সাধারণ মানুষকে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করে জঙ্গিরা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বইয়ের মাধ্যমে নতুন সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করা। নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে কিছু বই লেনদেন করে তারা। এসব বইয়ের প্রতি সেই ব্যক্তির যাতে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় সেজন্য বইগুলোর নামও দেওয়া হয় ‘জান্নাতের পাসপোর্ট বা আখিরাতের পাসপোর্ট’ ধরনের।
ডাউনলোড :
https://bit.ly/Rahikul-Maktum
বিভিন্ন জনের প্রশ্ন:
(ক)ন্যালসন ম্যান্ডেলা বা মাদার তেরেসার মতো ভালো মানুষেরা কি জান্নাতে যাবেন না জাহান্নামে যাবেন? অনেক মহান ব্যক্তি আছেন যারা মুসলিম নন, কিন্তু জীবনের সকল কর্ম মানুষের কল্যাণার্থে সম্পন্ন করেছেন। এই শ্রেণীর মানুষেরা পরকালে কি কোনো প্রতিদান পাবেন না?
(খ)যারা অমুসলিম এটা কি তাদের দোষ যে তারা অমুসলিম? তারা জন্ম নিয়েছে অমুসলিমের ঘরে। তাই তারা ভিন্ন ধর্মানুসারী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজ ধর্মকেই সত্য জানে এবং সেটাই পালন করে। আল্লাহ শাস্তি দিলে খারাপ মানুষদের দিতে পারেন কিন্তু ভালো মানুষ কেনো শাস্তি পাবে? মুসলিমরা জান্নাতে যাবে আর অন্য ধর্মের লোকেরা জাহান্নামে যাবে, এটা হলে কি বলা যায় যে- আল্লাহ সবার জন্য সুবিচার করেছেন?
(গ)পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানব সভ্যতার থেকে অনেক দূরে বসবাস করে। তারা অনেকে নানা প্রকার দেবদেবীতে বিশ্বাস নিয়ে চলে। তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? তারাতো আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরকালে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ কি সিদ্ধান্ত নেবেন? যারা কোনো নবীর দেখা পায়নি, কেউ তাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে অথবা ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করেনি তাদের বিচার কিভাবে হবে?
(ঘ)আল্লাহ কি সব অমুসলিমকে চির জাহান্নামী করবেন? তাহলে তো বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ অমুসলিম সরাসরি দোযখে যাবে আর বাকি প্রায় ২০ ভাগ মুসলিমের মধ্যে কেউ যাবে জান্নাতে কেউ জাহান্নামে। এটা কি করে সম্ভব?
(ঙ)খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ভেতরে যদি এমন কেউ থাকে যে ‘ত্রিত্ববাদ’ এ বিশ্বাস করে না কিন্তু হযরত ঈসা (আ.) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে তাহলে তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কি? কোনো একজন ইহুদীর ক্ষেত্রেই বা ফয়সালা কি হবে যদি সে কাজে কর্মে সৎ হয়?
(চ)কুরআনের সূরা আলে ইমরানে (৩:৮৫) বলা হয়েছে, ইসলাম ছাড়া অন্য বিধান গ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত মানে কি পরকালে চির জাহান্নামী হওয়া? তাছাড়া কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে ঢোকার পর আবার বের হয়ে আসতে পারবে?
জবাব:
প্রশ্ন চেপে রাখা উচিত নয়:
উপরিউক্ত প্রশ্নসমূহ অনেকেই ভেতরে চেপে রাখেন। এভাবে হয়তো বছরের পর বছরও পেরিয়ে যায়। এক সময় এসব প্রশ্ন বড় হয়ে মনে হয়তো বিকৃত চিন্তার উদ্ভব ঘটায়। তাই প্রশ্ন ছোট থাকতেই এর যথাযথ উত্তর অন্বেষণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অমুসলিমদের মধ্যে অনেকেই বহু প্রকারের সৎকাজ করে থাকেন:
সত্য কথা বলা, বিপন্নের সাহায্য করা, অন্যের মঙ্গল সাধনের জন্যে অর্থ ব্যয়, আত্মীয়-স্বজনের উপকার করা, পিতা-মাতাকে সম্মান করা, মেহমান এবং প্রতিবেশীদের অধিকার প্রদান করা, অভাবীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা, ত্যাগ স্বীকার করা ও বহু জনহিতকর কাজ করা প্রভৃতি কাজগুলো ইসলামসহ সকল ধর্মের লোকদের মধ্যে দেখা যায়। এ কাজগুলো যে পুণ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্বস্রষ্টা প্রতিটি মানুষকে বিবেক বা ‘কমন সেন্স’ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন:
বিবেক মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে যে, সকল সৃষ্টির একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছেন এবং স্রষ্টাই সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের দায়িত্ব হলো, স্রষ্টাপ্রদত্ত বিবেককে কাজে লাগিয়ে ‘সত্য ধর্ম’ অনুসন্ধান করা। বিবেক দ্বারা মানুষ এটাও বুঝতে পারে যে স্রষ্টার সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সকল ধারণা ঠিক হতে পারে না। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের চূড়ান্ত গরমিল সত্ত্বেও এ সকল ধর্ম ও মতাদর্শের সবগুলো সঠিক হতে পারে না। এ ধরনের চিন্তার ফল হলো এই যে, মানুষ এক পর্যায়ে ভ্রান্তিহীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন এর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করবে।
অমুসলিমরা এ সকল ভালো কাজের কারণে পরকালে পুরস্কার পাবে কি?
অনেকের বিশ্বাস অমুসলিমরা তাদের সৎকাজের পুরষ্কার স্বরূপ স্বর্গ বা বেহেশত (জান্নাত) লাভ করবেন। এ বিশ্বাস বা ধারণা কতটুকু সত্য তা পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
একথা কে অস্বীকার করতে পারে যে, বিশ্বজগত ও তার প্রতিটি সৃষ্টি কণার স্রষ্টা, মালিক ও প্রভু একমাত্র আল্লাহ? (বিস্তারিত জানতে দেখুন: সংযোজন ১ এ আল্লাহর অস্তিত্ব এবং সংযোজন ২ এ ‘আল্লাহ’ নামকরণের যুক্তি) মানুষকে তার জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই দিয়েছেন সেই আল্লাহ। জীবনে উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য নব নব উদ্ভাবনী কাজের সকল সামগ্রী ও উপাদান তিনি তৈরি করেছেন। জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক, কর্মশক্তি, প্রখর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েছেন তিনি। তিনিই মানুষের জন্যে পাঠিয়েছেন সত্য সুন্দর ও মঙ্গলকর জীবনবিধান (দ্বীনে হক)। মানুষকে সদা সৎপথে পরিচালিত করার জন্যে এবং তাদের নৈতিক শিক্ষার জন্যে পাঠিয়েছেন যুগে যুগে নবী ও রাসূল (তথা বার্তাবাহক) গণকে (দেখুন: সংযোজন ৩ এ নবীগণ সাধারণ মনীষীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং সংযোজন ৪ এ রাসূলুল্লাহ সা. সকল মানুষের সেরা) আল্লাহই ইহজগতের এবং পরজগতের স্রষ্টা, মালিক ও প্রভু। বিচার দিনের একচ্ছত্র মালিক এবং বিচারকও তিনি। এমন গুণাবলীসম্পন্ন যে আল্লাহ, তাঁর প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব ও আনুগত্য অস্বীকার করে, তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূল ও আখিরাতের বিচার দিবসকে অস্বীকার করে অথবা স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহর স্তবস্তুতি ও আনুগত্য-দাসত্ব করার পরিবর্তে তাঁরই কোনো সৃষ্টির অথবা কোনো কল্পিত বস্তুর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করলে তা কিভাবে গৃহীত হতে পারে? (দেখুন: সংযোজন ৫ এ ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল প্রয়োজন, পরকালে মুক্তির পথ একটাই, সব ধর্মই কি ঠিক, সঠিক ধর্ম কোনটি এবং আরও দেখুন সংযোজন ৬ এ সকল বিবেচনায় অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম জীবনবিধান কোনটি, আল কুরআনই একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্মগ্রন্থ, জীবন সমস্যা সমাধানে মানবসৃষ্ট মতাদর্শ ও ধর্মসমূহ কেন নির্ভুল নয়, বিধান রচনায় মানুষের দুর্বলতার আরও কিছু দিক, মানবরচিত কিছু মতাদর্শের পরিচয়)
উপরে বিভিন্ন ধর্মের সৎ ব্যক্তির গুণের মধ্যে একটা বলা হয়েছে সত্যবাদিতা। কিন্তু একমাত্র অভ্রান্ত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানকে অস্বীকার করার পর এবং দয়ালু স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করার পর সত্যবাদিতার কানাকড়ি মূল্য থাকে কি? সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের অনেকের মধ্যে বদান্যতা, জনহিতকর কাজ এবং দান-খয়রাতের মতো গুণাবলী রয়েছে। কিন্তু চিন্তা করুন, অর্থ-সম্পদ, জনহিতকর কাজের যাবতীয় সামগ্রী, জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মশক্তি সবই আল্লাহর দান। একদিকে দানের বস্তু দিয়ে অপরের সাহায্য করা হলো এবং প্রকৃত দাতার আনুগত্য, দাসত্ব ও কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করা হলো। এ যেনো পরের গরু পীরকে দান। এ দানের কি মূল্য হতে পারে? স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর আনুগত্যে মস্তক অবনত করা এবং তাঁরই স্তবস্তুতি ও ইবাদাত-বন্দেগী অস্বীকার করা কি গর্ব-অহংকার এবং কৃতঘ্নতার পরিচায়ক নয়? এটা কি চরম ধৃষ্টতা, নিমকহারামকারী ও বিশ্বাসঘাতকতা নয়? ইবাদাত-বন্দেগী, দাসত্ব-আনুগত্য করা হলো আল্লাহরই অন্যান্য সৃষ্টির। সৃষ্টিকে করা হলো স্রষ্টার মহিমায় মহিমান্বিত। এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা, এর চেয়ে বড় অন্যায় ও যুলুম আর কিছু হতে পারে কি?
আল্লাহ কুরআনে বলেন: “যারা আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে তাদের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তাদের সৎকাজগুলো হবে ভস্মস্তূপের মতো। ঝড়-ঝঞ্ঝার দিনে প্রচণ্ড বায়ু বেগে সে ভস্মস্তূপ যেমন শূন্যে উড়ে যাবে, ঠিক সে সৎকাজগুলোর কোনো অংশেরই তারা লাভ করবে না। কারণ আল্লাহর দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাস তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিয়ে গিয়েছিলো।” (১৪/সূরা ইবরাহীম:১৮) অর্থাৎ যারা আপন প্রভু আল্লাহর সাথে নিমকহারামী, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বেচ্ছাচারিতা অবাধ্যতা ও পাপাচারের আচরণ করেছে এবং দাসত্ব-আনুগত্য ও ইবাদাত-বন্দেগীর সেসব পন্থা অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে- যার আহ্বান নিয়ে এসেছিলেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম (নবীগণ), তাদের জীবনের পরিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং সারা জীবনের কাজ ও চরিত্রের মূলধন অবশেষে এমন ব্যর্থ ও অর্থহীন হয়ে পড়বে, যেনো একটা বিরাট ভস্মস্তূপ ধীরে ধীরে জমে উঠে পাহাড় পর্বতের আকার ধারন করেছে; কিন্তু একটি দিনের প্রচণ্ড বায়ুতে তার প্রতিটি ভস্মকণা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের প্রতারণামূলক সুন্দর সভ্যতা ও কৃষ্টি-কালচার তাদের বিস্ময়কর শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্প, বিরাট বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ললিতকলা, প্রভৃতি অনন্ত সম্ভার এমন কি তাদের উপাসনা-আরাধনা, প্রকাশ্য সৎকাজগুলো, দান-খয়ারত ও জনহিতকর কার্যাবলী একটা বিরাট ভস্মস্তূপ বলেই প্রমাণিত হবে। তাদের এসব গর্ব অহংকারের ক্রিয়াকলাপ আখেরাতের বিচার দিনে বিচারের দাঁড়িপাল্লায় কোনো ওজন বা গুরুত্বের অধিকারী হবে না। আল্লাহ আরও বলেন: “তোমাদের মধ্যে যারা দ্বীন ইসলাম থেকে ফিরে যাবে এবং কুফরী (বা অবাধ্যতার) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সকল সৎকাজগুলো বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা (সেখানে) থাকবে চিরকাল।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২১৭)
যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইসলাম সৎ কাজ গৃহীত হওয়ার জন্য ঈমান (বা বিশ্বাসকে) কে শর্ত বলে নির্ধারণ করেছে।:
আল্লাহ বলেন,
(ক)“এবং যে সৎ কাজ করবে, সে পুরুষ হোক অথবা নারী, তবে যদি সে মুমিন (বা বিশ্বাসী) হয়, তাহলে এসব লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কণামাত্র জুলুম করা হবে না (অর্থাৎ তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হবে না)।” (৪/সূরা আন নিসা:১২৪)
(খ)“যে ব্যক্তিই সৎ কাজ করবে- সে পুরুষ হোক বা নারী হোক- তবে শর্ত এই যে, সে মুমিন হবে- তাহলে দুনিয়াতে তাকে পূত-পবিত্র জীবনযাপন করাবো এবং (আখিরাতে) এমন লোকদের আমাল (বা কাজ) অনুযায়ী উৎকৃষ্ট প্রতিদান দেবো।” (১৬/সূরা আন নাহল:৯৭)
(গ)“এবং যে সৎ আমাল করবে- পুরুষ হোক বা নারী হোক যদি মুমিন হয়, তাহলে এমন লোক সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেখানে তাদেরকে অগণিত জীবিকা সম্ভার দান করা হবে।” (৪০/সূরা আল মুমিন:৪০)
উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে সৎ কাজের জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বারেই এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, সৎ কাজ সম্পাদনকারীকে অবশ্যই মুমিন হতে হবে। ইসলামী বুনিয়াদী আকীদাগুলোর প্রতি ঈমান আনার পরই সৎ কাজের পুরষ্কার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, ঈমান হলো সৎ কাজ গৃহীত হবার পূর্বশর্ত।
আল্লাহ, তাঁর কিতাব, রাসূল (বার্তাবাহক) এবং আখিরাত প্রভৃতির উপর প্রথমে ঈমান আনতে হবে। তারপর সৎকাজ কি কি তাও বলে দেওয়া হয়েছে। এ সৎকাজগুলো নবী-রাসূলগণ বাস্তব জীবনে স্বয়ং দেখিয়েছেন। তাদের বলে দেওয়া (বা প্রদর্শিত) পন্থা-পদ্ধতি অনুযায়ী সে কাজগুলো করতে হবে। এ কাজের লক্ষ্য হবে, যাকে স্রষ্টা, রিযিকদাতা, মালিক, প্রভু, বাদশাহ ও শাসক হিসেবে মেনে নেওয়া হলো (যার অর্থ ঈমান আনা হলো), তাঁর সন্তুষ্টিলাভের জন্যেই সেসব সৎ কাজ করা হবে। পুরষ্কার দেওয়ার একমাত্র অধিকার যার- তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভের ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে পুরষ্কার আসবে কোথা থেকে? সে জন্যে পরকালীন মুক্তি ও পুরষ্কার নির্ভর করছে সৎ আমালের উপর এবং সৎ আমাল ফলদায়ক হবে ঈমানের সাথে।
ইসলামের নিজস্ব আত্মমর্যাবোধ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আজ মুসলিমের তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই:
লেখার প্রথমে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহ করা হয় মূলত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন থেকে। একজন বস্তুবাদী মানুষ এ পৃথিবীকে ‘আলটিমেট’ ধরে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে। অপরদিকে মুসলিমরা দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে আখিরাতকে কেন্দ্র করে। দুনিয়া সম্পর্কে মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারীর) আর একজন কাফিরের (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীর) দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ন বিপরীত। ইসলাম নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি দ্বারা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি-নৈতিকতা থেকে শুরু করে সামাজিক,রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহ সকল অঙ্গনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। হযরত আয়িশা (রা.) একবার বলেছিলেন, সব দান করে দিয়েছি শুধু একটা (চতুষ্পদ জন্তুর) পা অবশিষ্ট আছে। মহানবী (সা.) তখন বলেছিলেন, হে আয়েশা, বলো, সব আছে বরং একটা পা নেই। অর্থাৎ, যা দান করা হয়েছে তা তো রয়েই গেলো। মানে- পরকালে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে।
আজকাল কাফির, মুশরিক, নাস্তিক শ্রেণীর মানুষদের সম্পদের প্রাচুর্য দেখে মুসলিমরা বিচলিত হয় না। তাদের এ জৌলুশ ইসলামের সভ্যতার ভিতকে কোনো অংশে নড়বড়ে করতে পারে না। আল্লাহ কুরআনে কোথাও বলেননি যে, কাফিরদের প্রাচুর্য দেওয়া হবে না। বরং আল্লাহ পরিষ্কার বলেছেন, “যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্যে সেই ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে, আমি তাকে তার কিছু দিয়ে দিই এবং পরকালে তার কোনো অংশ থাকবে না।” (৪২/সূরা আশ শুরা:২০) অর্থাৎ, এ অস্বীকারকারীরা যতোই চেষ্টা করুক না কেনো, দুনিয়ার যতোটা অর্জন করতে চায় তা তারা পুরোপুরি পাবে না, বরং তার একটা অংশমাত্র অর্থাৎ আল্লাহ তার জন্য যতোটা নিদিষ্ট করে রেখেছেন ততোটাই পাবে।
আল্লাহ বলছেন, “অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।” (৫/সূরা আল মায়িদা:১০০) ধরা যাক, কারো কাছে হালাল উপায়ে উপার্জিত পাঁচ টাকা আছে আর কারো কাছে হারাম উপায়ে উপার্জিত ১০০ টাকা আছে। সাধারনত মানুষ ১০০ টাকাকেই বড় মনে করলেও যাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ এবং যাদের মধ্যে সত্যের প্রানশক্তি নিহিত, তারা ৫ টাকাকেই বড় মনে করবে। আবার একজনের পা মোটা দেখে কেউ তার স্বাস্থ্যের প্রশংসা করতে পারে। কিন্তু কেউ জানতে পারলো যে, অসুস্থতার কারণে তার পায়ের ভেতরে পচন ধরেছে বলেই পা ফুলে গেছে। তাই মোটা হয়ে যাওয়া সবসময় সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন নয়।
আজকে যারা টাকার পাহাড়ে অবস্থান করছে, সে সকল দেশের টাকা ও সম্পদ দেখে হয়তো অনেকে বিস্মিত হয়ে আছে। কিন্তু তাদের সমাজের ভেতরের অবস্থা দেখলে জানা যায়, তাদের মধ্যে আত্নহত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদির হার বেশি। অতএব, পার্থিব জীবনে ইসলাম অস্বীকারকারীদের সমৃদ্ধি ইসলামের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।
আজকের মুসলিমদের এ দুর্দশার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। মহানবী (সা.) বিশ্বাসের ‘ট্রেনিং’ দেওয়ার সাথে সাথে কিছু পার্থিব ‘ট্রেনিং’ও দিয়ে গিয়েছিলেন যা এখন মুসলিমরা অনুসরন করছে না। অনেক ক্ষেত্রে অমুসলিমদের মধ্যেই এ পার্থিব ট্রেনিংয়ের উপস্থিতি আছে বলেই তারা উন্নতি করছে।
মহানবী (সা.) শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগে তাদের পারিশ্রমিক দিতে বলেছেন। কিন্তু আরব দেশ এবং ইউরোপের দেশগুলোর দিকে একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় অমুসলিমরা এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর শিক্ষা বেশি মানছে। মহানবী (সা.) এর দেওয়া সকল শিক্ষা মুসলিমরা নিতে পারেনি বলেই আজ তাদের এ করুণ অবস্থা। মুসলিমরা একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃত্বে থাকলেও আজ তারা সে স্থানটি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে নিপতিত হয়েছে কুসংস্কারের গহ্বরে। তাই আজকে মুসলিমদের অধ:পতনের আরেকটি কারণ ইসলামের কিছু শিক্ষাকে পদদলিত করা।
অমুসলিম ও মুসলিম নামধারী- সকলেরই সৎকর্ম ফলহীন হতে পারে:
দ্বীনে ইসলামে যারা অবিশ্বাসী কেবল তাদেরই সৎকাজগুলো বিনষ্ট হবে না, বরং দ্বীন ইসলামে বিশ্বাসস্থাপন করার পর যারা তা পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিণামও অবিশ্বাসী-কাফিরদের (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের) মতো হবে। মোটকথা, কুরআন হাকীমের প্রায় পাতায় পাতায় একথা দ্ব্যথহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যারাই আল্লাহর প্রেরিত দ্বীনে হক (বা সত্য জীবনবিধান) গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তারা এ দুনিয়ায় কোনো ভালো কাজ করুক বা না করুক, তাদের স্থান হবে জাহান্নামে।
আল্লাহর কাছে প্রতিদান চাইলে আল্লাহর জানানো বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে:
আল্লাহ ও রাসূলকে যারা অস্বীকার করে, পরকালে পুরষ্কার লাভ যদি তাদের একান্ত কাম্য হয়, তবে তা দাবি করা উচিত তাদের কাছে যাদের পূজা ও স্তবস্তুতি তারা করেছে, যাদের হুকুম-শাসনের অধীনে তারা জীবন যাপন করেছে, যাদের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া সেদিন কোনো শক্তিমান সত্তা থাকবে কি যে কাউকে কোনো পুরষ্কার অথবা শাস্তি দিতে পারে? বেহেশতের দাবি দাওয়া নিয়ে কোনো শ্লোগান, কোনো বিক্ষোভ মিছিল করার ক্ষমতা, সাহস ও স্পর্ধা হবে কি? তাছাড়া পুনর্জীবন, পরকাল, হিসাব-নিকাশ, দোযখ-বেহেশত যারা অবিশ্বাস করলো, সেখানে কিছু পাবার বা তার জন্যে তাদের বলারই বা কি আছে? আল্লাহদ্রোহী ও আল্লাহবিমুখ অবিশ্বাসীদের সৎকাজের কোনোই মূল্য যদি পরকালে দেওয়া না হয়, তাহলে তা হবে পরিপূর্ণ ন্যায় বিচারের কারণেই।
অবিশ্বাসীরা তাদের সৎ কাজের প্রতিদান এ দুনিয়াতে পাবে:
যদি কোনো অবিশ্বাসী পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে তাকে এই পৃথিবীতেই তার প্রতিদান দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন: হতে পারে আল্লাহ তার জীবনযাত্রার মান এবং জীবিকা বৃদ্ধি করে দেবেন, তাকে সুখ-সাচ্ছন্দ এবং যা সে ভালবাসে তা তাকে দান করবেন, এ পৃথিবীতে যা তার জন্য ক্ষতিকর তা তার থেকে সরিয়ে দেবেন, মানুষ যেনো তাদেরকে চেনে ও জানে সে ব্যবস্থা করে দেবেন, মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা তার সুনামের ব্যবস্থা করে দেবেন এবং এরকম আরো অনেক প্রতিদান তাকে দেবেন। এরপরেও যদি তাদের ভালো কাজগুলোর প্রতিদান দিতে কিছু বাকি থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ করে দিতে পারেন এবং জাহান্নামে তাদের আযাব কমিয়ে স্থির করতে পারেন।
কিন্তু মৃত্যুর পর অবিশ্বাসীদের কিছুই পাওনা থাকবে না। তার অবিশ্বাস তার ভালো কাজকে গ্রহণযোগ্য হতে বাধা প্রদান করবে। সে যদি সত্যিই পরকালে উপকৃত হতে চাইতো তাহলে তার ভালো কাজকে গ্রহণযোগ্য রাখার লক্ষ্যে সে অবশ্যই মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারী) হতো। আনন্দময় কিছু দিয়ে জাহান্নামবাসীদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে না। প্রথমবার দেওয়া শাস্তির মাত্রা তাদের থেকে কমানো হবে না। অবশ্য অধিক পাপে নিমজ্জিতদের জন্য শাস্তি আরো গুরুতর হবে।
