ত্রয়ী শব্দের অর্থ এটা নয় যে বেদ তিনটি, বরং বেদ এর মন্ত্র এবং অর্থকে তিন ভাগে বিভক্ত হেতু বেদকে ত্রয়ী বলে সম্বোধন করা হয়েছে ।
চার বেদের মন্ত্র গদ্যাত্মক, পদ্যাত্মক এবং গানাত্মক । পদ্যাত্মক মন্ত্রের অপর নাম ঋক্ । এই প্রকার উল্লেখ যে মন্ত্রগুলোতে অধিক তাকেই ঋগ্বেদ বলা বলা হয় ।
গদ্য এর অপর নাম যজু । গদ্যাত্মক ভাগের আধিক্য যে মন্ত্র গুলোতে রয়েছে তাকে যজুর্বেদ নামে সম্বোধন করা হয় ।
গান এর অপর নাম সাম, এর আধিক্য যে মন্ত্রগুলোতে রয়েছে তা সামবেদ ।
কেননা, চার বেদকে এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়, অতএব চার বেদে ঋক্-যজু-সাম লক্ষণ অথবা ত্রয়ী সম্বোধন করায় কোনো অযৌক্তিকতা হয় না ।
এজন্য এখানে ত্রয়ী অথবা ত্রয় এবং
ঋক্ যজু সাম লক্ষণ ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ হয়েছে ।
ঋষিগণ এমনটাই ব্যাখ্যা করেছেন —
" তেষামৃগ যত্রার্থবশেন পাদব্যবস্থা "
( মীমাংসা. ২/১/৩২ )
অর্থাৎ, যেসব মন্ত্রে পাদব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে, যে মন্ত্র ছন্দোবদ্ধ তাই-ই ঋগ্ ।
" গীতিষু সামাখ্যা " ( মীমাংসা. ২/১/৩৩ )
অর্থাৎ,যে মন্ত্র গানাত্মক, তাকেই সাম মন্ত্র বলা হয় ।
" শেষ য়জুঃ শব্দঃ " [ মীমাংসা. ২/১/৩৪ ]
অর্থাৎ, শেষ গদ্যাত্মক ভাগকেই যজু বলা হয় ।
সর্বানুক্রমণী বৃত্তি এর ভূমিকায় ষড়্গুরুশিষ্য উল্লেখ করেছেন —
বিনিয়োক্তব্যরূপশ্চ ত্রিবিধঃ স প্রদর্শ্যতে ।
ঋগ্যজুঃসামরূপেণ মন্ত্রো বেদচতুষ্টয়ে ।। ১
অহে বুধ্নিয়মন্ত্র মে গোপায়েত্যভিধীয়তে ।
চতুর্ষ্ণপি হি বেদেষু ত্রিধৈব বিনিয়ুজ্যতে ।।২
অর্থাৎ, যদিও বেদ চারটি তথাপি পদ্য, গান এবং গদ্য রূপে বেদ মন্ত্রেগুলোকে ত্রিধা ভেদে বিভক্ত করা হয় । অতএব বেদকে ত্রয়ী সম্বোধন করা কারণে এটা বুঝানো হয় না যে বেদ তিনটি ।
বেদত্রয়ী শব্দ প্রয়োগের অনেক অভিপ্রায় রয়েছে । প্রথমত যজ্ঞের কর্মকাণ্ড প্রথম তিন বেদের বর্ণনা করা হয়েছে এবং চতুর্থবেদ জ্ঞাতা ব্রহ্মার যজ্ঞে অংশগ্রহণের কোনো বিধান নাই । সে কেবল সাক্ষীমাত্র যৌন হয়ে অবস্থান করবে যজ্ঞ স্থলে ; অতএব যজ্ঞ কর্মের সম্বন্ধে তিন বেদেরই উল্লেখ করা হয়ে থাকে । [ বিস্তারিত চতুর্বেদ এর প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার মীমাংসাতীর্থকৃত অথর্ববেদ সংহিতা ভাষাভাষ্য প্রথমাবৃত্তি ভূমিকা ]
