মোক্ষ লাভ করা যায় জ্ঞানের মাধ্যমে
মোক্ষ শব্দের বাংলা অর্থঃ ভববন্ধন হতে মুক্তি; নির্বাণ, কৈবল্য; নিষ্কৃতি; মৃতু্য।
আত্মা যিনি প্রত্যেক জীবের মধ্যে অধিগত হয়ে আছেন , তিনি স্বরুপতঃ মুক্ত । কিন্তু অবিদ্যাযোগে তিনি বদ্ধ বলে প্রতিভাত হণ । এই অবিদ্যা তিরোহিত হলেই বদ্ধ আত্মা স্বরুপে প্রতিষ্ঠিত হন। জীব তখন দুঃখজনক জন্ম-মৃত্যু থেকে মুক্তিলাভ করে । এই যে অবিদ্যা ইহা বাস্তবিক পক্ষে আত্মার নয় , প্রকৃতিতে প্রতিবিম্বিত জীবাত্মা্ এই অবিদ্যা গ্রস্থ হন । কি রুপে তিনি অবিদ্যাগ্রস্থ হন? তাই হচ্ছে জ্ঞানের বিষয় এবং এই জ্ঞান লাভ হলে নিজ স্বরুপ অবগত হয়ে তিনি মুক্ত হন । প্রকৃতির যে জগৎরচনারুপ কার্য্য তা প্রকৃতপক্ষে বদ্ধ পুরুষের বিবেকোৎপাদন পূব্বক মুক্ত হওয়ার জন্যই । মুক্ত পুরুষের প্রতি তখন আর প্রকৃতির কোন কার্য্য থাকে না । অর্থ্যৎ তখন তিনি ত্রিগুনাতীত হয়ে ব্রহ্মস্বরুপে অবস্থান করেন।
বেদবিহিত পুরুষার্থ , অর্থাৎ পুরুষের প্রয়োজন হল চারটি – ধর্ম, অর্থ ,কাম ,মোক্ষ । এই গুলো লাভ করার জন্য জীবনকে চতুরাশ্রমে বিভক্ত করা হয়েছে , ১। ব্রহ্মচর্য্য ২। গার্হস্থ্য ৩। বানপ্রস্থ ৪। সন্ন্যাস .
ব্রহ্মর্চয্য বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জীবনের উপযোগী করে চরিত্রগঠনও করতে হবে, কারণ শ্রুতি বলেছেনঃ-
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্ ।।-(ঈশ)
জগতে যে কিছু পদার্থ আছে, তৎসমস্তই আত্মরূপী পরমেশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত
ব্রহ্ম এই চলমান জগতের সব কিছু সুষ্টি করে তার মধ্যে বাস করছেন, সুতরাং ত্যাগের দ্বরা ভোগ করবে ; অন্য কারও ধনের প্রতি লোভ করবে না । মূল উপদেশ হল , ত্যাগের দ্বারা ভোগ করবে । অর্থ্যৎ নিস্পৃহ হয়ে সংসার ধর্ম নির্ব্বাহ করবে । কঠোপনিষদের প্রথমে বলা আছে মানুষের জীবনে শ্রেয় এবং প্রেয় দুটোই উপস্থিত হয়; ধীর ব্যক্তি শ্রেয় গ্রহণ করেন এবং অল্পবুদ্ধি লোকেরা ভোগের বশর্বতী হয়ে প্রেয় বরণ করে থাকে । পরম করুনাময় ঈশ্বর বেদের মধ্যে দিয়ে শ্রেয় ও প্রেয় দুটোরই মানব জীবনে সামঞ্জস্য করেছেন । প্রথমে প্রবৃত্তিমার্গ অবলম্বন করে সংসারাশ্রমে ভোগ সমাপণ করে , পরে সংসারাশ্রমে নিস্পৃহ হয়ে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করে শ্রেয় লাভ রার জন্য । ধর্ম, অর্থ , কাম ,এই তিন পুরুষার্থ হচ্ছে সংসারাশ্রম ভিত্তিক এবং বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের লক্ষ্য হচ্ছে মোক্ষ । এই ভাবেই সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ মানব জীবনে পুরুষার্থ লাভের সুষ্ট পথ নির্দ্দেশ করেছেন ।
দেহ ধারণ করার মানেই হচ্ছে ত্রিবিধ , আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক দুঃখ ভোগ করা । যতক্ষণ দেহ আছে ততক্ষণ এই ত্রিবিধ দুঃখ ভোগ করতে হবে । প্রকৃত সুখ বলে কিছুই নেই । যা কিছু আমরা সুখ বলে মনে করি তাও দুঃখ মিশ্রিত । পরম কারুনিক ঋষি বলেছেন – এই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই হচ্ছে মোক্ষ।
মুক্তি লাভের পরে কি আমাদের আবার জন্ম নিতে হয় কিনা এ বিষয়ে বেদ কি বলে দেখুনঃ
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চাহু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দত্ পিতরং চ দৃশেয়ং মাতরং চ।।১।।
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দত্ পিতরং চ দৃশেয়ং মাতরং চ।।২।।
ঋগ্বেদ ১/২৪/১-২