আবু তালেব সব সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কে কাফির (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) দের অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর উপর ঈমান না আনার কারণে এই আবু তালেবকেও জাহান্নামে যেতে হবে। তবে হাদীসে বলা হয়েছে, দ্বীন ইসলামকে সাহায্য করার জন্য জাহান্নামবাসীদের মাঝে এই আবু তালেবের আযাবটা সবচেয়ে কম হবে। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যদি কোনো কাফির কোনো ভালো কাজ করে, এর জন্য তাকে এ পৃথিবীতেই তার জীবিকার ভালো উপকরণ দেওয়া হবে। আর ঈমানদারদের জন্য, আল্লাহ তাদের সৎকর্মগুলোকে পরকালে সংরক্ষণ করবেন এবং এ পৃথিবীতে তাদের আনুগত্যের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিদানের ব্যবস্থা করে দেবেন। (মুসলিম, ২৮০৮)
আল্লাহ কারো ওপর জুলুম বা অবিচার করেন না:
মানুষ নিজেই নিজের ওপর অবিচার করে। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ জুলুম করেন না মানুষের উপর, বরং মানুষ নিজেই নিজের উপর জুলুম করে।” (১০/সূরা ইউনুস:৪৪)
আল্লাহ তাঁর বিধান পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে তা গ্রহণ করা। কিন্তু অনেকেই আল্লাহর বিধান গ্রহণ করে না। আর এর জন্য আল্লাহ নয়, মানুষই দায়ী থাকবে।
আল্লাহ প্রদত্ত ‘কমন সেন্স’ যাদের ছিলো এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার যথেষ্ট উপকরণ যারা পেয়েছিলেন, এরপরও যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, তারা তাদের অপরাধের কারণেই জান্নাতে যেতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ কারো ওপর জুলুম করেন না। তারা যা ভালো কাজ করেছেন, এর প্রতিদান পৃথিবীতে আল্লাহ তাদেরকে দিতে পারেন। কিন্তু পরকালের প্রতিদান লাভের জন্য যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপনটা মূল চাহিদা বা ‘রিকোয়ারমেন্ট’, যা অমুসলিমদের বেলায় অনুপস্থিত, তাই তারা পারলোকিক কোনো প্রতিদান পাবেন না।
কেউ যদি দাবি করে যে, আল্লাহ তার জন্য অবিচার করেছে, তাহলে সে ভুল বলছে। কেননা সে কোনোদিন আল্লাহর বাণী (তথা কুরআন) পড়ার, বুঝার ও গবেষণা করার চেষ্টা করেনি। যে বিদ্যা অর্জন করলে পার্থিব সুবিধা পাওয়া যায় (যেমন: গাড়ি-ঘোড়া চড়া যায়), তা যদি আমরা আগ্রহের সাথে পড়তে পারি তবে, যে জ্ঞান অর্জন করলে চিরকাল জান্নাতে থাকা যায় তাতে এতো অনীহা কেনো এবং তা না পড়লে অন্যকে দোষী মনে করি না কেনো? এই কারণে মানুষ কিয়ামাতের দিন আফসোস করে বলবে যদি আমরা, বিবেক দিয়ে চিন্তা করতাম! কেননা যে নিজের বিবেক দিয়ে চিন্তা করবে সে অমুসলিম থাকতে পারবে না।
আল্লাহ বলেন, “ক্রোধে জাহান্নাম যেনো ফেটে পড়বে। যখনই তাতে কোনো সম্প্রদায় নিক্ষিপ্ত হবে তখন তাদেরকে তার সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করবে- তোমাদের কাছে কি কোনো সতর্ককারী আগমন করেনি? তারা বলবে, হ্যাঁ আমাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করেছিলো, তারপর আমরা মিথ্যারোপ করেছিলাম এবং বলেছিলাম: আল্লাহতাআলা কোনো কিছু নাজিল (বা অবতারণ) করেননি। তোমরা মহাবিভ্রান্তিতে পড়ে রয়েছো। তারা আরও বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।” (৬৭/সূরা আল মূলক:৮-১০) আল্লাহ আরও বলেন, “যে কেউ দ্রুত লাভের আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যা কিছু দিতে চাই দিয়ে দিই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দিই, যার উত্তাপে সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:১৮)
আল্লাহপ্রদত্ত ‘কমন সেন্স’ প্রসঙ্গে ইসলাম:
মানুষের ‘কমন সেন্স’ই আল্লাহর বাণীতে উল্লিখিত ‘ফিতরাত’ (বা স্বভাব ধর্ম)। আল্লাহ বলেন, “এটাই (হচ্ছে) আল্লাহর প্রকৃতি বা ফিতরাত (এর উপর নিজেকে দাঁড় করাও), যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (৩০/সূরা আর রূম:৩০) হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ সব নবজাতককে ফিতরাতের ওপর সৃষ্টি করেন। পরে তার পিতা-মাতা, পরিবেশ তাকে ইহুদী, খৃষ্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারী, মুসলিম) এ হাদীসে রাসূল (সা.) আরো বলেন, তোমরা তো বিভিন্ন পশু দেখেছো। কোনো পশু কি শরীরে চিহ্ন নিয়ে জন্মায়? না। বরং, তাকে পরে চিহ্নিত করা হয়।
আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে অনেক নবী-রাসূল (বার্তাবাহক) পাঠিয়েছেন:
আল্লাহ যে যুগে যাঁকে পাঠিয়েছেন, সে যুগে তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করাই ছিলো সঠিক পথ। সবশেষে আল্লাহ, মুহাম্মাদ (সা.) কে পাঠান। এরপর একমাত্র তাঁর পথই সঠিক পথ। অন্য সব পথ বিকৃত, ভ্রান্তিযুক্ত ও পরিত্যাজ্য। পরবর্তী সরকারের আমলে পূর্ববর্তী আইন মেনে চললে কি তাকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয় না?
ইহুদী ও খৃষ্টান যারা রাসূল (সা.) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি তাদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, সেই মহান সত্ত্বার শপথ যার কবজায় আমার প্রাণ, এই উম্মাতের কোনো ইহুদী, খৃষ্টান যদি আমার কথা শোনে, এরপর আমার আনীত (সত্য) বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আগেই মারা যায়, তাহলে সে জাহান্নামবাসী হবে। (মুসলিম)
সত্য নিজের সত্যতার ব্যাপারে অটল; কিন্তু মিথ্যা নিজের সত্যতার ব্যাপারেও আস্থাহীন:
ইসলামের সর্বপ্রধান উৎস আল কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৯) আল্লাহ আরও বলেন, “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন (ধর্ম বা মতাদর্শ) সন্ধান করে, কখনোই তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রন্ত।” (৩/সূরা আলে ইমরান:৮৫)
ইসলাম গ্রহণ না করা লোকদের প্রকারভেদ:
যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, তাদের মধ্যে দু’ধরনের লোক রয়েছে।
১.যারা অমুসলিমদের মাঝে ছিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানার কোনো উপায় ছিলো না। ইসলামের কথা কখনো শুনেনওনি। তাদের অবস্থা আহলুল ফাতরাত এর মতো হবে। অর্থাৎ, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করবেন। যেমন বলবেন, আগুনে ঝাপ দাও। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, তারা আগুনে ঝাপ দিয়ে দেখবে সেটা শীতল বেহেশত। যারা অমান্য করবে, তারা সত্যিই জাহান্নামে যাবে। (প্রমাণ আল্লাহ বলেন, “কোনো রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:১৫) এটা আল্লাহর ইনসাফের (বা ন্যায়বিচারের) প্রকাশ। আল্লাহ কাউকে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ ছাড়া শাস্তি দেবেন না। হয়তো রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে বা অন্য কোনো ভাবে আহ্বান (বা দাওয়াত) পৌঁছানোর মাধ্যমে আল্লাহ বার্তা পৌছাবেন। বার্তা পৌঁছার ব্যবস্থা না করে শাস্তি দেওয়ার মতো যুলম (বা অত্যাচার) আল্লাহ করবেন না।
২.এমন কিছু লোক আছেন যারা মুসলিমদের মাঝে ছিলেন, ইসলামের কথা শুনেছেন, ইসলাম সম্পর্কে জানা তাদের জন্য সহজ ছিলো, এরপরও তারা ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধান করেননি ও মুসলিম হননি। তাদের জন্য জাহান্নামই নির্ধারিত থাকবে।
জাহান্নামী লোকদের প্রকারভেদ:
জাহান্নামী লোকেরা দুই ধরণের:
১.যারা তাওহীদে (আল্লাহর একত্ববাদে বা প্রচলিত ভাষায় একেশ্বরবাদে) বিশ্বাসী (যাদের ঈমান নির্ভেজাল তথা শিরকমুক্ত) এবং যারা সৎ কাজের সাথে অসৎ কাজও মিলিয়ে ফেলেছিলো। মহান আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তাদের পাপের শাস্তির জন্য। আল্লাহ চাইলে এই শ্রেনীর লোকদের জাহান্নামে শাস্তি চিরদিনের জন্য হবে না। আল্লাহই তাদের জন্য শাস্তির সময়সীমা নির্ধারণ করবেন। তারপর তিনি তাদের সেই আগুন থেকে বের করে আনবেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তারা জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। (অবশ্য, আগে হোক আর পরে হোক যারা একবার জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা আর কখনো জাহান্নামবাসী হবে না।)
২.যারা অবিশ্বাসী, মুনাফিক, তাওহীদে যাদের কোনো বিশ্বাস ছিলো না, যারা শিরক করেছে, বহু প্রভুতে বিশ্বাস করেছে, আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছে (বা নাস্তিক হয়েছে) এবং যারা অবিশ্বাসী অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকে চিরদিনের জন্য জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের অপরাধ হলো তারা নিজেদের জন্য কুফরী (বা অবিশ্বাস ও অবাধ্যতাকে) কে এবং কুফরীর পরিণামকে (জাহান্নামের আগুনে বসবাস করাকে) বেছে নিয়েছে।
মুসলিমদের মধ্যেও চির জাহান্নামী থাকতে পারে:
মুসলিমদের মধ্যে অনেক নামধারী মুসলিম আছে যারা চিরকালের জন্য জাহান্নামে থাকবে। তাই মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও অনেক মানুষ চিরকালের জন্য জাহান্নামে যাবে। তাই যারা আল্লাহর বিধানের উপর চলে না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।
নামধারী মুসলিমরা কাফিরের চেয়ে মন্দও হতে পারে:
যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, অথচ কাফিরের মতোই জাহেল বা অজ্ঞ এবং আল্লাহর অবাধ্য; এমতাবস্থায় কেবল নাম, পোশাক ও খাওয়া-দাওয়ার পার্থক্যের কারণে সে কাফির অপেক্ষা কোনোভাবেই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না, আর এ ধরনের কোনো কারণেই সে ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর দয়ার অধিকারী হতে পারে না।
মুসলিম বাস্তবিকই যদি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতো তাহলে আল্লাহর সেই প্রিয়জনেরা দুনিয়ায় নানাভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে কেনো? আল্লাহ কি যালেম (নাউযুবিল্লাহ)? মুসলিম যদি আল্লাহর অধিকার জানতো, তার আদেশ পালন করতো, তাহলে তিনি তার অবাধ্য বান্দাদেরকে মুসলিমদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে দেবেন কেনো? আর মুসলিমদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের বিনিময়ে শাস্তিই বা দেবেন কোন কারণে?
স্বীকার করতেই হবে যে, মুসলিমদের মুসলিম হওয়ার দাবিতে কিছুটা গলদ আছে। তাদের নাম সরকারী দফতরে নিশ্চয়ই মুসলিম হিসেবে লিখিত আছে; কিন্তু সেই সরকারী দফতরের সার্টিফিকেট অনুসারে আল্লাহর দরবারে বিচার হবে না। আল্লাহর নিজস্ব দফতর রয়েছে এবং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই তাঁর দফতরে মুসলিমদের নাম তাঁর অনুগত লোকদের তালিকায় লিখিত আছে, না অবাধ্য লোকদের তালিকায় লিখিত হয়েছে তা খোঁজ করে দেখা আবশ্যক। যেসব কাজ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে, আল্লাহ তা এক এক করে বলে দিয়েছেন, কিন্তু মুসলিম কি সেসব কাজ ত্যাগ করেছে?
যদি স্বীকার করা হয় যে, আল্লাহর কিতাব হতে মুসলিমগণ যেমন কোনো জ্ঞান লাভ করতে চেষ্টা করেনি, তেমনি তাঁর প্রদর্শিত পথেও তারা একটুও চলেনি, তাহলে তারা মুসলিম হলো কিরূপে এবং তারা পুরষ্কারই বা কিরূপে চাচ্ছে। তারা যে ধরনের মুসলমানীর দাবি, ফলও তেমনি পাচ্ছে, আর তেমনি পুরস্কার তারা পরকালেও পাবে।
কাফিররা বিশ্বাস ও কর্ম শুদ্ধ করার লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন পড়ে না এবং তাতে কি লিখিত আছে তা সে জানে না। কিন্তু মুসলমানের অবস্থা যদি এ রকমই হয় তাহলে সে নিজেকে মুসলিম বলবে কোন অধিকারে?
কাফিররা আল্লাহর মর্জি মতো চলে না, চলে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী। মুসলিমও যদি সেরূপ স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়, সেরূপই আল্লাহর প্রতি উদাসীন ও বেপরোয়া হয় এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুগত দাস হয়, তবে তার নিজেকে ‘মুসলিম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর আদেশ পালনকারী’ বলার কি অধিকার আছে?
মোটকথা, কাফেরের ন্যায় মুসলিমও যদি ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ হয় এবং কাফির ও মুসলমানের কাজ-কর্ম যদি একই রকম হয়, তাহলে দুনিয়ায় কাফিরের পরিবর্তে কেবল মুসলিমরাই সম্মান লাভ করবে কেনো?
যাদেরকে মুসলিমরা “কাফির” অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য বান্দাহ মনে করে, তারা মুসলিমদের ওপর সকল ক্ষেত্রে বিজয়ী কেন? আর মুসলিমরা যারা আল্লাহর আদেশ পালনকারী বলে দাবি করে, তারাই বা সব জায়গায় পরাজিত কেনো? এর জবাব সম্ভবত এই যে, মুসলিমদের ও কাফিরদের প্রতি বর্তমানে শুধু নামেই পার্থক্য রয়েছে গিয়েছে। কার্যত মুসলিমরা আল্লাহর প্রতি অবহেলা, ভয়হীনতা এবং অবাধ্যতা দেখাতে কাফিরদের চেয়ে কিছুমাত্র পেছনে নেই। মুসলিমদের ওপর কাফিরদের জয়লাভ এবং সর্বদা মুসলিমদের পরাজয় হয়তো এ অপরাধেরই শাস্তি।
মাদার তেরেসা ও ন্যালসন ম্যান্ডেলার সৎ কাজ:
(ক)মাদার তেরেসা একজন ধর্মপ্রচারক (নান) ছিলেন যার একটি কাজ ছিলো দরিদ্র, নিঃস্ব এবং অসুস্থ লোকদেরকে সাহায্য করার দ্বারা তাদেরকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। তার সৎ কাজগুলো সৎ কাজ বলে আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে হলে তাকে ১.আল্লাহর অভ্রান্ত বিধানে বিশ্বাসী হতে হবে, ২.তার কাজ ঐ সঠিক বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পাদিত হতে হবে এবং ৩.তার সকল কাজের উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ সকল শর্ত পূরণ করা ছাড়া সে পরকালে এ সকল ভালো কাজের কোনো পুরস্কার আশা করতে পারে না। তবে, দুনিয়াতে সে তার প্রতিদান পেতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সুযোগ-সুবিধাকে নিশ্চিতভাবে তার ভালো কাজের প্রতিদান বলে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। কারণ, আল্লাহ বলেন, “যে কুফরী করবে আমি তাকেও কিছুকাল জীবনোপকরন দান করবো; তারপর তাকে ঠেলে দেবো জাহান্নামের আযাবের দিকে।” (২/সূরা আল বাক্বারাহ:১২৬) তাছাড়া সত্য জীবনবিধান (তথা ইসলাম) থেকে মানুষকে ভিন্নপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে (বা খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য) কাজ করা হলে সেটাকে কখনো সৎ কাজ বলা যায় না। আল্লাহর দ্বীন (ইসলাম) থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখার লক্ষ্যে মানুষের অভাব, দরিদ্রতা এবং অসুস্থতাকে কাজে লাগানো কি সৎ কাজ হতে পারে? এ সকল বিচারে ঐ সকল ধর্মপ্রচারকদের বিভিন্ন ভালো কাজকে (সার্বিক বিচারে) ভালো কাজ বলে মেনে নেওয়া যায় না। ফলে সে সকল কাজের পরকালীন সুফলও আশা করা যায় না।
(খ)কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের জন্য ন্যালসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু ইসলাম একদম প্রথম থেকেই কৃষ্ণাঙ্গদের শেতাঙ্গদের মতো সমান অধিকার দিয়ে রেখেছে। ইসলামী শরীআতে কৃষ্ণাঙ্গ, শেতাঙ্গ, আরব, অনারব হিসেবে মর্যাদার কোনো পার্থক্য নেই। এই ১৯৬৫ সাল থেকে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারে আর ইসলামের একদম শুরু থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমরা বড় বড় প্রদেশের গর্ভনর পদে নিয়োগ পেতো। তারপরও এক শ্রেণীর অজ্ঞ ও অন্ধ লোকের কাছে ইসলাম ‘ব্যাকডেটেড’ আর ইউরোপীয় বা আমেরিকান সভ্যতা ‘আপডেটেড’! ন্যালসন ম্যান্ডেলা কি আল্লাহর অভ্রান্ত বিধানে বিশ্বাসী ছিলেন? তার কাজ কি ঐ সঠিক বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পাদিত হয়েছিলো? তার কাজের উদ্দেশ্য কি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিলো? যদি এ প্রশ্নসমূহের উত্তর না বোধক হয় তাহলে সে তার ভালো কাজের পুরস্কার পরকালে কিভাবে আশা করতে পারে? তবে, হ্যাঁ, কারোর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কেউ ঈমান আনেনি, তাওবা (প্রত্যাবর্তন) করেনি; এমনটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যদি ঈমান না এনে থাকে তাহলে জান্নাত লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই।
আল্লাহ শুধু দয়ালু নন; পরাক্রমশালীও:
আল্লাহ নিজেকে কেবল দয়ালু বলে অভিহিত করেননি। দয়ালু নামের বিপরীতে আল্লাহর ভিন্ন গুণবাচক নামও রয়েছে। যেমন আল্লাহর কয়েকটি নাম হলো ১.‘আদদররু’ (ক্ষয়-ক্ষতি যার ইঙ্গিতে হয়ে থাকে) ২.‘আলমুনতাকিমু’ (যিনি প্রতিশোধপরায়ন) ৩.‘আল মুযিল্লু’ (অপমানকারী) ৪.‘আলমুমিতু’ (মৃত্যু দানকারী)। এ দুনিয়ার জীবনে বহু নবী-রাসূলকে কাফিররা হত্যা করেছিলো। কিন্তু আল্লাহ এই নবী-রাসূলদেরকে কাফিরদের অত্যাচার থেকে বাঁচাননি। কারণ, প্রকৃতপক্ষে, এ দুনিয়ার জীবন কোনো স্থায়ী জীবন নয় যে, এখানে প্রভুত্ব করলেই প্রকৃত সফল হওয়া যায়।
প্রকৃত মুসলিম ও কাফিরের আসল পার্থক্য:
এদের উভয়ের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য কেবল মাত্র কুফরি ও ইসলামের। ইসলামের অর্থ-আল্লাহর আনুগত্য করা এবং কুফরীর অর্থ আল্লাহকে অস্বীকার করা, অমান্য করা ও আল্লাহর অবাধ্য হওয়া। মুসলিম ও কাফির উভয়ই মানুষ, উভয়ই আল্লাহর সৃষ্ট জীব। কিন্তু তাদের একজন অন্যজন অপেক্ষা এজন্য শ্রেষ্ঠ যে, একজন নিজের প্রকৃত মনিবকে চিনতে পারে, তাঁর আদেশ পালন করে এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দু:খময় পরিণামকে ভয় করে। কিন্তু অন্যজন নিজ মনিবকে চেনে না এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দু:খময় পরিণামকে ভয় করে না এবং তাঁর আদেশ পালন করে না।
মুসলিমকে কাফির হতে পৃথক করা যায় মাত্র দু’টি জিনিসের ভিত্তিতে। ১.ইলম বা জ্ঞান ২.আমল বা কাজ। অর্থাৎ, প্রত্যেক মুসলিমকে প্রথমেই জানতে হবে যে, তার প্রকৃত মালিক কে? কিসে তিনি সন্তুষ্ট হন আর কিসে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এসব বিস্তৃতভাবে জেনে নেওয়ার পর নিজেকে প্রকৃত মালিকের একান্ত অনুগত বানিয়ে দেবে, তাঁর মর্জিমতো চলবে, নিজের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করবে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কাফির কিছুই জানে না এবং জ্ঞান না থাকার দরুনই তার কার্যকলাপও সে অনুযায়ী হয় না এ জন্য যে, সে আল্লাহ সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ এবং তার অবাধ্য বান্দা। ফলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হবে।
বিশ্বাস ও আচরণ খারাপ হলে ইসলামে বংশ মর্যাদার কোনো দাম নেই:
ব্রাহ্মণের পুত্র মূর্খ এবং চরিত্রহীন হলেও কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের পুত্র বলেই সে ব্রাহ্মণের মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং উচ্চ বংশ বলে পরিগণিত হয়। আর চামারের পুত্র জ্ঞানী ও গুণী হয়েও নীচ ও হীন থেকে যায়; কারণ সে চামারের মত নীচ জাতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসলামে এসব বংশ বা গোত্রীয় মর্যাদার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে লোক আল্লাহতাআলাকে বেশি ভয় করে (এবং সকলের অধিক তাঁর আদেশ পালন করে চলে) সে-ই তাঁর কাছে অধিক সম্মানিত (পরহেযগার)।” (৪৯/সূরা আল হুজরাত:১৩) এ আয়াতে বংশমর্যাদা প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি।
হযরত ইবরাহীম (আ.) একজন মূর্তি-পূজারীর ঘরে জন্ম লাভ করেছিলেন; কিন্তু তিনি আল্লাহকে চিনতে পেরে তাঁর আদেশ পালন করলেন। এ জন্য আল্লাহ তাঁকে সমস্ত জগতের নেতা বা ইমাম করে দিয়েছিলেন। হযরত নূহ (আ.) এর পুত্র একজন নবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল; কিন্তু সে আল্লাহকে চিনতে পারলো না বলে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গেলো। এজন্য তার বংশমর্যাদার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হলো না। উপরন্তু তাকে যে শাস্তি দেয়া হলো, সমস্ত দুনিয়া তা হতে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
মুসলিমরা ইসলাম মানে না- এর চেয়েও বড় বিপদ হলো মুসলিমরা ইসলাম জানে না বা এ সম্পর্কে ভুল জানে:
পবিত্র কুরআনের শিক্ষা কি? রাসুল (সা.) এর প্রদর্শিত পথ কি? এসব কথা প্রত্যেক মুসলমানেরই সুস্পষ্টরূপে জেনে নেওয়া আবশ্যক। এ জ্ঞান না থাকলে কোনো ব্যক্তিই মুসলিম হতে পারে না। মুসলিমদের নিজেদেরই যদি পিপাসা না থাকে, তবে পানি ভরা কূপ তাদের মুখের কাছে আসলেও তাতে কোনো লাভ নেই। আজ মুসলিমরা নামাযে আল্লাহর কাছে কি চায়, তা তারা জানে না। এটার চেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা আর কি হতে পারে? যে ‘কালেমা’ পাঠ করে তারা ইসলামে প্রবেশ করে, এর অর্থ পর্যন্ত তারা জানে না। এ কালেমা পাঠ করার সাথে সাথে মুসলিমদের উপর কি কি দায়িত্ব এসে পড়ে তাও তারা জানে না। বস্তুত একজন মুসলমানের পক্ষে এর চেয়ে বড় ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।
পরকালে কাফিরদের সৎ কাজের প্রতিদান লাভ সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহের জবাবের সারাংশ:
১. কাফিররা পার্থিব প্রতিদান পাবে কিন্তু পারলোকিক প্রতিদান থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
২. তাদেরকে আল্লাহ কিয়ামাতের দিন পরীক্ষা করবেন। তারা উত্তীর্ণ হলে জান্নাতে যাবে, অনুত্তীর্ণ হলে জাহান্নামে যাবে।
৩. মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমনের পর একমাত্র তাঁর প্রতি বিশ্বাসই মানুষকে মুক্তি দেবে। কাজেই অন্য কারো প্রতি বিশ্বাস থাকাটা যথেষ্ট হবে না।
সংযোজন:১
মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছেন কি?
