মনসা দেবী মূলত লৌকিক দেবতা। লোকমুখে যার দেবত্ব শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে যার পূজা করা হয়।
কিন্তু এই দেবীর উল্লেখ সনাতন ধর্মের কোন নির্ভরযোগ্য ধর্মগ্রন্থতে পাওয়া যায় না। এই দেবীর উল্লেখ না আছে বেদ-উপনিষদে, না আছে রামায়ন-মহাভারতে, এমনকি মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতেও নেই।
মনসার উৎপত্তি ও স্বরূপ 👈পড়ুন
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, কশ্যপ মুনি ব্রহ্মার উপদেশে সর্পমন্ত্র সমূহের সৃষ্টি করে তপোবলে মন দ্বারা তাঁকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে সৃষ্টি করেন— তাই তিনি মনসা।
বিসর্জন ও রাজর্ষি নামক দুটি উপন্যাসের মাধ্যমে একশো বছর আগে বলির বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিলেন মানবতার দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকে। তারপরও সচেতন হচ্ছে না। ঢাক ঢোল কাসর বাজিয়ে আসুরিক উন্মাধনায় যেভাবে খড়গের এক কোপে মাথাটাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সেটা নৃসংশতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্মের নামে এইসব বিভৎস প্রথা বদ্ধ করতে হবে। কোনো ধর্ম শাস্ত্রে এই আদর্শ নেই।
মা মনসা দেবীকে মেনে নেব, কিন্তু বলি এলো কোথায় থেকে?
দয়া করে জানতে চাই।
হ্যাঁ, সর্বপ্রথম পুরাণে মনসার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। আর পুরাণ গুলো হলো মানব রচিত। তাই একেক পুরাণে একেক কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। কোন পুরাণে আছে পৌরাণিক দেবতা শিব হলো মনসার পিতা আবার কোন জায়গায় আছে শিব নয়, ঋষি কশ্যপই হলো মনসার পিতা। মনসার সৎ-মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন। এই কারণে মনসা অত্যন্ত উগ্র স্বভাব ও অসুখী এক দেবী। আরো বিভিন্ন অসভ্য ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সভ্য সমাজে কোনোভাবে বলা উচিত হবে না। দয়া করে নিজ দায়িত্বে পড়ার দরকার আছে। সব কথা বলে বলে বুঝানো যায় না।
মনসা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি তথ্য যে গ্রন্থ থেকে জানা যায়,তা হলো "মঙ্গলকাব্য".কি
ন্তু এটি কোন ধর্মগ্রন্থ নয়, বা কোনো শাস্ত্র নয়।
মঙ্গলকাব্য খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে লোকদেবদেবী নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক ভক্তিমূলক লৌকিক কাব্য গাথা। এখানে লেখক তার কল্পনা রচিত কথা লিখেছেন বর্তমান সমাজের জন্য সভ্যতার সংকট হিসেবে। আমরা কিছু হিন্দুরা বর্তমানে সেটাকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ধরে বসে আছি। কারণ মনসার সবচেয়ে বেশি উল্লেখ পাওয়া যায় এ গ্রন্থেই।
এছাড়া মনসা বিজয় কাব্য নামেও আরেকটি মনুষ্য রচিত গ্রন্থ আছে। এই গ্রন্থে পার্বতী মনসার এক চোখ দগ্ধ করার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে।
তাছাড়া বেহুলা লক্ষীন্দর এর প্রেম কাহিনী তো সবাই জানি।
ওখানেও মনসার কথা উল্লেখ আছে। আসল কথা হলো বেহুলা-লক্ষীন্দর বলুন আর মনসা সম্বন্ধে অন্য কোনো উপাখ্যান বলুন -
সবইতো মানুষ রচিত কাহিনী। তর্কের খাতিলে বলি ছাড়া অন্য সব না হয় আপাতত মেনে নিলাম। যদিও এসব হিন্দু ধর্মের মুল শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে কথা বলা। আপোষ করা ঠিক নয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা কল্পনা প্রসূত গল্প গুলোকেই ধর্ম বানিয়ে ছাড়ছি। তারপরও অসুবিধে ছিলো না, যদি বলি প্রথাটা চালু না হতো। বলি নেই এরকমও অনেক কাহিনী ধর্মে মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অসুবিধা নেই, আস্তে আস্তে পরিশুদ্ধ হচ্ছে। এটাও হবে। শাস্ত্রে লক্ষ্য বলির কথা আছে। কিন্তু এই বলিতো সে বলি নয়। মনের পশুকে বলি দিতে বলেছে। বনের পশুকে নয়। পারলে বাঘ বলি দিন। হাতি বলি দিন। অসুর ধরে বলি দিন। দেখি টাকার জোর ও ক্ষমতার জোর। নিরীহ পশুকে কেন? সর্বক্ষেত্রে নিরীহর উপর জুলুম। অথচ ধর্ম নিরীহদের রক্ষার কথা বার বার বলছে। দুষ্টুের দমন শিষ্টের পালন। আগে ধর্ম কি বুঝতে হবে । শুধু শুধু তর্ক করলে হবে না। মূল শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে কথা বললে হবে না। অল্প বিদ্যা ভয়ংকর, মনসা পূজোর পুরোহিতরা হলো সবচেয়ে বড় ভন্ড। বড় প্রতারক। তারা ধর্ম সম্বন্ধে জেনেও এক কোপে পাঠার মাথা কাটতে উদ্যত হয়। তাদের ধর্মটা মনে হয় ফতুয়া দিয়ে চলা। তাদের সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু যেটা না বললে নয় সেটাই বলতে চাই।
সে সকল ভক্তরা জানে না সনাতন ধর্মে পশু বা প্রাণী হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তারা বেদের নির্দেশ কে লঙ্ঘণ করার সাহস দেখায় এসকল গল্প কথার উপর ভিত্তি করে পাঠাবলি দিয়ে। মানব হিসেবে একবার চিন্তা করুণ। প্রাণী হত্যা করে সেটা দেবীর পুজা হয় কি করে?
