আরণ্যক - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

14 August, 2018

আরণ্যক

 বৈদিক সাহিত্য- আরণ্যক ও উপনিষদ
বৈদিক সাহিত্যে ‘ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থগুলির শেষাংশে আর একজাতীয় রচনা সংযোজিত দেখা যায়, তার নাম ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’। এই রচনাগুলি ‘ব্রাহ্মণে’র সঙ্গে এমনভাবে সংযোজিত হয়েছে যে অনেক সময় ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘আরণ্যকে’র মধ্যে সীমারেখা সুস্পষ্ট নয় এবং ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদে’র মধ্যেও পার্থক্য প্রায় অস্পষ্ট। তবুও রচনাকালের দিক থেকে ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’ অবশ্যই পরবর্তী এবং আলোচ্য-বিষয়ের দিক থেকে ‘ব্রাহ্মণে’র সঙ্গে বিশেষ করে ‘উপনিষদে’র পার্থক্য অত্যন্ত মৌলিক।

বলা হয়, ‘ব্রাহ্মণ’ ভাগের পরিশিষ্ট অংশ হচ্ছে ‘আরণ্যক’। অরণ্য বা বন সম্পর্কিত রচনা বলে এগুলোর নাম হয়েছে ‘আরণ্যক’। বৃদ্ধ বয়সে যাঁরা সংসার ধর্ম ত্যাগ করে তপস্যার জন্য অরণ্যবাসী হয়েছেন তাঁদের ধর্মীয় জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে পথ প্রদর্শন করে এই ‘আরণ্যক’ রচিত হয়। ‘আরণ্যক’ নামের রচনাগুলির মধ্যে প্রধানত যাগযজ্ঞ সম্পর্কিত এবং দেবতা সম্পর্কিত বক্তব্য থাকতো। তবে এগুলির বাইরেও অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে যে দার্শনিক চিন্তার জন্ম হয় তার আভাস আরণ্যক গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। অথর্ববেদ ছাড়া অন্যসব সংহিতারই ‘আরণ্যক’ গ্রন্থ রয়েছে। তবে বস্তুত বৈদিক ও সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রাচীন ‘উপনিষদ’গুলিতেই সর্বপ্রথম সুস্পষ্ট ও সচেতন দার্শনিক প্রচেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় এবং পরবর্তী কালেও ভারতীয় দর্শনের অন্তত সম্প্রদায়বিশেষের কাছে ‘উপনিষদ’গুলির গুরুত্ব প্রায় অসীম।

অত্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরে উপনিষদকে অত্যন্ত গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়েছে বলেই অনেক পরবর্তী যুগেও বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায় ও দর্শন-সম্প্রদায়ের প্রচারকেরা নিজেদের বক্তব্যের মর্যাদা বাড়াবার উৎসাহে ‘উপনিষদ’ নাম দিয়ে নতুন নতুন গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুক্তিক উপনিষদে ১০৮টি উপনিষদের কথা জানা যায়। এবং নির্ণয় সাগর প্রেস হতে বাসুদেব লক্ষণ শাস্ত্রী উপনিষদের যে সংকলন গ্রন্থ বের করেছিলেন তাতে ১১২টি উপনিষদ স্থান পেয়েছিলো। স্বভাবতই ‘উপনিষদ’ নাম ব্যবহৃত হলেও এ-জাতীয় গ্রন্থাবলীকে প্রকৃত বৈদিক ‘উপনিষদ’ মনে করবার কোনো কারণ নেই। কেননা প্রত্যেকটি প্রাচীন (আরণ্যক’ ও) ‘উপনিষদ’ই কোনো-না-কোনো ‘বেদ’ বা বেদের শাখার সঙ্গে সংযোজিত। তাই যেগুলি বেদের অঙ্গীভূত বা ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সাথে সংযুক্ত নয় সেগুলিকে বৈদিক সাহিত্যের অংশ বলে স্বীকার করা হয় না। অর্থাৎ সেগুলি অনেক পরে রচিত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বেদবিদ পণ্ডিতেরা প্রকৃত বৈদিক উপনিষদ হিসেবে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপনিষদগুলি হলো,– ঈশ, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, প্রশ্ন, কেন, কঠ, মুন্ডক, মাণ্ডুক্য, কৌষীতকি, মৈত্রী ও শ্বেতাশ্বতর এই তেরোটি উপনিষদ। যেমন–

(ক) বেদের অঙ্গীভূত উপনিষদ :
—-(১) ঈশ,– শুক্ল-যজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার অংশ
—-(২) ঐতরেয়,– ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের অংশ
—-(৩) কৌষীতকি,– ঋগ্বেদের শাংখ্যায়ন আরণ্যকের অংশ
—-(৪) তৈত্তিরীয়,– কৃষ্ণ-যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ
—-(৫) বৃহদারণ্যক,– শুক্ল-যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ
—-(৬) কেন,– সামবেদের জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণের অংশ
—-(৭) ছান্দোগ্য,– সামবেদের ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অংশ
—-(৮) প্রশ্ন,– অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তর্ভুক্ত
(খ) ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সাথে সংযুক্ত :
—-(৯) কঠ,– ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত
—-(১০) শ্বেতাশ্বতর,– ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত
—-(১১) মুণ্ডক,– ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ববেদের অন্তর্ভুক্ত
—-(১২) মাণ্ডুক্য,– ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ববেদের অন্তর্ভুক্ত
—-(১৩) মৈত্রায়ণীয়,– ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত

উল্লেখ্য, সর্বশেষ মৈত্রায়ণীয় বা মৈত্রী উপনিষদকে বৈদিক-সাহিত্যের অংশ হিসেবে গ্রহণ না করে কোথাও কোথাও বারোটি উপনিষদকেই বৈদিক-উপনিষদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যেহেতু প্রত্যেকটি ‘উপনিষদ’ কোন-না-কোন বেদের সাথে সংযোজিত, তাই উপনিষদের তালিকা প্রস্তুত করবার সয় বেদ-ব্রাহ্মণ-আরণ্যকের সঙ্গে সেগুলির সম্পর্কও উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় বলে বিদ্বানেরা মনে করেন। সে-অনুযায়ী তালিকাটি হলো–

