি। ঐ প্রবন্ধ তিনটি দুইখানি সাময়িক পত্রে ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হইতেছে।
উক্ত তিনটি প্রবন্ধের একটি অনুশীলন ধর্মবিষয়ক; দ্বিতীয়টি দেবতত্ত্ব বিষয়ক; তৃতীয়টি কৃষ্ণচরিত্র। প্রথম প্রবন্ধ “নবজীবনে” প্রকাশিত হইতেছে; দ্বিতীয় ও তৃতীয় “প্রচার” নামক পত্রে প্রকাশিত হইতেছে। প্রায় দুই বৎসর হইল এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ আরম্ভ হইয়াছে; কিন্তু ইহার মধ্যে একটিও আজি পর্যন্ত সমাপ্ত করিতে পারি নাই। সমাপ্তি দূরে থাকুক, কোনটিও অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। তাহার অনেকগুলি কারণ আছে। একে বিষয়গুলি অতি মহৎ, অতি বিস্তারিত সমালোচনা ভিন্ন তন্মধ্যে কোন বিষয়েরই মীমাংসা হইতে পারে না; তাহাতে আবার দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ লেখকের সময়ও অতি অল্প; এবং পরিশ্রম করিবার শক্তিও মনুষ্যের চিরকাল সমান থাকে না।
এই সকল কারণের প্রতি মনোযোগ করিয়া, এবং মনুষ্যের পরমায়ুর সাধারণ পরিমাণ ও আপনার বয়স বিবেচনা করিয়া, আমি আমার বক্তব্য কথা সকলগুলি বলিবার সময় পাইব, এমন আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। যে দেবমন্দির গঠন করিবার উচ্চাভিলাষকে মনে স্থান দিয়া, দুই একখানি করিয়া ইষ্টক সংগ্রহ করিতেছি, তাহা সমাপ্ত করিতে পারিব, এমন আশা আর রাখি না। যে তিনটি প্রবন্ধ আরম্ভ করিয়াছি, তাহাও সমাপ্ত করিতে পারিব কি না, জগদীশ্বর জানেন। সকলগুলি সম্পূর্ণ হইলে তাহা পুনর্মুদ্রিত করিব, এ আশায় বসিয়া থাকিতে গেলে, হয়ত সময়ে কোন প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হইবে না। কেন না, সকল কাজেরই সময় অসময় আছে। এই জন্য কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম খণ্ড এক্ষণে পুনর্মুদ্রিত করা গেল। বোধ করি এইরূপ পাঁচ ছয় খণ্ডে গ্রন্থ সমাপ্ত হইতে পারে। কিন্তু সকলই সময় ও শক্তি এবং ঈশ্বরানুগ্রহের উপর নির্ভর করে।
আগে অনুশীলন ধর্ম পুনর্মুদ্রিত হইয়া তৎপরে কৃষ্ণচরিত্র পুনর্মুদ্রিত হইলেই ভাল হইত। কেন না, “অনুশীলন ধর্মে” যাহা তত্ত্ব মাত্র, কৃষ্ণচরিত্রে তাহা দেহবিশিষ্ট। অনুশীলনে যে আদর্শে উপস্থিত হইতে হয়, কৃষ্ণচরিত্র কর্মক্ষেত্রস্থ সেই আদর্শ। আগে তত্ত্ব বুঝাইয়া, তার পর উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্টীকৃত করিতে হয়। কৃষ্ণচরিত্র সেই উদাহরণ; কিন্তু অনুশীলন ধর্ম সম্পূর্ণ না করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না। সম্পূর্ণ হইবারও বিলম্ব আছে।
উক্ত তিনটি প্রবন্ধের একটি অনুশীলন ধর্মবিষয়ক; দ্বিতীয়টি দেবতত্ত্ব বিষয়ক; তৃতীয়টি কৃষ্ণচরিত্র। প্রথম প্রবন্ধ “নবজীবনে” প্রকাশিত হইতেছে; দ্বিতীয় ও তৃতীয় “প্রচার” নামক পত্রে প্রকাশিত হইতেছে। প্রায় দুই বৎসর হইল এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ আরম্ভ হইয়াছে; কিন্তু ইহার মধ্যে একটিও আজি পর্যন্ত সমাপ্ত করিতে পারি নাই। সমাপ্তি দূরে থাকুক, কোনটিও অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। তাহার অনেকগুলি কারণ আছে। একে বিষয়গুলি অতি মহৎ, অতি বিস্তারিত সমালোচনা ভিন্ন তন্মধ্যে কোন বিষয়েরই মীমাংসা হইতে পারে না; তাহাতে আবার দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ লেখকের সময়ও অতি অল্প; এবং পরিশ্রম করিবার শক্তিও মনুষ্যের চিরকাল সমান থাকে না।
এই সকল কারণের প্রতি মনোযোগ করিয়া, এবং মনুষ্যের পরমায়ুর সাধারণ পরিমাণ ও আপনার বয়স বিবেচনা করিয়া, আমি আমার বক্তব্য কথা সকলগুলি বলিবার সময় পাইব, এমন আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। যে দেবমন্দির গঠন করিবার উচ্চাভিলাষকে মনে স্থান দিয়া, দুই একখানি করিয়া ইষ্টক সংগ্রহ করিতেছি, তাহা সমাপ্ত করিতে পারিব, এমন আশা আর রাখি না। যে তিনটি প্রবন্ধ আরম্ভ করিয়াছি, তাহাও সমাপ্ত করিতে পারিব কি না, জগদীশ্বর জানেন। সকলগুলি সম্পূর্ণ হইলে তাহা পুনর্মুদ্রিত করিব, এ আশায় বসিয়া থাকিতে গেলে, হয়ত সময়ে কোন প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হইবে না। কেন না, সকল কাজেরই সময় অসময় আছে। এই জন্য কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম খণ্ড এক্ষণে পুনর্মুদ্রিত করা গেল। বোধ করি এইরূপ পাঁচ ছয় খণ্ডে গ্রন্থ সমাপ্ত হইতে পারে। কিন্তু সকলই সময় ও শক্তি এবং ঈশ্বরানুগ্রহের উপর নির্ভর করে।
আগে অনুশীলন ধর্ম পুনর্মুদ্রিত হইয়া তৎপরে কৃষ্ণচরিত্র পুনর্মুদ্রিত হইলেই ভাল হইত। কেন না, “অনুশীলন ধর্মে” যাহা তত্ত্ব মাত্র, কৃষ্ণচরিত্রে তাহা দেহবিশিষ্ট। অনুশীলনে যে আদর্শে উপস্থিত হইতে হয়, কৃষ্ণচরিত্র কর্মক্ষেত্রস্থ সেই আদর্শ। আগে তত্ত্ব বুঝাইয়া, তার পর উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্টীকৃত করিতে হয়। কৃষ্ণচরিত্র সেই উদাহরণ; কিন্তু অনুশীলন ধর্ম সম্পূর্ণ না করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিতে পারিলাম না। সম্পূর্ণ হইবারও বিলম্ব আছে।
কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম সংস্করণে কেবল মহাভারতীয় কেবল মহাভারতীয় কৃষ্ণকথা সমালোচিত হইয়াছিল। তাহাও অল্পাংশ মাত্র। এবার মহাভারতে কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রয়োজনীয় কথা যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহা সমস্তই সমালোচিত হইয়াছে। তা ছাড়া হরিবংশে ও পুরাণে যাহা সমালোচনার যোগ্য পাওয়া যায়, তাহাও বিচারিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া উপক্রমণিকাভাগ পুনর্লিখিত এবং বিশেষরূপে পরিবর্ধিত হইয়াছে। ইহা আমার অভিপ্রেত সম্পূর্ণ গ্রন্থ। প্রথম সংস্করণে যাহা ছিল, তাহা এই দ্বিতীয় সংস্করণের অল্পাংশ মাত্র। অধিকাংশই নূতন।
এত দূরও যে কৃতকার্য হইতে পারিব, পূর্বে ইহা আশা করি নাই। কিন্তু সম্পূর্ণ কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশ করিয়াও আমি সুখী হইলাম না। তাহার কারণ, আমার ত্রুটিতেই হউক, আর দূরদৃষ্ট বশত:ই হউক, মুদ্রাঙ্কনকার্যে এত ভ্রম প্রমাদ ঘটিয়াছে যে, অনেক ভাগ পুনর্মুদ্রিত করাই আমার কর্তব্য ছিল। নানা কারণবশত: তাহা পারিলাম না। আপাতত: একটা শুদ্ধিপত্র দিলাম। যেখানে অর্থবোধে কষ্ট উপস্থিত হইবে, অনুগ্রহপূর্বক পাঠক সেইখানে শুদ্ধপত্রখানি দেখিয়া লইবেন। শুদ্ধিপত্রেও বোধ হয়, সব ভুল ধরা হয় নাই। যাহা চক্ষে পড়িয়াছে, তাহাই ধরা হইয়াছে। ইহা ভিন্ন কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় যথাস্থানে লিখিতে ভুল হইয়া গিয়াছে। তাহা তিনটি ক্রোড়পত্রে সন্নিবিষ্ট করা গেল। পাঠক ৭ পৃষ্ঠার [৮ পংক্তির] পর ক্রোড়পত্র (ক), দ্বিতীয় খণ্ডের দশম পরিচ্ছেদের [১০৯ পৃষ্ঠা, ১২ পংক্তির] পর (খ) এবং ১৩৬ পৃষ্ঠার [১৭ পংক্তির] পর (গ) ও [২২২ পৃষ্ঠার ফুট নোটে] ক্রোড়পত্র (ঘ) পাঠ করিবেন।
আমি বলিতে বাধ্য যে, প্রথম সংস্করণে যে সকল মত প্রকাশ করিয়াছিলাম, এখন তাহার কিছু কিছু পরিত্যাগ এবং কিছু কিছু পরিবর্তিত করিয়াছি। কৃষ্ণের বাল্যলীলা সম্বন্ধে বিশিষ্টরূপে এই কথা আমার বক্তব্য। এরূপ মতপরিবর্তনের স্বীকার করিতে আমি লজ্জা করি না। আমার জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মতপরিবর্তন করিয়াছি-কে না করে? কৃষ্ণবিষয়েই আমার মতপরিবর্তনের বিচিত্র উদাহরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বঙ্গদর্শনে যে কৃষ্ণচরিত্র লিখিয়াছিলাম, আর এখন যাহা লিখিলাম, আলোক অন্ধকারে যত দূর প্রভেদ, এতদুভয়ে তত দূর প্রভেদ। মতপরিবর্তন, বয়োবৃদ্ধি, অনুসন্ধানের বিস্তার, এবং ভাবনার ফল। যাঁহার কখন মত পরিবর্তন হয় না, তিনি হয় অভ্রান্ত দৈবজ্ঞানবিশিষ্ট, নয় বুদ্ধিহীন এবং জ্ঞানহীন। যাহা আর সকলের ঘটিয়া থাকে, তাহা স্বীকার করিতে আমি লজ্জাবোধ করিলাম না।
এ গ্রন্থে ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের মত অনেক স্থলেই অগ্রাহ্য করিয়াছি, কিন্তু তাঁহাদের নিকট সন্ধান ও সাহায্য না পাইয়াছি এমত নহে। Wilson, Goldstucker, Weber, Muir-ইঁহাদিগের নিকট আমি ঋণ স্বীকার করিতে বাধ্য। দেশী লেখকদিগের মধ্যে আমাদের দেশের মুখোজ্জ্বলকারী শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত, C.I.E. শ্রীযুক্ত সত্যব্রত সামশ্রমী, এবং মৃত মহাত্মা অক্ষয়কুমার দত্তের নিকট আমি বাধ্য। অক্ষয় বাবু উত্তম সংগ্রহকার। সর্বাপেক্ষা আমার ঋণ মৃত মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের নিকট গুরুতর। যেখানে মহাভারত হইতে উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, আমি তাঁহার অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি। প্রয়োজনমতে মূলের সঙ্গে অনুবাদ মিলাইয়াছি। যে দুই এক স্থানে মারাত্মক ভ্রম আছে বুঝিয়াছি, সেখানে নোট করিয়া দিয়াছি। প্রয়োজনানুসারে, স্থানবিশেষে ভিন্ন, গ্রন্থের কলেবরবৃদ্ধি ভয়ে মহাভারতের মূল সংস্কৃত করি নাই। হরিবংশ ও পুরাণ হইতে যাহা উদ্ধৃত করিয়াছি, মূল উদ্ধৃত করিয়াছি, এবং তাহার অনুবাদের দায় দোষ আমার নিজের।
পরিশেষে বক্তব্য কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করা এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। তাঁহার মানবচরিত্র সমালোচন করাই আমার উদ্দেশ্য। আমি নিজে তাঁহার ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করি;-সে বিশ্বাসও আমি লুকাই নাই। কিন্তু পাঠককে সেই মতাবলম্বী করিবার জন্য কোন যত্ন পাই নাই।
কংসবধ
এদিকে কংসের নিকট সংবাদ পঁহুছিল যে, বৃন্দাবনে কৃষ্ণ বলরাম অতিশয় বলশালী হইয়াছেন। পূতনা হইতে অরিষ্ট পর্যন্ত কংসানুচর সকলকে নিহত করিয়াছেন। দেবর্ষি নারদ গিয়া কংসকে বলিলেন, কৃষ্ণ-রাম বসুদেবের পুত্র। দেবকীর অষ্টমগর্ভজা বলিয়া যে কন্যাকে কংস নিহত করিয়াছিলেন, সে নন্দ—যশোদার কন্যা। বসুদেব সন্তান পরিবর্তিত করিয়া কৃষ্ণকে নন্দালয়ে গোপনে রাখিয়াছেন। ইহা শুনিয়া কংস ভীত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বসুদেবকে তিরস্কৃত করিলেন, এবং তাঁহার বধে উদ্যত হইলেন; এবং রাম-কৃষ্ণকে আনিবার জন্য অক্রুরনামা এক জন যাদবপ্রধানকে বৃন্দাবনে প্রেরণ করিলেন। এ দিকে কংস আপনার বিখ্যাত বলবান্ মল্লদিগের দ্বারা রাম-কৃষ্ণের বধসাধনের অভিপ্রায়ে ধনুর্মখ নামে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেন। রামকৃষ্ণ অক্রূর কর্তৃক তথায় আনীত হইয়া[1] রঙ্গভূমিতে প্রবেশপূর্বক কংসের শিক্ষিত হস্তী কুবলয়াপীড়কে ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ মল্ল চাণুর ও মুষ্ঠিককে নিহত করিলেন। ইহা দেখিয়া কংস নন্দকে লৌহময় নিগড়ে অবরুদ্ধ করিবার এবং বসুদেবকে বিনাশ করিবার জন্য আদেশ করিয়া কৃষ্ণ-বলরামকে তাড়াইয়া দিবার আজ্ঞা করিলেন। তখন যে মঞ্চে মল্লযুদ্ধ দেখিবার জন্য অন্যান্য যাদবের সহিত কংস উপবিষ্ট ছিলেন, কৃষ্ণ লম্ফপ্রদান-পূর্বক তদুপরি আরোহণ করিয়া কংসকে ধরিলেন এবং তাঁহাকে কেশের দ্বারা আকর্ষণ করিয়া রঙ্গভূমে নিপাতিত ও তাঁহাকে নিহত করিলেন। পরে বসুদেবকে দেবকী প্রভৃতি গুরুজনকে যথাবিহিত বন্দনা করিয়া কংসের পিতা উগ্রসেনকে রাজ্যে অভিষেক করিলেন। নিজে রাজা হইলেন না।
হরিবংশ ও পুরাণ সকলে এইরূপ কংসবৃত্তান্ত কথিত হইয়াছে। কংসবধ ঐতিহাসিক ঘটনা বটে, কিন্তু তদ্বিষয়ক এই বিবরণ ঐতিহাসিকতাশূন্য। ইহাতে বিশ্বাস করিতে গেলে, অতিপ্রকৃত ব্যাপারে বিশ্বাস করিতে হয়। প্রথমতঃ দেবর্ষি নারদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতে হয়। তার পর সেই দৈববাণীতে বিশ্বাস করিতে হয়, কেন না, কংসের ভয় সেই দৈববাণীস্মৃতি হইতে উৎপন্ন। তাহা ছাড়া, দুইটি গোপবালক আসিয়া বিনা যুদ্ধে সভামধ্যে মথুরাধিপতিকে বিনষ্ট করিবে, ইহা ত সহজে বিশ্বাস করা যায় না। অতএব দেখা যাউক যে, সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে এই বিষয় কি আছে। মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ নিজে নিজের পূর্ববৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের নিকট বলিতেছেন:—
“কিয়ৎকাল অতীত হইল কংস[2] যাদবগণকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ঐ দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবর্গকে পরাজয় করতঃ সর্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠিল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রূরকে আহুক—কন্যা প্রদান করিয়া জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনার্থ বলভদ্র সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম।”
ইহাতে কৃষ্ণ বলরাম বৃন্দাবন হইতে আনীত হওয়ার কথা কিছুমাত্র নাই। বরং এমন বুঝাইতেছে যে, কংসবধের পূর্ব হইতেই কৃষ্ণ বলরাম মথুরাতে বাস করিতেন। কৃষ্ণ বলিতেছেন যে, বৃদ্ধ যাদবেরা জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন, অর্থাৎ পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তাহা না করিয়া জ্ঞাতিদিগের মঙ্গলার্থ কংসকেই বধ করিলেন। ইহাতে বলরাম ভিন্ন আর কেহ তাঁহার সহায় ছিল কি না, ইহা প্রকাশ নাই। কিন্তু ইহা স্পষ্ট বুঝা যাইতে পারিতেছে যে, অন্যান্য যাদবগণ প্রকাশ্যে তাঁহাদের সাহায্য করুন বা না করুন, কংসকে কেহ রক্ষা করিতে চেষ্টা করেন নাই। কংস তাঁহাদের সকলের উপর অত্যাচার করিত, এ জন্য বরং, বোধ হয়, তাঁহারাই রাম-কৃষ্ণের বলাধিক্য দেখিয়া তাঁহাদিগকে নেতৃত্বে সংস্থাপন করিয়া কংসের বধসাধন করিয়াছিলেন। এইটুকু ভিন্ন আর কিছু ঐতিহাসিক তত্ত্ব পাওয়া যায় না।
আর ঐতিহাসিক তত্ত্ব ইহা পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণ কংসকে নিহত করিয়া কংসের পিতা উগ্রসেনকেই যাদবদিগের আধিপত্যে সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। কেন না, মহাভারতেও উগ্রসেনকে যাদবদিগের অধিপতি স্বরূপ বর্ণিত দেখিতে পাওয়া যায়। এ দেশের চিরপ্রচলিত রীতি ও নীতি এই যে, যে রাজাকে বধ করিতে পারে, সেই তাহার রাজ্যভোগী হয়। কংসের বিজেতা কৃষ্ণ অনায়াসেই মথুরার সিংহাসন অধিকৃত করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না, কেন না, ধর্মতঃ সে রাজ্য উগ্রসেনের। উগ্রসেনকে পদচ্যুত করিয়াই কংস রাজা হইয়াছিল। ধর্মই কৃষ্ণের নিকট প্রধান, তিনি শৈশবাবধিই ধর্মাত্মা। অতএব যাহার রাজ্য, তাহাকেই তিনি রাজ্য প্রধান করিলেন। আমরা পরে দেখিব যে, তিনি প্রকাশ্যে বলিতেছেন যে, যাহাতে পরিহিত, তাহাই ধর্ম। এখানে ঘোরতর অত্যাচারী কংসের বধে সমস্ত যাদবগণের হিতসাধন হয়, এইজন্য তিনি কংসকে বধ করিয়াছিলেন—ধর্মার্থ মাত্র। বধ করিয়া করুণহৃদয় আদর্শপুরুষ কংসের জন্য বিলাপ করিয়া ছিলেন, এমন কথা গ্রন্থে লিখিত আছে। এই কংসবধে আমরা প্রথমে প্রকৃত ইতিহাসের সাক্ষাৎ পাই এবং এই কংসবধেই দেখি যে, কৃষ্ণ পরম বলশালী, পরম কার্যদক্ষ, পরম ন্যায়পর, পরম ধর্মাত্মা, পরহিতে রত, এবং পরের জন্য কাতর। এইখান হইতে দেখিতে পাই যে, তিনি আদর্শ মানুষ।
হরিবংশ ও পুরাণ সকলে এইরূপ কংসবৃত্তান্ত কথিত হইয়াছে। কংসবধ ঐতিহাসিক ঘটনা বটে, কিন্তু তদ্বিষয়ক এই বিবরণ ঐতিহাসিকতাশূন্য। ইহাতে বিশ্বাস করিতে গেলে, অতিপ্রকৃত ব্যাপারে বিশ্বাস করিতে হয়। প্রথমতঃ দেবর্ষি নারদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতে হয়। তার পর সেই দৈববাণীতে বিশ্বাস করিতে হয়, কেন না, কংসের ভয় সেই দৈববাণীস্মৃতি হইতে উৎপন্ন। তাহা ছাড়া, দুইটি গোপবালক আসিয়া বিনা যুদ্ধে সভামধ্যে মথুরাধিপতিকে বিনষ্ট করিবে, ইহা ত সহজে বিশ্বাস করা যায় না। অতএব দেখা যাউক যে, সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে এই বিষয় কি আছে। মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ নিজে নিজের পূর্ববৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের নিকট বলিতেছেন:—
“কিয়ৎকাল অতীত হইল কংস[2] যাদবগণকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ঐ দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবর্গকে পরাজয় করতঃ সর্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠিল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রূরকে আহুক—কন্যা প্রদান করিয়া জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনার্থ বলভদ্র সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম।”
ইহাতে কৃষ্ণ বলরাম বৃন্দাবন হইতে আনীত হওয়ার কথা কিছুমাত্র নাই। বরং এমন বুঝাইতেছে যে, কংসবধের পূর্ব হইতেই কৃষ্ণ বলরাম মথুরাতে বাস করিতেন। কৃষ্ণ বলিতেছেন যে, বৃদ্ধ যাদবেরা জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন, অর্থাৎ পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তাহা না করিয়া জ্ঞাতিদিগের মঙ্গলার্থ কংসকেই বধ করিলেন। ইহাতে বলরাম ভিন্ন আর কেহ তাঁহার সহায় ছিল কি না, ইহা প্রকাশ নাই। কিন্তু ইহা স্পষ্ট বুঝা যাইতে পারিতেছে যে, অন্যান্য যাদবগণ প্রকাশ্যে তাঁহাদের সাহায্য করুন বা না করুন, কংসকে কেহ রক্ষা করিতে চেষ্টা করেন নাই। কংস তাঁহাদের সকলের উপর অত্যাচার করিত, এ জন্য বরং, বোধ হয়, তাঁহারাই রাম-কৃষ্ণের বলাধিক্য দেখিয়া তাঁহাদিগকে নেতৃত্বে সংস্থাপন করিয়া কংসের বধসাধন করিয়াছিলেন। এইটুকু ভিন্ন আর কিছু ঐতিহাসিক তত্ত্ব পাওয়া যায় না।
আর ঐতিহাসিক তত্ত্ব ইহা পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণ কংসকে নিহত করিয়া কংসের পিতা উগ্রসেনকেই যাদবদিগের আধিপত্যে সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। কেন না, মহাভারতেও উগ্রসেনকে যাদবদিগের অধিপতি স্বরূপ বর্ণিত দেখিতে পাওয়া যায়। এ দেশের চিরপ্রচলিত রীতি ও নীতি এই যে, যে রাজাকে বধ করিতে পারে, সেই তাহার রাজ্যভোগী হয়। কংসের বিজেতা কৃষ্ণ অনায়াসেই মথুরার সিংহাসন অধিকৃত করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না, কেন না, ধর্মতঃ সে রাজ্য উগ্রসেনের। উগ্রসেনকে পদচ্যুত করিয়াই কংস রাজা হইয়াছিল। ধর্মই কৃষ্ণের নিকট প্রধান, তিনি শৈশবাবধিই ধর্মাত্মা। অতএব যাহার রাজ্য, তাহাকেই তিনি রাজ্য প্রধান করিলেন। আমরা পরে দেখিব যে, তিনি প্রকাশ্যে বলিতেছেন যে, যাহাতে পরিহিত, তাহাই ধর্ম। এখানে ঘোরতর অত্যাচারী কংসের বধে সমস্ত যাদবগণের হিতসাধন হয়, এইজন্য তিনি কংসকে বধ করিয়াছিলেন—ধর্মার্থ মাত্র। বধ করিয়া করুণহৃদয় আদর্শপুরুষ কংসের জন্য বিলাপ করিয়া ছিলেন, এমন কথা গ্রন্থে লিখিত আছে। এই কংসবধে আমরা প্রথমে প্রকৃত ইতিহাসের সাক্ষাৎ পাই এবং এই কংসবধেই দেখি যে, কৃষ্ণ পরম বলশালী, পরম কার্যদক্ষ, পরম ন্যায়পর, পরম ধর্মাত্মা, পরহিতে রত, এবং পরের জন্য কাতর। এইখান হইতে দেখিতে পাই যে, তিনি আদর্শ মানুষ।
———————–
1 পথিমধ্যে কুব্জা-ঘটিত ব্যাপারটা আছে। বিষ্ণুপুরাণে নিন্দনীয় কথা কিছু নাই। কুব্জা আপনাকে সুন্দরী হইতে দেখিয়া কৃষ্ণকে নিজ মন্দিরে যাইতে অনুরোধ করিলেন, কৃষ্ণ হাসিয়াই অস্থির। বিষ্ণুপুরাণে এই পর্যন্ত। কৃষ্ণের এ ব্যবহার মানবোচিত ও সজ্জনোচিত। কিন্তু ভাগবতকার ও ব্রহ্মবৈবর্তকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন, কুব্জার হঠাৎ ভক্তির হঠাৎ পুরস্কার দিয়াছেন, শেষ যাত্রায় কুব্জাপাটরাণী!
