বৈশেষিক দর্শনকে কখন কখন নব্য ন্যায়দর্শন বলা হইয়া থাকে। কারণ মহর্ষি গৌতম যে সমস্ত প্রমাণ স্বীকার করিয়াছেন মহর্ষি কনাদও তাহা স্বীকার করিয়াছেন। তবে গৌতমের সহিত কণাদের কিছু পার্থক্য আছে।
বৈশেষিক সূত্র বা কণাদ সূত্র হল হিন্দু দর্শনের বৈশেষিক-প্রতিষ্ঠিত শাখার প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ। এই সূত্রের রচয়িতা হলেন হিন্দু ঋষি কণাদ (অপর নাম কশ্যপ)।
গৌতম ষোড়শ পদার্থবাদী কিন্তু কণাদ ষট্ পদার্থবাদী এবং কাহারও কাহারও মতে কণাদ সপ্তপদার্থবাদী। কিন্তু তাহাতে কোনও প্রকার বিশেষ পার্থক্য হয় নাই, কারণ কণাদ তাঁহার সপ্ত পদার্থের মধ্যেই গোতমের ষোড়শ পদার্থ রাখিয়াছেন।
কণাদের সপ্ত পদার্থ যথা,—দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। কেহ কেহ বলেন এই অভাব কোন পদার্থ নহে, কারণ এক স্থানে এক বস্তুর ভাবই অপর বস্তুর অভাব। আবার কেহ বলেন যে দুঃখের অত্যন্ত অভাবই যখন মুক্তি তখন অভাবও একটি পদার্থ বিশেষ। তবে এ সম্বন্ধে মতভেদ আছে।
দ্রব্য নয়, প্রকার, যথা,—ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, কাল, দিকৃ, আত্মা ও মন। প্রথম চারিটি দ্রব্যের কেবলমাত্র পরমাণু নিত্য; আকাশ সর্ব্বাবস্থাতেই নিত্য কি না সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কিন্তু শেষোক্ত চারিটি দ্রব্য ভূত পদার্থ নাহে, তাহারা সর্ব্বক্ষণে নিত্য। আত্মা ও মন সম্বন্ধে গোতমের ও কণাদের এক মত।
গুণ চতুর্ব্বিংশতি প্রকাশ, যথা—রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, যত্ন, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধর্ম্ম ও অধর্ম্ম। প্রত্যেক দ্রব্যেতে এই সমস্ত গুণের একটি বা অনেকগুলি বর্ত্তমান আছে।
কর্ম্ম পাঁচ প্রকার—উৎক্ষেপন, অবক্ষেপন, আকুঞ্চন, প্রসারণ ও গমন।
সামান্য শব্দে জাতি বুঝায়। জাতি নিত্য। জাতি দুই প্রকার পরা ও অপরা। সত্ত্বা অপেক্ষা অধিক দেশ ব্যাপী জাতি নাই বলিয়া ইহাকে পরা জাতি কহে। যে সমস্ত জাতি অল্পদেশব্যাপী তাহারা অপরা জাতি।
কণাদ ‘বিশেষ’ নামে একটি পদার্থ স্বীকার করেন বলিয়া তাঁহার দর্শনের নাম বৈশেষিক দর্শন। এই বিশেষ পদার্থ কেবলমাত্র পরমাণু সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়। সমস্ত অবয়বী পদার্থ নিজ নিজ অবয়ব ভেদে পৃথক বলিয়া বোধ হয়; যেমন ঘট ও পটের আকার ভেদ আছে বলিয়াই আমরা উহাদিগের পার্থক্য বোধ করিতে পারি। মহর্ষি কণাদ বলেন যে পরমাণুর প্রকার ভেদ আছে। কিন্তু পরমাণু নিরবয়বী বলিয়া তাহাদিগের প্রকারভেদের কোনও প্রকার স্থূল নিদর্শন নাই। যে সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় পদার্থ পরমাণুদিগের প্রকারভেদ সংঘটন করে মহর্ষি কণাদ তাহাকেই “বিশেষ” কহেন।
অবয়বীর সহিত অবয়বের, জাতির সহিত ব্যক্তির, গুণ ও কর্ম্মের সহিত দ্রব্যের, এবং বিশেষের সহিত নিত্য পরমাণুর সম্বন্ধের নাম সমবায়।
অভাব প্রধানতঃ দুই প্রকার—সম্বন্ধের অভাব, ও ভেদ। সম্বন্ধের অভাব তিন প্রকার—এক বস্তুর সহিত আর এক বস্তুর পূর্ব্বে সম্বন্ধ ছিল না, কিন্তু পরে হইয়াছে ইহার নাম প্রাগভাব; আবার এক বস্তুর সহিত আর এক বস্তুর সম্বন্ধ ছিল, কিন্তু সেই সম্বন্ধ নষ্ট হইয়াছে, ইহার নাম ধ্বংসাভাব, আবার এক বস্তুর সহিত অন্য এক বস্তুর কখনই সম্বন্ধ ছিল না এবং হইবে না—যেমন আকাশ ও রূপ,—ইহার নাম অত্যন্ত অভাব। ঘটেতে পটের অভাব এবং পটেতে ঘটের অভাব, ইহার নাম ভেদ।
মুক্তির জন্য আত্মার শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন আবশ্যক। মনন অনুমানের দ্বারা সাধিত হয়। ব্যাপ্তিজ্ঞান না হইলে অনুমান হইতে পারে না। আবার পদার্থ জ্ঞান না হইলে ব্যাপ্তিজ্ঞান জন্মে না। অতএব পদার্থতত্ত্ব জ্ঞানই পরম্পরা সম্বন্ধে মুক্তির কারণ। আত্মা ও অনাত্মা উভয়ের জ্ঞান হইলে জীব অনাত্মপদার্থ ত্যাগ করিয়া আত্মসাক্ষাৎ বা মুক্তিলাভ করেন।
ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে অন্যতম দর্শন হলো বৈশেষিক দর্শন। এই দর্শনের ‘পদার্থতত্ত্ব’ বা ‘বিশ্বতত্ত্বে’র জ্ঞান প্রাচীনকালে যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হতো। বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই বৈশেষিক দর্শনের প্রধান আলোচনা। ন্যায়-সম্প্রদায়ের মতো বৈশেষিক সম্প্রদায়ও মোক্ষকেই পরমপুরুষার্থ বলে মনে করেন। ন্যায় দর্শনে যেমন ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানকে মোক্ষের হেতুরূপে গণ্য করা হতো, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি দ্রব্যাদি সপ্তপদার্থের সাধর্ম্য বা বৈধর্ম্যহেতুক তত্ত্বজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতুরূপে গণ্য করা হয়।
.
মহর্ষি কণাদ-এর ‘বৈশেষিকসূত্র’ হলো বৈশেষিক দর্শন সম্প্রদায়ের মূল ও আদিগ্রন্থ। ‘বিশেষ’ পদার্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করায় এই দর্শন ‘বৈশেষিক দর্শন’ নামে সমধিক পরিচিত হয়ে থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে ‘কণাদদর্শন’, ‘ঔলূক্যদর্শন’, ‘কাশ্যপীয় দর্শন’ প্রভৃতি নামেও পরিচিত। এই নামগুলির পেছনে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।
.
মহর্ষি কণাদ ‘কণভূক’, ‘কণভক্ষ’, ‘যোগী’, ‘উলূক’, ‘কাশ্যপ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন। প্রবাদ আছে যে, তিনি দিবাভাগে গহন অরন্যে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবং রাত্রিকালে সবাই যখন নিদ্রিত থাকতো তখন তিনি আহারান্বেষণে বের হতেন। এরকম বৃত্তি উলূক বা পেচকের বৃত্তি তুল্য বলে তাঁর উলূক নামকরণ করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্ব-১১-এ এরকম কাহিনীর ছায়া রয়েছে- ‘উলূকঃ পরমো বিপ্রো মার্কণ্ডেয় মহামুনিঃ’।
.
অন্য এক প্রবাদে বলা হয়েছে কণাদ কঠোর যোগাভ্যাসের ফলে শিবের অনুগ্রহ লাভ করেন। শিব কণাদের তপশ্চর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে উলূকের রূপ ধরে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন এবং ষটপদার্থের উপদেশ দান করেন। বায়ুপুরাণেও উল্লেখ আছে যে, কণাদ পরম শৈব ছিলেন। ‘কণাদ’ নাম প্রসঙ্গে ন্যায়-কন্দলীতে উল্লেখ আছে, ক্ষেত্রে পড়ে থাকা শস্যকণা ভক্ষণ করে অর্থাৎ একপ্রকার ভিক্ষাবৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন বলে তাঁকে কণাদ বলা হতো। এবং এ কারণেই তাঁকে কণভূক বা কণভক্ষ বলা হতো। আবার কণাদ কাশ্যপ গোত্রীয় ছিলেন বলে তাঁর দর্শনকে কাশ্যপীয় দর্শনও বলা হয়। মোটকথা বৈশেষিক সূত্রকারের বিবিধ নাম অবলম্বনেই এই সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে সাধারণভাবে এই দর্শন ‘বৈশেষিক দর্শন’ নামেই পরিচিত।
.
এক্ষেত্রে দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে কণাদ সম্পর্কে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণের মন্তব্যটিও উল্লেখের দাবি রাখে-
‘বৈশেষিকের আর একটি নাম উলূক্য দর্শন। বৈশেষিকের স্রষ্টার সঙ্গে উলূক পক্ষীর (পেচক) বা নিশাচর প্রাণীর যে কি সম্বন্ধ ছিলো তা বলা যায় না। কণাদ যদি শুধু সরস্বতী নয় লক্ষ্মীরও কৃপাধন্য হতে পারতেন তবে না হয় তাঁর নাম উলূক হতে পারত। উলূক এমন কিছু সুশ্রী বা উত্তম জাতীয় পক্ষী নয় যে মা বাবা স্নেহবশত কণাদের এমন নাম রাখবেন। পেচক এথেন্সের একটি পবিত্র চিহ্ন। তবে কি গ্রীকদর্শনের সঙ্গে এই দর্শনের যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল তারই ফলস্বরূপ এই নামের সূচনা হয়েছে ?’ (দর্শন-দিগদর্শন)
.
কণাদের বৈশেষিকসূত্র গ্রন্থের রচনাকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। তবে এ গ্রন্থকে বৌদ্ধ দর্শনের পূর্ববর্তী বলে স্বীকার করা হলেও তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বুদ্ধের জন্মের (৫৬৩ খ্রিস্টপূর্ব) প্রায় আটশ বছর পূর্বে বৈশেষিকসূত্র রচিত হয়েছে এমন জনশ্রুতি রয়েছে। তবে বৈশেষিকসূত্র যে ন্যায়সূত্র থেকে প্রাচীন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ কেউ (পণ্ডিত শ্রী শ্যামপদ মিশ্র প্রশস্তপাদভাষ্যের ভূমিকায়) কোন প্রমাণ ছাড়াই বৈশেষিকসূত্রের রচনাকাল ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব হিসেবে উল্লেখ করলেও এর সাথে ব্যাপক ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের বক্তব্যে। তিনি তাঁর দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে পরমাণুবাদী দার্শনিক কণাদের সময়কাল উল্লেখ করেছেন ১৫০ খ্রিস্টাব্দ। এ প্রসঙ্গে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত-
‘কণাদের বৈশেষিক দর্শনকে বুদ্ধের পূর্বযুগের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা পণ্ডশ্রম কারণ কণাদের দর্শন যদি আগেই সৃষ্টি হতো তবে বুদ্ধ তথা অন্যান্য সমকালীন দার্শনিকগণকে ত্রিপিটক এবং অন্যান্য জৈনাগমের ভাষা-পরিভাষা দ্বারা নিজেদের দর্শন আরম্ভ করার প্রয়োজন হতো না। তাঁরা কণাদের দর্শন থেকে নিজেদের প্রভাবমুক্ত রাখতে পারতেন না।
কতিপয় বিদ্বান ব্যক্তি বৈশেষিককে বুদ্ধের আগের যুগে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, এই বলে যে, কণাদের দর্শনের ওপর বৌদ্ধদর্শনের কোনো প্রভাব নেই। এর উত্তরে আমি আগেই বলেছি যে (১) বুদ্ধের দর্শনের ওপর কণাদের দর্শনের গন্ধ পর্যন্ত নেই; (২) কণাদের দর্শন বুদ্ধের দর্শন থেকে অপ্রভাবিত নয়। কার আঘাতের প্রত্যুত্তর হিসেবে আত্মা এবং নিত্যতার সিদ্ধির ওপর এত জোর দেওয়া হয়েছিলো ? এটা নিশ্চিতই যে বুদ্ধের ‘অনিত্য’ এবং ‘অনাত্মা’-র বিরুদ্ধেই কণাদের দর্শন যেন জেহাদ ঘোষণা করেছিল। গ্রীক দর্শনেও হেরাক্লিটাসের অনিত্যতাবাদের উত্তরে নিত্য-সামান্যের কল্পনা করা হয়েছিল। কণাদ এবং তাঁর ভক্তগণের শতাব্দী জুড়ে সেই সামান্যকেই নিত্যতার নমুনার ধারায় উপস্থিত করা বৌদ্ধের অনিত্য (=ক্ষণিক)-বাদেরই উত্তর, অতএব বৈশেষিক যে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচিত নয় এ কথা সর্বৈব মিথ্যা।’ (দর্শন-দিগদর্শন: পৃষ্ঠা-১২৭)
.
এ প্রসঙ্গে বৈশেষিক দর্শন যে প্রকৃতই বুদ্ধপরবর্তী এবং তা যে পূর্ববর্তী গ্রিক দর্শন কর্তৃক বিপুলভাবে প্রভাবিত তা প্রমাণের নিমিত্তে রাহুল সাংকৃত্যায়নের আরো কিছু অভিমত স্মর্তব্য-
‘…ডিমোক্রিটাসের (৪৬০-৩৭০ খৃঃ.পূঃ.) জন্ম বুদ্ধের নির্বাণের (৪৮৩ খৃঃ.পূঃ.) ২৩ বছর পূর্বে হয়েছিল। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন কিছু পুরাণ-উপনিষদ এবং বুদ্ধ-মহাবীর প্রভৃতি তীর্থঙ্করের উপদেশের ওপরেই আমাদের দর্শন নির্ভরশীল ছিল। শত অনুসন্ধান করলেও এর মধ্যে আমরা- “পরমাণুই জগতের মূলতত্ত্ব”- এর গন্ধ পর্যন্ত পাই না। ডিমোক্রিটাস যে সময়ে অবিভাজ্য, অবেধ্য, ‘অতোমোন’-এর সিদ্ধান্ত আবিষ্কার করেছিলেন, সে সময়ে ভারতে এ সম্পর্কে আবছা ধারণাও ছিল না। ডিমোক্রিটাস পরমাণুকেই সবচেয়ে সূক্ষ্ম সত্তা বলে মেনেছেন এবং তারও যে একটা পরিমাণ আছে তা অস্বীকার করেননি। কণাদও মনে করেছেন যে পরমাণু সূক্ষ্ম পরিমাণ-যুক্ত এবং উভয়েরই মতে পরমাণুই সৃষ্টি ইষ্টক স্বরূপ।
…পিথাগোরাস বলেছেন যে আকৃতিই মূল উপাদান, কারণ ভিন্ন ভিন্ন গরুর মৃত্যু হলেও গরু তার গো-আকৃতি নিয়েই জন্মাবে। প্লেটো আরও একটু অগ্রসর হয়ে পূর্বাপর আকৃতির মধ্যে যে সমানতা দেখা যায় তার ওপর অর্থাৎ সামান্যের ওপর জোর দিয়েছেন; তাঁর ধারণা বিশেষ মূল উপাদান (=ভাব)-এর মধ্যে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এই সামান্য-বিশেষের ধারণার কোনো আভাসই ভারতের সঙ্গে গ্রীসদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ার আগে ভারতীয় সাহিত্যে ছিল না।
…কণাদ তাঁর দর্শনে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায় এই ছ’ভাগের পদার্থে বিশ্বের উপাদানকে ভাগ করেছেন। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল তাঁর তর্কশাস্ত্রে আট ও দশটি পদার্থকে মেনেছেন : দ্রব্য, গুণ পরিমাণ, সম্বন্ধ, দিশা, কাল, আসন, স্থিতি, কর্ম, পরিমাণ। দ্রব্য, গুণ, কর্ম এবং সমবায় উভয়ের মতেই সমান। দিশা ও কালকে কণাদ দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পরিমাণকে গুণের। অতএব আমরা বলতে পারি যে কণাদ অ্যারিস্টটলের পদার্থকেই পুনরায় বর্গীকরণ করেছেন। এই সঙ্গে যুগের কথা ধরলে অর্থাৎ গ্রীসের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ তথা আদান-প্রদানকে দেখে সহজেই বোঝা যায় যে, এই সাদৃশ্য আকস্মিক নয়।’ (দর্শন-দিগদর্শন: পৃষ্ঠা-১২৭)
.
তবে একই প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতটিও উল্লেখযোগ্য-
‘…এ-অনুমান স্বীকারযোগ্য না হতেও পারে। কেননা, দুটি দেশে পরস্পরনিরপেক্ষভাবে পরমাণুবাদের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। তাছাড়া, বৈশেষিকদের দার্শনিক মতবাদের নানা বৈশিষ্ট্যও বর্তমান; তাকে কেবলমাত্র গ্রীস থেকে আমদানি করা পরমাণুবাদ মনে করলে অতিসারল্যের আশঙ্কাও থাকে। তৃতীয়ত, উলূক নামটি কোনো প্রাচীন গোত্রের পরিচায়কও হতে পারে; কেননা প্রাচীন ভারতে পশু-পক্ষীর নাম থেকে গোত্রনামের উদ্ভব মোটেই বিরল নয়।’ (ভারতীয় দর্শন: পৃষ্ঠা-১৭)
.
যাই হোক, বৈশেষিক সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ও নিজস্ব গ্রন্থাবলী খুব বেশি নয়। ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে প্রাচীনতম সূত্রর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে মহর্ষি কণাদের ‘বৈশেষিক সূত্র’কে স্বীকার করা হয়। এই গ্রন্থের প্রকৃত কোন ভাষ্যগ্রন্থ পাওয়া যায় না। লঙ্কেশ্বর রাবণ এই দর্শনের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে বেদান্ত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। আচার্য শঙ্কর এই ভাষ্যকে রাবণভাষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। বেদান্তদর্শনে বৈশেষিকমতখণ্ডন প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য রাবণভাষ্যের মতের খণ্ডন করেছেন বলে জানা যায়। অনেকের মতে আচার্য প্রশস্তপাদ (২০০ খ্রিঃ)-এর ‘পদার্থধর্মসংগ্রহ’ বৈশেষিক-দর্শনের সঠিক ভাষ্য না হলেও ভাষ্যস্থানীয় এবং তা প্রশস্তপাদভাষ্য নামে পরিচিত। মূলত পদার্থধর্মসংগ্রহে সূত্র ব্যাখ্যাত হয়নি, তবে সূত্রের তাৎপর্য সংক্ষেপে ও যোগ্যতার সাথে সংগৃহীত হয়েছে। এটিই বর্তমানে প্রাপ্ত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ। উদয়নাচার্যের (১০০০-১১০০ খ্রিঃ) ‘কিরণাবলী’ এবং শ্রীধরাচার্যের (৯৯১ খ্রিঃ) ‘ন্যায়কন্দলী’ এই পদার্থধর্মসংগ্রহের উপর উল্লেখযোগ্য টীকাগ্রন্থ। এছাড়া বল্লভাচার্যের (১১০০-১১৫০ খ্রিঃ) ‘ন্যায়লীলাবতী’, চন্দ্রানন্দের ‘বৃত্তি’, শঙ্কর মিশ্রের (১৪৬২ খ্রিঃ) ‘বৈশেষিকসূত্রোপস্কার’ প্রভৃতি বৈশেষিক দর্শনের উল্লেখযোগ্য স্বতন্ত্র গ্রন্থ।
.
বৈশেষিক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র গ্রন্থাবলী খুব বেশি না হলেও ভারতীয় দর্শনে বৈশেষিক-মতের আলোচনা সুবিশাল। কেননা বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ন্যায় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে উভয়েরই প্রতিপাদ্য বিষয় অভিন্ন বা প্রায়-অভিন্ন। এজন্যেই ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনকে সমানতন্ত্র দর্শন বলা হয়। ফলে বহু গ্রন্থেই ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের তত্ত্বসমূহ একই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হলেও আচার্য উদয়নের কাল থেকেই উভয় দর্শনের তত্ত্বসমূহ একই সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক হিসেবে আলোচিত হতে দেখা যায়। এভাবে পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন চর্চায় শিবাদিত্যের (১১৫০-১২০০ খ্রিঃ) ‘সপ্তপদার্থী’, লৌগাক্ষি ভাস্করের ‘তর্ককৌমুদী’, রঘুনাথ শিরোমণির (১৫০০-১৫৫০ খ্রিঃ) দীধিতি বা ‘পদার্থতত্ত্বনিরূপণ’, বিশ্বনাথ ন্যায় পঞ্চাননের (১৬০০-১৬৫০ খ্রিঃ) মুক্তাবলী টীকা সহ ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’ এবং অন্নংভট্টের (১৫৫০-১৬০০ খ্রিঃ) ‘তর্কসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে বৈশেষিকসম্মত মত এবং ন্যায়সম্মত মতের পার্থক্য প্রাসঙ্গিক স্থলে উল্লেখ করা হলেও যে সকল বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে যে কোন একটি মতেরই উল্লেখ আছে।
.
ন্যায় ও বৈশেষিক এই দুই সমানতন্ত্র দর্শনে প্রধান প্রধান বিষয়ে উভয় সম্প্রদায় একমত হলেও কোন কোন অপ্রধান বিষয়ে অবশ্য উভয় সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ন্যায়শাস্ত্র প্রধানত প্রমাণশাস্ত্র। তারা প্রমাণ চতুষ্টয়বাদী। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ- এই চারটি প্রমাণ ন্যায়দর্শনের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনের মুখ্য আলোচ্য বিষয় প্রমেয় বা পদার্থ। বৈশেষিক দর্শন মুখ্যত প্রমেয়শাস্ত্র বা পদার্থশাস্ত্র। নৈয়ায়িকদের স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে বৈশেষিকেরা প্রত্যক্ষ ও অনুমান এই দুটি প্রমাণ স্বীকার করেছেন। উপমান ও শব্দ প্রমাণকে বৈশেষিকেরা প্রত্যক্ষ ও অনুমানের অন্তর্গত করেছেন।
.
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু পরিভাষাগত ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। বৈশেষিক সম্প্রদায় যাকে ‘সামান্য’ বলেছেন, ন্যায় সম্প্রদায় তাকে প্রধানত ‘জাতি’ বলেছেন। আবার ন্যায় সূত্রোক্ত অনুমানের অবয়ব হিসেবে প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমনকে পদার্থধর্মসংগ্রহে প্রতিজ্ঞা, অপদেশ, নিদর্শন, অনুসন্ধান ও প্রত্যাস্নায় নামে কথিত হয়েছে। ন্যায়দর্শনে পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট এই ত্রিবিধ অনুমানের উল্লেখ আছে। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে দৃষ্ট ও সামান্যতোদৃষ্ট এই দ্বিবিধ অনুমানের উল্লেখ আছে। ন্যায় দর্শনে সব্যভিচার (অনৈকান্তিক), বিরুদ্ধ, প্রকরণসম (সৎপ্রতিপক্ষ), সাধ্যসম (অসিদ্ধ) ও কালাতীত (বাধিত) এই পাঁচপ্রকার হেত্বাভাস উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে অসিদ্ধ, বিরুদ্ধ ও সন্দিগ্ধ এই তিনপ্রকার হেত্বাভাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।
.
ন্যায়দর্শনে ষোড়শ পদার্থের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে সপ্ত পদার্থের কথা বলা হয়েছে। তবে এই পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। পদার্থ বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের সংখ্যার পার্থক্য দুটি ভিন্ন বিন্যাস-প্রক্রিয়ার পার্থক্য মাত্র। বস্তুত সামগ্রিকভাবে জগতের পদার্থ বিষয়ে উভয় মতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ন্যায় দর্শনে ষোড়শ পদার্থের মাধ্যমে যে সকল তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, বৈশেষিক দর্শনে তা সপ্তপদার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
.
ন্যায়মতে সমবায় প্রত্যক্ষসিদ্ধ। কিন্তু বৈশেষিক মতে সমবায় প্রত্যক্ষের দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে না, অনুমানের দ্বারা সমবায়ের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
মূলত ন্যায়সম্মত কোন মূলতত্ত্বই বৈশেষিকগণ কিংবা বৈশেষিকসম্মত কোন মূলতত্ত্বই নৈয়ায়িকগণ অস্বীকার করেননি।
২.০ : বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব
.
ন্যায় দর্শনে যেমন প্রমাণের আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্ববৈচিত্র্য তথা পার্থিব জগতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বৈশেষিক সম্প্রদায় সাতটি পদার্থ স্বীকার করেছেন। এই সাতটি পদার্থ হলো- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। জগতে এমন কিছু নেই যা এই সাতটি পদার্থের কোন না কোনটির অন্তর্গত নয়। সুতরাং, বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব হলো সাতটি।
.
এখানে উল্লেখ্য, বৈশেষিক সূত্রকার মহর্ষি কণাদ কিন্তু পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। বৈশেষিক সূত্র-এ বলা হয়েছে-
‘দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্যবৈধর্ম্ম্যাভ্যাং তত্ত্বজ্ঞাননিঃশ্রেয়সম।’ (বৈশেষিক সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : দ্রব্য-গুণ-কর্ম-সামান্য-বিশেষ-সমবায় পদার্থসমূহের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যের তত্ত্বজ্ঞান থেকেই নিঃশ্রেয়স লাভ হয়।
.
‘নিঃশ্রেয়স’ শব্দের অর্থ সবথেকে শ্রেয়। ভারতীয় দর্শনে পরামুক্তি বা মোক্ষই সবথেকে শ্রেয়। তাই নিঃশ্রেয়স বলতে পরামুক্তি বা মোক্ষকেই বুঝতে হয়। অতএব, বৈশেষিক দর্শনে মোক্ষলাভের নিমিত্তেই পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান আবশ্যক। এক্ষেত্রে মহর্ষি কণাদ পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ না করলেও পরবর্তীকালে ভাষ্যকার প্রশস্তপাদ কিন্তু নিঃশ্রেয়সের হেতু হিসেবে প্রথম ছ’টি পদার্থের উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে অভাবের উল্লেখ নেই-
‘দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়ানাং ষণ্নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্য-বৈধর্ম্ম্যতত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সহেতুঃ। তচ্চেশ্বরচোদনানিভব্যক্তাদ্ধর্মাদেব।’ (প্রশস্তপাদভাষ্য)।
অর্থাৎ : দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায়- এই ছয়টি পদার্থের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যরূপ তত্ত্বের জ্ঞান নিঃশ্রেয়সের হেতু। এই নিঃশ্রেয়স কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাবিশেষের দ্বারা অভিমুখীকৃত ধর্ম বা ঈশ্বর-উপদিষ্ট ধর্ম থেকেই হয়।
.
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে সূত্রকার ও ভাষ্যকার কেন অভাব পদার্থের উল্লেখ করেননি। কণাদ অভাবের ইঙ্গিত করেছেন, তবে অভাব স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকৃত কিনা তা উল্লেখ করেননি। বিভিন্ন বৈশেষিকাচার্য এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। কিরণাবলীকার আচার্য উদয়ন বলেন-
‘অভাবস্তু স্বরূপবানপি পৃথঙনোদ্দিষ্টঃ প্রতিযোগিনিরূপণাধীননিরূপণত্বাৎ।’ (কিরণাবলী, পৃষ্ঠা-৫৭)।
অর্থাৎ : অভাব সৎ পদার্থ হলেও অভাবের নিরূপণ যেহেতু প্রতিযোগীর নিরূপণাধীন তাই তা পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়নি।
.
‘প্রতিযোগী’ অর্থ অভাবপদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব সেটিই অভাবপদার্থের প্রতিযোগী। উদয়নের মতে কণাদের বৈশেষিক সূত্রের সৃষ্টি-সংহার প্রকরণে উৎপত্তি ও বিনাশের ব্যাখ্যাতে প্রাগভাব ও প্রধ্বংসাভাব এবং বৈধর্ম্যের ব্যাখ্যাতে অন্যোন্যাভাব ও অত্যন্তাভাব আলোচিত হয়েছে। সুতরাং অভাব পদার্থ যে বৈশেষিক সম্মত তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে অভাবের নিরূপণ যেহেতু প্রতিযোগীর নিরূপণাধীন তাই নিঃশ্রেয়সের হেতুর কথনে পদার্থের তালিকায় অভাবের স্বতন্ত্র উল্লেখের প্রয়োজন হয়নি। আচার্য উদয়নই প্রথম অভাব সহ সাতটি বৈশেষিক পদার্থের উল্লেখ করেন। শ্রীধর, শিবাদিত্য প্রমুখ পরবর্তী দার্শনিকেরাও সপ্তম পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব সাতটি। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্টও বৈশেষিকসম্মত পদার্থের বিভাগ দেখিয়েছেন-
‘দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়াভাবাঃ সপ্ত পদার্থাঃ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব- এই সাতটি পদার্থ।
.
এই সাতটি মৌলিক তত্ত্বকেই বৈশেষিক দর্শনে ‘পদার্থ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ন্যায়মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না হলেও বৈশেষিক মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট এবং তা সাতটিই। এ থেকে বোঝা যায়, বৈশেষিক দর্শনে সাতের অতিরিক্ত কোন পদার্থ নেই। এজন্যেই বৈশেষিক সম্প্রদায়কে নিয়ত পদার্থবাদী বলা হয়। তাই বল্লভাচার্য তাঁর ‘ন্যায়লীলাবতী’ গ্রন্থে বলেন-
‘অনিয়তপদার্থবাদিনো নৈয়ায়িকাঃ
নিয়তপদার্থবাদিনশ্চ বৈশেষিকাঃ।’ (ন্যায়লীলাবতী)।
অর্থাৎ : নৈয়ায়িকরা অনিয়ত পদার্থবাদী, আর বৈশেষিকরা নিয়ত পদার্থবাদী।
.
সাধারণভাবে পদার্থ বলতে যা বোঝায় বৈশেষিক দর্শনে ঠিক তা বোঝায় না। বৈশেষিক দর্শনে পদার্থ কথাটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে পদের অর্থ অর্থাৎ পদের দ্বারা যে বস্তুকে বোঝানো হয়, তাই পদার্থ। নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)
অর্থাৎ : পদের অর্থকে (অভিধেয়) পদার্থ বলে।
.
জগতের যে কোন বস্তুই পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে। আর ন্যায়-বৈশেষিক মতে যা জ্ঞেয় তাই অভিধেয়। যাবতীয় অস্তিত্বশীল (কাল্পনিক নয়) বস্তুই জ্ঞেয়। জগতের যাবতীয় বস্তুই যেহেতু জ্ঞেয়, সেহেতু যাবতীয় বস্তুই অভিধেয় (পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে) অর্থাৎ পদার্থ। পদার্থ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞান নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। পদার্থ যখন জ্ঞানে ভাসমান হয়, তখন তাকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে ‘বিষয়’ বলে।
.
দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব- এই সপ্তপদার্থের মাধ্যমে বৈশেষিক দর্শনে জগতের যাবতীয় পদার্থের সাতটি শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এই সাতটি শ্রেণীকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে প্রথম ছ’টিকে বলা হয় ‘ভাবপদার্থ’ এবং সপ্তমটিকে বলা হয় ‘অভাবপদার্থ’।
.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পদার্থের সংখ্যা বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। যেমন ন্যায়দর্শনে ষোলটি পদার্থ স্বীকার করা হয়- প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান। ভাট্ট মীমাংসক সম্প্রদায় পাঁচটি পদার্থ স্বীকার করেন, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব। আবার প্রাভাকর মীমাংসক মতে পদার্থ আটটি, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, সংখ্যা, সমবায়, সাদৃশ্য এবং শক্তি। অন্যদিকে বেদান্ত মতে ভাট্ট মীমাংসকদের অনুরূপ পদার্থ পাঁচটি, যথা- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব। আবার পদার্থ বিষয়ে নৈয়ায়িকদের মধ্যেও মতভেদ দেখা যায়। যেমন, নব্যনৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি বিশেষকে পদার্থরূপে স্বীকার করেননি।
.
বৈশেষিক দর্শনে পদার্থকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ভাবপদার্থ এবং অভাবপদার্থ। ভাবপদার্থ ছয় প্রকার- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এবং সমবায়। সুতরাং বৈশেষিক মতে দ্রব্য হলো প্রথম ভাবপদার্থ। এই মতে দ্রব্য হলো গুণ ও কর্মের আধার বা আশ্রয় এবং গুণ ও কর্ম দ্রব্য নামক পদার্থে সমবায় সম্বন্ধে আশ্রিত থাকে।
‘ক্রিয়াগুণবৎ সমবায়িকারণমিতি দ্রব্যলক্ষণম্’। (বৈশেষিক সূত্র: ১/১/১৫)।
অর্থাৎ : যে পদার্থ ক্রিয়া বা গুণের আশ্রয় অথবা যা সমবায়ী কারণ হয় তাই দ্রব্য।
বস্তুত এই সূত্রে দ্রব্যের তিনটি বিকল্প লক্ষণ দেয়া হয়েছে- (১) যা ক্রিয়ার আশ্রয় বা ক্রিয়াবৎ তাই দ্রব্য, (২) যা গুণের আশ্রয় বা গুণবৎ তাই দ্রব্য এবং (৩) যা গুণ ও কর্মের সমবায়ী কারণ তাই দ্রব্য।
বলা বাহুল্য, এই তিনটি লক্ষণের কোনটিই এককভাবে নির্দোষ লক্ষণ হতে পারে না।
.
প্রথম লক্ষণ অনুসারে ‘ক্রিয়াবত্বং দ্রব্যত্বং’ অর্থাৎ ক্রিয়া দ্রব্যে আশ্রিত থাকে। যেমন- ঘোড়া হলো দ্রব্য কারণ ঘোড়া হলো গতিবান। গতি একটি ক্রিয়া এবং ঘোড়া হলো তারই আশ্রয়। এই কারণে ঘোড়া একটি দ্রব্য। একইভাবে প্রবহমান জলও দ্রব্য, কারণ সেখানেও প্রবাহ বা গমন নামক ক্রিয়া আছে।
কিন্তু দ্রব্যের এই লক্ষণ অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। কারণ কিছু কিছু দ্রব্য আছে যাতে কোন ক্রিয়া নেই। যেমন, আকাশ বা কাল হলো বিভুদ্রব্য। বিভু অর্থ সর্বব্যাপী। সর্বব্যাপী দ্রব্যের ক্রিয়া হয় না। বৈশেষিক মতে আকাশ, কাল, দিক্ ও আত্মা এই চারটি দ্রব্য নিষ্ক্রিয়। সুতরাং এই চারটি ক্রিয়াহীন দ্রব্যে ‘ক্রিয়াবত্বং দ্রব্যত্বং’ এই লক্ষণ প্রযোজ্য হতে পারে না। তাই লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট।
.
এই কারণে দ্রব্যের পরবর্তী লক্ষণে বলা হয়েছে, ‘গুণবত্বং দ্রব্যত্বং’ অর্থাৎ দ্রব্য হলো গুণের আশ্রয়। যেমন, নীল ঘট একটি দ্রব্য, কারণ সেখানে নীল গুণ আছে। অথবা শ্বেতপদ্মে শ্বেতত্ব গুণ আছে, এ কারণে শ্বেতপদ্মটি একটি দ্রব্য।
কিন্তু এই লক্ষণটিও নির্দোষ নয়। কারণ, কেবলমাত্র কোন আশ্রয়েই গুণগুলি উৎপন্ন হয়। এর অর্থ গুণের আশ্রয় বা দ্রব্য প্রথমে উৎপন্ন হলে তবে তারপরে সেখানে গুণ উৎপন্ন হবে। সেক্ষেত্রে গুণ উৎপন্ন হওয়ার আগে দ্রব্যটি হবে গুণশূন্য। সুতরাং দ্রব্যের এমন একটি অবস্থা আছে যা গুণের আশ্রয় নয়।
.
বৈশেষিক মতে দ্রব্য নিত্য ও অনিত্যভেদে দ্বিবিধ। পৃথিবী, তেজ, জল ও বায়ু এই চারটি দ্রব্যের পরমাণু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মন এগুলি হলো নিত্যদ্রব্য। এসবের উৎপত্তিও নেই, বিনাশও নেই। কিন্তু পরমাণু ভিন্ন সকল পার্থিব, জলীয়, তৈজস ও বায়বীয় দ্রব্যই উৎপত্তি-বিনাশশীল অনিত্যদ্রব্য। এই সকল অনিত্যদ্রব্য স্ব স্ব উৎপত্তিক্ষণে গুণহীন থাকে। বৈশেষিক মতে অনিত্য দ্রব্যের কারণসামগ্রি কেবল দ্রব্যই উৎপন্ন করতে পারে, গুণ উৎপন্ন করতে পারে না। দ্রব্যের উৎপত্তির পর সেই দ্রব্য গুণ উৎপন্ন করে। গুণ-উৎপত্তিকালীনদ্রব্য তাই নির্গুণই হয়। এই উৎপত্তিকালীন দ্রব্য নির্গুণ হওয়ায় ‘গুণবত্বাং দ্রব্যত্বং’ বা দ্রব্য গুণের আশ্রয় এই লক্ষণটিও অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়।
.
এ কারণে বৈশেষিক সূত্রে দ্রব্যের তৃতীয় লক্ষণে বলা হয়েছে ‘গুণকর্মসমবায়িকরণত্ব’ অর্থাৎ, যা গুণ ও কর্মের সমবায়ী কারণ তাই দ্রব্য। গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, নীল গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থেকে উৎপন্ন হয়, এ কারণে দ্রব্য নীল গুণের সমবায়ী কারণ।
.
