স্বামী বিবেকানন্দ অফুরন্ত প্রেরণার উৎস
বিবেকানন্দ কত মহান ছিলেন, কত বড় সাধক ছিলেন, কত বড় তার দেশপ্রেম ছিল, জীবে তার কত দয়া ছিলো, সামাজিক কুসংস্কার দূর করাতে তার কত আগ্রহ ছিলো, জাতিভেদ বাল্যবিবাহ, সতীদাহ দূর করার জন্য সাধারণ মানুষের জন্য কত কাজ করেছেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে কত আগুন ঝরা বক্তৃতা দিয়েছেন ইত্যাদি। এ লেখাগুলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিবেকানন্দের বলা বহু ব্যবহারে জীর্ণ কিছু বাণীকে সামনে নিয়ে আসা হয় –
- জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
- খালি পেটে ধর্ম হয় না, ক্ষুধার্ত জনগণকে ধর্ম উপদেশ দেয়া অবমাননাকর।
- হে ভারত ভুলিও না মেথর, মুচি চণ্ডাল তোমার ভাই…
- ব্রিটিশ সভ্যতা তিনটি ব এর সমষ্টি – বাইবেল, বেয়নেট ও ব্র্যাণ্ডি।
- আমি সন্ন্যাসী, তাই জগতে নিজেকে প্রভু নয়, দাস বলেই মনে করি।
ইত্যাদি।
এ কথাগুলো শুনতে ভালই লাগে। মনে হয় কত মহৎ সব কথা। কিন্তু বার বার বহুভাবে চর্চিত বাণীগুলোর পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিবেকানন্দকে জানার জন্য তার রচনাবলীর দিকে সংশয়ী দৃষ্টি দিলেই জাগবে চোখ ধাঁধানো বিভ্রম। দেখা যাবে উপরে যে ভাল ভাল কথামালার লিস্টি ঝোলানো হয়েছে, প্রতিটি বানীরই ঠিক একশত আশি ডিগ্রী বিপরীত কথা আবার তিনিই বলে গেছেন। এক দিকে জীবপ্রেমের গান শুনাচ্ছেন তো অন্যদিকে নিজেই বরাহনগর মঠে পশুবলি প্রবর্তন করেছেন। একদিকে চণ্ডালদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তো অন্যদিকে আবার বলছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মনেরাই চরম আদর্শ’। একদিকে বাল্য বিবাহকে খারাপ বলছেন তো পর-মুহূর্তেই আবার বলছেন, ‘বাল্য বিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করেছে’। একবার কুসংস্কার দূর করার জিকির তুলছেন তো একই মুখে আবার জন্মান্তর, আত্মা আর জাতিভেদ জিইয়ে রাখার পক্ষে সাফাই গাইছেন। একবার নিজেকে সন্ন্যাসী বলে জাহির করেছেন তো আরেকবার ভোগ, বিলাস ব্যসনে আর রাজ রাজাদের গৃহে গিয়ে উদরপূর্তিতে অফুরন্ত সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু ভক্তকুলের নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় সেই বিপরীত কথাগুলো কিংবা তার স্ববিরোধী কাজগুলোকে সযত্নে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। ভক্তকুলের অহর্নিশি স্তব, ফুল চন্দন আর নানাবিধ প্রশংসায় বিবেকানন্দ এখন পরিণত হয়েছেন ‘যুগ নায়ক’-এ, ‘অফুরন্ত প্রেরণার উৎসে’ । কিন্তু যুগ-নায়কের হলুদ গৈরিক বসনের লেবাস একটু ঠ্যালা মেরে সরিয়ে দিলেই বের হয়ে পড়ে নানাধরনের ভণ্ডামি আর স্ববিরোধিতার নগ্ন-রূপ। বেরিয়ে পড়ে চালেডালে মেলানো মেশানো অদ্ভুত খিচুড়ি বিবেকানন্দের আসল স্বাদটুকু। কিন্তু এই খিচুড়ির পূর্ণাংগ রসালো স্বাদ পেতে চাইলে বিবেকানন্দকে খণ্ডিত-ভাবে না জেনে সামগ্রিকভাবে জানতে হবে, আগাগোড়া পড়তে হবে তার ‘বাণী ও রচনা’, ‘পত্রাবলী’, নিবেদিতার লেখা ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি বইগুলো। যারা স্তবের আলো থেকে সরে নির্মোহ ভাবে বিবেকানন্দকে জানতে চান, তারা সংগ্রহে রাখতে পারেন নিরঞ্জন ধরের লেখা ‘বিবেকানন্দ : অন্য চোখে’ (উৎস মানুষ সংকলন) বইটি কিংবা রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ : মুক্তমনের আলোয়’ (র্যাডিকাল প্রকাশনী, কলকাতা) বই দুটো। গোলাম আহমাদ মোর্তজার লেখা ‘বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’ (বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন) এবং প্রবীর ঘোষের অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড, দ্বে’জ প্রকাশনী) বইটিতেও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যাবে।
‘বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না’
উদ্ধৃতিটি রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, ৮৫ নং পৃষ্ঠায়।
রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘ভারতীয় নারী’ পুস্তিকায়। বিবেকানন্দ বলেছেন,
‘কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয়, কেননা বর্ণের নির্দেশ। মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়াই যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেয়া ভাল। যদি অল্প বয়সে বিবাহ না দিয়া ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে বাড়িতে দেয়া হয়, তবে তাহার এমন কাহারো প্রতি আসক্ত হইতে পারে, যাহাদের সহিত বিবাহ বর্ণ অনুমোদন করিবেন না। সুতরাং তাহাতে অনর্থের সৃষ্টি হইতে পারে। সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ হইলে, বালক-বালিকার ভালবাসা রূপ-গুণের উপর নির্ভর না করিয়া স্বাভাবিক হইবে’।
উক্তিটির স্বপক্ষে আরো একটি প্রমাণ আছে অনলাইনে অপার্থিবের ‘An Irreverent Look at Some of India’s Most Revered Figures’ নামের লেখাটিতে। অপার্থিব লিখেছেন,
On child marriage Vivekananda had contradictory views. He said “I hate child marriage very much” (In Bharotio Nari, published by Udbodhon Karjyaloy, p-90), while on page-15 he is quoted as saying “Sometimes children are married at early age, because that is mandated by the Varna. If one has to be married off without their opinion, they better be married in childhood before they develop any romantic feelings”
সহমরণের সমর্থনেও বিবেকানন্দের উক্তি আছে। যেমন, বিবেকানন্দ বলেছেন, ভারতীয় নারীদের কাউকেই পুড়িয়ে মারা হয় না, তারা সবাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই যে স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেন তার উল্লেখ আছে ইংরেজি বিবেকানন্দ রচনাবলীর ৬৬৮ পৃষ্ঠায়-
Widows are not burned on the funeral pyre of their husband unless it is a voluntary act of self-immolation (vol 9, page 668)
বিদ্রোহী নারী নয়, বরং পতিভক্তা সর্বংসহা সীতাই, যাকে রামচন্দ্র সতীর অনলে দগ্ধ করে কলঙ্কিত হয়েছিলেন, তাকেই বিবেকানন্দ আদর্শ নারী ভাবতেন, তার স্বপক্ষে অজস্র উদ্ধৃতি হাজির করা যায়। যেমন,
O India! Forget not that the ideal of thy womanhood is Sita, Savitri, Damayanti (Vol 4, page 395)
বাংলা –
‘হে ভারত ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী ও দয়মন্তি’।
Any attempt to modernize our women, if it tries to take our women away from that ideal of Sita, is immediately a failure, as we see every day. The women of India must grow and develop in the footprints of Sita, and that is the only way (Vol 3, Page 214).
বাংলা-
‘আমাদের নারীগণকে আধুনিক–ভাবে গড়িয়া তুলিবার যে সকল চেষ্টা হইতেছে সেইগুলির মধ্যে যদি সীতা–চরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। … ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই একমাত্র উন্নতির পথ’।
Sita is the ideal of a woman in India … (Vol 9, Page 345)
‘জীবে প্রেম করে যেই জন’ বনাম পশুবলি
বিবেকানন্দকে নিয়ে আমার খটকার সূচনাটা হয়েছিলো প্রবীর ঘোষের অলৌকিক নয় লৌকিক বইটির (প্রথম পর্ব) মাধ্যমেই। একটি বই মানুষের জীবনকে কতভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ ছিল আমার জীবনে এই বইটি। ছেলেবেলায় এই বইটি পড়া না হয়ে উঠলে আমি এই আজকের আমি হয়ে উঠতাম কীনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে আমার। অলৌকিকতা, পারলৌকিকতা আর যাবতীয় ভাঁওতাবাজির গোমড় ফাঁস করার ব্যাপারগুলো তো আছেই, সেই সাথে প্রবীর ঘোষ আরেকটা বড় ব্যাপার করেছিলেন এ বইটির মাধ্যমে। মহাপুরুষ কিংবা মহামানব বলে কথিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার দিক সামনে নিয়ে এসেছিলেন, ভেঙ্গে ফেলেছিলেন সেই চিরন্তন মিথটি – মহাপুরুষ হলেই তাকে দেবতা বানিয়ে একেবারে মাথায় করে রাখতে হবে! প্রবীর ঘোষের ‘মিথ ব্লাস্টার’ তালিকায় ছিলেন রামকৃষ্ণ, ঋষি অরবিন্দ, সত্যেন বোস, অনুকূল চন্দ্র, গান্ধী সহ অনেকেরই অতিরঞ্জিত মিথ[1]। স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন তার সমালোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে। যেমন, বিবেকানন্দ রচনাবলী (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক নবপত্র, পৃঃ২৬৪ ) থেকে উদ্ধৃত করে প্রবীর ঘোষ দিয়েছেন বিবেকানন্দের অবৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভট চিন্তার উদাহরণ – অন্ধকার ঘরে ইস্পাতের পাতের উপর শক্তি প্রয়োগ করলে নাকি পাতটা চৈতন্য বা মনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। প্রবীর ঘোষ লিখেছেন [2]–
“একটি ইস্পাতের পাত গড়ে, তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে তুমি প্রথমে শুনতে পাবে একটি শব্দ – একটি গুন গুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরো বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।”কি, এই কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না? একটা ইস্পাতের পাত নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেই তো পারেন। মনে রূপান্তরিত হয়েছে কিনা কি করে বুঝবেন? কেন ই.সি.জি মেশিনের সাহায্যে।পরীক্ষায় ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হচ্ছে না? অদৃশ্য হচ্ছে না? উল্টো-পাল্টা বিজ্ঞানবিরোধী আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছি বলছেন? আমাকে এর জন্য ধিক্কার দেবেন নাকি? একটু থামুন। শুনুন, এমন একটা তথ্যের বা তত্ত্বের জন্য প্রশংসা বা নিন্দা কোন কিছুই আমার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য বিবেকানন্দের। বিবেকানন্দ রচনাসমগ্রের উল্লেখিত বইটির ২৬৪ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দের বক্তব্য হিসেবেই এমন উদ্ভট কথা লেখা হয়েছে।