আমরা এইখান হইতে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। তাহার কারণ, ভাগবতে ঐতিহাসিক কথা কিছুই পাওয়া যায় না; যাহা পাওয়া যায়, তাহা বিষ্ণুপুরাণেও আছে। তদতিরিক্ত যাহা পাওয়া যায়, তাহা অতিপ্রকৃত উপন্যাস মাত্র। তবে ভাগবতকথিত বাল্যলীলা অতি প্রসিদ্ধ বলিয়া, আমরা ভাগবতের সে অংশের পরিচয় দিতে বাধ্য হইয়াছি। এক্ষণে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে পারি।
2 কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়ের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করিলাম, কিন্তু বলিতে বাধ্য, এই অনুবাদে আছে “দানবরাজ কংস।” মূলে তাহা নাই, যথা- কস্যচিত্ত্বথ কালস্য কংসো নির্মথ্য যাদবান্।
সুতরাং “দানবরাজ” শব্দ তুলিয়া দিয়াছি।
1 পথিমধ্যে কুব্জা-ঘটিত ব্যাপারটা আছে। বিষ্ণুপুরাণে নিন্দনীয় কথা কিছু নাই। কুব্জা আপনাকে সুন্দরী হইতে দেখিয়া কৃষ্ণকে নিজ মন্দিরে যাইতে অনুরোধ করিলেন, কৃষ্ণ হাসিয়াই অস্থির। বিষ্ণুপুরাণে এই পর্যন্ত। কৃষ্ণের এ ব্যবহার মানবোচিত ও সজ্জনোচিত। কিন্তু ভাগবতকার ও ব্রহ্মবৈবর্তকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন, কুব্জার হঠাৎ ভক্তির হঠাৎ পুরস্কার দিয়াছেন, শেষ যাত্রায় কুব্জাপাটরাণী!
আমরা এইখান হইতে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। তাহার কারণ, ভাগবতে ঐতিহাসিক কথা কিছুই পাওয়া যায় না; যাহা পাওয়া যায়, তাহা বিষ্ণুপুরাণেও আছে। তদতিরিক্ত যাহা পাওয়া যায়, তাহা অতিপ্রকৃত উপন্যাস মাত্র। তবে ভাগবতকথিত বাল্যলীলা অতি প্রসিদ্ধ বলিয়া, আমরা ভাগবতের সে অংশের পরিচয় দিতে বাধ্য হইয়াছি। এক্ষণে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে পারি।
2 কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়ের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করিলাম, কিন্তু বলিতে বাধ্য, এই অনুবাদে আছে “দানবরাজ কংস।” মূলে তাহা নাই, যথা- কস্যচিত্ত্বথ কালস্য কংসো নির্মথ্য যাদবান্।
সুতরাং “দানবরাজ” শব্দ তুলিয়া দিয়াছি।
শিক্ষা
পুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কংসবধের পর কৃষ্ণ বলরাম কাশীতে সান্দীপনি ঋষির নিকট শিক্ষার্থে গমন করিলেন, এবং চতুঃষষ্টিদিবসমধ্যে শস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হইয়া গুরুদক্ষিণা প্রদানান্তে মথুরায় প্রত্যাগমন করিলেন।
কৃষ্ণের শিক্ষা সম্বন্ধে ইহা ছাড়া আর কিছু পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায় না। নন্দালয়ে তাঁহার কোন প্রকার শিক্ষা হওয়ার কোন প্রসঙ্গ কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। অথচ নন্দ জাতিতে বৈশ্য ছিলেন, বৈশ্যদিগের বেদে অধিকার ছিল। বৈশ্যালয়ে তাঁহাদিগের কোনও প্রকার বিদ্যাশিক্ষা না হওয়া বিচিত্র বটে। বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইবার পূর্বেই তিনি নন্দালয় হইতে মথুরায় পুনরানীত হইয়াছিলেন। পূর্ব-পরিচ্ছেদে মহাভারত হইতে যে কৃষ্ণবাক্য উদ্ধৃত করা গিয়াছে, তাহা হইতে এরূপ অনুমানই সঙ্গত যে, কংসবধের অনেক পূর্ব হইতেই তিনি মথুরায় বাস করিতেছিলেন, এবং মহাভারতের সভাপর্বে শিশুপালকৃত কৃষ্ণনিন্দায় দেখা যায় যে, শিশুপাল তাহাকে কংসের অন্নভোজী বলিতেছে—
“যস্য চানেন ধর্মজ্ঞ ভুক্তমন্নং বলীয়সঃ।
স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতং ||”
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৪০ অধ্যায়ঃ।
অতএব বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইতে না হইতেই কৃষ্ণ মথুরায় আনীত হইয়াছিলেন। বৃন্দাবনের গোপীদিগের সঙ্গে গ্রথিত কৈশোরলীলা যে উপন্যাস মাত্র, ইহা তাহার অন্যতর প্রমাণ।
মথুরাবাসকালেও তাঁহার কিরূপ শিক্ষা হইয়াছিল, তাহারও কোন বিশিষ্ট বিবরণ নাই। কেবল সান্দীপনি মুনির নিকট চতুঃষষ্টি দিবস অস্ত্রশিক্ষার কথাই আছে। যাঁহারা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলিতে পারেন, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের আবার শিক্ষার প্রয়োজন কি? ফলতঃ কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার হইলেও মানবধর্মাবলম্বী এবং মানুষী শক্তি দ্বারাই সকল কার্য সম্পন্ন করেন, এ কথা আমরা পূর্বে বলিয়াছি এবং এক্ষণেই তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ দেখাইব। মানুষী শক্তি দ্বারা কর্ম করিতে গেলে, শিক্ষার দ্বারা সেই মানুষী শক্তিকে অনুশীলিত এবং স্ফূরিত করিতে হয়। যদি মানুষী শক্তি সেই স্বতঃস্ফূরিত হইয়া সর্বকার্যসাধনক্ষম হয়, তাহা হইলে সে ঐশী শক্তি-মানুষী শক্তি নহে। কৃষ্ণের যে মানুষী শিক্ষা হইয়াছিল, তাহা এই সান্দীপনিবৃত্তান্ত ভিন্ন আরও প্রমাণ আছে। তিনি সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। মহাভারতের সভাপর্বে অর্ঘাভিহরণ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণের পূজ্যতা বিষয়ে ভীষ্ম একটি হেতু এই নির্দেশ করিতেছেন যে, কৃষ্ণ নিখিল বেদবেদাঙ্গপারদর্শী। তাদৃশ বেদবেদাঙ্গজ্ঞানসম্পন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি দুর্লভ।
“বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানাং বলং চাপ্যধিকং তথা।
নৃণাং লোকে হি কোহন্যোহস্তি বিশিষ্টঃ কেশবাদৃতে ||
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৩৮ অধ্যায়ঃ।
মহাভারতে কৃষ্ণের বেদজ্ঞতা সম্বন্ধে এইরূপ আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বেদজ্ঞতা স্বতঃলব্ধও নহে। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রমাণ পাইয়াছি যে, তিনি আঙ্গিরস-বংশীয় ঘোর ঋষির নিকট অধ্যয়ন করিয়াছিলেন।
সে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দিগের উচ্চশিক্ষার উচ্চাংশকে তপস্যা বলিত। শ্রেষ্ঠ রাজর্ষিগণ কোন সময়ে না কোন সময়ে তপস্যা করিয়াছিলেন, এইরূপ কথা প্রায় পাওয়া যায়। আমরা এক্ষণে তপস্যা অর্থে যাহা বুঝি, বেদের অনেক স্থানেই দেখা যায় যে, তপস্যার প্রকৃত অর্থ তাহা নহে। আমরা বুঝি, তপস্যা অর্থে বনে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া পানাহার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের ধ্যান করা। কিন্তু দেবতাদিগের মধ্যে কেহ কেহ এবং মহাদেবও তপস্যা করিয়াছিলেন, ইহাও কোন কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ শতপথব্রাহ্মণে আছে যে, স্বয়ং পরব্রহ্ম সিসৃক্ষু হইলে তপস্যার দ্বারাই সৃষ্টি করিলেন, যথা—
সোহকাময়ত। বহুঃ স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোহতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা ইদং সর্বমসৃজত।[1] অর্থ,—“তিনি ইচ্ছা করিলেন, আমি প্রজাসৃষ্টির জন্য বহু হইব। তিনি তপস্যা করিলেন। তপস্যা করিয়া এই সকল সৃষ্টি করিয়াছিলেন।”
এ সকল স্থানে তপস্যা অর্থে এই রকমই বুঝিতে হয় যে, চিত্ত সমাহিত করিয়া আপনার শক্তি সকলের অনুশীলন ও স্ফুরণ করিয়াছিলেন। মহাভারতে কথিত আছে যে, কৃষ্ণ দশ বৎসর হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন। মহাভারতের ঐশিক পর্বে লিখিত আছে যে, অশ্বত্থামাপ্রযুক্ত ব্রহ্মশিরা অস্ত্রের দ্বারা উত্তরার গর্ভপাতের সম্ভাবনা হইলে, কৃষ্ণ সেই মৃতশিশুকে পুনরুজ্জীবিত করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়াছিলেন, এবং তখন অশ্বত্থামাকে বলিয়াছিলেন যে, তুমি আমার তপোবল দেখিবে।
আদর্শ মনুষ্যের শিক্ষা আদর্শ শিক্ষাই হইবে। ফলও সেইরূপ দেখি। কিন্তু সেই প্রাচীন কালের আদর্শ শিক্ষা কিরূপ ছিল, তাহা কিছুই জানিতে পারা গেল না, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।
কৃষ্ণের শিক্ষা সম্বন্ধে ইহা ছাড়া আর কিছু পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায় না। নন্দালয়ে তাঁহার কোন প্রকার শিক্ষা হওয়ার কোন প্রসঙ্গ কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। অথচ নন্দ জাতিতে বৈশ্য ছিলেন, বৈশ্যদিগের বেদে অধিকার ছিল। বৈশ্যালয়ে তাঁহাদিগের কোনও প্রকার বিদ্যাশিক্ষা না হওয়া বিচিত্র বটে। বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইবার পূর্বেই তিনি নন্দালয় হইতে মথুরায় পুনরানীত হইয়াছিলেন। পূর্ব-পরিচ্ছেদে মহাভারত হইতে যে কৃষ্ণবাক্য উদ্ধৃত করা গিয়াছে, তাহা হইতে এরূপ অনুমানই সঙ্গত যে, কংসবধের অনেক পূর্ব হইতেই তিনি মথুরায় বাস করিতেছিলেন, এবং মহাভারতের সভাপর্বে শিশুপালকৃত কৃষ্ণনিন্দায় দেখা যায় যে, শিশুপাল তাহাকে কংসের অন্নভোজী বলিতেছে—
“যস্য চানেন ধর্মজ্ঞ ভুক্তমন্নং বলীয়সঃ।
স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতং ||”
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৪০ অধ্যায়ঃ।
অতএব বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইতে না হইতেই কৃষ্ণ মথুরায় আনীত হইয়াছিলেন। বৃন্দাবনের গোপীদিগের সঙ্গে গ্রথিত কৈশোরলীলা যে উপন্যাস মাত্র, ইহা তাহার অন্যতর প্রমাণ।
মথুরাবাসকালেও তাঁহার কিরূপ শিক্ষা হইয়াছিল, তাহারও কোন বিশিষ্ট বিবরণ নাই। কেবল সান্দীপনি মুনির নিকট চতুঃষষ্টি দিবস অস্ত্রশিক্ষার কথাই আছে। যাঁহারা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলিতে পারেন, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের আবার শিক্ষার প্রয়োজন কি? ফলতঃ কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার হইলেও মানবধর্মাবলম্বী এবং মানুষী শক্তি দ্বারাই সকল কার্য সম্পন্ন করেন, এ কথা আমরা পূর্বে বলিয়াছি এবং এক্ষণেই তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ দেখাইব। মানুষী শক্তি দ্বারা কর্ম করিতে গেলে, শিক্ষার দ্বারা সেই মানুষী শক্তিকে অনুশীলিত এবং স্ফূরিত করিতে হয়। যদি মানুষী শক্তি সেই স্বতঃস্ফূরিত হইয়া সর্বকার্যসাধনক্ষম হয়, তাহা হইলে সে ঐশী শক্তি-মানুষী শক্তি নহে। কৃষ্ণের যে মানুষী শিক্ষা হইয়াছিল, তাহা এই সান্দীপনিবৃত্তান্ত ভিন্ন আরও প্রমাণ আছে। তিনি সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। মহাভারতের সভাপর্বে অর্ঘাভিহরণ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণের পূজ্যতা বিষয়ে ভীষ্ম একটি হেতু এই নির্দেশ করিতেছেন যে, কৃষ্ণ নিখিল বেদবেদাঙ্গপারদর্শী। তাদৃশ বেদবেদাঙ্গজ্ঞানসম্পন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি দুর্লভ।
“বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানাং বলং চাপ্যধিকং তথা।
নৃণাং লোকে হি কোহন্যোহস্তি বিশিষ্টঃ কেশবাদৃতে ||
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৩৮ অধ্যায়ঃ।
মহাভারতে কৃষ্ণের বেদজ্ঞতা সম্বন্ধে এইরূপ আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বেদজ্ঞতা স্বতঃলব্ধও নহে। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রমাণ পাইয়াছি যে, তিনি আঙ্গিরস-বংশীয় ঘোর ঋষির নিকট অধ্যয়ন করিয়াছিলেন।
সে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দিগের উচ্চশিক্ষার উচ্চাংশকে তপস্যা বলিত। শ্রেষ্ঠ রাজর্ষিগণ কোন সময়ে না কোন সময়ে তপস্যা করিয়াছিলেন, এইরূপ কথা প্রায় পাওয়া যায়। আমরা এক্ষণে তপস্যা অর্থে যাহা বুঝি, বেদের অনেক স্থানেই দেখা যায় যে, তপস্যার প্রকৃত অর্থ তাহা নহে। আমরা বুঝি, তপস্যা অর্থে বনে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া পানাহার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের ধ্যান করা। কিন্তু দেবতাদিগের মধ্যে কেহ কেহ এবং মহাদেবও তপস্যা করিয়াছিলেন, ইহাও কোন কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ শতপথব্রাহ্মণে আছে যে, স্বয়ং পরব্রহ্ম সিসৃক্ষু হইলে তপস্যার দ্বারাই সৃষ্টি করিলেন, যথা—
সোহকাময়ত। বহুঃ স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোহতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা ইদং সর্বমসৃজত।[1] অর্থ,—“তিনি ইচ্ছা করিলেন, আমি প্রজাসৃষ্টির জন্য বহু হইব। তিনি তপস্যা করিলেন। তপস্যা করিয়া এই সকল সৃষ্টি করিয়াছিলেন।”
এ সকল স্থানে তপস্যা অর্থে এই রকমই বুঝিতে হয় যে, চিত্ত সমাহিত করিয়া আপনার শক্তি সকলের অনুশীলন ও স্ফুরণ করিয়াছিলেন। মহাভারতে কথিত আছে যে, কৃষ্ণ দশ বৎসর হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন। মহাভারতের ঐশিক পর্বে লিখিত আছে যে, অশ্বত্থামাপ্রযুক্ত ব্রহ্মশিরা অস্ত্রের দ্বারা উত্তরার গর্ভপাতের সম্ভাবনা হইলে, কৃষ্ণ সেই মৃতশিশুকে পুনরুজ্জীবিত করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়াছিলেন, এবং তখন অশ্বত্থামাকে বলিয়াছিলেন যে, তুমি আমার তপোবল দেখিবে।
আদর্শ মনুষ্যের শিক্ষা আদর্শ শিক্ষাই হইবে। ফলও সেইরূপ দেখি। কিন্তু সেই প্রাচীন কালের আদর্শ শিক্ষা কিরূপ ছিল, তাহা কিছুই জানিতে পারা গেল না, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।
—————————-
1 ২ বল্লী, অনুবাক।
1 ২ বল্লী, অনুবাক।
জরাসন্ধ
সকল সময়েই দেখা যায় যে, ভারতবর্ষে, অন্ততঃ ভারতবর্ষের উত্তরার্ধে এক এক জন সম্রাট্ ছিলেন, তাঁহার প্রাধান্য অন্য রাজগণ স্বীকার করিত। কেহ বা করদ, কেহ বা আজ্ঞানুবর্তী, এবং যুদ্ধকালে সকলেই সহায় হইত। ঐতিহাসিক সময়ে চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, অশোক, মহাপ্রতাপশালী গুপ্তবংশীয়েরা, হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য এবং আধুনিক সময় পাঠান ও মোগল—ইঁহারা এইরূপ সম্রাট্ ছিলেন। হিন্দুরাজ্যকালে অধিকাংশ সময়ই এই আধিপত্য মগদাধিপতিরই ছিল। আমরা যে সময়ের বর্ণনায় উপস্থিত, সে সময়েও মগদাধিপতি উত্তর—ভারতে সম্রাট্। এই সম্রাট্ বিখ্যাত জরাসন্ধ। তাঁহার বল ও প্রতাপ মহাভারতে, হরিবংশে ও পুরাণ সকলে অতিশয় বিস্তারের সহিত বর্ণিত হইয়াছে। কথিত হইয়াছে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমস্ত ক্ষত্রিয়গণ একত্র হইয়াছিল। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও উভয় পক্ষের মোটে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা উপস্থিত ছিল, লেখা আছে। একা জরাসন্ধের বিংশতি অক্ষৌহিণী সেনা লিখিত হইয়াছে।
কংস এই জরাসন্ধের জামাতা। কংস তাঁহার দুই কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। কংসবধের পর তাঁহার বিধবা কন্যাদ্বয় জরাসন্ধের নিকট গিয়া পতিহন্তার দমনার্থ রোদন করেন। জরাসন্ধ কৃষ্ণের বধার্থ মহাসৈন্য লইয়া আসিয়া মথুরা অবরোধ করিলেন। জরাসন্ধের অসংখ্য সৈন্যের তুলনায় যাদবদিগের সৈন্য অতি অল্প। তথাপি কৃষ্ণের সেনাপতিত্বগুণে যাদবেরা জরাসন্ধকে বিমুখ করিয়াছিলেন। কিন্তু জরাসন্ধের বলক্ষয় করা তাঁহাদের অসাধ্য। কেন না, জরাসন্ধের সৈন্য অগণ্য। অতএব জরাসন্ধ পুনঃপুনঃ আসিয়া মথুরা অবরোধ করিতে লাগিল। যদিও সে পুনঃপুনঃ বিমুখীকৃত হইল, তথাপি এই পুনঃপুনঃ আক্রমণে যাদবদিগের গুরুতর অশুভ উৎপাদনের সম্ভাবনা হইল। যাদবদিগের ক্ষুদ্র সৈন্য পুনঃপুনঃ যুদ্ধে ক্ষয় হইতে লাগিলে তাঁহারা সৈন্যশূন্য হইবার উপক্রম হইলেন। কিন্তু সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার ন্যায় জরাসন্ধের অগাধ সৈন্যের ক্ষয়বৃদ্ধি কিছু জানিতে পারা গেল না। এইরূপ সপ্তদশ বার আক্রান্ত হওয়ার পর, যাদবেরা কৃষ্ণের পরামর্শানুসারে মথুরা ত্যাগ করিয়া দুরাক্রম্য প্রদেশে দুর্গনির্মাণপূর্বক বাস করিবার অভিপ্রায় করিলেন। অতএব সাগরদ্বীপ দ্বারকায় যাদবদিগের জন্য পুরী নির্মাণ হইতে লাগিল এবং দুরারোহ রৈবতক পর্বতে দ্বারকা রক্ষার্থে দুর্গশ্রেণী সংস্থাপিত হইল। কিন্তু তাঁহারা দ্বারকা যাইবার পূর্বেই জরাসন্ধ অষ্টাদশ বার মথুরা আক্রমণ করিতে আসিলেন।
