পতঞ্জলি যোগসূত্র - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

09 June, 2020

পতঞ্জলি যোগসূত্র

বেদের ঈশ্বরসংক্রান্ত শ্লোক নিয়েই গড়ে উঠেছে উপনিষদ। যে উপনিষদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন এবং আর্যপূর্ব ধ্যানধারণা নিয়ে প্রাচীন ভারতে ছয়টি দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়।
এই ছয়টি দার্শনিক মতের মধ্যে অন্যতম হল যোগ বা যোগশাস্ত্র (Yoga )। এ প্রসঙ্গে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন: ... ... These are thought to be two of the many schools of philosophy that originated over the centuries that had common mystical roots derived from the early Vedic and Indus-Saraswati period. The orthodox Hindu philosophies of Samkhya, Yoga, Vedanta, as well as the non-orthodox Nastika systems of Jainism and Buddhism can all be seen as representing one stream of spiritual activity in Ancient India, in contrast to the Bhakti traditions and Vedic ritualism which were also prevalent at the same time.
কপিল প্রবর্তিত সাংখ্যদর্শনের ভিত্তিতেই যোগদর্শন গঠিত। তবে সাংখ্যদর্শন নিরেশ্বরবাদী হলেও যোগদর্শন আস্তিক ধারার দর্শন । কপিল ঈশ্বরকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলেও যোগের উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। অর্থাৎ ...how to achieve Union or Spiritual Absorption into the Supreme Absolute or God. এই কারণে প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান ধর্মশাস্ত্র ভগবত গীতার ভিত্তিই হল সাংখ্য-যোগ দর্শন।
কিন্তু যোগ কি?
এক কথায় যোগ হল আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে শারীরিক এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ। তবে যোগ বলতে আমরা কেবল আসন বা যোগব্যয়াম বুঝি। এই ধারণা অতীব ভ্রান্ত। কেননা আসন বা যোগাসন যোগশাস্ত্রের একটি অংশ মাত্র। বস্তুত, যোগ হল এক আধ্যাত্মিক দর্শন । যার উদ্দেশ্য ঈশ্বরে সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সৎ ও সুন্দর মানুষ তৈরি করা। ইসলামী সুফিদেরও লক্ষ্যও কিন্তু অভিন্ন। পাঠ করুন: When the Ṣūfī succeeds in purifying himself entirely of the earthly world and loses himself in the love of God, it is said that he has “annihilated” his individual will and “passed away” from his own existence to live only in God and with God.যোগের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সংস্কৃত পন্ডিত Chester Messenger লিখেছেন: Yoga means Union and the purpose is to teach the practitioner of Yoga, called the Yogi, how to achieve Union or Spiritual Absorption into the Supreme Absolute or God. Yoga teachs us that our true self is the soul and that our self identity is an illusion to be overcome.
কিন্তু, যোগ কি শিক্ষা দেয়?
এ প্রসঙ্গে কণকপ্রভা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ত্রিগুণা প্রকৃতির পরিণাম এই সংসারে সকলই সুখ, দুঃখ ও বিবাদের আকর। পুরুষ তত্ত্ব নির্লেপ। কিন্তু অবিবেকহেতু প্রকৃতির সঙ্গে আপন তাদাত্ম্য কল্পনা করে তার দুঃখভোগ হয়। এই দুঃখকে পরিহার করার একমাত্র উপায় তার উৎপত্তির মূলটি খুঁজে বার করে তাকে বিনষ্ট করা। যোগশাস্ত্র সেই শিক্ষাই দেয়।’ (সাংখ্য-পাতঞ্জল দর্শন। পৃষ্টা ৫৫।)
তাহলে যোগের উদ্দেশ্য হল ভবসংসারের দুঃখকে এড়িয়ে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ?
প্রাচীন ভারতবর্ষে যোগ সম্বন্ধে এমনই ধারণা প্রচার করেছিলেন মহাঋষি পতঞ্জলি। কিন্তু এমন ধারণা পতঞ্জলি কেন প্রচার করেছিলেন ?
মহাঋষি পতঞ্জলির জীবন সম্বন্ধে জানা না গেলেও তাঁর সময়কাল ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব বলে অনুমিত হয়। একটি সূত্রে উল্লেখ রয়েছে পতঞ্জলির পিতার নাম আত্রি এবং মায়ের নাম অনুসূয়া। এরা বাস করতেন কৈলাস। যাই হোক। পতঞ্জলির সময়ে ভারতবর্ষে মৌর্যদের শাসন চলছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাটি ছিল, আজকের মতোই, রাজকীয় অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে। মুষ্টিমেয়র সুখের নিমিত্তে ভূমিপুত্রদের ওপর অধিক করারোপ। নগর ও গ্রামের সাধারণ মানুষ লোভের যূপকাষ্ঠে বলি। এরও কিছুকাল আগে- অর্থাৎ বৌদ্ধযুগের সমাজেও অনুরূপ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। মানুষের জীবন ছিল দুঃখেকষ্ঠে ভারাক্রান্ত । এ বিষয়ে Kim Knott তাঁর Hinduism A Very Short Introduction বইতে : Anyone who knows the story of the Buddha will be aware that early Indian society in his time was viewed by a spiritual seeker as a place of misery and unrest. Happiness was transitory, to be replaced all to soon by ageing, disease, and death.As scholars have shown, it was also a time of social and political change, with towns growing up and the agrarian lifestyle and its social organization being eroded.(page,36)
এহেন বিরূপ পরিস্থিতিতে চিন্তাশীল পতঞ্জলি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য মানুষকে সমাজবিপ্লবের পথ দেখালেন না। বরং আত্মিক সংস্কারের মুক্তির পথ নির্দেশ করলেন।

পতঞ্জলি কি escapist ছিলেন? তিনি কি উপলব্দি করেছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা যে রাজকীয় অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে তাদের শোষন থেকে নিম্নকায় ভূমিপুত্রদের রেহাই নেই যখন তখন রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি না থেকে বরং মানসিক শান্তির জন্য ভিন্নপথ ধরাই শ্রেয়? বাংলার ভাটি অঞ্চলের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমও কি ওই একই কারণে escapist ছিলেন? কেননা,"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" গানটিতে তিনি কেন লিখলেন?

বর্ষা যখন হইত/গাজীর গান আইত/ রঙেঢঙে গাইত/ আনন্দ পাইতাম/
কে হবে মেম্বার/ কে-বা গ্রামসরকর/ আমরা কি তার খবর লইতাম হায়রে?

যা হোক। পতঞ্জলি ১৯৪ যোগসূত্র সঙ্কলন করে রচনা করলেন এক যুগান্তকারী গ্রন্থ: যোগসূত্র । যা আজ বিখ্যাত একটি গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। পতঞ্জলি কর্তৃক গ্রথিত যোগসূত্রটি চারটি পদে বা অধ্যায়ে বিভক্ত। এই পদসমষ্টি হল: সমাধি, সাধনা, বিভূতি এবং কৈবল্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে প্রাচীন ভারতে বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চার বিরোধী। যে জ্ঞান মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে না সে ধরণের বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি প্রাচীন ভারতের মণিষার আগ্রহ ছিল না। তারা মনে করতেন: জ্ঞানই মুক্তি। পক্ষান্তরে ইউরোপের প্রাচীন চিন্তাবিদেরা মনে করতেন জ্ঞানই শক্তি। ইউরোপ আজ জ্ঞানের সে শক্তিতে বাইরের দিক থেকে বদলেছে ঠিকই তবে তার আত্মার যথার্থ সংস্কার আজও হয়নি। এ কারণে পতঞ্জলির যোগসূত্রটি ঘিরে ইউরোপে আজ এত কৌতূহল এত আগ্রহ। যোগ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বইটিই পন্ডিত Ernest Wood -এর লেখা।
সে যাই হোক। পতঞ্জলি যোগসূত্রের শুরুতেই বললেন: Human unhappiness results from man’s acceptance of a state of servitude to the low condition of his own mind.(Ernest Wood Yoga; page 11.) এই উক্তির মাধ্যমে পতঞ্জলি কি সেই সুপ্রাচীন কালেই মনোবিজ্ঞান চর্চার পথটি উম্মোচন করলেন না? পতঞ্জলি কেবল যোগসূত্রই রচনা করেন নি তিনি বিখ্যাত বৈয়াকরণিক পানিনির অষ্টাধ্যয়ী গ্রন্থের একটি ভাষ্যও রচনা করেছেন। সেই সঙ্গে পতঞ্জলি আয়ুবের্দ শাস্ত্রের ওপর বই লিখেছেন ।
আমরা জানি যে, যে যোগ সাধনা করে সে যোগী
যিনি যোগ অনুশীলন করেন বা দক্ষতার সহিত উচ্চমার্গের যোগ দর্শন অনুসরণ করেন, তাকে যোগী বা যোগিনী বলা হয়। একজন যোগীকে কৈবল্য (মুক্তি) লাভ করতে হলে বিভিন্ন স্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। পতঞ্জলি যোগসূত্রে সেরকম স্তর নির্দেশ করেছেন। একে বলা হয় অষ্টাঙ্গ যোগসূত্রের দ্বিতীয় পদে অর্থাৎ সাধনা পদে অষ্টাঙ্গের বর্ণনা রয়েছে। অষ্টঙ্গ হল: যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।
যম- অহিংসা সত্য আস্তেয় ব্রহ্মচর্য অপরিগ্রহ -এই ৫ ভাগে বিভক্ত। অহিংসা হল জীবিত প্রাণীর প্রতি হিংসা পোষন না করা। সত্য হল সদা সত্য কথা বলা এবং সত্যে অটল থাকা। আস্তেয় হল লোভ না করা; ব্রহ্মচর্য হল নিষ্কাম জীবনযাপন করা। এবং অপরিগ্রহ হল কোনও কিছুর অধিকারী না হওয়া।
