কুরআন pdf - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

16 February, 2022

কুরআন pdf

সূরাভিত্তিক ডাউনলোড
১৯ খন্ডে প্রকাশিত বাংলা তাফহিম ডাউনলোড 


তাফহিম (সম্পূর্ণ এক সাথে)
                                                সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ - ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। তিনি তার নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামী নামক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম স্কলারদের মধ্যে একজন। ইসলামে অবদান রাখার জন্যে তাকে ১৯৭৯ সালে মুসলিম বিশ্বের নোবেলখ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয়।তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ব্যক্তি যার গায়েবানা জানাজার নামাজ কাবাতে পড়া হয়।
মওদুদী সাহেব তাঁর লিখিত বিভিন্ন বইয়ে নবী-রাসুলদের তথা ইসলাম সম্পর্কে যেসব বিরূপ মন্তব্য করেছেন, তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো।
যেমন মওদুদী বলেন, 'নবীগণ মাসুম (নিষ্পাপ) নন। প্রত্যেক নবীর দ্বারাই কিছু না কিছু গোনাহ সংঘটিত হয়েছে'- (তাফহীমাত ২/৪৩)। 'কোনো কোনো নবী দ্বীনের চাহিদার ওপর অটল থাকতে পারেননি, বরং তারা নিজ মানবীয় দুর্বলতার কাছে হার মেনেছেন'- (তাফহীমুল কোরআন ২/৩৩৪)। 'নবী হোক বা সাহাবা হোক কারো সম্মানার্থে তার দোষ বর্ণনা না করাকে জরুরি মনে করা (মওদূদীর দৃষ্টিতে) মুর্তিপূজারই শামিল'- (তরজমানুল কোরআন, সংখ্যা ৩৫, পৃষ্ঠা ৩২) । 'হজরত ইউনুস (আ.) ঠিকমতো নবুয়তের দায়িত্ব পালন করেননি'- (তাফহীমুল কোরআন ২/৯৯) । 'হজরত ইব্রাহিম (আ.) ক্ষনিকের জন্য শিরকের গোনাহে নিমজ্জিত ছিলেন'- (তাফহীমুল কোরআন ১/৫৫৮)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে মওদুদী বলেন, 'মহানবী (সা.) মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি মানবিক দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে গোনাহ করেছিলেন'- (তরজমানুল কোরআন, সংখ্যা-৮৫, পৃষ্ঠা-২৩০)। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সম্পর্কে মওদুদী বলেন- 'সাহাবাদের সত্যের মাপকাঠি জানবে না'- (দস্তুরে জামায়াতে ইসলামী, পৃষ্ঠা-৭)। শুধু তাই নয়, ইসলামের বহু মৌলিক পরিভাষা বিকৃত করার ধৃষ্টতা তিনি দেখিয়েছেন। মওদুদী মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইমান হরণের অপচেষ্টা চালিয়েছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নদওয়াতুর উলামার সাবেক শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা ইসহাক সিন্দিলভী সাহেব বলেন, ''মওদুদী সাহেবের কিতাব 'খিলাফত ও মুলুকিয়াত' পড়ে মনে হলো, মওদুদী সাহেব 'ছাবাই' ফেতনার মুজাদ্দিদ, চিন্তাধারায় একজন পাক্কা শিয়া। সাহাবিদের গালাগাল করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুন্নীদের শিয়া বানানোর ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন।'' মওদুদী সাহেবের পুত্র হায়দার ফারুক বলেন, 'বাবা (মওদুদী) উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ৯ সন্তানের কেউই দলটির রাজনীতিতে জড়াননি। বাবার রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য সন্তানদের ওপর পারিবারিক কোনো চাপও ছিল না। বরং তারা যাতে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে না জড়ান, সেজন্য তিনি সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত রহস্য ছেলেমেয়েদের তিনি কোনো দিন বলেননি'- (সুত্র : বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ৬ ও ৮ অক্টোবর ২০১৩ এর সংবাদ)। তা ছাড়া উপমহাদেশের খ্যাতনামা উলামাদের প্রায় সবাই মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারায় যেসব মারাত্মক ভুলভ্রান্তি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, সে বিষয়ে জাতিকে সতর্ক করেছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর প্রথম দিকের অনেক নেতাও মওদুদীকে সেসব ভুল-ভ্রান্তি প্রকাশ্যে প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল মওদুদী সাহেব তা প্রত্যাহার করার পরিবর্তে মানুষকে আরো বেশি গোমরাহির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, তখন তাঁরা একে একে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী দল থেকে পৃথক হয়ে গেছেন। উদাহরণত, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মাওলানা মনজুর নো'মানী, সেক্রেটারি কমরুদ্দীন বেনারসী, মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য হাকীম আবদুর রহীম আশরাফ, বিশ্ববরেণ্য মুসলিম মনীষী মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) প্রমুখসহ প্রথম সারির প্রায় আরো ৭০ জন নেতা জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন- (ফতোয়ায়ে রাহমানিয়া, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা. ৫৮)। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফি সাহেব বলেন, 'জামায়াতের সহযোগী না বলে বরং আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুন'- (কালের কণ্ঠ ৪-৪-২০১৩)। বর্তমানের জামায়াতে ইসলামীও কোনো ইসলামী দল নয়। তাদের বেশির ভাগ নেতা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, যেমনটা মওদুুদীরও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা ছিল না। তাদের দেহ-পোশাক ও কাজকর্মে ইসলামের বালাই নেই। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। সম্প্রতি খবর বের হয়েছে, জামায়াত নেতারা নিজেদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয় না, এমনকি রাজনৈতিক ধ্বংসাত্মক কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে তাদের ব্যবহার করে না; অথচ গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের মওদুদীবাদ শিক্ষা দিয়ে একদিকে যেমন তাদের ইমান হরণ করছে, অন্যদিকে তাদের জিহাদের নামে মানুষ হত্যা ও সম্পদের ক্ষতি সাধনে প্ররোচিত করছে। অতএব তাদের থেকে সাবধান!

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
অর্থনৈতিক প্রচেষ্টায় সমান অধিকার
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যেই সৃষ্টি করেছেন। অতএব এ যমীন থেকে আপন জীবিকা অর্জনের চেষ্টা মানুষের জন্মগত অধিকার। সকল মানুষই সমানভাবে এ অধিকারের অংশীদার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না। আর না এ ব্যাপারে কেউ অন্যের চেয়ে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি, বংশ বা শ্রেণীর প্রতি এ বিধি বিশেধ আরোপিত হতে পারে না যে, জীবিকার উপাদানসমূহের মধ্যে কিছু ব্যবহার করার অধিকার তার থাকবে না অথবা কোন পেশা অবলম্বনের পথ তার জন্যে বন্ধ করে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে শরীয়ত অনুযাযী এ ধরনের পার্থক্যকরণও করা যেতে পারে না, যার ভিত্তিতে জীবিকার উপায় অথবা ধন-দৌলতের দুয়ার বিশেষ শ্রেণী, বংশ অথবা পরিবারের জন্যে একচেটিয়া হয়ে যাবে। খোদার সৃষ্ট যমীনে তাঁরই সৃষ্ট উপায়-উপাদানে স্বীয় অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টায় প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে এবং এর পথ সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত।
(ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি)

অর্থনৈতিক সমস্যা ও ইসলাম
ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সঞ্চিত রাখাকে দূষণীয় মনে করেছে। তার দাবি এই যে, যা কিছু ধন তোমার আছে তা তোমার প্রয়োজন পূরণে ব্যয় কর অথবা অন্যকে দান কর যাতে সে তার প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারে। এভাবে সমগ্র ধন সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আবর্তিত হতে থাকবে। কিন্তু এমন করা না হলে এবং একত্রে সঞ্চিত করার জেদ করা হলে এ সঞ্চিত ধনের শতকরা আড়াই ভাগ তার থেকে বের করে তা এমন লোককে দিতে হবে যারা জীবিকা অর্জনে সক্ষম নয় অথবা জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। এই হলো ‌’যাকাত ব্যবস্থা’। যাকাত ব্যবস্থাপনার যে পরামর্শ ইসলাম দেয় তা হলো এই যে, তাকে জনসাধারণের ধনভাণ্ডারে (Public Exchequer) জমা দিতে হবে, যেখান থেকে সকল অভাবগ্রস্থের প্রয়োজন পূরণ করা হবে। এ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সমাজের জন্যে আর্থিক নিরাপত্তার (Social Insurance) সর্বোত্তম পন্থা এবং সামাজিক সাহায্য বিতরণের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে যে অনাচার হয়ে থাকে, এ যাবত ব্যবস্থা তার মূলোৎপাটন করে।
কোরআন-হাদীসে এ সবের বিস্তারিত বিধি ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। মাওলানা তাঁর ‘যাকাতের হাকীকত’ গ্রন্থে এ সবের যুক্তিপূর্ণ ও মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।
মাওলানা বলেনঃ
‘বায়তুল মাল’ সর্বদা আপনার সাহায্যদাতা হিসাবে বিদ্যমান থাকে, যার জন্যে আপনার চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারে না। আপনি অভাবগ্রস্ত হলে বায়তুলমালের সাহায্যপ্রার্থী হোন এবং স্বীয় হক আদায় করুন। এর পরে ব্যাংক ড্রাফট ও ইনসিউরেন্স পলিসির কোন প্রয়োজন নেই। আপনি পুত্র পরিজন ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করুন। সমাজের ধনভাণ্ডার আপনার মৃত্যুর পর তাদের ভরণপোষণের জন্যে দায়ী। বার্ধক্য ও সকল প্রকার বিপদে আপদে বায়তুল মাল আপনার সকল সময়ের সাহায্যকারী যেখানে আপনি সাহায্য চাইতে পারেন। পুঁজিপতি আপনাকে বাধ্য করতে পারবে না যে, তারই শর্তাধিন আপনাকে কাজ করতে হবে। বায়তুলমাল বিদ্যমান থাকতে অভূক্ত ও বিবস্ত্র হয়ে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করার কোন আশংকা থাকতে পারে না। [অর্থনৈতিক সমাস্যা ও তার সমাধান (উর্দু) পৃঃ ৪০,৪৩]
অর্থনীতির বিশদ বিশ্লেষণ করে মাওলানা ‘সুদ’ ও ‘ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ’ নামে দু’খানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। অর্থনীতির উপরে প্রামাণ্য মূল্যবান গ্রন্থ এ দু’খানি।
‘সুদ’ গ্রন্থে সুদভিত্তিক অর্থনীতি ও সুদহীন ইসলামী অর্থনীতির বিশদ আলোচনার পর ইসলামী অর্থনীতিকেই মানব জাতির জন্যে একমাত্র মঙ্গলকর অর্থব্যবস্থা হিসাবে প্রমাণ করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রন্থে পুঁজিবাদ, কমিউনিজম ও ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা করে প্রথম দুটি ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করেছেন। জায়গীরদারী সামস্তবাদী ব্যবস্থা, ইউরোপীয় রেনেসাঁ, মধ্যযুগের লিবারেলিজম, শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক লিবারেলিজমের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছেন। অতঃপর আধুনিক অর্থ সমস্যার ইসলামী সমাধানও পেশ করেছেন।