শব্দার্থঃ (অমৃতানাম্) নিত্য পদার্থের মধ্যে (কতমস্য কস্য দেবস্য) কোন-এক তথা কি গুণের দেবকে (চারু নাম মনামহে) সুন্দর নাম আমরা স্বরণ করি। (কঃ নঃ) কে আমাদের (মহ্যা অদিতয়ে পুনঃ দাত্) মহতী, অখণ্ড-সম্পত্তি-মুক্তির জন্য পুনঃ প্রদান করে (পিতরং চ মাতরং চ দৃশেয়ম্) আর আবার কিছুর প্রেরণা হইতে মাতা-পিতারর দর্শন করতে হয়।।১।।
(বয়ম্) আমরা (অমৃতানাম্) নিত্য পদার্থের মধ্যে (প্রথমস্য অগ্নেঃ দেবস্য) সর্বপ্রমুখ, জ্ঞানস্বরূপ, পরমাত্মদেব কে (চারু নাম মনামহে) সুন্দর নামকে স্বরণ করি। (সঃ নঃ) সেখানে পরমাত্মা আমাদের (মহ্যা অদিতয়ে) মহতী মুক্তির জন্য (পুনঃ দাত্) আবার প্রদান করে আর তাহার হইতে প্ররণা নিয়ে (পিতরং চ মাতরং চ দৃশেয়ম্) আমি মাতা আর পিতার দর্শন করি।।২।।
ভাবার্থঃ ১.মনুষ্যের সর্বপ্রমুখ, জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকেই জপ, ধ্যান এবং স্বরণ করা উচিত।
২.সেই প্রভুই জীবের মুক্তিতে পৌচ্ছে দেয়।
৩.সেখানে পরমাত্মা মুক্ত জীবকে মুক্তি-সুখ-ভোগের পশ্চাত মাতা-পিতার দর্শন করায়, তাকে জন্ম ধারণ করায়।
৪.জন্ম ধারণ করা, মুক্তি প্রাপ্ত করা, পুনঃ জন্ম ধারণ করা- এ এক ক্রম হয় যা নিরন্তর চলতে থাকে আর চলাও উচিত। যদি জীব পরমাত্মা মধ্যে বিলীন হয়ে যায় তবে সেই মুক্তি কি হবে।
স্বামী_জগদীশ্বরানন্দ_সরস্বতী_ভাষ্য।
মোক্ষ - অবিদ্যা জাত প্রকৃতি হতে বন্ধন থেকে তথা দুঃখ থেকে মুক্তি তথা ব্রহ্মে অব্যাহত গতিতে বিচরণ করা হলো মোক্ষ । (কঠ: ১/২/১৭)
জীবাত্মার কর্ম স্বার্থ অত: জীবাত্মার ফলও স্বার্থ লাভ করে । মোক্ষে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার পর জীবাত্মার পুনরাবৃত্তি হয় ।
যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তামাহু পরমাং গতিম্।।
(কঠঃ ২।৩।১০)
শব্দার্থঃ (যদা) যখন (পঞ্চ জ্ঞানানি) যোগাভ্যা দ্বারা নিজ নিজ বিষয় থেকে পৃথক হয়ে শ্রোত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়র (মনসা সহ) মনের সাথে (অবতিষ্ঠন্তে) পরমেশ্বরে স্থির হয়ে যায় (চ) এবং (বুদ্ধিঃ) মনের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি (ন, বিচেষ্টতে) জ্ঞানের বিরুদ্ধে চেষ্টা করে না (তাম্) তাহাকে (পরমাং গতিম্) সর্বোৎকৃষ্ট মোক্ষ - অবস্থা অথবা জীবনমুক্তিদশা (আহুঃ) জ্ঞানী যোগীপুরুষ বলে।।
বেদে মোক্ষ প্রাপ্তি সম্বন্ধে পরিস্কারভাবে বর্ণনা এসেছে -
যত্রানন্দাশ্চ মোদাশ্চ মুদঃ প্রমুদ আসতে।
কামস্য যত্রাপ্তাঃ কামাস্তত্র মামমৃতং কৃধীন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
(ঋগবেদ ৯।১১৩।১১)
পদার্থঃ (যত্র) যেখানে (আনন্দাঃ) আনন্দ (চ) এবং (মোদাঃ) হর্ষ (মুদঃ চ, প্রমুদঃ) এবং যেখানে আনন্দিত তথা হর্ষিত মুক্ত পুরুষ (আসতে) বিরাজমান হয় (কামস্য, যত্র, আপ্তা, কামাঃ) এবং যেখানে কামনা কারীর সব কামনা প্রাপ্ত হয় (তত্র) সেখানে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষসুখের ভাগী (কৃধি) করো (ইন্দো) হে পরমাত্মন! আপনি (ইন্দ্রায়) জ্ঞানযোগীর জন্য (পরি, স্রব) পূর্ণাভিষেকের নিমিত্ত হও।।
ভাবার্থঃ হে ভগবান! যেই অবস্থায় আনন্দ তথা হর্ষ হয় এবং যেখানে সব কামনা পূর্ণ হয় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত করাও, পরমাত্মন! সেই মুক্তি অবস্থায় যেখানে আনন্দই আনন্দ প্রতীত হয় অন্য সব সেই সময় তুচ্ছ হয়ে যায় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত হও।
স নো বন্ধুর্নিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভূবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবাহঅমৃতমানশানাস্তৃতীয়ে ধামন্নধ্যৈরয়ন্ত।।
(যজুর্বেদ ৩২।১০)
