অবিদ্যা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 March, 2020

অবিদ্যা

মোক্ষ
অবিদ্যা শব্দের আবিধানিক অর্থ অজ্ঞান বা মায়া। মায়া ঈশ্বরের ছায়া, তবে ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়। যেমন- একজন মানুষের ছায়া তার থেকে পৃথক নয়। এটা ওই মানুষটির প্রতিবিম্ব যা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে এবং দেখতে উল্টো দেখায়। তাই একটি ছায়া দেখে তার সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। ছায়া মরীচিকার ন্যায় মায়ারূপ এক প্রতিবিম্ব, আদর্শ রূপ নয়। ময়লা থাকলে যেমন আয়নাতে নিজের রূপ দেখা যায় না, ঠিক তেমনি মায়ায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি ঈশ্বরের স্বরূপ দেখতে পায় না। এ মায়া বা অবিদ্যা পাঁচ প্রকার। যথা- তম, মোহ, মহামোহ, তামিস্র ও অন্ধতামিস্র।
জ্ঞান সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন মান শূন্যতা, দম্ভহীনতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদগুরুর সেবা, শৌচ, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয় বিষয়ে বিরক্তি, অহংকার, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধিকে দুঃখ হিসেবে দেখা, পুত্র-স্ত্রী-গৃহের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে নিত্যের (ঈশ্বরের) প্রতি মনোনিবেশ করা, বঞ্চিত ও অবাঞ্ছিত বস্তু প্রাপ্তিতে সমভাবাপন্ন, জনবহুল স্থান বর্জন, নির্মল স্থান প্রিয়তা ও অনন্য নিষ্ঠা ও অপ্রতিহতা ভক্তির মাধ্যমে আমার সেবা করার নামই জ্ঞান। আর এ নিত্য, আধ্যাত্ম ও তত্ত্বজ্ঞান যিনি অনুসন্ধান করেন তিনিই জ্ঞানী। বাকিরা অজ্ঞানী। এতে স্পষ্ট যে, যে বিদ্যা আধ্যাত্ম, পারমাত্মিক, বা ঐশ্বরিক জ্ঞান দান করে না তা বিদ্যা নয়, অবিদ্যা।
অবিদ্যা জাত প্রকৃতি হতে বন্ধন থেকে তথা দুঃখ থেকে মুক্তি তথা ব্রহ্মে অব্যাহত গতিতে বিচরণ করা হলো মোক্ষ । (কঠ: ১/২/১৭) জীবাত্মার কর্ম স্বার্থ অত: জীবাত্মার ফল‌ও স্বার্থ লাভ করে । মোক্ষে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার পর জীবাত্মার পুনরাবৃত্তি হয় ।
অবিদ্যা হইতে অজ্ঞানতা (Ignorance) দর্শনের ভাষায় অবিদ্যা হচ্ছে দুঃখকে না জানা, দুঃখের কারণকে না জানা, দুঃখের নিবৃত্তিকে না জানা এবং দুঃখ-নিবৃত্তির উপায়কে না জানা। কিন্তু সাধারণ ভাষায় অবিদ্যা কি তা জানতে হবে। অবিদ্যা হচ্ছে যথাভূত, যথাসত্য সম্বন্ধে অজ্ঞান। যেমন- চেয়ারকে টেবিল বললে অবিদ্যা হবে।
যোগসূত্র অনুযায়ী ক্লেশ পাঁচ রকম– অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ। যেমন–
‘অবিদ্যাস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃ ক্লেশাঃ।’- (যোগসূত্র-২/৩)
অর্থাৎ : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম।

