মন্ডল সুক্ত মন্ত্র |
যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ।
বি হোত্রা দধে বয়ুনাবিদেক দন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ।।
---(ঋগ্বেদ ৫/৮১/১)---
পদার্থ - হে মানব! যেভাবে (হোত্রাঃ) গ্রহণ কিংবা দান কারী অর্থ্যাৎ জ্ঞানাদি উত্তম বস্তুর অাদান-প্রদান কারী (বিপ্রাঃ) বুদ্ধিমান যোগীগণ (বিপ্রস্য)বিশেষভাবে ব্যাপ্ত , (বৃহতঃ) বৃহৎ, (বিপস্চিতঃ) অনন্ত বিদ্যাবান (সবিতুঃ) সমগ্র জগতকে উৎপন্নকারী, (দেবস্য) সমগ্র জগতকে প্রকাশকারী সেই পরমাত্মার মধ্যে (মনঃ) মননস্বরূপ মনকে (যুঞ্জতে) যুক্ত করেন (উত) এবং (ধিয়ঃ) বুদ্ধিকে (যুঞ্জতে) যুক্ত করেন অার যিনি (বায়ুনাবিত্) প্রজ্ঞানকে অানয়নকারী
(একঃ) সহায়রহিত একাই (বি, দধে) সমগ্র জগতকে রচনা কারী যিনি (মহী) অতীব প্রসংসার যোগ্য (পরিস্তূতি) যার স্তুতি সর্বত্র ব্যাপ্ত, তার মধ্যে তোমরাও সেভাবে অাপন চিত্তকে ধারণ করো।
যুঞ্জন্তি ব্রধ্নমরুষং চরন্তং পরি তস্থুষঃ।
রোচান্তে রোচনা দিবি।।
---(ঋগ্বেদ ১/৬/১)---
পদার্থ -
(অরুষম্) হিংসারহিত (চরন্তম্) সমগ্র জগত সম্পর্কে জ্ঞাত, (পরিতস্থুষঃ) সর্বত্র বিরাজমান, (ব্রধ্নম্) সেই মহান পরমেশ্বরের সাথে জীবাত্মা [উপাসনাযোগ দ্বারা] (যুঞ্জন্তি) যুক্ত হয়ে (দিবি) প্রকাশস্বরূপ পরমেশ্বরের মাঝে ( রোচন্তে) জ্ঞান দ্বারা প্রকাশমান হয়ে (রোচন্তে) অানন্দে প্রকাশিত হন।
ঋক বেদে দশটি মণ্ডল ও আটটি অষ্টক আছে। এক একটি মন্ত্রকে ঋচ্ বলে। এক ঋষির রচিত দেবতার স্তুতি সম্বন্ধে মন্ত্রগুলিকে একটি সূক্ত বলে। এই রকম বহুসংখক ঋষির দ্বারা রচিত সূক্ত সব একজন ঋষির দ্বারা সংগৃহীত হলে তাকে একটি মণ্ডল বলে। এ রকম দশটি মণ্ডল আছে ঋকবেদ সংহিতায়, এর প্রথম মণ্ডলের প্রথম অনুবাকের প্রথম সূক্তের প্রথম ঋকটি বলা হল উদাহরণ স্বরূপ এবং সংহিতার অর্থ পরিষ্কার করার জন্য আগে সূক্তটির শিরোনাম বিশ্লেষণ করি। 'ঋষির্বিশ্বামিত্রপুত্র মধুছন্দা অগ্নির্দেবতা গায়ত্রীচ্ছন্দ ব্রহ্মযজ্ঞান্তে বিনিয়োগ অগ্নিষ্টোমে চ'। এর চারটি অর্থ আছে-
প্রবন্ধটি লিখতে বিশেষ করে নীচের গ্রন্থগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।
টীকা:
নিরুক্ত - বেদের দুরূহ শব্দসমূহের ব্যুত্পত্তি ও ব্যাখ্যাসঙ্কলিত গ্রন্থ বিশেষ। যাস্ক প্রমুখ কয়েকজন প্রাচীন পণ্ডিত নিরুক্তকার হিসেবে খ্যাত।
অনুবাক - বিভাগ ও অনুবিভাগ।
(১) এই সূক্তের ঋষি, বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুছন্দা ।
(২) এই সূক্তের দেবতা অগ্নি।
(৩) এই সূক্তের ছন্দ গায়ত্রী
(৪) এই সূক্তের প্রয়োগ ব্রহ্মযজ্ঞান্তে এবং অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে।
(২) এই সূক্তের দেবতা অগ্নি।
(৩) এই সূক্তের ছন্দ গায়ত্রী
(৪) এই সূক্তের প্রয়োগ ব্রহ্মযজ্ঞান্তে এবং অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে।
এই রকম সব সূক্তেরই একটি ঋষি, একটি দেবতা, ছন্দ ও প্রয়োগ নিদ্র্দিষ্ট আছে। এর তাত্পর্য বিশ্লেষণ করি এবারে আমরা।
'ঋষি' শব্দ বলতে কি বোঝায়? সাধারণ অর্থে ঋষি বলতে আমরা বুঝি ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। কিন্তু এখানে ঋষি কথার অন্য তাত্পর্য, সাধারণ অর্থ নয়। বেদের অর্থ বোঝানোর জন্য একটি আলাদা শাস্ত্র আছে- তার নাম 'নিরুক্ত'। এটি একটি বেদাঙ্গ। যাস্ক, স্থৌলষ্ঠিবী, শাকপুণি প্রভৃতি প্রাচীন মহর্ষিগণ নিরুক্তস্রষ্টা। বেদের কোন শব্দের যথার্থ অর্থ জানতে গেলে নিরুক্তের আশ্রয় নিতে হয়। নিরুক্তকার বলেন, 'যস্য বাক্যং স ঋষি', অর্থাত্ যাঁর কথা সেই ঋষি। তাহলে যখন কোন সূক্তের প্রথমে যে ঋষির নামোল্লেখ আছে, তিনিই বক্তা ঐ সূক্তের। এখন একটি প্রশ্ন ওঠে ঐ বক্তা অর্থে রচয়িতা বোঝায় কি? যাঁরা বলেন বেদ নিত্য অর্থাত্ কারও দ্বারা রচিত নয়, তাঁদের উত্তর এই যে বেদ মন্ত্র সব ঋষিদের সামনে আবির্ভুত হয়েছিল- তাঁরা রচনা করেন নি, জ্ঞানবলে দেখেছিলেন। যে ঋষি যে সূক্ত দেখেছিলেন- তিনিই সেই সূক্তের ঋষি। আমরা জানি শব্দ শোনা যায়। কিন্তু শব্দ দেখা যায়- যোগবলে বা যে বলেই হোক, তা মানা যুক্তিবাদী মনের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কেউ মনে করেন সূক্তমন্ত্রগুলি লিপিবিদ্যা সৃস্টি হবার আগে এই মূর্তি ধরে ঋষিদের সামনে আবির্ভুত হয়েছিল তা হলে সেটা তাঁর বিশ্বাস। আমরা এটুকু বলতে চাই বেদেই অনেক জায়গায় আছে যে মন্ত্রগুলি ঋষিদের দ্বারা রচিত, দৃষ্ট নয়। অনেকই উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- কিন্তু পরিসরের হিসেব রাখতে গেলে দেওয়া চলে না। তাই এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এমন অনেক সূক্ত আছে যাতে ঋষিরা বলেছেন, 'আমরা মন্ত্র রচনা করেছি'। যা হোক এটুকু বোঝা গেল যে ঋষির অর্থ মোটেই তপোবলসম্পন্ন মহাপুরুষ নয়, সূক্তের বক্তা মাত্র। তাই ঋষির সধারণ বা লৌকিক অর্থের ব্যবহার এখানে হয় নি।
এবারে দেবতা শব্দের তাত্পর্য বিচার করলে দেখা যাবে 'যস্য বাক্যং স ঋষি যা তেনোচ্যতে সা দেবতা' - নিরুক্তকারের মতে সূক্তে যার কথা থাকে সেই সে সূক্তের দেবতা। অর্থাত্ সূক্তের বিষয়ই দেবতা। এখনে একটি কথা উঠতে পারে- এই সব সূক্তে যাদের দেবতা বলে অর্থাত্ ইন্দ্রাদি, সকলেই তারা স্তুত হয়েছেন- তাঁরা বেদমন্ত্রেও কি দেবতা একই অর্থে? দানস্তুতিগুলি বুঝতে পারলে এই কথা ওঠে না। কতগুলি সূক্তে কোন দেবতার প্রশংসা নাই, কেবল দানেরই প্রশংসা আছে, অতএব দানই দেবতা সেখানে।
