বেদব্যাস ও পুরাণঃ
প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব পুরাণ রচনা করেছেন, কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ মহামতি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব প্রণীত নয়। তার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ প্রণয়ন করেছিলেন, তাও এখন প্রচলিত নাই। যা প্রচলিত আছে, তা কার প্রণীত, কবে প্রণীত হয়েছে, তার কোন স্থিরতা নাই। এটা আমার কথা না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যুক্তি প্রমাণ সহ তার কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে দেখিয়েছেন প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ এই গুলা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত না।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেনঃ
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে,
তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি —
১ম,— এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনা করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করে বলবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,— এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,— আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ,— বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
২য়,— এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,— আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ,— বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করেছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁকে পুরাণসংহিতা দান করলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হতে তিনটা সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক।
বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তার কিছুই স্থিরতা নাই।
[তথ্যসূত্র: কৃষ্ণচরিত্র- প্রথম খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদ]
[তথ্যসূত্র: কৃষ্ণচরিত্র- প্রথম খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদ]
❏ ইতিহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ গাথানং চ
নারশংসীনাং চ প্রিয় ধাম ভবতি য এবং বেদ।।
🔥(অথর্ববেদ ১৫/৬/১১-১২)
তিনি অনুসরন করেন ইতিহাস, পুরান (জ্ঞান ও কর্মের প্রাচীন গল্প) গাথাসমূহ (উদযাপনের কবিতা) এবং নারাশংসীদের ৷ যিনি এটি জানেন ইতিহাস, পুরাণ ও গাথাসমূহ তার প্রিয় হয়, গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ৷
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে-
❏ "ইতিহাসপুরানাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ"
(ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭/১/২)
অর্থাৎ ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ।
(পৌরাণিক বন্ধু গণ) আপনাদের দৃষ্টিতে, ডালাও ভাবে যখন পুরান সমূহের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গেল, তাহলে গ্রিক পুরাণের দেবতা জিউস, এসক্লেপিয়াস, অ্যাপোলো বা মিশরীয় পৌরাণিক দেবতা হোরাস যার শরীর ছিল মানুষের মত কিন্তু মাথা ছিল বাজপাখির মত, মণিপুরী পৌরাণিক ঈশ্বর গুরু শিদারা ও তাদের দেবদেবী; ইত্যাদি এই সব পুরাণের ঈশ্বর, দেবতার প্রতিমা তৈরি করে পূজা করেন না কেন???
জবাবে পৌরাণিক বন্ধুরা নিশ্চয় বলবেন এখানে ‘পুরাণ’ বলতে কোন পুরাণ গুলাকে বুঝানো হয়েছে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। এখানে গ্রিক, মিশরীয় পুরাণের কথা বলা হয়নি। এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলার কথা বলা হয়েছে।
তার মানে এখান থেকে এটা পরিষ্কার যে “ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ” এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, “পুরাণ” নামক যত গ্রন্থ প্রচলিত আছে, তার সব গুলা কে বুঝানো হয়েছে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণের কথাই বা বলা হয়েছে সেটা আপনারা(পৌরাণিকরা) কিভাবে বুঝলেন???
“পুরাণ” অর্থ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বাশয়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই।(১)
বর্তমান প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব মহাভারত লেখার পরে পুরাণসমূহ রচনা করেন।
যেমন ভাগবতে বলা হয়েছে.....