সেই থেকে শুরু। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বামীজী বিজ্ঞান হয়তো ভাল জানতেন না, তাই দু-এক জায়গায় হয়তো উল্টো-পাল্টা কিছু লিখেছেন। সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যাপারগুলোতে নিশ্চয় এমনতর গুবলেট করেননি। তারপরও এক ধরণের সংশয়ী মন নিয়েই বিবেকানন্দ পড়া এবং জানার চেষ্টা করলাম। প্রথমে পড়লাম বিবেকানন্দ সমগ্র, এরপরে পড়লাম আরো আনুষঙ্গিক বইপত্র। এই অযাচিত আগ্রহ আর বেত্তমিজির ফল খুব একটা সুখপ্রদ হল না; যা বেড়িয়ে এলো তা রীতিমত চমক! স্তব আর মোহের স্তর সরিয়ে যে বিবেকানন্দকে আমি খুঁজে পেলাম, তিনি আগা-পাশ-তলা আদ্যোপান্ত এক স্ববিরোধী বিবেকানন্দ। এ নিয়ে আগে কারো কারো সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে মন্তব্য আকারে কিছু লিখেছিলাম (যেমন এখানে কিংবা এখানে), তবে পূর্ণাঙ্গ আকারে বাংলায় কিছু লেখা হয়নি। আমার আজকের এই প্রবন্ধে খণ্ডিত নয়, পূর্নাঙ্গ ভাবে স্বামী বিবেকানন্দকে দেখবার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হল।
জীব প্রেম নিয়ে স্বামীজীর অমিয় বাণীটির কথা আমরা সবাই জানি। স্বামীজী বলেছেন –
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বরজীবে প্রেম করে যেই জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।
ভাল কথা। কিন্তু আমি ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম, এই বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে ১৮৮৬ সালে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ‘বরাহনগর মঠে’র প্রতিষ্ঠার পরে সেখানে মহা উৎসাহে পশুবলি পবর্তন করেছিলেন। অধিকাংশ গুরুভাইদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সর্বদাই দেবী পূজায় পশুবলির ব্যবস্থা রাখতেন। এমনকি বেলুড়মঠের দুর্গাপূজাতেও তিনি পাঁঠাবলি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার গুরু রামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা দেবী আপত্তি করলে তিনি তা করতে পারেননি[3]। কিন্তু বেলুড় মঠে করতে না পারলেও কালিঘাট থেকে বলি দিয়ে পাঁঠা নিয়ে এসে ভোজনের আয়োজন করতেন। পরবর্তী জীবনে আমরা আরো দেখি তার ইংরেজ শিষ্য নিবেদিতাকে দিয়ে বিভিন্ন জনসভায় পশুবলির সমর্থনে বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন[4]। বিবেকানন্দের জীবপ্রেমের কি অত্যাশ্চর্য নমুনা! একজন বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী হিসেবে সমগ্র জীবজগতকে ভালবাসার উপদেশের সাথে পশুবলি একেবারে অসঙ্গতিহীন, তা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে। শুধু তাই নয়, বিবেকানন্দ বললেন[5] –
আরে একটা পাঁঠা কী, যদি মানুষ বলি দিলে যদি ভগবান পাওয়া যায়, তাই করতে আমি রাজি আছি।
(উক্তিটি পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির ঘটনাবলী(প্রথম খণ্ড)-এর ৯৬ পৃষ্ঠায়। অন্য অনেক লেখকই উদ্ধৃতিটি হুবহু ব্যবহার করেছেন তাঁদের বইয়ে একই রেফারেন্স দিয়ে)
অর্থাৎ কল্পিত ভগবানকে পাওয়ার জন্য দরকার হলে মানুষকে পর্যন্ত বিবেকানন্দ বলি দেবেন! এই না হলে ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’।
বিবেকানন্দের নারী ভাবনা : বিধবা-বিয়ে বিরোধিতা এবং বাল্য বিবাহ আর সহমরণ সমর্থন
বাল্যবিবাহ নিয়ে বিবেকানন্দের দড়ি টানাটানির নমুনা আরো এককাঠি মজাদার। বিবেকানন্দের একটি উক্তিকে খুব বড়াই করে সামনে নিয়ে আসেন বিবেকানন্দ ভক্তরা[6] – ” বাল্যবিবাহের উপর আমার প্রবল ঘৃণা।”
এমনকি বিবেকানন্দ এও বলেছেন[7], “বাল্যবিবাহ দেয় এমন মানুষকে খুন পর্যন্ত করতে পারি”।
অথচ, সেই বিবেকানন্দই আবার আরেক জায়গায় গণেশ উল্টিয়ে দিয়ে বলেছেন[8]–
‘বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে’।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিয়ে দিয়ে হিন্দুদের কুসংস্কার দূর করাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন, তখন বিবেকানন্দ শোনাচ্ছেন অন্য কথা, অন্য গান[9] -‘ বিধবাদের পুনর্বিবাহ দিলে কুমারী মেয়েদের ভাগ্যে স্বামী কম পড়ে যাবে’, এবং ‘বিধবাগনের স্বামী সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না’; এবং এও বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ আন্দোলনে শতকরা সত্তর জন ভারতীয় নারীর কোন স্বার্থই নাই’।
এ জায়গায় পাশ্চাত্য মেয়েদের প্রশংসা করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বলছেন[10],
‘এ দেশের (আমেরিকা) স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখিনি … এরা কেমন স্বাধীন। এদের মেয়েরা কি পবিত্র। ২৫-৩০ বছরের কমে কারুর বিয়ে হয় না। আর আমরা কি করি? আমার মেয়ের ১১ বৎসরে ‘বে’ না হলে খারাপ হয়ে যাবে! আমরা কি মানুষ?’
আবার পরক্ষণেই ভারতীয় মেয়েদের আকাশে তুলে আর পাশ্চাত্যের মেয়েদের যা-তা বিশেষণে বিশেষিত করে লিখেছেন[11],
ওদেশে (পাশ্চাত্যে) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হত না – ঠিক যেন পুরুষ মানুষ। গাড়ী চালাচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, প্রফেসরি করছে। একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা, বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায়।
বাল্যবিবাহ যে আসলে ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘কত ভাল’, তা আমরা প্রত্যক্ষ করি বিবেকানন্দের নানা কুসংসারাচ্ছন্ন উক্তিতে, যেখানে তিনি বলছেন ‘প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হইবার পূর্বে বাল্যকালে’ বিয়ে দেয়া ভাল হবে, নইলে হবে ঘোর ‘অনর্থ’ [12] –
কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয়, কেননা বর্ণের নির্দেশ। মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়াই যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেয়া ভাল। যদি অল্প বয়সে বিবাহ না দিয়া ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে বাড়িতে দেয়া হয়, তবে তাহার এমন কাহারো প্রতি আসক্ত হইতে পারে, যাহাদের সহিত বিবাহ বর্ণ অনুমোদন করিবেন না। সুতরাং তাহাতে অনর্থের সৃষ্টি হইতে পারে। সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ হইলে, বালক-বালিকার ভালবাসা রূপ-গুণের উপর নির্ভর না করিয়া স্বাভাবিক হইবে।
‘প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে’ বিয়ে দেয়ার পরামর্শটা বিবেকানন্দের কোন হাল্কাচালে করা আপ্তবাক্য ছিলো না, ছিল চিন্তাশীল বাক্যই। আসলে মানুষের স্বাভাবিক প্রেম ভালবাসা নিয়ে তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় শুচিবায়ুগ্রস্ত। তিনি মনে করতেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কেউ বিয়ে করলে তার সন্তান নাকি হবে আসুরিক বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। তিনি বলেছেন[13],
“যদি কাউকে ইচ্ছেমত পতি বা পত্নীরূপে গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ এবং পাশবপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির চেষ্টা সমাজে বিস্তার লাভ করে, তার ফল নিশ্চয় অশুভ হবে- দুষ্টপ্রকৃতি, অসুর ভাবের সন্তান জন্মাবে।”
কাজেই যে স্বাধীনচেতা ছেলে মেয়েরা ইচ্ছেমত প্রেম ভালবাসা আর ডেট-এর মাধ্যমে প্রণয় কিংবা বিয়ের জন্য সঙ্গি খুঁজে নিচ্ছেন, তাঁদের এখন থেকেই আসুরিক সন্তানের আশঙ্কায় অপকর্ম থেকে নিবৃত হওয়া উচিৎ, কী বলেন।
আসলে প্রেম ভালবাসা বিয়ে প্রভৃতি নিয়ে কোন যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেকানন্দের মধ্যে কখনোই গড়ে উঠেনি। তিনি নিজে ছিলেন চিরকুমার, আজীবন বিয়ে-থা করেননি। নিজে তো বিয়ে করেননিই, অন্যদের বিয়ে করতে দেখলেও তার মেজাজ বিগড়ে যেত। এমনকি নিজের ভাই মহেন্দ্রনাথের বিয়ের যখন কথা চলছিল, তিনি এমন রেগে গিয়েছিলেন যে, বলেছিলেন তার সাথে কোন সংশ্রব রাখবেন না। তার উক্তিতেই[14] –
“এ বিষয়ে আমার একটিমাত্র সিদ্ধান্ত থাকিতে পারে – নিন্দা! বালক-বালিকা-যাহারাই হউক না কেন, আমি বিবাহের নাম পর্যন্ত ঘৃণা করি। তুমি কি বলিতে চাও আমি, আমি একজনের বন্ধনে সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন (মহেন্দ্রনাথ) আজ বিয়ে করে, আমি তার সাথে কোন সংস্রব রাখব না। এ বিষয়ে আমি স্থির সংকল্প। ”
আরেকবার বিবাহোন্মুখ মাদ্রাজীদের সম্পর্কে অযথাই ‘যোনিকীট’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন, আর তাঁদের বিয়েকে তুলনা করেছিলেন বেশ্যালয়ে গমনের সাথে এভাবে[15] –
“মাদ্রাজীরা অপেক্ষাকৃত চটপটে ও দৃঢ়তা সহকারে একটা বিষয়ে লাগিয়া থাকিতে পারে বটে। কিন্তু হতভাগাগুলো সকলেই বিবাহিত। বিবাহ! বিবাহ! বিবাহ! পাষণ্ডেরা যেন ঐ একটা কামেন্দ্রিয় লইয়া জন্মাইয়াছে – যোনিকীট – এদিকে আবার নিজেদের ধার্মিক এবং সনাতন পন্থাবলম্বী বলিয়া পরিচয়টুকু দেয়া আছে। অনাসক্ত গৃহস্থ হওয়া অটি উত্তম কথা, কিন্তু উহার ততটা প্রয়োজন নাই, চাই এখন অবিবাহিত জীবন! যাক, বলাই! বেশ্যালয়ে গমন করিলে লোকের মনে ইন্দ্রিয়াসক্তির যতটা বন্ধন উপস্থিত হয়, আজকালকার বিবাহ প্রথায় ছেলেদের ঐ বিষয়ে প্রায় তদ্রূপ বন্ধনই উপস্থিত হয়। এ আমি বড় শক্ত কথা বলিলাম।”
প্রেম ভালবাসা বিয়ে নিয়ে বিবেকানন্দের এই বিকৃত মনোভাবের কারণ যে কী এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার ধারণা এর পেছনে তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রলাপের কিছুটা হলেও প্রভাব আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক অশিক্ষিত, মূলতঃ মানসিক বিকারগ্রস্ত এক সাধক, যাকে নিয়ে ভারতবাসীরা এখনো যার পর নাই গর্বিত। এই প্রায়-অর্ধোন্মাদ সাধক বলতেন তিনি সাধনায় মা কালীর সাথে এক্কা দোক্কা খেলেন; সাধনা করতে করতে প্রায়ই মূর্ছা যেতেন তিনি। আজকের দিন হলে তাকে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে হিস্টিরিয়ার চিকিৎসা করা হত নিঃসন্দেহে। তার আধ্যাত্মিকতা কিংবা অসুস্থতা – কোনটা নিয়েই আমার অবশ্য কোন আগ্রহ নেই। আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। নারী সম্পর্কে তার মনোভাব ছিলো খুবই সনাতন। নারীকে তিনি মনে করতেন ‘নরকের দ্বার’[16] –
‘কামিনী নরকস্য দ্বারম্। যত লোক স্ত্রী লোকের বশ’।
নারী সম্বন্ধে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের আরো কিছু ‘কথামৃত’ শ্রবণ করা যাক[17] –
- মেয়ে মানুষের কাছে খুব সাবধান হ’তে হয়। মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে।
- আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে। আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি! সব রাক্ষসীর মত দেখি।
- মেয়ে মানুষের শরীরে কি আছে – রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মূত্র, বিষ্ঠা এই সব। সেই শরীরের উপর ভালবাসা কেন?