অন্যান্যের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞ ও মনীষীগণের মন্তব্য রয়েছে, রয়েছে তার ঘনিষ্ঠজনের অনুভূতি যা অনেক শিক্ষণীয় এবং অনুসরণীয়। তার কিছু নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

বেমম মওদূদী
মওদূদী সাহেব একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কোরআন এবং নবী চরিত্রের যে মাহাত্ম্য দান করেছে, তাতে বিনা দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপ কোরআন সম্মত।
“আমি ছিলাম গুমরাহ। মওদূদী সাহেব আমার সামনে উদিত হন সিরাতুল মুস্তাকীমের’ রাহবার হিসাবে। তিনি ছিলেন নির্বাক, কিন্তু তাঁর কার্যকলাপই প্রতিমূহূর্তে সত্য পথের দিকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। যদি তিনি মুখ খুলতেন, আমার প্রত্যেক কাজে বাধা দিতেন এবং প্রতিটি বিষয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করতেন, তাহলে আমার সংশোধন তো দূরে কথা, তাঁর সাথে জীবন যাপন করাও আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। কিন্তু তা তিনি করেননি কোনদিন। এটাই ছিল তাঁর ইসলাম প্রচারের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা, যা তিনি শিক্ষা করেছিলেন কোরআন পাক থেকে।
“তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ধৈর্যশীল ও স্নেহশীল। আমার স্মরণ নেই যে, তিনি বিগত পনেরো বিশ বছর ‘অমর-বিল মারুফ’ ও ‘নাহী আনিল মুনফার’ সম্পর্কে আমার প্রতি কোন কঠোর আদেশ করেছেন কি না। তাঁর চরিত্রের মাধুর্যই এই যে, কিছুকাল তাঁর সংস্পর্শে থাকলেই তাঁর মনঃপূত হওয়া যায়।”
“মওদূদী সাহেব বাহ্যিক সংশোধন অপেক্ষা আধ্যাত্মিক সংশোধনের প্রতি অধিকতর দৃষ্টি রাখেন। একবার তিনি কোথা হতে এসে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়েন। এমন সময় আগন্তুক তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেন। আমি বললাম যে, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। একথা শুনে মওদূদী সাহেব শুধু এতটুকু বললেন, ‘তুমি মিথ্যা কথা বলে ফেললে’?”
“একবার আমরা সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছি। আমি বড় ছেলেকে বলছিলাম, ‘ব্যাটাৱ, নামায পড়ো। নতুবা লোকে বলবে মওদূদী সাহেবের ছেলে নামায পড়ে না’।”
“তিনি বললেন, দেখ ব্যাটা, যখন নামায পড়বে, তখন একমাত্র আল্লাহর জন্যেই পড়বে, পিতর জন্যে না।”
“সন্তানের প্রতি এত স্নেহশীল যে, এমনটি আর কাউকে দেখিনি। যখনই তিনি বাড়িতে আসেন, প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে ডাকতেন। দারুল ইসলামে আমাদের এক টাঙা ছিল। তিনি নিজেই আমাকে এবং ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যার আগে বেগাতে যেতেন। অন্য কারো সঙ্গে তাদের কখনো কোন সথানে পাঠাতেন না, পাছে কেউ হঠাৎ টাঙা থেকে পড়ে যায়। একবার কি কারণে কোচওয়ানের সঙ্গে ছেলেদের পাঠানকোট পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি নদীর ধারে বেড়াতে যান। মাগরিবের আগেই নদীর ধার থেকে ফিরে এসে জানতে পারলেন যে, ছেলেরা তখন্টো ফিরেনি। তখন তিনি বাড়ির ভিতরে না এসে বাইরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইলেন। ছেলেরা ফিরে এলে, তবে তাদের নিয়ে তিনি ভেতরে এলেন।”
“সতেরো বছরবয়সে মওদূদী হাসেব পিতৃহীন হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মা এখনও বেঁচে আছেন।” [বেগম মওদূদীর উপরোক্ত উক্তির পর ১৯৫৭ সালে মাওলানা মওদূদীর মাতা জান্নাতবাসী হন।]
“তিনি মায়ের এতদূর খেদমত করেন যে, এমন পুত্র সত্যিই বিরল। মায়ের কোন কিছু তাঁর মনঃপূত না হলে নীরব থাকেন। কোনরূপ বিরক্তিও প্রকাশ করেননি। তাঁকে কোন মন্দ বললেও তিনি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন না। প্রতি মুহূর্তে তাঁর খেদমতের জন্যে প্রস্তুত থাকেন।
“আমার পূর্ব পুরুষ বাদশাহ শাহজাহানের আমালে বোখরা থেকে দিল্লী আসেন। তখন থেকে পুরুষানুক্রমে দিল্লীতে বসবাস করার ফলে আমরা শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। মাওলানা মওদূদী হায়দারাবাদ থেকে দারুল ইসলামে আসার পর আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।”
“আমাদের পরিবারসহ মাত্র তিনটি পরিবার নিয়ে দারুল ইসলামের বসতি শুরু হয়। সাদাসিধে গ্রাম্য ঘরবাড়ি। না সেখানে বৈদ্যুতিক আলো আছে, না পানির কল এবং না জীবন যাপনের অন্যান্য সহজ উপায়-উপাদান। এটা ছিল আমার জীবনে ধৈর্য্যশীলতার প্রাথমিক স্তর।”
“একবার আমাদের ঘরে জ্বালানী কাঠ ছিল না। মাওলানা সকালে নাশতা করে অফিসে চলে যান। তখন আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম কি করি। এমন সময়ে মাওলানা অন্দরে এসে বললেন, ‘ব্যাপার কি, এমন চুপচাপ বসে রয়েছ যে?”
বললাম, ‘জ্বালানী কাঠ নেই, পাচিকা বসে আছে।’ তিনি বললেন, ব্যাস এতটুকুতেই অধীর হয়ে পড়েছ? এই বলে একটা কুঠার হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের বাইরে কতকগুলি কাষ্ঠখণ্ড পড়েছিল। তা নিজ হাতেই ফাড়তে শুরু করলেন। কুঠারের দু’এক ঘা মারতেই চারদিক থেকে লোকজন ছুটে এলো এবং অল্পক্ষণের মধ্যে জ্বালানি কাঠের স্তূপ হয়ে গেল।”
“এমনি একদিন কি কারণে ভিস্তিওয়ালা পানি দেয়নি। সেদিন ছিল আবার ভয়ানক গরম। আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। মাওলানা জানতে পেরে দু’টি বালতি হাতে কূপে চলে গেলেন এবং নিজ হাতেই পানি তুলে বালতি ভরতে লাগলেন। লোকজন তা দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিতে বাড়ি ঘর ভরে দিল।” [বেগম মওদূদী মাহমুদা খাতুন ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন।]

মাহিরুল কাদিরী
পাক-ভারতের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক এবং মাসিক পত্রিকা ‘ফারান’র সম্পাদক জনাব মাহিরুল কাদিনী বলেনঃ
“আমি মাওলানার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। আমার বিশ্বাস, লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি দ্বীনের যে খেদমত করছেন, বর্তমান যুগে তার তুলনা বিরল। এমন কি আরব দেশগুলিতেও তার তুলনা নেই।”
মাওলানা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ
“তিনি ইসলামী জগতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সত্যিকার ইসলামী গবেষণার সূত্রপাত করেছেন এবং মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনয়ন করেছেন- যিনি কোরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যকার, সত্যের সহায়ক, সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতীক- ইসলামী ঐতিহ্যের অস্পষ্ট চিত্রাবলীর রূপদানকারী, আল্লাহর দ্বীনের একনিষ্ঠ সেবক, যাঁর কথা ও কাজে পূর্ণ বিশ্বাস করা যায়, যাঁর সমগ্র যৌবনকাল দ্বীনের কাজে উৎসর্গীকৃত এবং তাঁরই চিন্তা গবেষণায়, শ্রম ও সাধনায় যিনি অকালবৃদ্ধ-যাঁর কথা ও লেখা শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ কাল যাবত সত্যের আহ্বান জানিয়ে আসছে, এত বড় বিজ্ঞ আলিম-যিনি একই সময়ে কোরআন-হাদীস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, শাসনতন্ত্র, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করতে পারেন- যিনি যুক্তির সম্রাট এবং জ্ঞানের সাগর, শুধু প্রাচ্যেরই নন পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সাথেও যিনি শুধু পরিচিতই নন বরং তাকে পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেছেন, যিনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য পালনের আহ্বায়ক মুলতান জেলের প্রাচীর চতুষ্টয় ও লাহোর দুর্গের অন্ধকার ফাঁসিকক্ষ যাঁর আন্দোলন স্তব্ধ করতে পারেনি, কুফরের ফতোয়াবাজি যাঁর কণ্ঠরোধ করতে পারেনি, যিনি কোরআন ও সুন্নাহর কষ্টিপাথরে প্রত্যেক কথা ও কাজকে যাচাই-পর্যালোচনাকারী এবং কষ্টিপাথরে যা কিছুই ধরা পড়ুক তা যত বড় বিদ্বান পণ্ডিতের বেলায় হোক না কেন, নির্ভয়ে প্রকাশকারী, দ্বীনের প্রতিষ্ঠা যাঁর ব্রত, সত্যের আহ্বান যাঁর কর্মসূচী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি যাঁর লক্ষ্য-সত্য প্রচারের জন্যের যিনি সমগ্র জগতের রোষানলে ভীত শঙ্কিত নন এবং স্বীয় সুনাম নষ্টের ভয়ও যার নেই অজ্ঞ-অর্বাচীনরা তাঁর প্রতি নানা প্রকারের অপবাদ করলেও যিনি সবকিছুই ধৈর্য সহকারে উপেক্ষা করেছেন, যাঁর লেখনী উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও পবিত্র করেছে এবং উর্দু ভাষার অমূল্য অবদান হয়ে রয়েছে- বক্তৃতায় এক অভিনব প্রকাশ ভঙ্গিমার যিনি উদ্ভাবক এবং বক্তৃতাকালে মনে হয় যেন থমথমে আকাশ থেকে ঝটিকাপ্রবাহ ও বিদ্যুতমালার স্ফূরণ -যাঁর নামে ‘কাদিয়ানীবাদ’ প্রকম্পিত ও হাদীস অবিশ্বাসকারীদের শ্বাসরোধ শুরু হয়, যিনি সুন্নাতের পরিপোষক ও শির্কবিদয়াতের মূলোৎপাটক, যিনি জ্ঞান গরিমা ও অসাধারণ খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও সাধারণ লোকের সঙ্গে বিনা-লৌকিকতায়, সরলতা ও মিষ্ট মধুর ভাষায় এমনভাবে মিশতে পারেন যেন অপরের সঙ্গে তাঁর কোন পার্থক্যই থাকে না, যিনি শুধু একজন আলিম, চিন্তাবিদ, বাগ্মী এবং গ্রন্থকারই নন, বরং এমন এক মর্দে মুজাহিদ মৃত্যুদণ্ডাদেশ শ্রবণেও তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না-যিনি ইতিহাস-সৃষ্ট নন, বরং ইতিহাস-স্রষ্টা।”
বশীরুল ইবরাহিমী
আলজিরিয়ার জননেতা এবং তথাকার জমিয়তে উলামায়ে মুসলিমীনের সভাপতি আল্লামা মুহাম্মদ আল-বশীরুল ইবরাহিমী বলেন-
“তাঁর মত (সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী) মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। বিশেষ করে তাঁর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি আলেম সমাজে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন- আমি অতি অল্পই দেখেছি। তাঁর গুণপনার মধ্যে বিশেষ গুণ এই যে, তিনি সত্যের উপর অচল-অটল, সত্যপথে ধৈর্যশীল এবং শাসকশ্রেণীর তোষামোদ করা তো দূরের কথা, তাঁদের সাহায্য লাভেরও বিরোধী।
“পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান আমি যাঁদেরকে দেখেছি এবং যাঁদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি, ইসলামী শরীয়ত ও ইসলামী ইতিহাসের তথ্যাদি সম্পর্কে তিনি সকলের চেয়ে অধিক জ্ঞান লাখেন। তাঁর অধ্যয়ন অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। তিনি সূক্ষ্ম বোধশক্তি, উচ্চতম মস্তিষ্ক, স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী।
“আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সম্পর্কে মাওলানা মাওদূদী যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছে। সকলকে তিনি ন্যায়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করেন।”
“বিগত মাসে পাকিস্তানে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং কিছু খুন খারাবীও হয়। আরব দেশের সংবাদপত্রগুলো এ সম্পর্কে কোন বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করেনি বলে আমি এর কারণ ও গুঢ় রহস্য বুঝতে পারিনি। তবে আমার সুস্পষ্ট ধারণা এই যে, ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিই এ সবের মূলীভূত কারণ। সম্ভবত গভর্ণমেন্ট দেশের মধ্যে মাওলানা মওদূদী এবং তাঁর সহকর্মীগণের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষ্য করে অধিকাংশ সহকর্মীকে কারারুদ্ধ করেছেন। অতঃপর লাহোরে সামরিক আইন জারি করে সামরিক বাহিনীর উপরই সকল ভার ন্যস্ত করা হয়। সামরিক আদালত মাওলানাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। পরে জানতে পালাম মৃত্যুদণ্ড রহিত করে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। পাকিস্তানের মুসলমানগণ এই জুলুমশাহীর সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও শোভাযাত্রার তুমুল ঝড় উত্থিত হয়। দেশময় বিক্ষোভের ফলেই যে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
ওদিকে মিসর, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত প্রভৃতি স্থানের সুসংগঠিত ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও আনজুমানগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ উত্থিত হয় এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। আমি যখন কুয়েতে ছিলাম, তখনই এসব সংবাদের সত্যতা জানতে পারি। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে এবং জমিয়তে উলামা ও এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধের ভিত্তিতে আমিও বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে পড়েছি। কারণ মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিত্ব কোন এক বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাঁর ব্যক্তিত্ব মুসলিম জাহানের অনুসরণযোগ্য। আমাদের প্রতি তাঁর যে হক আছে, তার মধ্যে একটি এই যে, গভর্ণমেন্ট যখন তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন, তখন তাঁর মুক্তির জন্যে আন্দোলন করা আমাদের কর্তব্য।…”
“মাওলানা মওদূদী আল্লাহর পথে যে জিহাদের অভিযান শুরু করেছেন, তার জন্যে এ জগতে এতটুকু প্রতিদানই যথেষ্ট যে, দুনিয়ার মুসলমান তাঁর সাহায্যর-সহযোগিতার জন্যে একতাবদ্ধ হয়েছেন। এর চেয়ে বিরাট ও চিরস্থায়ী প্রতিদান তাঁর জন্যে আল্লাহর নিকট গচ্ছিত আছে।”