মহাবিশ্বের স্রষ্টা না থাকার পক্ষে নাস্তিকদের যুক্তি ও বক্তব্য হলো (ক)স্রষ্টাকে দেখা যায় না (খ)তাঁকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না (গ)স্রষ্টা মানুষকে তৈরি করেননি বরং মানুষই (কল্পনা করে) স্রষ্টাকে তৈরি করেছে (ঘ)অনেক ধর্মীয় বিধান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ। তাই ধর্ম তথা স্রষ্টায় বিশ্বাস করা অযৌক্তিক।
অপরদিকে স্রষ্টায় বিশ্বাসীগণ নাস্তিকদের যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করেন এভাবে- (ক) অনেক কিছুকেই আমরা না দেখে বিশ্বাস করি। যেমন- বায়ু, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ইত্যাদি। কাজেই দেখতে না পেলেও স্রষ্টাকে বিশ্বাস করাটা অযৌক্তিক হতে পারে না। (খ) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, এমন বিষয়েই বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। যেমন- ১.শৈশবে মা বলে দিয়েছেন যে, অমুক আমার বাবা। আমরা তা বিশ্বাস করেছি। ২.অসুখ হলে ডাক্তারের উপর বিশ্বাস না করলে চিকিৎসা হবে কি করে? ৩.বিচারকের মনে সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে আসামি দোষী বলে বিশ্বাস হলেই বিচারক শাস্তি দেয়, বিশ্বাস না হলে বা সন্দেহ হলে শাস্তি দেয় না। ৪.মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিশ্বাসের উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, ভাই-ভাইয়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক সবই বিশ্বাসনির্ভর। ৫.বাংলা ভাষা শেখার জন্য অ, আ, ক, খ তে বিশ্বাস করেই এ ভাষা শিখতে হয়েছে। ৬.ফসল হবে- এ কথা বিশ্বাস না হলে কৃষক চাষাবাদই করতে পারবে না। ৭.যে কোন সময় মৃত্যু আসতে পারে। তবু মানুষ আরও বেঁচে থাকবে বিশ্বাস করে বলেই জীবন সচল আছে। ৮.জ্যামিতি পড়তে হলে প্রথমেই কিছু Axiom বা স্বত:সিদ্ধ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হয়। যেমন বিশ্বাস করতে হয় যে, বিন্দু (Point)-এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কোনোটিই নেই; তবু বিন্দুর অস্তিত্ব আছে। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এটি একেবারেই অযৌক্তিক। তবুও এটি বিশ্বাস না করলে জ্যামিতি শেখা শুরুই করা যায় না। ৯.বিজ্ঞান চর্চা প্রথমে হাইপথেসিস (বা কল্পনা, অনুমান) দিয়েই শুরু হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক নিউটনের মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন শক্তি আছে, যা বস্তুকে আকর্ষণ করে। এভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার সৃষ্টি হয়। (গ) স্রষ্টা ছাড়া কোনো কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা যে কলম দিয়ে লিখি, যে চেয়ারে বসি বা যে কাপড় পরিধান করি প্রভৃতি সবকিছুরই এক একজন কারিগর থাকে। সেই কারিগরকে না দেখলেও আমরা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। তাই, মহাবিশ্বের কারিগর বা স্রষ্টা অবশ্যই আছেন। স্রষ্টায় বিশ্বাস করাটা তাই (নিঃসন্দেহে) মানব-বিবেকের দাবি। এ বিশাল মহাবিশ্বকে মানুষ সৃষ্টি করেনি বরং স্রষ্টাই মানুষসহ মহাবিশ্বের সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। (ঘ) স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় বিধান ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে না। ত্রুটিপূর্ণ বিধান আসলে কোন ধর্মই নয়। সেটি আসলে অধর্ম বা ভ্রান্ত ধর্ম।
স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো যাচাই করলে সুস্থ বিবেক রায় দেয় যে- মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছেন এবং তিনি আমাদেরকে যে ধর্ম বা বিধি-বিধান দিয়েছেন তাতে কোনো রকম ভ্রান্তি থাকতে পারে না।
সংযোজন:২
আল্লাহ শব্দের যৌক্তিকতা:
‘ঈশ্বর’ পুরুষ লিঙ্গের শব্দ যার স্ত্রী লিঙ্গ হলো ‘ঈশ্বরী’। অনুরূপভাবে ‘God’/‘god’ পুরুষ লিঙ্গের আর ‘goddess’ স্ত্রী লিঙ্গের। ‘God’/‘god’ ও ‘ঈশ্বর’ পুরুষলিঙ্গ হওয়ায় তারা তো পুরুষের পক্ষে আর নারীর বিপক্ষে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অপরদিকে ‘আল্লাহ’ শব্দের কোনো পুরুষ বা স্ত্রী লিঙ্গ হয় না। এছাড়া অর্থের দিক দিয়েও ‘God’/‘ঈশ্বর’ ও ‘আল্লাহ’র মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাছাড়া ‘আল্লাহ’ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই এবং ভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন কোনো অনুবাদও নেই। ‘আল্লাহ’ শব্দের বিকল্প শুধু ‘আল্লাহ’ই।
‘ইলাহ’ শব্দ দ্বারা বুঝায় ১.যাকে ছাড়া আর কারো গোলামী (বন্দেগী, ইবাদাত, দাসত্ব) করা যায় না ২.যাকে ছাড়া (বা যার বিরোধী) আর কারোর হুকুম (বিধান, আইন) মানা যায় না ৩.যাকে ছাড়া আর কাউকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করা যায় না ইত্যাদি। আর ‘আল্লাহ’ শব্দের বিশ্লেষণ করলে হয় আল + ইলাহ (অর্থাৎ একমাত্র ইলাহ। ইংরেজিতে: The (/only one) + Ilah.
প্রচলিত অধিকাংশ সাহিত্যে লক্ষ্যার্থের দিক থেকে ‘God’, ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘খোদা’, ‘স্রষ্টা’ এগুলো প্রায় সমার্থক। কিন্তু অর্থের দিক থেকে এ শব্দগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দের বহু অর্থের একটি মাত্র। এছাড়া, ‘God’, ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘খোদা’, ‘স্রষ্টা’ ইত্যাদি শব্দের অর্থ তুলনামূলকভাবে ‘আল্লাহ’ শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ হওয়ায় সেগুলো একজন বিবেকবান মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দটি ব্যাপক অথর্বোধক হওয়ায় তা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
সংযোজন:৩
নবীগণ সাধারণ মনীষীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কেনো?
নবী নন এমন মনীষীরা বিশ্বমানবতার সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানে পরস্পরবিরোধী ও ভ্রান্তিযুক্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তাছাড়া তারা বিশ্বস্রষ্টার পক্ষ থেকে নির্ভূল কোনো পথ-নির্দেশনা লাভ করেন না। ফলশ্রুতিতে তারা মানুষের সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানে একচোখা ধরনের মতবাদ উপস্থাপন করেন। কেউ বলেন, মানুষের ‘পেট সমস্যা’র সমাধান হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। আবার কেউ বলেন মানুষের ‘যৌন সমস্যা’র সমাধান হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ও সম-চরিত্রের মানুষ নন। অথচ, সকল নবীই আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত, তারা সর্বোত্তম মানুষ, তাদের মূল প্রচারণা একটিই (বা এক ধরনের)। মানুষের উপর মানুষের অন্যায় আধিপত্য সরিয়ে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়াকেই তাঁরা সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠিরূপে প্রচার করেছেন।
সংযোজন:৪
রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল মানুষের সেরা:
রাসূল (সা.) এর সাথে অন্য কোনো মানুষের তুলনা হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (৩/সূরা আল আহযাব:২১) বুঝার সুবিধার্তে (উদাহরণ হিসেবে) ধর্মনেতা গৌতম বুদ্ধের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। কিছু বিচারবিন্দু সামনে এনে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে গৌতম বুদ্ধকে মেলালেই বুঝা যায় যে. রাসূল (সা.)-ই সর্বোত্তম, অদ্বিতীয় ও অনন্য আদর্শ। রাসূল (সা.) প্রসঙ্গে বিচারের বিষয়গুলো নিম্নরূপ হতে পারে: ১.রাসূল (সা.) এর জন্ম, মৃত্যু, বংশ, ঐতিহাসিক বিবরণ ইত্যাদি বিষয় খুঁটিনাটিসহ সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়। ২.জীবনের সকল অঙ্গনে রাসূল (সা.) শ্রেষ্ঠ আদর্শ রেখে গেছেন (যেমন: সামাজিক, সংগ্রামী ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে)। ৩.রাসূল (সা.) সমস্যা এড়িয়ে যাননি। বরং সমাধান করে দেখিয়েছেন। রাখাল হওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তিনি বিচরণ করেছেন। ৪.শিশুকাল, শিক্ষাকাল, বিয়ে, সংসার, মৃত্যুকাল প্রভৃতি সকল বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রদর্শন করেছেন। ৫.তিনি নারীর প্রতি সুধারণা দিয়েছেন। সার্বিক বিচারে নারীকে পুরুষের সম অধিকার (তথা প্রাপ্য অধিকার) প্রদান করেছেন। ৬.দাস-দাসীর সাথেও তিনি ভালো ব্যবহার করতেন। দাসমুক্তিতে তিনি ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। শত্রু-মিত্র, স্বধর্মী-বিধর্মী সকলের সাথে তিনি উত্তম ব্যবহার করতেন। ৭.সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হয়ে তিনি সমাধান করেছেন, দেখিয়েছেন ও শিখিয়েছেন। ৮.তিনি আংশিক নয় পূর্ণাঙ্গ জীবনে পরিবর্তন এনেছেন। ৯.তিনি চরম ও কঠিন বাধা এবং অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১০.নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই তিনি আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। ১১.তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান (কুরআন) লাভ করেছিলেন। ১২.তিনি ইহকালে সৎকর্মের মাধ্যমে পরকালের সাফল্যকে অগ্রাধিকার দিতেন। ১৩.তিনি দেহ ও আত্মার সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৪.তাঁর শিষ্যরা (সাহাবীরা) তাকে ত্যাগ করেনি বরং তাঁকে রক্ষা করতে অকাতরে প্রাণ দান করেছেন। ১৫.তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে ‘আধুনিকতাকে ইসলামীকরণ’ ও ‘জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ করতে হয়। ১৬.তিনি ধর্মহীন কর্ম ও কর্মহীন ধর্মের দীক্ষা দেননি। ১৭.তিনি দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করেছিলেন। ১৮.তিনি পার্থিব কাজকে দ্বীনি ও দুনিয়াবী এভাবে বিভাজন না করে হালাল ও হারামে ভাগ করেছিলেন। ১৯.কিশোর, যুবক, গৃহী, সেনাপতি, ইমাম (ধর্মীয় নেতা), রাষ্ট্রনেতা ইত্যাদি সর্বস্তরের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ আছে তাঁর জীবনে। ২০.তাঁর জীবনে মানুবজীবনের সকল সমস্যা সমাধানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত বিদ্যমান। ২১.সকল পরিস্থিতিতে খাপ-খাওয়ানোর আদর্শ তিনি দেখিয়েছেন। ২২.তিনি ব্যবহারোপযোগী ও বাস্তব বিধান নিয়ে এসেছিলেন। অহিংসা, জীবহত্যা, শান্তি এগুলোর কাল্পনিক, অবাস্তব ও তাত্ত্বিক রূপের পরিবর্তে তিনি প্রকৃত রূপ তুলে ধরেছিলেন। এভাবে গৌতম বুদ্ধের সাথে মেলালে দেখা যায় রাসূল (সা.) অদ্বিতীয়। প্রধান প্রধান প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থে রাসূল (সা.) এর আগমণবার্তা স্থান পেয়েছে যা রীতিমতো আশ্চর্য হওয়ার মতো। ব্যাপারটি এমন যে- কেউ যদি প্রকৃত খৃস্টান হতে চায় বা প্রকৃত হিন্দু হতে চায় তাহলে তাদেরই উচিত তাদের ধর্মগ্রন্থের অনুসরণে রাসূল (সা.) এর প্রকৃত অনুসারী হয়ে যাওয়া।
সংযোজন:৫
ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল প্রয়োজন:
(ক)পৃথিবীতে ১০০০ জনকে হত্যার অপরাধে কোনো অপরাধীকে ১০০০ বার হত্যা করার যায় না।
(খ)এ পৃথিবীতে মানুষ সব সময় ভালো কাজের অনুরূপ ভালো ফল আর মন্দ কাজের অনুরূপ মন্দ ফল পায় না।
(গ)উপরিউক্ত প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার সম্ভব নয় বলেই ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল অবশ্যই প্রয়োজন।
পরকালে মুক্তির পথ একটাই:
(ক)একই অসুখে বিভিন্ন মানুষের জন্য একই ধরনের গুণসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োজন। ডায়রিয়া হলে বৌদ্ধের জন্য যে স্যালাইন লাগে খ্রিষ্টানের জন্যও তা প্রযোজ্য। বিনা যাচাইয়ে যে যার খুশিমতো ওষুধ সেবন করলে রোগমুক্ত হওয়ার পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
(খ)অনুরূপভাবে, পরকালে মুক্তির জন্যও বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন পথ অনুসরণ করলে চলবে না; বরং সকল মানুষকে একটি পথই অনুসরণ করে চলা আবশ্যক।
সব ধর্মই কি ঠিক?
(ক)পৃথিবীতে হাজার হাজার বা ততোধিক ধর্ম রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পরস্পর বিপরীত।
(খ)পরস্পরবিরোধী দুটি তথ্যের দুটোই সত্য হতে পারে না। ঠিক তেমনি, বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ধর্মসমূহের সবগুলোই সর্বাংশে সত্য হতে পারে না।
(গ)পৃথিবীতে বিদ্যমান ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে দুটো বিষয় সত্য বলে প্রমাণিত হয়- ১.প্রায় সকল ধর্মেই কিছু না কিছু ভালো কথা আছে। ২.প্রায় সকল ধর্মেই কিছু ত্রুটিপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যায়।
(ঘ)উপরিউক্ত তথ্যদ্বয় দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অধিকাংশ ধর্ম ভালো কথা ও ত্রুটিপূর্ণ কথার সমাহার। কিন্তু প্রকৃত ও সত্য ধর্মে (বা জীবনবিধানে) একটিও ত্রুটি থাকা সম্ভব নয়।
(ঙ)যে ধর্মে একটিও ত্রুটিপূর্ণ কথা নেই সেই ধর্মটিই কেবল সঠিক। অন্য সকল ধর্ম ভ্রান্ত বা অন্তত ভ্রান্তিমিশ্রিত।
(চ)গাণিতিক সমস্যার সঠিক ফলাফল এক রকমেরই হয় কিন্তু ভুল ফলাফল হয় বহু ধরনের। ঠিক তেমনি, সঠিক ধর্ম কেবল একটি আর ভ্রান্তিমিশ্রিত ধর্ম অগণিত।
সঠিক ধর্ম কোনটি?
(ক)জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রধান প্রধান ধর্মগুলো হলো ইসলামী জীবনবিধান, খ্রিষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি।
(খ)সব ধর্মের অনুসারীরাই সাধারণত নিজ নিজ ধর্মকে সঠিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু সঠিক নয় এমন কোনো ধর্মকে তথ্য ও যুক্তির দ্বারা শ্রেষ্ঠতম বলে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে বল-প্রয়োগে, ভয় দেখিয়ে বা প্রচার-মাধ্যমের শক্তির জোরে কেউ তার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করলে ভিন্ন কথা।
(গ)পৃথিবীতে কেবল একটি অভ্রান্ত ধর্ম (প্রকৃত অর্থে জীবনবিধান) আছে যা সকল দিক দিয়েই অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম। নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করলে তা অবশ্যই সকলের কাছে ধরা পড়বে বলে আশা করা যায়।
সংযোজন:৬
সকল বিবেচনায় অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম জীবনবিধান কোনটি?
