শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সপ্তম অধ্যায় - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

17 July, 2018

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সপ্তম অধ্যায়

সপ্তম অধ্যায়-বিজ্ঞান-যোগ

শ্রীভগবানুবাচ
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ। 
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা  জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু।। ১।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন- হে পার্থ! আমাতে আসক্তচিত্ত হয়ে, আমাতে মনোনিবেশ করে যোগাভ্যাস করলে, কিভাবেসমস্ত সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে আমাকে জানতে পারবে, তা শ্রবণ কর।

জ্ঞানং তেহহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ।
যজজ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োহন্যজজ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে।।২।।
অনুবাদঃ আমি এখন তোমাকে বিজ্ঞান সমন্বিত এই জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণরূপে বলব, যা জানা হলে এই জগতে আর কিছুই জানবার বাকি থাকে না।

মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে। 
মততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।৩।।
অনুবাদঃ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন সিদ্ধি লাভের জন্য যত্ন করেন, আর সেই প্রকার যত্নশীল সিদ্ধদের মধ্যে কদাচিৎ একজন আমাকে অর্থাৎ আমার ভগবৎ-স্বরূপকে তত্ত্বত অবগত হন।

ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ। 
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।৪।।
অনুবাদঃ ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার-এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধিমে পরাম্। 
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।৫।।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জগৎকে ধারণ করে আছে।
এতদযোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয়। 
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা।।৬।।
অনুবাদঃ আমার এই উভয় প্রকৃতি থেকে জড় ও চেতন সব কিছু উৎপন্ন হয়েছে। অতএব নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো যে, আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারণ।

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়। 
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।৭।।
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে।

রসোহহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ।
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।৮।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ব বেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ।

পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ। 
জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু।।৯।।
অনুবাদঃ আমি পৃৃথিবীর পবিত্র গন্ধ, অগ্নির তেজ, সর্বভূতের জীবন এবং তপস্বীদের তপ।

বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্। 
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।।১০।।
অনুবাদঃ হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন কারণ বলে জানবে। আমি বুদ্ধিমানের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।

বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জিতম্।
ধর্মাবিরুদ্ধো ভুতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ।।১১।।
অনুবাদঃ হে ভরতর্ষভ! আমি বলবানের কাম ও রাগ বিবর্জিত বল এবং ধর্মের অবিরোধী কামরূপে আমি প্রাণীগণের মধ্যে বিরাজমান।

যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে। 
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।১২।।
অনুবাদঃ সমস্ত সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাবসমূহ আমার থেকেই উৎপন্ন বলে জানবে। আমি সেই সকলের অধীন নই, কিন্তু তারা আমার শক্তির অধীন।

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ। 
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্।।১৩।।
অনুবাদঃ (সত্ত্ব, রজ, ও তম) তিনটি গুণের দ্বারা মোহিত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।
পদার্থঃ (এভিঃ, ত্রিভিঃ) এই তিন (গুনময়ৈঃ) গুণ রূপ
(ভাবৈঃ) ভাব হতে (ইদম্, সর্বম্, জগত্) এই সমস্ত জগৎ (মোহিতম্) মোহ কে প্রাপ্ত হয় (এভ্যঃ, পরম্) তিন গুণ হতে অতীত (অব্যয়ম্) বিকার রহিত (মাম্) আমাকে (ন, অভিজানাতি) জানে না।।

ভাবার্থঃ হে অর্জুন! সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক এই তিন গুণের ভাব হতে সম্পূর্ণ জগৎ মোহ কে প্রাপ্ত হয়, কাজেই তিন গুণ হতে অতীত বিকার রহিত আমাকে জানতে পারে না।।