ডাঃ মুহম্মদ আতাউর রহমান নদভী
‌’এতো ইবনে তাইমিয়ারই রং।’
আজ থেকে পনেরো বছর আগে একখানি পবিত্র মুখ থেকে আমি উক্ত কয়েকটি কথা শুনতে পেয়েছিলাম। যে মর্মস্পর্শী ভঙ্গিমায় কথাগুলো শুনেছিলাম, সে দৃশ্য অবিকল সুরক্ষিত অবস্থায় আমার চোখের সামনে ভাসমান রয়েছে। মনে হয় যেন এখনও সেই মুখমণ্ডল আমি দেখতে পাচ্ছি এবং সেই মর্মস্পর্শী কথাগুলো আজো আমার কর্ণকুহরে ঝংকৃত হচ্ছে।
সব কথা খুলে বলাই শ্রেয় মনে করি।
আমি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠ্যভ্যাস করছিলাম। ১৯৩৫ সালে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় (লাখনো) ভর্তি হই। এ সময়ে ‘তর্জুমানুল কোরআন দেখার আমার সুযোগ হয়েছিল। আমার মনের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তর্জুমানুল যে, তর্জুমানুল কোরআন’ পাঠ করা আমার এক স্বাভাবিক চাহিদা হয়ে পড়েছিল।
গ্রীষ্মের বন্ধে যখন আমি বাড়ি যাই (মৌজা-পাহাড়পুর বাজার, পোঃ বড় হরিয়া, সারন) তখন তর্জুমানুল কোরআন সঙ্গে করে নিয়ে যাই। অতঃপর অতি আগ্রহে আমি আমার মুহতারাম পিতার নিকটে উক্ত পত্রিকার বিষয় উত্থাপন করি। তিনি তা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমার পিতা জনাব মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ জামিল আনসারী (রহঃ) একজন সত্যনিষ্ঠ দ্বীনের আলেম ছিলেন। তিনি সমগ্র জীবন অধ্যাপনায় কাটিয়ে দেন। তিনি শুধু অধ্যাপকই ছিলেন না বরং একজন মুফতীও ছিলেন। তিনি ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং এর দারুল ইফতার মুফতী ছিলেন।
“তর্জুমানুল কোরআনের” যতগুলি সংখ্যা আমার কাছে ছিল, তার সবই পিতার খেদমতে হাযির করলাম। এসব দেখে তিনি সর্বপ্রথম যে মন্তব্য করেন তা হচ্ছে এই-মিঞা, এসবই কোরআন এবং সুন্নায় আছে। এখন শুধু তার আমলের প্রয়োজন। সাধারণ ইংরেজী শিক্ষিত লোকে এসব বিষয়ে তাঁদের পত্র-পত্রিকায় লিখে থাকেন, কিন্তু নিজেরা তা মেনে চলেন না।”
‘উনিশ শ’ ছত্রিশ সালের ছুটিতে যখন বাড়ি আসি, তখন ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ সদ্য প্রকাশিত সংখ্যা এনে পিতাকে দিলাম। তিনি তা বেশ মনোযোগ সহকারে পাঠ করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার বিরাট ভুল ধারণা ছিল। এ ব্যক্তি (মওদূদী) শুধু ইংরেজী শিক্ষিতই নন, বরং আরবী ভাষায়ও মহাপণ্ডিত। আচ্ছা, তাঁর বয়স কত?’
আমি বললাম, ‘খুব সম্ভব ত্রিশ-বত্রিশ হবে।’
তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘এত অল্প বয়সে এতখানি পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতা? তাঁর পত্রিকা পাঠ কররে অবাক হতে হয়।’
“আমি মাওলানা মওদূদী সাহেবকে সবকিছু জানিয়ে দিলাম। তিনি তখন পাঠানকোটে এসে পড়েছিলাম। মাওলানা প্রভ্যুত্তরের সঙ্গে ‘সিয়াসী কাশ্‌মকাশ্‌, ‘ দীনিমাত’ প্রভৃতি গ্রন্থাবলী পাঠিয়ে দিলেন। আমার বুযুর্গ পিতা মরহুম এসব গ্রন্থ বারবার পাঠ করেন এবং বলেন, ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কে আমার ভ্রান্ত ধারণা ছিল। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। এত অবিকল আল্লামা ইবনে তাইমিয়ারই রঙ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন এক কালে যখন প্রকৃত প্রতিভাবান ব্যক্তি বিরল এবং বিশেষ করে এই হিন্দুস্তানে, এই ব্যক্তির কেমন করে আবির্ভাব হলো? ইনি যখন এর আদর্শ কার্যকর করতে থাকবেন, তখন তার সাথে চরম বিরোধিতা শুরু হবে। কারণ পৃথিবীতে সত্যনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তির সাথে এরূপ ব্যবহারই হয়ে থাকে। এমনও হতে পারে যে, তাঁকে শহীদ করা হবে।’
এ সময় হতে ‘তর্জুমানুল কোরআন’ পাহাড়পুর বাজার, আনসারী কুতুবখানার ঠিকানায় নিয়মিত আসতে লাগলো। পিতা ছুটিতে কলকাতা থেকে বাড়ি এলে তা অবসর সময় মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। অবশেষেএকটি আদর্শবাদী দল গঠনের আবশ্যকতা সম্পর্কে যখন ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মাওলানা মওদূদী ইঙ্গিত করতে আরম্ভ করেন, তখন আমার বযুর্গ পিতা বলেন-
‘যদি এ দল গঠিত হয়, তাহলে এর প্রথম সদস্য আমি হবো।’
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, উক্ত দল (জামায়াতে ইসলামী) কায়েম হবার মাত্র দশ দিন পূর্বে (১৬ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল) আমার পিতা জান্নাতবাসী হন। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন।
এ সময়ে আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী (রহঃ) এক বিরাট জনসভায় মাওলানা মওদূদীর বিরাট ব্যক্তিত্বের কথা ঘোষণা করেন।
উনিশ শ’ চল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দারুল উলুমের প্রাক্ত ছাত্রদের “নদভী সম্মেলন” হয়। আমি ১৯৩৯ সালে নদওয়ার দারুল উলুম থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। অতএব “নদভী সম্মেলন” যোগদান করার জন্যে আমিও লাখনো গিয়েছিলাম। এ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে যা আমাকে বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছিল তা এই যে, ঠিক ঐ সময়ে মাওলানা মওদূদীরও লাখনো আসার কথা ছিল। আমার মত নদওয়ার অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্রদেরও মাওলানার সাথে আলাপ করার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সম্মেলন শেষে মাওলানা মওদূদী নদওয়ার মেহমানখানায় তাশরীফ আনেন। সকল শিক্ষক এবং প্রাক্তন ছাত্র তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। নদওয়ার কর্তৃপক্ষ সুধীবৃন্দ এবং ছাত্রদের সম্মুখে বক্তৃতা করার জন্যে মাওলানা মওদূদীকে অনুরোধ করেন। লাখনোর আঞ্জুমানটি ছিল লাখনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদওয়ার ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা গঠিত। মাওলানা মওদূদী ‌’নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা’ সম্পর্কে তাঁর বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় বক্তৃতা করেন। মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী সভাপতিত্ব করেন এবং আল্লামা সাইয়িদ সোলায়মান নদভী মাওলানার পরিচয় করিয়ে দেন। যে কথাও যে ভাষায় জনাব সাইয়েদ সাহেব মাওলানার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তা আজো আমার কর্ণকুহরে ঝংকৃত হয়। তিনি বলেছিলেন–
আমি আপনাদের সামনে একটি যুবক অথচ এক জ্ঞান সমুদ্রের পরিচয় করিয়ে দিতে দাঁড়িয়েছি। আজ সমগ্র শিক্ষিক জগত মাওলানা মওদূদীর পরিচয় লাভ করেছে। তিনি বর্তমান যুগে ইসলামের একজন মুখপাত্র এবং দীনের একজন বিরাট আলেম। ইউরোপ থেকে ধর্মদ্রোহিতা এবং নাস্তিক্যবাদের যে প্রবল বন্যা ভারত পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এই পবিত্র হস্তেই ন্যস্ত করেছেন। তিনি ইউরোপের প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, কোরআন এবং সুন্নাহ সম্পর্কেও তিনি এমন গভীর জ্ঞানের অধিকারী যে, তারই পরিপেক্ষিতে বর্তমান যুগের সকল সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান তিনি পেশ করতে পারেন। এ জন্যেই বড় বড় নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী তাঁর অকাট্য যুক্তি তর্কের সম্মুখে নতি স্বীকার করেছে। একথা দ্বিধাহীন চিত্তে স্পষ্ট ভাষায় বলা যেতে পারে যে, ভারত এবং ইসলামী জগতের সুমলমানগণ দ্বীনের ব্যাপারে মাওলানা মওদূদীর কাছে বিরাট কিছু আশা করতে পারে।