বৈশেষিক মতে এই সমবায়িকারণতার অবচ্ছেদকরূপে দ্রব্যত্ব জাতিকে সিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই মতে দ্রব্যের লক্ষণে বলা হচ্ছে- ‘দ্রব্যত্ব’ জাতি যাতে আছে তাই দ্রব্য। ভাষ্যকারেরা দ্রব্যের এই লক্ষণের নাম দিয়েছেন ‘দ্রব্যত্ববত্ব’, এটি একটি জাতিঘটিত লক্ষণ। অর্থাৎ, বিভিন্ন দ্রব্যে সমবেত যে নিত্য অনুগত দ্রব্যত্ব ধর্ম, সেটি হলো জাতি। যা দ্রব্যত্ববৎ বা দ্রব্যত্ববান তাই দ্রব্য। এই দ্রব্যত্ববত্বকে দ্রব্যের নির্দোষ লক্ষণ বলা হয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা দ্রব্যত্ব জাতি সিদ্ধ করা যায় না। এ কারণে অনুমান প্রমাণের দ্বারা দ্রব্যত্ব জাতি সিদ্ধ করা হয়েছে। ভাষাপরিচ্ছেদকার বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চাননও সিদ্ধান্ত মুক্তাবলীতে দ্রব্যত্বজাতির দ্বারাই দ্রব্যের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। তর্কসংগ্রহদীপিকায় অন্নংভট্টও দ্রব্যের লক্ষণে বলেন-
‘দ্রব্যত্বজাতিমত্ত্বং গুণবত্ত্বং বা দ্রব্যসামান্যলক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে দ্রব্যত্ব জাতি থাকে তাই দ্রব্য, অথবা যাতে গুণ থাকে তাই দ্রব্য। দ্রব্যত্বজাতিমত্ত্ব অথবা গুণবত্ত্ব দ্রব্যের সামান্যলক্ষণ।
.
তবে এতোসব জটিলতায় না গিয়ে সহজ কথায় দ্রব্যের লক্ষণ বলতে আমরা বুঝি, দ্রব্য হলো গুণবান ও কর্মবান। যা সর্ব অনিত্যগুণের ও সর্ব কর্মের সমবায়ী কারণ। সমবায়ী কারণে কার্য সরাসরি সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হয়। গুণ ও কর্ম দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে বর্তমান থাকে। গুণ বা কর্ম কখনও দ্রব্য ছাড়া থাকতে পারে না। আবার দ্রব্যও উৎপত্তির পর কোন না কোন গুণ বা কর্মের সমবায়ী কারণ হয়। গুণ বা কর্মহীন কোন দ্রব্য আমরা পাই না। ন্যায়-বৈশেষিক মতে একমাত্র উৎপত্তিক্ষণেই দ্রব্য নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। গুণ ও কর্ম পদার্থ কোন না কোন আশ্রয়ে আশ্রিত। আশ্রয় ব্যতীত আশ্রিত থাকতে পারে না। যে পদার্থ গুণ ও কর্ম পদার্থের আশ্রয়, তাকেই দ্রব্য বলা হয়।
.
দ্রব্যের বিভাগ:
বৈশেষিক মত অনুযায়ী তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট দ্রব্যের প্রকার নির্দেশ করে বলেন-
‘তত্র দ্রব্যাণি পৃথিব্যপতেজোবায়ব্কাশকালদিগাত্মমনাংসি নবৈব’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পদার্থসমূহের মধ্যে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক্, আত্মা ও মন- এই ন’টি মাত্র দ্রব্য।
.
আবার তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় তিনি বলেন-
‘দ্রব্যং বিভজতে তত্রেতি। তত্র দ্রব্যাদিমধ্যে দ্রব্যাণি নবৈবেত্যন্বয়ঃ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : দ্রব্য ন’টি- একথা বলার দ্বারা বলা হয়েছে যে, দ্রব্য ন’টি এবং ন’টির অতিরিক্ত দ্রব্য নাই।
.
অতএব, বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয় প্রকার। যথা- ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিক, কাল, আত্মা এবং মন।
এই নয়টি দ্রব্যের মধ্যে ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্-কে ভূতদ্রব্য বা পঞ্চভূত এবং ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও মনকে মূর্তদ্রব্য বলা হয়। অর্থাৎ ন্যায়-বৈশেষিক মতে ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ এই চারটি ভূতদ্রব্যও বটে আবার মূর্তদ্রব্যও বটে। কাল, দিক্ ও আত্মা ভূতও নয় আবার মূর্তও নয়। ব্যোম্ ভূতদ্রব্য কিন্তু মূর্তদ্রব্য নয়। মন মূর্ত দ্রব্য কিন্তু ভূতদ্রব্য নয়।
.
পঞ্চ ভূতদ্রব্যের সমন্বয়ে ভৌতজগৎ সৃষ্ট হয়েছে। যে দ্রব্যের বহিরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ গুণ আছে তাকে ভূতদ্রব্য বলে। সীমিত পরিমাণযুক্ত দ্রব্যকে বলে মূর্তদ্রব্য। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্ এই পাঁচটি ভূতদ্রব্য যথাক্রমে গন্ধ, রস বা স্বাদ, রূপ, স্পর্শ এবং শব্দ এই পাঁচটি উদ্ভূত বিশেষ গুণবিশিষ্ট। উদ্ভূত বিশেষগুণ নির্দিষ্ট দ্রব্য ছাড়া অন্যত্র থাকে না। গন্ধ, ক্ষিতির বিশেষ গুণ। তাই ক্ষিতি ছাড়া গন্ধ থাকতে পারে না। একইভাবে উদ্ভূত স্বাদ জল ব্যতীত, উদ্ভূত রূপ তেজ ব্যতীত, উদ্ভূত স্পর্শ বায়ু ব্যতীত এবং শব্দ আকাশ ব্যতীত কোথাও উদ্ভূতরূপে থাকে না। ন্যায়-বৈশেষিক মতে এক একটি বিশেষগুণ এক একটি বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য। পাঁচটি ভূতদ্রব্যের পাঁচটি বিশেষগুণ যথাক্রমে ঘ্রাণেন্দ্রিয় (নাক), রসনেন্দ্রিয় (জিহ্বা), চক্ষুরিন্দ্রিয় (চোখ), ত্বগিন্দ্রিয় (ত্বক) ও শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের (কান) দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। বৈশেষিকমতে যে যে বিশেষগুণ যে যে বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য, সেই সেই বিশেষগুণের আশ্রয় যে ভূতদ্রব্য তাদের উপাদানে সেই সেই ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। অন্যভাবে বললে, যে ইন্দ্রিয় যে ভূতদ্রব্যের উপাদানে গঠিত, সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সেই ভূতদ্রব্যের বিশেষগুণ প্রত্যক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে নৈয়ায়িকেরা বৈশেষিকদের সঙ্গে একমত। এ কারণেই ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে বহিরিন্দ্রিয়গুলিকে ভৌতিক বলা হয়েছে।
অভৌতিক দ্রব্যগুলিরও বিশেষগুণ আছে। কিন্তু এই বিশেষগুণগুলি বহিরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যেমন- জ্ঞান আত্মার বিশেষগুণ, কিন্তু কোন বহিরিন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য নয়। অভৌতিক ইন্দ্রিয় মন এই গুণকে প্রত্যক্ষ করে।
.
ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ এই চতুর্বিধ ভৌত দ্রব্য নিত্য ও অনিত্য ভেদে দু’প্রকার। প্রত্যক্ষগ্রাহ্য সাবয়ব ভৌত দ্রব্য অনিত্য এবং আদি উপাদানরূপ প্রত্যক্ষের অগোচর পরমাণু দ্রব্য নিত্য। এই ভৌত দ্রব্যগুলির মৌলিক আদি উপাদান হলো যথাক্রমে ক্ষিতি পরমাণু, অপ্ পরমাণু, তেজ পরমাণু এবং মরুৎ পরমাণু। এই পরমাণুগুলি নিত্য অর্থাৎ, এদের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই এবং এরা নিরাবয়ব। কিন্তু এই সমস্ত পরমাণুর সংযোগের ফলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে স্থূল ক্ষিতি, স্থূল অপ্, স্থূল তেজ ও স্থূল মরুৎ উৎপন্ন হয়, এগুলি অনিত্য। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ যৌগিক দ্রব্য বলে এদের উৎপত্তি ও বিনাশ রয়েছে। বৈশেষিক মতে পরমাণুগুলি অতীন্দ্রিয়, এ কারণে পরমাণুর প্রত্যক্ষ হয় না। পরমাণুর অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ করা হয়েছে।
.
নিত্য ও অনিত্য দ্রব্যসমূহ
.
(১) ক্ষিতি বা পৃথিবী (Earth) : নবদ্রব্যের তালিকায় ক্ষিতির উল্লেখই প্রথম। ক্ষিতি বা পৃথিবী হলো গন্ধবতী দ্রব্য। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে পৃথিবীর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘তত্র গন্ধবতী পৃথিবী। সা দ্বিবিধা নিত্যা অনিত্যা চ। নিত্যাপরমাণুরূপা। অনিত্যা কার্যরূপা।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পৃথিবী হলো সেই দ্রব্য যা গন্ধযুক্ত। নিত্য ও অনিত্য ভেদে পৃথিবী দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ পৃথিবী নিত্য, কার্যরূপ পৃথিবী অনিত্য।
.
পৃথিবীর লক্ষণ হলো গন্ধবত্ব কিংবা গন্ধের সমবায়িকারণত্ব। গন্ধের সমবায়িকারণতার অবচ্ছেদক ধর্মই হলো পৃথিবীত্ব। এই পৃথিবীত্ব জাতির দ্বারাও পৃথিবীর লক্ষণ করা যায়। বৈশেষিক মতে ক্ষিতি বা পৃথিবীতে মোট চৌদ্দটি গুণ থাকে, যথা- গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমিতি, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব ও সংস্কার (বেগ ও স্থিতিস্থাপক)।
পৃথিবী দুই প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। ক্ষিতির পরমাণু নিত্য। তার উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। পরমাণু ব্যতীত সকল ক্ষিতিই অনিত্য। অনিত্য ক্ষিতি ত্রিবিধ- শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয়। শরীররূপ ক্ষিতি দুই প্রকার- যোনিজ ও অযোনিজ। যোনিজ শরীর আবার দুই প্রকার- জরায়ুজ ও অণ্ডজ। অযোনিজ শরীরও দ্বিবিধ- স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ। ঘ্রাণেন্দ্রিয় ক্ষিতি থেকে উৎপন্ন।
.
(২) অপ্ বা জল (Water) : শীতস্পর্শবতী দ্রব্য হলো অপ্ বা জল। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-
‘শীতস্পর্শবত্য আপঃ। তা দ্বিবিধাঃ নিত্যা অনিত্যাশ্চ। নিত্যাঃ পরমাণুরূপা। অনিত্যা কার্যরূপাঃ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : জল হলো সেই দ্রব্য যাতে শীতলস্পর্শ থাকে। নিত্য ও অনিত্য ভেদে জল দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ জল নিত্য, কার্যরূপ জল অনিত্য।
.
শীতস্পর্শবত্বই জলের লক্ষণ। অনিত্য শীতস্পর্শের সমবায়িকারণতাবচ্ছেদক ধর্মরূপে জলত্ব জাতি সিদ্ধ হয়। পৃথিবীতে যে চৌদ্দটি গুণ থাকে সেই চৌদ্দটি গুণের মধ্যে গন্ধ ব্যতীত বাকি গুণগুলি জলেও থাকে। গন্ধের পরিবর্তে জলে স্নেহ গুণটি থাকে। এই চৌদ্ধটি গুণের মধ্যে রস জলের বিশেষ গুণ। জলের রূপ শুক্ল। পাত্রবিশেষে জলের যে বিভিন্ন বর্ণ দেখা যায় তা পাত্রেরই রূপ। জল দুই প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। নিত্য জল পরমাণু স্বরূপ। অনিত্য জল ত্রিবিধ- শরীর, ইন্দ্রিয় এবং বিষয়। রসনেন্দ্রিয় জলীয় দ্রব্য বা জল থেকে উৎপন্ন।
.
(৩) তেজ (Tejas) : উষ্ণস্পর্শবান দ্রব্য হলো তেজ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-
‘উষ্ণ স্পর্শবৎ তেজঃ। তৎ চ দ্বিবিধং নিত্যমনিত্যং চ। নিত্যং পরমাণুরূপম্ । অনিত্যং কার্যরূপম্ । (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : তেজ হলো সেই দ্রব্য যাতে উষ্ণ স্পর্শ থাকে। তেজ দ্বিবিধ- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ তেজ নিত্য, কার্যরূপ তেজ অনিত্য।
.
উষ্ণস্পর্শবত্বই তেজের লক্ষণ। অনিত্য উষ্ণ স্পর্শের সমবায়িকারণতাবচ্ছেদক রূপে তেজস্ত্ব জাতি সিদ্ধ হয়। পৃথিবী ও জলের বিশেষ গুণ গন্ধ ও রস তেজদ্রব্যে থাকে না। এছাড়া গুরুত্ব গুণটিও তেজে থাকে না, ফলে পৃথিবীর চৌদ্দটি গুণের মধ্যে মোট এগারটি গুণ তেজদ্রব্যে থাকে। যেমন- রূপ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমিতি, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, দ্রবত্ব ও বেগ নামক সংস্কার। তেজের রূপ হলো ভাস্বর শুক্ল। সোনা, রূপা প্রভৃতি পদার্থ তেজঃ পদার্থ। সেজন্য বাসনপত্রকে তৈজস বলা হয়। তেজ দ্রব্য নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। পরমাণু স্বরূপ তেজ নিত্য। অন্য সমস্ত তেজ অনিত্য। অনিত্য তেজ পৃথিবী ও জলের ন্যায় শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয় ভেদে ত্রিবিধ। চক্ষুরিন্দ্রিয় তেজ থেকে উৎপন্ন। তৈজস শরীর তৈজস পরমাণুর দ্বারা গঠিত। তেজের বিষয়কে অর্থাৎ বিষয়রূপ তেজকে কেউ কেউ চতুর্বিধ বলে মনে করেন- ভৌম, দিব্য, উদর্য ও আকরজ। অগ্ন্যাদি তেজ হলো ভৌম তেজ। বিদ্যুৎ, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি হলো দিব্য তেজ। অন্নাদি পরিপাকের জন্য উদরস্থিত তেজ হলো উদর্য তেজ এবং সুবর্ণ রত্নাদি হলো আকরজ তেজ।
.
(৪) মরুৎ বা বায়ু (Air) : রূপরহিত স্পর্শবান দ্রব্য হলো বায়ু। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বায়ুর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘রূপরহিতস্পর্শবান্ বায়ুঃ। স দ্বিবিধঃ নিত্যঃ অনিত্যশ্চ। নিত্যঃ পরমাণুরূপঃ। অনিত্যঃ কার্যরূপঃ। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বায়ু হলো সেই দ্রব্য যাতে স্পর্শ আছে, কিন্তু রূপ নাই। বায়ু দু’প্রকার- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ বায়ু নিত্য, কার্যরূপ বায়ু অনিত্য।
.
পৃথিবী, জল ও তেজদ্রব্যে রূপ থাকে এবং স্পর্শও থাকে, কিন্তু বায়ুতে স্পর্শ থাকলেও রূপ থাকে না। স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব ও সংস্কার (বেগ) এই নয়টি গুণ বায়ুতে থাকে। প্রাচীনমতে বায়ু স্পর্শাদি গুণের আশ্রয়রূপে অনুমেয় কিন্তু নব্যমতে বায়ু ত্বাচপ্রত্যক্ষসিদ্ধ। ত্বগেন্দ্রিয় দ্বারা বায়ুকে স্পর্শ করা যায়। বায়ু দুইপ্রকার- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ বায়ু নিত্য। অনিত্যবায়ু তিন প্রকার- শরীর, ইন্দ্রিয় ও বিষয়। ত্বগেন্দ্রিয় বায়ু থেকে উৎপন্ন। ত্বগেন্দ্রিয় সর্বশরীরব্যাপী। কেবল পুবিতৎ নাড়ীতে ত্বগেন্দ্রিয় থাকে না। বায়ুকে প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান ও উদান এই পঞ্চপ্রকার বলা হয়। হৃদয়ে স্থিত বায়ু প্রাণ, নিম্নগামীবায়ু অপান, নাভিস্থিত বায়ু সমান, কণ্ঠদেশস্থ বায়ু উদান এবং সর্বশরীর সঞ্চারী বায়ু ব্যান নামে পরিচিত। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে বায়ুর সমবায়ী কারণ নেই। কারো কারো মতে বায়ু নিত্য।
.
(৫) ব্যোম্ বা আকাশ (Akasa) : বৈশেষিকসম্মত পঞ্চম ভূতদ্রব্য হলো ব্যোম্ বা আকাশ। এই মতে আকাশ হলো এক, বিভু, নিত্য, ভূতদ্রব্য। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আকাশের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘শব্দগুণকম্ আকাশম্ । তৎ চ একং বিভু নিত্যং চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : শব্দ গুণ যার সেই দ্রব্য আকাশ। আকাশ এক, নিত্য ও বিভু।
.
আকাশ শব্দগুণের অধিকরণ বা আশ্রয়। শব্দ আকাশে সমবেত। শব্দের প্রত্যক্ষ হয়, কিন্তু আকাশ অপ্রত্যক্ষ। আকাশের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ। আকাশ অতীন্দ্রিয় ও সর্বব্যাপী। যেহেতু আকাশ সর্বব্যাপী সেহেতু সকল মূর্ত দ্রব্যের সঙ্গে আকাশের সংযোগ আছে। সর্বমুর্ত্তসংযোগিত্ব অর্থাৎ যে দ্রব্য সমস্ত মূর্ত দ্রব্যের সঙ্গে সংযুক্ত তাকে বলে বিভুদ্রব্য। এই কারণে আকাশ বিভু পদার্থ। আকাশের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। তাই আকাশ নিত্য এবং এক। আকাশ এক হওয়ায় আকাশত্ব জাতি স্বীকৃত হতে পারে না। আকাশত্বকে তাই অখণ্ডোপাধি বলা হয়। যদি আকাশ উৎপন্ন দ্রব্য হতো তাহলে তার সমবায়ী কারণরূপে আকাশের পরমাণু স্বীকার করতে হতো। কিন্তু পরমাণু থেকে উৎপন্ন দ্রব্য হয় অণুপরিমাণ বিশিষ্ট হবে অথবা মহৎ পরিমাণ বিশিষ্ট হবে। আকাশ বিভু পরিমাণ হওয়ায় তা পরমাণু থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। অনুৎপন্ন ভাবপদার্থ মাত্রই অবিনাশী। অতএব আকাশ নিত্য।
.
আবার আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না অর্থাৎ আকাশ অতীন্দ্রিয় হওয়ায় পরিশেষানুমানের দ্বারা আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে শব্দ অনিত্য গুণ পদার্থ। শব্দ গুণ হওয়ায় তা কোন না কোন দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হবে। আবার তা অনিত্য হওয়ায় তার সমবায়ী কারণরূপে কোন দ্রব্য স্বীকার করতে হবে। শব্দ একটি বিশেষ গুণ হওয়ায় তা কাল, দিক্ ও মনে আশ্রিত হতে পারে না। কারণ এই তিনটি দ্রব্য কোন বিশেষ গুণের আশ্রয় হয় না। আবার শব্দ যেহেতু শ্রোত্রেন্দ্রিয় গ্রাহ্য সেহেতু তা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আত্মার গুণ হতে পারে না। পৃথিব্যাদি দ্রব্যের গুণ শ্রোত্রেন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় না। এভাবে পৃথিব্যাদি আটটি দ্রব্যের শব্দাশ্রয় বা শব্দের সমবায়ী-কারণতা অস্বীকৃত হওয়ায় নবতম দ্রব্য আকাশকেই শব্দাশ্রয় বা শব্দের সমবায়ী কারণরূপ দ্রব্য বলে স্বীকার করতে হয়। এভাবে পরিশেষানুমানের সাহায্যে আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
.
(৬) কাল (Time) : বৈশেষিক স্বীকৃত ষষ্ঠ দ্রব্য হলো কাল। কালকে অতীতাদি ব্যবহারের হেতু বলা হয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ প্রভৃতির বোধ থেকে কালের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কালের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অতীতাদিব্যব্যবহারহেতুঃ কালঃ। স চ একঃ বিভুঃ নিত্যঃ চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এরূপ ব্যবহারের হেতু যে দ্রব্য, তাই কাল। কাল এক, বিভু ও নিত্য।
.
কালের রূপ নেই, এজন্য কাল অপ্রত্যক্ষ। কালের কল্পিত বিভাগ হলো মুহূর্ত। কাল জড়পদার্থ নয়, তাই কাল অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য। বৈশেষিক মতে কাল এক, বিভু ও নিত্য। কালের কোন বিশেষ গুণ নেই, সামান্য গুণ আছে। সামান্য গুণগুলি হলো সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল এক। কালে আশ্রিত পদার্থসমূহের ক্রিয়ার জন্য কাল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ক্ষণ, প্রহর, দিন, মাস, কর্ষাদি ভেদে ভিন্ন ভিন্নরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের ভেদ-ব্যবহার ঔপাধিক। প্রকৃতপক্ষে কাল এক ও অখণ্ড।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে উৎপত্তি ও বিনাশ না থাকায় কাল নিত্য। মহাপ্রলয়ে অনিত্য পদার্থসমূহের ধ্বংস কালেই উপপাদন করতে হয়। তাই প্রলয়েও কাল জগৎ-বিনাশের সাক্ষিরূপে অক্ষতই থাকে। আবার জগতের সৃষ্টি কালেই উপপাদন করতে হয় বলে কাল অনাদি। অনাদি ও অবিনাশী কালকে নিত্যই বলতে হয়।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল বিভু বা পরম মহৎপরিমাণ বিশিষ্ট। সর্বদা ও সর্বত্র ক্রিয়াসমূহ কালেই সম্পাদিত হয় বলে কাল সর্বব্যাপক বা সর্বত্র ব্যাপ্ত। কাল এক বলে কালত্ব ধর্ম জাতি হতে পারে না। কাল সকল কার্যের নিমিত্ত কারণ। তাই তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকাগ্রন্থে অন্নংভট্ট বলেন-
‘সর্বাধারঃ কালঃ সর্বকার্যনিমিত্তকারনং চ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : কাল সব কিছুর আধার এবং সকল কার্যের নিমিত্ত কারণ।
.
(৭) দিক্ (Space) : দিকের অপর নাম দেশ। তা আকাশের মতোই এক, অতীন্দ্রিয়, বিভু বা সর্বব্যাপী ও নিত্য দ্রব্য। কাছে-দূরে, এখানে-ওখানে, পূর্বে-পশ্চিমে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের কারণরূপে দিকের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দিক্-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘প্রাচ্যাদিব্যবহারহেতুঃ দিক্ । সা চ একা নিত্যা বিভুঃ চ।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, এখানে, সেখানে, কাছে, দূরে প্রভৃতি ব্যবহারের কারণ যে দ্রব্য, তাই দিক্ । (কালের মতো) দিক্ এক, নিত্য ও বিভু দ্রব্য।
.
কালের মতো দিকেরও কোন বিশেষ গুণ নেই, সামান্য গুণ আছে। যথা- সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ। কালের মতো দিক্-এও উদ্ভূতরূপ বা উদ্ভূতস্পর্শ নাই। তাই দিক্-এর প্রত্যক্ষ হয় না। এছাড়া দিক সকল কার্যের প্রতি নিমিত্ত কারণ। তর্কসংগ্রদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন-
‘দিগপিকার্যমাত্রে নিমিত্ত কারণম্ ।’ (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : দিক্ কার্যমাত্রের প্রতি নিমিত্ত কারণ।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে পরত্ব এবং অপরত্ব বলে দুটি গুণ পদার্থ স্বীকৃত। পরত্ব এবং অপরত্ব গুণদ্বয়ের ব্যবহার আবার দুই প্রকার। একপ্রকার পরত্ব ও অপরত্বের দ্বারা জ্যেষ্ঠত্ব ও কনিষ্ঠত্বের উপপত্তি হয়। অপর প্রকার পরত্ব ও অপরত্বের দ্বারা দূরত্ব ও নিকটত্বের উপপত্তি হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে প্রথম প্রকার ব্যবহারের দ্বারা কাল অনুমিত হয় এবং দ্বিতীয় প্রকার ব্যবহারের দ্বারা দিক্ অনুমিত হয়।
আমরা প্রাচী (পূর্ব), প্রতীচী (পশ্চিম), উদীচী (উত্তর) এবং অবাচী (দক্ষিণ) প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে দূরত্ব-নিকটত্বের প্রতীতি লাভ করি। দূরত্ব-নিকটত্ব দৈশিক অবস্থান নির্দেশক। এই দৈশিক অবস্থানই পরত্ব-অপরত্বের একটি অর্থ। এই দূরত্ব ও নিকটত্ব আমরা ফুট, গজ, মাইল, কিলোমিটারের দ্বারা নির্দেশ করি।
.
বৈশেষিক মতে দিক্ এক ও বিভু। কিন্তু এক্ষেত্রে আপত্তি উঠতে পারে যে, যার দ্বারা প্রাচী ও প্রতীচী প্রভৃতি ব্যবহার সিদ্ধ হয় তা কি করে এক ও বিভু হতে পারে। প্রাচী প্রতীচী নয়, আবার প্রতীচী প্রাচী নয়। তাই দিককে এক ও বিভু বলা যায় না। এর উত্তরে বৈশেষিকাচার্যরা বলেন প্রাচী-প্রতীচী ইত্যাদি ব্যবহার উপাধি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে দিক্ এক। উপাধিভেদে দিককে ভিন্ন ভিন্ন বলে মনে হয়। দিক্ এক হওয়ায় তার বস্তুত কোন ভেদ নেই। উৎপত্তি ও বিনাশ রহিত দিক্ এক, বিভু ও নিত্য।
.
(৮) আত্মা (Soul) : বৈশেষিক দার্শনিকরা আত্মাকে দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মন থেকে স্বতন্ত্র একটি নিত্যদ্রব্য বলেছেন। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আত্মার লক্ষণ দিয়েছেন-
‘জ্ঞানাধিকরণমাত্মা।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আত্মা জ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
.
আত্মা জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপ নয়। জ্ঞানাধিকরণত্ব আত্মার লক্ষণ। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার একটি গুণ। তবে জ্ঞান আত্মার নিত্য গুণ নয়, আগন্তুক গুণ। আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে আত্মাতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। এই কারণে আত্মা হলো জ্ঞানের সমবায়ী কারণ। কিন্তু আত্মাতে জ্ঞান সর্বদা থাকে না। তিনপ্রকার সংযোগের ফলে আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সেগুলি হলো বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সংযোগ, বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ এবং মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগ। কিন্তু সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রাকালে অথবা মুক্তির অবস্থায় আত্মাতে জ্ঞান থাকে না।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘স দ্বিবিধঃ জীবাত্মা পরমাত্মা চ ইতি।’
অর্থাৎ : ‘আত্মা দু’প্রকার- জীবাত্মা ও পরমাত্মা বা ঈশ্বর।’
.
জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য, কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্য জ্ঞানবান। তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন-
‘নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বং ঈশ্বরত্বম’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্যজ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
.
নিত্যজ্ঞান পরমাত্মার গুণ। সুতরাং ঈশ্বর সগুণ। সর্বজ্ঞ পরমাত্মা সর্ববিষয়ক নিত্যজ্ঞানের আশ্রয়, কিন্তু নিত্যজ্ঞানস্বরূপ নন। ঈশ্বর অতীন্দ্রিয়দর্শী, অনাদি, অসীম, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তিনি জ্ঞানাদি সকল গুণবিশিষ্ট, নিত্য।
ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ, জ্ঞান, ধর্ম, অধর্ম, সংস্কার- এই ন’টি জীবত্মার বিশেষ গুণ। জ্ঞানবত্ত্ব, ইচ্ছাবত্ত্ব, প্রযত্নবত্ত্ব- এই তিনটি জীবত্মা ও পরমাত্মা এই দ্বিবিধ আত্মারই সামান্য লক্ষণ, কারণ পরমাত্মা বা ঈশ্বরেরও নিত্য জ্ঞান, নিত্য ইচ্ছা, নিত্য প্রযত্ন আছে। জগতের নিমিত্ত কারণরূপে পরমাত্মার অস্তিত্ব অনুমান করা হয়। কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সুখ, দুঃখ, দ্বেষ না থাকায় সুখবত্ত্ব, দুঃখবত্ত্ব, দ্বেষবত্ত্ব পরমাত্মার লক্ষণ নয়। এগুলি কেবল জীবাত্মারই লক্ষণ।
.
জীবাত্মা এক নয়, বহু। শরীর ভেদে বিভিন্ন জীবাত্মা স্বীকার করা হয়েছে। জীবাত্মা নিত্য অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিনাশরহিত। জীবাত্মা বিভু, অর্থাৎ পরম মহৎপরিমাণ বিশিষ্ট। শরীরের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বলে জীবাত্মাকে সীমিত বলে মনে হয়। পরমাত্মা বা ঈশ্বর এক ও সর্বজ্ঞ।
.
(৯) মন (Manas) : ন্যায়-বৈশেষিক মতে মন নবম দ্রব্য এবং অন্তিম দ্রব্য। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব (দৈশিক), সংস্কার (বেগ)- এই আটটি গুণের অধিকরণ হলো মন।
.
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- মন অন্তরিন্দ্রিয়। সুখ, দুঃখ প্রভৃতি আন্তর বস্তুর জ্ঞান চক্ষুরাদি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয় না। সুখ, দুঃখ প্রভৃতি আত্মার গুণ। সুখ-দুঃখাদির প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধির সাধন হলো মন। প্রত্যেক আত্মায় ভোগসাধনরূপে একটি মন স্বীকার করা প্রয়োজন। বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষ করার জন্য যেমন বহিরেন্দ্রিয়ের প্রয়োজন, সেরকম সুখ, দুঃখ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করার জন্য একটি ইন্দ্রিয়কে করণ হিসেবে স্বীকার করতে হয়। এই অন্তরেন্দ্রিয়ই হলো মন। মন আত্মার মতো নিত্য দ্রব্য। আত্মা অসংখ্য, তাই মনও অসংখ্য। মন যেহেতু অতীন্দ্রিয়, তাই মনের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় মন-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘স্পর্শরহিতত্বে সতি ক্রিয়াবত্ত্বং মনসো লক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যা স্পর্শশূন্য, কিন্তু ক্রিয়াবান, তাই মন।
.
পৃথিবী, জল, বায়ু, তেজে স্পর্শ ও ক্রিয়া উভয়ই থাকে। আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা এই চারটি দ্রব্যে স্পর্শ ও ক্রিয়া থাকে না। কেবলমাত্র মন ক্রিয়াবান, কিন্তু স্পর্শরহিত। তাই মন পৃথিব্যাদি আটটি দ্রব্য হতে ভিন্ন।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, মনের প্রত্যক্ষ হয় না, মনকে অণুপরিমাণ বলা হয়েছে। মনের অস্তিত্ব অনুমানসিদ্ধ। এই মতে মন দ্রব্য হওয়ায় তার পরিমাণ থাকবে। দর্শনের দৃষ্টিতে পরিমাণ তিন প্রকার- অণুপরিমাণ, মধ্যমপরিমাণ ও বিভুপরিমাণ। ন্যায়-বৈশেষিক মতে মন মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট হতে পারে না। কেননা মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট দ্রব্য সাবয়ব বলে তার বিনাশ স্বীকার্য। সুতরাং মন মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট হলে মন বিনাশী অর্থাৎ অনিত্য একথা স্বীকার করতে হয়। আবার একথা বলা যায় না যে, আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা স্পর্শরহিত কিন্তু বিভুদ্রব্য এবং মন স্পর্শরহিত দ্রব্য হওয়ায় মনও আকাশাদির মতো বিভু দ্রব্য। মন বিভুদ্রব্য হলে আত্মমনঃসংযোগ রূপ অসমবায়িকারণ না থাকায় জ্ঞানের উৎপত্তি হবে না। কেননা ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা দুটি বিভু দ্রব্যের সংযোগ স্বীকার করেন না বলে আত্মমনঃসংযোগ রূপ অসমবায়িকারণ ছাড়াই জ্ঞানোৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তা অসম্ভব। কারণ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ ঘটলেই প্রত্যক্ষণ বা জ্ঞানোৎপত্তি হয় না, প্রত্যক্ষণের জন্য প্রয়োজন আত্ম-মনোসংযোগ। সুতরাং যেহেতু আত্মার বিভুত্ব স্বীকৃত, সেহেতু স্বীকার করতে হবে যে, মন বিভুপরিমাণবিশিষ্ট নয়। অনুমানসিদ্ধ মনের অস্তিত্ব সাধনে ন্যায়সূত্র-এ বলা হয়েছে-
‘যুগপৎ জ্ঞানানুৎপত্তিঃ মনসো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৬)।
অর্থাৎ : যুগপৎ বা একই সময়ে দুটি বিষয়ের জ্ঞানের উৎপত্তি না হওয়ায় মনের অস্তিত্ব অনুমিত হয়।
.
এই যুক্তির ব্যাখ্যা হলো, বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের যুগপৎ সম্বন্ধ থাকলেও যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান আমাদের হয় না। আত্মা বিভু হওয়ায় আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সর্বদাই বর্তমান। তা সত্ত্বেও যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান না হওয়ার জন্য আত্মার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সরাসরি সংযোগ স্বীকার করা যায় না। উভয়ের মধ্যবর্তী তৃতীয় একটি কারণের অনুসন্ধান করতে হয়। এই তৃতীয় কারণটি হলো মন নামক দ্রব্য। আত্মার সঙ্গে সরাসরি মনের সংযোগ হয় এবং মনের সঙ্গে বহিরিন্দ্রিয়গুলির সংযোগ হয়। বহিরিন্দ্রিয়গুলি যুগপৎ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হলেও কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে মনের সঙ্গে একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সম্ভব। কারণ মন অণুপরিমাণবিশিষ্ট। অণুপরিমাণ দ্রব্য একক্ষণে একাধিক দ্রব্যের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে না। কোন একক্ষণে মনের সঙ্গে যে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয় সেইক্ষণে কেবল সেই ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংবদ্ধ বিষয়েরই প্রত্যক্ষ হয়, অন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংবদ্ধ বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় না। তাই দ্রব্যরূপ মন বহিরিন্দ্রিয়গুলির দ্বারা বাহ্যবিষয়ের জ্ঞানের নিয়ন্ত্রক। এভাবেই মনের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এছাড়া মানস-প্রত্যক্ষের করণরূপ ইন্দ্রিয় হলো মন। এজন্যেই মনকে অন্তরিন্দ্রিয় বলা হয়। তবে ভাট্টমীমাংসা ও পাতঞ্জল দর্শন সম্প্রদায় মনের অণুপরিমাণ স্বীকার করেন না। তাদের মতে মন বিভু।
.
বৈশেষিক সম্মত সপ্তপদার্থের দ্বিতীয় পদার্থ হলো গুণ। গুণ একটি ভাবপদার্থ। যে পদার্থ দ্রব্যে অবস্থান করে এবং যার কোন কর্ম নেই তার নাম গুণ। গুণ সব সময়ই দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। দ্রব্য ছাড়া গুণের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে গুণের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন-
‘দ্রব্যাশ্রয়া অগুণবান সংযোগবিভাগেষবকারণমনপেক্ষ ইতি গুণলক্ষণম্’। (বৈশেষিকসূত্র: ১/১/১৬)।
অর্থাৎ : দ্রব্যাশ্রয়ী, অগুণবান, এবং সংযোগ বিভাগের নিরপেক্ষ অকারণ পদার্থ হলো গুণ।
বৈশেষিক মতে দ্রব্যই গুণের আশ্রয়। দ্রব্য ছাড়া গুণাদি কোন পদার্থই গুণের আশ্রয় হয় না। তাই গুণ দ্রব্যাশ্রয়ী। গুণের গুণ স্বীকৃত নয় বলে গুণ হলো অগুণবান। কোন কোন গুণ বৈশেষিকমতে সংযোগ ও বিভাগের কারণ হয় যেমন, ধর্ম, অধর্ম, জ্ঞান, ইচ্ছা প্রভৃতি। কিন্তু এই গুণগুলি কর্মকে অপেক্ষা না করে সংযোগ বা বিভাগের কারণ হয় না। অর্থাৎ কর্মের দ্বারাই সংযোগ বা বিভাগ সম্ভব, একক গুণের দ্বারা নয়। এজন্যেই বলা হয়েছে গুণ সংযোগ ও বিভাগের অনপেক্ষ কারণ নয়। অর্থাৎ গুণকে সংযোগ-বিভাগ-অকারণ-নিরপেক্ষ পদার্থ বলা হয়।
.
‘দ্রব্যাশ্রয়ী-অগুণবান’ ও ‘সংযোগ-বিভাগ-অকারণ-অনপেক্ষ’ এই দুটি পদের দ্বারা গুণকে যথাক্রমে দ্রব্য ও কর্ম থেকে পৃথক করা হয়েছে। অন্যভাবে গুণকে দ্রব্য ও কর্ম ভিন্ন সামান্য বা জাতিবিশিষ্ট পদার্থও বলা হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে দ্রব্য, গুণ ও কর্মই কেবলমাত্র জাতিবিশিষ্ট, অন্য কোন পদার্থ জাতিবিশিষ্ট নয়। তাই দ্রব্য ও কর্ম বাদ দিলে যা জাতিমান বা সামান্যবান তাই গুণ।
.
প্রশস্তপাদ উদ্দেশ প্রকরণে গুণের কোন লক্ষণ নির্দেশ করেননি। তবে তাঁর মতে গুণবত্বই গুণের লক্ষণ। শঙ্কর মিশ্র গুণের একাধিক লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। এই লক্ষণগুলির অন্যতম লক্ষণ হলো-
‘সামান্যবত্ত্বেসতি কর্ম্মান্যত্ত্বে সতি অগুণবত্ত্বং’। (বৈশেষিকসূত্রোপষ্কার)।
অর্থাৎ : সামান্যবান, কর্মভিন্ন অথচ যা গুণরহিত পদার্থ তাই গুণ।
.
প্রশস্তপাদভাষ্য থেকে জানা যায় যে, বৈশেষিক সম্মত গুণপদার্থ চব্বিশপ্রকার। এই চব্বিশপ্রকার গুণের মধ্যে সতেরোটি গুণ মহর্ষি কণাদ তাঁর বৈশেষিকসূত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এই সতেরোটি গুণ হলো- (১) রূপ, (২) রস, (৩) গন্ধ, (৪) স্পর্শ, (৫) সংখ্যা, (৬) পরিমাণ, (৭) পৃথকত্ব, (৮) সংযোগ, (৯) বিভাগ, (১০) পরত্ব, (১১) অপরত্ব, (১২) বুদ্ধি বা জ্ঞান, (১৩) সুখ, (১৪) দুঃখ, (১৫) ইচ্ছা, (১৬) দ্বেষ ও (১৭) প্রযত্ন।
.