এখন আবারও প্রশ্ন করা যেতে পারে- যদি দেবতা শব্দের অর্থ সূক্তের বিষয়, তবে দেবতার আধুনিক অর্থ এল কোথা থেকে? একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে দেবতা শব্দের অর্থ। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন, 'যো দেবঃ সা দেবতা' - যাকে দেব বলে তাকেই দেবতা বলা যায়। দিব্ ধাতু থেকে দেব শব্দের জন্ম। যা উজ্জল তাই দেব। 'দিব্ দীপনে'। আকাশ, সূর্য, অগ্নি, চন্দ্র সবাই উজ্জল, এ জন্য এ সব আদি দেব, মহিমাময় বস্তু, এবং আদিতে এদের প্রশংসায় স্তোত্র বা সূক্ত রচিত হয়েছিল। কালক্রমে যাদের প্রশংসায় সূক্ত রচিত হতে থাকলো তারাই দেব বলে গণ্য হলো। পজ্র্জন্য, যিনি বৃষ্টি করেন, তিনি উজ্জল না হয়েও দেব হলেন। ইন্দ্ ধাতুর পর 'র' প্রত্যয় যোগ করে 'ইন্দ্র' হয়। যিনি বৃষ্টি করেন তিনিই ইন্দ্র- তিনি উজ্জল না হলেও ক্ষমতাবান- বৃষ্টি না হলে শস্য হয় না- শস্য ছাড়া লোকের প্রাণ বাঁচে না। কাজেই তিনি বৈদিক সূক্তে স্তুত হলেন ও দেবতার স্থান পেলেন।
এখন বলি 'গায়ত্রীছন্দঃ' শব্দের অর্থ। ছন্দ বাংলা ও ইংরাজী দুই ভাষাতেই আছে, ঋকগুলি পদ্যে রচিত তাই ছন্দে নিবদ্ধ। 'যদক্ষর পরিমাণং তচ্ছন্দঃ'- অক্ষরের পরিমাণকে ছন্দ বলে। চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার হয়- পয়ার একটি ছন্দ। বাংলাতে যেমন পয়ার, ত্রিপদী, চতুäপদী, নানা ছন্দ আছে, বেদেও তেমনি গায়ত্রী, অনুষ্টুভ, ত্রিষ্টুভ, বৃহতী পংত্তি ইত্যাদি নানা ছন্দ আছে। সূক্তে দেবতা ও ঋষির পরে ছন্দের নাম বলা থাকে। যাঁরা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র ইত্যাদি পুরাতন কবিদের কাব্য পড়েছেন, তাঁরা এ প্রথার সঙ্গে পরিচিত।
ঋষি, দেবতা ও ছন্দের পরে প্রয়োগ বলা হয়- অর্থাত্ যে কাজের জন্য সূক্তটির প্রযোজন তাই প্রয়োগ বা বিনিয়োগ। যেমন অগ্নিষ্টোমে বিনিয়োগঃ- অর্থাত্ সূক্তটি অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে ব্যবহার হয়। এ রকম প্রায় সব সূক্তেই শিরোনামটি আগে থাকে যার দ্বারা রচয়িতা বা ঋষি, দেবতা, ছন্দ ও বিনিয়োগ বোঝা যায়।
ঋষি, দেবতা ও ছন্দের পরে প্রয়োগ বলা হয়- অর্থাত্ যে কাজের জন্য সূক্তটির প্রযোজন তাই প্রয়োগ বা বিনিয়োগ। যেমন অগ্নিষ্টোমে বিনিয়োগঃ- অর্থাত্ সূক্তটি অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে ব্যবহার হয়। এ রকম প্রায় সব সূক্তেই শিরোনামটি আগে থাকে যার দ্বারা রচয়িতা বা ঋষি, দেবতা, ছন্দ ও বিনিয়োগ বোঝা যায়।
এবার ঋকটি বলি-
অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্।
হোতারং রত্নধাতমম্।।
হোতারং রত্নধাতমম্।।
'অগ্নিমীলে' - অর্থাত্ অগ্নিকে স্তব করি। বাকী কথাগুলি সব অগ্নির বিশেষণ। অগ্নি পুরোহিত, কারণ তিনিই হোমকার্য সম্পন করেন। 'রত্নধাতমম্'- যিনি রত্ন দান করেন। অগ্নি যজ্ঞফল স্বরূপ রত্ন প্রদান করেন।
এই সূক্তে এরকম নয়টি ঋক আছে। সবই প্রশংসা, স্তুতি ও প্রার্থনা সূক্তের দেবতার কাছে। দ্বিতীয় সূক্তের দেবতা একজন নয়, প্রথম তিন ঋকের দেবতা বায়ু। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ ঋকের দেবতা ইন্দ্র ও বায়ু; শেষ তিনটি ঋকের দেবতা মিত্র ও বরুণ। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। বত্র্তমান যুগে হিন্দুর এমন অনেক দেব বা দেবীর পূজা করেন যাঁদের উল্লেখ বেদে নেই। (যাঁরা বেদ পড়েছেন তাঁরাই জানেন।) এইভাবে তৃতীয় সূক্তের অনেক দেবতা - যথা দুই অশ্বিনীকুমার, ইন্দ্র, বিশ্বদেবাঃ, সরস্বতী। চতুর্থ সূক্তের দেবতা আবার ইন্দ্র, ঋকবেদে ইন্দ্রেরই প্রাধান্য। ষষ্ঠতে মরুতগণ - তাঁরা বায়ু থেকে আলাদা - ১২ নং সূক্তে আবার অগ্নি দেবতা- ইন্দ্রের পরে অগ্নির স্থান ঋকবেদে, ১৩ নং সূক্ত আপ্রীসূক্ত, এটির প্রয়োগ পশুযজ্ঞে- ১০-টি এরকম আপ্রীসূক্ত আছে ঋকবেদে। এর দেবতাও অগ্নি। এই সূক্তে অবশ্য অগ্নির ১২-টি মূর্তির স্তব করা হয়েছে। ১৪ নং সূক্তে অনেক দেবতা- বিশ্বদেবাঃ, ইন্দ্র, বায়ু,অগ্নি, মিত্র, বৃহäপতি, পূষা, ভগ, আদিত্য ও মরুদগণ। ১৫ নং সূক্তেরও অনেক দেবতা, ঋতুরাই প্রধানতঃ এই সূক্তের দেবতা। ১৬ নং- এ ইন্দ্র একা দেবতা, ১৭-তে ইন্দ্র ও বরুণ, ১৮-তে দেবতা ব্রহ্মণস্পতি- যদিও তাঁর পরিচয় বিশেষ ভাবে উল্লিখিত নেই, আরও ইন্দ্র ও সোম, দক্ষিণা ও সদসস্পতি বা নারাশংস বলে এক দেবতা আছেন। ১৯-তে দেবতা অগ্নি ও মরুত্, বৈদিক দেবতাদের মোটামুটি তালিকা এই রকম। এই তালিকায় বত্র্তমানে পূজিত ব্রহ্মা, বিষুÎ, মহেশ্বর, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, কাত্র্তিক, গণেশ - এরা কেউ নেই। ঋে±÷দের অন্য স্থানে বিষুÎর উল্লেখ আছে, শিবের বদলে রুদ্রকে, ব্রহ্মার বদলে প্রজাপতি ও লক্ষ্মীর স্থানে শ্রীকে স্তুতি করা হয়েছে। কিন্তু বাকীদের বৈদিক আবাস নেই। ঋকবেদ অনুযায়ী ৩৩ জন দেবতা আছেন কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের নামের উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে, রামায়ণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ৩৩ জন দেবতার কথাই বলা আছে। তাহলে প্রশ্ন এই ৩৩ জন কী করে তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, তার সঙ্গত কোন উত্তর দেওয়া যায় না। তবে ৩৩ জন দেবতা কে কে ঋকবেদে তার উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে ও মহাভারতে এদের শ্রেণীবিভাগ ও নাম পাওয়া যায়।