——————————————————————————————————-
সংহিতা——-     ————ব্রাহ্মণ—–          ———–আরণ্যক—–               –উপনিষদ–।
——————————————————————————————————-
ঋগ্বেদ-        ১। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ।                ১। ঐতরেয় আরণ্যক।        ১। ঐতরেয় উপনিষদ
                 ২। কৌষীতকি ব্রাহ্মণ               ২। কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন  ২। কৌষীতকি-উপনিষদ্
——————————————————————————————————-
সামবেদ-      ১। পঞ্চবিংশ বা তাণ্ড্যমহা           ১। আরণ্যক সংহিতা         ১। ছান্দোগ্য উপনিষদ্
                 ২। ষড়বিংশ                         ২। আরণ্যক-গান             ২। কেন-উপনিষদ্
                ৩। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ              ৩। জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ            ৩। জৈমিনীয়-উপনিষদ ব্রাহ্মণ
——————————————————————————————————-
কৃষ্ণ-যজুর্বেদ   ১। কঠ ব্রাহ্মণ                       ১। কঠ আরণ্যক              ১। কঠ-উপনিষদ্
                  ২। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ                  ২। তৈত্তিরীয়                  ২। তৈত্তিরীয়-উপনিষদ্
                                                                                         ৩। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ 
                                                                                         ৪। মৈত্রী-উপনিষদ্ বা
                                                                                             মৈত্রাণীয়-উপনিষদ্
——————————————————————————————————-
শুক্ল-যজুর্বেদ        ১। শতপথ ব্রাহ্মণ            ১। শতপথ আরণ্যক          ১। বৃহদারণ্যক-উপনিষদ্
                                                                                           ২। ঈশ-উপনিষদ্
——————————————————————————————————-
অথর্ববেদ            ১। গোপথ ব্রাহ্মণ                         (নাই)                   ১। মুণ্ডক-উপনিষদ্
                                                                                           ২। মাণ্ডুক্য-উপনিষদ্
                                                                                           ৩। প্রশ্ন-উপনিষদ্
——————————————————————————————————

এই তেরোটি উপনিষদের মধ্যে কোনো-কোনোটি আকারের দিক থেকে নেহাতই নগণ্য। যেমন, ঈশ-উপনিষদে মোট শ্লোক-সংখ্যা ১৮টি, এক্ষেত্রে মাণ্ডুক্য-উপনিষদের কলেবর আরও ছোট, মাত্র ১২টি শ্লোক। কেন-উপনিষদ এবং ঐতরেয়-উপনিষদের আকার সামান্য বড়। তবে আকারে ছান্দোগ্য-উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক-উপনিষদ সবচেয়ে বড়।
সামবেদের অঙ্গ ছান্দোগ্য-উপনিষদের আটটি অধ্যায়ে ৬২৭টি মন্ত্র রয়েছে। এই আটটি অধ্যায় ১৫৪টি খণ্ডে বিভক্ত। তবে মন্ত্রসংখ্যা প্রতি খণ্ডে সমসংখ্যক নয়, কোন খণ্ডে কম, কোন খণ্ডে বেশি। শুক্ল-যজুর্বেদের অঙ্গ বৃহদারণ্যক-উপনিষদে ছয়টি অধ্যায়ে ৪৪টি খণ্ড; সর্বশুদ্ধ এর মন্ত্রসংখ্যা ৪৩৯টি। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অঙ্গ তৈত্তিরীয়-উপনিষদের অধ্যায় তিনটি, খণ্ড-সংখ্যা ৩০ এবং মোট মন্ত্রসংখ্যা মাত্র ৫০টি। ঋগ্বেদের অঙ্গ ঐতরেয়-উপনিষদে তিনটি অধ্যায়ে মন্ত্র রয়েছে মাত্র ৩৩টি। প্রথম অধ্যায়ে খণ্ড ৩টি, বাকি দুটি অধ্যায় অখণ্ড। সামবেদীয় কেন-উপনিষদে চারটি অধ্যায়ে মন্ত্রসংখ্যা ৩৪টি। কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয় কঠ-উপনিষদের দুটি অধ্যায়ে সর্বশুদ্ধ মন্ত্রসংখ্যা ১২৭। প্রতিটি অধ্যায় তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদ ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত; মোট মন্ত্রসংখ্যা ১১৩টি। অথর্ববেদীয় মুণ্ডক-উপনিষদের তিনটি অধ্যায়ে মোট মন্ত্রসংখ্যা ৬৫টি। প্রতিটি অধ্যায় দুটি খণ্ডে বিভক্ত। অথর্ববেদীয় প্রশ্ন-উপনিষদে অধ্যায় ছয়টি এবং মোট মন্ত্রসংখ্যা ৬৭টি। অথর্ববেদীয় মাত্র বারো শ্লোকের মাণ্ডুক্য-উপনিষদ বুঝতে হলে ২১৫ শ্লোকের গৌড়পাদ কারিকা ছাড়া অন্দরে প্রবেশ করা যায় না।

রচনাভঙ্গির দিক থেকে সমস্ত উপনিষদই এক-রকমের নয়। কোনোটি আগাগোড়াই ছন্দোবদ্ধ শ্লোকে রচিত, কোনোটি আগাগোড়া গদ্যে রচিত, আবার কোনোটির রচনা আংশিক গদ্যে ও আংশিক পদ্যে। কিন্তু মোটের উপর গদ্য-রচনার পরিচয়ই তুলনায় অনেক বেশি। এবং এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১১৩) বলেন-
আধুনিক বিদ্বানেরা অনুমান করেছেন যে পদ্যে– বা আংশিকভাবে পদ্যে– রচিত উপনিষদগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের রচনা। এ-জাতীয় উপনিষদ বলতে, ঈশা-উপনিষদ, কঠ-উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদ, মুণ্ডক-উপনিষদ, এবং প্রশ্ন-উপনিষদ,– যদিও অবশ্য প্রশ্ন-উপনিষদে পদ্যাংশ যৎসামান্যই। অপরপক্ষে, ঐতরেয়-উপনিষদ, বৃহদারণ্যক-উপনিষদ, ছান্দোগ্য-উপনিষদ, তৈত্তিরীয়-উপনিষদ এবং কৌষীতকি-উপনিষদ গদ্যে রচিত এবং সে-গদ্য বহুলাংশেই ‘ব্রাহ্মণ’-গ্রন্থের অনুরূপ। শুধু তাই নয়; এই পাঁচটি উপনিষদের সঙ্গে ‘ব্রাহ্মণ’-গ্রন্থের সম্পর্ক ও সংযোগ অনেক সুস্পষ্ট। অপর-পক্ষে ঈশ, কঠ প্রভৃতি পূর্বোল্লিখিত পাঁচটি উপনিষদের ক্ষেত্রে তা নয়। এগুলিকে আমরা কোনো আরণ্যকের অংশ হিসেবে পাই না; তার বদলে স্পষ্টই বোঝা যায়, পরবর্তী কালে রচিত হয়েও এগুলি প্রথাগতভাবে কিন্তু সরাসরি কোনো-না-কোনো বেদ বা বেদের শাখার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। অতএব, ঐতরেয়, বৃহদারণ্যক প্রভৃতি পাঁচটি উপনিষদকেই প্রাচীনতম বলে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু উপনিষদের প্রাচীনত্ব-নির্ণয়ে আধুনিক বিদ্বানেরা শুধুমাত্র গদ্যরীতির উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখেন নি। যেমন, মৈত্রী-উপনিষদ বা মৈত্রায়ণীয়-উপনিষদ এবং মাণ্ডুক্য-উপনিষদ গদ্যে রচিত হলেও সে-গদ্য ‘ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থের গদ্যের মতো নয় এবং এই দুটি উপনিষদকে সবচেয়ে পরবর্তী কালের রচনা বলেই সনাক্ত করা হয়েছে। অপরপক্ষে, কেন-উপনিষদ আংশিক গদ্যে এবং আংশিক পদ্যে রচিত; তবুও এটি ঈশ প্রভৃতির পূর্ববর্তী– যদিও ঐতরেয় প্রভৃতির পরবর্তী– বলে বিবেচিত। এদিক থেকে সংক্ষেপে ১৩টি মূল উপনিষদের তালিকা- 
ক।। সর্বপ্রাচীন ও গদ্যে রচিত উপনিষদ্ :
—-১। ঐতরেয়।
—-২। বৃহদারণ্যক।
—-৩। ছান্দোগ্য।
—-৪। তৈত্তিরীয়।
—-৫। কৌষীতকি।
খ।। অপেক্ষাকৃত পরবর্তী এবং আংশিকভাবে পদ্যে রচিত উপনিষদ্ :
—-৬। কেন।
গ।। আরও পরবর্তী এবং সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পদ্যে রচিত উপনিষদ্ :
—-৭। ঈশা।
—-৮। কঠ।
—-৯। শ্বেতাশ্বতর।
—-১০। মুণ্ডক।
—-১১। প্রশ্ন।
ঘ।। সর্ব-পরবর্তী, যদিও গদ্যে রচিত উপনিষদ্ :
—-১২। মৈত্রী (বা মৈত্রায়ণীয়)।
—-১৩। মাণ্ডুক্য।