(ক) ধর্মের নামকরণ:
১.প্রায় সকল ধর্মের নামকরণ হয়েছে ঐ ধর্মের প্রবর্তকের নাম অনুসারে। যেমন যীশুখৃষ্টের নামানুসারে খ্রিষ্ট ধর্ম, গৌতম বুদ্ধের নামানুসারে বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামের নামকরণ কোন ব্যক্তির নামানুসারে হয়নি।
২.প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোন বিশেষ জাতির ধর্ম নয়; এটা গোটা মানবজাতির জন্য এক অভ্রান্ত জীবনবিধান (যে কোনো জাতির, বংশের, বর্ণের, ভাষার অথবা দেশের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে পারে বা মুসলিম হতে পারে)।
৩.ইসলাম (আত্মসমর্পন বা শান্তি) কথাটাও যেমন সার্বজনীন এ নামের জীবনবিধানটাও তেমনই সার্বজনীন।
(খ) ধর্মকে অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে:
১.একমাত্র ইসলামই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার যৌক্তিক দাবি তুলতে পারে।
২.ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র-পরিচালনা, যুদ্ধ-সন্ধি, চুক্তি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের খুঁটিনাটি ও বিস্তারিত আইন-কানুন একমাত্র ইসলামেই আছে; যা অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নেই।
(গ) ধর্মীয় আইন হতে হবে নির্ভুল:
১.পৃথিবীতে এমন বহু ধর্ম আছে যার আইন মানুষকেই সংশোধন করতে হয়। যে ধর্ম বা আইন ভুল এবং যা মানুষকেই সংশোধন করতে হয়, তা কি স্রষ্টা প্রেরিত ধর্ম হতে পারে? নিশ্চয়ই নয়।
২.অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন ধর্ম ত্যাগ করে কেনো মুসলিম হয়েছেন তার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, অন্যান্য ধর্মের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে মানুষ, আর মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে ইসলাম।
৩.প্রকৃতপক্ষে, এ গৌরব একমাত্র ইসলামই করতে পারে যে এর একটি কথাও অবৈজ্ঞানিক নয়। উপরন্তু, প্রায়ই দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভিন্ন সময়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সর্বশেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, সেকথা বহু আগেই ইসলাম বলে রেখেছে।
(ঘ) ধর্মীয় বিধান পক্ষপাতহীন হতে হবে:
১.কোনো কোনো ধর্মে দেখা যায় ‘উপাসনা’ সবাইকে করতে হয় না। এমনকি সবার উপাসনার অধিকার পর্যন্ত নেই।
২.হিন্দুদের বেলায় এমন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে যা অবশ্যই পক্ষপাতমূলক। যেমন পূজার পৌরহিত্য করার অধিকার একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই আছে এবং তা আছে জন্মসূত্রে।
৩.খ্রিষ্টানদের বেলায় উপাসনা মূলত ধর্মযাজকদের জন্য। আর অন্যান্যদের জন্যে শুধু যীশুখৃষ্টের প্রতি বিশ্বাসই যথেষ্ট।
৪.ইসলামে উপরিউক্ত ধরণের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষপাত অনুপস্থিত।
(ঙ) পৈত্রিক ধর্ম অপেক্ষা অধিক যুক্তিগ্রাহ্য না হলে কেউ সাধারণত নতুন ধর্ম গ্রহণ করে না:
১.যারাই শিক্ষিত ও জ্ঞানী (স্বার্থবাজ, মূর্খ বা অতিদরিদ্র নয়) তারা কেউই কোনোদিন ইসলামের চেয়ে অন্য ধর্মকে অধিক যুক্তিগ্রাহ্য মনে করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছে এমন নজির ইতিহাসে নেই বললেই চলে।
২.কিন্তু অন্যান্য ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণের দৃষ্টান্ত রয়েছে অগণিত।
(চ) ধর্মীয় গুরু ব্যক্তিগণকে হতে হবে সবার জন্য আদর্শ:
১.কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি পাশ একজন নও-মুসলিম তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: “যদি দেশের যুবক ছেলেরা শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ অনুসরণ করে যুবতী মেয়েদের কাপড় নিয়ে গাছে বসে থাকে তাহলে সমাজের অবস্থা কি হবে?” “কোথায় হিন্দুদের ভগবানের লীলা আর কোথায় মুসলমানদের নবী-রাসূলগণের আদর্শ চরিত্র?” এসব চিন্তা করে আমি আর হিন্দু থাকতে পারলাম না; ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম।
(ছ) ধর্মের দৃষ্টিতে সাধু ব্যক্তি:
১.অনেক ধর্ম অনুযায়ী সাধু ব্যক্তিগণ সমাজে মিশতে পারেন না, বিয়ে করতে পারেন না বা এরকম আরও অনেক অনেক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে বাধ্য থাকেন।
২.অনেক সময় সাধারণ লোকদেরকে ঐ সাধু ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে নিষেধ বা অনুৎসাহিত করা হয়।
৩.ধর্মীয় সাধু ব্যক্তিগণ যদি অনুসরণীয়ই না হন তাহলে তারা কি রকম সাধু?
৪.অপরদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে মহামণীষীবৃন্দ সকলের জন্য সমভাবে অনুসরণীয়।
৫.যে সকল ধর্মের সাধু ব্যক্তিদের দ্বারা একটি দেশ চলতে পারে না, সে সকল ধর্ম কি করে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম হতে পারে?
(জ) ধর্মের ব্যপ্তি:
১.হিন্দু ধর্মের যাবতীয় ইতিহাস আর কর্মকাণ্ড সবই ভারতকেন্দ্রিক। তাহলে প্রশ্ন: হিন্দুদের ভগবান কি শুধু ভারতই চেনেন এবং অন্যান্য দেশ সম্পর্কে কি তিনি কোন খোঁজ-খবর রাখেন না?
২.আল-কুরআন শুধু পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মাটির নীচের সমুদ্রের তলদেশের এমনকি আকাশের সাত স্তরের উপরে কোথায় কি আছে- না আছে তার কোনো তথ্য দিতেও ভুল করেনি।
আল-কুরআনই একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্মগ্রন্থ:
(ক)কুরআনে এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা নাযিল হয়েছে ১৪ শত বছরেরও অধিক পূর্বে আর তার সত্য প্রমাণ হচ্ছে এ শতাব্দীতে।
(খ)কুরআনের একটি কথাকেও আজ পর্যন্ত কেউ অবৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণ করতে পারেনি।
(গ)বিজ্ঞান কুরআনের ভুল ধরতে পারেনি কখনও কিন্তু কুরআন বিভিন্ন সময় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার ভুল ধরেছে। প্রথমে বিজ্ঞানীদের একাংশ কুরআনের ভুল ধরার অহমিকা করলেও পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।
(ঘ)যুগের পরিবর্তনেও কুরআন বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি অপরদিকে বিজ্ঞান প্রায়ই নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে
(ঙ)কুরআন প্রথমেই সর্বশেষ সংস্করণ। কোন ভুল না থাকার চ্যালেঞ্জ দ্বারা কুরআন শুরু হয়েছে।
(চ)আল্লাহ বলেন, “আমি আমার বান্দার প্রতি যে গ্রন্থ ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ করেছি, সে বিষয়ে যদি তোমরা সন্দেহ কর, তবে এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। আর এজন্য আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সমর্থক ও সাহায্যকারীদের ডেকে আনো, যদি তোমরা তোমাদের সন্দেহে সত্যবাদী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর, যদিও তা তোমরা কখনও করতে পারবে না; তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা হয়েছে সত্য-প্রত্যাখ্যানকারী (কাফির)-দের জন্য।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৩-২৪)
(ছ)এক বৈজ্ঞানিকের স্বীকারোক্তি হচ্ছে, “বিজ্ঞান এতদিন (নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে) যে দাবি করে এসেছে, তার অধিকাংশই অতিরঞ্জিত। বিজ্ঞানের নবজাগ্রত আত্মচেতনা সত্য এখন বুঝতে পেরেছে।” (বিশ্বনবী: গোলাম মোস্তফা)
(জ)মহাবিজ্ঞানময় কুরআনের বিপরীতে সকল বৈজ্ঞানিক মতবাদই অগ্রহণযোগ্য। কারণ, বিজ্ঞানীদের জ্ঞান সীমিত; আল্লাহর জ্ঞান নয়। আল্লাহ বলেন, “তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:৮৫)
(ঝ)কুরআনে রয়েছে এক মহা আশ্চর্য ও নির্ভুল গাণিতিক বন্ধন। যেমন “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” লিখতে আরবিতে ১৯টি অক্ষর লাগে। এতে ইসম, আল্লাহ, আর-রহমান, আর-রহীম শব্দ চতুষ্টয় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ইসম’ শব্দ কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে ১৯ বার (১×১৯), আল্লাহ ২৬৯৮ (১৪২×১৯) বার, আর রহমান ৫৭ (৩×১৯) ও আর রহিম ১১৪ (৬×১৯) বার; অর্থাৎ সবই ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য। ‘আলিফ লাম মীম’ সহ ১৪টি বর্ণ নিয়ে গঠিত ১৪টি কোড ব্যবহৃত হয়েছে ২৯টি সূরায়; যার অর্থ ১৪+১৪+১৯=৫৭=৩×১৯। এক কথায় সম্প্রতি আবিষ্কৃত কুরআনে ব্যবহৃত বর্ণসমূহের মধ্যে বিদ্যমান নিখুঁত গাণিতিক বন্ধনও কুরআনকে অদ্বিতীয় করে দিয়েছে।
(ঞ)কুরআন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিজের রচনা হতে পারে না। কারণ, কুরআন তাঁর রচনা হলে এতে তাঁর প্রতি ধমক স্থান পেতো না। (সূরা আবাসা ওয়াতা ওয়াল্লা দ্রষ্টব্য) তাছাড়া যেহেতু কুরআনের অলৌকিকত্ব এটিকে শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের মর্যাদা দেয় সেহেতু কেউ যদি (জোর করে) এটিকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিজের রচনা বলেনও তখন তাকে একথা স্বীকার করতে হবে যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে) শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। আর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেই বলেছেন- কুরআন আল্লাহর কিতাব।
(ট)বিশ্বে কুরআনের সকল কপির মধ্যে বিন্দু পরিমাণ তারতম্যও নেই; যা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে আছে।
(ঠ)বিশ্বের সকল ধর্মগ্রন্থ নষ্ট হয়ে গেলে শুধু কুরআনই হাফেজদের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তাছাড়া আগা-গোড়া, বুঝে বা না বুঝে কুরআন কন্ঠস্থ করেছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। অন্য ধর্মগ্রন্থ কন্ঠস্থকারী (বা মুখস্থকারী) একজন লোকও পাওয়া যায়নি।
(ড)একমাত্র কুরআনই অবিকৃত অবস্থায় আছে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হয়ে গেছে।
জীবন সমস্যা সমাধানে মানবসৃষ্ট মতাদর্শ ও ধর্মসমূহ কেন নির্ভুল নয়?
(ক)মানবীয় আদর্শসমূহ অত্যন্ত দুর্বল। মানুষের বুদ্ধি প্রায়ই স্বার্থের দাস হয়ে থাকে। সমকালীন পরিবেশ ও ঘটনাবলী তার বুদ্ধি-বিবেককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তাই, মানবরচিত বিধান সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকে।
(খ)পক্ষান্তরে, কুরআন প্রণেতা আল্লাহতাআলা কামনা-বাসনা ও স্বার্থের উর্ধ্বে। তাঁর বুদ্ধি-বিবেক ত্রুটিহীন। তিনিই মানুষ এবং মানুষের স্বভাব প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহর বিধানই ত্রুটিহীন হওয়া সম্ভব।
বিধান রচনায় মানুষের দুর্বলতার আরও কিছু দিক:
(ক)মানুষের জ্ঞান সীমিত। পক্ষান্তরে আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। “মহাকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবই আল্লাহ জানেন। (আর) সকল বিষয় সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান আছে।” (৪৯/সূরা হুজরাত:১৬)
(খ)মানুষ প্রায়ই অতীতকে ভুলে যায়, বর্তমান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে আর ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত জ্ঞান তার নেই। পক্ষান্তরে, “(আল্লাহ) তাদের সম্মুখের (বর্তমান বা ভবিষ্যতের) ও পেছনের সকল কিছুই জানেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৫৫)
(গ)মানুষ অন্য মানুষের মনের ভেতরে কি আছে তা জানে না; কিন্তু আল্লাহ তা জানেন। “পৃথিবী ও মহাকাশের প্রত্যেকটি বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে তাঁর (আল্লাহর) জ্ঞান আছে। তোমাদের প্রকাশ্যে বা গোপনে করা সকল কাজই তিনি জানেন এবং (প্রতিটি কাজের সময়) তোমাদের মনের অবস্থাও তিনি জানেন।” (৬৪/সূরা আত তাগাবুন:৪)
(ঘ)মানুষ সর্বদা ১০০% পক্ষপাতহীন আইন তৈরি করতে চাইলেও পারে না। কিন্তু আল্লাহ এতে সমর্থ। “তিনি (আল্লাহ) সকল কিছুর রব। নিজ অর্জন নয় এমন কিছু তিনি কারো উপর চাপান না। একজনের বোঝা অন্যজনের উপর তিনি চাপান না।” (৬/সূরা আল আনআম:১৬৪)
(ঙ)মানুষ জীবনের এক দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দিকে অবহেলা করে বসে। কারণ, তার মেধাশক্তি ও স্মৃতিশক্তিসহ সকল শক্তিই সীমিত। পক্ষান্তরে- “সকল শক্তি একমাত্র আল্লাহর করায়ত্ত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৬৫)
(চ)মানুষের কর্মস্থল সংকীর্ণ। কিন্তু- “তাঁর (আল্লাহর) গদি (ক্ষমতা ও প্রশাসন) পৃথিবী ও মহাকাশ জুড়ে বিস্তৃত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৫)
(ছ)মানুষ মরণশীল। পক্ষান্তরে আল্লাহ চিরঞ্জীব। “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো (সঠিক বা সার্বিকভাবে কল্যাণকর) আইন প্রণেতা নেই। তিনি চিরস্থায়ী এবং সব কিছুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে রেখেছেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৫)
(জ)সময়ের পরিবর্তনে মানবরচিত বিধান বা আইন পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আল্লাহ সর্বজ্ঞানী বিধায় তার আইনে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহ বলেন, “(ভুল না থাকায়) আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নেই। এটি এক মহাসাফল্য।” (১০/সূরা ইউনুস:৬৪)
(ঝ)মানুষ নানা বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেন না। কুরআন বলছে-“মানুষেরই কৃতকর্মের ফলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর জলভাগে ও স্থলভাগে।” (৩০/আর রূম:৪১)
(ঞ)আরও কিছু কিছু কারণে মানবরচিত আইন ভুল-ত্রুটি ও অকল্যাণের জন্ম দেয়। কারণ, ১.যারা আইন রচনা করে, তারা অনেক সময় সব মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে আইন তৈরি করে ২.কখনও কখনও অপশক্তির চাপে বা স্বেচ্ছায় দেশের বেশির ভাগ লোকের ঈমান-আকীদা (বিশ্বাস ও চেতনা) বিরোধী আইন তৈরি করা হয়। পক্ষান্তরে, আল্লাহর বিধান কোন অত্যাচারী গোষ্ঠীকে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার সুযোগ দেয় না। আর সেজন্যই, আল্লাহর আইনের পক্ষে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা কোন কালেই বন্ধ হয়নি।
মানবরচিত কিছু মতাদর্শের পরিচয়:
সমাজতন্ত্র (Socialism):
এটি বলতে এমন এক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায়, যে ব্যবস্থায় উৎপাদনের সকল উপাদান সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বন্টন এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থা সমাজ কর্তৃক পরিচালিত এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি তিরোহিত, না হয় নিয়ন্ত্রিত।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.সম্পদে ব্যক্তির কোনো অধিকার থাকবে না ২.সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের ৩.নাস্তিকতাবাদ বা পরকালে অবিশ্বাস ৪.এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের জন্ম দেয় ৫.রাষ্ট্র বা পার্টি প্রধানদের অবাধ ব্যয়ের সুযোগ
সাম্যবাদ (Communism):
বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়কে সাম্যবাদ বলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন সমাজে শ্রেণী সংঘাত থাকবে না। শ্রেণীহীন সমাজ (Classless Society) প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজতন্ত্র যখন এ অবস্থায় পৌছাবে তখন রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন হবে না। রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি আপনা থেকেই লোপ পাবে। এ অবস্থায় সাম্যবাদ এর পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism):
এ মতবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.আল্লাহর সার্বভৌমত্বে অনাস্থা ২.ধর্ম ব্যক্তি জীবনেই শুধু সীমাবদ্ধ ৩.এটি একটি কুফরী মতবাদ (৪/সূরা আন নিসা:৭৬ দ্রষ্টব্য) ৪.নৈতিকতা বিবর্জিত ৫.আদর্শ বিমুখতা ৬.চরিত্র বিধ্বংসী কার্যকলাপ ৭.স্বেচ্ছাচারী ও ত্রুটিপূর্ণ শাসন।
পুঁজিবাদ (Capitalism):
অবাধ ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী একটি মতাদর্শ। পুজিঁ সংগ্রহ ও বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা। মূল কথা- বস্তুবাদ ও ভোগবাদ। আত্মতুষ্টির জন্য ব্যক্তি বস্তুর যথেচ্ছ ব্যবহার (maximization of satisfaction) ও তা কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং maximization of satisfaction এর পথ পরিস্কার রাখা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবেনা। পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আত্মতুষ্টি পাওয়ার জন্য অন্য দেশ ও জাতির উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী থাবা বিস্তার করে। এমনকি গোটা পৃথিবীটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.আদর্শহীনতা ২.ব্যক্তি তার উপার্জিত সম্পদের মালিক, এতে অন্যের কোনো অধিকার নেই ৩.ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আকাশচুম্বী ৪.স্রষ্টা ও ধর্ম উপেক্ষিত ৫.মজুতদারীর অবাধ সুযোগ ও অবৈধ-বৈধের পার্থক্যহীনতা ৬.উপার্জিত অর্থ ইচ্ছামত ব্যয় করা যাবে।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism):
জাতীয়তাবাদ হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, ভাষা, বংশ, গোত্র, ধর্ম, অর্থনৈতিক ঐক্য, এক শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে গঠিত একটি চেতনা, এক ধরনের মানসিকতা এবং অনুভূতি যা মানুষকে একত্রিত করে এবং জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.জাতির জন্য যে কোনো কাজ করা যাবে ২.আদর্শহীনতা ৩.জাতিকে বিতর্কিতকরণ ৪.বিশ্বমানবতাকে উপেক্ষা ৫.ন্যায়-অন্যায়ে পার্থক্য না করা বা কম করা ৬.অহংকারের জন্মদান ৭.ব্যক্তি সমস্যায় উদাসীনতা ৮.বিশ্বরাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করা ৯.সংঘাত সৃষ্টিকারী ১০.হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো।
গণতন্ত্র (Democracy):
গণতন্ত্র হচ্ছে একপ্রকারের শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর জনগণ সমভাবে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় এবং রাজনৈতিক কার্যাবলীতে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার থাকে। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থাই গণতন্ত্র। আব্রাহাম লিংকনের ভাষায় “Democracy is a government of the people, by the people and for the people.”
উল্লেখ্য, (ক)জনগণের সার্বভৌমত্বভিত্তিক গণতন্ত্র ইসলামে স্বীকৃত নয়। (খ)যারা নিজ দলের ভেতরেই গণতন্ত্র চালু করতে ব্যর্থ হয়, তারা কিভাবে দেশে গণতন্ত্র চালু করবে?
প্রচলিত গণতন্ত্র আসল (বা উপকারী) গণতন্ত্র নয় (বা জনগণের প্রকৃত কল্যাণের তন্ত্র বা মতবাদ নয়)। এ গণতন্ত্রে তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। কিন্তু বাস্তবে ধনী, ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী ও মুষ্টিমেয় কিছু লোকই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে। এমনকি জনগণ কাকে ভোট দেবে- এ বিষয়টিও অনেকটা ঐ মুষ্টিমেয় লোকদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। অপরদিকে তাত্ত্বিকভাবে হলেও ‘জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস’ বলা হলে তা ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস’ এ তথ্যের বিরোধী হয়ে যায় যা এক ধরণের শিরকও বটে।
আসল (বা উপকারী) গণতন্ত্র (বা মানুষের কল্যাণের পথ) রয়েছে ইসলামে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার পরই ইসলামী গণতন্ত্র (তথা ইসলামের মূলনীতির আলোকে মানুষের কল্যাণের পথ) প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ইসলামের মতো শ্রেষ্ঠ নিয়ামাত গ্রহণে অনিচ্ছুক জাতিকে জোর করে এ নিয়ামাত চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর রীতি (বা সুন্নাত) নয়। তাছাড়া, যথোপযুক্ত জনসমর্থন আদায় না করে অধিকাংশ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের উপর জোর করে ইসলামী বিধান জারি করা স্বাভাবিক ও কার্যকর পদ্ধতি নয়। আবার, প্রচলিত পন্থাকে পাশ কেটে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা জোর করে ক্ষমতা দখল করারই নামান্তর- যা সাধারণত ফলপ্রসূ ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে, বিনা রক্তপাতে কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে ক্ষমতায় পৌঁছানোর সুযোগ থাকলে সে সুযোগ গ্রহণ করাতে দোষের কিছু নেই।
তর্কের খাতিরে নির্বাচনের পন্থাকে ভুল ধরে নিলেও এ পন্থা সকলের জন্য খোলা রাখা হয়েছে। ইসলামী আদর্শের বিজয়ের লক্ষ্যে অন্য পন্থা এর চেয়ে ভালো হলেও তার সুযোগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শকে এগিয়ে নেওয়াটাই মূল বিষয়, কোন পন্থা বেশি ভালো এ বিতর্ক করে সময় ক্ষেপন করে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে থমকে থাকাটা নয় বড় বিষয় নয়।
তথ্যসূত্র:
১.যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু অনেক ভালো কাজ করেছেন, কিংবা যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, তাদের পরিণাম কী হবে- ইউসুফ সুলতান
(http://yousufsultan.com/those-who-didnt-get-dawah-of-islam/)
২.মুসলিমরা জান্নাতে যাবে আর হিন্দুরা জাহান্নামে যাবে এতে কি সুবিচার হয়- শায়খ বিন বায (https://deenilhaq.wordpress.com/2014/03/17/)
৩.অমুসলিমদের এত সম্পদ! তার মানে কি ইসলাম ভূল- মুহাম্মদ রাসেল (http://pchelplinebd.com/Islam/archives/3852)
৪.ন্যালসন ম্যান্ডেলা কি জান্নাতে যাবেন না জাহান্নামে যাবেন - শফিউর রহমার ফারাবী (https://www.amarblog.com/shafiur2012/posts/175691)
৫.ঈমানের হাকীকত- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
৬.মৃত্যু যবনিকার ওপারে- আব্বাস আলী খান
৭.ইসলাম একমাত্র ভ্রান্তিহীন বিধান- তানজীর আহমাদ
ডাউনলোড :
https://bit.ly/Rahikul-Maktum
বিভিন্ন জনের প্রশ্ন:
(ক)ন্যালসন ম্যান্ডেলা বা মাদার তেরেসার মতো ভালো মানুষেরা কি জান্নাতে যাবেন না জাহান্নামে যাবেন? অনেক মহান ব্যক্তি আছেন যারা মুসলিম নন, কিন্তু জীবনের সকল কর্ম মানুষের কল্যাণার্থে সম্পন্ন করেছেন। এই শ্রেণীর মানুষেরা পরকালে কি কোনো প্রতিদান পাবেন না?
