ঈশ্বর কৃত সূর্য যখন প্রকাশিত হয় তখন কারো সাথে ভেদ করে না, তার আলো প্রদান করতে। পৃথিবী সমান ভাবে সকল কে ধারণ করছে। জল ব্রাহ্মণ, শূদ্র নারী মানব মাত্র সকলের প্রয়োজন মেটায়, তৃষ্ণা নিবারণ করে, তাহলে বেদ যদি ঈশ্বর প্রদত্ত হয় তবে কেন সকল মানুষের বেদের উপর সমান অধিকার নাই?
মন্দবুদ্ধির লোকেরা তখন এই বলে তাদের কে নিগৃহীত করেছে, দেখ যেখানে শাস্ত্রেই বলা হয়েছে নারী, শূদ্র অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, তোমাদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, সেখানে তোমরা এত কথা বলছ কেন?
আজকে এমনি এক কল্পিত পুরাণের দাবি কে বিচার করে দেখব।
ভাগবত বলে——
❏ স্ত্রীশুদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতিমাখ্যাং কৃপয়া মুনিনা কৃতম।।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৪/২৫)
বঙ্গানুবাদঃ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহর্ষি ব্যাসদেব মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।
এখানে বলা হচ্ছে স্ত্রী, শূদ্রের বেদ বুঝার ক্ষমতা নাই।
এই শ্লোকের তাৎপর্যে অন্যতম বৈষ্ণব প্রভুপাদ ব্যাখা করে বলেন---
(মূল শ্লোক এবং প্রভুপাদের ব্যাখার গোঁজামিল ভাল করে লক্ষ্য করুন)
প্রথমে প্রভুপাদ দ্বিজবন্ধু কারা সে সম্পর্কে বলেন—
যে সমস্ত মানুষ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য অথবা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ যাদের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয়নি, তাদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু। যথাযথ সংস্কার না থাকায় তাদের দ্বিজ বলে স্বীকার করা হয় না। বৈদিক সমাজে সংস্কারগুলি জন্মের পূর্ব থেকেই অনুষ্ঠান হয়। মাতৃগর্ভে বীজ রোপণ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় গর্ভাধান সংস্কার। এই গর্ভাধান সংস্কার বা পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা ব্যতীত যার জন্ম হয়েছে, তাকে যথার্থ দ্বিজ-পরিবারভুক্ত বলে গণনা করা হত না।
তারপর প্রভুপাদ ‘দ্বিজ’ কারা? সে সম্পর্কে বলেন-
গর্ভাধান সংস্কারের পর অন্য আরো সংস্কার রয়েছে যার একটি হচ্ছে উপনয়ন সংস্কার। এটি অনুষ্ঠিত হয় দীক্ষা গ্রহণের সময়। এই বিশেষ সংস্কারটির পর তাকে ‘দ্বিজ’ বলা হয়। প্রথম জন্ম হয় গর্ভাধান সংস্কারের সময়, এবং দ্বিতীয় বার জন্মটি হয় সদগুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের সময়। যারা এই মহান, সংস্কারগুলির দ্বারা যথাযথভাবে সংস্কৃত হয়েছেন, তাদেরই প্রকৃতপক্ষে দ্বিজ বলা হয়।
পিতামাতা যদি গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে, তা হলে তাদের সন্তানদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু। এই দ্বিজবন্ধু যথাযথ সংস্কারের দ্বারা সংস্কৃত দ্বিজ পরিবারের সন্তানদের মতো ততটা বুদ্ধিমান হয় না। দ্বিজবন্ধুদের সাধারণত বুদ্ধিসম্পন্ন স্ত্রী এবং শুদ্রদের সমকক্ষ বলে বিবেচনা করা হয়। শুদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংস্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংস্কারের অনুষ্ঠান করতে হয় না। অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, অর্থাৎ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজবন্ধুদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছিল।
তাহলে প্রভুপাদের বক্তব্য অনুসারে বুঝলাম, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ যাদের মধ্যে পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয় নাই তাদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু, যাদের যথাযথ সংস্কার নাই তারা দ্বিজবন্ধু। পিতামাতা গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে, তা হলে তাদের সন্তানদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু।
আর গর্ভাধান, উপনয়ন সংস্কার এবং দীক্ষা গ্রহণের পর তাদের কে ‘দ্বিজ’ বলা হয়।
এই দ্বিজবন্ধু যথাযথ সংস্কারের দ্বারা সংস্কৃত দ্বিজ পরিবারের সন্তানদের মতো ততটা বুদ্ধিমান হয় না। এ জন্য উত্তম সমাজ, বুদ্ধিমান মানব, “দ্বিজ” সৃষ্টি করার জন্য সংস্কার আবশ্যক। গর্ভাধান, উপনয়ন, দীক্ষা ইত্যাদি সংস্কারের পর মানুষ দ্বিজ পরিবারের হয়।
কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে দ্বিজবন্ধু তাদের কে বলা হচ্ছে যারা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, কিন্তু পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয় নাই, গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে তাদের কে। তাদের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দের সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিজ বুদ্ধিমান সন্তান সৃষ্টি করার সুযোগ আছে; কিন্তু স্ত্রী, শুদ্রদের সংস্কারের সুযোগ নাই, তাদের সংস্কারের প্রয়োজন নাই কারণ তারা জন্মগত ভাবেই অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন।
এ জন্য প্রভুপাদ বলছেন তাদের “শুদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংস্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংস্কারের অনুষ্ঠান করতে হয় না। অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, অর্থাৎ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজবন্ধুদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছিল।” অর্থাৎ সংস্কার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দের জন্য, শুদ্র এবং স্ত্রী দের জন্য নয়। তাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই। মানে বলা হচ্ছে শুদ্র, স্ত্রী তোমাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই, যে জিনিস তোমাদের হৃদয়ঙ্গম, উপলব্ধী বা বুঝার ক্ষমতা নাই সে জিনিস তোমাদের পড়ার দরকার টা কি? তোমরা মহাভারত পর এটাই তোমাদের জন্য প্রযোজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রীদের যদি সংস্কারের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে পুরুষ সংস্কৃত হয়ে, অর্থাৎ শুধুমাত্র পুরুষের একার পক্ষে কি দ্বিজ বুদ্ধিমান সন্তান সৃষ্টি করা সম্ভব?
