দয়ানন্দ সরস্বতীকে কেন মহর্ষি বলা হয়? বিষয় টির আলোচনা থেকে আমরা বুঝবো ঋষি ও মহর্ষি কাদের বলা হয়।
আমরা সকলে জানি, সংস্কৃত ভাষায় একটি শব্দের একাধিক অর্থ থাকে। তেমনি প্রাচীন শাস্ত্রে 'ঋষি' শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। নিরুক্তে বলা আছে, "ঋষিণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ো ভবন্তি" [নিরুক্ত- ৭।৩] অর্থাৎ নানা প্রকার অভিপ্রায় দ্বারা ঋষিদের মন্ত্রদর্শন হয়।
এটি মূলত বৈদিক ঋষিদের মুখ্যার্থ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হতে পারে, বেদমন্ত্র দ্রষ্টা ছাড়া অন্য মানুষও কি ঋষি হতে পারেন? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, হতে পারেন।
কারণ মহাভারত, রামায়ণসহ বিভিন্ন গ্রন্থে ব্যাসদেব, যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখকে অসংখ্য বার মহর্ষি, ঋষি ইত্যাদি বলা হয়েছে। এই তালিকা এতই দীর্ঘ যে তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। এনারা কিন্তু বেদ মন্ত্র দ্রষ্টা ছিলেন না।
আবার মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে 'মহষয়ঃ' শব্দের ভাষ্য করতে গিয়ে মেধাতিথি লিখেছেন, "ঋষির্বেদঃ। তদধ্যয়ন-বিজ্ঞান-তদার্থনুষ্ঠানাতিশয়যোগাৎপুরুষেহপ্যৃষিশব্দঃ।"
অর্থাৎ বেদ অধ্যয়ন, বিজ্ঞান, অর্থানুষ্ঠান প্রভৃতির কারণে পুরুষের উপরে ঋষি শব্দের প্রয়োগ হয়।
মেধাতিথির এই উক্তি হতে বোঝা যায়, যে কোনো মানুষ যদি বেদজ্ঞানী হয়, তবে তাঁর উপর ঋষি শব্দ প্রয়োগ হতে পারে। আবার ঋষি বলতে এমন জ্ঞানীদের বোঝায়, যাঁরা বেদের মন্ত্রের অর্থ বা তাৎপর্য সঠিক ভাবে জানতে পারেন।
এই বিষয়ে শতপথ ব্রাহ্মণে [৬।১।১।১] বলা আছে,
"তে যৎ পুরা অস্মাৎ সর্বস্মাৎ ইদমিচ্ছন্তঃ শ্রমেণ তপসারিংষতস্মাদ্ ঋষয়ঃ।"
অর্থাৎ প্রাচীন কালে যাঁরা বেদমন্ত্রের তাৎপর্য জানতে কঠোর পরিশ্রম ও তপস্যা করেছিলেন, তাঁদেরই ঋষি বলা হয়।
শতপথের এই বাক্য থেকেও স্পষ্ট হয় যে, শুধু মন্ত্র দ্রষ্টাই ঋষি নন, যারা কঠোর পরিশ্রম বা তপস্যা করে বেদ মন্ত্রের সঠিক তাৎপর্য জানতে পারেন, তাঁরাই ঋষি।
দয়ানন্দজীর অপূর্ব বেদভাষ্য রচনার পেছনে ছিলো তাঁর দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিরুক্ত, নিঘণ্টু, অষ্টাধ্যায়ী, মহাভাষ্য, ব্রাহ্মণাদি অধ্যয়ন করেছেন। এরপরেই তিনি বেদভাষ্য রচনার মাধ্যমে বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ উদ্ঘাটন করেছেন। তাই শতপথ ব্রাহ্মণের উপর্যুক্ত বচন থেকে দয়ানন্দজীর ঋষিত্ব সিদ্ধ হয়।
