শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী কয়জন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

30 June, 2020

শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী কয়জন


শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী কয়জন
শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী কয়জন

তথাকথিত নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধারকৃত শ্রীকৃষ্ণের ১৬,১০০ স্ত্রী : ইতিহাস, না কল্পকাহিনী ? শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহ সম্পর্কে প্রচলিত গল্প এই যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রধান মহিষী বা স্ত্রী ছিলো ৮ জন এবং আসামের রাজা নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধার করা স্ত্রীর সংখ্যা ছিলো ১৬,১০০ জন; সব মিলিয়ে শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা ১৬,১০৮।

এই কথা শুনেলই তো প্রথমত যেকোনো হিন্দুর মাথা হেট হয়ে যায়, হিন্দু ধর্মের প্রধান পুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে তাদের আর কোনো গর্ব করার জায়গা থাকে না। আর এই তথ্যকে সামনে এনে মুসলমানরাও যুক্তি দেখায় যে, কৃষ্ণ যদি ১৬ হাজার বিয়ে করতে পারে, তাহলে আমরা চারটা বিয়ে করতে পারবো না কেনো ? আর প্রকৃত তথ্য না জেনে, এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বা শ্রীকৃষ্ণের বহু বিবাহের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে আমরা হিন্দুরাও নানা রকম ন্যায় ও যুক্তি সঙ্গত গল্পের অবতারণা করার চেষ্টা করে থাকি, বাস্তবে যার কোনো প্রয়োজনই নেই; কারণ, শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী ছিলো মাত্র এক জন, সে রুক্মিনী। অপর ১৬,১০৭ জন সম্পর্কে যে গল্প, তা যে ডাহা মিথ্যা, তা এই পোস্ট পড়ার পর বুঝতে পারবেন।
বিষ্ণু পুরাণের ৪ অংশের ১৫ নং অধ্যায়ের ১৯ নং শ্লোকে আছে,
“ভগবতোহপ্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য। ষোড়শসহস্রাষণ্যেকোত্তরশতা ধিকানি স্ত্রীণামভবন।।
এর সরল অর্থ শ্রীকৃষ্ণের ষোলহাজার একশত স্ত্রী।
কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের ৫ অংশের ২৮ নং অধ্যায়ে বলা আছে,
“অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ”
“ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।”
এই দুই শ্লোকের অর্থ হলো কৃষ্ণের মোট স্ত্রীর সংখ্যা ষোল হাজার সাত জন।
এর মধ্যে ষোল হাজার বা ষোল হাজার একশ জন হলো হলো কথিত নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধারকৃত নারী। এই কাহিনীর সূত্রপাত বিষ্ণুপুরাণে এবং তারপর তার বিস্তৃতি ভাগবত পুরাণে। না বুঝে পুরাণকে যেহেতু আমরা হিন্দুরা- বেদ, গীতার পরেই স্থান দিয়ে এসেছি, সেহেতু পুরাণে উল্লিখিত এই সব ঘটনাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের হিন্দুদের ছিলো না, আর পুরাণের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো জ্ঞানী লোকও খুব কম ছিলো, তাই এই ঘটনাগুলো ডালপালা মেলে কৃষ্ণ চরিত্রকে হাজার হাজার বছর ধরে কলুষিত করেছে এবং হিন্দু সমাজ ধ্বংসের কারণ হয়েছে।
মূল আলোচনার পূর্বে ভাগবত পুরাণ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, তাহলে বুঝতে পারবেন যে ভাগবত পুরাণ কী জিনিস, আর এই ভাগবত পুরাণের উদ্দেশ্যটা কী ?
বাংলায় দুই ধরণের ভাগবত পুরাণ পাওয়া যায়, একটা হলো সুবোধচন্দ্রের ভাগবত, অন্যটা বেনী মাধব শীলের ভাগবত। দুই ভাগবতের কাহিনী মোটামুটি একই। কিন্তু সুবোধ চন্দ্রের ভাগবতে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে এমন অশ্লীল যে, তা কাউকে পড়ে শোনানো যায় না এবং নিজে পড়লেও সেক্স স্টোরি পড়ার ফিলিংস পাওয়া যায়।
সুবোধ চন্দ্রের ভাগবতে কৃষ্ণের রাসলীলা একটা সেক্স পার্টি, যেখানে নয় লক্ষ পুরুষ এবং নয় লক্ষ নারী নগ্ন হয়ে একত্রে কামলীলায় মেতে উঠে। এর মধ্যে কৃষ্ণও আছে। কিন্তু কোথাও এই কথা বলা নেই যে, রাসলীলার সময় কৃষ্ণের বয়স ছিলো মাত্র ৮, তাই তার পক্ষে ঐ ধরণের যৌনলীলায় অংশ গ্রহন করা সম্ভবই ছিলো না। আর বস্ত্রহরণ পর্বে কৃষ্ণ তো একটা মহা লম্পট, যার উদ্দেশ্যই মনে হবে মেয়েদের নগ্ন শরীর দেখা। এমনভাবে বর্ণনা করে সুবোধের ভাগবত পুরাণ লেখা। আমি ভেবে অবাক হই যে, শত শত নয়, হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুরা এসব গো গ্রাসে গিলে আসছে, আর কেউ এর প্রতিবাদ করে বলে নি যে, না, কৃষ্ণ চরিত্র এমন হতেই পারে না; এমন কি কেউ এমন প্রশ্নও তুলে নি যে, ৭/৮ বছর বয়সী একজন বালকের পক্ষে এই রকম যৌন সম্পর্কিত ব্যাপারে জড়ানো কিভাবে সম্ভব ? এর বিপরীতে সবাই সরল বিশ্বাসে ভাগবত পুরাণের কাহিনীকে বিশ্বাস করে এসেছে এবং হিন্দু সমাজকে দিনের পর দিন রসাতলে নিয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, সুবোধের ভাগবত এবং বেণীমাধবের ভাগবতের কাহিনী প্রায় সেম। কিন্তু বেণী মাধবের ভাগবতের বর্ণনায়, সুবোধের ভাগবতের তুলনায় অশ্লীলতা কিছুটা কম। কিন্তু রাসলীলা এবং বস্ত্রহরণের ঘটনা একই, উভয়ক্ষেত্রেই কৃষ্ণ যৌনতার জ্বরে আক্রান্ত। তার মানে প্রকৃত সত্য উভয় ভাগবতেই অনুপস্থিত এবং উভয় ভাগবতের উদ্দেশ্যই হলো কৃষ্ণ চরিত্রকে কলুষিত করা। গোপীদের কাপড় চুরির তথাকথিত ঘটনার সময় কৃষ্ণের বয়স যে মাত্র ৭ এবং রাসলীলা সময় তার বয়স মাত্র ৮, এমন তথ্যকে আড়াল করে উভয় ভাগবতেই কৃষ্ণকে পূর্ণ যুবক হিসেবে দেখানো হয়েছে, ফলে এই ভাগবতগুলো পড়ে হিন্দুরা প্রকৃত সত্যকে জানতে পারে না, এইদিক থেকে বিবেচনা করলে ভাগবতের প্রায় সমস্ত কাহিনী মিথ্যা বা মিথ্যার আড়ালে সত্যকে গোপন করা।
এমন ভাগবতকে আমরা হিন্দুরা ধর্ম পুস্তক জ্ঞান করে পূজা করে আসছি, হিন্দু ধর্ম ও সমাজের পতন কি আর এমনি এমনি ?
যা হোক, কৃষ্ণের ষোল হাজার একশ স্ত্রীর কাহিনী এই সব ভাগবতের মাধ্যমেই লোক সমাজে প্রচারিত, যে ভাগবতের উদ্দেশ্য হলো কৃষ্ণ চরিত্রকে মহান করে তোলা নয়, তাকে ছোট করা; আর যারা ভাগবতকে ধর্ম পুস্তক মনে করে তাদের পক্ষে এসব ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনো উপায়ও থাকে না। কিন্তু হিন্দু ধর্ম বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পড়ে, কৃষ্ণের তথাকথিত সেই ষোল হাজার একশ স্ত্রীর ঘটনাকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য আমরা নানারকম ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করে যুক্তি দিই, সত্য কথা বলতে কি, প্রকৃত সত্যকে না জেনে এই ধরণের যুক্তি আমার আগের পোস্টগুলোতে আমিইও দেবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রকৃত সত্য জানলে এই ধরণের কোনো যুক্তি দেবার প্রয়োজন ই পড়বে না, সেই সত্যই আজ তুলে ধরবে আপনাদের সম্মুখে।
নরকাসুরের জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে বিভিন্ন পুরাণে বলা হয়েছে,
বিষ্ণু যখন বরাহ অবতার রূপ ধারণ করে জলমগ্ন পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন, তখন পৃথিবী ও বরাহের সংস্পর্শে নরকাসুরের জন্ম, এই সূত্রে পৃথিবী মানে Earth হলো নরকের মা। এখন বলেন, বাস্তবে এটা কি সম্ভব ? পৃথিবী কি মানুষ, যে সে সরাসরি কোনো মানব সন্তানের জন্ম দেবে ? নরকাসুরের জন্মের এই অবাস্তব কাহিনীই বলে দেয় যে, নরকের ঘটনা সম্পূর্ণ বানানো, বাস্তবে কোনো দিন নরকাসুর ছিলোই না, তাই তার ১৬,১০০ মেয়েকে বন্দী করে রাখা, কৃষ্ণের গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে আনা এবং বিয়ে করা সম্পূর্ণই কাল্পনিক। তাছাড়াও যদি ধরে নিই যে, বরাহ অবতার ও পৃথিবীর সংস্পর্শে কোনোভাবে নরকাসুরের জন্ম হয়েছিলো, তাহলেও কি কৃষ্ণের সময় পর্যন্ত নরকের বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো ? বরাহ অবতার বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার রূপ ধারণের ঘটনা, যেটা ঘটেছিলো সত্য যুগে, আর কৃষ্ণ, বিষ্ণুর নবম অবতার, এই দীর্ঘ সময় কি নরকাসুর জীবিত থেকে রাজত্ব করে যাচ্ছিলো ?
তবে নরকাসুরের ঘটনা পুরানে আছে এবং সে যে মহাদেবের বর লাভের পর ষোল হাজার মেয়েকে বন্দী করে রেখে তাদেরকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিলো, সে কথাও বলা আছে; এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষ্ণ যদি নরকাসুরকে না মারে, তাহলে মারলো কে ?
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বোঝা দরকার যে, কৃষ্ণ হলো ঐতিহাসিক চরিত্র আর নরকাসুর হলো পৌরাণিক চরিত্র; পৌরাণিক চরিত্র মানেই কাল্পনিক, আর পৌরাণিক কাহিনীগুলো বানানো শুধুমাত্র লোক শিক্ষার জন্য। সুতরাং কাল্পনিক চরিত্রের সাথে বাস্তব চরিত্রের দেখা সাক্ষাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। পৌরাণিক চরিত্রের বিনাশ পৌরাণিক চরিত্র দিয়েই করতে হয়, তাই পৌরাণিক কাহিনী মতে, শিব, নরকাসুরকে হত্যা করে। সুতরাং নরকাসুরের কাহিনীর সাথে কৃষ্ণের কোনো সংযোগই নেই, তাই কাল্পনিক নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধার হওয়া ষোলহাজার নারীও কাল্পনিক।
আর একটা ঐতিহাসিক তথ্য এখানে জেনে রাখেন, কৃষ্ণের সময় নরকাসুরের রাজত্ব বলে যা বলা হয়, সেই প্রাগজ্যোতিষপুর বা বর্তমানের আসামের রাজা ছিলো ভগদত্ত নামের এক ব্যক্তি, যে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো এবং অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করে মারা যায়।
কৃষ্ণের জীবনে যে এই ধরণের কোনো ঘটনা, কখনোই ঘটে নি, তার আরেকটা প্রমাণ হলো- মহাভারতে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই, যেমন উল্লেখ নেই রাধার। যদি কৃষ্ণ এই ধরণের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতো, তাহলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়, সেখানে উপস্থিত শিশুপাল, যে ছিলো কৃষ্ণের প্রধান শত্রু ও সমালোচক, সে কৃষ্ণ নিন্দার সময় এই ষোলহাজার একশ মেয়ের ঘটনার কথা অবশ্যই উল্লেখ করতো, কিন্তু শিশুপালও তা উল্লেখ করে নি, যেমন শিশুপাল উল্লেখ করে নি রাধার কথা। কারণ, কৃষ্ণের জীবনে রাধা বলে যেমন কেউ ছিলো না, তেমনি তার জীবনে ষোল হাজার একশ মেয়েকে উদ্ধার ও বিয়ে করার ঘটনাও ঘটে নি।