তাহলে শ্রীমদ্ভাগবতের শ্লোক এবং ইসকন প্রতিষ্ঠাতা প্রভুপাদের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম স্ত্রী, শূদ্ররা হচ্ছে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন; তাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার বা বুঝার ক্ষমতা নাই; শূদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংষ্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংষ্কার অনুষ্ঠান করতে হয় না। মানব সমাজের একটা বড় অংশ শুদ্র এবং স্ত্রী আর তাদের কেই বলা হচ্ছে তোমাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই এটা তাদের জন্য যে অপমান জনক সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবার তাহলে আসুন, স্বয়ং বেদ কি বলে দেখি—
❏ যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ,ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।।
➢ যজুর্বেদ ২৬/২
বঙ্গানুবাদঃ হে মনুষ্যগন আমি যেরূপে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র , স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সকল জনগনকে এই কল্যানদায়িনী পবিত্র বেদবাণী বলিতেছি, তোমরাও সেই রূপ কর। যেমন বেদবাণীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেইরুপ হও। আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক। এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক ।
উপরোক্ত বেদ মন্ত্রে পরমেশ্বর স্বয়ং বলেছেন আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, নারী মনুষ্য মাত্র সকলের জন্য কল্যানদায়ি বেদবাণী বলিয়াছি এবং সবাইকে বেদবাণী উপদেশ কর; বেদ অধ্যয়ন না করে তার উপদেশ, প্রচার করা কি সম্ভব? এ জন্য এখানে সবাই কে বেদ অধ্যয়ন করতে বলেছেন, প্রচার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন ভাগবতের বক্তব্য অনুসারে প্রশ্ন হচ্ছে....
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে তাদের কে বেদবাণী বলেছে কেন?
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকলে, তাদের জন্য বেদের বাণী কিভাবে কল্যানদায়িনী হল?
☞ যে বেদ তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না সে বেদ তারা প্রচার করবে কিভাবে?
☞ তাদের কেও বেদ বাণীর উপদেশ প্রচার করতে বল্লেন কেন?
স্ত্রী, শূদ্রের বেদ পাঠ করার অধিকার, বুঝার, হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা তো আছেই এমনকি বেদ দ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে নারী, শূদ্র ঋষি পর্যন্ত আছে। নারী ঋষিকাগণের মধ্যে রোমশ, লোপামুদ্রা, বাক্, অপালা, কাদ্রু, বিশ্ববারা, ঘোষা, জুহু, ভগম্ভ্রিনি, পৌলমি, যমী, ইন্দ্রাণী, সাবিত্রী, দেবযানী, নোধা, গৌপায়না, অম্ভৃনী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বেদ দ্রষ্টা ঋষি দের মধ্যে যেমন নারী ঋষিকা আছে; তেমনি "শূদ্র" ঋষিও আছে। সেই বেদ দ্রষ্টা শূদ্র ঋষির নাম হচ্ছে "কবষ"। তিনি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সূক্তের মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি।
☞ প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রী, শূদ্রের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা যদি না থাকে এবং পড়ার অধিকার ও যদি না থাকে তাহলে তাঁরা বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন কিভাবে?
