শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পঞ্চদশ অধ্যায় - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

18 February, 2019

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পঞ্চদশ অধ্যায়

পঞ্চদশ-অধ্যায়-পুরুষোত্তম-যোগ


 শ্রীভগবানুবাচ
ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যন্তং বেদ স বেদবিৎ।।১।।
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) [ঈশ বিমুখ জীবের কর্ম্মনির্ম্মিত এই সংসারটী] ঊর্দ্ধ্বমূলম্ (ঊর্দ্ধ্বমূল অর্থাৎ সর্ব্বোর্দ্ধতত্ত্বস্বরূপ ঈশ্বরে বৈমুখ্য যার মূল) অধঃশাখম্ (অধঃশাখাযুক্ত অর্থাৎ ব্রহ্মাদি যার শাখা) অব্যয়ম্ (জৈব স্বাতন্ত্র্য-কর্ম্মাশ্রিত জনের পক্ষে যার শেষ নাই বলিয়া অবিনশ্বর) অশ্বত্থং (অথচ ভক্তিমান্ জনের পক্ষে কা'ল পর্য্যন্ত থাকিবে না বলিয়া—নশ্বর) প্রাহুঃ (শাস্ত্রে—এইরূপ বলিয়া থাকেন) । ছন্দাংসি (সকাম কর্ম্মোপদেশক বেদবাক্য সকল) যস্য (যে সংসাররূপ অশ্বত্থবৃক্ষের) পর্ণানি (রক্ষণার্থ পত্রস্থানীয়), তং (সেই সংসার বৃক্ষকে) যঃ (যিনি) বেদ (এইরূপ জানেন) সঃ (তিনি) বেদবিৎ (বেদতাৎপর্য্যবেত্তা) ॥১॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-ঊর্ধ্বমূল ও অধঃশাখা-বিশিষ্ট একটি অব্যয় অশ্বত্থ বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রসমূহ সেই বৃক্ষের পত্রস্বরূপ। যিনি সেই বৃক্ষটিকে জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ।

শ্রীভগবান্ কহিলেন—শাস্ত্রে এইরূপ বলিয়া থাকেন যে এই সংসার একটী ঊর্দ্ধ্বমূল ও অধঃশাখ অশ্বত্থ (‘কাল’ থাকে না—এইরূপ) বৃক্ষবিশেষ এবং ইহা অব্যয় । ইহার পোষাক বেদবাক্য সমূহ—এই বৃক্ষের পত্র স্থানীয়—যিনি ইহাকে এইরূপ জানেন তিনিই যথার্থ বেদজ্ঞ ।

তাৎপর্য্য এই যে,—এই সংসার ঊর্দ্ধ্বমূল অর্থাৎ ইহার মূলকারণ সর্ব্বোচ্চ ধামে সংসৃষ্ট—ঈশবৈমুখ্য, এবং অধঃশাখ অর্থাৎ ক্রমশঃ কর্ম্মফলে পশ্বাদি অধম যোনি পর্য্যন্ত পল্লবিত, ইহা একটী অশ্বত্থ অর্থাৎ কা'ল পর্য্যন্ত একভাবে থাকে না—এইরূপ বিনশ্বর, অথচ অব্যয় অর্থাৎ কার্য্যকারণ প্রবাহরূপে নিত্যদৃশ্যমান । সংসার পোষাক কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিসমূহ এই বৃক্ষের পত্রস্তানীয় অর্থাৎ পত্র যেমন বৃক্ষকে পোষণ ও শোভিত করে তদ্রূপ বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিসমূহ এই সংসারকে পোষণ ও উজ্জ্বল করিতেছে । যিনি এই সংসারকে নিত্যাশক্তি মায়াপ্রসূত হইলেও বিনশ্বর, কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিপুষ্ট হইলেও সেই শ্রুতি পরোক্ষবাদ অবলম্বনে প্রকাশিত—এইরূপে বেদার্থ জানেন—তিনিই যথার্থ বেদতত্ত্বজ্ঞ ॥১॥


অধশ্চোর্ধ্বং প্রসৃতাস্তস্য শাখা
গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ।
অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি
কর্মানুবদ্ধীনি মনুষ্যলোকে।।২।।

তস্য (সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের) গুণপ্রবৃদ্ধাঃ (গুণত্রয়ের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত) বিষয়প্রবালাঃ (শব্দাদিবিষয়রূপ পল্লবযুক্ত) শাখা (শাখা স্থানীয় জীবসমূহ) অধঃ (মনুষ্য পশ্বাদি যোনিতে) ঊর্দ্ধ্বং চ (ও দেবাদি যোনিতে) প্রসৃতাঃ (বিস্তৃত হইয়াছে) ; মনুষ্যলোকে (মানুষ জন্মে) কর্ম্মানুবন্ধীনি (ধর্ম্মাধর্ম্মপ্রবৃত্তি অনুসারে) মূলানি (জটা স্থানীয় কতকগুলি মূল) অধঃ চ (নিম্নদিকেও) অনুসন্ততানি (কর্ম্মফলানুসন্ধানহেতু কারণরূপে বিস্তৃত হইয়াছে) ॥২॥