এপ্রসঙ্গে এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়, স্টার জলসায় প্রচারিত মহাভারতে কিন্তু শিশুপাল- রাধা ও নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের কথা বলেছে, এই সিরিয়াল দেখে এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, এগুলো সত্য। স্টার পরিবার, কৃষ্ণ সম্পর্কিত প্রচলিত মিথগুলোকেই তুলে এনেছে, তারা কোনো কিছু বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দর্শক হারাতে চায় নি। তাই স্টার জলসার মহাভারত, প্রকৃত মহাভারতের হুবহু নির্মান নয়, অনুষ্ঠানকে জাঁকজমক করার জন্য তারা শুধু প্রচলিত গল্পকেই প্রাধান্য দেয় নি, নানা রকম স্বাধীনতা নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনার কথা বলতে পারি, মূল মহাভারতে রুক্মিণীকে বিয়ে করার জন্য কৃ্ষ্ণ একাই যায়, পিছনে কিছু যাদব বাহিনী ছিলো, কিন্তু স্টার জলসার মহাভারতে এখানে অর্জুনের একটা ভূমিকা দেখানো হয়েছে, যা সত্য নয়। এই একই কথা প্রযোজ্য স্টার জলসায় প্রচারিত ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে, এরাও কৃষ্ণ সম্পর্কে প্রচলিত ঘটনাগুলোকেই তুলে ধরেছে, গবেষণা করে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরার ইচ্ছা এদের নেই, তাই এখানে যেমন রাধাকে দেখতে পেয়েছেন, তেমনি, কৃষ্ণের বহুবিবাহকেও দেখেছেন। কিন্তু এগুলোকে বিশ্বাস করে ঠকবেন না বলেই আশা করছি।
যা হোক, অনেকে, কৃষ্ণের এই ষোল হাজার একশ মেয়েকে উদ্ধার সম্পর্কিত কিছু ভৌগোলিক ঘটনার কথা বলতে পারে, যেমন একটি জায়গার নাম আছে অশ্বক্লান্ত, বলা হয়, কৃষ্ণ, মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে ফেরার সময় সেই জায়গায় তার রথের ঘোড়ারা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েছিলো, এই ভাবে সেই জায়গার নাম হয় অশ্বক্লান্ত।
আসলে পুরাণে লেখা কাহিনীর প্রভাবে এই নামকরণগুলো ঘটেছে এবং এই ভাবে নামকরণ অসম্ভব কিছু নয়, যেখানে পুরাণ লিখিত হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে। এইসব পুরাণের প্রভাবে যেখানে হিন্দুদের চিন্তাধারাই বদলে গেছে, তারা কাল্পনিক ঘটনাকে সত্য বলে মনে করেছে, সেখানে পুরাণে লেখা কাহিনীর প্রভাবে কোনো এক জায়গার নামকরণ হওয়া, এ আর অসম্ভব কী ?
কৃষ্ণের এই ষোলহাজার বিয়ে সংক্রান্ত বিষ্ণুপুরাণের আরেকটি আজগুবি তথ্য, যা আমরা বিশ্বাস করে এসেছি, তা হলো কৃষ্ণের ছিলো ১ লক্ষ ৮০ হাজার পুত্র। আবার এও বলা হয় কৃষ্ণের প্রত্যেক স্ত্রীর ছিলো ১০টি করে পুত্র, একটি করে কন্যা; এই সূত্রে কৃষ্ণের পুত্র কন্যা হওয়া সম্ভব ১,৭৭,১৮৮ জন। পুরাণ রচয়িতাদের মাথা যে ঠিক ছিলো না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত; কারণ, তারা কৃষ্ণের প্রধান স্ত্রী ৮ জন বললেও, নাম দিয়েছে ২১ জনের, এই সূত্রে আবার কৃষ্ণের সন্তান সংখ্যা হয় ১,৭৭,৩৩১ জন। কৃষ্ণ জীবিত ছিলেন ১২৫ বছর, ২৯ বছর বয়সে সে রুক্মিনীকে বিয়ে করে, এর পর থেকে যদি তার সন্তান জন্মানো শুরু করে তাহলে সে সন্তান জন্ম দিয়েছে ৯৫ বছর ধরে, বাস্তবে যেটা অসম্ভব, তারপরও তর্কের খাতিরে সেটাকে সম্ভব বলে ধরে নিলে প্রতিবছর কৃষ্ণ জন্ম দিতো ১৮৬৬ জন সন্তানের, এভাবে প্রতিদিন জন্ম হতো ৫ জনেরও বেশি সন্তানের। এটা কি কখনো সম্ভব ?
প্রকৃত সত্যকে না জেনে বা বোঝার চেষ্টা না করে আমরা কৃষ্ণের ষোল হাজার স্ত্রীকে স্বীকার করে নিয়ে বলি, তারা ছিলো লক্ষ্মীর অংশ বা অবতার এবং কৃষ্ণ একই সাথে সব স্ত্রীর কাছে থাকতে পারতো, তাকে পালা করে কোনো স্ত্রীর কাছে থাকতো হতো না। এভাবে হয়তো কৃষ্ণের পক্ষে থাকা অবশ্যই সম্ভব এবং এভাবে সব স্ত্রীর কাছে প্রতি রাতে থাকলে এক জীবনে অবশ্যই এতগুলো সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কৃষ্ণের এতগুলো সন্তান এবং স্ত্রীর কেউ কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নেই কেনো ? তারা বাস্তবে থাকলে তাদের অস্তিত্বের কোনো প্রমান কি কোথাও থাকতো না ?
উইকিপিডিয়া তো কৃষ্ণের তথাকথিত প্রধান ৮ স্ত্রী এবং তাদের ছেলে মেয়েদের নামও লিখে রেখেছে। এই তালিকায়, অন্য সাত স্ত্রীর সন্তানদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম, কৃষ্ণ ও রুক্মিনীর ছেলে প্রদুম্ন ছাড়াও অন্য ১০ জনের নাম আছে। তাহলে প্রদুম্ন ছাড়া অন্য কোনো পুত্রের নাম বা তার কাজের কোনো কিছুর উল্লেখ শুধু মহাভারতেই নয়, অন্য কোনো পুরাণেও উল্লেখ নেই কেনো ? রুক্মিনীর যদি ১০ পুত্র থাকে, তাহলে তো প্রদুম্নের মতো তাদেরও সমান গুরুত্ব কৃষ্ণের কাছে থাকা উচিত ছিলো। অথচ কৃষ্ণ বলেছে শুধু প্রদুম্নের কথা, কারণটা কী ? কারণটা হলো কৃষ্ণের পুত্র ছিলো একজনই সেটা প্রদুম্ন, আর প্রদুম্নের মা রুক্মিনীই ছিলো কৃষ্ণের একমাত্র স্ত্রী।
কৃষ্ণের স্ত্রী সম্পর্কে উইকিপিডিয়া, যার তথ্য পৃথিবীর কোটি কোটি লোক বিশ্বাস করে, তার দ্বিচারিতার ব্যাপারটা এবার একটু লক্ষ্য করুন :
একটু আগেই বলেছি, কৃষ্ণের প্রধান ৮ স্ত্রী এবং তাদের প্রত্যকের ১০ টি পুত্র এবং একটি করে কন্যার কথা উইকিপিডিয়া তাদের সাইটে লিখে রেখেছে, সেই সাথে আরও যা যা লিখে রেখেছে দেখুন,
“কৃষ্ণ বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা রুক্মিণীকে তাঁর অনুরোধে শিশুপালের সাথে অনুষ্ঠেয় বিবাহ মণ্ডপ থেকে হরণ করে নিয়ে এসে বিবাহ করেন। এরপরই কৃষ্ণ ১৬১০০ নারীকে নরকাসুর নামক অসুরের কারাগার থেকে উদ্ধার করে তাদের সম্মান রক্ষার্থে তাদের বিবাহ করেন।[৫৩][৫৪] কৃষ্ণের মহিষীদের মধ্যে আটজন ছিলেন প্রধান, যাদের অষ্টভার্যা নামেও অভিহিত করা হয়। এঁরা হলেন রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দি, মিত্রবৃন্দা, নগ্নাজিতি, ভদ্রা এবং লক্ষণা।[৫৫][৫৬][৫৭] কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে সমস্ত বন্দী নারীদের মুক্ত করেন। তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুসারে বন্দী নারীদের সমাজে কোন সম্মান ছিল না এবং তাদের বিবাহের কোন উপায় ছিল না কারণ তারা ইতিপূর্বে নরকাসুরের অধীনে ছিল।… শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০০ অধিক পত্নী ও অষ্টভার্যা সম্পর্কে সঠিক ভিত্তি নেই ৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর রচিত কৃষ্ণচরিত্র প্রবন্ধে শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহের ভিত্তিহীন তথ্য সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দেওয়া আছে ৷ কৃষ্ণচরিত্রে দেখা যায় যে, কৃষ্ণের ১৬০০০ অধিক পত্নী শুধু পুরাণের একটি অংশে সীমাবদ্ধ ৷ শ্রীকৃষ্ণের জীবনের অন্য কোনো কার্যক্ষেত্রে এসবের উল্লেখ নেই ৷ তিনি এটাকে নেহাতই উপকথা বা গল্প বলে উল্লেখ করেন ৷ শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিতে রুক্মিনী ভিন্ন অন্য কোনো পত্নীর কার্যক্রম দেখা যায় না।”
-উইকিপিডিয়া একবার কৃষ্ণের তথাকথিকত সর্বমোট ১৬,১০৮ স্ত্রীর কথা ঘটা করে বলছে, পরে আবার বলছে, “শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০০ অধিক পত্নী ও অষ্টভার্যা সম্পর্কে সঠিক ভিত্তি নেই।”
আবার এও বলেছে,
“বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর রচিত কৃষ্ণচরিত্র প্রবন্ধে শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহের ভিত্তিহীন তথ্য সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দেওয়া আছে ৷ কৃষ্ণচরিত্রে দেখা যায় যে, কৃষ্ণের ১৬০০০ অধিক পত্নী শুধু পুরাণের একটি অংশে সীমাবদ্ধ ৷ শ্রীকৃষ্ণের জীবনের অন্য কোনো কার্যক্ষেত্রে এসবের উল্লেখ নেই।”
মানুষ আশা এবং বিশ্বাস করে, উইকি যখন কিছু লিখবে, তখন গবেষণা করে সত্য কথাটাই লিখবে, কিন্তু তারাই যদি এইভাবে দুরকম কথা বলে, মানুষ কিসের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবে বা সত্য জানবে ? মিথ্যা দিয়ে সত্যকে যতই আড়াল করার চেষ্টা হোক না কেনো, সত্য কোনো না কোনো দিক দিয়ে উঁকি মারবেই, এভাবেই হয়তো কৃষ্ণের স্ত্রী সম্পর্কে সত্য উঁকি দিয়েছে উইকির এই তথ্যে যে, “শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০০ অধিক পত্নী ও অষ্টভার্যা সম্পর্কে সঠিক ভিত্তি নেই।”
ভিত্তি থাকবে কিভাবে ? ঘটনা সত্য হলেই তো তার ভিত্তি থাকবে। ঘটনা মিথ্যা বলেই তো তার কোনো ভিত্তি নেই এবং এভাবে হাজারো মিথ্যার আড়ালে প্রকৃত সত্য সন্ধানীদের জন্য উইকির পেজে উঁকি দিচ্ছে একটি সত্য যে,
“শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০০ এর অধিক পত্নী ও অষ্টভার্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো ভিত্তি নেই।”
তার মানে এই ব্যাপারগুলো পুরোটাই মিথ্যা। কারণ, কৃষ্ণের স্ত্রী ছিলেন একজনই, সে রুক্মিণী এবং রুক্মিণীর ১০টি নয়, পুত্র ছিলো একটি ই সে প্রদুম্ন, আর প্রদুম্নের পুত্র পুরাণে উল্লিখিত বীর অনিরুদ্ধ।
যার অস্তিত্ব থাকে, সে এভাবেই তার অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে যায়, কৃষ্ণের সব স্ত্রী ও পুত্রের কথা না হয় বাদ ই দিলাম, পুরাণ বা উইকি যে বলেছে, রুক্মিনী ও কৃষ্ণের আরো ১০ পুত্র ছিলো, তারা কে কোথায় ? কোথাও তাদের কোনো কথা নেই কেনো ? যে প্রশ্নটা আগেও করেছি। এদের উল্লেখ নেই, এই কারণে যে প্রদুম্ন ভিন্ন কৃষ্ণের কোনো পুত্রই ছিলো না। আর অন্য কোনো পুত্র না থাকাটা এটা প্রমান করে যে, প্রদুম্নের মা রুক্মিনী ছাড়া কৃষ্ণের অন্য কোনো স্ত্রীই ছিলো না।
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহ নিয়ে যে প্রচলিত গল্প, তা যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বানোয়াট, আশা করছি তা আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।