এছাড়া সূত্রগ্রন্থের স্থানে স্থানে বাকি সাতটি গুণ যথা (১৮) গুরুত্ব, (১৯) দ্রবত্ব, (২০) স্নেহ, (২১) সংস্কার, (২২) ধর্ম, (২৩) অধর্ম ও (২৪) শব্দ-এর উল্লেখ থাকায় প্রশস্তপাদের ভাষ্যে এই সাতটি গুণও সূত্রকারের অভিপ্রেত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আচার্য প্রশস্তপাদ ‘ধর্ম’ ও ‘অধর্ম’-এর পরিবর্তে ‘অদৃষ্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার দ্বারা তিনি ধর্ম ও অধর্মকেই বুঝিয়েছেন। নইলে শেষোক্ত গুণের সংখ্যা সাত হবে না। তাই বৈশেষিক দর্শনে মোট চব্বিশ প্রকার গুণ স্বীকৃত। নব্য-নৈয়ায়িকেরাও এই চব্বিশ প্রকার গুণকে স্বীকার করেছেন।
.
বৈশেষিক দর্শনে যে চব্বিশ প্রকার গুণ স্বীকৃত তা মৌলিক গুণ। বৈশেষিক মতে মৌলিক গুণ চব্বিশ প্রকারের কম বা বেশি নয়। এই চব্বিশ প্রকার মৌলিক গুণের পারস্পরিক সংযোগে কোন কোন নতুন গুণের আবির্ভাব হতে পারে কিন্তু মৌলিক গুণের তালিকায় তারা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
.
গুণমাত্রই গুণত্বের আশ্রয়, দ্রব্যে সমবেত, গুণরহিত ও ক্রিয়াশূন্য। বৈশেষিক সম্মত চব্বিশ প্রকার গুণের মধ্যে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ ও বেগরূপ-সংস্কার- এই দশটি গুণ হলো মূর্তদ্রব্যের গুণ। অর্থাৎ এরা পরিচ্ছিন্ন পরিমাণবিশিষ্ট দ্রব্যের গুণ। বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, ধর্ম, অধর্ম, ভাবনাখ্য-সংস্কার ও শব্দ- এই দশটি হলো অমূর্ত দ্রব্যের গুণ। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ- এই পাঁচটি মূর্ত এবং অমূর্ত উভয়প্রকার দ্রব্যের গুণ। সংযোগ, বিভাগ, পৃথকত্ব, সংখ্যা প্রভৃতি গুণ একাধিক দ্রব্যে আশ্রিত হতে পারে। আবার রূপ, রস প্রভৃতি গুণ কেবলমাত্র একটি দ্রব্যেই আশ্রিত।
.
রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, স্নেহ, দ্রবত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, ধর্ম, অধর্ম, ভাবনাখ্য-সংস্কার ও শব্দ- এই ষোলটি গুণ হলো বিশেষ গুণ। সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব এবং বেগরূপ-সংস্কার- এই দশটি হলো সামান্যগুণ।
গুরুত্ব, ধর্ম, অধর্ম ও ভাবনাখ্য-সংস্কার- এই চারটি গুণ হলো অতীন্দ্রিয় গুণ। বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং প্রযত্ন- এই ছয়টি গুণ অন্তরিন্দ্রিয় মনের দ্বারা গ্রাহ্য। রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ ও গন্ধ- এই পাঁচটি গুণ একেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য গুণ। সংখ্য, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, স্নেহ ও বেগরূপ-সংস্কার- এই নয়টি গুণ হলো দুইটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য গুণ।
.
গুণপদার্থ সমূহ :
.
(১) রূপ (Colour) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো রূপ। রূপের লক্ষণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-
‘চক্ষুর্মাত্রগ্রাহ্যো গুণো রূপম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কেবলমাত্র চক্ষুরিন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহিত হয় যে গুণ তাকেই রূপ বলা হয়।
.
রূপ চক্ষু ভিন্ন অন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহিত হয় না। ক্ষিতি, অপ্ এবং তেজ এই তিনটি দ্রব্যে রূপ থাকে, অন্য দ্রব্যে থাকে না। রূপ সাত প্রকার- শুক্ল, নীল, পীত, রক্ত, হরিত (সবুজ), কপিশ ও চিত্র। ন্যায়-বৈশেষিক মতে নীল, কৃষ্ণ, শ্যাম প্রভৃতি অভিন্ন। কৃষ্ণ ও পীতরূপের মিশ্রিত রূপ কপিশ। ক্ষিতিতে সকল প্রকার রূপই থাকে, কিন্তু অপ্ ও তেজে শুধু শুক্লরূপ থাকে। রূপকে দুইভাগে ভাগ করা হয়- উদ্ভূত ও অনুদ্ভূত। ‘উদ্ভূত’ শব্দের অর্থ প্রকাশিত এবং ‘অনুদ্ভূত’ শব্দের অর্থ অপ্রকাশিত।
.
রূপকে আবার অন্যদিক থেকে দুভাগে ভাগ করা হয়- নিত্য এবং অনিত্য। অপ ও তেজের পরমাণুতে স্থিত রূপ নিত্য। পার্থিব পরমাণুর যে রূপ তা অনিত্য। কারণ তেজঃ সংযোগে ক্ষিতির পরমাণুতে পাক হয়ে থাকে এবং রূপ পরিবর্তিত হয়। পাক বলতে তেজের সংযোগকে বোঝায়। বায়ুর পরমাণুতে রূপ থাকে না। পৃথিবী, জল ও তেজে রূপ থাকলেও রূপ তেজেরই বিশেষ গুণ। চক্ষুরিন্দ্রিয় তেজের পরমাণু থেকে উৎপন্ন। তাই চক্ষুরিন্দ্রিয় তৈজস বা তেজ দ্রব্য।
.
(২) রস (Taste) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো রস। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে রস-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘রসনাগ্রাহ্যো গুণো রসঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : রসনা (জিহ্বা) ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহিত হয় যে গুণ তাকে রস বলা হয়।
.
এই গুণটি জল ও পৃথিবী এই দুই দ্রব্যে থাকে, অন্য দ্রব্যে থাকে না। রস ছয় প্রকার- মধুর, অম্ল, লবণ, কটু (ঝাল), কষায় ও তিক্ত। ক্ষিতি বা পৃথিবীতে সকল প্রকার রসই থাকে, কিন্তু জলে কেবল মধুর রস থাকে। জলীয় পরমাণুর রস নিত্য, কিন্তু অনিত্য জলের রস অনিত্য। পৃথিবীর রস অনিত্য। জলের বিশেষ গুণ রস। রসনা ইন্দ্রিয় জল পরমাণু থেকে উৎপন্ন হয়। তাই রসনা ইন্দ্রিয় জলীয় দ্রব্য।
.
(৩) গন্ধ (Smell) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো গন্ধ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট গন্ধ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘ঘ্রাণগ্রাহ্যো গুণো গন্ধঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে গুণ গ্রাহ্য বা গৃহিত হয় তাকে গন্ধ বলা হয়।
.
কেবল ক্ষিতি বা পৃথিবীই গন্ধের আশ্রয়। গন্ধমাত্রেই অনিত্য। পৃথিবীর বিশেষ গুণ গন্ধ। গন্ধ দু প্রকার- সুরভি ও অসুরভি। পৃথিবী পরমাণু থেকে ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। তাই ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় পার্থিব দ্রব্য।
.
(৪) স্পর্শ (Touch) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো স্পর্শ। স্পর্শের লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেন-
‘ত্বগিন্দ্রিয়মাত্রগ্রাহ্যো গুণঃ স্পর্শ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কেবলমাত্র ত্বক্ ইন্দ্রিয় দ্বরা যে গুণ গ্রাহ্য হয় তাকে স্পর্শ বলা হয়।
.
পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু এই চারটি দ্রব্যে স্পর্শ গুণ থাকে। বায়ুর বিশেষ গুণ স্পর্শ। বায়ুর পরমাণু থেকে ত্বক্ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন। তাই ত্বগিন্দ্রিয় বায়বীয় দ্রব্য বা বায়ু দ্রব্য। স্পর্শ তিনপ্রকার- উষ্ণ, শীত, অনুষ্ণাশীত। তেজের স্পর্শ উষ্ণ, জলের স্পর্শ শীত এবং পৃথিবী ও বায়ুর স্পর্শ অনুষ্ণাশীত। পৃথিবীর স্পর্শ পাকজ হওয়ায় তা অনিত্য। তবে জল, তেজ ও বায়ুর স্পর্শ অপাকজ। জল, তেজ ও বায়ুর পরমাণুর এই অপাকজ স্পর্শ নিত্য। কিন্তু অনিত্য জল, তেজ ও বায়ুর দ্ব্যণুক। ত্র্যণুকের স্পর্শ অনিত্য।
উল্লেখ্য, পাক বলতে তেজের সংযোগকে বোঝায়। পাকের ফলে পূর্বরূপের নাশ হয় এবং একটি নতুন রূপের উৎপত্তি হয়। পাকজ রূপ বলতে পাকের ফলে উৎপন্ন রূপই বোঝায়। দুইটি পরমাণু সংযোগে দ্ব্যণুক ও তিনটি দ্ব্যণুক মিলে একটি ত্র্যণুক গঠিত হয়।
.
(৫) সংখ্যা (Number) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংখ্যা। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সংখ্যা’র লক্ষণ দিয়েছেন-
‘একত্বাদি ব্যবহারহেতুঃ সংখ্যা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সংখ্যা হলো বস্তুর সেই ধর্ম যা এক, দুই, তিন ইত্যাদি ব্যবহারের হেতু বা কারণ।
.
সংখ্যা হলো এমন গুণ যা প্রত্যেক দ্রব্যেই থাকে। তাই সংখ্যা একটি সামান্য গুণ। একত্ব থেকে পরার্ধ পর্যন্ত সংখ্যা নামে অভিহিত হয়। সংখ্যার ক্রম এক থেকে শুরু হয়ে পরার্ধে শেষ হয়। এক হলো সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম সংখ্যা এবং পরার্ধ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সংখ্যা। যে দ্রব্যে একত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘এক’ বলা হয়, যে দ্রব্যে দ্বিত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘দুই’ বলা হয়, যে দ্রব্যে ত্রিত্ব সংখ্যা থাকে তাকে ‘তিন’ বলা হয়। নিত্য দ্রব্যের একত্ব সংখ্যা নিত্য, অপর সমস্ত সংখ্যাই অনিত্য। পৃথিবী, জল, বায়ু ও তেজের পরমাণু এবং আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মন নিত্যদ্রব্য বলে তাদের প্রত্যেকটিতে স্থিত একত্ব সংখ্যা নিত্য। অর্থাৎ নিত্যদ্রব্যস্থিত একত্ব সংখ্যার উৎপত্তি ও বিনাশ নাই। কিন্তু বৃক্ষ, ঘট প্রভৃতি অনিত্য দ্রব্যে স্থিত একত্ব সংখ্যা অনিত্য। দ্বিত্বাদি সংখ্যা সর্বত্র অনিত্যই হয়। অর্থাৎ দ্বিত্ব, ত্রিত্ব প্রভৃতি সংখ্যার উৎপত্তি ও বিনাশ হয়।
.
দ্বিত্ব, ত্রিত্ব প্রভৃতি সংখ্যা অপেক্ষাবুদ্ধি থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপত্তিতে ‘এটি এক’, ‘এটি এক’ এরকম জ্ঞানের অপেক্ষা থাকে বলে এই জ্ঞান অপেক্ষাবুদ্ধি। অনেককে বিষয় করে প্রত্যেকটিতে যে একত্বের জ্ঞান হয় তাই অপেক্ষাবুদ্ধি। দ্বিত্ব, ত্রিত্ব ইত্যাদি সংখ্যার উৎপত্তিতে যে দুটি বা তিনটি দ্রব্যকে আমরা গণনা করি সেই দ্রব্যগুলিই তার সমবায়ী কারণ, প্রতিটি দ্রব্যের একত্ব অসমবায়ী কারণ এবং প্রত্যেকটি দ্রব্যের একত্বের জ্ঞান নিমিত্ত কারণ। যেমন যদু ও মধুকে গণনা করে জানা যায় যে এরা দুজন। যদু ও মধুতে যে দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপন্ন হলো, যদু ও মধুই তার সমবায়ী কারণ। যদু সমবেত একত্ব ও মধু সমবেত একত্ব, এই দ্বিত্ব সংখ্যা অসমবায়ী কারণ। আর আমি যে যদুকে এক বলে জেনেছি এবং যে মধুকে এক বলে জেনেছি সেই জ্ঞানই (অপেক্ষাবুদ্ধি) হচ্ছে দ্বিত্ব সংখ্যার উৎপত্তির নিমিত্ত কারণ। উল্লেখ্য, বৈশেষিক মতে পরমাণুতে দ্বিত্ব সংখ্যার ও দ্ব্যণুকে ত্রিত্ব সংখ্যার উৎপত্তিতে ঈশ্বরের অপেক্ষাবুদ্ধিই কারণ হয়।
.
(৬) পরিমাণ (Magnitude) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো পরিমাণ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট পরিমাণ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘মানব্যবহারাসাধারণং কারণং পরিমাণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : মান বা পরিমিতি ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে পরিমাণ বলা হয়।
.
‘এটি বড়’, ‘এটি দীর্ঘ’, ‘এটি হ্রস্ব’ এভাবে দ্রব্যের মানের যে ব্যবহার হয়, তার অসাধারণ কারণকেই পরিমাণ বলা হয়। পরিমাণ গুণটি সকল দ্রব্যেই থাকে। তাই পরিমাণ একটি সামান্য গুণ। পরিমাণ চতুর্বিধ- অণু, হ্রস্ব, মহৎ এবং দীর্ঘ। প্রত্যেক পরিমাণ আবার নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। নিত্য দ্রব্যের পরিমাণ নিত্য এবং অনিত্য দ্রব্যের পরিমাণ অনিত্য। অনিত্য পরিমাণ তিন প্রকারে উৎপন্ন হয়- (১) কারণের সংখ্যার দ্বারা কার্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয়, (২) কারণের পরিমাণের দ্বারা কার্যদ্রব্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয় এবং (৩) পরিমাণাশ্রয় দ্রব্যের অবয়বসমূহের প্রচয় বা শিথিল সংযোগের দ্বারা ঐ দ্রব্যের পরিমাণ উৎপন্ন হয়।
.
আকাশ, কাল, দিক্ ও আত্মাতে নিত্যমহত্ব (পরমমহত্ব) আশ্রিত থাকে। অনিত্য মহত্ব ত্র্যণুক থেকে শুরু করে যাবৎ অবয়বী দ্রব্যের গুণ। নিত্য অণুত্ব মন ও পরমাণুর গুণ। অনিত্য অণুত্ব কেবল দ্ব্যণুকেই থাকে। দীর্ঘত্ব ও হ্রস্বত্ব গুণদ্বয় মহত্ব এবং অণুত্বের আশ্রয়ে সমবেত হয়। অনিত্য পরিমাণগুলি সংখ্যা, পরিমাণ ও শিথিল সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়।
.
(৭) পৃথকত্ব (Difference) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো পৃথকত্ব। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে পৃথকত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘পৃথক্ ব্যবহারাসাধারণকারণং পৃথকত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ‘এটি ঐটি থেকে পৃথক্’ এরূপ ব্যবহারের অসাধারণ কারণ হলো পৃথকত্ব।
.
একটি পদার্থ যে অন্য পদার্থ থেকে পৃথক তা (ভেদজ্ঞান) বোঝানোর জন্য যে শব্দ প্রয়োগ করা হয় তার হেতু হলো পৃথকত্বের জ্ঞান। সকল দ্রব্যেই পৃথকত্ব থাকে। তাই পৃথকত্ব সামান্য গুণ। পৃথকত্ব দ্বিবিধ- একপৃথকত্ব ও দ্বিপৃথকত্ব। একপৃথকত্ব নিত্যও হয় আবার অনিত্যও হয়, কিন্তু দ্বিপৃথকত্ব সর্বদাই অনিত্য হয়। আবার পৃথকত্বকে একদ্রব্যক ও অনেকদ্রব্যক ভেদে দ্বিবিধ বলা হয়, অর্থাৎ পৃথকত্ব কখনো একটি দ্রব্যে থাকে আবার কখনো অনেক দ্রব্যে থাকে।
.
(৮) সংযোগ (Conjunction) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংযোগ। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট সংযোগ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সংযুক্ত ব্যবহার হেতুঃ সংযোগঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দুটি দ্রব্য সংযুক্ত, এরূপ ব্যবহারের হেতু বা কারণ হলো সংযোগ।
.
যে সকল দ্রব্য স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে, তাদের মিলনকে সংযোগ বলা হয়। সংযোগ তিন প্রকার- (১) অন্যতর কর্মজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের একটির ক্রিয়ার ফলে যে সংযোগ উৎপন্ন হয়, যেমন- একটি পাখি উড়ে এসে একটি গাছের ডালে বসলে গাছ ও পাখির সংযোগ হয়। (২) উভয় কর্মজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের উভয়ই ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হওয়ার ফলে যে সংযোগ ঘটে, যেমন- দুটি চলন্ত গাড়ি দুই দিক থেকে এসে মুখোমুখি লেগে গেলো। (৩) সংযোগজ সংযোগ : দুটি দ্রব্যের মধ্যে তৃতীয় কোন দ্রব্যের মাধ্যমে যদি সংযোগ ঘটে, যেমন- হাতের লাঠি দিয়ে ভূতল স্পর্শ করলে লাঠির মাধ্যমে হাতের সঙ্গে ভূতলের সংযোগ ঘটে। সংযোগজ সংযোগ একটি সংযোগ বা একাধিক সংযোগ থেকে হতে পারে।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সংযোগ অনিত্য গুণ।
.
(৯) বিভাগ (Disjunction) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো বিভাগ। বিভাগ হলো সংযোগের বিপরীত গুণ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বিভাগের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সংযোগনাশকো গুণঃ বিভাগঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সংযোগের নাশক যে গুণ তাই বিভাগ।
.
যে দুটি দ্রব্য পরস্পর বিভক্ত হয় বিভাগ গুণটি তাদের প্রত্যেকটিতেই থাকে। বিভাগ সর্বদ্রব্যবৃত্তি অর্থাৎ সকল দ্রব্যেই এই গুণ থাকে। তাই বিভাগ সামান্য গুণ। বিভাগও তিন প্রকার- (১) অন্যতর কর্মজন্য বিভাগ : সংযোগ দ্রব্যের কোন একটা দ্রব্য ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হওয়ার জন্য যে বিভাগ হয়, যেমন- গাছ থেকে পাখিটি উড়ে গেলেই গাছ ও পাখির বিভাগ হয়। এই বিভাগ কেবলমাত্র পাখির প্রযত্নে উৎপন্ন তাই এটি অন্যতর কর্মবিভাগ। (২) উভয়কর্মজন্য বিভাগ : সংযুক্ত দ্রব্যের উভয়ই গতিশীল হওয়ায় যে বিভাগ ঘটে, যেমন- দুটি চলমান গাড়ি বিপরীত দিকে চলার ফলে যে বিভাগ ঘটে। (৩) বিভাগজন্য বিভাগ : তৃতীয় দ্রব্যের মাধ্যমে সংযুক্ত দুটি দ্রব্যের সংযোগ থেকে তৃতীয় দ্রব্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যে বিভাগ ঘটে, যেমন- হাত থেকে লাঠি ছেড়ে দিলে ভূতল ও হাতের যে বিভাগ হয় তা হাত ও লাঠির বিভাগজন্য বিভাগ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে বিভাগ অনিত্য গুণ।
.
(১০-১১) পরত্ব (Remoteness) ও অপরত্ব (Proximity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম দুটি গুণ হলো পরত্ব ও অপরত্ব। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট পরত্ব ও অপরত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘পরাপরব্যবহারাসাধারণ কারণে পরত্বাপরত্বে’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : পর (দূরবর্তী বা জ্যেষ্ঠ) ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে পরত্ব এবং অপর (নিকটবর্তী বা কনিষ্ঠ) ব্যবহারের অসাধারণ কারণকে অপরত্ব বলে।
.
যে গুণ পর অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ বা দূর এইরূপ ব্যবহারের কারণ তাই পরত্ব এবং যে গুণ অপর অর্থাৎ কনিষ্ঠ বা নিকট এইরূপ ব্যবহারের কারণ তাই অপরত্ব। অর্থাৎ পরত্ব ও অপরত্ব দ্রব্যের এমন দুটি গুণ যা দ্বারা আমরা দ্রব্যের দূরত্ব ও নিকটত্ব অথবা অতীত ও বর্তমান এই ধারণাগুলি করি। পরত্ব ও অপরত্ব গুণ দুটি পরস্পর সাপেক্ষ। এককভাবে একটির প্রতীতি হয় না। পরত্বের প্রতীতি অপরত্বের প্রতীতি না হলে হয় না আবার অপরত্বের প্রতীতি পরত্বের প্রতীতি না হলে হয় না। এই দুটি গুণ পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও মনে থাকে। পরত্ব ও অপরত্ব দু’প্রকার- কালিক ও দৈশিক। ঐ দ্রব্যটি দূরে অথবা এই দ্রব্যটি নিকটে এটাই হলো দৈশিক বা দেশগত। আর একটি দ্রব্য পুরাতন বা জ্যেষ্ঠ কিংবা একটি দ্রব্য নতুন বা কনিষ্ঠ এটা কালিক বা কালগত।
.
পরত্ব ও অপরত্ব সামান্য বা জাতি না হওয়ায় তাদের একই অধিকরণে আশ্রয় সম্ভব। কালিক পরত্ব ও অপরত্ব গুণ নিত্যদ্রব্যে থাকে না, কেবল জন্য (উৎপন্ন) দ্রব্যেই থাকে। আর দৈশিক পরত্ব ও অপরত্ব গুণ কেবল মূর্তদ্রব্যেই থাকে, বিভুদ্রব্যে থাকে না।
.
(১২) বুদ্ধি বা জ্ঞান (Buddhi or Knowledge) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো বুদ্ধি বা জ্ঞান। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বুদ্ধি বা জ্ঞানের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘সর্বব্যবহারহেতুঃ গুণঃ বুদ্ধিঃ জ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে পদার্থ সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ, সেই গুণস্বরূপ পদার্থই জ্ঞান এবং জ্ঞান বুদ্ধির নামান্তর বা বুদ্ধি জ্ঞানের নামান্তর। যা বুদ্ধি তাই জ্ঞান, যা জ্ঞান তাই বুদ্ধি। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন।
.
সাংখ্যমতে বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন হতে পারে না, কারণ বুদ্ধি অচেতন প্রকৃতি হতে উদ্ভূত প্রথম তত্ত্ব। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তিতে আত্মা বা পুরুষের প্রতিবিম্ব বা প্রতিফলন হলে জ্ঞান হয়। কিন্তু অন্নংভট্ট ন্যায়দর্শন প্রণেতা মহর্ষি গৌতমকে অনুসরণ করে বুদ্ধি ও জ্ঞানকে অভিন্ন বলেছেন। মহর্ষি গৌতম বলেছেন-
‘বুদ্ধিঃ উপলব্ধিঃ জ্ঞানম্ ইতি অনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র)।
অর্থাৎ : বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান শব্দগুলি ভিন্নার্থক নয়, তারা একই পদার্থকে বোঝায়।
.
বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ ও প্রযত্ন হলো আত্মার বিশেষ গুণ। বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান ও প্রত্যয় ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে পর্যায়শব্দ। জ্ঞান আত্মা নামক দ্রব্যের গুণ। তাই জ্ঞান গুণ পদার্থের অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধি ও জ্ঞান অভিন্ন। যা বুদ্ধির লক্ষণ তাই জ্ঞানের লক্ষণ, আবার যা জ্ঞানের লক্ষণ তাই বুদ্ধির লক্ষণ। জ্ঞান গুণস্বরূপ, এবং জ্ঞানকে সকল ব্যবহারের প্রতি কারণ বলা হয়েছে। ব্যবহার বলতে গ্রহণ, বর্জন, উপেক্ষা, শব্দব্যবহারকে বোঝায়। কোন পদার্থের ব্যবহার সম্ভব হয় যদি ব্যবহারকারীর ঐ পদার্থ বিষয়ে জ্ঞান থাকে। এই জ্ঞান হলো ইচ্ছার সাক্ষাৎ কারণ, আত্মার বিশেষ গুণ এবং জ্ঞানত্ব জাতিমান। ইষ্টসাধনতা জ্ঞান থেকেই ইচ্ছা হয়। এজন্য জ্ঞানকে ইচ্ছার সাক্ষাৎকারণ বলা হয়। আবার জ্ঞানত্ব জাতি জ্ঞানে থাকে বলে জ্ঞানকে জ্ঞানত্বজাতিমানও বলা হয়। জ্ঞানত্ব ধর্ম জ্ঞানের অসাধারণ ধর্ম এবং তা জ্ঞানকে অন্য বস্তু থেকে পৃথক করে।
.
বুদ্ধি বা জ্ঞানের বিষয় অনন্ত, তাদের কারণও ভিন্ন ভিন্ন এবং তার প্রকারও অনেক। নানাভাবে বুদ্ধি বা জ্ঞানের প্রকারভেদ করা হয়। অনুভূতি ও স্মৃতিভেদে বুদ্ধি দুই প্রকার।
‘সংস্কারমাত্রজন্যং জ্ঞানং স্মৃতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ, কেবলমাত্র সংস্কারের দ্বারা উৎপন্ন যে জ্ঞান সেই জ্ঞানই স্মৃতি।
.
‘তদভিন্নং জ্ঞানম্ অনুভবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ, অনুভব হলো স্মৃতি ভিন্ন জ্ঞান।
অনুভব বা অনুভূতি আবার প্রত্যক্ষ এবং লৈঙ্গিক বা অনুমিতিভেদে দ্বিবিধ- প্রত্যক্ষণ ও অনুমান।
.
অন্য একভাবে জ্ঞানকে বিদ্যা ও অবিদ্যাভেদে দ্বিবিধ বলা হয়। বিদ্যা মানে প্রমা বা যথার্থজ্ঞান এবং অবিদ্যা মানে অপ্রমা বা অযথার্থজ্ঞান। বৈশেষিক ভাষ্যকার প্রশস্তপাদ চারপ্রকার বিদ্যা ও চারপ্রকার অবিদ্যার উল্লেখ করেছেন। চারপ্রকার বিদ্যা হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমিতি, স্মৃতি ও আর্ষ। চারপ্রকার অবিদ্যা হলো- সংশয়, বিপর্যয়, অনধ্যবসায় ও স্বপ্ন।
জ্ঞানকে নিত্য ও অনিত্য ভেদেও দ্বিবিধ বলা হয়। ঈশ্বর বা পরমাত্মার জ্ঞান নিত্য, কিন্তু জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য। জীবাত্মা অনিত্যজ্ঞানের সমবায়িকারণ, এবং আত্মমনোসংযোগ জ্ঞানের অসমবায়িকারণ। সুষুপ্তি কালে আত্মায় কোন জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। এর কারণরূপে ত্বগেন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগকে জ্ঞানের নিমিত্তকারণ বলা হয়। সুষুপ্তিতে যেহেতু এই সংযোগ থাকে না সেহেতু জ্ঞান উৎপন্ন হয় না।
.
(১৩) সুখ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সুখ। সুখের লক্ষণ হলো ‘অনুগ্রহ লক্ষণং সুখম্’ অর্থাৎ, সুখ হলো অনুগ্রহ বা অনুকূল স্বভাব।
বুদ্ধির ন্যায় সুখও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট সুখ-এর লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘সর্বেষাং অনুকূল (তয়া) বেদনীয়ং সুখম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা সকলে অনুকূল বলে অনুভব করে, তাই সুখ।
.
সুখ সকলেরই কাম্য বা কামনার বিষয়। আবার যে বিষয়ের প্রাপ্তিতে সুখ হয় সেই বিষয়ও সবার কাম্য বিষয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, সুখ তার নিজের জন্যই কাম্য। কিন্তু যে বিষয়টির প্রাপ্তিতে সুখ হয় তা সুখজনক বলেই কাম্য। এজন্য সুখকে স্বতোকাম্য বলা হয়। সুখ তার জ্ঞানের কারণ সহযোগেই উৎপন্ন হয়। সুখের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়ী কারণ। আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং ধর্ম নিমিত্তকারণ। এজন্য সুখ উৎপন্ন হলে তার পরক্ষণে সুখের জ্ঞান উৎপন্ন হয়। একই কারণে তাই সুখকে তীব্র সংবেগী বলা হয়। জ্ঞানের সঙ্গে সুখের এখানেই পার্থক্য। যদিও জ্ঞান উৎপন্ন হলে পরবর্তীকালে তার মানসপ্রত্যক্ষ হতে পারে, তবে প্রতিটি জ্ঞানের মানসপ্রত্যক্ষ হবেই এমন কোন কথা নেই। কিন্তু সুখ উৎপত্তির পরক্ষণেই ‘আমি সুখী’ এরূপে তার মানসপ্রত্যক্ষ হয়। সুখের মানসপ্রত্যক্ষে সুখত্ব জাতিরও মানসপ্রত্যক্ষ হয়।
.
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন- ‘আমি সুখী’ এরূপ অনুব্যবসায়ে যে সুখত্বের প্রকাশ হয়, তাই সুখের প্রকৃত লক্ষণ। তর্কসংগ্রহে যা বলা হয়েছে তা সুখের স্বরূপকথন। বৌদ্ধমতে অবশ্য সুখ ও সুখজ্ঞান এক ও অভিন্ন।
.
(১৪) দুঃখ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দুঃখ। দুঃখের লক্ষণ হলো ‘উপঘাত লক্ষণং দুঃখম্’ অর্থাৎ, দুঃখ হলো উপঘাত লক্ষণ।
দুঃখ পীড়াজনক এবং প্রাণীগণের পক্ষে প্রতিকূল অবস্থা। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দুঃখ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘সর্বেষাং প্রতিকূল (তয়া) বেদনীয়ং দুঃখম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা সকলে প্রতিকূল বলে অনুভব করে, তাই দুঃখ।
.
দুঃখকে কেউ কামনা করে না। দুঃখ তাই স্বতোই পরিত্যাজ্য। যে বিষয় দুঃখদায়ক, দুঃখের ন্যায় তাও পরিত্যাজ্য। সুখের ন্যায় দুঃখ তীব্র সংবেগী। ফলে দুঃখ উৎপন্ন হলেই পরক্ষণেই তার উপলব্ধি হয়। এ কারণে বৌদ্ধগণ দুঃখ ও দুঃখের অনুভবকে এক ও অভিন্ন বলেন। কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক মতে দুঃখ ও দুঃখের অনুভব এক নয়। দুঃখের অনুভব সামগ্রি দুঃখের সঙ্গেই উৎপন্ন হয়। কিন্তু তবুও দুঃখ ও দুঃখের অনুভবকে এক বলা যাবে না। দুঃখের মানসপ্রত্যক্ষের মাধ্যমে দুঃখত্ব জাতিরও প্রত্যক্ষ হয়।
.
জ্ঞান বা বুদ্ধি ও সুখের ন্যায় দুঃখও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। দুঃখের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়ী কারণ, আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং ধর্ম নিমিত্তকারণ হয়। অন্যান্য বিশেষ গুণের উৎপত্তিতে দুঃখের বিনাশ হয়। বস্তুত যেকোন বিশেষ গুণই পরবর্তী বিশেষ গুণের দ্বারা বিনষ্ট হয়।
.
(১৫) ইচ্ছা : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো ইচ্ছা। ইচ্ছার লক্ষণ হলো- ‘স্বার্থং পরার্থং বা অপ্রাপ্তপ্রার্থনেচ্ছা’ অর্থাৎ, নিজের জন্য বা পরের জন্য অপ্রাপ্ত বিষয়ের যে প্রার্থনা তাই ইচ্ছা।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ইচ্ছা-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘ইচ্ছা কামঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ইচ্ছা হলো কোন কিছুর কামনা।
.
এই ইচ্ছা সুখ প্রভৃতি বা স্মৃতি প্রভৃতির সহায়তায় আত্মমনোসংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়। আত্মা ইচ্ছার সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ ইচ্ছার অসমবায়ী কারণ এবং ইচ্ছার নিমিত্তকারণ দ্বিবিধ। ইষ্টের জ্ঞান ফলবিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ। এবং ইষ্টসাধনতার জ্ঞান উপায়বিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ। নিমিত্তকারণের ভেদে ইচ্ছারও ভেদ স্বীকৃত হয়। সুখ ও দুঃখাভাব আমাদের ইষ্ট। ফলের জ্ঞানই ফলের ইচ্ছার কারণ বলে সুখ ও দুঃখাভাবের ইচ্ছাকে বলা হয় ফলবিষয়ক ইচ্ছা। উপায়বিষয়ক ইচ্ছা ফলের ইচ্ছার অধীন। যে বিষয় সুখ ও দুঃখাভাবের সাধক তার প্রতি আমাদের ইচ্ছাকে বলা হয় উপায়বিষয়ক ইচ্ছা। যে বিষয় পূর্বে আমাদের সুখসাধন করেছিলো সেজাতীয় কোন বিষয়কে আমরা ইষ্টের সাধক বলে জানি ও তাকে কামনা করি। এজন্য ইষ্টসাধনতার জ্ঞানই হলো উপায়বিষয়ক ইচ্ছার নিমিত্তকারণ।
.
জ্ঞানাদির ন্যায় ইচ্ছাও মানসপ্রত্যক্ষের বিষয়। ইচ্ছার প্রত্যক্ষে ইচ্ছার জাতিরও মানসপ্রত্যক্ষ হয়। ইচ্ছা শুধু জীবাত্মার গুণ নয়, পরমাত্মারও গুণ। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই জগতের সৃষ্টি হয়। তবে ঈশ্বরেচ্ছা তার জ্ঞানের মতোই নিত্য। সুখ ও দুঃখ এ দুটি বিশেষ গুণ কিন্তু ঈশ্বরে থাকে না, এগুলি কেবলই জীবাত্মার গুণ। কাম, অভিলাষ, রাগ, সংকল্প, করুণা, বৈরাগ্য, উপধা এবং ভাব প্রভৃতি ইচ্ছারই প্রকারভেদ।
.
(১৬) দ্বেষ : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দ্বেষ। দ্বেষের লক্ষণ হলো- ‘প্রজ্জ্বলণাত্মকো দ্বেষঃ’ অর্থাৎ, দ্বেষ হলো প্রজ্জ্বলনরূপ আত্মগুণ।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে দ্বেষ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘ক্রোধো দ্বেষঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কোন কিছুর প্রতি ক্রোধকে দ্বেষ বলা হয়।
.
দ্বেষের উৎপত্তিতে প্রাণীগণ প্রজ্জ্বলিত বা দগ্ধ হয়। জীবাত্মা দ্বেষের সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং দুঃখের জ্ঞান বা দুঃখ সাধনতার জ্ঞান হলো তার নিমিত্তকারণ। যে বিষয় থেকে দুঃখের আশঙ্কা থাকে সেই বিষয়ের প্রতি আমাদের দ্বেষ জন্মায়। আবার পরিণতিতে অভিষ্ঠসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকলে দুঃখজনক বিষয়ের প্রতিও আমাদের দ্বেষ জন্মায় না। যেমন ভোজনের আনন্দ অন্নপাকের প্রতি দ্বেষের জনক হয় না। দ্বেষ যত্ন, স্মৃতি, ধর্ম ও অধর্মের জনক। ক্রোধ, দ্রোহ, মন্যু, অক্ষমা এবং অমর্ষ এইগুলি দ্বেষের প্রকারভেদ।
জ্ঞানাদির ন্যায় দ্বেষও মানসপ্রত্যক্ষের বিষয় হয়। দ্বেষ প্রত্যক্ষকালে দ্বেষত্বজাতিরও প্রত্যক্ষ হয়। দ্বেষ জীবাত্মার গুণ, পরমাত্মা বা ঈশ্বরের দ্বেষ নেই।
.
(১৭) প্রযত্ন : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো প্রযত্ন। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট প্রযত্ন-এর লক্ষণে বলেছেন-
‘কৃতিঃ প্রযত্নঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কৃতি বা প্রচেষ্টাকে প্রযত্ন বলে।
.
প্রযত্ন, সংরম্ভ, উৎসাহ ও কৃতি পর্যায় শব্দ। জ্ঞানাদির ন্যায় প্রযত্নও আত্মার একটি বিশেষ গুণ। আত্মা প্রযত্নের সমবায়ী কারণ, আত্মমনোসংযোগ অসমবায়ী কারণ এবং কোন বিষয়ের প্রতি ইচ্ছা বা দ্বেষ হলো তার নিমিত্তকারণ। ইচ্ছা থেকে ঐ ইচ্ছার বিষয়কে প্রাপ্তির প্রযত্ন উৎপন্ন হয়, দ্বেষ থেকে ঐ দ্বেষের বিষয়কে পরিহারের প্রযত্ন উৎপন্ন হয়।
.
প্রযত্ন তিন প্রকার- প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি ও জীবনযোনি। ইচ্ছা থেকে ঐ ইচ্ছার বিষয়কে প্রাপ্তির যে প্রযত্ন বা চেষ্টা, তাকে বলে প্রবৃত্তি প্রযত্ন। দ্বেষ থেকে ঐ দ্বেষের বিষয়কে পরিহারের যে প্রযত্ন বা চেষ্টা, তাকে বলে নিবৃত্তি প্রযত্ন। আর যে প্রযত্ন প্রাণীর শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণ হয় তাকে বলে জীবনযোনি প্রযত্ন।
.
