শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ষষ্ঠ অধ্যায় - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 July, 2018

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগ-(Bangla Gita)

শ্রীভগবানুবাচ

অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ। 
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ।।১।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্নাসী বা যোগী। 
অর্থ- শ্রীভগবান বললেন- যে মানুষ কর্মফলে আশ্রয় না নিয়ে কর্তব্য কম করেন তিনি সন্ন্যাসী ও যোগী। আর অগ্নিত্যাগী ব্যক্তি (সন্ন্যাসী) নয় এবং কর্মত্যাগী ব্যক্তিও (যোগী) নয়।

যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পান্ডব। 
ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন।।২।।
অনুবাদঃ হে পান্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না। 
অর্থ:- হে পাণ্ডব (অর্জুন)! যাকে সন্ন্যাস বলে, তাকেই যোগ বলে জানবে। কেননা সংকল্প ত্যাগ না করলে কোনো মানুষ যোগী হয় না।

আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে। 
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে।।৩।। 
অনুবাদঃ অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই  যোগারূঢ় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন। 
অর্থ:- যোগে আরোহণ ইচ্ছাযুক্ত মুনির (মননশীল মানুষের নিষ্কামকর্ম করাকেই কারণ বলা হয়েছে। সেই যোগরূঢ় মননশীল মানুষের সর্বসংকল্পের অভাবই কল্যাণের কারণ বলা হয়।

যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে। 
সর্বসংকল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে।।৪।। 
অনুবাদঃ যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তথন তাঁকেই যোগারূঢ় বলা হয়।
অর্থ- যখন ইন্দ্রিয়াদি ভোগে আসক্ত হন না, কর্মেও আসক্ত হন না, তখন সর্বসংকল্পত্যাগী সন্ন্যাসীকে যোগরূঢ় বলা হয়। 

উদ্ধরেদাত্মনাত্মনং নাত্মনমবসাদয়েৎ। 
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।৫।।
অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে  অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে। 
অর্থ- নিজ আত্মাকে অধঃপতিত না করে নিজের দ্বারাই নিজেকে (সংসার থেকে) উদ্ধার করবে। এই আত্মাই নিজের বন্ধু, আত্মাই নিজের শত্রু হয়।

বন্ধুরাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। 
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ।।৬।।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু ‍যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু। 
অর্থ:-যে আত্মার দ্বারা আত্মা জয়ী হয়েছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু এবং অনাত্মার আত্মাই শত্রুর মতো শত্রুতাচরণ করে।
টীকাঃ প্রকৃতপক্ষে জীবের আত্মা একটিই। কিন্তু এখানে দুটি আত্মার কথা বলা হয়েছে। এই আত্মা শব্দটি সম্ভবত রূপকভাবে বলা হয়েছে। কারণ বৈদিক শাস্ত্রসমূহে একজন জীবের কেবল একটি জীবাত্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এই শ্লোকে দুটি আত্মার অর্থ এই যে, জীব নিজেই নিজেকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করবে; ইন্দ্রিয়সমূহ বশীভূত হলে নিজেই নিজের বন্ধু আর ইন্দ্রিয়সমূহ বশীভূত না হলে নিজেই নিজের শত্রু।
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ।।৭।।
অনুবাদঃ জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাঁর কাছে শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ এবং সম্মান ও অপমান সবই সমান। 
অর্থ- শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ তথা মান-অপমানে যাঁর চিত্ত পূর্ণরূপে শান্ত, এইরূপ স্বাধীন-চিত্ত মানুষ পরমাত্মায় স্থিত থাকেন।

জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ। 
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ।।৮।।
অনুবাদঃ যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত, ‍যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি মৃৎখন্ড,প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী, তিনি যোগারূঢ় বলে কথিত হন। 
অর্থ- যাঁর চিত্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা তৃপ্ত এবং অবিকৃত, যাঁর ইন্দ্রিয় উত্তমরূপে বশে আছে তথা যাঁর জ্ঞানে মাটি, পাথর ও স্বর্ণ সমান; সেই যোগী (পরমাত্মায়) যুক্ত –এইরূপ বলা হয়।
অর্থ- যাঁর চিত্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা তৃপ্ত এবং অবিকৃত, যাঁর ইন্দ্রিয় উত্তমরূপে বশে আছে তথা যাঁর জ্ঞানে মাটি, পাথর ও স্বর্ণ সমান; সেই যোগী (পরমাত্মায়) যুক্ত –এইরূপ বলা হয়।

সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু। 
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে।।৯।।
অনুবাদঃ যিনি সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, মৎসর, বন্ধু, ধার্মিক ও পাপাচারী-সকলের প্রতি সমবুদ্ধি, তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন। 
অর্থ:-(৯) সুহৃদ (অর্থাৎ যিনি স্বার্থ শূণ্য হয়ে সবার মঙ্গল করেন), মিত্র, শত্রু, উদাসীন (পক্ষপাতশূণ্য), মধ্যস্থ (অর্থাৎ যিনি উভয়পক্ষের ভালো চান), দ্বেষী, বন্ধু, সাধু ও পাপীগণেও যিনি সমান ভাব বিশিষ্ট, তিনিই শ্রেষ্ঠ।
শব্দার্থ- সুহৃদ= যিনি স্বার্থ শূণ্য হয়ে সবার মঙ্গল করেন।
উদাসীন= পক্ষপাতশূণ্য৷
মধ্যস্থ = যিনি উভয়পক্ষের ভালো চান।
দ্বেষী= যার হৃদয় হিংসায় পূর্ণ।




যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মনং রহসি স্থিতঃ। 
একাকাী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ।।১০।।
অনুবাদঃ যোগারূঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তিনি  একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন। তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন। 
অর্থ- সংযতচিত্ত, সংযতদেহ,ও সংগ্রহরহিত যোগী একা নির্জন স্থানে স্থিত হয়ে নিরন্তর আত্মাকে(পরমাত্মা) নিযুক্ত করবে।।
 শুচৗৈ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ। 
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্।।১১।।
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা ষতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ। 
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে।।১২।। 
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন। 
অর্থ:- খুব উঁচু বা খুব নিচু নয় এমন শুদ্ধ ভূমিতে কুশ, হরিণের চামড়া এবং বস্ত্রাদি পেতে নিজের স্থির আসন করবে।।-(১১)
অর্থ:- সেই আসনে বসে চিত্ত এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সমূহকে বশ করে, মনকে একাগ্র করে, অন্তঃকরণের শুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করবে।।-(১২)


সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ।।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্।।১৩।। 
প্রশান্তাত্মা বিগদভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ। 
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ।।১৪।।
অনুবাদঃ শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্য-ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন। 
অর্থ-মেরুদণ্ড, মস্তক, গ্রীবা সমান ও অচলভাবে ধারণ করে স্থির হয়ে নিজের নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি রেখে অন্য দিকে না তাকিয়ে ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত! ভয় ছেড়ে ও প্রশান্ত-চিত্ত যোগী সতর্কতার সাথে মনকে সংযত করে আমাতেই চিত্ত-যুক্ত মৎপরায়ণ হয়ে স্থিত হবে।-(১৩_১৪)
শব্দার্থ- গ্রীবা= ঘাড়।
নাসিকার= নাকের।
অগ্রভাগে= সমনের দিকে।
চিত্ত=মন।
মৎপরায়ণ= আমাতেই স্থির।
টীকা: অনুরূপভাবে শ্লোকটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (২/৮) রয়েছে।


যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ। 
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি।।১৫।।
অনুবাদঃ এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন। 
অর্থ- সংযতচিত্ত যোগী এভাবে আত্মাকে নিরন্তর লগ্ন করে আমাতে: স্থিতিরূপ নির্বাণ-পরমাত্মা যুক্ত শান্তি লাভ করে।।-(১৫)

নাত্যশ্নতস্ত যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ। 
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন।।১৬।।
অনুবাদঃ অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়। 
অর্থঃহে অর্জুন! অতিরিক্ত আহারকারী একান্ত অনাহারী, অতিরিক নিদ্রাশীল এবং জাগরণশীলের এই যোগ সিদ্ধ হয় না।।-(১৬)

যুক্তহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা।।১৭।।
অনুবাদঃ যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন। 
অর্থ- যিনি নিয়মিত আহার-বিহার করেন, কর্মসমূহতে যথাযোগ্য চেষ্টা করেন আর যথাযোগ্য নিদ্রিত ও জাগ্রত থাকেন, তাঁর যোগ দুঃখনাশকারী হয়।।-(১৭)

যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে। 
নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচতে তদা।।১৮।।
অনুবাদঃ যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়। 
অর্থ:-একান্ত বশীভূত চিত্ত যখন উত্তমরূপে পরমাত্মাতেই স্থিত হয়, তখন সকল কামনা থেকে ইচ্ছাশূন্য মানুষ (পরমাত্মাতে) যুক্ত এইরূপ বলা হয়েছে।। -(১৮)

যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা। 
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ।।১৯।।
অনুবাদঃ বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে। 
অর্থ:-যে প্ৰকার বায়ু-প্ৰবাহ শূন্য স্থানে প্রাদীপ শিখা বিচলিত হয় না, সেইরূপ উপমা পরমাত্মার ধ্যানে সংঘচিত্ত যোগীর বশীভূত চিত্তের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।। -(১৯)

যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া। 
যত্র চৈবাত্মনাত্মনং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি।।২০।।
অর্থ:-যে অবস্থায় যোগের অনুষ্ঠান দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত নিবৃত্ত (ক্ষান্ত)হয় এবং যে অবস্থায় (অষ্টাঙ্গযোগের অভ্যাসে) শুদ্ধ চিত্ত দ্বারা পরমাত্মার সাক্ষাৎ করে পরমাত্মাতেই সন্তুষ্ট হয়।।-(২০)
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম।
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ।।২১।।
অর্থ:-যে অবস্থায় অনন্ত সুখ অনুভব হয়, যে আনন্দ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি থেকেও ঊর্দ্ধে স্থিত, কেবল শুদ্ধবুদ্ধি দ্বারা গ্রহণযোগ্য এবং যে অবস্থাতে স্থিত হয়ে এই যথার্থ তত্ত্ব (পরমাত্মা) থেকে বিচলিত হন না।।-(২১)
যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।২২।।
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্।।২৩।।
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধিবলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুথ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি। 

 স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোহনির্বিণ্ণচেতসা। 
সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বনশেষতঃ। 
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ।।২৪।।
অনুবাদঃ অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত। সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য। 

শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধা ধৃতিগৃহীতয়া। 
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ।।২৫।।
অনুবাদঃ ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়। 

যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্। 
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ।।২৬।।
অনুবাদঃ চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে  মনকে আত্মার বশে আনতে হবে। 

প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্। 
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্।।২৭।।
অনুবাদঃ ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজোগুণ প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই  পরম সুখ প্রাপ্ত হন। 

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ।
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে।।২৮।।
অনুবাদঃ এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম-সংস্পর্শরূপ পরম সুখ আস্বাধন করেন। 

সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি। 
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।২৯।।
অনুবাদঃ প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন। 

যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।৩০।।
অনুবাদঃ যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না। 

সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।৩১।।
অনুবাদঃ যে যোগী সর্বভূতে স্থিত পরমাত্মা রূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই  আমাতে অবস্থান করেন। 

আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন। 
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।৩২।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। 

অর্জুন উবাচ
যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন। 
এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্।।৩৩।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। 

চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।৩৪।।
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান,  তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি। 

শ্রীভগবানুবাচ
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।৩৫।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে  কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়। 

অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ। 
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।৩৬।।
অনুবাদঃ অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায়  অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত। 

 অর্জুন উবাচ
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ।
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি।।৩৭।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়? 

কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি। 
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি।।৩৮।।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো কৃষ্ণ! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে,  সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?
এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ।
ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হুপপদ্যতে।।৩৯।।
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না। 

শ্রীভগবানুবাচ
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশন্তস্য বিদ্যতে। 
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।।৪০।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি  হয় না। হে বৎস! তার কারণ, কল্যানকারীর কখনও অধোগতি হয় না। 

প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ। 
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোহভিজায়তে।।৪১।।
অনুবাদঃ যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। 

অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্। 
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্।।৪২।।
অনুবাদঃ অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগিগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ। 

তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্। 
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন।।৪৩।।
অনুবাদঃ হে কুরুনন্দন! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পূর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।  

পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোহপি সঃ। 
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে।।৪৪।। 
অনুবাদঃ তিনি পূর্ব জন্মের অভ্যাস বসে যেন অবশ হয়ে যোগ-সাধনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদোক্ত সকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকাম কর্মমার্গে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন। 

প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ। 
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্।।৪৫।।
অনুবাদঃ যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত  সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন। 

তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ। 
কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদযোগী ভবার্জুন।।৪৬।।
অনুবাদঃ যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও। 

যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা। 
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।।৪৭।।
অনুবাদঃ যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদগত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।

ওঁ তত্সদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষত্সু ব্রহ্মবিদ্যাযাং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে
আত্মসংযমযোগো নাম ষষ্ঠোঽধ্যাযঃ

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

মনুস্মৃতি প্রথম অধ্যায়

স্মৃতি শাস্ত্রের মধ্যে মনুস্মৃতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন বৃ্হস্পতিস্মৃতিতে বলা হয়েছে- বেদার্থপ্রতিবদ্ধত্বাত্ প্রাধাণ্যং তু মনো: স্মৃত...

Post Top Ad

ধন্যবাদ