গীতা-২/৪২-৪৫ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

20 August, 2019

গীতা-২/৪২-৪৫ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ

 শ্রীকৃষ্ণের তথাকথিত ভক্তদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বলে থাকেন যে, গীতা-২/৪২-৪৪ শ্লোকে বেদের বিরুদ্ধতা করা হয়েছে, ঘোর নিন্দা করা হয়েছে। মহাভারত, শান্তিপর্ব-১২/৫ শ্লোকে বেদবিরোধীকে নাস্তিক বলা হয়েছে, মনুস্মৃতিতে ২/১১ শ্লোকেও বেদ নিন্দুককে নাস্তিক বলা হয়েছে - "নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ"। আরও বলা হয়াছে - "সাধুভির্বহিষ্কার্য্যো" সাধুশ্রীগণ বেদ নিন্দুক নাস্তিককে ত্যাগ করে, সমাজ হইতে বহিষ্কার করে।

◑শ্রীকৃষ্ণ কি নাস্তিক ছিল যে বেদের বিরুদ্ধতা করবে, বেদের নিন্দা করবে?
আমাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ বেদের নিন্দা/বিরোধ করেননি এবং তিনি নাস্তিকও নন বরং আপ্ত পুরুষ ও সকল আস্তিকদের আদর্শস্বরূপ। তিনি ২/৪২-৪৫ শ্লোকে যে বিষয় নিয়ে বলছিলেন তা ২/৩৯ শ্লোকেই বলে নিয়েছেন -
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি॥৩৯॥
সরলার্থ : হে পার্থ! তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য=সদ্বিবেচনার বিষয়ে জ্ঞানযোগের উপদেশ করেছি, এখন কর্মযোগ বিষয়ক এই উপদেশ শ্রবণ করো, যে বুদ্ধি দ্বারা যুক্ত হয়ে তুমি কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করবে (তা বলিতেছি)
সকাম কর্মই বন্ধনের কারণ এবং নিষ্কাম কর্ম দ্বারাই বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ হয়। এই শ্লোকদ্বয়ে শ্রীকৃষ্ণ সকাম ও নিষ্কাম কর্ম-কর্মীদের সম্পর্কে বলেছেন। যথা-
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ৷
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনঃ॥৪২॥
পদপাঠ: যাম্ । ইমাম্ । পুষ্পিতাম্ । বাচম্ । প্রবদন্তি । অবিপশ্চিতঃ । বেদবাদরতা । পার্থ । ন । অন্যত্ । অস্তি । ইতি । বাদিনঃ॥
পদার্থ: (বেদবাদরতাঃ) বেদের মর্ম জানেনা এমন (অবিপশ্চিতঃ) অবিবেকী ব্যক্তি (যাম্ ইমাম্) যে এই (বাচম) বাণীর (পুষ্পিতাম্) অর্থাবাদরূপ কথন করে থাকে (পার্থ) হে অর্জুন! সেই ব্যক্তি (ন অন্যত্ অস্তি) বেদে তদ্ভিন্ন অন্য কোন পরমার্থ উপদেশ নেই (ইতি বাদিনঃ) এরূপ বলে থাকে অর্থাৎ বেদের তত্ত্ব না বুঝিয়া অজ্ঞানী ব্যক্তি ইহার অনেক অর্থাভাস করে থাকে।
সরলার্থ: বেদের মর্ম জানেনা এমন অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, অবিবেকী ব্যক্তি বেদ বাণীর অর্থাবাদরূপ কথন করে থাকে। হে অর্জুন! সেই ব্যক্তি বেদে তদ্ভিন্ন অন্য কোন পরমার্থ উপদেশ নেই এরূপ বলে থাকে অর্থাৎ বেদের তত্ত্ব না বুঝিয়া অজ্ঞানী ব্যক্তি ইহার অনেক অর্থাভাস করে থাকে।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্৷
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি॥৪৩॥
