বাৎস্যায়নের কামসূত্র - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

14 December, 2019

বাৎস্যায়নের কামসূত্র

অতিথি লেখক 

প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে মালঙ্গ বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ একটি কালজয়ী গ্রন্থ। নারী ও পুরুষের দাম্পত্য জীবন, কামকলা, অভিজাত শ্রেণীর সংস্কৃতি, এবং আমোদ-ফুর্তি বিষয়ে এ গ্রন্থটি বিগত দু’হাজার বছর ধরে পাঠকদের আকৃষ্ট করে রেখেছে। ১৮৭৬ সালে রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, ভগবান-লাল ইন্দ্রজি, ফস্টার ফিটজজেরাল্ড আর্বাথনট, এবং শিবরাম পরশুরাম ভিড়ে’র সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘কামসূত্র’র ইংরেজি তর্জমা প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্যে বইটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে, তবে সেটা ‘কামসূত্র’র সামগ্রিক বিষয়বস্তুর কারণে নয়; মূলত বাণিজ্যের স্বার্থে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপনের কারণে। পন্ডিতজনের ধারণা, প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ভাষায় যখন এ বইটি লেখা হয়েছিল তখন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ভেতরে ধর্ম এবং অর্থশাস্ত্রের পাশাপাশি কামশাস্ত্রের চর্চা ছিল। সংস্কৃত ‘কাম’ এর অর্থ বাসনা, প্রেম, আনন্দ, এবং যৌনক্রিয়া। অর্থাৎ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়লব্ধ যে কোন আনন্দই কামের আওতাভুক্ত, আর ‘সূত্র’র অর্থ কোন নীতি বা তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। এ পদ্ধতিতে লেখার সুবিধা হলো শিক্ষার্থীরা সূত্রগুলো সহজেই স্মরণ করতে পারে। প্রাচীন ভারতে প্রায় সব উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত গ্রন্থ, যেমন: যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, এবং দর্শনশাস্ত্র এ সূত্ররীতিতে লেখা হয়েছে। বাৎস্যায়নের এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য ‘কাম’ অর্থাৎ আমোদ- প্রমোদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারেপাঠকদের যথাযথ ধারনা প্রদান করা। উল্লেখ্য, ‘কামসূত্র’ শুধুমাত্র যৌনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; প্রাচীন ভারতের সমাজ জীবনের হরেক রকম বিষয়ে বিস্তারিত এবং বাস্তব-ধর্মী তথ্যাবলীর সমাবেশ ঘটেছে এখানে, যেমন: পোশাক, প্রসাধনী, বিনোদন, সমাজ, ক্রীড়া, বাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এবং বহিরাঙ্গনের নান্দনিকতা। উপরন্তু, বাৎস্যায়ন কমবেশি মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, যৌন বাসনা, সমকামিতা, ভেষজ চিকিৎসা, এবং নারী যৌনকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নসহ আরও অনেক বিষয়ে এখানে পরামর্শ দিয়েছেন। অতএব, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে ‘কামসূত্র’ সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণা (marriage manual, sex guide, pillow book) বদলে যাবে। মূলত, ‘কামসূত্র’ প্রাচীন ভারতের মৌর্য এবং গুপ্ত সভ্যতার ৮০০ বছরের শিল্প সংস্কৃতির একটি লিখিত প্রমাণ। প্রকাশের পর থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ‘কামসূত্র’ ভারতের সাহিত্য এবং শিল্পকলাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রাচীন কাল থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ভারতে কামশাস্ত্রের চর্চা অব্যাহত ছিল, এবং এ বিষয়ে রচিত একাধিক গ্রন্থ তার সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু ভারতে ইংরেজ শাসনামলে এ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়।

কামসূত্র

ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজ প্রশাসন এ সাহিত্যচর্চায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এবং সু-পরিকল্পিতভাবে ভারতবাসীর মতামত এর বিপক্ষে নিয়ে যায়। যৌনতার প্রতি ভারতীয়দের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলার জন্য খ্রিস্টান মিশনারি, ইংরেজ প্রশাসন, এবং তাদের সৃষ্ট ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতের শৃঙ্গাররস-কেন্দ্রিক সাহিত্য, শিল্পকলা, অভিনয়, এবং সঙ্গীতের প্রতি অশ্লীলতার অভিযোগ এনে এর নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, এবং একটি আইন (Obscene Publication Act) প্রণয়নের মাধ্যমে এধারার সাহিত্যকর্মের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে, ভারত উপমহাদেশে দু’হাজার বছর ব্যাপী প্রবহমান কামশাস্ত্রের চর্চা উনিশ শতকে এসে ব্যাহত হয়, এবং তখন থেকেই এ সাহিত্যধারার প্রতি ভারতীয়দের, বিশেষত: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। এ প্রবন্ধে ভারতের শিল্প-সাহিত্যের আঙিনায় কামসূত্রের প্রভাব, ইংরেজদের এ সাহিত্যধারার প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণ, এবং এর নিয়ন্ত্রণের পরিণাম বিশ্লেষণ করা হবে।

অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদারের মতে বাৎস্যায়ন দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের অধিবাসী ছিলেন। কামসূত্রে ভারতের প্রায় সব অঞ্চল সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোচনা থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত সম্পর্কে লেখকদের ব্যাপক এবং গভীর ধারণা লক্ষ্য করা যায়। যশোধরা’র মতানুযায়ী ‘বাৎস্যায়ন’ হচ্ছে তাঁর বংশ এবং ‘মালঙ্গ’ তাঁর নিজের নাম। বাৎস্যায়নের জন্মকাল নিয়েও বিতর্ক আছে। শ্যামশাস্ত্রীর (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সম্পাদক) ধারণা তিনি ১৩৭-২০৯ খ্রিস্টাব্দে মধ্যে কোন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভান্ডারকরের মতে তাঁর জন্ম ১০০ খ্রিস্টাব্দের ভেতরে। এ বি কিথ এর দাবী, বাৎস্যায়নের জন্ম চতুর্থ শতাব্দীতে। অধ্যাপক হারানচন্দ্র চাকলাদার এ সমস্যাটি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ‘কামসূত্র’ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আগে লেখা হয়েছে এবং সেটা কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’র পরে, কেননা বাৎস্যায়ন এ দুটি গ্রন্থ দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। অতএব, উপরিউক্ত মতামতের ভিত্তিতে অন্তত এটা ধরে নেয়া যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৩০০ এর মাঝে কোন এক সময়ে বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্র’ রচনা করেছিলেন। কামসূত্রে অভিজাত শ্রেণির ভোগ-বিলাস এবং আভিজাত্যের ফিরিস্তি থেকে অনুমান করা যায় যে এ ধরণের গ্রন্থ রচনা তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্র ছিল সমৃদ্ধশালী, নগরবাসীরা ছিল ধনবান এবং বিলাস-ব্যাসনে মশগুল। সন্দেহ নেই যে, সময়টা ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ওই জনপদ ছিল কোন রকমের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, এবং বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত। গুপ্ত যুগ (৩০০ -৩০০ খ্রি:) ছিল এমনই একটা সময় যখন শিল্পকলা এবং সাহিত্য চর্চা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল।


