শঙ্করাচার্য - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

30 September, 2018

শঙ্করাচার্য

অদ্বৈতবাদ
আদি শঙ্কর অধুনা কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য বহুলাংশে দায়ী। শঙ্কর নিজে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। এছাড়া তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের দশনামী সম্প্রদায় ও হিন্দুদের পূজার সন্মত নামক পদ্ধতির প্রবর্তক।
সংস্কৃত ভাষায় লেখা আদি শঙ্করের রচনাবলির প্রধান লক্ষ্য ছিল অদ্বৈত তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। সেযুগে হিন্দু দর্শনের মীমাংসা শাখাটি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতার উপর জোর দিত এবং সন্ন্যাসের আদর্শকে উপহাস করত। আদি শঙ্কর উপনিষদ্‌ ও ব্রহ্মসূত্র অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্‌, ব্রহ্মসূত্র ও ভগবদ্গীতার ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ মীমাংসা শাখার পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের সাংখ্য শাখা ও বৌদ্ধ দর্শনের মতও খণ্ডন করেন।আদি শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০) আদি শঙ্করাচার্য ছিলেন একজন দার্শনিক। 
‘অদ্বৈত বেদান্ত’ নামে হিন্দু দর্শনের যে শাখাটি আছে, তিনি ছিলেন সেই শাখার একজন প্রবক্তা। সারা ভারত ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁর মত প্রচার করেছিলেন। দেশের চার প্রান্তে স্থাপন করেছিলেন চারটি মঠ। মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় হিন্দুধর্ম ও তার অদ্বৈত বেদান্ত মতটি নতুন করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।এখনকার কেরল রাজ্যের কালাডি নামে একটি গ্রামে শঙ্করাচার্যের জন্ম হয়েছিল। ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ায় বেশ ভাল ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সেই চারখানি বেদ পড়ে শেষ করে ফেলেন। তারপর খুব অল্প বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে যান তিনি। কেরল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন উত্তর ভারতের উদ্দেশ্যে। হিন্দুধর্মকে পথনির্দেশ দেওয়ার জন্য ভারতের চার প্রান্তে স্থাপন করেন চারখানি মঠ। এই মঠগুলি হল শৃঙ্গেরী (এখনকার কর্ণাটক রাজ্যে), দ্বারকা (এখনকার গুজরাত রাজ্যে), পুরী (এখনকার ওড়িশা রাজ্যে) ও জ্যোতির্মঠ বা জোশিমঠ (এখনকার উত্তরাখণ্ড রাজ্যে)।
হিন্দুদের তিনখানি অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও ভাগবত গীতা। এই তিনটি বইয়ের উপর শঙ্করাচার্য যে ভাষ্য বা টীকা লিখেছিলেন, তা খুবই বিখ্যাত। এছাড়া আরও কয়েকটি দর্শন গ্রন্থ এবং দেবদেবীদের স্তবস্তুতিও রচনা করেছিলেন তিনি।
সেই সময় হিন্দুধর্ম নানাভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। শঙ্করাচার্য সেই পিছিয়ে পড়া হিন্দুধর্মকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর প্রচারকার্যের ফলে ভারতে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের প্রভাব কমতে শুরু করে। মাত্র বত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর হিন্দুধর্ম সংস্কারের কথা আজও লোকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে। একটি সম্প্রদায় আজও তাঁর মতাবলম্বী।
শঙ্কর তাঁর দর্শন প্রচার করার জন্য বক্তৃতা দিয়ে ও অন্যান্য চিন্তাবিদের সাথে বিতর্ক করে ভারতব্যাপী এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশ ভ্রমণ করেন। অদ্বৈত বেদান্তের ঐতিহাসিক উন্নয়ন, পুনর্জাগরণ এবং প্রসারে সাহায্য করার জন্য চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর সুখ্যাতি আছে। বিশ্বাস করা হয় যে, আদি শঙ্কর দশনামী সন্ন্যাসী ক্রমের সংগঠক এবং পূজার সম্মত ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
সংস্কৃতে তাঁর কাজ ছিল অদ্বৈত মতবাদ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত। তিনি এমন এক সময়ে উপনিষদ ও ব্রহ্ম সূত্রে অনুমোদিত সন্ন্যাসী জীবনের গুরুত্বও প্রতিষ্ঠা করেন যখন মীমাংসা পাঠশালা কঠোর ধর্মীয় আচার প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সন্ন্যাস-ব্রতকে বিদ্রুপ করেছিল। শঙ্কর উপনিষদে প্রাপ্ত ধারণাসমূহের বিশদ বর্ণনা হিসেবে তাঁর কাজসমূহ উপস্থাপন করেন এবং তিনি তাঁর তত্ত্বের সমর্থনে বৈদিক অনুশাসনের (ব্রহ্ম সূত্র, মূল উপনিষদসমূহ এবং ভাগবত গীতা) উপর প্রাচুর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। তাঁর কাজে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল মীমাংসা ধী গোষ্ঠী, যদিও তিনি শাক্যের মত কিছু পাঠশালা এবং বৌদ্ধ ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু পাঠশালার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মতানৈক্য প্রস্তাব করেন।
জীবনীঃ
আদি শঙ্করের প্রথাগত জীবনী পাওয়া যাবে শঙ্কর বিজয়মে যেটি মহাকাব্যিক ধরণে লিখিত কাব্যিক কাজ যাতে রয়েছে জীবনী ও পৌরাণিক উপাদানের মিশ্রণ। এ জীবনীগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাধব শঙ্কর বিজয়ম (মাধবের, ১৪তম শতাব্দী), চিদবিলাস শঙ্কর বিজয়ম (চিদবিলাসের, ১৫তম এবং ১৭তম শতাব্দীর মধ্যে), এবং কেরালা শঙ্কর বিজয়ম (কেরালা এলাকার, ১৭তম শতাব্দী)।
জন্ম ও শৈশবঃ
শঙ্কর বর্তমান সময়ের কেরালার কালাদিতে বা এর নিকটে ব্রাহ্মণ সমাজের শ্রী শিবাগুরু ঔরসে এবং আরিআম্বার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। লোক-জ্ঞান অনুসারে তাঁর পিতামাতা অনেক বছর সন্তানহীন থাকার পর তারা থ্রিসুরের ভাদাক্কুন্নাথান মন্দিরে প্রার্থনা করলে শঙ্কর থিরুভাথিরা নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করেন। শঙ্করের বয়স যখন খুব অল্প তখন তাঁর পিতা মারা যান। তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণে শঙ্করের উপনয়ন, ছাত্র-জীবনে দীক্ষাগ্রহণ বিলম্বিত হয় এবং পরে তাঁর মাতা কর্তৃক এগুলো সম্পাদন করা হয়। শিশু হিসেবে আট বছর বয়সের মধ্যে চারটি বেদ আয়ত্ত করে শঙ্কর অসামান্য পান্ডিত্য দেখান।
সন্ন্যাসঃ
নবীন বয়স থেকে শঙ্কর সন্ন্যাস জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, কিন্ত্তু অনেক প্ররোচনার পরই তাঁর মাতা এতে তাঁর অনুমতি দেন। একদিন পুকুরে স্নান করার সময় শঙ্কর তাঁর মায়ের অনুমতি পান যখন একটি কুমির তাঁর পা ধরেছিল। সে সময়ে তাঁর মাতা পুকুরের নিকট আসলে শঙ্কর সন্ন্যাসী হবার প্রার্থনা জানিয়ে তাঁর মায়ের নিকট আবদেন জানান। কুমিরটি যাতে যুবক শঙ্করকে ছেড়ে দেয় তার জন্যই তাঁর মাতা চূড়ান্ত অনুমতি দেন। শঙ্কর তারপর কেরালা ছেড়ে উত্তর ভারতের উদ্দেশ্যে এক গুরুর খোঁজে বের হন। নর্মদা নদীর তীরে তিনি গৌরপদের শিষ্য গোবিন্দ ভগবতপদের দেখা পান। যখন গোবিন্দ ভগবতপদ শঙ্করের পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, তিনি পূর্বচিন্তা ছাড়াই এক শ্লোকের মাধ্যমে উত্তর দেন যা অদ্বৈত বেদান্তের দর্শন ব্যক্ত করে। গোবিন্দ ভগবতপদ প্রভাবিত হন এবং শঙ্করকে তাঁর শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। গুরু শঙ্করকে ব্রহ্ম সূত্রের উপর একটি ব্যাখ্যা/ভাষ্য লিখতে এবং অদ্বৈত দর্শন প্রচার করতে নির্দেশ দেন। শঙ্কর কাশীতে ভ্রমণ করেন যেখানে দক্ষিণ ভারতের চোলা এলাকা থেকে আগত সদানন্দ নামের এক যুবক তাঁর প্রথম শিষ্য হন। লোককাহিনী অনুসারে বিশ্বনাথ মন্দিরে যাবার পথে শঙ্কর চারটি কুকুরের সঙ্গে থাকা এক অস্পৃশ্যের দেখা পান। শঙ্করের শিষ্যরা তাঁকে পাশে সরতে বললে অস্পৃশ্যটি উত্তর দেন: “আপনারা কি চান আমি আমার চিরস্থায়ী আত্মাকে সরাব নাকি রক্ত-মাংসে গঠিত এ শরীরটাকে?” অস্পৃশ্যটি ভগবান শিব এবং তাঁর চারটি কুকুর চার বেদ ছাড়া আর কিছুই নয় এটা উপলব্ধি করে শঙ্কর তাঁর সম্মুখে সাষ্টাঙ্গপ্রণত হলেন এবং মনীষা পঞ্চকম নামে পরিচিত পাঁচটি শ্লোক রচনা করেন। বাদারীতে তিনি তাঁর বিখ্যাত ভাষ্য এবং প্রকারণ গ্রন্থসমূহ লেখেন।
মন্দন মিশ্রের সাথে সাক্ষাৎঃ
আদি শঙ্করের সবচেয়ে বিখ্যাত বিতর্কসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল আচার-অনুষ্ঠান কঠোরভাবে পালনকারী মন্দন মিশ্রের সঙ্গে তর্ক। মন্দন মিশ্র এ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন যে গৃহস্থের জীবন একজন সন্ন্যাসীর জীবনের থেকে অনেক শ্রেয়। সে সময়ে ভারতব্যাপী এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপকভাবে সম্মান করা হতো।] এতদনুসারে তার সাথে আদি শঙ্করের বিতর্ক করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মন্দন মিশ্রের গুরু ছিলেন বিখ্যাত মীমাংসা দার্শনিক কুমারিলা ভট্ট। শঙ্কর কুমারিলা ভট্টের সাথে একটি বিতর্ক চান এবং তার সঙ্গে প্রয়াগে দেখা করেন যেখানে তিনি তার গুরুর বিরুদ্ধে করা পাপের জন্য অনুশোচনা করার জন্য নিজেকে একটি মৃদু জ্বলন্ত চিতাতে সমাহিত করেছিলেন: কুমারিলা ভট্ট তার বৌদ্ধ গুরুর নিকট মিথ্যা ছলে বৌদ্ধ দর্শন শিখেছিলেন একে অসত্য/অমূলক বলে প্রতিপন্ন করার জন্য। বেদ অনুসারে কেউ গুরুর কর্তৃত্বের অধীণে থেকে তাঁর অজ্ঞাতসারে কিছু শিখলে তা পাপ বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং কুমারিলা ভট্ট তার পরিবর্তে আদি শঙ্করকে মহিসমতিতে (বর্তমানে বিহারের সহরসা জেলার মহিষী নামে পরিচিত) গিয়ে মন্দন মিশ্রের সাথে দেখা করে তার সঙ্গে বিতর্ক করতে বলেন। পনের দিনের অধিক বিতর্ক করার পর মন্দন মিশ্র পরাজয় স্বীকার করেন, যেখানে মন্দন মিশ্রের সহধর্মিণী উভয়া ভারতী বিচারক হিসেবে কাজ করেন। ষড়দর্শনগুলো হচ্ছে—

