৩৩ কোটি দেবতা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

12 February, 2018

৩৩ কোটি দেবতা

৩৩ কোটি দেবতা
ঋগ্বেদ,১ম মন্ডল,৩৪,৩৫ সূক্তে ৩৩ প্রকার দেবতা উল্লেখ পাওয়া যায়
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্ভং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব স্বঃ।।
(অথর্ববেদ ১০.৭.১৩)
অনুবাদ-কার মহিমায় এই তেত্রিশ দেব সমাহিত?কে তা জানে?স্কম্ভ,সকলকে ধারনকারী পরমাত্মাতেই সেই সকল কিছু সমাহিত হয়ে আছে।
বেদে ৩৩ কোটি দেবতার উল্লেখ নেই কিন্তু ৩৩ ধরনের দেবতার উল্লেখ রয়েছে। সংস্কৃত'তে কোটি অর্থ হচ্ছে ধরন বা প্রকার।যস্য ত্রয়ত্রিংশদা দেবা অঙ্গ গাত্রা বিভেজিরে।
তান বৈ ত্রয়স্ত্রিংশদা দেবানো ব্রহ্মবিদো বিদুঃ।।
(অথর্ববেদ ২০।৭।২৭)
অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ লোক জানে যে তেত্রিশ প্রকার দেব সংসারের ধারন এবং পালন করে।
বৈদিক সংস্কৃতিতে "কোটি" শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকার। অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে দেব হচ্ছে তেত্রিশ প্রকার
তেত্রিশ কোটি নয়। তেত্রিশ কোটি দেবতার কল্পনা মিথ্যা এবং ভ্রামক।
শতপথ ব্রাহ্মণে (১৪/৫)যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাকল্য বলছেন এই ৩৩ ধরনের দেবতাদের মধ্যে রয়েছেন –

🌍অষ্টবসু👉 ১.পৃথিবী ২.জল ৩.অগ্নি ৪.বায়ু ৫. আকাশ ৬.চন্দ্র ৭.নক্ষত্র ৮.সূর্য্য

🌼১২ টি আদিত্য / দ্বাদশ আদিত্য
(দ্বাদশ আদিত্য : ১২মাসকে এক সাথে দ্বাদশ আদিত্য বলা হয়)
[দ্বাদশ মাসাঃ সম্বৎসরস্য এতে আদিত্যাঃ।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ-১১/৬/৩/৮)]

💦একাদশ রুদ্র ১.প্রাণ ২.অপান ৩.ব্যান ৪.উদান ৫.সমান ৬.নাগ ৭.কূর্ম্ম ৮.কৃকল ৯.দেবদত্ত ১০.ধনঞ্জয় ১১.জীবাত্মা

💥৩২.ইন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যুৎ এবং🔆 ৩৩.প্রজাপতি বা শুভকর্ম(যজ্ঞ) মিত্রগণ,
দশবিধ প্রাণঃ ১)পঞ্চপ্রাণঃ প্রাণ=হৃদয়স্থ বায়ু অপান=গুহ্যদেশস্থ বায়ু ব্যান=সর্বদেহস্থ ব্যাপী বায়ু সমান=নাভি মধ্যস্থ বায়ু উদান=কন্ঠদেশস্থিত বায়ু ২)সূক্ষ্যপঞ্চপ্রানঃ নাগ=উদগার নিঃসারক বায়ু কূর্ম=অক্ষিচালক বায়ু কৃকল=জৃম্ভক্ বায়ু দেবদত্ত=ক্ষুৎকারক বায়ু ধনঞ্জয়=মৃতক শরীরস্থ বায়ু ও জীবাত্মা =১১ রুদ্র
একাদশ রুদ্র
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়
এবং জীবাত্মা
...এই এগারটি দেবতা দেহান্তকালে জীবকে রোদন করায় বলেই ইহাদের নাম রুদ্র বলা হয়েছে

অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।
এর পর আশা করে সবাই ৩৩ দেবতার নাম এক নিমিষেই বলতে পারবেন। সকলের কল্যান হোক।
 " অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব

প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশা চিতি"

(বৃহঃ উপঃ ৩।৯।২)

অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয় জন মিলিয়া একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলিয়া তেত্রিশ দেব।

.
★ অষ্ট বসুঃ 
(অগ্নিশ্চ পৃথিবীশ্চ বায়শ্চান্তিরিক্ষং চাদিত্যশ্চ
দ্যৌশ্চ চন্দ্রমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈত্রে বসব ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৩। )