আগা সুরেশ কাশ্মীরী
মাওলানা মওদূদীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাকিস্তানের মানসিক প্রতিভাকে জ্ঞানের রাজপথ প্রদর্শন করেছেন।
যে সময়ে আমাদের ইসলামী ভাবধারা দু’শত বছরের পরাধীনতার নাগপাশে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সে সময়ে তিনিই ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন হিসাবে পেশ করেছেন।
তাঁর আন্দোলন এমন একটি শক্তি, যা আধুনিক ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে ইসলামের এতখানি প্রাণশক্তি বিদ্যমান যে, বর্তমান যুগের নব্য যুবকদল তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে উদ্যোগী হতে পারে।
দেশের নিত্য পরিবর্তনশীল শাসনতন্ত্র আইনের বলে দেশের স্থূল দেহিক বিপ্লব কিছুকালের জন্যে দমন করতে পারে। কিন্তু মানসিক বিপ্লব দমন করার কোন শক্তি অথবা অস্ত্রশস্ত্রাদি তার নেই। আমাদের সমাজ জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে অথবা কতিপয় বিশেষ কারণে ইসলামের বিপক্ষে এক মানসিক বিপ্লব গড়ে তুলেছে। এর গতিরোধ করার যদি কারো সাধ্য থাকে, তা একমাত্র মাওলানা মওদূদী এবং তাঁর আদর্শভিত্তিক দলেরই আছে।

মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী
পাঠকদের কাছে তর্জুমানুল কোরআন সম্পাদকের পরিচয় দান নিষ্প্রয়োজন। তাঁর প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিরাট দ্বীনী খেদমতের কথা তর্জুমানুল কোরআনের পৃষ্ঠায় বারবার আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান যুগের অশান্তি-অনাসৃষ্টি প্রতিরোধের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বক্ষকে বিশেষভাবে প্রশস্ত ও উন্মক্ত করে দিয়েছেন্ তাঁর লেখা প্রতিটি ছত্র আধুনিক শিক্ষিতদের জন্যে অমৃতস্বরূপ। এ ব্যাপারে উলামা সমাজে মাওলানার স্থান অতি উচ্চে। তিনি প্রকৃতপক্ষে মিল্লাতের চিন্তাশীল পুরুষ।

মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেবের সুস্থ প্রকৃতি, সুষ্ঠু চিন্তাশাক্তি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রতি আমার চিরদিনই আস্থা রয়েছে। তাঁর আচার-আচরণ খোদা প্রদত্ত। সমস্যাবলীর প্রতি তাঁর দৃষ্টি সূক্ষ্ম, গভীর ও সর্বন্যাপী। তাঁর সমালোচনা এত পুঙ্কানুপুঙ্খ যে, কোন বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাঁর কার্যপদ্ধতি মনোমুগ্ধকর, ব্যাখ্য-বিশ্লেষণ হৃদয়গ্রাহী। এতদসহ তাঁর মহৎ প্রকৃতির সাক্ষ্য ত আমি বারংবার দিয়েছি। স্বয়ং এ অধম মাওলানা আবদুল বারীর সাহচর্যে উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কার্য গ্রহণের জন্য মাওলানাকে অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থা অতীব শোচনীয় থাকা সত্ত্বেও তিনি সন্তুষ্টচিত্তে আমাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যাঁর আত্মা এত বিরাট ও ঐশ্বর্যশালী, মননশীল ও চিন্তাশীল, প্রবন্ধকার হিসাবে যিনি খোদাপ্রদত্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাঁকে বেশী কিছু বলার ধৃষ্টতা ত ছিল না। কিন্তু এতটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালা মাওলানা মওদূদীর উপরে অসাধারণ কৃষা বর্ষণ করেছেন। ঈমানের জ্যোতিতে তাঁর অন্তর উদ্ভাসিত দেখতে পাই। নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাঃ)-এর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা দিয়ে তাঁর অন্তর সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এতদসহ নানাবিধ যোগ্যতায় তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে। এ সমুদয় সাহিত্য, মন ও ঈমানের শক্তি দিয়ে আল্লাহর পথে আহ্বানকে জীবনের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে যদি তিনি দণ্ডায়মান হন এবং উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় যদি কিছুদিন এ কাজ করা যায়, তা হলে হয়ত হতে পারে যে, লোকে সহসা তা গ্রহণ করবে না, কিন্তু ইসলাম যে সব স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়, অন্তত মনের মধ্যে যে সব জিজ্ঞাসার স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে।

মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী
তাঁর লেখার পদ্ধতি, অকাট্য যুক্তি, মৌলিক ও বুনিয়াদি আলোচনা পদ্ধতি এবং সর্বোপরি তাঁর সুষ্ঠু চিন্তাধারা ছিল আমাদের প্রকৃত ও মানসিকতার অত্যন্ত উপযোগী। এমন মনে হচ্ছিল যে, তাঁর খোদাপ্রদত্ত লেখনীশক্তি আমাদের মূক প্রতিভা ও রুচিরই মুখপাত্র। যেদিন নদওয়ার দারুল ইলুমের মসজিদ সংলগ্ন মেহমানখানায় বসে আমরা কয়েক বন্ধুতে হিজরী ১৩৫৬ সালের মহররম মাসের তর্জুমানুল কোরআনের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়ছিলাম, যাতে একটি প্রলয়ের ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছিল-তা কখনো ভুলবার নয়। এ মাওলানার এমন এক উদ্দীপনাপূর্ণ প্রবন্ধ ছিল যার প্রতিধ্বনি শুনা যেতো বহুদিন ধরে। আমরা সকলে মাওলানার বিচক্ষণতা, অন্তর্দৃষ্টি, সংকটের প্রতি অংগুলি নির্দেশ এবং তাঁর অসাধারণ লেখনীশক্তির অন্তর দিয়ে প্রশংসা করেছি। এরপর মাওলানার যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তা আমরা আনন্দের সাথে পড়তাম।

মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর নো‘মানী
মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর কাজের মধ্যে যা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হাজার হাজার তরুণ যুবক যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও শিক্ষায়তনের নাস্তিকতাপূর্ণ পরিবেশের প্রভাবে ইসলামের প্রতি সন্দিহান হয়ে তা একেবারে পরিত্যাগ করেছিল অথবা করার উপক্রম করেছিল, মাওলানা মওদূদীর প্রবন্ধাদি এবং জামায়াতে ইসলামীর কর্মতৎপরতা তাদেরকে শুধু যে ইসলামের দিকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে তা নয়, বরং তাদের ব্যবহারিক জীবনে এমন এক ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয়েছে যে, অনেক বংশানুক্রমিক দ্বীনদারদের জন্যে তা ছিল এক শিক্ষণীয় ব্যাপার।

অধ্যাপক আলফ্রেড স্মিথ
মাওলানা মওদূদী বর্তমান যুগের ইসলামী চিন্তাধারার উপরে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং তাঁর দল পাকিস্তানের প্রতীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে একটি। এই আন্দোলন যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছে তা অতি বিরাট ও ব্যাপক। এই সাহিত্য বেশীর ভাগ উর্দু ভাষায়। তথাপি এর আরবী ও ইংরেজী অনুবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। মওদূদী সাহেবের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি আপন ভাবধারা ধীরে ধীরে এবং অত্যন্ত ধারাবাহিকতার সাথে একটি সঠিক এবং আকর্ষণীয় জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন। মওদূদী সাহেবকে আধুনিক যুগে ইসলাম সম্পর্কে সংগঠিত ও আদর্শভিত্তিক পদ্ধতিতে একজন চিন্তাশীল পুরুষ বলে মনে হয়। তিনি ইসলামকে একটা শাসন-শৃঙ্খলার ছাঁচে ঢালবার আধুনিক ঝোঁক-প্রবণতাকে সুষমামণ্ডিত করে তুলেছন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী আইন কানুনকে আধুনিক যুগের একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকরী ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন। তিনি ইসলামকে এমন এক জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন যা বহু শতাব্দী পূর্বেই ভবিষ্যতের সকল যুগের সকল মানবিক সমস্যার সমাধান সংগৃহীত রেখেছে। তাঁর কাছে ইসলাম এমন কোন ধর্ম নয়, যে প্রতিদিন প্রত্যুষে মানুষকে তার সমস্যার সমাধানকল্পে নতুন খোদায়ী জ্ঞান দান করার এক নতুন ঝঞ্ছাট সৃষ্টি করবে। যে চিন্তা ব্যবস্থাকে তিনি ক্রমশ মজবুত করে তুলেছেন তার উৎস ইসলামের প্রাথমিক যুগ, যেখান থেকে এই ব্যবস্থা-প্রাসাদের মৌলিক ভিত্তি সংগৃহীত হয়। এতদসহ তিনি যথেষ্ট পরিমাণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারারও সুযোগ গ্রহণ করেছেন।
সত্য কথা এই যে, পাকিস্তানের মানসিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সময়ে তিনি বুদ্ধিজীবীদের এবং জনসাধারণেও একটা বিরাট অংশকে প্রভাবিত করেছেন। নৈতিক অধঃপতনের প্রবল ঝঞ্ছায় তিনি আপন সংকল্পিত লক্ষ্যের জন্যে অনুপম ঐকান্তিকতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন।
মাওলানা মওদূদী সাহেবকে একজন বিরাট এবং মহান ব্যক্তি মনে করি। এমন লোক অল্পই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু আজ তিনি এত বড় হয়েছেন যে, এমন বড় তাঁকে আগে মনে করিনি। আমি ভাবতেই পারিনি যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্যে এমন এক সৌভাগ্য সৃষ্টি করে রেখেছেন যে, তিনি দ্বীনের পথে একদিন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আল্লাহ তাঁকে হাজারের মধ্যে বেছে নিয়ে এমেন উচ্চস্থান দান করেছেন।’

