আধ্যাত্মিক ভাষ্য - (পরমাত্মা ও জীবাত্মা বিষয়ক)
বেদের তত্ত্ব ও রহস্যকে সুস্পষ্ট করিতেই বিভিন্ন ভাষ্যের সৃষ্টি হইয়াছে। স্মরণাতীত কাল হইতে কত জনে, কতভাবে বেদভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রাচীন কালের সায়ণাচার্য এবং বর্তমান যুগের দয়ানন্দ সরস্বতীই উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদ ভাষ্য পড়িলে জানা যায়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধুরন্ধর পণ্ডিত ছিলেন। সায়ণাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয় নগরের মহারাজার মন্ত্রীপদে অসীন ছিলেন। তাঁহার ভাষ্য পড়িলে মনে হয়, তিনি একাকী সমগ্র ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। তাঁহার নেতৃত্বে অন্যান্য পণ্ডিতেরা ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী(১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ) বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। পণ্ডিত রোম্যাঁরলার মতে –“আচার্য শঙ্করের পর বেদের এতবড় পণ্ডিত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন নাই”।
ঋগ্বের ভাষ্যকার
১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।
ঋগ্বের ভাষ্যকার
১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।
ঋগ্বেদের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে সায়নাচার্যের নাম বিখ্যাত হলেও তাঁর আগেও বিভিন্ন ভাষ্যকার, যেমন স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, উদ্গীথ, প্রমুখ, ঋগ্বেদের ভাষ্য করেছেন।
ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণ দুটি, ঐতরেয় ও কৌষীতকী, এদের মধ্যে ঐতরেয় প্রাচীনতর, যার ভৌগোলিক পটভূমিকা কুরুপাঞ্চাল ও বশঊশীনর অঞ্চল। কৃষ্ণ যজুর্বেদের একটি মাত্র ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় – তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বহু গবেষিত হচ্ছে শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ। এর রচয়িতা হিসেবে দুজনের নাম পাওয়া যায়, শাণ্ডিল্য ও যাজ্ঞবল্ক্য। শাণ্ডিল্য রচিত অংশটির ভৌগোলিক পটভূমিকা ভারতের উত্তর-পশ্চিম আর যাজ্ঞবল্ক্য রচিত অংশটিতে বিদেহর মতো দক্ষিণ-পূর্বের উল্লেখ আছে। তাই মনে করা হয় এই ব্রাহ্মণ সুদীর্ঘ কাল ধরে রচিত। প্রত্যেক সংহিতার এক বা একাধিক ব্রাহ্মণ থাকলেও প্রতি সংহিতার নিজস্ব আরণ্যক বা উপনিষদ নেই। শুধু তিন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম – ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকী এবং যজুর্বেদের তৈত্তিরীয়, যাদের নিজস্ব সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রয়েছে।
যজুর্বেদ ভাষ্যকার
১। শৌনক। ২। হরিস্বামী (৫৮১খৃঃ)। ৩। উবট (১১শ শতাব্দী)। ৪। গৌরধর (১২৯৩ খৃঃ)। ৫। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৬। মহীধর (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১১৮৩ খৃষ্টাব্দ)
সামবেদ ভাষ্যকার
১। গুণ বিষ্ণু (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ২। মাধব। ৩। ভরত স্বামী (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৪। সায়ণাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৫। শোভাকর ভট্ট (খৃঃ ১৫শ শতাব্দী)। ৬। মহাস্বামী। ৭। সূর্যদৈবজ্ঞ(খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)।
অথর্বদেব ভাষ্যকার
১। সায়নাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। দয়ানন্দের পরে পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালংকার আজমীড় হইতে চতুর্বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনি এবং পণ্ডিত শিবশংকর কাব্যতীর্থের বেদভাষ্য উচ্চ সম্মান লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর যজুর্বেদ ভাষ্য, তুলসীরাম স্বামীর সামবেদ ভাষ্য এবং পণ্ডিত ক্ষেমকরণের অথর্ববেদ ভাষ্য বর্তমানে আদৃত হইয়াছে।
বেদাঙ্গ দ্বারা বেদের ভাষ্য করলে সেটা সঠিক মানা উচিৎ-বেদ এর অঙ্গ হলো বেদাঙ্গ -শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ (পাণিনি), নিরুক্ত( শব্দতত্ত্ব), ছন্দ, জ্যোতিষ(গণিত এবং গ্রহ বিজ্ঞান) । এই হলো ছয় বেদাঙ্গ, বেদাঙ্গ এর শিক্ষা ছাড়া কেউই বেদ ভাষ্য করতে পারবে না, যদিও সংস্কৃত এর মহান পণ্ডিত হন না কেন তবুও মাত্র ২০% সঠিক বেদ ভাষ্য করতে পারবে না, শুধু বেদাঙ্গ নয়, ব্রাহ্মণ শাস্ত্র হলো বেদের ব্যাখ্যা শাস্ত্র, তাই বেদের ভাষ্য করতে গেলে ব্রাহ্মণ শাস্ত্র জানা আবশ্যক।
-দীর্ঘতম ব্রাহ্মণ গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণ(শুক্ল যজুর্বেদ/ঋগ্বেদ), তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ(সামবেদ),ঐতরেয় ব্রাহ্মণ(কৃষ্ণ যজুর্বেদ/ ঋগ্বেদ),কৈশিতিকি ব্রাহ্মণ,গোপথ ব্রাহ্মণ (অথর্ববেদ),মহা-তন্দ্যা,আরণ্যক: এটা ব্রাহ্মন গ্রন্থসমূহের সারাংশ,বলা যায় ব্রাহ্মন গ্রন্থগুলোর থেকে নিংড়ানো রস।
East Tradition Researc Institutie কর্তৃক প্রকাশিত বেদ এর বিভিন্ন অনুবাদ এর উপর প্রকাশিত আর্টিকেল এর কিছু অংশ।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বেদ এর অনুবাদসমূহ-
১.ঋগবেদ সংহিতা,H.H wilson,6 vol,London,
২.The hymns of Rigveda,Ralph T.H Gripphith,১৮৯৬-১৮৯৭.
৩.ঋগবেদ সংহিতা,স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী,New Delhi,veda pratisthana,১৯৭৭
৪.ঋগবেদ সংহিতা,পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যালংকার,১৯৮৭
৫.Pt. Dharmadev
৬.T.V Kapali shastry
১.ঋগবেদ সংহিতা,H.H wilson,6 vol,London,
২.The hymns of Rigveda,Ralph T.H Gripphith,১৮৯৬-১৮৯৭.
৩.ঋগবেদ সংহিতা,স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী,New Delhi,veda pratisthana,১৯৭৭
৪.ঋগবেদ সংহিতা,পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যালংকার,১৯৮৭
৫.Pt. Dharmadev
৬.T.V Kapali shastry
এই আর্টিকেলটি পাব্লিশ হবার অনেক পড়ে সম্প্রতি পন্ডিত দেবীচাঁদ ও আচার্য ড. তুলসীরাম এর অনুবাদ গোবিন্দরম হাসানন্দ পাব্লিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে,এছাড়া পন্ডিত জয়দেব শর্মা এর অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যপার হল প্রথম দুইজন ইংরেজ ব্যক্তির অনুবাদ কার ভাষ্য থেকে জানেন কি?হ্যঁ,সেই কালপ্রিট ম্যক্স মুলার এর ভাষ্য অনুযায়ী করা যার মূল উদ্দেশ্য ই ছিল বেদ এর ভূল অনুবাদ এর মাধ্যমে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা। কিন্তু দুঃখের বিষয়,সত্য যে উদঘাটিত হবেই প্রকাশমান সূর্যের ন্যয়!