পদপাঠ : কামাত্মনঃ । স্বর্গপরাঃ । জন্মকর্মফলপ্রদাম্ । ক্রিয়াবিশেষবহুলাম্ । ভোগৈশ্বর্যগতিম্ । প্রতি ॥
পদার্থ : (কামাত্মানঃ) কামনাযুক্ত ব্যক্তি (স্বর্গপরাঃ) স্বর্গপ্রাপ্তির ইইচ্ছাকারী (জন্মকর্মফলপ্রদাম্) জন্মরূপী কর্মফল প্রদানকারী (ক্রিয়াবিশেষবহুলাম) ক্রিয়াকলাপবিশিষ্ট বানীর (ভোগৈশ্বর্যগতিম প্রতি) ভোগ এবং ঐশ্বর্যের জন্য আশ্রয় নেয়॥
সরলার্থ : কামনা-বাসনায় আসক্ত, স্বর্গপ্রাপ্তির ইচ্ছাকারী ব্যক্তি -ভোগ এবং ঐশ্বর্যের জন্য জন্মরূপী কর্মফল প্রদানকারী ক্রিয়াকলাপবিশিষ্ট বানীর আশ্রয় নেয়॥
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্৷
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে॥৪৪॥
পদপাঠ: ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাম্ । তয়া । অপহৃতচেতসাম্ । ব্যবসায়াত্মিকা । বুদ্ধিঃ । সমাধৌ । ন । বিধীয়তে ॥
পদার্থ: (ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং) ভোগ আর ঐশ্বর্যে আসক্ত ব্যক্তির (তয়া) সেই পুষ্পিত বাণী দ্বারা (অপহৃতচেতসাম্) বিমুগ্ধচিত্ত (ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ) নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি (সমাধৌ ন বিধীয়তে) পরমাত্মা তে বিধান করেন না॥
সরলার্থ: ভোগ আর ঐশ্বর্যে আসক্ত ব্যক্তির, সেই পুষ্পিত বাণী দ্বারা বিমুগ্ধচিত্ত নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি পরমাত্মা তে বিধান করেন না অর্থাৎ সমাধিস্থ হয়না॥
এই শ্লোকদ্বয়ে বেদকে নয় বরং বেদার্থ সম্পর্কে অজ্ঞ সকাম ব্যক্তিদের অজ্ঞতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। গীতা-৩/২৫ শ্লোকেও শ্রীকৃষ্ণ - কর্মে আসক্ত ব্যক্তিদের অবিদ্বান্ বলেছেন "সক্তাঃ কর্মণি অবিদ্বাংসঃ"। বেদে বলা হয়েছে -"ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা (যজু.৪০/১)"ত্যাগপূর্বক অর্থাৎ বৃত্ত হতে চিত্তকে সরিয়ে (ভুঞ্জিথা) ভোগের উপভোগ করো। কিন্তু ত্যাগী না হয়ে ভোগ আর ঐশ্বর্যে আসক্ত অবিদ্বান্ ব্যক্তিরা নিজেদেরক বিদ্বান্ ভেবে নিজেদের কামনা পূর্তির জন্যে বেদ বাণীর নানাপ্রকার মনগড়া অর্থ করে থাকে। কেহ বলে এই মন্ত্রপাঠ করিলে শত্রুর বিনাশ(মৃত্যু) হয়ে যায়, কেহ বলে এই মন্ত্র পাঠ করে পশুবলি দিলে উন্নতি লাভ হয়.... এবং বলে যে তদ্ভিন্ন আর কিছুই নেই।
উপনিষদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে-
অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতম্মন্যমানাঃ।
দন্দ্রম্যমাণাঃ পরিয়ন্তি মূঢ়া অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ॥
---(কঠোপনিষদ্-১/২/৫ ও মুণ্ডোপনিষদ্-১/২/৮)
সরলার্থ : যে সকল মূঢ় বা অবিবেকী ব্যক্তি অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন থকিয়াও নিজদিগকে বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত বলিয়া মনে করে, তাহারা অন্ধের দ্বারা পরিচালিত অপর অন্ধ ব্যক্তির ন্যায় অতিশয় কুটিল পথে পরিভ্রমণ করে, কখনও শ্রেয়োলাভ করিতে পারে না।