অর্থাৎ অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক,
চন্দ্র, নক্ষত্রপুন্জ ইহারা অষ্ট বসু। কারন নিখিল পদার্থ ইহাদের
মধ্যে নিহিত আছে সেই জন্য এদের নাম বসু। 

★ একাদশ রুদ্রঃ 
(দশমে পুরুষো প্রাণা আত্মৈকাদশন্তে ; বৃহঃউপঃ ৩।৯।৪)
অর্থাৎ পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা
মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায় বলিয়া রুদ্র বলা হয়। 
এগুলো হচ্ছে -
পঞ্চ প্রাণঃ প্রাণ, উদান,সমান, ব্যান, অপান।
উপ প্রাণঃ নাগ, কুর্ম, কৃকল, দেব, ধনন্জয়।
এবং জীবাত্মা।
.
★ দ্বাদশ আদিত্যঃ
(দ্বাদশ বৈ মাসা ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৬)
সম্বৎসরে বার মাস আছে ইহারাই আদিত্য। কারন ইহারা এই সমস্তকে আদান করিয়া যান। যেহেতু এই সমস্ত কে আদান করিয়া যান অতএব তাহারা আদিত্য। দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে -
চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্ত্তিক,
মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন।
.
★ ইন্দ্রঃ
 (স্তনযিত্নুরেবেন্দ্রো ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) 
অর্থাৎ বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র । কারন ইহা ঐশ্বর্যের সাধন গতি শক্তি, প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্ত হয়।
.
★ প্রজাপতিঃ (যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) যজ্ঞ
হচ্ছে প্রজাপতি। কারন ইহার দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণীদের সুখ
মিলে।
বেদ সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব থাকায় আমরা অধিকাংশ মানুষ মনে করে এগুলো হল মানুষ আকৃতির বিভিন্ন দেবতা যাদেরকে ওই মন্ত্রটিতে স্তুতি করা হয়েছে।ঋষি কাত্যায়ন মন্ত্রের দেবতা কি তার
ব্যখ্যায় বলেছেন-

"যা তেন উচ্চতে সা দেবতা" অর্থাত্ মন্ত্রের যে বিষয়বস্তু অর্থাত্ যা নিয়ে মন্ত্রে কথা বলা হয়েছে তাই ওই মন্ত্রের দেবতা। মহর্ষি যস্কাযার্চ লিখিত বৈদিক শব্দকোষ ও ব্যকরন গ্রন্থ নিরুক্ত সাংহিতায় বলা
হয়েছে- "যত্কাম ঋষির্যেস্যাং দেবতাযামার্থপত্যম্ ইচ্ছত্ স্তুতিং প্রযুক্তেতম্ দেবতঃ স মন্ত্রো ভবতি।।" অর্থাত্ যখন ঈশ্বর কোন একটি বিষয়ের সম্বন্ধে আমাদের মন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দেন তখন মন্ত্রের সেই বিষয়টিকে দেবতা বলা হয়।
উদাহরনস্বরুপ-----
ঋগ্বেদ ১০.১৫১ এর দেবতা হল
'শ্রদ্ধা' এবং এই সুক্তের আলোচ্য বিষয় হল ঈশ্বর ও
গুরুজনে শ্রদ্ধা বা সম্মান।

ঋগ্বেদ ১০.১১৭ এর দেবতা হল
'ধনদানপ্রশাংসা' এবাং এই সুক্তের মন্ত্রসমূহের আলোচ্য বিষয় হল গরীবদুঃখীদের দানে উত্সাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা।