১) বৈশেষিক দর্শন —আচার্য কণাদ
২) ন্যায়দর্শন  —মহর্ষি গৌতম
৩) সাংখ্যদর্শন —কপিল মুনি
৪) যোগদর্শন —মহর্ষি পাতঞ্জল
৫) পূর্বমীমাংসা বা কর্মমীমাংসা দর্শন —মহর্ষি জৈমনি
৬) বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র —মহর্ষি বাদরায়ণ ব্যাসদেব

 প্রথম চারটি দর্শনের পর পূর্বমীমাংসা এবং শেষে হয় বেদান্তদর্শন পড়তে হয় । কেননা ঐগুলো প্রথমে বুঝে নিলে বেদান্তদর্শন বুঝতে সহজ হয় ৷ পূর্ব-মীমাংসায় বর্ণিত হয়েছে কর্মমার্গ, আর বেদান্তদর্শনে বর্ণিত হয়েছে জ্ঞানমার্গ ৷ কর্মমার্গের অনুসারীদের কর্মবাদী ও জ্ঞানমার্গের অনুসারীদের বলা হয় জ্ঞানবাদী ৷ আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সময় পূর্বমীমাংসক বা কর্মবাদীদের বলা হতো প্রধানমল্ল । কারণ তখন মীমাংসা দর্শনের এতো শক্তিশালী প্রভাব ছিল যে যদি কেউ মীমাংসকদের হারিয়ে দিতে পারে তাহলে ধরে নিতে হবে জগতের যতো দর্শন অাছে সবাইকে সে হারিয়ে দিয়েছে; যেমন ধরুন কলকাতার সবথেকে বড় মল্লবীরকে যদি চেন্নাইয়ের কোন মল্লবীর হারিয়ে দেয় তাহলে সে কলকাতার সব মল্লবীরকে হারিয়ে দিয়েছে সেটা মানতে হবে ৷

কর্মমীমাংসকদের হারাতে গিয়ে জ্ঞানবাদী শঙ্করাচার্যকে খুব কঠিন কঠিন শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমে তিনি খোজ নিলেন মীমাংসকদের প্রধান কে? খোজ নিয়ে জানলেন যে তাদের প্রধান হলেন কুমারিল ভট্ট । এক ব্রাহ্মণের কাছে তিনি কুমারিল ভট্টের জীবনকথা বিস্তারিত শুনলেন ৷ কুমারিলের অপূর্ব জীবনকথা শুনে শঙ্করাচার্য মুগ্ধ হয়ে শিষ্যসহ কুমারিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ৷ কুমারিল ভট্টকে যখন শঙ্করাচার্য খুজে পেলে তখন কুমারিল ভট্ট একটা প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তুষের অাগুনে নিজেকে অাত্মাহুতি দিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন । কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধ ধর্মকে জানার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । বৌদ্ধ ধর্মকে ভালো করে জেনে বুঝে, এদের দূর্বলতা ও দোষ ক্রুটিকে অায়ত্ত করে নিয়ে পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে অাক্রমণ করলেন, র এমন ভাবে অাক্রমণ করলেন যে সারা ভারতে বৌদ্ধধর্মকে একেবারে নস্যাৎ করে ছেড়ে দিলেন । কিন্তু নিজের ধর্মকে ছেড়ে যেহেতু বিধর্মী হয়েছিলেন সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি নিজেকে তুষাগ্নিতে অাহুতি দিয়ে তিল তিল করে পুড়তে থাকেন, র মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন । ঐ সময় শঙ্করাচার্য তাঁকে গিয়ে বললেন, “আমি পনার অতুলনীয় পান্ডিত্যশক্তির কথা শুনে আপনার কাছে এসেছি। আমি ব্রহ্মসূত্রের অদ্বৈতমতের পোষক ভাষ্য রচনা করেছি ৷ ইচ্ছা ছিল যদি আপনি আমার এই মতবাদ গ্রহণ করেন এবং ইহার ওপর একটি বার্ত্তিক রচনা করে দেন তবে এই অদ্বৈতমত নির্দোষভাবে জগতে প্রতারিত হতো ৷”
কুমারিল ভট্ট শঙ্করাচার্যকে তখন বলেন, “ মিথিলাতে অামার পরম শিষ্য মণ্ডন মিশ্র অাছে, তুমি ওকে গিয়ে বিতর্কে যদি হারাতে পারো ও তোমার মত যদি সে গ্রহণ করে তবে তা আমিও গ্রহণ করেছি বলে বুঝে নিবে ৷”

শঙ্করাচার্য কুমারিল ভট্টের মৃত্যু অবধি সেখানেই অপেক্ষা করলেন, এবং মৃত্যুর পর ক্রিয়াকর্মাদি করে মিথিলাতে গিয়ে মণ্ডন মিশ্রকে সরাসরি তর্কে আহ্বান জানালেন। সাত দিন ধরে এই তর্ক চলছিল এবং সাতদিন পর মণ্ডন মিশ্র শঙ্করাচার্যের মতের সহিত আপোষ করেন ও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । পরবর্তী কালে শঙ্করাচার্যের প্রধান চার শিষ্যের মধ্যে মণ্ডন মিশ্র একজন হয়ে উঠলেন। আর তাঁর নাম হয় সুরেশ্বরাচার্য। মণ্ডন মিশ্রকে যেদিন শঙ্করাচার্য অবনত করলেন সেদিন থেকে ভারতবর্ষের প্রধান দর্শন হয়ে গেলো বেদান্ত । শঙ্করাচার্যের পর প্রায় তেরশো বছর ভারতের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু কেউ এখনো পর্যন্ত বেদান্তকে হারাতে পারেনি । বেদান্তের অনেক শাখা প্রশাখা আছে- দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্ট্যদ্বৈতবাদ, অচিন্ত্যভেদাভেদভাদ ইত্যাদি 
দার্শনিক ভ্রমণঃ
আদি শঙ্কর তারপর তাঁর শিষ্যদের সাথে নিয়ে মহারাষ্ট্র ও শ্রীশৈলম ভ্রমণ করেন। শ্রীশৈলে তিনি শিবের প্রতি ভক্তিমূলক স্তোত্রগীত শিবানন্দলাহিড়ী রচনা করেন। মাধবীয়া শঙ্করাবিজয়াম অনুসারে যখন শঙ্কর কপালিকা দ্বারা বলি হতে যাচ্ছিলেন, পদ্মপদাচার্যের প্রার্থনার উত্তরস্বরুপ ভগবান নরসিংহ শঙ্করকে রক্ষা করেন। ফলস্বরুপ আদি শঙ্কর লক্ষ্মী-নরসিংহ স্তোত্র রচনা করেন। তারপর তিনি গোকর্ণ, হরি-শঙ্করের মন্দির এবং কোল্লুড়ে মুকাম্বিকা মন্দির ভ্রমণ করেন। কোল্লুড়ে তিনি এক বালককে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন যে বালকটিকে তার পিতামাতা বাকশক্তিহীন বলে মনে করতেন। শঙ্কর তার নাম দেন হষ্টমালাকাচার্য (“বৈঁচি-জাতীয় ফল হাতে কেউ”, অর্থাৎ যিনি নিজেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করেছেন)|পরবর্তীতে তিনি সারদা পীঠ প্রতিষ্ঠা করতে শৃঙ্গেরী ভ্রমণ করেন এবং তোতাকাচার্যকে তাঁর শিষ্য বানান। এরপর আদি শঙ্কর অদ্বৈত দর্শনের বিরোধিতা করা সকল দর্শন অস্বীকারের দ্বারা এর প্রচারের জন্য দিগ্বিজয় ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি দক্ষিণ ভারত হতে কাশ্মীর অভিমুখে ভারতের সর্বত্র এবং নেপাল ভ্রমণ করেন এবং পথিমধ্যে সাধারন মানুষের মাঝে দর্শন প্রচার করেন এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য পন্ডিত ও সন্ন্যাসীদের সাথে দর্শন বিষয়ে তর্ক করেন।
মালায়ালী রাজা সুধনভকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে শঙ্কর তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিদর্ভের মধ্য দিয়ে যান। এরপর তিনি কর্ণাটকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন যেখানে তিনি একদল সশস্ত্র কাপালিকার সামনে পড়েন। রাজা সুদনভ তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিরোধ করেন এবং কাপালিকাদের পরাজিত করেন। তারা নিরাপদে গোকর্ণে পৌঁছান যেখানে শঙ্কর বিতর্কে শৈব পন্ডিত নীলাকান্তকে পরাজিত করেন। সৌরাষ্ট্রের (প্রাচীন খাম্বোজা) দিকে অগ্রসর হয়ে এবং গিরনার, সোমনাথ ও প্রভাসার সমাধিমন্দিরসমূহ ভ্রমণ শেষে এবং এ সকল স্থানে বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি দ্বারকা পৌঁছান। উজ্জয়িনীর ভেদ-অভেদ দর্শনের প্রস্তাবক ভট্ট ভাস্কর হতগর্ব হলেন। উজ্জয়িনীর সকল পন্ডিত (অবন্তী নামেও পরিচিত) আদি শঙ্করের দর্শন গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি বাহলিকা নামক এক জায়গায় দার্শনিক বিতর্কে জৈনদের পরাজিত করেন। তারপর তিনি কাম্বোজা (উত্তর কাশ্মীরের এলাকা), দারোদা ও মরুভূমিটিতে অবস্থিত অনেক এলাকার কয়েকজন দার্শনিক এবং তপস্বীর উপর তাঁর বিজয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রকান্ড পর্বতচূড়া অতিক্রম করে কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কামরুপে এক তান্ত্রিক নবগুপ্তের সম্মুখীন হন।
সারদা পীঠে আরোহণঃ
আদি শঙ্কর কাশ্মীরে (বর্তমানে পাকিস্তান-দখলকৃত কাশ্মীর) সারদা পীঠ ভ্রমণ করেন।[২১] মাধবীয়া শঙ্করাবিজয়ম অনুসারে এ মন্দিরে চারটি প্রধান দিক থেকে পন্ডিতদের জন্য চারটি দরজা ছিল। দক্ষিণ দরজা (দক্ষিণ ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী) কখনই খোলা হয়নি যা নির্দেশ করত যে দক্ষিণ ভারত থেকে কোনো পন্ডিত সারদা পীঠে প্রবেশ করেনি। সকল জ্ঞানের শাখা যেমন মীমাংসা, বেদান্ত এবং অন্যান্য হিন্দু দর্শনের শাখাসমূহে সকল পন্ডিতকে বিতর্কে পরাজিত করে আদি শঙ্কর দক্ষিণ দরজা খোলেন; তিনি সে মন্দিরের সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর জীবনের শেষদিকে আদি শঙ্কর হিমালয়ের এলাকা কেদারনাথ-বদ্রীনাথে যান এবং বিদেহ মুক্তি (“মূর্তরুপ থেকে মুক্তি”) লাভ করেন। কেদারনাথ মন্দিরের পিছনে আদি শঙ্করের প্রতি উৎসর্গীকৃত সমাধি মন্দির রয়েছে। যাহোক, স্থানটিতে তাঁর শেষ দিনগুলির বিভিন্ন পরম্পরাগত মতবাদ রয়েছে। কেরালীয়া শঙ্করাবিজয়াতে ব্যাখ্যাকৃত এক পরম্পরাগত মতবাদ তাঁর মৃত্যুর স্থান হিসেবে কেরালার থ্রিসুরের বদাক্কুন্নাথান মন্দিরকে নির্দেশ করে। কাঞ্চী কামাকোটি পীঠের অনুসারীরা দাবি করেন যে তিনি সারদা পীঠে আরোহণ করেন এবং কাঞ্চীপুরমে (তামিলনাড়ু) বিদেহ মুক্তি লাভ করেন।
মঠসমূহঃ
আদি শঙ্কর হিন্দু ধর্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো দক্ষিণে কর্ণাটকের শৃঙ্গেরীতে, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকায়, পূর্বে ওড়িশার পুরীতে এবং উত্তরে উত্তরখন্ডের জ্যোতির্মঠে (জোসিরমঠে)| হিন্দু পরম্পরাগত মতবাদ বিবৃত করে যে তিনি এসব মঠের দায়িত্ব দেন তাঁর চারজন শিষ্যকে যথাক্রমে: সুরেশ্বরা, হষ্টমালাকাচার্য, পদ্মপদ এবং তোতাকাচার্য। এ চারটি মঠের প্রত্যেক প্রধান প্রথম শঙ্করাচার্যের নামানুসারে শঙ্করাচার্য (“পন্ডিত শঙ্কর”) উপাধি গ্রহণ করেন।
আদি শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বলেন যে , ব্রহ্মই হল একমাত্র সত‍্য - এই জগৎ ব্রহ্মময় । তার মতে , " সঠিক বিদ‍্যা না থাকার ফলে মানুষ ব্রহ্মকে বুঝতে পারে না '' । আত্মাই হল ব্রহ্ম । এই ব্রহ্ম নির্গুণ এবং আনন্দময় । কিন্তু ব্রহ্ম আবার পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম হলেও ব‍্যবহারিক দৃষ্টিতে ঈশ্বর বলে প্রতিভাত হয় । অবিদ‍্যা ব্রহ্মের শক্তিবিশেষ যার ফলে জীব নিজেকে ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন মনে করে । প্রকৃতপক্ষে , জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন ।
উপনিষদ্ বা বেদান্তর উপর একান্ত নির্ভরশীল দার্শনিক সম্প্রদায়ের নাম বেদান্ত বা উত্তর-মীমাংসা। উত্তর-মীমাংসার নানা উপসম্প্রদায়ের মধ্যে অদ্বৈত-বেদান্তই সর্ব-বিখ্যাত এবং শঙ্করাচার্যই তার প্রকৃষ্টতম ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে তাকে প্রায়ই শঙ্কর-মত নামে উল্লেখ করা হয়। এই শঙ্কর-মতের সর্ববিদিত নামান্তর হলো ‘মায়া-বাদ’। শঙ্কর-মতের মূল বক্তব্যটা হচ্ছে–
‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’।। (শাঙ্করভাষ্য)।
অর্থাৎ : ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ।

