অহং ব্রহ্মাস্মি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

01 August, 2019

অহং ব্রহ্মাস্মি

অহং ব্রহ্মাস্মি
                               এক সময় জৈনগন বেদের অর্থ না বুঝিয়া ভ্রান্ত হইয়া বেদের নিন্দা করতে শুরু করে। বেদের পঠন পাঠন ও যজ্ঞোপবীতাদি এবং ব্রহ্মচর্য্যাদি নিয়মেরও নাশ করিতে লাগিল এবং নানা স্থানে বেদাদি সম্বন্ধীয় পুস্তু যা প্রাপ্ত হইল তৎসমস্ত নষ্ট করিয়া আর্য্যদিগের উপর অত্যন্ত প্রভুত্ব করিতে এবং দুঃখ দিতে শুরু করেছিল। যখন আর উহাদের অন্য কাহারও নিকট ভয় রহিল না তখন আপনাদিগের মতালম্বী গৃহস্থ এবং সাধুদিগের প্রতিষ্ঠা করতে লাগিল এবং বেদমার্গীদিগকে আপমান করিতে এবং পক্ষপাত পূর্ব্বক দন্ডও দিতে আরম্ভ করিল এবং নিজেরা সুখে স্বচ্ছন্দে এবং দর্পে স্ফীত হইয়া বেড়াইতে লাগিল।ঋষভ দেব হইতে মহাবীর পর্য্যন্ত ইহারা নিজেদের তীর্থঙ্করদিগের বৃহৎ বৃহৎ মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়া পূজা করিতে লাগিয়াছিল। এবংএই জৈনগণ হইতেই ব্যাপক হারে পাষাণাদি মূর্ত্তি পূজার মূল আরম্ভ হয়েছিল। এই রূপ তিনশত বৎসর আর্য্যাবর্ত্তে জৈন দিগের রাজত্ব রহিল এবং বদার্থজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হইয়া তিয়েছিল। অনুমানানুসারে প্রায় সার্দ্ধ দ্বিসহস্র বৎসর অতীত হইল যখন এই সকল ঘটনা ঘটিয়া ছিল।

দ্বাবিংশ শত বর্ষ অতীত হইল দ্রাবিড় দেশোৎপন্ন শঙ্করাচার্য্য নামক এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ব্যাকরণাদি সমস্ত শাস্ত্র পাঠ করতঃ জৈন মতের পরিবর্তে পুনরায় বৈদিক মত প্রচলেনর চিন্তা করেন। মহোদয় শঙ্করাচার্য্য নানা শাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন এবং জৈন মতেরও গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন।

শাস্ত্রার্থ দ্বারা সকল লোক কে পরাস্ত করে বৈদিক মতের পুনঃ প্রতিষ্ঠার বিচার করিয়া তিনি উজ্জয়িনী নগরীতে তৎকালিন স্বধন্বা নামক রাজা যিনি জৈন দিগের গ্রন্থ এবং কিছু সংস্কৃতও পাঠ করিয়াছিলেন।তথায় উপস্থিত হইয়া শঙ্করাচার্য্য বেদের উপদেশ দিতেলাগিলেন এবং রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কহিলেন যে আপনি সংস্কৃত এবং জৈন দিগের গ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন এবং জৈন মত  বিশ্বাস ও করেন। এই জন্য আপনাকে নিবেদন করিতেছি যে আপনি আমাকে জৈন পন্ডিদিগের সহিত শাস্ত্রার্থ ও বিচার করান্।এই প্রতিজ্ঞা থাকিবে যে,যে জন পরাজিত হইবে সে জয়কর্ত্তার মত স্বীকার করয়া লইবে এবং স্বয়ং ঐক্ত জয়কর্ত্তার মতালম্বী হইবে। রাজা সুধম্বা তাই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন,তিনি জৈন পন্ডিদিগকে বহু দূর হইতে আহ্বান করিয়া এক সভা করাইয়াছিলেন। শঙ্করাচার্য্যের পক্ষে বেদমত স্থাপন ও জৈনমত খন্ডন বিষয় ছিল এবং জৈনদিগের পক্ষে তা বিপরীত ছিল। জৈন দিগের প্রাকশিত মত এইরূপ ছিলযে সৃষ্টিকর্ত্তা অনাদি ঈশ্বর কেহ নাই,এই জগৎ এবং জীব অনাদি এবং এই উভয়ের উৎপত্তি এবং নাশ কখন হয় না।

শঙ্করাচার্য্যেরমত ইহার বিরুদ্ধ ছিল। তিনি বলিলেন যে অনাদি নিত্য পর।আত্মাই জগতের কর্ত্তা এই জগৎ এবং জীব মিথ্যা,কারণ উক্ত পরমেশ্বর আপনার মায়া হইতে জগতের নির্ম্মান ধারণ এবং প্রলয় করিয়া থাকেন এবং এই (জগৎ) প্রপঞ্চ ও জীব স্বপ্নবৎ মাত্র। পরমেশ্বর স্বয়ংই সমস্ত জগৎরূপ হইয়া লীলা বিস্তার করিতেছেন । বহুদিন যাবৎ শাস্ত্রার্থ বিচার হইতে লাগিল পরন্তু অবশেষে যুক্তি এবং প্রমাণবলে জৈনদিগের মত খন্ডিত হইল এবং শঙ্করাচার্য্যের মত অখন্ডিত রহিল। তখন উক্ত জৈন পন্ডিতগণ এবং রাজা সুধন্বা বেদমত স্বীকার করিয়া লইলেন এবং জনমত ত্যাগ করিলেন।

পরে দশ বছর সুধন্বা প্রভৃতি রাজাগণ আর্ষ্যাবর্ত্তের পরিভ্রমান করিয়া শঙ্করাচার্যের মত প্রচার করেন।উক্ত সময় থেকে পুনরায় যজ্ঞোপবীত হইতে লাগিল এবং বেদ সকলের পঠন ও পাঠনা চলিতেলাগিল। শঙ্করের সময়েই জৈন প্রধ্বংস হয়; অর্থাৎ(আজকাল) যত (ভগ্ন)জৈনমূর্ত্তি পাওয়া যাইতেছে তংসমস্ত সেই সময় ভগ্ন করা হইয়াছিল।

উক্ত সময়ে এই দেশে প্রভুত ধন ছিল এবং স্বদেশ ভক্তিও অতিশয় প্রগাঢ় ছিল। শঙ্করাচার্য্য এবং সুধম্বা রাজা জৈনদিগের মন্দির ভগ্ন করেন নাই,কারন তাঁহাদের ইচ্ছা ছিল যে উক্ত মন্দিরে বেদাদি অধ্যয়নের জন্য পাঠশালা স্থাপন করিবেন।দুইজন জৈন বারহ্য কপট মুনি ছিল কেবল বেদমতালম্বী কিন্তু অন্তরে কঠোর জৈনমতবিশ্বাসী ছিল। উহারা অবসর পাইয়া শঙ্করাচার্য্যকে এরূপ বিষাক্ত পদার্থ ভোজন করাইল যে তাঁহার ক্ষুধামান্দ্য হইল এবং শরীরে ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ বিস্ফোটক নির্গত হইয়া ছয় মাসের মধ্যেই তাঁহার দেহান্ত হইয়াছিল। ফলে বিদ্যা প্রচারের যে ব্যবস্থা ছিল তাহা বন্ধ হইয়া গেল। শঙ্করাচার্য্য শারীরিক ভাষ্যাদি যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন তাহা তাঁহার শিষ্যেরা প্রচার করিতে লাগিল, অর্থাৎ জৈন মত খন্ডনের জন্য ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও বহ্মের একতা যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন তাহার উপদেশ দিতে লাগিলেন। শঙ্করাচার্য্যের পর তঁহার শিষ্যগনের অতিশয় প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। নিজেরা শঙ্করাচার্য্যের নামে শাস্ত্র গ্রন্থের ভাষ্য করতে শুরু করেছিল। নানান গ্রন্থের অর্থ না বুঝে ভুল ভাষ্য নিজেরা করেছিল । পরে দক্ষিণে শৃঙ্গেরী, পূ্ব্বে ভগোর্বদ্ধন, উত্তরে জোসী এবং দ্বারিকায় সারদা মঠ স্থাপন করিয়া শঙ্করাচার্য্যের শিষ্যগণ মোহস্ত হইয়া এবং সম্পন্ন হইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। 


এক্ষণে ইহা বিচার করিয়া বুঝা উচিত যে জীব ও ব্রহ্মের একতা এবং জগৎ মিথ্যা ইত্যাদিরূপ যে শঙ্করাচার্য্যের মত ছিল তাহা উৎকৃষ্ট মত নহে। তবে যদি তিনি জৈন মত খন্ডনের নিমিত্ত উক্ত মত স্বীকার করিয়া থাকেন তবে অপেক্ষাকৃত ভাল বলিতে হইবে।

জীবাত্মা পরমাত্মা ও প্রকৃতি ভিন্ন বেদ মন্ত্রে প্রমানঃ

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখাযা সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।

তযোরন‍্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত‍্যনশ্নন্নন‍্যো অভি চাকশীতি।। [ঋগ্বেদ০১।১৬৪।২০]

ভাবার্থঃ-(দ্বা) ব্রহ্ম বা ঈশ্বর উভয়ে,(সুপর্ণা)চেতনা ইত‍্যাদি একইরকম গুণবিশিষ্ট,(সযুজা) ঈশ্বর সর্বব‍্যাপক বলে জীবের সাথে সবসময় সংযুক্ত,(সখাযা) ঈশ্বর ও জীব পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ,(সমানং) ঈশ্বর ও জীব উভয়ে সনাতন ও অনাদি,(বৃক্ষম) অনাদি প্রকৃতিরূপ বৃক্ষ বা গাছ অর্থাৎ এই জগৎ- সংসারে, ঈশ্বর ও জীব উভয়ে বসবাস করে,(তযোরন‍্যঃ)এই জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে, জীব ‌এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পুণ‍্যরূপ ফলসমূহ(স্বাদ্বত্তি) উত্তমরূপে ভোগ করে,আর ঈশ্বর,কর্মফল (অনশ্নন্)ভোগ না করে চারদিকে অর্থাৎ অন্তর ও বাইরে সর্বত্র প্রকাশিত হয়ে আছেন। ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি ভিন্নধর্মী ও অনাদি।

তিনি সর্বব্যাপক [যজুর্বেদ ৪০।১, ৪০।৮] অর্থাৎ তিনি সমস্ত জায়গায় অবস্থান করছেন [ঋগ্বেদ ১০।৯০।১] অথচ যিনি সর্বাত্মা হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তিনিই ঈশ্বর [ঋগ্বেদ ৬।৪৭।১৮]।

যিনি সর্বাত্মা হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তিনিই ঈশ্বর / ব্রহ্ম [যোগসূত্র ১।২৪]।

জীবাত্মা বিষয়ে বেদ মন্ত্র
रूपम्ऽरूपम्। प्रतिऽरूपः। बभूव। तत्। अस्य। रूपम्। प्रतिऽचक्षणाय। इन्द्रः। मायाभिः। पुरुऽरूपः। ईयते। युक्ताः। हि। अस्य। हरयः। शता। दश ॥
ঋগ্বেদ-৬/৪৭/১৮
বিষয়- তাহলে এই জীবাত্মা কেমন, এই বিষয়ে বলেন।
#পদার্থ-হে মনুষ্য!যে ( ইন্দ্রঃ) জীব ( মায়াভিঃ) বুদ্ধিতে ( প্রতিক্ষণায়) প্রত্যক্ষ বিবৃতির জন্য ( রূপরূপম্) রূপ-রূপকে ( প্রতিরূপঃ) প্রতিরূপ অর্থাৎ তার স্বরূপে বর্তমান ( বভূব) এবং ( পুরুরূপঃ) বহু শরীর ধারণ করে অনেক প্রকারে ( ঈয়তে) পাওয়া যায় ( তত্) সে ( অস্য) এই শরীরের ( রূপম্) রূপ এবং যা ( অস্য) এই জীবাত্মাকে ( হি) সংকল্প করে ( দশ) দশ সংখ্যাতে বিশিষ্ট এবং ( শতা) শত সংখ্যার জন্য বিশিষ্ট (হরযঃ) অশ্বের ন্যায় ইন্দ্রিয়,অন্ত-করণ এবং প্রাণ ( যুক্তাঃ) যুক্ত হয়ে শরীরে ধারণ করে,এই তার সামর্থ্য।
#ভাবার্থ-এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালঙ্কার আছে। হে মনুষ্য! বজ্র পদার্থের অনুরূপ, একইভাবে জীব দেহের সাথে তত্ত্বভাব এবং যখন সে বাহ্যিক বস্তুকে দেখতে চায়, তখন তা দেখে এই জীব তথ্যরূপ জ্ঞান লাভ করে এবং জীবের দেহে যা অগণিত। বজ্রপাত সহ. নাড়ী আছে, সেই নাড়ীগুলি.এসব থেকে বিস্তারিত জানে।।
( ভাষ্যম্-মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী)
এগারোটি প্রামাণিক উপনিষদ হলঃ-
ঈশ,কেন,কঠ, প্রশ্ন,মন্ডুক,মান্ডূক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়,শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক।

যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রয়ন্তভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব  তদ ব্রহ্ম

তৈত্তীরিয় উপনিষদ ভৃগুবল্লী/১ম অনুবাক/১ম মন্ত্র

অনুবাদ:- জীব জগত যার থেকে উৎপন্ন, উৎপত্তির পর যাতে স্থিত, বা যার সহায়তায় জীবিত, প্রলয়ে যাতে প্রবেশকরে, তাকে জানো তিনিই ব্রহ্ম


ব্রহ্ম শব্দটি 'বৃংহ্' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, যার মানে to swell, to expand(বিস্তৃত হওয়া)।

অপরদিকে শূন্য শব্দটি 'শ্বী' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, যার মানেও to swell, to expand(বিস্তৃত হওয়া)।

আমার কাছে মনে হয় যিনি শূন্যতা বলতে কেবল নাস্তিত্বকে বুঝেন, তিনি শূন্যতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেননি। শূন্যতার তাৎপর্য সুমেরু পর্বতমালার বিশালতার সাথে তুলনীয়(যদিও বাস্তবে তা তুলনীয় নয়, বুঝার সুবিধার্থে তুলনা করা মাত্র)।

সংসারকে শূন্য বলা মানে সংসারের নাস্তিত্ব বলা নয়। মৈত্রীয়াণ্যুপনিষদে তো ব্রহ্মকেই বলা হয়েছে 'শূন্য' (এষঃ শুদ্ধঃ শূন্যঃ শান্তঃ ২/৪)! শূন্য কথার অর্থ যদি কেউ অলীক ভাবে, তাহলে তো ব্রহ্মকেই আকাশ কুলসুমের মত অলীক বলে মানতে হয়।

ঋগবেদ ১০/১২৯/১-৩ নং এ এই ব্যাপারে সুন্দর কয়েকটি মন্ত্রও দেখতে পাওয়া যায়, এত বলা হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে যখন পরিবর্তনশীল জগৎ ছিলনা, পরমাণু পূর্ণ অন্তরিক্ষও ছিল না, সেই সময় মৃত্যু অমরত্ব, দিন রাত ইত্যাদি কি কোথায় কিভাবে ছিল? সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় জাগতিক বস্তুসকল "কেবল সৎ" কিংবা "কেবল অসৎ" ছিল- এরকম বলা যায় না। বরংচ বলা যায়, সে অবস্থায় "সৎ অসৎ মিলেমিশে" পদার্থ সকল অনির্বাচ্য সত্তায় ছিল। এসবের উত্তরে পবিত্র বেদই ঘোষণা করে বলছে- "তুচ্ছ্যেন আভু অপিহিতম্ অর্থাৎ শূন্যতার দ্বারা ব্যাপক প্রকৃতি আবৃত ছিল।"

"সম্পাদ্যহবির্ভাবঃ স্বন শব্দাৎ।

ব্রাহ্মেণ জৈমিনিরুপন্যাসাদিভ্যঃ।।

চিতিতন্মাত্রেণ তদাত্মকত্বাদিত্যৌড়লোমিঃ।

এবমপ্যুপন্যাসাৎ পর্ব্বভাবাদবিরোধাং বাদরায়ণঃ।।

অতএব চানন্যাধিপতিঃ।
 বেদান্ত দঃ অঃ ৪ পা ৪ সুঃ১।৫-৭।৯।

অর্থাৎঃ যাবত জীব স্বকীয় শুদ্ধ স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া ও সকল মল হইতে নির্মূক্ত হইয়া পবিত্র না হয় তাবৎ,যোগ দ্বারা ঐশ্বর্য্যপ্রাপ্ত হইয়া ও জীব নিজ অন্তর্য্যামী ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে স্থিত হইতে পারে না। এইরূপ যোগী যখন পাপাদি রহিত হইয়া ঐশ্বর্য্যযুক্ত হয় তখনই, ব্রহ্মের সহিত মুক্তির আনন্দ ভোগ করিতে পারে,জৈমিনি আচার্য্যের এই মত।

যখন অবিদ্যাদি দোষ দুরীভূত হইয়া জীব শুদ্ধ চৈতন্যমাত্র স্বরূপে স্থিত থাকে তখনই "তদাত্মকত্ব" অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ প্রাপ্ত হয়। যখন জীব ব্রহ্মের সহিত ঐশ্বর্য্য এবং শুদ্ধ বিজ্ঞান জীবিতাবস্থায় প্রাপ্ত হইয়া জীবন্মুক্ত হয় তখন সে নিজ নির্ম্মল পূর্ব্ব স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া আনন্দিত হইয়া থাকে, ইহাই মহামুনি ব্যাসের মত।

যোগীর যখন সত্যসঙ্কল্প হয় তখন সে স্বয়ং পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত হইয়া মুক্তিসুখ প্রাপ্ত হয় এবং স্বস্থানে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাকে। সংসারে যেরূপ একজন প্রধান এবং অন্য একজন অপ্রধান হয়,মুক্তির অবস্থায় তদ্রূপ হয় না কিন্তু সকল জীবই তুল্যভাবে অবস্থান করে

তা না হইলে...

উপনিষদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

"যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানম ধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।"

- ইহা বেদবিরূদ্ধ বচন তাই এই কথা দ্বারা ঈশ্বরের অবতার প্রমান হয় না।


যজুর্বেদের ৩৪ নং অধ্যায়ের ৫৩ মন্ত্রে "অজ একপাৎ"অর্থাৎঃ আমি এক,আমি জন্ম গ্রহণ করিনা। "সপর্য্যগাচ্ছূক্রমকারম্"-যজুর্বেদের ৪০ অধ্যায়ের ৮ নং মন্ত্রে উল্লেখ আছেঃ-স পর্য্য গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমব্রণমসন্বিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম।কবির্মনীষী পরিভূতঃ স্বয়ং ভূর্য়াথাতথ্যতোৎর্থান ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্য সমাভ্য।

অর্থঃ- ঈশ্বর সমগ্র জগতে পরিপূর্ণভাবে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন তিনি সমগ্র জগতের রচয়িতা এবং অনন্ত বিদ্যাবলযুক্ত।তিনি কদাপি কোনরুপ জন্ম বা শরীর গ্রহণ করেন না।তিনি সদা ছিন্দ্র রহিত বা অক্ষতরুপে সদা বিরাজমান।তার কোন প্রকার বন্ধন বা আবরণ নাই।তিনি অবিদ্যা,অস্মিতা,রাগ দ্বেষ ও অভিনিবেশাদি রুপ অজ্ঞান, ক্লেশ ও দোষ হইতে পৃথক রুপে বর্তমান আছেন। তিনি কদাপি পাপযুক্ত বা পাপকারী নহেন।তিনি সকলের অর্ন্তযামীরুপ হইয়া ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান যথাবৎ জ্ঞাত আছেন।তিনি সদা সর্বোপরি বিরাজমান। তিনি কদাপি উৎপন্ন হন না।তিনি অনাদি,অনন্ত নিজ সত্য সামর্থের সহিত বর্তমান আছেন।

 অথর্ব বেদের ১৩নং কাণ্ডের ৪ অনুবাকের ১৬,১৭,১৮ নং মন্ত্রে আছে,

"ঈশ্বর একোমেবাদ্বিতীয়ম ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।

ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।।

অর্থঃ- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, তদ্ভিন্ন কোন দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ পরমেশ্বের নাই।তিনি ব্যতীত কোন পঞ্চম, ষষ্ট বা সপ্তম পরমেশ্বর নাই।এইরুপে তদ্ভিন্ন কোন অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর নাই।

শ্বেতাশ্বর উপনিষদের ৬ অধ্যায়ের ৮ নং মন্ত্রে বলা হয়েছেঃ-

ন তস্য কার্য্যং করণং চ বিদ্যতে,ন তৎসমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে।

পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রূয়তে,স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ।।


অর্থঃ- পরমাত্মার ন্যায় কোনও তদ্রুপ কার্য্য এবং উহার কারন অর্থাৎ সার্থকতম অপর কেহ আপেক্ষিকত নাই।তাদার সাদৃশ অথবা তদপেক্ষা মহান কেহই নাই।তাঁহারা সর্বোত্তম শক্তি অর্থাৎ তাঁহাতে অনন্ত জ্ঞান অনন্ত বল এবং অনন্ত ক্রিয়া আছে,তাহা স্বাভাবিক।

শ্বেতাশ্বর উপনিষদের ৩ অধ্যায়ের ১৯ নং মন্ত্রে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ-

অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা,পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ।

স বেত্তি বিশ্বং ন চ তস্যাস্তি, বেত্তা তমাহুরগ্যা পুরুষ পুরাণম।।

অর্থঃ- পরমেশ্বরের হস্ত নাই,কিন্তু তিনি নিজ শক্তি স্বরুপ হস্ত দ্বারা সমস্ত রচনা এবং গ্রহণ করেন।তাঁহারা চরণ নাই,কিন্তু তিনি ব্যাপক বলিয়া সসর্বাপেক্ষা অধিক বেগবান। তাঁহার চক্ষুগোলক নাই, কিন্তু তিনি সমস্ত যথাযথ রুপে দর্শন করেন।তাঁহার শোত্র নাই,তথাপি তিনি সকলের কথা শ্রবণ করেন।তাঁহার অন্তকরণ নাই,কিন্তু তিনি সমস্ত জগৎ কে জানেন।তাঁহাকে সম্পূর্ণরুপে জানতে পারে,এমন কেহই নাই।তিনি সনাতন,সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বত্র পূর্ণ বলিয়া তাঁহার নাম পুরু।তিনি নিজ সামর্থ্যের দ্বারা অনুষ্ঠিত যাবতীয় কর্ম করিয়া থাকেন।

