বরাহ অবতার কেন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

19 August, 2017

বরাহ অবতার কেন

বরাহ অবতার কেন
প্রথমে দেখে নেব অগ্নিপুরাণে কি লেখা আছে

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নির্দেশে স্বায়ম্ভুব মনুর তিন কন্যা শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে ব্রতী হলেন। কিন্তু আরও সৃষ্টি চাই। ব্রহ্মা মনুকে আরও সৃষ্টির আদেশ করলে তিনি বললেন-হে পিতা প্রলয় সলিলে ত্রিভুবন জল মগ্ন হলে জীব কোথায় গিয়ে ঠাঁই নেবে?

ব্রহ্মা ভাবলেন তাই তো ধরিত্রীকে উদ্ধার করার একটা উপায় বের করতে হয় শ্রীহরি তার নাসারন্ধ্র থেকে এক বরাহ মূর্তির আবির্ভাব করলেন। সেই বরাহ দেখতে দেখতে মহা আকার ধারণ করলেন, তিনি প্রচণ্ড গর্জন করে উঠলেন।

ধরিত্রীর সন্ধানে জলে ডুব দিলেন, ঘ্রাণের সাহায্যে তাকে অবলীলায় নিজের দাঁতের অগ্রভাগ দ্বারা জল থেকে তুলে ধরলেন ধরণিকে।

ভগবান বরাহ দেবের কাজে বাধা দিতে ছুটে এলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যাক্ষ। তিনি তার গদার আঘাতে দৈত্যের বিনাশ ঘটালেন তখন বরাহদেবের গায়ের রং ছিল তখন নীল। ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের বুঝতে দেরি হল না যে ইনিই স্বয়ং শ্রীহরি। সকলে মিলে তখন তাঁর স্তব করতে শুরু করলেন।

একদিন দক্ষ কন্যা দিতি কামশরে পীড়িত হলেন। তিনি স্বামী কশ্যপের কাছে এসে হাজির হলেন। তার কামপীড়া প্রশমিত করার জন্য স্বামীকে আবেদন জানালেন। কিন্তু মহর্ষি কশ্যপ রাজি হলেন না।


 
তিনি দিতিকে নানা ধর্মতত্ত্ব শোনালেন। কিন্তু দিতি নাছোড়বান্দা। অতএব শেষ পর্যন্ত সেই নিষিদ্ধ সন্ধ্যায় মুনি কশ্যপের বীর্য ধারণ করলেন নিজ গর্ভে।

কশ্যপ বললেন-সন্ধ্যাকালে মৈথুন করা নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও তুমি মৈথুনে রত হয়েছ, যেহেতু তোমার চিত্ত পবিত্র ছিল না, তোমার অভিশপ্ত ওই গর্ভ হতে দুটি কুলাঙ্গার পুত্রের জন্ম হবে। তারা ত্রিলোকের সকলের দুঃখের কারণ হবে।

ভগবান শ্রীহরির দ্বারা তাদের বিনাশ হবে। তবে ভগবানের প্রতি এবং স্বামীর প্রতি তোমার অবিচল ভক্তি আছে। যার প্রভাবে তুমি এক নাতি লাভ করবে, যে হবে শ্রীবিষ্ণুর মহান ভক্ত।

স্বামীর মুখে এই কথা শুনে দিতি মনে মনে অত্যন্ত দুঃখ পেল, পরক্ষণেই ভগবতবৎসল নাতির কথা শুনে তার মন খুশি হল। শত বছর ধরে দিতি কশ্যপের বীর্য গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সেই গর্ভের তেজে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল।

ঢাকা পড়ে গেল সূর্য-চন্দ্রের মুখ। দেবতাগণ বিচলিত হলেন, অন্ধকারের কারণ জানতে চেয়ে ব্রহ্মার কাছে দেবতারা ছুটলেন।

ব্রহ্মা বললেন-আমার চারপুত্র সনক, সনদ, সনাতন ও সনকুমার। তারা যোগ শক্তির প্রভাবে চিজগতে বৈকুণ্ঠ লোকে হাজির হয়েছে। তাদের দেখে মনে হয় পাঁচ বছরের বালক, আসলে তাঁরা সমস্ত জীবকুলের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ও আত্মতত্ত্ববেত্তা।


 
তাঁরা দিগম্বর হয়ে স্বর্গের প্রবেশদ্বারে এলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। জয় ও বিজয় নামে দুই প্রহরী তাঁদের ঢুকতে না দিলে তাঁরা রেগে গিয়ে অভিশাপ দিল-তোমরা এই মুহূর্তে দানববংশে জন্ম নেবে।

