ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম পৃষ্ঠপোষকতা
ব্রহ্মবৈবর্ত নামে একটি পুরাণ রয়েছে। এই পুরাণটি রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের নানা প্রকার লীলার বর্ণনা করাই এই পুরাণের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম পৃষ্ঠপোষক রূপে দেখা যায়। ব্রহ্মবৈবর্তের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে একটি কাহিনী আছে। কৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ একবার ইন্দ্রযজ্ঞের আয়োজন করছিলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কৃষ্ণ সেই ইন্দ্রযজ্ঞের বিরোধীতা করতে থাকেন। এই বিরোধীতা করার সময় কৃষ্ণের মুখ থেকে কিছু কথা বেরিয়ে আসে, যে কথাগুলো আসলে ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণ্যবাদী ইউটোপিয়ার প্রধান বক্তব্য। ব্রাহ্মণেরা তাদের রচিত নানান শাস্ত্রে নিজেদের স্বার্থে জাতপাত তৈরি করে সমাজের নানা স্তরের মানুষদের শোষণ করেছে, ফায়দা লুটেছে। তারা হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুসমাজের মগডালে বসে ছড়ি ঘুরিয়েছে এবং সুযোগ পেলেই নিজেদের দেবতা বলে ঘোষণা করেছে।ভারতবর্ষে সুদীর্ঘকাল জাতপাতের নামে মানুষের উপর সীমাহীন অত্যাচার করা হয়েছে এবং এখনো এই বৈষম্য ভারতের নানা স্থানে ভীষণভাবে চলমান। বাঙ্গালী সমাজেও এখনো বিবাহের সময় জাতপাত বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পত্রপত্রিকার ‘পাত্র চাই, পাত্রী চাই’ এর বিজ্ঞাপনে প্রায়শই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এইসব বৈষম্যকে অনেক শিক্ষিত আধুনিক ব্যক্তিরা কেবল সামাজিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট ভাবতে ভালোবাসেন। এই সব বৈষম্যের পেছনে যে ধর্মীয় প্ররোচনাও অনেকাংশেই কাজ করেছে, তা কেন জানি তারা বেমালুম ভুলে যান! কিন্তু খুঁজলে হিন্দু ধর্মের অসংখ্য শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণবাদ এবং জাতপাতের সন্ধান মেলে।
যাইহোক, কৃষ্ণ আসলে কি বলেছিলেন তা শোনা যাক। কৃষ্ণ বলেন-
.
“ বেদে বলা আছে ব্রাহ্মণেরা পৃথিবীর দেবতা। হে পিতা! দেবতার পূজা করার চাইতে ব্রাহ্মণের পূজা করা সুপ্রশস্ত।“ ২১/ ৫৪
.
জনার্দনের রূপ ধরে ব্রাহ্মণেরা নৈবদ্য গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ সন্তুষ্ট হলে সকল দেবতা সন্তুষ্ট হয়। ২১/৫৫
.
যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণের অর্চনা করে তার কাছে দেবপূজা মূল্যহীন। ব্রাহ্মণদের পূজা করলেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করা হয়। ২১/৫৬
.
দেবতাদের নৈবদ্য দেওয়ার পর যদি ব্রাহ্মণদেরও নৈবদ্য না দেওয়া হয় তবে সেই নৈবদ্য ভস্মীভূত হয়ে যায় এবং সেই পূজা নিষ্ফল হয়ে যায়। ২১/৫৭
.
যে ব্রাহ্মণদের নৈবদ্য দান করে সে সীমাহীন ফল লাভ করে এবং দেবতারা তুষ্ট হয়ে তার গৃহে বাস করেন। ২১/৫৮
.
যদি কোনো মূঢ় ব্যক্তি ব্রাহ্মণদের নৈবদ্য দান না করে কেবল দেবতাকে নৈবদ্য দান করে অথবা নিজে তা ভক্ষণ করে তাহলে বলা যায় সে দেবতাদের ধন চুরি করছে, যার ফলস্বরূপ সে নরকে গমন করবে। ২১/৫৯
.
কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি দেবতাদের নৈবদ্য না দিয়ে ব্রাহ্মণের তা প্রদান করেন, তাহলে ব্রাহ্মণেরা সেই নৈবদ্য ভক্ষণ করলেই দেবতারাও তুষ্ট হন এবং তারা স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেন। ২১/৬১
.
তাই সবরকমভাবেই ব্রাহ্মণদের অর্চনা করা উচিত কারণ তাদের সেবা করার মাধ্যমেই ইহলোক এবং পরলোকে প্রশস্ত ফল লাভ করা যায়। ২১/৬২
.
জপ,তপ, পূজা, যজ্ঞ, দান, মহোৎসব এইসকল কর্মের সমাপ্তি হয় ব্রাহ্মণদের তুষ্টি এবং দক্ষিণার মাধ্যমে। ২১/৬৩
.
ব্রাহ্মণের শরীরে সকল দেবতা বাস করেন। ব্রাহ্মণের পায়ে সকল তীর্থ বিরাজ করে এবং তার পদধূলিতে সকল পুণ্য বিরাজ করে। ২১/৬৪
.
