পুরাণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

09 June, 2020

পুরাণ

বৈদিক মানত্যা হিসাবে ব্রাহ্মণ গ্রন্থ পুরাণ
 মোট ১৯টি পূর্ণাকার ব্রাহ্মণ অদ্যাবধি বিদ্যমান: এগুলির মধ্যে দুটি ঋগ্বেদ, ছয়টি যজুর্বেদ, দশটি সামবেদ ও একটি অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত।  শতপথ ব্রাহ্মণ, গোপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, বা অশ্বলয়ন ব্রাহ্মণ ( ঋগ্বৈদিক ব্রাহ্মণ ), তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ (সামবেদের ব্রাহ্মণ ), জৈমিনীয় উপনিষদ্ ব্রাহ্মণ বা তলবকার উপনিষদ্ ব্রাহ্মণ (সামবেদের ব্রাহ্মণ), গোপথ ব্রাহ্মণ 
(অথর্ববেদের  ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ),ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বহু গবেষিত হচ্ছে শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ। এর রচয়িতা হিসেবে দুজনের নাম পাওয়া যায়, শাণ্ডিল্য ও যাজ্ঞবল্ক্য।  
প্রচলিত পুরাণ সমূহের সাথে বেদ,উপনিষদের বিরোধী সাংঘর্ষিকতার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, পৌরাণিক বন্ধু গণ কোন উপায় না পেয়ে অথর্ব্ববেদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে নিন্মক্ত রেফারেন্স দিয়ে বলে; দেখুন বেদ, উপনিষদ ও পুরাণ কে স্বীকার করেছে। এটা কে কি বলবেন?

তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২/৯
তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে- ''ব্রাহ্মণানীতিহ্যাসন্ পূরাণানি কল্পান্ গাথানারাশংসীরিতি" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২/৯]। অর্থাৎ ব্রাহ্মণগ্রন্থকেই ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাঁথা ও নারাশংসী বলা হয়। পাণিনী ঋষি ব্রাহ্মণ শাস্ত্র কে পুরাণ সংজ্ঞা হিসেবে মেনেছেন- "পুরাণপ্রোক্তেষু ব্রাহ্মণকল্পেষু" [অষ্টাধ্যায়ী ৪/৩/ ১০৫]। অতএব ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকে ইতিহাস ও পুরাণ বলা হয়েছে বলা হয়েছে।


ভগবতের দ্বিতীয় স্কন্ধের সপ্তম অধ্যায় এবং চতুর্থ স্কনধের উনবিংশ অধ্যায়ে জৈন বৌদ্ধ তান্ত্রিক কাপালিক মতকে "পাষন্ডমত" বলে নিন্দা করা হয়েছে। কাজেই জৈন এবং বৌদ্ধমত ভারতবর্ষে প্রচারিত হওয়ার পরে ভাগবত রচিত। "বিশ্বকোষ" এবং সুবলমিত্রের বাংলা অভিধানে (৬ষ্ঠ সংস্করণ) গ্রন্থে ভাগবতের রচয়িতা বোপদেব লেখা হয়েছে অতঃ মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থ প্রকাশেও এ বিষয় উল্লেখ করেছেন। মহাভারত এবং ভাগবতের মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্য আছে-যদি ভাগবত বেদব্যাসেরই রচনা হয় তাহলে একই ব্যক্তির রচিত মহাভারত এবং ভাগবতের ভাব,মতবাদ, সিদ্ধান্ত এবমন কি চরিত্র বর্ণনায় এত তফাৎ কেন ? 
পুরাণের পিডিএফ সমূহঃ
পদ্মপুরাণ
মহাভাগবত পুরাণ
নারসিংহ পুরাণ
মার্কেন্ডয় পুরাণ
মৎস পুরাণ
শ্রীশ্রী গায়মাহাত্ম্য স্কন্দ পুরাণ

❏ ইতিহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ গাথানং চ
নারশংসীনাং চ প্রিয় ধাম ভবতি য এবং বেদ।।
(অথর্ববেদ ১৫/৬/১১-১২)
তিনি অনুসরন করেন ইতিহাস, পুরান (জ্ঞান ও কর্মের প্রাচীন গল্প) গাথাসমূহ (উদযাপনের কবিতা) এবং নারাশংসীদের ৷ যিনি এটি জানেন ইতিহাস, পুরাণ ও গাথাসমূহ তার প্রিয় হয়, গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ৷


ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে-
❏ "ইতিহাসপুরানাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ"
(ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭/১/২)
অর্থাৎ ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ।

(পৌরাণিক বন্ধু গণ) আপনাদের দৃষ্টিতে, ডালাও ভাবে যখন পুরান সমূহের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গেল, তাহলে গ্রিক পুরাণের দেবতা জিউস, এসক্লেপিয়াস, অ্যাপোলো বা মিশরীয় পৌরাণিক দেবতা হোরাস যার শরীর ছিল মানুষের মত কিন্তু মাথা ছিল বাজপাখির মত, মণিপুরী পৌরাণিক ঈশ্বর গুরু শিদারা ও তাদের দেবদেবী; ইত্যাদি এই সব পুরাণের ঈশ্বর, দেবতার প্রতিমা তৈরি করে পূজা করেন না কেন???

জবাবে পৌরাণিক বন্ধুরা নিশ্চয় বলবেন এখানে ‘পুরাণ’ বলতে কোন পুরাণ গুলাকে বুঝানো হয়েছে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। এখানে গ্রিক, মিশরীয় পুরাণের কথা বলা হয়নি। এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলার কথা বলা হয়েছে।

তার মানে এখান থেকে এটা পরিষ্কার যে “ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ” এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, “পুরাণ” নামক যত গ্রন্থ প্রচলিত আছে, তার সব গুলা কে বুঝানো হয়েছে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণের কথাই বা বলা হয়েছে সেটা আপনারা(পৌরাণিকরা) কিভাবে বুঝলেন???

বিঃদ্রঃ বেদের ভুল অর্থের কারনে নানা মত, পন্থ সৃষ্টি হয়েছে
“পুরাণ” অর্থ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বাশয়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই।(১)

বর্তমান প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব মহাভারত লেখার পরে পুরাণসমূহ রচনা করেন।
যেমন ভাগবতে বলা হয়েছে.....
❏ কৃষ্ণে স্বধামোপগতে ধর্মজ্ঞানাদিভিঃ সহ।
কলৌ নষ্টদৃশামেষ পুরাণার্কোহধুনোদিতঃ।।

(১/৩/৪৩)
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ যখন তার লীলা সংবরণ করে ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সহ নিজ ধামে গমন করলেন, তখন সূর্যের মতো উজ্জ্বল এই পুরাণের উদয় হয়েছে। কলিযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভগবৎ-দর্শনে অক্ষম মানুষেরা পুরাণ থেকে আলোক প্রাপ্ত হবে।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে, ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে; তাহলে যে পুরাণ গুলার সৃষ্টি হয়েছে মহাভারতের পরে সেই পুরাণ গুলার কথা অথর্ব্ববেদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ কিভাবে আসবে? কারণ বেদ, উপনিষদ মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন; বেদ, উপনিষদের সময়ে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ ছিল না; তখন এই পুরাণ গুলোর কোন অস্তিতই ছিল না, তখন শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব কারো জন্মই হয়নি। 
তার মানে এটা পরিষ্কার যে, এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, মহাভারতের বহু কাল পরে সৃষ্টি হওয়া অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলোর কথা বলা হয়নি। বরং এমন পুরাণের কথা বলা হয়েছে যে পুরাণ গুলো মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন, যে পুরাণ গুলো ব্যাসদেবের জন্মের পূর্বে, মহাভারত সৃষ্টির আগে এমনকি উপনিষদের সময়েও বিদ্যমান ছিল; সে পুরাণ গুলোকে “পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ” বলা হয়েছে। প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ কে পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলা হয়নি।

প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব পুরাণ রচনা করেছেন, কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ মহামতি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব প্রণীত নয়। তার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ প্রণয়ন করেছিলেন, তাও এখন প্রচলিত নাই। যা প্রচলিত আছে, তা কার প্রণীত, কবে প্রণীত হয়েছে, তার কোন স্থিরতা নাই। এটা আমার কথা না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‍যুক্তি প্রমাণ সহ তার কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে দেখিয়েছেন প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ এই গুলা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত না।



বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেনঃ

অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে,

তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি 
                                     
১ম,—
 এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনা করিয়া থাকে।যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় নাতেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ  ভাগবতপুরাণ পাঠ করে বলবেনদুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারেতাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।

২য়,— 
এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখেসে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ  গ্রন্থ হতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যেএক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছেআবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছেবায়ুপুরাণে আছেশ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম  ১১শ স্কন্ধে আছেব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছেএবং পদ্ম  বামনপুরাণে  কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।

৩য়
 আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকেতাহা হইলেতন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যেএইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।

৪র্থ,— 
বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ অংশ অধ্যায়১৬-১৯ শ্লোক

পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাসআখ্যানউপাখ্যানগাথা  কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করেছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁকে পুরাণসংহিতা দান করলেন। সুমতিঅগ্নির্বচ্চামিত্রয়ুশাংশপয়ানআকৃতব্রণসাবর্ণিতাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তার মধ্যেকাশ্যপসাবর্ণি  শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হতে তিনটা সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ
 ||শ্রীমদ্ভাগবত১২ স্কন্ধ অধ্যায়- শ্লোক।