পরবর্তী শ্লোকেই বলা হয়েছে সাংসারিক ভোগ ঐশ্বর্য্যের প্রতি অতিশয় আসক্ত ব্যক্তির নিকট পরলোকের পরমার্থ বিচার অপছন্দনীয়। (যেহেতু অপছন্দের সেহেতু প্রেয়তাকে প্রাধান্য দেওয়া ব্যক্তিরা পরমতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চায়না আর তাই জানতে পারেওনা।) তারা বলে সাংসারিক সুখ ভিন্ন মোক্ষ বলতে কিছু নেই (মু.উ.-১/২/১০)। সঠিক অর্থজ্ঞানহীন সম্পর্কে বেদেও বলা হয়েছে -
উত ত্বঃ পশ্যন্ন দদর্শ বাচমুত ত্বঃ শৃণ্বন্ন শৃণোত্যেনাম্ ।
উতো ত্বস্মৈ তন্বংবি সস্ত্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ॥
---(ঋগ্বেদ-১০/৭১/৪)
অর্থাৎ বাণীকে লিপিরূপ দেখেও লিপিজ্ঞান রহিত দেখেনা, এবং অর্থজ্ঞানশূণ্য ব্যক্তি কান দ্বারা বাণী শ্রবণ করেও করতে পারেনা কিন্তু জ্ঞানবান্ মনুষ্যের জন্য বাণী নিজ স্বরূপকে এরূপ প্রকাশ করে যেরূপ কোন স্ত্রী নিজ স্বামীর নিকট নিজ সৌন্দর্য্য প্রকাশ করে।
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন৷
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্॥৪৫॥
পদপাঠ : ত্রৈগুণ্যবিষয়াঃ । বেদাঃ । নিস্ত্রৈগুণ্যঃ । ভব । অর্জুন । নির্দ্বন্দ্বঃ । নিত্যসত্ত্বস্থঃ । নির্যোগক্ষেমঃ । আত্মবান্ ॥
পদার্থ: তিন গুনের যে ভাব তাকে ''ত্রৈগুণ্য" বলা হয় অর্থাৎ তিন গুণযুক্ত যে পুরুষ রয়েছে তাহার বিষয় বেদ [ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা=ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি] ,এইজন্য "ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা" বলেছেন, হে অর্জুন! এই মনুষ্য তিন গুণের ভাব = তিন গুণযুক্ত, এইজন্য বেদের অর্থাভাসে ফেসে যায় আর তুমি নিস্ত্রৈগুণ্যো = তিন গুণ থেকে [ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির আকৃষ্টতা] রহিত (নির্দ্বন্দ্বঃ) শীত, উষ্ণ, কাম, ক্রোধ, মোহাদি দ্বন্দ্ব থেকে রহিত (নিত্যসত্ত্বস্থঃ) সদা সত্ত্বগুণে স্থির অর্থাৎ সত্ত্বপ্রধান হয়ে যাও (নির্যোগক্ষেম) অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তির নাম "যোগ" আর প্রাপ্তির রক্ষাকে "ক্ষেম" বলা হয় অর্থাৎ এই প্রকার নিষ্কাম কর্ম করো যাতে অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তি আর প্রাপ্তির রক্ষা করার চিন্তা না হয় (আত্মবান্) "আত্মবিদ্যতেযস্য স আত্মবান্"= তুমি আত্মিক বলশালী হও॥
ভাষ্যঃ - প্রকৃতির সত্ত্ব, রজ, তম এই তিন গুণে যে ফেসে গেছেন, সে অর্থাভাস এবং অর্থবাদ থেকে কদাপি বাঁচতে পারে না, সত্ত্বপ্রধান ব্যক্তিই বেদার্থে বেদবাদ থেকে বাঁচতে পারে, এই অভিপ্রায়ে "নিত্যসত্ত্বস্থো" বলেছেন, আর যে ব্যক্তি এর এরূ অর্থ করেন - বেদ কেবল তিন গুণ যুক্ত আর তুমি তিন গুণ থেকে পার হয়ে যাও, 'এই অর্থ সঠিক নয় ' কেননা সত্ত্ব গুণও তিন গুণের মধ্যে একটি গুণ তাহলে ''নিস্ত্রৈগুণ্যো'' কিভাবে? এইজন্য ''নিস্ত্রৈগুণ্যো'' এর অর্থ সত্ত্বপ্রধান বলা হয়েছে, অতএব বেদের