অদ্বৈতবাদ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 June, 2020

অদ্বৈতবাদ

অদ্বৈতবাদ

অদ্বৈতবাদ

                                                            উপনিষদে অদ্বৈতবাদের বীজ থাকলেও জগদ্গুরু শঙ্করকেই অদ্বৈতবাদের জনক বলা হয়। অদ্বৈত অর্থ দুই না অর্থাৎ ব্রহ্ম ও জগৎ বা পরমাত্মা ও জীবাত্মা দুই নয়, এক। ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদের কোন প্রকার ভেদই নেই। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১/৪/১০) আছে- ‘‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ তদাত্মানমেবাবেৎ অহং ব্রহ্মাস্মীতি’’ অর্থাৎ এই জগৎ ব্রহ্ম রূপেই বর্তমান ছিল। তিনি নিজেকে ‘আমিই ব্রহ্ম’ রূপ জেনেছিলেন। মাণ্ডূক্য উপনিষদে আছে ‘‘সর্বং হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ এই সকলই ব্রহ্ম, এই আত্মাই ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদে আছে-‘‘যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি’’ অর্থাৎ ঐ যে সূর্যমণ্ডলস্থ পুরুষ আমিই তিনি। ছান্দোগ্য উপনিষদে তত্ত্বমসি (তুমিই সেই) ও সঃ অহম (আমিই তিনি) বাক্যদ্বয় রয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যত্র আছে ‘‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’’ অর্থাৎ সব কিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সংক্রান্ত এই বিদ্যাকে শাণ্ডিল্য বিদ্যা বলা হয়। অতএব একথা স্পষ্ট যে উপনিষদ বা বেদান্তই অদ্বৈতবাদ দর্শনের ভিত্তি।

অদ্বৈতমতে জীব

শঙ্করাচার্য বর্ণিত অদ্বৈতবেদান্তের মূল সূত্রেই জীব সম্পর্কেও বলা আছে- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তার মানে, শঙ্করের তৃতীয় বাণীটি হলো- ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন তথা জীব ব্রহ্মস্বরূপ।

বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন শঙ্করাচার্য। অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন-


‘শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’।।
অর্থাৎ : কোটি কোটি গ্রন্থ যে সত্য প্রতিপাদন করতে ব্যস্ত, আচার্য তা শ্লোকার্ধেই ব্যক্ত করেছেন। এই মূল সত্য হলো : ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন’।

জীবের সাথে ব্রহ্মের এবং জগতের সাথে ব্রহ্মের যদি কোন পার্থক্য বা ভেদ না থাকে তবে জীব-জগৎকে ব্রহ্ম হতে পৃথক মনে হচ্ছে কেন? প্রকৃতপক্ষে এই ভেদজ্ঞান অজ্ঞানতাবশত সৃষ্টি হয়। প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হলে রাতের অন্ধকার যেমন দিনের আলোর সাথে মিলিয়ে যায় তেমন করে এই অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। জগৎই ব্রহ্ম অর্থাৎ জগৎ ও ব্রহ্মে কোন ভেদ নেই, এরকম চিমত্মাই হল জ্ঞান আর জগৎ ও ব্রহ্মে ভেদ কল্পনা করাই হল অজ্ঞান বা অবিদ্যা।

প্রকৃতপক্ষে এই দৃশ্যমান জগৎ মিথ্যা এর অর্থ জগৎ অস্তিত্বহীন নয়। জগৎ মিথ্যা বলতে বোঝায় জগৎ আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল ও পরিণামী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে জগতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক এক স্থানে জগৎ এক এক রকম, এক এক সময়ে জগৎ এক এক রকম এবং এক এক জনের কাছে জগৎ এক এক রকম। অর্থাৎ জগৎ সব সময়, সব স্থানে এবং সবার কাছে এক রকম মনে হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে প্রাচ্য দেশে ও পাশ্চত্য দেশে জগতের রূপ এক রকম নয়। বসমত্ম ঋতুতে জগৎকে যেমন দেখা যায় বর্ষা ঋতুতে তেমন দেখা যায় না। একজন মানুষ জগৎকে যেমন দেখে একটি গরু বা অন্য প্রাণী কিন্তু তেমন দেখে না। তাই জগৎকে সৎ মনে হলেও অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল হওয়ায় জগৎকে মিথ্যা বলা হয়েছে। ভগবান শঙ্করাচর্য তাঁর বিবেকচূড়ামণি নামক গ্রন্থে বলেছেন-
  ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেত্যেবংরূপো বিনিশ্চয়ঃ।
                                                         সোহয়ং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ সমুদাহৃতঃ।।
                                                                                                                     -বিবেকচূড়ামণি (২০)
-‘ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে। জগৎকে সত্য বলে মনে করা মূলত ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। রজ্জুতে যেমন সর্প ভ্রম হয় ব্রহ্মতে তেমনি জগৎ ভ্রম হয়। ভগবান শঙ্করাচার্য এ সম্পর্কে বলেছেন-
 সম্যগ্ বিচারতঃ সিদ্ধা রজ্জুতত্ত্বাব ধারণা।
                                                            ভ্রান্তোদিতমহাসর্পভয়দুঃখ বিনাশিনী।।
                                                                                                -বিবেকচূড়ামণি (২)
অর্থাৎ অজ্ঞানের জন্যে ভ্রান্তিবশত রজ্জুতে মহাসর্পের মিথ্যাজ্ঞান থেকে ভয়, হৃদকম্প ইত্যাদি যে সব দুঃখের উদ্ভব হয় সেসবের নাশ হয় রজ্জুকে রজ্জু বলে জানলে। ঠিক-ঠিক বিচারের দ্বারা জ্ঞানের উন্মেষ হলে সর্পের মিথ্যাজ্ঞান চলে গিয়ে রজ্জুর পরিচয়ই সত্য হয়। দড়িকে অনেক সময় সাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞানতা বা ভ্রমের কারণে এমন মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে দড়ি দড়িই, সাপ নয়। তেমনি ব্রহ্মকেও অজ্ঞানতাবশত জগত মনে হয়। যখন অজ্ঞানতা দূর হয় তখন কিন্তু দড়িকে সাপ মনে হয় না। ভ্রম যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হবে ঠিক ততক্ষণ পর্যমত্ম দড়িকে সাপ মনে হবে এবং ভ্রমের ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে সাপের আর অস্তিত্ব থাকবে না। সাপ যেমন মিথ্যা এবং দড়িই সত্য তেমনি এই জগৎ মিথ্যা এবং একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। 

ব্রহ্ম অনাদি, অসীম, অনন্ত, নিরাকার ও অপরিণামী। ব্রহ্মের সৃষ্টি ও ধ্বংস নেই। ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়নি। ব্রহ্ম আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে এবং ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে। বস্ত্তত জগৎ সৃষ্টির ধারণা ভ্রম মাত্র। কোন কিছু সৃষ্টি করতে হলে উপাদান বা উপকরণ প্রয়োজন। ব্রহ্ম যদি এক ও অদ্বিতীয় হয় তবে উপকরণ সৃষ্টি হবে কিভাবে? যদি উপকরণের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয় তখন ব্রহ্ম দুই হয়ে যাবে। ব্রহ্ম থেকেও উপকরণের সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ ব্রহ্ম চৈতন্যয় ও অপরিণামী। কিন্তু উপকরণ হল জড় ও পরিণামী। একই বস্ত্তর মধ্যে পরিণামী ও অপরিণামী এই দ্বৈত-সত্ত্বা থাকা অসম্ভব। তাই ব্রহ্মের কোন উপাদান বা উপকরণ নেই। যেহেতু উপাদান নেই সেহেতু সৃষ্টি অসম্ভব। সুতরাং কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। যা কিছু  সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় তা আসলে মায়া। মায়ার কারণেই ব্রহ্ম ও জীবে এবং ব্রহ্ম জগতে ভেদজ্ঞান হয়। মায়া কেটে গেলে দৃশ্যমান জগৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই যতক্ষণ মায়া থাকবে ঠিক ততক্ষণ জগৎকে সত্য বলে মনে হবে। এই মায়াকে ত্রিগুণাত্বিকা প্রকৃতিও বলা হয়।

কোন হ্রদের জলে সূর্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে সে প্রতিবিম্ব মিথ্যা। দর্পণে যে প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাকে সত্য বলে মনে হলেও তা আসলে সত্য নয়। ঐ প্রতিবিম্ব যেমন মিথ্যা, জগৎও তেমনি মিথ্যা। জলে যে বুদবুদের সৃষ্টি হয় সে বুদবুদ জল থেকে পৃথক নয় অর্থাৎ জল ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তদ্রূপ জগৎও ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। অদ্বৈতবাদ দর্শনে জীবাত্মা ও পরমাত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই।

অদ্বৈতবাদ কি শূণ্যবাদকে সমর্থন করে? শঙ্কর বলেছেন দড়িতে সর্প-ভ্রমের কথা কিন্তু তিনি শূন্যে অর্থাৎ যেখানে কোন কিছু নেই এমন স্থানে সর্প-ভ্রমের কথা বলেননি। দড়ি ছিল বলে সর্প-ভ্রম হয়েছে কিন্তু দড়ি না থাকলে সর্প-ভ্রম হত না। অজ্ঞানতাবশত শূন্যস্থানে জগৎ কল্পিত হয় না ব্রহ্মকেই জগত বলে মনে হয়। সুতরাং অদ্বেতবাদ শূণ্যবাদকে সমর্থন করে না। তাই অদ্বৈতবাদের মুলকথা হল মায়ার কারণেই ব্রহ্মকে জগৎ বলে মনে হয়। মায়াই মরুভূমিতে মরীচিকা সৃষ্টি করে। মরুভূমিতে মরীচিকার কারণে তপ্ত বালিকে জল বলে মনে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কাছে না যাওয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত জলের অসিত্মত্ব থাকে কাছে গেলে জলের অস্তিত্ব থাকে না তখন শুধু বালিই দেখা যায়। তাই মায়া দূর হলে অথাৎ জ্ঞানের উদয় হলে জগতের অস্তিত্বও দূর হয়ে যায়।

রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈত দর্শন মতে জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। কিন্তু পরমাত্মা অখণ্ড ও পূর্ণ এবং তাঁকে কর্তন ও ছেদন করা যায় না। সুতরাং পরমাত্মার কোন অংশ হতে পারে না। 
উপনিষদে বলা হয়েছে, 

‘‘পূর্ণমদ, পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। 
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’’
 অর্থাৎ এই পরব্রহ্ম পূর্ণ (অখণ্ড), এই নাম-রূপস্থ ব্রহ্মও পূর্ণ, পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হন। পূর্ণের (নাম-রূপস্থ ব্রহ্মের) পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্ম) অবশিষ্ট থাকেন। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদজ্ঞান মূলত ভ্রম বা মায়া। একটি ঘটের মধ্যেও আকাশ আছে আর ঘটের বাইরেও আকাশ আছে তাই জীবাত্মা যদি হয় ঘটের আকাশ তবে পরমাত্মা হবে বাইরের উন্মুক্ত আকাশ। ঘটের ভেতরের আকাশ ও ঘটের বাইরের আকাশ মূলত একই। তাই জীবাত্মা ও পরমাত্মাও এক কিন্তু মায়ার কারণে ভেদজ্ঞান সৃষ্টি হয়। শঙ্কর বলেছেন, ‘‘অজ্ঞানযোগাৎ পরমাত্মনস্তব হ্যনাত্মবন্ধস্তত এব সংসৃতিঃ’’ অর্থাৎ অজ্ঞানযুক্ত হওয়ার ফলেই তোমার এই দেহাদি অনাত্মবস্তুতে বন্ধন, বস্ত্ততঃ তুমি পরমাত্মাই।

এখন মায়া প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মায়া আসলে কি? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? মায়া কি ব্রহ্ম ? এসব প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর বলেছেন,‘‘মায়া ব্রহ্মের শক্তি। মায়াকে অব্যক্তও বলা হয়। এই মায়া অনাদি, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট, কারণসরূপা। বিজ্ঞ ব্যক্তি জগতের সৃষ্টিকার্য থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করেন। এই মায়া যে আছে তাও নয় আবার নেই এরকমও নয়। আছেও আবার নেইও এ দুই এর মিশ্রণও নয়। মায়া পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয় অভিন্নও নয় আবার ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়রূপাও নয়। মায়া অঙ্গযুক্ত বা অঙ্গহীন নয় অথবা অঙ্গ আছে আবার নেই এই দুয়ের একত্র অবস্থাও নয়। মায়া অতি অদ্ভুতরূপা ও বাক্যের দ্বারা অবর্ণনীয়’’।

প্রকৃতপক্ষে মায়া অজ্ঞেয়। মানুষের চোখ তার নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্য মানুষ তার বদন-মণ্ডল দেখতে পায়। চোখ বদনমণ্ডলে অবস্থিত, তাই চোখ নিজের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায় না কিন্তু অন্যের বদনমণ্ডলকে দেখতে পায়। জীব মায়ার মধ্যে বাস করে তাই সে মায়া উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ মায়াকে উপলব্ধি করতে হলে মায়া-সমুদ্রের ওপারে যেতে হবে যা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব মায়া অজ্ঞেয়। মায়া অজ্ঞেয় বলেই সৃষ্টিপ্রবাহ বেঁচে আছে। মায়াকে জানলে সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে এই জগৎ-প্রপঞ্চ মনের ভ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু মন কি? মন কি দেহ থেকে পৃথক? আসলে মন-দেহ সবই মায়া। পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা কোন বস্তুর অস্তিত্ব উপলদ্ধি করা হয়। যতক্ষণ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ পর্যমত্ম জগতের অসিত্মত্ব থাকে। ঘুমের সময় পঞ্চ-ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক) মনে লুপ্ত হয়। তাই স্বপ্ন দেখার সময় মনই জগৎকে বিভিন্ন রূপে দর্শন করায়। কিন্তু স্বপ্নহীন নিদ্রা বা সুসুপ্তির সময় পঞ্চ ইন্দ্রিয় মনে এবং মন আত্মাতে লীন হয়। তখন জগৎকে আর উপলব্ধি করা যায় না। তখন মনই জগৎকে উপলব্ধি করায়। এই মন আছে কি নেই তা বোঝা কষ্ট, তাই এই মনও মায়া। যদি জগৎ সত্য হত তবে সুসুপ্তির সময়ও জগৎকে উপলব্ধি করা যেত। যেহেতু সুসপ্তিতে জগৎকে উপলব্ধি করা যায় না সেহেতু জগৎ মিথ্যা।

এখন অদ্বৈতবাদ দর্শনের মুক্তি প্রসঙ্গে আসা যাক। যেহেতু আত্মা মুক্ত অর্থাৎ আত্মার কোন বন্ধন নেই সেহেতু মুক্তির প্রশ্নই আসে না। যদি জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই হয় তাহলে আবার মুক্তি কিসের? অদ্বৈত দর্শনে মুক্তি অর্থ অজ্ঞানতা বা মায়া থেকে মুক্তি। কারণ মায়ার কারণেই আত্মার বন্ধন হয়েছে এমন মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ভগবান শঙ্কর বলেছেন-
ব্রহ্মাভিন্নত্ববিজ্ঞানং ভবমোক্ষস্য কারণম্।
                                                           যেন অদ্বিতীয়মানন্দং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে বুধৈঃ।।
-ব্রহ্মের থেকে আমি অভিন্ন এই জ্ঞানই সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তির কারণ স্বরূপ। আর এই জ্ঞানের দ্বারাই বিবেকী ব্যক্তিরা অদ্বিতীয় আনন্দরূপ ব্রহ্ম লাভ করেন ও ব্রহ্মই হয়ে যান। আবার তিনি বলেছেন- সকাম কার্য নাশ হলে বিষয়-চিন্তার নাশ হয় আর তার থেকে বাসনা ক্ষয় হয়ে যায়। বাসনার পুরোপুরি ক্ষয় হওয়াই হল মোক্ষ। এই অবস্থাকেই জীবন্মুক্তি বলে। মায়া দূর হলেই বিষয় চিমত্মা দূর হবে। তাই মায়া থেকে মুক্তি পেতে গেলে নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভেদ ভাবতে হবে এবং বেদবিহিত কর্ম করতে হবে। ভেতরের আমি-আমি ভাব বা অহংকার দূর করতে হবে কারণ এই অহং ভাবই ভেদজ্ঞান সৃষ্টি করে। শঙ্কারচার্যের মতে কর্ম হতে হবে নিষ্কাম। মুমুক্ষু জীব যখন বিষয়-তৃষ্ণা ত্যাগ করে, নিজেকে ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন মনে করে উপাসনা করবে, তখন মায়া দূর হবে এবং মোক্ষ লাভ হবে।


 ঈশ্বর ও জীব তথা পরমাত্মা ও জীবাত্মার এবত্ব মনে করে যে মতবাদ তাকে অদ্বৈতবাদ বলা হয়। শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য ও শ্রীপাদ রামানুযাচার্য এই মতবাদের ধারক। উভয়ে অদ্বৈতবাদী হলেও তাদের মধ্যে বিশ্বষত্ব এই যে, শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য জীবজগদাদির বা ভগবদৈশ্বর্যাদির বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করেন না ; কিন্তু শ্রীপাদ রামানুজাচার্য এসবের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করেন। শ্রীপাদ শঙ্করের মতে কেবল নির্বিশেষ ব্রহ্মই সত্য, অপর কোন বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই বলে ব্রহ্ম দ্বিতীয়-হীন-অদ্বৈত। তাই তার মতবাদকে কেবলাদ্বৈতবাদ ও বলা হয়। অার শ্রীপাদ রামানুজের মতে, জীবজগদাদি বা ভগবদৈশ্বর্যাদিও সত্য, বাস্তব অস্তিত্ব বিশিষ্ট, সবিশেষ বা বিশেষণবিশিষ্ট ; তাই তার মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

এভাবে সমাজে বহু মতবাদ রয়েছে। বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামীগণের অন্যতম শ্রীল জীবগোস্বামী বিভিন্ন শাস্ত্র-প্রমাণ ও শক্তি-শক্তিমানতত্ত্বের ভেদ-অভেদ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বর ও জীবজগৎ যুগপৎ ভেদ ও অভেদ এবং তা অামাদের চিন্তার অতীত। তাই এ মতবাদকে বলা হয় অচিন্ত্যভেদাভেদ, যা গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ ধারন করেন।
অদ্বৈতবাদকে উপনিষদীয় চিন্তাধারার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি বলে মনে করা হয়। যদিও এই মতবাদের সূত্রপাত শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) আবির্ভাবের পূর্বকালেই ঘটেছিলো, তবুও এই মতবাদ শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। শঙ্করাচার্যের গুরু ছিলেন আচার্য গোবিন্দ। গোবিন্দের গুরু গৌড়পাদ। গৌড়পাদই প্রথম উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়কে অবলম্বন করে একটি যুক্তিসঙ্গত অদ্বৈত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর বিখ্যাত গৌড়পাদকারিকা রচনা করেন, যা অদ্বৈতকারিকা বা মাণ্ডুক্যকারিকা নামে প্রসিদ্ধ। শঙ্করাচার্য বারবার গৌড়পাদ ও তাঁর কারিকার কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। তাই আচার্য গোবিন্দ শঙ্করাচার্যের দীক্ষাগুরু হলেও শিক্ষাগুরু ছিলেন গৌড়পাদই।
তবে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলমাত্র তাঁর পূর্বসূরীর পুনরাবৃত্তি ছিলো না মোটেও। অসাধারণ প্রতিভাবান তিনি বেদ, উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র, গীতা ও গৌড়পাদকারিকাকে ভিত্তি করে এক অনবদ্য, সুসংহত ও যুক্তিপ্রয়াসের মাধ্যমে অদ্বৈত দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। এই দর্শনই তাঁর অসামান্য মৌলিক দার্শনিক প্রতিভা ও অধ্যাত্মবোধের প্রতিফলন। আচার্য শঙ্কর অদ্বৈতবাদ তথা সমগ্র বেদান্ত দর্শনকে এমন এক যুক্তিভিত্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ ভাববাদীয় স্তরে উন্নীত করেছেন যে, বেদান্তের আলোচনা বলতে প্রথমেই তাঁর মতবাদের আলোচনাই মনে পড়ে। তবে অদ্বৈতবাদের ধারণা যেহেতু শঙ্করপূর্বকালের, তাই শঙ্করের দর্শনের উৎস অনুসন্ধানের জন্য তাঁর পূর্বসূরী গৌড়পাদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখা আবশ্যক মনে হয়।

১.১ : গৌড়পাদ (৫০০খ্রিঃ)
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীকে গৌড়পাদের সময়কাল বলে ধারণা করা হয়, এবং তিনি ছিলেন নর্মদাতীরস্থ স্থানের অধিবাসী। নর্মদা নদী ভারতের মধ্যপ্রদেশ, মালব ও গুজরাট পর্যন্ত বহমান হলেও ঠিক কোন জায়গায় গৌড়পাদের নিবাস ছিলো তা নিশ্চিত করা যায়নি।

গৌড়পাদ মাণ্ডুক্য উপনিষদকে ভিত্তি করে বিখ্যাত আগমশাস্ত্র বা মান্ডুক্যকারিকা রচনা করেন। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার ওপরেও গৌড়পাদের একটি ক্ষুদ্র টীকা আছে বলে জানা যায়। তবে তাঁর মহান কৃতি হলো আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকা। মাণ্ডুক্য-কারিকার চারটি অধ্যায় যার প্রথম অধ্যায়টিই শুধু মাণ্ডুক্য উপনিষদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর বাকি তিনটি অধ্যায়ের মাধ্যমে গৌড়পাদ স্বীয় দার্শনিক মত প্রকাশ করেছেন। মাণ্ডুক্য উপনিষদটি একটি অতি ক্ষুদ্র বারোটি মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ। গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য-কারিকার প্রথম অধ্যায় আগম প্রকরণে মাণ্ডুক্য উপনিষদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় বৈতথ্য প্রকরণে জগতের মিথ্যাত্বের প্রমাণ রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় অদ্বৈত প্রকরণে জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে। আর চতুর্থ অধ্যায় অলাতশান্তি প্রকরণে মায়ার কারণে যে জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয় তারই আলোচনা রয়েছে।

পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য উপনিষদের ওপর কারিকা রচনা প্রমাণ করে যে তিনি উপনিষদকে তাঁর দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত মনে করতেন কিন্তু সেই সঙ্গে বুদ্ধও যে তাঁর নিকট সমান মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এ কথা তিনি গোপন করতে চাননি।’ অর্থাৎ এখানে বৌদ্ধ প্রভাব স্পষ্ট। কিভাবে ? রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন-
‘চতুর্থ অধ্যায়ের (“আলাতশান্তি-প্রকরণ” যা কি-না বস্তুত বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ) প্রারম্ভিক কারিকাতেই তিনি বলেছেন : “আমি দ্বিপদাম্বরকে (=মনুষ্যশ্রেষ্ঠ) প্রণাম করি, যিনি তাঁর আকাশ-সদৃশ বিস্তৃত জ্ঞানের দ্বারা জেনেছেন (সম্বুদ্ধ করেছেন) যে, সকল ধর্মই (= ভাব, বস্তুসমূহ) আকাশসম শূন্য।” এই প্রকরণের ১৯তম কারিকায় পুনরায় বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে (“সর্বথা বুদ্ধৈরজাতিঃ পরিদীপিতা।”) এ ছাড়াও তিনি বুদ্ধের উপদেশের কথা দ্বিতীয় কারিকায় (৪/২) আলোচনা করেছেন। ৪২তম কারিকায় (৪/৪২) তিনি আবার বুদ্ধ এবং ৯০তম কারিকায় অগ্রযানের (=মহাযান) নাম গ্রহণ করেছেন। ৯৮ ও ৯৯তম কারিকায় (নাগার্জুনের ন্যায়) বুদ্ধের নাম করে বলেছেন যে বস্তুসমূহ স্বভাবত শুদ্ধ ও অনাবৃত; বুদ্ধ তাকে অধিক স্পষ্টভাবে জানেন। অন্তিম কারিকায় (৪/১০০) আবার তিনি পর্যায়ক্রমে বুদ্ধের বন্দনা করে গ্রন্থ সমাপ্ত করেছেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৫)।

তবে এখানে উল্লেখ্য যে, রাহুল সাংকৃত্যায়ন উদ্ধৃত ‘বুদ্ধ’ শব্দটিকে কারিকার তর্জমা বা ব্যাখ্যায় বেদান্তবাদীরা কিন্তু প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী অর্থেই ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যেমন, অন্তিম কারিকাটি হলো-


‘দুর্দর্শমতিগম্ভীরমজং সাম্যং বিশারদম্ ।
বুদধ্বা পদমনানাত্বং নমস্কুর্মো যথাবলম্ ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/১০০)
অর্থাৎ :
এই তত্ত্ব ধারণা করা কঠিন। এই তত্ত্ব সুগভীর, অনাদি, সদা অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ এবং অদ্বৈত। আমি এই তত্ত্বকে বোঝার (বুদধ্বা) জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি। আমি তাঁকে নমস্কার করি। (আগমশাস্ত্র-৪/১০০)।।
কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য উপনিষদকেই নির্বাচন করার পেছনে গৌড়পাদের কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো বলে মনে করা হয়; যেমন- প্রথমত, মাণ্ডুক্য একটি অতি ক্ষুদ্র বারো মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ হওয়ায় সেখানে তাঁর নিজের মতকে অধিক স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করা সহজসাধ্য ছিলো।
দ্বিতীয়ত, মাণ্ডুক্যে মাত্র ‘ওম্’ এবং তার চারটি অক্ষর দ্বারা আত্মার (=জীবের) জাগ্রতাদি চার অবস্থার (=চতুর্বর্গ) বর্ণনা করা হয়েছে, এটা এমনই একটা বিষয়, যাতে তাঁর মাধ্যমিক-যোগাচারী বৌদ্ধমত বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। যেমন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘ওম্ ইত্যেদক্ষরমিদং সর্বম্ । তস্যোপব্যাখ্যানং- ভূতং ভবদ্ ভবিষ্যদিতি সর্বমোঙ্কার এব যৎ চ অন্যৎ ত্রিকালতীতং তৎ অপি ওঙ্কার এব’। (মান্ডুক্য-১)।।  সর্বম্ হোতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, সঃ অয়মাত্মা চতুষ্পাৎ’। (মাণ্ডুক্য-২)।।
অর্থাৎ :
সবকিছুই ‘ওম্’ অক্ষরাত্মক। এই যে সমুদয় জগৎ, যা আমাদের ইন্দ্রিয় চোখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আবার ইন্দ্রিয়ের অগোচরেও যে জগৎ রয়েছে, সবই ‘ওম্’ এই অক্ষরের স্বরূপ। ‘ওম্’ এই অক্ষরের মধ্যে যে রূপ আছে, এইসব জগতের মধ্যেও সেই একই রূপ। এখানে তারই ব্যাখ্যা। এই জগৎ তিনটি কালের অধীন- অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এই তিন কালই ওঙ্কার। আবার এই তিন কালের বাইরে যে অনন্ত কাল আছে, তাও ওঙ্কার। ওঙ্কারই সব। (‘ওম্’- পরমাত্মা বা ব্রহ্ম-ও প্রতীক শব্দ) (মাণ্ডুক্য-১)।।  তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ জীবদেহে অবস্থান করে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ। (মাণ্ডুক্য-২)।।

সেই চারটি অংশ বা অবস্থা কী কী ? জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তূরীয়। আত্মা জীবের এই চার অবস্থার মধ্যে থেকে কী কী কাজ করছেন ? মাণ্ডুক্য-উপনিষদে তার বর্ণনায় বলা হয়েছে-