নিয়ম - শৌচ, সন্তোষ, তাপস, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রনিধান- এই ৫টি ভাগে বিভক্ত। শৌচ হল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা; সন্তোষ হল সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা; তাপস হল মন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সংযমী হওয়া। স্বাধ্যায় হল নিয়মিত ধর্মীয় শাস্ত্র অধ্যায়ন করা। এবং ঈশ্বরপ্রনিধান হল ঈশ্বরের কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্বসমর্পন করা।
আসন হল এক ধরনের শারীরচর্চা ; এর উদ্দেশ্য হল শক্তি সংরক্ষণ। আসনসাধনায় অঙ্গপ্রতঙ্গ সুগঠিত হয় ও স্নায়ূ সুস্থ থাকে । কয়েকটি আসনের নাম হচ্ছে: শবাসন, শীর্ষাসন ইত্যাদি।
প্রাণায়াম মূলত শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ

প্রাণায়ম ("প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণ")

প্রাণস্বরূপ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ।
 প্রত্যাহার
বাইরের বিষয়গুলি থেকে ইন্দ্রিয়কে সরিয়ে আনা। আসন ও প্রাণায়ামের সাহায্যে শরীরকে নিশ্চল করলেও ইন্দ্রিয় ও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে। এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হল প্রত্যাহার।
 ধারণা
কোনো একটি বিষয়ে মনকে স্থিত করা। কোনো বিশেষ বস্তুতে বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ করে রাখাকে ধারণা বলে।
 ধ্যান
মনকে ধ্যেয় বিষয়ে বিলীন করা। যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সে বিষয়ে যদি চিত্তে একাত্মতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে। এই একাত্মতার অর্থ অবিরতভাবে চিন্তা করতে থাকা।
সমাধি
ধ্যেয়ের সঙ্গে চৈতন্যের বিলোপসাধন। ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবষ্ট হয়ে পড়ে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ধ্যান রূপ প্রক্রিয়া ও ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্তের এই প্রকার অবস্থাকেই সমাধি বলে। এই সমাধি প্রকার - সবিকল্প এবং নির্বিকল্প। সাধকের ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকলে, তাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমধি। তখন তাঁর মনে চিন্তার কোনো লেশমাত্র থাকে না। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর, যোগীর পরম প্রাপ্তি।
অষ্টাঙ্গিক যোগ

যোগদর্শন হলো প্রধানত সাধনশাস্ত্র ও প্রয়োগবিদ্যা। যোগমতে প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হলো কৈবল্য লাভ বা মুক্তিলাভের উপায়। বিবেকখ্যাতির অর্থ হলো পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার থেকে পৃথক শুদ্ধ চৈতন্য সত্তা। এই বিবেকখ্যাতির জন্য প্রয়োজন চিত্তবৃত্তির নিরোধ। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী চিত্তবৃত্তি নিরোধের দুটি প্রধান উপায় হলো অভ্যাস ও বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়ে বৈরাগ্য আসে এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেক-জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু ধারণা, ধ্যান, সমাধি প্রভৃতি অভ্যাস করার মতো চিত্তশুদ্ধি যাদের হয়নি তাদের জন্য প্রথমে চিত্তবৃত্তি নিরোধের সাক্ষাৎ উপায় হিসেবে আটটি যোগাঙ্গ অভ্যাসের মাধ্যমে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়েছে। এগুলি একসঙ্গে অষ্টাঙ্গ-যোগ নামে পরিচিত। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘যমনিয়মাসন-প্রাণায়ামপ্রত্যাহারধারণাধ্যানসমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি’- (যোগসূত্র : ২/২৯)
অর্থাৎ : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ।
 .
যোগের এই অষ্টাঙ্গ যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে চিত্তের মলিনতা নষ্ট হয় এবং জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পায়। যোগশাস্ত্রকাররা বলেন, যোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অষ্টাঙ্গিক যোগের অনুষ্ঠানের দ্বারা অশুদ্ধি অর্থাৎ অজ্ঞান এবং তার থেকে উৎপন্ন সংস্কার যতোই ক্ষয় হয়, প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান ততোই দীপ্তিমান হয়ে ওঠে। জ্ঞানের দীপ্তির চরম সীমাই হলো বিবেকখ্যাতি বা ভেদজ্ঞান। বিবেকখ্যাতি লাভের উপায় হিসেবে যোগের এই অষ্টাঙ্গের অনুশীলন অপরিহার্য।
.
 .
যম :
প্রথম যোগাঙ্গ হলো যম। যম হলো একপ্রকার নিষেধাত্মক বিধি। যম সম্পর্কে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘অহিংসাসত্যাস্তেয়ব্রহ্মচর্য্যাপরিগ্রহা যমাঃ’- (যোগসূত্র : ২/৩০)
অর্থাৎ : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ- এই পাঁচটি সাধনকে একসঙ্গে বলা হয় যম।
 .
(ক) অহিংসা : অহিংসা হলো সর্বপ্রকারে, সর্বদা, সর্বভূতের প্রতি হিংসা থেকে বিরত থাকা। হিংসা বলতে এখানে কায়িক, বাচিক ও মানসিক- তিনপ্রকার হিংসার কথাই বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার হিংসাই বর্জনীয়। অর্থাৎ কোনপ্রকারেই অপরকে আঘাত না করা বা অপরকে ব্যথা না দেয়া। অহিংসার ইতিবাচক ভাব হলো মৈত্রী।
.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যোগী পুরুষরা যেভাবে অহিংসা মহাব্রত পালন করেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব নয়। যেমন আততায়ীকে বধ করা, খাবার জন্য ফসল, গাছ প্রভৃতি নাশ করা, অপকারী প্রাণীকে বধ করা ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ হিংসারূপে গণ্যই করেন না। কেননা দেহধারণের জন্য কিছু না কিছু খেতেই হবে। আবার প্রতি পদক্ষেপে কিছু না কিছু জীবাণুর প্রাণহানি হয়। এমনকি গৃহস্থের বাড়িতে অসময়ে ও অনাহূতভাবে অন্নগ্রহণ করলেও তা একপ্রকার পীড়নই বলা চলে। বস্তুত এক্ষেত্রে এরূপ বিধান দেয়া হয়েছে যে, অবশ্যম্ভাবী কিছু হিংসা ত্যাগ করা না গেলেও যোগীপুরুষ যথাসম্ভব হিংসাকে বর্জনের সংকল্প করে চিত্তশুদ্ধি করবেন। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিতর্কবাধনে প্রতিপক্ষভাবনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৩)
‘বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভমোহাক্রোধপূর্ব্বিকা মৃদুমধ্যাধিমাত্রা দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৪)
‘অহিংসা প্রতিষ্ঠায়াং তৎসন্নিধৌ বৈরত্যাগঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৫)
অর্থাৎ :
যোগবিঘ্ন হিংসা প্রভৃতি বিতর্ক নিবারণ করতে হলে যোগের অনুকূল অবিতর্ক অহিংসা প্রভৃতির যাতে স্ফূরণ হয়, তারই চেষ্টা করতে হয় (পাতঞ্জল-২/৩৩)।  লোভ, মোহ এবং ক্রোধ বশতই নিজ ইচ্ছাক্রমে অন্য কারো অনুরোধে অথবা নিজ অনুমোদনের দ্বারা হিংসা প্রভৃতি বিবিধ বিতর্ক সম্পাদিত হয়ে থাকে। ঐ লোভ, মোহ এবং ক্রোধ, মৃদু, মধ্য অথবা উগ্রভাবে উৎপন্ন হয়। মৃদুভাবে লোভ, মোহ কিংবা ক্রোধের উদয় হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মৃদু হয়। ঐগুলি মধ্যভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মধ্য হয়। আর সেগুলি উগ্রভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও উগ্র হয়। হিংসা প্রভৃতি বিতর্কবৃত্তি যেভাবেই স্ফূরিত হোক না কেন, তারা দুঃখ অজ্ঞান এবং ঐ উভয়ের অনন্ত ফল উৎপন্ন করে, এইভাবে ভাবনার নামই প্রতিপক্ষভাবনা। এই প্রতিপক্ষভাবনাবলে হিংসা বিতর্কসমূহের দোষ অনুসন্ধানে সেইসব থেকে যেসব দুঃখ হয়, তাদের আলোচনায় সমস্ত বিতর্কেরই নিবৃত্তি হয় (পাতঞ্জল-২/৩৪)।  যে মহাপুরুষ সম্পূর্ণ হিংসাশূন্য হয়েছেন, তাঁর কাছে হিংস্র বন্য জন্তুরাও হিংসা পরিত্যাগ করে, তিনি হিংস্র জন্তুদের সহবাসেও নিরাপদে অবস্থান করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৫)।
 .
(খ) সত্য : সত্য হলো চিন্তায় এবং বাক্যে কোনরূপ মিথ্যাচরণ না করা। তবে যোগশাস্ত্রে সত্য কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত। কাল ও পরিবেশ নির্বিশেষে সত্য যেন অপরের কল্যাণকর হয়। যথাদৃষ্ট, যথাশ্রুত এবং যথাউপলব্ধকে ব্যক্ত করাকে বলা হয় সত্যনিষ্ঠ। সৎ উদ্দেশ্যেও অসত্যের কথন বর্জনীয়, এমনকি অর্ধসত্যও অসত্যের মতোই বর্জন করা উচিত। তত্ত্ব বা সত্য যদি অপ্রিয় হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে মৌন থাকার বিধান দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সত্যপ্রতিষ্ঠায়াং ক্রিয়াফলাশ্রয়ত্বম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৬)
অর্থাৎ : সত্যে প্রতিষ্ঠা জন্মিলে, সত্য ছাড়া মিথ্যা কথা না বললে, বাকসিদ্ধি হয়। কেউ যদি কোন ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান না করেন, অথচ কোন বাকসিদ্ধ পুরুষ যদি তার ভক্তি হবে বলেন, তাহলে সেই ভক্তি প্রাপ্তির অনুকূল কার্য না করেও সেসব কার্যের ফল ভক্তি লাভ করেন (পাতঞ্জল-২/৩৬)।
 .