                                      "ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীত্তদাত্মানমেবাবেৎ।
অহং ব্রহ্মাস্মীতি।
অস্মাত্তৎসর্ব্বমভবৎ।
তদ্ যো যো দেবানাং প্রত্যবুধ্যত স এব তদভবত্ততর্ষীণাং তথা মনুষ্যণাং তদ্ধৈসৎ পশ্যন্নরষির্বাদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভব সূর্য্যশ্চেতি।
তদিদমপ্যেতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদ সর্ব্বং ভবতি তস্য় হ ন দেবাশ্চ নাভূত্যা ঈশতে।
আত্মা হ্যেষাꣳ স ভবতি।
অথ যোহন্যাং দেবতামুপাস্তেহন্যেহসাবন্যোহহমস্মীতি ন স বেদ যথা পশুরেব স দেবানাম
যথা হ বৈবহবঃ পশবো মনুষ্যং ভুঞ্জ্যুরেবমেকৈকঃ পুরুষো দেবান্ ভুনক্ত্যেকস্মিন্নেব পশাবাদীয়মানেহপ্রিয়ং ভবতি কিমু বহুষু তস্মাদেষাং তন্ন প্রিয়ং যদেতন্মনুষ্য। বিদ্যুঃ।।"
[বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ১ম অধ্যায়।৪র্থ ব্রাহ্মণম্।১০নং কন্ডিকা]
যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ pdf page 216 বৃঃউঃ
অপর ব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভই ব্রহ্মশব্দের অর্থ, যেহেতু তাঁহারই বিজ্ঞানসাধ্য সর্ব্বস্বরূপতা ফল পূর্বে বলা হয়েছে, পরব্রহ্মের সর্ব্বস্বরূপতা বিজ্ঞানসাধ্য নয়, স্বাভাবিক, "তস্মাত্তৎ সর্ব্বভবৎ"[সবকিছু ব্রহ্ম দ্বারা সৃষ্ট]- এইশ্রুতিতে বিজ্ঞানসাধ্য সর্ব্বস্বরূপতা অপর ব্রহ্মেরই অভিহিত আছে। তবে ইহাই বলিতে হয় যে, "ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ" শ্রুতিতে ব্রহ্মশব্দের অপর ব্রহ্মই অর্থ। অথবা পূর্ব্বশ্রুতিতে মনুষ্যের প্রস্তাব আছে, এবং মনুষ্যই অভ্যুদয় ও নিঃশ্রয়স ফলসাধনে বিশেষরূপে অধিকারী, এই হেতু ব্রহ্মশব্দে পরব্রহ্ম হইবে বা অপরব্রহ্ম (প্রজাপতি)-কে না বুঝাইয়া, যে ব্রহ্মণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়া ব্রহ্মময় হইবে, তাহাকেই বুঝাইয়াছে। অতএব ইহা নিষ্কর্ষ হয় যে, যে ব্রাহ্মণ নিত্য নৈমিত্তিক ও নিষ্কাম কর্ম্ম সহিত দ্বৈতৈকত্ব (সর্ব্বদ্বৈতের ঐক্য) জ্ঞান বা অপর ব্রহ্মবিদ্যা দ্বারা অপরব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইয়া সমস্ত ভোগ বিরত এবং সকল অভিলষিত ফলের লাভবশঃত কাম্য কর্ম্মবন্ধন হইতে বিমুক্ত হইয়াছেন ও ক্রমশঃ পরব্রহ্মবিদ্যা লাভ করিয়া ভবিষ্যতে পরব্রহ্মভাব লাভ করিবেন, সেই ব্রাহ্মণই এই শ্রুতিতে ব্রহ্মশব্দের লক্ষ্য। 
ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীত্ত= হিরন্যগর্ভ ব্রহ্ম
অস্মাত্তৎসর্ব্বমভবৎ= সমস্তকিছু ব্রহ্ম দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।
তদ্ যো যো [যে তা জানে]
স এব তদভবত্ততর্ষীণাং [সেই বড় হয়ে যায়]
মনুষ্যণাং তদ্ধৈসৎ পশ্যন্নরষির্বাদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভব [ঋষিদের মধ্যে যারা তা জানে তারা বড় জ্ঞানী হয়ে যায়]
ইদ সর্ব্বং ভবতি তস্য় হ ন দেবাশ্চ নাভূত্যা ঈশতে= দেবতাদেরও তিনি উপাস্য হয়ে যায়
বেদ যথা পশুরেব স দেবানাম=  পশুপালক যেমন মালিকের জন্য পশু সেবকের জন্য, পশুতুল্য জীবন যাপন।
পশাবাদীয়মানেহপ্রিয়ং ভবতি কিমু বহুষু তস্মাদেষাং তন্ন প্রিয়ং যদেতন্মনুষ্য।=যেমন অনেক পশু মানুষের সেবা করে তেমন বহু মানুষ একজন মহান ব্যক্তির অন্ধ ভক্ত হয়ে পশুর মতো অনুসরন করে

ঋগ্বেদ ৬।৪৭।১৮ যিনি সর্বাত্মা থেকে সম্পূর্ণ সতন্ত্র তিনিই ব্রহ্ম [ব্রহ্মসূত্রঃ ১।২৪]

মূল সংস্কৃত বাক্য অহং ব্রহ্মাস্মীতি।[যজুর্বেদের ব্রাহ্মণ]

অহং (আমি) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম) অস্মি (হই) ইতি (এইরূপে)।

বেদান্তের এই মন্ত্রের উৎস হলঃ

ঋগ্বেদে ৪র্থ মণ্ডলে ২৬ নং সূক্তের ১মন্ত্র

অহং মনুরভবং, সূর্যশ্চাহং কক্ষীবী ঋষিরস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ং ন্যৃংজে অহং কবিরুশনা পশ্যতা মা।।

अ॒हं मनु॑रभवं॒ सूर्य॑श्चा॒हं क॒क्षीवाँ॒ ऋषि॑रस्मि॒ विप्रः॑।

 अ॒हं कुत्स॑मार्जुने॒यं न्यृ॑ञ्जे॒ऽहं क॒विरु॒शना॒ पश्य॑ता मा ॥

पदार्थान्वयभाषाः -

हे मनुष्यो ! जो (अहम्) मैं सृष्टि को करनेवाला ईश्वर (मनुः) विचार करने और विद्वान् के सदृश सम्पूर्ण विद्याओं का जनानेवाला (च) और (सूर्य्यः) सूर्य्य के सदृश सब का प्रकाशक (अभवम्) हूँ और (अहम्) मैं (कक्षीवान्) सम्पूर्ण सृष्टि की कक्षा अर्थात् परम्पराओं से युक्त (ऋषिः) मन्त्रों के अर्थ जाननेवाले के सदृश (विप्रः) बुद्धिमान् के सदृश सब पदार्थों को जाननेवाला (अस्मि) हूँ और (अहम्) मैं (आर्ज्जुनेयम्) सरल विद्वान् ने उत्पन्न किये हुए (कुत्सम्) वज्र को (नि) अत्यन्त (ऋञ्जे) सिद्ध करता हूँ और (अहम्) मैं (उशना) सब के हित की कामना करता हुआ (कविः) सम्पूर्ण शास्त्र को जाननेवाला विद्वान् हूँ, उस (मा) मुझको तुम (पश्यत) देखो ॥


भावार्थभाषाः -इस मन्त्र में वाचकलुप्तोपमालङ्कार है। हे मनुष्यो ! जो जगदीश्वर मन्त्रियों अर्थात् विचार करनेवालों में विचार करने और प्रकाश करनेवालों का प्रकाशक, विद्वानों में विद्वान्, अखण्डित न्याययुक्त, सर्वज्ञ और सब का उपकारी है उस ही का विद्या, धर्म्माचरण और योगाऽभ्यास से प्रत्यक्ष करो ॥१॥-स्वामी दयानन्द सरस्वती

(is mantr mein vaachakaluptopamaalankaar hai. he manushyo ! jo jagadeeshvar mantriyon arthaat vichaar karanevaalon mein vichaar karane aur prakaash karanevaalon ka prakaashak, vidvaanon mein vidvaan, akhandit nyaayayukt, sarvagy aur sab ka upakaaree hai us hee ka vidya, dharmmaacharan aur yogaabhyaas se pratyaksh karo )

হে মানবজাতি! যিনি জগদীশ্বর মন্ত্রী অর্থাৎ যিনি বিচার করেন এবং যিনি বিচারকদের মধ্যে বিচারক, পণ্ডিতদের মধ্যে পণ্ডিত, অবিচ্ছিন্ন ন্যায়বিচারকারী, সর্বজ্ঞ এবং সকলের জন্য কল্যাণকারী,
যিনি কেবল জ্ঞান, ধর্মচর্চা ও যোগসাধনার মাধ্যমেই প্রকাশ হন। 

"অস্য লোকস্য কা গতিরিত্যাকাশ ইতি হোবাচ"- ছান্দগ্য উপনিষদে্র প্রঃ ১খন্ড ৯মঃ ১ ব্রহ্মকে "আকাশ" শব্দে বাচ্য বলা হয়েছে। আকাশের মতো ব্রহ্ম অশরীর সূক্ষ্ম অর্থাৎ দুর্বিজ্ঞেয় বলে ব্রহ্ম "আকাশ" শব্দের দ্বারা অভিহিত হয়ে থাকে।

“সোহহমস্মি” বেদান্তের অন্যতম একটি মহাবাক্য।

উৎসঃ “যজুর্বেদ” ঈশোপনিষদের ১৬ নং মন্ত্র, বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৫/১৫ নং মন্ত্র এবং ছান্দোগ্য উপনিষদের ৪/১১/১ নং মন্ত্রে সোহহমস্মি বাক্যটির উল্লেখ রয়েছে।
अहं ब्रह्मास्मि - यजुर्वेदः बृहदारण्यकोपनिषत् अध्याय 1 ब्राह्मणम् 4 मंत्र 10

পদার্থঃ সোহহমস্মি = সঃ + অহম্ + অস্মি

অর্থাৎ সেই পুরুষই আমি। আমিই সেই পুরুষ(আত্মা)। আমিই হই সেই (পুরুষ) ।
উপনিষদের যে স্থলে "অহং ব্রহ্মাস্মি,অয়মাত্মা ব্রহ্ম" ইত্য়াদি বাক্য দেখিতে পাওয়া যায় সেখানে সমাধিপ্রাপ্ত যোগী ও মুক্ত আত্মার সম্বন্ধে পরামর্শ বুঝিতে হইবে।বৈদিক সংস্কৃত ও বৈদিক
ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করা প্রয়োজন।মহর্ষি পাণিণির ব্যকরণ ও অষ্টধ্য়ায়ীতে সূত্র আছে "তাতৎস্তোপাধি" তৎসহচরিত উপাধি। ঐস্থলে স্থ শব্দ উহ্য আছে জানিতে হইবে।
"অহং ব্রহ্মাস্মি" শব্দের অর্থ অহং ব্রহ্মস্থ অস্মি অর্থাৎ আমি সর্বব্যাপক ব্রহ্মেই অবস্থিত এইরূপ বুঝিতে হইবে।"অয়মাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত। "তত্ত্বমসি ইহা ছান্দোগ্য উপনিষদের বচন শ্বেতকেতু কে তাহার পিতা বলিতেছেন-"হে শ্বেতকেতু তুমি সেই অন্তর্যামী পরমাত্মাতে যুক্ত।" ঋষিদের উপদেশ এই যে অপরাবিদ্যা অর্থাৎ সৃষ্টি বিজ্ঞান পাঠ করিবার পর তবে
পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা পাঠ করিবে-নতুবা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইবে।আমরা সৃস্টি বিজ্ঞানের যথার্থ জ্ঞানলাভ না করিয়াই পরাবিদ্যা বা বেদান্ত ও উপনিষদাদি পাঠ করিতে গিয়া এই মায়াবাদ বা
অদ্বৈত-বাদরূপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়া তাহাতে মোহিত হইয়া পড়িব।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্ত মূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বাভূতানি ন চাহং তেস্বাস্থিতঃ।।-গীতা।।৯।৪
অর্থাৎঃ আমি অব্যক্তরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি।সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত,আমি কিন্তু তৎ সমুদেয়ে অবস্থিত নই। এখানে এই "আমি"কথার অর্থ বৈষ্ণবরা বা অনেকেই শ্রী কৃষ্ণকেই প্রতিপন্ন করতে চান। কিন্তু এখানে 'আমি' অর্থে পরমাত্মার কথাই বেলছেন। কারন গীতার ৯।৫ শ্লোকে বলেছেন-
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে য়োতমৈশ্বরম্।। অর্থাৎঃ তিনি অর্জুনকে যত উপদেশ দিয়েছেন, তা তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। এ কারণে তিনি গীতার বহু জায়গায় একাধিকবার পশ্য মে য়োগমৈশ্বম্ কথাটি অর্জুনের প্রতি ব্যবহার করেছেন।
উপনিষদের যে স্থলে "অহং ব্রহ্মাস্মি, অয়মাত্মা ব্রহ্ম" ইত্যাদি বাক্য দেখিতে পাওয়া যায় সেখানে সমাধিপ্রাপ্ত যোগী ও মুক্ত আত্মার সম্বন্ধে পরামর্শ বুঝিতে হইবে। জীবাত্মা নির্গুণ বলিয়া পরমাত্মা সহিত পূর্ণভাবে সম্বন্ধ উৎপন্ন করিয়া তাহাতে সমাধিপ্রাপ্ত হইয়া তদাকার প্রাপ্ত হইয়া যায়।
তদ্ভিন্ন মুক্তি হইতে পার না। পরমাত্মায় মগ্ন হিয়া স্বরূপ শুন্যের ন্যায় সমাধি প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মভাব ধারণ করে। ব্রহ্মবিদ ঋষিগণ মুক্তির অবস্থা উপলব্ধি..
"অহং ব্রহ্মাস্মি"- এই বাক্যের যদি অর্থকরা যায় তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত প্রীতির উদাহরণ(=আদর্শ) হইবে।ইহাই লৌকিক দৃষ্টান্ত দ্বারা স্পষ্ট হয়,-"আমিই আমার মিত্র" এরূপ বলা হয়, পরন্তু আমি এবং আমার মিত্র,  ইহাদের মধ্যে সর্ব থৈব অভিন্নতা রহিয়াছে এরূপ পলিতার্থ করা সম্ভব নহে। সমাধিস্থ অবস্থায় তত্ত্বমতি মুনিরা এইরূপ বলিয়াছেন,পরন্তু সাহচর্য্যের প্রতি ধ্যান দিলে মুনিদেরএই উক্তি"জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন" এইমতের পোষক হয় না। কারণ, এই বচনের [কি উক্তির] পূর্ব ভাগে এই সমস্ত স্থুল ও সুক্ষ্ম জগতে করাণ রূপে পরমাত্মার এতদাত্ম্য [কথিত] বিদ্যমান। 
পরমাত্মার আত্মা ভিন্ন নহে,'স আত্মা' সেই আত্মা 'ভদন্তর্যামী ত্বমসি" যিনি সমস্ত জগতের আত্মা,সে তোমারই। এ কারণ জীবাত্মাও পরমাত্মা ইহাদের মধ্যে পরস্পর সেব্য-সেবক,ব্যাপ্য-ব্যাপক আধারাধেয় এসমস্ত বাস্তবিকই খাঁটে। ঐতরোয়োপনিষদ্ গ্রন্থে-"প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম" বাল্যটি এই রূপ।
 ইহার মহাবাক্য-বিবরণে "প্রজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম" এইরূপ বিস্তার করা হইয়াছে,তথাপি পরমেশ্বরই সৃষ্টি রচনা করিয়াছেন, এইরূপ অর্থ " তৎসৃষ্টিং প্রাবিশত"-এই বাক্যের আধারে অর্থ করিলে কার্য কারণের ভিন্নতা হওয়া সম্ভব। ঈশ্বর,যদি জ্ঞানবান্ হন, তাহা হইলে তিনি অবিদ্যা মায়া আদির অধীন হইয়া সৃষ্ট্যুৎপত্তির কারণ হইবে। এরূপ বলিলে "তিনি ভ্রান্ত" এইরূপ প্রতিপদন করিতে হইবে। যেখানে দেশ, কাল, বস্তু[র] পরিচ্ছেদ হইবে,উহা ভ্রান্তময়। ব্রহ্মের এই ভ্রান্তি হইয়াছে যদি বলা হয় তাহা হইলে ব্রহ্ম জ্ঞান অনিত্য প্রমাণিত হইবে[অতঃ]ইহা বিচারণীয় বিষয়। এইরূপ "জীবভাবনা" ভ্রান্তির পরিণাম। ভ্রান্তি দূর হওয়া মাত্রই জীব ব্রহ্ম হইল। যদি এইরূপ ধারণা হয় তাহা হইলে[এই ধারণা]যথার্থ নহে। কারণ পরমাত্মায় ভ্রান্তি সম্ভব নহে। আধুনিক বেদান্তানুসারে মুক্তি স্বীকার করিলে ব্রহ্মের উপর অনির্মোক্ষ ব্রহ্মই দেখা দিবে। যদি বলো, জীব ও ব্রহ্ম এক তাহা হইলে জীবে তো ব্রহ্মের গুণ পাওয়া যায় না। জীবে অপরিমিত জ্ঞান ও অপরিমিত
সামর্থ্য নাই। যদি আমি ব্রহ্ম হইয়া যাই তাহা হইলে আমি জগৎ রচনাও করিতে পারিব। এ কারণ পুনঃ একবার এরূপ মনে করা উচিত যে,বিশ্ব জড়, আর ব্রহ্ম চেতন;ইহাদের মধ্যে আধার-আধেয়,সেব্য-সেবক, ব্যাপ্য ও ব্যাপক সম্বন্ধ বর্তমান। "সুখমস্বাপ্ সম্" এই অনুভবের যোজনা করা যাইতেছে। কারণ এই যে,ইহা চৈতন্য ও নিত্যজ্ঞানী। তৈত্তিরীয়োপনিষদে আনন্দময় কোষের অবয়ব বর্ণনা করা আছে।

সারাংশঃ জীব ব্রহ্ম নহে,জগৎও ব্রহ্ম নহে। এস্থলে কার্য্য কারণ পৃথক্ পৃথক্। ইহা সত্য,পরন্তু ঈশ্বর সজীব ও নির্জীব যাবতীয় পদার্থ স্বীয় সামর্থ্য বলে নির্মাণ করিয়াছেন। সেই সামর্থ্য তাহার নিকট সদা বিদ্যমান থাকে,এই তাৎপর্য্যে ভেদ দৃষ্ট হয় না।  

 শংকরের মতে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য চার প্রকার সাধনার প্রয়োজন যথা- (১) নিত্য ও অনিত্য বস্ত্তর ভেদাভেদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা, (২) ইহলোক ও পরলোকের ফলভোগে অনাশক্তি, (৩) অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রয় সংযম এবং (৪) মুক্তি লাভের ঐকান্তিক ইচ্ছা। এই চার প্রকার সাধনার ফলে জীব বুঝতে পারে যে,  তাতে এবং ব্রহ্মতে কোনো পার্থক্য নেই। তার উপলব্ধি ঘটে যে, সব কিছুই ব্রহ্মময় বা "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম"-ছান্দোগ্য উপনিষদ
ব্রহ্মইএই চরাচর জগতের রূপধারণ করেছেন, তাই সর্বত্রই ব্রহ্মময়।। তার ধারণা স্পষ্ট হয় তিনি ভাবেন: ‘সোহ্হম’ অর্থাৎ আমিই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-সত্য স্বভাবরূপ পরমানন্দ অদ্বয় ব্রহ্ম এবং জীব তখন মোক্ষ লাভ করে।

উপনিষদ ব্যাখ্যা কৌশল বুঝতে হলে ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ১।১১।১ (পৃষ্ঠাঃ৪৪৫) দেখুন। "তাহাই দেবগণের অন্নস্বরূপ" "দেবগণ তাহাদিগকে ভক্ষণ অর্থাৎ উপভোগ করেন" ইত্যাদি শ্রুতি হতে জানা যায় যে, তাঁহারাই দেবগণের অন্নস্বরূপ। "অন্ন ভোজন করিতেছ" "প্রিয়জনকে দর্শন করিতে পারিতেছ"-ইত্যাদি বাক্যই এর লক্ষণ অর্থাৎ জ্ঞাপক চিহ্নস্বরূপ। অনায়াসে বোধগম্য করিবার নিমিত্ত ও বিদ্যাদানের যে রীতি আছে, সেই রীতি প্রদর্শনের নিমিত্ত আখ্যায়িকা হয়। 
আত্মা ও ব্রহ্ম এই দুটি শব্দ পরস্পর বিশেষ্য ও বিষেষণভাবাপন্ন অর্থাৎ আমাদের আত্মস্বরূপ ব্রহ্মটি কে ? এই স্থানে "ব্রহ্ম" এই শব্দ টি অধ্যাত্মপরিচ্ছিন্ন অর্থাৎ দেহপরিচ্ছিন্ন আত্মাকে নিষেধ করে, আর আত্মা এই শব্দটিও আত্মা ব্যতীত আদিত্যাদিরূপ ব্রহ্মের উপাস্যত্বকে নিবৃত্তি করে।
ব্রহ্মশব্দ শরীরাদি পরিচ্ছিন্ন আত্মাকে অপর হইতে ব্যাবৃত্ত করে, আবার আত্মশব্দ ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মই আত্মা, এই প্রকার অভেদ নিবন্ধন পরিশেষে সর্ব্বাত্মা বৈশ্বানরই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা নির্ণীত হয়।

ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিতভাবে (সমাধি অবস্থায়) জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তাঁর আত্মা তখন সর্বব্যাপী পরমেশ্বরের সাথে সর্ব্বব্যপক দেখেন(বৃহদারণ্যক-১/৪/১০)।

ব্রহ্মৈব ভবতি (মুণ্ডক উপঃ ৩/২/৯)

অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে থাকেন। [যত পিন্ড তৎ ব্রহ্মান্ডে:- বোঝানোর সুবিধার্থে নিজ পিন্ড বা পুরী কে বুঝলে ব্রহ্মান্ড কে বোঝা যায়.. কিন্তু বস্তবে তা সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না]

অনেকে শংকরের বক্তব্যকে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, শংকর জগতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। এ বক্তব্য সঠিক নয়। শংকর বলেছেন জগৎ মিথ্যা। কিন্তু জগৎ অস্তিত্বহীন অর্থাৎ জগতের কোনো অস্তিত্বই নেই এ কথা তিনি কোথাও বলেননি। অন্যদিকে তিনি বলেন, বন্ধ্যা নারীর সন্তান প্রসব অবাস্তব বা অস্তিত্বহীন। বন্ধ্যা নারী সন্তান প্রসব করেছে- এমন কথা কেউ দাবী করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এটা  যৌক্তিকভাবে পরস্পরবিরোধী। তাঁর এই যুক্তি প্রমাণ করতে তিনি সত্যের পক্ষে মত দিয়েছেন। সত্যকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেছেন: ব্যবহারিক সত্য এবং পারমার্থিক সত্য। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। শুধুমাত্র ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ সত্য।
শঙ্করাচার্য বর্ণিত অদ্বৈতবেদান্তের মূল সূত্রেই জীব সম্পর্কেও বলা আছে- ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তার মানে, শঙ্করের তৃতীয় বাণীটি হলো- ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন তথা জীব ব্রহ্মস্বরূপ।

ব্রহ্ম সম্বন্ধে  মহর্ষি ব্যাসদেব লিখেছেন  -জন্মাদ্যস্য য়তঃ[ব্রহ্মসূত্র ১/১/২]-অর্থাৎ যিনি এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় করেন তিনিই ব্রহ্ম। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৫ এর মধ্যে বলা হয়েছে যে - 'সত্ত্ব, রজ, তম গুণের প্রকৃতি, জীবাত্মা এবং পরমাত্মা হলো 'অজ' অর্থাৎ অজন্মা, আর এই অজন্মা প্রকৃতি কে জীবাত্মা ভোগ করে'।