ভাষ্যঃ এই শ্লোকে কথন করা হয়েছে যে তিন গুণ দ্বারা সংসার মোহ কে প্রাপ্ত হয় কিন্তু পরমাত্মা কে নয়, আর মায়াবাদীদের সিদ্ধান্ত অনুকূল পরমাত্মাই মোহ কে প্রাপ্ত হয়ে জীব ঈশ্বর ভাব কে ধারণ করে, এই প্রকারে ইহার অজ্ঞান ব্রহ্মাশ্রিত থেকে ব্রহ্ম কে মোহগ্রস্ত করে। এই সিদ্ধান্ত গীতা শাস্ত্র হতে সর্বথা বিরুদ্ধ। এই শ্লোকের সঙ্গতিতে মধুসূদন স্বামী লিখেন 'রসোহহমপ্সু কৌন্তেয়' ইত্যাদি বচনে পরমেশ্বর সমস্ত জগৎ কে নিজের স্বরূপ কথন করে আর যে নিজে
নিত্য শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত স্বভাব যুক্ত, তাহলে পরমেশ্বর হতে অভিন্ন এই জগতে সংসারী কিভাবে তৈরি হবে, যদি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত স্বভাব যুক্ত পরমাত্মা অজ্ঞান হতে সংসারী হয়, বাস্তবে নয় তাহলে জীবের মধ্যে অজ্ঞান কোথা হতে উদ্ভব হয় ? অর্জুনের শঙ্কার জন্য উক্ত শ্লোক। উক্ত স্বামীজীর এই সঙ্গতি সর্বথা অসঙ্গত, কেননা ইহাদের মতানুসারে অজ্ঞান জীবের মোহের কারণ নয় বরং ব্রহ্ম কে মোহিত করে জীব তৈরি করার কারণে এমন হয়, তাহালে বেচারা জীবের কি অপরাধ ? যখন শুদ্ধ ব্রহ্মই অজ্ঞানে বশীভূত হয়ে জীব হয়, মায়াবাদীদের মতানুসারে উপালম্ভ হয় যে কৃষ্ণজী জীব কে তখনই দেয় যখন স্বয়ং মায়ার বশীভূত হয়ে নিজের স্বরূপ কে ভুলে যায় না, যখন ব্রহ্মই ভুলে জীব তৈরি হয়ে যায় তাহলে জীব কে কি উপালম্ভ দিতে পারে যে তুমি মোহের বশীভূত হয়ে আমাকে জানো না, বৈদিক মতানুকূল প্রকৃতিই (মায়া) জীবের মোহের কারণ কিন্তু পরমাত্মা মোহের কারণ নয়

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। 
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।১৪।।
অনুবাদঃ আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।
পদার্থঃ (এষা) যে (গুণময়ি) সত্ত্ব, রজ, তম এই তিন গুণ যুক্ত (মম) আমার (মায়া) প্রকৃতি (দুরত্যয়া) দুঃখ কে অতিক্রম করার যোগ্য (মাম্, এব) আমাকেই ₹য়ে) যে লোক (প্রপদ্যন্তে) প্রাপ্ত হয় তে সে (এতাম্, মায়াম্) এই মায়া কে (তরন্তি) অতিক্রম করে।।

ভাবার্থঃ যে সত্ত্ব, রজ, তম এই তিন গুণ যুক্ত আমার প্রকৃতি দুঃখ কে অতিক্রম করার যোগ্য, যে লোক আমাকে প্রাপ্ত হয় সে এই মায়া কে অতিক্রম করতে পারে।।

ভাষ্যঃ মায়া শব্দের অর্থ এখানে প্রকৃতি যেমন 'মায়ান্তু প্রকৃতিম্ বিদ্যাত্ মায়িনন্তু মহেশ্বরম্' শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/১০ =প্রকৃতি কে মায়া আর (মায়ী) মায়াবী পরমেশ্বর কে জানো, ইত্যাদি উপনিষদ বাক্য দ্বারা স্পষ্ট পাওয়া যায় যে মায়া নাম প্রকৃতির আর এই মায়ারূপী প্রকৃতি=মোহের হেতু প্রকৃতি কে পরমাত্মার জ্ঞান দ্বারাই পুরুষ পার হতে পারবে অন্যথা নয়, যেমন পরম্ জ্যোতিরূপসংপদ্য স্বেন রুপেণাভিনিষ্পদ্যতে' ওই পরম জ্যোতি পরমাত্মা কে প্রাপ্ত হয়ে নিজের স্বরূপ দ্বারা স্থির হয় অর্থাৎ প্রকৃতির বন্ধন হতে রহিত হয়, এই আশয় দ্বারা কৃষ্ণজী কথন করেন যে পরমাত্মার জ্ঞান দ্বারা প্রকৃতির বন্ধন হতে পুরুষ মুক্ত হয়।।