ত্রয্যারুণিকাশ্যপসাবর্ণিঅকৃতব্রণশিংশপায়নহারীতএই ছয় পৌরাণিক।

বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।

পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ
 ||

এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেনতাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছেতাহা কাহার প্রণীতকবে প্রণীত হইয়াছিলতার কিছুই স্থিরতা নাই।
ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
“রথন্তরস্য কল্পস্য বৃত্তান্তমধিকৃত্য যৎ।
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
অর্থাৎ যে পুরাণে রথন্তর কল্পবৃত্তান্তাধিকৃত কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুক্ত কথা নারদকে সাবর্ণি বলিতেছেন এবং যাহাতে পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মবরাহচরিত কথিত হইয়াছে, সেই অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকসংযুক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
এক্ষণে যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ প্রচলিত আছে, তাহা সাবর্ণি নারদকে বলিতেছেন না। নারায়ণ নামে অন্য ঋষি নারদকে বলিতেছেন। তাহাতে রথন্তরকল্পের প্রসঙ্গমাত্র নাই, এবং ব্রাহ্মবরাহচরিতের প্রসঙ্গমাত্র নাই। এখনকার প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তে প্রকৃতিখণ্ড ও গণেশখণ্ড আছে। যাহার কোন প্রসঙ্গ দুই শ্লোকে নাই। অতএব প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এক্ষণে আর বিদ্যমান নাই। যাহা ব্রহ্মবৈবর্ত নামে চলিত আছে, তাহা নূতন গ্রন্থ। তাহা দেখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-সঙ্কলন-সময় নিরূপণ করা অপূর্ব রহস্য বলিয়াই বোধ হয়।
উইল্‌সন সাহেব পুরাণ সকলের এইরূপ প্রণয়নকাল নিরূপিত করিয়াছেন:—
ব্রহ্মপুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দী।
পদ্মপুরাণ – ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।[2]
বিষ্ণুপুরাণ-দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ -সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ- ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ- অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ -ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ- খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ -দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ- ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ- ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
পাঠক দেখিবেন, ইঁহার মতে (এই মতই প্রচলিত) কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, বোধ হয়, ইংরাজি পড়িয়া যাঁহার নিতান্ত বুদ্ধিবিপর্যয় না ঘটিয়াছে, তিনি ভিন্ন এমন কোন হিন্দুই নাই, যিনি এই সময়নির্ধারণ উপযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। দুই একটা কথার দ্বারাই ইহার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাইতে পারে।
এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক লোক এবং বিক্রমাদিত্য খ্রীঃ পূঃ ৫৬ বৎসরে জীবিত ছিলেন। কিন্তু সে সকল কথা এখন উড়িয়া গিয়াছে। ডাক্তার ভাও দাজি স্থির করিয়াছেন যে, কালিদাস খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এখন ইউরোপ শুদ্ধ এবং ইউরোপীয়দিগের দেশী শিষ্যগণ সকলে উচ্চৈঃস্বরে সেই ডাক ডাকিতেছেন। আমরাও এ মত অগ্রাহ্য করি না। অতএব কালিদাস ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক হউন। সকল পুরাণই তাঁহার অনেক পরে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাই উইল্‌সন্ সাহেবের উপরিলিখিত বিচারে স্থির হইয়াছে। কিন্তু কালিদাস মেঘদূতে লিখিয়াছেন—
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ শ্লোক।
যে পাঠক সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাকে শেষ ছত্রের অর্থ বুঝাইলেই হইবে। ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা উজ্জ্বল বিষ্ণুর গোপবেশের সহিত ইন্দ্রধনুশোভিত মেঘের উপমা হইতেছে। এখন, বিষ্ণুর গোপবেশ নাই, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের গোপবেশ ছিল। ইন্দ্রধনুর সঙ্গে উপমেয় কৃষ্ণচূড়াস্থিত ময়ূরপুচ্ছ। আমি বিনীতভাবে ইউরোপীয় মহামহোপাধ্যায়দিগের নিকট নিবেদন করিতেছি, যদি ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে কোন পুরাণই ছিল না, তবে কৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছচূড়ার কথা আসিল কোথা হইতে? এ কথা কি বেদে আছে, না মহাভারতে আছে, না রামায়ণে আছে?—কোথাও না। পুরাণ বা তদনুবর্তী গীতগোবিন্দাদি কাব্য ভিন্ন আর কোথাও নাই। আছে, হরিবংশে বটে; কিন্তু হরিবংশও ত উইল্‌সন্ সাহেবের মতে বিষ্ণুপুরাণেরও পরবর্তী। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, কালিদাসের পূর্বে অর্থাৎ অন্ততঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে হরিবংশ অথবা কোন বৈষ্ণব পুরাণ প্রচলিত ছিল।
আর একটা কথা বলিয়াই এ বিষয়ের উপসংহার করিব। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রচলিত, তাহা প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত না হইলেও, অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর অপেক্ষাও প্রাচীন গ্রন্থ। কেন না, গীতগোবিন্দকার জয়দেব-গোস্বামী গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেনের সভাপণ্ডিত। লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমাংশের লোক। ইহা বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রমাণীকৃত, এবং ইংরেজদিগের দ্বারাও স্বীকৃত। আমরা পরে দেখাইব যে, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তখন চলিত ও অতিশয় সম্মানিত না থাকিলে, গীতগোবিন্দ লিখিত হইত না, এবং বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায় তখন প্রচলিত না থাকিলে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক “মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্” ইত্যাদি কখনও রচিত হইত না। অতএব এই ভ্রষ্ট ব্রহ্মবৈবর্তও একাদশ শতাব্দীর পূর্বগামী। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত না জানি আরও কত কালের। অথচ উইল্‌সন্ সাহেবের বিবেচনায় ইহা দুই শত মাত্র বৎসরের গ্রন্থ হইতে পারে।


1 ভাগবতের বক্তা ব্যাসপুত্র শুকদেব। “বৈশম্পায়নহারীতৌ” ইতি পাঠান্তরও আছে।
2 তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
আঠারখানি পুরাণ মিলাইলে অনেক সময়ই ইহা দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনেকগুলি শ্লোক কতকগুলি পুরাণে একই আছে। কোনখানে কিঞ্চিৎ পাঠান্তর আছে। কোনখানে তাহাও নাই। এই গ্রন্থে এইরূপ কতকগুলি শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে বা হইবে। নন্দ মহাপদ্মের সময়-নিরূপণ জন্য যে কয়টি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা এ কথার উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার অপেক্ষা আর একটা গুরুতর উদাহরণ দিতেছি। ব্রহ্মপুরাণের উত্তরভাগে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইয়াছে, ও বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। উভয়ে কোন প্রভেদ নাই; অক্ষরে অক্ষরে এক। এই পঞ্চম অংশে আটাশটি অধ্যায়। বিষ্ণুপুরাণের এই আটাশ অধ্যায়ে যতগুলি শ্লোক আছে, ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে, এবং ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে যে শ্লোকগুলি আছে, বিষ্ণুপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে। এই দুই পুরাণে এই সম্বন্ধে কোন প্রকার প্রভেদ বা তারতম্য নাই। নিম্নলিখিত তিনটি কারণের মধ্যে কোন একটি কারণে এরূপ ঘটা সম্ভব।
১ম,—ব্রহ্মপুরাণ হইতে বিষ্ণুপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
২য়,—বিষ্ণুপুরাণ হইতে ব্রহ্মপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
৩য়,—কেহ কাহারও নিকট চুরি করেন নাই; এই কৃষ্ণচরিতবর্ণনা সেই আদিম বৈয়াসিকী পুরাণসংহিতার অংশ। ব্রহ্ম ও বিষ্ণু উভয় পুরাণেই এই অংশ রক্ষিত হইয়াছে।
প্রথম দুইটি কারণ যথার্থ কারণ বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, এরূপ প্রচলিত গ্রন্থ হইতে আটাশ অধ্যায় স্পষ্ট চুরি অসম্ভব, এবং অন্য কোনও স্থলেও এরূপ দেখাও যায় না। যে এরূপ চুরি করিবে, সে অন্ততঃ কিছু পরিবর্তন করিয়া লইতে পারে এবং রচনাও এমন কিছু নয় যে, তাহার কিছু পরিবর্তন হয় না। আর কেবল এই আটাশ অধ্যায় দুইখানি পুরাণে একরূপ দেখিলেও, না হয়, চুরির কথা মনে করা যাইত, কিন্তু বলিয়াছি যে, অনেক ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের অনেক শ্লোক পরস্পরের সহিত ঐক্যবিশিষ্ট। এবং অনেক ঘটনা সম্বন্ধে পুরাণে পুরাণে বিরোধ থাকিলেও অনেক ঘটনা সম্বন্ধে আবার পুরাণে পুরাণে বিশেষ ঐক্য আছে। এ স্থলে, পূর্বকথিত একখানি আদিম পুরাণসংহিতার অস্তিত্বই প্রমাণীকৃত হইয়াছে। সেই আদিম সংহিতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাসরচিত না হইলেও হইতে পারে। তবে সে সংহিতা যে অতি প্রাচীন কালে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। কেন না, আমরা পরে দেখিব যে, পুরাণকথিত অনেক ঘটনার অখণ্ডনীয় প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায়, অথচ সে সকল ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয় নাই। সুতরাং এমন কথা বলা যাইতে পারে না যে, পুরাণকার তাহা মহাভারত হইতে লইয়াছেন।
যদি আমরা বিলাতী ধরনে পুরাণ সকলের সংগ্রহসময় নিরূপণ করিতে বসি, তাহ হইলে কিরূপ ফল পাই দেখা যাউক। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্থাংশে চতুর্বিংশাধ্যায়ে মগধ রাজাদিগের বংশাবলী কীর্তিত আছে। বিষ্ণুপুরাণে যে সকল বংশাবলী কীর্তিত হইয়াছে, তাহা ভবিষ্যদ্বাণীর আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। অর্থাৎ বিষ্ণুপুরাণ বেদব্যাসের পিতা পরাশরের দ্বারা কলিকালের আরম্ভসময়ে কথিত হইয়াছিল বলিয়া পুরাণকার ভূমিকা করিতেছেন। সে সময়ে নন্দবংশীয়াদি আধুনিক রাজগণ জন্মগ্রহণ করেন নাই। কিন্তু উক্ত রাজগণের সমকাল বা পরকালবর্তী প্রক্ষেপকারকের ইচ্ছা যে, উক্ত রাজগণের নাম ইহাতে থাকে। কিন্তু তাঁহাদিগের নামের উল্লেখ করিতে গেলে, ভবিষ্যদ্বাণীর আবরণ রচনার উপর প্রক্ষিপ্ত না করিলে, পরাশরকথিত বলিয়া পাচার করা যায় না। অতএব সংগ্রহকার বা প্রক্ষেপকারক এই সকল রাজার কথা লিখিবার সময় বলিয়াছেন, অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তিনি যে সকল রাজদিগের নাম করিয়াছেন, তাহার মধ্যে অনেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং তাঁহাদিগের রাজত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধগ্রন্থ, যবনগ্রন্থ, সংস্কৃতগ্রন্থ, প্রস্তরলিপি ইত্যাদি বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
যথা;— নন্দ, মহাপদ্ম, মৌর্য, চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, পুষ্পমিত্র, পুলিমান্, শকরাজগণ, অন্ধ্ররাজগণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে লেখা আছে,—“নব নাগাঃ পদ্মাবত্যাং কান্তিপুর্যাং মথুরায়ামনুগঙ্গাপ্রয়াগং মাগধা গুপ্তাশ্চ ভোক্ষ্যন্তি।”* এই গুপ্তবংশীয়দিগের সময় Fleet সাহেবের কল্যাণে নিরূপিত হইয়াছে। এই বংশের প্রথম রাজাকে মহারাজগুপ্ত বলে। তার পর ঘটোৎকচ ও চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার পর সমুদ্রগুপ্ত। ইঁহারা খ্রীঃ চতুর্থ শতাব্দীর লোক। তার পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, বুদ্ধগুপ্ত—ইঁহারা খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর লোক। এই সকল গুপ্তগণ রাজা হইয়াছিলেন বা রাজত্ব করিতেছেন, ইহা না জানিলে, পুরাণসংগ্রহকার কখনই এরূপ লিখিতে পারিতেন না। অতএব ইনি গুপ্তদিগের সমকাল বা পরকালবর্তী। তাহা হইলে, এই পুরাণ খ্রীষ্টীয় চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বা প্রণীত হইয়াছিল। কিন্তু এমন হইতে পারে যে, এই গুপ্তরাজাদিগের নাম বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থাংশে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। অথবা এমনও হইতে পারে যে, এই চতুর্থাংশ এক সময়ের রচনা, এবং অন্যান্য অংশ অন্যান্য সময়ে রচনা; সকলগুলিই কোনও অনির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হইয়া বিষ্ণুপুরাণ নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। আজিকার দিনেও কি ইউরোপে, কি এদেশে, সচরাচর ঘটিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা একত্রিত হইয়া একখানি সংগ্রহগ্রন্থে নিবদ্ধ হয়, এবং ঐ সংগ্রহের একটি বিশেষ নাম দেওয়া হয়। যথা, “Percy Reliques,” অথবা রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায় সঙ্কলিত ফলিত জ্যোতিষ।” আমার বিবেচনায় সকল পুরাণই এইরূপ সংগ্রহ। উপরি-উক্ত দুইখানি পুস্তকই আধুনিক সংগ্রহ; কিন্তু যে সকল বিষয় ইহাতে সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা প্রাচীন। সংগ্রহ আধুনিক বলিয়া সেগুলি আধুনিক হইল না।
তবে এমন অনেক সময়েই ঘটিয়া থাকিতে পারে যে সংগ্রহকার নিজে অনেক নূতন রচনা করিয়া সংগ্রহের মধ্যে প্রবেশিত করিয়াছেন অথবা প্রাচীন বৃত্তান্ত নূতন কল্পনাসংযুক্ত এবং অত্যুক্তি অলঙ্কারে রঞ্জিত করিয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণ সম্বন্ধে একথা বলা যায় না, কিন্তু ভাগবত সম্বন্ধে ইহা বিশেষ প্রকারে বক্তব্য।
প্রবাদ আছে যে, ভাগবত পুরাণ বোপদেবপ্রণীত। বোপদেব দেবগিরির রাজা হেমাদ্রির সভাসদ্। বোপদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু অনেক হিন্দুই উহা বোপদেবের রচনা বলিয়া স্বীকার করেন না। বৈষ্ণবেরা বলেন, ভাগবতদ্বেষী শাক্তেরা এইরূপ প্রবাদ রটাইয়াছে।
বাস্তবিক ভাগবতের পুরাণত্ব লইয়া অনেক বাদবিতণ্ডা ঘটিয়াছে। শাক্তেরা বলেন, ইহা পুরাণই নহে,—বলেন, দেবীভাগবতই ভাগবত পুরাণ। তাঁহারা বলেন, “ভগবত ইদং ভাগবতং” এইরূপ অর্থ না করিয়া “ভাগবত্যা ইদং ভাগবতং” এই অর্থ করিবে।
কেহ কেহ এইরূপ শঙ্কা করে বলিয়া শ্রীধর স্বামী ইহার প্রথম শ্লোকের টীকাতে লিখিয়াছেন—“ভাগবতং নামান্যদিত্যপি নাশঙ্কনীয়ম্”। ইহাতে বুঝিতে হইবে যে, ইহা পুরাণ নহে—দেবীভাগবতই প্রকৃত পুরাণ, এরূপ আশঙ্কা শ্রীধর স্বামীর পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল; এবং তাহা লইয়া বিবাদও হইত। বিবাদকালে উভয় পক্ষে যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নামগুলি বড় মার্জিত রুচির পরিচায়ক। একখানির নাম “দুর্জনমুখচপেটিকা,” তাহার উত্তরের নাম “দুর্জনমুখমহাচপেটিকা” এবং অন্য উত্তরের নাম “দুর্জনমুখপদ্মপাদুকা”। তার পর “ভাগবত-স্বরূপ-বিষয়শঙ্কানিরাসত্রয়োদশঃ” ইত্যাদি অন্যান্য পুস্তকও এ বিষয়ে প্রণীত হইয়াছিল। আমি এই সকল পুস্তক দেখি নাই, কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন এবং Bournouf সাহেব “চপেটিকা,” “মহাচপেটিকা” এবং “পাদুকা”—র অনুবাদও করিয়াছেন। Wilson সাহেব তাঁহার বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদে ভূমিকায় এই বিবাদের সারসংগ্রহ লিখিয়াছেন। আমাদের সে সকল কথায় কোন প্রয়োজন নাই। যাঁহার কৌতূহল থাকে, তিনি Wilson সাহেবের গ্রন্থ দেখিবেন। আমার মতের স্থূল মর্ম এই যে, ভাগবত পুরাণেও অনেক প্রাচীন কথা আছে। কিন্তু অনেক নূতন উপন্যাসও তাহাতে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এবং প্রাচীন কথা যাহা আছে, তাহাও নানাপ্রকার অলঙ্কারবিশিষ্ট এবং অত্যুক্তি দ্বারা অতিরঞ্জিত হইয়াছে। এই পুরাণখানি অন্য অনেক পুরাণ হইতে আধুনিক বোধ হয়, তা না হইলে ইহার পুরাণত্ব লইয়া এত বিবাদ উপস্থিত হইবে কেন?
পুরাণের মধ্যে যে সকল পুরাণে কৃষ্ণচরিত্রের প্রসঙ্গ নাই, সে সকলের আলোচনায় আমাদিগের কোনও প্রয়োজন নাই। যে সকল গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের কোনও প্রসঙ্গ আছে, তাহার মধ্যে ব্রহ্ম, বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত, এই চারিখানিতেই বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে। তাহার মধ্যে আবার ব্রহ্মপুরাণ বিষ্ণুপুরাণে একই কথা আছে। অতএব এই গ্রন্থে বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত ভিন্ন অন্য কোন পুরাণের ব্যবহার প্রয়োজন হইবে না। এই তিন পুরাণ সম্বন্ধে যাহা আমাদিগের বক্তব্য, তাহা বলিয়াছি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে আরও কিছু সময়ান্তরে বলিব। এক্ষণে কেবল আমাদের হরিবংশ সম্বন্ধে কিছু বলিতে বাকি আছে।
[তথ্যসূত্রকৃষ্ণচরিত্রপ্রথম খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদ]


ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবং চ শৈবং লৈঙ্গং সগাকড়ম্।
নারদীয়ং ভাগবতং আগ্নেয়ং স্কান্দসংজিতম্ ॥২৩ ৷৷ 
ভবিষ্যং ব্রহ্মবৈবর্তং মার্কণ্ডেয়ং সবামনম্।
বারাহং মাৎস্যং কৌর্মং চ ব্রহ্মাণ্ডাখ্যমিতি ত্ৰিষট্ ৷৷ ২৪ ৷৷
 শ্রীমদ্ভাগবত স্কন্ধ ১২ অধ্যায় ৭



১৮+ পুরাণঃ  গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক।

১। অগ্নিপুরাণ বা আগ্নেয় পুরাণ 


অগ্নিপুরাণের সঠিক রচনাকাল জানা যায়নি। শ্লোকসংখ্যা ১১৫০০ টি। এটি একটি প্রাচীন পুরাণ এবং একে “পৌরাণিক ও সাহিত্যবিদ্যার কোষগ্রন্থ” বলা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি বশিষ্ঠের অনুরোধে অগ্নি এই পুরাণ রচনা করেছিলেন। এই পুরাণে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের বর্ণনা, বংশানুচরিত, সৃষ্টিতত্ত্ব, ভূগোল, ছন্দ, অলংকার, ব্যাকরণ, স্মৃতিশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, রাজনীতি, অশ্বচিকিৎসা ইত্যাদির বর্ণনা আছে। এটি বৈষ্ণব পুরাণ, তবে এতে তান্ত্রিক উপাসনা পদ্ধতি, লিঙ্গপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি শাক্ত ও শৈব বিষয়বস্তুও সংযোজিত হয়েছে। 

২। ভাগবত পুরাণ


ভাগবত ( ১৮,০০০ শ্লোক) : সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় পুরাণ। এই পুরাণের মূল উপজীব্য বিষয় বিষ্ণুর দশাবতারের কাহিনী। দশম স্কন্দটি গ্রন্থের বৃহত্তম অধ্যায়, এই অধ্যায়ে কৃষ্ণের লীলা বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীকালে একাধিক ভক্তি আন্দোলনের মুখ্য বিষয়বস্তু কৃষ্ণের বাল্যলীলা এই পুরাণেই লিপিবদ্ধ। 

৩। ভবিষ্য পুরাণ (১৪,৫০০ শ্লোক)

৪। ব্রহ্মপুরাণ বা আদিপুরাণ 


(রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী) : শ্লোকসংখ্যা ২৪০০। কিংবদন্তি অনুসারে, সূত লোমহর্ষণ নৈমিষারণ্যে উপস্থিত ঋষিদের কাছে এই পুরাণ প্রথম বর্ণনা করেন। এই পুরাণে ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি, দেব, মনু, চন্দ্র ও সূর্য্য বংশের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ভূগোল, স্বর্গ-নরক, তীর্থের মাহাত্ম্য, সূর্য্য ও বিষ্ণুর উপাসনার পদ্ধতি, আদিত্যগণের বিবরণ, বিষ্ণু-সংক্রান্ত পৌরাণিক গল্প, শিব-পার্বতীর গল্প, কৃষ্ণের জীবনি, বর্ণাশ্রম ধর্ম, নীতিধর্ম ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। এই পুরাণের প্রক্ষিপ্ত অংশগুলি অন্যান্য পুরাণ থেকে গৃহীত এবং কয়েকটি প্রক্ষিপ্ত ভীর্থ মাহাত্মের বর্ণনা বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ও সৌর সম্প্রদায়ের লেখকদের রচনা। 

৫। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ  ( ১২,০০০ শ্লোক, হিন্দু প্রার্থনাগাথা ললিত সহস্রনাম এই গ্রন্থের অন্তর্গত) 

৬। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (১৮,০০০ শ্লোক)

৭। গরুড় পুরাণ (১৯,০০০ শ্লোক)

৮। বিষ্ণু পুরাণ (২৩,০০০ শ্লোক)

৯। কূর্ম পুরাণ (১৭,০০০ শ্লোক) 

১০। লিঙ্গ পুরাণ (১১,০০০ শ্লোক) 

১১। মার্কন্ডেয় পুরাণ ( ৯,০০০ শ্লোক ) 

১২। মৎস্য পুরাণ ( ১৪,০০০ শ্লোক) 

১৩। নারদ পুরাণ ( ২৫,০০০ শ্লোক) 

১৪। পদ্ম পুরাণ ( ৫৫, শ্লোক) 

১৫। শিব পুরাণ (২৪,০০০ শ্লোক) 

১৬। স্কন্দ পুরাণ ( ৮১, ১০০ শ্লোক) 

১৭। বামন পুরাণ ( ১০,০০০ শ্লোক) 


১৮। বরাহ পুরাণ (১০,০০০ শ্লোক)
ত্রিমূর্তির বিচারে নিম্নলিখিত তিন শ্রেণিতে পুরাণগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে:
পদ্ম পুরাণ[২৫] অনুসারে সত্ত্বগুণরজোগুণ ও তমোগুণ – এই তিন গুণের নিরিখে পুরাণ তিনপ্রকার:
১৮ টি উপপুরাণঃ-
১. হংস পুরাণ
২. গনেশ পুরাণ
৩. দেবী-ভগবতপুরাণ
৪. বশিষ্ঠ পুরাণ
৫. পরাশর পুরাণ
৬. সূর্য পুরাণ
৭. নন্দী পুরাণ
৮. শাম্ভ পুরাণ
৯. কালিকা পুরাণ
১০ বরুণ পুরাণ
১১. ভার্গব পুরাণ
১২. কল্কি পুরাণ
১৩. কপিলা পুরাণ
১৪. দূর্ভাশা পুরাণ
১৫. শিবরহস্যম পুরাণ
১৬. বৃহৎনারদীয়া পুরাণ
১৭. নরসিংহ পুরাণ
১৮. সনৎকূর্মায় পুরাণ


 ‘আগম’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘শাস্ত্র’। বেদের অপর নাম ‘আগম’। তবে হিন্দুধর্মে এই শব্দটির প্রয়োগ হয় অন্য একটি সংকীর্ণ অর্থেও। ‘আগম’ বলতে বোঝায়, ঈশ্বরের একটি নির্দিষ্ট রূপের উপাসনা ও সেই সম্পর্কিত বিষয় এবং সেই নির্দিষ্ট রূপের পূজকদের উপসাম্প্রদায়িক মতবাদ। আগমের অপর নাম হল ‘সাধনশাস্ত্র’। কারণ, আগমের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল পূজা, উপাসনা ইত্যাদি।

বৈষ্ণব আগমের প্রধান দেবতা বিষ্ণু।
উপনিষদের মতোই আগমের সংখ্যাও অনেক। তবে এগুলিকে ঈশ্বরের তিনটি রূপ–বিষ্ণু, শিব ও মহাশক্তির উপাসনার ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই তিনটি শ্রেণি হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি শাখার জন্ম দিয়েছে। এগুলির নাম হল–(১) বৈষ্ণবধর্ম, (২) শাক্তধর্ম ও (৩) শৈবধর্ম। প্রতিটি আগমের চারটি অংশ। এগুলি হল–(১) দর্শন, (২) মনঃসংযম, (৩) মন্দির ও প্রতিমা নির্মাণের নিয়মাবলি ও (৪) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা সাধনমার্গের বর্ণনা। এগুলি মোটামুটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপার। তবে আগমকে ঘিরে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় যেসব ভক্তিমূলক কাব্যের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলিই আগমের আসল গুরুত্বের নির্ধারক। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আগম ধর্মকে সাধারণ মানুষের ঘরের বস্তু করে তুলেছিল। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি, রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের শাক্ত পদাবলি গান ইত্যাদি এই জাতীয় সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পঞ্চরাত্র-সংহিতা
‘বৈষ্ণব-আগম’ বা ‘পঞ্চরাত্র-সংহিতা’-য় ঈশ্বরের মাহাত্ম্য বিষ্ণুর নানা রূপ ও নামের কীর্তন করা হয়। পঞ্চরাত্র-সংহিতার সংখ্যা ২১৫। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল–(১) ঈশ্বর, (২) পৌষ্কর, (৩) পরম, (৪) সাত্বত, (৫) বৃহৎব্রহ্ম ও (৬) জ্ঞানামৃত-সার-সংহিতা।
শৈব আগম

