‘সেল (Cell)’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২,০০০ বছর বা তার আগেই পশুশিকারী মানুষের একটা দল ভাগ হয়ে চলে যায় মধ্য এশিয়ার ইরানের দিকে, দ্বিতীয়টি চলে আসে প্রাচীন ভারতের সিন্ধু নদের অববাহিকায়। আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ থেকে ৭,৫০০ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০-৫,৫০০) সময়কালের মধ্যে, আজকের উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাপ্ত সিন্ধু তথা হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তোলে এরাই। আজকের শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর তটে (ঘগ্গর-হাকরা বেসিন) অবস্থিত ‘ভিরানা’ শহর রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী প্রায় ৮,০০০ থেকে ৯,৫০০ বছরের পুরনো এবং হরপ্পা সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন। সেল (Cell) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, হরপ্পা সভ্যতার বৃহত্তম শহর, রাখিগড়িতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে প্রাপ্ত ৪,০০০ বছর পুরনো এক কঙ্কালের ডিএনএ (আই৬১১৩)-এর অ্যানালিসিস করে জানা যাচ্ছে যে এর সাথে সেই বহুহাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভারতে আসা মানুষের জীনগত সাদৃশ্য রয়েছে। মিল রয়েছে ইরানের দিকে যাওয়া দলটির ডিএনএ-এর সাথেও; কিন্তু, ইরানে চলে গিয়ে যে দলটি পশুশিকার ও প্রতিপালন ছেড়ে পরবর্তীকালে কৃষি কাজ শুরু করেছিল, তাদের সাথে এই সিন্ধু সভ্যতার মানুষের বংশানুক্রমিক কোন যোগ নেই। অর্থাৎ, হরপ্পা সভ্যতার বিকাশের সময়ে এখানকার ভূমিপুত্রেরাই কৃষিকাজ এর পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার রূপায়ণ করে।
অথচ, এতদিন ভাবা হত যে ইরান থেকে আসা মানুষেরাই ভারতবর্ষে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। অবশ্য ইরানের সাথে সেসময়ে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল কিনা বা তা’ এই হরপ্পা সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল কিনা, এই গবেষণা থেকে তা জানা যায় না। সাথে সাথেই, এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে সেই যুগে দাহ করার রীতিও চালু ছিল, সবাইকে গোর দেওয়া হত না। কাজেই গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনাটি হরপ্পা সভ্যতার অংশীদার শতশত গোষ্ঠীর মানুষের কারোর একটি। ভবিষ্যতে আরও এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
Max Muller, যিনি আর্যবাদের মূল প্রবক্তা, তিনি ১৮৭২ সালে স্ট্রেসবার্গ বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক বক্ত্তায় বলেন, আর্যভাষা-র অস্তিত্ব থাকলে -ও আর্যজাতি বা আর্য রক্তের কথা বলা অবৈজ্ঞনিক। [There are Arya and semitic languages but it is unscientific.. to speak of Aryan race, Aryan blood and Aryan skulls..]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে [১৭০০-] তিন শ্রেণীর ইউরোপীয় মানুষ ভাগ্যন্বেষণে ভারতে আসেন। প্রথম শ্রেণীর মানুষেরা এলেন বারতের মাটিতে বানিজ্যিক কারনে। ইংরেজ, ফরাসী,ডাচ এবং পর্তুগীজরা তাদের দেশে এক একটি East India Company স্থাপন করলেন এবং সমৃদ্ধশালী (তেমনটাই প্রচারিত ছিল ইউরোপের মাটিতে) ভারতের সাথে বানিজ্য করতে বেরিয়ে পড়লেন। জলপথে ভারতে পৌঁছাবার তাগিদ থেকেই অতীতে কলম্বাস, ভাস্কো-ডা-গামা-দের মতন লুটেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, তাদের নিজ নিজ দেশের রাজানুগ্রহ পেয়ে। এসব East India Company গুলো ভারত ও অন্যন্য দেশে বানিজ্যিক ঘাটি গেড়ে বসল এবং পারস্পরিক লড়াই চালিয়ে গেল, যাদের মধ্যে British Est India Company ভারতের বুকে রাজনৈতিক তথা শাসন ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হল।
দ্বিতীয় দল এলেন খ্রীষ্টান মিশনারী-রা যারা ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়লেন খ্রীষ্ট-মত প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং এদেশের সাধারণ মানুষ ও তাদের শিক্ষা-সৃস্কৃতির সাথে এই মিশনারীদের যোগাযোগ হতে লাগল।
তৃতীয় একদল মানুষ এলেন ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে, কোন-ও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ার বাইরে। তারা বিলাতে নিযুক্ত Est India Company বা মিশনারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী নন। এদেশে এসে কোন-ও না কোন-ও কাজে যুক্ত হয়ে অর্থোপার্জন করা তাদের মূল উদ্দেশ্য হলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ এদেশের সাথে সাংস্কৃতিগত ভাবে জরিয়ে পড়লেন। সেময় ইউরোপ নবজাগরণের মধ্যে দিয়ে এসেছে এবং সাহিত্য , বিজ্ঞান, শিল্প সর্বক্ষেত্রে-ই পারদর্শিতার চূড়ান্ত শিখরে বসে থেকে তারা পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের অশিক্ষিত, বর্বর বলে মনে করছেন। সর্বনিষয়ে ভারতের মানুষদের তারা অনুন্নত জাতি হিসাবে-ই দেখছিলেন। কিন্তু গোল বাধল এদেশের মাটিতে খুঁজে পাওয়া বৈদিক সাহিত্যিক নিদর্শনগুলি -যা রচনা ও অভ্যাস করার জন্য যে উন্নত, সভ্য ও শিক্ষিত মানুষদের প্রয়োজন তা সেইসময় ভারতের মাটিতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঐসব বৈদিক সাহিত্যগুলিতে "আর্য" শব্দটি পাওয়া যাচ্ছিল যা একশ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে প্রয়োগ করা ছিল।
১৬০০ সাল তেকে ভারতে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করেছিল। মিশনারীরা তার একটু আগে থেকেই ভারতে আসছিল। Robert De Noboli, যিনি ১৬০৬ সালে এদেশে আসেন, তার লেখা থেকে জানা যায় ১৫৫৯ সালে গোয়ার মিশনারীগণ এক খৃষ্টমত গ্রহণকারী ব্রাহ্মণের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্র তথা দর্শন গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন। উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ব্রাহ্মণদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান করা।
১৬৯৭ সালে একদল ফরাসী জেসুইট মিসনারী এলেন। তাদের মধ্যে Father pons ১৭৪০ সালে ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থগুলির এক তালিকা প্রস্তুত করেন। এরপর ১৭৯০ সালে Johann Philip Wesdin নামক এক জার্মান পন্ডিত একটি সংস্কৃত ব্যকরণ পুস্তক রচনা করেন।
Abbe Dubois নামক এক ফরাসী মিশনারী সর্বপ্রথম "আর্য জাতি" শব্দটি প্রয়োগ করলেন। পরবর্ত্তীকালে British Est India Company এই মতবাদটি লুফে নিল এবং দৃঢ়ভাবে এই মতটি প্রচার করতে লাগল যে যেমন ভাবে ইউরোপ থেকে তারা আধুনিক উন্নত শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এদেশে এসেছেন সেরকম-ই "আর্য জাতি"-র লোকেরা এদেশে এসেছিল এবং এসব বৈদিক সাহিত্য তাদের-ই উন্নত শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ।
প্রথমদিকে ভারতীয় সাহিত্য সম্ভারের বিস্তর জ্ঞান যত-ই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছিল, ইউরোপীয় পান্ডিতদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক উচ্চকিত ধারণার জন্ম দিচ্ছিল। দুই বিখ্যাত ইউরোপীয়ান পন্ডিত ভলতেয়ার ও স্লেগেল-----এর দুটি বক্তব্য
[Source:" The Invasion That never was": Michel Danino & Sujata Nahar;page 12-13 & 90-91] এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