কংস এই জরাসন্ধের জামাতা। কংস তাঁহার দুই কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। কংসবধের পর তাঁহার বিধবা কন্যাদ্বয় জরাসন্ধের নিকট গিয়া পতিহন্তার দমনার্থ রোদন করেন। জরাসন্ধ কৃষ্ণের বধার্থ মহাসৈন্য লইয়া আসিয়া মথুরা অবরোধ করিলেন। জরাসন্ধের অসংখ্য সৈন্যের তুলনায় যাদবদিগের সৈন্য অতি অল্প। তথাপি কৃষ্ণের সেনাপতিত্বগুণে যাদবেরা জরাসন্ধকে বিমুখ করিয়াছিলেন। কিন্তু জরাসন্ধের বলক্ষয় করা তাঁহাদের অসাধ্য। কেন না, জরাসন্ধের সৈন্য অগণ্য। অতএব জরাসন্ধ পুনঃপুনঃ আসিয়া মথুরা অবরোধ করিতে লাগিল। যদিও সে পুনঃপুনঃ বিমুখীকৃত হইল, তথাপি এই পুনঃপুনঃ আক্রমণে যাদবদিগের গুরুতর অশুভ উৎপাদনের সম্ভাবনা হইল। যাদবদিগের ক্ষুদ্র সৈন্য পুনঃপুনঃ যুদ্ধে ক্ষয় হইতে লাগিলে তাঁহারা সৈন্যশূন্য হইবার উপক্রম হইলেন। কিন্তু সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার ন্যায় জরাসন্ধের অগাধ সৈন্যের ক্ষয়বৃদ্ধি কিছু জানিতে পারা গেল না। এইরূপ সপ্তদশ বার আক্রান্ত হওয়ার পর, যাদবেরা কৃষ্ণের পরামর্শানুসারে মথুরা ত্যাগ করিয়া দুরাক্রম্য প্রদেশে দুর্গনির্মাণপূর্বক বাস করিবার অভিপ্রায় করিলেন। অতএব সাগরদ্বীপ দ্বারকায় যাদবদিগের জন্য পুরী নির্মাণ হইতে লাগিল এবং দুরারোহ রৈবতক পর্বতে দ্বারকা রক্ষার্থে দুর্গশ্রেণী সংস্থাপিত হইল। কিন্তু তাঁহারা দ্বারকা যাইবার পূর্বেই জরাসন্ধ অষ্টাদশ বার মথুরা আক্রমণ করিতে আসিলেন।
এই সময়ে জরাসন্ধের উত্তেজনায় আর এক প্রবল শত্রু কৃষ্ণকে আক্রমণ করিবার জন্য উপস্থিত হইল। অনেক গ্রন্থেই দেখা যায় যে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে স্থানে স্থানে যবনদিগের রাজত্ব ছিল। এক্ষণকার পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে প্রাচীন গ্রীকদিগকেই ভারতবর্ষীয়েরা যবন বলিতেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বিশুদ্ধ কি না, তদ্বিষয়ে অনেক সন্দেহ আছে। বোধ হয়, শক, হূণ, গ্রীক প্রভৃতি অহিন্দু সভ্য জাতিমাত্রকেই যবন বলিতেন। যাহাই হউক, ঐ সময়ে, কালযবন নামে একজন নামে একজন যবন রাজা ভারতবর্ষে অতি প্রবলপ্রতাপ হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি আসিয়া সসৈন্যে মথুরা অবরোধ করিলেন। কিন্তু পরমসমররহস্যবিৎ কৃষ্ণ তাঁহার সহিত সসৈন্যে যুদ্ধ করিতে ইচ্ছা করিলেন না। কেন না, ক্ষুদ্র যাদবসেনা তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে বিমুখ করিলেও, সংখ্যায় বড় অল্প হইয়া যাইবে। হতাবশিষ্ট যাহা থাকিবে, তাহারা জরাসন্ধকে বিমুখ করিতে সক্ষম হইতে না পারে। আর ইহাও পশ্চাৎ দেখিব যে, সর্বভূতে দয়াময় কৃষ্ণ প্রাণিহত্যা পক্ষে ধর্ম প্রয়োজন ব্যতীত অনুরাগ প্রকাশ করেন না। যুদ্ধ অনেক সময়েই ধর্মানুমোদিত, সে সময়ে যুদ্ধে অপ্রবৃত্ত হইলে, ধর্মের হানি হয়, গীতায় কৃষ্ণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। এবং এখানেও কালযবন এবং জরাসন্ধের সহিত যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ। আত্মরক্ষার্থে এবং স্বজনরক্ষার্থে, প্রজাগণের রক্ষার্থে যুদ্ধ না করা ঘোরতর অধর্ম। কিন্তু যদি যুদ্ধ করিতেই হইল, তবে যত অল্প মনুষ্যের প্রাণহানি করিয়া কার্য সম্পন্ন করা যায়, ধার্মিকের তাহাই কর্তব্য। আমরা মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায়ে দেখিব যে, যাহাতে অন্য কোন মনুষ্যের জীবন হানি না হইয়া জরাসন্ধবধ সম্পন্ন হয়, কৃষ্ণ তাহার সদুপায় উদ্ভূত করিয়াছিলেন। কালযবনের যুদ্ধেও তাহাই করিলেন। তিনি সসৈন্যে কালযবনের সম্মুখীন না হইয়া কালযবনের বধার্থ কৌশল অবলম্বন করিলেন। একাকী কালযবনের শিবিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কালযবন তাঁহাকে চিনিতে পারিল। কৃষ্ণকে ধরিবার জন্য হাত বাড়াইলে, কৃষ্ণ ধরা না দিয়া পলায়ন করিলেন। কালযবন তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইল। কৃষ্ণ যেমন বেদে বা যুদ্ধবিদ্যায় সুপণ্ডিত, শারীরিক ব্যায়ামেও তদ্রূপ সুপারগ। আদর্শ মনুষ্যের এইরূপ হওয়া উচিত, আমি “ধর্মতত্ত্বে” দেখাইয়াছি। অতএব কালযবন কৃষ্ণকে ধরিতে পারিলেন না। কৃষ্ণ কালযবন কর্তৃক অনুসৃত হইয়া এক গিরিগুহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কথিত আছে, সেখানে মুচুকুন্দ নামে এক ঋষি নিদ্রিত ছিলেন। কালযবন গুহান্ধকারমধ্যে কৃষ্ণকে দেখিতে না পাইয়া, সেই ঋষিকেই কৃষ্ণভ্রমে পদাঘাত করিল। পদাঘাতে উন্নিদ্র হইয়া ঋষি কালযবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র কালযবন ভস্মীভূত হইয়া গেল।
এই অতিপ্রকৃত ব্যাপারটাকে আমরা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। স্থূল কথা এই বুঝি যে, কৃষ্ণ কৌশলাবলম্বনপূর্বক কালযবনকে তাহার সৈন্য হইতে দূরে লইয়া গিয়া, গোপন স্থানে তাহার সঙ্গে দ্বৈরথ্য যুদ্ধ করিয়া তাহাকে নিহত করিয়াছিলেন। কালযবন নিহত হইলে, তাহার সৈন্য সকল ভঙ্গ দিয়া মথুরা পরিত্যাগ করিয়া গেল। তাহার পর জরাসন্ধের অষ্টাদশ আক্রমণ,—সে বারও জরাসন্ধ বিমুখ হইল।
উপরে যেরূপ বিবরণ লিখিত হইল, তাহা হরিবংশে ও বিষ্ণুদিপুরাণে আছে। মহাভারতে জরাসন্ধের যেরূপ পরিচয় কৃষ্ণ স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের কাছে দিয়াছেন, তাহাতে এই অষ্টাদশ বার যুদ্ধের কোন কথাই নাই। জরাসন্ধের সঙ্গে যে যাদবদিগের যুদ্ধ হইয়াছিল, এমন কথাও স্পষ্টতঃ নাই। যাহা আছে, তাহাতে কেবল এইটুকু বুঝা যায় যে, জরাসন্ধ মথুরা একবার আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু হংস নামক তাঁহার অনুগত কোন বীর বলদেব কর্তৃক নিহত হওয়ায় জরাসন্ধ দুঃখিত মনে স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছিলেন। সেই স্থান আমরা উদ্ধৃত করিতেছি:—
“কিয়ৎকাল অতীত হইল, কংস যাদবগণকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ঐ দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবর্গকে পরাজয় করতঃ সর্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠিল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রূরকে আহুককন্যা প্রদান করিয়া জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধানার্থ বলভদ্র সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম। তাহাতে কংসভয় নিবারিত হইল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরেই জরাসন্ধ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিল। তখন আমরা জ্ঞাতি বন্ধুগণের সহিত একত্র হইয়া পরামর্শ করিলাম যে, যদি আমরা শত্রুনাশক মহাস্ত্র দ্বারা তিন শত বৎসর অবিশ্রাম জরাসন্ধের সৈন্য বধ করি, তথাপি নিঃশেষিত করিতে পারিব না। দেবতুল্য তেজস্বী মহাবলপরাক্রান্ত হংস ও ডিম্বক নামক দুই বীর তাহার অনুগত আছে; উহারা অস্ত্রাঘাতে কদাচ নিহত হইবে না। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, এই দুই বীর এবং জরাসন্ধ এই তিন জন একত্র হইলে ত্রিভুবন বিজয় করিতে পারে। হে ধর্মরাজ! এই পরামর্শ কেবল আমাদিগের অভিমত হইল এমত নহে, অন্যান্য ভূপতিগণও উহাতে অনুমোদন করিবেন।
হংস নামে সুবিখ্যাত এক নরপতি ছিলেন। বলদেব তাঁহাকে সংগ্রামে সংহার করেন। ডিম্বক লোকমুখে হংস মরিয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিয়া নামসাদৃশ্যপ্রযুক্ত তাহার সহচর হংস নিধন প্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া স্থির করিল। পরে হংস বিনা আমার জীবন ধারণে প্রয়োজন নাই, এই বিবেচনা করতঃ যমুনায় নিমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিল। এ দিকে তৎ-সহচর হংসও পরম প্রণয়াস্পদ ডিম্বকে আপন মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে প্রাণত্যাগ করিতে শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া যমুনাজলে আত্মসমর্পণ করিল। জরাসন্ধ এই দুই বীর পুরুষের নিধনবার্তা শ্রবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও শূন্যমনা হইয়া স্বনগরে প্রস্থান করিলেন। জরাসন্ধ বিমনা হইয়া স্বপুরে গমন করিলে পর আমরা পরমাহ্লাদে মথুরায় বাস করিতে লাগিলাম।
কিয়দ্দিনান্তর পতিবিয়োগ-দুঃখিনী জরাসন্ধনন্দিনী স্বীয় পিতার সমীপে আগমন পূর্বক আমার পতিহন্তাকে সংহার কর’ বলিয়া বারংবার তাঁহাকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমরা পূর্বেই জরাসন্ধের বলবিক্রমের বিষয় স্থির করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহা স্মরণ করতঃ সাতিশয় উৎকণ্ঠিত হইলাম। তখন আমরা আমাদের বিপুল ধনসম্পত্তি বিভাগ করতঃ সকলে কিছু কিছু লইয়া প্রস্থান করিব, এই স্থির করিয়া স্বস্থান পরিত্যাগ পূর্বক পশ্চিমদিকে পলায়ন করিলাম। ঐ পশ্চিম দেশে রৈবতোপশোভিত পরম রমণীয় কুশস্থলীনাম্নী পুরীতে বাস করিতেছি—তথায় এরূপ দুর্গসংস্কার করিয়াছি যে, সেখানে থাকিয়া বৃষ্ণিবংশীয় মহারথিদিগের কথা দূরে থাকুক, স্ত্রীলোকেরাও অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। হে রাজন্! এক্ষণে আমরা অকুতোভয়ে ঐ নগরীমধ্যে বাস করিতেছি। মাধবগণ সমস্ত মগধদেশব্যাপী সেই সর্বশ্রেষ্ঠ রৈবতক পর্বত দেখিয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। হে কুরুকুলপ্রদীপ! আমরা সামর্থ্যযুক্ত হইয়াও জরাসন্ধের উপদ্রবভয়ে পর্বত আশ্রয় করিয়াছি। ঐ পর্বত দৈর্ঘ্যে তিন যোজন, প্রস্থে এক যোজনের অধিক এবং একবিংশতি শৃঙ্গযুক্ত। উহাতে এক এক যোজনের পর শত শত দ্বার এবং অত্যুৎকৃষ্ট উন্নত তোরণ সকল আছে। যুদ্ধদুর্মদ মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণ উহাতে সর্বদা বাস করিতেছেন। হে রাজন্! আমাদের কুলে অষ্টাদশ সহস্র ভ্রাতা আছে। আহুকের একশত পুত্র, তাহারা সকলেই অমরতুল্য। চারুদেষ্ণ ও তাঁহার ভ্রাতা, চক্রদেব, সাত্যকি, আমি, বলভদ্র, যুদ্ধবিশারদ শাম্ব—আমরা এই সাত জন রথী; কৃতকর্মা, অনাবৃষ্টি, সমীক, সমিতিঞ্জয়, কক্ষ, শঙ্কু ও কুন্তি, এই সাত জন মহারথ, এবং অন্ধকভোজের দুই বৃদ্ধ পুত্র ও রাজা এই মহাবলপরাক্রান্ত দৃঢ়কলেবর দশ জন মহাবীর,—ইঁহারা সকলেই জরাসন্ধাধিকৃত মধ্যম দেশ স্মরণ করিয়া যদুবংশীয়দিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন।”
এই জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায় প্রধানতঃ মৌলিক মহাভারতের অংশ বলিয়া আমার বিশ্বাস। দুএকটা কথা প্রক্ষিপ্ত থাকিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশই মৌলিক। যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে, কৃষ্ণের সহিত জরাসন্ধের বিরোধ-বিষয়ে উপরি উক্ত বৃত্তান্তই প্রামাণিক বলিয়া আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। কেন না, পূর্বে বুঝাইয়াছি যে, হরিবংশ এবং পুরাণ সকলের অপেক্ষা মহাভারতের মৌলিকাংশ অনেক প্রাচীন। যদি এ কথা যথার্থ হয়, তবে জরাসন্ধকৃত অষ্টাদশ বার মথুরা আক্রমণ এবং অষ্টাদশ বার তাহার পরাভব, এ সমস্তই মিথ্যা গল্প। প্রকৃত বৃত্তান্ত এই হইতে পারে যে, একবারমাত্র সে মথুরা আক্রমণে আসিয়াছিল এবং নিষ্ফল হইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়াছিল। দ্বিতীয়বার আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু কৃষ্ণ দেখিলেন যে, চতুর্দিকে সমতল ভূমির মধ্যবর্তী মথুরা নগরীতে বাস করিয়া জরাসন্ধের অসংখ্যসৈন্যকৃত পুনঃপুনঃ অবরোধ নিষ্ফল করা অসম্ভব। অতএব যেখানে দুর্গনির্মাণপূর্বক দুর্গাশ্রয়ে ক্ষুদ্র সেনা রক্ষা করিয়া জরাসন্ধকে বিমুখ করিতে পারিবেন, সেইখানে রাজধানী তুলিয়া লইয়া গেলেন। দেখিয়া জরাসন্ধ আর সে দিকে ঘেঁষিলেন না। জয়-পরাজয়ের কথা ইহাতে কিছুই নাই। ইহাতে কেবল ইহাই বুঝা যায় যে, যুদ্ধকৌশলে কৃষ্ণ পারদর্শী, তিনি পরম রাজনীতিজ্ঞ এবং অনর্থক মনুষ্যহত্যার নিতান্ত বিরোধী। আদর্শ মনুষ্যের সমস্ত গুণ তাঁহাতে ক্রমশঃ পরিস্ফুট হইতেছে।
কৃষ্ণের বিবাহ
কৃষ্ণের প্রথম ভার্যা রুক্সিণী। ইনি বিদর্ভরাজ্যের অধিপতি ভীষ্মকের কন্যা। তিনি অতিশয় রূপবতী এবং গুণবতী শুনিয়া কৃষ্ণ ভীষ্মকের নিকট রুক্সিণীকে বিবাহার্থ প্রার্থনা করিয়াছিলেন। রুক্সিণীও কৃষ্ণের অনুরক্তা হইয়াছিলেন। কিন্তু ভীষ্মক কৃষ্ণশত্রু জরাসন্ধের পরামর্শে রুক্সিণীকে কৃষ্ণে সমর্পণ করিতে অসম্মত হইলেন। তিনি কৃষ্ণদ্বেষক শিশুপালের সঙ্গে রুক্সিণীর বিবাহ স্থির করিয়া দিনাবধারণপূর্বক সমস্ত রাজগণকে নিমন্ত্রণ করিলেন। যাদবগণের নিমন্ত্রণ হইল না। কৃষ্ণ স্থির করিলেন, যাদবদিগকে সঙ্গে লইয়া ভীষ্মকের রাজধানীতে যাইবেন এবং রুক্সিণীকে তাঁহার বন্ধুবর্গের অসম্মতিতেও গ্রহণ করিয়া বিবাহ করিবেন।
কৃষ্ণ তাহাই করিলেন। বিবাহের দিন রুক্সিণী দেবারাধনা করিয়া দেবমন্দির হইতে বাহির হইলে পর, কৃষ্ণ তাঁহাকে লইয়া রথে তুলিলেন। ভীষ্মক ও তাঁহার পুত্রগণ এবং জরাসন্ধ প্রভৃতি ভীষ্মকের মিত্ররাজগণ কৃষ্ণের আগমনসংবাদ শুনিয়াই এইরূপ একটা কাণ্ড উপস্থিত হইবে বুঝিয়াছিলেন। অতএব তাঁহারা প্রস্তুত ছিলেন। সৈন্য লইয়া সকলে কৃষ্ণের পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন। কিন্তু কেহই কৃষ্ণকে ও যাদবগণকে পরাভূত করিতে পারিলেন না। কৃষ্ণ রুক্সিণীকে দ্বারকায় লইয়া গিয়া যথাশাস্ত্র বিবাহ করিলেন।
কৃষ্ণের প্রথম ভার্যা রুক্সিণী। ইনি বিদর্ভরাজ্যের অধিপতি ভীষ্মকের কন্যা। তিনি অতিশয় রূপবতী এবং গুণবতী শুনিয়া কৃষ্ণ ভীষ্মকের নিকট রুক্সিণীকে বিবাহার্থ প্রার্থনা করিয়াছিলেন। রুক্সিণীও কৃষ্ণের অনুরক্তা হইয়াছিলেন। কিন্তু ভীষ্মক কৃষ্ণশত্রু জরাসন্ধের পরামর্শে রুক্সিণীকে কৃষ্ণে সমর্পণ করিতে অসম্মত হইলেন। তিনি কৃষ্ণদ্বেষক শিশুপালের সঙ্গে রুক্সিণীর বিবাহ স্থির করিয়া দিনাবধারণপূর্বক সমস্ত রাজগণকে নিমন্ত্রণ করিলেন। যাদবগণের নিমন্ত্রণ হইল না। কৃষ্ণ স্থির করিলেন, যাদবদিগকে সঙ্গে লইয়া ভীষ্মকের রাজধানীতে যাইবেন এবং রুক্সিণীকে তাঁহার বন্ধুবর্গের অসম্মতিতেও গ্রহণ করিয়া বিবাহ করিবেন।
কৃষ্ণ তাহাই করিলেন। বিবাহের দিন রুক্সিণী দেবারাধনা করিয়া দেবমন্দির হইতে বাহির হইলে পর, কৃষ্ণ তাঁহাকে লইয়া রথে তুলিলেন। ভীষ্মক ও তাঁহার পুত্রগণ এবং জরাসন্ধ প্রভৃতি ভীষ্মকের মিত্ররাজগণ কৃষ্ণের আগমনসংবাদ শুনিয়াই এইরূপ একটা কাণ্ড উপস্থিত হইবে বুঝিয়াছিলেন। অতএব তাঁহারা প্রস্তুত ছিলেন। সৈন্য লইয়া সকলে কৃষ্ণের পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন। কিন্তু কেহই কৃষ্ণকে ও যাদবগণকে পরাভূত করিতে পারিলেন না। কৃষ্ণ রুক্সিণীকে দ্বারকায় লইয়া গিয়া যথাশাস্ত্র বিবাহ করিলেন।
ইহাকে ‘হরণ’ বলে। হরণ অর্থে কন্যার প্রতি কোনরূপ অত্যাচার বুঝায় না। কন্যার যদি পাত্র অভিমত হয়, এবং সে বিবাহে সে সম্মত থাকে, তবে তাহার প্রতি কি অত্যাচার? রুক্সিণী-হরণেও সে দোষ ঘটে নাই, কেন না, রুক্মিণী কৃষ্ণে অনুরক্তা, এবং পরে দেখাইব যে, কৃষ্ণানুমোদিত অর্জুনকৃত সুভদ্রাহরণেও সে দোষ ঘটে নাই। তবে এরূপ কন্যাহরণে কোন প্রকার দোষ আছে কি না, তাহার বিশেষ বিচার আবশ্যক, এ কথা আমরা স্বীকার করি। আমরা সে বিচার সুভদ্রাহরণের সময় করিব। কে না, কৃষ্ণ নিজেই সে বিচার সেই সময় করিয়াছেন। অতএব এক্ষণে সে বিষয়ে কোন কথা বলিব না।
তবে ইহার ভিতর আর একটা কথা আছে। সে কালে ক্ষত্রিয়রাজগণের বিবাহের দুইটি পদ্ধতি প্রশস্ত ছিল;—এক স্বয়ংবর বিবাহ, আর এক হরণ। কখনও কখনও এক বিবাহে দুই রকম ঘটিয়া যাইত, যথা—কাশিরাজকন্যা অম্বিকাদির বিবাহে। ঐ বিবাহে স্বয়ংবর হয়। কিন্তু আদর্শ ক্ষত্রিয় দেবব্রত ভীষ্ম, স্বয়ংবর না মানিয়া, তিনটি কন্যাই কাড়িয়া লইয়া গেলেন। আর কন্যার স্বয়ংবরই হউক, আর হরণই হউক, কন্যা একজন লাভ করিলে, উদ্ধতস্বভাব রণপ্রিয় ক্ষত্রিয়গণ একটা যুদ্ধবিগ্রহ উপস্থিত করিতেন। ইতিহাসে দ্রৌপদীস্বয়ংবরে এবং কাব্যে ইন্দুমতীস্বয়ংবরে দেখিতে পাই যে, কন্যা হৃতা হয় নাই, তথাপি যুদ্ধ উপস্থিত। মহাভারতের মৌলিক অংশে রুক্মিণী যে হৃতা হইয়াছিলেন, এমন কথাটা পাওয়া যায় না।
শিশুপালবধ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ বলিতেছেন:—
রুক্মিণ্যামস্য মূঢ়স্য প্রার্থনাসীন্মুমূর্ষতঃ।
ন চ তাং প্রাপ্তবান্ মূঢ়ঃশূদ্রো বেদশ্রুতীমিব||
শিশুপালবধপর্বাধ্যায়ে, ৪৫ অঃ, ১৫ শ্লোকঃ।
শিশুপাল উত্তর করিলেন:—
মৎপূর্বাং রুক্মিণীং কৃষ্ণ সংসৎসু পরিকীর্তয়ন্।
বিশেষতঃ পার্থিবেষু ব্রীড়াং ন কুরুষে কথম্ ||
মন্যমানো হি কঃ সৎসু পুরুষঃ পরিকীর্তয়েৎ।
অন্যপূর্বাং স্ত্রিয়ং জাতু ত্বদন্যো মধুসূদন ||
শিশুপালবধপর্বাধ্যায়ে, ৪৫ অঃ, ১৮-১৯ শ্লোকঃ।
ইহাতে এমন কিছুই নাই যে, তাহা হইতে বুঝিতে পারিব যে, রুক্সিণী হৃতা হইয়াছিলেন, বা তজ্জন্য কোন যুদ্ধ হইয়াছিল। তার পর উদ্যোগপর্বে আর এক স্থানে আছে,—
যো রুক্মিণীমেকরথেণ ভোজান্ উৎসাদ্য রাজ্ঞঃ সমরে প্রসহ্য।
উবাহ ভার্যাং যশসা জ্বলন্তীং যস্যাং জজ্ঞে রৌক্মিণেয়ো মহাত্মা||
ইহাতে যুদ্ধের কথা আছে, কিন্তু হরণের কথা নাই।
আর এক স্থানে রুক্মিণীহরণবৃত্তান্ত আছে। উদ্যোগপর্বে সৈন্যনির্যাণ সময়ে রুক্মিণীর ভ্রাতা রুক্মী পাণ্ডবদিগের শিবিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তদুপলক্ষে কথিত হইতেছে:—