বাৎস্যায়ন যে নগরের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, কিংবা তাঁর রচনায় যে ‘নগর’ এর কথা উল্লেখ আছে-তার যথাযথ অবস্থান সম্পর্কে পন্ডিতজনের ভেতরে মত-ভিন্নতা রয়েছে। যশোধরা’র মতে এ নগর ছিল পাটালিপুত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, উন্ডি ডনিজের এবং সুধীর কাঁকরও একই মত পোষণ করেন। অধ্যাপক চাকলাদারের অনুমান এ নগরটি হচ্ছে বর্তমানের জয়পুর। আবার পি. সি. বাগচী’র মতে এ অনুপম নগরটি ছিল উজ্জয়নি, বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়রের উজৈন, কিংবা হতে পারে গান্ধারা, অথবা বাকট্রিয়া। যেসব অঞ্চলের অধিবাসীরা তাঁর আলোচনায় স্থান পেয়েছে, যেমন: বল্লীকা (বাকট্রিয়া), বিদর্ভ, অবন্তী, মহারাষ্ট্র, অবহিরা, সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণাপথ, ভানাভাস, এবং কুন্তলা – এর মাঝে বাকট্রিয়া বাদে সবগুলোর অবস্থান পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে। সে কারণে এটা সম্ভব যে বাৎস্যায়ন পশ্চিম ভারতে বসবাস করতেন এবং নগরটি ছিল সম্ভবত উজ্জয়নি,অবন্তীর প্রাচীন রাজধানী, যা গুপ্ত যুগ এবং তার আগে থেকেই সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান ছিল। বাকট্রিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথটি উজ্জয়নির ভেতর দিয়ে উত্তর ভারতের ভারুচ (ভৃগুকচ্ছ) পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। অতএব, এটাই সম্ভবত কোন বাণিজ্যপথের উপরে স্থাপিত একমাত্র বহুজাতিক শহর, যা দূরবর্তী দেশগুলোকে স্থলপথে এবং সমুদ্রপথে সংযোগ স্থাপন করেছিল (Bagchi)। প্রাচীন মঘধ সাম্রাজ্যের (মৌর্য এবং গুপ্ত যুগ) অভিজাত শ্রেণীর রুচি এবং সংস্কৃতির একটি লিখিত প্রমাণ ‘কামসূত্র’ (ভূমিকা: Danielou)। সে সময় মগধ ছিল বিশ্বের বড় সাম্রাজ্যগুলোর একটি, যার আয়তন ছিল ৫,০০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। মৌর্য এবং গুপ্ত সভ্যতার উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটেছিলো এই মঘধে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। তাঁর পুত্র বিম্বিসারের শাসনামলে গৌতম বুদ্ধ এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু সৌধ-নগরী ‘পাটালিপুত্র’ নির্মাণ করেন। কামসূত্রে নাগরিকদের সামাজিক অবস্থান এবং তাদের সচ্ছলতার বিস্তারিত বর্ণনা থেকে বাৎস্যায়নের এ নগরে বসবাসের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। কেননা, পাটলিপুত্র ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি, সে কারণে এ নগর পন্ডিত এবং বুদ্ধিজীবীদের আকৃষ্ট করতো। অভিজাত শ্রেণীরা শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শিল্পী, নাট্যকার, কবি , দার্শনিক, এবং অর্থশাস্ত্রবিদরা ভাগ্যান্বেষণে এ নগরে বিচরণ করতেন, যেমন দত্তক, চাণক্য এবং বররুচি।


‘কামসূত্র’ মৌর্য (৪০০ খ্রি:পূর্ব) এবং গুপ্ত সভ্যতার (৪০০ খ্রি:) জনজীবনের নানাবিধ আচার-ব্যবহার এবং রীতিনীতির প্রামাণ্য গ্রন্থ, কেননা এ মূল্যবান সাহিত্যকর্মটি আসলে হাজার বছর আগে কামশাস্ত্র বিষয়ে রচিত একটি আকর গ্রন্থের সার-সংকলন। বাৎস্যায়নের পূর্ববর্তী লেখকরা সে গ্রন্থটিকে সাধারণের পাঠযোগ্য করার জন্য পরিমার্জন এবং সংক্ষেপণ করেছিলেন। অনেকে আবার এ বিশালকায় গ্রন্থের অধ্যায়গুলোর ভিত্তিতে পৃথক-পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। মূল গ্রন্থটি লিখেছিলেন নন্দী, দেবতা শিবের সঙ্গী। তিনি কামশাস্ত্র বিষয়ে এক হাজার অধ্যায়ের একটি বই লিখেছিলেন। নন্দীর বইয়ের বিশালতা তাঁর পরবর্তী লেখকরা সংক্ষেপ করে গেছেন। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব আট শতকে ঔদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু এটাকে ৫০০ অধ্যায়ে কমিয়ে আনেন। তারপর পাঞ্চলা দেশের লেখক বাভ্রু তাঁর চেলা বা পুত্রদের সহযোগে এটাকে সংক্ষেপ করে ১৫০ অধ্যায়ে নিয়ে আসেন, এবং সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩ থেকে ১ শতকের ভেতরে একাধিক লেখক এ অধ্যায়গুলোর ভিত্তিতে গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন দত্তক। তিনি পাটালিপুত্রের গণিকাদের পরামর্শে ষষ্ঠ অধ্যায়ের ভিত্তিতে একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং শিরোনাম দেন ‘কামশাস্ত্র’। দত্তকের অনুকরণে সারন্য, সুবর্ণভা, ঘোটকামুখা, গোনারদিয়া, গণিকাপুত্রা, এবং কুচুমারা বাকি ছয়টি অধ্যায় নিয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মাঝে সারন্য লিখেছিলেন সাধারণ মন্তব্যগুলো নিয়ে, ঘোটকামুখা এবং গোনারদিয়া নব-দম্পতিদের নিয়ে, গণিকাপুত্রা উপপত্নীদের নিয়ে, সুবর্ণনভা লিখেছিলেন যৌন মিলনের বিভিন্ন কৌশল, এবং কুচুমারা লিখেছিলেন গুপ্ত তালিম বা শিক্ষণ নিয়ে। গোনারদিয়া’র আরেক নাম পতঞ্জলি, যিনি ‘মহাভাষ্য’র রচয়িতা। কিন্তু এ ধরণের খন্ড-বিখন্ডের ভিত্তিতে গ্রন্থ রচনার ফলে মূল পান্ডুলিপির মৌলিকত্ব নষ্ট খর্ব হয়ে গিয়েছিল, এমনটি দাবি করেছেন বাৎস্যায়ন, এবং সে কারণে ওই পৃথক পৃথক বিস্তারিত খন্ডের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার জন্য তাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে (খন্ড ১, অধ্যায় ১, সূত্র ১৪)। গ্রন্থের ভূমিকায় বাৎস্যায়ন এসব লেখকদের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন, এবং দাবী করেছেন যে, যদিও ‘কামসূত্র’ একটি সংকলন, কিন্তু এখানে সন্নিবেশিত সকল পরামর্শ এবং অনুশীলনগুলো তিনি নিজে পরখ করে দেখেছেন।


‘কামসূত্র’র খোশবু মধ্যযুগেই ভারতের বাইরে পৌঁছে গিয়েছিলো। ১৫ শতকে তিউনিসিয়ার সাহিত্যিক শেখ নাফজাওয়া (মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-নাফজাওয়া) তাঁর ‘দি পারফিউম গার্ডেন’ বইতে ভারতীয় কামশাস্ত্রের অনেক বিষয়ে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং ‘কামসূত্র’র অনেকগুলো আসনের জটিলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অবশ্য, নাফজাওয়ার পরেও এ ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে বাৎস্যায়নের প্রস্তাবিত বেশ কিছু আসনে মিলন একেবারেই অসম্ভব। আসলে প্রশ্নটি উঠেছে ‘কামসূত্র’ রচনার প্রায় দু’হাজার বছর পরে, কিন্তু ততদিনে মানবজাতির শরীরী কাঠামোতে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। অতএব,এ যুগে এসব আসন অসম্ভব মনে হলেও ধারণা করা যেতে পারে তখন এগুলো শারীরিকভাবে স্বাভাবিকই ছিল (ডোম মোরেস)। তাছাড়া বাৎস্যায়ন নিজেও দাবী করেছেন যে, বইটির পরামর্শগুলোর বাস্তব উপযোগিতা তিনি যাচাই করে দেখেছেন। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতে কামকলার অধ্যয়ন এবং চর্চা হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কিংবা তার কিছু আগে রচিত ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬.২.১২-১৩, ৬.৪.২-২৮)’ কামশাস্ত্র চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক সুশীল কুমার দে ধারণা করেন, নিশ্চয়ই কোন একটা সময়ে প্রাচীন কামশাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন এবং অনুশীলন হতো, ধর্ম এবং অর্থশাস্ত্র’র পাশাপাশি (৯১)। যদিও এ শিক্ষাটা সমাজের অভিজাত শ্রেণী, বণিক সম্প্রদায়, রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং অভিজাত গণিকাদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। সে যুগে সমাজে নারী যৌনকর্মীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ধর্মশাস্ত্র,কামশাস্ত্র, এবং অর্থশাস্ত্রে– তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে। প্রাচীন ভারতে দু’ধরণের যৌনকর্মীদের পরিচয় পাওয়া যায়; গণিকা এবং বেশ্যা। এর ভেতরে গণিকারা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী এবং চৌষট্টি কলায় শিক্ষিত। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিবেচনায় তারা সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। তাদের বাড়িতে শিল্প,সাহিত্য, দর্শন, এবং সঙ্গীত নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা হতো। সমাজের অভিজাত শ্রেণী- এমনকি রাজাও তাদের সম্মান প্রদর্শন করতেন। এসব অভিজাত গণিকাদের সান্নিধ্য লাভের আশায় সবাই উন্মুখ থাকতো, যেমন শুদ্রকের নাটকের বসন্তসেনা, কিংবা হেরমান হেসে’র ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসের কমলা। তাদের রূপ, রুচি, পোশাক এবং প্রসাধন অভিজাত সমাজে অনুকরণীয় ছিল।


বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ মূলত সমাজের অভিজাত এবং ধনপতি শ্রেণির আমোদ-প্রমোদ এবং কামনা-বাসনাকে প্রাধান্য দিয়ে লেখা হয়েছে। এসব উচ্চবিত্তরা- নগরে বাস করত এবং জীবন-যৌবন উপভোগ করার জন্য তাদের সচ্ছলতা ছিল। ‘কামসূত্রে’ রয়েছে নিম্নবিত্ত এবং দারিদ্রতার প্রতি সীমাহীন ঘৃণা। আদ্যোপান্ত বইটি পড়লে মনে হবে নিম্নবর্গের মানুষদের বুঝি এসবের কোন প্রয়োজন নেই। এমনকি, তিনি বেশ্যাদের পরামর্শ দিয়েছেন দেউলিয়া খদ্দেরদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে। বিষয় বৈচিত্রের কারণে ‘কামসূত্র’ সংস্কৃত সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ সন্দেহ নেই, কিন্তু এ গ্রন্থে লেখকের অনেক উপদেশ -পরামর্শ নৈতিক এবং সামাজিক অপরাধে উৎসাহিত করে, যেমন যৌন-লিপ্সা মেটানোর জন্য কোন নারীর স্বামীকে হত্যা করে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নেওয়া, ধর্ষণ-পূর্বক বিবাহে বাধ্য করা, বেশ্যাদের গ্রাহক ঠকানো, এবং ধনী গ্রাহকদের সহায়-সম্পদ হাতিয়ে তাদের প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু এধরনের সমাজবিরোধী কাজে পরামর্শের জন্য তাকে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ, অধ্যাপক চাকলাদারের মতে তিনি কোন গণরাজ্যে বসবাস করতেন, অর্থাৎ সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল।


বইটির মাত্র শতকরা কুড়ি ভাগ যৌন-মিলন নিয়ে আলোচনা আর বাকি অংশের লক্ষ্য- কিভাবে একজন পরিপূর্ণ মানুষের গুণাবলি অর্জন এবং পরিচ্ছন্ন জীবন উপভোগ করা যায়। মূলত, বাৎস্যায়ন মিলনের একঘেয়েমি কাটানো এবং পর্যাপ্ত দৈহিক আনন্দ লাভের জন্য বইয়ের দ্বিতীয় পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬৪ টি আসনের যে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘কামসূত্র’ শুধুমাত্র ওইটুকুর জন্যই অতিরঞ্জিত এবং বিতর্কিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগ শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘কামসূত্র’ শুধুমাত্র যৌনমিলনের আসন-ভঙ্গির পুস্তক নয় (ডনিজের, মোরেস, সিনহা)। ১৯৭০’র দশকে যখন পাশ্চাত্যে সক্রিয়ভাবে যৌন শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে তখন থেকেই ‘কামসূত্র’র বাণিজ্যিক উপস্থাপন শুরু হয়, এবং এটি একটি sex manual কিংবা marriage manual হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। এখন ‘কামসূত্র’ নামে পর্নোগ্রাফি, পত্রিকা, চলচ্চিত্র, কার্টুন, কনডম, ট্যাবলেট, জেলি, চকলেট, গাম, উপন্যাস, রেস্তোরাঁ, মদ, রেসের ঘোড়া, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কোর্স – পর্যন্ত চালানো হচ্ছে। এদের দৌরাত্ম্যে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘কামসূত্র’ শুধুমাত্র যৌন-লীলার সমার্থক, ইন্দ্র সিনহা: ““…no two Sanskrit words are more widely known and misunderstood than Kama Sutra. In the West the work is commonly believed to be salacious, anecdotal account of exotic lovemaking.” (1980:8)। কিন্তু ‘কামসূত্র’র উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক; দৈহিক আনন্দের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতায় উত্তীর্ণ হওয়া। বাৎস্যায়নের মতে, মানুষের জীবনে সময় ভেদে তিনটি লক্ষ্যে নিয়োজিত থাকা উচিৎ; ধর্ম, অর্থ এবং কাম, এবং এ তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত। ধর্মশাস্ত্র পঠন-পাঠন এবং রপ্ত করার মাধ্যমে ধর্মচর্চা চালিয়ে যেতে হবে, অর্থ-ধন-দৌলত সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য যেতে হবে বণিকদের কাছ (৯-১০) আর কাম অর্থাৎ আনন্দ – বাসনা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে হবে ‘কামসূত্র’ অধ্যয়নে এবং বিজ্ঞ নাগরিকদের কাছ থেকে। শ্যামশাস্ত্রীর মতে, যৌনানন্দের চূড়ান্ত লক্ষ্য যে আধ্যাত্মিক ‘কামসূত্র’র শিক্ষা সেটাই। দেবদত্ত শাস্ত্রী, কামসূত্রের হিন্দি ব্যাখ্যাকারী মনে করেন: “Without spiritual union between spouses or partners, marriage and love have no meaning (Danielou 35)।” দীপক চোপড়াও, আধ্যাত্মিক গুরু, অনুরূপ মতামত পোষণ করেন। তাঁর মতে ‘কামসূত্র’ হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা চর্চার একটি নির্দেশিকা।


বাৎস্যায়নের পরবর্তী ভারতীয় শিল্পকলা এবং সাহিত্যে কামসূত্রের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে; কবিতা, নাটক, চিত্রকলা, খোদাই চিত্র, এবং ভাস্কর্য কামসূত্র-প্রভাবিত। সংস্কৃত এবং বাংলা সাহিত্যে নায়ক-নায়িকার রূপের বয়ানে কামসূত্রের প্রভাব স্পষ্ট। খাজুরাহো (১১শতক), ভুবনেশ্বর (১১শতক) এবং কোনারকের সূর্য মন্দিরের (১৩ শতক) মিথুন-মূর্তি ‘কামসূত্র’র চুম্বন, আলিঙ্গন এবং দৈহিক মিলনের বিভিন্ন আসনের আদলে নির্মিত। কবি ও নাট্যকাররা তাদের নায়ক-নায়িকার সৌন্দর্য এবং আমোদ-প্রমোদের বর্ণনায় ‘কামসূত্র’র সহায়তা নিয়েছেন, যেমন: কালিদাস, মাঘ, ভবভুতি, ভারবি, এবং কুমার দাস। কালিদাস ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত ২ (শাসন কাল ৩৮০ -৮১৫ খ্রিঃ)’র সমসাময়িক, তার লেখনীতে শৃঙ্গাররস নিয়ে আলোচনা প্রমাণ করে তিনি ‘কামসূত্র’র ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। একই যুগের কবি সুবন্ধু সরাসরি ‘কামসূত্র’র উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব কাব্য’এ (৮,১৮) দন্তক্ষত’র লক্ষণ, এবং কিরাতের নখ বিলেখন, চুম্বন, দন্তক্ষত এবং ভারবির ৯,৪৯,৫৯, ৬২ লাইন আবার ‘কামসূত্র’কে মনে করিয়ে দেয়। মাঘ-এর ‘শিশুপাল বধ’ এবং কুমারদাসের ‘জানকিহরণ’ কিংবা জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’এ (১১,৬-৬,১২ এবং ২০-২) নখ-বিলেখনের বর্ণনায় কামসূত্রের প্রভাব রয়েছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ২৫ অধ্যায়ে উল্লিখিত দূতীর গুণাবলী, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বর্ণনা এবং প্রেমিকদের প্রতি বেশ্যাদের আচার ব্যবহারের আলোচনা ‘কামসূত্র’র অনুরূপ (মোতিচন্দ্র ৫২)। উপরন্তু, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে গণিকা বসন্তসেনার সৌন্দর্য, আচার -ব্যবহার, এবং ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’র বিদ্যাসুন্দর’ পর্বে বিদ্যা ও সুন্দরের মিলনের দৃশ্যাবলী সাজাতে লেখকরা ‘কামসূত্র’র সহায়তা নিয়েছেন।