ব্যাকরণের নিয়মানুসারে অথর্ব এর নাম শেষেই উল্লেখ থাকে । [ অল্পাতরম্ অষ্টাধ্যায়ী ২/২/৩৪ ] যেই শব্দে কম স্বর অবস্থান করে, তা পূর্বেই উল্লেখ থাকে ।
অথর্ব শব্দে সর্বাধিক স্বরের উল্লেখ রয়েছে এ কারণে তা সবশেষে অবস্থান করে ।
এ কারণে ত্রয়ীকে তিন হিসেবে গণনা করা ঠিক নয় ।
ত্রয়ী বিদ্যার অভিপ্রায় হলো জ্ঞান, কর্ম এবং উপাসনা । জ্ঞান-কর্ম-উপাসনারই বর্ণন চার বেদে রয়েছে ; এজন্য চার বেদকেই ত্রয়ী বিদ্যা বলা হয় ।
" ত্রয়ী বৈ বিদ্যা ঋচো য়জুংষি সামানি ইতি " [ শতপথ ব্রাহ্মণ. ৪/৬/৭/১ ]
অর্থাৎ, ত্রয়ী নাম ঋগ্-যজুঃ-সাম বিদ্যার কারণ ।
চার বেদই ত্রয়ীবিদ্যা নাম দ্বারা সম্বোধন করা হয় ।
মহর্ষি বেদব্যাস বলেছেন —
ত্রয়ীবিদ্যামর্ব ক্ষেত বেদে সূক্তমথাঙ্গতঃ ।
ঋক্সামবর্ণাক্ষরতা য়জুষোऽথবর্ণস্তথা ।।
[ মহাভারত. শান্তিপর্ব. ১৬৫ ]
অর্থাৎ, তিন বিদ্যাকে অবলোকন করা উচিত ; সেই তিন বিদ্যা ঋগ্, যজু, সাম তথা অথর্বরূপ ।
ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণাদি যেসব গ্রন্থে যেখানে তিন বেদের উল্লেখ রয়েছে সেখানে অন্য স্থলে চার বেদেরও বর্ণনা রয়েছে ।
ঋগ্বেদ বিজানাতি য়জুর্বেদং সামবেদমাথর্বণ চতুর্থম্ ।। ২।।
( ছান্দোগ্য উপনিষদ. ৭/৭ )
এখানে চার বেদের উল্লেখ রয়েছে ।
অথর্ব এর নিগদ, ব্রহ্ম, অথর্ব এবং ছন্দ নাম বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখ পাওয়া যায় ।
" চত্বারো বা হমে বেদা ঋগ্বেদো য়জুর্বেদো ব্রহ্মবেদঃ "
( গোপথ ব্রাহ্মণ. ২/১৬ ]
এখানে অথর্ববেদকে ব্রহ্মবেদ বলা হয়েছে ।
নিগদ নাম একে সরলতার জন্য পড়া হয়ে থাকে ।
" নিগদো বা চতুর্থ স্যাদ্ ধর্মবিশেষাৎ "
অর্থাৎ, বিশেষতার কারণেই নিগদনামক চতুর্থ বেদের অস্তিত্ব রয়েছে ।
অথর্ববেদ ১৮/৪/২৪ নং মন্ত্রে বর্ণনা রয়েছে —
" ঋচঃ সামানি ছন্দাংসি পুরাণং য়জুষা সহ "
এই মন্ত্রে ঋগ্, য়জু তথা সাম এর সাথে অথর্বকে ছন্দাংসি বলা হয়েছে ।
" য়ত্র ব্রহ্মা পবমানশ্ছন্দস্যাং বাচং বদন্ "
( ঋগ্বেদ. ৯/১১৩/৬ )
অর্থাৎ, এখানে যজ্ঞে ব্রহ্মাকে ছন্দবাণী বলা হয়েছে ।
যজ্ঞে ব্রহ্মা অথর্ববেদ এর ক্ষেত্রেই নিযুক্ত হয় । এই উক্তিই উক্ত ঋচাতে উল্লেখ হয়েছে । ঋচা বলে ব্রহ্মা ছন্দবাণী উচ্চারণ করে থাকে ।
এর তাৎপর্য হলো, ব্রহ্মা অথর্ববেদ এর অধ্যয়ন করে । অতএব ছন্দ অথর্ববেদই ।
