।।মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম।।
শ্রী রামচন্দ্র কে "মর্যাদা পুরুষোত্তম" (অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ") বলা হয়। শ্রী রামচন্দ্র সূর্যবংশে (ইক্ষ্বাকু বংশ বা পরবর্তীকালে উক্ত বংশের রাজা রঘুর নামানুসারে রঘুবংশ নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রী রাম সংক্রান্ত বিবরনের প্রধান উৎস ঋষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ।
শ্রী রামচন্দ্র ত্রেতা যুগে আজ থেকে সাড়ে ৯ লক্ষ বছর পূর্বে, চৈত্র মাসে, শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে পুনর্ব্বসু নক্ষত্রে,কর্কট লগ্নে শুভলগ্নে শুভক্ষণে শুভযোগে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁহার জন্মকালে রবি মেষ রাশিতে, মঙ্গল মকর রাশিতে। শনি তুলা রাশিতে, বৃহস্পতি ও চন্দ্র কর্কট রাশিতে এবং শুক্র মীন রাশিতে ছিল।
আদিকান্ড অষ্টাদশ সর্গঃ |
মর্যাদা—পুরুষোত্তম [(অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ")] ভগবান #শ্রীরামচন্দ্র ইক্ষ্বাকুবংশজাত, জনগণ যাঁকে 'রাম' নামে জানেন, (তিনি) সংযতাত্মা, মহাবলবান, কান্তিমান, ধৈর্যশীল এবং জিতেন্দ্রিয়। তিনি (শ্রীরামচন্দ্র) সুবুদ্ধিমান, নীতিজ্ঞ, বাগ্মী, শ্রীমান, শত্রুসংহারক, তাঁর স্কন্ধদেশ সুদৃঢ়, বাহুযুগল দীর্ঘ, শঙ্খের ন্যায় তাঁর গ্রীবাদেশ এবং গণ্ডস্থলের ঊর্ধ্বদিক সুপুষ্ট। শ্রীরামচন্দ্রের বক্ষোদেশ বিশাল বিশাল ধনু তাঁর, তাঁর কণ্ঠাহি মাংস দ্বারা আচ্ছাদিত; তিনি শত্রুদমনকারী, আজানুলম্বিত বাহুদ্বয় তাঁর, সুন্দর মস্তক ও উন্নত ললাট এবং তাঁর গমনাগমন মনোহর বিক্রমশালী শ্রীরামচন্দ্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ সুবিভক্ত, তাঁর গাত্রবর্ণ সুস্নিগ্ধ। তিনি তেজস্বী। তাঁর বক্ষঃস্থল বিশাল এবং নেত্রন্বয় আয়ত। তিনি লক্ষ্মীবান ও শুভলক্ষণযুক্ত। শ্রীরামচন্দ্র ধর্মজ্ঞ, সত্যনিষ্ঠ, প্রজা-কল্যাব্রতী, যশস্বী, জ্ঞানী, পবিত্র, জিতেন্দ্রিয় এবং যোগসমাধিমান পুরুষ। প্রজাপতি ব্রহ্মার ন্যায় বিশ্বের পালক, সর্বৈশ্বর্যসম্পন্ন, শত্রুমর্দনকারী এবং সকল প্রাণীর ও ধর্মের সংরক্ষক। (তিনি) স্বধর্ম এবং স্বজনদের প্রতিপালক, বেদ ও বেদাঙ্গগুলির গূঢ়রহস্যজ্ঞ এবং ধনুর্বিদ্যা বিষয়ে পারদর্শী। (তিনি) সকল শাস্ত্রের অর্থ ও তত্ত্ববিষয়ে জ্ঞানী, প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, প্রতিভাবান, সর্বজনপ্রিয়, সাধু, উদার ও বিচক্ষণ। নদীসমূহ যেমন সমুদ্রে মিলিত হয় তদ্রূপ সাধু সজ্জনগণ সর্বদা তাঁর শরণাগত হন। তিনি সদ্গুণসম্পন্ন, সর্বদাই সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহারসম্পন্ন এবং প্রিয়দর্শন। তিনি সর্বগুঙাম্বিত হয়ে মাতা কৌশল্যার আনন্দবর্ধনকারী। গাম্ভীর্যে তিনি সমুদ্রের মতো এবং হিমালয়ের মতো ধৈর্যশীল।(শ্রীরামচন্দ্র) ভগবান বিষ্ণুর মতো বীর্যবান, চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধদর্শন। ক্রুদ্ধ হলে তিনি প্রলয়াগ্নির মতো (ভয়ঙ্কর) আবার ধরিত্রী মাতার ন্যায় তিনি ক্ষমাশীল। মহান ত্যাগী হলেও তাঁর ধন কুবেরের মতো অক্ষয় এবং সত্যপালনে তিনি দ্বিতীয় ধর্মের ন্যায়।
সূর্য বংশের বংশলতা
ব্ৰহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচি পুত্র কশ্যপ, কশ্যপের পুত্র বিবস্বান্ (সূর্য) তাহা হতে বৈবস্বত মনুর জন্ম হয়। বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু পর তার পুত্র
কুকশী বা ভিখুকশী
পুরণজয় বা কাকুৎস্থা
আনিনা বা আনরণ্য
পৃথু
ভীশ্বাগাশ্ব
অর্দ বা চন্দ্র
যুবনাশ্ব
শ্রাভাস্ত
বৃহদাশ্ব
যুবনাশ্ব(২)
মান্ধাতা বা মান্ধাত্রী
পুরুকুৎস(১)
কুভালশ্বর বা ধুন্দুমারা
দ্রিধাশ্ব
প্রমোদ
হরিশ্ব(১)
নিকুম্ভ
শান্তশ্ব
কৃষাশ্ব
প্রসেনজিৎ
এসাদাস্যু
সম্বুত
অনরণ্য(২)
এাসদাশ্ব
হরিয়াশ্বর(২)
ভাসুমন
এিধান্য
এায়ারুনা
সত্যব্রত বা ত্রিশঙ্কু
হরিশচন্দ্র
রোহিতাশ্ব
হরিৎ
চেঞ্চু
বিজয়
রুসক
ভৃকা
বাহু বা অসিত
সাগর
আসামানজশ (পঞ্চল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন)
অংশুমান
দিলিপ(১)
ভগীরথ
শ্রুত
নভগা
অশ্বরীশ
সিন্ধুদ্বীপ
প্রত্যয়ু
শ্রুতপর্ন
সর্বকাম
সুদান(কুরু বংশের প্রতিষ্ঠাতা)
মিত্রাশাহ
সর্বকাম(২)
অনরণ্য(৩)
নিঘ্না
অনিমিত্র
দুলিদুহ
দিলিপ(২)
রঘু(২)
অজ
দশরথ
রামচন্দ্র
(ছবিঃসূর্য ও চন্দ্র বংশ পুস্তক) |
১। বালকাণ্ড
২। অযোধ্যাকাণ্ড
৩। অরণ্যকাণ্ড
৪। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড
৫। সুন্দরকাণ্ড
৬। যুদ্ধকাণ্ড এবং
৭। উত্তরকাণ্ড।
এ প্রসঙ্গে রাজশেখর বসু, যিনি বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণকে বাংলায় গদ্যে অনুবাদ করেছেন, তিনিতার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,
“বর্তমান বাল্মীকি রামায়ণের কতক অংশ পরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন উত্তরকাণ্ড। যুদ্ধকাণ্ডের শেষে রামায়ণ মাহাত্ম্য আছে, তাতেই প্রমান হয় যে মূল গ্রন্থ সেখানেই সমাপ্ত।”
এই উত্তরকাণ্ডেই আছে সীতার বনবাস এবং পরে যখন রাম আবার সীতাকে নিতে চায় তখন সবার প্রতি অভিমানে সীতার ভূগর্ভে প্রবেশ; এই বিষয়গুলোকে সত্য বলে মনে হয় না এই কারণে যে, একবার সীতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে রাম তাকে গ্রহন করেছিলেন, তাহলে পরে আবার কেনো রাম, সীতাকে বনবাস দেবেন ? রাম চরিত্রের এই দ্বিচারিতাই প্রমান করে, রামায়ণের উত্তরকাণ্ড, বাল্মীকি কর্তৃক রচিত নয়, পরে এগুলো কেউ রচনা করে বাল্মীকির মূল রামায়ণের সাথে জুড়ে দিয়েছে এবং তখন থেকে চলছে বাল্মীকির নামে সাত কাণ্ড রামায়ণ। উত্তরকাণ্ড যে পরে রচিত, এমন কি সেটা মহাভারতেরও পরে, তার প্রমান আছে মহাভারতেই; কারণ, মহাভারতে যে রাম উপাখ্যান আছে, তারও কাহিনী, রামের সীতা উদ্ধার পর্যন্তই শেষ। সুতরাং যুদ্ধ শেষে অযোধ্যায় ফেরার পর সীতার প্রতি রামের সন্দেহ এবং সীতার বনবাস পরবর্তী কাহিনী, যার জন্য রামকে অনেকেইঅভিযুক্ত করে এবং তার সমালোচনা করে, সেটা সত্য নয় বলেই প্রমাণিত হয়।
যা হোক, সংস্কৃত থেকে বাংলা গদ্যে অনুবাদ করা সময় কৃত্তিবাস ওঝা, রামায়ণের কী কী সর্বনাশ করেছেন এবার সেদিকে নজর দেওয়া যাক :
কৃত্তিবাস, রামায়ণ অনুবাদ করার সময় মূল রামায়ণ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে যা খুশি তাই রামায়নের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হিন্দু সমাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। অহিরাবণ মহীরাবনের পাতালের ঘটনা, বীরবাহুর বীরত্ব ও যুদ্ধ, তরণীসেনের কাহিনী, রামের অকাল বোধন, হনুমান কর্তৃক রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ, সীতার রাবণমূর্তি অঙ্কন, মৃত্যুপথযাত্রী রাবণের কাছে রামের শিক্ষা, লব ও কুশের যুদ্ধ সব কৃত্তিবাসের বানানো, এগুলোর একটিও সংস্কৃত রামায়ণে নেই। এভাবে কৃত্তিবাসের রাম, ত্রেতাযুগের কোনো ত্রাতা নয়, বিষ্ণুর কোনো অবতার নয়, এক পিতৃপরায়ণ সন্তান ও স্নেহপরায়ণ পিতা এবং একই সঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত ও সন্দেহে পর্যুদস্ত এক স্বামী । এ থেকে খুব সহজেই উপলবব্ধি করা যায় যে, কৃত্তিবাস- রামায়ণ অনুবাদ কালে বাল্মীকির প্রধান প্রধান কয়েকটি আখ্যান ও উপাখ্যান গ্রহণ করলেও সেগুলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রচনার শুরু থেকেই অগাধ স্বাধীনতা নিয়েছে এবং নিজের প্রয়োজনে বাল্মীকি থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিজের ইচ্ছা মতো যা খুশি তাই লিখেছেন। কৃত্তিবাসের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবকে বুঝতে পেরেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন,
‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’
যদিও এই কথাটি বলেছিলেন, নারদ, বাল্মীকিকে; কারণ, রাম-রাবনের যুদ্ধ শেষ হলে নারদ এই ইতিহাসটি বাল্মীকিকে রচনা করার জন্য অনুরোধ জানালে, বাল্মীকি বলেছিলেন, আমি তো সবটা জানি না, যদিও তার নাম এবং তার কীর্তিকাহিনী শুনেছি, কিন্তু সবটা না জেনে লিখে যদি সত্যভ্রষ্ট হই ? সেই ভয় আমার আছে, তখন নারদ বাল্মীকিকে বলেছিলেন,
‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,….’
