বিবেকানন্দ প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংসভক্ষণ সম্বন্ধে অনেক মন্তব্য করেছেন এবং তিনি নিজেও গোমাংস খাওয়ার খুব একটা বিরোধী ছিলেন বলে মনে হয় না। তার উক্তিগুলো নিচে উল্লেখ করা হলঃ-
১) আমরা যদি গোমাংস এবং মেষের মাংস না খেতাম তাহলে কোনো কসাই থাকতো না। যারা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী এবং যারা ভক্ত হবেন না একমাত্র তাদের ক্ষেত্রে মাংস খাওয়া গ্রহণযোগ্য কিন্তু আপনি যদি ভক্তি হতে চলেন তবে আপনার মাংস পরিত্যাগ করা উচিত।
২) সকল যুগের সকল দেশের সকল মানুষ অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে ধারণারও পরিবর্তন হওয়া উচিত। গোমাংস খাওয়া একসময় নৈতিক ছিল। জলবায়ু শীতল ছিল, খাদ্যশস্য খুব একটা পরিচিত ছিল না। মাংসই প্রধান সুলভ খাদ্য ছিল। সুতরাং সেই যুগে এবং আবহাওয়ায় গোমাংস খাওয়া একরকম অপরিহার্য ছিল। কিন্তু গোমাংস খাওয়া এখন অনৈতিক।
৩) “সত্য বটে , বহু বাক্য এক আধটির দ্বারা নিহত হওয়া অন্যায্য। তাহা হইলে চিরপ্রচলিত মধুপর্কাদি প্রথা [১] ‘অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম’ ইত্যাদি [২] দুই একটি বাক্যের দ্বারা কেন নিহত হইল ? বেদ যদি নিত্য হয় , তবে ইহা দ্বাপরের , ইহা কলির ধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ এবং সাফল্য কি?”
[১] মধুপর্ক বৈদিক প্রথা- ইহাতে গোবধের প্রয়োজন হইত।
দেবরেণ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ।।
অশ্বমেধ, গোবধ, সন্ন্যাস , শ্রাদ্ধে মাংসভোজন এবং দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন – কলিকালে এই পাঁচটি ক্রিয়া বর্জন করিবে।
[ বাণী ও রচনা, ৬ ষ্ঠ খণ্ড/ ১৭ ই আগস্ট, ১৮৮৯ এ প্রমদাবাবুকে লিখিত পত্র ]
৪) ব্রাহ্মণেরা একসময় গোমাংস খেতেন এবং শূদ্রাকে বিয়ে করতেন। অতিথির সন্তুষ্টির জন্য একটি গোবৎসকে হত্যা করা হত। শূদ্রেরা ব্রাহ্মণদের জন্য রান্না করতো।
৫) একসময় এই ভারতে গরু না খেলে কোনো ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ থাকতে পারতেন না। আপনি বেদে পড়তে পারেন, কোনো বাড়িতে সন্ন্যাসী, রাজা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ লোক এলে সবচাইতে ভালো বৃষকে হত্যা করা হত। ধীরে ধীরে সকলে বুঝলেন যেহেতু আমরা কৃষিজীবি জাতি , তাই সেরা সেরা বৃষ হত্যা করা মানে জাতির বিনাশ করা। তাই এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায় এবং গোহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে।
৬) আপনারা আশ্চর্যান্বিত হবেন, যদি আমি আপনাদের বলি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গরু না খেলে ভালো হিন্দু হওয়া যেত না। বিশেষ অনুষ্ঠানে তার অবশ্যই বৃষ বলি দিয়ে খেতে হত। এটা এখন অত্যন্ত বিরক্তিকর।
একবার গোরক্ষিণী সমিতির এক লোক বিবেকানন্দের কাছে চাঁদার জন্য এসেছিলেন। তখন বিবেকনন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ভারতে দুর্ভিক্ষে এত লোক যে মারা যাচ্ছে এ বিষয়ে গোরক্ষিণী সভা কি সাহায্য করেছেন? উত্তরে সেই গোরক্ষক বলেন, মানুষেরা তাদের কর্মফলের জন্য মরছে। তখন বিবেকানন্দও বললেন, গরুরাও একি ভাবে তাদের কর্মের জন্য মারা যাচ্ছে, এমনটাও বলা যায়। তারপর গোরক্ষক বলে, কিন্তু শাস্ত্রানুসারে গরু যে মা? তখন বিবেকানন্দ উপহাস করে তাকে বলেন, নইলে এমন কৃতি সন্তান আর কে প্রসব করবে? নিচে সম্পূর্ণ কথোপকথনটি দেওয়া হল-