 কঠ উপনিষদে আছে, ‘‘মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাসিত্ম কিঞ্চন। মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।’’ অর্থাৎ এই জগতে ব্রহ্ম হতে পৃথক কিছুই নেই, এই তত্ত্বটি সংস্কৃত মন দ্বারাই উপলব্ধি করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, অদ্বৈত মতানুসারে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট। কিন্তু জীব তো সত্যস্বরূপ নয়, জ্ঞানস্বরূপ নয় এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে জীব ও ব্রহ্মকে কিভাবে এক ও অভিন্ন বলা যাবে ?
উত্তরে বলা হয়, জীবেরও ব্রহ্মের মতোই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হওয়া উচিত। অর্থাৎ আগুন এবং আগুনের একটা ফুলকি যে অর্থে এক, জীব ও ব্রহ্ম সেই অর্থেই অভিন্ন। কিন্তু জীবের ব্রহ্মস্বরূপতা আমাদের উপলব্ধি হয় না। কারণ দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং বিষয়-বাসনার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে জীবের জ্ঞান, ঐশ্বর্য ইত্যাদি তিরোহিত হয়। সংসারদশায় অবিদ্যা জীবের ব্রহ্ম-স্বভাবকে আবৃত করে রাখে। এই অবিদ্যা মলিনসত্ত্বপ্রধান-ব্যষ্টি-অবিদ্যা। এর ফলে জীব নিজেকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
ব্যবহারিক স্তরে ‘আমি’কে আমরা প্রত্যেকেই জানি। এই ‘আমি’ই হলো আমাদের জ্ঞান অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদির অধিষ্ঠান ও কর্তা। ‘আমি জানি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ইচ্ছা করি’- এইসব বাক্যগুলির মধ্য দিয়ে সেই ব্যবহারিক আত্মা বা জীবের অস্তিত্ব বা বোধ প্রকাশিত হয়। আমার জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছার কর্তা হলো আমি বা অহং। সুতরাং, এখানে জীব কর্তা এবং ভোক্তা। কিন্তু ব্রহ্ম কর্তা নয়, এবং জ্ঞানের বিষয়ও নয়। জানা, অনুভব করা এবং ইচ্ছা করা- এগুলি সবই চৈতন্যের ক্রিয়া।
কিন্তু এই চৈতন্য শুদ্ধ চৈতন্য নয়। এগুলি মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা সীমিত চৈতন্যের ক্রিয়া। শুদ্ধ-চৈতন্য থেকে ভিন্ন জীবাত্মাকে তাই সাক্ষী-চৈতন্য বলে। জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছায় দ্বৈতভাব থাকে। যেমন- জ্ঞাতা ও বিষয়ের সম্পর্ক, অনুভব ও তার বিষয়ের সম্পর্ক, ইচ্ছা ও ইচ্ছার বিষয়ের সম্পর্ক। ব্রহ্ম কিন্তু অদ্বয় ও সকল প্রকার ভেদশূন্য। অপরপক্ষে কিছু জানতে গেলে, অনুভব করতে গেলে এবং কিছু ইচ্ছা হলে বিষয়ী ও বিষয়ের মধ্যে ভেদ অবশ্যম্ভাবী। তাই আমাদের অহং বা আমি-টি ব্রহ্ম নয়। অহং হলো অবিদ্যার দ্বারা সীমিত ব্রহ্ম বা জীব।

এ প্রেক্ষিতে শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেন-

‘তদ্যথা পুত্রভার্য্যাদিষু বিকলেষু সকলেষু বা অহমেব বিকলঃ সকলো বা ইতি বাহ্যধর্ম্মান্ আত্মনি অধ্যাসতি। তথা দেহধর্ম্মান্ স্থূলোহহং কৃশোহহং গৌরোহহং তিষ্ঠামি লঙ্ঘয়ামি চ ইতি। তথা ইন্দ্রিয়ধর্ম্মান্ মূকঃ ক্লীবঃ বধিরঃ কাণঃ-অন্ধঃ অহম্- ইতি। তথা অন্তঃকরণধর্ম্মান্ কামসংকল্প বিচিকিৎসাধ্যবসায়াদীন্ । এবং অহংপ্রত্যয়িনং অশেষ স্বপ্রচার সাক্ষিণি প্রত্যগাত্মনি অধ্যস্য তঞ্চ প্রত্যগাত্মানং সর্ব্ব সাক্ষিণং তদ্বিপর্ষ্যয়েণ অন্তঃকরণাদিষু অধ্যস্যতি। এবময়ং অনাদিঃ অনন্তঃ নৈসর্গিকঃ অধ্যাসঃ মিথ্যাপ্রত্যয়রূপঃ কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বপ্রবর্ত্তকঃ সর্ব্বলোকপ্রত্যক্ষঃ। অস্য অনর্থ হেতোঃ প্রহাণায় আত্মৈকত্ব বিদ্যাপ্রতিপত্তয়ে সর্ব্বে বেদান্তা আরভ্যন্তে।’- (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১, বেদান্তসূত্রম্,পৃষ্ঠা-৩১)
অর্থাৎ :
আমাদের মধ্যে কারও পুত্র বা স্ত্রী প্রভৃতি যদি পীড়িত অথবা সুস্থ হয়, তাহলে, সে যথাক্রমে নিজ আত্মাকেই পীড়িত বা সুস্থ বলে বোধ করে থাকে- এটাই আত্মার উপর বাহ্যধর্মসমূহের অধ্যাস। এভাবে আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি গৌড়বর্ণ, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমি চলছি ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর দেহের ধর্মগুলির আরোপ করে থাকে। এভাবে আমি মূক, আমি ক্লীব, আমি বধির, আমি কাণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর ইন্দ্রিয়গুলির ধর্মগুলিকে আরোপিত করে থাকে। এভাবেই আবার অন্তঃকরণের ধর্মগুলি অর্থাৎ কাম, সংকল্প, সংশয় ও নিশ্চয় প্রভৃতি- আত্মাতে আরোপ করে থাকে। এভাবেই আবার সেই আমি- এই প্রত্যয়যুক্ত জীবকে সকলপ্রকার মানসবৃত্তির সাক্ষী- সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মাতে আরোপিত করা যায়, এবং বিপরীতভাবে আবার সেই সর্ববৃত্তির সাক্ষীস্বরূপ- প্রকাশময় পরমাত্মাকে- সেই আমি-প্রত্যয়ের বিষয় জীবাত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। এই যে পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাস- তার আদি খুঁজে পাওয়া যায় না- তার অন্তও নাই। এই অধ্যাস আমাদের নৈসর্গিক- এটাই মিথ্যাজ্ঞান অর্থাৎ অবিদ্যা। এই অধ্যাসই আমাদেরকে কর্তা ও ভোক্তা এই দুভাবে সংসারে প্রবর্তিত করে থাকে। তা সব লোকেরই প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই সকল প্রকার অনর্থের হেতু অধ্যাসকে বিধ্বস্ত করতে হলে- অদ্বিতীয় আত্মতত্ত্বজ্ঞানই একমাত্র আবশ্যক (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১)

ব্যবহারিক জগতে জ্ঞান, অনুভূতি বা ইচ্ছার কর্তা যে অহং তা সর্বদাই একটি শরীরের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের সঙ্গে অহং-এর যোগ আছে বলেই আমি জানি, আমি অনুভব করি এবং আমি ইচ্ছা করি। এই অহংকে শরীর থেকে পৃথক করা যায় না। যদি কল্পনা করি যে শরীর নেই, তাহলে প্রশ্ন ওঠে- কার জ্ঞান? কার অনুভূতি? কার ইচ্ছা? যে শরীর অন্যান্যদের ইন্দ্রিয়গোচর তা হলো ‘স্থূলশরীর’। এই স্থূলশরীর ছাড়াও সূক্ষ্মশরীর ও কারণশরীর আছে। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সতেরোটি উপাদানের সমন্বয়ে জীবের সূক্ষ্মশরীর নির্মিত। তবে এই তিনরকম শরীরই মায়ার সৃষ্টি। শরীরমাত্রই নশ্বর অর্থাৎ, চিরকাল থাকে না।
ঈশ্বর ও জীবের প্রভেদ
ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন  অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বব‍্যাপক। কিন্তু তিনি জীব হতে পৃথক।এই বিষয়ে বেদ ও উপনিষদ এর প্রমাণ-

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখাযা সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তযোরন‍্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত‍্যনশ্নন্নন‍্যো অভি চাকশীতি।। ঋকবেদ-1.164.20
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্-4/6

অর্থ-(দ্বা) ব্রহ্ম বা ঈশ্বর উভয়ে,(সুপর্ণা)চেতনা ইত‍্যাদি একইরকম গুণবিশিষ্ট,(সযুজা) ঈশ্বর সর্বব‍্যাপক বলে জীবের সাথে সবসময় সংযুক্ত,(সখাযা) ঈশ্বর ও জীব পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ,(সমানং) ঈশ্বর ও জীব উভয়ে সনাতন ও অনাদি,(বৃক্ষম) অনাদি প্রকৃতিরূপ বৃক্ষ বা গাছ অর্থাৎ এই জগৎ- সংসারে, ঈশ্বর ও জীব উভয়ে বসবাস করে,(তযোরন‍্যঃ)এই জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে, জীব ‌এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পুণ‍্যরূপ ফলসমূহ(স্বাদ্বত্তি) উত্তমরূপে ভোগ করে,আর ঈশ্বর,কর্মফল (অনশ্নন্)ভোগ না করে চারদিকে অর্থাৎ অন্তর ও বাইরে সর্বত্র প্রকাশিত হয়ে আছেন। ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি ভিন্নধর্মী ও অনাদি।

শাশ্বতীভ‍্যঃ সমাভ‍্যঃ- যজুর্বেদ-40/8
অর্থ-জীব হল অনাদি ও সনাতন।

অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং,বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং স্বরূপা।
আজো হ‍্যেকো জুযমাণোহনুশেতে, জহাত‍্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন‍্যঃ।। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/5

অর্থ-প্রকৃতি,জীবাত্না এবং পরমাত্মা এই তিন অজ অর্থাৎ ইহাদের জন্ম হয় না ও চিরকাল বর্তমান।অনাদি জীব এই অনাদি প্রকৃতিকে,ভোগ করতে আসক্ত হয়।কিন্তু পরমাত্মা ইহাতে আসক্ত হন না এবং ভোগও করেন না।

অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্ আত্নাস‍্য জন্তোরনিহিতো গুহায়াম।
তমক্রতুঃ পশ‍্যতি বীতশোকো ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্ননঃ।। কঠ উপনিষদ-1/2/20

অর্থ-পরমাত্না ও জীবাত্মা উভয়েই জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত।যিনি সব রকম জড় বাসনা ও শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন,তিনিই কেবল ভগবৎ কৃপায় আত্নার মহিমা বুঝতে পারেন।

সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ‍্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ‍্যত‍্যন‍্যমীশমস‍্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
মুন্ডক উপনিষদ-3/1/2
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/7

অর্থ-দুটি পাখি(জীবাত্মা ও পরমাত্মা)একই গাছে(প্রকৃতি বা সংসাররূপ বৃক্ষ) বসে আছে,কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত,সে,গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা দুঃখ ভোগ করছে। কিন্তু সে যদি (জীবাত্মা) একবার তার নিত‍্যকালের বন্ধু,অপর পাখিটির(পরমাত্মা)দিকে  ফিরে তাকায়(যোগযুক্ত হয়)তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়।

সুতরাং ইহাতে প্রমাণিত হয় যে,জীবাত্মা, পরমাত্মা ও প্রকৃতি হল অনাদি বা নিত‍্য।পরমাত্মা জীবাত্মা কে পাপ-পুণ‍্যের ফল হেতু শরীর ধারণ করিয়ে স্বয়ং সেই শরীরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকেন,কারণ তিনি সর্বব‍্যাপক। তাই জীব ব্রহ্ম হতে পারে না এবং মুক্তিতেও জীব ব্রহ্মতে লীন হয় না।


জীবত্বের উৎপত্তি :
শঙ্করাচার্যের মতে, জীব হলো আত্মা ও অনাত্মার সংমিশ্রণ। শুদ্ধ আত্মায় অনাত্মার অধ্যাসের ফলে অর্থাৎ, যখন আত্মার উপর অনাত্মা আরোপিত হয়, তখনই শুদ্ধ চৈতন্য বা আত্মা সাক্ষী-চৈতন্য জীবে পরিণত হয়। শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহংকার প্রভৃতি হলো অনাত্মা। সাক্ষী-চৈতন্য অন্তঃকরণের (মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টি হলো অন্তঃকরণ) সঙ্গে যুক্ত হলে ভ্রান্তিবশত যখন আত্মা-অনাত্মার অভেদ বোধ হয়, তখনই অহং-রূপ জীবত্বের সৃষ্টি হয়। যেমন আমরা বলি- ‘আমি রোগা’ বা ‘আমি মোটা’ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আত্মা এবং শরীরের অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আবার যখন বলি- ‘আমি অন্ধ’ বা ‘আমি খোঁড়া’, তখন আত্মার সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রিয় বা কর্মেন্দ্রিয়ের অভেদ বোধ থাকে। তেমনি যখন বলি- ‘আমি সুখী’ বা ‘আমি দুঃখী’, তখন আত্মা ও মানসিক অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আত্মার উপর অনাত্মার অধ্যাস বা আরোপের ফলেই জীব দুঃখ ভোগ করে। আত্মা বা ব্রহ্ম কিন্তু স্বরূপত রোগা, মোটা, অন্ধ, খোঁড়া, সুখী, দুঃখী- এসব কিছুই নয়। চৈতন্য মায়ার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা উপহিত হলেই এইরকম অভেদ বোধ জন্মায়। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অহংকারের দ্বারা সীমিত বা অবচ্ছিন্ন আত্মা প্রকৃত বা শুদ্ধ আত্মা নয়। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বর, জীব ও জাগতিক বিষয় সবই মিথ্যা, ব্রহ্মের বিক্ষেপমাত্র। এ প্রেক্ষিতে অদ্বৈতবেদান্তের আধুনিক প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ’র বাণীতেও উক্ত হয়েছে-
‘অদ্বৈতবাদীদের কাছে জীবাত্মার কোন স্থান নেই। তাহাদের মতে জীবাত্মা মায়ার সৃষ্টি; আসলে জীবাত্মার কোন (পৃথক) অস্তিত্ব থাকিতে পারে না।’– (স্বামীজীর বাণী ও রচনা ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৭)
অদ্বৈতমতে অবিদ্যাপ্রসূত, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। শঙ্করের ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, এবং বিভিন্ন শ্রুতিতে জীবাত্মার উৎপত্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাই অদ্বৈতমতেও জীবাত্মা অবিনাশী। বেদান্তসূত্রকার বাদরায়ণও বলেছেন-

‘নাত্মা, অশ্রুতেঃ নিত্যত্বাৎ চ তাভ্যঃ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)
ভাবার্থ : জীবাত্মা উৎপন্ন হন এ কথা শ্রুতি বলেন নি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন।

জীবের স্বরূপ-উপলব্ধি :
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে উপলব্ধ বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনার মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী জীব ও ব্রহ্মের এই অভিন্নতাকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি- এই তিনটি ভিন্ন অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। জাগ্রত অবস্থায় জীবের ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ প্রভৃতি সক্রিয় থাকে। তাই এই অবস্থায় আমরা যতক্ষণ জাগ্রত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের স্থূলশরীর, ইন্দ্রিয়, মন প্রভৃতির সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা বোধ করি এবং নানা বিষয়কে জানি। জাগ্রত অবস্থায় যেমন বিষয়ী ও বিষয়ের (অর্থাৎ, জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের) ভেদ থাকে, তেমনি স্বপ্নেও জ্ঞান ও তার বিষয়ের মধ্যে ভেদের বোধ থাকে। স্বপ্নাবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু অন্তঃকরণ সক্রিয় থাকে বলে জাগ্রত অবস্থার অনুভবের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্নাবস্থায় জীব বিষয়কে জানে। এই অবস্থায় জীবের জ্ঞান অনুভবের সংস্কারের দ্বারা সীমিত। সুষুপ্তিতে ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ নিষ্ক্রিয় থাকে। তাই সুষুপ্তিকালে অর্থাৎ, স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার সময় কোন বিষয়ের ধারণা থাকে না। ফলে সুষুপ্তির সময় আমরা জ্ঞাতা হই না। তখন বিষয়ী ও বিষয়ের, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে ভেদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয় এবং শরীর, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা সীমিত হবার কোন বোধ থাকে না। কিন্তু তখনও চৈতন্য থাকে। যদি চৈতন্য না থাকতো, তবে সুষুপ্তির থেকে জেগে আমরা কখনোই বলতে পারতাম না যে, গভীর নিদ্রা হয়েছিলো। এ অবস্থা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘পুংস্ত্বাদিবৎ ত্বস্য সতঃ অভিব্যক্তিযোগাৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)
ভাবার্থ : পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

আত্মা স্বরূপত কেমন, তা সুষুপ্তির অবস্থাটি বিশ্লেষণ করলে আংশিক পরিচয় পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। তখন আত্মা সীমিত এবং দুঃখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট নয়। আত্মা তখন সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। এই অবস্থায় আমরা আত্মার অনন্দজ্ঞান, বিষয়হীনতা, আনন্দস্বরূপতা উপলব্ধি করি। কিন্তু এই উপলব্ধি ক্ষণিকের জন্য। জাগ্রত হবার পর জীব আবার ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ-সংশ্লিষ্ট হয়ে জগৎভ্রমে পতিত হয়।
শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম শরীর ও অন্তঃকরণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জীবে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্তা আছে এবং জীবের ব্যবহারিক সত্তা আছে। অবিদ্যা-সংশ্লিষ্ট আত্মাই জীব। তত্ত্বজ্ঞান লাভের দ্বারা অবিদ্যা দূরীভূত হলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ লোপ পায় এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন- এই উপলব্ধি হয়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ :
পারমার্থিক দিক থেকে যদিও জীব ব্রহ্মস্বরূপ, তবুও ব্যবহারিক দিক থেকে জীব ব্রহ্ম-ভিন্ন। এ বিষয়ে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘অংশো নানাব্যপদেশাৎ, অন্যতা চ অপি দাশকিতবাদিত্বম্ অধীয়ত একে’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৩)
ভাবার্থ : জীব পরমাত্মার অংশ, কারণ শ্রুতিও জীব এবং ব্রহ্মের ভেদ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; আবার অভেদও উপদেশ করেছেন। অতএব জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয়।

অদ্বৈতমতে, অবিদ্যা-উপহিত ব্রহ্মই জীব। এই অবস্থায় জীব ব্রহ্মস্বরূপতা বিস্মৃত হয়। জীব তাই ব্রহ্মের সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই। অদ্বৈতবেদান্তী একদিকে যেমন জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা দেখিয়েছেন, তেমনি অপরদিকে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা দেখিয়েছেন। তবে এই ব্যবহারিক ভিন্নতা ব্যাখ্যায় অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। বেদান্তসূত্রের যে সূত্রটিকে কেন্দ্র করে ঐ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিলো, সেটি হলো-

‘আভাস এব চ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০)
ভাবার্থ : এবং জীব পরমাত্মার একটি আভাস বা প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই জীবের সুখ-দুঃখ পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।

জীব ও ব্রহ্মের আপাত ভেদ-
এই সূত্রকে কেন্দ্র করে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা সম্পর্কে বিভিন্ন অদ্বৈতবেদান্তী বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাগুলি প্রধানত তিনটি মতবাদ সৃষ্টি করেছে। মতবাদ তিনটি হলো- অবচ্ছেদবাদ, প্রতিবিম্ববাদ এবং আভাসবাদ।

অবচ্ছেদবাদ : অবচ্ছেদবাদ অনুযায়ী স্বরূপত অভিন্ন বস্তু অবচ্ছেদভেদে ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হয়। যেমন আকাশকে ঘর ইত্যাদির দ্বারা সীমিত বোধ হয়, তেমনি এক ও অদ্বয় সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মও বিভিন্ন অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে প্রতিভাত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকাশ যেমন বিভিন্ন কক্ষের দ্বারা সীমিত হয় না, তেমনি ব্রহ্মও বুদ্ধির দ্বারা সীমিত হয় না। অন্তঃকরণ অবিদ্যাজন্য। অবিদ্যা দূর হলে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম অবচ্ছেদমুক্ত হয়ে একক সৎরূপে উপলব্ধ হয়।

প্রতিবিম্ববাদ : আয়নার মতো স্বচ্ছ পদার্থে বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়। বিভিন্ন স্বচ্ছ পদার্থে একই বস্তুর বিভিন্ন প্রতিবিম্ব পড়ে। সূর্য বিভিন্ন জলাশয়ে প্রতিবিম্বিত হয়, কিন্তু জলাশয়ের প্রকৃতির দ্বারা সূর্য প্রভাবিত হয় না। তেমনি একই ব্রহ্ম ভিন্ন ভিন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে আবির্ভূত হয়। ব্রহ্ম বিম্ব, জীব তার প্রতিবিম্ব। বিম্ব ও প্রতিবিম্বের ব্যবহারিক ভিন্নতা সর্বজনসিদ্ধ। প্রতিবিম্বের কারণ দূর হলে কেবল বিম্বই অবশিষ্ট থাকে।
প্রতিবিম্ববাদের সমর্থকদের মধ্যে নৃসিংহাশ্রম ও তাঁর অনুগামী বিবরণ-সম্প্রদায়ের অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বররূপে প্রতীয়মান হন। আবার ব্রহ্ম অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত হলে জীবের সৃষ্টি হয়।

আভাসবাদ : বস্তুর আপাত প্রতীয়মান রূপকে বলা হয় আভাস। আভাস মিথ্যা হলেও বস্তু থেকে তার ভিন্ন ব্যবহার স্বীকৃত। প্রতিবিম্ব বিম্বের আভাস। জীব ব্রহ্মের আভাস। আভাসের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যা দূর হলে আভাসের ভিন্ন অস্তিত্ব থাকে না। আভাসবাদ বস্তুত প্রতিবিম্ববাদেরই নামান্তর। এই কারণে আভাসবাদ ও প্রতিবিম্ববাদকে একই মতবাদ রূপেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই মতের সমর্থকরা যেমন সর্বজ্ঞাত্মমুনি প্রভৃতি প্রতিবিম্ববাদ সমর্থকদের মতো মায়া ও অবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য করেননি। তাঁরা বলেছেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা উৎপন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হলে জীব উৎপন্ন হয়।

বস্তুত প্রতিবিম্ববাদ এবং অবচ্ছেদবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অদ্বৈতবেদান্তের মূল বক্তব্য হলো জীব এবং ব্রহ্ম এক। জীব এবং ব্রহ্ম যে এক তা জীব বদ্ধ অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারে না। মোক্ষই হলো সেই অভেদের উপলব্ধি। অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ঐ অভেদের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো। প্রতিবিম্ববাদের সমর্থক দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন যে, ব্রহ্ম ও জীবের অভেদের উপলব্ধিই মোক্ষ। তাঁদের মতে বস্তু ও তার প্রতিবিম্ব এক। কিন্তু অবচ্ছেদবাদের সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিবিম্বের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন করলে মোক্ষলাভ হয়। যেমন রজ্জুতে সর্পের প্রত্যক্ষ ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞান হয়, তেমনি ব্রহ্মে অহং এর আরোপ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলেই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। অর্থাৎ, ‘আমিত্ব’ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রতিপন্ন হলে ব্রহ্মোপলব্ধি বা মোক্ষলাভ হয়।

জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভেদ-
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্মে বস্তুত কোন ভেদ নেই, অর্থাৎ, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তবুও আমরা যে জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সম্পূর্ণই অবিদ্যাবশত ব্যবহারিক ভেদের কল্পনা করি, বেদান্তের সূত্রগ্রন্থ বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণ তাই বলেছেন-

‘স্থানবিশেষাৎ, প্রকাশাদিবৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৪)
ভাবার্থ : স্থান এবং পাত্রের দ্বারা আলোক আকাশ যেমন সীমিত হয়, তেমনি নিরাকার অসীম ব্রহ্মও উপাধিহেতু রূপবান বলে কল্পিত হন।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপনিষদের জীব ও ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদক উপদেশ উদ্ধৃত করে অদ্বৈতবেদান্তীরা জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন উপনিষদে জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। অদ্বৈত-বেদান্তীদের মতে, সকল সাধনার সিদ্ধি ও সকল উপদেশের সারস্বরূপ বিভিন্ন উপনিষদে চারটি মহাবাক্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চারটি মহাবাক্য হলো-
(১) তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ, তুমিই সেই– (ছান্দোগ্য উপনিষদ), (২) অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ), (৩) প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম– (ঐতরেয় উপনিষদ), (৪) অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, আত্মাই ব্রহ্ম– (মাণ্ডুক্য উপনিষদ)।

