শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা দশম অধ্যায় - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

30 September, 2018

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা দশম অধ্যায়

দশম অধ্যায়-বিভূতি-যোগ

 শ্রীভগবানুবাচ
ভূয় এব মহাবাহো শৃণু মে পরমং বচঃ।
যত্তেহহং প্রীয়মাণায় বক্ষ্যামি হিতকাম্যয়।।১।।

শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর অর্জ্জুন !) ভূয়ঃ এব (পুনরায়) মে (আমার) পরমং (উৎকৃষ্ট) বচঃ (বাক্য) শৃণু (শ্রবণ কর) । যৎ (যেহেতু) প্রীয়মাণায় (প্রেমবান্) তে (তোমাকে) অহম্ (আমি) হিতকাম্যয়া (হিতকামনায়) বক্ষ্যামি (বলিব) ॥১॥


শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে মহাবাহো ! পুনর্ব্বার আমার উত্তম বাক্য শ্রবণ কর । যেহেতু প্রিয়পাত্র তোমাকে আমি তোমার মঙ্গল কামনা করিয়াই ইহা বলিব ॥১॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো! পুনরায় শ্রবণ কর। যেহেতু তুমি আমার প্রিয় পাত্র, তাই তোমার হিতকামনায় আমি পূর্বে যা বলেছি, তার থেকেও উৎকৃষ্ট তত্ত্ব বলছি।

 ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাং চ সর্বশঃ।।২।।

সুরগণাঃ (দেবতাগণ) মে (আমার) প্রভবং (সর্ব্বোত্তম বা সর্ব্ববিলক্ষণ জন্ম) ন বিদুঃ (জানেন না), মহর্ষয়ঃ ন (মহর্ষিগণও জানেন না) । হি (যেহেতু) অহম্ (আমি) দেবানাং (দেবতাদিগের) মহর্ষীণাং চ (ও মহর্ষিগণের) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বপ্রকারেই) আদিঃ (আদি কারণস্বরূপ) ॥২॥


সমস্ত দেবতাগণ আমার প্রকৃষ্ট বা সর্ব্ববিলক্ষণ জন্ম জানেন না, মহর্ষিগণও জানেন না । যেহেতু আমি দেবতাদিগের ও মহর্ষিগণের সর্ব্বপ্রকারেই আদি কারণ ॥২॥

অনুবাদঃ দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারেন না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।

যো মামজমনাদিং চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্।
অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্যেষু সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।৩।।

যঃ (যিনি) মাম্ (পরমেশ্বরকে) অজম্ (জন্মরহিত) অনাদিং (কারণ রহিত) লোকমহেশ্বরম্ চ (ও ভূত সকলের মহান্ ঈশ্বর বলিয়া) বেত্তি (জানেন), সঃ (তিনি) মর্ত্ত্যেষু (মনুষ্যগণের মধ্যে) অসংমূঢ়ঃ (মোহ বর্জ্জিত হইয়া) সর্ব্বপাপৈঃ (ভক্তিবিরোধী সমস্ত পাপ হইতে) প্রমুচ্যতে (মুক্ত হন) ॥৩॥


যিনি পরমেশ্বরকে, জন্মরহিত সর্ব্বাদি ও ভূতসকলের মহান্ ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তিনিই সমস্ত মনুষ্যলোকের মধ্যে সম্যক্ মোহরহিত হইয়া পাপ সমুদয় হইতে মুক্ত হইয়া থাকেন ॥৩॥

অনুবাদঃ যিনি আমাকে জন্মরহিত, অনাদি ও সমস্ত গ্রহলোকের মহেশ্বর বলে জানেন, তিনিই কেবল মানুষদের মধ্যে মোহশূন্য হয়ে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন।

বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ।
সুখং দুঃখং ভবোহভাবো ভয়ং চাভয়মেব চ।।৪।।
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোহযশঃ।
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগবিধাঃ।।৫।।

বুদ্ধিঃ (সূক্ষ্মার্থনিশ্চয় সামর্থ্য), জ্ঞানম্ (আত্মা অনাত্ম বিবেক), অসংমোহঃ (ব্যগ্রতার অভাব), ক্ষমা (সহিষ্ণুতা), সত্যং (যথার্থ ভাষণ), দমঃ (বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম), শমঃ (অন্তরিন্দ্রিয় সংযম), সুখং (সুখ), দুঃখং (দুঃখ), ভবঃ (জন্ম), অভাবঃ (মৃত্যু), ভয়ং চ (ভয়), অভয়ং এব চ (এবং অভয়) ; অহিংসা (অহিংসা) সমতা (নিজের তুলনায় সর্ব্বত্র সুখ দুঃখ দর্শন), তুষ্টিঃ (সন্তোষ), তপঃ (বেদোক্ত কায়ক্লেশ), দানং (দান), যশঃ (সুখ্যাতি) অযশঃ [চ] (ও অখ্যাতি) ভূতানাং (প্রাণিবর্গের) [এতে] (এই সমস্ত) পৃথগ্বিধাঃ (নানাপ্রকার) ভাবাঃ (ভাব) মত্তঃ এব (আমা হইতেই) ভবন্তি (উৎপন্ন হইয়া থাকে ) ॥৪–৫॥


বুদ্ধি, জ্ঞান, অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্যভাষণ, বাহ্য ইন্দ্রিয়গণের নিগ্রহ, অন্তরস্থ ইন্দ্রিয়গণের নিগ্রহ, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয় ও অভয়, অহিংসা, সর্ব্বত্র, সমদৃষ্টি, তুষ্টি, তপস্যা দান, যশ ও অযশ, প্রাণিমাত্রের এই সকল ভিন্ন ভিন্ন ভাব আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে ॥৪–৫॥

অনুবাদঃ বুদ্ধি, জ্ঞান, সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, ইন্দ্রিয়-সংযম, মনঃসংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, যশ ও অযশ- প্রাণীদের এই সমস্ত নানা প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়।

মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো মনবস্তথা।
মদভাবা মানসা জাতা যেষাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ।।৬।।

সপ্ত মহর্ষয়ঃ (মরিচ্যাদি সপ্ত মহর্ষিগণ) পূর্ব্বে (তাঁহাদরও পূর্ব্ববর্ত্তী) চত্বারঃ (সনকাদি চারিজন) তথা মনবঃ (এবং স্বায়ম্ভুবাদি চতুর্দ্দশ মনুগণ) [এতে] (ইঁহারা সকলেই) মদ্­ভাবাঃ (আমার প্রভাব সম্পন্ন) মানসাঃ জাতাঃ (এবং হিরণ্যগর্ভরূপী আমার মন হইতে উৎপন্ন), লোকে (এই পৃথিবীতে) ইমাঃ প্রজাঃ (এই দৃশ্যমান ব্রাহ্মণাদি প্রজাসমূহ) যেষাং (যাঁহাদের অর্থাৎ তাঁহাদেরই বংশজাত পুত্ত্রাদি ক্রমে এই পৃথিবী পরিপূর্ণ হইয়াছে) ॥৬॥