এছাড়া বেদজ্ঞানী মানুষ যে ঋষিপদ বাচ্য, এই বিষয়ে আরও প্রমাণ রয়েছে। বোধায়ন ধর্মসূত্রের ২।৬।৩৬ সূত্রে ঋষি শব্দটি রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় গোবিন্দ স্বামী লিখেছেন, 'ঋষি মন্ত্রার্থজ্ঞঃ'। অর্থাৎ বেদ মন্ত্রের অর্থের জ্ঞাতাই ঋষি। এখন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীজী যে বেদ মন্ত্রের সঠিক অর্থের জ্ঞাতা ছিলেন সেটি প্রমাণের জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। শুধুমাত্র যজুর্বেদের ২৩ অধ্যায়ের ২১ থেকে ৩০ নং মন্ত্রের অর্থ গুলো মহীধর, উব্বটের ভাষ্যের সাথে দয়ানন্দজীর ভাষ্যের তুলনা করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন। এরপরও যেসব ভণ্ড, ধর্মব্যবসায়ীরা দয়ানন্দজীর বেদার্থ জ্ঞান নিয়ে সন্দিহান তাদের প্রতি আমার সন্দেহ যে, তাদের ডিএনএ টেস্ট করলে নিশ্চয়ই ঘোড়ার জিন পাওয়া যাবে। ঘোড়ার জিন পাওয়ার কারণ যজুর্বেদের ২৩।২১-৩০ উব্বট, মহীধর ভাষ্য পড়লেই বুঝতে পারবেন আশা করি।
এবার আসি অন্য দিকে, নিরুক্ত পরিশিষ্টে বলা হয়েছে, "মনুষ্যা বা ঋষিষূৎক্রামৎসু দেবানব্রুবননকো ন ঋষির্ভবিষ্যতীতি, তেভ্য এতং তর্কঋষিং প্রায়চ্ছন্মন্ত্রার্থ চিন্তাভ্যূহমভ্যূঢম্। তস্মাদ্যদেবং কিং চানূচানোঽভ্যূহ ইত্যার্ষং তদ্ধবতি।।"[নিরুক্ত- ১৩।১২ তথা নিরুক্ত পরিশিষ্ট- ১।১২]
অর্থাৎ প্রাচীন কালে মনুষ্যগণ দেবতাদের (বিদ্বানদের) প্রশ্ন করেছিলেন যে, মনুষ্যদের মধ্যে কারা ঋষি হবেন। এর উত্তরে দেবতাগণ (বিদ্বানগণ) বলেছিলেন যে, তর্কই ঋষি। অর্থাৎ যাঁরা তর্কের মাধ্যমে গবেষণা পূর্বক বেদার্থ বুঝতে পারবেন, তাঁরাই আর্ষ ঋষি।
নিরুক্ত পরিশিষ্টের এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, তর্কের মাধ্যমে যাঁরা বেদার্থ জ্ঞাত হন, তাঁরাই ঋষি। এখন দয়ানন্দজীর জীবনী যদি আপনারা দেখেন, তবে দেখতে পারবেন তিনি এক জীবনে সহস্রাধিক তর্কসভায় অংশ গ্রহণ করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এমনকি এমনও অবস্থা হয়েছে, মহর্ষির সাথে তর্কে না পেরে তৎকালীন পণ্ডিতগণ অনেক কূটকৌশল, ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই এমন সুতার্কিক বেদজ্ঞকে কি মহর্ষি বলাটা অন্যায়, অশাস্ত্রীয়?
ঋষি অরবিন্দের কথাতেই মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জ্ঞান, বেদভাষ্যের উৎকৃষ্টতা প্রকাশিত হচ্ছে। এমন ঋষিকে মহর্ষি না বলে আর কি বা বলা যায়?