এই সূক্তে এরকম নয়টি ঋক আছে। সবই প্রশংসা, স্তুতি ও প্রার্থনা সূক্তের দেবতার কাছে। দ্বিতীয় সূক্তের দেবতা একজন নয়, প্রথম তিন ঋকের দেবতা বায়ু। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ ঋকের দেবতা ইন্দ্র ও বায়ু; শেষ তিনটি ঋকের দেবতা মিত্র ও বরুণ। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। বত্র্তমান যুগে হিন্দুর এমন অনেক দেব বা দেবীর পূজা করেন যাঁদের উল্লেখ বেদে নেই। (যাঁরা বেদ পড়েছেন তাঁরাই জানেন।) এইভাবে তৃতীয় সূক্তের অনেক দেবতা - যথা দুই অশ্বিনীকুমার, ইন্দ্র, বিশ্বদেবাঃ, সরস্বতী। চতুর্থ সূক্তের দেবতা আবার ইন্দ্র, ঋকবেদে ইন্দ্রেরই প্রাধান্য। ষষ্ঠতে মরুতগণ - তাঁরা বায়ু থেকে আলাদা - ১২ নং সূক্তে আবার অগ্নি দেবতা- ইন্দ্রের পরে অগ্নির স্থান ঋকবেদে, ১৩ নং সূক্ত আপ্রীসূক্ত, এটির প্রয়োগ পশুযজ্ঞে- ১০-টি এরকম আপ্রীসূক্ত আছে ঋকবেদে। এর দেবতাও অগ্নি। এই সূক্তে অবশ্য অগ্নির ১২-টি মূর্তির স্তব করা হয়েছে। ১৪ নং সূক্তে অনেক দেবতা- বিশ্বদেবাঃ, ইন্দ্র, বায়ু,অগ্নি, মিত্র, বৃহäপতি, পূষা, ভগ, আদিত্য ও মরুদগণ। ১৫ নং সূক্তেরও অনেক দেবতা, ঋতুরাই প্রধানতঃ এই সূক্তের দেবতা। ১৬ নং- এ ইন্দ্র একা দেবতা, ১৭-তে ইন্দ্র ও বরুণ, ১৮-তে দেবতা ব্রহ্মণস্পতি- যদিও তাঁর পরিচয় বিশেষ ভাবে উল্লিখিত নেই, আরও ইন্দ্র ও সোম, দক্ষিণা ও সদসস্পতি বা নারাশংস বলে এক দেবতা আছেন। ১৯-তে দেবতা অগ্নি ও মরুত্, বৈদিক দেবতাদের মোটামুটি তালিকা এই রকম। এই তালিকায় বত্র্তমানে পূজিত ব্রহ্মা, বিষুÎ, মহেশ্বর, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, কাত্র্তিক, গণেশ - এরা কেউ নেই। ঋে±÷দের অন্য স্থানে বিষুÎর উল্লেখ আছে, শিবের বদলে রুদ্রকে, ব্রহ্মার বদলে প্রজাপতি ও লক্ষ্মীর স্থানে শ্রীকে স্তুতি করা হয়েছে। কিন্তু বাকীদের বৈদিক আবাস নেই। ঋকবেদ অনুযায়ী ৩৩ জন দেবতা আছেন কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের নামের উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে, রামায়ণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ৩৩ জন দেবতার কথাই বলা আছে। তাহলে প্রশ্ন এই ৩৩ জন কী করে তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, তার সঙ্গত কোন উত্তর দেওয়া যায় না। তবে ৩৩ জন দেবতা কে কে ঋকবেদে তার উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে ও মহাভারতে এদের শ্রেণীবিভাগ ও নাম পাওয়া যায়।
শ্রেণীবিভাগটি এই রকম- ১২ জন আদিত্য, ১১ জন রুদ্র এবং আটজন বসু।
'আদিত্য', 'রুদ্র' এবং 'বসু' বিশেষ এক দেবতার নাম নয়, দেবতার জাতি বা শ্রেণীবাচক মাত্র। এ ভাবে আমরা ৩১ জন দেবতার হিসেব পাই; দ্যাবা ও পৃথিবী এই দুটি নিয়ে মোট ৩৩ জন হয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এঁদের নামোল্লেখ আছে। নামের তালিকাটি এ রকম-
'আদিত্য', 'রুদ্র' এবং 'বসু' বিশেষ এক দেবতার নাম নয়, দেবতার জাতি বা শ্রেণীবাচক মাত্র। এ ভাবে আমরা ৩১ জন দেবতার হিসেব পাই; দ্যাবা ও পৃথিবী এই দুটি নিয়ে মোট ৩৩ জন হয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এঁদের নামোল্লেখ আছে। নামের তালিকাটি এ রকম-
আদিত্য - অংশ, ভগ, মিত্র, জলেশ্বর, বরুণ ধাতা, অর্যমা, জয়ন্ত, ভাস্কর,ত্বষ্টা,পূষা, ইন্দ্র, বিষুÎ।
রুদ্র - অজ, একপদ, অহিব্রধু,পিণাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষকপি,শম্ভু, হবন, ঈস্বর।
বসু - ধর, ধ্রুব,সোম, সবিতা, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস।
গল্পে, কথকতায় এরাই তেত্রিশ কোটি হয়েছেন খুব সম্ভবত।
রুদ্র - অজ, একপদ, অহিব্রধু,পিণাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষকপি,শম্ভু, হবন, ঈস্বর।
বসু - ধর, ধ্রুব,সোম, সবিতা, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস।
গল্পে, কথকতায় এরাই তেত্রিশ কোটি হয়েছেন খুব সম্ভবত।
ঋকবেদ সংহিতা সব চেয়ে প্রাচীন, পণ্ডিতদের মতে। আগে যে দেবতাদের নাম বলেছি, তাঁরা আবার সকলেই ঋকবেদে নেই। আবার এমন নামও পাওয়া যায,যাঁরা ঐ তালিকায় নেই। ঋকবেদে কতগুলি আদিত্যের নাম আছে, রুদ্র ও বসু শব্দ দুটি বহূবচনে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু বারো জন আদিত্য, এগারো জন রুদ্র, আট জন বসু এমন উল্লেখও নেই। ঋকবেদে নীচে উল্লিখিত দেবতাদের নাম পাওয়া যায়।
১) মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড, সূর্য, সবিতা ও ইন্দ্র । এঁদের ঋকবেদে কোথাও না কোথাও আদিত্য বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আবার অর্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড- এঁদের কোন প্রাধান্য নেই।
