শতপথ ব্রাহ্মনে((শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩.২.২৪)) স্পষ্টভাবে লেখা আছে গার্গী প্রভৃতি নানীরা বেদাধ্যাণ করেছিলেন। বেদজ্ঞ ব্রহ্মনিষ্ঠ মহয়সী নারীকে ব্রহ্মবাদিনী বলা হ'ত;পুরাকালে কুমারীগণের মৌজীবন্ধন,বেদ-অধ্যয়ণ এবং সাবিত্রী বাচন প্রচলিত ছিল;
"পুরাকল্পে কুমারীনাং মৌঞ্জী বন্ধন মিথ্যতে
অধ্যয়নঞ্চ বেদানাং সাবিত্রী বচনং তথা"(যমঃ)
গোভিল গৃহ্যসূত্রে বিবাহ প্রকারণে যজ্ঞপবিত ধারিনী কন্যার উল্লেখ আছে
'প্রাবৃতাং যজ্ঞোপবীতিনীমভ্যুদানয়ন জপেৎ।
সোমোহদদৎ গন্ধর্ব্বায়েতি।।"[২ প্রপাঠক,১ম খন্ড,১৯ সূত্র]
শৌত সূত্রাদিতেও আছে,'ইমং মন্ত্রং পত্নী পঠেৎ'(শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১২.২৯.২১)। বেদ-অধ্যয়নে স্ত্রীলোকের যদি অধিকার নাই থাকে তো বেদমন্ত্র পাঠ কি করে সম্ভব..?
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ,ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।।
(যজুর্বেদ ২৬।২)
অর্থাৎ- হে মনুষ্যগণ আমি যে রূপে সমগ্র মনুষ্য জাতির জন্য (ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সমস্ত জনগনকে ) এই কল্যাণদায়িনী পবিত্র বেদবাণী বলিতেছি, তোমরাও সেই রূপ কর। যেমন বেদবাণীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেইরূপ হও। আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক। এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক।
এখানে দেখা যাচ্ছে বেদের সত্যদ্রষ্টা ঋষি বলছেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সকল জনগণের জন্যই এই পবিত্র বেদবাণী। তাই বেদ মন্ত্র উচ্চারণে ও চর্চা সকলেরই সমান অধিকার। এই স্থলে কেহ যদি এরূপ প্রশ্ন করে যে, জন’ শব্দ দ্বিজ অর্থে গ্রহণ করা উচিত, কারণ স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিত আছে যে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যেরই বেদপাঠে অধিকার আছে, স্ত্রী ও শূদ্রাদি বর্ণের নাই।
উত্তর- (ব্রহ্মরাজন্যাভ্যা) ইত্যাদি। দেখ ! পরমেশ্বর স্বয়ং বলিতেছেন, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, (অৰ্য্যায়) বৈশ্য, (শূদ্রায়) শূদ্র এবং (স্বায়) নিজের ভৃত্য বা স্ত্রী আদি এবং (অরণায়) অতি ক্ষুদ্রাদির জন্যও বেদ প্রকাশ করিয়াছি। অর্থাৎ সকল মনুষ্য বেদের পঠন পাঠন এবং শ্রবণ-শ্রাবণ দ্বারা বিজ্ঞান বৃদ্ধি করিয়া সদ্বিষয় গ্রহণ এবং অসদ্বিষয় বর্জন পূৰ্ব্বক দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া আনন্দ লাভ করুক।
এবার বল, তােমার কথা মানিব—না, পরমেশ্বরের ? পরমেশ্বরের কথা অবশ্যই মানিতে হইবে।
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে তাদের কে বেদবাণী বলেছে কেন?
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকলে, তাদের জন্য বেদের বাণী কিভাবে কল্যানদায়িনী হল?
☞ যে বেদ তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না সে বেদ তারা প্রচার করবে কিভাবে?
☞ তাদের কেও বেদ বাণীর উপদেশ প্রচার করতে বল্লেন কেন?