“ নরেন্দ্র বাবু চলিয়া গেলে পর, গোরক্ষিণী সভার জনৈক উদ্যোগী প্রচারক স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করিতে উপস্থিত হইলেন। পুরা না হইলেও ইহার বেশভূষা অনেকটা সন্ন্যাসীর মত- মাথায় গেরুয়া রঙ্গের পাগড়ি বাঁধা , দেখিলেই বোঝা যায়- ইনি হিন্দুস্থানী । গোরক্ষা প্রচারকের আগমন বার্তা পাইয়া স্বামীজী বাহিরের ঘরে আসিলেন। প্রচারক স্বামীজীকে অভিবাদন করিয়া গোমাতার একখানি ছবি তাহাকে উপহার দিলেন। স্বামীজী উহা হাতে লইয়া , নিকট বর্তী অপর এক ব্যক্তির হাতে দিয়া তাহার সহিত নিম্নলিখিত আলাপ করিয়াছিলেনঃ
স্বামীজী- আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কি?
প্রচারক- আমরা দেশের গোমাতাগণকে কসাইয়ের হাত হইতে রক্ষা করিয়া থাকি স্থানে স্থানে পিঁজরাপোল স্থাপন করা হইয়াছে। সেখানে রুগ্ন, অকর্মণ্য এবং কসাইয়ের হাত হইতে ক্রীত গোমাতাগণ প্রতিপালিত হন।
স্বামীজী- এ অতি উত্তম কথা। আপনাদের আয়ের পন্থা কি?
প্রচারক- দয়াপরবশ হইয়া আপনাদের ন্যায় মহাপুরুষ যাহা কিছু দেন, তাহা দ্বারাই সভার ঐ কারয নির্বাহ হয়।
স্বামীজী- আপনাদের গচ্ছিত কত টাকা আছে?
প্রচারক- মারোয়াড়ি বণিক সম্প্রদায় এই কারযের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক । তাহারা এই সৎকারযে বহু অর্থ দিয়াছেন।
স্বামীজী- মধ্য ভারতে এবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হইয়াছে । ভারত গভর্নমেন্ট নয় লক্ষ লোকের অনশনে মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করেছেন । আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষ কালে কোন সাহায্য দানের আয়োজন করেছে কি?
প্রচারক- আমরা দুর্ভিক্ষাদিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র গোমাতাগণের রক্ষা কল্পেই এই সভা স্থাপিত।
স্বামীজী- যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাত ভাই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হল , সামর্থ্য সত্ত্বেও আপনারা এই ভীষণ দুর্দিনে তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেননি?
প্রচারক- না। লোকের কর্মফলে … পাপে এই দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল ; ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ হইয়াছে।
প্রচারকের কথা শুনিয়া স্বামীজীর বিশাল নয়নপ্রান্তে যেন অগ্নিকণা স্ফুরিত হইতে লাগিল, মুখ আরক্তিম হইল; কিন্তু মনের ভাব চাপিয়া বলিলেনঃ
যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না , নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্যে এক মুষ্টি অন্ন না দিয়ে পশুপক্ষী রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে , তার সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; তার দ্বারা সমাজের বিশেষ কিছু উপকার হয় বলে আমার বিশ্বাস নেই। কর্ম ফলে মানুষ মরছে—এরূপ কর্মের দোহাই দিলে জগতে কোন বিষয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্র করাটাই একেবারে বিফল বলে সাব্যস্ত হয় । আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না। ঐ কাজ সম্বন্ধেও বলা যাইতে পারে—গোমাতারা নিজ কর্ম ফলেই কসাইদের হাতে যাচ্ছেন ও মরছেন , আমাদের ওতে কিছু করবার প্রয়োজন নেই।
প্রচারক- (একটু অপ্রতিভ হইয়া) , হাঁ, আপনি যাহা বলিয়াছেন তাহা সত্য, কিন্তু শাস্ত্র বলে – গরু আমাদের মাতা।
স্বামীজী- (হাসিতে হাসিতে) হাঁ গরু আমাদের যে মা , তা আমি বিলক্ষণ বুঝেছি – তা না হলে এমন সব কৃতি সন্তান আর কে সব প্রসব করিবেন?
