মহর্ষি কপিলদেব এই দর্শনের প্রণেতা। ইনি কহেন যে ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তিই অত্যন্ত পুরুষার্থ।
ত্রিবিধ দুঃখ যথা,—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দ্বিবিধ—শারীর ও মানস। আধিভৌতিক দুঃখ মনুষ্য, পশু, পক্ষী ও স্থাবরাদি ভূত পদার্থ হইতে উৎপন্ন হয়। আধিদৈবিক দুঃখ যক্ষ রাক্ষসাদি দেবযোনির আবেশ নিবন্ধন উৎপন্ন হয়।
জগতে আসিয়াই লোক এই ত্রিবিধ দুঃখের অধীন হইয়া পড়ে। পুরুষকার অবলম্বন করিলে কখন কখন কোনও প্রকার দুঃখের ক্ষণিক অবসান হয় বটে, কিন্তু তাহাকে পুরুষার্থ বা মোক্ষ বলা যাইতে পারে না। এই দুঃখ সমূহের চিরাবসান অর্থাৎ তাহাদিগের পুনরুৎপত্তির কারণ পর্য্যন্ত নাশ করাই পুরুষার্থ।
প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তির কারণ। কিন্তু এই বিবেক-জ্ঞান লাভ করিতে হইলে পুরুষ ও প্রকৃতির স্বরূপ ও কার্য্য এবং জগৎ কি ও তাহার কারণ কি ইত্যাদি জানিতে হইবে। এই নিমিত্ত সাংখ্যকার পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের অবতারণা করিয়া সমস্ত বিষয় বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।
পরিদৃশ্যমান জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে আমরা জড় ও চৈতন্য এই দুই পদার্থ দেখিতে পাই। চৈতন্য পদার্থ পুরুষ এবং জড় পদার্থ প্রকৃতি নামে অভিহিত হয়। এই দুই পদার্থই অনাদি, কিন্তু উভয়ে ভিন্নধর্ম্মী। সাংখ্যমতে পুরুষ বহু, কিন্তু কোনওপ্রকার প্রমাণ দ্বারা ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন সিদ্ধাস্ত করা যায় না।
প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ব; মহৎ হইতে অহঙ্কার; অহঙ্কারের সাত্বিক অংশ হইতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন এবং পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়, এবং অহঙ্কারের তামস ভাব হইতে পঞ্চ তন্মাত্রা —শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—এবং তাহা হইতে পঞ্চ মহাভূত যথা, ক্ষিতি, জল, তেজ বায়ু ও আকাশ—সৃষ্ট হয়।
পূর্ব্বোক্ত চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বের তিনটি প্রকার-ভেদ আছে, যথা, (১) প্রকৃতি, (২) প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন, (৩) এবং বিকৃতি। প্রকৃতি শব্দে কারণ বুঝায়। মূলা প্রকৃতি ত্রয়োবিংশতি তত্ত্বের কারণ অথচ নিজে কাহারও কার্য্য নহে, অতএব ইহা কেবলই কারণ ভাবাপন্ন। কিন্তু মহত্তত্ব প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন অথচ অহঙ্কারের কারণ, অতএব ইহা প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন। আবার যে সমস্ত তত্ত্ব হইতে অপর কোনও প্রকার তত্ত্ব উদ্ভূত হইতেছে না তাহারা কেবলই বিকৃতি ভাবাপন্ন।
কিন্তু পুরুষতত্ত্ব প্রকৃতি বা বিকৃতি ভাবাপন্ন নহে। পুরুষ কোনও কারণ হইতে উদ্ভূত হয় নাই এবং পুরুষ হইতে কোনও কিছু উদ্ভূত হয় না।
প্রকৃতির সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ আছে; কিন্তু পুরুষ নির্গুণ। প্রকৃতির রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টি, সত্ত্বদ্বারা স্থিতি ও তমঃ দ্বারা প্রলয় হইয়া থাকে। সৃষ্টি শব্দের অর্থ আবির্ভাব এবং প্রলয় শব্দের অর্থ তিরোভাব।
প্রকৃতির স্থুল ক্রিয়া দ্বারা যখন জগৎ স্থুল-রুপ ধারণ কবে তখনই ইহার আবির্ভাব এবং যখন প্রকৃতির সূক্ষ্মক্রিয়া দ্বারা জগৎ সূক্ষ্মভাবাপন্ন হয় তখনই ইহার তিরোভাব। বস্তুতঃ ইহার একেবারেই ধ্বংস নাই।
প্রকৃতিতে সৃষ্টির প্রবৃত্তি ও ভোগের উপাদান আছে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি ও ভোগ হইয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃতিই ভোক্ত্রী ও কর্ত্রী; পুরুষ ভোক্তাও নহেন কর্ত্তাও নহেন। পুরুষ প্রকৃতিতে আসক্ত হইয়া কর্ম্মীরূপে প্রতীয়-মান হয়েন।
“অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহং ইতি মন্যতে।”
অহঙ্কার বিমূঢ় ভাবই দুঃখের কারণ। অতএব পুরুষ যখনবিদ্যা আশ্রয় পূর্ব্বক অহং তত্ত্বের উপরে উঠিয়া স্বরূপে অবস্থিত হয়েন তখন প্রকৃতির তিনগুণের সাম্যাবস্থা হয়।
প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞান সম্বন্ধে আরও কিছু স্পষ্ট করিয়া লিখিত হইতেছে। পুরুষ যদিও নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয় এবং নির্গুণ, তথাপি অদৃষ্টবশতঃ অহঙ্কারকে আশ্রয় করিয়া নিজের দুঃখের বীজ নিজে রোপন করেন। কর্ম্মফল হইতে অদৃষ্টের উৎপত্তি। দর্শনকারগণ বলেন যে কর্ম্মের প্রথম নাই কারণ সৃষ্টি অনাদি, অতএব পুরুষের অদৃষ্টও অনাদি। কিন্তু অনাদি হইলেও সাংখ্যমতে কর্ম্মফল সান্ত। জ্ঞান কর্ম্মফলের ধ্বংস করিতে পারে। কর্ম্মফলের ধ্বংস হইলেই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ নষ্ট হইবে। তাহা হইলেই মুক্তি। এক্ষণে এই প্রকৃতি পুরুষের সংযোগ ধ্বংসকারী জ্ঞান কি? “নিজ স্বরূপ বোধ।” প্রকৃতিই সমস্ত ভোগের আধার ও বোধক, নিজে সমস্ত ভোগ হইতে পৃথক, এইরূপ জ্ঞান দ্বারা নিজের স্বরূপ বুঝিতে পারিলে আর কর্ম্মফলে বাধ্য হইতে হয় না। সাংখ্য মতাদর্শীদের মতে, তত্ত্বের সংখ্যা পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ। এই পঁচিশটি তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। সংখ্যাভিত্তিক এই দর্শন বলে এই দর্শনের নামকরণ করা হয়েছে সাংখ্যদর্শন। সাংখ্যদর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয়কে ‘তত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর মূলে রয়েছে নিত্য প্রকৃতি ও নিত্য পুরুষ নামক দুটি তত্ত্ব। এই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি হয় তেইশ প্রকার তত্ত্ব। এগুলো হলো-
মহৎ বা বুদ্ধি
অহঙ্কার
মন
পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক)
পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, হাত, পা, পায়ু. উপস্থ)
পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ)
পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি, অপ, অগ্নি, মরুৎ ও আকাশ)
