বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 June, 2020

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা হলেন শ্রী রামানুজ। রামানুজের পূর্বে যারা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ছিলেন তাঁরা হলেন- নাথমুনি ও যমুনাচার্য। কিন্তু একমাত্র রামনুজই সুন্দরভাবে যুক্তি স্থাপন করে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে প্রচার করেছেন এবং এই মতাদর্শী সম্প্রদায়ও তৈরী করে গেছেন বলে রামানুজকেই বৈশিষ্টাদ্বৈতবাদের জনক বলা হয়। রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈতাবাদের ভিত্তি মূলত উপনিষদ, গীতা, মহাভারতের নারায়ণী অধ্যায় ও বিষ্ণু পুরাণ। দ্বৈতবাদ অনুসারে জগৎ ও ব্রহ্ম এক নয়, ভিন্ন। কিন্তু দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অনুসারে জগত ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয় আবার জগৎ মিথ্যা বা অস্তিত্বহীন নয়। কারণ ব্রহ্মই জগতে পরিণত হয়েছে। তবে ব্রহ্ম জগতে পরিণত হলেও তা ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্রহ্মের অপরিণামী ও পরিণামী এই দুইটি অংশ রয়েছে। পরিণাম অর্থ অবস্থান্তর বা বিকার। তাই যার অবস্থান্তর বা পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ যা বিকৃত হয়ে অন্য বস্তুতে পরিণত হয় তাই পরিণামী। ব্রহ্মের এই পরিণামী অংশের বিকার ঘটার কারণে জগতের উৎপত্তি হয়েছে। সোজা কথায় ব্রহ্ম রূপান্তরিত হয়ে জগতে পরিণত হয়েছে। তাই এই প্রাণিকুল ও উদ্ভিদকুলসহ দৃশ্যমান যা কিছু আছে তা ব্রহ্মের পরিবর্তিত রূপ।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদীদের নিকট জগৎ ব্রহ্ম হতে অভিন্ন কিন্তু জগৎ ব্রহ্ম নয়, কারণ ব্রহ্মের অচিৎ অংশ জগতে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্ম বলতে শুধু চিৎ বা নিত্য ও অপরিণামী অংশকেই বুঝতে হবে। মুণ্ডক উপনিষদের আছে-
 যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ যথা পৃথিব্যামোষধয়ঃ সম্ভবন্তি।
                                               যথা সতঃ পুরুষাৎ কেশলোমানি তথাহক্ষরাঃ সম্ভবতীহ বিশ্বম্।।
                                                                                                                    - মুণ্ডক (১/১/৭)
-ঊর্ণনাভ (মাকড়সা) যেমন নিজ দেহ থেকে তন্তু উৎপাদন করে পুনরায় নিজ দেহেই তা গ্রহণ করে, পৃথিবীতে যেমন করে ওষধিসমূহ (ধান, গম, যব প্রভৃতি) উৎপন্ন হয়, মনুষ্যদেহে যেমন করে কেশ ও লোম উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমন করে অক্ষর ব্রহ্ম হতে এই বিশ্বের উৎপত্তি।

মাকড়সা তার দেহে থেকে সুতা নির্গত করে জাল তৈরী করে। ঐ জাল মাকড়সার দেহ থেকে অভিন্ন নয়। জাল মূলত মাকড়সার দেহেরই একটি রূপান্তরিত অংশ। তাই জালকে মাকড়সা বলা যাবে না। তেমনি এই জীব-জগতও ব্রহ্মের একটি পরিবর্তিত রূপ। সেজন্য জীব-জগৎ ব্রহ্ম নয়। মাকড়সার জাল যেমন তার দেহ থেকে অভিন্ন তেমনি এই জীব-জগৎও ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদীরা মনে করেন ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি, তিনি নিজেই জগৎ হয়েছেন। যেহেতু জগৎ হল তার পরিণাম সেহেতু তিনি জগৎ নন। বদরায়ণ প্রণীত ব্রহ্মসূত্রে আছে- ‘‘আত্মকৃতে পরিণামাৎ’’ অর্থাৎ ব্রহ্মের পরিণামেই জগতের উৎপত্তি। ব্রহ্মসূত্রের অন্যত্র আছে- ‘‘উপসংহারদর্শনান্নেতি চেৎ ন ক্ষীরবৃদ্ধি’’ অর্থাৎ উপকরণ ব্যতীত ব্রহ্ম কিভাবে জগৎ সৃষ্টি করলেন? যদি এরকম আপত্তি ওঠে, তার উত্তরে আমরা বলব, দুগ্ধ যেমন দধিতে পরিণত হয় ব্রহ্মও সে রকম জগতে পরিণত হয়ে থাকে’’। উপকরণ বা উপাদান ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি সম্ভব নয়। তবে ব্রহ্ম জগৎ সৃষ্টি করলেন কি উপাদান দিয়ে? সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই ছিল না তবে ব্রহ্ম জগৎ তৈরীর উপাদান কোথায় পেলেন? এর উত্তর ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে এক কার্য-কারণ ভাব আছে। প্রত্যেক কার্যের মূলে একটা কারণ থাকে অর্থাৎ কারণ বিনা কার্য হয় না। যেমন কুমার মাটি দিয়ে কলস তৈরি করল। এখানে মাটি কারণ আর কলস কার্য। কার্য-কারণ একে অন্যের পরিপূরক। কারণ না থাকলে কার্য হয় না আবার কার্য ছাড়া কারণের অস্তিত্ব কি? জগৎ কার্য হলে তার কারণ হবে ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যেহেতু এক ও অদ্বিতীয় সেহেতু তিনি অন্য কোন উপাদান থেকে জগৎ সৃষ্টি করেননি। ব্রহ্ম নিজেই উপাদান কারণ অর্থাৎ ব্রহ্মের পরিণামী বা অচিৎ (জড়) অংশই জগতের উপাদান কারণ। দুধ দধিতে পরিণত হতে অন্য কোন উপাদানের প্রয়োজন হয় না। দুধের মধ্যেই যে উপাদান আছে তা দধিতে পরিণত হয়। তদ্রূপ ব্রহ্মের অচিৎ অংশে জগৎ সৃষ্টির উপাদান রয়েছে যা হতে জগৎ সৃষ্টি হয়। কিন্তু ব্রহ্মের চিৎ অংশ অপরিণামী অর্থাৎ তার বিকার নেই।

রামানুজের মতে জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ নাই কিন্তু স্বগত ভেদ আছে। স্বজাতীয় ভেদ বলতে একই জাতীয় দুটি জীবের মধ্যে ভেদ বা পার্থক্য বোঝায়। যেমন- দুইটি গরুর মধ্যে যে ভেদ। দুইটি ভিন্ন জাতীয় জীবের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বিজাতীয় ভেদ বলে। যেমন- একটি ঘোড়া ও একটি সিংহের মধ্যে যে ভেদ। একই জীবের শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে ভেদ, তাকে স্বগত ভেদ হল । যেমন- মানুষের হাত ও পায়ের মধ্যে যে ভেদ। যেহেতু ব্রহ্মের অচিৎ (জড়) অংশ জগতে পরিণত হয়েছে সেহেতু জগৎ ও ব্রহ্ম ভিন্ন জাতি নয় এবং একই জাতির দুটি ভিন্ন বস্ত্তও নয়। তাই জগত ও ব্রহ্মে কোন স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ নেই। কিন্তু ব্রহ্মের অচিৎ অংশ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে জড়-জগতে পরিণত হয়েছে। তাই জগতের পরিণাম বা বিকার আছে কিন্তু ব্রহ্মের চিৎ অংশের কোন পরিণাম বা বিকার নেই। জগৎ ও ব্রহ্ম একই দেহের দুটি অঙ্গ সরূপ। একই দেহের দুইটি অঙ্গের মধ্যে যেরকম ভেদ থাকে, সেরকম জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে স্বগত ভেদ রয়েছে। তাই জগৎকে ব্রহ্মের দেহ বলা চলে।

এই জগৎ পরিবর্তনশীল এবং জগতের জীব-জড় সকল বস্তু পরিবর্তনশীল। এক জড় পদার্থ অন্য জড় পদার্থে রূপান্তরিত হয়। জীবের জন্ম হয়, বৃদ্ধি ঘটে আবার মৃত্যু হয়। জগৎ যদি ব্রহ্মের দেহ হয়ে থাকে এবং জগতের সব কিছু যদি নশ্বর ও পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে তবে ব্রহ্মের কি পরিবর্তন হবে না? জগতের পরিবতর্নের সাথে ব্রহ্মেরও পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রামানুজ বলছেন, ব্রহ্ম বিকারশূন্য, অবিনশ্বর ও অপরিণামী। তিনি আরও বলেছেন যে, জগৎ যদি দেহ হয় তবে ব্রহ্ম হবে আত্মা। দেহের জন্ম-মৃত্যু আছে কিন্তু আত্মার জন্ম-মৃত্যু নেই। যেহেতু দেহের পরিবর্তনে আত্মার পরিবর্তন হয় না সেহেতু জগতের পরিবর্তনে ব্রহ্মেরও পরিবর্তন হবে না।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদ মতে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অনুসারে ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু তাঁর দুইটি ভাব, একটি ব্যক্ত এবং অপরটি অব্যক্ত ভাব। অব্যক্ত ভাবে তিনি নিরাকার, অনন্ত, অসীম ও নির্গুণ। ব্রহ্মের এ অব্যক্ত ভাবকে পরমাত্মা বলা হয়। জীবাত্মা হল পরমাত্মার অংশ। যেমন অগ্নির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ অগ্নির অংশ এবং ঐ স্ফুলিঙ্গের মধ্যে অগ্নির গুণ বিদ্যমান তেমনি জীবাত্মার মধ্যেও পরমাত্মার গুণ বিদ্যমান। পরমাত্মার মত জীবাত্মাও অবিনশ্বর অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুরহিত। যেহেতু জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ সেহেতু জীবাত্মা অসীম নয়, সসীম। জীবাত্মার আকার অতি সূক্ষ্ম বলেই তা জীবের সমস্ত শরীরব্যাপী রয়েছে। আত্মার আকৃতি অতি সূক্ষ্ম বলে তাঁকে নিরাকারই বলা চলে। জীবাত্মা সমীম কিন্তু পরমাত্মা বা ব্রহ্ম অসীম তাই জীবাত্মা ও ব্রহ্ম অভেদ হতে পারে না। আবার জীবাত্মা ব্রহ্মের চিৎ-সত্ত্বার ক্ষুদ্র অংশ, তাই জীবাত্মার সাথে ব্রহ্মের ভেদও থাকতে পারে না কারণ অংশকে অংশী হতে পৃথক করা যায় না। তাই রামানুজের মতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে ভেদ ও অভেদের সম্পর্ক বিদ্যমান অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক আবার দুই। রামানুজের তত্ত্বসংক্রান্ত অভিমতকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়। কেননা এই মতে চিৎ ও অচিৎবিশিষ্ট ব্রহ্মা এক ও অদ্বিতীয়।

উপনিষদের ‘‘তত্ত্বমসি’’ কথাটির প্রকৃত অর্থ হল- তুমিই সেই ব্রহ্ম। কিন্তু রামানুজ ‘তৎ’ শব্দের অর্থ করছেন জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্ম এবং ‘ত্বম’ শব্দের অর্থ করেছেন জীবরূপী ব্রহ্ম। তাহলে তত্ত্বমসি (তৎ-ত্বম-অসি) শব্দের অর্থ দুই প্রকার গুণবিশিষ্ট ব্রহ্মের মিলন বা একত্ব। রামানুজের মতে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার জন্য আত্মার বন্ধন হয়। দেহে আত্মা বন্ধনপ্রাপ্ত হলে পুনর্জন্ম লাভ হয় এবং কর্মফল ভোগ করতে হয়। দেহ ও আত্মা ভিন্ন। দেহকে আত্মা মনে করাই হল অজ্ঞানতা। উপনিষদের 'তত্ত্বমসি' মহাবাক্যে, রামানুজের মতে, তৎ ও ত্বতের একান্ত অভেদের কথা না বলে বিশিষ্ট-অভেদের কথাই বলা হয়েছে। 'এই সেই দেবদত্ত' বাক্যটিতে যেমন দুটি ভিন্নকাল ও ভিন্নস্থানবিশিষ্ট অর্থাৎ দুটি ভিন্নপ্রকারবিশিষ্ট একই দেবদত্তের অভেদের কথা বলা হয়, 'তত্ত্বমসি' বাক্যেও তেমনি দুটি ভিন্ন বিশেষণযুক্ত একই ব্রহ্মের অভেদের কথাই বলা হয়। কোন ক্ষেত্রেই একাত্ত অভেদ প্রতিপাদ্য নয়। 
'তত্ত্বমসি'— উপনিষদের এই বাক্যটির তাৎপর্য হল- দুটি ভিন্ন প্রকারবিশিষ্ট বা গুণবিশিষ্ট ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদন। 'তৎ' অর্থে 'সর্বস, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক ব্রহ্ম' এবং ‘ত্বম' অর্থে' অচিৎ-বিশিষ্ট 
জীব-শরীরক ব্রহ্মা'। জীব, ব্রহ্মের চিহ্ন অংশরূপে ব্রহ্মের সঙ্গে অপৃথকসিদ্ধি সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ায় জীব ও ব্রহ্মা কার্যত ভিন্ন, কিন্তু স্বরূপত অভিন্ন। কাজেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ভিন্নাভিন্নের অভেদ। 
হম' অর্থাৎ পরমাত্মা' এবং 'তৎ' অর্থাৎ জীবাত্মার' একান্ত অভেদ শঙ্করাচার্য শব্দদুটির লক্ষণার দ্বারা (গৌণ অর্থের দ্বারা) ব্যাখ্যা করেছেন। (পৃঃ ৩৮৪); রামানুজ শব্দদুটির মুখ্যার্থ (শক্যার্থ) গ্রহণ করে তাদের 'বিশিষ্ট অভেদ' প্রতিপাদন করেছেন।

আত্মার মুক্তির জন্য বেদ নির্দেশিত কর্ম যেমন- আশ্রমধর্ম পালন, যাগযজ্ঞ পভৃতি করতে হবে। এবং তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হবে। তবে ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে সাধনার দ্বারা তুষ্ট করলে ঈশ্বর মুক্তি দেবেন। তাই রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ দর্শনে জ্ঞান ও ভক্তিযোগের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় বেদান্তের প্রভাব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। তাদের নিকট সত্য বহুমুখী। বেদান্তীরা এই বহুমুখী সত্যকে বহুরূপে উপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। তাই বেদান্ত চিন্তা বহুমুখী। উপনিষদীয় ভাবধারায় পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তগুলিকে প্রয়োজনীয় মীমাংসার মাধ্যমে মহর্ষি বাদরায়ণ যেমন ব্রহ্মসূত্র রচনা করে অভিন্ন লক্ষ্যাভিমুখী করার উদ্যোগ নিয়ে একটি পরমতত্ত্বের মধ্যে সমন্বয়কৃত  ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, আবার এই ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বেদান্তী দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মতবাদেরও সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে আচার্য শঙ্কর প্রবর্তিত অদ্বয় পরমব্রহ্মের ভাবনাপ্রসূত বিশুদ্ধাদ্বৈতবাদ যেমন অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি এই ব্রহ্মসূত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা-ভাষ্যে জ্ঞানকাণ্ড-প্রধান অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিক্রিয়ারূপে উদ্ভূত হয়েছে রামানুজাচার্য-প্রবর্তিত ভক্তিপ্রধান বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।

শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ও রামনুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এই উভয় বেদান্ত-চিন্তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরস্পর-নিরপেক্ষ। অদ্বৈতবেদান্তের জ্ঞানপ্রধান, নির্বিশেষ, বিমূর্তচিন্তা দার্শনিক বিচারে অতি উচ্চস্তরের হলেও এইমত সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক-তৃপ্তি সাধনে সক্ষম হয়নি। এই অক্ষমতাই হয়তো ভক্তিবাদী রামানুজাচার্যকে ভক্তিমার্গ অনুসরণ করে ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বেদান্তমত প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছে। রামানুজের মতবাদও অদ্বৈত মতবাদ, তবে তা নির্বিশেষ নয়। আচার্য শঙ্কর তাঁর অদ্বৈতমতে এক অদ্বয় পরমব্রহ্ম ছাড়া পরমার্থত আর দ্বিতীয় কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কিন্তু আচার্য রামানুজ বহুর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে নির্গুণ ব্রহ্মবাদের সঙ্গে ঈশ্বরবাদের সমন্বয়ের প্রচেষ্টারূপে গণ্য করা যায়।

বলা বাহুল্য যে, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা ভারতীয় চিন্তাধারায় কোন অভিনব বা নতুন সংযোজন নয়। নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও ঈশ্বরবাদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো। রামানুজাচার্যের বহুপূর্বে ভাগবতের ঈশ্বরবাদে, উপনিষদের সপ্রপঞ্চ-ব্রহ্মবাদে, মহাভারতের নারায়ণীয় অধ্যায়ে, ভগবদ্গীতায় ও বিষ্ণুপুরাণে এই চিন্তাধারার আভাস পাওয়া যায়। প্রাচীন বৈষ্ণব তামিল-কবি আলবারদের নানা গাথা ও গ্রন্থ, ভাস্কর, যাদবপ্রকাশ ও যমুনাচার্য’র চিন্তাধারা, ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত, ভাগবত ও মহাভারতের বৈষ্ণবপাদ রামানুজের চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয়। বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ যে তাঁর পূর্বেকার লেখক যথা বোধায়ন, টঙ্ক, কপরদিন, ভারুচী প্রমুখের মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, বেদান্তসূত্রভাষ্য ‘শ্রীভাষ্য’-এ রামানুজ তা স্বীকার করেছেন।