১৫/১২/১৭৭৫ তারিখে লেখা এক চিঠিতে , যা ১৭৭৭ সালে প্যারিস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল, ভলতেয়ার জানলেন-
"I am convinced that everything has come down to us from the bank of the Ganges-astronomy,astrology, metepsychosos etc" [জ্যোতিরবিদ্যা, জ্যোতিষ এর মতন সবকিছু-ই গঙ্গা নদীর তীর থেকেই এসেছে বলে আমি বিশ্বাস করি]।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক ভন স্নেগেল ১৮০৩ সালে বলেন-"Everything without exception is of India origin whether directly or indirectly, all nations are originally nothing but India colonies" [সবকিছু-ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারত থেকেই উদ্ভূত এবং সব দেশগুলো ভারতের উপনিবেশ]
কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় পন্ডিতদের এমনধারা মতামত ভারতে ক্রমবিস্তারশীল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি রূপে পরিগনিত হচ্ছিল না। East india Co.-এর "Divide and Rule" এবং মিশনারী-দের "Divide and convert' পরিকল্পনার আকারে ভারতে প্রযুক্ত হচ্ছিল। ফলে ভারতের অতীত সম্পর্কিত এমন একটি মতবাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল যা বৃটিশ শাসনের পথকে প্রশস্ত করবে।
১৮৩১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিকরা হল "বোডেন প্রফেসরশিপ" নামক একটি পদ, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য-ই ছিল ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং শাস্ত্রগুলির এমন ব্যাখ্যা প্রদান যা ভারতবর্ষে খ্রীষ্টমত প্রচারের সহায়ক হবে। ঠিক এই সময় থেকেই ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিদেশী রাজনীতি ও অর্থের অশুভ প্রভাব শুরু হয়ে গেল। আমেরিকান ঐতিহাসিক Thoman R.Traumann জানিয়েছেন, ইভাঞ্জেলিষ্টদের প্রভাবে ভারতীয় সভ্যতাকে ছোট করার কাজ শুরু হল ["Evangelical influence drove British policy down a path that tended to minimize and denigrate the accomplishment of Indian Civilization"-Aryans and British India, 1997]
"জ্যাকালয়ট্" নামক ফরাসী দেশীয় জনৈক সাহেব, তাঁর "বাইবেল্ ইন ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন য, আর্য্যাবর্ত্ত সমস্ত বিদ্যা ও কল্যানের ভান্ডার। সমস্ত বিদ্যা ও সমস্ত মত এই দেশ হইতেই বিস্তৃত হইয়াছে। তিনি পরমেশ্বরের কাথে পার্থনা করেছিলেন, "হে পরমেশ্বর ! পূর্ব্বকালে আর্য্যাবর্ত্ত যেরূপ উন্নত ছিল, আমাদের দেশকেও সেইরূপ করুন"।[সত্যার্থ প্রকাশ পৃঃ৩০১]
১৮৩৩ সালে টমাস ব্যারিংটন মেকলে নিযুক্ত হলেন ভারতে East India Co.র শিক্ষাবিষয়ক কিমটির অধিকর্তা পদে। তিনি ভারতে রইলেন মাত্র ছয় বছর কিন্তু তার গৃহীত নীতি-কেই আদর্শ করে বৃটিশ শাসন চলতে লাগল ভারতের মাটিতে, বর্তমান সময় পর্যন্ত ওনার নীতি অনুসরন করেই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা চলছে।
তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভারতীয়দের, বিশেষতঃ ব্রাহ্মন পন্ডিতদের ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তাঁরা বেদভিত্তিক হিন্দুদের অসারতা বুঝতে পারবে এবং সহজেই খ্রীষ্টমতের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ভারতীয় সংস্কৃতি, ও শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর মত ছিল-
"a literature admitted to be of small intrinsic value...(one) that inculcates the most serious erosion of the most important subject"[এ সাহিত্যের অতি নগণ্য মূল্য আছে এবং বহু বিষয়ে ভুল তথ্যে ভরা][Source:India:A world in transition -By B.P.Lamb;page-194]
ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে----ও তার পরিস্কার মতামত ছিল। তিনি এদেশেই ইংরেজী শিক্ষিত একদল মানুষ তেরী করতে চাইলেন যারা সর্ববিষয়ে বৃটিশরাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। "১৮৩৫ Minute" -এ তিনি বললেন যে তিনি চান, পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতিতে একদল শিক্ষিত ভারতীয় শ্রেনী সৃষ্টি করতে যারা রক্তে ও গাত্রবর্ণে ভারতীয় হলেও নীতি, মত ও রুচিতে হবে ইংরেজ [to create India elite through western style of education.... India in blood and colour, but English in taste, in opinion, in morals, in intellect"]
এই মেকলে সাহেব-ই পরবর্তীকালে ১৮৫৪ সালে জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমূলারকে খুঁজে পেলেন। মণিকাঞ্চন যোগাযোগ হল। কেহ কেহ বলে যে, জার্ম্মানীতে সংস্কৃতের বহুল প্রচার আছে এবং ম্যাক্সমূলর সাহেব যত সংস্কৃত অধ্যান করিয়াছেম, অন্য কেহ তত করেন নাই। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষায় ইহা কেবল কথার কথা। করাণ "যস্মিন্ দেশে দ্রুমো নাস্তি তত্রৈরন্ডোহপি দ্রুমায়তে" অর্থাৎ যে দেয়ে কোন বৃক্ষ নাই, সে দেশে এরন্ডকেই বৃহৎ বৃক্ষ বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়। সেই রূপ ইউরোপে সংস্কৃত প্রচার না থাকতে জার্ম্মানগণ
এবং ম্যাক্সমূলর সাহেব যৎসামান্য যাহা পাঠ করিয়াছেন তাহাই সে দেশের পক্ষে অধিক। কিন্তু আর্য্যাবর্ত্তের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে সংস্কৃতে তাঁহার পান্ডিত্য নগন্য মনে হইবে।[সত্যার্থ প্রকাশ পৃঃ৩০০] যাই হোক তথ্য বলছে তিনি (ম্যাক্সমূলর) দশ হাজার পাউন্ড পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঋগ্বেদের অনুবাদ কার্যে নিযুক্ত হন এই শর্তে যে বেদ এর ব্যাখ্যা ভারতের মাটিতে ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের সহায়ক হবে। ম্যাক্সমূলর ১৮৮৬ সালে তাঁর স্ত্রীকে চিঠিতে জানান-
"বেদের অনুবাদ অনেকাংশে ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ওদেশের লক্ষ লক্ষ লোক মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। বেদই তাঁদের ধর্ম্মের মুলে। এই মুলটা কি দেখানো গেলে, আমি নিশ্চিৎ, ৩০০০ বছর ধরে যা কিছু উদ্ভূত হয়েছে তা মূলোৎপাটিত হবে"[Life and letters of Friedrish Maxmuller from "Maxmuller Exposed"-by Brahma Dutt Bharati]
ইতিপূর্বে ওয়ারেন হেস্টি- এর আমলে (১৭৭৩)ইউরোপীয়ান দের সংস্কৃত চর্চা শুরু হয়। হেস্টিং নিজ উদ্যোগ নিয়ে আনলেন চার্লস উইলসকিন্সকে। ইনি বেনারস-এ গিয়ে সংস্কৃত চর্চা করলেন এবং ১৭৮৫ সালে "ভাগবতগীতা"-র ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করলেন।
ইতিমধ্যে ১৭৮৬ সালে উইলিয়ম জোন্স(যিনি এশিয়াটিক সোসাইটি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠা ও সভাপতি) সংস্কৃত,গ্রীক,ল্যাটিন, জার্মান ভাষাগুলি একটি বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীবূক্ত একথা ঘোষণা করলেন। জোন্স কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে থমাস ইয়ং (পদার্থবিজ্ঞানী তথা মিশরতত্ত্ববিদ) "ইন্দো-ইউরোপীয়ান" এই পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার [the Quarterly Revies;1813] করলেন। এই শব্দটির সাহায্যে তিনি উপরোক্ত ভাষাসমূহের একটি সাধারণ উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। খুব অল্পদিনে এই ধারনার উৎপত্তি হল যে ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি-ই হল এসব ভাষাসমূহের স্রষ্টা। (১৮১৮) সালে জার্মান ভাষাবিদ Klaproth "ইন্দো-জার্মানীয়" পরিভাষাটি ব্যবহার করলেন) একাথাও বলা হল যে তারা আদিতে ---একটি জায়গায় বাস করত। সে জায়গা কোথায় ?