এ-মতবাদের প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, এক অদ্বিতীয় পরব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং এই ব্রহ্মণ্ বিশুদ্ধ ‘অহং’ বা আত্মনের সঙ্গে অভিন্ন। স্বভাবতই, সাধারণ অভিজ্ঞতায় জানা পরিদৃশ্যমান জগৎ সত্য হতে পারে না। অতএব শঙ্কর-মতে তা অবিদ্যা বা অজ্ঞানেরই ফল– রজ্জুতে সর্পভ্রমের মতো বা শুক্তিতে রজতভ্রমের মতো অজ্ঞানের ফলেই আত্মান্ বা ব্রহ্মন্-এ জগৎ-ভ্রম হয়। অবিদ্যা বা অজ্ঞানেরই নামান্তর মায়া।

যদিও শঙ্কর-সম্প্রদায়ের সমস্ত দার্শনিক দাবি করেন, উক্ত মত একান্তভাবেই উপনিষদ-প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু আধুনিক বিদ্বানেরা প্রশ্ন তুলেছেন, এ-দাবি কি সত্যিই বস্তুনিষ্ঠ? উপনিষদ্-গুলিতে কি বাস্তবিকই এই মায়া-বাদই প্রস্তাবিত হয়েছে?
এই প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ হলো, উপনিষদ্-গুলি আধুনিক অর্থে দার্শনিক রচনা নয়; নানা প্রসঙ্গে নানা রকম দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা থাকলেও সে আলোচনাকে সুসংবদ্ধ যুক্তি-তর্ক প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক রূপ দেবার পরিচয় নেই। বিভিন্ন উপনিষদে– এমনকি একই উপনিষদে সংকলিত বিভিন্ন অংশে– সে যুগের বিভিন্ন চিন্তাশীল প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন তত্ত্বই ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এইসঙ্গেই মনে রাখা দরকার, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, এ-জাতীয় সমস্ত তত্ত্বের উপরই সমান গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। অর্থাৎ, ওই বহুবিধ এবং বিচিত্র তত্ত্বের মধ্যে তত্ত্ব-বিশেষের উপরই বারবার এবং নানাভাবে গুরুত্ব আরোপণের পরিচয় পাওয়া যায়। এবং এ-জাতীয় তত্ত্ব-বিশেষ বলতে প্রধানতই ব্রহ্মন্ ও আত্মন্-এর অভিন্নত্ব।

কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক না কেন, উত্তর-মীমাংসা সম্প্রদায়ের প্রত্যেক দার্শনিকই সামগ্রিক বা অখণ্ডভাবে উপনিষদ্-সাহিত্যকে অপৌরুষেয় ও অভ্রান্ত বলে দাবি করেছেন এবং প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিপাদ্য তত্ত্বই প্রকৃতপক্ষে ঔপনিষদিত তত্ত্ব। অর্থাৎ, উপনিষদের কোথাও তত্ত্বান্তরের স্থান নেই। বলা বাহুল্য, এ-রকম দাবি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়; কেননা– বিনা ব্যতিক্রমে সমস্ত উপনিষদ্-বাক্যকেই এক অভিন্ন দার্শনিক তত্ত্বের প্রতিপাদক বলে প্রমাণ করবার দাবি– বাস্তবিকই অসম্ভব।
থিব (Thibaut) প্রমুখ কারও কারও মতে, বড় জোর দু’একটি উপনিষদ্-বাক্যের সংশয়মূলক ব্যাখ্যার মধ্যে এই মায়াবাদের আভাস আবিষ্কার করা সম্ভব, যদিও জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার চূড়ান্ত অদ্বৈতমূলক তত্ত্ব উপনিষদে সরল, সুস্পষ্ট ও অবধারিতভাবেই ব্যাখ্যাত হয়েছে। তার মানে, তাঁরা বলতে চান, উপনিষদে মায়াবাদের পরিচয় নেই, কিন্তু অবধারিতভাবেই দেখানো হয়েছে জীবাত্মা ও পরমাত্মার– বা, আত্মন্ ও ব্রহ্মন্-এর– অদ্বৈত। কিন্তু এ-রকম মন্তব্য দার্শনিক বিচারে স্বীকারযোগ্য হতে পারে না। কেননা, উক্ত আত্মন্-ব্রহ্মন্ এর অদ্বৈতমূলক তত্ত্বের অনিবার্য অনুসিদ্ধান্ত আলোচ্য মায়াবাদই।

অতএব, দেবীপ্রসাদের মতে,– ‘যদি স্বীকার করা হয় উপনিষদে ব্রহ্মন্-আত্মন্-এর অদ্বৈতমূলক তত্ত্ব অবধারিত ভাবেই প্রতিপাদিত হয়েছে তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে যে শঙ্করাচার্য উক্ত তত্ত্বের অনিবার্য অনুসিদ্ধান্তটির– অর্থাৎ, মায়াবাদের– ব্যাখ্যা করে উপনিষদ্-প্রতিপাদ্য প্রধানতম দার্শনিক তত্ত্বরই পূর্ণাঙ্গ পরিণতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ উপনিষদে মায়াবাদের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও অন্তত মায়াবাদের মূল দার্শনিক শর্ত– মায়াবাদের বীজ– অবশ্য স্বীকার্য। তাই উপনিষদে মায়াবাদ নেই, এ-জাতীয় মন্তব্য অতিসারল্যেরই পরিচায়ক হবে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-১৯৮)
শঙ্কর আচার্যের বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য থেকেই এই "অদ্বৈতবাদ" বা "মায়াবাদের" উৎপত্তি হয়েছে । এই অদ্বৈতবাদ অনুযায়ী শঙ্করাচার্যের মত ছিল -

"অনাদি সিদ্ধি পরমাত্মাই জগতের কর্তা , জগৎ মিথ্যা ও জীব মিথ্যা । সেই পরমেশ্বর নিজ মায়া দ্বারা জগৎ নির্মাণ করেছেন , তিঁনিই ধারণ এবং প্রলয় কর্তা । আর এই জীবও প্রপঞ্চ স্বপ্নবৎ মিথ্যা । পরমেশ্বর স্বয়ং এই সকল লীলা করছেন ।"

এই মতবাদ অনুযায়ী এই জগৎ হলো স্বপ্নের মতো মিথ্যা , রজ্জুতে সর্প আদির মতো । মানে মায়াবাদ অনুযায়ী একমাত্র পরমাত্মা সত্য বাদবাকি সবকিছুই ভ্রম , যেমন স্বপ্নতে অনেক কিছুই দেখি তারপর জাগ্রত হওয়ার পর যেমন মনে হয় স্বপ্নের দৃশ্য গুলো মিথ্যা ছিল , তারপর রজ্জুতে সর্প অর্থাৎ দড়ি কে যেমন মাঝে মাঝে ভুল করে সাপ ভেবে ফেলি ঠিক এমনই হলো জগৎ মিথ্যা মায়াবাদ অনুযায়ী ।

হাজারও বছর পর সর্বপ্রথম এই বেদ বিরোধী অদ্বৈতবাদকে খণ্ডন করেন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী । সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে ১১ সমুল্লাস এবং ৮ সমুল্লাসে ।