এই একই কথা কৃত্তিবাস সম্পর্কেও সত্য।
এর মাধ্যমে এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, রত্নাকর দস্যুর বাল্মীকি হয়ে উঠার কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা; কারণ, বাল্মীকিকে নারদ যখন রামের ইতিহাস লিখতে বলেন, তখন বাল্মীকি বলেন, “আমি রামের নাম এবং তার কীর্তিকথা শুনেছি, কিন্তু সবটা জানি না”, রত্নাকর দস্যু যদি রাম নাম জপ করে বাল্মীকি মুনিতে পরিণত হতেন, তাহলে কি তিনি এই কথা বলতে পারতেন ?
কৃত্তিবাস তো নিজের ইচ্ছামতো রামায়ণকে অনুবাদ করে যা তা কাহিনী ঢুকিয়েছেই, কিন্তু কৃত্তিবাস যেখানে মূল রামায়ণের কাহিনীকেই অনুসরণ করেছেন, সেখানেও তিনি কিভাবে রামায়ণকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন, তার একটি উদাহরণ দেখুন নিচে-
সংস্কৃত রামায়ণে, সীতাকে যখন রাবন ধরে নিয়ে যায়; তখন সীতা, রাবনের সাথে ভয়ংকরভাবে সাহসের সাথে তর্ক বিতর্ক করে। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে ঐ সময়ে সীতা একজন ভীরু ও দুর্বল মহিলা। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামের চরিত্রও দুর্বল করে দেখানো হয়েছে এবং তাকে নপুংসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কেননা, কৃত্তিবাসী রামায়ণে, রামের চরিত্র নিয়ে এই প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে, রাম-সীতা বনে ১২ বছর এক সাথে থাকার পরেও কেনো সীতা গর্ভবতী হলো না ? কিন্তু সংস্কৃত রামায়ণের এই তথ্যকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে যে, বনবাসে যাওয়ার আগেই রাম সীতা প্রতিজ্ঞা করেছিলো, বনে গিয়ে তারা কোনো ভোগ-বিলাসে মত্ত হবে না; তারা বনবাসকালীন ব্রহ্মচর্য পালন করবে। তো যারা ব্রহ্মচর্য পালন করবে, তাদের সন্তান হবে কিভাবে ?
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। কিন্তু তিনি এই কাব্য লিখেছিলেন হিন্দু সমাজ ও রামের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, রাবন ও মেঘনাদের প্রতি ভালোবাসা থেকে; কারণ, তার কাছে রাবন ও মেঘনাদ ছিলো হিরো এবং রাম-লক্ষ্মণ ছিলেন ভিলেন; তাই রাম লক্ষ্মণের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি রচনা করেন মেঘনাদবধ কাব্য।মাইকেলের এই যে ভুল বুঝে ভিলেন কে নায়ক আর নায়ককে ভিলেন ভাবা বা বানানো, এর কারণও কৃত্তিবাস।
ঘটনাটি এরকম : মাইকেল তখন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করে বাড়ি তথা কোলকাতা থেকে বিতাড়িত, খ্রিষ্টান পাদ্রীদের প্রতারণায় তখন তার ইংল্যান্ড যাওয়াও হয় নি; এখানে উল্লেখ্য যে, মাইকেলের খ্রিষ্টান হওয়ার মূল কারণই ছিলো ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়া বা পাঠানোর শর্ত। কারণ, মাইকেলের বাপের সামর্থ্য থাকলেও, মাইকেল বিদেশে গেলেই কোনো ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করবে, এই ভয়ে তার বাপ তাকে বিদেশ পাঠাতে রাজী ছিলো না; কিন্তু মাইকেলের আজীবনের লালিত স্বপ্ন সে ইংল্যান্ড যাবে এবং ইংরেজিতে কাব্য চর্চা করে সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হবে; এই জন্যই মাইকেল খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে, যার মূল শর্তই ছিলো তাকে ইংল্যাল্ড পাঠাতে হবে; কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার পর পাদ্রীদের সেই ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ ছিলো না; শেষ পর্যন্ত মাইকেল গিয়ে স্থিতু হয় গুজরাটে এবং সেখানে অন্য এক পাদ্রীর মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করার এবং ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চার চেষ্টা করে।
এই চেষ্টারই ফল স্বরূপ মাইকেল ইংরেজিতে রচনা করে ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ এবং আরো কিছু সনেট। কিন্তু সেগুলোর সমালোচনা করতে গিয়ে ইংরেজরা যখন বলে, মাইকেলের মতো লোকেদের উচিত মাতৃভাষায় কাব্য রচনা করা, তখন ইংরেজিতে কাব্য চর্চা করে কিছু করা যাবে না মনে করে মাইকেল বাংলার দিকে মন দেয় এবং কোলকাতায় থাকা তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখে কিছু বাংলা বই পাঠাতে বলে; তখন বাংলা সাহিত্যের তেমন বইও ছিলো না; কারণ, তখন না ছিলো রবীন্দ্রনাথ, না ছিলো বঙ্কিম; তাই বই বলতে মধ্যযুগে অনুবাদ করা কিছু বই এবং মঙ্গলকাব্য। সেজন্য কোলকাতার সেই বন্ধু যেসব বই তাকে পাঠিয়েছিলো, তার মধ্যে একটি ছিলো এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং এই কৃত্তিবাসী রামায়ণের সকল কথা বিশ্বাস ক’রে অন্য সকল হিন্দুর মতো মাইকেলও হয়েছিলো বিভ্রান্ত; তাই বই পাঠানোর পরে, সেই বন্ধুকে মাইকেল চিঠি লিখে জানিয়েছিলো, লক্ষ্মণ যেভাবে কাপুরুষের মতো বিভীষণের সহায়তায় আড়াল থেক তীর মেরে মেঘনাদকে হত্যা করেছে, এর প্রতিশোধ আমি নেবো; আমি এই ঘটনা নিয়ে একটি মহাকাব্য লিখবো।
সেই মহাকাব্যই হলো মেঘনাদবধ কাব্য, এটা এক দিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র সার্থক মহাকাব্য; এছাড়াও এটির মাধ্যমে রাম লক্ষ্মণের চরিত্রকে খাটো করে হিন্দু সমাজকে দমন করা যায় ব’লে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে বাংলা বিভাগে পড়ানোর জন্য মুসলমানদের কাছে এটি একটি পছন্দের কাব্য, যেমন পছন্দের কাব্য বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য; কারণ, এর মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের প্রধা্ন পুরুষ কৃষ্ণকে লম্পট হিসেবে প্রমান করা যায়।
যা হোক, মাইকেলের কেনো এত রাগ ছিলো লক্ষ্মণের উপর, যে কারণে ভিলেন রাবন এবং তার ছেলে মেঘনাদ তথা ইন্দ্রজিৎ তার কাছে হয়ে উঠলো হিরো এবং রাম লক্ষ্মণ তার কাছে হয়ে গেলোভিলেন ?
কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়ে, বাংলাদেশের নাস্তিকজগতের একটি বিখ্যাত নাম এবং নাস্তিকদের গুরু আরজ আলী মাতুব্বর, তার একটি লেখা ‘রাবনের প্রতিভা’য় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, রাম ছিলো সন্তান জন্ম দানে অক্ষম, কারণ বনবাসে এক সাথে ১২ বছর থাকলেও সীতার গর্ভে রাম কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে নি; কিন্তু সীতাকে উদ্ধার করে আনার পর অগ্নিপরীক্ষা, যাকে আরজ আলী বিবেচনা করেছে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ হিসেবে, যাতে সীতা কিছুতেই স্বীকার করে নি যে রাবন তার সাথে কী করেছে, সেই অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে সীতা নিজেকে নিষ্কলঙ্ক প্রমান করলেও পরে যখন সীতার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন রাম প্রকৃত সত্য অর্থাৎ সীতার গর্ভের সন্তান যে রাবনের ই এটা বুঝতে পেরে সীতাকে আবার বনবাসে পাঠায়।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, সীতাকে উদ্ধার করে আনার পর প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে, রাম এই ফাঁকে রাজ্যটাকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তখনও সীতার গর্ভের লক্ষ্মণের কোনো খবর নেই, রাবন যদি সীতার সন্তানের পিতা হতো, তাহলে অযোধ্যায় ফেরার পর পরই তা অবশ্যই প্রকাশ পেয়ে যেতো। কিন্তু রাম, জনরবকে পাত্তা দিয়ে সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে পৌঁছার পর সীতা যখন বুঝতে পারে যে তাকে বনবাস দেওয়া হয়েছে, তখন সীতা লক্ষ্মণকে বলে, তোমার ভাই আমাকে মিথ্যা সন্দেহে ত্যাগ করলেও তুমি জেনে যাও যে আমি সবে মাত্র গর্ভ ধারণ করেছি। কিনতু কৃত্তিবাসী রামায়ণে এই ছোটখাটো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয় নি, যাতে সূক্ষ্ম ঘটনাগুলো ধরা পরে; যেমন- উল্লেখ করা হয় নি, প্রথম বার বনবাসের পূর্বেই রাম সীতা প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, তারা বনবাসে গিয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত হবে না, আর ভোগ বিলাসে মত্ত না হলে সন্তান হবে কিভাবে ? যে কথা উপরে একবার উল্লেখ করেছি। এই ভাবে কৃত্তিবাসী রামায়ণ যে কাউকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম, এই ভাবেই বিভ্রান্ত হয়েছিলো মাইকেল এবং সম্ভবত নিচের এই ঘটনাটা না জেনে-
কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাবে অনেকেই মনে করে লক্ষ্মণ, মেঘনাদকে বিনা যুদ্ধে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। অর্থাৎ এটাকে তারা ছলনা বলেই মনে করে। কিন্তু তারও আগে মেঘনাদ যে ছলনা করে রাম-লক্ষ্মণকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো, এটা অনেকেই জানে না বা বলা যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ তাদেরকে তা জানতে দেয় নি।
ঘটনাটি এরকম: মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ স্বয়ং যুদ্ধে নেমেও যখন কিছুতেই রাম লক্ষ্মণকে পরাস্ত করতে পারছিলো না, তখন সে একটি ছল করে; একদিন একটি মায়াসীতা তৈরি করে তার রথের উপর নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসে এবং এবং রাম লক্ষ্মণকে বলে, এই সীতাকে উদ্ধারের জন্যই তো তোমরা লংকায় যুদ্ধ করতে এসেছো ? এখন দেখো, একে আমি কিভাবে হত্যা করি? বলেই সে নির্মম প্রহারে সীতাকে হত্যা করে, এটা দেখেই রাম লক্ষ্মণ মূর্ছিত হয়ে পড়ে যায়। তারপর কোনোরকমে হনুমান, সুগ্রীব তাদেরকে সেভ করে শিবিরে নিয়ে আসে। পরে শিবিরে এসে বিভীষণ যখন রাম লক্ষ্মণের মূর্ছিত হওয়ার কারণ জানতে পারে, তখন তাদেরকে বলে যে, মেঘনাদ যাকে হত্যা করেছে সেটা আসল সীতা নয়, একটা নকল সীতা; কারণ, রাবন কিছুতেই মেঘনাদকে এই কাজ করতে দিতে পারে না।
ইন্দ্রজিতের এই ছলের বিপরীতেই বিভীষণ এবং লক্ষ্মণ আরেক ছলের পরিকল্পনা করে এবং তাতেই ইন্দ্রজিৎ মারা যায়। তো এখানে দোষ কী ? ছলের ফল তো ছল ই হয়।
কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণের এই সব ভুল ভাল তথ্যের বিরুদ্ধ সেই সময় কথা বলার কোনো লোক ছিলো না, কারণ সংস্কৃত জ্ঞানের অভাবে কেউ আসল সত্য সম্পর্কে অবগত ছিলো না। একই ঘটনা ঘটেছে মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশের পরেও, সঠিক জ্ঞানের অভাবে কেউ এর প্রতিবাদ করতে পারে নি।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাবে, আরজ আলী এটা মনে করতো যে, রামের চেয়ে রাবনের প্রতিভা বেশি, কেননা রাবন সেই সময় তার চলাচলের জন্য পুষ্পক রথ বানিয়েছিলেন, যাতে করে সে সীতাকে অপহরণ ক’রে সমুদ্র পারি দিয়ে তাকে লংকায় নিয়ে গিয়েছিললো; কিন্তু আরজ আলীর মতে, রামের এমন কোন বিমান ছিলো না, তাই তাকে সকলের সহায়তায় সমুদ্রের উপর সেতু নির্মান করে লংকায় যেতে হয়। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ এই তথ্য দেয় নি যে, রাবন যে পুষ্পক রথ ব্যবহার করতো, সেটা তার নিজের বানানো ছিলো না, ব্রহ্মা এই রথটি দিয়েছিলো কুবেরকে, কুবেরের কাছ থেকে রাবন তা ছিনতাই করে, যদিও কুবের ছিলো রাবনের সৎ ভাই।
এই ভাবে কৃত্তিবাস, রামায়ণের বহু সত্যকে চেপে গিয়ে বা কোথাও বিকৃত করে এক রামায়ণের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের ১২টা বাজিয়ে দিয়ে গেছে।
রামায়ণের পুষ্পক রথ অর্থাৎ বিমান থেকে কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে, হিন্দুরাই প্রথম বিমান আবিষ্কার করেছিলো বা হিন্দু ধর্মের তত্ত্ব বা প্রযুক্তিরই বাস্তব রূপায়ন আজকের বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা।
যা হোক, কৃত্তিবাস- রামায়ণ নিয়ে যে ছেলে খেলা খেলেছে, এটার পেছনে মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের ছিলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন। কারণ, মধ্যযুগের মুসলিম শাসকরা চায় নি যে, হিন্দুধর্ম, হিন্দুদের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হোক। তাই মধ্যযুগে শুধু অনুবাদ করা কাব্যেরই বিকৃতি নয়, নতুন নতুন পুরাণ এবং উপনিষদও লেখা হয়েছে এবং করা হয়েছিলো বেদেরও বিকৃতি। এসবই ছিলো হিন্দুধর্মকে হিন্দুদের কাছে বিকৃতভাবে উপস্থাপন ক’রে, প্রকৃত হিন্দুত্বের রূপ হিন্দুদেরকে বুঝতে না দিয়ে, হিন্দুধর্ম ও কালচারকে ধ্বংস করার মধ্যযুগীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হলো, সেই ষড়যন্ত্র এখনও চলমান এবং তা হিন্দুদের মাধ্যমেই।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে ছিলো এবং এখনও আছে- বহু জাতি এবং তাদের বহু ভাষা, কিন্তু তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ছিলো এক এবং তা ছিলো সনাতন এবং সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থগুলো লিখিত ছিলো এবং আছে সংস্কৃত ভাষায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জন, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় সনাতন ধর্মের এই গ্রন্থগুলোকে অনুবাদ করে; এভাবে অনুবাদ করার সময় সবার হাতেই প্রত্যেকটা গ্রন্থ কিছু না কিছু বিকৃত হয়েছেই, তাই ধর্ম এক হলেও ভারতের বিভিন্ন এলাকার কালচারে কিছু না কিছু ভিন্নতা আছেই; যেমন- কৃত্তিবাস, তার বাংলা রামায়ণে দুর্গা পূজার কথা উল্লেখ করেছিলো বলেই বাংলায় দুর্গা পূজা প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু ভারতের আর অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রামায়ণ প্রচলিত থাকলেও দুর্গা পূজা প্রচলিত নেই, কারন আর কিছুই নয়, সেই সব এলাকায় যে বা যারা রামায়ণ অনুবাদ করেছে, তারা তার মধ্যে দুর্গা পূজার উল্লেখ করে নি বা হয়তো অন্য কোনো পূজার উল্লেখ করেছে, যার মাধ্যমে ঐ এলাকায় সেই ধরণের উৎসব চালু হয়ে গেছে। একারণেই সম্ভবত ভারতের একেক এলাকায়, একেক ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রাধান্য।