২) মিত্র, সূর্য, বরুণ, সবিতা, ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। এ ছাড়া- অগ্নি, বায়ু, মরুদগণ, বিষ্ণু, পজ্র্জন্য, পূষা, ত্বষ্ঠা, অশ্বিনী দুজন, সোম এরাও প্রাধান্য পেয়েছেন।
৩) বৃহ্রপতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব আছে।
৪) ত্রিত, আপ্তা, অধিব্রধ ও অজএকপাদেরও নাম পাওয়া যায় কোন কোন অংশে।
৫) বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মা- এই কটি নাম দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায়।
৬) কজন দেবীও আছেন। অদিতি ও ঊষা প্রধানা।
৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহী, হোত্রা, বরুত্রী, ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী, গুঙ্গু, শ্রদ্ধা ও শ্রী- এঁরা দেবী পদভিষিক্তা। তা ছাড়া পরিচিত সব নদীরাও স্তুত হয়েছেন।
এখন আদিত্যদের সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। আদিত্য শব্দে সাধারণতঃ সূর্য বোঝায়। বারোজন আদিত্য বলতে বারোটি সূর্য বোঝায় তা হলে। কিন্তু অনেক পণ্ডিত আবার বারোজন আদিত্য বলতে বারোটি মাস বোঝান। আবার অন্য মতে আদিত্য দেবতাদের সাধারণ নাম।
এবার যদি আমরা আদিত্য শব্দের প্রকৃত অর্থ খুঁজি, তা হলে দেখি 'দিব্' ধাতু বন্ধনে বা ছেদনে ব্যবহৃত হলে কী অর্থ দাঁড়ায়? দিতি, যার বন্ধন নাই, কিন্তু সীমা আছে, তাই খণ্ডিত বা ছিন্ন। অদিতি, যার বন্ধন নাই, অখণ্ড, অচ্ছিন্ন, অসীম, যে অনন্ত; এই জড় জগত্, সূর্য, চন্দ্র, আকাশ, মেঘ সবই সেই অখণ্ড বা অনন্ত থেকে উত্পন্ন বা জাত। অদিতি অনন্ত- তাই তিনি দেবমাতা। আর দেবতারা আদিত্য, কারণ দেবতারাও অনন্ত থেকে উত্পন্ন।
কিন্তু আবার একটি প্রশ্ন আসে- সব দেবতাদের মাতাই কী অদিতি? বেদে এর ঠিক উল্লেখ নেই। অদিতিই সব দেবতার মাতা এটি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কথা। বেদে যে হিন্দু ধর্মের অঙ্কুর জন্মেছিল, পুরাণ ইতিহাসে তা সম্পূর্ণতা পায়। পৌরাণিকেরা বুঝেছিলেন, এই যে অনন্ত- অনন্ত কাল ও অনন্ত স্থিতি, অনন্ত জড় পরম্পরা, অনন্ত জীব পরম্পরা- তিনিই অদিতি - তিনিই সর্বপ্রসূতি। তাই যা তেজঃদীপ্ত, যাই সুন্দর, দীপ্তিমান, মহত্, বলবান- আকাশ, চন্দ্র, বরুণ, মরুত্, পর্জন্য, সকলেরই প্রসূতি তিনি। তাই তিনি দেবমাতা। কিন্তু ঋকবেদে অদিতির এতটা বিস্তার পাওয়া যায় না। তিনি অনন্ত বটে- কিন্তু তা হচ্ছে অনন্ত আকাশ তাই বেদে অদিতি কেবল সূর্যাদি আদিত্যদের মাতা। অদিতি যে আকাশ অর্থে বেদকাররা ব্যবহার করেছেন তা বেদের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। যেমন ঋকবেদের দশম মণ্ডলের তেষট্টি নং সূক্তের তৃতীয় ঋকে বলা হয়েছে 'যেভ্যো মাতা মধুমত্ পিন্বতে পয়োঃ পীযুষং দ্যেÝরদিতিরদ্রিবহ' ইত্যাদি। এখানে অদিতির বিশেষণ 'দ্যৌ' শব্দ। এর অর্থ আকাশ।
২) মিত্র, সূর্য, বরুণ, সবিতা, ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। এ ছাড়া- অগ্নি, বায়ু, মরুদগণ, বিষ্ণু, পজ্র্জন্য, পূষা, ত্বষ্ঠা, অশ্বিনী দুজন, সোম এরাও প্রাধান্য পেয়েছেন।
৩) বৃহ্রপতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব আছে।
৪) ত্রিত, আপ্তা, অধিব্রধ ও অজএকপাদেরও নাম পাওয়া যায় কোন কোন অংশে।
৫) বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মা- এই কটি নাম দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায়।
৬) কজন দেবীও আছেন। অদিতি ও ঊষা প্রধানা।
৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহী, হোত্রা, বরুত্রী, ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী, গুঙ্গু, শ্রদ্ধা ও শ্রী- এঁরা দেবী পদভিষিক্তা। তা ছাড়া পরিচিত সব নদীরাও স্তুত হয়েছেন।
এখন আদিত্যদের সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। আদিত্য শব্দে সাধারণতঃ সূর্য বোঝায়। বারোজন আদিত্য বলতে বারোটি সূর্য বোঝায় তা হলে। কিন্তু অনেক পণ্ডিত আবার বারোজন আদিত্য বলতে বারোটি মাস বোঝান। আবার অন্য মতে আদিত্য দেবতাদের সাধারণ নাম।
এবার যদি আমরা আদিত্য শব্দের প্রকৃত অর্থ খুঁজি, তা হলে দেখি 'দিব্' ধাতু বন্ধনে বা ছেদনে ব্যবহৃত হলে কী অর্থ দাঁড়ায়? দিতি, যার বন্ধন নাই, কিন্তু সীমা আছে, তাই খণ্ডিত বা ছিন্ন। অদিতি, যার বন্ধন নাই, অখণ্ড, অচ্ছিন্ন, অসীম, যে অনন্ত; এই জড় জগত্, সূর্য, চন্দ্র, আকাশ, মেঘ সবই সেই অখণ্ড বা অনন্ত থেকে উত্পন্ন বা জাত। অদিতি অনন্ত- তাই তিনি দেবমাতা। আর দেবতারা আদিত্য, কারণ দেবতারাও অনন্ত থেকে উত্পন্ন।
কিন্তু আবার একটি প্রশ্ন আসে- সব দেবতাদের মাতাই কী অদিতি? বেদে এর ঠিক উল্লেখ নেই। অদিতিই সব দেবতার মাতা এটি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কথা। বেদে যে হিন্দু ধর্মের অঙ্কুর জন্মেছিল, পুরাণ ইতিহাসে তা সম্পূর্ণতা পায়। পৌরাণিকেরা বুঝেছিলেন, এই যে অনন্ত- অনন্ত কাল ও অনন্ত স্থিতি, অনন্ত জড় পরম্পরা, অনন্ত জীব পরম্পরা- তিনিই অদিতি - তিনিই সর্বপ্রসূতি। তাই যা তেজঃদীপ্ত, যাই সুন্দর, দীপ্তিমান, মহত্, বলবান- আকাশ, চন্দ্র, বরুণ, মরুত্, পর্জন্য, সকলেরই প্রসূতি তিনি। তাই তিনি দেবমাতা। কিন্তু ঋকবেদে অদিতির এতটা বিস্তার পাওয়া যায় না। তিনি অনন্ত বটে- কিন্তু তা হচ্ছে অনন্ত আকাশ তাই বেদে অদিতি কেবল সূর্যাদি আদিত্যদের মাতা। অদিতি যে আকাশ অর্থে বেদকাররা ব্যবহার করেছেন তা বেদের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। যেমন ঋকবেদের দশম মণ্ডলের তেষট্টি নং সূক্তের তৃতীয় ঋকে বলা হয়েছে 'যেভ্যো মাতা মধুমত্ পিন্বতে পয়োঃ পীযুষং দ্যেÝরদিতিরদ্রিবহ' ইত্যাদি। এখানে অদিতির বিশেষণ 'দ্যৌ' শব্দ। এর অর্থ আকাশ।