এই মতাদর্শীদের কেউ কেউ মনে করেন- ‘সাংখ্য’ হলো এখানে সম্যক–জ্ঞান (সাং+খ্য = সম্যক+জ্ঞান) বা যথার্থ জ্ঞান। সাংখ্যমতে সমুদয় জ্ঞান দুই প্রকার। এর একটি তত্ত্বজ্ঞান, অপরটি ব্যবহারিক জ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানকে এই দর্শনে ‘বিবেকজ্ঞান’ বলা হয়। বিবেকজ্ঞানের মাধ্যমেই জীবের দুঃখনিবৃত্তি হয়। যেহেতু এ দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতু বলা হয়েছে, তাই এ দর্শনকে সাংখ্যদর্শন বলা হয়। এই মতে আত্মা বা পুরুষ নানা ধরনের মোহ দ্বারা আব্দ্ধ হয়ে পড়ে। এই মোহ থেকে মুক্তি হওয়াই মোক্ষ লাভ। এই দর্শনে কার্যত সকল জীবই আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক– দুঃখভোগ করে। মানুষ এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়ের সন্ধান করেছে যুগ যুগ ধরে। এর সব কিছু থেকে দিতে পারে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয়, এই কারণে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। অন্যদিকে এই জ্ঞান সকল দুঃখের নিবর্তক। তাই একে বলা হয় আত্যন্তিক জ্ঞান। আবার যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী। তাই এই জ্ঞানকে অক্ষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা এর বাইরে আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতির অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ সুখ ও দুঃখ উভয়ই আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ–দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন।
ঋষি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এই দর্শন দান করেছিলেন তাঁর শিষ্য আসুরিকে। আসুরির তাঁর শিষ্য পঞ্চশিখকে এই জ্ঞান দান করেন। এরপর পঞ্চশিখ তাঁর শিষ্যদের তা দান করেন। ক্রমে এই শিষ্যদের মাধ্যমে সাংখ্যদর্শন ছড়িয়ে পড়ে। এই দর্শন অনুসারে ঈশ্বরকৃষ্ণ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের মোট শ্লোকের সংখ্যা ৭২। এর ভিতরে ৭০টি শ্লোকে তত্ত্বটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে এই সাংখ্যকারিকা গ্রন্থটি ‘সাংখ্যসপ্ততি’ নামেও পরিচিত।
এখন পর্যন্ত এই গ্রন্থটিকেই সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঈশ্বরকৃষ্ণ এই গ্রন্থের পরিচয় দিয়েছেন এই ভাবে-
এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা–৭০)
কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
সাংখ্যকারিকার তত্ত্বসমূহ
সংখ্যাকারিক ১
সাংখ্যমতের তত্ত্বজ্ঞান
সাংখ্যমতে তত্ত্বজ্ঞানকে বিবেক জ্ঞান বলা হয়। জ্ঞানের দ্বারাই জীব দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি লাভ করতে পারে। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা পুরুষের স্বরূপ অনুধাবনের মাধ্যমেই দুঃখের হাত থেকে জীবের চিরনির্বত্তি লাভ হতে পারে। লৌকিক বা বৈদিক কোন প্রকার কর্মের দ্বারাই জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে না। এ বিষয়ে ‘সাংখ্যকারিকা’র দ্বিতীয় শ্লোকে উল্লেখ আছে-
‘দৃষ্টবদানুশ্রবিকঃ স হ্যবিশুদ্ধিক্ষয়াতিশয়যুক্তঃ।
তদ্বিপরীতঃ শ্রেয়ান্ ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২)
অর্থাৎ: বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়ের মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান–ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তত্ত্বের ২৫টি প্রতিপাদ্য আছে। এই কারণে তত্ত্বের সংখ্যাও ২৫টি ধরা হয়। এই তত্ত্বগুলোকে কার্যকারণের বিচারে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো হলো-
১. কেবল প্রকৃতি: একে বলা হয় মূল প্রকৃতি। মূল প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ, ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থায় থেক। তাই এই প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক। সকল কার্যই প্রকৃতির ভিতর অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পরম প্রকৃতি উৎপত্তিহীন। এই প্রকৃতি এবং পুরুষের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ২৩ প্রকার তত্ত্ব।
২. প্রকৃতি-বিকৃতি: মহৎ (বুদ্ধি), অহঙ্কার, অহংকার ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) এর দ্বারা নিত্য-প্রকৃতির বিকৃতি ঘটে। সাংখ্যমতে প্রধান প্রকৃতি থেকে মহৎতত্ত্বের উৎপত্তি হয়, মহৎতত্ত্ব থেকে অহংকারের উৎপত্তি হয়, অহংকার থেকে একাদশ ইন্দ্রিয় (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়) ও পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয় এবং পঞ্চতন্মাত্র থেকে পঞ্চমহাভূতের উৎপত্তি হয়।
৩. বিকার বা কেবল বিকৃতি : এই তত্ত্ব কোন তত্ত্বের কারণ নয়। কিন্তু অন্য কোন তত্ত্বের কার্যরূপে বিকৃতি ঘটায়। মোট ১৬টি তত্ত্বকে বিকার বিকৃতি বলা হয়। এগুলো হলো পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্), পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্), পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ) এবং মন।
৪. নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব: যে তত্ত্ব প্রকৃতিও নয় এবং অন্য কোন তত্ত্বের কার্য বা বিকৃতিও নয়। এই বিচারে পুরুষ হলো নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব। সাংখ্যমতে পুরুষ কারও কার্য বা কারণ হয় না। তাই একমাত্র পুরুষই নির্বিকার ও নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব। মূলত চৈতন্য হলো পুরুষের স্বরূপধর্ম। পুরুষ হলো নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব। পুরুষের বন্ধনও নেই, মোক্ষও হয় না। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ বলে তার দেখার বা জানার শক্তি রয়েছে, কিন্তু তার ক্রিয়াশক্তি নেই। প্রকৃতির রূপ দর্শনে পুরুষ সাক্ষী হলেও স্বভাবতই পুরুষ উদাসীন। চেতন পুরুষ কর্তা নয় এবং কর্তার বুদ্ধিও চেতন নয়।
সাংখ্যমতে পুরুষ সর্বব্যাপী ও সংখ্যায় বহু। অবিবেক-বশত পুরুষ বদ্ধাবস্থাপ্রাপ্ত হয়। বদ্ধ পুরুষকে তাই অবিবেকী বলা হয়। পুরুষের অবিবেক বিনাশ্য এবং তা বিনাশের মাধ্যমে পুরুষ মোক্ষ বা কৈবল্য লাভ করে।
পুরুষ ও প্রকৃতি আদি তত্ত্ব। উভয়ই অকারণ, অলিঙ্গ এবং নিত্য। পুরুষ প্রকৃতির পরিপূরক। প্রকৃতিতে যার অভাব দৃষ্ট্য হয়, তাই পুরুষে থাকে। সাংখ্যমতে চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ যেমন সত্য, তেমনি জড় প্রকৃতিও সত্য। উভয়ই প্রপঞ্চময় জড়জগতের মূল ও আদি কারণ। এককভাবে কেউই জগতের কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। পুরুষের সংস্পর্শে প্রকৃতির যে পরিণাম ঘটে, তাই জগৎ। আবার প্রলয়কালে এই জগৎ অব্যক্ত প্রকৃতিতেই লীন হয়ে যায়। সাংখ্য মতাদর্শে প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে। প্রকৃতি হলো নারীর অনুরূপ। সে তার সকাম হাস্য, লাস্য, ভাব, অনুভাবের মধ্য দিয়ে পুরুষকে মোহিত করে যৌনাকাঙ্ক্ষায়। এর মধ্য দিয়ে সন্তান নামক ফলের লাভ করে। এই ফল সযত্নে লালন করে প্রকৃতি তথা নারী। সেখানে প্রকৃতি হয়ে উঠে মাতৃ স্বরূপা।
কার্য ও কারণ
