আপনারা প্রায় সকলেই অবগত আছেন যে, আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে ধৃতরাষ্ট্রর ও যুধিষ্ঠিরের সময় ব্যাসদেব স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। সকলেই জানেন বুদ্ধদেবকে অষ্টাদশ পুরাণে, অবতার বলে স্বীকার করা হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী বুদ্ধদেব কলিতে জন্ম নিয়েছিলেন, দ্বাপরে ব্যাসদেবের প্রায় চব্বিশ শত বৎসর পরে। অতএব ব্যাসদেব যে, পুরাণ রচয়িতা নন এতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, ব্যাসদেবকৃত মহাভারতে কোথাও পুরাণের কোন নামই নেই। বরং পুরাণের বহুজায়গায় মহাভারতের নাম পাওয়া যায়। সেই কারণে প্রমাণ হয় যে, ভাগবত পুরাণ রচয়িতা ব্যাসদেব নন। মহাভারতের শান্তিপর্বে মােক্ষধর্ম পর্বাধ্যায়ের ৩৩২ এবং ৩৩৩ অধ্যায়ে লেখা আছে ব্যাস পুত্র শুকদেব যুধিষ্ঠির জন্মের পূর্বেই ইহলােক ত্যাগ করেছিলেন। মহাভারতের যুদ্ধশেষ হওয়ার পর যুধিষ্ঠির রাজত্ব করেন ৩৬ বৎসর ৮ মাস ২৫ দিন। এর পর পরীক্ষিৎ রাজত্ব করেন ৬০ বৎসর, সর্বমােট ৯৬ বৎসর ৮ মাস ২৫ দিন। সুতরাং এতদিন তাঁর জীবিত থাকা সম্ভব নয়। কারণ মহাভারতে বৈশম্পায়ন কৃত ভীষ্ম বাক্য বর্ণনায় জানা যায় যেকুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হওয়ার পূর্বেই শুকদেবের দেহান্ত হয়েছিল -
ভীষ্মউবাচঃ-
'‘নারদেনা-ভ্যনুজ্ঞাতঃ শুকো দ্বৈপায়নাত্মজঃ।
অভিবাদ্য পুনর্যোগমস্থায়াকাশমাবিশৎ।।"
নারদের অনুজ্ঞা নিয়ে শুকদেব যােগাবলম্বন করতঃ আকাশে আবেশ করলেন। অনন্তর তিনি প্রজ্বলিত বিধূম পাবকের ন্যায় নিত্য নিগুণ লিঙ্গ বর্জিত আদিত্যান্তৰ্য্যামী পরব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
যথা-
"ততস্তস্মিন পদে নিত্যে নিগুণে লিঙ্গ বর্জিতে।
ব্রহ্মণি প্রত্যতিষ্ঠৎ স বিধুমােচগিরিব জ্বলন্।।"
শুকদেবের বিদেহ কৈবল্য লাভ হল, তিনি সর্বগত, সর্বতােমুখ এবং সর্বাত্মা
হয়ে গেলেন।
"শুকঃ সর্বগতােভূত্বসর্বাত্মসর্বতােমুখঃ।।২৩ অন্তর্হিতঃ প্রভাবং তু দশয়িত্বা শুকস্তদা গুণান্ সন্ত্যজ্য শব্দাদী পদমভ্যগমৎ পরম্।।"
শুকদেবের এই মহাপ্রয়াণে ব্যাসদেব পুত্রশােকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন, মহাদেব সেখানে উপস্থিত হয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন
'‘স গতিং পরমাং প্রাপ্তো দুষ্প্রাপাং জিতেন্দ্রিয়ৈঃ। দৈবতৈরপি বিপ্রর্ষে তং ত্বং কিমনুশােচসি।।"
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বহু পূর্বেই যাঁর দেহপাত হয়ে গেল তাঁরপক্ষে পুনরায় যুদ্ধ শেষের বহু পরে দ্বাপরের শেষ প্রান্তে সুরধণীর তীরে, প্রয়ােগবেশনে উপবিষ্ট রাজা পরীক্ষিতকে, তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বে মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে দিগম্বর শুকদেব, তাঁকে ভাগবত শােনানো কি সম্ভব ? শুধু তাই নয়, ব্যাসদেব কৃত মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী পরীক্ষিৎ নিজেকে রক্ষা করার জন্য মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে এমন এক স্তম্ভ প্রাসাদ তৈরী