স্বর্গ ও নরক - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

11 June, 2020

স্বর্গ ও নরক


মানব জীবনের সুখী অবস্থাই স্বর্গ ও দুঃখময় পরিস্থিতিই নরক।

এতদ্ব্যতীত স্বর্গ নরক নামে আলাদা কোন স্থান থাকা অযৌক্তিক।

"কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
                                     স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।"       -
-কবি শেখ ফজলল করিম
 এই লেখায় আমি বেশকিছু শব্দের বৈদিক ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়ে আলোচনা করব। বেদের ইংরেজি অনুবাদকগণ সাধারণত সংস্কৃত দ্যৌ বা দ্যুলোক শব্দের অর্থ করেছেন “Heaven”, যা পড়ে কেও কেও ভাবছেন বেদে স্বর্গ নামক কোনো স্থানের কথা আছে। আসুন দেখে নেই বৈদিক শব্দকোষে ‘দ্যৌ’ বা দ্যুলোক শব্দের অর্থ কি?
পণ্ডিত চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় এবং শ্রী অনিল কুমার উপাধ্যায়(কেউই আর্য সমাজী নয়) সম্পাদিত “বৈদিক কোশ(শব্দকোষ)” এর ৭০৩ পৃষ্ঠায় লেখা আছে:
“দ্যুৎ(চমকানো) প্রকৃতির সাথে ডো প্রত্যয় যুক্ত হয়ে দ্যৌ শব্দ সিদ্ধ হয়। দ্যৌ খু = দ্যু শব্দ নিষ্পন্ন হয়। এর অর্থ প্রকাশমান অর্থাৎ যা নিজে নিজেই প্রকাশিত হয়(যেমন: সূর্যাদি নক্ষত্র যারা নিজের আলোয় স্বয়ং প্রকাশিত)।”
একই শব্দকোষের ৭৩৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে “দ্যৌ = সূর্য”
তাহলে বৈদিক শব্দকোষ থেকে দেখা যাচ্ছে দ্যুলোক হচ্ছে সেই স্থান যেখানে সূর্যাদি নক্ষত্রসমূহ বিচরণ করে।
দ্বিতীয়ত অনুবাদক কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘অন্তরিক্ষ’ অর্থ করেছেন “Heaven”, এবার দেখে নেই ‘অন্তরিক্ষ’ এর বৈদিক অর্থ কি?
“বৈদিক কোশ” এর ৬০ পৃষ্ঠায় বলা আছে,
‘অন্তরিক্ষ = অন্তরে ক্ষিয়তি’ অর্থাৎ মহাকাশ বা দ্যুলোক ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী যে স্থান তার নামই অন্তরিক্ষ’
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি দ্যুলোক বা অন্তরিক্ষ কোনোটিই এমন কোন স্থানকে নির্দেশ করে না যা কিনা পুরাণ কোরানে বর্ণিত মৃত্যু পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত বিলাসময় কোন স্থান।
এবার দেখে নেই বৈদিক শব্দকোষে স্বর্গ নরক নামে পৃথিবী বহির্ভূত কোন বিলাসবহুল বা ভয়ার্ত কোন স্থানের কথা বলা আছে কিনা! অনেকে দ্যুলোককে স্বর্গলোক বলেন। বৈদিক কোষেও একস্থানে দ্যুলোককে স্বর্গলোক বলা হয়েছে। কিন্তু এই স্বর্গ কি? “বৈদিক কোশ” এর ১৪৭৫-৭৬ পৃষ্ঠায় স্বর্গের ব্যাখ্যা আছে-
“স্বর্গ- স্বর্ গ। (১) সুখ প্রদান করে এমন পদার্থ। (২) আনন্দময় মোক্ষ। (৩) সুখার্থ পুরুষার্থ।”
অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি স্বর্গ এমন কোন স্থান না যেখানে রম্ভা উর্বশী অপ্সরা বা হুর বসবাস করে না। বরং জীবনের সুখাবস্থা বা মৃত্যুর পর পরম পুরুষার্থ বা মোক্ষকেই স্বর্গ বলা হয়েছে।
🏜এবার আসি নরক এর অর্থে। ‘বৈদিক কোশ’ এর ৭৬৯ পৃষ্ঠায় ‘নরক’ এর ব্যাখ্যায় বলা আছে-
“নরক- (১) ন্যরকম্- নীচৈঃ গমনম্ অর্থাৎ নীচে বা অধঃপতিত হওয়া। (২) নীচৈঃ অস্মিন্ অর্য়তে অর্থাৎ নীচ বা দুষ্ট মানুষদের সহবাস বা অনুকরণে নরকে যায় বা অধঃপতিত হয়।”
অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি নরক কোন আলাদা স্থানের নাম নয়। বরং দুষ্টলোকের সাথে থেকে অধপতিত হওয়াই নরক বা যে দুর্দশা প্রাপ্ত হয় সেটাই নরক।
অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি যেসব শব্দের আধারে মহীধর সায়ণরা স্বর্গ নরক নামক কল্পিত স্থানের কথা তাদের বেদভাষ্যে উল্লেখ করেছেন তার কোন বৈদিক ব্যুৎপত্তিগত ভিত্তি নেই।
অষ্টচক্র নবদ্বারা দেবনাং পুরযোধ্যা।
তস্যাং হিরণ্ময় কোশঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবৃতা।।
(অথর্ববেদ ১০।২।৩১)