স্ত্রী, শূদ্রের বেদ পাঠ করার অধিকার, বুঝার, হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা তো আছেই এমনকি বেদ দ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে নারী, শূদ্র ঋষি পর্যন্ত আছে। নারী ঋষিকাগণের মধ্যে রোমশ, লোপামুদ্রা, বাক্, অপালা, কাদ্রু, বিশ্ববারা, ঘোষা, জুহু, ভগম্ভ্রিনি, পৌলমি, যমী, ইন্দ্রাণী, সাবিত্রী, দেবযানী, নোধা, গৌপায়না, অম্ভৃনী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বেদ দ্রষ্টা ঋষি দের মধ্যে যেমন নারী ঋষিকা আছে; তেমনি "শূদ্র" ঋষিও আছে। সেই বেদ দ্রষ্টা শূদ্র ঋষির নাম হচ্ছে "কবষ"। তিনি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সূক্তের মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি।
☞ প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রী, শূদ্রের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা যদি না থাকে এবং পড়ার অধিকার ও যদি না থাকে তাহলে তাঁরা বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন কিভাবে?
নারী-পুরুষ, মনুষ্য মাত্র সকলের জন্য সংস্কার আবশ্যক এবং প্রযোজ্য।
❏ যুব সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎস উ শ্রেয়ান্ ভবতি জায়মানঃ।
তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো মনসা দেবয়ন্ত।।
➢ ঋগ্বেদ ৩/৮/৪
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য পূর্ব্বক বিদ্যালাভ করিয়া, উত্তমবস্ত্র পরিধান করিয়া যৌবন কালে যিনি গার্হস্থ্য আশ্রমে উপনীত হন তিনিই দ্বিজত্ব লাভে খ্যাতি অর্জ্জন করিয়া মহৎ হন। ধ্যান পরায়ণ, মননশীল, জ্ঞান প্রচারক, ধৈর্যবান্ বিদ্ধানেরা সেই পুরুষকে উন্নতি লাভে সহায়তা প্রদান করেন।
বেদ যুবক-যুবতী উভয় কে ব্রহ্মচর্য পালন করার নির্দেশ দেয়।
❏ ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।
অনডৃবান্ ব্রহ্মচর্যেনাশ্বো ঘাসং জিগীর্ষতি।।
➢ অথর্ববেদ ১১/৫/১৮
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিবার পর কুমারী কন্যা যুবা পতিকে লাভ করিবে। বলবান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ভোগ্য পদার্থকে সম্যক ভোগ করিতে পারে।
বেদ পতি-পত্নী কে একসাথে যজ্ঞ করতে বলেন।
❏ যা দম্পতী সমনসা সুনুত আ চ ধাবতঃ।
দেবাসো নিত্যয়াহশিরা।
➢ ঋগ্বেদ ৮/৩১/৫
বঙ্গানুবাদঃ হে বিদ্ধানগণ! যে পত্নী ও পতি এক সঙ্গে একমনে যজ্ঞ করে, উপাসনা দ্বারা যাহাদের মন পরমাত্মার দিকে ধাবমান হয় তাহারা নিত্য পরমাত্মার আশ্রয়েই সব কার্য করে।
☞ বেদ যদি নারীদের হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকত যেমটা ভাগবতে বলা হয়েছে, তাহলে বেদে নারীকে উদেশ্য করে কোন বাণী থাকত না। কারণ নারীদের তো বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই তাহলে, নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে বাণী বা নির্দেশ কিভাবে থাকবে? কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে অনেক বাণী আছে। যেমন-