দর্শনের পরমব্রহ্মকে ভক্তের ভগবানরূপে কল্পনা করে রামানুজ বেদান্ত দর্শনে ভক্তিবাদের অপূর্ব সমাবেশ করেছেন। বাস্তবভাব সমন্বয়ের দ্বারা একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা এবং ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য  মানুষের যে প্রবল বাসনা তার প্রতিষ্ঠা করাই রামানুজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষার সঙ্গে রামানুজের মতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই রামানুজ প্রচারিত দার্শনিক ভাবনা ও ধর্মমত সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো।
রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মূল্যায়ন
(Critical estimate of Ramanuja's Qualified Monism) 
রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ সাধারণ মানুষের কাছে এক অতি মূল্যবান দার্শনিক মতবাদরূপে গ্রাহ্য হলেও এই মতবাদে নানা অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় :

(১) রামানুজ ঈশ্বর ও জগতের সম্বন্ধকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। চিৎ ও অচিকে ব্রহ্মা বা ঈশ্বরের অংশরূপে গ্রহণ করেও, চিৎ ও অচিতের জগৎকে ব্রহ্ম-নির্ভর বলেও; রামানুজ ত্রিতত্ত্বের উল্লেখ করেছেন। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর, চিৎ ও অচিৎ। রামানুজের মতে, চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্ম-নির্ভর হলেও তারা রহ্মের ন্যায় নিত্য ও সনাতন সত্তা। রামানুজের এই অভিমত, ন্যায় গতভাবে, গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পরনির্ভর সত্তা কখনই স্বনির্ভর সত্তার সমতুল্য হতে পারে না। পাশ্চাত্য দর্শনে ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী দেকার্ডের (Descartes) বিরুদ্ধে একত্ববাদী স্পিনোজা (Spinoza) যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, রামানুজের বিরুদ্ধেও সেই একই অভিযোগ উত্থাপন করা যায়। দেকার্ত ঈশ্বর, জড় ও আত্মা— 'এই তিনটিকে দ্রব্য' (Substance) বললেও ঈশ্বরকে "স্বনির্ভর 'পরমদ্রব্য' এবং জড় ও আত্মাকে ঈশ্বর-নির্ভর 'সাপেক্ষদ্রব্য' বলেন। স্পিনোজার অভিযোগ হল--ঈশ্বর-সাপেক্ষ হলে জড় ও আত্মাকে কোনভাবেই দ্রব্য' বলা যায় না। দ্রব্যের লক্ষণ হচ্ছে স্বনির্ভরতা'। জড় ও আত্মা ঈশ্বর-নির্ভর অর্থাৎ অন্য-নির্ভর হওয়ায় তাদের কোনটিও দ্রব্য নয়। স্পিনোজার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য এবং জড় ও আত্মা, আরও স্পষ্টভাবে, বিস্তার ও চৈতন্য, এক ঈশ্বরের দুটি গুণমাত্র। রামানুজের বিরুদ্ধেও একইভাবে বলা যায় যে, চিৎ ও অচিৎ যদি ঈশ্বর-নির্ভর হয় তাহলে তাদের ঈশ্বরের সমতুল্য-সত্তাবান বলা যাবে না এবং চিৎ ও অচিৎ উপাদানে সৃষ্ট জীবজগৎকে ঈশ্বর অতিরিক্তভাবে 'সৎ' বলাও যাবে না। কাজেই, ত্রিতত্ত্বের পরিবর্তে একটি তত্ত্ব স্বীকার করে বলতে হবে যে, ঈশ্বরই কেবল পরমার্থসৎ।

(২) রামানুজ ঈশ্বরকে অংশী এবং চিৎ ও অচিংকে ঈশ্বরের অংশ বলেছেন এবং তাদের মধ্যে অপৃথকসিদ্ধি সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। রামানুজের মতে, ঈশ্বর তাঁর অন্তঃস্থ চিৎ ও অচিৎ উপাদানের সাহায্যে এই বিচিত্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন। ঊর্ণনাভ যেমন তার অন্তঃস্থ উপাদান থেকে বিচিত্র আবাস (জাল) রচনা করে, ঈশ্বরও তেমনি তাঁর অন্তঃস্থ উপাদান থেকে জগৎ রচনা করেছেন। কিন্তু এমন বললে অংশের (অন্তঃস্থ উপাদানের) পরিণামের (পরিবর্তনের) সঙ্গে অংশীরও (ঈশ্বরেরও) পরিবর্তন স্বীকার করতে হয়। অংশের বিকার হলে অংশীরও বিকার ঘটে। এমন ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে জগতের মতো পরিণামী ও দোষযুক্ত এবং জীবের মতো দুঃখকষ্ট নিপীড়িতরূপে স্বীকার করতে হয়।

রামানুজ অবশ্য আপত্তিটিকে নানা উপমার সাহায্যে খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন-- আত্মা ও শরীরের উপমা, রাজা এ প্রজার উপমা, দ্রব্য ও গুণ অথবা বিশেষ্য ও বিশেষণের উপমা। আত্মা ও শরীরের উপমাটি ব্যাখ্যা করা গেল। আত্মা যেমন শরীরের মধ্যে থেকে শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে, ঈশ্বরও তেমনি চিৎ-অচিৎ-বিশিষ্ট জগতের মধ্যে থেকে জগৎকে নিয়ন্ত্রিত করেন। শরীরের বিকার ও অপূর্ণতা যেমন আত্মাকে স্পর্শ করে না, জগতের পরিবর্তন ও অসম্পূর্ণতা তেমনি ঈশ্বরকে স্পর্শ করে না। কিন্তু এই প্রকার উপমার সাহায্যে ঈশ্বর ও জগতের সম্বন্ধের সঠিক ব্যাখ্যা হয় না। বদ্ধজীবের (বদ্ধআত্মার) সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক আকস্মিক, অজ্ঞানজন্য। ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বদ্ধজীবের সঙ্গে তার শরীরের সম্পর্কের অনুরূপ হলে, অর্থাৎ জগৎকে ঈশ্বরের শরীর বললে, ঈশ্বরের সেই শরীরকেও আকস্মিক ও অজ্ঞানজন্য বলতে হয়। এমন ক্ষেত্রে ঈশ্বরও বদ্ধজীবে পরিণত হন। রামানুজের অপরাপর উপমাগুলির ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়।

(৩) রামানুজ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের সম্পর্ককেও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। রামানুজের মতে, জীব বা আত্মা ব্রহ্মের অন্তর্গত হওয়ায় জীব ও ব্রহ্ম অভেদ হতে পারে না সমগ্র ও অংশ কখনই অভেদ নয়। আবার জীব ব্রহ্মের অন্তর্গত হওয়ায় ও তাদের মধ্যে অপৃথকসিদ্ধি সম্পর্ক থাকায় জীব ও ব্রহ্মের একান্ত ভেদও থাকতে পারে না। জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক ভেদ এবং অভেদও অর্থাৎ ভেদাভেদও হতে পারে না, কেননা তা ন্যায়শাস্ত্র বিরোধী। দুটি বিরুদ্ধধর্ম এককালে একই বস্তুকে আশ্রয় করে থাকতে পারে না। ভেদ ও অভেদ, আলোক ও অন্ধকারের ন্যায়, পরস্পর-বিরোধী হওয়ায় তারা একই পদার্থকে আশ্রয় করে থাকতে পারে না।

রামানুজ অবশ্য ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে 'অভেদই' বলেন, যদিও তা একান্ত অভেদ' নয়, তা হচ্ছে বিশিষ্ট অভেদ'। ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও বিজাতীয়ভেদ স্বীকার না করলেও, রামানুজ ব্রহ্মের স্বগতভেদ স্বীকার করেন। রামানুজের মতে, ব্রহ্মের অন্তর্গত চিৎ ও অচিৎ-এর ভেদ থাকার ব্রহ্মা স্বগতভেদবিশিষ্ট। জীব ও জগৎ ব্রহ্মের স্বগতভেদ। তবে, স্বগতভেদবিশিষ্ট হলেও ব্রহ্মা এক এবং অদ্বিতীয়। চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট হওয়ায় ব্রহ্ম এক ও অন্বয়। ব্রহ্ম বিশিষ্ট অথয়া বা “বিশিষ্ট অদ্বৈত'।

রামানুজের এ প্রকার বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বিশিষ্টতা এবং অন্বয়াত্বের মধ্যে যোগসাধন ন্যায় গতভাবে (logically) সম্ভব নয়। বিশিষ্টতা বা ভিন্নতা (অর্থাৎ বছর) প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা হয় না; আবার অদ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অভ্যসত্তার স্বগতভেদও স্বীকার করা যায় না। রামানুজ আসলে দুটি বিরুদ্ধ মতবাদকে——— জ্ঞানভিত্তিক একত্ববাদ ও ভক্তিভিত্তিক বহুত্ববাদকে তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে সমন্বিত করতে চেয়েছেন। রামানুজ একদিকে যেমন উপনিষদীয় নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অদ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তেমনি আবার উপনিষদের সম্প্রপক্ষ ব্রহ্মাবাদ, বৈষ্ণববাদ, ভগবতগীতার ঈশ্বরবাদ প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহুত্ববাদকেও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু অদ্বৈতবাদের সঙ্গে বহুত্ববাদের সমন্বয়সাধ্য কোনভাবেই সম্ভব নয়। একথা নিঃসঙ্কোচে বলা চলে যে, যুক্তিযুক্ততার দিক থেকে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ শঙ্করের অদ্বৈতবাদের সমতুল্য নয়। শঙ্কর তাঁর অসামান্য বুদ্ধি ও সুক্ষ্ম বিচারশক্তির দ্বারা, নিশ্ছিদ্র প্রায় যুক্তিসমূহের দ্বারা, তাঁর অদ্বৈতবাদকে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, রামানুজ তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হননি। মননশীলতাকে, যুক্তিযুক্ততাকে প্রাধান্য না দিয়ে রামানুজ তার মতবাদকে সাধারণের কাছে অধিকতর হৃদয়গ্রাহী ও গ্রহণযোগ্য করতে চেয়েছেন। শঙ্করের মতবাদ যুক্তিভিত্তিক। রামানুজের মতবাদ হৃদয়ভিত্তিক। শহরের আবেদন মানুষের বুদ্ধির কাছে। রামানুজের আবেদন মানুষের অনুভূতির কাছে। শঙ্করদর্শন মননশীল মানুষের কাছে সমাদৃত। রামানুজের দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে আদরণীয়। সাধারণ মানুষ তাদের অধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তির জন্য জ্ঞানমার্গ অপেক্ষা ভক্তিমার্গকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। সাধারণ মানুষ নিজেকে ব্রহ্মস্বরূপে উপলব্ধি করার পরিবর্তে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে জগৎ পিতারূপে কল্পনা করে ঈশ্বর সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চায়। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের বৈষ্ণববাদে করুণাময় ঈশ্বরকে জীবের পিতা ও ত্রাতারূপে গণ্য করায় তা সাধারণ মানুষের কাছে শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অপেক্ষা বেশি আদরণীয় ও সমাদৃত হয়েছে। যুক্তি-যুক্ততার দিক থেকে নানা অসঙ্গতি থাকলেও সাধারণ মানুষের জীবনে রামানুজের মতবাদের উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। সূক্ষ্মবিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে শঙ্কর-দর্শন যেমন এক অতি গৌরবের দর্শন, সাধারণ মানুষের জীবনে তেমনি রামানুজ-দর্শনও এক আদরণীয় দর্শন।


আবার রামানুজের মত নিম্বার্কও (খৃীঃ1100-1162)

ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দস্বরূপ, জগত-কারণ, অপ্রাকৃতবহুগুণাধার প্রভৃতি রূপে উপলব্ধি করেন। পার্থক্য এই যে, শ্রীকৃষ্ণকেই ঈশ্বর ও শ্রীমতী রাধাকে তাঁর শক্তি বলে তিনি অনুভব করেন। এবিষয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিমতের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য। রামানুজের মত তিনিও জীবাত্মাকে স্বরূপতঃ চেতন, জ্ঞানাশ্রয়, ঈশ্বর-নিয়ন্ত্রিত, ঈশ্বরাশ্রিত, পরিমাণে অনু এবং সংখ্যায় অনন্ত প্রভৃতি মনে করেন। পার্থক্য এই যে, চিৎ এবং অচিৎময় বিশ্বকে তিনি ঈশ্বরের দেহ বলে মনে করেন না, শক্তির পরিণাম বলেই চিন্তা করেন। রামানুজাচার্য্য ভেদকে স্বীকার করলেও তাঁর মতে অভেদের প্রাধান্য, জীবজগত বা যাবতীয় প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ নিয়ে ঈশ্বর একরি সমগ্র একক সত্তা। নিম্বার্কের মতে কেবল অভেদ হলে ঈশ্বরও দুঃখভাগী হয়ে পড়েন, তাঁর পূর্ণ শুদ্ধ সত্তা থাকে না। আবার চিৎ ও অচিৎ যেহেতু তাঁর শক্তি- পরিণাম বা অংশ, সেইহেতু অভেদও তাঁর মতে সত্য। ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের ও জগতের ভেদ এবং অভেদ বিষয়ে কারণ-কার্যের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছেন নিম্বার্ক| ব্রহ্ম কারণ এবং জীব ও জগত তাঁর কার্য্য। ব্রহ্ম অংশী, জীব-জগত অংশ, ব্রহ্ম জ্ঞেয়, জীব জ্ঞাতা, ব্রহ্ম উপাস্য, জীব উপাসক, অন্তর্যামী ব্রহ্ম নিয়ন্তা, জীব নিয়ন্ত্রিত। আবার ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ, জগত জ্ঞানহীন। নিম্বার্ক এই ভেদ ও অভেদকে স্বাভাবিক মনে করেছেন বলে তাঁর অভিমতকে বাস্তব ভেদাভেদবাদ / দ্বৈতাদ্বৈতবাদঃ বলে অভিহিত করা হয়।

রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খ্রিঃ)
আচার্য রামানুজ ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের শ্রীপেরম্বুদুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ ১২০ বছর জীবনধারণ করে ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বাল্য নাম লক্ষ্মণ। পিতার নাম কেশব ভট্ট এবং মাতার নাম কান্তিমতি। শৈশবে তিনি পিতৃহীন হন। যমুনাচার্য তাঁর মাতামহ এবং মহাপূর্ণ তাঁর মাতুল। বাল্যকালে তিনি কাঞ্চিপুরীতে আচার্য যাদবপ্রকাশের কাছে বেদান্ত অধ্যয়ন শুরু করেন, কিন্তু পরে মতবিরোধ-হেতু তিনি গুরু কর্তৃক বিতাড়িত হন। তারপর তিনি মাতামহ যমুনাচার্যের কাছে বেদান্তের পাঠ গ্রহণ করেন এবং শঙ্কর, ভাস্কর ও যাদবপ্রকাশের মতবাদ খণ্ডন করে বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ প্রচার করেন।

আচার্য রামানুজ ছিলেন অতীব ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। মহর্ষি বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তিনি যে ব্রহ্মসূত্রভাষ্য রচনা করেন তা ‘শ্রীভাষ্য’ নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও তিনি ‘গীতাভাষ্য’, ‘বেদান্তদীপ’, ‘বেদান্তসংগ্রহ’, ‘শরণাগতিগদ্য’, ‘শ্রীরঙ্গগদ্য’, ‘আগমপ্রামাণ্য’, ‘সিদ্ধিত্রয়’, ‘মহাপুরুষনির্ণয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

রামানুজের পরেও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের সমর্থনে বহু গ্রন্থ রচিত হয়। রামানুজের পরবর্তীকালের রামানুজ-শিষ্য সুদর্শন সূরি’র শ্রীভাষ্যের ‘শ্রুতপ্রকাশিকাটীকা’, বেঙ্কটনাথ-এর ‘শতদূষণী’, ‘ন্যায়পরিশুদ্ধি’, ‘তত্ত্বটীকা’, মেঘনাদারির ‘ন্যায়দ্যুমণি’, আচার্য শ্রীনিবাস-এর ‘যতীন্দ্রমতদীপিকা’, লোকাচার্য’র ‘তত্ত্বত্রয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের উপর অতি মূল্যবান গ্রন্থ।

রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের এক অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। পরম সদ্ববস্তুই পরম কল্যাণ এবং পরম অন্বিষ্ট সত্তা, কল্যাণ এবং পুরুষার্থ আত্যন্তিক অর্থে সমন্বিত, এই সত্যটিকে বিশিষ্টাদ্বৈত মতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। রামানুজের মতে ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। তবে-
বিশিষ্টাদ্বৈত মতে যদিও ব্রহ্মই চূড়ান্ত সত্য, তবুও ব্রহ্মকে নির্গুণ আখ্যা দেয়া ভুল। বরং ব্রহ্মকে অনন্ত-কল্যাণগুণের আধার মনে করতে হবে। তিনিই ঈশ্বর; উপাসনা সৎকর্মের সাহায্যে তাঁর করুণার উদ্রেক করতে পারলেই জীবের মুক্তি। পরিদৃশ্যমান জড়জগৎ এবং জীবাত্মার স্বাতন্ত্র্য মিথ্যা নয়। কেননা, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের মধ্যেই চিৎ এবং অচিৎ- চেতনা এবং জড়- উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। চিৎ বৈশিষ্ট্য থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি, অচিৎ থেকে জড়জগতের। ব্রহ্ম চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট। জীবাত্মার সঙ্গে জড়দেহের সম্পর্কই বন্ধনের স্বরূপ এবং তার মূলে রয়েছে জন্মজন্মান্তরের কৃতকর্মজনিত অজ্ঞান। ঈশ্বরের করুণায় জীবাত্মা এই অজ্ঞান কাটিয়ে মুক্তিলাভ করবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭)