সরলার্থঃ এই শরীররূপ নগরী সব সূর্য্যাদি দেবের অধিষ্ঠানভূত। আট চক্র এবং নয় ইন্দ্রীয় দ্বার বিশিষ্ট এইনগরী অজেয়। এই নগরীতে এক প্রকাশময় কোশ আছে [মনোময় কোষ ] আনন্দময় জ্যোতি দ্বারা আবৃত।

অর্থাৎ বেদে দেবপুরী বা স্বর্গলোক বলতে মূলত এই শরীরকেই বোঝানো হয়েছে।

অথর্বেদে স্বর্গের বর্ণনা আরো দেওয়া রয়েছেঃ—

ঘৃতহৃদা মধুকূলা সুরোদকঃ ক্ষীরেন পূর্ণা উদকেশ দধ্ন।
ত্রতস্তা ধারা উপয়ন্ত সর্বাঃ স্বর্গে লোকে মধুম্য
পিন্বমানাঃ উপত্বা তিষ্ঠন্ত পুষ্করিণী সমন্তাঃ।
(অথর্ববেদ ৪।৩৪।৬)

এই মন্ত্রে স্বর্গতূল্য গৃহের বর্ণনা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, এই গৃহে যেন ঘৃত, মধু, পবিত্র জল, দুধ, দধি কম না হয়। এই স্বর্গতুল্য গৃহপ্রদেশ মাধুর্য্যুক্ত রসের সেচনকারী হয় এবং চারিদিশাই পদ্মের সরোবর হয়।
নরকঃ

(১) ন্যরকম্- নীচৈঃ গমনম্ অর্থাৎ নীচে বা অধঃপতিত হওয়া।

(২) নীচৈঃ অস্মিন্ অর্য়তে অর্থাৎ নীচ বা দুষ্ট মানুষদের সহবাস বা অনুকরণে নরকে যায় বা অধঃপতিত হয়।

অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি নরক কোন আলাদা স্থানের নাম নয়। বরং দুষ্টলোকের সাথে থেকে অধপতিত হওয়াই নরক বা যে দুর্দশা প্রাপ্ত হয় সেটাই নরক। অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি যেসব শব্দের আধারে মহীধর সায়ণরা স্বর্গ নরক নামক কল্পিত স্থানের কথা তাদের বেদভাষ্যে উল্লেখ করেছেন তার কোন বৈদিক ব্যুৎপত্তিগত ভিত্তি নেই।