ন্যূনতা এই শ্লোকে নেই কিন্তু সত্ত্ব গুণের প্রধানতার উপদেশ রয়েছে, কারন যে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইহার সহিত সম্বদ্ধ রাখে সে জন্ম-মৃত্যু চক্রবন্ধনে আবদ্ধ হয় কিন্তু "ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা (গীতা-১৪/১৮)" সত্ত্বপ্রধান ব্যক্তিই উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হয় "সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং (গীতা-১৪/১৭)" সত্ত্বগুণ হইতেই জ্ঞান উৎপন্ন হয়, "ন বিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানে মোক্ষস্যাধিগমো ভবেত্ (মহা০, শান্তি০-৩২৬/২২)" জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া মোক্ষ প্রাপ্তি হয় না অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারাই মোক্ষপ্রাপ্তি হয়; জ্ঞানের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ গীতা অসংখ্য শ্লোক বলেছেন এটাও বলেছেন যে "ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে (গীতা-৪/৩৮) অর্থাৎ এই জগতে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছুই নেই , আর এই ভাবকে প্রয়োগ করলে বর্তমান শ্লোক সঙ্গত হতে পারে, অন্যথা মোক্ষার্থ শ্রোত বেদকে কদাপি বর্ণন করতেন না আর না বলতেন যে, বিজ্ঞানী ব্রাহ্মণদের মোক্ষার্থের একমাত্র সাধন বেদ, যেমন—
যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লুতোদকে৷
তাবানসর্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ॥৪৬॥
পদপাঠ : যাবান্ । অর্থঃ । উদপানে । সর্বতঃ । সংপ্লুতোদকে । তাবান্ । সর্বেষু । বেদেষু । ব্রাহ্মণস্য । বিজানতঃ ॥
পদার্থ + ভাবার্থঃ - (যাবান্) যেমন ( অর্থঃ) প্রয়োজন (উদপানে,সর্বতঃ,সংপ্লুতোদকে) সর্বদিক হইতে জল প্রবাহিত জলাশয়ের মতো হয় অর্থাৎ কেহ তা থেকে জমিনে জল দেয়, কেহ গৌ আদিকে পান করায়, কেহ স্বয়ং পান করেন, এবং সর্ব প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য সেই জলাশয় পর্যাপ্ত হয়ে থাকে ( তাবান্) তেমনই ( সর্বেষু) সব (বেদেষু) বেদের মধ্যে ( বিজানতঃ,ব্রাহ্মণস্য) বিজ্ঞানী ব্রাহ্মণের সব প্রয়োজন হয় অর্থাৎ ব্রাহ্মণের দৃষ্টিতে ধর্ম সম্বন্ধী সর্বার্থ সিদ্ধির আকর বেদ, পরন্তু ওই মোক্ষার্থীর জন্য মোক্ষোপযোগী কথন উপদেশ রয়েছে॥
শ্রীকৃষ্ণ অন্য অনেক শ্লোকেই বেদের মহত্ত্ব প্রকাশ করেছেন -
বেদানাং সামবেতোহস্মি (গীতা-১০/২২)
অর্থাৎ সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ।।
[অহম্]ঋক্ সাম যজুরেব চ (গীতা-৯/১৭)
ঋগ্বেদ,যজুর্বেদ, সামবেদও আমিই।
যারা বলেন বেদ কেবল ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতিরই বর্ণন করে, পরমাত্মার নয় তাই শ্রীকৃষ্ণ উপরোক্ত ২/৪৫ শ্লোকে বেদ ত্যাগ করতে বলেছে তাদের ভাবনা সঠিক নয়। উপনিষদেই বলা হয়েছে-
সর্বে বেদা যৎ পদমামনন্তি....(কঠোপনিষদ-১/২/১৫)