(গ) অস্তেয় : অস্তেয় হলো চৌর্যবৃত্তি পরিত্যাগ। যা নিজের নয় এমন দ্রব্য, এককথায় যা পরদ্রব্য তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, এমন কি তাতে স্পৃহাও না করাই হলো অস্তেয়। এর দ্বারা চিত্তমল দূরীভূত হয়। এ সম্পর্কে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অস্তেয়প্রতিষ্ঠায়াং সর্ব্বরত্নোপস্থানম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৭)
অর্থাৎ : সম্পূর্ণরূপে চৌর্য ত্যাগ হলে সমস্ত রত্নই প্রাপ্ত হওয়া যায় (পাতঞ্জল-২/৩৭)।
 .
(ঘ) ব্রহ্মচর্য : ব্রহ্মচর্য হলো জননেন্দ্রিয়ের সংযম। কাম-আচরণ ও কাম-চিন্তা থেকে বিরত থাকা। রমণীসম্ভোগ ত্যাগ এবং বীর্য-ধারণকে ব্রহ্মচর্য বলে। ব্যাপক অর্থে ব্রহ্মচর্য হলো শরীর ও মনের পবিত্রতা। এইজন্য সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করে অল্প আহার এবং অল্প নিদ্রার বিধান দেয়া হয়েছে। ব্রহ্মচর্যের দ্বারা বাক্য ও সংকল্পের শক্তি বৃদ্ধি হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘ব্রহ্মচর্য্য প্রতিষ্ঠায়াং বীর্য্যলাভঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৮)
অর্থাৎ : যিনি নিষ্কাম হয়েছেন, যিনি জিতেন্দ্রিয় হয়েছেন, যিনি সর্বতোভাবে ব্রহ্মচর্যে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁর অতুল বিক্রম, অদ্ভূত শক্তিলাভ হয়েছে। যে শক্তিপ্রভাবে কতো অলৌকিক কার্য করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৮)।
 .
(ঙ) অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ হলো দেহরক্ষার বা প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া সমস্ত প্রকার ভোগ বিলাসের আকাঙ্ক্ষা বর্জন, এবং অপরের দান অগ্রহণ। যোগসাধনাকালে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিষয় অর্জন করলে দুঃখ, বিষয়ের রক্ষণে দুঃখ, বিষয়ের ক্ষয়ে দুঃখ এবং বিষয়ের গ্রহণেও দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ, অধিক ভোগ্য বস্তুর অধিকারী হলে মোক্ষে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরিগ্রহের দ্বারা চিত্তে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত হয়। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে-
‘অপরিগ্রহস্থৈর্য্যে জন্মকথন্তাসংবোধ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩৯)
অর্থাৎ : দৃঢ়রূপে অপরিগ্রহ বৃত্তির স্ফূরণে যখন সর্বত্যাগ হয়, যখন সকল প্রকার ভোগবিলাসে বীতরাগ হয়, তখন নিজের সকল জন্মবৃত্তান্তই সুগোচর হয় (পাতঞ্জল-২/৩৯)।
 .
যম হলো নিষেধাত্মক বিধি। কতকগুলি কর্ম থেকে প্রতিনিবৃত্ত হওয়ার সাধনাই হলো যম। যম যোগাঙ্গের প্রথম অঙ্গ এই কারণে যে, ইন্দ্রিয়াসক্ত, বিষয়ভোগী ও অসংযতচিত্ত ব্যক্তি কখনো যোগ সাধনার দুর্গম পথে অগ্রসর হতে পারে না। পাঁচপ্রকার যম জাতি, দেশ ও কাল অতিক্রান্ত হলে তা মহাব্রত বলে গণ্য হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘এতে জাতিদেশকালসময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্ব্বভৌমা মহাব্রতম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩১)
অর্থাৎ : এই পাঁচপ্রকার যম যদি জাতি, দেশ, কাল ও সময় কর্তৃক বিচ্ছিন্ন না হয়ে সর্বাবস্থায় সমানভাবে আচরিত হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকটিকে একেকটি মহাব্রত বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৩১)।
.
 .
নিয়ম :
যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ হলো নিয়ম। নিয়ম অর্থ নিয়মিত ব্রতপালনের অভ্যাস। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ’- (যোগসূত্র : ২/৩২)
অর্থাৎ : শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধানকে বলা হয় নিয়ম।
 .
(ক) শৌচ : ‘শৌচ’ শব্দের অর্থ শুচিতা বা শুদ্ধি। যোগের জন্য দেহ ও মন উভয়েরই শুচিতা দরকার। এ কারণে শৌচ দ্বিবিধ- বাহ্য ও আন্তর। প্রাত্যহিক স্নান হলো বাহ্য শৌচ। বাসগৃহ নির্মল রাখা এবং সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা যোগীর বাঞ্ছনীয়। কারণ মদ, মাংস ইত্যাদি তামসিক আহার চিত্তের স্থিরতা নষ্ট করে এবং তার ফলে ব্রহ্মচর্যের হানি হয়। অপরপক্ষে আন্তর শৌচ হলো অহঙ্কার, অভিমান এবং হিংসা ইত্যাদি চিত্তের মলীনতা থেকে মুক্ত হওয়া। অহঙ্কারে উন্মত্ত, অভিমানী এবং হিংসাযুক্ত চিত্ত সর্বদা বিক্ষুব্ধ থাকায় সমাধিস্থ হতে পারে না। শৌচের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয় এবং চিত্তশুদ্ধির ফলে চিত্তে প্রসন্নতা আসে। পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন-
‘শৌচাৎ সাঙ্গজুগুপ্সা পরৈপরসঙ্গশ্চ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪০)
‘সত্ত্বশুদ্ধিসৌমনস্যৈকাগ্র ইন্দ্রিয়জয়াত্মদর্শন যোগ্যত্বানি’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪১)
অর্থাৎ :
শৌচ সিদ্ধ হলে নিজ শরীর পর্যন্ত অশুচি বোধ হয়। সেজন্য নিজ শরীরের প্রতিও ঘৃণা ও বীতরাগ হয়। শৌচসিদ্ধের পর পরসঙ্গ-ইচ্ছাও ত্যাগ হয়ে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪০)।  বাহ্যশৌচ সিদ্ধ হয়ে, পরে আন্তর শৌচ সিদ্ধ হলে সত্ত্বশুদ্ধি (অপূর্ব সুখপ্রকাশিনী সাত্তিকী বুদ্ধি শুদ্ধি) হয়। সত্ত্বশুদ্ধি থেকে সৌমনস্য (খেদ সম্পর্ক বিহীনা মানসী প্রীতি) হয়। সৌমনস্য থেকে একাগ্রতা (স্থৈর্য্য) হয়। ইন্দ্রিয়জয় থেকে আত্মদর্শন-শক্তি (আত্মজ্ঞান) হয় (পাতঞ্জল-২/৪১)।
 .
(খ) সন্তোষ : ‘সন্তোষ’ বলতে বোঝায় অহেতুক আকাঙ্ক্ষাকে বর্জন করে যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। কেবলমাত্র সন্তোষের দ্বারাই সুখ পাওয়া যায়। কারণ সমস্ত কাম্য বিষয় পেলে তবেই তুষ্ট হবো এরূপ ভাবলে সমস্ত কাম্য বিষয় কখনোই পাওয়া যায় না। সন্তোষ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪২)
অর্থাৎ : পূর্ণ সন্তোষ থেকে উত্তম সুখ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠসুখ লাভ হয়, যে সুখের অপর নাম দিব্যসুখ (পাতঞ্জল-২/৪২)।
 .
তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধান ক্রিয়াযোগের অন্তর্গত। চিত্তের স্থিরতার উদ্দেশ্যে যেসব ক্রিয়া বা কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাদের বলা হয় ক্রিয়াযোগ। ক্রিয়াযোগ সাধারণত তিনপ্রকার, যথা- তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধান। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘তপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি ক্রিয়াযোগঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/১)
‘স সমাধিভাবনার্থঃ ক্লেশতনূকরণার্থশ্চ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/২)
অর্থাৎ :
তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধানকেই ক্রিয়াযোগ বলা হয় (পাতঞ্জল-২/১)।  ঐ ক্রিয়াযোগের অন্তর্গত তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধান অভ্যাস করতে করতে নানাপ্রকার ক্লেশের ক্ষয় হতে থাকে এবং তার সাথে সাথে সমাধির অনুকূলশক্তিও বৃদ্ধি হতে থাকে (পাতঞ্জল-২/২)।
 .
(গ) তপঃ : ‘তপঃ’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা বা ব্রত। যে যে কর্মে আপাতত সুখ হয় সেই সেই কর্মের নিরোধের চেষ্টাকে বলা হয় তপের চর্যা। যেমন, উপবাস করা বা শয্যাগ্রহণ না করা ইত্যাদি। বস্তুত শরীরের ত্রিধাতুর বৈষম্য না ঘটিয়ে চিত্তকে রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি থেকে মুক্ত করে যে কষ্টসাধন করা হয়, তাই তপঃ। এই যোগ শরীরসংক্রান্ত বলে একে শারীর ক্রিয়াযোগ বলা হয়। তপস্যা বা ব্রতাচারের মাধ্যমে চিত্ত দৃঢ় হয়। বস্তুত বিচলিত না হয়ে শান্তভাবে শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা সহকারে মহাব্রতের সাধনই হলো তপস্যা। মহর্ষি পতঞ্জলি তপস্যার ব্যাখ্যায় পাতঞ্জলসূত্রে বলেছেন-
‘কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধি ক্ষয়াত্তপসঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৩)
অর্থাৎ : কঠোর তপস্যা দ্বারা শরীর ও ইন্দ্রিগণের অশুদ্ধি ক্ষয় হলে, শরীর ও ইন্দ্রিয়গণ সম্বন্ধেও সিদ্ধ হওয়া যায়। তখন শরীর ও ইন্দ্রিয়গণকে নিজ বশে আনা যায়। নিজ ইচ্ছানুসারে শরীরকে অতি স্থূল কিংবা অতি সূক্ষ্ম করা যেতে পারে। ইন্দ্রিয়দেরকে সুদূরবর্তী অতি সূক্ষ্ম ব্যবহিত পদার্থ মধ্যেও নিয়োগ করা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৪৩)।
 .