রাগ বা আসক্তি এবং দ্বেষ বা হিংসা সকলের কাছে সুপরিচিত এবং উন্নততর জীবন লাভ করার পথে এগুলির উচ্ছেদের বিধান অনেকেই দিয়ে থাকেন। ন্যায়দর্শনে রাগ ও দ্বেষকে ‘দোষ’ সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়েছে। যেমন–
প্রবর্ত্তনালক্ষণা দোষাঃ। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)।।
প্রবর্ত্তনা প্রবৃত্তিহেতুত্বং, জ্ঞাতারং হি রাগাদয়ঃ প্রবর্ত্তয়ন্তি পুণ্যে পাপে বা, যত্র মিথ্যাজ্ঞানং তত্র রাগদ্বেষাবিতি। (ন্যায়ভাষ্য-১/১/১৮)।।
অর্থাৎ :
প্রবর্ত্তণালক্ষণ অর্থাৎ প্রবৃত্তিজনকত্ব যাদের লক্ষণ এবং অনুমাপক, অর্থাৎ রাগ, দ্বেষ ও মোহ, সেই সব হচ্ছে ‘দোষ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)।। প্রবর্ত্তনা বলতে বোঝায় প্রবৃত্তিজনকত্ব। রাগাদি (রাগ, দ্বেষ ও মোহ) আত্মাকে পুণ্য বা পাপ কর্মে প্রবৃত্ত করে। যে আত্মাতে মিথ্যাজ্ঞান (মোহ) জন্মে, সেই আত্মাতে রাগ (বিষয়ে অভিলাষ) ও দ্বেষ জন্মে। (ন্যায়ভাষ্য-১/১/১৮)।।

রাগ ও দ্বেষের সঙ্গে অপর তিনটি ক্লেশেরও সবিস্তার বর্ণনা যোগশাস্ত্রে আছে। এই পঞ্চক্লেশ যে বৃত্তিগুলির মধ্যে থাকে, তাদেরকেই বলা হয় ক্লিষ্টবৃত্তি। ক্লেশগুলি দুঃখদায়ক। এবং যোগমতে সব ক্লেশের মূলেই অবিদ্যা বর্তমান। যোগসূত্রে তাই বলা হয়েছে–
‘অবিদ্যা ক্ষেত্রমুক্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারানাম্’।- (যোগসূত্র-২/৪)
অর্থাৎ :
অবিদ্যা থেকেই অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ উৎপন্ন হয়। এগুলি সকল সময় একভাবে থেকে কখনো প্রসুপ্ত, কখনো সূক্ষ্ম, কখনো বিচ্ছিন্ন এবং কখনো বা উদারভাবে চিত্তে বিরাজিত থাকে (পাতঞ্জল-২/৪)।

দেখাই যাচ্ছে, যোগশাস্ত্রে ক্লেশগুলির মধ্যে অবিদ্যাকে প্রধানতম বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অবিদ্যা নিজে ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশের প্রসবভূমি। যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা। অনাত্মাতে আত্মার, অনিত্যতে নিত্যের জ্ঞান হলো অবিদ্যাপ্রসূত। মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত যোগভাষ্যে এই সূত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে–
‘সর্ব এবামী ক্লেশা অবিদ্যাভেদাঃ, কস্মাৎ, সর্বেষু অবিদ্যৈবাভিপ্লবতে যদবিদ্যয়া বস্ত্বাকার্যতে’। (যোগভাষ্য-২/৪)।।
অর্থাৎ :
অবিদ্যার প্রভাবে প্রভাবিত জীব বিভিন্ন ধরনের ক্লেশের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সেইজন্য অবিদ্যাকে দূর করতে সমর্থ হলে স্বাভাবিকভাবেই সে অন্য ক্লেশের কবল থেকেও পরিত্রাণ পায়। (মুক্ততর্জমা)

কাজেই যোগশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী কর্মাশয়গুলির ফলবাহী হবার কারণ সাধারণভাবে ‘অবিদ্যা’। ভারতীয় অধ্যাত্ম দার্শনিক সম্প্রদায় দুঃখময় জগতের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই অবিদ্যার দ্বারপ্রান্তেই এসে উপনীত হয়েছেন। ‘বিদ্যা’ বা সত্য জ্ঞানের বিপরীত মিথ্যা জ্ঞানের সংস্কারের অর্থে ‘অবিদ্যা’ ব্যবহৃত। অধ্যাত্মবাদীদের মতে, আমাদের আত্মস্বরূপ নিত্য, মুক্ত ও শুদ্ধ এবং দেহ বা মন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সংসারী জীব মিথ্যা জ্ঞানের প্রভাবে নিজেকে বিকারশীল বস্তুজগতের সঙ্গে একাত্ম করে দেখে এবং এই জ্ঞানেরই সংস্কারবশে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘুরে কৃত কর্মের সুখদুঃখময় ফল ভোগ করে চলে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বলা হচ্ছে– ‘অবিদ্যা’ দূরীভূত হয় ‘বিবেকখ্যাতি’ বা সত্য জ্ঞানের মাধ্যমে; এবং এই জ্ঞান লাভ হলেই জীব মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করে। যেমন–
‘অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্যশুচিসুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা।’- (যোগসূত্র : ২/৫)
বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ। (যোগসূত্র-২/২৬)।।
‘ইত্যেষ মোক্ষস্য মার্গো হানস্যোপায় ইত্যি’। (যোগভাষ্য-২/২৬)।।
অর্থাৎ :
অনিত্যকে নিত্য, অশুচিকে শুচি, দুঃখকে সুখ এবং অনাত্মাকে আত্মাবোধ করা বা খ্যাতিই হলো অবিদ্যা (যোগসূত্র-২/৫)।।  সত্যজ্ঞান প্রদায়িনী বিবেকপ্রসূত প্রজ্ঞাই অবিদ্যা ত্যাগের প্রধান উপায়। (যোগসূত্র-২/২৬)।।  এই অবিদ্যা থেকে পরিত্রাণই মোক্ষ বা মুক্তির উপায় (মুক্ততর্জমা)। (যোগভাষ্য-২/২৬)।।