কিন্তু কাল-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষক-পণ্ডিতদের মধ্যে তারপরও মনে হয় কিছুটা পার্থক্য রয়ে গেছে। যেমন পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘দর্শন-দিগদর্শন’ দ্বিতীয় খণ্ডে (পৃষ্ঠা-২৪) উপনিষদের কাল-ক্রম উল্লেখপূর্বক যে তালিকাটি দিয়েছেন তা নিম্নরূপ–
আনুমানিকঃ
(১) প্রাচীনতম উপনিষদ (৭০০ খৃঃ.পূঃ)
—-(ক) ঈশ, (খ) ছান্দোগ্য, (গ) বৃহদারণ্যক
(২) দ্বিতীয় যুগের উপনিষদ (৬০০-৫০০ খৃঃ.পূঃ)
—-(ক) ঐতরেয়, (খ) তৈত্তিরীয়
(৩) তৃতীয় যুগের উপনিষদ (৫০০-৪০০ খৃঃ.পূঃ)
—-(ক) প্রশ্ন, (খ) কেন, (গ) কঠ, (ঘ) মুণ্ডক, (ঙ) মাণ্ডুক্য
(৪) চতুর্থ যুগের উপনিষদ (২০০-১০০ খৃঃ.পূঃ)
—-(ক) কৌষীতকি, (খ) মৈত্রী, (গ) শ্বেতাশ্বতর

তবুও কাল-ক্রম নির্ণয়ে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও তা হয়তো ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে না, কেননা, উভয়ক্ষেত্রেই আলোচ্য সেই তেরোটি উপনিষদই তালিকাভুক্ত আছে। আসল কথা হলো, সমস্ত উপনিষদেরই রচনাকাল সমান নয়। কিন্তু এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গবেষকদের মতে, বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্যের মতো প্রাচীন ও বৃহদাকার উপনিষদগুলি মোটেই কোনো রকম সুসংহত গ্রন্থ নয়। বরং প্রায়ই দেখা যায়, বিভিন্ন পরিচ্ছেদে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত এবং এমনকি অসংলগ্নভাবে বিভিন্ন উপাখ্যান এবং দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে। এবং একই উপাখ্যান এবং একই দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা বিভিন্ন উপনিষদে বিভিন্ন ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অতএব অনুমান করা হয়, এই উপনিষদগুলিকে আমরা পরবর্তী কালে যে সামগ্রিক রূপে পেয়েছি আদিতে মোটেই তা ছিলো না; তার বদলে খুব সম্ভব কয়েকটি ছোট ছোট স্বতন্ত্র উপনিষদকে একত্রিত করে এ-জাতীয় বড় উপনিষদে পরিণত করা হয়েছিলো এবং এইভাবে সামগ্রিক রূপ দেবার সময় নিশ্চয়ই কিছু কিছু নতুন অংশ সংযোজিত হওয়াও অসম্ভব নয়। অতএব ধারণা করা হয়, প্রাচীনতর উপনিষদগুলিও আগাগোড়া সমান প্রাচীন নয়– সম্ভবত একই উপনিষদের মধ্যে প্রাচীন ও পরবর্তী রচনা পাশাপাশি সংকলিত হয়েছে।

তবে ‘ব্রাহ্মণে’র সঙ্গে ‘উপনিষদ’গুলিকে সংযোজিত করে উভয়ের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা প্রতিপন্ন করবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই যে দুয়ের আলোচ্য বিষয়ে অন্তত মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন, ‘ব্রাহ্মণে’র মূল আলোচ্য হলো যাগযজ্ঞ। অন্যদিকে, যজ্ঞের কথা মাঝে মাঝে উল্লিখিত হলেও উপনিষদের মূল বিষয়বস্তু দার্শনিক তত্ত্বই। অতএব প্রশ্ন ওঠে, ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘উপনিষদ’ উভয়ই কি একই শ্রেণীর মানুষের রচনা? এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন-
যাঁরা ‘ব্রাহ্মণ’ রচনা করেছিলেন তাঁরাই– বা তাঁদের বংশধরেরাই উপনিষদ রচনা করেছিলেন,– একথা স্বীকার করলে অনুমান করতে হয় যে কালক্রমে যজ্ঞকথায় তাঁরা নিস্পৃহ হয়েছিলেন এবং ক্রমশই তাঁদের মন বিশ্বের রহস্য অনুসন্ধানের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অনেক সময় এ-জাতীয় একটি কথাই স্বীকার করা হয়। কিন্তু তাতে বাধা আছে। আমরা আগেই দেখেছি, ‘ব্রাহ্মণ’-গ্রন্থাবলী ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণীর রচনা এবং পুরোহিত-শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু ওই পুরোহিতেরা যে কালক্রমে নিজেদের স্বার্থ ভুলে, যজ্ঞ-কথায় নিস্পৃহ হয়ে, নির্লিপ্তভাবে বিশ্ব-রহস্যের অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন– এ-কথা কল্পনা করবার কোনো বাস্তব বা ঐতিহাসিক কারণ নেই। বরং উপনিষদেরই আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য হলো, উপনিষদের যুগেও ব্রাহ্মণ-পুরোহিতেরা বড় বড় রাজারাজড়াদের হয়ে যজ্ঞ-কর্ম সম্পাদন করছেন এবং দক্ষিণা হিসেবে প্রভূত গো-সম্পদাদি লাভ করছেন।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৫)