দেবীর কি খাবারের অভাব পড়েছে,
যে পাঠার মাংসই তার খেতে হবে!
আমিতো জানি দেবদেবীরা সব নিরামিষ ভুজি।
পাপকে কেন আমি পূর্ণ বলে মনে করবো?
মাংসতো এমনিতে খায়। পবিত্র ধর্মের নামে খেতে হবে কেন?
মহাভারত তথা বেদে স্পষ্ট প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য রয়েছে -
সুরা মৎসা মধু মাংসমাসবং কৃসরোদনম্।
ধুর্তেঃ প্রবর্তিতং হোতন্নৈবদ্ বেদেষু কল্পিতম।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ ২৬৫,শ্লোক ৯)
---সুরা, মৎস, মধু, মাংস, তাল রস, স্বাগু এইসব বস্তুকে ধুর্তরাই যজ্ঞে প্রচলিত করেছে। বেদে এসব উপযোগের বিধান নেই।
অব্যবস্থিতমর্যদৈবিমূঢর্নাস্তিকৈর্তবৈ।
সংশয়াত্মাভিরব্যক্তৈহিংসা সমনুবর্তিত।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ অঃ ২৬৫, শ্লোক ৪)
--- যে ধর্মের মর্যাদা থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে মূর্খ- নাস্তিক তথা যার আত্মা সংশয় যুক্ত এবং যার কোন প্রসিদ্ধি নেই এইরূপ লোকই এটাকে সমর্থন করে।
মানান্মোহাচ্চ লোভাচ্চ লৌল্যমেত্যপ্রকল
্পিতম্।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৬৫, শ্লোক ১০)
--- সেই ধূর্তরা মোহ এবং লোভের বশীভূত হয়ে সেই সব বস্তুর প্রতি আকর্ষণটা প্রকট করে থাকে।
যজ্ঞের মহিমা বর্ণনার জন্য পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠির কে এক উপ্যাখান শোনান। উপাখ্যানটি মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৭২ নং অধ্যায়ে এসেছে। সেই উপখ্যানে এক ব্রাহ্মণ যিনি কি না যজ্ঞে পশু বলি দেবার কথা চিন্তা মাত্রেই তার সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
তস্য তেনামুভাবনো মৃগহিংমমসাত্মনস্তদা।
তপো মহৎসমুচ্ছিন্নং তস্মাদ্হিংসান যজ্ঞিয়া।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ২৭২, শ্লোক ১৮)
----আমি সেই পশু কে বধ করে স্বর্গলোক প্রাপ্ত করবো। এই ভেবে মৃগকে হিংসা করার জন্য উদ্যত সেই ব্রাহ্মণের মহান তপস্যা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই জন্য হিংসা যজ্ঞের জন্য হিতকর নয়।
এই জন্য বেদ আমাদের সর্বদা হিংসাহিত কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আমাদের শরীর এবং দন্তের উপযোগী খাবার হিসেবে ডাল, ভাত সবজি ও ফল জাতীয় ইত্যাদি খাবারের অনুমোদন দিয়েছে।
ব্রীহিমন্নং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম ।
এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নেধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্ট পিতরং মাতরং চ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)
--- হে দন্ত! অন্ন খাও, যব খাও , মাষ কালাই এবং তিল খাও। তোমাকে এই উত্তম পদার্থ ধারনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে। মাংসাহার থেকে দূরে থাকো।
এবং বেদ মন্ত্রে সেই পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, আমাদের দন্ত যেন ব্যাঘের ন্যায় না হয়। কারন বাঘের দন্ত সর্বদা মাংসাহার করে থাকে। সে জন্য আমাদের দন্ত কে ব্যাঘের ন্যায় না করে কল্যাণকারী করো।
যৌ ব্যাঘ্রাববরূঢৌ জিঘত্সতঃ পিতরং মাতরং চ।
তৌ দন্ত ব্রহ্মণস্পতে শিবৌ কৃণু জাতবেদঃ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।১)
--- যে দন্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় পিতা মাতাকেও খাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, সেই দাঁতকে হে সর্বব্যাপক জ্ঞানের পরিপালক কল্যাণকারী করো।