মরিচ্যাদি সপ্ত মহর্ষি, তৎপূর্ব্ববর্ত্তী সনকাদি ব্রহ্মর্ষি চতুষ্টয় এবং স্বায়ম্ভুবাদি চতুর্দ্দশ মনু ইঁহারা সকলেই আমার প্রভাব সম্পন্ন এবং হিরণ্যগর্ভরূপী আমার মন হইতে উৎপন্ন । এই ব্রহ্মাণ্ডে এই সকল দৃশ্যমান ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদি প্রজাসমূহই তাঁহাদের বংশজাত ॥৬॥

অনুবাদঃ সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেনে।

এতাং বিভূতিং যোগং চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
সোহবিকল্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ।।৭।।

যঃ (যিনি) মম (আমার) এতাং (এই) বিভূতিং (বিভূতি) যোগং চ (ও ভক্তিযোগ) তত্ত্বতঃ (যথার্থরূপে) বেত্তি (জ্ঞাত আছেন), সঃ (তিনি) অবিকল্পেন (নিশ্চল) যোগেন (তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা) যুজ্যতে (যুক্ত হন) ; অত্র (এই বিষয়ে) ন সংশয়ঃ [অস্তি] (সন্দেহ নাই) ॥৭॥


যিনি আমার এই বিভূতি ও ভক্তিযোগ সম্যক্­রূপে অবগত আছেন, তিনি নিশ্চল তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা ভক্তিযোগের অনুষ্ঠান করেন । এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই ॥৭॥

অনুবাদঃ ‍যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগ যথার্থরূপে জানেন, তিনি অবিচলিতভাবে ভক্তিযোগে যুক্ত হন। সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ।।৮।।

অহং (আমি) সর্ব্বস্য (ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবদাদি সর্ব্ব কারণেরও) প্রভবঃ (উৎপত্তি অদ্বয়জ্ঞান স্বয়ং ভগবান্), মত্তঃ (আমা হইতে) সর্ব্বং (চিদচিৎ জগচ্চেষ্টা ও বেদাদি শাস্ত্র প্রভৃতি) প্রবর্ত্ততে (প্রবর্ত্তিত হয়), ইতি (এই রহস্য) মত্বা (উপলব্ধি করিয়া) বুধাঃ (সুমেধগণ) ভাবসমন্বিতাঃ (দাস্যসখ্যাদিভাবযুক্ত হইয়া) মাং (আমাকে) ভজন্তে (ভজন করেন) ॥৮॥


আমি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও নারায়ণেরও আকরতত্ত্ব অদ্বয়জ্ঞান-স্বরূপ কৃষ্ণ, আমা হইতেই চিদচিদ্ বিলাসময় বিশ্ব, তচ্চেষ্টা ও উদ্দেশ্য সাধ্য-সাধনময় বেদাদি শাস্ত্র সমস্তই প্রবর্ত্তিত—এই রহস্য বিচারপর সুমেধগণ ধর্ম্মাধর্ম্ম সমুদয় উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক রাগভক্তি অবলম্বনে আমার ভজন করিয়া থাকেন ॥৮॥

অনুবাদঃ আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই সত্ত্ব অবগত হয়ে পন্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।

মচ্চিত্তা মদগতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ।।৯।।

[তে] (তাঁহারা) মচ্চিত্তাঃ (আমাতে নিবেদিতাত্মা) মদ্গতপ্রাণাঃ (মদাত্মভূতা) পরস্পরম্ (পরস্পর) বোধয়ন্তঃ (স্বরূপগত ভাব বিনিময় করিতে করিতে) মাং কথয়ন্তঃ চ [সন্তঃ] (আমার কথা আলোচনা করিতে করিতে) নিত্যং (সর্ব্বদা) তুষ্যন্তি চ (তুষ্ট হন) রমন্তি চ (এবং মধুর রস আস্বাদন করেন) ॥৯॥


আমাতে নিবেদিতাত্মা ও মদাত্মভূত ভক্তগণ পরস্পর আমার কথা আলোচনা ও আমার সম্বন্ধীয়-ভাবের আদান প্রদান করিতে করিতে সর্ব্বদা স্বরূপগত বাৎসল্য মাধুর্য্যাদি রস আস্বাদন করিয়া পরিতোষ লাভ করেন ॥৯॥

অনুবাদঃ যাঁদের চিত্ত ও প্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলোচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে।।১০।।

[অহং] (আমি) সততযুক্তানাং (নিত্য আমার সংযোগ কামনাশীল) প্রীতিপূর্ব্বকম্ (ও স্নেহ পূর্ব্বক) ভজতাং (ভজনকারী) তেষাং (তাঁহাদিগকে) তং (সেই) বুদ্ধিযোগং (বুদ্ধিযোগ) দদামি (দান করি) যেন (যদ্দ্বারা) তে (তাঁহারা) মাম্ (আমাকে) উপযান্তি (নিকটে পাইতে পারেন) ॥১০॥


আমি সেই সর্ব্বদা আমার আত্মভূত ও প্রেমপূর্ব্বক ভজনশীল ভক্তগণকে এইরূপ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দ্বারা তাঁহারা আমাতে উপগত হন বা বিবিধ অন্তরঙ্গ সেবাপ্রাপ্ত হন ॥১০॥

অনুবাদঃ যাঁরা ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিপূর্বক  আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।

তেষামেবানুকম্পার্থমহজ্ঞানজং তমঃ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা।।১১।।

তেষাম্ এব (তাঁহাদেরই) অনুকম্পার্থম্ (প্রেমাধীন হইয়াই) অহম্ (আমি) আত্মভাবস্থঃ [সন্] (তাঁদের অন্তরে প্রকাশিত হইয়া) ভাস্বতা (উজ্জ্বল) জ্ঞানদীপেন (মৎসাক্ষাৎকার রূপ জ্ঞান দ্বারা) অজ্ঞানজং (অদর্শন জন্য) তমঃ (মোহরূপ অন্ধকার) নাশয়ামি (নাশ করি) ॥১১॥


তাঁহারা জ্ঞানশূন্য প্রেমভক্তির পরমাবস্থায় ইষ্টবিরহজনিত ভ্রম-মোহাদি তমোভাবাক্রান্ত হইয়া পড়িলে আমি প্রেমাধীন হইয়া তাঁহাদের অন্তরে স্বরূপসাক্ষাৎকাররূপ উজ্জ্বল জ্ঞানদ্বারা বিরহদুঃখরূপ তমোনাশ করিয়া থাকি ॥১১॥
অথবা
তাঁহাদেরই অনুকম্পার্থ আমি জীবজগতের হৃদয়স্থ হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার নাশ করিয়া থাকি ॥১১॥