- দেখ না, মেয়ে মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিনী মেয়েদের! পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ এক সঙ্গে ব’সে আছে, তখন বলি, আহা! এরা গেছে।
- হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশীক্ষণ কাছে বসতে দেই না। একটু পরে হয় বলি – ‘ঠাকুর দেখো গে যাও’; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
- যদি স্ত্রীলোক ভক্তিতে গড়াগড়ি যায়, তবুও তার কাছে যাতায়াত করবে না।
- মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকলেই তাঁদের বশ হয়ে যেতে হয়।
- মেয়ে ভক্তদের গোপাল ভাব- ‘বাৎসল্য ভাব’ বেশি ভাল নয়। ঐ ‘বাৎসল্য’ থেকেই আবার একদিন ‘তাচ্ছল্য’ হয়।
- মেয়ে মানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাঁদের হাওয়া গায় লাগে।
আমি নিশ্চিত কেউ যদি আজকে এই বাক্যগুলো লিখতেন কিংবা বলতেন তাকে পাগল ঠাউরিয়ে হেমায়েতপুরে পাঠানোর সকল ব্যবস্থা করা হত। অথচ হিন্দু ধর্মের গর্বে গর্বীরা তাঁকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সাধকের সম্মান। অশিক্ষিত এই সাধককে নিয়ে অতি সুশিক্ষিতরাও হয়ে পড়েন হতবিহবল; বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিশাল মর্মরমূর্তি গড়ে চলে ধুম ধারাক্কা পূজা-অর্চনার যাবতীয় আয়োজন।
চিত্র- বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মর্মরমূর্তি
রামকৃষ্ণ মনেই করতেন, মেয়েদের লজ্জাই হওয়া উচিৎ একমাত্র ভূষণ। আরো বলতেন, ভাল মেয়ে সেই, যার কাম ক্রোধ ঘুম এসব কম, আর স্নেহ, মায়া লজ্জা এসব বেশি থাকে। একবার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গৃহীভক্ত শ্রী মহেন্দ্র গুপ্তের বাড়ির নয়-দশ বছরের দুটি মেয়ে এসে একবার রামকৃষ্ণকে দুটো ভক্তি-গীতি শুনিয়েছিলেন। সেই গান শুনে ঠাকুর বড়ই আনন্দিত হন। তারপর আরেকদিন সেই মেয়ে দুটো কাশীপুর বাগানে ঠাকুরকে গান শোনানোর সময় ভক্তরাও সেটা শুনে ফেলে, আর তাঁদের ডেকে নিয়ে তারাও গান শোনে। তখন শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার মেয়েদের আর গান শিখিও না। যার তার কাছে গাইলে লজ্জা ভেঙ্গে যায়। লজ্জা মেয়েদের বড় দরকার’।
লজ্জা যে মেয়েদের খুবই দরকার, আর গান গাওয়া কিংবা মঞ্চে ওঠা মেয়েদের যে লজ্জা ফজ্জা থাকে না, তারা যে খারাপ মেয়ে – এই মানসিকতা শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্তরা আজো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন তাঁদের মননে এবং আচরণে। একটা উদাহরণ দেই। ১৯৯৪ সালের দৈনিক আজকালের একটা খবর থেকে জানা যায়, বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ‘লোককৃষ্টি’ নামের একটি নাটকের দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি। কারণ – ঐ দলে কিছু নারী শিল্পী ছিলেন। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিতর্ক শুরু হলে মিশনের প্রধান জানান[18],
‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কোন অনুষ্ঠানে মহিলারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেন না। ১৮৯৭ সালে স্বামীজি যখন বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখন থেকেই এই ঐতিহ্য এবং ভাবধারা বহমান। বেলুড় মঠের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ভাবধারা মেনেই ঐ অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি’।
মিশনের প্রধান ভুল কিছু বলেননি। তিনি নিয়মনিষ্ঠ ভাবে রামকৃষ্ণের সেই ‘নারীরা নরকের দ্বার’ নামক ঐতিহ্যই অনুসরণ করেছেন। আসলে নারীদের নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা আর যৌন-ভীতি ছিলো। তিনি সকল স্ত্রী লোককে নাকি ‘মা হিসেবে’ দেখতেন- এমনকি তার নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকেও। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীকে একটা সময় পরে তিনি ‘ভাই বোনের’ মত থাকার পরামর্শ দিতেন –
‘স্ত্রী লোক কিরূপ জান? যেমন, আচার তেঁতুল। মনে করলে মুখে জল সরে। আচার তেঁতুল সম্মুখে আনতে হয় না। … আপনারা যতদূর পার স্ত্রীলোকের সাথে অনাসক্ত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে নির্জন স্থানে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করবে। সেখানে যেন ওরা কেউ না থাকে। ঈশ্বরেতে বিশ্বাস ভক্তি এলে অনেকটা অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারবে। দু-একটি ছেলে হলে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনে ভাইবোনের মত থাকবে। আর ঈশ্বরকে সর্বদা প্রার্থনা করবে, যাতে ইন্দ্রিয় সুখেতে মন না যায়, ছেলেপুলে আর না হয়’।
নিজের স্ত্রীকে মা ডাকা, বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীদের ভাই-বোনের মত থাকার পরামর্শ দেয়া – এই নির্বোধ পাগলামি মনে হয় কেবল রামকৃষ্ণের পক্ষেই সম্ভব। তার পক্ষেই বলা সম্ভব – ‘যে বীরপুরুষ, সে রমণীর সাথে থাকে, না করে রমণ’। এটা নিঃসন্দেহ যে, রামকৃষ্ণের জীবন-চর্চায় যারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার বাণী অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন, তাঁদের সুস্থ স্বাভাবিক যৌন-জীবন ব্যহত হতে বাধ্য। এর কোন ব্যত্যয় নেই। রামকৃষ্ণের অন্ধ-স্তাবকেরা অবশ্য মিন মিন করে বলার চেষ্টা করেন – ‘আচার-তেঁতুল’ বলে নারীসঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারটা কিংবা রমণ না করার মত উক্তিগুলো নাকি কেবল সন্ন্যাসীদের কথা মাথায় রেখে বলেছেন, সংসারী মানুষের জন্য নয়। এটা ভুল ব্যাখ্যা। ‘যে বীরপুরুষ, সে রমণীর সাথে থাকে, না করে রমণ’ – রামকৃষ্ণের এই নির্দেশ কোন সন্ন্যাসীর প্রতি ছিলো না, ছিলো তার অন্যতম গৃহীভক্ত ভবনাথের প্রতি[19]। তার অপর এক গৃহীভক্ত বিনোদকে রামকৃষ্ণ স্ত্রীর সাথে না শুতে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন[20] –‘ দেখো, সঙ্গ হোক, আর না হোক, একসাথে শোয়াও খারাপ। গায়ের ঘর্ষণ, গায়ের গরম’। আজকের দিনের স্বামীরা রামকৃষ্ণের এই উপদেশগুলো মানলে তাঁদের সংসারে কী বিপত্তি নেমে আসবে, তা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে।
নারীদের নিয়ে নিজের মনেই এক ধরণের যৌন-ভীতি তৈরি করে অস্বাভাবিক উপায়ে কাম জয়ের চেষ্টা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ যে সফল হননি, তা বলাই বাহুল্য। তার স্বীকৃতি মেলে তার নিজের করা উক্তিতেই[21] –
‘ওরে ভগবদ্দর্শন না হলে কাম একেবারে যায় না। তা (ভগবানের দর্শন) হলেও শরীর যতদিন থাকে ততদিন একটু-আধটু থাকে, তবে মাথা তুলতে পারে না। তুই কি মনে করিস, আমারই একেবারে গেছে? একসময় মনে হয়েছিল কামটাকে জয় করেছি। তারপর পঞ্চবটিতে বসে আছি।, আর ওমনি কামের এমন তোড় এলো যে আর যেন সামলাতে পারিনি! তারপর ধুলোয় মুখ ঘষড়ে কাঁদি আর মাকে বলি – মা , বড় অন্যায় করেছি আর কখনো ভাবব না যে কাম জয় করেছি-’
কাম জয়ের চেষ্টায় সফল না হলেও, অস্বাভাবিক উপায়ে কাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার ফলে তার মনে তৈরি হয় নারী আর কাম নিয়ে নানা মানসিক বিকারগ্রস্থতা। এ জন্যই তিনি সারদামনির সাথে কোন সুস্থ যৌনসম্পর্ক কখনোই গড়ে তুলতে পারেননি। দক্ষিণেশ্বরে এ প্রায় ৮ মাস এক শয্যায় শয়ন করার পরেও স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক করতে পারেননি, বরং ‘ঠাকুর শ্রী শ্রী মাতাঠাকুরাণীর অঙ্গ স্পর্শ করতে উদ্যত হইবামাত্র মন কুণ্ঠিত হইয়া সহসা সমাধিপথে এমন বিলীন হইয়া গেল যে, সে রাত্রিতে উহা আর সাধারণ ভাবভূমিতে অবরোহণ করিল না … দেহবোধ বিরহিত ঠাকুরের প্রায় সমস্ত রাত্রি এইকালে সমাধিতে অতিবাহিত হইত’[22]। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আর মনস্তত্ত্বের নিরিখে বিচার করলে এই যৌন-ভীতি থেকে উদ্গত সমাধিকালকে ‘কনভারশন হিস্টিরিয়া’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না[23]। যৌনতা সংক্রান্ত মানসিক নানা টানাপোড়নের ফলে তিনি দেহবোধ বিরহিত শারীরিকভাবে অক্ষম এক পুরুষে পরিণত হন, আর তা ঢাকতে নিজের স্ত্রীকে মা ডাকা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে তোলা সহ নানা আজগুবি ধ্যান-ধারনার উন্মেষ ঘটান আর তার শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হন।
যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে গুরু এবং আদর্শ হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে গুরুর আদর্শ দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প হাতে তুলে নিয়েছেন, সেই বিবেকানন্দ মনে প্রাণে আর কতটুকুই বা ব্যতিক্রম হবেন? তারপরেও বিবেকানন্দ যে নারীদের নিয়ে ভাল কথা বলেননি তা নয়। বিপ্লব পাল সম্প্রতি মুক্তমনায় প্রকাশিত তার একটি লেখায় স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজিতে করা কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন[24] –
“The best thermometer to the progress of a nation is its treatment of its women.”” There is no chance for the welfare of the world unless the condition of women is improved.”“Woman has suffered for aeons, and that has given her infinite patience and infinite perseverance.”“The idea of perfect womanhood is perfect independence.”