কার্য ও কারণের মধ্য দিয়ে জগতের প্রকাশ। যা কিছু ঘটে বা যা কিছু উৎপন্ন হয় তার সবই কার্য বা কার্যের ফল। আর যা থেকে উৎপন্ন হয় তাই হলো কারণ। সাংখ্য মতে কারণের দুটি প্রকরণ রয়েছে, কারণ দুটি হলো উপাদান ও নিমিত্ত। উপাদান হলো- যা থেকে কোনো কার্য সৃষ্টি হয়। উপাদানকে কার্যের আশ্রয় বা অধিষ্ঠান বলা হয়। আর নিমিত্ত হলো- যে শক্তির দ্বারা কার্য সাধিত হয় এবং উপাদানকে আশ্রয় করে কার্য সম্পন্ন হয়। এই কার্য শক্তি বা নিমিত্তি কার্যের ফলফলের ভিতরে থাকে না। একটি মাটির কলসির মাটি হলো উপাদান, আর যে চক্রের সাহায্য কলসি তৈরি করা হয়েছে, তা হলো নিমিত্ত। আর মাটির কলসি হলো কার্য।
কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কার্য-কারণ থাকে কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে। সৎকার্যবাদীরা বলেন কার্যকারণ ছাড়া কার্য হয় না এবং কার্যকারণ আগে থেকেই থাকে। শুরুতে কার্য অব্যাক্তাবস্থায় থাকে। অন্য দিকে অসৎকার্যবাদীরা মনে করেন, কার্যের কার্যকারণ থাকে না। তাঁরা মনে করেন কার্য উৎপন্ন হওয়ার আগে কার্যের কোন অস্তিত্বই থাকে না, কার্য সম্পূর্ণভাবে নতুন সৃষ্টি বা আরম্ভ। সাংখ্যমতে কোনো কার্য উৎপন্নের আগের কার্য, কোনো না কোনো উপাদানকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে। তাই আগের উপাদান সত্য, উৎপন্নের পরের উপাদানও সত্য। সাংখ্য মতে 'সতঃ সজ্জায়ত’। অর্থাৎ, সৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়। সাংখ্যকারিকার নবম কারিকায় পাঁচটি যুক্তি এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘অসৎ অকরণাৎ উপাদানগ্রহণাৎ সর্বসম্ভবাভাবাৎ।
শক্তস্য শক্যকরণাৎ কারণভাবাৎ চ সৎ কার্যম্’ ।। (সাংখ্যকারিকা–৯)
অর্থাৎ: যা নেই তাকে উৎপন্ন করা যায় না, কার্য উৎপাদনে সমর্থ বস্তু থেকেই উৎপাদনযোগ্য বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, যে কোন কিছু থেকে যে কোন কিছু উৎপন্ন হয় না, একটি বস্তু যে কার্য উৎপাদনে সমর্থ সেই বস্তুটি কেবলমাত্র সেই কার্যই উৎপাদন করে এবং কার্য স্বরূপত কারণ থেকে অভিন্ন বলে একটি কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে অস্তিত্বশীল থাকে।
গুণ: সাংখ্য দর্শনে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়েছে। এখানে গুণ হলো- জাগতিক যাবতীয় দ্রব্যের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই গুণ দোষের বিপরীত শব্দ নয়। গুণ অপরের অর্থ বা প্রয়োজন সাধন করে। এই গুণগুলি সুখ, দুঃখ ও মোহ রূপে পাওয়া যায়। এরা পরস্পর বিরুদ্ধ স্বভাব হলেও কার্যক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের সহায়ক হয়।
গুণত্রয় পরিচয়
সত্ত্বগুণ: সুখাত্মক, লঘু, স্বচ্ছ ও প্রকাশক। এই গুণ ক্রিয়াহীন। সত্ত্বগুণকে শ্বেতবর্ণের সাথে তুলনা করা হয়।
রজঃগুণ: এই দুঃখাত্মক, উত্তেজক এবং ক্রিয়াশীল। জাগতিক সকল বস্তুর গতি, ক্রিয়া ও চঞ্চলতার জন্য রজোগুণই কারণ। রজগুণকে রক্রবর্ণের সাথে তুলনা করা হয়। এই গুণের প্রকাশ ঘটে প্রবৃত্তির ভিতর দিয়ে। তাই রজোগুণকে অন্য গুণের চালক বলা হয়। চলতে গিয়ে তমোগুণ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে রজোগুণ সকল বিষয়ে সমানভাবে কার্যকর হয় না।
তমঃগুণ: বিষাদাত্মক, গুরু এবং আবরক। এই গুণ সত্ত্বগুণের প্রকাশ এবং রজোগুণের প্রবৃত্তির নিবারণ করে। এই গুণ ক্রিয়াহীন। তমোগুণকে কালো বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়।
সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরভাবনা
প্রাচীন আধ্যাত্মবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী দর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই। প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। এই মতবাদ স্থাপনের জন্য তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। সাংখ্যমতে পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। যে কোনো কার্য সম্পাদনের পিছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, এ কথা স্বীকার করতে হয়। এক্ষেত্রে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তা জানা যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে তাঁকে পুরুষ রূপেই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর মুক্ত বা বদ্ধ কোন পুরুষ রূপেই স্বীকৃত হতে পারেন না। তিনি যদি বদ্ধ পুরুষ হন, তাহলে তিনিও দুঃখ–ত্রয়ের অধীন হবেন। কিন্তু ঈশ্বর কখনো দুঃখের অধীন হতে পারেন না। আবার ঈশ্বর যদি মুক্ত হন তাহলে তাঁকে নিত্য–মুক্তই বলতে হয়। তিনি যদি নিত্য–মুক্তই হন, তাহলে জগতের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।
সাংখ্য দর্শনের মুল কথাঃ
‘এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা–৭০)অর্থাৎ: কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
‘তত্র পঞ্চশিখো নাম কাপিলেয়ো মহামুনিঃ।পরিধাবন্মহীং কৃৎস্নাং জগাম মিথিলামথ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৬)অর্থাৎ : সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন।.ঋষীণামাহুরেকং যং কামাদবসিতং নৃষু।শাশ্বতং সুখমত্যন্তমন্বিচ্ছন্তং সুদুর্ল্লভম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৮)অর্থাৎ : সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্য, অত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেন, তা সেকালের লোকেরা বলতো।.যমাহুঃ কপিলং সাংখ্যাঃ পরমর্ষিং প্রজাপতিম্ ।স মন্যে তেন রূপেণ বিস্মাপয়তি হি স্বয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৯)অর্থাৎ : সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাঁকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেন; আমি মনে করি, স্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেন; তাও তখন কেউ কেউ বলতো।.তমাসীনং সমাগম্য কাপিলং মণ্ডলং মহৎ।পুরুষাবস্থমব্যক্তং পরমার্থং ন্যবেদয়ৎ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১১)অর্থাৎ : একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্ত, পরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন।.যত্তদেকাক্ষরং ব্রহ্ম নানারূপং প্রদৃশ্যতে।আসুরির্মণ্ডলে তস্মিন্ প্রতিপেদে তদব্যয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৩)অর্থাৎ : সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হন, সেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন।.এতন্মে ভগবানাহ কাপিলেয়স্য সম্ভবম্ ।তস্য তৎ কাপিলেয়ত্বং সর্ববিত্ত্বমনুত্তমম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৬)অর্থাৎ : ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তাঁর কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।