(যৎ) যেই (পদম্) প্রাপণীয় ব্রহ্মের (সর্বে বেদাঃ) ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ তথা অথর্ববেদ এই সকল চারো বেদ (আমনন্তি) বারংবার প্রতিপাদন করে।
অর্থাৎ বেদ বারংবার পরমাত্মার বর্ণন করে। গীতায়ও তাই বলা হয়েছে-
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো (গীতা-১৫/১৫)
অর্থাৎ আমিই সর্ববেদ দ্বারা জ্ঞাতব্য বিষয়।
অর্থাৎ সকল বেদেই পরমাত্মার বর্ণন করা হয়েছে।
ত্রৈগুণ্যবিষয়াঃ বেদাঃ বলতে কোন কোন ভাষ্যকার ভৌতিক বিজ্ঞানীদের বিষয় ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি বুঝিয়েছেন। ঈশাবাস্যোপনিষদ্-৯ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে - যে কেবল ভৌতিক বিজ্ঞানে রত থাকে সে গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করে।
একপক্ষ বলে থাকে যে, বেদ অপরা বিদ্যার (ভৌতিক বিজ্ঞানের) আর উপনিষদ এবং গীতা পরা (আধ্যাত্ম) বিদ্যার গ্রন্থ। তাই বেদ আমাদের প্রয়োজন নেই আমরা গীতাতেই সন্তুষ্ট। যদিও তাদের এই ভাবনা সঠিক নয় কিন্তু তাদের জন্যও উক্ত ৯ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে - যে কেবল আধ্যাত্মিকতায় রত থাকে সে আরো অধিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। ১১ নং মন্ত্রেই বলা হয়েছে - যে ভৌতিক বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্ম বিজ্ঞান উভয়ই জানেন সেই মোক্ষপ্রাপ্ত হয় বা করতে পারেন।
তাই বেদ ত্যাগ করতে বলা, এই যুগে, সেই যুগে বেদ প্রয়োজন নেই, বেদ চলেনা এইসকল অবান্তর মন্তব্য করা মূঢ়তা ব্যতীত আর কিছুই নয়।
বেদ ত্যাগকারী সম্পর্কে বেদেও বলা হয়েছে -
যস্তিত্যাজ সচিবিদং সখায়ং ন তস্য বাচ্যপি ভাগো অস্তি।
যদীং শৃণোত্যলকং শৃণোতি নহি প্রবেদ সুকৃতস্য পন্থাম্।।
---(ঋগ্বেদ - ১০/৭১/৬)
পদার্থঃ- (যঃ) যে মনুষ্য (সচিবিদম্) সর্বপ্রকার জ্ঞান আহরণে সহায়তা প্রদানকারী (সখায়ম্) বেদরূপী মিত্র কে (তিত্যাজ) ত্যাগ করে (তস্য) তাহার (বাচি অপি) বাণীতেও, কথনেও (ভাগঃ) কোন সার তত্ত্ব (ন অস্তি) রয় না (ঈম্) সেই ব্যক্তি (যত্) বেদ ভিন্ন অতিরিক্ত যাহা কিছু (শৃণোতি) শ্রবণ করে (অলকম্) ব্যর্থ'ই শ্রবণ করে। এমন মনুষ্য (সুকৃতস্য) সুকৃত, বাস্তবিক জ্ঞান, পূণ্য ধর্মের, সুন্দর কর্মানুষ্ঠানের (পন্থাম্) মার্গ সম্পর্কে (ন প্রবেদ) জানে না।
ভাবার্থঃ- বেদ আমাদের জীবন ধন, বেদ আমাদের সর্বস্ব। অতঃ প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিদিন বেদের সাধ্যায় করা উচিত্। কেননা -
১. বেদ সর্বপ্রকার জ্ঞান প্রাপ্ত করায়।
২. যে মনুষ্য বেদ কে ত্যাগ করে, বেদের সাধ্যায় করেনা, তাহার বাণী-কথনেও কোন প্রকার তত্ত্ব থাকে না।
৩. বেদ ত্যাগকারী ব্যক্তি যাহা কিছু শ্রবণ করে, তাহা সবকিছুই ব্যর্থ হয়, তা দ্বারা জীবনের নির্মাণ এবং উত্থান হয়না।
৪. বেদ ত্যাগকারী ব্যক্তির নিজ কর্তব্য কর্মের বোধ হয়না।
✍️প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী [সংগৃহীত]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