ঈশ্বর, চিৎ-শক্তি এবং অচিৎ-শক্তি এই ত্রিতত্ত্বে রামানুজ বিশ্বাস করেন। তার মতে ঈশ্বরই পরমতত্ত্ব। ঈশ্বর বিশেষ্য, চিৎ ও অচিৎ তার বিশেষণ। প্রমাণ ও প্রমেয় বিচারে রামানুজের মতে বিশিষ্ট ব্রহ্মই একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ জ্ঞানের ত্রিবিধ উপায়। তবে আচার্য রামানুজও শাস্ত্র বা শব্দপ্রমাণকেই প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন, ব্রহ্মবাদী বাদরায়ণের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- 

‘যস্মিন্ শব্দ এব প্রমাণং ন ভবতি, তৎ ‘অশব্দম্’, আনুমানিকং…’। ৪।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)
অর্থাৎ : যে বিষয়ে শব্দ বা আগম প্রমাণের অভাব, তা-ই অশব্দ- আনুমানিক (শ্রীভাষ্য-৪-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।
আবার অন্যত্র প্রত্যক্ষ-প্রমাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-


‘…শ্রুতিভিশ্চ ব্রহ্মব্যতিরিক্তস্য মিথ্যাত্বমবগম্যতে। নচাগমাবগতার্থস্য প্রত্যক্ষবিরোধঃ শঙ্কনীয়ঃ, যথোক্তপ্রকারেণ কার্যস্য মিথ্যাত্বাবগমাৎ, প্রত্যক্ষস্য সম্মাত্রবিষয়ত্বাচ্চ। বিরোধে সত্যপ্যসম্ভাবিতদোষস্য চরমভাবিনঃ স্বরূপসম্ভাবাদৌ প্রত্যক্ষাদ্যপেক্ষত্বেহপি প্রমিতৌ নিরাকাঙ্ক্ষস্য নিরবকাশস্য শাস্ত্রস্য বলীয়স্ত্বাৎ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)
অর্থাৎ :
শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মাতিরিক্ত বস্তুমাত্রেরই মিথ্যাত্ব জানা যায়। শাস্ত্র (শ্রুতি) দ্বারা নির্ধারিত বিষয়ে কখনোই প্রত্যক্ষের বিরোধ সম্ভাবিত হতে পারে না। কারণ পূর্বোক্ত প্রণালীতে সমস্ত জন্যপদার্থের (জগৎকার্যের) মিথ্যাত্ব নির্ধারিত হয়, আর প্রত্যক্ষ দ্বারা কেবল বস্তু-সত্তা মাত্র সিদ্ধ হয়। স্বভাবত নির্দোষ শাস্ত্র প্রত্যক্ষের পরভাবী, সুতরাং শাস্ত্রের অর্থ বুঝতে হলে প্রত্যক্ষের কথঞ্চিৎ অপেক্ষা থাকলেও কিন্তু শাস্ত্র-লব্ধ জ্ঞানে প্রত্যক্ষের কিছুমাত্র অপেক্ষা নাই; সুতরাং সে-অবস্থায় শাস্ত্র প্রত্যক্ষ-নিরপেক্ষ; নিরপেক্ষ বলেই সেই অংশে প্রত্যক্ষ অপেক্ষাও শাস্ত্রের বলবত্তা অধিক (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।
 রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা
আচার্য শঙ্করের ন্যায় রামানুজও ব্রহ্মকেই চরম ও পরম সত্তা বা সত্যরূপে গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁর মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। জগৎ ব্রহ্মের অচিৎ অংশ এবং জীবাত্মা ব্রহ্মের চিৎ অংশ। চিৎ এবং অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, তবে তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। বিশ্বের সব কিছুই ঈশ্বরের শরীর এবং ঈশ্বর হলেন অজৈব প্রকৃতি ও সকল জীবের আত্মা। চিৎ বা অচিৎ, ব্রহ্মের কোন অংশই মিথ্যা নয়। উভয় অংশই ব্রহ্মে বিধৃত। চিৎ ও অচিৎ-এর দ্বারা বিশিষ্ট বলেই রামানুজের ব্রহ্ম বিশিষ্টব্রহ্ম। অতএব, দার্শনিক বিচারে বলতে গেলে বলতে হয়, রামানুজ তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম, চিৎ ও অচিৎ এই ত্রিতত্ত্ব স্বীকৃত, তবে এই ত্রিতত্ত্ব সমন্বিত হয়ে এক পরমতত্ত্বে পর্যবসিত। এই পরমতত্ত্বই বিশিষ্ট অদ্বৈত ব্রহ্ম বা সগুণ ব্রহ্ম।

আচার্য রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যের মঙ্গলাচরণেই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মূলতত্ত্বকে অতি সংক্ষেপে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন-

‘অখিল জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় যাঁহার লীলা, শরণাগত বিবিধ জীবের রক্ষাই যাঁহার একমাত্র ব্রত এবং যিনি বেদান্তশাস্ত্রে বিশেষভাবে প্রতিপাদিত, সেই পরব্রহ্ম শ্রীনিবাস নারায়ণে আমার ভক্তিরূপা বুদ্ধি উৎপন্ন হউক।’- (যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের তর্জমায়)।

অর্থাৎ এই মঙ্গলাচরণে একথাই প্রতিপাদিত হয় যে, রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ, জগৎ-কারণ, রক্ষাকর্তা, ধ্বংসকর্তা ও ভক্তের পরমকরুণাময় ভগবান। এই পরমতত্ত্ব ভক্তির দ্বারাই বোধগম্য। তাই ভক্তিই তত্ত্বজ্ঞানলাভের উপায়।
তাহলে রামানুজের ব্রহ্মের স্বরূপ কী ?

২.১ : ব্রহ্মের স্বরূপ
রামানুজের মতে ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি এবং তা হলো- চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ- আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম স্বগত ভেদযুক্ত কিন্তু অপৃথকসিদ্ধ, সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্মই জগতের কর্তা এবং পরিণামস্বরূপ। তিনি নিত্যতৃপ্ত, বিকারহীন ও অনন্ত-কল্যাণময়। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেন-

‘অতঃ সর্ব্বজ্ঞঃ সর্ব্বশক্তিঃ সর্ব্বেশ্বরো নিরস্ত-সমস্তদোষগন্ধো অনবধিকঃ অতিশয়াসংখ্যেয় কল্যাণগুণগণ্যেঘমহার্ণবঃ পুরুষোত্তমো নারায়ণ এব নিখিলজগদেককারণং জিজ্ঞাস্যং ব্রহ্মেতি চ স্থিতম্’। ১।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
অতএব, এটাই স্থির হলো যে, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তি, সর্বপ্রকার দোষস্পর্শশূন্য, নিরবধি নিরতিশয় এবং অসংখ্য কল্যাণকর গুণের মহাসমুদ্রস্বরূপ সেই পুরুষোত্তম নারায়ণই সমস্ত জগতের কারণস্বরূপ জিজ্ঞাস্য (জিজ্ঞাসার বিষয়ীভূত) ব্রহ্ম (শ্রীভাষ্য-১-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
ব্রহ্ম স্বগত-ভেদযুক্ত
রামানুজের নিকট ব্রহ্ম কোন অভেদতত্ত্ব নন। শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে একমত যে, ব্রহ্মের কোন স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ নেই। একই জাতির অন্তর্গত দুটি ব্যক্তির ভেদকে বলা হয় স্বজাতীয়ভেদ; যেমন- দুটি মানুষের পারস্পরিক ভেদ। অপরদিকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতির অন্তর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় বিজাতীয়ভেদ; যেমন- একটি গরু সঙ্গে একটি অশ্বের ভেদ। এই দু’প্রকার ভেদ ছাড়াও তৃতীয় যে ভেদ প্রসিদ্ধ তা হলো স্বগতভেদ। একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ; যেমন- একই মানুষের হাত ও পায়ের ভেদ। একমাত্র ব্রহ্মই সত্য হওয়ায় বা ব্রহ্মের বাইরে কিছু না থাকায় ব্রহ্মের স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ সম্ভব নয়। ব্রহ্মের স্বজাতীয় ভেদ নেই, কারণ ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। আবার ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদ নেই, যেহেতু ব্রহ্মের অসদৃশ কিছুই নেই। তবে রামানুজের মতে ব্রহ্মের স্বগত ভেদ বর্তমান। একই ব্রহ্মে বিধৃত চিৎ ও অচিৎ অংশের ভেদই হলো ব্রহ্মের স্বগত ভেদ। তাই ব্রহ্ম সবিশেষ বা বিশিষ্ট।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ব্রহ্মের অন্তর্গত চিৎ ও অচিৎ-এর ভেদ রামানুজ-মতে এমন দুটি অংশের ভেদ, যারা ভিন্ন হলেও তাদের সম্পূর্ণ পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। রামানুজ ব্রহ্মের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সম্বন্ধকে অপৃথকসিদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন।

ব্রহ্ম অপৃথকসিদ্ধ
ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে একটি পৃথক সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন।

‘অপৃথকসিদ্ধি’ কথাটির অর্থ হলো ‘অবিচ্ছেদ্যতা’। রামানুজের মতে এই সম্বন্ধ দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্য ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়-স্বীকৃত সমবায় সম্বন্ধের সদৃশ। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহের সম্বন্ধকে ‘সমবায় সম্বন্ধ’ বলেছেন। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিরা সমবায় সম্বন্ধকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তাঁদের মতে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি।  তাই অপৃথকসিদ্ধিকে ঠিক সম্বন্ধ বলা যায় না; যদিও এটি সম্বন্ধরূপে অভিহিত হয়। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকদের সমবায় সম্বন্ধ এবং রামানুজের অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ- এই দুটির মধ্যে সাদৃশ্য হলো, উভয় সম্বন্ধই স্বতন্ত্র ও বাস্তব বিষয়সমূহে সম্বন্ধযুক্ত করে। তবে অপৃথকসিদ্ধি হলো আভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ, কিন্তু সমবায় সম্বন্ধ তা নয়।

রামানুজের মতে অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো- দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধ আবার দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্যের ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। রামানুজ দেহের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।’ এক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি। এই অপৃথকসিদ্ধির ধারণাটিকে রামানুজের দার্শনিক মতের কেন্দ্রভূমিরূপে গণ্য করা হয়।

চিৎ ও অচিৎ- উভয়ই হলো ঈশ্বরের শরীর। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং উভয়েই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান। চিৎ, অচিৎ এবং ঈশ্বরের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। এই তিনটি বিষয় একই ঐক্যে আবদ্ধ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রাণাধীন। রামানুজের পরমতত্ত্ব বা ব্রহ্ম হলেন এই ঈশ্বর। জীবের আত্মার সঙ্গে শরীরের যে সম্বন্ধ থাকে, ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সেই সম্বন্ধ আছে। একটি প্রাণীদেহে যেমন আত্মাই প্রাধান্য লাভ করে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ-এর সঙ্গে ঈশ্বরের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ থাকলেও ঈশ্বরই প্রাধান্য লাভ করেন এবং চিৎ ও অচিৎকে নিয়ন্ত্রিত করেন। চিৎ ও অচিৎ- এই দুটি অধীন বিষয়কে বিশেষণরূপে এবং ঈশ্বরকে বিশেষ্যরূপে গণ্য করা হয়েছে। যেহেতু কোন বিশেষণ বিশেষ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না, সেহেতু যে সমগ্রের তারা অন্তর্ভুক্ত সেই সমগ্রটিকে অদ্বৈত বা এক বলা হয়েছে। চিৎ ও অচিৎ- এই বিশেষণের দ্বারা ঐ এক বা অদ্বৈত বিশিষ্ট হয় বলে রামানুজের দার্শনিক মতকে বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তদর্শন বলা হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈতের ধারণাটিকে একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে পরিস্ফুট করা যায়। যেমন, একটি লাল গোলাপের লাল রংটি হলো গুণ, গোলাপটি দ্রব্য। দ্রব্য ও গুণ এক নয়। তাই লাল রংটি গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্র। আবার লাল রংটি গোলাপের গুণ হবার জন্য গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না। রংটির অস্তিত্ব গোলাপ ফুলটির উপর নির্ভর করে। সেজন্য রংটি যে গোলাপের বাইরে আছে, তা বলা যায় না। রং ও অন্যান্য বিশেষণ নিয়ে গোলাপটি একটি সমগ্র এবং গুণগুলি ঐ সমগ্রের অন্তর্ভুক্ত। রামানুজ লাল রং ও গোলাপের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করেছেন। তিনি দ্রব্য ও গুণের এই পার্থক্যকে বলেছেন স্বগত ভেদ। রামানুজ ‘নীলোৎপল’ বা নীলপদ্মের উদাহরণ টেনেও বিষয়টির বিশ্লেষণ করে বলেছেন-

‘যথা ‘নীলমুৎপলম্’ ইতি পদদ্বয়স্য বিশেষ্যৈকত্ব-প্রতিপাদনপরত্বেন নীলত্বোৎপলত্বরূপ-বিশেষণদ্বয়ং ন বিবক্ষ্যতে। তদ্বিবক্ষায়াং হি নীলত্ববিশিষ্টাকারেণ উৎপলত্ববিশিষ্টাকারস্যৈকত্ব প্রতিপাদনং প্রসজ্যেত; তত্তু ন সম্ভবতি, নহি নৈল্যবিশিষ্টাকারেণ তদ্বস্তু উৎপলপদেন বিশিষ্যতে, জাতি-গুণয়োরন্যোন্যসমবায়প্রসঙ্গাৎ। অতো নীলত্বোৎপলত্ব উপলক্ষিত-বস্ত্বৈক্যমাত্রং সামানাধিকরণ্যেন প্রতিপাদ্যতে।’ ১২।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
‘নীলবর্ণ উৎপল’ বললে এস্থলে বিশেষণ ও বিশেষ্য, উভয় পদেরই একমাত্র বিশেষ্য-বোধনে তাৎপর্য থাকায় ‘নীলত্ব’ ও ‘উৎপলত্ব’ এই দুটি বিশেষণ আর পৃথকভাবে বক্তার অভিপ্রেত হয় না। আর যদি নীলত্ব ও উৎপলত্বের পৃথক প্রতীতিই হতো, তাহলে নিশ্চয়ই উৎপলত্ব ধর্মবিশিষ্ট পদার্থটির (উৎপলের) নীলত্ব ধর্মবিশিষ্টরূপে অভেদ প্রতীতি অপরিহার্য হতো; অথচ তা সম্ভব হয় না; কারণ, উৎপল পদার্থটি কখনোই উৎপল পদ দ্বারা নীলত্ববিশিষ্টরূপে বিশেষিত হয় না; কেননা, তাহলে জাতি ও গুণের মধ্যে পরস্পর সমবায় সম্বন্ধের সম্ভাবনা হয়ে পড়ে। অতএব, বুঝতে হবে যে, নীলত্ব ও উৎপলত্ব ধর্মদ্বয়বিশিষ্ট বস্তুর কেবল একত্বই উক্ত সামানাধিকরণ্য দ্বারা প্রতিপাদিত হয় (শ্রীভাষ্য-১২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
ব্রহ্ম সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ
রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ। তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বর নির্বিশেষ বা নির্গুণ ব্রহ্ম নন। কারণ চিৎ ও অচিৎ তাঁর বিশেষণ। চিৎ ও অচিৎ তাঁর শরীর, তিনি তাদের আত্মা। রামানুজ চিৎ ও অচিৎ-এর সত্তা স্বীকার করেছেন, তবে তিনি তাদের স্ব-নির্ভর সত্তা স্বীকার করেননি। কারণ চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মাধীন এবং ব্রহ্ম-নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ব্রহ্মই পরম তত্ত্ব এবং তিনটি মাত্রাত্মক অদ্বৈতসত্তা। রামানুজের মতে উপনিষদে যে নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ হলো ব্রহ্মের অজ্ঞতা, জড়তা, ক্ষুদ্রতা প্রভৃতি হেয় গুণগুলি নেই। রামানুজ অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্মের অসিদ্ধি প্রতিপাদন করতে গিয়ে বলেন-

‘অত এব নির্ব্বিশেষ-চিন্মাত্রব্রহ্মবাদঃ অপি সূত্রকারেণ আভিঃ শ্রুতিভির্নিরস্তো বেদিতব্যঃ। পারমার্থিক-মুখ্যেক্ষণাদিগুণযোগি জিজ্ঞাস্যং ব্রহ্মেতি স্থাপনাৎ। নির্ব্বিশেষবাদে হি সাক্ষিত্বমপ্যপারমার্থিকম্, বেদান্ত-বেদ্যং ব্রহ্ম জিজ্ঞাস্যতয়া প্রতিজ্ঞাতম্ । তচ্চ চেতনমিতি ‘ঈক্ষতের্নাশব্দম্’ ইত্যাদিভিঃ সূত্রৈঃ প্রতিপাদ্যতে। চেতনত্বং নাম চৈতন্য-গুণযোগঃ। অত ঈক্ষণগুণবিরহিণঃ প্রধানতুল্যত্বমেব।’ ২।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
অর্থাৎ :
অতএব, জিজ্ঞাস্য ব্রহ্মে পারমার্থিক (প্রকৃত সত্য) মুখ্য ঈক্ষণ (আলোচনা) প্রভৃতি গুণসম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ায় এটাও বুঝতে হবে যে, (ব্রহ্মসূত্রের) সূত্রকার (বাদরায়ণ) কর্তৃক উক্ত শ্রুতিসমূহ দ্বারা নির্বিশেষ চিন্মাত্র ব্রহ্মবাদও (শঙ্করমতও) প্রত্যাক্ষাত হয়েছে। কেননা, নির্বিশেষবাদে ঈশ্বরের সাক্ষিত্ব ধর্মও অপারমার্থিক বা অসত্য ; (সুতরাং গৌণ)। বেদান্ত-বেদ্য ব্রহ্মই এখানে জিজ্ঞাস্যরূপে প্রতিজ্ঞাত হয়েছেন ; সেই ব্রহ্ম যে চেতন বস্তু, তা-ই ‘ঈক্ষতেঃ নাশব্দম্’ এসব শব্দ দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে। চেতনত্ব অর্থই চৈতন্যগুণের যোগ বা সম্বন্ধ ; অতএব, ঈক্ষণ-গুণহীন পদার্থ (ব্রহ্ম) তো সাংখ্যোক্ত প্রধানেরই সমান (শ্রীভাষ্য-২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।
অতঃপর রামানুজ আরো বলেন-