The life and letters of Friedrich Max Muller শীর্ষক বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডন এ ১৯০২ সালে যা পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে পুনঃপ্রকাশিত হয় আমেরিকায়। বইটিতে ১৮৬৭ সালের ৯ ই ডিসেম্বর তার স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি আছে যাতে তিনি লিখেছেন-
“…আমি যথেষ্ট নিশ্চিত যদিও তা হয়তো জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবনা যে আমার কর্তৃক অনুবাদিত বেদ ভারত এর ভাগ্যে একটা বিরাট প্রভাব ফেলবে।বেদ তাদের ধর্মগুলোর মূল এবং তাদেরকে আমার অনুবাদটি পৌঁছে দিতে পারলে আমি নিশ্চিত যে এটাই একমাত্র পথ তাদের দেশে গত তিনহাজার বছরের সব ধর্মচর্চাকে উত্খাত করার।”
“…আমি যথেষ্ট নিশ্চিত যদিও তা হয়তো জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবনা যে আমার কর্তৃক অনুবাদিত বেদ ভারত এর ভাগ্যে একটা বিরাট প্রভাব ফেলবে।বেদ তাদের ধর্মগুলোর মূল এবং তাদেরকে আমার অনুবাদটি পৌঁছে দিতে পারলে আমি নিশ্চিত যে এটাই একমাত্র পথ তাদের দেশে গত তিনহাজার বছরের সব ধর্মচর্চাকে উত্খাত করার।”
এছাড়া তার মাকে লেখা ১৮৪৭ সালের ১৫ ই এপ্রিলের চিঠিতে তিনি প্রত্যেক পৃষ্ঠা অনুবাদের জন্য তাকে মিশনারীদের দেয়া উচ্চ বেতনের জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।পরবর্তীতে তিনি ১৮৫৬ সালে মিশনারী Chevalier Bunsen কে লেখা চিঠিতে তাকে আস্বস্ত করেন যে ভারতকে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত করতে তার এই প্রচেষ্টা তিনি আজীবন অব্যাহত রাখবেন।যদিও তিনি তার জীবনের শেষভাগে এসে তার ভূল বুঝতে পারেন এবং তার লেখা Sacred books of east এর ষষ্ঠ খন্ডে তার অনুবাদিত বেদ এ যে ভূল আছে তা স্বীকার করে নেন এবং বেদ এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
আর এই ধূর্ত ম্যক্সমুলার তার এই ভাষ্যটি কার ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত হন?মনোযোগী পাঠকগন এতক্ষনে হয়তো ঠিক ই ধরেছেন,ভূলে ভরা যজ্ঞভিত্তিক সায়ন এর ভাষ্য থেকে!আর একই গোত্রের আরেকটি ভাষ্য হল মহীধর এর ভাষ্য।
আবার ফিরে আসা যাক East Tradition Research Institute এর আর্টিকেল এ। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত লিস্ট এ আমরা দেখলাম মোট ছয়জন ভারতীয় হিন্দু আচার্য-পন্ডিতগন বেদ এর অনুবাদ এর কাজ করেছেন।এদের মধ্যে স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী,পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যালংকার,আচার্য ড. তুলসীরাম,আচার্য ধর্মদেব ও পন্ডিত দেবীচাঁদ অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করেছেন মহাঋষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বেদ ভাষ্যের মাধ্যমে যাকে আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ ধরা হয় এবং যিনি শংকরাচার্যের পর একমাত্র মহর্ষি পদবী প্রাপ্ত।তাঁদের বেদ অনুবাদকে বিশেষজ্ঞগন সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন বলে অভিহিত করেন কেননা একমাত্র তাঁরা ই বেদ অনুবাদ এর জন্য বিজয়নগর রাজ্যের কোটাল সায়নকে নয় বরং বেদদ্রষ্ট ঋষিদের কর্তৃক বেদ বোঝার সুবিধার্থে লিখিত শিক্ষা(Shikhsa,phonetics),ব্যকরন(Vyakarana) ,নিরুক্ত,ছন্দ, কল্প ও জ্যোতিষ গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছেন যেখানে বৈদিক ঋষিদের কর্তৃক দেয়া বেদ এর বিভিন্ন শব্দের প্রেক্ষাপট ভেদে এদের অর্থ,উত্পত্তি দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে T.V Kapali Shastry ঋষি অরবিন্দের ভাষ্য অনুযায়ী অনুবাদ করেন যাকে বর্তমান যুগে Vedic Exegesis এর অন্যতম Pioneer হিসেব গন্য করা হয়।
এদিকে ঋষি অরবিন্দ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বেদ এর ভাষ্য সম্বন্ধে তাঁর বিখ্যাত বই The secret of the Vedas এ বলেন,
“বেদ এর অ যাবত্ সম্পাদিত অনুবাদকর্মের ব্যপারে আমি নিশ্চিত যে মহর্ষী দয়ানন্দ এর পথটিই সঠিক ও নিঁখুত মর্যাদা প্রাপ্তির যোগ্য।”
“বেদ এর অ যাবত্ সম্পাদিত অনুবাদকর্মের ব্যপারে আমি নিশ্চিত যে মহর্ষী দয়ানন্দ এর পথটিই সঠিক ও নিঁখুত মর্যাদা প্রাপ্তির যোগ্য।”
বৈদিক বিশেষজ্ঞ Mr. Roth তাঁর সংস্কৃত কোষগ্রন্থের প্রথম খন্ডে বলেছেন,”বেদের উদ্দেশ্য সায়নাদি কৃত অর্থ গ্রহন করা নয় বরং বৈদিক ঋষিরা যে গভীর অর্থ ব্যক্ত করে গেছেন তাই আবিস্কার করতে হবে।সায়নের সমসাময়িক কালে যে ভাবধারা(বলাই বাহুল্য মূর্তিপুজা,পশুবলি ইত্যাদি) তারই প্রতিবিম্ব তিনি বেদের মধ্যে দেখতে চেষ্টা করেছেন।এইভাবেই বেদের মর্ম সকল বিদ্বান ভূলতে বসেছিলেন।”
সায়ন ও মহীধরের অনুবাদকর্মের ব্যপারে তিনি বলেন,
“তাদের পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ভূল হল সবসময় তা অত্যন্ত Ritualistic এবং ক্রমাগতভাবে সেগুলো বেদের বিশালত্বকে অত্যন্ত সাধারন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।”
“তাদের পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ভূল হল সবসময় তা অত্যন্ত Ritualistic এবং ক্রমাগতভাবে সেগুলো বেদের বিশালত্বকে অত্যন্ত সাধারন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।”
দুঃখের বিষয় এই যে কতিপয় হিন্দু না জেনেই ওইসব ভূল অনুবাদের মাধ্যমে নিজেদের ভূল ধারনাকে সঠিক প্রমানের চেষ্টা চালাচ্ছে।তারা মহর্ষি,আচার্যদের অনুবাদ অনুসরন না করে ভূলে ভরা কিছু অনুবাদ পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে উদাহরনস্বরুপ “যজ্ঞ” শব্দটা ব্যখ্যা করা যাক।অনেকের ই ধারনা আছে যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া হত যেমনটি মুলার,গ্রিফিথদের অনুবাদে তথা সায়ন,মহীদরদের ভাষ্যে পাওয়া যায়।তাদের অনুবাদে ষাড়বলি,ঘোড়াবলি ইত্যাদি বেদ এ পাওয়া যায়।যে ধর্মের মূল ধারনা ই হল প্রানীহত্যা নিষেধ,নিরামিষ ভোজন কর সেই ধর্মের সর্বোচ্চ গ্রন্থেই কিনা এরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলি খুঁজে পায়!দেখে নেয়া যাক বেদ এ পশুবলি নিয়ে কি বলা হয়েছে-
“অগ্নি যম যজ্ঞ অধ্যরাম”-ঋগবেদ ১.১.৪ অর্থাত্ যজ্ঞ হল অধ্যরাম।
নিরুক্ত ২.২৭ এ বলা হয়েছে যজ্ঞ অধ্যরাম অর্থ সম্পূর্ন অহিংস যাতে কোন হত্যা হয়না।
যজ্ঞকে শুধু যজুর্বেদ এর ই ৪৩টি মন্ত্রে অধ্যরাম বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া যজুর্বেদ ১.১ এ বলা হয়েছে “অঘ্ন্যা যজমনস্য পশুনপাহি” অর্থাত্ কোন পশুকে হত্যার কথা চিন্তাও করিও না।
অথচ সায়ন মহীধররা সেই বেদেই যজ্ঞে পশুবলি,মাংস রান্না প্রভৃতি দেখে ফেলেছেন!আর পৌরানিক বিশ্বাসে অন্ধরা সেগুলো পড়েই নাচছেন!
