বিবেকানন্দ |
শিকাগো ধর্মমহাসভা নিয়ে বিবেকানন্দের সুখ্যাতির অন্ত নেই। প্রচারের ঢাকটির মাত্রারিক্ত শব্দ বাঙালীর কানে এমন ক্যাকাফোনির ঝঙ্কার তুলেছে যে এই একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করেই তিনি হিন্দু ধর্মের অবতারের পর্যায়ে উঠে এসেছেন। এই মহিমা কীর্তনের সাথে সাথে এমন সব আজগুবি, ভিত্তিহীন কাহিনী সংযোজিত করা হচ্ছে যে যার সাথে তথ্য, তত্ত্ব ও ইতিহাসের নামমাত্র সংযোগ নেই। আর রাষ্ট্রীয় সহায়তায় এই সমস্ত আজগুবি প্রচারগুলি নির্দ্বিধায় করে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষকতার সুবাদে দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুজোগ পেয়েছিলাম ১৯৯২ সাল থেকে।এই প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরীকে ব্যবহার করে নানা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ থেকে বিবেকানন্দকে জানার সুযোগও পেয়েছিলাম। আর তাতে মনে হয়েছিল যে বিবেকানন্দের উপর প্রকাশিত এই মিশনের নানা গ্রন্থে ভেজাল মেশানো হয়েছে। এই ভেজাল মেশানো হয়েছে ব্রাহ্মন্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। বেদান্ত দর্শনকে পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যই বিবেকানন্দকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। এই আলোচনায় আমি তেমন কিছু তথ্যভিত্তিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাই।
বিবেকানন্দের কালঃ
১৮৯৩ সালে যখন শিকাগোতে ধর্মসম্মেলন হয় তখন বিবেকানন্দের বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি স্নাতক পরীক্ষায়ও পাশ করেছিলেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে তার স্নাতক হওয়ার প্রায় একশ বছর আগের ঘটে যাওয়া ফরাসী বিপ্লবের কথা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন মন্তেস্কুর “L’Esprit des Lois” রুশোর Social Contact এবং ভলতেয়রের “Doctrine of Enlightened” সম্পর্কে। এমনকি তাঁর শিকাগো ধর্মসম্মেলনের আগে কার্ল মার্ক্স এর লেখা “Das Kapital (1859)”, চার্লস ডারউইনের “Evolutinism” এবং “Origin of Species” (1871-1872) সম্পর্কে তিনি জেনে থাকবেন। শোনা যায় তিনি হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিশেষত হারবার্ট স্পেনসারের “Education” বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারনে যে তিনি সমকালীন গবেষকদের আবিষ্কার ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু এ সব যুগান্তকারী চেতনা যে কোনভাবে তার ব্যবহারিক জীবনকে স্পর্শ করেনি তা তাঁর আচরণ এবং সিদ্ধান্ত থেকেই পাওয়া যায়।
১৮৮১ সালে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের খোঁজ পান। আর অদ্ভুত ভাবে এই রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি খুঁজে পান জীবনের অন্তিম গতি ও মুক্তির পথ!
Voice of Swami Vivekananda’s Chicago speech going viral 11 th September1893
বিবেকানন্দের কালঃ১৮৯৩ সালে যখন শিকাগোতে ধর্মসম্মেলন হয় তখন বিবেকানন্দের বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি স্নাতক পরীক্ষায়ও পাশ করেছিলেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে তার স্নাতক হওয়ার প্রায় একশ বছর আগের ঘটে যাওয়া ফরাসী বিপ্লবের কথা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন মন্তেস্কুর “L’Esprit des Lois” রুশোর Social Contact এবং ভলতেয়রের “Doctrine of Enlightened” সম্পর্কে। এমনকি তাঁর শিকাগো ধর্মসম্মেলনের আগে কার্ল মার্ক্স এর লেখা “Das Kapital (1859)”, চার্লস ডারউইনের “Evolutinism” এবং “Origin of Species” (1871-1872) সম্পর্কে তিনি জেনে থাকবেন। শোনা যায় তিনি হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিশেষত হারবার্ট স্পেনসারের “Education” বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারনে যে তিনি সমকালীন গবেষকদের আবিষ্কার ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু এ সব যুগান্তকারী চেতনা যে কোনভাবে তার ব্যবহারিক জীবনকে স্পর্শ করেনি তা তাঁর আচরণ এবং সিদ্ধান্ত থেকেই পাওয়া যায়।
১৮৮১ সালে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের খোঁজ পান। আর অদ্ভুত ভাবে এই রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি খুঁজে পান জীবনের অন্তিম গতি ও মুক্তির পথ!