‘জাগরিতস্থানো বহিঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ। একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভূগ্বৈশ্বানরঃ প্রথম পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৩)।।  ‘স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ। একোনবিংশতিমুখঃ প্রবিবিক্তভুক্ তৈজসো দ্বিতীয় পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৪)।।  ‘যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে, ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুষুপ্তম্ । সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এবানন্দময়ো হ্যানন্দভুক্ চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞস্তৃতীয় পাদঃ’। (মাণ্ডুক্য-৫)।।  ‘এষ সর্বেশ্বও এষ সর্বজ্ঞ এষঃ অন্তর্যামী এষ যোনিঃ সর্বস্য, প্রভবাপ্যয়ে ভূতানাম্’। (মাণ্ডুক্য-৬)।।  নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং ন উভয়তঃ প্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ । অদৃশ্যম্ অব্যবহার্যম্ অগ্রাহ্যম্ অলক্ষণম্ অচিন্ত্যম্ অব্যপদেশ্যম্ একাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে। স আত্মা। স বিজ্ঞেয়ঃ’। (মাণ্ডুক্য-৭)।।
অর্থাৎ :
জীবের যখন জাগ্রত অবস্থা, সব ইন্দ্রিয় সজাগ অর্থাৎ অতন্দ্র, আত্মা তখন বাইরের বিষয়-জ্ঞানে মত্ত। বাইরের বিষয় হলো- শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ। জীব তা থেকেই জ্ঞানসঞ্চয় করে। জ্ঞানই হলো আত্মার খাদ্য। আত্মা তখন সাতটি অঙ্গ, আর উনিশটি মুখ দিয়ে বিশ্বের যাবতীয় স্থূল পদার্থ অনুভব করেন, ভোগ করেন। সাতটি অঙ্গ আর উনিশটি মুখ কী কী ? মাথা, দুই চোখ, প্রাণ, মূত্রাশয় আর দুই পা। পরমপুরুষ আত্মার মাথা হলো দ্যুলোক (স্বর্গলোক), সূর্য-চন্দ্র দুই চোখ, বায়ু প্রাণ, জলাশয় মূত্রাশয়, আর পৃথিবী দুই পা। উনিশটি মুখ হলো- দশটি ইন্দ্রিয় (পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়), পাঁচটি প্রাণ আর বাকি চারটি হলো মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে, কোনটাই এর বাইরে নয়। তাই জীব যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন প্রতিটি বস্তুর জ্ঞান নিয়ে আত্মা হন বৈশ্বানর। সর্বব্যাপী আত্মার এটি হলো প্রথম পাদ বা অবস্থা। (মাণ্ডুক্য-৩)।।  আত্মার দ্বিতীয় পাদ বা স্বপ্নময় অবস্থাটি হলো তৈজস। বাইরের জগৎ তখন তাঁর পুষ্টিসাধন করে না, খোরাক যোগায় অন্তর্জগৎ। তাই তৈজস আত্মাকে বলা হয় প্রবিবিক্তভুক অর্থাৎ সূক্ষ্মবস্তুকে আশ্রয় করে আত্মা তখন অন্তরে থেকে অন্তরপ্রজ্ঞ- অন্তর জগতের জ্ঞানে জ্ঞানী। মানুষ কতো না কামনা-ধারণা-বাসনা-কল্পনা নিয়ে দিন কাটায়। যার হয়তো অনেক কিছুই সে প্রত্যক্ষ ভোগ করতে পারে না। ঘুমন্ত অবস্থায় সেগুলো স্বপ্নজগতে ভেসে ওঠে। আর এই সাত অঙ্গ, উনিশ মুখ বাইরে যদিও ঘুমোচ্ছে, ভেতরে কিন্তু সক্রিয়ভাবে থেকে সেগুলি উপভোগ করছে। (মাণ্ডুক্য-৪)।।  মানুষ যখন কোন কামনা না নিয়ে ঘুমোয়, ঘুমন্ত অবস্থায় কোন স্বপ্ন না দেখে বেশ একটি পরিচ্ছন্ন ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকে, তখন তার সেই ঘুমন্ত অবস্থাকে বলে সুষুপ্ত অবস্থা। এই সুষুপ্তির মধ্যে এখানে কোন বিচ্ছেদ নেই, সব বিষয়ের সব জ্ঞান একসঙ্গে মিশে গিয়ে ঘন এক হয়ে যায়, আনন্দঘন- জ্ঞান এবং আনন্দকে উপভোগ করে আত্মা এখানে প্রাজ্ঞ হয়ে যান। এই প্রাজ্ঞ আত্মাই হলো তাঁর তৃতীয় পাদ বা অবস্থা। আত্মার তৃতীয় অবস্থা হলো প্রাজ্ঞ, চেতোমুখ। আনন্দই তাঁর খাদ্য। জ্ঞানমুখ। সুষুপ্তিকালে প্রাজ্ঞ আত্মা এই আনন্দকে আশ্রয় করে আনন্দময় হয়ে থাকেন। (মাণ্ডুক্য-৫)।।  তৃতীয় ক্ষেত্রে এই যে প্রাজ্ঞ-আত্মা, ইনিই হলেন সর্বেশ্বর- সকলের প্রভু, স্রষ্টা, নিয়ন্তা- সর্বশক্তিমান। ইনিই সর্বজ্ঞ- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু নেই, যা এর অগোচর। ইনিই অন্তর্যামী- যেমন বাইরের জগতে ইনি আছেন, তেমনি দেহ-জগতের ভেতরে থেকে আমাদের পরিচালনা করছেন। যাবতীয় বস্তুর ইনিই যেমন উৎপত্তিস্থল, তেমনি আবার লয়স্থান। (মাণ্ডুক্য-৬)।।  (মানুষের ক্ষেত্রে যে অবস্থা মৃত্যুর নামান্তর, সাধকের কাছে সে অবস্থা হলো তুরীয় অবস্থা।) এই চতুর্থ পাদে তুরীয় অবস্থাতেই সাধকের সমাধি। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনে জীব শিব- শান্ত, অদ্বৈত- এক। এখানে আর কোন ভেদাভেদ নেই। ‘আমি’-‘তুমি’-‘সে’- এসবের বালাই নেই। সাধকের এখানে একটাই অনুভূতি, একটাই পরিচয়- ‘আমিই পরমাত্মা, পরমাত্মাই আমি’। কিন্তু এই যে অদ্বৈত-আত্মা, বিশাল অখণ্ড সত্তা, এর স্বরূপ কী ? আত্মার আগের যে রূপ- অন্তঃপ্রজ্ঞ, বহিঃপ্রজ্ঞ, প্রজ্ঞানঘন প্রজ্ঞ- এসবের কোন মাত্রাই সেখানে নেই। তাঁকে দেখা যায় না- অদৃশ্য, ব্যবহার করা যায় না- অব্যবহার্য, কোনভাবে তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না- অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়। কোন বিশেষণ তাঁর নেই, কোন গুণও নেই- নির্গুণ। (মাণ্ডুক্য-৭)।।

তার মানে হলো, যখন তিনি মাত্রাযুক্ত অর্থাৎ উপাধি নিয়ে, গুণ নিয়ে তখন তিনি সগুণ, সবিশেষ। আবার যখন মাত্রাহীন, উপাধিহীন, গুণহীন, তখন তিনি নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্ম। রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করেন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে আত্মার প্রতি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে (নির্গুণ ব্রহ্মে) যে সমস্ত বিশেষণ, যেমন- অ-দৃষ্ট, অ-ব্যবহার্য, অ-গ্রাহ্য, অ-লক্ষণ, অ-চিন্তা- প্রভৃতি আসে, তা নাগার্জুনের তত্ত্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারিকা রচনায় গৌড়পাদের চেষ্টা ছিলো বৌদ্ধদর্শনের প্রাধান্য বজায় রেখে তাকে উপনিষদের সঙ্গে সংযুক্ত করা। শূন্যবাদের মধ্যে পড়ে ক্ষণিকতা-অক্ষণিকতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন তাঁর ছিলো না। তাই গৌড়পাদের কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য-উপনিষদই বেছে নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘শঙ্করও বৌদ্ধদার্শনিক মতকে পুরোপুরি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা তিনি সম্পূর্ণত উপনিষদীয় বস্তুতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আবার একই সঙ্গে তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন, এইজন্য তাঁকে যোগাচারের বিজ্ঞানবাদকে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞান (=চিত্ত)-তত্ত্বের ঘোষণা করতে গিয়ে তাঁকে ক্ষণিকতা-অ-ক্ষণিকতার মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়েছিল; শঙ্কর অ-ক্ষণিক (=নিত্য) চিত্ত-তত্ত্বকে স্বীকার করে নিজেকে শুদ্ধ ব্রাহ্মণ দার্শনিকরূপে প্রমাণিত করার প্রযত্ন করেছিলেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৬)।

গৌড়পাদের দার্শনিক মত :
গৌড়পাদ মনে করতেন, একটি অদ্বয় (বিজ্ঞান) আছে, জগৎ মায়া এবং ভ্রম মাত্র, এবং আত্মা অস্তিত্বহীন, কেউই জন্ম-মৃত্যু-কর্মফল ভোগ করে না। মাণ্ডুক্য-কারিকায় গৌড়পাদ বলেছেন-

‘ঋজুবক্রাদিকাভাসম্ অলাতস্পন্দিতং যথা।
গ্রহণগ্রাহকাভাসং বিজ্ঞানস্পন্দিতং তথা।। (আগমশাস্ত্র-৪/৪৭)
অর্থাৎ : একটি জ্বলন্ত মশালকে ঘোরালে তার আলোর রেখা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা আবার কখনো বা অন্য কিছু বলে মনে হয় (যদিও প্রকৃতপক্ষে আলোকরশ্মি সবসময় সোজা)। ঠিক একইভাবে চৈতন্যের পরিবর্তনও প্রতিভাত হয়- একই চৈতন্য (=বিজ্ঞান) কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো কারণ, কখনো কার্য (যদিও চৈতন্য সতত অপরিবর্তিত)।- (আগমশাস্ত্র-৪/৪৭)।

‘ঘূর্ণায়মান বস্তুকে যেমন সোজা ও বক্র দুইভাবেই দেখা যায় তেমনি বিজ্ঞানও (=ভাব) ঐ রকম দ্রষ্টা এবং দৃশ্যকে দেখে।’- গৌড়পাদের এই অদ্বয় মত যে শঙ্করের ব্রহ্ম অপেক্ষা নাগার্জুনের বৌদ্ধ শূন্যবাদেরই অধিক নিকটবর্তী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও গৌড়পাদের যে দার্শনিক মতকে ভিত্তি করে মূলত শঙ্করাচার্য তাঁর দর্শনের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন, সংক্ষেপে সেই মত নিম্নরূপ। যেমন-

জগৎ মিথ্যা : গৌড়পাদ জগৎকে মূলত মিথ্যা বলেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘স্বপ্নজাগরিতস্থানে হ্যেকমাহুর্মনীষিণঃ।
ভেদানাং হি সমত্বেন প্রসিদ্ধেনৈব হেতুনা।।’ (আগমশাস্ত্র-২/৫)
‘স্বতো বা পরতো বা অপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে।
সৎ অসৎ সদসৎ বা অপি ন কিঞ্চিদ্বস্তু জায়তে।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/২২)
‘আদ্যবন্তে চ যন্নাস্তি বর্তমানে অপি তৎ তথা।
বিতথৈঃ সদৃশাঃ সন্তঃ অবিতথাঃ ইব লক্ষিতাঃ’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)
অর্থাৎ :
স্বপ্ন ও জাগ্রৎ এই উভয় অবস্থাতেই জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি একই থাকে। এই দুই অবস্থায় যেসব বস্তুর অভিজ্ঞতা হয় সেই বস্তুগুলি অভিন্ন। এই কারণেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থার বস্তুকেই মিথ্যা বলে মনে করেন। (আগমশাস্ত্র-২/৫)।।  স্বতন্ত্রভাবেই হোক বা কারও মাধ্যমেই হোক, কোন কিছুরই জন্ম হয় না। কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকুক বা নাই থাকুক, অথবা যার অস্তিত্ব আছেও বটে আবার নেইও বটে- যাই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বস্তুর জন্ম হয় না। (আগমশাস্ত্র-৪/২২)।।  যদি এমন বস্তু থেকে থাকে, যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলেই ধরে নিতে হবে। মরীচিকার মতোই এও এক দৃষ্টিভ্রম- মনে হয় সত্য, কিন্তু আসলে সত্য নয়। যা সত্য তা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এই তিনকালেই সত্য। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)।।
অতএব, যে বস্তু আদিতে নেই, অন্তেও নেই, তার বর্তমান অবস্থাও তথৈবচ, মিথ্যারূপী হয়ে তাকে মিথ্যা বলেই দেখা যায়। গৌড়পাদের দৃষ্টিতে জগৎ তাই।

সকলই মায়া : এই জগৎ বা সবকিছুই যে দৃষ্টিবিভ্রম বা মায়াই কেবল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘যথা স্বপ্নে দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া।
তথা জাগ্রৎ দ্বয়াভাসং চিত্তং চলতি মায়য়া।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬১)
‘অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং চিত্তং স্বপ্নে ন সংশয়ঃ।
অদ্বয়ং চ দ্বয়াভাসং তথা জাগ্রন্ন সংশয়ঃ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬২)
অর্থাৎ :
স্বপ্নে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবু মন দুই (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) দেখে ও সেই অনুরূপ কাজ করে। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও মন অবিদ্যার প্রভাবে দুই দেখে ও সেই অনুযায়ী চিন্তা ও কাজ করে। (বস্তুত দুই নেই, এক। অজ্ঞানতার ফলেই এই ভুল হয়।) (আগমশাস্ত্র-৪/৬১)।।  স্বপ্নকালে মন নিঃসঙ্গ থাকে, তবু দুয়ের (জ্ঞাতা-জ্ঞেয়) অভিজ্ঞতা হয়। সেইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও মনের দ্বৈতভূমিকা থাকে, এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ধারণা সৃষ্টি করে। এর ফলে বহু দেখা যায়। আর এই বহুর অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্রষ্টার মনে সংশয়মাত্র থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন ও জাগ্রত- এই দুই অবস্থার অভিজ্ঞতাই দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬২)।।

এখানে গৌড়পাদের বক্তব্য হলো, বস্তুসমূহের মধ্যে যাদের উৎপন্ন বলা হয় তা কি বস্তুত ভ্রম থেকে নয় ? তাদের জন্ম মায়ারূপী এবং মায়ার কোন সত্তা নেই। যেমন স্বপ্নের মধ্যে চিত্ত মায়াবশত দুটি রূপ (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) গ্রহণ করে, জাগ্রত অবস্থাতেও চিত্ত মায়াবশত ঐ রকম করে। অতএব এই জগৎ এবং এর সবকিছুই মায়া মাত্র।

আত্মা (=জীব) নেই : জীবাত্মা সম্বন্ধে গৌড়পাদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক মনে হয়। মাণ্ডুক্য-কারিকায় তিনি বলেন-

‘যথা স্বপ্নময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তে অপি চ।
তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬৮)
‘যথা মায়াময়ো জীবো জায়তে ম্রিয়তে অপি চ।
তথা জীবা অমী সর্বে ভবন্তি ন ভবন্তি চ।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬৯)
‘নাজেষু সর্বধর্মেষু শাশ্বতাশাশ্বতাভিধা।
যত্র বর্ণা ন বর্তন্তে বিবেকস্তত্র নোচ্যতে।।’ (আগমশাস্ত্র-৪/৬০)
অর্থাৎ :
স্বপ্নে কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। একইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও সকল প্রাণীর জন্ম বা মৃত্যু দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৮)।।  মায়ার মধ্যে বা জাদুখেলায় অনেক সময় কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও এইসব প্রাণীকে জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৯)।।  জীবাত্মার জন্ম হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে অমর বা মরণশীল এই শব্দগুলি প্রযোজ্য নয়। যা বর্ণনা করা যায় না তাকে শাশ্বত বা অশাশ্বত কিভাবে বলবো ? (আগমশাস্ত্র-৪/৬০)।।

গৌড়পাদ হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, স্বপ্নময় বা মায়াময় আত্মাকে যেমন জন্মাতে ও মরতে দেখা যায় তেমনভাবে এই আত্মাসমূহ আছে আবার নেই-ও বটে। জীবাত্মা সম্বন্ধে তাঁর এই অবর্ণনীয় সংশয়কে হয়তো শেষতক নেতিবাচক বলেই বর্ণনা করা চলে। প্রকৃতপক্ষে গৌড়পাদ হয়তো জীবাত্মার স্থলে বিজ্ঞান বা চৈতন্যকেই স্বীকার করেন বলে মনে হয়। যেমন, মাণ্ডুক্য-কারিকাতে বলা হয়েছে-

‘ঘটাদিষু প্রলীনেষু ঘটাকাশাদয়ো যথা।
আকাশে সংপ্রলীয়ন্তে তদ্বজ্জীবা ইহাত্মনি।।’ (আগমশাস্ত্র-৩/৪)
‘নাকাশস্য ঘটাকাশো বিকারাবয়বৌ যথা।
নৈবাত্মনঃ সদা জীবো বিকারাবয়বৌ তথা।।’ (আগমশাস্ত্র-৩/৭)
অর্থাৎ :
ঘট যখন ভেঙে যায় তখন ঘটের ভিতরের আকাশ বাইরের আকাশে মিশে যায়। সেইভাবে যে দেহের সঙ্গে জীবাত্মা যুক্ত সেই দেহের যখন নাশ হয় তখন জীবাত্মা (চৈতন্য) পরমাত্মাতে (চৈতন্যে) লয় হয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৪)।।  ঘটাকাশ অনন্ত আকাশের অংশ বা বিকার নয়। বস্তুত ঘটাকাশ অখণ্ড আকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। একইভাবে, জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ নয়, আবার বিকারও নয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৭)।।
পরমতত্ত্ব : গৌড়পাদ যে এক অদ্বয় সত্তা বা অদ্বৈত পরমসত্তায় বিশ্বাস করেছেন তা অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারীদের সমালোচনার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। কেননা, মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে-

‘অস্তি নাস্ত্যস্তি নাস্তীতি নাস্তি নাস্তীতি বা পুনঃ।
চল-স্থির-উভয়-অভাবৈঃ আবৃণোতি এব বালিশঃ’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৩)
‘কোট্যশ্চতস্র এতাস্তু গ্রহৈর্যাসাং সদা আবৃতঃ।
ভগবানাভিঃ অস্পৃষ্টো যেন দৃষ্টঃ স সর্বদৃক্’।। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৪)
অর্থাৎ :
নির্বোধ ব্যক্তি কখনো মনে করে তিনি (=পরমসত্তা) আছেন, কখনো মনে করে নেই, আবার কখনো মনে করে আছেনও বটে নেইও বটে। আর কখনো বা মনে করে আছেও নেইও তাও নয়, এইভাবে চার কোটিতে কখনো স্থির, কখনো চঞ্চল, কখনো দুই-ই, কখনো তাও নয়, ইত্যাদি ভেবে নির্বোধ ব্যক্তি পরমতত্ত্বকে আবৃত করে রাখে। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৩)।।   এই চারটি গোষ্ঠির কাছে ভগবান (=পরমসত্তা) সর্বদাই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। এর কারণ নিজ নিজ মতের প্রতি এঁরা মোহমুগ্ধ। কিন্তু এই চার মতবাদের উর্ধ্বে গিয়ে যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জ্যোতির্ময় সত্তার দর্শন লাভ করেন তিনি প্রকৃতই সর্বজ্ঞ। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৪)।।

গৌড়পাদ এখানে অদ্বৈতবিরোধী চারটি প্রধান দার্শনিক মতকে চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে বৈশেষিকরা বলেন, আত্মার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আত্মার পরিবর্তন হয়। আত্মা কখনো সুখী কখনো দুঃখী। যদিও তাঁদের মতে আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র। আর এক বিরোধী দার্শনিক মত হলো বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদর্শন। তাঁরা বিশ্বাস করেন বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। এই মত অনুসারে আত্মা বা পরমসত্তা বলে কিছু নেই। আবার অন্য মতগোষ্ঠি দিগম্বর জৈনরা বলেন, আত্মা আছেও বটে, নেইও বটে। যতক্ষণ দেহের অস্তিত্ব আছে ততক্ষণই আত্মার অস্তিত্ব। দেহের মৃত্যুর সঙ্গেই আত্মারও মৃত্যু হয়। আবার দেহ বড় বা ছোট হলে আত্মাও বড় বা ছোট হয়। বৌদ্ধদের আরেকটি শাখা যা মাধ্যমিক শূণ্যবাদী বলে পরিচিত, তাঁদের মতে আত্মা বলে কিছু নেই। পরম সত্য হলো শূন্য। এঁদের বলা হয় নিহিলিস্ট বা নাস্তিবাদী।
গৌড়পাদের মতে এইসব তর্কবিচার নিরর্থক। এতো বাগবিতণ্ডায় তাঁদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এঁদের আত্মজ্ঞান লাভের আশা সুদূরপরাহত। তাঁর মতে, যিনি বুঝেছেন তা বিতর্কের বিষয় নয় তিনি এই পরমসত্তাকে জানেন। তিনি যথার্থই প্রাজ্ঞ।

গৌড়পাদের এই দার্শনিক মত শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মস্বরূপ’- এই মতের সঙ্গে যথেষ্ট ব্যবধান বজায় রাখলেও শঙ্করের মায়াবাদের সমস্ত মৌলিক সামগ্রীই এর মধ্যে নিহিত আছে বলে মনে করা হয়।

১.২ : শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিঃ)
অষ্টম শতকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার অঞ্চলে তথা কেরলের এক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ পরিবারে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশাখী শুক্লপঞ্চমী তিথিতে শঙ্করের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বৈশিষ্টা। মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তাঁর পিতার দেহান্ত হয়, ফলে তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার গুরু দায়িত্ব তাঁর মাতাকেই বহন করতে হয়। শঙ্করের প্রতিভা ছিলো অতুলনীয় এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার অধিকারী ছিলেন তিনি। মাত্র আট বৎসর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ বেদ অধ্যয়ন করেন বলে জানা যায় এবং এই বয়সেই তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গৃহত্যাগ করে নর্মদা নদীর তীরে বৈদুর্যমণি পর্বতের গুহায় গোবিন্দপাদ নামক একজন বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছে অদ্বৈততত্ত্ব আয়ত্ত করেন। এই গোবিন্দ ছিলেন আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের শিষ্য। তাই শঙ্করের দীক্ষাগুরু গোবিন্দ হলেও শিক্ষাগুরু ছিলেন গৌড়পাদ। সেখান থেকে তিনি কাশী এবং পরে বদরিকাশ্রমে যান। এই বদরিকাশ্রমে থেকে বারো বছর বয়সেই শঙ্করাচার্য বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তাঁর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ শারীরকভাষ্য রচনা করেন বলে কথিত আছে। শঙ্কর যে কতোটা মেধাবী ছিলেন, মাত্র বত্রিশ বছর আয়ুকালের মধ্যেই ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র, ভগবদ্গীতা এবং ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয় ও শ্বেতাশ্বতর এই দশটি প্রধান উপনিষদের ওপর বিদগ্ধ ভাষ্যরচনাই তাঁর প্রতিভার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

শঙ্করের আবির্ভাবকালে তখন বৌদ্ধ ও জৈনমতের প্রবল প্রতাপ। ফলে বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি লোকের শ্রদ্ধাও কমে যাচ্ছিলো। দাক্ষিণাত্যে জৈন ধর্মের প্রসার লাভ করেছিলো। শৈব আদিয়াব ও বৈষ্ণব আলোয়ারগণ ভক্তিধর্ম প্রচার করছিলেন। মীমাংসকগণ বৈদিক যাগযজ্ঞ প্রচারের চেষ্টা করেন। অপরদিকে কুমারিল ও মণ্ডনমিশ্র সন্ন্যাসের তুলনায় গার্হস্থ্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বলা যায়, এটা ছিলো সেই সময় যখন বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, জৈন সকল ধর্মই মানুষকে সাধুতে পরিণত করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো। প্রকৃত ব্যাখ্যাতার অভাবে হিন্দুমত তখন শাস্ত্রের বিরোধ এবং আচার-অনুষ্ঠানের কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিলো। হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত এবং শাস্ত্রের আপাতবিরোধ দূর করাকে প্রাথমিক দায়িত্ব মনে করে শঙ্কর নানা শাস্ত্রের মূলতত্ত্বকে মানুষের কাছে তুলে ধরে দেখান যে, শাস্ত্রের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই। বিভিন্ন উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবাদকে সুদৃঢ়ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি দেখান যে, বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই পরমতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। এই পরমতত্ত্ব এক অনির্বচনীয় পরমসত্তা। বেদান্ত দর্শনে এই পরমসত্তাকে বলা হয় ব্রহ্ম।

বেদান্তের শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী, অজ্ঞানবশতই জীব সখণ্ডকে সত্য বলে মনে করে এবং পরমসত্তার কথা কখনও চিন্তা করে না। সখণ্ড প্রতিভাত জগৎ না সত্য, না অলীক। অখণ্ড পরমসত্তাই যেহেতু একমাত্র সত্য, সেহেতু প্রতিভাত সখণ্ড জগৎ সত্য নয়। আবার জগৎ শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকও নয়। জগৎ অনির্বচনীয়। জগতের এই অনির্বচনীয়তারই পারিভাষিক নাম হলো ‘মায়া’। জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃত জ্ঞানের উদয়ে জীব এই সকল সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা এই প্রস্থানত্রয়েরই ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর রচিত প্রধান ‘দশটি উপনিষদের ভাষ্য’, ব্রহ্মসূত্রের ‘শারীরকভাষ্য’ এবং ভগবদ্গীতার ‘গীতাভাষ্য’ বেদান্ত দর্শনের অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও তিনি অনেক স্বতন্ত্র গ্রন্থ ও স্তোত্র রচনা করেন। পরবর্তীকালে বহু মনীষী শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের উপর টীকা রচনা করেন। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের উপর বাচস্পতি মিশ্রের লেখা ‘ভামতী’ টীকা প্রসিদ্ধ। এছাড়া শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য পদ্মপাদাচার্য ‘পঞ্চপাদিকা’ বা ‘বিবরণ’ নামে শঙ্করভাষ্যের উপর একটি মনোরম টীকা রচনা করেন। কিন্তু শঙ্করের শারীরকভাষ্যের উপর টীকাকারদের মতপার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে অদ্বৈতমতের সমর্থকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে (বেদান্তের উপ-উপসম্প্রদায়) বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে পদ্মপাদাচার্যের ‘বিবরণ সম্প্রদায়’ এবং শ্রীবাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী সম্প্রদায়’ প্রধান। বিবরণ সম্প্রদায় ‘পঞ্চপাদিকা’ টীকার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং ভামতী সম্প্রদায় ‘ভামতী’ টীকার উপর প্রতিষ্ঠিত।

পদ্মপাদাচার্যের ‘পঞ্চপাদিকা’, প্রকাশাত্মযতি রচিত ‘পঞ্চপাদিকা-বিবরণ’ এবং বিদ্যারণ্য’র ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’ বিবরণ সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী’, অমলানন্দ’র ‘ভামতী-কল্পতরু’ ও ‘শাস্ত্রদর্পণ’ এবং অপ্পয়দীক্ষিত-এর ‘কল্পতরুপরিমল’ ভামতী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অদ্বৈত চিন্তাধারায় শাঙ্করভাষ্যের উপর আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার মধ্যে সুরেশ্বর আচার্যের ‘তৈত্তিরীয়ভাষ্যবার্ত্তিক’, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’, চিৎসুখাচার্য’র ‘চিৎসুখী’, মধুসূদন সরস্বতীর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’, ব্রহ্মানন্দ’র ‘লঘুচন্দ্রিকা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদানন্দ যোগীন্দ্রের ‘বেদান্তসার’ ও ধর্ম্মরাজাধবরীন্দ্রের ‘বেদান্ত পরিভাষা’ যথাক্রমে বেদান্ততত্ত্ব ও বেদান্তজ্ঞানতত্ত্বের উপর বহুলপ্রচলিত দুখানি উল্লেখযোগ্য প্রকরণগ্রন্থ।

শঙ্করের দার্শনিক মত : শঙ্কর তাঁর সকল গ্রন্থেই তাঁর মৌলিক চিন্তা তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর শারীরকভাষ্যে বাদরায়ণের বেদান্তসূত্রের প্রথম চারটি সূত্রের ভাষ্যের মধ্যে তিনি অধিক মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, বৌদ্ধের সংবৃত্তি-সত্য এবং পরম-সত্যকে উপজীব্য করে ব্রহ্মকেই একমাত্র সৎ (অদ্বৈত) পদার্থ বলে মানতে গিয়ে তিনি ব্যবহারিক সত্যের পটভূমিতে বুদ্ধি-এবং-অবুদ্ধিগম্য সব ব্রাহ্মণ-সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সবকিছু মিলিয়ে তাই বর্তমানে শঙ্করের দার্শনিক মত বলতে তাঁর শারীরকভাষ্যে প্রস্তাবিত অদ্বৈতবাদকেই বোঝানো হয়, যার অন্য দার্শনিক নাম অদ্বৈত-বেদান্ত।
শঙ্করের অদ্বৈতবাদ
বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন শঙ্করাচার্য। অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন-

‘শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’।।
অর্থাৎ : কোটি কোটি গ্রন্থ যে সত্য প্রতিপাদন করতে ব্যস্ত, আচার্য তা শ্লোকার্ধেই ব্যক্ত করেছেন। এই মূল সত্য হলো : ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন’।

বস্তুত ব্রহ্ম, জগৎ ও জীবের স্বরূপ ব্যাখ্যাই সমগ্র বেদান্ত দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়। অদ্বৈতবাদে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে একমাত্র ব্রহ্মকেই সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। ব্রহ্মই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। জগৎপ্রপঞ্চ স্ব স্ব কারণে লীন হয়ে ব্রহ্মমাত্রে অবশিষ্ট থাকে। যেহেতু এই মতে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য, সেহেতু জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্ম হলেন চৈতন্যস্বরূপ। জগতে আমরা সবাই চেতন জীব। তাহলে চেতন জীবের সাথে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী ? উত্তরে বলা হয়েছে যে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। জীবও মায়ামুক্ত হলে নিজেকে ব্রহ্ম বলেই জানে। সুতরাং ব্রহ্মই প্রকতপক্ষে সৎ। সংক্ষেপে এই হলো অদ্বৈততত্ত্ব।

আচার্য শঙ্কর উপনিষদীয় নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মতত্ত্বের অন্যতম প্রধান সমর্থক। তাঁর মতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নির্বিকার, নিরাকার, এক এবং অদ্বিতীয়। সাধারণত লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারা বিষয় সিদ্ধ হয়। তাহলে ব্রহ্মের লক্ষণ বা প্রমাণ কী ? নির্গুণ ব্রহ্মের সদর্থক লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুর অসাধারণ ধর্মের দ্বারা লক্ষণ নির্দেশ করা হয়। ব্রহ্ম নির্ধর্মিক হওয়ায় তাঁর লক্ষণ সম্ভব নয়। এ কারণে অদ্বৈতপন্থীরা এক বিশেষ যুক্তিপ্রণালীর সাহায্যে ব্রহ্মোপদেশ দিয়ে থাকেন। এই বিশেষ যুক্তিপ্রণালী ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’ নামে পরিচিত।

অধ্যারোপ = অধি + আরোপ। অর্থাৎ ভ্রমের আরোপকে বলা হয় অধ্যারোপ। যথার্থ বস্তুতেই ভ্রমের আরোপ হয়। কিন্তু যথার্থ বস্তুতে কি যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব ? এ বিষয়ে শাঙ্করভাষ্যে বলা হয়েছে-

‘ইত্যতো অস্মৎ প্রত্যয়গোচরে বিষয়িণি চিদাত্মকে যুষ্মৎ প্রত্যয়গোচরস্য বিষয়স্য তদ্ধর্মাণাঞ্চ অধ্যাসঃ, অদ্বিপর্য্যয়েণ বিষয়িণঃ তদ্ধর্ম্মাণাং চ বিষয়েহধ্যাসঃ মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্ ।’ (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)
অর্থাৎ :
‘অস্মৎ’ বা ‘আমি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে চৈতন্যময় আত্মা- তাতে ‘তুমি’ বা ‘তোমরা’ বা ‘এগুলি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে জড়জগৎ এবং যেসব জড়ধর্ম- তাদের আরোপ হবার সম্ভাবনা নেই। এভাবে বিপরীতক্রমেও আবার জড়বস্তুতেও চৈতন্য এবং চৈতন্যের ধর্ম প্রকাশ ও সত্তা প্রভৃতির আরোপ কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়।
শঙ্করমতে যথার্থ বস্তুতে যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব নয়, কেবল ভ্রমাত্মক আরোপই হতে পারে। তাই বেদান্তমতে অধ্যারোপ হলো বস্তুতে অবস্তুর আরোপ। আর অপবাদ হলো কার্যমাত্র পদার্থেরই মিথ্যাত্ব প্রতিপাদন। এই ভ্রমাত্মক আরোপের এবং কার্যপদার্থের মিথ্যাত্ব প্রতিপাদনের মাধ্যমে অদ্বৈতমতে গুরু শিষ্যকে ব্রহ্মের পরিচয় ও উপদেশ দেন এবং সৎ বস্তুকে অবস্তু থেকে পৃথক করেন। এই প্রণালীই ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’।
বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় আত্মতত্ত্বজ্ঞান। তাই এই আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভ্রমাত্মক ধারণাই এখানে অধ্যারোপ। বেদান্ত-বিরোধী এই মতগুলির অসারতা প্রতিপাদনের মাধ্যমে বেদান্তমতের পরিচয় তুলে ধরা হয়।