ঋগ্বেদ
১০.১৪৬ এর দেবতা হল 'দ্যুতনিন্দা' এবং তাই এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হল জুয়াখেলার অপকারিতা ও নিষিদ্ধতা। ঋগ্বেদ এর প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তের দেবতা হল 'অগ্নি'। আজ ম্যাক্সমুলার সহ বিদেশী মিশনারীদের অপপ্রচারের কারনে একে সবাই নির্দিষ্ট আকৃতিযুক্ত আলাদা একটি দেবতা
মনে করে যদিও তা সম্পূর্ন ভূল। উপযোগের দেব - এই তেত্রিশ প্রকার দেব এর মধ্যে কেবল জীবাত্মা
চেতন। ইহা অন্যের উপযোগ করে অথবা স্বয়ং অন্য জীবাত্মার উপযোগে আসে। যেমন গাভী দুধ দিয়ে, ভেড়া ঊণ দিয়ে, ষাড় হাল চাষের উপযোগে আসে। তেমনি সৈনিক, বৈদ্য আদি উপযোগে আসে এবং স্বামী, রাজা আদি উপযোগ নেয়। জীবাত্মার অতিরিক্ত শেষ বত্রিশ দেব জড় এবং উপযোগের দেব বলা হয়।
.
ব্যবহারের দেব -
মাতা, পিতা,আচার্য, অতিথি এবং পতি-পত্নি দ্বারা সংসারের ব্যবহার সিদ্ধ হয়। এ জন্য এই পাঁচ কে ব্যবহারের দেব বলা হয়। তৈঃ উপঃ ১।১১।২ অনুসারে, মাতৃদেব ভব, পিতৃদেব ভব, আচার্য
দেব ভব, অতিথিদেব ভব। তাহলে কি সমস্ত মানুষ ই দেব হয়ে যায়? না, দেব হচ্ছে বহু বিশেষন যুক্ত। একজন মাতা যদি নিজ পুত্রের পক্ষপাত করে অন্যের সাথে বিবাদ করে। তখন সে মাতা দেব এর সঙ্গার মধ্যে পড়ে না। দেব হবে সেই যার মধ্যে উত্তম গুনাবলী তথা বিভিন্ন দৈবী সম্পদ রয়েছে।
আমাদের আর্য্যাবর্ত্তে প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে "পঞ্চদেবতা পূজা" শব্দ চলিয়া আসিতেছে।কোন প্রকার মূর্তি পূজা করিবে না।কিন্তু নিম্নে যে " মূর্ত্তিমান্" সম্বন্ধে বলা হইবে, তাহার পূজা অর্থাৎ সম্মান করা উচিত। সেই পঞ্চদেব পূজা এবং পঞ্চায়তন পূজা শব্দের অর্থ অতি উত্তম। কিন্তু বিদ্যাহীন মূঢ়গণ তাহার সদর্খ পরিত্যাগ করিয়া কদর্থ গ্রহন করিয়াছে।
এখন সত্য, বেদোক্ত এবং বেদানুকূল পঞ্চায়তন,দেবপূজা ও মূত্তিপূজা বিষয় শ্রবণ কর-
মা নো বধীঃ পিতরং মাতরম্।। ১।।যজু।।
আচার্য্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিণমিচ্ছতে।। ২।।অথর্ব।।
অতিথির্গৃহানুপগচ্ছেৎ।। ৩।।অথর্ব।।
অর্চত প্রার্চত প্রিয়মেধাসো অর্চত।। ৪।।ঋক্।।
ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মসি ত্বামের প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি।। ৫।।তৈত্তিরীয়োপনি।।
কতম একো দেব ইতি স ব্রহ্ম ত্যদিত্যাচক্ষতে।। ৬।।শতপথ ( কাং ১৪)প্রপাঠ ৫।ব্রাহ্ম৭। কল্পিতা ১০।।
মাতৃদেবো ভব,পিতৃদেবো ভব,আচার্য্যদেব ভব,অতিথিদেবো ভব।।৭।।তৈত্তিরীঢিপনি।
পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ বহুকল্যাণমীপসুভিঃ।।৮।।মনুঃ পূজ্যে (হি) দেববৎ পতিঃ।।৯।।মনুস্মৃতৈ
প্রথম দেবতা-মাতা। মূর্ত্তিমতী পূজনীয়া অর্থাৎ সন্তাগণ কায়-মন-বাক্যে সেবা করিয়া মাতাকে প্রসন্ন রাখিবে। কখনও তাহাকে হিংসা অর্থাৎ তাড়না করিবে না।। ১।।
দ্বিতীয় দেবতা- পিতা।সম্মানের পাত্র। মাতার ন্যায় তাঁহারও সেবা করিবে।।২।।
তৃতীয় দেবতা- আচার্য্য।যিনি বিদ্যাদাতা কায়-মন-বাক্য দ্বারা তাঁহার সেবা করিবে।।৩।।
চতুর্থ দেবতা-অতিথি।অর্থাৎ যিনি বিদ্বান, ধার্মিক, অকপট এবং সকলকে সুখী করেন, তাঁহার সেবা কেনাবেচার।।৪।।
পঞ্চম দেবতা- স্ত্রীর পক্ষে পতি এবং পতির পক্ষে স্বপত্নী।। ৫।।
এই পাঁচ মূত্তিমান দেব। ইত্যাদিগের সংসর্গে মনুষ্যদেহের উৎপত্তি,পালন, সত্যশিক্ষা,বিদ্যা ও সত্যোপদেশ লাভ হইয়া থাকে। ইহারাই পরমেশ্বর প্রাপ্তির সোপান -পরম্পরা।যাহারা ইহাদিগের সেবা না করিয়া পাষাণাদি মূর্ত্তির পূজা করে,তাহারা অতীব নরকগামী।।
.
উপরের বর্ণিত যে তেত্রিশ প্রকার দেবের বর্ণনা করা হলো। ইহাদের হইতে সুখ যেমন মিলে তেমনি দুঃখ ও মিলে। অগ্নি দেব কিন্তু অনেক সময় সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়, অতিথী দেব কিন্তু পরবর্তিতে শত্রু ও হতে পারে। রাজা দেব কিন্তু কুপিত হয়ে দুঃখদায়ী হতে পারে। এই কারনে ইহা সদুপযোগ এবং সৎকারের মর্যাদা দ্বারা বাধে। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী এর সদুপযোগ করা মর্যাদা। মাতা, পিতা আচার্য এবং অতিথির সেবা করা ধর্ম। পূর্বজ মহাপুরুষের পথ অনুসরন, সংবিধান পালন এবং দেশের রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য। কিন্তু এরা কোন উপাস্য দেব নয়। উপাস্য দেব কেবল পরমাত্মা, কারন
পরমাত্মাই সবার ইষ্ট দেব। এই সৃষ্টির সব কাল এবং পরিস্খিতির মধ্যে পূর্ণতম দেব এক এবং সেই পরমাত্মা। সেই জন্য বেদ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন -
" হে মিত্র! পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কাহারো স্তবন করো না এবং