নারী-পুরুষ, মনুষ্য মাত্র সকলের জন্য সংস্কার আবশ্যক এবং প্রযোজ্য।
❏ যুব সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎস উ শ্রেয়ান্ ভবতি জায়মানঃ।
তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো মনসা দেবয়ন্ত।।
➢ ঋগ্বেদ ৩/৮/৪
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য পূর্ব্বক বিদ্যালাভ করিয়া, উত্তমবস্ত্র পরিধান করিয়া যৌবন কালে যিনি গার্হস্থ্য আশ্রমে উপনীত হন তিনিই দ্বিজত্ব লাভে খ্যাতি অর্জ্জন করিয়া মহৎ হন। ধ্যান পরায়ণ, মননশীল, জ্ঞান প্রচারক, ধৈর্যবান্ বিদ্ধানেরা সেই পুরুষকে উন্নতি লাভে সহায়তা প্রদান করেন।
বেদ যুবক-যুবতী উভয় কে ব্রহ্মচর্য পালন করার নির্দেশ দেয়।
❏ ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।
অনডৃবান্ ব্রহ্মচর্যেনাশ্বো ঘাসং জিগীর্ষতি।।
➢ অথর্ববেদ ১১/৫/১৮
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিবার পর কুমারী কন্যা যুবা পতিকে লাভ করিবে। বলবান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ভোগ্য পদার্থকে সম্যক ভোগ করিতে পারে।
বেদ পতি-পত্নী কে একসাথে যজ্ঞ করতে বলেন।
❏ যা দম্পতী সমনসা সুনুত আ চ ধাবতঃ।
দেবাসো নিত্যয়াহশিরা।
➢ ঋগ্বেদ ৮/৩১/৫
বঙ্গানুবাদঃ হে বিদ্ধানগণ! যে পত্নী ও পতি এক সঙ্গে একমনে যজ্ঞ করে, উপাসনা দ্বারা যাহাদের মন পরমাত্মার দিকে ধাবমান হয় তাহারা নিত্য পরমাত্মার আশ্রয়েই সব কার্য করে।
☞ বেদ যদি নারীদের হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকত যেমটা ভাগবতে বলা হয়েছে, তাহলে বেদে নারীকে উদেশ্য করে কোন বাণী থাকত না। কারণ নারীদের তো বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই তাহলে, নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে বাণী বা নির্দেশ কিভাবে থাকবে? কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে অনেক বাণী আছে। যেমন-
❏ সম্রাজ্ঞী —
যথা সিন্ধুর্ণদীনাং সাম্রাজ্যং সুষুবে বৃষা।
এবা ত্বং সম্রাজ্ঞ্যেধি পত্যুরস্তং পরেত্য।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৩।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধূ! যেমন বলবান সমুদ্র নদী সমূহের উপর সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে তুমিও তেমন পতিগৃহে গিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ পতিগৃহ —
সম্রাজ্ঞ্যেধি শ্বশুরেষু সম্রাজ্ঞ্যুত দেবৃষু।
ননান্দুঃ সম্রাজ্ঞ্যেধি সম্রাজ্ঞ্যুত শ্বশ্ব্রাঃ।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৪।
বঙ্গানুবাদঃ শ্বশুরদের মধ্যে এবং দেবরদের মধ্যে, ননদ ও শাশুড়ীদের সঙ্গে মিলিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ সুমঙ্গলী —
সুমঙ্গলী প্রতরণী গৃহাণাং সুশেবাপত্যে শ্বশুরায় শংভুঃ। স্যোনা শ্বশ্ব্রৈ প্র গৃহান্ বিশেমান্।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/২/২৬।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধু! কল্যাণময়ী, গৃহের শোভাবর্দ্ধনকারিণী, পতিসেবা পরায়ণা, শ্বশুরের শান্তিদায়িনী, শ্বাশুড়ীর আনন্দ দায়িনী! গৃহকার্যে নিপূণা হও।
অতএব স্ত্রী, শূদ্র সকলের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা আছে এবং সকলে বেদ অধ্যয়ন করতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে......
☞ আমাদের কোনটা গ্রহণ করা উচিত? বেদ নাকি ভাগবত?
☞ ব্যাসদেব যদি শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করতেন তাহলে তিনি এই বেদ বিরোধী কথা বল্লেন কিভাবে?
তার কারণ হচ্ছে ভাগবত ব্যাসদেব রচিত নয়।
যদি ভাগবতের কথা সত্যি বলে ধরে নি; অর্থাৎ স্ত্রী,শূদ্রের বেদ বুঝার ক্ষমতা নাই তাই তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছে।
☞ তাহলে, মহাভারতের যুগের আগেও স্ত্রী,শূদ্র ছিল কিন্তু তখন তাদের উদ্ধারের জন্য কি করা হয়েছিল? তারা ও যাতে তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে সে জন্য কি করা হয়েছিল?
প্রাচীন বৈদিক সমাজে নারীশিক্ষার ও নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য জীবন পালনের একটি চিত্র দেখা যাক:
“ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।”
(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)
অর্থাৎঃ ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে।
পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন-
“মাতুলাচার্যাণামানুক্ত”
(পাণিনি ৪.১.৪৬)
এবং “ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্”
(পাণিনি ৬.২.৭৬)
ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ ১.৩.১১, ১০.১৫৬.২ প্রভৃতিতে।
“চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী”
(ঋগ্বেদ ১.৩.১১)
এখানে নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরণদাত্রীরূপে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
পবিত্র বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে গার্গী, মৈত্রেয়ী, অত্রেয়ী, বাক, অপালাসহ বিভিন্ন নারীরা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ঋষি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।
উত্তররামচরিতমানস এর ২.৩ এ পাওয়া যায় ঋষিনী অত্রেয়ী বলছেন,
“এই অঞ্চলে অগস্ত্যসহ অনেক বিখ্যাত মহর্ষি আছেন। আমি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে এখানে এসেছি তাঁদের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়ন করতে।”
“ওঁ শুদ্ধ পুত যোসিত যজ্ঞিয়া ইমা ব্রাহ্মনম হস্তেষু প্রপ্রতক সদায়মি।
যত্কামা ইদমাভিসিন্চমি বো হামিন্দ্রো মরুত্বন্স দদাতু তন্বে।। ওঁ”
অর্থাৎ “আমার সকল কন্যাগণ পবিত্র, ধর্মনিষ্ঠ, সকল ধর্মানুষ্ঠান (যজ্ঞাদি) পালনে যোগ্য।তাঁরা সকলে পবিত্র বেদ মন্ত্র নিষ্ঠার সহিত পাঠ করবে। তাঁরা সকলে বিদ্বান গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করবে। ঈশ্বর তাদের নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন।”
বৈদিক শাস্ত্রে নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য পালনের বিষয়ে এর চেয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ আর কী হতে পারে?
সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামনীষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগণ ছিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন (ধর্ম একটিই, সনাতন ধর্ম, বাকীগুলো মার্গ/religion) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।
চলুন দেখে নেই পবিত্র বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ও ব্রহ্মজিজ্ঞাসুর মধ্যে কিছু শ্রদ্ধেয় নারী ঋষির(ব্রহ্মবাদিনী) নাম-
১) ঘোষা (ঋষি কক্ষিবান এর কন্যা, ঋগ্বেদ দশম মন্ডলের ৩৯-৪১ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
২) অপালা (ঋষি অত্রি এর কন্যা, ঋগ্বেদ ৮/৯১/১ এর ঋষি )
৩) ইন্দ্রানী (ইন্দ্রের পত্নী, ঋগ্বেদ ১০/১৪৫/১-৬ এর ঋষি)
৪) ভগম্ভ্রীনি (মহর্ষি অম্ভ্রন এর কন্যা, ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের ১২৫ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
৫) বাক্ (ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা ঋষি) এছাড়াও রয়েছেন:
৬) রাত্রি (মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা)
৭) বিশ্ববারা (ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টবিংশ সূক্তের ঋষি)
৮) রোমশা ৯) কত্রু ১০) গার্গেয়ী ১১) জুহু ১২) মৈত্রেয়্ ১৩) যরিতা ১৪) শ্রদ্ধা ১৫) উর্বশী ১৬) স্বর্ণগা ১৭) পৌলমী ১৮) সাবিত্রী ১৯) দেবায়নী ২০) নোধা ২১) আকৃষ্ভাষা ২২) শীকাতনবাবরি ২৩) গণ্পায়নী ২৪) মন্ধত্রী ২৫) গোধ ২৬) কক্ষিবতী ২৭) দক্ষিনা ২৮) অদিতি ২৯) অপত ৩০) শ্রীলক্ষ ৩১) লোপামুদ্রা প্রমুখ।
যে ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নারী হতে পারেন, সেই ধর্মে নারীর মর্যাদা, বেদপাঠের অধিকার, উপনয়ন ও ব্রহ্মচর্যের অধিকার নিয়ে আলোচনা করাটাই এক দুঃখজনক ব্যাপার।
এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কিছু কথা খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ:
“ …সাধারণের ভেতর আর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নেই। সেজন্য আমার ইচ্ছা কতকগুলি ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী তৈরি করব।
…ব্রহ্মচারিণীরা মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে। কিন্তু দেশী ধরণে ঐ কাজ করতে হবে। পুরুষদের জন্য যেমন কতকগুলি শিক্ষাকেন্দ্র করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষা দিতেও সেইরুপ কতকগুলি কেন্দ্র করতে হবে। শিক্ষিতা ও সচ্চরিত্রা ব্রহ্মচারিণীরা ঐ সকল কেন্দ্রে মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে। পুরান, ইতিহাস, গৃহকার্য, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক নীতিগুলি বর্তমান- বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ন ও নীতিপরায়ণ করতে হবে। কালে যাতে তারা ভাল গিন্নি তৈরি হয়, তাই করতে হবে। এই সকল মেয়েদের সন্তানসন্ততিগণ পরে ঐ সকল বিষয়ে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে। যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই বড়লোক জন্মায়।
… মেয়েদের আগে তুলতে হবে, জনসাধারণকে জাগাতে হবে; তবে তো দেশের কল্যাণ।
ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ঘরকন্না, রন্ধন, সেলাই, শরীরপালন এ-সব বিষয়ে স্থুল মর্মগুলোই মেয়েদের শেখানো উচিত।
…সব বিষয়ে চোখ ফুটিয়ে দিতে হবে। আদর্শ নারী চরিত্রগুলি ছাত্রীদের সামনে সর্বদা ধরে উচ্চ ত্যাগরূপ ব্রতে তাদের অনুরাগ জন্মে দিতে হবে। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা এদের জীবনচরিত্র মেয়েদের বুঝিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের জীবন ঐরূপে গঠন করতে হবে।
…বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে দেখতে পাব- মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েরা ব্রহ্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ককে ব্রহ্মবিচারে আহবান করেছিলেন।
…মেয়েদের পূজা করেই সব সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে দেশ সে জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্নিন কালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা। …যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারে- সে দেশের কখন উন্নতির আশা নেই (মনুসংহিতা বাণী); এজন্য এদের আগে তুলতে হবে- এদের জন্য আদর্শ মঠ স্থাপন করতে হবে।”
এই হলো স্বামীজির বিবেচনা। অথচ ভণ্ড পৌরানিক স্মৃতিকার পুরোহিতগণ পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মনুস্মৃতিতে সংযোজন এনে একসময় নারীদের শাস্ত্রপাঠ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নারীবিদ্বেষী শ্লোক সংযুক্ত করেন, সতীদাহের মত বেদবিরুদ্ধ একটা জঘণ্য প্রথা চালু করেছিলেন।
আসুন, মিথ্যা ও কুসংস্কার দুর করে, বেদের শুভ্র শ্রেষ্ঠ পথ অনুসরণ করে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন মানব সমাজ গঠন করি।
মন্দবুদ্ধির লোকেরা তখন এই বলে তাদের কে নিগৃহীত করেছে, দেখ যেখানে শাস্ত্রেই বলা হয়েছে নারী, শূদ্র অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, তোমাদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, সেখানে তোমরা এত কথা বলছ কেন?