মধ্যযুগে যারা সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ অনুবাদ করেছে তারা যে তাদের ইচ্ছামতো যা খুশি তা অনুবাদ করেছে, সেটা তো কৃত্তিবাসের কীর্তি দেখে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছেন। কিন্তু এই সময়ে এসেও কেউ যদি প্রকৃত সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাদের উদ্দেশ্যকে আপনি কীবলবেন ? নিশ্চয়, হিন্দু ধর্মকে ধ্বংস করার নতুন ষড়যন্ত্র ? হ্যাঁ, এই কাজটিই করা শুরু করেছে ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস।
গীতা প্রেস শুধু গীতা ই ছাপায় না, এরা প্রায় সব হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ, ভারতের প্রায় সব প্রধান ভাষায় ছাপিয়ে বিজনেস করে। এভাবে এরা বাংলা রামায়ণও সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করে ছাপিয়ে বিক্রি করছে, কিন্তু সর্বনাশটা যেখানে করছে, তা হলো, তাদের ছাপানো গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের নিজস্ব বিশ্বাসকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার অপচেষ্টা করছে।
আমি যদি মাছ মাংস অর্থাৎ আমিষ খাই, সেটা যেমন আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার; তেমনি আমি যদি নিরামিষ খাই, সেটাও আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি যখনশাস্ত্রের কথা বলবো, তখন শাস্ত্রে যেটা লিখা আছে, সেটাই আমাকে বলতে হবে; সেখানে আমি যদি আমার মতামত বা ইচ্ছাকে কৌশলে শাস্ত্রের মধ্যে দিয় প্রকাশ বা প্রমান করার চেষ্টা করি, সেটাকে আপনার কী বলবেন ? নিশ্চয় অপরাধ ? সেই অপরাধই করে চলেছে গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস।
বাল্মীকি রামায়ণে বেশ কয়েক জায়গায় স্পষ্ট করে লিখা আছে যে, বনবাস কালে রাম সীতা লক্ষ্মণ বিভিন্ন প্রাণী হত্যা করে তার মাংস খেতো। কিন্তু গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস যেহেতু চালায় একটি নিরামিষ ভোজী গোষ্ঠী অর্থাৎ তৃণভোজীরা, সেহেতু তারা ঐ সব শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করা সময় টীকা হিসেবে লিখে দিয়েছে যে, এসব জায়গায় অমুক অমুক গাছের মূল বা ফল বুঝতে হবে। এর কারণ, তারা যেহেতু হিন্দু ধর্মের প্রকৃত সত্য না জেনে বিভ্রান্ত হয়ে নিরামিষ ভোজী, তারাও চায় সবাই তাদের মতো নিরামিষ ভোজী হোক; তাই তাদের মতে, রাম সীতার পক্ষে মাংস খাওয়া- ইন ওয়ান ওয়ার্ড- অসম্ভব।
আগের কয়েকটি পোস্টেও আমি এই কথা বলেছি যে, বনবাস কালে রাম সীতা বিভিন্ন প্রাণীর মাংস ভোজন করতেন; এটাও তথ্য প্রমান এবং উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে, সীতা যে হরিণ শিকারের জন্য রামকে পাঠায়, যে সময় সে রাবন কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলো, সেটা তারা খাওয়ার জন্যই শিকার করতে চেয়েছিলো; কারণ, হরিণ ধরে পোষার শখ করার মতো অবস্থা সেই সময় সীতার ছিলো না। কিন্তু সীতার হরিণ ধরতে চাওয়ার কারণ তো পাবলিককে নিরামিষ আকারে বোঝাতে হবে যে কেনো সীতা, রামকে হরিণ ধরতে পাঠিয়েছিলো ? তাই কৌশলে সেই মায়া হরিণকে সোনার হরিণ বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সোনার হরিণ বলে যে বাস্তবে কিছু হয় না, সেটা আমাদের বাঙ্গালি হিন্দুদের মাথায় গত ৫/৬ শ বছরেও ধরা পড়ে নি, আমি বলার আগে।
যা হোক, এবার দেখে নিন, সংস্কৃত রামায়ণের কোথায় কোথায় রাম সীতার মাংস ভোজনের কথা আছে:
অযোধ্যাকাণ্ডের ১৪ নং উপাখ্যান (শৃঙ্গবেরপুর- নিষাদরাজ গৃহ) সর্গ : ৪৯-৫২ তে এক জায়গায় রাম তার পিতার প্রধানমন্ত্রী সুমন্ত্র, যে রামকে বনে ছাড়তে গিয়েছিলো, তাকে বলছে,
“আবার আমি কবে পিতা মাতার সঙ্গে মিলিত হয়ে সরযুতটের পুষ্পিত বনে মৃগয়া করবো ?” (ফটোপোস্টে যুক্ত পুস্তকের পৃষ্ঠা ১০৬)
যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি- মৃগয়া মানে শিকার করা, আর এই শব্দটি এসেছে মৃগ থেকে যার অর্থ হরিণ। প্রাচীন কালের রাজারা শুধু হরিণকেই শিকার করতো, তাই হরিণের প্রতিশব্দ মৃগ থেকে মৃগয়া শব্দের উৎপত্তি। আর রাজারা অন্যান্য হিংস্র প্রাণী বীরত্ব দেখানোর জন্য শিকার করলেও তৃণভোজী প্রাণী কিন্তু শিকার করতো শুধু মাত্র ভোজনের উদ্দেশ্যে। তাহলে রামের মৃগয়া করার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ? না পারলেও একটু পরেই সেটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। কা্রণ, এই উপাখ্যানেরই শেষের দিকে, উল্লিখিত পুস্তকের পৃষ্ঠা ১০৯ তে, সীতা গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করে বলছে, আমরা যদি ঠিক ঠাক মতো বনবাস শেষ করে রাজ্যে ফিরে যেতে পারি, তাহলে, “তোমাকে সহস্র ঘট সূরা এবং মাংসযুক্ত অন্নের ভোগ দেবো।”
যে মাংস খায় না, তার পক্ষে কি মাংসের ভোগ দেওয়া সম্ভব ?
এই পৃষ্ঠাতেই এই উপাখ্যানের একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে বলা আছে,
“কিছুকক্ষণ পর তারা সমৃদ্ধ শস্যসম্পন্ন বৎস্যদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে রাম লক্ষ্মণ- বরাহ (শুকর), ঋষ্য, পৃষত (কৃষ্ণসার হরিণ) এবং মহারুরু (শম্বর, এটা আমার অচেনা) এই চার প্রকার পশু বধ করে, তাদের পবিত্র মাংস নিয়ে ক্ষুধিত হয়ে সায়ংকালে বাসের নিমিত্তে বনে প্রবেশ করলেন।”
রাম-লক্ষ্মণ-সীতা যদি মাংসই না খায়, তাহলে তারা এই পশুগুলো হত্যা করলো কেনো ?
এরপর অযোধ্যাকাণ্ডের ১৫ নং উপাখ্যান, উক্ত পুস্তকের পৃষ্ঠা নং ১১১ তে বলা আছে, “এক ক্রোশ গিয়ে দুই ভ্রাতা বহু প্রকার পবিত্র মৃগ বধ করে এনে যমুনা তীরস্থ বনে ভোজন করলেন।”
এবং পৃষ্ঠা ১১২ তে বলা আছে- রাম, লক্ষ্মণকে বলছে,
“অতএব তুমি মৃগ বধ কর নিয়ে এসো। লক্ষ্মণ পবিত্র মৃগ বধ করে এনে তার মাংস অগ্নিপক্ব ও শোনিত শূন্য করে রামকে দিলেন।”
শুধু যে রাম লক্ষ্মণ সীতা ই মাংস খেতো, তাই নয়, খেতো ভরতও, তার প্রমান আছে, পৃষ্ঠা ১২৯ এ; সেখানে, রামের সাথে দেখা করে তাকে রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ভরত বনের মধ্যে এলে, গুহ নামক একব্যক্তির জনপদের কাছে ভরত শিবির ফেলে বিশ্রামের জন্য, খবর এবং পরিচয় পেয়ে সেই গুহ, মৎস্য-মাংস-মধু উপহার নিয়ে ভরতের সাথ দেখা করতে যায়।
সেগুলো যদি না খাওয়া হয়, তাহলে সেগুলো উপহার নিয়ে যাবে কেনো ?
গুহ এর ওখান থেকে ভরত যায় ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে, সেখান ভরতের সাথের সকল সৈন্যসামন্তকে বলা হয়, “সূরাপায়িগন সূরা পান করো, বুভূক্ষিতগণ পায়স ও সুসংস্কৃত মাংস যা ইচ্ছা হয় খাও”(পৃষ্ঠা-১৩২)।অনেক কিছুর সাথে এখানে ভরতের লোকজনের আপ্যায়ণের জন্য ছিলো- ছাগ ও বরাহের মাংস, মৃগ, ময়ূর ও কুক্কুটের(মুরগী) মাংস (পৃষ্ঠা-১৩৩)। এই তথ্যেএখানে পরিষ্কার যে, সেকালে ঋষিরাও মাংস খেতো, কেউ নিরামিষ ভোজী ছিলো না।
এরপর অরণ্যকাণ্ডের ১১ নং উপাখ্যান “মায়া মৃগ ও মারীচ বধ”, যে উপাখ্যানের ঘটনায় একটি সুন্দর হরিণ দেখে সীতা রামকে সেই হরিণ ধরে আনার জন্য বলেছিলো, সেই হরিণ ছিলো আসলেই একটি মায়া হরিণ, কিন্তু প্রচলিত ধারণা মতো সোনার হরিণ নয়, রামকে বিভ্রান্ত করার জন্য মারীচ এই হরিণের রূপ ধরেছিলো। যা হোক, এই উপাখ্যানের শেষে বলা আছে, শেষ পর্যন্ত সেই মায়া হরিণকে না পেয়ে “রাম অন্য মৃগ বধ করে মাংস নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন (পৃষ্ঠা-১৭৮)।”
রাম সীতা যদি মাংসই না খায়, তাহলে রাম, সীতার সেই পছন্দের হরিণকে ধরতে না পেরে অন্য হরিণ বধ করলো কেনো ?
শুধু তাই নয়, রাবন যখন সীতাকে অপহরণ করতে ছদ্মবেশে গেছে, তখন রাবনকে সীতা চিনতে না পেরে বলছে,
“আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমার স্বামী শীঘ্রই রুরু (হরিণ), গোধা (গোসাপ) বরাহ প্রভূতি পশু বধ করে নিয়ে আসবেন।”(পৃষ্ঠা-১৮২)
রাম সীতা যদি মাংসই না খায় তাহলে রাম এই পশুগুলো শিকার করবে কেনো এবং কেনো সীতা, একজন অতিথিকে মাংস খাওয়ানোর লোভ দেখাচ্ছে ?