অহং ব্রহ্মাস্মি
(অহম্) আমি (ব্রহ্ম) অর্থাৎ ব্রহ্মস্ত (অস্মি) আছি। জীব ব্রহ্মের সহচারী, জীব এবং ব্রহ্ম এক নয়। যেমন অনেকে বলে "আমি ও এই ব্যক্তি এক" অর্থাৎ অবিরোধী, সেরূপ যিনি সমাধিস্থ অবস্থায় পরমেশ্বরের প্রেমে বদ্ধ হয়ে তাহাতে নিমগ্ন তাকেন, তিনি বলিতে পারেন, "আমি এবং ব্রহ্ম এক অর্থাৎ অবিরোধী, অর্থাৎ এক অবকাশস্থ"। যিনি পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম্ম-স্বভাবানুযায়ী নিজের গুণ-কর্ম্ম-স্বভাব গঠন করেন, তিনি সাধর্ম্ম্য বশতঃ ব্রহ্মের সহিত এক বলিতে পারেন।

যেসব শ্রুতিতে এই চারটি মহাবাক্যের আবির্ভাব হয়েছে, সেই শ্রুতিগুলো হলো-

(১)
‘স যথা তত্র ন অদাহ্যেত ঐতদাত্ম্যম্ ইদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি তৎ হ অস্য বিজজ্ঞৌ ইতি বিজজ্ঞাবিতি।’- (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৬/১৬/৩)
অর্থাৎ : (সত্যনিষ্ঠার জন্য) সেই ব্যক্তি তপ্ত কুঠার দ্বারা দগ্ধ হয় না। এই সৎ বস্তুই সব কিছুর আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, ‘তত্ত্বমসি’- তুমিই সেই (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।
(২)
‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ, তৎ আত্মানম্ এবাবেৎ- অহং ব্রহ্মাস্মি ইতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ। তদ্ যো যো দেবানাম্ প্রত্যবুধ্যত স এব তৎ অভবৎ। তথা ঋষীণাং তথা মনুষ্যাণাং, তদ্ধৈতৎ পশ্যন্ ঋষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবৎ সূর্যশ্চেতি। তৎ ইদমপি এতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি…।’- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১/৪/১০)
অর্থাৎ : এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো। ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- আমিই ব্রহ্ম, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্মসদৃশ বলে জেনেছিলেন তিনিও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। এই একইভাবে ঋষি এবং মানুষদের মধ্যেও যাঁরা নিজেকেই ব্রহ্ম বলে জানতে পেরেছিলেন, তাঁরাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিতভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তাঁর আত্মা তখন সর্বব্যাপী (বৃহদারণ্যক-১/৪/১০)।
(৩)
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- … সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।’- (ঐতরেয় উপনিষদ-৩/৩)
অর্থাৎ : সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত।… প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞানই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সবকিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সবকিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনি এক অখণ্ড সত্তা, অদ্বিতীয় (ঐতরেয়-৩/৩)।
(৪)
‘সর্বম্ হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, সোহয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।’- (মাণ্ডুক্য উপনিষদ-২)
অর্থাৎ : তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবাই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ বা (জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, তূরীয়) অবস্থা জীবদেহে থেকে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ (মাণ্ডুক্য-২)।


‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ও ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’- এই চারটি মহাবাক্য বস্তুত চতুর্বেদের প্রধান বাক্য। ‘তত্ত্বমসি’ সামবেদের, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ যজুর্বেদের, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ঋগ্বেদের এবং ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অথর্ববেদের প্রধানবাক্য। চারটি মহাবাক্যেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। এই মহাবাক্য চতুষ্টয়ের তাৎপর্যের মধ্যেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদপ্রতিপাদক প্রামাণ্য রয়েছে বলে অদ্বৈতবেদান্তীরা ঘোষণা করেন।

মহাবাক্যের তাৎপর্য-
এক্ষেত্রে অদ্বৈতবেদান্তীরা কিভাবে অভেদপ্রতিপাদক ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের তাৎপর্য পরিস্ফুট করেছেন, তা সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে।
‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের বাক্যাংশগুলি হলো- ‘তৎ ত্বং অসি’। ‘তৎ’ মানে ‘সেই’, ‘ত্বং’ মানে ‘এই’। মহাবাক্যটিতে উক্ত ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা ‘সেই’ নির্গুণ ব্রহ্ম এবং ‘ত্বং’ শব্দের দ্বারা ‘এই’ জীবাত্মাকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভিন্নতা তিনভাবে দেখানো যেতে পারে- সামানাধিকরণ্য, বিশেষ্য-বিশেষণভাব ও লক্ষ্যলক্ষণভাব সম্বন্ধ বা লক্ষণার দ্বারা।

সামানাধিকরণ্য : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটি একই অধিকরণের অভিন্নবাচক শব্দ হিসেবে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘এই সেই দেবদত্ত’- এই বাক্যের অন্তর্গত ‘এই’ শব্দ ও ‘সেই’ শব্দ দুটি ভিন্নার্থবোধক হয়েও যেমন একই অধিকরণ দেবদত্তকে নির্দেশ করে, তেমনি ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও একই পদার্থ ব্রহ্ম বা শুদ্ধচৈতন্যকে নির্দেশ করে।

বিশেষ্য-বিশেষণভাব : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটিকে বিশেষ্য-বিশেষণভাবে গ্রহণ করেও তাদের অভিন্নতা দেখানো যায়। যেমন, ‘শ্বেতপদ্মে’র জ্ঞানে ‘শ্বেত’ শব্দটি বিশেষণবোধক এবং ‘পদ্ম’ শব্দটি বিশেষ্যবোধক। ‘শ্বেত’ ও ‘পদ্ম’ পদদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও বস্তুত এই পদদ্বয় একটি পদার্থকেই নির্দেশ করে। পদ্ম নানা রকম রঙের হতে পারে, কিন্তু শ্বেতপদ্ম একই রকম। সেইরূপ ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ পরস্পর পরস্পরের বিশেষ্য-বিশেষণ রূপে এক ও অদ্বয় অখণ্ড চৈতন্যের প্রকাশক, এবং তিনিই ব্রহ্ম।

লক্ষণা : বাক্যের মুখ্য অর্থকে পরিত্যাগ না করে কিংবা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে তাৎপর্য অনুধাবন-পূর্বক গৌণ অর্থ গ্রহণকে বলে লক্ষণা। লক্ষণা তিনপ্রকার- জহৎ, অজহৎ ও জহদজহৎ। জহৎ-লক্ষণায় মুখ্য অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা হয়। অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে অন্য অর্থ যুক্ত করা হয়। আর জহদজহৎ অর্থাৎ জহৎ-অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থের আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণ করা হয়।
এক্ষেত্রে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারা ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভেদ প্রতিপাদন করা হয়। ‘তৎ’ পরোক্ষ চৈতন্য, কিন্তু ‘ত্বং’ অপরোক্ষ চৈতন্য। পরোক্ষত্ব ও অপরোক্ষত্ব পরস্পর বিরুদ্ধ। কিন্তু চৈতন্যাংশে উভয়ে অবিরুদ্ধ। বিরুদ্ধাংশ পরিত্যাগ করে অবিরুদ্ধাংশে উভয়ের ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। চৈতন্যাংশে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর কোন বিরোধ নেই। এই অবিরুদ্ধ চৈতন্যাংশই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য।

অদ্বৈতবেদান্তীরা সামানাধিকরণ্য ও বিশেষ্য-বিশেষণভাব পরিত্যাগ করে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্যকে গ্রহণ করেছেন। অপর তিনটি মহাবাক্যও অনুরূপভাবে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করে। এই জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার ভেদাভেদ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘তুমি যখন নিজেকে দেহমাত্র বলিয়া ভাব তখন তুমি বিশ্বজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন; নিজেকে যখন জীব বলিয়া ভাব, তখন তুমি সেই শাশ্বত মহান জ্যোতির একটি কণিকামাত্র, আর যখন নিজেকে আত্মা বলিয়া ভাব, তখন তুমিই সবকিছু।

জীব এক না বহু ?
জীব এক না বহু, অদ্বৈতবেদান্তীদের কাছে এই প্রশ্নটি অন্যন্ত জটিল বলে মনে হয়। এদের কেউ কেউ বলেন যে অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। অন্তঃকরণে যেহেতু এক নয় বহু, তাই জীবও এক নয়, বহু। এই সম্প্রদায় অনেকজীববাদী নামে পরিচিত। আবার অন্য অদ্বৈতবৈদান্তিকদের মতে অজ্ঞানে বা মায়ায় প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। মায়া যেহেতু এক, সেহেতু জীবও এক। এই সম্প্রদায়কে একজীববাদী বলা হয়।

অনেকজীববাদীদের বক্তব্য হলো, যদি জীব এক হয় তাহলে একটি জীবের মুক্তি হলে সমস্ত জীবেরই মুক্তি হবে। কিন্তু সমস্ত জীবের কখনোই একসঙ্গে মুক্তি হয় না। সুতরাং, একজীববাদ গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, একজীববাদ স্বীকার করলে বলতে হবে যে, এক জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে একটি জীবের সুখদুঃখবোধ হলেই সকলেরই সুখদুঃখবোধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। একজনের সুখে সর্বদা অন্যজনের সুখ উৎপন্ন হয় না। আবার একজনের দুঃখও অন্যের দুঃখ নয়।
কিন্তু অনেকজীববাদীদের বিরুদ্ধে একজীববাদীদের বক্তব্য হলো, অনেক জীব স্বীকার করলে সৃষ্টি ও প্রলয়ের ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ প্রলয়ের সময় অন্তঃকরণগুলি তাদের উপাদান কারণে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তার ফলে সমস্ত জীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই বক্তব্যের উত্তরে অনেকজীববাদীরা বলেন যে, প্রলয়কালে অন্তঃকরণগুলি বিলীন হয়ে গেলেও তাদের সংস্কারগুলি যেহেতু থেকে যায়, সেহেতু সমস্ত জীবের ধ্বংসের আপত্তি হয় না।

একজীববাদীরা বলেন, বিভিন্ন মানুষের সুখদুঃখ ভোগের অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণ হলো অন্তঃকরণগুলির পার্থক্য। অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মের বহু অন্তঃকরণ। এই কারণে একই জীবের অন্তঃকরণ বহু।
প্রত্তোত্তরে বলা হয়, বস্তুত একজীববাদকে সত্য গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হবে যে অন্যান্য জীবের অস্তিত্বের জ্ঞান ভ্রান্ত, যেহেতু একটিমাত্র জীবেরই অস্তিত্ব আছে। যেমন এক ব্যক্তি স্বপ্নে নানা বিষয় ও প্রাণী প্রত্যক্ষ করে, তেমনি এক জীব অন্যান্য ব্যক্তি ও বিষয়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের বিষয়ের মতোই অন্যান্য জীবের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এই মতে ‘তুমি’ ও ‘সে’ হলো প্রকৃত আমির বিভিন্ন প্রতিভাসমাত্র।
অদ্বৈতমতে জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ হলেও অনাদি অবিদ্যাবশত অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয় এবং দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধ করে। জীবের এই ব্রহ্মস্বরূপত্ব বিস্মরণ ও দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে জীবের ‘অহং বোধ’ জন্মায়। জীব তখন নিজেকে সকল বস্তু থেকে পৃথক করে ক্ষুদ্র, পরিচ্ছিন্ন, সসীম সত্তার অধিকারী হয়। এই পরিচ্ছিন্ন জীবই বদ্ধ জীব। বদ্ধ জীব নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
বিদ্যার দ্বারা জীব যখন অবিদ্যাজনিত ভেদজ্ঞান দূর করে এবং দেহাদিসম্বন্ধ ছিন্ন করে, তখন সে নিজেকে ব্রহ্ম-অভিন্ন বলে জানে। নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানাকেই জীবের মুক্তি বলা হয়। অদ্বৈতমতে তাই জীবের বন্ধন ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে- আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি।

বিভিন্ন বেদান্তশাস্ত্রে নানা কাহিনীর মাধ্যমে জীবাত্মার এই দুই অবস্থা তথা আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি এরকম-
এক গর্ভবতী সিংহী একদল মেষশাবককে তাড়া করে পাহাড় থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ায় তার মৃত্যু হলো। কিন্তু ঐ সিংহীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলো এক সিংহশাবক। সিংহশাবক নিরুপায় হয়ে মেষশাবকদের দলে আশ্রয় নিলো এবং দিনে দিনে মেষশাবকদের অনুসরণে তার প্রকৃতিও মেষশাবকদের অনুরূপ হয়ে ঊঠলো। সিংহের হুংকার ভুলে তখন সে মেষশাবকদের মতো করে ডাকতে শিখলো। এ যেন জীবের আত্ম-বিস্মরণ ও বন্ধন-দশা প্রাপ্তি। পরবর্তীকালে অন্য এক সিংহ মেষশাবক শিকার করতে এসে এই সিংহশাবককে আবিষ্কার করলো। অন্যান্য মেষশাবকদের মতো সিংহশাবকও তখন সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণভয়ে পলায়মান। সিংহ সেই সিংহশাবককে ধরে তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝিয়ে দিলো। কয়েকবার চেষ্টার পর সিংহের অনুকরণে সিংহশাবকও তখন হুংকার দিয়ে উঠলো। এ যেনো গুরুর কাছ থেকে ‘তত্ত্বমসি’ বাক্য শ্রবণান্তর মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা জীবের আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধি। আত্মসাক্ষাৎকার জীবের পরম পুরুষার্থ। আত্মসাক্ষাৎকারেরই অপর নাম ব্রহ্মোপলব্ধি। তাই বেদ-বেদান্তে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ, আত্মা বা নিজেকে জানো।

উপনিষদানুসারী দর্শন হিসেবে অদ্বৈতমতানুযায়ী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই জীবের বন্ধনদশা দূর হয় এবং জীব মোক্ষলাভ করে। এজন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনকেই মোক্ষলাভের উপায় বলা হয়। যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রেই এই উপদেশ উক্ত হয়েছে-

‘…আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতাব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো মৈত্রেয়ী, আত্মনো বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।।
অর্থাৎ : মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে। অমৃতের মধুমাখা অনুভূতি নিয়ে অখণ্ড-সত্তায় তার প্রাণ ভরে উঠবে। আত্মজ্ঞান যার হয়, সবকিছুর সঙ্গে যে একাত্ম হতে পারে, তার কাছ থেকে কি অমৃত দূরে থাকতে পারে (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫) ?

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বেদান্তমতে বলা হয়ে থাকে, একমাত্র বেদান্তপাঠের অধিকারীই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের অধিকারী। তাই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের পূর্বে জীবকে বেদান্তপাঠের অধিকার অর্জন ও তার জন্য তৎকারণ বিধিপূর্বক বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন, জন্ম ও জন্মান্তরে কাম্যকর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধকর্ম পরিত্যাগ এবং কেবলমাত্র নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্ত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়াও বেদান্তের অধিকারীকে বিবেক, বৈরাগ্য, শমদমাদি ও মুমুক্ষুত্ব- এই সাধন-চতুষ্টয় অর্জন করতে হবে। এই সাধন-চতুষ্টয়-সমন্বিত ব্যক্তিই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের নিকট বেদান্তপাঠের অধিকারী। বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকরা এই যে পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, তার পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবদ্ধ’।

বেদান্তের অনুবন্ধ :
বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’।

‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রের আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত।
যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত থাকা আবশ্যক।

অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করতে হবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধনসম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।

‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।

এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।

বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।

সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।

প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।

মোক্ষ বা মুক্তির উপায় :
শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বেদান্ত-পাঠেরই ত্রি-অঙ্গ। প্রথমে আচার্যের নিকট বেদান্তপাঠ শ্রবণ, তারপর যুক্তি ও তর্কের দ্বারা আচার্যের উপদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপাদন বা মনন এবং পরিশেষে আচার্য-উপদিষ্ট তত্ত্বের নিরন্তর ধ্যান বা নিদিধ্যাসনের দ্বারা মোক্ষকামী ব্যক্তির অবিদ্যাজন্য মিথ্যাজ্ঞান বিনষ্ট হয় এবং ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি বা ব্রহ্মস্বরূপতার উপলব্ধি হয়। জীবের এই আত্মোপলব্দিই মোক্ষলাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি। অদ্বৈতমতে মোক্ষলাভ তাই জীবের পক্ষে নতুন কোন প্রাপ্তি-যোগ নয়। এ যেন নিজের হাতের মুঠোয় চাবিকাঠি রেখে সারা ঘরে চাবির অনুসন্ধান এবং অবশেষে মুঠোর ভিতর চাবির আবিষ্কার। তাই মোক্ষপ্রাপ্তি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি।

অদ্বৈতমতে বলা হয়, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। এই অধ্যাসের ফলেই জীব দুঃখাদি-জর্জরিত বদ্ধজীবন ভোগ করে। ব্রহ্ম যখন সূক্ষ্ম-শরীর, স্থূল-শরীর, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সকল উপাধির দ্বারা উপহিত (সীমিত) হন, তখনই তাকে জীব বলা হয়। সুতরাং ব্রহ্মে বিভিন্ন উপাধি আরোপের ফলেই জীবের আবির্ভাব হয়। এই আরোপ আবার অবিদ্যা-জনিত। ব্যষ্টি-অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত আত্মা ঐ সকল উপাধি-উপহিত হয়। উপাধিই জীবের দেহ, বর্ণ, জাতি ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে। অসংখ্য অন্তঃকরণ-উপহিত হয়ে একই আত্মা বহু জীবে রূপান্তরিত হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টিকে বলা হয় অন্তঃকরণ। অন্তঃকরণের ভিন্নতার দ্বারাই জীবের ভিন্নতা নির্ণীত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন জীব ভিন্ন ভিন্ন কর্মফল ভোগ করে।

উপাধি উৎপত্তি-বিনাশশীল। মৃত্যুতে জীবের স্থূলশরীর বিনষ্ট হয়। মৃত্যুর পর জীবের লিঙ্গ-শরীর বা সূক্ষ্ম-শরীর কর্মানুযায়ী বিভিন্ন লোকে গমন করে এবং ঐ কর্মানুযায়ীই পুনরায় নতুন স্থূল শরীর পরিগ্রহ করে। এরই নাম ‘পুনর্জন্ম’। সূক্ষ্ম শরীরেও জীব অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে জীবের কর্মফলও স্থূল-শরীরান্তরে গমন করে। শ্রুতিশাস্ত্রেও বলা হয়েছে-

‘…যত্রাস্য পুরুষস্য মৃতস্য অগ্নিং বাগপ্যেতি, বাতং প্রাণঃ, চক্ষুরাদিত্যং, মনশ্চন্দ্রং, দিশঃ শ্রোত্রং, পৃথিবীং শরীরং, আকাশং আত্মা, ওষধীর্লোমিনি, বনস্পতীন, কেশা, অপ্সু লোহিতং চ রেতশ্চ নিধীয়তে ক্বায়ং তদা পুরুষো ভবতীতি?… তৌ হ যদুচতুঃ কর্ম হৈব তদুচরথ। যৎ প্রশশংসতুঃ কর্ম হৈব তৎ প্রশশংসতুঃ পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি, পাপঃ পাপেনেতি।…’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৩/২/১৩)।।
অর্থাৎ : …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন?
…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।

আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তর-এ গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-

‘তে যে এবমেতদ্ বিদুর্ষে চামী অরণ্যে শ্রদ্ধাং সত্যমুপাসতে তেহর্চিরভিসংভবন্তি অর্চিষোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্যান ষণ্মাসানূদঙ্ঙাদিত্য এতি মাসেভ্যো দেবলোকং দেবলোকদাদিত্যম্ আদিত্যাৎ বৈদ্যুতং, তান্ বৈদ্যুতান্ পুরুষো মানস এত্য ব্রহ্মলোকান্ গময়তি। তে তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতো বসন্তি। তেষাং ন পুনরাবৃত্তি’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/২/১৫)।।
অর্থাৎ : পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাঁকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।

অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারেও মোক্ষলাভে জীবের স্থূল-শরীরের নাশ হয় এবং জন্ম-প্রবাহ রুদ্ধ হয়। জীব তখন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে লীন হয়ে নিজেকে ব্রহ্ম বলে উপলব্ধি করে (সোহহম্)।

অদ্বৈতবেদান্তমতে মুক্তি দুই ধরনের- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। এই মতে, মুক্ত অবস্থাতেও জীবের দেহ থাকতে পারে। দেহ থাকাকালীন জীবের যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অন্যদিকে, দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। জীবন্মুক্তি সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ, সাংখ্য ও জৈন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমত হয়ে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন।
আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মোপলব্ধিতে জীবের মুক্তি হয়। মুক্তিলাভকালে জীবের সঞ্চিত কর্মফল শেষ হয়ে যায়। মুক্তজীব বাসনাহীন। সুতরাং তার কর্মজন্য কোন নতুন ফলোৎপত্তির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তার প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ নাও হতে পারে। প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ না হলে সেই ফলভোগ শেষ করার জন্য মুক্ত পুরুষকে আরও কিছুকাল দেহ ধারণ করে থাকতে হয়। জীবের এইপ্রকার মুক্তিকে বলা হয় জীবন্মুক্তি।

জীবন্মুক্ত পুরুষকে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে হলেও তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি আর থাকে না। বরং সংসারের মায়ায় তিনি আর আবদ্ধ হন না। তিনি অনাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে জীবনযাপন করেন এবং বদ্ধজীবের হিতার্থে নিষ্কাম কর্ম করেন। মুক্তপুরুষের কাছে কর্মের সৎ-অসৎ বা পাপ-পুণ্যের ভেদ থাকে না। রাগ-দ্বেষ থেকেই অসৎ বা পাপকর্মের উৎপত্তি হয়। মুক্ত পুরুষ রাগ-দ্বেষহীন। তাই মুক্ত পুরুষের পক্ষে কোন অসৎ বা পাপকর্ম করার প্রশ্নই নেই। প্রারব্ধ কর্মফল নিঃশেষিত হলে মুক্ত পুরুষের স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুরুষ বিদেহমুক্তি লাভ করে।

অদ্বৈতমতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপ হলো ব্রহ্মসাযুজ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হয়ে যাওয়া। উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, ‘আমিই ব্রহ্ম’ এই উপলব্ধির সাথে লীন হয়ে যাওয়া। এটাই জীবন্মুক্ত অবস্থা। কিন্তু বেদান্তের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ অবশ্য জীবের জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন নি। তিনি বিদেহমুক্তির সমর্থক। তাঁর কাছে মুক্তির অর্থ ব্রহ্মস্বারূপ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সদৃশ হওয়া। ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হওয়া নয়।
অদ্বৈত-বেদান্ত মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হলো মায়াবাদ। তবে মায়াবাদ একটি প্রাচীনতম ধারণা। বেদ এবং উপনিষদের মধ্যেই প্রথম মায়াবাদের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। ঋগ্বেদে দুটি অর্থে ‘মায়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘প্রথমত, যে শক্তি বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করতে পারে তা-ই মায়া। দ্বিতীয়ত, যে শক্তি সত্যকে আবৃত করে রাখে তা-ই মায়া।’- (নীলিমা মণ্ডল, ভারতীয় দর্শন পরিচয়, পৃষ্ঠা-১৮৯)। আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরের মায়াশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি হয়েছে।  যেমন-

‘য একো জালবান্ ঈশত ঈশনীভিঃ সর্বান্ লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।
ঐ এবৈক উদ্ভবে সম্ভবে চ য এতৎ বিদুঃ অমৃতাস্তে ভবন্তি’।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)
‘ছন্দাংসি যজ্ঞাঃ ক্রতবো ব্রতানি ভূতং ভব্যং যচ্চ বেদা বদন্তি।
অস্মান্ মায়ী সৃজতে বিশ্বমেতৎ অস্মিন্ চ অন্যো মায়য়া সন্নিরুদ্ধঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)
‘মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্য অবয়বভূতৈঃ তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ :
সেই পরমাত্মা যিনি মায়াবী (জালবান), যিনি নিজের মায়াশক্তিতে সকল জগৎ শাসন করেন, সেই একই শক্তিতে যিনি এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি অথবা বিনাশের কারণ, তিনি অদ্বিতীয়। যাঁরা এই সত্য জানেন, তাঁরা অমর হন (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)।  চারটি বেদ, বৈদিক যাগযজ্ঞ, সবরকমের উপাসনা এবং ধর্মীয় সাধনা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ- সংক্ষেপে বেদে যা যা বলা হয়েছে তার সবকিছুই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিজের মায়াশক্তি দিয়ে ব্রহ্ম এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেন। আবার সেই একই শক্তির প্রভাবে জীবাত্মা মায়াময় জগৎ-সংসারে বাঁধা পড়ে (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)।  প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ (অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত) (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।