পদার্থঃ হে মনুষ্য! (যত্র) যেই (তৃতীয়ে) জীব এবং প্রকৃতি থেকে বিলক্ষণ (ধামন্) আধাররূপ জগদীশ্বরে (অমৃতম্) মোক্ষ সুখ কে (আনশানাঃ) প্রাপ্ত হয়ে (দেবাঃ) বিদ্বান লোক (অধৈরয়ন্ত) সর্বত্র নিজ ইচ্ছাপূর্বক বিচরণ করেন, যিনি (বিশ্বা) সব (ভূবনানি) লোক - লোকান্তর এবং (ধামানি) জন্ম, স্থান, নাম কে (বেদ) জানেন, (সঃ) তিনি পরমাত্মা (নঃ) আমাদের (বন্ধুঃ) ভাইয়ের তুল্য মান্য সহায়ক (জনিতা) উৎপন্ন কারক, (সঃ) তিনিই (বিধাতা) সমস্ত পদার্থ এবং কর্মফলের বিধান কারক।।
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্টরূপে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষের বর্ননা রয়েছে। অমৃত শব্দের অর্থে মহিধর বলেছেন - "অমৃতং মোক্ষপ্রাপকং জ্ঞানং"। শ্রী শঙ্করাচার্য জী "অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম" অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। " পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব (মুন্ডক ৩।২।৬) পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে।
अ॒ग्नेर्व॒यं प्र॑थ॒मस्या॒मृता॑नां॒ मना॑महे॒ चारु॑ दे॒वस्य॒ नाम॑। स नो॑ म॒ह्या अदि॑तये॒ पुन॑र्दात्पि॒तरं॑ च दृ॒शेयं॑ मा॒तरं॑ च॥
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।।
সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।।
पदार्थान्वयभाषाः -हम लोग जिस (अग्ने) ज्ञानस्वरूप (अमृतानाम्) विनाश धर्मरहित पदार्थ वा मोक्ष।प्राप्त जीवों में (प्रथमस्य) अनादि विस्तृत अद्वितीय स्वरूप (देवस्य) सब जगत् के प्रकाश करने वा संसार में सब पदार्थों के देनेवाले परमेश्वर का (चारु) पवित्र (नाम) गुणों का गान करना (मनामहे) जानते हैं, (सः) वही (नः) हमको (मह्यै) बड़े-बड़े गुणवाली (अदितये) पृथिवी के बीच में (पुनः) फिर जन्म (दात्) देता है, जिससे हम लोग (पुनः) फिर (पितरम्) पिता (च) और (मातरम्) माता (च) और स्त्री-पुत्र-बन्धु आदि को (दृशेयम्) देखते हैं॥
भावार्थभाषाः -हे मनुष्यो ! हम लोग जिस अनादिस्वरूप सदा अमर रहने वा जो हम सब लोगों के किये हुए पाप और पुण्यों के अनुसार यथायोग्य सुख-दुःख फल देनेवाले जगदीश्वर देव को निश्चय करते और जिसकी न्याययुक्त व्यवस्था से पुनर्जन्म को प्राप्त होते हैं, तुम लोग भी उसी देव को जानो, किन्तु इससे और कोई उक्त कर्म करनेवाला नहीं है, ऐसा निश्चय हम लोगों को है कि वही मोक्षपदवी को पहुँचे हुए जीवों का भी महाकल्प के अन्त में फिर पाप-पुण्य की तुल्यता से पिता-माता और स्त्री आदि के बीच में मनुष्यजन्म धारण कराता है॥-स्वामी दयानन्द सरस्वती
মোক্ষ ও পূণরাগমন
প্রথমে জানা আবশ্যক যে মোক্ষ বা মুক্তি কি? "মুঞ্চন্তি পৃথগভবন্তি জনা যস্যাং সা মুক্তিঃ" অর্থাৎ যাহা থেকে মুক্ত হওয়া তাহার নাম মুক্তি। এখন প্রশ্ন যে কি হতে মুক্ত হওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ন্যায় দর্শনে মহর্ষি গৌতম বলেছেন -
.
দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষমিথ্যাজ্ঞা
নানামুত্তরোত্তরাপায়ে তদন্তরাপায়াদপবর
্গঃ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২)
.
দুঃখ, জন্ম, প্রবৃত্তি, দোষ এবং মিথ্যাজ্ঞানের উত্তর উত্তরের নষ্ট হওয়ার পর তাহার অনন্তরের অব্যবহিত পূর্বের নাশ হওয়ার দ্বারা মোক্ষ হয়।
.
তদত্যন্তবিমোক্ষহপবর্গঃ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২২)
দুঃখের নিবৃত্তির = মুক্তির নাম অপবর্গ = মোক্ষ।।
.
উপনিষদে মোক্ষ বিষয়ে এইরূপ বলা হয়েছে -
.
যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তামাহু পরমাং গতিম্।।
(কঠ০ ২।৩।১০)
.
শব্দার্থঃ (যদা) যখন (পঞ্চ জ্ঞানানি) যোগাভ্যা দ্বারা নিজ নিজ বিষয় থেকে পৃথক হয়ে শ্রোত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়র (মনসা সহ) মনের সাথে (অবতিষ্ঠন্তে) পরমেশ্বরে স্থির হয়ে যায় (চ) এবং (বুদ্ধিঃ) মনের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি (ন, বিচেষ্টতে) জ্ঞানের বিরুদ্ধে চেষ্টা করে না (তাম্) তাহাকে (পরমাং গতিম্) সর্বোৎকৃষ্ট মোক্ষ - অবস্থা অথবা জীবনমুক্তিদশা (আহুঃ) জ্ঞানী যোগীপুরুষ বলে।।
.
অনেকের মতে বেদ মোক্ষ বিষয়ে কোনরূপ বর্ণনা করে নি। শুধুমাত্র বেদ স্বর্গ লোক প্রাপ্তি বিষয়েই বলেছে। অথচ বেদে মোক্ষ প্রাপ্তি সমন্ধ্যে পরিস্কারভাবে বর্ণনা এসেছে -
.
যত্রানন্দাশ্চ মোদাশ্চ মুদঃ প্রমুদ আসতে।
কামস্য যত্রাপ্তাঃ কামাস্তত্র মামমৃতং কৃধীন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
(ঋগবেদ ৯।১১৩।১১)
.
পদার্থঃ (যত্র) যেখানে (আনন্দাঃ) আনন্দ (চ) এবং (মোদাঃ) হর্ষ (মুদঃ চ, প্রমুদঃ) এবং যেখানে আনন্দিত তথা হর্ষিত মুক্ত পুরুষ (আসতে) বিরাজমান হয় (কামস্য, যত্র, আপ্তা, কামাঃ) এবং যেখানে কামনা কারীর সব কামনা প্রাপ্ত হয় (তত্র) সেখানে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষসুখের ভাগী (কৃধি) করো (ইন্দো) হে পরমাত্মন! আপনি (ইন্দ্রায়) জ্ঞানযোগীর জন্য (পরি, স্রব) পূর্ণাভিষেকের নিমিত্ত হও।।
.
ভাবার্থঃ হে ভগবান! যেই অবস্থায় আনন্দ তথা হর্ষ হয় এবং যেখানে সব কামনা পূর্ণ হয় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত করাও, পরমাত্মন! সেই মুক্তি অবস্থায় যেখানে আনন্দই আনন্দ প্রতীত হয় অন্য সব সেই সময় তুচ্ছ হয়ে যায় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত হও।
.
স নো বন্ধুর্নিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভূবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবাহঅমৃতমানশানাস্তৃতীয়ে ধামন্নধ্যৈরয়ন্ত।।
(যজুর্বেদ ৩২।১০)
.
পদার্থঃ হে মনুষ্য! (যত্র) যেই (তৃতীয়ে) জীব এবং প্রকৃতি থেকে বিলক্ষণ (ধামন্) আধাররূপ জগদীশ্বরে (অমৃতম্) মোক্ষ সুখ কে (আনশানাঃ) প্রাপ্ত হয়ে (দেবাঃ) বিদ্বান লোক (অধৈরয়ন্ত) সর্বত্র নিজ ইচ্ছাপূর্বক বিচরণ করেন, যিনি (বিশ্বা) সব (ভূবনানি) লোক - লোকান্তর এবং (ধামানি) জন্ম, স্থান, নাম কে (বেদ) জানেন, (সঃ) তিনি পরমাত্মা (নঃ) আমাদের (বন্ধুঃ) ভাইয়ের তুল্য মান্য সহায়ক (জনিতা) উৎপন্ন কারক, (সঃ) তিনিই (বিধাতা) সমস্ত পদার্থ এবং কর্মফলের বিধান কারক।।
.
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্টরূপে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষের বর্ননা রয়েছে। অমৃত শব্দের অর্থে মহিধর বলেছেন - "অমৃতং মোক্ষপ্রাপকং জ্ঞানং"। শ্রী শঙ্করাচার্য জী "অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম" অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। " পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব (মুন্ডক ৩।২।৬) পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে।
.
এখন প্রশ্ন এই যে, মোক্ষ প্রাপ্ত হয়ে জীব পুনরায় কখনো সংসারে পূনরাগমন করে কি না। কারণ উপনিষদ, গীতা আদি শাস্ত্রে বলা হয়েছে "সেখান হতে পুনরাগমন হয় না। যেমনঃ -
" ন চ পুনরাবর্ত্ততে ন চ পুনরাবর্ত্ততে ইতি " (শ্বেতাঃ ৮।১৫।১৫)
"যদ গত্বা ন নির্বত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।" (গীতাঃ ১৫।০৬)
.