(ঘ) স্বাধ্যায় : স্বাধ্যায় হলো বাচিক ক্রিয়াযোগ। ‘স্বাধ্যায়’ শব্দের অর্থ অধ্যয়ন ও জপ। প্রণব বা ওঁকারের জপ এবং আধ্যাত্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করাই মূলত স্বাধ্যায়। অধ্যয়ন আত্মজ্ঞানের প্রতি স্পৃহার উদ্রেক করে এবং জপ আত্মতত্ত্বে অনুপ্রবেশ ঘটায়। এর ফলে বিষয়চিন্তা ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে এবং পরমার্থ সত্যে আগ্রহ ও জ্ঞান বাড়ে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘স্বাধ্যায়াদিষ্ট দেবতা সম্প্রযোগঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৪)
অর্থাৎ : স্বাধ্যায় সিদ্ধ হলে, ইষ্টদেবতা সন্দর্শন এবং তাঁর সাথে সম্ভাষণ ঘটে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪৪)।
 .
(ঙ) ঈশ্বরপ্রণিধান : আর ক্রিয়াযোগ ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার মানসক্রিয়াযোগ। ঈশ্বরের ধ্যান এবং সকল কর্ম ও কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণই হলো ঈশ্বরপ্রণিধান। ‘যা কিছু হচ্ছে সব ঈশ্বরের দ্বারাই হচ্ছে, আমি অকর্তা’- প্রত্যেক কর্মে এরূপ ভাবনা করে সমস্ত কর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে এইভাবে বার বার ঈশ্বর-প্রণিধান করতে করতে যোগীর চিত্তের মালিন্য দূর হয়ে স্বরূপদর্শন হয়। যোগীর তখন এরূপ উপলব্ধি হয় যে ঈশ্বর যেমন শুদ্ধ অর্থাৎ ধর্ম এবং ধর্মরহিত, প্রসন্ন অর্থাৎ অবিদ্যা ইত্যাদি ক্লেশশূন্য, কেবল এবং বিপাকবর্জিত অর্থাৎ জাতি আয়ু ভোগরূপ কর্মফল শূন্য, তেমনি পুরুষ বা প্রত্যগাত্মাও নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্তস্বভাব। এভাবেই বুদ্ধি থেকে পুরুষ ভিন্ন হয়ে সমাধি লাভ করেন। ঈশ্বরপ্রণিধান থেকে সমাধি সিদ্ধি হয়। সমাধি সিদ্ধির ফলে দেহান্তরে, দেশান্তরে এবং কালান্তরে যা ঘটে তা সবই জানা যায়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সমাধিরীশ্বর প্রণিধানাৎ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৫)
অর্থাৎ : ঈশ্বর প্রণিধান বা ভগবানে চিত্ত নিবেশ দ্বারা সমাধি হয় (পাতঞ্জল-২/৪৫)।
.
.
আসন :
অষ্টাঙ্গের তৃতীয় যোগাঙ্গ হলো আসন। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘স্থিরসুখম্ আসনম্’- (যোগসূত্র : ২/৪৬)
অর্থাৎ : দেহের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্থির রেখে নিশ্চলভাবে সুখজনক অবস্থায় উপবেশনই আসন।
 .
আসনের দ্বারা সুস্থ ও নীরোগ দেহ লাভ করা যায়। আসন নানা প্রকারের রয়েছে, যেমন- পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন প্রভৃতি। সুস্থ ও শুচি দেহ যোগীদের সমাধিলাভের পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল। স্থির হয়ে আসন করতে করতে যোগীর নিজের শরীরকে শূন্য মনে হয় এবং তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, তাপে কাতর হন না। ক্রমশ যোগীর শারীরবোধ বিলীন হয়ে যায় এবং তাঁর মনে হয় যে তিনি অনন্ত আকাশে মিলিয়ে গিয়ে আকাশের মতো সর্বব্যাপী হয়ে গিয়েছেন। একেই বলা হয় অনন্ত সমাপত্তি। আসন একপ্রকার যৌগিক ব্যায়াম। আসন অভ্যাসের দ্বারা নির্বিঘ্নে সমাহিত হওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়-
‘প্রযত্নশৈথিলানন্তসমাপত্তিভ্যাম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৭)
‘ততোদ্বন্দ্বানভিঘাতঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪৮)
অর্থাৎ :
স্বাভাবিকভাবে যেসব পদ্ধতিক্রমে উপবেশন করা হয়, সেসব পরিহারপূর্বক যোগীদের পদ্ধতি অনুসারে আসন অভ্যাস করতে করতে অনন্তে মগ্ন হতে পারলে, অচৈতন্যবারক তদাত্ম্য (তন্ময়তা) প্রাপ্তি হয়। তদাত্ম্য প্রাপ্তি হলে আসন অভ্যাসে কোন কষ্টবোধই হয় না (পাতঞ্জল-২/৪৭)।  আসন সিদ্ধি দ্বারা শীত গ্রীষ্মে অভিভূত হতে হয় না। তার দ্বারা ক্ষুৎপিপাসাও ব্যাকুল করতে পারে না। তা প্রাণায়ামের বিশেষ অনুকূল (পাতঞ্জল-২/৪৮)।
.
.
প্রাণায়াম :
চতুর্থ যোগাঙ্গ হলো প্রাণায়াম। যোগী আসন সিদ্ধ হলে তবে তার প্রাণায়াম হয়। প্রাণায়াম হলো বায়ুর শ্বাসরূপ আভ্যন্তরিক গতি এবং প্রশ্বাসরূপ বহির্গতির বিচ্ছেদ। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘তস্মিন্ সতি শ্বাস-প্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ’- (যোগসূত্র : ২/৪৯)
অর্থাৎ : শ্বাসগতি ও প্রশ্বাসগতির যে বিচ্ছেদ তাকেই বলে প্রাণায়াম।
 .
স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস একটা ছন্দ অনুসারে বিরামহীনভাবে চলে। ঐ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে গতিবিচ্ছেদ আনাই প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য। শ্বাস নিয়ে প্রশ্বাস না ফেলে থাকা অবস্থায় যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটি একপ্রকার প্রাণায়াম। আবার প্রশ্বাস ফেলে শ্বাস না নিয়ে থাকলে যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটাও একপ্রকার প্রাণায়াম। পরম্পরাক্রমে এই প্রাণায়ামগুলি অভ্যাস করা হয়। তবে এই গতিবিচ্ছেদের সময় চিত্তকে অবশ্যই অচঞ্চল ও একাগ্র অবস্থায় রাখতে হয়। প্রাণায়ামের এই গতিবোধ তিন প্রকার- বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি এবং স্তম্ভবৃত্তি। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভ বৃত্তির্দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টোদীর্ঘঃ সূক্ষ্মঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫০)
অর্থাৎ :
একই প্রাণায়াম তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের নাম রেচক বা বাহ্যবৃত্তি, দ্বিতীয় ভাগের নাম পূরক বা অভ্যন্তরবৃত্তি, তৃতীয় ভাগের নাম কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি। ঐ তিন আবার দীর্ঘ ও সূক্ষ্মরূপে দেশ কাল এবং সংখ্যার দ্বারা সাধিত হয়ে থাকে। রেচক প্রাণায়ামের দেশ বহির্ভাগে, রেচক প্রাণায়াম করবার সময় বহির্ভাগে রেচিত বায়ু যদি অধিক দূর যায় তাহলে তার নাম দীর্ঘ, অল্পদূরে গেলে তার নাম সূক্ষ্ম। অভ্যন্তরই পূরক ও কুম্ভকস্থান। পূরক ও কুম্ভক করবার সময় শরীরের মধ্যে সর্বত্র বায়ু পূর্ণ হলে দীর্ঘ বলা যায়। তার বিপরীত হলে সূক্ষ্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। কালের দ্বারা ঐ তিন প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা স্থির করতে হলে, ঐ তিনের স্থিতিকাল নির্বাচন করতে হয়। ঐ তিন অধিক স্থায়ী হলে তাদের দীর্ঘ বলা যায়, অল্পস্থায়ী হলে সূক্ষ্ম। সংখ্যা অনুসারে মন্ত্র জপ দ্বারা ঐ তিনের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্ণয় হতে পারে। নির্দিষ্ট অধিক জপে যে সকল প্রাণায়াম শেষ হয়, সেগুলি দীর্ঘপ্রাণায়াম। অল্প সংখ্যক জপে শেষ হলে সূক্ষ্ম প্রাণায়াম বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫০)। 
 .
(ক) রেচক বা বাহ্যবৃত্তি : শাস্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে ভিতরের বায়ুকে বাইরে স্থাপন করার নাম বাহ্যবৃত্তি বা রেচক।
(খ) পূরক বা আভ্যন্তরবৃত্তি : অপরদিকে বাইরের বায়ুকে শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে ভিতরে স্থাপন করাকে বলা হয় আভ্যন্তরবৃত্তি বা পূরক।
(গ) কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি : আর রেচক ও পূরক কিছুকাল অভ্যাস করে তাদের সাহায্য ব্যতীতই দেহস্থ বায়ুকে ধরে রেখে সারা শরীরকে বায়ুপূর্ণ করার নাম স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভক। এ অবস্থায় শরীর জলপূর্ণ কুম্ভের ন্যায় স্থির ও নিষ্কম্প থাকে।
দেশ, কাল ও সংখ্যার দ্বারা প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্মিত হয়। মূলত প্রাণায়াম হলো শরীর এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াহীনতা। প্রাণায়ামের দ্বারা চিত্ত ক্রমশ বৃত্তিশূন্য হয়।
.