অর্থাৎ বেদ আমাদের সর্বদাই কল্যাণকারী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে করে আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যেন নিরীহ প্রাণীদের হিংসা না করি। হত্যা না করি। কারন, অহিংসাই পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহা পাপ। নিরীহ জীব হত্যা আরো মহাপাপ (মহাঃ আদিঃ অঃ ১১, শ্লোঃ ১৩) এবং "হিংসা অধর্মস্তথহিত" (মহাঃ শান্তিঃ ২৭২, শ্লোক ১৮) হিংসা অধর্ম এবং অহিতকর। "প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজায়ান্" (মহাঃ কর্ণ পর্ব, অঃ ২৬৯, শ্লোক ২৩) অর্থাৎ প্রাণীদের বধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
জীবিতুং যঃ স্বযং চেচ্ছেত্ কথং সোন্যং প্রঘাতয়েত।
যদ যদাৎমসি চেচ্ছেত তত পরস্যাপি চিন্তয়েত।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৫৯, শ্লোক ২২)
উপরিউক্ত মন্ত্রগুলি দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, বেদের কোনো নির্দোষ পশুকে হত্যার উপদেশ করেনি। বরং উপদেশ করেছে, পশুস্ত্রাঁয়েথাঙ (যজুর্বেদ ৬।১১) অর্থাৎ পশুদের রক্ষা করো এবং তাদের বর্ধিত করো। কারন বেদ সর্বদাই কল্যাণময়।
এবার আপনারাই বিবেচনা করুন যে কোনো অবস্থাতেই বলি বা পশু হত্যা করা উচিত কি না।
আপনাদের কাছে কি ঈশ্বরকে অবিবেচক মনে হয়?
তিনি এক জায়গায় বলবে প্রাণী হত্যা নিষেধ, আরেক জায়গায় দেবীর জন্য বলি দেয়া জায়েজ করে দেবেন?
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম
সংযোজন
হল মঙ্গলকাব্য । চৈতন্য পূর্ব যুগেই এই মঙ্গল
কাব্য গুলি রচিত । মঙ্গলকাব্যে দেখা যায়
অবৈদিক দেব দেবী গণ নিজেদের মাহাত্ম্য
প্রচারে নিজেরাই মর্তে এসেছেন ।
ভক্তদের
পূজা নিচ্ছেন , ও তাঁদের সুখ ঐশ্বর্য দিচ্ছেন ।
এছাড়া দারিদ্রতার মাধ্যমে সেই সময়কার
বঙ্গদেশের আর্থিক অবস্থা, সংসারের অনটন ,
রাজকীয় প্রশাসন , বৈদিক – অবৈদিক দেব
দেবী গনের একটা সূত্র কাব্যে বর্তমান ।
‘মঙ্গল’ কথাটির ব্যাখা বা প্রয়োগ
নিয়ে গবেষক গণ বিভিন্ন মত পোষোন
করেন ।
মঙ্গল শব্দ টির আক্ষরিক অর্থ হল ‘কল্যাণ’ ।
কাব্যে যে দেবী মাহাত্ম্য চিত্রিত আছে-
তা পাঠ করলে অথবা শুনলে সংসারে মঙ্গল
হবে । নানা প্রকার অমঙ্গল দূর হবে, মানুষ
পাপমুক্ত হবে। এই মঙ্গল জনক ফল
পাওয়া যাবে । তাই ‘মঙ্গল”
শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । আবার মঙ্গল
কাব্য গুলি এক মঙ্গল বারে পাঠ শুরু হতো- আবার
পরের মঙ্গলবারে পাঠ সমাপ্ত হতো- তাই
‘মঙ্গল’ শব্দ টির অবতারনা । আবার মঙ্গল নামক এক
বিশেষ রাগিনীর সুরে পাঠ
করা হতো বলে- ‘মঙ্গল’ শব্দ টির আগমন ।
আবার
উল্লেখ্য বিষয় মঙ্গল কাব্যের দেব দেবী
গণ
কেবল নিম্ন বর্ণের হিন্দু জাতির মধ্যেই
পূজা বেশী পেতেন । কিছু স্থানে হিন্দুদের
এই
দেব দেবীগণের পুজায় মুসলিম সম্প্রদায়ের
যোগদানের উল্লেখ দেখা যায় ।
তবে তা নিতান্তই অল্প। মনসা দেবী বা সর্প
দেবী হিসাবে পুজা বোধ
হয় বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে । বৌদ্ধ গ্রন্থেই
সর্প দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । ‘বিনয়বস্তু’
ও ‘সাধনমালা’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে সর্পের
দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । এখানে সর্পের
দেবীর বর্ণনা আছে । ‘সাধনমালা’ গ্রন্থে সর্প
দেবীকে ‘জাঙ্গুলি’ বা ‘জাঙ্গুলিতারা’
বলে উল্লেখ করা আছে। প্রাচীন যুগে
সাপের
ওঝাকে বলা হতো জাঙ্গুলিক
( বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ অসিতকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায়) । দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতির
অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ‘মঞ্চাম্মা’
বা ‘মনোমাঞ্চী’। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন
শাস্ত্রীর মতে মঞ্চামা নাম থেকেই ‘মনসা’
নামের উৎপত্তি । আবার ডাঃ আশুতোষ
ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সর্প দেবী জাঙ্গুলিকেই
‘মনসা’ বলে মানেন । তেঁনার মতে- “অত্যন্ত
প্রাচীনকাল হইতেই এই পূর্ব ভারতীয় বৌদ্ধ
সমাজে জাঙ্গুলীদেবীর পূজা প্রচলিত
হইয়া আসিতেছে । বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার
সূত্র গ্রন্থ সাধনমালাতে এই জাঙ্গুলী দেবীর
পূজার প্রকরণ ও তাহার মন্ত্রের
সম্বন্ধে বিস্তৃত উল্লেখ আছে। তাহা হইতে
সহজেই অনুমতি হইতে পারে যে, এই
জাঙ্গুলীদেবী বর্তমানে সমাজে পূজিতা সর্প
দেবী । ” গবেষক দের মতে মনসা অনার্য
দেবতা, পরে আর্য দের পুরানে স্থান
পেয়েছেন
। গবেষকরা বলেন বঙ্গদেশ ছিল জঙ্গলে ভরা
।
সাপের উপদ্রব ছিল বেশী । বাংলা ছিল
কৃষি প্রধান । এই বিষাক্ত সাপেদের সাথেই
তাঁদের বসবাস ও দ্বন্দ্ব । একটি বিষাক্ত
প্রানী, যার ছোবোলেই মৃত্যু। তাই
মনসা পূজা বঙ্গদেশে বিশেষ প্রসার পায় । ত্রিপুরা,
ওড়িশা, আসাম , দুই বঙ্গ, বিহারে এই
পূজোর প্রচলন বেশী । হিমালয়ের
পাদদেশে জঙ্গলে ছিল সাপেদের অবাধ বিচরণ
ভূমি । মানুষের বসতি বাড়লো, সাপেদের
সাথে সংঘাত বাড়লো । প্রথমে নিম্ন জাতির
মধ্যে এই পূজোর প্রসার থাকলে কালক্রমে
ব্রাহ্মণ্য দেবী হয়ে ওঠেন
মা মনসা । চাঁদ বেনে ও মা মনসা
সবাই বুঝতে চেষ্টা করুন, সনাতন ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে। সবাইকে সচেতন করতে পারলেই এসব ঘৃণ্য বলি প্রথা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের মুক্ত করা যাবে।
কিন্তু এই দেবীর উল্লেখ সনাতন ধর্মের কোন নির্ভরযোগ্য ধর্মগ্রন্থতে পাওয়া যায় না। এই দেবীর উল্লেখ না আছে বেদ-উপনিষদে, না আছে রামায়ন-মহাভারতে, এমনকি মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতেও নেই।
মনসার উৎপত্তি ও স্বরূপ 👈পড়ুন
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, কশ্যপ মুনি ব্রহ্মার উপদেশে সর্পমন্ত্র সমূহের সৃষ্টি করে তপোবলে মন দ্বারা তাঁকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে সৃষ্টি করেন— তাই তিনি মনসা।
‘বন্দুক দ্বীপের পাঁচালি’ (রবিবাসরীয়, ১৬-৬) প্রবন্ধে গৌতম চক্রবর্তী তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্তের সম্পাদনায় নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মনসার উদ্ভব শুধুমাত্র বাংলাতেই নয়। এর উদ্ভব ও প্রসার প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বেদ-পুরাণ পার হয়ে পূর্বভারতে (অসম, বাংলা, ওড়িশা, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের কিয়দংশে)।
দেবদেবী👈পড়ুন
মনসা হলেন জরুৎকারু মুনির পত্নী, আস্তিক মুনির মাতা এবং বাসুকির ভগ্নী। মনসা মঙ্গলে রয়েছে, চাঁদ সদাগর তাঁর গৃহিণী সনকার স্থাপিত ঘট পদাঘাতে ভেঙে দেন। পরে পুজো করেন। অষ্ট অঙ্গ সম্পন্ন পরিপূর্ণ একটি মানবীরূপে দেবী মনসার রূপলাভ ঘটেছে অনেক পরে।
তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্তের সম্পাদনায় নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণ’ প্রকাশকাল ১৯৪২, আর বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের ‘দি ইন্ডিয়ান বুদ্ধিস্ট আইকনগ্রাফি’ গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ ১৯২৪ সালে। সেখানে শ্রীভট্টাচার্য বৌদ্ধ দেবী জাঙ্গুলি থেকে মনসার উৎপত্তির কথা বলেছেন। বলা হয়ে থাকে জাঙ্গুলি বুদ্ধের মতোই প্রাচীন। এই প্রসঙ্গে সরস্বতী ও ব্রহ্মা বা শিব ও মনসা সংক্রান্ত কাহিনি স্মর্তব্য— যার উৎস ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৬১ সূক্তে ৫-৭ ঋকের রুদ্র ও উষার কাহিনি।
জৈন ধর্মেও মনসা কাহিনি প্রচলিত। সেখানে তিনি পদ্মাবতী, যিনি জৈন ধর্মের তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের সাধনকালে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। অন্য রক্ষা কর্তা ছিলেন ধরণেন্দ্র। পরবর্তীতে এই পদ্মাবতী জৈন ধর্মের মুখ্য দেবীতে পরিণত হন।
ভগিনী নিবেদিতা ও অানন্দ কুমারস্বামী ‘মিথস অব দ্য হিন্দুজ় অ্যান্ড বুদ্ধিস্টস’ গ্রন্থে মনসা কাহিনিকে তুলনা করেছেন Mykenean Stratum on Asiatic Culture-এর সঙ্গে (১৯৮৭, লন্ডন)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ই সি ডিমক-ও ‘মনসা, গডেস অব স্নেকস’-এ এই রকম মত পোষণ করেছেন।
সুতরাং মনসা এবং তার উদ্ভবকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ভাবলে তা হবে খণ্ডিত। পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিভাত করার জন্য দরকার অনুসন্ধানের আরও ব্যাপ্তি।
বিঃদ্রঃ বেদের রূঢ় অর্থের কারনে মূর্তি পূজোর উৎপত্তি
শাসদ্বহ্নির্দুহিতুর্নপত্যম্ দাদ্বিদ্বাম্ ঋতস্য দীভিতিম্ সপর্য়ন্।
পিতা যত্র দুজিতুঃ সেকমৃঞ্জন্তসম্ শগম্যেন মনসা দধন্বে।। [ঋগ্বেদ০ ৩/৩১/১]
পদঃ-শাসত্। বহ্নিঃ। দুহিতুঃ। নপত্যম্। গাত্। বিদ্বান্। ঋতস্য। দীধিতিম্। সপর্যন্। পিতা। যত্র। দুহিতুঃ। সেকম্। ঋঞ্জন্। সম। শগম্যেন। মনসা। দধন্বে।
পদার্থ-হে বিদ্বান্ মনুষ্য! ( যত্র) যে ব্যবহারে ( পিতা) উৎপন্ন কর্তা ( বহ্নিঃ) বহন করে অর্থাৎ ব্যবহারে চালনাকারী ( দুহিতুঃ) কন্যার ( সেকম্) সেচন কে ( ঋঞ্জন্) সিদ্ধ করা ( গাত্) প্রাপ্ত হয়ে সেই আচরণে ( বিদ্বান্) জানার যোগ্য ব্যবহারে জ্ঞানী ( ঋতস্য) সত্যের ( দীধিতিম্) ধারণকর্তাকে ( সপর্য্যন্) মেবা করা ( দুহিতুঃ) দূরের হিতকারিণী কন্যার (নপত্যম্) পৌত্রে উৎপন্ন হয়েছে (শাসত্) শিক্ষা দিবে এই (শগম্যেন) সুখে বর্তমান (মনসা ) অন্তঃকরণে ( সম,দধন্বে) সম্যক প্রসন্ন হয়।। निघं० ३। ६। (मनसा) अन्तःकरणेन
ভাবার্থ-হে মনুষ্য!যেমন পিতার সান্নিধ্যে কন্যা উৎপন্ন হয়, তেমনি সূর্য দ্বারা প্রাতঃকালের প্রকট হয়,এবং যে পতি নিজ স্ত্রীর গর্ভ ধারণ করান উপায় দ্বারা সদৃশ বর্তমান প্রাতঃকালর বেলায় সূর্য কিরণরূপ বীর্য্যকে ধারণ করে,তার থেকে দিবসরূপ পুত্র উৎপন্ন হয়।। -( ভাষ্যম্- মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী)
বিসর্জন ও রাজর্ষি নামক দুটি উপন্যাসের মাধ্যমে একশো বছর আগে বলির বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিলেন মানবতার দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকে। তারপরও সচেতন হচ্ছে না। ঢাক ঢোল কাসর বাজিয়ে আসুরিক উন্মাধনায় যেভাবে খড়গের এক কোপে মাথাটাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সেটা নৃসংশতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্মের নামে এইসব বিভৎস প্রথা বদ্ধ করতে হবে। কোনো ধর্ম শাস্ত্রে এই আদর্শ নেই।
মা মনসা দেবীকে মেনে নেব, কিন্তু বলি এলো কোথায় থেকে?