যোগশাস্ত্রে বর্ণিত এই ‘অবিদ্যা’ সাংখ্যে ‘অবিবেক’ বলে নির্দেশিত হয়েছে এবং সত্য বা বিবেক জ্ঞানের সাহায্যেই এই ‘অবিবেক’ দূর করার বিধান সাংখ্যদর্শনে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ ‘সাংখ্যকারিকা’য় বলেন–
‘দৃষ্টবদানুশ্রবিকঃ স হ্যবিশুদ্ধিক্ষয়াতিশয়যুক্তঃ।
তদ্বিপরীতঃ শ্রেয়ান্ ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ।।’- (সাংখ্যকারিকা-২)
অর্থাৎ :
বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়ের মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান-ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ-এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।
.
ধর্ম্মেণ গমনমূর্ধ্বং গমনমধস্তাদ্ভবত্যধর্ম্মেণ।
জ্ঞানেন চাপবর্গো বিপর্য্যয়াদিষ্যতে বন্ধঃ।।- (সাংখ্যকারিকা-৪৪)
অর্থাৎ :
ধর্মের দ্বারা (সূক্ষ্মশরীরের) উর্ধ্বগমন এবং অধর্মের দ্বারা (সূক্ষ্মশরীরের) অধোগমন হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির বিবেকজ্ঞান অথবা পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের) বিবেকজ্ঞান হলে পরম পুরুষার্থ অপবর্গ বা মোক্ষ লাভ হয়, এবং (বিবেকজ্ঞানের বিপরীত) অজ্ঞানবশত বন্ধন হয়– এটাই শাস্ত্রকারগণের অভিমত।

বেদান্ত মতবাদের এই ‘অবিদ্যা’কেই আবার বিশেষ ক্ষেত্রে ‘মায়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অদ্বৈতবাদীরা মূল সত্তা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে আত্মা বা চৈতন্যকে। শঙ্করের অদ্বৈতবাদে এই মূল চেতনা বা ব্রহ্ম জগতের আকারে বিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মের জগদাকারে প্রকাশটা মিথ্যা বা ভ্রান্তি। কারণ জগৎ বলে বস্তুত কিছু নেই, একমাত্র চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মেরই অস্তিত্ব আছে। যা নেই তাও ‘আছে’ বলে ভ্রান্ত প্রতীতি হয়। আচার্য রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতের মতেও মূল সত্তা একমাত্র ব্রহ্ম। কিন্তু ব্রহ্মের জগদাকারে বিকাশধারা ভ্রান্ত নয়, সত্য; যদিও ব্রহ্ম ব্যতিরিক্ত জগতের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমতও অনেকটা অদ্বৈতমতের অনুরূপ, কারণ মূল সত্তা ক্ষণিকবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের বিষয়রূপে প্রতিভাত বহির্জগৎ ভ্রান্তিকল্পিত।
এখানে আরো উল্লেখ্য, অদ্বৈতমতের ব্যাখ্যায় জগত বস্তুত মিথ্যা হলেও তাঁরা কিন্তু সরাসরি তা স্বীকার করেন না। একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বিষয়টার ব্যাখ্যা করেন তাঁরা। কীভাবে? সহজ করে বললে, হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ে ভাষায়– ‘অদ্বৈতবাদীরা পারমার্থিক ব্রহ্মসত্তার অতিরিক্ত একটি ব্যবহারিক সত্তার আমদানি করেছেন, যা আসলে মিথ্যা। এতে অদ্বৈতবাদের কোনো অঙ্গহানি হয় না। একে ‘আছে’ও বলা যাবে না, ‘নেই’ও বলা যাবে না, ‘আছে নেই’ও বলা যাবে না, ‘ভাব’ও বলা যাবে না, ‘অভাব’ও বলা যাবে না, ‘ভাবাভাব’ও বলা যাবে না সুতরাং অনির্বচনীয়। একেই বলে মিথ্যা; কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়। কারণ এর দ্বারা লৌকিক ব্যবহারিক সংসারের প্রয়োজন মেটানো যায়। তাই প্রয়োজনবোধে অন্য দর্শনের মতো খণ্ডন করা যায়, সামাজিক স্বার্থের প্রয়োজনে শূদ্র বা শ্রমিক জনসাধারণকে উচ্চবর্ণের আধিপত্যের স্বার্থে সকলপ্রকার মানবিক অধিকার থেকে আইন করে বঞ্চিত করা যায়। যখন যেমন প্রয়োজন মনে হয় তখন তেমন কাজ করা যায়। সুতরাং ব্যবহারিক সত্তাটি অপরূপ বহুরূপী।… সবই তো মায়া মাত্র। তাই যখন যেমন তখন তেমন– একেই বলে ব্যবহারিক সত্তা।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৩)