এইবার একটু আলোচনা করে দেখি এই মায়াবাদ কতটা যুক্তি-তর্কসঙ্গত এবং শাস্ত্র অনুকূল । বেদান্ত দর্শন বা ব্রহ্মসূত্রের প্রথম দুই সূত্র দ্বারাই অদ্বৈতবাদের ধারণা খণ্ডন হয়ে যায় , দেখুন -

ব্রহ্মসূত্র ১/১/১ - অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা = এখন ব্রহ্ম কে জানার ইচ্ছা করি ।

অর্থাৎ এখানে ব্রহ্ম কে জানার কথা বলছে সেই ব্রহ্ম কে বা কেমন ? এখন পরের ২য় সূত্রে মহর্ষি ব্যাস জী লিখেছে -

ব্রহ্মসূত্র ১/১/২ - জন্মাদ্যস্য য়তঃ = এই সমস্ত সংসারের জন্ম , স্থিতি তথা প্রলয় যার দ্বারা হয় , তিনিই ব্রহ্ম ।

অর্থাৎ যিনি এই জগতের সৃষ্টি , স্থিতি এবং প্রলয় করেন তিনিই "ব্রহ্ম" বা "পরমাত্মা"।

এই একই কথা ঋগ্বেদে - ১০/১২৯/৭ মন্ত্রেও বলা আছে । এইবার একটু বিচার করে দেখুন যে - জগতের সৃষ্টি হয় আবার স্থিতিতে থাকে আবার সময় মত ধ্বংসও হয় , সেই জগৎকে যদি কেউ যদি মিথ্যা বলে তাহলে সেই কথা পাগলামি ছাড়া আর কি হতে পারে !

অদ্বৈতবাদীরা উদাহরণ দেয় যে - "জগৎ স্বপ্নের মতো মিথ্যা" । তাহলে আমার প্রশ্ন হল যে - আমরা স্বপ্নে যা দেখি তা কি বাস্তবে কখনোই দেখিনি বা সেই সম্পর্কে কি কখনোই কোনো জ্ঞান হয়নি ?

আমরা যে বিষয়ে স্বপ্ন দেখি , সে বিষয় অবশ্যই আমাদের জ্ঞাত বিষয় । স্বপ্ন যদিও ভেঙে গেলে মনে হয় যে স্বপ্নের দৃশ্য গুলো মিথ্যা ছিল কিন্তু স্বপ্নে যে বস্তুর বিষয়ে দেখা হয় তা কিন্তু বাস্তবে এক সময় বিদ্যমান ছিল বা এখনো আছে ।

ধরুন আজ আমি স্বপ্ন দেখলাম যে - আমি আমেরিকায় গেছি , কাশ্মীরেও গেছি , সেখানে ঘুরছি মজা করছি , তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আর আমার জ্ঞান হলো যে - আমি বাড়িতেই আছি কোথাও যাইনি , তাহলে স্বপ্নে দেখা আমেরিকা , কাশ্মীরে যাওয়ার দৃশ্যটি মিথ্যা । কিন্তু তার মানে কি এই যে - আমেরিকা এবং কাশ্মীর বলে কোনো জায়গাই নেই ? বা এর মানে কি এই যে - আমেরিকা , কাশ্মীর বলে কিছু ছিলই না ?

তাই স্বপ্নের সাথে ওই জগৎ মিথ্যা এই উদাহরণটি সম্পূর্ণই যুক্তিহীন ।

মায়াবাদীরা আবার যুক্তি দেয় যে - রজ্জুতে সর্প , এর তাৎপর্য এই যে - যেমন মাঝে মাঝে আমরা দড়িকে ভ্রমের কারণে সাপ মনে করি ঠিক তেমনই এই জগৎ মিথ্যে মায়াবাদীদের মতে । এই উদাহরণও যে অযৌক্তিক তা এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে !

দেখুন এটা অবশ্যই ঠিক যে দড়িকে আমরা মাঝে মাঝে ভ্রমের কারণে সাপ ভাবি , কিন্তু সাপ কি কোনো বস্তু নয় ? দড়ি টি সাপ নয় কিন্তু অন্য কোথাও কি সাপ নেই ? বাস্তবে সাপ আছে এবং সাপের বিষয়ে জ্ঞান হয়েছে বলেই আমরা দড়ি কে ভ্রমের কারণে সাপ ভাবি । এই বিষয়টি সকলের জানা উচিত যে বস্তু বা যে পদার্থের কোনো অস্তিত্বই নেই সেই বিষয়ে কখনোই জ্ঞান হয়না ।

এই জগৎ অবশ্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্মের মতো নিত্য নয় কিন্তু মিথ্যাও নয় । কারণ এই জগৎ তৈরি হয়েছে "সত্ত্ব" , "রজ" এবং "তম" তিন গুণের প্রকৃতি নামক উপাদান দ্বারা । এই প্রকৃতি পরমাত্মার মতো নিত্য সত্ত্বা । বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী তিনটি সত্ত্বাকে অনাদি বা সনাতন বা অজন্মা বলা হয়েছে -

১ ) পরমাত্মা : যিনি এই সংসারের নির্মাণ কর্তা অর্থাৎ পরমাত্মা হলেন নিমিত্ত কারণ ।

২ ) প্রকৃতি : এই প্রকৃতি হলো জগতের উপাদান কারণ ।

৩ ) জীবাত্মা : এই জীবাত্মা হল সাধারণ কারণ ।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪ অধ্যায় ৫ শ্লোকে বলা হয়েছে - " 'সত্ত্ব' , 'রজ' , 'তম' গুণের প্রকৃতি , জীবাত্মা এবং পরমাত্মা হলো 'অজ' অর্থাৎ 'অজন্মা' বা 'জন্মরহিত' আর এই অজন্মা প্রকৃতিকে জীবাত্মা ভোগ করে ।"

যেখানে প্রকৃতি এবং জীবাত্মাকে "অজ" অর্থাৎ জন্মরহিত বলা হয়েছে , সেখানে 'প্রকৃতি' নামক উপাদান দ্বারা তৈরি জগৎকে যদি কোনো মায়াবাদীরা মিথ্যা বলে দাবি করেন তাহলে সেটা তাদের অজ্ঞানতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয় ।

এই একই ধরণের বিষয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণও গীতার ১৩/২০ শ্লোকে বলেছেন - "পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মা এবং প্রকৃতি এই দুই হলো অনাদি"। কৃষ্ণজী এখানে আরও বলেছেন - যে পরিমাণ , বিকার এবং সত্ত্ব আদি যে গুণ আছে তা প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন হয় ।

কৃষ্ণজী আবার ১৩/২১ শ্লোকে বলেছেন যে - কার্য-কারণ উৎপন্নের কারণ প্রকৃতি , আর এই প্রকৃতিই জীবের সুখ দুঃখ ভোগের কারণ ।

মহর্ষি কপিলের লিখা সাংখ্য দর্শনে এই বিষয়কে আরও সুন্দর করে স্থাপন করেছেন ।

সাংখ্যদর্শন ১/৬১ , ৬২ , ৬৩ , ৬৪ , ৬৫ , ৬৬ , ৬৭ সূত্র এবং আরও অন্যান্য সূত্রে আছে যেখানে প্রকৃতি উপাদান হতে জগৎ সৃষ্টির বর্ণনা করা হয়েছে ।

শুনেছি মায়াবাদীরা নাকি সাংখ্য দর্শনকে মানেনা এই দর্শনকে তাঁরা নাস্তিক দর্শন বলে , যদি এই কথিত বেদান্তিরা মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনকে নাস্তিক দর্শন বলেন , তাহলে তাদের যুক্তি অনুযায়ী স্পষ্টভাবে বলা যায় যে - গীতা জ্ঞানের দাতা শ্রীকৃষ্ণও একজন নাস্তিক ছিলেন ! কারণ গীতা ১৮/১৯ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট ভাবে বলছেন যে তিনি অর্জুনকে সাংখ্য দর্শনের বাণী শোনাবেন । গীতায় একবার নয় বহু বার সত্ত্ব , রজ , তম বিষয়ে কথন আছে । এই তিন গুণের কথাও কৃষ্ণজী সাংখ্য দর্শন থেকেই বলেছেন , কারণ সাংখ্যশাস্ত্র ছাড়া পূর্বের কোনো শাস্ত্রেই প্রকৃতির এই তিন গুণ সত্ত্ব , রজ , তম-এর কথন নেই অর্থাৎ উক্ত বিষয়ের তাৎপর্য এই হয় যে - শ্রীকৃষ্ণ নিজেও মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনকে মানতেন ।

প্রাসঙ্গিকভাবেই এবার ঋগ্বেদে এই মায়া’র প্রাক্-ইতিহাসটুকু পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

প্রাচীন বৈদিক কবিরা যে অবশ্যই মায়া শব্দটির সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, বলা বাহুল্য, বৈদান্তিক অর্থে মায়াবাদ তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। বস্তুত,– ‘মায়া শব্দটির প্রাক্-ইতিহাস বিচার করলে দেখা যায় যে তা জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়-মূলক কোনো সুপ্রাচীন ধারণারই পরিচায়ক। শব্দটির আদি-অর্থ বিচারে অবশ্যই আমাদের প্রধান সহায় নিঘণ্টু। নিঘণ্টু-মতে (নিঘণ্টু-৩/৯) মায়া একটি প্রজ্ঞা-বাচক শব্দ; মায়া মানে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি জ্ঞান। কিন্তু এ-বিষয়ে নিঘণ্টু থেকে আরও কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা নিঘণ্টু-মতে প্রজ্ঞার আর একটি প্রতিশব্দ বলতে ধী (নিঘণ্টু-৩/৯) এবং এই ধী শব্দটি কর্মনামেরও অন্তর্গত (নিঘণ্টু-২/১); ধী মানে কর্মও। স্বভাবতই অনুমান হয়, প্রাচীন বৈদিক কবিরা আধুনিক অর্থে কর্ম-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ জ্ঞানবলে কোনো কিছুর প্রশংসা শেখেননি; কঠোর জীবন-সংগ্রামের সম্মুখীন এই কবিদের কাছে সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান যা কিনা কর্মনির্বাহর বা কর্মপরিচালনার সহায়ক। নিঘণ্টু-তেই এ-অনুমানের আরো সমর্থন পাওয়া সম্ভব। কর্মের আর একটি প্রতিশব্দ ক্রতু (নিঘণ্টু-২/১); এই শব্দটিই আবার প্রজ্ঞা-নাম তালিকার অন্তর্ভুক্ত (নিঘণ্টু-৩/৯)। তেমনি শচী শব্দটি প্রজ্ঞা-নাম (নিঘণ্টু-৩/৯) এবং কর্ম-নাম (নিঘণ্টু-২/১) উভয়ই। শব্দ-ব্যবহারের এ-জাতীয় বৈশিষ্ট্য উপেক্ষণীয় নয়; প্রাচীন কবিদের চেতনায় জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়নি; অতএব প্রজ্ঞা-বাচক মায়া শব্দটির মধ্যেও জ্ঞান ও কর্মের কোনো আদিম সমন্বয় অনুমেয়। এবং জ্ঞান ও কর্মের আদিম সমন্বয়-মূলক বলেই মায়া শব্দের মধ্যে আদিম জাদুর ইঙ্গিত থাকাও স্বাভাবিক।’- (ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ, পৃষ্ঠা-১৯৮)