দয়া করে জানতে চাই।
হ্যাঁ, সর্বপ্রথম পুরাণে মনসার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। আর পুরাণ গুলো হলো মানব রচিত। তাই একেক পুরাণে একেক কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। কোন পুরাণে আছে পৌরাণিক দেবতা শিব হলো মনসার পিতা আবার কোন জায়গায় আছে শিব নয়, ঋষি কশ্যপই হলো মনসার পিতা। মনসার সৎ-মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন। এই কারণে মনসা অত্যন্ত উগ্র স্বভাব ও অসুখী এক দেবী। আরো বিভিন্ন অসভ্য ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সভ্য সমাজে কোনোভাবে বলা উচিত হবে না। দয়া করে নিজ দায়িত্বে পড়ার দরকার আছে। সব কথা বলে বলে বুঝানো যায় না।
মনসা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি তথ্য যে গ্রন্থ থেকে জানা যায়,তা হলো "মঙ্গলকাব্য".কি
ন্তু এটি কোন ধর্মগ্রন্থ নয়, বা কোনো শাস্ত্র নয়।
মঙ্গলকাব্য খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে লোকদেবদেবী নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক ভক্তিমূলক লৌকিক কাব্য গাথা। এখানে লেখক তার কল্পনা রচিত কথা লিখেছেন বর্তমান সমাজের জন্য সভ্যতার সংকট হিসেবে। আমরা কিছু হিন্দুরা বর্তমানে সেটাকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ধরে বসে আছি। কারণ মনসার সবচেয়ে বেশি উল্লেখ পাওয়া যায় এ গ্রন্থেই।
এছাড়া মনসা বিজয় কাব্য নামেও আরেকটি মনুষ্য রচিত গ্রন্থ আছে। এই গ্রন্থে পার্বতী মনসার এক চোখ দগ্ধ করার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে।
তাছাড়া বেহুলা লক্ষীন্দর এর প্রেম কাহিনী তো সবাই জানি।
ওখানেও মনসার কথা উল্লেখ আছে। আসল কথা হলো বেহুলা-লক্ষীন্দর বলুন আর মনসা সম্বন্ধে অন্য কোনো উপাখ্যান বলুন -
সবইতো মানুষ রচিত কাহিনী। তর্কের খাতিলে বলি ছাড়া অন্য সব না হয় আপাতত মেনে নিলাম। যদিও এসব হিন্দু ধর্মের মুল শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে কথা বলা। আপোষ করা ঠিক নয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা কল্পনা প্রসূত গল্প গুলোকেই ধর্ম বানিয়ে ছাড়ছি। তারপরও অসুবিধে ছিলো না, যদি বলি প্রথাটা চালু না হতো। বলি নেই এরকমও অনেক কাহিনী ধর্মে মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অসুবিধা নেই, আস্তে আস্তে পরিশুদ্ধ হচ্ছে। এটাও হবে। শাস্ত্রে লক্ষ্য বলির কথা আছে। কিন্তু এই বলিতো সে বলি নয়। মনের পশুকে বলি দিতে বলেছে। বনের পশুকে নয়। পারলে বাঘ বলি দিন। হাতি বলি দিন। অসুর ধরে বলি দিন। দেখি টাকার জোর ও ক্ষমতার জোর। নিরীহ পশুকে কেন? সর্বক্ষেত্রে নিরীহর উপর জুলুম। অথচ ধর্ম নিরীহদের রক্ষার কথা বার বার বলছে। দুষ্টুের দমন শিষ্টের পালন। আগে ধর্ম কি বুঝতে হবে । শুধু শুধু তর্ক করলে হবে না। মূল শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে কথা বললে হবে না। অল্প বিদ্যা ভয়ংকর, মনসা পূজোর পুরোহিতরা হলো সবচেয়ে বড় ভন্ড। বড় প্রতারক। তারা ধর্ম সম্বন্ধে জেনেও এক কোপে পাঠার মাথা কাটতে উদ্যত হয়। তাদের ধর্মটা মনে হয় ফতুয়া দিয়ে চলা। তাদের সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু যেটা না বললে নয় সেটাই বলতে চাই।
সে সকল ভক্তরা জানে না সনাতন ধর্মে পশু বা প্রাণী হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তারা বেদের নির্দেশ কে লঙ্ঘণ করার সাহস দেখায় এসকল গল্প কথার উপর ভিত্তি করে পাঠাবলি দিয়ে। মানব হিসেবে একবার চিন্তা করুণ। প্রাণী হত্যা করে সেটা দেবীর পুজা হয় কি করে?
দেবীর কি খাবারের অভাব পড়েছে,
যে পাঠার মাংসই তার খেতে হবে!
আমিতো জানি দেবদেবীরা সব নিরামিষ ভুজি।
পাপকে কেন আমি পূর্ণ বলে মনে করবো?
মাংসতো এমনিতে খায়। পবিত্র ধর্মের নামে খেতে হবে কেন?