পাতঞ্জলসূত্রে এই তিনপ্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও চতুর্থ এক প্রকার প্রাণায়ামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
‘বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী চতুর্থঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫১)
অর্থাৎ : প্রাণায়ামকর্তা যদি নিজ শরীরের অন্তর বাহ্য বিশেষরূপে পর্যালোচনা করে এই ত্রিবিধ প্রাণায়ামের অনুষ্ঠান করেন, তাহলে সেই অনুষ্ঠান চতুর্থ শ্রেণির প্রাণায়াম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫১)।
.
প্রাণায়াম অভ্যাসের ফললাভ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশবরনম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫২)
‘ধরনাসুযোগ্যতা মনসঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫৩)
অর্থাৎ :
ঐ চতুর্বিধ প্রাণায়াম অভ্যাস করতে করতে যখন সিদ্ধ হওয়া যায়, তখন সর্বশক্তিসম্পন্ন সর্ববস্তুপ্রকাশক বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশ হয়। বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশে মানসস্বরূপ অপ্রচ্ছন্ন হলে, তার অদ্ভূত ক্ষমতা তৈরি হয়। সেই ক্ষমতাবলে ধারণাশক্তি স্ফূরিত হয় (পাতঞ্জল-৫২-৫৩)।
.
.
প্রত্যাহার :
যোগমতে প্রত্যাহার হলো পঞ্চম যোগাঙ্গ। ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগত করাই প্রত্যাহার। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘স্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্তস্য স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ’- (যোগসূত্র : ২/৫৪)
অর্থাৎ : স্ববিষয় অসংযুক্ত হয়ে চিত্তের স্বরূপানুকার লাভকেই ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার বলা হয়। যেসব বিষয়ে যেসব বস্তুতে ইন্দ্রিয়গণ আসক্ত, সেসব বিষয় সেসব বস্তু থেকে তাদেরকে বিরত করে, সম্যক প্রকারে বিকৃতিহীন করে, নির্বিকার চিত্ত স্বরূপের অধীন করার নামই প্রত্যাহার (পাতঞ্জল-২/৫৪)।
 .
যোগের জন্য ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার প্রয়োজন। বিষয়সমূহ থেকে পঞ্চ বাহ্য ইন্দ্রিয় ও আন্তরিন্দ্রিয় মনকে বিযুক্ত বা নিবৃত্ত করা প্রয়োজন। তাই বিষয়বিযুক্তি সাধনের উপায় দুটি- (১) বাহ্য বিষয় লক্ষ্য না করা, (২) মানসভাব নিয়ে থাকা। এইভাবে চিত্ত যখন ইন্দ্রিয়গুলিকে চালনা করে তখন বিষয়ের প্রতি আসক্তি দূর হওয়ার ফলে যোগসাধনা সম্ভব হয়।
অনেক সময় অন্যমনস্কতাবশত ইন্দ্রিয়সমূহ বিষয় থেকে নিবৃত্ত হয়। এইরূপ নিবৃত্তি প্রত্যাহার নয়। ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজের বশীভূত করে বিষয় গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত হওয়াকেই প্রত্যাহার বলে। উল্লেখ্য যে, যম, নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাস করার পর প্রত্যাহার অভ্যাস করলে তবেই যথাযথ ফল পাওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন-
‘ততঃ পরম বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-২/৫৫)
অর্থাৎ : এই প্রত্যাহার প্রভাবে অবশীভূত ইন্দ্রিয়রা সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয় (পাতঞ্জল-২/৫৫)।
.
.
ধারণা :
ধারণা হলো, যে দেশে ধ্যেয়বস্তুকে ধ্যান করতে হবে, সেই দেশে চিত্তকে আবদ্ধ করা। যেমন, পূজার সময় দেখা যায় অন্য বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তকে শরীরের মধ্যে নাভিচক্র বা নাকের ডগায় স্থাপন করা হয় অথবা বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি মূর্তিতে চিত্তকে স্থির রাখা হয়। ধারণার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে-
‘দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা’- (যোগসূত্র : ৩/১)
অর্থাৎ : চিত্তকে কোন দেশে (নাড়ীচক্রে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে অথবা কোন দিব্যমূর্তিতে) আবদ্ধ বা সংস্থিত রাখাকেই বলা হয় ধারণা (পাতঞ্জল-৩/১)।
 .
চিত্তকে বাহ্য বা আন্তর দেশ বিশেষে আবদ্ধ রাখা যায়। পূর্ববর্ণিত যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার ও চিত্তশুদ্ধি ঘটলে চিত্তকে নাসিকাগ্র, ভ্রূমধ্য, নাভিচক্র, জিহ্বাগ্র বা হৃদপদ্মে স্থাপন করাকেই ধারণা বলা হয়। যোগশাস্ত্রে গ্রাহ্য, গ্রহণ এবং গ্রহীতা ভেদে ত্রিবিধ ধারণার কথা বলা হয়েছে। আবার তত্ত্বজ্ঞানময় ধারণা ও বৈষয়িক ধারণা ভেদে ধারণাকে দ্বিবিধ বলা হয়। অন্যদিকে যৌগিক তন্ত্রশাস্ত্রে ষট্চক্রকে ধারণার বিশেষ কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
 .
ষট্চক্র : আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়। বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
‘গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।’- (বিমুক্তিসোপান)
অর্থাৎ : ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।
 .
এই ষট্চক্র হচ্ছে, (১) ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra), (২) আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra), (৩) বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra), (৪) অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra), (৫) মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra), (৬) স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।
.
 .
ধ্যান :
ধ্যেয় বস্তুতে চিত্তকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আবদ্ধ করাই ধ্যান। যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে-
‘তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্’- (যোগসূত্র : ৩/২)
অর্থাৎ : ধারণাতে প্রত্যয় বা জ্ঞানবৃত্তির স্থির আলম্বন বা একতানতাকেই ধ্যান বলে।
 .
ধারণা গভীরতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে ধ্যানে পর্যবসিত হয়। সাধারণভাবে ধারণাতে জ্ঞানবৃত্তি কেবল অভীষ্ট বিষয়েই আবদ্ধ থাকে। এইরূপ বিষয়ক জ্ঞান খণ্ড খণ্ড ভাবে ধারাবাহিক ক্রমে চলতে থাকে। অভ্যাসের দ্বারা যখন তাদের মধ্যে একতান বা অখণ্ড ধারা প্রবাহিত হয় তখনই তাকে যোগের পরিভাষায় ‘ধ্যান’ বলে। ধ্যান তাই চিত্তস্থৈর্যের অবস্থা বিশেষ। ধ্যানশক্তির বলে সাধক যে কোন বিষয় অবলম্বন করে ধ্যান করতে পারেন। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘যথাভিমতধ্যানাৎ বা।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/৩৯)
অর্থাৎ : নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান করো না কেন, তার প্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হবে (পাতঞ্জল-১/৩৯)।
ধারণা ও ধ্যানের মধ্যে পার্থক্য হলো, ধ্যান অবিচ্ছিন্ন আর ধারণা বিচ্ছিন্ন। একই বিষয় সম্পর্কে চিন্তা হলেও ধারণার ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ড জ্ঞানের উদ্ভব হয়, আর ধ্যানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহের মতো চলতে থাকে। ধারণার প্রত্যয়কে বিন্দু বিন্দু জল বা তেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্যদিকে ধ্যানের প্রত্যয় হলো অবিচ্ছিন্ন জলধারা বা তৈলধারার ন্যায়।
.
.
সমাধি :
অষ্টাঙ্গিক যোগের সর্বশেষ যোগাঙ্গ হলো সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যাতা অর্থাৎ ধ্যানকর্তা এবং ধ্যেয় বিষয়ের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে লীন হওয়ার ফলে ধ্যেয়স্বরূপতা প্রাপ্ত হয়। যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে-
‘তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ’- (যোগসূত্র : ৩/৩)
অর্থাৎ : ধ্যান যখন ধ্যেয়ের স্বভাবের আবেশে জ্ঞানাত্মক স্বভাবশূন্য হয় তখন তাকে সমাধি বলা হয়।
 .
সমাধি হলো ধ্যানের চরম উৎকর্ষ, চিত্তস্থৈর্যের সর্বোত্তম অবস্থা। প্রগাঢ় ধ্যানে বিষয়ের স্বভাবে চিত্ত আবিষ্ট হয়ে যখন আত্মহারা হয় তখন তাকে বলে সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যেয় বিষয়ের সত্তারই উপলব্ধি হয়। আত্মসত্তা অভিভূত হয়। ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে ধ্যানকর্তার কোন ভেদ থাকে না। তাই সমাধিতে ধ্যানের জ্ঞানও থাকে না, ধ্যানকর্তার জ্ঞানও থাকে না। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে সম্পূর্ণ লীন হয়ে ধ্যেয়-স্বরূপই প্রাপ্ত হয়।
 .