ফরাসি বিপ্লব থেকে শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে একেবারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাগকাল পর্যন্ত শুরু হয়েছিল এক নবজাগরণের কাল। এই সময়ে বিজ্ঞানের নানা গবেষণা মানুষের যুক্তিকে ক্ষুরধার করে তোলে। রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। পুরোহিততন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ধ্বংস হয়ে যায়। গির্জাগুলি চিহ্নিত হয় অজ্ঞতার আঁতুড়ঘর হিসেবে। গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন গণআন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। আমেরিকায় সংগঠিত হয়েছে “মে বিপ্লব”।
নরেন্দ্রনাথ এগুলিকে অগ্রাহ্য করে আশ্রয় নিলেন ব্রাহ্মন্য ধর্মের চৌখুপিতে। অর্থাৎ মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক সমতা, স্বতন্ত্রতা ও ভ্রাতৃত্বের সংগ্রাম থেকে তিনি আধ্যাত্মবাদের মধ্যেই মোক্ষ খুঁজে পেলেন। ব্রাহ্মন্যবাদ এবং চতুর্বর্ণের প্রবক্তা হিসেবে সাম-দাম-দন্ড-ভেদের নীতিকে অনন্য স্থিতিশীল নীতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। যে সময়ে সারা পৃথিবীর মানুষ শৃঙ্খল ভাঙার প্রতিজ্ঞা নিয়ে একটি স্বপনের প্রভাতের অপেক্ষা করছে, সেই সময় নরেন্দ্রনাথ দত্ত আরো কিছু যুবককে সঙ্গে নিয়ে বেছে নিলেন সন্ন্যাসের পথ! ১৮৮৮ পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠিত মঠ, মন্দিরে অবস্থান করে বেদান্তবাদ প্রচার করার জন্য একটি কমণ্ডলু, লাঠি, এবং প্রিয় গ্রন্থ গীতা বগলে করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়লেন! ক্ষেত্রীর মহারাজার অনুরোধে স্বামিজী বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করলেন এবং এই নামেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হলেন।
নরেন্দ্রনাথ এগুলিকে অগ্রাহ্য করে আশ্রয় নিলেন ব্রাহ্মন্য ধর্মের চৌখুপিতে। অর্থাৎ মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক সমতা, স্বতন্ত্রতা ও ভ্রাতৃত্বের সংগ্রাম থেকে তিনি আধ্যাত্মবাদের মধ্যেই মোক্ষ খুঁজে পেলেন। ব্রাহ্মন্যবাদ এবং চতুর্বর্ণের প্রবক্তা হিসেবে সাম-দাম-দন্ড-ভেদের নীতিকে অনন্য স্থিতিশীল নীতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। যে সময়ে সারা পৃথিবীর মানুষ শৃঙ্খল ভাঙার প্রতিজ্ঞা নিয়ে একটি স্বপনের প্রভাতের অপেক্ষা করছে, সেই সময় নরেন্দ্রনাথ দত্ত আরো কিছু যুবককে সঙ্গে নিয়ে বেছে নিলেন সন্ন্যাসের পথ! ১৮৮৮ পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠিত মঠ, মন্দিরে অবস্থান করে বেদান্তবাদ প্রচার করার জন্য একটি কমণ্ডলু, লাঠি, এবং প্রিয় গ্রন্থ গীতা বগলে করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়লেন! ক্ষেত্রীর মহারাজার অনুরোধে স্বামিজী বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করলেন এবং এই নামেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হলেন।
বিবেকানন্দের সন্ন্যাস গ্রহণের কারণ কী?