বড়ু চন্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীতর্ন’ এর চরিত্রাবলির দৈহিক সৌন্দর্য এবং কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ এর কিছু কিছু বিষয় আমাদের ‘কামসূত্র’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন কি বাঙালিদের রচিত কিছু প্রহসন, যেমন গোপীনাথ চক্রবর্তীর ‘কৌতকসর্বস্বম (১৬০০-১৮০০ র্খ্রি :)’ এবং কবিতার্কিকের ‘কৌতুক রত্নাকরম’ ও ‘কামসূত্র’ প্রভাবিত। ভারতে কামশাস্ত্র রচনার ধারাবাহিকতা উনিশ শতক পর্যন্ত প্রবহমান ছিল, এবং ‘কামসূত্র’র পরেও অনেকগুলো গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেমন: দামদরগুপ্তের ‘কুট্টনীমত’ (৮ম শতক, কাশ্মীর), কুচুমারার ‘কুচোপনিষধ,’ পদ্মশ্রিজ্ঞানের ‘নগরসর্বস্ব (১০ম-১১ শতক)’ কোক্কোকের ‘রতি রহস্য’ বা কোকশাস্ত্র (১২ শতক), এবং কল্যানমল্লের ‘অনঙ্গরঙ্গ(১৫/১৬ শতক)’। কয়েকজন বাঙালি লেখকও সংস্কৃত ভাষায় কামশাস্ত্র রচনায় অংশ নিয়েছিলেন, যেমন জয়দেব (রতিম›জরী),’ হরিহর (শৃঙ্গারদীপিকা) এবং মিননাথ (স্মরদীপিকা)। তবে ঔপনিবেশিক আমলে এ সৃজনশীল সাহিত্যধারার ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি। ইংরেজ প্রশাসন এবং তাদের সহযোগী খ্রিস্টান মিশনারিদের চক্রান্তে এ ধারাটির যথাযথ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কোলকাতার মধ্যবিত্ত এবং ইংরেজি শিক্ষিত সমাজে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি অভিযোগ ‘অশ্লীলতা’ এর মূল কারণ। পশ্চাৎপদ ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে চালিত খ্রিষ্টান মিশনারি এবং প্রশাসনের ইংরেজ কর্মকর্তারা ভারতে এ অভিযোগটি উত্থাপন করে।


উপনিবেশিক আমলে ভারতে ইংরেজদের পরিকল্পিত নয়া শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় খ্রিস্টান ধর্ম-প্রচারকরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং পাঠতালিকায় খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ক পুস্তক -পুস্তিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের শিক্ষারীতিতে পাঠদানের মাধ্যমে অভিজাত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে ভিক্টোরীয় নৈতিকতার ধ্যান-ধারণা এবং মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ‘ব্যাপ্টিস্ট মিসন প্রেস’ স্থাপিত হয়। উইলিয়াম কেরি এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে ১৮৩২ সালের ভেতরে এ ছাপাখানা থেকে খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে ২১২,০০০ বই প্রকাশিত হয়। এসব বইয়ের লেখকদের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিলেন উইলিয়াম ইয়েটস, জসুয়া মার্সমান,উইলিয়াম ওয়ার্ড, অ্যালেকজান্ডার ডাফ, এবং উইলিয়াম কেরি। এদের প্রচার-প্রচারণা এবং মিশনারি শিক্ষকদের প্ররোচনা ও উৎসাহে ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদের মাঝে ধর্মান্তরিত হবার প্রবণতা দেখা দেয়। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-১৮৭৩ খ্রিঃ), রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী (১৮১৩-১৮৮৫খ্রিঃ), তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭ খ্রিঃ), এবং লালবিহারী দে। খ্রিস্টান মিশনারি, ইংরেজি শিক্ষিত তরুণ সমাজ, ‘ইয়ং বেঙ্গল’, এবং পাশ্চাত্য ভাবধারায় আচ্ছন্নরা মিশনারিদের উত্থাপিত নতুন হুজুগ – ‘অশ্লীলতা’ নিয়ে পত্র পত্রিকায় এবং সভা-সমিতিতে প্রচার চালাতে থাকে। ভারতীয়দের আবহমান গণ-সংস্কৃতির শেকড়-বাকড় উপরে ফেলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সেকালের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং সমাজ সংস্কারকদের সিংহভাগ ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, কিংবা পাশ্চাত্য মতাদর্শে দীক্ষিত। তাদের প্রচার-প্রচারণায় ১৮৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি ভারতে ব্রিটিশ সরকার Obscene Publication Act প্রণয়ন করে, যার আওতায় অশ্লীল পুস্তক এবং চিত্র, প্রকাশ্যে অশ্লীল নাচ,গান এবং এমনকি জনপ্রিয় পাঁচালি গানের অনুষ্ঠানও নিষিদ্ধ করা হয়। সাহিত্যের কণ্ঠরোধের জন্য হয়েছিল এ আইন, অন্যদিকে, নাট্যানুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা প্রণয়ন করেছিল Dramatic Performance Act(১৮৭৬)। এসব নিষেধাজ্ঞার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো ধর্মীয় মূল্যবোধের সংঘাত।


হিন্দু ধর্মে কামকলাকে আধ্যাত্মিকতা চর্চায় অত্যাবশ্যক বিবেচনা করা হয়। ঔপনিবেশিক আমলে ভিক্টোরীয় যুগের খ্রিস্ট ধর্ম চর্চা ছিল এর বিপরীত মেরুতে। ভিক্টোরীয় যুগে ‘যৌনতা’ বা ‘কাম’-এর কোন মূখ্য ভূমিকা ছিল না, এটাকে ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় বিবেচনা করা হতো। তখন ইংল্যান্ডে নারীর সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে। নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক পাওলো মন্তেগাজ্জাঃ ” Our Western civilization approaches woman like animals in heart, with hardly more than an animal comprehension of the anatomy and human refinement.” (Basu, B.N.)। যৌনতা বা কাম নিয়ে নারীদের কথা বলার অনুমতি ছিল না; এটা ছিল একটা সামাজিক কুসংস্কারের মতো। ভিক্টরিয় সমাজে ‘যৌনতা’ কোন উপভোগের বিষয় ছিল না। নারীর একমাত্র দায়িত্ব ছিল বিয়ে এবং সন্তান উৎপাদন, যৌনতা উপভোগ-অসম্ভব! বিবাহোত্তর যৌন মিলনের প্রয়োজন থাকলেও, ব্যাপারটা ছিল লজ্জাজনক। স্বামীর দ্বারা গর্ভবতী হওয়া ছাড়া, স্ত্রীরা, এমনকি ঘুমাতোও আলাদা কক্ষে, কারণ তারা যেন দৈহিকভাবে কামাসক্ত হয়ে না পড়ে। যৌনতার ব্যাপারে খোলাখুলি এবং সততার সাথে কোন আলোচনা হতো না। প্রকাশ্যে যৌনমিলন কিংবা এ জাতীয় ব্যাপারে কথোপকথনকে আহাম্মকি ধরে নেয়া হতো, এবং অস্বস্তি আর ভীতির চোখে দেখা হতো, মিশেল ফুকো:

Sexuality was carefully confined; it moved into the home. The conjugal family took custody of it and absorbed in into the serious function of reproduction. On the subject of sex, silence became the rule….it would be driven out, denied, and reduced to silence. Not only did it exist, it had no right to exist… ( 3-4)

ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডের আমজনতা যৌনতার ব্যাপারে অজ্ঞ এবং নিরাসক্ত ছিল। যৌনতার এই গ্রহণকাল থেকে সমাজকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই রিচার্ড বার্টন এবং তাঁর সহযোগীরা ‘কসমোপলি কামশাস্ত্র সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করে প্রাচ্যের শৃঙ্গাররসকেন্দ্রিক সাহিত্যের তর্জমা শুরু করেছিলেন। বার্টনের যুগে ইংল্যান্ডে অবদমন, বিকৃতি, এবং নারীদের মাঝে কামনা-বাসনার অভাবটা অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কেননা তখন, দৈহিক মিলনে কামানন্দ লাভ করাকে ঈশ্বর এবং চার্চের বিরুদ্ধে পাপ হিসেবে গণ্য করা হতো। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের সহজাত তাড়নার এমন অবদমনের নজির ইতিহাসে বিরল। কিন্তু ভারতের চিত্র ছিল এর বিপরীত; প্রাচীন কাল থেকেই এ ভূখন্ডে যৌনতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুধর্মে মানবিক জীবনাচরণে যৌনতাকে অত্যন্ত পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক চর্চার একটি অপরিহার্য অংশ বিবেচনা করা হয়, বৃহদারণ্যক উপনিষদে নারীকে হোমাগ্নির সাথে তুলনা করে যৌনমিলনকে কৃত্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে:

Women is the sacrificial fire,

the lips of her yoni the fuel,

the hairs around them the smoke,

and the vagina itself the flame.