শতপথ ব্রাহ্মণে আছে 'ইয়ং বৈ পৃথিবী অদিতি' এখানে অনন্ত অর্থে পৃথিবীকে অদিতি বলা হয়েছে। অথব্র্ব বেদে পৃথিবী থেকে অদিতির পার্থক্য করা হয়েছে। যেমন, 'ভূমির্মাতা অদিতি নো জনিত্রং ভ্রাতান্তরীক্ষম্'। এখানে তিন লোককেই ধরা হয়েছে।এখানেও অদিতি স্পষ্টতই আকাশ। তাই বলা যায় অদিতি প্রধানা একজন বৈদিক দেবী হলেও এই শব্দের দ্বারা আকাশকেই বুঝিয়েছেন বেদকারগণ। তাই আকাশ দেবতাও বলা যেতে পারে অদিতিকে। প্রকৃতপক্ষে ঋকবেদের দেবতারা হয়,
১) আকাশ দেবতা- যেমন: অদিতি, দ্যেÝ, বরুণ, ইন্দ্র, পর্জন্য - নয় তো,
২) সূর্যz দেবতা- যেমন: সূর্যz, মিত্র, সবিতা, পূষা, বিষুÎ - নয় তো,
৩) অগ্নি দেবতা- যেমন: অগ্নি, বৃহ্রপতি, ব্রহ্মণস্পতি, রুদ্র - নয়,
৪) অন্যান্য আলোক দেবতা- যেমন: সোম, ঊষা. অশ্বীদ্বয় - নয়,
৫) বায়ু দেবতা- যেমন: বায়ু, মরুদগণ - নয়,
৬) সৃষ্টিকত্র্তা- যেমন: প্রজাপতি, হিরণ্যগর্ভ, পুরুষ, বিশ্বকর্মা ;
৭) ত্বষ্টা; যম এরকম দুচারজন এই শ্রেণীর বাইরে।
১) আকাশ দেবতা- যেমন: অদিতি, দ্যেÝ, বরুণ, ইন্দ্র, পর্জন্য - নয় তো,
২) সূর্যz দেবতা- যেমন: সূর্যz, মিত্র, সবিতা, পূষা, বিষুÎ - নয় তো,
৩) অগ্নি দেবতা- যেমন: অগ্নি, বৃহ্রপতি, ব্রহ্মণস্পতি, রুদ্র - নয়,
৪) অন্যান্য আলোক দেবতা- যেমন: সোম, ঊষা. অশ্বীদ্বয় - নয়,
৫) বায়ু দেবতা- যেমন: বায়ু, মরুদগণ - নয়,
৬) সৃষ্টিকত্র্তা- যেমন: প্রজাপতি, হিরণ্যগর্ভ, পুরুষ, বিশ্বকর্মা ;
৭) ত্বষ্টা; যম এরকম দুচারজন এই শ্রেণীর বাইরে।
এখন এরকম বলা যায় যে যখন আকাশকে অনন্ত বলে ভাবি, তখন আকাশ অদিতি। যখন আকাশকে বৃষ্টিকারক বলে ভাবি, তখন আকাশ ইন্দ্র। যখন আকাশকে আলোকময় ভাবি, তখন দ্যৌঃ। ঠিক এ ভাবেই সূর্যz, অগ্নি, বায়ু - তাদের ভিন্ন ভিন্ন শক্তির ভিত্তিতে- ভিন্ন ভিন্ন বৈদিক দেবের উত্পত্তি করেছেন বেদকার ও পুরাণকাররা। বৃষ্টিকারী আকাশই ইন্দ্র বুঝলে, ইন্দ্র সম্বন্ধে যত গুণ বেদ, পুরাণ, ইতিহাসে বলা হয়েছে তা বোঝা যায়। যিনি বৃষ্টি করেন, তিনিই বজ্রপাত করেন। ইন্দ্রই তাই বজ্রধর।
পণ্ডিতেরা ঋে±÷দের সূক্তগুলি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কতগুলি সূক্ত প্রাচীন, কিছু অপেক্ষাকৃত আধুনিক। এটা অসম্ভব কিছু নয়। সংহিতা সঙ্কলিত গ্রন্থ, নানা সময়ে নানান ঋষির দ্বারা রচিত মন্ত্রগুলির সমাহার। এর মধ্যে কিছু আগে আর কিছু পরে অবশ্যই রচিত। আধুনিক সূক্তগুলিতে ইন্দ্র শরীরী, চৈতন্যযুক্ত দেবতা হয়েছেন, ঋষিরা ইন্দ্রের উত্পত্তির কথা ভুলে গেছেন। কিন্তু প্রাচীন সূক্তগুলিতে ইন্দ্র যে আকাশ তাই ঋষিরা মনে রেখেছেন সূক্ত রচনাকালে।
বেদে পাওয়া যায় যে বৃত্র, নমুচি, শম্বর প্রভৃতি অসুররা ইন্দ্রের শত্রু ছিল। ইন্দ্র তাদের বজ্র দ্বারা বধ করলে জল ছুটতে থকে। এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এই যে এই সব অসুররা বৃষ্টি হবার প্রাকৃতিক বাধা মাত্র। তাই সবই প্রাকৃতিক শক্তির বিকাশ ও গুণ যা বেদে দেবতা বলে পূজিত।
পুরাণ- ইতিহাসকাররা গল্প বানিয়েছেন অনেক এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে নিয়ে। কখনও তা কুরুচিরও পরিচয় বহন করে অন্যের সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অহল্যার উপাখ্যান। কথিত আছে ইন্দ্র গৌতমপত্নী অহল্যাকে হরণ করেন এবং ঋষি গৌতমের শাপে তাঁর শরীর বিকৃত হয়। তারপর সেই বিকৃত শরীর রূপান্তরিত হয়- সহস্র চোখ হয় ইন্দ্রের শরীরে। এরকম যুক্তিহীন, কষ্টকল্পিত গল্পের জন্য হিন্দুধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধাও পোষণ করেছেন অনেকে। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে মূর, ম্যzকস্মুলার, লাসেন প্রভৃতি মন্তব্য করেছেন লাম্পট্যপ্রিয় হিন্দু শাস্ত্রকাররা লাম্পট্যপ্রিয়তা বশতঃই ইন্দ্রাদি দেবতাকে এই রকম লম্পটরূপে চিত্রিত করেছেন।
যুক্তিবাদী মনই বুঝতে পারবে ইন্দ্র কেন সহস্রাক্ষ। ইন্দ্র আকাশ- আর আকাশের হাজার চোখ কে না দেখেছে? ষহস্র তারাযুক্ত আকাশই সহস্রচক্ষু ইন্দ্র। প্রাচীন গ্রীসেও এই কথা প্রচলিত ছিল। তারা বলে আর্গস শতাক্ষ। এবার অহল্যার কথাটা বিশ্লেষণ করা যায়। অহল্যা অর্থাত্ যে ভুমি হল বা লাঙল দিয়ে কর্ষণ অর্থাত্ চাষের উপযুক্ত করা যায় না- কঠিন অনুব্র্বর ভূমি। ইন্দ্র বর্ষণ করে সেই ভূমিকে কোমল করেন জীর্ণ করেন- বৃষ্টির দ্বারা ইন্দ্র অহল্যাতে প্রবেশ করেন, এই জন্য তিনি অহল্যাতে গমন করেন। আবার এই অর্থটিও গ্রহণ করা যায়। অহন্ অর্থাত্ দিনকে লয় করে বলে রাত্রির নাম অহল্যা। তেজোময় সবিতা ঐশ্বর্যzময় বলে ইন্দ্র পদবাচ্য। রাত্রিকে ক্ষয় বা জীর্ণ করেন বলে ইন্দ্র অর্থাত্ সবিতা অহল্যাজার, ব্যাভিচারী জার নয়। এবার কিছুটা পরিষ্কার হল ইন্দ্রাদি দেবতারা কোথা থেকে এসেছেন এই প্রশ্নের।
