বৈষ্ণব আন্দোলনের জবাব - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

12 November, 2017

বৈষ্ণব আন্দোলনের জবাব


বৈষ্ণব আন্দোলন

ন তস্য প্রতিমা অস্তি - প্রকৃত অর্থ বিশ্লেষণ


প্রথমে বৈষ্ণবদের ভন্ডামি দেখাবো 
তার পর খন্ডন দেখাবো প্রকৃত বৈদিক মত দ্বারা
বৈষ্ণবদের ভন্ডামি ঃ

দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-৩


‘ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ’ ৷
(শুক্লযজুর্বেদ ৩২৷৩)

বেদের এই মন্ত্রাংশটুকু তুলে ধরে আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (ও মুসলিমগণ) দাবি করে যে মূর্তিপূজা বেদ বিরোধী ৷ আসুন বিবেচনা করা যাক তার এই দাবি কতটুকু যুক্তিসংগত ৷

প্রথমতঃ অভিধানে ‘প্রতিমা’ শব্দের দুই প্রকার অর্থ পাওয়া যায় ৷ যথা—
১)  মূর্তি, বিগ্রহ, ভাস্কর্য 
২) তুল্য করা, পরিমাণ করা, সাদৃশ্য
এখন আমরা দেখব এই দুই প্রকার অর্থের মধ্যে কোনটি উক্ত মন্ত্রের অর্থ নির্ণয়ে যুক্তিযুক্ত ৷
(১) নং অর্থ গ্রহণ করলে উক্ত মন্ত্রের অর্থ দাড়ায়, ‘তাঁহার মূর্তি বা বিগ্রহ নাই যাঁহার নামে মহৎ যশ ৷’
একটু বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে যে এই অর্থ মোটেই সংগত নয় ৷ কারণ মূর্তি কল্পনাই যদি যশস্বীদের যশের হানি করত তবে যতসব রাজ-মহারাজ, লাট, পন্ডিত, এমনকি স্বামী দয়ানন্দেরও যে মূর্তি তৈরী আছে তা দুষ্কৃতির স্তম্ভ বলেই বিবেচিত হতো ৷ জগতে যশস্বী ব্যক্তিগণেরই মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরী করে রাখা হয়, হীন ব্যক্তির নয় ৷
(২) নং অর্থ অনুসারে, ‘তাঁহার তুলনা বা সাদৃশ্য নাই যাঁহার নামে মহৎ যশ ৷’
একথাই কি যশস্বীকে বলা শোভা পায় না যে ‘আপনার তুল্য আর কেহ নাই’ ? কোন কথাতে যশস্বী খুশি হবেন তা আপনারা স্বয়ং বিচার করে দেখুন ৷

এখন উক্ত মন্ত্রের কয়েকটি ভাষ্যব্যাখ্যা, অনুবাদ দেখুন-

ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ ৷
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষ যস্মান্ন জাত ইত্যেষঃ৷৷
[ শুক্ল-যজুর্বেদ ৩২৷৩ ]  

মহীধরভাষ্য: “তস্য” পুরুষস্য “প্রতিমা” প্রতিমানমুপমানং কি়ঞ্চিদ্বস্তু নাস্তি ... ৷ অর্থাৎ মহীধর এখানে প্রতিমা বলতে প্রতিমান উপমান বুঝিয়েছেন, মূর্তি বুঝাননি ৷

মিশ্রভাষ্য: (তস্য) সেই পুরুষের (প্রতিমা) প্রতিমান উপমান সদৃশ উপমা দেওয়ার যোগ্য কোনো বস্তু (ন, অস্তি) নাই ; (যস্য) যার (নাম) নাম প্রসিদ্ধ (মহৎ) বড় (যশঃ) যশ আছে অর্থাৎ সর্বাধিক তাঁর যশ ৷ এই বেদের “হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ” [২৫৷১০-১৩] “মা মা হিংসীদিত্যেষ” [১২৷১০২] এবং “যস্মান্ন জাত ইত্যেষা” [৮৷৩৬,৩৭] ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা তাঁকেই বর্ণনা করা হয়েছে ৷
“আধুনিক অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণ এই মন্ত্রে প্রতিমা অর্থ মূর্তি ধরে বলে যে, ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই আর মূর্তিপূজা উচিত নয় ৷”
      —পণ্ডিত শ্রীজ্বালাপ্রসাদ মিশ্র

