অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস ১৮৫৯ সালের ২৪ শে নভেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ যার লেখক চার্লস ডারউইন। বইটির পুরো নাম On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life যার বাংলা করলে দাঁড়ায় "প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি অথবা জীবন সংগ্রামে আনুকূল্য প্রাপ্ত গোত্রের সংরক্ষণ বিষয়ে"।
সন্দেহাতীতভাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ হাইপোথিসিসটি তার সময়কালে একটি অত্যন্ত প্রভাববিস্তারকারী তত্ব হিসেবে বিজ্ঞান মহলে স্বীকৃতি পেয়েছিল । কিন্তু বর্তমান হাইব্রিড প্রযুক্তির যুগে তত্বটি বিজ্ঞানীদেরই একাংশের কিছু যৌক্তিক সমস্যার সমাধান প্রদান করতে ব্যর্থ হয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে রয়েছে । কিছু সমস্যা :
প্রথমত, স্রেফ কতগুলো ক্যামিকেলের রিয়েকশন দিয়েই যদি প্রাণ সৃষ্টি করা যায় তাহলে বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানীরা টেস্ট টিউবে প্রাণ সৃষ্টির সকল উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়েও কেন প্রাণ উদ্ভাবনে ব্যর্থ হচ্ছে ?
প্রাণীজগতের ভেরিয়েশনের ফ্রেকুয়েন্সিতে এত ওয়াইড রেঞ্জ পরিলক্ষিত হয় কেন ? তাছাড়া বিভিন্ন বিবর্তিত প্রানীগুলোর মধ্যকার অন্তর্বর্তী প্রাণী অনুপস্থিত কেন ? এপ আর মানুষের অন্তর্বর্তী প্রাণীটি কোথায় ?
স্রেফ দুর্ঘটনা থেকেই যদি প্রানের উত্পত্তি ঘটে থাকে, তাহলে বর্তমান প্রানীগুলোর জিনেটিক কোডিং এত দৃঢ়ভাবে সংরক্ষিত কেন ? প্রাণীকুলের জিনেটিক কোডিং এ ক্রমাগত দুর্ঘটনা ঘটে ঘটে নতুন নতুন স্পেসিস তৈরী হয়ে যাবার কথা, কিংবা জিনেটিক কোডিং ক্রমাগত এ দুর্ঘটনা ঘটে কোন কোন প্রাণীর ৩ /৪ টা হাত, দুটা তিনটা মাথা গজানো প্রভৃতি দুর্ঘটনা ঘটে না কেন ?
বিস্ময়করভাবে রক্তখেকো প্রানীগুলোর আকৃতি মানুষের তুলনায় ছোট ছোট ( মশা, জোক প্রভৃতি )। প্রকৃতিতে এগুলোর অস্তিত্ব সুদৃঢ় করতে এরা কেন ঈগলের মত বড় আকৃতিতে বিবর্তিত হলো না ?
ধারণা ১ – বিবর্তন শুধু একটা তত্ত্ব
এই মিথ্যাচারটিকে, যদি না সেটা অজ্ঞানতাবশত করা হয়ে থাকে; অনেকেই তর্কে তুলে আনেন। “বিবর্তন ফ্যাক্ট না, এটা একটা থিওরি মাত্র” বলে বোঝাতে চান বিবর্তন বিশ্বাসযোগ্য নয়! বিবর্তন ফ্যাক্ট এবং থিওরি দুটোই, নির্ভর করে আপনি কী নিয়ে কথা বলছেন তার উপর।
সকল প্রাণী সরলতর প্রাণী থেকে কয়েক মিলিয়ন বছরে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। সেই সরলতর প্রাণীকে বলা হয় LUCA (Last Universal Common Ancestor)- এটা একটা বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট। এই ফ্যাক্টের সত্যতা পাওয়া যায় ফসিলে, ডিএনএতে আর জৈবভূগোলে। আপনি ফসিল খুঁজতে যত গভীরে যাবেন তত সরলতর প্রাণীর ফসিল পাবেন। সরলতর প্রাণীদের ভীড়ে আপনি জটিল গঠনের ফসিল পাবেন না, কখনোই। একই গভীরতায় পাওয়া ফসিলরা একই রকম গঠনের হবে, জটিলতার দিক থেকে।
ডিএনএর গঠনও প্রচ্ছন্নভাবে বিবর্তনের প্রমাণ দিয়ে যায়। শিম্পাঞ্জীর সাথে মানুষের কার্যকর জীন ৯৯.৬% মিলে যায়। ইদুরের সাথে ৮০% মিলে যায়। এই শতকরা অনুপাত আবার একক পূর্বপুরুষের জীবনকালের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো বিবর্তনকে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এবার দেখা যাক থিওরির অংশটা।
থিওরি হচ্ছে যা দিয়ে ফ্যাক্টকে বিশ্লেষণ করা হয়। The Theory of Evolution by the means of Natural Selection”, থিওরিটা হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের অংশটা।