যাই হোক, প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পূর্বপর্যন্ত এই মিথ্যা জগতকে জগতরূপে দেখাটা অদ্বৈতমতে অবিদ্যার কারণেই ঘটে থাকে। এই অবিদ্যা দূর না হলে মুক্তি সম্ভব নয়। দুঃখময় সংসারবন্ধন ছিন্ন করার জন্য ভারতীয় অন্যান্য দর্শনেও একই উপায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যদিও প্রকাশভঙ্গি এবং পরিভাষা এক্ষেত্রে প্রত্যেক দর্শনেরই নিজস্ব। এই সত্য জ্ঞানের উন্মেষ এক দিনে হয় না এবং এই জ্ঞান অর্জন করাও সহজ নয়। কিন্তু চরম দুঃখনিবৃত্তির জন্য অন্য কোন পথ নেই। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে যোগশাস্ত্রে এবং বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণে এই পথের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মুক্তি বা ভোগাত্মক সংসারের অবসানের পথ ধরে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের অগ্রগতি, কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন বা ব্যবহারিক জীবনে এর আবেদন বা প্রভাব কতটুকু?
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মোক্ষ পরম পুরুষার্থ হিসেবে বিবেচিত একমাত্র সেই শ্রেণীর লোকদের কাছে যাঁরা দুঃখের পরিবর্তে জাগতিক সুখের অভিলাষী নন, অর্থাৎ জাগতিক সুখের নশ্বরতা যাঁরা উপলব্ধি করতে সমর্থ। মানুষের মুক্তিপথের সূচনা মূলত এই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যার পূর্ব পর্যন্ত সাংসারিক সুখ তার একমাত্র কাম্য এবং মোক্ষের কোন আবেদনই তার কাছে থাকে না। সুতরাং মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মুক্তিপথের নির্দেশক ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনগুলি সাধারণ সংসারী মানুষের জীবনদর্শনে প্রয়োজনীয়তার কোন বার্তাই বয়ে আনতে পারে না। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে মানুষের সংসারী জীবনও তলে তলে এই দর্শনের পরিধির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কীভাবে?

ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত কর্মফলবাদ অনুসারে ভালো বা মন্দ কাজ যথাক্রমে সুখ ও দুঃখের জনক হিসেবে নির্দেশিত। ফলে সংসারী মানুষ সুখের আশায় সৎ কাজের অনুষ্ঠানে প্রেরণা পায়। এবং অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণেই মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। কাজেই মূলত আধ্যাত্মিক হলেও ভারতীয় দর্শন সংসারী মানুষের নৈতিক জীবনকে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করেছে বলা যায়। ‘অদৃষ্ট’, ‘ধর্ম-অধর্ম’, ‘পাপ-পুণ্য’ ইত্যাদি ধারণা জনজীবনে মূলত কর্মফলবাদের অবদান। তবু মানুষ নিজের অদৃষ্ট যে নিজেই তৈরি করে সেটা হয়তো সকলে ভেবে দেখে না, কিন্তু অন্যায় করলে তা ধর্মে সয় না এবং তাতে পাপ হয়– এ বিশ্বাস সাধারণ জনগণের মজ্জাগত। মূলত এই বিশ্বাসেরই ফলস্বরূপ এতদঞ্চলের জনজীবনে একটি নৈতিক মানদণ্ড বর্তমান। অতএব এ প্রভাব অস্বীকার করা যায় না অবশ্যই।