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ঋগ্বেদেই ‘মায়া’ শব্দের একটি ইতিহাস চোখে পড়ে এবং সে-ইতিহাসের মূলকথা হলো একদা-গরিমা-মণ্ডিত প্রজ্ঞা-কর্ম সূচক ওই প্রাচীন ধারণার ক্রমাধঃপতন। এই ইতিহাসটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক। কীরকম?
নিঘণ্টুর ব্যাখ্যায় নিরুক্তে (নিরুক্ত-৩/৯) বলা হয়েছে, মান বা পরিমাণ করা অর্থে মাঙ্ ধাতু থেকে মায়া শব্দের নিষ্পত্তি; এবং–
‘মীয়ন্তে পরিচ্ছিদ্যন্তে অনয়া পদার্থাঃ’। (নিরুক্ত-৩/৯)
অর্থাৎ : যার সাহায্যে পদার্থদের পরিচ্ছন্ন রূপদান করা হয় তাইই মায়া।
এবং এই অর্থে মায়ার ব্যবহার হিসেবে নিরুক্তকার ঋগ্বেদের নিম্নোক্ত নজির উদ্ধৃত করেছেন–
‘মায়াভিরিন্দ্র মায়িনং ত্বং শুষ্ণমবাতিঃ।’
বিদুষ্টে তস্য মেধিরাস্তেষাং শ্রবাংস্যুত্তির।।- (ঋগ্বেদ-১/১১/৭)।
‘ইমামূ নু কবিতমস্য মায়াং মহীং দেবস্য নকিরা দধর্ষ।’
একং যদুদ্না ন পৃণস্ত্যেনীরাসিঞ্চন্তীরবনয়ঃ সমুদ্রম্ ।।- (ঋগ্বেদ-৫/৮৫/৬)।
অর্থাৎ :
‘হে ইন্দ্র, তুমি তোমার মায়াসকলের দ্বারা মায়াবী শুষ্ম-কে হত্যা করেছিলে।’ মেধাবীগণ তোমার মহিমা জানে, তাদের অন্ন বর্ধন কর। (ঋক-১/১১/৭)।।  ‘কবিশ্রেষ্ঠ (কবিতমঃ) বরুণের মহান মায়াকে কেউ হিংসা বা খণ্ডন করতে পারে না।’ তাঁরই কারণে শুভ্র, বারিমোক্ষণকারী নদীসমূহ বারিদ্বারা একমাত্র সমুদ্রকে পরিপূর্ণ করতে পারে না। (ঋক-৫/৮৫/৬)।।

ঋক্-দুটিতে উদ্ধৃতি-চিহ্নর মাধ্যমে নিরুক্তকারের উদ্ধৃতি চিহ্নিত করা হয়েছে। ঋক্-দুটির পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য যাই হোক না কেন, এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় এখানে মায়া শব্দ ব্যবহারের মধ্যে পরবর্তীকালের অবিদ্যা বা অজ্ঞান অর্থে নিন্দিত তাৎপর্যের আভাসও নেই। এভাবে অন্যান্য বহু দৃষ্টান্তেও দেখা যায় বৈদিক কবিদের সমস্ত পৌরাণিক কল্পনা সত্ত্বেও ওই প্রাচীন প্রজ্ঞা-কর্মবাচক ধারণাটি নিয়ে করিরা কতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। যেমন–
অগ্নে ভূরীণি তব জাতবেদা দেব স্বধাবোহমৃতস্য নাম।
যাশ্চ মায়া মায়িনাং বিশ্বমিন্ব তে পূর্বীঃ সন্দধুঃ পৃষ্টবন্ধো।। (ঋগ্বেদ-৩/২০/৩)।
স প্রাচীনান্ পর্বতা দৃংহদোজসাধরাচীনম্ অকৃণোদপামপঃ।
অধারয়ৎ পৃথিবীং বিশ্বধায়সমস্তভ্নান্ মায়য়া দ্যামবস্রসঃ।। (ঋগ্বেদ-২/১৭/৫)।
যো বো মায়া অভিদ্রুহে যজত্রাচ পাশা আদিত্যা রিপবে বিচৃত্তাঃ।
অশ্বীব তা অতি যেষং রথেনারিষ্টা উরাবা শর্মন্তৃস্যাম।। (ঋগ্বেদ-২/২৭/১৬)।
স বহ্নিঃ পুত্রঃ পিত্রোঃ পবিত্রবান্ পুনাতি ধীরো ভুবনানি মায়য়া।
ধেনুঞ্চ পৃশ্নিং বৃষভং সুরেতসং বিশ্বাহা শুক্রং পয়ো অস্য দুক্ষত।। (ঋগ্বেদ-১/১৬০/৩)।
হোতা দেবো অমর্ত্যঃ পুরস্তাদেতি মায়য়া। বিদথানি প্রচোদয়ন্ ।। (ঋগ্বেদ-৩/২৭/৭)।
অর্থাৎ :
হে দ্যোতমান, জাতবেদা, মরণরহিত, অন্নবান অগ্নি! দেবতাগণ তোমাকে অনেক তেজ প্রদান করেছেন। হে বিশ্বের তৃপ্তিকারী, প্রার্থিত ফলদায়ী অগ্নি! মায়াবীগণের প্রাচীন মায়া সমস্ত তোমাতেই আছে। (ঋক-৩/২০/৩)।।  ইন্দ্র মায়াবলে ইতস্তত গমনকারী পর্বতসমূহকে অচল করেছেন, মেঘস্থিত জলরাশি অধোমুখে প্রেরণ করেছেন, বিশ্বধাত্রী পৃথিবীকে ধারণ করেছেন এবং দ্যুলোককে পতন হতে রক্ষা করেছেন। (ঋক-২/১৭/৫)।।  আদিত্যগণের মায়া তাঁদের পাশকে দ্রোহকারী শত্রুদের প্রতি প্রসারিত করে; আমি যেন অশ্বারোহী পুরুষের ন্যায় তা অনায়াসে অতিক্রম করে যেতে পারি। (ঋক-২/২৭/১৬)।।  (দ্যাবাপৃথিবী স্বরূপ) পিতামাতার পুত্র বহ্নি (অগ্নি) পবিত্র, ধীর; তিনি মায়ার দ্বারা ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন; তিনি চিরকাল ধরে শুক্লবর্ণ গাভী এবং শোভন রেতঃযুক্ত বৃষভ হতে শুক্র এবং দুগ্ধ দোহন করেন। (ঋক-১/১৬০/৩)।।  দেবতা অগ্নি, যিনি হোতা ও অমর, তিনি মায়াগুলির সাথে বিচরণ করেন এবং বিদথগুলিকে অনুপ্রাণিত করেন। (ঋক-৩/২৭/৭)।।

শুধু দেবতাই নয়, পার্থিব বস্তুর প্রসঙ্গেও ঋগ্বেদে এই মায়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–
ন যে দিবঃ পৃথিব্যা অন্তমাপু র্ন মায়াভি র্ধনদাং পর্ষভূবন্ ।
যুজং বজ্রং বষৃভশ্চক্র ইন্দো নির্জ্যিেতষা তমসো গা অদুক্ষৎ।। (ঋগ্বেদ-১/৩৩/১০)।
অর্থাৎ :
যখন জল মায়াগণের সাহায্যে (মায়াভিঃ) পৃথিবীর অন্ত প্রাপ্ত হলো না এবং ধনপ্রদ ভূমির উপর বিস্তৃত হলো না তখন বর্ষণকারী ইন্দ্র হস্তে বজ্র ধারণ করলেন এবং দ্যুতিমান (বজ্র) দ্বারা অন্ধকার রূপ (মেঘ) হতে পতনশীল (জল) নিঃশেষিতরূপে দোহন করলেন। (ঋক-১/৩৩/১০)।।

এই ঋকের ‘ভাষ্যে টীকাকার সায়ণ বলছেন, “ধনদাম্” মানে “ধনপ্রদাং ভূমিং”; স্বভাবতই এখানে আকাশের জলে জমির উর্বরতা-প্রাপ্তি উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, বৈদিক কবিদের কল্পনায় জলের এই উর্বরতা-দায়িনী শক্তিও আসলে জলের মায়া। সায়ণ তাই এখানে ‘মায়াভিঃ’ শব্দের অর্থ করেছেন– ‘শস্যোপকারাদিভিঃ কর্মভিঃ’, শস্যের উপকারী কর্মসমূহের দ্বারা। অতএব এই দৃষ্টান্তটি থেকেই অনুমান হয় প্রাচীন কবিরা মায়া বলতে এমনকি প্রাকৃতিক কর্মশক্তিকেও বুঝতে দ্বিধা করেন নি; সর্বকর্মের মূলেই মায়া, অতএব জলের ওই উর্বরতা-দায়িনী শক্তিও জলের মায়া বলে বিবেচিত।’- (ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ, পৃষ্ঠা-১৯৯)

কিন্তু আগেও বলা হয়েছে, ঋগ্বেদে এ-জাতীয় নানা প্রসঙ্গে মায়ার প্রশংসা পাওয়া গেলেও এই মায়া মূলতই বরুণ– বা মিত্রাবরুণের– বিশেষ শক্তি বলেই কল্পিত। যেমন–
ইমামূ ষ্বাসুরস্য শ্রুতস্য মহীং মায়াং বরুণস্য প্র বোচম্ ।
মানেনেব তস্থিবা অন্তরীক্ষে বি যো মমে পৃথিবীং সূর্যেণ।। (ঋগ্বেদ-৫/৮৫/৫)।
মায়া বাং মিত্রাবরুণা দিবি শ্রিতা সূর্যো জ্যোতিশ্চরতি চিত্রামায়ুধম্ ।
তমভ্রেণ বৃষ্ট্ব্যা গূহথো দিবি পর্জন্য দ্রপ্সা মধুমন্ত ঈরতে।। (ঋগ্বেদ-৫/৬৩/৪)।
রেবদ্বয়ো দধাথে বেবদাশাথে নরা মায়াভিরিত উতি মাহিনম্ ।
ন বাং দ্যাবো হভির্নোত সিন্ধবো ন দেবত্বং পণয়ো নানাশুর্মঘম্ ।। (ঋগ্বেদ-১/১৫১/৯)।
অর্থাৎ :
প্রসিদ্ধ অসুর বরুণের সেই সুমহতী মায়ার কথা বলছি, যার সাহায্যে তিনি সূর্যদ্বারা অন্তরীক্ষের পরিমাণ করেছিলেন। (ঋক-৫/৮৫/৫)।।  হে মিত্রাবরুণ, তোমদের মায়া স্বর্গকে আশ্রয় করেছে এবং সূর্যরূপে বিচিত্র আয়ুধ হয়ে তা অন্তরীক্ষে পরিভ্রমণ করছে। তোমাদের ইচ্ছাক্রমে মেঘ ও বৃষ্টিদ্বারা সুমধুর বারিবিন্দু সকল পতিত হয়। (ঋক-৫/৬৩/৪)।।  হে ধনবিশিষ্ট অন্নপ্রদানকারী মিত্রাবরুণ, তোমাদের ধনবিশিষ্ট অন্ন প্রচুর এবং তা মায়া দ্বারা রক্ষিত। দিবস বা রাত্রি তোমার দেবত্ব প্রাপ্ত হয়নি, নদীগণও তোমার দেবত্ব প্রাপ্ত হয়নি, পণিরাও প্রাপ্ত হয়নি; তারা তোমার দানও প্রাপ্ত হয়নি। (ঋক-১/১৫১/৯)।।