এরপর সুন্দরকাণ্ডের ৭ নং উপাখ্যান, ‘সীতা হনুমান সংবাদ’ এ, হনুমান, সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে রামের কী অবস্থা সেটা তাকে বোঝানোর জন্য বলছে, “তিনি মাংস খান না, মদ্য পান করেন না, কেবল বিহিত বন্য ফলমুল খান।” (পৃষ্ঠা-২৭৭)
সীতার শোকে রাম যে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সেই কথা ই হনুমান এখানে সীতাকে বোঝাচ্ছে।
আশা করছি, রাম- সীতা যে নিরামিষভোজী ছিলো না, সেই বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তারপরও যদি গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস এর লোকজনের মতো আপনার এই ধারণা থাকে যে, না, রাম সীতার পক্ষে মাংস খাওয়া অসম্ভব। তাহলে রাজশেখর বসুর অনুবাদ করা এই রামায়ণটি আপনাকে কালেক্ট করে পড়তে হবে। কেউ কেউ এই প্রশ্নও তুলতে পারেন যে, রাজশেখর বসুই যে রামায়ণের সঠিক অনুবাদ করেছে, তার নিশ্চয়তা কী ? তাহলে তো আপনাকে এটা পড়তেই হবে। কারণ, পড়ার পরই আপনি বুঝতে পারবেন, অনুবাদ কী এবং অনুবাদ করা কাকে বলে ?
এবার কৃত্তিবাসী রামায়ণের কিছু মজার গল্প আপনাদের শোনাই :
“রামের লঙ্কা অভিযানের সময়, রাবনের মানসপুত্র অহিরাবনছিলো পাতাল পতি এবং অহিরাবনের পুত্রের নাম মহীরাবন। রাম যখন রাবনের সৈন্যদের মেরে ছারখার করছিলো, তখন উপায় না দেখে রাবন তার অনুগত, অহিরাবন ও মহীরাবনকে তলব ক’রে রাম লক্ষ্মনকে হত্যার নির্দেশ দেয়। অহিরাবন তার মন্ত্রের শক্তি দ্বারা পাতাল থেকে রামের শিবিরে রামের ঘর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং মন্ত্রের শক্তিতে রাম লক্ষ্মণ ক’রে অজ্ঞান করে পাতালে নিয়ে যায়। হনুমান যখন বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে অপহরণ করা হয়েছে, তখন সেই সুড়ঙ্গ পথেই হনুমান পাতালে নেমে মহিরাবনের মন্দিরে চলে যায় এবং সেখানে রাম লক্ষ্মণকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পেয়ে দেবী পাতাল ভৈরবীর মূর্তির পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এরপর মহিরাবন সেখানে আসে এবং রাম লক্ষ্মণকে দেবীর কাছে বলি হওয়ার আদেশ দিয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রাখতে বললে- রাম বলে,
“আমরা তো রাজপুত্র, কোনোদিন কাউকে প্রণাম করি নি, সবাই আমাদেরকেই প্রণাম করতো, তাই কিভাবে প্রণাম করতে হয় সেটা আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দাও।”
শুনে মহিরাবন বলে, “এই কথা, দাঁড়াও শিখিয়ে দিচ্ছি,” এই ব’লে মহিরাবন যেই প্রণামের ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রেখেছে, অমনি হনুমান মূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে হাড়িকাঠের শিক আটকে দিয়ে এক কোপে মহিরাবনের গলা কেটে ফেলেছে। মহিরাবন শেষ।
এরপর অহিরাবন সহ অন্যান্যরা এলে তাদেরকেও রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমান মেরে সাফ করে দেয়। এরপর কৃত্তিবাস মৎস্য কন্যা বলে হনুমানের এক স্ত্রীর এবং মকরধ্বজ নামে এক পুত্রের আবির্ভাব ঘটায়, যে পুত্রের হাতে পাতাল শাসনের ভার দিয়ে রাম-লক্ষ্মন-হনুমান ফিরে আসে; এখানে রামের মুখে বলানো-“আমরা তো রাজপুত্র, কোনোদিন কাউকে প্রণাম করি নি, সবাই আমাদেরকেই প্রণাম করতো, তাই কিভাবে প্রণাম করতে হয় সেটা আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দাও”- এটা পড়ার পর আমার মনে হলো, এ্যাডাল্ট সিনেমাগুলোতে যেমন সতর্কবাণী থাকে যে প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচের কারো দেখা নিষেধ, তেমনি কৃত্তিবাসের রামায়ণের উপর লিখে দেওয়া দরকার যে,
“ছোটদের রামায়ণ, ১০ বছরের উর্ধ্বের কেউ পড়বেন না।”
কারণ, কেচ্ছার মতো ঐ গল্প বড়দের জন্য নয়, শিশুদের জন্যই মানায় ভালো। বিয়ে শাদী করা প্রাপ্ত বয়স্ক একজন লোক বলছে যে, ‘প্রণাম কিভাবে করতে হয় আমরা জানি না’, আর সেটা আরেক প্রাপ্ত বয়স্ক রাজা বিশ্বাস করছে; কৃত্তিবাস এখন বেঁচে থাকলে এসব লেখার জন্য পাবলিকের মার খেয়ে হাত পা ভেঙ্গে ওকে হসপিটালে ভর্তি হতে হতো।
যা হোক, রামায়ণ নিয়ে আরো কিছু কথা না বললেই নয়- রামায়ণ, মহাভারতের মতো নির্ভুল গ্রন্থ নয়। এখানে সংখ্যাতত্ত্বের বেশ কিছু ভুল ভ্রান্তি আছে। যেমন- যুদ্ধকাণ্ডের ৪ নং উপাখ্যানে বলা আছে,
“সমুদ্রের উপর সীমন্তরেখার ন্যায় শোভমান এই সেতুপথে সহস্র কোটি বানর লাফাতে লাফাতে সগর্জনে পার হতে লাগলো।”
এই বানররা যে বানর ছিলো না, ছিলো মানুষ, সেটা একটু পরেই আপনার বুঝতে পারবেন, এখানে শুধু সংখ্যাটা খেয়াল রাখুন, সহস্র কোটি মানে হাজার কোটি; এখনও সারা পৃথিবীর মানুষের সংখ্যা ১ হাজার কোটি নয়, অথচ এই হাজার কোটি বানর সমুদ্র পার হয়ে লংকার মতো একটি ছোট দ্বীপে থাকতে পারছে! শুধু তাই নয়, রাবন যখন রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে, তখন সে কী কী নিয়ে যুদ্ধ করতে আসে দেখুন- এক নিযুত(১০ লক্ষ) রথ, তিন নিযুত (৩০ লক্ষ) হস্তী, ষাট কোটি অশ্ব, ও অসংখ্য পদাতিক সৈন্য (পৃষ্ঠা-৩৬৯)। ১০ লক্ষ রথে কমপক্ষে ২০ লক্ষ মানুষ ছিলো; কারণ, একজন রথ চালায় এবং অন্যজন যুদ্ধ করে; একইভাবে ৩০ লক্ষ হাতিতেও কমপক্ষে ৬০ লক্ষ মানুষ ছিলো, তারপর ষাট কোটি ঘোড়ায় ৬০ কোটি মানুষ; এভাবে রাবনের বাহিনীতে ছিলো প্রায় ৬১ কোটি মানুষ এবং তাদের রথ, হাতি ও ঘোড়া। খেয়াল করবেন, রাম ও রাবনের এই সমগ্র বাহিনী কিন্তু যুদ্ধ করছে লংকার মতো একটি ছোট্ট দ্বীপে, এটা কি সম্ভব ?
রাজশেখর বসুর অনুবাদের সত্যতা নিয়ে যাদের সন্দেহ আছে, তাদের জন্য এখানে আছে একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, অনুবাদ হয় এইরকমই, যেখানে ব্যক্তিগত লাভালাভ বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সত্যকে বিকৃতি বা চাপা দেওয়া হয় না। বসু মহাশয় চাইলেই এই সংখ্যাগুলোকে কম করে লিখে একটা বাস্তব রূপ দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেই চেষ্টা করেন নি, যা পেয়েছেন তাই লিখেছেন। এই একই কারণে কোরানের বাংলা অনুবাদ যদি আপনারা গিরিশের টা না পড়েন, প্রকৃত সত্যের নাগাল কখনো পাবেন না। কারণ, গিরিশ, কোরান অনুবাদ করেছিলেন নিজের লাভালাভের কথা চিন্তা না করে; কিন্তু পরে যে সব মুসলমান কোরান অনুবাদ করেছে, তাদের সবার মাথায় ছিলো বেহেশতের ৭২ হুরের চিন্তা।
এছাড়াও, রামায়ণ পড়লে, রামের বনবাস এবং যুদ্ধকালীন, শুধু রাম-সীতা এবং লক্ষ্মণকেই আপনি মানুষ হিসেবে পাবেন, আর তাদের আশে পাশে যাদেরকে পাবেন, তারা সবাই বানর, রাক্ষস ইত্যাদি। রাক্ষস বলতে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই, আছে রাক্ষস স্বভাবের মানুষ; সেই হিসেবে রাবনের পক্ষের সবাই রাক্ষস স্বভাবের মানুষ। কিন্তু বিভীষণ সেই রাক্ষস স্বভাবের উর্ধ্বে ছিলো বলেই তাকে আমরা সুসংস্কৃত মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি, যদিও তিনি রাক্ষসকূলজাত। বিভীষণ যদি প্রকৃতই রাক্ষস হতো বা রাক্ষস বলে যদি আলা্দা প্রজাতির কোনো প্রাণী থাকতো, তাহলে বিভীষণ মানুষের মতো বিচার বুদ্ধি বা আচরণ করে কিভাবে ?