অষ্টাঙ্গিক যোগের যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গকে যোগের বহিরঙ্গ সাধন বলা হয়। কারণ এগুলির সেরূপ কোন বিষয় নেই। যোগের এই বহিরঙ্গ মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সাধনপাদে বর্ণিত হয়েছে। আর ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটি যোগাঙ্গ হচ্ছে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন। কেননা এগুলি চিত্তবৃত্তিনিরোধের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কিত। এই তিনটি যোগাঙ্গকে একসঙ্গে বলা হয় সংযম। পাতঞ্জলসূত্রে সংযমের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-
‘ত্রয়মেকত্র সংযমঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৪)
অর্থাৎ : পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোন বস্তুতে বা বিষয়ে ধারণা, ধ্যান ও সমাধির যে সন্মিলিত প্রয়োগ, তারই এক নাম সংযম (পাতঞ্জল-৩/৪)।
সংযম জয় করলে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় সম্বন্ধে তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা হয়। যোগসূত্রের বিভূতিপাদে এই তিনটি যোগাঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। পতঞ্জলি বলেন-
‘তজ্জয়াৎ প্রজ্ঞালোকঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৫)
অর্থাৎ : সংযম আয়ত্ত হলে দিব্যজ্ঞানময়ী পরমাবুদ্ধি স্ফূরিত হয়। সেই বুদ্ধিপ্রভাবে অসম্ভব সম্ভব হয়। অসাধ্য সাধ্য হয়। তার প্রভাবে করা যায় না এমন কার্য নেই (পাতঞ্জল-৩/৫)।
 .
উপরিউক্ত অষ্টাঙ্গ যোগ সবীজ বা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির উপযোগী। নির্বীজ বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি এই অষ্ট যোগাঙ্গের লক্ষ্য নয়। যোগমতে সম্প্রজ্ঞাত সমাধির মাধ্যমেই কেবল অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে উন্নীত হওয়া যায়। অর্থাৎ, উপরিউক্ত অষ্ট যোগাঙ্গ সম্প্রজ্ঞাত সমাধির পথ প্রস্তুতকারক। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে-
‘অয়মন্তরঙ্গং পূর্ব্বেভ্যঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৭)
‘তদপিবহিরঙ্গং নির্বীজস্য’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/৮)
‘তস্য প্রশান্ত বাহিতা সংস্কারাৎ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/১০)
‘সর্ব্বার্থতৈকাগ্রতয়োঃ ক্ষয়োদয়ৌ চিতস্য সমাধিপরিণামঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৩/১১)
অর্থাৎ :
সংযম অপেক্ষা যমনিয়মাদি সমাধির অন্তরঙ্গ নয়। সংযম-বলে অতি সূক্ষ্ম বস্তুতেও চিত্ত সমাহিত হয় (পাতঞ্জল-৩/৭)।  সর্বমনোবৃত্তির নিরোধের নাম নির্বীজ সমাধি। সংযম সেই নির্বীজ সমাধির বহিরঙ্গ ব্যতীত অন্তরঙ্গ নয় (পাতঞ্জল-৩/৮)।  বারবার চিত্ত নিরোধপরিণাম উৎপন্ন হলে তার প্রভাবে যে সুদৃঢ় সংস্কার জন্মায়, সেই সংস্কার-বলে সেই চিত্ত নিরোধপরিণামের প্রশান্ত স্থৈর্য্যস্রোত নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে (পাতঞ্জল-৩/১০)।  নানা বস্তু সম্বন্ধীয় নানা প্রকার মনোবৃত্তির নিবৃত্তি হলে যে এক পরমবস্তু বিষয়ক পরমাবৃত্তি উদিত হয়, তা-ই সমাধি-পরিণাম (পাতঞ্জল-৩/১১)।
এর আগের এক পোস্টে আমি বলেছিলাম যে ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে বাংলার বাউলগানের একটা সম্পর্ক রয়েছে।Maqsoodul Haque (ঢাকা ব্যান্ডের মাকসুদ) এর Bauliana Worshiping the great God in man বইয়ের কয়েকটি লাইন পড়ে আমার সেরকমই ধারণা হল। কেননা, ওই বইতে মাকসুদ লিখেছেন `Yoga taught us proper breathing thousands of years ago ...this deliberation on breathing is essential in our real underatanding after translation of the word Baul. (page 5) পতঞ্জলিনির্দেষত প্রাণায়াম এবং বাংলার বাউলের সম্পর্কের বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রতিহার হল Withdrawal of senses from their external objects. এর মানে কি? বহিস্থ বস্তু থেকে ইন্দ্রিয় অপসারণ কী ভাবে সম্ভব?
যাই হোক। ধারণা হল চিত্তকে (মনকে?) কোনও বস্তুর ওপর নিবিষ্ট করা। এই যেমন প্রদীপের আলো কিংবা দেবতার ছবি। এতে চিত্ত স্থির এবং মন শান্ত হয়।
ধ্যান অর্থ কোনও কিছুতে একাগ্র মনোনিবেশ করা। এক কথায় ধ্যান হল Undisturbed flow of thought around the object of meditation (pratyayaikatanata).তবে The act of meditation and the object of meditation remain distinct and separate.
সমাধি হল আরাধ্যবস্তুতে বা ধারণায় বিলীন হয়ে যাওয়া। উপাস্যের সঙ্গে একাত্ম বোধ করা। পতঞ্জলির সমাধির ধারণা বৈষ্ণবদের প্রভাবিত করেছে কিনা এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে। রাধা কৃষ্ণসমুদ্রে বিলীন হতে চায়। কৃষ্ণই তো রাধার আরাধ্য। পতঞ্জলির সমাধির ধারণাটির সঙ্গে ইসলামি সুফিদের ফানার ধারণার সাদৃশ্য রয়েছে। ফানা সম্বন্ধে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা লিখেছে, fana, Arabic Fanā, ʾ (“to pass away,” or “to cease to exist”), the complete denial of self and the realization of God that is one of the steps taken by the Muslim Ṣūfī (mystic) toward the achievement of union with God. Fana may be attained by constant meditation and by contemplation on the attributes of God, coupled with the denunciation of human attributes. মহাঋষি পতঞ্জলির সময়কাল ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব বলে পতঞ্জলির সময়কাল জৈন্য ও বৌদ্ধ যুগের পরে। কাজেই পতঞ্জলির যোগসূত্রে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। যেমন যোগসূত্রের সমাধির ধারণা অনেকটা বুদ্ধকথিত নির্বান-এর মতো । কেবল তাই নয়- দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাবার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ অস্টাঙ্গিক মার্গ বা ৮টি মহান পথের কথা বলেছেন। যাম ধারণাটি একান্তভাবেই জৈনদের । জৈনধর্মের ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর ‘চর্তুযাম’ প্রচার করেছেন, যার অন্তর্গত অহিংসা, আস্তেয় এবং অপরিগ্রহ। এভাবে ভারতীয় চিন্তাধারায় ‘অহিংসা’র ধারণাটি মহাবীরেরই গভীর অবদান বলা যেতে পারে। উল্লখ্য,কুড়ি শতকে অহিংস আন্দোলনের জন্য বিশ্বময় শ্রদ্ধেয় মহাত্মা গান্ধীর জন্ম একটি জৈন পরিবারে। যদিও তিনি বেদান্ত দর্শনে বিশ্বাস করতেন।
পতঞ্জলির ওপর জৈন-বৌদ্ধ প্রভাব সত্ত্বেও তাঁর সঙ্কলিত যোগসূত্রটি বিগত ২৩০০ বছরে বিশ্বময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানেও গ্রন্থটির প্রতি জিজ্ঞাসু মানুষের গভীর আগ্রহ বিদ্যমান । পতঞ্জলির যোগসূত্রটি ঘিরে ইউরোপে গভীর আগ্রহের কারণটি পূর্বেই বলেছি।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতিষী মহাজাতক আজও তাঁর শিষ্যদের যে মেডিটেশন-এর কলাকৌশল শেখাচ্ছেন সেই সমস্ত কলাকৌশলের মধ্যেও রয়েছেন মহাঋষি পতঞ্জলি এবং তাঁর ১৯৪টি সূত্র সম্বলিত যোগসূত্র ...যে যোগসূত্রটি মহাঋষি পতঞ্জলি প্রাচীন ভারতের এক অন্ধকার অধ্যায়ের বিপর্যস্ত মানুষের কল্যাণে সংকলিত করেছিলেন ... আজ তাই বিশ্বের লক্ষকোটি মানুষের মনের শান্তির নিয়ামক হয়ে উঠেছে।

চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি

যোগদর্শনে চিত্তের কতগুলি বিকারকে একত্রে চিত্ত বলা হয়। এই বিকারগুলি হলো মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। এবং যোগমতে চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়েছে। যোগসূত্রকার পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলেন-

‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’- (যোগসূত্র)
অর্থাৎ : চিত্তের বিভিন্ন প্রকারের বৃত্তির নিরোধই যোগ।
 .
এই যোগ বা চিত্তবৃত্তির নিরোধ কিভাবে হবে ? যোগশাস্ত্রকারদের মতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১২)
অর্থাৎ : অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের সাহায্যে প্রত্যেক মনোবৃত্তিই নিরুদ্ধ হতে পারে (পাতঞ্জল-১/১২)।
এ বক্তব্যের প্রতিফলন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও দেখা যায়-
‘অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৫)
‘অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৬)
অর্থাৎ : হে মহাবাহো, মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাকে সংযত করা যায়। (৬/৩৫)
অসংযত ব্যক্তির পক্ষে সমাধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্যসাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ করতে পারেন। (৬/৩৬)
 .
সাংখ্য-যোগ দার্শনিকগণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই ত্রিতাপ ব্যাপী দুঃখের উপস্থিতি উপলব্ধি করে জগতকে দুঃখময় বলে অভিহিত করেন। এই ত্রিতাপ হলো- তাপ-দুঃখ, পরিণাম-দুঃখ এবং সংস্কার-দুঃখ। সংস্কার-দুঃখ অতীত, তাপ-দুঃখ বর্তমান ও পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
 .