শঙ্করাচার্য ও তাঁর অনুগামী দার্শনিকরা বেদ এবং উপনিষদের এই মায়াবাদকে যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। অঘটন-ঘটনপটীয়সী যে শক্তি ব্রহ্মকে আবৃত করে তার উপর জগৎ-প্রপঞ্চকে আরোপ করে, অদ্বৈতবেদান্তে তাকে অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়া বলা হয়েছে। এই অবিদ্যা, অজ্ঞান বা মায়ার দ্বারা উপহিত হয়েই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম কল্যাণগুণাধার হয়ে সগুণ ঈশ্বর বা জগৎ-কারণ হন। মায়া নিজের ক্রিয়া ব্রহ্মে আরোপ করে বলেই মায়াকে ব্রহ্মের উপাধি বলা হয়েছে। মায়া-উপহিত এই চৈতন্যসত্তা জগৎপ্রপঞ্চের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ।

অদ্বৈতমতে উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আর সব কিছুই- এই বিচিত্র জগৎ মিথ্যা- শুধু আপাত প্রতীয়মান সত্তামাত্র। জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন, এক এবং অদ্বিতীয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে- সত্য যদি একই হন, তাহলে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা এই নানাত্ব অনুভব করি কেন ? সত্য তো অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এজন্যেই শঙ্কর সত্য এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে অদ্বৈতমতে আপাত বিরোধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, জগতের এই নানাত্ব হলো মায়া। যখনই আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান জন্মে তখনই নানাত্ব থাকে না- সুতরাং তার কোন সত্যতা নেই। অন্ধকারে রজ্জুতে সর্প দর্শনের ন্যায় তা একটি ভ্রম। অবিদ্যার জন্যেই এই ভ্রান্তি। এই অবিদ্যা অনাদি। এই অবিদ্যাই যাবতীয় নানাত্ব দর্শনের কারণ- এজন্যই ব্রহ্মকে জগৎ বলে ভ্রম হয়। এই অবিদ্যার কারণেই জীবাত্মা নিজেকে উপাধিযুক্ত অর্থাৎ দেহ, ইন্দ্রিয়াদি যুক্ত বলে মনে করে। উপাধিগুলি জীবের উপর আরোপিত মাত্র। উপাধির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যই জীব নিজেকে কর্তা ভোক্তা ইত্যাদি মনে করে। যদিও যথার্থত জীবাত্মার সঙ্গে উপাধির কোন সম্পর্কই নেই- তবু তা মায়াবলে সংসারাবদ্ধ হয়ে নিজেকে জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখাদির অধীন বলে মনে করে।

এখানে উল্লেখ্য, আচার্য শঙ্কর তাঁর শারীরকভাষ্যে যদিও ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ শব্দদ্বয়কে সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, তথাপি ভামতী সম্প্রদায়ের বাচস্পতিমিশ্রের মতো কোন কোন অদ্বৈতবেদান্তী এই শব্দদ্বয়ের পৃথক প্রয়োগ করেছেন। তাঁদের মতে জগৎ বিক্ষেপকারী, ঈশ্বরের উপাধি, সমষ্টিগত অজ্ঞান, মূলাবিদ্যাই হলো মায়া; আর জীবের উপাধি, আবরণকারী, ব্যক্তিগত অজ্ঞান, তুলাবিদ্যাই হলো অবিদ্যা। সে যাক্, এখন প্রশ্ন হলো- এই উপাধি বা মায়ার স্বরূপ কী ?

মায়ার স্বরূপ :
অদ্বৈতবেদান্তে মায়ার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘সদসদভ্যাম, অনির্বচনীয়ম্, ত্রিগুণাত্মকম্, জ্ঞানবিরোধী, ভাবরূপম্, যৎকিঞ্চিৎ’

সদসদভ্যাম : বেদান্তমতে ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোন সৎ বস্তু নেই। যা সৎ, তা নিত্য। অজ্ঞান পরমসত্তার জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়। কারণ, মায়া বা অজ্ঞান ব্রহ্মের মতো অবাধিত বা পারমার্থিক সত্তা নয়। সৎ বস্তু কখনো বাধিত বা বিনাশ হয় না। কিন্তু অজ্ঞান জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। যেমন রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। কিন্তু পরে আমরা জানি যে ঐ সর্প মিথ্যা। অতএব আমার অজ্ঞান ধ্বংস হয়। সুতরাং অজ্ঞানকে সৎ বলা যায় না।
আবার দৃশ্যমান জগতের বিক্ষেপক অজ্ঞানকে অসৎও বলা যায় না যেহেতু সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। অজ্ঞানের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব প্রমাণ। রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি অজ্ঞানের বিষয় প্রত্যক্ষীভূত ঘটনা। এইজন্য ঐ সর্পটি আকাশ-কুসুমের মতো সম্পূর্ণ অসৎ বা অলীক নয়। অলীক কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। আবার অজ্ঞানকে একইসঙ্গে সৎ ও অসৎ অর্থাৎ সদসৎও বলা যায় না। কারণ একই বস্তুতে সত্তা ও সত্তার অভাবরূপ পরস্পর বিরোধী ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না। সৎ ও অসৎ পরস্পর বিরুদ্ধ, এবং বিরুদ্ধভাবের অভিন্ন আশ্রয় অসম্ভব। তাই অজ্ঞান বা মায়াকে সদসৎও বলা যায় না।

অনির্বচনীয়ম্ : যেহেতু অজ্ঞান সৎ, অসৎ ও সদসৎ নয়, সেহেতু অদ্বৈতমতে অজ্ঞান সদসৎ ভিন্ন বা অনির্বচনীয়। যাকে সৎ, অসৎ ও সদসৎ- কোন রূপেই নির্দেশ করা যায় না, তা-ই অনির্বচনীয়। এই অর্থে কোন বস্তু হয় সৎ অথবা অসৎ হবে, এমন কোন কথা নেই। এমন বস্তুও থাকতে পারে, যা সৎও নয়, আবার অসৎও নয়। মায়া বা অজ্ঞান এরূপ সদসদবিলক্ষণ। সদসদবিলক্ষণকেই অদ্বৈতমতে অনির্বচনীয় বলা হয়। তাই বেদান্তসার গ্রন্থে মায়াকে বলা হয়েছে- 
‘সদসদভ্যাম অনির্বচনীয়ম্’। অর্থাৎ, মায়া সৎরূপে, অথবা অসৎরূপে অথবা সদসৎরূপে বচনীয় নয়।

ত্রিগুণাত্মকম্ : অদ্বৈতমতে মায়া হলো ত্রিগুণাত্মক। অর্থাৎ, সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিনটি গুণ দিয়ে মায়া গঠিত। যেহেতু মায়ার দ্বারা সৃষ্ট এই জগতের বস্তুগুলির মধ্যে সত্ত্ব, রজো এবং তমো গুণগুলি দেখা যায়, সেহেতু এই জগতের কারণ মায়াকে ত্রিগুণাত্মক বলা হয়েছে। সত্ত্ব প্রভৃতি গুণগুলির কার্য আমরা আমাদের সুখ, দুঃখ ও অবসাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করি। মায়া সম্পূর্ণরূপে অবোধ্য নয় যেহেতু মায়ার ত্রিগুণাত্মক ধর্মটি আছে। অজ্ঞানজন্য যাবতীয় পদার্থেই এই ত্রিবিধ গুণ পরিলক্ষিত হয়।

জ্ঞানবিরোধী : মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানবিরোধী। জ্ঞানের উদয়ে মায়া বা অজ্ঞান বাধিত বা অন্তর্হিত হয়। জ্ঞান ও অজ্ঞান পরস্পরবিরোধী। একটা বিশেষ অধিষ্ঠানে অজ্ঞান থাকলে তা বিষয়কে আবৃত করে। সেই একই অধিষ্ঠানে একই বিষয়ের অভ্রান্ত জ্ঞান হলে অজ্ঞানটি বাধিত হয়। রজ্জুর সম্যগ্জ্ঞানে রজ্জুতে আভাসিত সর্প যেমন বিলুপ্ত হয়, সেরূপ জ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান দূর হয়। এ কারণে মায়া বা অজ্ঞানকে জ্ঞানবিরোধী বলা হয়েছে।

ভাবরূপম্ : মায়া বা অজ্ঞানকে ভাবরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানের অভাব নয়, এটি ভাবরূপ বা ভাব পদার্থের মতো। কিন্তু মায়া যেহেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সেহেতু এটি সম্পূর্ণ ভাব পদার্থ নয়। মায়া ভাবপদার্থ এ কারণে যে, মায়া বন্ধ্যাপুত্র বা আকাশকুসুমের মতো অলীক নয়। মায়া যদি আকাশকুসুমের মতো অভাবপদার্থ হতো, তাহলে তার অভিজ্ঞতা আমাদের কখনোই হতো না। আবার অজ্ঞান কেবল বস্তুর স্বরূপ আচ্ছাদন করে না, এক বস্তুতে অন্য বস্তুর প্রতিভাসের সৃষ্টি করে। বিক্ষেপকর্ম সব সময় ভাবাত্মক। তাই অজ্ঞান শুধু জ্ঞানের অভাব নয়, মিথ্যাজ্ঞানও বটে। অবশ্য অজ্ঞানের এই ভাবরূপ চিৎ আত্মার ভাবরূপ থেকে পৃথক। চিৎ আত্মার ভাবরূপ নিত্য, অজ্ঞানের ভাবরূপ অনিত্য। অজ্ঞান ভাবরূপ হলেও তা ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ নয়। ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ হলে অজ্ঞানের বিনাশ সম্ভব হতো না, কিন্তু আমরা জানি যে, প্রকৃতজ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে যে, মায়া বহু বিচিত্র বিশ্ব সংস্কারের ভিত্তি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ’। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
অর্থাৎ : মায়াপ্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ কালো (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)।

অজা অর্থ হলো মায়া যার জন্ম নেই অর্থাৎ অনাদি। লোহিত বা লাল রজো গুণ, শুক্ল বা সাদা সত্ত্ব গুণ এবং কৃষ্ণ বা কালো তমো গুণকে নির্দেশ করে। মায়া ঐ তিনটি গুণস্বরূপ। সুতরাং, মায়া যেহেতু ভাব পদার্থের ভিত্তি সেহেতু মায়া কখনোই অভাব পদার্থ নয়।

যৎকিঞ্চিৎ : মায়াকে বলা হয়েছে ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’। অর্থাৎ, মায়ার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না। মায়া অস্থির ও অনির্বচনীয় কিছু। ব্রহ্মের থেকে মায়া সম্পূর্ণ পৃথক নয়। শ্রুতিতে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৩/১, ৪/৯) মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি বলা হয়েছে। মায়া ব্রহ্মের থেকে অপৃথকও নয়। কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ সম্ভব নয়। ভেদ ও অভেদ পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক বলে একই পদার্থে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ থাকতে পারে না। আবার মায়া নিরবয়ব বা অংশহীন নয়। যেহেতু কোন নিরংশ পদার্থ কোন কিছুর কারণ হতে পারে না। অথচ মায়া জগতের কারণ। আবার মায়ার অংশ আছে- একথাও বলা যায় না। কারণ তাহলে মায়া একটি উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই আরম্ভ আছে, সেহেতু মায়ার আরম্ভকে স্বীকার করতে হবে। তাহলে মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্মও সাদি অর্থাৎ, সীমিত হয়ে পড়বে। এই কারণে মায়াকে অনির্বচনীয় বলা হয়েছে এবং ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’ রূপে মায়াকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মায়ার শক্তিদ্বয় :
শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন। জীবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা অবিদ্যা, ব্রহ্মের দিক থেকে তাই মায়া। অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে মায়া হলো অবিদ্যা। অবিদ্যার দুটি শক্তি- একটি আবরণশক্তি এবং অপরটি বিক্ষেপশক্তি। আবরণ শক্তির দ্বারা অবিদ্যা প্রথমে তার অধিষ্ঠানকে আবৃত করে। বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা অবিদ্যা সেই অধিষ্ঠানে অন্য এক মিথ্যা বস্তুকে আরোপ করে। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই অধ্যাস বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রথমে রজ্জুর যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঘটে এবং পরে রজ্জুতে মিথ্যা সর্পকে আরোপ করা হয়। ঠিক একইভাবে অবিদ্যাবশত নির্গুণ ব্রহ্মে জগৎ বা ঈশ্বর ভ্রম হয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের মায়াশক্তির বলে ‘এক’ ব্রহ্মের স্থলে বহু বস্তু দৃষ্ট হয়। সুতরাং, জগৎ মিথ্যা। এক্ষেত্রে ‘জগৎ মিথ্যা’ অর্থ হলো ‘বহু মিথ্যা’ বা ‘ভেদ মিথ্যা’।

আবরণশক্তির কাজ সত্যকে আচ্ছাদন করে রাখা। অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি আত্মার যথার্থ স্বরূপকে আবৃত করে রাখে। বিক্ষেপশক্তির কাজ মিথ্যাকে প্রকাশ করা। অজ্ঞানবশত রজ্জু যেমন সর্পেরূপে প্রকাশিত হয়, সেরূপ অজ্ঞানবশতই পরমাত্মায় কর্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। কোন বস্তু আবরণশক্তি দ্বারা বাধিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তার মিথ্যারূপ প্রকাশ পায়। অদ্বৈতমতে বিক্ষেপশক্তি হলো সৃষ্টিশক্তি। অজ্ঞানের এই বিক্ষেপশক্তি অনিত্য জগৎ সৃষ্টিকারী। অদ্বৈতমতে অজ্ঞানের আবরণশক্তি ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপশক্তি ব্রহ্মকে জগৎরূপে প্রকাশ করে।

মায়া ও অবিদ্যায় ভেদ-অভেদ :
শঙ্করাচার্য এবং কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (বিবরণ সম্প্রদায়) মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন হলেও অন্য কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (ভামতী সম্প্রদায়) মতে মায়া এবং অবিদ্যা এক নয়। তাঁদের মতে মায়া সদর্থক এবং ভাবরূপ, যদিও সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল এবং ব্রহ্ম থেকে অবিচ্ছেদ্য। অপরপক্ষে অবিদ্যা সম্পূর্ণ নঞর্থক ও অভাবরূপ। কারণ অবিদ্যার অর্থ হলো বাস্তব সত্তার জ্ঞানের অভাব।
দ্বিতীয়ত, মায়া ঈশ্বরকে সীমিত করে। কিন্তু ঈশ্বর অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন হন না। অবিদ্যা হলো ব্যক্তির জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যা জীবকে অবচ্ছিন্ন বা সীমিত করে। মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বর এবং অবিদ্যায় প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে জীব। তাই জ্ঞানের দ্বারা ব্যক্তির অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু মায়া ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শক্তি বলে ব্যক্তির জ্ঞানের দ্বারা মায়া অপসারিত হয় না।
তৃতীয়ত, মায়া প্রধানত সত্ত্ব গুণসম্পন্ন। কিন্তু অবিদ্যা সত্ত্ব, রজো ও তমো গুণের দ্বারা গঠিত।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ অদ্বৈতবেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি উভয়পক্ষই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া উভয়পক্ষই স্বীকার করেন যে, ঈশ্বর অজ্ঞানের নঞর্থক দিকের দ্বারা প্রভাবিত হন না। এবং তাঁর মধ্যে সত্ত্ব গুণেরই প্রাধান্য আছে। সুতরাং, আবরণকে তুলাবিদ্যা বলা হলে এবং বিক্ষেপকে মায়া বা মূলাবিদ্যা বলা হলেও প্রকৃত তত্ত্বটি অবিকৃত থেকে যায়।

অজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রমাণ :
অজ্ঞানের অস্তিত্ববিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব ও শ্রুতি হলো প্রমাণ। আমরা প্রত্যেকেই ‘আমি অজ্ঞ’ এইরূপ অবস্থা সরাসরি উপলব্ধি করি। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্’

প্রশ্ন হতে পারে যে, মায়া বা অজ্ঞান এক না বহু ? বেদান্তসারের বক্তব্য অনুসারে মায়াকে এক এবং বহু, উভয়রূপেই চিন্তা করা সম্ভব। সমগ্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অজ্ঞান হলো এক। আবার প্রতিটি জীবকে পৃথকভাবে চিন্তা করলে অজ্ঞান বহু। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, অজ্ঞান দু’ধরনের- সমষ্টি অজ্ঞান ও ব্যষ্টি অজ্ঞান।
বন বললেই যেমন বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের সমষ্টি সমস্ত গাছের একযোগে প্রতীতি হয়, জলাশয় যেমন জলবিন্দুর সমষ্টি, অনুরূপভাবে অন্তঃকরণ উপাধিভেদে জীবগত অজ্ঞান বহু হয়েও সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক। আবার সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক হলেও বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ হিসেবে বৃক্ষ যেমন বহু, বিন্দু বিন্দু জলকণা হিসেবে জল যেমন বহু, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জীবের অজ্ঞান হিসেবে ব্যষ্টিরূপে অজ্ঞান বা মায়া হলো বহু।

অদ্বৈতমতে সমষ্টি অজ্ঞান ঈশ্বরের উপাধি। ব্যষ্টি অজ্ঞান অজ্ঞ জীবের উপাধি। ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞান বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণপ্রধান। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ বেশি পরিমাণে বর্তমান থাকে। ব্যষ্টি জীবের উপাধিরূপে, অজ্ঞান মলিনসত্ত্বপ্রধান। অর্থাৎ অজ্ঞ জীবের উপাধি হিসেবে ব্যষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে থাকে। ব্যষ্টি অজ্ঞানে রজঃ ও তমঃ গুণ মিশ্রিত থাকায় জীবের প্রকাশশক্তি কম। এজন্য জীবকে প্রাজ্ঞ বলা হয়। ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ।

অন্যভাবে সমষ্টি অজ্ঞানকে মূলাবিদ্যা এবং ব্যষ্টি অজ্ঞানকে তুলাবিদ্যা বলা হয়। অজ্ঞানের এই যে সমষ্টি ও ব্যষ্টি বিভাগ, তা কল্পিত বিভাগমাত্র। বন ও বৃক্ষ যেমন বস্তুত এক, জল ও জলাশয় যেমন বস্তুত এক, তেমনি সমষ্টি ও ব্যষ্টি অজ্ঞান বস্তুত এক ও অভিন্ন। একই মায়াশক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী নামের এই ভিন্নতা। অদ্বৈতবেদান্তী এই উভয়প্রকার উপহিত চৈতন্যের উর্ধ্বে এক ও অদ্বিতীয় তুরীয়চৈতন্যবাদী। সেই তুরীয়চৈতন্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্ম। অঘটন-ঘঁটন-পটীয়সী জগৎ বিক্ষেপকারী অনাদি মায়া যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ব্রহ্মের অতিরিক্ত তার কোন সত্তা নেই। এই অবিদ্যাতত্ত্ব, মায়াতত্ত্ব বা বিবর্ততত্ত্ব যে কেবলাদ্বৈতবাদীর জগৎ ব্যাখ্যার পক্ষে এক অপরিহার্য তত্ত্ব, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মায়ার সাথে ব্রহ্ম ও জগতের সম্বন্ধ :
মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী ?  শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম মায়া শক্তির প্রভাবে জগৎরূপে প্রতিভাত হয়। মায়া ব্রহ্মেরই শক্তি। আগুনের দাহিকা শক্তিকে যেমন আগুন থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়, তেমনি ব্রহ্মের মায়াশক্তিকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক করা যায় না। বস্তুত মায়ার আশ্রয় এবং বিষয় উভয়ই ব্রহ্ম। তবে ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই প্রেক্ষিতে শ্বেতাশ্বতর-এ একটি উপমাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়-
যাদুকর ইন্দ্রজাল রচনা করেন। যাঁরা অজ্ঞ ব্যক্তি তাঁরাই যাদুকরের ঐন্দ্রজালিক ঘটনাগুলিকে সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু যাদুকর তাঁর ইন্দ্রজালের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করলেও নিজে প্রভাবিত হন না। সুতরাং, মায়া এবং ব্রহ্ম দুটি পৃথক সত্তা নয়।

মায়ার সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ কী ?  অদ্বৈতবেদান্ত অনুসারে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা। মায়া সগুণ ব্রহ্মের শক্তিরূপে তাঁর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, মায়া এই জগতের কারণ। জগৎ হলো মায়ার পরিণাম।
অদ্বৈতমতে সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ অনুসারে অদ্বৈত সত্তাকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা হয়। যথা- পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রহ্মজ্ঞান হলে যাকে একমাত্র সৎ বলে প্রতীয়মান হয় তার সত্তা হলো পারমার্থিক সত্তা। এই অর্থে ব্রহ্ম হলেন পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কিন্তু যতক্ষণ আমিই ব্রহ্ম- এরূপ উপলব্ধি না হয়, ততক্ষণ যে সব পদার্থ সৎরূপে প্রতীয়মান হয়, সেগুলি হলো ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই কারণে অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করা হয়েছে। জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্তা আছে, জগতের কারণ মায়াও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি সমান হয় তাহলে কার্যটি হয় কারণের পরিণাম। সুতরাং, জগৎ হলো মায়ার পরিণাম। কিন্তু উপাদান কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি ভিন্ন হয় তাহলে কার্যটি হলো কারণের বিবর্ত। সুতরাং, জগৎ হলো ব্রহ্মের বিবর্ত।

বস্তুত মায়ার আশ্রয়রূপে সগুণ ব্রহ্ম জগতের অপরিবর্তনশীল উপাদান কারণ বা বিবর্ত উপাদান কারণ। কারণ, যদি ব্রহ্মকে উপাদান কারণ বলে গণ্য করা না হয়, তাহলে কয়েকটি শ্রুতিবাক্যের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন ‘এক বিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানম্’ বা ‘এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়’, ‘ব্রহ্মৈবেদম্ অসর্বম্’ ‘আত্মৈবেদম্ অসর্বম্’- এই বাক্যগুলিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। আবার মায়ারূপ উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিফলিত হলে তাঁর ঈক্ষণবৃত্তির উদয় হয়। ঈক্ষণবৃত্তি হলো জগৎ সৃষ্টির সংকল্প। এই কারণে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত কারণও বলেছেন।
তাঁর মতে ব্রহ্মকে উপাদান ও নিমিত্ত- এই দ্বিবিধ কারণ বলা উচিত। কারণ তাহলে শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের বিরোধ হয় না। শ্রুতিতে এরকম প্রতিজ্ঞা আছে- এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা হয়েছে- ঘট প্রভৃতির উপাদান কারণস্বরূপ এক মৃৎপিণ্ডকে জানলে যেমন সমস্ত মৃন্ময় বস্তুরই জ্ঞান হয় ইত্যাদি। উপাদান কারণের জ্ঞান না থাকলে এক বিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান হয় না। অতএব জগতের অন্য অধিষ্ঠাতা না থাকায় আত্মাই অধিষ্ঠাতা বা নিমিত্তকারণ এবং অন্য উপাদান না থাকায় আত্মাই জগতের উপাদান কারণ।

অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবক্তা আচার্য শঙ্কর তাঁর শারীরকভাষ্যে পারমার্থিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে অবিদ্যার জন্যই জীব অনাত্মাকে আত্মার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। অবিদ্যা হলো ব্যবহারিক জ্ঞান। অবিদ্যায় জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার পারস্পরিক ভেদ বর্তমান থাকে। শঙ্করের মতে ব্রহ্মেরই একমাত্র সত্তা আছে, ব্রহ্মের বাহিরে বা ভেতরে ব্রহ্ম ছাড়া আর কোন সত্তা নেই। ব্রহ্মের কোন প্রকার ভেদ নেই। পরাবিদ্যা সব রকমের ভেদরহিত জ্ঞান এবং নিরপেক্ষ জ্ঞান। আর অপরাবিদ্যা আপেক্ষিক জ্ঞান হলেও শঙ্করের মতে এ জ্ঞান পরাবিদ্যা বা অনপেক্ষ জ্ঞান লাভের সোপান স্বরূপ।

এই মতে, শ্রুতি থেকে ব্রহ্মের জ্ঞান হয়, তারপর যুক্তি-তর্কের সাহায্যে তার যৌক্তিকতা উপলব্ধ হয় এবং সর্বশেষ অনুভবের মাধ্যমে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হয়। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন হলো তিনটি উপায়। শ্রুতি ছাড়া অন্য কোন কিছু থেকে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান লাভ হয় না। শ্রুতির প্রামাণ্য নিরপেক্ষ। বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণও বলেছেন-

‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩)
ভাবার্থ : শাস্ত্ররাশিই হলো ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের উপায়।

শ্রুতিলব্ধ জ্ঞানের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করার জন্য যুক্তি-তর্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শ্রুতির কথায় বিশ্বাস না থাকলে কেবলমাত্র যুক্তি-তর্কের দ্বারা আত্মোপলব্ধি হয় না। যে তর্ক শ্রুতির অনুগামী, সেই তর্কই গ্রহণযোগ্য। যেহেতু মানুষের বুদ্ধি এক প্রকার নয় সেজন্য তর্ক বিভিন্নরূপের হয়। একজন তার্কিক তাঁর তর্কক্ষমতা দ্বারা কোন তত্ত্বকে সিদ্ধ করতে পারেন, আবার তাঁর চেয়েও যুক্তিকুশল ব্যক্তি অধিকতর দক্ষতায় সেটার ত্রুটি প্রমাণ করে নিজ মতকে সিদ্ধ করতে পারেন। অতএব যুক্তি-তর্কের দ্বারা আমরা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না, কেবলমাত্র শ্রুতি বা উপনিষদ থেকেই আমরা সত্যকে প্রাপ্ত হতে পারি। যুক্তি তর্ককে আমরা শুধুমাত্র উপনিষদের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করতে পারি। শঙ্করের মতে তর্ক যেহেতু অপ্রতিষ্ঠা দোষে দূষিত সেজন্য তর্কের উপর নির্ভর করে শাস্ত্রের অর্থ নির্ণয় করা যুক্তিসঙ্গত নয়। বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণও বলেছেন-

‘তর্ক অপ্রতিষ্ঠানাৎ অপি, অন্যথা অনুমেয়ম্ ইতি চেৎ, এবং অপি অবিমোক্ষপ্রসঙ্গঃ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১১)
ভাবার্থ : তর্ক অপ্রতিষ্ঠ; অতএব শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মের কারণত্ববাদ কেবলমাত্র তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা চলে না।

বেদান্ত-সিদ্ধান্তের সত্যতা তর্ক বা যুক্তিনির্ভর তো নয়ই বরং উপনিষদ প্রতিপাদিত। বেদ নিত্য, তাই বেদ থেকে প্রাপ্ত অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কালই এক। শাস্ত্র মতে তর্কের দ্বারা সগুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লব্ধ করা যাবে, কিন্তু পরব্রহ্মের বা নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করা যায় না। তাই শঙ্করের মতে শ্রুতি বা শব্দই স্বত প্রমাণ। অন্যান্য প্রত্যক্ষ, অনুমানাদি প্রমাণসমূহ শব্দের (=বেদ) করুণা দ্বারাই প্রমাণিত হতে পারে। অতএব, প্রমাণ সম্পর্কে শঙ্করের ব্যাখ্যা জৈমিনি তথা ভাট্ট-মীমাংসকদের মতবাদেরই অনুরূপ।
প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায়। শঙ্কর ছয় প্রকার প্রমাণ স্বীকার করেন, যেমন- প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি।

কোন সৎ বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে যে জ্ঞান হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কোন জ্ঞান বিষয়ের উপরের নির্ভর করে এবং তার দ্বারা সমর্থিত হয়ে যদি কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় তাকে অনুমান বলে। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন হলো শব্দ এবং এই বচনের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ হয় তাকে শব্দজ্ঞান বলে। সংজ্ঞা ও সংজ্ঞীর যে জ্ঞান তাই উপমান। নৈয়ায়িক ও মীমাংসকরা উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। কোন বিষয়কে যখন জ্ঞাত কোন কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না তখন অন্য কোন অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করা হয়, এই অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করার নাম অর্থাপত্তি। কোন বস্তুর অভাবের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুপলব্ধি নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণকে শঙ্করাচার্য স্বীকার করেন। তবে অদ্বৈতমতে সকল প্রমাণের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলো শব্দ প্রমাণ, এবং শব্দই স্বত প্রমাণ।

সত্যতা :
যে জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না তাই সত্য। তখন অদ্বয় অর্থাৎ অদ্বিতীয় আত্মজ্ঞান লাভ হয়। শঙ্করের মতে সত্যতা নির্ণয় করার মূল উপায় হলো আধিতত্ত্ব বা অবিরুদ্ধতা। অদ্বয়জ্ঞান যথার্থ, কারণ এ জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয় না। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে সঙ্গতি হলো সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। শঙ্করও এই অভিমত সমর্থন করেন। তাঁর মতে সঙ্গতি ছাড়াও অনুরূপতা এবং প্রবৃত্তি সামর্থও সত্যতা নিরূপণের উপায়। অনুরূপতা অর্থাৎ যখন কোন ধারণা বস্তুর অনুরূপ হয় তখন ধারণা সত্য হয়, এটাও ব্যবহারিক সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। প্রবৃত্তি সামর্থ্য অর্থাৎ যখন ধারণা সফল প্রবৃত্তির কারণ হয় তখন ধারণা সত্য হয়।

ভ্রম :
অদ্বৈতবেদান্ত মতে ভ্রমের কারণ হলো অবিদ্যা। ব্রহ্মে জগৎ ভ্রমেরও কারণ হলো অবিদ্যা। ভ্রম সম্পর্কে অদ্বৈতবাদীদের মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায় ভ্রমের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা শঙ্কর স্বীকার করেন না।

মীমাংসকরা প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ভ্রমের সম্ভাবনাকে মোটেই স্বীকার করেন নি। তাঁরা সব জ্ঞান, বিশেষ করে অপরোক্ষ জ্ঞানকে সত্য বলে মনে করেন। তাঁদের এই মত যথার্থ বলে স্বীকার করলে অদ্বৈতমতে দেয়া জগৎ ব্যাখ্যার কোন যুক্তি থাকে না। মীমাংসামতে রজ্জুতে যে সর্পভ্রম হয় সেখানে প্রত্যক্ষ এবং স্মৃতির মিশ্রণ ঘটে এবং দুটির মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন আমরা রজ্জু প্রত্যক্ষ করি, যে রজ্জুর অস্তিত্ব আছে। তার সাথে সর্পের স্মৃতি মনে জাগরিত হয়। কারণ সর্পের সঙ্গে রজ্জুর সাদৃশ্য আছে। রজ্জুর প্রত্যক্ষ এবং সর্পের স্মৃতি দুটোর যে পার্থক্য বা বিবেকের অখ্যাতি তা ভ্রম সৃষ্টি করে।

আবার নৈয়ায়িকদের ন্যায়মতে ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ। তাদের মতে ভ্রমের ক্ষেত্রে একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। যখন রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটে তখন রজ্জু অন্য বস্তুরূপে দৃষ্ট হয়। অদ্বৈতবেদান্তীরা এই মত গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন না। বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা আত্মখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। তাঁদের মতে ভ্রমে মনের ধারণা বাহ্যবস্তু হিসেবে দৃষ্ট হয়। রজ্জুতে সর্পভ্রম একটি নিছক মনের ধারণা। সে জন্য সর্পকে অস্তিত্বশীল বাহ্যবস্তু হিসেবে দেখা যায়। এক্ষেত্রে বেদান্তীরা মনে করেন, ভ্রমের ক্ষেত্রে যদি কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা না যায় তাহলে রজ্জুতে সর্পভ্রম না হয়ে যে কোন ভ্রম ঘটতে পারতো। অদ্বৈতমতে ব্রহ্মই জগৎভ্রম হয়।

অদ্বৈতবাদীদের ভ্রম সম্পর্কিত মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ অনুসারে, ভ্রমজ্ঞানকে সৎও বলা যায় না, অসৎও বলা যায় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন সর্পকে অসৎ বলা যায় না, কারণ সর্প অসৎ হলে সর্পকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সর্পকে সৎও বলা যায় না, কারণ পরে রজ্জুজ্ঞান দ্বারা সর্পজ্ঞান বাধিত হয়। আবার সর্পকে সদসৎও বলা যায় না, কারণ সৎ এবং অসৎ পরস্পরবিরোধী, তাই সৎ ও অসৎ কারো ক্ষেত্রে একই সময়ে একই অর্থে সত্য হতে পারে না। কাজেই অদ্বৈতমতে সর্প অনির্বচনীয়। এই অনির্বচনীয় সর্প প্রাতিভাসিক। যতক্ষণ পর্যন্ত রজ্জুর জ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্তই সর্প ভ্রান্তদর্শীর দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। ভ্রম দূর হলে সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না।

অদ্বৈতমতে জগতের যাবতীয় বস্তুই চৈতন্যে অধিষ্ঠিত। রজ্জু যে চৈতন্যে অধিষ্ঠিত সেই চৈতন্যে আশ্রিত অবিদ্যার তমোভাগ থেকে অনির্বচনীয় সর্পের উৎপত্তি। কাজেই অদ্বৈতবেদান্ত মতে সর্প অনির্বচনীয়। অবিদ্যার জন্যই রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়। একইভাবে ব্রহ্মে জগৎভ্রম এই অবিদ্যার জন্যই হয়ে থাকে। অবিদ্যা অপসারিত হলেই একই অদ্বয় ব্রহ্মের উপলব্ধি ঘটে।
অদ্বৈতমতে জগৎ
বেদান্তদর্শনের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র বা শারীরকসূত্রের দ্বিতীয় সূত্রটি হলো-

‘জন্মাদ্যস্য যতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)
ভাবার্থ : জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যা থেকে হয় (তাহাই ব্রহ্ম)।

এই সূত্রটির ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেন-

‘অস্য জগতো নামরূপাভ্যাং ব্যাকৃতস্য অনেক কর্ত্তৃভোক্তৃসংযুক্তস্য প্রতিনিয়িত দেশকালনিমিত্ত ক্রিয়াফলাশ্রয়স্য মসসা অপি অচিন্ত্যরচনারূপস্য জন্মস্থিতিভঙ্গং যতঃ সর্ব্বজ্ঞং সর্ব্বশক্তেঃ কারণাৎ ভবতি তদব্রহ্ম ইতি বাক্য শেষঃ’। (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-২)
অর্থাৎ :
এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অব্যক্ত ছিলো, কিন্তু সৃষ্টিদশায় সেই অব্যক্তই নাম ও রূপ এই দ্বিবিধ উপাধি দ্বারা ব্যক্ত বা ব্যবহারগোচর হয়েছে। এই জগতের ভোক্তা এবং কর্তা অসংখ্য। এই জগতের অন্তঃপাতি প্রত্যেক বস্তুই নিয়ত দেশে, নিয়ত কালে এবং নিয়ত নিমিত্তের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে; এবং প্রত্যেক বস্তুরই ফল নিয়ত দেশে ও নিয়ত কালেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কী উপাদান থেকে- কী ভাবে এই জগতের উৎপত্তি প্রভৃতি হয়ে থাকে, তা মনে মনে ভেবেও স্থির করবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই (বিচিত্র কৌশলময়) জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং প্রলয়ের যা একমাত্র কারণ- সেই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিসম্পন্ন কারণই- ব্রহ্ম। এটাই হলো এই (সূত্রদ্বারা সূচিত) বাক্যের অবশিষ্ট অংশ (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-২)

আবার, প্রমাণ শাস্ত্রের দৃষ্টিতে বিচার করলে বোঝা যায় যে জগৎ দৃশ্যমান কিন্তু তা শুধু বর্তমানের মধ্যেই। জগতের পরিবর্তনশীলতা প্রমাণ করে যে পূর্বে তা কখনও ছিলো না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এইভাবে- সর্বকালের মধ্যে তার অস্তিত্ব আছে- এই তত্ত্ব ভুল মনে হয়। তাই শঙ্করাচার্য মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের এই মতকেই মেনে নিয়েছেন যে-

‘আদৌ অন্তে চ যৎ নাস্তি বর্তমানোৎপি তৎ তথা। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)
অর্থাৎ : যদি এমন বস্তু থেকে থাকে যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলে ধরে নিতে হবে।

বস্তুত শঙ্করের মতে ত্রিকালের মধ্যে জগৎ নেই। তিনি বলেন, ‘জগৎ আছে’- এই বাক্যের মধ্যে জগতের কল্পনা ভ্রান্তিমূলক, এবং ‘আছে’ (=সৎ) ব্রহ্মের মৌলিক স্বরূপ। সৎ না থাকলে যা জগতের ছলনা তাও থাকে না, এজন্যই ব্রহ্ম জগতের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান বা ভ্রমস্থান, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে সর্পের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান রজ্জু।

শঙ্করাচার্যের মতে যেহেতু নির্গুণ ব্রহ্ম একমাত্র সত্তাবিশিষ্ট, সেহেতু জগত বা জগতের বিষয়গুলি মিথ্যা। অর্থাৎ, যেহেতু এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য সেহেতু বহুত্ব সত্য নয়। কিন্তু যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে তো জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ঐ বিষয়গুলির যেহেতু জ্ঞান হয় সেহেতু অদ্বৈতমতে ঐ জ্ঞান কিভাবে হয় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
অদ্বৈতবেদান্ত বিবর্তবাদী। বিবর্তবাদ অনুযায়ী অধ্যাস বা ভ্রান্তিবশত অবস্তু বস্তুরূপে প্রতীয়মান হয়। যেভাবে ভ্রান্তিবশতই রজ্জুতে সর্প প্রতীয়মান হয়, অনুরূপভাবে ব্রহ্মে এই জগৎ-প্রপঞ্চ অধ্যস্ত হয়। চৈতন্যে অচৈতন্যের, আত্মা বা বিষয়ীতে বিষয়ের, আরোপই অধ্যাস। অধ্যাসই মিথ্যাকে উৎপন্ন করে। রজ্জুতে সর্পের অধ্যাস যেমন মিথ্যা, ব্রহ্মে জগৎ-প্রপঞ্চের অধ্যাসও তেমনি মিথ্যা। অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদের মাধ্যমেই জগতের গ্রহণযোগ্য ও সুসংগত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

বেদান্তদর্শনে অসৎকার্যবাদ ও পরিণামবাদ বেদান্তের দ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের নির্দেশক। অসৎকার্যবাদ অনুযায়ী পূর্বস্থিত উপাদান থেকেই চেতন-কর্তা কার্য উৎপন্ন করে। সুতরাং এই মতবাদ দ্বৈতবাদের নির্দেশক। আর পরিণামবাদ অনুযায়ী কারণ বাস্তবিকই কার্যে পরিণত হয়। সুতরাং এই মতে কারণ পরিণামী ও কার্যসমসত্তাবিশিষ্ট। ফলে শঙ্করাচার্য বিবর্তবাদের সাহায্যে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে অদ্বৈতব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদ অনিবার্য বলেই মনে হয়।

অদ্বৈতবাদীদের বিবর্তবাদের উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে যেতে হয়। বেদান্ত প্রস্থানের উৎসগ্রন্থ বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে-

‘প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্ত-অনুপরোধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৩)
ভাবার্থ : ব্রহ্ম জগতের শুধু নিমিত্ত-কারণ নন, উপাদান-কারণও, এইরূপ সিদ্ধান্তেই শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্য হয়।

এখানে যে দৃষ্টান্তের কথা বলা হয়েছে তা হলো- ‘হে সৌম্য, যেমন একটি মৃত্তিকাপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিমাণ-ভূত সমস্তই জানা যায় যেতে পারে (কারণ) সমস্ত বিকারই বাচাবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য;… হে সৌম্য, এইরূপেই উক্ত উপদেশ হয়ে থাকে।’ (ছান্দোগ্য-উপনিষদ-৬/১/৪-৬)। শ্রুতি এখানে ‘বিকার’ শব্দটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মূল উপাদান মৃত্তিকা ছাড়া ঘটাদির পৃথক কোন সত্তা নেই। এরা পৃথক কোন বস্তু নয়, তা বিভিন্ন অবস্থা মাত্র, যেমন একই দেবদত্তের বাল্য, যৌবন ইত্যাদি অবস্থা মাত্র কিন্তু এদের কোনটাই সত্য নয়। সুতরাং মৃৎপিণ্ডের জ্ঞানলাভ করেই ঘটাদির আসল স্বরূপকে জানতে হয়। বিভিন্ন রূপকে জানতে না পারলেও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ এরা অসৎ বলে জ্ঞাতব্যই নয়। যদিও ঘটাদি বস্তুগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ের বিষয়, তথাপি বিচার করে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, মৃত্তিকা ছাড়া অন্য কোন সত্য এদের মধ্যে নেই। এরা বাক্য থেকে উদ্ভূত কতকগুলি নামমাত্র- এর বেশি কিছু নয়। যেহেতু এগুলি অবিদ্যার মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়- সেজন্যে এরা অসৎ। অপরপক্ষে মৃৎপিণ্ডকে নাম এবং রূপ থেকে পৃথকভাবেও জানা যায়, সুতরাং তা সত্য। একইভাবে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং এই জগৎ অসৎ। জগৎ তার কারণ ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন বলে সত্য হলো এই যে, তা এক, অদ্বিতীয় ব্রহ্মই- ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। তাই ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-

‘তৎ অনন্যত্বম্ আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৪)
ভাবার্থ : ‘বাচারম্ভণ’ ইত্যাদি শব্দ থেকে অবগত হওয়া যায় যে, এই কার্যভূ জগৎ তৎ-কারণ ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়।

ভারতীয় আচার্যরা উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে ধাপে ধাপে শিষ্যকে চরম সত্য উপলব্ধির দিকে নিয়ে যান, এটাই প্রচলিত রীতি। এই সর্বসম্মত রীতি অনুসরণ করে সূত্রকার বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রে বিভিন্ন সূত্রে ব্রহ্মকে পরিণাম মতানুসারে জগৎকারণ বলে বর্ণনা করে উপরিউক্ত সূত্রের মাধ্যমে বিবর্তমতের প্রতিষ্টা করেছেন বলে মনে করা হয়। কেননা এই সূত্রগুলি থেকেই আচার্য শঙ্কর তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্য বা শারীরকভাষ্যে ব্রহ্ম এবং মায়া উভয়কে জগতের কারণ বলে নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্ম বিবর্তের মাধ্যমে এবং মায়া পরিণামের মাধ্যমে জগৎরূপ কার্যে বর্তমান, কারণ তাদের উভয়ের গুণগুলিই কার্যে দৃষ্ট হয়। তাই অদ্বৈতবাদের মূল সূত্র হিসেবে শঙ্কর বলেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম হলেন অভিন্ন।

অদ্বৈতমতে জগৎ মিথ্যা। কিন্তু জগৎকে মিথ্যা বললেই জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। তাহলে ‘জগৎ মিথ্যা’- এ কথার অর্থ কী ? জগৎ কি আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ, না স্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাস ? অদ্বৈতমতে জগৎ এই দুই-এর কোনটিই নয়। এই মতে জগৎ সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয়। জগতের যথার্থ স্বরূপ বোঝার জন্য অদ্বৈতবেদান্তীর সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ বা ত্রিবিধ সত্তা জানা দরকার। সত্তার ত্রৈবিধ্য অর্থাৎ তিনপ্রকার সত্তা সম্বন্ধে জানলেই অদ্বৈতবেদান্তীর জগতের প্রকৃতস্বরূপ ও মিথ্যাত্বের যথার্থ তাৎপর্য পরিস্ফুট হতে পারে।

সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ :
অদ্বৈতবেদান্ত মতে আকাশকুসুম বা বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকের কোন সত্তা নেই। অলীক নিঃস্বভাব অসৎ। অসৎ কখনো ভাবরূপে প্রতিভাত হয় না। কিন্তু যা কিছু ভাবরূপে প্রতিভাত হয়, তা-ই সমানসত্তাবিশিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য তিনপ্রকার সত্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন- পারমার্থিক, ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক।

ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ, ব্রহ্ম বিষয়ে সাক্ষাৎ উপলব্ধি হলে যার সত্যতা জানা যায়, সেই পদার্থ পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই দৃষ্টিতে বিভু, নিত্য ও যাবতীয় বস্তুর স্বরূপ-সত্তারূপে ব্রহ্ম পারমার্থিক সৎ। অপরপক্ষে ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত যে সকল পদার্থ সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়, তার সত্যতা হলো ব্যবহারিক সত্যতা। তার মানে, প্রতীয়মান সকল বস্তুই সেই বস্তুরূপে ব্যবহারিক সৎ, যেমন, রজ্জুরূপে রজ্জু। আর ভ্রমজ্ঞানের বিষয় হলো প্রাতিভাসিক সত্তা। প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা সত্য। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক।

অদ্বৈতমতে কেবল ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্যতা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে, কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক। আবার যখন সর্পের যথার্থ জ্ঞান হয়, তখন সর্পের সত্তাটি ব্যবহারিক। বস্তু বিষয় না থাকলে বিষয়ের জ্ঞান হয় না। যেমন আকাশকুসুমের জ্ঞান হয় না। সেহেতু আকাশকুসুম নেই। কিন্তু প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক জগতের জ্ঞান আমাদের হয়। সুতরাং, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক দুটি জগৎ আছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই যে যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান কিভাবে হয় ?
উত্তরে শঙ্করাচার্য এবং তাঁর অনুগামী অদ্বৈতবাদীরা বলেন, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগৎ হলো অবিদ্যার রূপান্তর। ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিকের ভেদ হলো যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা ও ভ্রমের ভেদ। অবিদ্যা বা মায়ার দ্বারা এই ব্যবহারিক জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। রজ্জুকে যখন রজ্জুরূপে জানা হয়, তখন রজ্জুর ব্যবহারিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় অর্থাৎ ঐ সত্তা অন্যেরাও স্বীকার করেন। কিন্তু রজ্জুকে যখন সর্পরূপে জানা হয়, তখন সর্পের প্রাতিভাসিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় না। রজ্জুতে সর্পের প্রতিভাস সর্পের সত্তা অবিদ্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বিশেষের নিকটই স্বীকৃত। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সেই সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না। কেবলমাত্র রজ্জুর বা মিথ্যা সর্পের অধিষ্ঠানটির অস্তিত্ব থাকে। এক্ষেত্রে সর্পটি হলো রজ্জুর প্রতিভাস, বিবর্ত বা অসত্য রূপান্তর। অনুরূপভাবে ব্যবহারিক জগৎ ব্রহ্মের সত্য পরিণাম নয়, ব্রহ্মের বিবর্তমাত্র। মায়া বা অবিদ্যার প্রভাবে জগতের প্রকৃত অধিষ্ঠানটিকে আমরা জানতে পারি না, কেবলমাত্র জগৎ প্রপঞ্চকেই জানতে পারি। এভাবে ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক সত্তার ভেদের মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী সর্বজনসিদ্ধ ভ্রমের বিষয় ও প্রমার বিষয়ের ভেদকেই ব্যক্ত করেছেন। ভ্রমের বিষয় প্রাতিভাসিক সৎ, কিন্তু প্রমার বিষয় ব্যবহারিক সৎ।