ইহার (এই সংসার বৃক্ষের) কতকগুলি শাখা ঊর্দ্ধ্বে (দেবাদি লোকে) বিস্তৃত, কতকগুলি অধোদেশে (মনুষ্য, পশু ও স্থাবরাদি লোকে) বিস্তৃত এবং ইহারা (প্রকৃতির সত্ত্বাদি) গুণপুষ্ট ও (শব্দাদি) বিষয় সমূহ ইহাদের পল্লব স্বরূপ । আবার অধোদেশেও (এই বৃক্ষের) কতকগুলি মূল প্রসারিত হইয়া কর্ম্মভূমি মনুষ্যলোকে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছে ।

তাৎপর্য্য এই যে—এই নশ্বর অথচ নিত্য সংসারের সমষ্টি প্রকাশে কতকগুলি জীব সত্ত্বগুণ পুষ্ট হইয়া দেবাদি ঊর্দ্ধলোকে এবং কতকগুলি রজস্তমোগুণ প্রভাবে মনুষ্য পশু স্থাবরাদি লোকে অস্মিতাভিনিবেশে ব্যাপ্ত হইয়া বিচরণ করিতেছে । শব্দাদি বিষয় সমূহও এই সংসার-বৃক্ষশাখার পল্লব স্থানীয়—যেহেতু ইহারা জীবের অহঙ্কার-সঞ্জাত পঞ্চ তন্মাত্রেরই বিকারস্বরূপ । আবার প্রধান মূল ঈশ বৈমুখ্য বিপরীত ভাবে ঊর্দ্ধ্বে স্থাপিত হইলেও কতকগুলি পরবর্ত্তী অধোগামী বটবৃক্ষের জটা বা নামাল স্থানীয় মূল, কর্ম্মভূমি মনুষ্যলোকে সংযোজিত রহিয়াছে অর্থাৎ মনুষ্য জন্মের কর্ম্মফল ভোগচেষ্টা—পৃথক্ কারণরূপে এই সংসারবৃক্ষের পুষ্টিরস সরবরাহ করিতেছে ॥২॥

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের শাখাসমূহ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা পুষ্ট হয়ে অধোদেশে ও ঊর্ধ্বদেশে বিস্তৃত। ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহই এই শাখাগণের পল্লব। এই বৃক্ষের মূলগুলি তধোদেশে প্রসারিত এবং সেগুলি মনুষ্যলোকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ।


ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে
নাস্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা।
অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলম্
অসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা।।৩।।
ততঃ পদং তৎপরিমার্গিতব্যং
যস্মিন্ গতা ননিবর্তন্তি ভূয়ঃ।
তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে
যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী।।৪।।

ইহ (এই মনুষ্যলোকে) অস্য (এই সংসার অশ্বত্থের) রূপং (স্বরূপ) তথা (সেই ঊর্দ্ধ্বমূলত্বাদি প্রকারে) ন উপলভ্যতে (শ্রৌতজ্ঞান ব্যতীত অবগত হওয়া যায় না) [অস্য] (ইহার) অন্তঃ ন (শেষ দেখা যায় না) আদি চ ন (আদিও দৃষ্ট হয় না) সংপ্রতিষ্ঠা চ ন (এবং আশ্রয় ও লক্ষিত হয় না) । সুবিরূঢ়মূলম্ (মায়াবাদের অতীত ঈশ বৈমুখ্যরূপ সুদৃঢ়মূল) এনং (এই) অশ্বত্থম্ (বাস্তব বিনশ্বর সংসার বৃক্ষকে) দৃঢ়েন (সাধুসঙ্গ জাত তীব্র) অসঙ্গশস্ত্রেণ (বৈরাগ্যরূপ কুঠার দ্বারা) ছিত্ত্বা ([ব্যক্তিগত সংসার] ছেদব করিয়া) ততঃ (তদনন্তর) যস্মিন্ (যে পদ) গতাঃ [সন্তঃ] (প্রাপ্ত হইয়া) [কেচিদপি] (কেহই) ভূয়ঃ (পূনর্ব্বার) ন নিবর্ত্তন্তি (প্রত্যাবর্ত্তন করেন না), যতঃ (যাঁর মায়া হইতে) [এষা] (এই) পুরাণী (চিরন্তন) প্রবৃত্তিঃ (সংসারপ্রবাহ) প্রসৃতা (প্রবাহিত হইয়াছে) তম্ এব চ (সেই) আদ্যং (আদি) পুরুষং (পুরুষের) প্রপদ্যে (শরণ লইতেছি), [ইতি এবং] (এইরূপে) [একান্তভক্ত্যা] (অনন্য ভক্তি দ্বারা) তৎপদং (সেই বিষ্ণুর পরমপদ) পরিমার্গিতব্যং (অভিগমন করা কর্ত্তব্য) ॥৩–৪॥