এ-ব্যাপারে উপনিষদীয় সাক্ষ্য হিসেবে দু-একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ছান্দোগ্য-উপনিষদের একটি উপাখ্যান এরকম (ছান্দোগ্য-১/১০/১-১/১১/৩)–
‘মটচীহতেষু কুরুষ্বাটিক্যা সহ জায়য়োষস্তির্হ চাক্রায়ণ ইভ্যগ্রামে প্রদাণক উবাস। (ছান্দোগ্য-১/১০/১)।।…… স হ প্রাতঃ সঞ্জিহান উবাচ যদ্বতান্নস্য লভেমহি লভেমহি ধনমাত্রাং রাজাহসৌ যক্ষ্যতে স মা সর্বৈরার্ত্বিজ্যৈর্বৃণীতেতি। (ছান্দোগ্য-১/১০/৬)।।…… ভগবাংস্ত্বেব মে সর্বৈরার্ত্বিজ্যৈরিতি তথেত্যথ তর্হ্যতে এব সমতিসৃষ্টাঃ স্তুবতাং যাবত্ত্বেভ্যো ধনং দদ্যান্তাবন্মম দদ্যা ইতি তথেতি হ যজমান উবাচ’। (ছান্দোগ্য-১/১১/৩)।।
আখ্যানটির অংশ-বিশেষের সংক্ষিপ্ত তর্জমা :
‘একবার কুরুদেশ যখন শিলাবৃষ্টিতে বিধ্বস্ত হয়েছিলো তখন উষস্তি চাক্রায়ণ (জনৈক পুরোহিত) ‘ইভ্য’-গ্রামে আপন পত্নীকে নিয়ে অত্যন্ত দুর্দশায় পড়েছিলেন।’ ভিক্ষালব্ধ উচ্ছিষ্ট মাষকলাই খেয়ে তিনি রাত কাটালেন; পরদিন সকালে স্ত্রীকে বললেন, ‘হায়, যদি কিঞ্চিৎ অন্ন পেতাম তাহলে কিছু অর্থলাভ হতো। ঐ রাজা যজ্ঞ করবেন; ঋত্বিকগণের সমুদয় কার্য-সম্পাদনের জন্য তিনি আমাকে বরণ করতেন।’ স্ত্রী পূর্ব-দিবসের ভিক্ষালব্ধ মাষকলাই সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, স্বামীকে খেতে দিলেন। তাই খেয়ে তিনি প্রারব্ধ যজ্ঞে গমন করলেন এবং ইতোমধ্যে রাজা যে পুরোহিতদের যজ্ঞকর্মে নিযুক্ত করেছিলেন উষস্তি তাঁদের প্রত্যেককে জ্ঞান-দ্বন্দ্বে আহ্বান করলেন। অনন্তর যজমান তাঁকে বললেন, ‘আমি আপনাকে জানতে ইচ্ছা করি।’ উষস্তি বললেন, ‘আমি উষস্তি চাক্রায়ণ।’ যজমান বললেন, ‘এই সমুদয় ঋত্বিক-কর্মের জন্য আমি সর্বত্র আপনার অন্বেষণ করেছিলাম; আপনার সন্ধান পাই নি বলেই অন্য সমুদয় লোককে বরণ করেছিলাম। আপনিই আমার সমস্ত ঋত্বিক-কার্যের ভার গ্রহণ করুন। উষস্তি বললেন, ‘তাই হোক। এখন এরাই আমার অনুমতিতে স্তুতিগান করুক। আপনি এদের যে-পরিমাণ অর্থ দেবেন আমাকেও সেই পরিমাণ অর্থ দেবেন।’ যজমান বললেন, ‘তাই দেব।’

বৃহদারণ্যক-উপনিষদের একটি উপাখ্যান এরকম (বৃহদারণ্যক-৩/১/১-২)–
‘জনকো হ বৈদেহো বহুদক্ষিণেন যজ্ঞেনেজে। তত্র হ কুরুপঞ্চালানাং ব্রাহ্মণা অভিসমেতা বভুবুঃ। তস্য হ জনকস্য বৈদেহস্য বিজিজ্ঞাসা বভূব–কঃ স্বিদেষাং ব্রাহ্মণানাং অনুচানতম ইতি।…… –নমো বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো গোকামা এব বয়ং স্ম ইতি। তং হ তত এব প্রষ্টুং দধ্রে হোতা অশ্বলঃ–।’ (বৃহদারণ্যক-৩/১/১-২)।।
আখ্যানটির অংশ-বিশেষের সংক্ষিপ্ত তর্জমা :
বিদেহ-রাজ জনক একবার বহু-দক্ষিণাযুক্ত বিশাল এক যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। সেই যজ্ঞে কুরু এবং পাঞ্চালের বহু ব্রাহ্মণ সমাগত হয়েছিলেন। বিদেহ-রাজ জনকের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগলো– ‘এই ব্রাহ্মণদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, ব্রহ্মিষ্ঠতম?’ তিনি সহস্র গাভী অবরুদ্ধ করালেন এবং প্রত্যেক গাভীর শিঙ-এ দশটি করে (সুবর্ণময়) পাদ আবদ্ধ করা হলো। এবং তিনি ব্রাহ্মণদের বললেন, ‘হে পূজ্যপাদ ব্রাহ্মণগণ, আপনাদের মধ্যে যিনি ব্রহ্মিষ্ঠ (শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ) তিনি এই গাভীগুলি নিয়ে যান।’ উক্ত ব্রাহ্মণেরা প্রগল্ভতা প্রকাশ করলেন না। তখন যাজ্ঞবল্ক্য নিজের শিষ্যকে বললেন, ‘হে সৌম্য সামশ্রবা, এই গাভীগণকে চালিত কর।’ এতে অন্য ব্রাহ্মণরা ক্রুদ্ধ হয়ে ভাবলেন, ‘ইনি কীভাবে নিজেকে আমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্মিষ্ঠ বলতে পারেন?’ অতএব, বিদেহরাজ নিযুক্ত অন্যান্য পুরোহিতেরা যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করতে লাগলেন।