অন্যভাবে বলতে গেলে, বিবর্তন হচ্ছে ফ্যাক্ট, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সেটা ঘটে এটা হচ্ছে থিওরি। আরো কিছু থিওরি যদি আমরা দেখি তবে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে- The theory of universal gravity, The germ theory, The cell theory, The heliocentric theory, যেগুলো সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক সম্মানপ্রাপ্ত সত্য সেগুলোকেও থিওরিই বলা হয়।
চার্লস ডারউইন আর আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের আগেও অনেক প্রকৃতিবাদী-জীববিজ্ঞানী-দার্শনিক বিবর্তনের কথা বলে গেছেন। তারা যেটা পারেন নি সেটা হচ্ছে “কেনো” প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া। ডারউইন আর ওয়ালেস “কেনো” আর “কিভাবে” ব্যাখা করতে পেরেছেন। আর সেটাই তাদের অসাধারণ আর ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃনার পাত্র করে তুলেছে।
ধারণা ২ – বানর/এপ থেকে মানুষের বিবর্তন হয়েছে
“যদি মানুষের বিবর্তন বানর/এপ থেকে হয় তাহলে এখনো কেনো বানর/এপ আছে?” প্রশ্নটি হতাশাজনক ভাবে ভুল।
মানুষ বানর বা এপ থেকে বিবর্তিত হয় নি। মানুষ এবং বানর/এপের একক একটা পূর্বপুরুষ ছিল। যদি সময় যাত্রা করে আমরা কয়েক মিলিয়ন বছর অতীতে যেতে পারি তবে আমরা আমাদের এপ-সদৃশ পূর্বপুরুষদের দেখতে পাবো। এদের জনসংখ্যা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়েছিল আর বিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেছিল। একটা ধারায় আসা সর্বশেষ প্রাণী আমরা, আরেকটা ধারার সর্বশেষ প্রাণী শিম্পাঞ্জী। (সর্বশেষ বলতে সবচেয়ে নতুন প্রাণী বোঝানো হয়েছে- ধারা এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। বিস্তারিত পাবেন “ভুল ধারনা ৭” এ)
তো শিম্পাঞ্জী আর মানুষের একক প্র-প্র-প্র-প্র…পিতামাতারা ৪-৬ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছেন। এর পরে আসা মানবসদৃশ প্রাণীদের ১৪টির মতো ফসিল পাওয়া গেছে যেগুলো “ভুল ধারণা ৪”এ জানতে পারবেন।
ধারণা ৩ – তাপগতিবিদ্যার ২য় সুত্র বিবর্তনবাদের সাথে সাংঘর্ষিক
প্রায়ই যে কথাটা শোনা যায় সেটা হচ্ছে- “তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র বিবর্তনকে সমর্থন করে না”। আসুন দেখি তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র কি বলে-
“কোনো সিস্টেম নিন্মশক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে যেতে পারবে না, যদি না বাইরে থেকে শক্তির প্রবেশ না হয়।” অন্য ভাষায়- “সিস্টেমের disorder বাড়তেই থাকবে যদি না বাইরে থেকে order সরবরাহ করা হয়।”
ধরুন আপনি মইয়ের চড়ে মাটি থেকে ৫ফুট উচ্চতায় দাড়িয়ে আছেন, আপনার বন্ধু নিচে মাটিতে দাড়িয়ে আছেন। একজন পদার্থবিদের কাছে আপনার বন্ধুর চেয়ে আপনার potential energy বেশী হওয়ায় আপনি বেশী “ordered”। আপনার বন্ধুটির এনট্রপি (শক্তি রূপান্তরের অক্ষমতা বা অসম্ভাব্যতা বা শক্তির অপ্রাপ্যতা) আপনার চাইতে বেশী।
লক্ষ্য করুন- তাপগতিবিদ্যার ২য় সুত্রে কম শক্তিস্তর থেকে বেশী শক্তিস্তরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধ নাই, তবে শর্ত একটাই- বাইরে থেকে শক্তির সরবরাহ আসতে হবে। নিচে দাড়ানো আপনার বন্ধুটি মই চড়ে উপরের শক্তিস্তরে উঠার পথে কোনো বাধা নাই, তবে তাকে তার মাংসপেশীর শক্তি ক্ষয় করতে হবে। অন্য কথায়, শক্তি সরবরাহ করতে হবে।
আরেকভাবে দেখা যাক- বদ্ধ সিস্টেম- যেখানে বাইরে থেকে শক্তি প্রবেশ করানো যায় না, সেখানে এনট্রপির পরিবর্তন অসম্ভব। খোলা সিস্টেমে এনট্রপি বাইরে থেকে শক্তি নিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে।
এবার ২য় সুত্রকে বিবর্তনের সাথে মিলিয়ে দেখা যাক। পৃথিবী খোলা সিস্টেম- নিকটবর্তী শক্তির আধার হচ্ছে সূর্য, যেখান থেকে আমরা প্রতিনিয়ত শক্তি পাচ্ছি। সূর্য ছাড়া প্রাণ অসম্ভব। সূর্যের তাপশক্তি ব্যবহার করে প্রাণীরা খাদ্য তৈরি করছে। সুতরাং তাপগতিবিদ্যার ২য় সুত্রের সাথে বিবর্তনবাদের কোন সংঘর্ষ নাই, বরং বিবর্তনবাদ তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র মেনেই চলছে।