মহাভারত তথা বেদে স্পষ্ট প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য রয়েছে -
সুরা মৎসা মধু মাংসমাসবং কৃসরোদনম্।
ধুর্তেঃ প্রবর্তিতং হোতন্নৈবদ্ বেদেষু কল্পিতম।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ ২৬৫,শ্লোক ৯)
---সুরা, মৎস, মধু, মাংস, তাল রস, স্বাগু এইসব বস্তুকে ধুর্তরাই যজ্ঞে প্রচলিত করেছে। বেদে এসব উপযোগের বিধান নেই।
অব্যবস্থিতমর্যদৈবিমূঢর্নাস্তিকৈর্তবৈ।
সংশয়াত্মাভিরব্যক্তৈহিংসা সমনুবর্তিত।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ অঃ ২৬৫, শ্লোক ৪)
--- যে ধর্মের মর্যাদা থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে মূর্খ- নাস্তিক তথা যার আত্মা সংশয় যুক্ত এবং যার কোন প্রসিদ্ধি নেই এইরূপ লোকই এটাকে সমর্থন করে।
মানান্মোহাচ্চ লোভাচ্চ লৌল্যমেত্যপ্রকল
্পিতম্।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৬৫, শ্লোক ১০)
--- সেই ধূর্তরা মোহ এবং লোভের বশীভূত হয়ে সেই সব বস্তুর প্রতি আকর্ষণটা প্রকট করে থাকে।
যজ্ঞের মহিমা বর্ণনার জন্য পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠির কে এক উপ্যাখান শোনান। উপাখ্যানটি মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৭২ নং অধ্যায়ে এসেছে। সেই উপখ্যানে এক ব্রাহ্মণ যিনি কি না যজ্ঞে পশু বলি দেবার কথা চিন্তা মাত্রেই তার সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
তস্য তেনামুভাবনো মৃগহিংমমসাত্মনস্তদা।
তপো মহৎসমুচ্ছিন্নং তস্মাদ্হিংসান যজ্ঞিয়া।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ২৭২, শ্লোক ১৮)
----আমি সেই পশু কে বধ করে স্বর্গলোক প্রাপ্ত করবো। এই ভেবে মৃগকে হিংসা করার জন্য উদ্যত সেই ব্রাহ্মণের মহান তপস্যা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই জন্য হিংসা যজ্ঞের জন্য হিতকর নয়।
এই জন্য বেদ আমাদের সর্বদা হিংসাহিত কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আমাদের শরীর এবং দন্তের উপযোগী খাবার হিসেবে ডাল, ভাত সবজি ও ফল জাতীয় ইত্যাদি খাবারের অনুমোদন দিয়েছে।
ব্রীহিমন্নং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম ।
এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নেধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্ট পিতরং মাতরং চ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)
--- হে দন্ত! অন্ন খাও, যব খাও , মাষ কালাই এবং তিল খাও। তোমাকে এই উত্তম পদার্থ ধারনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে। মাংসাহার থেকে দূরে থাকো।
এবং বেদ মন্ত্রে সেই পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, আমাদের দন্ত যেন ব্যাঘের ন্যায় না হয়। কারন বাঘের দন্ত সর্বদা মাংসাহার করে থাকে। সে জন্য আমাদের দন্ত কে ব্যাঘের ন্যায় না করে কল্যাণকারী করো।
যৌ ব্যাঘ্রাববরূঢৌ জিঘত্সতঃ পিতরং মাতরং চ।
তৌ দন্ত ব্রহ্মণস্পতে শিবৌ কৃণু জাতবেদঃ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।১)
--- যে দন্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় পিতা মাতাকেও খাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, সেই দাঁতকে হে সর্বব্যাপক জ্ঞানের পরিপালক কল্যাণকারী করো।
অর্থাৎ বেদ আমাদের সর্বদাই কল্যাণকারী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে করে আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যেন নিরীহ প্রাণীদের হিংসা না করি। হত্যা না করি। কারন, অহিংসাই পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহা পাপ। নিরীহ জীব হত্যা আরো মহাপাপ (মহাঃ আদিঃ অঃ ১১, শ্লোঃ ১৩) এবং "হিংসা অধর্মস্তথহিত" (মহাঃ শান্তিঃ ২৭২, শ্লোক ১৮) হিংসা অধর্ম এবং অহিতকর। "প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজায়ান্" (মহাঃ কর্ণ পর্ব, অঃ ২৬৯, শ্লোক ২৩) অর্থাৎ প্রাণীদের বধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
জীবিতুং যঃ স্বযং চেচ্ছেত্ কথং সোন্যং প্রঘাতয়েত।
যদ যদাৎমসি চেচ্ছেত তত পরস্যাপি চিন্তয়েত।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৫৯, শ্লোক ২২)
উপরিউক্ত মন্ত্রগুলি দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, বেদের কোনো নির্দোষ পশুকে হত্যার উপদেশ করেনি। বরং উপদেশ করেছে, পশুস্ত্রাঁয়েথাঙ (যজুর্বেদ ৬।১১) অর্থাৎ পশুদের রক্ষা করো এবং তাদের বর্ধিত করো। কারন বেদ সর্বদাই কল্যাণময়।
এবার আপনারাই বিবেচনা করুন যে কোনো অবস্থাতেই বলি বা পশু হত্যা করা উচিত কি না।
আপনাদের কাছে কি ঈশ্বরকে অবিবেচক মনে হয়?
তিনি এক জায়গায় বলবে প্রাণী হত্যা নিষেধ, আরেক জায়গায় দেবীর জন্য বলি দেয়া জায়েজ করে দেবেন?