দুঃখী হয়ো না। এই উৎপন্ন জগতের সাথে মিলে সেই

শক্তিশালী শত্রুর নাশকারী প্রভূর স্তুতি করো এবং বারংবার

উক্ত স্তোত্রের স্তবন করো (অথর্ববেদ ২০।৮৫।১)"
অর্থাৎ আমাদের শুধু সেই এক পরমাত্মার উপাসনা করা উচিৎ।


নিরক্তে দেব শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে।

"দেবো দানদ বা, দীপনাদ্ বা, দৌতনাদ বা,
দ্যুস্থানো ভবতীতি বা; নিঃ ৭।১৫।
অর্থাৎ দেবের লক্ষন হচ্ছে দান। সবার হিতার্থে যে দান করে সে দেব। দেবের গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য,চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়। দেবের কর্ম হচ্ছে দৌতন অর্থাৎ সত্যপদেশ করা। অর্থাৎ যে মানুষ সত্য মানে, সত্য বলে এবং সত্য উপদেশ দান করে সে দেব। দেবের বিশেষতা হচ্ছে দ্যুস্খান অর্থাৎ উপরে স্থিতি লাভ। ব্রহ্মাণ্ডের উপরে স্থিতি লাভ করার জন্য সূর্যকে, সমাজের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য বিদ্যান কে এবং রাষ্টের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য রাজা কে দেব বলে।

“ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভুতান্য শাম্যন্ প্রজাপতিঃ।
পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসীত্।।”
যজুর্বেদ ১৪.৩১
পদার্থ-(ভূতানি অশাম্যন্) যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি শান্ত হয় ( প্রজাপতিঃ) যিনি প্রজাপালক ( পরমেষ্ঠী আসীৎ) আকাশে ব্যাপক পরমেশ্বর ( অধিপতিঃ) অধিষ্ঠাতা ( ত্রয়স্ত্রিংশত) তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ গুণের (অস্তুবত) প্রশংসা কর।
অনুবাদ:- যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রজার পালক, সর্বব্যপক ,অন্তরীক্ষে ব্যপ্ত, তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ প্রকার গুনের স্তুতি কর।
এখন কি এই তেত্রিশ ধরনের দেবতা বা দিব্য শক্তি? শতপথ ব্রাহ্মন ১৪.৫ এ যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাকল্যকে বলছেন-দেব ৩৩টি যা পরমেশ্বরের মহিমার প্রকাশক।
আর সেই তেত্রিশ দেবতা হল ৮ বসু,১১রুদ্র,১২ আদিত্য,ইন্দ্র,প্রজাপতি। মনুসংহিতা ও বৃহদারন্যক উপনিষদ এ এর বিস্তারিত বর্ননা দেয়া আছে।
শতপথ ব্রাহ্মণঃ শতপথ ব্রাহ্মণে ( কা০ ১৪ অঃ ৫) যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাল্যকে বলিতেছেন দেবতাঃ ৩৩টি, ইহারা পরমেশ্বরের মহিমাকে প্রকাশ করিতেছেন। তারা হলেন ৮ বসু, ১১রুদ্র,১২ আদিত্য,ইন্দ্র ও প্রজাপতি-এই ৩৩ দেবতা। অগ্নি ( Heated Cosmic Bodies),পৃথিবী ( Planets),বায়ু ( Atmoshpheres), অন্তরিক্ষ ( Supperterrestrial Space) আদিত্য ( Suns) দ্যৌঃ ( Rays of Ethereal Space), চন্দ্র ( Satellites) ও নক্ষত্র (Stars)-এই অষ্টবসু। প্রাণ,অপান,ব্যান,সমান্,উদাম,নাগ,কুর্ম,কৃকল,দেবদত্ত,ধনঞ্জয় এই দশ প্রাণ ( Vital Forces) এবং জীবাত্মা ( The Human Spirit) একত্রে এই একাদশ রুদ্র। ১২ মাসকে দ্বাদশ আদিত্য বলে। ইন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যুৎ ( Electricity or Force)। প্রজাপতি অর্থাৎ যজ্ঞ বা শুভকর্ম ( Auspicious Action)।
বৃহদারন্যক উপনিষদ এ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য কে শাকল্য প্রশ্ন করছেন,
“কতি এব দেবা ইতিঃ”
অর্থাৎ দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন,
“ত্রয়ত্রিংশৎ ইতি”
অর্থাৎ দেবতা ৩৩ টি।
তখন শাকল্য আবার বললেন,
উত্তম,কিন্তু দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-
“ষট্” অর্থাৎ ৬ টি
শাকল্য বললেন,
উত্তম,কিন্তু দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন,
“ত্রয়” অর্থাৎ ৩ টি।
শাকল্য পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
উত্তম,কিন্তু দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন,
“দ্বৌ” অর্থাৎ দুইটি।
আবার শাকল্য বললেন,
উত্তম,কিন্তু দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য জবাব দিলেন,
“অধ্যর্ধ” অর্থাৎ দেড়টি।“
শেষবারের মত শাকল্য প্রশ্ন করলেন,
উত্তম,কিন্তু দেবতা কয়টি?
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন,
এক!
এরপর যাজ্ঞবল্ক্য ব্যখ্যা করলেন সেই তেত্রিশ দেবতা হল অষ্টবসু(৮),একাদশ(১১) রুদ্র,দ্বাদশ আদিত্য(১২),ইন্দ্র এবং প্রজাপতি।যাজ্ঞবল্ক্য আরও ব্যাখ্যা করলেন সবদেবতা সমূহের নাম-
অষ্টবসু-
অগ্নি
পৃথিবী
বায়ু
অন্তরীক্ষ
আদিত্য
দ্যৌ(পৃথিবী,চন্দ্র,সূর্য ও নক্ষত্র ব্যাতিত মহাবিশ্বের বাকি সকল গ্রহ,গ্রহাণু ইত্যাদি)
চন্দ্র
নক্ষত্রসমূহ
এদের নাম বসু কারন মহাবিশ্বের যাবতীয় সকল কিছু এদের মধ্যেই বাস করে বা এদের মধ্যেই ধারিত হয়ে আছে।
একাদশ রুদ্র যা হল ৫ টি জ্ঞানেন্দ্রিয়,৫টি কর্মেন্দ্রিয় এবং আত্মা।এদের নাম রুদ্র কারন মানুষ মৃত্যুবরন করলে এই ইন্দ্রিয়সমূহ বিনষ্ট হয় এবং আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় যা মৃত ব্যাক্তির স্বজনদের ‘রোদন’ করায় তাই এদের নাম ‘রুদ্র’।