এরপর বালী- সুগ্রীবের কাহিনী যখন আপনি পড়বেন, তখন আপনার মনেই হবে না যে, তারা বানর; কারণ, তাদের রাজ্য আছে, রাজত্ব আছে, তারা মানুষের মতো কথা বলে, তাদের স্ত্রী সন্তান আছে, তাদের বসবাস করার জন্য নগর, দালান- ইমারত আছে। যদি তারা প্রকৃতপক্ষে বানর হতো, তাহলে তারা কি এসব নির্মান করতে পারতো, না তাদের জীবনে এসবের প্রয়োজন হতো ? আর বানর হিসেবে এইরকম বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষই বা কিভাবে সম্ভব ? এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই বুঝতে পারবেন না যতক্ষণ না আপনি, প্রাচীন যুগের মানুষের গোত্র বিভাগ কিভাবে হয়েছিলো, সেই ইতিহাস না জানবেন।
আমরা অনেক হিন্দুরই নামের শেষে পদবী হিসেবে লাগানো দেখি সিংহ (Lion), কারো নামের সাথে নাগ (সাপ) বা কারো সাথে সেন (শ্যেন, বাজ পাখি)। কিন্তু এগুলো কেনো ? যাদের নামের সাথে সিংহ লাগানো আছে তারা কি প্রকৃত পক্ষেই সিংহ, বা যাদের নামের সাথে নাগ আছে, তারা সাপ ? আসলে তারা প্রকৃত সিংহ, সাপ বা বাজপাখি নয়। প্রাচীন কালে এক গোত্রের মানুষের থেকে অন্য গোত্রের মানুষকে আলাদা করার জন্য পশু পাখিদের নামে তাদের নামকরণ করা হয়েছিলো, শুধু কোন গোত্রের মানুষ, তা আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য। বানর রাজ সুগ্রীব বা বালি বলতে বানরদের রাজাকে বোঝায় না, এরা আসলে বানর গোত্রের মানুষদের রাজা। তাই রামায়ণে বানর, রাক্ষস বলতে যাদেরকে বোঝানো হয়, আসলে এরা কেউ প্রকৃত অর্থে বানর বা রাক্ষস নয়, সবাই মানুষ, তবে ভিন্ন গোত্র বা ভিন্ন ধরণের।
জয় শ্রীরাম
৫৫ কোটি (550 million) বছর আগে গন্ডোয়ানা ল্যান্ড,৩৫ কোটি(350 million) বছর আগে তৈরী হয় অতি মহাদেশ প্যানজিয়া আজ থেকে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে ভারতীয় পাতটি বছরে প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার বেগে উত্তরে এগিয়ে আসতে শুরু করে। এমনকী আজও ভারতীয় পাতের এই উত্তরমুখী গতি চালু রয়েছে। প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বছরে ৫ সেন্টিমিটার হারে এখনও তা উত্তরে (একটু পুব দিকে, সরাসরি উত্তরের সাথে ৩৩° কোণ করে) কাজাখস্তান, সাইবেরিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চীনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলে মহাদেশীয় পাতগুলির মধ্যে এখনও সংঘর্ষ চলছে ও একটি পাতের তলায় আরেকটি প্রবেশ (*subduction*) করে চলেছে। ফলে এই অঞ্চলে *অরোজেনি* বা [পর্বত উৎক্ষেপন প্রক্রিয়া](https://bn.wikipedia.org/w/index.php…) এখনও সজীব। ৯.৫ লাখ বছর আগে জন্মে ছিলেন মর্যাদা **পুরুষোত্তম রামচন্দ্র**
অনেকে ধারনা করেন যে ঋগ্বেদে ভগবান রামচন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ফন্ডিত বর্গ জানেন না বেদে কোন মনুষের জন্মবৃত্তান্ত বা রামন্দ্রের নাম নেই, তা উক্ত মন্ত্র টি দেখলে বুঝতে পারবেন
प्र तद्दु॒:शीमे॒ पृथ॑वाने वे॒ने प्र रा॒मे वो॑च॒मसु॑रे म॒घव॑त्सु ।
ये यु॒क्त्वाय॒ पञ्च॑ श॒तास्म॒यु प॒था वि॒श्राव्ये॑षाम् ॥-ऋग्वेद १०.९३.१४
पदार्थान्वयभाषाः -(ये-अस्मयु) जो हमें चाहनेवाले हितैषी विद्वान् (पञ्चशता) पाँच सौ गुणित शक्तिवाली इन्द्रियों को (युक्त्वाय) योजित करके (पथा) ज्ञानमार्ग से-ज्ञानप्रदान क्रम से (विश्रावि) विशेषरूप से सुनाने योग्य परमात्मज्ञान है (एषाम्) इनके अर्थ (तत्) उस सुनाए हुए (दुःशीमे) जहाँ दुःख से सोते हैं, ऐसे (पृथवाने) विस्तृत (वेने) कामनापूर्ण (राये) भोग में रमे हुए जनसमुदाय में (मघवत्सु) धनवान् जनों में (प्रवोचम्) प्रवचन करूँ ॥
(ये-अस्मयु) ये हितैषिणो विद्वांसोऽस्मान् कामयमानाः “सुपां सुलुक्…” [अष्टा० ७।१।३९] इति जसो लुक् (पञ्चशता युक्त्वाय) पञ्चशतानि-इव ‘लुप्तोपमावाचकालङ्कारः’ अश्वान्-इन्द्रियाणि पञ्चशतगुणितशक्तिमन्ति योजयित्वा (पथा) ज्ञानमार्गेण ज्ञानप्रदानक्रमेण (विश्रावि) विशेषेण श्रावणीयं परमात्मज्ञानम् (एषाम्) एतेषां खलु (तत्) तच्छ्रावितं (दुःशीमे) दुःशयनस्थाने यत्र दुःखेन जनाः शेरते तत्र कष्टस्थाने “शीङ् धातोर्मन् प्रत्यय औणादिको बाहुलकात्” (पृथवाने) विस्तीर्यमाणो (वेने) कामयमाने (रामे) भोगेषु जनवर्गे (मघवत्सु) जनेषु (प्रवोचम्) प्रवचनं कुर्याम् ॥-ब्रह्ममुनि
भावार्थभाषाः -जिन हितैषी विद्वानों द्वारा ज्ञानप्रदान क्रम से हमारे मन आदि को पाँच सौ गुणित शक्तिवाले बना करके परमात्मज्ञान प्रदान करते हैं, उसका विशेषरूप से विषयों में रत हुए दुःख से सोनेवाले जनसमुदाय में तथा धन के लोलुप जनों में उपदेश करना चाहिये ॥ (jin hitaishee vidvaanon dvaara gyaanapradaan kram se hamaare man aadi ko paanch sau gunit shaktivaale bana karake paramaatmagyaan pradaan karate hain, usaka vishesharoop se vishayon mein rat hue duhkh se sonevaale janasamudaay mein tatha dhan ke lolup janon mein upadesh karana chaahiye .)