শ্রী কৃষ্ণের বহুবিবাহ একটি ভ্রান্ত ধারণা

কৃষ্ণ রুক্মিণীকে পূর্বে বিবাহ করিয়াছিলেন, এক্ষণে এক  সম্যন্তক মণির প্রভাবে আর দুটি ভার্যা জাম্ববতী এবং সত্যভামা, লাভ করিলেন। ইহাই বিষ্ণুপুরাণ লেন, হরিবংশ এক পৈঠা উপর গিয়া থাকেন,—তিনি বলেন, দুইটি না, চারিটি। সত্রাজিতের তিনটি কন্যা ছিল,—সত্যভামা, প্রস্বাপিনী এবং ব্রতিনী। তিনটিই তিনি শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলেন। কিন্তু দুই চারিটায় কিছু আসিয়া যায় না—মোট সংখ্যা নাকি ষোল হাজারের উপর। এইরূপ লোকপ্রবাদ।

বিষ্ণুপুরাণে ৪ অংশে আছে, “ভগবতোহ'প্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য ষোড়শসহস্রাণ্যেকোত্তরশতা—ধিকানি স্ত্রীণামভবন্।”- বিষ্ণুপুরাণ, ৪ অং, ১৫ অ, ১৯।
  কৃষ্ণের ষোল হাজার এক শত এক স্ত্রী।
 কিন্তু ঐ পুরাণের ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে প্রধানাদিগের নাম করিয়া পুরাণকার বলিতেছেন, রুক্মিণী ভিন্ন “অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ।” তার পর, “ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।” তাহা হইলে, দাঁড়াইল ষোল হাজার সাত জন। ইহার মধ্যে ষোল হাজার নরককন্যা। সেই আষাঢ়ে গল্প বলিয়া আমি ইতিপূর্বেই বাদ দিয়াছি।
গল্পটা কত বড় আষাঢ়ে, আর এক রকম করিয়া বুঝাই। বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশের ঐ পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যে, এই সকল স্ত্রীর গর্ভে কৃষ্ণের এক লক্ষ আশী হাজার পুত্র জন্মে। বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ এক শত পঁচিশ বৎসর ভূতলে ছিলেন। হিসাব করিলে, কৃষ্ণের বৎসরে ১৪৪০টি পুত্র, ও প্রতিদিন চারিটি পুত্র জন্মিত। এ স্থলে এইরূপ কল্পনা করিতে হয় যে, কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছায় কৃষ্ণমহিষীরা পুত্রবতী হইতেন।
এই নরকাসুরের ষোল হাজার কন্যার আষাঢ়ে গল্প ছাড়িয়া দিই কিন্তু তদ্ভিন্ন আট জন “প্রধানা” মহিষীর কথা পাওয়া যাইতেছে। এক জন রুক্মিণী।বিষ্ণুপুরাণকার বলিয়াছেন, আর সাত জন। কিন্তু ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে নাম দিতেছেন আট জনের, যথা—

“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||”

১।
কালিন্দী
৫।রোহিণী (ইনি কামরূপিণী)
২।মিত্রবিন্দা
৬।মদ্ররাজসুতা সুশীলা
৩।নগ্নজিৎকন্যা সত্যা
৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪।জাম্ববতী
৮।লক্ষ্মণা

রুক্মিণী লইয়া নয় জন হইল। আবার ৩২ অধ্যায়ে আর এক প্রকার। কৃষ্ণের পুত্রগণের নামকীর্তন হইতেছে:—
প্রদ্যুম্নাদা হরেঃ পুত্রা রুক্মিণ্যাঃ কথিতাস্তব।
ভানুং ভৈমরিকঞ্চৈব সত্যাভামা ব্যজায়ত || ১||
দীপ্তিমান্ তাম্রপক্ষাদ্যা রোহিণ্যাং তনয়া হরেঃ।
বভূবুর্জাম্বুবত্যাঞ্চ শাম্বাদ্যা বাহুশালিনঃ || ২||
তনয়া ভদ্রবিন্দাদ্যা নাগ্নজিত্যাং মহাবলাঃ।
সংগ্রামজিৎপ্রধানাস্তু শৈব্যায়াস্ত্বভবন্ সুতাঃ || ৩||
বৃকদ্যাস্তু সুতা মাদ্র্যাং গাত্রবৎপ্রমুখান্ সুতান্।
অবাপ লক্ষ্মণা পুত্রাঃ কালিন্দ্যাঞ্চ শ্রুতাদয়ঃ || ৪||
এই তালিকায় পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
১।সত্যভামা (৭)
৫।শৈব্যা (২)
২।রোহিণী (৫)
৬।মাদ্রী (৬)
৩।জাম্ববতী (৪)
৭।লক্ষ্মণা (৮)
৪।নাগ্নজিতী (৩)
৮।কালিন্দী (১)
কিন্তু ৪র্থ অংশের ‍১৫ অধ্যায়ে আছে, “তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী-জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।” এখানে আবার সব নাম পাওয়া গেল না, নূতন নাম “জালহাসিনী” একটা পাওয়া গেল। এই গেল বিষ্ণুপুরাণে। হরিবংশে আরও গোলযোগ।

হরিবংশে আছে;—
মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ ||
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||
               ১১৮ অধ্যায়ে, ৪০-৪৩ শ্লোকঃ।
এখানে পাওয়া যাইতেছে যে, লক্ষ্মণাই জালহাসিনী। তাহা ধরিয়াও পাই,—
১।কালিন্দী