এমন দৃষ্টান্ত ঋগ্বেদে আরও প্রচুর আছে। বৈদিক কবিরা যে কোন-এক কালে জ্ঞান-কর্মের সমন্বয়মূলক ওই আদিম ধারণাটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপণ করেছিলেন, উপরোদ্ধৃত দৃষ্টান্তগুলিই তার প্রমাণ হিসেবে পর্যাপ্ত। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, বৈদিক ঐতিহ্যেই এই মায়ার গৌরব ক্রমশ ম্লান হতে দেখা যায় এবং এমনকি ঋগ্বেদের রচনাকালেই মায়া শেষ পর্যন্ত বন্ধ্যা ও নিষ্ফল বলে নিন্দিত হয়েছে! ঋগ্বেদের দর্শম মণ্ডলেই দেখা যায় মায়া যেন বন্ধ্যাত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে– যে-মায়া দেবতাদের প্রধানতম কর্ম-কৌশল ছিলো, সেই মায়াই নিষ্ফল ও বন্ধ্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন–
উত ত্বং সখ্যে স্থিরপীতমাহুর্নৈনং হিন্বন্ত্যপি বাজিনেষু।
অধেন্বা চরতি মায়য়ৈষ বাচং শুশ্রুবা অফলামপুষ্পাম্ ।। (ঋগ্বেদ-১০/৭১/৫)।
অর্থাৎ :
(হে বৃহস্পতি) তুমি এই সখ্যে স্থির নিশ্চয় হয়েছো, কেউ আর সংগ্রামে তার অনুগমন করে না।  সে ব্যক্তি ধেনুহীন হয়ে মায়ার দ্বারা বিচরণ করে, সে নিষ্ফল পুষ্পবিহীন বাক্য শ্রবণ করে। (ঋক-১০/৭১/৫)।।


এই ঋকটি ঋগ্বেদের একটি অতি অর্বাচীন সূক্তের অন্তর্গত এবং এতোটা অর্বাচীন বলেই আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তও বটে। কেননা এর সাহায্যে বৈদিক চিন্তা-বিবর্তনের প্রসঙ্গে মায়ার যে ইতিহাস উপেক্ষিত তা গ্রন্থিত হতে পারে। এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন,– ‘আমাদের যুক্তি হলো, যে-মূল সমাজ-বিবর্তনের পটভূমিতে আমরা বৈদিক চিন্তা-বিবর্তন বোঝবার প্রস্তাব করেছি তারই মধ্যে মায়ার এই অত্যাশ্চর্য ইতিহাসটিকেও বোঝবার মূলসূত্র পাওয়া যাবে এবং সেই মূলসূত্র অনুসারেই বৈদিক ঐতিহ্যে ভাববাদের আবির্ভাব ব্যাখ্যাত হতে পারে।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২০০)



আদি শঙ্করের রচনাবলির আংশিক তালিকা নিচে দেওয়া হল:

ভাষ্য

আদি শঙ্কর নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলির ভাষ্য রচনা করেছিলেন:

প্রকরণ গ্রন্থ

আদি শঙ্কর নিম্নোক্ত প্রকরণ গ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন:
  • বিবেকচূড়ামণি[note ২]
  • উপদেশসাহস্রি
  • শতশ্লোকি
  • দশশ্লোকি
  • একশ্লোকি
  • পঞ্চীকরণ
  • আত্মবোধ
  • অপরোক্ষানুভূতি
  • সাধনাপঞ্চকম্‌
  • নির্বাণষটকম্‌
  • মণীষাপঞ্চকম্‌
  • যতিপঞ্চকম্‌
  • বাক্যসুধা
  • তত্ত্ববোধ
  • বাক্যবৃত্তি
  • সিদ্ধান্ততত্ত্ববিন্দু
  • নির্গুণমানসপূজা
  • প্রশ্নোত্তররত্নমালিকা
  • প্রবোধসুধাকর
  • স্বাত্মপ্রকাশিকা

স্তোত্র

আদি শঙ্কর শিববিষ্ণুদুর্গাগণেশ ও সুব্রহ্মণ্যের উপর একাধিক স্তোত্র রচনা করেছিলেন।[১০]
  • গণেশ পঞ্চরত্নম্‌
  • অন্নপূর্ণাষ্টকম্‌
  • কালভৈরবাষ্টকম্‌
  • দক্ষিণামূর্তি স্তোত্রম্‌
  • কৃষ্ণাষ্টকম্‌
  • ভজ গোবিন্দম্‌ বা মোহমুদ্গর
  • শিবানন্দলহরী
  • সৌন্দর্যলহরী
  • শ্রীলক্ষ্মীনৃসিংহকরাবলম্বস্তোত্রম্‌
  • শারদা ভুজঙ্গম্‌
  • কনকধারা স্তোত্রম্‌
  • ভবানী অষ্টকম্‌
  • শিবমানসপূজা
  • পাণ্ডুরঙ্গাষ্টকম্‌
  • সুব্রহ্মণ্য ভুজঙ্গম্‌




সংস্করণ

আদি শঙ্করের রচনাবলির একাধিং সংস্করণ পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি নিচে দেওয়া হল:[১১]

রচনাসমগ্র

  • আদি শঙ্কর গ্রন্থাবলি (মূল সংস্কৃত), ১ – ১০ খণ্ড। সংশোধিত সংস্করণ, সমতা বুকস, মাদ্রাজ, ১৯৯৮ (শৃঙ্গেরি সারদা পীঠম মঠের পরিলাচনাধীনে প্রথম বাণী বিলাস প্রেস, শ্রীরঙ্গম থেকে প্রকাশিত)
  • শঙ্করাচার্য গ্রন্থমালা, ১ – ৪ খণ্ড, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, ১৯৯৫ (সম্পূর্ণ রচনাবলি, বঙ্গানুবাদ ও টীকা সহ)
  • উপনিষদ্‌-ভাষ্য-সংগ্রহ, মহেশানুসন্ধান সংস্থান, মাউন্ট আবু, ১৯৭৯-৮৬। কঠ, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের শাঙ্কর ভাষ্য (আনন্দগিরি টীকা ও অন্যান্য উপটীকা সহ)।
  • প্রকরণদ্বাদশী, মহেশানুসন্ধান সংস্থান, মাউন্ট আবু, ১৯৮১ (টীকা সহ বারোটি প্রকরণ গ্রন্থের সংকলন)।
  • আ বুকে অফ ননডুয়াল টেক্সটস, অনুবাদ: ড. এইচ. রামমূর্তি ও নোম, সোসাইটি অফ অ্যাবিডেন্স ট্রুথ, ২০০৮। এটটি বইয়ে মূল সংস্কৃত সহ ইংরেজি কাব্যানুবাদ।

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য

  • কাশীনাথ শাস্ত্রী লেলে কর্তৃক মারাঠি অনুবাদ সহ সম্পাদিত, শ্রীকৃষ্ণ মুদ্রণালয়, ওয়াই, ১৯০৮।
  • বিষ্ণু বামন বাপত শাত্রী কর্তৃক ভারতীতীর্থের বৈয়াশিক-ন্যায়মালা ও মারাঠি টীকা সহ অনূদিত, পুণে, ১৯২৩।
  • এস. কে. বেলভালকর কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ, পুণে, ১৯৩৮।
  • ভারতীতীর্থের অধিকরণ-রত্নমালা সহ সম্পাদিত, শ্রীভেঙ্কটেশ্বর মুদ্রণালয়, বোম্বাই, ১৯৪৪।
  • ভি. এম. আপ্টে কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ, পপুলার বুক ডিপো, বোম্বাই, ১৯৬০।
  • জর্জ থিবাউট কর্তৃক ইংরেজি অন্যবাদ, ডোভার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬২।
  • পল ডসেন কর্তৃক জার্মান অনুবাদ, জি. ওমস, হিল্ডেসেম, ১৯৬৬।

ভগবদ্গীতা ভাষ্য

  • দিনকর বিষ্ণু গোখেল কর্তৃক সমালোচনামূলক সম্পাদনা, ওরিয়েন্ট বুক এজেন্সি, পুণে, ১৯৩১।
  • কাশীনাথ শাস্ত্রী আগাসে কর্তৃক আনন্দগিরি টীকা সহ সম্পাদিত, আনন্দাশ্রম, পুণে, ১৯৭০।
  • আল্লাদি মহাদেব শাস্ত্রী কর্তৃক সম্পাদিত, সমতা বুকস, মাদ্রাজ, ১৯৭৭।
  • এ. জি. কৃষ্ণ ওয়ারিয়ার কর্তৃক সম্পাদিত, রামকৃষ্ণ মঠ, মাদ্রাজ, ১৯৮৩।
  • ট্রেভর লেগেট, রিয়েলাইজেশন অফ দ্য সুপ্রিম সেলফ: দ্য ভগবদ্গীতা যোগাস (শাঙ্কর ভাষ্যের অনুবাদ), কেগান পল ইন্টারন্যাশানাল, লন্ডন, ১৯৯৫।

উপদেশসহস্রি

  • সীতারাম মহাদেব ফাড়কে কর্তৃক সম্পাদিত, রসিকারঞ্জন গ্রন্থ প্রকাশ মণ্ডলী, পুণে, ১৯১১। (মারাঠি অনুবাদ সহ)
  • পল হ্যাকার কর্তৃক জার্মান অনুবাদ ও টীকা, এল. রোহরশিল্ড, বন, ১৯৪৯।

বিবেকচূড়ামণি

  • মোহিনী চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ সহ সম্পাদিত, থিওসফিক্যাল পাবলিশিং হাউস, মাদ্রাজ, ১৯৪৭।
  • দ্য পিনাকল অফ ইন্ডিয়ান থট, আর্নেস্ট উড কর্তৃক সম্পাদিত, থিওসফিক্যাল পাবলিশিং হাউস, হোয়েটন (ইলিনোইস), ১৯৬৭। (ইংরেজি অনুবাদ)
  • স্বামী প্রভবানন্দ ও ক্রিস্টোফার ইশারউড কর্তৃক শঙ্কর’স ক্রেস্ট-জুয়েল অফ ডিসক্রিমিনেশন, সঙ্গে আ গারলেন্ড অফ কোয়েশ্চনস অ্যান্ড অ্যানসারস, বেদান্ত প্রেস, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৭১।
  • শ্রীশঙ্করের বিবেকচূড়ামণি, সঙ্গে শৃঙ্গেরির চন্দ্রশেখর ভারতীর সংস্কৃত টীকার ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ: পি. শঙ্করনারায়ণ, ভারতীয় বিদ্যা ভবন, ১৯৯৯।