রাময়নে আমরা রামরাজ্যের বর্ণনা দেখি
ন পর্যদেবেন বিধবা ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম৷
ন ব্যধিজং ভয়ং চাসীদ্ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
নির্দস্যুরভবল্লোকো নানর্থং কশ্চিদস্পৃশৎ ।
ন চ স্ম বৃদ্ধা বালানাং প্রেতকার্যানি কুৰ্বতে।।
সর্ব মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্মপরো্যভবৎ।
রামমেবানুপশ্যন্তো নাভ্যহিংসন্ পরস্পরম্।।
আসন্ বর্ষসহস্রানি ততা পুত্র সহশ্রিনঃ ।
নিরাময়া বিশোকাশ্চ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
(বাঃ রাঃ যুদ্ধঃ ১২৮/৯৮-১০১)
রামের শাসনকালে বিধবাদের ক্রন্দন শোনা যেত না, হিংস্র প্রাণীর ভয় ছিলো না, ব্যাধি থেকে উৎপন্ন ভয়ও ছিলো না অর্থাৎ রোগ কাউকে কষ্ট দিতো না। প্রজাগণ চোর-ডাকাতের ভয় থেকে রহিত, কেউ কারো প্রতি অনর্থ বা পাপ করতো না। বৃদ্ধদের সম্মুখে শিশুদের মৃত্যু হতো না। সকলেই সন্তুষ্ট ছিলো, সকলেই ধর্মপরায়ণ ছিলো, রামকে স্মরণে রেখে পরস্পর হিংসা করতো না, অনেক পুত্র-পৌত্র যুক্ত বংশ সহস্র বর্ষ পর্যন্ত চলত অর্থাৎ কারো বংশচ্ছেদন হতো না, প্রজারা রোগ ও শোক থেকে বিযুক্ত ছিলো, রাষ্ট্রে বিধবাদের বৃদ্ধি, সিংহাদির ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ব্যবহারিক অনর্থ, বাল্যমৃত্যু, পারস্পরিক বিবাদ, বংশচ্ছেদন ইত্যাদির কারণ নেতা রাজার অনুচিত শাসন। বাল্যবিবাহ, বৃদ্ধ বিবাহ, বন-জঙ্গলের অনিয়ম, প্রজাদের অসুরক্ষা, চিকিৎসার জন্য চিকিৎসালয় এবং খাদ্যবস্তুর ন্যূনতা রাজ্যের দুর্ব্যবস্থার পরিণাম।
শ্রীরামচন্দ্র বরাবরই নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের নন, বরং সর্ববিশ্বের চীর আদর্শ স্বরূপ। মানবীয় সকল গুণই উনার মধ্যে সর্বদা পরিমিত পরিমাণে ছিল।
শ্রীরামচন্দ্র রাজপুত্রের দায়িত্ব নির্বাহন করার সময় রাজপুত্র হিসেবে সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ করার সময় ত্যাগ করেছেন, ভাতৃত্ববোধে সর্বদা অটল থেকেছেন, জীবন পথে দুঃখে পর্যপবসিত হলেও ভেঙে পড়েননি।
বেদ-বেদাঙের মনুষ্যরূপ সর্বোচ্চ ফলাফল যেন শ্রীরামচন্দ্র। তাই তো, তার বেদজ্ঞান নিয়ে বলা আছে,
সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতো য়থাবৎ সাঙ্গবেদবিৎ।
-অযোধ্যা কাণ্ড ১২/৩৩
--->>> রাম সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতক তথা যথাবৎ বেদাঙ জ্ঞাতা।
মধ্যযুগে রাজ্যদখল যখন ছিল যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য, প্রাচীন যুগে শ্রীরাম লঙ্কা জয় করবার পরেও রাজ্যভার বিভীষণের হাতে ন্যস্ত করে দিয়ে এসেছিলেন। কেননা, সনাতন আদর্শ সর্বদা দিগবিজয়ী হবার প্রেরণা জোগায়, কিন্তু কাউকে বঞ্চিত নয়।
রামায়ণে শুধু শ্রীরামচন্দ্রই নন, এর সকল চরিত্র থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছুই বিদ্যমান।
ভ্রাতৃ প্রেমের অনন্য নিদর্শন লক্ষণ। মাতা সীতার প্রতি রামচন্দ্রকে তাঁর উক্তির মাধ্যমেই সনাতনী সদাচারী মনোভাব প্রতীয়মান হয়।
নাহং জানামি কেয়রে নাহং জানামি কুন্ডলে। নূপুরে তৃভিজানামি নিত্যং পাদাভিবন্দনাৎ।।(বা০ রা০ কিষ্কি০৫/২২)
-সীতার অন্বেষণে পথে কিছু অলঙ্কার দেখে যখন লক্ষ্মণকে রাম জিজ্ঞাসা করলেন - হে লক্ষ্মণ! তুমি কি এই অলঙ্কারগুলি চিনতে পারছাে ? এগুলি কি সীতার? লক্ষ্মণ উত্তরে বললেন - আমি সীতার বাহুভূষণ চিনি না, তাঁর কর্মকুণ্ডলও জানি না, আমি কেবল তাঁর নূপুরকে চিনি কেননা প্রতিদিন আমি তাঁর পদাভিবন্দন (চরণে প্রণাম) করে থাকি।
রামের ভ্রাতা ভরতও ধর্মীয় চেতনা, সংযমের যেন এক অনন্য প্রতিভূ।
সপাদুকে সংপ্রনম্য রামং বচনমন্রবীৎ। চতুর্দশ হিবর্ষানি জটাচীরধারাে হ্যহম্।।
ফলমূলাশনাে বীর ভবেয়ং রঘুনন্দন।
তবাগমনমাকাংক্ষন বসন্ বৈ নগরাদ বহিঃ।।
তব পাদুকয়াের্ন্যস্য রাজ্যতন্ত্রং পরন্তপ।
চতুর্দশে হিসম্পর্ণে বর্ষেs হনি রঘূক্তম।।
ন দ্রক্ষ্যামি য়দি ত্বাং তু প্রবেক্ষ্যামি হুতাশ নম্।।(বা০ রা০ অযাে০ ১১২/২৩-২৫)
- ভরত রামের চরণ-পাদুকা গ্রহণ করে বললেন - হে রাম! চতুর্দশ বৎসর পর্যন্ত জটাবল্কধারী বানপ্রস্থ ধারণ করে ফলমূল আহার করে আপনার আগমনের আকাঙ্খ পােষণ করে নগরের বাহিরে বাস করতে থাকব এবং চতুর্দশ বর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিন আপনার দর্শন না পেলে আমি অগ্নিতে আত্মাহুতি দেবাে।
বর্তমানে ভাই ভাই যেখানে সম্পদের জন্য মারামারিতে ব্যস্ত, সেখানে ভ্রাতৃপ্রেমের এই নিদর্শন।
শ্রীহনুমান জীও ভক্তির এক অনন্য প্রতিভূ। বেদবিদ্যা যেন তার ব্যক্তিত্বকে এতোটাই সুন্দর করেছিল যে, স্বয়ং রামচন্দ্রও তাঁর প্রশংসা না করে পারেননি।
নানৃগ্বেদ বিনীতস্য নায়জুর্বেদধারিণঃ।
না সাম বেদ বিদুষঃ শক্যমেবং প্রভাষিতুম।।
নূনং ব্যাকরণং কৃৎস্নমনেন বহুধা শ্রুতম্। (বা০ রা০ কি০ ৩/২৯-৩০)
- রাম হনুমানের সম্বন্ধে বললেন - ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও সামবেদের বিদ্বান না হলে এরকম ভাষণ করতে পারেন না। নিশ্চয়ই তিনি ব্যাকরণও যথেষ্ট পাঠ করেছেন।
রামের সর্বজীবন মঙলময়, অপরের জন্য নিমিত্ত। রামচন্দ্র অপরকে প্রয়োজনে যেমন উপদেশ প্রদান করতেন, তেমনি নিজের প্রয়োজনেও অপরের উপদেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন।
অপরাধং বিনা হন্তং লােকান্ বীর ন কাময়ে।
ক্ষত্রিয়ানাং তু বীরানাং বনেষু নিয়তাত্মনাম্।।
ধনুষা কায়মেতাবদার্তা নামমিরক্ষনম্।
সচশস্ত্রং স্ চবনং স্ব চক্ষাত্রং তপঃ ক্ব চ।।
আত্মানং নিয়মৈস্তৈস্তৈঃ কর্ষয়িত্বা প্রয়ন্নতঃ।
প্রাপ্যতে নিপুনৈর্ধর্মো ন সুখাল্লভতে সুখম্।।
নিত্যং শুচিমতিঃ সৌম্য চর ধর্মং তপােবনে।
(বা০ রা০ অরণ্য ৯/২৫, ২৬, ৫১)
-হে রাম! বিনা অপরাধে কারাে হত্যা করা বাঞ্ছনীয় নয়। বনে নিবাসকারী জিতেন্দ্রিয় বীর ক্ষত্রিয়ের ধনুকের প্রয়ােজন কেবল আর্তদের রক্ষাকরা। কোথায় রাজ্য আর কোথায় এই বনবাস ? কোথায় শস্ত্র এবং কোথায় এই তপস্যা? হে রাম! সেই সব নিয়মগুলি দ্বারা নিজ আত্মাকে প্রচেষ্টা সহ সংযত করে নিপুণ জনধর্মপ্রাপ্ত করে থাকে। নিয়মরহিত হয়ে সহজে ধর্মপ্রাপ্তি সম্ভবনয়। অতএব, এই তপােবনে নিত্য পবিত্র মতিসম্পন্ন হয়ে ধর্মাচরণ করাে।
যে রাম মানবোচিত আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, সেই আদর্শকে বিচারপূর্বক আমরা সম্ভুহত্যাকারী, সীতা মাতার চরিত্রে প্রশ্ন উত্থাপনকারী,মাংসখোর, নীরিহ প্রাণি হত্যাকারী, হনুমানজীকে কল্পনাপ্রসূত জীব, প্রভৃতি বলেই চলেছি।
আনৃশংস্যম্ অনুক্রোশ: শ্রুতম্ শীলম্ দমঃ শমঃ |
রাঘভম্ শোভ্যন্তি এতে ষড়্ গুণাঃ পুরুষ উত্তমম্।।
- রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড/৩৩/১২
-> অহিংস স্বভাব, সমবেদনা, পাণ্ডিত্য, উত্তম আচরণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রশান্তি- এই ছয়টি গুণ রামচন্দ্রের চরিত্রকে সজ্জিত করেছে, তাই তিনি পুরুষোত্তম।
রামায়ণকালীন বৈদিক সংস্কৃতি
সন্ধ্যা আর অগ্নিহোত্রঃ
বাল্মীকি রামায়ণ থেকে বিদিত হয় যে সেই কালে আর্যদের উপাসনা সন্ধ্যার রূপে হতো। জপ, প্রাণায়াম তথা অগ্নিহোত্রেরও বিপুল উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক মূর্তিপূজা, ব্রত, তীর্থ, নামস্মরণ বা কীর্তনরূপে ধার্মিক কৃত্যের বর্ণনা মূলতঃ নেই। ক্ষণিক উল্লেখ যা এই সম্বন্ধে পাওয়া যায় সেটাও অপ্রাসঙ্গিক প্রক্ষেপ বা মূলকথার সঙ্গে অসম্বন্ধীয়। ঈশস্তুতি, সন্ধ্যা, গায়ত্রী জপ, অগ্নিহোত্র আর প্রাণায়ামের কিছু প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য -
উত্তিষ্ট নর শারদূল! কর্তব্যম্ দৈবমাহ্রিকম।।