❏ সম্রাজ্ঞী —
যথা সিন্ধুর্ণদীনাং সাম্রাজ্যং সুষুবে বৃষা।
এবা ত্বং সম্রাজ্ঞ্যেধি পত্যুরস্তং পরেত্য।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৩।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধূ! যেমন বলবান সমুদ্র নদী সমূহের উপর সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে তুমিও তেমন পতিগৃহে গিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ পতিগৃহ —
সম্রাজ্ঞ্যেধি শ্বশুরেষু সম্রাজ্ঞ্যুত দেবৃষু।
ননান্দুঃ সম্রাজ্ঞ্যেধি সম্রাজ্ঞ্যুত শ্বশ্ব্রাঃ।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৪।
বঙ্গানুবাদঃ শ্বশুরদের মধ্যে এবং দেবরদের মধ্যে, ননদ ও শাশুড়ীদের সঙ্গে মিলিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ সুমঙ্গলী —
সুমঙ্গলী প্রতরণী গৃহাণাং সুশেবাপত্যে শ্বশুরায় শংভুঃ। স্যোনা শ্বশ্ব্রৈ প্র গৃহান্ বিশেমান্।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/২/২৬।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধু! কল্যাণময়ী, গৃহের শোভাবর্দ্ধনকারিণী, পতিসেবা পরায়ণা, শ্বশুরের শান্তিদায়িনী, শ্বাশুড়ীর আনন্দ দায়িনী! গৃহকার্যে নিপূণা হও।
অতএব স্ত্রী, শূদ্র সকলের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা আছে এবং সকলে বেদ অধ্যয়ন করতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে......
☞ আমাদের কোনটা গ্রহণ করা উচিত? বেদ নাকি ভাগবত?
☞ ব্যাসদেব যদি শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করতেন তাহলে তিনি এই বেদ বিরোধী কথা বল্লেন কিভাবে?
তার কারণ হচ্ছে ভাগবত ব্যাসদেব রচিত নয়।
যদি ভাগবতের কথা সত্যি বলে ধরে নি; অর্থাৎ স্ত্রী,শূদ্রের বেদ বুঝার ক্ষমতা নাই তাই তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছে।
☞ তাহলে, মহাভারতের যুগের আগেও স্ত্রী,শূদ্র ছিল কিন্তু তখন তাদের উদ্ধারের জন্য কি করা হয়েছিল? তারা ও যাতে তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে সে জন্য কি করা হয়েছিল?
ঋগ্বেদঃ
১/ ১/১৭৯ সূক্তের দেবতা রতি, ঋষি অগস্ত্যের পত্নী লোপামুদ্রা ।
২/৫/ ২৮ সূক্তের দেবতা অগ্নী, ঋষি অত্রিকন্যা বিশ্ববারা ।
৩/৮/৯৬ সূক্তের দেবতা ইন্দ্র, ঋষি অত্রি কন্যা অপালা ।
৪/ ১০/ ৩৯ ও ৪০ সূক্তের দেবতা অশ্বিদয় , ঋষি কক্ষিবত্ কন্যা ঘোষা ।
৫/ ১০/ ৮৫ সূক্ত যা বিবাহ সূক্ত বলে খ্যাত, ঋষি সাবিত্রি সূর্যা ।
৬/ ১০/ ১২৫ সূক্তের দেবতা আত্মা, ঋষি অশ্ভৃণ কন্যা বাকৃ।
৭/ ১০/১৮৫ সূক্তের দেবতা সপত্নীবাধন, ঋষি ইন্দ্রানী ।
বিঃদ্রঃ-ঐতরেয় মহীদাস শুদ্র হয়েও ঋগবেদের অধ্যয়ন করে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ রচনা করেছেন।
পাণিনি ৪.১.৪৯ ও ৬.২.৮৬ নারীরা আচার্য হিসাবে নিযোগ হতেন
যাঁর ব্রহ্ম-জ্ঞান আছে , যিনি বেদের পঠন-পাঠন এবং পরমাত্মার উপাসনাতে নিযুক্ত থেকে বিদ্যা আদি উত্তম গুণ ধারণকারী ব্যক্তি , তিঁনি ব্রাহ্মণ ।