ইহা সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয় একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত এই কথা সত্য। কারণ প্রথমত জীবের সামর্থ্য ও দেহাদির সাধন পরিমিত। সূতরাং ঐ সকলের ফল অনন্ত হতে পারে না। জীবের অসীম সামর্থ্য, কর্ম এবং সাধন নেই। এই কারণে জীব অনন্ত ফল ভোগ করতে পারে না। যাহাদের সাধন অনিত্য, তাহাদের ফল নিত্য হতে পারে না।আবার যদি কেউ মুক্তি হতে প্রত্যাবর্তন না করে তবে সংসারের উচ্ছেদ ঘটবে অর্থাৎ জীব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
.
বেদে স্পষ্টরূপেই বলা আছে ঈশ্বর মোক্ষপ্রাপ্ত জীবদের পৃথিবীতে পূনরায় প্রেরণ করেন-
.
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দাত পিতরং চ দৃশোয়ং মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।১)
.
পদার্থঃ আমরা (কস্য) কিভাবে গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (কতমস্য) কোন বহু (অমৃতানাম্) উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের (দেবস্য) প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে (চারু) সুন্দর (নাম) প্রসিদ্ধ নাম কে (মনামহে) জানিব যিনি (নূনম্) নিশ্চয় করে (কঃ) কোন সুখস্বরূপ দেব (নঃ) মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে (মহৈ) বিশাল কারণরূপ নাশরহিত (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পুনঃ) পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে (দৃশেয়ম্) দেখতে পারি।।
.
সরলার্থঃ আমরা কিরূপ গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত কোন বহু উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে সুন্দর প্রসিদ্ধ নাম কে জানিব যিনি নিশ্চয় করে কোন সুখস্বরূপ দেব মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে বিশাল কারণরূপ নাশরহিত পৃথিবীর মধ্যে পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে দেখতে পারি।।
.
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
.
পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।। ২।।
.
সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।। ২।।
.
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্ট যে, নিশ্চয় আমাদের তিনি মোক্ষপদবী কে পৌছানো জীবকেও মহাকল্পের অন্তে পূনরায় পিতা - মাতা এবং স্ত্রী আদির মধ্যে মনুষ্যজন্ম ধারণ করান। উপনিষদেও এই সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে -
.
বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থঃ সন্নাসযোগাদ্ যতয়ঃ শূদ্ধসত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমূচ্যন্তি সর্বে।।
(মুন্ডক ৩।২।৬)
.
শব্দার্থঃ (বেদান্তবিজ্ঞান
সূনিশ্চিতার্থাঃ) বেদান্তের পুস্তক দ্বারা উৎপন্ন হওয়া যে জ্ঞান অর্থাৎ উপনিষদ্ এবং বেদান্তের দর্শন দ্বারা যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা দ্বারা যে অর্থ কে নিশ্চয় করে নেয় (সন্ন্যাসযোগাত্) বৈরাগ্য দ্বারা অর্থাৎ প্রত্যেক সাংসারিক বস্তুতে দোষ জানার দ্বারা অথবা যোগাভ্যাস দ্বারা মন কে রুদ্ধ করার দ্বারা (যতয়ঃ) যিনি ইন্দ্রীয় কে বশ করে নেয়, ইহা দ্বারা (শুদ্ধসত্ত্বাঃ) বুদ্ধি কে সব প্রকার দোষ দ্বারা শুদ্ধ করে নেয় (তে) তিনি জ্ঞানী পুরুষ (ব্রহ্মলোকেষু) ব্রহ্মলোক অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শনে (পরান্তকালে) মহা কল্পের সীমা পর্যন্ত অথবা পরাবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া শুদ্ধ সুখের অন্ত কাল পর্যন্ত (পরামৃতাঃ) পরা বিদ্যা দ্বারা মুক্ত জীব (পরিমুচ্যন্তি) সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (সর্বে) সব।
.
মূলভাব- যে মনুষ্য বেদান্তের গ্রন্থ অর্থাৎ উপনিষদ এবং বেদান্ত সূত্র ইত্যাদির সূত্র এবং মন দ্বারা জীবাত্মা এবং পরমাত্মা এবং প্রকৃতির স্বরূপ কে নিশ্চয় করে ফেলে, তিনি জীবন্মুক্ত সন্যাস অর্থাৎ বৈরাগ্য দ্বারা সব বস্তুতে দোষ দেখে অথবা যোগ দ্বারা মন ঠিক করার দ্বারা অথবা প্রকৃতির ত্যাগ এবং পরমাত্মার যোগ দ্বারা মন শুদ্ধ করে, ইন্দ্রীয় কে বশকারী মহাত্মা, ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত প্রাপ্ত হয়ে অর্থাৎ দর্শ করে পরাবিদ্যার উৎপন্ন জ্ঞানের অন্ত পর্যন্ত পরাবিদ্যা দ্বারা প্রাপ্ত মুক্তি কে ভোগ করে এবং মহাকল্পের পশ্চাৎ পুণরায় সেই দশা থেকে মুক্ত হন।
.
মহাকল্পের গণনা এইরূপঃ---তেতাল্লিশ লক্ষ, বিংশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যুগী; দুই সহস্র চতুর্যুগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিংশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এইরূপ বারমাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এক "পরান্তকাল" হইয়া থাকে। ইহা গণিতের নিয়মানুসারে সম্যক রূপে বুঝে নিতে হবে।
.