বিবেকানন্দের বলা এই ‘perfect independence’ যে তিনি নারী স্বাধীনতার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব, তা স্পষ্ট করেছেন আরো অনেক উদ্ধৃতিতেই –
‘বিকশিত হবার প্রথম শর্তই হল স্বাধীনতা। এটা খুবই অন্যায়, সহস্রবার অন্যায়, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ এ কথা বলার দুঃসাহস রাখে যে, আমি নারী এবং শিশুর মুক্তিসাধন করব’।
তিনি মেয়েদের শিক্ষিত হবার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, মেয়েদের সমস্যা বিষয়ে বলবার অধিকার পুরুষের নয়, কেবল নারীদের হাতেই সেটা থাকা উচিৎ তার ইঙ্গিত করেও বলেছেন –
‘প্রথমে তোমাদের নারী জাতিকে শিক্ষিত করে তুলে তাদের ব্যাপার তাঁদের উপরেই ছেড়ে দাও; তখন তারাই তোমাদেরকে বলবে তাঁদের জন্য কোন কোন সংস্কার প্রয়োজন। তাদের ব্যাপারে তোমরা মাথা গলাবার কে?’।
এই উক্তিগুলো পড়ে বিবেকানন্দকে খুব প্রগতিশীল, নারী স্বাধীনতার ‘অগ্রদূত’ টাইপ বলে কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু সেই ইমেজ পরক্ষণেই ধূলিস্ম্যাৎ হয়ে যায়, যখন আমরা শুনি, বিবেকানন্দই আবার অন্য মুখে বলছেন[25] –
‘হে ভারত ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী ও দয়মন্তি’।
যে স্বামীজী নারী স্বাধীনতার জন্য এতো অন্তপ্রাণ, তিনিই আবার সীতার মত পতিব্রতা হয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন; সীতা, সাবিত্রী দয়মন্তিদের আদর্শ মেনে চলার জন্য মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি বলছেন[26],
‘আমাদের নারীগণকে আধুনিক-ভাবে গড়িয়া তুলিবার যে সকল চেষ্টা হইতেছে সেইগুলির মধ্যে যদি সীতা-চরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। … ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই একমাত্র উন্নতির পথ’।
সীতার মত পতিব্রতা নারী স্বামিজীর পছন্দ ছিল বলেই কীনা জানিনা, সতীদাহ কিংবা সহমরণের মত ঘৃণ্য প্রথাকেও তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্থন করেছেন । সতীর আদর্শকে মহান প্রতিপন্ন করতে গিয়ে বলেছেন[27] –
এই আদর্শের চরম অবস্থায় হিন্দু বিধবারা সহমরণে দগ্ধ হতেন।
সহমরণের সমর্থনে তার আরো অনেক সুস্পষ্ট উদ্ধৃতিই হাজির করা যাবে। যেমন[28] –
‘প্রথমে সেই ভাবটাই উস্কে দিয়ে তাঁদের (হিন্দু নারীদের) character form করতে হবে – যাতে তাঁদের বিবাহ হোক বা কুমারী থাকুক, সকল অবস্থাতেই সতীত্বের জন্য প্রাণ দিতে কাতর না হয়। কোন একটা ভাবের জন্য প্রাণ দিতে পারাটা কি কম বীরত্ব?’
স্বামী বিবেকানন্দ যে সহমরণ সমর্থন করতেন, তা ভগ্নি নিবেদিতার ভাষ্যেও স্পষ্ট হয়[29] –
‘জগতের চোখে সহমরণ এত বড় প্রথা কেন – কারণ ওতে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়’।
স্বামীজি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরের বিধবা বিয়ে নিয়েও ছিলেন দারুণ বিরূপ। ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ায় ভারতের নারীদের নিয়ে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, যেহেতু পুরুষের চেয়ে নারীরা সংখ্যায় বেশি, সেহেতু বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হলে নাকি ‘কুমারী মেয়েদের স্বামী মিলবে না’।
স্বামীজির এই সারবত্তাহীন বক্তব্য জাকির নায়েকের ‘জোকারি মূলক’ উক্তির সমতুল্য, যেখানে তিনি পুরুষের বহুবিবাহকে বৈধতা দিতে চান পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাধিক্য টেনে এনে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই সত্য নয়। সারা পৃথিবীতে নারী এবং পুরুষের অনুপাত হল ১ :১.০১ । পুরুষেরাই বরং সামান্য হলেও সংখ্যায় অধিক। এমনকি ভারতের ক্ষেত্রেও স্বামীজির বক্তব্য যে অসার তা দৈনিক আজকালে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সম্পাদিকা সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালের ৮ ই এপ্রিল[30] (সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ নির্মোহ চিঠিকে এবং তার পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদী পাঠকদের জবাবকে কেন্দ্র করে দৈনিক আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিলো, যেগুলো পরবর্তীতে সংকলিত হয়েছে রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ : মুক্ত মনের আলোয়’ শীর্ষক গ্রন্থে। উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন)-
‘১৯০১ সালের সেন্সাস অনুজায়ই ভারতীয় নারী-পুরুষের অনুপাত হল ৯৭২ : ১০০০। অর্থাৎ, প্রতি একহাজার জন পুরুষ পিছু ৯৭২ জন নারী। সুতরাং স্বামীজি তার স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারী পরিসংখ্যানকে শুধু বিকৃত করেননি, বিদ্যাসাগরের মত একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’কেও অস্বীকার করেছেন’।
আসলে স্বামীজি হিন্দু ধর্মের কোনরূপ সংস্কারের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, তা সে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন হোক কিংবা হোক জাতিভেদ প্রথার বিলোপসাধন। আমরা সেটা আরো ভাল করে বুঝতে পারব এই প্রবন্ধের পরবর্তী ‘সমাজ সংস্কারক নাকি প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দ?’ অংশে। কিন্তু তার আগে সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের ভোগ বিলাস নেয়েও একটু জানা দরকার।
‘সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দের ভোগ বিলাস আর জিহ্বা লাম্পট্য
বিবেকানন্দ সমালোচক যুক্তিবাদী নিরঞ্জন ধর ‘বিবেকানন্দ: অন্য চোখে’ গ্রন্থে বিবেকানন্দের সন্ন্যাস গ্রহণ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন- ‘বিবেকানন্দ স্বভাব সন্ন্যাসী ছিলেন না, ছিলেন অভাব সন্ন্যাসী’[31]। কথাটা ঠিকই। তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সন্ন্যাস জীবনের মাহাত্ম্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ন্যাসী হননি, তিনি হয়েছিলেন অভাবের তাড়নায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একে বলতেন ‘পেট বৈরাগী’। সেজন্যই তার সন্ন্যাস জীবনের লেবাস ভেদ করে মাঝেমধ্যেই উঁকি দিতো উদগ্র লোভাতুর গৃহী রূপটিও। শুধু তার সন্ন্যাস গ্রহণ নয়, পরবর্তী কালে শিকাগো ভ্রমণ সহ যাবতীয় যশ খ্যাতি সবই ছিলো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মিলনের জন্য তৈরি বিবেকানন্দ এমনি এমনি রেডিমেড পয়দা হয়নি, নরেন্দ্রনাথকে বিবেকানন্দ বানিয়েছিলেন রাজস্থানের খেতরি মহারাজা অজিত সিংহ। সে সময়টা অখ্যাত এই নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দের আসল নাম) তখন পরিচিত ছিলেন ‘বিবিদিষানন্দ’ এবং ‘সচ্চিনানন্দ’ নামে। ১৮৯১ সালের জুন মাসে মাউন্ট আবুতে খেতরি রাজার সাথে আলাপ হয় এবং তিনি সেখানে ৬ মাস থেকে যান। খেতরি রাজার কোন পুত্র ছিল না। স্বামীজি ‘হুজুর সাইদাবাদী’ মার্কা কিছু পানি পড়া দিলেন (ডিটেল না হয় নাই বা বললাম) মনে হয় সেখানে, ফলে মহারাজা এক পুত্রসন্তান লাভ করলেন। পুত্র দেখতে শুনতে বিবেকানন্দর মতো হয়েছিলো কীনা তা আমার জানা নেই, কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় এর পর থেকেই মহারাজার সাথে বিবেকানন্দের এক ‘স্পেশাল’ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৮৯৩ সালে শিকাগো যাত্রার আগে আবার তিনি সেখানে যান। মহারাজা তাকে ৩০০০ টাকা দেন যাত্রার খরচ বাবদ; শুধু তাই নয় যে পোশাক পরা বিবেকানন্দের ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত, সেই পোশাকও তাকে দিয়েছিলেন অজিত সিংহ, দেখিয়ে দেন কিভাবে এই পোশাক পরতে হয়। সেই সাথে তার নতুন নামকরণ করেন ‘বিবেকানন্দ’[32]!