ইউরোপের নবজাগরণের ঢেউ কিছুটা পৌঁছেছিল রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ নিবারণ আন্দোলনের মাধ্যমে। সারা ভারত জুড়ে ব্রাহ্মণদের প্রবল বাঁধাকে উপেক্ষা করে ১৮২৯ সালে এই বর্বর প্রথা বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এই সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন লর্ড ইউলিয়াম বেন্টিং। ব্রাহ্মন্যবাদীদের অহংকারে আঘাত লাগে। তারা এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করেন। ১৯৩২ সালে লর্ড বেন্টিং আইন প্রণয়ন করে নারীর প্রতি চরম অবিচারের এই ঘৃণ্য অমানবিক প্রথাকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করে দেন।
১৮৬৬ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু বিবাহ নিবারণ এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন আন্দোলনেও ব্রাহ্মণ রচিত স্বেচ্ছাচারী সমাজ প্রবল ধাক্কা খায়। পূর্ববঙ্গে ১৮৩০-৩২ সাল থেকে হরিচাঁদের নেতৃত্বে আরম্ভ হয় চণ্ডাল বিদ্রোহ। হরিচাঁদ বেদ, বিধি, শৌচাচারকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রতিষ্ঠা করেন মতুয়া ধর্ম। নেড়ে-চণ্ডালকে একত্রিত করে ভূমিসত্ত্ব ও স্বাধিকার আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন।
অন্য দিকে মহারাষ্ট্রে জ্যোতি রাও ফুলের নেতৃত্বে শুরু হয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাগিদারী আন্দোলন। মনুবাদ, ব্রাহ্মন্যবাদের নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য ১৮৭৩ সালে ফুলে দম্পতি গঠন করেন "সত্য শোধক সমাজ"। মা সাবিত্রী ফুলে এই সামাজিক আন্দোলনের মহিলা শাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮২-৮৩তে জ্যোতি রাও ফুলে হান্টার কমিশনের কাছে সার্বজনীন শিক্ষার দাবী তোলেন। ব্রাহ্মন্যবাদকে বিসর্জন দিয়ে সকল মানুষের জন্য সত্য শোধক সমাজ গঠনের বিপুল সাড়া পড়ে যায়। দলে দলে মানুষ সত্য শোধক সমাজে নাম লেখাতে শুরু করে। রাষ্ট্র পিতা জ্যোতি রাও ফুলের আহ্বান ছিল “এক মানুষ, এক জাতি, এক ধর্ম”।
হরিচাঁদের যোগ্য সন্তান গুরুচাঁদের নেতৃত্বে পূর্ববাঙলায় শুরু হয়ে যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন।
এই মানবিক একীকরণের গণজাগরণে প্রমাদ গণে ব্রাহ্মণ সমাজ। তড়িঘড়ি এই আন্দোলনের মোড় ঘোরাতে দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “আর্য সমাজ”। কিন্তু সংশয় থেকে যায় যে শূদ্র সমাজের মধ্যে আর্য সমাজের এই প্রয়াস খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা শূদ্র সমাজ ঐতিহাসিক কারনেই ব্রাহ্মণের চতুর্বর্ণ সমাজ থেকে বাইরে আসার প্রবল চেষ্টা শুরু করেছে। তাই শূদ্র সমাজকে বাগে আনার জন্য শূদ্র সন্যাসী চাই। আর এই কারনেই একজন জলচল শূদ্র নরেন্দ্রনাথ দত্তকে বানানো হল স্বামী বিবেকানন্দ।স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী তাই যথার্থ বলেছিলেন যে “বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে বাঁচিয়েছেন, ভারতকে বাঁচিয়েছেন ।”
১৮৬৬ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু বিবাহ নিবারণ এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন আন্দোলনেও ব্রাহ্মণ রচিত স্বেচ্ছাচারী সমাজ প্রবল ধাক্কা খায়। পূর্ববঙ্গে ১৮৩০-৩২ সাল থেকে হরিচাঁদের নেতৃত্বে আরম্ভ হয় চণ্ডাল বিদ্রোহ। হরিচাঁদ বেদ, বিধি, শৌচাচারকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রতিষ্ঠা করেন মতুয়া ধর্ম। নেড়ে-চণ্ডালকে একত্রিত করে ভূমিসত্ত্ব ও স্বাধিকার আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন।
অন্য দিকে মহারাষ্ট্রে জ্যোতি রাও ফুলের নেতৃত্বে শুরু হয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাগিদারী আন্দোলন। মনুবাদ, ব্রাহ্মন্যবাদের নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য ১৮৭৩ সালে ফুলে দম্পতি গঠন করেন "সত্য শোধক সমাজ"। মা সাবিত্রী ফুলে এই সামাজিক আন্দোলনের মহিলা শাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮২-৮৩তে জ্যোতি রাও ফুলে হান্টার কমিশনের কাছে সার্বজনীন শিক্ষার দাবী তোলেন। ব্রাহ্মন্যবাদকে বিসর্জন দিয়ে সকল মানুষের জন্য সত্য শোধক সমাজ গঠনের বিপুল সাড়া পড়ে যায়। দলে দলে মানুষ সত্য শোধক সমাজে নাম লেখাতে শুরু করে। রাষ্ট্র পিতা জ্যোতি রাও ফুলের আহ্বান ছিল “এক মানুষ, এক জাতি, এক ধর্ম”।