এখন প্রশ্ন এই যে, যদি এরূপ হয় তবে মুক্তিও জন্ম মরণ সদৃশ। অতএব শ্রম করা বৃথা।
.
উত্তরঃ মুক্তি জন্ম মরণ সদৃশ নয়। কেননা ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্যন্ত জীবসমূহের মুক্তির আনন্দে থাকা এবং দুঃখ ভোগ না করা কি সামান্য কথা?
জীবাত্মা আনন্দ স্বরূপ হইতে পারে না এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদ পাওয়া যায় তাহাই বলিতেছেন।
নৈকস্যানন্দচিদ্রুপত্বে দ্বায়োর্ভোদাৎ।।
সাংখ্য সূত্র-৫।৬৬
পদঃ- ন। একস্য। আনন্দচিদ্রুপাত্বে। দ্বয়ো। ভেদাৎ।।
সরলার্থ- জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক নহে। উভয়েই চৈতন্য হইলেও পরস্পর বিজাতীয় চৈতন্য। দুইয়ে মধ্যে এই ভেদ পাওয়া যায়, জীবাত্মা অজ্ঞ, পরমাত্মা সর্বজ্ঞ,জীব কেবল চৈতন্য স্বরূপ, পরমাত্মা জ্ঞান ও আনন্দ স্বরূপ জীবাত্মা অনু ও একদেশী, পরমাত্মা অনন্ত ও সর্বব্যাপী এবং অমূর্ত্ত অর্থাৎ কোন স্হান অধিকার করন না, জীবাত্মা বহু এবং পরমাত্মা এক -জীব ও ব্রহ্মে এই প্রভেদ। জীবাত্মা সচ্চিৎস্বরূপ এবং পরমাত্মা সচ্চিদানন্দস্বরূপ।।
যদি জীবাত্মা আনন্দস্বরূপ নহে তবে আনন্দিত হইয়াছি এ প্রতীত তাহার কেন হয়?
দুঃখনিবৃতত্তের্গৌণঃ।।
সাংখ্য সূত্র-৫। ৬৭
পদঃ- দুঃখনিবৃত্তেঃ।গৌণঃ।।
সরালার্থ- স্হূল শরীরে ভোগের দ্বারা যে সুখ হইয়া থাকে উহা দুঃখের ক্ষণিক নিবৃত্তিজনিত সুখের আভাসমাত্র,উহা গৌণ। কারণ সাংসারিক কোন সুখই আশা ও আকাঙ্খা রহিত হইতে পারে না বলিয়া প্রকৃত শান্তিপ্রদ নহে। প্রকৃত আনন্দ জ্ঞানের দ্বারাই হইয়া থাকে। মোক্ষ বা প্রকৃত শান্তি একমাত্র আনন্দস্বরূপ পরমাত্মার সম্বন্ধ দ্বারাই হইয়া থাকে।।
তবে মুক্ত অবস্হায় জীবিত্মাকে আনন্দ স্বরূপ বলা হয় কেন?
বিমুক্তিপ্রশংসামন্দানাম্।।
সাংখ্য সূত্র -৫।৬৮
পদঃ- বিমুক্তিপ্রশংসা। মন্দানাম্।।
সরলার্থ- মুক্ত অবস্হায় জীব আনন্দস্বরূপ হইয়া যায় ইহা অবিবেকী পুরুষের কথা, মুক্ত অবস্হায় জীবাত্মা পরমাত্মার আনন্দস্বরূপে অবস্হান করিয়া আনন্দিত হইয়া থাকে- আনন্দস্বরূপ হয় না। জীবের এই অবস্হার নাম মুক্তি। স্বরূপের কখনও পরিবর্তন হয় না।
প্রসঙ্গে ন্যায় দর্শনে মহর্ষি গৌতম বলেছেন -.
দুঃখজন্মপ্রবৃত্তিদোষমিথ্যাজ্ঞা
নানামুত্তরোত্তরাপায়ে তদন্তরাপায়াদপবরর্গ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২)
দুঃখ, জন্ম, প্রবৃত্তি, দোষ এবং মিথ্যাজ্ঞানের উত্তর উত্তরের নষ্ট হওয়ার পর তাহার অনন্তরের অব্যবহিত পূর্বের নাশ হওয়ার দ্বারা মোক্ষ হয়।.