এই মনুষ্যলোকে সংসাররূপ অশ্বত্থ বৃক্ষের সেই স্বরূপ অর্থাৎ ঊর্দ্ধ্বমূলত্বাদি (শ্রৌতজ্ঞান ব্যতীত) জানা যায় না, বা ইহার আদি, অন্ত ও আশ্রয় দেখিতে পাওয়া যায় না । ঈশবৈমুখ্যরূপ সুদৃঢ়মূল এই অবাস্তব সংসাররূপ অশ্বত্থবৃক্ষকে সাধুসঙ্গজাত তীব্রবৈরাগ্যরূপ কুঠার দ্বারা (ব্যক্তিগত সংসার বৃক্ষ) ছেদন করিয়া তদনন্তর যে পদ লাভ করিলে কেহই পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তন করেন না, যাঁহার মায়া হইতে এই চিরন্তনী সংসার বৃক্ষের প্রবর্ত্তন ও প্রসারণ হইয়াছে,—সেই আদি পুরুষ পরমেশ্বরের আমি শরণাপন্ন হইলাম—এই প্রকারে ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা সেই বিষ্ণুর পরমপদের অভিগমন করা কর্ত্তব্য ॥৩–৪॥

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের স্বরূপ এই জগতে উপলব্ধ হয় না। এর আদি, অন্ত ও স্থিতি যে কোথায় তা কেউই বুঝতে পারে না। তীব্র বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা দৃঢ়মূল এই বৃক্ষকে ছেদন করে সত্য বস্তুর অন্বেষণ করা কর্তব্য, যেখানে গমন করলে, পুনরায় ফিরে আসতে হয় না। স্মরণাতীত কাল হতে যাঁর থেকে সমস্ত কিছু প্রবর্তন ও বিস্তৃত হয়েছে, সেই আদি পুরুষের প্রতি শরণাগত হও।

নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা
অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।
দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-
র্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ।।৫।।

নির্ম্মানমোহাঃ (অভিমান ও মিথ্যাভিনিবেশশূন্য) জিতসঙ্গদোষা (দুঃসঙ্গরূপ দোষরহিত) অধ্যাত্মনিত্যাঃ (নিত্যানিত্য বস্তুর বিচারপরায়ণ) বিনিবৃত্তকামাঃ (সম্পূর্ণভাবে ভোগবাসনা রহিত) সুখদুঃখসংজ্ঞৈঃ (সুখ ও দুঃখাদি নামক) দ্বন্দ্বৈঃ (দ্বন্দ্বসমূহ হইতে) বিমুক্তাঃ (বিমুক্ত) [অতএব] অমূঢ়াঃ [সন্তঃ] (অজ্ঞানমুক্ত হইয়া) [তে] (সেই শরণাগতগণ) তৎ (সেই) অব্যয়ং (নিত্য) পদম্ (পরমপদ) গচ্ছন্তি (প্রাপ্ত হন) ॥৫॥


সেই শরণাগত জনগণ অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্যাত্মার অনুশীলন তৎপর, ভোগাভিলাষ শূন্য এবং সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব ও অজ্ঞান মুক্ত হইয়া সেই পরমপদ লাভ করেন ॥৫॥

অনুবাদঃ যাঁরা অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য-অনিত্য বিচার পরায়ণ, কামনা-বাসনা বর্জিত, সুখ- দুঃখ আদি দ্বন্দ্বসমূহ থেকে মুক্ত এবং মোহমুক্ত, তাঁরাই সেই অব্যয় পদ লাভ করেন।

ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।৬।।

যৎ (যে ধাম) গত্বা (লাভ করিয়া) [প্রপন্নাঃ] (শরণাগত ব্যক্তিগণ) [ততঃ] (তাহা হইতে) ন নিবর্ত্তন্তে (প্রত্যাবৃত হন না) তৎ (তাহা) মম (আমার) পরমং (সর্ব্বপ্রকাশক) ধাম (চিন্ময় নিবাস) । তৎ (তাহাকে) সূর্য্যঃ (সূর্য্য) ন ভাসয়তে (প্রকাশ করিতে পারে না) ন শশাঙ্কঃ ( না চন্দ্র) ন পাবকঃ (না অগ্নি অর্থাৎ কেহই প্রকাশ করিতে পারে না) ॥৬॥


