দ্বৈতবাদ
দ্বৈতবাদের প্রবর্তক মাধবাচার্য, দ্বৈত অর্থ দুই। ঈশ্বর ও জগত দুই অর্থাৎ এক নয়, এটাই দ্বৈতবাদের মুল কথা। মাধবাচার্যকে দ্বৈতবাদের জনক বলা হয়, তবে দ্বৈতজ্ঞান মূলত স্বভাবজাত বা জন্মগত জ্ঞান। দ্বৈতবাদীরা মনে করেন ঈশ্বর নিরাকার নয় অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্দিষ্ট রূপ আছে। ঈশ্বরের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, এজন্য তিনি স্বয়ম্ভু। দ্বৈতবাদীরা মনে করে ঈশ্বর কোন নির্দিষ্ট লোকে বাস করেন। তাই তাঁরা বিষ্ণুলোক বা বৈকুণ্ঠলোক, শিবলোক, ব্রহ্মলোক প্রভৃতি লোকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তারা মনে করেন ঈশ্বর ঐসব লোকে বাস করেন আবার সূক্ষ্ম-আত্মা রূপে জীবের হৃদয়াকাশেও বাস করেন। কুমার যেমন নিজ হাতে মাটি দিয়ে কলস, ঘট প্রভৃতি তৈরি করেন, ঈশ্বরও তেমনি পঞ্চভূত দ্বারা এই জড়-জগৎ ও জীবকুলকে সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর একাধারে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা।
ভক্তিযোগই দ্বৈতবাদীদের প্রধান অবলম্বন। ঈশ্বরকে ভক্তি করলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে মুক্তি দেবেন-এটাই দ্বৈতবাদীদের সাধনার মূলকথা। দ্বৈতবাদীদের ঈশ্বর সচ্চিদানন্দময়। ঈশ্বর সৎ অর্থাৎ তাঁর সত্ত্বা আছে, চিৎ অর্থাৎ তিনি চৈতন্যময় আবার তিনি আনন্দময়ও বটে। ঈশ্বর-ভক্তির মাধ্যমে ভক্তের দুঃখ দূর হয় এবং ভক্ত আনন্দ লাভ করেন। ব্রহ্মসূত্রেও বলা হয়েছে- ‘‘আনন্দময়েহভ্যাসাৎ’’ অর্থাৎ ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, শাস্ত্রে পুনঃপুনঃ এ কথাই বলা হয়েছে। দ্বৈতবাদীরা ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন যখন ধর্মের পরিমান কমে যায় এবং অধর্ম বেড়ে যায়, তখন ঈশ্বর বিভিন্ন রূপে পৃথিবীতে এসে ধর্মকে রক্ষা করেন এবং অধর্মকে বিনাশ করেন।
|
রামানুজ
রামানুজ (১০১৭-১১৩৭) ছিলেন একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক। তিনি শ্রী রামানুচার্য, উপাধ্যায়, লক্ষ্মণ মুনি নামেও পরিচিত। সাধারণভাবে হিন্দুরা তাকে হিন্দু দর্শনের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে দেখেন। বৈষ্ণব আচার্য রামানুজাচার্যের শিষ্য রামানন্দ । যার শিষ্য ছিলেন কবির ও সুরদাস। রামানুজ বেদান্ত দর্শনের উপর ভিত্তি করে তাঁর নতুন দর্শন বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত রচনা করেছিলেন।বেদান্ত ছাড়াও রামানুজাচার্য সপ্তম-দশম শতকের মরমী ও ভক্ত আলওয়ার সাধুদের ভক্তি দর্শনের এবং দক্ষিণের পঞ্চরাত্র ঐতিহ্যের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। |
রামানুজ ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তিনি তাঁর গুরু যাদব প্রকাশের কাছ থেকে বেদ শেখার জন্য কাঞ্চি গিয়েছিলেন। রামানুজাচার্য ছিলেন আলওয়ার সন্ত যমুনাচার্যের প্রধান শিষ্য। গুরুর ইচ্ছানুসারে রামানুজ তিনটি বিশেষ কাজ করার অঙ্গীকার করেছিলেন ।তিনি ব্রহ্মসূত্র, বিষ্ণু সহস্রনাম এবং দিব্য প্রবন্ধধামের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। তিনি গৃহ ত্যাগ করেন এবং শ্রীরঙ্গমের জ্যোতিরাজ নামে এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে দীক্ষা নেন।
রামানুজ মহীশূরের শ্রীরঙ্গম থেকে শালিগ্রাম নামক স্থানে চলে এসেছিলেন। রামানুজ সেই অঞ্চলে বারো বছর বৈষ্ণব মত প্রচার করেছিলেন। এর পরে বৈষ্ণব মত প্রচারের জন্য তিনি পুরো ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। ১১৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ১২০ বছর পূর্ণ করেন এবং ব্রাহ্মণ হন।
যদিও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তবে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে রচিত তাঁর দুটি বই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল - শ্রীভাষ্যম এবং বেদান্ত সংগ্রহ।