ধারণা ৪ – মিসিং লিংক নাই
Odontochelys একটি মধ্যবর্তি প্রাণীর ফসিল যেটা কচ্ছপ আর গিরগিটির মাঝামাঝি একটি প্রাণী ছিল। ছবিতে আমরা একটা গিরগিটির মত লম্বা লেজ আর কচ্ছপের মত খোলস দেখতে পাচ্ছি।
মিসিং লিংকগুলো আর মিসিং নয়, বিজ্ঞানীরা শত শত ফসিল পেয়েছেন যেগুলো একই সাথে দুটো প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বহন করে। উদাহরণস্বরূপ- তিমি। স্তন্যপায়ী হয়েও তিমি পানিতে বেঁচে আছে মাছের মতো। তিমির কংকালে পায়ের হাড়গুলো এখনো বিদ্যমান, যা প্রমাণ করে তিমি বা তার কোনো পূর্বপুরুষ স্থলজ প্রাণী ছিল।
এছাড়াও Archaeopteryx, Confuciusornis, আর Jeholornis পাখি আর সরীসৃপ মধ্যবর্তী প্রাণীর ফসিল। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এই ফসিলগুলো প্রমাণ করে বিবর্তনবাদের সত্যতা। সৃষ্টিতত্ত্ববিদেরা এগুলোকে অস্বীকার করেন, তারা বলেন মধ্যবর্তী ফসিল বলে কিছু নাই, তবে তারা মিসিং লিংক দিয়ে বিবর্তনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চান। ফসিলের প্রমাণ দেখালেও তারা অস্বীকার করেন।
এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে এমন মানবসদৃশ প্রাণীর ফসিলগুলো হচ্ছে-
Sahelanthropus tchadensis
Ardipithecus ramidus
Australopithecus anamensis
Australopithecus afarensis
Kenyanthropus platyops
Australopithecus africanus
Australopithecus garhi
Australopithecus sediba
Australopithecus aethiopicus
Australopithecus robustus
Australopithecus boisei
Homo habilis
Homo georgicus
Homo erectus
Homo ergaster
Homo antecessor
Homo heidelbergensis
Homo neanderthalensis
Homo floresiensis
ধারণা ৫ঃ বিবর্তন বিজ্ঞান নয়, কারণ এটা প্রত্যক্ষ বা পরীক্ষা করা যায় না
ক্ষুদ্রতর পরিসরে বিবর্তন বহুবার প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। ব্যাকটেরিয়ারা এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, বিজ্ঞানীরা সেটা প্রতিনিয়ত দেখে নতুন এন্টিবায়োটিক বানাচ্ছেন। গ্রান্ট আর গ্রান্টের করা ২০০২ সালের পরীক্ষায় আমরা দেখেছি খরার কারণে কিভাবে গ্যালাপাগোসের ফিঞ্চ পাখিদের ঠোঁটের পরিবর্তন হয়েছে।
যাই হোক- যখন কেউ এই দাবি করেন তখন তারা বোঝান দীর্ঘ পরিসরে বিবর্তন প্রত্যক্ষ করার কথা। তারা বলেন “মাইক্রোইভোলিউশন হতেই পারে, তবে সরীসৃপ কিভাবে মোরগে পরিণত হয় আমরা সেটা দেখতে চাই।”
প্রথমত- মাইক্রোইভুলূ্যশন আর ম্যাক্রোইভুলূ্যশনের মাঝে পার্থক্য খুব বেশী নয়। ক্ষুদ্র পরিসরে বিবর্তন হতে পারলে বৃহৎ পরিসরেও হতে পারে। অনেকগুলো মাইক্রোইভোলিউশন (মিউটেশন) মিলেই ম্যাক্রোইভোলিউশন হয়।
আর বিজ্ঞান মানেই যে প্রত্যক্ষ করতে হবে সেটা কিন্তু না। আপেক্ষিকতাবাদের প্রতিপাদ্য সময়কালের বক্রতা প্রত্যক্ষ করা আমাদের মত ত্রিমাত্রিক প্রাণীদের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু আমরা সময়কালের বক্রতার প্রমাণ ঠিকই বের করে নিয়েছি। বিজ্ঞানীরা তথ্য ধরে আগান, গোয়েন্দাদের মতো সূক্ষ প্রমাণ জড়ো করে বড় বড় রহস্য সমাধান করেন তাঁরা। বিজ্ঞান সবসময় প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভর করে না।
বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা তথ্য-প্রমাণ জড়ো করে করে বলতে পারেন- মোরগ সরীসৃপ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ফসিল-ডিএনএ ইত্যাদি তথ্য বিচার বিশ্লেষন করে তাঁরা আমাদের দেখান এটাই সত্য। তাঁরা বলেন- “পাখিরা যদি সরীসৃপ থেকে বিবর্তিত হয়ে থাকে তবে পাখিদের ডিএনএ সরীসৃপদের সাথে বেশী মিলবে।” পরে সেটার প্রমাণ হাজির করার পর তাঁরা উপসংহার টানেন। এটাকেই বলে scientific method!