শৈব আগমের প্রধান দেবতা শিব।
ঠিক একইভাবে ‘শৈব-আগমে’ ঈশ্বর শিবের নাম ও রূপের মাধ্যমে আরাধিত হন। শৈব-আগমগুলি ‘শৈবসিদ্ধান্ত’ নামে এক অত্যন্ত উচ্চমানের দার্শনিক শাখার জন্মদাতা। শৈব আগমের সংখ্যা ২৮টি। এগুলির আবার কয়েকটি উপাগমও আছে। তবে এখন এগুলির মধ্যে মাত্র কুড়িটির কিছু কিছু অংশ পাওয়া যায়।
তন্ত্র

মহাশক্তিরূপিণী দুর্গা। শাক্ত আগম ঈশ্বরকে মাতৃরূপা পূজার কথা বলে।
‘শাক্ত-আগম’ বা তন্ত্র ঈশ্বরকে আদ্যাশক্তি বা মাতৃরূপে চিন্তা করার উপদেশ দেয়। তন্ত্রে আদ্যাশক্তিকে বিভিন্ন মূর্তি বা প্রতীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে। তন্ত্রগুলি রচিত হয়েছে শিব ও পার্বতীর কথোপকথনের আদলে। কোথায় প্রশ্নকর্তা পার্বতী ও উত্তরদাতা শিব ; কোথায় প্রশ্নকর্তা শিব ও উত্তরদাতা পার্বতী। প্রথম প্রকারের তন্ত্রকে বলে ‘আগম’ এবং শেষের প্রকারের তন্ত্রকে বলে ‘নিগম’। তন্ত্রের সংখ্যাও অনেক। তারমধ্যে ৬৪টি তন্ত্র খুবই প্রসিদ্ধ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির নাম হল–(১) মহানির্বাণ, (২) কুলার্ণব, (৩) কুলসার, (৪) প্রপঞ্চসার, (৫) তন্ত্ররাজ, (৬) রুদ্রযামল, (৭) ব্রহ্মযামল, (৮) বিষ্ণুযামল ও (৯) তোড়লতন্ত্র।
প্রশ্ন উঠবে, আগম কী শ্রুতির ভিত্তিতে রচিত? অবশ্যই, শ্রুতিকে অস্বীকার করে কোনো গ্রন্থই প্রামাণ্য শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। কয়েকটি বই অবশ্য বেদ-বহির্ভুত অবস্থায় লেখা হয়। কিন্তু সেই বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়টি যেই হিন্দুধর্মে প্রবেশ করল, অমনি বেদ সেগুলির উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করল। বৈদিক ধারণায় স্নাত হওয়ার পর সেই সব বইয়ের প্রামাণ্যতাও স্বীকার করে নেওয়া হল। বৈষ্ণব গুরু যমুনাচার্য বেদের সঙ্গে বৈষ্ণব আগমগুলির সম্পর্ক আলোচনা করে প্রমাণ করেন যে, বৈষ্ণব আগমও মানসিকতার দিক থেকে বেদ-অনুসারী ; সুতরাং প্রামাণ্য। শৈব টীকাকার শ্রীকান্ত বলেছেন, “বেদ ও শৈব আগমগুলির মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য দেখি না।” শৈব শাস্ত্রকার মেয়কন্ডরও বলেছেন, “(শৈব) আগমগুলি বিশেষভাবে এবং ঈশ্বরের কৃপাধন্যদের জন্য রচিত ; এগুলিতে বেদ ও বেদান্তের মূল সত্যগুলি নিহিত রয়েছে।” তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, উপাসনার পদ্ধতি ও উপাস্যের রূপ নিয়ে আগমগুলির মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, এগুলি চরিত্রগতভাবে পুরোপুরিই বৈদিক।
এখানে একটি ব্যাপারও লক্ষণীয়। আগম রচনাকারী কয়েকটি সম্প্রদায় পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে প্রবেশ করেছিল। তবে কী তারা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল? হ্যাঁ, মূল ব্যাপারটা তাই। তবে হিন্দুধর্মের ধর্মান্তর তরবারির জোরে বা পরধর্মের নিন্দা করে হয় না। হিন্দুধর্ম কালে কালে একাধিক সম্প্রদায়কে অঙ্গীভূত করে তাদের ধর্মের চরিত্রকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু আদি ধর্মগুলির লোকাচার, আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করেনি।

পুরাণ সম্বন্ধেও দুই রকম ভ্রম আছে,—দেশী ও বিলাতী। দেশী ভ্রম এই যে, সমস্ত পুরাণগুলিই এক ব্যক্তির রচনা। বিলাতী ভ্রম এই যে, এক একখানি পুরাণ এক ব্যক্তির রচনা। আগে দেশী কথাটার সমালোচনা করা যাউক।
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি;—
১ম,—এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনাই করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তাহা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করিয়া বলিবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।
২য়,—এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করিবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই ইহার উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,—আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ—বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করিয়াছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁহাকে পুরাণসংহিতা দান করিলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তাহার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হইতে তিনখানি সংহিতা প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।[1]
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই।
এক্ষণে ইউরোপীয়দিগের যে সাধারণ ভ্রম, তাহার বিষয়ে কিছু বলা যাউক। ইউরোপীয় পণ্ডিতদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা মনে করেন যে, একও খানি পুরাণ একও ব্যক্তির লিখিত এই ভ্রমের বশীভূত হইয়া তাঁহারা বর্তমান পুরাণ সকলের প্রণয়নকাল নিরূপণ করিতে বসেন। বস্তুতঃ কোনও পুরাণান্তর্গত সকল বৃত্তান্তগুলি এক ব্যক্তির প্রণীত নহে। বর্তমান পুরাণ সকল সংগ্রহ মাত্র। যাহা সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা। কথাটা একটু সবিস্তারে বুঝাইতে হইতেছে।
“পুরাণ” অর্থে আদৌ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বালায়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই। পাঠকের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অতি প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে লিপিবিদ্যা অর্থাৎ লেখা পড়া প্রচলিত থাকিলেও গ্রন্থ সকল লিখিত হইত না; মুখে মুখে রচিত, অধীত এবং প্রচারিত হইত। প্রাচীন পৌরাণিক কথা সকল ঐরূপ মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া অনেক সময়েই কেবল কিম্বদন্তী মাত্রে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। পরে সময়বিশেষে ঐ সকল কিম্বদন্তী এবং প্রাচীন রচনা একত্রে সংগৃহীত হইয়া এক একখানি পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল। বৈদিক সূক্ত সকল ঐরূপে সঙ্কলিত হইয়া ঋক্ যজুঃ সাম সংহিতাত্রয়ে বিভক্ত হইয়াছিল, ইহা প্রসিদ্ধ। যিনি বেদবিভাগ করিয়াছিলেন, তিনি এই বিভাগজন্য ‘ব্যাস’ এই উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ‘ব্যাস’ তাঁহার উপাধিমাত্র—নাম নহে। তাঁহার নাম কৃষ্ণ এবং দ্বীপে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বলিত। এ স্থানে পুরাণসঙ্কলনকর্তার বিষয়ে দুইটি মত হইতে পারে। একটি মত এই যে, যিনি বেদবিভাগকর্তা, তিনিই যে পুরাণসঙ্কলনকর্তা ইহা না হইতে পারে, কিন্তু যিনি পুরাণসঙ্কলনকর্তা, তাঁহারও উপাধি ব্যাস হওয়া সম্ভব। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ এক ব্যক্তি কর্তৃক অথবা এক সময়ে যে বিভক্ত ও সঙ্কলিত হইয়াছিল, এমন বোধ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্কলিত হওয়ার প্রমাণ ঐ সকল পুরাণের মধ্যেই আছে। তবে যিনিই কতকগুলি পৌরাণিক বৃত্তান্ত বিভক্ত করিয়া একখানি সংগ্রহ প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তিনিই ব্যাস নামের অধিকারী। হইতে পারে যে, এই জন্যই কিম্বদন্তী আছে যে, অষ্টাদশ পুরাণই ব্যাসপ্রণীত। কিন্তু ব্যাস যে এক ব্যক্তি নহেন, অনেক ব্যক্তি ব্যাস উপাধি পাইয়াছিলেন, এরূপ বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, অষ্টাদশপুরাণপ্রণেতা ব্যাস, বেদান্তসূত্রকার ব্যাস, এমন কি—পাতঞ্জল দর্শনের টীকাকার একজন ব্যাস। এ সকলই এক ব্যাস হইতে পারেন না। সে দিন কাশীতে ভারত মহামণ্ডলের অধিবেশন হইয়াছিল, সংবাদপত্রে পড়িলাম, তাহাতে দুই জন ব্যাস উপস্থিত ছিলেন। এক জনের নাম হরেকৃষ্ণ ব্যাস, আর এক জনের নাম শ্রীযুক্ত অম্বিকা দত্ত ব্যাস। অনেক ব্যক্তি যে ব্যাস উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। এ বেদবিভাগকর্তা ব্যাস, মহাভারতপ্রণেতা ব্যাস, এবং অষ্টাদশ পুরাণের সংগ্রহকর্তা আঠারটি ব্যাস যে এক ব্যক্তি নন, ইহাই সম্ভব বোধ হয়।
দ্বিতীয় মত এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নই প্রাথমিক পুরাণসঙ্কলনকর্তা। তিনি যেমন বৈদিক সূক্তগুলি সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, পুরাণ সম্বন্ধেও সেইরূপ একখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বিষ্ণু, ভাগবত, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণ হইতে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে সেইরূপই বুঝায়। অতএব আমরা সেই মতই অবলম্বন করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাহাতেও প্রমাণীকৃত হইতেছে যে বেদব্যাস একখানি পুরাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আঠারখানি নহে। সেখানি নাই। তাঁহার শিষ্যেরা তাহা ভাঙ্গিয়া তিনখানি পুরাণ করিয়াছিলেন, তাহাও নাই। কালক্রমে, নানা ব্যক্তির হাতে পড়িয়া তাহা আঠারখানি হইয়াছিল।
ইহার মধ্যে যে মতই গ্রহণ করা যাউক, পুরাণবিশেষের সময় নিরূপণ করিবার চেষ্টায় কেবল এই ফলই পাওয়া যাইতে পারে যে, কবে কোন্ পুরাণ সঙ্কলিত হইয়াছিল, তাহারই ঠিকানা হয়। কিন্তু তাও হয় বলিয়াও আমার বিশ্বাস হয় না। কেন না, সকল গ্রন্থের রচনা বা সঙ্কলনের পর নূতন রচনা প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে ও পুরাণ সকলে তাহা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। অতএব কোন্ অংশ ধরিয়া সঙ্কলনসময় নিরূপণ করিব? একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।
মৎস্যপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্বন্ধে এই দুইটি শ্লোক আছে;—
“রথন্তরস্য কল্পস্য বৃত্তান্তমধিকৃত্য যৎ।
সাবর্ণিনা নারদায় কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুতম্ ||
যত্র ব্রহ্মবরাহস্য চরিতং বর্ণ্যতে মুহুঃ।
তদষ্টাদশসাহস্রং ব্রহ্মবৈবর্তমুচ্যতে ||”
অর্থাৎ যে পুরাণে রথন্তর কল্পবৃত্তান্তাধিকৃত কৃষ্ণমাহাত্ম্যসংযুক্ত কথা নারদকে সাবর্ণি বলিতেছেন এবং যাহাতে পুনঃ পুনঃ ব্রহ্মবরাহচরিত কথিত হইয়াছে, সেই অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকসংযুক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ।
এক্ষণে যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ প্রচলিত আছে, তাহা সাবর্ণি নারদকে বলিতেছেন না। নারায়ণ নামে অন্য ঋষি নারদকে বলিতেছেন। তাহাতে রথন্তরকল্পের প্রসঙ্গমাত্র নাই, এবং ব্রাহ্মবরাহচরিতের প্রসঙ্গমাত্র নাই। এখনকার প্রচলিত ব্রহ্মবৈবর্তে প্রকৃতিখণ্ড ও গণেশখণ্ড আছে। যাহার কোন প্রসঙ্গ দুই শ্লোকে নাই। অতএব প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এক্ষণে আর বিদ্যমান নাই। যাহা ব্রহ্মবৈবর্ত নামে চলিত আছে, তাহা নূতন গ্রন্থ। তাহা দেখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-সঙ্কলন-সময় নিরূপণ করা অপূর্ব রহস্য বলিয়াই বোধ হয়।
উইল্‌সন সাহেব পুরাণ সকলের এইরূপ প্রণয়নকাল নিরূপিত করিয়াছেন:—
ব্রহ্মপুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দী।
পদ্মপুরাণ – ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে।[2]
বিষ্ণুপুরাণ-দশম শতাব্দী।
বায়ুপুরাণ -সময় নিরূপিত হয় নাই, প্রাচীন বলিয়া লিখিত হইয়াছে।
ভাগবত পুরাণ- খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী।
নারদপুরাণ- ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দী, অর্থাৎ দুই শত বৎসরের গ্রন্থ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-নবম কি দশম শতাব্দী।
অগ্নিপুরাণ- অনিশ্চিত; অতি অভিনব।
ভবিষ্যপুরাণ -ঠিক হয় নাই।
লিঙ্গপুরাণ- খ্রীষ্টীয় অষ্টম কি নবম শতাব্দীর এদিক্ ওদিক্।
বরাহপুরাণ -দ্বাদশ শতাব্দী।
স্কন্দপুরাণ- ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পাঁচখানি পুরাণের সংগ্রহ।
বামনপুরাণ- ৩।৪ শত বৎসরের গ্রন্থ।
কূর্মপুরাণ প্রাচীন নহে।
মৎস্যপুরাণ পদ্মপুরাণেরও পর।
গারুড় পুরাণ
ব্রহ্মবৈববর্ত পুরাণ প্রাচীন পুরাণ নাই। বর্তমান গ্রন্থ পুরাণ নয়।
ব্রাহ্মাণ্ড পুরাণ
পাঠক দেখিবেন, ইঁহার মতে (এই মতই প্রচলিত) কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, বোধ হয়, ইংরাজি পড়িয়া যাঁহার নিতান্ত বুদ্ধিবিপর্যয় না ঘটিয়াছে, তিনি ভিন্ন এমন কোন হিন্দুই নাই, যিনি এই সময়নির্ধারণ উপযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করিবেন। দুই একটা কথার দ্বারাই ইহার অযৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাইতে পারে।
এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক লোক এবং বিক্রমাদিত্য খ্রীঃ পূঃ ৫৬ বৎসরে জীবিত ছিলেন। কিন্তু সে সকল কথা এখন উড়িয়া গিয়াছে। ডাক্তার ভাও দাজি স্থির করিয়াছেন যে, কালিদাস খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এখন ইউরোপ শুদ্ধ এবং ইউরোপীয়দিগের দেশী শিষ্যগণ সকলে উচ্চৈঃস্বরে সেই ডাক ডাকিতেছেন। আমরাও এ মত অগ্রাহ্য করি না। অতএব কালিদাস ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক হউন। সকল পুরাণই তাঁহার অনেক পরে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাই উইল্‌সন্ সাহেবের উপরিলিখিত বিচারে স্থির হইয়াছে। কিন্তু কালিদাস মেঘদূতে লিখিয়াছেন—
“যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমালপ্স্যতে তে
বর্হণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।” —১৫ শ্লোক।
যে পাঠক সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাকে শেষ ছত্রের অর্থ বুঝাইলেই হইবে। ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা উজ্জ্বল বিষ্ণুর গোপবেশের সহিত ইন্দ্রধনুশোভিত মেঘের উপমা হইতেছে। এখন, বিষ্ণুর গোপবেশ নাই, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের গোপবেশ ছিল। ইন্দ্রধনুর সঙ্গে উপমেয় কৃষ্ণচূড়াস্থিত ময়ূরপুচ্ছ। আমি বিনীতভাবে ইউরোপীয় মহামহোপাধ্যায়দিগের নিকট নিবেদন করিতেছি, যদি ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে কোন পুরাণই ছিল না, তবে কৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছচূড়ার কথা আসিল কোথা হইতে? এ কথা কি বেদে আছে, না মহাভারতে আছে, না রামায়ণে আছে?—কোথাও না। পুরাণ বা তদনুবর্তী গীতগোবিন্দাদি কাব্য ভিন্ন আর কোথাও নাই। আছে, হরিবংশে বটে; কিন্তু হরিবংশও ত উইল্‌সন্ সাহেবের মতে বিষ্ণুপুরাণেরও পরবর্তী। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, কালিদাসের পূর্বে অর্থাৎ অন্ততঃ ষষ্ঠ শতাব্দী পূর্বে হরিবংশ অথবা কোন বৈষ্ণব পুরাণ প্রচলিত ছিল।
আর একটা কথা বলিয়াই এ বিষয়ের উপসংহার করিব। এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রচলিত, তাহা প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত না হইলেও, অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর অপেক্ষাও প্রাচীন গ্রন্থ। কেন না, গীতগোবিন্দকার জয়দেব-গোস্বামী গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণ সেনের সভাপণ্ডিত। লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমাংশের লোক। ইহা বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রমাণীকৃত, এবং ইংরেজদিগের দ্বারাও স্বীকৃত। আমরা পরে দেখাইব যে, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তখন চলিত ও অতিশয় সম্মানিত না থাকিলে, গীতগোবিন্দ লিখিত হইত না, এবং বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায় তখন প্রচলিত না থাকিলে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক “মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্” ইত্যাদি কখনও রচিত হইত না। অতএব এই ভ্রষ্ট ব্রহ্মবৈবর্তও একাদশ শতাব্দীর পূর্বগামী। আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত না জানি আরও কত কালের। অথচ উইল্‌সন্ সাহেবের বিবেচনায় ইহা দুই শত মাত্র বৎসরের গ্রন্থ হইতে পারে।