যে স্থান প্রাপ্ত হইয়া (প্রপন্ন জনগণ) তাহা হইতে আর প্রত্যাবর্ত্তন করেন না—তাহাই আমার পরম (সর্ব্বপ্রকাশক) ধাম । তাহাকে সূর্য্য, চন্দ্র ও অগ্নি ইহাদের কেহই প্রকাশ করিতে পারে না ॥৬॥

অনুবাদঃ সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি।।৭।।

জীবভূতঃ (জীবরূপ) মম এব (আমারই) অংশ (বিভিন্নাংশ বা শক্তিবিশেষ) [অতএব] সনাতনঃ (নিত্য) জীবলোকে (এই জগতে) প্রকৃতিস্থানি (প্রকৃতির কার্য্য) মনঃষষ্ঠানি (মন সহ ছয়টী) ইন্দ্রিয়াণি (জ্ঞানেন্দ্রিয়কে) কর্ষতি (আকর্ষণ বা বহন করিতেছে) ॥৭॥


আমারই অংশ (অর্থাৎ বিভিন্নাংশ শক্তিবিশেষ) জীবতত্ত্ব সনাতন হইয়াও প্রকৃতির অন্তর্গত (মায়া কল্পিত) মন ও পঞ্চেন্দ্রিয় বহন করিয়া থাকে ॥৭॥

অনুবাদঃ এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রাম করছে।

শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ।।৮।।

ঈশ্বরঃ (দেহাদির স্বামী জীবাত্মা) যৎ (যে) শরীরম্ (দেহ) অবাপ্নোতি (প্রাপ্ত হন) যৎ চ অপি (ও যে শরীর হইতে) উৎক্রামতি (নিষ্ক্রান্ত হন), [তদা] (তখন) বায়ুঃ (বায়ুর) আশয়াৎ (পুষ্পাদি আধার হইতে) গন্ধান্ ইব (গন্ধ গ্রহণের ন্যায়) এতানি (এই ছয়টী ইন্দ্রিয়কে) গৃহীত্বা (গ্রহণ পূর্ব্বক) [শরীরান্তরং] (শরীরান্তরে) সংযাতি (গমন করেন) ॥৮॥


দেহাদির অধীশ্বর জীব যখন শরীর হইতে নির্গত হন তখন তিনি—বায়ুর পুষ্পাদি আধার হইতে গন্ধ গ্রহণের ন্যায়—এই সকল ইন্দ্রিয়কে সঙ্গে লইয়াই দেহান্তরে গমন করেন ॥৮॥

অনুবাদঃ বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনই এই জড় জগতে দেহের ঈশ্বর জীব এক শরীর থেকে অন্য শরীরে তার জীবনের বিভিন্ন ধারণাগুলি নিয়ে যায়।

শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনং চ রসনং ঘ্রাণমেব চ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে।।৯।।

অয়ং (এই জীব) শ্রোত্রং (কর্ণ) চক্ষুঃ (চক্ষু) স্পর্শনং (ত্বক্) রসনং চ (জিহ্বা) ঘ্রাণম্ এব চ (ও নাসিকা) মনঃ চ (এবং মনকে) অধিষ্ঠায় (আশ্রয় করিয়া) বিষয়ান্ (শব্দাদি বিষয় সমূহ) উপসেবতে (উপভোগ করেন) ॥৯॥


এই জীব কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্, জিহ্বা ও নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দ ও স্পর্শাদি বিষয় সকল উপভোগ করিতে থাকে ॥৯॥

অনুবাদঃ এই জীব চক্ষু, কর্ণ, ত্বক, জিহ্বা, নাসিকা ও মনকে আশ্রয় করে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ উপভোগ করে।



উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভুঞ্জানং বা গুণান্বিতম্।
বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ।।১০।।

বিমূঢ়াঃ (অবিবেকিগণ) উৎক্রামন্তং (দেহ হইতে গমনকালে) বা স্থিতং (বা দেহে অবস্থান কালে) ভূঞ্জানং বা অপি (কি বিষয় ভোগ কালেও) গুণান্বিতম্ (ইন্দ্রিয়াদি সমন্বিত) [জীবং] (জীবাত্মাকে) ন অনুপশ্যন্তি (দেখিতে পায় না), [কিন্তু] জ্ঞানচক্ষুষঃ (বিবেকিগণ) পশ্যন্তি (দর্শন করেন) ॥১০॥


মূঢ় মানবগণ জীবাত্মার উক্তরূপ দেহ পরিত্যাগ, দেহে অবস্থান ও বিষয়ভোগ কিছুই দেখিতে পায় না, কিন্তু জ্ঞান-চক্ষুযুক্ত ব্যক্তিসকল এ সমুদয়ই দেখিতে পান ॥১০॥