তদত্যন্তবিমোক্ষহপবর্গঃ।।
(ন্যায় দ০ ১।১।২২)
দুঃখের নিবৃত্তির = মুক্তির নাম অপবর্গ = মোক্ষ।।
উপনিষদে মোক্ষ বিষয়ে এইরূপ বলা হয়েছে -
.যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তামাহু পরমাং গতিম্।।
(কঠ০ ২।৩।১০)
.শব্দার্থঃ (যদা) যখন (পঞ্চ জ্ঞানানি) যোগাভ্যা দ্বারা নিজ নিজ বিষয় থেকে পৃথক হয়ে শ্রোত্রাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়র (মনসা সহ) মনের সাথে (অবতিষ্ঠন্তে) পরমেশ্বরে স্থির হয়ে যায় (চ) এবং (বুদ্ধিঃ) মনের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি (ন, বিচেষ্টতে) জ্ঞানের বিরুদ্ধে চেষ্টা করে না (তাম্) তাহাকে (পরমাং গতিম্) সর্বোৎকৃষ্ট মোক্ষ - অবস্থা অথবা জীবনমুক্তিদশা (আহুঃ) জ্ঞানী যোগীপুরুষ বলে।।
.অনেকের মতে বেদ মোক্ষ বিষয়ে কোনরূপ বর্ণনা করে নি। শুধুমাত্র বেদ স্বর্গ লোক প্রাপ্তি বিষয়েই বলেছে। অথচ বেদে মোক্ষ প্রাপ্তি সমন্ধ্যে পরিস্কারভাবে বর্ণনা এসেছে -
.যত্রানন্দাশ্চ মোদাশ্চ মুদঃ প্রমুদ আসতে।
কামস্য যত্রাপ্তাঃ কামাস্তত্র মামমৃতং কৃধীন্দ্রায়েন্দো পরি স্রব।।
(ঋগবেদ ৯।১১৩।১১)
.পদার্থঃ (যত্র) যেখানে (আনন্দাঃ) আনন্দ (চ) এবং (মোদাঃ) হর্ষ (মুদঃ চ, প্রমুদঃ) এবং যেখানে আনন্দিত তথা হর্ষিত মুক্ত পুরুষ (আসতে) বিরাজমান হয় (কামস্য, যত্র, আপ্তা, কামাঃ) এবং যেখানে কামনা কারীর সব কামনা প্রাপ্ত হয় (তত্র) সেখানে (মাম্) আমাকে (অমৃতম্) মোক্ষসুখের ভাগী (কৃধি) করো (ইন্দো) হে পরমাত্মন! আপনি (ইন্দ্রায়) জ্ঞানযোগীর জন্য (পরি, স্রব) পূর্ণাভিষেকের নিমিত্ত হও।।
.ভাবার্থঃ হে পরমাত্মান্! যেই অবস্থায় আনন্দ তথা হর্ষ হয় এবং যেখানে সব কামনা পূর্ণ হয় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত করাও, পরমাত্মন! সেই মুক্তি অবস্থায় যেখানে আনন্দই আনন্দ প্রতীত হয় অন্য সব সেই সময় তুচ্ছ হয়ে যায় সেই অবস্থা আমাকে প্রাপ্ত হও।
.স নো বন্ধুর্নিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভূবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবাহঅমৃতমানশানাস্তৃতীয়ে ধামন্নধ্যৈরয়ন্ত।।
(যজুর্বেদ ৩২।১০)
.পদার্থঃ হে মনুষ্য! (যত্র) যেই (তৃতীয়ে) জীব এবং প্রকৃতি থেকে বিলক্ষণ (ধামন্) আধাররূপ জগদীশ্বরে (অমৃতম্) মোক্ষ সুখ কে (আনশানাঃ) প্রাপ্ত হয়ে (দেবাঃ) বিদ্বান লোক (অধৈরয়ন্ত) সর্বত্র নিজ ইচ্ছাপূর্বক বিচরণ করেন, যিনি (বিশ্বা) সব (ভূবনানি) লোক - লোকান্তর এবং (ধামানি) জন্ম, স্থান, নাম কে (বেদ) জানেন, (সঃ) তিনি পরমাত্মা (নঃ) আমাদের (বন্ধুঃ) ভাইয়ের তুল্য মান্য সহায়ক (জনিতা) উৎপন্ন কারক, (সঃ) তিনিই (বিধাতা) সমস্ত পদার্থ এবং কর্মফলের বিধান কারক।।
.#উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্টরূপে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষের বর্ননা রয়েছে। অমৃত শব্দের অর্থে মহিধর বলেছেন - "অমৃতং মোক্ষপ্রাপকং জ্ঞানং"। শ্রী শঙ্করাচার্য জী "অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম" অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। " পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব (মুন্ডক ৩।২।৬) পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে।
.এখন প্রশ্ন এই যে, মোক্ষ প্রাপ্ত হয়ে জীব পুনরায় কখনো সংসারে পূনরাগমন করে কি না। কারণ উপনিষদ, গীতা আদি শাস্ত্রে বলা হয়েছে "সেখান হতে পুনরাগমন হয় না। যেমনঃ -
" ন চ পুনরাবর্ত্ততে ন চ পুনরাবর্ত্ততে ইতি " (শ্বেতাঃ ৮।১৫।১৫)
"যদ গত্বা ন নির্বত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।" (গীতাঃ ১৫।০৬)
.ইহা সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয় একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত এই কথা সত্য। কারণ প্রথমত জীবের সামর্থ্য ও দেহাদির সাধন পরিমিত। সূতরাং ঐ সকলের ফল অনন্ত হতে পারে না। জীবের অসীম সামর্থ্য, কর্ম এবং সাধন নেই। এই কারণে জীব অনন্ত ফল ভোগ করতে পারে না। যাহাদের সাধন অনিত্য, তাহাদের ফল নিত্য হতে পারে না।আবার যদি কেউ মুক্তি হতে প্রত্যাবর্তন না করে তবে সংসারের উচ্ছেদ ঘটবে অর্থাৎ জীব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
.বেদে স্পষ্টরূপেই বলা আছে ঈশ্বর মোক্ষপ্রাপ্ত জীবদের পৃথিবীতে পূনরায় প্রেরণ করেন-
.কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দাত পিতরং চ দৃশোয়ং মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।১)