করালেন যেটি অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং সেখানে বসেই তিনি উপযুক্ত পাহারায় রাজকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন। এখানে প্রশ্ন হল ভাগবতের কথানুযায়ী রাজা পরীক্ষিৎ শ্রীকৃষ্ণের পদ সেরা শ্রেষ্ঠ মনে করে প্রাণত্যাগের সংকল্প নিয়ে (সুরধণী) গঙ্গার তীরে উপবেশন করলেন। অথচ ব্যাসকৃত মহাভারতের বর্ণনায় তিনি নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় একটি সুরক্ষিত দুর্গ বা প্রাসাদ তৈরী করেছিলেন। তাহলে কোনটি সত্য ? নিশ্চয়ই কল্পিত ভাগবত নয়! কারণ একই লেখক ব্যাসদেব দুই বইয়ে একই ঘটনা নিয়ে দুই জায়গায় দুরকম লিখতে পারেন কি ? সুতরাং ভাগবত যে ব্যাসদেবের লেখা নয় এটাই সত্য। এই সব অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রসিদ্ধ গােড়ীয় বৈষ্ণবাচাৰ্য্য রাধাবিনােদ গােস্বামীকেও “বৈষ্ণবাচার পদ্ধতি নামে গ্রন্থ লিখতে হয়েছিল। তিনি ওই গ্রন্থের ১৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন বর্তমান সময়ে ভােগী ব্যবসাদার গুরুরা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে, নিজেরাই স্বয়ং কৃষ্ণ সেজে শিষ্যশিষ্যাদের দ্বারা পূজিত হন। অতএব ভাগবত যে কত অশ্লীল মিথ্যাচারে ভর্তি একটি গ্রন্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন কি ভাগবতের কথা অনুযায়ী শুকদেব দ্বারা রাজা পরীক্ষিৎ কে মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে ভাগবত শােনানােও সব মিথ্যা কথা, এতে কোন সন্দেহ নেই। মহাভারতে আছে মহাপ্রস্থানের সময় পঞ্চ পান্ডবদের সাথে দ্রৌপদী মেরুপৰ্বতের শিখর দেশে এসে--
"যাজ্ঞসেনী ভ্ৰষ্টযােগা নিপপাত মহীতলে"
অর্থাৎ দ্রৌপদী ওখানে প্রাণ ত্যাগ করেন। আবার ভাগবতে আছে কৃষ্ণের তিরােভাবের সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির সহপঞ্চভ্রাতা দ্রৌপদীর জন্য অপেক্ষা না করে উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করলেন। তখন দ্রৌপদী বাসুদেব উপাগত হয়ে দেহত্যাগ করেন।
'‘দ্রৌপদী চ তদাজ্ঞায় পতীনামন পেক্ষতাম্।
বাসুদেবে ভগবতিহ্যেকান্ত মতিরাপতম্।।"
ভাগবত ১,১৫,৫০।
এখানেও একই লেখক ব্যাসদেব একই ঘটনা দুই জায়গায় দুইরকম লিখতে পারেন কি ? অতএব ভাগবত যে ব্যাসদেব কৃত নয় ইহাই প্রমাণ করে। এরকম অনেক কাহিনী আছে যা এক পুরাণের সাথে আরেক পুরাণের মধ্যে কোন মিল নাই এখন আপনারাই বিচার করে দেখুন ধূর্তরা কিভাবে নিজেদের সার্থ হাসিল করার জন্য ব্যাসদেবের নাম ব্যবহার করেছেন। এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমান আবার দেবীভাগবত পুরাণেই মিলে দেখুন-
"ধূর্তঃ পূরাণের চতুরৈঃ হরি শংকরাণা।
সেবা পরাশ্চ বিহিতাস্তব নির্মিতানাম।।"
(দেবী ভাগবত স্কন্দ ৫,অধ্যায়১৯)
অনুঃ- পুরানের নির্মিতারা অত্যন্ত চতুর, ধূর্তরা শিব ও বিষ্ণু পুজার শ্ৰেষ্ঠতা নিজেদের উদরপূর্তি করার
জন্য লিখেছেন।
ব্যসদেব যে পুরাণ শাস্ত্র গুলোর রচিয়তা নয় ধূর্তদের দ্বারা তৈরি করা গ্রন্থ এ-র থেকে বড়ো প্রমান আর কি হতে পারে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