এবার আসি কিছু অজ্ঞের বেদ এ দাবীকৃত ঈশ্বরের সাকার বর্ণনা নিয়ে।তারা বলছে বেদ এর পুরুষ সুক্তের প্রথম মন্ত্রটি ঈশ্বরের সাকার বর্ননা করছে।অথচ প্রকৃত সত্য তা নয়!আগে আমরা পবিত্র বেদ এর বিখ্যাত পুরুষ সুক্তটি দেখে নেই।
ওঁ সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষ সহস্রপদ।
স্বভুমিং বিশ্বতো বৃত্তাঃ অত্যাতিষ্ঠদ দশাঙ্গুলম।।
স্বভুমিং বিশ্বতো বৃত্তাঃ অত্যাতিষ্ঠদ দশাঙ্গুলম।।
এই মন্ত্রটি ঋগবেদ ১০.৯০.১,সামবেদ ৬.৪.১,যজুর্বেদ ৩১.১ ও অথর্ববেদ ১৯.৬.১ এ অবতীর্ন হয়েছে।
চক্ষু মানেই Physical চোখ,পদ মানেই Physical পা,শীর্ষ মানেই Physical মাথা,এরুপ বাংলা উদ্ভূত সংস্কৃত জ্ঞান যাদের তাদের বেদ নিয়ে মন্তব্য না করাই ভাল।বেদ এর অনুবাদ অবশ্যই প্রেক্ষাপট এবং পারিপার্শ্বিক তথ্য বিবেচনায় করতে হবে।
যজুর্বেদ ৪০.৮ এ ঈশ্বরকে “অকায়মব্রণমাস্নাবিরম” অর্থাত্ আকারবিহীন এবং স্থূল ও সুহ্ম যে কোন প্রকার দেহবিহীন বলা হয়েছে।
কেনোপনিষদ ১.৬ এ বলা হয়েছে যচ্চক্ষুষা ন পশ্যতি অর্থাত্ যাকে কেউ ই চোখে দেখতে পায়না কেননা তিনি নিরাকার।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪.২০ এ বলা হয়েছে “ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রুপমস্য” অর্থাত্ তার কোন রুপ বা আকার নেই।আর এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ এর ৩.৩ এ বলা হয়েছে
“বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো বিশ্বতোবাহুরত বিশ্বতস্পাত্” অর্থাত্
সর্বত্র যেন তাঁর চোখ,সর্বত্র যেন মুখময়,সর্বত্র হস্তময় এবং সর্বত্র যেন চরণময়।
“বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো বিশ্বতোবাহুরত বিশ্বতস্পাত্” অর্থাত্
সর্বত্র যেন তাঁর চোখ,সর্বত্র যেন মুখময়,সর্বত্র হস্তময় এবং সর্বত্র যেন চরণময়।
অর্থাত্ স্পষ্টতই এগুলো রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
তাই বৈদিক আচার্যগন পুরুষ সুক্তের প্রথম মন্ত্রটির সঠিক অর্থ করেছেন এভাবে,
“সহস্র(অগনিত,অশেষ) মস্তিস্কময়(সর্বজ্ঞানী),সহস্র অক্ষিময়(সর্বদ্রষ্টা),সহস্র পদযুক্ত(সর্বব্যপী) পরমেশ্বর সমস্ত জগত্ কে দশদিকে(Ten dimensionally)/চারদিকে ব্যপ্ত করে আছেন।
“সহস্র(অগনিত,অশেষ) মস্তিস্কময়(সর্বজ্ঞানী),সহস্র অক্ষিময়(সর্বদ্রষ্টা),সহস্র পদযুক্ত(সর্বব্যপী) পরমেশ্বর সমস্ত জগত্ কে দশদিকে(Ten dimensionally)/চারদিকে ব্যপ্ত করে আছেন।
বেদের ভাষ্য
বেদ মন্ত্রার্থ তিন প্রকার আধিভৌতিক, আধিদেবিক, আধ্যাত্মিক (নিরুক্ত ৭।১-২)
আধিভৌতিক মনুষ্যের ব্যবহারিক বিষয়ক, আধিদৈবিক অর্থাৎ পদার্থ বিদ্যা বিষয়ক, আধ্যাত্মিক পরমাত্মা এবং জীবাত্মা বিষয়ক।
ভাষ্যকারেরা একভাবে বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। বিভিন্ন ভাষ্যকার বিভিন্ন প্রণালীতে বেদের ভাষ্য প্রচার করিয়াছেন। ভাষ্যগুলিকে সাধারণতঃ তিনভাগে বিভক্ত করা যায় –নৈরুক্তিক প্রণালী ঐতিহাসিক প্রণালী, এবং পৌরাণিক প্রণালী। নৈরুক্তিক প্রণালীকে প্রাচীনতম প্রণালী বলিতে হইবে, কারণ ইহা সৃষ্টির আদিকাল হইতে বৈদিক শব্দ কোষ নিঘন্টু পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক প্রণালী ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সময় হইতে উৎপন্ন হইয়া সায়ণাদির সময় পর্যন্ত বর্তমান ছিল। পৌরাণিক প্রণালীকে প্রকৃত পক্ষে কোনও প্রণালী বলা যাইতে পারে না। অনেক বেদ মন্ত্রের এক একটি শব্দলইয়া তাহাতে কপোল কল্পিত ব্যাখ্যা প্রকাশ করিয়াছেন। ইহাকেই পৌরাণিক প্রণালী বলা যায়। প্রচলিত হিন্দু সমাজের পূজা অনুষ্ঠানে কতকগুলি বেদমন্ত্র যেভাবে প্রকাশিত হয় তাহা ঐতিহাসিক ভাষ্যকার সায়ণ মহীধর প্রভৃতির বহু পরে গৃহীত হইয়াছে।
বেদার্থ প্রকাশ সন্বন্ধে নিরুক্তকার বলিতেছেন – “সাক্ষাৎ কৃত ধর্মান্ ঋষবো বভুবুঃ তেহবরেভ্যোহ সাক্ষাৎ কৃতধর্মেভ্য উপদেশেন মন্ত্রান সম্প্রাদুঃ উপদেশায গ্লাযন্তোহবরে বিল্ম গ্রহণাযেমং গ্রন্থং সামান্নাসিযুবেদং চ বেদাঙ্গানি চ” (নিরুক্ত অঃ ১ খঃ ২০।২। অর্থাৎ প্রথমতঃ এমন সব ঋষি জন্মিয়াছিলেন যাঁহারা ধর্মবিধায়ক মন্ত্রের ছিলেন দ্রষ্টা। যাঁহারা ধর্মের সাক্ষাৎকার লাভ করেন নাই এবং যাঁহারা যোগ্যতায়ও পশ্চাৎপদ ছিলেন তাঁহাদের নিকট ইহারা বেদমন্ত্রের উপদেশ দান করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর ঋষিরা বেদমন্ত্রের উপদেশ দানে অসমর্থ ছিলেন। তাঁহারা বৈদিক শব্দের অর্থ প্রকাশের জন্যই নিঘন্টু অর্থাৎ মূল বৈদিক কোষ, ব্রাহ্মণ এবং বেদাঙ্গ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ঋষিরা যথাক্রমে নিঘন্টু ব্রাহ্মণ বেদাঙ্গ প্রণয়ন করিয়াছেন। কেহ কেহ ব্রাহ্মণ গ্রন্থকেও বেদ মনে করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি বেদ অর্থাৎ সংহিতা ভাগের ব্যাখ্যা। মূল গ্রন্থের টীকা বা ভাষ্য ও যেমন