1 ভাগবতের বক্তা ব্যাসপুত্র শুকদেব। “বৈশম্পায়নহারীতৌ” ইতি পাঠান্তরও আছে।
2 তাহা হইলে, এই পুরাণ দুই তিন, কি চারি শত বৎসরের গ্রন্থ।
আঠারখানি পুরাণ মিলাইলে অনেক সময়ই ইহা দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনেকগুলি শ্লোক কতকগুলি পুরাণে একই আছে। কোনখানে কিঞ্চিৎ পাঠান্তর আছে। কোনখানে তাহাও নাই। এই গ্রন্থে এইরূপ কতকগুলি শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে বা হইবে। নন্দ মহাপদ্মের সময়-নিরূপণ জন্য যে কয়টি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা এ কথার উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার অপেক্ষা আর একটা গুরুতর উদাহরণ দিতেছি। ব্রহ্মপুরাণের উত্তরভাগে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইয়াছে, ও বিষ্ণুপুরাণের পঞ্চমাংশে শ্রীকৃষ্ণচরিত বিস্তারিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। উভয়ে কোন প্রভেদ নাই; অক্ষরে অক্ষরে এক। এই পঞ্চম অংশে আটাশটি অধ্যায়। বিষ্ণুপুরাণের এই আটাশ অধ্যায়ে যতগুলি শ্লোক আছে, ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে, এবং ব্রহ্মপুরাণের কৃষ্ণচরিতে যে শ্লোকগুলি আছে, বিষ্ণুপুরাণের কৃষ্ণচরিতে সে সকলগুলিই আছে। এই দুই পুরাণে এই সম্বন্ধে কোন প্রকার প্রভেদ বা তারতম্য নাই। নিম্নলিখিত তিনটি কারণের মধ্যে কোন একটি কারণে এরূপ ঘটা সম্ভব।
১ম,—ব্রহ্মপুরাণ হইতে বিষ্ণুপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
২য়,—বিষ্ণুপুরাণ হইতে ব্রহ্মপুরাণ চুরি করিয়াছেন।
৩য়,—কেহ কাহারও নিকট চুরি করেন নাই; এই কৃষ্ণচরিতবর্ণনা সেই আদিম বৈয়াসিকী পুরাণসংহিতার অংশ। ব্রহ্ম ও বিষ্ণু উভয় পুরাণেই এই অংশ রক্ষিত হইয়াছে।
প্রথম দুইটি কারণ যথার্থ কারণ বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। কেন না, এরূপ প্রচলিত গ্রন্থ হইতে আটাশ অধ্যায় স্পষ্ট চুরি অসম্ভব, এবং অন্য কোনও স্থলেও এরূপ দেখাও যায় না। যে এরূপ চুরি করিবে, সে অন্ততঃ কিছু পরিবর্তন করিয়া লইতে পারে এবং রচনাও এমন কিছু নয় যে, তাহার কিছু পরিবর্তন হয় না। আর কেবল এই আটাশ অধ্যায় দুইখানি পুরাণে একরূপ দেখিলেও, না হয়, চুরির কথা মনে করা যাইত, কিন্তু বলিয়াছি যে, অনেক ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের অনেক শ্লোক পরস্পরের সহিত ঐক্যবিশিষ্ট। এবং অনেক ঘটনা সম্বন্ধে পুরাণে পুরাণে বিরোধ থাকিলেও অনেক ঘটনা সম্বন্ধে আবার পুরাণে পুরাণে বিশেষ ঐক্য আছে। এ স্থলে, পূর্বকথিত একখানি আদিম পুরাণসংহিতার অস্তিত্বই প্রমাণীকৃত হইয়াছে। সেই আদিম সংহিতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাসরচিত না হইলেও হইতে পারে। তবে সে সংহিতা যে অতি প্রাচীন কালে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। কেন না, আমরা পরে দেখিব যে, পুরাণকথিত অনেক ঘটনার অখণ্ডনীয় প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায়, অথচ সে সকল ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয় নাই। সুতরাং এমন কথা বলা যাইতে পারে না যে, পুরাণকার তাহা মহাভারত হইতে লইয়াছেন।
যদি আমরা বিলাতী ধরনে পুরাণ সকলের সংগ্রহসময় নিরূপণ করিতে বসি, তাহ হইলে কিরূপ ফল পাই দেখা যাউক। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্থাংশে চতুর্বিংশাধ্যায়ে মগধ রাজাদিগের বংশাবলী কীর্তিত আছে। বিষ্ণুপুরাণে যে সকল বংশাবলী কীর্তিত হইয়াছে, তাহা ভবিষ্যদ্বাণীর আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। অর্থাৎ বিষ্ণুপুরাণ বেদব্যাসের পিতা পরাশরের দ্বারা কলিকালের আরম্ভসময়ে কথিত হইয়াছিল বলিয়া পুরাণকার ভূমিকা করিতেছেন। সে সময়ে নন্দবংশীয়াদি আধুনিক রাজগণ জন্মগ্রহণ করেন নাই। কিন্তু উক্ত রাজগণের সমকাল বা পরকালবর্তী প্রক্ষেপকারকের ইচ্ছা যে, উক্ত রাজগণের নাম ইহাতে থাকে। কিন্তু তাঁহাদিগের নামের উল্লেখ করিতে গেলে, ভবিষ্যদ্বাণীর আবরণ রচনার উপর প্রক্ষিপ্ত না করিলে, পরাশরকথিত বলিয়া পাচার করা যায় না। অতএব সংগ্রহকার বা প্রক্ষেপকারক এই সকল রাজার কথা লিখিবার সময় বলিয়াছেন, অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তাহার পর অমুক রাজা হইবেন, তিনি যে সকল রাজদিগের নাম করিয়াছেন, তাহার মধ্যে অনেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং তাঁহাদিগের রাজত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধগ্রন্থ, যবনগ্রন্থ, সংস্কৃতগ্রন্থ, প্রস্তরলিপি ইত্যাদি বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
যথা;— নন্দ, মহাপদ্ম, মৌর্য, চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, পুষ্পমিত্র, পুলিমান্, শকরাজগণ, অন্ধ্ররাজগণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে লেখা আছে,—“নব নাগাঃ পদ্মাবত্যাং কান্তিপুর্যাং মথুরায়ামনুগঙ্গাপ্রয়াগং মাগধা গুপ্তাশ্চ ভোক্ষ্যন্তি।”* এই গুপ্তবংশীয়দিগের সময় Fleet সাহেবের কল্যাণে নিরূপিত হইয়াছে। এই বংশের প্রথম রাজাকে মহারাজগুপ্ত বলে। তার পর ঘটোৎকচ ও চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার পর সমুদ্রগুপ্ত। ইঁহারা খ্রীঃ চতুর্থ শতাব্দীর লোক। তার পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, বুদ্ধগুপ্ত—ইঁহারা খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর লোক। এই সকল গুপ্তগণ রাজা হইয়াছিলেন বা রাজত্ব করিতেছেন, ইহা না জানিলে, পুরাণসংগ্রহকার কখনই এরূপ লিখিতে পারিতেন না। অতএব ইনি গুপ্তদিগের সমকাল বা পরকালবর্তী। তাহা হইলে, এই পুরাণ খ্রীষ্টীয় চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বা প্রণীত হইয়াছিল। কিন্তু এমন হইতে পারে যে, এই গুপ্তরাজাদিগের নাম বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থাংশে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। অথবা এমনও হইতে পারে যে, এই চতুর্থাংশ এক সময়ের রচনা, এবং অন্যান্য অংশ অন্যান্য সময়ে রচনা; সকলগুলিই কোনও অনির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হইয়া বিষ্ণুপুরাণ নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। আজিকার দিনেও কি ইউরোপে, কি এদেশে, সচরাচর ঘটিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রচনা একত্রিত হইয়া একখানি সংগ্রহগ্রন্থে নিবদ্ধ হয়, এবং ঐ সংগ্রহের একটি বিশেষ নাম দেওয়া হয়। যথা, “Percy Reliques,” অথবা রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায় সঙ্কলিত ফলিত জ্যোতিষ।” আমার বিবেচনায় সকল পুরাণই এইরূপ সংগ্রহ। উপরি-উক্ত দুইখানি পুস্তকই আধুনিক সংগ্রহ; কিন্তু যে সকল বিষয় ইহাতে সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা প্রাচীন। সংগ্রহ আধুনিক বলিয়া সেগুলি আধুনিক হইল না।
তবে এমন অনেক সময়েই ঘটিয়া থাকিতে পারে যে সংগ্রহকার নিজে অনেক নূতন রচনা করিয়া সংগ্রহের মধ্যে প্রবেশিত করিয়াছেন অথবা প্রাচীন বৃত্তান্ত নূতন কল্পনাসংযুক্ত এবং অত্যুক্তি অলঙ্কারে রঞ্জিত করিয়াছেন। বিষ্ণুপুরাণ সম্বন্ধে একথা বলা যায় না, কিন্তু ভাগবত সম্বন্ধে ইহা বিশেষ প্রকারে বক্তব্য।
প্রবাদ আছে যে, ভাগবত পুরাণ বোপদেবপ্রণীত। বোপদেব দেবগিরির রাজা হেমাদ্রির সভাসদ্। বোপদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু অনেক হিন্দুই উহা বোপদেবের রচনা বলিয়া স্বীকার করেন না। বৈষ্ণবেরা বলেন, ভাগবতদ্বেষী শাক্তেরা এইরূপ প্রবাদ রটাইয়াছে।
বাস্তবিক ভাগবতের পুরাণত্ব লইয়া অনেক বাদবিতণ্ডা ঘটিয়াছে। শাক্তেরা বলেন, ইহা পুরাণই নহে,—বলেন, দেবীভাগবতই ভাগবত পুরাণ। তাঁহারা বলেন, “ভগবত ইদং ভাগবতং” এইরূপ অর্থ না করিয়া “ভাগবত্যা ইদং ভাগবতং” এই অর্থ করিবে।
কেহ কেহ এইরূপ শঙ্কা করে বলিয়া শ্রীধর স্বামী ইহার প্রথম শ্লোকের টীকাতে লিখিয়াছেন—“ভাগবতং নামান্যদিত্যপি নাশঙ্কনীয়ম্”। ইহাতে বুঝিতে হইবে যে, ইহা পুরাণ নহে—দেবীভাগবতই প্রকৃত পুরাণ, এরূপ আশঙ্কা শ্রীধর স্বামীর পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল; এবং তাহা লইয়া বিবাদও হইত। বিবাদকালে উভয় পক্ষে যে সকল পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নামগুলি বড় মার্জিত রুচির পরিচায়ক। একখানির নাম “দুর্জনমুখচপেটিকা,” তাহার উত্তরের নাম “দুর্জনমুখমহাচপেটিকা” এবং অন্য উত্তরের নাম “দুর্জনমুখপদ্মপাদুকা”। তার পর “ভাগবত-স্বরূপ-বিষয়শঙ্কানিরাসত্রয়োদশঃ” ইত্যাদি অন্যান্য পুস্তকও এ বিষয়ে প্রণীত হইয়াছিল। আমি এই সকল পুস্তক দেখি নাই, কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন এবং Bournouf সাহেব “চপেটিকা,” “মহাচপেটিকা” এবং “পাদুকা”—র অনুবাদও করিয়াছেন। Wilson সাহেব তাঁহার বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদে ভূমিকায় এই বিবাদের সারসংগ্রহ লিখিয়াছেন। আমাদের সে সকল কথায় কোন প্রয়োজন নাই। যাঁহার কৌতূহল থাকে, তিনি Wilson সাহেবের গ্রন্থ দেখিবেন। আমার মতের স্থূল মর্ম এই যে, ভাগবত পুরাণেও অনেক প্রাচীন কথা আছে। কিন্তু অনেক নূতন উপন্যাসও তাহাতে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এবং প্রাচীন কথা যাহা আছে, তাহাও নানাপ্রকার অলঙ্কারবিশিষ্ট এবং অত্যুক্তি দ্বারা অতিরঞ্জিত হইয়াছে। এই পুরাণখানি অন্য অনেক পুরাণ হইতে আধুনিক বোধ হয়, তা না হইলে ইহার পুরাণত্ব লইয়া এত বিবাদ উপস্থিত হইবে কেন?
পুরাণের মধ্যে যে সকল পুরাণে কৃষ্ণচরিত্রের প্রসঙ্গ নাই, সে সকলের আলোচনায় আমাদিগের কোনও প্রয়োজন নাই। যে সকল গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের কোনও প্রসঙ্গ আছে, তাহার মধ্যে ব্রহ্ম, বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত, এই চারিখানিতেই বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে। তাহার মধ্যে আবার ব্রহ্মপুরাণ বিষ্ণুপুরাণে একই কথা আছে। অতএব এই গ্রন্থে বিষ্ণু, ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত ভিন্ন অন্য কোন পুরাণের ব্যবহার প্রয়োজন হইবে না। এই তিন পুরাণ সম্বন্ধে যাহা আমাদিগের বক্তব্য, তাহা বলিয়াছি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে আরও কিছু সময়ান্তরে বলিব। এক্ষণে কেবল আমাদের হরিবংশ সম্বন্ধে কিছু বলিতে বাকি আছে।
কৃষ্ণচরিত্র-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 
বেদব্যাস ও পুরাণঃ
প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব পুরাণ রচনা করেছেন, কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ মহামতি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব প্রণীত নয়। তার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ প্রণয়ন করেছিলেন, তাও এখন প্রচলিত নাই। যা প্রচলিত আছে, তা কার প্রণীত, কবে প্রণীত হয়েছে, তার কোন স্থিরতা নাই। এটা আমার কথা না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যুক্তি প্রমাণ সহ তার কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে দেখিয়েছেন প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ এই গুলা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত না।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেনঃ
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে,
তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি —
১ম,— এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনা করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করে বলবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র।