ধারণা ৬- একক প্রাণীর বিবর্তন
প্রজাতির বিবর্তন হয়, একক প্রাণীর নয়। বিবর্তন হল নির্দিষ্ট সময়ে একটা প্রজাতির জীনগত গঠনে যে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং, যেহেতু কোন একক প্রাণী তার জীনগত কাঠামোতে কোন পরিবর্তন আনতে পারে না, তার একক বিবর্তন সম্ভব নয়। যেমন, যদি কোন খরার সময় শুধুমাত্র বড় বীজসম্পন্ন গাছগুলো ছাড়া সকল বীজসম্পন্ন গাছ ধ্বংস হয়ে যায়, ছোট ঠোঁটের কোন পাখি ঐ খরার আদলে বিবর্তিত হতে পারবে না। অন্য ভাষায়, এটি বড় বীজ খাওয়ার জন্য তার জীনগত কাঠামোর পরিবর্তন করে তার ঠোঁটের আকার-আকৃতি বদলে ফেলতে পারবে না। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, এটি অভিযোজিত হতে পারবে না। ফলাফলস্বরূপ, বড় ঠোঁটের পাখিগুলোর তুলনায় ছোট ঠোঁটের পাখিগুলো কম খাবার পাবে এবং কম সন্তানের জন্ম দেবে। এর মানে হলো, পরবর্তী প্রজন্মে বড় ঠোঁটের জন্য জীন বেশি থাকবে। সুতরাং সম্পূর্ণ প্রজাতির খরার সাথে খাপ খাওয়াতে বিবর্তিত এবং অভিযোজিত হবে, কোনো একক প্রাণী নয়।
ধারণা ৭: বিবর্তনের কোন লক্ষ্য আছে
মানুষ প্রায়ই বিবর্তন সম্পর্কে বলে যে, “কিছু সাধন করে ফেলায় চেষ্টারত”; নয়তো তারা প্রাইমেট এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের অন্য প্রাণীদের তুলনায় “বেশি বিবর্তিত” বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু এ ধরণের বিবৃতিগুলো প্রবল সমস্যাযুক্ত কারণ তারা এটারই পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে বিবর্তনের কোন উদ্দেশ্য আছে, যা সত্য নয়। জীববিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলেন যে, “বিবর্তন অন্ধ।” বিবর্তন যা করে তা হলো কোন জীব প্রজাতিকে তার বর্তমান পরিবেশ এবং জীবনপ্রণালীর সাথে অভিযোজিত করে তোলে। বিবর্তনের কোন উদ্দেশ্য নেই, এবং এটি কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম নয়। সুতরাং, সহস্র প্রজন্মের জন্য নির্বাচিত বৈশিষ্ট্য পরিবেশের এ কোন পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
কারণ, বিবর্তন শুধু জীবকে তার বর্তমান পরিবেশ এবং জীবনপ্রণালীর সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে, যেকোন এক প্রজাতিকে অন্যদের চেয়ে “বেশি বিবর্তিত” বলে আখ্যা দেওয়ার কোন মানে হয় না। যেমন, একটা বানর একটা মাছির চেয়ে বেশি বিবর্তিত নয় যে মাছি বানরটার পায়খানা থেকে আর্দ্রতা পায়। বানর অবশ্যই বেশি জটিল, কিন্তু এটি আসলে বেশি বিবর্তিত নয় কারণ বানর এবং মাছি দুজনই তাদের নিজ নিজ জীবনপ্রণালীর সাথে খুব ভালভাবেই খাপ খাইয়েছে। যদি আপনি বলতে চান যে বানরটা মাছিটার চেয়ে বেশি বিবর্তিত, তাহলে আপনি বলছেন যে বিবর্তনের উদ্দেশ্য আছে, যা ভুল।
পরিশেষে, এটা সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের প্রচলিত সমালোচনা, “কিছু প্রজাতির উলটো বিবর্তন হয়েছে (যেমনঃ পেঙ্গুইনের ওড়ার ক্ষমতা হারানো, তিমির সাগরে ফিরে যাওয়া)”, এর ব্যাখ্যা দেয়। মনে হতে পারে যে বিবর্তনের নির্দিষ্ট লক্ষ রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এটা শুধু জীবকে তার বর্তমান পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াচ্ছে। সুতরাং, একটা সময়ে, যখন ওড়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল, বিবর্তন পাখিকে ওড়ার সামর্থ দিয়েছে। কিন্তু অ্যান্টার্কটিকায় যেসব পাখির বাস, ওড়ার বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তাদের এত বেশি ছিল না, যতটা ছিল সাঁতার এবং উষ্ণ থাকার বিদ্যার, যা বিবর্তন তাদের দিয়েছে ওড়ার ক্ষমতার পরিবর্তে এবং পেঙ্গুইন এসেছে।