রাজা জগনফর আলী খান
ঊনিশ শ’ উনচল্লিশ থেকে নিয়াল্লিশ সাল পর্যন্ত আমি লাহোর ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করতাম। এ সময় মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হাবিবিয়া হলে ইসলামিয়াতের উপর লেকচার দেয়ার জন্যে প্রতি রোববারে আসতেন। শুক্রবার ছিল কলেজের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কিন্তু রোববার দিনে খেলাধুলা ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানাদি হতো। মাওলানার লেকচারও ঐদিন হতো। কলেজের সকলেই তাঁর লেকচার ক্লাসে যোগদান করত।
এ এমন এক সমায়ের কথা যখন মাওলানার দুধ-আলতা রঙের মুখমণ্ডলের উপরে দাড়ি ছিল কালো বর্ণের। মাথায় কালো টুপি, পরণে ডার্ক-ব্রাউন শিরওয়ানী এবং সাদা পায়জামা, চোখে নীল চশমা। মাওলানার যৌবনকাল তখন। কিন্তু কখনো তাঁর স্বভাবের মধ্যে রুক্ষতা অথবা ভাবাবেগ দেখিনি। কথা বলার ধরন বড়ই শালীনতাপূর্ণ এবং যা বলতেন তা খুবই যুক্তিসঙ্গত।
তাঁর ক্লাসে যোগদানকারী ছেলেরা কাগজ-পেনসিল সাথে করে আনত। লেকচার শেষ হলে কাগজের টুকরোয় প্রশ্ন করা হতো। মাওলানা তার সুন্দর করে জওয়াব দিতেন।
এ সময়ে খাকসার আন্দোলনের দ্বারা ছাত্ররা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। চল্লিশের আগ পর্যন্ত আমি খাকসার আন্দোলনের বলতে গেলে একজন কর্মীই ছিলাম। এ আন্দোলন এবং তার নেতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাওলানা যে জওয়াব দিতেন, তা আমার মনঃপূত হতো না বলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারিনি। তাঁর সাহিত্যও পড়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। সে সময়ে খাকসার আন্দোলন এবং তার মুখপত্র ‘আল-ইসলাহ’ সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ আন্দোলন আমাদের মন-মস্তিষ্ক প্রভাবিত করে রেখেছিল।
চল্লিশের ২৩ শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ অধিবেশনে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মরহুমের ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হই। তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা, চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর সততা এবং কার্যকলাপে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা আমাকে খাকসার আন্দোলন থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে টেনে আনে।
আমার জীবনের তৃতীয় পর্যায়ে আমি ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। এ সময়ে মার্কস, লেনিন ও স্টালিনের বই পত্র পড়াশুনা করি। তারপর এ মতবাদের লোকদের প্রতি আকৃষ্ট হই। এতদসত্ত্বেও একটি ধর্মীয় পরিবারের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সামাজিক পরিবেশ আমাকে কমিউনিজমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বাড়িতে আব্বা মরহুমের সাথে আমার প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হতো। এমন এক জাহিলিয়াতের বেড়াজালে আটকে পড়েছিলাম যে, আল্লাহ মাফ করুন, আব্বা মরহুম আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
পাকিস্তান হতে তখনও বাকী। এদিন আব্বা মরহুম আমাকে মাওলানা মওদূদীর ইংরেজী বই Towards Understanding Islam পড়তে দেন। বইখানা পড়লাম। তারপর আবার পড়লাম। আমার উপর বইখানির প্রভাব এই হলো যে, আমার মন-মস্তিষ্কের উপরে জমে ওঠা গোমরাহীর অন্ধকার দূর হয়ে গেল। মাওলানার অকাট্য যুক্তি ও বর্ণনাভঙ্গি ছিল বড়ই হৃদয়গ্রাহী, যার ফলে তাঁর অন্যান্য সাহিত্যও পড়াশুনা শুরু করলাম।
পাকিস্তান হওয়ার পর মাওলানা তাঁর ইছরার বাড়ির সামনে সবুজ-শ্যামল ঘাসে-ভরা ছোট্ট বাগানটিতে বিকেলবেলা বৈঠক করতেন। আমি যেখানে গিয়ে বসতাম। তখন অতটা ভিড় জমতো না। আমি মাওলানাকে অনেক আজেবাজে এবং অসঙ্গত প্রশ্ন করে বসতাম। মাওলানা তাতে কিছুই মনে করতেন না। প্রত্যেকটি কথার জওয়াব ধীর স্থির ও মিষ্টি ভাষায় দিতেন। বেখাপ্পা প্রশ্নেও কখনো তাঁর চেহারার উপরে বিরক্ত বা রাগের চিহ্ন দেখা যেত না। ‘তুলুয়ে ইসলাম’ পড়ে যেসব প্রশ্ন মনে জাগত, তা অকাতরে মাওলানাকে বলে ফেলতাম। মাওলানা যুক্তির শানিত অস্ত্র দিয়ে ভ্রান্ত প্রশ্নের খণ্ডন করতেন। তাঁর জওয়াবের ধরণটাই এমন ছিল যে, প্রশ্নকারী প্রভাবিত না হয়ে পারত না।
যদি আমার মত লোক শুধু যুক্তির ভিত্তিতে কমিউনিজম পরিত্যাগ করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, তাহলে এরূপ আরো অনেকেই নিশ্চয়ই হয়ে থাকবে, যারা নিশ্চিতরূপে মাওলানার সাহিত্যের প্রভাবে সৎ পথ গ্রহণ করেছে অথবা নিদেনপক্ষে জন্মগত মতবাদ থেকে সরে পড়েনি। মাওলানার এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে অগাধ জ্ঞানের দিক দিয়ে মাওলানার মত আর কাউকে দেখিনি। এ জন্যে আমি তাঁকে আলবৎ এ যুগের মুজাদ্দিদই বলব।
যে সব বিষয়ে মাওলানা মওদূদীর সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতেরমতপার্থক্য রয়েছে, তাহলো কুরআন, হাদীস, প্রিয় নবী, ইসলাম, ফেরেশতা, সাহাবায়ে কেরাম, মুজতাহিদ, ইমাম মাহদী, ওলামায়ে কেরাম, আওলিয়ায়ে এজাম, উসূলে হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, তাসাউফ, তাকলীদ, মাজহাব থেকে শুরুকরে আরো অসংখ্য বিষয়ে। এখানে মাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপস্থাপন করছি।


মওদূদীর ভ্রান্ত আকীদা নবীগণ নিষ্পাপ নন!

عصمت انبياءعليهم السلام كے لوازم ذات سے نہيى اورايكلطيف نكتہ يہ ہے کہ اللہ تعا لے نے بالاراده ہر نبى سے كسى نہ كسى وقتحفاظت اٹھا كر ايك دولغز شيى ہو جانےدى ہے

নিষ্পাপ হওয়া আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জন্যআবশ্যকীয় নয়, এতেএমন একটি সূক্ষ্ণ রহস্য বিদ্যমান আছে যে,আল্লাহতাআলা ইচ্ছাপূর্বক প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন মূহুর্তেস্বীয় হেফাজত উঠিয়েনিয়ে তাদের থেকে দু’একটিপদস্খলন পদচ্যুতি (গুনাহ) হতে দেন। নবীহওয়ার পূর্বে তো হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কর্তৃকও একটি বিরাট গুনাহেরকাজ সংঘটিতহয়ে গিয়েছিল। (রসায়েল ও মাসায়েল,পৃষ্ঠা ২৪, ১ম খন্ড। তাফহীমাত,আবুল আলা মওদূদী। ২য় খন্ড,৬ষ্ঠ মুদ্রণ, পৃষ্ঠা: ৫৭, পাকিস্তান। )

প্রসিদ্ধ নবী দাউদ (আ.) সম্পর্কে:

“হযরত দাউদ (আ.) এর কাজের মধ্যে নফস ও আভ্যন্তরীন কুপ্রবৃত্তিরকিছুটা দখল ছিল।অনুরুপভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথেও তার কিছুটা সম্পর্ক ছিল।আর তা ছিল এমন ধরনের কাজ, যাহক পন্থায় শাসনকারী কোন মানুষের পক্ষেইশোভা পায়না।” [তাফহিমুল কোরআন(উর্দু):৪র্থ খন্ড, সুরা সাদ, ৩২৭পৃ. ১ম সংস্করণ, অক্টোবর ১৯৬৬ইং]
হযরত দাউদ (আ.)ত-কালীন যুগে ইসরাঈলী সোসাইটির দ্বারাপ্রভাবান্বিত হয়ে এক বিবাহিতা যুবতীর উপর আসক্ত হয়ে তাকে বিবাহ করার জন্য তারস্বামীর নিকট তালাকদেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন” [তাফহিমাত ২য় খন্ড: ৪২পৃ. ২য় সংস্করণ ; নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা)২য় খন্ড, ৭৩পৃ, আধুনিকপ্রকাশনী, ১মপ্রকাশ ১৯৯১ইং]
হযরত নূহ (আ.) সম্পর্কে:

“হযরত নূহ (আ.) চিন্তাধারার দিক থেকে দ্বীনের চাহিদা হতে দূরেসরে গিয়েছিলেন।তার মধ্যে জাহিলিয়াতের জযবা স্থান পেয়েছিল।”[তাফহিমুল কোরআন:২য়খন্ড, ৩৪৪পৃ.৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ইং]
হযরত ইউনুস (আ.) সম্পর্কে:

“হযরত ইউনুস (আ.) থেকে রিসালাতের দায়িত্ব আদায় করার ব্যাপারেকিছু দুর্বলতা হয়েগিয়েছিল।সম্ভবত তিনি ধৈর্যহারা হয়ে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই আপন স্থান ত্যাগকরে চলে গিয়েছিলেন।” [তাফহিমুলকোরআন: ২য়খন্ড, সূরাইউনুস (টিকা দ্রষ্টব্য)৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ইং]
হযরহ আদম (আ.) সম্পর্কে:

“হযরহ আদম (আ.) মানবিক দূর্বলতায় আক্রান্ত ছিলেন। তিনি শয়তানীপ্রলোভন হতে সৃষ্টতরি- জযবায় আত্মভোলা হয়ে নিজ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন। ফলে আনুগত্যের উচ্চশিখর হতে নাফারমানীর অতল গহ্বরে গিয়ে পড়েন।”[তাফহিমুল কোরআন(উর্দু): ৩য়খন্ড,১২৩ পৃ.]
হযরত মুহাম্মাদ (স.) সম্পর্কে:

“আল্লাহ তা’য়ালার নিকট কাতর কন্ঠে এই আবেদন করুন, যে কাজের দায়িত্বআপনাকে দেওয়াহয়েছিল, তাসম্পন্ন করার ব্যাপারে আপনার দ্বারা যে ভুল ত্রুটি হয়েছে কিম্বা তাতে যে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে তাযেন তিনি ক্ষমা করে দেন।” [তাফহিমুলকোরআন (বাংলা) ১৯শ খন্ড, ২৮০পৃ.মুদ্রনে ওরিয়েন্টাল প্রেস, ঢাকা ১৯৮০ইং; কোরআনেরচারটি মৌলিক পরিভাষা(বাংলা) ১১২পৃ. ৮ম প্রকাশ,আধুনিকপ্রকাশনী:জুন ২০০২]

“মহানবী (স.) মানবিক দূর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনিমানবিক দূর্বলতারবশীভূত হয়ে গুনাহ করেছিলেন।” [তরজমানুল কোরআন ৮৫ তম সংখ্যা,২৩০পৃ.]

