পাণিনির জন্মস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও গবেষকরা মোটামুটি ভাবে একমত যে তিনি, গান্ধার প্রদেশের (বর্তমান- পাকিস্তান) শালাতুর (বর্তমান- লাহোর) গ্রামে জন্মেছিলেন।
পাণিনির জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রে। তাই কিছু পণ্ডিতের মতে পাণিনির পূর্বপুরুষেরা শালাতুর গ্রামের হলেও পাণিনির জন্ম হয়েছিল, পাটলীপুত্রে।পাণিনি ছিলেন একজন শিষ্ট। শিষ্টেরা ছিলেন এক ধরণের ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রের ওপর ছিল তাঁদের অসামান্য অধিকার।
পার্থিব সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে তাঁরা একটি বিশেষ অঞ্চলে বসবাস করতেন(গবেষণা? ) । বাস স্থানের উত্তরে ছিল হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা, পূর্বে বঙ্গভূমি এবং পশ্চিমে আরাবল্লী পাহাড়ের রেখা।
পাণিনি ছিলেন, পণি নামে এক ঋষির সন্তান। এবার পণি বা পাণিন্ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়।
পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক এবং ফিনিসীয় গোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসবাস করতেন। পাণিনির বাবা ছিলেন ফিনিকিয় পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর নাম ছিল, শালঙ্কি। তাই পাণিনির আর এক নাম ছিল শালাঙ্কি। পাণিনির মা ছিলেন ডেসিয়ান (দাক্ষী )। দক্ষ জাতির মহিলা। তাই তাঁর নাম দাক্ষি। তিনি রূপে গুণে অতুলনীয়া ছিলেন। পাণিনির আর এক নাম তাই দাক্ষিপুত্র। পাণিনির ভক্ত পতঞ্জলি পাণিনি কে এই নামে বিখ্যাত করেছেন।তাঁর শিক্ষকের নাম ছিল উপবৎস।
পাণিনি ছিলেন অহিগলমালা শিবের উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।
অতএব, পাণিনির পুরো নাম হলো:-
আহিক দাক্ষিপুত্র শালাঙ্কি শালাতুরীয় পাণিন্ পাণিনি।
এই নামের মধ্যে পাণিনির ইষ্ট,মাতা,পিতা, জন্মস্থান, গোত্র সবকিছুর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, তাঁর ব্যাকরণ সম্বন্ধে।পাণিনির আগে কি ব্যাকরণ ছিল না? ছিল। বেদের যে ষড়ঙ্গ অর্থাৎ ৬ টি অঙ্গ (শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত ও জ্যোতিষ) তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকরণ।
বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, ভাষাতত্ত্ব, (Linguistics), উচ্চারণ বিধি বা (Phonetics ) এবং ব্যাকরণ শাস্ত্র(Grammar) এই তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাণিনির আগে মোট ৮ টি ব্যাকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হলো:- ঐন্দ্রং, চান্দ্রং, কাশকৃৎস্নং, কৌমারং,সারস্বতং , আপিশলং, শাকলং এবং শাকটায়নং। এর মধ্যে শাকটায়নং ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।
পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে বৈদিক ভাষা (ছান্দস) এবং আঞ্চলিক ভাষা ( লৌকিক) এই ২টি ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। এই ব্যাপারটি পৃথিবীর কোন ব্যাকরণে আগেও ঘটেনি এবং পরেও না।
এখানে বলে রাখা ভাল, রামায়ণে যখন সুগ্রীব ছদ্মবেশে হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন রামচন্দ্রের পরিচয় জানতে, তখন হনুমানের কথা শুনে, রামচন্দ্র লক্ষণকে বলছেন যে হনুমান পরিশীলিত ও ব্যাকরণ সম্মত কথা বলছেন। রামচন্দ্র এও বলছেন যে হনুমান ব্যাকরণ বেশ ভালভাবে আয়ত্ত করেছেন।
সুতরাং প্রাচীন যুগে যে ব্যাকরণের চর্চা ছিল, এব্যাপারে কোন বিতর্ক উঠতে পারে না।
শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা।সেজন্য, এটির আর ১ টি নাম সংজ্ঞাসূত্র। মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এগুলোকে আরো সংক্ষিপ্ত করলেন। নাম দিলেন:- প্রত্যাহার সূত্র। প্রত্যাহার মানে সংক্ষেপিত।