অনুবাদঃ তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞান-জনিত অন্ধকার নাশ করি।

 অর্জুন উবাচ


পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্।।১২।।
আহুস্ত্বামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষিনারদস্তথা।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে।।১৩।।

অর্জ্জুন উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) ভবান্ (আপনি) পরমং (পরম) পবিত্রং (অবিদ্যামালিন্যনাশক) পরং ধাম (সর্ব্বোৎকৃষ্ট শ্যামসুন্দর বপুই) পরং ব্রহ্ম (পরমব্রহ্ম অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবান্) [অহং মন্যে] (আমি মনে করি), সর্ব্বে ঋষয়ঃ (সকল ঋষিগণ) দেবর্ষিঃ নারদঃ (দেবর্ষি নারদ) অসিতঃ (অসিত) দেবলঃ (দেবল) তথা ব্যাসঃ (এবং মহর্ষি ব্যাস সকলেই) ত্বাম্ (আপনাকে) শাশ্বতং পুরুষং (সনাতন পুরুষ) দিব্যম্ (স্বয়ং প্রকাশ) আদিদেবম্ (আদিদেব) অজং (জন্মরহিত) বিভুম্ (ও সর্ব্বব্যাপক) আহুঃ (বলিয়া থাকেন), স্বয়ং চ এব (এবং আপনি নিজেই) মে (আমাকে) ব্রবীষি (বলিতেছেন) ॥১২–১৩॥


অর্জ্জুন কহিলেন—হে ভগবান্ আপনি পরব্রহ্ম, পরমাশ্রয় ও পরমপাবন ! দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল ও ব্যাসাদি প্রধান প্রধান মহর্ষিগণ সকলেই আপনাকে স্বয়ংপ্রকাশ স্বয়ম্ভু, সমগ্র ঐশ্বর্য্যের মূলীভূত লীলাময় সর্ব্বাদি সনাতন পুরুষোত্তমরূপে বর্ণন করিয়াছেন, এবং আপনি নিজেও তাহাই বলিতেছেন ॥১২–১৩॥

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ। তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাতে তা বলছ।

সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব।
ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুর্দেবা ন দানবাঃ।।১৪।।

[হে] কেশব ! (হে কেশব !) মাং (আমাকে) যৎ (‘ন মে বিদুঃ’ ইত্যাদি শ্লোক দ্বারা যাহা) বদসি (বলিতেছেন) এতৎ সর্ব্বম্ (এ সমস্তই) ঋতং (যথার্থ বলিয়া) মন্যে (মানি) । হি (ইহা নিশ্চয় যে) [হে] ভগবন্ (হে ভগবন্) তে (আপনার) ব্যক্তিং (পরিচয়) ন দেবাঃ দানবাঃ (কি দেবগণ, কি দানবগণ কেহই) ন বিদুঃ (জানেন না) ॥১৪॥


হে কেশব ! ‘ন মে বিদুঃ’ ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা আমাকে যাহা বলিতেছেন সে সমুদয়ই আমি যথার্থ বলিয়া মানি । হে ভগবন্ ! ইহা নিশ্চিত যে দেবগণ বা দানবগণের মধ্যে কেহই আপনার পরিচয় জানেন না ॥১৪॥

অনুবাদঃ হে কেশব! তুমি আমাকে যা বলেছ, তা আমি সত্য বলে মনে করি। হে ভগবান! দেবতা অথবা দানবেরা কেউই তোমার তত্ত্ব যথাযথভাবে অবগত নন।

স্বয়মেবাত্মনাত্মনং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম।
ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে।।১৫।।

[হে] পুরুষোত্তম ! (হে পুরুষোত্তম !) [হে] ভূতভাবন ! (হে জগৎপিতঃ !) [হে] ভূতেশ ! (হে ভূতনাথ !) [হে] দেবদেব ! (হে দেবারাধ্য !) [হে] জগৎপতে (হে জগন্নাথ !) ত্বং (আপনি) স্বয়ম্ এব (নিজেই) আত্মনা (চিচ্ছক্তি দ্বারা) আত্নানং (আপনাকে) বেত্থ (জানিতেছেন) ॥১৫॥


হে পুরুষোত্তম ! হে জগৎপিতা ! হে ভূতনাথ ! হে দেবদেব ! হে জগৎপতে! আপনি স্বয়ংই নিজ চিচ্ছক্তি দ্বারা আপনাকে জানিতেছেন ॥১৫॥

অনুবাদঃ হে পুরুষোত্তম! হে ভূতভাবন! হে ভূতেশ! হে দেবদেব! হে জগৎপতে! তুমি নিজেই তোমার চিৎশক্তির দ্বারা তোমার ব্যক্তিত্ব অবগত আছ।

বক্তুমর্হস্যশেষণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ।
যাভির্বিভূতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি।।১৬।।

ত্বং (আপনি) যাভিঃ (যে যে) বিভূতিভিঃ (ঐশ্বর্য্য দ্বারা) ইমান্ (এই) লোকান্ (লোক সমূহ) ব্যাপ্য (ব্যাপিয়া) তিষ্ঠসি (রহিয়াছেন), [তাঃ] (সেই) দিব্যাঃ (উৎকৃষ্ট) আত্মবিভূতয়ঃ (স্বকীয় ঐশ্বর্য্য সকল) অশেষেণ (সবিশেষ ভাবে) [ত্বং] হি বক্তং অর্হসি (একমাত্র আপনিই বলিতে সমর্থ) ॥১৬॥


আপনি যে যে বিভূতি দ্বারা এই লোক সকল ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছেন, সেই সমুদয় অলৌকিক আত্ম-বিভূতিগুলি সম্পূর্ণরূপে আমাকে অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলুন ॥১৬॥

অনুবাদঃ তুমি যে সমস্ত বিভূতির দ্বারা এই লোকসমূহে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছ, সেই সমস্ত তোমার দিব্য বিভূতি সকল তুমিই কেবল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে সমর্থ।
কথং বিদ্যামহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়ন্।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোহসি ভগবন্ময়া।।১৭।।

[হে] যোগিন্ ! (হে যোগমায়াধিপতে !) সদা (সর্ব্বদা) কথং (কিরূপে) পরিচিন্তয়ন্ (সর্ব্ব প্রকারে চিন্তা করিয়া) অহং (আমি) ত্বাং (আপনাকে) বিদ্যাম্ (জানিতে পারিব ?) [হে] ভগবন্ ! (হে ভগবন্ !) কেষু কেষু চ (এবং কোন্ কোন্) ভাবেষু (পদার্থ সমূহে) [ত্বং] (আপনি) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) চিন্ত্যঃ অসি (চিন্তনীয়) ॥১৭॥


হে যোগমায়াপতে ভগবন্ ! কিরূপে সর্ব্বদা সর্ব্বপ্রকারে চিন্তা করিয়া আমি আপনাকে জানিবে এবং কোন্ কোন্ পদার্থ সকলে আমি আপনার চিন্তনরূপ ভক্তি আচরণ করিব ? ॥১৭॥

অনুবাদঃ হে যোগেশ্বর! কিভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করলে আমি তোমাকে জানতে পারব? হে ভগবন্! কোন্ কোন্ বিবিধ আকৃতির মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব?

বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিং চ জনার্দন।
ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্।।১৮।।

[হে] জনার্দ্দন ! (হে জনার্দ্দন !) আত্মনঃ (আপনার) যোগং (ভক্তিযোগ) বিভূতিং চ (ও বিভূতি) ভূয়ঃ (পুনরায়) বিস্তরেণ (বিস্তৃতভাবে) কথয় (বলুন) । হি (যেহেতু) অমৃতম্ (আপনার অমৃতময় বাক্য) শৃণ্বতঃ (শ্রবণ করিয়া) মে (আমার) তৃপ্তিঃ (তৃপ্তি) ন অস্তি (হইতেছে না) ॥১৮॥


হে জনার্দ্দন ! আপনার যোগ ও বিভূতি সকল পুনর্ব্বার সবিস্তারে বলুন । যেহেতু আপনার এই সকল উপদেশরূপ অমৃতময়বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না ॥১৮॥

অনুবাদঃ হে জনার্দন! তোমার যোগ ও বিভূতি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আমাকে বল। কারণ তোমার উপদেশামৃত শ্রবণ করে আমার পরিতৃপ্তি হচ্ছে না; আমি আরও শ্রবণ করতে ইচ্ছা করি।

শ্রীভগবানুবাচ
হস্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ।
প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যস্তো বিস্তরস্য মে।।১৯।।

শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) হন্ত কুরুশ্রেষ্ঠ ! (ওহে কুরুশ্রেষ্ঠ !) দিব্যাঃ (অলৌকিক) আত্মবিভূতয়ঃ (প্রপঞ্চ চিচ্ছক্তিজাত প্রকটিত নিজ ঐশ্বর্য্য সমূহ) প্রাধান্যতঃ (প্রধান প্রধান রূপে) তে (তোমাকে) কথয়িষ্যামি (বলিব) । হি (যেহেতু) মে (আমার) বিস্তরস্য (বিস্তৃত বিভূতির) অন্তঃ (শেষ) ন অস্তি (নাই) ॥১৯॥


শ্রীভগবান্ কহিলেন—ওহে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! আমার অলৌকিক চিচ্ছক্তিজাত প্রপঞ্চ প্রকটিত ঐশ্বর্য্যসকল প্রধান প্রধান রূপেই তোমার নিকট বলিতেছি ; যেহেতু আমার বিস্তৃত বিভূতি সমূহের সীমা নাই ॥১৯॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে অর্জুন, আমার দিব্য প্রধান প্রধান বিভুতিসমূহ তোমাকে বলব, কিন্তু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই।

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ।
অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ।।২০।।

[হে] গুড়াকেশ ! (হে জিতনিদ্র !) অহম্ (আমি) সর্ব্বভূতাশয়স্থিতঃ (সমস্ত জীবের অন্তঃকরণে অবস্থিত) আত্মা (পরমাত্মা) । অহম্ এব চ (এবং আমিই) ভূতানাম্ (প্রাণিগণের) আদিঃ (জন্ম), মধ্যং চ (ও স্থিতি) অন্তঃ চ (এবং নাশের হেতু) ॥২০॥


হে গুড়াকেশ ! আমি সমস্ত জীবের অন্তঃকরণে নিয়ামকরূপে অবস্থিত পরমাত্মা এবং আমিই ভূতগণের জন্ম, স্থিতি ও সংহারের কারণ ॥২০॥

অনুবাদঃ হে গুড়াকেশ! আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।

আদত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী।।২১।।

আদিত্যানাম্ (দ্বাদশ আদিত্যগণের মধ্যে) অহং (আমি) বিষ্ণুঃ (বিষ্ণু নামক আদিত্য), জ্যোতিষাং (প্রকাশকগণের মধ্যে) অংশুমান্ (মহাকিরণশালী) রবিঃ (সূর্য্য), মরুতাম্ (বায়ুগণের মধ্যে) মরীচিঃ (মরীচি নামক বায়ু) নক্ষত্রাণাম্ (নক্ষত্রগণের মধ্যে) অহং (আমি) শশী (চন্দ্র) অস্মি (হই) ॥২১॥


আমি দ্বাদশ আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণুনামক আদিত্য, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে প্রচুর কিরণশালী সূর্য্য, বায়ুগণের মধ্যে মরীচি নামক বায়ু, এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে আমি চন্দ্ররূপে আছি ॥২১॥

অনুবাদঃ আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।

বেদানাং সামবেতোহস্মি দেবনামস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা।।২২।।

[অহং] (আমি) বেদানাং (বেদগণের মধ্যে) সামবেদঃ (সামবেদ) অস্মি (হই), দেবানাম্ (দেবতাগণের মধ্যে) বাসবঃ (ইন্দ্র) অস্মি (হই), ইন্দ্রিয়াণাং (ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে) মনঃ (মন) অস্মি (হই), ভূতানাম্ [চ] (এবং ভূতগণের মধ্যে) চেতনা (জ্ঞানশক্তি) অস্মি (হই) ॥২২॥


আমি বেদগণের মধ্যে সামবেদ, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র, এবং প্রাণিগণের মধ্যে জ্ঞান শক্তি ॥২২॥

অনুবাদঃ সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মম্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা।

রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্।।২৩।।

[অহং] (আমি) রুদ্রাণাং (একাদশ রুদ্রগণের মধ্যে) শঙ্করঃ (শিব) যক্ষরক্ষসাম্ চ (এবং যক্ষ ও রক্ষোগণের মধ্যে) বিত্তেশঃ (কুবের) অস্মি (হই) । বসূনাং (অষ্টবসু মধ্যে) পাবকঃ (অগ্নি), শিখরিণাম্ চ (এবং পর্ব্বত সমূহ মধ্যে) অহম্ (আমি) মেরুঃ (সুমেরু) অস্মি (হই) ॥২৩॥


আমি একাদশ রুদ্রগণের মধ্যে শঙ্কর, এবং যক্ষ ও রক্ষোগণের মধ্যে কুবের । আমি অষ্টবসু মধ্যে অগ্নি, এবং পর্ব্বতসমূহ মধ্যে সুমেরু পর্ব্বত ॥২৩॥

অনুবাদঃ রুদ্রদের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু।

পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্।
সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ।।২৪।।