দেবর্ষি– যিনি দেবতা হয়েও ঋষি তিনি দেবর্ষি।
মহর্ষি– ঋষিদের মধ্যে যারা প্রধান ও মহান তারা মহর্ষি।
পরমর্ষি– পরম ব্রহ্মকে যিনি দর্শন করেছেন তিনি পরমর্ষি।
কাণ্ডর্ষি – বেদের দুইটি কান্ড- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞ্যানকান্ড। কর্মকাণ্ডে আছে যাগ-যজ্ঞের কথা আর জ্ঞ্যানকান্ডে আছে জ্ঞ্যানের কথা, ব্রহ্মের কথা। বেদের কোন কান্ড সম্পর্কে জ্ঞ্যানী ঋষিদের বলা হয় কান্ডর্ষি।
শ্রুতর্ষি– বেদ ঈশ্বরের বানী। ঋষিরা তপস্যা করে বেদ মন্ত্র লাভ করেছেন। কিন্তু এভাবে সকল ঋষি বেদ মন্ত্র লাভ করেন নি। কেউ কেউ অন্য ঋষির কাছ থেকে শুনেছেন। যারা শুনে শুনে বেদ মন্ত্র লাভ করেছেন তারাই শ্রুতর্ষি।
রাজর্ষি– রাজা হয়েও যিনি ঋষি তিনি রাজর্ষি। তিনি ঋষির মত জ্ঞ্যানি। ঋষির মত আচরন করেন।
ব্রহ্মন্ ( ব্রাহ্মণ ) অথচ ঋষি, কর্মধা। বি; পু। ব্রহ্মর্ষিরা জাতিগতভাবে ব্রাহ্মণ ! তাঁদের সঙ্গে 'ব্রহ্ম'-এর কোন যোগসূত্র আলাদাভাবে নেই ! শাস্ত্রে, 'ব্রহ্ম' এবং 'ব্রাহ্মণ' এক করা হয়েছে ! এটা ঠিক নয় ! ব্রহ্মর্ষি বসিষ্ঠ প্রমুখ !
দেবর্ষি।
যিনি দেব ও মন্ত্রদর্শন হেতু, ঋষিত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন ! যেমন, নারদ প্রমুখ।
মহর্ষি।
প্রধান মুনি। সপ্ত প্রকার পৌরাণিক ঋষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঋষি ! মহান যে ঋষি, কর্মধা। মহা + ঋষি। বি; পু। বেদব্যাস প্রমুখ।
পরমর্ষি।
শ্রেষ্ঠ ঋষি। ভেলাদি প্রমুখ। বেদব্যাসও পরমর্ষি group-এ ( দলে ) পড়েন ! পরম যে ঋষি। কর্মধা। বি; পু।
কাণ্ডর্ষি।
বেদবিভাগের মীমাংসক ঋষি। যেমন,
কর্মকাণ্ডের বেদভাগের মীমাংসক, জৈমিনি।
ব্রহ্মকাণ্ডের বেদভাগের মীমাংসক, বেদব্যাস।
ভক্তিকাণ্ডের বেদভাগের মীমাংসক, শাণ্ডিল্য।
এঁরা সবাই, কাণ্ডের, অর্থাৎ বেদপরিচ্ছেদের ঋষি।
ষষ্টিতৎপুরুষ। বি; পু।
যেমন, জৈমিনি, বেদব্যাস, শাণ্ডিল্য, প্রভৃতি !
মীমাংসক। নিষ্পত্তিকারক। সনন্ত মান্ ( বিচার করা ) + ণক কর্তৃ। বিণ;। ( স্ত্রী- মীমাংসিকা। )
মিমাংসক। মীমাংসাশাস্ত্রজ্ঞ।
শ্রুতর্ষি।
শ্রুতপ্রধান ঋষি। সুশ্রুত প্রভৃতি ।
রাজর্ষি।
রাজা অথচ ঋষি।
যিনি রাজা হয়েছেন, রাজা রয়েছেন, অথচ ঋষির মতন আচরণ করেন !
যিনি রাজকার্য সামলান, রাজত্বও করেন, অথচ সময় সুবিধা বুঝে, ঋষির মতন 'তত্ত্ব' আলোচনা করেন !