দার্শনিক দৃষ্টিতে এই ভ্রমাত্মক আরোপ বা অধ্যারোপ কিভাবে হয় ? অদ্বৈতমতে বস্তুর ভিন্নরূপ প্রতীতি বা অবস্তুর বস্তুরূপে প্রতীতিকে বলা হয় ভ্রম বা অধ্যাস। আমরা যখন রজ্জুকে সর্প বলে জানি, তখন পূর্বদৃষ্ট সর্পের সদৃশ বস্তু রজ্জুতে সর্পের আপাত-প্রতীতি ঘটে। রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্যে এই ভ্রম-প্রতীতি বা অধ্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে-

‘আহ কোহয়ং অধ্যাসো নাম ইতি ? উচ্যতে। স্মৃতিরূপঃ পরত্র পূর্বদৃষ্টাবভাসঃ।’- (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)
অর্থাৎ :
এই অধ্যাস কী রকম ? ভিন্ন-বস্তুতে ভিন্ন-বস্তুর জ্ঞানই অধ্যাস। পূর্বানুভব থেকে সংস্কার হয়- এই সংস্কার থেকে যেমন স্মরণ হয়, তেমনি এই অধ্যাসও পূর্বানুভবজনিত সংস্কারের ফল- একারণে এর নাম স্মৃতিরূপ (কারণ সংস্কার হতে উৎপন্ন হওয়াই স্মৃতির রূপ বা ধর্ম)। এই যে বিভিন্ন-বস্তু, যার অবভাসকে অধ্যাস বলা হচ্ছে- তা পূর্বদৃষ্টবৎ অর্থাৎ পূর্বে যা অনুভবের বিষয় হয়েছে তার সাথে এর সাদৃশ্য আছে মাত্র; প্রকৃতপক্ষে তা পূর্বদৃষ্ট নয়। (কেননা পূর্বদৃষ্টাবভাস মানে পূর্বদৃষ্টবৎ অবভাস বোঝায়।)

তার মানে, যার সাথে যার কোনো সম্বন্ধ নেই, কেবল পূর্বদৃষ্ট বস্তুর সাদৃশ্য আছে, সেই বস্তুতে সেই পূর্বদৃষ্ট বস্তুর ভ্রমাত্মক আরোপকেই অধ্যাস বলা যায়। অধ্যাসের আরেকটি স্বভাব হলো-

‘তত্রৈবং সতি যত্র যদধ্যাসঃ তৎকৃতেন দোষেন গুণেন বা অণুমাত্রেণ অপি স ন সম্বধ্যতে। তমেতং অবিদ্যাখ্যম্ আত্মানাত্মনো ইতরেতর অধ্যাসং…’। (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)
অর্থাৎ :
যে বস্তুর উপর যার অধ্যাস বা আরোপ হয়,- সেই বস্তু- সেই বস্তুর অণুমাত্র দোষ বা গুণের সংসৃষ্ট হতে পারে না। আত্মা ও জড়-প্রপঞ্চের এরকম পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাসই অবিদ্যা।

যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে রজ্জুতে যখন সর্পের আরোপ বা অধ্যাস হয়- তখন সর্পের কোনো গুণ বা দোষ রজ্জুতে কিছুতেই সংক্রান্ত হয় না,- রজ্জুকে আমরা সর্প বলে বুঝি কেবল। কিন্তু তাই বলে রজ্জু সর্প হয়ে যায় না, কিংবা সর্পের গুণ বা দোষও রজ্জু গ্রহণ করে না। তাই রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বেদান্তের ভাষায় বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। অবভাসের কারণ সত্য, কিন্তু অবভাস সত্য নয়। ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়। অদ্বৈতবেদান্ত মতে অবভাস বা ভ্রমীয় বস্তু হলো অপূর্ব। এই মতে, ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়, আবার অসৎও নয়। তবে কি ভ্রমীয় বস্তু সদসৎ ? অদ্বৈতমতে ভ্রমীয় বস্তু সদসৎও নয়। ভ্রমীয় বস্তু প্রকৃত বস্তু সম্বন্ধে অবিদ্যা বা অজ্ঞানের পরিণাম এবং তা অনির্বাচ্য। রজ্জুর অজ্ঞান থেকেই রজ্জুতে সর্পের বিবর্ত ঘটে। রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞানে অধ্যস্ত সর্প মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বিষয়ের প্রকৃতজ্ঞানে ঐ বিষয়ের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়। কিন্তু তাই বলে প্রতিভাত সর্প অসৎ নয়। আসলে অধ্যস্ত সর্পটির রজ্জু-অতিরিক্ত কোন সত্তা নেই। যথার্থ জ্ঞানে প্রতিভাত সর্প রজ্জুতে বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে, অদ্বৈত মতানুসারে জীব ও জগৎ প্রকৃতজ্ঞানে ব্রহ্মে বিলীন হয়।

অন্যদিকে ব্রহ্ম নির্গুণ ও নির্ধর্মিক হওয়ায় সদর্থকভাবে বা বিধিমুখে ব্রহ্মের লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ব্রহ্মের নিষেধমূলক বা নঞর্থকভাবে লক্ষণ করা হয়। কেনোপনিষদে বলা হয়েছে (কেনোপনিষদ : ১/৫-৯) যে,- দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, বিষয় প্রভৃতি দৃশ্যমান বস্তুর অতিরিক্ত সত্তাই ব্রহ্ম। এবং কেনোপনিষদে আরো বলা হয়েছে-

‘অন্যদেব তৎ বিদিতাদথো অবিদিতাদধি।
ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নঃ তৎ ব্যাচচক্ষিরে’।। (কেন-১/৪)
অর্থাৎ : সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র ; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা- আমরা তাঁদের কাছ থেকে একথা শুনেছি (কেন-১/৪)।
অনেক ক্ষেত্রে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বা সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও বলা হয়েছে-
‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জান ও অনন্ত। (তৈত্তিরীয়-২/১/১)
এসব ক্ষেত্রেও নিষেধের মাধ্যমেই ব্রহ্মকে বুঝতে হবে। সদর্থকভাবে এইসব লক্ষণকে গ্রহণ করা হলে ব্রহ্মের সৎ-ত্ব, চিৎ-ত্ব, আনন্দত্ব, জ্ঞানত্ব, সত্যত্ব, অনন্তত্ব প্রভৃতি গুণকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু নির্গুণ ব্রহ্মের এইসব গুণ থাকা সম্ভব নয়। তাই অদ্বৈতমতে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বলতে ব্রহ্ম অসৎ নয়, অচিৎ নয় এবং দুঃখরূপ নয় বলে বুঝতে হবে। জগতের অসৎ-বস্তু, অচিৎ-বস্তু, দুঃখরূপ-বস্তু, অজ্ঞানরূপ-বস্তু, মিথ্যাবস্তু, সসীমবস্তু প্রভৃতি বস্তুর সঙ্গে জীব পরিচিত। এইসব পরিচিত বস্তুর নিষেধের মাধ্যমে সাধারণ জীবের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সহজতর। এই কারণেই অপবাদ-ন্যায়ে ব্রহ্মকে নিষেধের মাধ্যমে বোঝানো হয়। নিষেধের মাধ্যমে ব্রহ্মের লক্ষণ করা হয় বলে ব্রহ্মকে প্রত্যগাত্মা বলে। সুতরাং অপবাদ ন্যায় নেতিবাচক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ নির্ধারণ করে।

এইভাবে উপরিউক্ত উপায়ে অধ্যারোপ ও অপবাদ ন্যায়ের সাহায্যে অদ্বৈতবেদান্তীরা ব্রহ্মের পরিচয় দেন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ, নিরাকার, নিরবয়ব, অদ্বয়, সর্বব্যাপক, অসীম, স্বয়ম্ভূ, স্বপ্রকাশ ইত্যাদি। ব্রহ্মের সকল বর্ণনাই নঞর্থক, অথচ ব্রহ্ম সৎ। ব্রহ্ম মাধ্যমিক বৌদ্ধমতের শূন্য থেকে পৃথক। ব্রহ্ম সম্পর্কিত সদর্থক শব্দের নেতিমূলক ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ব্রহ্ম ভাবাত্মক পরমার্থ সৎ। ব্রহ্ম শূন্য হলে ব্রহ্ম মিথ্যা জগতের অধিষ্ঠান হতে পারেন না। মিথ্যা অধিষ্ঠানে মিথ্যার অবভাসও সম্ভব নয়। এখানে প্রশ্ন আসে- ভাবাত্মক সৎ ব্রহ্মের সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব নয় কেন ? উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন- কোন বিশেষ বস্তুরই সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব। ঘট-পটাদি যাবতীয় জাগতিক বিষয় সসীম, বিশেষ বস্তু। এই বিশেষ বস্তু থেকে ক্রমশ সামান্য এবং সামান্য থেকে ক্রমশ সামান্যতর বস্তুর ধারণা থেকে আমরা এক মহাসামান্য সত্তার পরিচয় পাই। এই মহাসামান্য সত্তার মধ্যে সকল বিশেষ বস্তু অন্তর্গত হওয়ায় কোন বিশেষ বস্তুর মাধ্যমে এই মহাসামান্যের পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। যে কোন বিশেষ (সে সামান্যই হোক বা সামান্যতরই হোক) অন্য বস্তুর দ্বারা সীমিত। যে মুহূর্তে আমরা সীমাকে অতিক্রম করি, সেই মুহূর্তে এমন একটা অসীম সত্তায় আমরা উপনীত হই, যার সার্বিক ও সার্বত্রিক রূপকে কোন সীমিত বস্তুর রূপের ন্যায় সদর্থকভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু সেই অসীম পরমসত্তা যে, যে কোন সীমিত বস্তুর রূপ থেকে ভিন্ন, সে কথা আমরা অতি সহজেই বলতে পারি।
অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম
অনাদিকাল ধরে প্রচলিত অবিদ্যার বা অজ্ঞানতার ফলস্বরূপ নানা প্রকার ভেদ প্রতীতি হয় বলে শঙ্করের অভিমত, যা থেকে উৎপন্ন হয় জন্ম, জরা, মৃত্যু ইত্যাদি সাংসারিক দুঃখসমূহ। এই সমস্ত দুঃখের জড়তাকে কাটানোর জন্য শুধুমাত্র ‘এক আত্মাই সত্য’ এই জ্ঞান প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এই আত্মার একত্ব বা ‘ব্রহ্ম-অদ্বৈত’ জ্ঞানের প্রতিপাদনকেই শঙ্কর তাঁর গ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন। তাই বিশুদ্ধ অদ্বৈবাদের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ। অতএব, এই মতে ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য।

ব্রহ্মের স্বরূপ :
‘বৃহ্’ ধাতুর উত্তর ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে ব্রহ্ম শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। বৃহ ধাতুর অর্থ হলো বড় বা ব্যাপক এবং মন্ প্রত্যয়ের অর্থ হলো অতিশয়। সুতরাং ধাতুগত অর্থে ব্রহ্ম হলেন, তিনিই, যাঁর থেকে অতিশয় ব্যাপক বা বৃহত্তম আর কিছুই নেই। ঋগ্বেদের পুরুষ-সূক্তের ‘পুরুষ’ ধারণার মধ্যে এই বৃহত্তম রূপেরই পরিচয় পাওয়া যায়।  সাধারণভাবে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। তাই শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘বৃহত্তমত্বাৎ ব্রহ্ম’, অর্থাৎ, যা বৃহত্তম তাই ব্রহ্ম। এবং নিরুক্তকারের মতে- ‘বর্হতি, বৃংহয়তি তদুচ্যতে পরং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ বা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সত্তাই ব্রহ্ম (নিরুক্ত)। আর ভামতীকার বাচস্পতিমিশ্র তাঁর ভামতী-টীকায় বলেছেন-

‘বৃহত্ত্বাদ্ বৃংহনত্ত্বাদ্ বা আত্মা ব্রহ্মেতি গীয়তে’।- (ভামতী)
অর্থাৎ : যা নিরতিশয় বৃহৎ কিংবা যা দেহাদির পরিণামঘটক আত্মাস্বরূপ, তাই ব্রহ্ম।

ব্রহ্মের এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে বোঝা যায় যে, ব্রহ্ম অনন্ত, অসীম, সর্বব্যাপী, পরিপূর্ণ, এক ও অদ্বয় সত্তা। এই অদ্বয় সত্তা একদিকে যেমন নিরাকার, নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিরবয়ব, অনির্বচনীয়, ভেদরহিত ও পরিণামরহিত, তেমনি অপরদিকে স্বপ্রকাশ, স্বয়ম্ভূ, সর্বগত, সর্বোচ্চ, সর্বব্যাপক ও সচ্চিদানন্দময়। শারীরকভাষ্যেও দেখা যায় শঙ্করাচার্য বলেছেন-

‘অস্তি তাবৎ, নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবং সর্ব্বজ্ঞং সর্ব্বশক্তিসমন্বিতং ব্রহ্ম ব্রহ্মশব্দস্য হি ব্যুৎপাদ্যমানস্য নিত্যশুদ্ধত্বাদয়োহর্থাঃ প্রতীয়ন্তে। বৃহতের্ধাতো অর্থানুগমাৎ। সর্ব্বস্যাত্মত্বাচ্চ ব্রহ্মাস্তিত্বসিদ্ধিঃ। সর্ব্বোহি আত্মাস্তিত্বং প্রত্যেতি। ন নাহমস্মীতি। যদিহি ন আত্মাস্তিত্বপ্রসিদ্ধিঃ স্যাৎ সর্ব্বোলোকোনাহহমস্মীতি প্রতীয়াৎ আত্মা চ ব্রহ্ম।’- (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)
অর্থাৎ :
সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিসমন্বিত, নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ ও নিত্যমুক্তস্বভাব ব্রহ্ম আছেন। কারণ, ব্রহ্ম শব্দটির যদি ব্যুৎপত্তি করা যায়, তাহলেও ঐ সব অর্থই পাওয়া যায়। ‘মহান্’ এই অর্থবোধক বৃহ ধাতু থেকেই তো ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, ব্রহ্ম- যেহেতু সকলেরই আত্মা, এ কারণে, সবার নিকট সর্বদা ব্রহ্মের অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ রয়েছে। সকলেই নিজের আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে থাকে। আমি নাই- এরকম জ্ঞান কখনও কারও হয় না। যদি এভাবে আমার অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ না হতো- তাহলে সকলেই আমি নাই- এভাবে বুঝতো। আত্মাই তো ব্রহ্ম।
ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। যেহেতু ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন নিত্য। যেহেতু কোন প্রকার দোষ বা মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করে না, সেহেতু তিনি হলেন শুদ্ধ। যেহেতু তিনি জড়বস্তু নন, সেহেতু তিনি হলেন বুদ্ধ বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। যেহেতু তাঁর কোন সীমা নেই, সেহেতু তিনি হলেন নিত্যমুক্ত। ব্রহ্মকে বলা হয়েছে অদ্বিতীয়, কারণ দ্বিতীয় কোন পদার্থ স্বীকার করলে অদ্বৈত হানি হয়। ব্রহ্মের কোন অংশও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে নির্বিশেষ। ব্রহ্ম হলেন অসীম। কারণ তার বাইরে কোন কিছু নেই। বিশ্বের যাবতীয় পদার্থ ব্রহ্মের মধ্যেই অবস্থিত। তাই বলা হয়েছে- ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, এই বিশ্বে সবই ব্রহ্ম অথবা এই বিশ্বে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই।

ব্রহ্ম ভেদশূন্য :
শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম হলেন সকল প্রকার ভেদরহিত বা ভেদশূন্য। ভেদ বা পার্থক্য প্রধানত তিন প্রকার- স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদ। এক জাতীয় দুটি ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বজাতীয় ভেদ। যেমন, একটি মানুষের থেকে অপর একটি মানুষের ভেদ হলো স্বজাতীয় ভেদ। দুটি ভিন্ন জাতীয় ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলে বিজাতীয় ভেদ। যেমন, একটা কুকুরের থেকে একটা গরুর ভেদ বিজাতীয় ভেদ। আবার একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ বা অংশের মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ। যেমন একজন মানুষের হাত, পা, মুখ প্রভৃতির মধ্যে ভেদ হলো স্বগত ভেদ। ব্রহ্ম নির্বিশেষ মহাসামান্য হওয়ায় তিনি এই তিনপ্রকার ভেদরহিত।
যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদরহিত। আবার যেহেতু ব্রহ্মের কোন অংশ নেই, সেহেতু ব্রহ্মের স্বগত ভেদও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- ‘একম্ এব অদ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। এক্ষেত্রে ‘একম্’ বা এক শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও স্বগত ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। আবার ‘অদ্বিতীয়’ শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। সুতরাং, ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদশূন্য। তিনি সাংশ বা অংশযুক্ত নন, অপরপক্ষে তিনি অংশবিহীন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম একমাত্র সৎ ও নিরবয়ব সত্তা। একমাত্র ও নিরবয়ব সত্তার কোনপ্রকার ভেদের প্রশ্নই ওঠে না।

অদ্বৈত বেদান্তমতে ব্রহ্ম হলেন স্বরূপত নির্গুণ এবং নিরাকার। ব্রহ্ম নির্গুণ, কারণ তাঁকে কোন গুণ বা বিশেষণ দ্বারা ভূষিত করা যায় না। কোন পদার্থে বিশেষ প্রয়োগ করার অর্থ হলো তার মধ্যে ভেদরেখা টানা। যেমন, যদি বলা হয় ‘কলমটি লাল’, তাহলে এর দ্বারা বোঝানো হয় যে কলমটির লাল রং ছাড়া অন্য কোন রং নেই। অর্থাৎ, রং-এর দিক থেকে কলমটিকে এক বিশেষ গন্ডীর মধ্যে সীমিত করা হলো। তাছাড়া যেহেতু কলম এবং লাল রং এক নয়, সেহেতু কলম এবং লাল রং এর মধ্যে একটি ভেদ বা পার্থক্য টানা হলো। সুতরাং, যদি বিশেষ্যকে কোন গুণ বা বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট করা হয়, তাহলে বিশেষ্যটি সীমিত হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে একটা ভেদরেখা টানা হয়। যেহেতু ব্রহ্ম অসীম, সেহেতু তিনি নির্গুণ, স্বগুণ নন। কারণ ব্রহ্মকে স্বগুণ বললে তিনি সীমাযুক্ত হয়ে পড়েন।

ব্রহ্মের তটস্থ ও স্বরূপ লক্ষণ :
ভারতীয় দর্শনের রীতি অনুসারে ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ব্রহ্মের দু’প্রকার লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। একটি হলো তটস্থ লক্ষণ এবং অপরটি হলো স্বরূপ লক্ষণ। যে লক্ষণ কোন তত্ত্বের স্বরূপকে প্রকাশ করে, সেই লক্ষণকে বলা হয় স্বরূপ লক্ষণ। অপরদিকে যে লক্ষণ তত্ত্বের আপাত রূপকে প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় তটস্থ লক্ষণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন ব্যক্তি যখন রাজা হরিশ্চন্দ্রের অভিনয় করেন, তখনো ঐ ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় যা, তা হলো তার স্বরূপ লক্ষণ। কিন্তু অভিনয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরিচয় তার তটস্থ পরিচয়।
অতএব, ব্রহ্মের ক্ষেত্রে, যে লক্ষণ ব্রহ্মে আপাত থাকে, কিন্তু সর্বদা ব্রহ্মে থাকে না, তাই ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। ব্রহ্মের তটস্থ হলো- ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের কারণরূপ ঈশ্বর। অর্থাৎ, ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টির কারণ, স্থিতির কারণ এবং লয়ের কারণ। এই লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়। কারণ, বেদান্ত দর্শন সর্বমুক্তিবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ, তাঁদের মতে কোন একটা সময় আসবে যখন সকল মানুষ মুক্তিলাভ করবে। এই অবস্থায় ব্রহ্মের সৃষ্টি করার কিছু থাকবে না। ব্রহ্ম যদি সৃষ্টিকর্তা না হন, তাহলে তিনি স্থিতি বা লয়ের কর্তাও হবেন না। সুতরাং, সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তৃত্ব ঐ অবস্থায় ব্রহ্মের থাকবে না। এ কারণে উক্ত লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়েছে।

ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- সচ্চিদানন্দস্বরূপ অর্থাৎ, ব্রহ্ম হলেন সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। সৎ শব্দের অর্থ হলো অস্তিত্ব, চিৎ শব্দের অর্থ হলো চৈতন্য বা জ্ঞান, এবং আনন্দ শব্দের অর্থ হলো ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে ঐশ্বরীক আনন্দের অনুভূতি। সৎ, চিৎ এবং আনন্দ কিন্তু ব্রহ্মের গুণ নয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের সঙ্গে সৎ, চিৎ ও আনন্দের কোন বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্ক নেই। এগুলি হলো ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ, অর্থাৎ, এগুলির দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হয়। এই তিনটি পদের দ্বারা ব্রহ্মকে কখনোই বিশেষিত করা হচ্ছে না।
ব্রহ্ম সৎস্বরূপ বা অস্তিত্বস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অসৎ বা অস্তিত্বহীন নয়। এখানে সৎ বা অস্তিত্বের অর্থ হলো যা কোনদিন লয়প্রাপ্ত হয় না। সুতরাং, অসৎ বা অস্তিত্বহীনের ভিত্তি হলো সৎ। ব্রহ্ম কখনও অভাব পদার্থ হতে পারেন না। কারণ অভাব থেকে কখনও ভাবের উৎপত্তি হতে পারে না। সুতরাং, পরম সত্য বা ব্রহ্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
ব্রহ্ম চিৎ বা চৈতন্যস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অচিৎ অর্থাৎ, জ্ঞানাভাব নন। ব্রহ্ম চৈতন্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। তিনি নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। সুতরাং, ব্রহ্ম বা চৈতন্য সর্বকালে প্রকাশিত।

এ প্রসঙ্গে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, চৈতন্য সব সময় প্রকাশিত হয় না। যেমন, মূর্চ্ছা ও নিদ্রাতে চৈতন্য প্রকাশিত হয় না। কারণ মূর্চ্ছা বা নিদ্রাভঙ্গের পর কোন ব্যক্তি মূর্চ্ছা বা নিদ্রিত অবস্থার কোন জ্ঞান পুনরুজ্জীবিত করতে পারে না।
কিন্তু অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। কারণ নিদ্রাভঙ্গের পর আমরা অনেক সময় বলি যে সুখনিদ্রা হয়েছিলো। এই স্মৃতি থেকে প্রমাণ হয় যে, নিদ্রা বা সুষুপ্তি প্রভৃতি অবস্থায় চৈতন্য থাকে। ব্রহ্মের প্রকাশ অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না। ঘট, পট ইত্যাদি অন্যান্য বিষয় প্রকাশিত হওয়ার জন্য চৈতন্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যিনি ‘চৈতন্যস্বরূপ’ তিনি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করেন না। যেমন সূর্যকে প্রদীপের সাহায্যে দেখার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং, ব্রহ্ম কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। তিনি জ্ঞানমাত্র।

ব্রহ্মকে আনন্দস্বরূপও বলা হয়েছে। যেহেতু ব্রহ্ম নিত্যতৃপ্ত, সেহেতু তিনি আনন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম আনন্দাভাব বা দুঃখস্বভাব নন। ব্রহ্ম বা আত্মা যে আনন্দস্বরূপ, বেদান্তবাদীদের মতে তার একটা প্রমাণ হলো- নিদ্রিত অবস্থায় কোন বিষয়ের জ্ঞান থাকে না। তখন কেবলমাত্র আত্মা থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় আনন্দের কারণ হলো এই আত্মা বা ব্রহ্ম।

নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্ম :
অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্রহ্মকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করা যায়। পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন সগুণ অর্থাৎ, গুণযুক্ত। ব্রহ্মকে যখন কোনরকম শক্তিসম্পন্ন নয় বা সকল গুণের উর্ধ্বে বলে আমরা ভাবি তখন ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। এই নির্গুণ ব্রহ্ম হলো পরমসত্তার আধিবিদ্যক রূপ। যদি পরমসত্তার কোন গুণ বা শক্তি থাকতো, তাহলে সেই সত্তা আনন্দ বা অসীম হতে পারতো না। ব্রহ্মের একটি নির্দিষ্ট গুণ আছে- একথা বললে স্বীকার করতে হবে যে, ব্রহ্মে সেই গুণের বিপরীত গুণটি নেই। তখন ব্রহ্ম একটি সীমিত সত্তায় পরিণত হবেন। একারণে অদ্বৈত বৈদান্তিকরা পারমার্থিক সত্তাকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলেছেন।
শ্রুতিতেও ব্রহ্মকে নির্গুণ হিসেবে দেখা হয়েছে। শ্রুতিতে আছে- ‘তদেজতি ও তন্নৈজতি তদ্দুরে তদবদন্তিকে’ অর্থাৎ, সে চলে আবার সে চলে না, সে দূরে আবার সে কাছে। এরূপ বাক্যের দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, ব্রহ্মে কোন নির্দিষ্ট গুণ নেই। কারণ পরস্পর বিপরীত গুণগুলি থাকার অর্থ হচ্ছে কোন গুণ না থাকা।

অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যতক্ষণ আমাদের কাছে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য- এই উপলব্ধি না হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী ব্রহ্মকে জগতের স্রষ্টা, পালক এবং সংহারক ঈশ্বররূপে ভাবা হয়। বেদান্ত এই সাধারণ ধারণার বিরোধিতা করে ঈশ্বরের ধারণাকে অবিদ্যাপ্রসূত বলে ঘোষণা করেছেন। বেদান্তমতে এই ঈশ্বর সগুণ ব্রহ্ম। এই সগুণ ব্রহ্মই মায়াশক্তির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর পূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। তিনি আমাদের উপাসনার বস্তু। তিনি দীনবন্ধু, করুণাসিন্ধু, জগৎপতি, অনাথের নাথ, ভক্তের ভগবান ইত্যাদি।

উপনিষদকে অনুসরণ করে শঙ্করাচার্য নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সগুণ ব্রহ্মের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে অপর ব্রহ্ম এবং নির্গুণ ব্রহ্মকে পর ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হলো ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। অন্যদিকে নির্গুণ ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ অর্থাৎ, ব্রহ্ম স্বরূপত নির্গুণ। নির্গুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ক্লীবলিঙ্গ এবং সগুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য পুংলিঙ্গের ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘শান্তং নিরঞ্জনং নিষ্কলং ব্রহ্ম’ হলো নির্গুণ ব্রহ্মের বর্ণনা। অপরপক্ষে ‘যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ’ হলো সগুণ ব্রহ্মের বর্ণনা।

শঙ্করের মতে পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি, যাঁরা নির্গুণ ব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে জানেন। তাই যারা জগৎকে সত্য বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানী যারা জগৎকে অবভাস বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন না। বিজ্ঞ বা তত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে ব্রহ্ম বিশ্বাতীত। উপনিষদে ব্রহ্মকে বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত বলা হয়েছে। শঙ্করও বলেন যে ব্রহ্ম বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অদ্বৈতবেদান্তে সগুণ ব্রহ্ম ও নির্গুণ ব্রহ্ম- দুটি ভিন্ন তত্ত্ব নয়। এই মতে ব্রহ্মের সগুণ ভাব তাঁর লীলা মাত্র। নির্গুণ ব্রহ্মই মায়ারূপ উপাধি গ্রহণ করে সগুণরূপে প্রতিভাত হন। সুতরাং, মায়াবিশিষ্ট ব্রহ্মকেই অদ্বৈতবেদান্তে ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়।

ব্রহ্মের উপলব্ধি :
ব্রহ্মকে কিভাবে উপলব্ধি করা যায় ? উত্তরে শঙ্করাচার্য বলেন- ‘ব্রহ্ম অবাঙমনসগোচর’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অতীত। সুতরাং, বাক্য বা সাধারণ বুদ্ধির দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। কেবলমাত্র অপরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা যায়। শঙ্করাচার্যের মতে, ব্রহ্মের উপলব্ধিই হলো মুক্তি। এই মুক্তি কোন নতুন অবস্থাপ্রাপ্তি নয়। এটি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি। জীবাত্মা নিত্যমুক্ত এবং জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার কোন ভেদ নেই। সুতরাং, ব্রহ্মকে জানার অর্থ হলো ‘ব্রহ্ম হওয়া’।

অজ্ঞ জীবের পক্ষে সব সময় সরাসরি পারমার্থিক শুদ্ধ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের কাছে প্রাথমিকভাবে জগৎই সৎরূপে প্রতীয়মান। ক্রমশ সে যখন এই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের কারণ আবিষ্কার করতে চায়, তখন সে এক সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে উপনীত। জড়বাদী মন তখন ঈশ্বরবাদী হয়ে ওঠে। তা হলো অবিদ্যাপ্রসূত ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঈশ্বরবাদী মনের কাছে ঈশ্বর ও জগৎ উভয়ই সত্য বলে প্রতিভাত হয়। এরপর ক্রমশ ঈশ্বরবাদী মন তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে অতিক্রম করে এক সর্বব্যাপী মহাসামান্য শুদ্ধ ব্রহ্মে উপস্থিত হয়। এই শুদ্ধ ব্রহ্মের উপলব্ধিতে জগৎ, ঈশ্বর ও জীব ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় এবং সেই পরম ব্রহ্মই একমাত্র সৎ ও সবকিছুর অধিষ্ঠানরূপে বিরাজ করে।
অদ্বৈতমতে জগৎ
বেদান্তদর্শনের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র বা শারীরকসূত্রের দ্বিতীয় সূত্রটি হলো-

‘জন্মাদ্যস্য যতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)
ভাবার্থ : জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যা থেকে হয় (তাহাই ব্রহ্ম)।

এই সূত্রটির ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেন-

‘অস্য জগতো নামরূপাভ্যাং ব্যাকৃতস্য অনেক কর্ত্তৃভোক্তৃসংযুক্তস্য প্রতিনিয়িত দেশকালনিমিত্ত ক্রিয়াফলাশ্রয়স্য মসসা অপি অচিন্ত্যরচনারূপস্য জন্মস্থিতিভঙ্গং যতঃ সর্ব্বজ্ঞং সর্ব্বশক্তেঃ কারণাৎ ভবতি তদব্রহ্ম ইতি বাক্য শেষঃ’। (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-২)
অর্থাৎ :
এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অব্যক্ত ছিলো, কিন্তু সৃষ্টিদশায় সেই অব্যক্তই নাম ও রূপ এই দ্বিবিধ উপাধি দ্বারা ব্যক্ত বা ব্যবহারগোচর হয়েছে। এই জগতের ভোক্তা এবং কর্তা অসংখ্য। এই জগতের অন্তঃপাতি প্রত্যেক বস্তুই নিয়ত দেশে, নিয়ত কালে এবং নিয়ত নিমিত্তের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে; এবং প্রত্যেক বস্তুরই ফল নিয়ত দেশে ও নিয়ত কালেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কী উপাদান থেকে- কী ভাবে এই জগতের উৎপত্তি প্রভৃতি হয়ে থাকে, তা মনে মনে ভেবেও স্থির করবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই (বিচিত্র কৌশলময়) জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং প্রলয়ের যা একমাত্র কারণ- সেই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিসম্পন্ন কারণই- ব্রহ্ম। এটাই হলো এই (সূত্রদ্বারা সূচিত) বাক্যের অবশিষ্ট অংশ (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-২)