এই অজিত সিং এর সাথে স্বামীজির সম্পর্ক এতোটাই ‘স্পেশাল’ ছিলো যে, সেটাকে বিবেকানন্দ নিজের পরিবারের স্বার্থে কাজে লাগাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের আগে তিনি মা এবং ভাইদের ভরণপোষণের জন্য তিনি মহারাজকে দিয়ে একশত টাকার এক মাসিক ভাতা মঞ্জুর করতে রাজি করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন নরেন্দ্রনাথের মা ভুবনেশ্বরী দেবী বেঁচে ছিলেন) নিয়মিত এই টাকা দিয়ে এসেছেন অজিত সিংহ। শুধু তাই নয় ১৮৯৮ সালে আবার স্বামীজির অনুরোধে মহারাজ স্বামীজির ব্যক্তিগত খরচের জন্য তাঁকে আরো একশ টাকা ভাতা মঞ্জুর করেন।
তিনি বরাবরই এ ধরণের দেশীয় রাজা-মহারাজদের আথিত্য গ্রহণে অতিশয় ঔৎসুক্য দেখিয়েছেন। তিনি সুযোগ পেলেই রাজাদের রাজপ্রাসাদে বাস করতেন, রাজাদের সাথে খানাপিনা করতেন। বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর বিবেকানন্দের সম্মাননার আয়োজন করেন রামনাদের রাজা, মহীশুরের মহারাজা এবং পোরবন্দরের দেওয়ান। ভারত ভ্রমণে বেড়িয়েও তিনি অধিকাংশ সময় রাজ রাজড়াদের বাসস্থানেই উঠতেন। এ প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধর লিখেছেন –
‘… উক্ত রাজ্যসমূহের প্রায় সর্বত্রই বিবেকানন্দ তাঁদের রাজা বা রাজ্যের দেওয়ানদের আতিথ্য নিতেন এবং সেই রাজ্য ছেড়ে যাবার সময় নৃপতি বা দেওয়ানদের আতিথ্য নিতেন এবং সেই রাজ্য ছেড়ে যাবার সময় নৃপতি বা দেওয়ানদের কাছ থেকে পরবর্তী উদ্দিষ্ট শাসক, দেওয়ান বা উচ্চ-কর্মচারীর নামে পরিচয়পত্র নিয়ে যাত্রা করতেন। সন্ন্যাস জীবনের যে সর্বজন স্বীকৃত আদর্শ, তার সঙ্গে রাজা-গজাদের আতিথ্যের জন্য এতোখানি লালায়িত হওয়ার সামঞ্জস্য পাওয়া দুষ্কর’।
রাজ রাজড়াদের সাথে ‘সন্ন্যাসী’ স্বামীজির অন্তরঙ্গতা স্বামীজীর জীবদ্দশাতেই গৃহী গুরুভাইদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। দেশের বিত্তশালী অংশের সাথে বিবেকানন্দের এতটা মাখামাখি রামকৃষ্ণভক্তরা সুনজরে দেখেনি। তারা মনে করেছিলেন যে, স্বামীজি রামকৃষ্ণের আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন। ১৮৯৯ সালে সাধারণ সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের ব্যাপারটা এতো প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, তারা বেলুড় মঠের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘গরীব রামকৃষ্ণ সভা’ নামে আলাদা সংস্থা সৃষ্টি করে ফেলতে শুরু করেছিলেন। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন গিরীন্দ্র ও হারাধন[33]। তবে শেষ পর্যন্ত নানামুখি মধ্যস্থতায় তাঁদের অসন্তোষ দূর করা হলেও এটি আমাদের কাছে বিবেকানন্দের ভোগবাদী চরিত্রের একটি দৃষ্টান্ত হয়েই রইবে।
স্বামীজির ভোগবাদী চরিত্র বোঝার জন্য একটা নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না । পুনা থেকে স্বামীজি একবার ভাবনগরের মহারাজার পরিচয়পত্র নিয়ে কোলাহপুরে গিয়েছিলেন এবং কোলাহপুরের রানির প্রাইভেট সেক্রেটারি স্বামীজিকে বেলগাঁওয়ের এক মহারাষ্ট্রীয় ভদ্রলোকের কাছে একটি পরিচয়পত্র দেন। সেই পরিচয়পত্র নিয়ে স্বামীজি একদিন ওই ভদ্রলোকের বাসায় যান। ভদ্রলোকের বাসায় হঠাৎ হাজির হলেন, গল্প গুজব করলেন, তারপর ভুঁড়ি-ভোজ সম্পন্ন করার পরে স্বামীজি আয়েশ করে পান-সুপুরি চেয়ে বসলেন। তারপর চাইলেন দোক্তা। স্বামীজির ব্যাপার-স্যাপার দেখে গৃহকর্তার সুশিক্ষিত পুত্র মন্তব্য করলেন[34] :
‘যে সন্ন্যাসীর এই এই প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈহিক ভোগের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া উচিৎ, তাঁর মুখে এই জাতীয় চাহিদা শুনলে মনে কী ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হয় তা সহজেই অনুমেয়। … সন্ন্যাসী হয়েও তিনি এমন সব জিনিসের জন্য লালায়িত যা শুধু গৃহস্থদের বেলা শোভা পায়’।
খানাপিনা আর ভোগ-বিলাসের দিকে স্বামীজির এই দুর্বলতাগুলো শুধু ভারতে নয়, পশ্চিমেও নানা ভ্রু-কুঞ্চনের কারণ ঘটিয়েছিল। ১৮৯৪ সালে আলা-সিঙ্গাকে বিবেকানন্দ একটি পত্রে লিখেছেন –
‘কিছু একটা করে দেখাও। মাদ্রাজে আমার জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করতে না পার তো আমি থাকবো কোথায়?’
আবার আমেরিকায় থাকাকালীন অবস্থায় ইসাবেলকে লিখছেন,
‘গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা মীরশ্যাম পাইপ কিনেছি। ফাদার পোপকে যেন আবার বোল না। কোটের দাম পড়বে ৩০ ডলার। আমি তো বেশ ভালই আছি। খাবার দাবার জুটছে, যথেষ্ট টাকা কড়িও। আগামী বক্তৃতাগুলো হয়ে গেলে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব আশা করি’।
শিকাগো মহাসভার পরের দিনগুলোতে পাশ্চাত্যের মহনীয় বিলাস ব্যসনে এতটাই আপ্লুত হয়ে যান যে, তিনি ভারতে ফিরতেও দ্বিধান্বিত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে আলা-সিঙ্গাকে লেখেন –
‘ভারতে গিয়ে ফল কি? ভারত আমার আইডিয়া শক্তিশালী করতে পারবে না। আমার আইডিয়ার প্রতি এদেশের (আমেরিকার) মানুষ সহৃদয়।‘
তার বোনকে ১৮৯৬ সালে লেখেন –
‘আমার হৃদয় রয়েছে আমেরিকায়। আমি ভালবাসি ইয়াঙ্কি দেশকে’।
তা ‘ইয়াঙ্কি দেশকে’ তিনি ভালবাসবেন নাইবা কেন, ভারতের হিন্দু ভিখারিরা তো আর তার রোজকার চুরুটের দামও দিতে পারবেন না, সেখানে তিনি পারবেন না ১৩ ডলার দিয়ে মীরশ্যাম পাইপ কিনতে বা ৩০ ডলার দিয়ে কোট কিনতে। বলা বাহুল্য, আজকের দুর্দিনের বাজারেও শিকাগোর কাপড়ের দোকানে সেল দিলে এখনো চল্লিশ ডলারের মধ্যেই থ্রি-পিস স্যুট দিব্বি পাওয়া যায়, সাথে টাই ফ্রি। আর ‘সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দ সে সময়ে বসে একটা পাইপের জন্যই খরচ করছেন ১৩ ডলার, আর একটা কোট কিনেছেন ৩০ দলার দিয়ে।
এমনকি স্বামীজির বেহিসেবী খরচ আর অমিতব্যায়িতা দেখে আমেরিকার বহু ভক্ত তার সান্নিধ্য ত্যাগ করেছিলেন। বিবেকানন্দ স্তাবকদের বদান্যতায় আমরা অবশ্য কেবল আইরিশ নারী মিস মার্গারেট নোবলের নামই জানি, যিনি শিষ্য হিসেবে ভারতে এসে ভগ্নি নিবেদিতা নামে পরিচিত হন। কিন্তু একই সময় আবার অগণিত শিষ্য যে স্বামীজির অসন্ন্যাসীমার্কা কার্যকলাপের পরিচয় পেয়ে তার থেকে দূরে সরে গেছেন সে ব্যাপারটি চেপে যাওয়া হয়েছে নিপুণ কৌশলে। এপ্রসঙ্গে এডওয়ার্ড স্টার্ডির কথা বলা যেতে পারে, যার সাথে স্বামীজির পরিচয় হয়েছিল ইংল্যান্ডে। স্টার্ডি ইংল্যান্ডে স্বামীজির কাজের পরিচালকও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে তিনি জানালেন যে, স্বামীজি মধ্যে তিনি ‘মহত্তম বন্ধু ও বিশুদ্ধ গুরুর’ সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু পরের বছরের শুরুতেই স্বামীজির স্বরূপ পুরোপুরি বুঝবার পর তার সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখি। তিনি স্বামীজির অন্ধভক্ত সিস্টার নিবেদিতাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন –
‘এই দেশে যে সব সন্ন্যাসীর পদার্পণ ঘটেছে তাঁদের বৈরাগ্য সম্পর্কে অনেক কিছু শোনা গেলেও আমি তাঁদের মধ্যে বৈরাগ্যের অতি সামান্য পরিচয়ই পেয়েছি। আমি কোনভাবে আপনার আদর্শকে প্রভাবিত করতে চাই না, তবে স্বীকার করতেই হবে যে, নানাভাবে আমি তার সম্পর্কে নিরাশ হয়েছি’।
আরেকটি চিঠিতে স্টার্ডি বলেন,
‘এই দেশে আমি সন্ন্যাসের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু মুখে যারা এ-বিশয়ে সোচ্চার, তাঁদের ব্যবহারে আমি এর কোন নিদর্শন পাইনি। … আহার ও বাসস্থান নিয়ে তাঁরা সর্বদা অসন্তোষ জানাচ্ছেন। বস্তুত এই সব তথাকথিত সন্ন্যাসীদের পুষতে আমাদের দারিদ্র্য-পীড়িত কেন্দ্রগুলির যে ব্যয় বহন করতে হচ্ছে তা একজন পরিশ্রমী অধ্যক্ষ, তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক কিংবা একজন ডাক্তারের ভরণ-পোষণের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি, যদিও তারা ত্যাগী বলে নিজেদের জাহির করেন না। … আমি শুধু বলতে চাই যে, আমি কোথাও উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা দেখার আশা রাখি না, বা দেখতেও চাই না, তবে কোন ছলনা বা মিথ্যাচারকেও স্বীকার করতে রাজি নই। যদি সন্ন্যাসীর মধ্যে আমরা মানসিক সন্তোষ ও স্থৈর্য, সরল পরিবেশের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি না দেখি এবং তার পরিবর্তে যদি তারা শিলং-মূল্যের চুরুট, সর্বোৎকৃষ্ট আহার ও বেশভূষার জন্য কেবলই দাবী জানাতে থাকেন তাহলে তাঁদের স্বরূপ সম্পর্কে আমরা কী ধারণা করতে পারি? আমি শুধু বলতে পারি যে, তাঁদের জীবনে সন্ন্যাসের আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি’।
স্টার্ডির এই অভিযোগ নিবেদিতাকে খুব বেকায়দায় ফেলেছিল। তিনি সে সময় আমতা আমতা করে কিছু জবাব দিলেও তার পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি যে, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা ‘যথেষ্ট আত্মসংযমী নন’। শুধু স্টার্ডি নয়, স্বামীজির বেহুদা বেপরোয়া খরচ আর ভোগ বিলাস দেখে তিতি বিরক্ত হয়ে স্বামীজির সংস্রব ত্যাগ করেন একদা অনুরক্ত হেনরিয়েটা মুল্যারও। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি ভারতের জনগণের সেবার জন্য স্বামীজিকে যে অর্থ দিয়েছিলেন তা বিবেকানন্দ পারিবারিক প্রয়োজনে এবং বেলুড় মঠে নিজে থাকার জন্য বড় বড় তিনটি আরামপ্রদ ঘর (নিরঞ্জন ধর একে বিবেকানন্দের বাগানবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন) তৈরিতে ব্যয় করেছেন। লুই বার্কের ‘সেকেন্ড ভিজিট’ গ্রন্থে স্বামীজির ভোগবিলাস এবং জিহ্বা লাম্পট্যের অনেক উদাহরণ সংকলিত হয়েছে [35]।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শিকাগো মহাসভার সম্মিলনের সময় এবং তার পরবর্তী বছরের সময়গুলোতে সমগ্র ভারতবর্ষে চলছিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ১৮৯৬-৯৭ সালে রাজস্থান, বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, বোম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ বিশেষত মধ্যপ্রদেশে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের সংখ্যা ছিলো ৯৬.৯ লক্ষ এবং দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ছিলো ৫১.৫ লক্ষ। অথচ ‘জীব-প্রেমিক’ বিবেকানন্দ মধ্যভারতের দুর্ভিক্ষের সময় প্রপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য একটি কপর্দকও সাহায্য দিতে রাজী হননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তিনি কিন্তু স্বদেশ তার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে প্রচুর অর্থব্যয় করতে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আমেরিকা থেকেই। তখনো দেশে দুর্ভিক্ষ পুরোদমে চলছিলো। অভ্যর্থনা বাদ দিয়ে কিংবা সংক্ষেপিত করে সেই অর্থ তিনি দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং, তার বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন[36],
হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করেছিলাম যে আমায় নিয়ে একটা হৈ চৈ হয়। কি জানিস, একটা হৈ চৈ না হলে তাঁর (ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের) নামে লোক চেতবে কি করে! … তাকে ঠিক জানলে তবে ঠিক মানুষ তৈরি হবে; আর মানুষ তৈরি হলে দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি তাড়ানো কতক্ষণের কথা!