.পদার্থঃ আমরা (কস্য) কিভাবে গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (কতমস্য) কোন বহু (অমৃতানাম্) উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের (দেবস্য) প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে (চারু) সুন্দর (নাম) প্রসিদ্ধ নাম কে (মনামহে) জানিব যিনি (নূনম্) নিশ্চয় করে (কঃ) কোন সুখস্বরূপ দেব (নঃ) মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে (মহৈ) বিশাল কারণরূপ নাশরহিত (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পুনঃ) পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে (দৃশেয়ম্) দেখতে পারি।।
.সরলার্থঃ আমরা কিরূপ গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত কোন বহু উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে সুন্দর প্রসিদ্ধ নাম কে জানিব যিনি নিশ্চয় করে কোন সুখস্বরূপ দেব মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে বিশাল কারণরূপ নাশরহিত পৃথিবীর মধ্যে পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে দেখতে পারি।।
.অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
.পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।। ২।।
.সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।। ২।।
.উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে স্পষ্ট যে, নিশ্চয় আমাদের তিনি মোক্ষপদবী কে পৌছানো জীবকেও মহাকল্পের অন্তে পূনরায় পিতা - মাতা এবং স্ত্রী আদির মধ্যে মনুষ্যজন্ম ধারণ করান। উপনিষদেও এই সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে -
.বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থঃ সন্নাসযোগাদ্ যতয়ঃ শূদ্ধসত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমূচ্যন্তি সর্বে।।
(মুন্ডক ৩।২।৬)
.শব্দার্থঃ (বেদান্তবিজ্ঞান
সূনিশ্চিতার্থাঃ) বেদান্তের পুস্তক দ্বারা উৎপন্ন হওয়া যে জ্ঞান অর্থাৎ উপনিষদ্ এবং বেদান্তের দর্শন দ্বারা যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা দ্বারা যে অর্থ কে নিশ্চয় করে নেয় (সন্ন্যাসযোগাত্) বৈরাগ্য দ্বারা অর্থাৎ প্রত্যেক সাংসারিক বস্তুতে দোষ জানার দ্বারা অথবা যোগাভ্যাস দ্বারা মন কে রুদ্ধ করার দ্বারা (যতয়ঃ) যিনি ইন্দ্রীয় কে বশ করে নেয়, ইহা দ্বারা (শুদ্ধসত্ত্বাঃ) বুদ্ধি কে সব প্রকার দোষ দ্বারা শুদ্ধ করে নেয় (তে) তিনি জ্ঞানী পুরুষ (ব্রহ্মলোকেষু) ব্রহ্মলোক অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শনে (পরান্তকালে) মহা কল্পের সীমা পর্যন্ত অথবা পরাবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া শুদ্ধ সুখের অন্ত কাল পর্যন্ত (পরামৃতাঃ) পরা বিদ্যা দ্বারা মুক্ত জীব (পরিমুচ্যন্তি) সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (সর্বে) সব।
.মূলভাব- যে মনুষ্য বেদান্তের গ্রন্থ অর্থাৎ উপনিষদ এবং বেদান্ত সূত্র ইত্যাদির সূত্র এবং মন দ্বারা জীবাত্মা এবং পরমাত্মা এবং প্রকৃতির স্বরূপ কে নিশ্চয় করে ফেলে, তিনি জীবন্মুক্ত সন্যাস অর্থাৎ বৈরাগ্য দ্বারা সব বস্তুতে দোষ দেখে অথবা যোগ দ্বারা মন ঠিক করার দ্বারা অথবা প্রকৃতির ত্যাগ এবং পরমাত্মার যোগ দ্বারা মন শুদ্ধ করে, ইন্দ্রীয় কে বশকারী মহাত্মা, ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত প্রাপ্ত হয়ে অর্থাৎ দর্শ করে পরাবিদ্যার উৎপন্ন জ্ঞানের অন্ত পর্যন্ত পরাবিদ্যা দ্বারা প্রাপ্ত মুক্তি কে ভোগ করে এবং মহাকল্পের পশ্চাৎ পুণরায় সেই দশা থেকে মুক্ত হন।
.মহাকল্পের গণনা এইরূপঃ---তেতাল্লিশ লক্ষ, বিংশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যুগী; দুই সহস্র চতুর্যুগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিংশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এইরূপ বারমাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এক "পরান্তকাল" হইয়া থাকে। ইহা গণিতের নিয়মানুসারে সম্যক রূপে বুঝে নিতে হবে।
.এখন প্রশ্ন এই যে, যদি এরূপ হয় তবে মুক্তিও জন্ম মরণ সদৃশ। অতএব শ্রম করা বৃথা।
.উত্তরঃ মুক্তি জন্ম মরণ সদৃশ নয়। কেননা ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্যন্ত জীবসমূহের মুক্তির আনন্দে থাকা এবং দুঃখ ভোগ না করা কি সামান্য কথা?
ওতম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