‘কিঞ্চ নির্ব্বিশেষ-প্রকাশমাত্র-ব্রহ্মবাদে তস্য প্রকাশত্বমপি দুরুপপাদম্ । প্রকাশো হি নাম স্বস্য পরস্য চ ব্যবহারযোগ্যতামাপাদয়ন্ বস্তুবিশেষঃ। নির্ব্বিশেষস্য বস্তুনস্তদুভয়রূপত্বাভাবাৎ ঘটাদিবদচিত্বমেব। তদুভয়রূপত্বাভাবেহপি তৎক্ষমত্বমস্তীতি চেৎ; তন্ন, তৎক্ষমত্বং হি তৎসামর্থ্যমেব। সামর্থ্য-গুণযোগে হি নির্ব্বিশেষবাদঃ পরিত্যক্তঃ স্যাৎ।’ ৩।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)
অর্থাৎ :
আরও এক কথা, ব্রহ্মকে নির্বিশেষ প্রকাশমাত্রস্বরূপ বললে, তাঁর ‘প্রকাশত্ব’ই উপপাদন বা সমর্থন করা যায় না; কারণ, (অন্যের নিকট) নিজের ও অপরের ব্যবহার-যোগ্যতা সম্পাদক বস্তুবিশেষই প্রকাশ পদবাচ্য; নির্বিশেষ বস্তুতে সেই উভয়ই অসম্ভব; সুতরাং ঘটাদি পদার্থের ন্যায় তার অচিদ্রূপতাই (জড়তা) সিদ্ধ হতে পারে। যদি বলো, স্ব-পর ব্যবহার্যতারূপ এই অবস্থাদ্বয় না থাকলেও নিশ্চয়ই এ-বিষয়ে তার ক্ষমতা আছে। না- তা হয় না; কারণ, এ-বিষয়ে ক্ষমতা অর্থ- এ-বিষয়ে সামর্থ্য; ব্রহ্মে এই সামর্থ্যরূপ গুণের সম্বন্ধ স্বীকার করলে তো নির্বিশেষবাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে (শ্রীভাষ্য-৩-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম অনন্ত গুণের অধিকারী। এই অনন্তগুণের মধ্যে সত্তা, চৈতন্য ও আনন্দ ব্রহ্মের একাধারে স্বরূপ ও গুণ। তাই ব্রহ্ম শুধু সৎ নন, সত্তাবানও বটে; শুধু জ্ঞান নন, জ্ঞানবান; আবার শুধু আনন্দ নন, আনন্দময়। চিৎ ও অচিৎ তাঁর অংশ। চিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জীবের এবং অচিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই তিনি জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয়ই।

ব্রহ্ম সনাতন কর্তা ও পরিণামরূপ জগৎ-কারণ
রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তাঁর মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয়, পরিণাম। ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা যায়- কারণরূপে ও কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড়, ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীররূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। সংক্ষেপে বললে, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। প্রমাণস্বরূপ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ শ্রুতিতেও বলা হয়েছে-

‘যো যোনিং যোনিম্ অধিতিষ্ঠতি একঃ যস্মিন্ ইদং সং চ বি চৈতি সর্বম্ ।
তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিম্ অত্যন্তম্ এতি’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)
অর্থাৎ :
ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছুর মূল। জগৎ প্রকাশিত হলে সেই জগৎকে তিনিই পালন করেন। আবার প্রলয়কালে জগৎ তাঁর কাছেই ফিরে যায়। তিনি সবকিছুর নিয়ন্তা। একমাত্র তিনিই ভক্তদের বর দেন। তিনিই একমাত্র আরাধ্য। এই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হলে শাশ্বত শান্তি লাভ করা যায় (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)।
রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী এবং অতিবর্তী উভয়ই। তিনি জীব-জগতে উপাদান কারণ হিসেবে সংসারে অনুস্যুত থেকে জড় প্রকৃতি ও আত্মাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কার্য-ব্রহ্ম হিসেবে এই বিশ্বসংসারের সব কিছুই ব্রহ্মাত্মক। আবার ঈশ্বর জগতের অতিবর্তীও। কারণ এই সসীম জগতে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব নয়। বস্তুত ঈশ্বর হলেন একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা। তিনি অপ্রাকৃত দেহ-বিশিষ্ট। রামানুজের মতে দেহ বন্ধনের কারণ নয়, কর্মই বন্ধনের কারণ। তাই ঈশ্বর দেহবিশিষ্ট হয়েও বদ্ধ নন। তিনি কর্মের অধ্যক্ষ ও নিয়ন্তা।

ব্রহ্ম নিত্য-তৃপ্ত ও বিকারহীন
ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। পরিণামবাদী রামানুজ ব্রহ্মের কোন বিকার স্বীকার করেন নি। ঈশ্বরের চিৎ ও অচিৎ অংশ নিত্য। তাই চিৎ ও অচিৎ-এর পরিণামের জন্য ঈশ্বরের কোন প্রকার বিকার হয় না। তিনি নিজে অপরিবর্তিত দ্রব্যরূপে অবস্থান করে বিশ্বসংসারের পরিবর্তন ঘটান। অপরপক্ষে ঈশ্বরের প্রকারগুলির অর্থাৎ আত্মা ও জড় পদার্থের বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে রামানুজ গুণ ও প্রকারের পার্থক্য করেননি। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের গুণ বা প্রকার। যেমন- একজন ব্যক্তির বাল্য যৌবন এভাবে দেহ ও মনের পরিবর্তন হলেও তার ব্যক্তিত্বের ঐক্য ও অভিন্নতা অক্ষুণ্ন থাকে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ পরিবর্তিত হলেও ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই অচিৎ বা জড়ের প্রকৃতিগত সীমাতে তিনি আবদ্ধ নন এবং জীবাত্মাগুলির দুঃখযন্ত্রণা তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না। শ্রীভাষ্যে তাই রামানুজ বলেছেন-

‘এবঞ্চ সতি পরমাত্মানং প্রতি জীবস্য শরীরতয়া অন্বয়াৎ জীবগতা ধর্ম্মাঃ পরমাত্মানং ন স্পৃশন্তি যথা স্বশরীরগতা বালত্বযুবত্বাদয়ো ধর্ম্মা জীবং ন স্পৃশন্তি।’ ১৯।- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ :
এইরূপে জীবাত্মা পরমাত্মার শরীরস্থানীয় হওয়ায় স্বীয় শরীরগত বালত্ব, যুবত্ব প্রভৃতি ধর্ম যেমন জীবকে স্পর্শ করে না, তেমনি জীবগত ধর্মসমূহও পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না (শ্রীভাষ্য-১৯-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)।

রামানুজের মতে, ব্রহ্ম নির্বিকার হলেও নিষ্ক্রিয় নন। তিনি জীবের কর্মানুসারে জীবকে পরিচালনা করেন এবং জীবের সাধনায় বা উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে মুক্তি দান করেন। তবে জগতের সৃষ্টি বা পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর কোন প্রয়োজন সাধিত হয় না। জীবের প্রয়োজনেই তাঁর জগৎ-পরিচালনা। তিনি নিত্য-তৃপ্ত এবং তাঁর দিক থেকে জগৎসৃষ্টি লীলা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি জগতে অন্তর্লীন হয়েও জগতের অতিরিক্ত। তাই শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘এবং পরমাত্মচিদচিৎ-সঙ্ঘাতরূপজগদাকারপরিণামে পরমাত্ম-শরীরভূতচিদংশগতাঃ সর্ব্ব এবাপুরুষার্থঃ; তথাভূতাচিদংশগতাশ্চ সর্ব্বে বিকারাঃ; পরমাত্মনি কার্য্যত্বম্; তদবস্থয়োস্তয়োর্নিয়ন্তৃত্বেনাত্মত্বম্; পরমাত্মা তু তয়োঃ শরীরভূতয়োর্নিযন্তৃ তয়াত্মভূতস্তদ্গতাপুরুষার্থৈর্ব্বিকারৈশ্চ ন স্পৃশ্যতে; অপরিচ্ছিন্নজ্ঞানানন্দময়ঃ সর্ব্বদৈকরূপ এব জগৎপরিবর্ত্তনলীলয়াবতিষ্ঠতে। তদেতদাহ- ‘সত্যং চানৃতং চ সত্যমভবৎ’-(তৈত্তিরীয়-৬/২) ইতি। বিচিত্র চিদচিদ্রূপেণ বিক্রিয়মাণমপি ব্রহ্ম সত্যমেবাভবৎ- নিরস্তনিখিলদোষগন্ধমপরিচ্ছিন্ন-জ্ঞানানন্দমেকরূপম্ এব ভবদিত্যর্থঃ। সর্ব্বাণি চিদচিদ্বস্তূনি সূক্ষ্মাদশাপন্নানি স্থূলদশাপন্নানি চ পরস্য ব্রহ্মণো লীলোপকরণানি; সৃষ্ট্যাদয়শ্চ লীলেতি ভগবদ্দ্বৈপায়ন-পরাশরাদিভিরুক্তম্ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।
অর্থাৎ :
পরমাত্মার যে চেতনাচেতনসমষ্টিরূপ জগদাকারে পরিণাম, তাতে পরমাত্মার শরীরস্থানীয় চেতনাংশগত সমস্তই অপুরুষার্থ, অর্থাৎ জীবের প্রকৃত মঙ্গলকর নয়; এবং পরমাত্মার শরীরভূত অচেতনপদার্থগত সমস্ত বিকার (পরিণাম), পরমাত্মগত কার্য্যত্ব এবং সেই অবস্থায় যে চেতন ও অচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মত্ব; স্বশরীরভূত সেই চেতনাচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মস্বরূপ পরমাত্মা কিন্তু স্বশরীরগত উক্ত অনর্থরাশি ও বিকার দ্বারা স্পৃষ্ট হন না; বরং অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ তিনি সর্বদা একরূপ থেকে জগতের পরিবর্তনরূপ লীলা সম্পাদনকারী হিসেবে অবস্থান করেন। এ কথাই ‘সেই সত্যরূপ পরমাত্মা সত্য ও অসত্যরূপ হলেন’-(তৈত্তিরীয়-৬/২) বাক্যে অভিহিত হয়েছে। (অভিপ্রায় এই যে,) ব্রহ্ম চেতনাচেতনরূপে বিকারপ্রাপ্ত হয়েও স্বয়ং সত্যই ছিলেন, অর্থাৎ সবধরনের দোষসম্বন্ধশূন্য ও অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপে একরূপই ছিলেন। সূক্ষ্মাবস্থাপন্নই হোক, আর স্থূলাবস্থাপন্নই হোক, চেতনাচেতন সমস্তই পরব্রহ্মের লীলোপকরণ। সৃষ্টি প্রভৃতি কার্য যে ভগবানেরই লীলা, তা ভগবন দ্বৈপায়ন এবং পরাশর প্রভৃতি মুনি বিভিন্ন স্মৃতিতেও বলেছেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।
তাই ব্রহ্মসূত্রেও (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) বলা হয়েছে- ‘লোকবত্তু লীলা-কৈবল্যম্’ অর্থাৎ, ‘লোকব্যবহারের ন্যায় সৃষ্টি কেবল ঈশ্বরের লীলা মাত্র’।

ব্রহ্ম পুরুষোত্তম ও অনন্ত-কল্যাণময়
রামানুজের মতে ব্রহ্ম পুরুষোত্তম বা পুরুষশ্রেষ্ঠ, কল্যাণগুণাধার, উপাস্য ভগবান। এই মতে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও জগৎকর্তা একই সত্তার নামান্তরমাত্র। যেহেতু ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই তাঁর কোন দোষ-ত্রুটি নেই। তিনি পুণ্য ও ধর্মের আশ্রয়স্থল। তাঁর জ্ঞান ও আনন্দ অনন্ত। তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বরের জ্ঞান, শক্তি ও করুণা অনন্ত, নিত্য, অসীম ও অনুপম। তিনি অজ্ঞানের জ্ঞান, শক্তিহীনের শক্তি, ভক্তের ভগবান, অনাথের নাথ, অপরাধীর কাছে ক্ষমা, পীড়িতের কাছে করুণা, অশুচি ও অপবিত্র জনের কাছে স্নেহময় পিতা ও সকলের প্রতি সদয়। শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভক্তির মাধ্যমে এই পুরুষশ্রেষ্ঠকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর কৃপা বা করুণাতেই আমরা দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হই।

রামানুজ বলেন যে, ঈশ্বর যদিও স্বয়ং এক ও অদ্বৈত, তবুও তিনি ভক্তদের সাহায্য করার জন্য নিজেকে পঞ্চরূপে প্রকাশ করেন। তাঁর এই পাঁচটি রূপ হলো- প্রথমত, তিনি জগতের ও জীবাত্মাসমূহের আত্মা বা অন্তর্যামীরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। তাঁর দ্বিতীয় রূপটি হলো জগতের অতিবর্তী বৈকুণ্ঠবাসী নারায়ণ। তিনি হলেন পরম পুরুষ। ঈশ্বর তাঁর তৃতীয় রূপটি আবার চারপ্রকার ব্যূহের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
প্রথম ব্যূহরূপটি হলো বাসুদেব, যিনি জগতের কর্তা। দ্বিতীয় ব্যূহরূপটি হলো সংকর্ষণ। এই রূপে তিনি জীবের বুদ্ধির কর্তৃত্ব করেন এবং জগতের সংহার করেন। তৃতীয় ব্যূহরূপটি হলো প্রদ্যুম্ন। এই রূপে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন এবং জীবসমূহের আবেগের কর্তৃত্ব করেন। চতুর্থ ব্যূহরূপটি হলো অনিরুদ্ধ। এই রূপে তিনি জগৎ পালন করেন এবং জীবদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। চারটি ব্যূহরূপ হলো এককভাবে পরমেশ্বরের আংশিক প্রকাশ। যখন ঈশ্বর মানুষের বা পশুর শরীর ধারণ করে জগতে অবতরণ করেন, তখন তাঁকে বিভব বা অবতার বলা হয়। এটিই তাঁর চতুর্থ রূপ।

রামানুজের মতবাদের সাথে ভগবদ্গীতার শিক্ষার প্রচুর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, অবতার বিষয়ে শ্রীগীতায় উদ্ধৃত হয়েছে-

‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্’।। (গীতা-৪/৭)
‘পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’।। (গীতা-৪/৮)
অর্থাৎ :
হে ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়াবলে যেন দেহবান হই, যেন জাত হই (গীতা-৪/৭)।  সাধুদিগের রক্ষার জন্য, দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নবাদিরূপে অবতীর্ণ হই (গীতা-৪/৮)।

আচার্য রামানুজও যেন তারই পুনরুক্তি করে বলেন, সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মের পুনঃস্থাপনের জন্য ঈশ্বর অবতার হন। অবতার দু’প্রকারের- মুখ্য ও গৌণ অবতার। ঈশ্বর যখন স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাঁকে মুখ্য অবতার বলা হয়। যেমন শ্রীকৃষ্ণ। কয়েকটি আত্মা যখন ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হন, তখন তাঁদের ঈশ্বরের গৌণ অবতার বলা হয়। যেমন শিব, বুদ্ধ ইত্যাদি। পরমকারুণিক ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের সেবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য তাঁর পঞ্চম রূপটি ধারণ করেন। এই রূপটিকে বলা হয় অর্চাবতার। রামানুজের মতে ঈশ্বর মূর্তিকে আশ্রয় করে মন্দিরে অবস্থান করেন যাতে ভক্তগণ তাঁর সেবার প্রত্যক্ষ সুযোগ পায়।

আচার্য রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যের সমন্বয়-অধিকরণের আলোচনান্তে বলেছেন- ‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’ প্রভৃতি বেদান্তবাক্য একথাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, সকলপ্রকার দোষরহিত, অনন্ত কল্যাণ-গুণের আকর, নিরবধিক, নিরতিশয় ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মই জগতের একমাত্র কারণ।
রামানুজের মতে জগৎ
বেদান্তসূত্রের ভাষ্য গ্রন্থ হিসেবে রচিত শ্রীভাষ্যে আচার্য রামানুজ তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদে তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন- ব্রহ্ম বা ঈশ্বর, চিৎ বা আত্মা এবং অচিৎ বা জড়। তাঁর মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব। কিন্তু ঈশ্বর একমাত্র তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। অর্থাৎ ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি এবং তা হলো চিৎ-অচিৎ বিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রামানুজের মতে ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এ কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেহেতু যথার্থই জগৎ-স্রষ্টা, তাই সৃষ্ট-জগৎ যথার্থই সত্য। তাঁর মতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাঁর নিজের মধ্য থেকে জীব ও জড় সমন্বিত এই জগৎ সৃষ্টি করেন। মাকড়সা যেমন তার অভ্যন্তর থেকে তন্তু বের করে জাল বোনে, ঈশ্বরও তেমনি তাঁর চিৎ অংশ থেকে জীবজগৎ এবং অচিৎ অংশ থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি করেন। জড় অচিৎ এবং চেতন জীবাত্মাগুলি ঈশ্বরেই বিধৃত। ঈশ্বর জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের চিৎ অংশ জীবের এবং অচিৎ অংশ জগতের উপাদান কারণ। আবার ঈশ্বর জীব ও জগতের নিমিত্তকারণ। কারণ তিনিই জীব ও জগতের আবির্ভাব নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির পূর্বে জীব ঈশ্বরের চিৎ অংশে এবং জড়জগৎ ঈশ্বরের অচিৎ অংশে অব্যক্ত রূপে বর্তমান থাকে।