এখন এই অচেতন বর্ষণকারী আকাশকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করার উত্তর এই যে অচেতন আকাশকে ভিত্তি করেই আমরা জগদীশ্বরের শক্তি মহিমা দয়ার পরিচয় পাই। তাই আকাশকে সচেতন ভেবে ইন্দ্রের উপাসনা। এই আকাশ নিজে অচেতন হয়েও জগদীশ্বরের বর্ষণশক্তির বিকাশস্থল। এই অনন্ত করুণাময়ের গুণে পৃথিবী বৃষ্টি পেয়ে শীতল, জলশালিনী, শষ্যশালিনী, জীবশালিনী হয়। তাই আকাশকে পূজা করলে ঈশ্বরকে পূজা করা হয়। ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তাঁর শক্তি ও দয়ার পরিচয় পাই আমরা এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির মাধ্যমে। যেখানেই এই শক্তির প্রকাশ- যে মাধ্যমেই তাঁর প্রকাশ, তাই উপাসনার বিষয়। তা না হলে তাঁর প্রতি আন্তরিক ভক্তির প্রকাশ বা স্ফুরণ হয় না। জগতে যা কিছু মহত্, সুন্দর, শক্তিমান তাঁর উপাসনা করে হৃদয় তৃপ্ত হয়। হিন্দুধর্মে চিত্তের বৃত্তিকে স্থান দেওয়া হয়েছে সর্বাগ্রে। এটাই হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ।
হিন্দুধর্মে ঈশ্বর ভিন্ন আর দেবতা নাই এবং ঈশ্বরই বিশ্বরূপ। তাই যেখানেই তাঁর রূপ, সেখানেই তাঁর পূজা। সেই অর্থে ইন্দ্রাদি দেবতার উপাসনা পূণ্যময়।
এবার আসি বরুণাদি দেবতাদের কথায়- বরুণ আর একজন আকাশ দেবতা- 'বৃ' ধাতু আবরণে, যা সচরাচর বিশ্বকে আবরণ করে আছে তাই বরুণ। তাই আকাশ যখন সর্ব আবরণকারী, তখন সে বরুণ- পুরাণে অবশ্য আকাশ দেবতা নন, তিনি জলেশ্বর। ঋকবেদেও কোথাও কোথাও তিনি জলাধিপতি বলে চিহ্নিত হয়েছেন। তার কারণ বেদে পৃথিবীর বায়বীয় আবরণ অনেক জায়গায় জল বলে বর্ণিত হয়েছে। ঋকবেদে বরুণের প্রাধান্য অনেক। তাঁকে রাজা বা সম্রাট বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইউরোপীয় অনেক পণ্ডিতের মতে বরুণ বৈদিক উপাসকদের প্রধান দেবতা ছিলেন, পরে ইন্দ্র সেই স্থান অধিকার করে। পৌরাণিক কাহিনীতে অবশ্য বরুণ ক্ষুদ্র দেবতা। আর একটি আকাশদেবতা পর্জন্য। ইনিও ইন্দ্রের ন্যায় সব কাজ করেন এবং ইন্দ্রের অপেক্ষা প্রাচীন। ইন্দ্রের নাম ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও নেই। আর্যেরা ভারতবর্ষে এলে এর সৃষ্টি হয়। তাই ইন্দ্র পর্জন্যর পরবর্তী।
এবার আসি বরুণাদি দেবতাদের কথায়- বরুণ আর একজন আকাশ দেবতা- 'বৃ' ধাতু আবরণে, যা সচরাচর বিশ্বকে আবরণ করে আছে তাই বরুণ। তাই আকাশ যখন সর্ব আবরণকারী, তখন সে বরুণ- পুরাণে অবশ্য আকাশ দেবতা নন, তিনি জলেশ্বর। ঋকবেদেও কোথাও কোথাও তিনি জলাধিপতি বলে চিহ্নিত হয়েছেন। তার কারণ বেদে পৃথিবীর বায়বীয় আবরণ অনেক জায়গায় জল বলে বর্ণিত হয়েছে। ঋকবেদে বরুণের প্রাধান্য অনেক। তাঁকে রাজা বা সম্রাট বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইউরোপীয় অনেক পণ্ডিতের মতে বরুণ বৈদিক উপাসকদের প্রধান দেবতা ছিলেন, পরে ইন্দ্র সেই স্থান অধিকার করে। পৌরাণিক কাহিনীতে অবশ্য বরুণ ক্ষুদ্র দেবতা। আর একটি আকাশদেবতা পর্জন্য। ইনিও ইন্দ্রের ন্যায় সব কাজ করেন এবং ইন্দ্রের অপেক্ষা প্রাচীন। ইন্দ্রের নাম ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও নেই। আর্যেরা ভারতবর্ষে এলে এর সৃষ্টি হয়। তাই ইন্দ্র পর্জন্যর পরবর্তী।
এবার সূর্যদেবতাদের কথা কিছুটা জানার চেষ্টা করি। সূর্যদেবতা সংখ্যায় অনেক। যথা: সূর্য, সবিতা, পূষা, মিত্র, অর্যমা, ভগ, বিষুÎ। সূর্যকে আমরা রোজ দেখি। তার পরিচয় দেওয়ার বিশেষ দরকার নেই, যজুর্বেদের মাধ্যন্দিনী শাখার ৩৪ নং অধ্যায়ে ব্রহ্মযজ্ঞ পাঠে কতগুলি দেবতার স্তুতি আছে। তার মধ্যে রাত্রি, ঊষা ও প্রাতস্তুতির পর কতগুলি সৌরদেবতার স্তুতি আছে। প্রথমে 'ভগ', তার পর 'পূষা' তার পর 'অর্জমা'- র স্তুতি। বিষুÎস্তুতি সব শেষে। পণ্ডিতবর সত্যব্রত সামশ্রমী এই চারটি সূর্যদেবতার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলেছেন, "ঊষোদয়ের পরেই প্রাতঃকাল- ইহাকেই অরুণোদয়কাল কহে। প্রাতঃকালের পরই ভগোদয় কাল - অর্থাত্ অরুণোদয়ের পরেই যখন সূর্যের প্রকাশ অপেক্ষাকৃত তীব্র হইয়া উঠে, ভগ সেই কালের সূর্য।"
- " যে পর্যন্ত সূর্যের তেজ অত্যুগ্র না হয়, তাবত্ তাদৃশ স্বল্পতেজের সূর্যকে পূষা কহে, অর্থাত্ পূষা ভগোদয়ের পরবর্তীকালের সূর্য।"
- "পুষোদয়ের পরেই অর্কোদয় কাল- ইঁহার পরেই মধ্যাহ্ন। এই কালের সূর্যকেই অর্ক বা অর্যমা কহে। এই অর্যমার অস্তেই পূর্বাহ্ন শেষ হয়।"
- "মধ্যাহ্নকালের সূর্যকে বিষুÎ কহে।"
- " যে পর্যন্ত সূর্যের তেজ অত্যুগ্র না হয়, তাবত্ তাদৃশ স্বল্পতেজের সূর্যকে পূষা কহে, অর্থাত্ পূষা ভগোদয়ের পরবর্তীকালের সূর্য।"
- "পুষোদয়ের পরেই অর্কোদয় কাল- ইঁহার পরেই মধ্যাহ্ন। এই কালের সূর্যকেই অর্ক বা অর্যমা কহে। এই অর্যমার অস্তেই পূর্বাহ্ন শেষ হয়।"
- "মধ্যাহ্নকালের সূর্যকে বিষুÎ কহে।"
মিত্র সূর্য, কিন্তু মিত্র বরুণের ভাই। বেদে যেখানে মিত্রের স্তুতি সেখানেই বরুণের স্তুতি। এই দুজন বেদের দুই প্রধান দেবতা। আদিত্য শব্দ এই দুই দেবতা সম্বন্ধে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনটি অন্য দেবতা সম্বন্ধে হয় নি। প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই আসে- বরুণ আকাশ তবে মিত্র সূর্য কী করে হলেন? তৈত্তিরীয় সংহিতায় আছে- দিন ছিল না, রাত্রি ছিল না, জগত্ অব্যাকৃত ছিল, তখন দেবতারা মিত্র বরুণকে বললেন- তোমরা একে বিভাগ কর। মিত্র দিবা করলেন, বরুণ রাত্রি করলেন।