অনুবাদঃ মূঢ় লোকেরা দেখতে পায় না কিভাবে জীব দেহ ত্যাগ করে অথবা প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিভাবে তার পরবর্তী শরীর সে উপভোগ করে। কিন্তু জ্ঞান-চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সমস্ত বিষয় দেখতে পান।


যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্।
যতন্তোহপ্যকৃত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ।।১১।।

যতন্তঃ (যত্নশীল) যোগিনঃ চ (যোগিগণও) আত্মনি (দেহে) অবস্থিতম্ (অবস্থিত) এনং (এই জীবাত্মাকে) পশ্যন্তি (দর্শন করেন) ; যতন্তঃ অপি (যত্ন করিয়াও) অকৃতাত্মানঃ (অশুদ্ধ চিত্ত) অচেতসঃ (অবিবেকিগণ) এনং (এই জীবাত্মাকে) ন পশ্যন্তি (দেখিতে পায় না) ॥১১॥


যত্নশীল কোন কোন যোগীও শরীরে অবস্থিত এই জীবাত্মাকে দর্শন করেন ; কিন্তু অশুদ্ধচিত্ত অবিবেকিগণ যত্ন করিয়াও এই জীবাত্মাকে দেখিতে পায় না ॥১১॥

অনুবাদঃ আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত যত্মশীল যোগিগণ, এই তত্ত্ব দর্শন করতে পারেন। কিন্তু আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত অবিবেকী গণ যত্মপরায়ণ হয়েও এই তত্ত্ব অবগত হয় না।

যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ ভাসয়তেহখিলম্।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্।।১২।।

আদিত্যগতং (সূর্য্যস্থিত) যৎ (যে) তেজঃ (তেজ), চন্দ্রমসি (চন্দ্রে) যৎ (যে তেজ) অগ্নৌ চ (ও অগ্নিতে) যৎ (যে তেজ) অখিলম্ (সমগ্র) জগৎ (ব্রহ্মাণ্ডকে) ভাসয়তে (প্রকাশিত করে) তৎ (সেই সমস্ত তেজ) মামকম্ (আমারই) তেজঃ (তেজ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিও) ॥১২॥


সূর্য্যস্থিত যে তেজ অখিল জগৎকে প্রকাশ করে, চন্দ্র ও অগ্নিতে যে তেজ বিরাজমান, সেই সমুদয় আমারই তেজ বলিয়া জানিব ॥১২॥

অনুবাদঃ সূর্যের যে জ্যোতি এবং চন্দ্র ও অগ্নির যে জ্যোতি সমগ্র জগতকে উদ্ভাসিত করে, তা আমারই তেজ বলে জানবে।

গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা। 
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ।।১৩।।

অহম্ (আমি) গাম্ (পৃথিবীতে) আবিশ্য চ (অধিষ্ঠীত হইয়া) ওজসা (নিজ শক্তি দ্বারা) ভূতানি (চরাচর প্রাণিগণকে) ধারয়ামি (ধারণ করিতেছি) রসাত্মকঃ চ (ও অমৃতময়) সোমঃ ভূত্বা (চন্দ্র হইয়া) সর্ব্বাঃ (সমস্ত) ওষধীঃ (ব্রীহি ও যবাদি ওষধিগণকে) পুষ্ণামি (পোষণ করিতেছি) ॥১৩॥


আমি পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত হইয়া নিজ শক্তি দ্বারা জীবগণকে ধারণ করিতেছি ; আবার অমৃতময় চন্দ্র স্বরূপে সমুদয় (ব্রীহি ও যবাদি) ওষধিগণকে পোষণ করিতেছি ॥১৩॥

অনুবাদঃ আমি পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়ে আমার শক্তির দ্বারা সমস্ত জীবদের ধারণ করি এবং রসাত্মক চন্দ্ররূপে ধান, যব আদি ওষধি পুষ্ট করছি।

অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। 
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।১৪।।

অহং (আমি) বৈশ্বানরঃ (জঠরাগ্নি) ভূত্বা (হইয়া) প্রাণিনাং (প্রাণিগণের) দেহম্ (শরীরকে) আশ্রিতঃ (আশ্রয় করিয়া) প্রাণাপানসমাযুক্তঃ (প্রাণ ও অপান বায়ুর সহযোগে) চতুর্ব্বিধম্ (চারি প্রকার) অন্নং (অন্ন) পচামি (পরিপাক করিয়া থাকি) ॥১৪॥


আমি জঠরানল রূপে জীবদেহ আশ্রয় পূর্ব্বক প্রাণ ও অপান বায়ুর সহযোগে চর্ব্ব্য-চুষ্যাদি চতুর্ব্বিধ আহার্য্য পরিপাক করিয়া থাকি ॥১৪॥