৫।রোহিণী
২।মিত্রবিন্দী

৬।মাদ্রী সুশীলা
৩।সত্যা

৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪। জাম্ববৎ-সুতা

৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা


৯)শৈব্যা


ক্রমেই শ্রীবৃদ্ধি-রুক্মিণী ছাড়া নয় জন হইল। এ গেল ১১৮ অধ্যায়ের তালিকা। হরিবংশে আবার ১৬২ অধ্যায়ে আর একটি তালিকা আছে, যথা—
অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী ||
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী    *    *    *
ইহাতে পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
(১)সত্যভামা

(৬)মিত্রবিন্দা
(২)নাগ্নজিতী

(৭)কালিন্দী
(৩)সুদত্তা

(৮)জাম্ববতী
(৪)শৈব্যা

(৯)পৌরবী
(৫)লক্ষ্মণা জালহাসিনী

(১০)সুভীমা


(১১)মাদ্রী

হরিবংশকার ঋষি ঠাকুর, আট জন বলিয়া রুক্মিণী সমেত বার জনের নাম দিলেন। তাহাতেও ক্ষান্ত নহেন। ইহাদের একে একে সন্তানগণের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন আবার বাহির হইল—
(১২)সুদেবা।

(১৪)কৌশিকী
(১৩)উপাসঙ্গ

(১৫)সুতসোমা


(১৬)যৌধিষ্ঠিরী। (
ইঁহারাও প্রধানা অষ্টের ভিতর গণিত হইয়াছেন। ‘তাসামপত্যান্যষ্টানাং ভগবন্ প্রব্রবীতে মে।’ ইহার উত্তরে এ সকল মহিষীর অপত্য কথিত হইতেছে।)


এছাড়া পূর্বে সত্রাজিতের আর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীর কথা বলিয়াছেন।

এ ছাড়া মহাভারতের নূতন দুইটি নাম পাওয়া যায়—গান্ধারী ও হৈমবতী। 
             রুক্মিণী ত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
          দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্ ||
                     মৌসলপর্ব, ৭ অধ্যায়।

সকল নামগুলি একত্র করিলে, প্রধানা মহিষী কতকগুলি হয় দেখা যাউক। মহাভারতে আছে,—
(১)রুক্মিণী
(৪)শৈব্যা
(২)সত্যভামা
(৫)হৈমবতী
(৩)গান্ধারী
(৬)জাম্ববতী
মহাভারতে আর নাম নাই, কিন্তু “অন্যা” শব্দটা আছে। তার পর বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে ১, ২, ৩, ছাড়া এই কয়েকটা নামও পাওয়া যায়।
(৭)কালিন্দী
(১০)রোহিণী
(৮)মিত্রবিন্দা
(১১)মাদ্রী
(৯)সত্যা নাগ্নজিতী
(১২)লক্ষ্মাণা জালহাসিনী
বিষ্ণুপুরাণের ৩২ অধ্যায়ে তদতিরিক্ত পাওয়া যায়, শৈব্যা। তাঁহার নাম উপরে লেখা আছে। তার পর হরিবংশের প্রথম তালিকা ১১৮ অধ্যায়ে, ইহা ছাড়া নূতন নাম নাই, কিন্তু ১৬২ অধ্যায়ে নূতন পাওয়া যায়।
(১৩)কালিন্দী

(১৪)রোহিণী


 (১৫)সভীমা

এবং ঐ অধ্যায়ে সন্তানগণনায় পাই,
(১৬)সুদেবা(১৮) কৌশিকী(২০)যৌধিষ্ঠিরী
(১৭)উপাসঙ্গ (১৯)সুতসোমা

এবং সত্যভামার বিবাহকালে কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা,
(২১)ব্রতনী।  
(২২)প্রস্বাপিনী।


আট জনের জায়গায় ২২ জন পাওয়া গেল।

উপন্যাসকারদিগের খুব হাত চলিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট। ইহার মধ্যে ১৩ হইতে ২২ কেবল হরিবংশে আছে। এই জন্য ঐ ১০ জনকে ত্যাগ করা যাইতে পারে। তবু থাকে ১২ জন। গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম মহাভারতের মৌসলপর্ব ভিন্ন আর কোথাও পাওয়া যায় না। মৌসলপর্ব যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাহা পরে দেখাইব। এজন্য এই দুই নামও পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। বাকি থাকে ১০ জন।

জাম্ববতীর নাম বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,—
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।”
হরিবংশে এইরূপ,—
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।”

ইহার অর্থে যদি বুঝা যায়, জাম্ববৎসুতাই রোহিণী, তাহা হইলে অর্থ অসঙ্গত হয় না, এবং সেই অর্থই সঙ্গত বোধ হয়। অতএব জাম্ববতী ও রোহিণী একই। বাকি থাকিল ৮ জন।
সত্যভামা ও সত্যাও এক। তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেছি।
সত্রাজিতবধের কথার উত্তরে
“কৃষ্ণঃ সত্যভামামমর্ষতাম্রলোচনঃ প্রাহ, সত্যে, মমৈষাবহাসনা।”
অর্থাৎ কৃষ্ণ ক্রোধারক্ত লোচনে সত্যভামাকে বলিলেন, “সত্যে! ইহা আমারই অবহাসনা।

পুনশ্চ পঞ্চমাংশের ৩০ অধ্যায়ে, পারিজাতহরণে কৃষ্ণ সত্যভামাকে বলিতেছেন,—
“সত্যে! যথা ত্বমিত্যুক্তং ত্বয়া কৃষ্ণাসকৃৎপ্রিয়ম্।”
আবশ্যক হইলে, আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা যথেষ্ট।