✔বেদার্থপারিজাত ভাষ্যের সম্পাদক পণ্ডিত ব্রজবল্লভদ্বিবেদী দর্শনাচার্য প্রদত্ত মন্ত্রার্থ:—
সেই মহানারায়ণ পুরুষের কোন উপমান নেই অর্থাৎ তাঁর সহিত বরাবরী করতে পারে এমন কেউ নেই ৷ তাঁর নাম মহান যশ প্রদায়ক, এ বিষয়ে এই বেদই প্রমাণ ৷ যেমন- “হিরণ্যগর্ভঃ” (২৫৷১০), “মা মা হিংসীৎ” (১২৷১০২), “যস্নান্ন জাতঃ” (৮৷৩৬) ইত্যাদি শ্রুতি তাঁর মহান যশের বর্ণনা করে ৷

✔শ্রীপাদ দমোদার সাতবলেকর লিখেছেন:—
“তার কোন প্রতি-মা নেই এই কথা বলা তাৎপর্য এই যে তার বরাবর শক্তিশালী কেউ নেই৷” (যজুর্বেদকা সুবোধ ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৫৪৩)

✔শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী কৃত বঙ্গানুবাদ:—
এ পুরুষের তুলনা দেবার কোন বস্তু নেই ৷ তার মহৎ যশ আছে ৷ ‘হিরণ্যগর্ভ’ ইত্যাদি, ‘আমাকে হিংসা করো না’ ইত্যাদি, ‘যা থেকে ইন্দ্র প্রভৃতি জাত, তিনি সম্রাট’ ইত্যাদি বাক্যে সে পুরুষকে বলা হয়েছে ৷
(যজুর্বেদ, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী)


চতুর্ব্বেদ ভাষ্যকার শ্রীদূর্গাদাস লাহিড়ী শর্ম্মণ একস্থানে লিখেছেন— “পাশ্চাত্য-শিক্ষিত অনেকে, পাশ্চাত্য দর্শন-বিজ্ঞানের যুক্তিজাল বিন্যস্ত করিয়া, আমাদের প্রতিমা-পূজা প্রভৃতিকে নিষ্ফল হেয় প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পান ৷ কিন্তু সে তাহাদের বিষম ভ্রান্তি ৷ কেননা, ঐ প্রতিমা-পূজার মধ্য দিয়াই প্রতিমার যিনি লক্ষ্যস্থল, তাঁহার নিকট পৌছানো যায় ৷ সমুদ্র যে কি, তাহা কখনও দেখি নাই; অথবা সমুদ্র যে কি, তাহা জানি না; কিন্তু যদি আমি জানি, এই নদীতেই সমুদ্রের রূপকণা আছে, আর এই নদীস্রোতের অনুগমন করিলেই সমুদ্রে উপনীত হওয়া যায়; তাহাতে, তদনুরূপ কর্মের ফলে, সমুদ্র-দর্শন বা সমুদ্রে মিলন আমার পক্ষে সম্ভবপর হইয়া আসে না কি? এজন্যই বলিতে হয়— যাহার যে পথ নির্দিষ্ট আছে, তিনি সেই পথ দিয়াই অগ্রসর হইতে আরম্ভ করুন, অগ্রসর হইতে হইতেই কেন্দ্রস্থানে উপনীত হইতে পারিবেন ৷”
(সামবেদ সংহিতা, প্রথম ৩৪২ সাম দ্রষ্টব্য)

দয়ানন্দের জ্ঞানের ন্যূনতা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আর্য-সমাজ প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সম্পর্কে তার শিষ্যবর্গকে বলেছিলেন,