[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) মাং (আমাকে) পুরোধসাং (পুরোহিতগণের মধ্যে) মুখ্যং (প্রধান) বৃহস্পতিম্ (বৃহস্পতি বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) । অহম্ (আমি) সেনানীনাম্ (সেনাপতিগণের মধ্যে) স্কন্দঃ (কার্ত্তিকেয়) সরসাম্ [চ] (এবং জলাশয়গণ মধ্যে) সাগরঃ (সমুদ্র) অস্মি (হই) ॥২৪॥


হে পার্থ ! আমাকে পুরোহিতগণের মধ্যে প্রধান—বৃহস্পতি বলিয়া জানিও । আমি সেনাপতিগণের মধ্যে কার্ত্তিকেয়, এবং জলাশয় সমূহ মধ্যে সমুদ্র ॥২৪॥

অনুবাদঃ হে পার্থ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।

মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্।
যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ।।২৫।।

অহং (আমি) মহর্ষীণাং (মহর্ষিগণের মধ্যে) ভৃগুঃ (ভৃগু), গিরাম্ (শব্দ সমূহের মধ্যে) একম্ অক্ষরম্ (এক অক্ষর প্রণব) অস্মি (হই) । যজ্ঞানাং (যজ্ঞ সকলের মধ্যে) জপযজ্ঞঃ (জপরূপ যজ্ঞ) স্থাবরাণাং [চ] (এবং স্থাবরগণের মধ্যে) হিমালয়ঃ (হিমালয় পর্ব্বত) অস্মি (হই) ॥২৫॥


আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্য সমুদয়ের মধ্যে একাক্ষর প্রণব, যজ্ঞ সকলের মধ্যে জপযজ্ঞ এবং স্থাবরগণের মধ্যে হিমালয় পর্ব্বত ॥২৫॥

অনুবাদঃ মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি ওঁকার। যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়।

অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবষীণাং চ নারদঃ।
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ।।২৬।।

[অহং] (আমি) সর্ব্ববৃক্ষাণাং (বৃক্ষ সকলের মধ্যে) অশ্বত্থঃ (অশ্বত্থ), দেবর্ষীণাং (দেবর্ষিগণের মধ্যে) নারদঃ (নারদ), গন্ধর্ব্বাণাং (গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে) চিত্ররথঃ (চিত্ররথ), সিদ্ধানাং চ (এবং সিদ্ধগণের মধ্যে) কপিলঃ মুনিঃ (কপিল মুনি) ॥২৬॥


আমি বৃক্ষ সমূহ মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধগণের মধ্যে কপিল মুনি ॥২৬॥

অনুবাদঃ সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি।

উচ্ছৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদ্ভবম্।
ঐরাবতং গেজেন্দ্রাণাং নরাণাং চ নরাধিপম্।।২৭।।

মাম্ (আমাকে) অশ্বানাং (অশ্বগণের মধ্যে) অমৃতোদ্ভবম্ (অমৃত-নিমিত্ত মন্থন হইতে জাত) উচ্চৈঃশ্রবসম্ (উচ্চৈঃশ্রবা), গজেন্দ্রাণাং (হস্তিগণের মধ্যে) ঐরাবতং (ঐরাবত), নরাণাং চ (এবং মনুষ্যগণের মধ্যে) নরাধিপম্ (রাজা বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥২৭॥


আমাকে অশ্বগণ মধ্যে অমৃত মন্থন সময়ে উত্থিত উচ্চৈঃশ্রবা হস্তিসমূহের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যসমূহের মধ্যে রাজা বলিয়া জানিবে ॥২৭॥

অনুবাদঃ অশ্বদের মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে। শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুণ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট।

আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্।
প্রজন্শ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকিঃ।।২৮।।

অহং (আমি) আয়ুধানাম্ (অস্ত্রগণের মধ্যে) বজ্রং (বজ্র), ধেনূনাম্ (ধেনুগণের মধ্যে) কামধুক্ অস্মি (কামধেনু), [কন্দর্পাণাং] (কন্দর্পগণের মধ্যে) প্রজনঃ (সন্তান উৎপত্তি হেতু) কন্দর্পঃ অস্মি (কামদেব), সর্পাণাম্ চ (এবং একমস্তকবিশিষ্ট সবিষ সর্পগণের মধ্যে) বাসুকিঃ অস্মি (সর্পরাজ বাসুকি) ॥২৮॥


আমি অস্ত্রগণের মধ্যে বজ্র ও গাভীগণের মধ্যে কামধেনু । কন্দর্পগণের মধ্যে সন্তান উৎপাদক কামদেব এবং এক মস্তকবিশিষ্ট সবিষ সর্পসমূহ মধ্যে সর্পরাজ বাসুকি ॥২৮॥

অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্।
পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্।।২৯।।

অহম্ (আমি) নাগানাং (অনেক মস্তকবিশিষ্ট বিষহীন নাগগণের মধ্যে) অনন্তঃ (অনন্ত নাগ), যাদসাম্ চ (এবং জলচারিগণের মধ্যে) বরুণঃ অস্মি (বরুণদেব) । পিতৄণাম্ (পিতৃগণের মধ্যে) অহম্ (আমি) অর্য্যমা (অর্য্যমা), সংযমতাম্ চ (এবং দণ্ডকারিগণের মধ্যে) যমঃ অস্মি (যমরাজ) ॥২৯॥


আমি অনেক মস্তকবিশিষ্ট বিষহীন নাগগণের মধ্যে অনন্ত নাগ, এবং জলচারিগণের মধ্যে বরুণদেব । আমি পিতৃগণের মধ্যে অর্য্যমা, এবং দণ্ডবিধানকারিগণের মধ্যে যমরাজ ॥২৯॥

 অনুবাদঃ সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। সন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি। সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ। পিতৃদের মধ্যে আমি অর্যমা এবং দন্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।

প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্।
মৃগাণাং চ মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্।।৩০।।

অহম্ (আমি) দৈত্যানাং (দৈত্যগণের মধ্যে) প্রহ্লাদঃ (প্রহ্লাদ), কলয়তাম্ চ (এবং বশীকারকদিগের মধ্যে) কালঃ অস্মি (কাল) । অহং (আমি) মৃগাণাং চ (পশু সমূহের মধ্যে) মৃগেন্দ্রঃ (সিংহ), পক্ষিণাম্ চ (এবং পক্ষিগণের মধ্যে) বৈনতেয়ঃ (গরুড়) ॥৩০॥


আমি দৈত্যগণের মধ্যে প্রহ্লাদ, এবং বশকারিগণের মধ্যে কাল । আমি পশু সকলের মধ্যে সিংহ, এবং পক্ষি সকলের মধ্যে গরুড় ॥৩০॥