নরকঃ ন্যরকম্ - নীচৈঃ গমনম্ (নিচে গমন অর্থাৎ অধঃপতন)। নি এর অর্থ হচ্ছে নিচে এর লোপ ন হওয়ার কারনে ন্যরক হয় অর্থাৎ নরক!
নিরুক্ত ১।১১ এ তে রয়েছে—
"ন জিহনায়ন্তো নরকে পতাম" অর্থাৎ কুটিল আচরন করে আমরা নরকে পতিত হই অর্থাৎ অধঃপাতিত হই।
মৃত্যুর পর আপনি স্বকর্ম অনুযায়ী পুনর্জন্ম লাভ করবেন। এবং সে অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করবেন এটাই নিয়ম

বেদাদি গ্রন্থে 'স্বর্গ' শব্দের উল্লেখ উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানকার কোথাও স্বর্গ আলাদা কোনো স্থানবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। বরং পরমসুখরূপ মোক্ষ, সুখদায়ক অবস্থা এবং সুখের উপকরণকে স্বর্গ বলা হয়েছে। "স্বর্গ" শব্দটির 'স্বঃ' (স্বর) এর অর্থ, নির্ঘণ্টতে (১৪) 'স্বপ্ন' শব্দটিকে সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করায় এটির বহু অর্থ হতে পারে। এজন্য 'স্বঃ' শব্দ দ্বারা সুখ অর্থ গ্রহণ করা যায়। নিঘণ্টুতে (১।৪) আরেকটি সাধারণ নামবাচক শব্দ রয়েছে। তা হলো 'নাকঃ'। 'নাকঃ' শব্দের নির্বাচন করতে গিয়ে নিরুতে (২১৪) বলা হয়েছে “কমিতি সুখনাম, তৎপ্রতিষিদ্ধং প্রতিবিধ্যেত” অর্থাৎ 'ক' হলো সুখনাম। তার বিপরীত (অক = দুঃখ) এর বিপরীত হলো নাক (ন+অক = না দুঃখ অর্থাৎ সুখ)। এভাবে 'নাকঃ' সাধারণ নাম হিসেবে নিঘন্টুতে পঠিত হওয়ার পরও সুখ নাম সিদ্ধ হওয়ায় একই পর্যায়বাচী 'স্বঃ' শব্দটিকে সুখনাম হিসেবে বিনা সংকোচে গ্রহণ করা যায়। আর 'স্বঃ' (স্বর্) এর সাথে যে 'গ' যুক্ত হয়ে স্বর্গ শব্দটি সিদ্ধ করে, সেই 'গ' গতি বোধক 'গ গতৌ' ধাতু থেকে উৎপন্ন। গতির আবার তিন প্রকার অর্থ হয়ে থাকে- জ্ঞান, গমন ও প্রাপ্তি। তাই স্বর্গ শব্দটির অর্থ হয় সুখ প্রাপ্তি অথবা সুখের দিকে গমন। যত প্রকারের সুখ রয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ হলো মোক্ষসুখ। মোক্ষ লাভ করলে মহাকল্পান্ত পর্যন্ত আত্মা জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়। ফলে তাকে জন্ম মৃত্যুরূপ দুঃখ, কষ্ট, ভয়, ক্লেশ, জরা, বুদ্ধত্ব প্রভৃতি প্রাপ্ত করতে হয়। বরং মোক্ষ অবস্থায় জীবাত্মা আনন্দময় পরমেশ্বর থেকে আনন্দ লাভ করে- “রসো বৈ সঃ। রসং হোবায়ং লব্ধা আনন্দী ভবতি।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২।৭।১)। ফলে মোক্ষরূপ সুখ বা আনন্দই হচ্ছে স্বর্গ। আর এই মোক্ষের (ন্যায় দর্শনে মোক্ষকে অপবর্গ বলে) বর্ণনা দিতে গিয়ে বাৎসায়ন মুনি ন্যায় দর্শনের (১০/২২) সূত্রের ভাষ্যে লিখেছেন- "দুঃখের=জন্মের অত্যন্ত বিচ্ছেদকে অপবর্গ বলে। কিভাবে ? গৃহীত জন্মের নিবৃত্তি এবং পুনরায় জন্মের গ্রহণ হয় না। এই বিনাশরহিত (জন্ম-মৃত্যু রহিত) অবস্থাকে (মোক্ষকে) বিদ্বানগণ অপবর্গ বলেন। এই অবস্থাকে অভয়, জরা, বৃদ্ধত্ব রহিত, মৃত্যুরহিত অবস্থা বলে।” অর্থাৎ আমরা স্বর্গের একটি অর্থ হিসেবে মোক্ষকে পাচ্ছি। আর এই মোক্ষ কোনো স্থান নয়, বরং জন্ম, মৃত্যু জনিত দুঃখ, ভয়, জরা প্রভৃতি মুক্ত একটি আনন্দময় অবস্থা। এবার আসি পার্থিব সুখের বিষয়ে। বলা হয়ে থাকে "স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল'। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির যদি নিজের শরীর ঠিক না থাকে, শরীরে যদি সুখ শান্তি না থাকে তবে সে কোনো দিনই পার্থিব সুখ ভোগ করতে পারবে না। এজন্য আমাদের এই দেহই ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাতেই স্বর্ণ নিহিত রয়েছে। এর সমর্থনে সুন্দর একটি বেদমন্ত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদে ( ১০। ২।৩১) বলা হয়েছে-
“অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পুরয়োধ্যা।
তস্যাং হিরন্ময়ঃ কোশঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবৃতঃ।”
অর্থাৎ, আট চক্র এবং নয় দ্বার বিশিষ্ট এই দেহ হলো দেবতাদের অজেয় নগরী। এই দেহে হিরণ্যময় কোষ রয়েছে, তাকে স্বর্গ বলে, যা ব্রহ্মজ্যোতি দ্বারা আবৃত রয়েছে। এই মন্ত্রে নবদ্বার হলো— দুই চোখ, দুই কান, দুই নাকের ছিদ্র, এক মুখ, এক মলদ্বার ও এক উপস্থ হিরণ্ময় কোশ হলো- মানবের হৃদয়, যেখানে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই জ্যোতি হলো- ব্রহ্মজ্যোতি। আর দেবতারা হলো- ইন্দ্রিয়াদি দেবতা। ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থেও মানবদেহকে দেবতাদের গ্রাম, দেবতাদের সংসদ অর্থাৎ আবাসস্থল বলা হয়েছে- “নরাঃ দেবানাং গ্রামঃ” (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ৬।১।২) - এই মানব দেহ হলো দেবতাদের গ্রাম (আবাসস্থল)। “এখা দৈবী সভা, দৈবী সংস" (জৈমিনি উপনিষদ ব্রাহ্মণ ২।৪।২) - এই দেহই হলো দেবতাদের সভা, দেবতাদের সংসদ। ফলে আমরা দেখতে পেলাম, স্বর্গ বলতে যেমন মোক্ষ সুখ বোঝায় তেমনি পার্থিব সুখও বোঝায়। বেদাদি শাস্ত্রে নরক শব্দটির উল্লেখ নেই বললেই চলে। 'নরক' শব্দের শাস্ত্র সম্মত অর্থ আমরা নিরুক্তে (১।১১) দেখতে পাই। সেখানে বলা হয়েছে- “নরকং ন্যরকং নীচের্গমন।”অর্থাৎ নরক অর্থ অধঃপতিত হওয়া বা নিম্নাভিমুখে গমন। এরপর আবার বলা হয়েছে- “নাস্মিন্ রমণকং স্থানমন্ত্রমপ্যত্তীতি বা।”অর্থাৎ অথবা এখানে আনন্দকর স্থান অল্পমাত্রও নাই। এটিই নরক শব্দের নির্বচন। অর্থাৎ নিজের চরিত্র, নৈতিকতা প্রভৃতিকে অধঃপতিত করে দুঃখ লাভই নরক। আবার যখন বিভিন্ন কারণে এই পৃথিবীতেই আমরা সামান্যতম সুখের স্থান খুঁজে পাই না, তখন সেটিই আমাদের জন্য নরক হয়ে যায়। নরক শব্দের বৈদিক শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণেও পুরাণোক্ত কোনো কঠিন