অধ্যাপনমধ্যয়নং য়জনং য়াজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহশ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।
অনুবাদ : অধ্যয়ন , অধ্যাপনা , যজ্ঞ করা ও করানো , দান দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা এই ছয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম ।
শ্রীমদ্ভগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ জী বলছেন -
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্৷৷
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৪২ শ্লোক
অর্থ : শম , দম , তপ , শৌচ , ক্ষান্তি , সরলতা , জ্ঞান , বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এই কয়টি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম ।
তাহলে আপনারা সকলেই জানতে পারলেন ব্রাহ্মণ কে এবং ব্রাহ্মণের কর্ম কি । এবার চলুন দেখে নিই এখনকার ব্রাহ্মনরা কি কর্ম করেন -
ধর্ম ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণদের পেট পূজার জন্য "পুরোহিত দর্পন" নামক একটি বই রচনা করা হয়েছে ১২৯৮ সালে । বইটির লেখক হলেন "সুরেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য" নামের এক চতুর ব্যক্তি । বইটি যে ব্রাহ্মণদের স্বার্থে , ধর্ম নিয়ে ব্যবসার জন্য রচনা হয়েছে , তা লেখক নিজেই স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করেছে তাঁর এই গ্রন্থে ।(তথ্যসূত্র : পুরোহিত দর্পন ৩ নং পৃষ্ঠায় নিবেদনে) এজন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই ।
আজ "পুরোহিত দর্পন" থেকে এমনই একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যা সম্পূর্ণ শাস্ত্রবিরুদ্ধ , ধর্মবিরুদ্ধ এবং সমাজসংস্কারে বাঁধা সৃষ্টিকারী একটি বিষয় । তার আগে জেনে নেবো -
"যিনি শাস্ত্রজ্ঞ , অর্থাৎ সকল শাস্ত্রের পণ্ডিত , যিনি গৃহস্থের ক্রিয়াকর্মের দ্বারা সকলের কল্যাণ করে থাকেন , তিঁনিই পুরোহিত।"
অনেকেরই এই ধারণা যে - পুরোহিত , ব্রাহ্মণ এবং দ্বিজ শব্দ গুলি এক অর্থে ব্যবহার করা হয় , কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা । আসলে ব্রাহ্মণ , পুরোহিত ও দ্বিজ প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে ।
ব্রাহ্মণ সম্পর্কে বললাম , পুরোহিত সম্পর্কে বললাম , এবার জানবো - "দ্বিজ কাকে বলে ?"
যিনি বিদ্যা শিক্ষার মধ্য দিয়ে উপনয়ন সংস্কার দ্বারা উপবীত ধারন-পূর্বক নবজন্ম লাভ করেন , তাঁকে দ্বিজ বলা হয় ।
অর্থাৎ , মাতার গর্ভ হইতে যখন কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় তখন সেই সন্তানের ভৌতিক জন্ম হয় । আচার্য্যর নিকট উপনয়ন নেওয়ার পর সেই সন্তান যখন গুরুর নিকট শিক্ষা-দীক্ষার আবেষ্টনীতে পারমার্থিক জ্ঞান লাভ করে তখন তাঁহার দ্বিতীয় জন্ম বা দ্বিজত্ব লাভ হয় । ইহাকে আধ্যাত্মিক জন্মও বলে । তাই উপনয়ন না হলে তাঁকে দ্বিজগণের মধ্যে গণ্য করা হয় না ।
বিঃ দ্রঃ - এখনও আমাদের বর্তমান সমাজে জন্মগত বর্ণবাদেই বিশ্বাসী । তাঁরা বর্ণ ব্যবস্থাকে শাস্ত্র মতে গুণও কর্ম অনুসারে মানতে পারেননি । উদাহরণ স্বরূপ দেখে থাকবেন ব্রাহ্মণের ছেলে সেও ব্রাহ্মণ ।