আজকে এমনি এক কল্পিত পুরাণের দাবি কে বিচার করে দেখব।
ভাগবত বলে——
❏ স্ত্রীশুদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা।
কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ।
ইতি ভারতিমাখ্যাং কৃপয়া মুনিনা কৃতম।।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৪/২৫)
বঙ্গানুবাদঃ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহর্ষি ব্যাসদেব মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।
এখানে বলা হচ্ছে স্ত্রী, শূদ্রের বেদ বুঝার ক্ষমতা নাই।
এই শ্লোকের তাৎপর্যে অন্যতম বৈষ্ণব প্রভুপাদ ব্যাখা করে বলেন---
(মূল শ্লোক এবং প্রভুপাদের ব্যাখার গোঁজামিল ভাল করে লক্ষ্য করুন)
প্রথমে প্রভুপাদ দ্বিজবন্ধু কারা সে সম্পর্কে বলেন—
যে সমস্ত মানুষ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য অথবা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ যাদের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয়নি, তাদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু। যথাযথ সংস্কার না থাকায় তাদের দ্বিজ বলে স্বীকার করা হয় না। বৈদিক সমাজে সংস্কারগুলি জন্মের পূর্ব থেকেই অনুষ্ঠান হয়। মাতৃগর্ভে বীজ রোপণ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় গর্ভাধান সংস্কার। এই গর্ভাধান সংস্কার বা পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা ব্যতীত যার জন্ম হয়েছে, তাকে যথার্থ দ্বিজ-পরিবারভুক্ত বলে গণনা করা হত না।
তারপর প্রভুপাদ ‘দ্বিজ’ কারা? সে সম্পর্কে বলেন-
গর্ভাধান সংস্কারের পর অন্য আরো সংস্কার রয়েছে যার একটি হচ্ছে উপনয়ন সংস্কার। এটি অনুষ্ঠিত হয় দীক্ষা গ্রহণের সময়। এই বিশেষ সংস্কারটির পর তাকে ‘দ্বিজ’ বলা হয়। প্রথম জন্ম হয় গর্ভাধান সংস্কারের সময়, এবং দ্বিতীয় বার জন্মটি হয় সদগুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের সময়। যারা এই মহান, সংস্কারগুলির দ্বারা যথাযথভাবে সংস্কৃত হয়েছেন, তাদেরই প্রকৃতপক্ষে দ্বিজ বলা হয়।
পিতামাতা যদি গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে, তা হলে তাদের সন্তানদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু। এই দ্বিজবন্ধু যথাযথ সংস্কারের দ্বারা সংস্কৃত দ্বিজ পরিবারের সন্তানদের মতো ততটা বুদ্ধিমান হয় না। দ্বিজবন্ধুদের সাধারণত বুদ্ধিসম্পন্ন স্ত্রী এবং শুদ্রদের সমকক্ষ বলে বিবেচনা করা হয়। শুদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংস্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংস্কারের অনুষ্ঠান করতে হয় না। অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, অর্থাৎ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজবন্ধুদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছিল।
তাহলে প্রভুপাদের বক্তব্য অনুসারে বুঝলাম, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ যাদের মধ্যে পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয় নাই তাদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু, যাদের যথাযথ সংস্কার নাই তারা দ্বিজবন্ধু। পিতামাতা গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে, তা হলে তাদের সন্তানদের বলা হয় দ্বিজবন্ধু।
আর গর্ভাধান, উপনয়ন সংস্কার এবং দীক্ষা গ্রহণের পর তাদের কে ‘দ্বিজ’ বলা হয়।
এই দ্বিজবন্ধু যথাযথ সংস্কারের দ্বারা সংস্কৃত দ্বিজ পরিবারের সন্তানদের মতো ততটা বুদ্ধিমান হয় না। এ জন্য উত্তম সমাজ, বুদ্ধিমান মানব, “দ্বিজ” সৃষ্টি করার জন্য সংস্কার আবশ্যক। গর্ভাধান, উপনয়ন, দীক্ষা ইত্যাদি সংস্কারের পর মানুষ দ্বিজ পরিবারের হয়।
কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে দ্বিজবন্ধু তাদের কে বলা হচ্ছে যারা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, কিন্তু পূর্বপুরুষদের সদগুণ গুলি প্রকাশিত হয় নাই, গর্ভাধান সংস্কাররুপ পারমার্থিক পরিবার-পরিকল্পনা না করে কেবল কামার্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করে তাদের কে। তাদের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দের সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিজ বুদ্ধিমান সন্তান সৃষ্টি করার সুযোগ আছে; কিন্তু স্ত্রী, শুদ্রদের সংস্কারের সুযোগ নাই, তাদের সংস্কারের প্রয়োজন নাই কারণ তারা জন্মগত ভাবেই অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন।
এ জন্য প্রভুপাদ বলছেন তাদের “শুদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংস্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংস্কারের অনুষ্ঠান করতে হয় না। অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, অর্থাৎ স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজবন্ধুদের বেদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছিল।” অর্থাৎ সংস্কার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দের জন্য, শুদ্র এবং স্ত্রী দের জন্য নয়। তাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই। মানে বলা হচ্ছে শুদ্র, স্ত্রী তোমাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই, যে জিনিস তোমাদের হৃদয়ঙ্গম, উপলব্ধী বা বুঝার ক্ষমতা নাই সে জিনিস তোমাদের পড়ার দরকার টা কি? তোমরা মহাভারত পর এটাই তোমাদের জন্য প্রযোজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রীদের যদি সংস্কারের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে পুরুষ সংস্কৃত হয়ে, অর্থাৎ শুধুমাত্র পুরুষের একার পক্ষে কি দ্বিজ বুদ্ধিমান সন্তান সৃষ্টি করা সম্ভব?