“সিঁতির বাগানে দেখতে গিয়েছিলাম; দেখলাম—একটু শক্তি হয়েছে; বুকটা সর্বদা লাল হয়ে রয়েচে; বৈখরী অবস্থা— দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই কথা (শাস্ত্রকথা) কচ্চে, ব্যাকরণ লাগিয়ে অনেক কথার (শাস্ত্রবাক্যের) মানে সব উল্টো-পাল্টা করতে লাগল; নিজে একটা কিছু করবো, একটা মত চালাব—এ অহংকার ভেতরে রয়েচে!”
(তথ্যসূত্র : শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, ৪র্থ খণ্ডের ২য় অধ্যায়, প্রসঙ্গ- গুরুভাব ও নানা সাধুসম্প্রদায়। ৯ম সংস্করণে পৃষ্ঠা- ১০৫)

অপরদিকে আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যখন শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখলেন তখন তিনি নিজের জ্ঞানের ন্যূনতা অনুভব করে আক্ষেপ করে বললেন, “আমরা অনেক বেদ-বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহৎ মানুষের মধ্যে তার প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি ৷ এঁনাকে দেখে প্রমাণ হলো যে আমার মতো পন্ডিতেরা শাস্ত্র মন্থন করে কেবল ঘোলটাই খান, কিন্তু এঁনার মতো মহাপুরুষেরা মাখনটা খান ৷”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ১৷১৩৷৫)

ভাবতে অবাক লাগে যে, দয়ানন্দ তার ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে মূর্তিপূজার বিরোধীতা করেছেন, বলেছেন যে মূর্তিপূজা বেদ-বিরোধী ৷ অথচ তিনি যাঁর মধ্যে সমগ্র বেদ-বেদান্তের প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন সেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ—
“মাটির প্রতিমাকে ভগবান ভেবে পূজা করা যদি ভুলই হয়ে থাকে তো যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ড চালাচ্ছেন, তিনি কি এইটুকু জানেন না যে এই পূজার লক্ষ্য তিনি ৷ ভগবান এই বিভিন্ন রকমের পূজার প্রচলন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকদের উপযোগী হবে বলে ৷ মা যেমন জানেন তাঁর কোন্ ছেলের কোন্ খাদ্য উপযোগী, ঠিক তেমনি ভগবান জানেন—কার পক্ষে কোনটি উপযুক্ত পথ ৷ তাই তাঁকে চিন্তা করবার এই ভিন্ন ভিন্ন সাধন পদ্ধতি তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ৷”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-প্রসঙ্গ, ১ম ভাগ, পৃঃ ৫০)

ব্রহ্ম প্রতিমা



রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব
             তদস্য রূপং প্রতিচক্ষণায় ৷
ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে
           যুক্তা হস্য হরয়াঃ শতা দশ ৷৷ঋগ্বেদ ৬.৪৭.১৮৷৷
অনুবাদঃ “রুপে রুপে প্রতিরুপ (তাহার অনুরুপ) হইয়াছেন, সেই ইহার রুপকে প্রতিখ্যাপনের (জ্ঞাপনের) জন্য ৷ ইন্দ্র মায়াসমূহের দ্বারা বহুরুপ প্রাপ্ত হন ৷ যুক্ত আছে ইহার অশ্ব শত দশ (অর্থাৎ সহস্র) ৷”


অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“অগ্নি যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷৯)
.
বায়ুর্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“বায়ু যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১০)
.
“রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷ অয়মত্মা ব্রহ্ম সর্ব্বানুভূঃ৷”
অর্থাৎ তিনি প্রতি বস্তুর রুপ ধারণ করিয়াছেন ৷ এই আত্মাই ব্রহ্ম ৷ তিনি সর্ব্বগত ৷ (বৃহদারণ্যক, ২৷৫৷১৯)
.
একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি৷
“একক নিয়ন্তা হয়েও এই সর্বভূতের অন্তরাত্মা একই রুপকে বহুধা করে চলেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১২)
.
“যো বিশ্বস্য প্রতিমানং বভুব” (ঋগ্বেদ ২৷১২৷৯)
অর্থাৎ—তিনি নিখিলের প্রতিমা হইয়াছিলেন ৷


সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি অর্থাৎ ঈশ্বরের তুল্য কেহ না থাকলেও, ঈশ্বর কিন্তু সকলের তুল্য হইতে পারেন, যেকোন রুপ পরিগ্রহ করতে পারেন ৷ তাই ভক্ত-সাধক ঈশ্বরকে যে-প্রতিমাতেই পূজা করুক না কেন, তিনি সেই মূর্তিরূপেই ভক্তকে দেখা দিবেন ৷
“বায়ু যেমন পার্থিব পঙ্কজাদির গন্ধ, রেণুর বর্ণ ধারণ করিয়া নানাগন্ধ ও রুপবিশিষ্ট হয়, তেমনি সর্বদেহের অন্তর্যামী পরমাত্মা শ্রীভগবান উপাসকের বাসনা অনুযায়ী তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন, সেই পরমেশ্বরই আমার মনোরথ পূর্ণ করুন, অন্য দেবতা আশ্রয়ের প্রয়োজন কি?” (শ্রীমদ্ভাগবত ৬৷৪৷৩৪)
.
নমস্তে দেবদেবেশ! শঙ্খচক্রগদাধর ৷
ভক্তেচ্ছোপাত্তরুপায়­ পরমাত্মন্! নমোহস্তু তে ৷৷
নমঃ পঙ্কজনাভায় নমঃ পঙ্কজমালিনে ৷
নমঃ পঙ্কজনেত্রায় নমস্তে পঙ্কজাঙ্ঘ্রয়ে ৷৷
— “হে দেবদেব, হে সর্বেশ্বর, শঙ্খ-চক্র-গদাধারী আপনাকে নমস্কার ! হে পরমাত্মা, আপনি ভক্তগণের ইচ্ছানুরুপ রুপ ধারণ করিয়া থাকেন, আপনাকে নমস্কার ৷ পদ্মনাভ আপনাকে নমস্কার, পদ্মমালাধারী আপনাকে নমস্কার, কমল-নয়ন আপনাকে নমস্কার, কমল-চরণ আপনাকে নমস্কার ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৫৯৷২৫-২৬)

বৈদিকমত দ্বারা ব্যাখ্যাঃ-
এমন এক সময় ছিল যখন সাধারণ হিন্দুদের কাছে তাদের শাস্ত্র ছিল অস্পৃশ্য। ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের যদিওবা বেদ শোনার অধিকার ছিল, শুদ্র বেদ শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়ার কুপ্রথা ছিল প্রচলিত। ভাগবতাদি পুরাণ ও বেদ বিরুদ্ধ মানব রচিত স্মৃতির এমনই ছিল আইন। এছাড়াও নানা কুসংস্কার, কুপ্রথায় জর্জরিত ছিল এই অভাগা হিন্দু সমাজ।

এসব কুপ্রথা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেসব মহাত্মারা লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে রাজা রাম মোহন রায় ও মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ছিলেন অগ্রগণ্য। বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র বিরুদ্ধ এসব অন্যায় কুসংস্কারের গুঁড়িতে তাঁরা আঘাত হেনেছিল বেদ, উপনিষদ ও অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থের আলোকে। উল্লেখ্য এই দুই মহাত্মার কর্মে আমরা বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখতে পাই। তাঁরা যেমন ছিলেন কুসংস্কারের বিরোধী, তেমনি তাঁরা অভাগা হিন্দুদের অধঃপতন থেকে মুক্তির পাথেয় হিসেবে খুঁজে নিয়েছিলেন বেদ-উপনিষদের আলোকবর্তিকা। তাঁদের উভয়ের মতেই আমাদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ আমরা বৈদিক এক ঈশ্বরের উপাসনা ত্যাগ করে বহু মতে, বহু পথে বিভক্ত হয়েছি। তাই তাঁরা জোর দিয়েছিলেন আমরা যেন সেই বৈদিক এক ঈশ্বরের উপাসনার পথে অগ্রসর হই। এই দুই মহাপুরুষই বেদ উপনিষদে বর্ণিত নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেছেন। এই বিষয়ে একটি মজার ঘটনা না বললেই নয়।