হিন্দুস্থানী প্রচারক ঐ বিষয়ে আর কিছু না বলিয়া (বোধ হয় স্বামীজির বিষম বিদ্রূপ তিন বুঝিতেই পারিলেন না) স্বামীজীকে বলিলেন যে, সেই সমিতির উদ্দেশ্যে তিনি তাহার কাছে কিছু ভিক্ষা প্রার্থী। …”
[স্থানঃ কলিকাতা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এর বাটী, বাগবাজার। কালঃ ফেব্রুয়ারি (শেষ সপ্তাহ), ১৮৯৭ । complete works of swami Vivekananda/volume 6/ conversations and dialogues/ 1 ]
Dr. John Henry Barrow বিশ্ব ধর্ম সভার (১৮৯৩) সভাপতি ছিলেন। তিনি তার Christian conquest of Asia নামক গ্রন্থে বিবেকানন্দের গোমাংস খাওয়ার কথা বলেছেন। এতে তিনি লিখেছেন-
“I knew how common it was in Calcutta for young Brahmans to go to the Great Pastern Hotel and secretly indulge in a meat dinner. And I knew, also, that the Hindus are accustomed to kill the goat before the hideous idol of the goddess Kali, and that no rational argument could be offered which would make the goat loss sacred than the cow. . . . . . At the close of the first session of the Parliament of Religions, I invited the Swami Vivekananda and other Asiatics to go with me to the restaurant in the basement of the Art Building, and I said to the Swami: ‘What shall I give you to eat?’ and he answered : ‘Give me beef.’ ” This simple remark was a thunder-bolt out of a clear sky. It changed the aspect of the whole meeting, and there were no further remarks about meat-eating.” [ source]
অর্থাৎ , আমি জানতাম কলকাতার ব্রাহ্মণ যুবকদের Great Pastern Hotel এ গিয়ে গোপনে মাংস খাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। এবং আমি আরও জানতাম হিন্দুরা দেবী কালির ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে ছাগল হত্যা করতো এবং কোনো যুক্তির মাধ্যমে ছাগলকে গরুর চাইতে কম পবিত্র প্রমাণ করা যায় না …
বিশ্ব ধর্ম সভার প্রথম অধিবেশনের শেষের দিকে আমি স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যান্য এশিয়া মহাদেশীয়দের আমার সাথে আর্ট বিল্ডিং এর নিচে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং আমি স্বামীকে বললাম – ‘ আপনি কি খাবেন? “ এবং তিনি উত্তর দিলেন- ‘আমাকে গোমাংস দিন’ এই সাধারণ মন্তব্য আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছিল। এটা পুরো সাক্ষাতের চেহারা পালটে দিয়েছিল, এবং সেখানে আর মাংস খাওয়া সম্বন্ধে মন্তব্য হয়নি।
তবে এর বিপরীতে এই ধরণের দাবীও করা যেতে পারে, Dr. John Henry Barrow বিবেকানন্দের শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ ছিলেন না। এ বিষয়ে এই ওয়েবসাইটটিতে কিছু আলোচনা আছে। আগ্রহীরা তা দেখতে পারেন।
বিবেকানন্দের সম্বন্ধে আরেকটি কথা জানা যায় যে, তিনি যখন আমেরিকাতে একটি পরিবারের সাথে অবস্থান করছিলেন তখন সেই পরিবারে গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ ছিল। এর ফলে একটি বাচ্চা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বিবেকানন্দকে তা জানালে বিবেকানন্দ নিজে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তাকে beef streak কিনে দেন। এই ঘটনাটি swami Vivekananda in the west: New discoveries নামক গ্রন্থে উল্লেখিত আছে –
There is an instance in his Life when a family with whom he was staying in the US stopped serving beef in their home when Swamiji was there. This disappointed a kid in their home. When he told Swamiji that he like beef streaks, the Swami personally took him into a restaurant which served beef streaks.
(Source: Swami Vivekananda in the West: New Discoveries )
(Source: Swami Vivekananda in the West: New Discoveries )
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