অতএব এই দশ জনের মধ্যে, সত্যা সত্যভামারই নাম বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন আট জন পাই। যথা—
১।রুক্মিণী
৫।কালিন্দী
২।সত্যভামা
৬।মিত্রবিন্দা
৩।জাম্ববতী
৭।মাদ্রী
৪।শৈব্যা
৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা
ইহার মধ্যে পাঁচ জন—শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, লক্ষ্মণা ও মাদ্রী সুশীলা—ইঁহারা তালিকার মধ্যে আছেন মাত্র। ইঁহাদের কখনও কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই না। ইঁহাদের কবে বিবাহ হইল, কেন বিবাহ হইল, কেহ কিছু বলে না। কৃষ্ণজীবনে ইঁহাদের কোন সংস্পর্শ নাই। ইঁহাদের পুত্রের তালিকা কৃষ্ণপুত্রের তালিকার মধ্যে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে তখনও কর্মক্ষেত্রে দেখি না। ইঁহারা কাহার কন্যা, কোন্ দেশসম্ভূতা, তাহার কোন কথা কোথাও নাই। কেবল, সুশীলা মদ্ররাজকন্যা, ইহাই আছে। কৃষ্ণের সমসাময়িক  মদ্ররাজ, নকুল সহদেবের মাতুল, কুরুক্ষেত্রের বিখ্যাত রথী শল্য। তিনি ও কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ দিন, পরস্পরের শত্রুসেনা মধ্যে অবস্থিত। অনেক বার তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে বলিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকে বলিতে হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে শুনিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকেও শুনিতে হইয়াছে। এক পলক জন্য কিছুতেই প্রকাশ নাই যে, কৃষ্ণ শল্যের জামাতা বা ভগিনীপতি, বা তাদৃশ কোন সম্বন্ধবিশিষ্ট। সম্বন্ধের মধ্যে এইটুকু পাই যে, শল্য কর্ণকে বলিয়াছেন, ‘অর্জুন ও বাসুদেবকে এখনই বিনাশ কর’। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে শল্যবধে নিযুক্ত করিয়া তাহার যমস্বরূপ হইলেন। কৃষ্ণ যে মাদ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বোধ হয়। শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা এবং লক্ষ্মণার কুলশীল, দেশ এবং বিবাহবৃত্তান্ত কিছুই কেহ জানে না। তাঁহারাও কাব্যের অলঙ্কার, সে বিষয়ে আমার সংশয় হয় না।
কেন না, কেবল মাদ্রী নয়, জাম্ববতী, রোহিণী ও সত্যভামাকেও ঐরূপ দেখি। জাম্ববতীর সঙ্গে কালিন্দী প্রভৃতির প্রভেদ এই যে, তাঁহার পুত্র শাম্বের নাম, আর পাঁচ জন যাদবের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাম্ব  কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ, কেবল এক লক্ষ্মণাহরণে। লক্ষ্মণা দুর্যোধনের কন্যা। মহাভারত যেমন পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত, তেমনি কৌরবদিগেরও জীবনবৃত্ত।লক্ষ্মণাহরণে যদি কিছু সত্য থাকিত, তবে মহাভারতে লক্ষ্মণাহরণ থাকিত। তাহা নাই। লক্ষ্মণাহরণ ভিন্ন যদুবংশধ্বংসেও শাম্বের নায়কতা দেখা যায়। তিনিই পেটে মুসল জড়াইয়া মেয়ে সাজিয়াছিলেন। আমি এই গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বলিয়াছি যে, এই মৌসলপর্ব প্রক্ষিপ্ত। মুসল-ঘটিত বৃত্তান্তটা অতিপ্রকৃত, এজন্য পরিত্যাজ্য। জাম্ববতীর বিবাহের পরে সুভদ্রার বিবাহ—অনেক পরে। সুভদ্রার পৌত্র পরিক্ষিৎ তখন ৩৬ বৎসরের, তখন যদুবংশধ্বংস। সুতরাং যদুবংশধ্বংসের সময় শাম্ব প্রাচীন। প্রাচীন ব্যক্তির গর্ভিণী সাজিয়া ঋষিদের ঠকাইতে যাওয়া অসম্ভব। জাম্ববতী নিজে ভল্লুককন্যা, ভল্লুকী। ভল্লুকী কৃষ্ণভার্যা বা কোন মানুষের ভার্যা হইতে পারে না। এই জন্য রোহিণীকে কামরূপিণী বলা হইয়াছে। কামরূপিণী কেন না, ভল্লুকী হইয়াও মানবরূপিণী হইতে পারিতেন। কামরূপিণী ভল্লুকীতে আমি বিশ্বাসবান্ নহি, এবং কৃষ্ণ ভল্লুককন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি না।
সত্যভামার পুত্র ছিল শুনি, কিন্তু তাঁহারা কোন কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন। তাঁহার প্রতি সন্দেহের এই প্রথম কারণ। যবে সত্যভামা নিজে রুক্মিণীর ন্যায় মধ্যে মধ্যে কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত বটে। তাঁহার বিবাহবৃত্তান্তও সবিস্তারে আলোচনা করা গিয়াছে।
মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে সত্যভামাকে পাওয়া যায়। ঐ পর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত; মহাভারতের বনপর্বের সমালোচনাকালে পাঠক তাহা দেখিতে পাইবেন। ঐখানে দ্রৌপদীসত্যভামা সংবাদ বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পর্বাধ্যায় আছে, তাহাও প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতীয় কথার সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। উহা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিরূপ আচরণ কর্তব্য, তৎসম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধমাত্র। প্রবন্ধটার লক্ষণ আধুনিক।
তার পর উদ্যোগপর্বেও সত্যভামাকে দেখিতে পাই—যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ে। সে স্থানও প্রক্ষিপ্ত, যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ের সমালোচনা কালে দেখাইব। কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বরণ হইয়া উপপ্লব্য নগরে আসিয়াছিলেন—যুদ্ধযাত্রায় সত্যভামাকে সঙ্গে আনিবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সত্যভামা সঙ্গে ছিলেন না, তাহা মহাভারত পড়িলেই জানা যায়। যুদ্ধপর্ব সকলে এবং তৎপরবর্তী পর্ব সকলে কোথাও আর সত্যভামার কথা নাই।
কেবল কৃষ্ণের মানবলীলাসম্বরণের পর, মৌসলপর্বে সত্যভামার নাম আছে। কিন্তু মৌসলপর্বও প্রক্ষিপ্ত, তাহাও পরে দেখাইব।
ফলতঃ মহাভারতের যে সকল অংশ নিঃসন্দেহে মৌলিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, তাহার কোথাও সত্যভামার নাম নাই। প্রক্ষিপ্ত অংশ সকলেই আছে। সত্যভামা সম্বন্ধীয় সন্দেহের এই দ্বিতীয় কারণ।
তার পর বিষ্ণুপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণে ইঁহার বিবাহবৃত্তান্ত স্যমন্তক মণির উপাখ্যানমধ্যে আছে। যে আষাঢ়ে গল্পে কৃষ্ণের সঙ্গে ভল্লুকসুতার পরিণয়, ইঁহার সঙ্গে পরিণয় সেই আষাঢ়ে গল্পে। তার পর কথিত হইয়াছে যে, এই বিবাহের জন্য দ্বেষবিশিষ্ট হইয়া শতধন্বা সত্যভামার পিতা সত্রাজিতকে মারিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে, জতুগৃহদাহপ্রবাদ জন্য পাণ্ডবদিগের অন্বেষণে গিয়াছিলেন। সেইখানে সত্যভামা তাঁহার নিকট নালিশ করিয়া পাঠাইলেন। কথাটা মিথ্যা। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে যান নাই—গেলে মহাভারতে থাকিত। তাহা নাই। এই সকল কথা সন্দেহের তৃতীয় কারণ।
তার পর, বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামাকে কেবল পারিজাতহরণবৃত্তান্তে পাই। সেটা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপার; প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় তাঁহাকে বিষ্ণুপুরাণে কোথাও পাই না। সন্দেহের এই চতুর্থ কারণ।
মহাভারতে আদিপর্বে সম্ভব-পর্বাধ্যায়ে সপ্তষট্টি অধ্যায়ের নাম ‘অংশাবতরণ’। মহাভারতের নায়কনায়িকাগণ কে কোন্ দেব দেবী অসুর রাক্ষসের অংশে জন্মিয়াছিল, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে। শেষ ভাগে লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের অংশ, বলরাম শেষ নাগের অংশ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ, দ্রৌপদী শচীর অংশ, কুন্তী ও মাদ্রী সিদ্ধি ও ধৃতির অংশ। কৃষ্ণমহিষীগণ সম্বন্ধে লেখা আছে যে, কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী অপ্সরাগণের অংশ এবং রুক্মিণী লক্ষ্মী দেবীর অংশ। আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর নাম নাই। সন্দেহের এই পঞ্চম কারণ। সন্দেহের এ কারণ কেবল সত্যভামা সম্বন্ধে নহে। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের সকল প্রধানা মহিষীদিগের প্রতি বর্তে। নরকের ষোড়শ সহস্র কন্যার অনৈসর্গিক কথাটা ছাড়িয়া দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোনও মহিষী ছিল না, ইহাই মহাভারতের এই অংশের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
ভল্লুকদৌহিত্র শাম্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা বাদ দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণীবংশেই রাজা হইল—আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।  ইহা নিশ্চিত বটে যে, সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ন যে, সে কোন মতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তপরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না, তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। আদালতে যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তাহার উদাহরণ আমরা সভ্যতর সমাজে দেখিতে পাইতেছি। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তা বুঝিতে পারি না। ইউরোপ যিহুদার নিকট শিখিয়াছিল যে, কোন অবস্থাতেই দারান্তর গ্রহণ করিতে নাই। যদি ইউরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেন্‌রীকে কথায় কথায় পত্নীহত্যা করিতে হইত না। ইউরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যাহাই বিলাতী, তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।
কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোন গণনীয় প্রমাণ নাই, ইহা দেখিয়াছি। যদি করিয়া থাকেন, তবে কেন করিয়াছিলেন, তাহারও কোন বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত নাই। যে যে তাঁহাকে স্যমন্তক মণি উপহার দিল, সে সঙ্গে সঙ্গে অমনি একটি কন্যা উপহার দিল, ইহা পিতামহীর উপকথা। আর নরকরাজার ষোল হাজার মেয়ে, ইহা প্রপিতামহীর উপকথা। আমরা শুনিয়া খুশি—বিশ্বাস করিতে পারি না।-