‘সমাজ সংস্কারক’
বিবেকানন্দেরই একটি উক্তি –
১৯৯৫ সালে আলাসিঙ্গাকে তিনি বলছেন,
‘বাজে সমাজ সংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজ সংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজ সংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না। ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না (পত্রাবলী, পত্র নং ২০৯, পৃঃ ৩৫৮)
ইংরেজীতে –
DEAR ALASINGA,19 W., 38 ST.,NEW YORK, 1895.Meddle not with so-called social reform, for there cannot be any reform without spiritual reform first. Who told you that I want social reform? Not I. Preach the Lord — say neither good nor bad about the superstitions and diets (Vol 5, page 90)
বিবেকানন্দের স্বজাত্যবোধের উৎস কি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নাকি অন্ধ হিন্দুত্ব?
লাগাতার প্রচারণার মাধ্যমে বিবেকানন্দকে খুব ঘটা করে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’ ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে, তাকে দেয়া হয়েছে ‘দেশ নায়ক’ উপাধি। অথচ বিবেকানন্দের স্বজাত্যবোধের উৎস কখনোই ভারতীয়তা ছিলো না, ছিল হিন্দুত্ব। এ প্রসঙ্গে তার নিজস্ব উক্তিই ছিলো – ‘হিন্দু জাতি সমগ্র জগত জয় করিবে’[37]।
দেশ যখন দুর্ভিক্ষে তোলপাড়, বিবেকানন্দ তখন খেতরির মহারাজার কাছ থেকে প্রভূত অর্থ যোগাড় করে শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দেন, এবং সেটাও হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্যই। রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথের’ দেখাদেখি তিনিও মুখে ‘সব ধর্মই সত্য’ টাইপের গৎবাঁধা বুলি মাঝে সাঝে প্রচার করলেও তিনি মূলত বেদান্ত দর্শনকেই মহাসত্য মনে করতেন। তিনি সেজন্যই বলতেন, ‘বেদান্ত – কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোন ধর্মই নয়’[38]। এমনকি জগতের অন্য সব জাতি অপেক্ষা হিন্দুদেরই তিনি অধিক নীতি-পরায়ণ জাতি বলে মনে করতেন[39]।
স্বামীজি ভারতবর্ষ বলতে কেবল হিন্দুদের ভারতবর্ষই বুঝতেন। তিনি যে ভারতবর্ষে কেবল হিন্দুদেরই একাধিপত্য চাইতেন তা মাদ্রাজে তার মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা দেখেই বোঝা যায়। তিনি বলেন[40],
‘আমরা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কথা বলিতেছি উহা অসাম্প্রদায়িক হইবে, উহাতে সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ উপাস্য ওঙ্কারেরই কেবল উপাসনা হইবে। যদি কোন সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপসনায় আপত্তি থাকে, তবে তাহার নিজেকে হিন্দু বলিবার অধিকার নাই।‘
এখন বহু জাতি এবং ধর্মের দেশ ভারতে যে ‘ওঙ্কার’ চিহ্ন কখনোই সকলের একমাত্র উপাস্য হতে পারে না, সেটা বিবেকানন্দ বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন। তিনি হিন্দুধর্মের ওঙ্কারোপসনাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে আবার সেটাকে নাম দিয়েছেন ‘অসাম্প্রদায়িক মন্দির’। এই দ্বিচারিতার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
স্বামীজি খেতরির মহারাজের বদান্যতায় শিকাগো মহাসভায় যোগ দেন হিন্দু ‘গৈরিক বসন’ পরে সেটা আমরা আগেই জেনেছি। সেখানে জনৈক ভক্তকে আশা প্রকাশ করে লেখেন, ‘প্রভুর ইচ্ছা হলে এখানে (আমেরিকা) ও ইংল্যাণ্ডে গৈরিক পরিহিত সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যাবে’[41]।
কখনো কখনো স্বামীজির হিন্দু ধর্মপ্রেম রূপ নিতো উদগ্র সাম্প্রদায়িকতাতেও। তার বহু উক্তি এবং লেখায় এর প্রতিফলন আছে। হিন্দুদের পরধর্মসহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন, পাশাপাশি আবার মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের ‘পরধর্মবিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন[42]। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মকে বিষাক্ত জীবাণুর সাথে তুলনা করে তিনি বলেন[43],
‘পাপ দুষিত খাদ্য ও নানাবিধ অনিয়মের দ্বারা (হিন্দুদের) দেহ পূর্ব হইতেই যদি দুর্বল না হইয়া থাকে, তবে কোন প্রকার জীবাণু মনুষ্যদেহ আক্রমণ করিতে পারে না’।
তিনি প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে ‘বেশ্যাবৃত্তির’ সাথে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন [44], হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলিমদের স্বামীজি ‘দেশের শত্রু’ বলেও চিহ্নিত করেন[45] –
‘কোন লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়। একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়’।
তিনি হিন্দু সমাজককে মুসলিমদের সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন[46], –
এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে।
শুধু ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের উপর ঝাল ঝেড়েই স্বামীজি ক্ষান্ত হননি, হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কারের দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন বৌদ্ধধর্মের উপরে। তিনি বলেন[47],
আমাদের সমাজে যে সকল বিশেষ দোষ রহিয়াছে, সেইগুলি বৌদ্ধধর্মজাত। বৌদ্ধধর্মই আমাদিগকে তাহার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতির ভাগী করিয়াছে।
ভারত যে হিন্দু-প্রধান দেশ, এবং দেশটা মূলতঃ সেজন্য হিন্দুদের জন্যই – সেটা সবসময় বিবেকানন্দ মাথায় রাখতে চেয়েছেন। হিন্দু ধর্মের এই জল হাওয়া কারো অপছন্দ হলে তাকে ‘মানে মানে সরে পড়বার’ উপদেশ দিয়ে বিবেকানন্দ বলেন[48],
‘এ দেশে সেই বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালি পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হওয়, সরে পড় না কেন’।
সমাজ সংস্কারক নাকি প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দ?
বিবেকানন্দকে সমাজ সংস্কারকের তকমা লাগিয়ে মিডিয়ায় তুলে ধরা হলেও তিনি আসলে যে বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন, আর সেই সাথে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ সহ অনেক কুৎসিত প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন, তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আমরা উপরে দেখেছি। তিনি প্রথাবিরোধী কেউ ছিলেন না, বরং প্রথার সুচতুর রক্ষক। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দের নিজস্ব স্বীকারোক্তি থেকেই[49] –
‘যতোই বয়োবৃদ্ধি হইতেছে, ততই এই প্রাচীন প্রথাগুলি আমার ভালো বলিয়া মনে হইতেছে’।
তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি এতোই মোহাবিষ্ট ছিলেন যে, সংস্কারের প্রয়োজনে পাছে ধর্মে আঘাত লাগে, তাই ‘সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়’ বলে নিশ্চেষ্ট থাকতে চেয়েছেন[50]। তার ব্রাহ্মণ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন, ‘তুই বামুন, অপর জাতের অন্ন নাই খেলি’[51]।
জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে এর চেয়েও স্পষ্ট উক্তি আছে স্বামীজির। তাঁর মতে[52],
‘জাতিভেদ আছে বলেই ত্রিশ কোটি মানুষ এখনো খাবার জন্য এক টুকরো রুটি পাচ্ছে’।
তিনি এও বলেছেন, ‘জাতিপ্রথায় উচ্চতা অর্থ দ্বারা নিরূপিত হয় না’। এমনকি জাতিভেদকে সমাজতন্ত্রের সাথেও তুলনা করে বলেছেন- জাতিপ্রথা এক ধরণের সমাজতন্ত্র, কেননা ‘জাতির মধ্যে প্রত্যেকেই সমান’[53]।
এ প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধর তার ‘বিবেকানন্দ অন্য চোখে’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন –
স্বামীজি কেবল জাতিপ্রথাকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হননি, এমনকি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তিনি তাঁদের বর্তমান হীন সামাজিক অবস্থাকে মেনে নিতেও পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন, ইন্দুমতী নাম্মি এক পত্রলেখিকাকে তিনি জানাচ্ছেন, ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ‘দেব দেবী’ লিখিবে, বৈশ্য ও শূদ্রেরা ‘দাস’ ও দাসী’। এমনকি বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়, কারণ তিনি লিখেছেন, ‘জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে। ’
সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রসঙ্গেও আসা যাক। বিবেকানন্দকে পরিচিতি দেয়া হয়েছে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তুখোড় ছাত্র এবং পরবর্তীতে বিশাল শিক্ষাবিদ হিসেবেও। কিন্তু তার এন্ট্রান্স, এফএ এবং বিএ পরীক্ষার মার্কশিটের হাল দেখলে কিন্তু তা মনে হবে না। ইংরেজি ভাষায় তিনি আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড জয় করেছেন বলে তার ভক্তরা হৈ-হুল্লোড় করেন, অথচ ইংরেজিতে তাঁর নম্বর এন্ট্রান্সে ছিলো ৪৭, এফএ-তে ৪৬ এবং বিএ-তে ৫৬। অঙ্ক, ইতিহাস প্রভৃতিতেও ফলাফল আশানুরূপ নয়। ত্রিশ চল্লিশ বড়জোর পঞ্চাশের ঘরে পেয়েছেন নম্বর বিষয়গুলোতে। লজিকে তো পেয়েছিলেন মাত্র ১৭।
অবশ্য বিবেকানন্দের মার্কশিটের ব্যাপারটা এখানে উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে জোর করে থাকে খারাপ প্রমাণ করা। কারণ আমরা জানি অনেক খারাপ ছাত্রই পরবর্তী জীবনে পেশাগত সাফল্য পেয়েছেন। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ কিংবা অধুনা বিল গেটস, স্টিভ জবস সহ অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও কিংবা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করেও স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন নিজের কাজের গুণেই তা আমরা দেখেছি। বিবেকানন্দও কিন্তু তেমনি। তার শিক্ষা জীবন পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ডের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মোটেই। তিনি তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন নিজ গুণেই। কিন্তু মার্কশিটের ব্যাপারটা উল্লেখ করা হোল এ জন্যই যে ভাবালুতা এড়িয়ে ভাবতে শেখা যে, বিবেকানন্দ কোন উঁচুমানের কৃতবিদ্য ছাত্র ছিলেন না, বরং ছিলেন আর দশজনের মতো অতি সাধারণ মানেরই।
শিক্ষায়তনের মার্কশিটের কথা না হয় বাদ দেই, ভারতবর্ষে যে শিক্ষার উন্নতির চেষ্টার জন্য বিবেকানন্দকে এতো উচ্চাসনে বসানো হয়, সেই শিক্ষা নিয়েই বা তার ভাবনা কেমন ছিলো? বিবেকানন্দ শিক্ষার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তার সে শিক্ষার ব্যাপারটা পুরোটাই তার হিন্দু ধর্মকে সামনে রেখে। বেদান্ত আর আনুষঙ্গিক হিন্দুধর্মের জ্ঞান ছাড়া অন্য কোন কিছুর দরকার নেই, সেটা তিনি স্পষ্ট করেছেন এই উদ্ধৃতিতে –
‘যত কম পড়বে তত মঙ্গল। গীতা ও বেদান্তের উপর যে সব ভাল গ্রন্থ আছে সেগুলি পড়। কেবল এগুলি হলেই চলবে।‘
যত কম পড়বে ততই ভাল, কিংবা কেবল হিন্দু বই-পুস্তক ছাড়া অন্য সব কিছু পরিত্যাজ্য, এটা বিবেকানন্দ শিক্ষাদর্শনের সার কথা। তারপরেও বিবেকানন্দের ভক্তরা তার শিক্ষাদর্শন নিয়ে নিদারুণ গর্বিত থাকেন। হ্যাঁ শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বিবেকানন্দের কিছু ভাল ভাল কথা আছে বটে, কিন্তু এর বিপরীতটাও কম দৃশ্যমান নয়। দুই একটি উদাহরণ দেয়া যাক –
‘বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হওয় না’[54]।
কিংবা এটি –
‘ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থাদি ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন ততই ভাল[55]।
তবে গ্রন্থ সম্বন্ধে বিবেকানন্দের এই উক্তিটিই ক্লাসিক –
গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলোর জন্য এই সকল গ্রন্থই দায়ী[56]।
যার বই-পুস্তক গ্রন্থাদির প্রতি এত বিরাগ তাকে কি করে একজন শিক্ষা-সচেতন আদর্শ ব্যক্তি বানিয়ে স্তব করা যায়, তা কোনক্রমেই আমার বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দীক্ষাকে তিনি ‘কেরানি গড়ার কল’ বলে ব্যঙ্গ করতেন, উচ্চশিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন,
‘একদিক থেকে দেখলে তদের বড়লাটের উপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। High education (উচ্চ শিক্ষা ) তুলে দিচ্ছে বলে দেশটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।‘
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির রাজা যেমন বলতেন, ‘জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ , বিবেকানন্দও একই ধরণের উপদেশ বর্ষণ করেছেন পাশ্চাত্য দেশবাসীদের জন্য[57] –
যতটা জানিলে তোমার পক্ষে কল্যাণ তোমরা তাহা অপেক্ষা বেশি জান – ইহাই তোমাদের মুশকিল।
ব্রিটিশ-বিরোধী বিবেকানন্দ, নাকি ব্রিটিশের একনিষ্ঠ স্তাবক?