“বাহুবলগর্বিত রুক্মী পূর্বে ধীমান্ বাসুদেবের রুক্মিণীহরণ সহ্য করিতে না পারিয়া, ‘আমি কৃষ্ণকে বিনষ্ট না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না’, এইরূপ প্রতিজ্ঞাপূর্বক প্রবৃদ্ধ ভাগীরথীর ন্যায় বেগবতী বিচিত্র আয়ুধধারিণী চতুরঙ্গিণী সেনা সমভিব্যাহারে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন। পরে তাঁহার সন্নিহিত হইবামাত্র পরাজিত ও লজ্জিত হইয়া প্রতিগমন করিলেন। কিন্তু যে স্থানে বাসুদেবকর্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন, তথায় ভোজকট নামক প্রভূত সৈন্য ও গজবাজিসম্পন্ন সুবিখ্যাত এক নগর সংস্থাপন করিয়াছিলেন। এক্ষণে সেই নগর হইতে ভোজরাজ রুক্মী এক অক্ষৌহিণী সেনা সমভিব্যাহারে সত্বরে পাণ্ডবগণের নিকট আগমন করিলেন এবং পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতসারে কৃষ্ণের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত কবচ, ধনু, তলবার, খড়্গ ও শরাসন ধারণ করিয়া আদিত্যসঙ্কাশ ধ্বজের সহিত পাণ্ডবসৈন্যমণ্ডলী মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।”
এই কথা উদ্যোগপর্বে ১৫৭শ অধ্যায়ে আছে। ঐ অধ্যায়ের নাম রুক্মিপ্রত্যাখ্যান। মহাভারতের যে পর্বসংগ্রহাধ্যায়ের কথা পূর্বে বলিয়াছি, তাহাতে লিখিত আছে যে, উদ্যোগপর্বে ১৮৬ অধ্যায়, এবং ৬৬৯৮ শ্লোক আছে।
“উদ্যোগপর্বনির্দিষ্টং সন্ধিবিগ্রহমিশ্রিতম্।
অধ্যায়ানাং শতং প্রোক্তং ষড়শীতির্মর্ষিণা ||
শ্লোকানাং ষট্সহস্রাণি তাবন্ত্যেব শতানি চ।
শ্লোকাশ্চ নবতিঃ প্রোক্তাস্তথৈবাষ্টৌ মহাত্মনা ||”
মহাভারতম্, আদিপর্ব।
এক্ষণে মহাভারতে ১৯৭ অধ্যায় পাওয়া যায়। অতএব ১১ অধ্যায় পর্বসংগ্রহাধ্যায় সঙ্কলিত হওয়ার পরে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এক্ষণে উদ্যোগপর্বে ৭৬৫৭ শ্লোক পাওয়া যায়। অতএব প্রায় এক হাজার শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। প্রক্ষিপ্ত এই একাদশ অধ্যায় ও সহস্র শ্লোক কোন্গুলি? প্রথমেই দেখিতে হয় যে, উগ্যোগপর্বান্তর্গত কোন্ বৃত্তান্তগুলি পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ধৃত হয় নাই। এই রুক্মিসমাগম বা রুক্মিপ্রত্যাখ্যান পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ধৃত হয় নাই। অতএব ঐ ১৫৭ অধ্যায় প্রক্ষিপ্ত একাদশ অধ্যায়ের মধ্যে একটি, ইহা বিচারসঙ্গত। এই রুক্মিপ্রত্যাখ্যান পর্বাধ্যায়ের সঙ্গে মহাভারতের কোন সম্বন্ধ নাই। রুক্মী সসৈন্যে আসিলেন এবং অর্জুন কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলেন, পশ্চাৎ দুর্যোধন কর্তৃকও পরিত্যক্ত হইলেন, পশ্চাৎ স্বস্থানে চলিয়া গেলেন, ইহা ভিন্ন মহাভারতের সঙ্গে তাঁহার আর কোন সম্বন্ধ নাই। এই দুইটি লক্ষণ একত্রিত করিয়া বিচার করিয়া দেখিলে, অবশ্য বুঝিতে হইবে যে, ১৫৭ অধ্যায় প্রক্ষিপ্ত, কাজেই রুক্মিণীহরণ বৃত্তান্ত মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত। ইহার অন্যতর প্রমাণ এই যে, বিষ্ণুপুরাণে আছে যে, মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বেই রুক্মী বলরাম কর্তৃক অক্ষক্রীড়াজনিত বিবাদে নিহত হইয়াছিলেন। রুক্মিণীকে শিশুপাল কামনা করিয়াছিলেন, ইহা সত্য এবং তিনি রুক্মিণীকে বিবাহ করিতে পান নাই—কৃষ্ণ তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহাও সত্য। বিবাহের পর একটা যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু ‘হরণ’ কথাটা মৌলিক মহাভারতে কোথাও নাই। হরিবংশে ও পুরাণে আছে।
শিশুপাল ভীষ্মকে তিরস্কারের সময় কাশিরাজের কন্যাহরণ জন্য তাঁহাকে গালি দিয়াছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকে তিরস্কারের সময় রুক্মিণীহরণের কোন কথাও তুলেন নাই। অতএব বোধ হয় না যে, রুক্মিণী হৃতা হইয়াছিলেন। পূর্বোদ্ধৃত কথোপকথনে ইহাই সত্য বোধ হয় যে, শিশুপাল রুক্মিণীকে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু ভীষ্মক রুক্মিণীকে কৃষ্ণকেই সম্প্রদান করিয়াছিলেন। তার পর তাঁহার পুত্র রুক্মী শিশুপালের পক্ষ হইয়া বিবাদ উপস্থিত করিয়াছিলেন। রুক্মী অতিশয় কলহপ্রিয় ছিলেন। অনিরুদ্ধের বিবাহকালে দ্যূতোপলক্ষে বলরামের সঙ্গে কলহ উপস্থিত করিয়া নিজেই নিহত হইয়াছিলেন।
নরকবধাদি
কথিত হইয়াছে, নরকাসুর নামে পৃথিবীর এক পুত্র ছিল। প্রাগ্জ্যোতিষে তাহার রাজধানী। সে অত্যন্ত দুর্বিনীত ছিল। ইন্দ্র স্বয়ং দ্বারকায় আসিয়া তাহার নামে কৃষ্ণের নিকট নালিশ করিলেন। অন্যান্য দুষ্কর্মের মধ্যে নরক ইন্দ্র বিষ্ণু প্রভৃতি আদিত্যদিগের মাতা অদিতির কুণ্ডল চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছিল। কৃষ্ণ ইন্দ্রের নিকট নরকবধে প্রতিশ্রুত হইয়া প্রাগ্জোতিষপুরে গিয়া নরককে বধ করিলেন। নরকের ষোল হাজার কন্যা ছিল, তাহাদিগের সকলকে লইয়া আসিয়া বিবাহ করিলেন। নরকমাতা পৃথিবী নরকাপহৃত অদিতিকুণ্ডল লইয়া আসিয়া কৃষ্ণকে উপহার দিলেন; এবং বলিয়া গেলেন যে, কৃষ্ণ যখন বরাহ অবতার হইয়াছিলেন, তখন পৃথিবীর উদ্ধারজন্য বরাহের যে স্পর্শ, সেই স্পর্শে পৃথিবী গর্ভবতী হইয়া নরককে প্রসব করিয়াছিলেন।
সমস্তই অতিপ্রকৃত এবং সমস্তই অতি মিথ্যা। বিষ্ণু বরাহরূপ ধারণ করেন নাই, প্রজাপতি পৃথিবীর উদ্ধারের জন্য বরাহরূপ ধারণ করিয়াছিলেন, ইহাই বেদে আছে। কৃষ্ণের সময়ে, নরক প্রাগ্জ্যোতিষের রাজা ছিলেন না—ভগদত্ত প্রাগ্জ্যোতিষের রাজা ছিলেন। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনহস্তে নিহত হন। ফলতঃ ইন্দ্রের দ্বারকা গমন, পৃথিবীর গর্ভাধান এবং একজনের ষোড়শ সহস্র কন্যা ইত্যাদি সকলই অতিপ্রকৃত উপন্যাস মাত্র। কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী থাকাও এই উপন্যাসের অংশমাত্র এবং মিথ্যা গল্প, ইহা পাঠককে আর বলিতে হইবে না।
সমস্তই অতিপ্রকৃত এবং সমস্তই অতি মিথ্যা। বিষ্ণু বরাহরূপ ধারণ করেন নাই, প্রজাপতি পৃথিবীর উদ্ধারের জন্য বরাহরূপ ধারণ করিয়াছিলেন, ইহাই বেদে আছে। কৃষ্ণের সময়ে, নরক প্রাগ্জ্যোতিষের রাজা ছিলেন না—ভগদত্ত প্রাগ্জ্যোতিষের রাজা ছিলেন। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনহস্তে নিহত হন। ফলতঃ ইন্দ্রের দ্বারকা গমন, পৃথিবীর গর্ভাধান এবং একজনের ষোড়শ সহস্র কন্যা ইত্যাদি সকলই অতিপ্রকৃত উপন্যাস মাত্র। কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী থাকাও এই উপন্যাসের অংশমাত্র এবং মিথ্যা গল্প, ইহা পাঠককে আর বলিতে হইবে না।
এই নরকাসুরবধ হইতে বিষ্ণুপুরাণের মতে পারিজাত হরণের সূত্রপাত। কৃষ্ণ দিতির কুণ্ডল লইয়া অদিতিকে দিবার জন্য সত্যভামা সমভিব্যাহারে ইন্দ্রালয়ে গমন করিলেন। সেখানে সত্যভামা পারিজাত কামনা করায় পারিজাত বৃক্ষ লইয়া ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ বাধিল। ইন্দ্র পরাস্ত হইলেন। হরিবংশে ইহা ভিন্নপ্রকারে লিখিত আছে। কিন্তু যখন আমরা বিষ্ণুপুরাণকে হরিবংশের পূর্বগামী গ্রন্থ বিবেচনা করি, তখন এখানে বিষ্ণুপুরাণেরই অনুবর্তী হইলাম। উভয় গ্রন্থকথিত বৃত্তান্তই অত্যদ্ভুত ও অতিপ্রকৃত। যখন আমরা ইন্দ্র, ইন্দ্রালয় এবং পারিজাতের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অবিশ্বাসী, তখন এই সমস্ত পারিজাতহরণবৃত্তান্তই আমাদের পরিহার্য।
ইহার পর বাণাসুরবধবৃত্তান্ত। তাহাও ঐরূপ অতিপ্রকৃত অদ্ভুতব্যাপার—পরিপূর্ণ, এজন্য তাহাও আমরা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য। তাহার পর পৌণ্ড্র বাসুদেববধ এবং বারাণসীদাহ। ইহার কতকটা ঐতিহাসিকতা আছে বোধ হয়। পৌণ্ড্রদিগের রাজা ঐতিহাসিক, এবং পৌণ্ড্র জাতির কথা ঐতিহাসিক এবং অনৈতিহাসিক সময়েও বিবিধ দেশী বিদেশী গ্রন্থে পাওয়া যায়। রামায়ণে তাহাদিগকে দাক্ষিণাত্যে দেখা যায়, কিন্তু মহাভারতের সময়ে তাহারা আধুনিক বাঙ্গালার পশ্চিমভাগবাসী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পৌণ্ড্রেরা উপস্থিত ছিল। মহাভারতে তাহারা অনার্য জাতির মধ্যে গণিত হইয়াছে। দশকুমারচরিতেও তাহাদিগের কথা আছে এবং একজন চৈনিক পরিব্রাজক তাহাদিগকে বাঙ্গালা দেশে স্থাপিত দেখিয়া গিয়াছেন। তিনি তাহাদিগের রাজধানী পৌণ্ড্রবর্ধনেও গিয়াছিলেন, কৃষ্ণের সময়ে যিনি পৌণ্ড্রদিগের রাজা ছিলেন, তাঁহারও নাম বাসুদেব। বাসুদেব শব্দের অনেক অর্থ হয়। যিনি বসুদেবের পুত্র, তিনি বাসুদেব। এবং যিনি সর্বনিবাস অর্থাৎ সর্বভূতের বাসস্থান, তিনিও বাসুদেব। অতএব যিনি ঈশ্বরের অবতার, তিনিই প্রকৃত বাসুদেব নামের অধিকারী। এই পৌণ্ড্রক বাসুদেব প্রচার করিলেন যে, দ্বারকানিবাসী বাসুদেব, জাল বাসুদেব; তিনি নিজেই প্রকৃত বাসুদেব—ঈশ্বরাবতার। তিনি কৃষ্ণকে বলিয়া পাঠাইলেন যে, তুমি আমার নিকটে আসিয়া, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাদি যে সকল চিহ্নে আমারই প্রকৃত অধিকার, তাহা আমাকেই দিবে। কৃষ্ণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া পৌণ্ড্ররাজ্যে গমন করিলেন এবং চক্রাদি অস্ত্র পৌণ্ড্রকের প্রতি ক্ষিপ্ত করিয়া তাহাকে নিহত করিলেন। বারাণসীর অধিপতিগণ পৌণ্ড্রেকের পক্ষ হইয়াছিল, এবং পৌণ্ড্রকের মৃত্যুর পরেও কৃষ্ণের সঙ্গে শত্রুতা করিয়া, যুদ্ধ করিতেছিল। এজন্য তিনি বারাণসী আক্রমণ করিয়া শত্রুগণকে নিহত করিলেন এবং বারাণসী দগ্ধ করিলেন।
এ স্থলে শত্রুকে নিহত করা অধর্ম নহে, কিন্তু নগরদাহ ধর্মানুমোদিত নহে। পরম ধর্মাত্মা কৃষ্ণের দ্বারা এরূপ কার্য কেন হইয়াছিল, তাহার বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ কিছু পাওয়া যায় না। বিষ্ণুপুরাণে লেখা আছে যে, কাশিরাজ কৃষ্ণহস্তে নিহত হইলে, তাঁহার পুত্র মহাদেবের তপস্যা করিয়া কৃষ্ণের বধের নিমিত্ত “কৃত্যা উৎপন্ন হউক,” এই বর প্রার্থনা করিলেন। কৃত্যা অভিচারকে বলে। অর্থাৎ যজ্ঞ হইতে শরীরবিশিষ্টা অমোঘ কোন শক্তি উৎপন্ন হইয়া শত্রুর বধসাধন করে। মহাদেব প্রার্থিত বর দিলেন। কৃত্যা উৎপন্ন হইয়া ভীষণ মূর্তিধারণপূর্বক কৃষ্ণের বধার্থ ধাবমান হইল। কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রকে আজ্ঞা করিলেন যে, তুমি এই কৃত্যাকে সংহার কর। বৈষ্ণবচক্রের প্রভাবে মাহেশ্বরী কৃত্যা বিধ্বস্তপ্রভাবা হইয়া পলায়ন করিল। চক্রও পশ্চাদ্ধাবিত হইল। কৃত্যা বারাণসী নগর মধ্যে প্রবেশ করিল। চক্রানলে সমস্ত পুরী দগ্ধ হইয়া গেল। ইহা অতিশয় অনৈসর্গিক ও অবিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। হরিবংশে পৌণ্ড্রকবধের কথা আছে, কিন্তু বারাণসীদাহের কথা নাই। কিন্তু ইহার কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ মহাভারতে আছে। অতএব বারাণসীদাহ অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। তবে কি জন্য বারাণসীদাহ করিতে কৃষ্ণ বাধ্য হইয়াছিলেন, তাহার বিশ্বাসযোগ্য কারণ কিছু জানা যায় না।
যে সকল যুদ্ধের কথা কথা বলা গেল, তদ্ভিন্ন উদ্যোগপর্বে ৪৭ অধ্যায়ে অর্জুনবাক্যে কৃষ্ণকৃত গান্ধারজয়, পাণ্ড্যজয়, কলিঙ্গজয়, শাল্বজয় এবং একলব্যের সংহারের প্রসঙ্গ আছে। ইহার মধ্যে শাল্বজয়বৃত্তান্ত মহাভারতের বনপর্বে আছে। ইহা ভিন্ন আর কয়টির কোন বিস্তারিত বিবরণ আমি কোন গ্রন্থে পাইলাম না। বোধ হয়, হরিবংশ ও পুরাণ সকল সংগ্রহের পূর্বে এই সকল যুদ্ধ-বিষয়ক কিম্বদন্তী বিলুপ্ত হইয়াছিল। হরিবংশে ও ভাগবতে অনেক নূতন কথা আছে, কিন্তু মহাভারতে বা বিষ্ণুপুরাণে তাহার কোন প্রসঙ্গ নাই বলিয়া আমি সে সকল পরিত্যাগ করিলাম।
দ্বারকাবাস-স্যমন্তক
দ্বারকায় কৃষ্ণ রাজা ছিলেন না। যত দূর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে বোধ হয় যে, ইউরোপীয় ইতিহাসে যাহাকে Oligarchy বলে, যাদবেরা দ্বারকায় তাহাই ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা সমাজের অধিনায়ক ছিলেন, কিন্তু তাঁহারা পরস্পর সকলে সমানস্পর্ধী। বয়োজ্যেষ্ঠকে আপনাদিগের মধ্যে প্রধান বিবেচনা করিতেন, সেই জন্য উগ্রসেনের রাজা নাম। কিন্তু এরূপ প্রধান ব্যক্তির কার্যতঃ বড় কর্তৃত্ব থাকিত না। যে বুদ্ধিবিক্রমে প্রধান, নেতৃত্ব তাহারই ঘটিত। কৃষ্ণ যাদবদিগের মধ্যে বলবীর্য বুদ্ধিবিক্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ, এই জন্যই তিনি যাদবদিগের নেতৃস্বরূপ ছিলেন। তাঁহার অগ্রজ বলরাম এবং কৃতবর্মা প্রভৃতি অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ যাদবগণও তাঁহার বশীভূত ছিলেন। কৃষ্ণও সর্বদা তাঁহাদিগের মঙ্গলকামনা করিতেন। কৃষ্ণ হইতেই তাঁহাদিগের রক্ষা সাধিত হইত এবং কৃষ্ণ বহুরাজ্যবিজেতা হইয়াও জ্ঞাতিবর্গকে না দিয়া আপনি কোন ঐশ্বর্যভোগ করিতেন না। তিনি সকলের প্রতি তুল্যপ্রীতিসম্পন্ন ছিলেন। সকলেরই হিতসাধন করিতেন। জ্ঞাতিদিগের প্রতি আদর্শ মনুষ্যের যেরূপ ব্যবহার কর্তব্য, তাহা তিনি করিতেন। কিন্তু জ্ঞাতিভাব চিরকালই সমান। তাঁহার বলবিক্রমের ভয়ে জ্ঞাতিরা তাঁহার বশীভূত ছিল বটে, কিন্তু তাঁহার প্রতি দ্বেষশূন্য ছিল না। এ বিষয়ে কৃষ্ণ স্বয়ং যাহা নারদের কাছে বলিয়াছিলেন, ভীষ্ম তাহা নারদের মুখে শুনিয়া যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছিলেন। কথাগুলি সত্য হউক মিথ্যা হউক, লোকশিক্ষার্থে আমরা তাহা মহাভারতের শান্তিপর্ব হইতে উদ্ধৃত করিতেছি,—
“জ্ঞাতিদিগকে ঐশ্বর্যের অর্ধাংশ প্রদান ও তাহাদিগের কটুবাক্যে শ্রবণ করিয়া তাহাদিগের দাসের ন্যায় অবস্থান করিতেছি। বহ্নিলাভার্থী ব্যক্তি যেমন অরণি কাষ্ঠকে মথিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ জ্ঞাতিবর্গের দুর্বাক্য নিরন্তর আমার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে। বলদেব বল, গদ সুকুমারতা এবং আমার আত্মজ প্রদ্যুম্ন সৌন্দর্য—প্রভাবে জনসমাজে অদ্বিতীয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন। আর অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরাও মহাবলপরাক্রান্ত, উৎসাহসম্পন্ন ও অধ্যবসায়শালী; তাঁহারা যাহার সহায়তা না করেন, সে বিনষ্ট হয় যাহারা সহায়তা করেন, সে অনায়াসে অসামান্য ঐশ্বর্য লাভ করিয়া থাকে। ঐ সকল ব্যক্তি আমার পক্ষ থাকিতেও আমি অসহায় হইয়া কালযাপন করিতেছি। আহুক ও অক্রূর আমার পরম সুহৃৎ, কিন্তু ঐ দুই জনের মধ্যে একজনকে স্নেহ করিলে, অন্যের ক্রোধোদ্দীপন হয়; সুতরাং আমি কাহারও প্রতি স্নেহ প্রকাশ করি না। আর নিতান্ত সৌহার্দবশতঃ উহাদিগকে পরিত্যাগ করাও সুকঠিন। অতঃপর আমি এই স্থির করিলাম যে, আহুক ও অক্রূর যাহার পক্ষ, তাহার দুঃখের পরিসীমা নাই, আর তাঁহারা যাহার পক্ষ নহেন, তাহা অপেক্ষাও দুঃখী আর কেহই নাই। যাহা হউক, এক্ষণে আমি দ্যূতকারী সহোদরদ্বয়ের মাতার ন্যায় উভয়েরই জয় প্রার্থনা করিতেছি। হে নারদ! আমি ঐ দুই মিত্রকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত এইরূপ কষ্ট পাইতেছি।”
“জ্ঞাতিদিগকে ঐশ্বর্যের অর্ধাংশ প্রদান ও তাহাদিগের কটুবাক্যে শ্রবণ করিয়া তাহাদিগের দাসের ন্যায় অবস্থান করিতেছি। বহ্নিলাভার্থী ব্যক্তি যেমন অরণি কাষ্ঠকে মথিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ জ্ঞাতিবর্গের দুর্বাক্য নিরন্তর আমার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে। বলদেব বল, গদ সুকুমারতা এবং আমার আত্মজ প্রদ্যুম্ন সৌন্দর্য—প্রভাবে জনসমাজে অদ্বিতীয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন। আর অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরাও মহাবলপরাক্রান্ত, উৎসাহসম্পন্ন ও অধ্যবসায়শালী; তাঁহারা যাহার সহায়তা না করেন, সে বিনষ্ট হয় যাহারা সহায়তা করেন, সে অনায়াসে অসামান্য ঐশ্বর্য লাভ করিয়া থাকে। ঐ সকল ব্যক্তি আমার পক্ষ থাকিতেও আমি অসহায় হইয়া কালযাপন করিতেছি। আহুক ও অক্রূর আমার পরম সুহৃৎ, কিন্তু ঐ দুই জনের মধ্যে একজনকে স্নেহ করিলে, অন্যের ক্রোধোদ্দীপন হয়; সুতরাং আমি কাহারও প্রতি স্নেহ প্রকাশ করি না। আর নিতান্ত সৌহার্দবশতঃ উহাদিগকে পরিত্যাগ করাও সুকঠিন। অতঃপর আমি এই স্থির করিলাম যে, আহুক ও অক্রূর যাহার পক্ষ, তাহার দুঃখের পরিসীমা নাই, আর তাঁহারা যাহার পক্ষ নহেন, তাহা অপেক্ষাও দুঃখী আর কেহই নাই। যাহা হউক, এক্ষণে আমি দ্যূতকারী সহোদরদ্বয়ের মাতার ন্যায় উভয়েরই জয় প্রার্থনা করিতেছি। হে নারদ! আমি ঐ দুই মিত্রকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত এইরূপ কষ্ট পাইতেছি।”
এই কথার উদাহরণস্বরূপ স্যমন্তক মণির বৃত্তান্ত পাঠককে উপহার দিতে ইচ্ছা করি। সামন্তক মণির বৃত্তান্ত অতিপ্রকৃত পরিপূর্ণ। অতিপ্রকৃত অংশ বাদ দিলে যেটুকু থাকিবে, তাহাও কত দূর সত্য, বলা যায় না। যাহা হউক, স্থূল বৃত্তান্ত পাঠককে শুনাইতেছি।