The act of penetration is the lighting.

The feelings of pleasure are sparks.

In this fire the gods offer up semen- seed.

And from this offering man is born. (qtd. in Shinha)


বেদ-পুরাণে মৈথুন বা কামকেলি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা রয়েছে। ঋগ্বেদ-এ যম-যমীর সুক্তে বোন যমী তার ভাই যমকে যৌনমিলনের আহ্বান জানালে যম তা প্রত্যাখ্যান করে, কেননা এটা ধর্মবিরুদ্ধ। উপরন্তু, যম যমীকে পরামর্শ দেয় যে এটা সে অন্যের সাথে করুক। ‘তোমার প্রতি তার কামনা জাগুক, আর, তার প্রতি তোমার, অতঃপর তোমরা সুখী মিলনে রত হও।’ যৌনতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র ছাপিয়ে এ ভূখন্ডের শিল্প এবং সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, খোদাইচিত্র, সংস্কৃত, হিন্দি, তেলেগু, এবং বাংলা সাহিত্যের পদাবলী কীর্তন, খেউর, তরজা, পাঁচালি, কবিগান, ঝুমুর, এবং টপ্পায় আদিরস যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে, এবং এ নিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের আগে কোন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। ইহুদি এবং খ্রিষ্টান ধর্মে সৃষ্টির শুরু বিবেচনা করা হয় ‘আলো’ থেকে, হিন্দু ধর্মে সৃষ্টির শুরু ‘কাম’ থেকে। অতএব ‘কাম’ যে-ধর্মে কৃত্যের পর্যায়ে সেখানে এর শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর। মানবজীবনে যৌনতার ভূমিকা অপরিসীম, সে কারণে এ কথাটি প্রচলিত যে, ”লতাপাতা, শেকড়-বাকড়ে জ্ঞান ব্যতীত কবিরাজ, গণিতে জ্ঞান বিনা হিসাবরক্ষক এবং কামশাস্ত্রে জ্ঞান ব্যতিরেকে বিবাহিত মানুষের কোনও মূল্য নেই ” (ভাগীঃ ১৮০)। সভ্যতার বিকাশে যৌনতার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি মানব জীবনের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতায় এর অবদানকে অস্বীকার করারও উপায় নেই।

বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্র’র তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম অংশে দাবি করেছেন যে তাঁর এ বইয়ের লক্ষ্য নরনারীর যৌন-শিক্ষা যা কিনা তাদের আনন্দ এবং পূর্ণতা প্রদান করবে। তিনি আরও বলেছেন যে, মানব দেহের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কামের আনন্দ প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন খাদ্যের (সূত্র ৪৬-৪৮)। অতএব, নারী এবং পুরুষ দু’জনারই ‘কামসূত্র’ অধ্যয়ন করা উচিৎ; আর নারীদের তা করতে হবে যৌবনে পদার্পণের আগেই, এবং বিয়ের পরেও, তাদের স্বামীদের অনুমতি নিয়ে এ চর্চা তারা চালিয়ে যাবে (সূত্র ১-২, ২য় অধ্যায়)। তবে এখানে তিনি অবিবাহিত নারীদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সঙ্গী বাছাইয়ের ব্যাপারটি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। মালঙ্গ বাৎস্যায়নের পরামর্শ হল কোন সুশীল সমাজে নারীরা একটা নির্জন স্থানে ‘কামসূত্র’র তত্ত্বের চর্চা, অনুশীলন, এবং চৌষট্টিকলা অধ্যয়ন করবে। কামকলা ব্যতিরেকেও এ চৌষট্টিকলার (অঙ্গবিদ্যা) ভেতরে আছে কণ্ঠ সংগীত, যন্ত্রসংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা,জলতরঙ্গ, ভাস্কর্য, বাস্তকলা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, অলংকার নির্মাণ, শরবত এবং পানীয় তৈরি করা, কাব্যপাঠ, বাগান বিলাস, পুতুল নির্মাণ, ইত্যাদি। নারীদের এই চৌষট্টিকলা রপ্ত করার লক্ষ্য শুধুমাত্র ভালো স্ত্রী হবার জন্যই নয়; বরং দক্ষ, যোগ্য, সমঝদার, সুরুচিসম্পন্ন, সুন্দর এবং বুদ্ধিমতী নারী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। কোন নারী এসব অঙ্গবিদ্যায় পারদর্শী হলে যে-কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সে সচ্ছলতার সাথে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। উল্লেখ্য, প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ পান্ডুলিপি রচিত হলেও বাৎস্যায়ন তাঁর রচনায় নারী এবং পুরুষদের, একে-অন্যের পরিপূরক হবার জন্য, কামকলা অধ্যয়নে সমান গুরুত্ব প্রদান করেছেন।


সংস্কৃত সাহিত্য, বাঙালির পল্লী সাহিত্য এবং লোকধর্মে কামকলা, দেহ, এবং যৌনাচারের যথেষ্ট বিবরণ আছে এবং এটা যে ‘অশ্লীল’ এমন কোনো অভিযোগ ইংরেজ শাসনের আগে কেউ তোলেনি। পাঁচালি, খেঁউড়, কবিগানের পৃষ্ঠপোষকরা ছিলেন সমাজের অভিজাত শ্রেণী যেমন: রাজা, জমিদার, তালুকদার, সামন্ত প্রভু, এবং ব্যবসায়ী। তাদের আর্থিক সহায়তায় এধরনের অনুষ্ঠানগুলো পরিচালিত হতো এবং তাতে গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে রাজকুমার এবং রাজকুমারীদের খেঁউড় গানের পংক্তি রচনা করে রীতিমত আবৃত্তি করতে হতো। এই খেঁউড়কে মিশনারিরা ‘অশ্লীল’ আখ্যা দিয়েছিল। আসলে অশ্লীলতা বিষয়টি নিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের আগে সাধারণের মাঝে কোন শুচিবাই ছিল না। পাঠে এবং অভিনয়ে তারা যা উপভোগ করতো, তাতে আদিরস থাকলেও সেটা কখনোই তাদের ভেতরে কোনো প্রশ্ন তৈরি করেনি। কিন্তু ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে চালিত ইংরেজরা যৌনতাকে পাপ (sex is sin) বিবেচনা করতো বলেই ভারতীয় শিল্প-সাহিত্যে প্রেম, এবং কামনা-বাসনার বয়ান তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিলাতি প্রশাসন এবং তাদের সহযোগী খ্রিস্টান মিশনারিরা উপলব্ধি করছিল যে ভারতীয়দের সংস্কৃতির শেকড় তাদের জীবনের অনেক গভীরে প্রোথিত, এবং একে উৎপাটন করতে হলে এর মূলে আঘাত করতে হবে। ভোগের মহিমা যে সমাজে স্বীকৃত, সেখানে ত্যাগের মহান বাণীর হালে পানি পাবার সম্ভাবনা কম, এটা তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। তারা অনুধাবন করেছিল যে শিল্প, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যের প্রতি ভারতীয়দের আস্থা টলাতে হলে ভারতীয়দের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। এবং সেটা সম্ভব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে একটা নয়া শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে যার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে পাশ্চাত্যের শিল্প-সংস্কৃতি, এবং ধর্ম শ্রেষ্ঠতর।