প্রবৃত্তি প্রযত্ন ও নিবৃত্তি প্রযত্ন মানসপ্রত্যক্ষের বিষয়, কিন্তু জীবনযোনি প্রযত্ন অনুমানের বিষয়। শারীরিক পরিশ্রম করলে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আমরা অনুভব করি। এর দ্বারা সুষুপ্তিকালে প্রাণীর প্রাণ-অপান ক্রিয়া প্রযত্ন হেতুক বলে আমরা অনুভব করি। সুষুপ্তিকালে ইচ্ছা বা দ্বেষ প্রযত্নের কারণ হয় না। অতএব জীবনযোনি প্রযত্নই যে সুষুপ্তিতে প্রাণ ও অপানের প্রেরক হয় তা অনুমান করা যায়। জীবন মানে শরীরে প্রাণ সঞ্চার। এই প্রাণ সঞ্চারের কারণরূপে প্রাণ-অপান ধারার প্রবর্তকরূপে যে প্রযত্ন তাই হলো জীবনযোনি প্রযত্ন। সুষুপ্তিকালে এই জীবনযোনি প্রযত্ন যেমন প্রাণ-অপান ধারার প্রবর্তক হয়, জাগ্রত অবস্থায় তেমনি এই প্রযত্ন বহিরিন্দ্রিয়ের দ্বারা মনের সংযোগের কারণ হয়।
প্রযত্ন জীবাত্মা ও পরমাত্মার সমানগুণ। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের প্রযত্ন তার জ্ঞানাদির ন্যায় নিত্য, জীবাত্মার প্রযত্ন অনিত্য।
.
(১৮) গুরুত্ব (Heaviness) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো গুরুত্ব। গুরুত্ব হলো দ্রব্যের এমন গুণ যার জন্য দ্রব্য নিচের দিকে পতিত হয়। গুরুত্বের লক্ষণ হলো- ‘গুরুত্বং জলভূম্যোঃ পতনকর্ম্মকারণম্’ অর্থাৎ, গুরুত্ব জল ও পৃথিবীর গুণ এবং পতনক্রিয়ার কারণ।
কোন দ্রব্যের প্রথম পতনক্রিয়ার অসমবায়ী কারণ হলো গুরুত্ব। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে গুরুত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘আদ্যপতনাসমবায়িকারণং গুরুত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : গুরুত্ব হলো আদ্যপতনের অসমবায়িকারণ।
.
গুরুত্ব হলো জড় দ্রব্যের গুণ বা প্রথম পতনক্রিয়ার (initial fall) কারণ। কোন দ্রব্যের পতন একপ্রকার গমনক্রিয়া (motion)- উর্ধ্বদেশ হতে নিম্নদেশে গমন ক্রিয়া। এই নিম্নদেশগামী গমনক্রিয়া অনেকগুলি নিম্নগামী গমনক্রিয়ার সমষ্টি। এই পতনক্রিয়াগুলির প্রথম পতনক্রিয়াকে বলে আদ্যপতন। এই ক্রিয়ার (আদ্যপতন) আশ্রয় দ্রব্যটি এই ক্রিয়ার সমবায়িকারণ এবং এই ক্রিয়ার অসমবায়িকারণ ঐ দ্রব্যের গুরুত্ব, ওজন বা ভার (Heaviness)। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেছেন- কোন দ্রব্যের পতনক্রিয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়াদি পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণ ঐ দ্রব্যের বেগ নামক গুণ।
.
গুরুত্ব গুণটিকে পতনক্রিয়ার দ্বারা অনুমান করা যায়। গাছের ডাল থেকে যখন একটি পাতা ঝরে মাটিতে পড়ে তখন ঐ পাতাটিতে অনেকগুলি পতনক্রিয়া ঘটে। ঐ সকল পতনক্রিয়ার মধ্যে প্রথম পতনক্রিয়ার প্রতি ঐ পত্রের ওজন অসমবায়িকারণ হয়। দ্বিতীয়াদি পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণ হয় বেগ নামক সংস্কার। কিন্তু গুরুত্ব বলা হবে কেবল প্রথম পতনক্রিয়ার অসমবায়িকারণকে।
গুরুত্ব গুণটি একটি সামান্যগুণ এবং তা পৃথিবী ও জলে থাকে। পৃথিবী ও জলের পরমাণুর গুরুত্ব নিত্য। অনিত্য পৃথিবী ও অনিত্য জলের গুরুত্ব অনিত্য।
.
(১৯) দ্রবত্ব (Fluidity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো দ্রবত্ব। দ্রব্যত্ব হলো দ্রব্যের সেই গুণ যার জন্য দ্রব্য গড়িয়ে পড়ে। দ্রবত্বের লক্ষণ হলো- ‘দ্রবত্বং স্যন্দনকর্মকারণম্’ অর্থাৎ, স্যন্দনের অসমবায়িকারণ হলো দ্রবত্ব।
কোন তরল দ্রব্যের প্রস্রবণ বা প্রবাহকে স্যন্দন (flowing) বলে। গুরুত্বের ন্যায় দ্রবত্বকেও আদি স্যন্দনের কারণ বলতে হয়। দ্বিতীয়াদি স্যন্দনের অসমবায়িকারণ বেগ নামক সংস্কার। অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহে দ্রবত্ব-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘স্যন্দনাসমবায়িকারণং দ্রবত্বম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : দ্রবত্ব হলো স্যন্দন-এর অসমবায়িকারণ।
.
দ্রবত্ব গুণটি পৃথিবী, জল ও তেজ এই তিনটি দ্রব্যে থাকে। দ্রবত্ব দু’প্রকার- সাংসিদ্ধিক বা স্বাভাবিক এবং নৈমিত্তিক। জলের দ্রবত্ব সাংসিদ্ধিক বা স্বাভাবিক, ক্ষিতি ও তেজের দ্রবত্ব নৈমিত্তিক। স্বাভাবিক দ্রবত্বের জন্য জল নিচের দিকে গড়িয়ে যায়। নৈমিত্তিক দ্রবত্বের জন্য তেজসংযোগে ঘৃতাদি পার্থিবদ্রব্য ও সুবর্ণাদি তৈজস দ্রব্য তরল হয়। দ্রবত্বগুণ চক্ষু ও ত্বক্ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য। জলের পরমাণুস্থিত দ্রবত্ব নিত্য, অন্য সকল দ্রবত্ব অনিত্য।
.
(২০) স্নেহ (Viscosity) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো স্নেহ। স্নেহ হলো সেই গুণ যে গুণের প্রভাবে চূর্ণ বস্তু সংলগ্ন হয়। স্নেহ গুণটি কেবলমাত্র জলে থাকে। স্নেহের লক্ষণে বলা হয়- ‘স্নেহঃ অপাং বিশেষ গুণ’ অর্থাৎ, স্নেহ জলের বিশেষগুণ।
জলভিন্ন অন্য কোন দ্রব্যে স্নেহ থাকে না। তেলে যে স্নেহের উপলব্ধি হয় তা তেলের অন্তর্গত জলেরই স্নেহ। তর্কসংগ্রহে স্নেহের লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট বলেন-
‘চূর্ণাদিপিণ্ডীভাব হেতুঃ গুণঃ স্নেহঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে গুণ চূর্ণাদি দ্রব্যের পিণ্ডভাবের (lumping together) হেতু বা কারণ তাকে স্নেহ বলা হয়।
.
আটা, ময়দা প্রভৃতি দ্রব্যকে জলে মিশিয়ে পিণ্ডাকার করা যায়। স্নেহগুণের দ্বারা এই পিণ্ডাকার হয়ে থাকে। স্নেহ নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। জলীয় পরমাণুতে অবস্থিত স্নেহ নিত্য। অপর সকল স্নেহ অনিত্য। উৎকৃষ্ট স্নেহ প্রজ্জ্বলনে সহায়তা করে। অপকৃষ্ট স্নেহ প্রজ্জ্বলনে বাধা দেয়।
.
(২১) সংস্কার : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো সংস্কার। সংস্কারত্ব জাতিমান পদার্থই সংস্কার নামক গুণ। অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় সংস্কার-এর লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন-
‘সংস্কারত্ব জাতিমান্ সংস্কারঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে সংস্কারত্ব জাতি আছে, তাই সংস্কার।
.
সংস্কার তিন প্রকার- বেগ, ভাবনা ও স্থিতিস্থাপক।
.
বেগ সংস্কার (speed) : যে গুণ ক্রিয়ার দ্বারা জন্য বা উৎপন্ন হয়ে অন্য ক্রিয়ার জনক তাই বেগ। বেগরূপ সংস্কার যেকোন দ্রব্যকে গতিশীল রাখে। দীপিকা টীকায় বেগ-এর লক্ষণে বলা হয়েছে-
‘বেগত্ব জাতিমান্ বেগঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যাতে বেগত্ব জাতি আছে, তাই বেগ।
.
পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু দ্বারা নির্মিত দ্রব্যে ও মনে বেগ থাকে। একটা ঢিল উপরে ছুঁড়লে হাতের ক্রিয়ার দ্বারা ঢিলটিতে ক্রিয়া উৎপন্ন হয়। এই ক্রিয়া আবার ঢিলটিতে বেগ উৎপন্ন করে। ঐ বেগ ঢিলটির পূর্বক্রিয়াকে বিনষ্ট করে এবং এজাতীয় অপর একটি ক্রিয়া উৎপন্ন করে। এই ক্রিয়াটি আবার পূর্ববেগকে নষ্ট করে এবং অন্য একটি বেগকে উৎপন্ন করে। এভাবেই নিক্ষিপ্ত ঢিলটি দ্রুত একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছায়। বেগ দ্বিবিধ- কর্মজন্য বেগ ও বেগজন্য বেগ। বেগ দ্রব্যের সামান্যগুণ ও তা প্রত্যক্ষগোচর।
.
ভাবনা সংস্কার (psychical trace) : ‘ভাবনা’ নামক সংস্কার হলো আত্মার বিশেষ গুণ। এইরূপ সংস্কারই স্মৃতির জনক এবং তা প্রত্যভিজ্ঞাকে সম্ভব করে। তর্কসংগ্রহে ভাবনার লক্ষণ দেওয়া হয়েছে-
‘অনুভবজন্যা স্মৃতিহেতুঃ ভাবনা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ভাবনা রূপ সংস্কার অনুভবজন্য হয়ে স্মৃতির হেতু হয়।
.
ভাবনাখ্যসংস্কার প্রত্যক্ষ গোচর নয়। স্মৃতির কারণরূপে তা অনুমান করা হয়। অনুভব আত্মায় সংস্কার উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়। এই সংস্কার আত্মায় সমবেত থাকে এবং পরে তা উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মাতে স্মৃতি উৎপন্ন করে। স্মৃতিকালে যেহেতু অনুভব থাকে না, সেহেতু স্মৃতির কারণরূপে সংস্কারকে অনুমান করা হয়। ভাবনাখ্য সংস্কার কেবল জীবাত্মারই গুণ। পরমাত্মায় সংস্কার থাকে না। পরমাত্মার জ্ঞান নিত্যপ্রত্যক্ষমূলক। সুতরাং সেখানে স্মৃতিজনক সংস্কারের কোন স্থান নেই।
.
স্থিতিস্থাপক সংস্কার (elasticity) : স্থিতিস্থাপক সংস্কার হলো দ্রব্যের সেই গুণ যার জন্য দ্রব্যের অবস্থান্তর ঘটাবার পরও দ্রব্য পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। নিবিড় অবয়বের দ্বারা সন্নিবিষ্ট স্পর্শবান দ্রব্যের গুণ হলো স্থিতিস্থাপক সংস্কার। তর্কসংগ্রহে স্থিতিস্থাপক-এর লক্ষণ দেওয়া হয়েছে-
‘অন্যথাকৃতস্য পুনস্তদবস্থাপাদকঃ স্থিতিস্থাপকঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : স্থিতিস্থাপক হলো যার জন্য একটি বস্তু পরিবর্তিত কোন অবস্থা হতে পূর্ব অবস্থায় ফিরে যায়।
.
এই সংস্কার কেবলমাত্র পৃথিবীতে বা পার্থিব দ্রব্যে থাকে। স্থাবর ও জঙ্গম উভয়প্রকার পৃথিবীরই গুণ হলো স্থিতিস্থাপক সংস্কার। স্থিতিস্থাপক সংস্কার তার আশ্রয়কে পূর্বাবস্থায় স্থাপন করে। যেমন একটি গাছের ডাল বা ধনুককে বাঁকিয়ে তা ছেড়ে দিলে তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। স্থিতিস্থাপক সংস্কার নিত্য দ্রব্যের গুণ হলে তা নিত্য এবং অনিত্য দ্রব্যের গুণ হলে তা অনিত্য।
বেগ ও স্থিতিস্থাপক সংস্কার হলো দ্রব্যের সামান্যগুণ। কিন্তু ভাবনা নামক সংস্কার হলো দ্রব্যের বিশেষ গুণ।
.
(২২) ধর্ম : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো ধর্ম। ধর্ম ও অধর্ম গুণকে একত্রে অদৃষ্ট বলা হয়। আর ধর্মকে বলা হয় পুরুষগুণ। এখানে পুরুষ হলো জীবাত্মা। জীবাত্মার অন্যতম বিশেষগুণ হলো ধর্ম। পরমাত্মা বা ঈশ্বরের ধর্মগুণ স্বীকৃত নয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে শাস্ত্রবিহিত যাগযজ্ঞাদিক্রিয়াজন্য জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয় তাই ধর্ম। তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘বেদবিহিত কর্মজন্যোধর্মঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বৈদিক শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের ফলে জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয়, তাই ধর্ম।
.
উৎকৃষ্ট গুণ হিসেবে ধর্মকে পুণ্যও বলা হয়। ধর্ম হলো শাস্ত্রসম্মত কৃতকর্মের ফল। ধর্মের ফল সুখ। সাংখ্যমতে মনের বৃত্তিবিশেষই ধর্ম। বৌদ্ধমতে ধর্ম হলো শুভ বাসনা। জৈনমতে কার্যের উৎপাদক সূক্ষ্ম মূর্তিমান পুদ্গলই হলো ধর্ম। প্রাভাকর মীমাংসামতে যাগাদি কর্মজন্য অপূর্বই হলো ধর্ম। অপূর্ব আত্মাশ্রিত হলেও এই মতে তা আত্মার গুণ নয়। আর ভাট্ট মীমাংসামতে যাগ, দান, হোম প্রভৃতি শাস্ত্রবিহিত কর্মই হলো ধর্ম।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে ধর্ম যদিও জ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদির মতো আত্মার একটি বিশেষ গুণ, তবু তা জ্ঞান, সুখ বা দুঃখ ইত্যাদির মতো তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট হয় না। ধর্ম সুখভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকে, শেষ হয়ে গেলে বিনষ্ট হয়। অবশ্য তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও ধর্ম বিনষ্ট হয়। তবে তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা সঞ্চিত ধর্মই বিনষ্ট হয়, কিন্তু প্রারব্ধ ধর্ম বিনষ্ট হয় না। ধর্ম অতীন্দ্রিয়।
ধর্ম মানসপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, কিন্তু জ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি মানসপ্রত্যক্ষযোগ্য। সুখের কারণ রূপে ধর্মকে অনুমান করা হয়। শাস্ত্রবিহিত কর্ম, ঐ কর্মের কর্তা যে আত্মা সেই আত্মাতেই ধর্ম উৎপন্ন করে। ধর্ম আত্মাতে সমবেত হয়ে উৎপন্ন হয়। তাই আত্মাই ধর্মের সমবায়িকারণ। আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ ধর্মের অসমবায়িকারণ। এবং শাস্ত্রবিহিত কর্মের অনুষ্ঠান হলো ধর্মের নিমিত্তকারণ।
.
(২৩) অধর্ম : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো অধর্ম। অধর্ম সম্বন্ধে বলা হয়- ‘অধর্ম্মোহপ্যাত্মগুণ’ অর্থাৎ, ‘ধর্মের ন্যায় অধর্মও আত্মার গুণ।’
অধর্ম সম্পর্কে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘নিষিদ্ধ কর্মজন্যঃ তু অধর্মঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বৈদিক শাস্ত্রনির্দিষ্ট নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনের ফলে জীবাত্মায় যে বিশেষ গুণ উৎপন্ন হয়, তাই অধর্ম।
.
অধর্মের উৎপত্তিতে আত্মা সমবায়িকারণ, আত্ম-মনোসংযোগ অসমবায়িকারণ। এবং শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্মের ফললাভের সংকল্প বা দুষ্ট অভিসন্ধি হলো নিমিত্তকারণ। ধর্মের ন্যায় অধর্মও অতীন্দ্রিয়। সাধারণভাবে অধর্ম বলতে পাপকে বোঝায়। অধর্ম দুঃখের হেতু বা কারণ। দুঃখ থেকেই অধর্ম অনুমিত হয়, সকল দুঃখই অধর্মজন্য।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে অন্ত্যদুঃখের অর্থাৎ চরম দুঃখের নাশে অধর্মের নাশ হয়। হিংসা, মিথ্যাবচন, স্তেয় (চৌর্যবৃত্তি) প্রভৃতি কর্মের জন্য অধর্ম উৎপন্ন হয়। দুঃখভোগ শেষ না হলে অধর্মের নাশ হয় না। অধর্ম যেমন ভোগের দ্বারা বিনষ্ট হয়, তেমনি আবার তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও সঞ্চিত অধর্ম বিনষ্ট হয়। অধর্ম কেবল জীবাত্মারই গুণ, পরমাত্মায় অধর্ম থাকে না।
.
(২৪) শব্দ (Sound) : ন্যায়-বৈশেষিক সম্মত চব্বিশটি গুণের অন্যতম গুণ হলো শব্দ। শব্দের লক্ষণে বলা হয় ‘শব্দ অম্বর গুণঃ শ্রোত্রগ্রাহ্যঃ’ অর্থাৎ, ‘শব্দ আকাশের গুণ এবং শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ হয়।’
.
শব্দের আশ্রয় আকাশ। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ যেমন ব্যাপ্যবৃত্তি অর্থাৎ আশ্রয়কে ব্যাপ্ত করে থাকে, শব্দ কিন্তু সেরূপ নয়। শব্দগুণ তার আশ্রয়কে ব্যাপ্ত করে থাকে না। কোন শব্দ যখন উৎপন্ন হয় তখন আকাশের এক বিশেষ অবচ্ছেদেই উৎপন্ন হয়। সারা আকাশ জুড়ে কোন শব্দ থাকে না। ধরা যাক দূরে কেউ শাঁখ বাজালো। তার ফলে সেখানের আকাশে একটি শব্দ উৎপন্ন হলো। এই শব্দ তার পূর্ববর্তী আকাশে আরেকটা শব্দ উৎপন্ন করলো। ঐ শব্দ থেকে আরেকটি শব্দ, তার থেকে আরেকটি শব্দ এভাবে শব্দ পরম্পরা ক্রমে আমাদের কর্ণবিবরবর্তী আকাশে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তাই আমরা শুনি। শব্দের কর্ণবিবরবর্তী হওয়ার এই প্রক্রিয়া ন্যায়দর্শনে কদম্বমুকুল-ন্যায় নামে পরিচিত।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে শব্দ-এর লক্ষণ দিয়েছেন-
‘শ্রোত্রগ্রাহ্যো গুণঃ শব্দঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : শ্রোত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত হয় যে গুণ তাকে শব্দ বলা হয়।
.
শব্দ দুই প্রকার- ধ্বন্যাত্মক শব্দ এবং বর্ণাত্মক শব্দ।
বর্ণাত্মক শব্দ হচ্ছে- ‘বর্ণাত্মকঃ সংস্কৃত ভাষাদিরূপঃ’ (তর্কসংগ্রহ), অর্থাৎ ‘যে শব্দ ক, খ, গ ইত্যাদি বর্ণে বিভক্ত হয় এবং যা সংস্কৃতাদি ভাষাতে পাওয়া যায়, তাই বর্ণাত্মক শব্দ।’
আর ধ্বন্যাত্মক শব্দ হচ্ছে- ‘ধ্বন্যাত্মকো ভের্যাদৌ’ (তর্কসংগ্রহ), অর্থাৎ ‘যে শব্দ ক, খ, গ ইত্যাদি বর্ণে বিভক্ত হয় না তাকে ধ্বনি বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।’ ভেরী (drum) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র থেকে যে শব্দ নির্গত হয়, যাকে পৃথক পৃথক বর্ণে বিভক্ত করা যায় না, তাই ধ্বন্যাত্মক শব্দ।
.
উৎপত্তি ভেদেও শব্দের প্রকারভেদ রয়েছে। তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় অন্নংভট্ট বলেন- উৎপত্তির দিক থেকে শব্দ তিন প্রকার, যথা- সংযোগজন্য, বিভাগজন্য ও শব্দজন্য শব্দ। ভেরী ও দণ্ডের সংযোগ থেকে উৎপন্ন শব্দ সংযোগজন্য শব্দ। বাঁশকে চিরলে বাঁশের দুটি অংশের বিভাগ থেকে উৎপন্ন চট্চট্ শব্দ বিভাগজন্য শব্দ। আর ভেরী ও দণ্ডের সংযোগ হতে কিংবা বাঁশের অংশ-বিভাগ থেকে শব্দ উৎপন্ন হলে ভেরী প্রভৃতির দেশ বা স্থান হতে আরম্ভ করে শ্রোতার শ্রোত্র ইন্দ্রিয় পর্যন্ত দ্বিতীয়াদি শব্দ-পরম্পরায় যে শব্দসমূহ উৎপন্ন হয়, তা শব্দজন্য শব্দ।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে শব্দ আকাশের বিশেষ গুণ। কর্ণ ইন্দ্রিয় হচ্ছে কর্ণবিররবর্তী আকাশ। আকাশে শব্দ সমবেত, অর্থাৎ সমবায় সম্বন্ধে থাকে। কর্ণ ইন্দ্রিয় বলতে আকাশকে বোঝায় এবং শব্দ আকাশের বিশেষ গুণ বলে কর্ণ ইন্দ্রিয়ই শব্দ গ্রহণে সমর্থ হয়।
২.৩ : কর্ম পদার্থ (Action)
.
বৈশেষিক স্বীকৃত সপ্তপদার্থের মধ্যে তৃতীয় পদার্থ হলো কর্ম। তবে গুণ দ্রব্যের নিষ্ক্রিয় ও স্থিতিবোধক বিশেষণ, কিন্তু কর্ম দ্রব্যের সক্রিয় ও গতিবোধক বিশেষণ। মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে কর্ম-এর লক্ষণে বলেছেন-
‘সংযোগবিভাগেষ্বনপেক্ষকারণমিতি কর্মলক্ষণম্’। (বৈশেষিকসূত্র: ১/১/১৭)।
অর্থাৎ : সংযোগ, বিভাগ ও বেগের সাধারণ কারণস্বরূপ পদার্থই হলো কর্ম।
.
বৈশেষিকসূত্র অনুসারে, যা একমাত্র দ্রব্যে থাকে, যা গুণশূন্য এবং কোন ভাবপদার্থকে অপেক্ষা না করেই যা সংযোগ এবং বিভাগের কারণ হয় তাই কর্ম। গুণ কিন্তু সংযোগ এবং বিভাগের প্রতি নিরপেক্ষ কারণ হয় না। কর্মই এক বস্তুর সঙ্গে অপর বস্তুর সংযোগ এবং এক বস্তু থেকে অপর বস্তুর বিভাগ করে থাকে। যেমন, হাতের সঙ্গে বই-এর সংযোগস্থলে সংযোগটি হাতের ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন। গুণ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় বেগের কারণ হতে পারে না। কর্মই বেগের কারণ। তর্কসংগ্রহে তাই অন্নংভট্ট কর্মের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘চলনাত্মকং কর্ম’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কর্ম হলো চলন বা গতি স্বরূপ।
.
গুণের সঙ্গে কর্মের সাদৃশ্য হলো উভয়েই দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে আশ্রিত। কিন্তু দ্রব্যে আশ্রিত হলেও কর্মকে স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যেহেতু কর্ম স্বতন্ত্রভাবে জ্ঞানের বিষয় হয়। এজন্যেই বলা হয় ‘কর্মত্বই কর্মের লক্ষণ’। কর্ম দ্রব্যে আশ্রিত হলেও সকল দ্রব্যে কর্ম থাকে না, কেবলমাত্র ক্ষিতি, অপ্, তেজ প্রভৃতি মূর্ত ও সীমিত দ্রব্যেই কর্ম থাকে। আকাশ, দিক, কাল ও আত্মা অমূর্ত ও সর্বব্যাপী বলে ইত্যাদি অমূর্ত দ্রব্যে কর্ম থাকে না।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কর্ম পাঁচ প্রকার- (১) উৎক্ষেপণ, (২) অবক্ষেপণ, (৩) আকুঞ্চন, (৪) প্রসারণ ও (৫) গমন।
.
(১) উৎক্ষেপণ : পদার্থের উর্ধ্বমুখী গতিসঞ্চারক ক্রিয়া হলো উৎক্ষেপণ। উপরের দিকে যখন ঢিল ছোঁড়া হয়, ঢিলটি তখন উপরের দিকে উঠতে থাকে। এরূপ ক্রিয়াই হলো উৎক্ষেপণ। উৎক্ষেপণ কর্মের দ্বারা উর্ধ্বস্থিত কোন দ্রব্যের সঙ্গে অন্য একটি দ্রব্যের সংযোগ করা হয়। উৎক্ষেপণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘উর্ধ্বদেশসংযোগ হেতুঃ উৎক্ষেপণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : উৎক্ষেপণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা ঐ ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যের উর্ধ্বদেশের সঙ্গে সংযোগ হয়।
.
(২) অবক্ষেপণ : অবক্ষেপণ হলো বস্তুর নিম্নমুখী গতি সঞ্চারক ক্রিয়া। একটি ফল যখন ডাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে, তখন ঐ ফলের নিম্নমুখী ক্রিয়াকে বলে অবক্ষেপণ। অবক্ষেপণ কর্মের দ্বারা নিম্নস্থিত কোন দ্রব্যের সঙ্গে অন্য একটি দ্রব্যের সংযোগ হয়। অবক্ষেপণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘অধোদেশসংযোগ হেতুঃ অপক্ষেপণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অপক্ষেপণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা ঐ ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যের অধোদেশের সঙ্গে সংযোগ হয়।
.
(৩) আকুঞ্চন : আকুঞ্চন হলো সংকোচন ক্রিয়া। একটি বায়ুপূর্ণ বেলুন থেকে যখন বায়ু নির্গত হয়, তখন বেলুনটি সংকুচিত হয়। বিস্তৃত দ্রব্যের অংশগুলিকে সংকুচিত করাই হলো আকুঞ্চন। বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সংযোগের জন্য আকুঞ্চন ক্রিয়া প্রয়োজন। তর্কসংগ্রহে আকুঞ্চন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘শরীরস্য সন্নিকৃষ্ট সংযোগ হেতুঃ আকুঞ্চনম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আকুঞ্চন হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের সন্নিকৃষ্ট দেশের সঙ্গে শরীরের অবয়বের সংযোগ হয়।
.
(৪) প্রসারণ : আকুঞ্চনের বিপরীত কর্ম হলো প্রসারণ। প্রসারণ বস্তু থেকে বস্তুকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রিয়া। একটি বায়ুশূন্য বেলুনকে যখন বায়ুপূর্ণ করা হয় তখন বেলুনটি প্রসারিত হয়। বেলুনের এই প্রসারিত হওয়ারূপ ক্রিয়াকে বলে প্রসারণ। প্রসারণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘শরীর বিপ্রকৃষ্ট সংযোগ হেতুঃ প্রসারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : প্রসারণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের দূরবর্তী দেশের সঙ্গে শরীরের অবয়বের সংযোগ হয়।
.
(৫) গমন : উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন ও প্রসারণ এই চারটি কর্ম ছাড়া বাকি সব গতিবিশেষ কর্মই গমনের অন্তর্ভুক্ত। বৈশেষিকমতে গমন শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। গমন ক্রিয়ার দ্বারা ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যটি অনিয়ত দেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ভ্রমণ, রেচন, স্যন্দন, উর্ধ্বজ্বলন, বক্রগমন, উন্নমন, নমন প্রভৃতি গমনেরই প্রকারভেদমাত্র। ভ্রমণের দৃষ্টান্ত হলো কুম্ভকারের চক্রের ঘূর্ণন। রেচন হলো অন্তঃস্থিত তরল বস্তুর নিঃসরণ, যেমন পিচকারি থেকে জলের বহির্গমন। স্যন্দন হলো তরল দ্রব্যের প্রবহন। উর্ধ্বজ্বলন হলো উপরের দিকে শিখাবিস্তার, যেমন প্রদীপের শিখার উর্ধ্বগতি। বক্র বা তির্যগ্গমনের দৃষ্টান্ত হলো সাপের গতি।
গমনক্রিয়ার সঙ্গে উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন ও প্রসারণ ক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, এই চতুর্বিধ ক্রিয়া গতিবিশেষ নয়, গতির অনুকূল ব্যাপারবিশেষ, কিন্তু গমনক্রিয়া স্বয়ং গতিবিশেষ।
২.৪ : সামান্য বা সার্বিক (General বা Universal)
.
জগতের ব্যাখ্যার জন্য বৈশেষিক স্বীকৃত সপ্তপদার্থের মধ্যে অন্যতম পদার্থ হলো সামান্য। সামান্য শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো একাধিক বস্তুর সমান ধর্ম। বহু বস্তুর মধ্যে যে ধর্ম থাকে তাই সমান ধর্ম। যেমন মনুষ্যত্ব হলো সকল মানুষের সমান ধর্ম, অথবা গোত্ব হলো সকল গরুর সমান ধর্ম।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সামান্য ব্যক্তি থেকে ভিন্ন নিত্য বস্তুস্বরূপ। ব্যক্তি সামান্যের আশ্রয় বা অধিষ্ঠান হলেও সামান্য ব্যক্তির অতিরিক্ত নিত্য পদার্থ। এই পদার্থ একই জাতীয় একাধিক বস্তুর মধ্যে বর্তমান সাধারণ ধর্ম। সাধারণ ধর্মের জন্যই একাধিক বস্তু একই জাতীয় বলে প্রতিভাত হয় (সমানানং ভাবঃ)। তাই সামান্যকে অনুগত প্রতীতির হেতু বলা হয়। ‘অনুগত প্রতীতি’ অর্থ বহু পদার্থ বিষয়ে একই রকমের বুদ্ধি বা জ্ঞান। যেমন রাম, শ্যাম, যদুর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এদের প্রত্যেককে আমরা ‘মানুষ’ শব্দের দ্বারা বুঝিয়ে থাকি। একে বলা হয় অনুগত ব্যবহার। এই অনুগত ব্যবহার সম্ভব হয় অনুগত প্রতীতির জন্য। সুতরাং অনুগত প্রতীতিই সামান্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
.
বৈশেষিকরা মনে করেন, সামান্য বলে কোন পদার্থ স্বীকার করা না হলে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার ব্যাখ্যা করা যায় না। অনুগতব্যবহার একটি অনুগতপ্রতীতি-নির্ভর। অনুগতপ্রতীতি ব্যতীত অনুগতব্যবহার যথার্থ হতে পারে না। আবার অনুগত বিষয় ভিন্ন অনুগতপ্রতীতিও সম্ভব নয়। তাই অনুগতব্যবহারের হেতুরূপে অনুগতপ্রতীতি এবং অনুগতপ্রতীতির হেতুরূপে অনুগত বিষয়কে আমাদের স্বীকার করতে হয়। অনুগত বিষয়রূপে যে অনুগতধর্ম স্বীকৃত, সেই ধর্মই হলো সামান্য পদার্থ। মানুষের ক্ষেত্রে এই অনুগতধর্মের নাম ‘মনুষ্যত্ব’, গরুর ক্ষেত্রে ‘গোত্ব’ এবং অশ্বের ক্ষেত্রে ‘অশ্বত্ব’ ইত্যাদি।
.
মহর্ষি কণাদের বৈশেষিকসূত্রে ও প্রশস্তপাদভাষ্যে সামান্যের আলোচনা পরিদৃষ্ট হলেও সামান্যের যথার্থ লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। বরং পরবর্তী আচার্যরাই এর যথার্থ লক্ষণ নির্দেশ করেছেন। বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চানন তাঁর মুক্তাবলীতে সামান্যের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন-
‘নিত্যত্বে সতি অনেকসমবেতত্বম্’। (মুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে ধর্ম নিত্য এবং অনেকের মধ্যে সমবায় সম্বন্ধে বর্তমান, তাই সামান্য।
.
আবার অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সামান্যের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘নিত্যম্-একম-অনেকানুগতং সামান্যম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সামান্য হলো বস্তু বা ব্যক্তির অনুগত ধর্ম যা নিত্য, এক ও অনেকে অনুগত বা সমবেত।
.
এই লক্ষণ বিশ্লেষণ করলে সামান্যের তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়- নিত্যত্ব, একত্ব ও অনেকবৃত্তিত্ব বা অনেকসমবেতত্ব।
প্রথমত, সামান্য পদার্থটি নিত্য। অর্থাৎ সামান্যের উৎপত্তিও নেই, বিনাশও নেই। বিশেষ বিশেষ মানুষের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, কিন্তু মনুষ্যত্বের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। কোন একটি মানুষের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটির মনুষ্যত্বের উৎপত্তি হয় না। কারণ ঐ মানুষটির উৎপত্তির পূর্বে যে মানুষ উৎপন্ন হয়েছে, তাতেও মনুষ্যত্ব আছে। আবার ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন, যদি সকল মানুষ মারা যায় তাহলেও মনুষ্যত্ব বিনষ্ট হবে না। ব্যক্তির বিনাশে সামান্য কালাশ্রিত থাকে। বৈশেষিকেরা বলেন, সামান্যের উৎপত্তি স্বীকার করলে প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বা বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন সামান্য স্বীকার করতে হয়। এরূপ গৌরব কল্পনা অপেক্ষা বিভিন্ন ব্যক্তিতে একটি নিত্য সামান্য স্বীকার করাই শ্রেয়। এক ও নিত্য সামান্য একই শ্রেণীর সকল ব্যক্তিতে আশ্রিত থাকে। ব্যক্তির মাধ্যমেই আমরা সামান্যকে জানতে পারি। কোন একটি ব্যক্তির বিনাশে ঐ ব্যক্তিতে সামান্য আশ্রিত হতে না পারায় ঐ ব্যক্তিতে আমরা আর ঐ সামান্যকে প্রত্যক্ষ করতে পারি না, কিন্তু অন্য কোন অস্তিত্বশীল ব্যক্তিতে সহজেই ঐ সামান্যকে প্রত্যক্ষ করা যায়।
.
আবার ন্যায়-বৈশেষিক মতে পরমাণু, বিশেষ, আকাশ, সমবায় প্রভৃতি নিত্য হওয়ায় পরমাণু প্রভৃতিতে নিত্যত্ব থাকে। কিন্তু এগুলি এক-সমবেত, অনেক-সমবেত নয়। সামান্যের অন্যতম লক্ষণ হলো ‘অনেকসমবেতত্ব’। ফলে সামান্যের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি ঘটে না।
.
দ্বিতীয়ত, সামান্য অনেকানুগত। অর্থাৎ সামান্য একই সময়ে অনেক পদার্থে বিদ্যমান। যেমন একই মনুষ্যত্ব একই সময়ে সকল মানুষের মধ্যে আছে।
.
তৃতীয়ত, সামান্য অনেক পদার্থে এক বিশেষ সম্বন্ধে থাকে। সেটি হলো সমবায়-সম্বন্ধ। এই সমবায় সম্বন্ধ হলো এমন দুটি পদার্থের সম্বন্ধ, যারা তাদের উভয়ের বিদ্যমান অবস্থায় পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে পারে না। যেমন মনুষ্যত্ব সমবায় সম্বন্ধে বিভিন্ন মানুষে থাকে, ঘটত্ব সমবায় সম্বন্ধে সকল ঘটে থাকে।
.
কিন্তু যদি ‘অনেকসমবেতত্ব’ সামান্যের একমাত্র লক্ষণ হয়, তাহলে যদিও পরমাণু, আকাশ ইত্যাদি নিত্য দ্রব্যের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি হয় না, কিন্তু সংযোগ প্রভৃতি সম্পর্কে অতিব্যাপ্তি হয়। কারণ সংযোগ হলো একপ্রকার গুণ। গুণ কোন না কোন দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। আবার সংযোগ সর্বদাই কোন দুটি পদার্থের মধ্যে হয়। একাধিক পদার্থে সমবায় সম্বন্ধে থাকায় সংযোগও অনেকসমবেত। সুতরাং সংযোগে ‘অনেকসমবেতত্ব’ থাকলেও সংযোগ নিত্য সম্পর্ক নয়। সংযোগে নিত্যত্ব নেই। কিন্তু সামান্য নিত্যত্ব লক্ষণযুক্ত।
অতএব, যে পদার্থ নিজে নিত্য হয়ে অনেক অর্থাৎ একাধিক পদার্থে সমবায় সম্বন্ধে থাকে তাই সামান্য।
.
সামান্যের প্রকারভেদ :
ন্যায়-বৈশেষিক মতে ব্যাপকতা অনুসারে সামান্য পর ও অপর ভেদে দুইপ্রকার। প্রশস্তপাদভাষ্য তথা প্রাচীন শাস্ত্রসমূহে সামান্যের এই দুই বিভাগের উপরই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চানন ও ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের কোন কোন দার্শনিক পরাপর নামক তৃতীয় এক প্রকার সামান্য স্বীকার করেছেন।
.
যে সামান্য সমস্ত জাতির ব্যাপক, যে জাতিকে অন্য কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, তাকে পর-সামান্য বলা হয়। যেমন সত্তা। সত্তা সামান্যের ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। সত্তা সামান্য দ্রব্য, গুণ ও কর্মে থাকে। আর যে জাতি সর্বাপেক্ষা কম ব্যাপক বা কেবল ব্যাপ্য, যে জাতির অন্তর্ভুক্ত আর জাতি থাকে না, তাকে অপর-সামান্য বলা হয়। যেমন ঘটত্ব। অন্যদিকে যে সামান্য কোন এক সামান্যের তুলনায় ব্যাপ্য, আবার কোন এক সামান্যের তুলনায় ব্যাপক, তাকে পরাপর-সামান্য বলা হয়। অর্থাৎ পর ও অপর সামান্যের মধ্যবর্তী জাতির নাম পরাপর-সামান্য। যেমন- দ্রব্যত্ব। মোটকথা, যা ব্যাপক-সামান্য তা পর এবং যা ব্যাপ্য-সামান্য তা অপর। এখানে দ্রব্যত্ব জাতি সত্তা জাতির তুলনায় ব্যাপ্যা বা কম জায়গায় থাকে এবং ঘটত্ব জাতির তুলনায় ব্যাপক বা বেশি জায়গায় থাকে।
.