সত্রাজিত নামে এক জন যাদব দ্বারকায় বাস করিতেন। তিনি একটি অতি উজ্জ্বল সর্বজনলোভনীয় মণি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন! মণির নাম স্যমন্তক। কৃষ্ণ সেই মণি দেখিয়া বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, ইহা যাদবাধিপতি উগ্রসেনেরই যোগ্য। কিন্তু জ্ঞাতিবিরোধ-ভয়ে সত্রাজিতের নিকট মণি প্রার্থনা করেন নাই। কিন্তু সত্রাজিত মনে ভয় করিলেন যে, কৃষ্ণ এই মণি চাহিবেন। চাহিলে তিনি রাখিতে পারিবেন না, এই ভয়ে মণি তিনি নিজে ধারণ না করিয়া আপনার ভ্রাতা প্রসেনকে দিয়াছিলেন। প্রসেন সেই মণি ধারণ করিয়া এক দিন মৃগয়ায় গিয়াছিলেন। বনমধ্যে একটা সিংহ তাঁহাকে হত করিয়া সেই মণি মুখে করিয়া লইয়া চলিয়া যায়। জাম্ববান্ সিংহকে হত করিয়া সেই মণি গ্রহণ করে। জাম্ববান্ একটা ভল্লুক। কথিত আছে যে, সে ত্রেতাযুগে রামের বানরসেনার মধ্যে থাকিয়া রামের পক্ষে যুদ্ধ করিয়াছিল।
এ দিকে প্রসেন নিহত এবং মণি অন্তর্হিত জানিতে পারিয়া দ্বারকাবাসী লোকে এইরূপ সন্দেহ করিল যে, কৃষ্ণের যখন এই মণি লইবার ইচ্ছা ছিল, তখন তিনিই প্রসেনকে মারিয়া মণি গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। এইরূপ লোকাপবাদ কৃষ্ণের অসহ্য হওয়ায় তিনি মণির সন্ধানে বহির্গত হইলেন। যেখানে প্রসেনের মৃতদেহ দেখিলেন, সেইখানে সিংহের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন। তাহা সকলকে দেখাইয়া আপনার কলঙ্ক অপনীত করিলেন। পরে সিংহের পদচিহ্নানুসরণ করিয়া ভল্লুকের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন। সেই পদচিহ্ন ধরিয়া গর্তের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তথায় জাম্ববানের পুত্রপালিকা ধাত্রীর হস্তে সেই স্যমন্তক মণি দেখিতে পাইলেন। পরে জাম্ববানের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাভব করিলেন। তখন জাম্ববান্ তাঁহাকে স্যমন্তক মণি দিল, এবং আপনার কন্যা জাম্ববতীকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিল। কৃষ্ণ মণি লইয়া দ্বারকায় আসিয়া মণি সত্রাজিতকেই প্রত্যর্পণ করিলেন। তিনি পরস্ব কামনা করিতেন না। কিন্তু সত্রাজিত, কৃষ্ণের উপর অভূতপূর্ব কলঙ্ক আরোপিত করিয়াছিলেন, এই ভয়ে ভীত হইয়া কৃষ্ণের তুষ্টিসাধনার্থ আপনার কন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন। সত্যভামা সর্বজনপ্রার্থনীয় রূপবতী কন্যা ছিলেন। এজন্য তিন জন প্রধান যাদব, অর্থাৎ শতধন্বা, মহাবীর কৃতবর্মা এবং কৃষ্ণের পরম ভক্ত ও সুহৃৎ অক্রূর ঐ কন্যাকে কামনা করিয়াছিলেন। এক্ষণে সত্যভামা কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা হওয়ায় তাঁহারা আপনাদিগেক অত্যন্ত অপমানিত বিবেচনা করিলেন এবং সত্রাজিতের বধের জন্য ষড়যন্ত্র করিলেন। অক্রূর ও কৃতবর্মা শতধন্বাকে পরামর্শ দিলেন যে, তুমি সত্রাজিতকে বধ করিয়া তাহার মণি চুরি কর। কৃষ্ণ তোমাদের যদি বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাহা হইলে, আমরা তোমার সাহায্য করিব। শতধন্বা সম্মত হইয়া কদাচিৎ কৃষ্ণ বারণাবতে গমন করিলে, সত্রাজিতকে নিদ্রিত অবস্থায় বিনাশ করিয়া মণি চুরি করিলেন।
সত্যভামা পিতৃবধে শোকাতুরা হইয়া কৃষ্ণের নিকট নালিশ করিলেন। কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় প্রত্যাগমন করিয়া, বলরামকে সঙ্গে লইয়া, শতধন্বার বধে উদ্যোগী হইলেন। শুনিয়া শতধন্বা কৃতবর্মা অক্রূরের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। তাঁহারা কৃষ্ণ বলরামের সহিত শত্রুতা করিতে অস্বীকৃত হইলেন। তখন শতধন্বা অগত্যা অক্রূরকে মণি দিয়া দ্রুতগামী ঘোটকে আরোহণ পূর্বক পলায়ন করিলেন। কৃষ্ণ বলরাম রথে যাইতেছিলেন, রথ ঘোটককে ধরিতে পারিল না। শতধন্বার অশ্বিনীও পথক্লান্তা হইয়া প্রাণত্যাগ করিল। শতধন্বা তখন পাদচারে পলায়ন করিতে লাগিল। ন্যায়যুদ্ধপরায়ণ কৃষ্ণ তখন রথে বলরামকে রাখিয়া স্বয়ং পাদচারে শতধন্বার পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন। কৃষ্ণ দুই ক্রোশ গিয়া শতধন্বার মস্তকচ্ছেদন করিলেন। কিন্তু মণি তাঁহার নিকট পাইলেন না। ফিরিয়া আসিয়া বলরামকে এই কথা বলিলে বলরাম তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন না। ভাবিলেন, মণির ভাগে বলরামকে বঞ্চিত করিবার জন্য কৃষ্ণ মিথ্যা কথা বলিতেছেন। বলরাম বলিলেন, “ধিক্ তোমায়! তুমি এমন অর্থলোভী! এই পথ আছে, তুমি দ্বারকায় চলিয়া যাও; আমি আর দ্বারকায় যাইব না।” এই বলিয়া তিনি কৃষ্ণকে ত্যাগ করিয়া বিদেহ নগরে গিয়া তিন বৎসর বাস করিলেন। এদিকে অক্রূরও দ্বারকা ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন। পরে যাদবগণ তাঁহাকে অভয় দিয়া পুনর্বার দ্বারকায় আনাইলেন। কৃষ্ণ তখন এক দিন সমস্ত যাদবগণকে সমবেত করিয়া অক্রূরকে বলিলেন যে, স্যমন্তক মণি তোমার নিকট আছে, আমরা তাহা জানি। সে মণি তোমারই থাক্, কিন্তু সকলকে একবার দেখাও। অক্রূর ভাবিলেন, আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে সন্ধান করিলে, আমার নিকট মণি বাহির হইবে। অতএব তিনি অস্বীকার না করিয়া মণি বাহির করিলেন। তাহা দেখিয়া বলরাম এবং সত্যভামা সেই মণি লইবার জন্য অতিশয় ব্যস্ত হইলেন। কিন্তু সত্যপ্রতিজ্ঞ কৃষ্ণ সেই মণি বলরাম বা সত্যভামা কাহাকেও দিলেন না, আপনিও লইলেন না, অক্রূরকেই প্রত্যর্পণ করিলেন।*
এই স্যমন্তকমণিবৃত্তান্তেও কৃষ্ণের ন্যায়পরতা, স্বার্থশূন্যতা, সত্যপ্রতিজ্ঞতা এবং কার্যদক্ষতা অতি পরিস্ফুট। কিন্তু উপন্যাসটা সত্যমূলক বলিয়া বোধ হয় না।
—————-
* এইরূপ বিষ্ণুপুরাণে আছে। হরিবংশ বলেন, কৃষ্ণ আপনিই মণি ধারণ করিলেন।
* এইরূপ বিষ্ণুপুরাণে আছে। হরিবংশ বলেন, কৃষ্ণ আপনিই মণি ধারণ করিলেন।
এই সম্যন্তক মণির কথায় কৃষ্ণের বহুবিবাহের কথা আপনা হইতেই আসিয়া পড়িতেছে। তিনি রুক্মিণীকে পূর্বে বিবাহ করিয়াছিলেন, এক্ষণে এক সম্যন্তক মণির প্রভাবে আর দুটি ভার্যা জাম্ববতী এবং সত্যভামা, লাভ করিলেন। ইহাই বিষ্ণুপুরাণ বলেন, হরিবংশ এক পৈঠা উপর গিয়া থাকেন,—তিনি বলেন, দুইটি না, চারিটি। সত্রাজিতের তিনটি কন্যা ছিল,—সত্যভামা, প্রস্বাপিনী এবং ব্রতিনী। তিনটিই তিনি শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলেন। কিন্তু দুই চারিটায় কিছু আসিয়া যায় না—মোট সংখ্যা নাকি ষোল হাজারের উপর। এইরূপ লোকপ্রবাদ। বিষ্ণুপুরাণে ৪ অংশে আছে, “ভগবতোহপ্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য ষোড়শসহস্রাণ্যেকোত্তরশতা—ধিকানি স্ত্রীণামভবন্।”[1] কৃষ্ণের ষোল হাজার এক শত এক স্ত্রী। কিন্তু ঐ পুরাণের ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে প্রধানাদিগের নাম করিয়া পুরাণকার বলিতেছেন, রুক্মিণী ভিন্ন “অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ।” তার পর, “ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।” তাহা হইলে, দাঁড়াইল ষোল হাজার সাত জন। ইহার মধ্যে ষোল হাজার নরককন্যা। সেই আষাঢ়ে গল্প বলিয়া আমি ইতিপূর্বেই বাদ দিয়াছি।
গল্পটা কত বড় আষাঢ়ে, আর এক রকম করিয়া বুঝাই। বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশের ঐ পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যে, এই সকল স্ত্রীর গর্ভে কৃষ্ণের এক লক্ষ আশী হাজার পুত্র জন্মে। বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ এক শত পঁচিশ বৎসর ভূতলে ছিলেন। হিসাব করিলে, কৃষ্ণের বৎসরে ১৪৪০টি পুত্র, ও প্রতিদিন চারিটি পুত্র জন্মিত। এ স্থলে এইরূপ কল্পনা করিতে হয় যে, কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছায় কৃষ্ণমহিষীরা পুত্রবতী হইতেন।
গল্পটা কত বড় আষাঢ়ে, আর এক রকম করিয়া বুঝাই। বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশের ঐ পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যে, এই সকল স্ত্রীর গর্ভে কৃষ্ণের এক লক্ষ আশী হাজার পুত্র জন্মে। বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ এক শত পঁচিশ বৎসর ভূতলে ছিলেন। হিসাব করিলে, কৃষ্ণের বৎসরে ১৪৪০টি পুত্র, ও প্রতিদিন চারিটি পুত্র জন্মিত। এ স্থলে এইরূপ কল্পনা করিতে হয় যে, কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছায় কৃষ্ণমহিষীরা পুত্রবতী হইতেন।
এই নরকাসুরের ষোল হাজার কন্যার আষাঢ়ে গল্প ছাড়িয়া দিই। কিন্তু তদ্ভিন্ন আট জন “প্রধানা” মহিষীর কথা পাওয়া যাইতেছে। এক জন রুক্মিণী। বিষ্ণুপুরাণকার বলিয়াছেন, আর সাত জন। কিন্তু ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে নাম দিতেছেন আট জনের, যথা—
“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||”
১। কালিন্দী
২। মিত্রবিন্দা
৩। নগ্নজিৎকন্যা সত্যা
৪। জাম্ববতী
৫। রোহিণী (ইনি কামরূপিণী)
৬। মদ্ররাজসুতা সুশীলা
৭। সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৮। লক্ষ্মণা
রুক্মিণী লইয়া নয় জন হইল। আবার ৩২ অধ্যায়ে আর এক প্রকার। কৃষ্ণের পুত্রগণের নামকীর্তন হইতেছে:—
প্রদ্যুম্নাদা হরেঃ পুত্রা রুক্মিণ্যাঃ কথিতাস্তব।
ভানুং ভৈমরিকঞ্চৈব সত্যাভামা ব্যজায়ত || ১||
দীপ্তিমান্ তাম্রপক্ষাদ্যা রোহিণ্যাং তনয়া হরেঃ।
বভূবুর্জাম্বুবত্যাঞ্চ শাম্বাদ্যা বাহুশালিনঃ || ২||
তনয়া ভদ্রবিন্দাদ্যা নাগ্নজিত্যাং মহাবলাঃ।
সংগ্রামজিৎপ্রধানাস্তু শৈব্যায়াস্ত্বভবন্ সুতাঃ || ৩||
বৃকদ্যাস্তু সুতা মাদ্র্যাং গাত্রবৎপ্রমুখান্ সুতান্।
প্রদ্যুম্নাদা হরেঃ পুত্রা রুক্মিণ্যাঃ কথিতাস্তব।
ভানুং ভৈমরিকঞ্চৈব সত্যাভামা ব্যজায়ত || ১||
দীপ্তিমান্ তাম্রপক্ষাদ্যা রোহিণ্যাং তনয়া হরেঃ।
বভূবুর্জাম্বুবত্যাঞ্চ শাম্বাদ্যা বাহুশালিনঃ || ২||
তনয়া ভদ্রবিন্দাদ্যা নাগ্নজিত্যাং মহাবলাঃ।
সংগ্রামজিৎপ্রধানাস্তু শৈব্যায়াস্ত্বভবন্ সুতাঃ || ৩||
বৃকদ্যাস্তু সুতা মাদ্র্যাং গাত্রবৎপ্রমুখান্ সুতান্।
অবাপ লক্ষ্মণা পুত্রাঃ কালিন্দ্যাঞ্চ শ্রুতাদয়ঃ || ৪||
এই তালিকায় পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
১। সত্যভামা (৭)
৩। জাম্ববতী (৪)
৪। নাগ্নজিতী (৩)
২। রোহিণী (৫)
৫। শৈব্যা (২)
৬। মাদ্রী (৬)
৭। লক্ষ্মণা (৮)
৮। কালিন্দী (১)
কিন্তু ৪র্থ অংশের ১৫ অধ্যায়ে আছে, “তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী-জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।” এখানে আবার সব নাম পাওয়া গেল না, নূতন নাম “জালহাসিনী” একটা পাওয়া গেল। এই গেল বিষ্ণুপুরাণে। হরিবংশে আরও গোলযোগ।
হরিবংশে আছে;—
মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ ||
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||
১১৮ অধ্যায়ে, ৪০-৪৩ শ্লোকঃ।
এখানে পাওয়া যাইতেছে যে, লক্ষ্মণাই জালহাসিনী। তাহা ধরিয়াও পাই,—
১। কালিন্দী
২। মিত্রবিন্দী
৩। সত্যা
৪। জাম্ববৎ-সুতা
৫। রোহিণী
৬। মাদ্রী সুশীলা
৭। সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৮। জালহাসিনী লক্ষ্মণা
৯) শৈব্যা
ক্রমেই শ্রীবৃদ্ধি-রুক্মিণী ছাড়া নয় জন হইল। এ গেল ১১৮ অধ্যায়ের তালিকা। হরিবংশে আবার ১৬২ অধ্যায়ে আর একটি তালিকা আছে, যথা—
অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী ||
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী * * *
ইহাতে পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
(১) সত্যভামা
(২) নাগ্নজিতী
(৩) সুদত্তা
(৪) শৈব্যা
(৫) লক্ষ্মণা জালহাসিনী
(৬) মিত্রবিন্দা
(৭) কালিন্দী
(৮) জাম্ববতী
(৯) পৌরবী
(১০) সুভীমা
(১১) মাদ্রী
হরিবংশকার ঋষি ঠাকুর, আট জন বলিয়া রুক্মিণী সমেত বার জনের নাম দিলেন। তাহাতেও ক্ষান্ত নহেন। ইহাদের একে একে সন্তানগণের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন আবার বাহির হইল—
(১২) সুদেবা।
(১৩) উপাসঙ্গ
(১৪) কৌশিকী
(১৫) সুতসোমা
(১৬) যৌধিষ্ঠিরী।[2]
এছাড়া পূর্বে সত্রাজিতের আর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীর কথা বলিয়াছেন। এ ছাড়া মহাভারতের নূতন দুইটি নাম পাওয়া যায়—গান্ধারী ও হৈমবতী।# সকল নামগুলি একত্র করিলে, প্রধানা মহিষী কতকগুলি হয় দেখা যাউক। মহাভারতে আছে,—
অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী ||
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী * * *
ইহাতে পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
(১) সত্যভামা
(২) নাগ্নজিতী
(৩) সুদত্তা
(৪) শৈব্যা
(৫) লক্ষ্মণা জালহাসিনী
(৬) মিত্রবিন্দা
(৭) কালিন্দী
(৮) জাম্ববতী
(৯) পৌরবী
(১০) সুভীমা
(১১) মাদ্রী
হরিবংশকার ঋষি ঠাকুর, আট জন বলিয়া রুক্মিণী সমেত বার জনের নাম দিলেন। তাহাতেও ক্ষান্ত নহেন। ইহাদের একে একে সন্তানগণের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন আবার বাহির হইল—
(১২) সুদেবা।
(১৩) উপাসঙ্গ
(১৪) কৌশিকী
(১৫) সুতসোমা
(১৬) যৌধিষ্ঠিরী।[2]
এছাড়া পূর্বে সত্রাজিতের আর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীর কথা বলিয়াছেন। এ ছাড়া মহাভারতের নূতন দুইটি নাম পাওয়া যায়—গান্ধারী ও হৈমবতী।# সকল নামগুলি একত্র করিলে, প্রধানা মহিষী কতকগুলি হয় দেখা যাউক। মহাভারতে আছে,—
(১) রুক্মিণী (৪) শৈব্যা
(২) সত্যভামা (৫) হৈমবতী
(৩) গান্ধারী (৬) জাম্ববতী
মহাভারতে আর নাম নাই, কিন্তু “অন্যা” শব্দটা আছে। তার পর বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে ১, ২, ৩, ছাড়া এই কয়েকটা নামও পাওয়া যায়।
(৭) কালিন্দী (১০) রোহিণী
(৮) মিত্রবিন্দা (১১) মাদ্রী
(৯) সত্যা নাগ্নজিতী (১২) লক্ষ্মাণা জালহাসিনী
বিষ্ণুপুরাণের ৩২ অধ্যায়ে তদতিরিক্ত পাওয়া যায়, শৈব্যা। তাঁহার নাম উপরে লেখা আছে। তার পর হরিবংশের প্রথম তালিকা ১১৮ অধ্যায়ে, ইহা ছাড়া নূতন নাম নাই, কিন্তু ১৬২ অধ্যায়ে নূতন পাওয়া যায়।
(১৩) কালিন্দী
(১৪) রোহিণী
(১৫) সভীমা
এবং ঐ অধ্যায়ে সন্তানগণনায় পাই,
(১৬) সুদেবা
(১৭) উপাসঙ্গ
(১৮) কৌশিকী
(১৯) সুতসোমা
এবং সত্যভামার বিবাহকালে কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা,
(২০) যৌধিষ্ঠিরী
(২১) ব্রতনী।
(২২) প্রস্বাপিনী।
আট জনের জায়গায় ২২ জন পাওয়া গেল। উপন্যাসকারদিগের খুব হাত চলিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট। ইহার মধ্যে ১৩ হইতে ২২ কেবল হরিবংশে আছে। এই জন্য ঐ ১০ জনকে ত্যাগ করা যাইতে পারে। তবু থাকে ১২ জন। গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম মহাভারতের মৌসলপর্ব ভিন্ন আর কোথাও পাওয়া যায় না। মৌসলপর্ব যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাহা পরে দেখাইব। এজন্য এই দুই নামও পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। বাকি থাকে ১০ জন।
জাম্ববতীর নাম বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,—
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।”
হরিবংশে এইরূপ,—
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।”
ইহার অর্থে যদি বুঝা যায়, জাম্ববৎসুতাই রোহিণী, তাহা হইলে অর্থ অসঙ্গত হয় না, এবং সেই অর্থই সঙ্গত বোধ হয়। অতএব জাম্ববতী ও রোহিণী একই। বাকি থাকিল ৮ জন।
সত্যভামা ও সত্যাও এক। তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেছি।
সত্রাজিতবধের কথার উত্তরে
“কৃষ্ণঃ সত্যভামামমর্ষতাম্রলোচনঃ প্রাহ, সত্যে, মমৈষাবহাসনা।”
অর্থাৎ কৃষ্ণ ক্রোধারক্ত লোচনে সত্যভামাকে বলিলেন, “সত্যে! ইহা আমারই অবহাসনা।” পুনশ্চ পঞ্চমাংশের ৩০ অধ্যায়ে, পারিজাতহরণে কৃষ্ণ সত্যভামাকে বলিতেছেন,—
(২) সত্যভামা (৫) হৈমবতী
(৩) গান্ধারী (৬) জাম্ববতী
মহাভারতে আর নাম নাই, কিন্তু “অন্যা” শব্দটা আছে। তার পর বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে ১, ২, ৩, ছাড়া এই কয়েকটা নামও পাওয়া যায়।
(৭) কালিন্দী (১০) রোহিণী
(৮) মিত্রবিন্দা (১১) মাদ্রী
(৯) সত্যা নাগ্নজিতী (১২) লক্ষ্মাণা জালহাসিনী
বিষ্ণুপুরাণের ৩২ অধ্যায়ে তদতিরিক্ত পাওয়া যায়, শৈব্যা। তাঁহার নাম উপরে লেখা আছে। তার পর হরিবংশের প্রথম তালিকা ১১৮ অধ্যায়ে, ইহা ছাড়া নূতন নাম নাই, কিন্তু ১৬২ অধ্যায়ে নূতন পাওয়া যায়।
(১৩) কালিন্দী
(১৪) রোহিণী
(১৫) সভীমা
এবং ঐ অধ্যায়ে সন্তানগণনায় পাই,
(১৬) সুদেবা
(১৭) উপাসঙ্গ
(১৮) কৌশিকী
(১৯) সুতসোমা
এবং সত্যভামার বিবাহকালে কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা,
(২০) যৌধিষ্ঠিরী
(২১) ব্রতনী।