ঋচা য়জুংষি সামানি, ছন্দাংস্যাথর্বণানি চ । চত্বারস্ত্বাখিলা বেদাঃ সরহস্যাঃ সবিস্তরাঃ ।।
[ হরিবংশ পুরাণ ]
এখানে ঋগ্, যজুঃ সাম এর সাথে " ছন্দাংসি অথর্ব " বলা হয়েছে । যার মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অথর্ববেদেরই নাম ছন্দবেদ ।
মহর্ষি পাণিনিও অথর্ববেদ এর বর্ণনা করেছেন —
" অথর্বাণিকস্যৈকলা পশ্চ "
( পা. ৪/৩/১৩৩ )
এই সূত্র দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায় যে পাণিনিরও অথর্ববেদ সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো ।
" শাকলাঢু " ( পা. ৪/৩/১২৮ ) এবং
" শৌনকাদিভ্যরচ্ছন্দসি " ( পা. ৪/৩/১০৫ )
দুটি সূত্রেই ঋগ্বেদ এবং অথর্ববেদ এর শাখার বর্ণনা হয়েছে ।
" কাশ্যপকৌশিকাভ্যাং ণিনিঃ "
( ৪/৩/১০৩ )
এ দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায় যে, অথর্ববেদের ওপর কৌশিক সূত্রেরও জ্ঞান পাণিনির ছিলো ।
" য়ামথর্বা মনুষ্যিতা দধ্যঙ্ ধিয়মতন্বত "
( ঋগ্বেদ. ১/৮০/১৬ )
" আথর্বণায়াশ্বিনা দঘীচে "
( ঋগ্বেদ. ১/১১৭/২২ )
এখানে অথর্ববেদ এর ঋষি পদের নাম উল্লেখ রয়েছে ।
সায়ণও তার ঋগ্ভাষ্যভূমিকায় লিখেছে —
" এতমেব মন্ত্রাऽবান্তরবিশেষমুপজীব্য বেদানা। ঋগ্বেদো য়জুর্বেদ সামবেদ ইতি ত্রৈবিধ্যং সম্পন্নমিতি ।
অর্থাৎ, এই গদ্য-পদ্য-গানাত্মক বিশেষতা দ্বারাই বেদের তিনটি ভেদ হয়েছে ।
সত্যব্রত সামশ্রমী লিখেছে —
" নৈতন্মতমস্মন্মনোদৃরম্ নাপি বিচারসহম্ নির্মূলত্বাৎ । ন ক্কাপি বেদে লোক বা তাদৃশম্ তস্য কিঞ্চিদপি মূলং কথমপি দৃশ্যতেনুমাতু বা শকয়তে । ত্রয়ীতি নাম্না বেদস্য ব্যবহার এবাত্র নিদানমিতি চেৎ, অস্মদুক্তত্রয়ীনামকরণমেব তৎসহারতয়া সদৈব জাগর্তি । সৎস্বপি চতুর্ষপি বেদেষু রচনাত্রয়ভেদ-নিবন্ধনং তেষু ত্রয়িত্বমব্যাহতমেব " [ নিরুক্তালোচন ]
অর্থাৎ, ত্রয়ী শব্দ দ্বারা চার বেদের তিন প্রকার অর্থের তাৎপর্য বুঝায় ।
" ব্রহ্ম প্রজাপতিধার্তা লোকা বেদাঃ সপ্ত ঋষয়োনয়ঃ
[ অথর্ববেদ: ১৯/৯/১২ ]
এই মন্ত্রে উল্লেখিত " বেদাঃ " শব্দ বহুবচনান্তে পদের সাপেক্ষে সায়নাচার্য লিখেন —
" বেদাঃ সাঙ্গাশ্বত্বারঃ "
অর্থাৎ, বেদ চারটি । জ্ঞান, কর্ম, উপাসনা এবং বিজ্ঞান ভেদ দ্বারা বেদ চার ভাগে ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব নাম দ্বারা সৃষ্টির আদিতে প্রসিদ্ধ হয়েছে ।
" ঋচন্তি স্তুবন্তি পদার্থানা গুণকর্মস্বভাবাননয়া সা ঋক্। "