অনুবাদঃ আমি জঠরাগ্নি রূপে প্রাণগিণের দেহ আশ্রয় করে প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগে চার প্রকার খাদ্য পরিপাক করি।

সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ। 
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো
বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্।।১৫।।

অহং (আমি) সর্ব্বশ্য চ (সকল প্রাণীরই) হৃদি (হৃদয়ে) সন্নিবিষ্টঃ (অন্তর্য্যামিরূপে অবস্থিত) মত্তঃ (আমা হইতে) [জীবস্য] (জীবের) স্মৃতিঃ (পূর্ব্বানুভূত বিষয়ের স্মরণ) জ্ঞানম্ (জ্ঞান) অপোহনং চ (ও তদুভয়ের বিলোপ হয়) ; সর্ব্বৈঃ চ (এবং সকল) বেদৈঃ (বেদের দ্বারা) অহম্ এব (একমাত্র আমিই) বেদ্যঃ (জ্ঞেয়), অহম্ এব (আমিই) বেদান্তকৃৎ (বেদব্যাসরূপে বেদান্ত কর্ত্তা) বেদবিৎ চ (ও বেদার্থবেত্তা) ॥১৫॥


আমি সমস্ত জীবেরই হৃদয়ে (অন্তর্যামিস্বরূপে) অবস্থিত, আমা হইতে জীবের (কর্ম্মানুসারে) স্মৃতি ও জ্ঞান এবং তদুভয়ের বিলোপ হয় ; আমিই সমস্ত বেদের একমাত্র জ্ঞাতব্য (রসময়) তত্ত্ব, আমিই বেদান্ত রচনাকারী অর্থাৎ বেদব্যাসরূপে জ্ঞেয় বেদার্থ নির্ণয়কারী ও আমিই বেদ-তাৎপর্য্য-বেত্তা ॥১৫॥

অনুবাদঃ আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত এবং আমর থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও বিলোপ হয়। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ।

পদ০-সর্বস্য। চ। অহম্। হৃদি। সন্নিবিষ্টঃ। মত্তঃ। স্মৃতিঃ। জ্ঞানম্। অপোহনম্। চ। বেদৈঃ। চ। সর্বৈ। অহম্। এব। বেদ্যঃ। বেদান্তকৃৎ। বেদ বিত্। এব। চ। অহম্।।

পদার্থ-( সর্বস্য) সমস্ত জীবের ( হৃদি) হৃদয়ে ( অহম্ সন্নিবিষ্টঃ) আমি স্থির ( মত্তঃ) আমার থেকে ( স্মৃতি,জ্ঞানম্) স্মৃতি এবং জ্ঞান আসে ( চ) এবং ( অপোহনম্) বিলোপ এই উভয়ের আবরণও আমার থেকেই আসে ( বেদৈঃ,চ,সর্বৈঃ) সমস্ত বেদসমূহকে ( বেদ্যঃ) জানার যোগ্য ( অহম্,এব) আমিই ( বেদান্ত-কৃত্) বেদান্তের সম্পত্তির কর্তা এবং ( বেদবিত্) বেদের জানানকারী ( অহম্,এব) আমিই।।