(কৃষ্ণচরিত্র -তৃতীয় খণ্ড/ সপ্তম পরিচ্ছেদ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
বিষ্ণু পুরাণের ৪ অংশের ১৫ নং অধ্যায়ের ১৯ নং শ্লোকে আছে,
“ভগবতোহপ্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য। ষোড়শসহস্রাষণ্যেকোত্তরশতা ধিকানি স্ত্রীণামভবন।।
এর সরল অর্থ শ্রীকৃষ্ণের ষোলহাজার একশত স্ত্রী।
কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের ৫ অংশের ২৮ নং অধ্যায়ে বলা আছে,
“অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ”
“ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।”
এই দুই শ্লোকের অর্থ হলো কৃষ্ণের মোট স্ত্রীর সংখ্যা ষোল হাজার সাত জন।
এর মধ্যে ষোল হাজার বা ষোল হাজার একশ জন হলো হলো কথিত নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধারকৃত নারী, এদের সম্পর্কে অন্য পোস্টে আলোচনা করেছি, , তাই এই পোস্টে এই ৭ বা ৮ জনের মীমাংসা টা আপনারা পাবেন।
বিষ্ণুপুরাণ বলছে, নরকাসুরের অন্তঃপুরের নারীরা বাদে কৃষ্ণের স্ত্রী ৭ জন, কিন্তু একই অধ্যায়ে একটু পরেই বিষ্ণুপুরাণ শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীদের যে তালিকা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ৮ জনের কথা, তার মধ্যে আবার শ্রীকৃষ্ণের প্রথম স্ত্রী রুক্মিনী নেই, দেখে নিন সেই তালিকা-
“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||
এখানে রুক্মিনী ছাড়া অন্য যে আটটি নাম আছে, সেগুলো হলো-
১.কালিন্দী, ২.মিত্রবিন্দা, ৩.নগ্নজিতকন্যা সত্যা, ৪.জাম্ববতী, ৫.রোহিনী, ৬.মদ্ররাজের কন্যা সুশীলা, ৭.সত্রাজিত কন্যা সত্যভামা ও ৮.লক্ষণা।
কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের ৪র্থ অংশের ১৫ অধ্যায়ে আছে,
“তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।”
এখানে সব নাম পাওয়া গেল না, কিন্তু নতুন নাম পাওয়া গেলো “জালহাসিনী”, এর মধ্যে রুক্মিণীর নামও আছে এবং সব মিলিয়ে বিষ্ণুপুরাণ এখানে বলছে, কৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা ৮ জন। কিন্তু উপরের ৮ জন এবং রুক্মিণী ও জালহাসিনী সহ কৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা হয় ১০ জন। পুরাণের মনগড়া তথ্যগুলোর প্রতি খেয়াল রাখা শুরু করুন।
মহাভারত ছাড়া, কৃষ্ণ সম্পর্কে যেসব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেগুলো হলো- বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ এবং হরিবংশ। উপরে বিষ্ণুপুরাণের শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে জানালাম, এবার দেখুন হরিবংশের কী অবস্থা ?
হরিবংশের ১১৮ অধ্যায়ের ৪০ থেকে ৪৩ নং শ্লোকে আছে,
“মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ |।
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||”
এখানে পাওয়া যাচ্ছে যে, লক্ষ্মণা ই জালহাসিনী; তাহলে লক্ষণাসহ অন্য যে নামগুলো এখানে আছে, সেগুলো হলো-
১.কালিন্দী, ২.মিত্রবিন্দা, ৩.সত্যা, ৪.জাম্ববতী, ৫.রোহিনী, ৬.মদ্ররাজ কন্যা সুশীলা, ৭.সত্রাজিত কন্যা সত্যভামা, ৮.জালহাসিনী লক্ষণা এবং ৯. শৈব্যা।
এখানে নতুন যে নাম যুক্ত হলো, সেটা শৈব্যা এবং বিষ্ণুপুরাণের জালহাসিনীকে লক্ষণা বলে ধরে নেওয়ার পরও রূক্মিণীসহ শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সংখ্যা হলো ১০ জন। জালহাসিনীকে আর লক্ষণাকে আলাদা বলে ধরলে এই সংখ্যা হয় ১১ জন।
সত্যের নয়, মিথ্যারই বহু রূপ হয়, সেই প্রমাণ বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ থেকে মিলতে শুরু করেছে।
হরিবংশের ১১৮ অধ্যায়ের এই তালিকার পর ১৬২ অধ্যায়ে রয়েছে আরেকটি তালিকা, দেখে নিন তার অবস্থা-
“অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী।।
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী…”
রুক্মিনীসহ এখানে পাওয়া গেলো নিচের ১২ টি নাম, যেমন- ১. রুক্মিনী, ২. সত্যভামা, ৩. নগ্নাজিতী, ৪. সুদত্তা, ৫. শৈব্যা, ৬. লক্ষণা জালহাসিনী, ৭. মিত্রবিন্দা, ৮. কালিন্দী, ৯. জাম্ববতী, ১০. পৌরবী, ১১. সুভীমা এবং ১২. মাদ্রী।
তাহলে এখন পর্যন্ত রুক্মিনী সহ কৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১২ জনে।
এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল করতে হবে যে, হরিবংশের রচয়িতা, শুরুতেই-
“অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।”
এই শ্লোকে বলেছেন, আটজন স্ত্রীর কথা, কিন্তু তালিকা দিলেন ১২ জনের। কিন্তু তাতেও তিনি ক্ষান্ত হন নি, যখন কৃষ্ণের সন্তানদের নাম বলতে শুরু করেন, তখন বেরিয়ে আসে আরও ৫ জন স্ত্রীর নাম, সেগুলো হলো- ১. সুদেবা, ২. কৌশিকী, ৩. উপাসঙ্গ, ৪. সুতসোমা এবং ৫. যৌধিষ্ঠিরী।
এছাড়াও বিষ্ণুপুরাণ না বললেও হরিবংশ এমনও বলে যে, সত্রাজিত তার অপর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীকেও শ্রীকৃষ্ণের কাছে সমর্পন করেছিলো। তাহলে সব মিলিয়ে পুরাণ মতে এখন পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৯ জনে। এছাড়াও মহাভারতের মৌষল পর্বে পাওয়া যায় দুইজনের নাম গান্ধারী ও হৈমবতী। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের মোট স্ত্রীর সংখ্যা হয় ২১ জন।
কৃষ্ণের স্ত্রী, তথাকথিত ১৬১০০ জন বাদে তথাকথিত ৮ জন বলা হলেও, কৃষ্ণ সম্পর্কিত সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে নাম পাওয়া যাচ্ছে ২১ জনের। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৯ পর্যন্ত নাম শুধু হরিবংশেই আছে, আর কোথাও নেই এবং যেহেতু হরিবংশের উল্টা পাল্টা তথ্য আলোচনা করে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, স্বল্প মাত্রার গাঁজা উপকারী হলেও হরিবংশ বিকৃতকারী একটু বেশি মাত্রায় গাঁজা খেয়ে এই কাজে হাত দিয়েছিলেন, তাই কোথায় কী লিখেছেন, তার তাল ঠিক রাখতে পারেন নি, সেহেতু এই ১৩ থেকে ১৯ জনের নাম একেবারেই বাদ বা পরিত্যাজ্য। এছাড়াও কৃষ্ণের স্ত্রী হিসেবে গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম শুধু মহাভারতের মৌষল পর্বেই আছে এবং মৌষল পর্বের কিছু অংশ যেহেতু মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, সেহেতু এই দুই নামও বাদ, বাকি থাকলো ১২ জন।
মহাভারতের মৌষল পর্বের কিছু অংশকে কেনো প্রক্ষিপ্ত বললাম, সেই আলোচনা পাবেন একটু পরেই এবং সেখানে আমি প্রমান করে দেবো যে, কিভাবে এই মৌষল পর্বটির কিছু অংশ মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত।
যা হোক, জাম্ববতী সম্পর্কে বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।
আবার হরিবংশে লিখা আছে,
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।
এই দুই শ্লোক মতে, জাম্ববতী ও রোহিনী একই নারী। তাহলে বাকি থাকলো ১১ জন। এই ১১ জনের মধ্যে সত্যভামা, ব্রতিনী ও প্রস্বাপিনী, যারা সত্রাজিতের কন্যা বলে বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ বলেছে, যাদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ স্যামন্তক মণির ঘটনাকে কেন্দ্র করে; সেই ঘটনা যে কখনোই ঘটেই নি, সেটা বুঝতে পারবেন নিচের এই কাহিনীটা পড়লে-
দ্বারকায় সত্রাজিৎ নামে এক ব্যক্তি বাস করতো। সে কোনো ভাবে এক মণি পেয়েছিলো, যার নাম স্যামন্তক মণি; পুরাণ মতে এই মণিকে কেন্দ্র করেই শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহের সূচনা।
যা হোক, দ্বারকার রাজা তখন উগ্রসেন হলেও কৃষ্ণই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। সত্রাজিৎ ভয় পেয়েছিলো যে, সেই মণি কৃষ্ণ তার কাছে চাইতে পারে, আর কৃষ্ণ যদি তা চায়, তাহলে সে তা তাকে দিতে বাধ্য থাকবে। এজন্য সত্রাজিৎ সেই মনি নিজের কাছে না রেখে তার ভাই প্রসেনের কাছে দেয় এবং প্রসেন তা নিয়ে বনে শিকার করতে যায়। কিন্তু বনের মধ্যে একটি সিংহ প্রসেনকে হত্যা করে সেই মণি মুখে করে নিয়ে যেতে লাগলে জাম্ববান নামে এক ভাল্লুক, যে নাকি রামের পক্ষ হয়ে রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কৃষ্ণের সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলো (!), সেই ভাল্লুক সিংহকে হত্যা করে সেই মণি দখল করে তার গুহায় নিয়ে গিয়ে রাখে।
বনের মধ্যে প্রসেন নিহত এবং মণি হারিয়ে যাওয়ার পর সবাই এজন্য কৃষ্ণকেই সন্দেহ করা শুরু করে, নিজের উপর অযথা আরোপিত এই কলঙ্ক ঘুচানোর জন্য কৃষ্ণ, সেই মনি কোথায় গেলো এবং প্রসেন কিভাবে নিহত হলো, তার জন্য তদন্ত করতে বনে গমন করে এবং প্রসেনের মৃতদেহ যেখানে পড়ে ছিলো, সেখানে সিংহের পদচিহ্ন দেখে তা অনুসরণ করতে করতে দেখে এক ভাল্লুকের পদচিহ্ন এবং সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে কৃষ্ণ গিয়ে পৌঁছায় এক গুহার মধ্যে, সেখানে সে জাম্ববানের পুত্রপালিকা এক ধাত্রীর হাতে সেই মণি দেখতে পায়, এরপর কৃষ্ণ জাম্ববানকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং স্যামন্তক মনি অধিকার করে। এরপর জাম্ববান শুধু মণিই কৃষ্ণকে দেয় না, তার কন্যা জাম্ববতীকেও কৃষ্ণকে অর্পণ করে। কৃষ্ণ, জাম্ববতীকে বিয়ে করে মণিসহ দ্বারকায় ফেরত আসে। দ্বারকায় ফিরে, কৃষ্ণ সেই মণি সত্রাজিৎকেই দেয়। কিন্তু মণি হারিয়ে যাওয়ার পর, সত্রাজিৎই প্রথম কৃষ্ণকে সন্দেহ করেছিলো, এই ভয়ে সত্রাজিৎ তার নিজের কন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণের সাথে বিয়ে দিয়ে এর একটা আপোষ মীমাংসা করে।