জয় ও বিজয় তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তারা সেই পাঁচ দিগম্বরের পায়ে পড়ে মাথা কুটতে লাগল। কিন্তু মুখ দিয়ে যা বেরিয়ে গেছে তা তো আর ফেরৎ নেওয়া যায় না। কিন্তু উপায়? স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি মুশকিল আসান হয়ে আবির্ভূত হলেন।

তিনি চতুঃসনকে দর্শন দিলেন এবং বললেন-তোমাদের যথোপযুক্ত অভিশাপ দিয়েছে।

তারপর দুই প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বললেন-তোমরা শান্ত হও। আমার আশীর্বাদে তোমরা আবার এই স্বর্গপুরীর দ্বারী হয়ে ফিরে আসবে।

চতুঃসনকের অভিশাপ শত বছর পরে দিতির গর্ভজাত দুই যমজ পুত্র হয়ে জয় ও বিজয় জন্ম নিল। তাদের ভূমিষ্ঠ ক্ষণে ত্রিভুবন ব্যাপী নানারকম ভীতিপ্রদ ও আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে গেল।

দুই পুত্রের মধ্যে আগে যার জন্ম হল, কশ্যপ তার নাম রাখলেন হিরণ্যাক্ষ আর দিতি যাকে প্রথমে গর্ভে ধারণ করেছিল, তার নাম রাখা হল হিরণ্যকশিপু।


 
কঠোর তপস্যা করে হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বর লাভ করলেন। সেই বরের প্রভাবে সে অত্যন্ত গর্বিত হয়ে উঠল। আর ব্রহ্মার বরে হিরণ্যাক্ষ হল অত্যন্ত পরাক্রমশালী এবং গর্বোদ্ধত। আর হিরণ্যাক্ষ ও ব্রহ্মার বলে অতীব গর্বোদ্ধত হল।

তারা কাজের ওপর মস্ত বড়ো একটা ঢাকা নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের যত্রতত্র বিচরণ করত। তাদের পথ আটকে দাঁড়াবে এমন সাধ্য কার আছে? কাউকে তারা ভয় পেত না। সকলেই তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে, ত্রিভুবন জুড়ে চলেছে তাদের রাজত্ব।

একদিন হিরণ্যাক্ষ সমুদ্রের তলদেশে প্রবেশ করল। বরুণদেবকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানাল।

বরুণদেব বললেন-হে বীর! তোমার যুদ্ধ করার যখন এতই বাসনা তখন আদিপুরুষ ভগবান বরাহদেবের কাছে যাও। তোমার অভিলাষ তিনিই পূর্ণ করবেন।

হিরণক্ষ এলো নারদের কাছে, বরাহদেব কোথায় আছেন? জেনে নিয়ে সে এসে হাজির হন রসাতলে, তখন বাহদেব তার দুটো দাঁতের ওপর পৃথিবীকে ধারণ করে ওপরদিকে তুলে নিয়ে চলেছেন। এ দৃশ্য দেখে দৈত্য হিরণক্ষ অত্যন্ত চটে গেল।

বরাহরূপী শ্রীহরির উদ্দেশ্যে যা নয় তাই বলে গালাগাল দিল। তারপর তাকে আক্রমণ করল।

শুরু হল দুজনের মধ্যে গদাযুদ্ধ। কী ভীষণ সেই যুদ্ধ! এক সময় শ্রীবিষ্ণুর হাত থেকে গদা পড়ে গেল। স্বর্গ থেকে দেবগণ এ যুদ্ধ দেখে আঁতকে উঠলেন। ভগবান এবার সুদর্শন চক্র তুলে নিলেন। হিরণক্ষ গদা ছেড়ে হাতে নিল ত্রিশূল, চক্র এবং ত্রিশূলের মধ্যে যুদ্ধ চলল।


 
এরপর অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুষ্টি যুদ্ধে মেতে উঠলেন। বজ্রকঠোর এক মুষ্টি প্রহার এসে পড়ল দৈত্যের মস্তকে, হিরনাক্ষের মাথা টলে গেল। চোখ বিস্ফারিত হল। তারপর বিশাল এক কাটা গাছের মতো মাটিতে সশব্দে পড়ে গেল।

অসুরকুলজাত দিতি পুত্র হিরণাক্ষকে শ্রীহরি নিজের মূর্তি দর্শন করালেন। হিরণ্যাক্ষের নামের বিনাশ হল, তার নশ্বর দেহটি পড়ে রইল, সে ঠাঁই পেল বৈকুণ্ঠলোকে। ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাগণ বলে উঠলেন-আহা, কী সৌভাগ্যজনক মৃত্যু।