ভাবার্থ-এই শ্লোকগুলিতে পরমাত্মাকে অন্তর্যামীরূপ দ্বারা বর্ণন করা হয়েছে। যেমন বৃহদারণ্যকের অন্তর্যামী ব্রাহ্মণে পরমাত্মার সকল সত্য বর্ণন করা হয়েছে এবং যিনি এই বলেছেন যে,স্মৃতি এবং জ্ঞানের অস্থিত্বও আমার থেকেই হয় এবং তাদের অনুপস্থিতিও আমার থেকেই হয়। এই নিমিত্তকারণেরর অভিমায় থেকেই বলা হয়েছে যে পূর্বকৃতে এর কারণ পরমাত্মাই স্মৃতি শ্রাদি দান করেন এবং সর্বস্ব গ্রহণ করেন। যেমন-ব্র০ সূ০ ৩/৩/৪২ তে পূর্বকৃতের অপেক্ষা থেকে পরমাত্মাকে ফল দাতা হিসেবে সমাদদৃত করা হয়েছে,যদি এর অর্থ একই হয় যদি বিশ্বাস করা হয় যে কৃষ্ণ একাই সমস্ত গৌরব দান করেন,তবে কৃষ্ণজী "সর্বধর্মান্পরিত্যজ্যমামেকং শরণং ব্রজ"। গী০ ১৮/৬৬ তে এই কেন বলা হয় কারণ যখন কৃষ্ণই সকলের জ্ঞান-অজ্ঞানের কারণ তাই সব ধর্মই শুধু কৃষ্ণের,তাহলে গোপন থাকবে কেন? এবং গী০ ১৬/১৬ তে এই বলা হয়েছে যে মানুষ অহংবোধ দ্বারা আমাকে বা আড়ালে আমাকে ঘৃনা করে তাদের আমি অসুরী যোনিতে নিক্ষেপ করি,তারপর ধন বিচারের কি অপরাধ,কারণ জ্ঞানের স্মৃতি কেবল কৃষ্ণের। যদি বিশ্বাস করা হয় যে,এই শ্লোক গুলির অর্থ তাই পূর্বোক্ত হাজার হাজার যুক্তি গীতাকে পরস্পর বিরুদ্ধে এবং উপনিষদের বিরুদ্ধে প্রমাণ করে এর সাথে সামঞ্জ্স্যপূর্ণ হওয়ার সুবিধা রয়েছে অন্তর্যামীরূপে পরমাত্মা সকলের হৃদয়ে স্থির আছেন। তিনি পূর্বের কর্মের অপেক্ষা দ্বারা জ্ঞান এবং স্মৃতি দেয় এবং ওই পূর্ব কর্মের কারণ জ্ঞান তথা স্মৃতি হরণ করেন। তিনি বেদান্তকৃত বৈদিক সিদ্ধান্তের স্থিরকারী এবং তিনি বেদের রচয়িতা,মায়াবাদি লোকেরা এই শ্লোকের অর্থ নিজেদের পক্ষে নেয় এবং আমরা এই প্রকার আঁকি যে যথন তিনি সকলের হৃদয়ে স্থির থাকেন,তখন এই অর্থ লাভ বলা হয় একই জীবরূপ এক হয়ে গেছে যদি এই শ্লোকের এই তাতপর্য হতো তাহলে ১৭ তম স্লোকে গিয়ে কৃষ্ণজী নিজেই জীব থেকে ভিন্ন করে বর্ণনা করেন এইজন্য এই শ্লোকের আশয় পরমাত্মাকে সর্বান্তার্যামী এবং সর্বোত্তম প্রতিপাদন করা, যেমন পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করেছেন ( ভাষ্য-আর্যমুনি )

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। 
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।১৬।।

লোকে (চতুর্দ্দশ ভুবনে) ক্ষরঃ চ (ক্ষর) অক্ষরঃ চ (ও অক্ষর) ইমৌ (এই) দ্বৌ এব (দুইটি মাত্র) পুরুষৌ (চেতন তত্ত্ব) [স্তঃ] (রহিয়াছেন), [তয়োঃ] (তাহার মধ্যে) সর্ব্বাণি (ব্রহ্মাদিস্থাবরান্ত) ভূতানি (প্রাণিসকল) ক্ষরঃ (স্বরূপ হইতে বিচ্যুত হয় বলিয়া ক্ষর), কূটস্থঃ (এবং অবিচ্যুত স্বরূপে নিত্য অবস্থিত ভগবৎ-পার্ষদতত্ত্ব) অক্ষরঃ (অক্ষর শব্দে) [বিদ্বদ্ভিঃ] (জ্ঞানিগণ কর্ত্তৃক) উচ্যতে (কথিত হন) ॥১৬॥


জগতে ক্ষর ও অক্ষর এই দুইটী মাত্র পুরুষ বর্ত্তমান ; তাহার মধ্যে ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্য্যন্ত প্রাণিসমূহ (স্ব-স্বরূপ হইতে বিচ্যুত হয় বলিয়া) ক্ষর, ও অবিচ্যুত স্বরূপে নিত্য অবস্থিত [ভগবৎ-পার্ষদ] তত্ত্বই অক্ষর শব্দবাচ্য ॥১৬॥

অনুবাদঃ ক্ষর ও অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতের সমস্ত জীবকে ক্ষর এবং চিৎ-জগতের সমস্ত জীবকে অক্ষর বলা হয়।

উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ। 
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্তব্যয় ঈশ্বরঃ।।১৭।।

তু (কিন্তু) অন্যঃ (অক্ষর পুরুষরূপ পার্ষদতত্ত্ব হইতে ভিন্ন) উত্তমঃ (উৎকৃষ্ট) পুরুষঃ (পুরুষ) পরমাত্মা (সেই পরমাত্মারূপ অক্ষর পুরুষ) ইতি (এই শব্দে) উদাহৃতঃ (কথিত হন) । যঃ (যিনি) ঈশ্বরঃ (সকলের প্রভু) অব্যয়ঃ [সন] (সনাতনরূপে) লোকত্রয়ম্ (ত্রিজগন্মধ্যে) আবিশ্য (প্রবেশ পূর্ব্বক) বিভর্ত্তি (জীবগণকে পালন করিতেছেন) ॥১৭॥