এ-জাতীয় দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই বোঝা যায়, উপনিষদের যুগেও ধনী যজমানেরা বড় বড় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করাতেন এবং ব্রাহ্মণেরা তাতে পৌরহিত্য করে প্রভূত ধনসম্পদ লাভ করতেন। অতএব মনে হয় না যে এই যুগে ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞে নিস্পৃহ হয়ে দার্শনিক তত্ত্বে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যদিও এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে উপনিষদে অনেক সময় যজ্ঞানুষ্ঠানের নানা রকম দার্শনিক ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করবার আয়োজন হয়েছিলো। যেমন, অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বকে বৃহদারণ্যক-উপনিষদের ঋষি ভাবছেন–
‘ওঁ ঊষা বা অশ্বস্য মেধ্যস্য শিরঃ। সূর্যশ্চক্ষুর্বাতঃ প্রাণো, ব্যাত্তম্ অগ্নিঃ বৈশ্বানরঃ, সংবৎসর আত্মা অশ্বস্য মেধ্যস্য। দ্যৌঃ পৃষ্ঠম্, অন্তরিক্ষমুদরং, পৃথিবী পাজস্যম্ । দিশঃ পার্শ্বে, অবান্তরদিশঃ পর্শব, ঋতুবোহঙ্গানি, মাসাশ্চার্ধ মাসাশ্চ পর্বাণি, অহোরাত্রাণি প্রতিষ্ঠা, নক্ষত্রাণ্যস্থীনি, নভো মাংসানি। উবধ্যং সিকতাঃ, সিন্ধবো গুদা, যকৃচ্চ ক্লোমানশ্চ পর্বতা, ওষধয়শ্চ বনস্পতয়শ্চ লোমানি, উদ্যন্ পূর্বার্ধো, নিম্নোচন্, জঘনার্ধো, যৎ বিজৃম্ভতে তদ্ বিদ্যোততে, যৎ বিধূনুতে তৎ স্তনয়তি, যৎ মেহতি তৎ বর্ষতি বাগেবাস্য বাক্’।। (বৃহদারণ্যক-১/১/১)।।
অর্থাৎ :
ব্রাহ্মমুহূর্ত, সূর্যোদয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে পুব-আকাশে যে ঊষার আভাস, অশ্বের সেটি হলো শির অর্থাৎ মাথা; সূর্য তার চোখ; বায়ু তার প্রাণ; অশ্বের মুখব্যাদন হলো বৈশ্বানর অগ্নি; দেহ হলো সংবৎসর। ‘দৌঃ’ অর্থাৎ দ্যুলোক এর পিঠ; অন্তরিক্ষ এর উদর; আর পৃথিবী ‘পাজস্যম্’ অর্থাৎ খুর। দিকগুলি অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এই চারদিক হলো এর দুটি পাশ, আর অবান্তর দিকগুলি অর্থাৎ অগ্নি-নির্ঋত-বায়ু-ঈশান– এই চার কোণ হলো অশ্বের পাঁজর। ঋতুগুলি এর অঙ্গ; মাস আর পক্ষ এর পর্ব অর্থাৎ সন্ধিস্থল। এই অশ্বমেধ অশ্বের চারটি পা হলো দিন এবং রাত্রি; আকাশের অগণিত নক্ষত্র হলো এর অস্থি, আকাশের মেঘ হলো এর মাংস।
‘উবধ্য’ অর্থাৎ উদরের অর্ধজীর্ণ-অর্ধপরিপক্ক খাদ্য হলো পৃথিবীর বালুকারাশি; নদীগুলি হলো এর নাড়ী। যকৃৎ এবং ‘ক্লোম’ অর্থাৎ গলনালী হলো ভূখণ্ডের তাবৎ পর্বত; অশ্বের গায়ে যে লোমরাজি, তা হলো ভূভাগের তাবৎ ওষধি-লতা আর বনস্পতি; অশ্বের প্রথম অর্ধ হলো উদীয়মান সূর্য আর শেষ-অর্ধ হলো অস্তগামী সূর্য। বিশ্বরূপ সেই অশ্ব যখন হাই তোলে, তখন আকাশে চমকে ওঠে বিদ্যুৎলহরী; সে যখন গাত্র বিধূনন করে অর্থাৎ শরীর কাঁপায়, তখন আকাশের মেঘ করে গর্জন। অশ্বের মূত্র-ত্যাগ মেঘের বারি বর্ষণ, আর শব্দ বা বাক্ হলো অশ্বের হ্রেষারব।

অতএব, যে-ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরা ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্য রচনা করেছিলেন সেই শ্রেণীর লোকেরাই যে পরবর্তী যুগে যজ্ঞানুষ্ঠানের পরিবর্তে দার্শনিক তত্ত্বে উৎসাহী হয়ে উপনিষদ রচনা করেন– এ-কথা মনে করা বোধহয় যুক্তিসঙ্গত নয়। তাছাড়া, উপনিষদেরই আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য আছে যে এ-যুগে যাঁরা দার্শনিক চর্চায় অগ্রণী ছিলেন তাঁরা প্রায়ই ক্ষত্রিয় শ্রেণীর মানুষ– ব্রাহ্মণ নন। এ-বিষয়েও দু-একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ছান্দোগ্য-উপনিষদে (ছান্দোগ্য-৫/৩/১-৭) একটি উপাখ্যান পাওয়া যায় এরকম–
‘শ্বেতকেতুর্হারুণেয়ঃ পঞ্চালানং সমিতিমেয়ায় তং হ প্রবাহণো জৈবলিরুবাচ কুমারানু ত্বাশিষৎ পিতেতানু হি ভগব ইতি। (ছান্দোগ্য-৫/৩/১)।।…… পঞ্চ মা রাজন্যবন্ধুঃ প্রশ্নানপ্রাক্ষীৎ তেষাং নৈকঞ্চনাশকং বিবক্তুমিতি স হোবাচ যথা মা ত্বং তদৈতানবদো যথাহহমেষাং নৈকঞ্চন বেদ যদ্যহমিমানবেদিষ্যং কথাং তে নাবক্ষ্যমিতি। (ছান্দোগ্য-৫/৩/৫)।।…… তং হ চিরং বসেত্যাজ্ঞাপয়াঞ্চকার তং হোবাচ যথা মা ত্বং গৌতমাবদো যথেয়ং ন প্রাক্ ত্বত্তঃ পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মণান্ গচ্ছতি তস্মাদু সর্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব প্রশাসনমভূদিতি তস্মৈ হোবাচ’। (ছান্দোগ্য-৫/৩/৭)।।
আখ্যানটির অংশ-বিশেষের সংক্ষিপ্ত তর্জমা :
একদা শ্বেতকেতু আরুণেয় পাঞ্চালদের সমিতিতে গিয়েছিলেন। সেখানে রাজন্যবন্ধু (রাজার পরিষদ) প্রবাহণ জৈবলি তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘হে কুমার! তোমার পিতা কি তোমাকে উপদেশ দিয়েছেন?’ শ্বেতকেতু বলেন, ‘নিশ্চয়ই দিয়েছেন।’ তখন প্রবাহণ জৈবলি শ্বেতকেতুকে পরপর পাঁচটি দার্শনিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন; একটিরও উত্তর শ্বেতকেতুর জানা ছিলো না। অতএব শ্বেতকেতু ক্ষুব্ধভাবে পিতা গৌতমের কাছে প্রত্যাবর্তন করে বলেন, ‘আপনি আমাকে উপদেশ না-দিয়েই বলেছিলেন যে আমাকে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন! রাজন্যবন্ধু আমাকে পাঁচটি প্রশ্ন করলেন; আমি তার একটিও উত্তর দিতে পারিনি।’ প্রশ্নগুলি শুনে পিতা গৌতম বললেন, ‘তুমি আমাকে যেসব প্রশ্নের কথা বললে আমি তাদের একটিরও উত্তর জানি না। আমি জানলে তোমায় কেন বলবো না?’ অতএব স্বয়ং গৌতম রাজভবনে গেলেন। রাজা তাঁকে সমাদর করলেন। প্রাতঃকালে রাজা সভায় উপস্থিত হলে গৌতমও সেখানে গেলেন। রাজা তাঁকে বললেন, ‘ভগবন্ গৌতম, মনুষ্যসম্বন্ধী বিত্তের বর প্রার্থনা করুন।’ গৌতম বললেন, ‘হে রাজন্, মনুষ্যসম্বন্ধী বিত্ত আপনারই থাকুক। আপনি আমার পুত্রের কাছে যে-কথা বলেছিলেন, আমাকে তাই বলুন।’ শুনে রাজা বিষণ্ন হলেন এবং তিনি গৌতমকে বললেন, ‘দীর্ঘকাল (শিষ্য হিসেবে আমার কাছে) বাস করো। (গৌতম তাই করলেন। একদিন) রাজা তাঁকে বললেন, ‘তুমি আমাকে সেই বিষয় জিজ্ঞাসা করেছিলে– তোমার পূর্বে পূরাকালে কোনো ব্রাহ্মণই এই বিদ্যা লাভ করেনি; এইজন্য সর্বলোকে ক্ষত্রিয়দেরই ক্ষমতা ছিলো।’