পরিকল্পনা মাফিক শুরু হয় অভিজাত শ্রেণীকে ‘রক্তমাংসে ভারতীয় কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ইংরেজ’ বানানোর প্রক্রিয়া। লর্ড উইলিয়াম ম্যাকুলে এই নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক। এ দুরভিসন্দ্বীমূলক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল দুটি; ক) ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করার জন্য মধ্যস্থতাকারী একদল কেরানি তৈরি করা, এবং খ) ভিক্টোরিয় চিন্তাচেতনার একটি শিক্ষিত সমাজ তৈরি করা। সে প্রেক্ষিতে, East India Company Act ১৮১৩ বা Charter Act ১৮১৩ অনুমোদনের মাধ্যমে খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং ধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু, এ আইনের প্রতি ভারতীয়দের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল; তারা আশঙ্কা করেছিল যে ইংরেজরা সব ভারতীয়দের ধর্মান্তরিত করবে, এবং সেটা যে অমূলক ছিলনা তার সত্যতা পাওয়া যায় লর্ড উইলিয়াম ম্যাকুলের জবানিতে। ১৮৩৬ সালে ভারতীয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি তাঁর বাবাকে উল্লাসের সাথে লিখেছিলেন: “আমাদের ইংরেজি বিদ্যালয়গুলির চমৎকার প্রসার ঘটছে। হিন্দুদের উপর এ শিক্ষার প্রভাবটি বিস্ময়কর । …আমার বিশ্বাস, যদি আমাদের শিক্ষার পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়, তাহলে আগামী আগামী ত্রিশ বছরের ভেতরে বাংলায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মাঝে একটিও মূর্তিপূজারী থাকবে না” (Rajaram)। ভারত বিশেষজ্ঞ, সংস্কৃত পন্ডিত ফ্রেদেরিক মাক্সমুলারও অনুরূপ মতামত প্রকাশ করেছেন। ১৮৮৮ সালে তিনি তখনকার ভারপ্রাপ্ত ‘সেক্রেটারি অফ স্টেট’ ডিউক অফ আর্গালকে লিখেছিলেন: “ভারতের প্রাচীন ধর্ম শেষ, আর খ্রিস্টান ধর্ম যদি এর স্থান দখল করতে না পারে তাহলে দোষটা হবে কার?”(ibid)। খ্রিষ্টান মিশনারিরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগে অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয়দের চিন্তা-চেতনায় অশ্লীলতার ধারণাটি স্থাপন করে।


ভারতীয় সমাজ থেকে তথাকথিত অশ্লীলতা নির্মূলের কার্যক্রমে মিশনারিদের পাশাপাশি যুক্ত ছিল প্রাচ্যবিদ, ভারত বিশেষজ্ঞ, ইংরেজি শিক্ষিত নয়া বুদ্ধিজীবী, ইসলামী মতাদর্শ চালিত কিছু সংগঠন, ‘আর্যসমাজ’ এবং ‘ব্রহ্মসমাজ’-এর সদস্যরা। এরা ভারতীয় সাহিত্য এবং শিল্পকলায় অশ্লীলতার উপস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হতে থাকে; যেমন, ১৮০৬ সালে রেভারেন্ড জেমস ওয়ার্ড শোভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণদেবের বাড়িতে ‘কবিগান’ শুনে তাকে অশ্লীল আখ্যা দেন। তাঁর মতে গান এবং নাচে ছিল নোংরামি, গানগুলো ছিল আগাগোড়া অশ্লীলতায় ভরা। ইয়ং বেঙ্গলদের তাত্ত্বিক গুরু হেনরি ডিরোজিওর পত্রিকা ‘The Kaleidoscope’ কবিগানকে অভিযুক্ত করছিল ‘so disgustingly obscene’ এবং vulgar হিসেবে। ‘কলকাতা ইশকুল বুক সোসাইটির’ সেক্রেটারি ই. এস. মন্তাগু লক্ষ্য করেছিলেন ব্যাপক সংখ্যক বাঙলা পুস্তক নাকি সাধারণ সৌজন্যতাবোধকেও ছাড়িয়ে গেছে। আসলে সে যুগে ভারত এবং ইংল্যান্ডের সৌজন্যবোধের মাপকাঠিতে যে বিস্তর ব্যবধান ছিল, এসব সরকারি বুদ্বিজীবীরা সে ব্যাপারটি কখনই বিবেচনা করেননি। প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ (১৮৪৮-১৯২০) আগ্রার চিত্রকলা এবং খোদাই চিত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ফরাসি পর্যটক মসিয়ে জ্য দো দেভনো ১৮৬৬ -১৮৬৭ সালে ভারত ভ্রমণে আগ্রার চিত্রকলা দেখে এর বিরুদ্ধে যে অতিমাত্রায় অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছিলেন তাতে তাঁরও অকপট সমর্থন ছিল। তাঁর মতে, সম্রাট শাহজাহান এই অলক্ষুণে দৃষ্টান্তটি স্থাপন করেছিলেন, কেননা তাঁর নির্দেশেই ১৬৬৬ সালে এসব অঙ্কন করা হয়েছিল (৩৩৬)। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্রকর্ম এবং সাহিত্যে প্রেমের রাগ-অনুরাগের বর্ণনায় যদি এমন প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে ছাইভস্ম মাখা কোনো উলঙ্গ যোগী দেখলে তো তাদের মূর্ছা যাবার কথা। কিন্তু এসব ঋষি-যোগী-সন্যাসীদের দেখে কোনো ভারতবাসী তেড়ে এসেছে এমন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আসলে পাশ্চাত্যের আয়নায় ভারত দেখার কুফল এই অযৌক্তিক সমালোচনা যা কিনা ভারতের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় পাহাড় সমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সাহিত্য এবং শিল্পকলার প্রতি এই মিথ্যা অভিযোগের তীর Obscene Publication Act অনুমোদনের পরেও অব্যাহত থেকেছে, যেমন ১৮৭৩ সালে কলকাতার টাউন হলে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একটি সংগঠন “Society for the Supression of Public Obscenity’’ গজিয়ে ওঠে, যাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে public obscenity, indecency এবং impurity’র অভিশাপ থেকে উদ্বার করা। ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, এবং শিক্ষক জর্জ স্মিথ (১৮৩৩-১৯১৯) এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বলেছিলেন এ সোসাইটির কাজ হবে “”… aid the executive in the suppression of one of the most subtle forms of public vice।‘ তিনি ‘পাবলিক ভাইস’ বা জন-কলঙ্ক বলতে এই আদিরসাত্মক প্রকাশনাকেই বুঝিয়েছেন। কবি এবং সাংবাদিক স্যার এডউইন আর্নল্ড (১৮৩২-১৯০৪) ১৮৭৫ সালে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’র তর্জমা করেছিলেন, কিন্তু শেষ সর্গটি (পাশ্চাত্যের ধর্মীয় অনুশাসনের বিবেচনায়) এতটাই বাড়াবাড়ি ছিল যে এ অংশটি তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাচ্যবিদ হরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) ভারতীয় পুরাণ নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেছেন, কিন্তু তিনি বিনয়ের সাথে ভারতীয়দের প্রেমের প্রতি অকপট দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

‘North Indian Christian Tract and Book Society’ এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল: ”ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু মন্দিরে এমন সব প্রতিকৃতি রয়েছে যে, কেউ তা দেখলে নিজেকে অশুচি মনে করবে। কৃষ্ণ যখন গোপীদের সাথে অশালীন কাজ-কারবার করে, তখন সে কি খারাপ ছিল না?। ” ইংল্যান্ডে শিক্ষিত মহাত্মা গান্দ্বী একদল শিষ্য পাঠিয়েছিলেন এসব মিথুন মূর্তি ভেঙে ফেলার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তক্ষেপে এগুলো রক্ষা পায় (ভুমিকাঃ Danielou)। চিত্রশিল্পী এবং সমালোচক রজার ফ্রাই ১৯৩৩ সালে ভারতীয় শিল্পকলার ধরন নিয়ে সমালোচনা করেন যে ভারতীয় শিল্পকলার একটা বড় অংশ, এমনকি ধর্মীয় চিত্রকলাও নিঃসন্দেহে অশ্লীল। এদের প্ররোচনায় এবং প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় ক্রমান্বয়ে ভারতীয়দের মনোজগতে প্রাচীনপন্থী ভিক্টোরীয় নীতি-নৈতিকতা জেঁকে বসে, এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ভদ্দরলোক এবং বুদ্বিজীবীদের মতামতে। সোমপ্রকাশ, সমাচার দর্পণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এসব মতামত প্রকাশিত হয়। এমনকি নারীদের ‘বামবোধিনী’ পত্রিকা বিদ্যাসুন্দর এবং পাঁচালী পড়ার অভ্যাস নারীদের ত্যাগ করার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাত্রা’কে অশ্লীল আখ্যা দেন, তারা যাত্রা পালাকার- অধিকারীদের নীচ, ইতর ব্যবসায়ী বলতে সংকোচ বোধ করেননি।


