নীলঃ পতঙ্গো হরিতাে লােহিতাক্ষস্তড়িৎগর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ।
অনাদিমত্ত্বং বিভুত্বেন বর্তসে যতাে জাতানি ভুবনানি বিশ্বা।।৪।।
শব্দার্থঃ ( অনাদিমৎ ) হে অনাদি কারণরূপ প্রকৃতি ! ( ত্বম্ ) তুমি ( বিভুত্বেন ) বিশাল ব্যাপকরূপে ( বর্তসে ) বিদ্যমান ( যতঃ ) যা থেকে ( নীলঃ ) নীলবর্ণ ( হরিতঃ ) সবুজবর্ণ ( লােহিতাক্ষঃ ) রক্তবর্ণের পদার্থ ( পতঙ্গঃ ) সূর্য ( তড়িৎগর্ভঃ ) মেঘ ( ঋতবঃ ) ঋতুসমূহ ( সমুদ্ৰাঃ ) সমুদ্র [ এবং ] ( বিশ্বা ) বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল ( ভুবনানি ) লােক - লােকান্তর [ গ্রহ - নক্ষত্র ] ( জাতানি ) উৎপন্ন হয়েছে ||
সরলার্থঃ [ এখন ঈশ্বরভক্ত ঋষি , প্রকৃতির প্রসঙ্গে বলছেন ] হে অনাদি কারণরূপ প্রকৃতি ! তুমি বিশাল ব্যাপকরূপে বিদ্যমান , যা থেকে - নীলবর্ণ , সবুজবর্ণ ও রক্তবর্ণের সকল পদার্থ , সূর্য , মেঘ , ঋতুসমূহ , সমুদ্র এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল লােক - লােকান্তর [ গ্রহ - নক্ষত্র ] উৎপন্ন হয়েছে ।।
ভাবার্থঃ প্রকৃতি অনাদি সত্তা অর্থাৎ এর কোন উৎপত্তি বা বিনাশ নেই । বর্তমান যে বিশ্বজগৎ আমরা দেখতে পাই তা তাে প্রকৃতিরই বিকার অর্থাৎ জগতের একমাত্র মূল উপাদানকারণ হচ্ছে প্রকৃতি । আর পরমাত্মা হচ্ছেন এই জগতের নিমিত্তকারণ । যেরূপ কুমাের মৃত্তিকা দ্বারা ঘট , হাড়ি , বাসন ইত্যাদি নির্মাণ করেন , তদ্রুপ পরমাত্মা প্রকৃতিরূপ উপাদান দ্বারা বিশ্বজগৎ নির্মাণ করেছেন । অর্থাৎ জগতের এই যে নানাবিধ বর্ণ , সূর্য , মেঘ , ঋতু , সমুদ্র তথা সমস্ত গ্রহ - নক্ষত্র , তা সেই অনাদি প্রকৃতি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে ।।
পৌরাণীকগন এই শ্লোকে ঈশ্বরের শরীরের দেখানোর চেষ্টা করে, বলে যে ঈশ্বরের শরীর নীল। বিশ্লেষন করে দেখা যাক প্রকৃত অর্থ কিঃ
স্থল ভূত ব্যক্ত হয়
এই শ্লোকে " পতঙ্গঃ " পদটির অর্থ " সূর্য " করা হয়েছে । পতঙ্গ শব্দটি যে সবক্ষেত্রেই " ভ্রমর অথবা পাখি " অর্থে বােঝায় , এমনটা নয় । ঋগ্বেদ ১০/১৮৯/৩ মন্ত্রে “ পতঙ্গ " শব্দের অর্থ " সূর্য " করা হয় । যথাঃ- “ ত্রিংশদ্ধাম বি রাজতি বাকপতঙ্গায় ধীয়তে । প্রতি বস্তোরহ দ্যুভিঃ ।। " অর্থাৎ দিন এবং রাত্রির অবয়বভূত ত্রিশ মুহূর্ত সূর্যের দীপ্তি দ্বারা প্রকাশিত হয় । সূর্যের জন্য প্রশংসনীয় উক্তি স্তোতাদের দ্বারা ধারণকৃত হয় । ঋগ্বেদের এই মন্ত্রের ভাষ্যে পৌরাণিক ভাষ্যকার সায়ণ " পতঙ্গ " শব্দটির অর্থ সূর্য " করেছেন । সায়ণ তার ভাষ্যে লিখেছেন , “ পতঙ্গায় । পততি গচ্ছতীতি পতঙ্গঃ সূর্যঃ । তস্মিংশ্চ সময়ে বাক্ ত্রয়ীরূপা তস্মৈ সূর্যরূপায় পতঙ্গায় প্রতি ধীয়তে প্রতিমুখং ধার্যতে । সূর্যং সেবত ইত্যর্থঃ । " এছাড়াও , যজুর্বেদ ২৯/১৭ মন্ত্রের ভাষ্যে উব্বট ও মহীধর সহ সকল ভাষ্যকারই " পতঙ্গ " শব্দটির অর্থ " সূর্য " করেছেন । এখন বর্তমান শ্লোকটিতে মেঘ , সমুদ্র , ঋতু অর্থাৎ প্রকৃতি প্রসঙ্গে বর্ণনা হওয়ায় এখানে " পতঙ্গঃ " পদটির " সূর্য " অর্থ - ই অধিক গ্রহণযােগ্য।।৪ ।।