“মহানবী (স.) নিজে মনগড়া কথা বলেছেন এবং নিজের কথায় নিজেইসন্দেহ পোষন করেছেন।” [তরজমানুলকোরআন, রবিউলআউয়াল সংখ্যা, ১৩৬৫হিজরী]


মাওলানা মওদুদী বাতিলপন্থী নাকিহকপন্থী? তাআপনি তার লিখা বইয়ের উদ্ধৃতি দিলেই বুঝতে পারবেন।
মওদুদীর কলম বলাযায় হাজ্জাজী কলম। নবী রাসূল থেকে নিয়ে হকপন্থীদের উপর যেমন তার কলম ছিল খরগ স্বরূপ, তেমনি কিছু বাতিলের বিরুদ্ধেও তার কলমছিল সিদ্ধহস্ত। সে এতটাই বেপরোয়া এবং বেয়াদব ছিল যে, নবীদের সমালোচনা করতেও দ্বিধাকরেনি। সাহাবায়ে কিরামতো তার কাছে কিছুই না। আর আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেস্তাদেরসম্পর্কেও পোষণ করতো ভ্রান্ত আক্বিদা।

প্রমাণ স্বরূপকয়েকটি ভ্রান্ত আক্বিদার নজীর নিচে উপস্থাপিত হল

আল্লাহ পাকসম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদাঃ

“যে ক্ষেত্রেনর-নারীর অবাধ মেলামেশা, সেক্ষেত্রে যেনার কারণে (আল্লাহ পাকের আদেশকৃত) রজম শাস্তি প্রয়োগ করানিঃসন্দেহে জুলুম।” (নাঊযুবিল্লাহ)
(তাফহীমাত,২য় খণ্ড,২৮১ পৃষ্ঠা)

ফেরেশতাসম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদাঃ

“ফেরেশতা প্রায়ঐ জিনিস যাকে গ্রীক, ভারতইত্যাদি দেশের মুশরিকরা দেবী-দেবতা স্থির করেছে।” (নাঊযুবিল্লাহ)
(তাজদীদ ওইহইয়ায়ে দ্বীন, ১০পৃষ্ঠা)

নবীদের ক্ষেত্রেমওদূদী সাহেবের বেয়াদবীমূলক মন্তব্য

হাদীসের বিশালভান্ডার আমাদের সামনে রয়েছে। কোন একটি হাদীস কোথাও নেই, যাতে নবীদের সমালোচনা করা হয়েছে। কোননবীর ব্যাপারে তির্যক মন্তব্য বা খাট করা হয়েছে। কিন্তু মওদুদী সাহেব চরমঐদ্ধতার সাথে বিভিন্ন নবীদের তার বেয়াদবী কলমে করেছেন নোংরাঘাত। নবীদেরব্যাপারে তার বেয়াদবীমূলক বক্তব্যের কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছি।

১- আম্বিয়াআলাইহিমুছ ছালাত ওয়াস সালাম সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “নবীগণ মা’ছূম নন। প্রত্যেক নবী গুনাহ করেছেন।”(নাঊযুবিল্লাহ)(তাফহীমাত, ২য় খণ্ড,৪৩ পৃষ্ঠা)

২-মুসা আঃ এরউদাহরণ ঐ তাড়াহুরাকারী বিজেতার মত, যে নিজের অধীনতদের নির্দেশ দেয়া ছাড়াই মার্চ করতে করতেচলে যায়, আরপিছনে জংলার অগ্নির মত বিজিত এলাকায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে যায়।[নাউজুবিল্লাহ] {রেসালায়েতরজুমানুল কুরআন-২৯/৪-৫}

৩-হযরত দাউদ আঃতার এলাকার ইসরাইলীদের সাধারণ রেওয়াজের বশবর্তী হয়ে উরিয়ার কাছ থেকে তালাকের আবেদন করেন।[নাউজুবিল্লাহ] {তাফহীমাত-২/৪২,দ্বিতীয় প্রকাশ,(তাফহিমুল কোরআন(উর্দু):৪র্থখণ্ড, সুরা সাদ,৩২৭ পৃ. ১ম সংস্করণ,অক্টোবর ১৯৬৬ইং)}

৪-হযরত দাউদ আঃযে কাজটি করেছিলেন তাতে প্রবৃত্তির কামনার কিছু দখল ছিল, শাসন ক্ষমতার অসংগত ব্যবহারের সাথেওতার কিছু সম্পর্ক ছিল, এবং তা এমন কোন কাজ ছিল যা কোন ন্যায়নিষ্ঠ শাসকেরজন্য শোভনীয় ছিল না। [তাফহীমুল কুরআন-১৩/৯৫, আধুনিক প্রকাশনী, ১১শ প্রকাশ}

৫- “হযরহ আদম আলাইহিস সালাম মানবিকদূর্বলতায় আক্রান্ত ছিলেন। তিনি শয়তানী প্রলোভন হতে সৃষ্ট তরিৎ জযবায়আত্মভোলা হয়ে নিজ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন। ফলে আনুগত্যের উচ্চশিখর হতে নাফারমানীর অতল গহ্বরে গিয়ে পড়েন।” (তাফহিমুল কোরআন (উর্দু): ৩য় খণ্ড,১২৩ পৃ.)

৬- “হযরত নূহ আলাইহিস সালাম চিন্তাধারারদিক থেকে দ্বীনের চাহিদা হতে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তার মধ্যেজাহিলিয়াতের জযবা স্থান পেয়েছিল।” (তাফহিমুল কোরআন: ২য়খণ্ড, ৩৪৪ পৃ. ৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ ইং)

৭- হযরতইব্রাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কেঃ “এখানে আর একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যখননক্ষত্র দেখে বলেছিলেন, এটা আমার প্রতিপালক এবং চন্দ্র-সূর্য দেখেএগুলোকেও নিজের প্রতিপালক হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন, তখন সাময়িকভাবে হলেও কি তিনি শিরকেনিপতিত হননি?” (তাফহিমুল কোরআন১মখণ্ড, ৫৫৮পৃ.)

৮- “নবী হওয়ার পূর্বে মুসা আলাইহিস সালামদ্বারা একটি বড় গুনাহ হয়েছিল। তিনি এক ব্যাক্তিকে কতল করেছিলেন।”
(রাসায়েল ওমাসায়েল, ১মখণ্ড, ৩১ পৃ.)

৯-“হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কেঃ ‘আমাকে মিসরের রাজকোষের পরিচালক নিয়োগকরুন’- এ কথাটি বলেশুধু অর্থমন্ত্রী হওয়ার জন্যই প্রার্থনা করেননি। কারো কারো ধারনা,বরং তিনি এ বলে ডিকটিটরীই চেয়েছিলেনমৌলিকভাবে। এরই ফলশ্রুতিতে বর্তমান ইতালীর মুসোলিনির যে মর্যাদা তিনিও এরকাছাকাছি মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।”
(তাফহীমাত: ২য়খণ্ড, ১২২ পৃ. ৫মসংস্করন এবং নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা) ২য় খণ্ড, ১৫১ পৃ, আধুনিক প্রকাশনী, ১ম সংস্করন ১৯৯১ইং)

১০- “হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম এর দ্বারারিসালাতের দায়িত্ব আদায় করার ব্যাপারে কিছু ত্রুটি হয়ে গিয়েছিল।সম্ভবত তিনি ধৈর্যহারা হয়ে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই আপন স্থান ত্যাগ করেচলে গিয়েছিলেন।”
(তাফহিমুল কোরআন:২য়খণ্ড, সূরাইউনুস (টিকা দ্রষ্টব্য) ৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ ইং)

১১- “হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম মারা গেছেনএকথাও বলা যাবেনা, বরংবুঝতে হবে ব্যাপারটি অস্পষ্ট।”
(তাফহিমুল কোরআন১মখণ্ড (সুরা নিসা), ৪২১পৃ.)

১২- হযরতমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কেঃ
“আল্লাহ তা’য়ালার নিকট কাতর কন্ঠে এই আবেদন করুন,যে কাজেরদায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছিল তা সম্পন্ন করার ব্যাপারে আপনার দ্বারা যে ভুল ত্রুটিহয়েছে কিংবা তাতে যে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে তা যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।”
(তাফহিমুল কোরআন(বাংলা) ১৯শ খণ্ড, ২৮০পৃ.মুদ্রনেঃ ওরিয়েন্টাল প্রেস, ঢাকা ১৯৮০ ইং এবং কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা (বাংলা) ১১২পৃ. ৮মপ্রকাশ, আধুনিকপ্রকাশনী: জুন ২০০২)

১৩- “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবিক দূর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি মানবিকদূর্বলতার বশীভূত হয়ে গুনাহ করেছিলেন।”
(তরজমানুল কোরআন৮৫ তম সংখ্যা, ২৩০পৃ.ও তরজমানুস্‌ সুন্নাহ, ৩য় খণ্ড, ৩০৫ পৃষ্ঠা)

১৪- “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মনগড়া কথা বলেছেন এবং নিজের কথায় নিজেই সন্দেহ পোষণ করেছেন।”
(তরজমানুল কোরআন,রবিউল আউয়ালসংখ্যা, ১৩৬৫হিজরী)

১৫- হযরতমুহাম্মদ (সা.) রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন, তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
(তাফহীমুল কুরআন,সুরায়ে নসর এরতাফসীর)

সাহাবা কিরামরদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদাঃ

আহলে সুন্নাতওয়াল জামাআতের আক্বিদা হল-সাহাবায়ে কেরাম সমলোচনার উর্দ্ধে। তাদেরদোষ বর্ণনা করা হারাম ও কবিরা গুনাহ”। (শরহুল আকায়েদপৃষ্ঠা ৩৫২)
মহান রাব্বুলআলামীন ইরশাদ করেছেন-আমি [সাহাবাদের] তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও আমার অনুগত। {সূরা তাওবা-১০০}
রাসূল সাঃসাহাবাদের সম্পর্কে বলেন-আমার সাহাবীরা তারকাতুল্য। তোমরা যারই অনুসরণকরবে হেদায়েত পেয়ে যাবে। {কানুযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-১০০২, জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-২৪৩৫৫}

অথচ দেখুনমওদুদী সাহেব কিভাবে সাহাবায়ে কিরামকে আক্রমণ করেছেন নোংরা উক্তিতে-

১) “সাহাবায়ে কেরাম সমলোচনার বাহিরে নন।তাদের দোষ বর্ণনা করা যায়। সাহাবাদের সম্মান করার জন্য যদি ইহাজরুরী মনে করা হয় যে, কোনভাবেই তাদের দোষ বর্ণনা করা যাবে না তবে আমার(মওদুদী) দৃষ্টিতে ইহা সম্মান নয় বরং মূর্তি পূজা। যার মূলোৎপাটন এরলক্ষ্যেই জামাতে ইসলামীর জন্ম”। (তরজুমানুল কুরআন৩৫শ’ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৩২৭)