আবার, প্রমাণ শাস্ত্রের দৃষ্টিতে বিচার করলে বোঝা যায় যে জগৎ দৃশ্যমান কিন্তু তা শুধু বর্তমানের মধ্যেই। জগতের পরিবর্তনশীলতা প্রমাণ করে যে পূর্বে তা কখনও ছিলো না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এইভাবে- সর্বকালের মধ্যে তার অস্তিত্ব আছে- এই তত্ত্ব ভুল মনে হয়। তাই শঙ্করাচার্য মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের এই মতকেই মেনে নিয়েছেন যে-

‘আদৌ অন্তে চ যৎ নাস্তি বর্তমানোৎপি তৎ তথা। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)
অর্থাৎ : যদি এমন বস্তু থেকে থাকে যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলে ধরে নিতে হবে।

বস্তুত শঙ্করের মতে ত্রিকালের মধ্যে জগৎ নেই। তিনি বলেন, ‘জগৎ আছে’- এই বাক্যের মধ্যে জগতের কল্পনা ভ্রান্তিমূলক, এবং ‘আছে’ (=সৎ) ব্রহ্মের মৌলিক স্বরূপ। সৎ না থাকলে যা জগতের ছলনা তাও থাকে না, এজন্যই ব্রহ্ম জগতের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান বা ভ্রমস্থান, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে সর্পের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান রজ্জু।

শঙ্করাচার্যের মতে যেহেতু নির্গুণ ব্রহ্ম একমাত্র সত্তাবিশিষ্ট, সেহেতু জগত বা জগতের বিষয়গুলি মিথ্যা। অর্থাৎ, যেহেতু এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য সেহেতু বহুত্ব সত্য নয়। কিন্তু যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে তো জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ঐ বিষয়গুলির যেহেতু জ্ঞান হয় সেহেতু অদ্বৈতমতে ঐ জ্ঞান কিভাবে হয় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
অদ্বৈতবেদান্ত বিবর্তবাদী। বিবর্তবাদ অনুযায়ী অধ্যাস বা ভ্রান্তিবশত অবস্তু বস্তুরূপে প্রতীয়মান হয়। যেভাবে ভ্রান্তিবশতই রজ্জুতে সর্প প্রতীয়মান হয়, অনুরূপভাবে ব্রহ্মে এই জগৎ-প্রপঞ্চ অধ্যস্ত হয়। চৈতন্যে অচৈতন্যের, আত্মা বা বিষয়ীতে বিষয়ের, আরোপই অধ্যাস। অধ্যাসই মিথ্যাকে উৎপন্ন করে। রজ্জুতে সর্পের অধ্যাস যেমন মিথ্যা, ব্রহ্মে জগৎ-প্রপঞ্চের অধ্যাসও তেমনি মিথ্যা। অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদের মাধ্যমেই জগতের গ্রহণযোগ্য ও সুসংগত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

বেদান্তদর্শনে অসৎকার্যবাদ ও পরিণামবাদ বেদান্তের দ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের নির্দেশক। অসৎকার্যবাদ অনুযায়ী পূর্বস্থিত উপাদান থেকেই চেতন-কর্তা কার্য উৎপন্ন করে। সুতরাং এই মতবাদ দ্বৈতবাদের নির্দেশক। আর পরিণামবাদ অনুযায়ী কারণ বাস্তবিকই কার্যে পরিণত হয়। সুতরাং এই মতে কারণ পরিণামী ও কার্যসমসত্তাবিশিষ্ট। ফলে শঙ্করাচার্য বিবর্তবাদের সাহায্যে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে অদ্বৈতব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদ অনিবার্য বলেই মনে হয়।

অদ্বৈতবাদীদের বিবর্তবাদের উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে যেতে হয়। বেদান্ত প্রস্থানের উৎসগ্রন্থ বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে-

‘প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্ত-অনুপরোধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৩)
ভাবার্থ : ব্রহ্ম জগতের শুধু নিমিত্ত-কারণ নন, উপাদান-কারণও, এইরূপ সিদ্ধান্তেই শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্য হয়।
এখানে যে দৃষ্টান্তের কথা বলা হয়েছে তা হলো- ‘হে সৌম্য, যেমন একটি মৃত্তিকাপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিমাণ-ভূত সমস্তই জানা যায় যেতে পারে (কারণ) সমস্ত বিকারই বাচাবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য;… হে সৌম্য, এইরূপেই উক্ত উপদেশ হয়ে থাকে।’ (ছান্দোগ্য-উপনিষদ-৬/১/৪-৬)। শ্রুতি এখানে ‘বিকার’ শব্দটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মূল উপাদান মৃত্তিকা ছাড়া ঘটাদির পৃথক কোন সত্তা নেই। এরা পৃথক কোন বস্তু নয়, তা বিভিন্ন অবস্থা মাত্র, যেমন একই দেবদত্তের বাল্য, যৌবন ইত্যাদি অবস্থা মাত্র কিন্তু এদের কোনটাই সত্য নয়। সুতরাং মৃৎপিণ্ডের জ্ঞানলাভ করেই ঘটাদির আসল স্বরূপকে জানতে হয়। বিভিন্ন রূপকে জানতে না পারলেও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ এরা অসৎ বলে জ্ঞাতব্যই নয়। যদিও ঘটাদি বস্তুগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ের বিষয়, তথাপি বিচার করে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, মৃত্তিকা ছাড়া অন্য কোন সত্য এদের মধ্যে নেই। এরা বাক্য থেকে উদ্ভূত কতকগুলি নামমাত্র- এর বেশি কিছু নয়। যেহেতু এগুলি অবিদ্যার মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়- সেজন্যে এরা অসৎ। অপরপক্ষে মৃৎপিণ্ডকে নাম এবং রূপ থেকে পৃথকভাবেও জানা যায়, সুতরাং তা সত্য। একইভাবে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং এই জগৎ অসৎ। জগৎ তার কারণ ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন বলে সত্য হলো এই যে, তা এক, অদ্বিতীয় ব্রহ্মই- ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। তাই ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-

‘তৎ অনন্যত্বম্ আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৪)
ভাবার্থ : ‘বাচারম্ভণ’ ইত্যাদি শব্দ থেকে অবগত হওয়া যায় যে, এই কার্যভূ জগৎ তৎ-কারণ ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়।

ভারতীয় আচার্যরা উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে ধাপে ধাপে শিষ্যকে চরম সত্য উপলব্ধির দিকে নিয়ে যান, এটাই প্রচলিত রীতি। এই সর্বসম্মত রীতি অনুসরণ করে সূত্রকার বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রে বিভিন্ন সূত্রে ব্রহ্মকে পরিণাম মতানুসারে জগৎকারণ বলে বর্ণনা করে উপরিউক্ত সূত্রের মাধ্যমে বিবর্তমতের প্রতিষ্টা করেছেন বলে মনে করা হয়। কেননা এই সূত্রগুলি থেকেই আচার্য শঙ্কর তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্য বা শারীরকভাষ্যে ব্রহ্ম এবং মায়া উভয়কে জগতের কারণ বলে নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্ম বিবর্তের মাধ্যমে এবং মায়া পরিণামের মাধ্যমে জগৎরূপ কার্যে বর্তমান, কারণ তাদের উভয়ের গুণগুলিই কার্যে দৃষ্ট হয়। তাই অদ্বৈতবাদের মূল সূত্র হিসেবে শঙ্কর বলেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম হলেন অভিন্ন।

অদ্বৈতমতে জগৎ মিথ্যা। কিন্তু জগৎকে মিথ্যা বললেই জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। তাহলে ‘জগৎ মিথ্যা’- এ কথার অর্থ কী ? জগৎ কি আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ, না স্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাস ? অদ্বৈতমতে জগৎ এই দুই-এর কোনটিই নয়। এই মতে জগৎ সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয়। জগতের যথার্থ স্বরূপ বোঝার জন্য অদ্বৈতবেদান্তীর সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ বা ত্রিবিধ সত্তা জানা দরকার। সত্তার ত্রৈবিধ্য অর্থাৎ তিনপ্রকার সত্তা সম্বন্ধে জানলেই অদ্বৈতবেদান্তীর জগতের প্রকৃতস্বরূপ ও মিথ্যাত্বের যথার্থ তাৎপর্য পরিস্ফুট হতে পারে।

সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ :
অদ্বৈতবেদান্ত মতে আকাশকুসুম বা বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকের কোন সত্তা নেই। অলীক নিঃস্বভাব অসৎ। অসৎ কখনো ভাবরূপে প্রতিভাত হয় না। কিন্তু যা কিছু ভাবরূপে প্রতিভাত হয়, তা-ই সমানসত্তাবিশিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য তিনপ্রকার সত্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন- পারমার্থিক, ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক।

ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ, ব্রহ্ম বিষয়ে সাক্ষাৎ উপলব্ধি হলে যার সত্যতা জানা যায়, সেই পদার্থ পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই দৃষ্টিতে বিভু, নিত্য ও যাবতীয় বস্তুর স্বরূপ-সত্তারূপে ব্রহ্ম পারমার্থিক সৎ। অপরপক্ষে ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত যে সকল পদার্থ সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়, তার সত্যতা হলো ব্যবহারিক সত্যতা। তার মানে, প্রতীয়মান সকল বস্তুই সেই বস্তুরূপে ব্যবহারিক সৎ, যেমন, রজ্জুরূপে রজ্জু। আর ভ্রমজ্ঞানের বিষয় হলো প্রাতিভাসিক সত্তা। প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা সত্য। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক।

অদ্বৈতমতে কেবল ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্যতা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে, কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক। আবার যখন সর্পের যথার্থ জ্ঞান হয়, তখন সর্পের সত্তাটি ব্যবহারিক। বস্তু বিষয় না থাকলে বিষয়ের জ্ঞান হয় না। যেমন আকাশকুসুমের জ্ঞান হয় না। সেহেতু আকাশকুসুম নেই। কিন্তু প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক জগতের জ্ঞান আমাদের হয়। সুতরাং, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক দুটি জগৎ আছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই যে যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান কিভাবে হয় ?
উত্তরে শঙ্করাচার্য এবং তাঁর অনুগামী অদ্বৈতবাদীরা বলেন, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগৎ হলো অবিদ্যার রূপান্তর। ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিকের ভেদ হলো যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা ও ভ্রমের ভেদ। অবিদ্যা বা মায়ার দ্বারা এই ব্যবহারিক জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। রজ্জুকে যখন রজ্জুরূপে জানা হয়, তখন রজ্জুর ব্যবহারিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় অর্থাৎ ঐ সত্তা অন্যেরাও স্বীকার করেন। কিন্তু রজ্জুকে যখন সর্পরূপে জানা হয়, তখন সর্পের প্রাতিভাসিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় না। রজ্জুতে সর্পের প্রতিভাস সর্পের সত্তা অবিদ্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বিশেষের নিকটই স্বীকৃত। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সেই সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না। কেবলমাত্র রজ্জুর বা মিথ্যা সর্পের অধিষ্ঠানটির অস্তিত্ব থাকে। এক্ষেত্রে সর্পটি হলো রজ্জুর প্রতিভাস, বিবর্ত বা অসত্য রূপান্তর। অনুরূপভাবে ব্যবহারিক জগৎ ব্রহ্মের সত্য পরিণাম নয়, ব্রহ্মের বিবর্তমাত্র। মায়া বা অবিদ্যার প্রভাবে জগতের প্রকৃত অধিষ্ঠানটিকে আমরা জানতে পারি না, কেবলমাত্র জগৎ প্রপঞ্চকেই জানতে পারি। এভাবে ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক সত্তার ভেদের মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী সর্বজনসিদ্ধ ভ্রমের বিষয় ও প্রমার বিষয়ের ভেদকেই ব্যক্ত করেছেন। ভ্রমের বিষয় প্রাতিভাসিক সৎ, কিন্তু প্রমার বিষয় ব্যবহারিক সৎ।

আবার প্রাতিভাসিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তা ভিন্ন হলেও উভয় সত্তাই সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন। যা সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন , তাকেই অদ্বৈতবেদান্তী মিথ্যা বলেন। তাই প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক সত্তাবিশিষ্ট উভয়প্রকার বিষয়ই অদ্বৈতমতে মিথ্যা। উভয়প্রকার সত্তাই পরবর্তীকালে বাধিত বা খণ্ডিত হয়। অন্যদিকে অসৎ ভাবরূপে প্রতিভাতই হয় না। যা চৈতন্যের সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত নয়, তা প্রতিভাত হতে পারে না। কিন্তু মিথ্যা বিষয় ভাবরূপে প্রতিভাত হয়। মিথ্যা বিষয় চৈতন্যময় ব্রহ্মে অধ্যস্ত এবং ব্রহ্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে মিথ্যা বিষয়ের মধ্যে প্রমার বিষয় (ব্যবহারিক সৎ) সমষ্টিগতভাবে সমর্থিত, কিন্তু ভ্রমের বিষয় (প্রাতিভাসিক সৎ) একান্তই ব্যক্তিগত। মিথ্যামাত্রই অবিদ্যাজন্য, তাই ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক উভয় সত্তাই অবিদ্যাজন্য। ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় মূলাবিদ্যা এবং প্রতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় তুলাবিদ্যা।

এবার প্রশ্ন হলো, অদ্বৈতমতে কী অর্থে জগৎ মিথ্যা ?
সাধারণ চিন্তার যে আকার তা শঙ্করাচার্যের জগৎ সম্পর্কিত বক্তব্যকে ধারণ করতে পারে না। কেননা আমরা যখন কোন বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন সেই চিন্তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসটি এরকম যে, হয় সেই বিষয়টির অস্তিত্ব আছে, কিংবা সেই বিষয়টির অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব পরস্পরবিরোধী। এই কারণে একটি বিষয় আছে আবার নেই, এরূপ চিন্তা আমরা করতে পারি না। কিন্তু শঙ্করাচার্যের মতে এই জগৎ আছে আবার নেইও, এই জগৎ কাল্পনিক, আবার কাল্পনিক নয়। যতদিন আমরা বদ্ধ অবস্থায় থাকি, ততদিন আমাদের আত্মোপলব্ধি হয় না। অর্থাৎ, ততদিন আমরা এই জগৎ সংসারকে তুচ্ছ বলে ভাবতে পারি না। শঙ্করাচার্য একমাত্র ব্রহ্মকেই সৎ বলেছেন। একমাত্র ব্রহ্মেরই প্রকৃত সত্তা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে; কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই।
তিনি আরো বলেন, যা সৎ বা সত্য তা কোন দেশে এবং কোন কালেই বাধিত হয় না। যা অসৎ বা তুচ্ছ, আকাশকুসুমের মতো কোন কালেই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। বদ্ধ অবস্থায় মোক্ষলাভ না হওয়া পর্যন্ত এই জগতকে কেউ অসৎ বা তুচ্ছ মনে করতে পারে না। তাই জগৎকে অসৎরূপে বর্ণনা করা যায় না। মোক্ষলাভ বা ব্রহ্মলাভ হবার পরেই এই জগৎ অন্তর্হিত হয়। যেহেতু এই জগৎ সর্বস্তরে থাকে না এবং সর্বকালেও থাকে না, সেহেতু এই জগতকে সৎ বলাও যায় না। পারমার্থিক সত্তায় জগৎ নেই, কেবল ব্যবহারিক সত্তাতেই জগৎ থাকে। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানের পরবর্তীকালে জগতের অস্তিত্ব থাকে না; ফলে জগতকে সৎ বলা যায় না। আবার অসৎও বলা যায় না। সুতরাং, জগৎ অনির্বচনীয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সৎ, কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ অসৎ।

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, জগৎ মিথ্যা হলেও আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ নয়। আবার ব্রহ্মের ন্যায় অবাধিত ত্রিকালসৎও নয়। জগৎ তথা জাগতিক বিষয় ভাবরূপে প্রতীত হয়ে ব্যবহৃত হয়। অথচ ব্রহ্মোপলব্ধিতে জগৎ বাধিত ও খণ্ডিত হয়। জগতের সত্তা ব্রহ্ম-সাপেক্ষ। ব্রহ্ম-সংশ্লিষ্ট হয়েই জগৎ সত্তাযুক্ত হয়। শুদ্ধচৈতন্যই একমাত্র নিরপেক্ষ সৎ। জগৎ তাই নিরপেক্ষ সৎ নয়। জগৎ ব্রহ্মে অধ্যস্ত অর্থাৎ শুদ্ধচৈতন্য নামক সৎ অধিষ্ঠানে জগৎ আরোপিত। সৃষ্টির অর্থ এখানে আরোপ। অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টি মানে উৎপন্ন নয়, সৃষ্টি বলতে আরোপ বা প্রক্ষেপকে বোঝানো হয়। তাই অদ্বৈতবেদান্তে জগতের সৃষ্টি বলতে ব্রহ্মে জগতের আরোপকে বোঝানো হয়েছে। রজ্জুর অধিষ্ঠানে সর্প যেমন আরোপিত হয়ে প্রতিভাত হয়, তেমনি জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত হয়ে সৎ রূপে প্রতিভাত হয়। রজ্জুর জ্ঞানে সর্প যেমন মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়, তেমনি ব্রহ্মের জ্ঞানে জগৎ মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়। রজ্জুতে সর্পের আবির্ভাবের কারণ হলো অজ্ঞান বা অবিদ্যা। এই অবিদ্যার ফলেই ব্রহ্মের অধিষ্ঠানে ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়ে ঘট-পটাদি জাগতিক বস্তু সৎরূপে আবির্ভূত হয়। অদ্বৈতমতে এরই নাম জগৎ-সৃষ্টি, যা বস্তুত অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়ার ফল।

তবে এই অবিদ্যা বা মায়ার প্রেক্ষাপটে জগতের সংস্থান সম্পর্কে অদ্বৈত বৈদান্তিক দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে দুটি মতের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ এবং অপরটি হলো দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ।

সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ : সৃষ্টিদৃষ্টিবাদের প্রবক্তা হলেন অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের বিবরণ সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা। তাঁদের মতে জগতের ভিত্তি মায়া বা অবিদ্যার অধিষ্ঠান হলো ব্রহ্ম। মায়া ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি এবং বিকার বা বিভিন্ন প্রকারের পরিবর্তন সাধনে সমর্থ। এই জগৎ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যার পরিণাম নয়, এই জগৎ হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তির বা মায়ার পরিণাম। সুতরাং, সৃষ্টি কোন অর্থেই জীবের উপর নির্ভর করে না। ঈশ্বরের জড়াত্মিকা শক্তি মায়া এই জগৎকে সৃষ্টি করে। ফলে বদ্ধ জীবের কাছে এই ব্যবহারিক জগৎ সত্য ও প্রদত্ত বলে মনে হয়। ঈশ্বর বদ্ধজীবদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এইজন্য ব্যবহারিক জগতে একজন ব্যক্তির জন্য ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেছেন তা সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বিষয় হয়। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিশক্তি মায়ার দ্বারা জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেছেন। বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘দেবাদিবৎ অপি লোকে’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)
ভাবার্থ : দেবতা এবং পৃথিবীর বহু সিদ্ধপুরুষও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সৃষ্টি করতে পারেন। ব্রহ্মও সেরূপ পারেন।
জগৎকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। শ্রুতি ও জ্ঞানের দৃষ্টিতে জগৎ তুচ্ছ ও অসৎ। ব্যবহারিক যুক্তি পদ্ধতির বিচারে জগৎ অনির্বচনীয় এবং ব্যবহারিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সত্য ও সৎ। অর্থাৎ, জগতের সত্তা ও অস্তিত্ব আছে- মায়ার সত্তা। মায়া জগতের আকারে পরিণত হয়, কিন্তু জগৎ মায়ার উপর নির্ভর করে না। ব্রহ্মই জগতের একমাত্র অবলম্বন। যেমন, প্রথমে তুলো থেকে সুতো প্রস্তুত হয়। তারপর সুতোগুলি কাপড়টি উৎপন্ন করে। সুতোগুলি কাপড়ের অধিষ্ঠান নয়, কাপড়ের প্রকৃত অধিষ্ঠান হলো তুলো। জগতের সৃষ্টির সঙ্গে জীবের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এই জগৎ জীবের উপর কোনভাবেই নির্ভর করে না। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে তাঁর মায়াশক্তি জগৎ সৃষ্টি করে। বেদান্তসূত্রানুযায়ী-

‘কৃৎস্নপ্রসক্তিঃ নিরবয়বত্ব শব্দকোপো বা’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৬)
ভাবার্থ : জগৎ-কারণ ব্রহ্ম হয় সম্পূর্ণভাবেই জগতে পরিণত হয়েছেন- তা মানতে হয়, অথবা শাস্ত্রের বিরোধিতা করতে হয়- যেহেতু শাস্ত্র বলেছেন ব্রহ্ম অংশরহিত।

কিন্তু অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা অস্বীকার করা না গেলেও জগতের পারমার্থিক সত্তা থাকতে পারে না। কারণ জগতের বিষয়মাত্রই স্ববিরোধী। ব্যবহারিক স্তরে কোন অভিজ্ঞতার বিষয়েই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেমন, ‘লাল ফুল’ একটি ব্যবহারিক স্তরের অভিজ্ঞতার বিষয়। এখানে ‘লাল’ এবং ‘ফুল’ সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন নয়। কারণ ‘লাল’ ও ‘ফুল’- এই দুটি সম্পূর্ণ পৃথক শব্দ। আবার দুটি যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও বলা যায় না। কারণ ‘লাল রং’ অবলম্বনহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। আবার লাল ও ফুলের সম্পর্কটি একটি গরুর সঙ্গে একটি ঘোড়ার বিজাতীয় সম্পর্কের মতোও নয়। লাল ও ফুল পরস্পরের সঙ্গে সমবায় সম্পর্কেও যুক্ত নয়। কারণ দুটির মধ্যে যদি সমবায় সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়, তাহলে সেই সমবায় ‘লাল’ ও ফুলের সঙ্গে যুক্ত করতে আরেকটি তৃতীয় সম্বন্ধের প্রয়োজন হবে এবং এই প্রক্রিয়া অন্তহীনভাবে চলতে থাকবে। সুতরাং, ‘লাল ফুল’ এর প্রকৃতি কী তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেহেতু স্ববিরোধী কোন বিষয়ের পারমার্থিক বা আধিবিদ্যক সত্তা থাকতে পারে না, সুতরাং, জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। তাই জগৎকে মিথ্যা বা অধ্যস্ত বলার তাৎপর্য হলো এই যে, জগৎ অনির্বচনীয়।

শ্রুতিতে এই জগতের কারণ মায়াকেও ‘সদসৎ-বিলক্ষণানির্বচনীয়া’ বলা হয়েছে। যেহেতু মায়া সৎ থেকে পৃথক এবং অসৎ থেকেও পৃথক, সেহেতু অনির্বচনীয়। মায়া এই জগতের কারণ এবং জগৎ মায়ারই পরিণাম। সুতরাং, জগৎ সৎও নয়, অসৎও নয়, অতএব, সদসৎ বিলক্ষণ অনির্বচনীয়া।

দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ : এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মতবাদ অর্থাৎ, দৃষ্টিসৃষ্টিবাদের প্রবর্তক হলেন ভামতী সম্প্রদায়। বাচস্পতিমিশ্র এই মতের প্রবক্তা। তিনি বলেছেন যে, জীব যেহেতু বহু, অবিদ্যাও বহু। জীবই অবিদ্যার আশ্রয় বা অধিষ্ঠান এবং এই জগৎ ঐ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যারই পরিণাম। জীব ও অবিদ্যা যেহেতু বহু, সেহেতু জগতে এতো বৈচিত্র্য। ব্রহ্ম জীবমাত্রেরই অধিষ্ঠান বলে অবিদ্যাগুলিরও অধিষ্ঠান এবং এই কারণে জগতেরও অধিষ্ঠান। এই কারণেই শ্রুতিতে ব্রহ্মকে জগতের উপাদানকারণ বলা হয়েছে। এবং এই একই কারণে শঙ্করাচার্য অবিদ্যাকে ‘পরমেশ্বরাশ্রিতা’ রূপে বর্ণনা করেছেন।

বাচস্পতিমিশ্র আরো বলেন যে অবিদ্যা দু’প্রকার- মূলাবিদ্যা এবং তুলাবিদ্যা। মূলাবিদ্যা হলো ঈশ্বরের উপাধি এবং তুলাবিদ্যা জীবাত্মায় অধিষ্ঠিত। বস্তুত তুলাবিদ্যাই জগৎ সৃষ্টি করে থাকে। অনাদিকাল থেকে জীবের সঞ্চিত সংস্কারই তুলাবিদ্যা। জগতের বহুত্ব তুলাবিদ্যারই সৃষ্টি, জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা বহুত্বকে ব্রহ্মের উপর আরোপ করে থাকে। ব্যবহারিক জগতের বহুত্বের ব্যাখ্যার জন্য বাচস্পতিমিশ্র মায়া বা মূলাবিদ্যার উপর গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে মূলাবিদ্যা জগৎ সৃষ্টির সহকারি কারণ, মূল কারণ নয়। প্রতিটি জীব তার নিজস্ব অবিদ্যা সংস্কার অনুসারে নিজের জ্ঞানের ও ভোগের বিষয় সৃষ্টি করে থাকে।

এই মতে আমাদের অভিজ্ঞতার বিষয় যে জগৎ, তা সত্য নয়। কারণ পারমার্থিক সত্তায় এই জগৎ বাধিত হয়। বাচস্পতিমিশ্রের মতে যতক্ষণ একটা বিষয়ের জ্ঞান হয়, ততক্ষণ সেই বিষয়টির সত্তা প্রতীয়মান হয়। এক অর্থে জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়েরই কেবল প্রাতিভাসিক সত্তা আছে। তুলাবিদ্যার ক্রিয়ার ফলে জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়ের উৎপত্তি হয়। ভ্রান্তপ্রত্যক্ষের বিষয়টি, উদাহরণস্বরূপ রজ্জুতে সর্পভ্রমে সর্পটি যেমন ব্যবহারিক জগতের অভ্রান্ত প্রত্যক্ষের দ্বারা বাধিত হয়, তেমনি সেই অভ্রান্ত প্রত্যক্ষটিও পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। কোন জ্ঞানের বিষয়েরই জ্ঞানাতিরিক্ত সত্তা বা অপ্রতীয়মান সত্তা নেই। সুতরাং, পারমার্থিক বিচারে সৃষ্টি নেই, ধ্বংস নেই, জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। জগৎ হলো জীবের অন্তর্ভুক্ত এক বিরাট ভ্রম। এইজন্যই জগৎ একটি অনির্বচনীয় প্রপঞ্চ।
সুতরাং, এই মতে জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা হলো মূলাবিদ্যারই একটি অবস্থা বা কার্য। তুলাবিদ্যাগুলি মূলাবিদ্যা থেকে উদ্ভূত। ধ্বংসের পর তার আবার মূলাবিদ্যায় লীন হয়ে যায়। তুলাবিদ্যা এবং মূলাবিদ্যার মধ্যে সম্পর্কটি হলো যথাক্রমে অংশ এবং সমগ্রের সম্বন্ধ। অংশের ক্রিয়া বা ধর্মকে সমগ্রের ক্রিয়া বা ধর্মরূপ গণ্য করা হয়। যেমন একটা সাদা কাপড়ের কোন একটা অংশে একটা কালো দাগ থাকলে আমরা সমস্ত কাপড়টাকেই দাগযুক্ত মনে করি এবং ঐ দাগের জন্য সমস্ত কাপড়টিই অব্যবহার্য হয়ে যায়।

বস্তুতপক্ষে পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকেই জগৎ ও জাগতিক বিষয়কে মিথ্যা বলা যায়। এই মতবাদীরা সমষ্টিগত অনুভবসিদ্ধ, তা অবিদ্যাজন্য হলেও, জাগতিক বিষয়ের দৈনন্দিন ব্যবহারকে কখনোই অস্বীকার করেননি। উচ্চতর স্তর থেকেই জাগতিক বিষয়ের সত্তাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি। এই উচ্চতর স্তর হলো  পারমার্থিক স্তর। ব্যবহারিক স্তর থেকে জাগতিক বস্তুর ব্যবহারকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এজন্যই এই মতে ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যা মূলাবিদ্যাকে প্রাতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যা তুলাবিদ্যা থেকে পৃথক করা হয়েছে। তুলাবিদ্যার বিনাশে মূলাবিদ্যার বিনাশ হয় না। বরং মূলাবিদ্যার দ্বারাই তুলাবিদ্যা খণ্ডিত হয়। একমাত্র নিত্য, শুদ্ধ, চৈতন্যের উপলব্ধিতেই তুলাবিদ্যার সঙ্গে মূলাবিদ্যাও বিনষ্ট হয় এবং জগৎ ও জাগতিক বস্তু ব্রহ্মে বিলীন হয়ে এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মই সৎরূপে বিরাজ করে। পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা জগৎ বাধিত হয় বলেই জগৎকে মিথ্যা বলা হয়- ‘জ্ঞানান্তরম্ বাধিতত্বম্ মিথ্যাত্বম্’

জগৎ-সৃষ্টির প্রক্রিয়া :
অদ্বৈতমতে জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্যতা আছে, সেহেতু তাঁরা জগতের সৃষ্টির পর্যায়গুলির বর্ণনাও দিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে, অদ্বৈতবেদান্তী বিবর্তবাদী। জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত। অজ্ঞান বা মায়াশক্তি আবরণরূপে ব্রহ্মকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপ রূপে নশ্বর জগৎ-প্রপঞ্চ সৃষ্টি করে।
শুদ্ধ চৈতন্য ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। উপাধি মায়া, ব্রহ্মকে আবৃত করে নিজের রূপকে ব্রহ্মে আরোপ করে। মায়া-উপাধিযুক্ত হয়ে ব্রহ্ম তখন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সর্বনিয়ন্তা, সর্ববীজস্বরূপ জগৎ-কারণ ঈশ্বররূপে আবির্ভূত হন। ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ডের অব্যক্ত অন্তর্যামী কারণ। ক্রমশ তিনি ব্যক্ত, সূক্ষ্ম কারণ রূপ পরিগ্রহ করে হিরণ্যগর্ভ হন। তারপর তিনি ব্যক্ত স্থূলরূপ পরিগ্রহ করে বৈশ্বানর বা বিরাট হন। বিরাটরূপে তিনি স্থূলজগৎকে বিকশিত করেন।

অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর চিৎ ও অচিৎবিশিষ্ট। সর্বপ্রথম ঈশ্বর মায়ার সহযোগে নামরূপ সমন্বিত সমগ্র বিশ্বের ধারণা সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি সংকল্প করেন যে তিনি বহু হবেন। ঐ সংকল্পে অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর থেকে ক্ষিতি (পৃথিবী বা মাটি), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ)- এই পাঁচটি অপঞ্চীকৃত মহাভূত উপাদান বা তন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। ব্যোমের ধর্ম হলো শব্দ। মরুতের ধর্ম হলো শব্দ এবং স্পর্শ। তেজের ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ ও বর্ণ। অপ্-এর ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ ও স্বাদ। ক্ষিতির ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ, স্বাদ এবং গন্ধ। অবিদ্যাপ্রসূত বলে এই পঞ্চতন্মাত্র ত্রিগুণাত্মক বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণবিশিষ্ট। সত্ত্বপ্রধান তন্মাত্র থেকে আবার পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় আবির্ভূত হয়- আকাশ থেকে শ্রোত্র বা কর্ণ, বায়ু থেকে ত্বক্, তেজ থেকে চক্ষু, অপ্ থেকে রসনা এবং ক্ষিতি থেকে নাসিকা।
পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও সত্ত্বপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র মিলিত হয়ে মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত উৎপন্ন হয়। অন্তঃকরণের এই চারটি অংশ হলো প্রকাশাত্মক অর্থাৎ, স্বচ্ছ। সুতরাং, এই অংশগুলিকে স্বত্ত্বগুণের কার্যরূপে গণ্য করতে হবে। অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি হলো বুদ্ধি। যেমন একই ব্যক্তি পাচক, ছাত্র, শিক্ষকরূপে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে, তেমনি একই অন্তকরণকে তার কাজের ভিন্নতা অনুসারে মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার বলা হয়।

আবার রজোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ- এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। রজঃপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় মিলিতভাবে প্রাণ, অপান্, ব্যান, উদান ও সমান- এই পাঁচটি প্রাণ উৎপন্ন করে। আর তমোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয় সূক্ষ্ম-শরীর ও আকাশাদি পঞ্চস্থূলভূত। স্থূলভূতগুলি পঞ্চীকৃত অর্থাৎ পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন। পঞ্চীকৃত ভূতগুলি হলো যৌগিক উপাদান।

অদ্বৈত-বেদান্ত যেহেতু উপনিষদানুসারী দর্শন, তাই এর দার্শনিক ধারণাগুলির উৎস কিন্তু প্রাচীন উপনিষদগুলিই, যেমন-

‘তমেকনেমিং ত্রিবৃতং ষোড়শান্তং শতার্ধারং বিংশতিপ্রত্যরাভিঃ।
অষ্টকৈঃ ষড়ভিঃ বিশ্বরূপঃ একপাশং ত্রিমার্গভেদং দ্বিনিমিত্তঃ একমোহম্’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৪)
‘পঞ্চস্রোতঃ অম্বুং পঞ্চযোন্যুগ্রবক্রাং পঞ্চপ্রাণোর্মিং পঞ্চবুদ্ধ্যাদিমূলাম্ ।
পঞ্চাবর্তাং পঞ্চদুঃখৌঘবেগাং পঞ্চাশদ্ভেদাং পঞ্চপর্বামধীমঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৫)
অর্থাৎ :
ব্রহ্মচক্রের সাধারণ পরিধি বা প্রান্তভাগ হলো মায়া বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের দ্বারা আবৃত। এর যোলটি অঙ্গ বা কলা (যথা- মন, পঞ্চমহাভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়)। এই ব্রহ্মচক্রের পঞ্চাশটি দণ্ড বা শলাকা (অর্থাৎ, মায়াজনিত প্রমাদ ও বৈকল্য), কুড়িটি খিল বা খোঁটা, ছয় শ্রেণীর বৈচিত্র যার প্রতিটি আবার আট প্রকারের (অষ্টসিদ্ধি অলৌকিক শক্তি- অণিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাককাম্যম্, মহিমা, ঈশিত্বম্, বশিত্বম্ ও কামাবসায়িত)। এইসব দণ্ড, খিল ও বিভিন্ন অংশ যেগুলি বহুবিধ বন্ধনের প্রতীক, তারই উপর ব্রহ্মচক্র দাঁড়িয়ে আছে। এই চক্রের বিচরণভূমি তিনটি (পুণ্য বা ধর্ম, পাপ বা অধর্ম এবং জ্ঞান)। ইন্দ্রিয়ের প্রতি দুই আসক্তিই (সুখ-দুঃখের) মূল কারণ। আমরা সেই ব্রহ্মচক্রের ধ্যান করি (শ্বেতাশ্বতর-১/৪)।
পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) যে নদীর পাঁচটি ধারা। পঞ্চভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি) জ্ঞানেন্দ্রিয়-রূপ নদীকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আঁকাবাঁকা ও খরস্রোতা করে তোলে। পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান) এই নদীর ঢেউ। পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, উপস্থ ও পায়ু) এই নদীর তরঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের উৎস যে মন, সেই মনই আবার এই নদীর উৎসমুখ। পাঁচটি গুণ (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ) যেন এই নদীর আবর্ত এবং পাঁচ রকমের দুঃখ (মাতৃগর্ভে থাকা, জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু) এই নদীর তরঙ্গ-সংক্ষুব্ধ ঢাল। এই নদীর পাঁচটি ভাব (অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা, আমিত্ব বা অহঙ্কার, আসক্তি, দ্বেষ বা বিতৃষ্ণা, এবং কোনকিছু নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি) এবং পঞ্চাশ রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এর গতি। তবে একথা ভুললে চলবে না মনই বিচিত্র ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান, যাকে আমরা জগৎ বলি, তার কারণ (শ্বেতাশ্বতর-১/৫)।
অদ্বৈতমতে পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়া হলো প্রতিটি স্থূলভূতেই পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণ একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে হয়ে থাকে। প্রতিটি স্থূলভূতে সেই সূক্ষ্মভূতের অর্ধাংশ এবং অপর চারটি সূক্ষ্মভূতের এক-অষ্টমাংশ করে থাকে। অর্থাৎ স্থূল আকাশ = ১/২ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী। এভাবে স্থূল বায়ু = ১/২ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থূলভূত থেকে উৎপন্ন হয় চতুর্দশ ভুবন বা লোক (ভুঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্য- এই সপ্ত উর্ধ্বলোক এবং অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল এং পাতাল- এই সপ্ত নিম্নলোক), চতুর্বিধ স্থূলশরীর (জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ) এবং এই সব শরীরের উপযোগী অন্নপানাদি।

যৌগিক বা স্থূলভূতগুলির তমোগুণ প্রাধান্য পেলে সেগুলি বিশ্বের বস্তুতে পরিণত হয় এবং স্থূল শরীরগুলি গঠিত হয়। সরল ভূতগুলি থেকে সূক্ষ্ম শরীরগুলির সৃষ্টি হয়। সূক্ষ্ম শরীর দুই প্রকার, যথা- হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর এবং জীবের সূক্ষ্ম শরীর। হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর উৎকৃষ্ট এবং একে বলা হয় মহৎ তত্ত্ব। অপরপক্ষে জীবের সূক্ষ্ম শরীর হলো নিকৃষ্ট। ঈশ্বর হলেন পাঁচটি সূক্ষ্মভূতের অর্থাৎ, পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চমহাভূত, সপ্তদশ উপাদানবিশিষ্ট সূক্ষ্ম শরীর এবং হিরণ্যগর্ভের স্থূলশরীর উৎপাদনের অপরোক্ষ কারণ। বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ের সৃষ্টি তিনি হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি প্রভৃতির মাধ্যমে করেন।

পঞ্চতন্মাত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্যই অবিদ্যাসৃষ্ট, ব্রহ্মের উপাধি। এই সব উপাধি দ্বারা উপহিত ব্রহ্মই ‘জীব’ নামে অভিহিত। ব্রহ্মজ্ঞানে সকল উপাধি বিনষ্ট হয় এবং শুদ্ধচৈতন্য ব্রহ্ম আবরণমুক্ত হয়ে পুনঃপ্রকাশিত হন। তাছাড়া অদ্বৈতবেদান্তীরা সৃষ্টি ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাস করেন। ধ্বংসের প্রক্রিয়া সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত। মূর্ত প্রপঞ্চ, অমূর্ত প্রপঞ্চে লীন হয়ে যায় এবং অমূর্ত প্রপঞ্চ অব্যাক্তৃত প্রপঞ্চে লীন হয়। অব্যাক্তৃত অর্থাৎ, অপ্রকাশিত অবশ্য অন্য কিছুতে লীন হয় না। কারণ তার কোন উপাদান কারণ নেই। একমাত্র মোক্ষলাভের সময়েই অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়। উপনিষদীয় শ্রুতিতেও শাঙ্করদর্শনের এই প্রাক-ধারণাটুকু পাওয়া যায়-

‘জ্ঞ অজ্ঞৌ দ্বৌ অজৌ ঈশ-অনীশৌ অৎা হি একা ভোক্তৃভোগ্যার্থযুক্তা।
অনন্তঃ চ আত্মা বিশ্বরূপঃ অকর্তা ত্রয়ং যদা বিন্দতে ব্রহ্মং এতৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/৯)
অর্থাৎ :
সর্বজ্ঞ ঈশ্বর এবং অজ্ঞ জীব উভয়ই অজাত (জন্মরহিত)। জীবের ভোগের জন্য মায়া-প্রকৃতি নানাবিধ ভোগ্যবস্তু সৃষ্টি করেন। কিন্তু পরমাত্মা অসীম, তাই তিনি সাক্ষীস্বরূপ। ভোক্তা, ভোগ্যবস্তু এবং ভোগ স্বয়ং- অর্থাৎ ‘জীব’, ‘প্রকৃতি’ (মায়া) এবং ঈশ্বর (পরমাত্মা)- এই তিনই ব্রহ্মে একাত্ম। এই সত্য উপলব্ধি করতে পারলে জীব মুক্ত হয় (শ্বেতাশ্বতর-১/৯)।
অদ্বৈতমতে মায়া বা অবিদ্যা
অদ্বৈত-বেদান্ত মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হলো মায়াবাদ। তবে মায়াবাদ একটি প্রাচীনতম ধারণা। বেদ এবং উপনিষদের মধ্যেই প্রথম মায়াবাদের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। ঋগ্বেদে দুটি অর্থে ‘মায়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘প্রথমত, যে শক্তি বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করতে পারে তা-ই মায়া। দ্বিতীয়ত, যে শক্তি সত্যকে আবৃত করে রাখে তা-ই মায়া।’- (নীলিমা মণ্ডল, ভারতীয় দর্শন পরিচয়, পৃষ্ঠা-১৮৯)। আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরের মায়াশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি হয়েছে।  যেমন-

‘য একো জালবান্ ঈশত ঈশনীভিঃ সর্বান্ লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।
ঐ এবৈক উদ্ভবে সম্ভবে চ য এতৎ বিদুঃ অমৃতাস্তে ভবন্তি’।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)
‘ছন্দাংসি যজ্ঞাঃ ক্রতবো ব্রতানি ভূতং ভব্যং যচ্চ বেদা বদন্তি।
অস্মান্ মায়ী সৃজতে বিশ্বমেতৎ অস্মিন্ চ অন্যো মায়য়া সন্নিরুদ্ধঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)
‘মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্য অবয়বভূতৈঃ তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ :
সেই পরমাত্মা যিনি মায়াবী (জালবান), যিনি নিজের মায়াশক্তিতে সকল জগৎ শাসন করেন, সেই একই শক্তিতে যিনি এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি অথবা বিনাশের কারণ, তিনি অদ্বিতীয়। যাঁরা এই সত্য জানেন, তাঁরা অমর হন (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)।  চারটি বেদ, বৈদিক যাগযজ্ঞ, সবরকমের উপাসনা এবং ধর্মীয় সাধনা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ- সংক্ষেপে বেদে যা যা বলা হয়েছে তার সবকিছুই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিজের মায়াশক্তি দিয়ে ব্রহ্ম এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেন। আবার সেই একই শক্তির প্রভাবে জীবাত্মা মায়াময় জগৎ-সংসারে বাঁধা পড়ে (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)।  প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ (অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত) (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।

শঙ্করাচার্য ও তাঁর অনুগামী দার্শনিকরা বেদ এবং উপনিষদের এই মায়াবাদকে যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। অঘটন-ঘটনপটীয়সী যে শক্তি ব্রহ্মকে আবৃত করে তার উপর জগৎ-প্রপঞ্চকে আরোপ করে, অদ্বৈতবেদান্তে তাকে অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়া বলা হয়েছে। এই অবিদ্যা, অজ্ঞান বা মায়ার দ্বারা উপহিত হয়েই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম কল্যাণগুণাধার হয়ে সগুণ ঈশ্বর বা জগৎ-কারণ হন। মায়া নিজের ক্রিয়া ব্রহ্মে আরোপ করে বলেই মায়াকে ব্রহ্মের উপাধি বলা হয়েছে। মায়া-উপহিত এই চৈতন্যসত্তা জগৎপ্রপঞ্চের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ।

অদ্বৈতমতে উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আর সব কিছুই- এই বিচিত্র জগৎ মিথ্যা- শুধু আপাত প্রতীয়মান সত্তামাত্র। জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন, এক এবং অদ্বিতীয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে- সত্য যদি একই হন, তাহলে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা এই নানাত্ব অনুভব করি কেন ? সত্য তো অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এজন্যেই শঙ্কর সত্য এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে অদ্বৈতমতে আপাত বিরোধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, জগতের এই নানাত্ব হলো মায়া। যখনই আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান জন্মে তখনই নানাত্ব থাকে না- সুতরাং তার কোন সত্যতা নেই। অন্ধকারে রজ্জুতে সর্প দর্শনের ন্যায় তা একটি ভ্রম। অবিদ্যার জন্যেই এই ভ্রান্তি। এই অবিদ্যা অনাদি। এই অবিদ্যাই যাবতীয় নানাত্ব দর্শনের কারণ- এজন্যই ব্রহ্মকে জগৎ বলে ভ্রম হয়। এই অবিদ্যার কারণেই জীবাত্মা নিজেকে উপাধিযুক্ত অর্থাৎ দেহ, ইন্দ্রিয়াদি যুক্ত বলে মনে করে। উপাধিগুলি জীবের উপর আরোপিত মাত্র। উপাধির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যই জীব নিজেকে কর্তা ভোক্তা ইত্যাদি মনে করে। যদিও যথার্থত জীবাত্মার সঙ্গে উপাধির কোন সম্পর্কই নেই- তবু তা মায়াবলে সংসারাবদ্ধ হয়ে নিজেকে জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখাদির অধীন বলে মনে করে।

এখানে উল্লেখ্য, আচার্য শঙ্কর তাঁর শারীরকভাষ্যে যদিও ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ শব্দদ্বয়কে সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, তথাপি ভামতী সম্প্রদায়ের বাচস্পতিমিশ্রের মতো কোন কোন অদ্বৈতবেদান্তী এই শব্দদ্বয়ের পৃথক প্রয়োগ করেছেন। তাঁদের মতে জগৎ বিক্ষেপকারী, ঈশ্বরের উপাধি, সমষ্টিগত অজ্ঞান, মূলাবিদ্যাই হলো মায়া; আর জীবের উপাধি, আবরণকারী, ব্যক্তিগত অজ্ঞান, তুলাবিদ্যাই হলো অবিদ্যা। সে যাক্, এখন প্রশ্ন হলো- এই উপাধি বা মায়ার স্বরূপ কী ?

মায়ার স্বরূপ :
অদ্বৈতবেদান্তে মায়ার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘সদসদভ্যাম, অনির্বচনীয়ম্, ত্রিগুণাত্মকম্, জ্ঞানবিরোধী, ভাবরূপম্, যৎকিঞ্চিৎ’

সদসদভ্যাম : বেদান্তমতে ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোন সৎ বস্তু নেই। যা সৎ, তা নিত্য। অজ্ঞান পরমসত্তার জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়। কারণ, মায়া বা অজ্ঞান ব্রহ্মের মতো অবাধিত বা পারমার্থিক সত্তা নয়। সৎ বস্তু কখনো বাধিত বা বিনাশ হয় না। কিন্তু অজ্ঞান জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। যেমন রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। কিন্তু পরে আমরা জানি যে ঐ সর্প মিথ্যা। অতএব আমার অজ্ঞান ধ্বংস হয়। সুতরাং অজ্ঞানকে সৎ বলা যায় না।
আবার দৃশ্যমান জগতের বিক্ষেপক অজ্ঞানকে অসৎও বলা যায় না যেহেতু সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। অজ্ঞানের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব প্রমাণ। রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি অজ্ঞানের বিষয় প্রত্যক্ষীভূত ঘটনা। এইজন্য ঐ সর্পটি আকাশ-কুসুমের মতো সম্পূর্ণ অসৎ বা অলীক নয়। অলীক কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। আবার অজ্ঞানকে একইসঙ্গে সৎ ও অসৎ অর্থাৎ সদসৎও বলা যায় না। কারণ একই বস্তুতে সত্তা ও সত্তার অভাবরূপ পরস্পর বিরোধী ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না। সৎ ও অসৎ পরস্পর বিরুদ্ধ, এবং বিরুদ্ধভাবের অভিন্ন আশ্রয় অসম্ভব। তাই অজ্ঞান বা মায়াকে সদসৎও বলা যায় না।

অনির্বচনীয়ম্ : যেহেতু অজ্ঞান সৎ, অসৎ ও সদসৎ নয়, সেহেতু অদ্বৈতমতে অজ্ঞান সদসৎ ভিন্ন বা অনির্বচনীয়। যাকে সৎ, অসৎ ও সদসৎ- কোন রূপেই নির্দেশ করা যায় না, তা-ই অনির্বচনীয়। এই অর্থে কোন বস্তু হয় সৎ অথবা অসৎ হবে, এমন কোন কথা নেই। এমন বস্তুও থাকতে পারে, যা সৎও নয়, আবার অসৎও নয়। মায়া বা অজ্ঞান এরূপ সদসদবিলক্ষণ। সদসদবিলক্ষণকেই অদ্বৈতমতে অনির্বচনীয় বলা হয়। তাই বেদান্তসার গ্রন্থে মায়াকে বলা হয়েছে- 
‘সদসদভ্যাম অনির্বচনীয়ম্’। অর্থাৎ, মায়া সৎরূপে, অথবা অসৎরূপে অথবা সদসৎরূপে বচনীয় নয়।ত্রিগুণাত্মকম্ : অদ্বৈতমতে মায়া হলো ত্রিগুণাত্মক। অর্থাৎ, সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিনটি গুণ দিয়ে মায়া গঠিত। যেহেতু মায়ার দ্বারা সৃষ্ট এই জগতের বস্তুগুলির মধ্যে সত্ত্ব, রজো এবং তমো গুণগুলি দেখা যায়, সেহেতু এই জগতের কারণ মায়াকে ত্রিগুণাত্মক বলা হয়েছে। সত্ত্ব প্রভৃতি গুণগুলির কার্য আমরা আমাদের সুখ, দুঃখ ও অবসাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করি। মায়া সম্পূর্ণরূপে অবোধ্য নয় যেহেতু মায়ার ত্রিগুণাত্মক ধর্মটি আছে। অজ্ঞানজন্য যাবতীয় পদার্থেই এই ত্রিবিধ গুণ পরিলক্ষিত হয়।

জ্ঞানবিরোধী : মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানবিরোধী। জ্ঞানের উদয়ে মায়া বা অজ্ঞান বাধিত বা অন্তর্হিত হয়। জ্ঞান ও অজ্ঞান পরস্পরবিরোধী। একটা বিশেষ অধিষ্ঠানে অজ্ঞান থাকলে তা বিষয়কে আবৃত করে। সেই একই অধিষ্ঠানে একই বিষয়ের অভ্রান্ত জ্ঞান হলে অজ্ঞানটি বাধিত হয়। রজ্জুর সম্যগ্জ্ঞানে রজ্জুতে আভাসিত সর্প যেমন বিলুপ্ত হয়, সেরূপ জ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান দূর হয়। এ কারণে মায়া বা অজ্ঞানকে জ্ঞানবিরোধী বলা হয়েছে।

ভাবরূপম্ : মায়া বা অজ্ঞানকে ভাবরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানের অভাব নয়, এটি ভাবরূপ বা ভাব পদার্থের মতো। কিন্তু মায়া যেহেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সেহেতু এটি সম্পূর্ণ ভাব পদার্থ নয়। মায়া ভাবপদার্থ এ কারণে যে, মায়া বন্ধ্যাপুত্র বা আকাশকুসুমের মতো অলীক নয়। মায়া যদি আকাশকুসুমের মতো অভাবপদার্থ হতো, তাহলে তার অভিজ্ঞতা আমাদের কখনোই হতো না। আবার অজ্ঞান কেবল বস্তুর স্বরূপ আচ্ছাদন করে না, এক বস্তুতে অন্য বস্তুর প্রতিভাসের সৃষ্টি করে। বিক্ষেপকর্ম সব সময় ভাবাত্মক। তাই অজ্ঞান শুধু জ্ঞানের অভাব নয়, মিথ্যাজ্ঞানও বটে। অবশ্য অজ্ঞানের এই ভাবরূপ চিৎ আত্মার ভাবরূপ থেকে পৃথক। চিৎ আত্মার ভাবরূপ নিত্য, অজ্ঞানের ভাবরূপ অনিত্য। অজ্ঞান ভাবরূপ হলেও তা ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ নয়। ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ হলে অজ্ঞানের বিনাশ সম্ভব হতো না, কিন্তু আমরা জানি যে, প্রকৃতজ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে যে, মায়া বহু বিচিত্র বিশ্ব সংস্কারের ভিত্তি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ’। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
অর্থাৎ : মায়াপ্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ কালো (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)।

অজা অর্থ হলো মায়া যার জন্ম নেই অর্থাৎ অনাদি। লোহিত বা লাল রজো গুণ, শুক্ল বা সাদা সত্ত্ব গুণ এবং কৃষ্ণ বা কালো তমো গুণকে নির্দেশ করে। মায়া ঐ তিনটি গুণস্বরূপ। সুতরাং, মায়া যেহেতু ভাব পদার্থের ভিত্তি সেহেতু মায়া কখনোই অভাব পদার্থ নয়।

যৎকিঞ্চিৎ : মায়াকে বলা হয়েছে ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’। অর্থাৎ, মায়ার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না। মায়া অস্থির ও অনির্বচনীয় কিছু। ব্রহ্মের থেকে মায়া সম্পূর্ণ পৃথক নয়। শ্রুতিতে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৩/১, ৪/৯) মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি বলা হয়েছে। মায়া ব্রহ্মের থেকে অপৃথকও নয়। কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ সম্ভব নয়। ভেদ ও অভেদ পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক বলে একই পদার্থে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ থাকতে পারে না। আবার মায়া নিরবয়ব বা অংশহীন নয়। যেহেতু কোন নিরংশ পদার্থ কোন কিছুর কারণ হতে পারে না। অথচ মায়া জগতের কারণ। আবার মায়ার অংশ আছে- একথাও বলা যায় না। কারণ তাহলে মায়া একটি উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই আরম্ভ আছে, সেহেতু মায়ার আরম্ভকে স্বীকার করতে হবে। তাহলে মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্মও সাদি অর্থাৎ, সীমিত হয়ে পড়বে। এই কারণে মায়াকে অনির্বচনীয় বলা হয়েছে এবং ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’ রূপে মায়াকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মায়ার শক্তিদ্বয় :
শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন। জীবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা অবিদ্যা, ব্রহ্মের দিক থেকে তাই মায়া। অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে মায়া হলো অবিদ্যা। অবিদ্যার দুটি শক্তি- একটি আবরণশক্তি এবং অপরটি বিক্ষেপশক্তি। আবরণ শক্তির দ্বারা অবিদ্যা প্রথমে তার অধিষ্ঠানকে আবৃত করে। বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা অবিদ্যা সেই অধিষ্ঠানে অন্য এক মিথ্যা বস্তুকে আরোপ করে। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই অধ্যাস বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রথমে রজ্জুর যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঘটে এবং পরে রজ্জুতে মিথ্যা সর্পকে আরোপ করা হয়। ঠিক একইভাবে অবিদ্যাবশত নির্গুণ ব্রহ্মে জগৎ বা ঈশ্বর ভ্রম হয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের মায়াশক্তির বলে ‘এক’ ব্রহ্মের স্থলে বহু বস্তু দৃষ্ট হয়। সুতরাং, জগৎ মিথ্যা। এক্ষেত্রে ‘জগৎ মিথ্যা’ অর্থ হলো ‘বহু মিথ্যা’ বা ‘ভেদ মিথ্যা’।

আবরণশক্তির কাজ সত্যকে আচ্ছাদন করে রাখা। অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি আত্মার যথার্থ স্বরূপকে আবৃত করে রাখে। বিক্ষেপশক্তির কাজ মিথ্যাকে প্রকাশ করা। অজ্ঞানবশত রজ্জু যেমন সর্পেরূপে প্রকাশিত হয়, সেরূপ অজ্ঞানবশতই পরমাত্মায় কর্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। কোন বস্তু আবরণশক্তি দ্বারা বাধিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তার মিথ্যারূপ প্রকাশ পায়। অদ্বৈতমতে বিক্ষেপশক্তি হলো সৃষ্টিশক্তি। অজ্ঞানের এই বিক্ষেপশক্তি অনিত্য জগৎ সৃষ্টিকারী। অদ্বৈতমতে অজ্ঞানের আবরণশক্তি ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপশক্তি ব্রহ্মকে জগৎরূপে প্রকাশ করে।

মায়া ও অবিদ্যায় ভেদ-অভেদ :
শঙ্করাচার্য এবং কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (বিবরণ সম্প্রদায়) মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন হলেও অন্য কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (ভামতী সম্প্রদায়) মতে মায়া এবং অবিদ্যা এক নয়। তাঁদের মতে মায়া সদর্থক এবং ভাবরূপ, যদিও সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল এবং ব্রহ্ম থেকে অবিচ্ছেদ্য। অপরপক্ষে অবিদ্যা সম্পূর্ণ নঞর্থক ও অভাবরূপ। কারণ অবিদ্যার অর্থ হলো বাস্তব সত্তার জ্ঞানের অভাব।
দ্বিতীয়ত, মায়া ঈশ্বরকে সীমিত করে। কিন্তু ঈশ্বর অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন হন না। অবিদ্যা হলো ব্যক্তির জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যা জীবকে অবচ্ছিন্ন বা সীমিত করে। মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বর এবং অবিদ্যায় প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে জীব। তাই জ্ঞানের দ্বারা ব্যক্তির অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু মায়া ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শক্তি বলে ব্যক্তির জ্ঞানের দ্বারা মায়া অপসারিত হয় না।
তৃতীয়ত, মায়া প্রধানত সত্ত্ব গুণসম্পন্ন। কিন্তু অবিদ্যা সত্ত্ব, রজো ও তমো গুণের দ্বারা গঠিত।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ অদ্বৈতবেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি উভয়পক্ষই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া উভয়পক্ষই স্বীকার করেন যে, ঈশ্বর অজ্ঞানের নঞর্থক দিকের দ্বারা প্রভাবিত হন না। এবং তাঁর মধ্যে সত্ত্ব গুণেরই প্রাধান্য আছে। সুতরাং, আবরণকে তুলাবিদ্যা বলা হলে এবং বিক্ষেপকে মায়া বা মূলাবিদ্যা বলা হলেও প্রকৃত তত্ত্বটি অবিকৃত থেকে যায়।

অজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রমাণ :
অজ্ঞানের অস্তিত্ববিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব ও শ্রুতি হলো প্রমাণ। আমরা প্রত্যেকেই ‘আমি অজ্ঞ’ এইরূপ অবস্থা সরাসরি উপলব্ধি করি। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্’

প্রশ্ন হতে পারে যে, মায়া বা অজ্ঞান এক না বহু ? বেদান্তসারের বক্তব্য অনুসারে মায়াকে এক এবং বহু, উভয়রূপেই চিন্তা করা সম্ভব। সমগ্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অজ্ঞান হলো এক। আবার প্রতিটি জীবকে পৃথকভাবে চিন্তা করলে অজ্ঞান বহু। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, অজ্ঞান দু’ধরনের- সমষ্টি অজ্ঞান ও ব্যষ্টি অজ্ঞান।
বন বললেই যেমন বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের সমষ্টি সমস্ত গাছের একযোগে প্রতীতি হয়, জলাশয় যেমন জলবিন্দুর সমষ্টি, অনুরূপভাবে অন্তঃকরণ উপাধিভেদে জীবগত অজ্ঞান বহু হয়েও সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক। আবার সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক হলেও বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ হিসেবে বৃক্ষ যেমন বহু, বিন্দু বিন্দু জলকণা হিসেবে জল যেমন বহু, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জীবের অজ্ঞান হিসেবে ব্যষ্টিরূপে অজ্ঞান বা মায়া হলো বহু।

অদ্বৈতমতে সমষ্টি অজ্ঞান ঈশ্বরের উপাধি। ব্যষ্টি অজ্ঞান অজ্ঞ জীবের উপাধি। ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞান বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণপ্রধান। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ বেশি পরিমাণে বর্তমান থাকে। ব্যষ্টি জীবের উপাধিরূপে, অজ্ঞান মলিনসত্ত্বপ্রধান। অর্থাৎ অজ্ঞ জীবের উপাধি হিসেবে ব্যষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে থাকে। ব্যষ্টি অজ্ঞানে রজঃ ও তমঃ গুণ মিশ্রিত থাকায় জীবের প্রকাশশক্তি কম। এজন্য জীবকে প্রাজ্ঞ বলা হয়। ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ।