বিঃদ্রঃ ১৮৭৫ সালে খ্রীষ্টীয় বিশপ রবার্ট কল্ডওয়েল কাল্পনিক দ্রাবিড় তত্ত্বের সৃষ্টি করেন
আর্য আক্রমণ তত্ত্ব :
খৃষ্ট জন্মের ১৫০০ বছর আগে (অর্থাৎ আজ থেকে ৩৫০০) বছর আগে ভারতের বাইরে থেকে কিছু যাযাবর শ্রেণীর লোক ভারতে প্রবেশ করে। তারা এসেছিল সম্ভবত মধ্য এশিয়া থেকে। তারা ছিল আর্যজাতি। বেদ তাদেরই রচনা এবং তা আনুমানিক খৃ. পু, ১২০০ অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে ৩২০০ বছর আগে। সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা এই আর্য সভ্যতার পূর্বসূরী। | ফ্রেডেরিক ম্যাক্সমুলার (১৮২৩-১৯০১): প্রথমেই বলতে হয় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লর্ড টমাস ব্যারিংটন মেকলে (১৮০০-১৮৫৮) ভারতবর্ষে ইংরাজী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন এবং এখনও প্রায় তাই আছে।অন্তত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের কোন পরিবর্তন হয়নি। (প, বঙ্গে পাঠক্রমে মার্কসীয় চিন্তা ইত্যাদি সংযোজিত হয়েছে মাত্র)। মেকলে এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার পরিবার ছিল গোঁড়া খৃষ্টান পরিবার এবং তার বিশ্বাস ছিল ভারত শাসনে খৃষ্টধর্ম চাবির কাজ করবে। খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরকরণ তার অন্যান্য অসদুদ্দেশের মধ্যে ছিল একটি। তিনি নিজেই বলেছেন – আমার পরিকল্পনা মত যদি ঠিক ঠিক ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা চলে তবে শিক্ষিত বাঙ্গ লীদের মধ্যে ৩০ বছরের মধ্যে মূর্তি পূজারী কেউ থাকবে না। (মেকলে, দি শেপিং অফ দি হিস্টোরিয়ান – জনক্লাইড, পৃ. ৪১২-৪১৩)
তার এই উদ্দেশ্য সাধনে তিনি এমন একজনকে চাইছিলেন যিনি ভারতীয় শাস্ত্রকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যাতে শাস্ত্ৰত্যাগকরে নিউটেস্টামেন্টের দিকে ভারতীয়রা আগ্রহান্বিত হয়। চেহারায় ভারতীয় থাকলেও মানসকিতায় ইংরাজের দাস হবে। প্রথমে তিনি হেরেস হেমান উইলসনকে ধরেন। উইলসন নিজে রাজী না হয়ে ফ্রেডেরিক ম্যাকমুলারকে এগিয়ে দেন। মুলারের বয়স তখন ৩১। ১৮৫৪ ডিসেম্বর ১ লক্ষ টাকা পাওয়ার চুক্তিতে মূলার দায়িত্ব নেন এমনভাবে বেদ-এর অনুবাদ করবেন যাতে হিন্দুদের বৈদিক শাস্ত্রে বিশ্বাস নষ্ট হয়। নিজে জামান (ইংরাজ বিরোধী) হলেও খৃষ্ট ধর্মের স্বার্থে তিনি এই কাজের দায়িত্ব নেন। (১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী উঠে যাওয়ায় প্রতিশ্রুতি ১ লক্ষ টাকা পেতে অসুবিধা হয়েছিল।) ৩১ বছর বয়স্ক সামান্য রোজগারের এক ব্যক্তির পক্ষে লক্ষ টাকা এবং খৃষ্ট ধর্মের প্রচার বড় কম লােভনীয় ছিল না। অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা লাভের সঙ্গে তুলনীয়। ম্যাকমুলার লিখেছেন – Sacred Books of the East। পরিকল্পিত প্রচারে মূলার হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত ভারততত্ত্ব বিদ যদিও তিনি কখনও ভারতবর্ষ ম্যাপে ব্যতীত অন্যভাবে দেখেননি। ভারতবর্ষের ইতিহাস ম্যাকমুলার তবের উপর ভিত্তি করে রচিত হল।
জাতি গর্ব (Racial Superiority) প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর মেকলে এবং অন্য বৃটিশ অফিসাররা প্রশাসনিক নীতি হিসাবে প্রতিপালন ও অনুসরণ করেছিলেন।
ম্যাকমুলার ছিলেন গোঁড়া খৃষ্টান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ৪০০৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দে ২৩ অক্টোবর সকাল ৯টায় পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। ফলে ঐ তারিখে আগে ভারতীয় বা কোন কিছু সভ্যতা সংস্কৃতি ধাক্স বাইবেল অনুসারে অসন্তুব। তাই তার এই পাণ্ডিত্বপূর্ণ পুস্তক ভারতীয়দের খৃষ্টধর্মে রূপান্তরিত করার গোপন প্রয়াস। বাইবেলের প্রতি মুলারের কতটা বিশ্বাস ছিল ?
I look upon the account of creation given in the Genesis as simply historical [পৃ. ৪১৮-৮২ Life & Letters by Georgina Muller.]
| বাইবেলের জেনেসিস-এ যা লেখা আছে সৃষ্টিতত্ব সম্পর্কে, আমি তা ঐতিহাসিক বিবরণ বলে মনে করি। এই প্রসঙ্গে মূলারের লেখা দুটি চিঠি প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। একটি চিঠি তিনি লিখেছিলেন তার স্ত্রীকে ১৮৬৬ সালে।
“আমার এই পুস্তক (দি স্যাক্রেড বুকস অফ দি ইষ্ট) ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলবে। তাদের ধর্মের মূলটা কোথায় তারা তা জানতে পারবে।
গত তিন হাজার বছর ধরে তারা যা বিশ্বাস করে এসেছে – সেই বিশ্বাসের মুলোৎপাটন করার এইটাই একমাত্র উপায় বলে আমি মনে করি।
This edition of mine and the translation of the Vedas will hercafter tell to a great extent on the fate of India and on the growth of millions of souls in that country. It is the root of their religion and to show them what the root is, I feel sure, this is the only way of uprooting all that has sprung from it during the last three thousand year (Max Muller, F. 1902. Life and Letters Edited by Georgina Muller, Page 328.]
১৮৬৮ সালে তিনি সেক্রেটারী অফ স্টেট ফর ইণ্ডিয়া – ডিউক অফ আরগিলকে লিখলেন:ভারতের প্রাচীন ধর্মের শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে, এরপর যদি খৃষ্টধর্ম সে স্থান দখল করতে পারে, সেটা কার দোষ?