(বালকাণ্ড ৩৩/২)
ভাবার্থ - মহর্ষি বিশ্বামিত্র বললেন - হে কৌশল্যা নন্দন রাম! প্রাতঃকালীন সন্ধ্যার সময় হয়েছে। হে নরশার্দূল! ওঠো আর নৈত্যিক কর্তব্য - সন্ধ্যা আর দেবযজ্ঞ করো।
তস্যর্ষেঃ পরমোদারম্ বচঃ শ্রুত্বা নরোত্তমৌ।
স্নাত্বা কৃতোদকৌ বীরৌ জেপতুঃ পরমম্ জপম্।।
(বালকাণ্ড ২৩/৩)
ভাবার্থ - ঋষি বিশ্বামিত্রের এই উদার বচন শুনে দুইভাই (রাম আর লক্ষ্মণ) ওঠে স্নান আদি হতে নিবৃত্ত হয়ে পরম জপ (গায়ত্রীর জপ) করলেন।
কুমারাবপি তাম্ রাত্রিমুষিত্বা সুসমাহিতৌ।
প্রভাতকালে চোত্থায় পূর্বাম্ সন্ধ্যামুপাস্য চ।।৩১।।
প্রশুচী পরমম্ জাপ্যম্ সমাপ্য নিয়মেন চ।
হুতাগ্নিহোত্রমাসীনম্ বিশ্বামিত্রমবন্দতাম্।।৩২।।
(বালকাণ্ড ২৯ তম সর্গ)
ভাবার্থ - রাম, লক্ষ্মণ দুই রাজকুমার সাবধান সহিত রাত্রি ব্যতীত করে প্রাতঃকালে ওঠেন আর সন্ধ্যোপাসনা করেন। অত্যন্ত পবিত্র হয়ে পরম জপ গায়ত্রীর নিয়মপূর্বক তাঁরা জপ করেন আর তারপর অগ্নিহোত্র করে বসে থাকা গুরু বিশ্বামিত্রকে অভিবাদন করেন।
আশ্বাসিতো লক্ষ্মণেন রামঃ সন্ধ্যামুপাসত।
(যুদ্ধকাণ্ড ৫/২৩)
ভাবার্থ - সীতার শোকে দুঃখী রাম লক্ষ্মণের দ্বারা আশ্বাসিত করার পর সন্ধ্যোপাসনা করেন।
সীতার সন্ধান করতে-করতে হনুমান অশোকবাটিকাতে একটা পবিত্র নদীকে দেখে ভাবলেন -
সন্ধ্যাকালমনাঃ শ্যামা ধ্রুবমেষ্যতি জানকী।
নদীম্ চেমাম্ শুভজলাম্ সন্ধ্যার্থে বরবর্ণিনী।।
(সুন্দরকাণ্ড ১৪/৪৯)
ভাবার্থ - যদি সীতা জীবিত থাকেন তাহলে প্রাতঃকালীন সন্ধ্যার জন্য এই সুন্দর জলের নদীর তীরে সন্ধ্যা করার জন্য এই স্থলে অবশ্যই আসবেন।
তস্মিন্ কালেপি কৌশল্যা তস্থাবামীলিতেক্ষণা।
প্রাণায়ামেন পুরুষম্ ধ্যায়মানা জনার্দনম্।।
(অযোধ্যাকাণ্ড ৪/৩২-৩৩)
ভাবার্থ - শ্রীরাম যখন কৌশল্যা জীর ভবনে যান সেই সময় কৌশল্যা জী নেত্র বন্ধ করে ধ্যানে বসে ছিলেন আর প্রাণায়াম দ্বারা পরমপুরুষ পরমাত্মার ধ্যান করছিলেন।
সা ক্ষৌমবসনা হ্রষ্টা নিত্যম্ ব্রতপরায়ণা।
অগ্নিম্ জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবত্কৃতমঙ্গলা।।
(অযোধ্যা কাণ্ড ২০/১৫)
ভাবার্থ - রেশমী বস্ত্র পরে রাম-মাতা কৌশল্যা প্রসন্নতার সঙ্গে নিরন্তর ব্রতপরায়ণ হয়ে মঙ্গল কৃত্য পূর্ণ করার পশ্চাৎ মন্ত্রোচারণপূর্বক সেই সময় অগ্নিতে আহুতি দিচ্ছিলেন।
গতে পুরোহিতে রামঃ স্নাতো নিয়ত মানসঃ।
সহ পত্ন্যা বিশালাক্ষ্যা নারায়ণমুপাগতম্।।
(অযোধ্যাকাণ্ড ৬/১)
ভাবার্থ - পুরোহিত চলে যাওয়ার পরে শ্রীরাম জী স্নান করে নিয়ত মনে বিশাললোচনা পত্নী সীতার সহিত পরমাত্মার উপাসনা করেন।
--------
বেদ বেদাঙ্গের অধ্যয়ন
রক্ষিতা স্বস্য ধর্মস্য স্বজনস্য চ রক্ষিতা।
বেদবেদাঙ্গত্তত্ত্বজ্ঞো ধনুর্বেদে চ নিষ্ঠিতঃ।।
(বালকাণ্ড ১/১৪)
ভাবার্থ - রাম স্বধর্ম আর স্বজনদের পালক বেদ-বেদাঙ্গের তত্ত্ববেত্তা তথা ধনুর্বেদে প্রবীণ ছিলেন।
সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতো য়থাবত্ সাঙ্গবেদবিত্।।
(অযোধ্যা কাণ্ড ১/২০)
ভাবার্থ - শ্রীরাম সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতক তথা ছয় অঙ্গ সহিত সম্পূর্ণ বেদের যথার্থ জ্ঞাতা ছিলেন।
অস্মিন্ চ চলতে ধর্মো য়ো ধর্ম নাতিবর্ততে।
য়ো ব্রাহ্মমস্রম্ বেদাম্শ্চ বেদবিদাম্ বরঃ।।
(যুদ্ধকাণ্ড ২৮/১৯)
ভাবার্থ - ধর্ম কখনও শ্রীরাম থেকে আলাদা হয় না। শ্রীরাম কখনও ধর্মের উলঙ্ঘন করেন না। তিনি ব্রহ্মাস্র আর বেদ উভয়ের জ্ঞাতা ছিলেন তথা বেদবেত্তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ
- Ramayana, translated in English by Griffith, from Project Gutenberg
- Vyas, R.T. (ed.) Vālmīki Rāmāyaṇa, Text as Constituted in its Critical Edition, Oriental Institute, Vadodara, 1992.
- Valmiki, Ramayana, Gita Press, Gorakhpur, India.
- Ramesh Menon, The Ramayana: A Modern Retelling of the Great Indian Epic আইএসবিএন ০-৮৬৫৪৭-৬৬০-৮
- F.S. Growse, The Ramayana of Tulsidas
- Devadutt Pattanaik, Indian Mythology: Tales, Symbols and Rituals from the Heart of the Subcontinent আইএসবিএন ০-৮৯২৮১-৮৭০-০
- Jonah Blank, Arrow of the Blue-Skinned God: Retracing the Ramayana Through India আইএসবিএন ০-৮০২১-৩৭৩৩-৪
- Valmiki's Ramayana illustrated with Indian miniatures from the 16th to the 19th century, Diane de Selliers Publisher, 2011, আইএসবিএন ৯৭৮-২-৯০৩৬৫৬-৭৬-৮. By Soumi Sarkar
- Ganguly, S. (২০০৩)। "The Crisis of Indian Secularism"। Journal of Democracy। 14 (4): 11–25। doi:10.1353/jod.2003.0076। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১২।
- ↑ http://www.hindutemplede.com/index.php?option=com_content&view=article&id=59
- ↑ http://translate.google.com/#hi/en/%E0%A4%AA%E0%A4%B0%E0%A4%BF%E0%A4%B5%E0%A4%BE%E0%A4%B0
- ↑ Dimock Jr, E.C. (১৯৬৩)। "Doctrine and Practice among the Vaisnavas of Bengal"। History of Religions। 3 (1): 106–127। doi:10.1086/462474। জেস্টোর 1062079।
- ↑ Rosen, S. (১৯৯৪)। Vaisnavism: Contemporary Scholars Discuss the Gaudiya Tradition। Motilal Banarsidass Publ.।
- ↑
- ক খ Hess, L. (২০০১)। "Rejecting Sita: Indian Responses to the Ideal Man's Cruel Treatment of His Ideal Wife"। Journal of the American Academy of Religion। 67 (1): 1–32। doi:10.1093/jaarel/67.1.1। PMID 21994992। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১২।
↑ Kanungo, H.। "The Distinct Speciality of Lord Jagannath" (PDF)। Orissa Review। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১২।
- ক খ গ ঘ Griffith, R.T.H. (১৮৭০–১৮৭৪)। The Rámáyana of Válmíki। London: Trübner & Co.; Benares: E. J. Lazarus and Co.।
- ↑ Goswami, S.D. (২০০১)। Vaisnava Compassion। La Crosse, Florida: GN Press।
- ↑ Hale, Wash Edward (১৯৮৬)। "Ásura- in early Vedic religion"। আইএসবিএন 978-81-208-0061-8।
- ↑ "श्रीविष्णुसहस्रनामस्तोत्रम् (Shri Vishnu sahasranama)|note search with string 'राम'"। ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩।
- ↑ Fallon, Oliver. 2009. Bhatti’s Poem: The Death of Rávana (Bhaṭṭikāvya). New York: Clay Sanskrit Library [১]. আইএসবিএন৯৭৮-০-৮১৪৭-২৭৭৮-২ | আইএসবিএন ০-৮১৪৭-২৭৭৮-৬ |
- ↑ The Oral Tradition and the many "Ramayanas", Moynihan @Maxwell, Maxwell School of Syracuse University's South Asian Center
- ↑ See Sankalia, H.D., Ramayana: Myth or Reality, New Delhi, 1963
- ↑ Basham, A.L., The Wonder that was India, London, 1956, p 303
- ↑ ""বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পূর্বে বাংলার মানুষ রামমন্ত্রে দীক্ষা নিত""। বঙ্গদেশ (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-১১-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-০৮।
- ↑ "গোবিন্দপুর অস্থল ও বাংলার প্রাচীনতম হনুমান মন্দির"। কৌলাল (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৫-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-০৮।
- ↑ "বাংলার দশেরা – রাবণ কাটা"। Anirban Saha. (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-০৬-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-০৮।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