রামানুজের মতে ভক্তির অর্থ আরাধনা বা কীর্তন-ভজন নয় বরং ঈশ্বরের ধ্যান করা বা প্রার্থনা করা। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে রামানুচার্য ভক্তিকে বর্ণ ও শ্রেণি থেকে পৃথক এবং সকলের পক্ষে সম্ভব বলে বিবেচনা করেছিলেন।
দ্বৈতবাদীরা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন পাপকার্য করলে নরকে যেতে হবে এবং পুণ্যকর্ম করলে স্বর্গে যাওয়া যাবে। তবে স্বর্গে গেলেও পুণ্যফল ক্ষয় হওয়ার পর আবার নতুন দেহ ধারণ করে মর্ত্যে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু উপাস্য-দেবতার লোকে (যেমন- ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক প্রভৃতি স্থানে) গেলে আর মর্ত্যে ফিরে আসতে হয় না। এটাই দ্বৈতবাদীদের নিকট মুক্তি নামে কথিত। জগতে যা কিছু হচ্ছে, সব ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে। ঈশ্বর যাকে সংসার-বন্ধন হতে মুক্তি দেবে একমাত্র তিনিই মুক্তি পাবেন। বস্তুত দ্বৈতবাদ স্বভাবসিদ্ধ জ্ঞান হলেও এ জ্ঞান চিরস্থায়ী নয়। জ্ঞানের পূর্ণতা আসলে দৈতজ্ঞান দূর হয়ে যায় তখন ঈশ্বরকে আর দূরে মনে হয় না।
দ্বৈতবাদটি এক অর্থেই একনিষ্ঠতার বিপরীত। যদিও এটি সর্বশক্তিমানের অস্তিত্বের কথা বলে, এটি বৈচিত্রতার ঐক্যকে অনুমোদন করে না এটা সব মানুষ একতা দেখতে না।
দ্বৈতবাদ : শংকর
শংকরের মতে, জ্ঞান দু’প্রকার- পরমার্থিক ও ব্যবহারিক। পরমার্থিক জ্ঞানে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। তাঁর মতে, জীব ও জগত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য- এগুলোর ব্যবহারিক মূল্য থাকলেও কোনো পরমার্থিক মূল্য নেই। ব্রহ্ম ব্যতীত জীব ও জগতের অপর কোনো স্বাধীন সত্তা নেই।
শংকর তাঁর শারীরিক-মীমাংসা ভাষ্যে আত্মা ও অনাত্মার মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করেন। কেবল বাহ্য বস্তু নয়, দেহধারী যাবতীয় বস্তুই অনাত্মা। কিন্তু আত্মা নির্গুণ এবং নিরাবয়ব। নির্গুণ এবং নিরাবয়ব বলেই আত্মা অবিশেষিত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি উপলব্ধির বিষয়। শংকরের মতে, যা বাস্তব তা চৈতন্যস্বরূপ এবং যা চৈতন্যস্বরূপ তা বাস্তব। আত্মার বেলায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অপ্রযোজ্য।
শংকরের শারীরিক-মীমাংসা ভাষ্যে ব্রেহ্মর স্বরূপ আলোচনাও বিশেষ স্থান পেল। তাঁর মতে, ব্রহ্ম নির্গুণ ও নিরাকার। এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই। জীব ও জগত সৃষ্টির পরে ব্রেহ্মর মধ্যে ছিল- এ-কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে, এগুলো ব্রেহ্মর সৎ পরিণাম নয়। এগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি ‘মায়া’ বা ‘অবিদ্যা’ ব্যবহার করেন।
শংকর ব্রহ্ম ও ঈশ্বরের মধ্যে তফাৎ ঘুচিয়েছেন। তাঁর মতে, ব্রেহ্মর প্রকৃত রূপ পরব্রেহ্মই। পরব্রহ্ম নির্গুণ কিন্তু অপরব্রহ্ম (ঈশ্বর) সগুণ। প্রথমটি জ্ঞানের বস্তু, দ্বিতীয়টি উপাস্য বস্তু। প্রকৃতপে অপরব্রহ্ম ব্রেহ্মরই আরেক রূপ- যেটা মানবমনের সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তা ও সংহারকর্তা হিসেবে পরব্রেহ্মর যে ঈশ্বররূপ অভিব্যক্ত রয়েছে তা প্রমাণ করা যায় না।
ঋতং পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে গুহাম্প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্ধে। — কঠোপনিষৎ ৩।১
— শরীরের পরম উৎকৃষ্ট স্থানে গুহামধ্যে দুইজন প্রবিষ্ট হইয়া আছেন, তন্মধ্যে একজন অবশ্যম্ভাবী কর্মফল ভোগ করেন, অপর একজন তাহা প্রদান করেন।
জীবসংজ্ঞোহন্তরাত্মান্যঃ সহজ সর্বদেহিনাম্। যেন বেদয়তে সর্বং সুখং দুঃখঞ্চ জন্মসু।। –মনুসংহিতা, ১২।১৩ –অন্তরাত্মা নামে একটি স্বতন্ত্র আত্মা প্রত্যেক ব্যাক্তির দেহের সঙ্গে জন্মে, তাহাই সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