‘সত্ত্বমাত্মা শরীরঞ্চ ত্রয়মেতাত্রিদণ্ডবৎ।লোকন্তিষ্ঠতি সংযোগাৎ তত্র সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্ ।।স পুমাং শ্চেতনং তচ্চ তচ্চাধিকরণং স্মৃতম্ ।বেদস্যাস্য তদর্থংহি বেদোহয়ং সম্প্রকাশিতঃ।। (চরক–সংহিতা : প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা–৬)অর্থাৎ : মন, আত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়া) প্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়, তেমনি মন, আত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফল, বিষয়বাসনা সুখ, দুঃখ, জ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতন, তিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।
‘তেষামিদন্তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যয়াদ্ব্যয়ম্ ।। (মনুসংহিতা : ১/১৯)অর্থাৎ : মহত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে; অবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মা) থেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে।.আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ।যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাব˜গুণঃ স্মৃতঃ।। (মনুসংহিতা : ১/২০)অর্থাৎ : আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পর–পর প্রত্যেকে পূর্ব–পূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়, সে ততগুলি গুণ পায়। –প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দ, স্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ।
‘সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।অর্থাৎ : সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী–বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্–যজুঃ–সামবেদাত্মক বেদ–বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
‘কালার্কভক্ষিতং সাংখ্যশাস্ত্রং জ্ঞান–সুধাকরম্ ।কলাবশিষ্টং ভূয়োহপি পুরয়িষ্যে বচোহমৃতৈঃ।। (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য)অর্থাৎ : সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যেও গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে ; আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।
‘সপ্তত্যাং কিল যেহর্থাস্তেহর্থাঃ কৃৎস্নস্য ষষ্টিতন্ত্রস্য।আখ্যায়িকাবিরহিতাঃ পরবাদবিবর্জ্জিতাশ্চাপি।। (সাংখ্যকারিকা–৭২)অর্থাৎ : (পঞ্চশিখ রচিত) সমগ্র ষষ্টিতন্ত্রে যে সমস্ত বিষয় (বা তত্ত্ব) বর্ণিত, আখ্যায়িকা ও পরমত খণ্ডন ছাড়া, সেই সমস্ত তত্ত্বই সত্তরটি কারিকায় বলা হয়েছে।
দুঃখত্রয়াভিঘাতাজ্জিজ্ঞাসা তদপঘাতকে হেতৌ।দৃষ্টে সাহপার্থা চেন্নৈকান্তাত্যন্ততোহভাবাৎ।। (সাংখ্যকারিকা–১)অর্থাৎ : ত্রিবিধ দুঃখের অভিঘাতের ফলে তার (অর্থাৎ সেই ত্রিবিধ দুঃখের) নিবৃত্তির (সাংখ্যশাস্ত্রীয়) উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসার উদয় হয়। লৌকিক উপায়ে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয় না বলে (দুঃখ নিবৃত্তির) সেই (সাংখ্যশাস্ত্রীয়) উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসা ব্যর্থ হয় না।
‘দুঃখানাং ত্রয়ং দুঃখত্রয়ং। তৎ খলু আধ্যাত্মিকং আধিভৌতিকং আধিদৈবিকং চঃ।’ (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : দুঃখসমূহের ত্রয় দুঃখত্রয় বা ত্রিবিধ দুঃখ। এই ত্রিবিধ দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক।
‘সন্তি চোপায়াঃ শতশঃ শারীরদুঃখপ্রতীকারায়েষৎকরাঃ সুকরা ভিষজাং বরৈরুপদিষ্টাঃ। মানসস্যাপি সন্তাপস্য প্রতীকারায় মনোজ্ঞস্ত্রী -পানভোজনবিলেপনঃ বস্ত্রালঙ্কারাদিবিষয়প্রাপ্তিরুপায়ঃ সুকরঃ। এবমাধি -ভৌতিকস্য দুঃখস্যাপি নীতিশাস্ত্রাভ্যাস কুশলতানিরত্যয়স্থানাধ্যসনাদিঃ প্রতীকারহেতুরীষৎকরঃ। তথাধিদৈবিকস্যাপি দুঃখস্য মণিমন্ত্রৌষধাদ্য উপযোগঃ সুকরঃ প্রতীকারোপায় ইতি।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ:(আধ্যাত্মিক) শারীর দুঃখ নিবারণের জন্য শত শত সহজ উপায় আছে, যেমন বৈদ্যদের (অর্থাৎ আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের) দ্বারা উপদিষ্ট ভেষজাদি সেবন। (আধ্যাত্মিক) মানস দুঃখ নিবৃত্তির জন্য মনোজ্ঞ স্ত্রী (অথবা পুরুষ), পানীয়, সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি (অনেক) সহজলভ্য ভোগ্য বিষয় রয়েছে। এইরূপ আধিভৌতিক দুঃখ নিরাকরণের জন্য নীতিশাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বাস ইত্যাদি বিবিধ সহজ উপায় আছে। অনুরূপভাবে আধিদৈবিক দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সহজলভ্য মণি, মন্ত্র, ঔষধাদির ব্যবহাররূপ অনেক সহজ উপায় আছে।
‘আনুশ্রবিকোহপি কর্ম্মকলাপো দৃষ্টেন তূল্যো বর্ত্ততে ইতি। ঐকান্তিকাত্যন্তিকদুঃখত্রয়ঃ প্রতীকারানুপায়ত্বস্যোভয়ত্রাপি তুল্যত্বাৎ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : আনুশ্রবিক (তথা বেদবিহিত) যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ দৃষ্ট উপায়ের মতোই হয়ে থাকে। একান্ত ও অত্যন্তভাবে দুঃখের নিবৃত্তি করতে পারে না বলে দৃষ্ট ও আনুশ্রবিক উভয়েই সমান।
‘দৃষ্টবদানুশ্রবিকঃ স হ্যবিশুদ্ধিক্ষয়াতিশয়যুক্তঃ।তদ্বিপরীতঃ শ্রেয়ান্ ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২)অর্থাৎ : বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়েল মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান–ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।
‘সতঃ সজ্জায়ত’। অর্থাৎ, সৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়।
‘অসৎ অকরণাৎ উপাদানগ্রহণাৎ সর্বসম্ভবাভাবাৎ।শক্তস্য শক্যকরণাৎ কারণভাবাৎ চ সৎ কার্যম্’ ।। (সাংখ্যকারিকা–৯)অর্থাৎ : যা নেই তাকে উৎপন্ন করা যায় না, কার্য উৎপাদনে সমর্থ বস্তু থেকেই উৎপাদনযোগ্য বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, যে কোন কিছু থেকে যে কোন কিছু উৎপন্ন হয় না, একটি বস্তু যে কার্য উৎপাদনে সমর্থ সেই বস্তুটি কেবলমাত্র সেই কার্যই উৎপাদন করে এবং কার্য স্বরূপত কারণ থেকে অভিন্ন বলে একটি কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে অস্তিত্বশীল থাকে।
‘অসৎ চেৎ কারণব্যাপারাৎ পূর্ব্বং কার্য্যম্, নাস্য সত্ত্বং কর্ত্তুং কেনাপি শক্যম্ । ন হি নীলং শিল্পিসহস্রেণাপি শক্যং পীতং কর্ত্তুম শক্যতে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : যদি কারণ–ব্যাপারের পূর্বে কার্য (উপাদান কারণে) অসৎ হয়, তবে কেউ তাকে উৎপন্ন করতে পারে না। সহস্র শিল্পীও নীলকে পীত (বা হলুদ) করতে পারে না।