২য়,— এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।

৩য়,— আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।

৪র্থ,— বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করেছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁকে পুরাণসংহিতা দান করলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয় শিষ্য ছিল। (তার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হতে তিনটা সংহিতা প্রস্তুত করেন।

পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক।
বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—
আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তার কিছুই স্থিরতা নাই।
[তথ্যসূত্র: কৃষ্ণচরিত্র- প্রথম খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদ]
❏ ইতিহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ গাথানং চ
নারশংসীনাং চ প্রিয় ধাম ভবতি য এবং বেদ।।
🔥(অথর্ববেদ ১৫/৬/১১-১২)
তিনি অনুসরন করেন ইতিহাস, পুরান (জ্ঞান ও কর্মের প্রাচীন গল্প) গাথাসমূহ (উদযাপনের কবিতা) এবং নারাশংসীদের ৷ যিনি এটি জানেন ইতিহাস, পুরাণ ও গাথাসমূহ তার প্রিয় হয়, গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন ৷


ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে-
❏ "ইতিহাসপুরানাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ"
(ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭/১/২)
অর্থাৎ ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ।

(পৌরাণিক বন্ধু গণ) আপনাদের দৃষ্টিতে, ডালাও ভাবে যখন পুরান সমূহের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গেল, তাহলে গ্রিক পুরাণের দেবতা জিউস, এসক্লেপিয়াস, অ্যাপোলো বা মিশরীয় পৌরাণিক দেবতা হোরাস যার শরীর ছিল মানুষের মত কিন্তু মাথা ছিল বাজপাখির মত, মণিপুরী পৌরাণিক ঈশ্বর গুরু শিদারা ও তাদের দেবদেবী; ইত্যাদি এই সব পুরাণের ঈশ্বর, দেবতার প্রতিমা তৈরি করে পূজা করেন না কেন???

জবাবে পৌরাণিক বন্ধুরা নিশ্চয় বলবেন এখানে ‘পুরাণ’ বলতে কোন পুরাণ গুলাকে বুঝানো হয়েছে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। এখানে গ্রিক, মিশরীয় পুরাণের কথা বলা হয়নি। এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলার কথা বলা হয়েছে।

তার মানে এখান থেকে এটা পরিষ্কার যে “ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ” এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, “পুরাণ” নামক যত গ্রন্থ প্রচলিত আছে, তার সব গুলা কে বুঝানো হয়েছে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণের কথাই বা বলা হয়েছে সেটা আপনারা(পৌরাণিকরা) কিভাবে বুঝলেন???