আবার প্রাতিভাসিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তা ভিন্ন হলেও উভয় সত্তাই সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন। যা সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন , তাকেই অদ্বৈতবেদান্তী মিথ্যা বলেন। তাই প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক সত্তাবিশিষ্ট উভয়প্রকার বিষয়ই অদ্বৈতমতে মিথ্যা। উভয়প্রকার সত্তাই পরবর্তীকালে বাধিত বা খণ্ডিত হয়। অন্যদিকে অসৎ ভাবরূপে প্রতিভাতই হয় না। যা চৈতন্যের সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত নয়, তা প্রতিভাত হতে পারে না। কিন্তু মিথ্যা বিষয় ভাবরূপে প্রতিভাত হয়। মিথ্যা বিষয় চৈতন্যময় ব্রহ্মে অধ্যস্ত এবং ব্রহ্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে মিথ্যা বিষয়ের মধ্যে প্রমার বিষয় (ব্যবহারিক সৎ) সমষ্টিগতভাবে সমর্থিত, কিন্তু ভ্রমের বিষয় (প্রাতিভাসিক সৎ) একান্তই ব্যক্তিগত। মিথ্যামাত্রই অবিদ্যাজন্য, তাই ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক উভয় সত্তাই অবিদ্যাজন্য। ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় মূলাবিদ্যা এবং প্রতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় তুলাবিদ্যা।

এবার প্রশ্ন হলো, অদ্বৈতমতে কী অর্থে জগৎ মিথ্যা ?
সাধারণ চিন্তার যে আকার তা শঙ্করাচার্যের জগৎ সম্পর্কিত বক্তব্যকে ধারণ করতে পারে না। কেননা আমরা যখন কোন বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন সেই চিন্তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসটি এরকম যে, হয় সেই বিষয়টির অস্তিত্ব আছে, কিংবা সেই বিষয়টির অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব পরস্পরবিরোধী। এই কারণে একটি বিষয় আছে আবার নেই, এরূপ চিন্তা আমরা করতে পারি না। কিন্তু শঙ্করাচার্যের মতে এই জগৎ আছে আবার নেইও, এই জগৎ কাল্পনিক, আবার কাল্পনিক নয়। যতদিন আমরা বদ্ধ অবস্থায় থাকি, ততদিন আমাদের আত্মোপলব্ধি হয় না। অর্থাৎ, ততদিন আমরা এই জগৎ সংসারকে তুচ্ছ বলে ভাবতে পারি না। শঙ্করাচার্য একমাত্র ব্রহ্মকেই সৎ বলেছেন। একমাত্র ব্রহ্মেরই প্রকৃত সত্তা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে; কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই।
তিনি আরো বলেন, যা সৎ বা সত্য তা কোন দেশে এবং কোন কালেই বাধিত হয় না। যা অসৎ বা তুচ্ছ, আকাশকুসুমের মতো কোন কালেই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। বদ্ধ অবস্থায় মোক্ষলাভ না হওয়া পর্যন্ত এই জগতকে কেউ অসৎ বা তুচ্ছ মনে করতে পারে না। তাই জগৎকে অসৎরূপে বর্ণনা করা যায় না। মোক্ষলাভ বা ব্রহ্মলাভ হবার পরেই এই জগৎ অন্তর্হিত হয়। যেহেতু এই জগৎ সর্বস্তরে থাকে না এবং সর্বকালেও থাকে না, সেহেতু এই জগতকে সৎ বলাও যায় না। পারমার্থিক সত্তায় জগৎ নেই, কেবল ব্যবহারিক সত্তাতেই জগৎ থাকে। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানের পরবর্তীকালে জগতের অস্তিত্ব থাকে না; ফলে জগতকে সৎ বলা যায় না। আবার অসৎও বলা যায় না। সুতরাং, জগৎ অনির্বচনীয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সৎ, কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ অসৎ।

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, জগৎ মিথ্যা হলেও আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ নয়। আবার ব্রহ্মের ন্যায় অবাধিত ত্রিকালসৎও নয়। জগৎ তথা জাগতিক বিষয় ভাবরূপে প্রতীত হয়ে ব্যবহৃত হয়। অথচ ব্রহ্মোপলব্ধিতে জগৎ বাধিত ও খণ্ডিত হয়। জগতের সত্তা ব্রহ্ম-সাপেক্ষ। ব্রহ্ম-সংশ্লিষ্ট হয়েই জগৎ সত্তাযুক্ত হয়। শুদ্ধচৈতন্যই একমাত্র নিরপেক্ষ সৎ। জগৎ তাই নিরপেক্ষ সৎ নয়। জগৎ ব্রহ্মে অধ্যস্ত অর্থাৎ শুদ্ধচৈতন্য নামক সৎ অধিষ্ঠানে জগৎ আরোপিত। সৃষ্টির অর্থ এখানে আরোপ। অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টি মানে উৎপন্ন নয়, সৃষ্টি বলতে আরোপ বা প্রক্ষেপকে বোঝানো হয়। তাই অদ্বৈতবেদান্তে জগতের সৃষ্টি বলতে ব্রহ্মে জগতের আরোপকে বোঝানো হয়েছে। রজ্জুর অধিষ্ঠানে সর্প যেমন আরোপিত হয়ে প্রতিভাত হয়, তেমনি জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত হয়ে সৎ রূপে প্রতিভাত হয়। রজ্জুর জ্ঞানে সর্প যেমন মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়, তেমনি ব্রহ্মের জ্ঞানে জগৎ মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়। রজ্জুতে সর্পের আবির্ভাবের কারণ হলো অজ্ঞান বা অবিদ্যা। এই অবিদ্যার ফলেই ব্রহ্মের অধিষ্ঠানে ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়ে ঘট-পটাদি জাগতিক বস্তু সৎরূপে আবির্ভূত হয়। অদ্বৈতমতে এরই নাম জগৎ-সৃষ্টি, যা বস্তুত অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়ার ফল।

তবে এই অবিদ্যা বা মায়ার প্রেক্ষাপটে জগতের সংস্থান সম্পর্কে অদ্বৈত বৈদান্তিক দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে দুটি মতের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ এবং অপরটি হলো দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ।

সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ : সৃষ্টিদৃষ্টিবাদের প্রবক্তা হলেন অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের বিবরণ সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা। তাঁদের মতে জগতের ভিত্তি মায়া বা অবিদ্যার অধিষ্ঠান হলো ব্রহ্ম। মায়া ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি এবং বিকার বা বিভিন্ন প্রকারের পরিবর্তন সাধনে সমর্থ। এই জগৎ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যার পরিণাম নয়, এই জগৎ হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তির বা মায়ার পরিণাম। সুতরাং, সৃষ্টি কোন অর্থেই জীবের উপর নির্ভর করে না। ঈশ্বরের জড়াত্মিকা শক্তি মায়া এই জগৎকে সৃষ্টি করে। ফলে বদ্ধ জীবের কাছে এই ব্যবহারিক জগৎ সত্য ও প্রদত্ত বলে মনে হয়। ঈশ্বর বদ্ধজীবদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এইজন্য ব্যবহারিক জগতে একজন ব্যক্তির জন্য ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেছেন তা সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বিষয় হয়। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিশক্তি মায়ার দ্বারা জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেছেন। বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘দেবাদিবৎ অপি লোকে’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)
ভাবার্থ : দেবতা এবং পৃথিবীর বহু সিদ্ধপুরুষও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সৃষ্টি করতে পারেন। ব্রহ্মও সেরূপ পারেন।

জগৎকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। শ্রুতি ও জ্ঞানের দৃষ্টিতে জগৎ তুচ্ছ ও অসৎ। ব্যবহারিক যুক্তি পদ্ধতির বিচারে জগৎ অনির্বচনীয় এবং ব্যবহারিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সত্য ও সৎ। অর্থাৎ, জগতের সত্তা ও অস্তিত্ব আছে- মায়ার সত্তা। মায়া জগতের আকারে পরিণত হয়, কিন্তু জগৎ মায়ার উপর নির্ভর করে না। ব্রহ্মই জগতের একমাত্র অবলম্বন। যেমন, প্রথমে তুলো থেকে সুতো প্রস্তুত হয়। তারপর সুতোগুলি কাপড়টি উৎপন্ন করে। সুতোগুলি কাপড়ের অধিষ্ঠান নয়, কাপড়ের প্রকৃত অধিষ্ঠান হলো তুলো। জগতের সৃষ্টির সঙ্গে জীবের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এই জগৎ জীবের উপর কোনভাবেই নির্ভর করে না। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে তাঁর মায়াশক্তি জগৎ সৃষ্টি করে। বেদান্তসূত্রানুযায়ী-

‘কৃৎস্নপ্রসক্তিঃ নিরবয়বত্ব শব্দকোপো বা’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৬)
ভাবার্থ : জগৎ-কারণ ব্রহ্ম হয় সম্পূর্ণভাবেই জগতে পরিণত হয়েছেন- তা মানতে হয়, অথবা শাস্ত্রের বিরোধিতা করতে হয়- যেহেতু শাস্ত্র বলেছেন ব্রহ্ম অংশরহিত।

কিন্তু অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা অস্বীকার করা না গেলেও জগতের পারমার্থিক সত্তা থাকতে পারে না। কারণ জগতের বিষয়মাত্রই স্ববিরোধী। ব্যবহারিক স্তরে কোন অভিজ্ঞতার বিষয়েই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেমন, ‘লাল ফুল’ একটি ব্যবহারিক স্তরের অভিজ্ঞতার বিষয়। এখানে ‘লাল’ এবং ‘ফুল’ সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন নয়। কারণ ‘লাল’ ও ‘ফুল’- এই দুটি সম্পূর্ণ পৃথক শব্দ। আবার দুটি যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও বলা যায় না। কারণ ‘লাল রং’ অবলম্বনহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। আবার লাল ও ফুলের সম্পর্কটি একটি গরুর সঙ্গে একটি ঘোড়ার বিজাতীয় সম্পর্কের মতোও নয়। লাল ও ফুল পরস্পরের সঙ্গে সমবায় সম্পর্কেও যুক্ত নয়। কারণ দুটির মধ্যে যদি সমবায় সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়, তাহলে সেই সমবায় ‘লাল’ ও ফুলের সঙ্গে যুক্ত করতে আরেকটি তৃতীয় সম্বন্ধের প্রয়োজন হবে এবং এই প্রক্রিয়া অন্তহীনভাবে চলতে থাকবে। সুতরাং, ‘লাল ফুল’ এর প্রকৃতি কী তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেহেতু স্ববিরোধী কোন বিষয়ের পারমার্থিক বা আধিবিদ্যক সত্তা থাকতে পারে না, সুতরাং, জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। তাই জগৎকে মিথ্যা বা অধ্যস্ত বলার তাৎপর্য হলো এই যে, জগৎ অনির্বচনীয়।

শ্রুতিতে এই জগতের কারণ মায়াকেও ‘সদসৎ-বিলক্ষণানির্বচনীয়া’ বলা হয়েছে। যেহেতু মায়া সৎ থেকে পৃথক এবং অসৎ থেকেও পৃথক, সেহেতু অনির্বচনীয়। মায়া এই জগতের কারণ এবং জগৎ মায়ারই পরিণাম। সুতরাং, জগৎ সৎও নয়, অসৎও নয়, অতএব, সদসৎ বিলক্ষণ অনির্বচনীয়া।

দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ : এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মতবাদ অর্থাৎ, দৃষ্টিসৃষ্টিবাদের প্রবর্তক হলেন ভামতী সম্প্রদায়। বাচস্পতিমিশ্র এই মতের প্রবক্তা। তিনি বলেছেন যে, জীব যেহেতু বহু, অবিদ্যাও বহু। জীবই অবিদ্যার আশ্রয় বা অধিষ্ঠান এবং এই জগৎ ঐ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যারই পরিণাম। জীব ও অবিদ্যা যেহেতু বহু, সেহেতু জগতে এতো বৈচিত্র্য। ব্রহ্ম জীবমাত্রেরই অধিষ্ঠান বলে অবিদ্যাগুলিরও অধিষ্ঠান এবং এই কারণে জগতেরও অধিষ্ঠান। এই কারণেই শ্রুতিতে ব্রহ্মকে জগতের উপাদানকারণ বলা হয়েছে। এবং এই একই কারণে শঙ্করাচার্য অবিদ্যাকে ‘পরমেশ্বরাশ্রিতা’ রূপে বর্ণনা করেছেন।

বাচস্পতিমিশ্র আরো বলেন যে অবিদ্যা দু’প্রকার- মূলাবিদ্যা এবং তুলাবিদ্যা। মূলাবিদ্যা হলো ঈশ্বরের উপাধি এবং তুলাবিদ্যা জীবাত্মায় অধিষ্ঠিত। বস্তুত তুলাবিদ্যাই জগৎ সৃষ্টি করে থাকে। অনাদিকাল থেকে জীবের সঞ্চিত সংস্কারই তুলাবিদ্যা। জগতের বহুত্ব তুলাবিদ্যারই সৃষ্টি, জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা বহুত্বকে ব্রহ্মের উপর আরোপ করে থাকে। ব্যবহারিক জগতের বহুত্বের ব্যাখ্যার জন্য বাচস্পতিমিশ্র মায়া বা মূলাবিদ্যার উপর গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে মূলাবিদ্যা জগৎ সৃষ্টির সহকারি কারণ, মূল কারণ নয়। প্রতিটি জীব তার নিজস্ব অবিদ্যা সংস্কার অনুসারে নিজের জ্ঞানের ও ভোগের বিষয় সৃষ্টি করে থাকে।

এই মতে আমাদের অভিজ্ঞতার বিষয় যে জগৎ, তা সত্য নয়। কারণ পারমার্থিক সত্তায় এই জগৎ বাধিত হয়। বাচস্পতিমিশ্রের মতে যতক্ষণ একটা বিষয়ের জ্ঞান হয়, ততক্ষণ সেই বিষয়টির সত্তা প্রতীয়মান হয়। এক অর্থে জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়েরই কেবল প্রাতিভাসিক সত্তা আছে। তুলাবিদ্যার ক্রিয়ার ফলে জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়ের উৎপত্তি হয়। ভ্রান্তপ্রত্যক্ষের বিষয়টি, উদাহরণস্বরূপ রজ্জুতে সর্পভ্রমে সর্পটি যেমন ব্যবহারিক জগতের অভ্রান্ত প্রত্যক্ষের দ্বারা বাধিত হয়, তেমনি সেই অভ্রান্ত প্রত্যক্ষটিও পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। কোন জ্ঞানের বিষয়েরই জ্ঞানাতিরিক্ত সত্তা বা অপ্রতীয়মান সত্তা নেই। সুতরাং, পারমার্থিক বিচারে সৃষ্টি নেই, ধ্বংস নেই, জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। জগৎ হলো জীবের অন্তর্ভুক্ত এক বিরাট ভ্রম। এইজন্যই জগৎ একটি অনির্বচনীয় প্রপঞ্চ।
সুতরাং, এই মতে জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা হলো মূলাবিদ্যারই একটি অবস্থা বা কার্য। তুলাবিদ্যাগুলি মূলাবিদ্যা থেকে উদ্ভূত। ধ্বংসের পর তার আবার মূলাবিদ্যায় লীন হয়ে যায়। তুলাবিদ্যা এবং মূলাবিদ্যার মধ্যে সম্পর্কটি হলো যথাক্রমে অংশ এবং সমগ্রের সম্বন্ধ। অংশের ক্রিয়া বা ধর্মকে সমগ্রের ক্রিয়া বা ধর্মরূপ গণ্য করা হয়। যেমন একটা সাদা কাপড়ের কোন একটা অংশে একটা কালো দাগ থাকলে আমরা সমস্ত কাপড়টাকেই দাগযুক্ত মনে করি এবং ঐ দাগের জন্য সমস্ত কাপড়টিই অব্যবহার্য হয়ে যায়।

বস্তুতপক্ষে পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকেই জগৎ ও জাগতিক বিষয়কে মিথ্যা বলা যায়। এই মতবাদীরা সমষ্টিগত অনুভবসিদ্ধ, তা অবিদ্যাজন্য হলেও, জাগতিক বিষয়ের দৈনন্দিন ব্যবহারকে কখনোই অস্বীকার করেননি। উচ্চতর স্তর থেকেই জাগতিক বিষয়ের সত্তাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি। এই উচ্চতর স্তর হলো  পারমার্থিক স্তর। ব্যবহারিক স্তর থেকে জাগতিক বস্তুর ব্যবহারকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এজন্যই এই মতে ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যা মূলাবিদ্যাকে প্রাতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যা তুলাবিদ্যা থেকে পৃথক করা হয়েছে। তুলাবিদ্যার বিনাশে মূলাবিদ্যার বিনাশ হয় না। বরং মূলাবিদ্যার দ্বারাই তুলাবিদ্যা খণ্ডিত হয়। একমাত্র নিত্য, শুদ্ধ, চৈতন্যের উপলব্ধিতেই তুলাবিদ্যার সঙ্গে মূলাবিদ্যাও বিনষ্ট হয় এবং জগৎ ও জাগতিক বস্তু ব্রহ্মে বিলীন হয়ে এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মই সৎরূপে বিরাজ করে। পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা জগৎ বাধিত হয় বলেই জগৎকে মিথ্যা বলা হয়- ‘জ্ঞানান্তরম্ বাধিতত্বম্ মিথ্যাত্বম্’

জগৎ-সৃষ্টির প্রক্রিয়া :
অদ্বৈতমতে জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্যতা আছে, সেহেতু তাঁরা জগতের সৃষ্টির পর্যায়গুলির বর্ণনাও দিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে, অদ্বৈতবেদান্তী বিবর্তবাদী। জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত। অজ্ঞান বা মায়াশক্তি আবরণরূপে ব্রহ্মকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপ রূপে নশ্বর জগৎ-প্রপঞ্চ সৃষ্টি করে।
শুদ্ধ চৈতন্য ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। উপাধি মায়া, ব্রহ্মকে আবৃত করে নিজের রূপকে ব্রহ্মে আরোপ করে। মায়া-উপাধিযুক্ত হয়ে ব্রহ্ম তখন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সর্বনিয়ন্তা, সর্ববীজস্বরূপ জগৎ-কারণ ঈশ্বররূপে আবির্ভূত হন। ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ডের অব্যক্ত অন্তর্যামী কারণ। ক্রমশ তিনি ব্যক্ত, সূক্ষ্ম কারণ রূপ পরিগ্রহ করে হিরণ্যগর্ভ হন। তারপর তিনি ব্যক্ত স্থূলরূপ পরিগ্রহ করে বৈশ্বানর বা বিরাট হন। বিরাটরূপে তিনি স্থূলজগৎকে বিকশিত করেন।

অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর চিৎ ও অচিৎবিশিষ্ট। সর্বপ্রথম ঈশ্বর মায়ার সহযোগে নামরূপ সমন্বিত সমগ্র বিশ্বের ধারণা সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি সংকল্প করেন যে তিনি বহু হবেন। ঐ সংকল্পে অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর থেকে ক্ষিতি (পৃথিবী বা মাটি), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ)- এই পাঁচটি অপঞ্চীকৃত মহাভূত উপাদান বা তন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। ব্যোমের ধর্ম হলো শব্দ। মরুতের ধর্ম হলো শব্দ এবং স্পর্শ। তেজের ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ ও বর্ণ। অপ্-এর ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ ও স্বাদ। ক্ষিতির ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ, স্বাদ এবং গন্ধ। অবিদ্যাপ্রসূত বলে এই পঞ্চতন্মাত্র ত্রিগুণাত্মক বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণবিশিষ্ট। সত্ত্বপ্রধান তন্মাত্র থেকে আবার পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় আবির্ভূত হয়- আকাশ থেকে শ্রোত্র বা কর্ণ, বায়ু থেকে ত্বক্, তেজ থেকে চক্ষু, অপ্ থেকে রসনা এবং ক্ষিতি থেকে নাসিকা।
পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও সত্ত্বপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র মিলিত হয়ে মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত উৎপন্ন হয়। অন্তঃকরণের এই চারটি অংশ হলো প্রকাশাত্মক অর্থাৎ, স্বচ্ছ। সুতরাং, এই অংশগুলিকে স্বত্ত্বগুণের কার্যরূপে গণ্য করতে হবে। অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি হলো বুদ্ধি। যেমন একই ব্যক্তি পাচক, ছাত্র, শিক্ষকরূপে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে, তেমনি একই অন্তকরণকে তার কাজের ভিন্নতা অনুসারে মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার বলা হয়।

আবার রজোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ- এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। রজঃপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় মিলিতভাবে প্রাণ, অপান্, ব্যান, উদান ও সমান- এই পাঁচটি প্রাণ উৎপন্ন করে। আর তমোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয় সূক্ষ্ম-শরীর ও আকাশাদি পঞ্চস্থূলভূত। স্থূলভূতগুলি পঞ্চীকৃত অর্থাৎ পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন। পঞ্চীকৃত ভূতগুলি হলো যৌগিক উপাদান।

অদ্বৈত-বেদান্ত যেহেতু উপনিষদানুসারী দর্শন, তাই এর দার্শনিক ধারণাগুলির উৎস কিন্তু প্রাচীন উপনিষদগুলিই, যেমন-

‘তমেকনেমিং ত্রিবৃতং ষোড়শান্তং শতার্ধারং বিংশতিপ্রত্যরাভিঃ।
অষ্টকৈঃ ষড়ভিঃ বিশ্বরূপঃ একপাশং ত্রিমার্গভেদং দ্বিনিমিত্তঃ একমোহম্’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৪)
‘পঞ্চস্রোতঃ অম্বুং পঞ্চযোন্যুগ্রবক্রাং পঞ্চপ্রাণোর্মিং পঞ্চবুদ্ধ্যাদিমূলাম্ ।
পঞ্চাবর্তাং পঞ্চদুঃখৌঘবেগাং পঞ্চাশদ্ভেদাং পঞ্চপর্বামধীমঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৫)
অর্থাৎ :
ব্রহ্মচক্রের সাধারণ পরিধি বা প্রান্তভাগ হলো মায়া বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের দ্বারা আবৃত। এর যোলটি অঙ্গ বা কলা (যথা- মন, পঞ্চমহাভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়)। এই ব্রহ্মচক্রের পঞ্চাশটি দণ্ড বা শলাকা (অর্থাৎ, মায়াজনিত প্রমাদ ও বৈকল্য), কুড়িটি খিল বা খোঁটা, ছয় শ্রেণীর বৈচিত্র যার প্রতিটি আবার আট প্রকারের (অষ্টসিদ্ধি অলৌকিক শক্তি- অণিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাককাম্যম্, মহিমা, ঈশিত্বম্, বশিত্বম্ ও কামাবসায়িত)। এইসব দণ্ড, খিল ও বিভিন্ন অংশ যেগুলি বহুবিধ বন্ধনের প্রতীক, তারই উপর ব্রহ্মচক্র দাঁড়িয়ে আছে। এই চক্রের বিচরণভূমি তিনটি (পুণ্য বা ধর্ম, পাপ বা অধর্ম এবং জ্ঞান)। ইন্দ্রিয়ের প্রতি দুই আসক্তিই (সুখ-দুঃখের) মূল কারণ। আমরা সেই ব্রহ্মচক্রের ধ্যান করি (শ্বেতাশ্বতর-১/৪)।
পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) যে নদীর পাঁচটি ধারা। পঞ্চভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি) জ্ঞানেন্দ্রিয়-রূপ নদীকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আঁকাবাঁকা ও খরস্রোতা করে তোলে। পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান) এই নদীর ঢেউ। পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, উপস্থ ও পায়ু) এই নদীর তরঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের উৎস যে মন, সেই মনই আবার এই নদীর উৎসমুখ। পাঁচটি গুণ (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ) যেন এই নদীর আবর্ত এবং পাঁচ রকমের দুঃখ (মাতৃগর্ভে থাকা, জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু) এই নদীর তরঙ্গ-সংক্ষুব্ধ ঢাল। এই নদীর পাঁচটি ভাব (অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা, আমিত্ব বা অহঙ্কার, আসক্তি, দ্বেষ বা বিতৃষ্ণা, এবং কোনকিছু নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি) এবং পঞ্চাশ রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এর গতি। তবে একথা ভুললে চলবে না মনই বিচিত্র ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান, যাকে আমরা জগৎ বলি, তার কারণ (শ্বেতাশ্বতর-১/৫)।