দেবতাগণ এরপর হিরণ্যাক্ষ দৈত্যের সংহারকারী বরাহরূপী শ্রীহরির স্তব করতে শুরু করলেন।

…………………….
অগ্নিপুরাণ
সম্পাদনা – পরিমার্জনা – গ্রন্থনা: পৃথ্বীরাজ সেন

শিল্পকলায় দুভাবে বরাহের চিত্র আঁকা হয়ে থাকে। কখনও তাকে দেখানো হয় সম্পূর্ণ পশুর রূপে; আবার কখনও দেখানো হয় আধা-মানুষ, আধা-পশুর রূপে। দ্বিতীয় রূপটিতে তার চারটি হাত; চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম; এবং বরাহদন্তে ধরা থাকে পৃথিবী। বরাহ অবতার প্রলয়ের পর পৃথিবীর নবজন্ম ও নতুন কল্প প্রতিষ্ঠার প্রতীক। বরাহ পুরাণে বরাহ অবহারের পূর্ণাঙ্গ উপাখ্যান পাওয়া যায়।
পৌরাণিক ভ্রাতাবৃন্দ বেদাদি শাস্ত্রে অবতার অন্বেষণ এ সর্বদাই মগ্ন তাঁরা এ বিষয়ে বেশ কিছু তথাকথিত প্রমাণ দেয় যা নিম্নলিখিত রূপ

শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.১.২.১১ অগ্রে পৃথিবী প্রাদেশ মাত্র ছিল
এমুষ নামক বরাহ তাঁকে উদ্ধার করে


তৈত্তরীয় আরণ্যক ১০.১.৮ (মৃত্তিকা ) তুমি পৃথিবী স্বরূপা ও ধেনু এবং সত্য ও প্রাণী সমূহের ধারণ কর্ত্রী একটি কৃষ্ণ বর্ণ শতবাহু বরাহ তোমাকে উদ্ধার করে



এই স্থলে বাহু = বল(শক্তি)   ,
তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ৬।১।৮ "তস্মাহু বাহুবীর্যো (রাজন্যঃ) বাহুভ্যাং হই সৃষ্টঃ"





শতপথ ৫।৪।১।১৭ বাহুরাজার শক্তির প্রতীক"বীর্যংবাऽএতদ্রাজন্যস্য যদ্ বাহু"

ভাষার্থ : এই পৃথিবীতে বৃষ্টির বহুধারা রূপ শক্তি যুক্ত কালো রং এর মেঘ উদ্ধার করেছে
তৈত্তিরীয় সংহিতা ৭.১.৫ এই জগত প্রথমে সলিলময় ছিল  প্রজাপতি বায়ু রূপ হইয়া তাহাতে বিচরণ করেন এই পৃথিবী দর্শন করিয়া তিনি বরাহ রূপ পরিগ্রহ পূর্ব্বক উদ্ধার করিলেন


 তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১.১.৩ এই জগত অগ্রে সলিলময় ছিল প্রজাপতি সৃষ্টি করিবার ঈক্ষণ করিলেন কিভাবে তাহাতে জগত নির্মিত হইবে  ? তিনি দেখিলেন একটি পদ্মপত্র রহিয়াছে মনে করিলেন নিশ্চয়ই ইহার আধার স্বরূপ কোন বস্তু বিদ্যমান রহিয়াছে তিনি বরাহ রূপ ধারণ করিয়া সলিলে নিমগ্ন হইয়া নিচে পৃথিবী প্রাপ্ত হইলেন ও তাহা লইয়া উত্থিত হইলেন



লক্ষণীয় কোথাও দন্ত দ্বারা পৃথিবী উত্তোলন নেই সায়ণাচার্য ও অন্যান্য অনুবাদকগণ শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনীর আধারে ভাষ্যে দন্ত লিখেছেন

এই প্রজাপতি সূর্য কারণ
য হৈব সবিতা স প্রজাপতি ; শতপথ ১২।৩।৫।১


বরাহ অর্থ মেঘ কারণ বরাহ মেঘৌ ভবতি নিরুক্ত ৫.৪.১





বৈদিক কোষ থেকে বরাহের অর্থ



সুতরাং এই কাহিনীর অর্থ জগতের প্রথমে যখন পৃথিবী জলময় ছিল কিন্তু স্থলভাগ ছিল না তখন সূর্য কিরণ রূপ বল পৃথিবীতে জলের ওপর পড়ে  এই জল ঐ কিরণ তথা বলের প্রভাবে মেঘ রূপ ধারণ করে ফলে স্থলভাগ বা মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় এবং তাতেও জীব সৃষ্টি হয়