ধারণা ৮: কিছু সিস্টেম বিবর্তনের জন্য খুব বেশিই জটিল
এটা বিবর্তনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে পুরনো সমালোচনা। এবং ইদানীং “সরলীকরণের অযোগ্য জটিলতা” নামে একে নিয়ে আবার কথা হচ্ছে।এর মূলকথা হল, কিছু সিস্টেম বিবর্তনের জন্য খুব বেশি জটীল কারণ সকল অংশ একত্রিত হবার আগ পর্যন্ত তারা কার্যকরী নয়। যেমন, একটা চোখের ছোট একটা অংশের অনুপস্থিতির জন্য চোখটা দেখতে পাবে না, একটা Bacterial Flagellum একটা প্রোটিনের অভাবে Flagellum এর মত আচরণে সক্ষম হবে না। সুতরাং, বিতর্কের মূলকথা হল, এই সিস্টেমগুলো বিবর্তিত হতে পারতো না কারণ সেখানে কোন কার্যকরী ধাপ থাকতো না, প্রকৃতি ঐ ধাপগুলো নির্বাচন করতে পারতো না। সমস্যা হল, এই বিতর্ক একটা বিষয়কে অবজ্ঞা করছে, “বিবর্তন অন্ধ”। বিবর্তনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে নির্বাচিত হবার জন্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে কার্যকরী হতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বরং, যদি কোন বৈশিষ্ট্য কার্যক্ষম হয়, প্রকৃতি তাদের নির্বাচিত করবে। প্রকৃতপক্ষে, কেউ এখনো পুরোপুরি সরলীকরণের অযোগ্য কোন সিস্টেম খুঁজে বের করতে পারেনি, এবং জটিল সিস্টেমের বিবর্তন ব্যাখ্যায় আমাদের আছে বিবর্তন পদ্ধতি। যেমনঃ পূর্বে উল্লেখিত চোখের উদাহরণে, চোখটা শুধু কিছু আলোক সংবেদনশীল কোষ যোগ করে নিত (অনেকটা চ্যাপ্টাকৃমির মত)। তারা ঠিক চোখের মত কাজ করে না, কিন্তু এরপরও তারা কার্যক্ষম, সুতরাং প্রকৃতি তাদের জন্য নির্বাচন করবে। একইভাবে, যসব প্রোটিনের জন্য Flagellum এর উদ্ভব হয়, তারা কোষের অন্যান্য কাজগুলো করে, এমনকি আমরা এমন এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া খুঁজে পেয়েছি যা প্রতি ধাপকে কোষের জন্য কার্যক্ষম করে Flagellum এ রূপান্তরিত করবে, যদিও চূড়ান্ত ধাপই হবে একটি পরিপূর্ণ Flagellum। সুতরাং এটি সত্য নয় যে কিছু সিস্টেম বিবর্তনের জন্য খুব বেশিই জটিল।
ধারণা ৯: বিবর্তন মহাবিশ্বের প্রথম কোষের নির্মাণ বর্ণনা করে
আমরা প্রায়ই মানুষকে বলতে শুনি যে, “বিবর্তনবাদ সত্য নয় কারণ……ব্লা…ব্লা…ব্লা… বিগ ব্যাং,” অথবা কেন আমরা এখনো প্রথম কোষের নির্মাণ কিভাবে হয়েছিল তা বের করতে পারিনি, এমন আজবাজে কথা। এসব বিতর্কের সাথে বিবর্তনবাদের কোন সম্পর্কই নেই। বিগ ব্যাং তত্ত্ব মহাবিশ্বের আবির্ভাব নিয়ে এবং Abiogenesis জীবনের নির্মাণ নিয়ে আলোচনা করে। বিবর্তন মঞ্চে আসে মূলত জীবনের উৎপত্তির পর। সুতরাং, যদি আপনি কোনভাবে বিগ ব্যাং বা Abiogenesis কে ভুল প্রমাণ করেও ফেলেন, আপনার পক্ষে এরপরও সম্ভব হবে না বিবর্তনকে ভুল প্রমান করা। প্রকৃতপক্ষে, কিছু মানুষ ভাবে প্রথম কোষটি ঈশ্বরের সৃষ্টি, তারা বিবর্তনবাদকেও তার জায়গা ছেড়ে দেয়। অন্য কথায়, তারা Abiogenesis কে না মানলেও বিবর্তনকে মেনে নিয়েছে (যদিও বিগ ব্যাং এবং Abiogenesis কে অস্বীকার করার মত কোন শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক কারণ নেই।)
ধারণা ১০: বিবর্তনের ভিত্তি হল বিশ্বাস