কিন্তু আমাদের শাস্ত্র সে কথা বলে না , আমাদের সকল শাস্ত্র গুণ ও কর্ম অনুসারে বর্ণ ব্যবস্থার কথা বলেছে । প্রমাণ দেখুন -
শ্রীমদ্ভাগবত গীতাতে কৃষ্ণজী বলছেন -
"চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"
অর্থাৎ "আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি ।"
ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা আছে দেখুন -
"সঃ (ক্ষত্রিয়ঃ) হ দীক্ষমাণ এব ব্রাহ্মণতামভ্যুপৈতি"
অর্থাৎ ক্ষত্রিয় দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত করতে পারে ।
"তস্মাদপি (দীক্ষিতম্) রাজন্যং বা বৈশ্যং বা ব্রাহ্মণ ইত্যেব ত্রুয়ান্ , ব্রাহ্মণো হি জায়তে যো যজ্ঞাজ জায়তে।।"
অর্থাৎ বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্ব গ্রহণ করতে পারেন ।
তাহলে এখন বোঝা গেলো যে - বর্ণ ব্যবস্থা গুণ ও কর্ম অনুসারেই সকল শাস্ত্রে বর্ণিত আছে । কারণ বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণত্বও গ্রহণ করতে পারেন ।
এবার আসি মূল বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় -
পুরোহিত দর্পনের ২২ পৃষ্ঠায় (শূদ্র আচমন) লেখা আছে , শূদ্র এবং স্ত্রীলোকদের বেদ মন্ত্র পাঠের অধিকার নেই । তাহলে আমার কথা হচ্ছে শূদ্র আর স্ত্রী লোক কি মানুষ নয় ? তাদের অপরাধটা কি , যে বেদ পাঠ করা যাবে না ?
প্রথমত আমরা সকলে মানুষ , পরমাত্মার নিকট আমরা সকলে সমান , এবং পরমাত্মা এবং তার জ্ঞানকে জানার অধিকার আমাদের সকলেরই সমান ভাবে আছে । তবে আমাদের মধ্যে এই বিভেদ কেন ? পরমাত্মা কি এই বিভেদ করেছেন ?
আসুন এই বিষয়ে শাস্ত্র কি বলে আমরা দেখে নিই -
যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানিজনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজান্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্যায় চ স্বায় চারণায়।
প্রিয়ো দেবানংদক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভুয়াসময়ং মে
কামংসমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।
ভাবার্থ : ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য এবং শূদ্র , স্বীয় স্ত্রীর ও সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মানুষকেই আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবানীর উপদেশ দান করেছি , তোমরাও সেইরূপ অন্যদের এই উপদেশ দান করো ।
মন্তব্য : কি....! অবাক হয়ে গেলেন ?
এখানে তো স্বয়ং পরমেশ্বর বলে দিয়েছেন যে নারী শূদ্র সকলের জন্য তিনি এই বেদবানী দিয়েছেন । তাহলে পুরোহিত দর্পন বলছে নারী ও শুদ্রের বেদ পাঠের অধিকার নেই ? স্বয়ং বেদেই তো এই কথার বিরোধিতা করা আছে , তাহলে এমন তথ্য কোথায় পেলো লেখক ?
আরও অবাক করা বিষয় দেখুন -
বেদে যদি নারীর অধিকার না থাকে তাহলে মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে নারীঋষি আসলো কোথা থেকে ?