বৃহদারণ্যক-উপনিষদেও (বৃহদারণ্যক-৬/২/১-৮) এই উপাখ্যানটি পাওয়া যায়; কেবল শেষাংশে সামান্য পার্থক্য। যেমন–
‘স হোবাচ প্রতিজ্ঞাতো ম এষ বরো যাং তু কুমারস্যান্তে বাচমভ্যষথাঃ তাং মে ব্রূহীতি। (বৃহদারণ্যক-৬/২/৫)।।  স হোবাচ দৈবেষু গৌতম তৎ বরেষু, মানুষাণাং ব্রূহীতি। (বৃহদারণ্যক-৬/২/৬)।।  স হোবাচ–বিজ্ঞায়তে হাস্তি হিরণ্যস্য আপাত্তং গো-অশ্বানাং দাসীনাং প্রবরাণাং পরিধানস্য মা নো ভবান্ বহোঃ অনন্তস্যাপর্যন্তস্য অভ্যবদান্যো ভূদিতি। স বৈ গৌতম তীর্থেনেচ্ছাসা ইত্যুপৈম্যহং ভবন্তম্ ইতি বাচা হ স্মৈব পূর্ব উপষন্তি। স হ উপায়নকীর্ত্যা উবাস। (বৃহদারণ্যক-৬/২/৭)।।  স হোবাচ তথা নস্ত্বং গৌতম মাপরাধাস্তব চ পিতামহা যথেয় বিদ্যেতঃ পূর্বং ন কস্মিংশ্চন ব্রাহ্মণ উবাস তাং তু অহং তুভ্যং বক্ষ্যামি। কো হি ত্বৈবং ব্রূবন্তুমর্হতি প্রত্যাখ্যাতুমিতি। (বৃহদারণ্যক-৬/২/৮)।।
অর্থাৎ :
গৌতম রাজাকে বললেন, ‘আপনি প্রতিজ্ঞা করলেন আমায় বর দেবেন। কুমারের কাছে আপনি যা বলেছিলেন আমায় তাই বলুন’ (বৃহদারণ্য-৬/২/৫)।  রাজা বললেন, ‘ওটা দৈববরের অন্তর্ভুক্ত। আপনার সাংসারিক যদি কোন অভাব থাকে সেই মানবীয় বর প্রার্থনা করুন’ (বৃহদারণ্যক-৬/২/৬)।  গৌতম বললেন, ‘রাজন্, আপনি জানেন আমার সুবর্ণের প্রাপ্তি আছে, গো, অশ্ব, দাসী এবং পরিবারবর্গের পরিধেয় বস্ত্রাদিও আছে। যাহা প্রভূত, অনন্ত ফলপ্রদ ও পর্যাপ্তিবিহীন সেই বস্তুটির প্রদান-বিষয়ে আপনি আমার প্রতি অবদান্য হবেন না।’ রাজা বলেন, ‘হে গৌতম, তাহলে যথোপযুক্তভাবে তা পেতে যত্ন করুন।’ গৌতম বললেন, ‘আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলাম’ (বৃহদারণ্যক-৬/২/৭)।  রাজা বললেন, ‘গৌতম, আপনি যেভাবে প্রার্থনা জানাচ্ছেন আপনাকে প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য আমার নেই। আচার্যের আসনে বসার জন্য আপনি আমাদের অপরাধ নেবেন না, যেমন আপনার পিতামহরাও নেননি। এই বিদ্যা এর পূর্বে কোনো ব্রাহ্মণ আয়ত্ত করেননি। আমি আপনাকে সেই বিদ্যা বলবো (বৃহদারণ্যক-৬/২/৮)।