আবার ‘অচ্’ প্রত্যাহারটির মানে অইউঋ৯এওঐঔ। প্রকৃতপক্ষে অণ্, অচ্, অল্, ইক্, উক্, জশ্, হল্ প্রভৃতি প্রত্যাহারগুলি এক ধরণের ‘কোড’বা ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি’(সাংকেতিক ভাষা) যার সাহায্যে পাণিনির ব্যাকরণের অনেক সূত্র তৈরী করা হয়েছে। পাণিনির ব্যাকরণে এরকম ৪৪ টি প্রত্যাহার আছে। প্রথম প্রত্যাহারটি ‘অণ্’ হওয়ায় শিবসূত্রকে অণাদি(অণ্-আদি) সূত্রও বলা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ‘অচ্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত স্বরবর্ণ এবং ‘হল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ‘অল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত বর্ণগুলি রয়েছে। সুতরাং ‘অল্’ মানে ALL বোঝা যেতে পারে। তাহলে শিবসূত্রজালের বিভিন্ন নামগুলি হোলো:-
শিবসূত্র
মহেশ্বরসূত্র
সংজ্ঞাসূত্র
প্রত্যাহারসূত্র
অণাদিসূত্র
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার আছে। চর্তুদশ সূত্রের প্রত্যেকটির শেষে হসন্তযুক্ত যে বর্ণগুলি আছে সেগুলি ‘ইৎ’ হয়। পাণিনির ব্যাকরণের ভাষায় ‘ইৎ’ মানে লোপ পাওয়া, কিন্তু বিনষ্ট হওয়া নয়। উদাহরণ:- ‘অণ্’ মানে অইউ। এখানে ‘ণ্’ বর্ণটি ‘ইৎ’হয়েছে। সমস্ত প্রত্যাহারের শেষের বর্ণটি ‘ইৎ’ হবে, যা পৃথিবীর অন্য কোন ব্যাকরণেই নেই।
শিবসূত্র জালের বর্ণমালাকে ভিত্তি করে সমকালীন বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার ওপর পাণিনি তাঁর সুবিখ্যাত অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেন। পাণিনির ব্যাকরণে মোট ৩৯৭৮ টি সূত্র আছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাকরণ সারা বিশ্বের কোনও পণ্ডিত রচনা করতে পারেন নি। পরবর্তী কালে পাণিনির ধারণা নিয়ে অন্যান্য দেশের ব্যাকরণ গুলি লেখা হয়েছে।
অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ শুধু ব্যাকরণ নয়, এটি হলো ভাষার বিজ্ঞান। পাণিনির সংস্কৃত বেদের ভাষা থেকে সরল হলেও তা একটি জটিল ভাষা। তাই প্রবন্ধের আরম্ভেই বলেছিলাম; সংস্কৃত শিখে পাণিনি পড়তে হয়। না হলে পাণিনির সন্ধির সূত্রগুলি বুঝতে অসুবিধা হয়। প্রচুর পড়াশোনা এবং কোন ভাষ্যকারের সহায়তা ছাড়া পাণিনির সূত্রগুলি বোঝা যায় না। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে শব্দের উৎপত্তি, ধ্বনিতত্ত্ব, বর্ণমালা, উচ্চারণবিধি, সন্ধির নিয়ম নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর সমকালীন প্রতিটি শব্দের ব্যূৎপত্তি নির্ণয় করেছেন এবং ৩৯৭৮ টি সূত্র সাহায্যে অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণটি রচনা করেছেন। ব্যাকরণের প্রধান বিষয়বস্তু হলো ভাষা। তাই ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণ নিয়ে পণ্ডিতেরা পুরুষানুক্রমিক ভাবে পাণিনির ব্যাকরণে ওপর চিন্তাভাবনা করে চলেছেন। পাণিনির সূত্রগুলি বহুদিন ধরে ব্যাকরণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে।বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ বলেছেন পৃথিবীর সমস্ত ভাষার উৎস হলো পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ। পাণিনির সময় থেকে ভাষা একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাঁর সময় থেকেই এই ভাষার নাম হয়েছে সংস্কৃত (মার্জিত) যা প্রাকৃত (অমার্জিত) থেকে আলাদা।প্রাকৃত ভাষা প্রাকৃতিকভাবেই অর্থাৎ নিজের থেকেই গড়ে উঠেছিল।