(২২) প্রস্বাপিনী।
আট জনের জায়গায় ২২ জন পাওয়া গেল। উপন্যাসকারদিগের খুব হাত চলিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট। ইহার মধ্যে ১৩ হইতে ২২ কেবল হরিবংশে আছে। এই জন্য ঐ ১০ জনকে ত্যাগ করা যাইতে পারে। তবু থাকে ১২ জন। গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম মহাভারতের মৌসলপর্ব ভিন্ন আর কোথাও পাওয়া যায় না। মৌসলপর্ব যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাহা পরে দেখাইব। এজন্য এই দুই নামও পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। বাকি থাকে ১০ জন।
জাম্ববতীর নাম বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,—
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।”
হরিবংশে এইরূপ,—
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।”
ইহার অর্থে যদি বুঝা যায়, জাম্ববৎসুতাই রোহিণী, তাহা হইলে অর্থ অসঙ্গত হয় না, এবং সেই অর্থই সঙ্গত বোধ হয়। অতএব জাম্ববতী ও রোহিণী একই। বাকি থাকিল ৮ জন।
সত্যভামা ও সত্যাও এক। তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেছি।
সত্রাজিতবধের কথার উত্তরে
“কৃষ্ণঃ সত্যভামামমর্ষতাম্রলোচনঃ প্রাহ, সত্যে, মমৈষাবহাসনা।”
অর্থাৎ কৃষ্ণ ক্রোধারক্ত লোচনে সত্যভামাকে বলিলেন, “সত্যে! ইহা আমারই অবহাসনা।” পুনশ্চ পঞ্চমাংশের ৩০ অধ্যায়ে, পারিজাতহরণে কৃষ্ণ সত্যভামাকে বলিতেছেন,—
“সত্যে! যথা ত্বমিত্যুক্তং ত্বয়া কৃষ্ণাসকৃৎপ্রিয়ম্।”
আবশ্যক হইলে, আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা যথেষ্ট।
অতএব এই দশ জনের মধ্যে, সত্যা সত্যভামারই নাম বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন আট জন পাই। যথা—
১। রুক্মিণী ৫। কালিন্দী
২। সত্যভামা ৬। মিত্রবিন্দা
৩। জাম্ববতী ৭। মাদ্রী
৪। শৈব্যা ৮। জালহাসিনী লক্ষ্মণা
ইহার মধ্যে পাঁচ জন—শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, লক্ষ্মণা ও মাদ্রী সুশীলা—ইঁহারা তালিকার মধ্যে আছেন মাত্র। ইঁহাদের কখনও কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই না। ইঁহাদের কবে বিবাহ হইল, কেন বিবাহ হইল, কেহ কিছু বলে না। কৃষ্ণজীবনে ইঁহাদের কোন সংস্পর্শ নাই। ইঁহাদের পুত্রের তালিকা কৃষ্ণপুত্রের তালিকার মধ্যে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে তখনও কর্মক্ষেত্রে দেখি না। ইঁহারা কাহার কন্যা, কোন্ দেশসম্ভূতা, তাহার কোন কথা কোথাও নাই। কেবল, সুশীলা মদ্ররাজকন্যা, ইহাই আছে। কৃষ্ণের সমসাময়িক মদ্ররাজ, নকুল সহদেবের মাতুল, কুরুক্ষেত্রের বিখ্যাত রথী শল্য। তিনি ও কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ দিন, পরস্পরের শত্রুসেনা মধ্যে অবস্থিত। অনেক বার তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে বলিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকে বলিতে হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে শুনিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকেও শুনিতে হইয়াছে। এক পলক জন্য কিছুতেই প্রকাশ নাই যে, কৃষ্ণ শল্যের জামাতা বা ভগিনীপতি, বা তাদৃশ কোন সম্বন্ধবিশিষ্ট। সম্বন্ধের মধ্যে এইটুকু পাই যে, শল্য কর্ণকে বলিয়াছেন, ‘অর্জুন ও বাসুদেবকে এখনই বিনাশ কর’। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে শল্যবধে নিযুক্ত করিয়া তাহার যমস্বরূপ হইলেন। কৃষ্ণ যে মাদ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বোধ হয়। শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা এবং লক্ষ্মণার কুলশীল, দেশ এবং বিবাহবৃত্তান্ত কিছুই কেহ জানে না। তাঁহারাও কাব্যের অলঙ্কার, সে বিষয়ে আমার সংশয় হয় না।
কেন না, কেবল মাদ্রী নয়, জাম্ববতী, রোহিণী ও সত্যভামাকেও ঐরূপ দেখি। জাম্ববতীর সঙ্গে কালিন্দী প্রভৃতির প্রভেদ এই যে, তাঁহার পুত্র শাম্বের নাম, আর পাঁচ জন যাদবের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাম্ব কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ, কেবল এক লক্ষ্মণাহরণে। লক্ষ্মণা দুর্যোধনের কন্যা। মহাভারত যেমন পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত, তেমনি কৌরবদিগেরও জীবনবৃত্ত। লক্ষ্মণাহরণে যদি কিছু সত্য থাকিত, তবে মহাভারতে লক্ষ্মণাহরণ থাকিত। তাহা নাই। লক্ষ্মণাহরণ ভিন্ন যদুবংশধ্বংসেও শাম্বের নায়কতা দেখা যায়। তিনিই পেটে মুসল জড়াইয়া মেয়ে সাজিয়াছিলেন। আমি এই গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বলিয়াছি যে, এই মৌসলপর্ব প্রক্ষিপ্ত। মুসল-ঘটিত বৃত্তান্তটা অতিপ্রকৃত, এজন্য পরিত্যাজ্য। জাম্ববতীর বিবাহের পরে সুভদ্রার বিবাহ—অনেক পরে। সুভদ্রার পৌত্র পরিক্ষিৎ তখন ৩৬ বৎসরের, তখন যদুবংশধ্বংস। সুতরাং যদুবংশধ্বংসের সময় শাম্ব প্রাচীন। প্রাচীন ব্যক্তির গর্ভিণী সাজিয়া ঋষিদের ঠকাইতে যাওয়া অসম্ভব। জাম্ববতী নিজে ভল্লুককন্যা, ভল্লুকী। ভল্লুকী কৃষ্ণভার্যা বা কোন মানুষের ভার্যা হইতে পারে না। এই জন্য রোহিণীকে কামরূপিণী বলা হইয়াছে। কামরূপিণী কেন না, ভল্লুকী হইয়াও মানবরূপিণী হইতে পারিতেন। কামরূপিণী ভল্লুকীতে আমি বিশ্বাসবান্ নহি, এবং কৃষ্ণ ভল্লুককন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি না।
সত্যভামার পুত্র ছিল শুনি, কিন্তু তাঁহারা কোন কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন। তাঁহার প্রতি সন্দেহের এই প্রথম কারণ। যবে সত্যভামা নিজে রুক্মিণীর ন্যায় মধ্যে মধ্যে কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত বটে। তাঁহার বিবাহবৃত্তান্তও সবিস্তারে আলোচনা করা গিয়াছে।
মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে সত্যভামাকে পাওয়া যায়। ঐ পর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত; মহাভারতের বনপর্বের সমালোচনাকালে পাঠক তাহা দেখিতে পাইবেন। ঐখানে দ্রৌপদীসত্যভামা সংবাদ বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পর্বাধ্যায় আছে, তাহাও প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতীয় কথার সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। উহা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিরূপ আচরণ কর্তব্য, তৎসম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধমাত্র। প্রবন্ধটার লক্ষণ আধুনিক।
তার পর উদ্যোগপর্বেও সত্যভামাকে দেখিতে পাই—যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ে। সে স্থানও প্রক্ষিপ্ত, যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ের সমালোচনা কালে দেখাইব। কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বরণ হইয়া উপপ্লব্য নগরে আসিয়াছিলেন—যুদ্ধযাত্রায় সত্যভামাকে সঙ্গে আনিবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সত্যভামা সঙ্গে ছিলেন না, তাহা মহাভারত পড়িলেই জানা যায়। যুদ্ধপর্ব সকলে এবং তৎপরবর্তী পর্ব সকলে কোথাও আর সত্যভামার কথা নাই।
কেবল কৃষ্ণের মানবলীলাসম্বরণের পর, মৌসলপর্বে সত্যভামার নাম আছে। কিন্তু মৌসলপর্বও প্রক্ষিপ্ত, তাহাও পরে দেখাইব।
ফলতঃ মহাভারতের যে সকল অংশ নিঃসন্দেহে মৌলিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, তাহার কোথাও সত্যভামার নাম নাই। প্রক্ষিপ্ত অংশ সকলেই আছে। সত্যভামা সম্বন্ধীয় সন্দেহের এই দ্বিতীয় কারণ।
তার পর বিষ্ণুপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণে ইঁহার বিবাহবৃত্তান্ত স্যমন্তক মণির উপাখ্যানমধ্যে আছে। যে আষাঢ়ে গল্পে কৃষ্ণের সঙ্গে ভল্লুকসুতার পরিণয়, ইঁহার সঙ্গে পরিণয় সেই আষাঢ়ে গল্পে। তার পর কথিত হইয়াছে যে, এই বিবাহের জন্য দ্বেষবিশিষ্ট হইয়া শতধন্বা সত্যভামার পিতা সত্রাজিতকে মারিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে, জতুগৃহদাহপ্রবাদ জন্য পাণ্ডবদিগের অন্বেষণে গিয়াছিলেন। সেইখানে সত্যভামা তাঁহার নিকট নালিশ করিয়া পাঠাইলেন। কথাটা মিথ্যা। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে যান নাই—গেলে মহাভারতে থাকিত। তাহা নাই। এই সকল কথা সন্দেহের তৃতীয় কারণ।
তার পর, বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামাকে কেবল পারিজাতহরণবৃত্তান্তে পাই। সেটা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপার; প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় তাঁহাকে বিষ্ণুপুরাণে কোথাও পাই না। সন্দেহের এই চতুর্থ কারণ।
মহাভারতে আদিপর্বে সম্ভব-পর্বাধ্যায়ে সপ্তষট্টি অধ্যায়ের নাম ‘অংশাবতরণ’। মহাভারতের নায়কনায়িকাগণ কে কোন্ দেব দেবী অসুর রাক্ষসের অংশে জন্মিয়াছিল, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে। শেষ ভাগে লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের অংশ, বলরাম শেষ নাগের অংশ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ, দ্রৌপদী শচীর অংশ, কুন্তী ও মাদ্রী সিদ্ধি ও ধৃতির অংশ। কৃষ্ণমহিষীগণ সম্বন্ধে লেখা আছে যে, কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী অপ্সরাগণের অংশ এবং রুক্মিণী লক্ষ্মী দেবীর অংশ। আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর নাম নাই। সন্দেহের এই পঞ্চম কারণ। সন্দেহের এ কারণ কেবল সত্যভামা সম্বন্ধে নহে। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের সকল প্রধানা মহিষীদিগের প্রতি বর্তে। নরকের ষোড়শ সহস্র কন্যার অনৈসর্গিক কথাটা ছাড়িয়া দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোনও মহিষী ছিল না, ইহাই মহাভারতের এই অংশের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
ভল্লুকদৌহিত্র শাম্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা বাদ দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণীবংশেই রাজা হইল—আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না। এমন হইতেও পারে, ছিল। তখনকার এই রীতিই ছিল। পঞ্চ পাণ্ডবের সকলেরই একাধিক মহিষী ছিল। আদর্শ ধার্মিক ভীষ্ম, কনিষ্ঠ ভ্রাতার জন্য কাশিরাজার তিনটি কন্যা হরণ করিয়া আনিয়াছিলেন। একাধিক বিবাহ যে কৃষ্ণের অনভিমত, এ কথাটাও কোথাও নাই; আমিও বিচারে কোথাও পাই নাই যে, পুরুষের একাধিক বিবাহ সকল অবস্থাতে অধর্ম। ইহা নিশ্চিত বটে যে, সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ন যে, সে কোন মতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তপরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না, তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। আদালতে যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তাহার উদাহরণ আমরা সভ্যতর সমাজে দেখিতে পাইতেছি। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তা বুঝিতে পারি না। ইউরোপ যিহুদার নিকট শিখিয়াছিল যে, কোন অবস্থাতেই দারান্তর গ্রহণ করিতে নাই। যদি ইউরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেন্রীকে কথায় কথায় পত্নীহত্যা করিতে হইত না। ইউরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যাহাই বিলাতী, তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।
কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোন গণনীয় প্রমাণ নাই, ইহা দেখিয়াছি। যদি করিয়া থাকেন, তবে কেন করিয়াছিলেন, তাহারও কোন বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত নাই। যে যে তাঁহাকে স্যমন্তক মণি উপহার দিল, সে সঙ্গে সঙ্গে অমনি একটি কন্যা উপহার দিল, ইহা পিতামহীর উপকথা। আর নরকরাজার ষোল হাজার মেয়ে, ইহা প্রপিতামহীর উপকথা। আমরা শুনিয়া খুসী—বিশ্বাস করিতে পারি না।
————————–
1 বিষ্ণুপুরাণ, ৪ অং, ১৫ অ, ১৯।
1 বিষ্ণুপুরাণ, ৪ অং, ১৫ অ, ১৯।
2 ইঁহারাও প্রধানা অষ্টের ভিতর গণিত হইয়াছেন। ‘তাসামপত্যান্যষ্টানাং ভগবন্ প্রব্রবীতে মে।’ ইহার উত্তরে এ সকল মহিষীর অপত্য কথিত হইতেছে।
# রুক্মিণী ত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্ ||
মৌসলপর্ব, ৭ অধ্যায়।
# রুক্মিণী ত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্ ||
মৌসলপর্ব, ৭ অধ্যায়।
যোহসৌ যুগসহস্রান্তে প্রদীপ্তার্চির্বিভাসুঃ।
সংভক্ষয়তি ভূতানি তস্মৈ ঘোরাত্মনে নমঃ ||
শান্তিপর্ব, ৪৭ অধ্যায়ঃ।
সংভক্ষয়তি ভূতানি তস্মৈ ঘোরাত্মনে নমঃ ||
শান্তিপর্ব, ৪৭ অধ্যায়ঃ।
যদুবংশধ্বংস
তার পর, আশ্রমবাসিক পর্ব। ইহার সঙ্গে কৃষ্ণের কোন সম্বন্ধ নাই। তার পর অতি ভয়াবহ মৌসল পর্ব। ইহাতে সমস্ত যদুবংশের নিঃশেষ ধ্বংস ও কৃষ্ণ বলরামের দেহত্যাগ কথিত হইয়াছে। যদুবংশীয়েরা পরস্পরকে নিহত করিয়াছিলেন। কৃষ্ণ নিজে এই মহাভয়ানক ব্যাপার নিবারণের কোন উপায় করেন নাই—বরং অনেক যাদব তাঁহার হস্তে নিধন প্রাপ্ত হইয়াছিল, এইরূপ কথিত হইয়াছে।
সে বৃত্তান্ত এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে। গান্ধারীকথিত ষট্ত্রিংশৎ বৎসর অতীত হইয়াছে। যাদবেরা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হইয়া উঠিয়াছেন। একদা বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও নারদ, এই লোকবিশ্রুত ঋষিত্রয় দ্বারকায় উপস্থিত। দুর্বিনীত যাদবেরা কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে মেয়ে সাজাইয়া ঋষিদিগের কাছে লইয়া গিয়া বলিলেন, ইনি গর্ভবতী, ইঁহার কি পুত্র হইবে? পুরাণেতিহাসে ঋষিগণ অতি ভয়ানক ক্রোধপরবশ স্বরূপ বর্ণিত হইয়া থাকেন। কথায় কথায় তাঁহাদের অভিসম্পাতের ঘটা দেখিলে তাঁহাদিগকে জিতেন্দ্রিয় ঈশ্বরপরায়ণ ঋষি না বলিয়া, অতি নৃশংস নরপিশাচ বলিয়া গণ্য করিতে হয়। এখনকার দিনে যে কেহ ভদ্রলোক এমন একটা তামাসা হাসিয়া উড়াইয়া দিত; অন্ততঃ একটু তিরস্কারবাক্যই যথেষ্ট হয়। কিন্তু এই জিতেন্দ্রিয় মহর্ষিগণ একেবারে সমস্ত যদুবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন। বলিলেন, লৌহময় মুসল প্রসব করিবে, আর সেই মুসল হইতে কৃষ্ণ বলরাম ভিন্ন সমস্ত যদুবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। কৃষ্ণ এ কথা অবগত হইলেন। তিনি বলিলেন, মুনিগণ যাহা বলিয়াছেন, তাহা অবশ্য হইবে। শাপ নিবারণের কোন উপায় করিলেন না।
অগত্যা শাম্ব, পুরুষই হউক আর যাই হউক, এক লোহার মুসল প্রসব করিল। যাদবগণের রাজা (কৃষ্ণ রাজা নহেন, উগ্রসেন রাজা বা প্রধান) ঐ মুসল চূর্ণ
করিতে আজ্ঞা দিলেন। মুসল চূর্ণ হইল—চূর্ণসকল সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইল। এদিকে যাদবগণ সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করিলেন। তখন কৃষ্ণ তাঁহাদিগের “বিনাশ বাসনায়” যাদবগণকে প্রভাসতীর্থে যাত্রা করিতে বলিলেন।
প্রভাসে আসিয়া, যাদবগণ সুরাপান করিয়া নানাবিধ উৎসব করিতে লাগিল। শেষে পরস্পর কলহ আরম্ভ করিল। কুরুক্ষেত্রের মহারথী সাত্যকি প্রথম বিবাদ আরম্ভ করিলেন। তিনি কৃতবর্মার সঙ্গে বিবাদ করিলে প্রদ্যুম্ন সাত্যকির পক্ষাবলম্বন করিলেন। সাত্যকি কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ করিলেন। তখন কৃতবর্মার জ্ঞাতি গোষ্ঠী (যাদবেরা, বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক, কুকুর ইতি ভিন্ন বংশীয়) সাত্যকি ও প্রদ্যুম্নকে নিহত করিল। তখন কৃষ্ণ এক মুষ্টি এরকা (শরগাছ) ক্রুদ্ধ হইয়া গ্রহণ করিলেন। এবং তদ্দ্বারা অনেক যাদব নিপাতিত করিলেন। গ্রন্থান্তরে আছে যে, এই শরগাছ মুসলচূর্ণ, যাহা রাজাজ্ঞানুসারে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। মহাভারতে সে কথাটা পাইলাম না, কিন্তু লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ এরকামুষ্টি গ্রহণ করাতে তাহা মুসলরূপে পরিণত হইল, এবং ইহাও আছে যে, ঐ স্থানের সমুদায় এরকাই ব্রাহ্মণ-শাপে মুসলীভূত হইয়াছিল। যাদবগণ তখন ঐ সকল এরকা গ্রহণপূর্বক পরস্পর নিহত করিতে লাগিল। এইরূপে সমস্ত যাদবগণ পরস্পরকে নিহত করিলেন। তখন দারুক (কৃষ্ণির সারথি) ও বভ্রূ (যাদব) কৃষ্ণকে বলিলেন, “জনার্দন! আপনি এক্ষণে অসংখ্য লোকের প্রাণসংহার করিলেন, অতঃপর চলুন, আমরা মহাত্মা বলভদ্রের নিকট যাই।”