অন্যদিকে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের বিভিন্ন শাখায় তার মূল লক্ষ্য দুঃখের একান্ত অবসানে উপনীত হবার পথের বর্ণনা নানাভাবে দেখা যায়। এই লক্ষ্য ও পথের বিস্তারের মধ্য দিয়েই ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক প্রস্থানগুলি শাখায় শাখায় পল্লবিত হয়েছে। যদিও ভিতরের খুঁটিনাটি নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে, কারও আশ্রয় চরম অধ্যাত্মবাদ, আবার কেউ বা বস্তুবাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু উদ্দেশ্য সবারই এক।
যেমন মোক্ষ লাভ করার জন্য প্রয়োজন আত্মার প্রকৃত স্বরূপের উপলব্ধি এবং এই আত্মস্বরূপের নির্ণয়ে সাংখ্য যোগ এবং বেদান্ত সাধারণভাবে একমত। সাংখ্য-যোগ মতে প্রকৃতি ও পুরুষ, ভোগ্য ও ভোক্তা, এই দুই-এর সংযোগে জগৎ তৈরি। এই পরিবর্তনশীল বা পরিদৃশ্যমান জগৎ প্রকৃতিরই বিভিন্ন বিকার, এবং এই পরিবর্তনের পটভূমিকায় পুরুষ বা আত্মা তার অপরিবর্তনীয় শাশ্বত অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজমান। সাংখ্যে প্রকৃতি ও পুরুষ একে অপরের পরিপুরক। প্রকৃতির মধ্যে যে অসম্পূর্ণতা আছে, সেই অসম্পূর্ণতাকে দূর করার জন্যই যেন সাংখ্যে পুরুষের কল্পনা। আমাদের চির পরিচয়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ বিকারধর্মী এই জগতের কোন ছাপ পুরুষ বা আত্মার মধ্যে নেই। আত্মার এরূপ সম্বন্ধে সাংখ্য এবং বেদান্তের মতের সাদৃশ্য রয়েছে। এছাড়া ন্যায়-বৈশেষিক, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি অন্য দার্শনিক গোষ্ঠীর ধারণা কিছুটা ভিন্ন হলেও এ বিষয়ে সকলেই অভিন্নমত যে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে হলে আমাদের লক্ষ্যকে একান্তভাবে অসম্পূর্ণ বস্তুজগতের বিপরীতমুখী করা উচিত। বুদ্ধের অনুগামীরা নির্বাণ বা শূন্যতার মধ্যে ভোগের অবসান খোঁজেন। স্থির আত্মস্বরূপ তাঁদের ধারণার গণ্ডির মধ্যে পড়ে না। আবার মীমাংসা দর্শন প্রধানত বেদানুগ হওয়ার ফলে ভারতীয় অন্য দার্শনিক গোষ্ঠীর সঙ্গে মীমাংসকদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পার্থক্য রয়েছে। কাজেই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি এঁদের লক্ষ্য হলেও বৈরাগ্যাত্মক মুক্তির পরিষ্কার চেহারা তাঁদের রূপায়নে পাওয়া যায় না।

তবে মতভেদ যাই থাক, অধ্যাত্ম দর্শনগুলির লক্ষ্যের এই পরিসমাপ্তি যে বস্তুনিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে– সেটি অধ্যাত্মবাদীরা সকলেই স্বীকার করেন। অতএব এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে– আমাদের ইন্দ্রিয় বা বুদ্ধির ধারণার সীমাবহির্ভূত এই লক্ষ্যকে ভারতীয় দর্শনের গণ্ডির মধ্যে আনা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? এ প্রশ্নের সমাধান পেতে হলে আমাদেরকে হয়তো ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় প্রমাণের ব্যবহার প্রসঙ্গে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