জগৎ সৃষ্টির ব্যাখ্যায় রামানুজ পরিণামবাদের সমর্থক। তাঁর মতে এই জগতের যাবতীয় জড় বস্তুর মূল উৎস হলো অচিৎ। এই অচিৎকেই ‘প্রকৃতি’ বলা হয়। এই ধরনের চিন্তা যে বিভিন্ন উপনিষদে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, তা প্রদর্শন করে রামানুজ তাঁর পরিণামবাদী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ।
অজো হ্যেকো জুষমাণঃ অনুশেতে জহাত্যেনাং ভুক্তভোগাম্ অৎঃ অন্যঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
‘মায়াং তু প্রকৃতিঃ বিদ্যাৎ মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্য অবয়বভূতৈঃ তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ :
প্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল (রজঃ গুণাত্মক), কেউ বা সাদা (সত্ত্ব গুণাত্মক) আবার কেউ কালো (তমঃ গুণাত্মক) (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)। একজন অজ্ঞান জীব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা ভোগ করে। কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল ব্যক্তি পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন তিনি বুঝেছেন যে এই স্থূল জগৎ ক্ষণস্থায়ী; সেই কারণেই তিনি এই জগৎকে ত্যাগ করেন (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)।
প্রকৃতি হলো সেই উপাদান যা দিয়ে জগৎ নির্মিত। প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বর (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ। অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।
শ্রুতির মতো পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতেও প্রকৃতিকে জড়জগতের উৎসরূপে গণ্য করা হয়েছে। আবার সাংখ্যদার্শনিকরাও প্রকৃতিকে অজা অর্থাৎ যার জন্ম নেই বলেছেন এবং প্রকৃতিকেই জগতের কারণরূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সাংখ্যদর্শন প্রকৃতিকে ঈশ্বরের অংশরূপে স্বীকার করেনি। সাংখ্যমতে প্রকৃতি স্বনির্ভর, নিত্য এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র সত্তা। আর রামানুজের মতে প্রকৃতি নিত্য ও ত্রিগুণাত্মক, কিন্তু স্বনির্ভর সত্তা নয়। তাঁর মতে প্রকৃতি ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের অংশ এবং ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন আকৃতির স্বর্ণালঙ্কার যেমন স্বর্ণ-নির্ভর, তেমনি এই বিচিত্র প্রকৃতি ব্রহ্ম-নির্ভর। মানুষের শরীরকে যেমন তার আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি ঈশ্বরও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বরের কোন অভাব নেই। তাই তিনি কোন অভাব পূরণের জন্য জগৎ সৃষ্টি করেননি। জগৎ সৃষ্টি তাঁর লীলা।

রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তাঁর মতে উৎপত্তির পূর্বে কার্য তার উপাদানকারণের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় বর্তমান থাকে। সৃষ্টির পূর্বে অচেতন প্রকৃতি ঈশ্বরে লীন হয়ে থাকে এবং সুপ্ত ও অবিভক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। ঈশ্বর জীবের পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সূক্ষ্ম ও অবিভক্ত অচিৎ তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থে পরিণত হয়। যথা অগ্নি, জল ও ক্ষিতি বা পৃথিবী। তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থ থেকে তিনটি গুণ প্রকাশ পায়- সত্ত্ব, রজো এবং তমো। এই তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান ক্রমশ মিলিত হয়ে এই জগতের বিভিন্ন জড় বস্তু উৎপন্ন করে থাকে। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘ত্রিবৃৎ-করণ’। জগতের প্রতিটি জড় বস্তুতে এই তিনটি উপাদান বর্তমান থাকে। তাই জগতের প্রতিটি বস্তুই হলো ঐ তিনটি সূক্ষ্ম উপাদানের সংমিশ্রণের ফল।

আবার উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘মায়ি নং তু মহেশ্বরম্’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে মায়া সৃষ্টির অধিকারী বলা হয়েছে। এই উক্তিটির ভাষ্যে রামানুজ বলেছেন যে, ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টি আমাদের বুদ্ধির অগম্য। ঈশ্বরের সৃষ্ট জগতের মতো তাঁর মায়াশক্তিও সত্য। যাদুকরের যাদু সৃষ্টির কৌশল যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির কৌশল ও শক্তিকে আমরা বুঝতে পারি না। তাছাড়া ঈশ্বর যে বহু বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই জগৎও ইন্দ্রজালের মতোই বিস্ময়কর। তাই উপনিষদে প্রকৃতিকে মায়া এবং ঈশ্বরকে মায়াধীশ বলা হয়েছে।

অদ্বৈতবাদীর ন্যায় রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মায়াকে মিথ্যা বলে না। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে মায়া ব্রহ্মের প্রকৃত শক্তি। ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনি তাঁর জগৎ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তিও সত্য, আবার সৃষ্ট জগৎও সত্য। এই মতে কার্য হলো কারণশক্তির বিকাশ। এই বিকাশকেই বলা হয় পরিণাম। সৃষ্টির পূর্বে চিৎ ও অচিৎ সংকুচিত অব্যক্ত অবস্থায় ব্রহ্মে নিহিত ছিলো। এই অবস্থায় ব্রহ্মকে কারণ-ব্রহ্ম বলা হয়। এই কারণ-ব্রহ্মই জীব ও জগৎরূপে কার্যে পরিণত হয়। জীব ও জগৎ তাই কার্য-ব্রহ্ম। সৃষ্টির আদিতে প্রথম আবির্ভূত হয় মহৎ। তারপর ক্রমশ মহৎ থেকে অহংকার এবং অহংকার থেকে পর্যায়ক্রমে সূক্ষ্মভূত, স্থূলভূত প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।

৩.১ : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তি
অদ্বৈতবেদান্তে মায়াশক্তি অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক শক্তি। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য মায়াকে মিথ্যা, অবিদ্যা বা অজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে সগুণ ঈশ্বর কল্পিত এবং মায়া। মায়া সৎও নয়, অসৎও নয়; অনির্বচনীয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের নিকট মায়া যথার্থই ঐশ্বরিক শক্তি। এই শক্তি মিথ্যা, অজ্ঞান বা অনির্বচনীয় নয়। রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ ও সবিশেষ। বিচিত্রার্থ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তির সাহায্যে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এভাবে অদ্বৈতবাদীর ‘নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ’ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর নিকট ‘সপ্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদে’ পর্যবসিত হয়েছে।

সপ্তধা অনুপপত্তি :
আচার্য রামানুজ তাঁর ‘শ্রীভাষ্যে’ শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি উত্তাপিত করেছেন। এই সাতটি আপত্তি ‘সপ্তধা অনুপপত্তি’ নামে পরিচিত। তবে অদ্বৈত বেদান্তীরা ঐসব আপত্তির উত্তরও দিয়েছেন। এই আপত্তি ও উত্তরগুলো নিম্নরূপ-

(১) আশ্রয়ানুপপত্তি : রামানুজের প্রথম অনুপপত্তিটি হলো আশয়ানুপপত্তি। অর্থাৎ, রামানুজের মতে শঙ্করাচার্যসম্মত মিথ্যা মায়া বা অবিদ্যার আশ্রয় উপপন্ন করা যায় না। মায়া শক্তিরূপা বলে এই শক্তির একটি আশ্রয় স্বীকার করা প্রয়োজন। রামানুজের মতে যদি সত্যই মায়া বা অবিদ্যার অস্তিত্ব থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো, মায়া বা অবিদ্যা কোথায় থাকে? কারণ আশ্রয় বা অধিষ্ঠান ছাড়া কোন বিষয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এখন মায়া ব্রহ্মে থাকলে নির্গুণ অদ্বয় ব্রহ্ম স্বগত ভেদসম্পন্ন হয়ে যাবে। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং ব্রহ্ম স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত-ভেদ বর্জিত। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানবিরোধী অবিদ্যারূপ মায়া ব্রহ্মে অবস্থান করলে ব্রহ্মকে জ্ঞানস্বরূপ ইত্যাদি বলা যাবে না। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। সুতরাং, ব্রহ্ম মায়ার আশ্রয় হলে অদ্বৈতবাদ মিথ্যা মতবাদে পরিণত হবে।
আবার জীবকেও অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য করা যাবে না। কারণ জীব স্বয়ং অবিদ্যার সৃষ্টি বা কার্য। যেহেতু কারণ কখনও নিজের অস্তিত্বের জন্য কার্যের উপর নির্ভর করে না, সুতরাং, ব্রহ্ম বা জীব কেউই অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য হতে না পারায় শঙ্করাচার্যসম্মত মায়া বা অবিদ্যার কোন অস্তিত্ব নেই।

উক্ত আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব এবং ব্রহ্ম উভয়েই অবিদ্যার আশ্রয় হতে পারে। জীবকে অবিদ্যার আশ্রয়রূপে স্বীকার করলে অসুবিধা দেখা দেয় তখনই যখন আমরা একটিকে অন্যটির পূর্ববর্তী ভাবি। কিন্তু জীব ও অবিদ্যাকে যদি আমরা একই জিনিসের দুটি পরস্পর নির্ভরশীল দিক রূপে গণ্য করি, তবে ঐ অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। যেমন একটা বৃত্তের পরিধি ও কেন্দ্র বৃত্তেরই দুটি দিক, একটা অন্যটার পূর্ববর্তী নয়। আবার ব্রহ্মকেও অবিদ্যার অধিষ্ঠানরূপে গণ্য করা যায়। মায়া বা অবিদ্যা ব্রহ্মেই অধিষ্ঠিত। ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা জগতের সত্যতার ভ্রম উৎপাদন করেন। কিন্তু তিনি জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্টি করে তার দ্বারা প্রভাবিত হন না।

(২) তিরোধানানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের দ্বিতীয় আপত্তিটি হলো  তিরোধানানুপপত্তি। তিরোধান শব্দের অর্থ হলো নাশ। শঙ্করাচার্যের মতে স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়াশক্তির দ্বারা আবৃত হন। রামানুজের আপত্তি হলো, এই অদ্বৈতমত স্বীকার করলে ব্রহ্মের স্বরূপ নাশপ্রাপ্ত হবে। কারণ, প্রথমত, স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেয়া হয় যে, ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হন, তাহলে ব্রহ্মকে আর স্বয়ং-প্রকাশ বলা যায় না। অবিদ্যা তাঁর স্বরূপ আবৃত করে বললে ব্রহ্মের স্বরূপ তিরোহিত হবে। কিন্তু স্বপ্রকাশ ব্রহ্মের তিরোধান বা নাশ সম্ভব নয়। সুতরাং, অদ্বৈতমতসম্মত মায়াবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘নিত্যমুক্ত-স্বপ্রকাশজ্ঞানস্বরূপস্যাবিদ্যোপাধি তিরোধানাসম্ভবাৎ। তিরোধানং নাম বস্তুস্বরূপে বিদ্যমানে তৎপ্রকাশনিবৃত্তিঃ। প্রকাশ এব বস্তুস্বরূপম্ ইত্যঙ্গীকারে তিরোধানাভাবঃ স্বরূপনাশো বা স্যাৎ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।
অর্থাৎ :
নিত্যমুক্ত ও নিত্যপ্রকাশময় জ্ঞানস্বভাব ব্রহ্মের অবিদ্যা-জনিত আবরণের অপগম সম্ভব হয় না। কেননা, তিরোধান অর্থ- বস্তুর স্বরূপ বিদ্যমান সত্ত্বেও তার প্রকাশ বা প্রতীতিযোগ্যতা নিবৃত্তি, (উচ্ছেদ নয়); অতএব, ‘প্রকাশই ব্রহ্মের স্বরূপ’ একথা স্বীকার করলে হয় আবরণের অভাব, না হয়, ব্রহ্মেরই স্বরূপোচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব অবিদ্যার বশীভূত হলে ব্রহ্মকে জানতে পারে না। কিন্তু অবিদ্যার ঐ আবরণের জন্য ব্রহ্মের স্বরূপ নাশ হয় না। কারণ ব্রহ্ম সর্বদাই স্বপ্রকাশ ও স্বয়ং-জ্যোতি। যেমন, মেঘ সূর্যকে আচ্ছন্ন করলে মানুষ সূর্যকে দেখতে পায় না। কিন্তু মেঘের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে সূর্য প্রভাবিত হয় না।

(৩) স্বরূপানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের তৃতীয় আপত্তিটি স্বরূপানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অদ্বৈতমত অনুসারে মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না। শঙ্করাচার্যের মতে মায়া অজ্ঞান। এখন প্রশ্ন হলো- এই অজ্ঞান জ্ঞানরূপ, না জ্ঞাতারূপ, না জ্ঞেয়রূপ ? মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না, কারণ মায়াকে জ্ঞান বলা হলে জ্ঞান নিজেই দোষদুষ্ট হয়ে পড়ে। তাছাড়া অদ্বৈতমতে একমাত্র ব্রহ্মই জ্ঞানরূপ, মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না। জ্ঞানকে দোষদুষ্ট বলা হলে তার মূলে অপর একটি জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের মূলে অপর একটি জ্ঞান স্বীকারে অনবস্থা দোষ দেখা দেয়। মায়া জ্ঞাতা হতে পারে না, কারণ মায়া চেতন নয়। আবার মায়া জ্ঞেয়ও হতে পারে না, কারণ অজ্ঞানরূপ মায়াকে জ্ঞেয় বলা হলে জ্ঞান ও জ্ঞেয় সমানাধিকরণ হয়ে পড়ে। কিন্তু জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিরুদ্ধস্বভাব হওয়ায় এদের মধ্যে সামানাধিকরণ্য সম্ভব নয়, অর্থাৎ একই অধিকরণ বা অধিষ্ঠানে পরস্পরবিরোধী দুয়ের অবস্থান থাকতে পারে না। যেহেতু জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিলক্ষণ কোন বস্তু থাকতে পারে না, অতএব মায়া স্বরূপতই অসিদ্ধ।
আবার অন্যভাবে বললে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত মতানুসারে স্বপ্রকাশ চৈতন্য জ্ঞাতাও নয়, আবার জ্ঞেয়ও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐ স্বপ্রকাশ চৈতন্য নিজের অভ্যন্তরস্থিত দোষের জন্য নিজেকে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়রূপে দেখে। রামানুজের প্রশ্ন হলো, ঐ দোষ সত্য, না মিথ্যা? ঐ দোষ সত্য নয় কেননা দোষের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। আবার ঐ দোষ মিথ্যাও নয়। কারণ যদি ঐ দোষ মিথ্যা হয়, তাহলে ঐ দোষটি জ্ঞাতা বা দ্রষ্টা, জ্ঞেয় বা দৃশ্য, কিংবা জ্ঞান বা দৃষ্টিরূপে গণ্য হবে। কিন্তু ঐ দোষ দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টির কোনটিই নয়। আবার দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টিকে যদি মিথ্যারূপে গণ্য করা হয়, তাহলে তাদের মিথ্যাত্বের ব্যাখ্যার জন্য আরও একটি দোষ স্বীকার করতে হবে। এইভাবে অনবস্থা দোষের সৃষ্টি হবে। সুতরাং, মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না।

এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, উক্ত দোষ জ্ঞানেরই বিষয়। বস্তুত অদ্বৈতবেদান্তমতে মায়া বা অবিদ্যা (জীবরূপ) সাক্ষী-চৈতন্যের বিষয়। কিন্তু অবিদ্যা জ্ঞাতাও নয়, জ্ঞানও নয়। যদিও মায়া বা অবিদ্যা ভ্রমাত্মক, তবুও অনাদি  স্বনির্বাহকরূপে মায়া নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মায়া অন্য কোন দোষের অপেক্ষা করে না। সুতরাং, মায়া অনাদি বলে অনবস্থা দোষের আশঙ্কা নেই।

(৪) অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি : শঙ্করের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের চতুর্থ আপত্তিটিকে বলা হয় অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি। অর্থাৎ, মায়াকে যে অদ্বৈতবাদীরা অনির্বচনীয় বলেছেন, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতমতে মায়া সৎ নয়, যেহেতু মায়ার পারমার্থিক সত্তা নেই। আবার মায়া আকাশ-কুসুমের মতো একেবারে অসৎ বা অলীক নয়। কেননা আমাদের কিছু একটার জ্ঞান হয়। আবার মায়া সদসৎও বলা যায় না, যেহেতু সেটি পরস্পরবিরোধী ধর্ম। এইজন্য অদ্বৈতমতে মায়া সদসৎ ভিন্ন অনির্বচনীয়। কিন্তু রামানুজ বলেন, জাগতিক বস্তু হয় সৎ হবে কিংবা অসৎ হবে। ঐ দুটি ছাড়া তৃতীয় কোন বিকল্প থাকতে পারে না। সুতরাং, মায়া আছে এবং নেই- একথা বলা স্ববিরোধী। তাই সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয় বস্তুর ধারণা নিছক কল্পনামাত্র।

কিন্তু এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ‘মায়া সৎ নয় এবং অসৎ নয়’- এরূপ উক্তি স্ববিরোধী নয়। কারণ সৎ অর্থ হলো যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই কালত্রয়ে বাধিত হয় না। আবার অসৎ অর্থ হলো যা সর্বকালে মিথ্যা।