রাজা রামমোহন রায় যখন বাংলায় ঈশ, কেন, কঠ উপনিষদ অনুবাদ করে নিরাকার ব্রহ্মবাদের প্রচার শুরু করলেন এক দল তথাকথিত পণ্ডিত প্রচার করা শুরু করে যে, উপনিষদ বলে সংস্কৃতে কোনো শাস্ত্রই নেই, ঈশ, কেন, কঠ প্রভৃতি নাকি তিনি রচনা করেছেন। এই অভিযোগ এত মানুষ বিশ্বাস করেছিল যে তিনি প্রকাশ্যে এসে এই বলেছিলেন যে, “এই কলিকাতা শহরে শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাড়িতে গেলেই দেখতে পাবেন যে, বেদান্ত শাস্ত্রের সকল পুঁথিই তাঁর ঘরে মজুত আছে।” উল্লেখ্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন রামমোহন রায়ের বিপক্ষ দলের অগ্রগণ্য পণ্ডিত।
এই ধরণের মূর্খ পণ্ডিত সর্বকালেই দেখা যায়। যে মহর্ষি বেদ মন্ত্র থেকে প্রমাণ বের করে দেখালেন বেদ কেবল ব্রাহ্মণ নয়, স্ত্রী-শুদ্র সকলেই পড়তে ও শুনতে পারবে; সেই মহর্ষিকেই আজকাল কতিপয় দুর্মুখ পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি বলেন যে তিনি নাকি ভুলভাবে বেদ ব্যাখ্যা করেছেন। আজ মহর্ষি বেঁচে থাকলে বুঝতেন এই হিন্দু জাতির বেদ অধিকার দিতে চেয়ে তিনি কত ভুল করেছেন।


আজকাল কিছু সেরকম পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি দাবি করেন যে বেদ তথা বৈদিক ঈশ্বর নিরাকার না, মহর্ষি দয়ানন্দ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেখানে অরবিন্দের মত যোগী বলেছেন যে, মহর্ষি দয়ানন্দই বেদের প্রকৃত তাৎপর্য, প্রকৃত অর্থ তুলে ধরেছেন সেখানে কুয়োর ব্যাঙের মত পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রলেপন বাতুলতা ভিন্ন কিছুই না।




তাদের দাবি যজুর্বেদের ৩২তম অধ্যায়ের ৩য় মন্ত্র নাকি প্রতিমা পূজার নিষেধ করছে না। তবে চলুন দেখি কি বলছে যজুর্বেদ ৩২/৩-




যজুর্বেদ ৩২/৩, মহর্ষির ভাষ্য সহিত

ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্ য়শঃ।
 হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা য়স্মান্ন জাত ইত্যেষঃ।।


অনুবাদ: যাঁর মহান প্রসিদ্ধ যশ রয়েছে সেই পরমাত্মার কোনো প্রতিমা নেই। "হিরণ্যগর্ভ" আদি মন্ত্রে, "মা মা হিংসীত্" এই মন্ত্রে ও "য়স্মান্ন জাত" এই মন্ত্রে সেই পরমাত্মার বর্ণন রয়েছে।
মহর্ষির ভাষ্য “ন নিষেধে তস্য পরমেশ্বরস্য প্রতিমা প্রতিমীয়তে য়য়া তৎপরিমাপকং সদৃশং তোলনসাধকং প্রকৃতিরাকৃতিরবা অস্তি বর্ততে” অর্থাৎ সেই পরমেশ্বরের তুল্য পরিমাণ সদৃশ সাধক প্রতিকৃতি বা মূর্তি কিছুই নেই।
সম্প্রদায়বাদী সেই গোঁড়াদের দাবি এই মন্ত্রে প্রতিমা শব্দ দ্বারা নাকি মূর্তিকে বোঝায় নি, কেবল উপমা বা তুলনা অর্থে বুঝিয়েছে। তাদের দাবি পুরাতন ভাষ্যকাররা নাকি এমন কোনো অর্থ করে যাননি, মহর্ষি দয়ানন্দই কেবল এই অর্থ করেছেন।
বেশ দেখুন তাদের আদরণীয় উবট ও মহিধর কি ভাষ্য করেছে,