এরপর এই স্যামন্তক মণি নিয়ে আরো কিছু ঘটনা আছে, কিন্তু সেগুলো কৃষ্ণের বহুবিবাহের ঘটনার সাথে যুক্ত নয় ব’লে এখানে তা আর উল্লেখ করলাম না।
কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এবার ঘটনাটিকে বিচার করে দেখা যাক, স্যামন্তক মণি নিয়ে পুরাণ রচয়িতারা যে গল্প ফেঁদেছে তা কতদূর সত্য বা এসব সম্ভব হতে পারে কি না ?
শ্রীকৃষ্ণ, কংসকে পরাজিত ও হত্যা করে। রাজাদের আমলে এই রীতি ছিলো যে, কোনো ব্যক্তি কোনো রাজাকে হত্যা করতে পারলে, ক্ষমতার সূত্রে সে ই, সেই রাজ্যের রাজা হতো। এই সূত্রে শ্রীকৃষ্ণই মথুরার রাজা হতে পারতো, কিন্তু সে তা না হয়ে কংসের পিতা উগসেনের হাতে রাজ্যের দায়িত্ব অর্পণ ক’রে তাকেই রাজা বানায়। এই ঘটনা থেকে শ্রীকৃষ্ণের নির্লোভ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। কংসকে হত্যা করায়, কংসের শ্বশুর জরাসন্ধের সাথে কৃষ্ণের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় এবং সে বার বার মথুরা আক্রমন করতে থাকে, জরাসন্ধ ছিলো সেই সময়ের ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা, বলা যেতে পারে চক্রবর্তী সম্রাট, যার ছিলো ২০ অক্ষৌহিনী সেনা, যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমাগত সমস্ত সৈন্যের চেয়ে বেশি। এখানে বলে রাখি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ছিলো মোট ১৮ অক্ষৌহিনী সেনা।
যা হোক, জরাসন্ধের সৈন্যবলের কাছে মথুরার সৈন্যবল ছিলো নিতান্তই শিশু, তারপরও জরাসন্ধ যখনই মথুরা আক্রমন করেছে, কৃষ্ণ তার শক্তি, বুদ্ধি ও কৌশলের দ্বারা জরাসন্ধকে হতাশ করে মথুরা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু জরাসন্ধের আক্রমনের ফলে প্রতিবারই মথুরার সৈন্য ক্ষয় হচ্ছিলো, এই অযথা মৃত্যু ঠেকাতে, শ্রীকৃষ্ণ, রাজধানীকে মথুরা থেকে তিন দিক জল দিয়ে ঘেরা দ্বারকায় স্থানান্তরিত করে, ফলে সেখানে আক্রমন করে আর কোনো ফল হবে না বিবেচনা ক’রে, জরাসন্ধ, দ্বারকা আক্রমন থেকে বিরত থাকে; কারণ, চতুর্দিকের আক্রমন ঠেকানোর চেয়ে একদিকের আক্রমন ঠেকানো সহজ। এই জরাসন্ধের সাথে, কৃষ্ণ বিরোধিতায় যুক্ত হয়েছিলো কাল যবন নামে এক রাজা, এই দুজনেরই দৈহিক শক্তি ছিলো যেমন অতুলনীয়, তেমনই কোনো সাধারণ অস্ত্রেও এদের মৃত্যু হতো না, তাই এদের হাত থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে কৃষ্ণকে ঐ পথ অবলম্বন করতে হয়েছিলো।
দ্বারকায় রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর, অর্থাৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, উগ্রসেন নামে মাত্র রাজা হলেও কৃষ্ণই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। এই কৃষ্ণের কাছ থেকে স্যামন্তক মণি লুকানোর জন্য পুরাণ রচয়িতারা সত্রাজিৎকে দিয়ে যা করিয়েছে, তা এক হাস্যকর ব্যাপার।
কারণ, কৃষ্ণ যদি মণি চায়, তাহলে কৃষ্ণকে তা দিতেই হবে, এই ভয়ে সত্রাজিৎ সেই মনি তার ভাই প্রসেনকে দিয়ে দেয়। প্রসেন কি এমন মহারথি ছিলো বা প্রসেনের কি এমন ক্ষমতা ছিলো যে, কৃষ্ণ চাইলে সে তাকে মণি না দিয়ে তা নিজের কাছে রক্ষা করতে পারতো ? দ্বারকায় যেখানে কৃষ্ণের ইচ্ছাই আইন, সেখানে এই প্রসেনের কথা বা ইচ্ছার মূল্য কী ? আর যে কৃষ্ণ, রাজা হওয়ার সুযোগ পেয়েও মথুরা বা দ্বারকায় রাজা হয় নি, সেই কৃষ্ণ, সামান্য এক মণির লোভ সামলাতে পারবে না, এটা সত্রাজিৎকে দিয়ে পুরাণ রচয়িতারা ভাবাতে পারলো কিভাবে বা পুরাণ রচয়িতারাই ভাবলো কী করে ?
যা হোক, এরপর প্রসেন সেই মনি নিয়ে বনে শিকার করতে যায় কিন্তু সিংহের হাতে মারা পড়ে। এই ব্যাপারটা কেউ জানতে পারে না, তার মানে বনে শিকার করতে প্রসেন একা গিয়েছিলো এবং এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সে ছিলো খুবই সাধারণ একজন লোক; কারণ, মানুষ যখন সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠে তখন তার চারপাশে সব সময় সকল কাজে প্রচুর লোকজনের ভীড় থাকে, হয় তার কাজে সাহায্য করার জন্য, নয়তো সাহায্য পাওয়ার আশায়। এই সামান্য লোক প্রসেনের কাছে কৃষ্ণ যদি মণি চাইতো, তাহলে সে তা কিভাবে রক্ষা করতে পারতো ? কোন ভরসায় সত্রাজিৎ তার ভাইকে ওই মণিটি দিয়েছিলো ?
আমরা জানি, সিংহের কোনো কিছু শিকারের একমাত্র কারণ তার পেটের ক্ষুধা অর্থাৎ খাদ্য। কিন্তু মণির জন্য কোনো সিংহ কাউকে আক্রমন করে হত্যা করেছে, এমন ঘটনার কথা লিখা একমাত্র পুরাণ রচয়িতাদের পক্ষেই সম্ভব। এই পুরাণ রচিয়তারা লিখেছে, প্রসেনকে হত্যা করে তার মাংস না খেয়ে, শুধু মনি মুখে সিংহ চলে যায় এবং সেই অবস্থায় জাম্ববান নামের ভাল্লুকের সাথে সিংহের দেখা হয়। সিংহ যে প্রসেনের মাংস খায় নি, তার প্রমান, পুরাণ মতে, কৃষ্ণ যখন তদন্ত করতে বনে যায়, তখন সেখানে প্রসেনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে।
যা হোক, আমরা জানি, সিংহ বনের রাজা, কোনো পশু তাকে পরাজিত করতে পারে না। কিন্তু এক ভাল্লুক তাকে পরাজিত করে ফেলে এবং তার কাছ থেকে সেই মণিটা দখল করে। মণি যে খুব মূল্যবান হয়, এই জ্ঞান বুদ্ধি আমাদের পুরাণ রচয়িতারা- সিংহ, ভাল্লুকের মতো হিংস্র প্রাণীদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ভাল্লুক থাকে এক গুহার মধ্যে, সেখানে সে তার বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য এক ধাত্রী নিযুক্ত করে রেখেছিলো, যা একমাত্র মনুষ্য সমাজই করে থাকে বা করতে পারে। জাম্ববানকে মানুষ হিসেবে দেখানোর যদি এতই শখ পুরাণ রচয়িতাদের থাকে, তাহলে তাকে প্রথমে ভাল্লুক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিলো ? নাকি কোনো মানুষের পক্ষে সিংহকে হত্যা করা সম্ভব নয় ব’লে, পুরাণ রচয়িতারা ভাল্লুককে দিয়ে প্রথমে সিংহকে হত্যা করিয়ে পরে তাকে মানুষ হিসেবে রূপান্তরিত করেছে; কিন্তু কোনো ভাল্লুকেরই কি সিংহকে হত্যা করার ক্ষমতা আছে ? আজগুবি গল্প আর কাকে বলে! ভাল্লুকের যদি সিংহকে হত্যা করার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তো ভাল্লুকই বনের রাজা হতো, সিংহের শক্তি ও ক্ষমতার জন্যই সিংহকে বনের বা পশুদের রাজা বলা হয়।
যা হোক, জাম্ববানকে যুদ্ধে পরাজিত করে, কৃষ্ণ, সেই মণিটা দখল করে। এতে জাম্ববানের খুবই অপমানিত বোধ হওয়ার কথা এবং কৃষ্ণের সাথে শত্রুতা স্থাপিত হওয়ার কথা। কিন্তু জাম্ববান ঘটায় উল্টো ঘটনা, কৃষ্ণের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। এই ভাল্লুককে তো পুরাণ রচয়িতারা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মানব আচরণের পক্ষে এটা কি সম্ভব যে, শত্রুর হাতে নিজের কন্যাকে সমর্পণ করা ? আর ভাল্লুকের মেয়ের তো শারীরিক আকার ভাল্লুকের মতোই হবে, তাকে কৃষ্ণ বিয়ে করতে যাবে কেনো ? যদি বলা হয় জাম্ববতীর মনুষ্য রূপ ধারণ করার ক্ষমতা ছিলো, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষমতা ও মন নিয়ে সে কিভাবে বনে গুহার মধ্যে বাস করতে পারছিলো ? কারো যখন ক্ষমতা ও বুদ্ধি হয় উন্নত সমাজে গিয়ে বাস করার, তখন সে নিম্ন সমাজ ব্যবস্থায় আর বাস করতে চায় না, এটাই মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, তাহলে জাম্ববতী কিভাবে মানব মন নিয়ে গুহার মধ্যে বাস করতে পারতো ? আবার জাম্ববানের ছেলে মেয়েকে দেখা শোনার জন্য যে ধাত্রীর কথা বলা হয়েছে, সেও মানব আকৃতির, তাহলে সে কিভাবে বনে, গুহার মধ্যে এক ভাল্লুকের সাথে বাস করতে পারতো ?
যা হোক, কৃষ্ণ, স্যামন্তক মণি উদ্ধার করে জাম্ববতী বিয়ে করে দ্বারকায় ফিরে এসে সেই মনি সত্রাজিৎকেই দেয়। কৃষ্ণকে সন্দেহ প্রথমে সত্রাজিৎই করেছিলো, তাই তার ভয় ছিলো, কৃষ্ণ এ ব্যাপারে সত্রাজিৎকে প্রশ্ন করবে, এই ভয়ে সত্রাজিৎ তার মেয়ে সত্যভামাকে কৃষ্ণের সাথে বিয়ে দিয়ে একটা আপোষ মীমাংসা করে। এইভাবে পুরাণ মতে রুক্মিনী সহ কৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা হয় তিন।
কৃষ্ণ যে রাজ্য ও সম্পদলোভী ছিলো না, সেটা কংস হত্যার পর, মথুরায় কংসের পিতা উগ্রসেনকে রাজা করার মধ্য দিয়ে ই প্রমাণিত; তারপর কৃষ্ণ নিজেই দ্বারকা নগরী নির্মান করে রাজতুল্য হয়ে যায়, আর এই কৃষ্ণ, সামান্য এক মণির জন্য এত কাহিনী ঘটাতে যাবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ? রাজ্যের কোনো সম্পদ কি রাজার হাতের বাইরে ? এছাড়াও কৃষ্ণ, চেয়েছিলো বলে, বিয়ের আসর থেকে রুক্মিনীকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলো, বিদর্ভ রাজার সমস্ত শক্তি কৃষ্ণের কিছুই করতে পারে নি। বলা হয়, সত্যভামা ছিলো খুবই সুন্দরী ও বহু রাজার পছন্দের পাত্রী, কৃষ্ণ যদি সত্যভামাকে বিয়ে করতেই চাইতো, তাহলে এমনিই করতে পারতো, সত্রাজিতের তাকে কৃষ্ণের হাতে সমর্পনের কোনো প্রয়োজনই পড়তো না।