The ancient religion of India is doomed and if Christanity does not step in, Whose fault will it be ? (একই পুস্তক – পৃ. ৩৫৭-৩৫৮) ।
মনে রাখতে হবে ১৮৫৭ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোং চলে যাওয়ার পর – তার সেই এক লক্ষ টাকার বাকী অংশে দেওয়ার মালিক ছিলেন বৃটিশ ইণ্ডিয়ার সেক্রেটারী অফ স্টেট ফর ইণ্ডিয়া। যে শর্তে তাকে ১ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা সেই শর্ত যে তিনি কত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেছেন এই দুটি চিঠি তার প্রমাণ। এগুলি তার গোপন উদ্দেশ্যেরও প্রমাণ বইকি।উল্লেখ্য যে ম্যাকমুলার পরবর্তীকালে তার মতামত পাল্টেছিলেন। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গিয়েছিল। | ১৮৭১ সালে মুলার তার তত্ব পাল্টালেন যে আর্য কোন জাতিবাচক শব্দ নয়। জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার মধ্যে তিনি বললেন যে আর্য বলতে জাতি বুঝায় না, ভাষা গোষ্ঠী বুঝায় – এই ভাষা গোষ্ঠীতে সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, আবেস্তা এবং অন্যান্যগুলি আছে।
(Max Muller Biographies of words and Home of Aryans – P. 26) |
কিন্তু তিনি মত পাল্টালেন কেন? জাতিতে জার্মান থাকেন ইংলন্ডে। তাকে ১ লক্ষ টাকাও দিয়েছেন ইংরাজরা। যশ প্রতিপত্তি হয়েছে ইংরাজ দয়ায়। কিন্তু ১৮৭১ সালে জার্মানী ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি রাষ্ট্রে পরিণত হলো। ইংরাজরা উল্লেখ করলো যে আর্য জাতি ও আর্য সংস্কৃতির ধারণা জার্মান ঐক্য তৈরীতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইংলন্ডে বসে ইংলন্ডের টাকা খেয়ে জার্মান জাতীয়তাবাদ সমর্থন ইংরাজরা মানতে চাইল । চাপ পড়ল মুলারের উপর। মতও পাল্টে গেল।
(মিশনারী ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য আছে। ইতিহাস ও পাণ্ডিত্য দুটো ক্ষেত্রেই তারা নিজের দলের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেছে। তারা সবয়সময়ই দেশের জনগণকে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য (tradition) থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। এও এক ধরণের ধর্মান্তরকরণ।)
প্রকৃতপক্ষে টমাস ব্যাবিংটন মেকলেও ম্যাকসমূলার এর মতলব না জানলে ভারতীয় ইতিহাসের এই বিকৃতি — আর্য আক্ৰমণতত্ত্ব বোঝা যায় না। তাই অতি সামান্য ভাবে ওদের সম্পর্কে লিখলাম। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও মেকলে প্রভাবিত। তাই থেকে এখনো মেকলাইট এডুকেশনাল সিস্টেম বলা হয়। এ সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য হাজির করা যায় কিন্তু প্রবন্ধের আয়তনের কথা আর পাঠকদের কৌতূহলের গভীরতার কথা ভেবে তা করা গেল না। আমি শুধু ভারতীয় ইতিহাস বিকৃতির পিছনে যে মানসিকতা ও যুক্তি কাজ করেছিল তার ইঙ্গিত দিলাম মাত্র। মেকলে প্রবর্তিত ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের শুধু চেহারাটাই হবে ভারতীয়। বাকী সবই আচার ব্যবহার, পোষাক, চিন্তাধারা, মানসিকতা সবই হবে ইংরাজ দাসত্বে। তারা ভারতীয় থাকবে, অভারতীয়ও হবে না, হবে ইণ্ডিয়ান।
আমাদের পাঠ্য ইতিহাস বইতে কী আছে দেখিঃ
প্রথমে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার একটি বিবরণ। ঘরবাড়ি, জল নিকাশী ব্যবস্থা ইত্যাদি। বলা হয় যে খৃষ্টপূর্ব ২৫০০-১৫০০ যুগে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। যদিও সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি এই সভ্যতাকে আরও আগে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০ সালের বলে বলছে।
যাইহোক, ইতিহাস বইতে লেখা হয়েছে . পূ. ১৫০০ অব্দ নাগাদ এই সভ্যতা বিনষ্ট হয়। এবার এই বিনষ্ট হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা (ইন্দো-ইউরোপীয়) এসে আক্রমণ করে। এরা অর্থাৎ আর্যরা ছিল nomadic barbarians অসভ্য বর্বর যাযাবর জাতীয়।
এই আর্যদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। তারা দ্রাবিড়দের বিরাট সভ্যতা ধ্বংস করল।
সিন্ধু সভ্যতার কালে সরস্বতী নদী.পূ. ২৫০০ অৰ
দ্রাবিড়দের তারা অনার্য বলত। দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস হয় মোটামুটি ১৫০০ খৃ. পূর্বাব্দে। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলত। তারপর বলা হয়েছে যে এই আর্যরা বেদগ্রন্থ রচনা করেছিল প্রায় ১২০০ খৃ. পূর্বাব্দে। দ্রাবিড়রা পরাজিত হয়ে দক্ষিণ ভারতে চলে যায়। এই হল অতি সংক্ষেপে আর্য আক্রমণ তত্ব – যা নাকি উনবিংশ শতাব্দীর ভাষাতত্ব ও ইতিহাস পাণ্ডিত্যের কহিনুর।
এই যে সাল তারিখ গুলো ওরা বললেন তা ওদের অনুমান মাত্র এর স্বপক্ষে কিছু ভাষাগত (linguistic) প্রমাণ খাড়া করা হল। বলা হল উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পণ্ডিতরা বহু গবেষণা করে এই তত্বে পৌঁচেছেন। এই গবেষকদের মধ্যে প্রধান হলেন ম্যাকস মূলার (১৮২৩-১৯০১)। আগেই বলেছি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে উপনিবেশবাদী ইংরাজরা এই কাজটি করেছিল এবং খৃষ্টান মিশনারীরা ছিল সহযোগী। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় – যত ইউরোপীয় ইভোলজিষ্ট আছেন – তাদের প্রায় সকলেরই খৃষ্টান মিশনারীর ব্যাক গ্রাউন্ড।
আর্য আক্রমণ তত্বের ক্রটি
ম্যাক্সমূলার প্রমুখ পণ্ডিতগণ এই তত্ত্ব যখন বাজারে ছাড়লেন তখন আর্কিওলজি – প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার জন্মই হয়নি। ফলে এদের এই তত্ত্বও সিদ্ধান্তগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সাল তারিখগুলি একেবারেই কাল্পনিক।
ভারত-৪০০০ লক্ষ্য করুন গঙ্গা ও যমুনা পশ্চিমে সরস্বতীর দিকে।
প্রবাহিত হত প্রাচীন ভারছে বেদে উল্লেখ আছে । এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, খৃষ্টান বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর জন্ম ৪০০৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দের ২৩ অক্টোবর। এই বিশ্বাসের কারণে এই খৃষ্টান পণ্ডিতরা তাদের যাবতীয় সাল তারিখ ৪০০৪ খৃ. পূ. পরে বসিয়েছিলেন। বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে যে সৃষ্টিতত্ত্ব আছে ম্যাক্সমুলার নিজে তাকে ইতিহাস বলেই মনে করতেন। তার 2011 : I look upon the account of creation given in the Genesis as simply historical. (Max Muller F – j902 P – 481482) (বাইবেলের) জেনেসিসে উল্লিখিত সৃষ্টিতত্ত্ব কে আমি ইতিহাস বলেই মনে করি – ম্যাক মূলার)
ম্যাক মূলারের কালে প্রত্নতত্ত্ব ছিল না। অতএব তার সমস্ত তত্বের সাল তারিখ তার মনগড়া – যে মন বিশ্বাস করত ৪০০৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দের পূর্বে পৃথিবী ছিল না। সেই মনগড়া সাল তারিখ আজও চলছে এবং পরবর্তীকালের প্রত্নতত্ত্বর আবিষ্কৃত তথ্যগুলিকে সেই মনগড়া তত্ত্বের সংগে খাপ খাওয়ানো হয়েছে। অর্থাৎ তথ্যের ভিত্তিতে তত্ব সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয় – তত্ত্বের অনুকুলে তথ্যকে খাপ খাওয়ানোর অবৈজ্ঞানিক, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অযৌক্তিক পদ্ধতি।