যজুর্বেদ ৩২/৩, উবট ও মহিধর ভাষ্য সহিত

"ন তস্য পুরুষস্য প্রতিমা প্রতিমানভূতং কিঞ্চিদ্বিদ্যতে"(উবট)
এবং
"তস্য পুরুষস্য প্রতিমা প্রতিমানমুপমানং কিঞ্চিদ্বস্তু নাস্তি"(মহিধর)


অর্থাৎ সেই পুরুষের প্রতিমা, তুলনা বা উপমা কিছুই নেই। 

উভয়েই বলছেন প্রতিমা নেই।
এই মন্ত্র দ্বারা যেমন প্রমাণ হয় ঈশ্বরের তুল্য কিছু নেই, তেমনি তাঁর প্রতিমা বা মূর্তি নেই। প্রতিমা অর্থ যে মূর্তি হয় তা মানতে নারাজ পণ্ডিতম্মন্যরা। মূর্তি শব্দ অবৈদিক দেখে বেদে মূর্তি শব্দ নেই, সে স্থলে আছে প্রতিমা। প্রতিমা অর্থ যে মূর্তি তা বৈদিক কোষেও উল্লেখিত আছে।





দেখা যায় প্রতিমা=উপমা দেখাতে তারা সাধারণ বাংলা অভিধান ইউজ করে৷ অথচ একটি বিখ্যাত প্রাচীন অভিধান অমরকোষ এ প্রতিমার ৮ প্রতিশব্দ আছে যা মূর্তি নির্দেশ করে৷ অমরকোষ ২.১০.৩৫
প্রতিমানং প্রতিবিম্বং প্রতিমা প্রতিয়াতনা প্রতিচ্ছায়া। 
প্রতিকৃতিরর্চা পুংসি প্রতিনিধিরুপমোপমানং স্যাত্।।




যারা বলে পরমাত্মার উপমা নেই তারাই বরং ভুল বলে। কারণ পুরুষসূক্তসহ বেদের অসংখ্যস্থলে পরমাত্মার মহিমাকে বিভিন্ন উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে৷ সামবেদের ৪৩ নং মন্ত্রটি দেখুন -

আ নো অগ্নে বয়োবৃধং রয়িং পাবক শংস্যম্। 
রাস্বা চ ন উপমাতে পুরুস্পৃহং সুনীতী মুযশস্তরম্ ॥

[সামবেদ - ৪৩]

পদার্থঃ হে (পাবক) চিত্তশোধক, পতিতপাবন (অগ্নে) সম্মুখ মার্গ প্রদর্শক পরমাত্মা ! তুমি (বয়োবৃধম্) আয়ুকে বর্ধনকারী, (শংস্যম্) প্রশংসাযোগ্য (রয়িম্) ধনকে (নঃ) আমাদের জন্য (আ) নিয়ে এসো। হে (উপমাতে) উপমানভূত, সর্বোপমাযোগ্য পরমাত্মা ! (পুরুস্পৃহম্) অধিক আকাঙ্ক্ষিত অথবা বহু লোক দ্বারা আকাঙ্ক্ষিত, (সুয়শস্তরম্) অতিশয় কীর্তিজনক সেই ধনকে (সুনীতী) সন্মুখ মার্গে চালিত করে (নঃ) আমাদের (রাস্ব চ) প্রদানও করো।