জন্ম মৃত্যু তাপ জরা ইত্যাদিই বর্তমানের তাপ-দুঃখ। জগতে সুখ ও দুঃখ দুটোই আছে বলে সাধারণ ধারণা। কিন্তু যোগশাস্ত্রকারদের মতে চিরায়ত সুখপ্রদ এমন কোন বস্তু জগতে নেই। জগৎ যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সুখপ্রদ বস্তুও পরিবর্তনশীল। সুখপ্রদ বস্তু আপাতত সুখের কারণ হলেও পরিণামে বিয়োগজনিত দুঃখেরই কারণ। সুখ ভোগের তৃষ্ণা বৃদ্ধির জন্য পরিণামে দুঃখ বাড়ে। এটাই পরিণাম-দুঃখ। সে কারণে পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
সুখ ও দুঃখের অনুভূতির ফলে জীবের মনে সংস্কার উৎপন্ন হয়। সুখানুভূতি সুখ সংস্কারের এবং দুঃখানুভূতি দুঃখ সংস্কারের সৃষ্টি করে। যোগশাস্ত্রকারগণ বাসনাকে সংস্কার মনে করেন। তাই সুখ-সংস্কারের ফলে জীব বারবার সুখপ্রদ বস্তুর প্রতি আসক্ত হয় এবং দুঃখ-সংস্কারের ফলে দুঃখপ্রদ বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়। এর ফলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করে। সংস্কার হতে এই যে দুঃখের সৃষ্টি তা-ই সংস্কার-দুঃখ। এসব দুঃখের নিবৃত্তিই হলো জীবের পরম পুরুষার্থ। এর উপায়ই হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ বা যোগ। ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে তার নিরোধ করা সম্ভব বলে যোগশাস্ত্রে স্বীকৃত।
অভ্যাস প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘তত্র স্থিতৌ যত্নোহভ্যাসঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৩)
‘স তু দীর্ঘকালনৈরন্তর্ষ্যসৎকারা সেবিতো দৃঢ়ভূমিঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৪)
অর্থাৎ :
চিত্ত স্থিার করবার জন্য রজস্তমোবৃত্তিশূন্য যে যত্ন, তাকেই অভ্যাস বলা হয় (পাতঞ্জল-১/১৩)। প্রযত্নসহকারে মনোনিবেশপূর্বক দীর্ঘকাল ঐ প্রকার অভ্যাস করতে করতে তবে তা সুদৃঢ় ও নিশ্চল হয় (পাতঞ্জল-১/১৪)।
.
এবং বৈরাগ্য প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘দৃষ্টানুশ্রবিক বিষয়বিতৃষ্ণস্য বশীকারসংজ্ঞা বৈরাগ্যম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৫)
‘তৎপরং পুরুষখ্যাতের্গুণবৈতৃষ্ণ্যম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৬)
অর্থাৎ :
যাঁর সমস্ত শাস্ত্রীয় অশাস্ত্রীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা জন্মেছে, যিনি সমস্ত দৃষ্টবিষয়ে বীতস্পৃহ হয়েছেন, তাঁরই বশীকার সংজ্ঞক বৈরাগ্য জন্মেছে (পাতঞ্জল-১/১৫)।  পরমবৈরাগ্য স্ফূরিত হলে, প্রকৃতি পুরুষ যে পরস্পর অভেদ নয়, সে সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান জন্মে। সেই জ্ঞানপ্রভাবে প্রাকৃতিক গুণনিচয়ের প্রতিও বীতস্পৃহ হতে হয় (পাতঞ্জল-১/১৬)।
 .
যোগমতে, বৈরাগ্য দু’প্রকার- বশীকার বা অপর এবং পর বা ধর্মমেষ। ভোগের বিষয়গুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- দৃষ্ট অর্থাৎ যা সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতায় গম্য এবং আনুশ্রবিক অর্থাৎ শ্রুতির উপর আস্থার ফলে যে বিষয়গুলি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ও আকর্ষণ হয়। দৃষ্ট বিষয়গুলি হলো খাদ্য, পানীয়, কাপড়, শয্যা, বাড়ি, রথ বা গাড়ি ইত্যাদি। আনুশ্রবিক বিষয় হলো যথাক্রমে স্বর্গ, প্রকৃতিলয়, বিদেহলয় ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি আপাতমনোরম হলেও এরা ত্রিতাপের আকার।
 .
এই বিষয়গুলি যখন আমাদের আয়ত্তে আসে তখন যদি তত্ত্বজ্ঞানের ফলে আমরা তাদের দোষ দেখে তাদের প্রতি বিরক্ত বা নিরাসক্ত হয়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের চিত্তে বশীকার বৈরাগ্য হয়েছে বলে বোঝা যাবে। পরবৈরাগ্য হলো আরও উচ্চস্তরের অবস্থা। যে জ্ঞান বা বুদ্ধির দ্বারা পুরুষতত্ত্বের সাক্ষাৎকার হয়, তাকে অগ্র্যাবুদ্ধি বা চরমজ্ঞান বলে। পুরুষ-সাক্ষাৎকার হলে ত্রিগুণাপ্রকৃতি থেকে আত্মা বা পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হয় এবং তার ফলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। পরবৈরাগ্যের ফলও দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। পরবৈরাগ্যে প্রবৃত্তির আত্যন্তিক নাশ হয় এবং খ্যাতি বা জ্ঞানবিষয়েও বৈরাগ্য দেখা যায়।
 .
চিত্তের বৃত্তিগুলির পরিপূর্ণ লয় বা নিরোধই মূলত সমাধি অবস্থা। যোগদর্শন মতে, সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকেই চিত্ত সমাধি স্তরে উন্নীত হয়। চিত্তের সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থাকে বলা হয় চিত্তভূমি। চিত্তভূমি পাঁচ প্রকার। যথা- ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। সকল জীবের চিত্তই স্থূলত এই পাঁচ অবস্থায় থাকে। যোগমতে এই পঞ্চবিধ চিত্তভূমির শেষোক্ত দুটি ভূমি অর্থাৎ একাগ্র ও নিরুদ্ধ অবস্থাই যোগ সাধনার অনুকূল। তবে এই দুই ভূমি যোগানুকূল হলেও যোগপ্রক্রিয়া অতি জটিল। একাগ্র অবস্থায় বিষয়মাত্র অবশিষ্ট থাকায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় সম্ভব হয় না। নিরুদ্ধ অবস্থায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় হয় এবং পুরুষ স্বস্বরূপে অবস্থান করে। একাগ্র অবস্থা থেকে চিত্তের পূর্ণ লয়ের অবস্থা পর্যন্ত যোগের অনেকগুলি পর্যায় বর্তমান। যোগের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী যোগের নানা প্রকারভেদ যোগদর্শনে স্বীকৃত হয়েছে।
 .
অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
.
(১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি 
যোগশাস্ত্রমতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলি নিরুদ্ধ হলে প্রথমে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দীভূত হয় এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেকস্রোত উদ্ঘাটিত হয়। এই উপায়দ্বয়ের দ্বারা প্রথম যে যোগ বা সমাধিপ্রাপ্তি ঘটে তাকেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় একই বিষয়াকারে বৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে একাগ্র চিত্তভূমিতে অবস্থান করে। ‘সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যক্ বা প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত। এ অবস্থায় ধ্যেয় বস্তুকে সম্যক্ ভাবে জানা যায় বলে এই সমাধিকে সম্প্রজ্ঞাত বলে। এ বিষয়ে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৭)
অর্থাৎ : বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা এই ভাবচতুষ্টয়ানুগত সমাধি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
 .
যোগাভ্যাসের প্রাথমিক স্তরে কোন স্থূল দেবমূর্তি বা ভৌতিক পদার্থকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়। স্থূলবস্তু থেকেই ক্রমশ সূক্ষ্ম বস্তুর দিকে চিত্ত প্রবাহিত হয়। তাই যোগমতে ধ্যেয় বা ভাব্য বস্তু দ্বিবিধ- স্থূল ও সূক্ষ্ম। এই দ্বিবিধ বস্তুই আবার বাহ্য ও আন্তর ভেদে দ্বিবিধ। সুতরাং মোট চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু বর্তমান। এগুলি হলো- (১) স্থূল বাহ্যবস্তু, যেমন- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূত, (২) স্থূল আন্তরবস্তু, যেমন- একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহ, চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক্-পানি-পাদ-পায়ু-উপস্থ এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও উভয়-ইন্দ্রিয় মন, (৩) সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু, যেমন- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহ ও (৪) সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু, যেমন- অহং ও বুদ্ধি।
.
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তুকে বিষয় হিসেবে বলা হয় যথাক্রমে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা। এই চারপ্রকার বিষয় তথা অবলম্বন ভেদে যোগ বা সমাধিও চারপ্রকার- (১) সবিতর্ক, (২) সবিচার, (৩) সানন্দ ও (৪) সাস্মিত।
 .
সাধারণত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে সকল বিষয় গৃহীত হয় তারা স্থূল বিষয়। যেমন গরু, ঘোড়া, ঘট ইত্যাদি। এইসব স্থূল বিষয় যখন শব্দের বাচ্যরূপে অর্থাৎ নামজ্ঞান ও সংকেতজ্ঞান হিসেবে সমাধিপ্রজ্ঞার বিষয় হয় তখন সেই সমাধিকে বলা হয় সবিতর্ক সমাধি। অর্থাৎ, এই অবস্থায় যোগীর কোন একটি শব্দের বাচ্য স্থূল বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সম্যক্ জ্ঞান হয়।
.
এরপর, অর্থাৎ স্থূলবিষয়ক সমাধি আয়ত্ত হলে যোগীর বিচারবিশেষের দ্বারা তন্মাত্র প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান হয়। একেই বলে সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যেহেতু শব্দ ব্যতীত বিচার হয় না, তাই সবিচার সমাধিতেও বাচকশব্দের অপেক্ষা থাকে।
.
সানন্দ অবস্থা হলো অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের অবস্থা। এই অবস্থায় বাচক শব্দের ততো অপেক্ষা নেই। আমাদের শরীর হলো জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, চিত্ত ও প্রাণের অধিষ্ঠাতা। অভ্যাসের ফলে ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণাদির সঙ্গে অধিষ্ঠাতা শরীরের যখন বিশেষ একপ্রকার স্থৈর্য সিদ্ধ হয় তখন এক সর্বব্যাপী সাত্ত্বিক সুখ অনুভূত হয়। সর্বশরীরে ঐ আনন্দময় সাত্ত্বিক ভাবের সহজ বোধই সানন্দ সমাধির বিষয়।
.