তেলেগু সমাজ সংস্কারক কান্দুকুরি ভীরসালিঙ্গাম ১৮৮৭ সালে তেলেগু কবি মুড্ডাপালানি’র আদিরসাত্বক কাব্যগ্রন্থ ‘রাধিকা সান্তয়ানাম (Radhika Santwanam)’ বিরুদ্বে যৌনতার অভিযোগ এনে এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। রাধার কামনাবাসনা এর কেন্দ্রীয় বিষয়। একটি অধ্যায়ে রাধা তাঁর ভাতিজী ইলাদেবীকে কামকলা এবং আমোদ- প্রমোদের তালিম দেয়। উপরন্ত, রাধা অল্পবয়সী নারীদের কামনা-বাসনা ব্যক্ত করার জন্য উৎসাহিত করে। ১৯১১ সালে পুনঃপ্রকাশের পর ইংরেজরা তড়িঘড়ি করে এটাকে নিষিদ্ব করে(Gupta, 31)। হিন্দি সাহিত্যিক মাহাভির প্রাসাদ দ্বিভেদী ভারতীয় সাহিত্যকে ভিক্টোরীয় মানদন্ডে বিচার করেছেন :

এসব বইতে কি লেখা হয়েছে দেখা যাকঃ

বেশ্যা আর পরকীয়ার নোংরামি! অবিবাহিত মেয়েদের পাপ কর্ম!! নির্লজ্জ আর নীচ নারীদের অর্থহীন বাগাড়ম্ভর!!! কোথাও কোথাও কোন নায়িকার রাতের আধারে যমুনার তীরে ছুটে বেড়ানো, কোথাও সে আবার চন্দ্রালোকে প্রিয়তম এর অপেক্ষায়…

আমাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে বড় শক্তি আর কি হতে পারে?…আমি এসব সাহিত্যকর্মের রচনা আচিরেই বন্দ্ব করার আবেদন জানাচ্ছি , এবং যেগুলো প্রচলিত আছে সেগুলো বেআইনি ঘোষণা করার আবেদন জানাচ্ছি (Cited in Gupta, 44)।

একই প্রতিধ্বনি শুনি আমরা হিন্দি রাষ্ট্র কবি মৈথিলীশরণ গুপ্ত’র কাছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত তাঁর ভারত-ভারতীঃ

অশ্লীল সাহিত্য আমাদের চরিত্রের সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি করছে….

কবিতার লক্ষ্য হয়েছে শৃঙ্গাররস…. ধন্য এসব কবিদের, ধন্য তাদের বাসনার। (ibid , 44)


এধনের উড়ে এসে জুড়ে বসা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এলাহাবাদের পন্ডিত কৃষ্ণকান্ত মালভিয়া আক্রমণ করেছিলেন। অভ্যুদয় প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর “Manoroma ke Patro: Apne Premiyon ke Nam” বইতে বিবাহিত মনোরমা তাঁর চার প্রাক্তন প্রেমিকের উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ ধারাবাহিক পত্র লেখে, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে মনোরমার প্রেম এবং দৈহিক কামনা ও বাসনা। উপরন্তু, এসব চিঠিতে পুরুষদের অক্ষমতা এবং দুর্বলতা ব্যক্ত করা হয়েছে এবং কিভাবে পরিপূর্ণ যৌন জীবন উপভোগ করা যায় তার নানাবিধ পরামর্শও দেয়া হয়ছে। ১৮৭৪ সালের চরক উৎসবে উত্তর কলকাতার কাঁসারি পাড়ার একটি সঙের দল মিছিলের মাধ্যমে এ অভিযোগের ব্যাঙ্গাত্বক প্রতিবাদ জানিয়েছিল: “শহরে এক নতুন হুজুগ উঠেছে রে ভাই, অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।” নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং সাহিত্যিক রাধা মাধব কর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বাঙালির জনপ্রিয় যাত্রার প্রতি যে অশ্লীলতার অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে।

অথচ, যখন এধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাশিত ছিল, সেই ইসলামী শাসনামলে ভারতের মুসলমান শাসকরা আদিরসের সাহিত্যচর্চায় কোন বাধা প্রদান করেননি। ১৫ থেকে ১৮ শতকের ভেতরে মুসলিম রাজদরবারে অনেক আদিরসাত্বক সংস্কৃত পান্ডুলিপি ফার্সি ভাষায় তর্জমা করা হয়েছিল রাজকুমার এবং রাজকুমারীদের পঠন-পাঠনের জন্য। ১৮ শতকে দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ শাহ ২, নিজের রক্ষিতাদের সাথে তাঁর মিলনের চিত্রাবলী (মিনিয়েচার) শিল্পীদের অঙ্কনের ফরমাশ দিয়েছিলেন। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকেরা ‘কামসূত্র’ নিয়ে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেমন লজ্জত-উন-নিসা (নারীর সুখ)। পনেরো শতকে বিদারের রাজপৃষ্ঠপোষকতায় এ গ্রন্থটি রচিত হয়, এবং ১৮৫০ সালে মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ মজুমদার মেহদুন উর্দু এবং ফারসি ভাষায় এটির সচিত্র অনুলিপি তৈরি করেন। অতএব, ভারতে আদিরসের সাহিত্য এবং শিল্পকলার চর্চায় ইসলামিক শাসকরা কোন ব্যাঘাত ঘটাননি, বরং তাদের বিরুদ্বে প্রণোদনা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। কামশাস্ত্র চর্চার ধারাবাহিকতায় নাটকীয় ছন্দপতন ঘটেছিলো উপনিবেশিক আমলে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ব্রিটিশ ভারতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক মিশনারিদের আগমনের মধ্য দিয়ে।


এখন দেখা যাক মিশনারি এবং বিলাতি প্রশাসনের এ উদ্দেশ্য হাসিলে আমরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলাম। উল্লেখ্য যে্ ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতরে অশ্লীলতার যে বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল তার প্রভাব পড়েছিল সমাজে ব্যাপক স্তরে। প্রায় দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনামলে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের ফলে ভারতবাসীর মনে ধীরে ধীরে অশ্লীলতার ধারণাটি আসন চেপে বসে; বিশেষত ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী খুব সহজেই এ ধারণাটি গ্রহণ করে। যেহেতু তারা শিক্ষিত এবং গণমাধ্যম ছিল তাদের কব্জায় – অতএব তাদের ‘অশ্লীলতা’ বিষয়ক মতামতের একটা প্রভাব পড়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজে, এবং তাদের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এ হুজুগটি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে যেমন এই সামাজিক চাপ, অন্যদিকে আবার প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকাশ্যে কামশাস্ত্র বিষয়ে লেখালেখি স্থগিত হয়ে যায়, এবং কামসূত্র, রতিশাস্ত্র, লজ্জত-ঊন-নিসা, মেঘদূত এর পঠন-পাঠন পর্দার অন্তরালে চলে যায়। এই বিচ্ছিন্নতা পাঠক এবং পুস্তকের ভেতরে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি করে। যেহেতু লিখলেও সেটা প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিলনা, অতএব লেখকরা আর এ বিষয়ে সাহিত্যচর্চায় অগ্রণী হলেন না। যদি হতেন, তাহলে আমরা ‘কামসূত্র’র মতো আরও অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম দেখতে পেতাম। অবশ্য, এর পরে আড়ালে-আবডালে যা কিছু হয়েছে তাতে মেধার অভাব লক্ষ করা যায়। শৃঙ্গাররসধর্মী সাহিত্যের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৈরিতা এমন পর্যায়ে গড়িয়েছিল যে, নৃবিজ্ঞানী মনি নাগ(১৯৯৩)-এর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ‘কামসূত্র’ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পেছনের দিকে একটি কক্ষে তালাবদ্ব করে রাখা হতো এবং শিক্ষকদের সেটা পেতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হতো ( Joyti Puri: Religions of the East)। ঐতিহাসিক কুমকুম রায় বলেছেন ‘কামসূত্র’ এবং অন্যান্য আদিরসের পুস্তকাদি গ্রন্থাগারিকরাও তালাবদ্ব করে রাখতেন, এবং পাঠকদের পড়তে দিতে গড়িমসি করতেন। একজন গ্রন্থাগারিক তাকে বইটি লাইব্রেরির টেবিলের উপর রাখতে নিষেধ করেছিলেন, কেননা অল্পবয়সী মেয়েরা নাকি ওটার পাতা উল্টিয়ে দেখবে (Vanita: 270)। এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বাৎস্যায়নের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়; তিনি বিয়ের আগে এবং পরে মেয়েদের ‘কামসূত্র’ অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের পরামর্শ দিয়েছেন।