কেবল সাংসারিকতায় ব্যস্ত থাকেন না !
এঁনাকে বলা যায়, রাজশ্রেষ্ঠ !
ইনি রাজাও এবং ঋষিও
!
রাজর্ষি, জনক প্রভৃতি !
আমার এই আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, বা ব্যাসদেব, 'মহর্ষি' হিসাবে, 'পরমর্ষি' হিসাবে, এবং, 'কাণ্ডর্ষি' হিসাবেও, তিন জায়গায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন !
'মহর্ষি' হিসাবে, বেদব্যাস প্রধান মুনি। তিনি সপ্ত প্রকার পৌরাণিক ঋষিদের মধ্যে, শ্রেষ্ঠ ঋষি !
'বেদব্যাস', 'পরমর্ষি' হিসাবেও শ্রেষ্ঠ ঋষি।
'কাণ্ডর্ষি' হিসাবেও', বেদব্যাস, 'ব্র্হ্মকাণ্ডের বেদভাগের মীমাংসক' !
বেদব্যাস, বেদের বিভাগকর্তা ব্যাসমুনি, যিনি পরাশর ও সত্যবতীর পুত্র।
বেদব্যাস/কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
উনি মহামনীষী ছিলেন !
উনিই সর্বপ্রথম, বেদের সংগ্র্হ ও বিভাগ করেন বলে তিনি 'বেদব্যাস'।
একটি দ্বীপে তাঁর জন্ম বলে, তিনি, দ্বৈপায়ন।
তিনি কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন বলে, তাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
মূলত তখনকার মুনিদের মধ্যে, বেদব্যাস একজন সুপ্রসিদ্ধ ও অসাধারণ ঋষি ছিলেন !
भश् ि[ वश +अशि ] त्रि, পুং, দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, শ্রতধি, প্রভূতি সপ্ত প্রকার ঋষির অস্ততম ; শ্ৰেষ্ঠ ঋষি
কিছু মহান ঋষিবৃন্দের নাম:-
অগ্নি,আদিত্য,অঙ্গিরা,বায়ু, ব্রহ্মা,কুৎস (অঙ্গিরাপুত্র),হিরণ্যস্তুপ (অঙ্গিরাপুত্র),কুমার (অগ্নিপুত্র),মহর্ষি বৃহস্পতি,জুহু (বৃহস্পতিপত্নী),নচিকেতা,কুমার (নচিকেতাপুত্র),ঋষি ভৃগু,কবি (ভৃগুপুত্র),সোমাহুতি (ভৃগুপুত্র), অরিষ্টনেমি,ইন্দ্র, ভরদ্বাজ,গর্গ (ভরদ্বাজপুত্র), অত্রি,কশ্যপ (মরীচিপুত্র),মহর্ষি বসিষ্ঠ,দ্যুম্নীক (বসিষ্ঠপুত্র), গগাচাৰ্য্য, অগস্ত্য,দৃঢ়চ্যুত (অগস্ত্যপুত্র), জৈমিনি, গৌতম, কশ্বপ, জমদগ্নি, জামদগ্ন্য,বিভাণ্ডক, কৌশিক, মহামতি মার্কণ্ডেয়,দধীচী, মিত্র,বরুণ,বালিপ্পিল্যাদি,অসিত, দেবল, ধৌম্য,দত্তাত্রেয়,অর্ডাবলু সুমিত্র, মৈত্রেয়, শুনক ,বলি,বক ঋষি, দালভ্য, স্থূলশিরা, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, তৎপুত্ৰ শুকদেব, দারুণ কৰ্ম্ম ,অথৰ্ব্ব বেদাচাৰ্য্য সুমন্ত ঋষি, বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্য,গালব, বায়ু ভক্ষক শাণ্ডিল্য, সত্যপালক,কণাদ,যাষ্ক,মহর্ষি বিশ্বামিত্র,প্রজাপতি (বিশ্বামিত্রপুত্র),মধুচ্ছন্দা (বিশ্বামিত্রপুত্র),সপ্তবধ্রি (অত্রিপুত্র),