টীকাঃ সাংখ্যদর্শনে জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে- সত্ত্বরজস্তমসাংসাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ
প্রকৃতের্মহামহতােহহঙ্কারঃ
অহঙ্কারাৎপঞ্চতন্মাত্রাভয়মিন্দ্রিয়ং— তন্মাত্রেভ্যঃস্থূলভূতানিপুরুষঃ ইতি পঞ্চবিংশতির্গণঃ।।৬১।।
পদঃ — সত্বরজস্তমসাং । সাম্যাবস্থা । প্রকৃতিঃ । প্রকৃতেঃ । মহান্ । মহতঃ । অহঙ্কারঃ । অহঙ্কারাৎ । পঞ্চতন্মাত্রাণি । উভয়ম্ । ইন্দ্রিয়ং । তন্মাত্রেভ্যঃ । স্থৃলভূতানি । পুরুষঃ । ইতি । পঞ্চবিংশতিঃ । গণঃ ।
সরলার্থঃ সত্বঃ , রজঃ ও তমঃ স্বরূপ তিন প্রকারের অনাদি নিত্য কারণ সমান সংখ্যক ও সমান শক্তি বিশিষ্ট থাকায় পরস্পর মুক্ত হইতে না পারিয়া পৃথক্ পৃথক্ থাকা অবস্থায় নাম প্রকৃতি যাহা এই সমস্ত সৃষ্ট পদার্থের মূল কারণ । উহা জড় ও ত্রিগুণাত্মক বলিয়া সংযােগ বিয়ােগের উপযােগী । যদি কোন জ্ঞাতা নিজ শক্তি দ্বারা সৃষ্টি ও প্রলয় না করিতেন , তবে এই সমস্ত প্রকৃতি মূল কারণ নিজ নিজ কারণ বা স্বরূপ অবস্থায় চিরকাল পড়িয়া থাকিত । এই সমস্ত প্রকৃতি বা পরমাণু হইতে প্রথম যে তত্ত্ব উৎপন্ন হয় অর্থাৎ প্রকৃতির যাহা প্রথম কাৰ্য্য তাহার নাম মহত্তত্ত্ব , মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার হইতে পঞ্চ তন্মাত্র অর্থাৎ শব্দ , স্পর্শ , রূপ , রস ও গন্ধ এবং উভয় ইন্দ্রিয় — পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা - চক্ষু , কর্ণ , নাসিকা , জিহ্বা ও ত্বক এবং পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা — পাণি , পাদ , বাক্ পায়ূ ও উপস্থ । পঞ্চ তন্মাত্র হইতে পঞ্চ স্থূল ভূত অর্থাৎ আকাশ , বায়ু , অগ্নি , জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে এবং এতদ্ব্যতীত অন্য একটী তত্ত্ব পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা । এই পঞ্চবিংশতি তত্ব বিদ্যমান আছে । এই প্রকৃতি হইতে সমস্ত স্থূল পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে এবং প্রলয় প্রাপ্ত হইলে এই সমস্ত স্থূল পদার্থ মূলতত্ত্ব প্রকৃতিতে পরিণত হইবে । আবার সৃষ্টির সময় ইহা হইতে উৎপন্ন হইবে । যতদিন না লয় হয় স্থূল পদার্থ সমূহ নষ্ট হইয়া নিজ নিজ কারণে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় তাহাদের হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে । এই তত্ত্ব সমূহের মধ্যে পুরুষ অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্ম কোন পদার্থের উপাদান বা কাৰ্য্য নহে । জড় প্রকৃতি স্বয়ং কার্যকরী হইয়া সৃষ্টি রচনা করিতে পারে না । সৃষ্টি রচনার প্রয়ােজনসিদ্ধি পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা ভিন্ন হইতে পারে না বলিয়া সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে পুরুষকে গণনা করিয়াছেন এবং উভয়েই চৈতন্য স্বরূপ বলিয়া এক পুরুষের গণনা করিয়াছেন বা এক পুরুষ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন । যেমন উভয় ইন্দ্রিয় বলিলে দুই ইন্দ্রিয় না বুঝাইয়া দশ ইন্দ্রিয় বুঝায় সেইরূপ পুরুষ বলিলে জীব ও ব্রহ্ম দুই পদার্থ বুঝিতে হইবে ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