এখানে রাজার উক্তির মধ্যে বিশেষ দ্রষ্টব্য হলো,– ‘ইয়ম্ বিদ্যা ইতঃ পূর্বম্ ন কস্মিন্চন ব্রাহ্মণ উবাস’, অর্থাৎ, এই বিদ্যা এর পূর্বে কোনো ব্রাহ্মণেই অবস্থান করেনি।
ছান্দোগ্য-উপনিষদের (ছান্দোগ্য-৫/১১/১-৬) আর একটি উপাখ্যান রয়েছে এরকম–
‘প্রাচীনশাল ঔপমন্যবঃ সত্যযজ্ঞঃ পৌলুষিরিন্দ্রদ্যুম্নো ভাল্লবেয়ো জনঃ শার্করাক্ষ্যো বুড়িল আশ্বতরাশ্বিস্তে হৈতে মহাশালা মহাশ্রোত্রিয়াঃ সত্যে মীমাংসাং চক্রূঃ কো ন আত্মা কিং ব্রহ্মেতি। (ছান্দোগ্য-৫/১১/১)।।…… স হ সম্পাদয়াঞ্চকার প্রক্ষ্যন্তি মামিমে মহাশালা মহাশ্রোত্রিয়াস্তেভ্যো ন সর্বমিব প্রতিপৎস্যে হন্তাহমন্যমভ্যনুশাসানীতি। (ছান্দোগ্য-৫/১১/৩)।।…… তে হোচুর্যেন হৈবার্থেন পুরুষশ্চরেত্তং হৈব বদেদাত্মানমেবেমং বৈশ্বানরং সম্প্রত্যধ্যেষি তমেব নো ব্রূহীতি।’ (ছান্দোগ্য-৫/১১/৬)।।
আখ্যানটির অংশ-বিশেষের সংক্ষিপ্ত তর্জমা :
পাঁচজন মহাগৃহস্থ এবং মহাবেদজ্ঞ– তাঁদের নাম, প্রাচীনশাল ঐপমন্যব, সত্যযজ্ঞ পৌলুষি, ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাল্লবেয়, জন শার্করাক্ষ্য, বুড়িল আশ্বতরাশ্বি– একত্রিত হয়ে বিচার করেছিলেন, ‘কে আমাদের আত্মা? ব্রহ্মই বা কী?’ তাঁরা ঠিক করলেন, ‘সম্প্রতি উদ্দালক আরুণি এই বৈশ্বানর আত্মাকে অবগত আছেন; তাঁর কাছে যাওয়া যাক।’ উদ্দালক স্থির করলেন, ‘এই মহাগৃহস্থ এবং মহাবেদজ্ঞরা আমাকে প্রশ্ন করবেন। সম্ভবত আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। এঁদের অন্য উপদেষ্টার কথা বলে দিই।’ তিনি তাঁদের বললেন, ‘হে ভগবদ্-গণ! সম্প্রতি অশ্বপতি কৈকেয় এই বৈশ্বানর আত্মাকে অবগত আছেন; তাঁর কাছে যাওয়া যাক।’ তাঁরা সকলে অশ্বপতি কৈকেয়-র কাছে গেলেন। অশ্বপতি কৈকেয় অভ্যাগতদের প্রত্যেককে পৃথক-পৃথক অভ্যর্থনা করালেন এবং প্রাতঃকালে শয্যাপরিত্যাগ করে বললেন, ‘আমার জনপদে চোর নেই, কুৎসিত ব্যক্তি নেই, মদ্যপ নেই, অগ্নিহোত্রী নয় এমন ব্রাহ্মণ নেই, অবিদ্বান নেই, স্বৈরী নেই, স্বৈরিণী নেই। হে ভগবদ্-গণ, আমি যজ্ঞে প্রবৃত্ত হয়েছি; এক-একজন ঋত্বিককে আমি যে-পরিমাণ ধন দেবো আপনাদের প্রত্যেককেও সেই পরিমাণ ধন দেবো। আপনারা এখানে বাস করুন।’ তাঁরা বললেন, ‘মানুষ যে-প্রয়োজনে আগমন করে সেই প্রয়োজনের কথাই বলা উচিত। আপনি বর্তমান কালে এই বৈশ্বানর আত্মাকে অবগত আছেন, তাঁর বিষয়ই আমাদেরকে বলুন।’ তিনি তাঁদের বললেন, ‘প্রাতঃকালে আমি প্রত্যুত্তর দেবো।’ তাঁরা (শিষ্যত্ব গ্রহণের লক্ষণ) সমিৎপাণি হয়ে পরদিন সকালে তাঁর কাছে আবার উপস্থিত হলেন এবং অশ্বপতি তাঁদের উপনীত (উপনয়ন সংস্কার) না করেই উপদেশ দিলেন।

বৃহদারণ্যক-উপনিষদের আর একটি আখ্যায়িকা (বৃহদারণ্যক-২/১/১-১৫) এরকম–
‘দৃপ্তবালাকির্হানুচানো গার্গ্য আস। স হোবাচাজাতশত্রুং কাশ্যং– ব্রহ্ম তে ব্রবাণীতি। স হোবাচ অজাতশত্রুঃ।–সহস্রমেতস্যাং বাচি দদ্মো। জনকো জনক ইতি বৈ জনা ধাবন্তীতি। (বৃহদারণ্যক-২/১/১)।।…… স হোবাচ অজাতশত্রুঃ–এতাবৎ নু? ইত্যেতাবৎ হি ইতি। নৈতাবতা বিদিতং ভবতীতি। স হোবাচ গার্গ্য–উপ ত্ত্বা যানীতি। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৪)।। স হোবাচাজাতশত্রুঃ–প্রতিলোমং চৈতদ্ যদ্ ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়মুপেয়াদ্ । ব্রহ্ম মে বক্ষ্যতীতি।’…(বৃহদারণ্যক-২/১/১৫)।।
কাহিনীটির অংশবিশেষ সংক্ষিপ্ত তর্জমা :
দৃপ্তবালাকি নামক জনৈক দাম্ভিক বিদ্বান গার্গ্য (গর্গগোত্রোদ্ভূত) ছিলেন। পাণ্ডিত্যাভিমানে তিনি কাশীরাজ অজাতশত্রুকে গিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে ব্রহ্ম-বিষয়ে উপদেশ দেবো।’ অজাতশত্রু বললেন, ‘এই কথার জন্যই আমি আপনাকে সহস্র গো দান করবো।’ সবাই ‘জনক’ ‘জনক’ বলে তাঁর সভাতেই ছোটেন, তিনি প্রসিদ্ধ দাতা এবং শ্রোতা বলে। তারপর অজাতশত্রু দৃপ্তবালাকি-কে প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং শেষ পর্যন্ত ওই গার্গ্য নীরব হলেন। গার্গ্যকে নীরব থাকতে দেখে রাজা অজাতশত্রু বললেন, ‘এই পর্যন্তই কি? আর কিছু বলবেন না?’ গার্গ্য বললেন, ‘এই পর্যন্তই। আর আমার কিছু বলার নেই।’ চূর্ণ-দর্প গার্গ্য বুঝলেন কাশীরাজ অজাতশত্রু অসীম জ্ঞানের অধীশ্বর। তাই নিমেষে সব অহমিকা ফেলে দিয়ে গার্গ্য বললেন, ‘রাজন্, আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাই। আপনি আমাকে ব্রহ্ম-উপদেশ দিন।’ বালাকির এই প্রস্তাবে কিছুটা বিব্রত অজাতশত্রু বললেন, ‘ব্রাহ্মণের পক্ষে ক্ষত্রিয়ের কাছে ব্রহ্মোপদেশ নিতে আসা বিপরীত পদ্ধতি (প্রতিলোমম্); আমি আপনাকে সে-বিষয়ে জ্ঞান দেবো।