সাস্মিত সমাধির বিষয় হলো মহান আত্মা বা ব্যবহারিক গ্রহীতা। এই ব্যবহারিক গ্রহীতা কিন্তু স্বরূপত পুরুষ নন। সাংখ্যদর্শনে এঁকে মহৎ-তত্ত্ব বলা হয়েছে। ‘আমি’ এই বোধমাত্রই সাস্মিত সমাধির বিষয়। এইটি হলো বুদ্ধি বা মহৎ-এর অভিমান। সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকায় একে পুরুষ বলে ভ্রম হয়। এই সাস্মিত অবস্থাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থা।
 .
কিন্তু সম্প্রজ্ঞাত সমাধি অবস্থায় চিত্তবৃত্তি কখনই সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হতে পারে না। কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম আকারে হলেও বিষয়াকার আলম্বন থেকেই যায়। এই সমাধিতে সংসার বীজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না, সুপ্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয় বলে এই সমাধিকে সবীজ সমাধিও বলা হয়।
.
(২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
সম্প্রজ্ঞাত সমাধির দ্বারা চিত্ত যখন বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয় তখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি সম্পূর্ণ আলম্বন বা বিষয়হীন। এটি পরবৈরাগ্যের অভ্যাসসাধ্য সংস্কার। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিরামপ্রত্যয়াভ্যাসপূর্ব্বঃ সংস্কারশেষোহন্যাঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৮)
অর্থাৎ : অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো পরবৈরাগ্যের অভ্যাসের দ্বারা সংস্কার শেষ স্বরূপ সমাধি। প্রবল বৈরাগ্যবশত যখন সমস্ত চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি হয়, তখন চিত্ত প্রত্যেক সংস্কার পরিশূন্য, সেই অবলম্বনরহিত অপূর্ব অবস্থাকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।
 .
সকলপ্রকার চিত্তবৃত্তির নিরোধকে বলা হয় বিরাম। এই বিরাম লাভের উপায় হলো বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিসমূহ নিরুদ্ধ হয়। অভ্যাসের দ্বারা এই বৈরাগ্য দৃঢ় হয়। বৈরাগ্য দৃঢ় হলে চিত্তবৃত্তির পুনরুৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে না। চিত্ত তখন দগ্ধবীজের ন্যায় শক্তিশূন্য হয়ে পড়ে।
শাস্ত্রবাক্যে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থ হলো-
‘ন কিঞ্চিৎ প্রজ্ঞায়তে ইতি অসম্প্রজ্ঞাতঃ’।
অর্থাৎ : যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।
 .
এইরূপ নিরালম্ব ও নির্বীজ সমাধিকে বলা হয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে স্থূলতত্ত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে অস্মিভাবে চিত্ত সমাহিত হয়। অস্মিভাবে কোন স্থূল ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিজ্ঞানের জ্ঞান বা সংস্কার থাকে। যখন ঐ অস্মিভাবও চাই না মনে করে যোগী নিরোধ আনতে পারেন, তখন তাঁর চিত্তবৃত্তি রুদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যোগমতে, এই অবস্থায় মনের সঙ্গে শরীরযন্ত্রের ক্রিয়াও রুদ্ধ হয়ে যায় এবং স্থম্ভিতপ্রাণ অবস্থায় থাকে। নিরোধ ভঙ্গ হলে আবার শরীরের যান্ত্রিক ক্রিয়া ফিরে এসে আগের অবস্থা হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পুরুষ প্রকৃতির সকল প্রকার সংযোগ ছিন্ন করে স্ব স্ব রূপে অবস্থান করে। প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষ জন্ম-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে কৈবল্যপ্রাপ্ত হয়। এইরূপ কৈবল্য-প্রাপ্তিকে যোগদর্শনে মোক্ষ বলা হয়।
 .
তবে যোগশাস্ত্রে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং উপায়প্রত্যয়। ভব অর্থ জন্ম এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। বিদেহলীন ও প্রকৃতিলীন যোগীদের এজাতীয় ভবপ্রত্যয় হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘ভব প্রত্যয়োবিদেহপ্রকৃতিলয়ানাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৯)
অর্থাৎ : সম্প্রজ্ঞাত সমাধিমূলক বিদেহলয়, কিংবা প্রকৃতিলয় উভয়ই মুক্তির কারণ হয় না। যেহেতু উভয়ই অবিদ্যা পরিশূন্য নয়। নিদ্রার পর জাগরণ হলে যেমন নানা কার্যে ব্যাপৃত থাকতে হয়, তেমনি ঐ উভয়বিধ অনাত্মলয়ের পরেও চিত্ত বারবার সাংসারিক ব্যাপারে আসক্ত হয় (পাতঞ্জল-১/১৯)।
যে যোগী সব বিষয়ের ত্যাগকে চূড়ান্ত মনে করে তাতেই আনন্দ লাভ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকায় ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণগুলি লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। তাদের দেহের নাশ হলে তারা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভ করেন। এঁরাই বিদেহলীন নামে পরিচিত। কিন্তু পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎকার না হওয়াতে এরা কৈবল্য লাভ করতে পারেন না। আবার যে সব যোগী পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎ করেননি কিন্তু বিষয়ের ত্যাগ জন্য তাঁদের অন্তঃকরণ মূলা প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতিলীন নামে পরিচিত। এঁদেরও মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।
 .
অপরপক্ষে উপায়প্রত্যয় হলো প্রকৃত অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। উপায় অর্থ যথাবিহিত উপায় এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। উপায়প্রত্যয় প্রকৃত যোগীর হয়ে থাকে। এর উপায়গুলি হলো শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। শ্রদ্ধা অর্থ হলো প্রসন্নচিত্তে ও আসক্তিসহ বিষয়ের গুণ আবিষ্কার করে জানার ইচ্ছা। বীর্য হলো অন্য বিষয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে চিত্তকে সাধনে নিযুক্ত করা। স্মৃতি হলো ধ্যেয় বিষয়কে বারবার অনুভব করা। বীর্য হলো শ্রদ্ধার ফল এবং স্মৃতি হলো বীর্যের ফল। যখন স্মৃতি স্থির এবং ধ্রুব হয়, তখন সমাধি হয়। সমাধি অবস্থাতেই প্রজ্ঞা বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের প্রকাশ হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘শ্রদ্ধাবীর্য্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্ব্বক ইতরেষাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২০)
অর্থাৎ : যিনি যোগ সম্বন্ধীয় শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধিবলে অতুল প্রজ্ঞা লাভ করেছেন, তিনিই মুক্ত হয়েছেন। কোন প্রাকৃতিক প্রলোভন আর তাঁকে প্রলোভিত করতে পারে না। তিনিই বিদেহলয় এবং প্রকৃতিলয় বিহীন উপায় প্রত্যয়শীল নিত্যমুক্ত যোগী হয়েছেন। তিনিই চিরকালের জন্য স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন (পাতঞ্জল-১/২০)।
.
এই সমাধিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে বলা হয়, তীব্র সম্বেগসম্পন্ন যোগীরই শীঘ্র সমাধিলাভ ঘটে। সম্বেগ হলো তীব্র কার্যশক্তিসম্পন্ন সংস্কারের নাম। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে তাই বলা হয়েছে-
‘তীব্রসম্বেগানামাসন্নঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২১)
‘মৃদুমধ্যাধিমাত্রত্বাত্ততোহপি বিশেষঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২২)
অর্থাৎ :
তীব্র সম্বেগশালী যোগীরই শীঘ্র সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২১)।  মৃদু, মধ্য ও অধিমাত্র ভেদে তিন প্রকার সম্বেগ আছে। মৃদু সম্বেগশীল যোগীর সমাধি বিলম্বে হয়। মধ্য সম্বেগবিশিষ্ট হলে তারচেয়ে শীঘ্র হয়। যাঁর অধিমাত্র সম্বেগ হয়েছে, অতি শীঘ্রই তিনি সমাধিমগ্ন হন (পাতঞ্জল-১/২২)।
 ..
অভ্যাস, বৈরাগ্য, শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি ছাড়াও ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধির অন্যতম সাধন বলেছেন যোগসূত্রকার পতঞ্জলি।
‘ঈশ্বর প্রণিধানাৎ বা।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৩)
‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৭)
‘তজ্জপস্তদর্থ ভাবনম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৮)
অর্থাৎ : শুদ্ধভক্তি সহকারে ঈশ্বরের অর্চনা করলেও সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অধিকারী হওয়া যায় (পাতঞ্জল-১/২৩)।  তিনি ওঙ্কারের বাচ্য। তাঁর নাম ওঁ (পাতঞ্জল-১/২৭)।  ঈশ্বরবাচক প্রণব জপ করতে করতে, সেই ঈশ্বরবাচক প্রণবের অর্থ ভাবতে ভাবতে একাত্ম হওয়া যায়। সম্যক্ একাগ্রতার উদয়ে সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২৮)।

এজন্যেই এ প্রসঙ্গে যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনা স্থান পেয়েছে। সুতরাং, বিবেকখ্যাতি বা সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞানলব্ধ হয়ে পুরুষ সাক্ষাৎকার হলে তবেই সম্পূর্ণ সমাধিলাভ হয়। এই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ফলে দ্রুত প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হওয়ার ফলে কৈবল্যলাভের পথ প্রশস্ত হয়।
পাতঞ্জল দর্শন(বই)
অনুবাদ : খগেন্দ্রনাথ শাস্ত্রী
ভোজদেব-কৃত বৃত্তি-সমেত
সরল ব্যাখ্যা, অনুবাদ এবং অন্যান্য টীকারকারগণের তাৎপর্যবোধক সাধনের অনুকুল যুক্তিমূলক আভাস সম্বলিত।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