অর্থাৎ, পদার্থের গুণ, কর্ম, স্বভাবের বর্ণনা ঋগ্বেদ-এ ।
" য়জন্তি য়েন মনুষ্যা ঈশ্বর, ধার্মিকান্ বিদুষশ্ব পুজয়ন্তি, শিল্পবিদ্যাসঙ্গতিকরণং চ কুর্বন্তি, শুভবিদ্যাগুণদানং চ কুর্বন্তি তদ্ য়জুঃ " ।
অর্থাৎ, যা মনুষ্যকে ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থসমূহের জ্ঞান দ্বারা ধার্মিক বিদ্বানগণের সঙ্গ শিল্পক্রিয়াসহিত বিদ্যা সমূহের সিদ্ধি শ্রেষ্ঠ বিদ্যা শ্রেষ্ঠ গুণগুলোকে দান করে তা যজুর্বেদ ।
" স্যতি কর্মাণীতি সামবেদঃ " যার মাধ্যমে কর্মের সমাপ্তি দ্বারা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় তা সামবেদ ।
" অথর্ব তিশ্বরতিকর্মা তৎ প্রতিষেধঃ "
[ নিরুক্ত: ১১/১৮ ]
চর সংশয়ে ( চুরাদিঃ ), সংশয়রাহিত্যং সম্পাদ্যতে য়েনেত্যর্থকথনম্ ।
অর্থাৎ, যা দ্বারা সংশয়ের নিবৃত্তি হয় তা অথর্ববেদ ।
" ঋগ্ভিঃ শংসন্তি, য়জুর্ভির্য়জন্তি, সামমিঃ, স্তুবন্তি অথর্বভির্জপন্তি " ।
[ কাঠক সংহিতা. ৪০/৭ ]
সব পদার্থের গুণসমূহের নিরুপণ ঋগ্বেদ করে থাকে ।
" ঋগ্ভিঃ শংসন্তি শব্দের অভিপ্রায় পদার্থ সমূহের লক্ষণ বর্ণনা করা ।
বস্তুর জ্ঞান প্রাপ্ত করার পর তার কার্য রূপমে পরিণত করার ক্রিয়ার নাম কর্মকাণ্ড যা যজুর্বেদ এর প্রধান বিষয় ।
যা সব সংঘটিত হওয়ার পর বিশিষ্ট জ্ঞান প্রাপ্ত হয় তা বিজ্ঞান ; যেটা অথর্ববেদ এর বিষয় ।
" তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোথর্ববেদঃ………. "
[ মুণ্ডকোপনিষদ: ১/১/৫ ]
" চত্বারো বেদাঃ সাঙ্গাঃ সরহস্যা বহুধা ভিন্না একশতমধ্বর্য়ু শাখাঃ সহস্রবর্ত্মা সামবেদ
একবিংশতিধা বাহ্বৃচ্যং নবধাথর্বণো বেদঃ…. "
[ মহাভাষ্য পস্পশাহ্নিক ]
" চত্বারি শৃঙ্গা " [ ঋগ্বেদ. ৪/৫৮/৩ ] এর ব্যাখ্যায় মহর্ষি যাস্ক বর্ণনা করেন —
" চত্বারি শৃঙ্গেতি বেলা বা এত উক্তাঃ "
[ নিরুক্ত: ১৩/৭ ]
এখানে মহর্ষি যাস্ক চার বেদ উল্লেখ করেছেন ।
ঋগ্বেদ এর নিম্ন মন্ত্রসমূহ দ্বারা প্রতীত হয় যে যজ্ঞে অথর্ববেদ এর প্রাধান্য রয়েছে ।
" যজ্ঞৈরথর্বা প্রথমঃ পথস্ততে "
[ ঋগ্বেদ. ১/৮৩/৫ ]
" অগ্নির্জাতো অথর্বণাং "
[ ঋগ্বেদ. ১০/২১/৫ ]
" ত্বামগ্নে পুষ্করাদধ্যথর্বা নিরমন্থন "
[ ঋগ্বেদ.৬/১৬/১৩ ]
উপরোক্ত তথ্যবহুল প্রমাণাদির আধারে প্রমাণিত হয় যে, অথর্ববেদ কোনো অবস্থাতেই অর্বাচীন নয় বরং ঋক্, যজু, সাম সদৃশ ঈশ্বরীয় জ্ঞান ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