অনুবাদঃ দৈত্যদের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়।

দৈত্য শব্দের দুই অর্থ হয়-এব দেব দুই রাক্ষস। অতঃপর অর্থ এই প্রকার হবে যে রাক্ষদের মধ্যে প্রহ্লাদ আস্তিক ছিলেন এবং দেব বৃত্তি যুক্ত ছিলেন। অতঃপর ভাব হয় যে রাক্ষাসদের মধ্যে প্রহ্লাদ হই। পরন্তু এই অর্থ কিংবদন্তি উপর আধারিত হয় এবং এতটা সত্য প্রতীত হয় না। বৈদিক আধারের উপর দুই অর্থ এই প্রকার হবে যে দৈত্যের অর্থ "দেব" এবং "প্রহ্লাদের অর্থ আনন্দ। অতঃপর দেবের মধ্যে ব্রহ্মের আনন্দ হয়। যারা দেব বৃত্তির আস্তিক পুরুষ হয় তারা বেদাধ্যয়ন,যজ্ঞ এবং যোগাভ্যাসের দ্বারা এক দিন আনন্দানুগত সমাধি প্রাপ্ত করে,এবং তাদের মধ্যে ব্রহ্ম অনুভূতির আনন্দ প্রকট হয় যেমন-ঋগ্বেদ মণ্ডল ১০/ সূক্ত ১১৯ এ সোম পান বলা হয়েছে।
ভাব এই যে পরমেশ্বর আনন্দস্বরূপ অতঃপর দৈত্য অর্থাৎ দেবতাদের সেই প্রহ্লাদ অর্থাৎ আনন্দ।।
"কালের অর্থ গণনা"। অতঃপর বলা হয়েছে গণনাকারীদের মধ্যে "কাল" হই। অথর্ব্বেদ কাণ্ড ৯/সূক্ত ৯ এর / মন্ত্র ১৩ তে বলা হয়েছে যে কাল চক্র নিরন্তর চলতে থাকে,কখনও জীর্ণ হন না। একই প্রকার পরমেশ্বরেরও সর্বদা আছেন, সর্বদা থাকেন এবং ঋগ্বেদ মন্ত্র ১০/৯০/৩ এ বলা হয়েছে, অজর, অমর, অবিনাশী কখনও জীর্ণ হন না এবং জন্ম- মৃত্যু থেকে ঊর্ধ্বে। সৃষ্টির আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত না জানা কত দার্শনিক সময়ের গণনা করেছেন। বস্তুতঃ অথর্ব্বেদ মন্ত্র ১৯/৫৩/৮ এ বলা হয়েছে ( কালঃ) কাল ( হ) ই ( সর্বস্য) সকলের ( ঈশ্বরঃ) স্বামী। কালই ঈশ্বর এবং প্রত্যেক সময়ের দ্রষ্টা। অনন্ত নামের মধ্যে "কাল"ও সর্বব্যাপক পরমেশ্বরের নাম। অথর্ব্বেদ কাণ্ড ১৯/সূক্ত ৫৩ এবং ৫৪ তে কালের বিস্তার থেকে বর্ণনা আছে। মন্ত্রে বলা হয়েছে-"কালঃ অশ্বঃ বহতি" কালের সময় রূপী অশ্ব চলতে থাকেন ইত্যাদি। ভাব এই যে পরমেশ্বরই সব থেকে মহান কালের গণনাকারী পরম্ পুরুষ কারণ তিনি প্রত্যেক কাল অর্থাৎ ভূতঃ,ভবিষ্য,বর্তমানে রঢেছেন,সকলের দ্রষ্টা।।
আরও বলা হয়েছে যে মৃগ অর্থাৎ পশুদের মধ্যে সিংহ হই। সিংহ পশুদের মধ্যে সব থেকে বলবান পশু মানা হয়। গীতার এই শ্লোকের অনুসারে সিংহও ঈশ্বরের বিভূতি। ঋগ্বেদ মন্ত্র ১/৮১/৬ এ বলা হয়েছে ( শ্বেতঃ) শুদ্ধ স্বরূপ পরমেশ্বর ( তুবিষ্মানঃ) কুটিল গতিযুক্তের জন্য ( মৃগঃ) সিংহ সমান। এখানে মৃগের অর্থ সিংহ। পরের মন্ত্রে বলা হয়েছে ( সতঃ অস্য রাজা) এই জগতের স্বামী। অতমপর কিনা বনের পশু হোক,সিংহ হোক,যে কেউও হোক সকলের রাজা তো পরমেশ্বরই।।
আরএ বলা হয়েছে পক্ষিদের মধ্যে "বৈনতেয়ঃ" হই। বৈনতেয় অর্থ গরুড়। গরুড়কে পক্ষিদের মধ্যে রাজা বলে। এটি সাপের শত্রু। যেমন গরুড় পক্ষিদের রাজা, পরমেশ্বর সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের রাজা,অথর্ব্বেদ মন্ত্র ৬/৫৬/১ এ বিদ্বানদের দ্বারা প্রার্থনা হয় যে ( মা) না ( নঃ) আমাদের ( দেবাঃ) বিদ্বান্ ( অহিঃ) সর্প ( বধীত্) বধ করা-কর্ত্তন অর্থাৎ হে বিদ্বান্! আমাদের এমন শিক্ষা দিন এবং কৃপা করুন যে আমাদের সর্প না দংশন করতে পারে। এখানে সর্পের অর্থ কাম,ক্রোধ,মদ,লোভ, অহংহঙ্কার আদি শত্রু। ভাব এই যে, যেমন গরুড় সর্পকে ভক্ণ করে,ওই প্রকার বিদ্বান্ দ্বারা দান ঈশ্বরের বৈদিক শিক্ষা বিষয়-বিকৃতিকে নষ্ট করে দেয়। অতঃপর ঈশ্বর গরুড়েরও গরুড়। যদি ঈশ্বর আমাদের বেদ বিদ্যার দান না করতো তবে কাম-ক্রোধ আদি শত্রুদের নাশ করে ঈশ্বরকে প্রাপ্তকারী ঋষি-মুনি সংসারে কখনও জন্ম না করতো। অতঃপর আসাদের সর্বদা বেদ বাণীকেই সম্মান করা এবং শ্রদ্ধাপূর্বক শ্রবণ করা উচিত।।
( ভাষ্যকার-স্বামী রামস্বরূপজী যোগাচার্য)

পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্।
ঋষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী।।৩১।।

অহম্ (আমি) পবতাম্ (পবিত্রকারী বা বেগবান্ বস্তুগণের মধ্যে) পবনঃ (পবন), শস্ত্রভৃতাম্ (শস্ত্রধারিবীরগণ মধ্যে) রমাঃ অস্মি (পরশুরাম) । ঝষাণাং (মৎস্যসমূহ মধ্যে) মকরঃ অস্মি (আমি মকর), স্রোতসাম্ চ (এবং নদীগণের মধ্যে) জাহ্নবী অস্মি (আমি জাহ্নবী) ॥৩১॥