অন্যভাবে সমষ্টি অজ্ঞানকে মূলাবিদ্যা এবং ব্যষ্টি অজ্ঞানকে তুলাবিদ্যা বলা হয়। অজ্ঞানের এই যে সমষ্টি ও ব্যষ্টি বিভাগ, তা কল্পিত বিভাগমাত্র। বন ও বৃক্ষ যেমন বস্তুত এক, জল ও জলাশয় যেমন বস্তুত এক, তেমনি সমষ্টি ও ব্যষ্টি অজ্ঞান বস্তুত এক ও অভিন্ন। একই মায়াশক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী নামের এই ভিন্নতা। অদ্বৈতবেদান্তী এই উভয়প্রকার উপহিত চৈতন্যের উর্ধ্বে এক ও অদ্বিতীয় তুরীয়চৈতন্যবাদী। সেই তুরীয়চৈতন্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্ম। অঘটন-ঘঁটন-পটীয়সী জগৎ বিক্ষেপকারী অনাদি মায়া যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ব্রহ্মের অতিরিক্ত তার কোন সত্তা নেই। এই অবিদ্যাতত্ত্ব, মায়াতত্ত্ব বা বিবর্ততত্ত্ব যে কেবলাদ্বৈতবাদীর জগৎ ব্যাখ্যার পক্ষে এক অপরিহার্য তত্ত্ব, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মায়ার সাথে ব্রহ্ম ও জগতের সম্বন্ধ :
মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী ?  শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম মায়া শক্তির প্রভাবে জগৎরূপে প্রতিভাত হয়। মায়া ব্রহ্মেরই শক্তি। আগুনের দাহিকা শক্তিকে যেমন আগুন থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়, তেমনি ব্রহ্মের মায়াশক্তিকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক করা যায় না। বস্তুত মায়ার আশ্রয় এবং বিষয় উভয়ই ব্রহ্ম। তবে ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই প্রেক্ষিতে শ্বেতাশ্বতর-এ একটি উপমাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়-
যাদুকর ইন্দ্রজাল রচনা করেন। যাঁরা অজ্ঞ ব্যক্তি তাঁরাই যাদুকরের ঐন্দ্রজালিক ঘটনাগুলিকে সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু যাদুকর তাঁর ইন্দ্রজালের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করলেও নিজে প্রভাবিত হন না। সুতরাং, মায়া এবং ব্রহ্ম দুটি পৃথক সত্তা নয়।

মায়ার সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ কী ?  অদ্বৈতবেদান্ত অনুসারে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা। মায়া সগুণ ব্রহ্মের শক্তিরূপে তাঁর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, মায়া এই জগতের কারণ। জগৎ হলো মায়ার পরিণাম।
অদ্বৈতমতে সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ অনুসারে অদ্বৈত সত্তাকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা হয়। যথা- পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রহ্মজ্ঞান হলে যাকে একমাত্র সৎ বলে প্রতীয়মান হয় তার সত্তা হলো পারমার্থিক সত্তা। এই অর্থে ব্রহ্ম হলেন পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কিন্তু যতক্ষণ আমিই ব্রহ্ম- এরূপ উপলব্ধি না হয়, ততক্ষণ যে সব পদার্থ সৎরূপে প্রতীয়মান হয়, সেগুলি হলো ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই কারণে অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করা হয়েছে। জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্তা আছে, জগতের কারণ মায়াও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি সমান হয় তাহলে কার্যটি হয় কারণের পরিণাম। সুতরাং, জগৎ হলো মায়ার পরিণাম। কিন্তু উপাদান কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি ভিন্ন হয় তাহলে কার্যটি হলো কারণের বিবর্ত। সুতরাং, জগৎ হলো ব্রহ্মের বিবর্ত।

বস্তুত মায়ার আশ্রয়রূপে সগুণ ব্রহ্ম জগতের অপরিবর্তনশীল উপাদান কারণ বা বিবর্ত উপাদান কারণ। কারণ, যদি ব্রহ্মকে উপাদান কারণ বলে গণ্য করা না হয়, তাহলে কয়েকটি শ্রুতিবাক্যের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন ‘এক বিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানম্’ বা ‘এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়’, ‘ব্রহ্মৈবেদম্ অসর্বম্’ ‘আত্মৈবেদম্ অসর্বম্’- এই বাক্যগুলিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। আবার মায়ারূপ উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিফলিত হলে তাঁর ঈক্ষণবৃত্তির উদয় হয়। ঈক্ষণবৃত্তি হলো জগৎ সৃষ্টির সংকল্প। এই কারণে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত কারণও বলেছেন।
তাঁর মতে ব্রহ্মকে উপাদান ও নিমিত্ত- এই দ্বিবিধ কারণ বলা উচিত। কারণ তাহলে শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের বিরোধ হয় না। শ্রুতিতে এরকম প্রতিজ্ঞা আছে- এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা হয়েছে- ঘট প্রভৃতির উপাদান কারণস্বরূপ এক মৃৎপিণ্ডকে জানলে যেমন সমস্ত মৃন্ময় বস্তুরই জ্ঞান হয় ইত্যাদি। উপাদান কারণের জ্ঞান না থাকলে এক বিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান হয় না। অতএব জগতের অন্য অধিষ্ঠাতা না থাকায় আত্মাই অধিষ্ঠাতা বা নিমিত্তকারণ এবং অন্য উপাদান না থাকায় আত্মাই জগতের উপাদান কারণ।
অদ্বৈতমতে জীব
শঙ্করাচার্য বর্ণিত অদ্বৈতবেদান্তের মূল সূত্রেই জীব সম্পর্কেও বলা আছে- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তার মানে, শঙ্করের তৃতীয় বাণীটি হলো- ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন তথা জীব ব্রহ্মস্বরূপ।

এখন প্রশ্ন হলো, অদ্বৈত মতানুসারে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট। কিন্তু জীব তো সত্যস্বরূপ নয়, জ্ঞানস্বরূপ নয় এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে জীব ও ব্রহ্মকে কিভাবে এক ও অভিন্ন বলা যাবে ?
উত্তরে বলা হয়, জীবেরও ব্রহ্মের মতোই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হওয়া উচিত। অর্থাৎ আগুন এবং আগুনের একটা ফুলকি যে অর্থে এক, জীব ও ব্রহ্ম সেই অর্থেই অভিন্ন। কিন্তু জীবের ব্রহ্মস্বরূপতা আমাদের উপলব্ধি হয় না। কারণ দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং বিষয়-বাসনার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে জীবের জ্ঞান, ঐশ্বর্য ইত্যাদি তিরোহিত হয়। সংসারদশায় অবিদ্যা জীবের ব্রহ্ম-স্বভাবকে আবৃত করে রাখে। এই অবিদ্যা মলিনসত্ত্বপ্রধান-ব্যষ্টি-অবিদ্যা। এর ফলে জীব নিজেকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।

জীবের সংসারদশা :
ব্যবহারিক স্তরে ‘আমি’কে আমরা প্রত্যেকেই জানি। এই ‘আমি’ই হলো আমাদের জ্ঞান অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদির অধিষ্ঠান ও কর্তা। ‘আমি জানি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ইচ্ছা করি’- এইসব বাক্যগুলির মধ্য দিয়ে সেই ব্যবহারিক আত্মা বা জীবের অস্তিত্ব বা বোধ প্রকাশিত হয়। আমার জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছার কর্তা হলো আমি বা অহং। সুতরাং, এখানে জীব কর্তা এবং ভোক্তা। কিন্তু ব্রহ্ম কর্তা নয়, এবং জ্ঞানের বিষয়ও নয়। জানা, অনুভব করা এবং ইচ্ছা করা- এগুলি সবই চৈতন্যের ক্রিয়া।
কিন্তু এই চৈতন্য শুদ্ধ চৈতন্য নয়। এগুলি মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা সীমিত চৈতন্যের ক্রিয়া। শুদ্ধ-চৈতন্য থেকে ভিন্ন জীবাত্মাকে তাই সাক্ষী-চৈতন্য বলে। জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছায় দ্বৈতভাব থাকে। যেমন- জ্ঞাতা ও বিষয়ের সম্পর্ক, অনুভব ও তার বিষয়ের সম্পর্ক, ইচ্ছা ও ইচ্ছার বিষয়ের সম্পর্ক। ব্রহ্ম কিন্তু অদ্বয় ও সকল প্রকার ভেদশূন্য। অপরপক্ষে কিছু জানতে গেলে, অনুভব করতে গেলে এবং কিছু ইচ্ছা হলে বিষয়ী ও বিষয়ের মধ্যে ভেদ অবশ্যম্ভাবী। তাই আমাদের অহং বা আমি-টি ব্রহ্ম নয়। অহং হলো অবিদ্যার দ্বারা সীমিত ব্রহ্ম বা জীব।

এ প্রেক্ষিতে শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেন-

‘তদ্যথা পুত্রভার্য্যাদিষু বিকলেষু সকলেষু বা অহমেব বিকলঃ সকলো বা ইতি বাহ্যধর্ম্মান্ আত্মনি অধ্যাসতি। তথা দেহধর্ম্মান্ স্থূলোহহং কৃশোহহং গৌরোহহং তিষ্ঠামি লঙ্ঘয়ামি চ ইতি। তথা ইন্দ্রিয়ধর্ম্মান্ মূকঃ ক্লীবঃ বধিরঃ কাণঃ-অন্ধঃ অহম্- ইতি। তথা অন্তঃকরণধর্ম্মান্ কামসংকল্প বিচিকিৎসাধ্যবসায়াদীন্ । এবং অহংপ্রত্যয়িনং অশেষ স্বপ্রচার সাক্ষিণি প্রত্যগাত্মনি অধ্যস্য তঞ্চ প্রত্যগাত্মানং সর্ব্ব সাক্ষিণং তদ্বিপর্ষ্যয়েণ অন্তঃকরণাদিষু অধ্যস্যতি। এবময়ং অনাদিঃ অনন্তঃ নৈসর্গিকঃ অধ্যাসঃ মিথ্যাপ্রত্যয়রূপঃ কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বপ্রবর্ত্তকঃ সর্ব্বলোকপ্রত্যক্ষঃ। অস্য অনর্থ হেতোঃ প্রহাণায় আত্মৈকত্ব বিদ্যাপ্রতিপত্তয়ে সর্ব্বে বেদান্তা আরভ্যন্তে।’- (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১, বেদান্তসূত্রম্,পৃষ্ঠা-৩১)
অর্থাৎ :
আমাদের মধ্যে কারও পুত্র বা স্ত্রী প্রভৃতি যদি পীড়িত অথবা সুস্থ হয়, তাহলে, সে যথাক্রমে নিজ আত্মাকেই পীড়িত বা সুস্থ বলে বোধ করে থাকে- এটাই আত্মার উপর বাহ্যধর্মসমূহের অধ্যাস। এভাবে আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি গৌড়বর্ণ, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমি চলছি ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর দেহের ধর্মগুলির আরোপ করে থাকে। এভাবে আমি মূক, আমি ক্লীব, আমি বধির, আমি কাণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর ইন্দ্রিয়গুলির ধর্মগুলিকে আরোপিত করে থাকে। এভাবেই আবার অন্তঃকরণের ধর্মগুলি অর্থাৎ কাম, সংকল্প, সংশয় ও নিশ্চয় প্রভৃতি- আত্মাতে আরোপ করে থাকে। এভাবেই আবার সেই আমি- এই প্রত্যয়যুক্ত জীবকে সকলপ্রকার মানসবৃত্তির সাক্ষী- সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মাতে আরোপিত করা যায়, এবং বিপরীতভাবে আবার সেই সর্ববৃত্তির সাক্ষীস্বরূপ- প্রকাশময় পরমাত্মাকে- সেই আমি-প্রত্যয়ের বিষয় জীবাত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। এই যে পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাস- তার আদি খুঁজে পাওয়া যায় না- তার অন্তও নাই। এই অধ্যাস আমাদের নৈসর্গিক- এটাই মিথ্যাজ্ঞান অর্থাৎ অবিদ্যা। এই অধ্যাসই আমাদেরকে কর্তা ও ভোক্তা এই দুভাবে সংসারে প্রবর্তিত করে থাকে। তা সব লোকেরই প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই সকল প্রকার অনর্থের হেতু অধ্যাসকে বিধ্বস্ত করতে হলে- অদ্বিতীয় আত্মতত্ত্বজ্ঞানই একমাত্র আবশ্যক (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১)
ব্যবহারিক জগতে জ্ঞান, অনুভূতি বা ইচ্ছার কর্তা যে অহং তা সর্বদাই একটি শরীরের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের সঙ্গে অহং-এর যোগ আছে বলেই আমি জানি, আমি অনুভব করি এবং আমি ইচ্ছা করি। এই অহংকে শরীর থেকে পৃথক করা যায় না। যদি কল্পনা করি যে শরীর নেই, তাহলে প্রশ্ন ওঠে- কার জ্ঞান? কার অনুভূতি? কার ইচ্ছা? যে শরীর অন্যান্যদের ইন্দ্রিয়গোচর তা হলো ‘স্থূলশরীর’। এই স্থূলশরীর ছাড়াও সূক্ষ্মশরীর ও কারণশরীর আছে। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সতেরোটি উপাদানের সমন্বয়ে জীবের সূক্ষ্মশরীর নির্মিত। তবে এই তিনরকম শরীরই মায়ার সৃষ্টি। শরীরমাত্রই নশ্বর অর্থাৎ, চিরকাল থাকে না।

জীবত্বের উৎপত্তি :
শঙ্করাচার্যের মতে, জীব হলো আত্মা ও অনাত্মার সংমিশ্রণ। শুদ্ধ আত্মায় অনাত্মার অধ্যাসের ফলে অর্থাৎ, যখন আত্মার উপর অনাত্মা আরোপিত হয়, তখনই শুদ্ধ চৈতন্য বা আত্মা সাক্ষী-চৈতন্য জীবে পরিণত হয়। শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহংকার প্রভৃতি হলো অনাত্মা। সাক্ষী-চৈতন্য অন্তঃকরণের (মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টি হলো অন্তঃকরণ) সঙ্গে যুক্ত হলে ভ্রান্তিবশত যখন আত্মা-অনাত্মার অভেদ বোধ হয়, তখনই অহং-রূপ জীবত্বের সৃষ্টি হয়। যেমন আমরা বলি- ‘আমি রোগা’ বা ‘আমি মোটা’ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আত্মা এবং শরীরের অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আবার যখন বলি- ‘আমি অন্ধ’ বা ‘আমি খোঁড়া’, তখন আত্মার সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রিয় বা কর্মেন্দ্রিয়ের অভেদ বোধ থাকে। তেমনি যখন বলি- ‘আমি সুখী’ বা ‘আমি দুঃখী’, তখন আত্মা ও মানসিক অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আত্মার উপর অনাত্মার অধ্যাস বা আরোপের ফলেই জীব দুঃখ ভোগ করে। আত্মা বা ব্রহ্ম কিন্তু স্বরূপত রোগা, মোটা, অন্ধ, খোঁড়া, সুখী, দুঃখী- এসব কিছুই নয়। চৈতন্য মায়ার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা উপহিত হলেই এইরকম অভেদ বোধ জন্মায়। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অহংকারের দ্বারা সীমিত বা অবচ্ছিন্ন আত্মা প্রকৃত বা শুদ্ধ আত্মা নয়। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বর, জীব ও জাগতিক বিষয় সবই মিথ্যা, ব্রহ্মের বিক্ষেপমাত্র। এ প্রেক্ষিতে অদ্বৈতবেদান্তের আধুনিক প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ’র বাণীতেও উক্ত হয়েছে-
‘অদ্বৈতবাদীদের কাছে জীবাত্মার কোন স্থান নেই। তাহাদের মতে জীবাত্মা মায়ার সৃষ্টি; আসলে জীবাত্মার কোন (পৃথক) অস্তিত্ব থাকিতে পারে না।’– (স্বামীজীর বাণী ও রচনা ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৭)

অদ্বৈতমতে অবিদ্যাপ্রসূত, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। শঙ্করের ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, এবং বিভিন্ন শ্রুতিতে জীবাত্মার উৎপত্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাই অদ্বৈতমতেও জীবাত্মা অবিনাশী। বেদান্তসূত্রকার বাদরায়ণও বলেছেন-

‘নাত্মা, অশ্রুতেঃ নিত্যত্বাৎ চ তাভ্যঃ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)
ভাবার্থ : জীবাত্মা উৎপন্ন হন এ কথা শ্রুতি বলেন নি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন।

জীবের স্বরূপ-উপলব্ধি :
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে উপলব্ধ বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনার মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী জীব ও ব্রহ্মের এই অভিন্নতাকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি- এই তিনটি ভিন্ন অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। জাগ্রত অবস্থায় জীবের ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ প্রভৃতি সক্রিয় থাকে। তাই এই অবস্থায় আমরা যতক্ষণ জাগ্রত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের স্থূলশরীর, ইন্দ্রিয়, মন প্রভৃতির সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা বোধ করি এবং নানা বিষয়কে জানি। জাগ্রত অবস্থায় যেমন বিষয়ী ও বিষয়ের (অর্থাৎ, জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের) ভেদ থাকে, তেমনি স্বপ্নেও জ্ঞান ও তার বিষয়ের মধ্যে ভেদের বোধ থাকে। স্বপ্নাবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু অন্তঃকরণ সক্রিয় থাকে বলে জাগ্রত অবস্থার অনুভবের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্নাবস্থায় জীব বিষয়কে জানে। এই অবস্থায় জীবের জ্ঞান অনুভবের সংস্কারের দ্বারা সীমিত। সুষুপ্তিতে ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ নিষ্ক্রিয় থাকে। তাই সুষুপ্তিকালে অর্থাৎ, স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার সময় কোন বিষয়ের ধারণা থাকে না। ফলে সুষুপ্তির সময় আমরা জ্ঞাতা হই না। তখন বিষয়ী ও বিষয়ের, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে ভেদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয় এবং শরীর, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা সীমিত হবার কোন বোধ থাকে না। কিন্তু তখনও চৈতন্য থাকে। যদি চৈতন্য না থাকতো, তবে সুষুপ্তির থেকে জেগে আমরা কখনোই বলতে পারতাম না যে, গভীর নিদ্রা হয়েছিলো। এ অবস্থা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘পুংস্ত্বাদিবৎ ত্বস্য সতঃ অভিব্যক্তিযোগাৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)
ভাবার্থ : পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
আত্মা স্বরূপত কেমন, তা সুষুপ্তির অবস্থাটি বিশ্লেষণ করলে আংশিক পরিচয় পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। তখন আত্মা সীমিত এবং দুঃখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট নয়। আত্মা তখন সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। এই অবস্থায় আমরা আত্মার অনন্দজ্ঞান, বিষয়হীনতা, আনন্দস্বরূপতা উপলব্ধি করি। কিন্তু এই উপলব্ধি ক্ষণিকের জন্য। জাগ্রত হবার পর জীব আবার ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ-সংশ্লিষ্ট হয়ে জগৎভ্রমে পতিত হয়।
শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম শরীর ও অন্তঃকরণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জীবে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্তা আছে এবং জীবের ব্যবহারিক সত্তা আছে। অবিদ্যা-সংশ্লিষ্ট আত্মাই জীব। তত্ত্বজ্ঞান লাভের দ্বারা অবিদ্যা দূরীভূত হলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ লোপ পায় এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন- এই উপলব্ধি হয়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ :
পারমার্থিক দিক থেকে যদিও জীব ব্রহ্মস্বরূপ, তবুও ব্যবহারিক দিক থেকে জীব ব্রহ্ম-ভিন্ন। এ বিষয়ে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-

‘অংশো নানাব্যপদেশাৎ, অন্যতা চ অপি দাশকিতবাদিত্বম্ অধীয়ত একে’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৩)
ভাবার্থ : জীব পরমাত্মার অংশ, কারণ শ্রুতিও জীব এবং ব্রহ্মের ভেদ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; আবার অভেদও উপদেশ করেছেন। অতএব জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয়।

অদ্বৈতমতে, অবিদ্যা-উপহিত ব্রহ্মই জীব। এই অবস্থায় জীব ব্রহ্মস্বরূপতা বিস্মৃত হয়। জীব তাই ব্রহ্মের সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই। অদ্বৈতবেদান্তী একদিকে যেমন জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা দেখিয়েছেন, তেমনি অপরদিকে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা দেখিয়েছেন। তবে এই ব্যবহারিক ভিন্নতা ব্যাখ্যায় অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। বেদান্তসূত্রের যে সূত্রটিকে কেন্দ্র করে ঐ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিলো, সেটি হলো-

‘আভাস এব চ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০)
ভাবার্থ : এবং জীব পরমাত্মার একটি আভাস বা প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই জীবের সুখ-দুঃখ পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।

জীব ও ব্রহ্মের আপাত ভেদ-
এই সূত্রকে কেন্দ্র করে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা সম্পর্কে বিভিন্ন অদ্বৈতবেদান্তী বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাগুলি প্রধানত তিনটি মতবাদ সৃষ্টি করেছে। মতবাদ তিনটি হলো- অবচ্ছেদবাদ, প্রতিবিম্ববাদ এবং আভাসবাদ।

অবচ্ছেদবাদ : অবচ্ছেদবাদ অনুযায়ী স্বরূপত অভিন্ন বস্তু অবচ্ছেদভেদে ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হয়। যেমন আকাশকে ঘর ইত্যাদির দ্বারা সীমিত বোধ হয়, তেমনি এক ও অদ্বয় সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মও বিভিন্ন অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে প্রতিভাত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকাশ যেমন বিভিন্ন কক্ষের দ্বারা সীমিত হয় না, তেমনি ব্রহ্মও বুদ্ধির দ্বারা সীমিত হয় না। অন্তঃকরণ অবিদ্যাজন্য। অবিদ্যা দূর হলে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম অবচ্ছেদমুক্ত হয়ে একক সৎরূপে উপলব্ধ হয়।

প্রতিবিম্ববাদ : আয়নার মতো স্বচ্ছ পদার্থে বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়। বিভিন্ন স্বচ্ছ পদার্থে একই বস্তুর বিভিন্ন প্রতিবিম্ব পড়ে। সূর্য বিভিন্ন জলাশয়ে প্রতিবিম্বিত হয়, কিন্তু জলাশয়ের প্রকৃতির দ্বারা সূর্য প্রভাবিত হয় না। তেমনি একই ব্রহ্ম ভিন্ন ভিন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে আবির্ভূত হয়। ব্রহ্ম বিম্ব, জীব তার প্রতিবিম্ব। বিম্ব ও প্রতিবিম্বের ব্যবহারিক ভিন্নতা সর্বজনসিদ্ধ। প্রতিবিম্বের কারণ দূর হলে কেবল বিম্বই অবশিষ্ট থাকে।
প্রতিবিম্ববাদের সমর্থকদের মধ্যে নৃসিংহাশ্রম ও তাঁর অনুগামী বিবরণ-সম্প্রদায়ের অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বররূপে প্রতীয়মান হন। আবার ব্রহ্ম অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত হলে জীবের সৃষ্টি হয়।

আভাসবাদ : বস্তুর আপাত প্রতীয়মান রূপকে বলা হয় আভাস। আভাস মিথ্যা হলেও বস্তু থেকে তার ভিন্ন ব্যবহার স্বীকৃত। প্রতিবিম্ব বিম্বের আভাস। জীব ব্রহ্মের আভাস। আভাসের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যা দূর হলে আভাসের ভিন্ন অস্তিত্ব থাকে না। আভাসবাদ বস্তুত প্রতিবিম্ববাদেরই নামান্তর। এই কারণে আভাসবাদ ও প্রতিবিম্ববাদকে একই মতবাদ রূপেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই মতের সমর্থকরা যেমন সর্বজ্ঞাত্মমুনি প্রভৃতি প্রতিবিম্ববাদ সমর্থকদের মতো মায়া ও অবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য করেননি। তাঁরা বলেছেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা উৎপন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হলে জীব উৎপন্ন হয়।

বস্তুত প্রতিবিম্ববাদ এবং অবচ্ছেদবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অদ্বৈতবেদান্তের মূল বক্তব্য হলো জীব এবং ব্রহ্ম এক। জীব এবং ব্রহ্ম যে এক তা জীব বদ্ধ অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারে না। মোক্ষই হলো সেই অভেদের উপলব্ধি। অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ঐ অভেদের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো। প্রতিবিম্ববাদের সমর্থক দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন যে, ব্রহ্ম ও জীবের অভেদের উপলব্ধিই মোক্ষ। তাঁদের মতে বস্তু ও তার প্রতিবিম্ব এক। কিন্তু অবচ্ছেদবাদের সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিবিম্বের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন করলে মোক্ষলাভ হয়। যেমন রজ্জুতে সর্পের প্রত্যক্ষ ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞান হয়, তেমনি ব্রহ্মে অহং এর আরোপ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলেই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। অর্থাৎ, ‘আমিত্ব’ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রতিপন্ন হলে ব্রহ্মোপলব্ধি বা মোক্ষলাভ হয়।

জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভেদ-
অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্মে বস্তুত কোন ভেদ নেই, অর্থাৎ, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তবুও আমরা যে জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সম্পূর্ণই অবিদ্যাবশত ব্যবহারিক ভেদের কল্পনা করি, বেদান্তের সূত্রগ্রন্থ বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণ তাই বলেছেন-

‘স্থানবিশেষাৎ, প্রকাশাদিবৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৪)
ভাবার্থ : স্থান এবং পাত্রের দ্বারা আলোক আকাশ যেমন সীমিত হয়, তেমনি নিরাকার অসীম ব্রহ্মও উপাধিহেতু রূপবান বলে কল্পিত হন।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপনিষদের জীব ও ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদক উপদেশ উদ্ধৃত করে অদ্বৈতবেদান্তীরা জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন উপনিষদে জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। অদ্বৈত-বেদান্তীদের মতে, সকল সাধনার সিদ্ধি ও সকল উপদেশের সারস্বরূপ বিভিন্ন উপনিষদে চারটি মহাবাক্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চারটি মহাবাক্য হলো-
(১) ‘তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ, তুমিই সেই– (ছান্দোগ্য উপনিষদ), (২) ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ), (৩) ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম– (ঐতরেয় উপনিষদ), (৪) ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, আত্মাই ব্রহ্ম– (মাণ্ডুক্য উপনিষদ)।

যেসব শ্রুতিতে এই চারটি মহাবাক্যের আবির্ভাব হয়েছে, সেই শ্রুতিগুলো হলো-

(১)
‘স যথা তত্র ন অদাহ্যেত ঐতদাত্ম্যম্ ইদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি তৎ হ অস্য বিজজ্ঞৌ ইতি বিজজ্ঞাবিতি।’- (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৬/১৬/৩)
অর্থাৎ : (সত্যনিষ্ঠার জন্য) সেই ব্যক্তি তপ্ত কুঠার দ্বারা দগ্ধ হয় না। এই সৎ বস্তুই সব কিছুর আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, ‘তত্ত্বমসি’- তুমিই সেই (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।
(২)
‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ, তৎ আত্মানম্ এবাবেৎ- অহং ব্রহ্মাস্মি ইতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ। তদ্ যো যো দেবানাম্ প্রত্যবুধ্যত স এব তৎ অভবৎ। তথা ঋষীণাং তথা মনুষ্যাণাং, তদ্ধৈতৎ পশ্যন্ ঋষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবৎ সূর্যশ্চেতি। তৎ ইদমপি এতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি…।’- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১/৪/১০)
অর্থাৎ : এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো। ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- আমিই ব্রহ্ম, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্মসদৃশ বলে জেনেছিলেন তিনিও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। এই একইভাবে ঋষি এবং মানুষদের মধ্যেও যাঁরা নিজেকেই ব্রহ্ম বলে জানতে পেরেছিলেন, তাঁরাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিতভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তাঁর আত্মা তখন সর্বব্যাপী (বৃহদারণ্যক-১/৪/১০)।
(৩)
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- … সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।’- (ঐতরেয় উপনিষদ-৩/৩)
অর্থাৎ : সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত।… প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞানই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সবকিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সবকিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনি এক অখণ্ড সত্তা, অদ্বিতীয় (ঐতরেয়-৩/৩)।
(৪)
‘সর্বম্ হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, সোহয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।’- (মাণ্ডুক্য উপনিষদ-২)
অর্থাৎ : তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবাই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ বা (জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, তূরীয়) অবস্থা জীবদেহে থেকে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ (মাণ্ডুক্য-২)।

‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ও ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’- এই চারটি মহাবাক্য বস্তুত চতুর্বেদের প্রধান বাক্য। ‘তত্ত্বমসি’ সামবেদের, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ যজুর্বেদের, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ঋগ্বেদের এবং ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অথর্ববেদের প্রধানবাক্য। চারটি মহাবাক্যেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। এই মহাবাক্য চতুষ্টয়ের তাৎপর্যের মধ্যেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদপ্রতিপাদক প্রামাণ্য রয়েছে বলে অদ্বৈতবেদান্তীরা ঘোষণা করেন।

মহাবাক্যের তাৎপর্য-
এক্ষেত্রে অদ্বৈতবেদান্তীরা কিভাবে অভেদপ্রতিপাদক ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের তাৎপর্য পরিস্ফুট করেছেন, তা সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে।
‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের বাক্যাংশগুলি হলো- ‘তৎ ত্বং অসি’। ‘তৎ’ মানে ‘সেই’, ‘ত্বং’ মানে ‘এই’। মহাবাক্যটিতে উক্ত ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা ‘সেই’ নির্গুণ ব্রহ্ম এবং ‘ত্বং’ শব্দের দ্বারা ‘এই’ জীবাত্মাকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভিন্নতা তিনভাবে দেখানো যেতে পারে- সামানাধিকরণ্য, বিশেষ্য-বিশেষণভাব ও লক্ষ্যলক্ষণভাব সম্বন্ধ বা লক্ষণার দ্বারা।

সামানাধিকরণ্য : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটি একই অধিকরণের অভিন্নবাচক শব্দ হিসেবে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘এই সেই দেবদত্ত’- এই বাক্যের অন্তর্গত ‘এই’ শব্দ ও ‘সেই’ শব্দ দুটি ভিন্নার্থবোধক হয়েও যেমন একই অধিকরণ দেবদত্তকে নির্দেশ করে, তেমনি ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও একই পদার্থ ব্রহ্ম বা শুদ্ধচৈতন্যকে নির্দেশ করে।

বিশেষ্য-বিশেষণভাব : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটিকে বিশেষ্য-বিশেষণভাবে গ্রহণ করেও তাদের অভিন্নতা দেখানো যায়। যেমন, ‘শ্বেতপদ্মে’র জ্ঞানে ‘শ্বেত’ শব্দটি বিশেষণবোধক এবং ‘পদ্ম’ শব্দটি বিশেষ্যবোধক। ‘শ্বেত’ ও ‘পদ্ম’ পদদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও বস্তুত এই পদদ্বয় একটি পদার্থকেই নির্দেশ করে। পদ্ম নানা রকম রঙের হতে পারে, কিন্তু শ্বেতপদ্ম একই রকম। সেইরূপ ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ পরস্পর পরস্পরের বিশেষ্য-বিশেষণ রূপে এক ও অদ্বয় অখণ্ড চৈতন্যের প্রকাশক, এবং তিনিই ব্রহ্ম।