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম
সংযোজন
হল মঙ্গলকাব্য । চৈতন্য পূর্ব যুগেই এই মঙ্গল
কাব্য গুলি রচিত । মঙ্গলকাব্যে দেখা যায়
অবৈদিক দেব দেবী গণ নিজেদের মাহাত্ম্য
প্রচারে নিজেরাই মর্তে এসেছেন ।
ভক্তদের
পূজা নিচ্ছেন , ও তাঁদের সুখ ঐশ্বর্য দিচ্ছেন ।
এছাড়া দারিদ্রতার মাধ্যমে সেই সময়কার
বঙ্গদেশের আর্থিক অবস্থা, সংসারের অনটন ,
রাজকীয় প্রশাসন , বৈদিক – অবৈদিক দেব
দেবী গনের একটা সূত্র কাব্যে বর্তমান ।
‘মঙ্গল’ কথাটির ব্যাখা বা প্রয়োগ
নিয়ে গবেষক গণ বিভিন্ন মত পোষোন
করেন ।
মঙ্গল শব্দ টির আক্ষরিক অর্থ হল ‘কল্যাণ’ ।
কাব্যে যে দেবী মাহাত্ম্য চিত্রিত আছে-
তা পাঠ করলে অথবা শুনলে সংসারে মঙ্গল
হবে । নানা প্রকার অমঙ্গল দূর হবে, মানুষ
পাপমুক্ত হবে। এই মঙ্গল জনক ফল
পাওয়া যাবে । তাই ‘মঙ্গল”
শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । আবার মঙ্গল
কাব্য গুলি এক মঙ্গল বারে পাঠ শুরু হতো- আবার
পরের মঙ্গলবারে পাঠ সমাপ্ত হতো- তাই
‘মঙ্গল’ শব্দ টির অবতারনা । আবার মঙ্গল নামক এক
বিশেষ রাগিনীর সুরে পাঠ
করা হতো বলে- ‘মঙ্গল’ শব্দ টির আগমন ।
আবার
উল্লেখ্য বিষয় মঙ্গল কাব্যের দেব দেবী
গণ
কেবল নিম্ন বর্ণের হিন্দু জাতির মধ্যেই
পূজা বেশী পেতেন । কিছু স্থানে হিন্দুদের
এই
দেব দেবীগণের পুজায় মুসলিম সম্প্রদায়ের
যোগদানের উল্লেখ দেখা যায় ।
তবে তা নিতান্তই অল্প। মনসা দেবী বা সর্প
দেবী হিসাবে পুজা বোধ
হয় বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে । বৌদ্ধ গ্রন্থেই
সর্প দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । ‘বিনয়বস্তু’
ও ‘সাধনমালা’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে সর্পের
দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । এখানে সর্পের
দেবীর বর্ণনা আছে । ‘সাধনমালা’ গ্রন্থে সর্প
দেবীকে ‘জাঙ্গুলি’ বা ‘জাঙ্গুলিতারা’
বলে উল্লেখ করা আছে। প্রাচীন যুগে
সাপের
ওঝাকে বলা হতো জাঙ্গুলিক
( বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ অসিতকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায়) । দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতির
অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ‘মঞ্চাম্মা’
বা ‘মনোমাঞ্চী’। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন
শাস্ত্রীর মতে মঞ্চামা নাম থেকেই ‘মনসা’
নামের উৎপত্তি । আবার ডাঃ আশুতোষ
ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সর্প দেবী জাঙ্গুলিকেই
‘মনসা’ বলে মানেন । তেঁনার মতে- “অত্যন্ত
প্রাচীনকাল হইতেই এই পূর্ব ভারতীয় বৌদ্ধ
সমাজে জাঙ্গুলীদেবীর পূজা প্রচলিত
হইয়া আসিতেছে । বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার
সূত্র গ্রন্থ সাধনমালাতে এই জাঙ্গুলী দেবীর
পূজার প্রকরণ ও তাহার মন্ত্রের
সম্বন্ধে বিস্তৃত উল্লেখ আছে। তাহা হইতে
সহজেই অনুমতি হইতে পারে যে, এই
জাঙ্গুলীদেবী বর্তমানে সমাজে পূজিতা সর্প
দেবী । ” গবেষক দের মতে মনসা অনার্য
দেবতা, পরে আর্য দের পুরানে স্থান
পেয়েছেন
। গবেষকরা বলেন বঙ্গদেশ ছিল জঙ্গলে ভরা
।
সাপের উপদ্রব ছিল বেশী । বাংলা ছিল
কৃষি প্রধান । এই বিষাক্ত সাপেদের সাথেই
তাঁদের বসবাস ও দ্বন্দ্ব । একটি বিষাক্ত
প্রানী, যার ছোবোলেই মৃত্যু। তাই
মনসা পূজা বঙ্গদেশে বিশেষ প্রসার পায় । ত্রিপুরা,
ওড়িশা, আসাম , দুই বঙ্গ, বিহারে এই
পূজোর প্রচলন বেশী । হিমালয়ের
পাদদেশে জঙ্গলে ছিল সাপেদের অবাধ বিচরণ
ভূমি । মানুষের বসতি বাড়লো, সাপেদের
সাথে সংঘাত বাড়লো । প্রথমে নিম্ন জাতির
মধ্যে এই পূজোর প্রসার থাকলে কালক্রমে
ব্রাহ্মণ্য দেবী হয়ে ওঠেন
মা মনসা । চাঁদ বেনে ও মা মনসা
সবাই বুঝতে চেষ্টা করুন, সনাতন ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে। সবাইকে সচেতন করতে পারলেই এসব ঘৃণ্য বলি প্রথা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের মুক্ত করা যাবে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