চলুন বৈদিক ঈশ্বরের সাকার নিরাকার কি আকার সে নিয়ে বেদ উপনিষদ কি বলে তা দেখে নিই:
যজুর্বেদ ৪০/৮ বলছে ঈশ্বর অকায়ম(সর্বপ্রকার শরীররহিত)




যজুর্বেদ ৪০/৮, মহর্ষির ভাষ্য সহিত


আচার্য শঙ্করের ভাষ্য দেখুন, তিনিও বলছেন সেই আত্মা(পরমাত্মা) স্থুল, সূক্ষ্ম শরীর বিবর্জিত




ঈশ উপনিষদ ৮, শঙ্কর ভাষ্য



এবার তাহলে প্রশ্ন রইল, যার কোনো শরীরই নেই তাঁর মূর্তি বা প্রতিমা আপনারা কিভাবে তৈরি করবেন? 


শ্বেতাশ্বতর উপনিষদও বলছে, “তাঁর কোনও প্রতিরূপ বা প্রতিমা নেই”(৪/১৯) এবং “সনাতনের কোন রূপ নেই যা চক্ষুর গোচর হয়, দৃষ্টির দ্বারাও তাঁকে কেও দেখে না”(৪/২০)




শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, শ্রী অরবিন্দের অনুবাদ


কঠ উপনিষদেও ১/২/২২ এ বলা হচ্ছে ব্রহ্ম প্রাণীগণের শরীরে থেকেও শরীর রহিত





কঠ উপনিষদের ১/৩/১৫ তে আরও বলা হয়েছে, পরমাত্মা অরূপম বা রূপহীন, কেবল সেই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারলেই মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।




শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১০-এও একই কথা বলা হয়েছে।



একই কথা বলছে তৈত্তিরীয় উপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লীর সপ্তম অনুবাক



মুণ্ডক উপনিষদ ২/১/২ তো বলেই দিচ্ছে, সেই দিব্য পুরুষ অমূর্ত বা মূর্তিহীন
সেই পরমেশ্বরের মূর্তি তো দূরে থাক, 





শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/৯ বলছে সেই ঈশ্বরের কোনও চিহ্নবিশেষও নেই




উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বেদ উপনিষদের সর্বত্রই নিরাকার মূর্তিহীন ঈশ্বরের কথা বলছে। বেদের কোথাও যেখানে পরমাত্মার মূর্তি বা অবয়ব উপাসনার নামগন্ধ নেই, সেখানে ধূর্তরা বেদ মন্ত্র বিকৃতির আশ্রয় নিয়ে প্রতিমা পূজা প্রচলিত করে ও তা প্রচার করে বেড়ায়। বৈদিক ধর্মে পৌত্তলিকতার কোনো স্থান নেই। আর বৈদিক ধর্ম কেবল এক পরমাত্মার উপাসনার কথাই বলে। যারা জড় মূর্তি পূজা করে ভাবছেন ঈশ্বরের উপাসনা করছেন তারা কেন উপনিষদের এই মন্ত্রটি জেনে রাখুন-

কেন উপনিষদ ১/৬
য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষুংষি পশ্যতি।
 তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে।।
অনুবাদ: চোখ দিয়ে যাঁকে দেখা যায় না, কিন্তু লোকে দৃশ্যমান বিষয়গুলো যাঁর দ্বারা দেখে থাকে, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে যেন। লোকে যেসব দৃশ্যমান বস্তুর উপাসনা করে তা ব্রহ্ম নয়।




তাহলে আপনারাই ভাবুন আপনারা মূর্তির সামনে গড়াগড়ি খেয়ে প্রকৃতপক্ষে কার উপাসনা করছেন? তা মোটেও ব্রহ্মোপাসনা নয়। তাই আমাদের সকল বৈদিক মতাদর্শীর উচিত সকল প্রকার মূর্তিপূজা তথা পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে কেবল এক সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের উপাসনা করা। তবেই আমাদের যথার্থ মঙ্গল হবে।
সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