পঞ্চীকরণ

  • সুরেশ্বরের বর্তিকা ও অভিনবনারায়ণেন্দ্র সরস্বতীর বর্তিকাভরণ সহ সম্পাদিত, শ্রীবাণীবিলাস প্রেস, শ্রীরঙ্গম, ১৯৭০।
  • গুজরাতি অনুবাদ ও টীকাসহ সম্পাদিত, শ্রীহরিহর পুস্তকালয়, সুরাত, ১৯৭০।

তথ্যসূত্র

  1.  "Works of Adi Shankara"। ১৮ জুন ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৬, ২০০৬
  2. ↑    Shah-Kazemi 2006, পৃ. 4।
  3. ↑   Singh 2004, পৃ. 1315।
  4. ↑   Nakamura 2004, পৃ. 262-265।
  5.  Isayeva 1993, পৃ. 94।
  6. ↑    Nakamura 2004, পৃ. 263।
  7.  Nakamura 2004, পৃ. 263-264।
  8.  Nakamura 2004, পৃ. 264।
  9.  Nakamura 2004, পৃ. 265।
  10.  "Slokas"। ১৫ জুন ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৬, ২০০৬
  11.  Vidyasankar, S। "A Select Bibliography"। ১৫ জুন ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৬, ২০০৬
শঙ্করের আবির্ভাবকালে তখন বৌদ্ধ ও জৈনমতের প্রবল প্রতাপ। ফলে বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি লোকের শ্রদ্ধাও কমে যাচ্ছিলো। দাক্ষিণাত্যে জৈন ধর্মের প্রসার লাভ করেছিলো। শৈব আদিয়াব ও বৈষ্ণব আলোয়ারগণ ভক্তিধর্ম প্রচার করছিলেন। মীমাংসকগণ বৈদিক যাগযজ্ঞ প্রচারের চেষ্টা করেন। অপরদিকে কুমারিল ও মণ্ডনমিশ্র সন্ন্যাসের তুলনায় গার্হস্থ্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বলা যায়, এটা ছিলো সেই সময় যখন বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, জৈন সকল ধর্মই মানুষকে সাধুতে পরিণত করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো। প্রকৃত ব্যাখ্যাতার অভাবে হিন্দুমত তখন শাস্ত্রের বিরোধ এবং আচার-অনুষ্ঠানের কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিলো। হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত এবং শাস্ত্রের আপাতবিরোধ দূর করাকে প্রাথমিক দায়িত্ব মনে করে শঙ্কর নানা শাস্ত্রের মূলতত্ত্বকে মানুষের কাছে তুলে ধরে দেখান যে, শাস্ত্রের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই। বিভিন্ন উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবাদকে সুদৃঢ়ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি দেখান যে, বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই পরমতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। এই পরমতত্ত্ব এক অনির্বচনীয় পরমসত্তা। বেদান্ত দর্শনে এই পরমসত্তাকে বলা হয় ব্রহ্ম।

বেদান্তের শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী, অজ্ঞানবশতই জীব সখণ্ডকে সত্য বলে মনে করে এবং পরমসত্তার কথা কখনও চিন্তা করে না। সখণ্ড প্রতিভাত জগৎ না সত্য, না অলীক। অখণ্ড পরমসত্তাই যেহেতু একমাত্র সত্য, সেহেতু প্রতিভাত সখণ্ড জগৎ সত্য নয়। আবার জগৎ শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকও নয়। জগৎ অনির্বচনীয়। জগতের এই অনির্বচনীয়তারই পারিভাষিক নাম হলো ‘মায়া’। জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃত জ্ঞানের উদয়ে জীব এই সকল সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা এই প্রস্থানত্রয়েরই ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর রচিত প্রধান ‘দশটি উপনিষদের ভাষ্য’, ব্রহ্মসূত্রের ‘শারীরকভাষ্য’ এবং ভগবদ্গীতার ‘গীতাভাষ্য’ বেদান্ত দর্শনের অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও তিনি অনেক স্বতন্ত্র গ্রন্থ ও স্তোত্র রচনা করেন। পরবর্তীকালে বহু মনীষী শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের উপর টীকা রচনা করেন। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের উপর বাচস্পতি মিশ্রের লেখা ‘ভামতী’ টীকা প্রসিদ্ধ। এছাড়া শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য পদ্মপাদাচার্য ‘পঞ্চপাদিকা’ বা ‘বিবরণ’ নামে শঙ্করভাষ্যের উপর একটি মনোরম টীকা রচনা করেন। কিন্তু শঙ্করের শারীরকভাষ্যের উপর টীকাকারদের মতপার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে অদ্বৈতমতের সমর্থকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে (বেদান্তের উপ-উপসম্প্রদায়) বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে পদ্মপাদাচার্যের ‘বিবরণ সম্প্রদায়’ এবং শ্রীবাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী সম্প্রদায়’ প্রধান। বিবরণ সম্প্রদায় ‘পঞ্চপাদিকা’ টীকার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং ভামতী সম্প্রদায় ‘ভামতী’ টীকার উপর প্রতিষ্ঠিত।

পদ্মপাদাচার্যের ‘পঞ্চপাদিকা’, প্রকাশাত্মযতি রচিত ‘পঞ্চপাদিকা-বিবরণ’ এবং বিদ্যারণ্য’র ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’ বিবরণ সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী’, অমলানন্দ’র ‘ভামতী-কল্পতরু’ ও ‘শাস্ত্রদর্পণ’ এবং অপ্পয়দীক্ষিত-এর ‘কল্পতরুপরিমল’ ভামতী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অদ্বৈত চিন্তাধারায় শাঙ্করভাষ্যের উপর আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার মধ্যে সুরেশ্বর আচার্যের ‘তৈত্তিরীয়ভাষ্যবার্ত্তিক’, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’, চিৎসুখাচার্য’র ‘চিৎসুখী’, মধুসূদন সরস্বতীর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’, ব্রহ্মানন্দ’র ‘লঘুচন্দ্রিকা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদানন্দ যোগীন্দ্রের ‘বেদান্তসার’ ও ধর্ম্মরাজাধবরীন্দ্রের ‘বেদান্ত পরিভাষা’ যথাক্রমে বেদান্ততত্ত্ব ও বেদান্তজ্ঞানতত্ত্বের উপর বহুলপ্রচলিত দুখানি উল্লেখযোগ্য প্রকরণগ্রন্থ।

শঙ্করের দার্শনিক মত : শঙ্কর তাঁর সকল গ্রন্থেই তাঁর মৌলিক চিন্তা তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর শারীরকভাষ্যে বাদরায়ণের বেদান্তসূত্রের প্রথম চারটি সূত্রের ভাষ্যের মধ্যে তিনি অধিক মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, বৌদ্ধের সংবৃত্তি-সত্য এবং পরম-সত্যকে উপজীব্য করে ব্রহ্মকেই একমাত্র সৎ (অদ্বৈত) পদার্থ বলে মানতে গিয়ে তিনি ব্যবহারিক সত্যের পটভূমিতে বুদ্ধি-এবং-অবুদ্ধিগম্য সব ব্রাহ্মণ-সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সবকিছু মিলিয়ে তাই বর্তমানে শঙ্করের দার্শনিক মত বলতে তাঁর শারীরকভাষ্যে প্রস্তাবিত অদ্বৈতবাদকেই বোঝানো হয়, যার অন্য দার্শনিক নাম অদ্বৈত-বেদান্ত।

শঙ্করের অদ্বৈতবাদ
বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন শঙ্করাচার্য। অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন-

‘শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’।।
অর্থাৎ : কোটি কোটি গ্রন্থ যে সত্য প্রতিপাদন করতে ব্যস্ত, আচার্য তা শ্লোকার্ধেই ব্যক্ত করেছেন। এই মূল সত্য হলো : ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন’।

বস্তুত ব্রহ্ম, জগৎ ও জীবের স্বরূপ ব্যাখ্যাই সমগ্র বেদান্ত দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়। অদ্বৈতবাদে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে একমাত্র ব্রহ্মকেই সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। ব্রহ্মই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। জগৎপ্রপঞ্চ স্ব স্ব কারণে লীন হয়ে ব্রহ্মমাত্রে অবশিষ্ট থাকে। যেহেতু এই মতে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য, সেহেতু জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্ম হলেন চৈতন্যস্বরূপ। জগতে আমরা সবাই চেতন জীব। তাহলে চেতন জীবের সাথে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী ? উত্তরে বলা হয়েছে যে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। জীবও মায়ামুক্ত হলে নিজেকে ব্রহ্ম বলেই জানে। সুতরাং ব্রহ্মই প্রকতপক্ষে সৎ। সংক্ষেপে এই হলো অদ্বৈততত্ত্ব।

আচার্য শঙ্কর উপনিষদীয় নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মতত্ত্বের অন্যতম প্রধান সমর্থক। তাঁর মতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নির্বিকার, নিরাকার, এক এবং অদ্বিতীয়। সাধারণত লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারা বিষয় সিদ্ধ হয়। তাহলে ব্রহ্মের লক্ষণ বা প্রমাণ কী ? নির্গুণ ব্রহ্মের সদর্থক লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুর অসাধারণ ধর্মের দ্বারা লক্ষণ নির্দেশ করা হয়। ব্রহ্ম নির্ধর্মিক হওয়ায় তাঁর লক্ষণ সম্ভব নয়। এ কারণে অদ্বৈতপন্থীরা এক বিশেষ যুক্তিপ্রণালীর সাহায্যে ব্রহ্মোপদেশ দিয়ে থাকেন। এই বিশেষ যুক্তিপ্রণালী ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’ নামে পরিচিত।

অধ্যারোপ = অধি + আরোপ। অর্থাৎ ভ্রমের আরোপকে বলা হয় অধ্যারোপ। যথার্থ বস্তুতেই ভ্রমের আরোপ হয়। কিন্তু যথার্থ বস্তুতে কি যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব ? এ বিষয়ে শাঙ্করভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘ইত্যতো অস্মৎ প্রত্যয়গোচরে বিষয়িণি চিদাত্মকে যুষ্মৎ প্রত্যয়গোচরস্য বিষয়স্য তদ্ধর্মাণাঞ্চ অধ্যাসঃ, অদ্বিপর্য্যয়েণ বিষয়িণঃ তদ্ধর্ম্মাণাং চ বিষয়েহধ্যাসঃ মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্ ।’ (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)
অর্থাৎ :
‘অস্মৎ’ বা ‘আমি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে চৈতন্যময় আত্মা- তাতে ‘তুমি’ বা ‘তোমরা’ বা ‘এগুলি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে জড়জগৎ এবং যেসব জড়ধর্ম- তাদের আরোপ হবার সম্ভাবনা নেই। এভাবে বিপরীতক্রমেও আবার জড়বস্তুতেও চৈতন্য এবং চৈতন্যের ধর্ম প্রকাশ ও সত্তা প্রভৃতির আরোপ কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়।