অনেক সময় মূল গ্রন্থের নামে পরিচিত হয়, ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিও সেইরূপ অনেকের নিকট মূল গ্রন্থের নামে পরিচিত হইতেছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বেদমন্ত্রের মর্মার্থকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। প্রয়োজন বোধে উদাহরণের জন্য নানারূপ উপাখ্যান প্রদত্ত হইয়াছে বৈদিক শব্দকোষ পাঠ করিলে জানা যায়, ইহাতে প্রত্যেকটি শব্দ যৌগিক অর্থে প্রকাশিত হইয়াছে, ইহা ধাতুগত অর্থ ও ব্যুৎপত্তি মূলক নহে। নিঘন্টুর বহু পরে ব্রাহ্মণ বা বেদ ব্যাখ্যা গ্রন্থরচিত হয় এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থেই সর্বপ্রথম ইতিহাসের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের এই সব উপাখ্যানকে ভিত্তি করিয়াই অনেক বেদমন্ত্রে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা করিয়াছেন। নিঘন্টুর নির্মাতা কশ্যপ ঋষি। যাস্কাচার্য নিঘন্টুর ভাষ্য নিরুক্ত প্রণয়ন করেন। বেদ ভাষ্যের নৈরুক্তিক প্রণালী ও ঐতিহাসিক প্রণালী সন্বন্ধে নিরুক্তেই দৃষ্ট হয় –“তৎ কো বৃত্র মেঘ ইতি নরুক্তাঃ ত্ত্বাষ্ট্রেীহ সুর ইত্যেতিহাসিকাঃ অপাং চ জ্যোতিষশ্চ মিশ্রীভাব কর্মণো বর্ষ কর্ম জাযতে তত্রোপ মার্থেন যুদ্ধ বর্ণনা ভবন্তি” (নিরুক্ত অ ২খ ১৬।২)। এখানে নিরুক্তকার বেদের বৃত্র শব্দের অর্থ লিখিয়াছেন। ‘বৃত্র’ কাহাকে বলে? নৈরুক্তিক বেদ ভাষ্যকরার ‘মেঘ’কে বৃত্র বলেন এবং ঐতিহাসিক বেদভাষ্যকার ‘অসুর’কে বৃত্র বলেন। অনেকে বলেন, - ‘বৃত্রের সহিত ইন্দ্রের তো স্পষ্ট সংগ্রামের বর্ণনা রহিয়াছে। কিন্তু এখানে জল ও বিদ্যুতের মিলনে বৃষ্টির উৎপত্তি হয়। এই কথাটিই যুদ্ধের উপমায় বর্ণিত হইয়াছে। বেদমন্ত্রে উপমালংকারের দ্বারা অতি সরল উপায়ে জ্ঞান প্রকাশ করা হইয়াছে। কিন্তু ঐতিহাসিক ভাষ্যকারেরা উপমালংকারকে না বুঝিয়া তাহাকে বাস্তবিক ঘটনা মনে করিয়া তাহাতে ইতিহাস আরোপ কারিয়াছেন ও নানারূপ অনর্থের সৃষ্টি করিয়াছেন।
পৌরাণিক ভাষ্য সন্বন্ধেও একই কথা। পৌরাণিক ভাষ্যকারেরা বেদ মন্ত্রের একটি শব্দকে গ্রহণ করিয়াই সম্পর্ণ মন্ত্রের অর্থের দিকে না তাকাইয়া তাহার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন। বেদ মন্ত্রের দুই একটি শব্দকে গ্রহণ করিয়াই নানারূপ পৌরাণিক উপাখ্যানের সৃষ্টি হইয়াছে। সে সব উপাখ্যান বহুল প্রচার লাভ করিলেও তাহা অলীক ও কাল্পনিক মাত্র। বেদ ভাষ্যের যর্থাথতা জানিবার কয়েকটি উপায় আছে। প্রথমতঃ –বেদভাষ্য সংস্কৃত শব্দকোষ অনুযায়ী হইবে। দ্বিতীয়তঃ-ইহা সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে হইবে তৃতীয়তঃ- ইহা যুক্তি বা তর্ক সঙ্গত হইবে। চতুর্থতঃ- ইহা ঋষিদের বিচার সম্মত হইবে। পঞ্চমতঃ- কর্ম্ম কাণ্ডের মন্ত্রগুলির যাহা মর্ম্ম তাহার অনুকূল কর্ম্মের সেই সেই মন্ত্রের বিনিয়োগ হইবে। বেদভাষ্য এই কয়েকটি নিয়ম রক্ষিত হইবেই তাহা প্রকৃত ও উৎকৃষ্ট বেদভাষ্য।
বর্তমানে হিন্দু সমাজে বেদ মন্ত্রের পৌরাণিক ভাষ্যই গৃহীত হইতেছে। অনেকের ধারণা মহীধর ও উবটাদি মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ভাষ্যকারেদের প্রণালী অনুসারেই প্রচলিত হিন্দু সমাজ সব বেদার্থ গ্রহণ করিয়াছে কিন্তু তাহাও ভ্রান্তিমাত্র। মহীধর উবটাদি নৈরুক্তিক ভাষ্যক যেমন অতিক্রম করিয়াছেন। পৌরাণিক হিন্দুসমাজও তেমনই মহীধর উবটাদিকে উপেক্ষা করিয়াছে। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিলেই ইহা বোধগম্য হইবে। যজুর্বেদের ১৭শ অধ্যায়ের ৪৬ সংখ্যক মন্ত্রটি এইরূপ –
“প্রেতা জযতা নর ইন্দ্রো বঃ শর্ম্ম যচ্ছতু। উগ্র বঃ সন্তু বাহবোহনাধৃষ্ষ্যা যথাহসথ।”
ঐতিহাসিক বেদভাষ্যকার মহীধর এই মন্ত্রের অর্থ করিতেছেন –“যোদ্ধৃ দেবত্যানুষ্টভ যোদ্ধৃন স্তৌতি। নরোহ স্মদীযা যোদ্ধারঃ। যুযং প্রেত পরসৈন্যং প্রতি প্রকর্ষেণ গচ্ছত ততো জাযতা বিজযংপ্রাপ্নুত। দ্বচে হস্তিঙঃ (পা ৬।৩।১৩৭) ইতি জযতা ইত্যত্রা দীর্ঘঃ। অর্থাৎ এই মন্ত্রের যোদ্ধা দেবতা এখানে যোদ্ধাদের স্তুতি করা হইয়াছে। অনুষ্টুপ ছন্দ। হে (নরঃ) মনুষ্যগণ! অর্থাৎ যোদ্ধৃগণ! তোমরা (প্রেত) বিপক্ষ সৈন্যদের প্রতি দ্রুত গতিতে অগ্রসর হও, তাহাদের উপর (জয়ত) বিজয় লাভ কর। অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র অনুসারে প্রেত শব্দ (প্র+ই ধাতু গমন অর্থে) “প্রেতা” ও জযত” শব্দে “জযতা” হইয়াছে।
উবট এই মন্ত্রের ভাষ্য করিতেছেন ‘হে নরঃ মনুষ্যঃ প্রেত গচ্চুত জযত চ’ অর্থ্যৎ (হে নরঃ) মনুষ্য! (প্রেত যাও এবং জয় লাভ কর।
মহর্ষি দয়ানন্দ এই মন্ত্রের ভাষ্য করিতেছেন “(প্রইত) শত্রূন্ প্রাপ্নূত। অত্র দ্বেচেহ তস্তিঙঃ ইতি দীর্ঘঃ (জযত) বিজযধ্বম্। অত্রান্যেষামপি দৃশ্যত ইতি দীর্ঘ (নরঃ) নায়ক।”অর্থাৎ হে (নরঃ) অনেক প্রকারের কর্ম্মকৌশল দাতা মনুষ্য। তোমরা শত্রুগণকে প্রাপ্ত হও এবং তাহাদিগকে জয় কর। সংস্কৃতে যে সব ধাতুর অর্থ যাওয়া সেই সব ধাতুর অর্থই প্রাপ্ত হওয়া। এই জন্যই দায়ানন্দ জানার স্থলে প্রাপ্ত হওয়া লিখিয়াছেন।