(৫) প্রমাণানুপপত্তি : অদ্বৈত মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের পঞ্চম আপত্তিটি হলো প্রমাণানুপপত্তি। অর্থাৎ, অবিদ্যা বা মায়ার সমর্থনে প্রমাণ অনুপপন্ন। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ভাবরূপ এবং ‘আমি অজ্ঞ’ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ-প্রতীতি ভাবরূপ মায়ার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ। রামানুজ এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে বলেছেন, অজ্ঞানরূপ মায়া কখনোই ভাববস্তু হতে পারে না। ‘আমি অজ্ঞ’ এরূপ প্রত্যক্ষ-প্রতীতি অদ্বৈতবাদীর প্রমাণাভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যক্ষের দ্বারা কেবলমাত্র কোন বস্তুর অস্তিত্ব বা অভাবকে জানা যায়। ‘অজ্ঞ’ শব্দ অভাববোধক। অভাবরূপ বস্তু প্রত্যক্ষপ্রমাণলভ্য হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যা যেহেতু সৎও নয় আবার অসৎও নয়, তাই অবিদ্যাকে অনুমানের দ্বারা জানা যাবে না। কারণ যে কোন অনুমানে হেতু থাকা অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু ঐ অনুমানে কোন হেতু নেই। তৃতীয়ত, শব্দ প্রমাণের দ্বারাও মায়াকে জানা যায় না। কারণ শ্রুতিতে মায়ার অর্থ হলো ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি। এই শক্তিকে শ্রুতি মিথ্যা অনির্বচনীয়রূপে ঘোষণা করেনি। সুতরাং, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ- কোন প্রমাণের দ্বারাই মায়ার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না বলে মায়া অসিদ্ধ।

এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদীরা বলেন যে, অনুমানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অনুমানের দ্বারা অবিদ্যার কেবল ভাবরূপত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরোক্ষ সজ্ঞার দ্বারা সাক্ষী চৈতন্য অনাদি অবিদ্যাকে জানে। সুতরাং, মায়া বা অবিদ্যার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই একথা বলা যায় না।

(৬) নিবর্তকানুপপত্তি : মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের ষষ্ঠ আপত্তিটি নিবর্তকানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অবিদ্যার নিবর্তক বা নাশক কে, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্মজ্ঞান মিথ্যা মায়ার নিবর্তক। নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু রামানুজের আপত্তি হলো, ব্রহ্ম ও মায়া উভয়ই সৎ হওয়ায় ব্রহ্মজ্ঞান মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। একটি সৎ বস্তু অপর একটি সৎ বস্তুর নিবর্তক হয় না। উপরন্তু সকল সৎ বস্তুই যেখানে সবিশেষ, সেখানে নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞান কিভাবে মায়ার নিবর্তক হতে পারে? জীবের জ্ঞানও মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। জীবের জ্ঞানমাত্রই যখন মায়াপ্রসূত, তখন জীবের জ্ঞানকে মায়ার নিবর্তক বলার প্রশ্নই ওঠে না।
রামানুজ বলেন, জ্ঞান হবার জন্য জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া অবিভক্ত, বৈশিষ্ট্যহীন কোন বিষয়ের জ্ঞান সম্ভব নয়। অতএব অদ্বৈতবেদান্তীদের নির্গুণ ব্রহ্ম বিষয়বিযুক্ত হবার জন্য ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব, সেহেতু অবিদ্যার বিনাশও সম্ভব নয়।

এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, শ্রুতিতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধিকেই অবিদ্যা দূর করার উপায় রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা ও উপলব্ধি নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সোপানমাত্র।

(৭) নিবৃত্তানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের সর্বশেষ আপত্তিটি হলো নিবৃত্তানুপপত্তি। নিবৃত্তি অর্থ নাশ। রামানুজের মতে অবিদ্যাকে দূর করা অসম্ভব। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে নির্বিশেষ জ্ঞানের দ্বারা অর্থাৎ, ‘জীব ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন’- এই ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা নিবৃত্ত বা দূর হয়। কিন্তু রামানুজ আপত্তি করে বলেন, মায়ার নিবর্তকই যখন অসিদ্ধ, তখন মায়ার নিবৃত্তিরও কোন সম্ভাবনা নেই। রামানুজের মতে ঐরূপ জ্ঞান অসম্ভব। সুতরাং, অবিদ্যার নিবৃত্তি সম্ভব নয়। আর মায়ার নিবৃত্তি সম্ভব না হওয়ায় মায়াকে সৎ বলেই গ্রহণ করতে হবে।

এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীদের বক্তব্য হলো, রামানুজের মতে জীবাত্মার বন্ধনের কারণ কর্ম, অবিদ্যা নয়। কিন্তু শ্রুতি ও স্মৃতিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে মায়ার জন্যই জীবের বন্ধন হয় এবং জ্ঞান কর্মকে বিনষ্ট করে। ব্রহ্মোপলব্ধিরূপ জ্ঞান অবিদ্যাকে নিবৃত্ত করে। অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান হলে কর্ম ক্ষয় হয় এবং অবিদ্যাও নিবৃত্ত হয়। সুতরাং, মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তিগুলি যুক্তিযুক্ত নয়।
রামানুজের মতে জীবের ধারণা
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবর্তক রামানুজ তাঁর মতবাদে তিনটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তিনটি তত্ত্ব হলো- ঈশ্বর, চিৎ এবং অচিৎ। রামানুজের মতে এই তিনটি তত্ত্বই সৎ বা পদার্থ। চিৎ হলো আত্মা বা জীবাত্মা। তাঁর মতে দেহবিশিষ্ট আত্মাই জীব। জীবের আত্মা ব্রহ্মের চিৎ-অংশ এবং জীবের দেহ ব্রহ্মের অচিৎ-অংশজাত। জড়দেহ অনিত্য, কিন্তু চিৎ আত্মা নিত্য। তবে আত্মা নিত্য হলেও এই মতে আত্মা অসীম নয়। আত্মা নিত্য, সসীম ও সংখ্যায় বহু। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। ন্যায়মতে চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ বা বহিরাগত ধর্ম। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপও নয়, আবার চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণও নয়, চৈতন্য আত্মার নিত্যগুণ।

আচার্য রামানুজকৃত মহর্ষি বাদরায়ণের বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যায় বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ভাষ্যগ্রন্থ ‘শ্রীভাষ্যে’ জীব বা আত্মার স্বরূপ ও লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোই জীব সম্বন্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ধারণা প্রকাশ করে। যেমন-

জীবাত্মা নিত্য, সসীম ও স্বতন্ত্র :
রামানুজের মতে জীবাত্মা ঈশ্বরের একটি অংশ বা প্রকাররূপে তাঁর শরীরের উপাদানস্বরূপ। তবে প্রকার বা অংশ হলেও জীবাত্মা একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য এবং নিত্য। আত্মার সৃষ্টি এবং বিনাশ নেই। প্রলয়ের সময় জীবাত্মায় যে কর্ম নিহিত থাকে, সেই কর্ম অনুসারে পরবর্তী জন্মে সে অন্য শরীর পরিগ্রহ করে। প্রলয় ও সৃষ্টির মধ্যবর্তী কালে জীবাত্মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করে পূর্বজন্মে কৃত কর্মের ফল ভোগ করে থাকে। রামানুজের মতে জীবাত্মার সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক অনাদি। একমাত্র জীবাত্মা মোক্ষলাভ করলেই কর্ম তার জ্যোতিকে ম্লান ও আচ্ছন্ন করতে পারে না। কারণ মোক্ষলাভ করলে আত্মা পৃথিবীতে অবতরণ করে শরীর গ্রহণ করে না।

রামানুজ বলেছেন যে, জীবাত্মা যদিও নিত্য ও সত্য, তবুও সীমিত। কারণ জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ বা প্রকার। সুতরাং আত্মা অণুপরিমাণ। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘নায়ং সর্ব্বগতঃ, অপিতু অণুরেবায়মাত্মা; কুতঃ? উৎক্রান্তিগত্যাগতীনাং শ্রুতেঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)
অর্থাৎ : এই জীবাত্মা সর্বগত অর্থাৎ সর্বব্যাপী নয়; বরং এই আত্মা অণুপরিমাণই (সূক্ষ্মই) বটে; কারণ? যেহেতু তার উৎক্রান্তি, গতি ও আগতি (আগমন) বিষয়ে শ্রুতি রয়েছে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।

তবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আত্মাকে জানা যায় না। জ্ঞানই আত্মাকে প্রকাশ করে। আত্মা সকলপ্রকার জ্ঞানের সাক্ষী। যদিও আত্মা অণুপরিমাণ, কিন্তু আত্মার জ্ঞান বিভুপরিমাণ। এই কারণে জ্ঞান আত্মার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। জ্ঞান একাধারে আত্মার ধর্ম ও স্বরূপ। অতএব, আত্মা প্রত্যক্ষগোচর নয় এবং তার কোন পরিবর্তনও হয় না। পৃথিবীতে অবস্থানের সময় দেহযুক্ত আত্মা অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। তবে ঐ যন্ত্রণা আত্মার স্বরূপকে স্পর্শ করতে পারে না।

রামানুজের মতে আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। প্রাণবায়ু ও জ্ঞান থেকেও আত্মা পৃথক। সংসারে অবস্থানকালে আত্মা অবিদ্যা ও কর্মের বশীভূত হয়ে ভুলবশত নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। যেমন, শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘সংসার-বন্ধনাদ্বিমুক্তা এব হি বিধূতপুণ্য-পাপা নিরঞ্জনা নাম-রূপাভ্যাং বিনির্মুক্তাশ্চ। পুণ্য-পাপনিবন্ধন অচিৎসংসর্গপ্রযুক্ত-নামরূপভাক্ত্বমেব হি সংসারঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২)
অর্থাৎ :
যারা সংসার-বন্ধন থেকে বিমুক্ত হন, তারাই পুণ্য-পাপ পরিত্যাগপূর্বক নিরঞ্জন হন, এবং নাম-রূপ থেকেও বিমুক্ত হন। পুণ্য-পাপ নিবন্ধন যে জড়পদার্থের সাথে সংসর্গ, অর্থাৎ ‘ইহা আমার’ এসব অভিমান, সেই জড়সংসর্গ বশত যে নাম ও রূপে আসক্তি, তাই জীবের সংসার, (তার অতিরিক্ত নয়) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২)।
দেহ-যুক্ত আত্মার এইরকম জ্ঞান হলো ‘আমি রোগার্ত’, ‘আমি শোকার্ত’, ‘আমি বধির’ ইত্যাদি। এখানে ‘আমি’ শব্দটি আত্মাকে নির্দেশ করে। রোগ শরীরের একটি অবস্থা, শোক একটি মানসিক অবস্থা এবং বধিরতা একটি ইন্দ্রিয়ের বৈকল্য। সংসারে অবস্থানের সময় আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। তাই দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের বৈকল্য তাকে দুঃখ দেয়। রামানুজ বলেন- অবিদ্যা ও কর্মের প্রভাবেই আত্মার এরকম ভ্রান্ত অভেদ বোধ জন্মায়।

জীবাত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা :
জ্ঞাতারূপেই আত্মার পরিচয়। শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘জ্ঞ এব- অয়মাত্মা জ্ঞাতৃত্বস্বরূপ এব, ন জ্ঞানমাত্রম্, নাপি জড়স্বরূপঃ; কুতঃ? অতএব- শ্রুতেরেবেত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)
অর্থাৎ : এই আত্মা (জীব) নিশ্চয়ই জ্ঞ, অর্থাৎ স্বরূপত জ্ঞাতাই বটে, কিন্তু কেবলই জ্ঞানস্বরূপ নয়, এবং জড়স্বরূপও নয়। কারণ? শ্রুতিপ্রমাণই কারণ (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।

তাই জ্ঞান কেবলমাত্র আত্মার গুণ নয়, স্বরূপও বটে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ আত্মাকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তারূপে গণ্য করেছেন। তাঁর মতে ক্রিয়া ও ভোগ হলো আত্মার দুটি পৃথক জ্ঞানের অবস্থা। জ্ঞান আত্মার সারভূত। আত্মা একাধারে স্বয়ং ভাস্বর দ্রব্য এবং আত্মসচেতন বিষয়ী বা জ্ঞানের কর্তা। আত্মাতে যে ধর্মভূতজ্ঞান থাকে, তা প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। আত্মা তার জ্ঞানের মাধ্যমেই বিষয়সমূহে জানে। ঐ জ্ঞান নিজেকে এবং আত্মার জ্ঞেয় বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে। আত্মার জন্যই জ্ঞানের অস্তিত্ব। জ্ঞান যদিও নিজেকে ও তার বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে, তবুও ঐ দুটির কোনটিকেই জ্ঞান জানতে পারে না। একমাত্র আত্মাই জ্ঞান ও তার বিষয়কে জানতে পারে অর্থাৎ জ্ঞাতা। সুতরাং জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার সারভূত ধর্ম, আগন্তুক বা বহিরাগত ধর্ম নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘তদ্গুণসারত্বাৎ- বিজ্ঞানগুণসারত্বাৎ আত্মনো বিজ্ঞানমিতি ব্যপদেশঃ। বিজ্ঞানমেবাস্য সারভূতো গুণঃ, যথা প্রাজ্ঞস্যানন্দঃ সারভূতো গুণঃ, ইতি প্রাজ্ঞ আনন্দ-শব্দেন ব্যপদিশ্যতে’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৯)।
অর্থাৎ :
তদ্গুণসারত্ব অর্থ- যেহেতু বিজ্ঞানই আত্মার সারভূত গুণ, সেহেতু ‘বিজ্ঞান’ শব্দে আত্মার ব্যবহার হয়ে থাকে। বস্তুত বিজ্ঞানই তার সারভূত গুণ; আনন্দ যেমন প্রাজ্ঞ পরমাত্মার সারভূত গুণ বলে ঐ আনন্দ-শব্দে প্রাজ্ঞ আত্মা অভিহিত হয়ে থাকেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৯)।

রামানুজের মতে আত্মা হলো জ্ঞানের আধার। দ্রব্যরূপ আত্মাতে জ্ঞান অবিচ্ছেদ্য ধর্মরূপে অবস্থান করে। এমনকি সুষুপ্তিতে এবং মোক্ষলাভ করার পরেও আত্মায় জ্ঞান থাকে। কিন্তু সুষুপ্তিতে জ্ঞান প্রকাশিত হয় না, কারণ তখন কোন বিষয় থাকে না। জ্ঞান অনন্ত ও সর্বব্যাপক। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় আত্মার জ্ঞান কর্মের দ্বারা আচ্ছন্ন ও সীমিত থাকে। আত্মা মোক্ষলাভ করলে কর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং কর্মজনিত বাধা অপসারিত হয় বলে আত্মার জ্ঞান সর্বব্যাপক হয়ে যায়। তাই মুক্ত অবস্থায় আত্মা সর্বজ্ঞ হয়। কেননা রামানুজের মতে আত্মা অণুপরিমাণ হলেও তার জ্ঞান অনন্ত।
আবার রামানুজ বলেছেন যে, আনন্দও আত্মার সারভূত অর্থাৎ আত্মা আনন্দরূপ। সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। মোক্ষলাভ করলে আত্মা অনন্ত জ্ঞান ও নিত্য আনন্দের অধিকারী হয়।

এই মতে আত্মা হলো বিশুদ্ধ অহং বা আত্মসচেতন অহং। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় যে আমি বা অহংবোধ থাকে, তা ব্যবহারিক। কর্ম ও অবিদ্যার প্রভাবে সংসারে বদ্ধ আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বোধ করে। এই ব্যবহারিক আমি-বোধ বা অহং বোধকে অহঙ্কার বলা হয়। তাই রামানুজের মতে জীব কর্তা ও ভোক্তা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘বাগাদিকরণসম্পন্নোহপ্যাত্মা যদা ইচ্ছতি, তদা করোতি, যদা তু নেচ্ছতি, তদা ন করোতি।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।
অর্থাৎ : আত্মা বাগাদি ইন্দ্রিয়সম্পন্ন থেকেও, যখন ইচ্ছা করে তখনই কার্য করে, আবার যখন ইচ্ছা না করে, তখন করে না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।
তবে এটাও ঠিক যে-

‘পরমাত্মানুমতিমন্তরেণাস্য প্রবৃত্তির্নোপপদ্যত ইত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)
অর্থাৎ : পরমাত্মার অনুমতি বা অনুকুল ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোন কার্যেই জীবের প্রবৃত্তি সম্ভব হয় না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)।

রামানুজের মতে জীব কর্তাই। জীব অকর্তা হলে জীবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার জীব সংসার-দশায় নিজ নিজ কর্মানুসারে ফলভোগ করে থাকে। সুতরাং জীব ভোক্তা। রামানুজের মতে জ্ঞাতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব আত্মার স্বাভাবিক গুণ। তাই বদ্ধজীবের ন্যায় মুক্তজীবও জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা।

জীবাত্মা ঈশ্বরাধীন ও বহু :
রামানুজের মতে আত্মা একটি বাস্তব সত্তা হলেও এর সত্যতা ও বাস্তবতা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। আত্মা সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের অধীন। ঈশ্বর আত্মার আত্মা। আর আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা ঈশ্বরের শরীর। ঈশ্বর জীবাত্মার নিয়ন্তা। রামানুজ বলেন, জীবাত্মা ঈশ্বরেরই প্রকার বা অংশ এবং ঈশ্বর প্রকারী বা অংশী। আবার জীবাত্মা হলো শরীর এবং ঈশ্বর শরীরী। তবে জীবাত্মা ঈশ্বরের অধীন ও ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হলেও তার ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে।

বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জীবাত্মা এক নয়, কিন্তু বহু। তবে সকল জীবাত্মার প্রকৃতি ও স্বরূপ একই। যদিও রামানুজ অসংখ্য জীবাত্মা স্বীকার করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবাত্মাগুলির গুণগত বা প্রকৃতিগত ঐক্যও স্বীকার করেছেন। রামানুজের মতে জীবাত্মা তিনপ্রকার- নিত্য-মুক্ত, মুক্ত ও বদ্ধ আত্মা।

প্রথমপ্রকার নিত্য-মুক্ত আত্মা কখনোই বদ্ধ হয়নি। কারণ তাঁরা কর্ম ও প্রকৃতির অধীন কখনও হননি এবং হবেনও না। সকল প্রকার কর্ম-বন্ধনমুক্ত বৈকুণ্ঠ-নিবাসী নিত্য-মুক্ত আত্মারা নিরন্তর ঈশ্বরের সেবা করেন। শেষনাগ, গড়ুর প্রভৃতি এরূপ নিত্য-মুক্ত আত্মার দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয়প্রকার আত্মা হলো মুক্ত-আত্মা। যাঁরা একসময় বদ্ধ ছিলেন, কিন্তু জ্ঞান, কর্ম এবং ভক্তির দ্বারা মোক্ষলাভ করেছেন, তাঁরা হলেন মুক্ত-আত্মা। অর্থাৎ, মুক্তজীব জ্ঞান ও ভক্তির বলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত।
তৃতীয়প্রকার আত্মা হলো বদ্ধ-আত্মা। বদ্ধ আত্মাগুলি কর্ম ও অবিদ্যাবশত বারবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ থেকে বদ্ধজীব সংসারচক্রে আবর্তিত হতে থাকে। বদ্ধজীব চারধরনের হয়- অতিমানব, মানব, পশু ও স্থাবর। এবং রামানুজের মতে বদ্ধজীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, মূর্ছা ও মরণ- এই পাঁচটি অবস্থা ভোগ করে। সুষুপ্তি আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য হলো মৃত্যু মানে জীবাত্মার দেহাশ্রয় ত্যাগ, অন্যদিকে সুষুপ্তি হলো দেহত্যাগ না করেই জীবাত্মার স্বরূপাবস্থায় অবস্থান, যেখান থেকে ফের জাগ্রৎ অবস্থায় জীবের প্রত্যাবর্তন ঘটে। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন-

‘সুষুপ্তিকালেহপি হি নাম-রূপে বিহায় সতা সম্পরিষ্বক্তঃ পুনরপি জাগ্রদ্দশায়াং নাম-রূপে পরিষ্বজ্য তত্তন্নামরূপো।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।
অর্থাৎ :
জীবগণ সুষুপ্তিকালে যে নাম ও রূপ পরিত্যাগ করে সৎ-সম্মিলিত হয়, জাগ্রৎ-অবস্থায় আবার নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধ লাভ করে পুনশ্চ সেই-সেই নাম ও রূপভাগী হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

৪.১ : জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নয়। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, কিন্তু চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। এই বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে এক স্বতন্ত্র অবিচ্ছেদ্যতার সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন। এই সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। কেননা দেহ বলতে রামানুজ বুঝিয়েছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ প্রকাশ করতে গিয়ে রামানুজ অংশ-অংশী, দেহ-দেহী, অবয়ব-অবয়বী, কার্য-কারণ, বিশেষণ-বিশেষ্য প্রভৃতি সম্পর্কের কথা বলেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম হলেন সগুণ এবং তিনিই ঈশ্বর। রামানুজ ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ স্বীকার না করলেও ব্রহ্মের স্বগতভেদ স্বীকার করে চিৎ ও অচিৎকে ব্রহ্মেরই অংশরূপে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম হলেন অংশী এবং জীব ও জড়জগৎ ব্রহ্মের অংশ বলে এদের মধ্যে যে সম্বন্ধ তা হলো বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ। এই বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ আসলে অপৃথকসিদ্ধির সম্বন্ধ। অংশ অর্থাৎ বিশেষণ কখনোই অংশী অর্থাৎ বিশেষ্য (ব্রহ্ম) থেকে পৃথকভাবে থাকতে পারে না। বস্তুত অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

বৃক্ষের সঙ্গে তার শাখা-প্রশাখার, আত্মার সঙ্গে তার দেহের, বা দ্রব্য উৎপলের সঙ্গে তার গুণ নীলরূপের যে সম্বন্ধ, ব্রহ্মের সঙ্গে জীব তথা জগতেরও সেই সম্বন্ধ। রামানুজ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সামানাধিকরণ্য স্বীকার করে বলেছেন যে, ব্রহ্ম ও জীব ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই।
জীব ও জগৎ ব্রহ্মেরই দুটি অংশ হওয়ায় উপাদানস্বরূপ জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আবার কার্য-কারণ সম্বন্ধেও জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। কেননা সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী রামানুজের মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয় পরিণাম হওয়ায় ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা হয়- কারণরূপে এবং কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড় ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীর রূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। অপরপক্ষে সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। অর্থাৎ, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘অনেন কল্পনোপদেশেনাস্যাঃ প্রকৃতেঃ কার্য্যকারণরূপেণ অবস্থাদ্বয়ান্বয়ঃ অবগম্যতে। সা হি প্রলয়বেলায়াং ব্রহ্মতাপন্না অবিভক্তনামরূপা সূক্ষ্মরূপেণাবতিষ্ঠতে; সৃষ্টিবেলায়ান্তু উদ্ভূতসত্ত্বাদিগুণা বিভক্তনামরূপা অব্যক্তাদিশব্দবাচ্যা তেজোহবন্নাদিরূপেণ চ পরিণতা লোহিত-শুক্ল-কৃষ্ণকারা চাবতিষ্ঠতে। অতঃ কারণাবস্থা অজা, কার্য্যাবস্থা চ জ্যোতিরূপক্রমা, ইতি ন বিরোধঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১০)
অর্থাৎ :
(শ্রুতির) সৃষ্টিবাক্য হতে জানা যায় যে, এই প্রকৃতি দুই প্রকার অবস্থায় অবস্থিত; তার একটি অবস্থা কার্যস্বরূপ, আর একটি অবস্থা কারণস্বরূপ; প্রকৃতি সেই উভয় অবস্থাতেই অনুগত। প্রলয়কালে ব্রহ্মে বিলীন সেই প্রকৃতিই নাম ও রূপ-বিনির্মুক্ত হয়ে সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করে; সৃষ্টিসময়ে আবার সত্ত্বাদি গুণরূপে উদ্ভূত বা অভিব্যক্ত হওয়ায় এবং নাম ও রূপ তা থেকে পৃথক হওয়ায় অব্যক্ত প্রভৃতি শব্দবাচ্য সেই প্রকৃতিই তেজ, জল ও পৃথিবী ইত্যাদিরূপে পরিণত হয়ে লোহিত (রজঃ), শুক্ল (সত্ত্ব) ও কৃষ্ণরূপে (তমোগুণরূপে) অবস্থান করে। অতএব, কারণাবস্থায় অজা (প্রকৃতি), আর কার্যাবস্থায় জ্যোতিরূপক্রমা (ব্রহ্মোৎপন্না); (সুতরাং একই প্রকৃতির উভয়াবস্থা স্বীকারে) কোন বিরোধ নেই (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১০)।
অন্যদিক থেকে জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন, কারণ জীব সীমিত বা অণুপরিমাণ ও সৃষ্টিশক্তিহীন। কিন্তু ব্রহ্ম বিভুপরিমাণ ও স্রষ্টা। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজের যে বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-

‘তদেতৎ চেতনাচেতনাত্মক-কৃৎস্নবস্ত্বাধারত্বং জীবাৎ অর্থান্তরভূতেঃ অস্মিন্ পরমাত্মন্য এব উপপদ্যত ইত্যর্থঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩০)।
অর্থাৎ : এই যে চেতন-অচেতন সর্বপদার্থের আশ্রয়ত্ব (ধারকতা), তা জীব হতে পৃথক পদার্থ পরমাত্মাতেই সম্ভব হয়, (জীবে হয় না) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩০)।

এইভাবেই জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে ভেদ ও অভেদ সম্বন্ধের বিশিষ্টতা উপস্থাপন করে রামানুজ উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘তত্ত্বমসি’-এর অর্থ নির্ণয় করেছেন। তাঁর মতে, ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের দ্বারা জীব যে ব্রহ্মে থেকে ভিন্ন হয়েও অভিন্ন, একথাই বোঝানো হয়। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য জহৎ-অজহৎ লক্ষণার দ্বারা বিরুদ্ধধর্মের পরিত্যাগপূর্বক ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের অদ্বয় তাৎপর্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু রামানুজের মতে উক্ত মহাবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণের জন্য লক্ষণা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে ‘তৎ’ ও ‘ত্বম্’ পদদ্বয়ের বিশেষ্য-বিশেষণভাবজনিত সামানাধিকরণ্যের দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের তাৎপর্য প্রতিপাদিত হতে পারে।
পুত্র শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা উদ্দালকের উপদেশ হিসেবে ছান্দোগ্য উপনিষদের একাধিক শ্লোকে আছে-

‘তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতু।’- (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)
অর্থাৎ : সেই সৎ পদার্থই সত্য, সেই পদার্থই আত্মা। হে শ্বেতকেতু তুমি হও সেই অর্থাৎ সেই সৎ পদার্থ ও আত্মা (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।

রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যে ছান্দোগ্য-উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘ব্রহ্ম থেকে জীব স্বরূপতঃ অভিন্ন।’ তত্ত্বমসি বাক্যটির অর্থ হলো ‘তিনিই তুমি’ অর্থাৎ জীবাত্মাই ঈশ্বর। জীব ঈশ্বর থেকে ধর্মতঃ পৃথক হলেও স্বরূপতঃ এক ও অভিন্ন।
রামানুজ বলেন যে, ‘তৎ’ এবং ‘ত্বম্’-এর মধ্যে ঐক্য থাকলেও উভয়ের বিশিষ্টতা আছে। ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটিতে ‘ত্বম্’ শব্দটি জীবকে নির্দেশ করে এবং ঈশ্বরকেও নির্দেশ করে। কারণ ঈশ্বর জীবের অন্তর্যামী। জীব ও তার শরীর ঈশ্বরের প্রকার। ‘তৎ’ শব্দটিও জীব সমন্বিত জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে নির্দেশ করে। ‘ত্বম্’ অন্তর্যামীরূপে ঈশ্বরকে এবং ‘তৎ’ শব্দটি জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে বোধিত করছে। সুতরাং ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো- যদিও জীব এবং জগৎ দুটি স্বতন্ত্র ও সত্য, তবুও তারা যে পরম সত্তার অন্তর্ভুক্ত তা এক ও অদ্বৈত। বস্তুত জীব ও জগৎ ঈশ্বরের শরীররূপে নিত্য।

উল্লেখ্য, রামানুজ কখনো ব্রহ্ম ও জীবের ভেদের উপর, আবার কখনো উভয়ের অভেদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শ্রীভাষ্যে তিনি ব্রহ্ম ও জীবকে স্বরূপত পৃথক বলেও উল্লেখ করে বলেছেন-

‘নাপি চিৎ-অচিৎ-ঈশ্বরাণাং স্বরূপভেদনিষেধঃ।’- (শ্রীভাষ্য-৯৫)
অর্থাৎ: চিৎ ও অচিৎ- ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ব্রহ্ম (ঈশ্বর) ও জীব স্বরূপত অভিন্ন নয়। (মুক্ত তর্জমা)

বস্তুত, রামানুজের মতে ব্রহ্ম ভেদের দ্বারা বিশেষিত রূপেই সৎ। ভেদ-নিরপেক্ষ অভেদ বা অভেদ-নিরপেক্ষ ভেদ সম্ভব নয়। এজন্যই এই মতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।
রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ

জীবের বন্ধন :
রামানুজের মতে কর্ম ও অবিদ্যার দ্বারা জীবাত্মা বদ্ধ হয়। জীবাত্মার সঙ্গে কর্ম ও অবিদ্যার যোগ অনাদি যেহেতু সংসার অনাদি। কৃতকর্মের জন্যই আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসারদশা প্রাপ্ত হয়। এই অবস্থাই হলো আত্মার বন্ধন বা বদ্ধাবস্থা। এই যোগ বা সংশ্লিষ্টতার ফলে জীবের ‘অহং’, ‘মম’ প্রভৃতি বোধ জন্মায়। এ অবস্থায় জীবের স্বরূপ আচ্ছাদিত হয়। বদ্ধজীব তখন ‘অহংবোধ’ ও ‘ক্ষুদ্র-আমিত্বের’ বশবর্তী হয়। দেহ, ইন্দ্রিয়, মনের বিভিন্ন অবস্থা থেকে জীবাত্মা নিজেকে পৃথক করতে পারে না। আর পৃথক করতে না পারার জন্যই জীবাত্মা অবিদ্যার বশীভূত হয়। এই অবিদ্যাজনিত জীবাত্মার জ্ঞান হলো ‘আমি স্থূল’, ‘আমি বধির’, ‘আমি দুঃখিত’ ইত্যাদি।

‘মমত্ববোধ’ও ঐ অবিদ্যা থেকে উৎসারিত হয়। যে বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবের দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সুখ উৎপাদন করে সেই বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবাত্মার প্রিয় হয়। এই অবিদ্যাজনিত মমত্ববোধের দৃষ্টান্ত হলো- ‘আমার স্ত্রী’, ‘আমার পুত্র’, ‘আমার বাড়ি’ ইত্যাদি। বস্তুত ‘আমার’ সঙ্গে ঐ বিষয়গুলির কোন যোগ নেই। জীব কর্মের বন্ধনে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে ঐরূপ অবিদ্যার আশ্রয় হয়। তাই প্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির বিয়োগে এবং অপ্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির সংযোগে জীবাত্মা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। এ প্রেক্ষিতে রামানুজের শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘আমোক্ষাৎ জীবস্য নাম-রূপপরিস্বঙ্গাদেব হি স্বব্যতিরিক্তবিষয়জ্ঞানোদয়ঃ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।
অর্থাৎ :
বস্তুতই মোক্ষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধবশতই জীবের স্ব-ভিন্ন বস্তু-বিষয়ে জ্ঞান সমুৎপন্ন হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

রামানুজ বলেন যে, আত্মা প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ, কর্তা ও ভোক্তা। কিন্তু দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আত্মা বদ্ধ হয়। সকাম কর্মের ফলভোগ করার জন্যই আত্মা দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়। দেহ ও আত্মার এই একত্রীকরণের নাম ‘অহঙ্কার’। এই অহঙ্কারের জন্যই জীবাত্মা পার্থিব সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সকাম কর্ম সম্পাদন করে। আর তার ফলেই জীবাত্মাকে বারবার এই সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয়। রামানুজের মতে এই জন্মই হলো আত্মার ‘বন্ধন’ বা বদ্ধাবস্থা।

মোক্ষ :
জীবের বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তিই হলো মোক্ষ। মোক্ষে জীবের স্বরূপ বিকশিত হয়। রামানুজের মতে মোক্ষ হলো জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। জীব স্বভাবতই জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। বদ্ধাবস্থায় জীবের জ্ঞান, কর্ম ও ভোগ সীমিত হয়ে পড়ে। মোক্ষাবস্থায় জীব সর্বজ্ঞ, সর্বময়কর্তা ও পূর্ণ আনন্দময় ভোক্তা। সুতরাং জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ হলো জীবের স্বাভাবিক গুণের চরম উৎকর্ষ লাভ।

জীবাত্মা মুক্তিলাভ করলে ব্রহ্ম-সাদৃশ্য লাভ করে অর্থাৎ ঈশ্বরের মতো হয়। তাই মুক্তজীব ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ন্যায় সচ্চিদানন্দময় হয়। কিন্তু মোক্ষলাভের পর জীবের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হলেও তার জীবত্ব থাকে। তাই রামানুজের মতে মুক্তজীব ব্রহ্মের সদৃশ, কিন্তু ব্রহ্ম-স্বরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন নয়। মুক্তজীব ঈশ্বর-সদৃশ হলেও প্রধানতঃ দুটি বিষয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকে। ব্রহ্মের সঙ্গে মুক্তজীবের এই দুটি প্রধান পার্থক্য হলো- (১) মুক্তজীব অণুপরিমাণ, কিন্তু ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বিভুপরিমাণ এবং (২) জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা বা ঈশ্বর এই জগতের কারণ এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তা, কিন্তু মুক্তজীব এই জগতের কারণ নয় এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তাও নয়। মুক্তজীব ব্রহ্মাশ্রিত, ব্রহ্মশাসিত, ব্রহ্মসেবক, সচ্চিদানন্দময়, কিন্তু ব্রহ্মভিন্ন।

রামানুজের মতে জীবের মুক্তি হলো বিদেহমুক্তি। ভারতীয় দর্শনে সাধারণত দুইপ্রকার মুক্তির কথা বলা হয়- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। জীবিত অবস্থায় যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অপরদিকে দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। বৌদ্ধ ও অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় যথাক্রমে বুদ্ধ ও শঙ্করাচার্যকে জীবন্মুক্ত পুরুষ বলে মনে করেন। জীবন্মুক্ত পুরুষ লোকহিতার্থে নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হন। রামানুজের মতে জীবন্মুক্তি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাঁর মতে যতদিন পর্যন্ত জীব দেহধারণ করে, ততদিন পর্যন্ত জীব বদ্ধ। এই অবস্থায় তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জরা, বেদনা প্রভৃতির অধীন দেহাদি যতক্ষণ জীবে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, ততক্ষণ জীব এই সকল অনুভূতি থেকে রক্ষা পেতে পারে না। তাই রামানুজ জীবন্মুক্তিতে বিশ্বাসী নন।