কৃষ্ণ দারুককে হস্তিনায় অর্জুনের নিকট পাঠাইলেন। অর্জুন আসিয়া যাদবদিগের কুলকামিনীগণকে হস্তিনায় লইয়া যাইবে, এইরূপ আজ্ঞা করিলেন। বলরামকে কৃষ্ণ যোগাসনে আসীন দেখিলেন। তাঁহার মুখ হইতে একটি সহস্রমস্তক সর্প নির্গত হইয়া সাগর, নদী, বরুণ, এবং বাসুকি প্রভৃতি অন্য সর্পগণ কর্তৃক স্তুত হইয়া সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিল। বলরামের দেহ জীবনশূন্য হইল। তখন কৃষ্ণ স্বয়ং মর্ত্যলোক ত্যাগ বাসনায় মহাযোগ অবলম্বনপূর্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। জরা নামে ব্যাধ মৃগভ্রমে তাঁহার পাদপদ্ম শরদ্বারা বিদ্ধ করিল। পরে আপনার ভ্রম জানিতে পারিয়া শঙ্কিতমনে কৃষ্ণের চরণে নিপতিত হইল। কৃষ্ণ তাহাকে আশ্বাসিত করিয়া আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
এদিকে অর্জুন দ্বারকায় আসিয়া রামকৃষ্ণাদির ঔর্ধ্বদৈহিক কর্ম সম্পাদন করিয়া যাদবকুলকামিনীগণকে লইয়া হস্তিনায় চলিলেন। পথিমধ্যে দস্যুগণ লাঠি হাতে তাঁহাকে আক্রমণ করিল। যিনি পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন, এবং ভীষ্ম কর্ণের নিহন্তা, তিনি লগুড়ধারী চাষাদিগকে পরাভূত করিতে পারিলেন না। গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। রুক্মিণী, সত্যভামা, হৈমবতী, জাম্ববতী প্রভৃতি কৃষ্ণের প্রধানা মহিষীগণ ভিন্ন আর সকলকেই দস্যুগণ হরণ করিয়া লইয়া গেল।
এই সকল কথা কি মৌলিক? মুসল এরকার অনৈসর্গিক উপন্যাস আমরা পূর্বনিয়মানুসারে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য। কিন্তু তাহা ত্যাগ করিলে যে, প্রাকৃতিক স্থূল কথা কিছু বাকী থাকে, তাহা তত শীঘ্র ত্যাগ করা যায় না। যাদবেরা পানাসক্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ হইয়াছিল; ইহা পূর্বে কথিত হইয়াছে। তাহারা সকলে একবংশীয় নহে; ভিন্ন ভিন্ন বংশীয়, এবং অনেক সময়ে পরস্পর বিরুদ্ধাচারী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বার্ষ্ণেয় সাত্যকি ও কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে, কিন্তু অন্ধক ও ভোজবংশীয় কৃতবর্মা, দুর্যোধনের পক্ষে। তার পর, যাদবদিগের কেহ রাজা ছিল না, উগ্রসেনকে কখন রাজা বলা হইয়া থাকে, কিন্তু যাদবদিগের মধ্যে কেহই রাজা নহেন, ইহাই প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণের গুণাধিক্য হেতু, তিনি যাদবগণের নেতা ছিলেন, কিন্তু তাঁহার অগ্রজ বলরামের সঙ্গে তাঁহার মতভেদ দেখা যায়, এবং শান্তিপর্বে দেখিতে পাই, ভীষ্ম একটি কৃষ্ণনারদসংবাদ বলিতেছেন, তাহাতে কৃষ্ণ নারদের কাছে দুঃখ করিতেছেন যে, তিনি জ্ঞাতিগণের মনোরঞ্জনার্থ বহুতর যত্ন করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এ সকল কথা পূর্বে বলিয়াছি। অতএব, যখন যাদবেরা, পরস্পর বিদ্বেষবিশিষ্ট, স্ব স্ব প্রধান, অত্যন্ত বলদৃপ্ত, দুর্নীতিপরায়ণ, এবং সুরাপাননিরত,* তখন তাঁহারা যে পরস্পর বিবাদ করিয়া যদুকুলক্ষয় করিবেন এবং তন্নিবন্ধন কৃষ্ণ বলরামেরও যে ইচ্ছাধীন বা অনিচ্ছাধীন দেহান্ত হইবে, ইহা অনৈসর্গিক বা অসম্ভব নহে। বোধ হয়, এরূপ একটা কিম্বদন্তী প্রচলিত ছিল, এবং তাহার উপর পুরাণকারগণ যদুবংশধ্বংস স্থাপিত করিয়াছেন। অতএব এ অংশের মৌলিকতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই। তবে কেবল দুই একটা কথা বলা আবশ্যক। লিখিত হইয়াছে যে, যদুবংশধ্বংস নিবারণ জন্য কৃষ্ণ কিছুই করেন নাই, বরং তাহার আনুকূল্যই করিয়াছিলেন। ইহাও যদি সত্য হয়, তাহাতে কৃষ্ণচরিত্রের অসঙ্গতি বা অগৌরব কিছুই দেখি না। আদর্শ মনুষ্য আদর্শ মনুষ্যের উপযুক্ত কাজই করিয়াছিলেন। তাঁহার আত্মীয় বা অনাত্মীয় কেহ নাই—আদর্শ পুরুষের ধর্মই আত্মীয়। যদুবংশীয়েরা যখন অধার্মিক হইয়া উঠিয়াছিল, তখন তাহাদের দণ্ড ও প্রয়োজনীয় স্থলে বিনাশসাধনই তাঁহার কর্তব্য। যিনি জরাসন্ধ প্রভৃতিকে অধর্মাত্মা বলিয়াই বিনষ্ট করিলেন, তিনি যাদবগণকে অধর্মাত্মা দেখিয়া তাহাদের যদি বিনষ্ট না করেন, তবে তিনি ধর্মের বন্ধু নহেন, আত্মীয়গণের বন্ধু, আপনার বন্ধু, ধর্মের পক্ষপাতী নহেন, আপনার পক্ষপাতী, বংশের পক্ষপাতী। আদর্শ ধর্মাত্মা, তাহা হইতে পারেন না—কৃষ্ণও তাহা হয়েন নাই।
কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণটা কতক অনিশ্চিত রহিল। চারি প্রকার কারণ নির্দেশ করা যাইতে পারে।
প্রথম, টাল্বয়স-হুইলরি সম্প্রদায় বলিতে পারেন, কৃষ্ণ, জুলিয়স্ কাইসরের মত, দ্বেষবিশিষ্ট বন্ধুগণ কর্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। এরূপ কথা কোন গ্রন্থেই নাই।
দ্বিতীয়, তিনি যোগাবলম্বন করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। পাশ্চাত্য-বৈজ্ঞানিকদিগের শিষ্যগণ যোগাবল্বনে দেহত্যাগের কথাটার বিশ্বাস করিবেন না। আমি নিজে অবিশ্বাসের কারণ দেখি না। যাঁহারা যোগাভ্যাসকালে নিশ্বাস অবরুদ্ধ করা অভ্যাস করিয়াছেন, তাঁহারা নিশ্বাস অবরুদ্ধ করিয়া আপনার মৃত্যু সম্পাদন করিতে পারেন না, এমন কথা আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি না। এরূপ ঘটনা বিশ্বস্তসূত্রে শুনাও গিয়া থাকে। অন্যে বলিতে পারেন, ইহা আত্মহত্যা, সুতরাং পাপ; সুতরাং আদর্শ মনুষ্যের অনাচরণীয়, আমি ঠিক তাহা বলিতে পারি না। প্রাচীন বয়সে, জীবনের কার্য সমস্ত সম্পন্ন হইলে পরে, ঈশ্বরে লীন হইবার জন্য, মনোমধ্যে তন্ময় হইয়া, শ্বাসরোধকে আত্মহত্যা বলিব না, “ঈশ্বরপ্রাপ্তি” বলিব? সেটা বিচারস্থল। আত্মহত্যা মহাপাপ স্বীকার করি, জীবনশেষে যোগবলে প্রাণত্যাগও কি তাই?
তৃতীয়, জরাব্যাধের শরাঘাত।
চতুর্থ, এই সময়ে কৃষ্ণের বয়স শত বর্ষের অধিক হইয়াছিল, বলিয়া বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছিল। এই জরাব্যাধ, জরাব্যাধি নয় ত?
যাঁহারা কৃষ্ণকে মনুষ্যমাত্র বিবেচনা করিয়া তাঁহার ঈশ্বরত্ব স্বীকার করেন না, তাঁহারা এই চারিটি মতের যে কোনটি গ্রহণ করিতে পারেন। আমি কৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করি। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণ। আমার মতে ইহা বটে যে, জগতে মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচার তাঁহার ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছা পূরণজন্য তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা সকল কর্ম নির্বাহ করেন, কিন্তু তাহা বলিলেও ঈশ্বরাবতারের জন্মমৃত্যু তাঁহার ইচ্ছাধীন মাত্র বলিতে হইবে। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের একমাত্র কারণ।
মৌসলপর্ব মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত কি না, তাহার আমি বিচার করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই, বলিয়া সমালোচনা করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই কেন, তাহাও বলিয়াছি। স্থূল ঘটনাটা কতক সত্য বলিয়াই বোধ হয়। তবে তাহা হইলেও, ইহা মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত নহে বলিয়াই বোধ হয়। যাহা পুরাণ ও হরিবংশে আছে, কৃষ্ণজীবনঘটিত এমন আর কোন ঘটনাই মহাভারতে নাই। একটিই কেবল পুরাণাদিতেও আছে, হরিবংশেও আছে, মহাভারতেও আছে। পাণ্ডবদিগের সম্বন্ধে যাহা কিছু কৃষ্ণ করিয়াছিলেন, তাহা ভিন্ন আর কোন কৃষ্ণবৃত্তান্ত মহাভারতে নাই ও থাকিবার সম্ভাবনা নাই। এইটিই কেবল সে নিয়মবহির্ভূত। কৃষ্ণ এখানে ঈশ্বরাবতার, এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের চিহ্ন পূর্বে বলিয়াছি। এরূপ বিবেচনা করিবার অন্যান্য হেতুও নির্দেশ করা যাইতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনাভাব। তবে, ইহা বলা কর্তব্য যে, অনুক্রমণিকাধ্যায়ে মৌসলপর্বের কোন প্রসঙ্গই নাই। পরীক্ষিতের জন্মবৃত্তান্তের পরবর্তী কোন কথাই অনুক্রমণিকাধ্যায়ে নাই। আমার বিবেচনায় পরীক্ষিতের জন্মই আদিম মহাভারতের শেষ। তার পরবর্তী যে সকল কথা, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের।
সে বৃত্তান্ত এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে। গান্ধারীকথিত ষট্ত্রিংশৎ বৎসর অতীত হইয়াছে। যাদবেরা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হইয়া উঠিয়াছেন। একদা বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও নারদ, এই লোকবিশ্রুত ঋষিত্রয় দ্বারকায় উপস্থিত। দুর্বিনীত যাদবেরা কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে মেয়ে সাজাইয়া ঋষিদিগের কাছে লইয়া গিয়া বলিলেন, ইনি গর্ভবতী, ইঁহার কি পুত্র হইবে? পুরাণেতিহাসে ঋষিগণ অতি ভয়ানক ক্রোধপরবশ স্বরূপ বর্ণিত হইয়া থাকেন। কথায় কথায় তাঁহাদের অভিসম্পাতের ঘটা দেখিলে তাঁহাদিগকে জিতেন্দ্রিয় ঈশ্বরপরায়ণ ঋষি না বলিয়া, অতি নৃশংস নরপিশাচ বলিয়া গণ্য করিতে হয়। এখনকার দিনে যে কেহ ভদ্রলোক এমন একটা তামাসা হাসিয়া উড়াইয়া দিত; অন্ততঃ একটু তিরস্কারবাক্যই যথেষ্ট হয়। কিন্তু এই জিতেন্দ্রিয় মহর্ষিগণ একেবারে সমস্ত যদুবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন। বলিলেন, লৌহময় মুসল প্রসব করিবে, আর সেই মুসল হইতে কৃষ্ণ বলরাম ভিন্ন সমস্ত যদুবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। কৃষ্ণ এ কথা অবগত হইলেন। তিনি বলিলেন, মুনিগণ যাহা বলিয়াছেন, তাহা অবশ্য হইবে। শাপ নিবারণের কোন উপায় করিলেন না।
অগত্যা শাম্ব, পুরুষই হউক আর যাই হউক, এক লোহার মুসল প্রসব করিল। যাদবগণের রাজা (কৃষ্ণ রাজা নহেন, উগ্রসেন রাজা বা প্রধান) ঐ মুসল চূর্ণ
করিতে আজ্ঞা দিলেন। মুসল চূর্ণ হইল—চূর্ণসকল সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইল। এদিকে যাদবগণ সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করিলেন। তখন কৃষ্ণ তাঁহাদিগের “বিনাশ বাসনায়” যাদবগণকে প্রভাসতীর্থে যাত্রা করিতে বলিলেন।
প্রভাসে আসিয়া, যাদবগণ সুরাপান করিয়া নানাবিধ উৎসব করিতে লাগিল। শেষে পরস্পর কলহ আরম্ভ করিল। কুরুক্ষেত্রের মহারথী সাত্যকি প্রথম বিবাদ আরম্ভ করিলেন। তিনি কৃতবর্মার সঙ্গে বিবাদ করিলে প্রদ্যুম্ন সাত্যকির পক্ষাবলম্বন করিলেন। সাত্যকি কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ করিলেন। তখন কৃতবর্মার জ্ঞাতি গোষ্ঠী (যাদবেরা, বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক, কুকুর ইতি ভিন্ন বংশীয়) সাত্যকি ও প্রদ্যুম্নকে নিহত করিল। তখন কৃষ্ণ এক মুষ্টি এরকা (শরগাছ) ক্রুদ্ধ হইয়া গ্রহণ করিলেন। এবং তদ্দ্বারা অনেক যাদব নিপাতিত করিলেন। গ্রন্থান্তরে আছে যে, এই শরগাছ মুসলচূর্ণ, যাহা রাজাজ্ঞানুসারে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। মহাভারতে সে কথাটা পাইলাম না, কিন্তু লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ এরকামুষ্টি গ্রহণ করাতে তাহা মুসলরূপে পরিণত হইল, এবং ইহাও আছে যে, ঐ স্থানের সমুদায় এরকাই ব্রাহ্মণ-শাপে মুসলীভূত হইয়াছিল। যাদবগণ তখন ঐ সকল এরকা গ্রহণপূর্বক পরস্পর নিহত করিতে লাগিল। এইরূপে সমস্ত যাদবগণ পরস্পরকে নিহত করিলেন। তখন দারুক (কৃষ্ণির সারথি) ও বভ্রূ (যাদব) কৃষ্ণকে বলিলেন, “জনার্দন! আপনি এক্ষণে অসংখ্য লোকের প্রাণসংহার করিলেন, অতঃপর চলুন, আমরা মহাত্মা বলভদ্রের নিকট যাই।”
কৃষ্ণ দারুককে হস্তিনায় অর্জুনের নিকট পাঠাইলেন। অর্জুন আসিয়া যাদবদিগের কুলকামিনীগণকে হস্তিনায় লইয়া যাইবে, এইরূপ আজ্ঞা করিলেন। বলরামকে কৃষ্ণ যোগাসনে আসীন দেখিলেন। তাঁহার মুখ হইতে একটি সহস্রমস্তক সর্প নির্গত হইয়া সাগর, নদী, বরুণ, এবং বাসুকি প্রভৃতি অন্য সর্পগণ কর্তৃক স্তুত হইয়া সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিল। বলরামের দেহ জীবনশূন্য হইল। তখন কৃষ্ণ স্বয়ং মর্ত্যলোক ত্যাগ বাসনায় মহাযোগ অবলম্বনপূর্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। জরা নামে ব্যাধ মৃগভ্রমে তাঁহার পাদপদ্ম শরদ্বারা বিদ্ধ করিল। পরে আপনার ভ্রম জানিতে পারিয়া শঙ্কিতমনে কৃষ্ণের চরণে নিপতিত হইল। কৃষ্ণ তাহাকে আশ্বাসিত করিয়া আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
এদিকে অর্জুন দ্বারকায় আসিয়া রামকৃষ্ণাদির ঔর্ধ্বদৈহিক কর্ম সম্পাদন করিয়া যাদবকুলকামিনীগণকে লইয়া হস্তিনায় চলিলেন। পথিমধ্যে দস্যুগণ লাঠি হাতে তাঁহাকে আক্রমণ করিল। যিনি পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন, এবং ভীষ্ম কর্ণের নিহন্তা, তিনি লগুড়ধারী চাষাদিগকে পরাভূত করিতে পারিলেন না। গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। রুক্মিণী, সত্যভামা, হৈমবতী, জাম্ববতী প্রভৃতি কৃষ্ণের প্রধানা মহিষীগণ ভিন্ন আর সকলকেই দস্যুগণ হরণ করিয়া লইয়া গেল।
এই সকল কথা কি মৌলিক? মুসল এরকার অনৈসর্গিক উপন্যাস আমরা পূর্বনিয়মানুসারে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য। কিন্তু তাহা ত্যাগ করিলে যে, প্রাকৃতিক স্থূল কথা কিছু বাকী থাকে, তাহা তত শীঘ্র ত্যাগ করা যায় না। যাদবেরা পানাসক্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ হইয়াছিল; ইহা পূর্বে কথিত হইয়াছে। তাহারা সকলে একবংশীয় নহে; ভিন্ন ভিন্ন বংশীয়, এবং অনেক সময়ে পরস্পর বিরুদ্ধাচারী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বার্ষ্ণেয় সাত্যকি ও কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে, কিন্তু অন্ধক ও ভোজবংশীয় কৃতবর্মা, দুর্যোধনের পক্ষে। তার পর, যাদবদিগের কেহ রাজা ছিল না, উগ্রসেনকে কখন রাজা বলা হইয়া থাকে, কিন্তু যাদবদিগের মধ্যে কেহই রাজা নহেন, ইহাই প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণের গুণাধিক্য হেতু, তিনি যাদবগণের নেতা ছিলেন, কিন্তু তাঁহার অগ্রজ বলরামের সঙ্গে তাঁহার মতভেদ দেখা যায়, এবং শান্তিপর্বে দেখিতে পাই, ভীষ্ম একটি কৃষ্ণনারদসংবাদ বলিতেছেন, তাহাতে কৃষ্ণ নারদের কাছে দুঃখ করিতেছেন যে, তিনি জ্ঞাতিগণের মনোরঞ্জনার্থ বহুতর যত্ন করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এ সকল কথা পূর্বে বলিয়াছি। অতএব, যখন যাদবেরা, পরস্পর বিদ্বেষবিশিষ্ট, স্ব স্ব প্রধান, অত্যন্ত বলদৃপ্ত, দুর্নীতিপরায়ণ, এবং সুরাপাননিরত,* তখন তাঁহারা যে পরস্পর বিবাদ করিয়া যদুকুলক্ষয় করিবেন এবং তন্নিবন্ধন কৃষ্ণ বলরামেরও যে ইচ্ছাধীন বা অনিচ্ছাধীন দেহান্ত হইবে, ইহা অনৈসর্গিক বা অসম্ভব নহে। বোধ হয়, এরূপ একটা কিম্বদন্তী প্রচলিত ছিল, এবং তাহার উপর পুরাণকারগণ যদুবংশধ্বংস স্থাপিত করিয়াছেন। অতএব এ অংশের মৌলিকতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই। তবে কেবল দুই একটা কথা বলা আবশ্যক। লিখিত হইয়াছে যে, যদুবংশধ্বংস নিবারণ জন্য কৃষ্ণ কিছুই করেন নাই, বরং তাহার আনুকূল্যই করিয়াছিলেন। ইহাও যদি সত্য হয়, তাহাতে কৃষ্ণচরিত্রের অসঙ্গতি বা অগৌরব কিছুই দেখি না। আদর্শ মনুষ্য আদর্শ মনুষ্যের উপযুক্ত কাজই করিয়াছিলেন। তাঁহার আত্মীয় বা অনাত্মীয় কেহ নাই—আদর্শ পুরুষের ধর্মই আত্মীয়। যদুবংশীয়েরা যখন অধার্মিক হইয়া উঠিয়াছিল, তখন তাহাদের দণ্ড ও প্রয়োজনীয় স্থলে বিনাশসাধনই তাঁহার কর্তব্য। যিনি জরাসন্ধ প্রভৃতিকে অধর্মাত্মা বলিয়াই বিনষ্ট করিলেন, তিনি যাদবগণকে অধর্মাত্মা দেখিয়া তাহাদের যদি বিনষ্ট না করেন, তবে তিনি ধর্মের বন্ধু নহেন, আত্মীয়গণের বন্ধু, আপনার বন্ধু, ধর্মের পক্ষপাতী নহেন, আপনার পক্ষপাতী, বংশের পক্ষপাতী। আদর্শ ধর্মাত্মা, তাহা হইতে পারেন না—কৃষ্ণও তাহা হয়েন নাই।
কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণটা কতক অনিশ্চিত রহিল। চারি প্রকার কারণ নির্দেশ করা যাইতে পারে।
প্রথম, টাল্বয়স-হুইলরি সম্প্রদায় বলিতে পারেন, কৃষ্ণ, জুলিয়স্ কাইসরের মত, দ্বেষবিশিষ্ট বন্ধুগণ কর্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। এরূপ কথা কোন গ্রন্থেই নাই।
দ্বিতীয়, তিনি যোগাবলম্বন করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। পাশ্চাত্য-বৈজ্ঞানিকদিগের শিষ্যগণ যোগাবল্বনে দেহত্যাগের কথাটার বিশ্বাস করিবেন না। আমি নিজে অবিশ্বাসের কারণ দেখি না। যাঁহারা যোগাভ্যাসকালে নিশ্বাস অবরুদ্ধ করা অভ্যাস করিয়াছেন, তাঁহারা নিশ্বাস অবরুদ্ধ করিয়া আপনার মৃত্যু সম্পাদন করিতে পারেন না, এমন কথা আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি না। এরূপ ঘটনা বিশ্বস্তসূত্রে শুনাও গিয়া থাকে। অন্যে বলিতে পারেন, ইহা আত্মহত্যা, সুতরাং পাপ; সুতরাং আদর্শ মনুষ্যের অনাচরণীয়, আমি ঠিক তাহা বলিতে পারি না। প্রাচীন বয়সে, জীবনের কার্য সমস্ত সম্পন্ন হইলে পরে, ঈশ্বরে লীন হইবার জন্য, মনোমধ্যে তন্ময় হইয়া, শ্বাসরোধকে আত্মহত্যা বলিব না, “ঈশ্বরপ্রাপ্তি” বলিব? সেটা বিচারস্থল। আত্মহত্যা মহাপাপ স্বীকার করি, জীবনশেষে যোগবলে প্রাণত্যাগও কি তাই?