স্বামীজির ব্রিটিশ বিরোধিতা নিয়েও প্রচুর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে ভক্তদের তরফ থেকে। তার বহু ভাষণ, বানী উদ্ধৃতি সামনে নিয়ে এসে বিবেকানন্দ ভক্তরা প্রমাণ করতে চান যে, বিবেকানন্দ ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য একেবারে যেন ঝাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন! তিনি ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, এমনকি বন্ধুক নির্মাতা ম্যাক্সিম হিরণের সঙ্গে নাকি বন্ধুত্ব করেছিলেন। তিনি নাকি মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশ থেকে অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে এসে সেহ স্বাধীন করার পায়তারা করছিলেন। কিন্তু এ সমস্ত ঘটনা বেশিরভাগই অতিরঞ্জন কিংবা বিবেকানন্দের খণ্ডিত চিত্র। হ্যাঁ বিবেকানন্দের অনেক বানীই আছে যা উপর থেকে দেখলে ‘ব্রিটিশ বিরোধিতার’ মত শোনাবে বটে, কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলেই পাওয়া যায় তার চিরন্তন স্ববিরোধী চরিত্রের হদিসটি। যেমন, প্রাসঙ্গিক-ভাবে একটি ঘটনার কথা বলা যায়। শিকাগো মহাসভা থেকে ফেরার পর কলকাতায় এক অভিনন্দন সমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিবেকানন্দ আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, “ইংরাজদের সম্বন্ধে যে ঘৃণার হৃদয় নিয়ে আমি ইংলণ্ডের মাটিতে পদার্পন করেছিলাম, কোন জাতি সম্বন্ধে তার থেকে অধিক ঘৃণার ভাব লয়ে সে দেশের মাটিতে আর কেউ কখনো নামেনি।” বিবেকানন্দভক্তরা বিবেকানন্দের এই বক্তব্যকে তুলে ধরে প্রমাণ করতে চান এটি তার ইংরেজ-বিরোধিতার নমুনা। কিন্তু আসলে এটা বিবেকানন্দের বক্তব্যের খণ্ডিতাংশ। “কেউ কখনো নামেনি”-র পরের লাইনেই বিবেকানন্দই কিন্তু বলেছিলেন, “এই সভা মঞ্চে যেসব ইংরেজ বন্ধু উপস্থিত আছেন, তারাই সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু যতই আমি তাদের মধ্যে বাস করতে লাগলাম, তাদের জাতীয় জীবনযন্ত্র কিভাবে কাজ করছে দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে মিশে জানলাম কোথায় রয়েছে তাদের জাতির হৃৎস্পন্দন – ততই আমি তাদের ভালবাসতে লাগলাম। তার ফলে, হে ভাতৃগণ, এখানে এমন কেউ নেই যিনি আমার থেকে ইংরাজদের বেশি ভালবাসেন।”[58]
বিবেকানন্দ তার বহু লেখাতেই ইংরেজদের অভিহিত করেছেন ‘বীরের জাতি’,’ প্রকৃত ক্ষত্রিয়’, ‘অটল ও অকপট’, এবং ‘প্রভু’ হিসেবে [59]। কীভাবে ‘বীর্য, অধ্যবসায় ও সহানুভূতির’ সাথে শাসন করলে ভারতে ‘শতবার’ ইংরেজ শাসন বজায় থাকবে, তার ফিরিস্তি দিয়েছেন[60]। বিবেকানন্দ যে ছিলেন চরম ও পরম ইংরেজভক্ত, সেটা নিজেই লেখায় উল্লেখ করেছেন[61]। ভক্তদের পক্ষ থেকে আজ তাকে অযথা ‘যুগনায়ক’, ‘মহাবিপ্লবী’ প্রভৃতি বানানোর চেষ্টা করা হলেও আসল কথা হল, স্বামীজি কখনোই ইংরেজ শাসনের সংগে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যেতে চাননি। ব্রিটিশ শাসককে তোষামোদ করতে গিয়ে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে বাতিল করে, এবং বিদ্রোহীদের ‘ডাকাত’ হিসেবে অভিহিত করে দিয়েছিলেন নিম্নোক্ত মন্তব্য[62] –
“সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে – ‘ইংরেজ আমাদের দাও।’ বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়াছে, তারের খবর দিয়াছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়াছে, ডাকাতদের তাড়াইয়াছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়াছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি তোরা কী দিয়েছিস?”
এই উক্তি থেকে বোঝা যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের কোন স্পষ্ট ধারনা ছিলো না। হ্যাঁ, রেল ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রচলন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ব্রিটিশরা করেছে, কিন্তু এগুলোও তারা করেছে তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার প্রয়োজনেই, ভারতের উন্নতি করার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, যা রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দেরা সে সময় ভাবতেন। ব্রিটিশেরা ভারতে এসে প্রথমেই যেটা করতে সফল হয়েছিল তা হচ্ছে দেশী শিল্পের ধ্বংস সাধন, এবং পাশাপাশি ব্রিটেন থেকে আসা দ্রব্যের একটা বড় সড় বাজার তৈরি। এই প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সে সময় অনুভব করে ইংরেজরা[63]। ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো শিল্পজাত নানা দ্রব্য ভারতের বন্দরগুলো থেকে দেশের অভ্যন্তরে বহন করে নিয়ে যাওয়া, ভারতের কাঁচামাল বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো, আর তার সাথে চলমান বিদ্রোহ বিপ্লবকে ঠাণ্ডা করে ভারতকে সামরিক শক্তির পদানত রাখার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ কম সময়ের মধ্যে সৈন্য সামন্ত প্রেরণের সুবিধার জন্য ভারতে রেলপথ স্থাপন খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। এমনকি লর্ড ডালহৌসির ১৮৫৩ সালের প্রতিবেদনেও ব্যাপারটা স্বীকার করে বলা হয়েছিল, রেলওয়ে স্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের কাঁচামাল সরবরাহের উৎস এবং অপরদিকে ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের রপ্তানিকৃত শিল্পদ্রব্যের বাজার হিসেবে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে[64]।
শুধু বিবেকানন্দ নন, তার সারা জীবনের অর্থের যোগানদাতা বন্ধু রাজা অজিত সিংহও ছিলেন এক পরম ব্রিটিশ অনুরক্ত শাসক। ১৮৯৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের হীরক জয়ন্তী উৎসব পালিত হয়েছিলো। সেই সময় ব্রিটিশ অনুরক্ত নৃপতিরা দলে দলে ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে আনুগত্যের শপথ জানিয়ে এসেছিলেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, মহারাজা অজিত সিংহও দলের সাথে মিলে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার স্তব করতে সেখানে গিয়েছিলেন।
স্বামীজি- বহুরূপে সম্মুখে তোমার
আসলে পুরো স্বামীজিই আদ্যোপান্ত স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। বিবেকানন্দের যেমন অনেক বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল উক্তি আছে, তেমনি আছে বহু কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং গোঁড়া উক্তি-ও। এটা আমার কথা নয়, রামকৃষ্ণ জিবনীকার ক্রিস্টোফার ইশারউডও সেটা স্বীকার করে বলেছেন[65] –
‘স্বামীজি আজ যা বলতেন, পরদিন তার কথার সাথে কোন মিল থাকতো না।‘
‘আজ যা বলতেন, পরদিন তার কথার সাথে কোন মিল থাকতো না’ – দুর্ভাগ্যক্রমে এইটাই স্বামীজির পরিপূর্ণরূপ। সেজন্য সচেতনভাবেই আমি এই প্রবন্ধের নামকরণ করেছি ‘স্ববিরোধী বিবেকানন্দ’। হ্যাঁ, বিবেকানন্দ জনসেবামূলক কাজ করেছেন, জীবপ্রেমের কথা বলেছেন, কিন্তু আবার অন্যমুখে যে পশুবলি দিয়ে উৎসাহিত হয়েছেন, সেটা আমরা প্রবন্ধের প্রথমেই দেখেছি। এমনকি আরেকটু গভীরে ঢুকলে দেখা যাবে, তার জনসেবামুলক কাজগুলোর প্রেরণাও নিঃস্বার্থ ছিলো না। মূলত জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের মাথার মধ্যে ‘হিন্দুধর্মের বীজ’ বপনই ছিলো তার সেবাপরায়ণতার মূল উদ্দেশ্য। তিনি জনসেবাকে অস্ত্র হিসেবে নিয়েছিলেন দরিদ্র মানুষের মগজ ধোলাই করে বিশ্বাসের কাতারে আনতে, সেটা তার অনেক কাজ এবং উক্তি থেকেই স্পষ্ট হয়। ১৮৯৭ সালে আলমোড়া থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত এক পত্রে স্বামীজি নির্দেশ দেন[66] –
কলিকাতার মিটিং এর খরচা বাদে যা বাঁচে, তা ঐ famine তে পাঠাও বা কলিকাতা, ডোমপারা, হাড়িপারা বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাঁদের সাহায্য কর… ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাঁদের সাহায্য কর… ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর লোকের (হিন্দুত্বে) বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।
স্বামী অখণ্ডানন্দ মহুলাতে যখন গ্রামে গ্রামে গরীব ঘরে চাল বিতরণ করছিলেন, তখন স্বামীজি তার সমালোচনা করে বলেছিলেন – ‘চাল বিতরণে শক্তিখরচ করে কি হবে, যদি কোন প্রচারকার্যই না হয়’[67]।
তিনি একবার ‘প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যত হন, কারণ, তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্মের একই ছায়ার নীচে আনতে চেয়েছিলেন। তার নিজের কথাতেই,
‘প্রবুদ্ধ –শব্দটার মধ্যেই (প্র + বুদ্ধ) বুদ্ধের অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে ভারত জুড়লে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ হিন্দু ধর্মের সাথে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন বোঝাতে পারে। ঐ নামটা দিলে তাতে হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদেরও আমাদের দিকে আকৃষ্ট করবে’।
তার সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ বজায় রাখতে বিবেকানন্দ সবসময় সচেতনভাবেই নানা স্ববিরোধী মন্তব্যের আশ্রয় নিয়েছেন। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলির ২য় খণ্ডে বর্ণিত একটি ঘটনায়। গঙ্গা মহারাজা (স্বামী অখণ্ডানন্দ) তখন নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য খেতরি রাজ্যে গিয়েছিলেন। তখন বিবেকানন্দ তাকে একটি চিঠিতে গরীব এবং নিচু জাতির লোকজনের ঘরে গিয়ে ধর্মোপদেশ দিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু অখণ্ডানন্দ খেতরিতে এসে দেখলেন সেখানে অনেক নীচতলার অধিবাসীরা দাসসুলভ ব্যবহারে অতিষ্ঠ। তিনি তখন গোলাম বলে চিহ্নিত দাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনে শরিক হয়ে যান। কিন্তু প্রজাপীড়ক রাজা অজিত সিংহও এতে যার পর নাই রুষ্ট হন। ঘটনা কালক্রমে বিবেকানন্দের কানে পৌঁছুলে তিনি অজিত সিংহের পক্ষ নিয়ে গঙ্গাকে ভর্ৎসনা করে বলেন,
‘গঙ্গা সন্ন্যাসী, তারা রাজা, তাঁদের রাজকর্মের পলিটিকসে হাত দিতে গেছলো কেন? এর জন্য তো রাজা অজিত সিং একটু বিরক্ত হয়েছিল’।