রামানুজের মতে দেহের সঙ্গে আত্মার বিচ্ছেদ হলে মুক্তিলাভ হয়। এই মুক্তিকে সাধারণত বিদেহ মুক্তি বলা হয়। কিন্তু তাঁর মতে মুক্ত জীবেরও দেহ থাকে। সেই দেহ শুদ্ধ সত্ত্বের দ্বারা গঠিত। মোক্ষলাভের পর মুক্ত আত্মা ঐ দেহ ধারণ করে বৈকুণ্ঠে নারায়ণের অর্থাৎ ঈশ্বরের আপন ধামে গমন করে। অতএব রামানুজের মতে জীব কখনোই সম্পূর্ণ বিদেহ বা দেহ-বিযুক্ত হয় না। বৈকুণ্ঠে মুক্ত জীবাত্মা এবং নিত্য-আত্মা পূর্ণ আনন্দ ও শান্তিতে বাস করে। রামানুজ বলেন- মোক্ষ হলো এক বিশুদ্ধ আনন্দের অবস্থা। মোক্ষ অবস্থায় জীব ব্রহ্মসদৃশ হয়, কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায় না। তাই রামানুজ ‘সামীপ্য মুক্তি’তে বিশ্বাসী।

মুক্তির উপায় :
রামানুজ মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ের উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে রামানুজ বলেছেন, মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। যে সকল জীব সকাম কর্ম ও তজ্জনিত ভোগে লিপ্ত, মুক্তিলাভের কোনরূপ ইচ্ছা যাদের নেই (বুভুক্ষু), তাদের মুক্তি সম্ভব নয়। সংসার থেকে মুক্তিলাভ করতে হলে জীবাত্মাকে সর্বপ্রথম কর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। মুক্তিকামী জীব (মুমুক্ষু) নিষ্কাম কর্ম প্রতিপালনের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি করেন এবং জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে মোক্ষলাভে প্রবৃত্ত হন। রামানুজের মতে বেদ-নির্দেশিত কর্ম এবং যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়। বেদবিহিত কর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান করলে জীবাত্মা কর্মজনিত মালিন্য দূর করতে পারে। তবে ঐ কর্মের অনুষ্ঠান নিষ্কামভাবে করতে হবে। বস্তুত গীতার নিষ্কাম কর্মবাদকে রামানুজ মোক্ষলাভের সহায়ক উপায়রূপে গ্রহণ করেছেন।

মুমুক্ষু জীব শাস্ত্রোপদিষ্ট নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম ছাড়াও সপ্তবিধ নিষ্কাম কর্ম করে থাকেন। এই সাতরকম নিষ্কাম কর্ম হলো- বিবেক, বিমোক, অভ্যাস, ক্রিয়া, কল্যাণ, অনবসাদ ও অনুর্ধর্ষ।
বিবেক হলো অশুদ্ধ পানাহার বর্জন। বিমোক হচ্ছে আসক্তিহীনতা। অভ্যাস মানে লক্ষ্যসাধনের জন্য বারবার অনুশীলন। ক্রিয়া হলো যজ্ঞানুষ্ঠান। কল্যাণ অর্থ দয়া, দান, অহিংসা, নির্লোভতা। অনবসাদ হলো মানসিক দৈন্য ও দুর্বলতা বর্জন। এবং অনুর্ধর্ষ অর্থ হলো উগ্র আত্মবিশ্বাস বা দাম্ভিকতার অভাব।

কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। ভক্তিবাদের সমর্থক রামানুজ কেবলমাত্র জ্ঞানকেও মুক্তিলাভের উপায় বলে মনে করেননি। তাঁর মতে মোক্ষের জন্য জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি বা ধ্যানও প্রয়োজন। সম্যগ্জ্ঞান লাভের পর মুমুক্ষু ধ্যান বা উপাসনায় রত হন এবং উপাসনায় তিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন। ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য অবশ্য মুমুক্ষুর উপাসনা ছাড়াও ঈশ্বরের করুণা প্রয়োজন। ঈশ্বরের করুণা ছাড়া কোন জীবের পক্ষেই মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। একমাত্র ভগবৎ কৃপাই জীবকে মুক্তি দিতে সক্ষম। ভক্তি ও উপাসনার দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে ভগবানের কৃপালাভ সম্ভব। জ্ঞান ও কর্ম হলো এই ভক্তির সহকারি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মোক্ষলাভের ইচ্ছা, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়।

মোক্ষলাভের জন্য রামানুজ যে পথ নির্দেশ করেছেন তা হলো, যাঁরা নিষ্কাম কর্মযোগে সাফল্যলাভ করেছেন, কেবলমাত্র তাঁরাই জ্ঞানযোগের আশ্রয় নেবার উপযুক্ত। সমর্থ গুরুর কাছে আত্মার প্রকৃত তত্ত্ব শ্রবণ করে আত্মার স্বরূপ ধ্যান করা জ্ঞানযোগের অন্তর্গত। ঐ ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে আত্মা যে পৃথক ও স্বতন্ত্র, তা উপলব্ধি করা। জ্ঞানযোগে সাফল্য লাভ করলেও ঈশ্বরের সঙ্গে জীবাত্মার কী সম্পর্ক, তা উপলব্ধি করার জন্য ধ্যানের অনুশীলন অব্যাহত রাখা কর্তব্য।
কিন্তু যাঁরা জ্ঞানযোগে সাফল্যলাভ করেছেন কেবলমাত্র তাঁরাই ভক্তিযোগের আশ্রয় নেবার যোগ্য। ভক্তিযোগের ভিত্তি হলো সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রতি যুক্তিসিদ্ধ আস্থা ও বিশ্বাস। ‘ভক্তি’ শব্দের দ্বারা রামানুজ উপনিষদগুলিতে বিবৃত উপাসনা বা ধ্যানকে বুঝিয়েছেন। অবশ্য তাঁর মতে ভক্তি হলো উপনিষদে কথিত ধ্যানের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা বা প্রেমের মিশ্রণ। জীব ঈশ্বরের উপর তার সম্পূর্ণ নির্ভরতা বা শেষত্ব বোধ করে তাঁকে বিশ্বের নিয়ন্তারূপে অনুভব করে তাঁর প্রতি প্রেমে আপ্লুত হয়ে তাঁর স্বরূপ ধ্যান করবে। সুতরাং রামানুজের মতে ভক্তি হলো ঈশ্বরকে পুরুষোত্তমরূপে গণ্য করে প্রেমের সঙ্গে তাঁর স্বরূপ ধ্যান করা। এই ধ্যানে সাফল্য লাভ করলে জীব ঐশী দৃষ্টির অধিকারী হয়।

তবে রামানুজ এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন যে, ভক্তিযোগ আশ্রয় করে সাফল্য লাভ করার পরও বেদ-বিহিত নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান অবশ্য কর্তব্য। কারণ নিত্যকর্মগুলি না করলে জীব আবার পাপগ্রস্ত হবে। রামানুজের মতে কর্মের মাধ্যমেই ভক্তি উৎসারিত হয় এবং ঐ ভক্তি ঈশ্বরের অপরোক্ষ উপলব্ধির কারণ হয়। তবে রামানুজ মুক্তির সহায়ক কারণরূপে কেবল বেদবিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব দেননি। তিনি বৈষ্ণব শাস্ত্র-নির্দেশিত পূজা-উপাসনা-সমন্বিত ক্রিয়াযোগকেও প্রাধান্য দিয়েছেন।

এখানে উল্লেখ্য, রামানুজ মোক্ষলাভের জন্য যে যোগগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলিতে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনটি উচ্চশ্রেণীর মানুষের অধিকার আছে। নিম্নবর্ণের মানুষের এগুলিতে অধিকার নেই, যেহেতু নিম্নবর্ণের মানুষের বেদবিহিত আচরণের অধিকার নেই। যেমন, শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘ন শূদ্রস্যাধিকারঃ সম্ভবতি; কুতঃ? সামর্থ্যাভাবাৎ; ন হি ব্রহ্মস্বরূপ-তদুপাসনপ্রকারম্ অজানতঃ তদঙ্গভূত বেদানুবচন-যজ্ঞাদিষ্বনধিকৃতস্য উপাসনোপসংহারসামর্থ্যং সম্ভবতি; অসমর্থস্য চার্থিত্বসদ্ভাবেহপি অধিকারো ন সম্ভবতি; অসামর্থ্যং চ বেদাধ্যয়নাভাবাৎ। যথৈব হি ত্রৈবর্ণিকবিষয় অধ্যয়ন বিধিসিদ্ধ-স্বাধ্যায়সম্পাদ্য-জ্ঞানলাভেন কর্ম্মবিধয়ো জ্ঞানতদুপায়াদীন্ অপরান্ ন স্বীকুর্ব্বন্তি, তথা ব্রহ্মোপাসনবিধয়োহপি। অতোহধ্যয়নবিধিসিদ্ধ-স্বাধায়াধিগত-জ্ঞানস্যৈব ব্রহ্মোপাসনোপায়ত্বাৎ শূদ্রস্য ব্রহ্মোপাসনসামর্থ্যাসম্ভবঃ। ইতিহাস-পুরাণে অপি বেদোপবৃংহণং কুর্ব্বতী এব উপায়ভাবমনুভবতঃ, ন স্বাতন্ত্র্যেণ; শূদ্রস্যেতিহাস-পুরাণ শ্রবণানুজ্ঞানং পাপক্ষয়াদিফলার্থম্; নোপাসনার্থম্ ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।
অর্থাৎ :
(ব্রহ্মবিদ্যায়) শূদ্রের অধিকার-সম্ভব হয় না; কারণ? যেহেতু তার সামর্থ নাই। কেননা, যে লোক ব্রহ্মের স্বরূপ এবং তাঁর উপাসনা-প্রণালী জানে না; সুতরাং তারই অঙ্গস্বরূপ বেদানুবচন (বেদপাঠ) ও যজ্ঞাদি কার্যেও অনধিকৃত তার পক্ষে কখনোই উপাসনার অনুকুল সামর্থ সম্ভবপর হয় না। বেদাধ্যয়নের অভাবই তার সামর্থাভাবের কারণ। ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের সম্বন্ধে বেদাধ্যয়ন বিহিত থাকায় তার-সম্পাদ্য জ্ঞানেও অধিকার প্রাপ্ত হওয়া যায়; এজন্য, কর্মবিধি সমূহ যেরূপ জ্ঞান ও সে-উপযোগী অপরাপর সাধনের অপেক্ষা করে না, ব্রহ্মোপাসনা বিধিগুলিও সেরকম। অতএব অধ্যয়নবিধিলব্ধ বেদাধ্যয়নজনিত জ্ঞানই যখন ব্রহ্মোপাসনার প্রধান উপায়, তখন সেই বৈদিক জ্ঞান না থাকায় শূদ্রের ব্রহ্মোপাসনা-সামর্থ কখনো সম্ভবপর নয়। আর ইতিহাস এবং পুরাণশাস্ত্রও বেদার্থের পরিপোষণ করে বলেই উপায়তা লাভ করে থাকে, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে নয়। শূদ্রের পক্ষে যে ইতিহাস ও পুরাণপাঠে অনুমতি প্রদত্ত হয়েছে, তাও কেবল পাপক্ষয়াদি ফলসিদ্ধির জন্যই, কিন্তু উপাসনার্থে নয় (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।

বিভিন্ন শাস্ত্রেই শূদ্রের উপনয়নাদি সংস্কার-অযোগ্যতা তথা যজ্ঞকর্মে অধিকারহীনতা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, যেমন-

‘ন শূদ্রে পাতকং কিঞ্চিন্ন চ সংস্কারমর্হতি।’- (মনুসংহিতা-১০/১২৬)
‘চতুর্থো বর্ণ একজাতি র্ন চ সংস্কারমর্হতি।’- (গৌতম-সংহিতা-১০/৯)
অর্থাৎ :
শূদ্রে কোন প্রকার পাতক নাই এবং শূদ্র কোনপ্রকার সংস্কারার্হও নয়, কোনও ধর্মে শূদ্রের নিয়ত অধিকার নেই (মনুসংহিতা-১০/১২৬)।
চতুর্থ বর্ণ (শূত্র) একজাতি অর্থাৎ উপনয়নসংস্কার-জনিত দ্বিজত্বধর্ম-রহিত, এবং কোনও সংস্কারার্হও নয় (গৌতম-সংহিতা-১০/৯)।

এইজন্য নিম্নবর্ণের জীবাত্মাদের মুক্তির জন্য রামানুজ দুটি উপায় অবলম্বন করতে বলেছেন। এই উপায় দুটি হলো- প্রপত্তি ও শরণাগতি।
প্রপত্তির অর্থ হলো ঈশ্বরকে একমাত্র আশ্রয় ও অবলম্বনরূপে গণ্য করা। অপরপক্ষে শরণাগতি অর্থ হলো ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভিন্নরূপে যথাক্রমে মর্কটন্যায় ও মার্জারন্যায়ও বলা হয়। মর্কটন্যায়ে মর্কট বা বানর সন্তান যেমন নিজ প্রচেষ্টায় মাতৃক্রোড়ে নিজেকে নিবেদন করে, তেমনি জীব নিজেকে পরমেশ্বরের কাছে নিবেদন করে। আর মার্জারন্যায়ে মার্জার বা বিড়ালশাবক যেমন আত্মপ্রচেষ্টাহীনভাবে মাতার নিকট আত্মনিবেদন করে, জীবও তেমনি পরমেশ্বরের কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে।

অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, রামানুজের মতে কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই যদিও জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়, তবুও শুধুমাত্র ঈশ্বরে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ বা ভক্তির মাধ্যমেও জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে। তবে বিশিষ্টাদ্বৈত দার্শনিকরা প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভক্তির থেকে আরো কার্যকরি উপায়রূপে গণ্য করেন। কারণ ভক্তিযোগের জন্য শিক্ষণ ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রপত্তি ও শরণাগতির জন্য কোন শিক্ষা বা অনুশীলনের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া রামানুজ ভক্তিযোগের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতিকে অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করতেন।
বস্তুত রামানুজ যেহেতু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানষের মুক্তির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতির সুগম পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই তাঁর দর্শন ও ধর্মমত জনপ্রিয় হয়েছিলো।
অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের পার্থক্য
ব্রহ্মবাদী বেদান্ত সূত্রকার মহর্ষি বাদরায়ণের একই ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করলেও দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু মৌলিক পার্থক্যের কারণে ব্যাখ্যার ভিন্নতায় আচার্য শঙ্করের শারীরকভাষ্যকে কেন্দ্র করে অদ্বৈত-বেদান্ত এবং আচার্য রামানুজের শ্রীভাষ্যকে কেন্দ্র করে বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব। যদিও উভয় সম্প্রদায়ই দাবি করেন যে মহর্ষি বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে তাদেরই নিজস্ব মতবাদ তথা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁদের এই দাবিকে বহাল রেখেও এক্ষেত্রে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের সঙ্গে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কিছু মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

(১) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্গুণ ও নির্বিশেষ। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সগুণ ও সবিশেষ।
(২) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সক্রিয়, জগৎ-স্রষ্টা।
(৩) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সকল প্রকার ভেদরহিত। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম স্বগতভেদযুক্ত, স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদরহিত।
(৪) অদ্বৈতমতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এই সত্যের কোন পরিমাণগত ও প্রকারগত ভেদ নেই। অপরদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ সমানভাবে সত্য। এই পরিমাণগত ভেদ নেই, কিন্তু প্রকারগত ভেদ আছে।
(৫) অদ্বৈতমতে ব্রহ্মের মায়াশক্তি মিথ্যা বা অবিদ্যাপ্রসূত। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্মের মায়াশক্তি যথার্থই ব্রহ্মের শক্তি।
(৬) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। আর বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সৎ ও সত্তাবান, চিৎ ও চৈতন্যময়, আনন্দ ও আনন্দময়।
(৭) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম ও জীব অভিন্ন। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম ও জীব ভিন্নও বটে, অভিন্নও বটে।
(৮) অদ্বৈতমতে মুক্তজীব অভোক্তা ও অকর্তা। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে মুক্তজীব ভোক্তা ও কর্তা।
(৯) অদ্বৈত মতানুযায়ী মোক্ষে জীব ব্রহ্মে বিলুপ্ত হয় অর্থাৎ মুক্তজীব ব্রহ্ম-সাযুজ্য লাভ করে। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈত মতানুযায়ী মোক্ষে জীব ব্রহ্মে লীন হয় না, বরং ব্রহ্ম-সদৃশ হয় অর্থাৎ, ব্রহ্ম-স্বারূপ্য লাভ করে।
(১০) অদ্বৈতমতে জীবিত অবস্থায় মুক্তি বা জীবন্মুক্তি সম্ভব। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জীবন্মুক্তি অসম্ভব।
(১১) অদ্বৈতমতে শুদ্ধজ্ঞানই মুক্তির উপায়। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয় এবং প্রপত্তি ও শরণাগতি মুক্তির উপায়।
(১২) অদ্বৈতমতে আত্মা বিভুপরিমাণ। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে আত্মা অণুপরিমাণ।
(১৩) অদ্বৈতমতে জহৎ-অজহৎ লক্ষণার সাহায্যে ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে বিশেষ্য-বিশেষণভাবজনিত সামানাধিকরণ্যের দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য প্রতিপাদিত হয়।
(১৪) অদ্বৈতমতে জগৎ মিথ্যা। অথচ বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জগৎ সত্য। 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