প্রায় হুবহু এই উপাখ্যানটিই পাওয়া যায় কৌষীতকি-উপনিষদেও (কৌষীতকি-৪/১-১৯)। এবং এ-জাতীয় দৃষ্টান্ত থেকেই আধুনিক গবেষক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকে সিদ্ধান্ত করেছেন যে উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বদলে ক্ষত্রিয় শ্রেণীরই উদ্ভাবন। তবে, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন-
এইভাবে সমগ্র উপনিষদ-দর্শনকে একান্তভাবে ক্ষত্রিয়-শ্রেণীর সঙ্গে সংযুক্ত করা সত্যিই সম্ভব কিনা– এ-বিষয়েও নানা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কেননা, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, উপনিষদের একজন প্রধান দার্শনিক যাজ্ঞবল্ক্য সুস্পষ্টভাবে পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ ছিলেন, সত্যকাম জাবালকে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় কিছু বলেই সনাক্ত করা যায় না, শকটবান রৈক্ক-কে ব্রাহ্মণ বলেই অনুমান করা স্বাভাবিক। এবং এ-জাতীয় আরও নানা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা সম্ভব।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৭)

উল্লিখিত শকটবান রৈক্ক-এর পরিচয়-সন্ধান প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য-উপনিষদের চতুর্থ-অধ্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে রাজা জানশ্রুতি ও রৈক্ক উপাখ্যান রয়েছে। আর সত্যকাম জাবালের পরিচয় প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য-উপনিষদের প্রসিদ্ধ আখ্যানের শুরুতেই বর্ণনায় পাওয়া যায়–
সত্যকামো হ জাবালো জবালাং মাতরমামন্ত্রয়াঞ্চক্রে ব্রহ্মচর্যং ভবতি বিবৎস্যামি কিংগোত্রো ন্বহমস্মীতি। (ছান্দোগ্য-৪/৪/১)।।  সা হৈনমুবাচ নাহমেতদ্বেদ তাত যদ্-গোত্রস্ত্বমসি বহ্বহং চরন্তী পরিচারিণী যৌবনে ত্বামলভে সাহহমেতন্ন বেদ যদ্-গোত্রস্ত্বমসি জবালা তু নামাহমস্মি সত্যকামো নাম ত্বমসি স সত্যকাম এব জাবালো ব্রূবীথা ইতি। (ছান্দোগ্য-৪/৪/২)।।
অর্থাৎ :
একদা সত্যকাম জাবাল মাতা জবালাকে সম্বোধন করে বললেন– ‘পূজনীয় মা, আমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে (গুরুগৃহে) বাস করতে চাই। আমার কী গোত্র? (ছান্দোগ্য-৪/৪/১)।।  জবালা তাকে বললেন– ‘পুত্র, তোমার গোত্র কী তা আমি জানি না। যৌবনে বহু লোকের পরিচর্যায় ব্যস্ত থেকে আমি তোমাকে পেয়েছি। সুতরাং তুমি কোন্ গোত্রীয় তা জানতে পারিনি। আমার নাম জবালা এবং তোমার নাম সত্যকাম। সুতরাং (কেউ গোত্র জিজ্ঞাসা করলে) তুমি সত্যকাম জাবাল বলেই পরিচয় দিও।

অতএব, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সামগ্রিকভাবে উপনিষদের দর্শনকে শুধুমাত্র ক্ষত্রিয় শ্রেণীর অবদান বলা সম্ভব না-হলেও অন্তত স্বীকার করা প্রয়োজন যে এ-দর্শন বহুলাংশেই ক্ষত্রিয় শ্রেণীর উদ্ভাবন এবং উপনিষদের যুগে ক্ষত্রিয় রাজ-রাজড়ারা দার্শনিক আলাপ-আলোচনা রীতিমতো উপভোগ করতেন। যেমন, বৃহদারণ্যক-উপনিষদের একটি উপাখ্যানের শুরুটা হলো–
‘জনকো হ বৈদেহ আসাঞ্চক্রেহথ হ যাজ্ঞবল্ক্য আবব্রাজ। তং হোবাচ–যাজ্ঞবল্ক্য, কিমর্থমচারীঃ? পশূনিচ্ছন্, অন্বন্তনীতি? উভয়মেব সম্রাড়িতি হোবাচ।’ (বৃহদারণ্যক-৪/১/১)।।
অর্থাৎ :
একদা বিদেহ-রাজ জনক সভাসীন ছিলেন; এমন সময় যাজ্ঞবল্ক্য সেখানে উপস্থিত হলেন। জনক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘যাজ্ঞবল্ক্য, আপনি কী প্রয়োজনে এসেছেন– পশুকামনায়, না সূক্ষ্ম তত্ত্ব আলোচনার কামনায়?’ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ‘সম্রাট, আমি উভয় উদ্দেশ্যেই আগমন করেছি।’

অনন্তর জনক এবং যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যে দার্শনিক তত্ত্বের সুদীর্ঘ আলোচনা হলো।  অতএব, বলা যেতেই পারে যে, উপনিষদে যে দার্শনিকতার উন্মেষ ঘটেছে তার প্রধান অবদান ক্ষয়িত্রদেরই। আর যাগযজ্ঞ বিষয়ক আলোচনার বাইরে গিয়ে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের মধ্যে যে প্রাসঙ্গিক দর্শন-ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তা মূলত ক্ষত্রিয়-রাজন্য যজমানদের দর্শনালোচনায় নিরন্তর আগ্রহের প্রেক্ষিতে তাদেরকে সন্তুষ্ট করে প্রভূত ধন-সম্পদ লাভের অন্যতম উপায় হিসেবেই ব্রাহ্মণেরা দর্শনালোচনায় অভিনিবেশ করেছিলেন হয়তো। এখানে নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও জড়িত হয়ে পড়েছিলো। উপনিষদ জুড়ে যে দার্শনিক-তত্ত্বের উন্মেষ ঘটেছিলো যা থেকে পরবর্তীকালের দার্শনিক প্রস্থানগুলির জন্ম-স্পন্দন শুরু হয়েছিলো বলে দার্শনিক পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন, উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত-দর্শন প্রসঙ্গেই এই উপনিষদ-প্রতিপাদ্য তত্ত্বের আলোচনায় প্রত্যাবর্তন করা অধিকতর প্রাসঙ্গিক হবে।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

মনুস্মৃতি প্রথম অধ্যায়

স্মৃতি শাস্ত্রের মধ্যে মনুস্মৃতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন বৃ্হস্পতিস্মৃতিতে বলা হয়েছে- বেদার্থপ্রতিবদ্ধত্বাত্ প্রাধাণ্যং তু মনো: স্মৃত...

Post Top Ad

ধন্যবাদ