(খ)যারা অমুসলিম এটা কি তাদের দোষ যে তারা অমুসলিম? তারা জন্ম নিয়েছে অমুসলিমের ঘরে। তাই তারা ভিন্ন ধর্মানুসারী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজ ধর্মকেই সত্য জানে এবং সেটাই পালন করে। আল্লাহ শাস্তি দিলে খারাপ মানুষদের দিতে পারেন কিন্তু ভালো মানুষ কেনো শাস্তি পাবে? মুসলিমরা জান্নাতে যাবে আর অন্য ধর্মের লোকেরা জাহান্নামে যাবে, এটা হলে কি বলা যায় যে- আল্লাহ সবার জন্য সুবিচার করেছেন?
(গ)পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানব সভ্যতার থেকে অনেক দূরে বসবাস করে। তারা অনেকে নানা প্রকার দেবদেবীতে বিশ্বাস নিয়ে চলে। তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? তারাতো আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরকালে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ কি সিদ্ধান্ত নেবেন? যারা কোনো নবীর দেখা পায়নি, কেউ তাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে অথবা ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করেনি তাদের বিচার কিভাবে হবে?
(ঘ)আল্লাহ কি সব অমুসলিমকে চির জাহান্নামী করবেন? তাহলে তো বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ অমুসলিম সরাসরি দোযখে যাবে আর বাকি প্রায় ২০ ভাগ মুসলিমের মধ্যে কেউ যাবে জান্নাতে কেউ জাহান্নামে। এটা কি করে সম্ভব?
(ঙ)খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ভেতরে যদি এমন কেউ থাকে যে ‘ত্রিত্ববাদ’ এ বিশ্বাস করে না কিন্তু হযরত ঈসা (আ.) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে তাহলে তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কি? কোনো একজন ইহুদীর ক্ষেত্রেই বা ফয়সালা কি হবে যদি সে কাজে কর্মে সৎ হয়?
(চ)কুরআনের সূরা আলে ইমরানে (৩:৮৫) বলা হয়েছে, ইসলাম ছাড়া অন্য বিধান গ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত মানে কি পরকালে চির জাহান্নামী হওয়া? তাছাড়া কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে ঢোকার পর আবার বের হয়ে আসতে পারবে?
জবাব:
প্রশ্ন চেপে রাখা উচিত নয়:
উপরিউক্ত প্রশ্নসমূহ অনেকেই ভেতরে চেপে রাখেন। এভাবে হয়তো বছরের পর বছরও পেরিয়ে যায়। এক সময় এসব প্রশ্ন বড় হয়ে মনে হয়তো বিকৃত চিন্তার উদ্ভব ঘটায়। তাই প্রশ্ন ছোট থাকতেই এর যথাযথ উত্তর অন্বেষণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অমুসলিমদের মধ্যে অনেকেই বহু প্রকারের সৎকাজ করে থাকেন:
সত্য কথা বলা, বিপন্নের সাহায্য করা, অন্যের মঙ্গল সাধনের জন্যে অর্থ ব্যয়, আত্মীয়-স্বজনের উপকার করা, পিতা-মাতাকে সম্মান করা, মেহমান এবং প্রতিবেশীদের অধিকার প্রদান করা, অভাবীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা, ত্যাগ স্বীকার করা ও বহু জনহিতকর কাজ করা প্রভৃতি কাজগুলো ইসলামসহ সকল ধর্মের লোকদের মধ্যে দেখা যায়। এ কাজগুলো যে পুণ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্বস্রষ্টা প্রতিটি মানুষকে বিবেক বা ‘কমন সেন্স’ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন:
বিবেক মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে যে, সকল সৃষ্টির একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছেন এবং স্রষ্টাই সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের দায়িত্ব হলো, স্রষ্টাপ্রদত্ত বিবেককে কাজে লাগিয়ে ‘সত্য ধর্ম’ অনুসন্ধান করা। বিবেক দ্বারা মানুষ এটাও বুঝতে পারে যে স্রষ্টার সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সকল ধারণা ঠিক হতে পারে না। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের চূড়ান্ত গরমিল সত্ত্বেও এ সকল ধর্ম ও মতাদর্শের সবগুলো সঠিক হতে পারে না। এ ধরনের চিন্তার ফল হলো এই যে, মানুষ এক পর্যায়ে ভ্রান্তিহীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন এর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করবে।
অমুসলিমরা এ সকল ভালো কাজের কারণে পরকালে পুরস্কার পাবে কি?
অনেকের বিশ্বাস অমুসলিমরা তাদের সৎকাজের পুরষ্কার স্বরূপ স্বর্গ বা বেহেশত (জান্নাত) লাভ করবেন। এ বিশ্বাস বা ধারণা কতটুকু সত্য তা পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
একথা কে অস্বীকার করতে পারে যে, বিশ্বজগত ও তার প্রতিটি সৃষ্টি কণার স্রষ্টা, মালিক ও প্রভু একমাত্র আল্লাহ? (বিস্তারিত জানতে দেখুন: সংযোজন ১ এ আল্লাহর অস্তিত্ব এবং সংযোজন ২ এ ‘আল্লাহ’ নামকরণের যুক্তি) মানুষকে তার জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই দিয়েছেন সেই আল্লাহ। জীবনে উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য নব নব উদ্ভাবনী কাজের সকল সামগ্রী ও উপাদান তিনি তৈরি করেছেন। জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক, কর্মশক্তি, প্রখর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েছেন তিনি। তিনিই মানুষের জন্যে পাঠিয়েছেন সত্য সুন্দর ও মঙ্গলকর জীবনবিধান (দ্বীনে হক)। মানুষকে সদা সৎপথে পরিচালিত করার জন্যে এবং তাদের নৈতিক শিক্ষার জন্যে পাঠিয়েছেন যুগে যুগে নবী ও রাসূল (তথা বার্তাবাহক) গণকে (দেখুন: সংযোজন ৩ এ নবীগণ সাধারণ মনীষীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং সংযোজন ৪ এ রাসূলুল্লাহ সা. সকল মানুষের সেরা) আল্লাহই ইহজগতের এবং পরজগতের স্রষ্টা, মালিক ও প্রভু। বিচার দিনের একচ্ছত্র মালিক এবং বিচারকও তিনি। এমন গুণাবলীসম্পন্ন যে আল্লাহ, তাঁর প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব ও আনুগত্য অস্বীকার করে, তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূল ও আখিরাতের বিচার দিবসকে অস্বীকার করে অথবা স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহর স্তবস্তুতি ও আনুগত্য-দাসত্ব করার পরিবর্তে তাঁরই কোনো সৃষ্টির অথবা কোনো কল্পিত বস্তুর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করলে তা কিভাবে গৃহীত হতে পারে? (দেখুন: সংযোজন ৫ এ ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল প্রয়োজন, পরকালে মুক্তির পথ একটাই, সব ধর্মই কি ঠিক, সঠিক ধর্ম কোনটি এবং আরও দেখুন সংযোজন ৬ এ সকল বিবেচনায় অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম জীবনবিধান কোনটি, আল কুরআনই একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্মগ্রন্থ, জীবন সমস্যা সমাধানে মানবসৃষ্ট মতাদর্শ ও ধর্মসমূহ কেন নির্ভুল নয়, বিধান রচনায় মানুষের দুর্বলতার আরও কিছু দিক, মানবরচিত কিছু মতাদর্শের পরিচয়)
উপরে বিভিন্ন ধর্মের সৎ ব্যক্তির গুণের মধ্যে একটা বলা হয়েছে সত্যবাদিতা। কিন্তু একমাত্র অভ্রান্ত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানকে অস্বীকার করার পর এবং দয়ালু স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করার পর সত্যবাদিতার কানাকড়ি মূল্য থাকে কি? সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের অনেকের মধ্যে বদান্যতা, জনহিতকর কাজ এবং দান-খয়রাতের মতো গুণাবলী রয়েছে। কিন্তু চিন্তা করুন, অর্থ-সম্পদ, জনহিতকর কাজের যাবতীয় সামগ্রী, জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মশক্তি সবই আল্লাহর দান। একদিকে দানের বস্তু দিয়ে অপরের সাহায্য করা হলো এবং প্রকৃত দাতার আনুগত্য, দাসত্ব ও কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করা হলো। এ যেনো পরের গরু পীরকে দান। এ দানের কি মূল্য হতে পারে? স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর আনুগত্যে মস্তক অবনত করা এবং তাঁরই স্তবস্তুতি ও ইবাদাত-বন্দেগী অস্বীকার করা কি গর্ব-অহংকার এবং কৃতঘ্নতার পরিচায়ক নয়? এটা কি চরম ধৃষ্টতা, নিমকহারামকারী ও বিশ্বাসঘাতকতা নয়? ইবাদাত-বন্দেগী, দাসত্ব-আনুগত্য করা হলো আল্লাহরই অন্যান্য সৃষ্টির। সৃষ্টিকে করা হলো স্রষ্টার মহিমায় মহিমান্বিত। এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা, এর চেয়ে বড় অন্যায় ও যুলুম আর কিছু হতে পারে কি?
আল্লাহ কুরআনে বলেন: “যারা আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে তাদের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তাদের সৎকাজগুলো হবে ভস্মস্তূপের মতো। ঝড়-ঝঞ্ঝার দিনে প্রচণ্ড বায়ু বেগে সে ভস্মস্তূপ যেমন শূন্যে উড়ে যাবে, ঠিক সে সৎকাজগুলোর কোনো অংশেরই তারা লাভ করবে না। কারণ আল্লাহর দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাস তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিয়ে গিয়েছিলো।” (১৪/সূরা ইবরাহীম:১৮) অর্থাৎ যারা আপন প্রভু আল্লাহর সাথে নিমকহারামী, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বেচ্ছাচারিতা অবাধ্যতা ও পাপাচারের আচরণ করেছে এবং দাসত্ব-আনুগত্য ও ইবাদাত-বন্দেগীর সেসব পন্থা অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে- যার আহ্বান নিয়ে এসেছিলেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম (নবীগণ), তাদের জীবনের পরিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং সারা জীবনের কাজ ও চরিত্রের মূলধন অবশেষে এমন ব্যর্থ ও অর্থহীন হয়ে পড়বে, যেনো একটা বিরাট ভস্মস্তূপ ধীরে ধীরে জমে উঠে পাহাড় পর্বতের আকার ধারন করেছে; কিন্তু একটি দিনের প্রচণ্ড বায়ুতে তার প্রতিটি ভস্মকণা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের প্রতারণামূলক সুন্দর সভ্যতা ও কৃষ্টি-কালচার তাদের বিস্ময়কর শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্প, বিরাট বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ললিতকলা, প্রভৃতি অনন্ত সম্ভার এমন কি তাদের উপাসনা-আরাধনা, প্রকাশ্য সৎকাজগুলো, দান-খয়ারত ও জনহিতকর কার্যাবলী একটা বিরাট ভস্মস্তূপ বলেই প্রমাণিত হবে। তাদের এসব গর্ব অহংকারের ক্রিয়াকলাপ আখেরাতের বিচার দিনে বিচারের দাঁড়িপাল্লায় কোনো ওজন বা গুরুত্বের অধিকারী হবে না। আল্লাহ আরও বলেন: “তোমাদের মধ্যে যারা দ্বীন ইসলাম থেকে ফিরে যাবে এবং কুফরী (বা অবাধ্যতার) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সকল সৎকাজগুলো বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা (সেখানে) থাকবে চিরকাল।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২১৭)
যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইসলাম সৎ কাজ গৃহীত হওয়ার জন্য ঈমান (বা বিশ্বাসকে) কে শর্ত বলে নির্ধারণ করেছে।:
আল্লাহ বলেন,
(ক)“এবং যে সৎ কাজ করবে, সে পুরুষ হোক অথবা নারী, তবে যদি সে মুমিন (বা বিশ্বাসী) হয়, তাহলে এসব লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কণামাত্র জুলুম করা হবে না (অর্থাৎ তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হবে না)।” (৪/সূরা আন নিসা:১২৪)
(খ)“যে ব্যক্তিই সৎ কাজ করবে- সে পুরুষ হোক বা নারী হোক- তবে শর্ত এই যে, সে মুমিন হবে- তাহলে দুনিয়াতে তাকে পূত-পবিত্র জীবনযাপন করাবো এবং (আখিরাতে) এমন লোকদের আমাল (বা কাজ) অনুযায়ী উৎকৃষ্ট প্রতিদান দেবো।” (১৬/সূরা আন নাহল:৯৭)
(গ)“এবং যে সৎ আমাল করবে- পুরুষ হোক বা নারী হোক যদি মুমিন হয়, তাহলে এমন লোক সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেখানে তাদেরকে অগণিত জীবিকা সম্ভার দান করা হবে।” (৪০/সূরা আল মুমিন:৪০)
উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে সৎ কাজের জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বারেই এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, সৎ কাজ সম্পাদনকারীকে অবশ্যই মুমিন হতে হবে। ইসলামী বুনিয়াদী আকীদাগুলোর প্রতি ঈমান আনার পরই সৎ কাজের পুরষ্কার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, ঈমান হলো সৎ কাজ গৃহীত হবার পূর্বশর্ত।
আল্লাহ, তাঁর কিতাব, রাসূল (বার্তাবাহক) এবং আখিরাত প্রভৃতির উপর প্রথমে ঈমান আনতে হবে। তারপর সৎকাজ কি কি তাও বলে দেওয়া হয়েছে। এ সৎকাজগুলো নবী-রাসূলগণ বাস্তব জীবনে স্বয়ং দেখিয়েছেন। তাদের বলে দেওয়া (বা প্রদর্শিত) পন্থা-পদ্ধতি অনুযায়ী সে কাজগুলো করতে হবে। এ কাজের লক্ষ্য হবে, যাকে স্রষ্টা, রিযিকদাতা, মালিক, প্রভু, বাদশাহ ও শাসক হিসেবে মেনে নেওয়া হলো (যার অর্থ ঈমান আনা হলো), তাঁর সন্তুষ্টিলাভের জন্যেই সেসব সৎ কাজ করা হবে। পুরষ্কার দেওয়ার একমাত্র অধিকার যার- তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভের ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে পুরষ্কার আসবে কোথা থেকে? সে জন্যে পরকালীন মুক্তি ও পুরষ্কার নির্ভর করছে সৎ আমালের উপর এবং সৎ আমাল ফলদায়ক হবে ঈমানের সাথে।
ইসলামের নিজস্ব আত্মমর্যাবোধ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আজ মুসলিমের তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই:
লেখার প্রথমে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহ করা হয় মূলত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন থেকে। একজন বস্তুবাদী মানুষ এ পৃথিবীকে ‘আলটিমেট’ ধরে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে। অপরদিকে মুসলিমরা দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে আখিরাতকে কেন্দ্র করে। দুনিয়া সম্পর্কে মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারীর) আর একজন কাফিরের (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীর) দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ন বিপরীত। ইসলাম নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি দ্বারা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি-নৈতিকতা থেকে শুরু করে সামাজিক,রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহ সকল অঙ্গনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। হযরত আয়িশা (রা.) একবার বলেছিলেন, সব দান করে দিয়েছি শুধু একটা (চতুষ্পদ জন্তুর) পা অবশিষ্ট আছে। মহানবী (সা.) তখন বলেছিলেন, হে আয়েশা, বলো, সব আছে বরং একটা পা নেই। অর্থাৎ, যা দান করা হয়েছে তা তো রয়েই গেলো। মানে- পরকালে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে।
আজকাল কাফির, মুশরিক, নাস্তিক শ্রেণীর মানুষদের সম্পদের প্রাচুর্য দেখে মুসলিমরা বিচলিত হয় না। তাদের এ জৌলুশ ইসলামের সভ্যতার ভিতকে কোনো অংশে নড়বড়ে করতে পারে না। আল্লাহ কুরআনে কোথাও বলেননি যে, কাফিরদের প্রাচুর্য দেওয়া হবে না। বরং আল্লাহ পরিষ্কার বলেছেন, “যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্যে সেই ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে, আমি তাকে তার কিছু দিয়ে দিই এবং পরকালে তার কোনো অংশ থাকবে না।” (৪২/সূরা আশ শুরা:২০) অর্থাৎ, এ অস্বীকারকারীরা যতোই চেষ্টা করুক না কেনো, দুনিয়ার যতোটা অর্জন করতে চায় তা তারা পুরোপুরি পাবে না, বরং তার একটা অংশমাত্র অর্থাৎ আল্লাহ তার জন্য যতোটা নিদিষ্ট করে রেখেছেন ততোটাই পাবে।
আল্লাহ বলছেন, “অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।” (৫/সূরা আল মায়িদা:১০০) ধরা যাক, কারো কাছে হালাল উপায়ে উপার্জিত পাঁচ টাকা আছে আর কারো কাছে হারাম উপায়ে উপার্জিত ১০০ টাকা আছে। সাধারনত মানুষ ১০০ টাকাকেই বড় মনে করলেও যাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ এবং যাদের মধ্যে সত্যের প্রানশক্তি নিহিত, তারা ৫ টাকাকেই বড় মনে করবে। আবার একজনের পা মোটা দেখে কেউ তার স্বাস্থ্যের প্রশংসা করতে পারে। কিন্তু কেউ জানতে পারলো যে, অসুস্থতার কারণে তার পায়ের ভেতরে পচন ধরেছে বলেই পা ফুলে গেছে। তাই মোটা হয়ে যাওয়া সবসময় সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন নয়।
আজকে যারা টাকার পাহাড়ে অবস্থান করছে, সে সকল দেশের টাকা ও সম্পদ দেখে হয়তো অনেকে বিস্মিত হয়ে আছে। কিন্তু তাদের সমাজের ভেতরের অবস্থা দেখলে জানা যায়, তাদের মধ্যে আত্নহত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদির হার বেশি। অতএব, পার্থিব জীবনে ইসলাম অস্বীকারকারীদের সমৃদ্ধি ইসলামের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।
আজকের মুসলিমদের এ দুর্দশার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। মহানবী (সা.) বিশ্বাসের ‘ট্রেনিং’ দেওয়ার সাথে সাথে কিছু পার্থিব ‘ট্রেনিং’ও দিয়ে গিয়েছিলেন যা এখন মুসলিমরা অনুসরন করছে না। অনেক ক্ষেত্রে অমুসলিমদের মধ্যেই এ পার্থিব ট্রেনিংয়ের উপস্থিতি আছে বলেই তারা উন্নতি করছে।
মহানবী (সা.) শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগে তাদের পারিশ্রমিক দিতে বলেছেন। কিন্তু আরব দেশ এবং ইউরোপের দেশগুলোর দিকে একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় অমুসলিমরা এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর শিক্ষা বেশি মানছে। মহানবী (সা.) এর দেওয়া সকল শিক্ষা মুসলিমরা নিতে পারেনি বলেই আজ তাদের এ করুণ অবস্থা। মুসলিমরা একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের নেতৃত্বে থাকলেও আজ তারা সে স্থানটি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে নিপতিত হয়েছে কুসংস্কারের গহ্বরে। তাই আজকে মুসলিমদের অধ:পতনের আরেকটি কারণ ইসলামের কিছু শিক্ষাকে পদদলিত করা।
অমুসলিম ও মুসলিম নামধারী- সকলেরই সৎকর্ম ফলহীন হতে পারে:
দ্বীনে ইসলামে যারা অবিশ্বাসী কেবল তাদেরই সৎকাজগুলো বিনষ্ট হবে না, বরং দ্বীন ইসলামে বিশ্বাসস্থাপন করার পর যারা তা পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিণামও অবিশ্বাসী-কাফিরদের (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের) মতো হবে। মোটকথা, কুরআন হাকীমের প্রায় পাতায় পাতায় একথা দ্ব্যথহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যারাই আল্লাহর প্রেরিত দ্বীনে হক (বা সত্য জীবনবিধান) গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তারা এ দুনিয়ায় কোনো ভালো কাজ করুক বা না করুক, তাদের স্থান হবে জাহান্নামে।
আল্লাহর কাছে প্রতিদান চাইলে আল্লাহর জানানো বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে:
আল্লাহ ও রাসূলকে যারা অস্বীকার করে, পরকালে পুরষ্কার লাভ যদি তাদের একান্ত কাম্য হয়, তবে তা দাবি করা উচিত তাদের কাছে যাদের পূজা ও স্তবস্তুতি তারা করেছে, যাদের হুকুম-শাসনের অধীনে তারা জীবন যাপন করেছে, যাদের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া সেদিন কোনো শক্তিমান সত্তা থাকবে কি যে কাউকে কোনো পুরষ্কার অথবা শাস্তি দিতে পারে? বেহেশতের দাবি দাওয়া নিয়ে কোনো শ্লোগান, কোনো বিক্ষোভ মিছিল করার ক্ষমতা, সাহস ও স্পর্ধা হবে কি? তাছাড়া পুনর্জীবন, পরকাল, হিসাব-নিকাশ, দোযখ-বেহেশত যারা অবিশ্বাস করলো, সেখানে কিছু পাবার বা তার জন্যে তাদের বলারই বা কি আছে? আল্লাহদ্রোহী ও আল্লাহবিমুখ অবিশ্বাসীদের সৎকাজের কোনোই মূল্য যদি পরকালে দেওয়া না হয়, তাহলে তা হবে পরিপূর্ণ ন্যায় বিচারের কারণেই।
অবিশ্বাসীরা তাদের সৎ কাজের প্রতিদান এ দুনিয়াতে পাবে:
যদি কোনো অবিশ্বাসী পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে তাকে এই পৃথিবীতেই তার প্রতিদান দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন: হতে পারে আল্লাহ তার জীবনযাত্রার মান এবং জীবিকা বৃদ্ধি করে দেবেন, তাকে সুখ-সাচ্ছন্দ এবং যা সে ভালবাসে তা তাকে দান করবেন, এ পৃথিবীতে যা তার জন্য ক্ষতিকর তা তার থেকে সরিয়ে দেবেন, মানুষ যেনো তাদেরকে চেনে ও জানে সে ব্যবস্থা করে দেবেন, মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা তার সুনামের ব্যবস্থা করে দেবেন এবং এরকম আরো অনেক প্রতিদান তাকে দেবেন। এরপরেও যদি তাদের ভালো কাজগুলোর প্রতিদান দিতে কিছু বাকি থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ করে দিতে পারেন এবং জাহান্নামে তাদের আযাব কমিয়ে স্থির করতে পারেন।
কিন্তু মৃত্যুর পর অবিশ্বাসীদের কিছুই পাওনা থাকবে না। তার অবিশ্বাস তার ভালো কাজকে গ্রহণযোগ্য হতে বাধা প্রদান করবে। সে যদি সত্যিই পরকালে উপকৃত হতে চাইতো তাহলে তার ভালো কাজকে গ্রহণযোগ্য রাখার লক্ষ্যে সে অবশ্যই মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারী) হতো। আনন্দময় কিছু দিয়ে জাহান্নামবাসীদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে না। প্রথমবার দেওয়া শাস্তির মাত্রা তাদের থেকে কমানো হবে না। অবশ্য অধিক পাপে নিমজ্জিতদের জন্য শাস্তি আরো গুরুতর হবে।
আবু তালেব সব সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কে কাফির (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) দের অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর উপর ঈমান না আনার কারণে এই আবু তালেবকেও জাহান্নামে যেতে হবে। তবে হাদীসে বলা হয়েছে, দ্বীন ইসলামকে সাহায্য করার জন্য জাহান্নামবাসীদের মাঝে এই আবু তালেবের আযাবটা সবচেয়ে কম হবে। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যদি কোনো কাফির কোনো ভালো কাজ করে, এর জন্য তাকে এ পৃথিবীতেই তার জীবিকার ভালো উপকরণ দেওয়া হবে। আর ঈমানদারদের জন্য, আল্লাহ তাদের সৎকর্মগুলোকে পরকালে সংরক্ষণ করবেন এবং এ পৃথিবীতে তাদের আনুগত্যের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিদানের ব্যবস্থা করে দেবেন। (মুসলিম, ২৮০৮)