এখানে উল্লেখ্য, সামান্যের পরত্বাপরত্ব আপেক্ষিক। একটি সামান্য অপর একটি সামান্যের পরিপ্রেক্ষিতেই পর বা অপর হয়। ঘটত্ব ও পটত্ব উভয়ই সামান্য হলেও উভয়ের মধ্যে পরাপরভাব থাকে না, কারণ এই দুইয়ের মধ্যে সামানাধিকরণ্য নেই। কেননা ঘট বা পট কেউ কারো অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু দুটি সামান্য যখন সমানাধিকরণ হয়, তখনই তাদের পরাপরভাব থাকে। দ্রব্যত্ব ও ঘটত্বের সামানাধিকরণ্য আছে বলেই দ্রব্যত্বের তুলনায় ঘটত্ব অপর। যেমন ঘট একটি দ্রব্য, অর্থাৎ ঘটত্ব জাতি দ্রব্যত্ব জাতির অন্তর্ভুক্ত। ফলে এক্ষেত্রে দ্রব্যত্ব পর-সামান্য এবং তার সাপেক্ষে ঘটত্ব অপর-সামান্য।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সামান্যকে আবার জাতি ও উপাধি ভেদে দুই প্রকার বলা হয়েছে। যে অনুগত ধর্মে জাতির লক্ষণ প্রযোজ্য হয়, তাকে জাতি বলা হয়। আর যে অনুগত ধর্মে জাতির লক্ষণ সমন্বয় হয় না, তা হলো উপাধি। জাতি হলো সেই অনুগত ধর্ম যা নিত্য ও অনেকে সমবেত। উপাধি হলো বস্তু বা ব্যক্তির আগন্তুক ধর্ম। অনাগন্তুক বা স্বাভাবিক ধর্ম জাতি। গোত্ব বা মনুষ্যত্ব হলো জাতি, কিন্তু পাচকত্ব উপাধি। গো বা মানুষ ব্যক্তি গোত্ব বা মনুষ্যত্ব ত্যাগ করে কখনও থাকতে পারে না। কিন্তু দেবদত্ত (ব্যক্তি) পাচকত্ব ধর্মকে ত্যাগ করে থাকতে পারে। জাতি ও ব্যক্তির সম্বন্ধ স্বাভাবিক। কিন্তু দেবদত্ত প্রভৃতিতে পাচকত্ব ধর্ম স্বাভাবিক নয়। তাই পাচকত্ব ধর্ম জাতি নয়, উপাধি।
.
জাতিবাধক :
ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন, একটি সামান্য জাতি হতে পারে যদি জাতিবাধক না থাকে। অপরপক্ষে জাতিবাধক থাকলে সামান্যটি জাতি না হয়ে হয় উপাধি। জাতিবাধক কাকে বলে এ বিষয়ে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে কোন সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। তবে আচার্য উদয়ন তাঁর কিরণাবলী গ্রন্থে ছয় প্রকার জাতিবাধকের উল্লেখ করেছেন-
‘ব্যক্তেরভেদস্তুল্যত্বং সঙ্করোহথানবস্থিতিঃ।
রূপহানিরসম্বন্ধো জাতিবাধকসংগ্রহঃ।। (কিরণাবলী)।
অর্থাৎ : ব্যক্তির অভেদ, তুল্যত্ব, সঙ্কর, অনবস্থা, রূপহানি, অসম্বন্ধ- এই ছটি জাতির বাধক।
.
(১) ব্যক্তির অভেদ : ‘ব্যক্তির অভেদ’ কথার অর্থ হলো আশ্রয়ের ঐক্য বা একাশ্রয়ত্ব বা অভিন্ন ব্যক্তিমাত্রবৃত্তি। অর্থাৎ যদি কোন জাতি এমন হয় যে তার আশ্রয় ব্যক্তির সংখ্যা এক, তাহলে সেই ধর্ম জাতি হতে পারে না। যেমন- আকাশত্ব, কালত্ব ইত্যাদি জাতি নয়। কারণ আকাশত্বের আশ্রয় আকাশ বা কালত্বের আশ্রয় কাল এক, অনেক নয়। সামান্যের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয় যে সামান্য হলো অনেকসমবেত। সুতরাং যে ধর্মের আশ্রয় ব্যক্তি একাধিক নয়, তা জাতি হতে পারে না।
.
(২) তুল্যত্ব : ‘তুল্যত্ব’ শব্দের অর্থ হলো তুল্য আশ্রয়ত্ব বা অন্যূন-অনতিরিক্ত বৃত্তিত্ব। দুটি পদার্থ যদি পরস্পর পরস্পরের অন্যূন ও অনতিরিক্ত হয় তাহলে সেই পদার্থদ্বয়কে বলা হয় তুল্য পদার্থ। যখন দুটি ধর্মের আশ্রয়ব্যক্তি সমান অর্থাৎ ন্যূনও নয়, অতিরিক্তও নয়, তখন সেই দুটি ধর্মকে তুল্য ব্যক্তিবৃত্তি বা অন্যূন-অনতিরিক্ত আশ্রয়ক বলা হয়। আবার ঐ ধর্মদ্বয় পরস্পর পরস্পরের ব্যাপ্য-ব্যাপক হওয়ায় তাকে সমনিয়ত ধর্মও বলা হয়। ন্যায়-বৈশেষিক মতে নিয়ম হলো, দুটি জাতি তখনই ভিন্ন হবে যদি তাদের আশ্রয়ের বৈষম্য থাকে। সুতরাং দুটি অনুগত ধর্ম যদি এমন হয় যে একটি অপরটি থেকে অল্প বা অধিক দেশবৃত্তি নয়, দুটির আশ্রয়ই সমান, সেক্ষেত্রে দুটিকে দুটি পৃথক জাতিরূপে গণ্য করা যায় না। যেমন, ঘটত্ব ও কলসত্ব দুটি ভিন্ন জাতি নয়। ঘটত্ব অথবা কলসত্ব হলো জাতি। কারণ যে যে পদার্থ ঘটত্বের আশ্রয়, সেই সেই পদার্থ কলসত্বেরও আশ্রয়।
বস্তুত ঘটত্ব এবং কলসত্ব দুটি ভিন্ন ধর্মই নয়। ব্যক্তির আকৃতি হলো জাতির ব্যঞ্জক। ঘটের আকৃতি এবং কলসের আকৃতি যেহেতু এক, সেহেতু ব্যঞ্জক জাতিও এক। ঘট এবং কলস দুটি পর্যায় শব্দমাত্র।
.
(৩) সঙ্কর : যদি দুটি অনুগত ধর্ম পরস্পরের অভাবের অধিকরণে থাকে এবং এক অধিকরণেও থাকে, তাহলে সেখানে সঙ্কর হয়। যে দুটি ধর্মের মধ্যে সঙ্কর হয়, সেই দুটি ধর্মের একটিও জাতি হয় না। যেমন- ভূতত্ব এবং মূর্তত্ব ধর্মের একটিও জাতি নয়। ভূতত্ব হলো পঞ্চভূতের অনুগত ধর্ম। মূর্তত্ব হলো সকল মূর্ত দ্রব্যের অর্থাৎ সীমিত পরিমাণবিশিষ্ট দ্রব্যের অনুগত ধর্ম।
এখন আকাশ ভৌতিক দ্রব্য, কিন্তু মূর্ত দ্রব্য নয়। সুতরাং আকাশে ভূতত্ব আছে, কিন্তু মূর্তত্বের অভাব আছে। আবার মন যেহেতু ভৌতিক দ্রব্য নয়, কিন্তু মূর্ত দ্রব্য, সেহেতু মনে ভূতত্বের অভাব আছে, কিন্তু মূর্তত্ব আছে। আবার এমন অধিকরণ আছে যেখানে ভূতত্ব ও মূর্তত্ব দুই-ই আছে। যথা- ঘট। কারণ ঘট পঞ্চভূতের অন্তর্ভুক্ত ক্ষিতি বা পৃথিবী নামক দ্রব্য। সুতরাং তাতে ভূতত্ব আছে। আবার ঘট যেহেতু সীমিত পরিমাণ বিশিষ্ট দ্রব্য, সেহেতু তাতে মূর্তত্ব আছে। যেহেতু ভূতত্ব এবং মূর্তত্ব পরস্পরের অভাবের সমানাধিকরণ হয়ে আবার একই অধিকরণে থাকে, সেহেতু ভূতত্ব বা মূর্তত্ব কোনটিকেই জাতি বলা যায় না।
.
(৪) অনবস্থা : অবিশ্রান্ত অপ্রামাণিক পদার্থ কল্পনাকে বলা হয় অনবস্থা। যে সব কল্পনার বিশ্রান্তি নেই, সে সব কল্পনা অনবস্থা দোষে দুষ্ট। জাতিতে অপর একটি জাতি স্বীকার করলে সেই জাতিতে আবার অপর একটি জাতি স্বীকার করতে হয়। এভাবে অনবস্থা দোষ হয়। জাতি কখনোই অপর জাতির ব্যক্তি হতে পারে না। ব্যক্তি হলো জাতির ব্যঞ্জক তথা অধিকরণ। এজন্য ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় জাতির জাতি স্বীকার করেন না। বৈশেষিকমতে দ্রব্য, গুণ ও কর্মই জাতির আশ্রয়। জাতিকে জাতির আশ্রয় বলা যায় না।
.
(৫) রূপহানি : ‘রূপ’ বলতে এখানে স্বরূপকে বোঝানো হয়েছে। যাকে জাতিরূপে স্বীকার করলে তার স্বরূপের হানি হয়, তাকে জাতি স্বীকার করা যায় না। বৈশেষিক মতে বিশেষত্ব বিশেষের অনুগত ধর্ম হলেও জাতি নয়। বিশেষ স্বরূপতই জাতি ও জাতিমান থেকে ভিন্ন, নিঃসামান্য ও স্বতোব্যাবর্তক। বিশেষ পদার্থকে জাতি স্বীকার করলে বিশেষ পদার্থের স্বরূপের হানি হয়। এজন্য বিশেষত্ব জাতি নয়।
.
(৬) অসম্বন্ধ : ‘অসম্বন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো সম্বন্ধের অভাব। জাতি ও ব্যক্তির সম্বন্ধ হলো সমবায় সম্বন্ধ। কোন অনুগত ধর্ম যদি এমন হয় যে, সে তার আশ্রয়ে সমবায় সম্বন্ধে থাকে না, তাহলে সেই ধর্ম জাতি হতে পারে না। যেমন- অভাবত্ব বিভিন্ন অভাবের সমান ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও অভাবত্ব জাতি নয়। কারণ অভাবত্ব অভাবে সমবায় সম্বন্ধে থাকে না, থাকে স্বরূপ সম্বন্ধে। অনুরূপভাবে সমবায়ত্ব জাতি নয়। কারণ সমবায়ত্ব সমবায়ে স্বরূপ সম্বন্ধে থাকে, সমবায় সম্বন্ধে থাকে না। সমবায় সম্বন্ধের অভাবে তাই সমবায়ত্ব ও অভাবত্ব জাতি হয় না।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, এই ছটি জাতিবাধকের কোন একটি না থাকলে নিত্য ও অনেকসমবেত ধর্মকে জাতি বলা হয়। জাতি দ্রব্য, গুণ, কর্ম- এই তিনটি পদার্থে থাকে। সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাবে জাতি থাকে না।
.
সামান্য প্রসঙ্গে অন্যান্য দার্শনিকমত :
সামান্য বা সাধারণ ধর্মসম্বন্ধীয় সমস্যা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক সমস্যা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দার্শনিক এই সমস্যার উপর আলোকপাত করেছেন। ভারতীয় দর্শনেও এই সমস্যার গুরুত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধ, জৈন, বেদান্ত, ন্যায়-বৈশেষিক প্রভৃতি সম্প্রদায় নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামান্য সম্পর্কীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভারতীয় দর্শনে সামান্য সম্পর্কীয় তিনটি প্রধান মতবাদ হলো- বৌদ্ধ সমর্থিত অপোহবাদ বা নামবাদ, জৈন সমর্থিত প্রত্যয়বাদ এবং ন্যায়-বৈশেষিক সমর্থিত বস্তুবাদ। বেদান্ত সম্প্রদায় এই বিষয়ে মূলত জৈন সম্প্রদায়ের অনুগামী এবং মীমাংসা সম্প্রদায় মূলত ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের অনুগামী।
.
বৌদ্ধমত :
বৌদ্ধমতে জগতের প্রবহমান স্বলক্ষণই একমাত্র সত্য। সামান্য বা জাতি বলে কোন পদার্থ নেই। জাতি বা সামান্য মানব-মনের বস্তুশূন্য কল্পনামাত্র। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি (কল্পনা) কতকগুলি জিনিসকে একটি নামের দ্বারা নির্দেশ করে। এই নাম বা নামের দ্বারা লক্ষিত বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এগুলি অস্তিত্বশীল স্বলক্ষণের উপর মানবমনের আরোপিত কল্পনা। সুতরাং জাতি বা সামান্যের অস্তিত্ব নামের জগতেই সীমাবদ্ধ। কল্পিত নাম ভিন্ন এদের পৃথক কোন সত্তা নেই। যেমন কতকগুলি জন্তুকে আমরা গরু বলি। গরু নামে আখ্যায়িত করার অর্থ এই নয় যে, এদের কোন একটি বা একাধিক সাধারণ প্রকৃতি আছে, যার জন্য গরু নামটি দেয়া হয়েছে। গরু অন্য জন্তু যেমন ঘোড়া, হাতি, বাঘ, কুকুর ইত্যাদি হতে পৃথক একটি জন্তু।
.
বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, অনুগত প্রতীতি ব্যাখ্যার জন্য জাতি স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। ‘অনুগত প্রতীতি’ অর্থ বহু পদার্থ বিষয়ে একই রকমের বুদ্ধি বা জ্ঞান। বিভিন্ন গরুতে গোত্ব (জাতি) নামক পদার্থের জ্ঞান হয় বলে যে আমাদের ‘এটি গরু, এটি গরু’ বলে অনুগত প্রতীতি হয়, তা নয়। প্রতিটি গরুতে গরু ভিন্ন ঘোড়া, হাতি ইত্যাদির ব্যাবৃত্তি বা ভেদের জ্ঞান অর্থৎ ‘এটি গরু ভিন্ন অন্যকিছু নয়, এটি গরু ভিন্ন অন্যকিছু নয়’ এরকম জ্ঞান হয় বলে আমাদের ‘এটি গরু, এটি গরু’ বলে অনুগত প্রতীতি হয়। জাতি সম্বন্ধে বৌদ্ধদের এই মতবাদকে বলা হয় অপোহবাদ। ‘অপোহ’ অর্থ তদ্ভিন্নের পরিত্যাগ বা বর্জন। বৌদ্ধমতে ক্ষণভঙ্গবাদ অনুসারে ‘শব্দ’ বা বস্তুর নাম সরাসরি ক্ষণিক স্বলক্ষণকে নির্দেশ করতে পারে না। যে মুহূর্তে নাম বস্তুকে নির্দেশ করে, বস্তু ক্ষণিক হওয়ায় সে মুহূর্তে তা অস্তিত্বহীন। তাই অন্য বস্তুর নিষেধের দ্বারাই শব্দ অর্থকে বোঝাতে পারে। শব্দের এই পরোক্ষ অভিধেয়ত্বই বৌদ্ধ পরিভাষায় ‘অপোহ’ নামে পরিচিত। অপোহবাদ অনুসারে, ‘গরু’ শব্দের যদি কোন অর্থ থাকে তাহলে তা হবে ‘অ-গরু-ব্যাবৃত্তি’ বা ‘অ-গোব্যাবৃত্তি’, অর্থাৎ ‘গরু ভিন্ন অন্যকিছু নয়’।
.
বৌদ্ধ দার্শনিকেরা আরো বলেন যে, ন্যায়-বৈশেষিকমত অনুযায়ী অনুগত পদার্থ স্বীকার করলে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
প্রথমত, প্রশ্ন হলো গরুতে অনুগত যে গোত্ব (জাতি), তা সর্বাংশে বিভিন্ন গো-ব্যক্তিতে থাকে, না অংশত থাকে ? যদি গোত্ব সর্বাংশে থাকে, তাহলে গোত্ব যখন কালী নামের গরুটির মধ্যে আছে, তখন ঐ গরুটিতেই তা নিঃশেষিত হয়ে থাকবে, বুধী বা অন্য কোন গরুতে তা থাকতেই পারে না। অপরপক্ষে যদি জাতি অংশত ব্যক্তিতে থাকে, তাহলে জাতি পদার্থের অংশ আছে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু সামান্যের অংশ স্বীকার করলে সামান্য আর নিত্য হতে পারে না। অথচ ন্যায়-বৈশেষিকগণ সামান্যকে নিত্য বলে স্বীকার করেছেন।
.
দ্বিতীয়ত, ন্যায়-বৈশেষিক মতে জাতির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধও ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ জাতি যেহেতু নিত্য পদার্থ, সেহেতু যখন কোন ব্যক্তি উৎপন্ন হয়, সেই ব্যক্তির জাতি তার সঙ্গে উৎপন্ন হতে পারে না। জাতি, অপর কোন ব্যক্তি থেকে উঠে গিয়ে সদ্য-উৎপন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্তও হতে পারে না। কারণ জাতি দ্রব্য নয়, তার গমনক্রিয়া থাকতে পারে না।
.
তৃতীয়ত, প্রশ্ন হলো জাতি কোন্ অর্থে সর্বগত ? অর্থাৎ জাতি কি সর্বত্র বিদ্যমান ? অথবা স্বশ্রেণীর সর্ব ব্যক্তিতে বিদ্যমান ? প্রথমপক্ষ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তাহলে অশ্বেও গোত্ব আছে বলতে হবে। তাহলে অশ্বে গোবুদ্ধি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের অশ্বে অশ্ববুদ্ধিই হয়, গোবুদ্ধি হয় না। অপরপক্ষে যদি বলা হয় যে, গোত্ব কেবল তার স্বশ্রেণীর যে ব্যক্তি অর্থাৎ গো-ব্যক্তিতেই থাকে, তাহলে একটি সদ্যোজাত গো-ব্যক্তির সঙ্গে গোত্বের সম্বন্ধ হতে পারে না। কারণ গোত্বের যেহেতু কোন ক্রিয়া থাকতে পারে না, সেহেতু অন্য গরু থেকে গোত্ব এসে ঐ গো-ব্যক্তিতে সম্বন্ধযুক্ত হতে পারে না।
.
চতুর্থত, সমস্ত ব্যক্তি বিনাশ হলেও জাতি বিনষ্ট হয় না- ন্যায়-বৈশেষিকদের এই বক্তব্য যুক্তিবিরুদ্ধ। ব্যক্তিই জাতির আশ্রয়। সুতরাং, নিরাশ্রয় হয়ে জাতি থাকতে পারে না।
.
বৌদ্ধ পক্ষের যুক্তি খণ্ডনে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, অপোহবাদ যুক্তিযুক্ত নয়।
প্রথমত, জাতি ব্যক্তিতে সর্বাংশে থাকে না অংশত থাকে- এই প্রশ্নই অবান্তর। জাতির স্বভাবই এই যে, জাতি প্রত্যেক ব্যক্তিতে একই সময়ে স্বরূপত উপস্থিত থাকে। এই কারণে জাতি ব্যক্তি নয়। জাতির কোন অংশও নেই যেহেতু জাতি নিত্য।
.
দ্বিতীয়ত, জাতির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করাও কোন সমস্যা নয়। কারণ জাতি সর্বত্র বিদ্যমান হলেও, ব্যক্তিই জাতির ব্যঞ্জক তথা অধিকরণ বা আশ্রয়। স্বশ্রেণীর ব্যক্তিতে জাতি সমবায় সম্বন্ধে থাকে এবং ব্যক্তির মাধ্যমেই জাতি প্রকাশিত এবং অনুভূত হয়। অন্যান্য ব্যক্তিতে জাতি থাকলেও, সমবায় সম্বন্ধে থাকে না, স্বরূপত থাকে। এই কারণে গো-ব্যক্তিতেই গো-বুদ্ধি হয়, অশ্ব-ব্যক্তিতে গো-বুদ্ধি হয় না।
.
তৃতীয়ত, জাতির নিরাশ্রয়তার আপত্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যদিও স্বশ্রেণীর কোন ব্যক্তি ছাড়া জাতির ব্যঞ্জনা সম্ভব হয় না, কিন্তু এর দ্বারা তার সত্তার কোন হানি হয় না। অপ্রকট অবস্থায় জাতি কালকে আশ্রয় করে থাকে যেহেতু কালই জগতের আধার।
.
সর্বোপরি, বৌদ্ধরা যেভাবে অনুগত প্রতীতির ব্যাখ্যা করেছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। গোত্ব পদার্থের অস্তিত্ব ছাড়া বিভিন্ন গরুতে আমাদের যে অনুগত প্রতীতি হয় তা ব্যাখ্যা করা যায় না। বৌদ্ধরা অনুগত প্রতীতির কারণরূপে যে অ-গোব্যাবৃত্তির কথা বলেছেন, সেই অ-গোব্যাবৃত্তির জ্ঞান আমাদের আদৌ হতে পারে না। কারণ গোত্ব-সামান্যের জ্ঞানের দ্বারা যাবৎ গো-ব্যক্তির জ্ঞান হলে তবে অ-গোব্যাবৃত্তির জ্ঞান আমাদের হওয়া সম্ভব। গোত্বের জ্ঞান ছাড়া সকল গরুর জ্ঞান যেহেতু আমাদের হতেই পারে না, সেহেতু মূলত সামান্য পদার্থকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
.
জৈনমত :
জৈনমতে সামান্য হলো এক জাতীয় দ্রব্যে উপস্থিত কতকগুলি সমান গুণের সমষ্টি। যেমন, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে একে অন্যের থেকে পৃথক হলেও তাদের মধ্যে এমন কতকগুলি সমান গুণ থাকে যাদের জন্য তাদের একই জাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানুষ জাতির মনুষ্যত্বরূপ সামান্য বলতে সকল মানুষের মধ্যে উপস্থিত সমান গুণের (জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি) সমষ্টিকে বোঝায়।
.
মূলত জৈনমতে সামান্য ব্যক্তি-নির্ভর। কতকগুলি বস্তু বা ব্যক্তিকে অপর কতকগুলি বস্তু বা ব্যক্তি থেকে পৃথক করার জন্য আমরা এক শ্রেণীর বিশেষ বিশেষ বস্তুর সাধারণ গুণগুলিকে মানসিক বিশ্লেষণের সাহায্যে একত্রিত করে একটি সামান্য ধারণা গঠন করি। এই সামান্য ধারণাই সামান্য বা জাতিরূপে ব্যবহৃত হয়। তবে সামান্য ধারণার অনুরূপ কোন সামান্য বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। জগতে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা ধর্মই অস্তিত্বশীল, সামান্যধর্ম অস্তিত্বশীল নয়। ব্যক্তিই সামান্যের ভিত্তি এবং ব্যক্তির সঙ্গে সামান্যের সম্বন্ধ হলো তাদাত্ম্য সম্বন্ধ। এই সামান্য সম্পর্কীয় এই জৈন মতবাদই প্রত্যয়বাদ নামে পরিচিত।
.
এই মতের বিরুদ্ধে বৈশেষিক আচার্যগণের বক্তব্য এই যে, জ্ঞান মাত্রই বিষয়-নির্ভর। অনেক গো-ব্যক্তিতে যে অনুগতাকার জ্ঞান, তার বিষয় নিছক বিশেষ গো-ব্যক্তি হতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন গো-ব্যক্তি একটি অনুগত প্রতীতির বিষয় হতে পারে না, কারণ তারা পরস্পর ব্যাবৃত্তি (পৃথক বা ভেদজ্ঞান) প্রতীতিরই বিষয় হয়। দুটি ভিন্ন গো-ব্যক্তি থেকে দুটি ভিন্ন গরুর জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সুতরাং অনেক ব্যক্তির অনুগতাকার জ্ঞানের জন্য একটি অনুগতধর্ম অবশ্যই স্বীকার করতে হয়। এই অনুগত ধর্মই সামান্য। গোত্ব, অশ্বত্ব প্রভৃতি সাধারণ ধর্ম গরু, অশ্বাদি ব্যক্তির অতিরিক্ত এবং তা গরু, অশ্বাদির প্রতীতি থেকে ভিন্ন প্রতীতির বিষয়। এই কারণেই গো-ব্যক্তির অতিরিক্ত গোত্বাদি ধর্ম স্বতন্ত্র সামান্য পদার্থ রূপে স্বীকৃত হয়েছে। গোত্ব যদি গরুর অতিরিক্ত কিছু না হয়, তাহলে গরুর উৎপত্তি ও বিনাশে গোত্বেরও উৎপত্তি ও বিনাশ হতো। কিন্তু তা হয় না। অতএব সামান্য পদার্থের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
বিশেষ (Individuality)
.
বৈশেষিক স্বীকৃত সপ্তপদার্থের মধ্যে অন্যতম পদার্থ হলো বিশেষ। কারো কারো মতে বিশেষ পদার্থ স্বীকার করার জন্যই এই সম্প্রদায় বৈশেষিক সম্প্রদায় নামে পরিচিত। বৈশেষিক সম্মত সপ্তপদার্থের অনেক পদার্থই অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায়ে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষ পদার্থ কেবল বৈশেষিক দর্শনেই আলোচিত হয়েছে। সাধারণ অর্থে যা কোন পদার্থকে বিশিষ্ট করে তাকেই বিশেষ বলা হয়। কিন্তু বৈশেষিক দর্শনে ‘বিশেষ’ পদটি পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্য অনুযায়ী-
‘বিশেষয়তি ইতরেভ্যঃ ব্যাবর্তয়তি ইতি বিশেষঃ’। (ন্যায়ভাষ্য: ২/১/৩২)।
অর্থাৎ : যা কোন পদার্থকে বিশিষ্ট করে অর্থাৎ অন্যের থেকে ভিন্ন করে, তাই বিশেষ।
.
অর্থাৎ কোন পদার্থের ভেদক ধর্মই তার বিশেষ। বিশেষ হলো এক বিশেষ প্রকারের ব্যাবর্তক বা ভেদক। সাধারণভাবে নাম, জাতি, গুণ, ক্রিয়া, অবয়ব প্রভৃতি পদার্থের ব্যাবর্তক বা ভেদকরূপে গৃহিত হয়। নামের দ্বারা, জাতির দ্বারা, গুণের দ্বারা, ক্রিয়ার দ্বারা এবং অবয়বের দ্বারা একটি পদার্থকে অন্যান্য পদার্থ থেকে ব্যাবৃত্ত বা পৃথক করা হয়। কিন্তু এই ব্যাবর্তকগুলি চরম ব্যাবর্তক নয়। যেমন ঘটে আছে যে ঘটত্ব ধর্ম, সেই ঘটত্বই ঘটটির বিশেষ। কারণ ঘটত্ব ধর্মই ঘটটিকে পট ইত্যাদি থেকে ব্যাবৃত্ত বা পৃথক করে। ঘটের ঘটত্বজাতি ঘটকে পটাদি থেকে ব্যাবৃত্ত করলেও একটি ঘটকে অপর একটি ঘট থেকে ব্যাবৃত বা পৃথক করে না। গুণ বা ক্রিয়ার দ্বারা একটি ঘটকে অপর একটি ঘট থেকে ব্যাবৃত্ত করা যেতে পারে। যেমন, একটি লালবর্ণের ঘট একটি শ্যামবর্ণের ঘট থেকে ভিন্ন। এখানে লাল ঘটের লালবর্ণ ঘটটির বিশেষ। আবার যদি দুটি ঘটই লাল হয় ? যদিও বৈশেষিক মতে গুণ ব্যক্তিগত অর্থাৎ ব্যক্তিভেদে গুণ ভিন্ন, তবু দুটি লাল ঘটের ভেদ নির্ণয় তাদের গুণের দ্বারা সম্ভব হয় না। কারণ ঐ দুটি ঘটের ভিন্ন দুটি লালবর্ণ স্বজাতীয় এবং লালবর্ণের অনুগত প্রতীতির জনক। ব্যক্তির ভেদের দ্বারাই তাদের ভেদ সিদ্ধ হয়। ফলে দুটি লাল ঘটের ক্রিয়া যদি ভিন্ন হয় তাহলে তাদের ক্রিয়ার দ্বারা তাদের ভেদ সাধন করা যায়। কিন্তু তাদের ক্রিয়াও যদি একই হয়, তাহলে তাদের অবয়বের ভিন্নতা দ্বারা উভয়ের মধ্যে ভেদ সাধন করতে হয়। এইভাবে দেখা যায় যে, জাত্যাদি ব্যাবর্তক অন্য ব্যাবর্তকের অপেক্ষা করে অর্থাৎ এদের কোনটিই চরম ব্যাবর্তক নয়। এইসব ব্যাবর্তক থেকে বিশেষকে পৃথক করার জন্য বিশেষকে অন্ত্যব্যাবর্তক বলা হয়। অর্থাৎ বিশেষ কোন সাধারণ ভেদক ধর্ম নয়। বিশেষ হলো সেই চরম ব্যাবর্তক, যার পর আর কোন ব্যাবর্তক নেই।
.
প্রকৃতির দিক থেকে বিশেষ পদার্থ সামান্য পদার্থের ঠিক বিপরীত। সামান্য পদার্থ অনুগত প্রতীতির হেতু। বিপরীতভাবে, বিশেষ পদার্থ ব্যাবৃত্তি-প্রতীতির হেতু। বিশেষের জন্যই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরমাণুসকল এবং অন্যান্য নিত্য দ্রব্যের পারস্পরিক ব্যাবৃত্তি-বুদ্ধি (ভেদজ্ঞান) সম্ভব হয়।
ভাষ্যকার প্রশস্তপাদাচার্য উদ্দেশ প্রকরণে বিশেষ পদার্থের নিরূপণে মহর্ষি কণাদের উদ্ধৃতি করেছেন-
‘নিত্যদ্রব্যবৃত্তয়ো হি অন্ত্যা বিশেষাঃ’।
অর্থাৎ : অন্ত্যনিত্যদ্রব্যবৃত্তি পদার্থকে বিশেষ বলে। অর্থাৎ, যে পদার্থ কেবল নিত্যদ্রব্যেই সমবায় সম্বন্ধে বর্তমান থেকে তাদের পারস্পরিক সর্বশেষ ব্যাবৃত্তি-বুদ্ধি (চরম ভেদজ্ঞান) উৎপন্ন করে, তাই বিশেষ।
.
এখানে ‘নিত্যদ্রব্যবৃত্তয়ো’ পদটি বিশেষ স্থাননির্দেশক। ‘অন্ত্য’ পদটি বিশেষের লক্ষণের সূচক। অন্তে অর্থাৎ ব্যাবর্তকের অবসানে থাকে বলে বিশেষের নাম অন্ত্য। অন্ত্য-বিশেষ অর্থ চরম বিশেষ বা চরম ব্যাবর্তক ধর্ম। চরম ব্যাবর্তক ধর্ম বলতে আমরা তাকেই বুঝি যা অন্য ব্যবর্তক ধর্মকে অপেক্ষা করে অন্য পদার্থ থেকে ব্যবর্তিত হয় না।
.
যদিও বস্তুর ভেদক ধর্মকে বিশেষ বলে। তবু জাতি, গুণ প্রভৃতি সকলেই ভেদবুদ্ধির জনক হলেও জাতি, গুণ প্রভৃতি ‘জাতিবিশেষ’, ‘গুণবিশেষ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে এবং কেবলমাত্র বিশেষকে অন্ত্যবিশেষ বলা হয়েছে। ফলে যৌগিক দ্রব্যের ব্যাবৃত্তি পার্থক্য ব্যাখ্যা করার জন্য কোন অন্ত্যবিশেষ বা বিশেষের প্রয়োজন হয় না। কেননা যৌগিক দ্রব্য তাদের অংশের পার্থক্যের জন্য পরস্পর ভিন্ন বলে স্বীকৃত হয়। কেবল অংশহীন নিত্য দ্রব্যগুলির পৃথকত্ব ব্যাখ্যা করবার জন্যেই বিশেষের প্রয়োজন।
.
কণাদের মতে তাই বিশেষ নামক পদার্থটি নিত্য দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে বর্তমান থেকে একটি নিত্য দ্রব্য থেকে অন্য নিত্য দ্রব্যের পৃথকত্ব নির্দেশ করে। তাই প্রতিটি নিত্য দ্রব্যে একটি করে বিশেষ থাকে এবং বিশেষ নিজেও নিত্য পদার্থ। ফলে বিশেষ সংখ্যায় বহু। প্রত্যেকটি বিশেষ কেবল একটি নিত্য দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। বৈশেষিকেরা বলেন, বিশেষ পদার্থ যে কেবল প্রত্যেক পরমাণুতে আছে তা নয়। প্রত্যেক নিত্য দ্রব্যেই একটি করে বিশেষ আছে। বদ্ধ আত্মা তার নিজস্ব সুখ, দুঃখের দ্বারা অন্য আত্মা থেকে বিশিষ্ট হতে পারে। সুতরাং এই সুখ, দুঃখই বদ্ধ আত্মার ভেদক ধর্ম। কিন্তু সকল মুক্ত আত্মা সমান গুণবিশিষ্ট এবং একই আত্মত্ব জাতিবিশিষ্ট বলে প্রত্যেক আত্মায় একটি করে বিশেষ স্বীকার করতে হবে।
.
আবার মন নামক দ্রব্যও অসংখ্য এবং সমান ধর্মবিশিষ্ট। তাদের পরস্পরের ভেদও যোগীদের প্রত্যক্ষের বিষয় হয় বলে স্বীকার করা হয়। এজন্য প্রত্যেক মনে একটি করে বিশেষ স্বীকার করা হয়েছে।
.
তাছাড়া দিক্, কাল ও আকাশেও একটি করে বিশেষের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু দিক্, কাল ও আকাশ নামক নিত্য দ্রব্য সংখ্যায় বহু নয়। দিক্, কাল কোন জাতিবিশিষ্টও নয়। এই দুই দ্রব্যেরই কেবলমাত্র সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ- এই সামান্য গুণগুলি আছে, কোন বিশেষ গুণ নেই। তাহলে কোন্ ধর্ম দিককে কাল থেকে বিশিষ্ট করবে ?
এ কারণে ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকরা দিক্ ও কালেও একটি করে ভেদক ধর্ম স্বীকার করেছেন। দিক্ দ্রব্যে সমবেত, বিশেষ তার ভেদক ধর্ম। কাল দ্রব্যে সমবেত, বিশেষ তার ভেদক ধর্ম। আকাশেও বিশেষ নামক একটি ধর্ম স্বীকার করা হয়েছে এবং আকাশে যে শব্দের সমবায়িকারণতা আছে, এই বিশেষকেই তার অবচ্ছেদক ধর্ম বলা হয়েছে।
.
মূলত পরবর্তীকালের ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকেরা মহর্ষি কণাদের নির্দেশিত লক্ষণকে অনুসরণ করেই বিশেষের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বিশেষের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘নিত্যদ্রব্যবৃত্তয়োঃ ব্যবর্তকাঃ বিশেষাঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা নিত্যদ্রব্যসমূহে থাকে এবং তাদেরকে পরস্পর থেকে ব্যাবৃত্ত বা পৃথক করে, তাই বিশেষ।
.
বিশেষ পদার্থ স্বীকার না করলে একই রকম দুটি নিত্যদ্রব্যকে পৃথক করা যাবে না। ন্যায়-বৈশেষিক মতে নিত্যদ্রব্যগুলি হলো- পৃথিবী, জল, বায়ু ও তেজের পরমাণু এবং আকাশ, দিক, কাল, আত্মা ও মন। জাতি, গুণ, ক্রিয়া, অবয়ব প্রভৃতির দ্বারা দুটি অনিত্য দ্রব্যের পারস্পরিক ভেদ সিদ্ধ হয়ে থাকে। যৌগিক দ্রব্য তাদের অংশের পার্থক্যের জন্য পরস্পর ভিন্ন বলে স্বীকৃত হয়। তাদের পার্থক্য ব্যাখ্যা করার জন্য কোন বিশেষের প্রয়োজন হয় না। কেবল অংশহীন নিত্যদ্রব্যগুলির পৃথকত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য বিশেষের প্রয়োজন। একটি পার্থিব পরমাণু ও একটি জলীয় পরমাণুর ভেদ তাদের গুণের ভেদের দ্বারা সম্ভব হয়। কিন্তু একটি পার্থিব পরমাণু ও অপর একটি পার্থিব পরমাণুর ভেদ কিংবা একটি জলীয় পরমাণু ও অপর একটি জলীয় পরমাণুর ভেদ তাদের অবয়ব বা গুণের দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে না। কেননা পরমাণুগুলি নিরবয়ব এবং দুটি পার্থিব বা দুটি জলীয় পরমাণুর গুণও এক। প্রলয়কালে পরমাণুসমূহের জাতি, গুণ, ক্রিয়া প্রভৃতি সমান বলে ঐগুলির দ্বারা পরমাণুসমূহের ভেদ সিদ্ধ হতে পারে না। তাই দুটি পার্থিব বা দুটি জলীয় পরমাণুকে পরস্পর থেকে পৃথক করার জন্য বিশেষ পদার্থ অবশ্যস্বীকার্য।
.
আবার বিশেষ দুটি নিত্যদ্রব্যকে ব্যাবৃত্ত বা পৃথক করে এবং অন্য বিশেষ থেকে নিজেকেও ব্যাবৃত্ত করে। এজন্য বৈশেষিকেরা বিশেষকে স্বতোব্যাবর্তক বলেছেন। অন্ত্যব্যাবর্তক হিসেবে বিশেষ সবার শেষে থাকায় বিশেষের কোন ব্যাবর্তক স্বীকৃত হয় না। বিশেষ অন্যান্য নিত্য দ্রব্যকে পরস্পর হতে পৃথক করে কিন্তু নিজেদের পরস্পর হতে পৃথক করবার জন্য বিশেষের কোন কিছু প্রয়োজন হয় না। বিশেষ কেবল ব্যাবৃত্তিবুদ্ধির বা ভেদের হেতু। এই বিশেষ প্রতিটি নিতদ্রব্যে থাকে। একটি বিশেষ একটি নিত্যদ্রব্যেই থাকে। অসংখ্য নিত্য দ্রব্যে যে অসংখ্য বিশেষ পদার্থ ব্যাবৃত্তি বা ভেদক ধর্মরূপে বিদ্যমান, তারাও আবার পরস্পর থেকে ভিন্ন। কিন্তু দুটি বিশেষের পারস্পরিক ভেদ উপপন্ন করার জন্য বিশেষের আর বিশেষ স্বীকার করা হয় না। কারণ এক্ষেত্রে এই ভেদ উপপত্তির জন্য বিশেষ স্বীকার করলে অনবস্থা দোষ হতো। অর্থাৎ বিশেষগুলি যদি তাদের স্বগত ভেদের জন্য অন্য বিশেষের অপেক্ষা করতো, তাহলে সেই বিশেষগুলিও আবার তাদের স্বগত ভেদের জন্য অন্য বিশেষের অপেক্ষা করতো। এইভাবে অনবস্থা দোষ দেখা দিতো। এই জন্যই ন্যায়-বৈশেষিকরা বিশেষকে স্বতোব্যাবর্তক বলেছেন। অর্থাৎ বিশেষ নিজের স্বরূপবশতই অন্যান্য সকল পদার্থ থেকে ভিন্ন। বস্তুত বিশেষ অন্য বিশেষ বা অন্য ধর্মকে অপেক্ষা করে অন্য পদার্থ থেকে ব্যাবর্তিত হয় না বলেই এই বিশেষকে অন্ত্য-বিশেষ বলা হয়। নিত্যদ্রব্যে সর্বদা সমবেত অর্থাৎ সমবায় সম্বন্ধে থাকে বলে বিশেষও নিত্য। বিশেষকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অনুমানের মাধ্যমেই তা সিদ্ধ হয়।
.