যারা এটা দাবি করেন তাদের কাছে আমি জানতে চাইব যে ঠিক কোন অংশটি আপনি মনে করেন স্রেফ বিশ্বাসভিত্তিক? ৫ম পয়েন্টে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের বিবর্তন নিজের চোখে দেখিনি বলে বিবর্তনকে অবৈজ্ঞানিক বলে আখ্যা দেয়া যায় না। বরং বিবর্তন হচ্ছে বিজ্ঞানের সর্বাধিক স্বীকৃত ধারণাগুলোর একটি, এবং যদি আপনি আসলেই ‘Origin of the Species’ পড়ে থাকেন তো দেখবেন, এটি প্রমাণে পরিপূর্ণ। এছাড়াও, ডারউইন ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী এবং তিনি পরিষ্কার ভবিষ্যদ্বানী করে গেছেন যে তাঁর থিওরি সঠিক হলে পরবর্তীতে রিসার্চাররা কী কী ফলাফল পেতে পারেন। যেমন, তিনি স্পষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন আমাদের মধ্যবর্তী ফসিল আবিষ্কারের কথা, এবং আমরা করেছি। কিছু জীব আছে, যাদের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাওয়ার কয়েক যুগ আগেই বিবর্তন এদের ধারণা দিয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে এক অনন্য কৃতিত্ব। একইভাবে, বিবর্তন জেনেটিকস এবং ফসিল রেকর্ডের মধ্যেকার শক্তিশালী সম্পর্কের ধারণা করেছিল, এবং আবারো, এর ধারণা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং আপনি যদি দাবি করেন বিবর্তন স্রেফ বিশ্বাসভিত্তিক, আপনার কাছে আমি জানতে চাইব যে ঠিক কোন অংশটি আপনি মনে করেন শুধুমাত্র বিশ্বাসভিত্তিক, কারণ এর কোন দিক নেই যা আমি গবেষণামূলক তথ্য দিয়ে ভুল প্রমাণ করতে পারেন।
বিবর্তনের বিপক্ষে লেখাটি ডঃ প্রশান্ত মন্ডলের
স্যার রিচার্ড ওয়েন (২০শে জুলাই ১৮০৪ - ১৮ই ডিসেম্বর ১৮৯২) ছিলেন একজন ইংরেজ জীববৈজ্ঞানিক, তুলনামূলক শারীরস্থান বিশেষজ্ঞ এবং পুরাজীববিদ। বেশ কিছু বিতর্কে জড়িত থাকা সত্ত্বেও ওয়েনকে বিশেষত জীবাশ্মের বিশ্লেষণে অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন একজন প্রকৃতি-বৈজ্ঞানিক হিসেবে মানা হয়।
চার্লস ডারউইন-এর প্রাকৃতিক নির্বাচন মারফত বিবর্তনের তত্ত্বের প্রবল ও প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্যেও তাকে মনে রাখা হয়। তিনি ডারউইনের সাথে একমত ছিলেন যে বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি বাস্তব, কিন্তু মনে করতেন ডারউইনের অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বইতে বর্ণিত পদ্ধতির চেয়ে আসল বিবর্তন অনেক বেশি জটিল।(Cosans (2009) pp. 97–103) প্রাথমিকভাবে ডারউইনের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক থাকলেও ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস বইয়ের কঠোর সমালোচক ছিলেন ওয়েন; বইটিতে ওয়েন ও চেম্বার্স সমেত অন্যান্য পূর্ববর্তী গবেষকদের প্রাণ সংক্রান্ত কাজকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়নি বলে। এখানে উল্লেখ্য যে ওয়েন প্রমুখ গবেষকেরা বিবর্তনকে বাইবেলে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে তুলনা করেছিলেন।
বিবর্তনীয় উন্নয়নমূলক জীববিজ্ঞান-এর সাম্প্রতিক উত্থানের পিছনে যে নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাব আছে, ওয়েনকে তার জনক বলা যায়। ডারউইন এবং ওয়েন উভয়ের কাছেই তুলনামূলক শারীরস্থানের এই সামঞ্জস্য বিবর্তনীয় উত্তরাধিকারের প্রমাণ রূপে প্রতিভাত হয়।
অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস-এ ডারউইনের তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর বইটির লেখক ওয়েনের কাছে একটি নোট পাঠান যেখানে এই তত্ত্ব সম্বন্ধে লেখা ছিল "ব্যাপারটাকে ঘৃণ্য মনে হতে পারে"। ওয়েন দ্রুত সাড়া দিয়ে যথাযথ ভদ্রতা সহকারে লেখেন যে তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ বিশ্বাস করেন "উপস্থিত প্রভাবক" সমূহের দ্বারাই প্রজাতির "পরিকল্পিত" অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। এরপর ডারউইন ওয়েনের সাথে দীর্ঘ কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন এবং ওয়েন জানান যে ডারউইনের বইতেই "প্রজাতির উৎপত্তির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আজ অবধি প্রকাশিত" সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যদিও তার মনে এই সংশয় তখনও ছিল যে পরা-পরিব্যক্তির তত্ত্ব মানুষকে পাশবিক বলে চিহ্নিত করবে। সম্ভবত ডারউইন ওয়েনকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে তিনি গোটা ব্যাপারটাকে পূর্বনির্ধারিত কোনো 'নকশার' ফল হিসেবে দেখছেন। ওয়েন এই কথাকে "সৃষ্টিকারী শক্তি"র প্রতি তাঁদের দু'জনের সাধারণ বিশ্বাসের সূচক হিসেবে অনুবাদ করেন।