সায়নাচার্য বলেছেন, "অস্তং গচ্ছন্ সূর্য এব বরুণ ইতি উচ্যতে- স হি স্বগমনেন রাত্রিং জনয়তি।" অর্থাত্, অস্তগামী সূর্যকে বরুণ বলে, তিনি আপনার গমনের দ্বারা রাত্রির সৃষ্টি করেন। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে- "অয়ং হি লোকো মিত্রঃ। অসৌ বরুণঃ।" অর্থাত্ ইহলোকে মিত্র, পরলোকে বরুণ। বরুণ সর্ব আবরণকারী অন্ধকার - তিনি সর্বত্রই আছেন, যেখানে মিত্র আলো করেন, সেখানেই আলো হয়। অন্যত্র অন্ধকার।
সায়নাচার্য বলেছেন, "অস্তং গচ্ছন্ সূর্য এব বরুণ ইতি উচ্যতে- স হি স্বগমনেন রাত্রিং জনয়তি।" অর্থাত্, অস্তগামী সূর্যকে বরুণ বলে, তিনি আপনার গমনের দ্বারা রাত্রির সৃষ্টি করেন। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে- "অয়ং হি লোকো মিত্রঃ। অসৌ বরুণঃ।" অর্থাত্ ইহলোকে মিত্র, পরলোকে বরুণ। বরুণ সর্ব আবরণকারী অন্ধকার - তিনি সর্বত্রই আছেন, যেখানে মিত্র আলো করেন, সেখানেই আলো হয়। অন্যত্র অন্ধকার।
সবিতা ও গায়ত্রী - সূর্যকে আবার সবিতাও বলা হয়। এই সবিতা নামটি নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্পত্তি হয়। প্রসিদ্ধ গায়ত্রীমন্ত্রে যেখানে সবিতা আছেন (তত্সবিতুঃ) সেখানে তিনি স্বয়ং পরব্রহ্ম পরমেশ্বর বলে পরিচিত। অনেকেই সবিতা অর্থে জগত্স্রষ্টাকেই বোঝেন। সবিতা সেই গায়ত্রীর দেবতা। গায়ত্রী কেবলই তাঁর স্তব। তাই আগে একটি সন্দেহের নিরসন করতে হয় এই সবিতা কি কেবল একটি বৃহত্ জড়পিণ্ড, না সর্বস্রষ্টা, অনন্তচৈতন্য পরমেশ্বর।
'সু' ধাতু থেকে সবিতৃ শব্দ উত্পন্ন হয়েছে, তাই সবিতা অর্থে প্রসবিতা। কার প্রসবিতা? নিরুক্তকার যাস্ক বলেন, "সর্বস্য প্রসবিতা"। সায়নাচার্য গায়ত্রীর ব্যাখ্যার সময় বলেন, "তত্সবিতুঃ" অর্থাত্ 'জগত্প্রসবিতুঃ'। তা হলে সবিতা পরব্রহ্ম পরমেশ্বর। রঘুনন্দন ভট্টাচার্যি প্রমুখেরা একই ব্যাখ্যা করেন। বেদের একস্থানে তাঁকে প্রজাপতি বলা হয়েছে। আর একস্থানে বলা হয়েছে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র কেউই তাঁর বিরোধী হতে পারে না। জল বায়ু তাঁর আজ্ঞাকারী, অন্য দেবতারা তাঁর অনুগামী।বরুণ, মিত্র, অর্যমা, অদিতি ও বসুগণ তাঁর স্তুতি করেন- তিনি প্রার্থনার বস্তু ঈশ্বর; আমাদের কাম্য বস্তু সব দান করেন। তিনি ভূবনের প্রজাপতি। কথাগুলি যেন কেবল পরমেশ্বরকেই বোঝায়।
অন্যদিকে বলা যায় ঋকবেদের সূক্তের একটি লক্ষণ এই যে, যখন যে দেবতা স্তুত হন, তখন তিনিই সকলের বড় হয়ে ওঠেন। সবিতা যে সূর্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তা ঋকবেদের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। যথা:
১) চতুর্থ মণ্ডলের চতুর্দশ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে।
২) সূর্যের ন্যায় তাঁর রূপ ও কিরণ (প্রসুবন্নক্তভির্জগত্) চতুর্থ মণ্ডল, ৫৩ নং সূক্ত তৃতীয় ঋক
৩) যাস্ক বলেন, "যখন আকাশ থেকে অন্ধকার গেছে, রশ্মি বিকীর্ণ হয়েছে, সেই সবিতার কাল।" সায়নাচার্য বলেন, "উদয়ের পূর্বে যে মূর্ত্তি, সেই সবিতা, উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত যে মূর্ত্তি, সেই সূর্য।"
৪) তাই দেখা গেল এদের মতে সবিতা পরব্রহ্ম নন।
'সু' ধাতু থেকে সবিতৃ শব্দ উত্পন্ন হয়েছে, তাই সবিতা অর্থে প্রসবিতা। কার প্রসবিতা? নিরুক্তকার যাস্ক বলেন, "সর্বস্য প্রসবিতা"। সায়নাচার্য গায়ত্রীর ব্যাখ্যার সময় বলেন, "তত্সবিতুঃ" অর্থাত্ 'জগত্প্রসবিতুঃ'। তা হলে সবিতা পরব্রহ্ম পরমেশ্বর। রঘুনন্দন ভট্টাচার্যি প্রমুখেরা একই ব্যাখ্যা করেন। বেদের একস্থানে তাঁকে প্রজাপতি বলা হয়েছে। আর একস্থানে বলা হয়েছে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র কেউই তাঁর বিরোধী হতে পারে না। জল বায়ু তাঁর আজ্ঞাকারী, অন্য দেবতারা তাঁর অনুগামী।বরুণ, মিত্র, অর্যমা, অদিতি ও বসুগণ তাঁর স্তুতি করেন- তিনি প্রার্থনার বস্তু ঈশ্বর; আমাদের কাম্য বস্তু সব দান করেন। তিনি ভূবনের প্রজাপতি। কথাগুলি যেন কেবল পরমেশ্বরকেই বোঝায়।
অন্যদিকে বলা যায় ঋকবেদের সূক্তের একটি লক্ষণ এই যে, যখন যে দেবতা স্তুত হন, তখন তিনিই সকলের বড় হয়ে ওঠেন। সবিতা যে সূর্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তা ঋকবেদের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। যথা:
১) চতুর্থ মণ্ডলের চতুর্দশ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে।
২) সূর্যের ন্যায় তাঁর রূপ ও কিরণ (প্রসুবন্নক্তভির্জগত্) চতুর্থ মণ্ডল, ৫৩ নং সূক্ত তৃতীয় ঋক
৩) যাস্ক বলেন, "যখন আকাশ থেকে অন্ধকার গেছে, রশ্মি বিকীর্ণ হয়েছে, সেই সবিতার কাল।" সায়নাচার্য বলেন, "উদয়ের পূর্বে যে মূর্ত্তি, সেই সবিতা, উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত যে মূর্ত্তি, সেই সূর্য।"
৪) তাই দেখা গেল এদের মতে সবিতা পরব্রহ্ম নন।