তাহলে শ্রীমদ্ভাগবতের শ্লোক এবং ইসকন প্রতিষ্ঠাতা প্রভুপাদের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম স্ত্রী, শূদ্ররা হচ্ছে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন; তাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার বা বুঝার ক্ষমতা নাই; শূদ্র এবং স্ত্রীদের বিবাহ সংষ্কার ব্যতীত অন্য কোনও সংষ্কার অনুষ্ঠান করতে হয় না। মানব সমাজের একটা বড় অংশ শুদ্র এবং স্ত্রী আর তাদের কেই বলা হচ্ছে তোমাদের বেদের বাণী হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই এটা তাদের জন্য যে অপমান জনক সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবার তাহলে আসুন, স্বয়ং বেদ কি বলে দেখি—
❏ যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ,ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।।
➢ যজুর্বেদ ২৬/২
বঙ্গানুবাদঃ হে মনুষ্যগন আমি যেরূপে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র , স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সকল জনগনকে এই কল্যানদায়িনী পবিত্র বেদবাণী বলিতেছি, তোমরাও সেই রূপ কর। যেমন বেদবাণীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেইরুপ হও। আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক। এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক ।
উপরোক্ত বেদ মন্ত্রে পরমেশ্বর স্বয়ং বলেছেন আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, নারী মনুষ্য মাত্র সকলের জন্য কল্যানদায়ি বেদবাণী বলিয়াছি এবং সবাইকে বেদবাণী উপদেশ কর; বেদ অধ্যয়ন না করে তার উপদেশ, প্রচার করা কি সম্ভব? এ জন্য এখানে সবাই কে বেদ অধ্যয়ন করতে বলেছেন, প্রচার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন ভাগবতের বক্তব্য অনুসারে প্রশ্ন হচ্ছে....
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে তাদের কে বেদবাণী বলেছে কেন?
☞ স্ত্রী, শূদ্রদের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকলে, তাদের জন্য বেদের বাণী কিভাবে কল্যানদায়িনী হল?
☞ যে বেদ তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না সে বেদ তারা প্রচার করবে কিভাবে?
☞ তাদের কেও বেদ বাণীর উপদেশ প্রচার করতে বল্লেন কেন?
স্ত্রী, শূদ্রের বেদ পাঠ করার অধিকার, বুঝার, হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা তো আছেই এমনকি বেদ দ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে নারী, শূদ্র ঋষি পর্যন্ত আছে। নারী ঋষিকাগণের মধ্যে রোমশ, লোপামুদ্রা, বাক্, অপালা, কাদ্রু, বিশ্ববারা, ঘোষা, জুহু, ভগম্ভ্রিনি, পৌলমি, যমী, ইন্দ্রাণী, সাবিত্রী, দেবযানী, নোধা, গৌপায়না, অম্ভৃনী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বেদ দ্রষ্টা ঋষি দের মধ্যে যেমন নারী ঋষিকা আছে; তেমনি "শূদ্র" ঋষিও আছে। সেই বেদ দ্রষ্টা শূদ্র ঋষির নাম হচ্ছে "কবষ"। তিনি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সূক্তের মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি।
☞ প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রী, শূদ্রের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা যদি না থাকে এবং পড়ার অধিকার ও যদি না থাকে তাহলে তাঁরা বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন কিভাবে?