আল্লাহ কারো ওপর জুলুম বা অবিচার করেন না:
মানুষ নিজেই নিজের ওপর অবিচার করে। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ জুলুম করেন না মানুষের উপর, বরং মানুষ নিজেই নিজের উপর জুলুম করে।” (১০/সূরা ইউনুস:৪৪)
আল্লাহ তাঁর বিধান পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে তা গ্রহণ করা। কিন্তু অনেকেই আল্লাহর বিধান গ্রহণ করে না। আর এর জন্য আল্লাহ নয়, মানুষই দায়ী থাকবে।
আল্লাহ প্রদত্ত ‘কমন সেন্স’ যাদের ছিলো এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার যথেষ্ট উপকরণ যারা পেয়েছিলেন, এরপরও যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, তারা তাদের অপরাধের কারণেই জান্নাতে যেতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ কারো ওপর জুলুম করেন না। তারা যা ভালো কাজ করেছেন, এর প্রতিদান পৃথিবীতে আল্লাহ তাদেরকে দিতে পারেন। কিন্তু পরকালের প্রতিদান লাভের জন্য যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপনটা মূল চাহিদা বা ‘রিকোয়ারমেন্ট’, যা অমুসলিমদের বেলায় অনুপস্থিত, তাই তারা পারলোকিক কোনো প্রতিদান পাবেন না।
কেউ যদি দাবি করে যে, আল্লাহ তার জন্য অবিচার করেছে, তাহলে সে ভুল বলছে। কেননা সে কোনোদিন আল্লাহর বাণী (তথা কুরআন) পড়ার, বুঝার ও গবেষণা করার চেষ্টা করেনি। যে বিদ্যা অর্জন করলে পার্থিব সুবিধা পাওয়া যায় (যেমন: গাড়ি-ঘোড়া চড়া যায়), তা যদি আমরা আগ্রহের সাথে পড়তে পারি তবে, যে জ্ঞান অর্জন করলে চিরকাল জান্নাতে থাকা যায় তাতে এতো অনীহা কেনো এবং তা না পড়লে অন্যকে দোষী মনে করি না কেনো? এই কারণে মানুষ কিয়ামাতের দিন আফসোস করে বলবে যদি আমরা, বিবেক দিয়ে চিন্তা করতাম! কেননা যে নিজের বিবেক দিয়ে চিন্তা করবে সে অমুসলিম থাকতে পারবে না।
আল্লাহ বলেন, “ক্রোধে জাহান্নাম যেনো ফেটে পড়বে। যখনই তাতে কোনো সম্প্রদায় নিক্ষিপ্ত হবে তখন তাদেরকে তার সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করবে- তোমাদের কাছে কি কোনো সতর্ককারী আগমন করেনি? তারা বলবে, হ্যাঁ আমাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করেছিলো, তারপর আমরা মিথ্যারোপ করেছিলাম এবং বলেছিলাম: আল্লাহতাআলা কোনো কিছু নাজিল (বা অবতারণ) করেননি। তোমরা মহাবিভ্রান্তিতে পড়ে রয়েছো। তারা আরও বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।” (৬৭/সূরা আল মূলক:৮-১০) আল্লাহ আরও বলেন, “যে কেউ দ্রুত লাভের আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যা কিছু দিতে চাই দিয়ে দিই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দিই, যার উত্তাপে সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:১৮)
আল্লাহপ্রদত্ত ‘কমন সেন্স’ প্রসঙ্গে ইসলাম:
মানুষের ‘কমন সেন্স’ই আল্লাহর বাণীতে উল্লিখিত ‘ফিতরাত’ (বা স্বভাব ধর্ম)। আল্লাহ বলেন, “এটাই (হচ্ছে) আল্লাহর প্রকৃতি বা ফিতরাত (এর উপর নিজেকে দাঁড় করাও), যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (৩০/সূরা আর রূম:৩০) হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ সব নবজাতককে ফিতরাতের ওপর সৃষ্টি করেন। পরে তার পিতা-মাতা, পরিবেশ তাকে ইহুদী, খৃষ্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারী, মুসলিম) এ হাদীসে রাসূল (সা.) আরো বলেন, তোমরা তো বিভিন্ন পশু দেখেছো। কোনো পশু কি শরীরে চিহ্ন নিয়ে জন্মায়? না। বরং, তাকে পরে চিহ্নিত করা হয়।
আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে অনেক নবী-রাসূল (বার্তাবাহক) পাঠিয়েছেন:
আল্লাহ যে যুগে যাঁকে পাঠিয়েছেন, সে যুগে তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করাই ছিলো সঠিক পথ। সবশেষে আল্লাহ, মুহাম্মাদ (সা.) কে পাঠান। এরপর একমাত্র তাঁর পথই সঠিক পথ। অন্য সব পথ বিকৃত, ভ্রান্তিযুক্ত ও পরিত্যাজ্য। পরবর্তী সরকারের আমলে পূর্ববর্তী আইন মেনে চললে কি তাকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয় না?
ইহুদী ও খৃষ্টান যারা রাসূল (সা.) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি তাদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, সেই মহান সত্ত্বার শপথ যার কবজায় আমার প্রাণ, এই উম্মাতের কোনো ইহুদী, খৃষ্টান যদি আমার কথা শোনে, এরপর আমার আনীত (সত্য) বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আগেই মারা যায়, তাহলে সে জাহান্নামবাসী হবে। (মুসলিম)
সত্য নিজের সত্যতার ব্যাপারে অটল; কিন্তু মিথ্যা নিজের সত্যতার ব্যাপারেও আস্থাহীন:
ইসলামের সর্বপ্রধান উৎস আল কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৯) আল্লাহ আরও বলেন, “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন (ধর্ম বা মতাদর্শ) সন্ধান করে, কখনোই তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রন্ত।” (৩/সূরা আলে ইমরান:৮৫)
ইসলাম গ্রহণ না করা লোকদের প্রকারভেদ:
যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, তাদের মধ্যে দু’ধরনের লোক রয়েছে।
১.যারা অমুসলিমদের মাঝে ছিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানার কোনো উপায় ছিলো না। ইসলামের কথা কখনো শুনেনওনি। তাদের অবস্থা আহলুল ফাতরাত এর মতো হবে। অর্থাৎ, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করবেন। যেমন বলবেন, আগুনে ঝাপ দাও। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, তারা আগুনে ঝাপ দিয়ে দেখবে সেটা শীতল বেহেশত। যারা অমান্য করবে, তারা সত্যিই জাহান্নামে যাবে। (প্রমাণ আল্লাহ বলেন, “কোনো রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:১৫) এটা আল্লাহর ইনসাফের (বা ন্যায়বিচারের) প্রকাশ। আল্লাহ কাউকে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ ছাড়া শাস্তি দেবেন না। হয়তো রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে বা অন্য কোনো ভাবে আহ্বান (বা দাওয়াত) পৌঁছানোর মাধ্যমে আল্লাহ বার্তা পৌছাবেন। বার্তা পৌঁছার ব্যবস্থা না করে শাস্তি দেওয়ার মতো যুলম (বা অত্যাচার) আল্লাহ করবেন না।
২.এমন কিছু লোক আছেন যারা মুসলিমদের মাঝে ছিলেন, ইসলামের কথা শুনেছেন, ইসলাম সম্পর্কে জানা তাদের জন্য সহজ ছিলো, এরপরও তারা ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধান করেননি ও মুসলিম হননি। তাদের জন্য জাহান্নামই নির্ধারিত থাকবে।
জাহান্নামী লোকদের প্রকারভেদ:
জাহান্নামী লোকেরা দুই ধরণের:
১.যারা তাওহীদে (আল্লাহর একত্ববাদে বা প্রচলিত ভাষায় একেশ্বরবাদে) বিশ্বাসী (যাদের ঈমান নির্ভেজাল তথা শিরকমুক্ত) এবং যারা সৎ কাজের সাথে অসৎ কাজও মিলিয়ে ফেলেছিলো। মহান আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তাদের পাপের শাস্তির জন্য। আল্লাহ চাইলে এই শ্রেনীর লোকদের জাহান্নামে শাস্তি চিরদিনের জন্য হবে না। আল্লাহই তাদের জন্য শাস্তির সময়সীমা নির্ধারণ করবেন। তারপর তিনি তাদের সেই আগুন থেকে বের করে আনবেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তারা জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। (অবশ্য, আগে হোক আর পরে হোক যারা একবার জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা আর কখনো জাহান্নামবাসী হবে না।)
২.যারা অবিশ্বাসী, মুনাফিক, তাওহীদে যাদের কোনো বিশ্বাস ছিলো না, যারা শিরক করেছে, বহু প্রভুতে বিশ্বাস করেছে, আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছে (বা নাস্তিক হয়েছে) এবং যারা অবিশ্বাসী অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকে চিরদিনের জন্য জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের অপরাধ হলো তারা নিজেদের জন্য কুফরী (বা অবিশ্বাস ও অবাধ্যতাকে) কে এবং কুফরীর পরিণামকে (জাহান্নামের আগুনে বসবাস করাকে) বেছে নিয়েছে।
মুসলিমদের মধ্যেও চির জাহান্নামী থাকতে পারে:
মুসলিমদের মধ্যে অনেক নামধারী মুসলিম আছে যারা চিরকালের জন্য জাহান্নামে থাকবে। তাই মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও অনেক মানুষ চিরকালের জন্য জাহান্নামে যাবে। তাই যারা আল্লাহর বিধানের উপর চলে না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।
নামধারী মুসলিমরা কাফিরের চেয়ে মন্দও হতে পারে:
যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, অথচ কাফিরের মতোই জাহেল বা অজ্ঞ এবং আল্লাহর অবাধ্য; এমতাবস্থায় কেবল নাম, পোশাক ও খাওয়া-দাওয়ার পার্থক্যের কারণে সে কাফির অপেক্ষা কোনোভাবেই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না, আর এ ধরনের কোনো কারণেই সে ইহকাল ও পরকালে আল্লাহর দয়ার অধিকারী হতে পারে না।
মুসলিম বাস্তবিকই যদি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতো তাহলে আল্লাহর সেই প্রিয়জনেরা দুনিয়ায় নানাভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে কেনো? আল্লাহ কি যালেম (নাউযুবিল্লাহ)? মুসলিম যদি আল্লাহর অধিকার জানতো, তার আদেশ পালন করতো, তাহলে তিনি তার অবাধ্য বান্দাদেরকে মুসলিমদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে দেবেন কেনো? আর মুসলিমদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের বিনিময়ে শাস্তিই বা দেবেন কোন কারণে?
স্বীকার করতেই হবে যে, মুসলিমদের মুসলিম হওয়ার দাবিতে কিছুটা গলদ আছে। তাদের নাম সরকারী দফতরে নিশ্চয়ই মুসলিম হিসেবে লিখিত আছে; কিন্তু সেই সরকারী দফতরের সার্টিফিকেট অনুসারে আল্লাহর দরবারে বিচার হবে না। আল্লাহর নিজস্ব দফতর রয়েছে এবং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই তাঁর দফতরে মুসলিমদের নাম তাঁর অনুগত লোকদের তালিকায় লিখিত আছে, না অবাধ্য লোকদের তালিকায় লিখিত হয়েছে তা খোঁজ করে দেখা আবশ্যক। যেসব কাজ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে, আল্লাহ তা এক এক করে বলে দিয়েছেন, কিন্তু মুসলিম কি সেসব কাজ ত্যাগ করেছে?
যদি স্বীকার করা হয় যে, আল্লাহর কিতাব হতে মুসলিমগণ যেমন কোনো জ্ঞান লাভ করতে চেষ্টা করেনি, তেমনি তাঁর প্রদর্শিত পথেও তারা একটুও চলেনি, তাহলে তারা মুসলিম হলো কিরূপে এবং তারা পুরষ্কারই বা কিরূপে চাচ্ছে। তারা যে ধরনের মুসলমানীর দাবি, ফলও তেমনি পাচ্ছে, আর তেমনি পুরস্কার তারা পরকালেও পাবে।
কাফিররা বিশ্বাস ও কর্ম শুদ্ধ করার লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন পড়ে না এবং তাতে কি লিখিত আছে তা সে জানে না। কিন্তু মুসলমানের অবস্থা যদি এ রকমই হয় তাহলে সে নিজেকে মুসলিম বলবে কোন অধিকারে?
কাফিররা আল্লাহর মর্জি মতো চলে না, চলে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী। মুসলিমও যদি সেরূপ স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়, সেরূপই আল্লাহর প্রতি উদাসীন ও বেপরোয়া হয় এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুগত দাস হয়, তবে তার নিজেকে ‘মুসলিম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর আদেশ পালনকারী’ বলার কি অধিকার আছে?
মোটকথা, কাফেরের ন্যায় মুসলিমও যদি ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ হয় এবং কাফির ও মুসলমানের কাজ-কর্ম যদি একই রকম হয়, তাহলে দুনিয়ায় কাফিরের পরিবর্তে কেবল মুসলিমরাই সম্মান লাভ করবে কেনো?
যাদেরকে মুসলিমরা “কাফির” অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য বান্দাহ মনে করে, তারা মুসলিমদের ওপর সকল ক্ষেত্রে বিজয়ী কেন? আর মুসলিমরা যারা আল্লাহর আদেশ পালনকারী বলে দাবি করে, তারাই বা সব জায়গায় পরাজিত কেনো? এর জবাব সম্ভবত এই যে, মুসলিমদের ও কাফিরদের প্রতি বর্তমানে শুধু নামেই পার্থক্য রয়েছে গিয়েছে। কার্যত মুসলিমরা আল্লাহর প্রতি অবহেলা, ভয়হীনতা এবং অবাধ্যতা দেখাতে কাফিরদের চেয়ে কিছুমাত্র পেছনে নেই। মুসলিমদের ওপর কাফিরদের জয়লাভ এবং সর্বদা মুসলিমদের পরাজয় হয়তো এ অপরাধেরই শাস্তি।
মাদার তেরেসা ও ন্যালসন ম্যান্ডেলার সৎ কাজ:
(ক)মাদার তেরেসা একজন ধর্মপ্রচারক (নান) ছিলেন যার একটি কাজ ছিলো দরিদ্র, নিঃস্ব এবং অসুস্থ লোকদেরকে সাহায্য করার দ্বারা তাদেরকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। তার সৎ কাজগুলো সৎ কাজ বলে আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে হলে তাকে ১.আল্লাহর অভ্রান্ত বিধানে বিশ্বাসী হতে হবে, ২.তার কাজ ঐ সঠিক বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পাদিত হতে হবে এবং ৩.তার সকল কাজের উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ সকল শর্ত পূরণ করা ছাড়া সে পরকালে এ সকল ভালো কাজের কোনো পুরস্কার আশা করতে পারে না। তবে, দুনিয়াতে সে তার প্রতিদান পেতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সুযোগ-সুবিধাকে নিশ্চিতভাবে তার ভালো কাজের প্রতিদান বলে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। কারণ, আল্লাহ বলেন, “যে কুফরী করবে আমি তাকেও কিছুকাল জীবনোপকরন দান করবো; তারপর তাকে ঠেলে দেবো জাহান্নামের আযাবের দিকে।” (২/সূরা আল বাক্বারাহ:১২৬) তাছাড়া সত্য জীবনবিধান (তথা ইসলাম) থেকে মানুষকে ভিন্নপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে (বা খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য) কাজ করা হলে সেটাকে কখনো সৎ কাজ বলা যায় না। আল্লাহর দ্বীন (ইসলাম) থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখার লক্ষ্যে মানুষের অভাব, দরিদ্রতা এবং অসুস্থতাকে কাজে লাগানো কি সৎ কাজ হতে পারে? এ সকল বিচারে ঐ সকল ধর্মপ্রচারকদের বিভিন্ন ভালো কাজকে (সার্বিক বিচারে) ভালো কাজ বলে মেনে নেওয়া যায় না। ফলে সে সকল কাজের পরকালীন সুফলও আশা করা যায় না।
(খ)কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের জন্য ন্যালসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু ইসলাম একদম প্রথম থেকেই কৃষ্ণাঙ্গদের শেতাঙ্গদের মতো সমান অধিকার দিয়ে রেখেছে। ইসলামী শরীআতে কৃষ্ণাঙ্গ, শেতাঙ্গ, আরব, অনারব হিসেবে মর্যাদার কোনো পার্থক্য নেই। এই ১৯৬৫ সাল থেকে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারে আর ইসলামের একদম শুরু থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমরা বড় বড় প্রদেশের গর্ভনর পদে নিয়োগ পেতো। তারপরও এক শ্রেণীর অজ্ঞ ও অন্ধ লোকের কাছে ইসলাম ‘ব্যাকডেটেড’ আর ইউরোপীয় বা আমেরিকান সভ্যতা ‘আপডেটেড’! ন্যালসন ম্যান্ডেলা কি আল্লাহর অভ্রান্ত বিধানে বিশ্বাসী ছিলেন? তার কাজ কি ঐ সঠিক বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পাদিত হয়েছিলো? তার কাজের উদ্দেশ্য কি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিলো? যদি এ প্রশ্নসমূহের উত্তর না বোধক হয় তাহলে সে তার ভালো কাজের পুরস্কার পরকালে কিভাবে আশা করতে পারে? তবে, হ্যাঁ, কারোর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কেউ ঈমান আনেনি, তাওবা (প্রত্যাবর্তন) করেনি; এমনটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যদি ঈমান না এনে থাকে তাহলে জান্নাত লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই।
আল্লাহ শুধু দয়ালু নন; পরাক্রমশালীও:
আল্লাহ নিজেকে কেবল দয়ালু বলে অভিহিত করেননি। দয়ালু নামের বিপরীতে আল্লাহর ভিন্ন গুণবাচক নামও রয়েছে। যেমন আল্লাহর কয়েকটি নাম হলো ১.‘আদদররু’ (ক্ষয়-ক্ষতি যার ইঙ্গিতে হয়ে থাকে) ২.‘আলমুনতাকিমু’ (যিনি প্রতিশোধপরায়ন) ৩.‘আল মুযিল্লু’ (অপমানকারী) ৪.‘আলমুমিতু’ (মৃত্যু দানকারী)। এ দুনিয়ার জীবনে বহু নবী-রাসূলকে কাফিররা হত্যা করেছিলো। কিন্তু আল্লাহ এই নবী-রাসূলদেরকে কাফিরদের অত্যাচার থেকে বাঁচাননি। কারণ, প্রকৃতপক্ষে, এ দুনিয়ার জীবন কোনো স্থায়ী জীবন নয় যে, এখানে প্রভুত্ব করলেই প্রকৃত সফল হওয়া যায়।
প্রকৃত মুসলিম ও কাফিরের আসল পার্থক্য:
এদের উভয়ের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য কেবল মাত্র কুফরি ও ইসলামের। ইসলামের অর্থ-আল্লাহর আনুগত্য করা এবং কুফরীর অর্থ আল্লাহকে অস্বীকার করা, অমান্য করা ও আল্লাহর অবাধ্য হওয়া। মুসলিম ও কাফির উভয়ই মানুষ, উভয়ই আল্লাহর সৃষ্ট জীব। কিন্তু তাদের একজন অন্যজন অপেক্ষা এজন্য শ্রেষ্ঠ যে, একজন নিজের প্রকৃত মনিবকে চিনতে পারে, তাঁর আদেশ পালন করে এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দু:খময় পরিণামকে ভয় করে। কিন্তু অন্যজন নিজ মনিবকে চেনে না এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দু:খময় পরিণামকে ভয় করে না এবং তাঁর আদেশ পালন করে না।
মুসলিমকে কাফির হতে পৃথক করা যায় মাত্র দু’টি জিনিসের ভিত্তিতে। ১.ইলম বা জ্ঞান ২.আমল বা কাজ। অর্থাৎ, প্রত্যেক মুসলিমকে প্রথমেই জানতে হবে যে, তার প্রকৃত মালিক কে? কিসে তিনি সন্তুষ্ট হন আর কিসে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এসব বিস্তৃতভাবে জেনে নেওয়ার পর নিজেকে প্রকৃত মালিকের একান্ত অনুগত বানিয়ে দেবে, তাঁর মর্জিমতো চলবে, নিজের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করবে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কাফির কিছুই জানে না এবং জ্ঞান না থাকার দরুনই তার কার্যকলাপও সে অনুযায়ী হয় না এ জন্য যে, সে আল্লাহ সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ এবং তার অবাধ্য বান্দা। ফলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হবে।
বিশ্বাস ও আচরণ খারাপ হলে ইসলামে বংশ মর্যাদার কোনো দাম নেই:
ব্রাহ্মণের পুত্র মূর্খ এবং চরিত্রহীন হলেও কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের পুত্র বলেই সে ব্রাহ্মণের মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং উচ্চ বংশ বলে পরিগণিত হয়। আর চামারের পুত্র জ্ঞানী ও গুণী হয়েও নীচ ও হীন থেকে যায়; কারণ সে চামারের মত নীচ জাতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসলামে এসব বংশ বা গোত্রীয় মর্যাদার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে লোক আল্লাহতাআলাকে বেশি ভয় করে (এবং সকলের অধিক তাঁর আদেশ পালন করে চলে) সে-ই তাঁর কাছে অধিক সম্মানিত (পরহেযগার)।” (৪৯/সূরা আল হুজরাত:১৩) এ আয়াতে বংশমর্যাদা প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি।
হযরত ইবরাহীম (আ.) একজন মূর্তি-পূজারীর ঘরে জন্ম লাভ করেছিলেন; কিন্তু তিনি আল্লাহকে চিনতে পেরে তাঁর আদেশ পালন করলেন। এ জন্য আল্লাহ তাঁকে সমস্ত জগতের নেতা বা ইমাম করে দিয়েছিলেন। হযরত নূহ (আ.) এর পুত্র একজন নবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল; কিন্তু সে আল্লাহকে চিনতে পারলো না বলে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গেলো। এজন্য তার বংশমর্যাদার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হলো না। উপরন্তু তাকে যে শাস্তি দেয়া হলো, সমস্ত দুনিয়া তা হতে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
মুসলিমরা ইসলাম মানে না- এর চেয়েও বড় বিপদ হলো মুসলিমরা ইসলাম জানে না বা এ সম্পর্কে ভুল জানে:
পবিত্র কুরআনের শিক্ষা কি? রাসুল (সা.) এর প্রদর্শিত পথ কি? এসব কথা প্রত্যেক মুসলমানেরই সুস্পষ্টরূপে জেনে নেওয়া আবশ্যক। এ জ্ঞান না থাকলে কোনো ব্যক্তিই মুসলিম হতে পারে না। মুসলিমদের নিজেদেরই যদি পিপাসা না থাকে, তবে পানি ভরা কূপ তাদের মুখের কাছে আসলেও তাতে কোনো লাভ নেই। আজ মুসলিমরা নামাযে আল্লাহর কাছে কি চায়, তা তারা জানে না। এটার চেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা আর কি হতে পারে? যে ‘কালেমা’ পাঠ করে তারা ইসলামে প্রবেশ করে, এর অর্থ পর্যন্ত তারা জানে না। এ কালেমা পাঠ করার সাথে সাথে মুসলিমদের উপর কি কি দায়িত্ব এসে পড়ে তাও তারা জানে না। বস্তুত একজন মুসলমানের পক্ষে এর চেয়ে বড় ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।
পরকালে কাফিরদের সৎ কাজের প্রতিদান লাভ সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহের জবাবের সারাংশ:
১. কাফিররা পার্থিব প্রতিদান পাবে কিন্তু পারলোকিক প্রতিদান থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
২. তাদেরকে আল্লাহ কিয়ামাতের দিন পরীক্ষা করবেন। তারা উত্তীর্ণ হলে জান্নাতে যাবে, অনুত্তীর্ণ হলে জাহান্নামে যাবে।
৩. মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমনের পর একমাত্র তাঁর প্রতি বিশ্বাসই মানুষকে মুক্তি দেবে। কাজেই অন্য কারো প্রতি বিশ্বাস থাকাটা যথেষ্ট হবে না।
সংযোজন:১
মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছেন কি?