হরিচাঁদের যোগ্য সন্তান গুরুচাঁদের নেতৃত্বে পূর্ববাঙলায় শুরু হয়ে যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন।
এই মানবিক একীকরণের গণজাগরণে প্রমাদ গণে ব্রাহ্মণ সমাজ। তড়িঘড়ি এই আন্দোলনের মোড় ঘোরাতে দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “আর্য সমাজ”। কিন্তু সংশয় থেকে যায় যে শূদ্র সমাজের মধ্যে আর্য সমাজের এই প্রয়াস খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা শূদ্র সমাজ ঐতিহাসিক কারনেই ব্রাহ্মণের চতুর্বর্ণ সমাজ থেকে বাইরে আসার প্রবল চেষ্টা শুরু করেছে। তাই শূদ্র সমাজকে বাগে আনার জন্য শূদ্র সন্যাসী চাই। আর এই কারনেই একজন জলচল শূদ্র নরেন্দ্রনাথ দত্তকে বানানো হল স্বামী বিবেকানন্দ।স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী তাই যথার্থ বলেছিলেন যে “বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে বাঁচিয়েছেন, ভারতকে বাঁচিয়েছেন ।”
এই ধর্মসম্মেলন নিয়ে এতকাল যা প্রচার হয়েছে তার অধিকাংশটাই আমরা জানতে পেরেছি রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশিত গ্রন্থ এবং পত্রিকা থেকে।বিবেকানন্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা প্রকাশিত জগজ্জ্যোতি পত্রিকায় রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায় লিখিত “শিকাগো ধর্মসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিঃ এক তথ্যনির্ভর ব্যবচ্ছেদ” নামে একটি অনন্য লেখা আমার হাতে আসে। এই লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৮৯৩ সালের এই ধর্মসভার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে বেশ কিছু প্রামাণ্য পুস্তক আছে।এগুলি হলঃ
১) The World’s Parliament of Religions, Edi. Rev John Henry Barrows
2) The World’s Congress of Religions at the world’s Columbian Exposition, Edi. J.W. Hanson
3) The Parliament of Religions and Religious Congress at the World’s Coluambian Exposite, Edi. Walter R. Houghton
2) The World’s Congress of Religions at the world’s Columbian Exposition, Edi. J.W. Hanson
3) The Parliament of Religions and Religious Congress at the World’s Coluambian Exposite, Edi. Walter R. Houghton
4) Review of the World’s Religious Congress, Edi. L.P. Mercer
5) A chorus of Faith. By Jenkin Lloyed Jones
রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায় তার প্রবন্ধে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দিখিয়েছেন যে, ব্যারোজের রিপোর্ট অনুযায়ী এই ধর্মসভায় যে ২০ জন ভারতীয় গুরুত্ব পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি জায়গা পেয়েছিলেন অনাগরিক ১) ধর্মপাল(২৩ পাতা), ২) হিন্দু মনিলাল দ্বিবেদী (২০.৫ পাতা), ৩) প্রতাপ মজুমদার (১৯ পাতা), ৪) যে যে মোদি (১৭ পাতা), ৫) স্বামী বিবেকানন্দ (১৫ পাতা), ৬) বি বি নাগরকার (১৫ পাতা)......।
বিখ্যাত ট্রিবিউন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ধর্মসভার এই বিবরণ। ব্যারোজের রিপোর্ট অনুসারে ২০শে সেপ্টেম্বর ছাড়া বিবেকানন্দ কোনদিন ট্রিবিউনের প্রথম পাতায় জায়গা পায়ননি। তার বক্তব্য নিয়ে শিকাগোর কোন কাগজেই হইচই হয় নি। অন্যান্য পত্রিকাতে বিবেকানন্দ সম্পর্কে সামান্য লেখালেখি হলেও কোথাও তাকে এই ধর্মসভার সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা, মহত্তম ব্যক্তি, সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয় নি। বরং “ডুবুক টাইমস” নামে একটি পত্রিকায় বিবেকানন্দকে নিন্দা করা হয়েছিল।