বিভিন্ন নিত্যদ্রব্যে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ স্বীকার করা হলেও বিশেষের অনুগত ধর্ম বিশেষত্বকে জাতি বলা হয় না। বিশেষত্বকে জাতি বলে স্বীকার করলে রূপহানি ঘটে। অর্থাৎ বিশেষের স্বরূপহানি হয়। বিশেষত্ব জাতি হলে তার দ্বারাই বিভিন্ন বিশেষ পৃথক হয়ে যাবে। ফলে বিশেষের স্বতোব্যাবর্তকত্ব রূপের হানি হবে। তাই কিরণাবলীকার উদয়নাচার্য বিশেষের লক্ষণের ব্যাখ্যায় বলেছেন-
‘নিঃসামান্যত্বে সতি একদ্রব্যমাত্রসমবেতত্বম্’। (কিরণাবলী)।
অর্থাৎ : সামান্যবর্জিত এবং একটিমাত্র নিত্য দ্রব্যে সমবেত পদার্থগুলিই হলো বিশেষ।
.
যেহেতু বিশেষ জাতিশূন্য, সেহেতু বিশেষ গুণস্বরূপ নয়। এ কারণে কিরণাবলী গ্রন্থে আচার্য উদয়ন আরো বলেছেন- অত্যন্তব্যাবৃতি বুদ্ধির হেতু হয়, অনুগত বুদ্ধির হেতু হয় না বলে বিশেষ বিশেষই, বিশেষ সামান্য নয় বা অন্য পদার্থের অন্তর্গতও নয়। প্রত্যেকটি বিশেষ হলো অনুপম পদার্থ এবং যা অনুপম তাই স্বতোব্যাবর্তক।
.
বিশেষ ও সামান্য উভয়ই নিত্য পদার্থ। বিশেষের সাথে সামান্যের পার্থক্য হলো, অত্যন্তব্যাবৃতি-বুদ্ধির হেতু বিশেষ কেবল একটি নিত্য দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। কিন্তু অনুগত-বুদ্ধির হেতু সামান্য এক জাতীয় বহু দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে। বিশেষের আশ্রয় দ্রব্যগুলি যেমন নিত্য, বিশেষ নিজেও তেমনই নিত্য পদার্থ।
সমবায় (Inherence)
.
বৈশেষিক দর্শনে সপ্তপদার্থকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাবপদার্থ ছয়টি, আর একটি অভাবপদার্থ। ছটি ভাবপদার্থের ষষ্ঠ তথা সর্বশেষ ভাবপদার্থটি হচ্ছে সমবায়।
.
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় যেমন নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল বিভিন্ন দ্রব্য পদার্থ স্বীকার করেছেন, তেমনি এই সকল পদার্থের পারস্পরিক সম্বন্ধেরও নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। জগতের সকল পদার্থই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কোন না কোন সম্বন্ধে সম্পর্কযুক্ত। পদার্থের এই পারস্পরিক সম্বন্ধগুলি নানা প্রকারের, যেমন- সমবায়, সংগোগ, বিভাগ, স্বরূপ প্রভৃতি। এ সকল সম্বন্ধের মধ্যে সমবায় সম্বন্ধকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সমবায় এক ধরনের সম্বন্ধ হলেও জগতের সাতটি মৌলিক পদার্থের অন্যতম। সমবায় ভিন্ন অন্যান্য সম্বন্ধগুলিকে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় অন্যান্য পদার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একমাত্র সমবায়ই স্বতন্ত্র পদার্থের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি নিশ্চয়ই গুরুত্ববহ।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে কার্য-কারণভাব, আত্মাদি দ্রব্যের নিত্যতা প্রভৃতি বহু মুখ্য সিদ্ধান্ত সমবায়-নির্ভর। অন্যদিকে সাংখ্য, বেদান্ত, বৌদ্ধ, জৈন ও ভাট্ট মীমাংসায় সমবায় উপেক্ষিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আবার প্রাভাকর মীমাংসক সম্প্রদায় মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের অনুগমন করে সমবায়কে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একমাত্র ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনেই সমবায় সগৌরবে এবং সমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
.
মূলত দুটি পদার্থের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ও নিত্য সম্পর্কের নাম ‘সমবায়’। বৈশেষিক সূত্রকার মহর্ষি কণাদ সপ্তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় আহ্নিকে বলেছেন-
‘ইহেদমিতি যতঃ কার্যকরণয়োঃ স সমবায়ঃ’। (বৈশেষিকসূত্র: ৭/২/২৬)।
অর্থাৎ : কার্য ও কারণের এবং অকার্য ও অকারণের সম্বন্ধই সমবায় পদার্থ।
.
মহর্ষি কণাদ সমবায়কে অন্যতম পদার্থরূপে উল্লেখ করলেও তিনি সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করেননি। ভাষ্যকার প্রশস্তপাদই বিস্তারিতভাবে সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক আচার্যরা সমবায় পদার্থের আলোচনা করেছেন। আচার্য প্রশস্তপাদ উদ্দেশ প্রকরণে সমবায়ের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-
‘অযুতসিদ্ধানাম্ আধার্যাধারভূতানাং যৎ সম্বন্ধ ইহ প্রত্যয়হেতুঃ স সমবায়ঃ’। (প্রশস্তপাদভাষ্য)।
অর্থাৎ : অযুতসিদ্ধ ও আধার-আধেয়রূপ পদার্থ সমূহের যে সম্বন্ধ আধার-আধেয় ভাবরূপ প্রত্যয়ের হেতু তাই সমবায়।
.
উক্ত ভাষ্যে সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ দুটি লক্ষণ চিহ্নিত করা হয়েছে, ‘অযুতসিদ্ধানাম্’ বা অযুতসিদ্ধরূপী এবং ‘আধার্যাধারভূতানাং’ বা আধার-আধেয়রূপ পদার্থ। অযুতসিদ্ধ পদার্থ হলো সেই পদার্থ যা অন্য একটি পদার্থের সঙ্গে এমনভাবে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকে যে ঐ দুই পদার্থের কোন একটির বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যেমন সুতার সঙ্গে পট বা কাপড়ের সম্বন্ধ। কাপড় সুতার মধ্যেই অবস্থান করে। কাপড় ও সুতা পৃথকভাবে অবস্থান করতে পারে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অযুতসিদ্ধ-এর সংজ্ঞা দিয়েছেন-
‘যয়োঃ দ্বয়োঃ মধ্যে একম্ অবিনশ্যৎ এব অবতিষ্ঠতে তাবৎ অযুতসিদ্ধৌ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে দুটি পদার্থের একটি, তার বিনাশ পর্যন্ত, অন্যটিতে আশ্রিত হয়েই থাকে, সে দুটি পদার্থ অযুতসিদ্ধ।
.
তাই প্রশস্তপাদ-ভাষ্যোক্ত ‘অযুতসিদ্ধানাম্’ পদকে সমবায়ের লক্ষণ নির্দেশ বলে বর্ণনা করে কিরণাবলীকার আচার্য উদয়ন ‘অযুতসিদ্ধ’ পদের অর্থ নিরূপণার্থে বলেন-
‘অযুতাঃ প্রাপ্তাশ্চসিদ্ধা ইতি অযুতসিদ্ধাঃ’। (কিরণাবলী)।
অর্থাৎ : যারা প্রাপ্ত হয়েই (অযুত) সিদ্ধ হয় তারাই অযুতসিদ্ধ।
.
যারা কখনো অপ্রাপ্ত থাকে না, সর্বদা প্রাপ্ত হয়েই থাকে তারাই অযুতসিদ্ধ এবং তাদের মধ্যস্থিত প্রাপ্তসম্বন্ধই সমবায়। সমবায়কে তাই নিত্যপ্রাপ্তি সম্বন্ধ বলা যায়। উদয়নের মতে তাই ‘নিত্যপ্রাপ্তিঃ সম্বন্ধঃ সমবায়ঃ’ অর্থাৎ ‘নিত্যপ্রাপ্তি সম্বন্ধই সমবায়’। বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চাননও মুক্তাবলীতে নিত্যসম্বন্ধকেই সমবায়ের লক্ষণ বলেছেন। এবং নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে সমবায়ের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘নিত্যসম্বন্ধঃ সমবায়ঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : নিত্য সম্বন্ধই সমবায়।
.
উল্লেখ্য, যদি দুটি পদার্থ পরস্পর যুত হয়ে (অসম্বন্ধ হয়ে) সিদ্ধ হয়, অর্থাৎ পরস্পরের সম্বন্ধ নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারে, সে দুটি পদার্থকে যুতসিদ্ধ বলা হয়। দুটি যুতসিদ্ধ পদার্থের সম্বন্ধকে সংযোগ বলা হয়। যুতসিদ্ধ ভিন্ন পদার্থকেই অযুতসিদ্ধ বলা হয়েছে। যেমন হাতের সাথে কলমের যে সম্পর্ক তা সংযোগ। কেননা হাত ও কলম দুটি যুতসিদ্ধ পদার্থ। অর্থাৎ পূর্বে হাত ও কলমের সম্পর্ক বিযুক্ত ছিলো এবং পরেও তা বিযুক্ত হয়ে ভিন্ন আশ্রয়ে আশ্রিত হতে পারে। তাই সংযোগ অনিত্য সম্পর্ক বলে তা অযুতসিদ্ধ নয়। কিন্তু সমবায় হচ্ছে নিত্য সম্বন্ধ।
.
সমবায়ের অপর লক্ষণটি হলো আধার্যাধার বা আধার-আধেয়ভাব। সমবায়ের আধার-আধেয়ভাব একপাক্ষিক। যেমন মনুষ্যত্ব জাতি রাম, শ্যাম প্রভৃতি ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে এমনভাবে সম্বন্ধযুক্ত থাকে যে, ব্যক্তিমানুষের নাশ না হওয়া পর্যন্ত মনুষ্যত্বকে ব্যক্তিমানুষ থেকে পৃথক করা যায় না। তেমনি ঘট থেকে ঘটের রূপকে, পট বা কাপড় থেকে তন্তু বা সুতাকে, ঘট বা পটকে অক্ষুণ্ন রেখে পৃথক করা যায় না। ব্যক্তিমানুষ ও মনুষ্যত্ব জাতি, ঘট ও ঘটরূপ, পট ও তন্তুকে তাই অযুতসিদ্ধ পদার্থ বলা হয়। এগুলির সম্পর্ক আবার আধার-আধেয় সম্পর্ক। আধেয় মনুষ্যত্ব জাতির আধার হচ্ছে ব্যক্তিমানুষ, আধার ঘটরূপে আধেয় হচ্ছে ঘট ইত্যাদি। এদের পারস্পরিক সম্বন্ধ হলো সমবায় সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধই দুটি পদার্থের অযুতসিদ্ধরূপে প্রতীতির কারণ বা হেতু।
.
অন্যদিকে ‘হাঁড়িতে আম আছে’ এইরূপ আধার্যাধার পদার্থদ্বয়ের আধার-আধেয় ভাবরূপ প্রত্যয়ের হেতু সংযোগ সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধকে কোনভাবে সমবায় সম্বন্ধ বলা যাবে না, এতে সমবায় লক্ষণের অতিব্যাপ্তি দোষ ঘটে। কারণ আধার হাঁড়ির সঙ্গে আধেয় আমের সম্বন্ধ হচ্ছে সংযোগ সম্বন্ধ। হাঁড়ি ও আম এই পদার্থদ্বয় হলো যুতসিদ্ধ। যুতসিদ্ধ পদার্থদ্বয় পরস্পর পরস্পরকে পরিহার করে ভিন্ন আশ্রয়ে আশ্রিত হতে পারে। আম হাঁড়িতে না থেকে অন্যত্র থাকতে পারে। সংযোগ নিত্য সম্বন্ধ নয়। তাই আম ও হাঁড়ির সম্বন্ধকে সমবায় বলা হয় না।
.
আবার ধর্ম ও সুখ, অধর্ম ও দুঃখ সমানাধিকরণ হওয়ায় সব সময় ধর্মের সঙ্গে সুখ এবং অধর্মের সঙ্গে দুঃখ থাকে। ধর্ম হলো সুখের কারণ, অধর্ম হলো দুঃখের কারণ। ধর্ম ও অধর্ম আত্মার গুণ হিসেবে যেমন আত্মাতে আশ্রিত, তেমনি সুখ ও দুঃখ আত্মার গুণ হিসেবে আত্মাতে আশ্রিত। সুতরাং বলা যায় যে ধর্ম ও সুখ, অধর্ম ও দুঃখ অযুতসিদ্ধ সম্বন্ধ (অভিন্নাশ্রয়ত্ববিশিষ্ট)। কিন্তু ধর্ম ও সুখ এবং অধর্ম ও দুঃখের মধ্যে আধার-আধেয় ভাব না থাকায় এদের মধ্যস্থিত সম্বন্ধ সমবায় বলে বিবেচিত হয় না।
.
অর্থাৎ, যে সম্বন্ধে অযুতসিদ্ধ ও আধার-আধেয়ভাবের সার্বত্রিক ও সর্বকালিক প্রতীতি হয়, তাই সমবায় সম্বন্ধ। ন্যায়মতে সমবায় প্রত্যক্ষসিদ্ধ, অর্থাৎ সমবায়ের জ্ঞান হয় প্রত্যক্ষের দ্বারা। কিন্তু বৈশেষিক মতে, সমবায় প্রত্যক্ষের দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে না। তাঁদের মতে, সমবায়ের অস্তিত্ব অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ। এবং এই মতে, সমবায় নিত্য ও এক।
.
সমবায়ের দৃষ্টান্ত বা ক্ষেত্র :
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সমবায়ের দৃষ্টান্ত হলো পঞ্চবিধ। ‘দৃষ্টান্ত’ বলতে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ জোড়া সম্বন্ধীর কথা বোঝানো হয়েছে। এই পাঁচটি যুগ্ম পদার্থ অযুতসিদ্ধ। সমবায়ের এই বিভিন্ন দৃষ্টান্তগুলিকে উল্লেখপূর্বক সমবায়ের পরিচয় নির্দেশ করতে গিয়ে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর ভাষাপরিচ্ছেদ গ্রন্থে বলেছেন-
‘ঘটাদীনাং কপালাদৌ দ্রব্যেষু গুণকর্মণোঃ
তেষু জাতেশ্চ সম্বন্ধঃ সমবায়ঃ প্রকীর্তিতঃ।।’ (ভাষাপরিচ্ছেদ)।
অর্থাৎ : দ্রব্য ও গুণ, দ্রব্য ও কর্ম, জাতি ও ব্যক্তি, অবয়ব ও অবয়বী, নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের মধ্যে যে সম্বন্ধ, তাই হলো সমবায় সম্বন্ধ।
.
এই সমবায় সম্বন্ধই অযুতসিদ্ধ। অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে তাবৎ অযুতসিদ্ধ সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন-
‘তাবৎ অযুতসিদ্ধৌ যথা অবয়ব-অবয়বিনৌ, গুণ-গুণিনৌ, ক্রিয়া-ক্রিয়াবন্তৌ, জাতি-ব্যক্তী, বিশেষ নিত্যদ্রব্যে চেতি।’ (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অবয়ব-অবয়বী, গুণ-গুণী (দ্রব্য), ক্রিয়া-ক্রিয়াবান (দ্রব্য), জাতি-ব্যক্তি, বিশেষ-নিত্যদ্রব্য এই পাঁচটি যুগ্ম পদার্থ অযুতসিদ্ধ। এদের সম্বন্ধ সমবায়।
.
অতএব, ন্যায়-বৈশেষিক মতে সমবায় সম্পর্ক পাঁচ প্রকারের- (১) দ্রব্য ও গুণের (গুণ-গুণীর) সম্পর্ক, (খ) দ্রব্য ও কর্মের (ক্রিয়া-ক্রিয়াবান) সম্পর্ক, (৩) ব্যক্তি ও জাতির সম্পর্ক, (৪) অবয়ব ও অবয়বীর (অংশ-অংশীর) সম্পর্ক, (৫) নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের সম্পর্ক।
.
(১) দ্রব্য ও গুণের সম্পর্ক : গুণ দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, ঘটের রূপ হচ্ছে তার গুণ এবং তা ঘটে (দ্রব্যে) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। ঘট ও তার রূপ- এ দুটির অন্তত একটি (ঘটের রূপ) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ঘটেই থাকে। কিন্তু ঘট অন্তত একটি ক্ষণ (উৎপত্তি ক্ষণ) রূপ ছাড়া থাকতে পারে। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
.
(২) দ্রব্য ও কর্মের সম্পর্ক : ক্রিয়া দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, গাছের পাতা (দ্রব্য) ও তার ক্রিয়া- এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি (ক্রিয়া) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ গাছের পাতাতেই থাকে। উৎপত্তিকালীন দ্রব্যে ক্রিয়া থাকে না বলে দ্রব্য ক্রিয়াহীন থাকতে পারে। এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে তারা অযুতসিদ্ধ।
.
(৩) ব্যক্তি ও জাতির সম্পর্ক : জাতি দ্রব্য, গুণ ও ক্রিয়াতে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন, জাতি (গোত্ব) ব্যক্তি গো-তে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। গোত্ব ও গো (গরু)-এ দুটির মধ্যে গো (গরু) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তাতে গোত্ব জাতি থাকবেই। কিন্তু গো-ব্যক্তি না থাকলেও গোত্ব জাতি থাকতে পারে। এ দুটির মধ্যে অন্তত একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে তারা অযুতসিদ্ধ।
.
(৪) অবয়ব ও অবয়বীর সম্পর্ক : অবয়বী অবয়বে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। যেমন বস্ত্র (অবয়বী) সুতা বা তন্তুতে (অবয়ব) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। তন্তু বস্ত্র ছাড়া থাকতে পারে, কিন্তু বস্ত্র তন্তু ছাড়া থাকতে পারে না। এই দুটি পদার্থের মধ্যে অন্তত একটি (বস্ত্র) যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তা তন্তুতেই থাকে। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
.
(৫) নিত্যদ্রব্য ও বিশেষের সম্পর্ক : পরমাণু, আকাশ, দিক্, কাল, আত্মা, মন প্রভৃতি নিত্যদ্রব্যে বিশেষ থাকে সমবায় সম্বন্ধে। এক্ষেত্রে সম্বন্ধী দুটিই নিত্য বলে এরা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। তাই তারা অযুতসিদ্ধ।
.
সংযোগ ও সমবায়
ন্যায়-বৈশেষিক মতে সম্বন্ধ প্রধানত দুই রকমের- সংযোগ ও সমবায়। ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে সংযোগকে সম্বন্ধ বলা হলেও সংযোগ ও সমবায়ের মধ্যে নানা পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
.
১. সমবায় স্বরূপগতভাবে সম্বন্ধ হলেও তা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে একটি স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সংযোগকে পদার্থ বলা হয় নি। সংযোগকে গুণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
.
২. সমবায়কে নিত্য সম্বন্ধ বলা হয়েছে। কিন্তু সংযোগ অনিত্য সম্বন্ধ। যেখানে সংযোগ সম্বন্ধ হয়, সেখানে শেষে বিভাগ দেখা যেতে পারে। যেমন, বৃক্ষে পাখির যে সংযোগ বা হাতের সাথে পুস্তকের যে সংযোগ, তা শেষে বিভাগ হলে নষ্ট হয়ে যায়। গাছ থেকে পাখি আবার উড়ে গেলে গাছের সাথে পাখির সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তাই সংযোগ অনিত্য সম্বন্ধ।
অপরপক্ষে, কপাল (আকৃতি) ও ঘটের যে সমবায় সম্বন্ধ তা বিভাগে শেষ হয়ে যায় না। ঘট বা কপাল কোনটিই কখনও বিভক্ত হয়ে অবস্থান করে না। সমবায়ের উৎপত্তি ও বিনাশ নাই। সমবায়ের সম্বন্ধীর বিনাশে সম্বন্ধের জ্ঞান সামগ্রি বিনষ্ট হয়, কিন্তু সমবায় নিত্য ও স্বতন্ত্র বলে তা বিনষ্ট হয় না।
.
৩. সমবায় সম্বন্ধ অবয়ব-অবয়বী, দ্রব্য-গুণ প্রভৃতি অযুতসিদ্ধ পদার্থেই হয়। অপরপক্ষে, সংযোগ যে সম্বন্ধীদ্বয়ে থাকে তা যুতসিদ্ধ, অযুতসিদ্ধ নয়। দণ্ড পুরুষ প্রথমে অসম্বন্ধ থাকে, পরে সম্বন্ধ হয়। তাই দণ্ড ও পুরুষ যুতসিদ্ধ পদার্থ। এদের সম্বন্ধই সংযোগ। কিন্তু ঘট ও তার রূপ, ঘট ও ঘটত্ব কখনও অসম্বন্ধ হয়ে থাকতেই পারে না। তাই তারা অযুতসিদ্ধ পদার্থ। এদের সম্বন্ধই সমবায়।
.
৪. সংযোগ সম্বন্ধ দুটি দ্রব্যেই হয়। দ্রব্যাতিরিক্ত পদার্থে সংযোগ হয় না। ঘট ও পট দুটি দ্রব্য। এদের সংযোগ হতে পারে। কিন্তু সমবায় সম্বন্ধ দুটি দ্রব্যের মধ্যে (যেমন, অবয়ব-অবয়বী) হতে পারে, আবার এমন দুটি পদার্থের মধ্যেও হতে পারে যারা দুটিই দ্রব্য নয় (যেমন, দ্রব্য-গুণ, দ্রব্য-কর্ম)।
.
৫. সংযোগ ও সমবায় উভয়ই বৃত্তি নিয়ামক সম্বন্ধ। কিন্তু এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। সমবায় সম্বন্ধ যে দুটি অযুতসিদ্ধ পদার্থে থাকে তাদের মধ্যে সর্বদা আধার-আধেয় ভাব থাকে। যেমন, কপাল (আকৃতি) ও ঘটের যে সমবায় সম্বন্ধ সেস্থলে কপাল হচ্ছে আধার এবং ঘট আধেয়। কিন্তু সংযোগ সম্বন্ধ যে দুটি সম্বন্ধীতে থাকে তাদের মধ্যে সর্বদা আধার-আধেয় ভাব থাকে না। হাত ও কলমের যে সংযোগ, সে স্থলে হাত আধার এবং কলম আধেয় হয়। কিন্তু হাতের দুটি আঙুলের মধ্যে যে সংযোগ সেখানে কোন আঙুলই আধার বা আধেয় হয় না। সুতরাং সমবায় ও সংযোগ ভিন্ন।
.
৬. সংযোগ অব্যাপ্যবৃত্তি সম্বন্ধ। অর্থাৎ সংযোগ যে অধিকরণে (আশ্রয়ে) থাকে, সেই অধিকরণে তার অভাবও থাকে। যেমন, বৃক্ষে পাখিসংযোগ আছে বললে সেখানে পাখিসংযোগের অভাবও আছে বলা যায়। কেননা বৃক্ষের সর্বাংশে পাখিসংযোগ থাকে না। কিন্তু সমবায় ব্যাপ্যবৃত্তি সম্বন্ধ। ঘটে রূপ থাকে সমবায় সম্বন্ধে। ঘটের কোন অংশে রূপ আছে, কোন অংশে রূপের অভাব আছে, তা বলা যায় না।
.
ভাট্ট মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে সমবায়ের পরিবর্তে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়েছে। তাঁদের মতে, তাদাত্ম্যের অর্থ ভেদাভেদ বা ভেদ-সহিষ্ণু অভেদ। অর্থাৎ কোন অংশে ভেদ, কোন অংশে অভেদ। ন্যায়-বৈশেষিকেরা তাদাত্ম্য বলতে অভেদকে বোঝেন। ভাট্ট ও বেদান্তীদের মতে, ঘট ও রূপ এ দুটি পদার্থের সম্বন্ধ সমবায় হতে পারে না। ‘ঘটে রূপ থাকে’ এক্ষেত্রে ঘট আধার ও রূপ আধেয় হয়। সুতরাং ঘট ও রূপ অভিন্ন নয়, যেহেতু অভিন্ন পদার্থে আধার-আধেয় ভাব হয় না। আবার ঘট ও রূপ ভিন্নও নয়, যেহেতু এ দুটি পৃথকভাবে থাকে না। সুতরাং ঘট ও রূপের সম্বন্ধ ভেদাভেদ।
এর বিরুদ্ধে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, ভেদাভেদ পরস্পর বিরুদ্ধ, তাই তা একই অধিকরণে থাকতে পারে না। সুতরাং সমবায় অবশ্য স্বীকার্য।
অভাব পদার্থ (Negation or Non-existence)
.
নিয়তপদার্থবাদী বৈশেষিক সম্প্রদায়সম্মত সপ্তম ও শেষ পদার্থ হলো অভাব। অভাব একটি নঞর্থক পদার্থ। বৈশেষিক সম্প্রদায় পদার্থকে প্রধানত ভাব ও অভাব ভেদে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায় এই ছটি হলো ভাবপদার্থ। সপ্তম পদার্থ হলো অভাব। ‘টেবিলে কলমটি আছে’ এভাবে যেমন ভাব বস্তুর জ্ঞান হয়, তেমনি ‘টেবিলে বই নেই’ এভাবে আমাদের অভাব পদার্থের জ্ঞান হয়। রঘুনাথ শিরোমণি’র মতে, ‘নঞ্’ আদি শব্দের দ্বারা নিষেধবোধক জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় অভাব। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা বস্তুস্বাতস্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অভাব পদার্থ স্বীকার করেছেন। ন্যায়-বৈশেষিক মতে জ্ঞান কখনো নির্বিষয়ক হয় না। জ্ঞান মাত্রই সবিষয়ক, অর্থাৎ বিষয় ছাড়া জ্ঞান হয় না। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞান নিরপেক্ষ সত্তাবিশিষ্ট। ভাববোধক সদর্থক জ্ঞানের বিষয়ের ন্যায় তাই নঞর্থক জ্ঞানেরও বিষয় স্বীকার করতে হয়। অভাব হলো এরূপ নঞর্থক জ্ঞানের বিষয়।
.
মহর্ষি কণাদের বৈশেষিকসূত্রে এবং মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায় না। মহর্ষি কণাদ তাঁর উদ্দেশ সূত্রে সপ্তম পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ না করলেও তিনি অভাব ও তার বিভাগসমূহ বৈশেষিকসূত্রের বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিক স্থলে উপস্থাপন করেছেন। আর নবম অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকের প্রথম সূত্র থেকেই মহর্ষি কণাদ প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব, অত্যন্তাভাব ও অন্যোন্যাভাবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। এইসব সূত্র ধরেই তাঁর অনুগামী দার্শনিকগণ বৈশেষিক সম্মত সপ্তবিধ পদার্থের উল্লেখ করে সূত্রকারের অভিপ্রায়কেই ব্যক্ত করেছেন বলে অনুগামীদের অভিমত। পরবর্তীকালে অভাব পদার্থের স্বরূপ ও বিভাগ নিয়ে বিচার শুরু হয়। বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্যে এবং উদয়নাচার্যের কিরণাবলীতে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়।
.
বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর মুক্তাবলীতে অভাব পদার্থ নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন-
‘অভাবত্বম্ দ্রব্যাদিষট্কান্যোন্যাভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে পদার্থে ছয়টি ভাবপদার্থের ভেদ আছে তাই অভাব।
.
দ্রব্যাদি ছয়টি ভাবপদার্থে (নিজ নিজ ভেদ ভিন্ন) ‘দ্রব্য নয়’ ‘গুণ নয়’ এইভাবে ভাবপদার্থের কেবল পাঁচটি ভেদ আছে, ছয়টি ভেদ নেই। একমাত্র অভাব পদার্থেই ছয়টি ভাবপদার্থের ভেদ আছে। তাই অভাব হলো দ্রব্যাদি ছয়টি ভাবপদার্থের অন্যোন্যাভাব (পারস্পরিক অভাব) বোধক পদার্থ।
.
ভারতীয় দর্শনে লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারা পদার্থ সিদ্ধ হয়। অভাবের লক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অভাবনিরূপণ ভাবনিরূপণসাপেক্ষ। সেই কারণে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অভাব পদার্থ নিরূপণের আগে ছ’টি ভাব পদার্থ (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায়) নিরূপিত হয়েছে।
.
যার অভাব থাকে, তাকে ঐ অভাবের প্রতিযোগী বলে এবং যেখানে অভাব থাকে, তাকে অভাবের অধিকরণ বা অনুযোগী বলে। টেবিলে কলমের অভাবের ক্ষেত্রে কলম অভাবের প্রতিযোগী এবং টেবিল অনুযোগী। অতএব অভাব সবসময় কোন অনুযোগীতে কোন প্রতিযোগীর অভাব। অভাবের সঙ্গে তার অনুযোগী বা প্রতিযোগীর সম্বন্ধ হলো স্বরূপ সম্বন্ধ। কোথাও কোথাও এই সম্বন্ধকে বিশেষণতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষণতা এক প্রকার স্বরূপ সম্বন্ধ হওয়ায় এই সম্বন্ধ অন্য কোন সম্বন্ধের অপেক্ষা করে না। অভাব অনুযোগী ও প্রতিযোগী সাপেক্ষ। যেহেতু অভাব পদার্থ প্রতিযোগী ভাবপদার্থের নিরূপণ ব্যতিরেকে নিরূপিত হতে পারে না, সেহেতু অভাব পদার্থকে ভাবপরতন্ত্র বলা হয়। কারণ প্রতিযোগী ভাবপদার্থের জ্ঞান ব্যতীত অভাবের স্বরূপ বোঝা যায় না। কিন্তু প্রতিযোগী পদার্থ পরিচিত হলেই, যেখানে প্রতিযোগী থাকে, সেস্থান ছাড়া অন্যস্থানে তা অভাব জ্ঞানের বিষয় হয়। দ্রব্য, গুণ প্রভৃতি ভাবপদার্থ পদার্থান্তর নিরূপণের অধীন নয়, তাই তাদের বলা হয় স্বতন্ত্র। ন্যায়-বৈশেষিক মতে অভাব বলতে আসলে নাস্তিত্বকে বোঝায় না। অভাব বলতে ‘কোন কিছুতে কোন কিছুর অভাব’ বোঝায়।
.
অভাব বিষয়ে দার্শনিক মতান্তর :
কোন কোন দার্শনিক সম্প্রদায় ‘অভাব’ নামক অতিরিক্ত পদার্থ স্বীকার করেন না। যেমন প্রাভাকর মীমাংসক মতে, অভাব ভাব-পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র কোন পদার্থ নয়। কিন্তু বিভিন্ন ভাব পদার্থগুলিই অবস্থাবিশেষে অন্য ভাব-বস্তুর অভাবরূপে প্রতীত হয়। তাদের মতে, জ্ঞানের বিষয় সবসময় সদর্থকই হয়, নঞর্থক বিষয় বলে কোন বিষয় নেই।
.
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অভাব প্রমাণসিদ্ধ। কারণ ‘যা থাকে’ তা যেমন পদার্থ, ‘না-থাকা’টিও যেহেতু জ্ঞানের বিষয় সেহেতু পদার্থ।
দ্বিতীয়ত, অভাবকে পদার্থ বলে না মানলে নঞর্থক বচনের সত্যতা ও মিথ্যাত্বের পার্থক্য করা যায় না। কোন বচন যখন সত্য বলে বিবেচিত হয়, তখন তার অনুরূপ পদার্থ বাস্তব জগতে থাকে। ধরা যাক ‘ঘরে হাতি নেই’ এই বচনটি সত্য। ন্যায়-বৈশেষিক মতে হাতির অভাববিশিষ্ট ঘরই এই বচনের অনুরূপ বাস্তব পদার্থ। সুতরাং, হাতির অভাবকে পদার্থ বলে মানতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ন্যায়-বৈশেষিকদের ন্যায় বেদান্তী এবং ভাট্টমীমাংস সম্প্রদায়ও অভাবকে ভাববস্তুর মতোই পদার্থ বলে স্বীকার করেছেন।
.
কিন্তু প্রাভাকর মতে, ‘ঘরে হাতি নেই’ এই জ্ঞানের অনুরূপ যে পদার্থ বাস্তব জগতে আছে, তা ঘরটি ছাড়া আর কিছু নয় এবং তা ভাব পদার্থ। এই কারণে তাঁরা বলেন যে, অভাবের জ্ঞান সর্বদাই কোন না কোন অধিকরণে বা আশ্রয়ে হয়। যে অধিকরণে অভাবের জ্ঞান হয়, অভাব সেই অধিকরণস্বরূপ। যেমন টেবিলে যে বই-এর অভাবের জ্ঞান হচ্ছে, সেটি টেবিলস্বরূপ অর্থাৎ টেবিল। সুতরাং, টেবিলের অতিরিক্ত বই-এর অভাব বলে কোন পদার্থ নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঘটের অভাবকে যখন অধিকরণ ভূতলস্বরূপ বলা হয়, তখন অধিকরণের তৎকালীন স্বরূপকেই বুঝতে হবে। ‘ভূতলে ঘট নেই’ এই প্রতীতির বিষয় যে নাস্তিতা, তা হলো কেবল ভূতল অর্থাৎ ঘট-সংযোগ না থাকাকালীন ভূতল। ‘বিনষ্ট ঘট’ এই প্রতীতির বিষয় যে বিনাশরূপ অভাব, তা ঘটের ভাঙা খণ্ডগুলি ছাড়া আর কিছু নয়। ‘এই কপালে ঘট হবে’ এইভাবে উৎপত্তির পূর্বে যে ঘটাভাবের প্রতীতি হয়, তার বিষয়ও ঐ কপাল ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আবার ‘ঘট পট নয়’ এইভাবে ঘটে যে পটের অভাব প্রতীত হয়, তা পৃথকত্ব গুণমাত্র, অতিরিক্ত অভাব পদার্থ নয়।
.
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন যে, অভাবকে অধিকরণ-স্বরূপ বললে কল্পনার গৌরব দোষ হয়। কারণ সেক্ষেত্রে ভূতলবৃত্তি ঘটাভাবকে ভূতলস্বরূপ বলতে হবে। আবার টেবিলবৃত্তি ঘটাভাবকে টেবিলস্বরূপ বলতে হবে। কিন্তু ভূতল ও টেবিল এক নয়। ফলে ঘটাভাব অনন্ত হয়ে পড়ায় গৌরব দোষ অবশ্যম্ভাবী।
অপরপক্ষে ঘটাভাবকে অধিকরণের অতিরিক্ত একটি পদার্থ বলে স্বীকার করলে আমরা বলতে পারি যে, একই ঘটাভাব ভূতলে আছে, আবার টেবিলে আছে। অধিকরণভেদে ঘটাভাব ভিন্ন ভিন্ন হয় না।
.
এক্ষেত্রে প্রাভাকর মীমাংসক বলেন যে, ঐ অধিকরণগুলিই যেহেতু স্বীকৃত পদার্থ, সেহেতু নতুন কোন পদার্থ কল্পনা করা হয়নি। কিন্তু ঘটাভাবকে ভূতলের অতিরিক্ত বলায়, ‘ঘটাভাব’ বলে অপর একটি নতুন পদার্থ স্বীকার করতে হচ্ছে। সুতরাং ন্যায়-বৈশেষিকমতেই গৌরব দোষ হচ্ছে।
.
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকরা বলেন, যদিও অধিকরণগুলি স্বীকৃত পদার্থ, তবুও অভাবকে অধিকরণস্বরূপ বললে গৌরব দোষ হবে এইজন্যে যে, অধিকরণভেদে একই অভাবকে অনেক বলে কল্পনা করতে হচ্ছে। ঘটাভাবের কল্পনা হলো এক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়। ন্যায়-বৈশেষিকমতে ঘটাভাবকে এক বলে কল্পনা করলেই চলে। কিন্তু প্রাভাকর মতে ঘটাভাবকে অনেক বলে কল্পনা করতে হয়। কারণ অধিকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন। অভাব যখন অধিকরণস্বরূপ, তখন বিভিন্ন অধিকরণবৃত্তি অভাবও বিভিন্ন। যদিও ন্যায়-বৈশেষিক মতে অভাবকে অধিকরণের অতিরিক্ত পদার্থ বলে স্বীকার করলে অভাব বলে স্বতন্ত্র একটি পদার্থ স্বীকার করতে হয়, তবুও তাতে গৌরব দোষ হয় না। কম স্বীকার করলে যেখানে চলে, সেখানে যদি বেশি স্বীকার করা হয়, তাহলেই দোষ হয়। কিন্তু অভাবকে অধিকরণের অতিরিক্তরূপে স্বীকার না করলে আমাদের অনুভবের যথাযথ ব্যাখ্যা হয় না। সুতরাং এই স্বীকারে কোন গৌরব দোষ নেই।
সর্বোপরি প্রত্যক্ষ এবং অনুমান প্রমাণের দ্বারা অভাব পদার্থ সিদ্ধ হয়।
.
অভাবের জ্ঞান :
এখন প্রশ্ন হলো, অভাবের জ্ঞান কিভাবে হয় ? ভাট্ট মীমাংসক ও অদ্বৈত বেদান্ত সম্প্রদায় অভাবপদার্থের জ্ঞানের জন্য ‘অনুপলব্ধি’ নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ স্বীকার করেছেন। এইমতে ঘটাদি বস্তুর উপস্থিতি যেমন প্রত্যক্ষাদি প্রমাণসিদ্ধ, তেমনি ঐ সকল বিষয়ের অনুপস্থিতি অনুপলব্ধি প্রমাণসিদ্ধ।
.