মুলারের তত্ত্বের পদ্ধতির যে মূল ভিত্তি – ভাষা তত্ত্ব, তাও তখনকার দিনে কোন উচ্চ মার্গের ছিল না। তবু সেই ভাষা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করা পদ্ধতি অর্থাৎ বৈদিক ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় কোন ভাষার মিল দেখে উনি সিদ্ধান্ত করলেন আর্যরা বিদেশ থেকে এসেছিল। ৪০০৪ খৃ. পূর্বাব্দের আগে যেহেতু পৃথিবী ছিল না তাই ভারতবর্ষও ছিল না। আর ধরে নেওয়া হল বাইরে থেকে ঐ ভাষা ভারতে এসেছে। ভারত থেকেও যে বাইরে যেতে পারে এ চিন্তা মুলার করেন নি – কারণ তার প্রতিপাদ্যই ছিল – ভারতের নিজস্ব কিছু ছিল না এবং ভারত বরাবরই বিদেশী অধিকৃত। তাই ইংরাজরা ভারত শাসন করছে এতে আপত্তির কিছু নাই।
মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও আবিষ্কার হয়েছিল – আৰ্য্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রচারিত হওয়ার পর। এই তত্ত্ব রচিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। আর হরপ্পা খনন ১৯২১ এবং ১৯২২-এ। দয়ারাম সাহানী ১৯২১ সালে এবং আর, ডি, ব্যানার্জী ১৯২২ সালে খনন করে যা পেলেন – তারা ভারতীয় হওয়ায় ইংরাজরা তাদের সেই আবিষ্কারের মূল্য দিতে রাজী হয়নি। ১৯২৪ সালে জন মার্শাল সেই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করলেন।
ঐ সময়ের পর মহেঞ্জেদাড়ো ও হরপ্পা সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন জানা গেছে যে তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতার প্রাণ সিন্ধুনদ নয়, সরস্বতী। এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল সাড়ে দশ লক্ষ বর্গ কিমি. এলাকা জুড়ে। এই সভ্যতার কালে মেসোপটেমিয়া ও সুমেরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। সোভিয়েত সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান এমনকি বাহারিনের সঙ্গেও ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। গুজরাটের লোথালে খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক এস আর রাও দেখিয়েছেন যে ঐ যুগে ভারতীয়দের জলপথেও কত ক্ষমতা ছিল।
প্রাচীন সরস্বতী নদীর উল্লেখ বেদ গ্রহে পাওয়া যায়। তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতাসরস্বতী-সিন্ধুকে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার শেষ দিকের কথা।
ভি, এস, ওয়াকানকর এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিকের আবিষ্কৃত তথ্য থেকে এখন জানা গেছে যে সরস্বতী কয়েকবার গতিপথ পরিবর্তন করে আনু ২০০০ খ. পূর্বাব্দে সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে যায় এবং হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার কারণ পরিবেশগত। আনুমানিক ২২০০ খৃ. পূ. থেকে ভয়াবহ খরার কারণে সিন্ধু বা হরপ্পা ধ্বংস হয়। বিদেশ থেকে কোন আর্যজাতি এসে তা করেনি।
হরপ্পায় আবিষ্কৃত শীলমোহরগুলির ভাষা দ্রাবিড়িয় বলে দাবী করা হয়েছিল। এস. আর, রাও (ডন এন্ড ডেভলিউশন অফ দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন) এখন যতটা আবিস্কার করেছেন তার থেকে জানা গেছে শীলমোহরগুলির ভাষাও সংস্কৃতর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত, দ্রাবিড়িয় না। ক্রিপটোলজিষ্ট (লিপিবিদ্যা বিশারদ) সুভাষ কাক কম্পিউটার বিশ্লেষণ করেও প্রমাণ করেছেন যে ঐ ভাষা সংস্কৃতর সঙ্গেই যুক্ত।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি আর্য আক্রমণ তত্ত্বের সমর্থন করে না শুধু নয় – তার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করে। J. G Shaffer প্রণীত ইন্দো-ইউরোপীয়ান ইনভ্যাসন ও কালচারাল মিথ এন্ড আর্কিওলজিক্যাল রিয়ালিটি গ্রন্থে বলেছেন যে আর্য আক্রমশতত্ত্ব একটি অলীক কল্পনা – ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভাবেই নিজস্ব (পৃ. ৮৮)।
এই তত্ত্ব অনুসারে যেহেতু আর্যরা ১৫০০ . পূ. নাগাদ ভারতে এসেছিল সেহেতু হরপ্পা সভ্যতা আর্য পূর্ব ভারতীয় সভ্যতা যা আর্য আক্রমণে পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেয়। আর্য দ্রাবিড় সংঘর্ষের গল্প এইভাবে তৈরী। এর কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও তারা খাড়া করলেন।
মার্টিমার হুইলার বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক মহেঞ্জোদারো কয়েকটি কঙ্কাল দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত করলেন যে আর্যরা যে গণহত্যা করেছিল এ তারই প্রমাণ। পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতাত্তিক এস আর রাও প্রমাণ করলেন যে আক্রমণকারী ও আক্রান্তর হাড়গুলি বা কঙ্কালগুলির মধ্যে কয়েকশত বছরের সময় ব্যবধান আছে। সিমেট্রি আর ৩৭ এবং সিমেট্রি এইচ এই সময় ব্যবধান এমনই যে তথাকথিত আক্রমণকারীরা যখন এসেছিল তখন তথাকথিত আক্রান্তরা ছিল না। ফলে গণহত্যার তত্ত্ব হাস্যকর।
খননে প্রাপ্ত কতকগুলি পাথর ও পোড়ামাটির বস্তু দেখিয়ে হুইলার, মাশাল, পিগট প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্য আক্ৰমণতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বললেন যে – এগুলি প্রমাণ করে যে লিঙ্গ পূজা সে যুগে ছিল – এদেরই পরে দাক্ষিণাত্যে লিঙ্গ পূজক দ্রাবিড়ীয় বলে আমরা দেখতে পাই।
এস, আর, রাও বললেন যে ওগুলি কোন দেবমূর্তি নয় – ওজনের বাটখারা যা নাকি গুজরাট এলাকাতেও খনন করে পাওয়া গেছে (The Aryan Invasion Theory • A Repraisal by Srikant G Talager উদ্ধৃত পৃ. vi)। তা ভারতে কয়েকশত বছর প্রচলিত ছিল।
আর্য আক্রমণের তত্বের এই সব তাত্ত্বিকরা ধরেছেন শিবপূজা মানেই দ্রাবিড়ীয় এবং ‘দাক্ষিণাত্য। প্রকৃত কথা হল শিব পূজা প্রধানত হিমালয় ভিত্তিক অথাৎ নেপাল, কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ প্রভৃতি এলাকার। ঐ সব তাত্ত্বিকেরা যে শিব পূজা সংক্রান্ত কোন তথ্য পেয়েছিলেন হরগায় তাও নয় – সেটাও কাল্পনিক। দ্রাবিড় তত্ত্ব আর শিব পূজাকে এক করে দিয়ে দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেওয়া এবং বলা হল যে আর্য আক্রমণের ফলে হরপ্পীয়রা পালিয়ে গেছিল — বাকীরা ধ্বংস হয়ে গেছিল।
এই তাত্ত্বিকরা আরও বলেন যে হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহার ছিল না, আর্যরাই ঘোড়া এনেছিল – চাল সম্পর্কেও তারা একই কথা বলেন। এস, আর, রাও দেখালেন। যে লোথাল, কালিবান গাঁও, সুরকোটাডা, রোপার এবং অধুনা পাকিস্তানের মহেঞ্জেদাড়োতে খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা ঐ তত্ত্বের সমর্থন করে না বরং পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক আর্যদের সভ্যতারই অঙ্গ। আর্য যুগেই ঘোড়া এবং চালের ব্যবহার ছিল। পরে তা সিন্ধু যুগে এসেছে।