টীকা-টিপ্পনিঃ মায়াবাদিগণ ইহার অর্থ করেন যে প্রকারে গুণ রহিত রজ্জু দৃঢ় হয় ঠিক এই প্রকারে অত্যন্ত দৃঢ় হওয়ার অভিপ্রায়ে এখানে মায়া কে গুনময়ী কথন করা হয়েছে আর গুণ শব্দের অর্থ ইহারা সাংখ্য শাস্ত্রে কথন করা গুণ কে মান্য করেনি, কেননা এখানে যদি ঐ অর্থ নেওয়া হতো ইহাদের মায়া সিদ্ধ হতো না আর মায়া সিদ্ধ না হওয়ার ফলে ইহাদের সমস্ত প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যেতো, কেননা ইহাদের মতানুসারে সমস্ত জগতের উপাদান কারণ হলো মায়া, আর মায়া হতেই ইহাদের মতে জীব ঈশ্বর তৈরি হয়, শুদ্ধ সত্ত্ব প্রধান মায়া উপাধিযুক্ত ঈশ্বর আর মলিন সত্ত্ব প্রধান অবিদ্যা উপাধিযুক্ত জীব কথন করা হয় অর্থাৎ যে অবিদ্যা সত্ত্ব গুণের প্রধানতা হতে অত্যন্ত স্বচ্ছ হয় যেরূপে স্বচ্ছ দর্পণ মুখের আভাস কে গ্ৰহণ করে এই প্রকারে স্বচ্ছ অবিদ্যা চেতনের আভাস কে গ্রহণ করে যে প্রকারে দর্পণের কোনো দোষ মুখ রূপ বিম্ব কে দূষিত করে না, আর যে বিম্বস্থানীয় ঈশ্বর কে দূষিত করে না, আর যে প্রকারে দর্পণের দোষ হতে প্রতিবিম্ব দূষিত হয় এই প্রকারে অবিদ্যার দোষ হতে প্রতিবিম্ব-স্থানীয় জীবাত্মা দূষিত হয়, এই প্রকারের অবিদ্যা উপাধি দ্বারাই ইহাদের মতে জীব ঈশ্বর আদি সমস্ত প্রপঞ্চ তৈরি হয়। অবিদ্যা, অজ্ঞান ইহাদের মতে একই বস্তুর নাম, যদি এখানে অবিদ্যারূপ মায়া কে না মান্য করে প্রকৃতিরূপ মায়া কে মান্য করা হতো তাহলে ইহাদের মায়াবাদ মনোরথ হয়ে যেতো অর্থাৎ মায়াবী পুরুষের মায়াজালের সমান উহাদের মায়ার নাশ দ্বারা মায়াবাদ নাশ কে প্রাপ্ত হয়ে যেতো, এইজন্য যেখানে যেখানে গীতায় মায়া শব্দ প্রকৃতির অর্থ আসে উহার অর্থ মায়াবাদীগণ অবিদ্যা অর্থ করেন, পরন্তু 'মম মায়া' কথন করার ফলে যদি ইহার অর্থ অজ্ঞান করা হয় তাহলে অর্থ সর্বথা বিকৃত হয়ে যায়।

ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।১৫।।
অনুবাদঃ মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুস্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।



চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সৃকৃতিনোহর্জুন।
আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থাথী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।১৬।।
অনুবাদঃ হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী-এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন।

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে। 
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।১৭।।
অনুবাদঃ এই চার প্রকার ভক্তের মধ্যে নিত্যযুক্ত, আমাতে একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কেন না আমি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।
উদারাঃ সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্। 
অস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্।।১৮।।
অনুবাদঃ এই সকল ভক্তেরা সকলেই নিঃসন্দেহে মহাত্মা, কিন্তু যে জ্ঞানী আমার তত্ত্বজ্ঞানে অধিষ্ঠিত, আমার মতে তিনি আমার আত্মস্বরূপ। আমার অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত হয়ে তিনি সর্বোত্তম গতিস্বরূপ আমাকে লাভ করেন।

বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মং প্রপদ্যতে। 
বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।১৯।।
অনুবাদঃ বহু জন্মের পর তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে সর্ব কারণের পরম কারণ রূপে জেনে আমার শরণাগত হন। সেইরূপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।

কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।২০।।
অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।

যো যো যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি। 
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্।।২১।।
অনুবাদঃ পরমাত্মরূপে আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করি। যখনই কেউ দেবতাদের পূজা করতে ইচ্ছা করে, তখনই আমি সেই সেই ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি।

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে। 
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্।।২২।।
অনুবাদঃ সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার কাছ থেকেই আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।

অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।২৩।।
অনুবাদঃ অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তের আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ। 
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।।২৪।।
অনুবাদঃ বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।

পদার্থ-( ব্যক্তি) ব্যক্তি ( আপন্নম্) প্রাপ্ত ( মাম্) আমাকে ( অবুদ্ধয়ঃ) বুদ্ধহীন=অজ্ঞানী মানুষ ( অব্যক্তম্) অক্ষর পরমাত্মা রূপ দ্বারা স্বীকৃত এবং ( মম্) আমার সম্পর্কে ( মন্যন্তে) মনে করে ( অব্যয়ম্) বিকার রহিত ( অনুত্তমম্) যে কেউ উত্তম না আছে ( পরম্ ভাবম্) পরমাত্মা স্বরূপ ভাবকে ( অজানন্তঃ) না জেনে।।