দ্বাদশ আদিত্য হল্য বার মাস,এই মাসগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর চলে যায় অর্থাৎ ‘আদান’ হয় তাই এদের নাম ‘আদিত্য’।
ইন্দ্র কি?
বজ্র হল ইন্দ্র,যা লোকসমূহের সংহার সাধন করে তাই বজ্র অর্থাৎ ঈশ্বরের যে বিভূতির কারনে প্রাণীসমূহের মৃত্যু হয় তাই ইন্দ্র।
প্রজাপতি কি?
প্রজাপতি হল যজ্ঞ।যজ্ঞ কি?যজ্ঞ হল পশব অর্থাৎ ঈশ্বরের যে মঙ্গলময় বিভূতি প্রাণীসমূহের চালনা করছে তাই যজ্ঞ তথা প্রজাপতি।
শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন তাহলে ৬টা দেব কি কি?
তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন,
অগ্নি,পৃথিবী, বায়ু,অন্তরীক্ষ, আদিত্য,দ্যো এই ছয়।
তখন শাকল্য বললেন তাহলে ৩টি দেব কি?
তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন তিনলোক(ভ্যু,দ্যু,অন্তরীক্ষ)।
তারপর শাকল্য আবার বললেন সেই দুইটি দেব কি কি?খাদ্য এবং প্রান-উত্তর দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য।
তখন আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন সেই দেড়টি কি?তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন যিনি বায়ুরুপে প্রবাহিত হন তিনিই সেই অধ্যর্ধ।
তখন শাকল্য বললেন,
“লোকে বলে বায়ু এক হয়েই প্রবাহিত হয়,তাহলে সে দেড় হল কি করে?”
তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন কারন তিনি প্রবাহিত হন বলেই সকল কিছু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়(অধ্যার্ধ্নোত্) তাই এর নাম অধ্যার্ধ।
কতমঃ একঃ দেবঃ
তাহলে কে সেই এক দেব?প্রশ্ন করলেন শাকল্য।
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন,
“প্রান!তিনি ব্রহ্ম!হ্যঁ প্রান(পরমাত্মা) সেই এক এবং অদ্বিতীয় দেব যাকে সবাই তত্ বলে জানে!”
বৃহদারন্যক উপনিষদ ৩.৯.২-১১
অসাধারন এই শৈল্পিক ও গভীর দার্শনিক কথোপকথন ব্যখ্যা করছে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরব্রহ্ম থেকে সবকিছু উত্পন্ন হতে শুরু করে।মহাবিশ্বের এই সকল মঙ্গলময় অস্তিত্ব তথা শক্তিসমূহকে,যারা কিনা ঈশ্বর এর বিভূতির ই প্রকাশ সেই অগ্নি,বায়ু,আদিত্য,ভু,দ্যু এবং অন্তরীক্ষলোক,সকল গ্রহ,নক্ষত্র, সবকিছুই যার সমস্তই তাঁর থেকে সৃষ্ট,তাঁর মহিমাতেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তাদেরকে ৩৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে বেদাদি শাস্ত্রে এবং এদেরকে বলা হয় দেব অর্থাত্ শক্তি যাকে আমরা বলী ৩৩ কোটি দেবতা।প্রকৃতপক্ষে মূলত এই সমস্ত শক্তিই এক ও অদ্বিতীয় সেই পরমাত্মার ই বিভূতি, যার হতে সকল কিছু আপাতশক্তিপ্রাপ্ত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র ৩৩ কোটি দেবতা প্রসঙ্গে এজন্য বলেছিলেন-
“বাঙ্গালার চাউল কলার উপর তাঁহাদের আর যে দাবি দাওয়া থাকে থাকুক, বেদ-কর্ত্তা ঋষিদিগের কাছে তাঁহারা সনদ পান নাই, ইহা নিশ্চিত। এখন দেবত্র বাজেয়াপ্ত করা যাইবে কি?
বাজেয়াপ্ত করিলে, অনেক বেচারা দেবতা মারা যায়। হিন্দুর মুখে ত শুনি, হিন্দুর দেবতা তেত্রিশ কোটি।
কিন্তু দেখি, বেদে আছে, দেবতা মোটে তেত্রিশটি!”
(দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম,অন্যান্য রচনাবলী)
ধাতা,মিত্র,অর্য্যমা,শত্রু,বরুণ,অংশ,ভগ,বিবস্বান,পূষা,সবিতা,ত্বর্ষ্টা ও বিষ্ণু- দ্বাদশ আদিত্য ধব,ধ্রুব,সোম,বিষ্ণু,অনিল,অনল,প্রত্যুষ ও প্রভাব-অষ্টবসু মৃগ,ব্যাধ,সর্প,নিঋতি,অজৈকপাৎ,অহিবুধ্ন,পিনাকী,ঈশ্বর,দহন,কপালী,স্থানু এবং ভগ- একাদশ রুদ্র দ্যু এবং ভু- ৩৩ প্রকার(কোটি) দেবতা-[ঋগ্বেদ ১ম মন্ডল, ৩৪,৩৫সূক্ত]
আর এই ৩৩ শব্দটি লোকমুখের,জনশ্রুতির অত্যাচারে আজ ৩৩ কোটি তে উপনীত হয়েছে!

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