যজুর্বেদের উল্লিখিত মন্ত্রের উত্তরে মহীধর, উবট ও দয়ানন্দ প্রেত শব্দের অর্থ করিয়াছেন শীঘ্র যাও, কিন্তু পৌরাণিকেরা এই মন্ত্রের ‘প্রেত’ শব্দ টুকরাটি লইয়া এক মহা অনর্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহারা প্রেত শব্দে বুঝিয়াছেন মৃত মনুষ্যের প্রাণ এবং এই মন্ত্রের দ্বারা তাঁহারা মৃত প্রাণীকে আহবান করেন। অন্তেষ্ট্যি পদ্ধতির প্রেত বলি প্রয়োগ তাঁহারা ব্যবস্থা রাখিয়াছেন – “মধ্য কলশে বিষ্ণু রূপি প্রেত রাজায নমঃ বিষ্ণরূপি প্রেত রাজন্ আবাহবামি স্থাপযামী। ভো প্রেতরাজ ইহাগচ্ছেহতিষ্ঠ। এবং সর্ব্বত্র ততঃ পূর্ব্বাদি ক্রেমেণ ওম্ প্রেতা জযতা নর ইন্দ্রো বঃ শর্ম্ম যচ্ছতু উগ্রা বঃ সন্তু বাহবোহ নাধৃষ্ষ্যা যথা ইলখ প্রেতায নমঃ প্রেতম্ আবহযামী ভো প্রেত ত্বং ইহাগচ্ছে হভিষ্ঠ।”। অর্থাৎ মধ্যস্থিত কলসীতে বিষ্ণুরূপী প্রেত রাজাকে নমস্কার। বিষ্ণুরূপী প্রেত রাজাকে নমস্কার। বিষ্ণুরূপ প্রেতরাজকে আমি আহবান করিতেছি। এবং স্থাপন করিতেছি। হে প্রেতরাজ। এখানে আগমন কর এখানে অবস্থান কর। এই ভাবে সর্ব্বত্র পাঠ করিবে। ওম্ প্রেতা জযতা নর ইত্যাদি। প্রেতকে নমস্কার। প্রেতকে আমি আহবান করিতেছি। হে প্রেত! এখানে আগমন কর ওবং অবস্থান কর।
যজুর্ব্বেদের ২৩ অধ্যায়ের ৩২ সংখ্যক মন্ত্রটী এইরূপ- দধীক্রাব্ণো অকারীষং জীজ্ঞোরশ্বস্য বাজনঃ সুরভি নো মুখা করৎ প্রাণ জাযূংষী তারীষৎ।” যজুর্ব্বেদের ৩৪ অধ্যায়ের ১১ সংখ্যক মন্ত্রটি এইরূপ “পঞ্চানদ্যঃ সরস্বতীমপী যন্তি সস্রোতসঃ। সরস্বতী---- পষ্ণধা সো দেশেহ ভবৎসরাৎ” প্রথম মন্ত্রটিতে বলা হইয়াছে – নদীর তুল্য (সস্রোতসঃ) প্রবহমান (পঞ্চনদ্য) জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তি (সরস্বতীম্) বিজ্ঞান যুক্ত –বাণীকে যেরূপ প্রাপ্ত হয়, সেইরূপ (সরিৎ) চলমান (সরস্বতী) বাণীও (দেশ) স্বীয় নিবাস স্থানে (পঞ্চধা) পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের শব্দাদি পঞ্চ বিষয়ের প্রতিপাদন করিয়া পঞ্চ প্রকারের হয়।
মহীধর প্রথমে মন্ত্রের “দধি” শব্দের অর্থ করিতেছেন “দধাতি” ধারযতি নরমিতি দধি” যাহা মনুষ্যক ধারণ করে তাহাই দধি। উবট ও দধিকে ধারণ কর্ত্তা অর্থ প্রয়োগ করিয়াছেন, দয়ানন্দের ভাষ্যে “দধীক্রাব্ণঃ যো দধীন্ পোষকান্ ধারকান” অর্থাৎ যে ধারণ পোষণকে প্রাপ্ত হয় –এইরূপ লিখিত হইয়াছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের “পঞ্চনদ্যঃ শব্দের অর্থ মহীধর ও উবটের মতে পঞ্চ নদী, দয়ানন্দের মতে জ্ঞানেন্দ্রিয়রূপ পঞ্চনদী। কিন্তু পৌরাণিকেরা এই ‘দধি’ ও পঞ্চ’ শব্দে বুঝিয়াছেন দধি ও পঞ্চ গব্য। তাঁহারা প্রথম মন্ত্র পাঠ করিয়া পঞ্চগব্য অর্থাৎ দধি, দুগ্ধ, ঘৃত গোমূত্র ও গোময় দ্বারা মূর্ত্তিকে স্নান করাইয়া থাকেন। তাঁহারা প্রতিষ্ঠা ময়ূখ প্রন্থে প্রমাণ লিখিয়া রাখিয়াছেন ‘দেবাযার্ঘ্যং সমর্প্য স্নাপযেৎ তদ্যথা পঞ্চনদ্য ইতি পঞ্চ গব্যেন দধীক্রাব্ণ ইতি দধ্না” অর্থাৎ দেবতাকে পূজা দ্রব্য সমর্পণ করিয়া স্নান করাইবে। পঞ্চ নদ্য ইত্যাদি মন্ত্র পড়িয়া পঞ্চ গব্য দ্বারা এবং দধি ক্রাব্ণ ইত্যাদি মন্ত্র পড়িয়া দধি দ্বারা স্নান করাইবে।
যজুর্ব্বেদের ৩১ অধ্যায়ের প্রথম মন্ত্রটী এইরূপ “সহস্রর্শীষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ স ভূমী সর্বতঃস্পত্বা হ ত্যতিষ্ঠদশাঙ্গুলম্।” অর্থাৎ নেত্র এবং অসংখ্য চরণ রহিয়াছে। এইরূপ সর্বত্র পরিপূর্ণ ব্যাপক জগদীশ্বর সর্বদেশে ভূগোলে সর্বত্র ব্যাপক থাকিয়া পঞ্চ স্থূল ভূত এই দশ যাহার অবয়ব সেই সমস্ত জগৎকে অতিক্রম করিয়া বিরাজমান। মন্ত্রটীতে পরমাত্মার সর্ব্বব্যাকত্ব ও বিরাটত্ব ঘোষিত হইয়াছে। কিন্তু পৌরাণিকেরা এই মন্ত্রটী পাঠ করিয়া নারায়ণ শিলাকে স্নান করাইয়া থাকেন। পৌরাণিকদের হাতে পড়িয়া বেদ মন্ত্রের এইরূপ অনর্থ ঘটিয়াছে।
বৈদিক ভাষা
সংস্কৃত ভাষা দুই প্রকারের – বৈদিক সংস্কৃত ও লৌকিক সংস্কৃত। পুরাণ উপপুরাণ সাহিত্য স্মৃতি কাব্যাদি যে সব গ্রন্থ সচারাচর দৃষ্ট হয় তাহা লৌকিক ভাষায় লিখিত। বেদের ভাষার নাম বৈদিক ভাষা। বৈদিক ও লৌকিক ভাষার ব্যাকরণের নিয়মাবলী একরূপ নয়। এই জন্য লৌকিক ভাষার জ্ঞান লাভ করিয়াও বৈদিক ভাষা সম্যক বুঝিবার উপায় নাই। যাস্ক প্রণীত নিরুক্ত গ্রন্থে লৌকিক ও বৈদিক উভয় ভাষাই দৃষ্ট হয় এজন্য পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তে পৌছিয়াছেন যে সৃষ্টির আদি হইতে নিরুক্ত গ্রন্থের পূর্ব্ব পর্যন্ত যত গ্রন্থ দুষ্ট হয় সকলেরই ভাষা বৈদিক এবং নিরুক্ত হইতে আজ পর্যন্ত যত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছে সে সকলেরই ভাষা লৌকিক নিরুক্ত লৌকিক সংস্কৃত ভাষার