ভাষ্য-সেই পরম ভাব যা মানুষ জানে না, শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা বলে মনে করে। "আত্মেতিতুপগচ্ছন্তি গ্রাহয়ন্তি চ" ব্র০ সূ০-৪/১/৩ সেই পরমাত্মার পরম ভাবকে প্রাপ্ত করে পরুষোত্তম পুরুষ তার আত্মরূপ দ্বারা কথন্ করে,যেমন-"ত্বমবাহমস্মির গবোদেবতেহমবৈত্বমসি" হে পরমাত্মদেব! তুমি আমি আর তুমি আমি অর্থাৎ তদ্ধমতাপত্তির কারণ আমার এবং আপনার একাগ্রভাব হয়ে গেছে,যেহেতু মানুষের অত্যন্ত,মিত্রতায় একাত্মভাব রয়েছে,এই মতে একাত্মভাব এই আত্মাধিকরণে বলা হয়েছে,এই পরম ভাবের ব্যাখ্যা গী০ ৯/১১ তে এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পরমভাব=সর্বোত্কৃষ্টভাব অর্থাৎ পরমতত্ব তাকে না জেনে মানুষ আমাকে মনুষ্যমাত্র বিবেচনা করে অবজ্ঞা করে। আমি কেমন হই "মহামশ্চাসৌ ঈশ্বরমশ্চেতি মহেশ্বঃ"=আমি ঈস্বর=মহেশ্বর হই, এখানে তদ্ধমতাপত্তির কারণে কৃষ্ণজী নিজেকে তিনি মহেশ্বর বলেছেন, যদি "অবজানন্তি মাম্ মূঢ়াঃ" গী০-৬/১১ এই শ্লোকের সেই ব্যাখ্যা করতে হবে, স্বমী শঙ্করাচার্য ও মধুসূধন স্বামী আদিকে স্বীকার করুন যে তারপরও কৃষ্ণজী ঈশ্বর সিদ্ধ নন। কারণ তার অর্থে লিখা আছে মানুষ ভেবে আমাকে অপমান করে, এটা বিবেচনা করা উচিত যে যখন কৃষ্ণজীর সখা=মিত্র সেই সময়ে কৃষ্ণজীকে ঈশ্বর না মনে করত তাহলে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।।-( ভাষ্য-আর্যমুনি পরিব্রাজক)
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ। 
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্।।২৫।।
অনুবাদঃ আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনও প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি। তাই, তাঁরা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।

বেদাহং সমতীতানি বর্তানাননি চার্জুন। 
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন।।২৬।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত। আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।

ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত। 
সর্বভূতানি সম্মোহং  সর্গে যান্তি পরন্তপ।।২৭।।
অনুবাদঃ হে ভারত! হে পরন্তপ! ইচ্ছা ও দ্বেষ থেকে উদ্ভত দন্দ্বের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সমস্ত জীব মোহাচ্ছন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ
করে।

যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্।
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ।।২৮।।
অনুবাদঃ যে সমস্ত পুণ্যবান ব্যক্তির পাপ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়েছে এবং যাঁরা দ্বন্দ্বমোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ভজনা করেন।

জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে। 
তে ব্রক্ষ তদ্ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্নং কর্ম চাখিলম্।।২৯।।
অনুবাদঃ যে সমস্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি জরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাকে আশ্রয় করে যত্ন করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ব্রক্ষভূত, কেন না তাঁরা অধ্যাত্মতত্ত্ব ও কর্মতত্ত্ব সব কিছু সম্পূর্ণরূপে অবগত।

সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ।
প্রয়াণকালেহপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ।।৩০।।
অনুবাদঃ যাঁরা অধিভূত-তত্ত্ব, অধিদৈব-তত্ত্ব ও অধিযজ্ঞ-তত্ত্ব সহ আমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে অবগত হন, তাঁরা আমাতে আসক্তচিত্ত, এমন কি মরণকালেও আমাকে জানতে পারেন।
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

মনুস্মৃতি প্রথম অধ্যায়

স্মৃতি শাস্ত্রের মধ্যে মনুস্মৃতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন বৃ্হস্পতিস্মৃতিতে বলা হয়েছে- বেদার্থপ্রতিবদ্ধত্বাত্ প্রাধাণ্যং তু মনো: স্মৃত...

Post Top Ad

ধন্যবাদ