২) “সাহাবায়ে কিরাম অনেকে মনগড়া হাদিসবর্ণনা করেছেন।”
(তরজমানুল কোরআন৩৫ সংখ্যা) ঙ/৩)

৩) “সাহাবাদের মধ্যে জাহেলিয়াতেরবদ-স্বভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটে।”
(তাফহীমাত ২য়খণ্ড, ১৫৫ পৃষ্ঠা)

৪) “হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুখিলাফতের দায়িত্ব পালনে সম্পুর্ণ অযোগ্য ছিলেন”।
(তাজদীদ ওইয়াহইয়ায়ে দীন: পৃষ্ঠা ২২,)

৫) “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের সময় ব্যাক্তিসম্মানের কু-মনোবৃত্তি হযরত উমর (রঃ)কে পরাভূতকরেছিল।
(তরজুমানুল কুরআন,রবিউস সানি ৩৫৭হিজরী)।

৬) “হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু এর মাঝেসজন-প্রীতির বদগুণ বিদ্যমান ছিল।
(খেলাফত ওমুলকিয়াত, পৃষ্ঠা৯৯)

৭) “হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয়খেলাফতকালে এমন কিছু কাজ করেছেন যাকে অন্যায় বলা ছাড়া উপায় নেই।(খেলাফত ও মুলকিয়াত, পৃষ্ঠা ১৪৬/১৪৩)

৮) “হযরত মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুস্বার্থবাদী, গনিমতেরমাল আত্মসাৎকারী, মিথ্যাসাক্ষ্যগ্রহকারী ও অত্যাচারী ছিলেন”।
(খেলাফত ওমুলকিয়াত, পৃষ্ঠা১৭৩)

পবিত্র কুরআনশরীফ সম্পর্কে ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্য

কোরআন করিমহেদায়েতের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু নাজাত বা মুক্তির জন্য নয়।” (তাফহিমাত, ১ম খণ্ড, ৩১২ পৃষ্ঠা)

আল্লাহ তাআলাবলেন, আমি কুরআনঅবতীর্ণ করেছি যেন আপনি (নবী) মানবজাতিকে অন্ধকারের অতল গহবর থেকে উদ্ধার করেআলোর পথ দেখাতে পারেন। সূরা ইবরাহীম, আয়াতঃ ১।
মুফাসসিরীনেকেরামের ব্যাখ্যানুযায়ী আলোর পথই হচ্ছে মুক্তির পথ। কে সত্যবাদী? মহান মালিক নাকি মাওদূদী সাহেব?

নবীজী সাঃ এরহাদীস সম্পর্কে ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্য

“হাদীস কিছু লোকথেকে কিছু লোক পর্যন্ত অর্থাৎ মানুষের মুখে মুখে বর্ণিত হয়ে আসছে। এসবকে বড়জোর সঠিক বলেধারণা করা যেতে পারে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার কোন অবকাশ নেই। আর একথাস্পষ্ট যে, আল্লাহরদীনের যে সকল বিষয় এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলোর দ্বারা ঈমান ও কাফেরের মাঝেপার্থক্য নির্ণীত হয় সেগুলো গুটিকয়েক লোকের বর্ণনার উপর নির্ভর করে মানুষকে বিপদগ্রস্তকরা আল্লাহ তায়ালা কখনো পছন্দ করতে পারেন না।”
(রাসায়েল ওমাসায়েল, ৬৭পৃষ্ঠা) কী কুখ্যাত মন্তব্য!!! একটু বিবেচনা করুন।

ইসলামী আকীদা

ইসলামী শরীয়তের আলোকে عصمت বা নিষ্পাপ হওয়া নবীদের জন্য অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, বরং عصمت এর ক্ষেত্রেনবীগণ ফেরেশতাথেকেও অধিক হকদার। যেমন নিবরায  কিতাবে عصمت সম্পর্কে ইমামমাতুরিদী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি বলেন,

اَلْأَنْبِيَاءُأَحَقُّ بِالْعِصْمَةِ مِنَ الْمَلئِكَةِ

“নবীগণ ফিরিশতাদের তুলনায় ইসমতের অধিক হকদার।” (নিবরায। পৃষ্টা ২৮৪।)
কেননা, শয়তাননবীদের থেকে অনেক দূরে থাকে।

عصمت সম্পর্কে নকলীদলীলঃ
পবিত্র কুরআন পাকেও আল্লাহ পাক শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

اِنَّعِبَادِىْ لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ

“হে ইবলিস! আমার বিশিষ্ট বান্দাদের উপর তোমার কর্তৃত্ব নেই।” (সূরা আল হিজার, আয়াত : ৪১ )
আর শয়তানও স্বয়ং স্বীকার করেছিল,

وَلَأُغِوَينهُمْ أَجْمعيْنَ – اِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُم الْمُخْلِصِيْنَ

“হে আল্লাহ! তোমার বিশিষ্ট বান্দাগণব্যতীত বাকী সবাইকে বিপথগামী করবো।”(সূরা আল হিজার,আয়াত ৪১)
উল্লিখিত আয়াতে নবীগণ যে নিষ্পাপ তা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হলো।কারণ গুনাহ হয়শয়তানের  وسوسه দ্বারা । আরনবী-রাসূল তথা বিশিষ্ট বান্দাগণ وسوسه থেকে পূতঃপবিত্র। মিশকাত শরীফে اَلْوَسْوَسَةُ অধ্যায়ে বর্ণিতআছে প্রত্যেকমানুষের সাথে একজন শয়তান অবস্থান করে যার নাম কারীণ। প্রিয় নবী বলেন, আমার কারীন মুসলমানহয়ে গেছে। মিশকাতের অপর হাদীসে মনাকেবে ওমর অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, হযরত ওমররাদিয়াল্লাহু তা’আলাআনহু যে রাস্তা দিয়ে গমন করেন তথা হতে শয়তান পালিয়ে যায়। তাহলে বুঝা গেল, যার উপর নবীর সুদৃষ্টিরয়েছে সেও শয়তান থেকে নিরাপদ থাকেন। অতএব,বর্ণিত কুরআন হাদীসথেকে প্রমাণিত হল নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ। তাঁদের কোন গুনাহ থাকতেপারে না।
সে জন্যই ইমাম মোল্লা আলী কারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয়কিতাব মিরকাত শরহেমিশকাতে নবীগণ যে নবুয়াতের আগে ও পরে সর্বদা যাবতীয় ছোট-বড় ভুলত্রুটিগুনাহ থেকে পবিত্র নিষ্পাপ থাকেন। তা এভাবে র্ব্ণনা করেছেন,

اَلْأَنْبِيَاءُمَعْصُوْمُوْنَ قَبْلَ النَّبُوَّةِوَبَعْدَهَا عَنْ كَبَائِرِ الذُّنُوْبِ وَصَغَائِرِهَا وَ لَو سَهْوًاعَلى مَاهُوَ الْحَقُّ عِنْدَ الْمحقِّقين

“নবীগণ নবুয়াতের পূর্বে ও পরে কবীরা-সগীরাউভয় প্রকার গুনাহ থেকে নিষ্পাপ পবিত্র এমনকি অনিচ্ছাকৃতভাবেও । এটাইমুহাক্কিক ওলামাদের নিকট হক কথা।”(মিরকাত)
কারণ নবীদের উপর থেকে যদি আল্লাহর হেফাযত উঠে গিয়ে  عصمت নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তাদের নির্দেশিত শরীয়তের বিধানাবলীতে সন্দেহের অবকাশথেকে যায়। আর যৌক্তিক দিক দিয়েওযতক্ষণ নবীগণকে নিষ্পাপ (মাসূম) মেনে নেয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত নবী, সাধারণ দার্শনিক ওসংস্কারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তাই ইসলাম এটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। অথচমওদূদী নবীদের থেকে হেফাযত উঠিয়েনিয়ে আল্লাহ কর্তৃক তাঁদের থেকে ভূলত্রুটি গুনাহ সংঘটিত করারযে মারাত্নক কুফরীআকীদা প্রকাশ করেছে তা কখনও ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটা অল্লাহর শানেওচরম বিয়াদবী বৈ কিছুই নয়।
আর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এক মিশরীকে শাসনের উদ্দেশ্যেই শাস্তিদিয়েছিলেন। এতে ওই মিশরীর মৃত্যু ঘটে।এটা কখনও গুনাহ নয় বরং ন্যায় বিচার। অথচ মওদূদী এটিকে বড়গুনাহ বলে নবীদেরশানে চরম আবমাননাকর উক্তি করলেন।

দলীলসমূহ : কানযুল ঈমান, রুহুল ইরফান, নিবরায, ফিকহ আকবর, শরহে আকায়েদে নসফী, শরহে মাওয়াকিফ, মিরকাত শরহে মিশকাত।

আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-১৯৭৯) পাকিস্তান ভিত্তিক দল জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা যা বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের ধর্ম ব্যবসা খুলেবসেছে। প্রথম দিকে মওদুদী পাকিস্তান রাস্ট্রপ্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করলেও ১৯৪০ এর দশকে এসে নিজেরভোল পাল্টায় এবং তখন থেকেই সে পাকিস্তানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠারদীর্ঘ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সে ইসলামকে একটি জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে।ইসলামের মৌলিক নীতি ও ভিত্তি সমূহ, যেমন: তাওহীদ,একআল্লাহর ওপর বিশ্বাস, সালাত, সাওম, যাকাত, হ্জ্জ ইত্যাদিকেউপেক্ষা করে মওদুদী শাসন ব্যবস্থার ওপর বেশি জোর দেয়।রাস্ট্রের কর্তৃত্ব আকাংক্ষার ব্যাপারে তার মতামত:

“তাইকর্তৃত্বের আকাংক্ষা ছাড়া কোন দর্শণে আস্থাজ্ঞাপন করার কোন অর্থ নেই, এবং কোনটি আইনসম্মত বা কোনটি নিষিদ্ধ অথবা নির্দেশিত আইন, কোনটিরই কোন মানে নেই।"

- তাজদীদউদ দ্বীন, পৃষ্ঠা ৩২ - ৩৩

অথচহযরত মুহাম্মদ (স) পরিস্কার ভাবে কর্তৃত্বের লালসাকে পুরোপুরি নিষেধ করে দিয়েছেন; ওনার মতে কর্তৃত্ব ও শাসন করার লোভ মানুষকেপুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। তিনিবলেন:

“নেতৃত্বেরআকাংক্ষা করোনা। কেননা তোমরা যদি নেতৃত্বের আকাংক্ষা করে তা পাও তবে সে দায়িত্ব তোমাদের একাই পালন করতে হবে। কিন্তু আকাংক্ষা না করেইযদি তোমরা নেতৃত্ব পাও তবে তোমরা সাহায্য পাবে(আল্লাহর কাছ থেকে)।”

- মুসলিম,৪৬৯২




এখানেমওদুদীর কিছু ইসলাম বিকৃতির নমুনা তুলে ধরছি। এখানে পবিত্র কুরআন, হাদীস এবংমওদুদীর বিভিন্ন লেখা ও ভাষন থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে; এখানে পরিষ্কার যে মওদুদী জেনেশুনে ইসলামের বিকৃতি ঘটানোর অপচেষ্টা করেছে।তাতেও যদি গন্ডমূর্খ জামাত-শিবিরের সমর্থকদের কিছুটাবোধ হয়।