“পুরাণ” অর্থ পুরাতন; পশ্চাৎ পুরাতন ঘটনার বিবৃতি। সকল সময়েই পুরাতন ঘটনা ছিল, এই জন্য সকল সময়েই পুরাণ ছিল। বেদেও পুরাণ আছে। শতপথব্রাহ্মণে, গোপথব্রাহ্মণে, আশ্বাশয়ন সূত্রে, অথর্বসংহিতায়, বৃহদারণ্যকে, ছান্দোগ্যোপনিষদে, মহাভারতে, রামায়ণে, মানবধর্মশাস্ত্রে সর্বত্রই পুরাণ প্রচলিত থাকার কথা আছে। কিন্তু ঐ সকল কোনও গ্রন্থেই বর্তমান কোনও পুরাণের নাম নাই।(১)

বর্তমান প্রচলিত পুরাণসমূহ দাবি করে ব্যাসদেব মহাভারত লেখার পরে পুরাণসমূহ রচনা করেন।
যেমন ভাগবতে বলা হয়েছে.....
❏ কৃষ্ণে স্বধামোপগতে ধর্মজ্ঞানাদিভিঃ সহ।
কলৌ নষ্টদৃশামেষ পুরাণার্কোহধুনোদিতঃ।।

(১/৩/৪৩)
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ যখন তার লীলা সংবরণ করে ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান সহ নিজ ধামে গমন করলেন, তখন সূর্যের মতো উজ্জ্বল এই পুরাণের উদয় হয়েছে। কলিযুগের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভগবৎ-দর্শনে অক্ষম মানুষেরা পুরাণ থেকে আলোক প্রাপ্ত হবে।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে, ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছে দ্বাপর যুগে; তাহলে যে পুরাণ গুলার সৃষ্টি হয়েছে মহাভারতের পরে সেই পুরাণ গুলার কথা অথর্ব্ববেদ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ কিভাবে আসবে? কারণ বেদ, উপনিষদ মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন; বেদ, উপনিষদের সময়ে অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ ছিল না; তখন এই পুরাণ গুলোর কোন অস্তিতই ছিল না, তখন শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব কারো জন্মই হয়নি।
তার মানে এটা পরিষ্কার যে, এই যেন পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলতে, মহাভারতের বহু কাল পরে সৃষ্টি হওয়া অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ গুলোর কথা বলা হয়নি। বরং এমন পুরাণের কথা বলা হয়েছে যে পুরাণ গুলো মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন, যে পুরাণ গুলো ব্যাসদেবের জন্মের পূর্বে, মহাভারত সৃষ্টির আগে এমনকি উপনিষদের সময়েও বিদ্যমান ছিল; সে পুরাণ গুলোকে “পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ” বলা হয়েছে। প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ কে পঞ্চম বেদরুপ পুরাণ বলা হয়নি।

পুরাণের মূল বিষয় পাঁচটি। এগুলি পঞ্চলক্ষণ নামে পরিচিত –

  1. সর্গ – ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকাহিনি
  2. প্রতিসর্গ – পরবর্তীকালের (মুখ্যত প্রলয় পরবর্তী) সৃষ্টিকাহিনি
  3. বংশ – দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত
  4. মন্বন্তর – মানবজাতির সৃষ্টি ও প্রথম সৃষ্ট মানবজাতির কাহিনি। মনুর শাসনকালের কথা; এই শাসনকাল ৭১টি দিব্য যুগ বা ৩০৮,৪৪৮,০০০ বছরের সমান
  5. বংশানুচরিতম্ – রাজবংশের ইতিহাস

কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে পঞ্চলক্ষণ নামে পরিচিত এই বিশেষ লক্ষণগুলি অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও দৃষ্ট হয়।[Rao, Velcheru Narayana (১৯৯৩)। "Purana as Brahminic Ideology"। Doniger Wendy। Purana Perennis: Reciprocity and Transformation in Hindu and Jaina Texts (Book)। Albany: State University of New York Press। পৃষ্ঠা 85–100। আইএসবিএন 0-7914-1381-0]

পুরাণে বংশবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ রাখার উপরেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বায়ু পুরাণ অনুসারে: "পুরাকালে ল দেবতা, ঋষি, গৌরবশালী রাজন্যবর্গের বংশবৃত্তান্ত ও মহামানবদের কিংবদন্তি লিপিবদ্ধ রাখার দায়িত্ব সূতের উপর অর্পিত হয়।"[Vayu Purana 1. 31-2.] পৌরাণিক বংশবৃত্তান্ত অনুযায়ী মনু বৈবস্বত ভারত যুদ্ধের ৯৫ প্রজন্ম পূর্বে জীবিত ছিলেন।[ R. C. Majumdar and A. D. Pusalker (editors): The history and culture of the Indian people. Volume I, The Vedic age. Bombay: Bharatiya Vidya Bhavan 1951, p.273]

পারগিটার (১৯২২) বলেছেন, "মূল পুরাণগুলি" ("original Purana") সম্ভবত বেদের সর্বশেষ লিখিত রূপের সমসাময়িক।[ Pargiter, F E (১৯৬২)। Ancient Indian historical tradition (Book)। Original publisher Oxford University Press, London। Delhi: Motilal Banarasidass। পৃষ্ঠা 30–54। ওসিএলসি 1068416 অজানা প্যারামিটার |origdate= উপেক্ষা করা হয়েছে (|orig-year= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)] এবং পারগিটার (১৯৭৯) মনে করেন,[Pargiter 1979] বায়ু পুরাণে যে যুগগুলি ৪৮০০, ৩৬০০, ২৪০০ ও ১২০০ বছরে বিভক্ত হয়েছে তার মধ্যে পৌরাণিক কৃত যুগ " সমাপ্তি রাম জমদগ্ন্যের দ্বারা হৈহয়দের ধ্বংসপ্রাপ্তিতে; ত্রেতা যুগের সূত্রপাত রাজা সগরের সময়কালে এবং সমাপ্তি রাম দাশরথি কর্তৃক রাক্ষস ধ্বংসে; দ্বাপর যুগের সূত্রপাত অযোধ্যা-প্রত্যাবর্তনে এবং সমাপ্তি ভারতযুদ্ধে।"

আরিয়ান রচিত ইন্ডিকায়, মেগাস্থিনিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ভারতীয়রা শিব (ডায়োনিসাস) থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (সান্ড্রাকোটাস) পর্যন্ত "ছয় হাজার তেতাল্লিশ বছরে একশো তিপান্ন জন রাজা" গণনা করে।খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রচিত বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪।৬) গুরু-পরম্পরায় ৫৭টি যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ গুরু-পরম্পরা তারও ১৪০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত ছিল। যদিও এই তালিকার যথার্থতা নিয়ে মতদ্বৈধ রয়েছে। কহ্লন রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে বর্ণিত রাজাবলিতে খ্রিস্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজাদের তালিকা পাওয়া যায়।

পুরাণ গ্রন্থসমুচ্চয় এমন এক জটিল উপাদান-সংগ্রহ যাতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ের উদ্ভবতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। তাই গেভিন ফ্লাড ঐতিহাসিকভাবে লিখিত পুরাণের উদ্ভবের সঙ্গে গুপ্তযুগে নির্দিষ্ট দেবতাকেন্দ্রিক ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভবের ঘটনাকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে করেছেন:

যদিও এই গ্রন্থগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এদের একটিতে অপরটির উপাদান প্রায়শই গৃহীত হয়েছে, তবুও বলতে হয়, প্রতিটি গ্রন্থেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে জগতকে দেখা হয়েছে। এগুলিকে প্রচলিত উপকথার এলোপাথাড়ি সংকলন মনে করা উচিত নয়। এগুলি সুসংকলিত, বিষয়গতভাবে সুসংবদ্ধ, বিশ্বচেতনার অভিপ্রকাশ এবং ধর্মীয় তত্ত্বকথা। ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নির্দিষ্ট দর্শনকে তুলে ধরার জন্য এগুলি সংকলন করেছিলেন; কেবল কেউ বিষ্ণু, কেউ শিব, কেউ বা দেবী বা অন্য কোনো দেবতার উপর আলোকপাত করেন।

স্থানীয় ভাষার অনুবাদে পুরাণগুলি সহজলভ্য। কথক নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে কথকতার মাধ্যমে ভক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণের কাহিনিগুলি জনসমাজে প্রচার করে সাধারণ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেন।

ঊনবিংশতি সংহিতা ( সংবর্ত, কাত্যায়ণ, পরাশর, ব্যাস, বৃহস্পতি, শঙ্খ, লিখিত, দক্ষ ,গৌতম, শাতাতপ, অত্রি, বশিষ্ট, বিষ্ণু, হারীত, যাজ্ঞবল্ক্য, উশনা, অঙ্গীরা, যম, আপস্তম্ভ )পুরাণকালিকা পুরাণ