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় অভাবকে প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলেছেন। অভাবের প্রতিযোগী যদি লৌকিক প্রত্যক্ষের যোগ্য হয়, তাহলে তাদের অভাবও লৌকিক প্রত্যক্ষের যোগ্য। তবে ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যে প্রতিযোগীর প্রত্যক্ষ যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয়, তার অভাবেরও কেবল সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লৌকিক প্রত্যক্ষ হতে পারে, অন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয় না। যেমন, রূপ চক্ষুরিন্দ্রিয়ের বিষয়। এইজন্য রূপাভাব চক্ষু দ্বারাই প্রত্যক্ষ হয়, ত্বক্ বা কর্ণের দ্বারা রূপাভাবের প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। কিন্তু যে প্রতিযোগী প্রত্যক্ষের অযোগ্য, তার অস্তিত্ব অমুমান দ্বারা সিদ্ধ হয়। এই কারণে তার অভাবও অনুমানযোগ্য।
.
পদার্থের অভাব প্রত্যক্ষে বিশেষণ-বিশেষ্যভাব বা বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকৃত (ন্যায়দর্শনের সন্নিকর্ষ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষ ভেদে বিশেষণতা সন্নিকর্ষও ষড়বিধ। দ্রব্যের অভাব প্রত্যক্ষে যে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ হয় তা হলো সংযুক্ত বিশেষণতা। কিন্তু দ্রব্যের গুণের অভাব প্রত্যক্ষে দরকার সংযুক্তসমবেত বিশেষণতা।
.
ন্যায়-বৈশেষিকমতে কোন বিষয়ের অভাব প্রত্যক্ষে প্রতিযোগীর যোগ্য অনুপলব্ধি সহকারিকারণ হয়। যে পদার্থ উপস্থিত থাকলে উপলব্ধি হয়, তার অনুপলব্ধিই যোগ্যানুপলব্ধি। যেমন এই ভূতলে ঘট থাকলে ভূতলের ন্যায় ঘটেরও উপলব্ধি হতো। কিন্তু এখন ভূতলের উপলব্ধি হলেও ঘটের উপলব্ধি হচ্ছে না। তাই ঘটের এই অনুপলব্ধিকে বলা হবে যোগ্যানুপলব্ধি। ঘটাভাবাদির সঙ্গে চক্ষুর সন্নিকর্ষ হলে যোগ্যানুপলব্ধিরূপ সহকারি কারণের মাধ্যমে ঐ সন্নিকর্ষ অভাবের লৌকিক প্রত্যক্ষ ঘটায়। ঘটাভাববিশিষ্ট ভূতলের জ্ঞানে ঘটাভাব ভূতলের বিশেষণ হওয়ায় ইন্দ্রিয়সংযুক্ত সন্নিকর্ষটি হবে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ। আবার ভূতলে ঘটাভাবের জ্ঞানে ঘটাভাবটি বিশেষ্য হওয়ায় চক্ষুসংযুক্ত সন্নিকর্ষটি হবে বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষ।
বিশেষণতা ও বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষ ষড়বিধ। বিশেষণতার ক্ষেত্রে এই ষড়বিধ সন্নিকর্ষ হবে সংযুক্ত-বিশেষণতা, সংযুক্ত-সমবেত বিশেষণতা, সংযুক্ত-সমবেত-সমবেত বিশেষণতা, সমবেত-বিশেষণতা, সমবেত-সমবেত-বিশেষণতা ও বিশেষণতা-নিরূপিত-বিশেষণতা। অনুরূপভাবে বিশেষ্যতা সন্নিকর্ষও ষড়বিধ হয়।
.
অভাবের শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অভাবকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) অন্যোন্যাভাব ও (খ) সংসর্গাভাব।
.
(ক) অন্যোন্যাভাব : অন্যোন্যাভাব বলতে বোঝায় দুটি বস্তুর পারস্পরিক ভেদ। অন্য, ভিন্ন, অপর, পৃথক, নহে, নয় ইত্যাদি শব্দ থেকে অন্যোন্যাভাবের প্রতীতি হয়। যেমন, রস রূপ হতে অন্য, গুণ দ্রব্য হতে ভিন্ন, বিশেষ সামান্য হতে অপর বস্তু, ক্রিয়া গুণ হতে পৃথক, রাম শ্যাম নয়, তেঁতুল মিষ্ট নয়, ঘট পট নয় ইত্যাদি বাক্য অন্যোন্যাভাবের প্রকাশক।
.
‘অন্যোন্য’ শব্দের অর্থ পরস্পর। এক্ষেত্রে পরস্পর অর্থ প্রতিযোগী ও অনুযোগী। অন্যোন্যের অভাব অন্যোন্যাভাব। দুটি ভিন্ন জিনিসের মধ্যে পাস্পরিক যে অভাব, তাকে বলে অন্যোন্যাভাব। যেমন, গরু ও অশ্বের পারস্পরিক অভাব। এই অন্যোন্যাভাবের দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্য।
প্রথমত, যে ভেদবিশেষের যা প্রতিযোগী, তা তারই অনুযোগী হয় না। যেমন, জলভেদের প্রতিযোগী জল। সুতরাং, জল জলভেদের অনুযোগী হয় না। যদি তা হতো তাহলে জল ‘জল ভিন্ন’ হতো। ভেদের প্রতিযোগী এবং অনুযোগী পরস্পর বিভিন্ন পদার্থই হবে এরূপ স্বভাব নির্ধারিত থাকায় জল কখনও জলভিন্ন হয় না। কিন্তু জলভিন্ন হয় অগ্নি বা অন্যান্য কিছু।
দ্বিতীয়ত, যে প্রতিযোগী পদার্থের ভেদ যে অনুযোগী পদার্থে থাকে, সেই অনুযোগী পদার্থের ভেদও সেই প্রতিযোগী পদার্থে অবশ্যই থাকে। যেমন, রাম শ্যাম হতে ভিন্ন। সুতরাং, শ্যামও রাম থেকে ভিন্ন হবেই। প্রতিযোগী ও অনুযোগীর পরস্পর এই বৈপরীত্য থেকে ভেদের অন্যোন্যাভাব সংজ্ঞার তাৎপর্য বোঝা যায়।
.
নব্য নৈয়ায়িক বিশ্বনাথ ন্যায়-পঞ্চানন মুক্তাবলীতে অন্যোন্যাভাবের লক্ষণে বলেছেন-
‘অন্যোন্যাভাবত্বং তাদাত্ম্য-সম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকাভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাবের প্রতিযোগিতা তাদাত্ম্য (অবিচ্ছেদ্য) সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন (পৃথক) সেই অভাবকেই অন্যোন্যাভাব বলে।
.
এই লক্ষণ অনুসারে, ‘ঘট পট নয়’ বা ‘গরু অশ্ব নয়’ ইত্যাদি বাক্যে যে অভাবের কথা বলা হয় তাই অন্যোন্যাভাব। প্রশ্ন হলো, এরূপ আকারের অভাবসূচক বাক্যে কাকে নিষেধ করা হয় ? ‘ঘট পট নয়’ এরূপ প্রতীতির বিষয়রূপে যে অভাব তা ঘট-অনুযোগিক ও পট-প্রতিযোগিক। ঘটে পট নিষিদ্ধ হয় তাদাত্ম্য সম্বন্ধে। তাই তাদাত্ম্য সম্বন্ধটি প্রতিযোগিতার অবচ্ছেদক বা প্রতিযোগিতাবচ্ছেদক সম্বন্ধ। এক্ষেত্রে ঘটাধিকরণে পটরূপ প্রতিযোগীকে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে নিষেধ করা হয়। অন্যোন্যাভাব সম্পর্কে এটিই নব্যমত।
.
অন্যদিকে প্রাচীনমতে অন্যোন্যাভাবে যা নিষিদ্ধ হয় তা হলো দুটি পদার্থের তাদাত্ম্য সম্বন্ধ, তাদাত্ম্যসম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগী নয়। ‘ঘট পট নয়’ এরূপ অভাবপ্রতীতির বিষয় হলো পট-তাদাত্ম্য। এক্ষেত্রে প্রাচীন মতানুসারী নৈয়ায়িক আচার্য উদয়ন বলেন- ‘এই বাক্যের দ্বারা যার নিষেধ হয়, তা হচ্ছে ঘটের সঙ্গে পটের তাদাত্ম্য। কাজেই অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী হচ্ছে এই তাদাত্ম্য সম্বন্ধ। তবে এই তাদাত্ম্য বাস্তবিক তাদাত্ম্য নয়। ঘটের সঙ্গে পটের বাস্তবিক তাদাত্ম্য থাকে না। যখন ‘ঘট পট নয়’ এই জ্ঞান হয়, তখন ঘটে আরোপিত পট-তাদাত্ম্যের নিষেধ বিষয় হয়। এখানে নিষেধ করা হচ্ছে পট-তাদাত্ম্যের। ঘটেই নিষেধ করা হচ্ছে। কাজেই ঘট হচ্ছে এই নিষেধের অধিকরণ বা অনুযোগী এবং পট-তাদাত্ম্য হচ্ছে প্রতিযোগী।
.
কিন্তু নব্য ন্যায়মতে নিষেধের বিষয় পট-তাদাত্ম্য নয়, পট। তবে পট ঘটে নিষিদ্ধ হচ্ছে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে। সুতরাং তাদাত্ম্য সম্বন্ধটি প্রতিযোগী নয়, প্রতিযোগিতার অবচ্ছেদক সম্বন্ধ। অর্থাৎ, যে প্রতিযোগীটি তাদাত্ম্য সম্বন্ধে নিষিদ্ধ হয়, তাকে বলে অন্যোন্যাভাব। নব্যনৈয়ায়িক অন্নংভট্টও তর্কসংগ্রহে অন্যোন্যাভাবের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-
‘তাদাত্ম্যসম্বন্ধাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকঃ অন্যোন্যাভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অন্যোন্যাভাব হলো সেই অভাব যার প্রতিযোগিতা তাদাত্ম্য সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন।
.
অন্যোন্যাভাব এক ও নিত্য। ‘ঘট পট নয়’, ‘গরু অশ্ব নয়’, ‘রাম রহিম নয়’ প্রভৃতি অভাব প্রতীতিতে একই নিত্য অন্যোন্যাভাব প্রতীত হয়। এই অভাব বা পারস্পরিক ভেদ এমন নয় যে আজ আছে, কাল থাকবে না। এই ভেদ চিরকালীন। ঘট ও পট বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাদের ভেদ অবিনাশী। কোন ঘট ও পট না থাকলেও ঘট ও পটের ভেদ থাকেই। ঘট ও পট বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু বিনষ্ট হয়ে এক হয়ে যেতে পারে না। কারণ দুটি ভিন্ন বস্তু কখনই অভিন্ন হতে পারে না। তাই অন্যোন্যাভাব নিত্য।
.
(খ) সংসর্গাভাব : অন্যোন্যাভাব ভিন্ন অভাবকে বলা হয় সংসর্গাভাব। যার দ্বারা একটি পদার্থ অন্য একটি পদার্থের আশ্রয় হয় তাকে সংসর্গ বলে। সংযোগ, সমবায় প্রভৃতি সম্বন্ধের দ্বারা একটি পদার্থ অন্য একটি পদার্থের আশ্রয় হয় বলে সংযোগাদিকে সংসর্গ বলে। তাদাত্ম্য (অবিচ্ছেদ্যতা) এই অর্থে সংসর্গ নয়। যে অভাব স্বপ্রতিযোগী সংসর্গবিরোধী তাই সংসর্গাভাব। সংসর্গাভাবমাত্রই তাই কোন অনুযোগীতে কোন প্রতিযোগীর সংসর্গের অভাব। যেমন, টেবিলে ঘটের অভাব। এখানে অনুযোগী টেবিলে প্রতিযোগী ঘটের সংসর্গের অভাব প্রতীতি হয়। এভাবে সংসর্গাভাবকে অন্যোন্যাভাবভিন্ন অভাব বলা যায়। তাই সংসর্গাভাবের লক্ষণে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন মুক্তাবলীতে বলেছেন-
‘সংসর্গাভাবান্যোন্যাভাবভিন্ন অভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : অন্যোন্যাভাব ভিন্ন অভাবই হলো সংসর্গাভাব।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী কেবল তাদাত্ম্য সম্বন্ধের দ্বারাই অবচ্ছিন্ন হয়, কিন্তু সংসর্গাভাবের প্রতিযোগী সংযোগ, সমবায়, স্বরূপ প্রভৃতি সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হতে পারে।
সংসর্গাভাব ত্রিবিধ- (১) প্রাগভাব, (২) ধ্বংসাভাব ও (৩) অত্যন্তাভাব।
.
(১) প্রাগভাব : কোন একটি বস্তু উৎপন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা যে অভাব, তাকে প্রাগভাব বলে। প্রাক+অভাব- এইরূপ ব্যুৎপত্তি অনুসারে কোন কার্যের উৎপত্তির পূর্বে তার সমবায়িকারণে ঐ কার্যের যে অভাব, তাই ঐ কার্যের প্রাগভাব। যেমন, একটা বস্ত্রের উৎপত্তির পূর্বে, সুতোতে ঐ বস্ত্রের অভাব হলো ঐ বস্ত্রের প্রাগভাব। বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন মুক্তাবলীতে প্রাগভাবের লক্ষণে বলেছেন-
‘বিনাশ্যভাবত্বং প্রাগভাবত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাব বিনাশ্য বা যে অভাবের বিনাশ আছে তাই প্রাগভাব।
.
এখানে ‘যে অভাবের বিনাশ আছে’ বলতে বোঝায়, যে অভাবের বিনাশ আছে কিন্তু উৎপত্তি নেই। কেননা, যে ঘটটি এখনও উৎপন্ন হয়নি, জগতে সেই ঘটের অভাব আছে। এই অভাব কখন শুরু হয়েছে কেউ জানে না। উৎপত্তির পূর্বে একটি পদার্থ কোন কালেই থাকতে পারে না, তাই তার প্রাগভাব অনাদি। তবে যে মুহূর্তে ঘটটি উৎপন্ন হবে, সেই মুহূর্তেই ঐ ঘটের অভাব বিনষ্ট হবে। অর্থাৎ প্রাগভাব সান্ত, তার অন্ত বা শেষ আছে। তাই তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট আরো স্পষ্টভাবে প্রাগভাবের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অনাদি সান্তঃ প্রাগভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব অনাদি ও সান্ত, তাই প্রাগভাব।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যে প্রতিযোগীর প্রাগভাব থাকে, তারই উৎপত্তি হয়, আবার প্রতিযোগীর উৎপত্তিতে প্রাগভাব বিনষ্ট হয়। তাই প্রাগভাব একাধারে প্রতিযোগীর জনক এবং প্রতিযোগীর দ্বারা বিনাশ্য।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা কোন কার্যের প্রাগভাবকে সেই কার্যের কারণ বলে স্বীকার করেছেন। যেহেতু প্রাগভাবকে কারণ বলে না মানলে একই ঘটের বারবার উৎপত্তির সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে। কারণ কুম্ভকার, ঘট-কপাল, কপালদ্বয়ের সংযোগ, কুম্ভকারের চক্র, লাঠি ইত্যাদি, দিক, কাল, অদৃষ্ট প্রভৃতি ঘট উৎপত্তির কারণ। এই কারণগুলির কোনটিই পরক্ষণে বিনষ্ট হতে বাধ্য নয়। সুতরাং, অনায়াসেই কল্পনা করা যায় যে, ঘটটি উৎপন্ন হওয়ার পরক্ষণেও এই কারণগুলি থাকবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়ক্ষণে আবার ঘটটির উৎপত্তি স্বীকার করতে হবে। যেহেতু কারণসমূহ উপস্থিত থাকলে পরক্ষণে কার্য উৎপন্ন হতে বাধ্য। কিন্তু একই ঘটের বারবার উৎপত্তি কেউ স্বীকার করেন না। যদি প্রাগভাবকে কারণ বলে স্বীকার করা হয় তাহলে এই সমস্যার সহজেই সমাধান করা যায়। কুম্ভকার, কপাল ইত্যাদির মতো ঘটের প্রাগভাবও ঘট উৎপত্তির কারণ। কিন্তু এই কারণটি অন্যান্য কারণের মতো নয়। ঘটটি উৎপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কারণ বিনষ্ট হয়ে যায়।
.
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, কার্যের প্রাগভাবের অধিকরণ কী ? অর্থাৎ ঘটটি উৎপত্তির পূর্বে ঐ ঘটের প্রাগভাব কোথায় ছিলো ?
ন্যায়-বৈশেষিক আচার্যরা এর উত্তরে বলেন, কার্যোৎপত্তির পূর্বে কার্যের সমবায়িকারণে তার প্রাগভাব থাকে। একটি ঘটের উৎপত্তির পূর্বে ঐ ঘটটির সমবায়িকারণ যে কপালদ্বয়, সেই কপালদ্বয়ই হলো ঐ ঘটের প্রাগভাবের অধিকরণ। ঘট ঘটাভাবের প্রতিযোগী। উভয়ের মধ্যে বিরোধ থাকায় ঘটের উৎপত্তিতে ঘটাভাব বিনষ্ট হয়। এজন্য প্রাগভাবকে বিনাশ্য অভাব বলা হয়। প্রাগভাবের অস্তিত্বে প্রমাণ হলো ‘কোন কার্য উৎপন্ন হবে’ এরূপ ব্যবহার।
.
(২) ধ্বংসাভাব : কোন একটি জিনিস ধ্বংস হয়ে যাবার পর তার যে অভাব শুরু হয়, তাকে ধ্বংসাভাব বলে। কোন কার্য বিনষ্ট হলে তার যে অভাব তাই ধ্বংসাভাব। যেমন একটি ঘট ভেঙে গেলে, তার সমবায়িকারণে বা অংশগুলিতে ঐ ঘটটির যে অভাব, তাই ঐ ঘটের ধ্বংসাভাব। মুক্তাবলীতে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন ধ্বংসাভাবের লক্ষণে বলেছেন-
‘জন্য অভাবত্বং ধ্বংসত্বম্’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : যে অভাব জন্য বা যে অভাবের উৎপত্তি আছে তাই ধ্বংসাভাব।
.
এখানে ‘যে অভাবের উৎপত্তি আছে’ বলতে বোঝায়, যে অভাবের উৎপত্তি আছে কিন্তু বিনাশ নেই। ধ্বংসাভাবের আদি আছে যেহেতু একটি বস্তুর বিশেষ বিশেষ সময়ে ধ্বংস হয়। কিন্তু এই অভাবের অন্ত বা শেষ নেই, যেহেতু ঐ বিনষ্ট ঘটটি আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ধ্বংসাভাবের লক্ষণে আরো স্পষ্টভাবে বলেন-
‘সাদিরনন্তঃ প্রধ্বংসঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব সাদি ও অনন্ত, তাই ধ্বংসাভাব।
.
প্রাগভাবের ন্যায় ধ্বংসাভাবও নিজ প্রতিযোগীর সমবায়িকারণে অবস্থিত হয় এবং ঐ সমবায়িকারণ নষ্ট হলে কালিক সম্বন্ধে থাকে। প্রাগভাবের সঙ্গে ধ্বংসাভাবের পার্থক্য হলো, প্রাগভাগ তার প্রতিযোগীর জনক, কিন্তু ধ্বংসাভাব তার প্রতিযোগীর দ্বারা জন্য বা উৎপন্ন। অর্থাৎ ঘট ধ্বংসের একটি কারণ হলো ঘট নিজে। উৎপত্তিযোগ্য দ্রব্য, গুণসমূহ, যাবতীয় কর্ম এবং প্রাগভাব- এরা ধ্বংসের প্রতিযোগী। কিন্তু ধ্বংস স্বয়ং কোন ধ্বংসের প্রতিযোগী নয়, যেহেতু ধ্বংসের ধ্বংস স্বীকৃত হয় না।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, ধ্বংসাভাব উৎপন্ন হয় অথচ বিনষ্ট হয় না। ঘট, পট, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি ভাবপদার্থ বিশেষ সময়ে উৎপন্ন হয়ে আবার তা একসময়ে বিনষ্ট হলেও, অভাবপদার্থের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কারণ ধ্বংসাভাবের অভাবপদার্থ বিনাশ হতে হলে যার দ্বারা ঐ অভাব উৎপন্ন হয়েছে সেই পদার্থেরই পুনরাবির্ভাব দরকার। কিন্তু বিনষ্ট পদার্থের পুনরাবির্ভাব কখনোই সম্ভব নয়। বিনষ্ট পদার্থের পুনরাবির্ভাবের জন্য তার কারণসামগ্রির উপস্থিতি প্রয়োজন। কোন পদার্থের প্রাগভাব তার কারণসামগ্রির অন্তর্গত। প্রাগভাব বিনষ্ট হয়েই পদার্থটির উৎপত্তি হয়েছে। ঐ প্রাগভাবের উপস্থিতি তাই আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ঐ পদার্থের পুনরাবির্ভাবও সম্ভব নয়। এজন্যেই ধ্বংসাভাব অনন্ত বা অবিনাশী।
.
(৩) অত্যন্তাভাব : কোন একটি জিনিসে অন্য কোন একটি জিনিসের চিরকালীন যে অভাব, তাকে বলে অত্যন্তাভাব। যেমন, বায়ুতে রূপের অভাব বা জলে গন্ধের অভাব প্রভৃতি অত্যন্তাভাবের দৃষ্টান্ত। বায়ুতে রূপ বা জলে গন্ধ কখনো ছিলো না, আবার কখনো থাকবেও না। এই অভাব নিত্য অর্থাৎ অনাদি ও অনন্ত। মুক্তাবলীতে অত্যন্তাভাবের লক্ষণে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন বলেছেন-
‘নিত্যসংসর্গাভাবত্বম্ অত্যন্তাভাবত্বম’। (সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : নিত্য সংসর্গের অভাবই হলো অত্যন্তাভাব।
.
ধ্বংসাভাবের আদি আছে, অন্ত নেই। প্রাগভাবের অন্ত আছে, আদি নেই। কিন্তু অত্যন্তাভাবের আদিও নেই, অন্তও নেই। এই নিত্য সংসর্গের অভাব ত্রৈকালিক অর্থাৎ অতীতে যে অভাব ছিলো, বর্তমানে সে অভাব আছে এবং ভবিষ্যতেও এই অভাব থাকবে। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অত্যন্তাভাবের লক্ষণে বলেন-
‘ত্রৈকালিক সংসর্গাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাকঃ অত্যন্তাভাবঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে অভাব ত্রৈকালিক অর্থাৎ নিত্য এবং যার প্রতিযোগিতা কোন সংসর্গ বা সম্বন্ধের দ্বারা অবচ্ছিন্ন, তাই অত্যন্তাভাব।
.
অত্যন্তাভাব নিত্য হিসেবে প্রাচীন নৈয়ায়িকেরা আকাশে কুসুমের অভাবের ন্যায় অলীকের অভাবকে অত্যন্তাভাব বলে উল্লেখ করলেও নব্য নৈয়ায়িকেরা অবশ্য অলীকের অভাব স্বীকার করেন না।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অন্যোন্যাভাব, প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব ও অত্যন্তাভাব এই চতুর্বিধ অভাব সাধারণভাবে প্রচলিত। কিন্তু এই চতুর্বিধ বিভাগ ছাড়াও ন্যায়-বৈশেষিক প্রস্থানে নানা ধরনের অভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় এ ধরনের কয়েকটি অভাবের আলোচনা করেছেন, যেমন- সাময়িক অভাব, অভাবের অভাব, ব্যধিকরণ ধর্মাবচ্ছিন্ন অভাব, কেবলাভাব, বিশিষ্টাভাব, সামান্যাভাব, বিশেষাভাব, অন্যতরাভাব, উভয়াভাব প্রভৃতি। ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লিখিত হলেও এই অভাবগুলি ইতঃপূর্বে বর্ণিত চতুর্বিধ বিভাগের কোন না কোনটির অন্তর্গত হতে পারে বলে মনে করা হয়।
কারণ ও তার বিভাগ
.
বৈশেষিক মতে এই জগৎ অনিত্য। জগতের সৃষ্টি আছে এবং লয় আছে। জগতের সৃষ্টি ও লয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় কার্য-কারণ তত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। কারণ ও কার্য হলো যথাক্রমে স্রষ্টা ও সৃষ্ট। স্রষ্টা কোন কিছু সৃষ্টি করে। স্রষ্টার এই সৃষ্টি হলো কার্য। কারণ হলো কার্যের ঘটক। কারণ নিত্য হতে পারে, আবার অনিত্য হতে পারে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল, দিক, আকাশ, ঈশ্বর, পরমাণু এইগুলি হলো নিত্য কারণ। এই কারণগুলি অন্য কারণের দ্বারা সৃষ্ট নয়। অপরদিকে ঘট, পট প্রভৃতি কারণ হলো অনিত্য কারণ। ঘট, ঘটরূপের কারণ। কিন্তু এই ঘট আবার কপালদ্বয় সংযোগের কার্য। এইজন্য ঘটকে অনিত্য কারণ বলি। অনিত্য কারণের উৎপত্তি ও বিনাশ থাকে।
.
বিভিন্ন বৈশেষিক শাস্ত্রে নানাভাবে কারণের লক্ষণ দেয়া হয়েছে। এইসকল লক্ষণ প্রধানত কার্য ভিত্তিক। অর্থাৎ কার্যের ভিত্তিতেই কারণের লক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যোন্যাশ্রয় দোষ অর্থাৎ পারস্পরিক আশ্রয়দোষ পরিহারের অভিপ্রায়ে কারণের ভিত্তিতে কার্যের লক্ষণ দেয়া হয় নি। স্বতন্ত্রভাবেই কার্যের লক্ষণ দেয়া হয়েছে।
.
কার্য (Effect) :
কার্যের লক্ষণ দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘কার্যং প্রাগভাব প্রতিযোগী’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কার্য হলো প্রাগভাবের প্রতিযোগী।
.
কোন পদার্থের উৎপত্তির পূর্বে যে অভাব থাকে তাকে বলা হয় প্রাগভাব। যেকোন প্রকার অভাবের ক্ষেত্রে যে পদার্থটির অভাব অনুভূত হয় সেই পদার্থটিকে বলা হয় অভাবের প্রতিযোগী। প্রাগভাবের প্রতিযোগী যতক্ষণ না উৎপন্ন হয় ততক্ষণই তার প্রাগভাব থাকে। যে ঘটটি এখনও উৎপন্ন হয়নি, জগতে তার প্রাগভাব বর্তমান। ন্যায়মতে, কার্যের উৎপত্তির পূর্বে তার প্রাগভাব থাকে। ঘটের উৎপত্তির পূর্বে ঘটের প্রাগভাব থাকে। যা উৎপন্ন হয় তাই কার্য। যে ক্ষণে ঘটটি উৎপন্ন হবে সেই ক্ষণেই ঐ ঘটের প্রাগভাব ধ্বংস হবে। বস্তুত প্রাগভাব ধ্বংস করেই কার্য উৎপন্ন হয়। যার প্রাগভাব নেই, তার উৎপত্তিরও প্রশ্ন নাই। এজন্য কোন কার্যের উৎপত্তির প্রতি ঐ কার্যের প্রাগভাব অন্যতম কারণরূপে বিবেচিত হয়। কার্য হলো তাই, উৎপত্তির পূর্বে যার অস্তিত্ব থাকে না, যা পরে আরম্ভ হয়। ফলে কার্য যেহেতু তার প্রাগভাবকে ধ্বংস করে উৎপন্ন হয়, সেহেতু কার্যকে প্রাগভাবের প্রতিযোগী বলা হয়েছে।
.
কারণ (Cause) :
কারণের লক্ষণে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
.
তন্তু, তন্তুসংযোগ, তন্তুবায়, তুরী, বেমা বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বলে বস্ত্রের কারণ। মৃত্তিকা, কুম্ভকার, জল ঘটের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বলে ঘটের কারণ। এখানে ‘কার্য’ শব্দটি পূর্ববৃত্তির বিশেষণ এবং ‘নিয়ত’ শব্দটিও পূর্ববৃত্তির বিশেষণ। বৃত্তি মানে থাকা। ‘পূর্ববৃত্তি’ বলতে বোঝায় পূর্বে বৃত্তি বা পূর্বে থাকা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, কার পূর্বে বৃত্তি ? এর উত্তরে বলা হয়, কার্যের পূর্বে বৃত্তি। আর যদি প্রশ্ন উঠে, কিরূপ পূর্ববৃত্তি ? এর উত্তর হবে কার্যের নিয়ত পূর্বে বৃত্তি। পুনরায় যদি প্রশ্ন উঠে, কত পূর্বে বৃত্তি ? এর উত্তর হবে, অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি। যদিও অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে স্পষ্টত অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি বলেননি, তবু পরবর্তী টীকাকারেরা অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি যে গ্রন্থকারের অভিপ্রায় তা ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, পূর্ব শব্দের দ্বারা কার্যের দূরবর্তী পূর্বগামী পদার্থকে বুঝলে হবে না। পূর্ব শব্দের দ্বারা কার্যের দূরবর্তী পূর্বগামী পদার্থকে বুঝলে গতকাল উৎপন্ন বস্ত্রের কারণ তন্তু, বেমা, তুরী প্রভৃতি আজকে উৎপন্ন বন্ত্রের নিয়ত পূর্ববর্তী বলে ঐ বস্ত্রের প্রতি কারণ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না। গতকাল উপস্থিত তুরী, বেমা, তন্তু প্রভৃতি আজকে উৎপন্ন বস্ত্রের প্রতি তাদের কারণ বলা যাবে না। অতএব পূর্ববৃত্তি মানে কার্যের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বে থাকা। এরপরেও যদি প্রশ্ন উঠে, কোথায় বা কোন্ স্থলে পূর্ববৃত্তি ? তার উত্তরে বলা হয়, কার্যের অধিকরণে পূর্ববৃত্তি। অর্থাৎ, যা কার্যের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণে কার্যের অধিকরণে নিয়ত থাকে, তাই কারণ। কোন স্থলে যখন কোন কার্য ঘটে তখন সেই স্থলে কার্য ঘটার অব্যবহিত পূর্বে ঘটক কারণ উপস্থিত থেকে কার্যকে ঘটায়। সর্বত্র এইরূপ নিয়ম। এই জন্য কারণকে কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি বলা হয়েছে।
.
কারণের এই লক্ষণে ‘নিয়ত’ শব্দ ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ‘নিয়ত’ শব্দ না দিলে কারণের লক্ষণ হয়ে যাবে- ‘যা কার্যের পূর্বে থাকে তাই কারণ’। কিন্তু এটি কারণের লক্ষণ হলে তা অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হবে। ঘট-কার্যের উৎপত্তির পূর্বে মৃত্তিকা বহনকারী গর্দভ (রাসভ) কখনও কখনও উপস্থিত থাকতে পারে। ফলে গর্দভ ঘট-কার্যের পূর্ববৃত্তি হওয়ায় গর্দভকেও ঘট-কার্যের কারণ বলতে হবে। পূর্ববৃত্তি কারণের লক্ষণ গর্দভে সমন্বয় হয়ে যায় বলে লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্যেই কারণের লক্ষণে ‘নিয়ত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ কার্যের কেবল পূর্ববৃত্তি নয়, কারণ কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি। গর্দভ ঘটরূপ কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কখনও থাকলেও ঘটরূপ কার্যের উৎপত্তির পূর্বে নিয়ত থাকে না। গর্দভ ঘটের উৎপত্তিতে অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়। অর্থাৎ কারণের লক্ষণে যদি ‘নিয়ত’ শব্দটি সন্নিবিষ্ট না হয় তাহলে কোন আকস্মিক পূর্ববর্তী ঘটনাও কার্যের কারণ বলে বিবেচিত হতে পারে। একটি ঘটের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণে কোন একটি কাক উড়ে যেতে পারে, কিন্তু তার জন্য ঐ ঘটনাকে ঘট-কার্যের কারণ বলা যায় না। যেখানে কার্য, সেখানে কারণ থাকে। তাই কারণ কার্যের ব্যাপক হয়। ‘নিয়ত’ শব্দের অর্থ নিয়মযুক্ত বা সর্বত্র বা ব্যাপক। গর্দভ বা কাক ঘট-কার্যের ব্যাপক হয় না বলে ঘটের কারণ হয় না। যখনই কোন কার্য ঘটে তখনই তার পূর্বে তার কারণ উপস্থিত হয়। একই জাতীয় কার্যের উৎপত্তিতে সর্বদা একই জাতীয় কারণের পূর্ববৃত্তিত্ব থাকে। অতএব যা কোন কার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী তাকেই ঐ কার্যের কারণ বলা হয়।
.
আবার কারণের লক্ষণে ‘পূর্ববৃত্তি’ শব্দটিও অপরিহার্য। শুধু বৃত্তি বললে কারণের লক্ষণ হবে- ‘যা কার্যের সঙ্গে নিয়ত বৃত্তি তাই কারণ’। এবং এটি কারণের লক্ষণ হলে এক্ষেত্রেও তা অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হবে। কেননা ঘটকার্য নিয়ত নিজের সঙ্গে থাকায় ঘট নিজেই নিজের প্রতি কারণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কারণের লক্ষণ কার্যে সমন্বয় হয়ে যাবে। ফলে কারণের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। যে কোন বস্তু তাদাত্ম্য সম্বন্ধে সর্বদা নিজের সঙ্গে থাকে। তাই যে কোন কার্যও তাদাত্ম্য সম্বন্ধে সর্বদা নিজের সঙ্গে থাকে। ফলে একটি কার্য নিজেই নিজের ব্যাপক হবে, যাকে বলে স্ব-ব্যাপক বা স্ব-নিয়ত। কিন্তু যা কার্যের বাপক তাই কারণ, এটা হতে পারে না। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্যেই কারণের লক্ষণে ‘পূর্ববৃত্তি’ শব্দ সংযোজিত হয়েছে।
.
কিন্তু এতোসব ব্যাখ্যার পরেও কারণের এই যে লক্ষণ- ‘কার্যনিয়ত পূর্ববৃত্তি কারণম্’ বা ‘যা কার্যের নিয়ত পূর্বে থাকে তাই কারণ’, তাতেও কারণের লক্ষণ নির্দোষ হয় না। একটি কার্য উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বে জগতে এতো বিচিত্র ঘটনা ঘটে যাদের সঙ্গে হয়তো ঐ কার্যের কোন সম্পর্ক নাই। যেমন- তন্তু বা সুতা যেমন বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি হওয়ায় বস্ত্রের কারণ হবে, তেমনি তন্তুরূপও বস্ত্রের কারণ হয়ে পড়বে। কেননা তন্তুর মতো তন্তুরূপও বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি। কিন্তু ন্যায়মতে তন্তু বস্ত্রের কারণ হলেও তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি কারণ নয়। কার্যের সাথে এরূপ সম্বন্ধহীন ঘটনাকে কারণ থেকে বহির্ভূত করার জন্য নৈয়ায়িকরা অনন্যথাসিদ্ধ বা অন্যথাসিদ্ধিশূন্য ধারণার সাহায্য নিয়েছেন।
.
যে ঘটনা কোন কার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী হয়েও কার্যের জনক হয় না, তাই অন্যথাসিদ্ধ। অন্যথাসিদ্ধির অভাব বা বিরহই হলো অনন্যথাসিদ্ধ বা অন্যথাসিদ্ধিশূন্য। অন্যথাসিদ্ধ কার্যের কারণ হয় না। অনন্যথাসিদ্ধই কার্যের কারণ হয়। যে তন্তু পট বা বস্ত্র উৎপন্ন করে সেই তন্তু পটের কারণ। কিন্তু ঐ তন্তুর রূপ পটরূপের কারণ হলেও ঐ পটের কারণ নয়। অথচ তন্তুর রূপ তন্তুর সঙ্গেই পটকার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী হয়। এই কারণে তন্তুর রূপকে পটকার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ বলা হয়। এইরূপ অন্যথাসিদ্ধিশূন্য নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনাকেই কোন কার্যের কারণ বলা যায়। এইজন্য অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় অবশেষে কারণের নির্দোষ লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অনন্যথাসিদ্ধ নিয়ত পূর্ববৃত্তিত্বং কারণত্বম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যা অনন্যথাসিদ্ধ ও নিয়ত পূর্ববৃত্তি, তাই কারণ।
.
অতএব, কারণের প্রকৃত লক্ষণ হলো, যা অন্যথাসিদ্ধ নয়, অর্থাৎ অনন্যথাসিদ্ধ- যা কার্যের উৎপত্তির জন্য অপ্রয়োজনীয় নয়, এবং যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
.
অন্যথাসিদ্ধি ও তার প্রকারভেদ :
অন্নংভট্ট অন্যথাসিদ্ধির কোন লক্ষণ দেননি। তিনি তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেছেন- যা কোন কার্যের কারণ, তা অন্যথাসিদ্ধ হবে না, অন্যথাসিদ্ধ থেকে ভিন্ন হবে (অনন্যথাসিদ্ধ)। অতএব বলা যায়, যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, অথচ কোন যুক্তিতে তা কার্যের উৎপত্তির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়, তাই অন্যথাসিদ্ধ। যেমন, তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ। তন্তু রূপ ছাড়া হয় না, তন্তুর কোন না কোন রূপ থাকবেই। কিন্তু বস্ত্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেহেতু তন্তুই, তা যে কোন রঙেরই হোক না কেন, বস্ত্রের উৎপত্তির জন্য অপরিহার্য, তাই তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ, কিন্তু তা বস্ত্ররূপের প্রতি কারণ।
.
বিভিন্ন ন্যায়শাস্ত্রে অন্যথাসিদ্ধির বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। তর্কসংগ্রহদীপিকায় অন্নংভট্ট তিন প্রকার অন্যথাসিদ্ধির উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
.
(ক) প্রথমপ্রকার অন্যথাসিদ্ধির ব্যাখ্যায় অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘যেন সহৈব যস্য যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বং অবগম্যতে, তং প্রতি তেন তৎ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : কোন কার্যের প্রতি যে পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব যে সব ধর্মের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে জ্ঞাত হয়, সেই কার্যের প্রতি সেই সব ধর্ম ঐ কার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ।
.