সরস্বতী নদী ঃ ঋগ্বেদে গঙ্গা নদীর নাম উল্লিখিত হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু সরস্বতী উল্লিখিত হয়েছে অন্তত ৫০ বার। ঋগব্দেদের দ্বিতীয় মণ্ডলের ৪১নং সুক্তের ১৬নং মন্ত্রটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মন্ত্রে সরস্বতীকে বলা হয়েছে – অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে শ্রেষ্ঠ মাতা, শ্রেষ্ঠ নদী ও শ্রেষ্ঠা দেবী।
যমুনার পশ্চিমে আর শতদ্রুর পূর্বে ছিল এর অবস্থান। ঋগ্বেদের ৭ম মণ্ডলের ৯৫নং সূক্তের ২য় মন্ত্রে বলা হয়েছে এই নদী পাহাড় থেকে সমুদ্রগামী। এই নদী নহুষের সন্তানদের (বৈদিক যুগের জনগণ) প্রতিপালন করে। ঋষি শৌনক, গৃৎসমদ, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র সকলেই এই নদীর কথা বলেছেন। এই কারণেই যে সভ্যতা বৈদিক যুগে শুরু হয়ে হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা অব্দি অগ্রসর হয়েছিল – তাকে সরস্বতী সিন্ধু সভ্যতা বলাই সঙ্গত।
সরস্বতী ছয় থেকে আট কিমি. চওড়া কোথাও কোথাও ১৪ কিমি.। এই নদী তাহলে কোথায় গেল? প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাও উপগ্রহ মারফৎ গৃহীত ছবি থেকে জানা যাচ্ছে সরস্বতী উপনদীগুলির জলের অভাবে ক্রমশঃ দুর্বল হতে শুরু করে এবং ১৯০০/২০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। এই নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসতির প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। উপগ্রহ ছবি দেখিয়েছে যে ঘর্ঘরা একসময় খুব বিরাট নদী ছিল।
ওয়াকানকার (লুপ্ত সরস্বতী নদী শোধা-হিন্দু-মারাঠী থেকে অনুদিত। ১৯৯২ সাল) দেখিয়েছেন যে একটি বিরাট নদী হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থানের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পতিত হত ভূগুকচ্ছের কাছে। আমেরিকান উপগ্রহ ল্যান্ডসার্ট ও ফরাসী উপগ্রহ স্পট এই তথ্যকে সমর্থন করেছে।
বেদোক্ত সরস্বতী নদীর ভৌগোলিক অবস্থানকে কেন্দ্রীয় সূত্র ধরে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বৈদিক সভ্যতার সন্ধ্যাকালে সিন্ধু সভ্যতার সৃষ্টি। বৈদিক যুগ খুব কম করে হলেও ৭০০০ খৃ. পূর্বাব্দে শুরু এবং সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার কাল দাঁড়ায় খৃ. পূ. ৩০০০-২০০০ অব্দ।
আর্য আক্রমণ তত্ত্ব শুধু প্রত্নতত্ত্বকেই অস্বীকার করেনি ভূগোলকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। তাই ঐ তত্ত্ব অনুসারে খৃ. পূ. ১৫০০ অব্দে আর্য আক্রমণ এবং ১২০০ খ. পূর্বাব্দে বেদ রচনার কাল সম্পূর্ণ হাস্যকর। সরস্বতী সিন্ধু সভ্যতা খুব কম করেও ৫০০০ বছর চলে ছিল। সিন্ধু নদের তীরবর্তী এলাকায় বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং যাচ্ছে। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব অনুসারে আগে হরপ্পা সভ্যতা পরে বৈদিক সভ্যতা কাল্পনিক। এর স্বপক্ষে কোন ধরণের প্রমাণই নাই। এখানকার কথা অনুসারে প্রমাণিত হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে বিস্তৃত বিশাল বৈদিক যুগের শেষ মাথায় সিন্ধু সভ্যতার যুগ এসেছিল।
সরস্বতীর ভৌগোলিক অবস্থানে যা জানা গেছে এবং তার তীরবর্তী এলাকাতে যত বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে আর্যরা ১৫০০ খৃ. পূর্বাব্দে বিদেশ থেকে এসে সিন্ধু সহ ৫টি নদী অতিক্রম করে সরস্বতী তীরে এসে বসবাস করল কেন যে সরস্বতী ২০০০ খৃ. পূর্বাব্দে শুকিয়ে গেছে? আর সেই শুকিয়ে যাওয়া নদীটিকে অম্বিতমে, নদীতমে, দেবীতমে বলে সাহিত্য রচনা করল ১২০০ খৃ. পূর্বাব্দে ?
২২০০-১৯০০ খৃ. পূর্বাব্দে খরার কারণে সরস্বতী একাই শুকিয়ে যায় নি।
আকাদীয় যুগের সভ্যতা (মেসোপটেমিয়া ২২০০ খ. পূর্বাব্দে) শেষ হয়ে যায়। মিশরীয় (দ্বিতীয় রাজা) সভ্যতাও প্রায় ঐ সময়ে। ভারতে সিন্ধু সভ্যতাও ঐ সময়ে।
এস, আর, রাও তার ডন এন্ড ডেভোলিউশান গ্রন্থে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। বেদে উল্লিখিত আর একটি বিশাল নদীর নাম দৃশ্যাদ্বতী – তৃতীয় মণ্ডলের ২৩নং সূক্তের ৪ নং মন্ত্রে এই নদীর স্ততি আছে। সরস্বতীও দৃশদ্বতীর দোয়াব অঞ্চলে ছিল কুরুদের বসতি।
ঝখেদে উত্তর ভারতের যে বর্ণনা আছে যে ভূগোলের কথা আছে – তা ১২০০ খ. পূর্বাব্দের হতেই পারে না। তারা অনেক অনেক আগের।
আমরা আগেই বলেছি যে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব – প্রত্নতত্ত্ব বা ভূগোলের সঙ্গে মেলে না। বেদ গ্রন্থে বর্ণিত ভূগোল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি বৈদিক কালকে সিন্ধু সভ্যতার অনেক পূর্ববর্তীকালের বলে প্রমাণ করে।
বশিষ্ঠের মাথা ও প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক প্রমাণ ব্যতীত ধাতুবিদ্যাও আর্য আক্রমণ তত্বকে নসাৎ করে দিয়ে বৈদিক কাল সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।
জানাল অফ দি ইন্দো ইউরোপিয়ান স্টাডিজ নামক একটি বিজ্ঞান ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ক পত্রিকায় ১৯৯০ সালের ১৮ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটির নাম – এ্যানালিসিস অফ ইভো ইউরোপীয়ান ভেডিক এরিয়ান হেড, ফোর মিলেনিয়াম বি. সি.। ঐ প্রবন্ধে ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি মাথা’র বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রয়েছে (পৃ. ৪২৫৪৪৬)। ঐ মাথাটি নিয়ে ধাতুগত সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছিল তা ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি সম্মেলনে পেশ করা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। ঐ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন ক্রোকার নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরি অফ দি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্ণিয়া।
শ্রী নটরাজ এস রাজারাম (হাউসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত) ঐ মাথাটির নাম দিয়েছেন বশিষ্ঠের মাথা। আমরা অতঃপর ঐ নামটি ব্যবহার করব। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে ঐ মাথাটি খ. পূ. ৩৮০০-৩৭০০ অব্দের – অথাৎ আজ থেকে প্রায় ৬০০০ হাজার বছর আগেকার। এই মাথাটি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে কার্বন ১৪ পরীক্ষা ছাড়াও রেডিও এ্যাকটিভ পরীক্ষা সমূহ করা হয়েছে। সব পরীক্ষার ফলাফল প্রায় একই দাঁড়িয়েছে যে ঐ ধাতু নির্মিত মাথাটির বয়স অন্ততঃ পক্ষে ছয় হাজার বছর। বশিষ্ঠের কাল ঐ সময় হওয়ায় শ্রী রাজারাম ঐ মাথার নাম দিয়েছেন বশিষ্ঠের মাথা। এই আবিষ্কার এতকাল প্রচলিত একটি মতবাদের (আর্য আক্রমণ তত্ত্ব) মূলে কুঠারঘাত করেছে।