‘কারণাচ্চাস্য সতোহভিব্যক্তিরেবাশিষ্যতে সতশ্চাভিব্যক্তিরুপপন্না, যথা– পীড়নেন তিলেষু তৈলস্য, অবঘাতেন ধান্যেষু তণ্ডলানাং, দোহনেন সৌরভেয়ীষু পয়সঃ। অসতঃ করণে তু ন নিদর্শনং কিঞ্চিদস্তি। ন খল্বভিব্যজমানং চোৎপদ্যমানং বা ক্কচিদসদ্ দৃষ্টম্ ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : কারণ–ব্যাপারের ফলে এই সৎ কার্যেরই অভিব্যক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন, পীড়ন বা পেষণের দ্বারা তিল থেকে তেল উৎপন্ন হয়, আঘাতের দ্বারা ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয়, দোহনের দ্বারা গাভী থেকে দুধ পাওয়া যায়। কিন্তু অসদ্বস্তু উৎপন্ন হচ্ছে, এমন কোথাও দেখা যায় না।
‘মূলপ্রকৃতিরবিকৃতিঃ মহদাদ্যাঃ প্রকৃতিবিকৃতয়ঃ সপ্ত।ষোড়শকস্তু বিকারো ন প্রকৃতির্ন বিকৃতিঃ পুরুষঃ।। (সাংখ্যকারিকা–৩)অর্থাৎ : মূলপ্রকৃতি কোন তত্ত্বের বিকার বা কার্য নয়। মহৎ আদিতে যাদের এমন সাতটি তত্ত্ব (যথা– মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র কোন তত্ত্বের) কারণ এবং (অন্য কোন তত্ত্বের) কার্য। ষোলটি তত্ত্ব (যেমন– মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চমহাভূত) কিন্তু (কোন না কোন তত্ত্বের কেবলমাত্র) কার্য। পুরুষ (কোন তত্ত্বের) কারণও নয় এবং (অন্য কোন তত্ত্বের) কার্যও নয়।
‘প্রকৃতের্মহাংস্ততোহহঙ্কারস্তস্মাদ্গণশ্চ ষোড়শকঃ।তস্মাদপি ষোড়শকাৎ পঞ্চভ্যঃ পঞ্চভূতানি।। (সাংখ্যকারিকা–২২)অর্থাৎ : প্রকৃতি থেকে মহৎ, মহৎ থেকে অহঙ্কার, অহঙ্কার থেকে (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র– এই) ষোলটি গণ (বা বিকার) এবং ষোলটি বিকারের অন্তর্গত পঞ্চতন্মাত্র থেকে (আকাশাদি) পঞ্চমহাভূত (উৎপন্ন হয়)।
‘সংক্ষেপতো হি শাস্ত্রার্থস্য চতস্রো বিধাঃ। কশ্চিদর্থঃ প্রকৃতিরেব, কশ্চিদর্থো বিকৃতিরেব, কশ্চিৎ প্রকৃতিবিকৃতিরেব কশ্চিদনুভয়রূপঃ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : (সাংখ্য) শাস্ত্রের (বিষয় বা) তত্ত্ব সংক্ষেপে চার প্রকার। কোন তত্ত্ব কেবল প্রকৃতি (বা কারণ), কোন তত্ত্ব কেবল বিকৃতি (বা কার্য), কোন কোন তত্ত্ব প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয়ই এবং কোন তত্ত্ব প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয়।
‘ত্রিগুণমবিবেকি বিষয়ঃ সামান্যমচেতনং প্রসবধর্ম্মি।ব্যক্তং তথা প্রধানং তদ্বিপরীতস্তথা চ পুমান্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১১)অর্থাৎ : ব্যক্ত তত্ত্ব মাত্রই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণাত্মক (হওয়ায়) ত্রিগুণ থেকে অভিন্ন, ভোগ্য বা বিষয় (অনেক পুরুষের জ্ঞানে গৃহীত হবার যোগ্য), অচেতন ও পরিমাণস্বভাব। অব্যক্ত বা প্রকৃতিও সেইরূপ। কিন্তু জ্ঞ বা পুরুষ সেইরূপ হওয়া সত্ত্বেও (ব্যক্ত ও অব্যক্ত তত্ত্ব মাত্রের) বিপরীত।
‘হেতুমদনিত্যমব্যাপি সক্রিয়মনেকমাশ্রিতং লিঙ্গম্ ।সাবয়বং পরতন্ত্রং ব্যক্তং বিপরীতমব্যক্তম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১০)অর্থাৎ : ব্যক্ত (তত্ত্ব মাত্রই) হেতুমৎ বা কারণযুক্ত, অনিত্য, অব্যাপি বা কারণের একাংশে স্থিত, সক্রিয় বা চলনক্রিয়াযুক্ত, অনেক, আশ্রিত, লিঙ্গ বা লয়শীল ও অনুমাপক, সাবয়ব বা অবয়বযুক্ত এবং পরাধীন। তার বিপরীত (ধর্মবিশিষ্ট তত্ত্বই) অব্যক্ত।
‘কারণমন্ত্যব্যক্তং প্রবর্ত্ততে ত্রিগুণতঃ সমুদয়াচ্চ।পরিণামতঃ সলিলবৎ প্রতি–প্রতি–গুণাশ্রয়–বিশেষাৎ।।’ -(সাংখ্যকারিকা–১৬)অর্থাৎ : অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতি (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই) ত্রিগুণরূপে সমবেত হয়ে কার্যাকারে পরিণত হয়। একই জল যেমন ভিন্ন ভিন্ন আধারে নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়, সেরূপ এক একটি গুণের প্রাধান্য অনুযায়ী ও সহকারীভেদে একই প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়।
‘প্রতিসর্গাবস্থায়াং সত্ত্বং রজস্তমশ্চ সদৃশপরিণামাবি ভবন্তি। পরিণামস্বভাবা হি গুণা নাপরিণম্য ক্ষণমপ্যবতিষ্টন্তে। তস্মাৎ সত্ত্বং সত্ত্বরূপতয়া, রজো রজোরূপতয়া, তমস্তমোরূপতয়া প্রতিসর্গাবস্থায়ামপি প্রবর্ত্ততে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : প্রলয়কালে সত্ত্ব, রজ ও তম গুণের সদৃশ পরিণাম হয়। গুণগুলির স্বভাব পরিণাম। পরিণত না হয়ে এরা ক্ষণকালও থাকতে পারে না। তাই সত্ত্ব সত্ত্বরূপে, রজঃ গুণ রজোরূপে ও তমঃ গুণ তমোরূপে প্রলয়কালেও পরিণাম প্রাপ্ত হয়।
‘মূলপ্রকৃতিরবিকৃতিঃ’ ইতি। প্রকরোতীতি প্রকৃতিঃ প্রধানম্ সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা। সা অবিকৃতিঃ, প্রকৃতিরেবেত্যর্থঃ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : মূলপ্রকৃতি অবিকৃতি (অর্থাৎ কেবল কারণ, যা কোন তত্ত্বের কার্য নয়)। যিনি প্রকৃষ্ট রূপে কার্য উৎপন্ন করেন তিনিই প্রকৃতি বা প্রধান– তিনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই তিন গুণের সাম্যাবস্থা। তিনি অবিকৃতি– অর্থাৎ তিনি কেবল কারণ।
‘ভেদানাং পরিমাণাৎ সমন্বয়াৎ শক্তিতঃ প্রবৃত্তেশ্চ।কারণকার্যবিভাগাদবিভাগাদ্বৈশ্বরূপ্যস্য।। (সাংখ্যকারিকা–১৫)অর্থাৎ : ভেদাদি (অর্থাৎ মহদাদি ত্রয়োবিংশতি কার্যবিশেষ বা বিভিন্ন বস্তু) পরিমিত বা পরিমাণবিশিষ্ট বলে, বিভিন্ন কারণ ও কার্যের মধ্যে (গুণের দিক থেকে) সমন্বয়ের উপস্থিতি বা সমতা থাকায়, (কারণের) শক্তি থেকে কার্যের উৎপত্তি হওয়ায়, সকল উৎপন্ন বস্তুতে (সৃষ্টি কালে) কারণ ও কার্যের বিভাগ থাকায় এবং (প্রলয় কালে) ঐরূপ বিভাগ না থাকায় সকল বস্তুর অধিষ্ঠানের প্রয়োজন হেতু অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতির অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
‘প্রীত্যপ্রীতিবিষাদাত্মকাঃ প্রকাশপ্রবৃত্তিনিয়মার্থাঃ।অন্যোহন্যাভিভবাশ্রয়জননমিথুনবৃত্তশ্চ গুণাঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১২)অর্থাৎ : সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই গুণগুলি সুখ, দুঃখ ও মোহ–স্বরূপ। প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও নিয়ম তাদের অর্থ বা প্রয়োজন। পরস্পরকে অভিভূত করা, পরস্পরকে আশ্রয় করা, পরস্পরের সাহায্যে বৃত্তির জনক হওয়া এবং পরস্পরের নিত্যসঙ্গী হওয়া তাদের বৃত্তি।
‘সত্ত্বং লঘু প্রকাশকমিষ্টমুপষ্টম্ভকং চলঞ্চ রজঃ।গুরুবরণকমেব তমঃ প্রদীপবচ্চার্থতো বৃত্তিঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১৩)অর্থাৎ : সত্ত্বগুণ লঘু, প্রকাশক ও ইষ্ট, রজোগুণ চালক, আরম্ভক ও চঞ্চল, এবং তমোগুণ ভারী ও আবরক। প্রয়োজন বা কার্য–সিদ্ধির জন্য প্রদীপের মতো তাদের বৃত্তি বা কার্য হয়।
‘ত্রিগুণমবিবেকি বিষয়ঃ সামান্যমচেতনং প্রসবধর্ম্মি।ব্যক্তং তথা প্রধানং তদ্বিপরীতস্তথা চ পুমান্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১১)অর্থাৎ : ব্যক্ত–এর ধর্ম হলো ত্রিগুণত্ব, অবিবেকিত্ব, বিষয়ত্ব, সামান্যত্ব, অচেতনত্ব, প্রসবধর্মিত্ব। অব্যক্ত বা প্রকৃতিও সেইরূপ। কিন্তু এই গুণগুলির কোনটিই জ্ঞ বা পুরুষে থাকে না। পুরুষ হলো ব্যক্ত ও অব্যক্তের বিপরীত।