সর্বপ্রথম গ্রন্থ। মহর্ষি পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী পড়িলেই আমরা জানিতে পারি যে, ভাষা দুই প্রকারের –বৈদিক ও লৌকিক। একই অষ্টাধ্যায়ী পাঠ করিলে আমরা লৌকিক ও বৈদিক উভয় ব্যাকরণের নিয়মাবলী জানিতে পরি। বৈদিক ব্যাকরণের নিয়মে যাহা শুদ্ধ, লৌকিক ব্যাকরণের নিয়েমে তাহা অশুদ্ধ হইতে পারে। লৌকিক ব্যাকরণের জ্ঞান দ্বারা বেদের ভাষ্য করা অসম্ভব, এজন্য বৈদিক ব্যাকরণের শরণাপন্ন হইতে হয়। বৈদিক ব্যাকরণের নিয়মাবলীতে বহু বিষয়ের বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। অষ্টাধ্যায়ীর একটি সূত্র- ব্যত্যযো লহুলম্ এই সূত্রটি সর্ব্বাধিক প্রসিদ্ধ ও প্রয়োজনীয়। সূত্রটির অর্থ – “বেদে শব্দাদির পরিবর্ত্তন হয়, কখনও বিকল্পে হয় এবং কখনও বা হয় না।”। সাধারণ দৃষ্টিতে কখনও কখনও প্রাকৃতিক জগতে কখনও কখনও নিয়ম ও শৃঙ্খলা লক্ষিত হয় না কিন্তু যাঁহার বিশেষজ্ঞ ও তীক্ষদৃষ্টিসম্পন্ন তাঁহারা প্রাকৃতিক জগতের সেই অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখিয়া থাকেন। বৈদিক ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে অনিয়ম দেখা সাধারণ দৃষ্টিতে খুবই স্বাভাবিক। পতঞ্জলি অষ্টাধ্যায়ী সূত্রের মহাভাষ্য রচনা করিয়াছেন। ইহাতে তিনি একটি কারিকা বা শ্লোক লিখিয়াছেন। সিদ্ধান্ত কৌমুদীতেও ইহার উল্লেখ রহিয়াছে।
শ্লোকটি এইরূপ-
‘সুপ্তিঙ্ উপগ্রহ লিঙ্গনরাণাং কাল হলচ্ স্বর
কর্ত্তৃযঙ্ আংচ। ব্যতযমিচ্চতি শাস্ত্র কৃদেযাং
সোহপি চ সিধ্যতি বাহলকেন।” অ -৩ পাদ১।সূত্র ৮৫
অর্থাৎ বেদশাস্ত্র সুপ্, তিঙ, উপগ্রহ, লিঙ্গ, নর, কাল, হল, অচ্, স্বর, কর্ত্তৃ যঙ ব্যবহারে ইচ্ছা হইলে ব্যতয় হইতে পারে।
(১) সুপ্ অর্থাৎ কারকে ও সন্বন্ধে পরিবর্তন হইতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পারে লৌকিক সংস্কৃত ব্যাকরণে ‘অগ্নিঃ’ কর্ত্তৃকারক, অন্যান্য কারকে বা সন্বন্ধে ইহার রূপ পরিবর্ত্তিত হয় কিন্তু বৈদিক ভাষায় ‘অগ্নি’ পদ অগ্নিকে, অগ্নিদ্বারা অগ্নি হইতে, অগ্নির, অগ্নিতেও হে অগ্নে –সব অর্থেই প্রযুক্ত হইতে পারে। (২) তিঙ্ অর্থাৎ বেদে ধাতুর রূপও পরিবর্ত্তিত হইতে পারে। (৩) উপগ্রহ অর্থাৎ বেদে আত্মনেপদ ধাতুর পরস্মৈপদ এবং পরেস্মৈপদ ধাতুর আত্মনেপদ হইতে পারে। (৪) লিঙ্গ অর্থাৎ বেদে স্ত্রীলিঙ্গের পুংলিঙ্গ, পুংলিঙ্গের স্ত্রীলিঙ্গ, স্ত্রী ও পুংলিঙ্গের নপুংসক লিঙ্গ এবং নপুংসক লিঙ্গের পুং বা স্ত্রীলিঙ্গ হইতে পারে। (৫) পুরুষ অর্থাৎ বেদে পুরুষের পরিবর্ত্তন হইতে পারে। উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষের যে কোন একটি যে কোন স্থানে পরিবর্তিত হইতে পারে। (৬) কাল অর্থাৎ বেদে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ কালেরও পরিবর্তন হইতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ “স দাধার পৃথিবীম্” বেদের এই মন্ত্রাংশটিকে ঈশ্বর পৃথিবকে ধারণ করিয়াছেন এইরূপ দুই কালেই বুঝিতে পারা যায়। (৭) হল অর্থাৎ বেদে ব্যঞ্জন বর্ণের যে কোনও একটির স্থলে অন্যটি হইতে পারে। যেমন দ স্থানে ধ, ক স্থানে প হইতে পারে। (৮) অচ্ অর্থাৎ বেদে স্বরবর্ণের যে কোনও একটি স্থলে অন্যটি হইতে পারে। (৯) স্বর অর্থাৎ বেদে উদাত্ত ও স্বরিতের উচ্চারণ পরিবর্তিত হইতে পারে। (১০) কর্ত্ত ও যঙ্ প্রত্যয়ের শেষ কৃদন্ত তদ্ধিতাদি ও অন্যান্য বহুস্থানেই বেদে পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। বৈদিক ব্যাকরণ শুধু একটি সূত্র বিচার করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে যে বেদে অক্ষর পর্যন্তও পরিবর্ত্তিত হয়। বেদের কোন মন্ত্রের বা শব্দের কি তাৎপর্য, স্বচ্ছ হৃদয় ঋষিরা সমাধি যোগে যাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন তাহা সর্ব সাধারণের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া রহিয়াছে। অনেক সময় দেখা যায় যে বেদমন্ত্র অতি সরল ও সুবোধ্য কিন্তু ভাষ্যকারদের পাণ্ডিত্যের জটিলতা প্রকাশ হইতে দেয়না ভাষ্যকারদের পাণ্ডিত্যের প্রতিযোগিতায় বেদ সাধারণের নিকট নীরস ও দুরধিগম্য হইয়াছে। সংস্কৃত ভাষায় সাধারণ জ্ঞান থাকিলে অষ্টাধ্যায়ী নিরুক্তের সাহায্যে, বেদের রহস্য অনেকেই বুঝিতে পারিবেন- তাহাতে সন্দেহ নাই। যে কোন বিদেশী ভাষার সহিত তুলনায় বৈদিক ভাষা কঠিন নহে।