বৈদিক সাহিত্যে ঋষি আদি শব্দের প্রয়োগ ঠিক সেই অর্থে হয়েছে যেই অর্থে অর্বাচীন সাহিত্য "আচার্য" শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। গুরু বা আচার্যের অর্থেও " মন্ত্রকৃত" শব্দ প্রয়োগ হয়ে থাকে।
নিরুক্তাকারের এই কথন যে - ঋষিদের এরূপ প্রসংশা যে, নানা প্রকার অভিপ্রায় দ্বারা ঋষিদের মন্ত্রদর্শন হয় (ঋষিণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ো ভবন্তি ; নিরুক্ত ৭।৩)। ঋষিদের নানা প্রকার দৃষ্টির তাৎপর্য এই যে, তাদের বৃহৎ পুরুষার্থ দ্বারা মন্ত্রের ঠিক ঠিক প্রকার সাক্ষাৎ হয়।
নিরুক্তকার আরো বলেছেন -
"সাক্ষাত্কৃতধর্মোণ ঋষয়ো বভূবুস্তেহবরেভ্যোহসাক্ষাত্ কৃতধর্মস্য উপদেশেন মন্ত্রানসম্প্রাদু ; নিরুক্ত ১।১৯"
অর্থাৎ তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি)। আর তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করে নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
তৈতেরীয় অরণ্যকের ২।৯।১ এ প্রকার বর্ননা মিলে যে,
"অজান হ বৈ পৃশ্নীংস্তপস্যমানান্ব্রহ্ম স্বয়ম্ভ্বভ্যানর্ষত্ত ঋষয়োহভবন্তদৃষীণামৃষিত্বং তাং "
অর্থাৎ বেদ (ব্রহ্ম) কে (স্বয়ম্ভূ) যা কাহারো রচনা বিনা স্বয়ং (ঈশ্বর দ্বারা) প্রাপ্তকারী (আন্যানর্ষত্) বিনা পাঠে, নিজ বিশেষ তপের কারণে ঋষিদের দিয়েছেন, তাহাই ঋষিদের ঋষিত্ব।
যে লোক মন্ত্রার্থ কে জেনে ধর্ম এবং বিদ্যার প্রচার করেন, সত্যোপদেশ দ্বারা সবার অনুগ্রহ করে, ছল রহিত, মোক্ষ ধর্মের সাধনার জন্য ঈশ্বরের উপাসনা করেন এবং ইচ্ছানুরূপ ফল প্রাপ্ত করার জন্য ভৌতিক অগ্নি আদির গুণ কে জেনে কার্য্য সাধন করেন সেই মনুষ্য "ঋষি" শব্দে গৃহীত হন।
কাত্যায়ন ঋষি তার সর্বানুক্রমণী পঙ্কিতে প্রত্যেক মন্ডলদ্রষ্টা ঋষির বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন -
"গৃৎসমদো দ্বিতীয়ং মন্ডলপশ্যত। গাথিনো বিশ্বামিত্রঃ স তৃতীয়ং মন্ডলপশ্যত্। বামদেবো গৌতমশ্চতুর্থৈ মন্ডলম পশ্যত। বাঈস্পত্যো ভরদ্বাজঃ ষষ্টং মন্ডলমপশ্যত্। সপ্তমং মন্ডলং বসিষ্টোহপশ্যত। ইত্যাদি।।
অর্থাৎ গৃৎস্মদ দ্বিতীয় মন্ডল দর্শন করেছেন। গাথিন বিশ্বামিত্র তৃতীয় মন্ডল দর্শন করেছেন। বামদেব গৌতম চতুর্থ মন্ডল দর্শন করেছেন। বাঈস্পত্য ভরদ্বাজ ষষ্ঠ মন্ডল দর্শন করেছেন। সপ্তম মন্ডল বসিষ্ট দর্শন করেছেন। ইত্যাদি সর্বত্র "দৃশ" ধাতুর প্রয়োগ হয়েছে। কোন স্খানে ঋষিকে প্রতিপাদন করতে কাত্যায়ন "চকার" "কৃতাবান" ইত্যাদি প্রয়োগ করেন নি।