‘তস্মাচ্চ বিপর্য্যাসাৎসিদ্ধং সাক্ষিত্বমস্য পুরষস্য।কৈবল্যং মাধ্যস্থ্যং দ্রষ্টৃত্বমকর্ত্তৃভাবশ্চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–১৯)অর্থাৎ : সেই (ব্যক্ত ও অব্যক্তের) বিপর্যয় ও বৈপরীত্য–বশত এই পুরুষের উদাসীন নির্লিপ্তভাব, দ্রষ্টার ভাব, কেবল একাকীত্বের (শুদ্ধ–চৈতন্যের) ভাব, মধ্যস্থের ভাব এবং অকর্তাভাব সিদ্ধ হয়।
‘তস্মাত্তৎসংযোগাদচেতনং চেতনাবদিব লিঙ্গম্ ।গুণকর্ত্তৃত্বে চ তথা কর্ত্তেব ভবত্যুদাসীনঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২০)অর্থাৎ : সেইহেতু, পুরুষের সংযোগবশত অচেতন মহদাদি চেতনার মতো মনে হয় এবং ত্রিগুণের কর্ত্তৃত্ববশত উদাসীন পুরুষ কর্তার মতো প্রতিভাত হন।
‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য।পঙ্গ্বন্ধবদুভয়োরপি সংযোগস্তৎকৃতঃ সর্গঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২১)অর্থাৎ : পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।
‘পুরুষস্যাপেক্ষাং দর্শয়তি– ‘পুরুষস্য কৈবল্যার্থম্’ ইতি। তথাহি ভোগ্যেন প্রধানেন সম্ভিন্নঃ পুরুষস্তদ্গতং দুঃখত্রয়ং স্বাত্মন্যভিমন্যমানঃ কৈবল্যং প্রার্থয়তে। তচ্চ সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিনিবন্ধনম্ । ন চ সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিঃ প্রধানমন্তরেণেতি কৈবল্যার্থৎ পুরুষঃ প্রধানমপেক্ষতে। অনাদিত্বাচ্চ সংযোগপরম্পরায়া ভোগায় সংযুক্তোহপি কৈবল্যায় পুনঃ সংযুজ্যত ইতি যুক্তম্ ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : (প্রকৃতির সঙ্গে) পুরুষের (সংযোগের) অপেক্ষার (পক্ষে) যুক্তি দেখানো হয়েছে, ‘পুরুষের কৈবল্যের জন্য’ ইত্যাদি। প্রধানের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরুষ প্রধানের ধর্ম দুঃখত্রয়কে নিজের বলে মনে করে সেই দুঃখত্রয় থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে। সেই কৈবল্য বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি (বা বিভেদজ্ঞান) থেকে হয়। বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি প্রধান ছাড়া হয় না। (অতএব) কৈবল্যের জন্য পুরুষ প্রধানকে অপেক্ষা করে। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ–পরম্পরা অনাদি বলে (পুরুষ) ভোগের জন্য (প্রকৃতির সঙ্গে) সংযুক্ত হয়েও কৈবল্যের জন্য পুনরায় সংযুক্ত হয়– এটাই যুক্তিযুক্ত।
‘আস্ত্যাত্মা নাস্তিত্ব সাধনাভাবাৎ।’অর্থাৎ : আত্মার নাস্তিত্ব সাধক প্রমাণ না থাকায় আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
‘সংঘাতপরার্থত্বাৎ ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াদধিষ্ঠানাৎ।পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ।’– (সাংখ্যকারিকা–১৭)অর্থাৎ : সংঘাতবস্তু অপরের প্রয়োজন সাধন করে থাকে, ত্রিগুণ ইত্যাদির বিপরীত কেউ আছে, কোন চেতন অধিষ্ঠাতা ছাড়া জড়বর্গ চলতে পারে না, রূপরসাদি ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা আছে, এবং কেবল বা শুদ্ধ আত্মার ভাব কৈবল্য বা মোক্ষ লাভের জন্য চেষ্টা আছে বলে পুরুষ আছেন– এটাই প্রমাণিত হয়।
‘জনন–মরণ–করণানাং প্রতিনিয়মাদযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ।পুরুষবহুত্বং সিদ্ধং ত্রৈগুণ্যবিপর্য্যয়াচ্চৈব।।’– (সাংখ্যকারিকা–১৮)অর্থাৎ : জন্ম–মরণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের পৃথক পৃথক অস্তিত্বের জন্য, পৃথক পৃথক ভাবে অন্তঃকরণের চেষ্টা বা যত্নের জন্য এবং ত্রিগুণের বিশেষ বা তারতম্যবশত পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধ হয়।
‘নিকায়বিশিষ্টাভিরপূর্ব্বাভির্দেহ ইন্দ্রিয়মনোহহঙ্গারবুদ্ধি বেদনাভিঃ পুরুষস্যাভিসম্বন্ধো জন্ম, ন তু পুরুষস্য পরিণামঃ তস্য হি অপরিণামিত্বাৎ। তেষামেব চ দেহাদীনামুপাত্তানাং পরিত্যাগো মরণম্, ন ত্বাত্মানো বিনাশঃ, তস্য কূটস্থনিত্যত্বাৎ। করণানি বুদ্ধ্যাদীনি ত্রয়োদশ। তেষাং জন্মমরণকরণানাং প্রতিনিয়মো ব্যবস্থা। সা খল্বিয়ং সর্ব্বশরীরেষ্বেকস্মিন্ পুরুষে নোপপদ্যতে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : নিকায় বিশিষ্ট (অর্থাৎ মনুষ্যত্বাদি জাতি বিশিষ্ট) নতুন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার, বুদ্ধি ও সংস্কারের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধকে জন্ম বলে। পুরুষের পরিণামরূপ জন্ম হয় না, তার অপরিণামিত্বের জন্য। এরূপ সম্বন্ধযুক্ত (অর্থাৎ নিকায়–বিশিষ্ট) উপাত্ত দেহাদির পরিত্যাগকে মৃত্যু বলে। আত্মার কিন্তু মৃত্যু হয় না, তার কুটস্থ–নিত্যত্ব স্বভাবের জন্য। বুদ্ধি ইত্যাদি ইন্দ্রিয় তেরোটি। জন্ম, মৃত্যু ও ইন্দ্রিয়গুলির প্রত্যেকের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা আছে। সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে সেই ব্যবস্থা বা নিয়মের উপপত্তি হয় না।
‘প্রবৃত্তিঃ প্রযত্নলক্ষণা যদ্যপ্যন্তঃকরণবর্ত্তিনী তথাহপি পুরুষ উপচর্য্যতে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)অর্থাৎ : অন্তঃকরণের ধর্মরূপ প্রবৃত্তি পুরুষে আরোপিত হয়েই পুরুষের ভেদ সাধন করে।
‘নাদ্বৈত শ্রুতিবিরোধঃ জাতিপরত্বাৎ।’– (সাংখ্যপ্রবচনসূত্র)অর্থাৎ : সাংখ্য পুরুষ–বহুত্ব স্বীকার করলেও শ্র“তি বিরোধী নয়, কারণ সাংখ্যমতে পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে বহু হলেও জাতি হিসেবে এক।
‘ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাৎ।’– (সাংখ্যপ্রবচনসূত্র–১/৯২)অর্থাৎ : প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ।
‘অনেকং ব্যক্তমেকব্যক্তং তথা পুমানপ্যেকঃ।’– (গৌড়পাদভাষ্য)অর্থাৎ : ব্যক্ত অনেক, অব্যক্ত এক, সেই প্রকার পুরুষও এক।
‘ঈক্ষতেঃ ন অশব্দম্ ।’– (ব্রহ্মসূত্র: ১/১/৫)শংকরাচার্যেরব্যাখ্যানুযায়ীসূত্রটিরঅর্থ : জগতের আদি কারণের চিন্তা, দর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে– এই ব্রহ্ম চেতন–পদার্থ। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নাই বলে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানকে জগৎসৃষ্টির আদি কারণ বললে তা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে।
‘এতচ্চ নিরীশ্বরসাংখ্যশাস্ত্রম্ ।’– (সাংখ্য–প্রস্থানম্, সর্বদর্শনসংগ্রহ)অর্থাৎ : এইভাবে নিরীশ্বর সাংখ্যশাস্ত্রের প্রবর্তক কপিলের মত প্রদর্শিত হলো।
‘…ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ’–অর্থাৎ, ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয়।