এবার পতঞ্জলির কথায় আসা যাক। পতঞ্জলির কথা না বললে পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।পতঞ্জলি ছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর লোক এবং ভোজপুর নিবাসী ব্রাহ্মণ। পতঞ্জলি ছিলেন পাণিনির একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি পাণিনিকে আচার্য্য, ভগবান, মহর্ষি এইসব নামে সম্বোধন করেছেন। পাণিনির ব্যাকরণের ৩৯৭৮ টি সূত্রর মধ্যে পতঞ্জলি মাত্র ১৭২০ টি সূত্র বেছে নিয়েছিলেন, যে গুলো সমালোচিত হয়েছিল। কে প্রধানতঃ সমালোচনা করেছিলেন? ইনি হলেন বার্ত্তিককার কাত্যায়ন। পাণিনির উত্তরসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলেন এই কাত্যায়ন। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম হলো বার্ত্তিক। তাই তিনি বার্ত্তিককার কাত্যায়ন নামে পরিচিত। তাঁর জীবনকাল সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। কিন্তু তিনি যে পাণিনির চেয়ে ন্যূনতম ১ শতাব্দী পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তার কারণ বার্ত্তিককার কাত্যায়ন তাঁর গ্রন্থে বেশ কিছু ভাষা ব্যবহার করেছেন যেগুলি পাণিনির সময়ে প্রচলিত ছিল না। বার্ত্তিককার কাত্যায়ন ব্যাকরণের অন্য এক শিক্ষাধারায় গড়ে উঠেছিলেন যার নাম কাতন্ত্র বা কলাপ ব্যাকরণ। বলা হয়, দেবসেনাপতি কুমার কার্ত্তিক এর স্রষ্টা। কাত্যায়ন, পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের কিছু সূত্রের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি কিছু সূত্রের পরিবর্তন, কিছু সূত্রের পরিবর্ধন এবং কিছু সূত্রকে পরিত্যাগ করেন।তাছাড়া তিনি তাঁর সময়ে প্রচলিত কিছু নতুন শব্দগুলির জন্য অতিরিক্ত কিছু সূত্র গঠন করেন।
এবার যাঁরা পাণিনিকে অনুসরণ করতেন তাঁদের মনে হলো কাত্যায়ন, পাণিনির ওপর সুবিচার করেন নি, উপরন্তু তাঁকে বিকৃত করেছেন।অনেকেই চেস্টা করেছিলেন এই বিকৃতি থেকে পাণিনিকে বাঁচাবার, কিন্তু সফল হন নি। প্রথম যিনি সফল হয়েছিলেন, তিনি পতঞ্জলি। তাই পতঞ্জলি এখানে প্রাসঙ্গিক। পতঞ্জলি যে ৪ টি বই লেখেন, সেগুলো হলো ১) যোগদর্শন(এটি ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম; সাংখ্য, বেদান্ত, যোগ, বৈশষিক, ন্যায় এবং মীমাংসা)।২) মহাভাষ্য, এগুলি তিনি লিখেছিলেন চিত্তশুদ্ধির জন্য।৩) আয়ুর্বেদ, দেহশুদ্ধির জন্য।৪) ব্যাকরণ, বাক্ শুদ্ধির জন্য।(এই ৪ পতঞ্জলি ১ ই ব্যক্তি কিনা; তাই নিয়ে মতভেদ আছে, তবে সেটা প্রসঙ্গান্তরে আলোচনা করা যাবে সময় এবং সুবিধা মত।)
পতঞ্জলির মহাভাষ্য প্রন্থটি গ্রীক পণ্ডিত প্লেটোর মত সংলাপের ভঙ্গিতে লেখা। তাঁর গ্রন্থে পাণিনির কিছু সূত্রকে বিকল্পভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর বর্ণনা দেখলে মনে হয় পাণিনির বিরুদ্ধবাদীদের নিরস্ত করার জন্যই তিনি এই কাজ করেছিলেন।
পাণিনির সমালোচনা করে বার্ত্তিককার কাত্যায়ন যা লিখেছিলেন এবং কাত্যায়নকে সমালোচনা করে পতঞ্জলি যা লিখেছিলেন সবগুলোই শেষ পর্য্যন্ত পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণেরই অঙ্গ হয়ে উঠল। সেই জন্য পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণকে ত্রিমুনি ব্যাকরণ বলা হয়। এই ৩ জনের সম্মিলিত অবদানের জন্য সাধারণভাবে এই ব্যাকরণকে পাণিনি ব্যাকরণ, পাণিনি তন্ত্র বা পাণিনিনয় নামে বলা হয়ে থাকে।
পাণিনির এই বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়েছে:- “ AHIK DAKHSHIPUTRA SALANKI SALATURIYA PANIN PANINI was not only the best grammarian of Vedic and Sanskrit language, but also a Sacrificer, Priest, Logician, Philosopher, Mathematician, Astronomer, Poet and politician. He was the precursor of the most intelligent and powerful computing system and the probability for Physics of the Cosmos. In that way his ‘PANINI MACHINE’ is the most powerful model of recent Computers.”
- বৈদিক ব্যাকরণ, ধীরেন্দ্রনাথ তরফদার, বাংলা একাডেমি
- সিদ্ধান্তকৌমুদীর আলোকে কৃৎ প্রত্যয় বিচার, দিলীপ কুমার ভট্টাচার্যয়, বাংলা একাডেমি
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