ইংরেজদের সৃষ্ট অশ্লীলতার এ ধারণাটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে শেকড় গেড়ে বসার পরিণামে এ মূল্যবান গ্রন্থটির প্রকাশ্য চর্চা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। এখনও শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে প্রকাশ্যে ‘কামসূত্র’ নিয়ে কথা বলতেও অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। ‘কামকলা’ হচ্ছে চৌষট্টি কলার একটি, কিন্তু বর্তমান যুব সমাজ এটাকে তেমনটি বিবেচনা করছে না। বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞতাই এর মূল কারণ। যেহেতু এটার প্রকাশ্য স্বীকৃতি সামাজিকভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে এবং এধরনের বই-পুস্তক পঠন-পাঠন একটা নিষিদ্ধ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে সাধারণের মাঝে এবিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এ বিচ্ছিন্নতার কারণে অসচেতন যুব-সমাজ যৌনতার দিকে থেকে সাংঘাতিক রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। যে নিজের এবং তার সঙ্গীর দেহকে যথাযথভাবে বুঝতে অক্ষম তার পক্ষে পরিপূর্ণ জীবন উপভোগ করা সম্ভব নয়। দৈহিক এবং মানসিক আনন্দ লাভের জন্য সবার কামকলায় জ্ঞান থাকা উচিত, কেননা এ বিষয়ে অনভিজ্ঞতা, ঝগড়া ঝাঁটি, দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ, বিশ্বাসহীনতা , পরকীয়া, ধর্ষণ, এবং প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজের মূল কারণ। বাৎস্যায়ন এ ব্যাপারে পুরুষদের সতর্ক করে দিয়েছেন; কোনো নারী যদি তার পুরুষ সঙ্গীর কাছে আনন্দ-তৃপ্তির অভিজ্ঞতা লাভ না করে, তাহলে সে তাকে ঘৃণা করবে এবং তাকে ছেড়ে অন্যজনের সাথে চম্পট দেবে (৪.২.৩১-৩৫)। কামকলায় অনভিজ্ঞ পুরুষরা দৈহিক এবং মানসিক আনন্দ লাভের জন্য নারীদের সাথে পশুর মতো আচরণ করে। ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার অনরে দ্য ব্যলজাক গতানুগতিক স্বামীদের তুলনা করেছে ওরাং-ওটাঙের গিটার বাজানোর চেষ্টার সাথে। জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত থাকা আধুনিক মানুষের দাম্পত্য জীবনে অস্থিরতার মূল কারণ যৌনতা সংশ্লিষ্ট : অতিরিক্ত মানসিক চাপ, সময়ের অভাবে পরস্পরের ইচ্ছা, চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা বুঝতে অনাগ্রহ এর মূল কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের পথ দু’হাজার বছর আগেই বাৎস্যায়ন বাতলে দিয়েছিলেন; ‘কামসূত্র’ অধ্যয়ন এবং অনুশীলনে নারী এবং পুরুষ আনন্দ এবং পূর্ণতা লাভ করবে। অথচ,আমরা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে সেটাকে দূরে ঠেলে রাখছি।

অতএব এটা এখন স্পষ্ট যে, ইংরেজ শাসনের আগে ভারতে যৌনতা বিষয়ে সাধারণের মাঝে যে ইতিবাচক মনোভাব বিরাজ করছিল, ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পর তাতে পরিবর্তন ঘটে। বিলাতি প্রশাসন, মিশনারি, এবং তাদের সৃষ্ট ভারতীয় নয়া বুদ্বিজীবীদের রক্ষণশীল মানসিকতাই ছিল কামশাস্ত্র চর্চার প্রধান অন্তরায়। এরা নানাবিধ কূটকৌশলে ভারতীয়দের মনোজগতে যৌনতা বিষয়ে সংকীর্ণ এবং অবাস্তব ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে। এর পরিণামে ভারতে আদিরসের সাহিত্যধারার প্রতি সাধারণ মানুষের একটি বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। মূলত, যৌনতার ক্ষেত্রে হিন্দুধর্ম এবং খ্রিস্টান ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর ব্যবধানই ভারতে কামশাস্ত্র চর্চার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ইংরেজরা কখনই ভারতে শিল্প-সাহিত্যের এ ধারাটি আমলে আনেনি এবং এটাকে আত্মস্থ করার চেষ্টাও করেনি, মুঘলরা যেটা করেছিল। ঔপনিবেশিক আমলে কামশাস্ত্র রচনা ও প্রকাশনায় রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ভারতবাসীর জন্য কোন শুভবার্তা বয়ে আনেনি। এ নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক প্রত্যাখ্যানের পরিণামে ভারত উপমহাদেশ এখনও যৌনতার দিক থেকে অনেক কুসংস্কার এবং অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অথচ, এ ধারাটির যথাযথ চর্চা অব্যাহত থাকলে যৌনতার ব্যাপারে আমরা অনেক প্রগতিশীল চিন্তাধারা অর্জন করতে পারতাম।


পাঠ তালিকা:

A. Smith, Vincent. A History of Fine Art in India and Cylone: From the Earliest time to

Present Day, (Oxford, 1911)


Bagchi, Dr. P.C. (Foreword), Kama Sutra. Trans. Dr. B.N.Basu, Revised by S.L. Ghosh,

M.A.


Bhagi, M.L., Ancient India: Culture and Thought. The Indian Publications, 1974.


Chakladar, Haranchandra. Social Life in Ancient India: A Study in Vatsyayana’s

Kamasutra, Susil Gupta (India) Limited, Calcutta 1954.


Chandra, Moti (Foreward). The Kama Sutra of Vatsyayana. Trans. S.C. Upadhyaya,

Bombay, Taraporevela,1974.


De, S.K. Ancient Indian Erotics. India, Firma K.L. Mukhopadhya, 1st Ed.1959, Reprinted

1969.


Doniger, Wendy and Sudhir Kakar. Vatsyayana Kamasutra: A New Translation, Oxford

University Press, 2009, New York.


Danielou, Alain. The Complete Kama Sutra, Rochester, Vermont, 1994.


Foucault, Michel. The Will to Knowledge: The History of Sexuality: 1, Penguin Books,

1998, England.


Gupta, Charu. Sexuality, Obscenity, Community: Women, Muslims, and the Hindu Public

in Colonial India, Plagrave, New York, 2002.


Moraes, Dom (Introduction). The Kama Sutra of Vatsyayana, trans. Sir Richard Burton

and F.F. Arbuthnot, Edt. John Muirhead-Gould, Panther Books Limited, Manchester,

England.


Nefzaoui, Sheikh.The Perfume Garden.trans. Burton, Sir Richard. Hardfordshire:

Wordsworth Classics, 1995.


Puri, Joyti. Article: Concerning Kamasutras: Challenging Narratives of History and

Sexuality (Chapter 1), Book titled: Religions of the East, edited by Stephen Hunt,

Rutledge, N.Y. 2016


Sinha, Indra. The Love Teachings of Kama Sutra. New Delhi, Bookwise (India) Pvt.

Ltd.,1980.


The Sexual History of the Global South: Sexual Politics in Africa, Asia and Latin

America. Edt. Saskia Wieringa and Horacio Sivori, Zed Books Ltd., London, 2013.


Vanita, Ruth. Gandhi’s Tiger and Sita’s Smile: Essays on Gender, Sexulity and Culture.

Yoda Press, New Delhi, 2005.

Web:

Dr. N.S. Rajaram. Aryan Invasion – History or Politics?

http://www.archaeologyonline.net/artifacts/aryan-invasion-history, Accessed 27/5/2018


Article: British Education in India. Web: History of British Rule and Colonization in India

http://veda.wikidot.com/article:british-education-in-india, accessed 27/5/2018






No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