“শাসনও কর্তৃত্ব করার নামই হচ্ছে ধর্ম, শাসন ব্যবস্থার আইন হল শরিয়া এবং উপাসনা হচ্ছে শাসন ব্যবস্থার ঐতিহ্যকে অনুসরন করা’’ - খুতবা, পৃষ্ঠা ২১৭।

“লোকেসাধারণত বলে ইসলামের পাচটি স্তম্ভ: এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, নামাজ, যাকাত, রোযা এবং হজ্জ।এবং এ গুলোই ইসলাম এই ভুল ধারণার মধ্যে তারা অনেকদিন ধরে আছে। এসলেএটা একটা বড় বিভ্রান্তি যা মুসলমানদের পথ এবং কর্মকে ধ্বংস করেছে।“

(কাউসার,৯ফেব্রুয়ারি ১৯৫১- মওদুদীর ভাষণ থেকে উদ্ধৃত)

অথচসহীহ বুখারী এবং মুসলিম শরীফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ইসলামের মূল স্তম্ভ পাচটি: ১. শাহাদাহ ২. সালাত ৩. বাধ্যতামূলক যাকাত প্রদান ৪.সাওম এবং ৫. হজ্জ।

শুধুতাই নয়, মওদুদী হাদীস শরিফের ও সমালোচনা করতে ছাড়েনি। মওদুদী এ সম্পর্কেবলেছে:

“কোনসত্যবাদী মানুষই এই দাবী করতে পারবেনা যে ৬ - ৭ হাজার হাদীসের (সহীহ বুখারী শরিফ)সবগুলোই পুরোপুরি ঠিক।“

(১৯৫৫সালের ১৫ মে বরকত হলে মওদুদীর দেয়া ভাষণ থেকে; যা পরেআল-ইতেশাম পত্রিকায় ২৭ মে ১৯৫৫ এবং ৩ জুন ১৯৫৫ তারিখে প্রকাশিত হয়।)

শুধুএই নয়, হযরতমুহাম্মদ (স) চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী বিয়ে (মুতাহ) হারাম ঘোষনা করেছেন।কিন্তু মওদুদী হাস্যকর উদাহরণ টেনে তা হালাল করতে চেয়েছে:

“ধরেনসমুদ্রের মাঝে একটি নৌকা ডুবে গেল। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বেচে গিয়ে এক নির্জন দ্বীপে গিয়ে ওঠে। এ অবস্থায় তাদের একসাথে থাকতেই হবে। কিন্তু ইসলামী আইন মতে তারা নিকাহ করতে পারবে না। তাই তাদের কাছে যে একমাত্র রাস্তাটা খোলা আছে তা হল নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে অস্থায়ীবিয়ে করা ততদিনের জন্য যতদিন না তারা লোকালয়ে পৌছাতেপারে বা লোকেরা তাদের খুজে পায়। অস্থায়ীবিয়ে (মুতাহ) এ ক্ষেত্রে বা এর মত পরিস্থিতিতে জায়েজ।“

-তারজুমামুলকুরআন, ১৯৫৫,পৃষ্ঠা:৩৭৯

যুদ্ধবন্দীমহিলাদের ব্যাপারে মওদুদীর মতামত দেখুন:

“এমনকিবর্তমান যুগেও যুদ্ধবন্দী মহিলাদের সৈনিকদের মধে বন্টন করে দেয়া উচিৎ এবং সৈন্যদেরকে তাদের (মহিলাদের) ভোগ করার অনুমতি দেয়া উচিৎ।“

অথচপবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া আছে। আল্লাহ বলেন:

“অবশেষেযখন তাদেরকে (কাফিরদের) পূর্ণরূপে পরাভূত কর তখন তাদেরকে শক্ত করে বেধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদেরনিকট হতে মুক্তিপণ লও (এবং মুক্তিদাও) ।”

- সূরামুহাম্মদ, আয়াত ৪

বাল্যবিবাহ নিয়ে মওদুদী বলেছে:

“নাবালিকামেয়েদের (বয়:প্রাপ্তির আগে) বিয়ে করা যায়। স্বামীরাও তাদের সাথে সহবাস করতে পারে।“

-তাহফীমুলকুরআন, পঞ্চমখন্ড, পৃষ্ঠা:৫৭১

বিভিন্ননবী-রাসূলদের নিয়ে মওদুদীর সমালোচনার বিস্তর উদাহারণ আছে। যেমন নিচের মন্তব্যে সে হযরত ইউসুফ (আ) কে মানুষ হত্যাকারী জঘন্যমুসোলিনীর সাথে তুলনা করেছে -

“কিছুমানুষ যে ধারনা পোষণ করে যে তিনি [হযরত ইউসুফ (আ)] মিশরেরতত্ত্বাবধায়কেরদায়িত্ব চেয়েছিলেন শুধু সেখানকার অর্থ মন্ত্রী হবার জন্য তা আদপে ঠিক নয়; প্রকৃত পক্ষে তিনি একজন সৈরশাসক হতে চেয়েছিলেন।এমতাবস্থায় হযরত ইউসুফ (আ) যে পদ পান তাবর্তমানকালের ইতালির মুসোলিনীর অবস্থার সমতুল্য।“

- তাহফিমাত,খন্ড২, পৃষ্ঠা১২২, ৫মসংস্করণ

মওদুদীহযরত সুলাইমান (আ) এর ১০০ স্ত্রী থাকার ব্যাপারে মন্তব্য করেছে:

“হয়আবু হুরাইরা (রা) নবীর কথা শুনতে ভুল করেছেন অথবা তিনি পুরো ব্যাখ্যা শোনেননি।“

-রাসাইল-ও-মাসাইল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৭

নবী-রাসুলগণ সকলেই মাসুম, তারা সকলেইনিষ্পাপ-এই হলো ইসলামী আকীদা। তবেজনাব আবুল আলা মওদুদী ইসলামের বদ্ধমূল এ আকীদার উপর কুঠারাঘাতকরে এবং কুরআনও সুন্নাহর চিরন্তন শিক্ষাকে পদদলিত করে আম্বিয়ায়ে কেরামের এ পূত পবিত্রজামাতের প্রতি কলংক লেপন করার উদ্দেশ্যে এমন ধৃষ্টতাপূর্ন কথা বলেছেন, যা কোন মুসলমানেরপক্ষে বরদাশত করা সম্ভব নয়।

মওদূদী সাহেবের আরো কিছুভ্রান্ত মতবাদ

ইসলামীরীতিনীতি

“পোশাকপরিচ্ছদ, চাল-চলন, আকৃতি-প্রকৃতি চুল কার্টিং ইত্যাদির ব্যাপারে বিধর্মীদের অনুকরণ করতে কোন দোষ নেই”। (তরজুমানুল কুরআন, ছফর সংখ্যা, ১৩৬৯ হিজরী)

ইসলামবলে, ইসলামীপোশাক-পরিচ্ছদ-প্রকৃতি চাল-চলন ইত্যাদি গ্রহণ করবে। এসব ব্যাপারেবিধর্মীদের অনুকরণ করবে না। (এমদাদুল মুফতিয়ীন, ২য় খণ্ড,১৫৪ পৃষ্ঠা)

প্রসঙ্গঃদাড়ি কাটা ও রাখা

ইবনেওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন-তোমরা গোফ খাট কর আর দাড়ি লম্বা কর।(তিররমিযী শরীফ, হাদিস নং-২৭৬৩)
এছাড়াঅন্য হাদিসে এসেছে-পুরুষদের স্বাভাবিক প্রকৃতি হল সে তার দাড়ি লম্বা রাখবে। (আবুদাউদ শরীফ, হাদিস নং-৫৩)
দাড়িলম্বা করার কথা হয়েছে হাদিসে। কাটার কথা কোথাও নেই। তাই সাহাবায়ে কিরামের আমলই আমাদের একমাত্র ভরসা এই ক্ষেত্রে যে, দাড়ি কতটুকুবড় রাখতে হবে? মুসান্নাফে ইবনেশাইবাতে এসেছে-হযরত ইবনে ওমর রা. এর আমল ছিল-তিনি দাড়ি এক মুষ্টিপরিমাণ রাখতেন। সুতরাং দাড়ি এক মুষ্টি পরিমাণ রাখা ওয়াজিব। এর চে’কমদাড়ি রাখা আর চেছে ফেলার মাঝে কোন পার্থক্য নাই। যেমন জোহরের ফরজনামায চার রাকাত। দুই রাকাত সারা জীবন পড়লেও যেমন জোহর কোনদিনও আদায় হবেনা। তেমনি এক মুষ্টির কম দাড়ি রাখলে তা কোনদিনও দাড়ি রাখাবলে সাব্যস্ত হবেনা।
অথচমওদুদী সাহেবের আক্বিদা দেখুন কী বলে?

“দাড়িকাটা ছাঁটা জায়িয। কেটে ছেঁটে এক মুষ্টির কম হলেও ক্ষতি নেই। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পরিমাণ দাড়ি রেখেছেন সেপরিমাণ দাড়ি রাখাকে সুন্নত বলা এবং এর অনুসরণে জোরদেয়া আমার মতে মারাত্মক অন্যায়”। (রাছায়েল মাছায়েল,১মখণ্ড, ২৪৭পৃষ্ঠা)

প্রসঙ্গঃসুন্নতে রাসূল

“হুযূরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদত, আখলাককে সুন্নতবলা এবং তা অনুসরণে জোর দেয়া আমার মতে সাংঘাতিকধরনের বিদয়াত ও মারাত্মক ধর্ম বিকৃতি।
(রাছায়েলমাছায়েল, ২৪৮ পৃষ্ঠা)

ইসলামবলে, হুযূরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদত,আখলাক ও স্বভাব-চরিত্র আমাদের অনুকরণের জন্য উত্তম নমুনা বা সুন্নত। মহানরাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-তোমাদের জন্য নবীজীর মাঝেরেখেছি উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব, আয়াতঃ ২১,সহীহবুখারী, হাদীস নং-১৫৪৪}

প্রসঙ্গঃদ্বীনের আসল উদ্দেশ্য

“দ্বীনেরআসল মকছুদ হলো ইসলামী হুকুমত। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদিসমস্ত ইবাদত হলো উক্ত মকছুদ অর্জনের মাধ্যম”।
(আকাবেরেউম্মত কী নজরমে, ৬৪ পৃষ্ঠা)
* ইসলামবলে, দ্বীনেরআসল মকছুদ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি কায়েম করা। ইসলামীহুকমত উক্ত মকছুদ অর্জনে সহায়ক। (শরহুল আকায়েদ, ৩০৪ পৃষ্ঠা)


এতসব ভ্রান্ত আক্বিদা পোষণ করার পরও যদি কেউ তাকে আল্লাহ ওয়ালা বলে সম্বোধন করে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কী’বা বলার আছে।আল্লাহ তায়ালা আমাদের মওদুদীফিতনা থেকে আমাদের দেশে সাধারণ মুসলমানদের হিফাযত করুন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