অদ্বৈতমতে পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়া হলো প্রতিটি স্থূলভূতেই পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণ একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে হয়ে থাকে। প্রতিটি স্থূলভূতে সেই সূক্ষ্মভূতের অর্ধাংশ এবং অপর চারটি সূক্ষ্মভূতের এক-অষ্টমাংশ করে থাকে। অর্থাৎ স্থূল আকাশ = ১/২ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী। এভাবে স্থূল বায়ু = ১/২ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থূলভূত থেকে উৎপন্ন হয় চতুর্দশ ভুবন বা লোক (ভুঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্য- এই সপ্ত উর্ধ্বলোক এবং অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল এং পাতাল- এই সপ্ত নিম্নলোক), চতুর্বিধ স্থূলশরীর (জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ) এবং এই সব শরীরের উপযোগী অন্নপানাদি।

যৌগিক বা স্থূলভূতগুলির তমোগুণ প্রাধান্য পেলে সেগুলি বিশ্বের বস্তুতে পরিণত হয় এবং স্থূল শরীরগুলি গঠিত হয়। সরল ভূতগুলি থেকে সূক্ষ্ম শরীরগুলির সৃষ্টি হয়। সূক্ষ্ম শরীর দুই প্রকার, যথা- হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর এবং জীবের সূক্ষ্ম শরীর। হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর উৎকৃষ্ট এবং একে বলা হয় মহৎ তত্ত্ব। অপরপক্ষে জীবের সূক্ষ্ম শরীর হলো নিকৃষ্ট। ঈশ্বর হলেন পাঁচটি সূক্ষ্মভূতের অর্থাৎ, পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চমহাভূত, সপ্তদশ উপাদানবিশিষ্ট সূক্ষ্ম শরীর এবং হিরণ্যগর্ভের স্থূলশরীর উৎপাদনের অপরোক্ষ কারণ। বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ের সৃষ্টি তিনি হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি প্রভৃতির মাধ্যমে করেন।

পঞ্চতন্মাত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্যই অবিদ্যাসৃষ্ট, ব্রহ্মের উপাধি। এই সব উপাধি দ্বারা উপহিত ব্রহ্মই ‘জীব’ নামে অভিহিত। ব্রহ্মজ্ঞানে সকল উপাধি বিনষ্ট হয় এবং শুদ্ধচৈতন্য ব্রহ্ম আবরণমুক্ত হয়ে পুনঃপ্রকাশিত হন। তাছাড়া অদ্বৈতবেদান্তীরা সৃষ্টি ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাস করেন। ধ্বংসের প্রক্রিয়া সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত। মূর্ত প্রপঞ্চ, অমূর্ত প্রপঞ্চে লীন হয়ে যায় এবং অমূর্ত প্রপঞ্চ অব্যাক্তৃত প্রপঞ্চে লীন হয়। অব্যাক্তৃত অর্থাৎ, অপ্রকাশিত অবশ্য অন্য কিছুতে লীন হয় না। কারণ তার কোন উপাদান কারণ নেই। একমাত্র মোক্ষলাভের সময়েই অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়। উপনিষদীয় শ্রুতিতেও শাঙ্করদর্শনের এই প্রাক-ধারণাটুকু পাওয়া যায়-

‘জ্ঞ অজ্ঞৌ দ্বৌ অজৌ ঈশ-অনীশৌ অৎা হি একা ভোক্তৃভোগ্যার্থযুক্তা।
অনন্তঃ চ আত্মা বিশ্বরূপঃ অকর্তা ত্রয়ং যদা বিন্দতে ব্রহ্মং এতৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৯)
অর্থাৎ :
সর্বজ্ঞ ঈশ্বর এবং অজ্ঞ জীব উভয়ই অজাত (জন্মরহিত)। জীবের ভোগের জন্য মায়া-প্রকৃতি নানাবিধ ভোগ্যবস্তু সৃষ্টি করেন। কিন্তু পরমাত্মা অসীম, তাই তিনি সাক্ষীস্বরূপ। ভোক্তা, ভোগ্যবস্তু এবং ভোগ স্বয়ং- অর্থাৎ ‘জীব’, ‘প্রকৃতি’ (মায়া) এবং ঈশ্বর (পরমাত্মা)- এই তিনই ব্রহ্মে একাত্ম। এই সত্য উপলব্ধি করতে পারলে জীব মুক্ত হয় (শ্বেতাশ্বতর-১/৯)।


আত্মার সাথে পরমাত্মার একরূপ মিলন ঘটিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা সবাই নিজেকে আমিই বলেছেন।
তাহলে ঐ আমি কে? যিনি আমি বলেছেন আসলেই তিনি নিজেই কি ঈশ্বর?
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্ তদ্বন্তিকে। তদন্তরস্য সর্বদ্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।। ঈশাবাস্যোপনিষদ্-৫
অর্থঃ- তিনি চলেন এবং চলেনও না। তিনি বহুদুরে আবার অতি নিকটেও, তিনি সমস্ত জগতের অন্তরে পরিপূর্ণ আবার বাহিরেও পরিপূর্ণ।
জ্ঞানীদের জন্য তিনি পরমাত্মা অন্তরে বাস আর অজ্ঞানীদের জন্য দূরে থেকেও বহু দূরে।
অজ্ঞানীরা ঈশ্বরের স্বক্ষমতার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে আকারেই খুঁজে, ফলশ্রুতিতে তারা জন্ম মৃত্যুর আবর্তে ঘুরতে থাকে আর জ্ঞানীরা ঈশ্বের শব্দ ব্রহ্ম ও৩ম্ এর সাধনা করে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন ঘঠিয়ে পরম সুখ লাভ করে।
স বেদৈতৎ পরমং ব্রহ্ম ধাম যত্র বিশ্বং নিহিতং ভাতি শুভ্রম্।
উপাসতে পুরুষং যে হ্যকামাস্তে শুক্রমেতদতিবর্তন্তি ধীরাঃ।।
মুন্ডকোপনিষদ
-৩য় মুণ্ডক/২য়/১
অর্থঃ- পরমাত্মার ধ্যানে রত নিষ্কামভাব যুক্ত সাধক প্রকাশময় পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে উপলব্দি করেন, যার মধ্যে সম্পূর্নজগত প্রতীত হয়। সেই নিষ্কামভাবযুক্ত সাধকই বুদ্ধিমান, যাদের রজোবীর্যময় শরীর অতিক্রম করে আর পুনঃজন্ম হয়না।
অর্থাৎ তাঁহারা মোক্ষ লাভ করেন, বা ব্রহ্ম লাভ করেন।।
এখন দেখি ত্রিশঙ্ক মুনি ব্রহ্ম লাভের পর কি বলেছিলেনঃ-
অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। ঊর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণঁ সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোক্ষিতঃ। ইতি
ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।
তৈত্তিরীয়োপনিষদ- শিক্ষা বল্লী-দশম অনুবাক-১।।
অনুবাদঃ-
ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর ত্রিশঙ্ক মুনি বলেছিলেন, আমি সংসাররূপী বৃক্ষের প্রেরয়িতা। ব্রহ্মে পরিনত হয়ে আমি সমস্ত বিশ্বের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি।
গিরিপৃষ্ঠের, মতো আমার কীর্তি উচুঁ। ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হবার দরুন আমার কীর্তি ব্রহ্মের মতো মহান ও অনন্ত। আমি ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি কাজেই আমি পবিত্র। সূর্যে যেমন উত্তম অমৃত আছে আমিও সেরূপ উত্তম অমৃত। আমিই সেই ধনরূপ আত্মতত্ব শ্রেষ্ট মেধাযুক্ত। আমি অমৃত ও অক্ষয়।
ছান্দোগ্য উপনিষদে সনৎকুমার
তাঁর শিষ্য নারদকে বলেছেন-
স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিনতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিতি। অথাতোহহঙ্কারাদেশ
এবাহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং
পশ্চাদহং পুরস্তাদহং
দক্ষিণতোহহমুত্তরতোহহমেবেদং
সর্বমিতি। (ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭/২৫/১)
অর্থ: সেই ভুমাই নিম্নে, তিনি উর্ধ্বে, তিনিই পশ্চাতে, তিনিই সম্মূখে, তিনিই দক্ষিনে, তিনিই বামে- তিনিই এই সমস্ত কিছু। এখন "অহম" দৃষ্টিতে উপদেশ- আমিই অধোভাগে, আমি উর্ধ্বে, আমি পশ্চাতে, আমি সম্মূখে, আমি দক্ষিণে, আমি উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।

ব্রহ্ম এক ইহা সমস্ত উপনিষদের সিদ্ধান্ত

একমেবাদ্বিতীয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ //)

তৎসমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে (শ্বেতাশ্বতর /)

সর্বে বেদা যৎ পদমানন্তি তপাংসি সর্বাণি যদ বদন্তি (কঠ //১৫)

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্নং তমসঃ পরস্তাত

তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়ঃ (যজুর্বেদ ৩১/১৮)

সদেব সৌম্য ইদম অগ্র আসিৎ (ছান্দোগ্য উপনিষদ //)

ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ (বৃহদারণ্যক //১০, মৈত্রী /১৭)

আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীৎ নান্যৎ কিঞ্চন মিষৎ ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি(ঐতরেয় ব্রাহ্মণ //)

অনুবাদ:- এই জগত সৃষ্টির প্রথমে একমাত্র পরমাত্মাই ছিলেন তিনি ভিন্ন অন্য কেউ ছিলেন না তিনি লোকসমূহ সৃষ্টির জন্য ইচ্ছা করলেন

সোহকাময়ৎ বহুস্যাম প্রজায়েয়তি (তৈত্তীরিয় উপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লী /)

অনুবাদ:- সেই পরমেশ্বর ইচ্ছা করলেন আমি বহু হয়ে যাই(গল্প আকারে)

যথোর্ণনাভিস্তন্তুনোচ্চরেদ্যথাগ্নেঃ ক্ষুদ্রা বিস্ফুলিঙ্গাঃ ব্যুচ্চেরন্ত্যেবমেবাস্মাদত্মনঃ সর্বে প্রাণাঃ সর্বে লোকাঃ সর্বে দেবাঃ সর্বাণি ভূতানি ব্যুচ্চরন্তি তস্যোপনিষৎ সত্যস্য সত্যমিতি প্রাণা বৈ সত্যং তেষামেষ সত্যম।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ //২০)

শঙ্কর ভাষ্য অনুযায়ী অনুবাদ:- যেমন একটি মাকড়সা তার লালা দিয়ে জাল তৈরী করে সেই জালে স্বেচ্ছায় বিচরন করেন, যেমন আগুনের অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ তৈরী হয় তেমন পরমাত্মার থেকে সকল ইন্দ্রিয় সকল জীব, সকল দেবতা, ত্রিলোক সহ এই জগত সৃষ্টি হয়  সেই পরমাত্মার উপনিষৎ সত্যের সত্য ইন্দ্রিয়বৃন্দই সত্য, ইনি তাহাদের সত্য(উদাহরন আকারে)

তদৈক্ষত বহুষ্যা প্রজায়য়েতি (ছান্দোগ্য উপনিষদ //)

সর্ব্ব বেদান্ত প্রত্যয়ঞ্চোদনাদ্য বিশেষাৎ (বেদান্ত সূত্র //)

সূত্রার্থ:- সমস্ত বেদান্তে ভিন্ন ভিন্ন রূপ উপাসনার কথা বলা হলেও মূলত তাদের কোনো ভেদ নেই

 

যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রয়ন্তভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব  তদ ব্রহ্ম

তৈত্তীরিয় উপনিষদ ভৃগুবল্লী/১ম অনুবাক/১ম মন্ত্র

অনুবাদ:- জীব জগত যার থেকে উৎপন্ন, উৎপত্তির পর যাতে স্থিত, বা যার সহায়তায় জীবিত, প্রলয়ে যাতে প্রবেশকরে, তাকে জানো তিনিই ব্রহ্ম

# দ্যুভ্বাদ্যায়তনং স্বশব্দাৎ (ব্রহ্ম সূত্র১//)

সূত্রার্থ:-ব্রহ্ম শব্দে তাকে বোঝায় যিনি শ্রুতিতে দ্যুলোক ভূলোক প্রভৃতির আধার বলে কীর্তীত হয়েছেন

# ব্রহ্ম সূত্র // জন্মাদস্য যতঃ সৃষ্টি ইত্যাদি যার থেকে

) জগদব্যাপারবর্জ্জং প্রকরণাদসন্নিহিতত্বাচ্চ।। ব্রহ্ম সূত্র //১৭

একমাত্র জগতসৃষ্টাদি কার্য্য বাদে (জগদব্যাপারবর্জ্জং) অণিমাদি অন্যান্য ঐশ্বর্য্য মুক্তজীবগন বা অন্যদেবতাগনের মধ্যেও থাকে একমাত্র পরমেশ্বরই সৃষ্টিকার্য্যাদি করতে পারেন মুক্তজীবগন সৃষ্টাদিকার্য্যের সঙ্গে যুক্ত নয় (অসন্নিহিত) শ্রুতি পরমেশ্বর বিষয়ক প্রকরণে তাই বলে

# বৈ নৈব রেমে তস্মাদেকাকী রমতে দ্বিতীয় মৈচ্ছত বৃহদারণ্যক //

সৃষ্টির আদিতে একমাত্র ব্রহ্মই ছিলেন একাকী আনন্দ নেই তাই তিনি মনে করলেন বহু হব তাই তিনি নিজ প্রকৃতির প্রতি ঈক্ষণ করলেন(গল্প আকারে)

জীবাত্মা কখনো ব্রহ্ম হতে পারে না কারন বেদে ব্রহ্মের স্বরূপ নিয়ে বলা হয়েছে..

ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হলেন সর্বব্যাপক।ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছু বস্তুকে তিনি আচ্ছাদন করে আছেন।(যর্জুবেদ_অধ্যায়_40, মন্ত্র_1)।
এইজন্য তিনি নিরাকার(যর্জুবেদ,40/8, ঈশোপনিষদ_8)। অর্থাৎ ঈশ্বর আকার বা ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট নন।কারণ,আকার ধারণকারী জীব,এক সময়ে,সব জায়গায় অবস্থান করতে পারে না।
এই বিষয়ে,বেদ,উপনিষদ ও গীতার অনেক প্রমাণ আছে দেখুন-------------
বেদের যে মন্ত্রটি নিয়ে সবচেয়ে অপব্যাখ্যা করা হয়,সেই মন্ত্রটি দেখুন-
সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাহত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।। [ঋগ্বেদ_10/90/1, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ_3/14]
অর্থ#সেই পূর্ণস্বরূপের অনন্ত মস্তক,অনন্ত নয়ন, অনন্ত চরণ।তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডকে সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করে এবং অতিক্রম করে,অসীমরূপে বিদ্যমান আছেন।
এইমন্ত্রে,নিরাকার, সর্বব্যাপক ঈশ্বরের অনুবৃত্তি রয়েছে।ঈশ্বর সব জায়গায় অবস্থান করছেন,এটাই এই মন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো বিশ্ববাহুরুত বিশ্বতস্পাৎ।
সং বাহুভ্যাং ধমতি সং পতত্রৈ র্দ্যাবাভূমী জনয়ন্ দেব একঃ।।
যর্জুবেদ-17/19
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্_3/3
অর্থ#যত চোখ,যত মুখ, যত হাত,যত পা আছে,সব ঈশ্বরেরই।তিনিই মানুষ আদিদের বাহু সংযুক্ত করেন এবং মানুষাদিকে পা ও পাখি আদিকে পাখনা সংযুক্ত করেন।দ্যুলোক ও ভূলোক সৃষ্টি করে তাহার অদ্বিতীয় প্রকাশকরূপে ঈশ্বর বিরাজিত।
বিচার করার বিষয় হল এই যে,এখানে কোন স্থুল শরীরধারী ঈশ্বরের কথা বলা হয় নি। এখানেও ঈশ্বরের সর্ব ব্যাপকতার অনুবৃত্তি আছে।
এই বিষয়ে, যর্জুবেদ_অধ্যায়_ 40,মন্ত্র_8 এর প্রমাণ দেখুন-----
যর্জুবেদে,(অধ্যায়_40,মন্ত্র_8) খুব স্পষ্টভাবে বলা আছে যে,ঈশ্বর শরীর ধারণ করেন না অর্থাৎ ঈশ্বর নিরাকার।ঈশ্বরের অবতার বা সাকার রূপ হওয়া সম্ভব নয়।
{ঈশোপনিষদ্, যর্জুবেদের 18টি মন্ত্র নিয়ে গঠিত। যর্জুবেদের,40/8 মন্ত্রটি পাওয়া যায়,ঈশোপনিষদের,8 নং মন্ত্রে।এই মন্ত্রের, শংকারাচার্য যা ভাষ্য করেছেন,তা মূল সংস্কৃত ভাষ্যসহ বাংলা অনুবাদ ও পদের অর্থ সহকারে দিলাম---------------- }
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ-
র্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
ঈশোপনিষদ:মন্ত্র:8
যর্জুবেদ:অধ্যায়_ 40,মন্ত্র নং_8
ব্যাখ্যা:(অন্বয়)------
সঃ(সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্(শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ(ক্রান্তদর্শী), মনীষী(সর্বজ্ঞ),পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান),স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ),[সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ(লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
অনুবাদ-----
তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা, সর্বব্যাপী,জ্যোতির্ময় ও অশরীরী(অশরীর শব্দে পরমাত্মার লিঙ্গ শরীরের নিষেধ) ক্ষতরহিত,শিরাহীন, স্নায়ুহীন,(ক্ষতরহিত ও শিরাহীন শব্দে, স্থূল শরীরের নিষেধ), নির্মল (নির্মল শব্দে,কারণ শরীরের নিষেধ করা হল) ও অপাপবিদ্ধ।তিনি, সর্বদর্শী,সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান ও স্বয়ম্ভূ।পরমাত্না, চিরকাল ধরে, লোকের যথাযথ কর্মফল অনুসারে কর্তব্য বিধান করছেন।
শংকর-ভাষ্যম্
যোহয়মতীতৈর্মন্ত্রৈরুক্ত আত্না, স স্বেন রূপেণ কিংলক্ষণ ইত্যাহ অয়ং মন্ত্রঃ। স পর্য্যগাৎ, স যথোক্ত আত্না পর্য্যগাৎপরি সমন্তাৎ অগাৎ গতবান্ আকাশবদ্ব্যাপীতর্থ্যঃ। শুক্রং শুদ্ধং জ্যোতিষ্মৎ দীপ্তিমানিত্যর্থঃ।অকায়মশরীরঃ--
লিঙ্গশরীরবর্জিত ইত্যর্থঃ।অব্রণমক্ষতম্।অস্নাবিরং--স্নাবাঃ শিরা যস্মিষ্ ন বিদ্যন্ত ইত্যস্নাবিরম্।অব্রণমস্নাবিরমিত্যেতাভ্যাং স্থুলশরীরপ্রতিষেধঃ। শুদ্ধং নির্মলমবিদ্যামলরহিতমিতি কারণ শরীর প্রতিষেধঃ।অপাপবিদ্ধং ধর্মাধর্মাদিপাপবর্জিতম্।শুক্রমিত্যাদীনি বচাংসি পুংলিঙ্গত্বেন পরিণেয়ানি। 'স পর্য্যগাৎ' ইত্যুপক্রম্য 'কবির্মনীষী' ইত্যাদিনা পুংলিঙ্গত্বেনোপসংহারাৎ।কবিঃ ক্রান্তদর্শী---সর্বদৃক্। 'নান্যোহতোহস্তি দ্রষ্টা'(বৃ.আ. 3/7/23) ইত্যাদিশ্রুতেঃ। মনীষী মনস ঈষিতা-----সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ইত্যর্থঃ।পরিভূঃ সর্বেষাং পরি উপরি ভবতীতি পরিভূঃ।স্বয়ম্ভূঃ স্বয়মেব ভবতীতি,যেষামুপরি ভবতি,যশ্চোপরি ভবতি,সঃ সর্ব স্বয়মেব ভবতীতি স্বয়ম্ভূঃ।স নিত্যমুক্ত ঈশ্বরো যাথাতথ্যতঃ, সর্বজ্ঞত্বাদ্,যথাতথাভাবো যাথাতথ্যং তস্মাদ্ যথাভূতকর্মফলসাধনতোহ-র্থান্ কর্তব্যপদার্থান্ ব্যদধাদ্বিহিতবান্ যথানুরূপং ব্যভজদিত্যর্থঃ শাশ্বতীভ্যো নিত্যাভ্যঃ সমাভ্যঃ সংবৎসরাখ্যেভ্যঃ প্রজাপতিভ্য ইত্যর্থঃ।।

ওম্ স্বয়ম্ভূরসি শ্রেষ্ঠোরস্মিবর্চোদা অসি।
বর্চো মে দেহি সূর্যসাবৃত মন্বাবর্তে।।
যজুঃবেদ~26/2
অনুবাদ# হে পরমাত্মা! তুমি স্বয়ম্ভু,শ্রেষ্ঠ,ও জ্যোতির্ময়।তুমি জ্ঞানদাতা, আমাকেও জ্ঞান দান করো।তুমি চরাচর জগতের আত্মা।মহাপুরুষগণ তোমার উপদেশ গ্রহণ করে থাকেন।হে প্রভু, আমিও তা গ্রহণ করে জীবনকে পরিচালিত করব।

গীতা ও উপনিষদের প্রমাণ
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।
গীতা_13/14,
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ_3/16
অর্থ#সর্বত্র যাঁর হাত ও পা,সর্বত্র যাঁর চোখ,মাথা ও মুখ,সর্বত্র যাঁর কান,তিনি ইহলোকে সমস্ত ব্যাপ্ত করে অবস্থান করেন।
অর্থাৎ,ঈশ্বর সমস্ত প্রাণী শরীরে অবস্থান করছেন।
এই শ্লোক পড়ে অনেক সময়,ভ্রান্ত ধারণা হতে পারে যে,ঈশ্বর শরীরধারী।
এইজন্য তার পরের শ্লোকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দেখুন--------
সর্বেন্দ্রিয়গুণানাং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
অসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।
গীতা_13/15
অর্থ#ব্রহ্মের ইন্দ্রিয়গুলি সকল গুণের প্রকাশক হলেও তিনি ইন্দ্রিয় বর্জিত। তিনি সকলের সঙ্গে সম্বন্ধহীন হয়েও সকলকেই ধারণ করে রয়েছেন।তিনি নির্গুণ হয়েও সকল গুণের প্রতিপালক।
সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্য শরণং বৃহৎ।।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ_3/17
অর্থ#ব্রহ্ম নিখিল ইন্দ্রিয়ের গুণবিশিষ্ট-রূপে প্রতিভাত হন।অথচ তিনি সমুদয় ইন্দ্রিয়ব্যাপার-শূন্য।তিনি সকলেরই শক্তিশালী নিয়ন্তা সকলের আশ্রয়, এবং পরম কারণ।
অপাণিণাদো জবনো গ্ৰহীতা।
পশ্যতচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্ৰ্যং পুরুষং মহান্তম্
।।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্_3/19

অর্থ#ব্রহ্মের,হাত-পা না থাকলেও তিনি দ্রুত গমন করেন এবং সর্ববস্তু গ্রহণ করেন,চোখ না থাকলেও দর্শন করেন,কান না থাকলেও শ্রবণ করেন। তিনি জ্ঞাতব্য সর্ব বস্তু জানেন,অথচ তাঁকে কেউ জানে না।ব্রহ্মবিদগণ তাঁকে সর্বাগ্ৰণী,পরিপূর্ণ এবং মহান বলে থাকেন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