সাক্ষাতকৃতধর্মোণ ঋষয়ো
বভূবুস্তেহবরেভোহসাক্ষাত্ কৃতধর্মস্য
উপদেশেন মন্ত্রাণসম্প্রাদু।
অর্থ : তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি)।
আর তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করে নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
ঋষিদের মন্ত্রদর্শন বিষয়ে কিছু বিদ্বানদের আক্ষেপ এই যে, যেসব ঋষিদের নাম মন্ত্রে মেলে তারাই মন্ত্রের রচনাকারী । আর্য লোক বেদ কে অপৌরুষেয় সিদ্ধ করার জন্য মন্ত্র রচনাকারী ঋষিদের নাম মন্ত্রদ্রষ্টা রেখেছে।
উক্ত আক্ষেপের সমাধান গোপথ ব্রাহ্মণে অতি সুন্দররূপে দেওয়া রয়েছে। সেখানে দেখা যায় এক বেদমন্ত্রের দ্রষ্টা এক ঋষি না হয়ে অনেক ঋষি।
"তান বা এতান্ সম্পাতান্ বিশ্বামিত্রঃ প্রথমম্পশ্যত্। এবাত্বামিন্দ্র বজ্রন্ (ঋ ৪।১৯) তান্ বিশ্বামিত্রেণ দ্রষ্টান্ বামদেবো অসৃজন।। গোঃ ব্রাঃ ৬।১"
অর্থাৎ সম্পাত্ত কে বিশ্বামিত্র প্রথমে দর্শন করেছেন পুনরায় তাকে বামদেব দর্শন করেছেন। এই উদ্ধরণে স্পষ্ট যে, এই মন্ত্র (ঋঃ ৪।১৯) প্রথমে বিদ্যমান ছিলো। তাকে প্রথমে বিশ্বামিত্র দর্শন করেন অর্থাৎ তার ক্রিয়াকান্ড সবার প্রথমে দর্শন করেন। এবং পুনরায় বামদেব তা দর্শন করেন। দুই ঋষি একই সুক্তের মন্ত্রের কর্তা হতে পারে না "সম্পাত্ত " এই মন্ত্র দ্বারা কৃত কর্মকান্ডের সংকেত। সেই কর্মকান্ডের নামেই মন্ত্রের নাম "সম্পাত" হয়েছে। এই বিশেষ কর্মযোগের দর্শনের জন্যই বিশ্বামিত্র এবং বামদেব ঋষির মন্ত্রদ্রষ্টা হওয়ার কারণ। অনুক্রমণীকার ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কর্মকান্ড কে দর্শনকারী ঋষি কে ব্রাহ্মণ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে মন্ত্রের ঋষি আদির নির্ণয় করেছেন।
বেদের সুক্তে যেমন দুই দুই (ঋঃ ৮।১৪) তিন তিন, পাঁচ পাঁচ (ঋঃ ১।১০০) ঋষি রয়েছে। তেমনি এক সুক্তে (ঋঃ ৯।৬৬) একশ ঋষি রয়েছে।
এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, এতগুলো ঋষি মিলে একটি মন্ত্র রচনা করেন নি । বরং একটি মন্ত্রই তারা পর পর দর্শন করেছেন। অতএব ঋষি মন্ত্রের রচনাকারী নয়। বরং তারা মন্ত্র দ্রষ্টা।
সন্দর্ভঃ ঋগবেদ ভাষ্যভূমিকা (জয়দেব শর্মা), বেদ রহস্য (মহাত্মা নারায়ন স্বামী)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