বেদের শব্দ জ্ঞান না থাকিলে শুধু লৌকিক শব্দ কোষের সাহায্যে মন্ত্রার্থ বুঝিবার উপায় নাই। লৌকিক ব্যাকরণ ও বৈদিক ব্যাকরণ যেমন পৃথক, লৌকিক শব্দ কোষ এবং বৈদিক শব্দ কোষও তেমন পৃথক। লৌকিক সংস্কৃতের জন্য যেমন অমর কোষ, বৈদিক সংস্কৃতের জন্য তেমন নিঘন্টু। নিঘন্টুর টীকা লিখিয়া নিঘন্টুর বহুল প্রচার করিয়াছিলেন, এজন্য নিঘন্টু ও নিরুক্ত উভয়ই যাস্কের নামে চলিতেছে। লৌকিক শব্দ-কোষের সাহায্যে বেদভাষ্য করিতে গিয়া বহু অনর্থের সৃষ্টি হইয়াছে। যজুর্বেদের ১৬ অধ্যায়ের ২৮ মন্ত্রের প্রথম অংশ হইতেছে –“নম্য শ্বভ্যঃ”। এই বাক্যটি লৌকিক শব্দকোষ অনুসারে অর্থ প্রকাশ করিবে “কুকুরকে নমস্কার”। যজুর্বেদের ভাষ্যকার লৌকিক শব্দকোষ অবলম্বনে ইহার ভাষ্য করিতে গিয়া যেন মু্স্কিলেই পড়িয়াছিলেন। কেমন করিয়া বেদে কুকুরকে নমস্কারের বিধান রাখা হইয়াছে- তাঁহার মানে এই সন্দেহ হওয়ায় তিনি কুকুরকে ভৈরবের মূর্ত্তি কল্পনা করিয়া ভাষ্য করিলেন – “শ্বানঃ কুক্কুরাস্তদ্রুপেভ্যো নমঃ” ইতি নমস্কার মন্ত্রঃ অর্থাৎ কুকুররূপী যে ভগবান তাঁহাকে নমস্কার। স্বামী দয়ানন্দ এই মন্ত্রের ভাষ্য করিয়াছেন- (শ্বভ্যঃ) কুকরকে (নমঃ) অন্ন দিবে। বৈদিক শব্দকোষ নিঘন্টুর সহিত যাঁহাদের পরিচয় নাই তাঁহারা দয়ানন্দ ভাষ্যকে অসঙ্গত মনে করিবেন, কেননা “নমঃ” অর্থে ‘অন্ন’ ইহা তাঁহারা শুনেন নাই। কিন্তু বৈদিক শব্দ কোষ নিঘন্টু শুনিলেই তাঁহারা দেখিতে পাইবেন “নমঃ” শব্দের এক অর্থ ‘অন্ন’। মহীধর লৌকিক শব্দ-কোষ অমর কোষের সাহায্যে লইয়াছেন এবং দয়ানন্দ বৈদিক শব্দকোষ নিঘন্টুর সাহায্য লইয়াছেন। ‘নমঃ’ অর্থে ‘অন্ন’ জানিলে মহীধর কুকুরকে রুদ্ররূপ দিয়া নমস্কার করিতেন না।
যজুর্ব্বেদের পঞ্চম অধ্যায়ের দ্বিতীয় মন্ত্র আছে –অগ্নের্জমিত্রমসি ষবৃণৌস্থ উর্বশ্য স্যাযুরসিপুরূরবা অসি নৃপস্যহভোগায়াধস্তাচ্ছেতে তদ্বৎ ত্বমধোহবস্থিতাসীত্যর্থ – হে উত্তরারণে ত্বং পুরূরবা অসি যথা পুরূরবা নৃপ উর্বশ্যা অভিমুখ উপরি বর্ততে তথা ত্বমপীত্যর্থঃ। অর্থাৎ “হে নীচের অরণি (যজ্ঞ কাষ্ঠ) তুমি ঊর্বশী হও। ঊর্বশী যেরূপ পুরূরবা রাজার ভোগের জন্য নীচে শয়ন করে সেইরূপ তুমিও নীচে অবস্থিত রহিয়াছ। হে উপরের অরণি (যজ্ঞ কাষ্ঠ) তুমি পুরূরবা হও। যেমন পুরূরবা রাজা উর্বশীর সম্মুখে উপরে থাকে তদ্রূপ তুমি থাক। মন্ত্রের এই অর্থ।“ মহীধর লৌকিক কোষ অবলম্বনে মন্ত্রটিকে এইরূপ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এইরূপ ব্যাখ্যায় কতগুলি দোষ ঘটে। প্রথমতঃ- বৈদিক কোষানুসারে ইহার ভাষ্য করা হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ- কোন পবিত্র ধর্ম্মগ্রন্থের নামে এইরূপ অশ্লীল উক্তির প্রচার করা সেই ধর্ম্ম গ্রন্থের অপমান করা মাত্র। তৃতীয়ত- যদি ঐতিহাসিক পরূরবা ও উর্বশীর কথা বেদে উল্লেখিত হয় তবে বুঝিতে হইবে, বেদ পরূরবা ও উর্বশীর পরে রচিত হইয়াছে সুতরাং ইহা সৃষ্টী রচনার আদি হইতে ঈশ্বরীয় জ্ঞান হইতে পারে না।
মহর্ষি দয়ানন্দ এই মন্ত্রের ভাষ্য বৈদিক কোন নিঘন্টু অনুসারে করিয়াছেন। নিঘন্টু গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় ২য় পাদে ৪৭ সংখ্যক শব্দের উর্বশী এবং ৫ম অধ্যায় ৪র্থ পাদের ৩ সংখ্যক শব্দই পুরুরবা নির্ঘন্টুর টীকাকার উর্বশী শব্দের অর্থ করিতেছেন – “ঊর্বশী ঊর্ব ভাশ্লতে।” নিরুক্ত অ-৫, খ-৪৬ বি২। অথ্যাৎ যাহা অনেককে সর্ব্ব প্রকার ব্যাপ্ত করে বা প্রাপ্ত হয়। পুরূরবা তাহার নাম যাহা পুরু অর্থাৎ বহু রব করে। উর্বশী যজ্ঞের নাম। যজ্ঞ বহু সুখ দ্বারা ব্যাপ্ত হয় পরূরবার নাম যজ্ঞ। যজ্ঞে বহু শব্দ করা হয়। যজ্ঞে নানাবিধ শাস্ত্র উপদেশ করা হয় বলিয়া তাহার নাম পুরূরবা। যেখানে যজ্ঞ সন্বন্ধে নানাবিধ উপদেশ প্রদান করা হইয়াছিল সেখানে অশ্লীল বাক্যে প্রচার করা কোন ক্রমেই সঙ্গত হইতে পারে না।
মন্ত্রের অর্থের অনুকুল না হইলেও নানা অনর্থের সৃষ্টি হয়। যজুর্বেদের ষষ্ঠ অধ্যায় ১৫ শ মন্ত্রে আছে – “স্বধিতেমৈনংহিংসীঃ।।” মহীধর কাত্যায়ণ সূত্রের প্রমাণ দিয়া অর্থ করিতেছেন – ‘স্বধিত ইতি প্রজ্ঞাতযাভিনিধায’ (কাত্যায়ণ ৬।৬।৯) মহীধর- “অসিধারাং নিধায তুষ্ণীং সতৃণমুদরত্বং চ ছিন্দ্যাদিতি সূত্রার্থঃ। এনং পশুংস্বধিতে মাহিংসী।” অর্থাৎ স্বাধিতে মৈনং হিংসী ইহা পড়িয়া চিহ্নিত তরবারীকে শাণিত করিয়া চুপে চুপে তৃণ দ্বারা পূর্ণ উদর পশুর পেটের চর্ম্ম ছেদন করিবে। ইহাই কাত্যায়ণ সূত্রের অর্থ। মন্ত্রের অর্থ – হে পরশু! এই পশুকে হত্যা করিও না। এখানে মন্ত্রে অর্থ হত্যা করিওনা এবং এই মন্ত্রকে পড়িয়া মহীধর কাত্যায়ণ সূত্রের বিনিয়োগ দিয়া অর্থ করিতেছেন হত্যা কর। স্বামী দয়ানন্দ উক্ত মন্ত্রের অর্থ করিতেছেন এইরূপ অস্য বিদ্বাংসো দেবতাঃ। (স্বধিতে) স্বেযাত্মীযেষু ধিতিঃ পোষণং যস্যাঃ তৎ সন্বুদ্ধৌ (মা নিষেধে (এমন) পূর্ব্বোক্তম্ (হিংসা) কুশিক্ষযা লালনেন বা মা বিনশযেঃ”। হে (স্বধিতে) প্রশস্তাধ্যাপক। তুমি কুমারী শিষ্যকে অনুচিত তাড়না করিও না। এখানে মন্ত্রের বিষয় বা দেবতা বিদ্বান। এজন্য এ মন্ত্রের অর্থ বিদ্বানদের সন্বন্ধেই করিতে হইবে। বেদমন্ত্রের বিনিয়োগ না বুঝিয়া ভাষ্যকারেরা বেদের নামে মানব জাতির কিরূপ সর্বনাশ করিয়াছে নিম্নলিখিত দুই একটি দৃষ্টান্তে সম্যক বৃঝিতে পারা যাইবে।