শান্তির আলাদা স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। বেদাদি শাস্ত্রের অনেক স্থানে আবার 'স্বর্গ' শব্দটির সাথে 'লোক' শব্দটি যুক্ত থাকতে দেখা যায়। অর্থাৎ 'স্বৰ্গলোক' শব্দটিতে 'লোক' শব্দটি দেখে অনেকে ধারণা করেন এই লোক শব্দ দ্বারা পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোনো স্থানকে স্বর্গ হিসেবে নির্দেশ করছে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ লোক শব্দটির প্রয়োগ বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে পৃথিবীকেই নির্দেশ করে। যেমন-
“প্র মে পতিয়ানঃ পন্থাঃ কল্পত শিবা অরিষ্টা পতিলোক গমেয়ম্।” (মন্ত্রব্ৰাহ্মণ ১১৮, গোভিল
গৃহ্যসূত্র ২।১।১৯) অর্থাৎ, আমার যাওয়ার রাস্তা কল্যাণকারী হোক। আমি পতিলোক প্রাপ্ত হই।
“কন্যলা পিতৃতাঃ পতিলোকং য়তীয়ম্।” (মন্ত্রব্রাহ্মণ ১:২৫, গোভিল গৃহ্যসূত্র 21218) অর্থাৎ, কন্যা পিতৃলোক থেকে পতিলোক প্রাপ্ত হয়। এই উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, পিতৃলোক, পতিলোক এসব পৃথিবী ভিন্ন আলাদা কোনো স্থান নয়। বরং কন্যার অবস্থান পরিবর্তনকেই এখানে লোক বলা হয়েছে। এর দ্বারা আমরা 'স্বর্গলোক' শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো- স্বর্গের অর্থ সুখ এবং “লোকয়তেহনেনেতি লোকঃ” যেখানে তার অনুভব করা যায় তার নাম 'লোক'। তাই এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দ্বারা 'লোক' শব্দটি স্থানবিশেষ নয়, বরং অবস্থাবিশেষকেই বোঝায়।
সমগ্র আলোচনার আলোকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে-
১. স্বর্গ বা নরক আলাদা কোনো স্থান নয়।
২. স্বর্গ অর্থ সুখ। এই সুখ মোক্ষের মাধ্যমে বা পার্থিব অন্য কোনো মাধ্যমে দেহের সাহায্যে প্রাপ্ত হতে পারে।
৩. নরক অর্থ অধঃপতিত হওয়া, দুঃখময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করা।
৪. লোক শব্দটি দ্বারা আলাদা কোনো স্থান বোঝায় না, বরং অবস্থা বোঝায়। এই সমগ্র আলোচনার মূলভাব স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর অমর গ্রন্থ “সত্যার্থ প্রকাশ”-এ বলেছেন- “এই সুখ বিশেষই 'স্বর্গ' আর বিষয় তৃষ্ণায় আবদ্ধ হয়ে দুঃখ বিশেষ ভোগ করার নাম 'নরক'। সুখের নাম 'স্বঃ'। 'স্বঃ সুখং গচ্ছতি যস্মিন স স্বর্গঃ' 'অতো বিপরীতো দুঃখ ভোগো নরক ইতি'। যা সাংসারিক সুখ তা 'সামান্য স্বর্গ' এবং পরমেশ্বরের সাক্ষাৎকারজনিত আনন্দকে 'বিশেষ স্বর্গ' বলে।” (সত্যার্থ প্রকাশ নবম সমুল্লাস)। পরিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান রইল, পৌরাণিক বা আব্রাহামিক মতবাদের লোভ বা ভয়ে আকৃষ্ট না হয়ে নিজেদের উদার, মহান ও বাস্তবসম্মত বৈদিক সনাতন দর্শন মেনে চলুন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