পণ্ডিত ম্যাকস মূলার এবং অন্যান্য অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত সহ এদেশের মেকলে শিক্ষায় শিক্ষিত ইন্ডিয়ান (ভারতীয় লিখলাম না ইচ্ছা করেই কারণ ইণ্ডিয়া এবং ইণ্ডিয়ান আর ভারত এবং ভারতীয় – দুটি বিভিন্ন ব্যাঞ্জনা বহন করে) এতকাল আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে আসছিলেন যে ভারতবর্ষের বৈদিক কাল বা উপস্থিতি খ. পূ. ১৫০০ অব্দের আগে নয়। অথাৎ আজ থেকে প্রায় ৩৫০০ বছর আগে। অথচ এই আবিষ্কার ভারতবর্ষে আর্য উপস্থিতি ৬০০০ বছর আগে বলে ইঙ্গিত দেয়।
এই ধাতু নির্মিত বশিষ্ঠর মাথা ১৯৫৮ সালে দিল্লীতে পাওয়া যায়। পেয়েছিলেন – হ্যারিহিকস নামে এক আমেরিকান সংগ্রহকারী। পরে রবার্ট এ্যাণ্ডারসন নামে অপর এক আমেরিকান পদার্থবিদ নানা রকম পরীক্ষায় পরীক্ষা করে এর কাল নির্ণয় করেন ৩৭০০ খৃ. পূ. পরে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ এবং আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়ায় এই মাথাটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। সব পরীক্ষাতেই একই ফল পাওয়া যায়। যে এটি আনুমানিক ৩৮০০-৩৭০০ খৃ. পূর্বাব্দের।
বেদের সপ্তম মণ্ডলে বশিষ্ঠের যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে এই মাথাটির মিল থাকায় হিসও এটিকে বশিষ্ঠের মাথা বলেছেন।
বশিষ্ঠ ছিলেন ভারত বংশীয় রাজা সুদাসের প্রধান পুরোহিত। রাজা সুদাসের কাল মহাভারতের ৬৫০ বৎসর পূর্বে। মহাভারতে কাল নির্ণীত হয়েছে আনুমানিক ৩১০০ খৃ. পূর্বাব্দে। তাহলে বশিষ্ঠের কাল, রাজা সুদাসের কাল ৩৮০০-৩৭০০ খৃ. পূর্বাব্দে দাঁড়ায়।
এ যুগে ধাতুর ব্যবহার সম্পর্কে নবতম আবিষ্কার হরিয়ানার কুনাল। কুনাল সরস্বতী নদী তীরবর্তী অঞ্চল ছিল। কুনালে রৌপ্য অলংকারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। কুনালের ঐতিহাসিক কাল ৩০০০ খৃ. পূর্বাব্দ – ৩৩০০ খৃ. পূর্বাব্দে। তাহলে রৌপ্য নিষ্কাষনের জ্ঞান ৩৩০০ খৃ. পূর্বাব্দের আগেই হয়েছিল।
ঋখেদে রৌপের উল্লেখ নাই। রূপার সংস্কৃত নাম – রজত হিরণ্যম – অর্থাৎ সাদা সোনা এবং এই রজত হিরণ্যমের উল্লেখ পাওয়া যায় সর্ব প্রথম যজুর্বেদে। তাই অনুমান করা যায় ঋক বেদের কালে ধাতুর ব্যবহার থাকলেও – তা থেকে রজত হিরণ্য নিষ্কাষণের পদ্ধতি জ্ঞাত ছিল না।
কে. ডি. শেঠনা – The problem of Aryan.Origin 1992 গ্রহে এবং Aryans and the Origin of Civilization ডেভিড ফ্রলে রাজারাম প্রণীত গ্রন্থে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে।
কুনালেরও পরে আসছে হরপ্পা যুগ। এই যুগে ধাতু বিদ্যা অনেক উন্নতমানের। হরপ্পার যুগ বৈদিক যুগের শেষের দিকে আনুমানিক ৩০০০-২৫০০ খৃ. পূর্বাব্দে। গুজরাটের কাছে লোথালে এই উন্নত ধাতু বিদ্যার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে তার থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও ধাতু বিদ্যার নিদর্শন থেকে বলা যায় যে আর্য জাতি বলে বিদেশাগত কোন জাতি ছিল না – তারা এদেশেরই।
আর্য-দ্রাবিড় সংঘর্ষ অলীক।
বৈদিক কাল প্রায় সাত হাজার বছর বিস্তৃত ছিল।
বৈদিক সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতার থেকে প্রাচীনতর – এখন থেকে ৬ হাজার বছর আগে সরস্বতী নদী কেন্দ্র করে বৈদিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে ধারাবাহিক। এখন থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগেকার। ম্যাকস মুলার কথিত সময় কাল কাল্পনিক তার স্বপক্ষে প্রত্নতত্ত্ব, ভূগোল বা ধাতু বিদ্যার সমর্থন নাই। অনুন্নত ভাষাতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ঐ মতবাদ বিশেষ উদ্দেশ্যে রচিত। পরে দেখা যাবে ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিটিও ঠিক নয়।
ফ্রলের ধাধা! গণিতশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশ্লেষণেও আর্যত হাস্যকর প্রমাণিত হয়। কিন্তু সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমেরিকান পণ্ডিত ডেভিড ফ্রলের উল্লিখিত একটি ধাধার উল্লেখ করতে হয়। ধাঁধাটি এইরকম :
বহিরাগত আর্যরা ভারতে এসে বিশাল সাহিত্য রচনা করল – বেদ-ব্রাহ্মণ, সূত্র, মহাকাব্য, পুরান ইত্যাদি যার সম্পূর্ণ আমাদের কাছে না পৌঁছালেও যতটুকু পাওয়া গেছে তা থেকেই বলা যায় – বিশ্বের বিশালতম সাহিত্য কীর্তি। কিন্তু তাদের কোন ইতিহাস আমরা জানতে পারলাম না। শুধুমাত্র তারা বহিরাগত। তাদের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমরা পেলাম না। অপরদিকে আমরা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার অনেক ইতিহাস পেলাম – অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পেলাম কিন্তু তাদের কোন সাহিত্য পেলাম না।
তাহলে ধাঁধাটা দাঁড়াল এইরকম যে তথাকথিত যাযাবর বর্বর বহিরাগত আর্যদের সাহিত্য আছে কিন্তু ইতিহাস নাই আবার সিন্ধু বা হরপ্পার লোকেদের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব আছে কিন্তু কোন সাহিত্য নাই। এতবড় সভ্যতা এত দীর্ঘকাল স্থায়ী হল অথচ তার কোন সাহিত্য সম্ভার পাওয়া গেল না।
আর্যদের সাহিত্য আছে, ইতিহাস নাই। সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস আছে, সাহিত্য নাই। অসভ্য বর্বর যাযাবরদের সাহিত্য পাওয়া গেল। কিন্তু সুসভ্য সংস্কৃত হরঙ্গীয়দের কোন সাহিত্য পাওয়া গেল না।
বেদ পণ্ডিত ফ্রলের ধাঁধার বাইরে আমরা আর একটি বক্তব্য পাঠকদের ভাবতে অনুরোধ করি –
এত বিশাল বৈদিক সাহিত্যে ভারতবর্ষের বাইরে কোন ভূগোল বা সভ্যতা সংস্কৃতির উল্লেখ নাই। নাই কোন গাছপালা, পাহাড় পর্বত বা নদীনালার উল্লেখ। অথচ কলকাতার খ্যাতিলাভ করা বহু হিত্যিকের সাহিত্য কীর্তিতে পূর্ববঙ্গের ছবি পাওয়া যায়। মাতৃভূমির আকর্ষণ gravitation pull of the Motherland সাহিত্যে একটি অতি সাধারণ ঘটনা সাহিত্যের বাইরের কথপোকথনেও। এদেশে বসবাসকারী বহু পূর্ববঙ্গবাসী নিজ দেশের নিজেদের সম্পত্তি মাছ ভরা পুকুর, আম গাছ ও নারিকেল গাছের কথা কথোপকথনে উল্লেখ করেন – সাহিত্যিকরা তাদের গল্পে উপন্যাসে। কিন্তু বিশাল বৈদিক সাহিত্যে gravitation pull of the Motherland সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এটা কি বাস্তবে সম্ভব ? দাক্ষিণাত্যের সাহিত্যেও এমন কিছু পাওয়া যায় না যা থেকে বলা যায় যে তারা কোনও এক জায়গা (সিন্ধু সভ্যতা) থেকে পালিয়ে এসে দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গ থেকে প. বঙ্গে পালিয়ে আসার পরে সাহিত্য যদি পূর্ববঙ্গীয় ভূগোল ও ভাষার রেশ পাওয়া যায় মধ্য এশিয়া থেকে চলে আসা আর্যদের বিশাল সাহিত্যে তাদের পুরানো মাতৃভূমির ভূগোলের রেশ কেন পাওয়া যাবে না ? সিন্ধু সভ্যতার এলাকা থেকে আর্যদের আক্রমণে সুদূর দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে এলে দাক্ষিণাত্যের ভাষাগুলির পরবর্তীকালে সাহিত্য তার রেশ থাকবে না কেন?