‘তেন নিবৃত্তপ্রসবামর্থবশাৎ সপ্তরূপবিনিবৃত্তাম্ ।প্রকৃতিং পশ্যতি পুরুষঃ প্রেক্ষকবদবস্থিতঃ স্বস্থঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৬৫)অর্থাৎ : সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা পুরুষ–প্রকৃতি বিবেকজ্ঞান–রূপ সিদ্ধ হওয়ায় স্ব–স্বরূপে অবস্থিত পুরুষকে তখন সপ্তভাবশূন্যা প্রকৃতি স্পর্শ বা প্রভাবিত করতে পারে না এবং দর্শকের ন্যায় পুরুষ তখন উদাসীন, অসঙ্গ ও নির্বিকার।
‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য।পঙ্গ্বন্ধবদুভয়োরপি সংযোগস্তৎকৃতঃ সর্গঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২১)অর্থাৎ : পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।
‘ইত্যেষ প্রকৃতিকৃতো মহাদাদিবিশেষভূতপর্য্যন্তঃ।প্রতিপুরুষবিমোক্ষার্থং স্বার্থে ইব পরার্থ আরম্ভঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৬)অর্থাৎ : এইভাবে মহৎ থেকে (শুরু করে) পঞ্চমহাভূত পর্য্যন্ত এই যে সৃষ্টি তা প্রত্যেক পুরুষের মুক্তির জন্য প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনের মতই পরের (অর্থাৎ পুরুষের) প্রয়োজনে সৃষ্টি করে।
‘সর্ব্বং প্রত্যুপভোগং যস্মাৎপুরুষস্য সাধয়তি বুদ্ধিঃ।সৈব চ বিশিনষ্টি পুনঃ প্রধানপুরুষান্তরং সূক্ষ্মম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৭)অর্থাৎ : যেহেতু মহৎ বা বুদ্ধি সংসারদশায় পুরুষের সমস্ত ভোগ সাধন করে, (সেহেতু) সেই বুদ্ধিই পুনরায় মোক্ষদশায় প্রধান ও পুরুষের দুর্বিজ্ঞেয় ভেদ বিশেষভাবে প্রকাশ করে।
‘প্রকৃতের্মহাংস্ততোহহঙ্কারস্তস্মাদ্গণশ্চ ষোড়শকঃ।তস্মাদপি ষোড়শকাৎ পঞ্চভ্যঃ পঞ্চভূতানি।। (সাংখ্যকারিকা–২২)অর্থাৎ : প্রকৃতি থেকে মহৎ, মহৎ থেকে অহঙ্কার, অহঙ্কার থেকে (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র– এই) ষোলটি গণ (বা বিকার) এবং ষোলটি বিকারের অন্তর্গত পঞ্চতন্মাত্র থেকে (আকাশাদি) পঞ্চমহাভূত (উৎপন্ন হয়)।
‘অধ্যবসায়ো বুদ্ধির্ধর্ম্মো জ্ঞানং বিরাগ ঐশ্বর্য্যম্ ।সাত্ত্বিকমেতদ্রূপং তামসমস্মাদ্বিপর্য্যস্তম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৩)অর্থাৎ : অধ্যবসায় (তথা অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি) হলো বুদ্ধি। ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও (অনিমা ইত্যাদি) ঐশ্বর্য্য বুদ্ধির সাত্ত্বিক রূপ। এই ধর্মাদির বিপরীত– অধর্ম, অজ্ঞান, অবৈরাগ্য ও অনৈশ্বর্য্যরূপ চারটি অস˜গুণ বুদ্ধির তামস রূপ।
‘অভিমানোহহঙ্কারস্তস্মাদদ্বিবিধঃ প্রবর্ত্ততে সর্গঃ।একাদশকশ্চ গণস্তন্মাত্রপঞ্চকশ্চৈব।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৪)অর্থাৎ : অন্তঃকরণের অভিমানাত্মক বৃত্তি অহঙ্কার। অহঙ্কার থেকে দুই প্রকার সৃষ্টি হয়– একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র।
‘বুদ্ধীন্দ্রিয়াণি চক্ষুঃশ্রোত্রঘ্রাণরসনত্বগাখ্যানি।বাক্পাণিপাদপায়ুপস্থানি কর্মেন্দ্রিয়াণ্যাহুঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৬)অর্থাৎ: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক্– এই পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে এবং বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ (যোনি)- এই পাঁচটিকে কর্মেন্দ্রিয় বলে।
‘সাত্ত্বিকঃ একাদশকঃ প্রবর্ত্ততে বৈকৃতাদহঙ্কারাৎ।ভূতাদেস্তন্মাত্রঃ স তামসস্তৈজসাদুভয়ম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৫)অর্থাৎ : বৈকৃত নামক সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে সাত্ত্বিক একাদশ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। ভূতাদি নামক তামস অহঙ্কার থেকে সেই তামসিক পাঁচটি তন্মাত্র উৎপন্ন হয়। তৈজস বা রাজস অহঙ্কার থেকে ইন্দ্রিয় ও তন্মাত্র উভয়েই উৎপন্ন হয়।
‘উভয়াত্মকমত্র মনঃ সংকল্পকমিন্দ্রিয়ঞ্চ সাধর্ম্ম্যাৎ।গুণপরিণামবিশেষান্নানাত্বং বাহ্যভেদাশ্চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৭)অর্থাৎ: মন উভায়ত্মক ও সঙ্কল্পাত্মক। ইন্দ্রিয়ের সমানধর্মবশত (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মত মনও সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে উৎপন্ন বলে) মনও ইন্দ্রিয়। গুণত্রয়ের পরিণামবিশেষহেতু ইন্দ্রিয় নানা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দাদি বাহ্য বিষয়গুলিও বহু।
‘শব্দাদিষু পঞ্চানামালোচনমাত্রমিষ্যতে বৃত্তিঃ।বচনাদানবিহরণোৎসর্গানন্দাশ্চ পঞ্চানাম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২৮)অর্থাৎ : শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ বিষয়ে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তি আলোচনজ্ঞান বা নির্বিকল্পক জ্ঞান মাত্র এবং বচন, আদান (গ্রহণ), বিহরণ (গমন), উৎসর্গ (মলাদিত্যাগ) ও আনন্দ (স্ত্রীসম্ভোগরূপ সন্তোষ) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের বৃত্তি– এটাই সাংখ্য স্বীকৃত।
‘তন্মাত্রাণ্যবিশেষাস্তেভ্যো ভূতানি পঞ্চ পঞ্চভ্যঃ।এতে স্মৃতা বিশেষাঃ শান্তা ঘোরাশ্চ মূঢ়াশ্চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৮)অর্থাৎ : (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ– এই পাঁচটি) তন্মাত্রকে অবিশেষ (বা সূক্ষ্ম ভূত) বলে। সেই পাঁচটি (তন্মাত্র) থেকে (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম– এই) পাঁচটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। এই পাঁচটি স্থূলভূত (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণাত্মক বলে এদের) সুখ, দুঃখ ও মোহ–স্বভাব বলা হয়।
‘সূক্ষ্মা মাতাপিতৃজাঃ সহ প্রভূতৈস্ত্রিধা বিশেষাঃ স্যুঃ।সূক্ষ্মাস্তেষাং নিয়তা মাতাপিতৃজা নিবর্ত্তন্তে।।’– (সাংখ্যকারিকা–৩৯)অর্থাৎ : বিশেষ তিন প্রকার (যথা-) সূক্ষ্মশরীর, মাতা–পিতা থেকে জাত স্থূলশরীর ও পাঁচটি মহাভূত। এদের মধ্যে সূক্ষ্মশরীর প্রলয়কাল পর্যন্ত (আপেক্ষিক) নিত্য, স্থূলশরীর (কিছুদিন থেকে) নষ্ট হয়।
‘রঙ্গস্য দর্শয়িত্বা নিবর্ত্ততে নর্ত্তকী যথা নৃত্যাৎ।পুরুষস্য তথাত্মানং প্রকাশ্য বিনিবর্ত্ততে প্রকৃতিঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৯)অর্থাৎ : নর্তকী যেমন দর্শকগণকে নৃত্য দেখিয়ে নৃত্য থেকে নিবৃত্ত হয়, প্রকৃতিও সেইরূপ পুরুষের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে (সৃষ্টি ব্যাপার থেকে) নিবৃত্ত হয়।
‘ঔৎসুক্যনিবৃত্ত্যর্থং যথা ক্রিয়াসু প্রবর্ত্ততে লোকঃ।পুরুষস্য বিমোক্ষার্থং প্রবর্ত্ততে তদ্বদব্যক্তম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫৮)অর্থাৎ : লোকে যেমন কৌতুহল বা আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়, তেমনি প্রকৃতিও পুরুষের মোক্ষের জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়।