যে জল দ্বারা ব্রাহ্মণের পা ধৌত করা হয়, তাতে সকল তীর্থস্থান বিরাজ করে। সেই জলের স্পর্শে সকল তীর্থে স্নানের ফল লাভ হয়। ২১/ ৬৫
.
হে বল্লভ, কেউ যদি ভক্তিভরে ব্রাহ্মণের সেই জল গ্রহণ করে, তবে তার সব রোগ দূর হয়ে যায়। সে নিঃসন্দেহে তার সাত জন্মে করা সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ২১/৬৬
.
পঞ্চবিধ পাপ করার পরও যে ব্রাহ্মণের কাছে নত হয় , সে সমস্ত পাপ হতে মুক্ত হয়ে যায়, যেমনি তীর্থস্থানে স্নান করেও সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ২১/৬৭
.
ব্রাহ্মণের স্পর্শেই পাপী পাপমুক্ত হয়ে যায় এবং ব্রাহ্মণের দর্শনেই সব পাপ দূর হয়ে যায়। এটাই বেদের সিদ্ধান্ত। ২১/৬৮
.
বিদ্বান এবং মূর্খ সকল ব্রাহ্মণেরা বিষ্ণুর বিগ্রহ স্বরূপ। যেসকল ব্রাহ্মণেরা বিষ্ণুর সেবা করে, তারা তার প্রাণাধিকপ্রিয়। হরি ভক্ত ব্রাহ্মণদের প্রভাব দুর্লভ, এটা শ্রুতির মত। কোনো তীর্থস্থানেও যদি কোনো পাপ করা হয়, তবে ব্রাহ্মণের পদধূলিতে তা দূর হয়ে যায়। তাদের আলিঙ্গন, তাদের সুমধুর বাক্য, তাদের দর্শন, তাদের স্পর্শ মানুষকে সকল পাপ হতে মুক্ত করে। ২১/৬৯-৭২
.
সকল তীর্থ ভ্রমণ করে, তাতে স্নান করে যে পুণ্য অর্জিত হয় , তা বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণের দর্শনমাত্রেই অর্জিত হয়। ২১/৭৩
.
এই কথাগুলো থেকে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণ আর দেবতাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই, বরং অনেক স্থানে দেখা যায়, ব্রাহ্মণের স্থান দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে। এই কথাগুলো শোনার পরও অনেকে হয়তো এইসব কথা এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনঃ ব্রাহ্মণেরা যেহেতু বিদ্বান ছিল, সমাজের মস্তিষ্ক ছিল, তাই তাদের সম্মানার্থে তাদের দেবতার সমান করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায় যখন কৃষ্ণ বললেন, ‘বিদ্বান এবং মূর্খ সকল ব্রাহ্মণেরা বিষ্ণুর বিগ্রহ স্বরূপ’। তখন স্পষ্টভাবে উপলব্ধি হয়, এই ব্রাহ্মণ্যবাদ ভ্রষ্ট এবং কৃষ্ণ এই ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম পৃষ্ঠপোষক!হে গোপেন্দ্র,এসব দ্রব্য ব্রাহ্মণদের যারা না দেয়, তারা ভবিষ্যতে ভস্মীভূত হয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। ২১/৭৮”
ঈশ্বর, ভগবান বা দেবতা তারা কিভাবে কোনো অন্যায়কে সমর্থন করতে পারেন, স্বার্থান্বেষীদের নিজেদের আখের ঘোচাতে কিভাবে মদত দিতে পারেন? কথিত যেসব মহাপুরুষদের কেবলই ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্রীড়ানক হিসাবে দেখা যায় তারা ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে গড়া নানান কাল্পনিক চরিত্রের রুপ নিয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ – চারি খণ্ডে সম্পূর্ণ (ব্রহ্মখণ্ড, প্রকৃতিখণ্ড, গণেশখণ্ড, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড)
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ – সুবোধচন্দ্র মজুমদার অনুদিত(বেদব্যাস বিরচিত সংস্কৃত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের অবিকল পদ্যানুবাদ)
.
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড/২১ অধ্যায় ; ইংরেজি অনুবাদকঃ Shanti Lal Nagar; সম্পাদকঃ আচার্য রমেশ চতুর্বেদী; Parimal Publications Delhi
স্ক্রিনশটঃ
.(শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ড,অধ্যয়২৩)
শ্রীকৃষ্ণকে রাধার অভিশাপ
হে কৃষ্ণ বৃজকান্ত!গচ্ছ মহৎপুরতী হরে।
কথং দূতীষিমানং লীলং রতি চোর অতি লম্পট।।
মো জগোতো অসি ভদ্র তে গচ্ছ মীমাশ্রামান।।
শশ্বতে মনুষযানং চ ব্যবহারস্য লম্পট।
লভতাং মানুষী যোনি গোলোকাদ ব্রজ ভরতম।।
হে সুশীলে,হে শশিকলে, হে পদ্মাবতি মাধবী।
নিবার্য তাচ্চ্বধূর্ত য কিমস্রত্র প্রযোজতম।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান,শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড,অধ্যায় ৩,শ্লোক ৫৯,৬০,৬১,৬২)