আমি পবিত্রকারী বা বেগবান্ বস্তুগণের মধ্যে বায়ু, শস্ত্রধারী বীরগণ মধ্যে পরশুরাম, মৎস্য সমূহের মধ্যে মকর এবং নদী সমূহের মধ্যে গঙ্গা ॥৩১॥

অনুবাদঃ পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা।

সর্গাণামাদিরন্তশ্চ মধ্যং চৈবাহমর্জুন।
অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্।।৩২।।

[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) সর্গাণাম্ (আকাশাদি সৃষ্টবস্তুসমূহের) আদিঃ (সৃষ্টি), অন্তঃ (সংহার) মধ্যং চ (ও স্থিতি) অহম্ এব (আমিই), বিদ্যানাং (সমস্ত বিদ্যার মধ্যে) অধ্যাত্মবিদ্যা (আত্মবিদ্যা), প্রবদতাম্ চ (এবং তর্ক বা বিচারকারিগণের মধ্যে) অহম্ (আমি) বাদঃ (তত্ত্বনির্ণায়ক বিচার) ॥৩২॥


হে অর্জ্জুন ! আকাশাদি সৃষ্ট বস্তুগণের সৃষ্টি, প্রলয় ও স্থিতি আমিই । সমুদয় বিদ্যার মধ্যে আত্মজ্ঞান, এবং তর্ক বা বিচারকারিগণের বাদ বা জল্প ও বিতণ্ডা মধ্যে আমি বাদ স্বরূপ ॥৩২॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন! সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমি আদি, অন্ত ও মধ্য সমস্ত বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ, জল্প ও বিতণ্তার মধ্যে আমি সিদ্ধান্তবাদ।

অক্ষরাণামকারেহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ। 
অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ।।৩৩।।

[অহং] (আমি) অক্ষরাণাম্ (বর্ণ সকলের মধ্যে) অকারঃ (অকার), সামাসিকস্য চ (এবং সমাস সমূহ মধ্যে) দ্বন্দ্বঃ অস্মি (দ্বন্দ্বসমাস), অহম্ এব (আমিই) অক্ষয়ঃ (প্রবাহস্বরূপ অনন্ত) কালঃ (কাল), [স্রষ্টৄণাং চ] (এবং সৃষ্টিকারিগণের মধ্যে) বিশ্বতোমুখঃ (চতুর্ম্মুখ) ধাতা (ব্রহ্মা) ॥৩৩॥


আমি অকারাদি বর্ণ সকলের মধ্যে অকার এবং সমাসগণের মধ্যে দ্বন্দ্বসমাস । আমিই প্রবাহস্বরূপ অনন্তকাল, এবং সৃষ্টিকারিসকলের মধ্যে চতুর্ম্মুখ ব্রহ্মা ॥৩৩॥

অনুবাদঃ সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব-সমাস, সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা।

মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্। 
কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা।।৩৪।।

অহম্ (আমি) [হরণকারিণাং] (হরণকারিদিগের মধ্যে) সর্ব্বহরঃ (সর্ব্বস্মৃতি নাশকারী) মৃত্যুঃ (মৃত্যু), ভবিষ্যতাম্ চ (ও ভাবি ষড়্বিধ প্রাণি-বিকার মধ্যে) উদ্ভবঃ (জন্মরূপ আদিবিকার), নারীণাং চ (এবং নারীগণের মধ্যে) কীর্ত্তিঃ (কীর্ত্তি) শ্রীঃ (কান্তি) বাক্ (সংস্কৃত বাণী) স্মৃতিঃ (স্মৃতিশক্তি) মেধা (শাস্ত্রার্থাবধারণশক্তি) ধৃতিঃ (ধৈর্য্যশক্তি) ক্ষমা চ (এবং ক্ষমারূপিনী সপ্ত ধর্ম্মপত্নী) ॥৩৪॥


আমি হরণকারিগণের মধ্যে সর্ব্বস্মৃতি নাশকারী মৃত্যু, ও ভাবি ষড়্বিধ প্রাণি-বিকার মধ্যে জন্মরূপ প্রথমবিকার, এবং নারীগণের মধ্যে কীর্ত্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি এবং ক্ষমা রূপিণী সপ্ত ধর্ম্মপত্নী ॥৩৪॥

অনুবাদঃ সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভাবীকালের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব। নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি,  মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা।

বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্। 
মাসানাং মার্গশীর্ষোহহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ।।৩৫।।

অহম্ (আমি) সাম্নাং (সামবেদীয় মন্ত্র সকলের মধ্যে) বৃহৎসাম (ইন্দ্রস্তুতিরূপ মন্ত্র বিশেষ) তথা ছন্দসাম্ (এবং ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রগণের মধ্যে) গায়ত্ত্রী (গায়ত্ত্রী মন্ত্র) । মাসানাং (মাসসমূহের মধ্যে) অহম্ (আমি) মার্গশীর্ষঃ (অগ্রহায়ণ মাস) ঋতূনাং [চ] (এবং ঋতুগণের মধ্যে) কুসুমাকরঃ (বসন্ত) ॥৩৫॥


আমি সামবেদীয় মন্ত্র সকলের মধ্যে ইন্দ্রস্তুতিরূপ বৃহৎসাম, এবং ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রগণের গায়ত্ত্রীচ্ছন্দ । মাস সমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ মাস এবং ঋতুগণের মধ্যে বসন্ত ঋতু ॥৩৫॥

অনুবাদঃ সামবেদের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী। মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রাহয়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত।
দ্যূতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্। 
জয়োহস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্।।৩৬।।

অহম্ (আমি) ছলয়তাম্ (পরস্পর বঞ্চনাকারিগণের সম্বন্ধে) দূত্যং (দ্যূতক্রীড়া), তেজস্বিনাম্ (তেজস্বিগণের সম্বন্ধে) তেজঃ অস্মি (প্রভাব), অহম্ (আমি) [জেতৄণাং] (বিজয়িগণের সম্বন্ধে) জয়ঃ অস্মি (জয়স্বরূপ), [অহং ব্যবসায়িনাং] (আমি উদ্যমশীলগণের সম্বন্ধে) ব্যবসায়ঃ (অধ্যবসায়), সত্ত্ববতাম্ [চ] (এবং বলবান্গণের সম্বন্ধে) সত্ত্বং অস্মি (বলস্বরূপ) ॥৩৬॥


আমি পরস্পর বঞ্চনাকারিগণের সম্বন্ধে পাশা খেলা ও তেজস্বিগণের সম্বন্ধে প্রভাব । আমি বিজয়িগণের সম্বন্ধে জয়স্বরূপ, উদ্যমশীলগণের সম্বন্ধে অধ্যবসায়, এবং বলবান্গণের সম্বন্ধে বলস্বরূপ ॥৩৬॥

অনুবাদঃ সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।

বৃষ্ণীনাং বাসুদেবোহস্মি পান্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ। 
মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ।।৩৭।।