নারী-পুরুষ, মনুষ্য মাত্র সকলের জন্য সংস্কার আবশ্যক এবং প্রযোজ্য।
❏ যুব সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎস উ শ্রেয়ান্ ভবতি জায়মানঃ।
তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো মনসা দেবয়ন্ত।।
➢ ঋগ্বেদ ৩/৮/৪
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য পূর্ব্বক বিদ্যালাভ করিয়া, উত্তমবস্ত্র পরিধান করিয়া যৌবন কালে যিনি গার্হস্থ্য আশ্রমে উপনীত হন তিনিই দ্বিজত্ব লাভে খ্যাতি অর্জ্জন করিয়া মহৎ হন। ধ্যান পরায়ণ, মননশীল, জ্ঞান প্রচারক, ধৈর্যবান্ বিদ্ধানেরা সেই পুরুষকে উন্নতি লাভে সহায়তা প্রদান করেন।
বেদ যুবক-যুবতী উভয় কে ব্রহ্মচর্য পালন করার নির্দেশ দেয়।
❏ ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।
অনডৃবান্ ব্রহ্মচর্যেনাশ্বো ঘাসং জিগীর্ষতি।।
➢ অথর্ববেদ ১১/৫/১৮
বঙ্গানুবাদঃ ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিবার পর কুমারী কন্যা যুবা পতিকে লাভ করিবে। বলবান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ভোগ্য পদার্থকে সম্যক ভোগ করিতে পারে।
বেদ পতি-পত্নী কে একসাথে যজ্ঞ করতে বলেন।
❏ যা দম্পতী সমনসা সুনুত আ চ ধাবতঃ।
দেবাসো নিত্যয়াহশিরা।
➢ ঋগ্বেদ ৮/৩১/৫
বঙ্গানুবাদঃ হে বিদ্ধানগণ! যে পত্নী ও পতি এক সঙ্গে একমনে যজ্ঞ করে, উপাসনা দ্বারা যাহাদের মন পরমাত্মার দিকে ধাবমান হয় তাহারা নিত্য পরমাত্মার আশ্রয়েই সব কার্য করে।
☞ বেদ যদি নারীদের হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা না থাকত যেমটা ভাগবতে বলা হয়েছে, তাহলে বেদে নারীকে উদেশ্য করে কোন বাণী থাকত না। কারণ নারীদের তো বেদ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নাই তাহলে, নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে বাণী বা নির্দেশ কিভাবে থাকবে? কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নারীকে উদ্দেশ্য করে বেদে অনেক বাণী আছে। যেমন-
❏ সম্রাজ্ঞী —
যথা সিন্ধুর্ণদীনাং সাম্রাজ্যং সুষুবে বৃষা।
এবা ত্বং সম্রাজ্ঞ্যেধি পত্যুরস্তং পরেত্য।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৩।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধূ! যেমন বলবান সমুদ্র নদী সমূহের উপর সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে তুমিও তেমন পতিগৃহে গিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ পতিগৃহ —
সম্রাজ্ঞ্যেধি শ্বশুরেষু সম্রাজ্ঞ্যুত দেবৃষু।
ননান্দুঃ সম্রাজ্ঞ্যেধি সম্রাজ্ঞ্যুত শ্বশ্ব্রাঃ।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/১/৪৪।
বঙ্গানুবাদঃ শ্বশুরদের মধ্যে এবং দেবরদের মধ্যে, ননদ ও শাশুড়ীদের সঙ্গে মিলিয়া সম্রাজ্ঞী হইয়া থাক।
❏ সুমঙ্গলী —
সুমঙ্গলী প্রতরণী গৃহাণাং সুশেবাপত্যে শ্বশুরায় শংভুঃ। স্যোনা শ্বশ্ব্রৈ প্র গৃহান্ বিশেমান্।।
➢ অথর্ব্ববেদ ১৪/২/২৬।
বঙ্গানুবাদঃ হে বধু! কল্যাণময়ী, গৃহের শোভাবর্দ্ধনকারিণী, পতিসেবা পরায়ণা, শ্বশুরের শান্তিদায়িনী, শ্বাশুড়ীর আনন্দ দায়িনী! গৃহকার্যে নিপূণা হও।
অতএব স্ত্রী, শূদ্র সকলের বেদ হৃদয়ঙ্গম করার, বুঝার ক্ষমতা আছে এবং সকলে বেদ অধ্যয়ন করতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে......
☞ আমাদের কোনটা গ্রহণ করা উচিত? বেদ নাকি ভাগবত?
☞ ব্যাসদেব যদি শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করতেন তাহলে তিনি এই বেদ বিরোধী কথা বল্লেন কিভাবে?
তার কারণ হচ্ছে ভাগবত ব্যাসদেব রচিত নয়।
যদি ভাগবতের কথা সত্যি বলে ধরে নি; অর্থাৎ স্ত্রী,শূদ্রের বেদ বুঝার ক্ষমতা নাই তাই তাদের জন্য মহাভারত রচনা করা হয়েছে।
☞ তাহলে, মহাভারতের যুগের আগেও স্ত্রী,শূদ্র ছিল কিন্তু তখন তাদের উদ্ধারের জন্য কি করা হয়েছিল? তারা ও যাতে তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে সে জন্য কি করা হয়েছিল?
প্রাচীন বৈদিক সমাজে নারীশিক্ষার ও নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য জীবন পালনের একটি চিত্র দেখা যাক:
“ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।”
(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)
অর্থাৎঃ ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে।
পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন-
“মাতুলাচার্যাণামানুক্ত”
(পাণিনি ৪.১.৪৬)
এবং “ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্”
(পাণিনি ৬.২.৭৬)
ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ ১.৩.১১, ১০.১৫৬.২ প্রভৃতিতে।
“চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী”
(ঋগ্বেদ ১.৩.১১)
এখানে নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরণদাত্রীরূপে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
পবিত্র বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে গার্গী, মৈত্রেয়ী, অত্রেয়ী, বাক, অপালাসহ বিভিন্ন নারীরা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ঋষি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।
উত্তররামচরিতমানস এর ২.৩ এ পাওয়া যায় ঋষিনী অত্রেয়ী বলছেন,
“এই অঞ্চলে অগস্ত্যসহ অনেক বিখ্যাত মহর্ষি আছেন। আমি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে এখানে এসেছি তাঁদের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়ন করতে।”
“ওঁ শুদ্ধ পুত যোসিত যজ্ঞিয়া ইমা ব্রাহ্মনম হস্তেষু প্রপ্রতক সদায়মি।
যত্কামা ইদমাভিসিন্চমি বো হামিন্দ্রো মরুত্বন্স দদাতু তন্বে।। ওঁ”
অর্থাৎ “আমার সকল কন্যাগণ পবিত্র, ধর্মনিষ্ঠ, সকল ধর্মানুষ্ঠান (যজ্ঞাদি) পালনে যোগ্য।তাঁরা সকলে পবিত্র বেদ মন্ত্র নিষ্ঠার সহিত পাঠ করবে। তাঁরা সকলে বিদ্বান গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করবে। ঈশ্বর তাদের নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন।”
বৈদিক শাস্ত্রে নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য পালনের বিষয়ে এর চেয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ আর কী হতে পারে?
সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামনীষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগণ ছিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন (ধর্ম একটিই, সনাতন ধর্ম, বাকীগুলো মার্গ/religion) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।
চলুন দেখে নেই পবিত্র বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ও ব্রহ্মজিজ্ঞাসুর মধ্যে কিছু শ্রদ্ধেয় নারী ঋষির(ব্রহ্মবাদিনী) নাম-
১) ঘোষা (ঋষি কক্ষিবান এর কন্যা, ঋগ্বেদ দশম মন্ডলের ৩৯-৪১ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
২) অপালা (ঋষি অত্রি এর কন্যা, ঋগ্বেদ ৮/৯১/১ এর ঋষি )
৩) ইন্দ্রানী (ইন্দ্রের পত্নী, ঋগ্বেদ ১০/১৪৫/১-৬ এর ঋষি)
৪) ভগম্ভ্রীনি (মহর্ষি অম্ভ্রন এর কন্যা, ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের ১২৫ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
৫) বাক্ (ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা ঋষি) এছাড়াও রয়েছেন:
৬) রাত্রি (মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা)
৭) বিশ্ববারা (ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টবিংশ সূক্তের ঋষি)
৮) রোমশা ৯) কত্রু ১০) গার্গেয়ী ১১) জুহু ১২) মৈত্রেয়্ ১৩) যরিতা ১৪) শ্রদ্ধা ১৫) উর্বশী ১৬) স্বর্ণগা ১৭) পৌলমী ১৮) সাবিত্রী ১৯) দেবায়নী ২০) নোধা ২১) আকৃষ্ভাষা ২২) শীকাতনবাবরি ২৩) গণ্পায়নী ২৪) মন্ধত্রী ২৫) গোধ ২৬) কক্ষিবতী ২৭) দক্ষিনা ২৮) অদিতি ২৯) অপত ৩০) শ্রীলক্ষ ৩১) লোপামুদ্রা প্রমুখ।
যে ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নারী হতে পারেন, সেই ধর্মে নারীর মর্যাদা, বেদপাঠের অধিকার, উপনয়ন ও ব্রহ্মচর্যের অধিকার নিয়ে আলোচনা করাটাই এক দুঃখজনক ব্যাপার।
এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কিছু কথা খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ:
“ …সাধারণের ভেতর আর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নেই। সেজন্য আমার ইচ্ছা কতকগুলি ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী তৈরি করব।
…ব্রহ্মচারিণীরা মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে। কিন্তু দেশী ধরণে ঐ কাজ করতে হবে। পুরুষদের জন্য যেমন কতকগুলি শিক্ষাকেন্দ্র করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষা দিতেও সেইরুপ কতকগুলি কেন্দ্র করতে হবে। শিক্ষিতা ও সচ্চরিত্রা ব্রহ্মচারিণীরা ঐ সকল কেন্দ্রে মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে। পুরান, ইতিহাস, গৃহকার্য, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক নীতিগুলি বর্তমান- বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ন ও নীতিপরায়ণ করতে হবে। কালে যাতে তারা ভাল গিন্নি তৈরি হয়, তাই করতে হবে। এই সকল মেয়েদের সন্তানসন্ততিগণ পরে ঐ সকল বিষয়ে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে। যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই বড়লোক জন্মায়।
… মেয়েদের আগে তুলতে হবে, জনসাধারণকে জাগাতে হবে; তবে তো দেশের কল্যাণ।
ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ঘরকন্না, রন্ধন, সেলাই, শরীরপালন এ-সব বিষয়ে স্থুল মর্মগুলোই মেয়েদের শেখানো উচিত।
…সব বিষয়ে চোখ ফুটিয়ে দিতে হবে। আদর্শ নারী চরিত্রগুলি ছাত্রীদের সামনে সর্বদা ধরে উচ্চ ত্যাগরূপ ব্রতে তাদের অনুরাগ জন্মে দিতে হবে। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা এদের জীবনচরিত্র মেয়েদের বুঝিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের জীবন ঐরূপে গঠন করতে হবে।
…বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে দেখতে পাব- মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েরা ব্রহ্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ককে ব্রহ্মবিচারে আহবান করেছিলেন।
…মেয়েদের পূজা করেই সব সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে দেশ সে জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্নিন কালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা। …যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারে- সে দেশের কখন উন্নতির আশা নেই (মনুসংহিতা বাণী); এজন্য এদের আগে তুলতে হবে- এদের জন্য আদর্শ মঠ স্থাপন করতে হবে।”
এই হলো স্বামীজির বিবেচনা। অথচ ভণ্ড পৌরানিক স্মৃতিকার পুরোহিতগণ পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মনুস্মৃতিতে সংযোজন এনে একসময় নারীদের শাস্ত্রপাঠ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নারীবিদ্বেষী শ্লোক সংযুক্ত করেন, সতীদাহের মত বেদবিরুদ্ধ একটা জঘণ্য প্রথা চালু করেছিলেন।
আসুন, মিথ্যা ও কুসংস্কার দুর করে, বেদের শুভ্র শ্রেষ্ঠ পথ অনুসরণ করে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন মানব সমাজ গঠন করি।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