আবার প্রজাপতি যজ্ঞও হয় কারণ "যজ্ঞ প্রজাপতি" শত০ ১১।৬।৩।৯




আর যজ্ঞ থেকে মেঘ বৃষ্টি ও জীবাদি সৃষ্টি গীতা সম্মত

अन्नाद्भवन्ति भूतानि पर्जन्यादन्नसम्भवः ।
यज्ञाद्भवति पर्जन्यो यज्ञः कर्मसमुद्भवः ॥
कर्म ब्रह्मोद्भवं विद्धि ब्रह्माक्षरसमुद्भवम् ।
तस्मात्सर्वगतं ब्रह्म नित्यं यज्ञे प्रतिष्ठितम् ॥
एवं प्रवर्तितं चक्रं नानुवर्तयतीह यः ।
अघायुरिन्द्रियारामो मोघं पार्थ स जीवति ॥
অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ।।
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ ।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।

গীতা ৩য় অধ্যায় শ্লোক ১৪-১৫

=>>প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হইতে মেঘ জন্মে, কর্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত; সেই হেতু সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন ।





শ্রী যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি এই বরাহ অবতারের একটি জ্যোতিষপূরক অর্থ করেছেন যা নিম্নলিখিতরূপঃ

কালপুরুষ নক্ষত্র আমরা সকলেই চিনি। ইহাতে ১৩ টি তারা সহজেই প্রত্যক্ষ হয় । 


ইহাকে শ্রাবণ মাসের ভোর ৪ টায়, আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহে রাত ৮ টায় উদিত হতে দেখা যায়। কালপুরুষের ১৩ টি তারা লইয়া বহুবিধ আকারে কল্পিত হইয়াছিল। ঋগ্বেদে এই নক্ষত্র রুদ্রের প্রতিমা। সেখানেই ইনি স্বর্গীয় বরাহ ।



এই বরাহ দিব্য-বরাহ, শ্বেত-বরাহ, যজ্ঞ-বরাহ। তিনি আরণ্য পশু তুল্য ভীম (ভয়ঙ্কর) কালপুরুষের সংস্কৃত নাক মৃগনক্ষত্র। মৃগের মস্তকে তিনটি ছোট ছোট তারা ত্রিকোণাকারে আছে (মৃগশিরা)। চারি পদে চারিটি তারা উজ্জ্বল, সম্মুখ পদের পূর্বদিকে তারা তাম্রবর্ণ (আদ্রা)। কটিতে তিনটি এক তির্ষক রেখায় (ইন্বকা); পুচ্ছে তিনটি; মধ্যরটি এক নভন্য শুভ্র মেঘখন্ডবৎ। এই ১৩ টি তারায় মৃগ ও বরাহের দেহ গঠিত হইয়াছে।





সৃষ্টির পূর্বে জলমগ্ন ছিল। কৃষ্ণ যজুর্বেদে আছে প্রজাপতি বরাহ-রূপ ধারণ করিয়া পৃথিবীকে জল হইতে উত্তোলন করিয়াছিলেন। এখন ইহার অর্থ বুঝিতে হইবে। জল কি, পৃথিবী কি, বরাহ কেমন করিয়া পৃথিবী উত্তোলন করিয়াছিলেন, তাহা বুঝিতে হইবে।

নক্ষত্র-খচিত, আকাশকে ঋষিগণ স্বর্গ বলিতেন। কেমনে স্বর্গ শুন্যে রহিয়াছে? ঋষিগণ বলতেন, বল-শালী ইন্দ্র স্বর্গকে ধারণ করিয়া আছেন। তাঁহারা বিষ্ণুর মহিমার পার দেখিতে পান নাই (ঋ ৭/৯৯)। তিনি বৃহৎ স্বর্গকে উর্ধ্বে ধারণ করিয়া আছেন। তিনি সর্বত্রস্থিত ময়ূখ (খোঁটা) দ্বারা এই পৃথিবীকে ধারণ করিয়া আছেন।