বৈদিক গণিত ঃ এ. সিডেনবার্গ দুটি তথ্য বিস্ফোরক পুস্তক তার গবেষণার ভিত্তিতে রচনা করেছেন The Ritual Origin of Geometry এবং The Origin of Mathematics। প্রথমটি ১৯৬২তে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন বৈদিক গণিত-প্রাচীন শুলবা সূত্রগুলি প্রাচীন গণিত শাস্ত্রের জনক যা ভারতবর্ষ থেকে প্রাচীন ব্যবিলনমিশর ও গ্রীসের পিথাগোরাস-এর কাল পর্যন্ত পৌঁচেছিল। প্রাচীন ব্যবিলন (খৃ. প. ১৯০০/১৭৫০) ও মিশর (খ্র. পূ. ২০০০-১৮০০) তাদের গণিত সুনিশ্চিত ভাবেই বৈদিক গণিতশূল বা সূত্র থেকে গ্রহণ করেছিল।
আর্য আক্রমণ তত্ত্বের প্রবক্তারা বলেন যে ঐ সূত্রগুলি খ. প ১৫০০ অব্দের আগে হতেই পারে না কারণ আর্যরা আক্রমণ করেছিল ১৫০০ খৃ. পূর্বাব্দে এবং বেদ রচিত হয়েছিল ১২০০ খৃ. পূর্বাব্দে।
সিডেনবার্গ তার অরিজিন অফ ম্যাথিমেটিকস গ্রন্থে যুক্তি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে পিথাগোরাসের জ্যামিতিক সূত্র প্রাচীন ব্যবিলনের গণিত দুটোই আরও কোন প্রাচীন সূত্র থেকে গৃহীত। (প, ৩২৯) এই আরও কোন প্রাচীন সূত্র বলতে শুলবা সূত্রগুলিকেই বোঝায়।
এন, এস রাজারাম তার Language, Mathematics andAstronomyachronologic synthesis of the Vedic Age গ্রহে এবং রাজারাম ও ডেভিড ফ্রলে প্রণীত Vedic Aryans and Origin of Civilisation গ্রহে (দুটিই ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত) বলেছেন যে মিশরের পিরামিড যে জ্যামিতিক ও গাণিতিক সূত্রের নির্মিত তা বৌধায়ন সূত্রে পাওয়া যায়।
The Ritual Origin of Geometry পুস্তকে সিডেনবার্গ লিখলেন – মিশরে এবং ব্যাবিলনে যে জ্যামিতিক সন্ধান পাওয়া গেছে – তা শুলবা সূত্রগুলি থেকেই নেওয়া (পৃ. ৫১৫)। সিডেনবার্গ এর গবেষণা থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে সূত্রগুলি অন্তত ২১০০ খৃ. পূর্বাব্দের। কিন্তু আর্য আক্রশ তত্ত্বানুসারে সূত্রগুলির কাল নির্ণীত হয়েছে খৃ. পূ. ৬০০/২০০০ অব্দ।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘর বাড়ি সম্পর্কে পাওয়া গেছে তা কঠিনভাবে গণিত জ্ঞান নিয়ে। একথা সাধারণভাবে সত্য যে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার প্রয়োগ প্রায় সমসাময়িক হবে। ২১০০ খৃ. পূর্বাব্দের আগে যদি গণিত না থাকে তবে তার পরবর্তীকালের হরপ্পা সভ্যতার ঘর বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সম্ভব কী করে?
আর্য আক্রমণ তাত্ত্বিকরা আমাদের একটি অসম্ভব কথা বুঝাতে চাইছেন যে হরপ্পা সভ্যতা প্রাচীন ২০০০-১৮০০ খৃ. পূর্বাব্দে, সূত্র গণিত ৬০০-২০০ খৃ. পূর্বা। অর্থাৎ তারা যা বোঝাতে চাইছেন তা সম্পূর্ণ উল্টো। আগে তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে অর্থাৎ সূত্র রচিত হয়েছে – তার উপর ভিত্তিক করে পরে প্রয়োগ হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ও সহজ সরল যুক্তি। তাহলে দেখা যাচ্ছে তথাকথিত ভাষাতত্ত্ব যা ম্যাকস মুলারদের যুগে খুবই অনুন্নত ছিল তার ভিত্তিতে তার ঐ আর্য আক্রমনতত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, পরিবেশ বিজ্ঞান, ভূগোল, ধাতুশাস্ত্র এবং গণিতের সাহায্যে প্রমাণিত হয় না। সবগুলি শাস্ত্রই আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে হাস্যকর করে তুলেছে।
References:
1. An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers. Shinde, V.*, Narasimhan, V. M.*, Rohland, N., et.al; (2019); An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers; Cell; 179:1–7; (Paper, Genotype data, Online Data Visualizer, doi: 10.1016/j.cell.2019.08.048).
2. The Formation of Human Populations in South and Central Asia. Narasimhan, V. M.*, Patterson, N. J.*, et al; (2019); The Formation of Human Populations in South and Central Asia; Science; 365:eaat7487; (Paper, Supplementary Materials, Genotype data, Online Data Visualizer, doi: 10.1126/science.aat7487, )
3. Genomic reconstruction of the history of extant populations of India reveals five distinct ancestral components and a complex structure. Analabha Basu, Neeta Sarkar-Roy, and Partha P. Majumder. PNAS February 9, 2016 113 (6) 1594-1599; first published January 25, 2016 https://doi.org/10.1073/ pnas.1513197113.
4. The Indian origin of paternal haplogroup R1a1* substantiates the autochthonous origin of Brahmins and the caste system. Swarkar Sharma, Ekta Rai, Prithviraj Sharma, Mamata Jena, Shweta Singh, Katayoon Darvishi, Audesh K Bhat, A J S Bhanwer, Pramod Kumar Tiwari & Rameshwar N K Bamezai.
5.Indus Valley Civilisation is largest source of ancestry for South Asians: David Reich, The Economic Times, 9 September 2019.
লেখক- রজত দাশ গুপ্ত
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