যেমন পটকার্যের প্রতি তন্তুর রূপ, তন্তুত্ব প্রভৃতি ধর্ম। তন্তুর কোন না কোন রূপ থাকবেই। আবার তন্তুতে তন্তুত্ব বলে জাতি বা ধর্ম সর্বদাই থাকে। তন্তু পটের নিয়ত পূর্ববর্তী ও পটের কারণ। তন্তুর রূপ ও তন্তুত্ব তন্তু সহযোগেই পটের নিয়ত পূর্ববর্তী। স্বতন্ত্রভাবে তারা পটকার্যের প্রতি নিয়ত পূর্ববর্তী হয় না। তন্তু কারণ হওয়ায় তার দ্বারা তার রূপ ও জাতি পটকার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ হয়। বস্তুতঃ তন্তুই পটের কারণ। পট যেহেতু তার রূপ ও জাতির আশ্রয়, সেইহেতু তন্তুর সঙ্গে তাদের পটের প্রতি নিয়ত পূর্ববৃত্তিত্ব ঘটে থাকে।
.
প্রশ্ন হতে পারে, তন্তুরূপ ও তন্তুত্ব যেহেতু তন্তুর মতোই পট বা বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, তবে তাদের তন্তুর মতোই বস্ত্রের প্রতি কারণ বলা হবে না কেন ? উত্তরে বলা হয়েছে, লাঘবের নীতি অনুযায়ী তন্তুরূপ ও তন্তুত্বকে বস্ত্রের কারণ বলা হয়নি। যদি অল্পসংখ্যক নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপারের দ্বারা কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে অধিকতর নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপার স্বীকার করলে গৌরব দোষ হয়। তন্তুরূপ তন্তু (দ্রব্য) ছাড়া থাকতে পারে না, তন্তুত্বের জ্ঞান তন্তুর পূর্বজ্ঞান ছাড়া হয় না। তাই পট বা বস্ত্রের উৎপত্তির ব্যাপারে তন্তু ছাড়া তন্তুর অপরিহার্য ধর্মকে কারণরূপে স্বীকার করা অপ্রয়োজনীয়।
.
(খ) দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির বর্ণনা দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘অন্যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বে জ্ঞাত এব যস্য যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বং অবগম্যতে তং প্রতি তৎ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : অন্য কার্যের প্রতি কোন পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব জানার পরই যদি আরেকটি কার্যের প্রতি সেই পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব জানা যায়, তবে সেই দ্বিতীয় কার্যের প্রতি ঐ পদার্থ অন্যথাসিদ্ধ হয়।
.
যেমন পটকার্যের প্রতি আকাশ নিয়ত পূর্ববৃত্তি হলেও অন্যথাসিদ্ধ। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, আকাশ নিত্য ও বিভু (সর্বব্যাপী) দ্রব্য। তাই আকাশ যে কোন কার্যেরই নিয়ত পূর্ববৃত্তি। তাই আকাশকে যে কোন কার্যের প্রতি কারণ বলতে হয়। কিন্তু নৈয়ায়িকরা তা বলেন না। আকাশের পরিচয় হলো শব্দসমবায়িকারণত্ব। শব্দের সমবায়িকারণরূপে আকাশ শব্দের নিয়ত পূর্ববর্তী। পটের প্রতি আকাশের পূর্ববৃত্তিত্বের জ্ঞানের পূর্বে শব্দের প্রতি তার পূর্ববৃত্তিত্বের জ্ঞান সর্বদা হওয়ায় আকাশকে শব্দেরই কারণ বলা হয়, তাই পটের প্রতি আকাশ অন্যথাসিদ্ধ। যদিও বৈশেষিকেরা একাধিক কার্যের প্রতি একটি পদার্থের কারণতা স্বীকার করেন, তবুও যেক্ষেত্রে একটি কার্যের কারণতা জানতে হলে সর্বদাই অন্য একটি কার্যের প্রতি কারণতা আগে জানতে হয় সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়াদি কার্যের প্রতি তার কারণতা সিদ্ধ হয় না। দ্বিতীয়াদি কার্যের প্রতি তা অন্যথাসিদ্ধ হয়।
.
প্রশ্ন হতে পারে, আকাশ পটের নিয়ত পূর্ববৃত্তি হলেও তা পটের কারণ নয় কেন ? উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, লাঘবের নীতি অনুযায়ী আকাশকে পটের প্রতি কারণ বলা হয় নি। অল্পসংখ্যক নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপারের দ্বারা কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলে অধিকতর নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপার স্বীকার করলে গৌরব দোষ হয়। পটের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তন্তু প্রভৃতি অন্যান্য নিয়ত পূর্বগামী পদার্থের উল্লেখই যথেষ্ট ও প্রয়োজনীয়। তাই আকাশকে পটের কারণ বললে গৌরব দোষ হয়। আকাশ শব্দের জনক। শব্দজনকত্বই আকাশের পরিচায়ক। আকাশ আকাশরূপে শব্দ ভিন্ন কার্যের কারণ হয় না। তাই আকশ আকাশরূপে শব্দ ভিন্ন সব কার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ।
.
(গ) তৃতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির ব্যাখ্যায় অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘অন্যত্র ক্লিপ্ত নিয়তপূর্ববর্তিনা এব কার্যসম্ভবে তৎ সহভূতম্ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যে সব নিয়তপূর্বগামী ব্যাপার কার্যের উৎপত্তির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় তাই কার্যের কারণ, তার সঙ্গে যা যা থাকে তা তা অন্যথাসিদ্ধ।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, পাকের ফলে পাকজস্থলে একটি পার্থিব দ্রব্যে রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ এই চারটি গুণ যুগপৎ অর্থাৎ একসঙ্গেই উৎপন্ন হয়। পাকের ফলে উৎপন্ন রূপাদিকে পাকজ রূপ, পাকজ রস, পাকজ গন্ধ, পাকজ স্পর্শ বলা হয়। উৎপত্তির পূর্বে প্রতিটি গুণের প্রাগভাব তার উৎপত্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু গন্ধের উৎপত্তিতে গন্ধের প্রাগভাবই কারণ হবে। গন্ধ প্রাগভাবের সঙ্গে রূপপ্রাগভাব গন্ধের নিয়ত পূর্ববর্তী হলেও গন্ধের প্রতি রূপপ্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ হবে, কারণ হবে না। একইভাবে পাকজ রূপের প্রতি রূপের প্রাগভাব কারণ, গন্ধের প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ। কেননা পাকজ রূপের উৎপত্তির জন্য গন্ধের প্রাগভাব প্রয়োজনীয় নয়। অনুরূপ, পাকজ রসের প্রতি রসের প্রাগভাব কারণ, রূপাদির প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ, এবং পাকজ স্পর্শের প্রতি স্পর্শের প্রাগভাব কারণ, গন্ধাদির প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ।
.
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় উপরিউক্ত তিনপ্রকার অন্যথাসিদ্ধির কথা বললেও বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর ভাষাপরিচ্ছেদ গ্রন্থে পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি স্বীকার করেছেন- (১) কারণতার অবচ্ছেদক ধর্ম (যেমন, ঘটের প্রতি দণ্ডত্ব), (২) কারণের গুণ (যেমন, ঘটের প্রতি দণ্ডরূপ), (৩) ঘটাদি কার্যের প্রতি আকাশ, (৪) ঘটের প্রতি কুলালপিতা বা কুম্ভকারপিতা, (৫) ঘটমাত্রের প্রতি রাসভ (গর্দভ)। এই পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি সর্বসম্মত। তবে উল্লিখিত পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি অন্নংভট্ট স্বীকৃত তিন প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত।
.
(ক) উল্লিখিত প্রথম প্রকার অন্যথাসিদ্ধি কারণতার অবচ্ছেদক ধর্ম ও দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধি কারণের গুণ এই দুটিকে অন্নংভট্ট পৃথক পৃথক অন্যথাসিদ্ধি না বলে দুটিকে প্রথম প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
(খ) উল্লিখিত তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার অন্যথাসিদ্ধিকে অন্নংভট্ট দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
(গ) উল্লিখিত পঞ্চম প্রকার অন্যথাসিদ্ধি রাসভাদিকে অন্নংভট্ট তৃতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
.
টীকাকার নীলকণ্ঠের মতে, নব্য-নৈয়ায়িক গঙ্গেশকে অনুসরণ করে অন্নংভট্টের এই তিনপ্রকার শ্রেণীবিভাগই যুক্তিযুক্ত।
.
কারণের শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কারণ তিন প্রকার- (১) সমবায়িকারণ, (২) অসমবায়িকারণ ও (৩) নিমিত্তকারণ।
.
ন্যায়মতে কার্য দুই প্রকার হতে পারে- ভাবকার্য ও অভাবকার্য। ঘট, পট প্রভৃতি উৎপন্ন বস্তু ভাবকার্য। লাঠির আঘাতে ঘট ভেঙে গেলে ঘটের যে ধ্বংস উৎপন্ন হয় সেই ঘটধ্বংস অভাবকার্য। ন্যায়মতে ভাবকার্য সমবায়ি, অসমবায়ি ও নিমিত্ত- এই তিনটি কারণ হতে উৎপন্ন হয়। ভাবকার্য মাত্রেরই সমবায়ি, অসমবায়ি ও নিমিত্তকারণ থাকে। যেমন, তন্তু থেকে উৎপন্ন বস্ত্র ভাবকার্য। বস্ত্রের সমবায়িকারণ তন্তু, অসমবায়িকারণ তন্তুসংযোগ, নিমিত্তকারণ তন্তুবায়, তুরী, বেমা ইত্যাদি। কিন্তু ঘটধ্বংস রূপ অভাবকার্য কেবল নিমিত্তকারণ থেকে উৎপন্ন হয়। অভাবকার্যের সমবায়ি ও অসমবায়িকারণ নাই। অভাব কোথাও সমবায় সম্বন্ধে থাকে না বলে অভাব কার্যের সমবায়ি, অসমবায়ি কারণ হয় না। ঘটধ্বংস রূপ অভাবকার্য লাঠি, লাঠি ও ঘটের সংযোগ প্রভৃতি নিমিত্তকারণ থেকে উৎপন্ন।
.
(১) সমবায়িকারণ (Inherent cause) : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সমবায়িকারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘যৎ সমবেতং কার্যমুৎপদ্যতে তৎ সমবায়িকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যাতে অর্থাৎ যে দ্রব্যে সমবেত হয়ে বা সমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্যের উৎপত্তি হয়, তাই কার্যের সমবায়িকারণ।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে দ্রব্যই গুণ-ক্রিয়াদির আশ্রয়। একমাত্র দ্রব্যেই সমবায় সম্বন্ধে কার্য উৎপন্ন হতে পারে। তাই কেবল দ্রব্যই এই মতে সমবায়িকারণ হতে পারে। যেমন, তন্তু পট বা বস্ত্রের সমবায়িকারণ এবং পট পটরূপের সমবায়িকারণ। তন্তু দ্রব্য। তন্তুতে সমবেত হয়ে পট উৎপন্ন হয়। তাই তন্তু অর্থাৎ দ্রব্যই সমবায়িকারণ হয়। গুণ বা কর্ম (ক্রিয়া) সমবায়িকারণ হয় না। পট হলো অবয়বী (whole) এবং তন্তুসমূহ হলো তার অবয়ব (part)। ন্যায়মতে অবয়বী ও অবয়বের সম্বন্ধ সমবায়। পট (কার্য) তন্তুসমূহে (অবয়ব) সমবায় সম্বন্ধে থেকে উৎপন্ন হয়। তাই তন্তুসমূহ পটের সমবায়িকারণ। ন্যায়মতে, কার্য ও কারণ সমানাধিকরণ হওয়া প্রয়োজন। পট তন্তুতে সমবায় সম্বন্ধে এবং তন্তু তন্তুতে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে থাকায় তন্তু (কারণ) ও পট (কার্য) সমানাধিকরণ হয় বা একই অধিকরণে থাকে বলা যায়। তাই তন্তু পটের কারণ হয়।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, জন্যদ্রব্য অর্থাৎ উৎপন্নদ্রব্য গুণ ও কর্মের সমবায়িকারণ হওয়ায় দ্রব্যকে গুণ ও কর্মের অন্তত একক্ষণ আগে উৎপন্ন হতে হয়। যে ক্ষণে দ্রব্য উৎপন্ন হয় সেইণে দ্রব্য নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় থাকে। দ্রব্য উৎপত্তির পরক্ষণে গুণ উৎপন্ন করে কিন্তু কর্ম উৎপন্ন হওয়ার জন্য আরো একটি ক্ষণ প্রয়োজন হয়। কর্ম উৎপন্ন হওয়ার জন্য সংযোগ-বিভাগের অপেক্ষা করে। সংযোগাদি গুণ হওয়ায় দ্রব্য উৎপত্তির পরক্ষণেই তা উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু সংযোগের উৎপত্তিক্ষণে কর্মের উৎপত্তি সম্ভব নয়। তাই কর্মকে উৎপত্তির জন্য আরো একক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সুতরাং বলতে হয় যে, প্রথমক্ষণে দ্রব্যের উৎপত্তি, দ্বিতীয়ক্ষণে গুণের উৎপত্তি এবং তৃতীয়ক্ষণে কর্মের উৎপত্তি স্বীকার্য।
.
(২) অসমবায়িকারণ (Non-inherent cause) : তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট অসমবায়ি কারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘কার্যেণ কারণেন বা সহ একস্মিন অর্থে সমবেতত্বে সতি যৎ কারণং তৎ অসমবায়িকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কার্যের সঙ্গে বা কারণের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে অর্থাৎ সমবায়িকারণে থেকে যা কার্যকে উৎপন্ন করে তাই কার্যের অসমবায়িকারণ।
.
যেমন, তন্তুসংযোগ পটের (বস্ত্রের) অসমবায়িকারণ, তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ। তন্তুসংযোগের অধিকরণ তন্তুতে পট (কার্য) সমবায় সম্বন্ধে থাকে বলে তন্তুসংযোগ পটের অসমবায়িকারণ হয়। আবার তন্তুরূপের অধিকরণ তন্তুতে পটরূপের কারণ পট থাকে বলে তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ হয়।
.
অসমবায়িকারণ দুইভাবে কার্যের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়- (ক) সাক্ষাৎ সম্বন্ধে অসমবায়িকারণ কার্যৈকার্থ। অথবা (খ) পরম্পরা সম্বন্ধে অসমবায়িকারণ কারণৈকার্থ।
.
কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ : কার্যের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে যা কার্য উৎপন্ন করে সেই কারণকে বলা হয় কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ। অন্যকথায়, যখন কার্যের অসমবায়িকারণ কার্যের সমবায়িকারণে সাক্ষাৎ সমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্য উৎপন্ন করে তখন ঐ অসমবায়িকারণকে কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ বলা হয়। যেমন, তন্তুসংযোগ পটের অসমবায়িকারণ। এক্ষেত্রে পট কার্য তার অসমবায়িকারণ তন্তুসংযোগে থাকে না। কিন্তু তন্তুসংযোগের অধিকরণ তন্তুতে পট (কার্য) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। ফলে তন্তুসংযোগ (কারণ) ও পট (কার্য) সমানাধিকরণ হয়। তাই তন্তুসংযোগকে পটের অসমবায়িকারণ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, তন্তুসংযোগ কার্য পটের সঙ্গে পটের সমবায়িকারণ তন্তুতে সমবায় সম্বন্ধে সমবেত থেকে পট কার্য উৎপন্ন করে বলে পটের প্রতি তন্তুসংযোগ অসমবায়িকারণ।
.
কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ : কারণের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে যা কার্য উৎপন্ন করে সেই কারণকে বলা হয় কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ। অন্যকথায়, যখন কার্যের অসমবায়িকারণ কার্যের সমবায়িকারণে স্বসমবায়িসমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্য উৎপন্ন করে তখন ঐ অসমবায়িকারণকে কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ বলা হয়। যেমন, তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ। এখানে পটরূপ কার্য। কিন্তু তন্তুরূপ (কারণ) ও পটরূপ (কার্য)-এর সামানাধিকরণ্য (একই অধিকরণে থাকা) সাক্ষাৎভাবে দেখানো যায় না। তবে পরম্পরাভাবে এরা একই অধিকরণে থাকে, তা দেখানো যায়। তাই তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ।
তন্তুরূপ সমবায় সম্বন্ধে থাকে তন্তুতে। তন্তু তন্তুরূপে অধিকরণ। কিন্তু সেই তন্তুতে পটরূপ (কার্য) থাকে না। পটরূপ থাকে পটে। তাই তন্তুরূপ (কারণ) ও পটরূপ সমানাধিকরণ হয় না। কিন্তু তন্তুরূপের অধিকরণ তন্তুতে পটরূপের কারণ পট সমবায় সম্বন্ধে থাকে। অর্থাৎ তন্তুরূপ সমবায় সম্বন্ধে থাকে তন্তুতে এবং সেই তন্তুতে পটরূপের সমবায়িকারণ পট সমবায় সম্বন্ধে থাকে। এভাবে পরম্পরা সম্বন্ধে বা স্বসমবায়ি সমবায় সম্বন্ধে তন্তুরূপ পটরূপের সমবায়িকারণ পটে থাকে বলে তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ হয়।
.
(৩) নিমিত্তকারণ (Efficient cause) : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে নিমিত্তকারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘তৎ উভয়ভিন্নং কারণং নিমিত্তকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে কারণ সমবায়ি ও অসমবায়ি এই উভয় কারণ থেকে ভিন্ন তাই নিমিত্তকারণ।
.
যে কারণ কোন কার্যের সমবায়িকারণ ও অসমবায়িকারণ থেকে ভিন্ন তাই নিমিত্তকারণ। যেমন, পটকার্যের প্রতি তন্তু সমবায়িকারণ এবং তন্তু-সংযোগ অসমবায়িকারণ। কিন্তু এই দুই প্রকার কারণ ছাড়াও পটকার্যের বহুবিধ কারণ আছে, যথা- তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতি। এই কারণগুলিকে পটকার্যের নিমিত্ত কারণ বলা হয়। তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতিতে পট সমবায় বা স্বসমবায়িসমবায় সম্বন্ধে থাকে না। ফলে এগুলি পটের সমবায়ি বা অসমবায়ি কারণ হয় না। অথচ তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতি যে পটে প্রতি কারণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরনের কারণকেই ন্যায়-বৈশেষিকমতে নিমিত্ত কারণ বলা হয়।
বৈশেষিক পরমাণুবাদ
.
বৈশেষিকমতে জগৎ সৃষ্টি উদ্দেশ্যপূর্ণ। এই উদ্দেশ্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। এটি যান্ত্রিক নয়। জীব যাতে তার অদৃষ্ট বা কর্মফল অনুসারে পুণ্যের জন্য পুরস্কার এবং পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে পারে এবং জীবাত্মা যাতে নিঃশ্রেয়স বা মুক্তিলাভের চেষ্টা করতে পারে সে জন্যই পরমাত্মা বা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন। বৈশেষিক সম্প্রদায় পরমাণুবাদের সাহায্যে জগতের সৃষ্টি ও লয় ব্যাখ্যা করেছেন। তাই পরমাণুবাদ বা পরমাণুতত্ত্ব বৈশেষিক দর্শনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব।
.
ভারতীয় দর্শনে দৃশ্যমান জগতে বস্তুর কার্য-কারণভাবের দ্বারাই তাদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কার্যকারণ মতবাদ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে সৎ নাকি অসৎ ? সাংখ্য ও বেদান্ত মতে কার্য উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে কোন এক অবস্থায় সৎ অর্থাৎ অস্তিত্বশীল। এই মতবাদ সৎকার্যবাদ নামে পরিচিত।
কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় এই সৎকার্যবাদ স্বীকার করেন না। বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তারা এই মতবাদ খণ্ডন করেছেন। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে তার উপাদান কারণে অসৎ। কারণ ও কার্য দুটি ভিন্ন বস্তু। সুতরাং কার্যদ্রব্য নতুন সৃষ্টি। এ মতবাদকে অসৎকার্যবাদ বলা হয়। জগতের উপাদান কারণ (সমবায়িকারণ) পরমাণুসমূহ সৎ অর্থাৎ নিত্য। পরমাণু থেকে যেসব কার্যের উৎপত্তি হয় তা উৎপত্তির পূর্বে ছিলো না, বিনাশে থাকবে না। তাই এগুলি অসৎ। কার্যোৎপত্তির পূর্বে সৎ উপাদান কারণে অসৎ কার্যের উৎপত্তি হলো ন্যায়-বৈশেষিক মতে আরম্ভ। এ কারণে এই অসৎকার্যবাদকে আরম্ভবাদ বলা হয়। অসৎকার্যবাদই আরম্ভবাদের মূল, এবং এই আরম্ভবাদের রূপান্তরই পরমাণুবাদ।
.
বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি কণাদের মতে জগতের যাবতীয় অনিত্য ও যৌগিক বস্তু পরমাণু থেকেই উৎপন্ন। পরমাণু হলো জগতের উৎপত্তির প্রতি উপাদান কারণ। বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয়টি- ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ, মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিক, কাল, আত্মা এবং মন। এর মধ্যে ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ এই চারটি হলো অনিত্য ভূতদ্রব্য। বাকিগুলি নিত্যদ্রব্য। চারটি অনিত্য ভূতদ্রব্যের ক্ষুদ্রতম এবং অবিভাজ্য অংশই হলো পরমাণু। অর্থাৎ পরমাণু চারপ্রকার, যথা- ক্ষিতি পরমাণু, জল পরমাণু, তেজ পরমাণু এবং বায়ু পরমাণু। এই পরমাণুগুলির গুণগত পার্থক্য থাকায় এরা প্রত্যেকে ভিন্ন। ক্ষিতি পরমাণুর গুণ হলো গন্ধ, জল পরমাণুর গুণ হলো স্বাদ, তেজ পরমাণুর গুণ হলো রূপ এবং বায়ু পরমাণুর গুণ হলো স্পর্শ। জগতের যাবতীয় অনিত্য ও সাবয়ব বস্তুর সৃষ্টি ও ধ্বংস ব্যাখ্যা করার জন্যেই ন্যায়-বৈশেষিক মতে পরমাণু স্বীকার করা হয়েছে।
.
যেহেতু পরমাণু হলো জড়বস্তুর অবিভাজ্য ও ক্ষুদ্রতম অংশ, তাই পরমাণু অতীন্দ্রিয়। এ কারণে প্রত্যক্ষের দ্বারা পরমাণুকে জানা যায় না। অনুমান প্রমাণের দ্বারাই পরমাণুর অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। এই অনুমান প্রমাণ হিসেবে ন্যায়-বৈশেষিক মতে বলা হয়, জড়বস্তুকে যদি আমরা ভাঙতে শুরু করি তাহলে ভাঙতে ভাঙতে আমরা এমন একটা অংশে উপনীত হই যাকে আর বিভাগ করা যায় না। জড়বস্তুর এই অবিভাজ্য ও ক্ষুদ্রতম অংশকেই পরমাণু বলা হয়। পরমাণু অবিভাজ্য অর্থাৎ পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না, কারণ পরমাণু হলো নিরংশ বা নিরবয়ব। কেননা যার অংশ বা অবয়ব নেই তাকে ভাঙা যায় না।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে আরো বলা হয়, জড়বস্তুর বিভাজন অনন্তকাল ধরে চলে একথা স্বীকার করলে পর্বত এবং সর্ষের পরিমাণের তারতম্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ সেক্ষেত্রে জড়বস্তুর বিভাজনের ফলে আমরা যে অবয়ব পাই, তার আবার অবয়ব থাকবে, সেই অবয়বেরও আবার অবয়ব থাকবে। এইভাবে পর্বত এবং সর্ষে অনন্ত অবয়ব বিশিষ্ট হওয়ায় উভয়ের পরিমাণের পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু আমরা জানি যে, পর্বত এবং সর্ষের মধ্যে পর্বত হলো বৃহত্তর এবং সর্ষে হলো ক্ষুদ্রতর। পর্বত এবং সর্ষের পরিমাণের তারতম্য ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে বস্তুর বিভাজন প্রক্রিয়া কোন না কোন সময় শেষ হয়। যেহেতু সর্ষের থেকে পর্বতের অবয়ব-সংখ্যা বেশি সেহেতু আমাদের স্বীকার করতে হবে উভয়ের বিভাজন প্রক্রিয়া ভিন্ন সময়ে শেষ হয়। পর্বত এবং সর্ষের অবয়বে ভেদ থাকায় উভয়ের পরিমাণের ভেদও অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যায়। সুতরাং, পরমাণু নিরবয়ব তা প্রমাণিত হয়।
.
যেহেতু পরমাণু নিরবয়ব, সেহেতু পরমাণু নিত্য। অর্থাৎ পরমাণুর উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। উৎপত্তি অর্থ বিভিন্ন অবয়বের সংযোগ এবং বিভাগ অর্থ বিভিন্ন অবয়বের বিভাগ। যেহেতু পরমাণুর কোন অবয়বই নেই, সেহেতু পরমাণুর উৎপত্তি ও বিনাশ নেই।
.
ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা এই পরমাণুর সাহায্যে জগতের যাবতীয় অবয়ব এবং অনিত্য বিষয়ের সৃষ্টি ও ধ্বংসকে ব্যাখ্যা করেছেন। আগেই বলা হয়েছে যে, পরমাণুগুলি বিশেষ গুণবিশিষ্ট। অর্থাৎ রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ গুণবিশিষ্ট। কিন্তু গুণবিশিষ্ট হলেও তারা গতিহীন অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়। তাহলে গতি ছাড়া সৃষ্টি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যাবে কীভাবে ?
মূলত এখানেই ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা জগতের নিমিত্ত-কারণ হিসেবে একজন ঈশ্বর বা পরমাত্মার সত্তা স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, পরমাণুগুলি স্বরূপত গতিহীন হলেও ঈশ্বরের ইচ্ছায় (চিকীর্ষা) পরমাণুগুলি গতিশীল হয়ে জগতের যাবতীয় বস্তুকে সৃষ্টি করে।
.
কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে, ঈশ্বর যেহেতু পূর্ণতম সত্তা, তাঁর কোন অপূর্ণ ইচ্ছা নেই, তাহলে পরমাণুগুলিকে গতিশীল করে জগৎসৃষ্টির ইচ্ছা ঈশ্বরের মনে জাগে কেন ?
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, জীব যাতে অদৃষ্ট অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করতে পারে, সেজন্য ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা হয়। অদৃষ্ট হলো জীবের শুভ ও অশুভ কর্মফলের সমষ্টি। পরমাণু ও অদৃষ্টের নিজস্ব ক্রিয়াশীলতা নেই। তাই ঈশ্বর জীবের অদৃষ্টশক্তি অনুসারে তাদের কর্মফল ভোগের জন্য পরমাণুগুলির সাহায্যে এই সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিত জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আবার প্রয়োজনবোধে তিনি পরমাণুগুলির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে জগতের বিনাশসাধন করেন। সুতরাং বৈশেষিক মতে, পরমাণুগুলি হলো জগৎ ও জাগতিক বস্তুগুলির সৃষ্টির প্রতি উপাদান কারণ বা সমবায়িকারণ এবং ঈশ্বর ও জীবের অদৃষ্ট হলো নিমিত্ত কারণ। যেহেতু সৃষ্টির মাধ্যমে জীব কর্মফল ভোগ করে, সেহেতু সৃষ্টিপ্রক্রিয়া হলো উদ্দেশ্যমূলক।
.
বৈশেষিক মতে জাগতিক বস্তুর সৃষ্টির প্রতি পরমাণুসংযোগ হলো অসমবায়িকারণ। এখানেও প্রশ্ন, পরমাণুগুলি যদি নিরবয়ব পদার্থ হয়, তাহলে একটি পরমাণুর সঙ্গে অপর একটি পরমাণু সংযুক্ত হয় কীভাবে ? কোন দ্রব্যের সঙ্গে অপর একটি দ্রব্যের সংযোগস্থলে, একটি দ্রব্যের কোন অংশের সঙ্গে অপর দ্রব্যের কোন অংশের সংযোগ ঘটে। পরমাণুর সংযোগ স্বীকার করলে পরমাণুর অংশ স্বীকার করতে হবে। আর পরমাণুর অংশ স্বীকার করলে পরমাণুকে নিরবয়ব বলা যাবে না।
উত্তরে বৈশেষিকেরা বলেন, সাবয়ব দুটি দ্রব্য যেমন পরস্পর সংযুক্ত হয়, অনুরূপভাবে দুটি নিরবয়ব পদার্থও পরস্পর সংযুক্ত হতে পারে। পরমাণুসংযোগে কীভাবে বস্তুসৃষ্টি হয় তা বৈশেষিকেরা ব্যাখ্যা করেছেন।
.
ঈশ্বরের ইচ্ছায় গতি সঞ্চারিত হওয়ার ফলে প্রথমে দুটি সজাতীয় পরমাণু পরস্পর সংযুক্ত হয় এবং তার ফলে একটি দ্ব্যণুকের সৃষ্টি হয়। যেমন দুটি ক্ষিতি-পরমাণু সংযুক্ত হয়ে ক্ষিতির দ্ব্যণুক সৃষ্টি হয়। অপ্, তেজ ও মরুতের দ্ব্যণুকের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি প্রক্রিয়া একই থাকে। বিজাতীয় পরমাণু সংযোগে দ্ব্যণুকের উৎপত্তি কখনও হয় না। পরমাণুগুলির ন্যায় দ্ব্যণুকও প্রত্যক্ষ করা যায় না। এই দ্ব্যণুকের সৃষ্টিই হলো সৃষ্টির প্রথম স্তর। পরবর্তী স্তরে সজাতীয় তিনটি দ্ব্যণুকের সমন্বয়ে গঠিত হয় ত্র্যণুক বা ত্রসরেণু। ত্রস অর্থ গতি। ত্রসরেণু হলো গতিশীল রেণু। এই ত্রসরেণু হলো প্রত্যক্ষযোগ্য এবং সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুসমূহ। এরপর চারটি ত্র্যণুক মিলে উৎপন্ন হয় একটি চতুরণুক। স্বভাবতই চতুরণুক হলো ত্র্যণুক অপেক্ষা স্থূল পদার্থ। এভাবেই ক্রমে ক্রমে স্থূল থেকে স্থূলতর একই জাতীয় বস্তুর (স্থূলতর ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ) সৃষ্টি হয়।
.
প্রশ্ন হতে পারে, পরমাণু ও দ্ব্যণুক প্রত্যক্ষযোগ্য না হলেও ত্র্যণুক প্রত্যক্ষযোগ্য হয় কেন ?
উত্তরে বলা হয়, প্রত্যক্ষের প্রতি কারণ হলো উপাদানের মহৎ পরিমাণ এবং বহুত্বসংখ্যা। দ্ব্যণুকের উপাদান কারণ পরমাণুর পরিমাণ হলো অণুপরিমাণ, মহৎপরিমাণ নয়। আবার দ্ব্যণুকের উপাদানকারণ পরমাণুর স্থূলত্ব বা বহুত্ব বা তুলাপিণ্ডের মতো শিথিল সংযোগ না থাকায় দ্ব্যণুকের প্রত্যক্ষ হয় না। কিন্তু ত্র্যণুকের পরিমাণ হলো মহৎপরিমাণ। আবার ত্র্যণুকের উপাদানকারণ দ্ব্যণুকের বহুত্ব সংখ্যা থাকায় ত্র্যণুকের প্রত্যক্ষ হয়।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই জগতের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হলেও এই সৃষ্টিপ্রবাহ অনাদি। সৃষ্টির পর প্রলয় এবং প্রলয়ের পর সৃষ্টি অনাদিকাল ধরে চলে আসছে। সুতরাং সৃষ্টির আদি নির্ণয় করা যায় না। সৃষ্টি অনাদি। যখন মহেশ্বর জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা করেন, তখন জীবাত্মার মধ্যে অদৃষ্ট শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রথমে বায়ু পরমাণুগুলিতে স্পন্দন শুরু হয় এবং এদের মিলনে দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক গঠিত হয়। আবার দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক মিলিত হয়ে বায়ুরূপ মহাভূত সৃষ্টি করে। এই মহাভূত আকাশে সবসময় কম্পমান অবস্থায় বিরাজ করে। তারপর অনুরূপভাবে অপ্-পরমাণুগুলি সক্রিয় হয় এবং অপ্-রূপ মহাভূত বা মহাসমুদ্র সৃষ্টি করে। এই মহাসমুদ্র বায়ুর দ্বারা কম্পিত হয়ে বায়ুতেই বিরাজ করে। এরপর ক্ষিতি-পরমাণু সক্রিয় হয়ে ক্ষিতি-রূপ মহাভূত বা মহাপৃথিবী সৃষ্টি করে এবং এই মহাপৃথিবী মহাসমুদ্রে অবস্থান করে। অবশেষে ঐ একইভাবে তেজ-পরমাণু সক্রিয় হয়ে তেজ-রূপ মহাভূত বা মহাতেজোরাশি সৃষ্টি করে এবং ঐ মহাতেজ মহাসমুদ্রের জলরাশিতে অবস্থান করতে থাকে। এরপর সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষিতি এবং তেজ পরমাণু মিলিত হয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হয়। ঈশ্বর এই ব্রহ্মাণ্ডকে জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্য গুণসম্পন্ন ব্রহ্মা বা জগৎ-আত্মার দ্বারা সঞ্জীবিত করেন। ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ব্রহ্মা জীবের অদৃষ্ট অনুযায়ী জগতের যাবতীয় স্থূল ও সূক্ষ্ম বস্তু সৃষ্টি করেন।
.
এইভাবে ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট জগৎ বহুকাল ধরে চলতে থাকে। কিন্তু এই সৃষ্টি চিরন্তন বা চিরস্থায়ী নয়। কারণ জগৎ অনিত্য এবং যা অনিত্য তার ধ্বংস অনিবার্য। এ প্রসঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর রাত্রিতে আমরা যেমন বিশ্রাম গ্রহণ করি, তেমনি দুঃখ যন্ত্রণায় ক্লান্ত জীবাত্মাকে কিছুটা বিশ্রাম দেবার জন্য ঈশ্বর এই জগতের ধ্বংস বা প্রলয় ঘটিয়ে থাকেন। কাজেই সৃষ্টিকালের পর আসে প্রলয়কাল। বৈশেষিক দার্শনিকেরা সৃষ্টিকে ঈশ্বরের দিন এবং প্রলয়কে ঈশ্বরের রাত্রিরূপে বর্ণনা করেছেন। সৃষ্টি ও প্রলয়- এই দুটি দিয়ে গঠিত হয় একটি কল্প এবং এই কল্প অনন্তকাল ধরে পর্যায়ক্রমে চলছে।
.
বৈশেষিক দর্শনে জগতের প্রলয়-ক্রিয়ারও বর্ণনা পাওয়া যায়। সৃষ্টির মতো প্রলয়ও হঠাৎ হয় না, কিন্তু তা হয় ক্রমে ক্রমে। অন্যান্য আত্মার মতো জগৎ-আত্মা বা ব্রহ্মা যখন তাঁর জগৎরূপ দেহ পরিত্যাগ করেন, তখন ঈশ্বরের মধ্যে জগৎ ধ্বংস করবার ইচ্ছা (সংজিহীর্ষা) দেখা দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই জীবাত্মার মধ্যে অধিষ্ঠিত সৃজন-অভিমুখী অদৃষ্ট ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্টের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর ফলে সৃজন-অভিমুখী অদৃষ্ট তার শক্তি হারায় এবং ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্ট সক্রিয় হয়ে পড়ে। ধ্বংস-অভিমুখী অদৃষ্টের সক্রিয়তার জন্য দ্ব্যণুকের উৎপাদক পরমাণুতে ক্রিয়া শুরু হয় এবং দুটি পরমাণুর বিভাগ বা সংযোগের নাশ হয়। পরমাণুদ্বয় সংযোগের নাশে দ্ব্যণুকের নাশ হয়, দ্ব্যণুকের নাশে ত্র্যণুকের নাশ হয়, ত্র্যণুকের নাশে চতুরণুকের নাশ হয় এবং ক্রমে ক্রমে পৃথিব্যাদি মহাভূতের নাশ হয়। তখন কেবল ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ- এই চারপ্রকারের পরমাণু এবং আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মার মতো নিত্য দ্রব্যগুলি বর্তমান থাকে। অবশ্য তখনও আত্মার মধ্যে অতীতের সংস্কারযুক্ত ভাবনা ও অদৃষ্ট বিরাজ করে।
.
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সৃষ্টিকালে প্রথমে বায়ু, তারপর অপ্, তারপর ক্ষিতি এবং তারপর তেজ মহাভূত আবির্ভূত হয়। অপরপক্ষে, প্রলয়কালে প্রথমে ক্ষিতি মহাভূতের পরমাণুগুলি বিযুক্ত হয় এবং তারপর ক্রমান্বয়ে অপ্, তেজ ও বায়ু মহাভূতের পরমাণুগুলির বিযুক্তি ঘটে। বস্তুত বৈশেষিক পরমাণুবাদে জড়বাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মিশ্রণ দেখা যায়।
.
বৈশেষিক পরমাণুবাদ ও পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদের মধ্যকার পার্থক্য :
আমরা জানি যে, প্রাচীন গ্রিক দর্শনেও পরমাণুতত্ত্ব নামে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ রয়েছে। পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদ ও বৈশেষিক পরমাণুবাদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য থাকলেও কিছুটা বৈসাদৃশ্যও দেখা যায়। যেমন-
.
(১) বৈশেষিক পরমাণুবাদে জগৎ সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে পরমাণুবাদে সৃষ্টির মূলে কোন উদ্দেশ্য বা আদর্শ নেই। জগতের প্রতি ভারতীয় দার্শনিকদের একপ্রকার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা বৈশেষিক দর্শনেও প্রতিফলিত হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের পরমাণুবাদ অনুসারে অসংখ্য পরমাণু আকস্মিক যান্ত্রিক গতির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেছে।
.
(২) বৈশেষিকদের মতে পরমাণু নিত্য। আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মা নিত্য। এদের কোন উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। আকাশ, দিক, কাল, মন ও আত্মাকে পরমাণুতে পরিণত করা যায় না। কিন্তু পাশ্চাত্য পরমাণুবাদ অনুসারে মন ও আত্মা পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট।
.
(৩) পাশ্চাত্য পরমাণুবাদ অনুসারে জগৎ সৃষ্টির পেছনে এমন কোন কর্তা নেই যার দ্বারা পরমাণুগুলি অনুশাসিত হতে পারে। কিন্তু বৈশেষিক পরমাণুবাদ বিশ্বাস করে যে, জগৎ সৃষ্টির পেছনে একজন সর্বশক্তিমান কর্তা রয়েছেন, যার ইচ্ছায় জগতের সৃষ্টি ও বিনাশ সংঘটিত হয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