অহং (আমি) বৃষ্ণীনাং (যাদবগণের মধ্যে) বাসুদেবঃ (শ্রীবাসুদেব) পাণ্ডবানাং (পাণ্ডবগণের মধ্যে) ধনঞ্জয়ঃ (অর্জ্জুন) মুনীনাম্ (মুনিগণের মধ্যে) ব্যাসঃ (ব্যাসদেব) কবীনাম্ অপি (এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ মধ্যে) উশনাঃ কবিঃ অস্মি (পণ্ডিত শুক্রাচার্য্য) ॥৩৭॥


আমি যাদবগণের মধ্যে বাসুদেব, পাণ্ডবগণের মধ্যে অর্জ্জুন, মুনিগণের মধ্যে ব্যাসদেব, এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণের মধ্যে পণ্ডিত শুক্রাচার্য্য ॥৩৭॥

অনুবাদঃ বৃষ্ণিদের মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পান্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন। মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি শুক্রাচার্য।

দন্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্। 
মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্।।৩৮।।

[অহং] (আমি) দময়তাম্ (দণ্ডকারিগণের সম্বন্ধে) দণ্ডঃ অস্মি (দণ্ড), জিগীষতাম্ (এবং জয়েচ্ছুগণের সম্বন্ধে) নীতিঃ অস্মি (সামাদি উপায়রূপা নীতি) । অহম্ (আমি) গুহ্যানাং (গোপ্য সকলের মধ্যে) মৌনং (মৌনভাব) জ্ঞানবতাম্ এব চ (এবং জ্ঞানবান্গণের সম্বন্ধে) জ্ঞানং অস্মি (জ্ঞান) ॥৩৮॥


আমি দণ্ডকারিগণের সম্বন্ধে দণ্ড, এবং জয়েচ্ছুগণের সম্বন্ধে সামাদি উপায়রূপা নীতি । আমি গোপনীয় সকলের মধ্যে মৌনীভাব, এবং জ্ঞানিদের সম্বন্ধে জ্ঞান ॥৩৮॥

অনুবাদঃ দমনকারীদের মধ্যে আমি দন্ড এবং জয় অভিলাষীদের মধ্যে আমি নীতি। গুহ্য ধর্মের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমিই জ্ঞান।

যচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন। 
ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্।।৩৯।।

[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যৎ চ (আর যাহা) সর্ব্বভূতানাং (ভূত সকলের) বীজং (মূল কারণ) তৎ অপি (তাহাও) অহম্ (আমি) ময়া বিনা (আমাকে পরিত্যাগ করিয়া) যৎ স্যাৎ (যাহা হইতে পারে ) তৎ (সেরূপ) চরাচরম্ (স্থাবর ও জঙ্গম) ভূতং (কোনও বস্তু বা জীব) ন অস্তি (নাই) ॥৩৯॥


হে অর্জ্জুন ! আর যাহা যাহা সকল ভূতগণের উৎপত্তির কারণ বলিয়া কথিত হয় সে সকলই আমি । আমাভিন্ন যাহা হইতে পারে তাদৃশ স্থাবর বা জঙ্গম কোন বস্তু বা জীব নাই ॥৩৯॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন! যা সর্বভূতের বীজস্বরূপ তাও আমি, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোন বস্তুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

নাস্তোহস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ। 
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভুতের্বিস্তরো ময়া ।।৪০।।

[হে] পরন্তপ ! (হে শত্রুতাপন !) মম (আমার) দিব্যানাং (অলৌকিক) বিভূতীনাং (বিভূতি সমূহের) অন্তঃ (সীমা) ন অস্তি (নাই) । এষঃ তু (কিন্তু এই) বিভূতেঃ (বিভূতির) বিস্তরঃ (বাহুল্য) উদ্দেশতঃ (সংক্ষেপেই) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) প্রোক্তঃ (কথিত হইল) ॥৪০॥


হে পরন্তপ ! আমার উৎকৃষ্ট বিভূতি সকলের অন্ত নাই ; কেবলমাত্র তোমার অবগতির জন্যই বিভূতিগণের এই বিস্তার নামমাত্র আমি তোমার নিকট বর্ণন করিলাম ॥৪০॥

অনুবাদঃ হে পরন্তপ! আমার দিব্য বিভুতি-সমূহের অন্ত নেই। আমি এই সমস্ত বিভুতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম।

যদ্যদ্বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা। 
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্।।৪১।।

যৎ যৎ (যে যে) সত্ত্বং এব (বস্তুই) বিভূতিমৎ (ঐশ্বর্য্যযুক্ত), শ্রীমৎ (সৌন্দর্য্য বিশিষ্ট), ঊর্জ্জিতম্ বা (অথবা বল প্রভাবাদির আধিক্যবিশিষ্ট) তৎ তৎ এব (সেই সমস্ত বস্তুই) মম (আমার) তেজোঽংশসম্ভবম্ (প্রভাবের অংশ হইতে উৎপন্ন বলিয়া) ত্বং (তুমি) অবগচ্ছ (জানিবে) ॥৪১॥


যে যে বস্তুই ঐশ্বর্য্যযুক্ত, সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট অথবা বলপ্রভাবাদির আধিক্যবিশিষ্ট সেই সমুদয় বস্তুই আমার শক্তির অংশ হইতে উৎপন্ন বলিয়া তুমি জানিবে ॥৪১॥

অনুবাদঃ ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।

অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন। 
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ।।৪২।।
অনুবাদঃ  হে অর্জুন! অথবা এই প্রকার বহু জ্ঞানের দ্বারা তোমার কি প্রয়োজন? আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত আছি।

[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) অথবা (অথবা) এতেন (এই) বহুনা (পৃথক্ পৃথক্ উপদিষ্ট) জ্ঞাতেন (জ্ঞানের দ্বারা) তব (তোমার) কিং ? (কি প্রয়োজন ?) অহম্ (আমি) ইদং (এই ) কৃৎস্নম্ (চিৎ অচিৎ সমস্ত) জগৎ (বিশ্ব) একাংশেন (প্রকৃতির অন্তর্যামী পুরুষরূপ এক অংশ দ্বারা) বিষ্টভ্য (ধারণ করিয়া) স্থিতঃ (অবস্থিত) [অস্মি] (রহিয়াছি) ॥৪২॥


অথবা হে অর্জ্জুন ! আমার বিভূতির এই বিস্তৃত জ্ঞানে তোমার কি প্রয়োজন ? আমি প্রকৃতির অন্তর্যামী কারণার্ণবশায়ী পুরুষরূপ আমার এক অংশ দ্বারা এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বকে ধারণ করিয়া অবস্থান করিতেছি ॥৪২॥

 

ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভবগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে বিভূতিযোগো
নাম দশমোঽধ্যায়ঃ ॥১০॥


ইতি দশম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥


ইতি দশম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