আর ধূর্তরা বলে কিনা সেই নারীকেই বেদ পাঠ করতে দেওয়া যাবেনা ! নারী ঋষির প্রমান দিয়ে শেষ করা যাবেনা তাই প্রমান দেওয়ার জন্য ঋগ্বেদ থেকে অল্প কিছু সংখ্যক নারী ঋষির প্রমান দিচ্ছি দেখুন -
★ ঋগ্বেদ ১ মণ্ডল ১৭৯ সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন -
ঋষি অগস্ত্যের পত্নী "লোপামুদ্রা" ।
★ ঋগ্বেদ ৫ মণ্ডল ২৮ সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন -
ঋষি অত্রিকন্যা "বিশ্ববারা" ।
★ ঋগ্বেদ ৮ মণ্ডল ১ সুক্তের ৩৪ মন্ত্রের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন - ঋষি অসঙ্গের ভার্যা অঙ্গিরার কন্যা "শশ্বতী" ।
★ ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডল ৯৫ সুক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন - "পুরুরবা" ও "উর্বশী"।
★ ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডল ৩৯ ও ৪০ সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন - ঋষি কক্ষিবত্ কন্যা "ঘোষা" ।
★ ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডল ৮৫ সূক্ত যা বিবাহ সূক্ত বলে খ্যাত , তাহার দ্রষ্টা ঋষি হচ্ছেন - ঋষি "সাবিত্রি সূর্যা" ।
তাহলে আপনারা বলুন যে বেদ পাঠের অধিকার যদি না থাকে তবে এই নারী ঋষিরা মন্ত্রদ্রষ্টা এবং ঋষি হলেন কি করে ?
আমাদের সনাতন শাস্ত্রে কোথাও মানুষে মানুষে বিভেদ করেনি । সকল বর্ণের মনুষ্যের জন্যই বেদ জ্ঞানের সমান অধিকার আছে । সকলকে সমান দৃষ্টিদিয়ে দেখার কথা বলা আছে । আর ভণ্ড গুলো বলে কি যে , নারী ও শূদ্রদের বেদ পাঠ নিষিদ্ধ ?
শূদ্র কোন ব্যক্তিকে বলা হয় ?
শূদ্র হলেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের অজ্ঞানতার কারণে কোন প্রকারের উন্নত স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারেননি এবং যিনি নিজের নিম্ন স্থিতি হওয়ার কারণে তথা নিজের উন্নতির চিন্তা করেন তথা নিজের প্রভূর ভরণ পোষণের চিন্তা করেন এরূপ সেবক মানুষ হলেন শূদ্র । অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে যার নিম্ন জীবনস্থিতি , যে কেবল সেবা আদি কার্য করে , ওইরূপ মানুষ শূদ্র ।
এখন আপনাকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য গুরুগৃহে পাঠানো হল কিন্তু আপনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলেন না ব্যর্থ হলেন , যথা - একটা স্কুলে অনেক বিদ্যার্থী থাকেন সকলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না , যিনি পারেন না তিঁনি তাঁর কর্ম জীবনে বুদ্ধি দ্বারা উন্নতি করতে পারেনা , তাই তিঁনি দৈহিক পরিশ্রম করে জীবনযাপন করেন বলে , তিঁনি শূদ্র ।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা আছে - "অসতো বা এষ সম্ভূতো যৎ শুদ্রঃ" (তৈ০ ৩।২।৩।৯) । অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে যার নিম্ন জীবনস্থিতি , যে কেবল সেবা আদি কার্য করে , ওইরূপ মানুষ হলেন শূদ্র ।
আশা করি বোঝাতে পেরেছি পাঠকদের - শূদ্র কাদের বলা হয় !
শূদ্রর কর্ম সম্পর্কে মহর্ষি মনু বলছেন -
একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেৰ বর্ণনাং শুশ্রষামনসূয়য়া।।
অনুবাদ : নিন্দা , ঈর্ষা এবং অভিমানাদি দোষ পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , এবং বৈশ্যদিগের যথাযথ ভাবে সেবা করা শূদ্রের কর্তব্য এবং তদ্দ্বারাই জীবন যাত্রা নির্বাহ করা । এটিই শূদ্রের একমাত্র গুণ এবং কর্ম ।
গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ জী বলছেন -
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্৷
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্৷৷
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৪৪ শ্লোক
অর্থ: কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়টি বৈশ্যের স্বাভাবিক কর্ম। পরিচর্যা শুদ্রের স্বভাবজাত কর্ম ।
যেহেতু বেদ পাঠের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে , তাই বেদ এবং অন্যান্য শাস্ত্র থেকে আপনাদের প্রমাণ দিলাম , নারী এবং শুদ্রের বেদ পাঠের অধিকার আছে কি নেই ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