বামন পুরাণ

বরাহ পুরাণ

ভবিষ্য পুরাণ

বায়ু পুরাণ

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ

বিষ্ণু পুরাণ

ব্রহ্মপুরাণ

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ

বৃহদ্ধর্ম পুরাণ

বৃহন্নারদীয় পুরাণ

মহাভাগবত পুরাণ

গরুড় পুরাণ

হরিবংশ পুরাণ / মহাভারতের হরিবংশ পর্ব

কল্কি পুরাণ

কূর্ম পুরাণ

লিঙ্গ পুরাণ

মার্কণ্ডেয় পুরাণ

মৎস্য পুরাণ

নৃসিংহ পুরাণ

সূর্য পুরাণ

স্কন্দ পুরাণ

পদ্ম পুরাণ তন্ত্র

লোকমতে, মহাভারত-রচয়িতা ব্যাসদেব পুরাণসমূহের সংকলক। যদিও পুরাণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঠগুলি
গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিক বা
অন্যান্য সূত্রাণুযায়ী এই সময়কাল ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণগ্রন্থগুলি ভারতের
নানা স্থানে রচিত হয়েছিল। লিখিত পাঠ্যগুলির রচনাতারিখ পুরাণের প্রকৃত রচনাতারিখ নয়। কারণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পূর্ববর্তী এক সহস্রাব্দ কাল ধরে এই কাহিনিগুলি মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে আসে। এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এগুলির আকার ও রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।
১। যাহারা পুরাণ পাঠ করিয়াছেন তাহারা দেখিতে পাইবেন যে অষ্টাদশ পুরাণই বুদ্ধদেবকে অবতার বলিয়া
স্বীকার করিয়াছেন ও পুরাণে যেখানে বুদ্ধদেবের কথার অবতারণা করা হইয়াছে তথায় অতীত কালের ক্রিয়া
ব্যতীত ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার উল্লেখ নাই। অতএব স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে বুদ্ধদেবের আবির্ভাব ও তিরোভাবের পূর্বে অবশ্যই উপপুরাণ সকল লিখিত হইয়াছে। শিব-পুরাণের পূর্ব্বার্দ্ধে পঞ্চম খণ্ডের তৃতীয়
অধ্যায় হইতে নবম অধ্যায় পর্য্যন্ত পাঠ করিলে বেশ বুঝা যায় যে বুদ্ধদেবের পরে পুরাণ প্রণীত হইয়াছে।
এখন অনেকে, বৌদ্ধ রাজাদিগের জয়স্তম্ভ, মন্দির, স্তূপাদি তথা আর্য্যাবর্ত, লঙ্কাদ্বীপ, ব্রহ্মদেশ ও
তিব্বতীয় গ্রন্থাদির প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট সিদ্ধ করিয়াছেন যে বুদ্ধদেব বিক্রমাদিত্যের ৬১৪ (ছয় শত চৌদ্দ) বৎসর পূর্বে গোরক্ষপুরের নিকট কপিলাবস্তু নগরে জন্মগ্রহণ করেন ও অশীতি বর্ষ বয়ঃক্রমে পরলোক প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ প্রায় ২৬২৩ বৎসর গত হইল বুদ্ধদেবের মৃত্যু হইয়াছে। পূর্বেই বলেছি যে পাঁচ হাজার বৎসরেরও কিছু
পূর্বে ব্যাসদেবের জন্ম হয়। সুতরাং বুদ্ধদেব ব্যাসদেবের প্রায় দুই হাজার চারি শত কয়েক বৎসর পর জন্মগ্রহণ
করেন। কাজেই বুদ্ধদেবের সময় ব্যাসদেবের থাকা সম্ভব নয়। কোন কোন পৌরাণিক মহাশয় বলিতে পারেন যে পুরাণের মতে ব্যাসদেব অমর, অতএব তিঁনি যে বুদ্ধদেবের পরে পুরাণ প্রণয়ন করিবেন তাহাতে আর বিচিত্রতা কি? নীরবতাই এ বাক্যের প্রকৃত প্রত্তুতর। তথাচ আমাদের বক্তব্য এই যে, ব্যাসদেব বেদশাস্ত্রের ব্যাখ্যাকর্তা ও পূর্ণ বেদজ্ঞ। তিঁনি যদি বুদ্ধদেবের সময় জীবিত থাকিতেন, তাহলে দেশমধ্যে অবশ্যই বেদবিরুদ্ধ
বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার প্রতিরোধ করিতেন। কিন্তু কোন স্থানেই অর্থাৎ কি বৌদ্ধ গ্রন্থে বা পুরাণে বৌদ্ধধর্ম্ম
সম্বন্ধে ব্যাসের কোন বিরোধী তর্ক দেখা যায় না। অতএব পুরাণ প্রচারের সময় ব্যাসদেব যে জীবিত ছিলেন
ইহা অসম্ভব।
২। রামানুজ স্বামী, বিক্রম ১২০০ (বার শত) সম্বতে আর্য্য ভূমিতে আবির্ভূত হন, ইহা সকল ইতিহাসবেত্তারা এক
বাক্যে স্বীকার করেন। রামানুজ স্বামীই প্রথমে বৈষ্ণবদিগের দেহ বিষ্ণুচক্রে অঙ্কিত করিবার প্রথা
প্রচলিত করেন। এই প্রথার বিরুদ্ধে লিঙ্গ -পুরাণ বলিতেছে, " শঙ্খচক্রে তাপয়িত্বা যশা দেহঃ প্রদহ্যতে।
ন্ সজীব কুণপস্ত্যাজাঃ সর্ব্বধর্ম্মবহিস্কৃতঃ।। " অর্থাৎ যে মনুষ্যের শরীর অগ্নিদগ্ধ শঙ্খচক্রাদি দ্বারা
চিহ্নিত করা হয় তাহাকে সর্ব্বধর্ম্ম বহিস্কৃত জানিয়া জীবিতাবস্থাতেই ত্যাগ করিবে। উপরোক্ত প্রমাণ দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, রামানুজ স্বামীর বৈষ্ণব মত প্রচারের পর, লিঙ্গ-পুরাণ
লিখিত হইয়াছে। কারণ " প্রাপ্তিসত্বাং নিষেধঃ "অর্থাৎ নিষেধ বাক্য, পূর্বে কোন একটি ব্যবহার প্রচলিত
থাকিলেই প্রয়োগ করা যায় নচেৎ নহে। এই লিঙ্গ-পুরাণের নাম প্রায় সমস্ত পুরাণেই পাওয়া যায়।
সুতরাং লিঙ্গ পুরাণের পরেই যে অন্যান্য পুরাণ রচিত হইয়াছে তাহা একপ্রকার সপ্রমাণ হয়। আরও রামানুজ স্বামী প্রায় ৭৫০ বৎসর গত হইল জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং লিঙ্গ পুরাণ ও অন্যান্য পুরাণ যে
৭৫০ বৎসরেরও ন্যূন কাল হইতে রচিত হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। পূর্বে বলিয়াছি যে, ব্যাসদেব ৫০০০ বৎসরেরও অধিক হইল জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। অতএব ব্যাসদেব রামানুজ স্বামীরও পরে কখনই জীবিত থাকিতে পারেন না। এইজন্য ব্যাসদেবের পুরাণকর্তা হওয়া অসম্ভব।
৩। আরও দেখা যায় জাহাঙ্গীর বাদশাহ তৌজুকে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়াছেন যে, " গোল আলু, তামাক ও কফি এই তিন দ্রব্য তাহার পিতা আকবর শাহ্-র সময়ে জনৈক পাদ্রী কতৃক মার্কিন দেশ হইতে আনীত হইয়া ভারতে রোপিত হয়। " ইংরাজ ইতিহাসবেত্তাগণ একবাক্যে একথা স্বীকার করেন। এখন ব্রহ্মাণ্ড -পুরাণে তামাক সেবনের বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়।
যথা-
" প্রাপ্তে কলিযুগে ঘোরে.....................।
তমালং ভক্ষিতং যেন স গচ্ছেন্নরকার্ণবে।। "
অর্থাৎ এই ঘোর কলিযুগে চাতুর্বর্ণের লোক ও অপরে যে কেহ তামাক সেবন করিবে সে নরকে যাইবে।
পুনশ্চ পদ্মপুরাণে আমরা নিম্নলিখিত শ্লোকটি প্রাপ্ত হই,
" ধুম্রপানরতং বিপ্রমিত্যাদি। "
ইহাতেও তামাক সেবনের কথা রহিয়াছে। উল্লিখিত প্রমাণ দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ও
পদ্মপুরাণ অবশ্যই এদেশে তামাক প্রচলিত হইবার পরে রচিত হইয়াছে। আর্য্যদিগের কোন প্রাচীন গ্রন্থে তামাকের বিষয়ে কিছুই লিখিত নাই। বিশেষতঃ তামাল বা তামাক এই শব্দটি আমেরিকা দেশীয় আদি নিবাসীদিগের ভাষা হইতে গৃহীত। অতএব তামাক শব্দ কোন আর্য্য গ্রন্থে থাকিতে পারে না। শিখ গুরুদিগের মধ্যে মহাত্মা নানক হইতে আরম্ভ করে নবম গুরু পর্য্যন্ত কেহই তামাক সেবন বিষয়ে নিষেধ বাক্য
কিছুই প্রয়োগ করেন নাই; কারণ তাঁহাদিগের সময়ে তামাক তত অধিক পরিমাণে প্রচলিত হয় নাই। কিন্তু দশম
গুরু গোবিন্দ সিং এর সময়ে পাঞ্জাবে অতিরিক্ত পরিমাণে তামাকের ব্যবহার প্রচলিত হওয়াতেই, তিঁনি
তামাক সেবন নিষেধ করেন। এখন আকবর শাহ্ প্রায় তিন শত বৎসর হইল পরলোকগত
হইয়াছেন। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ও পদ্মপুরাণে যখন তামাকের কথা লিখিত আছে তখন তাহা যে কত নবীন গ্রন্থ, তাহা
ইহাতেই প্রমাণ হয়। এইজন্য বলা যাইতে পারে, ব্রহ্মাণ্ড- পুরাণ ও পদ্ম-পুরাণাদি ব্যাসের রচিত নহে।
৪। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেনঃ
অষ্টাদশ পুরাণ যে এক ব্যক্তির রচিত নহে, তাহার কতকগুলি প্রমাণ দিতেছি —
১ম,— এই ব্যক্তি এক প্রকার রচনা করিয়া থাকে। যেমন এক ব্যক্তির হাতের লেখা পাঁচ রকম হয় না, তেমনই এক ব্যক্তির রচনার গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয় না। কিন্তু এই অষ্টাদশ পুরাণের রচনা আঠার রকম। কখনও তা এক ব্যক্তির রচনা নহে। যিনি বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণ পাঠ করে বলবেন, দুইই এক ব্যক্তির রচনা হইতে পারে, তাঁহার নিকট কোন প্রকার প্রমাণ প্রয়োগ বিড়ম্বনা মাত্র। এরকম হাজার হাজার প্রমান আছে যা একটির সাথে আর একটির মিল নাই তাহলে কি ব্যাসদেব পাগল ছিল।
২য়,— এক ব্যক্তি এক বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে না। যে অনেকগুলি গ্রন্থ লেখে, সে এক বিষয়ই পুনঃ পুনঃ গ্রন্থ হতে গ্রন্থান্তরে বর্ণিত বা বিবৃত করবার জন্য গ্রন্থ লেখে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণে দেখা যায় যে, এক
বিষয়ই পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে সবিস্তারে কথিত হইয়াছে। এই কৃষ্ণচরিত্রই উদারহণ স্বরূপ লওয়া যাইতে
পারে। ইহা ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, আবার বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে,
শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ৩য় খণ্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও
কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এইরূপ অন্যান্য বিষয়েও বর্ণনা পুনঃ পুনঃ কথন ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে আছে। এক
ব্যক্তির লিখিত ভিন্ন ভিন্ন পুস্তকের এরূপ ঘটনা অসম্ভব।
৩য়,— আর যদি এক ব্যক্তি এই অষ্টাদশ পুরাণ লিখিয়া থাকে, তাহা হইলে, তন্মধ্যে গুরুতর বিরোধের সম্ভাবনা
কিছু থাকে না। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মধ্যে, এইরূপ গুরুতর বিরুদ্ধ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই
কৃষ্ণচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন পুরাণে ভিন্ন প্রকারে বর্ণিত হয়েছে। সেই সকল বর্ণনা পরস্পর সঙ্গত নহে।
৪র্থ,— বিষ্ণুপুরাণে আছে;—
আখ্যা নৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পশুদ্ধিভিঃ।
পুরাণসংহিতাং চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ ||
প্রখ্যাতো ব্যাসশিষ্যোভূৎ সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাং তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ ||
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রয়ুঃ শাংশপায়নঃ।
অকৃতব্রণোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্ ||
কাশ্যপঃ সংহিতাকর্তা সাবর্ণিঃ শাংশপায়নঃ।
লোমহর্ষণিকা চান্যা তিসৃণাং মূলসংহিতা ||
বিষ্ণুপুরাণ, ৩ অংশ, ৬ অধ্যায়, ১৬-১৯ শ্লোক।
পুরাণার্থবিৎ (বেদব্যাস) আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও
কল্পশুদ্ধি দ্বারা পুরাণসংহিতা করেছিলেন। লোমহর্ষণ নামে সূত বিখ্যাত ব্যাসশিষ্য ছিলেন। ব্যাস মহামুনি তাঁকে পুরাণসংহিতা দান করলেন। সুমতি, অগ্নির্বচ্চা, মিত্রয়ু, শাংশপয়ান, আকৃতব্রণ, সাবর্ণি—তাঁহার এই ছয়
শিষ্য ছিল। (তার মধ্যে) কাশ্যপ, সাবর্ণি ও শাংশপায়ন সেই লোমহর্ষণিকা মূল সংহিতা হতে তিনটা সংহিতা
প্রস্তুত করেন।
পুনশ্চ ভাগবতে আছে;—
ত্রয্যারুণিঃ কশ্যপশ্চ সাবর্ণিরকৃতব্রণঃ।
শিংশপায়নহারীতৌ ষড়্বৈ পৌরাণিকা ইমে ||
অধীয়ন্ত ব্যাসশিষ্যাৎ সংহিতাং মৎপিতুর্মুখাৎ।*
একৈকামহমেতেষাং শিষ্যঃ সর্বাঃ সমধ্যগাম্ ||
কশ্যপোহহঞ্চ সাবর্ণী রামশিষ্যোহকৃতব্রণঃ।
অধীমহি ব্যাসশিষ্যাচ্চত্বারো মূলসংহিতাঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ স্কন্ধ, ৭ অধ্যায়, ৪-৬ শ্লোক।
ত্রয্যারুণি, কাশ্যপ, সাবর্ণি, অকৃতব্রণ, শিংশপায়ন, হারীত, এই ছয় পৌরাণিক। বায়ুপুরাণে নামগুলি কিছু ভিন্ন,—আত্রেয়ঃ সুমতির্ধীমান্ কাশ্যপোহং কৃতব্রণঃ।
পুনশ্চ অগ্নিপুরাণে;—
প্রাপ্য ব্যাসাৎ পুরাণাদি সূতো বৈ লোমহর্ষণঃ।
সুমতিশ্চাগ্নির্বচ্চাশ্চ মিত্রায়ুঃ শাংসপায়নঃ ||
কৃতব্রতোহথ সাবর্ণিঃ ষট্ শিষ্যাস্তস্য চাভবন্।
শাংসপায়নাদয়শ্চক্রুঃ পুরাণানান্তু সংহিতাঃ ||
এই সকল বচনে জানিতে পারা যাইতেছে যে, এক্ষণকার প্রচলিত অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস প্রণীত নহে। তাঁহার
শিষ্য প্রশিষ্যগণ পুরাণ-সংহিতা প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে প্রচলিত নাই। যাহা প্রচলিত আছে, তাহা
কাহার প্রণীত, কবে প্রণীত হইয়াছিল, তার কিছুই স্থিরতা নাই।
[তথ্যসূত্র: কৃষ্ণচরিত্র- প্রথম খণ্ড চতুর্দশ পরিচ্ছেদ]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