আর একটি প্রমাণ - পরব্রহ্মবাদীরা ঈশ্বরকে নিরাকার বলেন, অথবা বিশ্বরূপ। কিন্তু সবিতা অন্য দেবতাদের মত সাকার। তিনি হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যহস্ত, হিরণ্যজিহু, হিরণ্যপাণি, সুপাণি, সুজিহু, মন্দ্রজিহু, হরিকেশ ইত্যাদি শব্দে বর্ণিত হয়েছেন।
তাই মনে হয়, সবিতা পরব্রহ্ম নন, জড়পিণ্ড সূর্য। তা হলে গায়ত্রীর 'তত্সবিতুঃ' শব্দের মানে কি দাঁড়ায়? গায়ত্রী বস্তুটি বুঝতে পারলে সব দ্বন্দের অবসান হয়। গাযত্রী আর কিছুই নয়, ঋকবেদের একটি ঋক। তৃতীয় মণ্ডলের ৬২- তম সূক্তে ১৮- টি ঋক আছে। দশম ঋক এই গায়ত্রী। এই সূক্তের ঋষি বিশ্বামিত্র - ইন্দ্র, বরুণ, বৃহ্রপতি, পূষা, সবিতা, সোম, মিত্র, বরুণ এই সূক্তের দেবতা। বিশ্বামিত্র এই সূক্তে এদের স্তুতি করেছেন। সবিতা, বন্দিত দেবতাদের একজন। যে ঋকটিকে গায়ত্রী বলা হয়, তা তাঁরই স্তব। দশম ঋকটি:
"তত্সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গ দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো ন: প্রচোদয়াত্" -
অর্থ: সবিতৃদেবের বরণীয় তেজ আমরা ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি দান করেন।
"তত্সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গ দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো ন: প্রচোদয়াত্" -
অর্থ: সবিতৃদেবের বরণীয় তেজ আমরা ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি দান করেন।
যখন ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, সোমাদির সঙ্গে সবিতা স্তুত হয়েছেন, তখন তিনি পরব্রহ্ম না হয়ে সূর্য হবারই সম্ভাবনা।
এই ঋকটির নাম গায়ত্রী কেন? গায়ত্রী একটি ছন্দের নাম। ৬২- তম সূক্তের প্রথম তিনটি ঋক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত। বাকী পনেরটি গায়ত্রীচ্ছন্দে। এই ঋকটির প্রাধান্য আছে বলে এটি গায়ত্রী নামে প্রচলিত। এর প্রাধান্য এর অর্থগৌরবের জন্য। ভারতবর্ষে প্রধান ঋষিরা যখন ব্রহ্মবাদী হলেন আর ব্রহ্মবাদ বেদমূলক বলে প্রচার করতে চাইলেন, তখন থেকেই গায়ত্রীর অর্থ আর সূর্য নয় - ব্রহ্মই হল এবং ব্রাহ্মণমণ্ডলীতে তাই প্রচলিত হল- এবং গায়ত্রী প্রাধান্য পেল। ঋষি যে অর্থই করে থাকুন না কেন, যখন ব্রহ্মপক্ষে গায়ত্রী ব্যবহৃত হল তা সনাতন ধর্ম উপযোগী ও চিত্তশুদ্ধিকারক হল এবং সেই অর্থই প্রচলিত থাকল। তাতে হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ উভয়েরই গৌরব।
বায়ুদেবতারা - বায়ু বা বাত; দ্বিতীয় মরুদগণ- বায়ু সূর্যের মত আমাদের নিত্যপরিচিত। পৌরাণিক দেবতাদের মধ্যে বায়ু পবন নাম ধারণ করেছেন এবং ইন্দ্রাদি দেবতাদের মত একজন দিকপাল। প্রচলিত দেবতাদের মধ্যেই এর স্থান। কিন্তু মরুদগণ বায়ুর মত নন। বায়ু সাধারণ বাতাস, মরুদগণ ঝড়। নামটি সর্বত্রই বহূবচনে আছে। এরা সংখ্যায় ১৮০ জন। কখনও এদের রুদ্রও বলা হয়। ঝড় বড় শব্দ করে, এই জন্য এদের রুদ্র বলা হয়েছে।
তার পর অগ্নিদেবতা- তিনি আমাদের কছে সুপরিচিত। ঋকবেদে আর একটি দেবতা আছেন - তাঁকে কখনও বৃহ্রপতি কখনও বা ব্রহ্মণস্পতি বলা হয়েছে। বৃহ্রপতি দেবগুরু অথবা আকাশের একটি তারা। সোমকে চন্দ্র বলা হয়। কিন্তু ঋকবেদে সোম চন্দ্র নন, সোমরসের দেবতা। অশ্বীদ্বয় পুরাণ, ইতিহাসে অশ্বিনীকুমার বলে খ্যাত। কথিত আছে তাঁরা সূর্যের ঔরসে অশ্বিনীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার এমনও বলা হয় তাঁরা শেষ রাত্রির দেবতা; ঊষার পূর্বগামী দেবতা।
পুরাণ, ইতিহাসের বিশ্বকর্মা ঋকবেদের ত্বষ্টা’ অর্থাত্ দেবতাদের কারিগর।
আরও একজন ঋকবেদের দেবতা যম।
তার পর অগ্নিদেবতা- তিনি আমাদের কছে সুপরিচিত। ঋকবেদে আর একটি দেবতা আছেন - তাঁকে কখনও বৃহ্রপতি কখনও বা ব্রহ্মণস্পতি বলা হয়েছে। বৃহ্রপতি দেবগুরু অথবা আকাশের একটি তারা। সোমকে চন্দ্র বলা হয়। কিন্তু ঋকবেদে সোম চন্দ্র নন, সোমরসের দেবতা। অশ্বীদ্বয় পুরাণ, ইতিহাসে অশ্বিনীকুমার বলে খ্যাত। কথিত আছে তাঁরা সূর্যের ঔরসে অশ্বিনীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার এমনও বলা হয় তাঁরা শেষ রাত্রির দেবতা; ঊষার পূর্বগামী দেবতা।
পুরাণ, ইতিহাসের বিশ্বকর্মা ঋকবেদের ত্বষ্টা’ অর্থাত্ দেবতাদের কারিগর।
আরও একজন ঋকবেদের দেবতা যম।
এতক্ষণে ঋকবেদের দেবদেবীদের মোটামুটি একটা পরিচয় পাওয়া গেল।
প্রবন্ধটি লিখতে বিশেষ করে নীচের গ্রন্থগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।
টীকা:
নিরুক্ত - বেদের দুরূহ শব্দসমূহের ব্যুত্পত্তি ও ব্যাখ্যাসঙ্কলিত গ্রন্থ বিশেষ। যাস্ক প্রমুখ কয়েকজন প্রাচীন পণ্ডিত নিরুক্তকার হিসেবে খ্যাত।
অনুবাক - বিভাগ ও অনুবিভাগ।
প্রবন্ধটি লিখতে বিশেষ করে নীচের গ্রন্থগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।
পিডিফ সমূহঃ
ঋগ্বেদ (মর্মানুসারিণী ব্যাখ্যা)
size: 58.82 Mb
ঋগ্বেদ (১ম অষ্টক, ১ম অধ্যায়)
— শ্রীমতিলাল দাশ
size: 5.53 Mb
ঋগ্বেদ (সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ)
— রমেশচন্দ্র দত্ত
size: 74.54 Mb
ঋগ্বেদীয় পুরুষসূক্ত
—শ্রীশ্রীযুক্তেশ্বর ব্রহ্মব্রত সামাধ্যায়িসরস্বতী
size: 7.2 Mb
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