লক্ষণা : বাক্যের মুখ্য অর্থকে পরিত্যাগ না করে কিংবা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে তাৎপর্য অনুধাবন-পূর্বক গৌণ অর্থ গ্রহণকে বলে লক্ষণা। লক্ষণা তিনপ্রকার- জহৎ, অজহৎ ও জহদজহৎ। জহৎ-লক্ষণায় মুখ্য অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা হয়। অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে অন্য অর্থ যুক্ত করা হয়। আর জহদজহৎ অর্থাৎ জহৎ-অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থের আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণ করা হয়।
এক্ষেত্রে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারা ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভেদ প্রতিপাদন করা হয়। ‘তৎ’ পরোক্ষ চৈতন্য, কিন্তু ‘ত্বং’ অপরোক্ষ চৈতন্য। পরোক্ষত্ব ও অপরোক্ষত্ব পরস্পর বিরুদ্ধ। কিন্তু চৈতন্যাংশে উভয়ে অবিরুদ্ধ। বিরুদ্ধাংশ পরিত্যাগ করে অবিরুদ্ধাংশে উভয়ের ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। চৈতন্যাংশে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর কোন বিরোধ নেই। এই অবিরুদ্ধ চৈতন্যাংশই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য।

অদ্বৈতবেদান্তীরা সামানাধিকরণ্য ও বিশেষ্য-বিশেষণভাব পরিত্যাগ করে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্যকে গ্রহণ করেছেন। অপর তিনটি মহাবাক্যও অনুরূপভাবে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করে। এই জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার ভেদাভেদ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘তুমি যখন নিজেকে দেহমাত্র বলিয়া ভাব তখন তুমি বিশ্বজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন; নিজেকে যখন জীব বলিয়া ভাব, তখন তুমি সেই শাশ্বত মহান জ্যোতির একটি কণিকামাত্র, আর যখন নিজেকে আত্মা বলিয়া ভাব, তখন তুমিই সবকিছু।

জীব এক না বহু ?
জীব এক না বহু, অদ্বৈতবেদান্তীদের কাছে এই প্রশ্নটি অন্যন্ত জটিল বলে মনে হয়। এদের কেউ কেউ বলেন যে অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। অন্তঃকরণে যেহেতু এক নয় বহু, তাই জীবও এক নয়, বহু। এই সম্প্রদায় অনেকজীববাদী নামে পরিচিত। আবার অন্য অদ্বৈতবৈদান্তিকদের মতে অজ্ঞানে বা মায়ায় প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। মায়া যেহেতু এক, সেহেতু জীবও এক। এই সম্প্রদায়কে একজীববাদী বলা হয়।

অনেকজীববাদীদের বক্তব্য হলো, যদি জীব এক হয় তাহলে একটি জীবের মুক্তি হলে সমস্ত জীবেরই মুক্তি হবে। কিন্তু সমস্ত জীবের কখনোই একসঙ্গে মুক্তি হয় না। সুতরাং, একজীববাদ গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, একজীববাদ স্বীকার করলে বলতে হবে যে, এক জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে একটি জীবের সুখদুঃখবোধ হলেই সকলেরই সুখদুঃখবোধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। একজনের সুখে সর্বদা অন্যজনের সুখ উৎপন্ন হয় না। আবার একজনের দুঃখও অন্যের দুঃখ নয়।
কিন্তু অনেকজীববাদীদের বিরুদ্ধে একজীববাদীদের বক্তব্য হলো, অনেক জীব স্বীকার করলে সৃষ্টি ও প্রলয়ের ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ প্রলয়ের সময় অন্তঃকরণগুলি তাদের উপাদান কারণে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তার ফলে সমস্ত জীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই বক্তব্যের উত্তরে অনেকজীববাদীরা বলেন যে, প্রলয়কালে অন্তঃকরণগুলি বিলীন হয়ে গেলেও তাদের সংস্কারগুলি যেহেতু থেকে যায়, সেহেতু সমস্ত জীবের ধ্বংসের আপত্তি হয় না।

একজীববাদীরা বলেন, বিভিন্ন মানুষের সুখদুঃখ ভোগের অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণ হলো অন্তঃকরণগুলির পার্থক্য। অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মের বহু অন্তঃকরণ। এই কারণে একই জীবের অন্তঃকরণ বহু।
প্রত্তোত্তরে বলা হয়, বস্তুত একজীববাদকে সত্য গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হবে যে অন্যান্য জীবের অস্তিত্বের জ্ঞান ভ্রান্ত, যেহেতু একটিমাত্র জীবেরই অস্তিত্ব আছে। যেমন এক ব্যক্তি স্বপ্নে নানা বিষয় ও প্রাণী প্রত্যক্ষ করে, তেমনি এক জীব অন্যান্য ব্যক্তি ও বিষয়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের বিষয়ের মতোই অন্যান্য জীবের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এই মতে ‘তুমি’ ও ‘সে’ হলো প্রকৃত আমির বিভিন্ন প্রতিভাসমাত্র।
অদ্বৈতমতে জীবের বন্ধন ও মুক্তি
অদ্বৈতমতে জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ হলেও অনাদি অবিদ্যাবশত অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয় এবং দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধ করে। জীবের এই ব্রহ্মস্বরূপত্ব বিস্মরণ ও দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে জীবের ‘অহং বোধ’ জন্মায়। জীব তখন নিজেকে সকল বস্তু থেকে পৃথক করে ক্ষুদ্র, পরিচ্ছিন্ন, সসীম সত্তার অধিকারী হয়। এই পরিচ্ছিন্ন জীবই বদ্ধ জীব। বদ্ধ জীব নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
বিদ্যার দ্বারা জীব যখন অবিদ্যাজনিত ভেদজ্ঞান দূর করে এবং দেহাদিসম্বন্ধ ছিন্ন করে, তখন সে নিজেকে ব্রহ্ম-অভিন্ন বলে জানে। নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানাকেই জীবের মুক্তি বলা হয়। অদ্বৈতমতে তাই জীবের বন্ধন ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে- আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি।

বিভিন্ন বেদান্তশাস্ত্রে নানা কাহিনীর মাধ্যমে জীবাত্মার এই দুই অবস্থা তথা আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি এরকম-
এক গর্ভবতী সিংহী একদল মেষশাবককে তাড়া করে পাহাড় থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ায় তার মৃত্যু হলো। কিন্তু ঐ সিংহীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলো এক সিংহশাবক। সিংহশাবক নিরুপায় হয়ে মেষশাবকদের দলে আশ্রয় নিলো এবং দিনে দিনে মেষশাবকদের অনুসরণে তার প্রকৃতিও মেষশাবকদের অনুরূপ হয়ে ঊঠলো। সিংহের হুংকার ভুলে তখন সে মেষশাবকদের মতো করে ডাকতে শিখলো। এ যেন জীবের আত্ম-বিস্মরণ ও বন্ধন-দশা প্রাপ্তি। পরবর্তীকালে অন্য এক সিংহ মেষশাবক শিকার করতে এসে এই সিংহশাবককে আবিষ্কার করলো। অন্যান্য মেষশাবকদের মতো সিংহশাবকও তখন সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণভয়ে পলায়মান। সিংহ সেই সিংহশাবককে ধরে তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝিয়ে দিলো। কয়েকবার চেষ্টার পর সিংহের অনুকরণে সিংহশাবকও তখন হুংকার দিয়ে উঠলো। এ যেনো গুরুর কাছ থেকে ‘তত্ত্বমসি’ বাক্য শ্রবণান্তর মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা জীবের আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধি। আত্মসাক্ষাৎকার জীবের পরম পুরুষার্থ। আত্মসাক্ষাৎকারেরই অপর নাম ব্রহ্মোপলব্ধি। তাই বেদ-বেদান্তে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ, আত্মা বা নিজেকে জানো।

উপনিষদানুসারী দর্শন হিসেবে অদ্বৈতমতানুযায়ী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই জীবের বন্ধনদশা দূর হয় এবং জীব মোক্ষলাভ করে। এজন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনকেই মোক্ষলাভের উপায় বলা হয়। যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রেই এই উপদেশ উক্ত হয়েছে-

‘…আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতাব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো মৈত্রেয়ী, আত্মনো বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।।
অর্থাৎ : মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে। অমৃতের মধুমাখা অনুভূতি নিয়ে অখণ্ড-সত্তায় তার প্রাণ ভরে উঠবে। আত্মজ্ঞান যার হয়, সবকিছুর সঙ্গে যে একাত্ম হতে পারে, তার কাছ থেকে কি অমৃত দূরে থাকতে পারে (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫) ?
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বেদান্তমতে বলা হয়ে থাকে, একমাত্র বেদান্তপাঠের অধিকারীই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের অধিকারী। তাই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের পূর্বে জীবকে বেদান্তপাঠের অধিকার অর্জন ও তার জন্য তৎকারণ বিধিপূর্বক বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন, জন্ম ও জন্মান্তরে কাম্যকর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধকর্ম পরিত্যাগ এবং কেবলমাত্র নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্ত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়াও বেদান্তের অধিকারীকে বিবেক, বৈরাগ্য, শমদমাদি ও মুমুক্ষুত্ব- এই সাধন-চতুষ্টয় অর্জন করতে হবে। এই সাধন-চতুষ্টয়-সমন্বিত ব্যক্তিই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের নিকট বেদান্তপাঠের অধিকারী। বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকরা এই যে পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, তার পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবদ্ধ’।

বেদান্তের অনুবন্ধ :
বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’।

‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রের আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত।
যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত থাকা আবশ্যক।

অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করতে হবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধনসম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।

‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।

এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।

বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।

সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।

প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।
মোক্ষ বা মুক্তির উপায় :
শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বেদান্ত-পাঠেরই ত্রি-অঙ্গ। প্রথমে আচার্যের নিকট বেদান্তপাঠ শ্রবণ, তারপর যুক্তি ও তর্কের দ্বারা আচার্যের উপদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপাদন বা মনন এবং পরিশেষে আচার্য-উপদিষ্ট তত্ত্বের নিরন্তর ধ্যান বা নিদিধ্যাসনের দ্বারা মোক্ষকামী ব্যক্তির অবিদ্যাজন্য মিথ্যাজ্ঞান বিনষ্ট হয় এবং ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি বা ব্রহ্মস্বরূপতার উপলব্ধি হয়। জীবের এই আত্মোপলব্দিই মোক্ষলাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি। অদ্বৈতমতে মোক্ষলাভ তাই জীবের পক্ষে নতুন কোন প্রাপ্তি-যোগ নয়। এ যেন নিজের হাতের মুঠোয় চাবিকাঠি রেখে সারা ঘরে চাবির অনুসন্ধান এবং অবশেষে মুঠোর ভিতর চাবির আবিষ্কার। তাই মোক্ষপ্রাপ্তি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি।

অদ্বৈতমতে বলা হয়, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। এই অধ্যাসের ফলেই জীব দুঃখাদি-জর্জরিত বদ্ধজীবন ভোগ করে। ব্রহ্ম যখন সূক্ষ্ম-শরীর, স্থূল-শরীর, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সকল উপাধির দ্বারা উপহিত (সীমিত) হন, তখনই তাকে জীব বলা হয়। সুতরাং ব্রহ্মে বিভিন্ন উপাধি আরোপের ফলেই জীবের আবির্ভাব হয়। এই আরোপ আবার অবিদ্যা-জনিত। ব্যষ্টি-অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত আত্মা ঐ সকল উপাধি-উপহিত হয়। উপাধিই জীবের দেহ, বর্ণ, জাতি ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে। অসংখ্য অন্তঃকরণ-উপহিত হয়ে একই আত্মা বহু জীবে রূপান্তরিত হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টিকে বলা হয় অন্তঃকরণ। অন্তঃকরণের ভিন্নতার দ্বারাই জীবের ভিন্নতা নির্ণীত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন জীব ভিন্ন ভিন্ন কর্মফল ভোগ করে।

উপাধি উৎপত্তি-বিনাশশীল। মৃত্যুতে জীবের স্থূলশরীর বিনষ্ট হয়। মৃত্যুর পর জীবের লিঙ্গ-শরীর বা সূক্ষ্ম-শরীর কর্মানুযায়ী বিভিন্ন লোকে গমন করে এবং ঐ কর্মানুযায়ীই পুনরায় নতুন স্থূল শরীর পরিগ্রহ করে। এরই নাম ‘পুনর্জন্ম’। সূক্ষ্ম শরীরেও জীব অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে জীবের কর্মফলও স্থূল-শরীরান্তরে গমন করে। শ্রুতিশাস্ত্রেও বলা হয়েছে-

‘…যত্রাস্য পুরুষস্য মৃতস্য অগ্নিং বাগপ্যেতি, বাতং প্রাণঃ, চক্ষুরাদিত্যং, মনশ্চন্দ্রং, দিশঃ শ্রোত্রং, পৃথিবীং শরীরং, আকাশং আত্মা, ওষধীর্লোমিনি, বনস্পতীন, কেশা, অপ্সু লোহিতং চ রেতশ্চ নিধীয়তে ক্বায়ং তদা পুরুষো ভবতীতি?… তৌ হ যদুচতুঃ কর্ম হৈব তদুচরথ। যৎ প্রশশংসতুঃ কর্ম হৈব তৎ প্রশশংসতুঃ পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি, পাপঃ পাপেনেতি।…’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৩/২/১৩)।।
অর্থাৎ : …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন?
…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।

আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তর-এ গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-

‘তে যে এবমেতদ্ বিদুর্ষে চামী অরণ্যে শ্রদ্ধাং সত্যমুপাসতে তেহর্চিরভিসংভবন্তি অর্চিষোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্যান ষণ্মাসানূদঙ্ঙাদিত্য এতি মাসেভ্যো দেবলোকং দেবলোকদাদিত্যম্ আদিত্যাৎ বৈদ্যুতং, তান্ বৈদ্যুতান্ পুরুষো মানস এত্য ব্রহ্মলোকান্ গময়তি। তে তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতো বসন্তি। তেষাং ন পুনরাবৃত্তি’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৬/২/১৫)।।
অর্থাৎ : পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাঁকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।
অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারেও মোক্ষলাভে জীবের স্থূল-শরীরের নাশ হয় এবং জন্ম-প্রবাহ রুদ্ধ হয়। জীব তখন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে লীন হয়ে নিজেকে ব্রহ্ম বলে উপলব্ধি করে (সোহহম্)।

অদ্বৈতবেদান্তমতে মুক্তি দুই ধরনের- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। এই মতে, মুক্ত অবস্থাতেও জীবের দেহ থাকতে পারে। দেহ থাকাকালীন জীবের যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অন্যদিকে, দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। জীবন্মুক্তি সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ, সাংখ্য ও জৈন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমত হয়ে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন।
আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মোপলব্ধিতে জীবের মুক্তি হয়। মুক্তিলাভকালে জীবের সঞ্চিত কর্মফল শেষ হয়ে যায়। মুক্তজীব বাসনাহীন। সুতরাং তার কর্মজন্য কোন নতুন ফলোৎপত্তির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তার প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ নাও হতে পারে। প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ না হলে সেই ফলভোগ শেষ করার জন্য মুক্ত পুরুষকে আরও কিছুকাল দেহ ধারণ করে থাকতে হয়। জীবের এইপ্রকার মুক্তিকে বলা হয় জীবন্মুক্তি।

জীবন্মুক্ত পুরুষকে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে হলেও তাঁর দেহাত্মবুদ্ধি আর থাকে না। বরং সংসারের মায়ায় তিনি আর আবদ্ধ হন না। তিনি অনাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে জীবনযাপন করেন এবং বদ্ধজীবের হিতার্থে নিষ্কাম কর্ম করেন। মুক্তপুরুষের কাছে কর্মের সৎ-অসৎ বা পাপ-পুণ্যের ভেদ থাকে না। রাগ-দ্বেষ থেকেই অসৎ বা পাপকর্মের উৎপত্তি হয়। মুক্ত পুরুষ রাগ-দ্বেষহীন। তাই মুক্ত পুরুষের পক্ষে কোন অসৎ বা পাপকর্ম করার প্রশ্নই নেই। প্রারব্ধ কর্মফল নিঃশেষিত হলে মুক্ত পুরুষের স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুরুষ বিদেহমুক্তি লাভ করে।

অদ্বৈতমতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপ হলো ব্রহ্মসাযুজ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হয়ে যাওয়া। উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, ‘আমিই ব্রহ্ম’ এই উপলব্ধির সাথে লীন হয়ে যাওয়া। এটাই জীবন্মুক্ত অবস্থা। কিন্তু বেদান্তের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ অবশ্য জীবের জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন নি। তিনি বিদেহমুক্তির সমর্থক। তাঁর কাছে মুক্তির অর্থ ব্রহ্মস্বারূপ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সদৃশ হওয়া। ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হওয়া নয়।
অদ্বৈত জ্ঞানতত্ত্ব
যথার্থ জ্ঞান বুদ্ধির অধীন নয় বস্তুর অধীন, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান বস্তুর অধীন। যে বস্তু যেমন, সেরূপ জ্ঞানই তত্ত্বজ্ঞান। অদ্বৈতমতে পরমাত্মা ব্রহ্মই হলো নিত্য, আর জগৎ অনিত্য। একমাত্র ব্রহ্মেরই পারমার্থিক সত্তা আছে এবং পরাবিদ্যার সাহায্যেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। ব্রহ্মজ্ঞানই সত্যজ্ঞান বা পরাবিদ্যা। এ জ্ঞান নিরপেক্ষ জ্ঞান যাকে অনুভব করা যায়। বিচারবুদ্ধি অনুভবের একটি উপায়।

অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবক্তা আচার্য শঙ্কর তাঁর শারীরকভাষ্যে পারমার্থিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে অবিদ্যার জন্যই জীব অনাত্মাকে আত্মার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। অবিদ্যা হলো ব্যবহারিক জ্ঞান। অবিদ্যায় জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার পারস্পরিক ভেদ বর্তমান থাকে। শঙ্করের মতে ব্রহ্মেরই একমাত্র সত্তা আছে, ব্রহ্মের বাহিরে বা ভেতরে ব্রহ্ম ছাড়া আর কোন সত্তা নেই। ব্রহ্মের কোন প্রকার ভেদ নেই। পরাবিদ্যা সব রকমের ভেদরহিত জ্ঞান এবং নিরপেক্ষ জ্ঞান। আর অপরাবিদ্যা আপেক্ষিক জ্ঞান হলেও শঙ্করের মতে এ জ্ঞান পরাবিদ্যা বা অনপেক্ষ জ্ঞান লাভের সোপান স্বরূপ।

এই মতে, শ্রুতি থেকে ব্রহ্মের জ্ঞান হয়, তারপর যুক্তি-তর্কের সাহায্যে তার যৌক্তিকতা উপলব্ধ হয় এবং সর্বশেষ অনুভবের মাধ্যমে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হয়। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন হলো তিনটি উপায়। শ্রুতি ছাড়া অন্য কোন কিছু থেকে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান লাভ হয় না। শ্রুতির প্রামাণ্য নিরপেক্ষ। বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণও বলেছেন-

‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩)
ভাবার্থ : শাস্ত্ররাশিই হলো ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের উপায়।

শ্রুতিলব্ধ জ্ঞানের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করার জন্য যুক্তি-তর্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শ্রুতির কথায় বিশ্বাস না থাকলে কেবলমাত্র যুক্তি-তর্কের দ্বারা আত্মোপলব্ধি হয় না। যে তর্ক শ্রুতির অনুগামী, সেই তর্কই গ্রহণযোগ্য। যেহেতু মানুষের বুদ্ধি এক প্রকার নয় সেজন্য তর্ক বিভিন্নরূপের হয়। একজন তার্কিক তাঁর তর্কক্ষমতা দ্বারা কোন তত্ত্বকে সিদ্ধ করতে পারেন, আবার তাঁর চেয়েও যুক্তিকুশল ব্যক্তি অধিকতর দক্ষতায় সেটার ত্রুটি প্রমাণ করে নিজ মতকে সিদ্ধ করতে পারেন। অতএব যুক্তি-তর্কের দ্বারা আমরা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না, কেবলমাত্র শ্রুতি বা উপনিষদ থেকেই আমরা সত্যকে প্রাপ্ত হতে পারি। যুক্তি তর্ককে আমরা শুধুমাত্র উপনিষদের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করতে পারি। শঙ্করের মতে তর্ক যেহেতু অপ্রতিষ্ঠা দোষে দূষিত সেজন্য তর্কের উপর নির্ভর করে শাস্ত্রের অর্থ নির্ণয় করা যুক্তিসঙ্গত নয়। বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণও বলেছেন-

‘তর্ক অপ্রতিষ্ঠানাৎ অপি, অন্যথা অনুমেয়ম্ ইতি চেৎ, এবং অপি অবিমোক্ষপ্রসঙ্গঃ’। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১১)
ভাবার্থ : তর্ক অপ্রতিষ্ঠ; অতএব শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মের কারণত্ববাদ কেবলমাত্র তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা চলে না।
বেদান্ত-সিদ্ধান্তের সত্যতা তর্ক বা যুক্তিনির্ভর তো নয়ই বরং উপনিষদ প্রতিপাদিত। বেদ নিত্য, তাই বেদ থেকে প্রাপ্ত অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কালই এক। শাস্ত্র মতে তর্কের দ্বারা সগুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লব্ধ করা যাবে, কিন্তু পরব্রহ্মের বা নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করা যায় না। তাই শঙ্করের মতে শ্রুতি বা শব্দই স্বত প্রমাণ। অন্যান্য প্রত্যক্ষ, অনুমানাদি প্রমাণসমূহ শব্দের (=বেদ) করুণা দ্বারাই প্রমাণিত হতে পারে। অতএব, প্রমাণ সম্পর্কে শঙ্করের ব্যাখ্যা জৈমিনি তথা ভাট্ট-মীমাংসকদের মতবাদেরই অনুরূপ।
প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায়। শঙ্কর ছয় প্রকার প্রমাণ স্বীকার করেন, যেমন- প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি।

কোন সৎ বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে যে জ্ঞান হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কোন জ্ঞান বিষয়ের উপরের নির্ভর করে এবং তার দ্বারা সমর্থিত হয়ে যদি কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় তাকে অনুমান বলে। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন হলো শব্দ এবং এই বচনের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ হয় তাকে শব্দজ্ঞান বলে। সংজ্ঞা ও সংজ্ঞীর যে জ্ঞান তাই উপমান। নৈয়ায়িক ও মীমাংসকরা উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। কোন বিষয়কে যখন জ্ঞাত কোন কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না তখন অন্য কোন অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করা হয়, এই অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করার নাম অর্থাপত্তি। কোন বস্তুর অভাবের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুপলব্ধি নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণকে শঙ্করাচার্য স্বীকার করেন। তবে অদ্বৈতমতে সকল প্রমাণের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলো শব্দ প্রমাণ, এবং শব্দই স্বত প্রমাণ।

সত্যতা :
যে জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না তাই সত্য। তখন অদ্বয় অর্থাৎ অদ্বিতীয় আত্মজ্ঞান লাভ হয়। শঙ্করের মতে সত্যতা নির্ণয় করার মূল উপায় হলো আধিতত্ত্ব বা অবিরুদ্ধতা। অদ্বয়জ্ঞান যথার্থ, কারণ এ জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয় না। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে সঙ্গতি হলো সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। শঙ্করও এই অভিমত সমর্থন করেন। তাঁর মতে সঙ্গতি ছাড়াও অনুরূপতা এবং প্রবৃত্তি সামর্থও সত্যতা নিরূপণের উপায়। অনুরূপতা অর্থাৎ যখন কোন ধারণা বস্তুর অনুরূপ হয় তখন ধারণা সত্য হয়, এটাও ব্যবহারিক সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। প্রবৃত্তি সামর্থ্য অর্থাৎ যখন ধারণা সফল প্রবৃত্তির কারণ হয় তখন ধারণা সত্য হয়।

ভ্রম :
অদ্বৈতবেদান্ত মতে ভ্রমের কারণ হলো অবিদ্যা। ব্রহ্মে জগৎ ভ্রমেরও কারণ হলো অবিদ্যা। ভ্রম সম্পর্কে অদ্বৈতবাদীদের মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায় ভ্রমের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা শঙ্কর স্বীকার করেন না।

মীমাংসকরা প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ভ্রমের সম্ভাবনাকে মোটেই স্বীকার করেন নি। তাঁরা সব জ্ঞান, বিশেষ করে অপরোক্ষ জ্ঞানকে সত্য বলে মনে করেন। তাঁদের এই মত যথার্থ বলে স্বীকার করলে অদ্বৈতমতে দেয়া জগৎ ব্যাখ্যার কোন যুক্তি থাকে না। মীমাংসামতে রজ্জুতে যে সর্পভ্রম হয় সেখানে প্রত্যক্ষ এবং স্মৃতির মিশ্রণ ঘটে এবং দুটির মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন আমরা রজ্জু প্রত্যক্ষ করি, যে রজ্জুর অস্তিত্ব আছে। তার সাথে সর্পের স্মৃতি মনে জাগরিত হয়। কারণ সর্পের সঙ্গে রজ্জুর সাদৃশ্য আছে। রজ্জুর প্রত্যক্ষ এবং সর্পের স্মৃতি দুটোর যে পার্থক্য বা বিবেকের অখ্যাতি তা ভ্রম সৃষ্টি করে।

আবার নৈয়ায়িকদের ন্যায়মতে ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ। তাদের মতে ভ্রমের ক্ষেত্রে একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। যখন রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটে তখন রজ্জু অন্য বস্তুরূপে দৃষ্ট হয়। অদ্বৈতবেদান্তীরা এই মত গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন না। বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা আত্মখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। তাঁদের মতে ভ্রমে মনের ধারণা বাহ্যবস্তু হিসেবে দৃষ্ট হয়। রজ্জুতে সর্পভ্রম একটি নিছক মনের ধারণা। সে জন্য সর্পকে অস্তিত্বশীল বাহ্যবস্তু হিসেবে দেখা যায়। এক্ষেত্রে বেদান্তীরা মনে করেন, ভ্রমের ক্ষেত্রে যদি কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা না যায় তাহলে রজ্জুতে সর্পভ্রম না হয়ে যে কোন ভ্রম ঘটতে পারতো। অদ্বৈতমতে ব্রহ্মই জগৎভ্রম হয়।

অদ্বৈতবাদীদের ভ্রম সম্পর্কিত মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ অনুসারে, ভ্রমজ্ঞানকে সৎও বলা যায় না, অসৎও বলা যায় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন সর্পকে অসৎ বলা যায় না, কারণ সর্প অসৎ হলে সর্পকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সর্পকে সৎও বলা যায় না, কারণ পরে রজ্জুজ্ঞান দ্বারা সর্পজ্ঞান বাধিত হয়। আবার সর্পকে সদসৎও বলা যায় না, কারণ সৎ এবং অসৎ পরস্পরবিরোধী, তাই সৎ ও অসৎ কারো ক্ষেত্রে একই সময়ে একই অর্থে সত্য হতে পারে না। কাজেই অদ্বৈতমতে সর্প অনির্বচনীয়। এই অনির্বচনীয় সর্প প্রাতিভাসিক। যতক্ষণ পর্যন্ত রজ্জুর জ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্তই সর্প ভ্রান্তদর্শীর দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। ভ্রম দূর হলে সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না।

অদ্বৈতমতে জগতের যাবতীয় বস্তুই চৈতন্যে অধিষ্ঠিত। রজ্জু যে চৈতন্যে অধিষ্ঠিত সেই চৈতন্যে আশ্রিত অবিদ্যার তমোভাগ থেকে অনির্বচনীয় সর্পের উৎপত্তি। কাজেই অদ্বৈতবেদান্ত মতে সর্প অনির্বচনীয়। অবিদ্যার জন্যই রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়। একইভাবে ব্রহ্মে জগৎভ্রম এই অবিদ্যার জন্যই হয়ে থাকে। অবিদ্যা অপসারিত হলেই একই অদ্বয় ব্রহ্মের উপলব্ধি ঘটে।