তৃতীয়, জরাব্যাধের শরাঘাত।
চতুর্থ, এই সময়ে কৃষ্ণের বয়স শত বর্ষের অধিক হইয়াছিল, বলিয়া বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছিল। এই জরাব্যাধ, জরাব্যাধি নয় ত?
যাঁহারা কৃষ্ণকে মনুষ্যমাত্র বিবেচনা করিয়া তাঁহার ঈশ্বরত্ব স্বীকার করেন না, তাঁহারা এই চারিটি মতের যে কোনটি গ্রহণ করিতে পারেন। আমি কৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করি। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণ। আমার মতে ইহা বটে যে, জগতে মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচার তাঁহার ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছা পূরণজন্য তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা সকল কর্ম নির্বাহ করেন, কিন্তু তাহা বলিলেও ঈশ্বরাবতারের জন্মমৃত্যু তাঁহার ইচ্ছাধীন মাত্র বলিতে হইবে। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের একমাত্র কারণ।
মৌসলপর্ব মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত কি না, তাহার আমি বিচার করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই, বলিয়া সমালোচনা করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই কেন, তাহাও বলিয়াছি। স্থূল ঘটনাটা কতক সত্য বলিয়াই বোধ হয়। তবে তাহা হইলেও, ইহা মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত নহে বলিয়াই বোধ হয়। যাহা পুরাণ ও হরিবংশে আছে, কৃষ্ণজীবনঘটিত এমন আর কোন ঘটনাই মহাভারতে নাই। একটিই কেবল পুরাণাদিতেও আছে, হরিবংশেও আছে, মহাভারতেও আছে। পাণ্ডবদিগের সম্বন্ধে যাহা কিছু কৃষ্ণ করিয়াছিলেন, তাহা ভিন্ন আর কোন কৃষ্ণবৃত্তান্ত মহাভারতে নাই ও থাকিবার সম্ভাবনা নাই। এইটিই কেবল সে নিয়মবহির্ভূত। কৃষ্ণ এখানে ঈশ্বরাবতার, এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের চিহ্ন পূর্বে বলিয়াছি। এরূপ বিবেচনা করিবার অন্যান্য হেতুও নির্দেশ করা যাইতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনাভাব। তবে, ইহা বলা কর্তব্য যে, অনুক্রমণিকাধ্যায়ে মৌসলপর্বের কোন প্রসঙ্গই নাই। পরীক্ষিতের জন্মবৃত্তান্তের পরবর্তী কোন কথাই অনুক্রমণিকাধ্যায়ে নাই। আমার বিবেচনায় পরীক্ষিতের জন্মই আদিম মহাভারতের শেষ। তার পরবর্তী যে সকল কথা, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের।
————————-
* যাদবেরা এমন মদ্যাসক্ত ছিলেন যে, কৃষ্ণ বলরাম ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, দ্বারকায় যে সুরা প্রস্তুত করিবে, তাহাকে শূলে দিব। আমি পাশ্চাত্য রাজপুরুষগণকে এই নীতির অনুবর্তী হইতে বলিতে ইচ্ছা করি।
* যাদবেরা এমন মদ্যাসক্ত ছিলেন যে, কৃষ্ণ বলরাম ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, দ্বারকায় যে সুরা প্রস্তুত করিবে, তাহাকে শূলে দিব। আমি পাশ্চাত্য রাজপুরুষগণকে এই নীতির অনুবর্তী হইতে বলিতে ইচ্ছা করি।
উপসংহার
সমালোচকের কার্য প্রয়োজনানুসারে দ্বিবিধ;—এক প্রাচীন কুসংস্কারের নিরাস; অপর সত্যের সংগঠন। কৃষ্ণচরিত্রে প্রথমোক্ত কার্যই প্রধান; এজন্য আমাদিগের সময় ও চেষ্টা সেই দিকেই বেশী গিয়াছে। কৃষ্ণের চরিত্রে সত্যের নূতন সংগঠন করা অতি দুরূহ ব্যাপার, কেন না, মিথ্যা ও অতিপ্রকৃত উপন্যাসের ভস্মে অগ্নি এখানে এরূপ আচ্ছাদিত যে, তাহার সন্ধান পাওয়া ভার। যে উপাদানে গড়িয়া প্রকৃত কৃষ্ণচরিত্র পুনঃ সংস্থাপিত করিব, তাহা মিথ্যার সাগরে ডুবিয়া গিয়াছে। আমার যত দূর সাধ্য, তত দূর আমি গড়িলাম।
উপসংহারে দেখা কর্তব্য যে, যতটুকু সত্য পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায়, ততটুকুতে কৃষ্ণচরিত্র কিরূপ প্রতিপন্ন হইল।
উপসংহারে দেখা কর্তব্য যে, যতটুকু সত্য পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায়, ততটুকুতে কৃষ্ণচরিত্র কিরূপ প্রতিপন্ন হইল।
দেখিয়াছি, বাল্যে কৃষ্ণ শারীরিক বলে আদর্শ বলবান্। তাঁহার অশিক্ষিত বলপ্রভাবে বৃন্দাবন হিংস্রজন্তু প্রভৃতি হইতে সুরক্ষিত হইত। তাঁহার অশিক্ষিত বলেও কংসের মল্ল প্রভৃতি নিহত হইয়াছিল। গোচারণকালে গোপালগণের সঙ্গে সর্বদা ক্রীড়া ও ব্যায়ামাদিতে তিনি শারীরিক বলের স্ফূর্তি জন্মাইয়াছিলেন। দেখিয়াছি, দ্রুতগমনে কালযবনও তাঁহাকে পারেন নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁহার রথসঞ্চালনবিদ্যার বিশেষ প্রশংসা দেখা যায়।
এই বল শিক্ষিত হইলে, তিনি সে সময়ের ক্ষত্রিয়সমাজে সর্বপ্রধান অস্ত্রবিৎ বলিয়া গণ্য হইয়াছিলেন। কেহ কখন তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারেন নাই। তিনি কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি সে সময়ের সর্বপ্রধান যোদ্ধৃগণের সঙ্গে, এবং অন্যান্য বহুতর রাজগণের সঙ্গে,—কাশী, কলিঙ্গ, পৌণ্ড্রক, গান্ধার প্রভৃতি রাজাদিগের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সকলকেই পরাভূত করিয়াছিলেন, কেহ কখন তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারেন নাই। তাঁহার যুদ্ধশিষ্যেরা, যথা—সাত্যকি ও অভিমন্যু যুদ্ধে প্রায় অপরাজেয় হইয়াছিলেন। স্বয়ং অর্জুনও তাঁহার নিকট কোন কোন বিষয়ে যুদ্ধ সম্বন্ধে শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন।
কেবল শারীরিক বলের ও শিক্ষার উপর যে রণপটুতা নির্ভর করে, পুরাণেতিহাসে তাহারই প্রশংসা দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেরূপ রণপটুতা একজন সামান্য সৈনিকেরও থাকিতে পারে। সৈনাপত্যই যোদ্ধার প্রকৃত গুণ। সৈনাপত্যে সে সময়ের যোদ্ধৃগণ পটু ছিলেন না। মহাভারতে বা পুরাণে কাহারও সে গুণের বড় পরিচয় পাই না, ভীষ্মের বা অর্জুনেরও নহে। কৃষ্ণের সৈনাপত্যের বিশেষ কিছু পরিচয় পাওয়া যায়, জরাসন্ধযুদ্ধে। তাঁহার সৈনাপত্য গুণে ক্ষুদ্রা যাদবসেনা জরাসন্ধের সংখ্যাতীত সেনা মথুরা হইতে বিমুখ করিয়াছিল। সেই অগণনীয়া সেনার ক্ষয়, যাদবসেনার দ্বারা অসাধ্য জানিয়া মথুরা পরিত্যাগ, নূতন নগরীর নির্মাণার্থ সাগরদ্বীপ দ্বারকার নির্বাচন, এবং তাহার সম্মুখস্থ রৈবতক পর্বতমালায় দুর্ভেদ্য দুর্গশ্রেণীনির্মাণ যে রণনীতিজ্ঞতার পরিচয়, সেরূপ পরিচয় পুরাণেতিহাসে কোন ক্ষত্রিয়েরই পাওয়া যায় না। পুরাণকার ঋষিদিগের ইহা অবোধগম্য—অতএব ইহাও এক অন্যতর প্রমাণ যে, কৃষ্ণেতিহাস তাঁহাদের কল্পনামাত্রপ্রসূত নহে।
শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকলও চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত, তাহারও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। তিনি অদ্বিতীয় বেদজ্ঞ, ইহাই ভীষ্ম তাঁহার অর্ঘপ্রাপ্তির অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। শিশুপাল সে কথার অন্য উত্তর দেন নাই, কেবল ইহাই বলিয়াছিলেন যে, তবে বেদব্যাস থাকিতে কৃষ্ণের পূজা কেন?
কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকল যে চরমোৎকর্ষ প্রাপ্ত হইয়াছিল, কৃষ্ণপ্রচারিত ধর্মই ইহার তীব্রোজ্জ্বল প্রমাণ। এই ধর্ম যে কেবল গীতাতেই পাওয়া যায়, এমত নহে, মহাভারতের অন্য স্থানেও পাওয়া যায়, ইহা দেখিয়াছি। কৃষ্ণকথিত ধর্মের অপেক্ষা উন্নত, সর্বলোকহিতকর, সর্বজনের আচরণীয় ধর্ম আর কখন পৃথিবীতে প্রচারিত হয় নাই, ইহা গ্রন্থান্তরে বলিয়াছি। এই ধর্মে যে জ্ঞানের পরিচয় দেয়, তাহা প্রায় মনুষ্যাতীত। কৃষ্ণ মানুষী শক্তির দ্বারা সকল কার্য সিদ্ধ করেন, ইহা আমি পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি ও প্রমাণীকৃত করিতেছি। কেবল এই গীতায়, শ্রীকৃষ্ণ প্রায় অনন্ত জ্ঞানের আশ্রয় লইয়াছেন।
সর্বজনীন ধর্ম হইতে অবতরণ করিয়া রাজধর্মে বা রাজনীতি সম্বন্ধেও দেখিতে পাই যে, কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তি সকল চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্ভ্রান্ত রাজনীতিজ্ঞ বলিয়াই যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের পরামর্শ পাইয়াও কৃষ্ণের পরামর্শ ব্যতীত রাজসূয় যজ্ঞে হস্তার্পণ করিলেন না। অবাধ্য যাদবেরা এবং বাধ্য পাণ্ডবেরা তাঁহাকে না জিজ্ঞাসা করিয়া কিছু করিতেন না। জরাসন্ধকে নিহত করিয়া, কারারুদ্ধ রাজগণকে মুক্ত করা, উন্নত রাজনীতির অতি উৎকৃষ্ট উদাহরণ— সাম্রাজ্য স্থাপনের অল্পায়াসসাধ্য অথচ পরম ধর্ম্য উপায়। ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের পর, ধর্মরাজ্য শাসনের জন্য রাজধর্মনিয়োগ ভীষ্মের দ্বারা রাজব্যবস্থা সংস্থাপন করান, রাজনীতিজ্ঞতার দ্বিতীয় অতিপ্রশংসীয় উদাহরণ। আরও অনেক উদাহরণ পাঠক পাইয়াছেন।
কৃষ্ণের বুদ্ধি, চরম স্ফূর্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া, তাহা সর্বব্যাপিনী, সর্বদর্শিনী, সকল প্রকার উপায়ের উদ্ভাবিনী, ইহা আমরা পুনঃ পুনঃ দেখিয়াছি। মনুষ্যশরীর ধারণ করিয়া যত দূর সর্বজ্ঞ হওয়া যায়, কৃষ্ণ তত দূর সর্বজ্ঞ। অপূর্ব অধ্যাত্মতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব, যাহার উপরে আজিও মনুষ্যবুদ্ধি আর যায় নাই, তাহা হইতে চিকিৎসাবিদ্যা ও সঙ্গীতবিদ্যা এমন কি, অশ্বপরিচর্যা পর্যন্ত তাঁহার আয়ত্ত ছিল। উত্তরার মৃত পুত্রের পুনর্জীবন একের উদাহরণ; বিখ্যাত বংশীবিদ্যা দ্বিতীয়ের, এবং জয়দ্রথবধের দিবসে অশ্বের শল্যোদ্ধার তৃতীয়ের উদাহরণ।
কৃষ্ণের কার্যকারিণী বৃত্তি সকলও চরমস্ফূর্তিপ্রাপ্ত। তাঁহার সাহস, ক্ষিপ্রকারিতা, এবং সর্বকর্মে তৎপরতার অনেক পরিচয় দিয়াছি। তাঁহার ধর্ম এবং সত্য যে অবিচলিত, এই গ্রন্থে তাহার প্রমাণ পরিপূর্ণ। সর্বজনে দয়া ও প্রীতিই এই ইতিহাসে পরিস্ফুট হইয়াছে। বলদৃপ্তগণের অপেক্ষা বলবান্ হইয়াও লেকাহিতার্থ তিনি শান্তির জন্য দৃঢ়যত্ন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সর্বলোকহিতৈষী, কেবল মনুষ্যের নহে—গোবৎসাদি তির্যক্ যোনির প্রতিও তাঁহার দয়া। গিরিযজ্ঞে তাহা পরিস্ফুট। ভাগবতকারকথিত বাল্যকালে বানরদিগের জন্য নবনীত চুরির এবং ফলবিক্রেত্রীর কথা কতদূর কিম্বদন্তীমূলক, বলা যায় না। কিন্তু যিনি গোবৎসের উত্তম ভোজন জন্য ইন্দ্রযজ্ঞ বন্ধ করাইলেন, ইহাও তাঁহার চরিত্রানুমোদিত। তিনি আত্মীয় স্বজন জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কিরূপ হিতৈষী, তাহা দেখিয়াছি, কিন্তু ইহাও দেখিয়াছি, আত্মীয় পাপাচারী হইলে তিনি তাহার শত্রু। তাঁহার অপরিসীম ক্ষমাগুণ দেখিয়াছি, আবার ইহাও দেখিয়াছি যে, সময় উপস্থিত দেখিলে তিনি অযোনির্মিত হৃদয়ে অকুণ্ঠিতভাবে দণ্ডবিধান করেন। তিনি স্বজনপ্রিয়, কিন্তু লেকাহিতার্থে স্বজনের বিনাশেও তিনি কুণ্ঠিত হইতেন না। কংস মাতুল; পাণ্ডবেরা যাহা, শিশুপালও তাহা;—পিতৃষ্বসার পুত্র; উভয়কেই দণ্ডিত করিলেন; তারপর, পরিশেষে স্বয়ং যাদবেরা সুরাপায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণ হইলেও, তাহাদিগকেও রক্ষা করিলেন না।
এই সকল শ্রেষ্ঠ বৃত্তি কৃষ্ণে চরম স্ফূর্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলনে তিনি অপরাঙ্মুখ ছিলেন না, কেন না, তিনি আদর্শ মনুষ্য। যে জন্য বৃন্দাবন ব্রজলীলা, পরিণত বয়সে সেই উদ্দেশ্যে সমুদ্রবিহার, যমুনাবিহার, রৈবতক-বিহার। তাহার বিস্তারিত বর্ণনা আবশ্যক বিবেচনা করি নাই।
কেবল একটা কথা এখন বাকি আছে। ধর্মতত্ত্বে বলিয়াছি, ভক্তিই মনুষ্যের প্রধানা বৃত্তি। কৃষ্ণ আদর্শ মনুষ্য, মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচারের জন্য অবতীর্ণ—তাঁহার ভক্তির স্ফূর্তি দেখিলাম কই। কিন্তু যদি তিনি ঈশ্বরাবতার হয়েন, তবে তাঁহার এই ভক্তির পাত্র কে? তিনি নিজে।* নিজের প্রতি যে ভক্তি, সে কেবল আপনাকে পরমাত্মা হইতে অভিন্ন হইলেই উপস্থিত হয়। ইহা জ্ঞানমার্গের চরম। ইহাকে আত্মরতি বলে। ছান্দোগ্য উপনিষদে উহা এইরূপ কথিত হইয়াছে—“য এবং পশ্যন্বেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড় ভবতীতি।”
“যে ইহা দেখিয়া, ইহা ভাবিয়া, ইহা জানিয়া, আত্মায় রত হয়, আত্মাতেই ক্রীড়াশীল হয়, আত্মাই যাহার মিথুন (সহচর), আত্মাই যাহার আনন্দ, সে স্বরাট্।”
ইহাই গীতায় ব্যাখ্যাত হইয়াছে, কৃষ্ণ আত্মারাম; আত্মা জগন্ময়; তিনি সেই জগতে প্রীতি-বিশিষ্ট। পরমাত্মার আত্মরতি আর কোন প্রকার বুঝিতে পারি না। অন্ততঃ আমি বুঝাইতে পারি না।
উপসংহারের বক্তব্য, কৃষ্ণ সর্বত্র সর্বসময়ে সর্বগুণের অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, পুণ্যময়, প্রীতিময়, দয়াময়, অনুষ্ঠেয় কর্মে অপরাঙ্মুখ-ধর্মাত্মা, বেদজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, শাস্তা, নির্মম, নিরহঙ্কার, যোগযুক্ত, তপস্বী। তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা কর্ম নির্বাহ করেন, কিন্তু তাঁহার চরিত্র অমানুষ। এই প্রকার মানুষী শক্তির দ্বারা অতিমানুষ চরিত্রের বিকাশ হইতে তাঁহার মনুষ্যত্ব বা ঈশ্বরত্ব অনুমিত করা বিধেয় কি না, তাহা পাঠক আপন বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে স্থির করিবেন। যিনি মীমাংসা করিবেন যে, কৃষ্ণ মনুষ্যমাত্র ছিলেন, তিনি অন্ততঃ Rhys Davids শাক্যসিংহ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, কৃষ্ণকে তাহাই বলিবেন; “The Wisest and Greatest of the Hindus.” আর যিনি বুঝিবেন যে, এই কৃষ্ণচরিত্রে ঈশ্বরের প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়, তিনি যুক্তকরে, বিনীতভাবে এই গ্রন্থ সমাপনকালে আমার সঙ্গে বলুন—
নাকারণাৎ কারণাদ্বা কারণাকারণান্ন চ।
শরীরগ্রহণং বাপি ধর্মত্রাণায় তে পরম্ ||
——————-
* মহাভারতের যে সকল অংশে তাঁহাকে শিবোপাসক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, তাহা প্রক্ষিপ্তের লক্ষণবিশিষ্ট।
* মহাভারতের যে সকল অংশে তাঁহাকে শিবোপাসক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, তাহা প্রক্ষিপ্তের লক্ষণবিশিষ্ট।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
1 সোহকাময়ত। বহুঃ স্যাং প্রজায়েষেতি।-তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ২ বল্লী, ৬ অনুবাক্।
2 সত্যব্রত সামশ্রমী কৃত অনুবাদ।
3 সর্পমাংসাৎ পশু ব্যাড়ৌ গোভূবাচস্ত্বিড়া ইলা ইত্যমরঃ।
4 কখন কখন এই নাম “আয়ু” লিখিত হইয়াছে।
5 কোন অনুবাদকার অনুবাদে “রাক্ষসী” কথাটা বসাইয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণের মূলে এমন কথা নাই।
2 সত্যব্রত সামশ্রমী কৃত অনুবাদ।
3 সর্পমাংসাৎ পশু ব্যাড়ৌ গোভূবাচস্ত্বিড়া ইলা ইত্যমরঃ।
4 কখন কখন এই নাম “আয়ু” লিখিত হইয়াছে।
5 কোন অনুবাদকার অনুবাদে “রাক্ষসী” কথাটা বসাইয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণের মূলে এমন কথা নাই।
কৃষ্ণচরিত্র-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিঃদ্রঃ শ্রীকৃষ্ণ নিজের পত্মি রুক্মিণীর সাথে হিমালয়ে ১২ বছরের মহান ঘোর ব্রহ্মচর্য ব্রত ধারন করে তপস্যা করেছিলেন। দুইজনে সনত্ কুমারের ন্যায় তেজস্বী পুত্র প্রদ্যুম্ন নামক পুত্র উৎপন্ন করেছিলেন।" (মহাভারতঃ সৌপ্তিক পর্ব, অধ্যায় ১২, শ্লোক ৩০-৩১)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