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রাকৃতিক ইতিহাসের সংগ্রহের প্রধান থাকার সময় ওয়েন অরিজিন- এর উপর অজস্র প্রশ্ন ও অভিযোগমূলক চিঠি পান। এই সময় ঐ ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত সম্পর্কে যদিও কিছু জানা যায় না। সংসদীয় একটি কমিটির সামনে প্রাকৃতিক ইতিহাসের আলাদা জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য রাখার সময় তিনি খেয়াল করিয়ে দেন: "গোটা বুদ্ধিজীবী মহল এই বছর প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কিত একটা বই নিয়ে আলোড়িত হয়ে আছে; আর তার ফলে কী হচ্ছে? দর্শকেরা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আসেন আর বলেন, 'আমাদের এইসব পায়রাগুলো দেখান। টাম্বলার কোথায়? পাউটার কোথায়?' আর আমি লজ্জা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হই, আমি আপনাদের ওগুলোর কোনোটাই দেখাতে পারব না।"... "আপনাদের ওইসব প্রজাতির নমুনা দেখানোর ক্ষেত্রে, বা এমন কোনোরকম সাহায্যের ক্ষেত্রে যা সমস্ত রহস্যের গূঢ়তম রহস্য তথা প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারবে — এরকম স্থান বা পরিকাঠামো আমাদের নেই; কিন্তু অবশ্যই এরকম জায়গার প্রয়োজন আছে, আর ব্রিটিশ মিউজিয়াম ছাড়া আর কোথায়ই বা তেমন উপযুক্ত স্থান পাওয়া যাবে?"
অবশ্য হাক্সলির আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফলও ফলতে শুরু করেছিল। ১৮৬০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে এডিনবরা রিভিউ পত্রিকায় অরিজিন বইটির উপর ওয়েনের লেখা কিন্তু লেখক-পরিচয়বিহীন একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়। এখানে ওয়েন ক্রুদ্ধভাবে বইটির বিরুদ্ধে সৃষ্টিতত্ত্বের অবমাননার অভিযোগ আনেন; সেইসঙ্গে ডারউইন যে ওয়েনের "সজীব উপাদানের পূর্বনির্ধারিত ক্রমপরিণতির নিরন্তর প্রক্রিয়াকে" পুরোপুরি অবজ্ঞা করেছেন সেই কারণেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এছাড়া ডারউইনের "শিষ্য" হুকার ও হাক্সলিকেও একহাত নিয়ে বলেন তাদের কার্যকলাপ তাদের "অদূরদর্শী আনুগত্যের" পরিচায়ক, এবং আলোচনাধীন বইটি "বিজ্ঞানের সেই রকম অপব্যবহারের দ্যোতক ... যার কবলে পড়ে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে সাময়িকভাবে তাদের মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়েছিল"। এখানে ওয়েন ফরাসি বিপ্লবের প্রসঙ্গ এনেছেন। ডারউইনের কাছে এই রিভিউ "হিংসুক, চূড়ান্ত অসূয়াপ্রসূত, ধূর্ত, এবং ... ক্ষতিকারক" রূপে প্রতিভাত হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি বলেন, "লন্ডনবাসীরা বলে যে আমার বই নিয়ে লোকে আলোচনা করে বলে ও (ওয়েন) নাকি হিংসায় পাগল হয়ে গেছে। ওয়েন আমায় যেরকম প্রবলভাবে ঘৃণা করে তেমনভাবে কারো দ্বারা ঘৃণিত হওয়া পীড়াদায়ক"।