মহাবিশ্বের স্রষ্টা না থাকার পক্ষে নাস্তিকদের যুক্তি ও বক্তব্য হলো (ক)স্রষ্টাকে দেখা যায় না (খ)তাঁকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না (গ)স্রষ্টা মানুষকে তৈরি করেননি বরং মানুষই (কল্পনা করে) স্রষ্টাকে তৈরি করেছে (ঘ)অনেক ধর্মীয় বিধান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ। তাই ধর্ম তথা স্রষ্টায় বিশ্বাস করা অযৌক্তিক।
অপরদিকে স্রষ্টায় বিশ্বাসীগণ নাস্তিকদের যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করেন এভাবে- (ক) অনেক কিছুকেই আমরা না দেখে বিশ্বাস করি। যেমন- বায়ু, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ইত্যাদি। কাজেই দেখতে না পেলেও স্রষ্টাকে বিশ্বাস করাটা অযৌক্তিক হতে পারে না। (খ) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, এমন বিষয়েই বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। যেমন- ১.শৈশবে মা বলে দিয়েছেন যে, অমুক আমার বাবা। আমরা তা বিশ্বাস করেছি। ২.অসুখ হলে ডাক্তারের উপর বিশ্বাস না করলে চিকিৎসা হবে কি করে? ৩.বিচারকের মনে সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে আসামি দোষী বলে বিশ্বাস হলেই বিচারক শাস্তি দেয়, বিশ্বাস না হলে বা সন্দেহ হলে শাস্তি দেয় না। ৪.মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিশ্বাসের উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, ভাই-ভাইয়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক সবই বিশ্বাসনির্ভর। ৫.বাংলা ভাষা শেখার জন্য অ, আ, ক, খ তে বিশ্বাস করেই এ ভাষা শিখতে হয়েছে। ৬.ফসল হবে- এ কথা বিশ্বাস না হলে কৃষক চাষাবাদই করতে পারবে না। ৭.যে কোন সময় মৃত্যু আসতে পারে। তবু মানুষ আরও বেঁচে থাকবে বিশ্বাস করে বলেই জীবন সচল আছে। ৮.জ্যামিতি পড়তে হলে প্রথমেই কিছু Axiom বা স্বত:সিদ্ধ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হয়। যেমন বিশ্বাস করতে হয় যে, বিন্দু (Point)-এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কোনোটিই নেই; তবু বিন্দুর অস্তিত্ব আছে। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এটি একেবারেই অযৌক্তিক। তবুও এটি বিশ্বাস না করলে জ্যামিতি শেখা শুরুই করা যায় না। ৯.বিজ্ঞান চর্চা প্রথমে হাইপথেসিস (বা কল্পনা, অনুমান) দিয়েই শুরু হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক নিউটনের মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন শক্তি আছে, যা বস্তুকে আকর্ষণ করে। এভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার সৃষ্টি হয়। (গ) স্রষ্টা ছাড়া কোনো কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা যে কলম দিয়ে লিখি, যে চেয়ারে বসি বা যে কাপড় পরিধান করি প্রভৃতি সবকিছুরই এক একজন কারিগর থাকে। সেই কারিগরকে না দেখলেও আমরা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। তাই, মহাবিশ্বের কারিগর বা স্রষ্টা অবশ্যই আছেন। স্রষ্টায় বিশ্বাস করাটা তাই (নিঃসন্দেহে) মানব-বিবেকের দাবি। এ বিশাল মহাবিশ্বকে মানুষ সৃষ্টি করেনি বরং স্রষ্টাই মানুষসহ মহাবিশ্বের সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। (ঘ) স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় বিধান ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে না। ত্রুটিপূর্ণ বিধান আসলে কোন ধর্মই নয়। সেটি আসলে অধর্ম বা ভ্রান্ত ধর্ম।
স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো যাচাই করলে সুস্থ বিবেক রায় দেয় যে- মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছেন এবং তিনি আমাদেরকে যে ধর্ম বা বিধি-বিধান দিয়েছেন তাতে কোনো রকম ভ্রান্তি থাকতে পারে না।
সংযোজন:২
আল্লাহ শব্দের যৌক্তিকতা:
‘ঈশ্বর’ পুরুষ লিঙ্গের শব্দ যার স্ত্রী লিঙ্গ হলো ‘ঈশ্বরী’। অনুরূপভাবে ‘God’/‘god’ পুরুষ লিঙ্গের আর ‘goddess’ স্ত্রী লিঙ্গের। ‘God’/‘god’ ও ‘ঈশ্বর’ পুরুষলিঙ্গ হওয়ায় তারা তো পুরুষের পক্ষে আর নারীর বিপক্ষে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অপরদিকে ‘আল্লাহ’ শব্দের কোনো পুরুষ বা স্ত্রী লিঙ্গ হয় না। এছাড়া অর্থের দিক দিয়েও ‘God’/‘ঈশ্বর’ ও ‘আল্লাহ’র মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাছাড়া ‘আল্লাহ’ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই এবং ভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন কোনো অনুবাদও নেই। ‘আল্লাহ’ শব্দের বিকল্প শুধু ‘আল্লাহ’ই।
‘ইলাহ’ শব্দ দ্বারা বুঝায় ১.যাকে ছাড়া আর কারো গোলামী (বন্দেগী, ইবাদাত, দাসত্ব) করা যায় না ২.যাকে ছাড়া (বা যার বিরোধী) আর কারোর হুকুম (বিধান, আইন) মানা যায় না ৩.যাকে ছাড়া আর কাউকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করা যায় না ইত্যাদি। আর ‘আল্লাহ’ শব্দের বিশ্লেষণ করলে হয় আল + ইলাহ (অর্থাৎ একমাত্র ইলাহ। ইংরেজিতে: The (/only one) + Ilah.
প্রচলিত অধিকাংশ সাহিত্যে লক্ষ্যার্থের দিক থেকে ‘God’, ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘খোদা’, ‘স্রষ্টা’ এগুলো প্রায় সমার্থক। কিন্তু অর্থের দিক থেকে এ শব্দগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দের বহু অর্থের একটি মাত্র। এছাড়া, ‘God’, ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘খোদা’, ‘স্রষ্টা’ ইত্যাদি শব্দের অর্থ তুলনামূলকভাবে ‘আল্লাহ’ শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ হওয়ায় সেগুলো একজন বিবেকবান মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দটি ব্যাপক অথর্বোধক হওয়ায় তা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
সংযোজন:৩
নবীগণ সাধারণ মনীষীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কেনো?
নবী নন এমন মনীষীরা বিশ্বমানবতার সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানে পরস্পরবিরোধী ও ভ্রান্তিযুক্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তাছাড়া তারা বিশ্বস্রষ্টার পক্ষ থেকে নির্ভূল কোনো পথ-নির্দেশনা লাভ করেন না। ফলশ্রুতিতে তারা মানুষের সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানে একচোখা ধরনের মতবাদ উপস্থাপন করেন। কেউ বলেন, মানুষের ‘পেট সমস্যা’র সমাধান হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। আবার কেউ বলেন মানুষের ‘যৌন সমস্যা’র সমাধান হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ও সম-চরিত্রের মানুষ নন। অথচ, সকল নবীই আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত, তারা সর্বোত্তম মানুষ, তাদের মূল প্রচারণা একটিই (বা এক ধরনের)। মানুষের উপর মানুষের অন্যায় আধিপত্য সরিয়ে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়াকেই তাঁরা সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠিরূপে প্রচার করেছেন।
সংযোজন:৪
রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল মানুষের সেরা:
রাসূল (সা.) এর সাথে অন্য কোনো মানুষের তুলনা হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (৩/সূরা আল আহযাব:২১) বুঝার সুবিধার্তে (উদাহরণ হিসেবে) ধর্মনেতা গৌতম বুদ্ধের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। কিছু বিচারবিন্দু সামনে এনে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে গৌতম বুদ্ধকে মেলালেই বুঝা যায় যে. রাসূল (সা.)-ই সর্বোত্তম, অদ্বিতীয় ও অনন্য আদর্শ। রাসূল (সা.) প্রসঙ্গে বিচারের বিষয়গুলো নিম্নরূপ হতে পারে: ১.রাসূল (সা.) এর জন্ম, মৃত্যু, বংশ, ঐতিহাসিক বিবরণ ইত্যাদি বিষয় খুঁটিনাটিসহ সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়। ২.জীবনের সকল অঙ্গনে রাসূল (সা.) শ্রেষ্ঠ আদর্শ রেখে গেছেন (যেমন: সামাজিক, সংগ্রামী ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে)। ৩.রাসূল (সা.) সমস্যা এড়িয়ে যাননি। বরং সমাধান করে দেখিয়েছেন। রাখাল হওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তিনি বিচরণ করেছেন। ৪.শিশুকাল, শিক্ষাকাল, বিয়ে, সংসার, মৃত্যুকাল প্রভৃতি সকল বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রদর্শন করেছেন। ৫.তিনি নারীর প্রতি সুধারণা দিয়েছেন। সার্বিক বিচারে নারীকে পুরুষের সম অধিকার (তথা প্রাপ্য অধিকার) প্রদান করেছেন। ৬.দাস-দাসীর সাথেও তিনি ভালো ব্যবহার করতেন। দাসমুক্তিতে তিনি ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। শত্রু-মিত্র, স্বধর্মী-বিধর্মী সকলের সাথে তিনি উত্তম ব্যবহার করতেন। ৭.সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হয়ে তিনি সমাধান করেছেন, দেখিয়েছেন ও শিখিয়েছেন। ৮.তিনি আংশিক নয় পূর্ণাঙ্গ জীবনে পরিবর্তন এনেছেন। ৯.তিনি চরম ও কঠিন বাধা এবং অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১০.নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই তিনি আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। ১১.তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান (কুরআন) লাভ করেছিলেন। ১২.তিনি ইহকালে সৎকর্মের মাধ্যমে পরকালের সাফল্যকে অগ্রাধিকার দিতেন। ১৩.তিনি দেহ ও আত্মার সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৪.তাঁর শিষ্যরা (সাহাবীরা) তাকে ত্যাগ করেনি বরং তাঁকে রক্ষা করতে অকাতরে প্রাণ দান করেছেন। ১৫.তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে ‘আধুনিকতাকে ইসলামীকরণ’ ও ‘জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ করতে হয়। ১৬.তিনি ধর্মহীন কর্ম ও কর্মহীন ধর্মের দীক্ষা দেননি। ১৭.তিনি দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করেছিলেন। ১৮.তিনি পার্থিব কাজকে দ্বীনি ও দুনিয়াবী এভাবে বিভাজন না করে হালাল ও হারামে ভাগ করেছিলেন। ১৯.কিশোর, যুবক, গৃহী, সেনাপতি, ইমাম (ধর্মীয় নেতা), রাষ্ট্রনেতা ইত্যাদি সর্বস্তরের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ আছে তাঁর জীবনে। ২০.তাঁর জীবনে মানুবজীবনের সকল সমস্যা সমাধানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত বিদ্যমান। ২১.সকল পরিস্থিতিতে খাপ-খাওয়ানোর আদর্শ তিনি দেখিয়েছেন। ২২.তিনি ব্যবহারোপযোগী ও বাস্তব বিধান নিয়ে এসেছিলেন। অহিংসা, জীবহত্যা, শান্তি এগুলোর কাল্পনিক, অবাস্তব ও তাত্ত্বিক রূপের পরিবর্তে তিনি প্রকৃত রূপ তুলে ধরেছিলেন। এভাবে গৌতম বুদ্ধের সাথে মেলালে দেখা যায় রাসূল (সা.) অদ্বিতীয়। প্রধান প্রধান প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থে রাসূল (সা.) এর আগমণবার্তা স্থান পেয়েছে যা রীতিমতো আশ্চর্য হওয়ার মতো। ব্যাপারটি এমন যে- কেউ যদি প্রকৃত খৃস্টান হতে চায় বা প্রকৃত হিন্দু হতে চায় তাহলে তাদেরই উচিত তাদের ধর্মগ্রন্থের অনুসরণে রাসূল (সা.) এর প্রকৃত অনুসারী হয়ে যাওয়া।
সংযোজন:৫
ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল প্রয়োজন:
(ক)পৃথিবীতে ১০০০ জনকে হত্যার অপরাধে কোনো অপরাধীকে ১০০০ বার হত্যা করার যায় না।
(খ)এ পৃথিবীতে মানুষ সব সময় ভালো কাজের অনুরূপ ভালো ফল আর মন্দ কাজের অনুরূপ মন্দ ফল পায় না।
(গ)উপরিউক্ত প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার সম্ভব নয় বলেই ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরকাল অবশ্যই প্রয়োজন।
পরকালে মুক্তির পথ একটাই:
(ক)একই অসুখে বিভিন্ন মানুষের জন্য একই ধরনের গুণসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োজন। ডায়রিয়া হলে বৌদ্ধের জন্য যে স্যালাইন লাগে খ্রিষ্টানের জন্যও তা প্রযোজ্য। বিনা যাচাইয়ে যে যার খুশিমতো ওষুধ সেবন করলে রোগমুক্ত হওয়ার পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
(খ)অনুরূপভাবে, পরকালে মুক্তির জন্যও বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন পথ অনুসরণ করলে চলবে না; বরং সকল মানুষকে একটি পথই অনুসরণ করে চলা আবশ্যক।
সব ধর্মই কি ঠিক?
(ক)পৃথিবীতে হাজার হাজার বা ততোধিক ধর্ম রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পরস্পর বিপরীত।
(খ)পরস্পরবিরোধী দুটি তথ্যের দুটোই সত্য হতে পারে না। ঠিক তেমনি, বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ধর্মসমূহের সবগুলোই সর্বাংশে সত্য হতে পারে না।
(গ)পৃথিবীতে বিদ্যমান ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে দুটো বিষয় সত্য বলে প্রমাণিত হয়- ১.প্রায় সকল ধর্মেই কিছু না কিছু ভালো কথা আছে। ২.প্রায় সকল ধর্মেই কিছু ত্রুটিপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যায়।
(ঘ)উপরিউক্ত তথ্যদ্বয় দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অধিকাংশ ধর্ম ভালো কথা ও ত্রুটিপূর্ণ কথার সমাহার। কিন্তু প্রকৃত ও সত্য ধর্মে (বা জীবনবিধানে) একটিও ত্রুটি থাকা সম্ভব নয়।
(ঙ)যে ধর্মে একটিও ত্রুটিপূর্ণ কথা নেই সেই ধর্মটিই কেবল সঠিক। অন্য সকল ধর্ম ভ্রান্ত বা অন্তত ভ্রান্তিমিশ্রিত।
(চ)গাণিতিক সমস্যার সঠিক ফলাফল এক রকমেরই হয় কিন্তু ভুল ফলাফল হয় বহু ধরনের। ঠিক তেমনি, সঠিক ধর্ম কেবল একটি আর ভ্রান্তিমিশ্রিত ধর্ম অগণিত।
সঠিক ধর্ম কোনটি?
(ক)জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রধান প্রধান ধর্মগুলো হলো ইসলামী জীবনবিধান, খ্রিষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি।
(খ)সব ধর্মের অনুসারীরাই সাধারণত নিজ নিজ ধর্মকে সঠিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু সঠিক নয় এমন কোনো ধর্মকে তথ্য ও যুক্তির দ্বারা শ্রেষ্ঠতম বলে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে বল-প্রয়োগে, ভয় দেখিয়ে বা প্রচার-মাধ্যমের শক্তির জোরে কেউ তার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করলে ভিন্ন কথা।
(গ)পৃথিবীতে কেবল একটি অভ্রান্ত ধর্ম (প্রকৃত অর্থে জীবনবিধান) আছে যা সকল দিক দিয়েই অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম। নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করলে তা অবশ্যই সকলের কাছে ধরা পড়বে বলে আশা করা যায়।
সংযোজন:৬
সকল বিবেচনায় অন্য সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রম জীবনবিধান কোনটি?