❏ কৃষ্ণে স্বধামোপগতে ধর্মজ্ঞানাদিভিঃ সহ।
কলৌ নষ্টদৃশামেষ পুরাণার্কোহধুনোদিতঃ।।
(১/৩/৪৩)
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ যখন তার লীলা সংবরণ করে ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সহ নিজ ধামে গমন করলেন, তখন সূর্যের মতো উজ্জ্বল এই পুরাণের উদয় হয়েছে। কলিযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভগবৎ-দর্শনে অক্ষম মানুষেরা পুরাণ থেকে আলোক প্রাপ্ত হবে।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে, ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে; তাহলে যে পুরাণ গুলার সৃষ্টি হয়েছে মহাভারতের পরে সেই পুরাণ গুলার কথা অথর্ব্ববেদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ কিভাবে আসবে? কারণ বেদ, উপনিষদ মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন; বেদ, উপনিষদের সময়ে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ ছিল না; তখন এই পুরাণ গুলোর কোন অস্তিতই ছিল না, তখন শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব কারো জন্মই হয়নি।
তার মানে এটা পরিষ্কার যে, এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, মহাভারতের বহু কাল পরে সৃষ্টি হওয়া অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলোর কথা বলা হয়নি। বরং এমন পুরাণের কথা বলা হয়েছে যে পুরাণ গুলো মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন, যে পুরাণ গুলো ব্যাসদেবের জন্মের পূর্বে, মহাভারত সৃষ্টির আগে এমনকি উপনিষদের সময়েও বিদ্যমান ছিল; সে পুরাণ গুলোকে “পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ” বলা হয়েছে। প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ কে পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলা হয়নি।
নারশংসীনাং চ প্রিয় ধাম ভবতি য এবং বেদ।।
🔥(অথর্ববেদ ১৫/৬/১১-১২)
তিনি অনুসরন করেন ইতিহাস, পুরান (জ্ঞান ও কর্মের প্রাচীন গল্প) গাথাসমূহ (উদযাপনের কবিতা) এবং নারাশংসীদের ৷ যিনি এটি জানেন ইতিহাস, পুরাণ ও গাথাসমূহ তার প্রিয় হয়, গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ৷
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে-
❏ "ইতিহাসপুরানাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ"
(ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭/১/২)
অর্থাৎ ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ।
(পৌরাণিক বন্ধু গণ) আপনাদের দৃষ্টিতে, ডালাও ভাবে যখন পুরান সমূহের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গেল, তাহলে গ্রিক পুরাণের দেবতা জিউস, এসক্লেপিয়াস, অ্যাপোলো বা মিশরীয় পৌরাণিক দেবতা হোরাস যার শরীর ছিল মানুষের মত কিন্তু মাথা ছিল বাজপাখির মত, মণিপুরী পৌরাণিক ঈশ্বর গুরু শিদারা ও তাদের দেবদেবী; ইত্যাদি এই সব পুরাণের ঈশ্বর, দেবতার প্রতিমা তৈরি করে পূজা করেন না কেন???
জবাবে পৌরাণিক বন্ধুরা নিশ্চয় বলবেন এখানে ‘পুরাণ’ বলতে কোন পুরাণ গুলাকে বুঝানো হয়েছে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। এখানে গ্রিক, মিশরীয় পুরাণের কথা বলা হয়নি। এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলার কথা বলা হয়েছে।
তার মানে এখান থেকে এটা পরিষ্কার যে “ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ” এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, “পুরাণ” নামক যত গ্রন্থ প্রচলিত আছে, তার সব গুলা কে বুঝানো হয়েছে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণের কথাই বা বলা হয়েছে সেটা আপনারা(পৌরাণিকরা) কিভাবে বুঝলেন???
“পুরাণ” অর্থ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বাশয়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই।(১)
বর্তমান প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব মহাভারত লেখার পরে পুরাণসমূহ রচনা করেন।
যেমন ভাগবতে বলা হয়েছে.....
❏ কৃষ্ণে স্বধামোপগতে ধর্মজ্ঞানাদিভিঃ সহ।
কলৌ নষ্টদৃশামেষ পুরাণার্কোহধুনোদিতঃ।।
(১/৩/৪৩)
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ যখন তার লীলা সংবরণ করে ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সহ নিজ ধামে গমন করলেন, তখন সূর্যের মতো উজ্জ্বল এই পুরাণের উদয় হয়েছে। কলিযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভগবৎ-দর্শনে অক্ষম মানুষেরা পুরাণ থেকে আলোক প্রাপ্ত হবে।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে, ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে; তাহলে যে পুরাণ গুলার সৃষ্টি হয়েছে মহাভারতের পরে সেই পুরাণ গুলার কথা অথর্ব্ববেদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ কিভাবে আসবে? কারণ বেদ, উপনিষদ মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন; বেদ, উপনিষদের সময়ে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ ছিল না; তখন এই পুরাণ গুলোর কোন অস্তিতই ছিল না, তখন শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব কারো জন্মই হয়নি।
তার মানে এটা পরিষ্কার যে, এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, মহাভারতের বহু কাল পরে সৃষ্টি হওয়া অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলোর কথা বলা হয়নি। বরং এমন পুরাণের কথা বলা হয়েছে যে পুরাণ গুলো মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন, যে পুরাণ গুলো ব্যাসদেবের জন্মের পূর্বে, মহাভারত সৃষ্টির আগে এমনকি উপনিষদের সময়েও বিদ্যমান ছিল; সে পুরাণ গুলোকে “পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ” বলা হয়েছে। প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ কে পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলা হয়নি।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