ক সময় জৈনগন বেদের অর্থ না বুঝিয়া ভ্রান্ত হইয়া বেদের নিন্দা করতে শুরু করে। বেদের পঠন পাঠন ও যজ্ঞোপবীতাদি এবং ব্রহ্মচর্য্যাদি নিয়মেরও নাশ করিতে লাগিল এবং নানা স্থানে বেদাদি সম্বন্ধীয় পুস্তু যা প্রাপ্ত হইল তৎসমস্ত নষ্ট করিয়া আর্য্যদিগের উপর অত্যন্ত প্রভুত্ব করিতে এবং দুঃখ দিতে শুরু করেছিল। যখন আর উহাদের অন্য কাহারও নিকট ভয় রহিল না তখন আপনাদিগের মতালম্বী গৃহস্থ এবং সাধুদিগের প্রতিষ্ঠা করতে লাগিল এবং বেদমার্গীদিগকে আপমান করিতে এবং পক্ষপাত পূর্ব্বক দন্ডও দিতে আরম্ভ করিল এবং নিজেরা সুখে স্বচ্ছন্দে এবং দর্পে স্ফীত হইয়া বেড়াইতে লাগিল।ঋষভ দেব হইতে মহাবীর পর্য্যন্ত ইহারা নিজেদের তীর্থঙ্করদিগের বৃহৎ বৃহৎ মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়া পূজা করিতে লাগিয়াছিল। এবংএই জৈনগণ হইতেই ব্যাপক হারে পাষাণাদি মূর্ত্তি পূজার মূল আরম্ভ হয়েছিল। এই রূপ তিনশত বৎসর আর্য্যাবর্ত্তে জৈন দিগের রাজত্ব রহিল এবং বদার্থজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হইয়া তিয়েছিল। অনুমানানুসারে প্রায় সার্দ্ধ দ্বিসহস্র বৎসর অতীত হইল যখন এই সকল ঘটনা ঘটিয়া ছিল।
দ্বাবিংশ শত বর্ষ অতীত হইল দ্রাবিড় দেশোৎপন্ন শঙ্করাচার্য্য নামক এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা ব্যাকরণাদি সমস্ত শাস্ত্র পাঠ করতঃ জৈন মতের পরিবর্তে পুনরায় বৈদিক মত প্রচলেনর চিন্তা করেন। মহোদয় শঙ্করাচার্য্য নানা শাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন এবং জৈন মতেরও গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন।
শাস্ত্রার্থ দ্বারা সকল লোক কে পরাস্ত করে বৈদিক মতের পুনঃ প্রতিষ্ঠার বিচার করিয়া তিনি উজ্জয়িনী নগরীতে তৎকালিন স্বধন্বা নামক রাজা যিনি জৈন দিগের গ্রন্থ এবং কিছু সংস্কৃতও পাঠ করিয়াছিলেন।তথায় উপস্থিত হইয়া শঙ্করাচার্য্য বেদের উপদেশ দিতেলাগিলেন এবং রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কহিলেন যে আপনি সংস্কৃত এবং জৈন দিগের গ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন এবং জৈন মত  বিশ্বাস ও করেন। এই জন্য আপনাকে নিবেদন করিতেছি যে আপনি আমাকে জৈন পন্ডিদিগের সহিত শাস্ত্রার্থ ও বিচার করান্।এই প্রতিজ্ঞা থাকিবে যে,যে জন পরাজিত হইবে সে জয়কর্ত্তার মত স্বীকার করয়া লইবে এবং স্বয়ং ঐক্ত জয়কর্ত্তার মতালম্বী হইবে। রাজা সুধম্বা তাই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন,তিনি জৈন পন্ডিদিগকে বহু দূর হইতে আহ্বান করিয়া এক সভা করাইয়াছিলেন। শঙ্করাচার্য্যের পক্ষে বেদমত স্থাপন ও জৈনমত খন্ডন বিষয় ছিল এবং জৈনদিগের পক্ষে তা বিপরীত ছিল। জৈন দিগের প্রাকশিত মত এইরূপ ছিলযে সৃষ্টিকর্ত্তা অনাদি ঈশ্বর কেহ নাই,এই জগৎ এবং জীব অনাদি এবং এই উভয়ের উৎপত্তি এবং নাশ কখন হয় না।
শঙ্করাচার্য্যেরমত ইহার বিরুদ্ধ ছিল। তিনি বলিলেন যে অনাদি নিত্য পর।আত্মাই জগতের কর্ত্তা এই জগৎ এবং জীব মিথ্যা,কারণ উক্ত পরমেশ্বর আপনার মায়া হইতে জগতের নির্ম্মান ধারণ এবং প্রলয় করিয়া থাকেন এবং এই (জগৎ) প্রপঞ্চ ও জীব স্বপ্নবৎ মাত্র। পরমেশ্বর স্বয়ংই সমস্ত জগৎরূপ হইয়া লীলা বিস্তার করিতেছেন । বহুদিন যাবৎ শাস্ত্রার্থ বিচার হইতে লাগিল পরন্তু অবশেষে যুক্তি এবং প্রমাণবলে জৈনদিগের মত খন্ডিত হইল এবং শঙ্করাচার্য্যের মত অখন্ডিত রহিল। তখন উক্ত জৈন পন্ডিতগণ এবং রাজা সুধন্বা বেদমত স্বীকার করিয়া লইলেন এবং জনমত ত্যাগ করিলেন।
পরে দশ বছর সুধন্বা প্রভৃতি রাজাগণ আর্ষ্যাবর্ত্তের পরিভ্রমান করিয়া শঙ্করাচার্যের মত প্রচার করেন।উক্ত সময় থেকে পুনরায় যজ্ঞোপবীত হইতে লাগিল এবং বেদ সকলের পঠন ও পাঠনা চলিতেলাগিল। শঙ্করের সময়েই জৈন প্রধ্বংস হয়; অর্থাৎ(আজকাল) যত (ভগ্ন)জৈনমূর্ত্তি পাওয়া যাইতেছে তংসমস্ত সেই সময় ভগ্ন করা হইয়াছিল।
উক্ত সময়ে এই দেশে প্রভুত ধন ছিল এবং স্বদেশ ভক্তিও অতিশয় প্রগাঢ় ছিল। শঙ্করাচার্য্য এবং সুধম্বা রাজা জৈনদিগের মন্দির ভগ্ন করেন নাই,কারন তাঁহাদের ইচ্ছা ছিল যে উক্ত মন্দিরে বেদাদি অধ্যয়নের জন্য পাঠশালা স্থাপন করিবেন।দুইজন জৈন বারহ্য কপট মুনি ছিল কেবল বেদমতালম্বী কিন্তু অন্তরে কঠোর জৈনমতবিশ্বাসী ছিল। উহারা অবসর পাইয়া শঙ্করাচার্য্যকে এরূপ বিষাক্ত পদার্থ ভোজন করাইল যে তাঁহার ক্ষুধামান্দ্য হইল এবং শরীরে ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ বিস্ফোটক নির্গত হইয়া ছয় মাসের মধ্যেই তাঁহার দেহান্ত হইয়াছিল। ফলে বিদ্যা প্রচারের যে ব্যবস্থা ছিল তাহা বন্ধ হইয়া গেল। শঙ্করাচার্য্য শারীরিক ভাষ্যাদি যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন তাহা তাঁহার শিষ্যেরা প্রচার করিতে লাগিল, অর্থাৎ জৈন মত খন্ডনের জন্য ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও বহ্মের একতা যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন তাহার উপদেশ দিতে লাগিলেন। শঙ্করাচার্য্যের পর তঁহার শিষ্যগনের অতিশয় প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। নিজেরা শঙ্করাচার্য্যের নামে শাস্ত্র গ্রন্থের ভাষ্য করতে শুরু করেছিল। নানান গ্রন্থের অর্থ না বুঝে ভুল ভাষ্য নিজেরা করেছিল । পরে দক্ষিণে শৃঙ্গেরী, পূ্ব্বে ভগোর্বদ্ধন, উত্তরে জোসী এবং দ্বারিকায় সারদা মঠ স্থাপন করিয়া শঙ্করাচার্য্যের শিষ্যগণ মোহস্ত হইয়া এবং সম্পন্ন হইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। 
শঙ্কর আচার্যের বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য থেকেই এই "অদ্বৈতবাদ" বা "মায়াবাদের" উৎপত্তি হয়েছে । এই অদ্বৈতবাদ অনুযায়ী শঙ্করাচার্যের মত ছিল -
"অনাদি সিদ্ধি পরমাত্মাই জগতের কর্তা , জগৎ মিথ্যা ও জীব মিথ্যা । সেই পরমেশ্বর নিজ মায়া দ্বারা জগৎ নির্মাণ করেছেন , তিঁনিই ধারণ এবং প্রলয় কর্তা । আর এই জীবও প্রপঞ্চ স্বপ্নবৎ মিথ্যা । পরমেশ্বর স্বয়ং এই সকল লীলা করছেন ।"
এই মতবাদ অনুযায়ী এই জগৎ হলো স্বপ্নের মতো মিথ্যা , রজ্জুতে সর্প আদির মতো । মানে মায়াবাদ অনুযায়ী একমাত্র পরমাত্মা সত্য বাদবাকি সবকিছুই ভ্রম , যেমন স্বপ্নতে অনেক কিছুই দেখি তারপর জাগ্রত হওয়ার পর যেমন মনে হয় স্বপ্নের দৃশ্য গুলো মিথ্যা ছিল , তারপর রজ্জুতে সর্প অর্থাৎ দড়ি কে যেমন মাঝে মাঝে ভুল করে সাপ ভেবে ফেলি ঠিক এমনই হলো জগৎ মিথ্যা মায়াবাদ অনুযায়ী ।
হাজারও বছর পর সর্বপ্রথম এই বেদ বিরোধী অদ্বৈতবাদকে খণ্ডন করেন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী । সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে ১১ সমুল্লাস এবং ৮ সমুল্লাসে ।
এইবার একটু আলোচনা করে দেখি এই মায়াবাদ কতটা যুক্তি-তর্কসঙ্গত এবং শাস্ত্র অনুকূল । বেদান্ত দর্শন বা ব্রহ্মসূত্রের প্রথম দুই সূত্র দ্বারাই অদ্বৈতবাদের ধারণা খণ্ডন হয়ে যায় , দেখুন -
ব্রহ্মসূত্র ১/১/১ - অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা = এখন ব্রহ্ম কে জানার ইচ্ছা করি ।
অর্থাৎ এখানে ব্রহ্ম কে জানার কথা বলছে সেই ব্রহ্ম কে বা কেমন ? এখন পরের ২য় সূত্রে মহর্ষি ব্যাস জী লিখেছে -
ব্রহ্মসূত্র ১/১/২ - জন্মাদ্যস্য য়তঃ = এই সমস্ত সংসারের জন্ম , স্থিতি তথা প্রলয় যার দ্বারা হয় , তিনিই ব্রহ্ম ।
অর্থাৎ যিনি এই জগতের সৃষ্টি , স্থিতি এবং প্রলয় করেন তিনিই "ব্রহ্ম" বা "পরমাত্মা"।
এই একই কথা ঋগ্বেদে - ১০/১২৯/৭ মন্ত্রেও বলা আছে । এইবার একটু বিচার করে দেখুন যে - জগতের সৃষ্টি হয় আবার স্থিতিতে থাকে আবার সময় মত ধ্বংসও হয় , সেই জগৎকে যদি কেউ যদি মিথ্যা বলে তাহলে সেই কথা পাগলামি ছাড়া আর কি হতে পারে !
অদ্বৈতবাদীরা উদাহরণ দেয় যে - "জগৎ স্বপ্নের মতো মিথ্যা" । তাহলে আমার প্রশ্ন হল যে - আমরা স্বপ্নে যা দেখি তা কি বাস্তবে কখনোই দেখিনি বা সেই সম্পর্কে কি কখনোই কোনো জ্ঞান হয়নি ?
আমরা যে বিষয়ে স্বপ্ন দেখি , সে বিষয় অবশ্যই আমাদের জ্ঞাত বিষয় । স্বপ্ন যদিও ভেঙে গেলে মনে হয় যে স্বপ্নের দৃশ্য গুলো মিথ্যা ছিল কিন্তু স্বপ্নে যে বস্তুর বিষয়ে দেখা হয় তা কিন্তু বাস্তবে এক সময় বিদ্যমান ছিল বা এখনো আছে ।
ধরুন আজ আমি স্বপ্ন দেখলাম যে - আমি আমেরিকায় গেছি , কাশ্মীরেও গেছি , সেখানে ঘুরছি মজা করছি , তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আর আমার জ্ঞান হলো যে - আমি বাড়িতেই আছি কোথাও যাইনি , তাহলে স্বপ্নে দেখা আমেরিকা , কাশ্মীরে যাওয়ার দৃশ্যটি মিথ্যা । কিন্তু তার মানে কি এই যে - আমেরিকা এবং কাশ্মীর বলে কোনো জায়গাই নেই ? বা এর মানে কি এই যে - আমেরিকা , কাশ্মীর বলে কিছু ছিলই না ?
তাই স্বপ্নের সাথে ওই জগৎ মিথ্যা এই উদাহরণটি সম্পূর্ণই যুক্তিহীন ।
মায়াবাদীরা আবার যুক্তি দেয় যে - রজ্জুতে সর্প , এর তাৎপর্য এই যে - যেমন মাঝে মাঝে আমরা দড়িকে ভ্রমের কারণে সাপ মনে করি ঠিক তেমনই এই জগৎ মিথ্যে মায়াবাদীদের মতে । এই উদাহরণও যে অযৌক্তিক তা এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে !
দেখুন এটা অবশ্যই ঠিক যে দড়িকে আমরা মাঝে মাঝে ভ্রমের কারণে সাপ ভাবি , কিন্তু সাপ কি কোনো বস্তু নয় ? দড়ি টি সাপ নয় কিন্তু অন্য কোথাও কি সাপ নেই ? বাস্তবে সাপ আছে এবং সাপের বিষয়ে জ্ঞান হয়েছে বলেই আমরা দড়ি কে ভ্রমের কারণে সাপ ভাবি । এই বিষয়টি সকলের জানা উচিত যে বস্তু বা যে পদার্থের কোনো অস্তিত্বই নেই সেই বিষয়ে কখনোই জ্ঞান হয়না ।
এই জগৎ অবশ্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্মের মতো নিত্য নয় কিন্তু মিথ্যাও নয় । কারণ এই জগৎ তৈরি হয়েছে "সত্ত্ব" , "রজ" এবং "তম" তিন গুণের প্রকৃতি নামক উপাদান দ্বারা । এই প্রকৃতি পরমাত্মার মতো নিত্য সত্ত্বা । বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী তিনটি সত্ত্বাকে অনাদি বা সনাতন বা অজন্মা বলা হয়েছে -
১ ) পরমাত্মা : যিনি এই সংসারের নির্মাণ কর্তা অর্থাৎ পরমাত্মা হলেন নিমিত্ত কারণ ।
২ ) প্রকৃতি : এই প্রকৃতি হলো জগতের উপাদান কারণ ।
৩ ) জীবাত্মা : এই জীবাত্মা হল সাধারণ কারণ ।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪ অধ্যায় ৫ শ্লোকে বলা হয়েছে - " 'সত্ত্ব' , 'রজ' , 'তম' গুণের প্রকৃতি , জীবাত্মা এবং পরমাত্মা হলো 'অজ' অর্থাৎ 'অজন্মা' বা 'জন্মরহিত' আর এই অজন্মা প্রকৃতিকে জীবাত্মা ভোগ করে ।"
যেখানে প্রকৃতি এবং জীবাত্মাকে "অজ" অর্থাৎ জন্মরহিত বলা হয়েছে , সেখানে 'প্রকৃতি' নামক উপাদান দ্বারা তৈরি জগৎকে যদি কোনো মায়াবাদীরা মিথ্যা বলে দাবি করেন তাহলে সেটা তাদের অজ্ঞানতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয় ।
এই একই ধরণের বিষয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণও গীতার ১৩/২০ শ্লোকে বলেছেন - "পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মা এবং প্রকৃতি এই দুই হলো অনাদি"। কৃষ্ণজী এখানে আরও বলেছেন - যে পরিমাণ , বিকার এবং সত্ত্ব আদি যে গুণ আছে তা প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন হয় ।
কৃষ্ণজী আবার ১৩/২১ শ্লোকে বলেছেন যে - কার্য-কারণ উৎপন্নের কারণ প্রকৃতি , আর এই প্রকৃতিই জীবের সুখ দুঃখ ভোগের কারণ ।
মহর্ষি কপিলের লিখা সাংখ্য দর্শনে এই বিষয়কে আরও সুন্দর করে স্থাপন করেছেন ।
সাংখ্যদর্শন ১/৬১ , ৬২ , ৬৩ , ৬৪ , ৬৫ , ৬৬ , ৬৭ সূত্র এবং আরও অন্যান্য সূত্রে আছে যেখানে প্রকৃতি উপাদান হতে জগৎ সৃষ্টির বর্ণনা করা হয়েছে ।

এক্ষণে ইহা বিচার করিয়া বুঝা উচিত যে জীব ও ব্রহ্মের একতা এবং জগৎ মিথ্যা ইত্যাদিরূপ যে শঙ্করাচার্য্যের মত ছিল তাহা উৎকৃষ্ট মত নহে। তবে যদি তিনি জৈন মত খন্ডনের নিমিত্ত উক্ত মত স্বীকার করিয়া থাকেন তবে অপেক্ষাকৃত ভাল বলিতে হইবে।

••• অদ্বৈতবাদ সমীক্ষা •••
এই সংসারে যেখানে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন মত আদি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, সেখানে কিছু আধ্যাত্মবাদী মনে করেন যে এই সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে কেবলমাত্র ঈশ্বর তত্বের অস্তিত্বই রয়েছে, জীব ও প্রকৃতি আদির কোনো অস্তিত্ব নেই। এইরূপ ভাবনা মধ্যাকালে অনেক আচার্যদের ছিল। এই আচার্যদের মধ্যে আদ্য শঙ্করাচার্যকে প্রমুখ স্থান দেওয়া হয়ে থাকে। অদ্বৈতবাদের আধার মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বাদরায়ণ ব্যাস (মহর্ষি বেদব্যাস) এর ব্রহ্মসূত্র নামক মহত্বপূর্ণ গ্রন্থকে মানা হয়। এই মত বিশ্বের অনেক বৈদিক ও অবৈদিক কিংবা ভারতীয় ও বিদেশী মত মতান্তরদের প্রভাবিত করতো ও করছে। আমরা এসবের আলোচনা না করে কেবল এই বিষয়টির উপর বিচার করবো যে, এই মতটি কেন বেদ বিরুদ্ধ, স্বয়ং ব্রহ্মসূত্রেরও বিরুদ্ধ তথা বিজ্ঞান এবং যুক্তিরও বিরুদ্ধ? ব্রহ্মসূত্রের প্রথম দুটি সূত্র দ্বারাই অদ্বৈতবাদ খণ্ডিত হয়ে যায়। সেই সূত্র দুটি হল এই রকম -
"অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা" (ব্র০সূ০ ১|১|১)
"জন্মাষস্য য়তঃ" (ব্র০সূ০ ১|১|২)
এই দুটি সূত্র দ্বারা ব্রহ্ম বিষয়ক চর্চা প্রারম্ভ করার সঙ্গে বলা হয়েছে -
"এখন আমি ব্রহ্মকে জানার ইচ্ছা করছি। সেই ব্রহ্ম কিরকম এবং কে তিনি? এটা বলার সঙ্গে বলছেন যে যার দ্বারা জগতের জন্মাদি (জন্ম, স্থিতি ও প্রলয়াদি) হয়।"
একটু ভাবুন যে, যেই জগতের জন্ম হয়, তাতে স্থিতি হয় তথা সঠিক সময়ে ব্রহ্ম তার প্রলয়ও করে, সেই জগৎ কখনও মিথ্যা হতে পারে না। জানি না কেন, এই ব্রহ্ম প্রতিপাদক মহান গ্রন্থের আধারে ব্রহ্মের অতিরিক্ত অন্য সকল পদার্থের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়ে থাকে। আবার অন্যদিকে এই গ্রন্থটি তার প্রারম্ভেই জগতের সকল পদার্থের বাস্তবিকতাকে প্রতিপাদিত করছে। এই বিষয়টি পৃথক্ যে জগৎ ব্রহ্মের মতো নিত্য নয় কিন্তু জগৎ মিথ্যাও (অবাস্তবিকও) নয়। এখানে জীব ও প্রকৃতি রূপী মূল উপাদান কারণের অস্তিত্বেরও নিষেধ নেই। ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থের বিষয়ে এটা বড় ভারী ভ্রান্তি হয়েছে, এবং হচ্ছে। আমি "ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ওন্ বৈদিক সাইন্সেস" ব্যাঙ্গালোরে আগস্ট ২০০৪ এ অনেক বৈদিক বিদ্বানদের তথা বর্তমান ভৌতিক শাস্ত্রীদের ব্রহ্মসূত্রের মিথ্যা ব্যাখ্যা করতে দেখেছি। অদ্বৈতবাদের শাস্ত্রীয় সমীক্ষা হেতু পাঠকদের মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী রচিত "সত্যার্থ প্রকাশ" নামক ক্রান্তিকারী গ্রন্থ অবশ্যই পড়া উচিত। আমি এখানে তার পিষ্ঠপেষণ করাটা আবশ্যক বলে মনে করি না, বরং আমি এখানে বর্তমান বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে অদ্বৈতবাদের পুষ্টির প্রয়াসের সমীক্ষা অবশ্যই করবো। এই পক্ষের বিদ্বান সর্বপ্রথম আধুনিক বিজ্ঞানের পদার্থ দ্রব্য ও ঊর্জার পারস্পরিক রুপান্তরণের চর্চা করে অন্তিমে এই উভয়কে চেতন ঊর্জাতে পরিবর্তনীয় ও তারথেকে উৎপন্ন সিদ্ধ করে। সামান্যতঃ এই বিচারটি বৈজ্ঞানিক সত্যই মনে হয় কিন্তু এটির উপর বিশেষ চিন্তন করলে পরে এটির অসারতা স্পষ্ট হয়ে যায়। সর্বপ্রথম এই বিষয়টির উপর বিচার করুন যে, পরিবর্তনীয় তত্বটি কে কে হতে পারে? স্পষ্টতঃ যে পদার্থটি বিকারী হয়, সেটাই বিকারে প্রাপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হবে। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, বিকারী পদার্থটি কি ও কিরকম হয়? আমার দৃষ্টিতে বিকারী পদার্থটি জড়ই হতে পারে। যদি এক-একটি সূক্ষ্ম কণা বা ক্বাণ্টাকে জড়ের স্থানে চেতন মানা হয়, তাহলে প্রশ্ন এটা দাঁড়াবে যে, প্রত্যেক কণা বা ক্বাণ্টার চেতনা কি পৃথক্-পৃথক্ বা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের চেতনা কি একটাই? যদি প্রত্যেক কণার চেতনা পৃথক্-পৃথক্ হয়, তাহলে কিভাবে সারা ব্রহ্মাণ্ডের সম্পূর্ণ পদার্থকে এক প্রকারের নিয়মে বাঁধা দেখা যায়? যেভাবে প্রত্যেক প্রাণীর ঈচ্ছিক ক্রিয়া, বিচার, সংস্কার ভিন্ন-ভিন্ন হয়ে থাকে, সেইভাবে প্রত্যেক কণা ও ক্বাণ্টাকে যদি চেতন মানা হয়, তবে তাদের ক্রিয়া যে পরস্পর সমানই হবে, এমনটা আবশ্যক নয়। তারা পরস্পর সঙ্গত থাকুক বা না থাকুক সেটাও আবশ্যক নয়। প্রত্যেক কণার পৃথক্-পৃথক্ চেতন সত্তা হওয়ার পরেও তারা পরস্পর মিলে এই সৃষ্টির রচনা হেতু পরস্পর নিজের নানা সমুহ বানাতে পারে আর সম্পূর্ণ সৃষ্টির অসংখ্য নিয়মকেও বানাতে পারে, এটা সর্বথা অসম্ভব। এমনটা কোনো প্রাণীও করতে পারবে না। সর্বাধিক বুদ্ধিমান প্রাণী যাকে মানব বলে সেই প্রাণী মনুষ্য নিজের সমাজের নির্মাণ করে কিন্তু সেই সমাজের গঠন এরকম জটিল হয় না, যেমনটা বিভিন্ন জড় পদার্থের মধ্যে সেই পদার্থের অবয়বভূত সূক্ষ্মকণা বা ক্বাণ্টাজ নির্মিত করে। বিভিন্ন প্রাণী তাদের সামাজিক কাঠামোকে সময়ে-সময়ে নিজের-নিজের রুচি ও স্বভাব-সংস্কারের অনুসারে বদলাতে থাকে কিন্তু বিভিন্ন কণা বা ক্বাণ্টাজের নিয়মে কখনও পরিবর্তন হয় না।

অদ্বৈতবাদের তত্ত্ব হল ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। (১) ব্রহ্মা সত্যং মিথ্যা এটি বেদান্তের মূল তত্ত্ব। আচার্য শঙ্কর বলতেন______ অর্দ্ধ শ্লোকে প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ_____ কোটি কোটি গ্রন্থে যা লেখা আছে তা আধখানা শ্লোকে আমি বলছি,

ব্ৰহ্ম সত্যং জগমিথ্যা কীবো ব্রহ্মৈার নাপরঃ। 

ইসমের ভূ সজ্জাত্রমিতি বেদান্ত ডিত্তিমা। ২১ (ব্রহ্ম জ্ঞানী মালা)


এই শ্লোকের সরল অর্থ______ ব্রহ্মা সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মস্বরূপ, ব্রহ্ম হতে জীব ও জগতের পৃথক কোন কথা নাই। এই হল সমস্ত কোত্তের উচ্চনিনাদ বা ঘোষণা।

ব্রহ্মা সৎ চিৎ আনন্দস্বরূপ, নির্বিশেষ, স্বপ্রকাশ, দেশ কাল পাত্র দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন এক অদ্বয় পরমতত্ত্ব_______ আশা করি এই ঋষিবাক্যে আপনাদের কোন সংশয় নাই। এই দৃশ্যমান জগৎ, আপনাদের ভাষায় এত সুখের ও সাধের পৃথিবী মিথ্যা_____ এই কথাটি নিয়ে আপনাদের গোল বেধেছে। কিন্তু আচার্য এখানে কোন নঞ্র্থক (Negative) ভাবে 'মিথ্যা' শব্দটি প্রয়োগ করেন নি। 

মিথ্যা মানে আত্যন্তিক সত্তার অভাব। জলের কাছে দাঁড়ালে আপনাদের ছায়া পড়ে, আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে ছায়াকেও দণ্ডায়মান দেখা যাবে, বসে থাকলে ছায়াও বসবে, আপনারা জলের কাছ হতে দূরে সরে যান, তাহলে জলের মধ্যে আর ছায়া দেখা যাবে না। তাহলেই বুঝে দেখুন আপনাদের ছাড়া ছায়ার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা সত্তা নাই। এই অর্থে জগৎ মিথ্যা। জগৎ যে মিথ্যা তা জগৎ শব্দের মধ্যেই প্রতিপাদিত রয়েছে। গচ্ছতীতি জগৎ (গম্ + ড) যা নিয়ত গমন করে, নিয়ত পরিবর্তিত হয়, ever fleeting, ever changing, always inconstant, তাকে মিথ্যা ছাড়া আর কি বলা যাবে ?!

সত্য আমরা কাকে বলি ? কালত্রয়মবাধিডং সত্যং____ যা ত্রিকালে অবাধিত। যা পূর্বে ছিল, এখন আছে এবং পরেও থাকবে তারই নাম ঋষিরা দিয়েছেন 'সত্য'। যা পূর্বে ছিল, এখন নাই, তা সত্য নয়। পূর্বে ছিল না কিন্তু পরে হয়ত দেখা যাবে তাও সত্য নয়। আজ যে ৭০ তলা বা ১৫০ তলা বিশিষ্ট আকাশচুম্বী অট্রালিকার কথা শুনে আপনারা বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন, বিশ পঁচিশ বা পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ঐরকম ছিল না, কয়েক বৎসর পরে হয়ত দেখবেন তার রূপ এবং আকৃতি সবই বদলে গেছে! আপনারা আপনাদের স্ব স্ব স্থানেও দেখতে পাবেন এখানেও নানা পরিবর্তনের ধারা। জগতের প্রতি বস্তু সম্বন্ধেই এই কথা প্রযোজ্য। জাগতিক যে কোন বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখুন, বিচার করলেই বুঝতে পারবেন, এখানে কোন বস্তুই নিত্য স্থির নয়। দৃশ্যপট, তার রূপ, রঙ প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে। এইভাবে যার উৎপত্তি বৃদ্ধি, বিবর্ধন ও বিলুপ্তি ঘটে, তা স্বভাবতই মিথ্যা।

কোন কোন টীকাকারের মতে, জগৎ শব্দের অর্থ যা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের বিষয়। এই অর্থে তাবৎ দৃশ্য পদার্থই জগৎ পদবাচ্য। ব্রহ্মা জ্ঞেয় বা দৃশ্য হন না আবার যা সোনার পাথরবাটি, কাঠালের আমসত্ত্ব এবং বন্ধাপুত্রাদির ন্যায় অসৎ তাও দৃশ্য হয় না। সুতরাং জগৎ সৎ নয়, অসৎও নয়। মিথ্যা বলতে যা সৎ নয়, অসৎ নং এবং সদসৎও নয় তাকে বুঝায়। 

_______যেমন রজ্জুতে যে সর্পের জ্ঞান হয়, সেই সর্প মিথ্যা। মিথ্যা বস্তু তিনকালেই থাকে না অথচ তা জ্ঞানের বিষয় হয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে জ্ঞান হয় এজন্য এটি সৎ কিন্তু তিনকালে বিদ্যমান থাকে না, এজন্য এটি অসৎ। আবার অধিষ্ঠানের জ্ঞানে (রজ্জুকে রজ্জু বলে বুঝামাত্রই) এর নিবৃত্তি হয় বলে একে অসৎও বলা যায় না। এইভাবে এটি সদসৎ হতে ভিন্ন বস্তু। যা সদসৎ হতে ভিন্ন তা মিথ্যা। জগৎ এইরূপ মিথ্যা বস্তু।


যাইহোক, আমি আর একটি উদাহরণ দিয়ে পুনরায় তত্ত্বটি পরিস্ফুট করার চেষ্টা করছি। মনে করুন কোন মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে সন্ধেবেলা নদীর ধারে বেড়াতে গেছেন। 

আকাশে চাঁদ উঠেছে। ছেলেটি নিতান্ত খেলার ছলে জলে একটা ঢিল ছুঁড়ল। ঢেউ উঠল। বাচ্চা ছেলেটা তার মাকে বলল_________ দেখ দেখ মা জলের ভিতর চাঁদ নাচছে। ভেবে দেখুন 

ছেলেটার ঐ কথা কি ঠিক ? আকাশের চাঁদ আকাশেই আছে, পুকুরে চাঁদ নাই সে নাচছে না, মা হয়ত ভুল শুধরে দিবার জন্য বললেন না না, চাঁদ নাচছে না, জলের নীচে চাঁদের প্রতিবিম্বটাই নাচছে..." কিন্তু একথাও যথার্থ নয়। বিম্বে যা থাকে প্রতিবিম্বে ত তারই প্রতিফলন ঘটে। কাজেই চাঁদ যখন নাচছে না, তখন তার প্রতিবিম্বও নাচতে পারে না। বলা বা গতি জলে বাধা পেয়ে wave length সৃষ্টি করেছে, সেটাই কেঁপে কেঁপে চলেছে। পুকুরে চাঁদ নাই, তা নাচছে না, তার প্রতিবিম্বও নাচছে না।

এই উদাহরণ থেকে তাহলে একথাটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হল যে চর্মচক্ষুতে যা প্রত্যক্ষ দেখা যায়, সর্বদা তা সত্য হয় না। তাই আচার্য শঙ্করের অভিমত_______ জগৎ মিথ্যা। যোগী যার স্বরূপ জ্ঞান হয়, তাঁর চোখে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। এই দৃশ্যমান ব্যবহারিক জগৎ অবিদ্যামানোঽপি অবভাসতে। বাস্তবিক পক্ষে নাই অথচ আছে বলে মনে হয়, এই ভ্রান্ত জ্ঞানের উপরই জগৎ চলছে। এটি কেমন ? না শঙ্কর জী বলছেন যেমন, রজ্জুতে সর্পজ্ঞানবৎ। সত্যি সত্যি সাপ নাই অথচ একগাছি দড়ি দেখে মনে হল সেটা সাপ। ভ্রান্তিবশে দড়িতে সাপের চিত্র ভেসে উঠল। 

পরম বৈজ্ঞানিক ঋষিরা বলেছেন________ এই যে অবস্পন্দিত দৃষ্টি, এই যে ভ্রান্তি দর্শন, এর কারণ আপেক্ষিকতা (due to Relativity)। আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে একমাত্র তুরীয় ভূমিতে জীবাত্মার সম্মুখান ঘটলে তবেই বুঝা যায় যে নাভাবো বিদাতে সতঃ- সংএর বিদ্যমানতার কখন অভাব ঘটে না অর্থাৎ কিনা যা সৎ তা সদৈব অবিনাশী। সর্বব্যাপী ব্রহ্মে রজ্জুতে সর্পবং জগৎ ভাসে, কেবল প্রতীত হয়, প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে জগতের ব্রহ্মনিরপেক্ষ কোন আন্তরিক সত্তা নাই। কাজেই জগৎ যে মিথ্যা- এটি যুক্তিসিদ্ধ এবং অনুভবসিদ্ধ তত্ত্ব।

নোট: আমার দৃষ্টিতে আদ্য শঙ্করাচার্য মহারাজ অদ্বৈতবাদি ছিলেন না। তাঁকে বুঝতে তাঁর অনুয়ায়ীরা কিছু ভুল করেছে।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