(ক) ধর্মের নামকরণ:
১.প্রায় সকল ধর্মের নামকরণ হয়েছে ঐ ধর্মের প্রবর্তকের নাম অনুসারে। যেমন যীশুখৃষ্টের নামানুসারে খ্রিষ্ট ধর্ম, গৌতম বুদ্ধের নামানুসারে বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামের নামকরণ কোন ব্যক্তির নামানুসারে হয়নি।
২.প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোন বিশেষ জাতির ধর্ম নয়; এটা গোটা মানবজাতির জন্য এক অভ্রান্ত জীবনবিধান (যে কোনো জাতির, বংশের, বর্ণের, ভাষার অথবা দেশের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে পারে বা মুসলিম হতে পারে)।
৩.ইসলাম (আত্মসমর্পন বা শান্তি) কথাটাও যেমন সার্বজনীন এ নামের জীবনবিধানটাও তেমনই সার্বজনীন।
(খ) ধর্মকে অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে:
১.একমাত্র ইসলামই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার যৌক্তিক দাবি তুলতে পারে।
২.ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র-পরিচালনা, যুদ্ধ-সন্ধি, চুক্তি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের খুঁটিনাটি ও বিস্তারিত আইন-কানুন একমাত্র ইসলামেই আছে; যা অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নেই।
(গ) ধর্মীয় আইন হতে হবে নির্ভুল:
১.পৃথিবীতে এমন বহু ধর্ম আছে যার আইন মানুষকেই সংশোধন করতে হয়। যে ধর্ম বা আইন ভুল এবং যা মানুষকেই সংশোধন করতে হয়, তা কি স্রষ্টা প্রেরিত ধর্ম হতে পারে? নিশ্চয়ই নয়।
২.অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন ধর্ম ত্যাগ করে কেনো মুসলিম হয়েছেন তার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, অন্যান্য ধর্মের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে মানুষ, আর মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে ইসলাম।
৩.প্রকৃতপক্ষে, এ গৌরব একমাত্র ইসলামই করতে পারে যে এর একটি কথাও অবৈজ্ঞানিক নয়। উপরন্তু, প্রায়ই দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভিন্ন সময়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সর্বশেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, সেকথা বহু আগেই ইসলাম বলে রেখেছে।
(ঘ) ধর্মীয় বিধান পক্ষপাতহীন হতে হবে:
১.কোনো কোনো ধর্মে দেখা যায় ‘উপাসনা’ সবাইকে করতে হয় না। এমনকি সবার উপাসনার অধিকার পর্যন্ত নেই।
২.হিন্দুদের বেলায় এমন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে যা অবশ্যই পক্ষপাতমূলক। যেমন পূজার পৌরহিত্য করার অধিকার একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই আছে এবং তা আছে জন্মসূত্রে।
৩.খ্রিষ্টানদের বেলায় উপাসনা মূলত ধর্মযাজকদের জন্য। আর অন্যান্যদের জন্যে শুধু যীশুখৃষ্টের প্রতি বিশ্বাসই যথেষ্ট।
৪.ইসলামে উপরিউক্ত ধরণের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষপাত অনুপস্থিত।
(ঙ) পৈত্রিক ধর্ম অপেক্ষা অধিক যুক্তিগ্রাহ্য না হলে কেউ সাধারণত নতুন ধর্ম গ্রহণ করে না:
১.যারাই শিক্ষিত ও জ্ঞানী (স্বার্থবাজ, মূর্খ বা অতিদরিদ্র নয়) তারা কেউই কোনোদিন ইসলামের চেয়ে অন্য ধর্মকে অধিক যুক্তিগ্রাহ্য মনে করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছে এমন নজির ইতিহাসে নেই বললেই চলে।
২.কিন্তু অন্যান্য ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণের দৃষ্টান্ত রয়েছে অগণিত।
(চ) ধর্মীয় গুরু ব্যক্তিগণকে হতে হবে সবার জন্য আদর্শ:
১.কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি পাশ একজন নও-মুসলিম তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: “যদি দেশের যুবক ছেলেরা শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ অনুসরণ করে যুবতী মেয়েদের কাপড় নিয়ে গাছে বসে থাকে তাহলে সমাজের অবস্থা কি হবে?” “কোথায় হিন্দুদের ভগবানের লীলা আর কোথায় মুসলমানদের নবী-রাসূলগণের আদর্শ চরিত্র?” এসব চিন্তা করে আমি আর হিন্দু থাকতে পারলাম না; ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম।
(ছ) ধর্মের দৃষ্টিতে সাধু ব্যক্তি:
১.অনেক ধর্ম অনুযায়ী সাধু ব্যক্তিগণ সমাজে মিশতে পারেন না, বিয়ে করতে পারেন না বা এরকম আরও অনেক অনেক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে বাধ্য থাকেন।
২.অনেক সময় সাধারণ লোকদেরকে ঐ সাধু ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে নিষেধ বা অনুৎসাহিত করা হয়।
৩.ধর্মীয় সাধু ব্যক্তিগণ যদি অনুসরণীয়ই না হন তাহলে তারা কি রকম সাধু?
৪.অপরদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে মহামণীষীবৃন্দ সকলের জন্য সমভাবে অনুসরণীয়।
৫.যে সকল ধর্মের সাধু ব্যক্তিদের দ্বারা একটি দেশ চলতে পারে না, সে সকল ধর্ম কি করে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম হতে পারে?
(জ) ধর্মের ব্যপ্তি:
১.হিন্দু ধর্মের যাবতীয় ইতিহাস আর কর্মকাণ্ড সবই ভারতকেন্দ্রিক। তাহলে প্রশ্ন: হিন্দুদের ভগবান কি শুধু ভারতই চেনেন এবং অন্যান্য দেশ সম্পর্কে কি তিনি কোন খোঁজ-খবর রাখেন না?
২.আল-কুরআন শুধু পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মাটির নীচের সমুদ্রের তলদেশের এমনকি আকাশের সাত স্তরের উপরে কোথায় কি আছে- না আছে তার কোনো তথ্য দিতেও ভুল করেনি।
আল-কুরআনই একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্মগ্রন্থ:
(ক)কুরআনে এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা নাযিল হয়েছে ১৪ শত বছরেরও অধিক পূর্বে আর তার সত্য প্রমাণ হচ্ছে এ শতাব্দীতে।
(খ)কুরআনের একটি কথাকেও আজ পর্যন্ত কেউ অবৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণ করতে পারেনি।
(গ)বিজ্ঞান কুরআনের ভুল ধরতে পারেনি কখনও কিন্তু কুরআন বিভিন্ন সময় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার ভুল ধরেছে। প্রথমে বিজ্ঞানীদের একাংশ কুরআনের ভুল ধরার অহমিকা করলেও পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।
(ঘ)যুগের পরিবর্তনেও কুরআন বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি অপরদিকে বিজ্ঞান প্রায়ই নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে
(ঙ)কুরআন প্রথমেই সর্বশেষ সংস্করণ। কোন ভুল না থাকার চ্যালেঞ্জ দ্বারা কুরআন শুরু হয়েছে।
(চ)আল্লাহ বলেন, “আমি আমার বান্দার প্রতি যে গ্রন্থ ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ করেছি, সে বিষয়ে যদি তোমরা সন্দেহ কর, তবে এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। আর এজন্য আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সমর্থক ও সাহায্যকারীদের ডেকে আনো, যদি তোমরা তোমাদের সন্দেহে সত্যবাদী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর, যদিও তা তোমরা কখনও করতে পারবে না; তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা হয়েছে সত্য-প্রত্যাখ্যানকারী (কাফির)-দের জন্য।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৩-২৪)
(ছ)এক বৈজ্ঞানিকের স্বীকারোক্তি হচ্ছে, “বিজ্ঞান এতদিন (নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে) যে দাবি করে এসেছে, তার অধিকাংশই অতিরঞ্জিত। বিজ্ঞানের নবজাগ্রত আত্মচেতনা সত্য এখন বুঝতে পেরেছে।” (বিশ্বনবী: গোলাম মোস্তফা)
(জ)মহাবিজ্ঞানময় কুরআনের বিপরীতে সকল বৈজ্ঞানিক মতবাদই অগ্রহণযোগ্য। কারণ, বিজ্ঞানীদের জ্ঞান সীমিত; আল্লাহর জ্ঞান নয়। আল্লাহ বলেন, “তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:৮৫)
(ঝ)কুরআনে রয়েছে এক মহা আশ্চর্য ও নির্ভুল গাণিতিক বন্ধন। যেমন “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” লিখতে আরবিতে ১৯টি অক্ষর লাগে। এতে ইসম, আল্লাহ, আর-রহমান, আর-রহীম শব্দ চতুষ্টয় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ইসম’ শব্দ কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে ১৯ বার (১×১৯), আল্লাহ ২৬৯৮ (১৪২×১৯) বার, আর রহমান ৫৭ (৩×১৯) ও আর রহিম ১১৪ (৬×১৯) বার; অর্থাৎ সবই ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য। ‘আলিফ লাম মীম’ সহ ১৪টি বর্ণ নিয়ে গঠিত ১৪টি কোড ব্যবহৃত হয়েছে ২৯টি সূরায়; যার অর্থ ১৪+১৪+১৯=৫৭=৩×১৯। এক কথায় সম্প্রতি আবিষ্কৃত কুরআনে ব্যবহৃত বর্ণসমূহের মধ্যে বিদ্যমান নিখুঁত গাণিতিক বন্ধনও কুরআনকে অদ্বিতীয় করে দিয়েছে।
(ঞ)কুরআন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিজের রচনা হতে পারে না। কারণ, কুরআন তাঁর রচনা হলে এতে তাঁর প্রতি ধমক স্থান পেতো না। (সূরা আবাসা ওয়াতা ওয়াল্লা দ্রষ্টব্য) তাছাড়া যেহেতু কুরআনের অলৌকিকত্ব এটিকে শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের মর্যাদা দেয় সেহেতু কেউ যদি (জোর করে) এটিকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিজের রচনা বলেনও তখন তাকে একথা স্বীকার করতে হবে যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে) শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। আর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেই বলেছেন- কুরআন আল্লাহর কিতাব।
(ট)বিশ্বে কুরআনের সকল কপির মধ্যে বিন্দু পরিমাণ তারতম্যও নেই; যা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে আছে।
(ঠ)বিশ্বের সকল ধর্মগ্রন্থ নষ্ট হয়ে গেলে শুধু কুরআনই হাফেজদের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তাছাড়া আগা-গোড়া, বুঝে বা না বুঝে কুরআন কন্ঠস্থ করেছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। অন্য ধর্মগ্রন্থ কন্ঠস্থকারী (বা মুখস্থকারী) একজন লোকও পাওয়া যায়নি।
(ড)একমাত্র কুরআনই অবিকৃত অবস্থায় আছে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হয়ে গেছে।
জীবন সমস্যা সমাধানে মানবসৃষ্ট মতাদর্শ ও ধর্মসমূহ কেন নির্ভুল নয়?
(ক)মানবীয় আদর্শসমূহ অত্যন্ত দুর্বল। মানুষের বুদ্ধি প্রায়ই স্বার্থের দাস হয়ে থাকে। সমকালীন পরিবেশ ও ঘটনাবলী তার বুদ্ধি-বিবেককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তাই, মানবরচিত বিধান সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকে।
(খ)পক্ষান্তরে, কুরআন প্রণেতা আল্লাহতাআলা কামনা-বাসনা ও স্বার্থের উর্ধ্বে। তাঁর বুদ্ধি-বিবেক ত্রুটিহীন। তিনিই মানুষ এবং মানুষের স্বভাব প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহর বিধানই ত্রুটিহীন হওয়া সম্ভব।
বিধান রচনায় মানুষের দুর্বলতার আরও কিছু দিক:
(ক)মানুষের জ্ঞান সীমিত। পক্ষান্তরে আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। “মহাকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবই আল্লাহ জানেন। (আর) সকল বিষয় সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান আছে।” (৪৯/সূরা হুজরাত:১৬)
(খ)মানুষ প্রায়ই অতীতকে ভুলে যায়, বর্তমান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে আর ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত জ্ঞান তার নেই। পক্ষান্তরে, “(আল্লাহ) তাদের সম্মুখের (বর্তমান বা ভবিষ্যতের) ও পেছনের সকল কিছুই জানেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৫৫)
(গ)মানুষ অন্য মানুষের মনের ভেতরে কি আছে তা জানে না; কিন্তু আল্লাহ তা জানেন। “পৃথিবী ও মহাকাশের প্রত্যেকটি বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে তাঁর (আল্লাহর) জ্ঞান আছে। তোমাদের প্রকাশ্যে বা গোপনে করা সকল কাজই তিনি জানেন এবং (প্রতিটি কাজের সময়) তোমাদের মনের অবস্থাও তিনি জানেন।” (৬৪/সূরা আত তাগাবুন:৪)
(ঘ)মানুষ সর্বদা ১০০% পক্ষপাতহীন আইন তৈরি করতে চাইলেও পারে না। কিন্তু আল্লাহ এতে সমর্থ। “তিনি (আল্লাহ) সকল কিছুর রব। নিজ অর্জন নয় এমন কিছু তিনি কারো উপর চাপান না। একজনের বোঝা অন্যজনের উপর তিনি চাপান না।” (৬/সূরা আল আনআম:১৬৪)
(ঙ)মানুষ জীবনের এক দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দিকে অবহেলা করে বসে। কারণ, তার মেধাশক্তি ও স্মৃতিশক্তিসহ সকল শক্তিই সীমিত। পক্ষান্তরে- “সকল শক্তি একমাত্র আল্লাহর করায়ত্ত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৬৫)
(চ)মানুষের কর্মস্থল সংকীর্ণ। কিন্তু- “তাঁর (আল্লাহর) গদি (ক্ষমতা ও প্রশাসন) পৃথিবী ও মহাকাশ জুড়ে বিস্তৃত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৫)
(ছ)মানুষ মরণশীল। পক্ষান্তরে আল্লাহ চিরঞ্জীব। “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো (সঠিক বা সার্বিকভাবে কল্যাণকর) আইন প্রণেতা নেই। তিনি চিরস্থায়ী এবং সব কিছুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে রেখেছেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৫)
(জ)সময়ের পরিবর্তনে মানবরচিত বিধান বা আইন পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আল্লাহ সর্বজ্ঞানী বিধায় তার আইনে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহ বলেন, “(ভুল না থাকায়) আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নেই। এটি এক মহাসাফল্য।” (১০/সূরা ইউনুস:৬৪)
(ঝ)মানুষ নানা বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেন না। কুরআন বলছে-“মানুষেরই কৃতকর্মের ফলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর জলভাগে ও স্থলভাগে।” (৩০/আর রূম:৪১)
(ঞ)আরও কিছু কিছু কারণে মানবরচিত আইন ভুল-ত্রুটি ও অকল্যাণের জন্ম দেয়। কারণ, ১.যারা আইন রচনা করে, তারা অনেক সময় সব মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে আইন তৈরি করে ২.কখনও কখনও অপশক্তির চাপে বা স্বেচ্ছায় দেশের বেশির ভাগ লোকের ঈমান-আকীদা (বিশ্বাস ও চেতনা) বিরোধী আইন তৈরি করা হয়। পক্ষান্তরে, আল্লাহর বিধান কোন অত্যাচারী গোষ্ঠীকে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার সুযোগ দেয় না। আর সেজন্যই, আল্লাহর আইনের পক্ষে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা কোন কালেই বন্ধ হয়নি।
মানবরচিত কিছু মতাদর্শের পরিচয়:
সমাজতন্ত্র (Socialism):
এটি বলতে এমন এক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায়, যে ব্যবস্থায় উৎপাদনের সকল উপাদান সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বন্টন এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থা সমাজ কর্তৃক পরিচালিত এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি তিরোহিত, না হয় নিয়ন্ত্রিত।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.সম্পদে ব্যক্তির কোনো অধিকার থাকবে না ২.সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের ৩.নাস্তিকতাবাদ বা পরকালে অবিশ্বাস ৪.এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের জন্ম দেয় ৫.রাষ্ট্র বা পার্টি প্রধানদের অবাধ ব্যয়ের সুযোগ
সাম্যবাদ (Communism):
বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়কে সাম্যবাদ বলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন সমাজে শ্রেণী সংঘাত থাকবে না। শ্রেণীহীন সমাজ (Classless Society) প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজতন্ত্র যখন এ অবস্থায় পৌছাবে তখন রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন হবে না। রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি আপনা থেকেই লোপ পাবে। এ অবস্থায় সাম্যবাদ এর পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism):
এ মতবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.আল্লাহর সার্বভৌমত্বে অনাস্থা ২.ধর্ম ব্যক্তি জীবনেই শুধু সীমাবদ্ধ ৩.এটি একটি কুফরী মতবাদ (৪/সূরা আন নিসা:৭৬ দ্রষ্টব্য) ৪.নৈতিকতা বিবর্জিত ৫.আদর্শ বিমুখতা ৬.চরিত্র বিধ্বংসী কার্যকলাপ ৭.স্বেচ্ছাচারী ও ত্রুটিপূর্ণ শাসন।
পুঁজিবাদ (Capitalism):
অবাধ ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী একটি মতাদর্শ। পুজিঁ সংগ্রহ ও বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা। মূল কথা- বস্তুবাদ ও ভোগবাদ। আত্মতুষ্টির জন্য ব্যক্তি বস্তুর যথেচ্ছ ব্যবহার (maximization of satisfaction) ও তা কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং maximization of satisfaction এর পথ পরিস্কার রাখা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবেনা। পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আত্মতুষ্টি পাওয়ার জন্য অন্য দেশ ও জাতির উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী থাবা বিস্তার করে। এমনকি গোটা পৃথিবীটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.আদর্শহীনতা ২.ব্যক্তি তার উপার্জিত সম্পদের মালিক, এতে অন্যের কোনো অধিকার নেই ৩.ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আকাশচুম্বী ৪.স্রষ্টা ও ধর্ম উপেক্ষিত ৫.মজুতদারীর অবাধ সুযোগ ও অবৈধ-বৈধের পার্থক্যহীনতা ৬.উপার্জিত অর্থ ইচ্ছামত ব্যয় করা যাবে।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism):
জাতীয়তাবাদ হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, ভাষা, বংশ, গোত্র, ধর্ম, অর্থনৈতিক ঐক্য, এক শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে গঠিত একটি চেতনা, এক ধরনের মানসিকতা এবং অনুভূতি যা মানুষকে একত্রিত করে এবং জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য/স্বরূপ/ত্রুটিসমূহ: ১.জাতির জন্য যে কোনো কাজ করা যাবে ২.আদর্শহীনতা ৩.জাতিকে বিতর্কিতকরণ ৪.বিশ্বমানবতাকে উপেক্ষা ৫.ন্যায়-অন্যায়ে পার্থক্য না করা বা কম করা ৬.অহংকারের জন্মদান ৭.ব্যক্তি সমস্যায় উদাসীনতা ৮.বিশ্বরাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করা ৯.সংঘাত সৃষ্টিকারী ১০.হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো।
গণতন্ত্র (Democracy):
গণতন্ত্র হচ্ছে একপ্রকারের শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর জনগণ সমভাবে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় এবং রাজনৈতিক কার্যাবলীতে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার থাকে। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থাই গণতন্ত্র। আব্রাহাম লিংকনের ভাষায় “Democracy is a government of the people, by the people and for the people.”
উল্লেখ্য, (ক)জনগণের সার্বভৌমত্বভিত্তিক গণতন্ত্র ইসলামে স্বীকৃত নয়। (খ)যারা নিজ দলের ভেতরেই গণতন্ত্র চালু করতে ব্যর্থ হয়, তারা কিভাবে দেশে গণতন্ত্র চালু করবে?
প্রচলিত গণতন্ত্র আসল (বা উপকারী) গণতন্ত্র নয় (বা জনগণের প্রকৃত কল্যাণের তন্ত্র বা মতবাদ নয়)। এ গণতন্ত্রে তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। কিন্তু বাস্তবে ধনী, ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী ও মুষ্টিমেয় কিছু লোকই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে। এমনকি জনগণ কাকে ভোট দেবে- এ বিষয়টিও অনেকটা ঐ মুষ্টিমেয় লোকদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। অপরদিকে তাত্ত্বিকভাবে হলেও ‘জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস’ বলা হলে তা ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস’ এ তথ্যের বিরোধী হয়ে যায় যা এক ধরণের শিরকও বটে।
আসল (বা উপকারী) গণতন্ত্র (বা মানুষের কল্যাণের পথ) রয়েছে ইসলামে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার পরই ইসলামী গণতন্ত্র (তথা ইসলামের মূলনীতির আলোকে মানুষের কল্যাণের পথ) প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ইসলামের মতো শ্রেষ্ঠ নিয়ামাত গ্রহণে অনিচ্ছুক জাতিকে জোর করে এ নিয়ামাত চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর রীতি (বা সুন্নাত) নয়। তাছাড়া, যথোপযুক্ত জনসমর্থন আদায় না করে অধিকাংশ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের উপর জোর করে ইসলামী বিধান জারি করা স্বাভাবিক ও কার্যকর পদ্ধতি নয়। আবার, প্রচলিত পন্থাকে পাশ কেটে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা জোর করে ক্ষমতা দখল করারই নামান্তর- যা সাধারণত ফলপ্রসূ ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে, বিনা রক্তপাতে কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে ক্ষমতায় পৌঁছানোর সুযোগ থাকলে সে সুযোগ গ্রহণ করাতে দোষের কিছু নেই।
তর্কের খাতিরে নির্বাচনের পন্থাকে ভুল ধরে নিলেও এ পন্থা সকলের জন্য খোলা রাখা হয়েছে। ইসলামী আদর্শের বিজয়ের লক্ষ্যে অন্য পন্থা এর চেয়ে ভালো হলেও তার সুযোগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শকে এগিয়ে নেওয়াটাই মূল বিষয়, কোন পন্থা বেশি ভালো এ বিতর্ক করে সময় ক্ষেপন করে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে থমকে থাকাটা নয় বড় বিষয় নয়।
তথ্যসূত্র:
১.যারা ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু অনেক ভালো কাজ করেছেন, কিংবা যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, তাদের পরিণাম কী হবে- ইউসুফ সুলতান
(http://yousufsultan.com/those-who-didnt-get-dawah-of-islam/)
২.মুসলিমরা জান্নাতে যাবে আর হিন্দুরা জাহান্নামে যাবে এতে কি সুবিচার হয়- শায়খ বিন বায (https://deenilhaq.wordpress.com/2014/03/17/)
৩.অমুসলিমদের এত সম্পদ! তার মানে কি ইসলাম ভূল- মুহাম্মদ রাসেল (http://pchelplinebd.com/Islam/archives/3852)
৪.ন্যালসন ম্যান্ডেলা কি জান্নাতে যাবেন না জাহান্নামে যাবেন - শফিউর রহমার ফারাবী (https://www.amarblog.com/shafiur2012/posts/175691)
৫.ঈমানের হাকীকত- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
৬.মৃত্যু যবনিকার ওপারে- আব্বাস আলী খান
৭.ইসলাম একমাত্র ভ্রান্তিহীন বিধান- তানজীর আহমাদ
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