‘অতিদূরাৎসামীপ্যাৎ ইন্দ্রিয়ঘাতাৎ মনোহনবস্থানাৎ।সৌক্ষ্ম্যাৎ ব্যবধানাৎ অভিভবাৎ সমানাভিহারাৎ চ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৭)অর্থাৎ : অতি দূরে অথবা অতি নিকটে থাকায়, ইন্দ্রিয় আহত হওয়ায়, মনোযোগের অভাবে, সূক্ষ্মতার জন্য, ব্যবধান বা আড়াল থাকায়, (উচ্চ শক্তি দ্বারা নিম্নশক্তি) অভিভূত হওয়ায় এবং সমান বস্তুতে মিশে যাওয়ায় সৎ বস্তুর অনুপলব্ধি হয় (অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বাধা প্রাপ্ত হয়)।
‘অসন্দিগ্ধারিপরীতানধিগতবিষয়া চিত্তবৃত্তিঃ। বোধশ্চ পৌরুষেয়ঃ ফলং প্রমা, তৎ সাধনং প্রমাণমিতি।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী : কারিকা–৪)অর্থাৎ : অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত, অনধিগত বিষয়ের আকারে আকারিত চিত্তবৃত্তিকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের পুরুষনিষ্ঠ বোধরূপ ফলই প্রমা। তার (প্রমার) সাধনই প্রমাণ।
‘দৃষ্টমনুমানমাপ্তবচনঞ্চ সর্ব্বপ্রমাণসিদ্ধত্বাৎ।ত্রিবিধং প্রমাণম্ ইষ্টং প্রমেয়সিদ্ধিঃ প্রমাণাদ্ধি।।’– (সাংখ্যকারিকা–৪)অর্থাৎ : (উপমান, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি ইত্যাদি) সকল প্রকার প্রমাণ দৃষ্ট, অনুমান ও আপ্তবচনের দ্বারা সিদ্ধ হওয়ায় সাংখ্যশাস্ত্রে কেবলমাত্র এই তিনপ্রকার প্রমাণ অভিলষিত, যেহেতু প্রমাণের দ্বারাই প্রমেয় সিদ্ধি হয়।
‘প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টং ত্রিবিধম্ অনুমানম্ আখ্যাতম্ ।তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্ব্বকম্ আপ্তশ্র“তিঃ আপ্তবচনম্ তু।।’– (সাংখ্যকারিকা–৫)অর্থাৎ : বিষয়ের সঙ্গে সন্নিকৃষ্ট ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান দৃষ্ট বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ। লিঙ্গ ও লিঙ্গী পূর্বক অনুমান তিন প্রকার (যথা– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট) বলা হয়। কিন্তু, (বেদবাক্য বা) ঋষিবাক্যই আপ্তবচন বা শব্দ প্রমাণ।
‘প্রতিবিষয়াধ্যবসায়ো দৃষ্টম্’–অর্থাৎ, বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত যে অধ্যবসায়, তাই প্রত্যক্ষজ্ঞান।
‘তল্লিঙ্গলিঙ্গিপূর্ব্বকম্’–অর্থাৎ, লিঙ্গ ও লিঙ্গি পূর্বক অনুমান।
‘সামান্যতস্তু দৃষ্টাৎ অতীন্দ্রিয়াণাং প্রতীতিরনুমানাৎ।তস্মাদপি চ অসিদ্ধং পরোক্ষম্ আপ্তাগমাৎ সিদ্ধম্ ।।’– (সাংখ্যকারিকা–৬)অর্থাৎ : সামান্যতোদৃষ্ট অনুমানের দ্বারা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অতীত (প্রকৃতি, পুরুষাদি) তত্ত্বের জ্ঞান হয়। সামান্যতোদৃষ্ট এবং শেষবৎ অনুমানের দ্বারা অতীন্দ্রিয় কোন তত্ত্ব অসিদ্ধ হলে সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আপ্তবচনরূপ আগম বা শব্দ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়।
‘এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা–৭০)অর্থাৎ: কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
‘তত্র পঞ্চশিখো নাম কাপিলেয়ো মহামুনিঃ।পরিধাবন্মহীং কৃৎস্নাং জগাম মিথিলামথ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৬)অর্থাৎ : সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন।.ঋষীণামাহুরেকং যং কামাদবসিতং নৃষু।শাশ্বতং সুখমত্যন্তমন্বিচ্ছন্তং সুদুর্ল্লভম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৮)অর্থাৎ : সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্য, অত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেন, তা সেকালের লোকেরা বলতো।.যমাহুঃ কপিলং সাংখ্যাঃ পরমর্ষিং প্রজাপতিম্ ।স মন্যে তেন রূপেণ বিস্মাপয়তি হি স্বয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/৯)অর্থাৎ : সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাঁকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেন; আমি মনে করি, স্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেন; তাও তখন কেউ কেউ বলতো।.তমাসীনং সমাগম্য কাপিলং মণ্ডলং মহৎ।পুরুষাবস্থমব্যক্তং পরমার্থং ন্যবেদয়ৎ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১১)অর্থাৎ : একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্ত, পরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন।.যত্তদেকাক্ষরং ব্রহ্ম নানারূপং প্রদৃশ্যতে।আসুরির্মণ্ডলে তস্মিন্ প্রতিপেদে তদব্যয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৩)অর্থাৎ : সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হন, সেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন।.এতন্মে ভগবানাহ কাপিলেয়স্য সম্ভবম্ ।তস্য তৎ কাপিলেয়ত্বং সর্ববিত্ত্বমনুত্তমম্ ।। (শান্তিপর্ব : ২১৫/১৬)অর্থাৎ : ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তাঁর কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।
‘সত্ত্বমাত্মা শরীরঞ্চ ত্রয়মেতাত্রিদণ্ডবৎ।লোকন্তিষ্ঠতি সংযোগাৎ তত্র সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্ ।।স পুমাং শ্চেতনং তচ্চ তচ্চাধিকরণং স্মৃতম্ ।বেদস্যাস্য তদর্থংহি বেদোহয়ং সম্প্রকাশিতঃ।। (চরক–সংহিতা : প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা–৬)অর্থাৎ : মন, আত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়া) প্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়, তেমনি মন, আত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফল, বিষয়বাসনা সুখ, দুঃখ, জ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতন, তিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।
‘তেষামিদন্তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যয়াদ্ব্যয়ম্ ।। (মনুসংহিতা : ১/১৯)অর্থাৎ : মহত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে; অবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মা) থেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে।.আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ।যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাব˜গুণঃ স্মৃতঃ।। (মনুসংহিতা : ১/২০)অর্থাৎ : আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পর–পর প্রত্যেকে পূর্ব–পূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়, সে ততগুলি গুণ পায়। –প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দ, স্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ।
‘সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।অর্থাৎ : সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী–বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্–যজুঃ–সামবেদাত্মক বেদ–বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