মূলে "পৃথিবী" শব্দ আছে। এই স্থিরা পৃথিবীকে ধারণ করিবার কথা উঠিতে পারে না। এই পৃথিবী শুন্যেও নাই। ঋষিগণ জীও নভোমণ্ডলকে সমুদ্র বলিতেন। পার্থিব সমুদ্র যেমন নীল, আকাশ-সমুদ্রও তেমন নীল। এই আকাশ-সমুদ্র অর্ণব, মহার্ণবন। এই অর্ণব তরণ করে বলিয়াব তারার নাম তারা হইয়াছে। যেমন সমুদ্র দুইটি, একটি মর্ত্যলোকে, অপরটি স্বর্গলোকে, যেমন সরস্বতী দুইটি, একটি মর্ত্যলোকে (নদী) অপরটি স্বর্গলোকে (স্বর্গঙ্গা), তেমনি পৃথিবীও দুইটি, একটি মর্ত্যলোকে আরেকটি স্বর্গলোকে। ঋগ্বেদের পৃথিবী সূক্তে (ঋ ৫/৮৪) এক ঋষি বলিতেছেন, -"হে বিচিত্রগমনশালিনি! স্তোতৃগণ গমনশীল স্ত্রোত্র-দ্বারা তোমার স্তব করেন। হে অর্জুনি, তুমি শব্দায়মান অশ্বের ন্যায় বারিপূর্ণ মেঘকে উৎক্ষিপ্ত করো।

বলাবাহুল্য এই পৃথিবী গমনশীলা নহে, স্থিরা। অর্জুনি ও শ্বেতবর্ণ নহে। এখানে মেঘগর্জনও শুনিতে পাওয়া যায় না। সংস্কৃত শব্দে গো এর এক অর্থ পৃথিবী। কিন্তু এই পৃথিবী গমন করিতে পারে না, গো নাম পাইতে পারে না। এই গো নক্ষত্র-শোভিত নভোমণ্ডল বা স্বর্গ। বিষ্ণু ইহাকেই ধারণ করিয়া আছেন, নচেৎ পড়িয়া যাইত। ভূমণ্ডল বিস্তীর্ণা, এই হেতু পৃথিবী। স্বর্গ পৃথিবী গো, এই হেতু মর্ত্য-পৃথিবীও গো নাম পাইয়াছে।

যিনি প্রজা সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন, তিনি প্রজাশক্তি, কালরূপ। বিষ্ণু চরিষ্ণু সূর্য; যে সূর্য বর্ষচক্র পরিভ্রমণ করিতেছেন, পর্যায়ক্রমে ঋতু আনয়ন করিতেছেন, শীত, গ্রীষ্ম বর্ষা দ্বারা প্রজাপালন করিতেছেন। অতএব বিষ্ণু প্রজাপতি, আর বিষ্ণু সভাপতি। তিনি বৎসরের ও ঋতুর আরম্ভ দেখাইলেন। সে সময়ে যজ্ঞ হইত বলিয়া তিনি যজ্ঞপতি, যজ্ঞেশ্বর (বামনাবতারে বর্শিত হইবে)। প্রতি বৎসর সূর্য কালপুরুষ নক্ষত্র দিয়া গমন করিতেছেন, কিন্তু সূর্য ও নক্ষত্র একদা দেখিতে পাওয়া যায় না। এই কারণে সূর্যোদয়ের পূর্বে কিম্বা সূর্যাস্তের পরে দেখা যাইতো। যেদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে দিব্য বরাহকে উদিত হইতে দেখা যাইতো, সেদিন প্রাতে যজ্ঞ হইতো; এই হেতু দিব্য-বরাহের নাম যজ্ঞ-বরাহ হইয়াছিল। প্রজাপতি বিষ্ণু স্বর্লোকে, বরাহ স্বর্লোকে; অতএব বলিতে পারি যে পৃথিবী উত্তোলিত হইয়াছিল, তাহাও স্বর্লোক বা স্বর্গ।

শূন্য প্রান্তরে দন্ডায়মান হইয়া চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে মনে হয়, আকাশ চারিদিকে এক বৃত্তে পৃথিবীকে স্পর্শ করেছে। এই বৃত্ত দিকচক্র। আকাশ নভোমণ্ডল, সমুদ্র, মহার্ণব। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র পূর্ব সমুদ্র হইতে নিক্ষেপ হইয়া থাকেন; পশ্চিমসমুদ্রে নিমগ্ন হইলে আমরা বলি অস্ত। দিব্য বরাহের উদয়কালে মনে হয় যে ভূ-পৃথিবী হইতে উত্থিত হইতেছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য স্বর পৃথিবীকে উপরে তুলিতেছেন। ইহাই পৌরাণিক উপাখ্যানের অর্থ।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জম্বুদ্বীপে ভারখণ্ডে

 মহাভারতের ভীষ্মপর্ব হতে তৎকালীন ভৌগলি বর্ণনা পাওয়া যায়। পৃথিবীতে ৭টি দ্বীপ আছে (বর্ত্তমানের সপ্ত মহাদেশের মত)। সাত দ্বীপের মধ্যে একটি হলো জ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