কিন্তু এতদুভয় হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কোন উৎকৃষ্ট পুরুষকে পরমাত্মা বলা হয় । তিনিই ঈশ্বর এবং সনাতন স্বরূপে লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া জগজ্জনকে পালন করিতেছেন ॥১৭॥

অনুবাদঃ এই উভয় থেকে ভিন্ন উত্তম পুরুষকে বলা হয় পরমাত্মা, যিনি ঈশ্বর ও অব্যয় এবং ত্রিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পালন করছেন।

যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।
অতোহস্মিন লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।১৮।।

যস্মাৎ (যেহেতু) অহম্ (আমি) ক্ষরম্ (ক্ষর পুরুষ জীবের) অতীতঃ (অতীত) অক্ষরাৎ অপি চ (এবং অক্ষর পুরষ মুক্তাত্মা হইতেও) উত্তম (উৎকৃষ্ট তত্ত্ব) অতঃ (অতএব) লোকে (জগতে) বেদে চ (ও বেদাদি শাস্ত্রে) পুরুষোত্তমঃ (পুরুষোত্তম নামে) প্রথিতঃ [অস্মি] (প্রসিদ্ধ হইয়াছি) ॥১৮॥


যেহেতু আমি ক্ষর পুরুষের অতীত, এবং অক্ষর পুরুষ নিত্যপার্ষদ হইতেও উত্তম, অতএব জগতে ও বেদাদি শাস্ত্রে আমাকেই ‘পুরুষোত্তম’ বলিয়া কীর্ত্তন করে ॥১৮॥

অনুবাদঃ যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।

যো মামেবমসংমূঢ়ো জনাতি পুরুষোত্তমম্। 
স সর্ববিদ্ ভজতি মাং সর্বভাবেন ভারত।।১৯।।

[হে] ভারত ! (হে ভারত বংশীয় !) যঃ (যিনি) অসংমূঢ়ঃ (মোহশূন্য) [সন্] (হইয়া) মাম্ (আমাকে) এবং (পূর্ব্বোক্তপ্রকারে) পুরুষোত্তমম্ (পুরুষোত্তম বলিয়া) জানাতি (জানিতে পারেন), সঃ (তিনিই) সর্ব্ববিৎ (পূর্ণতত্ত্বজ্ঞ) মাং (আমাকে) সর্ব্বভাবেন (সর্ব্বপ্রকারে অর্থাৎ মধুরাদি সর্ব্বরসে) ভজতি (ভজনা করেন) ॥১৯॥


হে ভারত ! যিনি কোনরূপে মোহিত না হইয়া পূর্ব্বোক্ত প্রকারে আমার এই সচ্চিদানন্দ-স্বরূপকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানেন তিনিই পূর্ণতত্ত্বজ্ঞ এবং সর্ব্বপ্রকারে (শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য ও মধুর রসে) আমাকেই ভজন করেন ॥১৯॥

 অনুবাদঃ হে ভারত! যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।

ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ। 
এতদ্ বুদ্ধা বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত।।২০।।

[হে] অনঘ ! (হে নির্ম্মৎসর !) ময়া (আমা কর্তৃক) ইতি (এই প্রকারে) গুহ্যতমং (অতি গোপনীয়) ইদম্ (এই) শাস্ত্রম্ (সর্ব্বশাস্ত্র তাৎপর্য্য) উক্তং (কথিত হইল) । [হে] ভারত ! (হে ভারত !) এতৎ (ইহা) বুদ্ধ্বা (হৃদয়ঙ্গম করিয়া) বুদ্ধিমান্ (সুমেধজন) কৃতকৃত্যঃ চ (পরম কৃত কৃতার্থ) স্যাৎ (হইয়া থাকেন) ॥২০॥


হে নির্ম্মৎসর ! আমি এই প্রকারে অতি গুহ্যতম এই সর্ব্বশাস্ত্র তাৎপর্য্য তোমাকে বলিলাম । হে ভারত ! ইহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া সুমেধজন পরম কৃতকৃতার্থ হইয়া থাকেন ॥২০॥

অনুবাদঃ হে নিষ্পাপ অর্জুন! হে ভারত! এভাবেই সবচেয়ে গোপনীয় শাস্ত্র আমি তোমার কাছে প্রকাশ করলাম। যিনি এই তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান ও কৃতার্থ হন।
 
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষদ্­সু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে পুরুষোত্তমযোগ নাম
পঞ্চদশোঽধ্যায়ঃ ॥১৫॥


ইতি পঞ্চদশোঽধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥


ইতি পঞ্চদশ অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ॥

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

  সম্পাদকীয় বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