তাই একদিকে নিজের ‘প্রগতিশীল’ ইমেজ বজায় রাখতে ‘হে ভারত ভুলিও না…’ ধরণের জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন, তিনি আবার মুখ মুছে উপদেশ দিয়েছেন ‘ধনী-দরিদ্রের বিবাদ যেন বাঁধিয়ে বোস না; ধনীদের আদতে গালমন্দ দেবে না’[68]। ডোম, মেথর, মুচিদের প্রতি কিংবা শূদ্রদের প্রতি তার জ্বালাময়ী ভাষণ, কিংবা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিও ছিলো আসলে তার কৌশলগত প্রচারণা। শূদ্র-ভারতের জাগরণের কথা বললেও একই মুখে আবার বলেছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মণই মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ’। তিনি এও বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণদের মধ্যেই অধিকতর মনুষ্যত্ব-বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম হয়’[69]। শুদ্রদের নিয়ে তার সহানুভূতির খেলা যে কীরকম কৌশলী ছিলো তা বোঝা যায় ১৮৯৫ সালে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রদের সবাইকেই ‘খুশি করে চলার’ উপদেশ দিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে বলেন –
‘গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ানো হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তার পরের সংখ্যায় বৈশ্যদের’[70]।
যুগনায়ক, দেশনায়ক কিংবা সন্ন্যাসী কোনটিই নয়, বরং ‘বহুরূপে সম্মুখে’ উঠে আসা এই কৌশলী বিবেকনন্দই ছিলেন প্রকৃত বিবেকানন্দ। তিনি সব ধর্মের সব সম্প্রদায়ের মানুষদের হিন্দু ধর্মের ছায়ার নিচে আনতে ‘যখন যেমন, তখন তেমন নীতি’ অনুসরণ করেছেন, কখনো সেজেছেন প্রগতিশীল, কখনো বা চরম রক্ষণশীলতার মুখোশ ব্যবহার করেছেন। নিজেকে প্রগতিবাদী প্রমাণ করতে কখনো শূদ্রদের নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন, কখনো বা পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন, আবার যখন প্রয়োজন পড়েছে গোঁড়া রক্ষণশীলদের মতোই নারীদের নামে বক্রোক্তি করেছেন কিংবা জাতিভেদকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন। যখন পেরেছেন বিধবা বিয়েতে বাধা দিয়েছেন, এমনকি সমর্থন করেছেন সতীদাহের মত বর্বর প্রথাকেও।
স্বামীজির এই দ্বিচারী মনোভাবকে তুলে ধরার অর্থ এই নয়, তার ভাল ভাল কাজকে অস্বীকার করা। তার অসংখ্য ভাল কাজ আছে বলেই তিনি সমগ্র ভূ-ভারতে একজন আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু আমি চেয়েছি ভক্তদের ভক্তির ভাবালুতায় আপ্লুত হয়ে বিবেকানন্দের চারিদিকে যে স্বর্গীয় জোতির্বলয় (halo) তৈরি করা হয়েছে,তা থেকে স্বামী বিবকানন্দকে বের করে নিয়ে এসে মানুষ বিবেকানন্দকে অনুধাবন করতে। আমরা বরাবরই বলে এসেছি মুক্তমনা হওয়ার অর্থ কেবল ধর্মের সমালোচনা নয়, বরং মহাপুরুষদের অমহাপুরুষসুলভ বিভিন্ন কাজের আলোচনা কিংবা সমালোচনা করাটাও কিন্তু মুক্তমনাদের ‘ক্রিটিকাল থিংকিং’ এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। আহমদ শরীফ তার বইয়ে কাঙ্গাল হরিনাথের উপর ঠাকুর বাড়ির প্রবল আক্রোশের কথা সুনিপুণ শিল্পীর মতো তুলে ধরেছেন। প্রবীর ঘোষ তার অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থে অনুকূল চন্দ্র সহ ভারতবর্ষের সব সম্মানিত পুরুষদের অযৌক্তিক ধ্যান ধারনার উল্লেখ করেছেন। প্রয়াত মুক্তমনা লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার বইয়ে এবং প্রবন্ধে মাদার তেরেসার অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছেন – কিভাবে তেরেসা কালোবাজারির সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন, কিভাবে তিনি দারিদ্র্য নিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছেন, কিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ, কণ্ডম ব্যাবহার প্রভৃতিতে বাঁধা দিয়েছেন তেরেসা, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে তার যৌক্তিক বিশ্লেষণে। এগুলোতে দোষের কিছু নেই; মহাপুরুষদের পূজার আসনে বসিয়ে নিরন্তর স্তব নয়, বরং তাঁদের কাজের নির্মোহ বিশ্লেষণই কেবল আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সেজন্যই ধর্মীয় সমালোচনার পাশাপাশি মুক্তমনা লেখকেরা আগে রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, বায়েজিদ বোস্তামী, সম্রাট অশোক সহ অনেকের কাজেরই নির্মোহ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, সেগুলো রাখা আছে আমাদের সাইটের ‘নির্মোহ এবং সংশয়ী দৃষ্টি : মুক্তমনের আলোয়’ বিভাগে। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে আলোচনা সেই ধারাতেই নতুন সংযোজনমাত্র।
তথ্যসূত্র :
[1] অপার্থিব ইংরেজীতে একসময় এ প্রসংগগুলো নিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন মুক্তমনায় ‘An Irreverent Look at Some of India’s Most Revered Figures’ শিরোনামে।
[2] প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয়, লৌকিক, দে’জ পাবলিশিং, একাদশ মূদ্রণ, ১৯৯৮, পৃঃ ২১৭।
[3] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[4] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[5] মহেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির ঘটনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯৬।
[6] ভারতীয় নারী, উদ্বোধন, পৃষ্ঠা ৯০
[7] গোলাম আহমাদ মোর্তজা, বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, পৃঃ ১৫৯
[8] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২।
[9] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১২।
[10] এস মানুষ হও, ষষ্ঠ সংস্করণ, উদ্বোধন, পৃঃ ৮।
[11] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃঃ ১৮।
[12] ভারতীয় নারী, উদ্বোধন, পৃঃ ১৫।
[13] শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৪
[14] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পৃঃ ১৩৫।
[15] সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, বিবেকানন্দ চরিত, উদ্বোধন, পৃঃ ৩০১।
[16] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, ১৯৮৬-৮৭।
[17] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয় থেকে সংগৃগীত; উক্তিগুলো পাওয়া যাবে রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয় বইয়েও (র্যাডিক্যাল, ২০০২)।
[18] রাজেশ দত্ত (সম্পাদনা), রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয়, র্যাডিক্যাল, ২০০২।
[19] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ১৭৮।
[20] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ৩৬০।
[21] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব পূর্বার্ধ, প্রথম অধ্যায়, উদ্বোধন, পৃঃ ১৩।
[22] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, সাধক ভাব, বিংশ অধ্যায়, উদ্বোধন, পৃঃ ১৭৫।
[23] রাজেশ দত্ত (সম্পাদনা), রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয়, র্যাডিক্যাল, ২০০২।
[24] বিপ্লব পাল, স্বামী বিবেকানন্দ-একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ, মুক্তমনা।
[25] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[26] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১১৪-১১৫
[27] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩০
[28] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১০ম খণ্ড, পৃঃ ৩৯
[29] ভগ্নী নিবেদিতা, স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি, পৃঃ ১৮৩
[30] সুতপা বন্দোপাধ্যায়, গুরুজি ও স্বামীজি, দৈনিক আজকাল, এপ্রিল ৮, ১৯৯৪।
[31] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[32] রোমা রলাঁর মতে বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন বলেই তার নাম রাখা হয় বিবেকানন্দ।
[33] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[34] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[35] Marie Louis Burke, Swami Vivekananda’s second visit to the west, Vedanta Press ।
[36] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[37] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৩১
[38] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৫৪
[39] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩৫৯
[40] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪
[41] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং -২৭২, পৃঃ ৪৪৪
[42] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৯
[43] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩
[44] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩
[45] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪
[46] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২৬২
[47] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৮১
[48] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১১৮
[49] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২২
[50] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩১
[51] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩৭
[52] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[53] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন
[54] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৮৫
[55] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৯৯
[56] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১০৯
[57] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৪৪
[58] বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২
[59] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৩০৭
[60] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৫
[61] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৬
[62] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৩
[63] সুকোমল সেন, ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-২০০০), এনবিএ, ষষ্ঠ মূদ্রণ, ২০০৫
[64] সুকোমল সেন, পূর্বোক্ত।
[65] খ্রিস্টোফার ইশারউড, রামকৃষ্ণ ও তার শিষ্যগণ, পৃঃ ২৭৮
[66] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৩৬৩, পৃঃ ৫৭২
[67] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৩৬৫, পৃঃ ৫৭৫
[68] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৪৭৬, পৃঃ ৯৬
[69] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৬।
[70] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ২৩৯, পৃঃ ৩৯১-৯২
লেখা পড়ে মনে হলো যে লিখেছে সে আসতো একটা বড়ো বোকাচোদার হাড্ডি। স্বামীজী কে? আগে সেটা জান। তারপর তোর ওই গোবর ভরা মাথা নিয়ে স্বামীজির কথা লিখতে আসিস। বকচদ হাট শালা
ReplyDelete