কাত্যায়ণ সূত্র অনুসারে একটি বিনিয়োগ এইরূপ – পুরুষাশ্বগোহব্যজনা লভ্যাজেন যাগং কৃত্বা পঞ্চানাং শিরাংসি ঘৃতাক্তানি সংস্থাপ্য তেষাং কবন্ধাৎ যজ্ঞশেষং চ মৃদুক্তে তডাগাদি জলেপ্রাস্যেৎ উত্থার্থাকিষ্টকার্থং চ মৃদুং জলে চ তৎ পবোদেযম্। মনুষ্য, ঘোড়া, গো, মেষ, ছাগ এই পঞ্চ প্রাণির মস্তক ঘৃতসিক্ত করিয়া রাখিয়া তাহাদের অবশিষ্ট দেহকে যজ্ঞাবিশষ্ট দ্রব্যকে জলাশয়াদির মৃত্তিকা মিশ্রিত জলে নিক্ষেপ করিবে, তাহা দ্বারা (যজ্ঞের) উখ ও ইষ্টক প্রস্তুত করিতে হইবে। মহীধর মনুষ্য ও গোহত্যা করিবার বিধান কাত্যায়ণের বিনিয়োগ অনুসারেই দিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে – যজুর্বেদের ২৩ অধ্যায়ের ২০ মন্ত্রের বিনিয়োগ ক্যাত্যয়ন শ্রৌত্র সূত্রে এইরূপ আছে – “অশ্ন শিশ্নমুপস্থে কুরুতে বৃয বাজীতি” (কাত্যায়ন শ্রোত সূত্র অ ২০, কণ্ডিকা ৬, সূত্র ১৬) এই সূত্রের অর্থ মহীধর উক্ত মন্ত্রের ভাষ্য করিতে গিয়া এইরূপ লিখিয়াছেন –“মহিষী স্বযমেবাশ্ব শিশ্নমাকৃষ্য স্বযোনৌ স্থাপযতি” অর্থাৎ বৃষা বাজী ইত্যাদি মন্ত্র পড়িয়া রাণী (যজমনের স্ত্রী) স্বয়ং অশ্বের কে – নিজ ইন্দ্রিয়ে স্থাপন করিবে পরে অশ্বের হত্যা ও তাহার মাংস দ্বারা হোমের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
বেদের নামে এইরূপ বহু অশ্লীল ও বীভৎস ব্যাপারের প্রচার বেদ বিরোধী বামমার্গীরা এক সময় দেশে প্রচার করিয়াছিলেন। জন সাধারণ চিরদিনই বেদ প্রমাণিক ধর্ম্ম গ্রন্থ বলিয়া শ্রদ্ধা করিয়া আসিতেছে। যদি কোন নুতন মতের প্রবর্ত্তন করিতে হয় তবে বেদের নামে করিলে সহজ সাধ্য হইবে ইহা বামমার্গীরাও বুঝিয়াছেন বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডের নামে যখন এইরূপ অবৈদিক ক্রিয়া কলাপে দেশ পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল তখনই নাস্তিক দর্শন প্রণেতা চার্ব্বাক প্রচার করিয়াছিলেন ত্রযস্তে বদকর্তারঃ ভণ্ড ধুর্ত্ত নিশাচরাঃ অর্থাৎ ভণ্ড ধূর্ত্ত এবং নিশাচর এই তিন রূপ ব্যক্তিই বেদে কর্ত্তা। বহু যুগের বহু মালিন্য বেদের নামে দেশে চলিয়া আসিতেছে। গৌতমবুদ্ধ ও এই সব ক্রিয়া কলাপে বিরক্ত হইয়াছিলেন। শঙ্করাচার্য্য এই সব মালিন্য অপসারিত করিয়া স্বচ্ছ শুদ্ধ পবিত্র বৈদিক ধর্ম্মের প্রচার করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মতই প্রচার করিয়াছিলেন। বহু শতা্ব্দি পর মহর্ষি দয়ানন্দ তান্ত্রিকও বামমার্গীদের ভাষ্যে মলিনতা হইতে বেদকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। তাঁহার ভাষ্য প্রাচীন কালের নিঘন্টু ও নিরুক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। বেদে কর্ম্ম জ্ঞান ও উপাসনার সামঞ্জস্য রক্ষিত হইয়াছে। কর্ম্ম, জ্ঞান বা উপাসনার যে কোন একটি উপেক্ষিত হইলেই যে মোক্ষ লাভ সুদূর পরাহত তাহা মহর্ষি দয়ানন্দের বেদভাষ্য পড়িলে বা প্রাচীন ভাষ্যকারদের ভাষ্য পড়িলেই জানা যায়। ঋগ্বেদে জ্ঞান কাণ্ডের বিধান, যজুর্ব্বেদের কর্ম্মকাণ্ডের বিধান এবং সামবেদে উপাসনা কাণ্ডের বিধান। অথচ বেদকে কোন গুরুর নিকট না পড়িয়া বিজ্ঞান চর্চার জন্যই বিহিত। এই জন্যই বেদের এক নাম ‘ত্রয়ী’। বেদের জ্ঞান, কর্ম্ম ও উপাসনা এই ত্রিবিদ্যা সাধনের উপরই দেশ, সমাজ ও ব্যক্তির উন্নতি এবং বিশ্বের কল্যাণ নির্ভর করে।
সনাতন ধর্মের সকল মানুষ কি আর্য সমাজের নয়? আর্য সমাজের মানুষ কারা? আবার সেই অনর্থ হতে চলছে। আবার সেই বর্ণাশ্রমের মত সনাতন ধর্মকে দ্বিধাবিভক্ত করার অপ্রয়াস। সায়ণাচার্যের বেদভাষ্য দয়ানন্দ সরস্বতী মানেন না আবার সায়ণাচার্যের অনুসারীরা দয়ানন্দের ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। সায়ণাচার্যের ও দয়ানন্দ সরস্বতী উভয়ে কি তাহলে নিজেদের মত বেদ ভাষ্য প্রদান করেছেন? নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করার জন্য আমাদেরকে বলির পাঠা বানিয়েছেন। আমরা অজ্ঞ, বেদ সম্পর্কে বুঝি না। উনারা যা ভাষ্য করে গিয়েছেন তাই আমারা সত্য বলে মনে করি। কিন্তু নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে যেয়ে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ। কার ভাষ্য আমার অনুসরণ করব সায়ণাচার্যের নাকি দয়ানন্দ সরস্বতীর। উভয়ের অনুসারীদের মধ্যে যে যুদ্ধংদেহী ভাব তা আমাদেরকে ভীত করেছে, সন্ত্রস্ত করেছে। উভয় অনুসারীরা উদাহরণসহ বেদভাষ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন উনি এই ভুল করেছে আর উনি এই ভুল করেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই পথ নতুন যুগের নতুন চেতনা নিয়ে বিজ্ঞানমনষ্ক আধ্যাত্মিক মানুষের বড় প্রয়োজন। এখন না হোক ১০০ বছর পর হলে এটা হতে হবে। কারণ বিজ্ঞানের তাল মিলিয়ে সব কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে।
ReplyDeleteসায়নাচার্য নিজের সিদ্ধান্তের সাথেই স্ববিরোধ করেছেন। কিন্তু দয়ানন্দ সরস্বতীর বেদ ভাষ্যে এমন কিছু দেখাতে পারবেন?
Delete