বিখ্যাত ট্রিবিউন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ধর্মসভার এই বিবরণ। ব্যারোজের রিপোর্ট অনুসারে ২০শে সেপ্টেম্বর ছাড়া বিবেকানন্দ কোনদিন ট্রিবিউনের প্রথম পাতায় জায়গা পায়ননি। তার বক্তব্য নিয়ে শিকাগোর কোন কাগজেই হইচই হয় নি। অন্যান্য পত্রিকাতে বিবেকানন্দ সম্পর্কে সামান্য লেখালেখি হলেও কোথাও তাকে এই ধর্মসভার সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা, মহত্তম ব্যক্তি, সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয় নি। বরং “ডুবুক টাইমস” নামে একটি পত্রিকায় বিবেকানন্দকে নিন্দা করা হয়েছিল।
শিকাগো ধর্মসভার পরে বিবেকানন্দ নিজের প্রচার শুরু করেন। তিনি তার শিস্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে একটি চিঠি লেখেন এবং এই চিঠিতে তিনি একাধিক মিথ্যে এবং অতিরঞ্জিত করে নিজের সাফল্য দেখান। পাশাপাশি ভারত থেকে আগত অন্যান্যদের নিকৃষ্ট বলে প্রচার করেন।
বিবেকানন্দের এই সাফল্যের ঢাক পিটাতে আরম্ভ করে “ইন্ডিয়ান মিরর” তারা অনাগরিক ধর্মপালের জায়গায় বিবেকানন্দের নাম বসিয়ে প্রচার করতে শুরু করে। এই প্রচারে সামিল হয় রামকৃষ্ণ মিশন। উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী পূর্ণানন্দ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ৫০ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশ করেন Golden Jubilee Souvenir। এখানে লেখা হয়েছে যে শিকাগো ধর্মসভার সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। যা একেবারে একটি মিথ্যা প্রচার। আমরা জানি যে নরেন্দ্রনাথ জন্মে ছিলেন ১২ই জানুয়ারী ১৮৬৩ সাল। অন্যদিকে অনাগরিক ধর্মপাল জন্মে ছিলেন ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৬৪ সালে। অর্থাৎ ধর্মপাল প্রায় ২ বছরের ছোট ছিলেন।
আরেকটি নির্ভেজাল মিথ্যে প্রচার দিয়ে এই প্রতিবেদনের সমাপ্তি করতে চাই। এটা বিবেকানন্দকে নিয়ে গুগলে প্রচারিত বিকৃত সাইবার তথ্য। এখানে বলা হয়েছে যে,
“১৮৭১ সালে, নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৮৭৭ সালে তার পরিবার সাময়িকভাবে রায়পুরে (অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ছত্তীসগঢ় রাজ্যে) স্থানান্তরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।[১৯] ১৮৭৯ সালে দত্ত পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা) প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনিই ছিলেন সেইবছর উক্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র।[১৯]
জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে (অধুনা স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা) পড়ার সময় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন।[২৩] ১৮৮১ সালে তিনি চারুকলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টি লিখেছেন, “নরেন্দ্র সত্যিকারের মেধাবী। আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি; এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন ছাত্রদের মধ্যেও দেখিনি”।
এই ডাহা মিথ্যেটি এখনো প্রচার করে চলেছে বিবেক বর্জিত বিবেক ভক্তের দল।কিন্তু তার এন্ট্রান্স, এফএ এবং স্নাতকের মার্কসিট দেখলে এই প্রশংসা হাস্যরস ছাড়া আর কিছুই ছড়াবে না। এন্ট্রান্সে ইংরেজিতে তাঁর নম্বর ছিল ৪৭, এফএ-তে ৪৬ এবং বিএ-তে ৫৬। অঙ্ক, ইতিহাস প্রভৃতিতেও ফলাফল আশানুরূপ নয়। লজিক বা বিবেকেই তিনি মাত্র ১৭ !!
সর্বপরি ব্রাহ্মণ্যবাদের করালগ্রাস থেকে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য তার অবদান একেবারে শূন্য। যে মুহূর্তে তার নিজের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের জন্য জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা চিন্তা করছেন সে মুহূর্তে তিনি কমন্ডুল, লাঠি এবং বগলে গীতা নিয়ে জাতপাতের মহিমা প্রচার করতে প্রফেটের ভূমিকা নিয়েছেন!তার নৈতিক শিক্ষা যে কী বিষবৃক্ষ তৈরি করেছে তা আমরা রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। পরিশেষে বলতে চাই যে, একমাত্র নির্মোহ গবেষণা এবং অধ্যায়ন আমাদের বিবেকানন্দ মিথ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