প্রকৃতপক্ষে স্যামন্তক মণির এই ঘটনা যে একটা ডাহা মিথ্যা গল্প, আশা করছি পাঠক বন্ধুরা, উপরের এই আলোচনা থেকে বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, মহাভারতে তো সত্যভামার কথা আছে, তাহলে সত্যভামা যে কৃষ্ণের স্ত্রী নয়, তার প্রমান কী ? এ ব্যাপারে প্রমাণ একটু পরেই পেয়ে যাবেন, পোস্টটা পড়তে থাকুন।
সত্রাজিতের তিন কন্যার মধ্যে দুইটাকে আগেই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি, স্যামন্তক মণির ঘটনা মিথ্যা বলে বাদ পড়ে আরও দুই জন সত্যভামা ও জাম্ববতী। তাহলে বাকি থাকে ৯ জন। এই ৯ জনের মধ্যে একজনকে বলা হচ্ছে মদ্ররাজ কন্যা সুশীলা, এবার এ ব্যাপারে কিছু বলা যাক।
মদ্ররাজের বোন হচ্ছে মাদ্রী, যার বিয়ে হয় পাণ্ডুর সাথে এবং যার দুই পুত্রের নাম হচ্ছে নকুল ও সহদেব। এই সূত্রে মদ্ররাজ হলো নকুল ও সহদেবের মামা। এই মদ্ররাজ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো এবং নকুল ও সহদেবের মামা হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিত ছিলো, কিন্তু সে যে কৃষ্ণেরও শ্বশুর সেই কথা কিন্তু মহাভারতের কোথাও একটুও বলা নেই। তার মানে খুব সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে, সুশীলার সাথে কৃষ্ণের বিবাহ একটা গালগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুশীলাকে বাদ দিলে বাকি থাকলো ৮। এই ৮ জনকে বিষ্ণুপুরাণ রচয়িতা বা রচয়িতারা, কৃষ্ণের স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু এরা কোন দেশের, কার কন্যা, কবে বিয়ে হলো, এ সম্পর্কে কিন্তু কোনো তথ্য নেই। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণের জীবনের প্রকাশিত ঘটনার সাথে এদের কোনো সংস্পর্শই নেই। এদের সন্তানদের নাম পুরাণ রচয়িতারা অবশ্য উল্লেখ করেছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, রুক্মিনীর পুত্র প্রদুম্ন ছাড়া আর কারো কোনো কাহিনী নেই। নেই কোনো ? নেই এজন্যই যে, কৃষ্ণের সাথে রুক্মিণী ছাড়া অন্য কোনো নারীর বিয়ের কোনো ঘটনাই ঘটে নি এবং তাদের পুত্র হিসেবে যাদের নাম বলা হয়, তাদেরও কখনো জন্মই হয় নি। কৃষ্ণের সাথে অন্য কোনো নারীর বিয়ে হলে বা তাদের সন্তানের জন্ম হলে সেই সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পুরাণ রচয়িতারা দিতে পারতো। এই হিসেবে দেখা যাচ্ছে রুক্মিনী ছাড়া কৃষ্ণের অন্য কোনো স্ত্রী ই নেই।
বিকৃত মহাভারতের মৌষল পর্বে অবশ্য শাম্বের নাম উল্লেখ আছে, আর এই শাম্বের মাতার নাম জাম্ববতী। তাহলে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, জাম্ববতী যদি কৃষ্ণের স্ত্রী হয়, তাহলে স্যামন্তক মণির ঘটনা সত্য এবং তাহলে সত্যভামা, এমন কি সত্যভামার অপর দুই বোনের সাথে কৃষ্ণের বিয়ের ঘটনাকেও সত্য বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু গবেষণা বলছে, মহাভারতের মৌষল পর্বটির কিছু অংশ প্রক্ষিপ্ত, মৌষল পর্বের কিছু ঘটনা বাস্তবে কখনোই ঘটে নি।
আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, পুরাণ বলছে, শাম্বের সাথে দুর্যোধনের মেয়ে লক্ষণার বিয়ে হয়েছিলো। এটা হলে কৃষ্ণ আর দু্র্যোধনের আত্মীয়তার সম্পর্ক হয় বেয়াই। এমন ঘটনা কি সম্ভব ? শাম্ব, কৃষ্ণের ছেলে হলে, অমন দুরাচারী দুর্যোধন, যাকে বিনাশ করার জন্য কৃষ্ণের এই মানবজন্ম ধারণ, তার মেয়ের সাথে কি কৃষ্ণ তার ছেলের বিয়ে দিতো ? আর ঘটনাচক্রে যদি এমন ঘটনা ঘটেই থাকতো, মহাভারতে কি তার কিছু মাত্র উল্লেখ থাকতো না ?
এসবের কোনো কিছুর উল্লেখ নেই, এজন্যই নেই যে শাম্ব বলে কেউ ছিলো না, তাহলে মৌষল পর্বের ব্যাপারটা কী ? আর কেনো এটাকে বলছি প্রক্ষিপ্ত ?
মৌষল পর্বের ঘটনা শুরু এভাবে-
একদিন বিশ্বামিত্র কন্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় বেড়াতে গেলে শাম্বের সমবয়সী দুইজন, শাম্বকে স্ত্রী বেশে সজ্জিত করে তাদের কাছে গিয়ে বলে, ইনি গর্ভবতী, আপনারা বলুন, ইনি কী প্রসব করবে ?
মুনিরা, তাদের এই ছল বুঝতে পেরে অভিশাপ দেয় যে, এ একটি লৌহ মুষল প্রসব করবে এবং সেই লৌহ মুষল যদু বংশ ধ্বংসের কারণ হবে। এরপর শুরু হয় ঘটনা, দ্বারকাতে নানা অশুভ ঘটনা ঘটতে থাকে এবং বিনা কারণে যাদবরা একে অপরকে আঘাত করে হত্যা করতে থাকে, এভাবে ধ্বংস হয় যদু বংশ, যা পুরোপুরি কাল্পনিক এবং বানোয়াট; কারণ, এভাবে কোনো রাজবংশ ধ্বংস হওয়া সম্ভব নয় এবং পৃথিবীর কোথাও কখনো তা ঘটে নি।
শাম্বের লৌহ মুষল প্রসবের ঘটনা যে পুরোটাই মিথ্যা, এবার তার কিছু প্রমাণ দিই। শাম্ব যদি বাস্তবে থাকতো, তাহলে সে সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যুর চেয়ে বয়সে কিছু বড় হতো; কারণ পুরাণ রচয়িতারা অভিমন্যুর মা সুভদ্রার বিয়ের আগে কৃষ্ণের সাথে জাম্ববতীর বিয়ে দিয়েছে, ফলে অভিমন্যুর চেয়ে কয়েক বছর আগে শাম্বের জন্ম হওয়ার কথা।
যা হোক, এই অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিতের বয়স যখন ৩৬, তখন যদু বংশ ধ্বংসের কথা বলা হয়। মহাভারতের যুদ্ধের বছর পরীক্ষিতের জন্ম এবং সেই সময় কৃষ্ণের বয়স ছিলো ৮৯ বছর, তাহলে মহাভারতের যুদ্ধের সময় শাম্বের বয়স ছিলো কমপক্ষে ৫৫ বছর; কারণ, অভিমন্যু ১৬ বছর বয়সে মারা যায়, ফলে অভিমন্যুর ১৬ এবং পরীক্ষিতের ৩৬, মোট ৫২ বছর, কিন্তু হিসেব মতে শাম্বের বয়স ৫২ এর চেয়েও বেশি এবং তার স্ত্রী সেজে মুণিদের সাথে রসিকতা করার সময় তার বয়স কমপক্ষে ৫৫/৬০ বছর ছিলো, এই রকম বয়সে কি কেউ ঐ ধরণের রসিকতা করতে পারে ? তাছাড়া শাম্ব তো মেয়ে নয় যে সে প্রসব করবে, তাহলে মুষল সে প্রসব করলো কিভাবে ? এই তথ্যগুলোই প্রমান করে শাম্বের মুষল প্রসবের কোনো ঘটনাই ঘটে নি। গান্ধারীর যে অভিশাপ ছিলো সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যদু বংশ ধ্বংস হবে, বাস্তবে হয়েছেও তাই।
আরো মজার ব্যাপার হলো, পুরো মহাভারতের কোথাও সেই স্যামন্তক মুনির কোনো কাহিনী না থাকলেও, এই মুষল পর্বে তার কথা উল্লেখ আছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, যারা বিষ্ণুপুরাণে স্যামন্তক মুণির কাহিনী বানিয়ে কৃষ্ণের বহুবিবাহের সূচনা করেছিলো, তারাই মহাভারতে এই মৌষল পর্বটির কিছু অংশ প্রক্ষিপ্ত আকারে ঢুকিয়ে দিয়েছে। চোরের সাক্ষী চোর বা শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল আর কি !
মহাভারতের বন পর্বে সত্যভামার কথা একটু উল্লেখ আছে, এবার সেই ব্যাপারে একটু নজর দিই।
পাণ্ডবরা বনবাস কালে কাম্যক বনে এসে যখন বাস করতে থাকে, তখন সেখানে কৃষ্ণ ও সত্যভামা তাদেরকে দেখার জন্য যায়; তখন সেখানে কৃষ্ণ, দ্রৌপদীকে বলে, তোমার পুত্ররা দ্বারকাতে সুখেই আছে, তারা অভিমন্যু ও প্রদুম্নের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করছে। এখানে সত্যভামার স্থলে রুক্মিনীকে বসিয়ে দেখুন, সিচুয়েশনটা অনেক গ্রহনযোগ্য হবে। কারণ, মায়ের সামনে পুত্রের প্রশংসাই গ্রহনযোগ্য, সৎ মায়ের সামনে নয়। তাছাড়াও পুরাণে বলে, সত্যভামার ১০ পুত্র, তাদের কোনো খবর কোথাই নেই কেনো ? শুধু নাম দিলেই কি তাদের অস্তিত্বকে প্রমান করা যায় ? কৃষ্ণের পুত্র হিসেবে প্রদুম্নের কথা যেমন মাঝে মাঝে এসেছে, তাহলে কৃষ্ণের আর কোনো পুত্র থাকলে তাদের ঘটনাগুলো কি মাঝে মাঝে আসতো না ? এ থেকে এটা ধারণা করা যায় যে, বনপর্বে সত্যভামার উপস্থিতি মিথ্যা, বাস্তবে এটা হবে রুক্মিনী।
উপরে বলেছিলাম, মহাভারতের মৌষল পর্বটার কিছু অংশ প্রক্ষিপ্ত, আশা করছি সেই ব্যাপারটা আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে ক্লিয়ার হয়েছে। যারা প্রক্ষিপ্ত শব্দের মানে জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, কোনো গ্রন্থের মধ্যে যখন এমন কিছু যুক্ত করা হয়, যা মূল বইয়ে ছিলো না, তাকেই বলে প্রক্ষিপ্ত এবং এই কাজ করা হয় শুধু সেই গ্রন্থের বিকৃতির জন্যই নয়, বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যে।
তার মানে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টমহিষী সংক্রান্ত এই রটনাগুলো পুরোটাই মিথ্যা। কারণ, কৃষ্ণের স্ত্রী ছিলেন একজনই, সে রুক্মিণী এবং রুক্মিণীর ১০টি নয়, পুত্র ছিলো একটি ই সে প্রদুম্ন, আর প্রদুম্নের পুত্র পুরাণে উল্লিখিত বীর অনিরুদ্ধ।
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহ তথা অষ্টমহিষী নিয়ে যে প্রচলিত গল্প, তা যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বানোয়াট
মহাভারত সৌপ্তিক পর্ব,12 অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ জী ও রুক্মিণীর পুত্র প্রদ্যুম্ন বিষয়ে শ্লোক পাওয়া যায়



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