ডারউইনের তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ার সময় হাক্সলি ও ওয়েনের বাগ্যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ওয়েন হাক্সলির বদনাম করার চেষ্টা করেন তাকে "পরিবর্তিত নরবানর থেকে মানুষের উদ্ভবের তত্ত্বের সমর্থক" হিসেবে চিহ্নিত করে। এথিনিয়াম-এ হাক্সলির একটি রচনার শিরোনাম ছিল 'এপ অরিজিন অফ ম্যান অ্যাজ টেস্টেড বাই দ্য ব্রেইন' (মস্তিষ্কের দ্বারা পরীক্ষিত মানুষের বাঁদর-উৎস)। ১৮৬২ খ্রিঃ (আর অন্যান্য সময়ে) হাক্সলি নরবানরের মস্তিষ্কের ব্যবচ্ছেদ এবং প্রদর্শনের একাধিক ব্যবস্থা করেন (যেমন বিএ মিটিং-এ অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালা যেখানে উইলিয়াম হেনরি ফ্লাওয়ার ব্যবচ্ছেদের কাজটি করেছিলেন)। তথাকথিত 'অনুপস্থিত অঙ্গ' সমূহের উপস্থিতির চাক্ষুষ প্রমাণ (হিপোক্যাম্পাস মাইনর ইত্যাদি) কার্যত ওয়েনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনার কাজে ব্যবহৃত হয়। ওয়েন বলেছিলেন যে নরবানরদের মস্তিষ্কে উক্ত গঠনগুলোর অনুপস্থিতিই মানুষের সাথে তাদের পার্থক্যের প্রধান কারণ। হাক্সলির ব্যবচ্ছেদের পরেও তিনি শুধু স্বীকার করেন যে গঠনগুলো যদিও অপরিণত বা অনুন্নত রূপে নরবানরদের মস্তিষ্কে থাকতে পারে, তাও মানুষ ও নরবানরের পার্থক্যের প্রধান নির্ণায়ক মস্তিষ্কেরই আয়তন। হাক্সলি দুই বছর ধরে প্রচারকার্য চালান এবং ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। প্রতিটা কর্মশালার পর আরও বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ডারউইনের তত্ত্বের সমর্থনে এগিয়ে আসতে থাকেন এবং সাধারণভাবে বিজ্ঞান জগৎ ঐ তত্ত্বের সমর্থক হয়ে ওঠে। ওয়েন বলেছিলেন মানুষ বড় মস্তিষ্কের কারণে নরবানরদের থেকে আলাদা, কিন্তু হাক্সলি বলেন মানুষের নিজেদের জাতিগত বৈচিত্র্যের তুলনায় ঐ পার্থক্য নগন্য। ওয়েনের সমালোচনামূলক একটি গবেষণাপত্রে হাক্সলি সরাসরি লেখেন, "আমরা যদি ক অর্থাৎ ইউরোপীয় মগজ, খ অর্থাৎ বসজেসম্যান মগজ এবং গ অর্থাৎ ওরাং-ওটান মগজ পাশাপাশি সাজিয়ে রাখি, তাহলে ক আর খ এর মধ্যে যতটা পার্থক্য আজ অবধি বোঝা গেছে, খ আর গ এর মধ্যেও ঠিক সেরকম"। ওয়েন এর উত্তর হিসেবে বলেন যে প্রকৃতপক্ষে মানুষের বিভিন্ন জাতির মস্তিষ্ক একই রকম আয়তন ও ক্ষমতাবান, আর মানুষের মস্তিষ্ক যে গোরিলা প্রভৃতি অন্যান্য নরবানরের মস্তিষ্কের দ্বিগুণ বড় - গোরিলার দেহ মানুষের চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও - এই ব্যাপারটাই মানুষকে আলাদা করতে সক্ষম। ১৮৬১ খ্রিঃ হাক্সলি জুলজিকাল সোসাইটি কাউন্সিলে যোগদান করলে ওয়েন সংস্থাটি থেকে বেরিয়ে যান, আর পরের বছর হাক্সলি ওয়েনের বিরুদ্ধে "ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচারের" অভিযোগ এনে তার রয়াল সোসাইটিতে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা শেষ করেন।
১৮৬৩ খ্রিঃ ওয়েন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আর্কিওপ্টেরিক্স জীবাশ্মটি কেনেন। এই জীবাশ্মটি ডারউইনের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে প্রমাণ করে যে ডানায় অব্যবহারযোগ্য আঙুলবিশিষ্ট আদিম পাখির খোঁজ একদিন পাওয়া যাবে। যদিও ওয়েন নিজে এটিকে স্রেফ পাখি বলেই ঘোষণা করেছিলেন।
ওয়েন ও ডারউইনের সমর্থকদের বিবাদ চলতেই থাকে। ১৮৭১ খ্রিঃ ওয়েন কিউ-তে অবস্থিত জোসেফ ডালটন হুকার-এর উদ্ভিদবিদ্যা-সংগ্রহশালাটির সরকারি সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিতে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ওয়েন সম্ভবত প্রতিষ্ঠানটিকে তার ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আওতায় আনার চেষ্টা করছিলেন। ডারউইন এর পর মন্তব্য করেন, "আমি ওয়েনকে ঘৃণা করি বলে লজ্জা পেতাম, কিন্তু এবার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ঘৃণা আমি যত্ন করে পালন করব"।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