শঙ্করমতে যথার্থ বস্তুতে যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব নয়, কেবল ভ্রমাত্মক আরোপই হতে পারে। তাই বেদান্তমতে অধ্যারোপ হলো বস্তুতে অবস্তুর আরোপ। আর অপবাদ হলো কার্যমাত্র পদার্থেরই মিথ্যাত্ব প্রতিপাদন। এই ভ্রমাত্মক আরোপের এবং কার্যপদার্থের মিথ্যাত্ব প্রতিপাদনের মাধ্যমে অদ্বৈতমতে গুরু শিষ্যকে ব্রহ্মের পরিচয় ও উপদেশ দেন এবং সৎ বস্তুকে অবস্তু থেকে পৃথক করেন। এই প্রণালীই ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’।
বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় আত্মতত্ত্বজ্ঞান। তাই এই আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভ্রমাত্মক ধারণাই এখানে অধ্যারোপ। বেদান্ত-বিরোধী এই মতগুলির অসারতা প্রতিপাদনের মাধ্যমে বেদান্তমতের পরিচয় তুলে ধরা হয়।

দার্শনিক দৃষ্টিতে এই ভ্রমাত্মক আরোপ বা অধ্যারোপ কিভাবে হয় ? অদ্বৈতমতে বস্তুর ভিন্নরূপ প্রতীতি বা অবস্তুর বস্তুরূপে প্রতীতিকে বলা হয় ভ্রম বা অধ্যাস। আমরা যখন রজ্জুকে সর্প বলে জানি, তখন পূর্বদৃষ্ট সর্পের সদৃশ বস্তু রজ্জুতে সর্পের আপাত-প্রতীতি ঘটে। রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্যে এই ভ্রম-প্রতীতি বা অধ্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে-

‘আহ কোহয়ং অধ্যাসো নাম ইতি ? উচ্যতে। স্মৃতিরূপঃ পরত্র পূর্বদৃষ্টাবভাসঃ।’- (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)
অর্থাৎ :
এই অধ্যাস কী রকম ? ভিন্ন-বস্তুতে ভিন্ন-বস্তুর জ্ঞানই অধ্যাস। পূর্বানুভব থেকে সংস্কার হয়- এই সংস্কার থেকে যেমন স্মরণ হয়, তেমনি এই অধ্যাসও পূর্বানুভবজনিত সংস্কারের ফল- একারণে এর নাম স্মৃতিরূপ (কারণ সংস্কার হতে উৎপন্ন হওয়াই স্মৃতির রূপ বা ধর্ম)। এই যে বিভিন্ন-বস্তু, যার অবভাসকে অধ্যাস বলা হচ্ছে- তা পূর্বদৃষ্টবৎ অর্থাৎ পূর্বে যা অনুভবের বিষয় হয়েছে তার সাথে এর সাদৃশ্য আছে মাত্র; প্রকৃতপক্ষে তা পূর্বদৃষ্ট নয়। (কেননা পূর্বদৃষ্টাবভাস মানে পূর্বদৃষ্টবৎ অবভাস বোঝায়।)

তার মানে, যার সাথে যার কোনো সম্বন্ধ নেই, কেবল পূর্বদৃষ্ট বস্তুর সাদৃশ্য আছে, সেই বস্তুতে সেই পূর্বদৃষ্ট বস্তুর ভ্রমাত্মক আরোপকেই অধ্যাস বলা যায়। অধ্যাসের আরেকটি স্বভাব হলো-

‘তত্রৈবং সতি যত্র যদধ্যাসঃ তৎকৃতেন দোষেন গুণেন বা অণুমাত্রেণ অপি স ন সম্বধ্যতে। তমেতং অবিদ্যাখ্যম্ আত্মানাত্মনো ইতরেতর অধ্যাসং…’। (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)
অর্থাৎ :
যে বস্তুর উপর যার অধ্যাস বা আরোপ হয়,- সেই বস্তু- সেই বস্তুর অণুমাত্র দোষ বা গুণের সংসৃষ্ট হতে পারে না। আত্মা ও জড়-প্রপঞ্চের এরকম পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাসই অবিদ্যা।

যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে রজ্জুতে যখন সর্পের আরোপ বা অধ্যাস হয়- তখন সর্পের কোনো গুণ বা দোষ রজ্জুতে কিছুতেই সংক্রান্ত হয় না,- রজ্জুকে আমরা সর্প বলে বুঝি কেবল। কিন্তু তাই বলে রজ্জু সর্প হয়ে যায় না, কিংবা সর্পের গুণ বা দোষও রজ্জু গ্রহণ করে না। তাই রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বেদান্তের ভাষায় বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। অবভাসের কারণ সত্য, কিন্তু অবভাস সত্য নয়। ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়। অদ্বৈতবেদান্ত মতে অবভাস বা ভ্রমীয় বস্তু হলো অপূর্ব। এই মতে, ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়, আবার অসৎও নয়। তবে কি ভ্রমীয় বস্তু সদসৎ ? অদ্বৈতমতে ভ্রমীয় বস্তু সদসৎও নয়। ভ্রমীয় বস্তু প্রকৃত বস্তু সম্বন্ধে অবিদ্যা বা অজ্ঞানের পরিণাম এবং তা অনির্বাচ্য। রজ্জুর অজ্ঞান থেকেই রজ্জুতে সর্পের বিবর্ত ঘটে। রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞানে অধ্যস্ত সর্প মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বিষয়ের প্রকৃতজ্ঞানে ঐ বিষয়ের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়। কিন্তু তাই বলে প্রতিভাত সর্প অসৎ নয়। আসলে অধ্যস্ত সর্পটির রজ্জু-অতিরিক্ত কোন সত্তা নেই। যথার্থ জ্ঞানে প্রতিভাত সর্প রজ্জুতে বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে, অদ্বৈত মতানুসারে জীব ও জগৎ প্রকৃতজ্ঞানে ব্রহ্মে বিলীন হয়।

অন্যদিকে ব্রহ্ম নির্গুণ ও নির্ধর্মিক হওয়ায় সদর্থকভাবে বা বিধিমুখে ব্রহ্মের লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ব্রহ্মের নিষেধমূলক বা নঞর্থকভাবে লক্ষণ করা হয়। কেনোপনিষদে বলা হয়েছে (কেনোপনিষদ : ১/৫-৯) যে,- দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, বিষয় প্রভৃতি দৃশ্যমান বস্তুর অতিরিক্ত সত্তাই ব্রহ্ম। এবং কেনোপনিষদে আরো বলা হয়েছে-

‘অন্যদেব তৎ বিদিতাদথো অবিদিতাদধি।
ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নঃ তৎ ব্যাচচক্ষিরে’।। (কেন-১/৪)
অর্থাৎ : সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র ; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা- আমরা তাঁদের কাছ থেকে একথা শুনেছি (কেন-১/৪)।
অনেক ক্ষেত্রে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বা সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও বলা হয়েছে-
‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জান ও অনন্ত। (তৈত্তিরীয়-২/১/১)
এসব ক্ষেত্রেও নিষেধের মাধ্যমেই ব্রহ্মকে বুঝতে হবে। সদর্থকভাবে এইসব লক্ষণকে গ্রহণ করা হলে ব্রহ্মের সৎ-ত্ব, চিৎ-ত্ব, আনন্দত্ব, জ্ঞানত্ব, সত্যত্ব, অনন্তত্ব প্রভৃতি গুণকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু নির্গুণ ব্রহ্মের এইসব গুণ থাকা সম্ভব নয়। তাই অদ্বৈতমতে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বলতে ব্রহ্ম অসৎ নয়, অচিৎ নয় এবং দুঃখরূপ নয় বলে বুঝতে হবে। জগতের অসৎ-বস্তু, অচিৎ-বস্তু, দুঃখরূপ-বস্তু, অজ্ঞানরূপ-বস্তু, মিথ্যাবস্তু, সসীমবস্তু প্রভৃতি বস্তুর সঙ্গে জীব পরিচিত। এইসব পরিচিত বস্তুর নিষেধের মাধ্যমে সাধারণ জীবের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সহজতর। এই কারণেই অপবাদ-ন্যায়ে ব্রহ্মকে নিষেধের মাধ্যমে বোঝানো হয়। নিষেধের মাধ্যমে ব্রহ্মের লক্ষণ করা হয় বলে ব্রহ্মকে প্রত্যগাত্মা বলে। সুতরাং অপবাদ ন্যায় নেতিবাচক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ নির্ধারণ করে।

এইভাবে উপরিউক্ত উপায়ে অধ্যারোপ ও অপবাদ ন্যায়ের সাহায্যে অদ্বৈতবেদান্তীরা ব্রহ্মের পরিচয় দেন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ, নিরাকার, নিরবয়ব, অদ্বয়, সর্বব্যাপক, অসীম, স্বয়ম্ভূ, স্বপ্রকাশ ইত্যাদি। ব্রহ্মের সকল বর্ণনাই নঞর্থক, অথচ ব্রহ্ম সৎ। ব্রহ্ম মাধ্যমিক বৌদ্ধমতের শূন্য থেকে পৃথক। ব্রহ্ম সম্পর্কিত সদর্থক শব্দের নেতিমূলক ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ব্রহ্ম ভাবাত্মক পরমার্থ সৎ। ব্রহ্ম শূন্য হলে ব্রহ্ম মিথ্যা জগতের অধিষ্ঠান হতে পারেন না। মিথ্যা অধিষ্ঠানে মিথ্যার অবভাসও সম্ভব নয়। এখানে প্রশ্ন আসে- ভাবাত্মক সৎ ব্রহ্মের সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব নয় কেন ? উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন- কোন বিশেষ বস্তুরই সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব। ঘট-পটাদি যাবতীয় জাগতিক বিষয় সসীম, বিশেষ বস্তু। এই বিশেষ বস্তু থেকে ক্রমশ সামান্য এবং সামান্য থেকে ক্রমশ সামান্যতর বস্তুর ধারণা থেকে আমরা এক মহাসামান্য সত্তার পরিচয় পাই। এই মহাসামান্য সত্তার মধ্যে সকল বিশেষ বস্তু অন্তর্গত হওয়ায় কোন বিশেষ বস্তুর মাধ্যমে এই মহাসামান্যের পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। যে কোন বিশেষ (সে সামান্যই হোক বা সামান্যতরই হোক) অন্য বস্তুর দ্বারা সীমিত। যে মুহূর্তে আমরা সীমাকে অতিক্রম করি, সেই মুহূর্তে এমন একটা অসীম সত্তায় আমরা উপনীত হই, যার সার্বিক ও সার্বত্রিক রূপকে কোন সীমিত বস্তুর রূপের ন্যায় সদর্থকভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু সেই অসীম পরমসত্তা যে, যে কোন সীমিত বস্তুর রূপ থেকে ভিন্ন, সে কথা আমরা অতি সহজেই বলতে পারি।
শঙ্করাচার্যের জীবন বৃত্তান্তpdf

1 comment:

  1. রামবাদ কি এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই

    ReplyDelete

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